সরল অঙ্কের ব্যাপার
সোফার ওপর চিন্তিত মুখে দময়ন্তী বসে ছিল। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, এখনও সমরেশের পাত্তা নেই। আজ প্রায় তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে ওদের, কিন্তু খবর-টবর না দিয়ে এত দেরি সমরেশ কখনো করে না। একটি বিদেশি ফার্মের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সমরেশ দত্তগুপ্ত, রোজ সাড়ে ছ-টার মধ্যে বাড়ি ফেরে। চিন্তাগ্রস্ত মুখে টেলিফোন ডাইরেক্টরিটা খুলল দময়ন্তী। কাকে ফোন করা যায়? ফার্মের কোন সহকর্মীকে? এমন সময় দরজায় বেল বাজল।
দরজা খুলে দেখা গেল সামনেই মূর্তিমান আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দীর্ঘাকৃতি, সুপুরুষ ও প্রচণ্ড ফুর্তিবাজ মানুষটির প্রতি দময়ন্তী কোনোদিনই বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। কিছুক্ষণ রাগত চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, ‘এত দেরি হল যে? অফিসে কাজ পড়ে গিয়েছিল বুঝি?’
ব্যাগটা ধপ করে সোফার ওপর পেলে সমরেশ বলল, ‘আরে, না, না, অফিসের কাজ নয়। একটা ভয়ানক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম— যাকে বলে রোমহর্ষক ঘটনা।’ বলে একটা খালি সোফার ওপর লম্বা হল।
দময়ন্তী ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘রোমহর্ষক ঘটনা আবার কী? কালকের চ্যারিটি ম্যাচের টিকিট পেয়েছ বুঝি? ওই করেই তো মাথাটি খেলে নিজের। অফিসের কাজে মন নেই, কোথায় মোহনবাগান, কোথায় মহামেডান স্পোর্টিং এই করে বেড়াচ্ছ।’
হাত নেড়ে সমরেশ বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, লেকচার পরে দিয়ো। আগে চা-টা কিছু আনো দিকি। তারপর বলছি। চ্যারিটি ম্যাচ নয়, তার চেয়ে অনেক সাংঘাতিক ব্যাপার, খুনোখুনি যাকে বলে।’
রান্নাঘরের ভেতর থেকে দময়ন্তী বলল, ‘খুনোখুনি! কে কাকে খুন করল আবার?’
সমরেশ বলল, ‘সব বলছি। হাত মুখটা ধুয়ে নিই আগে। পাড়ায় থাকো, অথচ কোনো খবরই রাখো না। কবে তোমার পাশে খুন হয়ে পড়ে থাকব, জানতেও পারবে না।’
দময়ন্তী বাথরুমে তোয়ালে রেখে এল। বলল, ‘থাক, খুব হয়েছে। তুমি যখন ঘুমোও, তখন তো বাড়িতে ডাকাত পড়লেও হুঁশ থাকে না।’
.
খাওয়ার টেবিলে বসে সমরেশ বলল, ‘শোনো এবার। ওই তেত্রিশ নম্বরে এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক থাকেন, জানো? নাম বোধ হয়, সুখলাল চামারিয়া বা ওই ধরনের কিছু। আরে, ওই যে লনওয়ালা একতলা বাড়িটা!’
দময়ন্তী বলল, ‘জানি। সুখলাল চামারিয়া নয়, মোতিলাল জাজোড়িয়া। কিন্তু তার সঙ্গে রোমহর্ষক ঘটনা আর তোমার দেরি হওয়ার সম্পর্কটা কোথায়?’
একগাল হাসল সমরেশ, ‘হুঁ, হুঁ, ওইখানেই তো সম্পর্ক। সেই ভদ্রলোক আজ দুপুর দুটো থেকে চারটের মধ্যে খুন হয়েছেন— তাঁর বৈঠকখানা ঘরে। জানো সেকথা?’
আঁতকে উঠল দময়ন্তী। বলল, ‘সে কী! খুন হয়েছেন কী গো? কে খুন করলে? তাঁকে তো এই কালকেও দেখলুম, রিকশা করে কোথায় যেন যাচ্ছেন।’
সমরেশ বলল, ‘সে তো কাল। আজ আর তাঁকে দেখতে পাবে না। এতক্ষণে বোধ হয় পুলিশ তাঁকে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেছে।’
‘আহা, বেচারি!’ দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কোনোদিন আলাপ হয়নি। অথচ মনে হচ্ছে, যেন পরিচিতই ছিলেন। কিন্তু, তোমার দেরি হল কেন? সেখানে কি গোয়েন্দাগিরি করছিলে নাকি?’
‘আরে, না, না গোয়েন্দাগিরি-ফিরি নয়।’ সমরেশ বলল, ‘অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই আমিও দাঁড়িয়ে গেলুম। উঁকিঝুঁকি মারছিলুম, যদি কিছু দেখতে-টেখতে পাই।’
‘কিছু দেখলে?’
‘হ্যাঁ, দেখলুম। শুনলুমও অনেক।’
‘কী করে দেখলে? সে-বাড়ির সামনে তো বেশ খানিকটা কম্পাউন্ড। তোমায় ঢুকতে দিল পুলিশ?’
‘দেবে না মানে?’ সমরেশ বুক ফুলিয়ে বলল, ‘শুধু ঢুকতে দিল? আদর করে ডেকে নিয়ে গেল।’
‘বাজে কথা বোলো না।’ হাসল দময়ন্তী, ‘কেন? তোমাকে দেখে কি ওদের ব্যোমকেশ বক্সী বলে মনে হয়েছিল?’
‘না, ঠিক তা নয়। মানে, ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি তো অফিস থেকে ফিরছিলুম। তেত্রিশ নম্বরের সামনে ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলুম। কে একজন বললে, ভেতরে নাকি কে খুন হয়েছে। শুনে কৌতূহল আরও বাড়ল। কম্পাউন্ডের সামনে তো লোহার শিকের দেওয়াল, কাজেই বাড়িটা সবই দেখা যায়। দেখি, বারান্দায় আমাদের শিবেনচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘শিবেন, মানে শিবেন সেন? তোমার সেই সিআইডি বন্ধু?’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, সেই শ্রীমান। দেখে হাঁক মারলুম একটা। বেটা শুনতে পেয়েই এগিয়ে এল। ভিড়ের মধ্যে আমাকে দেখে একগাল হেসে এমনভাবে ”আয় আয়” বলে সম্বর্ধনা করল যেন নিজেরই বাড়ি। অবিশ্যি অনেক বছর বাদে দেখা, কাজেই আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক। তারপর একথা-সেকথা বলতে বলতে একেবারে ভেতরে নিয়ে গেল আমাকে। আমি অবশ্য বলেছিলুম, তোদের ইনভেস্টিগেশনে অসুবিধে হবে না তো? ও বলল, ইনভেস্টিগেশন যা হবার হয়ে গেছে। এখন ফটো তোলা, মাপজোক এইসব হচ্ছে। তুই আয়, কোনো অসুবিধে হবে না।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখলে ভেতরে ঢুকে?’
‘দেখলুম সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! ভদ্রলোক বসবার ঘরের মেঝেয় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। বোধ হয় পালিয়ে খাবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই খুনি তাঁর মাথায় মেরেছে ডান্ডা! মাথার পেছনটা রক্তে মাখামাখি, ঘরের মেঝেয়, খাবার ঘরের দরজায়, দেওয়ালে রক্ত আর রক্ত! দেখেই আমার কেমন গা ঘুলোতে লাগল, তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলুম।’
‘তারপর?’ দময়ন্তী আগ্রহব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
‘বাইরেও বিশ্রী দৃশ্য! ও বাড়ির দারোয়ান সূর্যকান্ত সিং না কী যেন নাম— যে বেটার ভয়ে একটা মাছি পর্যন্ত ও বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পেত না, সে তার বিশাল কুম্ভকর্ণ মার্কা শরীর দুলিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। তার বন্দুকটাও আবার পুলিশে নিয়ে গেছে। তবে তার কান্নাটা মনিবের শোকে, না তার সর্বক্ষণের সঙ্গী বন্দুকটার শোকে, ঠিক বুঝতে পারলুম না।’
‘আর মোতিলালবাবুর যে একটা ভাইপো থাকত?’
‘একটা নয়, দুটো। তাদের একটা অজ্ঞান, তার মাথায় সবাই জল-টল দিচ্ছে; আর অন্যটাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে— সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে আছে।’
দময়ন্তী বলল, ‘কিন্তু আমি তো জানতুম ওঁর একটাই ভাইপো। একদম বখাটে। রংচঙে জামাকাপড় পরে আর মেয়ে দেখলেই শিস দেয়।’
সমরেশ মিটমিট করে দময়ন্তীর দিকে তাকাল। বলল, ‘তোমাকে দেখেও দিয়েছিল নাকি? কিন্তু অপদার্থ পুলিশ তো সে বেটাচ্ছেলেকে অ্যারেস্ট করেনি, করেছে তার দাদাটাকে।’
‘দাদাটাকে কিন্তু কোনোদিন আমি দেখিনি। পাড়ায় ওরাই একমাত্র মাড়োয়ারি— নজরে পড়া উচিত ছিল।’
সমরেশ বলল, ‘না পড়াই স্বাভাবিক। কারণ উনি আগে এখানে ছিলেন না। বোম্বে থেকে মাসখানেক হল এসেছেন। এসেই বুড়োকে খতম করেছেন!’
দময়ন্তী বলল, ‘কিন্তু ওদের চাকরটা… রাজু? সে কোথায় ছিল?’
‘রাজু নাকি কাল রাত্রে ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। বলে গেছে একমাস পরে ফিরবে। পুলিশ অবশ্য তারও খোঁজ করছে। তাদের সন্দেহ, খুনের সঙ্গে সে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও, খুনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তার অনেক খবর জানার সম্ভাবনা আছে। যাক, পুরো গল্পটা তো শোনো। ভারি ইন্টারেস্টিং!’
গলা ঝেড়ে সমরেশ শুরু করল, ‘আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে এক বর্ষণমুখর রহস্যময় নিশীথে এই কাহিনির গোড়াপত্তন। কেমন, বেশ রোমহর্ষক রোমহর্ষক শোনাচ্ছে, না?’
‘ইয়ার্কি থামাবে? ভালো করে বলো।’ ঝংকার দিল দময়ন্তী।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শোনো। দশ বছর আগে— অর্থাৎ যখন তুমি রীতিমতো ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াও, তখন এই ভদ্রলোক তেত্রিশ নম্বরের বাড়িটি কিনে বসবাস শুরু করেন এ পাড়ায়। ভদ্রলোক অবিবাহিত, না বিপত্নীক— কেউ জানে না। তবে এসেছিলেন একা, সঙ্গে একটি বছর চোদ্দোর ভাইপোকে নিয়ে। তাঁর নিজের বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। নাদুসনুদুস ভালোমানুষ গোছের চেহারা। নাকের নীচে একটা প্রজাপতি-গোঁফ ছিল। তিনি কীসের ব্যাবসা করতেন, কেউ তখন তা জানত না; কারণ অত্যন্ত অমিশুক ছিলেন। এই দশ বছরে পাড়ায় প্রায় কারোর সঙ্গেই কোনো বাক্যালাপ করেননি। ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন, সন্ধের পরে ফিরতেন। বাড়িতে থাকত তাঁর ভাইপো, চাকর রাজু আর আর সেই ভীমভবানী দারোয়ান। কালেভদ্রে দু-একজন লোক ছাড়া কেউ আসত না তাঁর বাড়িতে। রাজু বাজার করত, ঘরদোর পরিষ্কার করত, রান্নাবান্না করত, সামনের লন নিড়োত, বাগানে জল দিত আর মনিবের ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে স্কুলে দিয়ে আসত, নিয়ে আসত। মোট কথা, রাজুই ছিল বাড়ির সকল কাজের কাজি। ভদ্রলোকের বোধ হয় ফুলের শখ ছিল। কারণ সামনের লনের চারদিকে সুন্দর বাগান করা হয়েছিল, তাতে নানা রকমের মৌসুমি ফুল লাগানো থাকত। কিন্তু ভদ্রলোককে কোনোদিন বাগান পরিচর্যায় দেখা যায়নি, যা করবার রাজুই করত। সে নানা রকমের ফুল লাগাত আর ভারি যত্ন-আত্তি করত।’
‘হ্যাঁ, আর সেইসব ফুলের একটারও নাম তুমি আজ পর্যন্ত শিখে উঠতে পারলে না!’ দময়ন্তী গঞ্জনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘যাকগে, যাকগে, তার সঙ্গে বর্তমান ঘটনার বিন্দুমাত্র যোগ নেই। তারপর শোনোই তো, গত দশ বছর যাবৎ ওই পরিবারটি প্রায় একইরকমভাবে জীবনযাপন করে আসছিল। পাড়ার কারোর সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলই না, এমনকী ওই শ্যামলালবাবুর সঙ্গে…’
‘শ্যামলাল আবার কে?’
‘আহা, ওই যে— যে ভদ্রলোক খুন হলেন।’
‘তিনি তো মোতিলাল!’
‘আরে ওই হল। সেই মোতিলালবাবুর সঙ্গে তাঁর পরিবারের বাকি লোকজনেরও যে বিশেষ যোগাযোগ ছিল তা মনে হয় না। তবে তাঁর চাকর, দারোয়ান এবং ভাইপোটি যে তাঁকে দুর্দান্ত ভয় বা ভক্তি করত, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মোট কথা, তাঁরা এতদিন প্রায় নিঃশব্দে ওই তেত্রিশ নম্বরে জীবন কাটিয়েছেন। ভাইপোটি বখে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করত না সে। এতদিন এইভাবেই চলছিল। তারপর হঠাৎ মাসখানেক আগে বোম্বে থেকে দু-নম্বর ভাইপো খুড়োর ব্যাবসায় যোগ দিতে ধূমকেতুর মতো এসে উপস্থিত হল। আর ধূমকেতু উঠলে যে কী হয়, তা তো জানোই।
‘এই ভাইপো বাবাজীবনের আগমনের কয়েকদিন পরেই আশপাশের বাড়ির লোকেরা তেত্রিশ নম্বরে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করল। যা এর আগে কখনো হয়নি, তাই ঘটতে আরম্ভ করল। বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতে লাগল। এমনকী সেই চেঁচামেচি গভীর রাত্রি পর্যন্ত মাঝে মাঝে শোনা গেল। কী নিয়ে চেঁচামেচি, সেটা না বোঝা গেলেও তাতে অংশগ্রহণকারীরা যে খুবই উত্তেজিত থাকত, সে-ব্যাপারে সকলেই একমত ছিলেন। এরপর একদিন রাজুর চাকরি গেল।
‘পঁয়ত্রিশ নম্বরে থাকেন রাখাল সান্যাল— তাঁকে তুমি চেনো। রাখালদার স্ত্রী মীরা বউদি একদিন সকাল বেলা দরজা খুলে দেখেন, তাঁদের রোয়াকে রাজু শুয়ে, পাশে কয়েকটা বাক্স-প্যাঁটরা। ব্যাপার কী? জিজ্ঞাসাবাদ করাতে রাজু জানাল যে তার চাকরি গেছে। তারপর গজর গজর করতে করতে সে আরও জানাল যে তার চাকরি যাওয়ার মূলে ওই দু-নম্বর ভাইপো এবং তার সঙ্গে চালাকির ফল সে পাবে; কারণ সে সব ফাঁস করে দেবে। মীরা বউদি ফাঁস করার কথা শুনে একটু ইয়ে হয়ে পড়েন, যাকে বলে কৌতূহলাক্রান্ত। কিন্তু অধিক প্রশ্নবাণ ছোড়ার আগেই এক নম্বর ভাইপোকে আসতে দেখা যায় এবং তার রাজুদাদাকে বগলদাবা করে বাড়ি ফিরে যায়। এই ভাইপোর কথায় জানা যায় যে কর্তাই নাকি রাজুকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
‘আর একটা পরিবর্তন দেখা গেল রামলাল… ইয়ে মোতিলালবাবুর ব্যবহারে। ভদ্রলোক বাতের রুগি ছিলেন। মাঝে মাঝে বাতের ব্যথা উঠলে অফিসে বা তাঁর কর্মস্থলে যেতেন না। বসবার ঘরে, যেখানে তিনি শেষ পর্যন্ত খুন হলেন, সেই ঘরে জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসে রাস্তার লোক চলাচল দেখতেন। ওই অবস্থায় বসে থাকতে তাঁকে অনেকেই দেখেছে। ইদানীং অফিসে যাওয়া তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। প্রায়ই তাঁকে বসবার ঘরের জানলার সামনে বসে থাকতে দেখা যেত। সম্ভবত বাতের ব্যথাটা খুব ঘন ঘন উঠছিল আজকাল।
‘তারপর শেষের সেদিন অর্থাৎ আজকের ঘটনা।
‘মোতিলাল আজকেও অফিসে যাননি। সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন বলেছিলেন। সকাল বেলা ন-টার মধ্যেই দুই ভাইপো বেরিয়ে যায়— বড়োজন ব্যাবসায় আর ছোটোজন কলেজে। দেড়টা নাগাদ বড়োজন ফিরে আসে। দারোয়ান তাকে দেখে। আড়াইটে নাগাদ সে আবার বেরিয়ে যায়। তার বেশ কিছুক্ষণ পরে দারোয়ান মাত্র পাঁচ মিনটকে লিয়ে বড়ো বাথরুম করতে যায় গেট বন্ধ করে। ফিরে এসে সে দেখে, দুটো মেয়ে-কুলি ”খুন হো গিয়া, খুন হো গিয়া” বলে পরিত্রাহি চিৎকার করছে। তারা ফুল চুরি করবার উদ্দেশ্যে গেট খুলে লনে ঢুকেছিল। তখন সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে জানলার মধ্যে দিয়ে দেখে যে কর্তা ঘরের মধ্যে রক্তগঙ্গায় শুয়ে আছেন। সে তখন দৌড়ে তেত্রিশের উলটো দিকে যে নতুন বাড়িটা উঠছে, তার কনট্রাক্টরকে খবর দেয়। তিনি পুলিশে ফোন করেন। এই হল মোটামুটি ঘটনা।’
দময়ন্তী স্থির দৃষ্টিতে সমরেশের দিকে চেয়ে গল্পটা শুনছিল। প্রথমদিকে চাবিটা নিয়ে অল্প অল্প ঠুন ঠুন করছিল, শেষের দিকে তাও বন্ধ হয়ে গেছিল। সমরেশ থামতেই জিজ্ঞেস করল, ‘এই বয়ানটা নিশ্চয়ই দারোয়ানটার সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করছে? আর পুলিশও সেটা বেদবাক্য বলে মেনে নিয়েছে?’
সমরেশ বলল, ‘সাক্ষ্যটা দারোয়ানের ঠিকই, তবে তা বেদবাক্য কি না বলতে পারব না। শিবেনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারি। তবে সাক্ষ্যটা যে মোটামুটি ঠিক, তার কতকগুলো প্রমাণ আছে। যেমন ধরো, দু-নম্বর ভাইপোর ঘরে একটা রক্তমাখা তোয়ালে পাওয়া গেছে।’
দময়ন্তী সশব্দে হেসে উঠল, ‘সেই অবধারিত রক্তমাখা তোয়ালে? আর একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ পাওয়া যায়নি?’
বিষম খেল সমরেশ, ‘হ্যাঁ, তাও পাওয়া গেছে। তবে…’
‘তবে সেটা আনকোরা নতুন— অব্যবহৃত মনে হচ্ছে, এই তো?’ দময়ন্তী যোগ করে দিল।
সমরেশ হাঁ করে তার স্ত্রী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘ঠিক তাই। আশ্চর্য, শিবেনও আমায় তাই বলছিল। হয়তো কেউ দোষটা এই শ্রীমানের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করছে। কারণ রক্তমাখা তোয়ালে ঘরের মধ্যে রেখে যাবে— লুকিয়ে বা অন্য কোনোভাবে, এহেন বোকামি আজকাল আর কোনো খুনি করে না। কিন্তু, খুন যদি এই শ্রীমান করে না থাকে, তাহলে করার সম্ভাবনা হয় দারোয়ান আর নয়তো দারোয়ানের যোগসাজশে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির। কিন্তু সেই সম্ভাবনা দুটো খুব জোর করে খাড়া করা যাচ্ছে না। কারণ আজ সকাল থেকেই দুটি লোক তেত্রিশ নম্বরের গেটের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখেছিল এবং তাদের সাক্ষ্য আর দারোয়ানের সাক্ষ্য মোটামুটি মিলে গেছে। এমনকী দু-নম্বর ভাইপোর আসার সময়টা পর্যন্ত। কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আজ সে-বাড়িতে ঢোকেওনি, বেরোয়ওনি।’
দময়ন্তী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই দুটি লোক আবার কারা! তারা নজরই-বা রাখতে গেছিল কেন?’
‘বুঝলে না? এরা ওই দুটো মেয়ে-মজুর, যারা প্রথমে লাশ আবিষ্কার করে, আজ ওদের ভগবান জানেন কীসের নাকি পরব। তাই দুটো ফুল লিবে বলে সারাদিন তক্কে তক্কে ছিল। দারোয়ান একটু উঠলেই চট করে গিয়ে কাজটা সারবে। দারোয়ান উঠে ভেতরে গেলে, সামনের বাড়ি থেকে রাস্তা পার হয়ে এসে, একটু এদিক-ওদিক দেখে, জানলা দিয়ে কেউ দেখছে কি না ইনস্পেক্ট করে, গেট খুলে ভেতরে খানিকটা গিয়ে তবে তারা খোলা জানলার ভেতর দিয়ে মৃত ভদ্রলোকের শরীরটা দেখতে পায়। এতে খুব বেশি করে ধরলেও পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগবার কথা নয়। শিবেন বলছে, দারোয়ানটার পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে চট করে খুনখারাপি করা অত্যন্ত কঠিন— প্রায় অসম্ভব বলা চলে। যদিও পাক্কা গোরিলার মতো চেহারা তার, তবু সে মাঝে মাঝে খুন করে আগেই হাত মকশো করে রেখেছিল— এমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
দময়ন্তী শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘হয়তো আপাতদৃষ্টিতে দারোয়ানর সাক্ষ্য ঠিক, কিন্তু কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল আছে, জানো, কেমন একটা খটকা লাগছে।’
হাসল সমরেশ। বলল, ‘গণ্ডগোল তো আছে বটেই। সমস্ত বাড়িটাতেই তো গণ্ডগোল। কর্তার ঘরে কার্পেটের তলায় মেঝের মধ্যে লুকোনো সিন্দুকে রাশি রাশি টাকা। দু-নম্বর ভাইপোর ঘরেও যা কাগজপত্র পাওয়া গেছে, তাতে চোরাই মাল কেনাবেচার এক বিরাট চক্রের সন্ধান মিলেছে, যার অন্যতম চক্রধর ছিলেন খুড়ো আর দু-নম্বর ভাইপো। রাজু যে ফাঁস করবার কথা বলেছিল, তা সম্ভবত এই ব্যাপার। যা হোক, এক নম্বর ভাইপোর ঘরে ইকনমিক্সের বইয়ের মলাটের ভেতর সন্ধান মিলেছে ভয়ংকর ভয়ংকর সব পর্নোগ্রাফির, যার এক লাইন পড়লে বা একটা ছবি দেখলে তুমি নির্ঘাত ভিরমি যেতে। আমি যে আমি, যাকে তুমি জগতের অশ্লীলতম মানুষ বলে মনে কর, সেই আমারও ছবি দেখে হাত-পা ছেড়ে গিয়েছিল প্রায়। আর দারোয়ানের ঘরেও পাওয়া গেছে অনুরূপ বই আর কয়েক বাক্স কনট্রাসেপটিভ! দেখেশুনে আমার বারংবার দাঁতকপাটি লাগবার জো।’
‘বাজে কথা বোলো না। যা অসম্ভব অসভ্য তুমি! তোমার লাগবে দাঁতকপাটি!’ দময়ন্তী সমরেশের দিকে একটা দুর্দান্ত কপট ক্রোধের কুটিল কটাক্ষ হানল।
সমরেশ খানিকক্ষণ মুগ্ধ বিহ্বল চোখে গৃহিণীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গলা-টলা ঝেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যিই তাই! আর কী ছাপা বাঁধাই সেসব বইয়ের। সুইডেনের মাল, ঝলমল করছে। কোত্থেকে যে ওই হারামজাদা এসব বই জোগাড় করেছিল, ভগবান জানেন। যা হোক, দারোয়ানকে যদি তুমি খুনি হিসেবে বাদ দাও, তৃতীয় ব্যক্তিও যদি কেউ না থাকে, তাহলে সমস্ত সন্দেহ স্বাভাবিকভাবেই গিয়ে ওই ধূমকেতু বাবাজীবনের ওপরেই পড়ে। যাকে বলে, বাই মেথড অব এলিমিনেশন। তা ছাড়া, তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকবেই-বা কোত্থেকে? জানলার সামনে তো সর্বক্ষণই মোতিলাল সমাসীন। তাঁর চোখ এড়িয়ে একটা ফালতু লোক আসে কী প্রকারে?’
দময়ন্তী সমরেশের কথা বলার ঢংটাকে নকল করে বলল, ‘তাই তো, কী প্রকারে? আচ্ছা, আজ ওদের রান্নাবান্না করল কে?’
‘রান্না? ও, হ্যাঁ, জানি। রান্না কেউ করেনি। হোটেল থেকে নাস্তা এসেছিল।’
‘চা বা কফি?’
‘তার পাট নেই ও বাড়িতে। কেবল মোতিলালের অভ্যেস ছিল খাওয়ার। দুটো আড়াইটে নাগাদ স্বহস্তে বানাতেন। আজও মৃত্যুর আগে শেষ শরবত বানিয়ে খেয়েছিলেন এবং গেলাস ধুয়ে-টুয়ে রেখেছিলেন।’
দময়ন্তীর চোখ দুটো উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘ওঁর কি ডায়াবেটিস ছিল?’
‘ডায়াবেটিস?’ সমরেশ অবাক। বলল, ‘কই, জানি না তো! কেন, সে-খবরে সুবিধে হবে কীসের?’
‘হবে, হবে।’ উত্তেজনায় দময়ন্তীর গলা কাঁপা কাঁপা শোনাল। ‘শিগগির ফোন করো মোতিলালের বাড়িতে। শিবেনবাবু থাকলে জিজ্ঞেস করো যে, মোতিলালের ডায়াবেটিস ছিল কি না। না থাকলে, চিনির কৌটোয় কতটা চিনি আছে। আর যে অস্ত্র মাথায় মারা হয়েছে, সেটা লম্বা এবং ধারালো কি না।’
‘ডায়াবেটিস আর লম্বা ধারালো অস্ত্র এবং চিনি? এ যে রীতিমতো রহস্যোপন্যাস বলে মনে হচ্ছে!’ সমরেশ বিড়বিড় করতে করতে উঠে টেলিফোন ডাইরেক্টরিটা খুলল।
তারপর নিম্নলিখিত বাক্যালাপ হল টেলিফোনের মাধ্যমে।
‘হ্যালো কে, শিবেন? শোন, আমার বউ এই মোতিলাল হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানতে চায়। কেন? রহস্যো উৎঘাটন জন্যে, আবার কেন? অলরেডি বেশ খানিকটা করেও ফেলেছে। এই যেমন ধরে ফেলেছে যে, রামেশ্বরের ঘরে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ পাওয়া গেছে! সেটা আবার আনকোরা নতুন, তাও ধরে ফেলেছে। প্রায় হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তারের মতো। হাঃ, হাঃ, হাঃ! বউয়ের বুদ্ধি থাকবে না মানে? বুদ্ধি না থাকলে চার বছর প্রেম করে বিয়ে করি? হাঃ, হাঃ, হাঃ! প্রশ্নগুলো? হ্যাঁ। এক নম্বর— মোতিলালের ডায়াবেটিস ছিল কি না। দুই নম্বর— যদি না থাকে, তাহলে চিনির কৌটোয় কতটা চিনি আছে? আর তিন নম্বর, যে অস্ত্র দিয়ে মাথায় মেরেছে, সেটা লম্বা মতন এবং ধারালো কি না। ব্যস। আচ্ছা, ধরে রইলুম।’
কিছুক্ষণ বাদে শোনা গেল, ‘ছিল না? চিনিও নেই? আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি।’ টেলিফোনের মাউথপিসটা হাত দিয়ে ঢেকে সমরেশ ডাকল দময়ন্তীকে, ‘শুনছ? শিবেন বলছে, চিনির কৌটো খালি আর যদিও অটোপসি না করলে ভালো বোঝা যাবে না, তবু ডাক্তারবাবুর মতে অস্ত্রটা তোমার বর্ণনা মতোই। এখন?’
দময়ন্তী একটু চিন্তা করে বলল, ‘শিবেনবাবুকে বলো তো, খাওয়ার ঘরের জানলাগুলোর বাইরের জমিটা একটু খুঁজে দেখতে, হয়তো একটু চিনি পাওয়া যেতে পারে। তবে খুব সম্ভব পাবেন না, কারণ জানলার ঠিক নীচে দিয়েই একটা ড্রেন গেছে।’
সমরেশ সেই কথাই বলল টেলিফোনে। তারপর আবার দময়ন্তীর দিকে ফিরে বলল, ‘আর অস্ত্রটা?’
‘সেটা ঘরের মধ্যেই আছে, খুঁজে দেখতে বলো।’ বলে দময়ন্তী রান্নাঘরের মধ্যে অদৃশ্য হল।
.
খাওয়া-দাওয়ার পর সমরেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘দ্যুৎ! রহস্যটা যে রহস্যই রয়ে গেল। ডায়াবেটিসেই মোলো নাকি মোতিলালচন্দ্র? আর অস্ত্রটা ঘরের মধ্যেই আছে? কেউ দেখতে পেল না, আর তুমি এখানে বসেই দেখতে পেলে?’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘পাব না কেন? তুমিই তো বললে যে, বসবার ঘরের সব জানলা খোলা ছিল।’
সমরেশ ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে কটমট করে তাকাল। বলল, ‘আমার সঙ্গে হেঁয়ালি? জানলা খোলা তেত্রিশ নম্বরে আর পঁচাত্তর নম্বর অর্কিড রোডে বসে উনি ঘরের মধ্যে অস্ত্র দেখলেন! চালাকি পায়া হ্যায়?’
এমন সময় সিঁড়িতে দুম দুম করে পদশব্দ শোনা গেল। দময়ন্তী বলল, ‘শিবেনবাবু আসছেন। যাও, দরজাটা খোলো গিয়ে। এক্ষুনি সব ফয়সালা হয়ে যাবে।’ বলে রান্নাঘরের ভেতর চলে গেল।
দরজা খুলে সমরেশ বলল, ‘পুলিশ হলেই কি এমন বিটকেল জুতোর আওয়াজ করতে হয়? আয়, বোস।’
শিবেন বলল, ‘এত রাতে বিরক্ত করলুম বোধ হয়? কিন্তু… যাক, ডাক তোর বউকে। শুয়ে পড়েছেন নাকি?’
দময়ন্তী ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। হেসে নমস্কার করে বলল, ‘না, না, শুইনি। মোটে তো রাত এগারোটা। বহুদিন বাদে দেখলুম আপনাকে, আছেন কেমন? রমলা কেমন আছে?’
শিবেন প্রতিনমস্কার করল। বলল, ‘ভালোই আছে। আমি কিন্তু টেলিফোনে সমরেশের কথাবার্তা শুনে ভারি আশ্চর্য হয়েছি। তাই এলুম, একটু আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে। সমরেশ আপনাকে কী বলেছে জানি না, কিন্তু আপনি কী বুঝেছেন বলুন তো?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে একটু চুপ করে থেকে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘আমি বোধ হয় পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছি, যদিও সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজের ধারণা। যাক, চিনি পেয়েছেন? কিছু ছিল সেই চিনিতে?’
শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। জানলার নীচে ক্রোটনের পাতার ফাঁকে খানিকটা, বাকিটা ভেসে গেছে ড্রেনে। আপনার কি বিশ্বাস, এই চিনিতে বিষ পাওয়া যাবে? আর যদিই-বা পাওয়া যায়, তাহলেই-বা প্রমাণ হবে কী? খুনি আগে বিষ দিয়েছে, পরে মাথায় ডান্ডা মেরেছে। এ ছাড়া অন্য কিছু?’
দময়ন্তী বলল, ‘আগে আপনি বসুন দেখি, তারপর বলছি। প্রমাণ হবে সন্দেহাতীতভাবে যে, রামেশ্বর খুন করেনি, করেছে অন্য কেউ। গোড়ায় এটা আমার শুধু সন্দেহই হচ্ছিল।’
মৃদু অবিশ্বাসের হাসি হেসে শিবেন জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে প্রমাণ হবে?’
‘বলছি। প্রথমত, রামেশ্বরের ঘরের তোয়ালেটা স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, তাকে কেউ ফাঁসাবার চেষ্টা করছে। সে কখনোই এত নির্বোধ হতে পারে না যে নিজের বিছানার তলায় নিজেই নিজের মৃত্যুবাণ পুলিশের আবিষ্কারের জন্যে রেখে যাবে। অর্থাৎ অন্য কেউ ওইটি তার ঘরে রেখে এসেছে, সে হত্যাকারী স্বয়ং হতে পারে অথবা তার কোনো শাগরেদ।
‘দ্বিতীয়ত, বিষ দেওয়া হোক বা না হোক, মাথায় ডান্ডা মারাটাই একটা অসম্ভব ব্যাপার।’
শিবেন গলার মধ্যে শব্দ করে হাসল; দময়ন্তী কিন্তু থামল না। বলে চলল, ‘অসম্ভব— তার কারণ আছে। সমরেশের বর্ণনা অনুযায়ী মোতিলালের বসবার ঘরের জানলা সব খোলা, সামনেই একটা বাড়ি উঠছে— যেখানে অনেক মজুর কাজ করছে। এ অবস্থায় দিনে-দুপুরে খুনি এসে মোতিলালের মাথায় ডান্ডা মারল, এটা অবাস্তব কল্পনা। কোনো মানুষের নার্ভ এত শক্ত হয় না— হতে পারে না। তা ছাড়া ভদ্রলোককে পাওয়া গেছে খাওয়ার ঘর আর বসার ঘরের মাঝে দরজার সামনে। ধরে নেওয়া হয়েছে যে ভদ্রলোক খাওয়ার ঘরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তখনই তিনি পড়ে যান। এই ব্যাপারটা একেবারে নিঃশব্দে ঘটল কীভাবে বলতে পারেন? একটা চিৎকার পর্যন্ত করলেন না ভদ্রলোক, কেন?’
শিবেনকে এবার একটু চিন্তিত দেখা গেল। বলল, ‘কিন্তু মাথা যে ফাটানো দেখা গেছে! কোনো লম্বা লাঠির মতো অস্ত্র দিয়ে মারা হয়েছিল। তা ছাড়া, আপনি বলছেন অস্ত্রটা ঘরের মধ্যেই আছে?’
দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছি; এবং এখনও বলছি। একটা জিনিস ধরেই নিচ্ছেন কেন যে অস্ত্র দিয়ে মাথায় মারলেই তবে মাথা ফাটে? মাথা দিয়ে অস্ত্রে মারলেও তো মাথা ফাটতে পারে?’
সমরেশ আর শিবেন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ বসবার ঘর আর খাওয়ার ঘরের মধ্যের দরজার চৌকাঠ। ভদ্রলোক খাওয়ার ঘর থেকে শরবত খেয়ে বসবার ঘরে ঢুকে কয়েক পা যেতেই ধড়াস করে উলটে পড়ে গেলেন। মাথাটা ঠুকে গেল চৌকাঠে, ফেটে গেল। ঘটনাটা ঘটতে এক পলক সময় লাগল। ঘরের ভেতর মোটামুটি অন্ধকার, বাইরে আলো। কেউ মেঝেতে পড়ে থাকলে খুব ভালো করে লক্ষ না করলে বাইরে থেকে বোঝা কঠিন। হত্যাকারীর শাগরেদ পরে নিজের সুবিধেমতো ঘরে ঢুকে পা ধরে টেনে মৃতদেহ একটু সরিয়ে দেয়, যাতে বোঝা না যায় যে মাথাটা চৌকাঠে ঠুকে গেছল। তারপর রক্ত দেখে রামেশ্বরকে ফাঁসানোর সমস্ত পথ পরিষ্কার রাখতে, খানিকটা তোয়ালেতে মুছে, রেখে আসে রামেশ্বরের ঘরে। হত্যাকারী এবং তার শাগরেদদের প্ল্যানে এ অংশটা একেবারেই ছিল না বলে আমার অনুমান। তারা এই অংশটার সুযোগ নিতে গিয়েই নিজেদের এক্সপোজড করে ফেলল।
‘তা ছাড়া এ অংশটা যে অরিজিন্যাল প্ল্যানের মধ্যে ছিল না, তার প্রমাণ রামেশ্বরের ঘরে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ। অটোপসির ফলে মোতিলালের শরীরে যে বিষ পাওয়া যাবে, সেটা তারা জানত। তাই সিরিঞ্জ রেখে পুলিশের দ্বিতীয় দফা সন্দেহ রামেশ্বরের ওপর ফেলবার চেষ্টা করা হয়েছিল।’
সমরেশ প্রশ্ন করল, ‘দ্বিতীয় দফা কেন?’
‘হত্যার টাইমিংটা লক্ষ করো। ওরা জানত যে রামেশ্বর দুপুর বেলা আসে খুড়োর সঙ্গে ব্যাবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলতে, আর সে চলে গেলেই খুড়ো শরবত বানিয়ে খেয়ে থাকেন। তাই এমন ব্যবস্থা হল যে প্রথম দফা সন্দেহ একমাত্র রামেশ্বরের ওপরেই গিয়ে পড়ে। প্ল্যানটা মোটামুটি ভালোই ছিল, কিন্তু একটু ওপরচালাকি করতে গিয়ে সব ভেস্তে গেল।’
শিবেন এতক্ষণ গভীর ভ্রূকুটি করে নিজের দুই বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে দময়ন্তীর কথা শুনছিল। এবার মুখ তুলে বলল, ‘আপনার কথামতো চৌকাঠে মাথা ঠুকেই যদি মাথা ফেটে থাকে, তবে তো চৌকাঠে চুল এবং রক্ত লেগে থাকবে। তেমন তো কিছু পেলাম না আমরা।’
দময়ন্তী বলল, ‘পাননি তার কারণ সেই চুল আর রক্ত তোয়ালে দিয়ে মুছে রামেশ্বরের ঘরে রেখে আসা হয়েছিল। কাল সকালে ল্যাবরেটরি টেস্টে সেটা পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
শিবেন বলল, ‘তাহলে দারোয়ানটাই…’
দময়ন্তী সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, দারোয়ানটা হত্যাকারী হতেই পারে না; সে শাগরেদ। সে যখন মৃতদেহের পা ধরে টেনে সরিয়েছে, তখন হত্যাকারী তার ত্রিসীমানাতেও ছিল না। তা ছাড়া সে হঠাৎ রান্নাঘরে ঢুকে চিনির কৌটো নিয়ে ”ঘটর ঘটর” করলে মোতিলালের সন্দেহ হতে পারত। আর স্পষ্টত, চিনিতে বিষ মেশানো হয়েছে ঘটনার সামান্য কিছু আগে। বেশি আগে মেশালে অন্য কোনো অঘটন ঘটতে পারত, হত্যাকারী খামোখা সে-রিস্ক নেবে বলে মনে হয় না।’
শিবেন অধৈর্য কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে আর কে? রামেশ্বর ছাড়া আর কাউকে তো পাওয়া যাচ্ছে না। তার মোটিভ আছে— টাকা হাতানো এবং ব্যাবসাটা নিজের কুক্ষিগত করা। সুযোগ আছে— প্রবেশ, প্রস্থান এবং চিনিতে বিষ মেশানো সবার অলক্ষ্যেই করা যেতে পারে।’
দময়ন্তী বলল, ‘দেখুন, এটা একটা অঙ্কের ব্যাপার। একটা নেগেটিভ আর একাধিক পজিটিভের ফলে একটা নেগেটিভই হয়। যখন স্পষ্টতই কেউ রামেশ্বরকে ফাঁসাতে চাইছে, তখন হাজার স্বপক্ষে যুক্তি থাকলেও রামেশ্বর হত্যাকারী হতে পারে না। অন্য কেউ এর পেছনে আছে।’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘ম্যাথামেটিক্স ঝাড়ছ যে বড়ো? তুমি না হিস্ট্রিতে এমএ?’
শিবেন সেকথায় কান না দিয়ে বলল, ‘তাহলে তো বলতে হয়, সামনের বাড়ির মজুরগুলো মিথ্যে কথা বলছে। কারণ তারা অন্য কাউকেই দেখেনি।’
দময়ন্তী বলল, ‘দেখেছে ঠিকই, লক্ষ করেনি।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, সোফার হাতলে একটা প্রচণ্ড ঘুসি মেরে লাফিয়ে উঠল শিবেন। বলল, ‘বুঝেছি— রাজু! সেই হচ্ছে দি ইনভিজিবল ম্যান। মজুরগুলো হতভাগা। তাদের যতই বলি অন্য কেউ ঢুকেছে কি না, তারা ভেবে বসে আছে, সে নিশ্চয়ই কালো সুট, কালো টুপি, কালো চশমা পরা হিন্দি ফিলমের হত্যাকারী ক্যারেক্টার। রাজুকে তারা লক্ষই করেনি। সে যে ছুটিতে আছে, তাও বোধ হয় তারা জানে না, জানলেও সন্দেহ করত না। রাজু মোতিলালের সামনে দিয়েই ঢুকেছে, হয়তো দু-চারটে কথাবার্তাও বলেছে, তারপর সোজা নিজের ঘরে গেছে। বোধ হয় দু-নম্বর যতক্ষণ ছিল, সে সেখানেই ঘাপটি মেরে ছিল। সে বেরিয়ে গেলে, খাওয়ার ঘরে ঢুকে কৌটোয় বিষ মিশিয়ে মোতিলালের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেছে। তার সর্বত্র অবাধ গতি, মোতিলালের সন্দেহ হয়নি। হয়তো তাকে দেখে খুশিই হয়েছিলেন। আর ওই দারোয়ান বেটা শাগরেদ। চমৎকার, চমৎকার! আর নাটের গুরু…’
দময়ন্তী বলল, ‘এক নম্বর ভাইপো।’
সমরেশ বলল, ‘মোটিভটা একটু খোলসা করে বলো।’
শিবেন বলল, ‘বুঝলি না? স্বর্ণডিম্ব-প্রসবকারী হংসকে যে মোটিভের বশবর্তী হয়ে মারা হয়েছিল, এও প্রায় তাই। এবারেও শেষরক্ষা হল না। মোতিলাল সারাদিন চোরাইমাল কেনাবেচা করে অজস্র কালোটাকা রোজগার করেন আর তাঁর ভাইপো সেই টাকা সরিয়ে চাকর আর দারোয়ানের সাহায্যে নরকের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে। রামেশ্বর এসে খুড়োর ব্যাবসায় যোগ দিয়ে বাড়ির এই চোরাকারবারটিকেও হৃদয়ঙ্গম করে ফেলে এবং সেটা খুড়োর কর্ণগোচর করে। তাই রাতবিরেতে এত চেঁচামেচি এবং খুড়োর গৃহে অবস্থান।’
‘এমন মধুর জীবনযাপনে বাধা আসতেই খুড়োকে সরানোর দরকার হয়ে পড়ল এবং সেইসঙ্গে রামেশ্বরকে ফাঁসানোর? এক ঢিলে দুই পাখি? বাপরে বাপ, কী পগেয়া ছেলে!’ সমরেশ বলল।
‘পগেয়া বলে পগেয়া!’ শিবেন বলল, ‘কী চমৎকার প্ল্যানটাই না ফেঁদেছিল! যে টাকা বাড়িতে মজুত ছিল, তা তিনজনের তিন জন্মের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কেবল শ্রীমানরা বোঝেনি যে রামেশ্বরের ব্যাগের কাগজপত্র দেখে সন্দেহ হওয়ায়, আমরা অত খুঁটিয়ে সার্চ করব এবং লুকোনো টাকা সব বেরিয়ে পড়বে। ছোটো শ্রীমানের অজ্ঞান হওয়া এবং দারোয়ানের অত কান্নার কারণ এবার বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা বউদি, রাজুর ওপর আপনার সন্দেহ হল কী করে?’
দময়ন্তী বলল, ‘সেটা অবশ্য আমি সংসার করি তাই সন্দেহ করেছিলাম। আপনাদের— পুরুষমানুষদের পক্ষে ধরা একটু কঠিন ছিল। ব্যাপার হল, রাজু যখন এক মাসের ছুটিতে গেল, তখন কোনো বদলি লোক দিয়ে গেল না কেন? বিশেষত, যেখানে রান্না করার বা ঘরদোর পরিষ্কার করার জন্য দ্বিতীয় কোনো লোক নেই। মোতিলালকে সে কী বুঝিয়েছিল জানি না, তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। ও কী, উঠছেন কেন? কফি খাবেন না? জল চড়িয়ে দিলুম যে!’
শিবেন স্মিতমুখে বলল, ‘না, না, অনেক ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ! আমি এক্ষুনি যাই। ফাঁদ পাততে হবে। ও বেটা নির্ঘাত ধারে-কাছেই আছে এবং বাকি দু-জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। আচ্ছা, চলি। নমস্কার।’
দরজা বন্ধ করে এসে সমরেশ খানিকক্ষণ হাস্যোজ্জ্বল চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দু-হাতে ওর মুখটা ধরে বলল, ‘ইস, কী কুক্ষণেই ওই হতচ্ছাড়া ভাইপো তোমার পেছনে সিটি মেরেছিল গো!’
লাজুক গলায় দময়ন্তী বলল, ‘যাও, অসভ্যতা কোরো না!’