নকল হিরে
সমরেশ অফিস থেকে ফিরেই লম্বা হওয়ার তাল করছিল। দময়ন্তী বাধা দিল। বলল, ‘শিবেনবাবু আসছেন। এখন শুয়ে পোড়ো না।’
‘শিবেন আসছে কেন?’
‘এক ভদ্রলোককে নিয়ে আসছেন। একটা ইন্টারেস্টিং কেস আছে নাকি।’
‘কে ভদ্রলোক?’
‘নাম বললেন সুশীল মৈত্র। তাঁর মেয়ে তার স্বামীকে খুন করেছে। কাগজে বেরিয়েছিল, পড়েছিলে? সোনারপুরে হত্যাকাণ্ড?’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘নাঃ। খেলার খবর ছাড়া আমি তো আর কিছুই পড়ি না।’
দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘জানি। আমার তো পড়ে মনে হয়েছিল খুব সোজা ব্যাপার। মেয়েটির স্বামীর চরিত্র ভালো ছিল না নাকি। সেই রাগে মেয়েটি খুব ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করেছিল তাকে, নিজের শোবার ঘরে, তার স্বামীরই রিভলভার দিয়ে।’
সমরেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘হুঃ। ক্রাইম প্যাসিওনেল— খুবই সোজা ব্যাপার সন্দেহ নেই। হরবখতই হচ্ছে। তা, শিবেন আবার এর মধ্যে ইন্টরেস্টিং কী পেল?’
‘কী জানি! মেয়েটি বলেছিল, সে সেলফ ডিফেন্সে ভদ্রলোককে গুলি করে। কিন্তু ভদ্রলোকের কাছে কোনো অস্ত্রই ছিল না। তা ছাড়া পুলিশের মতে ভদ্রলোক খুব শান্ত, নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিলেন।’
‘সেটা অবশ্য কিছুই প্রমাণ করে না। শান্ত লোক খেপে গেলে যে কী মূর্তি ধরে, তা তো মাঝে মাঝেই দেখছি।’ বলে সমরেশ দাঁত বের করে হাসল।
হুংকার দিল, ‘বাজে কথা বোলো না! কী এমন ভয়ংকর মূর্তি দেখেছ শুনি?’
সমরেশ এ প্রশ্নের কোনো জবাবই দিল না। উলটে সোফার ওপর আড় হয়ে ভাঙা বেসুরো গান জুড়ে দিল, ‘শ্মশান কালীর নাম শুনে রে ভয় কে পায়, ভয় কে পা-আ-আ-য়!’ তারপর বেজায় গণ্ডগোল বেধে গেল।
.
সুশীল মৈত্র সার্থকনামা ব্যক্তি। এমন বিনয়ী, নম্র ভদ্রলোক সচরাচর দেখা যায় না। পঞ্চাশের ওপর বয়েস, পক্বকেশ দীর্ঘকায় সুপুরুষ ব্যক্তি। এঁর মেয়ে যে খুনে হতে পারে, ভাবাই যায় না। ভদ্রলোক দুঃখিত আর নীচু গলায় ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন
‘আমার জামাই, মানে প্রতাপ, প্রতাপ চৌধুরী, একসময় আমার কর্মচারী ছিল। সোনারপুরে আমার একটা ফ্যাব্রিকেশন শপ আর ফাউন্ড্রি আছে, সেখানে যাদবপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বছর ছয়েক আগে জয়েন করে। অত্যন্ত পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান ছেলে দেখে আমি তার দায়িত্ব বাড়াতে থাকি এবং শেষ পর্যন্ত আমার ছোটোমেয়ে দীপান্বিতার সঙ্গে তার বিয়ে দিই। সে আজ বছর চারেক আগেকার কথা, দীপু তখন সদ্য বিএ পাশ করেছে।
বিয়ের পর বছর দুয়েক বেশ ভালোই কেটেছিল, কিন্তু তারপর থেকে গণ্ডগোল শুরু হল। আমার ছোটোমেয়ে খুবই চাপা স্বভাবের, কিন্তু তবু ওর কাছ থেকে যা জানতে পারি তাতে বুঝতে পারি যে প্রতাপের চরিত্রর প্রতি সে খুবই সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। অথচ এর কিন্তু সঠিক কোনো কারণ ছিল বলে আমার জানা নেই। প্রতাপ ছিল কাজপাগল ছেলে— দুশ্চরিত্র হবার মতো তার মানসিকতা বা সময়, কোনোটাই ছিল বলে আমার তখন মনে হয়নি, এখনও মনে হয় না।
প্রতাপ প্রায় সারাদিনই কারখানায় কাটাত, ডুবে থাকত কাজের মধ্যে। শনিবার নেই, রবিবার নেই, দিন নেই রাত নেই, প্রতাপ কারখানার কোনো-না-কোনো জায়গায় প্রবলেম সলভ করে বেড়াচ্ছে। এহেন ছেলেকে চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করা পাগলামি।
বুঝতেই তো পারেন, ঘরে শান্তি না থাকলে, বাইরেও শান্তি আসে না। প্রতাপও সম্প্রতি কাজকর্মে অমনোযোগী হতে আরম্ভ করেছিল। হঠাৎ হঠাৎ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ত, সিনেমা দেখত একটু একটু, ড্রিঙ্কও ধরেছিল নাকি।
আমি অবশ্য ক্রমাগতই দীপুকে বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলুম, কিন্তু ব্যাপারটা যে এমন ভয়ংকর হয়ে পড়বে, আমি যদি বুঝতে পারতুম, তাহলে হয়তো ওদের আলাদাই করে দিতুম। আমি বরং ভেবেছিলুম, একসঙ্গে থাকলে মিটমাট হয়ে যাবে।
এ ঘটনাটা যেদিন ঘটে, অর্থাৎ গত মাসের তিন তারিখে, আমি দীপুর কাছে গিয়েছিলুম দুপুর বেলা, কতগুলো ক্যাশ-সার্টিফিকেট সই করাতে। ওদের বাড়িটা আমার ফ্যাক্টরির গায়েই। আমি ফ্যাক্টরিতে আর যায়নি। ভেবেছিলুম, দুপুর বেলা প্রতাপ যখন আসবে, তখন একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে দু-জনে মিলেই কারখানায় যাব। কাজেই সইসাবুদ করিয়ে বসার ঘরে বসে আমি আর দীপু গল্প করছিলুম।
গল্প করতে করতে হঠাৎ দীপু উঠে ওপরে চলে গেল। ওপরে ওদের শোবার ঘর। আমি সে-ব্যাপারে কিছু না ভেবে বসে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়তে লাগলুম। এমন সময় টের পেলুম প্রতাপ এল। তার জানা ছিল না যে আমি এসেছি। সে সদর দিয়ে ঢুকে সোজা ওপরে চলে গেল। তার একটু বাদেই দড়াম দড়াম করে দুটো শব্দ হল। আমি শব্দ শুনে প্রথমটা কিন্তু কিছুই ভাবিনি। এমনিতেই ম্যাগাজিন পড়ছিলুম, কাজেই একটু অন্যমনস্ক ছিলুম। তার ওপর পাশেই কারখানা, অমন আওয়াজ তো হতেই পারে।
এর একটু বাদেই দীপু ওপর থেকে নীচে নেমে এল। দেখি, মেয়ের হাতে একটা রিভলভার। সেটা ঠকাস করে আমার সামনে টেবিলের ওপর রেখে বলল, বাবা, আমি প্রতাপকে মেরে ফেলেছি।
শুনে তো আমি থ। বলে কী? আমি বললুম, মেরে ফেলেছিস মানে? ব্যাপারটা কী?
মেয়ে বলল, ওই রিভলভার দিয়ে ওকে কুকুরের মতো মেরে ফেলেছি। আমাকে ও খুন করতে আসছিল, তোমাকেও মারত। শয়তানটা যেই পকেটে হাত দিয়েছে, অমনি গুলি চালিয়েছি। ও বোধ হয় ভেবেছিল, আমাকে মারা অতই সহজ।
আমি চেঁচিয়ে বললুম, পকেটে হাত দিল, আর অমনি গুলি করলি?
মেয়ে বলল, হ্যাঁ। ওর পকেটে অস্ত্র ছিল। এখনও আছে। তুমি দেখো গিয়ে।
শুনে আমি পড়ি-কি-মরি দৌড়ে ওপরে চলে গেলুম। গিয়ে দেখি বীভৎস দৃশ্য। দীপুর ঘরের ভেতর দরজাটার মুখে প্রতাপ চিত হয়ে পড়ে আছে, চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে।’
এইখানে দময়ন্তী বাধা দিল। জিজ্ঞেস করল, ‘দীপুর ঘর মানে? আপনার মেয়ে জামাই কি আলাদা ঘরে শুতেন?’
সংকুচিতভাবে সুশীলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। গত দু-বছর ওরা আলাদাই থাকছিল। সত্যি বলতে কী, প্রতাপ ও বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতেই চেয়েছিল। আমিই দিইনি। ওর প্রতি এমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। আমি বলেছিলুম, এখনই হুট করে কিছু একটা করে বোসো না। দীপুর কী যেন হয়েছে, ও সময়ে ঠিক হয়ে যাবেই। তখন যদি জানতুম যে তার এমন পরিণতি হবে!’ বলে ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন।
দময়ন্তী নীচু গলায় প্রশ্ন করল, ‘তারপর কী হল? আপনি প্রতাপবাবুর পকেট সার্চ করলেন?’
প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সুশীলবাবু বললেন, ‘না, না, তা কখনো পারি? এর কিছুদিন আগেই আমার কারখানার ভেতরে একটা খুন হয়েছিল— স্ট্যাবিং কেস। আমাদের এক সুপারভাইজার ডেডবডিতে হাত দিয়েছিল বলে পুলিশ একেবারে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিল। ওসব এখন আমার জানা হয়ে গেছে। এমন কাজ কখনো করতে নেই।
‘আমার শুধু মনে হল, দীপু আমার মেয়ে, খুন করেছে, তার ফাঁসি হবে, তাকে আমাকে বাঁচাতে হবে। এই মনে হতেই আমি আবার দৌড়ে নীচে চলে এলুম, দীপুকে বলে কেসটা কীভাবে ঘোরানো যায় তার একটা ব্যবস্থা করতে। কিন্তু নীচে এসে দেখি, দীপু সমস্ত ভণ্ডুল করে বসে আছে। প্রতাপের ড্রাইভার অহীন্দ্র আর মালি শিশিরকে ডেকে চিৎকার করছে, শিগগির পুলিশ ডেকে আনো তোমরা, তোমাদের বাবু, দ্যাট স্কাউন্ড্রেল প্রতাপ চৌধুরী, আমাকে খুন করতে যাচ্ছিল, উলটে আমিই তাকে মেরেছি।’
সমরেশ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’
‘তারপর পুলিশ এল। তাদের সামনেও দীপু সমানে বলে গেল যে আত্মরক্ষার্থেই এই হত্যাকাণ্ড।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশ কি প্রতাপবাবুর পকেটে কোনো অস্ত্র পেয়েছিল?’
‘না।’
‘কিছু কি পেয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। একটা কালো ভেলভেটের বাক্সে একটা হিরের আংটি। অ্যাপারেন্টলি, প্রতাপ ওই আংটিটা দেবার জন্যেই দীপুর ঘরে গিয়েছিল। সম্ভবত মিটমাট করার উদ্দেশ্যে একটা উপহার নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, কিন্তু উপহারটা আর পকেট থেকে বের করবার সুযোগ পেল না!’
‘উপহার বুঝলেন কী করে?’
‘কারণ, দীপুর ওরকম কোনো আংটি ছিল না।’
দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘হুঁ! ভারি আশ্চর্য ব্যাপার!’
‘কেন, আশ্চর্য কেন?’
‘কারণ, কোনো পুরুষমানুষ, সে যতই না কেন আপনভোলা বা কাজপাগল হোক, ভরদুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার আগে তার অভিমানী স্ত্রীর মান ভাঙাতে উপহার দিতে যাবে— এটা যেন আমার কাছে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে। মানে, স্থান কাল পাত্র কোনোটই ঠিক খাপ খাচ্ছে না আর কি।’
এতক্ষণে শিবেন কথা বলল, ‘আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। প্রতাপ চৌধুরীর পকেটে যে আংটিটা ছিল, তার হিরেটা জাল। একটা সুন্দর করে পল-কাটা কাচের টুকরো। যেকোনো কসটিউম জুয়েলারির দোকানে ওটার দাম দু-টাকা আড়াই টাকার বেশি হবে না।’
শুনে দময়ন্তী বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে রইল। তারপর যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘সুশীলবাবু, আপনার মেয়ে এ খবর পেয়ে কী বলল?’
সুশীলবাবু বললেন, ‘প্রথমে তো খেপে লাল হয়ে গেল। তারপর বলল, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা, সাজানো ব্যাপার, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবং তার সমস্ত রাগটা এসে পড়ল আমার ওপর। তার ধারণা হল, আমিই প্রতাপের পকেট থেকে অস্ত্রটা সরিয়ে ওই আংটিটা রেখে দিয়েছি যাতে তার শাস্তি হয়, কারণ তার বিশ্বাস আমি নাকি তার চেয়ে প্রতাপকেই বেশি ভালোবাসতুম।’
দময়ন্তী শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তার সন্দেহটা কি নিতান্তই অমূলক?’
‘নিতান্তই। জামাই আমার যতই প্রিয় হোক না কেন, তার জন্যে মেয়ের ফাঁসি হোক, এটা আমি কখনোই চাইতে পারি না। আর তা ছাড়া, সেদিন তো আমি হঠাৎই গিয়ে পড়েছিলুম। আমার তো আর জানা ছিল না যে সেদিনই এই ঘটনাটা ঘটবে যে পকেটে করে একটা ঝুটো আংটি নিয়ে যাব। আর ঝুটো আংটিই-বা কেন? আমি তো একটা আসল হিরের আংটিই নিয়ে যেতে পারতুম।’
‘তা ঠিক। আপনি এসব কথা আপনার মেয়েকে বলেছেন?’
‘বলেছি। কিন্তু সে কোনো কথাই শুনছে না। এখন তো সে কারোর সঙ্গেই দেখা করছে না, কথাও বলছে না। যতবার হাজতে দেখা করতে গেছি, বলে পাঠিয়েছে, তুমি যা চাও তাই হবে, দেখা করার কোনো দরকার নেই।’ বলতে বলতে সুশীল মৈত্রর গলা ধরে এল। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বিশ্বাস করুন মিসেস দত্তগুপ্ত, দীপুর এ ধারণা একেবারে মিথ্যে। আমার ওই দুই মেয়ে ছাড়া আমার জীবনে আর কিচ্ছু নেই। ওদের জন্যে আমি পারি না এমন কোনো কাজ নেই। ওদের মা যখন মারা যায়, দীপুর তখন চার বছর বয়েস। সেই তখন থেকে নিজের হাতে আমি ওদের বড়ো করেছি, ওদের অযত্ন হতে পারে, এই ভয়ে দ্বিতীয় কোনো স্ত্রীলোককে এ বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। আর সেই আমি কিনা…’ সুশীল মৈত্র আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তাঁর দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
.
দময়ন্তী আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কী করতে বলেন, সুশীলবাবু?’
সুশীলবাবু ততক্ষণে খানিকটা সামলেছেন। বললেন, ‘আমার জন্যে আমি ভাবি না মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনি দীপুকে বাঁচান। সে ন্যালাখ্যাপা নয়, নির্বোধ নয়, সোজা সরল বুদ্ধিমতী মেয়ে, লেখাপড়ায় ভালো। সে একটা কথা বলছে, সেটা বাহ্যত যতই অসম্ভব বলে মনে হোক না কেন, নিশ্চয়ই তার মধ্যে একটা সত্য আছে। সে প্রতাপকে খুন করতে চাইলে নানারকম অন্যরাস্তায় করতে পারত। প্রকাশ্য দিবালোকে লোকজন ডেকে একটা অবাস্তব যুক্তি খাড়া করে এমন কাজ করবার মতো জড়বুদ্ধি তো সে নয়। কোথাও একটা মস্ত বড়ো রহস্য আছে এর মধ্যে মিসেস দত্তগুপ্ত। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, দীপু যা বলছে তার আসল কথাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না বা হয়তো দেখতে চাইছিও না। আমার অনুরোধ, আপনি সেই আসল কথাটা বের করুন, দেখবেন হয়তো সত্যিই দীপু অপরাধী নয়। যে সত্যিকারের অপরাধী, সে-ই শাস্তি পাক। সে যদি আমিও হই, তাতেও কোনো ক্ষোভের কারণ থাকবে না।’
দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘হয়তো আপনার কথাই ঠিক। এই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে যে একটা রহস্য আছে, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু…’
সুশীলবাবু হাতজোড় করে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু নয় মিসেস দত্তগুপ্ত। আপনাকে আমার মেয়েকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতেই হবে। আমি কোনো কথাই শুনব না। এর জন্যে যত টাকা লাগে আমি দেব।’
দময়ন্তী ফিকে হাসল। বলল, ‘দেখুন, প্রফেশনাল প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলতে যা বোঝায়, আমি তা নই। টাকা নিয়ে আমি কাজ করি না। আর কাউকে বাঁচানোর কোনো দায়িত্বও আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। কোথাও কোনো রহস্য থাকলে, আমি সেটার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি মাত্র।’
সুশীলবাবু পূর্ববৎ করজোড়েই বললেন, ‘আমি অত্যন্ত লজ্জিত মিসেস দত্তগুপ্ত যে, টাকাপয়সার কথাটা তুলে ফেললুম। শিবেনবাবু আমাকে সব কথাই বলেছেন, তা সত্ত্বেও কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। কী করব বলুন? আমি যে ব্যাবসাদার লোক, আমি তো আবার এসব ছাড়া কোনো কাজের কথা চিন্তাই করতে পারি না। আমারই দোষ। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘না, না, ওসব কিছু নয়। আমি যেটা বলতে চাইছিলুম তা হচ্ছে, আমি যখন কোনো কেস হাতে নিই, তখন তাতে কোনো শর্ত থাকলে চলবে না।’
সুশীলবাবু প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, কোনো শর্ত আরোপ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না মিসেস দত্তগুপ্ত। অমি শুধু সত্য কথাটা বের করুন। আমার মেয়ে দীপু তার স্বামীকে হত্যা করেছে— এটা তো মিথ্যে হতে পারে না। কিন্তু কেন করল? সে যে আত্মরক্ষার কথা বলছে, কেন বলছে? প্রতাপের পকেটে একটা ঝুটো হিরের আংটি কোত্থেকে এল? প্রতাপ আর দীপুর মধ্যে ঝগড়া হল কেন? প্রতাপ কেন দীপুর সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করল না? এসব প্রশ্নের উত্তর পেলে হয়তো দেখবেন, দীপু নির্দোষ। তবে সে-উত্তর বের করার ক্ষমতা বা বুদ্ধি, কোনোটাই আমার নেই। সেইজন্যেই আপনার কাছে আমার অনুরোধ…’
দময়ন্তী বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে সুশীলবাবু, আমি আপনার মেয়ের ব্যাপারটা দেখব। তবে তার আগে আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’
.
‘আপনি বললেন যে আপনার স্ত্রী যখন মারা যান, তখন আপনার ছোটোমেয়ের বয়েস চার বছর। সেটা কত বছর আগেকার ঘটনা?’
দময়ন্তীর প্রশ্ন শুনে সুশীলবাবু একটু যেন ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘তা প্রায় বিশ বছর হবে।’
‘উনি কীভাবে মারা যান?’
সুশীলবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কি?’
‘সেটা আমি বুঝব, মিস্টার মৈত্র। তবে আপনি যদি উত্তর দিতে না চান, দেবেন না।’
সুশীলবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘না দিয়েই-বা যাব কোথায়? ওঁরা ঠিকই খুঁজে বের করবেন।’ বলে শিবেনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
‘তবে বলুন।’
‘আমার স্ত্রী ট্রেন থেকে পড়ে মারা যান!’
‘আপনি সেই ট্রেনে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, তবে অন্য কামরায়। আমার স্ত্রী আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করেই সেই ট্রেনে উঠি। কোনো একটি স্টেশনে আমার স্ত্রী আমাকে প্ল্যাটফর্মে দেখতে পান এবং তারপর বিবেকদংশন সহ্য করতে না পেরে বা ভয়ে ব্যাকুল হয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েন। অথবা তাঁকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়।’
‘পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস করেছিল?’
‘হ্যাঁ, করেছিল। কারণ সাক্ষীসাবুদের তো কোনো অভাব ছিল না।’
‘আপনার সেই বন্ধুটি এখন কোথায় আছেন?’
‘জানি না।’
শিবেন গম্ভীর মুখে বলল, ‘আপনি এসব কথা আমাদের বলেননি কেন?’
‘আপনারা তো জিজ্ঞেস করেননি। তা ছাড়া সেই বিশ বছর আগেকার ঘটনার সঙ্গে দীপুর ব্যাপারটার যে কী যোগাযোগ থাকতে পারে, সেটা তো আমি এখনও বুঝতে পারছি না।’
দময়ন্তী বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে মিস্টার মৈত্র। এরপর আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। প্রতাপবাবুর আত্মীয়স্বজন কে কে আছেন? কী করেন তাঁরা?’
‘প্রতাপের বাপ-মা তার ছেলেবেলাতেই মারা যান। তারপর তার এক বিধবা মাসি তাকে মানুষ করেন। ওর একটি ছোটো বোন আছে। তার বিয়ে হয়েছে এক ডাক্তারের সঙ্গে। তারা এখন আমেরিকায় থাকে। তবে তাদের সঙ্গে প্রতাপের বা তার মাসির এখন কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতাপের মৃত্যুর খবরও বোধ হয় সে পায়নি।’
‘কোনো সম্পর্ক নেই কেন?’
‘আমি সঠিক জানি না। তবে প্রতাপের ভগ্নীপতি শুনেছি খুব রগচটা ঝগড়াটে লোক। কারোর সঙ্গেই তার বনে না।’
‘প্রতাপবাবুর পরিবারের টাকাপয়সা কীরকম আছে?’
‘বিশেষ কিছু নেই। ব্যাঙ্কে জমানো কয়েক হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই।’
‘আপনি যখন আপনার মেয়ের সঙ্গে প্রতাপবাবুর বিয়ের ব্যবস্থা করেন, তখন কোনো তরফে কোনো আপত্তি উঠেছিল কি?’
‘না, তেমন কিছু নয়। তবে…’
‘তবে কী?’
‘কিছু উড়ো চিঠি এসেছিল আমি যাতে এ বিয়ে না দিই, সেই অনুরোধ নিয়ে। পরে আমাকে ভয় দেখিয়েও কয়েকটা চিঠি আসে।’
‘সেসব চিঠি আপনার কাছে আছে এখনও?’
‘নাঃ। সেসব তক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলে দিই। পাড়ার কোনো ফচকে ছোঁড়ার কাণ্ড বলেই আমার মনে হয়েছিল। বিশেষ পাত্তা দিইনি।’
‘দীপান্বিতা তো আপনার ছোটোমেয়ে। আপনার বড়োমেয়ে কোথায় থাকে?’
‘আমার বড়োমেয়ে থাকে বরাকরে। তার শ্বশুরবাড়ি সেখানে। তার জীবনটাও বড়ো দুঃখের।’
‘কেন?’
‘আমার বড়োমেয়ে শুচিস্মিতা দীপুর চেয়ে দু-বছরের বড়ো। তার বিয়ে দিয়েছিলুম বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার রামানুজ লাহিড়ীর সঙ্গে। হিরের টুকরো ছেলে। যেমন সুদর্শন, তেমনি তার পাণ্ডিত্য। বার্নপুরের ইস্পাত কারখানায় কাজ করত। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় তার দুটো পা-ই কাটা যায়। তারপর থেকে সে যেন কেমন একরকম হয়ে গেছে। ঠিক পাগল নয়, কিন্তু ঠিক স্বাভাবিকও নয়। সবসময় গম্ভীর আর অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। আর্টিফিশিয়াল লিম্ব থাকলেও কোথাও যায় না, বেরোয়ই না বাড়ি থেকে। সারাদিন বসে বসে নানা রকমের বই পড়ে। আমি ওকে দিয়ে কিছু কনসালটেন্সির কাজ করাতে চেয়েছিলুম। দেখলুম পারল না, কনসেনট্রেটই করতে পারে না।’
‘কতদিন আগে এ ঘটনা ঘটে?’
‘আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে। ওদের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই।’
‘সংসার চলে কী করে?’
‘রামানুজের বাবা বেশ পয়সাওলা লোক ছিলেন, যদিও অবস্থা এখন পড়তির দিকে। তা ছাড়া শুচি চাকরি করে। কাজেই সংসার চলে যায় আর কি।’
‘আপনার ছোটোমেয়ের এই ব্যাপারে আপনার বড়োমেয়ের এবং জামাইয়ের রিঅ্যাকশন কী?’
‘কী আর? শুচি খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিল। কান্নাকাটি করল। এই পর্যন্ত।’
‘জামাই আসেননি নিশ্চয়ই?’
‘না। সে তো একে বাড়ি থেকেই বেরোয় না, তার ওপর ট্রেনে-বাসে কলকাতা আসা তার পক্ষে একরকম অসম্ভবই বলতে পারেন।’
‘কিন্তু আর্টিফিশিয়াল লিম্ব নিয়ে তো লোকে রীতিমতো ঘুরে বেড়ায়, চাকরি-বাকরি করে।’
‘তা হয়তো করে, কিন্তু রামানুজ করে না। আসলে সে যখন সুস্থ ছিল, তখন সে বেশ দাম্ভিক এবং আত্মম্ভরী ছিল। ফলে এই দুর্ঘটনাটা তাকে এতই আঘাত দেয় যে সে প্রায় মানসিকভাবে বিকল হয়ে পড়ে। এই কারণেই সে কারোর সঙ্গে মেশে না, কথা কয় না। তার শারীরিক অক্ষমতাটাকে সে নিজের অপমান বলে মনে করে।’
‘আপনার বড়োমেয়ের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কেমন?’
‘অত্যন্ত ভালো। একমাত্র শুচিকেই সে ভালোবাসে এবং তাকেই একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করে।’
‘তাঁর শালি আর ভায়রার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?’
‘খুবই ভালো ছিল। দীপুর কাছে তো সে একজন হিরো। জামাইবাবু বলতে সে অজ্ঞান। ছোটোখাটো সব ব্যাপারেই তার জামাইবাবুর সঙ্গে কথা না বললে হয় না। আর তার পাণ্ডিত্য আর বুদ্ধি দেখে প্রতাপও তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত, তার কাছে নানারকম পরামর্শ নিত ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য প্রবলেমে। তবে আপাতদৃষ্টিতে সে বেশ রূঢ়। যাকে সে পছন্দ করে না, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে তার একটুও বাধে না।’
‘আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন না তো?’
‘না। তবে একটু এড়িয়ে চলে।’
‘বেশ। এবার আপনার কথা কিছু বলুন। কী করেন, কোথায় থাকেন। অতীতের কথাও কিছু বলতে পারেন।’
সুশীলবাবু ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘দেখুন, আমি একজন নিতান্ত নগণ্য লোক। আমাদের আদিবাড়ি কৃষ্ণনগরে, কিন্তু আমার বাবা কর্মসূত্রে কলকাতাতেই থেকেছেন। আমারও জন্ম এখানে, লেখাপড়াও এখানে। আমার ছেলেবেলা কেটেছে শোভাবাজারে। পরে বাবা নারকেলডাঙায় বাড়ি করেন। সেখানেই থাকি এখন। আমরা তিন ভাই। আমি সকলের ছোটো। আমার বড়দা আমেদাবাদে কাপড়ের কলে চাকরি করতেন। রিটায়ার করে এখন ওখানেই থাকেন। তাঁর দুই ছেলে। দু-জনেই বম্বেতে চাকরি করে। আমার ছোড়দা খুব পণ্ডিত লোক। গৌরমোহন কলেজের নামজাদা প্রফেসার। অর্থনীতির ওপর তাঁর কয়েকটি বেশ বিখ্যাত বই আছে। তাঁর নাম শুনেছেন বোধ হয়— ডক্টর সুবল মৈত্র।’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। শুনেছি। তিনিও কি আপনার সঙ্গেই থাকেন?’
‘না। ছোড়দা থাকেন টালিগঞ্জে, মুর অ্যাভিনিউতে। গৌরমোহন কলেজ ওখান থেকে কাছে হয়। ওঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে বড়ো। তার বিয়ে গেছে। ছেলে ছোটো, সে বিলেতে আছে পড়াশুনো করতে।
‘আর আমার কথা কী-ই বা বলব। আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে এমএসসি পাশ করে কিছুদিন একটা ওষুধের কারখানায় এবং কিছুদিন একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে, হঠাৎ একদিন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ব্যাবসায় নেমে পড়ি। ভাগ্যলক্ষ্মী আমার ওপর প্রসন্ন হয়েছিলেন, ফলে আজ আমার কিছু সচ্ছলতা এসেছে। আমার এখন দুটো কারখানা। একটা বেলেঘাটায়— তারক কেমিক্যাল ওয়ার্কস, অন্যটা সোনারপুরে— বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস। একটা আমার বাবার নামে, অন্যটা মা-র নামে। প্রথমটা আমি দেখি, দ্বিতীয়টা দেখত প্রতাপ।’
‘এখন কে দেখছেন? আপনি?’
‘না, এখন দেখছে আমার এক ভাগনে— সাত্যকি। প্রতাপ আসার আগেও ও-ই দেখত।’
‘আপনার ভাগনে? আপনার তো নিজের বোন নেই, তাই না?’
‘না, মানে সাত্যকির মা আমার আপন বোন নয়। দূরসম্পর্কের বলতে পারেন।’
‘কত দূর সম্পর্ক?’
‘সম্পর্কটা আসলে ঠিক আমরাও জানি না। সাত্যকির দাদু আর দিদিমাকে আমরা ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে দেখে আসছি। সাত্যকির দাদুকে আমরা কাশীনাথ কাকা বলে ডাকতুম। তবে তিনি যে বাবার ভাই ছিলেন না, সেটাও জানতুম। শাস্ত্রমতে ওঁকে হয়তো আমাদের আশ্রিতই বলা উচিত, কিন্তু আসলে উনি ছিলেন আমাদের পরিবারেরই একজন। ওঁকে কাকা ছাড়া অন্য কিছুই আমরা ভাবিনি কোনোদিন। এমনকী বাবার মৃত্যুর পরও তিনি আমাদের বাড়িতেই থেকেছেন, কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি এবং সেখানেই দেহরক্ষা করেছেন। ওঁর একটিই মেয়ে— পুষ্পলতা। সাত্যকি তার ছেলে।’
‘পুষ্পলতা বেঁচে আছেন এখনও?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তার তো বয়েস বেশি নয়। আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোটো। তার স্বামী টিটাগড়ে চাকরি করে। ওরা সেখানেই থাকে।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। গত মাসের তিন তারিখে আপনি যখন সোনারপুরে যান, তখন কি আপনার মেয়ের ব্যবহারে কোনো অস্বাভাবিক ভাব লক্ষ করেছিলেন?’
‘না, মানে হ্যাঁ। মানে, তার কিছুদিন আগে থেকেই দীপুর মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ করছিলুম যে, কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। সেদিনও কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই বাইরে তাকাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে ওপরে চলে গেল।’
‘আর কিছু?’
‘না। তেমন আর কিছু নয়।’
.
২
দময়ন্তী সমরেশকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী মনে হয় তোমার? আমাদের ব্যাপারটা আরও তলিয়ে দেখা দরকার, না, দরকার নয়?’
সমরেশ আঙুল নেড়ে বলল, ‘আলবত দরকার। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছে— চাট্টিখানি কথা? পত্রপাঠ এর রহস্য উন্মোচন করা দরকার, নইলে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা যদি এভাবে মরতে থাকে তাহলে জগতে আর থাকবে কে?’
শিবেন ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘ভদ্রলোকেরা থাকবে। আর, সবকটা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মরার দরকার নেই, কেবল তুই মরলেই যথেষ্ট। সরি বউদি!’
দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন বলুন তো, এই যে গল্পটা আমরা শুনলুম, তাতে কি এটা স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ঈর্ষাসঞ্জাত নরহত্যা বলে মনে হচ্ছে, না এর মধ্যে অনেক জায়গায় খটকা লাগার মতো বস্তু আছে?’
শিবেন বলল, ‘খটকা তো অনেক জায়গাতেই লাগছে।’
‘যেমন?’
‘প্রথমে তো আপনি যেরকম বললেন— টাইমিংয়ের ব্যাপারটা। দ্বিতীয়ত, দীপান্বিতার কথা যদি সত্যি বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে প্রশ্ন ওঠে, প্রতাপবাবুর রিভলভার তো তাঁর হাতেই ছিল, তাহলে যেই প্রতাপবাবু পকেটে হাত দিলেন, অমনি উনি তাঁকে গুলি করলেন কেন? তার মানে উনি নিশ্চয়ই জানতেন বা সন্দেহ করেছিলেন যে প্রতাপবাবুর পকেটে কোনো অস্ত্র আছে। বেশ, তাই যদি হয়, তাহলে কী ধরনের অস্ত্র উনি আশা বা আশঙ্কা করেছিলেন? প্রতাপবাবুর রিভলভার ছিল, সুশীলবাবুরও আছে। কাজেই একটা রিভলভার যে প্যান্টের সামনের পকেটে নিয়ে ঘোরা অসুবিধেজনক, সেটা উনি জানতেন বলে ধরে নেওয়া যায়। অতএব উনি নিশ্চয়ই একটা নতুন ধরনের অস্ত্র আশঙ্কা করছিলেন। কী সেই অস্ত্র?
‘এরপর ধরুন, দীপান্বিতার কথা যদি পুনরায় সত্যি বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে প্রশ্ন ওঠে, যে অস্ত্রের কথা উনি বলছেন, সেটা গেল কোথায়? এখানে লক্ষ করতে হবে যে উনি কিন্তু কোথাও কী অস্ত্র প্রতাপবাবুর পকেটে ছিল তার নামোল্লেখ করেননি। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে, এটা একটা কোনো নতুন ধরনের জিনিস। তাহলে যে সেটা সরাল, তার উদ্দেশ্য কি ছিল দীপান্বিতাকে ফাঁসানো, না অস্ত্রটা গোপন করা?
‘এরপর আংটি। আংটি কেন? আর ঝুটো হিরেই-বা কেন? ভরদুপুরবেলা গিন্নির মানভঞ্জন করতে যাওয়া অস্বাভাবিক হয়তো, কিন্তু তাই বলে ঝুটো হিরের আংটি নিয়ে?’
সমরেশ বলল, ‘এর মধ্যে আমি তো অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। নিজের বিয়ে করা বউয়ের মানভঞ্জন কি পাঁজি দেখে, তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে করতে হবে নাকি? যখন মুড আসবে, তখনই করতে হবে। আর ঝুটো গয়না? দ্যাখ শিবেন, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা তো আর তোর মতো পুলিশ নয় যে দুনিয়ার চোরাই হিরে-মণি-মুক্তো দেখে কোনটা আসল, কোনটা নকল বুঝতে শিখবে। যেটা দেখতে ভালো লেগেছে, সেটাই ভদ্রলোক কিনে নিয়েছিলেন হয়তো। অতটা ভেবে দেখেননি। তা ছাড়া ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের পকেট তো হরবখত গড়ের মাঠ। আসল হিরে কিনবে তার কাঁচা পয়সা কোথায় বাওয়া?’
শিবেন বলল, ‘আবার তুই বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করছিস? তোকে না বারণ করেছিলুম?’
দময়ন্তী বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনার প্রথম প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর আমি দিচ্ছি। ধরুন, দীপান্বিতার কোনো বাল্যবন্ধু, যে তাকে খুব ভালোবাসে বা স্নেহ করে, প্রতাপবাবুর কারখানাতেই কাজ করে। প্রতাপবাবু একজন ইঞ্জিনিয়ার, তিনিও তাই। এদিকে প্রতাপবাবু তাঁর স্ত্রীকে মারবার জন্যে অনেক মাথা খাটিয়ে এমন একটা যন্ত্র বানিয়েছেন, যেটা খুব ছোটো, সহজে বহনযোগ্য অথচ মারাত্মক। সেটা প্রতাপবাবু তাঁর কারখানাতেই তৈরি করিয়েছেন, কিন্তু সেটা যে একটা মারণাস্ত্র, সেটা কেউ বুঝতেই পারেনি। একমাত্র দীপান্বিতার বাল্যবন্ধুটি ছাড়া। সে, যখন যন্ত্রটি তৈরি হচ্ছিল, তখনই দীপান্বিতাকে জানিয়ে দিয়েছে, তাকে সাবধান করে দিয়েছে। যেদিন যন্ত্রটা তৈরি শেষ হয়েছে এবং প্রতাপবাবু সেটা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছেন, অমনি সে দৌড়ে দীপান্বিতার কাছে চলে গেছে এবং তার ঘরে লুকিয়ে থেকেছে। প্রতাপবাবু ঢুকতেই দীপান্বিতা তাঁকে গুলি করেছে, আর সেই ছেলেটি প্রতাপবাবুর পকেট থেকে অস্ত্রটা বের করে সেখানে একটা আংটি ভরে রেখে গোলমালের মধ্যে কেটে পড়েছে।’
শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘বাঃ, চমৎকার উত্তর হয়েছে। কিন্তু এর থেকে আবার দুটো প্রশ্ন ওঠে যে। একটা হল, ছেলেটি দীপান্বিতাকে খবরটা দিয়ে ঘরে লুকিয়ে রইল কেন? তার চেঁচামেচি করে লোক জোগাড় করা উচিত ছিল, তাই না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, সে যন্ত্রটা সরাতে গেল কেন?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, ছেলেটি হয়তো চাইছিল যে দীপান্বিতা প্রতাপকে খুন করুক। তাতে হয়তো আখেরে তার কোনো লাভ ছিল। কারণ একটা কথা তো ঠিক, প্রতাপবাবুর স্ত্রী ওই কারখানার আট আনার মালিক। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল যে, ওই যন্ত্রটা তৈরি করাতে হয়তো তারও কিছু অবদান ছিল। হয়তো প্রতাপবাবু তাকে দিয়েই যন্ত্রটা বানিয়েছিলেন। সে গোড়ায় বুঝতে পারেনি, একদম শেষের দিকে পেরেছিল। এখন যন্ত্রটা নিয়ে তদন্ত হলে তারও জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। সেইজন্যেই যন্ত্রটা তাকে সরাতে হয়েছিল। তাতে যে দীপান্বিতা বেশি করে ফেঁসে যাবে, সেটা সে বুঝতে পারেনি।’
শিবেন কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আপনার কি ধারণা যে এটাই আসল ব্যাপার?’
‘মোটেই না। অজস্র সম্ভাবনার মধ্যে এটা একটা, এটুকু বলা যেতে পারে।’
‘হুম। কিন্তু সম্ভাবনাটা কতটা প্রবল?’
‘সেটা এখুনি বলা অসম্ভব, শিবেনবাবু। তবে সমরেশের কথাটা এখানে মনে রাখতে হবে, একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে আসল হিরে আর সুন্দর করে কাটা একটা কাচের টুকরোর তফাত বোঝা সত্যিই বোধ হয় কঠিন।’
শিবেন বলল, ‘যাঃ, সব গুলিয়ে গেল। কী যে বললেন, কিছুই বুঝতে পারলুম না।’
‘আমিই কি ছাই সব ভালো বুঝেছি। ষড়যন্ত্রই যদি হবে, তবে দীপান্বিতা গুলি করতে গেল কেন? আর যদি ষড়যন্ত্রই না হয়, যদি আত্মরক্ষার জন্যেই গুলি চালাতে হয়ে থাকে, তবে প্রতাপের অস্ত্রটা গেল কোথায়? সুশীলবাবু সরাবেন কেন? তাঁর কী স্বার্থ? ওগো, বলো না কিছু?’
সমরেশ বলল, ‘ওই গাধাটা বলতে আর দিচ্ছে কই? শোনো, সমস্ত ব্যাপারটা জলের মতো সহজ। কর্তা-গিন্নির ঝগড়া চলছিল। কর্তা হয়তো কোনোদিন রাগের মাথায় বলেছিল, তোমায় খুন করে ফেলব। গিন্নি কর্তাকে সত্যবাদী বলেই জানতেন, কাজেই প্রাণের ভয়ে তাঁর রিভলভারটি সরিয়ে ফেললেন। এদিকে ঘটনার দিন দুপুর বেলা বেচারি কর্তামশাই মানভঞ্জনের উদ্দেশ্যে গিন্নির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে যেই পকেটে হাত ঢুকিয়েছেন, অমনি আতঙ্কিতা নায়িকা কড়াক করে পিং করে দিয়েছেন আর চেঁচাতে চেঁচাতে নেমে এসেছেন।’
দময়ন্তী গম্ভীর মুখে সব শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কর্তা-গিন্নির ঝগড়া চলছিল ঠিক, কিন্তু সেদিন গিন্নি একতলায় তাঁর বাবার সঙ্গে বসে বসে গল্প করছিলেন। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে ওপরে চলে গেলেন। তার একটু পরেই কর্তা ঢুকলেন। ঢুকেই চলে গেলেন গিন্নির ঘরে। গিন্নি যেন এরকমই হবে সেটা আঁচ করেই রেখেছিলেন আর বন্দুক বাগিয়ে তৈরি হয়ে বসে ছিলেন। কর্তা-গিন্নির মুখ দেখাদেখি নেই, অথচ সেদিনই কর্তা গেলেন গিন্নির ঘরে আর দরজার চৌকাঠে পা দিতেই— কী যেন বললে তুমি?’
‘কড়াক পিং।’
‘হ্যাঁ, তাই। এটা কি নিতান্তই কতকগুলি কাকতালীয় ঘটনার সমাহার, না অন্য কোনো ইঙ্গিত আছে?’
সমরেশ বা শিবেন, কেউই এ প্রশ্নের জবাব দিল না। দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বগতোক্তি করল, ‘প্রথম প্রশ্ন, প্রতাপ চৌধুরী কি রোজ একই সময়ে অফিস থেকে ফিরতেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, সুশীলবাবু কতটা সততার সঙ্গে ব্যাবসা করেন? তৃতীয় প্রশ্ন, প্রতাপ চৌধুরী মারা গেলে দীপান্বিতার কি কোনো সুবিধে হয়? চতুর্থ প্রশ্ন, এটা যে আত্মরক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড, সেটা কি আদালতে প্রমাণ করা যাবে? দীপান্বিতা এমন মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না যে তার কারণ কি যাতে বেফাঁস কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে যায় যেটা তার স্বার্থের পরিপন্থী?’ বলে শূন্য দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল।
বেশ কিছু সময় বাদে শিবেন জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কী করতে চান?’
‘একবার সোনারপুরের কারখানাটা দেখতে চাই।’
‘গোপনে? মানে সারপ্রাইজ ভিজিট?’
‘না, না। গোপনীয়তার কোনোই দরকার নেই। আগামী সপ্তাহে একটা ছুটি আছে। সেদিন অফিস আর কলেজ বন্ধ থাকলেও ফ্যাক্টরি বোধ হয় বন্ধ থাকে না। সেদিন একটা ব্যবস্থা করুন না।’
‘বেশ, তাই করা যাবে।’
.
৩
বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস একটা মাঝারি আকারের কারখানা। আট ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা পঞ্চাশ হাজার স্কোয়ার ফুট মতো জায়গা। বাসরাস্তার সঙ্গে লাগোয়া প্রায় তিন-শো ফুট লম্বা পাঁচিলের মাঝখানে বড়ো লোহার গেট। তার মাথায় লোহার পাত বেঁকিয়ে কারখানার নাম লেখা। গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ-দিকে মালপত্র রাখার জায়গা, সামনে ফাউন্ড্রি শপ আর ফ্যাব্রিকেশন শপ আর ডান দিকে অফিস। অফিসের সামনে গোটাকয়েক গাড়ি রাখার জায়গা আর একটা ছোটো বাগান।
সকাল বেলা এগারোটা নাগাদ শিবেনের জিপ সমরেশ আর দময়ন্তীকে নিয়ে কারখানায় ঢুকল। অফিস ঘরের সামনে তখন চারজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ওদের সম্বর্ধনা করা। চারজনের মধ্যে একজন সুশীলবাবু, বাকি তিনজন অপরিচিত।
শিবেন জিপ দাঁড় করাতে সুশীলবাবু এবং আর একজন ওদের কাছে এগিয়ে এলেন। সুশীলবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে নমস্কার করে বললেন, ‘আসুন শিবেনবাবু, আসুন মিসেস দত্তগুপ্ত, মিস্টার দত্তগুপ্ত।’
ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে প্রতিনমস্কার করল। সুশীলবাবু বললেন, ‘চলুন, ভেতরে গিয়ে বসা যাক প্রথমে। তারপরে না হয় আপনারা যা দেখবার, দেখবেন। সতু, তুই ওঁদের তোর ঘরে নিয়ে বসা। ভালো কথা, এ হচ্ছে সাত্যকি, সাত্যকি সান্যাল, আমার ভাগনে এবং এই কারখানার ম্যানেজার।’
ভাগনেটিকে দেখলে চিত্ত প্রফুল্ল হয় না। গাঢ় বাদামি রঙের সুট পরা ভদ্রলোকের বয়েস তেত্রিশ চৌত্রিশ হবে। প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। অসাধারণ স্বাস্থ্য, কিন্তু মুখটি যেন কেমন। কুৎসিত নয়, কিন্তু ভীতিপ্রদ। কোঁকড়ানো চুলের নীচে ঢালু কপাল, ঘন রোমাবৃত শুঁয়োপোকার মতো দুটো ভুরু আর তাদের তলায় প্রায় অদৃশ্য দুটি ছোটো ছোটো চোখ, অনুচ্চ নাক আর অত্যন্ত সরু একজোড়া ঠোঁট সেই মুখে একটা কঠিন জান্তব নিষ্ঠুরতার ছাপ মেরে দিয়েছে। অথচ হাসিটি ভারি সুন্দর, একেবারে রমণীমনোমোহন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, মেয়েদের আকৃষ্ট করতে ভাগনে বাবাজীবন একেবারে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু পুরুষদের বিশেষত প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষদের কাছে তিনি মোটেই আনন্দজনক নন।
ম্যানেজারের ঘরটি বেশ বড়ো। একতলা লম্বা বাড়িটার এক প্রান্তে। তার একদিকে দরজা, অন্য দু-দিকে বড়ো বড়ো কাচের জানলা আর একদিকে নিশ্ছিদ্র দেওয়াল। এই দেওয়ালের দিকে পেছন করে একটা মাঝারি সাইজের টেবিলের সামনে বসেন ম্যানেজার। তাঁর বাঁ-দিকে দরজা, সামনে আর ডান দিকে জানলা। সামনের জানলা দিয়ে চোখে পড়ে ফ্যাব্রিকেশন শপ আর ডান দিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় বাউন্ডারি ওয়াল আর তার ওপাশে বোগেনভিলিয়ায় ঢাকা একটা সাদা বাড়ি দোতলার কিছু অংশ আর একটা ব্যালকনি।
সাত্যকি সান্যাল ম্যানেজারের মোটা গদি মোড়া চেয়ারটিতে বসলেন, সুশীলবাবু এবং বাকি তিনজন তাঁর উলটোদিকে চারটে চেয়ার দখল করে বসল। সাত্যকি তাঁর শুঁয়োপোকা দুটি নাচিয়ে সেক্সি হাসিটি হেসে দময়ন্তীকে বললেন, ‘প্রতাপের মৃত্যুরহস্যের কিছু সূত্র খুঁজতে নাকি আপনি এই কারখানা দেখতে এসেছেন। এ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কোথায় সেটা অবশ্য আমার বোঝা সম্ভব নয়, তবে যেহেতু আমি এই কারখানায় অনেক দিন আছি, অতএব কী ধরনের সূত্র আপনি খুঁজছেন, সেটা জানতে পারলে হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারতুম।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘সেরকম কোনো সাহায্যের দরকার হবে কি না জানি না, তবে আপাতত আমার কয়েকটা প্রশ্নের যদি উত্তর দিতেন তো খুব উপকার হত।’
‘বিলক্ষণ! বলুন না, আপনার কী প্রশ্ন আছে? আমার সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই উত্তর দেব।’ বলে সাত্যকি হাসতে লাগলেন।
‘প্রতাপবাবু কোন ঘরে বসতেন?’
সাত্যকি হঠাৎ ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেলেন এই প্রশ্ন শুনে। বললেন, ‘এই ঘরে।’
‘উনি আসার আগে এই ঘরে কে বসতেন?’
‘আমি।’
‘ও। আচ্ছা সুশীলবাবু, আপনি এবার একটু বাইরে যান। আমি ওঁকে একা কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
সুশীলবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আমি যাচ্ছি, একটু চায়ের ব্যবস্থা করি গিয়ে।’
সুশীলবাবু বেরিয়ে গেলে দময়ন্তী আবার শুরু করল, ‘প্রতাপবাবুকে হত্যা করার কারণ হিসেবে দীপান্বিতা যা বলেছে, আপনি তা বিশ্বাস করেন?’
‘করি। প্রতাপ সুবিধের লোক ছিল না। ছোটোমামা তার মধ্যে কী দেখেছিলেন, ভগবান জানেন। তার মতো একটা লোকের হাতে দীপুর মতো একটি মেয়েকে তুলে দেওয়া তাঁর অন্যায় হয়েছিল। সেই অন্যায়ের ফল ভুগছেন এখন।’
‘প্রতাপবাবুর চরিত্র ভালো ছিল না?’
‘ভালো ছিল না বললে কম বলা হয়। অত্যন্ত খারাপ পারভার্টেড ছেলে ছিল প্রতাপ।’
‘কী করেছিলেন উনি?’
‘সে অত্যন্ত নোংরা ব্যাপার। আর এ প্রশ্নের জবাবই-বা আমাকে দিতে হবে কেন? পুলিশ কি এতদিনেও সেটা বের করতে পারেনি?’
শিবেন মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। আমরা কেবল শুনেছি যে মিস্টার চৌধুরীর চরিত্র ভালো ছিল না, কিন্তু তার কোনো বিশদ বিবরণ পাইনি। সুশীলবাবুও কিছু বলছেন না, তাঁর মেয়ে তো কিছু বলছেই না। আপনি জানেন যদি তো বলুন না।’
‘জানি, কিন্তু তা বলা যায় না। আপনাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।’
‘বেশ, তা না হয় আমরা বের করে নেব। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? সুশীলবাবু বলেছেন?’
‘ছোটোমামা? তাঁর তো ধারণা, প্রতাপ একেবারে গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসী পাতা। না, তিনি বলেননি।’
‘তবে কি দীপান্বিতা বলেছিলেন আপনাকে?’ প্রশ্নটা করল দময়ন্তী।
কথার পিঠে জবাব দিতে গিয়েও আটকে গেলেন সাত্যকি। আমতা আমতা করে বললেন, ‘না, দীপু বলেনি। কে বলেছে মনে পড়ছে না।’
‘নিশ্চয়ই আপনার বিশ্বাসভাজন কেউ। তা নাহলে আপনার একজন সহকর্মী এবং আত্মীয় সম্পর্কে এহেন কথা আপনি নিশ্চয়ই চটপট বিশ্বাস করে নিতেন না। কে হতে পারেন তিনি? একটু মনে করার চেষ্টা করে দেখুন না।’
‘না, মনে পড়ছে না।’ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন সাত্যকি। ‘তবে একেবারে এমনি এমনি বিশ্বাস করে নিয়েছি, তাও ঠিক নয়। দীপুকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলুম, সে কথাটা অস্বীকার করেনি।’
‘আপনি কোথায় থাকেন? সোনারপুরেই?’
প্রশ্নটার আকস্মিকতায় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন সাত্যকি। বললেন, ‘আমার বাড়ি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। গাড়িতে যেতে মিনিট দশেক লাগে।’
‘কে কে আছেন আপনার বাড়িতে?’
‘এখানে আমি একাই থাকি। ছোটো ফ্ল্যাট, গেস্ট থাকার অসুবিধে আছে।’ বলতে বলতে সাত্যকির কপালের নীচে শুঁয়োপাকা দুটো মুখে মুখে জুড়ে গেল, তাদের ভেতর ছোটো ছোটো চোখ দুটো কুঁচকে আরও ছোটো হয়ে গেল। অকম্পিত গলায় বললেন, ‘কিন্তু আমাকে এ প্রশ্ন করার অর্থ? আপনাদের কি ধারণা, প্রতাপের মৃত্যুর পেছনে আমার হাত আছে?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘থাকতেই পারে। একটা কথা তো ঠিক যে প্রতাপবাবুর মৃত্যুতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন আপনি। সেক্ষেত্রে আপনাকে এহেন সন্দেহ করা কি অন্যায়?’
দময়ন্তীর কথা শুনে সাত্যকি চেয়ারের ওপর খাড়া হয়ে বসলেন। তাঁর সমস্ত শরীরটা ফুলে উঠল, মুখের হাসির মুখোশটা খসে গিয়ে সেখানে একটা কুৎসিত নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠল। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটল না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সাত্যকি বললেন, ‘প্রতাপের মৃত্যুতে আমি লাভবান হইনি, হয়েছেন ছোটোমামা। তাঁর এই প্রতিষ্ঠানটা বেঁচে গেছে। গোড়া থেকে আমরা এর সঙ্গে জড়িত আছি, তিল তিল করে বড়ো করে তুলেছি। সেই কারখানাটা ছোটোমামা প্রতাপের হাতে ছেড়ে দিয়ে পথে বসতে যাচ্ছিলেন। কী অবস্থা হয়েছিল! কোনো ডিসিপ্লিন নেই, কাজকর্মের কোনো মাথামুন্ডু নেই, ওয়ার্কাররা সব মাথায় চড়ে বসেছে— এই করে কোনো ব্যাবসা চলে? আমার আর কী লাভ হয়েছে? পরিশ্রম ডবল হয়েছে, এই পর্যন্ত। প্রতাপ যা নষ্ট করে গিয়েছিল, সেটাকে আবার তৈরি করা— সহজ ব্যাপার তো নয়। লাভ যা হবার সেটা ছোটোমামারই হবে, আমাদের কিছু নয়।
‘আর এই ঘরে বসা? ভাবছেন, এখানে বসে আমার অ্যাম্বিশন ফুলফিল্ড হয়েছে? একেবারে ভুল ধারণা। সাত্যকি সান্যাল চাকরির তোয়াক্কা করে না, একথা মনে রাখবেন। কলকাতার অনেক বড়ো বড়ো অর্গানাইজেশন তাকে পেলে বর্তে যাবে। এখানে পড়ে আছি ছোটোমামার জন্যে। তাঁর প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের কৃতজ্ঞ থাকার কারণ আছে।’ একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে সাত্যকি হাঁপাতে লাগলেন।
দময়ন্তী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে এতক্ষণ সাত্যকির দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন প্রশ্ন করল, ‘আপনার কোয়ালিফিকেশন কী?’
গলার মধ্যে শব্দ করে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসলেন সাত্যকি। বললেন, ‘কোয়ালিফিকেশন? আমি গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বিলেত থেকে ফিরেছিলুম আট বছর আগে র্যালফ স্ট্যানহোপে চাকরি নিয়ে। কিন্তু ছোটোমামা রিকোয়েস্ট করলেন, ঠেলতে পারলুম না। এই বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে এসে ভিড়ে গেলুম। তখন থেকে এখানেই আছি। এই আমার কোয়ালিফেকেশন।’
সাত্যকির কথা শেষ হতে-না-হতেই ঘরে ঢুকলেন সুশীলবাবু। বললেন, ‘চা রেডি। দিতে বলি?’
.
চা-পর্ব শেষ হওয়ার পর সুশীলবাবু দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার তাহলে কারখানাটা ঘুরে দেখবেন চলুন। সাত্যকি! তুমি এঁদের নিয়ে যাও সঙ্গে করে।’
দময়ন্তী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না, সুশীলবাবু। আমরা নিজেরাই ঘুরে দেখব, কারোর সঙ্গে আসার কোনোই দরকার নেই।’
সুশীলবাবু বোধ হয় একটু অবাক হলেন, কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না। বললেন, ‘বেশ তো। নিজেরা ঘুরে দেখতে চান দেখুন। আমি আর সাত্যকি এখানেই অপেক্ষা করছি, দেখা হয়ে গেলে একসঙ্গে দীপুর বাড়িটা দেখতে যাব।’
দময়ন্তী ঘাড় নাড়ল। তারপর ডান দিকের জানলা দিয়ে পাঁচিলের ওপাশের বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই বাড়িটা?’
সুশীলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। ওটাই।’
‘এই জানলাটায় পর্দা লাগানোর কোনো ব্যবস্থা নেই দেখছি। পর্দা কি কোনোদিন লাগানো হত?’
‘পর্দা? ফ্যাক্টরির জানলায় আবার পর্দা কী?’
দময়ন্তী কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, তাও তো বটে।’ কিন্তু ওর চোখ দুটো চিন্তিত আর অন্যমনস্ক হয়ে রইল।
শিবেন আর সমরেশ ওই দৃষ্টি চেনে। দু-জনে কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। বারান্দাটা বেশ চওড়া, অফিসবাড়িটার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত টানা। দময়ন্তী কিছুক্ষণ বাদে ঘর থেকে বেরিয়ে চিন্তিত আর অন্যমনস্কভাবেই কারখানার দিকে না গিয়ে উলটোদিকে মেন গেটের দিকে হাঁটতে লাগল। শিবেন এরকমই আশা করছিল বলে মনে হল। সে-ও কোনোরকম বাধা না দিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে দময়ন্তীর পেছনে হাঁটা শুরু করল।
গেটের সামনে পার্ক করা গাড়িগুলোর সামনে এসে থামল দময়ন্তী। তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। শিবেনকে বলল, ‘দেখেছেন শিবেনবাবু, এখান থেকেও দীপান্বিতার বাড়ির বারান্দাটা দেখা যায়?’
শিবেন পেছন ফিরে দেখল। বলল, ‘হ্যাঁ, তা যায় বটে। তাতে কী?’
দময়ন্তী একটা গাড়ির গায়ে ঠেসান দিয়ে চিন্তিত দৃষ্টিতে সামনের একটা ফুলগাছ পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, ‘নাঃ, তা আর কী?’ বলে চুপ করে গেল।
একজন খাকি ইউনিফর্ম পরা মাঝারি গড়নের মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি এতক্ষণ অবাক হয়ে সমস্ত দৃশ্যটা দেখছিলেন। তিনজনকেই চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ উদবিগ্ন মুখে এগিয়ে এসে শিবেনকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি এখানকার সিকিউরিটি অফিসার। আমি কি আপনাদের কোনোরকম সাহায্য করতে পারি, স্যার?’
শিবেন হাত নেড়ে না বলতে যাচ্ছিল, দময়ন্তী বাধা দিল। বলল, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কী নাম আপনার? কতদিন কাজ করছেন এখানে?’
ভদ্রলোক অত্যন্ত খুশি হয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীনাথ ভট্টাচার্য। এখানে আছি, তা বছর আষ্টেক হল। তার আগে আর্মিতে ছিলুম। রিটায়ার করে…’
‘আমরা এখানে কেন এসেছি, আপনি তা জানেন?’
‘নিশ্চয়ই জানি। আমি সিকিউরিটি অফিসার, জানব না? আমার অজান্তে কি…’
‘আচ্ছা, তাহলে প্রতাপবাবুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা তদন্ত করতে এসেছি, তা আপনি জানেন। যেদিন এ ঘটনা ঘটে, সেদিন কি আপনি এখানে ছিলেন?’
‘নিশ্চয়ই ছিলুম। জানেন, আমার এখানে আট বছরে মোটে দু-দিন লিভ নেওয়া আছে। তাও সিক লিভ। একবার ভীষণ আমাশা…’
‘আচ্ছা, সেদিন কী কী ঘটেছিল, আপনার মনে পড়ে? মানে প্রতাপবাবু কী কী করেছিলেন, তাঁর হাবভাব কেমন ছিল, ইত্যাদি।’
দময়ন্তীর প্রশ্ন শুনে শ্রীনাথের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা গভীর, গম্ভীর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বলছি।’ তারপর হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রেখে একটু নীচু গলায় শুরু করলেন, ‘সেদিন ছিল তেসরা এপ্রিল। আমি অফিসে এসে পৌঁছোই যখন, তখন ঠিক সাড়ে সাতটা।’
সমরেশ দুম করে প্রশ্ন করে বসল, ‘আপনি কি সেদিন কুমড়োর ছক্কা দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন? পাঁজিতে কুষ্মাণ্ডভক্ষণ নিষেধ সত্ত্বেও?’
সমরেশের প্রশ্ন শুনে শ্রীনাথ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কুমড়ো? না, মানে ঠিক মনে পড়ছে না তো। তবে হ্যাঁ, কুমড়ো অবশ্য আমার ভীষণ ফেভারিট তরকারি। হয়তো সেদিন কুমড়ো খেয়েও আসতে পারি। মানে…’
দময়ন্তী বলল, ‘কুমড়োটা এখন বাদ দিন। ওটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। এখন বলুন, সেদিন প্রতাপবাবু কী কী করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ, আমি এলুম সাড়ে সাতটায়, প্রতাপবাবু এলেন পৌঁনে আটটা নাগাদ। উনি সবসময়েই ফ্যাক্টরি খোলার মিনিট পনেরো আগে আসতেন। উনি যখন ঢুকলেন, আমি তখন ওঁকে স্যালুট করলুম। মনে আছে, উনি কোনো প্রত্যভিবাদন করেননি। তবে সম্প্রতি এরকম মাঝে মাঝে হচ্ছিল। ওঁকে খুব চিন্তিত আর বিমর্ষ লাগত। যা হোক, ফ্যাক্টরিতে ঢুকেই উনি ওঁর ঘরে চলে গেলেন।’
দময়ন্তী বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘উনি কি হেঁটে আসতেন না গাড়িতে?’
‘উনি হেঁটেই আসতেন। ওই তো ওঁর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের পথও তো নয়। ওঁর গাড়িটা আগে বাড়ির গ্যারেজে থাকত, ইদানীং কিন্তু ফ্যাক্টরিতেই থাকছিল। তা সেদিনও উনি হেঁটেই এসেছিলেন। তারপর, তেমন আর বিশেষ কিছু ঘটেনি। আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম, উনি কী করছিলেন তা আর তেমন লক্ষ করে দেখিনি। বেলা এগারোটা নাগাদ উনি আমাকে ফোন করলেন। বললেন, আমি এখন একটু বেরোচ্ছি, অহীন্দ্রকে বলে দেবেন, যেন একটু বাদে আমার বাড়িতে গাড়ি লাগিয়ে দেয়। তার একটু বাদেই উনি আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন; উনি বেরিয়ে যাবার প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বাদে অহীন্দ্র গাড়ি নিয়ে ফিরে এল। দেখি, অহীন্দ্রর পাগলের মতো চেহারা। বললে, ভট্টাচার্যিবাবু শিগগির চলুন, বড়োবাবু ডাকছেন। আমি বললুম, কেন রে, কী হয়েছে? সে বললে, চৌধুরী সাহেবকে ছোড়দিমণি খুন করে ফেলেছে। শুনেই আমি সেই গাড়িতেই উঠে পড়লুম।’
দময়ন্তী আবার বাধা দিল। বলল, ‘একটা প্রশ্ন। আপনাদের ফ্যাক্টরি দুপুরে ক-টায় ছুটি হয়?’
‘বেলা একটায়। এক ঘণ্টা লাঞ্চ। তারপর দুটো থেকে সাড়ে চারটে। এটা জেনারেল শিফট। অন্য শিফটের কাজের সময় আবার আলাদা।’
‘প্রতাপবাবু এগারোটার সময় বেরোচ্ছিলেন কি লাঞ্চে?’
‘না। উনি রোজ একটা দশে লাঞ্চে বেরোতেন। ওঁর সময়জ্ঞান ছিল অসাধারণ। ওঁকে দেখে ঘড়ি মেলানো যেত।’
‘কখনো শরীর খারাপ হলে বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত কাজে কি কখনো তাড়াতাড়ি বাড়ি যাননি?’
‘গেছেন নিশ্চয়ই। তবে সেরকম ঘটনা আমার মনে পড়ে না।’
‘আপনাদের বড়োবাবুর মুখে শুনেছি, উনি নাকি হঠাৎ কারখানা থেকে বেরিয়ে যেতেন, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতেন?’
‘কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ওয়ার্কিং আওয়ার্সে ওঁকে আমি কখনো কারখানা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখিনি। তবে আগে যেখানে উনি কখনোই রাত ন-টা দশটার আগে কারখানা থেকে বেরোতেন না, সম্প্রতি মাঝে মাঝে সাড়ে চারটের ছুটির পর বেরিয়ে পড়তেন।’
‘কোথায় যেতেন?’
‘তা আমার ঠিক জানা নেই। তবে শুনেছি, মাঝে মাঝে ওঁকে নাকি এখানে ময়ূরপঙ্খি বলে একটা সিনেমায় ঢুকতে দেখা যেত। বোধ হয়, ওঁর সিনেমা দেখার নেশা ধরছিল।’
‘ময়ূরপঙ্খিতে কি উনি একাই যেতেন, না সঙ্গে কেউ যেত?’
‘সঙ্গে কেউ যেত বলে শুনিনি কখনো। তবে আপনি কী বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি। ওঁর কোনোরকম দোষ ছিল না।’
‘মদ খেতেন না?’
‘খেতেন হয়তো। কিন্তু আমি কখনো ওঁকে বেচাল দেখিনি।’
‘আমরা কিন্তু শুনেছি, কাগজেও পড়েছি যে ওঁর চরিত্র ভালো ছিল না। অথচ আপনি বলছেন…’
এইবার বাধা দিলেন শ্রীনাথ। রাগত কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওসব আমিও পড়েছি। একেবারে নির্ভেজাল মিথ্যে কথা সব। আচ্ছা, আপনিই বলুন, কাজ করে যে লোকটা কূল পেত না, এসব করার সময় কোথায় পাবে সে? দুশ্চরিত্র লোক কি আর দেখিনি? তারা সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। আর চৌধুরী সাহেব? দেবতুল্য মানুষ ছিলেন।’
‘তবে এসব কথা রটে কেন? যা রটে তার কিছুটা তো বটে?’
‘কক্ষনো নয়। এসব কথা রটে, যাদের স্বার্থ আছে তারা রটায় বলে। এতদিন যারা হাতে মাথা কাটছিল, প্রতাপ চৌধুরী আসায় তাদের খুব অসুবিধে হচ্ছিল কিনা। চৌধুরী সাহেব যে প্রমাণ করে দিচ্ছিলেন যে মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেও প্রোডাকশন ডবল করা যায়।’
‘আচ্ছা, সান্যাল সাহেব কি সেদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। চৌধুরী সাহেবের বেরোনোর আধঘণ্টাটাক আগে উনি বেরিয়ে যান। কানাঘুসোয় শুনেছি, সেদিন সকালে দু-জনে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। তারপরেই সান্যাল সাহেব কারখানা থেকে বেরিয়ে চলে যান।’
‘এরকম ঝগড়া কি আগেও হত?’
‘আমার ঠিক জানা নেই। তবে চৌধুরী সাহেব খুব শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। প্রায় কখনোই কারোর সঙ্গে জোরে কথা বলতেন না।’
সমরেশ বলল, ‘হুঁ! শান্ত লোক খেপে গেলে যে কী মূর্তি ধরে, তা তো আর জানেন না!’
.
সুশীলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখলেন আমাদের ফ্যাক্টরি?’
দময়ন্তী বলল, ‘ভারি সুন্দর। এমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন!’
‘এবার তাহলে কী করবেন?’
‘আপনার মেয়ের বাড়িটা একবার দেখতে যাব।’
‘বেশ তো, চলুন। অহীন্দ্রকে গাড়িটা আনতে বলি?’
‘না, না। তার কোনো দরকার নেই। আমরা হেঁটেই যাব।’
‘সে কী কথা? এই মে মাসের রোদ্দুরে, এমন গরমে হেঁটে যাবেন?’
‘হ্যাঁ সুশীলবাবু, হেঁটেই যাব। আর হেঁটে যেতে যেতে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি বরং অহীন্দ্রকে বলুন, সে যেন গিয়ে বাড়িটা খুলে রাখে।’
সুশীলবাবু বিমর্ষমুখে বললেন, ‘বেশ, তাই হবে।’ বলে শ্রীনাথকে কিছু পরামর্শ দিয়ে হাঁকডাক করে গোটা তিনেক ছাতা জোগাড় করে ফেললেন। তারপর জোর করে অতিথিদের হাতে ছাতাগুলো ধরিয়ে দিয়ে চারজনে মিলে ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকে মোড় নিলেন সকলে। বাসরাস্তা আর পাঁচিলের মধ্যে যে ফুট চারেক চওড়া ঘাসের জমি, তার মধ্যে একটা সরু পায়ে-চলা পথ দিয়ে হাঁটা শুরু হল।
হাঁটতে হাঁটতে দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা সুশীলবাবু, আপনার ভাগনে মিস্টার সান্যাল তো হাইলি কোয়ালিফায়েড, বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, তাই না? তা ছাড়া তিনি বোধ হয় আপনার জামাইয়ের চেয়ে বয়েসেও বড়ো। তা তাঁকে কারখানার সর্বময় কর্তৃত্ব না দিয়ে, আপনি জামাইকে দিলেন কেন? স্রেফ জামাই বলে?’
সুশীলবাবু বললেন, ‘দেখুন, সর্বময় কর্তৃত্ব আমি প্রতাপকে ঠিক দিইনি। তবে দেবার ইচ্ছে ছিল ঠিকই। সাত্যকি অত্যন্ত কোয়ালিফায়েড ছেলে, কাজেকর্মেও ভালো, সবই ঠিক। কিন্তু কী জানেন, ও বড়ো কঠিন হৃদয় লোক। যাকে বলে, স্ট্রিকট ডিসিপ্লিনেরিয়্যান। কোনো কর্মচারী যদি ভুল করল তো ওর কাছে তার কোনো ক্ষমা নেই। এখন, আজকালকার দিনে এমনভাবে তো কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যায় না। নমনীয় না হলে, কঠিনে কোমলে না হলে, আজকাল লোক চালানো বড়ো মুশকিল। কিন্তু সাত্যকি তা বিশ্বাস করে না। ফলে, ওর হাতে যতদিন সমস্ত ক্ষমতা ছিল, ততদিন প্রায়ই গণ্ডগোল লেগে থাকত। স্ট্রাইক আর অ্যাজিটেশনের ঠেলায় প্রোডাকশন লাটে উঠেছিল। কিন্তু প্রতাপ এসে সমস্ত কারখানার আবহাওয়াটাই পালটে দিয়েছিল।’
‘তাই যদি হয়, তাহলে ক্ষমতা প্রতাপবাবুকে দিলেন না কেন?’
‘তার দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণ, চক্ষুলজ্জা। দ্বিতীয় কারণ, এই কারখানাটা গড়ে তোলার পেছনে সাত্যকির যে অবদান আছে, তাতে তাকে চট করে সরানো অন্যায় হত বলে আমার বিশ্বাস।’
‘আপনার ছোটোমেয়ের সঙ্গে সাত্যকির সম্পর্ক কীরকম?’
‘ভালোই। সাত্যকি দীপুকে খুবই স্নেহ করে থাকে বলে আমার ধারণা।’
‘উনি কি বিবাহিত?’
‘হ্যাঁ, মানে না। সাত্যকি বিয়ে করেছিল, কিন্তু এখন ডিভোর্সড।’
‘ডিভোর্স হয়েছিল কেন, আপনার জানা আছে?’
‘না। তবে শুনেছি, খুব ঝগড়াঝাঁটি হত।’
‘আচ্ছা, ঘটনার দিন সাত্যকিবাবু কারখানা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বলে শুনলুম। কেন বলতে পারেন?’
‘কই, আমি তো তা জানি না। তবে মাঝে মাঝে ও তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায় বলে শুনেছি। উদ্দেশ্য লাঞ্চের সময় কারখানায় এসে চেক করা যে কেউ মালপত্র সরাচ্ছে কি না, যন্ত্রপাতি নষ্ট করছে কি না ইত্যাদি।’
‘অদ্ভুত তো। ভদ্রলোকের মাথায় কি ছিট আছে নাকি?’
‘না, ছিট নয়, তবে ওইরকমই। ভয়ানক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। কাউকে বিশ্বাস করে না। আর মনে করে যে একেই বলে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এই নিয়ে প্রতাপের সঙ্গে ওর মনোমালিন্য হত।’
‘প্রতাপবাবু তো খুব শান্ত লোক ছিলেন, তাহলে তিনি রিভলভার রাখতেন কেন?’
‘সেটা আমিই জোর করে ওকে দিয়েছিলুম। কেউ যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে ওঠে, তখন তার শত্রুর সংখ্যা বেড়ে যায়ই। তার ওপর এ অঞ্চলটাও তো তেমন ভালো নয়। খুনখারাপি হতে কতক্ষণ! বন্দুক পিস্তল বাড়িতে আছে জানলে চট করে বাজে লোক কাছে ঘেঁষে না।’
‘আপনাদের বাড়িতে বন্দুক-পিস্তলের চল আছে?’
‘আছে। আমার দুই দাদাই খুব ভালো শিকারি, আমিও অল্পস্বল্প করে থাকি। শুচি আর দীপু দু-জনেই ভালো বন্দুক চালাতে পারে।’
‘হুঁ। আচ্ছা, আপনার ভাগনে তো আপনাদের সত্যিকারের ভাগনে নয়। তার ওপর অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। তার সঙ্গে আপনাদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো?’
‘না।’
‘কেন, বংশমর্যাদায় বেধেছিল?’
সুশীলবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা একটা কারণ বটে। তা ছাড়া, ওর বাবা শিবরতনকে আমি পছন্দ করি না। সে সৎ লোক নয়। তাকে আমার বেয়াই হিসেবে আমি চিন্তা করতে পারি না। পুষ্পলতা প্রস্তাবটা ঠারেঠোরে আমার কাছে তোলবার চেষ্টা করেছিল ঠিকই, সাহস করে শেষ পর্যন্ত তুলে উঠতে পারেনি।’
‘আপনার মেয়েরা তো ওঁকে চেনে ছোটোবেলা থেকেই। তাদের কারোর ইচ্ছে ছিল না?’
সুশীলবাবুর মুখ ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ‘আমার জানা নেই মিসেস দত্তগুপ্ত। এই হচ্ছে দীপুর বাড়ি।’ বলে সামনে হাত বাড়িয়ে যে বাড়িটা দেখালেন, তারই অংশবিশেষ বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভেতর থেকে দেখা গিয়েছিল।
বাড়িটা দোতলা, সাদা সিমেন্ট পেন্ট করা, উঠেছে একেবারে রাস্তার ধার থেকেই। সাদামাটা বাড়ি, মাঝখানে সদর দরজা, দু-পাশে দুটো দুটো করে চারটে জানলা। দোতলাতেও তাই কেবল দরজার জায়গায় লম্বা লম্বা ঘষা কাচ বসানো সিঁড়ির জানলা। বাড়িটার সামনে দাঁড়ালে বাঁ-দিকে ফ্যাক্টরি, ডান দিকে একটা বেশ বড়ো ফুটবল খেলার মাঠ, আর পেছনে খানিকটা জমি, তার কিছুটায় ফুলের গাছ আর তরিতরকারির খেত আর এককোণে একটা টিনের শেড। ডান দিকে আর পেছনে পাঁচিলটা প্রায় দশ ফুট উঁচু, বোধ হয় ফুটবলের হাত থেকে একতলার জানলার কাচগুলো বাঁচানোর জন্যে। আপাতত অবশ্য সব দরজা-জানালাই আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ।
সুশীলবাবু চাবি দিয়ে নাইটল্যাচ খুলে অতিথিদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকেই সামনে সিঁড়ি, বাঁ-দিকে রান্নাঘর আর বোধ হয় চাকরদের থাকার ঘর আর ডান দিকে বসবার ঘর। সুশীলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রথমে কোত্থেকে শুরু করব আমরা?’
দময়ন্তী বলল, ‘দোতলা থেকেই শুরু করা যাক।’
দোতলার প্ল্যানটা একতলা থেকে সামান্য অন্যরকম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনে একটা টানা চওড়া বারান্দা। বারান্দার একদিকে সিঁড়ির দু-পাশে দুটো ঘর আর বাথরুম এবং অন্যদিকে ব্যালকনি। এই ব্যালকনিটাই ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে দেখা যায়।
সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সুশীলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ডান দিকে প্রতাপের ঘর আর বাঁ-দিকে দীপুর ঘর। কোনটা আগে দেখবেন?’
দময়ন্তী বলল, ‘চলুন, আগে প্রতাপবাবুর ঘরটা দেখা যাক।’
সুশীলবাবু চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘যান, আপনারা দেখে আসুন। আমি আর ঢুকব না।’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘ঠিক আছে সুশীলবাবু। আমরা দেখে নিচ্ছি।’
ঘরটা প্রকাণ্ড। তার রাস্তার দিকে দুটো জানলা আর খেলার মাঠের দিকে দুটো। মাঠের দিকের জানলার নীচে একটা সিঙ্গল খাট পাতা। খুবই সাধারণ খাট, তোশক বালিশ চাদর প্রভৃতি কোনোটাই বিলাসিতার সাক্ষ্য দেয় না। খাটের পাশে টুলের ওপর কতকগুলি বই, জলের গেলাস আর টেলিফোন। রাস্তার দিকে জানলার নীচে একটা বড়ো টেবিল আর একটা সাধারণ চেয়ার। টেবিলের ওপর কয়েকটা ফাইল আর কিছু বই। টেবিলের পাশে একটা বইয়ের আলমারি। তার মধ্যে নানারকম বই। আলমারির মাথায় একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিয়ো। সিঁড়ির দিকের দেওয়ালের সামনে একটা বড়ো আর দুটো ছোটো সোফা। তবে আসবাবপত্র সাধারণ হলেও ঘরটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে— তা হল পারিপাট্য।
দময়ন্তী চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা শিবেনবাবু, ঘটনার দিন ঘরটা কি এমনিই ছিল, না নাড়াচাড়া করা হয়েছে?’
শিবেন বলল, ‘না, এমনিই ছিল। অসম্ভব গুছোনো স্বভাবের লোক ছিলেন প্রতাপ চৌধুরী। আমাদের সার্চ করতে কোনো অসুবিধে হয়নি।’
‘ওঁর জামাকাপড় কোথায় থাকত? তার কোনো আলমারি দেখছি না তো?’
‘ওঁর জামাকাপড় কিছু আছে বাথরুমে আলনায়, কিছু একটা স্টিলের ট্রাঙ্কে ওই বিছানার নীচে।’
‘সার্চ করে কী পেয়েছিলেন?’
‘তেমন কিছুই না।’
‘কোনো চিঠিপত্র, ছবি বা ওই ধরনের কিছু?’
‘কিচ্ছু না।’
‘ভারি আশ্চর্য। ওঁকে কেউ চিঠি লিখত না? দুশ্চরিত্র লোক!’
‘লিখত না হয়তো। বা, পড়েই ছিঁড়ে ফেলতেন। প্রেমপত্র হলে কি আর কেউ যত্ন করে তুলে রাখে?’
‘বইগুলো ঝেড়েঝুড়ে দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ। কিচ্ছু নেই।’
‘আচ্ছা, ঘটনার পরে এবং পুলিশ আসার আগে কিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এরকম কোনো লক্ষণ দেখতে পেয়েছেন?’
‘না। তবে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বটে। কিন্তু সরাবে কে বা কেন? সেরকম কাগজপত্র থাকলে তো প্রতাপ চৌধুরী পাজি লোক সেটা প্রমাণ করাটা সহজ হয়, তাই না? তাহলে দীপান্বিতাকে বাঁচানো যায়।’
‘ঠিক তাই। সেখানে তো খটকা লাগছে।’ বলে দময়ন্তী পেছন ফিরল। বলল, ‘চলুন, দেখা হয়েছে। এবার দীপান্বিতার ঘর।’
দীপান্বিতার ঘরটি প্রতাপের ঘরেরই সমান, কিন্তু তার আসবাবপত্র সমস্তই অন্যরকম। অন্য ঘরটির সংযম বা পারিপাট্য এ ঘরে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মেঝের কার্পেট থেকে শুরু করে খাট, আলনা, স্টিলের আলমারি, কাঠের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সোফাসেট, মোড়া, রকিং চেয়ার, কী নেই? সমরেশ ঢুকেই বলল, ‘এঃ, ও ঘরটার পর এটাকে যে একেবারে গোডাউন বলে মনে হচ্ছে!’
শিবেন সহাস্যে বলল, ‘যা বলেছিস। গোডাউনই বটে। এ ঘর সার্চ করতে আমাদের দেদার সময় লেগেছে। যাই হোক। বউদি, এই দরজার মুখেই প্রতাপ চৌধুরীর মৃতদেহ পড়ে ছিল। চিত হয়ে পড়ে ছিল, একটা হাত পকেটে, পা দুটো ঘরের ভেতরে, ঘাড় আর মাথা বাইরে। দীপান্বিতা গুলি করেছে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। এর থেকে দুটো সম্ভাবনার কথা মনে আসে। এক, প্রতাপ চৌধুরী কথা বলতে বলতে কিছুটা ঘরের ভেতরে ঢুকে এসে পকেটে হাত ঢোকান। দীপান্বিতা সঙ্গেসঙ্গে গুলি করে। অথবা উনি ঝড়ের বেগে বা পকেটে হাত দিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন, দীপান্বিতার গুলি খেয়েও মোমেন্টামে একটু ভেতরে এসে তারপরে উলটে পড়ে যান।’
‘এ ব্যাপারে দীপান্বিতা কী বলে?’
‘অসংলগ্ন কথা। আসলে ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল যে সঠিক বিবরণ পাওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়।’
‘তা ঠিক। দীপান্বিতা যে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তা কে বলল?’
‘সেটা দীপান্বিতাই জবানবন্দি দিয়েছে।’
‘ক-টা গুলি করেছিল?’
‘দুটো। একটা লাগে চোয়ালে, অন্যটা বুকে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।’
‘প্রতাপবাবুর প্যান্টের পকেটে ওই হিরের আংটিটা ছাড়া আর কী কী ছিল?’
‘রুমাল, চাবির রিং, মানিব্যাগ আর কলম।’
‘চাবির রিং! তার প্রত্যেকটা চাবির তালার সন্ধান পেয়েছেন?’
‘সেরকম সন্ধান তো করিনি।’
‘করেননি, না? তাহলে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের কাউকে একটু লাগিয়ে দেবেন? দুটো দিনের মধ্যে আমাকে জানালেই হবে যে সবকটা চাবির তালার সন্ধান পাওয়া গেল কি না।’
শিবেন দময়ন্তীর কথায় বোধ হয় একটু অবাক হল। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করল না। বলল, ‘বেশ, তাই হবে।’
‘এ ঘরে চিঠিপত্র কিছু পেয়েছেন?’
‘পেয়েছি। তবে তেমন কিছু নয়। সুশীলবাবুর লেখা কয়েকটা পোস্টকার্ড। তাদের সকলেরই বিষয়বস্তু, অমুক দিন অতটার সময় যাইতেছি, লাঞ্চ বা ডিনারের ব্যবস্থা রাখিয়ো। আর বরাকর থেকে লেখা ওঁর দিদির কয়েকটা চিঠি। তাদের আবার বিষয়বস্তু হচ্ছে, যে যাই বলুক না কেন, কারোর কথায় কান দেবে না, প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কাউকে সন্দেহ করবে না, এমন কিছু করবে না যাতে বাবা দুঃখ পায় ইত্যাদি। মানে, ভালো ভালো উপদেশ আর কি।’
‘হুঁ! এরকম ক-টা চিঠি পেয়েছেন?’
‘বেশি নয়। গোটা তিনেক।’
ইতিমধ্যে দময়ন্তী ঘরের ভেতরে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। প্রকাণ্ড জোড়া খাটের পাশে টেবিলের ওপরে রাখা লাল রঙের টেলিফোনের নীচে রাখা ডাইরেক্টরিটা বের করে কিছুক্ষণ তার পাতা ওলটাল। তারপর সোফা সেটের মাঝখানে নীচু টেবিলের তলার তাকে রাখা কয়েকটা ম্যাগাজিন টেনে বের করল। কিছুক্ষণ তাদের পাতা উলটিয়ে বলল, ‘দেখুন শিবেনবাবু, এই ম্যাগাজিনগুলোর ওপরে হাওড়া স্টেশনের বুক স্টলের ছাপ।’
শিবেন বলল, ‘হুঁ, দেখেছি। বোধ হয় বরাকর যাবার সময় কেনা।’
‘তাই হবে হয়তো। তবে ম্যাগাজিনগুলো কিন্তু এক সময়ের নয়।’
‘তা না হতেই পারে। বরাকরে মাঝে মাঝে যাওয়ায় তো কোনো বাধা নেই।’
‘না, তা অবশ্য নেই। আচ্ছা, এবার তাহলে চলুন, নীচে যাই। একতলাটা দেখা দরকার।’
.
একতলায় তিনটে ঘর। সিঁড়ির ডান দিকে বসবার ঘরটি তার ঠিক ওপরের ঘরটির মতোই বড়ো, দামি দামি আসবাবপত্রে সাজানো। সোফা সেট, বুক কেস, ডিভান, টিভি সেট, রেডিয়োগ্রাম প্রভৃতি সবই আছে।
দময়ন্তী ঘরে ঢুকেই সুশীলবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনার দিন আপনারা কে কোথায় বসে ছিলেন?’
সুশীলবাবু রাস্তার দিকে জানলার নীচে রাখা একটা বড়ো সোফা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি এইখানে বসে ছিলুম আর দীপু আমার উলটোদিকে ওই ছোটো সোফাটায় বসে ছিল।’
দময়ন্তী ছোটো সোফাটার ওপর গিয়ে বসল। বলল, ‘আপনি বসুন ওখানে। বেশ। আপনি কিছু কাগজপত্র সই করাচ্ছিলেন। কাগজপত্রগুলো কোথায় ছিল?’
সুশীলবাবু ঘরের একপাশে রাখা একটা সেন্টার টেবিল দেখিয়ে বললেন, ‘ওটার ওপর। দীপুর কথা শুনে যখন আমি দৌড়ে ওপরে যাই, তখন আমার ধাক্কা লেগে ওটা উলটে পড়ে যায়। কেউ বোধ হয় তারপরে পাশে সরিয়ে রেখেছে।’
দময়ন্তী এবার শিবেনকে বলল, ‘আমার সামনে ওই জানলাটা একটু খুলে দেবেন?’
‘নিশ্চয়ই।’ বলে শিবেন জানলাটা খুলে দিল। জানলার ওপাশে বাসরাস্তা, তার ওপাশে একটা দোতলা লম্বা বাড়ি। বাড়িটার দোতলায় ছোটো ছোটো ফ্ল্যাট আর নীচে মিষ্টির দোকান, একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, একটা পোস্টঅফিস, একটা সাইকেল সারানোর দোকান আর একটা সেলুন। অনেক লোক ঘোরাঘুরি করছে, তবে মিষ্টির দোকান আর সেলুনটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে মনে হল। বাড়িটার দু-পাশে দুটো বড়ো বড়ো ফ্যাক্টরি।
দময়ন্তী কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ সুশীলবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি বলেছিলেন না যে প্রতাপবাবু তাঁর এক বিধবা মাসির কাছে মানুষ হয়েছিলেন? তিনি কোথায় থাকেন?’
সুশীলবাবু বললেন, ‘উনি থাকেন কেশবচন্দ্র অ্যাভিনিউর চন্দ্রহাল অ্যাপার্টমেন্টে।’
‘আমি কি ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?’
‘পারেন নিশ্চয়। আমি ব্যবস্থা করে দেব।’
‘বেশ, আগামী শনিবার হলে ভালো হয়। আর একটা প্রশ্ন। প্রতাপবাবু কি ঘন ঘন চুল কাটতেন?’
‘তা তো আমার জানা নেই। তবে খুব ছোটো ছোটো করে চুল কাটত ঠিকই।’
‘আপনার ছোটোমেয়ের বন্ধুবান্ধব ছিল না?’
‘ছিল, তবে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল বলে জানি না। ওরা মেট্রোপলিন ক্লাবের মেম্বার ছিল। দীপু প্রায় রোজ সন্ধেবেলা সেখানে যেত তাস খেলতে। ওই ক্লাবেই ওর কিছু তাসুড়ে বন্ধু ছিল— সমবয়সি ছেলেমেয়ে সব।’
‘প্রতাপবাবু যেতেন না?’
‘না। তবে আমি যেতুম। আমিই ওদের ক্লাবের মেম্বার করে দিয়েছিলুম।’
‘আমার দেখা হয়ে গেছে শিবেনবাবু। চলুন, এবার যাওয়া যাক। ও হ্যাঁ, ভালো কথা। এ বাড়ির রান্নাবান্না করত কে?’
‘বৃন্দা বলে একটি মেয়ে, সে পুষ্পলতার শ্বশুরবাড়িতে কাজ করত। সেখান থেকে এসেছিল। এই ঘটনার পর আবার সেখানেই ফিরে গেছে।’
‘ও। তাকে একবার বলবেন তো, সে যেন রবিবার একবার আমার সঙ্গে দেখা করে।’
.
৪
সোনারপুর থেকে অর্কিড রোড পর্যন্ত একটাও কথা বলল না দময়ন্তী। সারারাস্তা একদৃষ্টে জিপের বনেটের ওপরে একটা কাঠের ব্লক পর্যবেক্ষণ করতে করতে এল। ফলে শিবেন আর সমরেশকেও নীরব থাকতে হল।
বাড়ি এসে বসার ঘরে ঢুকে একটা সোফার ওপর এলিয়ে পড়ে দময়ন্তী প্রথম কথা বলল, ‘একটাও চিঠি নেই কেন?’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দ্বিতীয় কথা বলল, ‘কুড়ি মিনিট, তাই না?’
সমরেশ আর শিবেন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, কিন্তু প্রশ্ন দুটোর জবাব দেবার কিছুমাত্র চেষ্টা করল না।
দময়ন্তী হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, ‘শিবেনবাবু, আমাদের সামনে প্রশ্ন ছিল চারটে। প্রথম, প্রতাপ চৌধুরী কি রোজ একই সময়ে লাঞ্চ করতে বাড়ি আসতেন? উত্তর, হ্যাঁ, কেবল তাঁর মৃত্যুর দিনই ব্যতিক্রম হয়েছিল। দ্বিতীয়, সুশীলবাবু কতটা সততার সঙ্গে ব্যাবসা করেন? উত্তর, যথেষ্ট সততার সঙ্গে। তার চেয়েও বড়ো কথা ব্যাবসা করতে গিয়ে তাঁর সহৃদয়তা, সহানুভূতি, বিনয়, সুরুচি ইত্যাদি একেবারে শুকিয়ে যায়নি। তৃতীয়, প্রতাপ চৌধুরী মারা গেলে দীপান্বিতার কি কোনো সুবিধে হয়? হয়। প্রতাপ আর দীপান্বিতার বিয়ে আর যাই হোক, আদর্শ বিবাহ যে হয়নি, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দু-জনের স্বভাব, চরিত্র, রুচি, চালচলন, সম্পূর্ণ আলাদা। সুশীলবাবুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা যেতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এ বিয়ে টিকত না। চতুর্থ, এটা যে আত্মরক্ষার্থে হত্যা, এটা কি প্রমাণ করা যাবে আদালতে? এখনও পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয় সেটা অসম্ভব হবে।
‘তাহলে, এই উত্তরগুলো থেকে আবার কতগুলো প্রশ্ন ওঠে। এক, ঘটনার দিন প্রতাপবাবু তাড়াতাড়ি কারখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন কেন? সেটা কি নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার? দুই, সুশীলবাবু অপছন্দ করলেও সাত্যকিকে তাড়াতে পারেননি কেন? সেটা কি নিতান্তই তাঁর বোনের প্রতি স্নেহবশত, না অন্য কোনো কারণ আছে? গ্লাসগো-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার র্যালফ স্ট্যানহোপের চাকরি ছেড়ে স্রেফ মামার অনুরোধে বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে এসে জুটে গেলেন— এটা কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না? এটা অসম্ভব তা বলি না, কিন্তু সাত্যকির স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় কি? তিন, দীপান্বিতা আর প্রতাপের বিয়েটা হয়তো সুখের হয়নি, কিন্তু প্রতাপ চৌধুরী দুশ্চরিত্র লোক এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক, দীপান্বিতার পক্ষে বিশ্বাস করা বোধ হয় সবচেয়ে কঠিন। অথচ, সে তাই বিশ্বাস করত। কীভাবে এবং কেন তার এই বিশ্বাস জন্মাল? সে কি কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিল? যদি পেয়ে থাকে তো সুশীলবাবুকে সেকথা বলেনি কেন? অন্য কারোর মুখের কথায় তার এই বিশ্বাস জন্মেছিল, তা আমার মনে হয় না। এবং চার, এটা যে আত্মরক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড, একথাটা এত দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে দীপান্বিতা বলছে কেন? এই প্রত্যয়টাই-বা তার এল কোত্থেকে?’
শিবেন বলল, ‘অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন যে এই হত্যাকাণ্ডটা একটা ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি, তাই না?’
‘কী জানি! তবে, ষড়যন্ত্র যদি হবে, তাহলে দীপান্বিতা এমন ভয়ংকর রাস্তা নিতে গেল কেন? সমস্ত ব্যাপারটা অনেক সাজিয়ে-গুছিয়ে করা যেত। এমন হইচই না করে স্লো পয়জনিং করাটাই বোধ হয় স্বাভাবিক হত, বিশেষত যখন বিষটাই হচ্ছে মেয়েদের খুন করার সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্র। তা ছাড়া ষড়যন্ত্র যারা করে, তারা প্রথমেই পালাবার রাস্তাটা ঠিক করে রাখে। এক্ষেত্রে সেটা একেবারেই করা হয়নি।’
‘তাহলে তো আপনি সেদিন যে সম্ভাবনাটার কথা বলেছিলেন, সেটাই সত্যি বলতে হয়। প্রতাপ সত্যি সত্যিই দীপান্বিতাকে খুন করতে গিয়েছিল। সাত্যকি সেটা কোনোরকমে টের পেয়ে স্নেহবশত বা পুরাতন প্রেমবশত দীপান্বিতাকে সাবধান করতে তার বাড়িতে যায়। তাকে সাবধান করে লুকিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে প্রতাপ এলে দীপান্বিতা তাকে খুন করে। সাত্যকি তখন প্রতাপের পকেট থেকে অস্ত্রটা নিয়ে গোলমালের মধ্যে কেটে পড়ে। এই সম্ভাবনাটা আরও প্রবল বলে মনে হয়, কারণ সাত্যকি এ ঘটনার সময় কারখানায় ছিল না।’
দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারটা আরও তলিয়ে দেখা দরকার। তা ছাড়া, এখানে একটা জিজ্ঞাস্য আছে। শুনেছি, একটা ছোটো হালকা অথচ অব্যর্থ পিস্তলজাতীয় কিছু তৈরি করা বড়ো বন্দুক বা রাইফেল বানানোর চেয়ে ঢের শক্ত। তার জন্যে নানা রকমের সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত যন্ত্রপাতি দরকার হয়। বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে কারখানা আমরা দেখলুম, সেখানে এরকম কোনো যন্ত্র আছে কি? সমরেশ, তুমি কী বল?’
সমরেশ বলল, ‘খুব প্রিসিশন কাজ করার মতো কোনো যন্ত্র তো নজরে পড়ল না। সবই মোটা কাজের উপযোগী। তবে, একটা কথা আছে। প্রিসিশন কাজ করার জন্য যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাদের অনেকগুলোই কিন্তু খুব ছোটো আর সহজে বহনযোগ্য হতে পারে। এরকম হতে পারে যে, প্রতাপবাবু যন্ত্রটা ফাউন্ড্রিতে ঢালা করিয়ে নিয়ে এইসব ছোটো ছোটো যন্ত্র দিয়ে নিজের অফিস ঘরেই বসে মিলিং, শেপিং, ড্রিলিং, বোরিং ইত্যাদি করে নিয়েছেন।’
‘এরকম করা যায় নাকি?’
‘যেতে পারে। একটা টেবিলে ফিট করে চালানো যায়— এরকম লেদ মেশিন আছে যেটা ভার্সেটাইল আর অত্যন্ত অ্যাকিয়োরেট অথচ এত ছোটো যে একটা ছোটো আলমারির মধ্যেই ঢুকিয়ে রাখা যায়।’
দময়ন্তী শিবেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘প্রতাপবাবুর অফিস ঘরটা সার্চ করা হয়নি, তাই না?’
‘না, হয়নি।’ শিবেন বলল।
‘তার একটা ব্যবস্থা করবেন? চাবির রিংটা ভুলবেন না যেন। প্রতিটি চাবি কোথাকার সেটা বের করা চাই। আর সাত্যকির বাড়িটাও একবার সার্চ করান। যা চিঠিপত্র, কাগজ, ক্যাশমেমো, রসিদ ইত্যাদি পাওয়া যায়, সমস্ত ভালো করে দেখে নিতে বলবেন। হয়তো সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যেতে পারে।’
‘বেশ, তাই করা যাবে। এ ছাড়া, আপাতত প্রোগ্রাম কী?’
‘প্রোগ্রাম হচ্ছে, আগামী শনিবার মাসির সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রবিবারে বৃন্দার সঙ্গে, তার পরের শনিবার বরাকর, রবিবার টিটাগড়ে পুষ্পলতা এবং শিবরতন আর আজ নাইট-শোতে ময়ূরপঙ্খিতে পবন দাসের গ্রহবহ্নি। খুব চলছে বইটা।’
শিবেন সহাস্যে বলল, ‘বেশ। তবে গ্রহবহ্নির চেয়ে আপনি বোধ হয় ম্যানেজারবাবুর দর্শন পেতেই বেশি আগ্রহী, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই বটে। তবে গ্রহবহ্নিও ছাড়া নেই।’
‘তবে তো একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়। ঠিক আছে, আমি সব ব্যবস্থা করে সন্ধে নাগাদ চলে আসব।’
ময়ূরপঙ্খির ম্যানেজার অচ্যুত শীল অত্যন্ত রোগা, হাড়-বের-করা শরীরে একটা সাদা সুট, কালো কোঁচকানো সরু টাই আর নীল রঙের শার্ট পরে অতিথিদের ভয়ানকভাবে অভ্যর্থনা করলেন। ভাগ্যিস তখনও আগের শো ভাঙেনি, তাই ফয়ারে ক-জন আসার ছাড়া আর বিশেষ কেউ ছিল না। থাকলে, যেভাবে ম্যানেজারবাবু একটা রংচটা, জায়গায় জায়গায় ইঁদুরে খাওয়া লাল জুট কার্পেটের ওপর দিয়ে অতিথিদের হাঁটিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, তা দেখে যে তাঁরা অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়তেন, তাতে সন্দেহ নেই।
ম্যানেজারবাবুর ঘরটা সরু লম্বাটে। একপ্রান্তে একটা বড়ো টেবিল, কতকগুলি চেয়ার, টুল ইত্যাদি আর সামনে একটা লম্বা বড়ো সোফা। ম্যানেজারবাবুর বসার চেয়ারের পেছনে আর ডান পাশে গ্রিল লাগানো একটা করে জানলা। পাশের জানলাটা দিয়ে টিকিট কাউন্টারগুলো দেখা যায়।
ম্যানেজারবাবু মহা সমারোহে অতিথিদের সোফায় বসালেন। নিজে তাদের সামনে একটা টুলের ওপর বসে পানের ছোপ-লাগা বড়ো বড়ো দাঁত বের করে হেসে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের জন্যে কী করতে পারি। স্যার, একটু হুইস্কি খাবেন?’
শিবেন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘না। আমরা এখানে একটা মার্ডার কেসের তদন্ত করতে এসেছি। ইনি যা যা প্রশ্ন করবেন, তার ঠিক ঠিক জবাব দেবেন।’ বলে দময়ন্তীকে দেখিয়ে দিল।
অচ্যুত শীল বললেন, ‘নিশ্চয়ই জবাব দেব, স্যার। তবে পিটার স্কট আনিয়েছিলুম, স্যার। একটুও চলবে না?’
শিবেন আবার চোখ পাকিয়ে ধমক লাগাল, ‘আঃ, বলছি না, না? আমরা কি এখানে ফুর্তি করতে এসেছি নাকি?’
‘না, না, তা কেন? বলুন ম্যাডাম, আপনার কী প্রশ্ন ছিল।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কতদিন এই হলের সঙ্গে যুক্ত আছেন, অচ্যুতবাবু?’
অচ্যুত বললেন, ‘একেবারে গোড়া থেকেই। আমার বাবার বন্ধু লোচনদাস শ্রীবাস্তব এই হলের মালিক। যখন এই হল তৈরি করেন, তখন আমায় ডেকে এনে চাকরি দেন।’
‘সেটা কত বছর আগে? বারো বছর তো কম করে নিশ্চয়ই, তাই না?’
অচ্যুত মনে মনে একটু হিসেব করে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক বারো বছরই বটে। কী করে বুঝলেন?’
‘ওই কার্পেটের হাল দেখে। বুঝতেই পারছি, ওটা উদবোধনী অনুষ্ঠানের জন্যেই কেনা হয়েছিল। যাই হোক, আমরা যা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, তা হল বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের প্রতাপ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড।’
কথাটা শুনেই অচ্যুত শীলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সন্দিগ্ধ চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রতাপ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? তাকে তার স্ত্রী ঘরের মধ্যে গুলি করে মেরেছে। তার মধ্যে আমি আসি কোত্থেকে?’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে বললে, ‘না, না আপনি কোথাও আসেন না। আমরা শুধু আপনার কাছ থেকে কিছু খবরাখবর চাই।’
অচ্যুত ছেলেমানুষের মতো ঘাড় গোঁজ করে বললেন, ‘আমি কিছু জানি না।’
‘অচ্যুতবাবু, আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। আমাদের সাহায্য করলে, আপনার কোনো ক্ষতিরই সম্ভাবনা নেই।’
অচ্যুত পূর্ববৎ ঘাড় গোঁজ করেই বললেন, ‘আমি সত্যিই কিছু জানি না। প্রতাপবাবু মাঝে মাঝে এখানে সিনেমা দেখতে আসতেন, এইটুকু শুধু জানি।’
‘তিনি কি শুধু সিনেমা দেখতেই আসতেন?’
অচ্যুত একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই তো জানি।’
‘আপনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, তাই না?’
‘হ্যাঁ, ছিল। তো কী হয়েছে?’
‘না, কিছুই হয়নি। তবে শুনেছি, প্রতাপবাবু সিনেমা দেখতেন খুব কম, আপনার এই ঘরেই থাকতেন বেশি।’
‘কে, কে বলেছে? মিথ্যে কথা, একদম ডাহা মিথ্যে কথা। কখনো-সখনো আসত, এই পর্যন্ত।’
‘সেই কখনো-সখনো বোধ হয় ড্রিঙ্কসও চলত, তাই না?’
অচ্যুত আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ। আমি সন্ধেবেলা ড্রিঙ্ক করি, কেউ এলে তাকে অফারও করি। যার ইচ্ছে, সে খায়— তাতে আমার দোষ কোথায়? আমি তো আর কাউকে জোর করে বুকে হাঁটু দিয়ে ড্রিঙ্ক করাইনি।’
‘আহা, কেন আপনি মনে করছেন যে আপনার দোষ ধরতেই আমরা এখানে এসেছি? আমাদের উদ্দেশ্যই তা নয়।’
‘না, উদ্দেশ্য তা নয়! তাহলে প্রতাপ আমার সঙ্গে গল্প করত কি না, ড্রিঙ্ক করত কি না, এসব প্রশ্ন কেন?’
‘তার কারণ আমরা জানতে চাই, তিনি কেন ড্রিঙ্ক করতেন। তাঁর সম্পর্কে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, তাতে এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে তিনি ঠিক ড্রিঙ্ক করার টাইপ ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি এখানে এসে গোপনে ড্রিঙ্ক করতেন কেন?’
‘তার কারণ, তার মনে চাপা দুঃখ ছিল। মনে দুঃখ চেপে রাখলে লোকে ড্রিঙ্কই করে, গঙ্গাজল খায় না। দেবদাস পড়েননি?’
‘কিন্তু দেবদাস তো পার্বতীকে না পাওয়ার দুঃখে মদ ধরেছিল। প্রতাপবাবুর তো সে কেস নয়। বিবাহিত লোক…’
‘বিবাহিত লোক তো কী হয়েছে? যার ঘরের বউ পর হয়ে যায়, সে দেবদাসের মতো দিওয়ানা হবে না তো হবে কে?’
‘ঘরের বউ পর হয়ে গেল কেন?’
‘কেন আবার? কুলটা, কুলটা! বেশি সুন্দরী হলে যা হয়!’
‘কী সর্বনাশ! আমরা তো শুনেছিলুম, প্রতাপবাবুরই চরিত্র দোষ ছিল।’
‘তা তো শুনবেনই। অত বড়োলোকের মেয়ে, তার কি কখনো বদনাম হতে পারে? টাকা দিয়ে সব ঢাকা যায় ম্যাডাম। নইলে, প্রতাপের মতো হিরের টুকরো ছেলে, তাকেই কিনা এমন বেঘোরে মরতে হয়? আর তার বউকে দেখুন, কিছুদিনের মধ্যেই জেল থেকে বেরিয়ে ড্যাংডেঙিয়ে ঘুরে বেড়াবে।’
‘প্রতাপের স্ত্রী সম্বন্ধে একথা আপনাকে কে বলেছে? প্রতাপবাবু স্বয়ং?’
‘নাঃ। প্রতাপ এসব কথা বলত না। আমি অন্য জায়গা থেকে খবর পেয়েছি।’
‘কোত্থেকে পেয়েছেন? কে বলেছে আপনাকে এসব কথা? বলতে কোনো অসুবিধে আছে?’
‘তা আছে বই কী। তবে যে বলেছে, সে খুব খাঁটি লোক। আর তা ছাড়া তাকে আপনারা পাবেনও না। তিন-চারদিন আগে এখান থেকে বদলি হয়ে গেছে।’
‘তার নামটা জানতে পারি কি?’
‘না। যদি বেশি চাপাচাপি করেন তো একটা ভুয়ো নাম দেব।’
.
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ম্যানেজারবাবুর কথায় একটা ব্যাপার স্পষ্ট হল যে সন্দেহটা দু-তরফেই প্রবল ছিল, আর সেইজন্যই মিটমাট হচ্ছিল না।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘দীপান্বিতার কি সত্যিই কোনো গোলমাল ছিল?’
‘বিয়ের আগে ছিল বোধ হয়। তা না হলে তার পেছনে পেছনে তার বাবা ক্লাবে গিয়ে বসে থাকতেন না। সন্দেহ নেই যে বিয়েটা টিকে থাক, এটা উনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন।’
‘কিন্তু প্রতাপই-বা কেমন লোক? বউকে সন্দেহ করি, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না, অথচ সেই বউয়ের বাড়িতেই পড়ে থাকি— এটা কী ব্যাপার? শিক্ষিত, কর্মঠ ছেলে— বেরিয়ে চলে যেতে পারল না? বউয়ের গুলি খাবার জন্যে পড়ে থাকতে হল?’
‘ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে একটু অদ্ভুত সন্দেহ নেই, কিন্তু অস্বাভাবিক বোধ হয় নয়।’
শিবেন বলল, ‘আমার তো মনে হয়, বউকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করে, তার ওপরে তার বাবার মন বিষিয়ে দিয়ে অর্ধেক সম্পত্তি কুক্ষিগত করাই প্রতাপ চৌধুরীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তাহলেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়।’
‘না, তা হয় না। প্রতাপ চৌধুরীর জীবনযাত্রা প্রণালী এবং তার কাজ সম্পর্কে পাগলামি তাকে খুব একটা প্যাঁচালো লোক বলে প্রমাণ করে না। তার শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকার কারণ সম্ভবত সুশীলবাবুর প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের প্রতি ভালোবাসা। মনে রাখতে হবে যে খুব ছোটোবেলায় তার বাবা মারা যান। হতে পারে, সুশীলবাবুর মধ্যে সে পিতৃস্নেহ আর একটি পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছিল।’
‘অর্থাৎ আপনার কথা মেনে নিতে গেলে বলতে হয়, দীপান্বিতা প্রতাপের কাছে নিতান্তই একটা সেকেন্ডারি অস্তিত্ব ছিল। তাহলে অচ্যুত শীলের কাছে গিয়ে মদ খাওয়া কেন?’
‘না, দীপান্বিতা সেকেন্ডারি হবে কেন? প্রতাপ পিতৃমাতৃহীন হতে পারে, আত্মসম্মানহীন তো নয়। সে যদি নিঃসন্দেহ হয় যে তার স্ত্রী তাকে আর পাত্তা দিতে রাজি নয়, তাহলে সে মদ খাবে না? শত হলেও…’
‘বিয়ে করা বউ! তা ঠিক। তবে, ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কথা বলে কোনো নতুন সূত্র পেলেন?’
‘মনে হচ্ছে পেয়েছি, কিন্তু সূত্রটা যে ঠিক কী তা ধরতে পারছি না। মানে, কী-একটা কথা যেন ম্যানেজারবাবু বললেন যেটা খুব জরুরি কিন্তু সেটা এখুনি মনে আসছে না। একটু চিন্তা করতে হবে। আপাতত সুশীলবাবুকে ফোন করে একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে আগামী শনিবার আমাদের চন্দ্রহাস অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার কথা। আজ অবশ্য অনেক রাত হয়ে গেছে, ফোনটা কাল করলেই চলবে।’
.
শনিবার সকাল দশটা নাগাদ শিবেন হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির হল। বলল, ‘আপনার জন্য তিনটে খবর আছে বউদি। প্রথম, আজ এগারোটার সময় সুশীলবাবু এখানে আসছেন, আমাদের চন্দ্রহাসে নিয়ে যাবেন। দ্বিতীয়, প্রতাপ চৌধুরীর চাবির রিং-এ একটা চাবির কোনো তালা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতাপ যেরকম গুছোনো লোক, তাতে তার রিং-এ একটা ফালতু চাবি থাকবে, তা মনে হয় না। তৃতীয়, বৃন্দা নেই, কেটে পড়েছে।’
দময়ন্তী চমকে উঠে বলল, ‘বৃন্দা কেটে পড়েছে? কীরকম?’
‘সুশীলবাবু টিটাগড়ে শিবরতন সান্যালকে খবর পাঠিয়েছিলেন বৃন্দাকে আপনার কাছে পাঠানোর জন্যে। ওঁরা জানিয়েছেন যে প্রতাপ মারা যাবার পর পুলিশের জবানবন্দি দিতে গিয়ে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন মতো হয়। তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সকাল বেলা বাজার করতে গিয়ে সে হাওয়া হয়ে যায়, আর ফিরে আসেনি।’
‘বৃন্দার বাড়ি কোথায়?’
‘মেয়েটি উদবাস্তু। থাকত গোপালনগর বস্তিতে। সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সে নেই।’
‘বৃন্দা পুলিশকে কি জবানবন্দি দিয়েছিল?’
‘নতুন কিছু নয়। সুশীলবাবু যা যা বলেছেন, তার সঙ্গে কোনো তফাত নেই। যা হোক, আমি একটা কপি এনেছি, দেখে নেবেন সময়মতো। ইতিমধ্যে মিসিং পার্সনস স্কোয়াডে কেস ধরিয়ে দিয়েছি।’
‘কীরকম মেয়ে ছিল বৃন্দা?’
‘সোনারপুরের দারোগা আর গোপালনগরের লোকজনের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়, খুব চালাকচতুর মেয়ে। বয়েস বত্রিশ বা তার কাছাকাছি। স্বাস্থ্য খুব ভালো আর কিছুটা ঝগড়াটে।’
‘বিয়ে হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। তার স্বামী আর তিন ছেলেমেয়ে গোপালনগর বস্তিতেই থাকে। স্বামীটি কাজকর্ম বিশেষ করে না, মাঝে মাঝে ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করে।’
‘গোপালনগরের লোকেরা আর কী বলেছে? বৃন্দার কোনোরকম মানসিক গোলমাল তাদের নজরে পড়েছিল?’
‘না। সেরকম কিছুই তারা বলেনি।’
‘হুঁ। ব্যাপারটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। আর যে চাবির তালাটা পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা কি খোঁজা হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। কারখানা আর প্রতাপ চৌধুরীর বাড়িতে আবার লোক লাগানো হয়েছে। সেইসঙ্গে আপনার কথামতো সাত্যকির বাড়িতেও লোক পাঠিয়েছি।’
বলতে বলতেই সিঁড়িতে ভারী পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। আর তার একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন সাত্যকি সান্যাল। কিন্তু এ কোন সাত্যকি? প্রথম দর্শনে তাঁর মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্য দেখা গিয়েছিল, তার চিহ্নমাত্র নেই। তাঁর জান্তব মুখে এখন কেবল একটি জন্তুরই ছাপ— সেটি একটি ভীত ভিজে বেড়ালের।
একটি সোফায় নববধূর ভঙ্গিতে বসে, সাফারি সুটের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে সাত্যকি বললেন, ‘আপনারা আমার বাড়ি সার্চ করতে পাঠিয়েছেন? আমি কী অপরাধ করলুম বলতে পারেন? একটি মেয়ে তার হাজব্যান্ডকে গুলি করে মেরেছে, তার সাক্ষীসাবুদ আছে, এর মধ্যে অন্য লোক আসে কোত্থেকে? আমি খুনও করিনি, ঘটনার ধারে-কাছেও ছিলুম না, তবু আমাকে ধরে টানাটানি কেন? প্রতাপের সঙ্গে আমার রেষারেষি ছিল ঠিকই, মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও যে হয়নি তা নয়, কিন্তু সেটা নেহাতই কাজ উপলক্ষে। কোম্পানি এগজিকিউটিভদের মধ্যে অমন হামেশাই হয়ে থাকে। তাই বলে, প্রতাপ যদি পারিবারিক ব্যাপারে খুন হয়, তার জন্যে আমার বাড়ি সার্চ কেন হবে, বলুন তো? আমার চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অক্ষয় সরকারের সঙ্গেও তো প্রতাপের বনত না। তার বাড়িও কি আপনারা সার্চ করবেন?’
এক নিশ্বাসে গড়গড় করে এতগুলো কথা বলে গেলেন সাত্যকি। তিনজনেই উদগ্রীব হয়ে কথাগুলো শুনছিল, এখন উনি থামতেই শিবেন বলল, কী নাম বললেন? অক্ষয় সরকার? দরকার হলে তাঁর বাড়িও সার্চ করব বই কী। কিন্তু আপনার বাড়ি সার্চ কেন হবে না বলতে পারেন? প্রতাপ চৌধুরীর খুন যতটা সহজ সরল বলে মনে হয়, ব্যাপারটা যে তা নয়, সেটুকু আমরা এস্ট্যাবলিশ করতে পেরেছি। এখন, আপনার সঙ্গে তাঁর বনিবনা ছিল না, তাঁর প্রতি আপনার ঘৃণাও আপনি গোপন করেননি, তার ওপর আপনি দীপান্বিতার পরিবারের সঙ্গেও যুক্ত। এ অবস্থায় আপনার বাড়ি সার্চ করে পুলিশ কি মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে? আপনার বাড়িতে আপত্তিকর কিছু পাওয়া না গেলে, আমরা আপনাকে মোটেই বিরক্ত করব না।’
সাত্যকি আবার প্রবলভাবে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘দেখুন, ওই আপত্তিকর কিছু সম্পর্কেই আমার একটু বলবার ছিল। মানে, এই খুনের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই যুক্ত নই ঠিকই, কিন্তু আপনাদের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে সেরকম কিছু কাগজপত্র আপনার লোক নিয়ে গেছে আমার বাড়ি থেকে। মানে, সেগুলো কিন্তু কোনোভাবেই এ ঘটনা সংক্রান্ত কিছুই নয়, তবে আপনাদের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে, তাই…’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘আর একটু পরিষ্কার করে বলুন। আপনার কথা আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘হেঁ, হেঁ, মানে, বোঝেনই তো… আমি প্রায় দশ বছর বিলেতে ছিলুম। তার ওপর মানে এখন ডিভোর্সড। এইসব কারণে আমার ইয়ে, মানে মরাল কোডস অন্য সকলের চেয়ে একটু আলাদা। তা একটু এদিক-ওদিক…’
শিবেন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘অর্থাৎ আপনার নারীঘটিত ব্যাপারে কিছু দুর্বলতা আছে।’
সাত্যকি প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মানে…’
শিবেন হাত নেড়ে বাধা দিল। বলল, ‘আর আপনার বাড়ি সার্চ করে পুলিশ অনেকগুলি প্রেমপত্র পেয়েছে। এবং হয়তো কিছু কুৎসিত ছবি।’
সাত্যকি কেবল মাথা নাড়লেন, কোনো শব্দ করলেন না।
শিবেন বলে চলল, ‘আপনি বলতে চাইছেন সেই প্রেমপত্রগুলো বা ছবিগুলোর সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্কই নেই, সেগুলো সবই আপনার নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। অতএব পুলিশ যেন সেগুলো না পড়ে বা না দেখে, অগৌণে আপনাকে ফেরত দেয়। এই তো?’
সাত্যকি এতক্ষণে দন্তবিকাশ করলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, মানে…’
শিবেন কঠিন মুখ করে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, দময়ন্তী বাধা দিল। বলল, ‘আপনার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, এই খুনের সঙ্গে যেগুলির সম্পর্ক নেই, সেগুলি অবশ্যই আপনাকে ফেরত দেওয়া হবে সাত্যকিবাবু। কিন্তু একটা প্রশ্ন। আপনার মরাল কোড অন্যের থেকে অলাদা, অর্থাৎ আপনাকে খুব একটা নীতিবাগীশ বলা যায় না, তা সত্ত্বেও প্রতাপ চৌধুরীকে আপনার অত্যন্ত খারাপ এবং পারভার্টেড বলে মনে হয়েছিল। কেন? সেটা কি নেহাতই দীপান্বিতার প্রতি আপনার স্নেহবশত, না অন্য কোনো কারণ আছে?’
সাত্যকি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘দেখুন, দীপান্বিতাকে আমি সত্যিই স্নেহ করে থাকি, সে আমার ছোটোবোনের মতো। আমি লোকটা ভালো না হতে পারি, কিন্তু আশা করি যে দীপান্বিতার হাজব্যান্ড ভালো লোকই হবে। আর প্রতাপ শুধু বাকি সকলের স্ট্যান্ডার্ডে নয়, আমার স্ট্যান্ডার্ডেও অসৎ লোক ছিল। দীপান্বিতা ওঁকে গুলি করে কোনো অন্যায় কাজ করেনি।’
‘কেন?’
‘আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব নয়।’
শিবেন পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘ঘটনার দিন আপনি কারখানা থেকে আগেভাগে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন? হত্যাকাণ্ডের সময় আপনি যে ও বাড়িতে ছিলেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারেন?’
‘পারি। দীপান্বিতা যখন প্রতাপকে গুলি করে, তখন বেলা এগারোটা কুড়ি হবে। ঠিক সেই সময় আমি পোস্টঅফিসে ছিলুম এবং মাস্টারমশায়ের সঙ্গে কথা বলছিলুম। তিনি সাক্ষী দেবেন।’
‘কী কথা বলছিলেন?’
‘আমার অনেক গোপন চিঠি কেয়ার অফ পোস্টমাস্টার আসে। আমি সেগুলি কালেক্ট করতে গিয়েছিলুম।’
‘খবরটা আপনাকে দিল কে? এবং কখন?’
‘খবরটা দেয় শ্রীনাথ ভট্টাচার্য; পোস্টঅফিস থেকে বেরিয়ে যখন সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফ্যাক্টরিতে যাই, তখন।’
‘আপনি বাড়িতে প্রেমপত্র এবং আপত্তিকর ছবি জমিয়ে রাখেন কেন? ব্ল্যাকমেল করার জন্যে?’
‘না, না, মানে, তা নয়। ইয়ে… মানে আমাকে যাতে কেউ ব্ল্যাকমেল করতে না পারে, সেইজন্যে।’
‘বৃন্দা কোথায়? সে তো আপনার বাপের বাড়ির লোক। তাকে কোথায় পাঠিয়েছেন?’
এই প্রশ্নে ভয়ানক চমকে উঠলেন সাত্যকি। কম্পিত গলায় বললেন, ‘বৃন্দা কোথায়? কই, আমি তো জানি না। মানে, অনেকদিন টিটাগড়ে যাওয়া হয় না তো, তাই বোধ হয় শুনিনি কিছু। বৃন্দার স্বামী সহদেবকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।’
‘জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সেও কিছু জানে না।’ বলতে বলতে শিবেন হঠাৎ দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। একটু পরে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?’
দময়ন্তী স্থির পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল, আশেপাশের কোনো কথাই কানে যাচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না, কেবল চোখ দুটো একটা প্রখর উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্তু শিবেনের প্রশ্নটা কানে গেল। প্রায় আত্মগতভাবে বলল, ‘না, কিছু হয়নি, শিবেনবাবু। আচ্ছা মিস্টার সান্যাল, আপনার ছোটোমামিমা যখন মারা যান, তখন আপনার বয়েস কত ছিল?’
মি. সান্যাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, বোধ হয় মনে মনে অঙ্কের হিসেবটা কষলেন, তারপর চেপে চেপে জবাব দিলেন, ‘তেরো কি চোদ্দো হবে।’
‘আপনি বললেন, ‘আপনি দশ বছর বিলেতে ছিলেন এবং দেশে ফেরেন আট বছর আগে। অর্থাৎ আপনি বিলেতে যান পনেরো-ষোলো বছর বয়সে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, ম্যাট্রিক পাশ করার সঙ্গেসঙ্গেই।’
‘তার মানে, আপনার মামিমা যখন মারা যান, তখন আপনি দেশেই ছিলেন। কীভাবে মারা যান উনি?’
সাত্যকির চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলেন, ‘শুনেছি, ট্রেন থেকে পড়ে মারা যান; দুর্ঘটনা। কিন্তু মিসেস দত্তগুপ্ত, সেই ঘটনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সম্পর্ক কী?’
‘কিচ্ছু না, মিস্টার সান্যাল। আপনি বাড়ি যান, কালপরশুই চিঠিগুলো ফেরত পাবেন। আর একটু বাদেই আপনার ছোটোমামা এখানে আসছেন। আপনি নিশ্চয়ই চান না যে তাঁর সঙ্গে আপনার এখানে দেখা হোক?’
সাত্যকি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘একদম না। তাহলে আমি চলি। আপনাদের সকলকেই ধন্যবাদ।’ বলে ক্লান্ত, বিমর্ষ ভঙ্গিতে সাফারি সুটসহ বেরিয়ে চলে গেলেন।
সমরেশ বলল, ‘নিঃসন্দেহে ব্ল্যাকমেল।’
শিবেন বলল, ‘হুঁ, নিঃসন্দেহে। ছোটোমামি মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই ছোটোমামা পাতানো ভাগনেটিকে নিজের খরচায় বিলেতে পাঠান। কারণ, ম্যাট্রিক পাশ করে গেছে যখন তখন তো আর স্কলারশিপ নিয়ে যায়নি। কিন্তু, বোঝা যাচ্ছে, মামা বিলেত পাঠিয়েও ভাগনেকে কায়দা করতে পারেননি, আর সেইজন্যেই ভাগনের যাবতীয় অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছেন, ঘাড় থেকে নামাতে পারছেন না।’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘কিন্তু তার সঙ্গে এই খুনের সম্পর্কটা কোথায়? প্রতাপকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার স্বপক্ষে এটা কোনো একটা যুক্তিই নয়। শাশুড়ি কুলত্যাগিনী হয়েছিলেন বলে তার বিশ বছর বাদে জামাই দুশ্চরিত্র হয়ে পড়বে— এরকম অদ্ভুত কথা কেউ কখনো বিশ্বাস করবে? তাহলে ব্যাপারটা কী?’
দময়ন্তী পূর্ববৎ আত্মগতভাবে বলল, ‘ব্যাপারটা তাহলে এখন অনেকটা পরিষ্কার।’
শুনেই দুই বন্ধু একসঙ্গে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে সমস্বরে বলল, ‘অ্যাঁঃ? সে কী! কী পরিষ্কার হল?’
দময়ন্তী এই যুগলবন্দি কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। বলল, ‘একটা ছবির খানিকটা, সবটা নয়।’
‘সেখানে কী দেখা গেল?’ আবার সমস্বরে প্রশ্ন হল।
‘দেখা গেল, প্রতাপ তাঁর মৃত্যুর দিনে কারখানা থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন, কেন তাঁর মৃতদেহটা দীপান্বিতার ঘরের ভেতরে অনেকটা ঢুকে ছিল, কেন তিনি দুপুর বেলা দীপান্বিতার ঘরে গিয়েছিলেন, কেন তাঁর পকেটে নকল হিরের আংটিটা ছিল এবং কেন দীপান্বিতা স্থির নিশ্চিত যে সে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। আমার অনুমান যদি নেহাত ভুল না হয় তাহলে বলব, এই ঘটনার পেছনে যে নিষ্ঠুর নির্মম ষড়যন্ত্র কাজ করেছে, সেরকম শয়তানির সঙ্গে আমার ইতিপূর্বে পরিচয় হয়নি। কিন্তু…’
সমরেশ বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘শয়তানিটা কার সেটা দেখা গেছে কি?’
‘না। নাটের গুরুটি যে কে, সেটাই বুঝতে পারছি না। সকলের সঙ্গে পরিচিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে বোধ হয় সামনে আনতে পারব না।’
বলতে বলতেই সুশীলবাবু ঘরে ঢুকলেন। সকলকে নমস্কার করে বললেন, ‘গাড়ি এনেছি। চলুন।’
.
৫
কেশবচন্দ্র অ্যাভিনিউর চন্দ্রহাস অ্যাপার্টমেন্ট একটি কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাটবাড়ি— সুদৃশ্য, ছিমছাম এবং পরিচ্ছন্ন। তবে একেবারে নতুন বাড়ি, রঙের গন্ধও যায়নি।
পাঁচতলার যে ফ্ল্যাটটির দরজায় সুশীলবাবু ঘন্টি বাজালেন, তার ওপর পেতলের পাতের ওপর খোদাই করে বাংলায় লেখা— শ্রীমতী পাঞ্চালী ভট্টাচার্য। দময়ন্তীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে সুশীলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ইনিই প্রতাপের মামি। একাই থাকেন। আগে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন, সম্প্রতি ফ্ল্যাটটা কিনে উঠে এসেছেন।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করলেন, ‘উনি কি আর্টিস্ট?’
সুশীলবাবু ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ। নাম শুনেছেন দেখছি।’
সুশীলবাবু আরও কিছু তাঁর বেয়ানের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই দরজাটা খুলে গেল। যিনি দরজা খুললেন, তাঁকে দেখে শিবেন আর সমরেশ স্তম্ভিত। বিধবা মামি বললে সাধারণত যে সাদা থান পরা, ন্যাড়া মাথা, চোখে গোল স্টিলফ্রেমের চশমা পরা বয়স্কা মহিলার ছবি মনে ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে এই মহিলার কোনোমতেই কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে, একেবারে অসম্ভব নয়। চুল খুবই ছোটো করে করে ছাঁটা, চোখেও স্টিলফ্রেমের চশমা, তবে তাদের সাধারণ বিধবা মামিসুলভ না বলে, অত্যন্ত ফ্যাশনেবল বলাই সংগত। পরনে সাদা থানের পরিবর্তে হালকা সবুজ রঙের সুতির শাড়ি আর সেই রঙেরই স্লিভলেস ব্লাউজ। ছিপছিপে চাবুকের মতো ফিগার আর তার ওপরে একটা বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ন মুখ। বয়েস বলা অসম্ভব। কুড়ি থেকে চল্লিশ যা খুশি হতে পারে।
ভদ্রমহিলা সকলকে নমস্কার করে ভেতরে আহ্বান করলেন, কিন্তু সুশীলবাবু গেলেন না। বললেন, ‘আমি আজ আর বসছি না, পাঞ্চালী। আমার একটা কাজ আছে। তা ছাড়া ওঁদের তোমাকে কিছু প্রশ্ন করার থাকতে পারে, যা হয়তো আমার পক্ষে শোনা উচিত নয়।’ বলে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলেন। পাঞ্চালী কিছুক্ষণ সুশীলবাবুর চলে যাওয়া দেখলেন, তারপর অতিথিদের বসবার ঘরে এনে বসালেন।
বসবার ঘরটি ছোটো, কিন্তু ভারি সুন্দর করে সাজানো। আসবাবপত্র বা ঘর সাজানোর জিনিস বিশেষ কিছু নেই বটে, কিন্তু যা আছে তাদের মধ্যে গৃহকর্ত্রীর সুরুচি এবং শিল্পীমনের প্রভাব ছড়িয়ে আছে। একটি বেতের সোফাসেট, কয়েকটা মোড়া, মেঝেয় শীতলপাটি, দেওয়ালে কয়েকটা ছবি আর একটা বুককেসে ঘরটাকে এমন একটা বিশিষ্টতা দিয়েছে, যা হয়তো অনেক দামি দামি আসবাবপত্রে ভরিয়েও দেওয়া যেত না।
পাঞ্চালী দময়ন্তীর সামনে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। কেটে কেটে বললেন, ‘সুশীলবাবুর মুখে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনলুম। আপনি ইতিহাসের অধ্যাপিকা হয়েও শখের জন্যে এইসব কাজ করেন। সুশীলবাবু কেন আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন আমি জানি না, কিন্তু আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে দীপান্বিতা নির্দোষ, সে খোকা, মানে প্রতাপকে খুন করেনি?’
দময়ন্তী শান্ত গলায় বলল, ‘সুশীলবাবু আপনাকে আমার সম্বন্ধে কী বলেছেন আমি জানি না, তবে স্পষ্টতই একথা বলেননি যে কাউকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণ করা আমার কর্তব্য নয়। কোনো ঘটনার পেছনের পারম্পর্য এবং তার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বের করে, তার বিশ্লেষণই যেমন ঐতিহাসিকের কর্তব্য, আমারও তাই। দীপান্বিতা তার স্বামীকে দুপুর বেলা তার নিজের ঘরে গুলি করে মেরেছে এটা ঘটনা, কিন্তু তার এখানেই শুরু এবং এখানেই শেষ, তা নয়। আমাদের একথা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে এই দুর্ভাগা দম্পতি একটা দীর্ঘদিনের অতি নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকার। সেই ষড়যন্ত্রের মূল খুঁজে বের করব— এরকম কথাই আমি সুশীলবাবুকে দিয়েছি।’
দময়ন্তীর কথায় পাঞ্চালীর গলার সুরটা একটু নরম হল ঠিকই, কিন্তু তাঁর দু-চোখের অবিশ্বাস আগের মতোই রইল। বললেন, ‘আপনি কি সেই ষড়যন্ত্রের মূল এ বাড়িতে পাবেন বলে আশা করেন?’
দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘কিছু পাব সে আশা না থাকলে, এ বাড়িতে আসব কেন, বলুন? ইচ্ছে হোক, অনিচ্ছেয় হোক, এ নাটকে তো আপনারও কিছু অংশ, তাই না?’
পাঞ্চালীর গলা আবার কঠিন হয়ে উঠল, ‘না, এ নাটকে আমার কিছুমাত্র অংশ নেই। এ বিয়েতে আমার মত ছিল না। খোকাকে বহুবার বলেছি, এখনও সময় আছে, চলে আয়। আমার কথা তখন শোনেনি। আমার যদি কোনো অংশ থাকত, তাহলে ওর এরকম পরিণতি হত না।’
‘এ বিয়েতে আপনার মত ছিল না, কেন?’
‘দীপান্বিতা ভালো মেয়ে ছিল না। উড়নচণ্ডী স্বভাব, প্রচণ্ড খামখেয়ালি আর অত্যন্ত পুরুষঘেঁষা মেয়ে ছিল। কলেজে পড়তেই ওর অনেক বদনাম রটেছিল, আর শেষে তো একেবারে বয়ে গিয়েছিল। ওরকম নোংরা একটা মেয়েকে খোকার স্ত্রী হিসেবে কল্পনাই করা যায় না। আর হবে না-ই বা কেন? যার রক্তে দোষ, সে শত চেষ্টা করলেও কি কখনো ভালো হতে পারে?’
পাঞ্চালীর শেষ কথাটা শুনে তিনজনেই চমকে উঠল। দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘দীপান্বিতার রক্তে দোষ ছিল, এটা আপনি বিয়ের আগেই জানতেন?’
পাঞ্চালী মাথা নেড়ে বললেন, ‘জানতুম বোধ হয় বা পরেও জেনে থাকতে পারি। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। খোকাকে ঠেকাতে পারলুম? সে দীপান্বিতার রূপ দেখল, তার বাবার টাকা দেখল, ফ্যাক্টরি দেখল আর গলে জল হয়ে গেল। বলল, মামি, ওসব বাজে রটনা, আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে। এই তো ঠিক হল!’ বলতে বলতে পাঞ্চালীর দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল।
এরকম অবস্থায় দময়ন্তী সাধারণত চুপ করে যায়, ভাবাবেগ একটু কমলে তারপর শুরু করে। কিন্তু এখন অন্যরকম দেখা গেল। কোনো ভেতরের উত্তেজনার অপেক্ষা না করেই আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি বললেন যে দীপান্বিতা শেষদিকে একদম বয়ে গিয়েছিল, তার মানে কী?’
পাঞ্চালী চোখের জল মুছে ভারী গলায় বললেন, ‘আমি তা সঠিক জানি না। তবে খোকার মুখে শুনলুম, দীপান্বিতা বেলেল্লাপনার চূড়ান্ত করছিল। ক্লাবে যাবার নাম করে বেরিয়ে যেত, অনেক রাত্রে ফিরত। মাঝে মাঝে দিদির কাছে যাচ্ছি বলে, কলকাতার বাইরে চলে যেত, রাতের পর রাত বাড়িই ফিরত না।’
‘আপনি এ ব্যাপারে সুশীলবাবুর সঙ্গে কথা বলেননি?’
‘বলেছিলুম। তবে ওঁর কাছে এ প্রসঙ্গ পাড়লেই উনি বলতেন, মেয়েকে উনিই সঙ্গে করে ক্লাবে নিয়ে যান, উনিই বরাকরে নিয়ে যান। স্বভাবতই উনি নিজের মেয়ের রেপুটেশন প্রোটেক্ট করবার চেষ্টা করতেন, মা-মরা ছোটো মেয়ে তো। কিন্তু তার ফল কী হল? অন্যায়কে ধামাচাপা দিলে সেটা নিশ্চিহ্ন তো হয় না, বরং কোনো-না-কোনো সময়ে অবধারিতভাবে ফণা তুলে বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রেও তাই হল। সুশীলবাবু অত্যন্ত ভালোমানুষ, তিনি মেয়েদের আদরই দিয়ে গেছেন, কিন্তু এসব সম্ভাবনার কথা তাঁর মনেও আসেনি।’
‘সুশীলবাবু যে তাঁর ছোটো মেয়েকে আপনার সামনে প্রোটেক্ট করছেন, সত্যি কথা বলছেন না, এ বিশ্বাস আপনার হল কী করে? কোনো প্রমাণ পেয়েছিলেন?’
‘না, আমি কোত্থেকে প্রমাণ পাব? খোকা মাঝে মাঝে এসে যা বলত, তাই শুনেছি। আর সুশীলবাবুর প্রতি ওর অন্য সমস্ত ব্যাপারে গভীর শ্রদ্ধা ছিল, কেবল মেয়ের প্রতি অন্ধ ভালোবাসাটুকু ছাড়া।’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘আশ্চর্য! দীপান্বিতারও ধারণা যে সুশীলবাবু প্রতাপকেই অন্ধের মতো ভালোবাসতেন, তাকে নয়। সেকথা থাক। সুশীলবাবুর মুখে শুনলুম, প্রতাপবাবুকে আপনিই মানুষ করেছেন। সেটা কীভাবে হল?’
‘আমার দিদি খোকা আর ওর ছোটোবোন টুলুকে রেখে অল্প বয়েসে মারা যান। খোকার তখন বয়েস সাত, টুলুর চার হবে। আমার ভগ্নীপতি ছিলেন অত্যন্ত সাধুপ্রকৃতির লোক আর দিদিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করবেন না, একথা পরিষ্কারভাবে সকলকে জানিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন দুই ছেলেমেয়েকে আমাদের বাড়িতে এনে রেখে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলেন। আমার তখন বছর ষোলো বয়েস, ম্যাট্রিক দিয়ে বাড়িতে বসে আছি। কাজেই ওদের দেখাশুনোর ভার আমার ওপরেই পড়ল।
আইএ পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়। আমার শ্বশুরবাড়ি জোড়াবাগানে। বিশাল বাড়ি, পুকুর, টেনিস কোর্ট— কী নেই? অথচ থাকার মধ্যে ছিলেন আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাশুর, জা আর দুই ভাশুরপো। আমার বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ভাশুর বালিগঞ্জে বাড়ি করে উঠে গেলেন আর তার কয়েক মাসের মধ্যে আমার স্বামী মারা গেলেন। আমি পড়লুম এক প্রকাণ্ড নিঃসঙ্গতার মধ্যে। তখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ির অনুরোধে খোকাকে নিয়ে এলুম আমার কাছে মানুষ করার জন্যে। ততদিনে জামাইবাবুও গত হয়েছেন। সেই থেকে ও আমার কাছেই রয়ে গেল চব্বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত।’
‘আপনি আর্টিস্ট হলেন কী করে?’
‘আমার শ্বশুরমশাই যোগেশ ভট্টাচার্য অতীতের একজন খুব নামজাদা আর্টিস্ট ছিলেন। উনিই আমাকে বিএ পাশ করার পর আর্টস্কুলে ভরতি করে দেন। আমার প্রথম প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও উনিই করে দিয়েছিলেন।’
‘আপনি এখন কি কিছু করেন? মানে, রোজগারপাতি?’
‘হ্যাঁ, করি। আমি অক্টেভ অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সির একজন ডিরেক্টর।’
‘আপনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি কেন? সংস্কারবশত, না অন্য কোনো কারণ ছিল?’
‘কোনো সংস্কারের অমি ধার ধারি না। করা হয়নি খোকার জন্যে। নতুন করে কোনো সংসার পাতলে, সেখানে খোকার কোনো স্থান নাও থাকতে পারত। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন? আপনি কি আমার জীবনের ইতিহাস জানবার জন্যে এখানে এসেছেন?’
দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘না, ঠিক তা নয়। আমার এখানে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, প্রতাপবাবুর চাকরি জীবনের বাইরে কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল কি না সে-সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া।’
‘না, খোকার সেরকম অন্তরঙ্গ বন্ধু কেউ ছিল বলে আমার জানা নেই। সে ছিল তার বাবার মতন গম্ভীর, ইন্ট্রোভার্ট আর নরম প্রকৃতির। দোষও ছিল, তাও তার বাবার মতো— রেগে গেলে প্রচণ্ড খেপে যেত। এরকম ছেলের ইয়ারদোস্ত থাকা কঠিন।’
‘অচ্যুত শীল বলে কারোর নাম কখনো শুনেছেন ওঁর মুখে?’
‘না, কখনো নয়।’
‘আর একটা কথা। প্রতাপবাবুর বিয়ের আগের কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?’
‘আছে, তবে ফটোগ্রাফ নয়, আঁকা ছবি। ওই যে, ওইটে।’ বলে পাঞ্চালী দময়ন্তীর পেছনের দেওয়ালে একটা তেলরঙে আঁকা ছবির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তারপর বললেন, ‘খোকার বিয়ের মাস ছয়েক আগে আঁকা। এ ছবিটি অনেকগুলি প্রাইজ পেয়েছে— আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ।’
ছবিটি বেশ বড়ো— প্রায় ছত্রিশ ইঞ্চি লম্বা চব্বিশ ইঞ্চি চওড়া। গাঢ় বাদামি আর সবুজ রঙে আঁকা একটি প্রায়ান্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন অতিকায় মহিরুহর বন, নীচে বড়ো বড়ো পাতার ঝোপ আর সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ছুটে আসছে গ্রিক বনদেবতা প্যানের মতো একটি মানুষ, গ্রিক ভাস্কর্যের মতোই সুঠাম সুন্দর শরীর, মাথায় ফুলের মুকুট আর একহাতে একটি পুষ্পিত গাছের ডাল। মানুষটি বিবস্ত্র, একটি ঝুঁকে থাকা ঝোপের পাতায় কোনোরকমে তার লজ্জানিবারণ হয়েছে বটে, কিন্তু তার নগ্নতা নয় বরং দৌড়ে আসার স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক এবং দৃপ্ত ভঙ্গিই দর্শককে আকৃষ্ট আর মুগ্ধ করে। অথচ তার মুখে কিন্তু উল্লাস বা অতিরিক্ত হর্ষের কোনো অভিব্যক্তি নেই, তার বদলে রয়েছে একটি সরল আত্মহারা বিহ্বল ভাব যেন সুন্দরী প্রকৃতি তাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। বলা বাহুল্য, এই মানুষটিই প্রতাপ চৌধুরী।
দময়ন্তী কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে ছবিটা দেখল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘খুব সুন্দর।’
পাঞ্চালী ভারী গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেকেই ছবিটি কিনতে চেয়েছেন, আমি দিইনি।’
‘ছবিটা শেষ কবে প্রাইজ পেয়েছে?’
‘খোকা মারা যাবার মাস দুয়েক আগে। তারপর আর কোনো এগজিবিশনে পাঠাইনি, পাঠাবও না।’
‘এবার একটা অনুরোধ।’
‘কী, বলুন।’
‘দীপান্বিতার পরিবারে একটা কলঙ্কের ইতিহাস আছে, এ খবরটা আপনি তার বিয়ের আগে জানতেন, না পরে জেনেছিলেন— একথাটা আপনার মনে নেই বললেন। আমার অনুরোধ হল, এ ব্যাপারটা একটু মনে করবার চেষ্টা করবেন আর কীভাবে জেনেছিলেন সেটাও। আর মনে যদি পড়ে, তাহলে সঙ্গেসঙ্গে আমাকে টেলিফোন করে জানিয়ে দেবেন।’
‘বেশ, তাই করব। তাতে যদি আপনার বা অন্য কারোর উপকার হয় তো মন্দ কি!’
.
চন্দ্রহাস অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে শিবেন বললে, ‘চমৎকার! দু-জনেই দু-জনকে আপ্রাণ সন্দেহ করে যাচ্ছে, অথচ সেটাই খোলসা করে কথা বলছে না। বললে হয়তো এরকম ব্যাপারটা হত না।’
দময়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘না, তা হত না। শিবেনবাবু, বিকেল বেলা একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করতে পারেন?’
‘নিশ্চয়ই। জিপে যাবেন না আমার গাড়িতে?’
‘আপনার গাড়িটা হলেই ভালো হয়। অসুবিধে হবে না তো? রমলাকেও আনবেন।’
‘অসুবিধে হবে কেন? কী যে বলেন! ঠিক আছে, রমলাকে নিয়েই আসা যাবে। চারটে নাগাদ আসি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভালোই হবে, উইকএন্ড আউটিং। কোথায় যাবেন? টিটাগড়?’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ।’
.
ঠিক চারটের সময় শিবেন সস্ত্রীক এসে হাজির হল। সমরেশকে একটু আড়ালে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, তোর গিন্নির কাছ থেকে কোনো ক্লু পেলি?’
সমরেশ মাথা নাড়ল। বলল, ‘নাঃ, একবারে নির্বাক। সারা দুপুর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইল, নট-নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। তবে মনে হচ্ছে আর বেশি বাকি নেই।’
শিবেন সায় দিল। বলল, ‘হুঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
.
শিবরতন সান্যাল টিটাগড়ের ডেভিস কটন মিলসের সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মিলের ভেতরেই কোয়ার্টার্সে থাকেন। মোটা থপথপে চেহারা, মাথার সমস্ত চুল সাদা কিন্তু ছেলের সঙ্গে মুখের চেহারায় দারুণ সাদৃশ্য। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে ভদ্রলোক ব্যাজার মুখে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, অতিথিদের দেখে আরও বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তাঁদের সম্বর্ধনা করতে এবং বাড়ির ভেতরে এসে বসাতে যে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল, সেটা তিনি বেশ স্পষ্টই বুঝিয়ে দিলেন।
শিবরতনের স্ত্রী পুষ্পলতা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়েসটা কেবল তাঁর চুলটাতেই আক্রমণ করে সাদা করে দিয়েছে, শরীরের বাকি অংশে বিশেষ দাঁত ফোটাতে পারেনি। সেটি এখনও ঋজু, বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টতই কর্মক্ষম।
শিবরতন বিষণ্ণ সরু মেয়েলি গলায় বললেন, ‘আপনারা আসবেন সেকথা সুশীল আমাকে জানিয়েছিল বটে কিন্তু মনে হয় যেন আজ নয়, আগামী শনিবারের কথা বলেছিল।’
দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, সেইরকমই কথা হয়েছিল। কিন্তু একটি বিশেষ কারণে আজই চলে আসতে হল।’
‘কী বিশেষ কারণ?’
‘কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন ছিল।’
‘আর এক সপ্তাহ দেরি করা যেত না?’
‘না! আর সেইজন্যেই আসা।’
‘কী প্রশ্ন বলুন। যদি সাধ্যের মধ্যে হয়, উত্তর দেব।’
‘আপনার ছেলের সঙ্গে শুচিস্মিতার প্রেম ছিল, একথা সুশীলবাবু জানতেন?’
‘জানত।’
‘তাদের বিয়ে দেননি কেন? কোনো বাধা ছিল?’
‘সেকথা সুশীলকে জিজ্ঞাসা করবেন। সে-ই সঠিক জবাব দিতে পারবে।’
‘পুলিশ আপনার ছেলের বাড়ি সার্চ করে অনেক চিঠিপত্র পেয়েছে, এবারে কিন্তু শুচিস্মিতার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথাটা পুলিশের কাছে অজানা থাকবে না।’
‘অসম্ভব, শুচি আমার ছেলেকে চিঠি লেখে না। তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কই পুলিশের বা কারোর পক্ষে আইনত প্রতিপন্ন করা সম্ভব নয়।’
‘এখানেই আপনাদের হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে। শুচিস্মিতার চিঠিপত্র হয়তো সব নষ্ট করে ফেলেছেন কিন্তু আপনাদের ভূতপূর্ব পুত্রবধূর চিঠিতে তার উল্লেখ আছে। সেকথাটা বোধ হয় আপনাদের মনে ছিল না। আপনার ছেলের কথাটা একটু দেরিতে মনে পড়েছে আর সেইজন্যেই আজ সকাল বেলা তিনি চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার বাড়ি এসেছিলেন চিঠিগুলো ফেরত দেবার অনুরোধ জানাতে।’
শিবরতনের বিষণ্ণ চোখে একটা ক্রোধের আগুন ধক ধক করে জ্বলে উঠল। গলাটা একটু তুলে বললেন, ‘আপনারা কি আমার ছেলের পাস্ট লাইফ সম্পর্কে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছেন, না দীপান্বিতার খুনের ব্যাপারটা?’
‘আমরা এসেছি আপনার ছেলের প্রেজেন্ট লাইফ নিয়ে ইনভেস্টিগেট করতে শিবরতনবাবু, আর সেইসঙ্গে খুনের ব্যাপারটাও তো আছেই। দুটো তো একেবারে সম্পর্কহীন নয়।’
শিবরতনের গলা আরও উঠল। বললেন, ‘আপনি বলতে চান, আমার ছেলে এই খুনের সঙ্গে জড়িত? জানেন, আমি পুলিশ ডাকতে পারি?’
দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘পুলিশ তো আমাদের সঙ্গেই আছে শিবরতনবাবু। আর আপনার ছেলে যদি জড়িত না-ই হবে, তাহলে বৃন্দাকে বরাকরে পাঠিয়েছেন কেন?’
বলামাত্র পুষ্পলতা হঠাৎ গলার মধ্যে একটা বিকট শব্দ করে উঠলেন। আর শিবরতন তাঁর থপথপে শরীরটা অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় সোজা দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘দিস ইজ ইনসাল্ট! আমি মানহানির মোকদ্দমা করব, আপনাদের জেল খাটাব, হ্যাঁ!’
দময়ন্তী নির্বিকার মুখে বলল, ‘আমরা কাল ব্ল্যাক ডায়মন্ডে বরাকর যাচ্ছি। ছ-টা দশে ছাড়বে। তার আগে কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোবেন না, তাহলে এই এঁরা, মানে পুলিশ, খামোখা ঝঞ্ঝাট বাধাবেন।’
শিবরতনের কানে শেষ কথাগুলো গেল বলে মনে হল না। কারণ তিনি তখন দু-চোখ বন্ধ করে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছেন, ‘গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট—’
.
বাড়ি থেকে বেরিয়েই শিবেন বলল, ‘এখানকার থানায় একটা খবর দিয়ে যাই? শিবরতনকে সস্ত্রীক আটকে দিক।’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, তার দরকার হবে না।’
‘শুচিস্মিতার সঙ্গে সাত্যকির ব্যাপারটা ধরলেন কী করে?’
‘অনুমান। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে যেসব যুক্তি আছে, সেগুলো এখন না, পরে বলব।’
‘আর বৃন্দা?’
‘সেও অনুমান। হ্যাঁ, ভালো কথা, এখান থেকে বরাকরে যোগাযোগ করা সম্ভব?’
‘সম্ভব। কী করতে হবে?’
‘আজ রাত্রি থেকে রামানুজ লাহিড়ীর বাড়ি থেকে যারা বেরোবে, তাদের যেন সযত্নে অনুসরণ করা হয়। তারা কোথায় গেল, কার সঙ্গে দেখা করল, তার সমস্ত রিপোর্ট কাল সকালে আমাদের চাই। আর কোনো একটা ইঙ্গিতে চট করে বাড়ি ঘেরাও করার বন্দোবস্তও যেন থাকে।’
শিবেন গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘তাই হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কী হচ্ছে এখনও বুঝতে পারছি না।’
দময়ন্তী গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি পারছি। সন্দেহ বিশেষ কিছু আর নেই। কেবল কাল বরাকর না যাওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ বোধ হয় হতে পারব না।’
.
৬
বরাকর স্টেশনের বাইরে একপাশে সাইকেল রিকশা আর কয়েকটা গাড়ির মাঝখানে ট্রাউজার্স আর বুশশার্ট পরা যে দীর্ঘদেহী অল্পবয়সি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন, শিবেন তাঁর সঙ্গে দময়ন্তী আর সমরেশের পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, ‘এ হচ্ছে ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, এখানকার ওসি। খুব বুদ্ধিমান, কর্মঠ ছেলে। কী হে ইন্দ্রজিৎ, যেমন যেমন বলেছিলুম, সব তেমনি হয়েছে তো?’
ইন্দ্রজিৎ একটু বুকটা চিতিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার! সব ঠিক আছে। রিপোর্টটা কি এখুনি দেব স্যার? না, থানায় গিয়ে নেবেন?’
দময়ন্তী বলল, ‘থানায় আর যাব না, আপনি এখানেই বলুন।’
ইন্দ্রজিৎ একটু চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘বেশ, সংক্ষেপে বলে নিচ্ছি। কাল সন্ধেবেলা আমাদের খবর পাওয়ার পর থেকে আর এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তা হল এক, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, খুব সম্ভব মিসেস লাহিড়ীর বাবা, রাত্রের ট্রেনে লাহিড়ী বাড়িতে এসেছেন। তিনি আজ মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন, বাজার করে ফিরেছেন। দুই, একজন সন্দেহজনক চেহারার ভদ্রলোক একটা ফিয়াট গাড়িতে আজ দশটা নাগাদ এসে পৌঁছেছেন। আমি স্টেশনে রওনা হওয়া পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরোননি। তাঁকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। তিন, মিসেস লাহিড়ী কাল রাত্রে একবার বেরিয়েছিলেন, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।’
‘লাহিড়ী বাড়িতে রামানুজ লাহিড়ী আর তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কে কে থাকেন?’
‘থাকেন মিস্টার লাহিড়ীর মা, বৃদ্ধা মহিলা। আর একটি আশ্রিতা মেয়ে— বছর বারো বয়েস— নাম বোধ হয় ইরা।’
‘আর?’
‘আর তিনজন ঝি, চাকর, রান্নার লোক ইত্যাদি।’
‘তাদের ওপর নজর রাখেননি?’
ইন্দ্রজিতের ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। বললেন, ‘না। তারা সকলেই পুরোনো লোক, স্থানীয় লোক আর এখানকার সকলেরই পরিচিত। সেইজন্যে…’
‘না, না, ঠিক আছে। বাড়ি ঘেরাও করার ব্যবস্থা করেছেন?’
‘হ্যাঁ। আমাদের লোক চারদিকেই আছে। ভোর থেকে ”বংশীধর”, এই আওয়াজ পেলেই বাড়ি ঘিরে ফেলা হবে। মনে রাখবেন, বংশীধর।’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, চিচিং ফাঁক আর বংশীধরের মধ্যে যেন গুলিয়ে ফেলো না।’
সমরেশের কথা শেষ হতে-না-হতেই শিবেন ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে দময়ন্তীকে বলল, ‘দেখুন, দেখুন, কে রিকশাতে উঠছেন।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘দেখেছি, পাঞ্চালী ভট্টাচার্য। চলুন, আমরাও যাই। আপনি কি গাড়ি এনেছেন ইন্দ্রজিৎবাবু?’
ইন্দ্রজিৎ মাথা নেড়ে একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ির দিকে আঙুল দেখাল। সেদিকে যেতে যেতে সমরেশ বলল, ‘কী করে যে কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতাপ চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রায় সকলেই দেখছি আজ এখানে।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। শিবরতনবাবুরাও আসবেন, তবে একটু পরে। বর্ধমান পর্যন্ত লোকালে এসে বাকিটা বাসে।’
.
লাহিড়ীদের বাড়িটা বরাকরের ঘিঞ্জি বাজার এলাকাতে হলেও, অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় একটু স্বতন্ত্র। প্রথমত, বাড়িটার চারদিকে বেশ কিছু জমি আছে। দ্বিতীয়ত, বাড়িটা, খুব মজবুত আর খুব পুরোনো— যদিও এখন হতশ্রী অবস্থা আর তৃতীয়ত, একতলা কটেজ টাইপের বাড়ি, চারদিকের ন্যাড়া কুদর্শন তিন-চারতলা বাড়িগুলোর মতো নয়। ইন্দ্রজিৎ ঘোষের গাড়ি যখন লাহিড়ী বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ভেতরে জমির ওপর একটা নীল রঙের ফিয়াট দণ্ডায়মান দেখা গেল, যদিও কোনো জনমনিষ্যি দেখা গেল না। ইন্দ্রজিৎ সমরেশদের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল, তবে বলা বাহুল্য, বেশি দূরে নয়।
শিবেন গেট খুলে সকলকে নিয়ে একটু ভেতরে যেতেই সদর দরজা দিয়ে সাত্যকি সান্যালকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। সাত্যকি অত্যন্ত অন্যমনস্ক এবং চিন্তিত ছিলেন যে কারণে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে তবেই নবাগত অতিথিদের দেখতে পেলেন। আর দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন, ‘আরে, এ কী, আপনারা! ছোটোমামা যে বললেন, আপনারা আগামী শনিবারে বরাকরে আসছেন?’
শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, সেইরকমই কথা ছিল প্রথমে। বিশেষ কারণে প্ল্যানটা চেঞ্জ করতে হল।’
সাত্যকি আবার চমকে উঠলেন, ‘বিশেষ কারণ? অ্যাঁ? কী বিশেষ কারণ?’
‘সেটা একটু পরেই জানতে পারবেন। আপাতত, ভেতরে তো চলুন।’
‘ভেতরে? ইয়ে, না, আমি তো এখন কলকাতা যাচ্ছি।’
‘একটু পরে যাবেন। আমরাও ফিরব, একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।’
‘অ্যাঁ, তার মানে? আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন?’
‘না, এখনও করছি না। কিন্তু যদি সরে পড়ার তালে থাকেন, তাহলে করব।’
‘সরে পড়া? না, না, সরে পড়ব কেন? বেশ তো চলুন, ভেতরে যাওয়া যাক।’
বলে উনি পেছন ফিরতে-না-ফিরতেই বাড়ির ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন সুশীলবাবু। তাঁর মুখ লাল, চোখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি।
ভদ্রলোক হয়তো তাঁর ভাগনেকে কিছু বলতেন, কিন্তু তার পেছনে অন্য তিনজনকে দেখে থমকে গেলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এ কী! আপনারা?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, চলে আসতে হল। ভেতরে যেতে পারি?’
সুশীলবাবু ইতস্তত করে বললেন, ‘বাড়ি তো আমার নয়, আমি অনুমতি দেবার কে?’
‘তাহলে বাড়ির লোকদেরই একটু ডেকে দিন না।’
সুশীলবাবু এবারেও একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘হ্যাঁ, ডেকে তো দেব। কিন্তু…’
‘কী হয়েছে? শুচিস্মিতা কি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে?’
দময়ন্তীর প্রশ্ন শুনে সুশীলবাবু আর তাঁর ভাগনে দু-জনেই চমকে উঠলেন। প্রায় একইসঙ্গে বললেন, ‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘সেটা পরে বলব। তবে শুচিস্মিতা কেন উত্তেজিত হয়ে পড়েছে বা কান্নাকাটি করছে, তা তো আপনি জানেন সুশীলবাবু?’
সুশীল মাথা নাড়লেন, ‘না, তবে…’
‘তবে আজ সকালে সাত্যকিবাবুর সঙ্গে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটির পর হয়েছে, তাই না? কী নিয়ে কথা হয়েছিল, তা কি আপনি জানেন?’
সুশীল আবার মাথা নাড়লেন, ‘না।’
‘আপনার জামাইকে একবার ডাকবেন?’
‘সে তো দেখে এলুম শুচিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। যা হোক, তবু ডাকছি।’ বলে ভেতরে চলে গেলেন।
দময়ন্তী সাত্যকিকে জিজ্ঞেস করল, ‘সুশীলবাবু তাঁর জামাইকে খুব ভয় পান, তাই না?’
সাত্যকি বিকৃত মুখে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ। রামানুজ আগে অভদ্র ছিল, ইদানীং অসভ্য হয়ে গেছে। যাকে যা খুশি তাই মুখের ওপর বলে দেয়।’
‘কিন্তু আপনার সঙ্গে গত দু-বছর বোধ হয় কখনো অভদ্র বা অসভ্য ব্যবহার করেননি, তাই না?’
বিস্ময়ে সাত্যকির মুখ হাঁ হয়ে গেল। বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু…’
সাত্যকির কথা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ির সামনে একটা সাইকেল রিকশা এসে থামল। নামলেন মিসেস পাঞ্চালী ভট্টাচার্য। গেট খুলে ভেতরে ঢুকেই দময়ন্তীকে দেখে কিছু আশ্চর্য হয়ে এবং কিছুটা অসন্তোষে মুখ বিকৃত করলেন। বললেন, ‘এ কী? আপনি এখানে, আজ?’
দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘আমার এখানে আসাটা তো কোনো অদ্ভুত ঘটনা নয় মিসেস ভট্টাচার্য, বরং আপনার আসাটাই অদ্ভুত, তাই না? ভাইপোর শালির শ্বশুরবাড়িতে, কলকাতা থেকে এত দূরে…’
পাঞ্চালী গোমড়া মুখ করে বললেন, ‘রামানুজ খোকার ভায়রা বটে, তবে আমার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। আমি এদের খোকার বিয়ের আগে থেকেই চিনি।’
‘তবে, খোকার বিয়ের পর থেকে আর এখানে আসেননি বোধ হয়?’
‘না।’
‘তারপর এই এলেন?’
‘হ্যাঁ। অ্যাঁ? কী বলতে চান আপনি?’
‘তেমন কিছুই না। তবে, আপনার চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। এটা তো বোঝাই যাচ্ছে, আপনি রামানুজবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। এসেছেন সুশীলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। কাল আমরা চলে আসার পর আপনার খেয়াল হয়েছে যে আপনি আমাকে কিছু সত্যি কথা না বলে চেপে গেছেন যা পরে প্রকাশিত হয়ে পড়তে পারে। তখন সুশীলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখেন যে তিনি এখানে চলে এসেছেন। তাই আজ সকালে ট্রেন ধরে আপনিও চলে এসেছেন।’
পাঞ্চালী ততক্ষণে অনেকটা সামলেছেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘আপনার অনুমান অনেকটাই ঠিক। তবে কোন কথাটা চেপে গেছি, সেটাও কি অনুমান করতে পারেন?’
‘পারি। বেশ কয়েকটা পারি! তার মধ্যে একটা হচ্ছে, যেটা আপনি এখুনি বললেন, প্রতাপবাবুর বিয়ের আগে থেকেই রামানুজবাবুর পরিবারের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল।’
দময়ন্তীর কথার মধ্যেই সুশীলবাবু সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর মুখ চিন্তিত, বিমর্ষ। তাঁর দীর্ঘ শরীরটা অল্প সামনে ঝুঁকে পড়েছে। দময়ন্তীর শেষ ক-টি কথা শুনে বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, পরিচয় ছিল। এই বাড়ির এই লনেই প্রতাপের সঙ্গে দীপুর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে পাঞ্চালীও উপস্থিত ছিল বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি হিসেবে।’
পাঞ্চালী একটা যুদ্ধং দেহি ভাব করে বললেন, ‘হ্যাঁ, ছিলুম। তাতে কী হয়েছে?’
দময়ন্তী বলল, ‘হয়নি কিছুই। তবে, এটা সংবাদ। কী সুশীলবাবু, আপনার জামাই কি আমাদের বাড়ির ভেতরে যাবার অনুমতি দিয়েছেন?’
সুশীলবাবু মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না। যদি সার্চ ওয়ারেন্ট এনে থাকেন তাহলেই ঢুকতে পারেন, তা নইলে নয়। আর উকিলের উপস্থিতি ছাড়া রামানুজ আপনার সঙ্গে কথা বলতে বা আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নয়।’
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি এইরকমই আশা করেছিলুম। শিবেনবাবু, বংশীধরকে একবার বলবেন সার্চ ওয়ারেন্টটা নিয়ে আসতে?’
শিবেন সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই।’ বলে গেটের কাছে গিয়ে হেঁড়ে গলায়, ‘বংশীধর! বংশীধর!’ করে চিৎকার করতে লাগল।
পাঞ্চালী আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘বংশীধর কে?’
দময়ন্তী বলল, ‘একজন কনস্টেবল। তার কাছেই ওয়ারেন্টটা আছে।’ বলতে বলতে থেমে গেল। কারণ তখন সদর দরজায় একটি নারীমূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে যাকে দেখলে কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকতে হয়, কথা বলা যায় না। মেয়েটির বয়েস বছর ছাব্বিশ, অসাধারণ সুন্দরী কিন্তু এমন একটি স্নিগ্ধ অথচ গম্ভীর ব্যক্তিত্ব আছে যে তাকে দেখলে শিস দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয় না। তবে, তার কটা চুল আপাতত অবিন্যস্ত, চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ফুলে আছে, মনে হয় একটু আগেই কান্নাকাটি হচ্ছিল বা শরীর কোনো কারণে অসুস্থ।
মেয়েটি সামান্য ভাঙা গলায় বলল, ‘আপনার কনস্টেবল ডাকার কোনো দরকার নেই। আপনারা ভেতরে আসুন। কী দেখতে চান, দেখে যান।’
সুশীলবাবু একটু লজ্জিতভাবে বললেন, ‘কিন্তু শুচি, রামানুজ বারণ করেছিল যে…’
শুচি অধৈর্যভাবে বলে উঠল, ‘করুক বারণ। ওয়ারেন্ট দেখিয়ে বাড়ি সার্চ হবে, আত্মসম্মানের তাহলে আর থাকবে কী? সবই তো গেছে, এটুকু অন্তত থাক। প্রতাপ আর দীপুর ঝগড়া হবে আর জগদীশ লাহিড়ীর ভদ্রাসন পুলিশ সার্চ করবে! এই তো তোমার ইচ্ছে? তাই হোক।’
সুশীলবাবু ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়লেন। ব্যাকুলভাবে বললেন, ‘আহা, শুচি, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।’
‘না, আমি কিছুই ভুল বুঝছি না, বাবা। এই মহিলাকে অ্যাপয়েন্ট করেছ কেন তুমি? কী জানতে চাও তুমি এঁর কাছে, যা তুমি অলরেডি জান না? আসলে, প্রতাপের মৃত্যুর দায় তুমি নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাও। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, প্রতাপের মৃত্যুর জন্যে একমাত্র দায়ী তুমি, আর কেউ নয়। এখন দেখো, এই মহিলা তোমার অপরাধ কতটা স্খালন করতে পারেন। এই যে, আপনারা ভেতরে আসুন। দেখে যান, কী দেখতে চান।’
শুচিস্মিতার বাক্যবাণে সুশীলবাবু থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়লেন। সাত্যকিকেও বেশ চঞ্চল বলে মনে হল। কিন্তু দময়ন্তীর মধ্যে কোনো বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা গেল না। স্থির দৃষ্টিতে শুচিস্মিতার দিকে তাকিয়ে অবিচল গলায় বলল, ‘এতটার কোনো দরকার ছিল না, মিসেস লাহিড়ী। অবশ্য আপনার মানসিক অবস্থা বিশেষ ভালো নয়, বিশেষত আজ সকালে সাত্যকিবাবু আপনাকে যা বলেছেন, তারপর…’
শুচিস্মিতা প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘সাত্যকিদা কী বলেছে, আপনি জানেন?’
সাত্যকি দু-হাত তুলে লাফিয়ে উঠলেন, ‘না, না, শুচি, উনি কিচ্ছু জানেন না। অনুমান করেছেন।’
একটা প্রাণঘাতী বিষাক্ত দৃষ্টিতে সাত্যকিকে স্তব্ধ করে দিয়ে শুচিস্মিতা হিস হিস করে উঠল, ‘তুমি চুপ করে থাকো, কোনো কথা বোলো না। বেশি কথা বললে তোমার কী দশা হবে, তা তুমি ভালো করেই জান। মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনারা ভেতরে আসুন!’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘দেখুন, আপনি কিন্তু গোড়াতেই একটা ভুল করছেন। আমরা ঠিক আপনার বাড়ি সার্চ করবার জন্যে আসিনি। তবে কিছু একটা খুঁজতে এসেছি তো বটেই, আর তা হল প্রতাপ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে সত্যটা আছে, সেইটে। সেজন্যে আপনার শ্বশুরবাড়ির আলমারি বা সিন্দুক ঘাঁটা প্রয়োজন নয়, প্রয়োজন আপনাদের সঙ্গে কথা বলা।’
দময়ন্তীর কথায় শুচিস্মিতা একটু শান্ত হয়ে এল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বেশ, কথা বলতে চান, বলব। তবে আমার স্বামী বসবেন না।’
‘তার দরকারও হবে না। তাঁর কাছ থেকে আমাদের আর বিশেষ কিছু জানবারও নেই। যেটুকু আছে, সেটুকু হয়তো এমনিতেই জানা যাবে। তাহলে, আমাদের আর ভেতরে যাবার দরকার কী, এখানেই ছায়ায় বসা যাক।’
.
সদর দরজার সামনে সিঁড়ির ধাপের ওপর সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসল। শুচিস্মিতা বলল, ‘আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তবে আমি জবাব দেব কি না বলতে পারি না।’
দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘আপনার বোনের শাস্তি হোক, আপনার সুখশান্তি রসাতলে যাক, এই যদি আপনার কাম্য হয়, আপনি জবাব দেবেন না। তবে, সত্য গোপন করলে কেবল আইনের কাছে নয়, নিজের কাছেও যে ছোটো হয়ে যাবেন মিসেস লাহিড়ী। কারণ যে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র আপনার বোনকে বলি দিয়েছে, তা হয়তো আপনাকেও দেবে, শারীরিকভাবে কতটা জানি না, মানসিকভাবে তো বটেই।’
শুচিস্মিতা বলল, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি যে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি তা নয়, তবে খানিকটা বোধ হয় পেরেছি। ঠিক আছে, আপনি প্রশ্ন করুন।’
দময়ন্তী একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘বৃন্দার যে একটা ক্রিমিনাল অতীত জীবন আছে, তা আপনি জানেন?’
শুচিস্মিতা এই প্রশ্নে একটু চমকে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, জানি। পুষ্প পিসির কাছে কাজ করতে এসে ও শুধরে যায়। পিসিই ওর বিয়ে দেন।’
‘সে অনেক দিন। বছর চোদ্দো-পনেরো তো বটেই।’
দময়ন্তী হঠাৎ সাত্যকির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘বৃন্দা আর আপনি তো সমবয়সি, তাই না? শুনেছি, এখন তার বয়েস বত্রিশ আর আপনার তেত্রিশ।’
সাত্যকি ভীত গলায় বললেন, ‘অ্যাঁ, হ্যাঁ, মানে, তা হতে পারে।’
‘হুঁ, তা হতে পারে। আচ্ছা মিসেস লাহিড়ী, আপনাদের বাড়িতে বছর বারো বয়েসের ইরা নামে একটি আশ্রিতা মেয়ে আছে। সে বৃন্দার মেয়ে, তাই না?’
শুচিস্মিতা মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, তবে একথাটা তার কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে। সে জানে, সে লাহিড়ীদেরই এক অনাথ আত্মীয়। বড়ো ভালো মেয়েটি। তাকে যেন আবার এসবের মধ্যে টেনে আনবেন না।’
‘আপনার স্বামী খুব লেখাপড়া করেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, করেন।’
দময়ন্তী আর প্রশ্ন করল না, চুপ করে রইল। শুচিস্মিতা বলল, ‘আর কিছু?’
‘না, আর কিছু নয়।’
শিবেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আপনার কিছু জানবার বাকি নেই?’
‘না শিবেনবাবু, সবই জানা হয়ে গেছে। মাঝখানে কয়েকটা জায়গায় ফাঁক ছিল। আজ বরাকরে এসে সেসব ফাঁকও আর রইল না।’
সুশীলবাবু সংশয় আর দ্বিধা জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘দীপু কি নির্দোষ, মিসেস দত্তগুপ্ত?’
দময়ন্তী ম্লান হাসল। বলল, ‘নির্দোষ? না, নির্দোষ সে নয়। আপনারা তাকে খেলার পুতুলের মতো নাচিয়েছেন আর সে নেচেছে। তার দোষটা এখানেই।’
সুশীলবাবু কেটে কেটে প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা! তার মানে?’
দময়ন্তী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, শিবেন বাধা দিল। বলল, ‘না, এভাবে নয়, বউদি। আপনি গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। যে ছবি আপনার কাছে পরিষ্কার, আমাদের কাছে তা নয়। আমরা সবটা ভালো করে বুঝতে চাই। অবশ্য, যদি কোনো অসুবিধে না থাকে।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, আমার আর অসুবিধে কীসের? অসুবিধে হতে পারে এঁদের যাঁরা সবাই মিলে স্বার্থের খাতিরে হোক, আত্মসম্মানের খাতিরে হোক, মানসিক বিকৃতির জন্যে হোক, দুটি নির্বোধ ছেলেমেয়েকে চূড়ান্ত সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। সব কিছু বুঝেও বোঝেননি, দেখেও দেখেননি। যে হীন চক্রান্তের কথা আমাকে এবার বলতে হবে, এঁরা কেউই সেটা জানেন না, কারণ তাঁরা সেটা জানতে চাননি।’
সুশীলবাবু কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি বলুন মিসেস দত্তগুপ্ত। আমরা সবাই শুনব।’
.
দময়ন্তী শুরু করল, ‘সুশীলবাবু যখন আমার কাছে আসেন, তখন তাঁর কথায় আমার প্রথমে মনে হয়েছিল যে এটা একটা অতি সাধারণ ঘটনা। স্বামী দুশ্চরিত্র, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না অথচ শ্বশুরের পয়সার প্রতি এতই লোভ যে তাঁর বাড়ি ছেড়েও যায় না। কাজেই খণ্ডিতা নায়িকা স্ত্রীর মনে জিঘাংসা জাগতেই পারে। তারই পরিণতি এই খুন, অর্থাৎ পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সমাজের কাছে এহেন পতিঘাতিনী সতী সহানুভূতি পেতে পারে, আইনের কাছে পায় না।
কিন্তু সমস্ত ঘটনা শোনার পর কয়েকটা জায়গায় খটকা লাগল। প্রথমত, পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড যদি হবে, তাহলে গুলি করে মারার কী দরকার ছিল? এসব ক্ষেত্রে তো মেয়েরা সাধারণত বিষ দিয়ে থাকে। অথচ দীপান্বিতা এমনভাবে তার স্বামীকে মেরেছে, যেন সেটা একটা গ্রেভ অ্যান্ড সাডন প্রোভোকেশন থেকে করা। এই গ্রেভ অ্যান্ড সাডন প্রোভোকেশন প্রমাণ করতে পারলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যাকারী ছাড়া পেয়ে যায়। তবে কি, এটা দীপান্বিতা সাজিয়ে-গুজিয়ে করেছে? গুলি করে মেরে, হইচই করে, আত্মরক্ষার জন্যে মেরেছি বলে, আইনের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা?
তাই যদি হয়, তবে ধরে নিতে হয় যে এটা একটা অনেক ভেবেচিন্তে তৈরি করা ষড়যন্ত্র। তাহলে দীপান্বিতা আত্মরক্ষার জন্যে মেরেছি বলে এমন নির্বোধের মতো একটা কথা বলল কেন যে প্রতাপের পকেটে অস্ত্র আছে? আসলে প্রতাপের পকেটে ছিল একটা নকল হিরের আংটি। অথচ, দীপান্বিতা এতই নিশ্চিত যে সেই আংটির কথা শোনামাত্র সে তার বাবাকে দোষারোপ করে সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দিল। এরকম হল কেন? যে এমন সুন্দর একটা ষড়যন্ত্র করতে পারে, সে কি এতটা বোকা হতে পারে?
এক্ষেত্রে স্বভাবতই মনে হতে পারে যে দীপান্বিতা যা বলছে তার মধ্যে কিছুটা সত্য থাকলেও থাকতে পারে। একথা তো ঠিকই যে, যে প্রতাপ তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না, সেদিন সে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে তার ঘরে গিয়েছিল। হয়তো দীপান্বিতা তার চোখে-মুখে এমন কিছু দেখেছিল যে সত্যি সত্যিই আত্মরক্ষার জন্যেই সে গুলি চালায়।
এখানে দ্বিতীয় প্রশ্ন। সেদিন যে প্রতাপ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরবে, সেকথা দীপান্বিতা জানল কী করে? এ প্রশ্নটা জরুরি, কারণ সুশীলবাবুর কথায় আমরা জেনেছি, দীপান্বিতা নীচে বসার ঘরে তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে হঠাৎ উঠে ওপরে চলে যায়, তার একটু পরেই আসে প্রতাপ, আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যায়। যেন দীপান্বিতা আগেই তৈরি হয়ে ছিল, যাতে প্রতাপ আসামাত্র গুলি করতে পারে। এটা কী করে সম্ভব হল? তাকে কেউ খবর দেয়নি, দিলে সুশীলবাবু সেকথা জানতেন। প্রতাপ অফিস থেকে সোজা ফিরলে বসার ঘরের সামনে দিয়ে আসত না, কাজেই দীপান্বিতার পক্ষে তাকে দেখা সম্ভব হত না। তাহলে একটিমাত্র সম্ভাবনা— সে প্রতাপকে রাস্তা পার হয়ে আসতে দেখেছিল। সুশীলবাবু জানলার দিকে পেছন করে বসেছিলেন বলে তাকে দেখতে পাননি।
এদিকে সুশীলবাবুর কথায় জানতে পারছি যে বেশ কিছুদিন যাবৎ দীপান্বিতা উদবিগ্ন হয়ে ছিল। সে ছটফট করত, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত। অথচ, যদি তার প্রতাপকেই ভয় ছিল, তাহলে তো সে তার ব্যালকনি থেকেই তার গতিবিধির ওপর যথেচ্ছ নজর রাখতে পারত। আর অফিস থেকে তো প্রতাপ রোজই বাড়ি ফিরছে, সেদিনই গুলি করতে হল কেন? সেদিন এমন কী ঘটেছিল, যা অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক?
তিনটে ঘটনা। প্রথম, প্রতাপের তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোনো। দ্বিতীয়, বাড়ি আসতে যে সময় লাগার কথা, তার চেয়ে কুড়ি মিনিট বাদে রাস্তার উলটো দিক দিয়ে আসা। তৃতীয়, প্রতাপের দীপান্বিতার ঘরে যাওয়া।
আমি তৃতীয় ঘটনাটা নিয়ে আগে আলোচনা করছি। প্রতাপ দীপান্বিতার ঘরে সেদিনই গিয়েছিল কেন? তার পকেটে একটা আংটি দেখে আমরা সকলেই ধরে নিয়েছি যে তার উদ্দেশ্য ছিল স্ত্রীর মানভঞ্জন। ভরদুপুরবেলা? লাঞ্চের আগে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে? কুড়ি মিনিটে একটা নকল হিরের দু-টাকা দামের আংটি কিনে? অবিশ্বাস্য, হাস্যকর, অসম্ভব ব্যাপার। আসলে, প্রতাপ তার স্ত্রীর ঘরে গিয়েছিল তাকে শাসাতে, ভয় দেখাতে বা অপমান করতে। কারণ, সেই আংটি! প্রতাপ তার স্ত্রীকে সন্দেহ করত, এটা আমরা জানি। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না যে সেই আংটিটা কোনোভাবে সেই সন্দেহসঞ্জাত ঈর্ষাকে প্রবলভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল। তাই ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত, হয়তো-বা রক্তচক্ষু স্বামী গিয়েছিল স্ত্রীর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে।
আমার অনুমান যে মিথ্যে নয়, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ প্রতাপের মৃতদেহের অবস্থান। দীপান্বিতা যখন তাকে গুলি করে তখন সে ঘরের অনেকটা ভেতরে চলে এসেছে। সে মানভঞ্জন করার উদ্দেশ্যে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে বলতে গুটিগুটি ভেতরে আসেনি, কারণ যে সময়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে, তার মধ্যে অত সবের সুযোগ ছিল না। সে ঢুকেছিল হুড়মুড় করতে করতে, উত্তেজনায় অধীর হয়ে। কিন্তু কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি বলেই আমার ধারণা। পকেট থেকে আংটিটা পর্যন্ত বের করতে পারেনি।
এবার দ্বিতীয় ঘটনা। হঠাৎ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কুড়ি মিনিট ধরে রাস্তার ওপারে কী করছিল প্রতাপ? চুল কাটছিল না নিশ্চয়ই। আংটি কিনতে গিয়েছিল? অসম্ভব। মিষ্টির দোকানে মিষ্টিও খাচ্ছিল না। তবে? বাকি রইল পোস্ট অফিস। এতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে প্রতাপ সেখানে গিয়েছিল আংটিটা নিতে। কেউ তাকে খবর দিয়েছিল যে সেদিনই তার স্ত্রীর নামে একটা হিরের আংটি এসেছে— সেটা পোস্টমাস্টারও হতে পারেন, অন্য কেউও হতে পারে। প্রতাপ আংটি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ওটা যে নকল হিরে সেটা বুঝতেও পারে না। তার পরেই ছোটে বাড়ির দিকে দীপান্বিতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। এটা থেকে এও বোঝা যায় যে কেন সে সেদিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।’
সমরেশ বলল, ‘তার মানে, আংটিটা একটা টোপ? কেউ দীপান্বিতার নামে আংটি পাঠিয়ে প্রতাপকেও খবর দিয়ে রেখেছিল যাতে সে খেপে ওঠে?’
‘ঠিক তাই। সেইসঙ্গে দীপান্বিতাকেও জানিয়ে রেখেছিল যে প্রতাপের নামে হয়তো বিদেশ থেকে ডাক মারফত একটা অস্ত্র আসছে। সেটা পেলেই সে দীপান্বিতাকে আর তার বাবাকে খুন করে বসবে। কাজেই পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে রক্তচক্ষু প্রতাপকে বাড়িতে আসতে দেখে এবং প্রথমেই হুড়মুড় করে তার ঘরে ঢুকে পড়তে দেখে, দীপান্বিতা আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালায়। প্রতাপের পকেটে সত্যি সত্যি কী আছে সেটা যাচাই করার তার সময় ছিল না। তবে পুরো কাজটাই গ্রেভ অ্যান্ড সাডন প্রোভোকেশনেই করা, কিন্তু যিনি অন্তরালে থেকে এই প্রোভোকেশনটি সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন যে এটা কোনোমতেই আদালতে প্রমাণ করা যাবে না। দীপান্বিতার ফাঁসি না হোক, দীর্ঘদিনের কারাবাস হবেই। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
অতএব এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই হত্যাকাণ্ড একটা নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের ফল যার সঙ্গে হত্যাকারী বা নিহত কেউই জড়িত ছিল না। তাদের খেলানো হয়েছিল এবং তারা খেলেছিল। আর কী মর্মান্তিক সে-খেলা! এ ঘটনার দু-বছর আগে থেকে তারা যে দুঃখ এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে প্রতিটি দিন কাটিয়েছে, তা আমাদের পক্ষে বোধ হয় চিন্তা করাও কঠিন।
সুশীলবাবু যেদিন প্রথম আমার কাছে আসেন, তিনি আমাকে দুটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে দিতে বলেছিলেন— এক, দীপু আর প্রতাপের মধ্যে ঝগড়া হল কেন এবং দুই, কেন প্রতাপ মিটমাট করবার চেষ্টা করল না। জানেন সুশীলবাবু, এই দুই জবাবের মধ্যেই ষড়যন্ত্রের প্রথম আভাসটা পাওয়া যায়? অথচ আপনি কি সত্যিই এই জবাব জানতেন না? দীপু আপনাকে কখনোই কিছু বলেনি?’
সুশীলবাবু নতমস্তকে চুপ করে রইলেন। দময়ন্তী বলে চলল, ‘আমার বিশ্বাস, আপনি জানতেন। তবে, যদি আপনি কিছু না বলেন, তাতেও কিছু যায় আসে না, যখন এই দুটি জবাব আমি জানি। এবং এই দুটি জবাবই আসলে এক— দু-জনের প্রত্যেকেই একেবারে স্থিরনিশ্চিত হয়ে ছিল যে অপরজন ঘোরতর দুশ্চরিত্র, বিশ্বাসঘাতক, শয়তান। মজার ব্যাপার, দু-জনেরই বিশ্বাস ছিল একেবারে ভ্রান্ত। এবং এই ভ্রান্ত ধারণা তাদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ক্লাইম্যাক্সটা যেরকম প্ল্যান করা হয়েছিল সেরকমই হয়।
কিন্তু কীসের জন্যে এরকম সন্দেহ? দীপান্বিতা সন্দেহ করত তার স্বামী কেবল দুশ্চরিত্র নয়, বিকৃত মানসিকতার শিকার। এই সন্দেহ সে সাত্যকিবাবুর কাছে প্রকাশ করেছিল; সাত্যকিবাবু সেকথা তার মন থেকে দূর করবার চেষ্টা না করে বরং তাতে সায় দিয়েছিলেন এবং কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে জেনেও নিজেই সেটা জোর করে নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন। আমি কি কিছু ভুল বলছি, সাত্যকিবাবু? বিকৃত মানসিকতা আপনার থাকতে পারে, কিন্তু প্রতাপের যে থাকতে পারে না তা আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানত না। তবুও আপনি দীপান্বিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেননি। আপনি ভেবেছিলেন, প্রতাপ যদি বাড়িতে অশান্তির জন্য কষ্ট পায় তো পাক। তাই না?’
সাত্যকি মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না। বিশ্বাস করুন, কথাটা যে মিথ্যে, আমি জানতুম না।’
‘আপনি জানতেন। এমনকী কোথা থেকে কথাটা উঠেছে, তাও আপনি জানতেন। কেন উঠেছে তাও আন্দাজ করেছিলেন, নইলে কাল সকালে আপনি আমাদের বাড়িতে আসতেন না।’
সমরেশ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, দীপান্বিতা কি ছেলেমানুষ যে, যে যা বোঝাবে সে তাই বুঝবে? তার কি নিজের বিচারবুদ্ধি নেই?’
‘আছে, আর আছে বলেই গণ্ডগোল। অন্ধ পতিভক্তি তার ছিল না, থাকার কথাও নয়। থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। আসলে তার বিচারবুদ্ধিটা সযত্নে ভুল পথে পরিচালনা করা হয়েছিল। ধরো, দীপান্বিতা তোমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তুমি প্রথমে তাকে বললে যে প্রতাপ বদমাশ লোক। সে বিশ্বাস করল না। তার পরেও কয়েকবার বললে। সে তোমাকে ভক্তি করে বলেই এবার কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না। এইবার তুমি তাকে একটা প্রমাণ দেখালে যেটা একভাবে ব্যাখ্যা করলে তোমার কথা যে অকাট্য তা প্রমাণ হয়। অন্যভাবে করলে তোমার কথাটা মিথ্যে হয়ে যায়। তুমি দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা চেপে গিয়ে প্রথমটাই নানাভাবে নানা অ্যাঙ্গলে দেখালে। তখন কী হবে? দীপান্বিতা সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হবে, তাই না? তার ওপর সে বাপের আদুরে মেয়ে। একবার খেপে গেলে তাকে ফেরানো শক্ত। আর সেইটাই তো আশা করা হয়েছিল।’
হঠাৎ শিবেন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বুঝেছি। দীপান্বিতাকে বোঝানো হয়েছিল যে প্রতাপের সঙ্গে তার মাসির প্রেম আছে। আর তার প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল মিসেস ভট্টাচার্যর আঁকা প্রতাপের ন্যুড ছবিটা। ইয়া আল্লা, আর সাত্যকিবাবু সেটাই আমাদের বলবার চেষ্টা করছিলেন!’ বলে রক্তচক্ষু করে সাত্যকির দিকে তাকাল।
সমরেশ বলল, ‘কিন্তু সে-ছবি তো দীপান্বিতা বিয়ের পরে দেখেছে নিশ্চয়ই।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, সম্ভবত দেখেনি। কারণ পাঞ্চালী তখন থাকতেন শ্বশুরবাড়িতে। সেই বিশাল বাড়িতে এখনকার ছোটো বাড়ির মতো সব কিছু তো একজায়গায় নয়। কাজেই পছন্দ না হওয়া বউকে তিনি সম্ভবত তাঁর স্টুডিয়োতে নিয়ে যাননি। আর গেলেও, সেই ছবি দেখলে দীপান্বিতার মনে সন্দেহ না জাগাই স্বাভাবিক, কারণ তখনও তো ষড়যন্ত্র শুরু হয়নি, তার মনে বিষ ঢোকানোও শুরু হয়নি। ছবিটার দিকে তার বিষাক্ত দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয় পরে কোনো আর্টের ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপা ফটোগ্রাফ দেখিয়ে।’
‘তুমি কী করে বুঝলে যে সাত্যকিবাবু জানতেন যে প্রতাপ দুশ্চরিত্র বা বিকৃত মনোবৃত্তিসম্পন্ন নয়? অনেক লোক আছেন যাঁরা বাইরে ভিজে বেড়ালটি সেজে থাকেন, ভেতরে ভেতরে হাড়বজ্জাত। প্রতাপ যে তা নয়, এটা সাত্যকিবাবু নিশ্চিত কীভাবে হতে পারেন?’
‘সাত্যকিবাবু আর প্রতাপ একসঙ্গে ছ-বছর কাজ করেছেন। সাত্যকিবাবু নিজে হাড়বজ্জাত, বহুদিন অসৎ জীবনযাপন করছেন। প্রতাপকে চিনতে তাঁর বেশিদিন লাগার কথা নয়। প্রতাপ যদি সত্যি সত্যি তাঁর মতন হত, তাহলে তাকে সরাবার জন্যে সাত্যকিবাবুকে দীপান্বিতার কথায় সায় দিতে হত না। প্রতাপের সামনে প্রলোভনের জাল বিছিয়ে অনেক দিন আগেই কাজ হাসিল করতেন। কম করে হলেও বয়েসে সাত্যকিবাবু প্রতাপের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, নিজের মাঠে খেলতে নেমে তাকে কবজা করা তো ছেলেখেলা। কিন্তু সাত্যকি তা পারেননি, তাঁকে ক্রমাগত ঝগড়া করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে, প্রতাপের শান্তি নষ্ট করতে তার স্ত্রীর মনের আগুনে পাখার বাতাস দিতে হয়েছে। কিন্তু এতসব কেন করতে হয়েছে?
আমরা জানি, সমস্ত বিদ্যা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দু-জনের সঙ্গে প্রতাপের বনত না— একজন এই সাত্যকিবাবু, অপরজন চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অক্ষয় সরকার। একজন কারখানার প্রোডাকশন দেখতেন, অপরজন টাকাপয়সা। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানকে ওপরে ওঠাতে বা নীচে ফেলতে এঁরা দু-জনে যতটা সক্ষম, ততটা আর কেউ নন। এঁদের সঙ্গে সৎ, কর্মী প্রতাপের কেন লেগেছিল, সে-ব্যাপারে খোঁজ নেবেন সুশীলবাবু, আমরা নয়। তবে, এঁরা দু-জন, বিশেষত সাত্যকি যে প্রতাপের চূড়ান্ত পতন দেখতে বা ঘটাতে আগ্রহী হলেন, তাতে সন্দেহ থাকে না। আমরা অনুমান করতে পারি, তার সত্যাসত্য যাচাই করবেন সুশীলবাবু, যে বিলিতি ইঞ্জিনিয়ার সাত্যকি সাহেবি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে মামার ফার্মে ঢুকেছিলেন সেটা পুরো কবজা করে নিজেই ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে বসার উদ্দেশ্যে। সুশীলবাবু সেকথা জানতেন, কিন্তু কোনোদিন এফেক্টিভলি বাধা দেননি, কারণ তাঁর ভয় ছিল সাত্যকি তাহলে তাঁর পারিবারিক কলঙ্কের কথা সমাজে ফাঁস করে দেবেন। অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজেকে ব্ল্যাকমেলের শিকার হতে দিয়েছিলেন। সেইজন্যেই নিজের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তিনি প্রতাপের সঙ্গে দীপান্বিতার বিয়ে দেন অথচ তাদের দু-জনকে সাত্যকির জন্যে মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে দেখেও চুপ করে থাকেন। যখন সব কিছু ঘটে গেল, তখন তিনি অনুশোচনায় সেই সংকোচের বাধা কাটিয়ে আমাদের কাছে এলেন। অথচ প্রথমেই যদি অ্যাকশন নিতেন, সাত্যকি এবং সম্ভবত অক্ষয়কে অর্ধচন্দ্র দিতেন, তাহলে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না। হয়তো এই নিষ্ঠুর চক্রান্ত সফল হতেও পারত না।’
দময়ন্তী একটু চুপ করতেই সাত্যকি বলে উঠলেন, ‘আপনি আমার নামে অনেক নিষ্ঠুর কথা বললেন মিসেস দত্তগুপ্ত, কিন্তু ঈশ্বর জানেন যে প্রতাপকে মারার জন্যে কোনোরকম ষড়যন্ত্র আমি কখনো করিনি।’
দময়ন্তী ফিকে হাসল। বলল, ‘ঈশ্বর পর্যন্ত যাবার দরকার নেই সাত্যকিবাবু, আমরাও জানি যে, যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তাতে আপনি পোঁ ধরেছেন কেবল, আসল বাজিয়ে আপনি না।’
শিবেন রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কী করে আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন?’
‘নিশ্চিত হচ্ছি এই কারণে যে প্রতাপের মনের মধ্যেও দীপান্বিতার সম্পর্কে তীব্র বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটা এই ভদ্রলোকের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই ব্যাপারটাও করা হয়েছিল ঠিক দীপান্বিতার মেথডেই। অর্থাৎ কোনো শ্রদ্ধেয় বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি তাঁর প্রতি প্রতাপের বিশ্বাসকে এক্সপ্লয়েট করেই এই কর্মটি করেছিলেন।’
‘দীপান্বিতার বেলায় তো ছিল প্রতাপের ছবিটা। প্রতাপের বেলায় কী ছিল?’
‘দীপান্বিতার উড়নচণ্ডী স্বভাব আর তার রক্তের দোষ। প্রতাপের বিয়ের দু-বছর পর্যন্ত এই দোষের খবরটি ষড়যন্ত্রীর কানে পৌঁছোয়নি। পৌঁছোনোমাত্র তিনি জাল বুনতে শুরু করে দেন। এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, এই খবরটি তাঁর কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন পাঞ্চালী।’
পাঞ্চালী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কক্ষনো না। আপনি আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন মিসেস দত্তগুপ্ত।’
দময়ন্তী অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘বোধ হয় নয় মিসেস ভট্টাচার্য। আপনার পছন্দ না হওয়া পুত্রবধূর সম্পর্কে নিন্দা এবং কুৎসা গাইতে গিয়ে আপনি কি আপনার কোনো আত্মীয়র কাছে সুশীলবাবুর পারিবারিক কলঙ্কের কথা কখনো প্রকাশ করে বলেননি? আপনি অবশ্য এখন অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু আপনার ভাশুরকে জিজ্ঞেস করলে কি আপনার অস্বীকৃতির সমর্থন পাওয়া যাবে?’
পাঞ্চালী একটু চুপ করে জেদি গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়তো বলে থাকতে পারি। তাতে কী হয়েছে?’
‘হয়েছে এই যে আপনার স্নেহের প্রতাপ আজ নিহত। রাগের বশে, অহংকারে অন্ধ হয়ে আপনি অনধিকার চর্চা করতে গিয়ে প্রতাপের মৃত্যুবাণ ষড়যন্ত্রকারীর হাতে তুলে দিয়েছেন।’
পাঞ্চালীর গলা এবার একেবারে খাদে নেমে এল, ‘আমি… আমি বুঝতে পারিনি মিসেস দত্তগুপ্ত।’
‘আপনাকে এই খবরটি কে দিয়েছিল এবার বলবেন?’
ভারী গলায় পাঞ্চালী বললেন, ‘হ্যাঁ, দিয়েছিল সাত্যকি। খোকার এ বাড়িতে বিয়েটা বন্ধ করার জন্যে আমাকে পরামর্শ নিতে এসে বলেছিল।’
‘আপনার সেই ছবিটা উনি তখন দেখেছিলেন?’
‘না, সে-ছবি তখন আঁকাই হয়নি।’
সাত্যকি কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুশীলবাবুর দিকে একঝলক তাকিয়েই মাথা নীচু করে ফেললেন।
দময়ন্তী আবার প্রশ্ন করল, ‘প্রতাপ আপনার ছবির মডেল হতে আপত্তি করত না?’
‘না, কেন করবে? আমি ওর মা, আমার কাছে আপত্তি কীসের?’
‘তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, প্রতাপ কি কখনো আপনাকে বলেছিল যে তার স্ত্রীর একজন প্যারামূর আছেন যিনি কলকাতার বাইরে আছেন?’
‘হ্যাঁ, এরকম কথা কয়েকবার বলেছিল বটে, কিন্তু সঠিকভাবে কিছু বলেনি। বলতও না। খুব চাপা ছেলে ছিল।’ বলতে বলতে পাঞ্চালীর গলা ভেঙে গেল।
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, চাপা না হয়ে কাউকে যদি সব খুলে বলত আপনার ছেলে, তাহলে আজ এই পরিণতি তার হত না। অচ্যুত শীলের কাছে গিয়ে দুঃখ চাপা দেবার জন্যে সে মদ খেত, অথচ তাকেও কিছু খোলসা করে বলেনি। অচ্যুত জানত যে তার স্ত্রীর নামে প্রেমপত্র আসে, মাঝে মাঝে ছোটোখাটো উপহারও আসে কলকাতার বাইরে থেকে এবং সেই সহানুভূতিতে তাকে সে মদ খাওয়াত, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কখনো বন্ধুকৃত্য করেনি। অচ্যুতের কথায় আমরা জানতে পেরেছি যে তাদের একজন কমন ফ্রেন্ড ছিল যে তাকে ওইসব খবর দিত। তার পরিচয় জানাতে অচ্যুত শীল যদিও অস্বীকার করে, তবু তার কথাতেই বোঝা যায় যে সে ছিল স্থানীয় পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার।’
শিবেন বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে বুঝলেন?’
‘অচ্যুত বলেছিল যে সেই বন্ধুটি বদলি হয়ে গেছে। এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই বন্ধুটি সরকারি চাকুরে। এই অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে একমাত্র পোস্টমাস্টারের এই ধরনের খবর দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি একজন বিডিও বা পিডব্লুডি-র ওভারশিয়ারের চেয়ে।’
‘কিন্তু পোস্টমাস্টারই-বা জানবেন কোত্থেকে?’
‘কোনো একজন মহিলা যিনি স্থানীয় একজন ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকের স্ত্রী এবং একজন নামজাদা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ে, যদি নিয়মিত মোটা নীল খামে ভুরভুরে গন্ধওলা চিঠি পেতে থাকেন, তাঁর যদি বয়েস কম হয় এবং তিনি যদি সুন্দরী হন তাহলে ছোট্ট পোস্ট অফিসের লোকেদের সে-বিষয়ে কৌতূহল জেগে ওঠা কি নিতান্তই স্বাভাবিক নয়? কাজেই অচ্যুতের সেই পরিচয়হীন বন্ধুটি যে পোস্টমাস্টার এটা আমরা ধরে নিতে পারি অনায়াসেই। যদিও আমি প্রথমটা ধরতে পারিনি। কালকে সাত্যকিবাবুর পোস্ট অফিসে যাবার কথা শুনে হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম।’
‘সেই সুগন্ধি চিঠিগুলো গেল কোথায়? দীপান্বিতার ঘরে তো একটাও সে-ধরনের চিঠি পাইনি আমরা।’
‘আমার বিশ্বাস, সে-চিঠিগুলোর কয়েকটা গেছিল প্রতাপের হাতে। বাকিগুলো দীপান্বিতার হাতে গেছে এবং সেগুলো সে কোনো অর্বাচীনের কীর্তি ভেবে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কারণ তার তো সত্যি সত্যি সেরকম কোনো চিঠি পাবার কথা নয়।’
‘কিন্তু প্রতাপের ঘরে তো কোনো চিঠিই নেই।’
‘ঠিক তাই। ষড়যন্ত্রকারী ভেবেছিল যে এ ব্যাপারটা সবার নজর এড়িয়ে যাবে, কারণ সবাই চিঠি জমিয়ে রাখে না। কিন্তু প্রতাপ যেরকম গুছোনো ছেলে, তাতে তার ঘরে চিঠি থাকবে না এটা ভারি অদ্ভুত লেগেছিল আমাদের কাছে। পরে বুঝতে পারি, তার ঘরের যাবতীয় চিঠি পরিষ্কার করে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, কারণ এই ষড়যন্ত্রের সেগুলি প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কেবল দীপান্বিতার লেখা মিথ্যে প্রেমপত্রই নয়, আমার ষড়যন্ত্রকারীর লেখা চিঠিও সেখানে ছিল।’
‘কিন্তু কে সরাল সেই চিঠিগুলো?’
‘সে-ই হচ্ছে এই নাটকের অদৃশ্য মানব বা মানবী, ষড়যন্ত্রকারীর সোনারপুরের প্রতিনিধি। তার নাম বৃন্দা। সার্থকনামা সে বিন্দেদূতী। চমৎকার দূতিয়ালি করেছে, প্রতাপের কানে তার স্ত্রীর নামে ঠারেঠোরে সন্দেহ জাগিয়েছে, ছোটোখাটো মিথ্যে প্রমাণ এগিয়ে দিয়েছে, আর সব শেষে প্রতাপের মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে তার ঘর থেকে চিঠিপত্রর ফাইল বা বান্ডিল সরিয়ে নিয়েছে। আমরা যে সাত্যকিবাবুর দীপান্বিতার সঙ্গে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করছিলুম, সেটা ভয়ানক রিস্কি ব্যাপার ছিল। সাত্যকিবাবু অতটা ঝুঁকি নিতে পারতেন না। কিন্তু বৃন্দার সে-রিস্ক নেই। সে সবার চোখের সামনে রয়েছে, অথচ কেউ তাকে লক্ষ করেনি। সে-বাড়ির সর্বত্র তার অবাধ গতিবিধি। তারই সুযোগে সে চট করে একসময় প্রতাপের ঘরে ঢুকে কাজ হাসিল করেছে। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, বৃন্দাই পোস্টমাস্টারকে জানিয়ে রেখেছিল যে একটা বিশেষ ধরনের প্যাকেট মিসেস চৌধুরীর নামে আসছে, সেটি এলেই যেন মিস্টার চৌধুরীকে খবর দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য হেভিলি ইনসিয়োরড একটা পার্সেল দেখে পোস্টমাস্টার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েও খবর দিয়ে থাকতে পারেন। তবে তার সম্ভাবনা কম, সেটার মধ্যে অনিশ্চিতের ভাগ বেশ বেশি।
অনেক ভেবেচিন্তেই বৃন্দাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রের কোনো যোগাযোগ চট করে খুঁজে বের করা কঠিন, সে অতি ধড়িবাজ চালাক মেয়ে বলে ইনস্ট্রাকশনগুলো চটপট বুঝে নিতে পারে, তার একটা ক্রিমিনাল পাস্ট আছে বলে এসব ব্যাপারে সে নার্ভাস হয় না, উলটে নিজেও কিছু কারুকার্য যোগ করতে পারে। এককথায় এই দূতিয়ালির জন্য সে ছিল আদর্শ।’
শিবেন চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আর তার মেয়েই বোধ হয় ছিল সিকিউরিটি বা হস্টেজ, তাই না?’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’
সুশীলবাবু কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তার মানে, আপনারা বলতে চাইছেন…’
কিন্তু কথা শেষ করতে পারলেন না। বাধা দিল শুচিস্মিতা। হাসির একটা আপ্রাণ কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘ওঁরা কী বলতে চাইছেন, সেটা কি তুমি নিতান্তই ওঁদের মুখে শুনতে চাও? আমি বলছি। ওঁরা বলতে চান যে আমি ষড়যন্ত্র করেছি। আমার স্বামীর দুটো পা নেই, সে কোনো কাজ করতে পারে না, আমাকে চাকরি করতে হয় আর আমার বোন তার সুন্দর স্বাস্থ্যবান স্বামী নিয়ে পরম সুখে ঘর-সংসার করছে— এই দেখে ঈর্ষায় ব্যাকুল হয়ে আমি এ কাজ করেছি। আজ সকালে সাত্যকিদা এই কথাই আমাকে বলতে এসেছিল। আমাকে বলেছিল ওর সঙ্গে পালিয়ে যেতে। আমি তখন ওকে বলেছিলুম বটে যে আমার স্বামী বিকলাঙ্গ হলেও এক লক্ষ গোটা মানুষের চেয়েও মহৎ, দীপুর প্রতি আমার আর যাই থাক, ঈর্ষা কখনো ছিল না এবং কারো ভয়ে কোনো অবস্থাতেই আমি ওর মতো একটা আদ্যন্ত জানোয়ারের সঙ্গে পালাব না। কিন্তু ষড়যন্ত্র করিনি একথা বলিনি। আজ তোমার অ্যাপয়েন্টেড এই মহিলার এই সুদীর্ঘ অভিনয় দেখে বুঝলুম, তোমরা সকলেই প্রস্তুত হয়েই এসেছ। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো বাসনা বা প্রবৃত্তি আমার নেই। এই যে মিস্টার পুলিশ অফিসার, আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারেন। আমি স্বীকার করছি যে আপনার সঙ্গের ওই মহিলা বিরাট কথার জাল বুনে যে ষড়যন্ত্রের কথা বললেন, সেটা আমারই করা। আমিই প্রতাপকে খুন করিয়েছি, আমিই আমার বোনের সর্বনাশ করেছি।’
শিবেন শুচিস্মিতাকে অ্যারেস্ট করার কিছুমাত্র চেষ্টা করল না। ম্লান হেসে বলল, ‘মিসেস লাহিড়ী, আমার সঙ্গের এই মহিলা যখন এতটা বুঝেছেন, তখন আপনার এই অভিনয়টুকুতে যে উনি বোকা বনবেন না, এটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। উনি যে ষড়যন্ত্রকারী বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন, সেটা আপনার চেয়ে ভালো তো আর কারোর জানার কথা নয়। আপনার স্বামীকে আপনার বাঁচানোর এই প্রচেষ্টাটা যতই প্রশংসার্হ হোক না কেন, সেটাকে বোধ হয় সার্থক হতে দেওয়া যায় না, তাই না? ভালোবাসা অন্ধ হলেও তাকে কখনো অনাচার সহ্য করতে দেওয়া যায় কি?’
দময়ন্তী সুশীলবাবুকে সম্বোধন করে বলল, ‘আমি দুঃখিত সুশীলবাবু, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার লোক চিনতে ভুল হয়েছিল। আপনি যাকে হিরের টুকরো ছেলে ভেবেছিলেন, সে আসলে দীপান্বিতাকে পাঠানো আংটির হিরেটার মতোই জাল। তার পাণ্ডিত্য, বুদ্ধিমত্তা আর অহংকার সকলের সামনে তাকে একটা বেশ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের আসনে বসিয়েছিল, কিন্তু তার প্রকৃত রূপটি একেবারেই অন্যরকম। সে আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে, প্রতাপ আর আপনার দুই মেয়েকেও দিয়েছে। অর্থাভাব, প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং খঞ্জত্ব, এই তিনে মিলে যে তাকে ভেতরে ভেতরে এক নিষ্ঠুর অমানুষে পরিণত করেছে, সে এতদিন তা কাউকেই বুঝতে দেয়নি। যারা তাকে শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে, নির্দ্বিধায় নির্বিকার চিত্তে সে তাদের ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার শয়তানির কাছে পঙ্গুত্ব, দূরত্ব, কিছুই কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
গত দু-বছর ধরে অতি যত্নে যে রিমোট কন্ট্রোল ষড়যন্ত্র সে করেছিল, সেটা সফলই হত যদি না তার একটা জায়গায় ভুল হত। সেটা হল, বৃন্দাকে একটু বেশি বিশ্বাস করে ফেলা। তার যে একটা অপরাধময় অতীত আছে, সেটা জেনেও রামানুজের তাকে আংটিটা কিনতে দেওয়া উচিত হয়নি। অতগুলো টাকা দেখে যে সে লোভ সামলাতে পারবে না, এটা তার বোঝা উচিত ছিল। আংটিটার গুরুত্ব বৃন্দা বুঝবে কোত্থেকে? সে ভেবেছিল, একটা ঝকমকে কিছু হলেই হল। কয়েক মিনিটের তো মামলা। কিন্তু সেটাই যে একটা এমন সুন্দর নিশ্ছিদ্র ষড়যন্ত্রকে নষ্ট করে দিল, তা ভেবে আপনার বড়োজামাই যে বাকি জীবনটা ক্রমাগত হাত কামড়াবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
সাত্যকি ততক্ষণে বেশ সামলেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু এতক্ষণ ধরে আপনি যে এতসব কথা বললেন, তার বেশির ভাগই তো অনুমান। আদালতে প্রমাণ করতে পারবেন?’
দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘পারব। আমার প্রতিটি অনুমান যে সত্য, সে-বিষয়ে আদালতে সাক্ষী দেবেন তিনজন। প্রথম, আপনার বাবা অথবা মা। আপনার মতো তাঁদেরও এই ভ্রান্ত বিশ্বাস আছে যে শুচিস্মিতা এখনও আপনার প্রতি অনুরক্ত। রামানুজ সরে গেলে তাঁরা শুচিস্মিতা এবং সুশীলবাবুর অর্ধেক সম্পত্তি নিজেদের ঘরে তুলবেন। বৃন্দার মাধ্যমে রামানুজও এই ধারণায় ইন্ধন জুগিয়ে গেছে, যাতে বিপদ বুঝলে স্ত্রীকে এগিয়ে দেওয়া যায়। আপনার কথায় ভয় পেয়ে শুচিস্মিতা আজ যদি সত্যিই পালাত, তাহলে তার ষড়যন্ত্রের বেশ খানিকটা সফল হত সন্দেহ নেই। তা ছাড়া আমরা তাঁদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে এসেছি যে আমরা আপনাকে সন্দেহ করি। এ অবস্থায় তাঁরা সত্যি কথা বলবেন। এবং বলতে পারবেন, কারণ তাঁরা সব কথাই জেনেছেন। তা নাহলে তাঁরা তড়িঘড়ি বৃন্দাকে বরাকরে পাঠাতেন না। আপনার মা হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর নার্ভাস বৃন্দার পেটের থেকে ঠিক খবর টেনে বের করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, বৃন্দা। ক্রিমিনালদের স্বভাবই তো এই— একটু চাপ দিলেই সব কথা বেরিয়ে আসে। আজ সে গা ঢাকা দিয়েছে, কিন্তু দু-দিন বাদেই ধরা পড়বে।
তৃতীয়ত, সুশীলবাবু। আজ আর তাঁর সত্য গোপন করার কোনোই কারণ নেই!’
দময়ন্তী হয়তো আরও কিছু বলত, তার আগেই গেটের কাছে একটা গোলমাল শোনা গেল। ওসি ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ভেতরে এসে শিবেনকে বললেন, ‘পেছনের বাগানের দরজা দিয়ে একটি মেয়ে পালাচ্ছিল। তাকে অ্যারেস্ট করেছি, স্যার।’
শিবেন সহাস্যে বলল, ‘যাক, বিন্দেদূতীও ধরা পড়ল! এখন আর আশা করি সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ওপর নির্ভর করার দরকার হবে না। একেবারে ভেতরের খবরই পাওয়া যাবে।’
দময়ন্তী ম্লান হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, তা যাবে। সবই হবে শিবেনবাবু, কিন্তু আসল হিরেটি চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেল, তাকে আর পাওয়া যাবে না।’
Want this pdf