1 of 2

সন্ধ্যেবেলা রক্তপাত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সন্ধ্যেবেলা রক্তপাত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আগের দিন সন্ধ্যেবেলাতেই একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল, সকালবেলা উঠে দেখলুম, আমার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ব্রণ উঠেছে। সাদা টুসটুসে, ব্যথা কি! আয়নায় দেখা গেল আগুনের শিখার মতন, কাছাকাছি হাত নিয়ে যেতে ভয় হয়। আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো।

হয় এরকম আমার মাঝে মাঝে। গালে, থুতনিতে। সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগে ঠোঁটের কোণায় হলে। সেই চোদ্দ-পনেরো বছর থেকে শুরু হয়েছে। বড় পিসীমা সে সময় বলতেন, ও কিছু না, বয়েস ফোড়া, সময়কালে সেরে যাবে। কি জানি বড় পিসীমা সময় বলতে কি বুঝিয়েছিলেন, সাতাশ বছর বয়েস হলো, এখনও আমার নিষ্কলঙ্ক মুখের সময় আসেনি? বড় পিসীমা যেদিন মারা যান, সেদিন দাড়ি কামাতে গিয়ে একটা ব্রণ কেটে ফেলায় রক্তই বেরিয়েছিল আমার, খুব মনে আছে।

ব্ৰণ আমার গা সহা হয়ে গেছে। সাদা হয়ে এলেই আমি দেশলাই জ্বেলে একটা সেফটি-পিন পুড়িয়ে প্যাট করে গেলে দিই। ভেতরের সাদা জিনিসটা টিপে বার করে দিলে চুপসে যায়, তখন আর অতটা চোখে পড়ে না। নইলে, মুখের ওপর পাকা ব্রণ থাকলে অনেকে ভালো করে আমার মুখের দিকে তাকাতে চায় না কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি নিজে তো দেখেছি–অন্য কারুর মুখ ভর্তি ব্রণ দেখলে আমার গা বমি বমি করে, তাকাতে ইচ্ছে করে না।

কপালের ওপর ব্রণ, এতে একটা সুবিধে হয়েছে অবশ্য, দাড়ি কামাতে অসুবিধে হবে না, কেটে যাবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এ ব্ৰণ গেলে দেওয়াও যাবে না। কপালের ওপর ক্ষত তৈরী করতে নেই— এটা শুধু কুসংস্কার নয়— দারুন সেপটিক হয়ে যেতে পারে। ইরিসিপ্লাস না এই ধরনের কি যেন একটা অসুখ আছে–অরুণেশ দাস মজুমদার বলে একটা ছেলে আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়তো, তিনদিনের ছুটিতে মেদিনীপুরের দেশের বাড়িতে গেল— আর ফিরলো না, বৌদির শেলাইয়ের সূঁচ দিয়ে কপালের ব্রণ গেলেছিল। অরুণেশ হঠাৎ মরে গেল বলেই সেবার আমি ম্যাগাজিন এডিটর হতে পেরেছিলাম। যতই খারাপ দেখাক, কপালের ব্রণ আমি গালতে পারবো না। কিন্তু আজ গায়ত্রীর বুকে আমার কপাল সমেত মুখখানা একবার চেপে ধরবো ভেবেছিলাম।

গায়ত্রী ব্রণ দেখলে কখনো ঘেন্না করে না, অন্তত সে রকম কোনো ভাব কখনো দেখায়নি। বরং গায়ত্রী আমার জন্য নিত্যনতুন ওষুধ কিনে আনে। শাঁখের গুঁড়ো হজমের ওষুধ হরেক রকম মলম। গায়ত্রীর মসৃণ মুখের চামড়া, একটা দাগ নেই, কোনোদিন একটা ঘামাচিও হতে দেখিনি— তবু ব্রণের ওষুধ ও কার কাছ থেকে এবং কোন্ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে, আমি জানি না। বলেও না কখনো। গায়ত্রী ওর পাতলা স্বচ্ছ হাতখানি আমার মুখে বুলোতে বুলোতে কতদিন বলেছে, ছেলেমানুষ, তুমি এখনও একটা ছেলেমানুষ।

চন্দন কিংবা চুন কিংবা স্টিকিং প্লাসটার লাগাবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তাহলে প্রথমেই চোখে পড়ে, চোখের সামনে ক্যাট ক্যাট করে। কপালের ঠিক মাঝখানে ঐ দৃশ্যমান কলঙ্ক নিয়ে নিয়ে রাস্তায় হাঁটা আমার সম্ভব নয়। চোদ্দ বছর বয়স থেকে যার ব্রণ উঠছে, সেই লোকেরও আজ কপালের ওপর একটা মাত্র ব্রণ ওঠায় সত্যিকারের মন খারাপ হলো। আমি গোটা তিনেক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। অন্তত আজকের দিনটায় ওটা না উঠলে হতো না! দেড় মাস পর আজ গায়ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে। হঠাৎ দেবনাথের কথা মনে পড়ায় আমার বেশ রাগ হলো। বন্ধুদের মধ্যে দেবনাথকেই সবচেয়ে সুন্দর বলা চলে। কোঁকড়ানো চুল, ধারালো নাক আর ঠোঁট ঝকঝকে চামড়া, সব কিছুর সঙ্গে দামী করে গ্লাসের মিল আছে। ঐ রকম সুন্দর মুখ নিয়ে এখন দেবনাথ খবরের কাগজের অফিসে যুদ্ধের ইংরেজি খবরের বাংলা অনুবাদ করছে। অন্তত আজ বিকেলে ঐ কাজের জন্য দেবনাথের অমন সুন্দর মুখের কোনো দরকার ছিল না। আমার ছিল।

চৌরঙ্গীর ওপর, লিণ্ডসে স্ট্রীট ছাড়ালে বাইবেল সোসাইটির বাড়ি–যেখানে একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে বাইবেল খোলা অবস্থায় রাখা থাকে–প্রতিদিন কে বা কারা তার একটি করে পাতা উল্টে দেয়, সেই বাড়ির বারন্দার নিচে গায়ত্রী এসে দাঁড়াবে ঠিক ছটার সময়। আমি একটু আগেই বেরিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গায়ত্রী কোনোদিন আসে না, সুতরাং ওখানে আমাকে বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবেই–তাই বাসে ওঠার আগে আমি আর একটা সিগারেট ধরালাম। সেই আমার। প্রথম ভুল। ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে যারা মরে, তাদের অনেকেরই বোধহয় আগের ট্রেনে যাবার কথা থাকে।

সিগারেটটা মুখে রেখে দেশলাই জ্বেলেছি, কে যেন ফু দিয়ে সেটা নিবিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি কেউ না। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া উঠেছে, পাক দিয়ে ঘুরছে ধুলো। চোখ আড়াল করলুম আমি ধুলো আটকাবার জন্য। বিকেলবেলা এরকম হাওয়া ওঠা ভাল নয়, বিকেলটা না নষ্ট করে দেয়। কিছুতেই সুযোগ হয় না, গায়ত্রী অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারে না, লুকিয়ে দেখা করতে হয়। আজ দেড় মাস পরে আমি। গায়ত্রীকে সান্ত্বনা দেবো এবং সান্ত্বনা চাইবো। একটু পরেই চোখ খুলে দেখি, সেই ঘূর্ণী ঝড়টা উঠে গেছে শূন্যে, রাস্তা আবার আগের মতন শান্ত এবং রাস্তার উল্টো দিক থেকে আমারই জন্য একজন হেঁটে আসছে। সিগারেটটা ধরিয়েই আবার ফেলে দিতে হলো; কেননা, বাবার বন্ধু প্রতাপ কাকা। প্রতাপ-কাকা বললেন, রাস্তার ওপার থেকে তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলুম, তুই দেখতে পাসনি সন্তু?

আমি বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে বললুম, না তো আপনি আমাকে ডাকছিলেন?

-হ্যাঁ, তোদের বাড়িতে আমাকে যেতে হতো ভালোই হলো তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তোর মা-কে বলিস্… কপালের ওপর তোর ওটা কি হয়েছে? অড় ফেঁড়া?

–ফোঁড়া না, ব্রণ, এমন কিছু নয়—

–না, না কপালের ওপর ওরকম প্রকাণ্ড একটা, শোন্‌, আঙুলে রুমাল পেঁচিয়ে তারপর টিপে দে এমনি করে—

–না, না, প্রতাপ কাকা বিষম ব্যথা–

—আচ্ছা শোন, তোর মাকে বলিস…

প্রতাপ কাকা যতক্ষণ কথা বললেন, ততক্ষণে দুটো বাস চলে গেল বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তখন বুঝতে পারিনি— সেই দুটি বাসই আমার সমস্ত সৌভাগ্য নিঃশেষ করে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ দুটোর যে-কোনো একটায় উঠলে—।

তৃতীয় বাসে বেশ ভীড়, কিন্তু না উঠে উপায় নেই— এরপর দেরী হয়ে যাবে। পা দানিতে সিঁড়ির কাছে। একজন পাঞ্জাবি গোয়ালা সিঁড়ির নিচে দুধের বালতিটা রেখে আমার পাশে। সম্রাটের মতন তাঁর দাড়িময় মুখের সৌষ্ঠব। কিন্তু গায় খুব বদগন্ধ। দুটি মেয়ে নেমে যাবার আগে আমার দিকে বার বার ফিরে ফিরে তাকায়। বস্তুত ওরা আমার ব্রণের জন্যই তাকিয়েছিল, কিন্তু ওদের সেই চাহনিই আমাকে ব্রণের কথা ভোলাবার পক্ষে যথেষ্ট এবং আমাকে অমনোযোগী করে। কিছুক্ষণের জন্য গায়ত্রীর কথাও আমার মনে থাকে না। সেই অবসরকালে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতে এলে, আমার তো পয়সা হাতেই ছিল, অন্যমনস্ক হাত দেওয়া-নেওয়া সেরে নেয়, পাঞ্জাবী গয়লাটি কোমরের গেঁজের গিট খোলার চেষ্টা করে। হয়তো অসতর্ক মুহূর্তে আমি মুখ ঘুরিয়েছিলাম, কিংবা তার হাত পিছলে গিয়েছিল, অব্যথভাবে গয়লাটির কনুই আমার কপালে আঘাত করে। তৎক্ষণাৎ প্রথমেই আমার মনে হলো আমি অন্ধ হয়ে গেছি— এমনই তীব্র যন্ত্রণা এর থেকে বেশী শারীরিক যন্ত্রণা আমি আগে কখনো পাইনি। অস্পষ্ট ভাবে কানে এলো, মাফ কিজিয়ে, নেই দেখা, বিলকুল… খুন গিরতা। মনের মধ্যে বিদ্যুভাবে খেলে গেল গয়লার ময়লাসঙ্গী হাত, কতরকম বীজাণু, সেপটিক, ইরিসিপ্লাস, অরুণেশ দাস মজুমদার। কপালে রুমাল চেপে আমি বাস থেকে নেমে পড়লুম।

ব্যথা একটু কমতেই চিন্তা স্বাভাবিক হয়ে আসে, মনে হয়, মৃত্যু অত সোজা নয়। এখন চাই একটা আয়না কপালের ক্ষত কতখানি। সিগারেট কেনার জন্য এক টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে পানের দোকানের মহাভারতের ছবি আঁকা ক্যালেণ্ডারের পাশের ঝাপসা আয়নার সামনে আমার মুখ। একেবারে থেতলে গেছে ব্রণটা, এখনও রক্ত বেরুচ্ছে। এক একটা ব্রণ এই রকম অভিমানী— অসময়ে ফাটালে কিছুতেই রক্তস্রোত বন্ধ করতে চায় না। পানওয়ালা সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, বাবু, ধূপকাঠি কিনবেন। আমার কাছে ভাল ধূপকাঠি আছে—

আমি ধরা গলায় বললুম, না, না—

–খুব ভালো গন্ধ। রিফুজি মেয়েদের তৈরী করা, দু’প্যাকেট নিন, সাত আনায় হবে—

–না, না,

–গরীব মেয়েগুলো রোজগারের চেষ্টা করছে একটু সাহায্য করুন।

আমি কাতরভাবে জানালুম না, ভাই আমি ধূপকাঠি নেব না। এখানে ডাক্তারখানা কোথায় বলতে পার?

—ও কিছু না, একটু চুন লাগিয়ে নিন্—

না, চুন লাগাবো না—ডাক্তারখানা–

লোকটি নির্লিপ্তের মতন জানালো, কি জানি, ডাক্তারখানা কোথায়?

কী নিষ্ঠুর লোকটা। এই কি আমার ধূপকাঠি কেনার সময়। আমি ধূপকাঠি কিনিনি বলে আমাকে ও ডাক্তারখানা দেখাবে না। রাস্তাটার দু’ধারে শুধু পোশাক আর মনোহারী জিনিসের দোকানই চোখে পড়ে। কিন্তু ডাক্তারখানা বা ওষুধের দোকান একটা কোথাও থাকবেই লুকিয়ে।

কাপড়ের দোকানে সিঁড়িতে এক ধাপ উঠে এতক্ষণে আমার গায়ত্রীর কথা আবার মনে পড়ে। গায়ত্রী দাঁড়িয়ে থাকবে। সুতরাং গলায় সোনার চেন-পরা মলমলের পাঞ্জাবী গায়ে লোকটিকে ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করার আগে আমি প্রশ্ন করলাম, এখন কটা বাজে।

লোকটি আঁৎকে উঠে বললো, এ কি, আপনার সারা মুখে রক্ত! মাথা ফেটে গেছে বুঝি? ওরকম রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন? হাসপাতালে যান ট্যাক্সী ডেকে দেবো?

অবিচলিতভাবে পুনরায় আমার প্রশ্ন, এখন কটা বাজে?

–এমারজেন্সি সব সময় ভোলা। কি করে ফাটলো?

–কটা বাজে আগে বলুন!

–সাড়ে পাঁচটা।

—আপনার ঘড়ি ঠিক আছে? শ্লো নয় তো?

লোকটি গলা ছেড়ে কাকে ডাকলো, হেরম্ব, এদিকে এসো তো একবার বাণ্ডিলটা নামিয়ে রেখে এসো!

এখনও সময় আছে। ব্যথার জন্য মনে হয়েছিল অনেক সময় কেটে গেছে। বললুম, আমার বিশেষ কিছু হয়নি, একটা ফোড়া ফেটে… এখানে ওষুধের দোকান কিংবা ডাক্তারখানা আছে?

–বাঁ-দিকে চলে যান, পাঁচ সাতখানা বাড়ি পরে একজন ডাক্তার থাকেন। এ হে, মেঝেতে রক্ত পড়লো, হেরম্ব, জল নিয়ে এসো— বললুম না— বাণ্ডিলটা নামিয়ে রেখে এক্ষুনি একবার এদিকে এসো—

কপাল থেকে রুমালটা সরাতেই রক্ত আবার গলগল করে বেরুতে চায়। পুনরায় রুমাল চাপা। কাপড়ের দোকানের মেঝেতে পাতা দু ফোঁটা রক্ত। ছটা বাজতে এখনো দেরী।

পাঁচখানাও না, সাতখানাও না, আমি শুনতে শুনতে আসছিলাম, ঠিক একুশখানা বাড়ির পর এক বাড়িতে এক ডাক্তারের নেম প্লেট। বেল টিপতেই আর্দালি। আসুন ভেতরে। এখানে একটু বসুন। আমার খুব তাড়াতাড়ি আছে। আর্দালি সুইং দরজা ঠেলে অপর কক্ষে ঢুকে গেল, তখুনি বেরিয়ে এসে বললো, আসুন।

.

২.

টেবিলের ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে ডাক্তারটি কোনো বই পড়ছিলেন। চোখ তুলে আমাকে দেখেই বললেন, কি? স্টাবিং?

আমি বিনীতভাবে বললুম, না, হঠাৎ একটা ব্রণ ফেটে গেছে–

বিনীত, কেননা, এর আগের মুহূর্তেও ডাক্তারের ফির কথা মনে পড়েনি। আমার দরকার শুধু অ্যান্টিসেপটিক মলম–কিন্তু এই ডাক্তারের সময় নষ্ট করার জন্য যদি। কত? আট, যোলো বত্রিশ? পকেটে নি টাকা। ঘরখানায় আলো খুব জোরালো নয়, এত বেশী চামড়া বাঁধানো বই যে ডাক্তারের বদলে উকিলের ঘর বলে ভুল হয়। আরো চোখে পড়ে, তিনদিকের দেয়ালে প্রায় পনেরো-যোলোটা টিকটিকি, বেশ কেঁদো সাইজের।

ডাক্তার এবার বেশ ধীরে সুস্থে তিনটে ড্রয়ার খুঁজে একটা মলমের টিউব বার করলেন। সেটা হাতে রেখেই একটা আলমারি খুললেন। আলমারি ভর্তি থাকে থাকে সাজানো কাঁচের স্লাইড। অন্তত হাজার দুয়েক। তার থেকে একটা স্লাইড নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমি তখনও দাঁড়িয়ে। কাছে আসার পর আমার মনে হলো, এই ডাক্তারকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। কোথায়? মনে নেই। কুমের সুরে তিনি বললেন, রুমাল সরান। সরে গেল। কাঁচের স্লাইডে তিনি আমার কপাল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিলেন। তারপর রক্তটার দিকে নিৰ্ণিমেষে চেয়ে রইলেন। যেন ওঁর খুব দুঃখ। এইভাবে মানুষ কখনো কখনো প্রথম দেখা নদীর দিকে তাকায়। ডাক্তারের হারে কজীর ঘড়িতে দেখে নিলাম— পাঁচটা চল্লিশ, আর বেশী সময় নেই। বাসে এখান থেকে পনেরো মিনিট লাগবেই মেরে কেটে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। খালি চোখে রক্তে আবার কে কি দেখতে পায়। ভড়ং! ফি-তো দিচ্ছি না! এই ডাক্তারকে আগে কোথায় দেখেছি? ডাক্তার এবার মুখ ফিরিয়ে আবার হুকুম, আঙুল দেখি!

আঙুলগুলো ছড়িয়ে হাতের পাঞ্জাটা এগিয়ে দিলাম। ডাক্তার টিউব টিপে একটুখানি মলম আমার তর্জনীতে লাগিয়ে ডান দিকের একটা হেলানো চেয়ার দেখিয়ে বললেন, যান, ঐখানে বসে কপালে মলমটা লাগান।

চেয়ারে বসার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার, সময় নেই, অতএব আরও বিনীত, বিগলিত হাস্যময় মুখ, না, আমি আর বসবো না, আমাকে এক্ষুনি একটা কাজে যেতে হবে। অনেক ধন্যবাদ, মানে একটাও ওষুধের দোকান নেই কাছাকাছি, তাই আপনাকে বিরক্ত করতে হলো, মলমটা–

–বসুন ঐ চেয়ারে!

অবাক। হুকুম? কেন, কি এমন ব্যাপার হয়েছে? ভারী তো একটু মলম, এ ডাক্তারের কাছে তেমন পেসেন্টও তো আসে না। রথীনের মামার চেম্বারে দেখেছি সব সময় কানা খোঁড়ায় গিসগিস করে। বসলুম না, দাঁড়িয়েই রইলুম। ডাক্তার চলে গেছেন টেবিলের ডান পাশে, মাইক্রোসকোপের নিচে আমার রক্তমাখা স্লাইড, মাইক্রোসকোপের ওপরে ডাক্তারের মনোযোগী চোখ। চোখ না তুললে কথা বলতে পারছি না। এবারের কথাটা ডাক্তারের চোখের দিকে চোখ রেখে নির্ভীক ভাবে বলতে হবে। উপকার করেছেন ঠিকই কিন্তু এমন কিছু নয়, যার জন্যে আপনার স্কুম শুনতে হবে! এর জন্যে ফি আশা করাও আপনার অন্যায়।

নাকের কাছটা হঠাৎ ভিজে লাগলো। একটা ফোঁটা টলটল করছে। হঠাৎ সর্দি হয়ে গেল? ছিটেফোঁটাও তো ছিল না সকালে? আঙুল ছোঁয়ালুম। আঙুলের ডগা রক্ত মেখে ফিরে এলো। এখনও রক্ত। এবারে আঙুল গেল কপালে, খুব সবধানে ছুঁল। ভিজে ভিজে। মলম লাগিয়েও রক্ত বন্ধ হয়নি। রুমালটায় ছাপ ছাপ রক্ত। আমার হাতে। তাহলে নিশ্চিত মুখেও। ভালো করে না ধুয়ে তো যাওয়া যাবে না। এক একটা ব্রণ এরকম তেরিয়া ধরনের হয়, কপালের ব্রণ তো কোনো নিয়মই মানে না। অনেক ডাক্তারের ঘরে হাত ধোওয়ার জন্য বেসিন থাকে। এঁর নেই। আয়নাও নেই। এই প্রথম আমার মন খারাপ লাগলো। গায়ত্রীর কাছে এরকম রক্তমাখা হাত আর মুখ নিয়ে কুৎসিত ভাবে কি করে যাবো? আর কপালের রক্তপাত বন্ধ করতেই হবে।

ডাক্তার মাইক্রোসকোপে তন্ময়। আমি ক্রমশ অধৈর্য। মলমের টিউবটা কোথায় গেল। আমি একটু জোরে বললুম, মলমটা আর একটু দেবেন? আমার রক্ত বন্ধ হয়নি। মাইক্রোসকোপ থেকে চোখ উঠলো না, উত্তর এলো বেশী মলম লাগালে বেশী কাজ হয় কে বলেছে?

—কিন্তু আমার রক্ত পড়া তো বন্ধ করতে হবে।

–বললুম তা, ঐ চেয়ারটায় বসুন!

ঘরের ভেতর দিকে আর একটা দরজা আছে, আগে লক্ষ্য করিনি। খোলর পর চোখে পড়লো। খোলা দরজায় একটি মেয়ের শরীরের এক অংশ দাঁড়ালো। মুখ ঝুঁকলো ঘরের মধ্যে, কোঁকড়া চুল, চিবুক দেখলে উনিশ বছরের বেশী বয়েস মনে হয় না। ভারী চমক্কার দাঁত, সেই দাঁতের ঝিলিকে প্রশ্ন, বাবা, তুমি এখন চা খাবে?

–না।

—আবার তৈরী হয়ে গেছে।

–এখন না একটু পরে।

মেয়েটিকে দেখেই আমি মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। রক্ত মেখে আমার কপালের চেহারাটা এখন কি রকম হয়ে আছে কে জানে। কিন্তু মেয়েটি ঘরের দ্বিতীয় প্রাণীর উপস্থিতি ক্ষেপই করলো না, সম্পূর্ণ শরীরটা নিয়ে ঘরে এলো, দোহারা চেহারা, পুঁতে রঙের শাড়ি, আমি আড়চোখে দেখছি, সে টেবিল থেকে দুটো আলপিন তুলে নিয়ে আবার পিছনের দরজা দিয়ে চলে গেল।

ডাক্তার চোখ তুলে সাড়ম্বরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখখানা কিন্তু সত্যিকারের বিষাদময়। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, জানতুম! আমি আগেই জানতুম।

আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এতক্ষণ ধরে আমার রক্তে কি দেখছিলেন। কি হয়েছে আমার? রক্ত পড়া থামছে না কেন? নাঃ এসব বাজে ভয়। ‘জানতুম’। কি জানতেন? দরকার নেই জেনে। মলমটা বিনা পয়সায় হলেও রক্ত পরীক্ষার জন্য ফি দিতেই হয়।

—দেখুন, আমার রক্তটা বন্ধ হচ্ছে না। দয়া করে এর একটা ব্যবস্থা করবেন?

 —ঐ রক্ত শরীরে থেকেই বা লাভ কি? যতটা বেরিয়ে যায় যাক।

–তার মানে? আমি রাস্তা দিয়ে এভাবে যাবো কি করে?

—যেতে হবে না। সেইজন্যই তো ঐ চেয়ারে বসতে বললুম।

—আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে যে।

–কোথায় যাবেন?

অচেনা লোককে কেউ এ প্রশ্ন করে না। ডাক্তারটা আসল তো? নাকি কোনো পাগল? একটা ব্রণ ফাটার রক্তও তত বন্ধ করতে পারে না। জলের ঝাপটা দিতে পারিলে রং।

—আমার রক্তে কি দেখলেন?

—আমার এই ক্যাবিনেটে সাতশো রক্তের স্লাইড আছে। ওর সব কটাতে যা দেখছি, আপনারটাও তাই। দুষিত, পচা রক্ত।

—অসম্ভব, আমার কোনো অসুখ নেই।

—আসল অসুখটাই বাধিয়ে বসে আছে। ঐ সাড়ে সাতশো— প্রত্যেকেরই বয়েস তিরিশের নীচে সকলেরই এক রোগ।

অস্বীকার করতে পারবো না, ভয়ে বুকটা ছমছম করছে। অজান্তে কোনো মারাত্মক অসুখ শরীরে দানা বেঁধেছে? কখনো তো টের পাইনি। হঠাৎ একদিন মূল ধরে নাড়া দেবে? মরে যাবো? মৃত্যুর কথা ভাবলে বুক মোচড়ায়। না, মরতে চাই না। একটুও মরতে ইচ্ছে হয় না।

পূর্ব নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আমার শরীর। মুখ প্রশ্ন করে, কি অসুখ?

—এক্ষুনি যেতে হবে বলছিলেন যে?

—অসুখটা কি বলুন। পরে এসে আপনার কাছে চিকিৎসার ব্যাপার…

—কি নাম?

–সনৎ দাশগুপ্ত।

–বয়েস?

–সাতাশ।

—অসুখটার নাম কাপুরুষতা।

ডাক্তারের ঠিক দু’চোখের ওপর আমার দুচোখ। দেখছি। দেখা হয়ে গেল। লোকটা নিশ্চয়ই বাতিকগ্রস্ত। কিংবা আদর্শবাদী টাদী কিছু একটা হবে। গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য হেসে বললুম, আচ্ছা চলি। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়লো, রক্তটা ধুতে হবে। কপালে, নাকে, হাতে। এইরকম ভাবে রাস্তায়–।

ডাক্তারও উঠে দাঁড়িয়েছেন, প্রায় হুংকারের মত বললেন, অস্বীকার করতে পারবেন, কাপুরুষতার কথা। আমার বয়েস সাতচল্লিশ, আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার সাহস আছে?

পাঞ্জা লড়ার ভঙ্গিতে নিজের কজি মুচড়ে দিলেন তিনি, ঘড়িটা একেবারে আমার চোখের সামনে। ছটা বাজতে পাঁচ। আঃ, কেন তিনটে বাস ছেড়েছিলাম। কেন প্রতাপ কাকা। কেন গয়লাটার কনুই। এখনও ট্যাক্সী নিতে পারলে–চঞ্চল হয়ে বললুম, দেখুন, আজ আমায় এক্ষুনি যেতে হবে, পরে আর একদিন এসে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। এখন একটু যদি।

—এক হাত পাঞ্জা লড়ারও সাহস নেই?

—আমার এক্ষুনি যেতে হবে। যদি একটু…

কতক্ষণ আর লাগবে? এক মিনিট।

–কিছুতেই আর পারবো না। যদি একটু জল—

—কোথায় যেতে হবে?

—একটি মেয়ে ছটার সময় দাঁড়িয়ে থাকবে, ভীষণ দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু রক্তটা বন্ধ হলো না

—মেয়েটির সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?

পিছনের দরজা ঠেলে আবার সেই মেয়েটি। সেই পুঁতে রঙা শাড়ি, দোহারা উনিশ। এবারও ঘরের তৃতীয় ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করা গলায়, বাবা, তোমাকে মা ডাকছে

–এখন না, একটু পরে।

–খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে!

এবার মেয়েটি আমার দিকে ফিরে, আপনি একটু বসুন, বাবা এক্ষুনি ঘুরে আসছে। হঠাৎ আশা পেয়ে আমি মেয়েটিকে অনুনয় করি, দেখুন, আপনার বাবার সঙ্গে আমার আর কোনো দরকার নেই, আপনাদের এখানে কাছাকাছি কোনো বাথরুম আছে? আমি একটু মুখটা ধুতাম।

ডাক্তার চেঁচিয়ে বললেন, তার আগে একটা কথার উত্তর দিন। মেয়েটির সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

—আট ন বছর।

—নিশ্চয়ই মেয়েটি বিবাহিত?

–না, না,

—আবার মিথ্যে কথা? কাপুরুষ, কাপুরুষ! চোখের পাতা ফেলা দেখে বুঝতে। পারছি মিথ্যে কথা।

আমি মেয়েটিকে সনির্বন্ধ অনুরোধে, বাথরুমটা যদি দেখিয়ে দেন। —একতলার বাথরুম তো বন্ধ। পিসীমা গেছেন! দোতলায় আসুন

–না, না, থাক দোতলায় না। যদি একটু জল।

—শুধু জল চাই? বাইরে তো বৃষ্টি পড়ছে, তাতে ধুয়ে নিন না।

–বৃষ্টি পড়ছে?

–খুব জোরে। বেরুলেই ভিজে যাবেন।

—তা হোক, আমি চলি। অনেক ধন্যবাদ।

ডাক্তার তার মেয়েকে বললেন, রিস্টু, ঐ লোকটার অসুখ কোনোদিন সারবে না।–আমি আর ডাক্তারের কথায় বিন্দুমাত্র ক্রুক্ষেপ না করে বেরিয়ে এলাম সুইং ডোর ঠেলে। বসবার ঘর পেরিয়ে। বাইরে সত্যিই বৃষ্টি।

কিছুক্ষণ আগে যে ঘূর্ণী হাওয়া উঠেছিল, তারই অনুসরণকারী এই বৃষ্টি। বেশ কেঁপে এসেছে। আমি ভিজতে ভিজতে রাস্তার মাঝখানে। দু’হাত পেতে জল নিয়ে হাত দুটো রগড়ে নিলাম। আকাশের দিকে মুখ রাখতেই কিছুক্ষণ সচ্ছলভাবে জলবর্ষণ হলো, ব্রণ থ্যাঁৎলানো জায়গাটা জ্বালা করে উঠলো। একটা ট্যাক্সির জন্য আমার মনপ্রাণ আকুল।

.

৩.

অফিস ছুটির পর যে রাস্তাঘাট মানুষে ছেয়ে যায়, সেসব মানুষ এখন কোথায়? খাঁ খাঁ করছে চৌরঙ্গি। জলে ভেজা রাস্তার ওপর দিয়ে যাওয়া গাড়ির চিটচিটে শব্দ। অন্য দু একটা গাড়িবারান্দার নীচে কিছু লোক জমে আছে, কিন্তু বাইবেল সোসাইটির বাড়ির বারান্দার নীচেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই। সাড়ে ছটা বাজে। গায়ত্রী এসে চলে গেছে? এই বৃষ্টির মধ্যে গেল কি করে? বুকের মধ্যে একটা বিষম উত্তেজনা। কোনোদিন গায়ত্রীর বাড়িতে গিয়ে দেখা করিনি। কিন্তু আজ গায়ত্রীর সঙ্গে আমার। দেখা করতেই হবে। ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিতে বললাম।

ট্যাক্সি স্টার্ট নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম ফুটপাতের ধার ঘেঁষে গায়ত্রী হাঁটছে। বসন্তকালের আকস্মিক বৃষ্টি, কেউ ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে বেরোয়নি, সুজাং পথে লোক নেই। গায়ত্রী একা হাঁটছে ভিজতে ভিজতে মিউজিয়ামের পাশের প্রশস্ত ফুটপাতে। মন্থর, অভিমানী তার পদক্ষেপ। কষ্ট হলো, গায়ত্রী আমাকে ভুল ভেবেছে। বৃষ্টির ভয়ে আমি আসিনি। তাইও ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজছে। ট্যাক্সিওলা, রোখকে। গায়ত্রী!

দরজা খুলে আমি অতি ব্যস্ততায় নেমে পড়েছি। এবার সে ঘুরে তাকালো। গায়ত্রী নয়। লম্বাটে ধরনের মুখ, অতিরিক্ত ফর্সা, কিন্তু সেই মুখ বিষণ্ণ ছিল। অন্য মেয়ে কিন্তু একটু একটু চেনা মনে হলো। ডাক্তারটিকেও একটু চেনা মনে হয়েছিল, কোথাও যেন আগে দেখেছি, কিন্তু মনে করতে পারিনি। এরও নাম মনে এলো না। কিন্তু মেয়েটি আমাকে চিনতে পেরে বললো, সনবাবু? আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন? আমাকে একটু বেকবাগানের মোড়ে পৌঁছে দেবেন? একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না— সাড়ে ছটার মধ্যে পৌঁছুরার কথা।

আমি খিদিরপুরের জন্য রওনা হয়েছিলাম, বেকবাগান অন্যদিকে। কিন্তু না বলা যায় না। আসুন। সঙ্কুচিতভাবে আমি সরে বসলাম। মেয়েটি হাতব্যাগের মধ্যে থেকে শুকনো রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে, ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে দেখা হলো। সাড়ে ছ’টা এখানেই বেজে গেছে!

আমার একমাত্র সৌভাগ্য, আমি একটা ট্যাক্সি অধিকার করতে পেরেছি মেয়েটিকে তার ভাগ দিতে হবে। কিন্তু কে এই মেয়েটি? বেকবাগানের দিকে দ্রুত ধাবমান ট্যাক্সির দশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটির কাছ থেকে আমার যে ওর নাম মনে নেই সে কথা বুঝতে না দিয়ে, ওর নাম কি করে জানা যায়? জিজ্ঞেস করি, গায়ত্রীর সঙ্গে আপনার দু’চারদিনের মধ্যে দেখা হয়েছিল?

—কে গায়ত্রী?

—গায়ত্রীকে চেনেন না? গায়ত্রী সান্যাল?

–না তো।

—আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?

—ও না, আপনি বুঝি আমায় চিনতে পারেন নি?

–না।

—তাহলে একটা অচেনা মেয়েকে ট্যাক্সিতে তুললেন কেন?

—আপনি তো আমার নাম ধরে ডাকলেন।

—শুধু সেইজন্যই? আপনি-কোনদিকে যাচ্ছিলেন?

–খিদিরপুর।

–তাহলে বেকবাগানে যাচ্ছেন কেন?

—তাতে কি হয়েছে, আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

–না, আমি যাবো না, আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।

—আরে না, না, তা কি হয়? চলুন না, বেকবাগান আর কতদূরে।

–না, আমি কিছুতেই যাবো না। আপনি আমার নাম জানেন না?

—আপনি কি করে জানলেন যে আমার নাম সনৎ?

—সেটা আপনার দেখার দরকার নেই। ট্যাক্সি, এখানে বেঁধে দিন!

—আরে একি করছেন! চলুন না, এইটুকু তো পৌঁছে দেওয়া।

মেয়েটি দরজা খুলতে গেলে, আমি হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করি। মেয়েটি হিংস্রভাবে মুখ ঘুরিয়ে আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন যে? লজ্জা করে না? একটা অচেনা মেয়ের…

—আরে ছি ছি, তা নয়। আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে চাইছিলাম।

একটা অচেনা মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার অত গরজ কিসের আপনার?

—অচেনা কোথায়? আপনি তো আমাকে চেনেন।

–দুজনে দুজনকে না চিনলে চেনা হয় না। আপনি হাত রান, আমি নেমে যাব। আমাকে অপমান করতে চাইছেন আপনি।

আমার হাসিও পাচ্ছিল, আবার বুকের মধ্যে একটু কান্না কান্না ভাব। এই এক রনের অভিমান। ধৈৰ্য্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিকে আমি নেমে যেতে দিলাম। নেমে গিয়ে মেয়েটি ব্যাগ খুলে একটা টাকা বার করে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। কথা বলতে গেলেই কথা বাড়বে। মেয়েটি তিক্ত গলায় বললো, এই নিন, এই রাঙটুকুর ভাড়া। আমি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে ড্রাইভারকে বললাম, চলিয়ে। মেয়েটি এবার একটু হাসলো, বললো আপনার কপালে কেটে গেছে বোধহয়। রক্ত পড়ছে। মুছে ফেলুন।

.

৪.

দূর থেকে দেখেছি, এ বাড়িতে কোনো-দিন ঢুকিনি। দরজা ধাক্কা দিতে প্রতদা নিজেই খুললেন। আমাকে দেখে মুখে চোখে হাসি, বললেন, আরে সন্তু, কি ব্যাপার, এসো, এসো, ভাবতেই পারিনি— কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। ইস, একেবারে ভিজে গেছ যে–তোয়ালে দিচ্ছি, মুখটুখ মুছে নাও!

সাদা তোয়ালের মাঝে মাঝে লাল ছাপ পড়তে লাগলো। ইস, কি রিক্তিকর! সুব্রতদা কোনো ভনিতা করলেন না, পুলকের ছোঁয়া লাগা মুখেই বললেন, গায়ত্রীর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছো তো? কিন্তু সে কি আর তোমার সঙ্গে আজ দেখা করবে? যা রাগ করে বসে আছে সারাদিন।

—কেন, রাগ করেছে কেন?

কি জানি। সন্ধেবেলা বেরুবে বলেছিল, আমি এত বললুম, কিছুতেই আর বেরুলো না। সকালবেলা খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে তো।

—কি নিয়ে ঝগড়া?

সুব্রতদা সস্নেহে আমার কাঁধে দু’হাত রাখলেন। বললেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয়, তা কি জিজ্ঞেস করতে আছে ভাই?

–সুব্রতদা, আপনি ওকে আবার মেরেছে?

ছিঃ, ওসব কথা জিজ্ঞেস করে না!

কাঁধ থেকে দ্রুতদার হাত সরিয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়ালাম। চোয়াল কঠিন। বললাম, সুব্রতাদা, আপনি জঘন্যভাবে অসভ্যের মত গায়ত্রীর ওপর অত্যাচার করেন, আমি সব জানি। এর একটা শেষ হওয়া দরকার।

–সব শেষ হয়ে গেছে। আর কিছু হবে না।

—তার মানে?

—গায়ত্রী আর কখনো তোমার সঙ্গে দেখা করবে না, আমাকে কথা দিয়েছে।

–আমার সঙ্গে দেখা করাটা কোনো ব্যাপার নয়। বিয়ের পর দেড় বছর আরা একদিনও দেখা করিনি। কিন্তু আপনি পশুর মতন… সুব্রতদা, আপনি গায়ত্রীকে জোর করে বিয়ে করেছিলেন কেন?

—নিজে কষ্ট পাবার জন্য। এই ছ’বছর আমার জীবনটা তো জ্বলে পুড়ে গেল।

—গায়ত্রী আপনার সঙ্গে গোড়ার দিকে অনেক মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। গায়ত্রীর মত ভালো মেয়ে—

সুব্রতদা পরম আহলাদ পেয়ে হাসার মন মুখ করে বললেন, কিন্তু তার যে একটা উকিল ছিল তোমার মতন—

—আমি কি করেছি?

—তুমি আর কি করবে? তুমি কিছুই করোনি, তোমার কিছু করার সাধ্যও নেই, তুমি শুধু শখের প্রেমিক সেজে থেকেছে। গায়ত্রীর মাথাটা তাতেই বিগড়েছে।

–সুব্রতদা, আমি গায়ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাবো ওপরে।

—খুব ভালো কথা। তার আগে একটা কথা শুনবে ভাই? মাথা ঠাণ্ডা করে শোনো। গায়ত্রীর সঙ্গে আমার মিটমাট হয়ে গেছে। সে আর আমার অবাধ্য হবে না। তুমি আর মাঝখান থেকে উৎপাত করতে এসো না। ডাক্তার এসে বলে গেছেন, গায়ত্রীর বাচ্চা হবে। চারমাস চলছে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াই। এইজন্যই সুব্রতদার সারা শরীর ভরা খুশী। পুনশ্চ আমার কাঁধে বন্ধুর মত সুব্রতদার হাত। ফিস ফিস করে বললেন, বিয়ে তো কয়রানি এধ্ব বুঝবে না। আমি ব্রারই গায়ত্রীকে বলেছিলাম, আমার দিক থেকে কোন দোষ নেই, ডাক্তার বলেছেন—

—আপনি সত্যি বলছেন?

এ প্রশ্নটা বলার জন্যই বলা! তদার চোখ ঝিকঝিকে, লম্পট পাষণ্ডটা আমার দিকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মত তাকিয়ে বললো, এসব কথা কেউ মিথ্যে বলে? একটা সিগারেট দাও তো। আছে?

—দোতলা বাড়িটার কোথাও কোনো শব্দ নেই। চাকর-টাকরও কারুকে দেখা যাচ্ছে না। সুব্রতদার কানের কাছে একটুখানি সাবানের ফেনা। এইমাত্র দাড়ি কামিয়েছেন।

—নেই, সিগারেট নেই।

–যাকগে তুমি তাহলে ওপরে যাবে গায়ত্রীর কাছে? ভেবে দ্যাখো, সে এখন মা হতে যাচ্ছে এখন কি আর তোমাদের ও ছেলেমানুষী মানায়?

—শুধু একবার দেখা করবো–

চলো। সুব্রতদা আমার হাত ধরে সিঁড়ির কাছে এলেন। দুধাপ উঠে আবার থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলবে ওকে?

-জানি না।

—আর কোনদিন আসবে না বলো?

—ও যদি না চায়, ও যদি বারণ করে…

—ও কি বোঝে? তোমাতে আমাতে কথা হচ্ছে–পুরুষ মানুষের ব্যাপার, মেয়েরা এসবের কি বোঝে?

—সুব্রতদা, আমাকে একবার ওপরে যেতে দিন।

আরও কয়েক ধাপ উঠে সুব্রতদা আবার দাঁড়ালেন। কি যেন উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। মুখটা একটু বদলে গেল। খরগোসের মতন চোখ। তারপর আবার হাসলেন— ও কিছু না। সন্তু একটা কথা সত্যি করে বলো তো? তুমি কোনদিন গায়ত্রীর সঙ্গে…

—ছাড়ুন ছাড়ুন আমাকে। ঠেসে ধরেছেন কেন?

–সন্তু, তোমাকে যদি এই সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিই?

—কেন, আমি কি করেছি?

—তুমি কিছু করোনি। সেইটাই তো তোমার দোষ। তুমি একটি ন্যাকা—

—আমার কাঁধ ছাড়ুন। ভালো হবে না বলছি!

ইয়ার্কি করছি, তাও বোঝো না? তোমার কপালে রক্ত কেন? ব্রণ ফাটিয়েছো তুমি? দেখি, দেখি,–

—খবরদার, আপনি আমার কপালে হাত দেবেন না। না, বলছি—

—হাত দেবো কেন? রক্ত ছুঁতে আমার ঘেন্না করে। দেখছিলাম

নীচের দরজায় শব্দ হলো। সুব্রতদা আবার উত্তীর্ণ, সারা বাড়ির স্তব্ধতা ফাটিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে? দরজায় আবার শব্দ। আমাকে ছেড়ে বিদ্যুতের গতি, সুব্রতদা লাফিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে ছুটলেন। পিছনে পিছনে আমিও। দরজার সামনে গায়ত্রী দাঁড়িয়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে, নতমুখ, চুল থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। সিঁথির সিদূর গলে একটুখানি গড়িয়ে এসেছে নীচে। অনেকটা আমারই মতন রক্তাক্ত কপালের দৃশ্য। দরজায় হাত রেখে গায়ত্রী স্থির চোখে দেখলো দুজনকে। আমার চোখে চোখ রাখলো না। শরীরটা কাঁপছে ওর। আমি গায়ত্রীকে ডাকতে ভয় পেলাম। একদম মরতে ইচ্ছে করে না আমার। আমার খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

পৃথিবীতে যত বিষ, গলায় সব মিশিয়ে সুব্রতদা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুমি আবার ফিরে এসেছো? লজ্জা করে না? গায়ত্রী আমার দিকে তাকালো না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, কাঁদতেই লাগলো, আমি ঠায় দাঁড়িয়ে— গায়ত্রীর দিকে আমার দু-চোখ। গায়ত্রী চোখ মুছলো, আমাকে দেখলো না, সুব্রতদার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো, আমাকে ক্ষমা করো, না ফিরে আমার উপায় নেই, আমাকে ক্ষমা করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *