1 of 2

ছায়া গোধূলি – উত্তম ঘোষ

ছায়া গোধূলি – উত্তম ঘোষ

…অনেক ভেবে মনস্থির করে ফেলেছি। তোমার দুই চোখের অতলগভীর দৃষ্টির আহ্বানকে ফিরিয়ে দেবার শক্তি আমার নেই। কাল তোমার জন্মদিনের সানন্দক্ষণে তুমি আমাকে আপন করে নিয়ে একান্ত নিভৃতে যে শপথ গ্রহণ করবে, সেই হবে আগামী দিনে আমাদের মিলন স্বর্গ রচনার শুভ সূচনা। …কোন ভয়, কোন সংকোচ আর নেই। কথা দিলাম, আমি আসছি, তোমার কাছে, চিরদিনের জন্য। …

‘তোমার, এবং এখন একমাত্র তোমার জয়িতা’—

এই কথা ক’টাও লেখা হয়ে গেল।

রাত একটা।

টেবিল ল্যাম্পের আলোর নীচে জয়িতার লেখা মুক্তোর মত অক্ষরগুলো হাল্কা নীল রাইটিং প্যাডে মনে হতে পারে সন্ধের আকাশের গায়ে কতগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘের টুকরো। কালো, কিন্তু উজ্জ্বল। কালো। জগতের আলো।

পাশের ঘরেনা, ঠিক পাশের ঘর বললে ভুল হবে, ঘরের বাইরে লাউঞ্জে একটা সোফা কাম-বেডের ওপর জয়র চাদরমুড়ি দেওয়া অস্তিত্বটাকে এখুনিই একটু খোঁচা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। যদিও অনেক রাতে খাটাখাটুনির পর শুয়েছে। বেচারা, হ্যাঁ, জয়িতার এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে জয়ন্তকে একটু বেচারা’, দ্য পুওর ফেলো, মনে হচ্ছে বৈকি!

–কিছু বলেই ডাকতে হবে না।

–তার মানে।

—আমাদের মধ্যে ডাকাডাকির পর্ব শেষ হয়ে আসছে।

কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। সত্যি, সে এতখানি কল্পনা করেনি। অনেক গুজব কানে আসছিল, পথে-ঘাটে। অফিসে, দু-চার জন তথাকথিত বন্ধুর মুখেও লাউঞ্জে সোফাঁকাম-বেডে জয়ন্তের শয্যাগ্রহণ শুরু হয়েছে প্রায় একবছর আগে। ভালোই মনে আছে জয়িতার—এবং জয়ন্তেরও কবে শেষ তারা এক শয্যায় নিশিযাপন করেছিল। এবং কবে শেষবারের মতো—এই বিশাল সুন্দর আধুনিক দ্বি শয্যার আশ্রয়ে তারা একত্র হয়েছিল নিতান্ত দ্বিধাগ্রস্ততার মধ্যে! এবং সেই নিতান্ত মেকানিকাল এক উপভোগ্যতার শেষে তাদের বাকি রাতের কথাবার্তাগুলো দুজনের কারুর পক্ষেই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার নয়।

—আর অভিনয় করতে পারছি না—জয়িতা আক্ষেপের সুরে স্পষ্টই বলে ফেলেছিল।

—অভিনয়?—জয়ন্ত বোধহয় বুঝেও না বোঝার ভান করছিল। অর্থাৎ সে-ও অভিনয় করছিল। অন্তত জয়িতার তাই মনে হয়েছিল।

-হ্যাঁ, আজ সাত-আট মাস ধরে আমি অভিনয় করছি। কিন্তু খুব কাঁচা ভাবে, হেলাফেলা করে যাতে তুমি সেটা ধরে ফেলতে পার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয় তুমি ধরতে পারছ না আমার ছদ্ম আচরণগুলো, আর নয়, ধরতে চাইছ না—ইচ্ছে করেই হয়তো।

—আমি কিন্তু সত্যি তোমার কথার মানে ধরতে পারছি না জয়ি—

–প্লিজ আমাকে নাম ধরে ডাকাটা বন্ধ কর।

–সে কি, কি বলে ডাকব তাহলে?

—কিছু বলেই ডাকতে হবে না।

–তার মানে।

—আমাদের মধ্যে ডাকাডাকির পর্ব শেষ হয়ে আসছে।

কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। সত্যি, সে এতখানি কল্পনা করেনি। অনেক গুজব কানে আসছিল। পথে-ঘাটে, অফিসে, দু-চার জন তথাকথিত বন্ধুর মুখেও কিছু কিছু কথা সে শুনে আসছিল। জয়িতার কিছু বেপরোয়া আচরণ এবং উত্তরোত্তর তার বৃদ্ধি কলায় কলায়, এবং পাড়ায় নানা বয়সি রাশি লোকেদের ফিসফিস—এমন কি কিছু রোয়াকের ছেলের মুখ ঘুরিয়ে ছুঁড়ে মারা পরোক্ষ মন্তব্য–সব কিছুই বলছিল—সামথিং ইজ রং।

তারপর এই ব্যাপারগুলো, হুইস্পার ক্যাম্পেন ইত্যাদি বেশ সোচ্চার এবং স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছু ‘চক্ষেণ পশ্যতি’ ব্যাপারও ঘটল। তবু জয়ন্তর মন বলছিলনা, অসম্ভব, এ হতে পারে না। সারাজীন অভাবে কাটিয়েছে জয়িতা, এখন একজনের কল্যাণে সে একটু সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছে তাই সাড়া দিচ্ছে। এর বেশি কিছু নয়।

আজ পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেল—জয় শ্রীহীন সংসারের শ্রীবৃদ্ধির কোন সম্ভাবনাই ছিল না। গয়না, কসমেটিক্স দুরের কথা, একটা ভালো শাড়ি কোনদিন স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পারেনি জয়স্ত। তাই–

কিন্তু, তাই কি? জয়িতাকে তত বিয়ের পর থেকে টানা চার বছর একবারও মনে হয় নি টাকাপয়সার টানাটানিতে সে অসুখি! তাই সেই রাতে জয়ন্ত প্রশ্ন করেছিল—কেন, আমাদের ডাকাডাকির পর্ব শেষ হবে কেন?

জয়িতা জ্বলন্ত দৃষ্টিবাণ ছুঁড়ে বলেছিল–তুমি কি অন্ধ?

সত্যিই জয়ন্ত অন্ধ। নইলে আরও স্পষ্ট করে উত্তর শুনতে চেয়েছিল কেন? যে উত্তর শোনার আগে তার বধির হওয়া ভালো ছিল। চোখ এবং কান থাকতেও সে বোধহয় অন্ধ ও বধির হতেই চাইছিল।

—আমি কিন্তু সত্যি কিছু বুঝঝি না।

—তবে শোন, আমি শ্ৰীমন্ত মুখার্জীকে ভালবাসি।

ঘরে বজ্রপাত হয়েছিল। কিন্তু তাই বাজপড়া একটা গাছের মতো হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। আর জয়িতাকে মনে হচ্ছিল একটা রূপোলী সাপ—যেটা বিদ্যুৎ হয়ে বাজটাকে ডেকে এনেছিল।

দোষটা তো জয়ন্তেরই। তার কারখানার মালিক শ্ৰীমন্ত মুখার্জির সাথে কোন প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ওঠে না। মুখার্জি এন্টারপ্রাইজ-এর একমাত্র কর্ণধার শ্ৰীমন্ত সত্যি শ্রী ও শোভায় মস্ত। তার পাদনখকণা জয়ন্ত। তাই শ্ৰীমন্ত যখন জয়িতাকে আহ্বান জানিয়েছিল, বলেছিল— আমি কোন জোর করব না। দাবি জানাব না। শুধু আবেদন করব। তুমি আমার ঘরে এসো

—কিন্তু–চমকিত জয়িতা সেই সন্ধেবেলা চমকেছিল, আবার পুলকিত হয়েছিল। অপরাধবোধের সাথে চোখের সামনে ঝলকানি দিচ্ছিল এক অনন্ত সুখের জগৎ—বিশাল বাড়ি, অতি সুন্দর গাড়ি, আর শিক্ষিত রুচিশীল বড়লোক এক পুরুষের ডাক। হোক না তার বয়স একটু বেশি, কিন্তু তার দেহের সৌন্দর্য অটুট। মনের সৌন্দর্যও মুগ্ধ করার মতো। সত্যি শ্ৰীমন্ত।

—কিন্তু কি?

—জয়রে কি দোষ?

—ওর দোষ ওর অযোগ্যতা। ওর দারিদ্র। তোমাকে যেখানে ঠাই দেওয়ার কথা, সেটা দেবার ক্ষমতা ওর নেই।

সেটা ছিল শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর চতুর্থ আগমন। জয়ন্ত জয়িতার দীর্ণজীর্ণ ঘরে। জয়ন্ত তখন দোকানে মিষ্টি কিনতে গেছে। হঠাৎ বসে’র গাড়ির হর্নে বিস্মিত হয়ে আপ্যায়নের সাধারণ নিয়মটুকু মানবার জন্য তাকে ছুটতে হয়েছিল বাইরে—পকেটের সামান্য কয়েকটা টাকা সম্বল করে, বিশাল বিমূঢ়তা নিয়ে।

জয়িতা ব্যস্ত হয়েছিল রান্না ঘরে যেতে। চা করতে। কিন্তু জয়িতার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিল শ্ৰীমন্ত। শ্ৰীমন্তর কঠিন মুঠোতে জয়িতার হাত যেন বন্দী হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল।

-এখুনি চা করতে ব্যস্ত হতে হবে না।

–বসুন, পাখাটা পাড়ি।

–না, তারচেয়ে আমরা বারান্দায় দাঁড়াই। সুন্দর হাওয়া আসছে।…. আচ্ছা একেই কি ‘দখিনা পবন’ বলে?

কারখানার মালিক-এর মধ্যে এত কবিত্ব!

জয়িতার মুগ্ধতা স্বাভাবিক।

এবং ঠিক যে সময়ে সিঙ্গাড়া-আর রসগোল্লা কিনে, পকেটের পাই-পয়সা উজাড় করে বাড়ির দিকে ছুটছিল জয়ন্ত, হাঁটাপথে এখনও প্রায় দশ মিনিট—তখনই শ্ৰীমন্ত জয়িতাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। সেই অন্ধকার বারান্দায়। বলেছিল— কোন ভয় নেই, আমি তোমায় চিরকালের জন্য চাই। সামাজিক মর্যাদা দিয়ে চাই। আমার অতীত ভুলিয়ে দাও। আমার কাছে এসো।

—কিন্তু আমার এই ঘর—

এ ঘরে তোমাকে মানায় না।

শ্ৰীমন্তের আলিঙ্গনাবদ্ধ জয়িতা বাকরুদ্ধ। শ্ৰীমন্ত এখন প্রতিশ্রুতি চাইছে—

—তুমি কথা দাও—

ঠিক তখুনিই কি উত্তর দিত জয়িতা তা সে নিজেও জানে না। তাই বোধহয় ‘ঠুং’ করে কলিং বেলটা বেজে উঠল। খাবারের প্যাকেট হাতে জয়ন্ত দ্বারের ওপারে। মালিকের আপ্যায়নের জন্য মরিয়া। যদিও মালিক ইতিমধ্যেই নিদারুণ অ্যাপায়িত বোধ করেছেন। পকেটের শেষ পয়সা দিয়ে জয়ন্তের আনা সিঙ্গাড়া রসগোল্লা তাই মূল্যহীন।

শ্ৰীমন্ত মুখার্জী শুধু হেসে বলেছিলে—তুমি আবার ছুট মারলে কোথায়? আমি চা-ছাড়া কিছু খাব না।

তাই সেইরাতে ঘরে বজ্রপাতটা তো জয়ন্তই নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনেছিল। আগের ঘটনাগুলো থেকেই তো চোখের ঠুলি খসে পড়ার কথা। তাই বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ’—তখন কেউ আমার অস্তিত্ব টের পায় না। মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে।

ঠিক তাই। জয়ন্তের মাথায় বাজ ফেলেই টের পাওয়াতে হলোবাজ পড়েছে বটে।

আজ রাতে তাই বেচারা, পুওর ফেলো জয়ন্তকে এখন—প্রায় মাঝ রাতে তুলতে হবে। নাকি, কথাটা কাল বললেও চলবে?

চিঠিটা খামে এঁটে একটু ভাবল জয়িতা।

না, না, কেমন যেন টেনশন হচ্ছে। এখন মনটা ঠিক মুডে আছে। কাল দিনের বেলা ‘পুওর ফেললা’র গোবেচারা মুখ দেখে আবার যদি ধন্দ শুরু হয়।

না, এখনই বিহিত করতে হবে। এই ক-মাস প্রচুর ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কাল শ্ৰীমন্তর—জন্মদিন। কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। শ্ৰীমন্দ্র বিশাল ড্রইংরুমটা অবশ্য নতুন সাজে সাজবে। ফুল ভালোবাসে জয়িতা। তাই ফুলের আসর বসবে। আর শ্ৰীমন্তর একান্ত সাধ—ফুলের গয়না পরবে জয়িতা!

গাড়ি আসবে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছ’টায়। জয়িতা শ্ৰীমন্তর বাড়ি পৌঁছবে সাতটা? আটটায় আসবেন কয়েকজন। রেজিষ্ট্রেশন ম্যারেজের notice এ সই করবে।

শ্ৰীমন্ত ও জয়িতা। তারপর

তারপর কি, জয়িতাও জানে না।

কিন্তু এত পরিকল্পনা অনেক আগে জেনেও, বহুবার শ্রীমত্র বান্ধনে ধরা দিয়েও, বহুবার ঠোঁটের লিপস্টিকের আস্তরণ নষ্ট করেও, পরিষ্কার হ্যাঁ’-টা বলা হয়ে ওঠেনি জয়িতার।

তাই পরশু আল্টিমেটাম এসেছে। বিরহ-যাতনার অভিমানী বিদায়সম্ভাষণঃ ‘আগামী সতেরই জুন আমার জন্মদিন। ঐ দিন আমার আটচল্লিশ বক্স পূর্ণ হবে। উনপঞ্চাশে পা দেওয়ার মুহূর্তটা যদি আমার একা কেটে যায়, তবে বাকি জীবনটাও তাই কাটবে—যেমন কেটে এসেছে।

…মাঝে মাত্র একটা দিন, একটা রাত। কাল ২৭ জুন, আমাকে মানসিকভাবে হত্যা করার জন্য অথবা নতুন জীবন দানের জন্য তুমি দায়ী থাকবে। আমি ১৭ জুন সকাল বারোটা পর্যন্ত তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। বারোটা পার হয়ে গেলে…কি হবে, আমিও জানি না। …শ্ৰীমন্ত।

সর্বনাশ।

এখন রাত দুটো। কাল সকাল বারোটা তো এসে গেল।

ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে লাউঞ্জের আলো জ্বালল জয়িতা। বেশ ভালোই জানে সে-জয়য়ে ঘুম পাতলা। তবু একটু উঁচু স্বরেই ডাকল—একবার একটু উঠতে হবে। দরকার আছে।

অ্যাজ এক্সপেক্টেড, ধড়মড় করে উঠে বসল জয়ন্ত। সোফা-কাম-বেডে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে চাদরটা মুখেনাকে জড়িয়ে একটা কৌতুকবহ অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলল, তাই এত সিরিয়াস সুগম্ভীর অবস্থাতেও হাসি পেল জয়িতার আহা, বেচারা। বড় ঘরটা এক সুন্দর সাজানো ড্রইং রুম যেখানে শ্ৰীমন্ত এসে বসে। তাই পত্নীপরিত্যক্তা স্বামীর আলাদা কথা এই ইনসাইড লাউঞ্জ। শয্যা সোফা কাম বেড। এখানে তো খাটিয়া পাতা সম্ভব নয়। প্রথমে একটা ক্যাম্প-খাট ছিল। ক্রমশ জয় শয্যা প্রমোশন পেয়ে এখন একটা সোফা কাম-বেড পেয়েছে। দিনের বেলা এটা সোফা, রাতে বেড।

স্বামীর স্পর্শ ও সংস্পর্শ–বিশেষ করে নৈশকালীন সংস্পর্শ—এড়াতে এর চেয়ে সুন্দর ও সহজ উপায় আর কি আছে?

–কি হয়েছে?–উৎকণ্ঠিত জয়ন্ত।

–মুখটা ধুয়ে আমার ঘরে এখুনিই একবার এসো।

যো হুকুম! আজ বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল জয়ন্ত শুধু জরুকা-গোলাম নয়; কেমন একটা রোবটে পরিণত হয়ে গেছে।

নিজের ঘরে দুগ্ধ ফেনিল শয্যার ওপর বেশ রিল্যাক্স করেই বসল জয়িতা। জয়ন্ত সামনে দাঁড়িয়ে। একটা চেয়ার রয়েছে। কিন্তু বসার স্কুম না হলে

—বেচারা!—আবার মনে মনে হাসল জয়িতা। বলল বসো।

যো হুকুম! বসল জয়ন্ত। যেন মালকিনের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় বিশ্বস্ত ভৃত্য কৃতার্থ হলো বসার মর্যাদা পেয়ে।

–শোন, কালকে কথাটা বলার সময় হবে না। সকাল থেকেই ব্যস্ত থাকব। তাছাড়া একেবারে শেষ মুহূর্তে জানালে তোমারও কিছু অসুবিধা হতে পারে। তাই

জয়ন্তের ভাবলেশহীন মুখ। আজকাল প্রতিক্রিয়া বিশেষ বোঝা যায় না, তাছাড়া রোবটের আবার প্রতিক্রিয়া কিসের। কিন্তু এই মুহূর্তে জয়িতার কথায় রোবটের চোখেও যেন এক বিস্ময়ের প্রশ্নালু দৃষ্টি জেগে উঠল। কিন্তু কোন কথা নেই!

সামান্য ‘পজ’ দিয়ে জয়িতা বলল—খুব একটা নতুন ব্যাপার নয়। আমার ধারণা—তুমি এতদিনে বিষয়টা বুঝেছ।

আবার পজ, সংক্ষিপ্ত বিরতি কথার মধ্যে, পারফেক্ট ড্রামাটিক সাসপেন্স, বজায় রেখে।

রোবটের প্রশ্নালু দৃষ্টি আরেকটু গভীর হলো মাত্র। কিন্তু এখনও কোন বাক্যস্ফুর্তি নয়।

জয়িতা বুঝল-আর ভণিতা করে সময় নষ্টে লাভ নেই। এ হেন আকাট লোককে সোজাসুজি ‘হিট’ করাই ভালো। এরা বোধহয় সফিস্টিকেটে ভাষা বোঝে না। শিল্পসম্মত কলা-কৌশল, ভঙ্গী, ইঙ্গিত এদের বুদ্ধির অগম্য।

-শোন, কাল আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। আমার সামান্য কিছু জিনিষপত্র পরে নিয়ে যাব। তুমি এই ফ্ল্যাটে ইচ্ছে হলে থাকতে পার, বা অন্যত্র খুশি মতো কোথাও চলে যেতে পার। সেটা তোমার ব্যাপার।

ফ্ল্যাট! সত্যি এটা তো ফ্ল্যাট। যার ভাড়া প্রায় দু’হাজার টাকা। এবং সেটা শ্ৰীমন্ত মুখার্জী একটা এক্সেপশনাল ফেবার করে জয়ন্তকে দেন। এই রকম এইচ. আর. এ —অর্থাৎ হাউস রেস্ট অ্যালাউন্স জয়ন্তর মতো সুপারভাইজার-এর পাওয়ার কথা নয়। তবু পেয়েছে জয়ন্ত, এবং কেন পেয়েছে-সেটা বুঝেছে কিনা কে জানে। এই স্পেশাল অফারটার সময় অস্ফুট মৃদু প্রতিবাদ করেছিল বটে। কিন্তু শ্ৰীমন্ত মুখার্জী মালিক, তার উপর সুবক্তা।

আমাদের এই কারখানা আসলে একটা ফ্যামিলি। লক্ষ করেছ—এখানে লেবার ট্রাবল হয় না। আমার বাবা এটাকে মানি-মেকিং-মেশিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেননি। আমিও সেই ট্রাডিশন মেনে আসছি। আমার কারখানায় সিনসিয়ারিটির দাম সবচেয়ে বেশি। অ্যান্ড আই ফাউন্ড ইউ টু বি আ ভেরি সিনসিয়ার ওয়ার্কম্যান। সো দিস ফ্ল্যাট আলাউয়েন্স ইজ আ রিওয়ার্ড টু ইউ।একটা ভালো দেখে ফ্ল্যাট খুঁজে নাও তাড়াতাড়ি। সাউথ ব্লকে পাবে। পেতে অসুবিধে হলে, আমায় জানিও।

-স্যার, আমি এতটা আশা করতে পারিনি, আপনি সত্যিই—

–প্লিজ স্টপ। আমার কোন কথা এর মধ্যে নেই।

জয়ন্ত কোনমতে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসছিল। শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর জলদগম্ভীর ডাক শুনে আবার দাঁড়াতে হলো।

—শোন। রিমেম্বার দিস অফার ইজ টেম্পোরারি। এভিরিথিং ডিপেন্ডস্ অন হাউ ইউ ক্যারি অন….ও.কে?

-ইয়েস স্যার।

—ফ্ল্যাটে শিফট করেই আমাকে জানাবে। তোমার বাড়ির পুরনো মালপত্র বিশেষ নিও না। আমার ইনটিরিওর ডেকর ওটা সাজিয়ে দেবে। এর ফাইনেন্সিয়াল সাইডটা তোমাকে ভাবতে হবে না। .ধরে নাও, দিস উইল বি মাই গিফট টু জয়িতা—সেদিন ওর গান আমাকে সত্যিই চামড় করে দিয়েছিল—অ্যান্ড আই প্রমিজড় হার আ রিওয়ার্ড।

শ্ৰীমন্ত কথা থামিয়ে জয়ন্তর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিলেন। বিস্মিত জয়ন্ত আরও হবাক। বাশক্তি ফিরে পেয়ে আবার ‘ধন্যবাদ’ বলতে চাইল, কিন্তু গলার স্বর জড়িয়ে গেল।

–কাট ইট। ঐ থ্যাংকস গিভিংটা আমি জয়িতার মুখ থেকে শুনতে চাইব। …সো লঙ…

অর্থাৎ এখন তুমি যেতে পার। ভদ্র ভাষায় ‘গেট-আউট’।

কিন্তু তখনও কি জয়ন্ত বুঝেছিল তাকে জয়িতার জীবন থেকেও ‘আউট’ করে দেওয়া হবে? কে জানে!

ঢং! রাত্রি আড়াইটা। সতেরই জুন তো বারোটার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছ। বেলা বারোটা আর মাত্র সাড়েন’ঘণ্টা দূরে। শ্রীমন্তের প্রতীক্ষা অবসানের এবং চূড়ান্ত সিদ্ধারে ডেলাইন।

এখনও কোন প্রশ্ন এলো না রোবটের মুখ থেকে।

বেপরোয়া জয়িতা তাই নিজেই এবার প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো। লোকটাকে দিয়ে কিছু কথা বলাতেই হবে!

–ধারণা করতে পারছ নিশ্চয়—কোথায় যাচ্ছি।

–না। এতক্ষণে মুখ খুলল রোবট।

—শিট!

ক্ষিপ্ত, ডিসগাস্টেড জয়িতা ভাবল–এই লোকটাকে নিয়ে এতদিন সে ঘর। করেছে কি করে। অবশ্য সাথে সাথে এটাও ভাবতে বাধ্য হলোনা, লোকটা প্রথম থেকে তো এমন ছিল না। সাত-আট মাস হলো এমন বদলে গেছে। যেন অর্ধ-উন্মাদ।

তাই একটু ভয়ও জেগেছে জয়িতার মনে। সব কিছুই যারা মানতে থাকে, সব কথাতেই ইয়েস বলে—তারা ঠিক সুবিধের হয় না।

অ্যাবরাপ্টলি জ্যাম্পকাটের টেকনিক্‌ নিল জয়িতা। কাগজপত্র পরশু পেয়ে যাবে। সই করে দেবে। তারিখ বসিও না।

রোবট চুপ।

—কি এখনও বোঝনি, কোথায় যাচ্ছি আমি। আর কি ঘটতে চলেছে? আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে?

–বুঝেছি।

—কি বুঝেছ?

–যে ঘরে, যেখানে তোমায় মানায়, তুমি সেই ঘরে যাচ্ছ।

—তোমার কিছু বলার আছে?

–না।

—কেন নেই?—হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করে ওঠে জয়িতা। অবার এই প্রশ্ন—যার উত্তরের কোন প্রয়োজন নেই। বু মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে কথাটা।

—তোমার যেটা যোগ্য, উপযুক্ত স্থান, সেখানেই তুমি যাচ্ছ। আমি তো তোমায় তোমার উচিত জায়গা দিতে পারিনি।

-সেটা বুঝতে পেরেছ?

–বুঝেছি বলেই তো বললাম।

–কবে থেকে বুঝেছ?

-যেদিন শ্ৰীমন্ত মুখার্জী প্রথম আমাদের সেই পুরনো বাড়িতে এলেন। সেদিন থেকে। প্রায় বছরখানেক আগে।

–সবই যখন এতদিন ধরে বুঝেছ, তখন এমন কিছুই বোঝনি ভান করতে কেন?

—তোমার কোন অসুবিধে ঘটাতে চাইনি, আর—

–আর?

—আর এ সময়টার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম—কখন তুমি চলে যাবার কথা বলবে, পাকাঁপাকি সিদ্ধান্ত নেবে।

-ওঃ, বুঝেও ভেজা বেড়ালের মতো চলতে?

—বেড়ালটাকে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে। কি করবে সে?

–বঃ ব্রেভো, এত সুন্দর কথা বলতে কবে শিখলে?

–অবস্থাই শিখিয়ে দিল।

এইবার বুঝল জয়িতা, ভুল হচ্ছে। রোবট আবার মানুষ হয়ে উঠছে। প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এবং সেটার জন্য জয়িতাই দায়ী। যে কোন মুহূর্তে কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নেবে। সাবধান হতে হবে। কাজের কথা সব সেরে ফেলতে হবে। মোটামুটি সারা হয়ে গেছে অবশ্য।

তবু আবার অকস্মাৎ অসাবধানতা—তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে না।

–কষ্ট?

—হ্যাঁ, মানে, কোন অসুবিধে–

—অসুবিধে হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে।

জয় উত্তর অতি স্পষ্ট।

সর্বনাশ। আবার আত্মহত্যাপ্রবণ কথাবার্তা চলে আসছে। জয়িতা করছে কি!

—এই কষ্ট ক’দিনের মাত্র। পরে বই ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ডিভোর্সের পর তুমি তো বিয়েও করতে পারবে।

—এ কষ্ট আমার চিরদিন থাকবে।

চলে যায় জয়ন্ত। ধীর পায়ে।

.

আলো নিভিয়ে আবার যখন জয়িতা নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মগ্ন, তখন রাত তিনটে। শ্রীমঙ্ক চেহারাটা আর আগামীকালের কিছু ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্য সিনেমার মতো দেখতে দেখতে ঘুমাবার চেষ্টা করল সে।

সিনেমা সে দেখল-ও বটে! তবে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় কয়েকটি দৃশ্য। আজ থেকে বহু বছর আগে, বিয়ের কয়েক মাস পরের সময়ের একটি ছোট্ট টি.ভি. সিরিয়াল। এক পর্বের, আধ-ঘণ্টার মতো।

দৃশ্যটা এই রকম।

…ঠাকুর ঘর। রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরোয়া পরিবেশ। মীরাভজন গাইছে জয়িতা…অব শুনি ম্যয় হরি আওয়ন কি আওয়াজ….।

জয়িতার পূজারিণী বেশ। লালপাড় সাদা শাড়ি। খালি গা। আঁচল জড়ানো। অপূর্ব সুন্দরী ভক্তিমতীরূপ। জয়িতা গাইছে কব আও গে মহারাজ…

…হঠাৎ দরজার কাছে জয়রে আগমন। পরণে গেঞ্জি ধুতি। শান্ত সৌম্য চেহারা।

ওদের এই দীনদরিদ্র ভাড়াটে বাড়ির ওরা নিজেরাই একটা নামকরণ করেছিলঃ জয়-জয়িতা। লোকে ভুল কেরে প্রথমে পড়তঃ জয়-জয়ন্তী।

আরাধনার গানে চোখ বুজে থাকা জয়িতা টেরই পায়নি জয়ন্তের চুপিসারে উপস্থিত। তাই বাধ্য হয়ে দরজায় জোরে টোকা মারে জয়ন্ত। টক-টক-টক।

চোখ খোলে জয়িতা, বিস্মিত এবং ব্রিজ।

–একি, এই সময়ে? পুজোর ঘরে?

—কেন, পুজোর ঘরটায় আমার কোন অধিকার নেই নাকি। আমি এতই পাপী

ধমকের সুর জয়িতার কণ্ঠে—যাও, চান সেরে নাও। কটা বাজল খেয়াল নেই। আজ লেট হলে মাইনে কাটবেওয়ার্নিং দিয়েছে না?

জয়ন্তর মধ্যে নড়বার কোন লক্ষণ প্রকাশ পেল না। সূরাং চোখ বুজে গান শুরু করতে গিয়ে আবার বাধা পায় জয়িতা। জয় মতলবমার্কা উপস্থিতি।

একি, তবু দাঁড়িয়ে আছ? যাও বলছি। বললাম তো–আমি আসছি।

—আর কতক্ষণ?

–মানে?

—মানে—আর কতক্ষণ শুধু দেবতার আরাধনা চলবে। ঘরের প্রাণীটা যে আর ধৈৰ্য্য ধরতে পারছে না। সে তো দেবতা নয়, মানুষ।

জয়িতার কাঁধের আঁচল সরে গিয়েছিল। সেদিকে নজর পড়ে জয়জ্ঞ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে গায়ের আঁচল ঠিক করে জয়িতা।

–খবরদার, কোন অসভ্যতা করবে না।

—কিন্তু আমার যে ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে তোমায়। একটুখানি, সামান্য, প্লিজ ….

–সাবধান, ওই বাসি কাপড়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকবে না কিন্তু। যাও, স্নান সেরে নাও। ভাত ফুটে এসেছে।

জয়ন্ত তবু দাঁড়িয়ে। এইবার তাই সুর নরম করে জয়িতা লক্ষ্মী সোনা আমার যাও

–যাচ্ছি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারব না…আরে পতিদেবতাও কিছু পুজো চাইতে পারে। গানটান নাইবা হলো—কিন্তু–

—আবার অসভ্যতা। তুমি যাবে?

হাসতে থাকে জয়ন্ত–যাচ্ছিঃ। বাব্বা, স্বামীকে কেউ এইভাবে দূর-দূর করে ওঠে! জয়ন্ত চলে যায়।

জয়িতাও হাসে-ই, পতিদেবতা!

তারপরে বিগ্রহকে প্রণাম করে, গান শুরু করে।

পরের দৃশ্য :

স্নান সেরে খেতে বসেছে জয়ন্ত। মাটিতে পাত-পাতা। পাশে হাতপাখা হাতে জয়িতা। জয় পরনে সুপারভাইজারের ইউনিফর্ম। কারখানার।

জয়িতার নজর যায়জামার একটা বোম নেই।

–আঃ, আবার সেই ছেঁড়া জামাটাই গায়ে দিলে। কেন আরেকটা যে ইস্ত্রি করে রাখলাম।

জল খায় জয়-ওটা এখন প্রলে চলবে না। কাল ফ্যাক্টরিতে আমাদের একটা গেট-টুগেদার আছে। কারখানার ওয়ার্কাস রিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবস। মালিক শ্রীমবাবু আসবেন। ওটা তাই কালকের জন্য ভোলা থাক। আজ এটা দিয়েই

মুখ ধুতে ধুতে আরেকটা সারপ্রাইজ ঘোষণা করে জয়ন্ত—তাড়াতাড়ি ফিরব। নাইট শো সিনেমায় যাব—ভুলে গেছ?

–একে দেরি করে যাচ্ছ, কি করে তাড়াতাড়ি ফিরবে?

 —ম্যানেজ করতে হবে।

বেরিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয় জয়ন্ত।

জয়িতা খুশিই, ম্যানেজ মাস্টার।

তারপরেই ভীষণ গম্ভীর মুখ

—আমি যাব না।

—সে কি, আবার হাঁড়িমুখ করার কি হলো।

হঠাৎ জয়িতার মনের কিছু জমাট ক্ষোভ কথার বাম্প হয়ে বেরিয়ে আসে—মাসের শেষ। দুধের টাকা বাকি। রেশন আনা হয়নি।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় জয়িতা। অর্থাৎ জয়ন্ত্রে কাছে মুখের ভাব গোপন করতে চায়।

–বাড়িওয়ালার বৌ কাল খোঁটা দিয়ে গেছে। হুঃ, এই সময় সিনেমা।

জয়ন্ত বিরক্ত—এই একঘেয়ে, কথাগুলো আর ভালো লাগে না।

ঘুরে জয় মুখোমুখি হয় জয়িতা। চোখের কোণায় জল—কিন্তু কথাগুলো কি মিথ্যে?

এগিয়ে আসে জয়ন্ত। জয়িতার দুকাঁধে হাত রেখে বলে—তাই বলে কি সব সময়, সমস্ত মুহূর্তে শুধু অভাবের ব্যাপারগুলোকে পুজো করতে হবে?

জয়িতার চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা তুলে ধরে জয়ন্ত। চুমুর মুডটা তৈরি হয়নি এখনও।

—আরে বাবা, গরীরেও যেটুকু সাধ-আহলাদ থাকে, সেটা আপনা থেকে পূরণ হয় না। বেশ খানিকটা চেষ্টা করে মেটাতে হয়। রাতদিন খালি গেলাম, মরলাম, এটা নেই, সেটা নেই, কাল কি হবে—এই ভাবতে থাকলে জীবনটা যে বরবাদ হয়ে যাবে।

জয়িতার রাগ কমে এলেও, রেশটুকু রয়েছে।

-হ্যাঁ, তাই চারদিকে খোঁচাসানটা-তাগাদা খেয়েও সেজেগুঁজে লোক হাসিয়ে সিনেমা যাওয়া চাই।

জয়ন্ত হাসে–চাই-ই তো। গরীব বড়লোক যাই বল, প্রত্যেক মানুষের সুখী হবর অধিকার আছে।

আরও জোরে হাসতে থাকে এবং তারপরেই জয়িতাকে বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরে। যেন হারিয়ে যাবে জয়িতা। জয়িতা ঠোঁটের উপর আলতো কামড় দেয় জয়ন্ত। জয়িতারউঃ শুনে বলে—আগে বলো—ঠিক বলেছি কিনা, নইলে কিন্তু আরও জোরে!

মুক্তি পাবার জন্যই হোক, অথবা স্বামী সোহাগে মানসিক বিবর্তনে হোক, জয়িতা বলে—ঠিক বলেছ।

এইবার ঘর ছেড়ে রেবার আগে গান ধরে জয়ন্ত–

—মোরা গরীব হতে পারি,
 (তা বলে) সুখের সাথে নয়তো আড়ি–
(তাই) মুখ কোর না হাঁড়ি।

শেষ দৃশ্য :

জয়ন্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কারখানার দিকে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে হাত নাড়ে জয়িতা। একটু জোরে বলে—তাড়াতাড়ি ফিরো–

জয়ন্ত সম্মতিসূচক হাত নাড়ে। দূরে মিলিয়ে যায় সাইকেল।…

ঝনঝন করে কি যেন ভাঙল কোথাও। মনে হয় কাঁচের কোন জিনিস।

ঘুম ভেঙে যায় জয়িতার, আজকের জয়িতার। দুগ্ধফেনিল শয্যায়। চমকে উঠে বসে। জানলার ওপারে আকাশ সাদাটে-ঘোলাটে হয়ে এসেছে।

.

সরেই জুনের সকাল।

জন্মদিনেও কাজের কামাই দেন না শ্ৰীমন্ত মুখার্জী। তবে তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সুন্দরী, আধুনিকা রুবি রায় বিশেষ ব্যস্ত ছিল টেলিফোনে শেষ পর্বের কিছু জরুরি কাজ সারতে। বোঝা গেল, আজকের সন্ধের ‘বসে’র বার্থ-ডে পার্টিতে কবি রায়কে থাকতে হবে। এতদিন বাদে এমন একটা নাটকীয় কাণ্ড হতে চলেছে—শ্ৰীমন্ত মুখার্জী বিয়ে করছেন, বা অফিসিয়ালি সংসারী হওয়ার অঙ্গীকার নিচ্ছেন। সেখানে তার চিরবিশ্বস্ত সহযোগী রুবি রায় না থাকলে চলবে কি করে?

কিন্তু আজ বেশিক্ষণ অফিসে থাকবেন না শ্ৰীমন্ত মুখার্জী। কারণ যে যে এনগেজমেন্ট ও রুটিন প্রোগ্রামগুলো আছে, সেগুলো ঘড়ি ধরে সারতে হবে।

তাই বেলা সাড়ে বারোটার সময় শ্ৰীমন্ত মুখার্জী ও রুবি রায়কে দেখা গেল সাবার্বান সুইমিং ক্লাবে, যেখানে নারীপুরুষের একসাথে জলবিহারে কোন বাধা নেই। সানগ্লাস চোখে ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে বেতে চেয়ারে বসে ম্যাগাজিনে চোখ বুলোতে বুলোতে কখন এক বোতল বিয়ার প্রায় শেষ করে এনেছেন শ্ৰীমন্ত মুখার্জী, তখনই লেডিজ ক্লোকরুম থেকে আবির্ভূতা হলো রুবি। তার পাতাল সাদা ওভার-অলের নীচে টকটকে লাল বিকিনি-টু-পিস সুইমিং কম—শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর নির্লিপ্ত কালো চশমার ওপর হঠাৎ আলোর ঝলকানি হানল।

চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে, ম্যাগাজিনটা হেলায় ছুঁড়ে ফেলে হাসলেন শ্ৰীমন্ত। ছুটে এসে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল রুবি। তারপর পাশের চেয়ারটায় বসল।

—আপনাকে আজ রিয়েলি দারুণ চার্মিং লাগছে স্যার রুবি উচ্ছ্বসিত।

হাসলেন শ্ৰীমন্ত রুবি, আজ আমি উনপঞ্চাশে পা দেব। বয়সটা তো শিগগিরই হাফ-সেঞ্চুরি করে ফেলবে। দশ বছর আগে এসব কথায় দারুণ ফ্ল্যাটার্ড হতাম কিন্তু এখন আর–

রুবি মাথা ঝাঁকায়—ফ্ল্যাটারি নয় স্যার, বিশ্বাস করুন, ইউ আর লুকিং ভেরি মাচ হ্যান্ডসাম। বয়স আপনার মাথার চুলে কিছু ছাপ রাখলেও শরীরের আর কোন

জায়গা ছুঁতে পারেনি। বহু ইয়ং ছেলে আপনাকে হিংসে করবে।

শ্ৰীমন্ত আবার হাসে–আঃ রুবি, তুমি এ মাসেই আবার একটা ইনক্রিমেন্ট আদায় করে ছাড়বে!

রুবি মোটেই ঘাবড়াবার পাত্রী নয়—এবার কিন্তু স্যার আমি সত্যিই রাগ করব। আপনার বিজনেসম্যান আত্মাটা কোন সময়েই আপনার মাথা থেকে নামে না। তাই সব কথাতেই মোটিভ ধরে বসেন। আজকে আপনার এবড় একটা শুভদিনে আমি কেন মিথ্যে বলব বলুন তো?

শুভ দিন!

হ্যাঁ, সত্যিই শুভদিন। আজ বেলা এগারটার মধ্যেই চিঠি এসে গেছে অনেক ভেবে মনস্থির করে ফেলেছি। তোমরা দু-চোখের অতল গভীর দৃষ্টির আহ্বানকে ফিরিয়ে দেবার শক্তি আমার নেই..কথা দিলাম—আমি আসছি, তোমার কাছে, চিরদিনের জন্য…। এখন একমাত্র তোমার—জয়িতা।

হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান শ্ৰীমন্ত।

—আচ্ছা রুবি, আজকের ব্যাপারটা সত্যি উচিত হচ্ছে তো? তুমি তো সবই জান! নিশ্চয় এতদিনে এটাও বুঝতে পার—সারাজীবন আমি অদ্ভুত এক রাশিচক্রের তাড়নায় একা রয়ে গেছি। হয়তো বাকি জীবনটাও সেভাবেই কেটে যেত। কিন্তু হঠাৎ….

রুবি বাধা দেয়—ওসব চিন্তা ছাড়ুন স্যার। এত বড় কোম্পানির মালিক আপনি, হাজার লোকের সংসার আপনার মুখ চেয়ে থাকে, সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে—

—কিন্তু কাল থেকে যদি তারা অন্য দৃষ্টিতে দেখতে থাকে? অশ্রদ্ধা আসে? অবকোর্স, আই ডোন্ট কেয়ার—তবু সবাই কি আমাকেই দায়ী করবে না? সবাই কি বলবে না—টাকা আর প্রতিপত্তির জোরে আমি আমার এক নির্দোষ নিরীহ কর্মচারীর ঘর ভেঙ্গে দিলাম?

—মোটেই না। জয়িতাদেবী তো ছেলেমানুষ নন। তিনি স্বেচ্ছায় আপনার কাছে আসছেন। আপনি তাকে ফিরিয়ে দেবেন কেন? জয়বাবুর ক্ষমতা থাকলে ওকে আটকে রাখুক। আপনি তো কোন জোর করছেন না।

ধীরে ধীরে মেঘ কাটে। শ্ৰীমরে মনের মেঘ। হা রুবি তো যুক্তিসঙ্গত কথাই বলছে।

আবার হাসেন শ্ৰীমন্ত-এবার তোমার কথা বলো। তোমার আর কিরণের বিয়ে কবে হচ্ছে?

লজ্জা পাওয়ার মেয়ে না হয়েও একটু লজ্জা পায় রুবি।

—তার জন্য তাড়া কিসের?

—দেরিও বা কিরে? সারা জীবন শুধু প্রেম করেই কাটিয়ে দেবে? আমরা নেমন্তন্ন খেতে পাব না।

কথা ঘোরায় রুবি স্যার ঘড়ি দেখুন, টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে।

ঘড়ি দেখে চমকে ওঠেন শ্ৰীমন্ত। সত্যিই তো অনেকটা সময় কেটে গেছে। বলেন—অল রাইট, ইউ দেন গেট রেডি।

আমি তো রেডি বলে ওভারঅল লাল-বিকিনি পরা মোমের পুতুল হয়ে যায় রুবি। মাথায় ক্যাপটা লাগাতে লাগাতে ডাইভিং বোর্ডের দিকে এগোয়।

–আমি এগোচ্ছি, আপনি আসুন।

ঝপাং।

রুবির ডাইভের জলশব্দ শোনা যায়। ড্রেসিং গাউন খুলে মানের পোষাকে সাঁতারের জন্য প্রস্তুত হন শ্ৰীমন্ত। এবং ঠিক সেই সময়েই কোনায় রাখা টেলিফোন বেজে ওঠে।

ক্রিং ক্রিং! ক্রিং ক্রিং!

আবার ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে টেলিফোন ধরেন শ্ৰীমন্ত।

হ্যালো। ওপারে পুলিশ অফিসারের বরফ শীতল গলা—

—আমি এস. পি. বলছি। সন্ধেবেলা বাড়িতে থাকবেন। আনফরচুনেটলি, আমাদের ডিউটি আমাদের করতে হবে। ইনকাম ট্যাক্স, বৈদেশিক মুদ্রা আইন ইত্যাদি আরও কয়েকটি ইকোনমিক অফেন্সের জন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে। বাড়িতে ফোন করে জানলাম—আজ আপনাদের একটা সামাজিক ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে তাই। আমরা একটু রাত করেই যাব। সাপোেজ, অ্যারাউন্ড ও ইলেভেন—ততক্ষণে নিশ্চয়….

খবরের ধাক্কাটা সামলাতে একটু সময় লাগল শ্ৰীমন্তর। তভু যথাসম্ভব উত্তেজনা চেপে শান্ত স্বরে বললেন—আসবেন।

.

সন্ধে সাড়ে ছটায় শ্রীমন্তর গাড়ি আসবে। এখন দুপুর একটা। দেড় ঘণ্টা আগে—অর্থাৎ সাড়ে এগারটায় শ্রীমন্তর ফোন এসেছিল। তার মানেজয়িতার চিঠি বাড়ির পিওন মারফত শ্ৰীমন্তর হাতে পৌঁছে গিয়েছিল এগারোটা নাগাদ। ডেডলাইন ওভার হবার একঘণ্টা আগে।

–এখন ফোনে কিছু বলতে পারছি না। অফিসের চেয়ারে বসে ভয় করছে—যদি আমার উচ্ছাস বাঁধ ভেঙ্গে সব ডেকোরাম ভুলিয়ে দেয় তাই একটু পরেই বেরিয়ে যাচ্ছি। ক্লাবে স্নান-খাওয়া সেরে বাড়ি চলে যাব। খুবই লিমিটেড কয়েকজন উপস্থিত থাকবে। রুবি থাকবে তোমার পরিচৰ্য্যায়। ও-ও ভীষণ খুশি—একটা কথাই শুধু এখন বলছি। মনে হচ্ছে সন্ধেটা আসতে যেন একযুগ দেরি করছে।

—আমারও তাই মনে হচ্ছে।

–ফুলের সাজ! মনে আছে?

—আছে।

—গাড়ি ঠিক সাড়ে ছটায়।

—ঠিক আছে।

—তোমরা আসতে যেন সাতটা-এক না হয়।

–সাতটা বাজতে এক হতে পারে তো?

টেলিফোনের ওপারে হেসেছিল শ্ৰীমন্ত–হ্যাঁ, তা হতে পারে। মোট কথা, ইউ ওন্ট বি লেট বাই ইভেন ওয়ান মিনিট।

–যদি হয়—

—দেখবে আমি নেই!

–তার মানে?

—মানে, আমি উর্ধলোকে—

—ছিঃ,—মিষ্টি ধমক সুরেলা হয়ে উঠেছিল জয়িতার গলায়–আর দ্বিতীয়বার এমন কথা বলবে না।

…তাই এখন বেশ পাশবালিশটা জড়িয়ে শ্ৰীমন্তর ফটোটা আরেকবার মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জয়িতা। এর আগে বোধহয় একলক্ষ বার দেখেছে। এরপর এই ফটোর মানুষটাই ফটোটা এখন যেখানে রয়েছে—একদম বুকের ওপর—সেইখানে চলে আসবে।

এই মানুষটা জয়িতাকে পুনর্জন্ম দিল বলা যায়।

বিকেল থেকেই শ্ৰীমন্ত জয়িতার আওয়স-কি-আওয়াজের জন্য কান পেতে থাকবে।

সত্যিই, সন্ধেটা আসতে যেন এক যুগ দেরি।

এবং শ্ৰীমন্তর ছবিটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল জয়িতা। সব কিছু—অর্থাৎ এখন যেসব জিনিষপত্রগুলো নিয়ে যাবে—তৈরি আছে। চারটের মধ্যে উঠে পড়ে সাজসজ্জা রূপচর্চা। অপরূপা জয়ি যখন সর্বজয়ী রাজকন্যার মতো ঝলমল করে উঠবে—তখনই হয়তো শোনা যাবে শ্ৰীমন্ত গাড়ির হর্ন।

কিন্তু আশ্চর্য, বিধান কি বেরসিক—ঘুমের আগেই একটা দুর্বোধ্য টেলিফোন এলো-থানা থেকে বলছি। আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি—শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর বাড়িতে সন্ধেবেলা আপনার যাওয়া উচিত হবে না।

চমকিত উত্তেজনায় কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফোনটা রেখে দেওয়া হলো ওদিক থেকে।

নিজেকে সামলে নিল জয়িতা। অতীতেও এই ধরনের বহু উটকো টেলিফোন এসেছে অশ্লীল, অশালীন, ভীতি প্রদর্শন, শ্রীমম্ভর নামে কুৎসিত অপবাদ। শ্ৰীমন্ত বলেছিল—অল কুলপিট? ইগনোর দেম। এসব তুচ্ছ ব্যাপার আমাদের সুখ-শান্তি নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে না।

শ্ৰীমন্তর সেই ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভয়বাণীগুলো স্মরণ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল জয়িতা।

কিন্তু নিষ্ঠুর রসিক বিধাতার আবার কৌতুক। আবার স্বপ্নে উদিত হলো সেই অতীরে দৃশ্যগুলো সিনেমার মতো।

…জানলার কাছে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত। আজ হঠাৎ অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবর্ন।

সামনের মুদির দোকান থেকে টুকটাক কয়েকটা রান্নার জিনিষ কিনে ঘরে ঢুকেই জয়ন্তকে দেখে অবাক জয়িতা।

-কি ব্যাপার, আজ এত—

মুখ ফেরায় জয়ন্ত। অতি বিষণ্ণ মুখ।

খুব বিপদে পড়ে গেছি, জয়ি—

–কি হয়েছে?

কোনমতে জিনিষগুলো রেখে প্রায় ছুটে আসে জয়িতা।

জয়ন্ত বলে বিয়ের সময় আগরওয়ালার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়েছিলাম। তারপর নানা ঝাটে, দেখতেই পেয়েছ—তোমার অসুখ গেল, বাবা। মারা গেলেন, একটার পর একটা….তাই কিছুই শোধ দেওয়া যায়নি।

চুপ করে যায় জয়ন্ত। জয়িতা অস্থির।

—কিন্তু বিপদটা কি হলো?

আবার মুখ খোলে জয়ন্ত-সুদে-আসলে অঙ্কটা বেশ বড়ই দাঁড়িয়ে গেছে …আজ অফিসে এসে সকলের সামনে বিশ্রিভাবে শাসিয়ে গেল—তিনদিনের মধ্যে

–পুরো টাকা শোধ দিতে হবে।

–কত টাকা?

—তা প্রায় হাজার পাঁচেক হবে।

—পাঁচ হাজার!–এবার জয়িতাও চিন্তিত, বিষণ্ণ।

জয়ন্ত মৃদু কনসেশন শোনায়—আপাতত, পুরোটা না পারলেও, মানে অল্প কিছু দিলেও কদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে।

—অল্প কিছু? কত?

–ধরো, এই হাজার দেড়-দুই—

কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে জয়িতা। তারপর নিজের হাতের দু-গাছা চুড়ি, আর কানের দুল দুটো দ্রুত খুলে ফেলে।

—আপাতত এটা ধরো—ম্লান হাসি জয়িতার মুখে।

জয়ন্ত চমকে ওঠে–না না,এটা সম্ভব নয়—

—কেন নয়? এখন মানটা বাঁচাও, তারপর আবার সময়মতো করে দেবে।

না জয়ি, এ পর্যন্ত আমি তোমাকে নিজে থেকে কিছুই দিতে পারিনি। আর এখন, ….তার উপর তোমার বাবা-মা যেটুকু দিয়েছিলেন—আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন কি বলতেন–

–বলতেন—বেশ করেছিস, সংসারের প্রয়োজনেই তো এগুলো দেওয়া। পটের বিবি সেজে থাকার জন্য নয়–

জয়ন্ত স্থবির।

–নাও, ধরো, তুমি তো পরে আবার বানিয়ে দেবে।

–জানি না।…এই তো রোজগার। ধরো, যদি কোনদিনই দিতে না পারি?

–নাই বা পারলে।–এবার জয়িতার মুখে কেমন একটা বিজয়িনীর হাসি।

জয়স্তর গলা দুহাতে জড়ায় জয়িতা, বুকে মাথা রাখে—আমার আসল অলংকার তো এইখানে।

ঠিক এক সময়ে কে যেন উঁচু গলায় চিৎকার করে—কাট্‌।

ক্যামেরা, আলোর কাজ থেমে যায়।

কোন সুটিং চলছিল?

কে যেন অন্ধকার কোন থেকে বলে ওঠে—একেবারে ভিজে প্যাঁচপ্যাচে সেকেলে রোমান্স হয়ে গেল ডিরেক্টর সাহেব। দর্শক এই বই নেবে কি! নাচ গান ডেয়ারিং প্রেসের দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত দর্শকেরা হল ছেড়ে চলে যাবে।

ঘুম ভেঙ্গে যায় জয়িতার।

ইস, আবার সেই দুঃস্বপ্ন।

ঘড়িতে চারটে। এখুনি উঠতে হবে যে—বু উঠতে পারে না জয়িতা। কাল রাতে আর আজ দুপুরের স্বপ্নগুলো তো আসলে স্বপ্ন নয়। ওতো এই জীবনেই ঘটেছিল, গত জন্মে নয়। এই হাত দুটোই তো জড়িয়েছিল জয়ন্তের গলা। আজ সেই হাত দুটো কার গলা জড়াবে। এই মাথাটা স্থান পেয়েছিল জয়ন্ত্রে বুকে আজ

কেমন স্লথ, অলস, প্যারালেটিকাল একটা অবস্থা ছেয়ে ফেলে জয়িতার দেহমন। শয্যা ছেড়ে ওঠার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে জয়িতা।

হঠাৎ বুকটা কেঁপে ওঠে। দুপুরে থানা থেকে একটা ফোন এসেছিল না? কি যেন বলল পুলিশ? এখন মনে হচ্ছে—ওই ফোনটা ঠিক আর দশটা উটকো ভুতুড়ে ফোনের মতো নয়। রীতিমত সিরিয়াস কোন সতর্কবাণী। কিন্তু কেন?

জয়ন্ত এখন কোথায়? বাড়িতে নেই—সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারখানায়, রয়েছে কি এখনও? আর দশটা দিনের মত কাজ করে যাচ্ছে? সাড়ে পাঁচটায় ছুটি। বাড়ি আসতে আসতে প্রায় সাড়ে ছ’টা। তখন ফিরে জয়িতাকে তো আর দেখতে পাবে না জয়ন্ত। জয়িতা তখন অনেক দূরে একযুগ দূরে, অতীতের কেউ, একটা ছায়া বা একটা স্মৃতি। অথবা একটা কল্পনা মাত্র।

ভাবতে ভাবতে আরও নিথর হয়ে যায় জয়িতা। আঃ, জয়ন্ত আজও আসতে এত দেরি করবে। আর, আরো আশ্চর্য লোকটা তো একবারও এক মুহূর্তের জন্যেও বলল না—যেও না। কেন?

বাধা না পেলে ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে কোন মজা নেই। খেলায় ওয়াক-ওভার পেয়ে যেমন কোন আনন্দ হয় না।

কানের কাছে বারবার বাজছে একটা গানের সুর—

মোরা গরীব হতে পারি–
(তা বলে) সুখের সাথে নয়কো আড়ি–

 (তাই) মুখ করো না হাঁড়ি–

কে যেন বলছে—আমার আসল অলংকার তো–

ভিজে প্যাঁচপ্যাচে রোমান্স। খুব ভালো। বলার মধ্যে কিন্তু কোন ফাঁকি ছিল না। চোখের জলে জয়ন্তের পাঞ্জাবি ভিজেছিল—হয়তো বা এতই কেঁদেছিল জয়িতা যে জয় জামা প্যাঁচপ্যাচে হয়েই ভিজে গিয়েছিল। আজকের দিনের যাত্রার দৃশ্যের মতো। মেলোড্রামা। কিন্তু একবিন্দু কৃত্রিম কিছু ছিল না এই মেলোড্রামার মধ্যে।

আবার কেমন একটা ঘুম আসছে।

লড়াই করে বু একবার উঠবার চেষ্টা করল জয়িতা। কিন্তু বৃথা। মুখের কাছে একটা মুখ, সেইরকম হাসছে সুখের সাথে নয়কো আড়ি-মুখ করো না হাঁড়ি।

দুই হাতে সেই মুখটাকে কাছে টানতে চেষ্টা করল জয়িতা। কিন্তু ফাঁকা শূন্যে এলোমেলো ঘুরে ফিরে এলো হাতটা? আঃ সেই রক্ত মাংসের, শান্ত সৌম্য, দুষ্টমিষ্টি চোখের, চাপা হাসির মুখটা কই? কোথায়?

আবার সেই পরম ক্লান্তি এবং সেই প্রগাঢ় ঘুমের ঢেউ। ঘুমিয়ে পড়ল জয়িতা।

এবং টেরও পেল না কখন সাড়ে ছটা পেরিয়ে গেছে।

রক্ত মাংসের সেই মুখটাকে যখন সত্যিই দুহাতে ধরতে পারল জয়িতা, তখন রাত এগারটা…

…ঠিক সেই সময়েই বোধহয় এস. পি. সাহেবের গাড়ি এবং পুলিশের জিপ শ্ৰীমন্ত মুখার্জির বাড়ির গেটে ব্রেক কষল।

বারান্দা থেকে নেমে এসে এস. পি.-কে রিসিভ করলেন শ্ৰীমন্ত। এস. পি. জিজ্ঞেস করলেন—আশাকরি আপনার পারিবারিক অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে? ..অ্যাট লিস্ট, আমরা ব্যাঘাত ঘটাইনি।

অবকোর্স নট, হাসলেন শ্ৰীমন্ত-চলুন।

পুলিশের গাড়ি শ্ৰীমন্তকে নিয়ে এগিয়ে চলল। সিগারেট ধরালেন শ্ৰীমন্ত-আই অ্যাম এ স্পেসালি থ্যাংক ফুল টু ইউ এস. পি সাহেব। ইউ হ্যাভ স্টপ মি ইন কমিটিং অ্যানাদার অফেন্স…ইস ক্যাক্ট মাচ মোর সিরিয়াস দ্যান ইকোনমিক অফেন্স ইট কুড হ্যাভ বিন অফ রিয়েলি ইনহিউম্যান ক্রাইম.এ কাইন্ড অব ব্লডলেস মার্ডার, হাঃ হাঃ–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *