মিস্ ম্যানিং-সম্পাদিত ন্যাশনাল ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পত্রিকায় মারাঠি গাথা সম্বন্ধে অ্যাক্ওঅথ্ সাহেব-রচিত প্রবন্ধবিশেষ হইতে বর্ণিত ঘটনা সংগৃহীত। |
|
রণক্ষেত্র অমাবাই ও বিনায়ক রাও, |
|
অমাবাই। | পিতা! |
বিনায়ক রাও। | পিতা! আমি তোর পিতা! পাপীয়সী স্বাতন্ত্র৻চারিণী! যবনের গৃহে পশি ম্লেচ্ছগলে দিলি মালা কুলকলঙ্কিনী! আমি তোর পিতা! |
অমাবাই। | অন্যায় সমরে জিনি স্বহস্তে বধিলে তুমি পতিরে আমার, হায় পিতা, তবু তুমি পিতা! বিধবার অশ্রুপাতে পাছে লাগে মহা অভিশাপ তব শিরে, তাই আমি দুঃসহ সন্তাপ রুদ্ধ করি রাখিয়াছি এ বক্ষপঞ্জরে। তুমি পিতা, আমি কন্যা, বহুদিন পরে হয়েছে সাক্ষাৎ দোঁহে সমর-অঙ্গনে দারুণ নিশীথে। পিতঃ, প্রণমি চরণে পদধূলি তুলি শিরে লইব বিদায়। আজ যদি নাহি পারো ক্ষমিতে কন্যায় আমি তবে ভিক্ষা মাগি বিধাতার ক্ষমা তোমা লাগি পিতৃদেব! |
বিনায়ক রাও। | কোথা যাবি অমা? ধিক্ অশ্রুজল। ওরে দুর্ভাগিনী নারী, যে বৃক্ষে বাঁধিলি নীড় ধর্ম না বিচারি সে তো বজ্রাহত, দগ্ধ, যাবি কার কাছে ইহকাল-পরকাল-হারা? |
অমাবাই। | পুত্র আছে– |
বিনায়ক রাও। | থাক্ পুত্র। ফিরে আর চাস নে পশ্চাতে পাতকের ভগ্নশেষ-পানে। আজ রাতে শোণিততর্পণে তোর প্রায়শ্চিত্ত শেষ– যবনের গৃহে তোর নাহিকো প্রবেশ আর কভু। বল্ তবে কোথা যাবি আজ? |
অমাবাই। | হে নির্দয়, আছে মৃত্যু, আছে যমরাজ, পিতা হতে স্নেহময়, মুক্ত দ্বারে যাঁর আশ্রয় মাগিয়া কেহ ফিরে নাই আর। |
বিনায়ক রাও। | মৃত্যু? বৎসে! হা দুর্বৃত্তে! পরম পাবক নির্মল উদার মৃত্যু– সকল পাতক করে গ্রাস– সিন্ধু যথা সকল নদীর সব পঙ্করাশি। সেই মৃত্যু সুগভীর তোর মুক্তি গতি। কিন্তু মৃত্যু আজ না সে, নহে হেথা। চল্ তবে দূর তীর্থবাসে সলজ্জস্বজন আর সক্রোধসমাজ পরিহরি, বিসর্জি কলঙ্ক ভয় লাজ জন্মভূমি-ধুলিতলে। সেথা গঙ্গাতীরে নবীন নির্মল বায়ু, — স্বচ্ছ পুণ্যনীরে তিন সন্ধ্যা স্নান করি, নির্জন কুটিরে শিব শিব শিব নাম জপি শান্ত মনে, সুদূর মন্দির হতে সায়াহ্নপবনে শুনিয়া আরতিধ্বনি, — একদিন কবে আয়ুঃশেষে মৃত্যু তোরে লইবে নীরবে– পতিত কুসুমে লয়ে পঙ্ক ধুয়ে তার গঙ্গা যথা দেয় তার পূজা-উপহার সাগরের পদে। |
অমাবাই। | পুত্র মোর! |
বিনায়ক রাও। | তার কথা দূর কর্। অতীতনির্মুক্ত পবিত্রতা ধৌত করে দিক তোরে। সদ্যশিশুসম আর বার আয় বৎসে, পিতৃকোলে মম বিস্মৃতিমাতার গর্ভ হতে। নব দেশে, নব তরঙ্গিণীতীরে, শুভ্র হাসি হেসে নবীন কুটিরে মোর জ্বালাবি আলোক কন্যার কল্যাণকরে। |
অমাবাই। | জ্বলে পতিশোক বিশ্ব হেরি ছায়াসম; তোমাদের কথা দূর হতে আনে কানে ক্ষীণ অস্ফুটতা, পশে না হৃদয়মাঝে। ছেড়ে দাও মোরে, ছেড়ে দাও। পতিরক্তসিক্ত স্নেহডোরে বেঁধো না আমায়। |
বিনায়ক রাও। | কন্যা নহেকো পিতার। শাখাচ্যুত পুষ্প শাখে ফিরে নাকো আর। কিন্তু রে শুধাই তোরে কারে ক’স পতি লজ্জাহীনা! কাড়ি নিল যে ম্লেচ্ছ দুর্মতি জীবাজির প্রসারিত বরহস্ত হতে বিবাহের রাত্রে তোরে– বঞ্চিয়া কপোতে শ্যেন যথা লয়ে যায় কপোতবধূরে আপনার ম্লেচ্ছ নীড়ে– সে দুষ্ট দস্যুরে পতি ক’স তুই! সে রাত্রি কি মনে পড়ে? বিবাহসভায় সবে উৎসুক-অন্তরে বসে আছি, — শুভলগ্ন হল গতপ্রায়,– জীবাজি আসে না কেন সবাই শুধায়, চায় পথপানে। দেখা দিল হেনকালে মশালের রক্তরশ্মি নিশীথের ভালে, শোনা গেল বাদ্যরব হর্ষে উচ্ছ্বসিল অন্তঃপুরে উলুধ্বনি। দুয়ারে পশিল শতেক শিবিকা; কোথা জীবাজি কোথায় শুধাতে না শুধাতেই ঝটিকার প্রায় অকস্মাৎ কোলাহলে হতবুদ্ধি করি মুহূর্তের মাঝে তোরে বলে অপহরি কে কোথা মিলালো। ক্ষণপরে নতশিরে জীবাজি বন্ধনমুক্ত এল ধীরে ধীরে– শুনিনু কেমনে তারে বন্দী করি পথে লয়ে তার দীপমালা, চড়ি তার রথে, কাড়ি লয়ে পরি তার বরপরিচ্ছদ বিজাপুর-যবনের রাজসভাসদ দস্যুবৃত্তি করি গেল। সে দারুণ রাতে হোমাগ্নি করিয়া স্পর্শ জীবাজির সাথে প্রতিজ্ঞা করিনু আমি– দস্যুরক্তপাতে লব এর প্রতিশোধ। বহুদিন পরে হয়েছি সে পণমুক্ত। নিশীথসমরে জীবাজি ত্যজিয়া প্রাণ বীরের সদগতি লভিয়াছে। রে বিধবা, সেই তোর পতি– দস্যু সে তো ধর্মনাশী। |
অমাবাই। | ধিক্ পিতা, ধিক্! বধেছ পতিরে মোর– আরো মর্মান্তিক এই মিথ্যা বাক্যশেল। তব ধর্ম-কাছে পতিত হয়েছি, তবু মম ধর্ম আছে সমুজ্জ্বল। পত্নী আমি, নহি সেবাদাসী। বরমাল্যে বরেছিনু তাঁরে ভালোবাসি শ্রদ্ধাভরে; ধরেছিনু পতির সন্তান গর্ভে মোর, বলে করি নাই আত্মদান। মনে আছে দুই পত্র একদিন রাতে পেয়েছিনু অন্তঃপুরে গুপ্তদূতী-হাতে– তুমি লিখেছিলে শুধু, “হানো, তারে ছুরি।” মাতা লিখেছিল, “পত্রে বিষ দিনু পূরি, করো তাহা পান।” যদি বলে পরাজিত অসহায় সতীধর্ম কেহ কেড়ে নিত তা হলে কি এতদিন হত না পালন তোমাদের সে আদেশ? হৃদয় অর্পণ করেছিনু বীরপদে। যবন ব্রাহ্মণ সে ভেদ কাহার ভেদ? ধর্মের সে নয়। অন্তরের অন্তর্যামী যেথা জেগে রয় সেথায় সমান দোঁহে। মাঝে মাঝে তবু সংস্কার উঠিত জাগি; কোনোদিন কভু নিগূঢ় ঘৃণার বেগ শিরায় অধীর হানিত বিদ্যুৎকম্প, অবাধ্য শরীর সংকোচে কুঞ্চিত হত– কিন্তু তারো পরে সতীত্ব হয়েছে জয়ী। পূর্ণ ভক্তিভরে করেছি পতির পূজা; হয়েছি যবনী পবিত্র অন্তরে; নহি পতিতা রমণী– পরিতাপে অপমানে অবনতশিরে মোর পতিধর্ম হতে নাহি যাব ফিরে ধর্মান্তরে অপরাধীসম।–একি! একি! নিশীথের উল্কাসম এ কাহারে দেখি ছুটে আসে মুক্তকেশে! রমাবাইয়ের প্রবেশ জননী আমার! কখনো যে দেখা হবে এ জনমে আর হেন ভাবি নাই মনে। মা গো, মা জননী, দেহ তব পদধূলি। |
রমাবাই। | ছুঁস নে যবনী পাতকিনী! |
অমাবাই। | কোনো পাপ নেই মোর দেহে– নির্মল তোমারি মতো। |
রমাবাই। | যবনের গেহে কার কাছে সমর্পিলি ধর্ম আপনার? |
অমাবাই। | পতি-কাছে। |
রমাবাই। | পতি! ম্লেচ্ছ, পতি সে তোমার! জানিস কাহারে বলে পতি! নষ্টমতি, ভ্রষ্টাচার! রমণীর সে যে এক গতি, একমাত্র ইষ্টদেব। ম্লেচ্ছ মুসলমান ব্রাহ্মণকন্যার পতি! দেবতা-সমান! |
অমাবাই। | উচ্চ বিপ্রকুলে জন্মি তবুও যবনে ঘৃণা করি নাই আমি, কায়বাক্যে মনে পূজিয়াছি পতি বলি; মোরে করে ঘৃণা এমন কে সতী আছে? নাহি আমি হীনা জননী তোমার চেয়ে– হবে মোর গতি সতীস্বর্গলোকে। |
রমাবাই। | সতী তুমি! |
অমাবাই। | আমি সতী। |
রমাবাই। | জানিস মরিতে অসংকোচে? |
অমাবাই। | জানি আমি। |
রমাবাই। | তবে জ্বাল্ চিতানল। ওই তোর স্বামী পড়িয়া সমরভূমে। |
অমাবাই। | জীবাজি? |
রমাবাই। | জীবাজি বাগ্দত্ত পতি তোর। তারি ভস্মে আজি ভস্ম মিলাইতে হবে। বিবাহরাত্রির বিফল হোমাগ্নিশিখা শ্মশানভূমির ক্ষুধিত চিতাগ্নিরূপে উঠেছে জাগিয়া; আজি রাত্রে সে রাত্রির অসমাপ্ত ক্রিয়া হবে সমাপন। |
বিনায়ক রাও। | যাও বৎসে, যাও ফিরে তব পুত্র-কাছে, তব শোকতপ্ত নীড়ে। দারুণ কর্তব্য মোর নিঃশেষ করিয়া করেছি পালন– যাও তুমি। অয়ি প্রিয়া, বৃথা করিতেছে ক্ষোভ। যে নব শাখারে আমাদের বৃক্ষ হতে কঠিন কুঠারে ছিন্ন করি নিয়ে গেল বনান্তরছায়ে, সেথা যদি বিশীর্ণা সে মরিত শুকায়ে অগ্নিতে দিতাম তারে; সে যে ফলে ফুলে নব প্রাণে বিকশিত, নব নব মূলে নূতন মৃত্তিকা ছেয়ে। সেথা তার প্রীতি, সেথাকার ধর্ম তার, সেথাকার রীতি। অন্তরের যোগসূত্র ছিঁড়েছে যখন তোমার নিয়মপাশ নির্জীব বন্ধন– ধর্মে বাঁধিছে না তারে, বাঁধিতেছে বলে। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। যাও, বৎসে, চলে যাও তব গৃহকর্মে ফিরে– যাও তব স্নেহপ্রীতিজড়িত সংসারে, অভিনব ধর্মক্ষেত্রমাঝে। এসো প্রিয়ে, মোরা দোঁহে চলে যাই তীর্থধামে কটি মায়ামোহে, সংসারের দুঃখ-সুখ-চক্র-আবর্তন ত্যাগ করি– |
রমাবাই। | তার আগে করিব ছেদন আমার সংসার হাতে পাপের অঙ্কুর যতগুলি জন্মিয়াছে। করি যাব দূর আমার গর্ভের লজ্জা। কন্যার কুযশে মাতার সতীত্বে যেন কলঙ্ক পরশে। অনলে অঙ্গারসম সে কলঙ্ককালি তুলিব উজ্জ্বল করি চিতানল জ্বালি। সতীখ্যাতি রটাইব দুহিতার নামে, সতীমঠ উঠাইব এ শ্মশানধামে কন্যার ভস্মের ‘পরে। |
অমাবাই। | ছাড়ো লোকলাজ লোকখ্যাতি– হে জননী, এ নহে সমাজ, এ মহাশ্মশানভূমি। হেথা পুণ্যপাপ লোকের মুখের বাক্যে করিয়ো না মাপ, সত্যেরে প্রত্যক্ষ করো মৃত্যুর আলোকে। সতী আমি। ঘৃণা যদি করে মোরে লোকে তবু সতী আমি। পরপুরুষের সনে মাতা হয়ে বাঁধ যদি মৃত্যুর মিলনে নির্দোষ কন্যারে, লোকে তোরে ধন্য কবে, কিন্তু, মাতঃ, নিত্যকাল অপরাধী রবে শ্মশানের অধীশ্বর-পদে। |
রমাবাই। | জ্বালো চিতা, সৈন্যগণ! ঘেরো আসি বন্দিনীরে। |
অমাবাই। | পিতা! |
বিনায়ক রাও। | ভয় নাই, ভয় নাই। হায় বৎসে, হায়! মাতৃহস্ত হতে আজি রক্ষিতে তোমায় পিতারে ডাকিতে হল। যেই হস্তে তোরে বক্ষে বেঁধে রেখেছিনু, কে জানিত ওরে ধর্মেরে করিতে রক্ষা, দোষীরে দণ্ডিতে সেই হস্তে একদিন হইবে খণ্ডিতে তোমারি সৌভাগ্যসূত্র হে বৎসে আমার। |
অমাবাই। | পিতা! |
বিনায়ক রাও। | আয় বৎসে! বৃথা আচার বিচার। পুত্রে লয়ে মোর সাথে আর মোর মেয়ে আমার আপন ধন। সমাজের চেয়ে হৃদয়ের নিত্যধর্ম সত্য চিরদিন। পিতৃস্নেহ নির্বিচার বিকারবিহীন দেবতার বৃষ্টিসম, আমার কন্যারে সেই শুভ স্নেহ হতে কে বঞ্চিতে পারে– কোন্ শাস্ত্র, কোন্ লোক, কোন্ সমাজের মিথ্যা বিধি, তুচ্ছ ভয়? |
রমাবাই। | কোথা যাস্। ফের্। রে পাপিষ্ঠে, ওই দেখ্ তোর লাগি প্রাণ যে দিয়েছে রণভূমে, — তার প্রাণদান নিষ্ফল হবে না, তোরে লইবে সে সাথে বরবেশে ধরি তোর মৃত্যুপূত হাতে শূরস্বর্গমাঝে। শুন, যত আছ বীর, তোমরা সকলে ভক্ত ভৃত্য জীবাজির– এই তাঁর বাগ্দত্তা বধূ, — চিতানলে মিলন ঘটায়ে দাও, মিলিয়া সকলে প্রভুকৃত্য শেষ করো। |
সৈন্যগণ। | ধন্য পুণ্যবতী। |
অমাবাই। | পিতা! |
বিনায়ক রাও। | ছাড়্ তোরা। |
সৈন্যগণ। | যিনি এ নারীর পতি তাঁর অভিলাষ মোরা করিব পূরণ। |
বিনায়ক রাও। | পতি এঁর স্বধর্মী যবন। |
সেনাপতি। | সৈন্যগণ, বাঁধো বৃদ্ধ বিনায়কে। |
অমাবাই। | মাতঃ, পাপীয়সী, পিশাচিনী! |
রমাবাই। | মূঢ়, তোরা কী করিস বসি। বাজা বাদ্য, কর্ জয়ধ্বনি। |
সৈন্যগণ। | জয় জয়! |
অমাবাই। | নারকিণী! |
সৈন্যগণ। | জয় জয়! |
রমাবাই। | রটা বিশ্বময় সতী অমা। |
অমাবাই। | জাগো, জাগো, জাগো ধর্মরাজ! শ্মশানের অধীশ্বর, জাগো তুমি আজ। হেরো তব মহারাজ্যে করিছে উৎপাত ক্ষুদ্র শত্রু,– জাগো, তারে কারো বজ্রাঘাত দেবদেব! তব নিত্যধর্মে করো জয়ী ক্ষুদ্র ধর্ম হতে। |
রমাবাই। | বল্ জয় পুণ্যময়ী, বল্ জয় সতী! |
সৈন্যগণ। | জয় জয় পুণ্যবতী। |
অমাবাই। | পিতা, পিতা, পিতা মোর! |
সৈন্যগণ। | ধন্য ধন্য সতী! |