কর্ণ। | পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত সেই আমি– কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ! |
কুন্তী। | বৎস, তোর জীবনের প্রথম প্রভাতে পরিচয় করায়েছি তোরে বিশ্ব-সাথে সেই আমি, আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব লাজ তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ। |
কর্ণ। | দেবী, তব নতনেত্রকিরণসম্পাতে চিত্ত বিগলিত মোর, সূর্যকরঘাতে শৈলতুষারের মতো। তব কণ্ঠস্বর যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-‘পর জাগাইছে অপূর্ব বেদনা। কহো মোরে জন্ম মোর বাঁধা আছে কী রহস্য-ডোরে তোমা সাথে হে অপরিচিতা! |
কুন্তী। | ধৈর্য ধর্, ওরে বৎস, ক্ষণকাল। দেব দিবাকর আগে যাক অস্তাচলে। সন্ধ্যার তিমির আসুক নিবিড় হয়ে।– কহি তোরে বীর, কুন্তি আমি। |
কর্ণ। | তুমি কুন্তী! অর্জুনজননী! |
কুন্তী। | অর্জুনজননী বটে! তাই মনে গণি দ্বেষ করিয়ো না বৎস। আজো মনে পড়ে অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণকুমার রঙ্গস্থলে, নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো। যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী জাগায়ে জর্জর বক্ষে– কাহার নয়ন তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্-চুম্বন। অর্জুনজননী সে যে। যবে কৃপ আসি তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি, কহিলেন “রাজকুলে জন্ম নহে যার অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার’– আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী, দাঁড়ায়ে রহিলে, সেই লজ্জা-আভাখানি দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে কে সে অভাগিনী। অর্জুনজননী সে যে। পুত্র দুর্যোধন ধন্য, তখনি তোমারে অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক। ধন্য তারে। মোর দুই নেত্র হতে অশ্রুবারিরাশি উদ্দেশে তোমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি অভিষেক-সাথে। হেনকালে করি পথ রঙ্গমাঝে পশিলেন সূত অধিরথ আনন্দবিহ্বল। তখনি সে রাজসাজে চারি দিকে কুতূহলী জনতার মাঝে অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃসম্ভাষণে। ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে ধিক্কারিল; সেইক্ষণে পরম গরবে বীর বলি যে তোমারে ওগো বীরমণি আশিসিল, আমি সেই অর্জুনজননী। |
কর্ণ। | প্রণমি তোমারে আর্যে। রাজমাতা তুমি, কেন হেথা একাকিনী। এ যে রণভূমি, আমি কুরুসেনাপতি। |
কুন্তী। | পুত্র, ভিক্ষা আছে– বিফল না ফিরি যেন। |
কর্ণ। | ভিক্ষা, মোর কাছে! আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম ছাড়া আর যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার। |
কুন্তী। | এসেছি তোমারে নিতে। |
কর্ণ। | কোথা লবে মোরে! |
কুন্তী। | তৃষিত বক্ষের মাঝে– লব মাতৃক্রোড়ে। |
কর্ণ। | পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি, তুমি ভাগ্যবতী, আমি কুলশীলহীন ক্ষুদ্র নরপতি– মোরে কোথা দিবে স্থান। |
কুন্তী। | সর্ব-উচ্চভাগে তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি। |
কর্ণ। | কোন্ অধিকার-মদে প্রবেশ করিব সেথা। সাম্রাজ্যসম্পদে বঞ্চিত হয়েছে যারা মাতৃস্নেহধনে তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে কহো মোরে। দ্যূতপণে না হয় বিক্রয়, বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়– সে যে বিধাতার দান। |
কুন্তী। | পুত্র মোর, ওরে, বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে এসেছিলি একদিন– সেই অধিকারে আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্বিচারে_ সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম লহো আপনার স্থান। |
কর্ণ। | শুনি স্বপ্নসম, হে দেবী, তোমার বাণী। হেরো, অন্ধকার ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে, লুপ্ত চারি ধার– শব্দহীনা ভাগীরথী। গেছ মোরে লয়ে কোন্ মায়াচ্ছন্ন লোকে, বিস্মৃত আলয়ে, চেতনাপ্রত্যুষে। পুরাতন সত্যসম তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম। অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার, যেন মোর জননীর গর্ভের আঁধার আমারে ঘেরিছে আজি। রাজমাতঃ অয়ি, সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে রাখো ক্ষণকাল। শুনিয়াছি লোকমুখে জননীর পরিত্যক্ত আমি। কতবার হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায়, কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায় “জননী, গুণ্ঠন খোলো, দেখি তব মুখ’– অমনি মিলায় মূর্তি তৃষার্ত উৎসুক স্বপনেরে ছিন্ন করি। সেই স্বপ্ন আজি এসেছে কি পাণ্ডবজননীরূপে সাজি সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথীতীরে। হেরো দেবী, পরপারে পাণ্ডবশিবিরে জ্বলিয়াছে দীপালোক, এ পারে অদূরে কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া। কালি প্রাতে আরম্ভ হইবে মহারণ। আজ রাতে অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম আমার মাতার স্নেহস্বর। মোর নাম তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সংগীতে উঠিল বাজিয়া– চিত্ত মোর আচম্বিতে পঞ্চপাণ্ডবের পানে “ভাই’ ব’লে ধায়। |
কুন্তী। | তবে চলে আয় বৎস, তবে চলে আয়। |
কর্ণ। | যাব মাতঃ, চলে যাব, কিছু শুধাব না– না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা। দেবী, তুমি মোর মাতা! তোমার আহ্বানে অন্তরাত্মা জাগিয়াছে– নাহি বাজে কানে যুদ্ধভেরী, জয়শঙ্খ– মিথ্যা মনে হয় রণহিংসা, বীরখ্যাতি, জয়পরাজয়। কোথা যাব, লয়ে চলো। |
কুন্তী। | ওই পরপারে যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ স্কন্ধাবারে পাণ্ডুর বালুকাতটে। |
কর্ণ। | হোথা মাতৃহারা মা পাইবে চিরদিন! হোথা ধ্রুবতারা চিররাত্রি রবে জাগি সুন্দর উদার তোমার নয়নে! দেবী, কহো আরবার আমি পুত্র তব। |
কুন্তী। | পুত্র মোর! |
কর্ণ। | কেন তবে আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে। কেন চিরদিন ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে– কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে। রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে– তাই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে দুর্নিবার আকর্ষণে। মাতঃ, নিরুত্তর? লজ্জা তব ভেদ করি অন্ধকার স্তর পরশ করিছে মোরে সর্বাঙ্গে নীরবে– মুদিয়া দিতেছে চক্ষু। থাক্, থাক্ তবে– কহিয়ো না কেন তুমি ত্যজিলে আমারে। বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে মাতৃস্নেহ, কেন সেই দেবতার ধন আপন সন্তান হতে করিলে হরণ সে কথার দিয়ো না উত্তর। কহো মোরে আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে। |
কুন্তী। | হে বৎস, ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম শত খণ্ড করি। ত্যাগ করেছিনু তোরে সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক’রে তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন–তবু হায়, তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায়, খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে। বঞ্চিত যে ছেলে তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি বিশ্বদেবতার। আমি আজি ভাগ্যবতী, পেয়েছি তোমার দেখা। যবে মুখে তোর একটি ফুটে নি বাণী তখন কঠোর অপরাধ করিয়াছি– বৎস, সেই মুখে ক্ষমা কর্ কুমাতায়। সেই ক্ষমা বুকে ভর্ৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল, পাপ দগ্ধ ক’রে মোরে করুক নির্মল। |
কর্ণ। | মাতঃ, দেহো পদধূলি, দেহো পদধূলি– লহো অশ্রু মোর। |
কুন্তী। | তোরে লব বক্ষে তুলি সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে। ফিরাতে এসেছি তোরে নিজ অধিকারে। সূতপুত্র নহ তুমি, রাজার সন্তান– দূর করি দিয়া বৎস, সর্ব অপমান এসো চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা। |
কর্ণ। | মাতঃ, সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা, তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব। পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্, কৌরব কৌরব– ঈর্ষা নাহি করি কারে। |
কুন্তী। | রাজ্য আপনার বাহুবলে করি লহো, হে বৎস, উদ্ধার। দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির, ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর সারথি হবেন রথে, ধৌম্য পুরোহিত গাহিবেন বেদমন্ত্র– তুমি শত্রুজিৎ অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্নসিংহাসনে। |
কর্ণ। | সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ– তাহারে দিতেছ, মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস। একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত। মাতা মোর, ভ্রাতা মোর, মোর রাজকুল এক মুহূর্তেই মাতঃ,করেছ নির্মূল মোর জন্মক্ষণে। সূতজননীরে ছলি আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি, কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে ছিন্ন ক’রে ধাই যদি রাজসিংহাসনে, তবে ধিক্ মোরে। |
কুন্তী। | বীর তুমি, পুত্র মোর, ধন্য তুমি। হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর দণ্ড তব। সেইদিন কে জানিত হায়, ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায় সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে, আপনার জননীর কোলের সন্তানে আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে। এ কী অভিশাপ! |
কর্ণ। | মাতঃ, করিয়ো না ভয়। কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়। আজি এই রজনীর তিমিরফলকে প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে ঘোর যুদ্ধ-ফল। এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে জয়হীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন কর্মের উদ্যম– হেরিতেছি শান্তিময় শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান। জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান– আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে। জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে নামহীন, গৃহহীন– আজিও তেমনি আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-‘পরে। শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি, বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই। |
১৫ ফাল্গুন, ১৩০৬