সক্রেটিসের জবানবন্দি
চরিত্রাবলি
সক্রেটিস
মেলিটাস
স্থান
বিচারকক্ষ
বিচারকক্ষে ভাষণদানরত সক্রেটিস
এথেন্সবাসীগণ! আমি জানি না, আমার অভিযোগকারীগণ কীভাবে আপনাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু একথা সত্য, তাদের বিশ্বাস উৎপাদনকারী বক্তৃতা এত সুন্দর হয়েছে যে, আমি নিজেকে পর্যন্ত বিস্মৃত হয়েছি। তথাপি, তারা একটি কথাও সত্য বলেছে বলে আমি মনে করিনে। কিন্তু তাদের বিবৃত মিথ্যাভাষণের মধ্যে একটি মিথ্যা আমাকে বিস্মিত করেছে। তারা আপনাদের সাবধান করে বলেছে, যেন আপনারা আমার বাগ্মিতা সম্পর্কে সতর্ক থাকেন, যেন আমি আপনাদের প্রতারণা করতে সক্ষম না হই। তারা একথা জানে যে, আমি মুখ খুললেই তাদের মিথ্যাভাষণ ধরা পড়ে যাবে। আপনারা দেখতে পাবেন, বাগিতায় আমি কিরূপ ব্যর্থ। সুতরাং আমার বাগিতার অর্থ যদি সত্যভাষণ না হয়, তা হলে আমার সম্পর্কে তাদের সতর্কবাণী উচ্চারণ তাদের পক্ষেই লজ্জার বিষয়। কিন্তু আমার বাগ্মিতার অর্থ যদি সত্যভাষণ হয়, তা হলে আমি স্বীকার করব, আমি অবশ্যই একজন বাগ্মী। কিন্তু আমার অভিযোগকারীগণের বাগ্মিতার সাথে আমার বাগ্মিতার পার্থক্য বিরাট। আমি আপনাদের পূর্বেই বলেছি তারা একটি কথাও সত্য বলে নি। আমি আপনাদের নিকট সমগ্র সত্যকেই উপস্থিত করব। অবশ্য আমার সে বক্তৃতা তাদের বক্তৃতার ন্যায় আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ-সম্ভারে সজ্জিত হবে না। আমি কেবলমাত্র আমার মনে যে-সমস্ত যুক্তির উদয় হবে, সে-সমস্ত যুক্তিই আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করব। আমি বিশ্বাস করি, আমি সত্য পথ অবলম্বন করে চলেছি। এথেন্স নগরীর ভ্রাতৃবৃন্দ। আমার এই বয়সে আমি আর আপনাদের সম্মুখে যুবসুলভ বাগিতা নিয়ে উপস্থিত হতে চাইনে। আমার নিকট কেউ যেন সেটি প্রত্যাশা না করেন। আপনাদের নিকট আমার একটি অনুরোধ : আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যদি আমি আমার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় কথা বলি, যদি আমি বাজার কিংবা অর্থবিনিময়ের দোকানে ব্যবহৃত ভাষা ব্যবহার করি, তা হলে আপনারা বিস্মিত হবেন না, কিংবা আমাকে বাধা দেবেন না। আজ আমি সত্তর বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ। জীবনে এই প্রথম আমি বিচারকদের সম্মুখীন হয়েছি। আপনাদের বিচারালয়ের ভাষার সঙ্গে আদৌ আমি পরিচিত নই। সুতরাং আমার অনুরোধ, আপনারা মনে করুন যেন আমি একজন বিদেশী। একজন বিদেশী তার দেশীয় ভাষা এবং ভঙ্গিতে কথা বললে আপনারা যেমন তাকে ক্ষমার চোখে দেখেন, তেমনি আমার বিশিষ্ট ভঙ্গিকেও আপনারা ক্ষমার চোখে দেখবেন। জানি না, আমার এ অনুরোধটি অনুচিত কি না। আমার বক্তৃতার ভঙ্গিতে আপনারা বিব্রত হবেন না। আমার ভঙ্গি ভালো কিংবা মন্দ–উভয়ই হতে পারে। আপনারা দয়া করে বিবেচনা করবেন, আমি সত্যকে উপস্থিত করেছি কি না। আমার আবেদন : বক্তাকে সত্য কথা বলতে দিন, বিচারককে ন্যায্য বিচার করতে দিন।
প্রথমত, আমি আমার বিরুদ্ধে আনীত প্রথম অভিযোগকারীদের পুরোনো অভিযোগসমূহের জবাব দেব। তারপর আমি অপর সব অভিযোগ সম্পর্কে আমার কথা বলব। কেননা, বেশ কয়েক বছর যাবৎ বহু অভিযোগকারী আমার বিরুদ্ধে আপনাদের নিকট মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করে আসছে। আমি এ্যানিটাস এবং তার পার্শ্বচরদের চেয়ে তাদের সম্পর্কেই অধিক সতর্ক। এ্যানিটাস এবং তার সাথীগণও কম বিপজ্জনক নয়। কিন্তু অনেক বেশি বিপজ্জনক হচ্ছে তারা যারা আপনাদের শৈশব থেকেই আমার বিরুদ্ধে আপনাদের মন মিথ্যা দিয়ে মোহগ্রস্ত করে দিয়েছে। এক জ্ঞানী সক্রেটিসের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ। তারা বলছে : জ্ঞানী সক্রেটিস স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সম্পর্কে চিন্তা করে এবং সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে। এই উপাখ্যান প্রচারকারীদের সম্পর্কেই আমার ভীতি অধিক। কারণ, এদের প্রচার শুনে শ্রোতাবৃন্দ মনে করতে পারে যে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের যে চিন্তা করে সে নিশ্চয়ই সষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। এরূপ প্রচারকারীদের সংখ্যা অনেক। তাদের অভিযোগ বেশ প্রাচীন। আপনাদের মন যখন বর্তমানের চেয়ে অধিক নমনীয় ছিল তখন হয়তো আপনাদের শৈশব কিংবা কৈশোরে–তারা আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগসমূহের প্রচার করেছে। সে অভিযোগের জবাব দেবার জন্য তখন কেউ উপস্থিত ছিল না। তাই সে-সময়ে জবাবহীনভাবেই তারা মিথ্যার প্রচার করে আপনাদের মনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। আমার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টকর দিক হচ্ছে, আমার অভিযোগকারীদের নাম উল্লেখ করা। কেননা, আকস্মিকভাবে পরিচিত এক রসিক কবি ব্যতীত আমি এদের কাউকে চিনিনে এবং কারো নামও জানিনে। এদের অনেকে নিজেদের মনকে আমার বিরুদ্ধে প্রথমে বিশ্বাসী করে তুলেছে। তারপর তারা আপনাদের মনকে প্রভাবান্বিত করেছে। নাম না-জানা এই অভিযোগকারীগণই হচ্ছে আমার জন্য অসুবিধাজনক। কেননা, আমি তাদের ডেকে এনে এখানে হাজির করে জেরা করতে পারিনে। কাজেই এখানে কায়াহীন ছায়ার বিরুদ্ধে আমার লড়াই, আমার আত্মপক্ষ সমর্থন। আমি যখন তাদের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থিত করব, তখন তার জবাব দেওয়ার জন্যও কেউ উপস্থিত থাকবে না। এজন্যই আমার সঙ্গে আপনারা একমত হবেন যে, আমার অভিযোগকারীগণ দুই প্রকারের। এক প্রকার হচ্ছে সাম্প্রতিক : অপর প্রকার হচ্ছে পুরাতন। প্রথমে দ্বিতীয় প্রকার অভিযোগের জবাব দানও আশা করি আপনারা সমর্থন করবেন। কেননা, এই পুরাতন অভিযোগই আপনারা অপর সব অভিযোগের বহু পূর্ব থেকে পুনঃপুন শুনে আসছেন।
এবার আমি আমার জবানবন্দি শুরু করতে চাই। অল্প সময়ের মধ্যে আমি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত অপবাদসমূহের জবাব দিতে চেষ্টা করব। এ প্রচেষ্টায় আমার সাফল্য যদি আমার এবং আপনাদের সবার মঙ্গল সাধন করে, তা হলেই আমি নিজেকে সার্থক মনে করব। আমি জানি, আমার এ দায়িত্ব সহজসাধ্য নয়। এ গুরু কর্তব্যের প্রকৃতি সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। সমগ্র পরিস্থিতির ভার বিশ্বনিয়ন্তার উপর ন্যস্ত করে এবং রাষ্ট্রের বিধানকে শিরোধার্য করে আমি আমার আত্মপক্ষ সমর্থন শুরু করব।
আমি গোড়া থেকেই শুরু করতে চাই। আমি জিজ্ঞাসা করি : আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কী অভিযোগ রয়েছে যার ফলে আমার সম্পর্কে নিন্দাবাদের সৃষ্টি হয়েছে এবং মেলিটাস বর্তমান আক্রমণে উৎসাহিত হয়েছে। কুৎসা প্রচারকারীদের কী বক্তব্য? তারাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোক্তা। তাদের অভিযোগের সারমর্মকে হয়তো এরূপভাবে বলা যায় : সক্রেটিস অদ্ভুত চরিত্রের এক দুষ্কর্মকারক। সে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সব কিছু নিয়ে চিন্তা করে এবং খারাপকে ভালো বলে প্রতিপন্ন করে। উপরন্তু সক্রেটিস অন্য সবাইকে তার এই তত্ত্বে বিশ্বাসী করে তোলে।’ এই হচ্ছে আমার অভিযোক্তাদের অভিযোগ। নাট্যকার এ্যারিস্টোফেনিসের নাটকে আপনারা এই অভিযোগকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এ্যারিস্টোফেনিস তার নাটকে ‘সক্রেটিস’ নামক এই চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। সে-সক্রেটিস চতুর্দিকে বলে বেড়ায় যে, সে হচ্ছে আকাশচারী। তার মুখে এমন সব বিষয়ের আলোচনা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যাকে আমি-সক্রেটিস’ আদৌ জানিনে। এর দ্বারা আমি অবশ্য প্রাকৃতির দর্শনের কোনো একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক বা ছাত্রের প্রতি অসম্মানসূচক কিছু বলছিনে। মেলিটাস যদি আমার বিরুদ্ধে এরূপ কোনো অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে তা হলে উহা আমার জন্য বিশেষ দুঃখের বিষয়ই হবে। এথেন্সবাসীগণ! প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, ‘আমি-সক্রেটিস’ প্রাকৃতিক গবেষণার ক্ষেত্রে একেবারেই অজ্ঞ। আপনারা যারা এই বিচারকক্ষে উপস্থিত রয়েছেন তাঁদের অনেকেই এই সত্যকে স্বীকার করবেন। আমি তাদের নিকটই আবেদন করছি : আপনারা বলুন, একথা সত্য কিনা : আপনারা আমার বক্তৃতা বিভিন্ন সময়ে শুনেছেন? আপনারা বলুন, এসব বিষয়ে কি আমি কখনো কোনো আলোকপাত করতে পেরেছি?’ … মাননীয় বিচারপতিগণ! আপনারা আমার প্রশ্নের উত্তরে জনতার জবাব শুনেছেন। এ থেকে আপনারা আমার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগকারীগণের অবশিষ্ট অভিযোগসমূহের সত্যতাকেও বিচার করতে সক্ষম হবেন।
আমি কোনো পেশাদার শিক্ষক নই কিংবা আমি কারো নিকট থেকে এজন্য কেননা অর্থও গ্রহণ করি নি। অপর অভিযোগও যেমন ভিত্তিহীন, এ অভিযোগও তেমনি মিথ্যা। অবশ্য একথা সত্য, মানুষকে শিক্ষা দেবার যদি কারো জ্ঞান এবং ক্ষমতা থাকে, তা হলে তার জন্য অর্থগ্রহণ তার পক্ষে সম্মানেরই বিষয়। লিওনটিয়ামের গর্জিয়াস, সিওসের প্রডিকাস এবং এলিসের হিপিয়াসকে আপনারা জানেন। এঁরা এথেন্সনগরী বিচরণ করেন। যুব সম্প্রদায় তাদের বাক্যালাপ শ্রবণ করে বিনামূল্যে শিক্ষাদানে-প্রস্তুত শিক্ষকদের পরিত্যাগ করে এঁদের নিকটই ভিড় করে এবং বিনিময়ে শুধু যে এঁদের অর্থ প্রদান করে তাই নয়, অর্থপ্রদানের সুযোগ পেলে তরুণ সম্প্রদায় কৃতজ্ঞতাবোধ করে। বর্তমান সময়েই এথেন্স নগরীতে জনৈক পারীয় দার্শনিক অবস্থান করছেন। আমি তার কথা শুনতে পেলাম হিপোনিকাসের পুত্র ক্যালিয়াসের নিকট। আমি জানতাম, ক্যালিয়াসেরও পুত্রসন্তান রয়েছে। আকস্মিকভাবে ক্যালিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ করে আমি তাকে সম্বোধন করে বললাম : ক্যালিয়াস, তোমার পুত্রদ্বয় যদি অশ্বশাবক কিংবা গোবৎস হতো তা হলে তাদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হতো না। তা হলে আমরা কোনো অশ্বচালক বা কৃষককে সংগ্রহ করে তাদের জন্য নিযুক্ত করতাম। এরা তোমার শাবক দুটির প্রকৃতিগত গুণসমূহকে উন্নত এবং ত্রুটিহীন করে তুলতে পারত। কিন্তু তোমার পুত্রদ্বয় তো মনুষ্যসন্তান। সুতরাং তাদের জন্যে কিরূপ শিক্ষক নিয়োগের কথা তুমি চিন্তা করছ? এমন কোনো শিক্ষক কি রয়েছে যে মানবিক এবং রাজনৈতিক গুণাবলির প্রকৃতিকে বুঝতে সক্ষম? তোমার পুত্রসন্তান রয়েছে বলেই আমি এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছি। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তুমি ইতঃপূর্বে চিন্তা করেছ। তুমি বল, এরূপ কোনো শিক্ষাদাতা কি আছে? আমার প্রশ্নের জবাবে ক্যালিয়াস বলল : হ্যাঁ, আছে।’ আমি বললাম : কে তিনি? কোন দেশের তিনি অধিবাসী? কী তার শিক্ষাদানের পারিশ্রমিক? ক্যালিয়াস বলল : তিনি হচ্ছেন পারীয় দার্শনিক ইভানাস এবং পাঁচ মিনা হচ্ছে তার পারিশ্রমিক।’ এ জবাব শুনে আমি স্বগতভাবে বললাম : ‘পরিমিত এই অর্থের বিনিময়ে যে-ইভানাস শিক্ষাদান করেন, তিনি যদি প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিক্ষাদানের বিষয়ে জ্ঞানী হন, তা হলে অবশ্যই তিনি ভাগ্যবান। আমার যদি সেরূপ জ্ঞান থাকত, তা হলে আমার মনে অবশ্যই গর্ব এবং আনন্দের সৃষ্টি হতো। কিন্তু সত্যই আমার সেরূপ জ্ঞান নেই।
এথেন্সবাসীগণ! আমি জানি, আপনারা একথার জবাবে অবশ্যই বলে উঠবেন : ‘কিন্তু সক্রেটিস, তোমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগসমূহের কারণ কী? নিশ্চয়ই তুমি অদ্ভুত কিছু করেছ। যদি তুমি অপর সবার ন্যায় সাধারণ মানুষ হতে, তা হলে অবশ্যই তোমাকে নিয়ে এরূপ গুজব এবং আলাপের সৃষ্টি হতো না। সুতরাং তুমি আমাদের বল, এ সমস্ত অভিযোগের প্রকৃত কারণ কী? আমরা তোমার কোনো কথা না শুনেই বিচার করতে চাইনে। সেরূপ করা আমাদের অভিপ্রায় নয়। সেরূপ কার্য আমাদের নিকট দুঃখজনক। একথা আপনারা যথার্থই আমাকে বলতে পারেন। এবং আমিও যথাসাধ্য ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করব, কী কারণে আমাকে জ্ঞানী এবং দুষ্টখ্যাতিতে খ্যাতবলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আপনারা দয়া করে শ্রবণ করুন। আমার এ সাহস হয়তো আপনাদের নিকট পরিহাস বলে বোধ হবে। তথাপি আমি উচ্চকণ্ঠে বলছি : ‘আমি সত্যকে, সমগ্র সত্যকেই আপনাদের নিকট উপস্থিত করব।’ এথেন্সবাসীগণ! আমার এই সুনামের ভিত্তি হচ্ছে এই যে, আমার কিছু পরিমাণ জ্ঞান অবশ্যই রয়েছে। যদি আপনারা প্রশ্ন করেন, কী সে-জ্ঞান, আমি বলব, সে-জ্ঞান এরূপ জ্ঞান যা মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অর্জন করতে পারে। এবং একথা আমি স্বীকার করতে সম্মত রয়েছি যে, এরূপ জ্ঞানে আমি জ্ঞানী। কিন্তু আমি যাদের কথা বলছিলাম তাদের এরূপ অতিমানবিক জ্ঞান আছে যে জ্ঞানের প্রতি আমি বর্ণনা করতে অক্ষম। কেননা, আমি সে জ্ঞানের অধিকারী নই। সুতরাং যারা বলে যে, এই অতিমানবিক জ্ঞান আমার রয়েছে তারা অবশ্যই মিথ্যা বলে। এরূপ মিথ্যাভাষণে তারা আমার মানবিক চরিত্রকে লোপ করে দিতে চায়। এই মুহূর্তটিতে আমার আবেদন, ভ্রাতৃবৃন্দ! আমার বক্তব্য অহেতুক বোধ হলেও আপনারা আমায় বাধা দেবেন না। কেননা, আমি এখন যে কথা বলব সে আমার নিজের কথা নয়। আমি এমন এক সাক্ষীকে উপস্থিত করব যে অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। আমি ডেলফির দৈবজ্ঞের উল্লেখ করব। তিনি নিশ্চয়ই আপনাদের নিকট সত্য করে বলবেন, আদৌ আমার কোনো জ্ঞান রয়েছে কি না, এবং থাকলে সে-জ্ঞানের প্রকৃতি কী? আপনারা নিশ্চয় চারেফনের কথা শুনে থাকবেন। সে এককালে আমার সুহৃদ ছিল। বন্ধু সে আপনাদেরও। কেননা সাম্প্রতিক নির্বাসনে সে আপনাদের সাথী ছিল এবং কিছুকাল পূর্বে সে নির্বাসন থেকে প্রত্যাগমন করতে পেরেছে। আপনারা একথাও জ্ঞাত আছেন, চারেন তার সমস্ত কার্যাবলিতেই একটু উগ্র। সে যা হোক। চারেন একদা ডেলফির দৈবজ্ঞের নিকট উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করল : বলুন, সক্রেটিসের চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? বিস্ময়ের বিষয়, দৈবজ্ঞ জবাব দিলেন, না, অধিক জ্ঞানী কেউ নেই। চারেফন নিজে আজ লোকান্তরিত। কিন্তু তার ভ্রাতা বিচারকক্ষে উপস্থিত রয়েছে। সে অবশ্যই আমার কথার সত্যতাকে স্বীকার করবে।
কিন্তু একথা আমি কেন আপনাদের নিকট উল্লেখ করছি। কারণ, আমার দুর্নামের মূলটি আপনাদের নিকট আমি ব্যাখ্যা করে বলতে চাই। দৈবজ্ঞের উত্তর শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। দৈবজ্ঞ তার জবাব দ্বারা কী বুঝাতে চাইছেন? তার এ ধাঁধার কী ব্যাখ্যা হতে পারে? কেননা, আমি তো জানি, আমার ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ, কোনো জ্ঞানই নেই। সুতরাং দৈবজ্ঞ যখন বলেন, আমি হচ্ছি সবচেয়ে জ্ঞানী, তখন তার কথার কী অর্থ হতে পারে? দৈবজ্ঞের কথা সত্য বই মিথ্যা হতে পারে না। কারণ, তিনি দৈবজ্ঞ। তিনি দেবতা। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না। মিথ্যাভাষ তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। দীর্ঘ চিন্তার পরে আমি একটি কৌশলে দৈবজ্ঞের কথার যথার্থতা পরীক্ষা করা স্থির করলাম। আমি চিন্তা করে স্থির করলাম : আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানীকে আমার অন্বেষণ করে বার করতে হবে। তা হলেই দৈবজ্ঞের নিকট তার কথার অসত্যতার প্রমাণ উপস্থিত করতে সক্ষম হবে। আমি তাকে বলতে পারব : দৈবজ্ঞ! এই দেখুন, আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানীকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি বলেছেন, আমি সবচেয়ে জ্ঞানী। আপনার কথার সত্যতা কোথায়? এমনি স্থির করে আমি জনৈক প্রখ্যাত প্রাজ্ঞের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। তার নাম আমি আপনাদের নিকট উল্লেখ করতে চাইনে। তিনি একজন রাজনীতিজ্ঞ। তাঁকেই আমি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার জন্য বেছে নিলাম। আমার সে পর্যবেক্ষণের ফলটি বলছি : আমি যখন তার সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করলাম, তখন আমি এ সিদ্ধান্ত না করে পারলাম না যে, যদিও লোকে তাঁকে জ্ঞানী বলে বিবেচনা করে, এবং তিনি নিজেকে তার চেয়েও বেশি বলে মনে করেন, তথাপি একথা সত্য যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী নন। তারপর আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বলতে চেষ্টা করলাম : প্রাজ্ঞবর! যদিও আপনি নিজেকে জ্ঞানী মনে করেন, তথাপি সত্যকারভাবে আপনি জ্ঞানী নন। আমার এরূপ চেষ্টার ফল হিসাবে তিনি এবং উপস্থিত তার অপরাপর সঙ্গীগণ আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। এই পরিস্থিতিতে আমি তাকে পরিত্যাগ করে আপন মনে একথা বলতে বলতে অগ্রসর হলাম : যদিও ইনি এবং আমি উভয়ের কেউই মহৎ কিংবা সুন্দর কিছুই জানিনে, তথাপি দুজনার মধ্যে আমার অবস্থানটি এর চেয়ে কিঞ্চিৎ উৎকৃষ্ট। কেননা, ইনি কিছুই জানেন না, কিন্তু মনে করেন, ইনি জানেন; অপরদিকে আমি যেমন কিছু জানিনে, তেমনি মনেও করিনে যে, আমি কিছু জানি। শেষের বিষয়টিতে, অর্থাৎ আমি যে নিজেকে জ্ঞানী বলে মনে করিনে–এ বিষয়টিতে মনে হচ্ছে, আমি প্রাজ্ঞবরের চেয়ে কিঞ্চিৎ উৎকৃষ্ট। অতঃপর, আমি অপর এক ‘জ্ঞানীর’ নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। আপন জ্ঞান সম্পর্কে তার দাবি প্রথম ‘জ্ঞানীর’ চেয়ে অধিক। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হলো না। ফলে এখানেও আমি নিজের জন্য আর একজন ‘বিজ্ঞ’ শত্রু সংগ্রহ করলাম। শুধু একজন নয়, এখানেও তার সঙ্গীগণ আমার শত্রু হয়ে উঠল।
তারপর আমি, একের পর এক, বিভিন্ন ‘জ্ঞানীর’ নিকট গেলাম। আমি জানতাম, সবখানেই আমি শত্রু সৃষ্টি করে চলেছি। এজন্য আমার নিজের মনে অনুতাপ এবং ভীতির সঞ্চারও হচ্ছিল। কিন্তু দৈবজ্ঞের বাণী আমার বুকের উপর একট অপরিহার্যতার অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। দৈবজ্ঞের বাণীর তাৎপর্য আমাকে বুঝতেই হবে। আমি নিজেকে বললাম : আমাকে সবার নিকটই যেতে হবে। যাকেই জ্ঞানী বলে মনে হবে, তার নিকটই যাব এবং দৈবজ্ঞের বাণীর তাৎপর্য আমি নির্ধারণ করব। এথেন্সবাসীগণ! এবার আমি আমার এই অভিযানের ফলাফল আপনাদের নিকট বলতে চাই। আমি শপথ করে বলতে পারি, সারমেয়র নামে আশি শপথ করে বলছি, আমার এই অভিযানের ফল হলো এই : আমি দেখলাম যারা জ্ঞানী বলে খ্যাত তারাই সবচেয়ে অজ্ঞ বই আর কিছু নন। অপরদিকে, যাদের জ্ঞানী বলে খ্যাতি কম, তারাই বরঞ্চ অনেক উত্তম এবং সত্যকারভাবে জ্ঞানী। আমার পরিভ্রমণের কাহিনী, বরঞ্চ বলি, আমার এই দুঃসাধ্য পরিশ্রমের কাহিনী হলো এই যে, আমার এত পরিশ্রম শেষে আমি উপলব্ধি করলাম, দৈবজ্ঞের বাণীই অখণ্ডনীয়। রাজনীতিজ্ঞদের শেষ করে আমি এলাম কবিদের নিকট। বিষাদাত্মক, ভাবাত্মক, কোনো প্রকারের কবিকেই আমি বাদ রাখলাম না। এদের নিকটে আসতেই আমি নিজেকে উদ্দেশ করে বললাম : সক্রেটিস, এবার অবশ্যই তুমি ধরা পড়বে। তুমি দেখবে, এঁদের সবার চেয়ে তুমি কত অজ্ঞ। তাই মনে করে আমি তাদেরই রচিত কবিতাবলি থেকে দীর্ঘ অংশসমূহ উদ্ধৃত করে তাদের নিকটই তার অর্থ জানতে চাইলাম। আমার আশা ছিল, তারা অবশ্যই আমাকে কিছু শিখিয়ে দেবেন। কিন্তু কী আমার ভাগ্য! আমার অভিজ্ঞতাকে যদি বলি, আপনারা কি আমাকে বিশ্বাস করবেন? সে-সত্য সম্পর্কে বলতে আমি নিজেই লজ্জিত হচ্ছি। তবু আমি বলতে বাধ্য যে, আমার কবিবর্গ তাঁদের নিজেদের কবিতাবলি সম্পর্কে যা বললেন, এখানে উপস্থিত আপনাদের যে-কেউ তার চেয়ে উত্তমভাবে বলতে পারবেন। তখনি আমি বুঝলাম, কবিগণ জ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের কাব্যরচনা করেন না। তাঁরা তাঁদের কাব্যকলা সৃষ্টি করেন বিশেষ কোনো দৈবশক্তি এবং প্রতিভার বলে। তারাও দৈবজ্ঞদের ন্যায়। দৈবজ্ঞরাও অনেক সুন্দর কথা উচ্চারণ করেন। কিন্তু সে-সমস্ত কথার তাৎপর্য তাঁরা নিজেরা বুঝেন না। কবিদের অবস্থাও সেরূপ। আমি আরো দেখলাম, কবিগণ তাদের কাব্যশক্তিতে কাব্যরাজ্যের বাইরের অজানা বিষয় সম্পর্কেও নিজেদের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে মনে করেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি কাব্যরাজ্য ছেড়ে এলাম। রাজনীতির ন্যায় এখানেও আমি বুঝলাম, কবিদের চেয়েই বরঞ্চ আমার জ্ঞান অধিক।
পরিশেষে আমি শিল্পনিপুণ ব্যক্তিদের নিকট গেলাম। আমি এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম যে, এসব সম্পর্কে আমি কিছু জানিনে এবং আমি নিশ্চিতভাবেই আমি মনে করেছি, এঁরা অবশ্যই অনেক সুন্দর বিষয়কে জানেন। এরূপ ধারণায় আমি ভ্রান্ত ছিলাম না। এঁরা সত্যই অনেক কিছু জানেন যে-সমস্ত বিষয়ে আমি অজ্ঞ। এ সমস্ত বিষয়ে তারা অবশ্যই আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। তথাপি একটি বিষয়ে এখানেও লক্ষ করলাম যে, উত্তম শিল্পীও কবিদের মতো একই ভুলে ভ্রান্ত। যেহেতু তারা নিপুণ শিল্পী, সেজন্য তারাও তাদের জ্ঞানের বাইরের সব উচ্চ উচ্চ বিষয় সম্পর্কেও নিজেদের জ্ঞানী ভাবতে দ্বিধা করেন না। দুঃখের বিষয়, তাদের এই ক্রটি তাদের সব জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি নিজেকেই একটি প্রশ্ন করলাম : আমি কি হতে চাই? এঁদের জ্ঞান কিংবা অজ্ঞানের অধিকারী হতে, না আমি যা রয়েছি তাই থাকতে চাই? এ প্রশ্নের জবাব আমি নিজেই দিলাম। আমি বললাম : আমি যেরূপ রয়েছি সেরূপই আমি থাকতে চাই। সেটিই উত্তম।
এই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ আমার অনেক নিকৃষ্ট এবং বিপজ্জনক শত্রুর সৃষ্টি হয়েছে এবং আমার বিরুদ্ধে অপবাদের সূত্রপাত ঘটেছে। আমাকে অপর সবাই জ্ঞানী বলে আখ্যাত করেছে। কারণ, আমার কথা যারা শুনেছে তারা মনে করে, অপর সকলের মধ্যে যে-জ্ঞান নেই আমার সে-জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু এথেন্সবাসীগণ! সত্য হচ্ছে শুধু এই যে, একমাত্র বিধাতাই জ্ঞানী-অপর কেউ নয়। দৈবজ্ঞ আমাকে জ্ঞানী বলে অবশ্যই একথা বুঝতে চেয়েছেন যে, মানুষের জ্ঞানের মূল্য সামান্যই। তিনি যখন আমার নাম উল্লেখ করেছেন তখন সে-নামকে শুধু একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সক্রেটিস সম্পর্কে বলতে চাননি। এ নামের উল্লেখ করে তিনি যেন বলতে চেয়েছেন : “হে মনুষ্যবৃন্দ, তোমরা স্মরণ রেখো, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী একমাত্র সেই ব্যক্তি যে সক্রেটিসের ন্যায় জানে যে, তার জ্ঞানের মূল্য প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়।’ এই মনোভাব নিয়ে এবং আদেশ শিরোধার্য করে আমি ঘুরে বেড়াই এবং দেশী কিংবা বিদেশী, যাদের জ্ঞানী বলে বোধ হয় তাদের জ্ঞানের অনুসন্ধানে রত হই। অনুসন্ধানে যদি দেখা যায়, এরূপ কেউ সত্য জ্ঞানী নয়। তা হলে আমি দৈবজ্ঞের বাণীর তাৎপর্য অনুসারে তাদের বলি, “দেখুন, আপনারা সত্যই জ্ঞানী নন। আমার এ কাজটি অবশ্যই আমাকে সর্বক্ষণ নিমগ্ন রাখে। অপর কোনো সর্বজনীন বা ব্যক্তিগত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় আমি পাইনে। ফলস্বরূপ দৈবজ্ঞের বাণীর প্রতি আমার নিষ্ঠা আমাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।
আর একটি বিষয়ের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব; সম্পদশালী শ্রেণীর যুবকগণের খুব কিছু করণীয় না থাকায় আমার নিকটে তারা স্বেচ্ছায় আগমন করে! ভণ্ড জ্ঞানীদের আবার আমার অনুকরণে অপরকে অনুরূপভাবে পরীক্ষা করার চেষ্টা করে। তারাও অচিরে দেখতে পায় যে, এরূপ অনেক জ্ঞানীই রয়েছেন যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে দাবি করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কিছুই জানেন না। কিন্তু যুবকদের হাতে এই পরীক্ষার ফল হিসাবে তারা আপন অজ্ঞতার জন্য নিজেদের উপর রাগান্বিত না হয়ে আমার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন : যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টিকারী, বুদ্ধিভ্রষ্ট, পাপিষ্ঠ সক্রেটিসই এজন্য দায়ী। কিন্তু কেউ যদি তাঁদের জিজ্ঞেস করে : কেন, সক্রেটিস কী অপরাধ করেছে, কী দুষ্টশিক্ষা সে প্রচার করেছে, তা হলে তারা আর জবাব খুঁজে পান না। কিন্তু এক্ষেত্রেও তাদের যে, কোনো জবাব নেই সে-কথা যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য সব দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তারা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল খুঁজে বেড়াবার, দেবতাদের অস্তিত্বহীনতার কথা ঘোষণা করার এবং খারাপকে ভালো প্রতিপন্ন করার যে-অপবাদ প্রচারিত হয়েছে, সেই অপবাদেরই তারা পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। কারণ তাঁরা একথা স্বীকার করতে চান না যে, তাদের জ্ঞানের ভান ধরা পড়েছে। অথচ এটিই সত্য। তারা ধরা পড়েছেন। এঁদের সংখ্যা অনেক। এঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং উদ্যোগী। এঁরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী হয়ে শ্রেণীবদ্ধ হয়েছেন। সমর্থন সংগ্রহ করার ন্যায় ভাষার জোর এঁদের রয়েছে। এঁরাই আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কানে উচ্চস্বরে নিকৃষ্ট অপবাদসমূহের কথা পৌঁছে দিয়েছেন। এবং এরই জন্য মেলিটাস, এ্যানিটাস এসেছেন শিল্পকার এবং রাজনীতিজ্ঞদের পক্ষ থেকে, এবং লাইকন বাগীদের প্রতিভূ হয়ে। কাজেই আমি গোড়াতেই বলেছি, কুৎসার এই বিরাট স্তূপ আমি একমুহূর্তে অপসারণ করতে পারিনে। এথেন্সবাসী ভ্রাতৃবৃন্দ! এই আমার বক্তব্য। আমি সত্যকে প্রকাশ করেছি। সত্য বই অপর কিছুকে আমি উপস্থিত করি নি। কোনো সত্যকে আমি লুক্কায়িত রাখি নি। তথাপি আমি জানি, আমার সরলতা এবং স্পষ্টবাদিতাই তাদের ঘৃণার বস্তু। আমি বলি, তাঁদের ঘৃণাই কি আমার কথার সত্যতার প্রমাণ নয়? এরই জন্য আমার বিরুদ্ধে কুৎসার প্রবাহ ছুটেছে, আমার বিরুদ্ধে কুসংস্কার সৃষ্টি হয়েছে। এই সত্যকেই আপনারা বর্তমানে বা ভবিষ্যতের যে-কোনো অনুসন্ধানে দেখতে পাবেন।
প্রথম শ্রেণীর অভিযোগের বিরুদ্ধে এই আমার বক্তব্য। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি যথেষ্টই বলেছি। এবার আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিযোগ সম্পর্কে বলব। দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিযোগকারীদের পুরোধা হচ্ছেন মেলিটাস, দেশপ্রেমিক মেলিটাস। মেলিটাস নিজেকে দেশপ্রেমিক বলেই দাবি করেন। এঁদের অভিযোগের বিরুদ্ধে ও আমার আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি কিছু বলতে চাই। তাঁদের হলফনামাটিও পাঠ করা যাক। সে হলফনামাতেও রয়েছে এরূপ অভিযোগ : সক্রেটিস হচ্ছে দুষ্কর্মের নায়ক; সক্রেটিস হচ্ছে তরুণ সম্প্রদায়ের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী; সক্রেটিস দেশের দেবতাকুলকে বিশ্বাস করে না; সক্রেটিস আপনার মন থেকে নতুন দেবতার সৃষ্টি করে। এই হচ্ছে অভিযোগ। এবার আসুন আমরা অভিযোগের এই বিষয়গুলিকে পরীক্ষা করি। এথেন্সবাসীগণ! মেলিটাস বলেন, সক্রেটিস দুষ্কর্মা, সক্রেটিস তরুণ সম্প্রদায়ের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী। আমি বলি, দুষ্কর্মা হচ্ছেন মেলিটাস। কেননা, মেলিটাস যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেবার ভান করেন, সে বিষয়কে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে তিনি পরিহাস করেন। যে-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সে-বিষয়েও তিনি আগ্রহের ভান করে অপরকে জড়িত করে বিচারে সোপর্দ করতে পরমোৎসাহী হয়ে ওঠেন। এই সত্যকেই আমি আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করার চেষ্টা করব।
মেলিটাস, তুমি এগিয়ে এস। আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। তুমি তরুণ সম্প্রদায়ের উন্নতির বিষয়ে অবশ্যই বিশেষ আগ্রহ পোষণ কর?
হ্যাঁ, আমি তা পোষণ করি।
তা হলে বিচারকদের তুমি দয়া করে বল, কে তাদের উন্নয়নকারী। তুমি যখন কষ্ট করে তাদের অনিষ্টকারীকে খুঁজে বার করতে সক্ষম হয়েছ এবং আমাকেই সেই অভিযোগে বিচারকদের সম্মুখে হাজির করেছ, তখন তুমি অবশ্যই তরুণদের উন্নয়নকারীকেও জান। তা হলে তুমি বিচারকদের নিকট বল, কে তাদের উন্নতা।… মেলিটাস! তুমি আমার প্রশ্নের জবাবে নিঃশব্দ রয়েছ। তা হলে তোমার কিছু বলার নেই? কিন্তু এটি কি অসম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না? আমি যা বলছিলাম এতে তারইও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়–অর্থাৎ এ বিষয়ে তোমার কোনো আগ্রহ নেই। বন্ধুবর! মুখ খুলে জবাব দাও। আমাদের বল : তরুণ সম্প্রদায়ের উন্নেতা কে?
দেশের আইন।
নাগরিকবর! আমার প্রশ্ন সেটি নয়। আমি জানতে চাই, ব্যক্তি হিসাবে কে সে লোক যে তোমার ‘আইনকে’ সবার আগে জানে।
সক্রেটিস! আইনকে এই বিচারকক্ষের বিচারকরাই জানেন।
মেলিটাস, তুমি বলতে চাচ্ছ, বিচারকগণ তরুণদের শিক্ষা দিতে এবং তাদের উন্নতিসাধনে সক্ষম?
হ্যাঁ, অবশ্যই তারা সক্ষম।
তাঁদের সবাই সক্ষম? কিংবা তুমি বলতে চাও, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সক্ষম বটে কিন্তু অপর সবাই এ কাজে সক্ষম নন?
তাদের সবাই সক্ষম।
ধন্যবাদ। এটি অবশ্যই একটি উত্তম সংবাদ। তরুণদের উন্নয়নকারীর সংখ্যা তা হলে প্রচুর। কিন্তু এই বিচারকক্ষের যারা শ্রোতৃবর্গ, তাদের সম্পর্কে তুমি কী বলবে? তারাও কি তরুণদের উন্নতিসাধনে সক্ষম।
হ্যাঁ, তারাও তরুণদের উন্নতিসাধনে সক্ষম।
সিনেট–অর্থাৎ উচ্চ পরিষদের সদস্যবৃন্দ–তাঁরাও?
হ্যাঁ, সিনেটারগণও তরুণ সম্প্রদায়ের উন্নেতা।
তা হলে সাধারণ পরিষদের সদস্যবৃন্দও নিশ্চয়ই উন্নতি সাধন করেন?
হ্যাঁ, তারাও তাদের উন্নতি সাধন করেন।
তা হলে শুধু আমি ব্যতীত প্রত্যেকটি এথেন্সবাসীই তরুণদের উপকার সাধন করে, তাদের উন্নত করে তোলে? কেবল আমিই তাদের অনিষ্টকারী। মেলিটাস, এটিই কি তোমার বক্তব্য?
হ্যাঁ, দৃঢ়ভাবে আমি সে-কথাই বলছি।
মেলিটাস, তুমি সঠিক হলে, আমার জন্য সেটি খুবই মর্মান্তিক হবে। বেশ! আমি তোমাকে অপর একটি প্রশ্ন করছি : অশ্বদের বিষয়ে তুমি কি বলবে? তুমি কী বলবে যে, পৃথিবীর মাত্র একটি মানুষই তাদের অনিষ্ট করে, কিন্তু অপর সবাই তাদের উপকার করে? বরঞ্চ এর বিপরীত কথাটিই কি সত্য নয়? বস্তুত একটিমাত্র কিংবা বলা চলে অল্পসংখ্যক মানুষই–অর্থাৎ অশ্বের পরিচারক বা শিক্ষাদাতাই তাদের মঙ্গল সাধন করে। অপর সবাই তাদের অমঙ্গল বা ক্ষতি সাধন করবে। অশ্ব কিংবা অপর পশুদের সম্পর্কে এটিই কি সত্য নয়? মেলিটাস, তুমি এবং এ্যানিটাস আমার এ প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ যাই বল না কেন, অবশ্যই এটি সত্য। তরুণদের অবস্থাটিও খুবই সন্তোষজনক হতো যদি পৃথিবীর একটি মাত্র ব্যক্তি তাদের অনিষ্টকারী এবং অপর সবাই তাদের উন্নয়নকারী হতো। কিন্তু মেলিটাস, তুমি যে তরুণদের সম্পর্কে মোটেই আগ্রহান্বিত নও তার প্রমাণ তুমি যথেষ্ট দিয়েছ। তরুণদের সম্পর্কে তোমার অনাগ্রহ এবং অমনোযোগের বড় প্রমাণ হচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগসমূহ তুমি এনেছ তার সম্পর্কেও তুমি অমনোযোগী।
মেলিটাস, আমি তোমাকে আর একটি প্রশ্ন করতে চাই। জিউস দেবের দোহাই দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি বল, সৎসঙ্গে বাস কিংবা অসৎসঙ্গে বাস–কোনটি উত্তম? প্রিয় বন্ধু, জবাব দাও।… আমি বলি, এ প্রশ্নের জবাবদান তত সহজ ব্যাপার। যারা ভালো, তারা কি তাদের প্রতিবেশীদেরও ভালো করে না? এবং যারা খারাপ তারা কি তাদের প্রতিবেশীদেরও খারাপ করে না?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
বেশ! কিন্তু তুমি এমন কাউকে কি পাবে যে তার সঙ্গীর নিকট থেকে অপকার কামনা করবে? বন্ধু! তুমি জবাব দাও। আইনের দাবিতে তুমি জবাব দিতে বাধ্য। বল : কেউ কি অপকৃত হতে চায়?
অবশ্যই না।
তা হলে তুমি যখন তরুণ সম্প্রদায়কে নষ্ট করার দায়ে আমাকে অভিযুক্ত কর তখন কি তুমি বলতে চাও যে, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অনিচ্ছা সহকারে তাদের অনিষ্ট সাধন করি?
আমি বলি, ইচ্ছাকৃতভাবেই তুমি তাদের অনিষ্ট সাধন কর।
কিন্তু বন্ধুবর! তুমি এইমাত্র স্বীকার করেছ যে, উত্তম তার প্রতিবেশীর মঙ্গল এবং অধম তার প্রতিবেশীর অমঙ্গল সাধন করে। তুমি কি বলতে চাও, তোমার উচ্চতর জ্ঞান দ্বারা তোমার জীবনের প্রত্যূষেই এই সত্যের উপলব্ধি তুমি লাভ করেছ, আর বৃদ্ধ আমি এখনও এমন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত যে এটুকু আমি জানিনে যে, আমার প্রতিবেশীর ক্ষতিসাধন করলে আমারও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? তুমি বলতে চাও, তা সত্ত্বেও আমি আমার প্রতিবেশীর অনিষ্ট সাধন করেছি এবং ইচ্ছানুসাইে তা করছি? তোমার এরূপ কথায় আমার কিংবা অপর কারো প্রত্যয় হবে না। হয় আমি তাদের অনিষ্ট সাধন করিনে–কিংবা অনিচ্ছা সহকারে অনিষ্ট সাধন করি। উভয়ত তুমি মিথ্যা বলার দোষে দোষী। আমার অপরাধ যদি অনিচ্ছাকৃত হয় তা হলে আইন তাকে বিচারযোগ্য বলে গ্রহণ করবে না। এমন ক্ষেত্রে তুমি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে হুঁশিয়ার করতে পারতে। ব্যক্তিগতভাবে তুমি আমাকে তিরস্কার করতে পারতে। কেননা, আমার অপরাধ অনিচ্ছাকৃত হলে অবশ্যই তোমার সদুপদেশে আমি তা থেকে বিরত হতাম। কিন্তু এ বিষয়ে আমাকে বলার মতো তোমার কোনো মন্তব্য ছিল না। তুমি আমাকে আমার অপরাধ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে চাওনি। কিন্তু এখন তুমি আমাকে বিচারালয়ে নিয়ে এসেছ। বিচারালয় অবশ্যই শিক্ষাদানের স্থান নয়। বিচারালয় শাস্তিদানেরই স্থান।
এথেন্সবাসীগণ! এ থেকেই পরিষ্কারভাবে আমার কথার সত্যতা আপনারা বুঝতে পারবেন। আপনারা বুঝতে পারবেন, মেলিটাসের এ বিষয়ে অল্প কিংবা অধিক কোনো আগ্রহই নেই। কিন্তু মেলিটাস! আমি এখনো তোমার নিকট থেকে জানতে চাই : তরুণ সম্প্রদায়কে কোন ক্ষেত্রে আমি দুর্নীতিদুষ্ট করেছি। তোমার অভিযোগ থেকে আমার অনুমান, তুমি বলতে চাচ্ছ যে, আমি তরুণদের শিক্ষা দিই যেন তারা রাষ্ট্রের স্বীকৃত দেবতাদের স্বীকার না করে নতুন দেবতাদের কিংবা ঐশ্বরিক প্রতিভূসমূহকে সৃষ্টি করে। তোমার অভিযোগ অনুযায়ী এই শিক্ষার দ্বারা আমি তরুণদের দুর্নীতিদুষ্ট করে তুলেছি–নয় কি?
হ্যাঁ, আমি এ কথাই জোরের সঙ্গে বলতে চাই।
মেলিটাস। দেবতাদের দোহাই দিয়ে বলছি, তা হলে তুমি একটু স্পষ্ট করে আমাকে এবং এই বিচারালয়কে জানিয়ে দাও, কী তুমি বলতে চাও? কেননা, আমি এখনো বুঝতে পারছিনে, তোমার অভিযোগ কি এই যে, আমি বিশেষ কোনো দেবতার কথা প্রচার করি–সুতরাং আমি স্রষ্টায় অবশ্যই বিশ্বাস করি এবং আমি সম্পূর্ণরূপে একজন নাস্তিক বলে বিবেচিত হতে পারিনে। তুমিও নিশ্চয়ই আমাকে নাস্তিক বলে অভিযুক্ত করছ না? তোমার অভিযোগ শুধু এই যে, আমার ‘প্রচারিত’ দেবতা এবং আমাদের নগর-স্বীকৃত দেবতাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তারা ভিন্ন প্রকারের দেবতা। অথবা তোমার অভিযোগ হচ্ছে যে, আমি পরিপূর্ণরূপেই একজন নাস্তিক এবং নাস্তিক্যবাদেরই শিক্ষক?
তোমার দ্বিতীয় কথাই আমার কথা। সক্রেটিস, তুমি সম্পূর্ণরূপেই একজন নাস্তিক।
কী অদ্ভুত তোমার অভিযোগ, মেলিটাস! কিন্তু আমার সম্পর্কে তোমার মনে এরূপ চিন্তার উদয় হলো কেন? তুমি কি মনে কর যে, অপর সবার ন্যায় আমি সূর্যের কিংবা চন্দ্রের দেবত্বকে স্বীকার করিনে?
মহামান্য বিচারকবৃন্দ! আমি আপনাদের নিকট নিশ্চয় করে বলছি, সক্রেটিস সূর্য এবং চন্দ্রের দেবত্বে বিশ্বাস করে না। সক্রেটিস বলে, সূর্য হচ্ছে প্রস্তর এবং চন্দ্র হচ্ছে মৃৎপিণ্ড।
বন্ধু মেলিটাস! তুমি নিশ্চয়ই এনাক্সাগোরাসকে অভিযুক্ত করে একথা বলতে চাচ্ছ। তুমি যদি মহামান্য বিচারকবৃন্দকে এতখানি মূর্খ বলে কল্পনা কর যে তারা জানেন না, তোমার উল্লিখিত তত্ত্ব ক্লাজোমিনিয় দার্শনিক এনাক্সাগোরাসের পুস্তকেই পাওয়া যায় এবং তার সমস্ত পুস্তক এই তত্ত্ব দিয়েই পূর্ণ তা হলে বলতে হয় যে, বিচারকবৃন্দ সম্পর্কে তোমার ধারণা খুবই খারাপ। আর যথার্থ সে-জন্যই প্রচার করা হচ্ছে যে, তরুণ সম্প্রদায়কে সক্রেটিস এভাবে শিক্ষিত করে তুলছে। সেই শিক্ষার নাট্যরূপের প্রদর্শনীও প্রায়শ নাট্যশালার মঞ্চোপরেও এক ড্রাকমা প্রবেশহারের বিনিময়ে দেখতে পারা যায়। দর্শকবৃন্দ অবশ্যই তাদের অর্থের মূল্য ফিরে পায়। কেননা, সক্রেটিসের মস্তিষ্ক-উদ্ভুত এ সমস্ত অদ্ভুত তত্ত্বের পরিচয়ে সক্রেটিসকে ব্যঙ্গ ও পরিহাস করার একটি সুযোগ তারা পেয়ে থাকে। তা হলে মেলিটাস! তুমি যথার্থই মনে কর যে, আমি কোনো দেবতায় বিশ্বাস করিনে।
হ্যাঁ, জিউস দেবের শপথ করেই আমি বলতে পারি যে, তুমি আদৌ কোনো দেবতায় বিশ্বাস কর না।
তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না মেলিটাস। এবং আমি নিশ্চিত যে, তুমি নিজেও তোমার এই অভিযোগকে বিশ্বাস কর না। এথেন্সবাসীগণ! আমি একথা না ভেবে পারছিনে, মেলিটাস হঠকারী এবং নির্লজ্জ। মেলিটাস যুবসুলভ বাহাদুরি এবং বেপরোয়াভাব নিয়ে আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগপত্র তৈরি করেছে। সে কি একটি গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেনি? মেলিটাস নিজের মনে বলেছে : ‘দেখি সক্রেটিস কী করে আমার সৃষ্ট এই উদ্ভট জটিলতাকে ধরতে পারে? সক্রেটিস এবং অপর সবাইকে আমি নিশ্চয়ই এর দ্বারা প্রতারিত করতে সক্ষম হব। আমি একথা বলছি, কেননা আমি মনে করি, তার অভিযোগপত্রেই মেলিটাস পরস্পরবিরোধী কথা বলেছে। তার অভিযোগে, সক্রেটিস কেনো দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করার অপরাধেও অপরাধী। কোনো দায়িতুপূর্ণ ব্যক্তিই এরূপ পরস্পরবিরোধী উক্তি করতে পারে না।
এথেন্সবাসীগণ! আপনারা মেলিটাসের অসামঞ্জস্য ও পরস্পর বিরোধিতার বিষয়টির পরীক্ষাকার্যে আমার সঙ্গে যোগদান করুন। মেলিটাস, তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বিচারালয়ের দর্শক এবং শ্রোতবৃন্দের নিকট আমি আবেদন করব, আমার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আমি কথা বললেও যেন তারা গোলমাল সৃষ্টি না করেন।
মেলিটাস, তুমি জবাব দাও : এমনকি সম্ভব যে, কোনো ব্যক্তি মানবিক গুণাবলিতে বিশ্বাস করে অথচ মানুষের অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না? … এথেন্সবাসীগণ! মেলিটাস চুপ করে রয়েছে। কিন্তু তার চুপ করে থাকলে চলবে না। আমার বক্তব্যে বাধাদানের চেয়ে মেলিটাস আমার প্রশ্নের জবাব দিক : জগতে কোনো মানুষ কি কখনো অশ্বকৌশলে বিশ্বাস করেছে কিন্তু বাস্তব কোনো অশ্বের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি? এমনকি হতে পারে যে, আমরা বংশীবাদন বিশ্বাস করি, কিন্তু বংশীবাদককে বিশ্বাস করিনে? … বন্ধুবর, তুমি এখনো আমার প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করছ। বেশ, আমিই তোমার নিকট এবং আদালতের সম্মুখে এ প্রশ্নের জবাব পেশ করছি : আমার জবাব হচ্ছে, না
এরূপভাবে কোনো মানুষ কখনো চিন্তা করতে পারে না। এবার তুমি আমার পরবর্তী প্রশ্নের জবাব দাও : কেউ কি ঐশ্বরিক এবং স্বর্গীয় দূতসমূহকে বিশ্বাস করেও দেবতাদের অবিশ্বাস করতে পারে?
না, তা সে পারে না।
আহা! আমার কী ভাগ্য! আদালতের সাহায্যে তোমার নিকট থেকে পরিশেষে একটি জবাব আদায় করতে আমি সক্ষম হয়েছি। কিন্তু তুমি তো তোমার শপথনামায় হলফ করে বলেছ যে, আমি ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় শক্তিসমূহের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বস্ত স্বর্গীয় প্রতিভূগণ আধুনিক কিংবা প্রাচীন–সে কথা ভিন্ন। বড় কথা হচ্ছে যে, আমি ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাস করি। তা হলে, ঐশ্বরিক শক্তিসমূহে বিশ্বাস করেও দেবতাদের অস্তিত্বে আমি কিরূপে অবিশ্বাসী হতে পারি? তা হলে দেবতাদের অস্তিত্বও কি আমাকে বিশ্বাস করতে হয় না? নিশ্চিতভাবেই দেবতাদের অস্তিত্ব আমাকে বিশ্বাস করতে হয়। নয় কি? … আমার এ প্রশ্নেও তুমি নীরব রয়েছ। তোমার নীরবতাকে আমি সম্মতির লক্ষণ হিসাবে ধরে নিচ্ছি। এবার বল : এই উপদেবতাগণ কারা? তারা কি দেবতা এবং দেবতাদেরই সন্তান নয়?
হ্যাঁ, অবশ্যই তারা তাই।
এবং এখানেই তুমি একটি হাস্যকর জটিলতার সৃষ্ট করেছ। উপদেবতাগণও অবশ্যই দেবতা। তুমি প্রথমে বলেছ, আমি দেবতায় বিশ্বাস করিনে। আবার বলেছ, আমি দেবতায় বিশ্বাস করি। কেননা, তোমার স্বীকৃতি অনুসারে আমি উপদেবতায় বিশ্বাসী। উপদেবতাগণ যদি দেবতা এবং জলপরী বা অপর কোনো জননীজাত অবৈধ সৃষ্টি হয় তা হলে এভাবে উপদেবতাগণকে দেবতার সন্তান হিসাবে স্বীকার করার পরে কোনো মানুষের দেবতার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করা সম্ভব? তা হলে তো তুমি অশ্ব কিংবা গর্দভের মিলনজাত খচ্চরে অস্তিত্বে বিশ্বাস করেও অশ্ব কিংবা গর্দভকে অবিশ্বাস করতে পার। মেলিটাস! আমাকে বিচার করার জন্য এরূপ অর্থহীন অভিযোগ সৃষ্টি তোমার পক্ষেই সম্ভব। এই সমস্ত কথাকে তুমি অভিযোগপত্রে বসিয়েছ। কেননা আমাকে অভিযুক্ত করার ন্যায় প্রকৃত অভিযোগ তোমার কিছুই নেই। কিন্তু যার মধ্যে সামান্য পরিমাণ বৃদ্ধির অস্তিত্ব আছে সে তোমার এ অভিযোগ কখনো স্বীকার করতে পারবে না যে, কোনো ব্যক্তির পক্ষে ঐশ্বরিক শক্তিসমূহকে বিশ্বাস করার পরেও দেবতা উপদেবতা প্রভৃতিকে অবিশ্বাস করা সম্ভব।
মেলিটাসের অভিযোগের জবাবে আমি যথেষ্টই বলেছি। অধিকতর বিস্তৃত জবাবের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, আমার অনুসন্ধান দ্বারা যে শত্রুতার আমি সৃষ্টি করেছি তার পরিমাণ এবং সংখ্যা কম নয়। এবং আমার ধ্বংস যদি ঘটে তা হলে এই শত্রুতা থেকেই আমার ধ্বংস ঘটবে। ব্যক্তি হিসাবে মেলিটাস কিংবা এ্যানিটাস নগণ্য। কিন্তু মানুষেরই বিদ্বেষ এবং অপবাদ বহু মহৎমানুষের ধ্বংস এবং মৃত্যুর কারণ হয়েছে এবং সম্ভবত আরো বহু মহৎ মানুষের ধ্বংস এবং মৃত্যুর কারণ হবে। বিদ্বেষ এবং অপবাদের যূপকাষ্ঠে আমার বলি অবশ্যই শেষ বলি নয়।
কেউ হয়তো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন : সক্রেটিস, যে-জীবনযাপনে অকালে তোমার জীবন বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা, সে-জীবনের জন্য কি তুমি লজ্জিত নও? তার এ প্রশ্নের জবাবে দ্বিধাহীনভাবেই আমি বলব : সুহৃদবর, তুমি ভুল বলছ। কোনো মানুষের যদি সাধন করার মতো মহৎ কার্য কিছু থাকে তা হলে তার সম্মুখে বড় প্রশ্ন জীবন কিংবা মৃত্যু নয়। তার বিবেচনার একমাত্র বিষয় হওয়া আবশ্যক : আপন কার্য সাধনে সে কোথাও অন্যায় কিংবা অবিচারের আশ্রয় গ্রহণ করল কিনা? মহৎ কিংবা হীন–কোন মানুষের ভূমিকা সে পালন করতে সক্ষম হলো? অপরদিকে তোমার অভিমত অনুযায়ী ট্রয়ের ভূমিতে নিহত বীরদের জীবনের কোনো সার্থকতা নেই। কিন্তু থেটিসপুত্র অপমানজনক জীবনের বদলে বিপজ্জনক মৃত্যুকেই গ্রহণ করেছিল। থেটিসপুত্র যখন তার সাথীর মৃত্যুর প্রতিশোধ হেকটরকে বধ করতে উদ্যত, তখন তার স্বর্গীয় জননী তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, বন্ধু প্যাট্রোক্লাসের হত্যার প্রতিশোধ যদি সে হেকটরকে বধ করে তা হলে তার নিজের মৃত্যুও অবধারিত; বলেছিলেন : বৎস! হেকটরের পার্শ্বে ভবিতব্য তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে? কিন্তু পুত্র এ সতর্কবাণী সত্ত্বেও বিপদ এবং মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বীর সেদিন বিপদ এবং মৃত্যুকে ভয় করার চেয়ে অসম্মান এবং বন্ধুর রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকেই ভয় করেছিল। জননীর সতর্কবাণী শ্রবণ করে পুত্র বলেছিল : ‘মাতা! তত্ৰাচ আমি মৃত্যুকেই বরণ করতে চাই। দীর্ঘ চঞ্চু—আমাদের–এই অর্ণবযানসমূহের পার্শ্বে পৃথিবীর বুকে ভার এবং হাস্যাস্পদ জীব হিসাবে বেঁচে থাকার পরিবর্তে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের মৃত্যুই আমি বরণ করতে প্রস্তুত।’ থেটিসপুত্র একিলেসের মনে কি বিপদ এবং মৃত্যুর চিন্তা স্থান পেয়েছিল? না, তা পায়নি। কেননা, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে নির্দিষ্ট আপন স্থানকেই রক্ষা করা–তাকে পরিত্যাগ করা নয়। সে নির্দিষ্ট স্থান তার স্বনির্বাচিত হোক কিংবা সামরিক অধিনায়কের আদেশ–নির্দিষ্টই হোক–সেখানে অবস্থান করাই তার কর্তব্য। মানুষের চিন্তার বিষয় মৃত্যু নয়। মানুষের চিন্তার বিষয় হচ্ছে। অসম্মান। এথেন্সবাসীগণ! আমার এ বাক্যটি অবশ্যই একটি যথার্থ বাক্য।
এথেন্সের ভ্রাতৃবৃন্দ! যে-আমি আপনাদেরই নির্বাচিত অধিনায়কদের আদেশে পটিডিয়া, এ্যামপিফলিস এবং ডেলিয়ামের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখেও নির্দিষ্ট স্থান পরিত্যাগ করিনি, যে-আমি সেদিন অপর সবার ন্যায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পেরেছিলাম, সে আমি যদি আজ মৃত্যু কিংবা অপর কিছুর ভয়ে ভীত হয়ে আত্ম এবং পর’ সমস্ত বিষয়কে বিচার করার দার্শনিক কর্তব্য সমাপন থেকে পশ্চাদপসরণ করি, তা হলে আমার সেরূপ ব্যবহার লজ্জাকর বলেই বিবেচিত হবে। কর্তব্যের সেই অবহেলার জন্যই ন্যায়ত আমার বিচার করা চলত। আমি যদি ভবিষ্যদ্বক্তার বাণীর তাৎপর্য অনুসন্ধানে বিরত থেকে নিজেকে অজ্ঞ জেনেও জ্ঞানী বলে প্রচার করতাম তা হলেই আমি ন্যায়ত দেবতাদের আদেশ-বিরুদ্ধ কাজের অপরাধে বিচারালয়ে অভিযুক্ত হয়ে সোপর্দ হতে পারতাম। কেননা, মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের ভীতিই তার আপন অজ্ঞতা সত্ত্বেও নিজেকে জ্ঞানী বলে দাবি করার প্রমাণ। মৃত্যুকে কি আমরা জানি? যদি না জানি, তা হলে তাকে ভয় করার অধিকার অজানাকে জানি বলারই সামিল। কেননা, কে জানে, মৃত্যু ভালো কি মন্দ? কে জানে, যে-মৃত্যুকে মানুষ চরম ক্ষতি বলে আতঙ্কিত হয়, সে-মৃত্যুই মানুষের জন্য পরম মঙ্গল বহন করে আনে কিনা? মানুষের এই অজ্ঞতা এবং সেই অজ্ঞতাকেই আবার জ্ঞান বলে অহঙ্কার প্রকাশ করাই হচ্ছে মানুষের পক্ষে সবচেয়ে লজ্জার বিষয়। অপর সব মানুষের মতোই আমি জগতের কিছুই জানিনে, তথাপি আমি নিজে মনে করিনে যে, আমি জানি। কিন্তু একটি বিষয় আমি জানি যে, যা মহৎ তার প্রতি অন্যায় কিংবা তার বিরুদ্ধতা অবশ্যই মানুষের পক্ষে অসম্মানজনক। একথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে, নিশ্চিত অমঙ্গল এবং সম্ভাব্য মঙ্গলের মধ্যে যদি একটিকে গ্রহণ করতে হয় তা হলে আমি কখনো সম্ভাব্য মঙ্গলের বিনিময়ে নিশ্চিত অমঙ্গলকে গ্রহণ করব না। এ্যানিটাস বলবেন : আমার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আনা হয়েছে, তখন আমাকে অবশ্যই দণ্ডিত করা উচিত। কেননা, তার মতে, তা না হলে আমাকে আদৌ অভিযুক্ত করা উচিত বলে বিবেচিত হতে পারে না। তদুপরি তার মতে আমাকে মুক্তি দিলে আপনাদের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমার শিক্ষায় কলুষিত হয়ে যাবে। আমি আমার কথা বলছি। এ্যানিটাসের যুক্তি যদি আপনারা গ্রহণ না করেন এবং আমাকে এই বলে সাবধান করে মুক্তি দেন : সিক্রেটিস, এবার আমরা এ্যানিটাসের অভিযোগকে গ্রহণ করলাম না–এবং তোমাকে মুক্তি দিলাম। কিন্তু একটি শর্তে। শর্তটি হচ্ছে এই যে, বিশ্বের সমস্ত বিষয় সম্পর্কে তোমার অনুসন্ধান-কার্যটি তুমি বন্ধ করে দেবে। কিন্তু যদি দ্বিতীয়বার তোমাকে এরূপ দার্শনিক কার্যে লিপ্ত দেখা যায় তা হলে তখন তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। আপনাদের এরূপ শর্তের জবাবে তা হলে আমি বলব : এথেন্সবাসীগণ! আপনাদের আমি সম্মান করি এবং ভালবাসি। কিন্তু আমার চরম আনুগত্য আপনাদের প্রতি নয়। আমার আনুগত্য, বিশ্ববিধাতার প্রতি আমার জীবন ও শক্তি থাকা পর্যন্ত কখনোই আমি দর্শনের শিক্ষা এবং প্রচার হতে বিরত হব না। যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে আমি তাকেই বলব, হে আমার মহান এথেন্সনগরীর বন্ধু! জ্ঞান এবং আত্মার উন্নয়নের প্রতি তোমার লক্ষ্য নিবন্ধ না করে কেবল অর্থ, সম্মান এবং সুখ্যাতির সঞ্চয়ে কি তুমি লজ্জা বোধ কর না। আমার সঙ্গে তর্করত বন্ধু যদি বলেন : হ্যাঁ, তাবশ্যই তিনি লজ্জা বোধ করেন এবং আত্মার উন্নয়নে তিনি বেষ্টিত আছেন, তা হলে আমি অবশ্যই তাকে আদ্যোপান্ত প্রশ্ন করে দেখব, সত্যই তার সত্তার মধ্যে ধর্ম এবং ন্যায়পরায়ণতার অস্তিত্ব রয়েছে কিংবা তিনি ভিত্তিহীনভাবেই নিজেকে ন্যায়পরায়ণ বলে দাবি করছেন। আমি যদি দেখি তার দাবি ভিত্তিহীন তা হলে আমি অবশ্যই তাকে মহতের চেয়ে হীনকে মূল্যবান মনে করার জন্য ভর্ৎসনা করতে কুণ্ঠিত হব না। যুবক, বৃদ্ধ, নাগরিক কিংবা বিদেশী যার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটবে, তাকেই আমি একথা বলব। কিন্তু এথেন্সবাসীকে বলার অধিকারই আমার অধিক যেহেতু তারা আমার স্বদেশবাসী-ভ্রাতৃবৃন্দ। এ কর্তব্য পালনকে আমার প্রতি বিধাতার আদেশ বলেই আমি গণ্য করি। একথাও আমি বিশ্বাস করি, বিধাতার আদেশ পালন করাই রাষ্ট্রের প্রতি আমার মহত্তম সেবা। কেননা, আমি যখন আপনাদের সঙ্গে আলাপ করি সে-আলাপ শুধু একথা বলার জন্যই যে, আপন সম্পদ কিংবা স্বার্থের চেয়ে যেন আত্মার উন্নয়নকেই জীবনে প্রথম এবং প্রধান ব্রত বলে আপনারা গ্রহণ করেন। আমার দেশবাসীকে আমি বলব : সম্পদে ধর্ম নেই, ধর্মই সম্পদ। শুধু সম্পদ নয়, মানুষের সমষ্টিগত কিংবা ব্যক্তিগত সমস্ত মঙ্গলই ধর্মে নিহত। এই আমার শিক্ষা। আমার এই শিক্ষায় যদি দেশের যুব সম্প্রদায়ের চরিত্র কলুষিত এবং বিনষ্ট হচ্ছে বলে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়, তা হলে আমি সে অভিযোগকে স্বীকার করে বলব : হ্যাঁ, এই ‘অপরাধে’ আমি অপরাধী। কেউ যদি বলেন যে, এ শিক্ষা আমার নয়, তা হলে আমি বলব : সেও অসত্যভাষণে দোষী। সুতরাং আমি বলছি : বিচারপতিগণ, এ্যানিটাস যা আপনাদের করতে বলে, আপনারা তাই করুন। কিংবা এ্যানিটাস যা আপনাদের করতে নিষেধ করে, আপনারা তা করা থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের যেমন অভিরুচি তেমন আপনারা সিদ্ধান্ত করুন। আপনাদের ইচ্ছা হয় আমাকে আপনারা অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। ইচ্ছা হয় আমাকে দণ্ড দিতে পারেন। কিন্তু একথা নিশ্চিত জানবেন, আপনাদের কোনো সিদ্ধান্তই আমাকে আমার গৃহীত পথ থেকে ভ্রষ্ট করতে সক্ষম হবে না। শুধু একবার নয়, বারবারও যদি আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তা হলেও আমার জীবনের পথ অপরিবর্তিতই থাকবে।
এথেন্সবাসীগণ! আমাকে শ্রবণ করুন। আমাকে বাধা দেবেন না। আমাদের মধ্যে এ বিষয়ে স্থির বক্তব্য এখনো শেষ হয় নি। আমার আরো কথা রয়েছে। আমার সে কথা শুনলে হয়তো আপনারা আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠবেন। আমি বলি, আর্তনাদ না করে ধৈর্য ধরে আমার সব কথা শ্রবণ করুন। আমার কথা আপনাদের মঙ্গল বই কোনো অমঙ্গল সাধন করবে না। আপনারা একথা নিশ্চিত জেনে রাখুন, আমাকে হত্যা করে আমার ক্ষতি সাধানের চেয়ে আপনারা আপনাদেরই অধিক ক্ষতির কারণ হবেন। আমার ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা আপনাদের আয়ত্তের বাইরে। এ্যানিটাস কিংবা মেলিটাস কারু পক্ষেই আমার কোনো ক্ষতি সাধন সম্ভব নয়। কেননা, অধম কখনো উত্তমকে আঘাত করে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। একথা আমি অস্বীকার করিনে, অধম এ্যানিটাস উত্তমকে হত্যা করতে পারে, তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারে এবং এভাবে সে কল্পনা করতে পারে যে, উত্তমের সে চরম ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেই আমি আপনাদের সঙ্গে একমত নই। অধম যদি উত্তমকে আঘাত করতে অক্ষম হয়, তা হলে এ্যানিটাসও উত্তমকে হত্যা করে উত্তমের কোনো অনিষ্ট সাধন করতে পারবে না। কেননা, অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের জীবন গ্রহণ করে যে অন্যায় সাধন করবে, সে অন্যায় অপর যে-কোনো অন্যায়ের চেয়ে হীন, অপর যে-কোনো অন্যায়ের চেয়েই গুরুতর।
এথেন্সবাসীগণ! আমার এ যুক্তি আত্মস্বার্থে প্রদত্ত যুক্তি নয়। আপনারা হয়তো তাই মনে করেন। কিন্তু আত্মস্বার্থের জন্য নয়, আপনাদের মঙ্গলের জন্যই একথা বলছি। আমাকে আপনারা বিধিদত্ত একটি দান হিসাবেই জানবেন। আমাকে হত্যা করে বিধাতাকে অমান্য করার অপরাধেই আপনারা অপরাধী হবেন, কেননা, আমাকে হত্যা করলে আপনারা সহজে আমার স্থান পূরণ করার ন্যায় উত্তরাধিকারী কাউকে পাবেন না। সে কি আপনাদের ক্ষতির বিষয় হবে না? হাস্যকর একট উপমাকে যদি আমি ব্যবহার করি তা হলে আমি বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের জন্য আমি হচ্ছি বিধিদত্ত একটি উঁশ পোকা। রাষ্ট্র অবশ্যই একটি বিরাট অশ্ব বিশেষ। আপন আকারের ভারে সে মন্থরগতি। তার মধ্যে গতি সঞ্চারের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে আমি হচ্ছি সেই উস্কে দেবার উঁশ। বিরামহীনভাবে দিবসব্যাপী সর্বত্র আমি আপনাদের পেছনে লেগে রয়েছি, ভর্ৎসনা করে আপনাদের চেতনাকে আমি জাগরিত করে তুলছি। এরকম উপকারী লোক আপনারা দ্বিতীয় একটি খুঁজে পাবেন না। তাই আপনাদেরই স্বার্থে আমার জীবন রক্ষা করতে বলব। আমি জানি আমার একথায় আপনারা নিদ্রা থেকে সদ্য জাগরিত ব্যক্তির ন্যায় আমার উপর রুষ্ট হয়ে উঠবেন। কারণ এ্যানিটাসের মতো আপনারাও হয়তো মনে করবেন, আমাকে হত্যা করলেই আমার মৃত্যুর পরে আপনাদের অবশিষ্ট জীবন আপনারা উদ্বেগহীন নিদ্রার মধ্যে কাটাতে পারবেন, যতদিন না বিধাতা আমার ন্যায় অপর কোনো উঁশ পোকাকে আপনাদের জন্য প্রেরণ করেন। আপনাদের জন্য আমি বিধাতার দান। আমার একথা বলার প্রমাণ হচ্ছে এই যে, আমি যদি অপর সাধারণ লোকের ন্যায় হতাম, তা হলে আমার ব্যক্তিগত সমস্ত স্বার্থকে আমি নিরুদ্বিগ্নভাবে অবহেলিত হতে দিতাম না; আপনাদের মঙ্গলামঙ্গল নিয়ে চিন্তান্বিত থাকতাম না; আপনাদের পিতা কিংবা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় ধর্ম এবং ন্যায়ের পথে আপনাদের আনয়নের চেষ্টা করতাম না। এরূপ কার্য নিশ্চয়ই স্বাভাবিক মানুষের কার্য নয়। আমার শিক্ষাদানের বিনিময়ে যদি আমি কিছু পেতাম তা হলেও হয়তো এর কোনো অর্থ থাকত। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, কোনো উদ্ধত অভিযোক্তাই একথা আজ বলতে পারে না যে, শিক্ষাদানের বিনিময়ে কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে আমি কোনো মূল্য দাবি করেছি। এ অভিযোগের কোনো সাক্ষ্যই তারা উপস্থিত করতে পারে না। তাই আমার নিজের কথার বড় প্রমাণ এবং সাক্ষ্য হচ্ছে আমার নিজের আর্থিক দ্রারিদ্র্য।
কেউ হয়তো আশ্চর্য হয়ে বলবেন, আমি কেন প্রকাশভাবে রাষ্ট্রকে উপদেশ দ্বারা সাহায্য না করে ব্যক্তিগতভাবে অন্য লোকের বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং চিন্তান্বিত হই? কেন আমি সাহসভরে প্রকাশ্যে অগ্রসর হয়ে আসিনে? একথারও আমি জবাব দিচ্ছি : আপনারা বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন সময়ে আমাকে এক ভবিষ্যদ্বাণী এবং এক ভবিষ্যদ্বক্তার কথা বলতে শুনেছেন। মেলিটাস তাঁর অভিযোগে এ নিয়েই আমাকে ব্যঙ্গ করেছেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী আমার নিকট একটি বিশেষ সঙ্কেতস্বরূপ। আমি যখন শিশু তখন থেকেই এ বাণী আমাকে পথ প্রদর্শন করে এসেছে। এ বাণী আমাকে কেবল কোনো অন্যায় করা থেকে বিরত করে; কোনো কর্ম সাধনের জন্য সে আমাকে আদেশ দেয় না। এই বাণীর নিষেধেই আমি রাজনীতিতে যোগদান করা থেকে বিরত রয়েছি। ভ্রাতৃবৃন্দ, আমি জানি, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে রাজনীতি বহু পূর্বেই আমাকে ধ্বংস করে ফেলত। রাজনীতি দ্বারা আমি আমার নিজের কিংবা আপনাদের কোনো মঙ্গলই সাধন করতে পারতাম না। আমার সত্য কথা বলার জন্য আপনারা দয়া করে ক্রুদ্ধ হবেন না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্রের মধ্যে যত অরাজক এবং অন্যায় কার্য সাধিত হয়, যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে তার সংশোধনের জন্য আপনাদের বিরুদ্ধে কিংবা কোনো জনসমষ্টির বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত হয়, তা হলে তার ধ্বংস অনিবার্য। সুতরাং আমি মনে করি, সত্যের জন্য যদি কেউ সংগ্রাম করে এবং সে সংগ্রাম যদি ক্ষণস্থায়ীও হয়, তা হলেও তার উত্তম স্থান কোনো রাষ্ট্রীয় আসন নয়, তার উত্তম স্থান অবশ্যই অ-রাষ্ট্রীয়, অর্থাৎ বেসরকারি কর্মকেন্দ্র।
আমার একথার যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণই আমি আপনাদের দিতে পারি। শুধু উক্তি নয়, আপনারা যে-কাজের মূল্য দেন অধিক, সে-কাজের দৃষ্টান্ত দ্বারাই আমার কথার সত্যতা আমি প্রমাণ করছি। আমার জীবনের একটি কাহিনী আপনারা আমাকে বর্ণনা করতে দিন। এ কাহিনী অবশ্যই প্রমাণ করবে, মৃত্যুর ভয়ে অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করতে আমি পারিনে। এবং নতি স্বীকার করতে যেখানে আমি অক্ষম সেখানে মৃত্যুই আমার পক্ষে শ্রেয়। বিচারালয় সম্পর্কে আমি একটি গল্প বলছি। গল্পটি খুব আকর্ষণপূর্ণ না হলেও সত্য। এথেন্সবাসীগণ! আপনারা জানেন যে, সিনেটের সভ্য হিসাবে একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় পদই আমি জীবনে গ্রহণ করেছিলাম। আপনারা একথাও জানেন যে, আমি হচ্ছি এন্টিওকিস গোত্রভুক্ত। সমরবাহিনীর অধিনায়কগণ আরগিনুসি সমরক্ষেত্রে নিহত সৈন্যদের মৃতদেহ সঙ্গে করে নিয়ে না আসাতে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের জন্য সোপর্দ হয়েছিল। এই বিচারকমণ্ডলীর সভাপতিত্বে তখন আমার ক্ষেেত্রই ছিল অধিষ্ঠিত। এই বিচারে আপনারা সমরনায়কগণকে সমষ্টিগতভাবে বিচার করে দণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। এ পদ্ধতি অবশ্যই আইনবিরুদ্ধ ছিল। পদ্ধতিটি যে আইনবিরুদ্ধ ছিল, একথা আপনারা পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন বিচারকদের মধ্যে একমাত্র আমিই আপনাদের সে অসংগত প্রস্তাবের বিরুদ্ধতা করেছিলাম। বাগীর দল আমাকে গেপ্তার করে বিচার করার হুমকি দিয়েছিল। আপনারা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে আমাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি স্থির করলাম : আইন এবং ধর্ম আমার পক্ষে। আপনাদের বিরুদ্ধতা করার জন্য আমি বন্দিশালায় প্রেরিত হতে পারি, তাও আমি জানতাম। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত অটল ছিল : বন্দিত্ব কিংবা মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে আমি আপনাদের অন্যায় কার্যে অংশগ্রহণ করব না। এই ঘটনা ঘটেছিল দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তিরিশের স্বৈরতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তারা আমাকে এবং অপর চার ব্যক্তিকে সভাকক্ষে ডেকে নিয়ে আদেশ দিল যেন সালামিসের লীয়ঁকে আমরা তাদের যুপকাষ্ঠে বলিদানের জন্য বন্দি করে নিয়ে আসি। এই পদ্ধতিতেই তারা তাদের পাপকার্যে যত সংখ্যক ব্যক্তিকে সম্ভব জড়িত করার ষড়যন্ত্র করত। কিন্তু সেদিনও আমি শুধু মুখের কথায় নয়, কার্যদ্বারাই তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, মৃত্যুর জন্য আমি বিন্দুমাত্র পরোয়া করিনে। আমি বলেছিলাম, আমার একমাত্র চিন্তার বিষয় হচ্ছে, যেন আমি কোনো অন্যায় এবং অপবিত্র কার্যে নিজেকে নিযুক্ত না করি। সেদিনও স্বৈরতন্ত্রের পাশব হস্ত আমাকে অন্যায় কার্যে লিপ্ত করতে সক্ষম হয় নি। সভাকক্ষ থেকে আমরা যখন বেরিয়ে এলাম, তখন অপর চার ব্যক্তি লীয়কে বন্দি করে আনার জন্য সালামিস যাত্রা করেছিল এবং আমি সোজা আমার গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলাম। আমি জানি অল্পকালের মধ্যেই সেই ‘তিরিশের স্বৈরতন্ত্রের’ পতন না ঘটলে আমার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। আমার একথার সাক্ষ্যের কোনো অভাব হবে না।
আপনারা কি সত্যকারভাবে মনে করেন যে, সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করে রাজনৈতিক জীবনে আমি এতদিন এই সমস্ত বিপর্যয়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকতে পারতাম? না, আমাদের রাজনৈতিক জীবনে আমার পক্ষে কিংবা অপর কারো পক্ষেই এটি সম্ভব নয়। কিন্তু আমি একথা বলতে পারি যে, সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত, কোনো ক্ষেত্রেই আমি হীনতার কাছে মাথা নত করি নি। আমার সমস্ত কার্যক্রমে একই নীতি আমি অনুসরণ করেছি। অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যাদেরকে আমার শিষ্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে তাদের কিংবা অপর কারো ঘৃণ্য অনুরোধসমূহকে আমি কখনো। স্বীকার করি নি। রীতিমাফিক কোনো শিষ্য আমার রয়েছে, একথা আমি বলছিনে। তবে তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, কেউ যদি উপদেশ দানকালে আমার নিকট এসে আমার উপদেশ শ্রবণ করতে চায়, তা হলে কাউকে নিষিদ্ধ করারও আমার কোনো কারণ নেই। যারা আমাকে অর্থদান করেন কেবল তাদের নিকটই আমি আমার অভিমত পেশ করি, একথাও ঠিক নয়। অর্থহীন কিংবা অর্থবান যে কেউ আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন; ইচ্ছে হলে তারা আমার প্রশ্নের জবাবও দিতে পারেন–কিংবা আমার বক্তৃতা শ্রবণ করতে পারেন। এঁদের কারো সৎ কিংবা অসৎ হওয়ার দায়িত্ব তো আমার কাঁধে অর্পণ করা চলে না। কারণ আমি কখনো কাউকে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা দেবার দাবি করি নি। এঁদের কেউ যদি আজ বলেন, তিনি প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে আমার নিকট থেকে এমন কথা কিংবা মত শুনেছেন, আমার যে-কথা কিংবা মত বিশ্ববাসী শুনে নি, তা হলে আমি বলব, তিনি মিথ্যা কথা বলছেন।
আমি জানি, আমাকে তথাপি প্রশ্ন করা হবে : সক্রেটিস, তোমার সঙ্গে নগরবাসীগণ বিরামহীনভাবে আলাপ করতে কেন এত আগ্রহ বোধ করে। এথেন্সের ভাতৃবৃন্দ। এ বিষয়ে সমগ্র সত্যকে আমি ইতঃপূর্বে আপনাদের নিকট উপস্থিত করেছি। বস্তুত ভণ্ডজ্ঞানীকে যখন আমি জেরা করি, তখন বিষয়টি নগরবাসীদের নিকট বিশেষ উৎসাহজনক হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে জেরা করার এ দায়িত্বটি বিধাতা আমার উপর অর্পণ করেছেন। এক্ষেত্রে আমি উপায়হীন। বিধাতার আদেশ ভবিষ্যদ্বক্তার মুখে ঐশিক প্রত্যাদেশে এবং দৈববাণী লাভের সর্ব-উপায়ে আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে। এথেন্সবাসীগণ! একথা আমার সত্য। যদি সত্য না হয় তা হলে অবশ্যই অচিরে এটা খণ্ডিত হবে। যদি এমন হয় যে, তরুণদের আমি দুর্নীতি-দুষ্ট এবং কলুষিত করে আসছি। এবং এখনও করছি তবে, তাদের মধ্যে যারা আজ বয়োপ্রাপ্ত হয়ে উপলব্ধি করছেন যে, তরুণ বয়সে আমার ভ্রান্ত উপদেশে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উপলব্ধি করছেন যে, তরুণ বয়সে আমার ভ্রান্ত উপদেশে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা হলে তারা আজ অভিযোগকারী : হিসাবে অগ্রসর হয়ে আসুন, আমার ভ্রান্ত উপদেশের প্রতিশোধ তারাই আজ গ্রহণ করুন। তারা নিজেরা যদি এগিয়ে আসতে না চান, তা হলে যে-কোনো আত্মীয়, পিতা ভ্রতা কিংবা সম্পর্কিত অপর কোনো নাগরিক এগিয়ে এসে বলুন, তাঁদের পরিবার পরিজনের প্রতি কী ক্ষতি আমি করেছি? তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের এই তো উত্তম মুহূর্ত। এই বিচারকক্ষে তাদের অনেকেই আমি দেখতে পাচ্ছি। অদূরে আমারই পৌর এলাকাবাসী এবং সমবয়স্ক ক্ৰিটোকে আমি দেখতে পাচ্ছি। তার পুত্র ক্রিটোবুলাসও রয়েছে। তা ছাড়া সিফটাসবাসী ইকাইলিসের পিতা লিসানিয়াসও রয়েছেন। আরো রয়েছেন সেফিসাসের নাগরিক এপিজেনিসের পিতা এন্টিফন। বিভিন্ন সময়ে আমার সঙ্গী ছিলেন এরূপ ব্যক্তিদের ভ্রাতাগণও বিচারকক্ষে উপস্থিত রয়েছেন। থিওডোটাইডিসের পুত্র এবং থিওডোটাইডিসের ভ্রাতা নিকোসট্রাটাস রয়েছেন। থিওডোটাস আজ নিজে মৃত। সুতরাং তিনি নিশ্চয়ই তার ভাইকে আজ প্রতিশোধ গ্রহণে বাধা দান করবেন না। অদূরে ডিমোডোকাসের পুত্র পারালাস রয়েছেন। পারালাসের ভ্রাতা ছিলেন থিজিস। এরিস্টনের পুত্র এ্যাডিম্যানটাস এবং তার ভ্রাতা প্লেটোও উপস্থিত রয়েছেন। এ্যাপোলোডোরাসের ভ্রাতা ইনটোডোরাসকেও আমি দেখতে পাচ্ছি। আরো বহু নামের উল্লেখ করতে পারি। আমার অভিযোগকারী মেলিটাসের অবশ্যই উচিত ছিল তার বক্তৃতার মধ্যে এদের কাউকে তার অভিযোগের সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত করা। যদি মেলিটাস তাদের কথা পূর্বে বিস্মৃত হয়ে থাকে, তা হলে এখনও সে তাদের উপস্থিত করতে পারে। সেজন্য আমি আমার বক্তব্যে ক্ষান্তি দিতে অবশ্যই সম্মত হব। কোনো প্রকার প্রমাণ বা সাক্ষ্য থাকলে সে তা উল্লেখ করুক। কিন্তু, এথেন্সবাসীগণ! তা সে উল্লেখ করতে পারে না। বরং ব্যাপারটা বিপরীত রকম দাঁড়াবে। মেলিটাস বা এ্যানিটাস আমাকে অনিষ্টকারী বা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করলেও এঁরা আমার পক্ষেই উচ্চৈঃস্বরে কথা বলবেন। শুধু আমার দ্বারা ভ্রষ্ট তরুণরাই আমার পক্ষে দাঁড়াবে না। তা হলে হয়তো একটা স্বার্থের কথা বলা চলত। তাদের বয়স্ক আত্মীয়বর্গই আমার পক্ষে এসে দাঁড়াবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা আমার পক্ষে দাঁড়াবেন। সত্য এবং ন্যায়ের দাবিতেই তারা আমাকে সমর্থন করবেন। কারণ, তাঁরা জানেন, আমি সত্য কথাকে। ঘোষণা করছি এবং মেলিটাস একজন মিথ্যাবাদী।
নগরবাসীগণ! এই আমার জবানবন্দি; আত্মপক্ষ সমর্থনে এই আমার বক্তব্য : শুধু আর একটি কথা আমি বলতে চাই। একটি বিষয়ে কেউ আমার উপর রাগান্বিত বোধ করতে পারেন। আমি আজ বিচারালয়ে অভিযুক্ত। তিনিও হয়তো এমনি বা এর চেয়েও গুরুত্বহীন কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারালয়ে সোপর্দ হয়েছিলেন এবং দয়া ভিক্ষার জন্য সাশ্রনয়নে অসংখ্য আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবর্গসহ আপন সন্ততিতে বিচারকের সম্মুখে উপস্থিত করে একটি করুণ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিলেন। হয়তো এসব তার স্মৃতিপথে আজ জেগে উঠছে। জেগে উঠছে আমাকে দেখে। কেননা, আমার যখন জীবনসংশয় তখনো আমি মার্জনা ভিক্ষার জন্য এরূপ কোনো কাজই করছি না। অবস্থার এই বৈপরীত্যে হয়তো তিনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে আমার মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেই ভোট প্রদান করবেন। এমন কেউ এখানে আছেন, একথা আমি বলছিনে। তথাপি যদি এরূপ কেউ থাকেন, তা হলে আমি তাকে উদ্দেশ করে বলব : বন্ধু! আমিও একজন রক্তমাংসেরই মানুষ। হোমার কাষ্ঠ কিংবা প্রস্তুর নির্মিত মানুষ’-এর উল্লেখ করেছেন। আমি তা নই। আমার গৃহ হয়েছে। এথেন্সবাসীগণ আপনারা জানেন, আমার তিনটি পুত্র আছে। একটি প্রায় বয়োপ্রাপ্ত হয়েছে। অপর দুটি এখনো কিশোর। কিন্তু আমার মুক্তির জন্য তাদের কাউকে আমি আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করতে চাইনে। আমার অহমিকা কিংবা আপনাদের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে একথা আমি বলছিনে। মৃত্যুকে আমি ভয় করি কিংবা করিনে সে-কথা স্বতন্ত্র–সে সম্পর্কে এখন আর আমি কিছু বলব না। কিন্তু জনমতের সম্মান করেই আমি বলছি, এরূপ কাজ রাষ্ট্রের জন্য, আপনাদের জন্য এবং আমার নিজের জন্য অসম্মানজনক হবে। আমি মনে করি, আমার ন্যায় বয়সে বৃদ্ধ এবং জ্ঞানী বলে পরিচিত কোনো ব্যক্তির পক্ষে এরূপভাবে নিজেকে হেয় করা উচিত হবে না। আমার নিজের সম্পর্কে এরূপ ধারণা যথার্থ হোক বা না হোক, একথা সত্য যে, জগৎবাসী সক্রেটিসকে একটু অসাধারণ এবং কিছুটা শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচনা করে। আপনাদের মধ্যে যারা সাহসে, জ্ঞানে কিংবা অপরাপর গুণে অধিকতর শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত, তারা যদি এরূপভাবে নিজেদের হেয় করেন, তা হলে সে-কার্য কি লজ্জাজনক হবে না? মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিদের আমি দেখেছি। তাদের প্রতি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণায় তারা অত্যদ্ভুত আচরণ করেছেন। তাঁদের আচরণে বোধ হয়েছে যেন তারা মনে করেছেন মৃত্যু তাদের জন্য অসহনীয় যাতনা বহন করে আনবে; আর তাঁদের জীবন ভিক্ষা দিলে তারা পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবেন। আমি মনে করি, এরূপ ব্যবহার সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার বিষয়। বিদেশ হতে আগত কেউ এরূপ দেখে অবশ্যই বলবেন : ‘এথেন্সের সবচেয়ে খ্যাতিমান নাগরিক, যাদেরকে এথেন্সবাসী সম্মান করেছে এবং অধিনায়ক বানিয়েছে, তারা যখন এরূপ আচরণ করছেন, তখন তারা স্ত্রীলোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুতে নন? সেই জন্যই আমি বলছি, আমাদের মধ্যে যাদের একটু খ্যাতি রয়েছে তাদের এরূপ আচরণ করা সংগত নয়। এরূপ আচরণকে আপনারা নিষিদ্ধ করে দিন। আপনারা বরঞ্চ ঘোষণা করে দিন, মৃত্যুদণ্ডের মুখে যারা শান্ত থাকে তাদের চেয়ে যারা এরূপ অশ্রুপাতের দৃশ্য সৃষ্টি করে এবং এথেন্সনগরীকে হাস্যাস্পদ করে তোলে, তাদের প্রতি মৃত্যুদণ্ড প্রদানেই আপনারা অধিকতর ইচ্ছুক।’
জনমতের প্রশ্নটি ছেড়ে দিলেও, বিচারককে যুক্তি দিয়ে বুঝাবার পরিবর্তে অনুনয় করে প্রাণ ভিক্ষার মধ্যে আর একটি অন্যায়ের দিকও রয়েছে। বিচারকের কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়বিচার করা, ন্যায় বিচারকের দাম হিসাবে কাউকে ভিক্ষা দেওয়া তার কর্তব্য নয়। বিচারক শপথ গ্রহণ করেছেন, আপন ইচ্ছামতো নয়; দেশের বিধানসমূহকে মান্য করে তিনি বিচার করবেন। বিচারককে মিথ্যা গ্রহণে উৎসাহী করা কিংবা বিচারকের পক্ষেও মিথ্যা ভাষণের প্রশ্রয় দেওয়া সংগত নয়! এরূপ কার্যের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই যা আমি অবমাননাকর এবং ধর্মবিরুদ্ধ বলে বিবেচনা করি, আপনারা যেন আমাকে সে কাজ করতে অনুরোধ না করেন। আজ যখন মেলিটাসের অভিযোগ আমি অধর্মাচরণের দায়ে বিচারকক্ষে হাজির হয়েছি, তখন আমার পক্ষে এরূপ করা অধিকতর। দুঃসাধ্য। এথেন্সবাসীগণ! আমি যদি কেবল তর্কের জোরে আপনাদের শপথকে শক্তিহীন করে দিতে পারি তা হলে তর্কের জোরে দেবতাদের অস্তিত্বেও তো আমি আপনাদের অবিশ্বাসী করে তুলতে পারি। তেমন হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসহীন নাস্তিক হিসাবেই আমি নিজেকে দণ্ডিত করে ফেলব। কিন্তু আমি তো সেরূপ করতে পারিনে। কেননা, ঐশী শক্তিতে আমি বিশ্বাসী। বরঞ্চ আমি বলতে পারি, আমার অভিযোক্তাগণ দেবতাদের যতটা বিশ্বাস করেন, আমি তাদের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস করি। আমি আপনাদের নিকট এবং বিশ্ববিধাতার নিকট নিজেকে সঁপে দিচ্ছি। আপনারা সেই বিচারই করুন, যে-বিচার আপনাদের এবং আমার উভয়েরই মঙ্গল সাধন করবে।
এথেন্সবাসীগণ! আপনারা আমার মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ভোটদান করেছেন। একাধিক কারণেই এজন্য আমি দুঃখবোধ করছিনে। আপনাদের এ রায় আমার অপ্রত্যাশিত নয়। বরঞ্চ আমি বিস্মিত হয়েছি এই দেখে যে, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের সংখ্যা প্রায় সমান হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, আমার দণ্ডের পক্ষে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা অধিকতর হবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, আর ত্রিশটি ভোট আমার পক্ষে প্রদত্ত হলেই অভিযোগ থেকে আমি মুক্তি পেয়ে যেতাম। এখন আমি একথা বলতে পারি যে, মেলিটাসের ষড়যন্ত্রজাল আমি ছিন্ন করতে পেরেছি। কেননা, যে কেউ দেখতে পাবে, লাইকন এবং এ্যানিটাসের সাহায্য ব্যতিরেকে মেলিটাসের পক্ষে আইনসংগত এক পঞ্চমাংশ ভোট সংগ্রহ সম্ভব হতো না এবং মেলিটাসকেই তখন এক সহস্র ড্রাকমি জরিমানা দিতে হতো।
মেলিটাস আমার মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব করেছেন। এথেন্সবাসীগণ, আমারও একটা প্রস্তাব করার অধিকার আছে। কিন্তু কী প্রস্তাব আমি উত্থাপন করব? আমি যদি জীবন দিই, প্রতিদানে আপনারা আমাকে কী দেবেন? যার সমগ্র জীবনে একটি দিন আলস্যভাবে কাটাবার বুদ্ধিও সে প্রদর্শন করতে পারে নি, প্রতিদানে তাকে কী দেবেন আপনারা? সম্পদ কিংবা পারিবারিক স্বার্থ, সামরিক সম্মান কিংবা জনসভায় বক্তৃতাদান, বিচারকের আসন, ষড়যন্ত্রের খেলা কিংবা দল গঠনের অভীপ্সা–সাধারণ মানুষের কামনা বাসনার সব বিষয়েই যে নিরাসক্ত রইল, প্রতিদানে কী সে লাভ করবে? আমি চিন্তা করে দেখেছি, আমার সততা নিয়ে রাজনীতিক হিসাবে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য যে জীবনে আমি নিজের কিংবা আপনাদের কোনো মঙ্গল সাধন করতে পারব না বলে জেনেছি, সে জীবন আমি গ্রহণ করি নি। যে জীবনযাত্রায় আমি জনসাধারণের সর্বোত্তম মঙ্গল সাধন করতে পারি, সেই সঙ্গোপন জীবনই আমি গ্রহণ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রত্যেকের নিকট গিয়েছি। আপনাদের আমি একথা বুঝাবার চেষ্টা করেছি, যেন আপনারা ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করার পূর্বে নিজের আত্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন; যেন আপনারা আত্মস্বার্থের পূর্বে প্রজ্ঞা এবং ন্যায়পরায়ণতা অর্জনের প্রয়াস পান; যেন আপনারা ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে শ্রেয় মনে করেন; যেন এ নীতিকেই আপনারা আপনাদের জীবনের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেন। এমন ব্যক্তির কী প্রাপ্য? এথেন্সবাসী ভ্রাতৃগণ! নিশ্চয়ই এমন ব্যক্তি আপনাদের নিকট থেকে কিছু পরিমাণ পুরস্কারের দাবি করতে পারে। সে পুরস্কার তার উপযুক্ত হওয়াই সমীচীন। তার উপযুক্ত পুরস্কার আপনারা কি বিবেচনা করেন? আপনাদের সে উপকারক। সে উপকারক আপনাদের উপকারার্থে শিক্ষাদানের অবকাশ ব্যতীত অপর কিছু তো কামনা করে না। অলিম্পিয়াতে অশ্ব কিংবা রথের প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কৃত হয়েছে। তাদের রথ দুটি কিংবা অধিক সংখ্যক অশ্ব টেনেছে, সে প্রশ্ন তাদের পুরস্কারের ক্ষেত্রে আসে নি। প্রাইটেনিয়ামে তাদের ভরণপোষণের চেয়ে আপনাদের দরিদ্র উপকারকের ভরণপোষণ কিছু অন্যায় নয়। এটিই তার উপযুক্ত পুরস্কার। কেননা, আমি দারিদ্র্য নিপতিত, তারা সম্পদে বর্ধিত। তারা আপনাদের আপাত সুখের বিধান করে, আমি আপনাদের সত্যকার সুখের উপায় নির্ধারণ করি। কাজেই আমার ‘দণ্ডের’ যদি পরিমাপ করতে হয় তা হলে আমাকে প্রইটেনিয়ামে রক্ষা করাই আমার কর্মকাণ্ডের ন্যায্য প্রতিদান বলে বোধ হয়।
হয়তো আপনারা মনে করছেন, অশ্রুপাতের এবং করুণা ভিক্ষার প্রসঙ্গের ন্যায় এসব কথা আমার বাহাদুরি মাত্র। কিন্তু সে কথা সত্য নয়। একথা বলছি আমি, কেননা, আমি জানি, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারো কোনো অপকার আমি করি নি। আমার বক্তব্যকে হয়তো আমি আপনাদের নিকট বুঝিয়ে বলতে পারি নি। সেরূপ বলার মতো সময় আমাকে দেওয়া হয় নি। অন্যান্য নগরীর বিধানের ন্যায় এথেন্সেও যদি এমন বিধান থাকত যে, গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত একটি মাত্র দিনে গ্রহণ করা যাবে না, তা হলে আমি আপনাদের বুঝাতে অবশ্যই সক্ষম হতাম। কিন্তু মুহূর্তমাত্র সময়ে আমি প্রর্বতপ্রমাণ কুৎসার জবাব দিতে পারিনে। কিন্তু যেহেতু আমি জানি, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারো প্রতি কোনো অন্যায় আমি করি নি, সেজন্য আজ নিজের প্রতিও আমি অন্যায় করতে পারিনে। তাই আমি নিজের সম্পর্কে বলতে পারিনে যে, এমন কোনো অপরাধ আমি করেছি সেজন্য আমি শাস্তি পেতে পারি। তাই কোনো নির্দিষ্ট দণ্ডের প্রস্তাবও আমি করতে পারিনে। কেন আমি দণ্ডের প্রস্তাব করব? মেলিটাস আমার জন্য মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব করেছেন। আমি সে প্রস্তাবে ভীত বলেই কি বিকল্প দণ্ডের সুপারিশ করব? আমি কি জানি মৃত্যু মঙ্গল কি অমঙ্গল; আমি যখন তা জানিনে, তখন অপর এক দণ্ডের কেন আমি প্রস্তাব করব যাকে সুনির্দিষ্টভাবে অমঙ্গল বলেই জানি? আমি কি নিজেকে কারাগারে নিক্ষেপ করার প্রস্তাব করব? কিন্তু কেন আমি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে একাদশ বিচারকের দাসে পরিণত হব? অথবা কি বলব যে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আমার কারাদণ্ড হোক? কিন্তু এখানেও তো সেই একই প্রশ্ন। আমার তো অর্থ নেই। অর্থদানে অক্ষমতার জন্য আমাকে তো কারাগারেই জীবন কাটাতে হবে। নির্বাসনের প্রস্তাব তুলব? হতে পারে, আপনারাও নির্বাসনের কথা ভাবছেন। কিন্তু তা হলে তো বলতে হবে, জীবনের মোহ আমার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করেছে। কেননা, আপনারা আমার একান্ত আপনজন হয়েও যখন আমার আলাপকে সহ্য করতে পারেন নি তখন নির্বাসন-ভূমির অধিবাসীগণ আমাকে সহ্য করবে, এরূপ প্রত্যাশা করা আমার পক্ষে অযৌক্তিক নয় কি? এথেন্সবাসীগণ! না, সেরূপ হওয়া সম্ভব নয়। তদ্ব্যতীত বন্ধুগণ! আমার এই বৃদ্ধ বয়সে এক নির্বাসনভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে অপর কোথাও নির্বাসিত হয়ে, শহর থেকে শহরে বিচরণ করে কোন সার্থক জীবন আমি ধারণ করব? কেননা, আমি তো নিশ্চতরূপেই জানি, এখানে যেরূপ ঘটেছে, অপর সবখানেই সেরূপ ঘটবে। যুবকগণ আমার পার্শ্বে এসে সমবেত হবে। তখন আমি যদি তাদের বিতাড়িত করি তা হলে তাদের ক্ষুব্ধ দাবিতে তাদের অভিভাবকগণই আমাকে বিতাড়িত করে দেবেন; অপরদিকে যদি আমি তাদের আমার চতুঃপার্শ্বে সমবেত হতে দিই, তা হলেও তাদের অভিভাবকগণ তাদের মঙ্গলার্থে আমাকে বিতাড়িত করে দেবেন।
আপনাদের মধ্যে হয়তো কেউ বলে উঠবেন : তার চেয়ে সক্রেটিস, তুমি একটি বিদেশী নগরে গিয়ে নীরব এবং নিরুদ্বিগ্ন জীবনযাপন কর না কেন? এ প্রশ্নের জবাবটি বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য হবে। আমি যদি বলি, আপনাদের এরূপ আদেশ পালন করার অর্থ হবে, আমার স্রষ্টার আদেশকে অমান্য করা এবং আমি তা পারিনে, নির্বাক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তা হলে আপনারা হয়তো আমার কথাকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করবেন না। অপরদিকে যদি আমি বলি, আমার দৈনন্দিন আলাপনে আমি যেরূপ ন্যায়পরায়ণতা, আত্মজিজ্ঞাসা এবং অপর সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাই হচ্ছে মানুষের সর্বোত্তম মঙ্গলবিধায়ক এবং জিজ্ঞাসাশূন্য জীবন অর্থহীন বই অপর কিছু নয়, তা হলেও আপনারা আমাকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। তথাপি আমি সত্যভাষণ হতে ভ্রষ্ট হতে পারিনে, যদিও সে-সত্যের প্রতি আপনাদের প্রতীতি জন্মানো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। তদুপরি জীবনে আমি একথা ভাবতে অভ্যস্ত হই নি যে, আমি কখনো শাস্তিযোগ্য হতে পারি। আমার অর্থ থাকলে হয়তো আমি অর্থের মানদণ্ডে হিসাব কষে দেখতে পেতাম, আমার অপরাধের মূল্য খুব অধিক কিছু নয়। আমার অর্থ নেই। তাই আপনাদের আমি বলব, যেন আমার সামর্থ্যানুযায়ী আমার দেয় জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। নিজের মুখে বললে আমি বলব : এক মিনা পরিমাণ অর্থ দেবারই মাত্র আমার সংগতি রয়েছে। প্লেটো, ক্রিটো, ক্রিটোবুলাস এবং এ্যাপোলোডোরাস আমার শুভানুধ্যায়ী। তারা বলেছেন, আমি যেন জরিমানার পরিমাণ বর্ধিত করে ত্রিশ মিনার কথা বলি-তারাই এর জামিন হবেন। তা হলে তাই হোক। ত্রিশ মিনাই আমার দেয় জরিমানা ধার্য হোক। আশা করি উল্লিখিত বন্ধুবর্গ এ অর্থের জন্য উপযুক্ত জামিন বলে বিবেচিত হবেন।
এথেন্সবাসীগণ! আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে যে অখ্যাতিকে আপনারা লাভ করবেন তার বিনিময়ে উদ্বেগহীন অধিক সময় আপনারা প্রাপ্ত হবেন না। কেননা, আজকের নিন্দাকারীগণই আগামী কাল আপনাদের বিরুদ্ধে ‘জ্ঞানী সক্রেটিসকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উত্থাপন করবে। তারা আগামী কাল আমাকে জ্ঞানী বলবে এজন্য নয় যে, আমি জ্ঞানী। বরঞ্চ এজন্য, যেন তারা আপনাদের নিন্দার পাত্র করে তুলতে পারে। অথচ আপনারা যদি আর কিছুকাল অপেক্ষা করতেন তা হলে স্বাভাবিকভাবেই আমার সম্পর্কে আপনাদের মনোবাসনা পূর্ণ হতো। কেননা, আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আজ আমি বৃদ্ধ। জীবনপথে মৃত্যুর সীমান্ত থেকে আর আমি অধিক দূরে অবস্থিত নই। একথা আমি আপনাদের মধ্যে তাদের লক্ষ্য করেই বলছি যারা আমার প্রতি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা। করেছেন। আপনাদের নিকট আমার আর একটি কথা বলার আছে। আপনারা মনে করছেন, আমি এমন কিছু বলতে পারি নি যা আপনাদের অভিযোগ থেকে আমার মুক্তি আনতে পারত–অর্থাৎ আমি যদি অনুরোধ, উপরোধ কোনো কিছুই বাদ না রাখতাম তা হলেই আমার মুক্তি সম্ভব হতো। কিন্তু আমি তা মনে করিনে। বক্তব্যের ক্রটি নিশ্চয়ই আমার দত্রে কারণ নয়। আমার দণ্ডিত হওয়ার কারণ, বিচারকক্ষে আমার নিকট হতে মুক্তির যে আর্ত-আবেদন, যে বিলাপ ক্রন্দন আপনারা শুনতে চেয়েছিলেন এবং যে আর্ত আবেদন এবং বিলাপ শুনতেই আপনারা অভ্যস্ত সে আর্ত-বিলাপ আমার নিকট হতে আপনারা পান নি। সাহস, ঔদ্ধত্য, অনিচ্ছা–যে নামই আপনারা দিন না কেন, আপনাদের নিকট থেকে মুক্তি আদায়ের জন্য আর্ত-আবেদন কিংবা বিলাপ করতে আমি সম্মত নই। আমি এখনও মনে করি আমার পক্ষে এরূপ ব্যবহার প্রদর্শন অসংগত। এই বিচারের শুরুতেই আমি সিদ্ধান্ত করেছি : বিপদকালে অতি নগণ্য এবং নীচ কোনো ব্যবহার যেন আমি না করি। এখনও আমি আমার প্রদত্ত কৈফিয়তের জন্য অনুতপ্ত নই। যেকথা আমি বলেছি সেজন্য মৃত্যুবরণ করি, সে আমার শ্রেয়, তবু যেন না আমি আপনাদের অভিপ্রেত ভঙ্গিতে নিজেকে ছোট করে ক্ষমা ভিক্ষা করে জীবনধারণ করি। কেননা, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা আইনের সম্মুখে মৃত্যুকে পরিহারের জন্য ক্ষুদ্রতার আশ্রয় কারো নেওয়া উচিত নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সময়ই এরূপ ঘটে যে, আমার পশ্চাদ্ধাবনকারী শত্রুর সম্মুখে আমার হাতের অস্ত্র ত্যাগ করে নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলে মৃত্যুকে এড়ানো সহজ হয়। তেমনি বিপদের অন্যান্য ক্ষেত্রেও মৃত্যুকে এড়াবার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। মানুষ সে-সমস্তপন্থা অবলম্বন করলেই মৃত্যুকে এড়াতে পারে। প্রিয় বন্ধুগণ! মৃত্যুকে এড়ানো তত কষ্টকর কিছু নয়, যত কষ্টকর অন্যায়কে এড়ানো। কেননা, ক্ষিপ্রতার দিক দিয়ে অন্যায় মৃত্যুকে অতিক্রম করে আমাদের গ্রাস করে। আমি আজ বৃদ্ধ। গতি আমার মন্থর। আমাকে মন্থরগতি মৃত্যু যদি বা গ্রাস করেছে, কিন্তু আমার দ্রুতগতি অভিযোগকারীগণকে দ্রুততরগতি অন্যায় গ্রাস করেছে। সে কারণেই আপনাদের বিচারে আমি মৃতদণ্ডে দণ্ডিত আর ভবিষ্যতের বিচারে আমার হত্যাকারী বলে অখ্যাতির দণ্ডে আপনারা দণ্ডিত। আমার উপর প্রদত্ত দণ্ডকে আমি মাথা পেতে নেব। আমার অভিযোগকারী আপনারও যেন, আপনাদের উপযুক্ত দণ্ডকে মাথা পেতেই গ্রহণ করেন। আসুন, এই উভয় দণ্ডকেই আমরা বিধির অনিবার্য বিধান বলেই গ্রহণ করি।
এথেন্সবাসীগণ! আপনাদের মধ্যে যারা, আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন তারা আমার ভবিষ্যদ্বাণী শ্রবণ করুন। আমার মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুর মুখোমুখি যে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর একটি ক্ষমতাও জন্মলাভ করে, একথা আপনারা জানেন। সেই শক্তিতেই আমি ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করে বলছি : আমার হত্যাকারীগণ! একথা নিশ্চিত জেনো, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আমাকে যে শাস্তি দিতে তোমরা সক্ষম হয়েছ, আমার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তার চেয়ে কঠিনতর শাস্তি তোমাদের উপর নিপতিত হবে। তোমরা আমাকে হত্যা করেছ, কেননা, তোমরা আত্মজিজ্ঞাসা থেকে অব্যাহতি পেতে চাও। আমাকে তোমরা হত্যা করেছ, কেননা, জবাবহীন অভিযোগকে তোমরা এড়াতে চাও। কিন্তু তোমাদের আকাঙ্ক্ষিত সে অব্যাহতিকে তোমরা লাভ করবে না। তোমাদের আকাক্ষার বিপরীত ফলই তোমরা ভোগ করবে। আমি বলছি : একথা নিশ্চিত জেনো, সেদিন তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর সংখ্যা বর্তমানকে বহু পরিমাণে অতিক্রম করে যাবে। তোমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগকারীগণকে আমি সংযত রেখেছি আমার তিরোধানের পরে তারা দুর্বার হয়ে উঠবে। সে অভিযোগকারীগণ যুবক সম্প্রদায়। বয়সে তারা তরুণ। তারা তোমাদের সেদিন ক্ৰক্ষেপ করবে না, তোমরাও সেদিন তাদের অভিযোগে আজকের চেয়ে অধিকতর ক্ষুব্ধ হবে। তোমরা যদি মনে কর, মানুষকে হত্যা করে তোমাদের পাপকার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের কণ্ঠকে তোমরা রুদ্ধ করতে সক্ষম হবে, তা হলে অবশ্যই তোমরা ভ্রান্ত। তেমন পথে কেউ অব্যাহতি পেতে পারে না। সে পথ সম্মানের পথ নয়। মানুষের জন্য মহত্তম এবং প্রকৃষ্টতম পথ হচ্ছে অপরকে অক্ষম করে রাখা নয়। মহত্তম এবং প্রকৃষ্টতম পথ হচ্ছে নিজেকে উন্নত করে তোলা। আমার মৃত্যু আসন্ন আমি জানি। তথাপি এই মুহূর্তে আমার তিরোধানের পূর্বে যে বিচারকগণ আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন তাঁদের সম্মুখে এই ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করে গেলাম।
সুহৃদবর্গ! যারা আমার মুক্তিদানের পক্ষে মত জ্ঞাপন করেছেন, তাদের উদ্দেশেও আমি এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আমার বিচারকমণ্ডলী এখন কর্মব্যস্ত। অতি শীঘ্রই আমাকে বধ্যভূমিতে যেতে হবে। তার পূর্বে আমার কথা শ্রবণ করুন। ক্ষণকাল আপনারা অপেক্ষা করুন। আসুন আমরা পরস্পর খানিক আলোচনা করি। আপনারা আমার বন্ধু, আমার শুভাকাক্ষী। যে ঘটনা আমার জীবনে আজ সংঘটিত হলো, তার তাৎপর্য আপনারা উপলব্ধি করুন। আমার বিচারকমণ্ডলী। আপনারাও অবধান করুন। অবশ্যই আপনারা আমার বিচারক। একটি বিস্ময়কর ব্যাপার আমি আপনাদের অবগত করাতে চাই। যে ঐশিক শক্তি আমার অন্তর্বাণীর উৎস, সে এ যাবৎ আমার প্রতিটি কার্যে, এমনকি অতি সাধারণ ব্যাপারেও আমকে বাধা দিয়ে এসেছে। আমার বিন্দুমাত্র পদস্খলন কিংবা ভ্রান্তি থেকে আমাকে সে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আজ যে দুর্ভাগ্য আমাকে গ্রাস করেছে তাকে অবশ্যই আপনারা চরম দুর্ভাগ্য কবলে গণ্য করবেন। কিন্তু অদ্য প্রত্যূষে যখন আমি আমার গৃহ পরিত্যাগ করে আসি তখন আমার অন্তর্বাণী আমাকে এতটুকুও সাবধান করে নি। আমাকে বাধা দিয়ে সে বলে নিঃ সক্রেটিস! তুমি গৃহত্যাগ করো না।’ বিচারালয়ের উদ্দেশে আমি যাত্রা করলাম। তখনো সে কোনো নিষেধবাণী উচ্চারণ করে নি। বিচারকক্ষে আমার কোনো ভাষণের বিরুদ্ধে আমার অন্তর্বাণী আমাকে সাবধান করে নি। অথচ ইতঃপূর্বে আমার অনেক ভাষণের মধ্যপথে সে আমার কণ্ঠরুদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আজ এ প্রসঙ্গে আমার কোনো ভাষণ কিংবা কার্যে আমি আমার সে অন্তশক্তির নিকট বাধাপ্রাপ্ত হই নি। এই নীরবতার তাৎপর্য কী? এর তাৎপর্য আপনাদের নিকট আমি প্রকাশ করে বলছি। এ নীরবতার অর্থ হচ্ছে, আমার জীবনে আজ যা ঘটেছে, তা অবশ্যই মঙ্গলের জন্য ঘটেছে। যারা মৃত্যুকে অমঙ্গল বলে জানে তারাই ভ্রান্ত। আজকের ঘটনা যদি আমার জন্য মঙ্গলজনক না হয়ে অমঙ্গলজনক হতো, তা হলে ভবিষ্যদ্বক্তা অবশ্যই আমাকে এ পথে অগ্রসর হওয়া থেকে নিবৃত্ত করত।
বিষয়টিকে আমরা অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে পারি। তা হলেও আমরা দেখব, মৃত্যুকে মঙ্গল হিসাবে দেখাই যুক্তিসংগত। কেননা, হয় মৃত্যু এক অসীম শূন্যতা এবং চেতনার অবলোপ, নয়তো মানুষ যেরূপ কল্পনা করে, মৃত্যু হচ্ছে সেরূপ, এক জগৎ থেকে অপর এক জগতে আত্মার অতিক্রমণ। সুতরাং আমরা মৃত্যুকে যদি একটি ব্যাঘাতহীন নিদ্রা বলে মনে করি, যদি মনে করি চেতনা বলে কিছু নেই, আছে এমন এক অনন্ত নিদ্রা, যে নিদ্রা স্বপ্ন দ্বারাও বিঘ্নিত নয়, তা হলে অবশ্যই মৃত্যু আমাদের জন্য এক অবর্ণনীয় প্রাপ্তি। কেননা, কোনো ব্যক্তি যদি তার সমগ্র জীবনের নিদ্রাকে এমনভাবে ভাগ করতে সমর্থ হয় যে, তার একটি রাত্রির নিদ্রা স্বপ্নেরও অগোচর ছিল তা হলে সে অবশ্যই এই বিঘ্নহীন রাত্রিটিতেই জীবনের অবশিষ্ট দিন কিংবা রাত্রির চেয়েও উত্তম বলে মনে করবে। যদি তাকে তুমি জিজ্ঞাসা কর, এমন বিঘ্নহীন নিদ্ৰাময় রাত্রি তার জীবনে কটি এসেছে তা হলে সে ব্যক্তি–হোক সে সাধারণ, হোক সে সম্রাট,–নিশ্চয়ই বলতে পারবে না যে, এরূপ রাত্রি তার জীবনে বহুবার এসেছে। সুতরাং মৃত্যু যদি এমন বিঘ্নবিহীন নিদ্রা হয়, তা হলে আমি বলব, মৃত্যু আমাদের পরম সম্পদ। কেননা, অনন্তকাল তখন আত্মার জন্য একটি বিঘ্নহীন নিদ্রাময় রাত্রি বই অপর কিছু তো নয়। আবার মৃত্যু যদি মৃতের রাজ্যে গমন হয়, তা হলেও হে আমার বিচারক এবং বন্ধুগণ, মৃত্যুকে আমি মহত্তম মঙ্গল বলেই জানব। কেননা, এ জগতের যাত্রাশেষে পথিক আমি যদি পাতালপুরীতে গিয়েও প্রবেশ করি, তা হলে আপনাদের মতো ন্যায়পরায়ণ বিচারকমণ্ডলীর বন্ধন থেকে তো মুক্তি পাব। পাতালপুরীতে হয়তো আমি নীত হব মিনোস এবং রাডাম্যান্টাস এবং ইকাস এবং ট্রিপটোলেমাস এবং দেবরাজ্যের অপরাপর দেব-পুত্রদের সম্মুখে। তারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও ন্যায়পরায়ণ। তারাই সত্যকার বিচারক। তাদের সম্মুখে নীত হওয়ার সৌভাগ্য আমার আত্মার যাত্রাকে অবশ্যই সার্থক করে দেবে। মৃত অরফিউস এবং নিউসিয়াস এবং হেসিয়ড এবং হোমারের যদি আমি সঙ্গ পাই তা হলে বিনিময়ে আমার অদেয় কিই বা থাকতে পারে? এ যদি সত্য হয়, তা হলে আমি বলব : একবার নয়, শতবার যেন আমার মৃত্যু ঘটে। পালামেডিস এবং টেলামনের পুত্র আজাক্স–এমনি কত বীর সন্তানেরই মৃত্যু ঘটেছে অন্যায় দণ্ডে। আমি তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে পারব–এ সৌভাগ্যকে আমি আশীর্বাদ বলে জানব। তারাও একদিন দুঃখভোগে জীবনপাত করেছেন। আমার আপন জীবনের দুঃখভোগ ও নির্যাতনকে আমি তাদের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে দেখব। যে সম্ভাবনা আমার নিকট সবচেয়ে মূল্যবান সে হচ্ছে এই যে, মৃত্যুর জগতেই আমি সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ স্থির করতে পারব; সত্য-মিথ্যার অন্বেষণ আমি সে জগতেও বিরামহীনভাবে চালাতে পারব। কে জ্ঞানী আর কে জ্ঞানের প্রবঞ্চক–আমি তা সেখানেও নির্ধারণ করতে সক্ষম হবো। আমার বিচারকমণ্ডলী! মহান ট্রোজান অভিযানের অধিনায়ককে কিংবা অডিপাস, সিসিপাস এবং অপরাপর বীর নর-নারীকে সাক্ষাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার সৌভাগ্যের বিনিময়ে কি দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন? প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞাসা করতে পারব। এ সৌভাগ্যের কী অসীম আনন্দ। কেননা, মৃত্যুর ওপারে মৃতের সেই রাজ্যে কেউ তো কাউকে প্রশ্ন করার জন্য হত্যা করে না। আমার অধিকতর সুখী হওয়ার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে : মৃত্যুর পরে তো মরণ নেই। মৃত্যুকে পার হয়ে তো আমি অমর হয়ে যাব।
বিচারকমণ্ডলী! সুতরাং মৃত্যু সম্পর্কে আপনারা ভীত হবেন না। তাকে আপনারা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করুন। এবং একথাও আপনারা নিশ্চিত জেনে রাখুন : জীবনের এপারে কিংবা মৃত্যুর ওপারে মহতের ক্ষতিসাধন কেউ করতে পারে না। স্বর্গের দেবতারা মহতের পক্ষে। আমার আসন্নভাগ্যও আকস্মিক নয়। আমি উপলব্ধি করছি, আমার জীবনে এমন মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয়েছে, যখন জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তিই আমার জন্য শ্রেয়। এরই জন্য আমার অন্তর্বাণী আজ নীরব। এরই জন্য যারা আমার অভিযোগকারী, যারা আমার দণ্ডদাতা তাঁদের বিরুদ্ধেও আমার কোনো ক্ষোভ নেই। তারা আমার কোনো মঙ্গল কামনা না করলেও আমার কোনো ক্ষতি তারা করেন নি। বরঞ্চ এজন্য আমি তাদের খানিকটা ভৎর্সনাও করতে পারি।
শেষমুহূর্ত, তথাপি, তাদের নিকট আমার একটি যাত্থা রয়েছে। আমার প্রার্থনা, আমার পুত্রগণ যখন বয়োপ্রাপ্ত হবে তখন তাদেরও যেন আপনারা দণ্ডিত করেন। এবং তারা যেন ন্যায়ের চেয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, যদি তারা সত্যের চেয়ে সম্পদকে অধিক মূল্যবান মনে করে, যদি তারা অন্তঃসারশূন্য হয়ে নিজেদেরকে বিরাট বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, তা হলে আমি যেরূপ আপনাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছি, আপনারাও যেন তাদের জন্য সেরূপ উদ্বেগের কারণ হন, তা হলে আমি যেরূপ আপনাদের তিরস্কার করেছি আপনারাও যেন তাদেরকে সেরূপ তিরস্কার করেন। আমার এই প্রার্থনাটি মঞ্জুর করলেই আমি এবং আমার বংশধরগণ আপনাদের নিকট থেকে ন্যায় বিচার পেয়েছি বলে বোধ করব।
বিদায় মুহূর্তে সমাগত! আসুন আমরা আপন আপন পথে অগ্রসর হই। আমি অগ্রসর হই মৃত্যুর পথে। আপনারা অগ্রসর হউন জীবনের পথে। কোন পথ মহত্তর? জীবনের কিংবা মৃত্যুর? বিশ্বনিয়ন্তাই তার জবাব দেবেন।