ফিডো

ফিডো

চরিত্রাবলি

ফিডো [ফ্লিয়াসবাসী একিক্রাটিসের নিকট সংলাপের বর্ণনাকারী]
সক্রেটিস
এ্যাপোলোডারাস
সিমিয়াস
সিবিস
ক্রিটো
কারা পরিচালক

দৃশ্য : সক্রেটিসের কারাকক্ষ

সংলাপ বর্ণনার স্থান : ফ্রিয়াস।

একিক্রাটিস : ফিডো, সক্রেটিস যেদিন বিষপান করেছিলেন সেদিন তুমি নিজে কি কারাকক্ষে উপস্থিত ছিলে?

ফিডো : হ্যাঁ, একিক্রাটিস, আমি নিজেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

একি : আহ! সেদিনের সব ঘটনা যদি শুনতে পেতাম। অন্তিম মুহূর্তে তিনি সেদিন কী বলেছিলেন? আমরা শুধু এটুকু শুনেছি যে, সক্রেটিস বিষপানে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এর অধিক জানে এরূপ কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎ তো এ পর্যন্ত আমরা পাই নি। কারণ আজকাল কোনো ক্লিয়াসীর আর এথেন্স নগরীতে যাতায়াত করে না; এথেন্স থেকেও বহুদিন যাবৎ কেউ আমাদের এখানে পা দেয় নি। ফলে সক্রেটিসের অন্তিমকালের বিশদ বিবরণ আমরা বস্তুত কিছুই আজ পর্যন্ত পাই নি।

ফিডো : কিন্তু সক্রেটিসের বিচারের বিবরণ তত তোমরা পেয়েছ–নয় কি?

একি : হ্যাঁ, কারু কারু মুখে বিচারের বিবরণী আমরা কিছু পেয়েছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম না, সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে সঙ্গে সঙ্গে কেন সে দণ্ড কার্যকর করা হলো না কেন বিচার শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পরেই মাত্র তাকে হত্যা করা হলো? তুমি কি জানো ফিডো, কী কারণে এত বিলম্ব ঘটেছিল?

ফিডো : হ্যাঁ, বিলম্বের কারণ আমি জানি। বলতে পারো, সে বিলম্ব ঘটেছিল একটা দৈব যোগাযোগেরই ফলে। তোমরা হয়তো জানো যে, এথেন্সবাসীগণ ডেলস-এ জাহাজ পাঠিয়েছিল তার বিদায়-অভিষেক ঘটেছিল সক্রেটিসের বিচারের পূর্ব দিনটিতে।

একি : না, এ জাহাজটির বিষয় আমরা জানিনে। কী এ জাহাজ?

ফিডো : এ জাহাজ প্রেরণের ব্যাপারটা এথেন্সের একটা প্রচলিত প্রথায় দাঁড়িয়ে গেছে। এথেন্সের প্রাচীন লোককাহিনী অনুযায়ী থিসিউস চতুর্দশ তরুণকে সঙ্গে করে একটি জাহাজে চড়ে নাকি ক্রিট যাত্রা করেছিলেন। পথে জাহাজ বিপদগ্রস্ত হলে থিসিউস সাহসের সঙ্গে নিজের জীবন যেমন রক্ষা করেছিলেন, তেমনি তিনি রক্ষা করেছিলেন সঙ্গী চতুর্দশ তরুণকে। এই বিপদকালেই নাকি তারা এ্যাপোলোর নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল যে, তাদের জীবন রক্ষা পেলে প্রতি বৎসর তারা ডেলসের উদ্দেশে একটি জাহাজ প্রেরণ করবে। সেদিন থেকে জাহাজ প্রেরণের এই প্রথাটি আজ পর্যন্ত চলে এসেছে। এ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে এ্যাপোলোর পুরোহিত কর্তৃক নির্দিষ্ট জাহাজটির পশ্চাদ্ভাগের অভিষেক থেকে শুরু করে ডেলসে গমনাগমনের সমগ্র সময়টিকে এথেন্সে বিশেষ পবিত্র কাল বলে গণ্য করা হয়। পাছে এই অনুষ্ঠানের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়, সেজন্য এই সময়ের মধ্যে সমস্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাও স্থগিত রাখা হয়। ডেলস গমনাগমনের সাধারণ সময় কম নয়। কিন্তু বায়ু প্রতিকূলে বইলে জাহাজের প্রত্যাবর্তন আরো বিলম্বিত হয়ে অনুষ্ঠান-কালকে দীর্ঘতর করে দিতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আমি তোমাদের বলছিলাম, সক্রেটিসের বিচারের পূর্বদিনে এ বৎসরের এই জাহাজ প্রেরণের অভিষেক ঘটেছিল। ফলে জাহাজ প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও সক্রেটিসকে কারাগারে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন কাটাতে হয়েছিল-–এবং দণ্ডাজ্ঞার বহু পরেই তা কার্যকর করা হয়েছিল।

একি : প্রিয় ফিডো, কীভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন? মৃত্যুকালে কী তিনি করেছিলেন? কিছু কি তিনি বলেছিলেন? সক্রেটিসের প্রিয় সাথী ও সঙ্গীদের মধ্যে কে কে তখন তার নিকটে উপস্থিত ছিলেন? কিংবা কর্তৃপক্ষের নিষেধে কারুর পক্ষেই তাঁর অন্তিম মুহূর্তে তার নিকটে যাওয়া সম্ভব হয় নি?

ফিডো : না, তার কাছে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। বস্তুত সক্রেটিসের প্রিয় সাথীদের মধ্যে অনেকেই সেদিন তার নিকটে উপস্থিত ছিলেন।

একি : প্রিয় ফিডো, তোমার হাতে যদি তেমন কোনো জরুরি কাজ না থাকে তা হলে আমাদের আন্তরিক অনুরোধ, তুমি যথাসম্ভব সঠিকভাবে সেই দিনটির কাহিনী বর্ণনা করে আমাদের শোনাও।

ফিডো : না, আমার হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। তোমাদের অনুরোধ রক্ষা করতে আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। বস্তুত সক্রেটিসের কথা বলতে পারা বা শুনতে পারার ন্যায় আনন্দের বিষয় আমার নিকট অপর কিছুই নয়।

একি : এ মনোভাব শুধু তোমার নয়, আমাদেরও, আমাদের মধ্যে তুমি অবশ্যই তোমার মনোমতো শ্রোতাই পাবে। আমাদের অনুরোধ, যত সঠিক বর্ণনা দেওয়া সম্ভব তুমি সেরূপ বর্ণনাই আমাদের দেবে।

ফিডো : প্রিয় একিক্রাটিস! সেই দিনটিতে সক্রেটিসের সাহচর্যে থাকতে পেরেআমার মনে প্রকাশের অতীত এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা, একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমার প্রিয় বন্ধুর বধ্যভূমিতে তার হত্যাকাণ্ডের সম্মুখে আমি উপস্থিত রয়েছি। আর তাই তার জন্য কোনো করুণার ভাব আমার মনে সেদিন উদয় হয় নি। একিক্রাটিস। সত্যি করে বলতে কি সক্রেটিস তাঁর মৃত্যুতে এত নির্ভয়, এত মহৎ এবং এত উদার ছিলেন যে আমার মনে হচ্ছিল কোনো অলৌকিক শক্তির আশীর্বাদে তিনি ধন্য হয়েছেন। আমার মনে হচ্ছিল যেন একমাত্র বিধাতার আহ্বানেই আজ তিনি পরপারের উদ্দেশে যাত্রা করছেন, আর আনন্দধাম বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তা হলে এই যাত্রা শেষে তিনি সেই আনন্দধামে গিয়ে অবশ্যই উপস্থিত হবেন। তাই সক্রেটিস আজ আনন্দিত। প্রিয়ের মৃত্যুর দর্শনে প্রিয়ের মনে করুণার উদয় হয়; কিন্তু সেদিন আমার মনে সক্রেটিসের জন্য কোনো করুণার উদয় হয় নি। এ যেমন সত্য, তেমনি অপরদিকে সেই মুহূর্তটিতে দার্শনিক আলোচনায় স্বাভাবিক আনন্দও আমি উপভোগ করতে পারছিলাম না। অথচ তার অন্তিম মুহূর্তটিতেও সক্রেটিস দার্শনিক আলোচনাতেই রত ছিলেন। তাঁর দার্শনিক আলাপনে আনন্দবোধ না করে পারি নি একথা সত্য–তবু একথাও সত্য যে, সে আনন্দের সঙ্গে জড়িয়েছিল একটি বেদনাবোধও সমগ্র আলোচনার মধ্যেও আমার কেবল মনে হচ্ছিল : আর একটু পরেই তো সক্রেটিসের মৃত্যু হবে–অথচ এখনও তিনি আলাপরত। আমরা যারা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের সবার মনেই এই দুটো অনুভূতিই উঠানামা করছিল : কোনো সময় আমরা হাসিতে ফেটে পড়ছিলাম–আবার পরক্ষণে আমাদের চোখ থেকে অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ছিল। এ্যাপোলোডোরাস তো একটুতেই অভিভূত হয়ে পড়ে। তার অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে করুণ। এ্যাপোলোডোরাসের স্বভাব তো তুমি জানো।

একি : হ্যাঁ, এ্যাপোলোডোরাস তো ঐরূপই।

ফিডো : সে যেন সব সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছিল। আমি এবং অন্য সবাইও অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

একি : কে কে উপস্থিত ছিলেন?

ফিডো : খাস এথেন্সবাসীদের মধ্যে এ্যাপোলেডোরাস ছাড়া ক্রিটোবুলাস এবং তার পিতা ক্রিটো, হারমোজোনিস, এপিজেনিস, এসকাইনিস এবং এ্যানটিসথ্যানিস উপস্থিত ছিলেন; আর ছিলেন পিনিয়ার সিসিপাস, মেনেব্বোনাস এবং আরো কয়েকজন। আমার যতদূর স্মরণ আছে প্লেটো উপস্থিত থাকতে পারেন নি, কেননা তিনি অসুস্থ ছিলেন।

একি : এ ছাড়া বিদেশী কেউ কি উপস্থিত ছিলেন?

ফিডো : হ্যাঁ, বিদেশীও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন থিবের সিমিয়াস এবং সিবিস এবং ফিডনডিস আর মেগরাবাসী ইউক্লিড এবং টারপসিয়ন।

একি : এ্যারিস্পিটাস এবং ক্লিওমব্রোটাসও কি উপস্থিত ছিলেন?

ফিডো : না, শুনেছি তারা নাকি তখন ইজিনাতে ছিলেন।

একি : আর কেউ কি ছিলেন?

ফিডো : না, আমার মনে হয় যাদের কথা বলেছি কেবল এঁরাই উপস্থিত ছিলেন।

একি : বেশ! এবার শুনি সেদিন সক্রেটিস কী আলোচনা করেছিলেন?

ফিডো : তা হলে প্রথম থেকেই বলছি। সমগ্র আলোচনাটিরই আমি পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করব। কয়েকদিন আগে থেকেই আমরা প্রত্যূষেই সক্রেটিসের কারাকক্ষের অনতিদূরের বিচারালয়ের প্রাঙ্গণটিতে জমা হচ্ছিলাম। কারাকক্ষের দরোজা সাধারণত খুব ভোরে উন্মুক্ত করা হতো না। আমরা তাই কারাগারের দ্বার না খোলা পর্যন্ত বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করতাম। কারাকক্ষ উন্মুক্ত হলে আমরা সবাই ভিতরে প্রবেশ করে সমগ্র দিনটিই সক্রেটিসের সাহচর্যে যাপন করতাম। কিন্তু শেষ দিনটিতে আরো আগে আমরা আদালত প্রাঙ্গণে সমবেত হলাম, কেননা, পূর্ব দিন যখন আমরা সক্রেটিসের কারাকক্ষ ত্যাগ করে আসছিলাম তখনি শুনতে পেয়েছিলাম যে, ডেলস থেকে পবিত্র জাহাজটি প্রত্যাবর্তন করেছে। এজন্য সেদিন খুবই প্রত্যূষে নির্দিষ্ট প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার স্থির করেছিলাম। আমরা কারাকক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হলে কারাপাল আমাদের সবাইকে বলল যেন আহ্বান না করা পর্যন্ত আমরা কারাকক্ষের বাইরেই অপেক্ষা করি। কারণ ব্যাখ্যা করে কারাপাল বলল, ‘দ্বাদশ অধিকর্তা এখন সক্রেটিসের সঙ্গে রয়েছেন। তারা তার পদদ্বয়কে শৃঙ্খলমুক্ত করে আদেশ দান করবেন যে সক্রেটিসকে ‘আজই মৃত্যুবরণ করতে হবে।’ এই বলে কারাপাল চলে গেল। কিন্তু কিছু পরে সে আবার ফিরে এল এবং এবার আমাদের ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম ইতোমধ্যে সক্রেটিসের পা হতে শিকল খুলে নেওয়া হয়েছে। জানথিপ* [সক্রেটিসের পত্নী] একটি শিশু ক্রোড়ে করে সক্রেটিসের পার্শ্বে উপবিষ্ট রয়েছেন। আমাদের প্রবেশ করতে দেখেই জানথিপ নারীসুলভ আর্তধ্বনিতে ভেঙে পড়ে বলতে লাগলেন : ‘ওগো। এই তো শেষ। আর কোনোদিন তো তোমার প্রিয় সাথীরা তোমার সঙ্গে কিংবা তুমি তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে পারবে না।’ সক্রেটিস ক্রিটোর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন; ‘ক্রিটো তোমারা কেউ এঁকে গৃহে নিয়ে যাও।’ একথা শুনে ক্রিটোরই কিছু সঙ্গী ক্রন্দনরত জানথিপকে সরিয়ে নিয়ে গেল। জানথিপ চলে গেলে সক্রেটিস কৌচের উপর বসে নত হয়ে সদ্যশৃঙ্খলমুক্ত পদদ্বয়কে মার্জনা করতে করতে বলতে লাগলেন : যাকে আমরা আনন্দ বা সুখ বলি সে দেখ এক আশ্চর্য বস্তু। বেদনাকে আমরা আনন্দের পরিপন্থী বা বিরোধী বলে থাকি। অথচ দেখ অত্যভুতভাবে সেই আনন্দই বেদনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। এরা দুজনে একই মুহূর্তে আমাদের জীবনে আসে না বটে–তবু একজনকে ধরতে গেলে পরিণামে অপরজন এসে ধরা দেবেই। দেহে তারা অবশ্যই দুজন, কিন্তু মনে হয় যেন তাদের দুটি দেহ একটি মাত্র মাথার সঙ্গেই আবদ্ধ। একথা আমি তোমাদের নিশ্চয় করে বলতে পারি, উপকথার শিরোমণি ইসপ এ মজার ব্যাপারটি আদপেই খেয়াল করেন নি। যতি তার খেয়াল হতো তা হলে তিনি অবশ্যই বিধাতা সম্পর্কে আর একটি উপাখ্যান তৈরি করে বলতেন যে আনন্দ-বেদনার বিবাদকে বিধাতা মিটমাট করে দেবার চেষ্টা কম করেন নি। কিন্তু সাপে-নেউলে যাদের সম্পর্ক তাদের মধ্যে সমঝোতা আনা বিধাতারও সাধ্যে কুলোয় নি। আর তা না পেরে তিনি অবশেষে জোর করে দুই-এর মাথা এক করে বেঁধে দিয়েছেন। আর তারই ফল এখন আমরা একটিকে ডাকি তো অপরটিও পেছনে পেছনে এসে হাজির হন। এমন অনুমান যে মিথ্যা নয় তা আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই মুহূর্তেই বুঝতে পারছি। এই দেখ না, পায়ে আমার এতদিন শিকল ছিল–তাতে বেদনা অবশ্যই ছিল–কিন্তু আজ যেই শিকলমুক্ত হয়েছি অমনি বেদনার পেছনে আনন্দ এসে হাজির হয়েছে। সক্রেটিসের একথা শুনে সিবিস বলে উঠলেন, সক্রেটিস তুমি ইসপের কথা উল্লেখ করায় আমার একটি প্রশ্নের কথা মনে পড়েছে। প্রশ্নটি আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে। গত পরশু কবি ইভানাসও আমাকে প্রশ্নটি করেছেন এবং সাক্ষাৎ হলে পুনরায় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন। আমি সে প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারি নি। আজ তোমার নিকট থেকে সে প্রশ্নটির কী জবাব হবে শুনে রাখতে চাই। ইভানাস প্রশ্ন করেছেন, যদি তুমি জীবনে কখনো একটি ছত্রও কবিতা লিখ নি তবু আজ কারাগারে বসে কেন তুমি ইসপের উপকথাকে কবিতায় পরিণত করে যাচ্ছে আর কেনই বা এ্যাপোলোর সম্মানে স্তোত্রগাথা তৈরি করে চলেছো?

সক্রেটিস বললেন, সিবিস, তুমি তাকে সত্য কথাই বল। তাঁকে বল, তার ভীত হওয়ার কিছু নেই, আমি তার সঙ্গে কাব্য-প্রতিযোগিতায় নামি নি। কারণ আমি জানি কাব্য-প্রতিযোগিতায় তাকে হারিয়ে দেওয়া সহজ কাজ নয়। আসলে আমি চেষ্টা করে দেখছিলাম, একটি বিষয় সম্পর্কে আমার মনের সন্দেহ দূর করে দিতে পারি কি না। জীবনে বহুবারই আমার উপর স্বপ্নদেশ হয়েছে যেন আমি সংগীত রচনা করি’! বিভিন্ন সময়ে এই স্বপ্নের রূপ যদি বা বদল হয়েছে, কিন্তু তার বক্তব্য সব সময়ে প্রায় একই রয়েছে। সব সময়েই স্বপ্নের মধ্যে আমি আদেশ পেয়েছি : ‘সক্রেটিস তুমি সংগীতচর্চা কর; তুমি সংগীতকে সৃষ্টি কর।’ এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল যে, এ আদেশের অর্থ হচ্ছে, যেন আমি অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে আমার জীবনের ব্রত অর্থাৎ দর্শনচর্চাকে অনুসরণ করি। কেননা দর্শনকেই আমি মহত্তম এবং সুন্দরতম সংগীত বলে জেনে এসেছি। কাজেই আমার স্বপ্নের তাৎপর্যকে কেবল এই মনে করেছি যে, স্বপ্ন আমার নির্বাচিত কর্তব্যকে অধিকতর সুষ্ঠুতার সঙ্গে সম্পন্ন করার তাগিদ জানাচ্ছে, যেমন করে আমরা দর্শকগণ প্রতিযোগী ধাবমান অশ্বকে অধিকতর বেগে দৌড়বার জন্য উত্তেজিত করতে থাকি। অর্থাৎ নতুন কিছু করার তাৎপর্য এ স্বপ্নাদেশের মধ্যে ছিল না। তথাপি বিষয়টির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না। আমার এমনও মনে হলো যে, স্বপ্নদিষ্ট সংগীতের অর্থ তো সংগীতের দার্শনিক অর্থের পরিবর্তে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত অর্থও হতে পারে। এবার আমি যখন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলাম আর ডেলসের উৎসব অনুষ্ঠান আমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রেখে কারাকক্ষে আমাকে অবসরও খানিকটা দিয়ে দিল তখন ভাবলাম মনের সন্দেহ দূর করার জন্য আমি বরঞ্চ মৃত্যুর পূর্বে স্বপ্নের আদেশ মতো কিছু কবিতাই তৈরি করে যাই। এরূপ মনস্থ করে প্রথমে আমি উৎসবের দেবতার সম্মানের কিছু স্তব রচনা করলাম। পরে ভাবলাম, সত্যকার যে কবি তাকে তো শুধু মিল করে শব্দের গাঁথুনি গাঁথলে চলে না–উপাখ্যানের উদ্ভাবনও তার কর্তব্য। কিন্তু তোমরা জানো, আমার কোনো উদ্ভাবনী শক্তি নেই। আমার হাতের কাছে ছিল ইসপের উপাখ্যান। এগুলোই আমি জানতাম। আর তাই এদেরই কয়েকটিকে আমি কবিতায় পরিবর্তিত করেছি। সিবিস, তুমি কবি ইভানাসকে আমার কাহিনী বলে অভয় দিও। তিনি অবশ্যই জ্ঞানী। তা হলে আমি তাকে বলব আমার যাত্রা যখন শুরু হয়েছে, তিনিও যেন আর ইতস্তত না করে আমার অনুগমন করেন। তাকে বল, আমি হয়তো আজই পাড়ি জমাবো–এথেন্সবাসীগণ তো সে কথাই বলে বেড়াচ্ছে।

সিমিয়াস বলল; সক্রেটিস, ইভানাসের জন্য এ নিশ্চয়ই তোমার অকরুণ উপদেশ। আমি প্রায়শ তার সঙ্গ লাভ করি। তার সাহচর্যে আমার যেরূপ ধারণা হয়েছে তাতে বাধ্য না হলে সে যে তোমার পথ অনুসরণ করবে এমন তো মনে হয় না।

সক্রেটিস বললেন : কেন? ইভানাস কি একজন দার্শনিক নন? হা। অবশ্যই বলা চলে, তিনি একজন দার্শনিক।

তা হলে তিনি কিংবা অপর যে-কোনো ব্যক্তি, যার মধ্যে দার্শনিক প্রজ্ঞা রয়েছে, অবশ্যই স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করতে চাইবেন। কিন্তু তাই বলে আমি একথা বলছিনে যে তিনি আত্মহত্যা করবেন। না, তিনি নিজে নিজের জীবনকে বিনাশ করতে পারেন না। সে কাজ অবশ্যই আইন-বিরুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

এই সময়ে সক্রেটিস তাঁর উপবেশনের ভঙ্গি পরিবর্তন করলেন। পা দুখানি কৌচ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। কিন্তু এর পরে সমগ্র আলোচনার মধ্যেই তিনি এই অবস্থাতেই উপবিষ্ট রইলেন। সক্রেটিসের বক্তব্যের জের টেনে সিবিস এবার জিজ্ঞাসা করলেন : সক্রেটিস, তোমার এ বক্তব্যের তাৎপর্য কী? কেন দার্শনিক তার নিজের জীবন বিনাশ করার অধিকার পাবে না, কিন্তু তবু দর্শনিক তার নিজের জীবন বিনাশ করার অধিকার পাবে না, কিন্তু তবু দার্শনিক হিসাবে সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর অনুসরণ করতে চাইবে?।

সক্রেটিস বললেন; কেন, তোমরা ফিলোলাসের ভাবশিষ্য হয়েও কি তাকে এরূপ মত ব্যক্ত করতে শোন নি?

হ্যাঁ, তা শুনেছি বটে। কিন্তু তার প্রকাশের ভাষা ছিল আমাদের বোধের অগম্য। আমার কথাও কিছু নূতন নয়। আমার কথা তার কথারই প্রতিধ্বনি মাত্র। তবু যা শুনেছি তা আমার বলা আবশ্যক। আর তা ছাড়া আমি তো আর এক জগতের যাত্রী–হয়তো সূর্যের অস্তগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমারও সে যাত্রা শুরু হবে। কাজেই সূর্য ডোবার আগের এটি বিরামটুকুর সদ্ব্যবহার এই আলোচনা ব্যতীত অপর কিসের দ্বারা আমি করতে পারি?

বেশ! সক্রেটিস, তুমি তা হলে আমাদের বুঝিয়ে বল আত্মহত্যাকে কী কারণে বিধান বিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়? তুমি ফিলোলাসের কথা বলছ। আমিও তার মুখে, বিশেষ করে তিনি যখন আমাদের সঙ্গে থিবিসে অবস্থান করতেন তখন, এরূপ কথা শুনেছি। অপরাপর ব্যক্তির মুখেও এ সম্পর্কে একই মত ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু আমি আদপে এ বক্তব্যের কোনো তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি নি।

সেজন্য ঘাবড়াবার কিছু নেই প্রিয় সিবিস। তোমার জীবনে আবার এমন দিন আসতে পারে যেদিন তুমি এর সব কথাই বুঝতে পারবে। আমি বুঝতে পারছি একটা জিজ্ঞাসা তোমার মনকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে; তুমি ভাবছ আমরা যখন প্রত্যেকটি বস্তুরই ব্যতিক্রমের কথা চিন্তা করি–অর্থাৎ যা আজ অমঙ্গলজনক সে আগামীকাল মঙ্গলজনক হতে পারে বলে যখন আমরা মনে করি, তখন মৃত্যুর ক্ষেত্রে এরূপ ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা কেন থাকল। এক কথায় : তুমি ভাবছ ব্যক্তির জীবনে মৃত্যুই যখন শ্রেয় হয়ে দাঁড়ায় তখন নিজের হাতে জীবনকে বিনাশ করে দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করার অধিকার কেন তার থাকবে না, কেন তাকে নিজের জীবনের মৃত্যুর জন্য অপরের আদেশের অপেক্ষা করতে

সক্রেটিসের কথা শুনে স্মিতমুখে সিবিস তার দেশীয় ভাষায় বললেন : সক্রেটিস, তোমার এ বক্তব্য খুবই যথার্থ।

সক্রেটিস বলতে লাগলেন, আমি যা বলছি তার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে একটি অসামঞ্জস্যের দিক রয়েছে তা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাব যে, এর মধ্যে সত্যকারভাবে কোনো অসামঞ্জস্য নেই। একটা গূঢ় রহস্যজনক তত্ত্বের কথা প্রায়শ আমরা শুনি। শঙ্কার মধ্য দিয়েই যেন মানুষ ফিসফিস করে বলে : মানুষ তো শিকলপরা বন্দি। তার কি ক্ষমতা আছে রুদ্ধ দ্বার উন্মোচন করে মুক্তির পথে দৌড়ে যায়? এ তত্ত্বটির মধ্যে অবশ্যই রহস্য রয়েছে। আমি এ রহস্যকে বুঝতে পারিনে। তবু আমি বিশ্বাস করি, দেবতাগণ আমাদের মঙ্গলামঙ্গলের নিয়ামক আমরা সম্পূর্ণই তাঁদের করতলগত–তাঁদের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাস। এ বিষয়ে তুমি কী বল সিবিস?

একথা আমারও যথার্থই বলে মনে হয়।

আচ্ছা মনে কর তুমি নিজে যে অশ্ব কিংবা গর্দভটির মালিক সে তোমার দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করার সাব্যস্ত করল এবং তোমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে মৃত্যুর মারফত তোমার মালিকানার শিকল ছিঁড়ে ফেলল। এ ব্যাপারটিতে কি তোমার মনে কোনো ক্ষোভের সঞ্চার হবে না এবং তোমার পক্ষে সম্ভব হলে তার এ অবাঞ্ছিত কাজের জন্য তুমি কি তাকে শাস্তি দিতে চাইবে না?

সিবিস বললেন, অবশ্যই ব্যাপারটিকেও এভাবে দেখা যাক। এভাবে দেখলে আমার তত্ত্বটির মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলেই বুঝতে পারবে। উপরের দৃষ্টান্তের ন্যায় মানুষেরও উচিত নিজের জীবন নিজে বিনাশ না করে বিধাতার আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করা। তিনি যখন ডাকবেন যেন তখনি আমরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি। আমার নিজের ব্যাপারে তাই ঘটেছে। বিধাতা আমাকে ডাক দিয়েছেন বলেই আমি যাত্রা করছি।

সক্রেটিসের এ যুক্তির জবাবে সিবিস বলে উঠলেন : সক্রেটিস তোমার এ যুক্তির যথার্থতা আমি স্বীকার করি। কিন্তু তা হলে দার্শনিক সম্পর্কে তোমার অপর উক্তিটি কী করে যথার্থ হতে পারে? তুমি বলেছ, যে জ্ঞানী, যে দার্শনিক সে অবশ্যই মৃত্যুকে স্বাগত জানাতে চাইবে। তার অর্থ হবে, আমরা যেখানে বিধির নির্দেশে নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনে নিযুক্ত রয়েছি সেখানে জ্ঞানী এবং দার্শনিক হয়েও কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব পরিত্যাগ করে মৃত্যুকে কামনা করে রেহাই পাওয়ারই সে চেষ্টা করছে। অথচ, যিনি জ্ঞানী তিনি তো একথা মনে করতে পারেন না যে, দেবতাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে তিনি নিজেই নিজেকে অধিকতর উত্তমভাবে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালন করতে সক্ষম। যে মূর্খ কেবল সে-ই এরূপ চিন্তা করতে পারে। মূর্খ ভাবতে পারে যে, বিধি-নির্দিষ্ট দায়িত্বভার পরিত্যাগ করে স্রষ্টার দাসত্ব হতে মুক্তি লাভই শ্রেয়। সে এরূপ ভাবতে পারে, কেননা সে মুখ; কারণ সে জানে না যে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করা এবং কর্তব্যের স্থানে অবিচলিতভাবে অবস্থান করাই উত্তম, পলায়ন করা নয়। কেননা যিনি জ্ঞানী তিনি মহৎ এবং উত্তমের সঙ্গে কিংবা অধীনতা থেকে কোনোকালেই মুক্তি লাভ বাঞ্ছনীয় মনে করেন না। কিন্তু সক্রেটিসকে আমাদের এ ব্যাখ্যাটি তোমার উক্তির বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। তুমি বলেছ, জ্ঞানী মৃত্যুকে স্বাগত জানাবে। আমরা দেখছি, যে মূর্খ সে-ই কেবল স্বাগত জানাতে পারে, জ্ঞানীর পক্ষে কর্তব্য হচ্ছে মৃত্যুকে অবাঞ্ছিত মনে করা এবং মৃত্যুতে দুঃখ বোধ করা। সিবিসের একাগ্রতায় সক্রেটিস উফুল হয়ে উঠলেন। আমাদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন : আমাদের এই বন্ধু অবশ্যই একজন প্রকৃত সত্যসন্ধানী। ইনি শ্রবণমাত্র কোনো যুক্তিকে গ্রহণ করার মানুষ নন।

এবার সিমিয়াসও বলে উঠলেন : অবশ্যই। বস্তুত সিবিস তোমার উক্তির বিরুদ্ধে যে আপত্তি উত্থাপন করেছেন তার মধ্যে যুক্তির বেশ জোর রয়েছে বলে আমি মনে করি। কেননা, সত্যকারভাবে যিনি জ্ঞানী তিনি কী করে তার চেয়ে উত্তম যে প্রভু তাঁকে পরিত্যাগ করে কর্মক্ষেত্র থেকে পলায়ন করার কথা চিন্তা করতে পারেন? সিবিসের কথা অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমার মনে হয়, সিবিস তোমার প্রসঙ্গেই তার এটি যুক্তিটি উপস্থিত করছেন। সিবিস মনে করেন, তুমিও অন্যায়ভাবে আজ আমাদের পরিত্যাগ করে যাওয়াকে স্বাগত জানাচ্ছ। শুধু আমাদের সঙ্গ নয়, যে দেবতাদের তুমি মানুষের উত্তম প্রভু বলে স্বীকার কর তুমি তাদের পরিত্যাগ করে যাওয়াকেও বাঞ্ছনীয় মনে করছ?

প্রিয় সিমিয়াস, তোমার কথার জোরও কম নয়। এ যে দেখছি আমাকে আর এক বিচারালয়ে সোপর্দ করে জবাবদিহি করার চেষ্টা। তোমাদের জেরার কি সত্যিই আমাকে জবাব দিতে হবে।

সক্রেটিস! আমাদের সবারই সেই দাবি।

এ তো বড় বিপদের কথা। এবার তা হলে তো আমাকে আর একটা জোরদার কৈফিয়ত হাজির করতে হবে। আমার এ জবাবদিহিকে অবশ্যই আমার বিচারকের সম্মুখে পেশ করা বক্তব্যের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী হতে হবে। প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস! তোমাদের যুক্তিকে আমি অবশ্যই স্বীকার করতাম, যদি না আমি আর দুটি বিষয় সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হতাম। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, আমি আমার বর্তমান প্রভুদের তত্ত্বাবধান হতে যদি বা মুক্তি পেয়ে যাচ্ছি, তবু যাচ্ছি এমন প্রভুদের তত্ত্বাবধানে যাঁরা অবশ্যই জ্ঞানী এবং আমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। আর একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও আমি বিশ্বাস করি যে, মৃত্যুলোকে আমি যে তিরোভুতদের সমীপে গিয়ে উপস্থিত হব তারা আমার পরিত্যক্ত জীবিতদের চেয়ে অবশ্যই উত্তম হবেন। কেননা, প্রাচীন প্রবাদে আছে যে, মৃতের জন্য মৃত্যুর পরপারে উত্তম ভবিষ্যই অপেক্ষা করে রয়েছে। মৃতের জন্য জীবনেই সব শেষ নয়–তার এখনও আশা করার রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। এবং মৃত্যুর সে জগতে উত্তম অধমের চাইতে নিশ্চয়ই অনেক বেশি মঙ্গল প্রাপ্ত হতে পারবে। এ কারণেই আজ মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোমাদের বক্তব্যানুযায়ী কোনো দুঃখ বা বেদনা আমি বোধ করছিনে।

সিমিয়াস জবাব দিলেন : কিন্তু সক্রেটিস, তাই বলে তুমি কি তোমার চিন্তা সম্পদকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও? সে সম্পদলাভে তো আমাদের অধিকার রয়েছে। তুমি কি সে সম্পদ থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে পারো? তুমি তোমার চিন্তাকে আমাদের নিকট অধিকতর প্রকাশ কর, তোমার সে প্রকাশ দ্বারা যদি আমাদের বিশ্বাসী করে তুলতে পার, তা হলে তো তোমার বিরুদ্ধে আমাদের অধিকারও খণ্ডিত হয়ে যাবে।

একথা আমি স্বীকার করি সিমিয়াস। আমার শক্তিমতো আমি আমার কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করব। কিন্তু তার পূর্বে এস আমরা ক্রিটোর বক্তব্যটি শ্রবণ করি। মনে হচ্ছে, ক্রিটো বহুক্ষণ যাবৎ কিছু বলার ইচ্ছা পোষণ করে আসছেন।

ক্রিটো বললেন : আমি শুধু কারাভৃত্যের একটি অনুরোধ তোমাকে জানাতে চাচ্ছিলাম। যে ভৃত্যের উপর দায়িত্ব পড়েছে তোমাকে বিষ প্রদান করার সে বলছে, তুমি যেন অধিক পরিমাণে বাক্যালাপ না কর। কেননা তার অভিমত এই যে, বাক্যালাপ দেহে উষ্ণতার পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে দেহে প্রযুক্ত বিষের ক্রিয়া প্রকাশ পেতে বিলম্ব ঘটে। কারা-কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা এরূপ যে, যারা বিষ প্রয়োগের পূর্বে উত্তেজিত হয় তাদের মৃত্যুর জন্য দুবার এমনকি তিনবারও বিষ প্রয়োগের আবশ্যক হয়।

ক্রিটোর একথা শুনে সক্রেটিস জবাব দিলেন : আমাকে নিয়ে কারাভত্যের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তাকে বল তার আপন কর্তব্য নিয়েই সে ব্যস্ত থাকুক। আর আমার উপরে দুবার এমনকি তিনবারও যদি বিষপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় তা হলে সেরূপ করার জন্যই যেন সে প্রস্তুত থাকে। এ প্রসঙ্গ সম্পর্কে অধিক বলা আমি অনাবশ্যক বোধ করি।

ক্রিটো বললেন : এ ব্যাপারে তুমি কী বলবে তা আমি ভালো করেই জানতাম। তবু কারাভত্যের সন্তোষ সাধনের জন্য আমাকে এ প্রসঙ্গটি তুলতে হল।

সক্রেটিস বললেন : ঠিক আছে, ওকে নিয়ে আর চিন্তা কর না। … এবার আমি আবার আমার মাননীয় বিচারপতিগণকে লক্ষ্য করে বলছি : মাননীয় বিচারকগণ! আমি অবশ্যই আপনাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করব, কেন যে-সত্যকার দার্শনিক মৃত্যুর সম্ভাবনা তাকে আনন্দে পূর্ণ করে তোলে, এবং কী কারণে তিনি মৃত্যুর পরে সর্বোত্তম মঙ্গলপ্রাপ্তির আশা আপন হৃদয়ে পোষণ করতে পারেন। কী করে এটি হয় সে বিষয়টিই সিমিয়াস এবং সিবিস, তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলছি। কারণ সাধারণ মানুষ প্রায়শ দর্শন-অনুরক্তকে ভ্রান্তভাবে গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ একথাটি উপলব্ধি করতে পারে না যে, দার্শনিক সর্বদা মৃত্যুকেই অনুসরণ করছেন, সর্বদাই তিনি মৃত্যুকে কামনা করছেন। কাজেই জীবনব্যাপী দার্শনিক যে-মৃত্যুকে অনুসরণ করে আসছেন এবং কামনা করে আসছেন, বাস্তবে যখন সে-মৃত্যু তার জীবনে এসে উপস্থিত হলো তখন কেন তিনি তাকে বঞ্চিত করে তার দিক থেকে আপনার বাসনার মনকে ফিরিয়ে নেবেন?

সিমিয়াস হাসতে হাসতে বললেন : কী অদ্ভুত মানুষ তুমি সক্রেটিস! আজ আমাদের হাসির দিন নয়; হাসির মেজাজ আমাদের নেই তবু তোমার কথায় না হেসে পারলাম না। কেননা, আমি ভাবছি সাধারণ মানুষ তোমার এই ব্যাখ্যা শুনলে কী ভাববে? তারা বলবে, দার্শনিক সম্পর্কে তোমার বর্ণনা একেবারেই খাঁটি। তারা সত্যই মায়া আর মৃত্যুর পেছনে ছুটে বেড়ান এবং আজ যদি এরূপ দার্শনিককে খুঁজে বের করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে সে দও তার জন্য যথোচিতই হয়েছে।

তারা ঠিকই বলবে, সিমিয়াস। কেবল একটা ব্যাপারে তারা ভ্রান্ত। এরূপ দার্শনিককে তারা খুঁজে পেয়েছে একথা ঠিক নয়। কেননা, তারা জানে না, সত্যকার দার্শনিক যে-মৃত্যুর কামনা করেন, যে-মৃত্যুকে তিনি অনুসরণ করেন, আর যে-মৃত্যু তাঁর উপযুক্ত সে-মৃত্যু কী? কিন্তু সাধারণ লোকের কথা অনেক হয়েছে–আর নয়। এস বিষয়টি নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। বল, সত্যই কি আমরা বিশ্বাস করি যে, মৃত্যু বলে কিছু আছে?

সিমিয়াস বললেন : অবশ্যই মৃত্যু আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

বেশ! কিন্তু মৃত্যু মানে কি দেহ থেকে আত্মার এবং আত্মা থেকে দেহের বিচ্ছেদ নয়? এই বিচ্ছেদের কার্যটি মৃত্যুই তো সম্পন্ন করে দেয়। নয় কি? এজন্য আত্মা যখন দেহে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে এবং দেহ যখন আত্মবিমুখ অবস্থায় পড়ে থাকে আমরা তখন তাকেই মৃত্যু বলে মনে করি। একথা কি ঠিক নয়?

একথা অবশ্যই ঠিক।

আর একটি প্রশ্ন রয়েছে। আমরা এ দুটি সম্পর্কে একমত হলে এর জবাবটি আমাদের আলোচ্য সমস্যা সমাধানেও সাহায্য করবে। প্রশ্নটি হচ্ছে, আহার-বিহার অর্থাৎ জীবনের সুখ ভোগ বলতে আমরা যা বুঝি, দার্শনিক কি সেসব নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে পারেন? অর্থাৎ সেরূপ করা কি তার পক্ষে সংগত?

না, তা নিশ্চয়ই সংগত নয়।

ভালো কথা। কিন্তু প্রেম? প্রেমের আনন্দ কি তিনি ভোগ করতে পারবেন?

কোনোক্রমেই নয়।

শুধু প্রেম নয়। জীবনে নানাপ্রকার ভোগ এবং আনন্দ ও সম্পদের উপায় রয়েছে যেমন দেহের ভোগ, দেহকে মূল্যবান পোশাক এবং পাদুকা কিংবা অপরাপর আভরণ দ্বারা সজ্জিত করার আনন্দ। দার্শনিকের পক্ষে কি দৈহিক এই আনন্দসমূহের চিন্তা করা কিংবা এ সমস্ত আনন্দ ও সম্পদ লাভ করায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা সংগত; না, তাঁর কর্তব্য হচ্ছে জীবনধারণে ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত সমস্ত ভোগ এবং আনন্দকে ঘৃণা করা? এ সম্পর্কে, সিমিয়াস, তুমি কী বল?

আমি বলব এসব আনন্দ ও ভোগকে ঘৃণা করাই দার্শনিকের কর্তব্য।

তা হলে তোমার বক্তব্য হলো যে, দার্শনিক কেবল আত্মার উন্নতির চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকবেন, দেহের ভোগে নয়। তার পক্ষে স্বাভাবিক হবে দেহ থেকে নিজের ব্যবধান বৃদ্ধি করে আত্মার নৈকট্য লাভের আগ্রহ প্রকাশ করা। নয় কি?

হ্যাঁ, আমার বক্তব্য তাই।

এবং সাধারণ মানুষের চেয়ে দার্শনিকের প্রত্যেক কাজের মধ্যেই আমরা দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্নকরণের চিহ্নই দেখতে পাব? হ্যাঁ, আমরা তার কার্যালাপে সে চিহ্নই দেখতে পাব! অথচ, সিমিয়াস, জগৎ কিন্তু এরূপ দার্শনিককে মৃত জড় বলেই মনে করবে। কেননা, তাদের মতে, যারা আনন্দ কী তা জানল না এবং দৈহিক কোনো সুখ কোনোদিন ভোগ করল না, সুখের সমগ্র সামগ্রীর প্রতি যারা নিরাসক্ত তারা মৃত বই অপর কিছু নয়।

হ্যাঁ, জগৎ এরূপই মনে করে।

বেশ! কিন্তু জ্ঞান আহরণের বিষয়টিকে বিচার করে দেখ। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে দেহের ভূমিকা সম্পর্কে তুমি কি বলবে? চোখ, কান–এরা তো দেহ। এরা কি আমাদের জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে, না এরা জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ কাজ করে? কবিরা বলেন, চোখ-কানের সাক্ষ্য সঠিক না হলেও তারা মান্য–অর্থাৎ তাদের পর্যবেক্ষণের মূল্য আছে। কিন্তু চোখ ও কানের সাক্ষ্যকে যদি ভ্রান্ত বল–তবে দেহের অপরাপর অনুভূতি বাহক ইন্দ্রিয়াদি সম্পর্কে কী বলবে? আমাদের চোখ এবং কানই কি আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ এবং বিশ্বাসভাজন নয়?

অবশ্যই তারা ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম।

তা হলে আত্মার সত্যোপলব্ধি বা সত্যলাভ কী করে ঘটে? দেহের মারফত সত্যলাভের চেষ্টায় সে তো সর্বদাই ভ্রান্ত হয়। নয় কি?

তোমার একথা সত্য, সক্রেটিস।

তা হলে দেহের মারফত আত্মা সত্য লাভ করতে পারে না–তাকে মননের মারফতই সত্য লাভ করতে হয়। কি বল?

হ্যাঁ, তাই।

আবার আত্মার পক্ষে এ মননকার্যও সর্বোত্তমভাবে তখনই সম্ভব যখন সে আনন্দ, বেদনা, শব্দ, দৃশ্য–সবকিছু বিমুক্ত হয়ে কেবল আত্মা চিন্তাতেই রত রয়েছে–অর্থাৎ যখন সে দেহের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ছেদন করে ফেলেছে, দেহের কামনা-বাসনা বলতে আর কিছুই তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই, এখন সে কেবল পরম সত্যের সাধনায় রত। আত্মার মনন বলতে কি আমরা এই বুঝি নি?

হ্যাঁ, তোমার কথা অবশ্যই যথার্থ, সক্রেটিস।

কিন্তু তা হলে আমাদের বলতে হয় যে, এভাবেই দার্শনিক দেহকে উপেক্ষা করেন; তার আত্মা দেহকে পরিত্যাগ করেছে; আত্মসমাহিত হওয়ার বাসনাই এখন তাঁর আত্মার একমাত্র বাসনা।

হ্যাঁ, একথাও সত্য।

কিন্তু সিমিয়াস, আর একটি বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। অনন্যনির্ভর বা পরম ন্যায় বলে কিছুর অস্তিত্ব আছে।

কিন্তু অবিমিশ্র সুন্দর বা পরম মঙ্গল সম্পর্কেও কি তুমি তাই বলবে?

অবশ্যই আমি তাই বলব।

বেশ। কিন্তু তুমি এদের কাউকে কি কখনো নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছ?

না, তা করি নি।

শুধু চোখ নয়। তোমার অপর কোনো ইন্দ্রিয়ের মারফতও কি তুমি তাদের সাক্ষাৎ লাভ করতে পেরেছ? আমি কেবল পরম ন্যায়, পরম সুন্দর কিংবা পরম মঙ্গল সম্পর্কেই একথা বলছিনে। আমি পরম শক্তি, পরম স্বাস্থ্য, পরম শৌর্য–অর্থাৎ প্রত্যেকটি বস্তুর সত্তা সম্পর্কেই একথা বলছি। এদের অন্তর্নিহিত সত্য বা সত্তার জ্ঞান কি তুমি তোমার কোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে লাভ করতে পেরেছ? বরঞ্চ একথাই কি যথার্থ নয় যে, একমাত্র সে-ব্যক্তিই এদের আপন আপন সত্তার জ্ঞান সর্বাধিক পরিমাণে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে যে তার অন্তর্দৃষ্টিকে তার পর্যবেক্ষণের বস্তুটির উপর একান্ত করে নিবদ্ধ করেছে?

হ্যাঁ, তোমার একথা অবশ্যই যথার্থ।

তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একমাত্র সে-ই সমগ্র প্রকার সত্তার বিশুদ্ধতম সত্য লাভ করতে পারে যে সত্যের সন্ধানে কেবল তার মননকেই ব্যবহার করে, সে তার এ মননকার্যে দৃশ্য, শব্দ বা ইন্দ্রিয়গত কোনো উপসর্গকেই প্রভাব বিস্তার করতে দেয় না। প্রকৃতপক্ষে এ সত্যানুসন্ধানী প্রত্যেকটি সত্তার সত্যের গভীরে কেবল অন্তদৃষ্টির আলোতেই প্রবেশ লাভ করে। কেননা তার এ কার্যে সে তার চোখের দৃষ্টি এবং কর্ণের শ্রবণকে পরিত্যাগ করেছে। বলা চলে তার সমস্ত দেহের সঙ্গে সে তার সম্পর্ককে ছেদন করেছে; কারণ সে মনে করে দেহের এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আত্মাকে বিভ্রান্ত করে মানুষের জ্ঞান ও সত্যলাভে কেবল বিঘ্নই সৃষ্টি করে। সত্যের জ্ঞান অর্জনের সম্ভাবনা এরূপ জ্ঞানীরাই সর্বাধিক। তাই নয় কি সিমিয়াস?

সক্রেটিস, তোমার উক্তিকে বিস্ময়কর সত্য বলেই আমার বোধ হচ্ছে। যারা প্রকৃত দার্শনিক তারা জ্ঞানলাভের প্রসঙ্গে এ সমস্ত বিষয় নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করবেন। আর সে চিন্তার ফলে তারা নিশ্চয়ই পরস্পরকে বলবেন : “এবার আমরা জ্ঞানলাভের সত্যকার পথ দেখতে পেয়েছি। আমাদের চিন্তা ও যুক্তি এ সম্পর্কে এ সিদ্ধান্ত অনিবার্য করে তুলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দেহের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকব এবং যতক্ষণ অবধি দেহের পাপ আমাদের আত্মাকে সংক্রমিত করে রাখবে ততক্ষণ আমাদের স্ব স্ব জ্ঞান ও সত্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় সিদ্ধি ঘটতে পারবে না। কেননা আমাদের দেহ হচ্ছে সহস্র সমস্যা এবং উপসর্গের আকরবিশেষ। আমাদের দেহ খাদ্য গ্রহণে বাধ্য, কেবল এ ঘটনাটিই আমাদের জীবনে কত-না সমস্যার উদ্ধব হ্যায় এবং আমাদের সত্যলাভে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আমাদের দেহ রোগের শিকারে পরিণত হয়; আমাদের দেহ আমাদের মনে প্রেম, কামনা, লালসা, ভীতি, কল্পনা আর মূর্খতার সৃষ্টি করে আর এমনি করে আমাদের চিন্তাশক্তিকে বিনষ্ট করে দেয় এবং সত্যলাভকে অসম্ভব করে তোলে। জগতের যুদ্ধ, সংঘর্ষ এবং কোলাহল–এ সবেরই মূল কোথায়? এদের মূলেও রয়েছে আমাদের দেহেরই লোভ এবং লালসা। অর্থের লালসাই যুদ্ধের কারণ হয়। আর এ অর্থ আমরা আমাদের দেহের ভোগের নিমিত্তই অর্জন করি। দেহমূল থেকে উদ্ভূত এই সমস্যারাজি আমাদের মনকে এত আচ্ছন্ন করে রাখে যে সত্য বা দর্শনের চিন্তায় মুহূর্তমাত্রও আমরা ব্যয় করতে পারিনে। দেহের এই প্রতিবন্ধকতার সর্বশেষ এবং প্রকটতম দিকটি হচ্ছে এই যে, যদি বা কোনো মুহূর্তে ক্ষণকালের জন্য দর্শনের চিন্তায় আমরা মনকে নিবিষ্ট করেছি তখনো দেহের নানা উপসর্গ অনুক্ষণ আমাদের মনকে উদ্বেগে পূর্ণ করে আমাদের সত্যালোচনাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে, এবং আমাদের এমনভাবে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে যে সত্যের দর্শনলাভ আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কাজে কাজেই অভিজ্ঞতাই আমাদের নিকট প্রমাণ করেছে যে, কোনো বিষয়ের বিশুদ্ধ জ্ঞান যদি আমরা লাভ করতে চাই তা হলে অবশ্যই দেহের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ছেদন করতে হবে যেন আমাদের আত্মা দেহবিমুক্ত হয়ে নির্বিঘ্নভাবে সকল বিষয়কে তার স্ব-রূপে দর্শন করতে পারে। এরূপেই মাত্র যে-সত্যের আমরা সন্ধানী, যে-জ্ঞানের আমরা প্রেমিক তাকে আমরা লাভ করতে পারব। অর্থাৎ দেহসহ জীবনকালে আমাদের পক্ষে সত্য লাভ সম্ভব নয়-মৃত্যুর পরেই মাত্র সত্যকার জ্ঞান ও সত্যকে আমরা লাভ করতে পারি। তা হলে এই যদি সিদ্ধান্ত হয় যে, দেহী আত্মা সত্যকে লাভ করতে পারে না তবে দুটি বিকল্পের একটিকে আমাদের গ্রহণ করতে হয়–যথা : হয় জ্ঞানলাভকে আমরা অসম্ভব বলে স্বীকার করব, নয়তো মৃত্যুর পরেই মাত্র জ্ঞানের উদ্ভব–একথাকে আমরা গ্রহণ করব। কেননা, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তো আমাদের আত্মা দেহমুক্ত হতে পারবে না। আর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত সে একান্তভাবে আত্মসমাহিতও হতে পারবে না। আর একথাও সত্য যে, আত্মা একান্তভাবে আত্মসমাহিত হতে না পারলে প্রকৃত জ্ঞানলাভও সম্ভব হবে না। প্রশ্ন হতে পারে, জীবনকালে আমরা কতটুকু জ্ঞান পেতে পারি? সে প্রশ্নের জবাবে বলা চলে যে, জীবনকালে আমরা তখনি জ্ঞানের সন্নিকটে পৌঁছতে পারি যখন দেহের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্কটি পরিমাণে ন্যূনতম। অর্থাৎ দেহের তৃপ্তি যখন আমাদের আত্মাকে মোহিত করে ফেলে নি, তখনি মাত্র জ্ঞানের কাছাকাছি আমরা পৌঁছতে পারি। এর অধিক নয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এরূপ আত্মাকে যথাসম্ভব দেহমুক্ত রেখে সেদিনের অপেক্ষায় থাকা যেদিন দয়াবান বিধাতা আমাদের আত্মাকে প্রকৃতপক্ষেই দেহের বন্দিতু থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর তখন দেহের সব পাপ, স্থূলতা আর মূর্খতা থেকে মুক্ত হেয় আমাদের আত্মা বিশুদ্ধ হবে এবং বিশুদ্ধ সত্তার সাক্ষাতে আমরা উপস্থিত হতে সক্ষম হব এবং সত্যের আলোকে চতুর্দিক হতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের বিশুদ্ধ অস্তিত্বকে তখন উদ্ভাসিত করে তুলবে।” দার্শনিকদের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সঠিক বলব। কেননা অশুদ্ধ কখনো বিশুদ্ধকে লাভ করতে পারে না। প্রিয় সিমিয়াস। প্রকৃত জ্ঞানের যারা প্রেমিক তারা এরূপ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে কি বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে সক্ষম? নিশ্চয়ই অন্য কোনোভাবে বিষয়টি নিয়ে তারা আলাপ করতে পারেন না। তুমি কি বল?

এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই সক্রেটিস যে, এ বিষয়ে তোমার কথাই সত্য।

তা হলে এবার শুদ্ধিকরণের বিষয়টিতে আসা যাক। আমি পূর্বেই বলেছি আত্মার শুদ্ধ। হওয়ার মানেই হচ্ছে দেহ থেকে তার বিচ্ছিন্ন হওয়া। আত্মা ক্রমান্বয়ে চাইবে যেন সে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল নিজের মধ্যে স্থিতিলাভ করতে পারে। মৃত্যুর পরে অবশ্যই সে একান্তভাবে নিজের রাজ্যে রাজা হয়ে বসবে; কিন্তু জীবনকালেও তার চেষ্টা হবে যতখানি সম্ভব যেন সে দেহের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। এ কথা কি ঠিক নয়?

সিমিয়াস বললেন : অবশ্যই ঠিক।

আর দেহ থেকে আত্মার এই বিচ্ছেদ ও মুক্তিকেই তো আমরা মৃত্যু বলে আখ্যায়িত . করি। নয় কি?

হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমরা তাই করি।

কিন্তু আত্মার এ মুক্তি সত্যকারভাবে কে চায়? বস্তুত কেবল প্রকৃত দার্শনিক যারা তারাই নিয়ত দেহ থেকে তাদের আত্মার মুক্তির প্রচেষ্টায় রত থাকেন। কেননা তাদের ধ্যান, ধারণা, সাধনার একমাত্র বিষয় হলো দেহ থেকে আত্মার মুক্তি। তুমি কি একথা ঠিক মনে কর না?

একথা অবশ্যই ঠিক।

তা হলে আমার পূর্বের কথাটি এবার ভেবে দেখ। আমি বলেছিলাম, যে-ব্যক্তি নিয়ত মৃত্যুর নৈকট্যেরই সাধনা করছে তার পক্ষে মৃত্যুর মুহূর্তে তাকে বিমুখ খুবই হাস্যাস্পদ, এবং পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। নয় কি?

হ্যাঁ, তা তো বটেই।

সিমিয়াস, প্রকৃত দার্শনিকগণ যথার্থই মৃত্যুর সাধনাতে ব্যস্ত থাকেন। এজন্য তাদের কাছে মৃত্যুর ভীতি সব চাইতে কম। বিষয়টিকে নিম্নোক্তভাবে দেখতে চেষ্টা কর; আমরা দেখেছি দার্শনিকগণ নিজেদেরকে সর্বতোভাবে দেহের শত্রু বলে বিবেচনা করেন; তারা সর্বদাই দেহবিমুক্ত হয়ে আত্মার মধ্যে নিমজ্জিত থাকতে চান। কাজে কাজেই তারাই যদি মৃত্যুর মুহূর্তে ভীত ও শঙ্কায় কেঁপে উঠেন, যেখানে গেলে তাঁদের বাঞ্ছিত ধন অর্থাৎ জ্ঞানের সাক্ষাৎ পাবেন আর যেখানে তাঁরা তাঁদের দেহরূপ শক্রর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবেন সেখানে যাত্রার শুভ মুহূর্তে তারা যদি শঙ্কিত হয়ে উঠেন তা হলে কি চরম সংগতিহীনতার অপরাধেই তারা নিজেদের অপরাধী করে তোলেন না? বহু মানুষই মৃত্যুলোক-পাতালপুরীতে এই জগতেরই প্রেম, প্রিয়া, পত্নী ও পুত্র লাভের আশা নিয়ে যাওয়ার জন্য ইচ্ছুক হয়ে উঠে। তা হলে যিনি যথার্থই জ্ঞান-প্রেমিক আর যিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে পাতালপুরীতেই মাত্র তিনি জ্ঞান-প্রিয়ার সম্যক সাক্ষাৎ লাভ করতে পারবেন, তিনি কি মৃত্যুর চিন্তায় শঙ্কিত বা দুঃখিত হয়ে উঠতে পারেন? তার পক্ষে তো স্বাভাবিক হচ্ছে আনন্দের সঙ্গেই এ জগৎ থেকে বিদায় গ্রহণ করা। প্রিয় সিমিয়াস, যিনি প্রকৃত দার্শনিক তিনি অবশ্যই সানন্দে তার মৃত্যুলোকের যাত্রা শুরু করবেন। কেননা তিনি তো একান্তভাবে বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র সেখানেই তার জ্ঞান-প্রিয়াকে পবিত্রতম অবস্থায় তিনি লাভ করতে পারবেন। প্রকৃত দার্শনিক সম্পর্কে কথা যদি সত্য হয়, তা হলে তার পক্ষে মৃত্যুর ভয়ে ভীত হওয়া একেবারেই হাস্যাস্পদ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কী বল সিমিয়াস, একথা ঠিক নয় কি?

সিমিয়াস বললেন; তা হলে যথার্থই তিনি হাস্যাস্পদ হয়ে দাঁড়াবেন। তা হলে, সিমিয়াস, একথাও কি ঠিক নয় যে যখন তুমি কাউকে মৃত্যুর আগমনে ভীত হতে দেখবে এবং দেখবে যে নূতন জগতের উদ্দেশে পদক্ষেপে সে অনিচ্ছুক তখন তুমি নিশ্চিতরূপেই বুঝবে যে, এ ব্যক্তি আদপে কোনো জ্ঞান-প্রেমিক নয়; বরঞ্চ সে প্রেমিক হচ্ছে দেহের এবং হয়তো শুধু দেহের নয়, প্রেমিক হচ্ছে সে সম্পদ এবং শক্তিরও? একথা যথার্থ।

বেশ অপর একটি গুণ, সাহসের কথা ধরা যাক। সাহসও কি দার্শনিকের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য নয়?

হ্যাঁ, সাহস তাঁদের চরিত্রেরই একটি বৈশিষ্ট্য।

এ ছাড়াও আছে সংযম। সংযমের বিষয়ে যারা স্থলবুদ্ধি তারাও স্বীকার করে যে সংযমের অর্থ হচ্ছে রিপুসমূহের নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা। দেহকে যারা ঘৃণা করে তারা অবশ্যই রিপুর প্রভাবের ঊর্ধ্বে। সেদিক দিয়ে সংযমের সাক্ষাৎ আমরা কাদের চরিত্রে সবচেয়ে অধিক দেখার আশা করতে পারি? সে কি একমাত্র তাদের মধ্যেই নয়, যারা দেহকে নিকৃষ্ট বলে বিবেচনা করেন এবং দর্শন-চিন্তায় জীবন ব্যয় করেন?

অবশ্যই। তাদের মধ্যেই আমরা সংযমের সাক্ষাৎ পেতে পারি। কেননা, তুমি বিবেচনা করলেই দেখতে পাবে, দার্শনিক ব্যতীত অপর সবার চরিত্রে সাহস এবং সংযমের অবস্থান প্রকৃতপক্ষে একটা বিরোধাত্মক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তোমার একথা খুবই সত্য, সক্রেটিস।

কেননা, আমরা যাকে সাহসী বলি সে মৃত্যুর সম্মুখে অগ্রসর হয় মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক কিছুর ভয়ে সে ভীত বলেই। সত্য নয় কি?

একথাও সত্য, সক্রেটিস।

তা হলে দার্শনিক ব্যতীত আর সবাই যারা সাহসী, তারা ভীত বলেই সাহসী–অর্থাৎ কথাটা দাঁড়ায় এইরূপ : যে সাহসী সে সাহসী কেননা সে কাপুরুষ! কথাটি কি অদ্ভুত বলে বোধ হয় না?

অবশ্যই এ কথাটি অদ্ভুত কথা।

শুধু সাহসীদের ব্যাপারেই নয়। যাদের আমরা সংযমী বলি, তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কেননা সংযমী যারা, তারা অসংযমী বলেই সংযমী। কথাটা শুনতে পরস্পরবিরোধী বলে বোধ হয়, কিন্তু বেচারা সংযমের ক্ষেত্রে অবস্থাটা এরূপই দাঁড়ায়। কারণ হচ্ছে এই যে, যারা সংযমী–অর্থাৎ যারা বিশেষ কোনো ভোগ এবং আনন্দ থেকে নিজেদের বিরত রাখে তারা এ সংযমের পরিচয় এজন্যই দেয় যেন অপর কোনো বিশেষ ভোগ এবং আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত না থাকে। বর্তমানের আনন্দকে ভোগ করলে পাছে ভবিষ্যতের সে আনন্দ বিনষ্ট হয়, এ ভয়েই তারা বর্তমানের আনন্দের ব্যাপারে সংযমী। তা হলে বিষয়টি কি এই দাঁড়ায় না যে, একপ্রকার ভোগের আকর্ষণ দ্বারা তারা বিজিত বলেই অপর একপ্রকার ভোগকে তারা পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে? অথচ ভোগের দ্বারা বিজিত হওয়াকেই কিন্তু আমরা অসংযম বলি–আর এই ‘সংযমীদের ক্ষেত্রে দেখা গেল ভোগের উপর তাদের বিজয়ের অর্থ হচ্ছে ভোগের দ্বারা বিজিত হওয়া। এজন্যই আমি বলছি যে, সাধারণের ক্ষেত্রে সংযমও আসলে অসংযমেরই প্রকাশ।

তোমার ব্যাখ্যাতে বিষয়টি তো সেরূপ বোধ হচ্ছে।

অথচ আমরা যদি এক প্রকার ভয়, বেদনা, আনন্দ কিংবা ভোগকে কামনা করি, কিংবা মুদ্রার ক্ষেত্রে যেরূপ পরিমাণে কম-বেশির পার্থক্য থাকে সেরূপ কোনো একটি আনন্দ কিংবা ভোগের অল্প পরিমাণের পরিবর্তে অধিক পরিমাণকে পেতে চাই তা হলে আমাদের এ কার্যকে নিশ্চয় আমরা ন্যায়পরায়ণতা বা ধর্ম বলে অভিহিত করতে পারিনে।–অর্থাৎ আমরা বলতে পারিনে যে, একটির বিনিময়ে অপরটি গ্রহণ করে আমরা ন্যায়পরায়ণতাকে গ্রহণ করেছি। প্রিয় সিমিয়াস, কেন আমি একথা বলছি? কারণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে সত্যকার মুদ্রা বলে যাকে গণ্য করা চলে সে হচ্ছে একমাত্র জ্ঞান। আমি মনে করি, সাহস, কিংবা সংযম কিংবা ন্যায়, যা-ই তুমি বল না কেন, একমাত্র জ্ঞান এদের ক্রয় কিংবা বিক্রয় করা চলে। কেননা যাকে আমরা সত্যকার ন্যায়ধর্ম বলে মনে করি জ্ঞানের সঙ্গেই তো তার ঘনিষ্ঠতা। জ্ঞানই তার সঙ্গী। সত্যকার ন্যায়ধর্মের প্রশ্ন এই নয় যে, সে ভয়, আনন্দ কিংবা কোনো ভোগকে লাভ করল কিনা। তার নিকট বড় প্রশ্ন হলো, সে জ্ঞানকে তার ঘনিষ্ঠতম সঙ্গী হিসাবে পেল কিনা। কিন্তু যে ন্যায়ধর্ম বলতে কেবল ভয়, আনন্দ বা ভোগকে বুঝায়, সে ন্যায়ধর্ম জ্ঞান বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন একটির সঙ্গে অপরটির বিনিময়কার্য শুরু করে, তখন সে ন্যায়ের প্রচ্ছায়া ব্যতীত আর কিছু থাকে না। এ ন্যায়ের মধ্যে তুমি স্বাধিকার, স্বাস্থ্য বা সত্য কোনো কিছুর সাক্ষাৎই পাবে না। আবার সত্যকার বিনিময়ও আছে। সত্যের বিনিময়ের ক্ষেত্রে ন্যায়ধর্ম ভোগ, আনন্দ ইত্যাদিকে গ্রহণ করার পরিবর্তে বরঞ্চ এই সমস্ত অনিত্যকে বর্জন করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠে। প্রকৃত সংযম, ন্যায়, সাহস কিংবা জ্ঞান হচ্ছে এরূপ পরিশুদ্ধ সত্তা। এজন্যই রহস্যবাদের প্রতিষ্ঠাতাগণ যখন একটি সংখ্যা-সংকেত এরূপ বলেছিলেন যে, অপবিত্র এবং দীক্ষাহীনভাবে যারা পাতালপুরীতে প্রবেশ করবে তারা অবশ্যই মহাপঙ্কে নিমজ্জিত হবে; কিন্তু যারা আসবে দীক্ষা গ্রহণ করে এবং পবিত্র হয়ে তারা দেবতাদেরই সঙ্গ লাভ করবে, তখন তারা কথাটি অর্থহীনভাবে বলেন নি। রহস্যবাদ তাই বলেছে, “পাতালপুরীতে সুরাদেবের পাত্রবাহকের অভাব নেই, কিন্তু তার গূঢ় রহস্যাগারের উন্মোচনকারী আছে খুব কমই।” ‘রহস্যাগারের উন্মোচনকারী বলতে আমি প্রকৃত দার্শনিককেই বুঝি। আমার জীবনব্যাপী আমি এই দার্শনিকদের বলতে আমি প্রকৃত দার্শনিককেই বুঝি। আমার জীবনব্যাপী আমি এই দার্শনিকদের সঙ্গই কামনা করেছি; আমার পরিমিত শক্তি অনুযায়ী দার্শনিকদের জগতেই নিজের জন্যে একটি আসন অর্জনের চেষ্টা করেছি। সে চেষ্টা আমি সঠিক পথে করেছি, কিংবা আমার অন্বেষণের পথ ভ্রান্ত ছিল; আমার উদ্দেশ্য সাধনে আমি সফল হয়েছি কিংবা সফল হই নি, শীঘ্রই বিধাতা আমাকে তা বলে দেবেন। খানিক বাদে আমি যখন তার কাছে উপস্থিত হব তখনি আমার জীবনের সে হিসাব নির্দিষ্ট হবে। এ আমার আন্তরিক বিশ্বাস। প্রিয় সিমিয়াস। প্রিয় সিবিস, এই বিশ্বাস নিয়েই আমি মনে করি তোমাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ মুহূর্তে কিংবা জাগতিক প্রভুদের নিকট থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে আমার দুঃখ বোধ না করাই সংগত। কেননা আমার হৃদয়ের বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, মৃত্যু পেরিয়ে যে জগৎ সেখানেও আমি তোমাদের ন্যায় উত্তম বন্ধু এবং প্রভু পেয়ে ধন্য হব। কিন্তু অনেকেই এরূপ কথা বিশ্বাস করে না। কাজেই তোমাদের বিশ্বাস করানোর কাজ আমার পক্ষে খুবই কঠিন। এথেন্সের বিচারপতিগণের সম্মুখে আমি ভাষণ দিয়েছি। তাদের যতটা বুঝতে পেরেছি তার চেয়ে প্রকৃষ্টতরভাবে যদি আমি তোমাদের বুঝাতে পারি তা হলেই আমি নিজেকে সার্থক মনে করব।

সিবিস বললেন : সক্রেটিস, তোমার বক্তব্যের অধিকাংশের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আত্মার ব্যাপারটি এমন যে, সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে পারে। সাধারণ মানুষের ধারণা যে, দেহমুক্ত আত্মার কোথাও স্থিতি ঘটতে পারে না। বস্তুত তারা মনে করে যে, দেহের যেদিন মৃত্যু ঘটে, আত্মারও সেদিন বিনাস ঘটে। দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে আত্মা খানিকটা ধোয়া কিংবা বাতাসের ন্যায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এভাবে সে তার বিস্তারের মধ্য দিয়েই শূন্যে মিলিয়ে যায়। যে অবাঞ্ছিতদের মধ্যে দেহের বন্ধনে সে বাঁধা থাকে তাদের মধ্য থেকে মুক্তিলাভের পরে যদি আত্মার পক্ষে নিজের স্বাধীন অস্তিত্বের মধ্যে কোথাও স্থিতি লাভ করা সম্ভব হতো তা হলে অবশ্যই তোমার বক্তব্যকে যথার্থ বলে গ্রহণ করা সহজ হতো। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব বজায় থাকে, আত্মা তখনও মননের ক্ষমতাসহ সক্রিয় থাকে, এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেক যুক্তি এবং প্রমাণেরই আবশ্যক হয়।

সিবিসের বক্তব্য শুনে সক্রেটিস বললেন : তোমার একথা খুবই সত্য সিবিস। তা হলে এস, আমরা আত্মার এরূপ অস্তিত্বের সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়ে খানিকটা আলাপ করি?

এ বিষয়ে তোমার মতামত জানবার আগ্রহ আমার বিশেষভাবেই রয়েছে।

সক্রেটিস বললেন : আমার মনে হয় এতক্ষণ যাবৎ আমি তোমাদের সঙ্গে যে আলাপ করেছি সে আলাপ যদি আমার চরম শত্রু ব্যঙ্গ-কবিগণও শুনতেন তা হলে তারাও অভিযোগ করতে পারতেন না যে সক্রেটিস তার এখতিয়ারের বাইরে কতকগুলি অর্থহীন অলস বাক্যালাপে সময় ক্ষেপণ করেছে। কাজেই তোমরা যদি সম্মতি দাও, তা হলে আলোচনাটি নিয়ে আমি অগ্রসর হতে পারি।

মানুষের মৃত্যুর পরে তার আত্মা পাতালপুরীতে প্রবেশ করে সেখানেই অবস্থান করে কিনা,–এস আমরা এ প্রশ্নটির আলোচনাই প্রথমে করে নিই। এই প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন তত্ত্বের কথা আমার স্মরণ হচ্ছে। প্রাচীন এই মত অনুযায়ী মৃত্যুর পরে আত্মা অবশ্যই পরলোকে যাত্রা করে; কিন্তু সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে মৃত্যুর মধ্যেই সে আবার পুনর্জন্ম লাভ করে। এ মতের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা কথা বলা যায় যে, জীবিত যদি মৃতের মধ্য থেকেই জীবন লাভ করে তা হলে একথা সত্য যে, আমাদের আত্মা পরলোকেই অবস্থান করে। তা না হলে, তার পুনর্জন্ম সম্ভব হতো না। মৃতের পুনর্জন্ম ঘটে’-অর্থাৎ জীবিত মৃতদের মধ্য থেকেই জীবন লাভ করে–এ মতটি যদি প্রমাণ মারফত সুপ্রতিষ্ঠিত হতো, তা হলে এ নিয়ে আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এ মতটি যদি প্রমাণভিত্তিক মত না হয়, তা হলে ভিন্নতর যুক্তির অবতারণা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নয় কি?

হ্যাঁ, একথা সত্য।

তা হলে এস, আমরা সমগ্র প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা করি। কেবল মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, পশুদের, বৃক্ষদের লতা-গুলদের অর্থাৎ যা কিছুতেই জীবন আছে, তাদের সবাইকে সামনে রেখেই প্রশ্নটি আলোচনা করা যাক। তা হলে এর প্রমাণও সহজতর হবে। যে-কোনো বস্তুর জন্মের বিষয়টি লক্ষ কর। একথা কি সত্য নয় যে, বস্তুর মধ্যে যা কিছু পরস্পর বিরোধী, বিরোধের মাধ্যমেই তার সৃষ্টি? যেমন ধর, ভালো এবং মন্দ, ন্যায় এবং অন্যায় ইত্যাদি। এভাবে অসংখ্য বিষয়েরই উল্লেখ করা চলে যারা পরস্পরবিরোধী এবং যাদের উদ্ভব বা সৃষ্টি এই বিরোধের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এর প্রতিটি বিরোধের মধ্যেও বিপরীত প্রক্রিয়া কাজ করে। যেমন ধর অল্প এবং অধিকতর দৃষ্টান্তটি। যা অধিকে রূপান্তরিত হলো, সে পূর্বে অবশ্যই অল্প ছিল। অর্থাৎ অল্পের মধ্য দিয়েই সে অধিক হয়েছে।

হ্যাঁ, একথা যথার্থ।

আবার যা অল্প তাও এক সময়ে অধিক ছিল এবং অধিক থেকেই সে অল্প হয়েছে। তা তো অবশ্যই।

ঠিক তেমনি যে তুলনাক্রমে দুর্বল সে তুলিত শক্তিমানের কারণেই দুর্বল, যে গতিতে দ্রুততর সে গতিতে মন্থরের কারণেই দ্রুততর–তা না হলে নয়।

নিঃসন্দেহে।

আবার যে উত্তম সে অধমের কারণেই উত্তম, যে অধিক ন্যায়পরায়ণ সে অধিক অন্যায়কারীর কারণেই অধিক ন্যায়পরায়ণ।

এ সম্পর্কেও আর সন্দেহ কি?

তা হলে এভাবে আমরা সমস্ত পরস্পরবিরোধী চরিত্র সম্পর্কেই বলতে পারি যে, তাদের প্রত্যেকেই তার বিপরীত চরিত্র থেকেই সৃষ্ট, একথা কি সত্য নয়?

হ্যাঁ একথা সত্য।

কিন্তু সমস্ত বস্তুর মধ্যে এই যে পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক তার অভ্যন্তরে আবার আরো দুটি অন্তর্বর্তী ধারাকেও আমরা কি নিয়ত প্রবহমান দেখতে পাইনে? এই অন্তর্বর্তী ধারাকে আমরা সর্বদা এক বিপরীত থেকে অপর বিপরীতে গমন এবং প্রত্যাগমন করতে দেখি। যেমন অধিক এবং অল্পের যে বৈপরীত্যের কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সেখানেও বৃদ্ধি এবং হাসের অপর দুটি অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়াও কাজ করে চলেছে। এজন্যই যা বৃদ্ধি পায় তাকে বলা হয় বর্ধমান এবং যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাকে বলা হয় ক্ষীয়মান। আমার এ বক্তব্য কি যথার্থ বলে বোধ হয়?

সিবিস জবাব দিলেন : হ্যাঁ, তোমার এ অভিমত যথার্থ।

এ ছাড়া আরো কতকগুলি প্রক্রিয়ার উল্লেখ করা যায়–যেমন, বিভাজন, সংযোজন, শীতলকরণ, উষ্ণকরণ প্রভৃতি। এদের ক্ষেত্রেও একটি থেকে অপরটিতে রূপান্তরের একটি ধারা অনবরতই কাজ করে চলেছে। বস্তুত, আমি পূর্বেই বলেছি, সমস্ত বিরোধিতা সম্পর্কেই একথা সত্য। এই রূপান্তর কার্যাট যেসব সময়ে ভাষায় প্রকাশিত হয় এমন নয়। কিন্তু ভাষায় কেউ এ সত্য প্রকাশ করুক কিংবা না করুক–প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিরোধ থেকেই বিপরীতের সৃষ্টি হচ্ছে এবং দুই বিপরীতের মধ্যে সর্বদাই আগম-নিগমের একটি ধারা বয়ে চলেছে। একথা কি যথার্থ নয়?

হ্যাঁ, একথা খুবই যথার্থ।

বেশ! তা হলে জীবনের বিপরীতেও কিছু রয়েছে, যেমন জাগ্রত অবস্থার বিপরীত অবস্থা হচ্ছে নিদ্রা?

নিশ্চয়, জীবনের বিপরীত অবস্থাও একটি রয়েছে।

কিন্তু কি সে অবস্থা?

সিবিস জবাব দিলেন : সে হচ্ছে মৃত্যু।

ভালো কথা। কিন্তু এরা যদি পরস্পর বিরোধাত্মক অবস্থা হয় তা হলে এদের একটি অবশ্যই অপরটি থেকে সৃষ্টি হবে এবং উভয়ের মধ্যে রূপান্তরের একটি অন্তর্বর্তী ধারাও প্রবহমান থাকবে। কি বল?

অবশ্যই।

এবার আমি তোমাদের নিকট এই দুইটি বিরোধের একটিকে বিশ্লেষণ করে দেখাব।–এই বিরোধের মধ্যে ক্রিয়াশীল অন্তর্বর্তী ধারা বিশ্লেষণ করার চেষ্টাও আমি করবো। আশা করি সিবিস, তুমিও অপর বিরোধটি আমার কাছে বিশ্লেষণ করে দেখাবে। আমি যে বিরোধের বিশ্লেষণ করব তার একটিকে আমি বলব নিদ্রা, অপরটিকে জাগরণ। যাকে আমরা নিদ্রা বলি সে জাগ্রত অবস্থার বিপরীত। কিন্তু নিদ্রার মধ্য থেকেই তার বিপরীত জাগরণের জন্ম ঘটে; আবার জাগরণ থেকেই নিদ্রার জন্ম। একটি থেকে অপরটির জন্মের প্রক্রিয়াটিতে দেখা যায় যে, একের ব্যাপারে নিদ্রাগমন যেখানে জন্ম, অপরের ব্যাপারে জাগ্রত হয়ে ওঠাই সেখানে জন্ম। আমার একথা কি তুমি স্বীকার কর?

হ্যাঁ, আমি সম্পূর্ণরূপেই একথা স্বীকার করি।

বেশ! তা হলে এবার জীবন ও মৃত্যুর সম্পর্কটি এইভাবে তুমি আমার নিকট বিশ্লেষণ করে দাও।… তোমার বিশ্লেষণই এবার শুরু করা যাক। বল, মৃত্যু কি জীবনের বিপরীত সত্য নয়?

অবশ্যই।

তাদের একের উদ্ভব অপর থেকেই। নয় কি?

হ্যাঁ, তাই বটে।

বেশ! তা হলে জীবন থেকে কিসের জন্ম?

মৃতের বা মৃত্যুর।

মৃত্যু থেকে জাত কে?

সিবিস বললেন : আমার উত্তর তো কেবল একটিই হতে পারে : মৃত থেকে জীবিতই জাত।

তা হলে সিবিস, জীবিত বলতে তুমি মানুষই বল আর দ্রব্যই বল জীবিত অবশ্যই মৃত থেকে জাত?

হ্যাঁ স্পষ্টতই তাই।

তা হলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, আমাদের আত্মা পাতালপুরীতে অবস্থান করে। নয় কি?

হ্যাঁ, পাতালেই সে অবস্থান করে।

তা ছাড়া, সৃষ্টির যে দুটি ধারার আমরা উল্লেখ করেছি তার অন্তত একটিকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। কেননা মরে যাওয়া অবস্থাটি আমাদের নিকট অদৃশ্য নয়, সে অবশ্যই দৃশ্য। নয় কি।

হ্যাঁ, অবশ্যই সে দৃশ্য।

তাই যদি হয় তা হলে ফল কি দাঁড়ায়? সৃষ্টিধারার অপরটিকে কি আমরা হিসাবের বাইরে রেখে দেব? প্রকৃতিবর কি একটি পায়ের উপর ভর দিয়ে চলেন? তিনি কি পঙ্গু? তা যদি না হয় তা হলে জীবনের ন্যায় মৃত্যুরও জন্ম আছে এবং জীবনের ‘মরে যাওয়ার’ ন্যায় মৃত্যুরও ‘জাত হওয়ার’ একটি প্রক্রিয়া কার্যরত বলেই কি আমাদের অনুমান করা সংগত নয়?

অবশ্যই।

বেশ! তা হলে সেই প্রক্রিয়াটি কী?

সে প্রক্রিয়া হচ্ছে মৃত্যুর জীবনে প্রত্যাগমন।

তার অর্থ হচ্ছে, জীবিতদের রাজ্যে মৃতের জন্ম–নয় কি?

হ্যাঁ, তাই।

তা হলে এবার একটি নতুন রাস্তায় আমরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হলাম যে, জীবিতদের মধ্য থেকে যেমন মৃতের আগমন–তেমনি মৃতের মধ্য থেকেই জীবিতদের আগমন। এই অনুমান যদি সত্য হয় তা হলে এ-কথাটিও অবিসংবাদিত রূপেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মৃতের আত্মা কোথাও অবশ্যই অবস্থান করে এবং সেখান থেকেই সে জীবিতদের মধ্যে প্রত্যাগমন করে। সেকথা ঠিক, সক্রেটিস। আমাদের স্বীকৃতিসমূহ থেকে এই সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবেই আমাদের সম্মুখে এসে পড়ে।

সক্রেটিস বললেন : আর সে-সমস্ত স্বীকৃতি যে মোটেই অসংগত ছিল না তাও আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। কেননা, সৃষ্টির প্রক্রিয়া যদি কেবল একমুখো হতো, যদি তার মধ্যে ক্ষতিকর কোনো পূরণ এবং গতির কোনো আবর্তন কিংবা একটি সত্তার ক্ষেত্রে তার বিপরীতে প্রত্যাগমন না থাকত, তা হলে বিশ্বের সব অস্তিত্ব এই আকার প্রাপ্ত হয়ে একই অবস্থার মধ্যে লুপ্ত হয়ে যেত এবং সৃষ্টির প্রবাহ সেখানে স্তব্ধ হয়ে যেত।

সিবিস বললেন : সক্রেটিস, একথা দ্বারা তুমি কী বুঝাতে চাচ্ছ?

আমি যা বলতে চাচ্ছি সে কঠিন কিছু নয়। বিষয়টি খুবই সহজ। নিদ্রার দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিচ্ছি। সিবিস! তুমি তো বুঝতে পার যে, আমাদের জীবনে যদি নিদ্রা এবং জাগরণ–এই অবস্থা দুটি পরস্পর সংযুক্ত না হতো এবং এরা উভয়েই যদি পর্যায়ক্রমিকভাবে একটি অপরটির অনুগমন না করত, তা হলে পুরাণের এণ্ডিমিয়নের* উপাখ্যানটির কোনো তাৎপর্য থাকত না। কেননা তখন শুধু এণ্ডিমিয়ন নয়, সব কিছুই নিদ্রায় মগ্ন হয়ে থাকত; অপর সকলের থেকে ভিন্নভাবে এণ্ডিমিয়নের আর কোনো বৈশিষ্ট্য তখন থাকত না। তা ছাড়া সংশ্লেষণের দৃষ্টান্তটিও দেখতে পার। ধর, যদি বিশ্বে কেবল সংশ্লেষণই ঘটত, কোনো বিশ্লেষণ কিংবা বিভাজনের প্রক্রিয়া না থাকত তা হলে পরিশেষে বিশ্বে এনাক্সগোরাসের বিশৃঙ্খলারই প্রত্যাবর্তন ঘটত। প্রিয় সিবিস! অনুরূপভাবে জীবনময় যত অস্তিত্ব রয়েছে সব যদি মরে যেত এবং মৃত্যুর পরে মৃতের অবস্থাতেই অবস্থান করতে থাকত, যদি তারা আবার জীবন না পেত তা হলে এক সময়ে মৃত্যুই কি সার্বভৌম এবং জীবন কেবলই অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়াত না? এমন অবস্থায় অপর কোনো পরিণতির কথা তুমি ভাবতে পার? কেননা, একটি জীবন যদি অপর একটি জীবন থেকে জাত হয় এবং উভয়ের পরিণতি যদি প্রত্যাবর্তনহীন মৃত্যু হয় তা হলে বিশ্বের সব কিছুই কি মৃত্যুর কবলে লুপ্ত হয়ে যায় না?

[* এণ্ডিমিয়নের উপাখ্যানটি এইরূপ : এলিস-রাজ এণ্ডিমিয়ন ছিলেন অতীব সুন্দর এক তরুণ। লটমাস পর্বতের কেরিয়ান বন্দরে যখন তিনি একবার নিদ্রামগ্ন ছিলেন তখন সুকুমারী চন্দ্র সেলিনি নেমে এসে তাকে চুম্বন করলেন এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। এরপর একবার জাগরিত হয়েই পর্বত বন্দরে এলিস রাজ এণ্ডিমিয়ন পুনরায় এক স্বপ্নবিহীন অনন্ত সুখনিদ্রায় ডুবে গেলেন। এ নিদ্রা থেকে আর তার জাগরণ ঘটল না। সম্ভবত উপাখ্যানটির তাৎপর্য এই যে, চন্দ্রের সঙ্গে যার মিলন ঘটে তার পরিণতি এরূপই হয়।]

সিবিস বললেন : সক্রেটিস, তোমার যুক্তিকে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বস্তুত তোমার যুক্তি আমার নিকট সম্পূর্ণরূপেই যথার্থ বোধ হচ্ছে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ সিবিস, এ যুক্তি যথার্থ হতে বাধ্য। কাজেই আলোচনার শুরুতে যে সমস্ত প্রতিজ্ঞাকে আমরা স্বীকার করেছি তারা যুক্তিসহ প্রতিজ্ঞা। সে স্বীকৃতিতে আমরা ভ্রান্ত হই নি। বস্তুত আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ‘পুনর্জীবন’ বা ‘পুনর্জন্ম’ বলে একটা সত্যের অস্তিত্ব রয়েছে। আমি পূর্বেই বলেছি, মৃত থেকেই জীবিতের জন্ম এবং মৃতের আত্মা অস্তিত্বহীন নয় মৃতের আত্মা আপন অস্তিত্ব নিয়ে অবশ্যই অবস্থান করে এবং যে আত্মা সৎ সে-আত্মার আবাসস্থানও মহৎ; অসৎ আত্মার চেয়ে তার ভাগ্য অবশ্যই উত্তম।

সক্রেটিসের যুক্তির সঙ্গে একমত হয়ে সিবিস বললেন : সক্রেটিস এই প্রসঙ্গে জ্ঞান সম্পর্কেও তোমার প্রিয় তত্ত্বটির কথা আমাদের মনে পড়ছে। জ্ঞানের ব্যাপারেও তুমি বলেছ যে, জ্ঞান আর কিছুই নয়, কেবল বিস্মৃতকে স্মরণ করা। তোমার একথা যদি সত্য হয়, তা হলে এখানেও আমরা সেই জ্ঞানকেই স্মরণ করি যে-জ্ঞান আমরা ইতঃপূর্বে নিজেদের মধ্যে লাভ করেছি। কিন্তু মানুষের মধ্যে আত্মার আগমনের পূর্বে যদি সে কোথাও অস্তিত্বশীল হয়ে অবস্থান না করত তা হলে আমাদের পক্ষে বর্তমানের স্মৃতি জ্ঞানকে পূর্বে অর্জন করা সম্ভব হতো না। কাজেই এটিও তোমার আত্মার অমরতা রূপ তত্ত্বেরই আর একটি প্রমাণ।

এই সময়ে সিমিয়াস বাধা দিয়ে বললেন। কিন্তু সিবিস, স্মৃতির তত্ত্বটি আমি এই মুহূর্তে খুব নিশ্চিতরূপে স্মরণ করতে পারছিনে। স্মৃতির তত্ত্বের পক্ষে কী কী প্রমাণ উপস্থিত করা যেতে পারে সেটি আমাকে একটু বুঝিয়ে বল।

সিসি জবাব দিলেন : এর একটি উত্তম প্রমাণ হচ্ছে, আমাদের পক্ষে কেনো প্রশ্নের উত্তর দানের ক্ষমতা। কেননা, তুমি যখন কাউকে কোনো প্রশ্ন সঠিকভাবে জিজ্ঞাসা কর তখন সেও তার উত্তরটি দিতে সক্ষম হয়। জবাব দানের মতো জ্ঞান ও যুক্তি যদি তার নিজের মধ্যে পূর্ব থেকেই না থাকত, তা হলে তার পক্ষে এই জবাব দান কি করে সম্ভব হতো? এ বিষয়ে স্পষ্টতম প্রমাণ পাওয়া যাবে যখন তুমি তাকে অঙ্কের কোনো একটি নকশা কিংবা ঐরূপ কোনো চিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করবে।

এই সময়ে সক্রেটিস বলে উঠলেন : সিমিয়াস, তুমি যদি এ মতটি সম্পর্কে এখনও সন্দেহপূর্ণ থাক, তা হলে আশা করি তুমি আমার সঙ্গে বিষয়টিকে আর এক কোণ থেকে আলোচনা করতে সম্মত হবে। কিন্তু তুমি কি যথার্থই স্মৃতির তত্ত্ব সম্পর্কে এখনও সন্দেহপরায়ণ?

এ বিষয়ে আমি সন্দেহপরায়ণ, এমন কথা আমি বলছিনে। আমি শুধু স্মৃতির এই তত্ত্বটিকে নিজের স্মৃতির পথে জাগরূক করে তুলতে চাই। বস্তুত সিবিসের ব্যাখ্যা শুনে ইতোমধ্যেই বিষয়টি আমার স্মরণ হচ্ছে এবং আমি এর যুক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠছি। তা সত্ত্বেও, সক্রেটিস, তুমি এই মুহূর্তে যা বলতে শুরু করেছিলে তা আমি অবশ্যই শুনতে চাচ্ছি।

সক্রেটিস বললেন : আমার মনে হচ্ছে আমি এই বলতে চাচ্ছিলাম যে, মানুষ যখন কিছু স্মরণ করে তখন সে তাকে স্মরণ করতে পারে এজন্যই যে, স্মৃত বিষয়টিকে সে ইতঃপূর্বে অবশ্যই জেনেছে।

একথা খুবই সত্য।

বেশ! কিন্তু এই জ্ঞান বা স্মৃতির সঠিক চরিত্রটি কী? আমার প্রশ্ন হচ্ছে কোনো মানুষ যখন কোনো একটি বিষয়কে দেখে, বিষয়ের কথা শ্রবণ করে কিংবা তাকে প্রত্যক্ষ করে তখন কি সে শুধু সেই বিষয়টির জ্ঞানই আহরণ করে কিংবা সে এমন জ্ঞানও আহরণ করে যার বিষয়বস্তু তার আশু লক্ষ্য নয় এবং যখন সে তাকে আবার স্মরণ করে তখন শুধু পূর্বদৃষ্ট বস্তুকেই স্মরণ করে না বরঞ্চ স্মরণ করে সেই বিষয় প্রসঙ্গে আহৃত সমগ্র জ্ঞানকেই?

তোমার একথার কী অর্থ সক্রেটিস?

আমার কথার অর্থটিকে আমি নিম্ন দৃষ্টান্তটি মারফতই বরং ব্যাখ্যা করে বলছি : ধর, একটি বীণার জ্ঞান। বীণার জ্ঞান এবং বীণাবাদক সম্পর্কে জ্ঞান নিশ্চয়ই এক নয়?

ঠিকই।

কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রেমিক যখন প্রেমাস্পদের বীণাটিকে, কিংবা তার পরিচ্ছদকে–অথবা তার অপর কোনো ব্যবহৃত অঙ্গভূষণকে দর্শন করে তখন তার মনের অনুভূতিটি কী প্রকারের? প্রেমিক কি প্রেমাস্পদের বীণাটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বীণার মালিক তরুণ প্রেমাস্পদের একটি মূর্তিও স্মরণ করে না? সে অবশ্যই তাই করে। আর তার এরূপ করাকেই আমরা স্মরণ করা বলি। অনুরূপভাবে কেউ সিমিয়াসকে দেখে সিবিসকে স্মরণ করতে পারে। এরূপ দৃষ্টান্ত সংখ্যাহীনভাবেই উল্লেখ করা চলে। নয় কি?

সিমিয়াস বললেন : হ্যাঁ এরূপ দৃষ্টান্ত তো সংখ্যাহীনই বটে। আর স্মরণ করার ব্যাপারটি হচ্ছে সময়ের ব্যবধানে কিংবা অমনোযোগের ফলে আমরা যে বিষয়কে বিস্মৃত হই তাকেই বিস্মৃতির মধ্য থেকে পুনরুদ্ধার করে স্মৃতির পর্দায় প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া। একথা কি সত্য নয়?

হ্যাঁ, তোমার একথা অবশ্যই সত্য।

বেশ! তা হলে এ বিষয়টিকে আমরা বুঝলাম যে, একটি অশ্বের চিত্র দেখে কিংবা একটি বীণা দর্শন করে আমরা একটি মানুষকে স্মরণ করতে পারি–সিমিয়াসের চিত্র দেখেও আমরা সিবিসকে স্মরণ করতে পারি।

হ্যাঁ, একথা যথার্থ।

এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে স্মৃতির সঙ্গে দৃষ্ট। বস্তুর সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্যে দুই-ই থাকতে পারে। নয় কি?

তা থাকতে পারে।

কিন্তু সাদৃশ্য থেকেই যদি স্মৃতি বস্তুকে স্মরণ করা হয়ে থাকে তা হলে আর একটি প্রশ্নের বিবেচনা প্রয়োজন। তেমন ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে স্মৃত বস্তুর সঙ্গে এই সাদৃশ্য কি পরিপূর্ণ কিংবা অপরিপূর্ণ সাদৃশ্য?

হ্যাঁ, এ প্রশ্নটি স্বাভাবিক।

এতদূর যখন অগ্রসর হয়েছি তখন এস, আর এক কদম আমরা অগ্রসর হই। আমরা কি এমন একটি সমতার কথা ভাবতে পারি, যে সমতা শুধু একটি কাষ্ঠ কিংবা প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে অপর একটি কাষ্ঠ কিংবা প্রস্তরখণ্ডেরই সমতা নয়–বরঞ্চ যে সমতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সমতা বা চরম সমতা? এরূপ একটি সমতার অস্তিত্ব কি আমরা ঘোষণা করতে পারি?

হ্যাঁ, জোরের সঙ্গেই এরূপ অস্তিত্বের কথা আমরা ঘোষণা করতে পারি।

কিন্তু এই চরম সত্তার প্রকৃত চরিত্রকে কি আমরা জানি?

অবশ্যই।

বেশ! কিন্তু কোথা থেকে আমরা আমাদের এ চরম সমতার জ্ঞান লাভ করি? এ জ্ঞানও কি আমরা দুটি কাষ্ঠখণ্ড কিংবা দুটি প্রস্তরখণ্ডের সমতা থেকেই লাভ করিনে? প্রকৃতপক্ষে বস্তুসমূহের মধ্যে সমতা দর্শন করেই তো আমরা এমন এক সমতার ধারণা তৈরি করি, যে-সমতা বস্তুর বিশেষ সমতা থেকে পৃথক। বিশেষ সমতা আর চরম সমতার মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে, একথা নিশ্চয় তুমি স্বীকার করবে। অন্যদিক থেকেও বিষয়টিকে দেখতে পার। যেমন : দুটি কাষ্ঠখণ্ড কিংবা প্রস্তরখণ্ড কি কোনো সময়ে তোমার নিকট সমান আবার কোনো সময়ে অসমান বলে বোধ হয় না?

তা অবশ্যই হয়। কিন্তু প্রকৃত সমতা কি কোনো সময়ে অসমতা হতে পারে? কিংবা সমতা এবং অসমতা উভয়েই কি এক হতে পারে?

না, সক্রেটিস, তা হতে পারে না।

তথাপি দেখ, প্রকৃত সমতা থেকে পৃথক এরূপ সমতার মাধ্যমেই তুমি প্রকৃত সমতাটির ধারণা তৈরি করেছ।

হ্যাঁ, তোমার একথা খুবই সত্য।

আর এ সমতার সঙ্গে অপর সাধারণ সমতার সাদৃশ্য থাকতে পারে, আবার তাদের মধ্যে সাদৃশ্য নাও থাকতে পারে। তাই নয় কি?

তাই বটে।

কিন্তু তাতে আমাদের সিদ্ধান্তের কোনো হেরফের ঘটে না। কেননা, কোনো বস্তু দর্শন করে যদি অপর কোনো বস্তুকে আমরা স্মরণ করি তা হলেই আমাদের এ কার্যটি স্মরণ করা বলে গণ্য হবে : মৃত বস্তুটি দৃষ্ট বস্তুর সদৃশ কিংবা বিসদৃশ যাই হোক না কেন?

খুবই যথার্থ। বেশ। কিন্তু দুটি বস্তুর কিংবা কাষ্ঠখণ্ডের যে সমতা-অর্থাৎ বস্তুসমূহের মধ্যকার যে সমতা সে সম্পর্কে আমরা কি সিদ্ধান্ত করব? এ সমস্ত বস্তুর মধ্যকার সমতা আর চরম সমতা–এ উভয় সমতার অর্থ কি এক? অর্থাৎ চরম সমতা যে-অর্থে সমতা সেই অর্থেই কি সাধারণ বস্তুসমূহ সমান? অথবা আমাদের সিদ্ধান্ত হয়ে যে, সাধারণ সমতা চরম সমতার ন্যায় পরিপূর্ণ সমতা নয়? সাধারণ সমতা কি পরিপূর্ণ সমতা থেকে কোনো অংশে নূন?

হ্যাঁ, অনেকাংশেই সে চরম পরিপূর্ণ সমতা থেকে নন।

কিন্তু তা হলেও কি আমাদের স্বীকার করতে হয় না যে, আমি যখন বুঝি যে আমার দৃষ্ট বস্তুটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অপর একটি বস্তুর এবং এই অপর বস্তুটির সঙ্গে আমার দৃষ্ট বস্তুটির হুবহু মিল নেই- অর্থাৎ আমার দৃষ্ট বস্তু এবং মৃত বস্তু দুটি এক নয়–বরঞ্চ দৃষ্ট বস্তু স্মৃত বস্তুর চেয়ে সাদৃশ্যের ক্ষেত্রে অনেক পরিমাণে নূন তখন আমার এ বিচারের ভিত্তিমূলে রয়েছে সেই মূল বস্তুরই পূর্বজ্ঞান, আর সেই জ্ঞান থেকেই আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে আমার দৃষ্ট বস্তু আর স্মৃত বস্তু এক নয়।

অবশ্যই আমাদের একথা স্বীকার করতে হয়।

সাধারণ সমতা এবং চরম সমতার ক্ষেত্রেও আমাদের এ ব্যাপারটিই ঘটেছে।

একথা ঠিক।

তাই আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, বস্তু সাধারণ সমতা প্রত্যক্ষ করার পূর্বেই চরম সমতার জ্ঞান আমরা লাভ করেছি–এবং সেজন্যেই বস্তুসমূহের আপাত সমতা দেখে বুঝতে পারছি যে এই সমতাসমূহ চরম সমতা চেয়ে ন্যূন বটে, তবু এরা চরম সমতাকে লাভ করার প্রচেষ্টারই প্রকাশ।

একথা অবশ্যই সত্য।

আবার একথাও আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, চরম সমতাকে আমাদের চক্ষু কর্ণ তৃক ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারিকেননা তাকে জানার অপর কোনো মাধ্যম আমাদের নেই; আর মাধ্যমের ব্যাপারে এদের মধ্যে তারতম্যেরও কিছু নেই। বস্তুত জ্ঞানের মাধ্যম হিসাবে সব ইন্দ্রিয়ই এক।

হ্যাঁ, সক্রেটিস! যুক্তির দিক থেকে একটি থেকে অপরটির কোনো তারতম্য নেই।

তা হলে ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমেই আমরা এই জ্ঞান লাভ করি যে, সকল বস্তুই তাদের মধ্যকার সমতার ন্যূনতা নিয়েও একটি চরম পরিপূর্ণ সমতাকে লাভ করার চেষ্টা করে–নয় কি?

হ্যাঁ, তাই করে।

তার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমাদের দর্শন, শ্রবণ, বা অপর যে-কোনো অনুভবেরও পূর্বে আমাদের চরম সমতার একটি জ্ঞান অবশ্যই ছিল। তা না হলে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমতাসমূহকে চরম সমতার তুলনায় নূ্যন বলার ক্ষমতা আমাদের থাকত না–এবং আমরা বলতে পারতাম না যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমতাসমূহ চরম সমতাকে লাভ করারই কামনা করে। আমাদের পূর্ব স্বীকৃতিসমূহের উপর ভিত্তি করে এ ছাড়া অপর কোনো সিদ্ধান্তই আমরা গ্রহণ করতে পারিনে।

বেশ! কিন্তু আমাদের দর্শন শ্রবণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলিকে আমরা কখন লাভ করেছি–এবং কখন থেকে আমরা তাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছি? সে কি আমাদের জন্ম মুহূর্ত থেকেই নয়?

অবশ্যই।

তা হলে সমতার জ্ঞানটি আমাদের আরো পূর্বের অর্জিত। নয় কি?

হ্যাঁ, আরো পূর্বের অর্জিত।

অর্থাৎ আমাদের জন্মের পূর্বে। কি বল?

হ্যাঁ, তাই। আমাদের জন্মের পূর্বেই অর্জিত।

তা হলে, আমরা যদি আমাদের জন্মের পূর্বেই এই জ্ঞানকে লাভ করে থাকি এবং এই জ্ঞান নিয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকি তা হলে জন্মমাত্রই আমরা যে শুধু সমতা, অসমতা, আধিক্য, অল্পতা প্রভৃতি ভাবগুলোকে বুঝতে পারি তাই নয়–সৌন্দর্য, শুভ, ন্যায়, পবিত্রতা–অর্থাৎ প্রশ্নোত্তরের দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা সে-সমস্ত ভাবকেও আমরা অনুরূপভাবে জন্মমাত্র এবং জন্মের পূর্ব থেকেই জানতে পারি। অর্থাৎ এরূপ সমস্ত ভাব সম্পর্কেই আমরা বলতে পারি যে, এদের সম্পর্কে জ্ঞান আমরা আমাদের জন্মের পূর্বেই লাভ করেছি। কি বল, একথা আমরা কি বলতে পারিনে?

তা আমরা বলতে পারি।

কিন্তু ধর, যে-জ্ঞান আমরা জন্মের পূর্বে লাভ করেছি সে জ্ঞান আর বিস্মৃত হলাম; তা হলে সে জ্ঞান তো আমাদের সমগ্র জীবনকালই অক্ষয় হয়ে থাকবে। কেননা, কোনো বস্তুকে জানার অর্থ হচ্ছে সে সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা এবং আহৃত জ্ঞানকে সঞ্চিত করে রাখা। কিন্তু বিস্মৃত জ্ঞানকে আমরা নিশ্চয়ই হৃত জ্ঞান বলে আখ্যায়িত করব। কি বল সিমিয়াস?

হ্যাঁ, আমরা অবশ্য তাই করব।

আবার এমন যদি হয় যে জন্ম-পূর্বে অর্জিত জ্ঞান আমরা জন্মের সময়ে বিস্মৃত হয়ে যাই–কিন্তু পরবর্তী কালে আমাদের ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে আমরা সে বিস্মৃত জ্ঞানকে পুনরায় স্মরণ করি–তা হলে জ্ঞানলাভের এই প্রক্রিয়াটি কি প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের স্বাভাবিক পুনরুদ্ধার বলে বিবেচিত হবে না এবং একে আমরা স্মৃতি-চয়ন বলে আখ্যায়িত করব না?

অবশ্যই আমরা তাই করব।

তা হলে এ পর্যন্ত একথা আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝলাম যে দর্শন, শ্রবণ কিংবা অপর কোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যখন আমরা কিছু প্রত্যক্ষ করি তখন সেই প্রত্যক্ষীকৃত কিংবা দৃষ্ট বস্তুর মাধ্যমে অপর এমন বস্তুর ধারণাও আমরা করতে পারি যে-বস্তুর সঙ্গে আমাদের দৃষ্ট বস্তুর মিল কিংবা অমিল রয়েছে এবং যাকে আমরা ইতঃপূর্বে বিস্মৃত হয়েছিলাম। আমি পূর্বেই বলেছি, এই অবস্থায় জ্ঞান সম্পর্কে দুটি বিকল্প আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়–যথা, হয় জন্মমুহূর্তেও আমাদের এই জ্ঞান ছিল এবং সমগ্র জীবন ধরেই আমরা জন্মের পূর্বে অর্জিত এই জ্ঞানে জ্ঞানী হতে থাকি; নতুবা জন্মের পরে যারা জ্ঞান অর্জন করে তারা কেবল জন্মপূর্বের জ্ঞানকেই স্মরণ করে এবং জ্ঞান বলতে আমরা এই স্মৃতি-চয়নকেই বুঝি।

সক্রেটিস, তোমার একথা খুবই যথার্থ।

কিন্তু এই দুটি বিকল্পের মধ্যে কোনটিকে তুমি গ্রহণ করবে? তুমি কি বলবে যে, জন্মের সময়েই আমাদের মধ্যে জ্ঞান বিরাজ করে? অথবা তুমি বলবে যে, জ্ঞান বলতে জন্মের পূর্বে আমরা যা জেনেছি তাকে জীবনকালের বিভিন্ন স্মরণ করাকেই বুঝি? কোনটিকে তুমি অধিকতর গ্রহণীয় মনে করবে?

সক্রেটিস, এ সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছিনে।

তা হলেও তুমি নিশ্চয় বলতে পার যে, যার জ্ঞান আছে সে তার সেই জ্ঞানের হিসাব কিংবা বর্ণনা দিতে সক্ষম কিনা? কি বল, সে কি এরূপ হিসাবদানে সক্ষম?

হ্যাঁ, অবশ্যই সে এইরূপে হিসাবদানে সক্ষম।

বেশ! কিন্তু তুমি কি মনে কর প্রত্যেক মানুষই এরূপ হিসাবদানে সক্ষম?

সব মানুষই এরূপ হিসাবদানে সক্ষম হলে সবচেয়ে উত্তম ব্যাপারই হতো। কিন্তু আমার মনের আশঙ্কা হচ্ছে, আগামী কাল ঠিক এই মুহূর্তটিতে আর এমন একজনকে আমরা এ জগতে দেখতে পাবো না যে এই জ্ঞানের যথাযথ হিসাবদানে সক্ষম।

তা হলে তুমি বলতে চাচ্ছ যে, সব মানুষের পক্ষেই আমাদের আলোচিত বিষয়সমূহকে জানা কিংবা তার জ্ঞান রাখা সম্ভব নয়?

না; তা সম্ভব নয়।

অর্থাৎ তাদের পক্ষে যা সম্ভব সে হচ্ছে, যে-জ্ঞান তারা ইতঃপূর্বে লাভ করেছে তাকেই ক্রমান্বয়ে স্মরণ করা?

হ্যাঁ, তাই।

কিন্তু আমাদের মন এই জ্ঞানকে কখন অর্জন করেছে? নিশ্চয়ই আমরা মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করার পরে নয়।

তার মানে জন্মের পূর্বে এই জ্ঞানকে সে অর্জন করেছে?

অবশ্যই তাই।

সিমিয়াস, তাই যদি হয় তা হলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, আমাদের আত্মা মানুষের মধ্যে দেহ ধারণ করার পূর্বেও অস্তিত্বময় ছিল এবং দেহহীন সে অবস্থাতে সে জ্ঞান পূর্ণও ছিল। তোমার কি মনে হয়?

জ্ঞান জন্মমুহূর্তটিতে আত্মায় এসে ভর করে–এরূপ কথা যদি আমরা বলতে না চাই তা হলে তুমি যেরূপ বলেছ সেরূপ সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে অপর কোনো সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারিনে, সক্রেটিস। কেননা, জন্মের পূর্বে আত্মার জ্ঞানলাভ হয়েছে–একথার একমাত্র বিকল্প হচ্ছে জন্মের মুহূর্তটিতে জ্ঞান এসে আত্মায় ভর করেছে।

কিন্তু জ্ঞান লাভ করার বিষয়টি যদি এরূপ হয় তা হলেও প্রশ্ন থাকে যে, এ জ্ঞানকে আমরা বিস্মৃত হই কখন? কেননা আমরা দেখেছি বিস্মৃত জ্ঞানকে স্মরণ করাই জ্ঞান। যখন আমরা জন্মগ্রহণ করি তখন যে পূর্বলব্ধজ্ঞান আমাদের মধ্যে থাকে না সেটি আমরা স্থির করেছি। তা হলে কখন আমরা লব্ধজ্ঞানকে বিস্মৃত হই? সে কি জ্ঞান লাভ করার সময়টিতে, না অপর কোনো সময়ে?

সক্রেটিস, এবার আমি বুঝতে পেরেছি আসলে এর পূর্বে অচেতনভাবে আমি যা বলেছি তা যুক্তিসঙ্গত নয়,–তা অর্থহীন।

তা হলে একথা কি আমরা বলতে পারিনে যে, যখন পরম সুন্দর, পরম মঙ্গল এবং পরম সত্তা রূপ একটা অস্তিত্ব আমাদের অনিত্য জীবনকে অতিক্রম করে পূর্ব থেকে বিরাজমান রয়েছে এবং আমাদের সব অনুভূত ধারণার মূল্য আমরা এই নিত্যকালের অস্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করেই নির্ধারণ করি তখন আমাদের আত্মারও অনুরূপ দেহপূর্ব নিত্যকালের একটি অস্তিত্ব রয়েছে? অর্থাৎ দেহের অস্তিত্বের পূর্ব থেকেই আত্মার অস্তিত্ব বিরাজমান? আমাদের একথা সত্য না হলে সমস্ত যুক্তিটিই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। আবার আত্মা যেমন পূর্ব থেকে অস্তিত্বময়–তেমনি অস্তিতৃময় হচ্ছে পরম সুন্দর, পরম মঙ্গলরূপ ভাবসমূহ। এ দুটি অস্তিত্বই এত সম্পর্কিত যে আত্মার অস্তিত্ব ব্যতীত যেমন এই সমস্ত ভাবের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি কল্পনা করা চলে না এই সমস্ত পরম ভাবের অস্তিত্ব ব্যতীত আত্মার অস্তিত্বকে।

সক্রেটিস, এবার আর আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির জন্য অপরিহার্য। আমি বুঝতে পারছি, আমাদের যুক্তির ফলও এই দাঁড়ায় যে, আমাদের জন্মের পূর্বে আত্মার অস্তিত্বকে পরম সত্তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক করা চলে না। কেননা এবার আমি বুঝতে পারছি, পরম সুন্দর, পরম মঙ্গল প্রভৃতি পরম সত্তার ন্যায় বাস্তব অস্তিত্বময় সত্তা আর কিছুই নয়। এ সম্পর্কে তোমার প্রদত্ত প্রমাণ খুবই যথার্থ। আমি নিজে সে প্রমাণে সন্তুষ্ট।

বেশ! কিন্তু সিবিসও কি তোমার ন্যায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন? তা না হলে তাকেও তো আমায় ভালো করে বুঝতে হবে এবং বুঝিয়ে তার প্রত্যয় আমাকে সৃষ্টি করতে হবে।

সিমিয়াস বললেন, সিবিস অবশ্য একজন অতিশয় অবিশ্বাসী ব্যক্তি। তা হলেও আমার মনে হয় তোমার যুক্তি শুনে সিবিসও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে জন্মের পূর্বেও আমাদের আত্মার অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু অনুরূপভাবে মৃত্যুর পরেও যে আত্মা অস্তিত্বময় থাকবে–এ কথাটির উপর আমি নিজে এখনও পুরাপুরি বিশ্বাস আনতে পারছিনে। বস্তুত, এ সিদ্ধান্তটি এখন পর্যন্ত উপযুক্তরূপে প্রমাণিত হয় নি বলেই আমি মনে করি। সিবিস এ সম্পর্কে সাধারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে যে ধারণাটি রয়েছে তাকে আমি নিজের মন থেকে ভিত্তিহীন বলে দূর করে দিতে পারছিনে। সাধারণের মধ্যে এরূপ একটি ধারণা রয়েছে যে, মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মাও শূন্যে মিলিয়ে যায় এবং এই মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও হয়তো অবলোপ ঘটে। এ ধারণাটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। কেননা যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, আত্মার জন্ম হয়েছে আমাদের জন্মের পূর্বে এবং অপর কোনো জগতে; সে সৃষ্ট হয়েছে ভিন্নতর উপাদানে; এবং মানবদেহে প্রবেশের পূর্বেও সে বিরাজমান ছিল, তা হলেও একথা বুঝা যাচ্ছে না, কেন সেই প্রবেশালাভের পরে আবার দেহের মৃত্যুতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সেও লয়প্রাপ্ত হয়ে যেতে পারে না?

এবার সিবিস বলে উঠলেন : সিমিয়াস, তোমার কথা যথার্থ। বস্তুত, প্রয়োজনের অর্ধভাগই মাত্র প্রমাণিত হয়েছে বলা চলে। একথা আমরা বুঝলাম যে আমাদের জন্মের পূর্বেও আত্মা অস্তিত্বময় ছিল। কিন্তু জন্মের পূর্বের ন্যায় সে যে আমাদের মৃত্যুর পরেও আপন অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করতে থাকবে–এটি হচ্ছে আমাদের প্রতিপাদ্যের অপর ভাগ। এটির প্রমাণ আবশ্যক। কেন এটি এখনও প্রমাণিত হয় নি। এই প্রমাণ যখন দেওয়া হবে তখন সমগ্র প্রতিপাদ্যটিই প্রমাণিত হয়ে যাবে।

একথায় সক্রেটিস জবাব দিলেন : কিন্তু প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস। এ প্রমাণও তো দেওয়া হয়েছে। বর্তমান যুক্তির সঙ্গে যদি তোমরা আমাদের পূর্বের যুক্তিটি একত্র কর তা হলে প্রতিপাদ্যের শেষাংশও প্রমাণিত হয়েছে বলেই দেখতে পাবে। পূর্বের যুক্তিতে আমরা বলেছি, সব জীবিতদের জন্মই হচ্ছে মৃত থেকে। কাজেই আত্মা যখন জন্মের পূর্বেও বিরাজ করে এবং জাত হওয়ার কালে সে কেবল মৃত থেকেই জাত হয় এবং যখন তাকে দেহের মৃত্যুর পরে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়, তখন এ তো স্বাভাবিক যে, দেহের মৃত্যুর পরেও সে অবশ্যই অস্তিত্বময় থাকে। সুতরাং তোমরা যে প্রমাণ চাচ্ছ সে প্রমাণ ইতোমধ্যে প্রদত্ত হয়েছে। তথাপি আমার মনে হচ্ছে তুমি এবং সিমিয়াস যুক্তিটি নিয়ে আরো খানিকদূর অগ্রসর হওয়া পছন্দ কর। কেননা, আমি বুঝতে পারছি, তোমাদের মনে একটি শিশুসুলভ আশঙ্কা জেগে উঠছে যে, আত্মা যখন দেহ পরিত্যাগ করে যায় তখন তার যাত্রাপথে একটা দমকা হাওয়া কি তাকে ছিন্নভিন্ন করে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে পারে না; বিশেষ করে শান্ত আকাশের নিচে না হয়ে ভীষণ এক ঝঞ্ঝার মধ্যেই যদি আত্মার এই যাত্রা শুরু হয়, তা হলে তার লয় পাওয়ার আশঙ্কা কি সমূহ নয়?

সক্রেটিসের কথা শুনে সিবিস হেসে বললেন : বেশ তাই যদি হয় সক্রেটিস, তা হলে তোমাকে সেই ভয় অবশ্যই যুক্তি দ্বারা দূর করে দিতে হবে। সঠিকভাবে বলতে গেলে এই ভয় আমাদের ভয় নয়; বরঞ্চ আমাদের সবার মধ্যে যে একট শিশু লুকিয়ে রয়েছে–এ ভয় হচ্ছে তারই ভয়। মৃত্যু তার কাছে ভূতবিশেষ। আমাদের উচিত এই শিশুকেও অভয় দেওয়া যে, মৃত্যুর অন্ধকারে তার ভয়ের কিছু নেই।

সক্রেটিস বললেন : তা হলে সে শিশুর উপরে তোমরা প্রতিদিন জাদু কর বা বিমোহকের অভয় কণ্ঠ প্রয়োগ করতে থাক যতদিন না সে ভয়-বিমুক্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু সক্রেটিস তুমি যখন আজ চলে যাবে, তখন আমাদের মনের শঙ্কা ও ভয়কে দূর করে দিতে পারবে এমন জাদুকর আমরা কোথায় পাব?

তা কেন বলছ সিবিস? গ্রিসের আয়তন ক্ষুদ্র নয়। উত্তম লোকেরও এখানে অভাব নেই। অ-গ্রিক জাতিও রয়েছে প্রচুর। নিকটে কিংবা দূরে সর্বত্র তোমরা তোমাদের অভিপ্রেত মানুষকে অন্বেষণ কর। অর্থ কিংবা ক্লেশের চিন্তা যেন এ অন্বেষণকে বিঘ্নিত না করে। কেননা তোমাদের অর্থকে ব্যয় করার মহত্তর অপর কোনো পথ তোমরা পাবে না। আর শুধু বাইরে নয়, তোমাদের নিজেদের মধ্যেও সেই অভিপ্রেত পুরুষকে তোমরা খুঁজে দেখতে দ্বিধা কর না কেননা এখানে তোমাদের চাইতে উত্তম অনুসন্ধানী আর কে হতে পারে?

সিবিস বললেন : তোমার আদেশ শিরোধার্য। এ অন্বেষণ আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু যুক্তির যে-স্থলে আমরা কথান্তরে চলে গিয়েছিলাম এবার সেখান থেকে পুনরায় শুরু করা যাক।

সক্রেটিস বললেন : অবশ্যই। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আমার নিকট আর কি হতে পারে?

এবার তা হলে শুরু করা যাক।

সক্রেটিস বললেন : কিন্তু শুরুতে আবার কি আমাদের বিবেচনা করে দেখা উচিত নয় যে, দমকা হাওয়ায় যার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমরা ভীত সে বস্তুটি সঠিকভাবে কী? আর যে বস্তুটি সম্পর্কে আমরা ভীত নই সে বস্তুটিই বা কী? এর পরেই আমরা বিচার করে দেখতে পারব যে, ছিন্নভিন্ন হয় যে বস্তু সে আদৌ আত্মা কিনা। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবের উপর আত্মা সম্পর্কে যে ভয় আমরা পোষণ করি সে ভয় বিদূরিত হওয়ার বিষয়টিও নির্ভর করবে।

একথা ঠিক।

.

একটি মিশ্র দ্রব্য বা মিশ্রণের মারফত যার সৃষ্টি তার কথা ধরা যাক। এরূপ মিশ্র দ্রব্য তার স্বভাবগত কারণেই যেমন মিশ্রণযোগ্য তেমনি সে বিভাজুন কিংবা দ্রবণযোগ্যও। কিন্তু যে দ্রব্য অমিশ্র বা অযৌগিক সে দ্রব্যের আর দ্রবণ সম্ভব নয়।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।

সেদিক থেকেই অমিশ্র দ্রব্যকে সর্বদা পরিবর্তনহীন এবং মিশ্র দ্রব্যকে সর্বদাই পরিবর্তমান বলে বিবেচনা করা যেতে পারে-অর্থাৎ অমিশ্র দ্রব্য সর্বদাই এক এবং অভিন্ন, কিন্তু মিশ্র দ্রব্য কোনো সময়েই এক কিংবা অভিন্ন নয়।

তোমার একথার সঙ্গেও আমি একমত। এবার তা হলে আমাদের পূর্বের আলোচনাতে ফিরে যাওয়া যাক।

আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে : দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা যাকে সত্তা বলেছি, সে সত্তা সমতার সত্তা, সৌন্দর্য কিংবা অপর যে-কোনো অস্তিত্বের হোক না কেন, সে সত্তার কি কখনো পরিবর্তন ঘটে? অর্থাৎ সে কি পরিবর্তনযোগ্য? কিংবা এ সত্তার কখনো, কোনো অবস্থায় কোনো পরিমাণেই পরিবর্তন সম্ভব নয়; এ সত্তা সর্বদাই এক এবং অভিন্ন, সরল এবং স্ব-স্থিত অবস্থায় বিরাজ করছে?

সিবিস জবাব দিলেন : এরূপ সত্তা সর্বদাই এক এবং অভিন্ন, সক্রেটিস।

বেশ। কিন্তু তুমি সুন্দর দ্রব্যসমূহ সম্পর্কে কী বলবে? যেমন মানুষ, অশ্ব, কিংবা অঙ্গভূষণ কিংবা অপর যে-কোনো দ্রব্যকেই ধর না কেন, এদের সবাইকে আমরা সুন্দর কিংবা সমান’ আখ্যায় অভিহিত করি। অর্থাৎ একই শব্দ দ্বারা বহুকে আখ্যায়িত করি। তা হলে এসব দ্রব্যও কি সর্বদাই অভিন্ন এবং পরিবর্তনহীন। অথবা তাদের সম্পর্কে একথা বলাই ঠিক নয় যে, তারা কদাচিৎই এক এবং অভিন্ন। বরঞ্চ সর্বদাই তার নিজ সত্তার সঙ্গে আপন চরিত্রের পরিবর্তন সাধন করে চলেছে?

তোমার দ্বিতীয় উক্তিই যথার্থ সক্রেটিস। তারা অবশ্যই নিয়ত পরিবর্তমান সত্তা।

আর এই সত্তাসমূহের বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা তোমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য; তুমি তাদের স্পর্শ করতে পার, দর্শন করতে পার কিংবা অনুভব করতে পার। কিন্তু যে সত্তা অপরিবর্তনীয় তাকে তুমি শুধু মননের উপলব্ধি করতে পার; কেননা তারা শুধু অপরিবর্তনীয় নয়, তারা অদৃশ্যও।

একথা খুবই সত্য।

তা হলে সত্তা বা অস্তিত্বকে আমরা দুই ভাগে অর্থাৎ দৃশ্য এবং অদৃশ্য অস্তিত্ব বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। কি বল?

হ্যাঁ, তা আমরা পারি।

আর একটু অগ্রসর হওয়া যাক। আমাদের আপন অস্তিত্বেরও এক ভাগ দেহ এবং অপর ভাগ আত্মা–একথা কি সত্য নয়?

অবশ্যই।

তা হলে দৃশ্য-অদৃশ্যের মধ্যে আমাদের দেহ কার অধিক সগোত্র?

স্পষ্টতই সে দৃশ্যমানেরই সগোত্র। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু আত্মা কি দৃশ্য, না অদৃশ্য?

সক্রেটিস, আত্মা কখনো দৃশ্য হতে পারে না।

দৃশ্য বলতে আমরা আমাদের চোখে দেখা যায় এমন এবং অদৃশ্য বলতে চোখে দেখা যায় না এমন বস্তুকে বুঝাই। নয় কি?

হ্যাঁ, মানুষের চোখে যা দেখা যায় তাকেই দৃশ্য বলে।

তা হলে, আত্মাকে কি চোখে দেখা যায়? কিংবা আত্মাকে চোখে দেখা যায় না?

না, তাকে চোখে-দেখা যায় না?

অর্থাৎ সে অদৃশ্য?

হ্যাঁ, সে অদৃশ্য।

তা হলে আত্মার সঙ্গে অধিক সাদৃশ্য অদৃশ্যের; অপরদিকে দেহের অধিক সাদৃশ্য দৃশ্যের সঙ্গে। নয় কি?

এই সিদ্ধান্তকে অনিবার্যভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হয়, সক্রেটিস।

কিন্তু আমরা কি অনেক পূর্ব থেকেই বলে আসি নি যে, আত্মা জ্ঞানের উপলব্ধির জন্য যখন দেহকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে অর্থাৎ সে যখন জ্ঞানের জন্য দেহের চক্ষু কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে গ্রহণ করে তখন সে নিজেও পরিবর্তনের রাজ্যে নেমে যেতে বাধ্য হয়? কেননা দেহের মাধ্যমে উপলব্ধির অর্থই হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি। এই পরিবর্তনের রাজ্যে সে লক্ষ্যহীন হয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়; বিশ্বজগৎ তার চারদিক বন বন করে আবর্তিত হতে থাকে; পরিবর্তনের স্পর্শে আত্মা তখন সুরাপায়ীর ন্যায়ই মত্ত। আমার এ বর্ণনা কি সত্য নয়?

খুবই সত্য, সক্রেটিস।

কিন্তু আত্মা যখন নিজের মধ্যে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে তখন সে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যায়। আমার এই সময়েই সে অমরতা, নিত্যতা, অপরিবর্তনীয়তা, বিশুদ্ধতা প্রভৃতি সব কিছুর আধার পরলোকে গমন করে। এ জগই তার আপনার জগৎ; এখনকার নিত্যতা, অপরিবর্তনীয়তা, বিশুদ্ধতাই হচ্ছে তার সগোত্র। এখন থেকে এ জগতেই তার বিঘ্নহীন বাস; এখন আর তার ভ্রান্তি নেই; নিত্যর সঙ্গে মিলনে এখন নিজেও সে নিত্যসত্তা, অপরিবর্তনীয় অস্তিত্ব। আত্মার এই অবস্থাকেই কি আমরা জ্ঞান বলে অভিহিত করিনে?

সক্রেটিস, তোমার একথা সত্য। শুধু সত্য নয়, তুমি কথাটিকে প্রকাশও করেছ খুবই চমৎকারভাবে।

তা হলে আমাদের আগের কথা এবং বর্তমানের যুক্তি থেকে আত্মা কোনো প্রকার অস্তিত্বের সঙ্গে অধিক সাদৃশ্য বহন করে বলে আমরা অনুমান করতে পারি?

সক্রেটিস, আমার মনে হয় যে, যারা যুক্তির এই ধারাটি লক্ষ করবে তারা এই মতই পোষণ করবে যে অপরিবর্তনীয় অস্তিত্বের সঙ্গেই সর্বাধিক সাদৃশ্য বহন করে। অতি মুখের পক্ষেও একথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

আর দেহ পরিবর্তনশীলেরই সাদৃশ্য বহন করে?

হ্যাঁ।

একথা স্বীকৃত হলেও, এস, আমরা বিষয়টিকে আর একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখি : আত্মা এবং দেহ মন যখন পরস্পর সংযুক্ত হয় তখন প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী আত্মা শাসক এবং দেহ শাসিতের ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই নয় কি? কিন্তু এই দুই ভূমিকার মধ্যে কোন ভূমিকাকে তুমি ঐশ্বরিক এবং কোনটিকে মানবিক বলবে? দুয়ের মধ্যে যে স্বাভাবিকভাবে হুকুম করে এবং শাসন করে তার ভূমিকাই অবশ্য তোমার নিকট অধিকতর ঐশ্বরিক এবং যে হুকুম শোনে এবং আজ্ঞা মানে তাকে অধিকতররূপে মানবিক বলে বোধ হবে?

অবশ্যই।

কিন্তু আত্মার সাদৃশ্য কার সঙ্গে?

আত্মার সাদৃশ্য বিধাতার সঙ্গে আর দেহের সাদৃশ্য নশ্বরের সঙ্গে–এ সম্পর্কে আর সন্দেহ কি সক্রেটিস?

তা হলে, সিবিস, এবার চিন্তা করে দেখ, আমরা যা বলেছি তার সিদ্ধান্তই কি এই দাঁড়ায় না যে : আত্মা অবশ্যই ঐশ্বরিক, আত্মা অমর, সে বুদ্ধিময় এবং সংগতিপূর্ণ, সে অ-দ্রাব্য এবং অপরিবর্তনীয়; অপরদিকে দেহ হচ্ছে মানবিক, সে মর এবং মূর্খ, সে। বহুরূপী, সে দ্রাব্য এবং পরিবর্তনীয়। প্রিয় সিবিস, এ সিদ্ধান্তকে কি অস্বীকার করা যায়?

না, একে অস্বীকার করা যায় না।

এ সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয় তা হলে দেহের দ্রুত লয় প্রাপ্তির এবং আত্মার আদৌ লয় পাওয়ার সম্ভাবনাই কি অধিক নয়?

অবশ্যই।

তা ছাড়া আবার দেখ : মানুষের মৃত্যুর পর তার দেহ অর্থাৎ মানুষের দৃশ্য অংশ এই জগতেই থেকে যায়; আমরা দেহের এই অবস্থাকে বলি শব। এ শব অবশ্যই পচে যায়, গলে যায়। তবু একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, মৃত্যুমাত্রই দেহ পচে যায় না। পচন ব্যতীত দেহ বেশ কিছুকাল থাকতে পারে। দেহের গঠন দৃঢ় হলে এবং মৌসুম উপযুক্ত হলে দেহ দীর্ঘকালই অবিকৃত থাকতে পারে। আবার মিসরীয়দের কৌশলে দেহকে সুগন্ধী ঔষধাদি দ্বারা রক্ষা করলে দেহ শুষ্ক হয়ে কিন্তু ক্ষয়প্রাপ্ত না হয়ে সংখ্যাহীন যুগব্যাপীও থাকতে পারে। এমনকি সাধারণ অবস্থায় ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও অস্থি গ্রন্থি প্রভৃতি দেহের এমন কতকগুলি অংশ আছে যাকে প্রায় অক্ষয় বলা চলে। তুমি কি একথা স্বীকার কর?

হ্যাঁ, আমি একথা স্বীকার করি।

তা হলে এরূপ কি সম্ভব যে, মানুষের যে-আত্মা অদৃশ্য এবং যার গমন হচ্ছে হেডিসের* সেই পবিত্র রাজ্যে, যে-রাজ্যের রাজা নিজে অদৃশ্য, মহৎ এবং পবিত্র, সেই আত্মা মানুষের প্রচলিত ধারণানুসারে দেহ ত্যাগ করে শুভ এবং মঙ্গলের রাজ্যে যাত্রার মুহূর্তেই দমকা হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাবে? প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস। না, এরূপ কখনো হতে পারে না। এর চেয়ে বরঞ্চ সত্য হচ্ছে এই যে, আত্মা পবিত্র; দেহত্যাগের সময়েও সে পবিত্র : দেহের কোনো কলঙ্ক তাকে মিলন করতে পারে নি, কেননা জীবনকালে দেহের সঙ্গে স্বেচ্ছায় সে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় নি; বস্তুত দেহকে সে সর্বদা পরিহার করেই চলতে চেয়েছে; সে চেয়েছে দেহবিমুক্ত হয়ে আপন স্বাধীন অস্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে : দেহ থেকে এই মুক্তির প্রয়াসকেই সে তার আপনজীবনের সাধনা করেছে। অর্থাৎ আত্মাই দর্শনের যথার্থ অনুসারী হতে পেরেছে এবং এজন্যই সে নিয়ত মৃত্যুর প্রচেষ্টাতে নিরত রয়েছে। কারণ, আমরা তো দেখেছি, মৃত্যুর ধ্যানই হচ্ছে দর্শন।

[* হেডিস : পাতাললোক, যেখানে মৃতের অবস্থান ঘটে। ইলিশিয়াস এবং টারটারাস নিয়ে হেডিসের গঠন।]

অবশ্যই।

এই আত্মা, যে নিজে অদৃশ্য সে দেহত্যাগ করে যাত্রা করে অদৃশ্য অমর এবং অমৃতলোকেরই উদ্দেশে। আর সে রাজ্যে যখন সে উপনীত হয় তখন সে পরম সুখে সুখী। মানবিক মূর্খতা, ভ্রান্তি, ভীতি আর বলগাহীন কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে সে এখন দেবলোকের অমর অধিবাসী। একথা কি ঠিক নয়, সিবিস?

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, সক্রেটিস।

.

কিন্তু তা হলেও যে-আত্মা দূষিত হয়েছে, তার যাত্রা শুরুতেই অপবিত্র, যে-আত্মা দেহের দাস হিসাবে রয়েছে, তাকে সঙ্গদান করেছে, তাকে ভালবেসেছে, দেহের ভোগবিলাসে মোহমুগ্ধ হতে হতে এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছে যে, দেহের মধ্যেই মাত্র সত্যের অস্তিত্ব কেননা লালসার তৃপ্তি হতে দেহ শ্রবণ, দর্শন এবং আস্বাদনযোগ্য।–অর্থাৎ যে-আত্মা দ্বেষ ও ভয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আর যুক্তি বা মননের নীতিকে পরিহার করে চলতে শুরু করেছে, কেননা, দেহের চোখে যুক্তি অন্ধকার আর অদৃশ্য, দার্শনিক সাধনাতেই সে কেবল আয়ত্তযোগ্য, আমার প্রশ্ন হচ্ছে তুমি কি মনে কর এমন আত্মার পক্ষে সেই আনন্দলোকের উদ্দেশে পবিত্র আর বিশুদ্ধ আকারে যাত্রা শুরু করা আদৌ সম্ভব?

তা তো একেবারেই অসম্ভব।

কেননা, দীর্ঘকালব্যাপী ধারাবাহিক দৈহিক সাহচর্য এবং পরিচর্যা তাকে দেহের শিকলে শক্ত করেই বেঁধে ফেলেছে।

খুবই সত্য কথা।

আর দেহের যে শিকলের কথা আমরা বলছি তার ভার কম নয়। সে ওজনে যেমন ভারী ও গুরু তেমনি সে স্কুল; তার বড় ইন্দ্রিয় চক্ষু। তার চক্ষু দ্বারা সে আত্মাকে বিভ্রান্ত করে দৃশ্য জগতের গহ্বরে টেনে নামিয়ে আনে; সে আত্মার মধ্যে অদৃশ্য এবং পাতালজগৎ সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার করে; তার সম্মুখে সে সমাধিক্ষেত্রের স্তম্ভ এবং কবরের চতুর্দিকে বিচরণকারী দূষিত অভিশপ্ত আত্মার প্রতিচ্ছায়ার চিত্র তুলে ধরে।

এ তো খুবই সম্ভব, সক্রেটিস।

অভিশপ্ত আত্মার কথা বলছ? হা, সিবিস এদের ভাগ্য এরূপ হওয়া খুবই সম্ভব। কেননা, দূষিত এই আত্মা কোনো সৎ ব্যক্তির আত্মা হতে পারে না। এ আত্মা হচ্ছে অসৎ ব্যক্তির আত্মা। তাদের পূর্ব জীবনের পাপের মূল্য দেওয়ার জন্য অভিশপ্ত হয়ে তারা এই সমস্ত স্থানে বিচরণ করে। দেহের বাসনা তখনো তারা পরিত্যাগ করে নি। সেই দেহের বাসনায় উদ্ভ্রান্তভাবে বিচরণ করতে করতে তারা পুনরায় দেহের বন্দিশালায় নিজেদের বন্দি করে ফেলে; হয়তো তাদের দেহের এই দ্বিতীয় বন্দিশালা প্রথম বন্দিশালার ন্যায় একই চরিত্রসম্পন্ন, একই তাদের ক্রীড়া-কৌশল।

একই চরিত্র বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ সক্রেটিস?

আমি বলতে চাচ্ছি, যে-মানুষ জীবনে নিজের লোভকেই কেবল অনুসরণ করেছে, যে। ঔদরিক, যথেচ্ছাচারী আর মদ্যপের জীবনযাপন করেছে, যে কখনো এই সমস্ত চরিত্রকে পরিহার করার চেষ্টা করে নি তার আত্মা অবশ্যই গর্দভ কিংবা অনুরূপ অপর কোনো জন্তুর দেহে নূতনভাবে প্রবেশ লাভ করবে। এ সম্পর্কে তোমার কি মনে হয়?

তোমার এ অভিমতটিকে আমার খুবই সম্ভব বলে বোধ হচ্ছে।

আর যারা অবিচার, স্বৈরাচার এবং জবরদস্তির পথ গ্রহণ করেছে তারা নিশ্চয়ই নেকড়ে, শকুন কিংবা বাজপাখির দেহে প্রবেশ করে। এরকম যাদের চরিত্র তাদের আত্মা আর কোথায় গিয়ে আশ্রয় পেতে পারে?

অবশ্যই, এরূপ স্বভাবের আত্মা নিঃসন্দেহে এরূপ জীবজন্তুর অভ্যন্তরেই প্রবেশ করবে।

এভাবে যার যেরূপ প্রকৃতি এবং আসক্তি তার জন্য সেরূপ আশ্রয়দেহ নির্দিষ্ট করে দেওয়া মোটেই শক্ত নয়।

না, তা মোটেই শক্ত নয়।

এদের মধ্যে নূতন বন্দিনিবাসে একজন অপরজনের চাইতে আনন্দবোধ করতে পারে। তবে সবেচেয় সুখী হচ্ছে তারাই যারা দর্শনের সাধনা ব্যতিরেকে চর্চা এবং মনোযোগের সাহায্যে সংযম এবং ন্যায়ের মতো রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক গুণ অর্জন করেছে।

কিন্তু কী জন্য তারাই সবচেয়ে সুখী?

কেননা জন্মান্তরে তারা তাদের চরিত্রানুরূপ ভদ্র শান্ত মৌমাছি, বোলতা কিংবা পিপীলিকার দেহ লাভ করতে পারে কিংবা সেখান থেকে পুনরায় মানবজন্মে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। এরূপভাবে এদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ণ এবং মিতাচারী মানুষেরও উদ্ভব ঘটতে পারে।

হ্যাঁ, সেরূপ হওয়া খুবই সম্ভব।

কিন্তু যে-ব্যক্তি দর্শন অধ্যয়ন করে নি, যার আত্মা দেহ থেকে সম্পূর্ণরূপে পূত পবিত্ররূপে যাত্রা শুরু করতে পারল না, তার পক্ষে দেবগণের সঙ্গ লাভ কখনো সম্ভব হবে না। বস্তুত একমাত্র জ্ঞানের প্রেমিকই স্বর্গে প্রবেশের অধিকার লাভ করতে সক্ষম হবে। প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস, আমি এ জন্যই বলেছি যে, দর্শনের যারা সত্যকার সেবক তাঁরা দেহজ সর্বপ্রকার কামনা বাসনাকে পরিহার করে চলেন; তারা দৈহিক লোভলালসার বিরুদ্ধে স্থির থাকেন; তারা কখনো তাদের দাসত্ব স্বীকার করেন না। তাদের এই সংযমের কারণ এই নয় যে, তারা সাধারণ জগত্বাসী কিংবা অর্থপ্রেমিকদের ন্যায় কিংবা শক্তি ও সম্মানের উপাসকদের ন্যায় দারিদ্র্য কিংবা তাদের পরিবার পরিজনদের ধ্বংসকে ভয় করেন। দৈহিক লোভলালসার ক্ষেত্রে তারা সংযমী, কেননা তারা অন্যায়াচরণের অসম্মান এবং অমর্যাদাকে ভয় করেন।

সক্রেটিস, একথা সত্য। যারা দর্শনের সেবক তাদের পক্ষে অন্যায়াচরণের অসম্মানকে বরণ করা সম্ভব নয়।

ঠিকই বলেছ সিবিস। তাদের পক্ষে এরূপ আচরণ সম্ভব নয়। এজন্যই যারা আত্মার চিন্তায় চিন্তিত, যারা কেবল দেহের বিলাস-ব্যসনে জীবন ব্যয় করেন না তারা বিলাসের সব আকর্ষণকেই বিদায় জানান; তাঁরা অন্ধের পথ এবং পাপের শিকল থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তুলে ধরে তখন তারা অনুভব করেন, দর্শনের এই দানকে অস্বীকার করা তাদের অনুচিত। তাই দর্শন যে পথের নির্দেশ তাদের দেয় তারা নির্দেশ অনুসরণ করেই অগ্রসর হন।

তুমি কি বুঝাতে চাইছ, সক্রেটিস?

আমি বুঝিয়ে বলছি। জ্ঞানের যারা প্রেমিক তাঁরা জানেন যে, দর্শন তাদেরকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তাদের আত্মা দেহের শিকলে আবদ্ধ ছিল। এমন অবস্থায় আত্মা তার বন্দিশালার গরাদের মধ্য দিয়েই মাত্র পরম সত্তার আভাস পেত, তাকে নিজে প্রত্যক্ষ করতে পারত না। কেননা সে তখন অজ্ঞানতার তিমিরে নিমজ্জিত; আর লালসার জালে ধরা দিয়ে সে আপন বন্দিরে পথকে নিজেই প্রশস্ত করে দিয়েছে, নিজের বন্দিত্বের সহায়ক হয়েছে। এই ছিল দেহের বন্দিনিগড় হতে মুক্তির পূর্বে আত্মার অবস্থা। এর পরে আত্মার মুক্তি কী করে সম্ভব হলো সে কথা জ্ঞানপ্রেমিকগণ অবশ্যই জ্ঞাত আছেন। দর্শন আত্মার বন্দিত্বের এই নিদারুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সহানুভূতির সঙ্গে তাকে সান্ত্বনা প্রদান করে তাকে নিজের তৈরি বন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিদানের আশ্বাস দিয়ে বলল; ‘তোমার চক্ষু-কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়কে তুমি বিশ্বাস করো না, তুমি ওদের মোহজাল থেকে বেরিয়ে এস; নিজের জ্ঞানের জন্য ওদের উপর নির্ভর করা থেকে তুমি নিবৃত্ত হও, কেননা ও প্রতারক; তুমি নিজের পবিত্র সত্তার মধ্যে আত্মস্থ হও, নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর; তোমার আপন বিশুদ্ধ উপলব্ধিই তোমার জ্ঞান; অন্য উপায়ে লব্ধ ভাবকে তুমি জ্ঞান বলে বিশ্বাস কর না–কেননা ওরা দৃশ্য, ওরা স্পৃশ্য আর তোমার আপন সত্তার উপলব্ধি অদৃশ্য অস্পৃশ্য। প্রকৃত দার্শনিকের আত্মা মুক্তির এই সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে উপলব্ধি করে, এই মুক্তিকে প্রতিরোধ করা তার অনুচিত। এজন্য সে সমস্ত আনন্দ, উপভোগ, বেদনা, ভীতি থেকে নিজেকে সাধ্যমতো নিবৃত্ত রাখতে সচেষ্ট হয়। আত্মা উপলব্ধি করতে থাকে যে, মানুষ তার বৃহৎ আনন্দ কিংবা দুঃখ, ভয় অথবা বাসনার মধ্য দিয়ে কেবল যে এদের পায়ে উৎসর্গীকৃত হয়ে তার স্বাস্থ্য বা সম্পদের ক্ষতিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই নয়; এসবের জন্য সব ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি, সব পাপের চেয়ে বড় পাপ,–যে পাপ এবং ক্ষতি তার চিন্তারও অতীত ছিল সে পাপ এবং ক্ষতিকেই সে প্রাপ্ত হয়।

কি সে চরম ক্ষতি সক্রেটিস?

সে ক্ষতি হচ্ছে এই যে, মানুষের আত্মা যখন তীব্র কোনো আনন্দ কিংবা বেদনাকে সুনভব করে তখন তীব্রতার জন্য তাকেই সবচেয়ে সত্য বলে বিবেচনা করে। অথচ . আসলে এ অনুমান তার সঠিক নয়; সে যে অনুভূতি বোধ করে তা ভ্রান্ত, তা দৃশ্যবস্তু থেকেই জাত।

এ তো খুবই সত্য কথা।

কিন্তু এও কি সত্য নয় যে, এই অবস্থাতেই দেহ আত্মাকে চরম পুলক দান করে?

কী করে?

কেননা প্রত্যেকটি আনন্দ কিংবা বেদনা হচ্ছে এক একটি পেরেক বিশেষ। এই পেরেক দ্বারা দেহ আত্মাকে নিজের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে শক্ত করে গেঁথে ফেলে। ফলে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, আত্মাও দেহের পর্যায়েই নেমে আসে। তখন দেহ তাকে যা সত্য বলে বোধ করায় আত্মা তাকেই সত্য বলে অনুভব করে; দেহের মর্জিকে এভাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে এবং দেহের আনন্দকে উপভোগ করার ফলে আত্মার মধ্যে দেহের আচার আচরণ, স্পৃহাই প্রকাশ পেতে থাকে; দেহ তার সব স্বভাব নিয়েই তাকে সংক্রমিত করে ফেলে; এখন আর পবিত্র সত্তা নিয়ে তার অমর পাতালজগতে যাত্রা করা সম্ভব নয়; সে কেবল দেহান্তরে গমন করে আর সেখানেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সমস্ত কারণে দূষিত আত্মার পক্ষে স্রষ্টার দিদার লাভ কিংবা সারল্য বা পবিত্রের সাক্ষাৎ লাভ সম্ভব নয়।

সিবিস বললেন : একথা তো খুবই সত্য সক্রেটিস।

আর তাই, সাধারণ মানুষ যেজন্য মনে করে সেজন্য নয়; বরঞ্চ আত্মার যে চরম অনিষ্টের উল্লেখ আমরা করেছি তার আশঙ্কাতেই জ্ঞানের যারা প্রেমিক তারা সংযমী এবং সাহসী হন।

হ্যাঁ, অবশ্যই তারা সাধারণ মানুষের কল্পিত কারণের জন্য সাহসী কিংবা সংযমী হন না।

নিশ্চয়ই সেজন্য হন না?। কেননা দার্শনিকের আত্মার বিবেচনা হবে অন্যরূপ। তাঁর আত্মা দার্শনিককে বলবে না, তুমি আমাকে দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি দাও যেন আমি পুনরায় ভোগ-উপভোগের আনন্দবেদনার নিকট নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারি পেনিলোপের* ন্যায় গ্রন্থিমোচনের পরিবর্তে জটিল কারণের জন্য সে দার্শনিকের নিকট দেহের বন্ধন থেকে নিজের মুক্তি কামনা করবে না। তার আত্মা বাসনাকে শান্ত করে যুক্তির পথ অনুসরণ করে যা সত্য এবং ঐশ্বরিক, যা শুধু সাধারণের মুখের কথা নয়, তার ধ্যানে নিজেকে নিযুক্ত করবে, সেই ধ্যান থেকেই আপন জীবন-রস সে সংগ্রহ করবে। এভাবেই দেহের মধ্যেও সে বাঁচার চেষ্টা করবে, মৃত্যুর পরে সে মানবিক উপসর্গসমূহ থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র আত্মাজনদের নিকটই ফিরে যেতে চাইবে। কাজে কাজেই প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস, এমন আশঙ্কা তোমরা পোষণ কর না যে, এই আত্মা অর্থাৎ যে-আত্মা এমনি করে বর্ধিত হয়েছে, তার জীবন-রস সংগ্রহ করেছে এবং এরূপ জীবনযাপন করেছে সে-আত্মা দেহ বিমুক্ত হয়ে যাত্রার মুহূর্তে দমকা হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাবে, এবং কোথাও তার স্থিতি ঘটবে না, কোনো অস্তিত্ব সে গ্রহণ করতে পারবে না এবং সে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে।

[* গ্রিক কবি হোমারের ইউলিসিস-পত্নী পেনিলোপ ইউলিসিসের প্রবাস-অভিযানকালে সময়ক্ষেপণের জন্য দিনের বেলা বয়ন করা বস্ত্রের সূতা ও গ্রন্থি রাত্রিবেলা খলে ফেলতেন–যেন আবার তাকে বয়ন করা যায়।]

সক্রেটিস এস্থলে কথা বলা যখন বন্ধ করলেন, তখন অনেকক্ষণ পর্যন্ত কক্ষের মধ্যে একটা নীরবতা বিরাজ করতে লাগল; মনে হলো সক্রেটিস যেন এ পর্যন্ত যা বলেছেন সে সম্পর্কেই তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে গেছেন। আমাদের মধ্যেও অধিকাংশই তখন সক্রেটিসের বক্তৃতার বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম। কেবল সিবিস এবং সিমিয়াস নিজেদের মধ্যে দু একটি কথার বিনিময় করছিলেন। সক্রেটিস তাদের লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর যুক্তি সম্পর্কে তাদের অভিমত কী? তিনি বললেন : আমাদের বক্তব্যের মধ্যে এখনও এমন অনেক বিষয় রয়ে গেছে যারা সন্দেহ এবং আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে। তোমরা যদি আমাদের আলোচ্য বিষয় ব্যতীত অপর কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাক তা হলে আর আমি উত্থাপন করছিনে। কিন্তু তোমরা যদি আমার যুক্তি সম্পর্কে এখনো মনে কোনো সন্দেহ পোষণ কর তা হলে সে সন্দেহকে প্রকাশ করতে সঙ্কোচ করো না এবং আমাদের আলোচিত বিষয় সম্পর্কে যদি তোমাদের নতুন কোনো বক্তব্য থাকে তা হলে সে-কথাও তোমরা প্রকাশ করে বল। তা নিয়ে আবার আমরা আলোচনা করতে পারি। আমি যদি সে আলোচনার কোনো সাহায্য করতে পারি তা হলে তোমরা আমাকেও তোমাদের সে আলোচনায় শরিক করে নিও।

সক্রেটিসের একথায় সিমিয়াস বললেন : আমি স্বীকার করছি সক্রেটিস, আমাদের মনে কিছু কিছু সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি প্রশ্নের জবাব আমাদের প্রয়োজন। আমরা একে অপরকে এজন্য তাগিদ দিচ্ছিলাম যেন সে তোমার নিকট আমাদের প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু আমাদের সকলেরই সঙ্কোচ হচ্ছিল পাছে এই মুহূর্তে আমাদের প্রশ্ন। তোমার জন্য কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে।

সিমিয়াসের একথা শুনে সক্রেটিস স্মিতমুখে জবাব দিলেন : প্রিয় সিমিয়াস! আমার সম্পর্কে এ তুমি কি বলছ? আমি যদি তোমাদেরই বুঝতে না পারি যে, জীবনের অপর কোনো মুহূর্তের চাইতে বর্তমান মুহূর্ত আমার জন্য কোনো প্রকারেই কষ্টকর নয়, তা হলে অপর লোকদের আমি কি করে বুঝাতে সক্ষম হব যে, আমার বর্তমান ভাগ্যকে আমি মোটেই দুঃখজনক বলে বোধ করিনে? বলাকাদের ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা আছে বলে তোমরা জানো। তারা যখন বুঝতে পারে মৃত্যু তাদের আসন্ন তখন তারা সবচেয়ে আনন্দের সঙ্গে সংগীত-ধ্বনি প্রকাশ করতে থাকে। কেননা স্বর্গলোকের তারা দূত। সেই স্বর্গলোকে প্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত তাদের আসন্ন, একথা অনুভব করে আনন্দে তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ নিজে মৃত্যুভয়ে ভীত। তাই বলাকার বিরুদ্ধে অপবাদের ভঙ্গিতে তারা বলে যে, বলাকারা সংগীত ধ্বনিতে নয়–বরঞ্চ ভয়ের আর্তধ্বনিতেই ফেটে পড়ে। অথচ মানুষ একথা ভুলে যায় যে, কেবল বলাকা নয়, বুলবুল, দোয়েল কিংবা হুপো যার উল্লেখই কর না কেন, কোনো পাখিই ভয়ে কিংবা ক্ষুধায় অথবা বেদনার মধ্যে কোনো সুমধুর ধ্বনি প্রকাশ করে না। হুপোর কথা বলছি। হুপোর স্বাভাবিক সুর নাকি বিষাদের সুর। কিন্তু হুপো পাখিও কোনো প্রতিকূল অবস্থায় তার সে ধ্বনি প্রকাশ করে না। বলাকার বিরুদ্ধে অপবাদকে আমি বিশ্বাস করিনে–যেমন করিনে অন্যান্য পাখিদের সম্পর্কেও। আমি বিশ্বাস করি, এ্যাপোলোর প্রিয় এবং পবিত্র সঙ্গী এরা। কাজেই ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা তাদের নিশ্চয়ই রয়েছে। তারা অনুভব করতে পারে অমর জগতে যাত্রা তাদের আসন্ন। তাই তারা জীবনের অপর যে-কোনো দিনের চেয়ে অধিক আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আমি নিজের সম্পর্কে এটুকু বিশ্বাস করি যে, আমি বিধির পায়ে উৎসর্গীকৃত সেবক, বলাকার আমি দোসর। বিধাতার নিকট থেকে আমিও লাভ করেছি ভবিষ্যদ্বাণীর কিছু ক্ষমতা। সে ক্ষমতা বলাকাদের ক্ষমতার চেয়ে কম নয়। তোমরা কি এটুকু স্বীকার করবে না যে, বলাকার ভবিষ্যদ্বাণীর যে ক্ষমতা আছে আমার অন্তত সেটুকু ক্ষমতা রয়েছে? কাজেই বন্ধু সিমিয়াস, এই মুহূর্তে প্রশ্ন করা সম্পর্কে এই যদি হয় তোমার আপত্তি তা হলে আমি বলব, এ আপত্তিকে তুমি উপেক্ষা করে এথেন্সের দ্বাদশ বিচারক যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অনুমতি দেন ততক্ষণ আমার নিকট যে-কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা কর না।

সিমিয়াস বললেন : খুবই উত্তম কথা সক্রেটিস। তোমার আশ্বাস পেয়েছি, এবার আমি আমার সমস্যার কথা তোমার নিকট খুলে বলছি। সিবিসও তার নিজের কথা তোমার কাছে বলবেন। একটা বিষয়ে তুমি নিজেও নিশ্চয় একমত হবে সক্রেটিস যে, আমাদের বর্তমানের আলোচিত প্রশ্নগুলো এরূপ যে এ সম্পর্কে আমাদের জীবনকালে কোনো নিশ্চিত জবাব পাওয়া খুবই দুষ্কর, বলতে পারি প্রায় অসম্ভব। তথাপি কোনো সমস্যা যদি আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয় তা হলে তার সর্বাধিক প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকাও কাপুরুষতা বই আর কিছু নয়। উদ্ভূত সমস্যাকে সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করতে গিয়ে যার হৃদয় কেঁপে ওঠে সে অবশ্যই কাপুরুষ। কেননা, প্রশ্ন যার সম্মুখে উপস্থিত করা হলো তাকে অবশ্যই হয় সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, তার প্রমাণ হাজির করতে হবে; নতুবা যে প্রমাণ তার নিকট পেশ করা হয়েছে সঠিক বলে গ্রহণ করতে হবে। এ দুটো বিকল্পের চূড়ান্তরূপে কোনো একটিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে অবশ্যই অনুসন্ধান কার্যে রত থাকতে হবে। তা যদি তার পক্ষে সম্ভব না হয় তা হলে আমি বলব তার পক্ষে সব চাইতে উত্তম হবে প্রমাণের অতীত এক তত্ত্বকে গ্রহণ করা। এরূপ তত্ত্ব-তরী ভর করেই যেন সে জীবন-সমুদ্রে পাড়ি জমায়। বিধাতা সহায় হলে সে সফল হবে; না-হলে সে বিপন্ন হবে। এবার আমি আমার প্রশ্নটি উপস্থিত করতে চাই। তুমি যখন আদেশ করেছ তখন এ প্রশ্ন আমাকে অবশ্যই উত্থাপন করতে হবে। না-হলে পরবর্তীকালে উপযুক্ত সময়ে এ প্রশ্ন উত্থাপন না করার অপরাধেই আমি অপরাধী হব। কেননা আমাদের আলোচিত বিষয়টি নিয়ে যখন আমি একান্তে চিন্তা করি কিংবা সিবিসের সঙ্গে আলাপ করি, তখন মনে হয়, যেন আমাদের যুক্তি যথার্থরূপে প্রমাণিত হয় নি।

সক্রেটিস জবাব দিলেন : প্রিয় বন্ধু, আমার বলতে মোটেই আপত্তি নেই যে, তোমার বক্তব্যও সঠিক হতে পারে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, আমাদের যুক্তির অপূর্ণতা কোথায়?

সিমিয়াস বললেন : অপূর্ণার কথা উদাহরণ দিয়ে বলছি। মনে কর এক ব্যক্তি তোমার বীণা এবং তার সংগতির যুক্তি দিয়েই বলল : বীণার তারে যে সংগত সৃষ্ট হয় সে সংগত অদৃশ্য, সে বিদেহী, সে স্বর্গীয় এবং সম্পূর্ণ। তার অস্তিত্ব অবশ্যই বীণার তারে। বীণার তার কিন্তু জড় পদার্থ; সে জাগতিক, সে মিশ্র এবং মরণশীল। এবার যদি কেউ বীণাখানিকে ভেঙে ফেলে তা হলে তোমার ন্যায় সেও একই উপমা দিয়ে বলতে পারে, বীণা নষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু তারের সংগতি অক্ষয় হয়ে আছে। এক্ষেত্রে তারও যুক্তি হচ্ছে এই : এমন তো কল্পনা করা চলে না যে মরণশীল বীণা আর তার তন্ত্রীগুলো ভগ্ন অবস্থায়ও অস্তিত্বশীল থাকতে পারে কিন্তু অজর, অমর এবং স্বর্গীয় সংগতি ভগ্ন বীণাকে অতিক্রম করে আপন অস্তিত্ব অক্ষয় করে রাখতে পারে না। কেবল তাই নয়, মরণশীল জড় বীণার মৃত্যুর পূর্বেই সংগতির তিরোধান করতে হবে–এরূপ কথা কল্পনা করা চলে না। কাজে কাজেই বীণার পরেও থাকবে সংগতির অস্তিত্ব। বীণার কাষ্ঠখণ্ড এবং ধাতবতন্ত্রী একদিন ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, কিন্তু সংগতির ক্ষয়কে চিন্তা করা চলে না। সংগতি অক্ষয়। সক্রেটিস, তুমি নিজেও নিশ্চয় স্বীকার করবে যে, আত্মা সম্পর্কে আমাদের যুক্তিটি এই উপমার যুক্তিরই সদৃশ। আমাদের দেহ হচ্ছে যৌগিক দ্রব্য : তাপ এবং শৈত্য, আর্দ্রতা এবং উষ্ণতা প্রভৃতি পঞ্চভূতের মিশ্রণেই আমাদের দেহের উৎপত্তি এবং অস্তিত্ব : আত্মা হচ্ছে এই পঞ্চভূতের উপযুক্ত অনুপাতে সংমিশ্রণ সঞ্জাত সংগতি। কিন্তু আত্মার ব্যাপারে আমাদের এই ধারণা যদি সঠিক হয়, তা হলে আবার একথাও কেউ বলতে পারে যে, রোগ, আঘাত কিংবা অপর কোনো কারণে আমদের দেহ-বীণার তারগুলো যদি শিথিল হয়ে যায় কিংবা হয়ে যায় অত্যধিক কঠিন তা হলে আমাদের আত্মা যতই স্বর্গীয় হোক না কেন, সংগীত এবং অপরাপর সুকুমার শিল্পের ন্যায় তারও সঙ্গে মৃত্যু ঘটবে। বরঞ্চ বলা চলে আত্মার মৃত্যু অতিক্রম করে মরণশীল দেহ, পচনক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত কিংবা তাকে ভস্মীভূত না করা পর্যন্ত বেশ কিছুদিন অক্ষয় হয়ে থাকতে সক্ষম হবে। কাজেই সক্রেটিস, এমনভাবে কেউ যদি বলে যে, দেহের পঞ্চভূতের সঠিক সংমিশ্রণ সঞ্জাত আত্মার বিনাশই আগে ঘটবে; যাকে আমরা মৃত্যু বলি সেই মৃত্যুর মধ্যেই দেহের পূর্বেই তার লোপ ঘটবে, তা হলে আমরা কি জবাব দিতে সক্ষম হব?

সিমিয়াসের প্রশ্ন শুনে সক্রেটিস তার বিশিষ্ট ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ আমাদের সকলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তারপর স্মিত মুখে বললেন : সিমিয়াসের কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে। কিন্তু আমি বলি আমার চেয়ে জোরদার যারা তোমরা রয়েছে তাদের মধ্যেই কেউ তাকে জবাব দাও না কেন? কেননা আমার উপর যে আক্রমণের ফলা সে নিক্ষেপ করেছে তাতে অবশ্যই যথেষ্ট জোর আছে। কিন্তু তারও পূর্বে এস আমরা সিবিসের বক্তব্যটি শুনে নিই। এই শোনার অবসরে সিমিয়াসের উপযুক্ত জবাবটি নিয়েও আমরা চিন্তা করতে পারব। তারপর সিবিসের কথা শুনে যদি আমরা দেখি, তারা উভয়েই যুক্তিতে যথার্থ তা হলে আমরা তাদেরকেই মেনে নেব; না হলে যে যুক্তি আমরা পেশ করেছি তাতেই আমরা দৃঢ় থাকব। কাজেই এবার বরঞ্চ সিবিস, তুমি আমাদের খুলে বল আমাদের যুক্তির কোন বিষয়টি তোমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে?

সিবিস বললেন : বেশ, আমিও বলছি। আমার মনে হয় যুক্তির ক্ষেত্রে আমরা পূর্বেও যেখানে ছিলাম এখনো সেখানেই রয়েছি এবং পূর্বেও এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে যে যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছে সে যুক্তির জবাব এখন পর্যন্ত আমরা দিতে সক্ষম হই নি। একথা আমি স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি যে, দেহের মধ্যে অনুপ্রবেশের পূর্বে আত্মার অস্তিত্ব থাকে–এ প্রতিপাদ্য যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গেই প্রমাণিত হয়েছে; কিন্তু দেহের মৃত্যুর পরেও যে আত্মা অস্তিত্বময় থাকবে, আমাদের এ দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য এখনো উপযুক্তরূপে প্রমাণিত হয় নি। কিন্তু এ সম্পর্কে সিমিয়াসের আপত্তি এবং আমার আপত্তি এক নয়। কেননা আমি একথা অস্বীকার করিনে যে, আত্মা দেহের চেয়ে যেমন অধিক শক্তিশালী তেমনি অধিককাল স্থায়ী। উভয় ক্ষেত্রে দেহের চেয়ে আত্মার উৎকর্ষ অনেক বেশি। যুক্তি অবশ্য আমাকে এখানে প্রশ্ন করতে পারে : তা হলে সিবিস, তুমি এখনো কেন দ্বিতীয় প্রতিপাদ্যকেও বিশ্বাস করতে পারছ না? তুমি যখন দেখতে পাচ্ছ যে মানুষের মৃত্যুর পরেও অনেক দিন পর্যন্ত আত্মার চেয়ে দুর্বল যে দেহ, তারও অস্তিত্ব টিকে থাকে, তখন যে-আত্মা অধিক শক্তিশালী এবং স্থায়ী, দেহের মৃত্যুর পরে তারও কি অস্তিত্বময় থাকা অধিক স্বাভাবিক নয়? কিন্তু এর জবাবে আমি সিমিয়াসের ন্যায় একটা উপমা উপস্থিত করব। তুমি বিচার করে দেখ আমার এই উপমাটি যুক্তিযুক্ত কিনা। আমার উপমাটি হচ্ছে একজন বৃদ্ধ তন্ত্রশিল্পীর। তন্ত্রশিল্পী মারা গেল। কিন্তু কোনো একজন বলে উঠল : না, আমাদের তন্ত্রশিল্পী মরে নি। ঐ দেখ, সে যে কোটখানিকে তৈরি করেছে, যাকে সে নিজের শরীরে ধারণ করেছে সে এখনো পূর্ণ অবয়বে অক্ষত রয়েছে। তোমরা কি বলতে চাও যে, মানুষটার চেয়ে তার কোটটার শক্তি বেশি এবং মানুষটার চেয়ে তার পরিহিত এবং ব্যবহৃত কোটের জীবনই অধিক স্থায়ী তার এ প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই জবাব দিতে হয় : মানুষ নিশ্চয়ই তার একটি কোটের চেয়ে অধিক স্থায়ী? এ জবাব পেয়ে সে মনে করে যে অল্প স্থায়ী কোটের দৃষ্টান্ত দ্বারা সে অধিক স্থায়ী মানুষের অস্তিত্ব তার মৃত্যুর পরেও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সিমিয়াস, আমার বিবেচনায় সে ভ্রান্ত। কেননা, যে কেউই বুঝতে পারবে, এরূপ যুক্তি তোলা মূর্খতারই শামিল। বস্তুত এক্ষেত্রে ব্যাপারটি হচ্ছে এই যে, তন্তুবায় অবশ্যই জীবনে অনেক কোট তৈরি করেছে, অনেক কোট সে ব্যবহার করেছে এবং অনেক কোটই তার ক্ষয় হয়েছে, এবং সে কোটগুলোকে অতিক্রম করে সে ‘অক্ষয় হয়েছিল। তবু তার শেষ কোটটি তাকেই অতিক্রম করে স্থায়ী হয়ে রয়েছে আর সে ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এতে একথা প্রমাণিত হয়ে যে, সেজন্য মানুষ একটি কোটের চেয়ে কম শক্তিশালী এবং কম স্থায়ী। দেহ হচ্ছে আত্মার গায়ের কোট স্বরূপ। কোটের ন্যায় আত্মাও একাধিক দেহকে একের পর এক পরিধান করে ক্ষয় করে ফেলতে পারে। আত্মার পরিহিত একটি দেহ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আত্মা তন্তুবায়ের ন্যায় আর একটি দেহকে ‘বয়ন করে নেয় কিংবা ক্ষয়প্রাপ্ত দেহকে মেরামত করে নেয়। কিন্তু আত্মারও মৃত্যু আছে। এবং যখন সে মৃত্যুবরণ করে তখন নিশ্চয়ই তার পরিহিত সর্বশেষ দেহটি পড়ে থাকে। কিন্তু কিছুকাল পরে আত্মার পরিত্যক্ত সে দেহে ক্ষয় শুরু হয়ে এবং সে দ্রুত পচে গলে বিনষ্ট হয়ে যায়। এ উপমার মধ্যে রয়েছে দেহ আর আত্মার শক্তির তারতম্যের প্রশ্ন। কিন্তু শুধু এ যুক্তির উপর নির্ভর করেই আমি একথা বলব না যে, আত্মা দেহের চাইতে অধিক শক্তিশালী; সুতরাং দেহকে অতিক্রম করে। দেহের মৃত্যুর পরেও আত্মা অস্তিত্বময় থাকবে। কেননা তোমার কথাকে যদি আমি তোমার চেয়েও বেশি করে গ্রহণ করি; যদি শুধু তোমার এ অভিমতকেই নয় যে, জন্মের পূর্বেও আত্মার অস্তিত্ব ছিল, বরঞ্চ যদি একথাও গ্রহণ করি যে, কোনো কোনো আত্মা মৃত্যুর পরেও অস্তিত্বময় থাকবে এবং তারা পর্যায়ক্রমে বহু জন্ম এবং মৃত্যুকেও বরণ করতে থাকবে, তা হলেও কি একথাও বলা চলে না যে, এই পরিক্রম শেষে এক সময়ে আত্মা প্রকৃত মৃত্যুই বরণ করবে এবং বিনষ্ট হয়ে যাবে? একথা অবশ্য সত্য যে, দেহের যে ক্ষয়ের প্রক্রিয়ার ফলে আত্মাও পরিশেষে বিনষ্ট হয়ে যায় তার জ্ঞান আমাদের অজ্ঞাত, কেননা, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। তা হলে আত্মা সম্পর্কে অতি নিশ্চিত হওয়া আমাদের পক্ষে মূর্খত বই আর কি হতে পারে? কেবল তখনই কারুর পক্ষে আত্মা সম্পর্কে এরূপ স্থির বিশ্বাসী হওয়া সম্ভব যখন সে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে যে, আত্মা নিশ্চিরূপেই অমর এবং বিনাশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আত্মার অমরতা যদি নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত না হয় তা হলে মৃত্যু যার আসন্ন তার মনে এরূপ আশঙ্কা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, তার দেহ যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তখন আত্মাও তার সম্পূর্ণরূপেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।

এ দুজনের অভিমত শুনে আমাদের তখন যে অবস্থা হয়েছিল তা নিয়ে পরবর্তী সময়েও আমরা আলাপ করেছি। বস্তুত এই দুটি অভিমত শুনে আমাদের সকলের মনে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হলো। কেননা, যখন আমরা পূর্ব যুক্তিতে দৃঢ় আস্থা পোষণ করতে শুরু করেছিলাম, তখন এরূপ প্রতি-যুক্তি উত্থাপন করে সিমিয়াস এবং সিবিস এ পর্যন্ত প্রদর্শিত যুক্তির উপরই যে আমাদের আস্থা টলিয়ে দেবার এবং মনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেন তাই নয়; ভবিষ্যতেও কোনো যুক্তিতে আমাদের আস্থা স্থাপন প্রায় অসম্ভব করে তুললেন। কেননা দেখা যাচ্ছে, হয় আমাদের আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই, নয়তো কোনো যুক্তিতে বিশ্বাস করার কোনো হেতু নেই।

একিক্রাটিস : ফিডো, তুমি আমারও মনের কথা প্রকাশ করেছ। তোমার বর্ণনা শুনে আমিও নিজেকে প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম : তা হলে অপর কোন যুক্তিতে আমি বিশ্বাস স্থাপন করতে সক্ষম হব? কেননা, সক্রেটিসের যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি আর কি হতে পারে? অথচ এখন দেখতে পাচ্ছি সক্রেটিসের সেই যুক্তিই অসার প্রতিপন্ন হচ্ছে। ‘আত্মার অর্থ হচ্ছে সংগতি’ এ তত্ত্বটি সব সময়েই আমার নিকট বিশেষ আকর্ষণীয় তত্ত্ব ছিল। এজন্য তোমার মুখে এ তত্ত্বের উল্লেখ শুনতেই তত্ত্বটিকে আমার নিজের মূল বিশ্বাস বলে বোধ হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি আবার নূতন করে যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে যে, মানুষ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন সত্যই তার আত্মা তাকে অতিক্রম করেও বেঁচে থাকে। আমার একান্ত অনুরোধ ফিডো, তুমি আমায় বিশদভাবে বল, সক্রেটিস এর পরে কীভাবে অগ্রসর হলেন? সিমিয়াস এবং সিবিসের প্রশ্ন শুনে তোমাদের মনে যে উদ্বেগজনক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, সক্রেটিসের মনেও কি সেরূপ অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল? না, তিনি প্রশান্তচিত্তে তার উপর সিমিয়াস এবং সিবিসের এই আক্রমণের মোকাবেলা করেছিলেন? তাঁর জবাব কি জোরদার জবাব ছিল না, তিনি দুর্বলভাবে জবাব দিয়েছিলেন? এ সকল কথাই আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। কাজেই আমার অনুরোধ তখন যা ঘটেছিল তার যত সঠিক বর্ণনা সম্ভব তুমি সেই বর্ণনাই আমাদের শুনাবে।

ফিডো : একিক্রাটিস! সক্রেটিস আমার হৃদয়ে অনেক সময়েই বিস্ময়ের সঞ্চার করেছেন। কিন্তু সেদিনের মতো এবং সিবিসের আক্রমণের জবাব দিতে সক্ষম হবেন, সেটা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু আমি দেখে বিস্মিত হলাম, কী অপূর্ব মনোরম বিনয়ী এবং স্মিতভাবে তিনি প্রথমে তার যুক্তির বিরুদ্ধে তরুণদের প্রতি-যুক্তিকে শ্রবণ করলেন; কী অপূর্ব তীক্ষ্মতার সঙ্গে তাদের আক্রমণের আঘাতকে তিনি অনুভব করলেন এবং কী অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে তিনি আবার সে আঘাতকে নিরাময় করে ফেললেন। বস্তুত এ ব্যাপারে তাকে একজন সামরিক অধিনায়কের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। সামরিক অধিনায়কের মতোই যেন তিনি তার পরাজিত এবং ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে পুনরায় বৃহবদ্ধ করে তার সঙ্গে যুক্তির রণক্ষেত্রে তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

একিক্রাটিস : তার পরে কি হলো?

ফিডো : বলছি। তোমরা সব কথাই শুনতে পাবে, কেননা আমি সক্রেটিসের দক্ষিণপার্শ্বে একটি টুলের উপর তার কাছ ঘেঁষে বসেছিলাম। সক্রেটিস আমার চেয়ে খানিকটা উঁচুতে একটি কৌচের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন আর আমার দীর্ঘ চুলগুলোকে আমার ঘাড়ের উপর চেপে ধরছিলেন। আমার চুল নিয়ে খেলা করার তার একটি বিশিষ্ট ভঙ্গি ছিল। আমার চুল নিয়ে খেলতে খেলতে সক্রেটিস বললেন : ফিডো, আগামী কাল নিশ্চয়ই তোমার এই সুন্দর চুলের গুচ্ছগুলো আর আস্ত থাকবে না, তাদের হেঁটে ফেলা হবে।

আমি বললাম, হ্যাঁ আগামী কালই হয়তো এগুলো আমাকে হেঁটে ফেলতে হবে। সক্রেটিস বললেন : কিন্তু আমার কথামতো চললে চুলগুলো তোমার আগামীকাল কেটে ফেলতে নাও হতে পারে।

আমি বললাম : কিন্তু ওগুলো দিয়ে আমি কী করব?

সক্রেটিস বললেন : না, আমি বলছি কালকে নয় আজকেই তোমার এবং আমার উভয়ের চুল একেবারে মুড়ে ফেলতে হতে পারে। বস্তুত আজ যদি আমরা তর্কে হেরে যাই, এবং যে প্রশ্ন নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তাকে যদি আমরা অগ্রসর করে নিয়ে যেতে না পারি এবং সে আলোচনা যদি স্তব্ধ হয়ে যায় তা হলে একথা নিশ্চিত, তুমি এবং আমি উভয়ে আজই আমাদের মাথার চুল মুড়ে ফেলব। শুধু তাই নয়, আমি যদি তুমি হতাম আর যদি এই যুক্তির বলগা আমার হাতছাড়া হয়ে যেত এবং সিমিয়াস এবং সিবিসের নিকট আমি তর্কযুদ্ধে পরাজিত হতাম তা হলে কেবল আমার মাথার চুল মুড়ে ফেলা নয়, আমি আরগিভদের মতোই শপথ গ্রহণ করতাম; যতক্ষণ পর্যন্ত বিরোধের বিষয়টিকে আমি পুনরুজ্জীবিত করে তাদেরকে হারিয়ে দিতে সক্ষম না হই, ততক্ষণ আমি আর আমার মাথায় চুল ধারণ করব না।

.

আমি বললাম : হ্যাঁ সক্রেটিস, তোমার প্রতিজ্ঞা কঠিন নিশ্চয়ই। কিন্তু দুজনের সঙ্গে একা পেরে ওঠাও কম কঠিন নয়। হিরাক্লিস নিজেও দুজনের সঙ্গে একই সময়ে যুঝতে পারেন নি।

সক্রেটিস জবাব দিলেন–বেশ, তা হলে পরীক্ষা হোক। এস, সূর্য অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত আমিই তোমার আয়োলাসের ভূমিকাটি পালন করি।

বরঞ্চ আমি তোমাকে আহ্বান করছি, হিরাক্লিসের আহ্বানের ন্যায় নয়, আয়োলাস যেরূপ হিরাক্লিসকে আহ্বান করতে পারত তেমনিভাবেই আমি আহ্বান জানাচ্ছি। তোমাকে।

তাতেও চলবে। কিন্তু তার পূর্বে এস আমরা সাবধান হই, যেন একটু বিপদের মধ্যে গিয়ে আমরা না পড়ি।

কী বিপদ?

সক্রেটিস বললেন : আমরা সাবধান থাকব যেন যুক্তি-বিদ্বেষীতে আমরা পরিণত হয়ে না যাই। আমরা সাবধান থাকব, কেননা এই বিপদের চেয়ে বড় বিপদ মানুষের জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। কারণ, আমাদের মধ্যে যেমন আছে মানব-দ্বেষী তেমনি রয়েছে যুক্তি-দ্বেষী। এদের উভয়ের উৎপত্তির কারণ এক। আর এই কারণ হচ্ছে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা। মানব-বিদ্বেষের উৎপত্তি ঘটে অনভিজ্ঞের অতি-আস্থা থেকে। এই জগৎ সম্পন্ধে যে-অনভিজ্ঞ সে অতি সহজে মানুষ বিশ্বাস করে; যাকে দেখে তাকেই সে যথার্থ বলে মনে করে; মনে করে সে সুস্থ এবং অনুগত। কিন্তু কিছুকাল মধ্যেই সে দেখতে পায় যে তার আস্থার পাত্র প্রকৃতপক্ষে অন্তঃসারশূন্য এবং অসৎ। শুধু একটি ক্ষেত্রেই নয়। অভিজ্ঞতা তার বৃদ্ধি পেতে থাকে। একের পর এক অন্তঃসারশূন্য মানুষের সাক্ষাৎ সে লাভ করে। আর এই অভিজ্ঞতা যত তার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিশেষ করে যাদের উপর ছিল তার সবচেয়ে অধিক আস্থা, যারা তার পরিচিত বন্ধু তাদের মধ্যেই যখন সে সাক্ষাৎ পায় এই অন্তঃসারশূন্যতার, তাদের সঙ্গেই যখন তাকে কিছুকাল পর কলহে প্রবৃত্ত হতে হয়, তখন সে ঘৃণা করতে শুরু করে একজনকে নয়, সকল মানুষকে। আর তখন সে বিশ্বাস করে মানুষের মধ্যে মহৎ বলতে কিছুই নেই। অনভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে মানুষের চরিত্রে এই অভিজ্ঞতাজাত হতাশাকে নিশ্চয়ই তুমি লক্ষ্য করে থাকবে।

হ্যাঁ, আমি তা লক্ষ্য করেছি।

আর এই মনোভাবকে কি তুমি নিন্দনীয় মনে করবে না? এরূপ লোক যখন সমাজের অপর দশজনের সঙ্গে সম্পর্কিত জীবনযাপন করতে চাইল তখন স্পষ্টতই দেখা গেল মানুষের চরিত্র সম্পর্কে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার যদি অভিজ্ঞতা থাকত তা হলে সে প্রকৃত অবস্থাকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারত; সে দেখতে পেত যে, সমাজে কিছু সংখ্যক মানুষ সৎ, কিছু সংখ্যক অসৎ, আর অধিক সংখ্যকই হচ্ছে সৎ এবং অসৎ-এর মধ্যবর্তী পর্যায়সমূহের।

তুমি কি বলতে চাচ্ছ, সক্রেটিস?

আমি বলতে চাচ্ছি যে, কোনো প্রকার চরমের সংখ্যা খুবই কম। যেমন ধর বৃহৎ এবং ক্ষুদ্রের কথা : অতি বৃহৎ কিংবা অতি ক্ষুদ্র মানুষ কম সংখ্যায়ই তুমি দেখতে পাবে। তেমনি দ্রুত এবং মন্দ, সুন্দর এবং কুৎসিত, কালো এবং সাদা–সব চরম সম্পর্কেই একথা সত্য। এদের দৃষ্টান্ত হিসাবে তুমি মানুষ কিংবা কুকুর যাকেই গ্রহণ করা না কেন চরম চরিত্রের সংখ্যা দেখবে কম–কিন্তু অধিক সংখ্যক হচ্ছে দুই চরমের মধ্যবর্তী পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়টি কি তুমি লক্ষ কর নি?

হ্যাঁ, আমি লক্ষ্য করেছি।

তা হলে তুমি কি মনে কর না যে, চরম অসৎ-এর বিষয়ে যদি একটি প্রতিযোগিতা। আহ্বান করা হয় তা হলে চরম অসৎ হিসাবে খুব কম সংখ্যক লোককেই পাওয়া যাবে।

হ্যাঁ, এরূপ হওয়া খুবই সম্ভব।

সক্রেটিস বললেন : হ্যাঁ এরূপ হওয়া খুবই সম্ভব। অবশ্য এসব ক্ষেত্রের যুক্তি মানুষ থেকে ভিন্নতর হতে পারে। কিন্তু এ প্রসঙ্গ সম্পর্কে আর নয়। এ প্রসঙ্গে আমি যতটুকু বলতে ইচ্ছা করেছিলাম তুমি আমাকে দিয়ে তার চেয়ে অধিক বলিয়ে নিয়েছ। কিন্তু দুটি প্রসঙ্গের তুলনায় বিষয় হচ্ছে এই যে, যুক্তির ক্ষেত্রেও দ্বন্দ্বমূলক যুক্তিতে যে দক্ষ নয়, যে জ্ঞানে সরল যে যখন একটি যুক্তিকে বিশ্বাস করার পরে সেটিকে আবার ভ্রান্ত বলে মনে করে এবং এরূপভাবে একের পর এক করে অন্যান্য যুক্তিকেও সে প্রথমে বিশ্বাস এবং পরে অবিশ্বাস করতে শুরু করে তখন কোনো যুক্তির উপরই আর তার কোনো বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে না। এভাবে অনেক বড় বড় তার্কিকের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, তারা পরিশেষে নিজেদেরকে মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক বোদ্ধা বলে মনে করতে শুরু করে। তাদের ধারণা, কেবল তারাই সব যুক্তির, সব বস্তুর অসারতা এবং অনিশ্চয়তাকে জেনে ফেলেছে। আর তাদের জানার কিছু অবশিষ্ট নেই। কেননা যুক্তি কিংবা বস্তু সবই ইউরিপাস-এর জোয়ার-ভাটার উঠতি পড়তি বই আর কিছুই নয়।

আমি বললাম : হ্যাঁ, একথা খুবই সত্য।

তা হলে, ফিডো, ভেবে দেখ সত্য, কিংবা নিশ্চয়তা কিংবা জ্ঞানের সম্ভাবনা বলতে যদি কিছু থাকে, তার অবস্থা এর ফলে কিরূপ করুণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা কেউ হয়তো প্রথমে একটি যুক্তিকে যথার্থ বলে গ্রহণ করেছে কিন্তু কিছু পরে সেই যুক্তিটিই তার নিকট ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হলো। তখন সে এজন্য নিজকে এবং নিজের বুদ্ধির অভাবকে দায়ী না করে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ভ্রান্তির সমগ্ৰ দায়িত্ব যুক্তির উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে রেহাই পেয়ে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে এবং এর পর থেকে যুক্তিমাত্রই তার ঘৃণা, অবিশ্বাস ও নিন্দার পাত্র হয়ে ওঠে। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, এরূপ ব্যক্তি সত্য এবং বাস্তবের জ্ঞান থেকেই বঞ্চিত হয়।

হ্যাঁ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, অবস্থাটি বড়ই করুণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাই যদি হয় তা হলে এস, আমরা শুরুতেই সাবধান থাকি, যেন আমাদের নিজেদের মনে এরূপ ধারণা প্রবেশ করতে না পারে যে, কোনো যুক্তিই যথার্থ কিংবা সুস্থ নয়। বরঞ্চ আমাদের অন্তরে যেন এই ধারণা থাকে যে, আমরা নিজেরাই এখনো চিন্তার স্থৈর্যকে আয়ত্ত করতে সক্ষম হই নি এবং আমাদের সচেষ্ট হতে হবে, যেন সাহসের সঙ্গে সংগ্রাম করে আমরা সেই মানসিক স্থৈর্যকে আয়ত্ত করতে সক্ষম হই। তুমি, আমি এবং অপর সকলে আপন আপন জীবনের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য করেই সত্যকে লাভ করার এই সাধনায় রত হব। আমি আমার মৃত্যুকে সম্মুখে রেখেই এই কর্তব্যের কথা স্মরণ করব। কেননা আজ এই মুহূর্তে আমি অনুভব করছি, দার্শনিকের স্থৈর্য আমার নেই। সাধারণের ন্যায় আমিও এখন একদেশদর্শী একটিমাত্র পক্ষভুক্ত লোক। আর তুমি তো জানো, যে পক্ষভুক্ত সে যদি তর্কে অবতীর্ণ হয় তা হলে সে বিরোধের বিষয়টির যথার্থতা সম্পর্কে কিছুমাত্র চিন্তা করে না। তার একমাত্র চিন্তা হয় কী করে সে তার শ্রোতাবৃন্দকে নিজের বক্তব্যে বিশ্বাসী করে তুলবে। যুক্তির ক্ষেত্রে এরূপ পক্ষভুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আমার হয়তো এই মুহূর্তে এতটুকুই মাত্র পার্থক্য যে, সে যদি তার শ্রোতাবৃন্দকে বিশ্বাসী করে তুলতে চায়, আমি আমার নিজের সত্তাকেই নিজের যুক্তিতে বিশ্বাসী করে তুলতে চাচ্ছি। আমার শ্রোতাবৃন্দকে বিশ্বাসী করে তোলার ব্যাপারটি আমার কাছে গৌণ। অবশ্য এরূপ যুক্তি আমার জন্য দুদিক দিয়েই লাভজনক। প্রথমত আমি যা বলছি তা যদি সত্য হয় তা হলে তার সম্পর্কে আমার নিজের অন্তরে বিশ্বাসের সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া মৃত্যুর পরে কিছু যদি নাই থাকে তা হলেও মৃত্যুর পূর্বে যে অল্পকালের অবসর আমি পেলাম সে অবসরটিতে আমার বিলাপ দ্বারা আমার প্রিয় বন্ধুদের উদ্বেগের কোনো কারণ আমি হলাম না। আমার অজ্ঞানতার আয়ু তখন আর দীর্ঘ হবে না। শীঘ্রই আমার মৃত্যুর সঙ্গে তারও মৃত্যু ঘটবে। কাজেই আমার অজ্ঞানতা দ্বারা তোমাদের তেমন ক্ষতিসাধনও আমি করতে পারব না। প্রিয় সিমিয়স এবং সিবিস! এই মানসিক অবস্থা নিয়েই আমি যুক্তিটিকে নূতনভাবে বিচার করে দেখব। তোমাদের প্রতিও আমার অনুরোধ, তোমরা যেন যুক্তির যথার্থতার দিকটিই বিবেচনা কর, সক্রেটিসের অবস্থাটি নয়। যদি তোমরা বোধ কর যে, আমি যুক্তিতে যথার্থ, তা হলে আমার সঙ্গে তোমরা একমত হয়ে। কিন্তু তা যদি না হয়, তা হলে সমস্ত শক্তি দিয়ে আমায় প্রতিরোধ করো, যেন উৎসাহের আতিশয্যে আমি তোমাদের কিংবা নিজেকে প্রতারিত করতে সক্ষম না হই, যেন মৌমাছির ন্যায় দংশন করে মৃত্যুর পূর্বে তোমাদের অন্তরে আমি যন্ত্রণার হুলটি রেখে যেতে না পারি।

এবার তা হলে অগ্রসর হওয়া যাক। কিন্তু সব কিছুর আগে আমার নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক, তোমরা যা বলেছ আমার তা স্মরণ আছে কি না। আমি যদি সঠিকভাবে স্মরণ রাখতে পেরে থাকি, তা হলে বলব যে, সিমিয়াসের আশঙ্কাটি হচ্ছে এই যে, দেহের চাইতে আত্মা অধিক স্বর্গীয় এবং সুন্দর হওয়ার জন্য এবং আত্মার অস্তিত্ব বীণার সংগতির ন্যায় হওয়াতে আত্মাই দেহের ক্ষয়ের পূর্বেই বিলুপ্ত এবং বিনষ্ট হয়ে যায় কি না। সিবিস অবশ্য স্বীকার করেন যে, দেহের চাইতে আত্মা অধিক টেকসই। কিন্তু তারও বক্তব্য হচ্ছে, কে জানে দেহের পর দেহ ধারণ করতে করতে পরিণতিতে সর্বশেষ দেহটিকে পরিত্যাগ করে নিজেই সে বিনষ্ট হয়ে যায় কি না। আর মৃত্যু বলতে সিবিস আত্মার এই বিনষ্টকে বুঝাতে চেয়েছেন–দেহের ধ্বংস নয়। কেননা দেহের মধ্যে ধ্বংসের প্রক্রিয়া তো নিত্যকাল ধরেই চলছে। সিমিয়াস এবং সিবিস, এই বিষয়গুলিকেই তো আমরা বিবেচনা করতে চাই। নয় কি?

সিমিয়াস এবং সিবিস–উভয়েই তাঁদের বক্তব্যেরই বর্ণনার সঙ্গে একমত হলেন।

সক্রেটিস বললেন : কিন্তু তোমরা কি আমাদের পূর্বের সব যুক্তিকেই অস্বীকার করছ, শুধু তার একটি অংশকে?

সিমিয়াস এবং সিবিস উভয়েই বললেন : শুধু একটি অংশকে।

তা হলে আমাদের যুক্তির যে অংশটিতে আমরা বলেছি, জ্ঞান হচ্ছে কোনো কিছুকে স্মরণ করা এবং সেখান থেকে আমরা অনুমান করছি যে, দেহের মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার। পূর্বেও আত্মার অস্তিত্ব ছিল, যুক্তির সে অংশটি সম্পর্কে তোমাদের অভিমত কী?

সক্রেটিসের এ প্রশ্নের জবাবে সিবিস বললেন যে, যুক্তির ঐ অংশটিতে তিনি বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়েছেন এবং তার উপর তাঁর বিশ্বাস এখনো পুরোপুরিই অটুট রয়েছে। সিমিয়াসও এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন যে, তিনি ঐ যুক্তি থেকে ভিন্নতর কোনো যুক্তির কথা কল্পনা করতে পারেন না।

সক্রেটিস জবাব দিলেন : কিন্তু থিবের প্রিয় বন্ধু! সংগতিকে যদি তুমি মিশ্রণজাত ফল হিসাবে এখনও চিন্তা কর এবং মনে কর যে, আত্মা দেহের তারে ঝঙ্কার ভোলা সংগতি, তা হলে নূতন যুক্তির কথা তোমাকে অবশ্যই ভাবতে হয়। কেননা, তেমন ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে না যে, মিশ্রণের মাধ্যমে যে সংগতির জন্ম তার অস্তিত্ব মিশ্রণের পূর্বেও ছিল।

না, তা আমি কখনো স্বীকার করতে পারিনে, সক্রেটিস।

কিন্তু তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে, যখন তুমি বল, আত্মা দেহের আকার গ্রহণ করার পূর্বেও যেমন অস্তিত্বময় ছিল, তেমনি সে এমন উপাদানের সৃষ্টি যে-উপাদানের পূর্বে অস্তিত্ব ছিল না তখন তোমার কথার তাৎপর্য এরূপই দাঁড়ায়। কেননা ঐক্য বা সংগতিকে তুমি আত্মা বলতে পার না। বীণার ক্ষেত্রে কী ঘটে? প্রথমে আমরা পাই বীণা আর তাতে লাগানো তারগুলি; বীণার তারে প্রথম যখন শব্দ তুলি তখন সে শব্দের মধ্যে কোনো সংগতি থাকে না–সে শব্দরাজি তখন বিস্রস্ত। সংগতি আসে সবার শেষে। আবার সুরের সংগতি নষ্ট হয় সবার আগে। কাজেই আত্মা সম্পর্কে এই ধারণাকে তুমি অপর ধারণার সঙ্গে মিলাবে কী করে?

সিমিয়াস বললেন : না, তাকে আমি মিলাতে পারিনে। কিন্তু তবু সংগতি যেখানে আলোচ্য বিষয়, সেখানে আলোচনার মধ্যে একটি সংগতি থাকা কি অপরিহার্য নয়?

অবশ্যই আলোচনায় একটি সংগতি থাকা আবশ্যক। কিন্তু একদিকে জ্ঞানকে যদি আমরা স্মৃতি বলে আখ্যায়িত করি এবং আত্মাকে বলি সংগতি, তা হলে আলোচনার সঙ্গতি তো আমরা রক্ষা করতে পারিনে। এদের মধ্যে কোন মতটিকে তুমি গ্রহণ করবে?

সিমিয়াস বললেন : সক্রেটিস, আমি মনে করি প্রথমোক্ত মতটিই গ্রহণীয়। কেননা, প্রথম মতটি উপযুক্তরূপেই প্রমাণিত হয়েছে। শেষোক্ত মতটিই বরঞ্চ এখনো প্রমাণিত হয় নি। অধিকাংশ মানুষ অবশ্যই শেষোক্তটিকেই গ্রহণ করে, কেননা শেষোক্ত মতটির প্রমাণ এখনো কতগুলি বিশ্বাসযোগ্য কিংবা সম্ভব-যুক্তির মধ্যে নিহিত। কিন্তু আমি একথা প্রকৃষ্টভাবেই জানি যে, যুক্তির এই সমস্ত সম্ভাবনা আসলে প্রতারণার আকর। জ্যামিতি শাস্ত্রে যেরূপ এরা বহু ভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে তেমনি বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ না করলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ওই সমস্ত বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি’ ভ্রান্তিরই সৃষ্টি করবে। কিন্তু জ্ঞানের অর্থ যে-কোনো কিছুকে স্মরণ করা, এ তত্ত্বটি আমার নিকট উপযুক্তভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রমাণের প্রধান যুক্তি হচ্ছে এই যে, আত্মাতেই সমস্ত সত্তা; সুতরাং দেহের মধ্যে অনুপ্রবেশের পূর্বে অবশ্যই আত্মা অস্তিত্বময় হয়ে বিরাজ করছিল। সুতরাং আমি এ তত্ত্বকে যখন স্থির জেনেছি, উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এর সিদ্ধান্তকে যখন আমি গ্রহণ করেছি, তখন স্বভাবতই ‘আত্মা হচ্ছে সংগতি’ এ তত্ত্ব নিয়ে কারুর পক্ষে তর্কে প্রবৃত্ত হওয়াকে আমি বাঞ্ছনীয় মনে করব না। আমি নিজেও এ নিয়ে আর আলোচনা করতে চাইব না।

সক্রেটিস বললেন : সিমিয়াস, বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে প্রকাশ করছি : তুমি কি মনে কর ঐক্য বা সংগতি যে উপাদানসমূহের মিশ্রণে সৃষ্ট হয় তাদের থেকে ভিন্নভাবে তার অস্তিত্ব সম্ভব?

নিশ্চয়ই নয়।

কিংবা উপাদানের যা কার্য কিংবা ভোগ তা থেকে ভিন্ন?

এ প্রশ্নেও সিমিয়াস সক্রেটিসের সঙ্গে একমত হলেন।

তা হলে, সঠিকভাবে বলতে গেলে ঐক্য বা সংগতি তার নিজের কোনো জনক উপাদানসমূহকে পরিচালন করে না, উপাদনসমূহর অনুসরণ করে।

এ কথায়ও সিমিয়াস তার সম্মতি জানালেন।

কেননা, যে সংগতি বা ঐক্য তার মধ্যে নিশ্চয় গতি, শব্দ কিংবা অপর এমন কোনো গুণ অবস্থান করতে পারে না, যে সংগতির অন্তর্ভুক্ত কোনো অংশের বিরোধী।

সিমিয়াস বললেন : হ্যাঁ, এরূপ গুণের অবস্থান অসম্ভব।

তা ছাড়া যে-কোনো ক্ষেত্রেই উপাদানসমূহের ঐক্যের বৈশিষ্ট্যের উপর কি সংগতির নিজের বৈশিষ্ট্যটি নির্ভর করে না?

এবার আমি তোমাকে বুঝতে পারছিনে; সক্রেটিস।

আমি বলছিলাম যে, সংগতিরও পরিমাণ ভেদ আছে : একটা সংগতি যত অধিক এবং পরিপূর্ণরূপে সংগত তত অধিক পরিমাণে এবং পরিপূর্ণরূপে সে সংগতি; আবার যে সংগতি যত কম এবং অপূর্ণরূপে সংগত তত কম এবং অপূর্ণ সে সংগতি।

হ্যাঁ, একথা সত্য।

কিন্তু আত্মার ক্ষেত্রে কি এরূপ পরিমাণভেদে সম্ভব? কোনো আত্মাকে কি তুমি অপর কোনো আত্মার চেয়ে অল্প কিংবা অধিক আত্মা বলে ভাবতে পার?

না, কোনোক্রমেই সেরূপ ভাব সম্ভব নয়।

কিন্তু তা হলেও দুটি আত্মার মধ্যে একটিকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং বুদ্ধিমান এবং অপরটিকে অসৎ, পাপাচারী এবং মূর্খ আত্মা যথার্থভাবেই বলা চলে। কি বল?

হ্যাঁ, যথার্থভাবেই এরূপ বলা চলে।

কিন্তু যারা আত্মাকে সংগতি বলে আখ্যায়িত করেন তারা আত্মার এই গুণাগুণের কি ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হবেন? তারা কি এরূপ বলবেন যে, সৎ আত্মাই সংগতিপূর্ণ? আবার, আত্মা নিজেই যেহেতু সংগতি সেজন্য সংগতির ভিতরেও রয়েছে আর এক সংগতি; আর পাপাচারী আত্মার মধ্যে কোনো সংগতি নেই। তাদের ব্যাখ্যা কী হবে?

সিমিয়াস বললেন : তাঁদের বক্তব্য কী হবে, আমি ঠিক বলতে পারছিনে। তবে যারা আত্মাকে সংগতি বলেন তারা অনুরূপ কোনো ব্যাখ্যাই নিশ্চয় উপস্থিত করবেন।

কিন্তু আমরা তো ইতঃপূর্বে সিদ্ধান্ত করেছি যে, আত্মার পরিমাণভেদ নেই। সুতরাং আত্মা যদি সংগতি হয় তা হলে তার অর্থ দাঁড়ায় যে, সংগতিরও কোনো পরিমাণভেদ হতে পারে না অর্থাৎ কোনো সংগতি অধিক সংগতি কিংবা অল্প সংগতি কিংবা অধিকতর পূর্ণরূপে কিংবা অপূর্ণরূপে সংগতি বলে বিবেচিত হতে পারে না।

খুবই সত্য কথা।

সুতরাং যে-সংগতি অল্প কিংবা অধিক নয়, সে সংগতি অল্প কিংবা অধিক পরিমাণে সংগত এরূপও বলা চলে না।

অবশ্যই।

তা হলে বলতে হয় যে, যে-সংগতি অল্প কিংবা অধিক হতে পারে না, তার কেবল সম পরিমাণ সংগতি থাকাই সম্ভব।

হ্যাঁ, তার পরিমাণ ভেদ নেই–সে কেবল সম পরিমাণ সংগতিই হতে পারে।

কাজেই একটি আত্মা যখন অধিক কি অল্প সত্তাপূর্ণ আত্মা হতে পারে না, তখন সে অধিক কিংবা অল্প সংগতিপূর্ণ আত্মা বলেও বিবেচিত হতে পারে না।

যথার্থই।

অর্থাৎ আত্মার মধ্যে সংগতি কিংবা অসংগতির অল্পতা কিংবা আধিক্যকে কল্পনা করা চলে না।

হ্যাঁ, তা চলে না। সে পরিমাণে অল্প কিংবা অধিক নয়।

সুতরাং পাপকে যদি আমরা অসংগতি এবং ধর্মকে সংগতি বলি, তা হলে যেহেতু আত্মার অধিক কিংবা অল্প সংগতি কিংবা অসংগতি থাকতে পারে না, সেজন্য এক আত্মাকে অপর আত্মার চেয়ে অধিক ন্যায় কিংবা অন্যায়পূর্ণ বলেও ভাবা চলে না। ঠিক নয় কি?

না, কোনোক্রমেই সেরূপ ভাবা চলে না।

সিমিয়াস কথাটিকে সঠিকতর করে আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, যেহেতু সংগতি অবশ্যই সংগতি, অর্থাৎ সংগতির মধ্যে অসংগতির কোনো স্থান নেই, সেজন্য আত্মা যদি সংগতি হয় তা হলে তার মধ্যেও পাপ বা অন্যায় বলে কিছু স্থান হতে পারে না।

না, তা সম্ভব নয়।

কাজেই, যে-আত্মা নিশ্চিত এবং চরমরূপে আত্মা তার পাপ বলতে কিছু নেই।

না, পাপ তার থাকা সম্ভব নয়। আগের যুক্তিগুলি ঠিক হলে আত্মার পাপ কী করে থাকবে?

তা হলে যত আত্মা আছে তারা যদি স্বভাবগতভাবে আত্মাই হয়, তা হলে সমস্ত জীবিত প্রাণীর আত্মা সম পরিমাণেই সৎ। ঠিক নয় কি?

সিমিয়াস বললেন : সক্রেটিস, আমি তোমার সঙ্গে একমত।

কিন্তু এ সবই কি সত্য হতে পারে? অথচ আত্মাকে যদি আমরা সংগতি বলি তা হলে এ সকল সিদ্ধান্তকেই সেই স্বীকৃতির পরিণাম হিসাবে আমাদের গ্রহণ করতে হয়।

না, এগুলি সত্য হতে পারে না।

তা ছাড়া ভেবে দেখো, আত্মা ব্যতীত, বিশেষ করে প্রাজ্ঞ যে আত্মা সেই আত্মা ব্যতীত আর কে আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে? আত্মা ব্যতীত অপর কোনো শক্তি এরূপ পারে বলে কি তুমি মনে কর?

না, এরূপ অপর কোনো শক্তি পারে বলে আমি মনে করিনে।

আবার চিন্তা করে দেখ, আত্মা কি কখনো দেহের পীড়া কিংবা তার অবস্থান্তরকে স্বীকার করে; না, সে তার বিরোধিতা করে?

যেমন, দেহ উষ্ণ হলো কিংবা তার তৃষ্ণা পেল। আত্মা কি এরূপ অবস্থায় দেহের ইচ্ছাকে গ্রহণ করে, না সে তার বিরুদ্ধতা করে? কিংবা দেহ ক্ষুধিত হলো। আত্মা কি এই ক্ষুধাকে স্বীকার করে–না অস্বীকার করে? বস্তুত এরূপ দেহের ইচ্ছার ক্ষুধাকে স্বীকার করে–না অস্বীকার করে? বস্তুত এরূপ অবস্থার আত্মা দেহের ইচ্ছার বিরুদ্ধতাই করে। আমি মাত্র একটি উদাহরণ দিলাম। এরূপ তত দশ সহস্র দৃষ্টান্তই উপস্থিত করা যায় যেখানে আত্মা দেহের বিরুদ্ধতা করছে।

একথা অবশ্য সত্য?

কিন্তু আত্মা যদি সংগতি হয়, তা হলে এরূপ বিরুদ্ধতা তার পক্ষে কি করে সম্ভব? কেননা আমরা বলেছি যে, যেহেতু আত্মা সংগতি সেজন্য দেহের যে তন্ত্ৰীগুলির ঐক্যবদ্ধ যোজনায় তার সৃষ্টি, সে তন্ত্রীগুলির কড়ি কিংবা কোমল কোনো খাদের বিরুদ্ধেই তার নিজের অসংগতির সুর তুলে ধরা চলবে না। মিলিত সুরের বিরোধী কোনো সুর তুলে ধরা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। সেই ঐক্যবদ্ধ যোজনার অনুগমনই তার কার্য; সেই তার ক্ষমতা; কোনো তন্ত্রীর কোনো সুর সৃষ্টি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

সিমিয়াস বললেন : বিষয়টি তো এরূপই হবে।

অথচ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আত্মা ঠিক বিপরীত কাজটিই করে চলেছে : যে উপাদানের সংযোগে সে সৃষ্ট বলে ধারণা করা হয়েছে সে তাদের উপরই পুরোদমে কর্তৃত্ব করছে। প্রায় সর্বদাই সে দেহের ইন্দ্রিয়সমূহের বিরোধীতা করছে; জীবনভর তাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো সময়ে সে ক্রিয়া কসরত, ঔষধ ইত্যাদির ন্যায় জবরদস্তির মারফত ইন্দ্রিয়সমূহকে দুরন্ত রাখার চেষ্টা করছে। এজন্য কখনো সে তাদের প্রতি হুমকি উচ্চারণ করছে, কখনো তাদের কামনা, বাসনা, আতঙ্কভীতিকে তিরস্কার করছে। তার আচরণের ভাবটি এই, যেন সে নিজে এই সমস্ত তন্ত্ৰীভুক্ত আদৌ নয়। হোমার তার ‘অডিসি’-তে যেরূপ অডিসিয়াসের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন :

“নিজের বক্ষঃস্থলকে আঘাত করে আপন আত্মাকে সে বলল :
ধৈর্য ধর, স্থির হও, হে আমার আত্মা। কঠিনতর আঘাতকে
তুমি সহ্য করেছ একদিন, আজ কেন এই
চঞ্চলতা।”

আমাদের আত্মাও যেন সেরূপ ইন্দ্রয়সমূহকে ভর্ৎসনা করছে। তুমি কি মনে কর, তোমার আত্মাকে সংগতি বলে গ্রহণ করে কিংবা আত্মা দেহের ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিচালিত হয় ভেবে এই কথাগুলো লিখেছেন? বরঞ্চ একথাই কি সত্য নয় যে, হোমার মনে করেছেন, আত্মার প্রকৃতি হচ্ছে প্রভুর প্রকৃতি, দাসের নয়; তিনি মনে করেছেন, কোনো প্রকার সংগতির চেয়ে আত্মা অনেক বেশি স্বর্গীয়?

হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমি এরূপই মনে করি।

তা হলে প্রিয় বন্ধু, আমরা কখনোই আত্মাকে সংগতি বলে বিবেচনা করতে পারিনে। আত্মাকে সংগতি বলার অর্থ হচ্ছে স্বর্গীয় হোমার এবং আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধতা করা।

হ্যাঁ, একথা সত্য।

কিন্তু অধিক নয়, প্রিয় বন্ধু। তোমার থিবিসের দেবী সংগতি বা হারমোনিয়া সম্পর্কে। এই যথেষ্ট। তিনি সুন্দরভাবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছেন, এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ। এবার। রইল তার স্বামীদের ক্যাডমাস। তাঁকে শান্ত করি কী দিয়ে, সিবিস, সেটাই তো এখন প্রশ্ন।

সিবিস বললেন : তাঁকে তুষ্ট করার পথও তুমি নিশ্চয় বার করবে, সক্রেটিস। হারমোনিয়াকে যুক্তি দিয়ে যেভাবে তুমি বশ করেছ সে ছিল আমার একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কেননা, সিমিয়াস যখন তার সমস্যা এবং প্রশ্নের কথা তোমার নিকট উল্লেখ করেছিলেন তখন আমার মনে হয়েছিল যে, তার প্রশ্নের কোনো জবাব দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি দেখে বিস্মিত হয়েছি, তোমার প্রতি-আক্রমণের শুরুতেই সে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। এখন ভাবছি যাকে তুমি ক্যাডমাস’ বলছ সে বেচারীর ভাগ্যেও ঠিক একই দশা ঘটবে।

না, প্রিয়বন্ধু, অমন অহঙ্কার প্রকাশ করা আমাদের উচিত নয়, হয়তো কোনো শনির দৃষ্টি আমার মনের কথাকে আতঙ্কিত করে তাড়িয়ে দেবে; আমি আর তাকে প্রকাশ করতে পারব না। তার চেয়ে বরঞ্চ সাফল্যের বিষয়টি আমার ঊর্ধ্ব লোকবাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে হোমরীয় কৌশল প্রয়োগে আমার যুক্তির ধারাটি পরীক্ষা করার প্রয়াস পাই। তোমার যুক্তিটাকে তা হলে আর একবার ঝালাই করে নেওয়া যাক; তুমি চাও, তোমার নিকট আমরা প্রমাণ করে দেব যে আত্মা অক্ষয় এবং অমর। তোমার বক্তব্য হচ্ছে : দার্শনিক এই প্রমাণ ব্যতীত যদি বিশ্বাস করে যে, এই মর্তলোকের চেয়ে পাতাললোকে সে অধিকতর সুখী হবে তা হলে সে বিশ্বাস তার নিতান্তই অলীক বিশ্বাস। তা ছাড়া তুমি বলতে চাচ্ছ, দেহের মৃত্যুর পরে আত্মার অমরতা প্রমাণিত হয় না। এ আপত্তিতে তোমার যুক্তি হচ্ছে যে, আত্মার আয়ুষ্কাল দীর্ঘ এবং দেহ-পূর্ব অবস্থাতে সে বহুতর ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করেছে–এরূপ দাবিতেও আত্মার অমরতা প্রমাণিত হয় না। তুমি মনে কর, দেহের মধ্যে আত্মার প্রবেশ আসলে একটি রোগবিশেষও হতে পারে। এখান থেকেই হয়তো আত্মার ক্ষয়ের শুরু। এই রোগের কারণেই হয়তো জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভোগের পরে আত্মা মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, দেহের মধ্যে আত্মা একবার কিংবা বহুবার প্রবেশ করল–এই সত্য মৃত্যু সম্পর্কে ব্যক্তির ভীতিকে দূর করতে পারে না। কেননা, আত্মার অমরতার প্রমাণ দেওয়া যদি সম্ভব না হয় তা হলে সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষমাত্রই মৃত্যুকে ভয় না করে পারবে না। আমার মনে হয়, সিবিস, আমি যেরূপ বলেছি প্রায় এরূপই হচ্ছে তোমার বক্তব্য। আমি ইচ্ছা করেই বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করে নিচ্ছি, যেন এর কোনো অংশ আমাদের নজর এড়িয়ে না যায় এবং তোমার ইচ্ছা হলে যেন তুমিও এর কোনো কথা বাদ দিতে কিংবা এর সঙ্গে নূতন কথা যুক্ত করতে সক্ষম হও।

হ্যাঁ, সক্রেটিস, তুমি যা বলেছ, তা সবই আমার কথা। কিন্তু যতদূর আমি বর্তমানে দেখতে পারছি তাতে এর সঙ্গে কিছুই যোগ কিংবা এ বক্তব্য থেকে কিছু বিয়োগের কথা এখনই চিন্তা করতে পারছিনে।

এর পরে সক্রেটিস কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলেন। মনে হল যেন তিনি কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছেন। পরিশেষে তিনি বললেন : প্রিয় সিবিস, তুমি সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সমগ্র প্রক্রিয়ার রীতি সম্পর্কে বিপুল এক প্রশ্ন উত্থাপন করেছ। এ সম্পর্কে, তুমি যদি চাও তা হলে, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে পারি। আমার এ অভিজ্ঞতা যদি তোমার সমস্যার সমাধানে কিছু সাহায্য করে তা হলে তুমি তাকে ব্যবহার কর।

তোমার বক্তব্য শুনবার আমার আন্তরিক আগ্রহ রয়েছে, সক্রেটিস।

বেশ, আমি বলছি। সিবিস, আমি যখন তরুণ, তখন দর্শনের যে-শাখাকে প্রকৃতি জগতের গবেষণার শাখা বলে আখ্যায়িত করা হয় তার জ্ঞান অর্জনের আমার ছিল বিরাট এক আগ্রহ। বস্তু-জগতের কারণ কী? কী কারণে কোনো একটি বস্তু এই মুহূর্তে অস্তিত্বময় হয়ে রয়েছে? কেনই বা যার এই মুহূর্তে সৃষ্টি হল, পরমুহূর্তেই আবার তার লয় ঘটল? এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব জানাকে তখন নিজের নিকট একটি উঁচুদরের কাজ বলেই বোধ হতো। আমার মনে তখন প্রশ্নের পরে প্রশ্নের আলোড়ন : জীবজন্তুর দেহ ক্ষয়ের কী কারণ? কেউ কেউ বলেন এ নাকি উষ্ণতা এবং শৈত্যের সংকোচন প্রক্রিয়ারই ফল। একথা কি যথার্থ? আমরা চিন্তা করি কোন শক্তিতে, কিসের কারণে? সে কারণ কি ধমনীর রক্ত, না হাওয়া, না অগ্নি! অথবা এদের কেউই আমাদের চিন্তার মূল কারণ নয়। আমাদের চিন্তার শক্তি কে যোগায়? সে কি আমাদের মস্তিষ্ক? মস্তিষ্ক থেকেই কি উদ্ভূত হয় আমাদের সব অনুভূতির শক্তি, আমাদের প্রত্যক্ষ বোধ, আমাদের শ্রবণক্ষমতা, আমাদের চোখের দৃষ্টি, নাসিকার ঘ্রাণ, মনের স্মৃতি? কোথা থেকে আমাদের ধারণার জন্ম? কিসের উপর বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা? বিজ্ঞান কি স্মৃতি এবং ধারণা দূরীভূত হওয়ারই ফল? আমি এ সমস্ত বস্তু এবং বিষয়ের ক্ষয় এবং বিকৃতির কথাও চিন্তা করতে লাগলাম; চিন্তা করতে লাগলাম আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-মর্ত্য সম্পর্কে; আর অবশেষে দেখতে পেলাম যে, এদের বিষয়ে কোনো সঠিক ধারণায় উপস্থিত হতে আমি সম্পূর্ণরূপেই অক্ষম। তোমরা হয়তো কথাটা শুনে আশ্চর্য হচ্ছ। কিন্তু তোমাদের আমি প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব, আসলে ব্যাপারটা এরূপ হয়েই দাঁড়াল। কারণ, এ সমস্ত বিষয় দ্বারা আমি এরূপ মোহিত হয়ে গেলাম যে, তার ফল হিসাবে দেখলাম, আমি এতদিন যা উত্তমরূপে জানতাম বলে ভেবেছি আজ তাদের সম্পর্কে আমি অন্ধ এবং অজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়েছি; যাকে আমি পূর্বে স্বতঃসিদ্ধ বলে জানতাম আজ তাকেও আমি বিস্মৃত হয়ে গিয়েছি। আমি জানতাম দেহের বৃদ্ধি আহার এবং পানের ফলে। কেননা দেহে যখন খাদ্যদ্রব্য জারিত হয় তখন তাতে মাংসের সঙ্গে মাংস এবং অস্থির সঙ্গে অস্থি যুক্ত হয়। এরূপে সহায়ক উপাদান যখন দেহে এসে মিলিত হয় তখন আয়তনে যে ছিল অল্প সে হয় অধিক। যে ছিল ক্ষুদ্র সে বৃহৎ। আমার পূর্বকার এই ধারণা কি যুক্তিসংগত ছিল না?

সিবিস বললেন : হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমি তো সেরূপই মনে করি।

শুধু তাই নয়। আমি আরো বলছি। আমার জীবনে এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি মনে করতাম যে, অল্প এবং অধিকের পার্থক্য আমি ভালোভাবেই জানি। দীর্ঘকায় কোনো মানুষ যদি ক্ষুদ্রকায় কারুর পার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকত আমি ভাবতাম আমি ঠিকই বুঝতে পারছি এদের একজন অপর জনের চেয়ে একমাথা উচ্চতর; দুটি বিভিন্ন আকারের অশ্ব দেখে বুঝতে পারতাম একটি অপরটির চেয়ে দীর্ঘতর; আমার ধারণা ছিল আমি নিঃসন্দেহে জানি দশ-আটের চেয়ে দু-এ বেশি, দুই হাত এক হাতের চেয়ে দৈর্ঘ্যে অধিকতর, কেননা এক হাতের দ্বিগুণেই দুই হাত।

সিবিস বললেন; উত্তম কথা। এসব বিষয়ে তা হলে বর্তমানে তোমার ধারণা কী?

আজ আমি মনের কোণে এতটুকু ধারণা সৃষ্টি করতে পারি নি যে, এ সমস্ত বিষয়ের কারণ আমি জ্ঞাত হয়েছি। আজ আমি আত্মবিশ্বাস নিয়ে আর বলতে পারিনে যে, একটি একের সঙ্গে যখন আর একটি এক যুক্ত হয় তখন যে-একের সঙ্গে এক যুক্ত হলো সে এক-দুই হয়ে গেল কিংবা বলতে পারিনে যে, এক এবং এক যোগ করলে এই যোগের কারণেই তারা দুই হয়ে যায়। কেননা, আমি আজ আর বুঝিনে যে, যখন তারা পরস্পর ভিন্ন ছিল তখন তারা প্রত্যেকেই ‘এক ছিল কিন্তু যেমনি তাদের জোর করে এক জায়গায় নিয়ে আসা হলো, তখনি কেবল তাদের পরস্পরের এই পাশাপাশি অবস্থানের কারণেই তারা দুই হয়ে গেল। আবার এও আমার বোধের অগম্য যে, একটিকে ভাগ করলে সে দুই কী করে হতে পারে? কেননা, আগে দেখলাম যে পাশাপাশি বসলেই এক-দুই হয় : আর এবার দেখছি এক বিভক্ত হলেই দুই হয়। তা হলে ভিন্নতর কারণ কি একই প্রকার ফল সৃষ্টি করছে না? আর তা ছাড়া এখন আর আমি বুঝতে পারছিনে কেন যা সৃষ্ট হলো, তা সৃষ্ট হলো; কেনই বা যা ধ্বংস হলো; আর কেনই বা তা অস্তিত্বময় হয়ে আছে, তা অস্তিতুময় হয়ে রয়েছে। আমার বর্তমান অবস্থা এরূপ যে, নৃতন জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমি বিভ্রান্ত; আর পুরোনো জ্ঞানের বিশ্বাসের ভিত আমার বিনষ্ট।

কিন্তু এর পরেই আমি দেখতে পেলাম কে যেন এ্যানাক্সগোরাসের একখানা পুস্তক থেকে পড়ছে যে, সব কার্যের পেছনে কারণ হিসাবে রয়েছে মন; সমস্ত বিষয়ের সুবিন্যাসের মালিকও হচ্ছে মন। এ তত্ত্ব শুনে আমি উফুল্ল হয়ে উঠলাম। আমি ভাবলাম খুবই চমৎকার এ তত্ত্ব। আর সত্যই যদি সব বিন্যাসের মালিক হয় মন, তা হলে সে অবশ্যই সব কিছুর উত্তম বিন্যাসেই সম্পন্ন করবে : যার অবস্থান যেখানে সংগত, মন অবশ্যই তাকেই সেখানে বিন্যস্ত করে দেবে। এখান থেকে নিজের মনে আমি এ যুক্তিও দাঁড় করালাম, কেহ যদি এবার কোনো বস্তুর সৃষ্টি, লয় বা অস্তিত্বের কারণ জানতে চায় তা হলে তাকে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে বস্তুর জন্য কোন অবস্থাটি শ্রেয় অস্তিত্ব, ক্রিয়া না ভোগ? মানুষেরও বিবেচনার একমাত্র বিষয় হচ্ছে, কিসে তার নিজের এবং অপর সবার মঙ্গল সাধিত হবে। এই বিবেচনাতে সে উত্তম-অধম উভয়কেই জ্ঞাত হতে পারবে। কেননা, এক বিজ্ঞানেই এই উভয় বিষয়ের আলোচনা। এই ভেবে আমি আরো আনন্দিত হলাম যে, এ্যানাক্সাগোরাসই আমার উপযুক্ত শিক্ষক। তাঁর কাছেই আমি সকল অস্তিত্বের কারণকে জানতে পারব। তিনিই আমাকে জ্ঞাত করাবেন, পৃথিবীটা গোল না চ্যাপ্টা। সবচেয়ে বড় কথা, গোল বা চ্যাপ্টা পৃথিবীটা যাই হোক, এ্যানাক্সাগোরাস আমাকে বলে দেবেন তার অনিবার্য কারণটা কী? তিনি আমাকে বলবেন কোনটি সর্বোত্তম এবং কী কারণে সর্বোত্তম। তিনি যদি এমন বলেন যে, সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পৃথিবী তা হলে তিনি আমাকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করে বলে দেবেন পৃথিবীর পক্ষে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হওয়াই হচ্ছে সর্বোত্তম অবস্থা। তার ব্যাখ্যা আমার মনের সব প্রশ্নকে নিশ্চয়ই শান্ত করবে; এবং অপর কোনো কারণের খোঁজে আমাকে ছুটে বেড়াতে হবে না। এর পরে আমি তার কাছে জানতে পারব সূর্য এবং চন্দ্র এবং তারকাসমূহ কী? তাদের মধ্যে গতিবেগের তারতম্যের বিষয়টি তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করে বলবেন। তার কাছ থেকেই আমি বুঝতে পারব তাদের আবর্তন, তাদের বিভিন্ন অবস্থান এবং তাদের সচেষ্ট-নিশ্চেষ্ট অবস্থাকে। তার ব্যাখ্যাতে বুঝতে পারা যাবে যে, এদের সকলের আপন আপন অবস্থানই সর্বোত্তম। সর্বোত্তমের কথা আমি এজন্য ভাবলাম যে, মন যখন তাঁর নিকট সব কিছুর মূল বিন্যাসকারী তখন সমগ্র জগৎ প্রপঞ্চের বিন্যাসকে তিনি উত্তম বই অপর কিছু নিশ্চয়ই বলতে পারবেন না। আমি ভাবলাম, এরূপে তিনি যখন আমাকে প্রত্যেকটি বস্তু এবং বিষয়ের কারণকে দেখিয়ে দেবেন তখন তিনি আমাকে একথাও বলে দেবেন জগতে প্রত্যেকের জন্য যেমন, সকলের জন্যও তেমনি উত্তম কী? আমার এই বিপুল আশঙ্কা আমি অপর কারুর বিরাট পরিমাণ অর্থের বিনিময়েও বিলিয়ে দিতে পারতাম না। সুতরাং আমি তার সমস্ত পুস্তক সংগ্রহ করে ফেললাম এবং যত দ্রুত সম্ভব, উত্তম-অধমের রহস্য ভেদ করার আগ্রহে, সে সমস্ত পুস্তকের পাঠ আমি সমাপ্ত করে ফেললাম।

কিন্তু কী ভাগ্য আমার! কী বিরাট আশাই না আমি নিজের মনে তৈরি করেছিলাম আর কী বিরাট হতাশাই না আমি পরিশেষে প্রাপ্ত হলাম। এ্যানাক্সগোরাসের ভিতরে আমি যত প্রবেশ করলাম তত দেখতে পেলাম যে, আমার আরাধ্য দার্শনিক মন কিংবা সুবিন্যাসের সব নীতিকেই বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছেন। তাদের জায়গাতে তিনি এনে বসাচ্ছেন বাতাস, ইথার কিংবা পানিকে অথবা অপর কোনো বিকারকে। আমরা দার্শনিক যেন সেই ব্যক্তি যিনি শুরু করলেন এই বলে যে, সক্রেটিসের কার্যাবলির মূল কারণ হচ্ছে মন; কিন্তু যখন তিনি আমার বিভিন্ন প্রকার কার্যের কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেলেন তখন তিনি কেবল এইমাত্র বলতে পারলেন, আমার এখানে উপবিষ্ট হওয়ার কারণ হলো, আমার দেহ গঠিত হয়েছে অস্থি এবং পেশিতে; আমার অস্থিগুলো শক্ত, আর সন্ধিস্থলে তারা বিভক্ত; আমার মাংসপেশি হচ্ছে সম্প্রসারণশীল; অস্থিসমূহ আমার মাংসপেশি দ্বারাই আবৃত; আর মাংসপেশি ও অস্থির ধারক আবরণ হিসাবে রয়েছে আমার দেহের ত্বক; আমার দার্শনিক বললেন, আমার পেশিগুলো যখন সঙ্কুচিত কিংবা প্রসারিত হয়, আমার অস্থিগুলোও তখন তাদের সন্ধিস্থলে উত্থিত কিংবা নমিত হয়, এবং এজন্যই আমি অঙ্গাদিকে সোজা করতে কিংবা ভেঙে বসাতে পারি আর এই কারণেই নাকি আমি বর্তমানে তোমাদের সম্মুখে নতজানু হয়ে উপবিষ্ট রয়েছি। এই হচ্ছে আমার দার্শনিকের পক্ষ থেকে আমার বর্তমান অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা। তোমাদের সঙ্গে আমি যে আলাপে রত রয়েছি এর কারণও তিনি অনুরূপভাবেই শব্দ, বায়ু, আমাদের শ্রবণ-শক্তি কিংবা এরূপ আরো দশ সহস্র কারণের সাহায্যেই ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পাবেন–কেবল আসল কারণটিই তিনি স্মরণ করে উল্লেখ করতে পারবেন না। অর্থাৎ এথেন্সবাসীগণ যে আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করাই শ্রেয় বিবেচনা করেছেন এবং সে কারণেই আমাকে এখানে অবস্থান করে দণ্ড ভোগের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কেবল এই কারণটিই তিনি বলতে ভুলে যাবেন! বস্তুত, ভেবে দেখ, আমার এই অস্থি, মজ্জা, মাংসপেশি এসব অনেক, অনেক দিন পূর্বেই কি মেগারা কিংবা বোশিয়ার ধ্বংস রাজ্যে চলে যেত না? যদি আমি আমার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির ইচ্ছাকেই মেনে চলতাম, যদি আমি পাঠশালার পলাতক বালকের ন্যায় কর্তব্য থেকে পালিয়ে যেতাম; যা মহৎ এবং উত্তম তাকে অনুসরণ করার জন্য রাষ্ট্রদত্ত যে-কোনো দণ্ডকে বরণ করতে যদি আমি সম্মত না হতাম তা হলে কি আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ আমি বহু পূর্বেই মেগারা কিংবা বোশিয়াতে আমার প্রস্থান ঘটে যেত। বস্তুত, উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রেই কারণ এবং শর্তের মধ্যে একটি অদ্ভুত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে একথা বলা যেতে পারে, অস্থি, মাংসপেশি, কিংবা দেহের অন্যান্য অঙ্গ ব্যতিরেকে আমি আমার কোনো উদ্দেশ্য পালন করতে পারি নি। কিন্তু সেখান থেকেই যদি বলা হয় যে, আমি যে উদ্দেশ্য পালন করি কিংবা যে কার্য সাধন করি তা করার কারণই হচ্ছে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ; অর্থাৎ কোনো উত্তমের চিন্তা থেকে আমি কোনো কাজ করিনে, দেহই আমাকে যেমন ইচ্ছা তেমন করায় তা হলে বলব, এরূপ বক্তব্য অলস কিংবা চিন্তাশূন্য কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমার বিস্ময় হচ্ছে এই ভেবে যে, এঁরা কারণ’, এবং শর্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন না। অন্ধকারে তাই তারা একটিকে আর একটি বলে যেমন ভুল করেন, তেমনি একটির নাম অপরটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। এর ফলেই কেউ শূন্যের মধ্যে একটা আবর্তের সৃষ্টি করেনআর পৃথিবীকে মহাশূন্যে স্থির বলে কল্পনা করেন; আবার কেউ বলেন, পৃথিবীকে ধারণ করে রয়েছে বাতাস; বাতাস যেন ধারণ করার একটি পাত্রবিশেষ। যেরূপ সুবিন্যস্তভাবে আমরা সব বিশ্বসংসারকে দেখছি তার পেছনে যে-কোনো মন রয়েছে, কেবল একথাটিই তাদের চিন্তার মধ্যে আসে না। আর তাই মনের মধ্যে অসীম কোনো শক্তির সন্ধান না পেয়ে তারা আশা করেন দ্বিতীয় কোনো পৌরাণিক বীর এ্যাটলাসকে* তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। তাদের আশা তাঁদের এই নূতন এ্যাটলাস পুরাণের সেই বীরের চেয়েও শক্তিমান, স্থায়ী এবং মহৎ হবেন। পরম মহৎ-এর যে স্থির অস্তিত্ব আছে একথা তারা কল্পনাই করতে পারেন না। কিন্তু আমি এই দর্শনে বিশ্বাস করি। এই দর্শনের শিক্ষাই আমি লাভ করতে চাই। কেউ আমাকে এই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন তা হলে আমি তাকে স্বাগত জানাব। কিন্তু সর্বোত্তমের প্রকৃতি কী তা আমি নিজেও আবিষ্কার করতে সক্ষম হই নি। অপর কারো নিকট থেকেও এ শিক্ষা আমি লাভ করতে পারি নি। এই যখন পরিস্থিতি, তখন তোমরা যদি বল, তা হলে কারণের অন্বেষণে দ্বিতীয় উত্তম যে-জবাব আমি পেয়েছি তাকে তোমাদের নিকট আমি প্রকাশ করে বলতে পারি।

[* এ্যাটলাস : গ্রিক উপকথার বীর। জিউস এবং অলিম্পাসবাসী অপরাপর দেবতাগণ পিতা ক্রোনাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলে এ্যাটলাস জিউসের বিরুদ্ধে ক্রোনাসবাহিনীর নেতৃত্ব করেন। এ্যাটলাসের স্কন্ধের উপরই পৃথিবী রক্ষিত বলেও কাহিনীর প্রচলন আছে।]

সিবিস বললেন : তোমার জবাব শুনতে আমাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, সক্রেটিস।

সক্রেটিস বলে চললেন : আমি চিন্তা করে দেখলাম, পরম অস্তিত্বের সাধনায় আমি যখন ব্যর্থ হয়েছি তখন আমার খেয়াল রাখতে হবে কেননা অন্তর-চক্ষুর দৃষ্টিও আমি এবার নষ্ট না করি। কেননা, আমি জানি, যারা পানি কিংবা অপর কিছুর মাধ্যমে সূর্যের প্রতিফলন না দেখে সোজা সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখার চেষ্টা করে তারা। নিজেদের দৃষ্টিশক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুতরাং আমারও আশঙ্কা হচ্ছিল, আমি যদি সত্যের দিকে সোজা দৃষ্টিপাত করি কিংবা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সত্যকে অনুধাবন করতে চাই তা হলে আমার আত্মার দৃষ্টিও সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যাবে। কাজেই আমি স্থির করলাম, মনের আশ্রয় নেওয়া এবং মনের রাজ্যেই সত্যের সন্ধান আমার পক্ষে উত্তম হবে। আমি স্বীকার করি, আমার এ উপমাটি ত্রুটিহীন নয়। কেননা, আমি একথা অবশ্যই বলব না যে, মনের মারফত সত্যের সন্ধান মসিলিপ্ত কাঁচখণ্ডে সূর্য দেখার সদৃশ এবং যারা প্রত্যক্ষভাবে সত্যের সাক্ষালাভ চায় তাদের চেয়ে যারা মনের মরফত দর্শন চাইবে তারা সত্যের অধিকতর বিকৃত দর্শনই লাভ করতে সক্ষম হবে। সে যা হোক, এবার যে পদ্ধতিতে আমি অগ্রসর হলাম তার কথাই বলছি : এবার দৃঢ় এবং মজবুত একটি নীতিকে মূল হিসাবে গ্রহণ করলাম। এবার কারণ কিংবা অপর যে-কোনো বিষয়ের সত্যাসত্যের মাপকাঠি হলো : যে বিষয় আমার এই মূলনীতির সঙ্গে যত বেশি খাপ খাবে আমি তাকে তত অসত্য বলে জ্ঞান করব। হয়তো আমার বক্তব্যের তাৎপর্য তোমাদের নিকট এখন স্পষ্ট হয় নি। আমি বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বলছি।

সিবিস বললেন : যথার্থই বলেছ, সক্রেটিস। তোমার বক্তব্যকে খুব উত্তমরূপে এখনো বুঝে উঠতে পারছিনে।

আমি যা বলতে যাচ্ছি তার মধ্যে নূতনত্ব তেমন কিছু নেই। বস্তুত, আমি সকলের নিকট এবং সর্বত্রই যা বলে আসছি এখনও তাই বলব। পূর্বকার আলোচনাতে এবং অপরাপর আলোচনার ক্ষেত্রেও আমি একথাই বলেছি। আমি মূল কারণেই প্রকৃতিটিকেই উদ্বাটন করতে চাই। কারণে’র চিন্তাই আমার মনকে সর্বদা ব্যস্ত রেখেছে। এই কারণেই প্রকৃতির উঘাটন করতে হলে আমাকে প্রথমে বহুল প্রচারিত এবং সকলের মুখে উচ্চারিত সেইসব পরিচিত শব্দগুলিরই আলোচনা করতে হবে যাদের কথা আমি পূর্বেও উল্লেখ করেছি। আমাকে ধরে নিতে হবে যে, পরম সৌন্দর্য, পরম উত্তম কিংবা পরম মহত্ত্ব বলে কিছু রয়েছে। এরূপ পরম অস্তিত্বকে যদি তুমি স্বীকার কর, তা হলে কারণের প্রকৃতি এবং আত্মার অমরতার প্রমাণও আমি অচিরেই তোমার নিকট উপস্থিত করতে সক্ষম হব।

সিবিস বললেন; সক্রেটিস, তুমি সরাসরি প্রমাণদানেরই চেষ্টা কর; পরম অস্তিত্বকে আমি স্বীকার করে নিলাম।

বেশ, তা যদি হয়, তা হলে আমার আর একটু জেনে নিতে হবে যে, আমার পরবর্তী ধাপটিও তুমি গ্রহণ করবে কিনা? পরম সুন্দরের অস্তিত্বকে আমরা স্বীকার করেছি ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পরম সুন্দর বাদেও যদি কোনো সুন্দরের অস্তিত্ব থাকে তা হলে এই সুন্দর কি মাত্র ততটুকুই সুন্দর নয় যতটুকু পরিমাণ তার মিলন ঘটে পরম সুন্দরের সঙ্গে? আর সব পরম অস্তিত্ব সম্পর্কেও কি একথাই সত্য নয়? কারণের এইরূপ ধারণাকে কি তুমি স্বীকার করবে সিবিস?

সিবিস বললেন : হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি।

এ ছাড়া তথাকথিত জ্ঞানযুক্ত কারণের বিষয় আমি জানিনে এবং তাকে অনুধাবনও করতে পারিনে। কেউ যদি বলে, ফুলের রঙ কিংবা কোনো বস্তুর আকার কিংবা অনুরূপ কিছু হচ্ছে সৌন্দর্যের উৎস তা হলে আমার কিছু বক্তব্য নেই। এসব তত্ত্ব আমাকে বিভ্রান্ত করে। আমি শুধু জানি সৌন্দর্যের অস্তিত্ব ব্যতীত কেউ সুন্দর হতে পারে না। পরম সুন্দর যেভাবেই তার অস্তিত্বকে প্রকাশ করুক না কেন, একথা যথার্থ যে তার অস্তিত্ব এবং অংশদান ব্যতীত কোনো সুন্দরের পক্ষে সুন্দর হওয়া সম্ভব নয়। আমি এ বিশ্বাসে স্থির। হয়তো আমি সরলভাবে কিংবা মূর্খের মতোই এ বিশ্বাসে অটল। তথাপি একথা ঠিক, এই বিশ্বাসই আমার স্থির বিশ্বাস। কী উপায়ে পরমসুন্দর নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে কিংবা অপর অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব দান করে তা আমি সঠিক জানিনে। কিন্তু একথা আমি জোরের সঙ্গেই বলব যে, সুন্দরের মাধ্যমেই সব সুন্দর বস্তু সুন্দর হয়ে দাঁড়ায়। আমার এই জবাবই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জবাব। আমার নিজের কাছেও যেমন অপরের নিকটও তেমনি আমার এক মাত্র জবাব। যাকে আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে দিতে পারি। এ জবাবকে আমি নির্ভুল বলেই গণ্য করি। কেউ একে খণ্ডন করতে পারবে, এ আমি বিশ্বাস করিনে। কাজেই কারুর প্রশ্নের জবাবে অবশ্যই আমি বলব : সুন্দরের মাধ্যমেই সুন্দর হয়ে উঠে। তুমি কি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত হবে, সিবিস?

হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে একমত সক্রেটিস।

ঠিক অনুরূপভাবে, কেবল পরম বৃহতের মাধ্যমেই বৃহৎ বৃহৎ হয়ে উঠে কিংবা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ায়; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রের মাধ্যমেই ক্ষুদ্রতর হয়ে দাঁড়ায়। নয় কি?

যথার্থই।

তাই যদি হয় এবং কেউ যদি বলে ক খ-এর একমাথা উঁচু, কিংবা খ ক-এর চেয়ে একমাথা খাটো তা হলে তুমি নিশ্চয় সেকথা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তাকে বলবে তার ‘উঁচু নিচু’ কিংবা ‘ছোট-বড়’ কথাগুলির তাৎপর্য এই যে, বৃহত্তর বৃহৎ-এর কারণেই বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতর সে ক্ষুদ্রের কারণেই ক্ষুদ্রতর। তোমার এ জবাবের নিরাপত্তার দিকটি হচ্ছে এই যে, এভাবে বললে আর তুমি কারুর মাথা মেপে উঁচু নিচু কিংবা বৃহৎ, ক্ষুদ্র বলার বিপদে পড়বে না এবং ক্ষুদ্র মাথাওয়ালা বৃহৎ মানুষকেও তার মাথার কারণেই বৃহৎ বলার হাস্যকর পরিস্থিতি তোমার ঘটবে না। বস্তুত অনুমানের এরূপ পদ্ধতি গ্রহণে নিশ্চয়ই তুমি শঙ্কিত হয়ে উঠবে। নয় কি?

সিবিস হাসতে হাসতে বললেন : অবশ্যই সক্রেটিস। অনুমানের এরূপ পদ্ধতি ভয়ঙ্কর।

অনুরূপভাবে তুমি নিশ্চয়ই বলতে ভয় পাবে যে, দশ যে আটের চেয়ে অধিক সে কেবল দুই-এরই কারণে, কিংবা দুই হাত যে এক হাতের চেয়ে অধিক সে কেবল এক হাতের জন্য। কিংবা একথা না বলে তুমি হয়তো বলবে, দশ-আটের চেয়ে সংখ্যার কারণে অধিক, এবং দুই হাত এক হাতের চেয়ে পরিমাণের কারণে অধিক। অথচ ভুলের সম্ভাবনা উভয় ক্ষেত্রেই সমান।

একথা ঠিক, সক্রেটিস।

বেশ! তা হলে তুমি যখন বল যে, একের সঙ্গে একের যোগে কিংবা একের বিভাগে দুই হয় তখনো কি তোমার সতর্ক হওয়া আবশ্যক নয়? কিন্তু তুমি হয়তো নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলবে যে, বস্তুত প্রকৃত সত্তার অংশীদার ব্যতিরেকে কোনো বস্তু যে বস্তু হতে পারে এমন তুমি ভাবতেই পারো না। কাজে কাজেই দু-এর দুই হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে সংখ্যার দ্বিত্ব সত্তার সে অংশীদার। দ্বিত্বের প্রকাশ বলেই দুই হচ্ছে দুই। এভাবেই মাত্র দুই-এর সৃষ্টি, যেমন একের সৃষ্টি হচ্ছে একত্বের প্রকাশ মারফত। আমার এ দৃষ্টান্ত পছন্দ না হলে তুমি হয়তো বলবে : যোগ বিয়োগ ভাগের বাধা তুমি রেখে দাও সক্রেটিস। আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী পণ্ডিত যারা আছেন তারা এ নিয়ে তাদের মাথা ঘামাবেন। অনভিজ্ঞ মানুষ আমি। আমি বরঞ্চ প্রবাদ বাক্যের মর্মমতো আমার নিজের ছায়া থেকেই শুরু করব। কেননা, নীতিই আমার ছায়া; নীতির নিশ্চিত ভিত্তিকে আমি পরিত্যাগ করতে পারিনে। নীতির ভিত্তি তোমার অবশ্যই নিশ্চিত। সেখানে যদি কেউ তোমাকে আক্রমণ করে, তা হলে তোমার বিব্রতবোধ করার কোনো কারণ থাকবে না। বরঞ্চ শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তুমি তার সমুচিত জবাবই দিতে পারবে। তোমার আক্রমণকারীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের সময়ে তুমি শুধু লক্ষ রাখবে, যুক্তির যে পরিণতিতে তুমি উপস্থিত হচ্ছ সে পরিণতি প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। তোমার গৃহীত নীতিরও যদি ব্যাখ্যাদানের প্রয়োজন হয়, তা হলে তুমি উচ্চতর অপর এক নীতির মারফত তার ব্যাখ্যা দেবে। উচ্চতর নীতির ব্যাখ্যার জন্য তুমি তার চেয়ে উঁচু অপর এক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করবে। যুক্তির যাত্রায় এমনিভাবে তুমি অগ্রসর হতে থাকবে, যতক্ষণ না সংশয়হীন উচ্চতম নীতির আশ্রয়ে তুমি বিশ্রাম লাভ করতে সমর্থ হও। কিন্তু তুমি যদি সংগতির অনুসারী হও তা হলে কুতার্কিকদের ন্যায় তুমি নিশ্চয় কারণ এবং শর্তের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না। সত্যকার অস্তিত্ব এবং সত্তাকে যদি তুমি আবিষ্কার করতে চাও, তা হলে কারণ এবং শর্তের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা তোমার পক্ষে কোনোক্রমেই সংগত হবে না। অবশ্য যারা অনুসন্ধানের এই বিষয়টির গূঢ়ার্থ নিয়ে কোনো চিন্তাই করে না, যারা চিন্তার সব আলোড়নকে তুচ্ছ করে আত্মসন্তুষ্ট থাকতে সক্ষম তাদের নিকট বিভ্রান্তিরও কোনো তাৎপর্য নেই। কিন্তু তুমি যদি দার্শনিক হও, তা হলে তোমাকে অবশ্যই আমার প্রদর্শিত পথই অবলম্বন করতে হবে।

সক্রেটিসের কথা শ্রবণ করে এই সময়ে সিমিয়াস এবং সিবিস উভয় একই সঙ্গে বলে উঠলেন : সক্রেটিস, তুমি যা বলেছ তা সর্বতোভাবেই যথার্থ।

একিক্রাটিস : প্রিয় ফিডো, তারা দুজনেই যে সক্রেটিসের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। যার সামান্য পরিমাণ জ্ঞানও রয়েছে সে সক্রেটিসের যুক্তির বিস্ময়কর স্পষ্টতাকে অবশ্যই স্বীকার করবে।

ফিডো : একিক্রাটিস, তোমার একথা খুবই সত্য। বস্তুত আমরা, শ্রোতাদের যে দলটি উপস্থিত ছিলাম তাদের সকলের মনের ভাবটি এরূপ ছিল।

একি : শুধু তাদের নয়, আমরা যারা সেদিন উপস্থিত থাকতে পারিনি কিন্তু আজ তোমার মুখে তার বর্ণনা শুনছি তাদের মনেও একই ভাবের সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু তার পরে কী হলো, সেটি বল।

ফিডো : সক্রেটিসের সঙ্গে যখন তারা সবাই একমত হলো এবং এটা স্থির হলো,; ভাবের স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে এবং পার্থিব বস্তুসমূহ সেই অস্তিত্বেরই অংশীদার এবং প্রকাশ, আর ভাবের সেই অস্তিত্ব থেকে বস্তুর নিজ নিজ আখ্যা,–আমার যতদূর স্মরণ হচ্ছে, তখন সক্রেটিস আবার শুরু করলেন :

তুমি তো এভাবেই তোমার বক্তব্যকে প্রকাশ করবে। কিন্তু তুমি যখন বল যে, সক্রেটিসের চেয়ে সিমিয়াস বড় কিন্তু ফিডোর চেয়ে সে ছোট তখন কি তুমি সিমিয়াসের উপর একই সঙ্গে বড়ত্ব এবং ছোটত্ব আরোপ কর না।

হ্যাঁ, তা আমি করি।

কিন্তু তা হলেও তুমি স্বীকার করবে যে, সিমিয়াস সিমিয়াস হওয়ার কারণেই সক্রেটিসকে অতিক্রম করে না। অথচ ‘সিমিয়াস সক্রেটিসের চেয়ে বড় কথাটিতে সেরূপই বুঝায়। আসলে সিমিয়াস সক্রেটিসকে অতিক্রম করে সিমিয়াস হওয়ার কারণে নয়, তার দেহের আকারের কারণেই সে সক্রেটিসকে অতিক্রম করে। কথাটা অন্যদিকে দিয়েও বলা চলে। তুমি বলতে পার যে, সক্রেটিস বলেই যেমন সিমিয়াস তাকে অতিক্রম করে না, তেমনি সিমিয়াস সিমিয়াস বলেও সে সক্রেটিসকে অতিক্রম করে না। প্রকৃতপক্ষে সিমিয়াসের দীর্ঘ দেহের তুলনায় সক্রেটিসের দেহ ক্ষুদ্র বলেই সিমিয়াস সক্রেটিসকে অতিক্রম করে।

তোমার একথা যথার্থ।

অনুরূপভাবে, ফিডো যদি তার চেয়ে আকারে বড় হয় তা হলেও ফিডো এ কারণে বড় নয় যে, সে ফিডোবরঞ্চ বলা চলে আকারে বৃহৎ বলেই ফিডো বড়।

একথাও যথার্থ।

আর এজন্যই সিমিয়াস বড়ও যেমন, ছোটও তেমন। কেননা, সিমিয়াসের অবস্থান হচ্ছে দুজনের মধ্যখানে : সিমিয়াস একদিকে তার বড়ত্ব দিয়ে ছোটত্বকে অতিক্রম করছে; অপরদিকে নিজের ছোট দিয়ে অপরের বড়ত্বকে বড় করছে।

এরূপ বলতে বলতে সক্রেটিস হেসে ফেললেন : আমার কথা শুনতে শুনতে আমাকে নিশ্চয়ই একটি পুস্তক বলে তোমাদের বোধ হচ্ছে। কিন্তু তা হলেও আমি কিন্তু বিশ্বাস করি যে, আমি যা বলছি, তা সত্য।

সিমিয়াস সক্রেটিসের একথায় তার সম্মতি জানালেন।

আমি এরকমভাবে বলছি, তার কারণ আমি মনে করি আমার সঙ্গে একমত হয়ে একথাটিও তোমাদের স্বীকার করা প্রয়োজন যে, কেবল পরম বৃহৎই কোনোক্রমে যে ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ হতে পারে না, তাই নয়; আমাদের নিজেদের কিংবা কোনো বস্তুর বড়ত্বও কখনো হ্রাস পেতে পারে না, কিংবা তার ক্ষুদ্রত্বও বৃহৎ হতে পারে না। বরঞ্চ এরূপ না হয়ে বড়ত্ব এবং ছোটত্বের ব্যাপারটি দাঁড়াবে এরূপ যে, হয় বৃহত্তর তার বিপরীত ক্ষুদ্রতরের সম্মুখ থেকে অপসৃত হয়ে যাবে, কিংবা ক্ষুদ্রতরের আগমনে বৃহত্তর বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো ক্রমেই বিপরীতকে স্বীকৃতির মারফত সে কোনো পরিবর্তিত রূপ গ্রহণ করবে না। যেমন, সিমিয়াসের তুলনায় আমি আমার ক্ষুদ্রতা স্বীকার করি। কিন্তু সে স্বীকৃতি সত্ত্বেও আমার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। আমি সেই ক্ষুদ্র সক্রেটিস হিসেবেই বিদ্যমান থাকি। বৃহত্নপ ভাবটি অপরিবর্তিত ভাব; অর্থাৎ বৃহৎ যেমন সর্বদাই বৃহৎ, ‘বৃহৎ’ যেমন কখনো ‘ক্ষুদ্র’ হতে পারে না, ঠিক তেমনি আমাদের কোনো ক্ষুদ্রতাও ‘বৃহৎ’ হতে পারে না। শুধু ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ নয়। কোনো অপরিবর্তিত বিপরীতই তার বিপরীতে রূপান্তরিত হতে পারে না। পরিবর্তিত হলে হয় সে বিলীন হবে, নয়তো সে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, নিজের সত্তায় সে আর পরিচিত হবে না।

সিবিস বললেন, আমিও সেইরূপই মনে করি।

ফিডো : আমার ঠিক স্মরণ হচ্ছে না আমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি, কিন্তু কোনো একজন, এই সময়ে বলে উঠলেন : দোহাই, সক্রেটিস। তোমার এ উক্তি কি তোমার পূর্বের উক্তির সম্পূর্ণরূপেই বিপরীত হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? কেননা পূর্বেই তো আমরা বলেছি যে, বিপরীতের মধ্য থেকেই বিপরীতের সৃষ্টি হয়; বৃহৎ-এর সৃষ্টি হয় ক্ষুদ্রের মধ্য থেকে, আর ক্ষুদ্রের সৃষ্টি বৃহৎ-এর মধ্যে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি নীতিটিকে পুরোপুরিই অস্বীকার করতে চাচ্ছ।

সক্রেটিস এই বক্তার দিকে ঈষৎ নত হয়ে তাঁর কথাটি প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বলে উঠলেন : তুমি যে আমাদের এ কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ সেজন্য তোমার সাহসের আমি প্রশংসা করি। কিন্তু তুমি খেয়াল করো নি যে, দুটো ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। কেননা, আমরা তখন বাস্তব বৈপরীত্য সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আমাদের বর্তমান আলোচনা হচ্ছে নির্বিশেষে বৈপরীত্য বা বিপরীতের মৌলিক সত্তা নিয়ে। তুমি খেয়াল করছ না যে, বিপরীতের এই সত্তার মধ্যে কখনো কোনো বৈষম্য দেখা দিতে পারে না। পূর্বে আমরা সেইসব বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি, যে অস্তিত্বের সহজাত চরিত্র হচ্ছে বিপরীত-ধর্মী এবং এই চরিত্র অনুযায় যাদের বিশেষ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনা হচ্ছে সেইসব বিপরীত নিয়ে যার মূল এবং সামগ্রিক সত্তাই হচ্ছে বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের জন্যই সে বিপরীত বলে আখ্যাত। কিন্তু এখানে আমরা বলতে চাচ্ছি যে, এই বৈপরীত্যের কোনো পরিবর্তন নেই। এর পক্ষে অপর কিছুতেই পরিবর্তিত হয়ে জন্ম নেওয়া কিংবা অপর কোনো চরিত্র থেকে জাত হওয়া কখনো সম্ভব নয়।

একথা বলে সক্রেটিস সিবিসের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন : কি হে, তুমি কি আমাদের বন্ধুর প্রশ্নে বিব্রত বোধ করছো?

সিবিস বললেন : না, সক্রেটিস, আমি বিব্রত বোধ করছিনে। তথাপি একথাও আমি অস্বীকার করতে পারিনে যে, প্রশ্ন কিংবা বিরোধিতা আমাকে অনেক সময় উদ্বিগ্ন করে তোলে।

তা হলে এ বিষয়ে আমরা স্থির হলাম যে, বৈপরীত্য আপন সত্তার কখনো বিপরীত হয়ে দাঁড়াতে পারে না?

হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমরা পরিপূর্ণ একমত।

তথাপি আর একবার তোমাকে আমি নূতন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। এ প্রশ্নে তুমি আমার সঙ্গে একমত কিনা ভেবে দেখো। তাপ এবং শৈত্য বলে দুটো কথা আছে। ঠিক নয় কি?

হ্যাঁ, অবশ্যই এরূপ দুটি কথা রয়েছে।

কিন্তু তাপ এবং আগুন, আর শৈত্য এবং শিলা কি এক?

না, কিছুতেই নয়।

তাপকে আমরা আগুন থেকে পৃথক মনে করি, আর শৈত্যকেও শিলাখণ্ড কিংবা বরফের সঙ্গে এক মনে করিনে। ঠিক নয় কি?

অবশ্য। তথাপি বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এই, আর একথাটিকে আমরা পূর্বেও উল্লেখ করেছি যে, শিলা যখন তাপের নৈকট্যে আসে তখন শিলা কিংবা তাপ দুটি সত্তার কেউ আর পৃথকভাবে অবস্থান করতে পারে না। তাপের আগমনে হয় শিলা অপসৃত হবে, নয়তো সে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। নয় কি?

এত খুবই সত্য কথা।

তাপ সম্পর্কেও কথাটি অনুরূপভাবেই বলা চলে। শৈত্যের আগমনেও তাপ হয় বিতাড়িত হবে নয়তো সে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। শৈত্যের নৈকট্যেও তাপ, তাপ থাকে না, শৈত্য হিসাবেও বর্তমান থাকে না।

কি বল?

একথাও খুবই যথার্থ।

কিন্তু অনেক সময়ে এমন হয় যে, কোনো বস্তুর নাম যে ভাবানুযায়ী হয় তা নয়। ভাবানুযায়ী তার উপযুক্ত নাম যেমন অনেক ক্ষেত্রে, তেমনি এমন অনেক বস্তু আছে যে, একটি বিশেষ ভাবের নাম আঁকড়ে থাকলেও এই বিশেষ ভাবটি তার মধ্যে থাকে না। একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা আমার কথাকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি : একটি বেজোড় সংখ্যাকে সবসময়ে বেজোড় বলা হয়। নয় কি?

হ্যাঁ, অবশ্য তাকে বেজোড় বলা হয়।

কিন্তু আমরা কি কেবল বেজোড় সংখ্যাকেই বেজোড় বলি? প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরিবেশে এমন অনেক বস্তু আছে, যাদের নিজ নিজ বিশেষ নাম থাকা সত্ত্বেও আমরা তাকে বেজোড় বলি। এর কারণ হচ্ছে, এরা যদি নিজেরা ‘বেজোড় এবং এ সমস্ত বস্তু এক কথা নয়, তবু ‘বেজোড়’ বাদেও এদের অস্তিত্বকে দেখা যায় না। এজন্যই এদেরকেও আমরা বেজোড় বলি। যেমন ধর, সংখ্যা তিন। এ সংখ্যাটি অবশ্য একটি বেজোড়। কিন্তু এর নিজস্ব নাম হচ্ছে তিন। অথচ তিনকে আমরা যেমন তিন বলি, তেমনি আবার একে বেজোড় বলি। কিন্তু বেজোড়’ কথাটি আর তিন কথাটি এক নয়। এভাবে পাঁচকেও আমরা বেজোড় বলি। অথচ তার নাম হচ্ছে পাঁচ। শুধু পাঁচ নয়। প্রত্যেক পাল্টা সংখ্যা সম্পর্কেই একথা সত্য। এরা নিজেরা ভাব হিসেবে ‘বেজোড় না হয়েও বেজোড় বলে আখ্যায়িত। ঠিক এমনি অবস্থা হচ্ছে দুই, চার অর্থাৎ যাদেরকে জোড় সংখ্যা বলি, সেই সংখ্যাগুলোরও। এরা অস্তিত্ব হিসাবে ‘জোড়’ নয়, এরা অস্তিত্ব হিসাবে দুই কিংবা চার। তথাপি এরাও জোড়’ বলে অভিহিত। আমার এ ব্যাখ্যাটি কি তুমি গ্রহণ কর?

সিবিস বললেন : অবশ্যই।

এবার তা হলে আমি আসলে যা বলতে চাচ্ছি সেটি খেয়াল করে দেখ। আমি বলতে চাচ্ছি : তা হলে কেবল একথাই নয় যে, বৈপরীত্য আর বিপরীত হতে পারে না। বস্তুত বাস্তব কিংবা মূর্ত যে-বস্তু বিপরীত, অর্থাৎ সত্তা হিসাবে যারা বিমূর্ত, বৈপরীত্য না হলেও যাদের বিপরীতের ধর্ম রয়েছে, তারাও তাদের বিপরীতকে স্বীকার করতে পারে না। অর্থাৎ এদের আপন চরিত্রের বিপরীত-ধর্ম অপর বস্তুর সংঘর্ষে এরা লয় পাবে কিংবা বিতাড়িত হবে তবু একে অপরকে গ্রহণ করবে না; কিংবা একটি পরিবর্তিত হয়ে অপরটি হবে না। যেমন ধর সংখ্যা তিনের কথা। তিন কি কখনো তিন হিসাবে অস্তিত্বমান হয়ে দুইকে গ্রহণ করে দুই-এ পরিণত হবে? কিংবা তার চেয়ে বরঞ্চ সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চাইবে? অবশ্যই সে দু-এ রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বে নিজেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। নয় কি?

অবশ্যই।

কিন্তু তাই বলে কি তুমি দুইকে তিনের বিপরীত বলবে?

না, তা নয়।

তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেবল বিপরীত ভাবই যে পরস্পরকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে তাই নয়। অপরাপর বস্তুও তাদের বিপরীতকে কখনো নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করে না। তারাও বিপরীতের আগমনকে প্রতিহত করে।

তোমার একথা খুবই সত্য।

এস না, যদি সম্ভব হয়, আমরা এদেরও চরিত্র নির্ধারণ করার চেষ্টা করি?

নিশ্চয়ই। তা আমরা করতে পারি।

সিবিস, এরা কি আসলে সেই ধরনের চরিত্র নয়, যে চরিত্র শুধু আপন গৃহীত কিংবা আহ্বত চরিত্রের সন্তুষ্ট নয়; বরঞ্চ যারা আপন চরিত্র বহির্ভুত চরিত্রকেও নিজের চরিত্রের সামিল করে তুলতে চায়?

তুমি কি বলতে চাচ্ছ সক্রেটিস?

আমি বলতে চাচ্ছি যে, তিন শুধু ‘তিন’কে পেয়েই সন্তুষ্ট নয়, সে ‘বেজোড়’কেও চায়। আমার কথা নূতন কিছু নয়। কিছু পূর্বেই আমি বলেছি। আর তুমি তাকে স্বীকার করেছ।

হ্যাঁ, তোমার একথা সত্য।

আর তিন যখন নিজের গায়ে ‘বেজোড়ের’ ছাপ এঁকে দিল তখন ‘বেজোড়ের বিপরীত কেউ আর এখানে এসে মাথা গলাতে পারবে না।

না, তা পারবে না।

কিন্তু এ ছাপটি তো বেজোড় থেকেই প্রাপ্ত?

হ্যাঁ, তা বটে।

আর জোড়ই তো বেজোড়ের বিপরীত।

হ্যাঁ, জোড় হচ্ছে বেজোড়ের বিপরীত।

তা হলে জোড় সংখ্যা কখনো তিনের মধ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না?

না, সে তিনের মধ্যে কখনো প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না।

তা হলে জোড়ের মধ্যে তিনের কোনো জোড় নেই?

না, তিনের মধ্যে তার কোনো জোড় নেই।

তা হলে ত্রিত্ব বা তিন বেজোড়?

হ্যাঁ তিন বেজোড়।

তা হলে আবার আমাদের সেই ‘বিপরীতের কথা উল্লেখ করা যাক। আমি বলেছি যে, শুধু যে বিপরীতই তার বিপরীতকে স্বীকার করে না, তাই নয়। যে-ভাব বা অস্তিত্ব পরস্পর বিপরীত নয় তারাও আপন চরিত্র থেকে ভিন্নতর কোনো চরিত্রকে স্বীকার করে না। যেমন ধরে তিনের দৃষ্টান্ত। তিন জোড়ের বিরোধী নয়, তবু জোড়কে সে নিজে তো গ্রহণ করবেই না, বরঞ্চ জোড়ের বিরোধী ভাবকেই জোড়ের বিরুদ্ধে সে সক্রিয় করে তুলবে। অথবা ধর দুই-এর দৃষ্টান্ত। দুই কখনো বেজোড়কে স্বীকার করে না, যেমন স্বীকার করে না আগুন শীত বা ঠাণ্ডাকে। এরূপ দৃষ্টান্ত আরো উল্লেখ করা যায়। এই দৃষ্টান্তগুলি থেকে আমরা এই সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে, কেবল বিপরীতই যে বিপরীতকে গ্রহণ করে না তা নয়; বরঞ্চ যেভাব তার বিরোধী ভাবের সৃষ্টি করে সে ভাবও ঐ বিরোধী ভাবকে স্বীকার করে না। এখানে আমাদের পুরোনো কথাগুলি আর একবার স্মরণ করে নিতে পারি। পুনরাবৃত্তি আমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করবে না। পাঁচ যেমন জোড় কোনো সংখ্যাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে না, তেমনি পাঁচের দ্বিগুণ দশও কোনো বেজোড়কে গ্রহণ করে না। অথচ দ্বিগুণ এবং বেজোড় ভাব দুইটি পরস্পর বিরোধী নয়। কেননা, দ্বিগুণের বিপরীত ভাব বেজোড় নয়। অথচ দশও বেজোড়কে সম্পূর্ণরূপেই প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ৩ : ২-এর অনুপাতও একে অপরকে গ্রহণ করে না। যে ভগ্নাংশে অর্ধেক কিংবা এক তৃতীয়াংশের ভাব রয়েছে সেও স্বীকার করে না তাই বলে কি তুমি এদেরকে সমগ্রের বিরোধী বলবে? নিশ্চয়ই তা বলবে না। আমি তো এরূপ বোধ করি। তুমি কি আমার মত স্বীকার করবে?

হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমি তোমার মতকে পুরোপুরিই স্বীকার করি।

তা হলে আবার শুরু করা যাক। এখান থেকে আমাদের অগ্রসর হওয়ার একটি শর্ত তোমাকে স্বীকার করে নিতে হবে। আমি তোমাকে অবশ্যই প্রশ্ন করব। কিন্তু নিরাপদ জবাব হিসাবে আমার প্রশ্নের ভাষাতেই যেন তুমি তোমার জবাব দিয়ো না। এই নিরাপদ জবাবের কথা আমি পূর্বেও বলেছি। তোমার জবাব নিরাপদ না হয়ে যেন নিশ্চিত হয়। যেমন ধর, কেউ যদি তোমাকে প্রশ্ন করে : দেহকে উষ্ণ করে এমন বস্তু কী, যার অনুমান করা চলে? এর নিরাপদ এবং চিন্তাহীন জবাব হচ্ছে দেহকে উষ্ণ করে তাপ। কিন্তু এর চেয়েও উত্তম জবাব দানের পর্যায়ে নিশ্চয়ই আমরা এখন এসে পৌঁছেছি। অথবা ধর তোমাকে কেউ প্রশ্ন করল : দেহ রোগা হয় কেন? তুমি নিশ্চয়ই জবাবে বলবে না যে, দেহ রোগা হয় রোগের কারণে। তোমার বলা উচিত হবে, জ্বরের কারণেই দেহের রোগ। অনুরূপভাবে বেজোড় সংখ্যার কারণ হচ্ছে বেজোড়–একথা বলে তুমি বলবে বেজোড় সংখ্যার কারণ হচ্ছে সংখ্যার মৌল সত্তা। সমস্ত বিষয় সম্পর্কে এভাবে বলা চলে। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে, এর অধিক দৃষ্টান্ত না দিলেও তুমি আমার বক্তব্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারবে।

হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমি তোমাকে যথার্থই অনুধাবন করতে পারছি।

তা হলে, এবার তুমি আমায় বল : কিসের কারণে দেহ জীবিত হয়ে উঠবে?

সে অবশ্যই আত্মা।

সব সময়ের জন্য কি একথা সত্য?

হ্যাঁ, সব সময়ের জন্যই সত্য।

তা হলে আত্মার যা কিছু অধিকার, আত্মা তাতেই জীবন সঞ্চার করে?

অবশ্যই।

বেশ, জীবনের বিপরীত কিছু আছে কি?

হ্যাঁ, জীবনের বিপরীত নিশ্চয় আছে।

কে জীবনের বিপরীত?

জীবনের বিপরীত মৃত্যু।

কিন্তু আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে আত্মা দেহের মধ্যে যা বহন করে আনে তার বিপরীতকে সে স্বীকার করে না?

সিবিস বললেন : না, আত্মার পক্ষে তার বিপরীতকে স্বীকার করা অসম্ভব।

কিছু পূর্বে আমরা একটি নীতির কথা উল্লেখ করেছি যার ফলে জোড়ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। কি সে নীতিটি?

সে হচ্ছে বেজোড়।

কিন্তু ন্যায় কিংবা সুরকে অস্বীকার করে কে?

অন্যায় এবং অ-সুর।

কিন্তু যে মৃত্যুকে অস্বীকার করে তাকে আমরা কী বলি?

তাকে বলি অমর।

বেশ, আত্মা কি মৃত্যুকে স্বীকার করে?

না, তা সে করে না।

তা হলে আত্মা অমর।

তা হলে এবার আমরা বলতে পারি যে, ‘আত্মা অমর’ এ প্রতিপাদ্য প্রমাণিত হলো।

হ্যাঁ, সক্রেটিস এবার আমরা বলতে পারি যে, ‘আত্মা অমর’ একথা যথার্থভাবেই প্রমাণিত হয়েছে।

আচ্ছা ধর ‘বেজোড়’ ভাবটিও ধ্বংসের অতীত, তা হলে বেজোড় তিনও কি ধ্বংসের অতীত বলে বিবেচিত হবে না?

অবশ্যই সে ধ্বংসের অতীত বলে বিবেচিত হবে।

অনুরূপভাবে যদি শৈত্য ভাবটিও ধ্বংসের অতীত হয়, তা হলে উষ্ণতা যখন বরফখণ্ড শৈত্যকে আক্রমণ করতে উদ্যত হবে তখন শৈত্য কি দ্রবীভূত না হয়ে নিজের অস্তিত্বকে বজায় রেখে অপসৃত হয়ে যাবে না? অপসরণ ব্যতীত তার পক্ষে আর কি করা সম্ভব? কেননা, শৈত্য কখনো ধ্বংস হতে পারে না, আবার শৈত্য, শৈত্য হিসাবে উষ্ণতাকে নিজের অস্তিত্বে গ্রহণও করতে পারে না। যথার্থ নয় কি?

অবশ্যই যথার্থ।

যে-অমর তার সম্পর্কেও একথা সত্য। কেননা, যে-অমর সে যদি ধ্বংসের অতীত হয় তা হলে মৃত্যুর আক্রমণে অমর আত্মা ধ্বংস হতে পারে না। কারণ, পূর্বের যুক্তিতেই আমরা দেখেছি, তিন কিংবা বেজোড় যেমন জোড়কে কখনো স্বীকার করতে পারে না, আগুন কিংবা আগুনের তাপ যেমন ঠাণ্ডাকে স্বীকার করতে পারে না, ঠিক তেমনি আত্মা কখনো মৃত্যুকে স্বীকার করতে পারে না কিংবা আত্মার কখনো মৃত্যু হতে পারে না। আমাদের একথার পরেও কেউ বলতে পারে : “স্বীকার করি, বেজোড় জোড়ের আগমন বা আক্রমণের ফলে কখনো জোড় হবে না। কিন্তু তাই বলে এমনকি করে বলা চলে যে, বেজোড় আদৌ ধ্বংস হয়ে যাবে না বরং ধ্বংসপ্রাপ্ত বেজোড়ের স্থানে জোড় কখনো আসন গ্রহণ করতে পারবে না?” যে এমন আপত্তি উত্থাপন করে তার কি জবাব হবে? এখানে তার জবাব আমারা বলতে পারিনে, বেজোড় অবিনশ্বর। কেননা এরূপ কথা আমরা পূর্বে বলি নি। এটি যদি আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত হতো, তা হলে এই আপত্তির জবাব হিসাবে আমরা সহজেই বলতে পারতাম যে, জোড়ের আগমনে নীতি হিসাবে বেজোড় এবং সংখ্যা হিসাবে তিন অপসৃত হয়ে যায়। সিদ্ধান্তটি পূর্বে গৃহীত হলে শুধু জোড়, বেজোড়ের ক্ষেত্রে নয়, অগ্নি, ঘৃণা প্রভৃতি যে-কোনো বিষয়ে তাকে আমরা প্রয়োগ করতে সক্ষম হতাম।

সক্রেটিস, একথা খুবই সত্য।

তা হলে যে অমর তার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। এবং অমর যদি অবিনশ্বর হয় তা হলে আত্মা অবশ্যই অমর এবং অবিনশ্বর। কিন্তু অমরের ক্ষেত্রে একথা যদি সত্য না হয় তা হলে তার অবিনশ্বরতার ভিন্নতর কোনো প্রমাণ আমাদের উপস্থিত করতে হবে।

সিবিস বললেন, না, সক্রেটিস, অপর কোনো প্রমাণেরই আবশ্যক নেই। কেননা, অমর শাশ্বত হয়েও যদি নশ্বর হয় তা হলে কোনো ভাবকেই আমরা অবিনশ্বর বলতে পারিনে।

সক্রেটিস বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, সিবিস। সকল মানুষই একথা স্বীকার করে যে, পরম স্রষ্টা এবং জীবনের পরম সত্তা আর অমরতার কোনো ধ্বংস নেই।

সিবিসি বললেন, হ্যাঁ, শুধু সকল মানুষ নয়, আমি বলব স্বর্গের দেবতাগণও একথা স্বীকার করেন।

কাজেই অমর যদি অবিনশ্বর হয়, তা হলে আত্মা যখন অমর তখন আত্মাও কি অবিনশ্বর নয়।

অবশ্যই সে অবিনশ্বর।

তা হলে কি আমরা বলতে পারিনে যে, মৃত্যু যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন মানুষের নশ্বর অংশের মৃত্যু ঘটলেও তার অমর এবং অবিনশ্বর অংশের মৃত্যু ঘটে না; বরঞ্চ মৃত্যুর আগমনে সে দেহকে পরিত্যাগ করে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে?

যথার্থই আমরা তা বলতে পারি।

সিসি, তা হলে একথা কি সন্দেহাতীত যে, আমাদের আত্মা অমর এবং অবিনশ্বর; একথা নিশ্চিত হবে যে, আমাদের আত্মা লোকান্তরে অবশ্যই অস্তিত্বশীল হয়ে বিরাজ করতে থাকবে।

সিবিস বললেন; এ সম্পর্কে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই, সক্রেটিস। কিন্তু প্রিয় সিমিয়াস কিংবা অপর কারুর যদি কোনো আপত্তি থাকে তা হলে নীরব না থেকে তাদের তা প্রকাশ করে বলা উচিত। কেননা, এ সম্পর্কে কারুর যদি কিছু বক্তব্য থাকে কিংবা কেউ যদি তোমার মুখে আর কিছু শুনতে চান তা হলে তাকে প্রকাশ করার এই হচ্ছে একমাত্র মুহূর্ত। কোনো কথাকে স্থগিত রাখার ন্যায় কোনোদিন আর মিলবে বলে আমি বোধ করিনে।

এবার সিমিয়াস বললেন : আমারও আর কিছু বলার নেই। যা বলা হয়েছে তার পরে সন্দেহের কোনো কারণ থাকতে পারে বলে আমি মনে করিনে। কিন্তু একটি বিষয়ে আমার মনে এখনও প্রশ্ন জাগে; এখনও আমি একটি বিষয়ে সন্দেহাকুল না হয়ে পারিনে। বস্তুত আমি যখন তাদের আলোচিত বিষয়ের বিরাটতা সম্পর্কে চিন্তা করি তখন তার তুলনায় মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখে অসহায় বোধ না করে পারিনে।

একথায় সক্রেটিস জবাব দিলেন, বিষয়টিকে তুমি সুন্দরভাবে বলেছ সিমিয়াস। তোমার কথার উপরে আমি শুধু এই বলতে চাই যে, প্রতিপাদ্য মূলনীতি সত্য বলে বোধ হলেও তাকে সতর্ক বিশ্লেষণ এবং বিচারের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে হয়। বিচারের মারফত তুমি যদি সন্তোষজনকভাবে তাকে প্রতিপন্ন করতে পার তা হলে নিজের বিশ্বাসের ইতস্ততা নিয়েও তুমি যুক্তির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে পার। এই অনুসরণের বিষয়টি যদি সহজ এবং সুস্পষ্ট বলে বোধ হয় তা হলে আর তোমার সংশয়ের কারণ থাকবে না, বিরামহীন জিজ্ঞাসারও বিরাম ঘটবে।

একথা খুবই সত্য। কিন্তু প্রিয় বন্ধুগণ! আর একটি বিষয়েরও বিবেচনা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মা যদি যথার্থই অমর হয়, তা হলে কেবল আমাদের জীবনকালের জন্যই নয়, অনন্তকালের জন্যও সে আত্মার যত্ন কি আমাদের করা কর্তব্য? আবার যত্ন না করে আমরা যদি আমাদের সেই আত্মার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করি, তা হলেও আমাদের জন্য কী ভয়ঙ্কর বিপদ সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়টিও তো আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। মৃত্যুতেই যদি সব শেষ হয়ে যেত, তা হলে অসৎ-এর মৃত্যু সম্পর্কে আনন্দ বই চিন্তার কিছু থাকতো না। কেননা, তখন সানন্দে সে ভাবতে পারতো, তার আত্মা এবং অসৎ জীবন সবই দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন স্পষ্টতই যখন প্রমাণিত হচ্ছে যে, আত্মা অমর, তখন পরম জ্ঞান এবং ন্যায়কে লাভ করার সাধনা ব্যতীত কারুর পক্ষেই তো মোক্ষ কিংবা মুক্তি লাভ আর সম্ভব নয়। কারণ আমাদের আত্মা যখন পাতাললোকে যাত্রা শুরু করে, তখন সে শিক্ষা এবং সাধনা ব্যতীত অপর কাউকেই সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করে না। শিক্ষা এবং সাধনাই তার সঙ্গী, কেননা লোকান্তরিত আত্মার যাত্রার শুরু থেকে এরাই তার কোনো মহৎ উপকার কিংবা বৃহৎ অপকার সাধনে সক্ষম।

তার কারণ, যার যেরূপ ধর্ম সে তার কাছ থেকে সেরূপ সাহায্যই পেয়ে থাকে। আত্মার লোকান্তর যাত্রার কাহিনী তো আমরা জানি। মৃত্যুর পরে মৃতের নিজ নিজ ধর্ম মৃতকে পথ দেখিয়ে একটি স্থানে নিয়ে আসে। এখানেই মৃতের বিচার হয়। বিচার শেষে মৃতের যাত্রা শুরু হয় পাতালপুরীর পথে। পাতালপুরীর পথ সোজা নয়। কোথাও সে সোজা : কোথাও সে বক্র। কোথাও তিন সড়কের সঙ্গম হাতে সৃষ্টি হয়েছে সঙ্কটের। পথ প্রদর্শক ব্যতীত পাতালপুরীতে মৃতের পথ চলা দুরূহ। এজন্য বিচারালয় থেকে নির্ধারিত পথ প্রদর্শক মৃতকে লোক থেকে লোকান্তরে নিয়ে যায়। লোকান্তরে যুগের পর যুগ কাটে মৃতের। তার পরে পথপ্রদর্শক আবার তাকে ফিরিয়ে আনে মর্ত্যলোকে।’ এসকিলাস তার ‘টেলিফাসে যেরূপ বর্ণনা করেছেন লোকান্তরের সড়কগুলো যদি অমনি সরল আর সোজা হতো তা হলে মৃতের জন্য আর পথ প্রদর্শকের কোনো আবশ্যক হতো না। কেননা, তখন মৃতের পক্ষে পথ হারাবার আর কোনো আশঙ্কা থাকত না। কিন্তু পাতালপুরীর ঘাটে ঘাটে যেরূপ যাগ-যজ্ঞ আর বলিদানের ব্যাপার দেখা যায় তাতে পথের বিপদ তেমন কম বলে বোধ হয় না। কিন্তু যে-আত্মা জ্ঞানী আর নিয়মচারী তার পথভ্রষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। সে সোজা পথে অগ্রসর হয় আর তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কেও সে থাকে সচেতন। কিন্তু যে-আত্মা দেহের বাসনায় আসক্ত, যে প্রাণহীন দেহ আর দৃশ্যমান জগৎকে ঘিরে কাল ক্ষেপণ করেছে তার কষ্ট এবং দুর্ভোগের শেষ নেই। তার পথ-প্রদর্শক তাকে জবরদস্তির সঙ্গে টেনে নিয়ে আসে সকল আত্মার সম্মেলন ক্ষেত্রে। কিন্তু যদি সে অপবিত্র হয়, কলুষকার্যে, হত্যায় আর পাপাচারে যদি তার জীবন অতিবাহিত হয়ে থাকে তা হলে তার সঙ্গ থেকে অপর সবাই পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাকে পরিত্যাগ করে সরে যায়। এমন আত্মার অবস্থা হয় করুণ। সেই পাতালপুরীর সঙ্কটাকুল পথে কেউ তার সঙ্গী হবে না, কেউ তার পথপ্রদর্শক থাকবে না। সঙ্গীহীন অপবিত্র সেই আত্মা উদ্দেশ্যহীনভাবে পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াবে। এই তার দণ্ড। দণ্ডের কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমনি তার ভোগ। কাল অবশেষে তার প্রাপ্য জীবনে ঘটবে আবার তার অনিবার্য জন্ম। কিন্তু পবিত্র এবং ধার্মিক যে-আত্মা, যে জীবন ব্যয় করেছে ধর্মের নির্দেশিত পথে তার উপযুক্ত বাসভূমি লাভ করতে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।

মর্ত্যলোকের কথাও কিছু আলোচনা করা যাক। মর্ত্যলোকের রয়েছে নানা বিস্ময়কর ভূখণ্ড। বস্তুত তোমাদের ভৌগোলিকগণ যা বলেন আমাদের পৃথিবী তার চেয়ে, প্রকৃতি আর পরিধি উভয়দিক দিয়েই, ভিন্নতর। আমার এ অভিমত ভিত্তিহীন নয়। এ অভিমতের পেছনে রয়েছেন জাদরেল এক পণ্ডিত। তার নামটি আমি তোমাদের নাই বা বললাম।

সিমিয়াস আশ্চর্য হয়ে বললেন : এ তুমি কী বলছ,

সক্রেটিস : পৃথিবীর অনেক বর্ণনা আমিও পাঠ করেছি। তুমি কোনটিতে বিশ্বাসী, তাই আমাদের প্রকাশ করে বল।

সক্রেটিস বললেন, সিমিয়াস, গ্লকসের দক্ষতা যদি আমার থাকত, তা হলে হয়তো আমি তোমাদের সেকথা বলে চমৎকৃত করে দিতে পারতাম। অবশ্য গ্লকসের দক্ষতাও যে আমার কাহিনীর সত্যতাকে প্রমাণ করতে সমর্থ হতো এমন ভরসা আমি বোধ করছিনে। আমার নিজের সে ক্ষমতা নেই, তা আমি জানি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, তেমন ক্ষমতা যদি আমার থাকত তা হলেও আমার যুক্তির সমাপ্তির পূর্বেই তো আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। অবশ্য আমি আমার ধারণানুসারে পৃথিবীর আকৃতি এবং বিভাগ সম্পর্কে কিছু বলতে পারি।

সিমিয়াস বললেন, তাই বল সক্রেটিস। তোমার সেকথাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

সক্রেটিস বললেন : বেশ বলছি। আমার প্রথম বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, পৃথিবী গোলাকার এবং সে মহাকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে সংস্থাপিত। এজন্যই হাওয়া কিংবা অপর কোনো শক্তি তাকে ধারণ করে রাখবে, এমন কোনো আবশ্যকতা আমি দেখিনে। পৃথিবী শূন্যে রয়েছে, তথাপি যে সে কোনোদিকে বিন্দু পরিমাণ কাত হয় না কিংবা নিচে পড়ে যায় না, তার কারণ বাতাসের বহনশক্তি নয়। মহাকাশে পৃথিবী যে পরিবেষ্টনে সংস্থাপিত তার সমতা এবং পৃথিবীর আপন ভারসাম্যই তাকে আপন অবস্থানে অবস্থিত রাখতে সক্ষম। কারণ, যে-দ্রব্যে রয়েছে ভারসাম্য আর সমবিন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে যে সংস্থাপিত সে কোনোদিকেই নত হয়ে পড়ে না; সে কখনও বিপথগামী হয় না, আপন অবস্থানে সে থাকে সর্বদাই অটল।

সিমিয়াস বললেন, সক্রেটিস তোমার এ অভিমত তো খুবই যথার্থ।

আমি আরো বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর বিস্তার হচ্ছে বিপুল। ফাঁসিস নদী থেকে হিরাক্লিসের স্তম্ভ পর্যন্ত যে ভূখণ্ডে আমরা বাস করি সে ভূখণ্ড আসলে সমুদ্রের তীরবর্তী পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। পিপীলিকা কিংবা ভেক সম্প্রদায় যেমন জলাভূমির প্রান্তবর্তী কোনোস্থানে বাস করে, আমরাও সেরূপ। এরূপ স্থান পৃথিবীতে আরো আছে এবং সে সমস্ত স্থানে বসবাসকারী মানুষও রয়েছে। বস্তুত পৃথিবী-পৃষ্ঠের সর্বত্র বিভিন্ন গঠন ও আকৃতির গুহা এবং গহ্বর আছে। এ সমস্ত গহ্বরেই পানি, কুয়াশা এবং বাতাসের নিম্নাংশ জড়ীভূত হয়। কিন্তু পৃথিবীর প্রকৃত ভাগ যে-টি তার অবস্থান বিশুদ্ধ মহাকাশে। তারকারাজি রয়েছে। তাদের কথাও আমাদের চিন্তা করতে হয়। যাকে আমরা মহাকাশ বলেছি একেই আবার আমরা সাধারণত ‘ইথার’ বলে অভিহিত করি। আমাদের পৃথিবী হচ্ছে মহাশূন্যের নিম্নভাগের গহ্বরে ইথার-তলানির পুঞ্জবিশেষ। আসলে আমরা রয়েছি এই গহ্বরেরই মধ্যে। কিন্তু আমরা মিথ্যা বিশ্বাসে নিজেদের প্রতারিত করে ভাবি, ভূ-গহ্বরে নয়, ভূপৃষ্ঠেই আমাদের অবস্থান। আমাদের অবস্থা হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের সেই প্রাণীর ন্যায় যে মনে করে, সে সমুদ্রের নিচে নয়, সমুদ্রপৃষ্ঠেই সে ভেসে বেড়াচ্ছে। পানির মধ্য দিয়ে সূর্য আর তারকার কিরণ তার চোখে পড়ে। কিন্তু সেভাবে সোজাই সে আকাশকে এবং তার সূর্য এবং তারকাকে দেখতে পাচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশের এই প্রাণীর কী করুণ অবস্থা। সে নিজেকে এইরূপ প্রতারিত করে। আসলে সে দুর্বল। মন্থর তার গতি। সমুদ্রের পৃষ্ঠদেশে সে কোনোদিন চোখ বুলাতে পারল না। পানিরাশি ভেদ করে সে মাথা তুলে দেখতে পারল না, এমনকি যে দেখেছে তার কাছ থেকে শুনতে পাওয়ার ভাগ্যও সে পেল না যে, তার নিজের জগতের চেয়ে সত্যকার সমুদ্রপৃষ্ঠের জগৎ কত সুন্দর আর কত পবিত্র। ঠিক এমনি হচ্ছে আমাদের অবস্থা। আমরা বাস করছি পৃথিবীর একটা গুহার ভিতরে, কিন্তু নিজেদের প্রতারিত করছি এই ভেবে যে, আমরা রয়েছি পৃথিবীর পৃষ্ঠেই। সমুদ্রতলের প্রাণীর ন্যায় বাতাসকে বলি আমরা আকাশ আর মনে করি তারকারাজি সেই আকাশেই বিচরণ করছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমাদের শক্তির দুর্বলতা আর গতির মন্থরতার জন্য আমরা এই বাতাসের ঊর্ধ্বে আদৌ মাথা তুলতে পারলাম না। কেননা, মানুষ যদি তার এই বহিরাবরণের প্রান্তে এসে দাঁড়াতে পারত, কিংবা থাকত যদি তার পাখির পাখা আর তাতে ভর করে যদি সে উঠে আসতে পারত সব অতিক্রম করে, তা হলে সমুদ্রতলের যে মাছটি সমুদ্রের উপর মাথা তুলে বিস্ময়ের চোখে দেখেছিল সমুদ্রকে, সেই মাছটির ন্যায় মানুষও দেখতে পেত তাকে অতিক্রমকারী বিপুল আর এক পৃথিবীকে; এবং তখন তার দৃষ্টির সহ্য করার যদি ক্ষমতা থাকত তা হলে সে উপলব্ধি করত যে, এই পৃথিবীতেই রয়েছে সত্যকার মহাকাশ, এখানেই রয়েছে প্রকৃত আলো; এখানকার জগই সত্যকার জগৎ। কেননা, আমাদের পৃথিবী, তার মাটি, তার উপলরাশি আর তার পরিপার্শ্বে সবই দূষিত, সবই ক্ষয়গ্রস্ত। সমুদ্রের লবণাক্ততা যেমন তার মধ্যকার সকল বস্তুকে ক্ষয় করে দেয়, ঠিক অনুরূপভাবে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই পৃথিবী আর তার বস্তুপুঞ্জ। মহৎ বিকাশ কিংবা বৃদ্ধির সাক্ষাৎ তুমি এখানে কখনো পাবে না। এখানে পাবে তুমি গুহা, আর গর্ত, পাবে বালুরাশি আর পঙ্কপিণ্ড। আমাদের সেই মরচেধরা পৃথিবীর তীরভূমিকেও তুমি তুলনা করতে পার না এই ঊর্ধ্বলোকের পৃথিবীর দৃশ্যসমূহের সঙ্গে। বস্তুত কোনোক্রমেই এই দুই পৃথিবীর একটির সঙ্গে অপরটির তুলনা সম্ভব নয়। মহাকাশের নিম্নদেশে অবস্থিত ঊর্ধ্বলোকের সেই পৃথিবী সম্পর্কে একটি মনোরম গল্প আমি তোমাদের বলতে পারি, সিমিয়াস। গল্পটি শোনার মতো গল্প, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সিমিয়াস বললেন, সক্রেটিস, তোমার মুখে সে গল্প শ্রবণ করে অবশ্যই আমরা মোহিত হবো।

সক্রেটিস বললেন, গল্পটিকে এভাবে বলা যায়; ঊর্ধ্বদেশ থেকে তুমি যখন পৃথিবীকে দেখবে তখন তাকে তোমার নিকট বহু বর্ণমণ্ডিত দ্বাদশ চর্মরেখায় আবৃত একটি গোলকবিশেষ বলে বোধ হবে। পৃথিবীর শিল্পীগণ যে রঙের ব্যবহার করেন তাদের সে রং এই রং থেকেই প্রাপ্ত। কিন্তু ঊর্ধ্বদেশের সে রং আমাদের এই রঙের চেয়ে উজ্জ্বলতা এবং চমৎকারিত্বে অনেক বেশি ভাস্বর। বিস্ময়কর জ্যোতির্ময় রক্তবর্ণ যেমন সেখানে দৃষ্ট হয়, তেমনি সেই বর্ণমালার মধ্যে দৃষ্ট হয় স্বরবর্ণ আর পৃথিবীর শুদ্রের চেয়েও শুভ্র, খড়িমাটি কিংবা তুষারের চেয়েও শুভ্র এক শুভ্রবর্ণ। এইরূপ সব বর্ণ সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ঊর্ধ্বলোকের সেই পৃথিবী! সে বর্ণের যেমন সংখ্যা নেই, তেমনি তার সৌন্দর্য এত বিস্ময়কর যে মানুষের চোখে এমন সৌন্দর্য কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য লাভ করে নি। যে-গহ্বরের কথা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি সে সমস্ত গহ্বর বর্ণময় বাতাস এবং পানিতে পূর্ণ। বাতাস এবং পানির এ রং থেকে বিশিষ্ট। বর্ণবৈচিত্র্যের মধ্যে বাতাস এবং পানির এই রংকে মনে হবে একটি উজ্জ্বল আলোর রেখার মতো। আলোর এই রেখাঁটি যেন সকল বৈচিত্র্য এবং বিভিন্নতাকে একটি সমন্বিত ঐক্যে গ্রথিত করে দিয়েছে। ঊর্ধ্বলোকের এই পৃথিবীতে বৃক্ষ কিংবা পুষ্প কিংবা ফল যা কিছু জন্মে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তারা সবাই এই পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। সেই পৃথিবীতেও তুমি পর্বত দেখবে, কিন্তু তার উপলখণ্ডকে দেখবে অধিকতর মসৃণ আর স্বচ্ছ, তার সৌন্দর্য আমাদের পৃথিবীর মূল্যবান চুনী, মণি, পান্নার মূল্যকে অতিক্রম করে যায়। বস্তুত আমাদের মণিপান্না সেই পৃথিবীর মণিপান্নার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কেননা ঊর্ধ্বলোকের পৃথিবীর প্রস্তরখণ্ড মাত্রই আমাদের পৃথিবীর মূল্যবান মণির চেয়েও সুন্দর। তাদের এই সৌন্দর্যের মূল হচ্ছে তাদের পবিত্রতা এবং বিশুদ্ধতা। আমাদের পৃথিবীর মণিমুক্তার ন্যায় পচনশীল উপাদানে তৈরি হয়ে তারা দূষিত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে না। এই পচনশীল উপাদান আমাদের পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিদেহের অভ্যন্তরে ঘণীভূত হয়ে দূষিত হয়ে ওঠে এবং লতা, গুল, প্রাণী কিংবা প্রস্তর–সবকিছুর মধ্যে ব্যারামের সৃষ্টি করে। ঊর্ধ্বলোকের সেই পৃথিবীর মণিমুক্তা, স্বর্ণ এবং রৌপ্য তাদের বিস্ময়কর বৃহৎ আয়তন নিয়ে দিনের আলোয় এরূপ অপূর্ব আলোক রশি বিস্তার করে যে দর্শকমাত্রের দৃষ্টি সেই বিস্ময়কর দৃশ্যে মোহিত হয়ে ওঠে। সে পৃথিবীতেও বাস করে জীবজন্তু মানুষ। তাদের কেউ বাস করে মধ্যদেশে, কেউ বা বায়ুর প্রান্তে, যেমন এই পৃথিবীর আমরা অনেকে বাস করি সমুদ্র কিনারে। আবার অনেকে বাস করে বায়ু সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপের মধ্যে। বস্তুত, আমরা যেমন সমুদ্র এবং পানিকে প্রতি কাজে ব্যবহার করি, তারাও সেরূপ ব্যবহার করে তাদের নিত্য কাজে বায়ুকে। উপরন্তু, তাদের ঋতু এবং আবহাওয়া এত উত্তম যে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘজীবী। শুধু তাই নয়। তাদের দৃষ্টিশক্তি আমাদের চেয়ে প্রখর, তাদের শ্রবণক্ষমতা আমাদের চেয়ে তীক্ষ্ণ এবং তাদের আঘ্রাণশক্তিও অনেক বেশি প্রবল। এমনিভাবে তাদের সকল ইন্দ্রিয়ই আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের চেয়ে অধিক পরিমাণে ত্রুটিহীন। অনুরূপভাবে তাদের বাতাস এবং পানিও আমাদের বাতাস, পানি কিংবা ইথারের চেয়ে অধিক পরিমাণে বিশুদ্ধ। তাদেরও দেবমন্দির আছে। কিন্তু তাদের দেবতারা আমাদের দেবতাদের মতো নয়। তারা প্রকৃতই মন্দিরের মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকেন, ভক্তদের প্রার্থনার প্রতি তারা কর্ণপাত করেন, ভক্তরা তাদের দেবতাদের সঙ্গে আলাপ করে। দেবতাদের বাণী নিজেদের কর্ণে তারা শ্রবণ করে, তাদের প্রার্থনার জবাব তারা লাভ করে। তারা সূর্য, চন্দ্র এবং তারকারাজিকে তাদের প্রকৃত অস্তিত্বেই প্রত্যক্ষ করতে পারে। এমনিভাবে শক্তি, ক্ষমতা–সৌভাগ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বলোকের সেই পৃথিবীর অধিবাসীগণ আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান।

এই হচ্ছে সেই পৃথিবীর পরিপূর্ণ চিত্র। তার চারপার্শ্বের দৃশ্যাবলির এই হচ্ছে বর্ণনা। তার পৃষ্ঠদেশও বিভিন্ন প্রকার গর্ত এবং গহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে কারুর আয়তন এবং গভীরতা আমাদের গুহাসমূহের চাইতে অধিক। কারুর গভীরতা কম হলেও বিস্তারে তারা বৃহৎ। সকল গহ্বরেই অসংখ্য ছিদ্রপথ বিদ্যমান। এই ছিদ্রপথের কোনোটি প্রশস্ত, কোনোটি সংকীর্ণ। এই সমস্ত পথ অনুসরণ করে তুমি পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারো। পথগুলি পরস্পর সংযুক্ত। এই সমস্ত ছিদ্রপথে বিরামহীনভাবে পানির প্রবল প্রবাহ বয়ে চলেছে। অভ্যন্তরীণ ছিদ্রপথে চিরন্তন নদীও রয়েছে বহু। তাদের কোনোটির মধ্যে চলেছে শৈত্যের প্রবাহ, কোনোটিতে অগ্নির স্রোত, কোনোটির মধ্যে পঙ্করাশি। সে পঙ্ক সিসিলির পঙ্ক-নদী এবং তার অনুসারী লাভাস্রোতের ন্যায় কোথাও ঘন, কোথাও তরল। এই স্রোতের প্রবাহ তার পরিপার্শ্বকেও এই সমস্ত দ্রব্যতে পূর্ণ করে তুলেছে। এই পৃথিবীর গভীর তলদেশে এক প্রকার উঁচুনিচু ঢেউ-এর দোলা চলছে। এই তরঙ্গের কারণ হচ্ছে, হোমার যেমন বলেছেন : ‘সেই দূরে, মাটির গভীরে যেখানে রয়েছে এক গহ্বর সেইরূপ এক বিরাট গম্বর বিদ্যমান রয়েছে পৃথিবীর গভীর গর্ভে। অনেক কবি তাদের কাব্যে একে টারটারাস বলেও অভিহিত করেছেন। এই গর্ভদেশে বিরাট স্রোতরাশির প্রবেশ এবং নিষ্ক্রমণের প্রবল টানে উঁচুনিচু তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। স্রোতরাশির যেটি পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগের যে অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে, সেটি সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়েই মণ্ডিত। আর এই স্রোতরাশি এসে যে বিরামহীনভাবে প্রবেশ করছে এবং নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে তার কারণ, এই জলরাশির কোনো তল নেই যেখানে সে বিরামলাভ করতে পারে। এজন্যই সে বিরামহীনভাবে একবার উত্তোলিত হয়ে উঠছে আবার অবনতিতে বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপভাবে আলোড়িত হচ্ছে চারদিকের বায়ুমণ্ডল। বিপুল জলরাশির তরঙ্গমালার উন্নতি-অবনতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলও বিস্ফারিত এবং সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে আর পৃথিবী পৃষ্ঠের উপর যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ছে। বায়ুমণ্ডলের এই সঙ্কোচন প্রসারণকে তুমি মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তুলনা করতে পার। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যেমন বাতাস দেহের ভিতর একবার প্রবেশ করে আবার নিষ্ক্রান্ত হয়ে আসে, পৃথিবী-পৃষ্ঠেও জলরাশির উত্থান পতনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডল একবার সঙ্কুচিত, আর একবার প্রসারিত হয়ে ওঠে। জল এবং বায়ুর এই সম্মিলিত দেলনক্রিয়ার ফলে প্রচণ্ড এবং ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণ এবং শব্দের সৃষ্টি হয়। উত্থিত জলরাশি যখন বিপুল বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন সে পৃথিবীর সকল রন্ধ্রকে পূর্ণ করে তোলে; আবার সে যখন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে চায় তখন সে এই গহ্বরগুলোকে পুনরায় প্লাবিত করে দেয়। গহ্বরগুলি যখন জলপূর্ণ হয়ে যায় তখন মাটির অন্তর্নিহিত সুড়ঙ্গগুলি জলে ভরে যায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় সমুদ্র, হ্রদ, জলপ্রপাত, প্রস্রবণ বা নদীসমূহের। সেখান থেকে জল আবার প্রবেশ করে পৃথিবীগর্তে! তখন জলধারার কেউ কেউ এঁকেবেঁকে নানা দেশ অতিক্রম করে। আবার কেউ কিছুদূর প্রবাহিত হয়েই যায় থেমে। তখন সেখান থেকে আবার তারা টারটারাসের বুকেই গিয়ে মিলিত হয়। এই জলধারার অনেকে তাদের উত্থানের স্তর থেকে বেশ গভীরে গিয়ে তবে টারটারাসের সঙ্গে মিলিত হতে পারে; অনেকে তেমন গভীরে নয়, কিছুটা উপরের দিকেই তার সাক্ষাৎ পায়। তবু বলা চলে উত্থানের চরম বিন্দু থেকে নিম্নতর স্তরেই সবাই টারটারাসের সাক্ষাৎ লাভ করে। এদের মধ্যে অনেকে মিলনের পরে টারটারাসের বিপরীত তীরে গিয়ে আঘাত খেয়ে ভেঙে পড়ে; কেউ বা তার প্রবাহের তীরেই কেঁপে উঠে। আবার কেউ কেউ সাপের আকারে কুণ্ডলী পাকিয়ে পৃথিবীকে ঘিরে ধরতে প্রয়াস পায়; কিন্তু পরক্ষণে তারা আবার নিম্নদেশে ভেঙে পড়ে এবং গহ্বরের মধ্যে ফিরে আসে। নদীগুলি যেদিকেই প্রবাহিত হোক না কেন, তারা পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুকে অতিক্রম করতে পারে না। কেননা কেন্দ্রবিন্দুর বিপরীত দিকেই শুরু হয়েছে আর এক বিরাট চড়াই।

নদীসমূহের কথা আর একটু বলা যাক। নদীর সংখ্যা অবশ্যই বহু। তারা নানা রকমের এবং তারা মহাপরাক্রমশালী। কিন্তু এদের মধ্যে চারটা নদীই প্রধান। এই চারটির মধ্যেও যেটি বৃহত্তম এবং যে পৃথিবীর উপর দিয়ে চক্রাকারে প্রবাহিত হয়েছে তার নাম হচ্ছে সমুদ্র। সমুদ্রের বিপরীত দিকে অর্থাৎ পৃথিবীর গর্ভদেশে বয়ে চলেছে নদী আকেরন। আকেরন পৃথিবীর অন্তর্দেশের বহু মরুভূমিকে অতিক্রম করে যে হ্রদের সঙ্গে এসে মিলিত হয়েছে তাকেই বলে আকেরনের হ্রদ। এই হ্রদের তীরে এসেই জমায়েত হয় মৃত আত্মার দল। একটি নির্দিষ্টকাল তাদের অপেক্ষা করতে হয় এই হ্রদের তীরে।

আকেরন হ্রদের তীরে কালক্ষেপণের পরে তাদের পুনর্জন্ম ঘটে জন্তুর আকারে। তৃতীয় নদীর প্রবাহ হচ্ছে সমুদ্র এবং আকেরনের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে। বহির্গমনের মুখে এ নদী এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি করে। এই অগ্নিকুণ্ডই তৈরি করেছে এমন এক বৃহৎ সরোবরের যার আয়তন আমাদের পৃথিবীর ভূমধ্যসাগরকে যায় অতিক্রম করে। অগ্নিকুণ্ডের এই সরোবরে পানি এবং পঙ্ক সর্বদাই টগবগ করে ফুটছে। এই সরোবরের মধ্য দিয়ে কর্দমাক্ত দেহে এই নদী পৃথিবীকে ঘিরে ঘিরে বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে অবশেষে আকেরন হ্রদের প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়। আকেরনের বুকে এসে নামলেও এ নদীর পানি আকেরনের পানির সঙ্গে মিশে যায় না। সে যা হোক। পৃথিবীকে ঘিরে কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে তৃতীয় এই নদী অবশেষে গভীরতর স্তরে নেমে টারটারাসের বুকে আত্মসমর্পণ করে। আমাদের বর্ণিত এই তৃতীয় নদীকেই ‘পাইরী ফ্লেগেথন বলে অভিহিত করা হয়। আর এই পাইরী ফ্লেগেথন কেবল নিষ্ক্রমণের মুখে নয়, পৃথিবীপৃষ্ঠে তার অতিক্রমণের বিভিন্ন স্থানেই সে অগ্নির স্রোত সৃষ্টি করে অগ্রসর হতে থাকে। চতুর্থ নদীর গতি হচ্ছে বিপরীত দিকে। যাত্রার শুরুতেই সে সাক্ষাৎ পায় এক দুর্গম এলাকার। এই এলাকার বর্ণ হচ্ছে আশ্চর্য সুন্দর নিলার ন্যায় ঘোর নীল। আর এ নদীকেই বলা হয় স্টিজিয়া নদী। এ নদী নেমে এসে যে সরোবরের সৃষ্টি করে তার নাম হচ্ছে স্টিকস সরোবর। এই সরোবরে পতিত হয়ে স্টিজিয়া অদ্ভুত ক্ষমতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এই শক্তি নিয়ে তখন সে তৃতীয় নদীর বিপরীত পথে কুণ্ডলী পাকিয়ে পৃথিবীর তলদেশে চলে যেতে থাকে। অবশেষে সেই পাইরী ফ্লেগেথনের বিপরীত দিকে আকেরন সরোবরের সন্নিকটে ভেসে ওঠে। এ নদীর পানিও অপর কোনো নদীর পানির সঙ্গে মিশে না। চক্রাকারের সে কেবল আবর্তিত হতে থাকে। অবশেষে সেও পাইরী, ফ্লেগেথনের বিপরীতে টারটারাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবিরা বলেন যে, এই নদীরই নাম হচ্ছে ককিটাস।

প্রিয় বন্ধুগণ! আর এক পৃথিবীর কাহিনী আমি বললাম, এই তার রূপ। মৃতের দলকে। যখন তাদের আপন আপন ধর্ম পথ দেখিয়ে তাদের নির্দিষ্ট জায়গাতে নিয়ে আসে তখন প্রথমে তাদের প্রাপ্য দণ্ড নির্ধারিত হয়। ন্যায় কিংবা অন্যায়ভাবে তারা জীবনযাপন করেছে। তার মানদণ্ডেই এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়। যারা ন্যায় কিংবা অন্যায় কোনোভাবেই জীবনযাপন করেছে। তার মানদণ্ডেই এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়। যারা ন্যায় কিংবা অন্যায় কোনোভাবেই জীবনযাপন করে নি তাদের প্রেরণ করা হয় আকেরনের তীরে। সেখানে যে-কোনো নৌপতিকে তারা দেখতে পায় তাতে আরোহণ করেই আকেরনের বুকে ভাসতে থাকে। এখানে তারা পাপ-বিমুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ হয় এবং অপরের প্রতি তারা যে সমস্ত অন্যায় করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করে পাপমুক্ত হয়ে আপন আপন পুণ্যকর্মের ফল প্রাপ্ত হয়। কিন্তু যারা সংশোধনের অযোগ্য, যাদের পাপের বোঝা পর্বত প্রমাণ, যারা অন্যায় হত্যা, ভয়ঙ্কর ধর্মবিরুদ্ধ কাজ প্রভৃতি কোনো পাপ থেকেই বিরত থাকে নি তারা নিক্ষিপ্ত হয় টারটারাসের বুকে। এই তাদের উপযুক্ত দণ্ড। টারটারাসের বুক থেকে এদের উঠে আসা আর সম্ভব হয় না। আবার যাদের পাপ বৃহৎ বটে, তবু যারা উদ্ধারলাভের অতীত এখনো হয়নি। যারা হয়তো উত্তেজনার কোনো। মুহূর্তে তার জনক কিংবা জননীর প্রতি অন্যায় আচরণ করলেও অবশিষ্ট জীবন তার জন্যে অনুতাপে দগ্ধ হয়েছে; কিংবা যারা হয়তো হত্যা করেছে কাউকে, কিন্তু অবস্থাটি ছিল এমন যে সে ছিল উপায়হীন-–এরূপ সংশোধনযোগ্য পাপীরাও অবশ্য নিক্ষিপ্ত হবে টারটারাসের বুকে এবং তার ক্লেশকে তাদের ভোগ করতে হবে। কিন্তু এই দণ্ডের এক বৎসর পূর্ণ হলে যারা শুধু হত্যাকারী তাদের ককিটাস এবং যারা পিতৃহন্তা কিংবা মাতৃহন্তা তাদের পাইরী ফ্লেগেথন বহন করে নিয়ে যাবে অকেরন সরোবরে। এখানে নীত হলে তারা সরোবরের বুকে উচ্চকণ্ঠে তাদের হাতে যারা নিহত হয়েছে কিংবা তাদের অন্যায়ের শিকারে যারা পরিণত হয়েছে সেই হতভাগ্যদের ডাক দিয়ে বলবে যেন তারা তাদের প্রতি করুণা করে, যেন তারা তাদের অন্যায়কে মার্জনা করে দেয় এবং সরোবরে তাদের প্রবেশের পথ এমনিভাবে উন্মুক্ত করে দেয়। তাদের এই প্রার্থনা যদি মঞ্জুর হয় তা হলেই তাদের ভোগের শেষ হয়ে যায় এবং তারা আকেরনের বুক থেকে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু যদি তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর না হয় তা হলে আবার তারা টারটারাসের বুকে নীত হয়; টারটারাসের বুক থেকে নীত হয় তারা অপর কোনো নদীতে। এমনিভাবে চলতে থাকে তাদের দণ্ড। কেননা তাদের পাপ-পুণ্যের বিচারকগণ এই দণ্ডেই তাদের দণ্ডিত করেছেন যে, যতদিন পর্যন্ত না তাদের অন্যায়ের শিকারে যারা পরিণত হয়েছে তারা তাদের ক্ষমা করে দেবে, ততদিন পর্যন্ত তারা এই দণ্ডভোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। কিন্তু অপরদিকে যারা যাপন করছে এক পবিত্র জীবন তারা তৎক্ষণাৎ মুক্তি পেয়ে যাবে মর্তের এই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তারা চলে যায় ঊর্ধ্বলোকে নির্দিষ্ট তাদের পবিত্র ধামে এবং নিরুদ্বেগে বাস করতে থাকে মর্ত্য থেকে বিশুদ্ধতর এক লোকে। এদের মধ্যে যারা নিজেদের শুদ্ধ করেছে দর্শনের আলো দিয়ে তারা তো সম্পূর্ণরূপে দেহমুক্ত হয়েই বাস করতে থাকে। তাদের বাসের জন্য সৃষ্ট প্রাসাদ যে কত সুন্দর তাকে যেরূপ বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, তেমনি তাকে বলার উপযুক্ত সময়ও আমার হাতে আর অবশিষ্ট নেই।

কাজেই, সিমিয়াস, এই যখন প্রকৃত অবস্থা, তখন আমাদের এই জীবনে ন্যয়ধর্ম এবং জ্ঞানকে লাভ করার জন্য এমন কিছু কি থাকতে পারে যা আমাদের অকরণীয়? আশা আমাদের যেমনি বিরাট, প্রাপ্তিও আমাদের তেমনি মহৎ।

একথা অবশ্য ঠিক যে জ্ঞানবান কেউ একথা বলবেন না কিংবা আমিও এরূপ দাবি করব না যে, আত্মার এবং তার জন্য নির্ধারিত বাসভূমির যে-বর্ণনা আমি দিয়েছি তা হুবহু যথার্থ। কিন্তু একথা আমি দুঢ় প্রত্যয়ে বলব যে, আত্মা যখন অমর বলে প্রমাণিত হয়েছে। তখন আত্মার পক্ষে ভবিষ্যতের এই স্বপ্ন দেখা কিংবা এরূপ প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক নয়। আত্মার যাত্রা কম সাহসিকতাপূর্ণ নয়, কম গৌরবময় নয়, সে যাত্রাপথে এই বর্ণনা তাকে আশা দিক, ভরসা যোগাক। এই কারণেই আমি আমার কাহিনীকে দীর্ঘ করেছি। কাজেই আমি বলতে চাচ্ছি : মানুষ তার আপন আত্মার ভবিষ্যতের আশা রাখুক, ভরসা পোষণ করুক। কেননা, তার স্বভাবের বৈরী বলে বিচার করে তাকে পরিত্যাগ করে জ্ঞানের আনন্দকে অন্বেষণ করতে শুরু করেছে। তার আত্মা এখন দেহের আভরণকে পরিত্যাগ করে সংযম, বিচার, সাহস, মহত্ত্ব এবং সত্যের ভূষণে নিজেকে ভূষিত করার সাধনা শুরু করেছে। এই নতুন ভূষণে ভূষিত হয়ে, ডাক যখন তার আসবে তখন, পাতাললোকে যাত্রার জন্য সে প্রস্তুত রয়েছে। প্রিয় সিমিয়াস এবং সিবিস, তোমরা এবং পৃথিবীর অপর সকল মানুষই একদিন এই যাত্রা অবশ্যই শুরু করবে। বিষাদাত্মক কবির ভাষায় বলতে গেলে, ভাগ্যের আহ্বান আমি শুনতে পাচ্ছি। শীঘ্রই আমি বিষ পান করব। কাজেই আমি ভাবছি এখন স্নানাগারে গিয়ে আমার স্নান সেরে নেওয়াই প্রধান কর্তব্য, যেন আমার মৃত্যুর পরে আমাকে স্নান করিয়ে দেবার কষ্ট মেয়েদের পেতে না হয়।

সক্রেটিসের কথা শেষ হলে ক্ৰিটো বললেন, ‘সক্রেটিস আমাদের প্রতি তোমার কী আদেশ? তোমার সন্তানদের বিষয়ে কী তুমি বলে যেতে চাও? কিংবা অপর কোনো। বিষয়েও যদি তোমার কিছু নির্দেশ থাকে আমাদের তা দাও, যেন আমরা সে নির্দেশ যথাযথ পালন করতে পারি।’

সক্রেটিস জবাব দিলেন, না ক্রিটো, আমার বিশেষ কোনো নির্দেশ নেই। আমি শুধু এই বলব, সযত্নে জীবনযাপন করো। একথা আমি তোমাদের অতীতেও বহুবার বলেছি। সযত্নে জীবনযাপন করার মাধ্যমেই তোমরা নিজেদের, আমার এবং অপর সকলের মঙ্গল সাধন করতে সক্ষম হবে। তা না হলে আমার নিকট দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতিরই মূল্য থাকবে না। জীবনযাত্রার সংগত বিধান সম্পর্কে আমি অনেক সময়ে বলেছি। তোমরা যদি নিজেদের জন্য চিন্তিত বোধ না কর, যদি সংগত সেই বিধানকে তোমরা মেনে না চল, তা হলে আমাকে যত প্রতিশ্রুতি কিংবা ভরসাই তোমরা দাও না কেন, সবই ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য। আর এরূপ ব্যর্থতা যে তোমাদের জীবনে এই প্রথমবারই আসবে, এমনও নয়। অতীতেও এরূপ ব্যাপার বহুবার ঘটেছে।

ক্রিটো বললেন, ‘সক্রেটিস, আমরা আমাদের সকল সাধ্য দিয়ে তোমার আদেশকে পালন করার চেষ্টা করব। এবার আমাদের তুমি নির্দেশ দাও, তোমার সমাধিকাৰ্য আমরা কীভাবে নিষ্পন্ন করব।’

এবার লঘু সুরে সক্রেটিস বললেন, এ কাজটি তোমাদের যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ ভাবেই সম্পন্ন কর। কেবল সতর্ক থেকে যেন কাজটি সমাধা করার জন্য লোকটি পাওয়া যায়। গোর দেওয়ার সময়ে আমাকেই পেলে না, আমি গেলাম পালিয়ে; এমন ব্যাপারটি না ঘটে সেদিকে খেয়াল রেখো, ক্রিটো।’

একথা বলে সক্রেটিস স্মিত মুখে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, কী আশ্চর্যের বিষয়, দেখ, আমি ক্রিটোর হৃদয়ে কিছুতেই এই প্রত্যয় সৃষ্টি করতে পারছিনে যে, এই যে আমি কথা বলছি, তর্ক করছি, যুক্তি দিচ্ছি সে সেই সক্রেটিসই রয়েছি, আমি অপর কোনো সক্রেটিস নই। আমি যতই বলি না কেন, ক্ৰিটো কেবল ভাবছে, এ তো সেই সক্রেটিস যাকে সে মুহূর্ত পরেই মৃত দেখবে, যে একটু সময়ের ব্যবধানেই একটি মৃতদেহে পরিণত হয়ে যাবে। আর সে জন্যই সে কেবল প্রশ্ন করছে, কী উপায়ে সে আমার সমাধি কার্যটি নিষ্পন্ন করবে। অথচ আমি কিন্তু তোমাদের একথাই বুঝাতে চাইছিলাম যে, যখনি আমি বিষপান করব তখনি আমি আর তোমাদের নিকট থাকবো না, আমি তখন তোমাদের পরিত্যাগ করে আমার আকাঙ্ক্ষিত আনন্দলোকের উদ্দেশে যাত্রা করব। একথা বলে আমি নিজেকেও যেমন তোমাদেরকেও তেমন সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আমি দেখছি, আমার সে সমস্ত কথা ক্রিটোকে আদৌ প্রভাবিত করতে পারে নি। কাজেই এখন আমি বলব, তোমরা বরঞ্চ ক্রিটোর নিকট আমার জন্য জামিন হও। ক্ৰিটো যেরূপ বিচারকালে বিচারকদের নিকট আমার জন্য জামিন হয়েছিল, তোমরাও সেরূপ ক্রিটোর নিকট আমার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়াও। কিন্তু মুচলেকার কথা এবার অবশ্য ভিন্ন হবে। ক্রিটো কথা দিয়েছিল বিচারকদের যে, আমি অবশ্যই মৃত্যুর পরে তার নিকটে থাকবে না। কেননা আমি তো তখন যাত্রা করব, আর চলে যাব অনেক দূরে। এই প্রত্যয় যদি তার ঘটে তা হলে আমার মৃত্যুতে নিশ্চয়ই সে আর দুঃখবোধ। করবে না; আমার দেহকে যখন সে ভস্মীভূত হতে কিংবা সমাধিস্থ হতে দেখবে তখন। আর সে মর্মাহত হয়ে পড়বে না। কেননা আমি চাইনে, সমাধিক্ষেত্রে সে আমার দুর্ভাগ্য দুঃখবোধ করে বলবে : ‘হায় ভাগ্য! সক্রেটিসকে শেষ পর্যন্ত এভাবেই আমাদের শুইয়ে রাখতে হলো। কিংবা কী ভাগ্য! সক্রেটিসকে নিয়ে যেতে হচ্ছে সমাধিক্ষেত্রে। অথবা ‘এইভাবেই তাকে আমাদের সমাধিস্থ করতে হলো।’ এরূপ বিলাপ ধ্বনিকে আমি পছন্দ করিনে। পছন্দ করিনে, কারণ, অসত্য বাক্য শুধু যে অসৎ তাই নয়; অসত্য বাক্য আমাদের আত্মাকেও অসৎ করে তোলে। প্রিয় ক্রিটো, আমি তাই বলছি, দুঃখ বোধ করো না, তুমি প্রফুল্ল হয়ো এবং নিজের মনকে এই বলে প্রত্যয় দাও যে, তুমি তো আমাকে সমাধিস্থ করবে না, তুমি সমাধিস্থ করবে আমার দেহটিকে মাত্র। সে দেহ নিয়ে যা করা প্রয়োজন এবং যা করা স্বাভাবিক তাই তোমরা করো?

একথা বলে সক্রেটিস আসন থেকে উঠে স্নান করার জন্য অপর একটি কক্ষে চলে গেলেন। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ক্ৰিটো নিজেই সক্রেটিসের সঙ্গে গেলেন। আমরা তখন সকলে নিজেদের মধ্যে একদিকে যেমন আমাদের এই বিশাল দুঃখের কথা আলোচনা করতে লাগলাম, তেমনি অপর দিকে সক্রেটিস যে দার্শনিক আলোচনা করেছেন সে বিষয়েও চিন্তা করতে লাগলাম। আমাদের দুঃখের কোনো পরিমাপ ছিল না। সক্রেটিস ছিলেন আমাদের পিতার মতো। আজ আমরা তাকে হারাতে বসেছি। অবশিষ্ট সমস্ত জীবনই তো আমাদের অনাথ হয়ে কাটতে হবে। সক্রেটিসের স্নান সম্পন্ন হলে তাঁর সন্তানদের নিয়ে আসা হলো। সক্রেটিসের একটি বড় এবং অপর দুটির ছোট ছেলে ছিল। তার পরিবারস্থ মেয়েদেরও নিয়ে আসা হয়েছিল। ক্রিটোর সম্মুখে তিনি তাহার সঙ্গে কিছু আলাপ করলেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি দিলেন। তারপর তিনি তাদের সকলকে পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের নিকট ফিরে এলেন।

সক্রেটিস স্নানের জন্য যখন কক্ষান্তরে ছিলেন তখন বেশ কিছু সময় কেটে গিয়েছিল। যখন তিনি আমাদের নিকট ফিরে এলেন, সূর্যের অস্তগমনের সময় তখন নিকটবর্তী হয়ে এসেছে। তিনি স্নান সম্পন্ন করে ফিরে এসে আমাদের মধ্যে আবার আসন গ্রহণ করলেন। কিন্তু তখন আর বিশেষ কোনো বাক্যালাপ হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বাদশ প্রভুর পরিচারক হিসাবে কারাপাল এসে উপস্থিত হলো। কারাপাল কক্ষ মধ্যে সক্রেটিসের পার্শ্বে দণ্ডায়মান হয়ে বলতে লাগল : সক্রেটিস, আমি জানি যত বন্দি এই কারাগারে এ পর্যন্ত আনীত হয়েছে তাদের মধ্যে আপনার ন্যায় উত্তম, মহৎ এবং নম আর কেউ কখনো ছিল না। কর্তৃপক্ষের আমি আজ্ঞাবাহক। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বন্দির মুখে বিষণ্ড আমাকে তুলে দিতে হয়। যারা সাধারণ বন্দি তারা আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা আমাকে কটু বাক্যে বিদ্ধ করে। কিন্তু আমি জানি আপনি প্রবুদ্ধ, আপনি। আমার প্রতি বিরূপ হবেন না। আপনি জ্ঞাত আছেন, এ কাজের জন্য দায়ী আমি নই, এর দায়িত্ব অপরের। আমি আপনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এসেছি। আমার কর্তব্যকে আপনি জানেন। আমি শুধু এই বলব যেন আপনি সব অনিবার্যকে সহজভাবে গ্রহণ করেন। একথা বলতে কারাপালের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। কথা সমাপ্ত করে অশ্রুভরা চোখে সে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

সক্রেটিস কারাপালকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমার প্রতি তোমার এই শুভেচ্ছার জন্য তুমি আমার ধন্যবাদ জেনো। তোমার নির্দেশকে আমি পালন করবো।’ এবার সক্রেটিস আমাদের দিকে ফিরে বললেন, কী চমৎকার এই লোকটি। কারাগারে আমার পদার্পণের দিন থেকেই সে প্রায়শই আমাকে দেখতে এসেছে; আমার সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে সে আলাপ করেছে। তার সাধ্যমতো সে আমার প্রতি সদয় ব্যবহার প্রদর্শন করেছে। আর আজ আমার জন্য গভীরভাবে সে দুঃখও প্রকাশ করেছে। ক্রিটো, তার কথা আমাদের অমান্য করা উচিত নয়। সে যেরূপ বলেছে, সেরূপই আমাদের করা প্রয়োজন। কাজেই বিষণ্ড যদি প্রস্তুত হয়ে থকে তা হলে তাকে তোমরা নিয়ে এসো। যদি প্রস্তুত না হয়ে থাকে, তা হলে পরিচারককে তা প্রস্তুত করতে বল?

কিন্তু ক্ৰিটো বললেন, সক্রেটিস, এখনও কিছু সময় অবশিষ্ট রয়েছে, এখনও সূর্য পর্বতশীর্ষ অতিক্রম করে নিচে নামে নি। আমি একথা জানি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক বন্দি বিষপানে বিলম্ব করেছে। এমনকি বিষপানের সময়ের কথা ঘোষিত হওয়ার পরেও তারা পানাহার এবং প্রিয়জনের সঙ্গ উপভোগে সময় ক্ষেপণ করেছে। প্রিয় সক্রেটিস, যথেষ্ট সময় তো এখনও রয়েছে। আমাদের অনুরোধ, তুমি ত্বরা করো না।

সক্রেটিস একথার জবাব দিয়ে বললেন, “তোমার কথা যথার্থ, ক্রিটো। তুমি যাদের কথা বলছ তারা তাদের ব্যবহারে ন্যায্যও বটে। কেননা তাদের ধারণা যে বিলম্বের মধ্য দিয়েই তারা লাভবান হবে। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করাই তো আমার পক্ষে সংগত। কেননা আমি তো মনে করিনে যে খানিক বিলম্বে বিষপান করে আমি কোনোক্রমে লাভবান হবো। যে-জীবনের বিরুদ্ধে মৃত্যুর দণ্ড ঘোষিত হয়ে গেছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টা করে আমি কেবল নিজেকে নিজের কাছেই হাস্যাস্পদ করে তুলব। কাজেই দয়া করে তোমরা আমার কথার অন্যথা করো না। আমি যেমন বলেছি। তেমনি তোমরা কাজটি সমাধা কর।

কারাভৃত্য নিকটেই দণ্ডায়মান ছিল। ক্রিটো এবার ইঙ্গিত করতেই সে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে খানিক বিলম্বে পুনরায় কারাপালকে সঙ্গে করে ফিরে এল। কারাপালের হাতে তখন বিষভাণ্ড। সক্রেটিস কারাপালকে লক্ষ করে বললেন, ‘দয়ালু বন্ধু, তুমি এ সমস্ত বিষয়ে অবশ্যই অভিজ্ঞ। দয়া করে তুমি বলে দাও, কীভাবে আমি অগ্রসর হব। লোকটি তখন বলে দিল, সক্রেটিস, বিষপানের পর আপনি পদচারণা করবেন। পদচারণায় যখন আপনার পদদ্বয় ভারী হয়ে আসবে কেবল তখনি আপনি শায়িত হবেন। তা হলেই বিষক্রিয়া সঠিকভাবে চলতে থাকবে।’ একথা বলা শেষ করে কারাপাল তার হাতের বিষপূর্ণ পেয়ালাটিকে সক্রেটিসের হাতে তুলে দিল। একিক্রাটিস, তুমি তো সক্রেটিসের ধীর-স্থির ব্যবহারকে জানো। সেদিনও আমরা দেখলাম কী আশ্চর্য সহজ এবং নম্রভাবে কারাপালের হাত থেকে বিষের পেয়ালাকে তিনি নিজের হাতে গ্রহণ করলেন। তাঁর সৌম্য মুখাবয়বে ভীতির লেশমাত্র প্রকাশ ছিল না? মুখমণ্ডলে রঙের কোনো পরিবর্তন হলো না; রেখাবলির কোনো সংকোচন ঘটল না। ধীর-শান্তভাবে তিনি কারাপালকে লক্ষ করে আবার বললেন, এই পেয়ালা থেকে দেবতাদের উদ্দেশে কি আমি কিছু অর্পণ করতে পারি।’ লোকটি বলল, সক্রেটিস, আমরা তো কেবল ততটুকু বিষই প্রস্তুত করি যতটুকু প্রয়োজন বলে বোধ হয়; তার অতিরিক্ত নয়।’ সক্রেটিস বললে, ‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি, বন্ধু। তাই হোক। আমি কেবল আমার দেবতাদের ডেকে বলছি, এ-লোক থেকে ও-লোকে আমার যাত্রাটিকে তারা নির্বিঘ্ন করে দিন। আমার এ প্রার্থনাটি মঞ্জুর হোক।’ এই বলে তিনি আগ্রহের সঙ্গে সহজভাবে এবং সহাস্যমুখে বিষের পেয়ালাটিকে তার ওষ্ঠপুটে তুলে ধরলেন এবং পেয়ালার বিষকে পান করে ফেললেন।

এ যাবৎ যদি বা আমরা আমাদের বেদনাকে কোনোক্রমে সংযত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম তিনি বিষের পেয়ালাকে নিজের ওষ্ঠে তুলে নিয়েছেন, যখন দেখলাম তিনি বিষপান শেষ করেছেন, তখন আর আমাদের সহ্য করার ক্ষমতা রইল না। আমার নিজের বাধা দেবার চেষ্টা সত্ত্বেও আমার চোখে অশ্রুর ধারা নেমে এল। আমি মুখমণ্ডলকে আবৃত করে ক্রন্দন করতে লাগলাম। সক্রেটিসের জন্য আমি কাঁদি নি। আমি কাঁদলাম সক্রেটিসের ন্যায় প্রিয় সখার বিচ্ছেদ আমার জীবনে যে বিপর্যয় স্বরূপ ছিল তার জন্য। আমি একাই কাঁদি নি। ক্রিটো তার চোখের অশ্রুকে অধিক সংযত করতে না পেরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও তার অনুগমন করলাম। এ্যাপোলোভোরাস সর্বক্ষণই ক্রন্দনরত ছিলেন। এবার তিনি সশব্দ আর্তনাদে ভেঙে পড়লেন। এতে আমরা সকলেই অধিকতর বিহ্বল হয়ে পড়লাম। দেখলাম, শুধুমাত্র সক্রেটিসই নির্বিকার, শান্ত। শান্ত সক্রেটিস বলে উঠলেন, এ কী অদ্ভুত তোমাদের ক্রন্দন। আমি তো এ জন্যই মেয়েদের পাঠিয়ে দিলাম যেন তারা এরূপ দৃশ্যের অবতারণা করতে না পারে। আমাকে তো বলা হয়েছে, যেন শান্তিতে আমার মৃত্যু ঘটে। কাজেই তোমাদের তো শান্ত হওয়া উচিত। তোমরা শান্ত হও, ধৈর্য ধারণ কর।

সক্রেটিসের ভর্ৎসনায় আমাদের লজ্জাবোধ হলো। আমরা আমাদের চোখের অশ্রুকে সংযত করলাম। সক্রেটিস পদচারণা করতে লাগলেন। ক্রমান্বয়ে তার পা ভারী হয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ল। নির্দেশমতো তিনি তখন শায়িত হলেন। বিষপ্রদানকারী কারাভ্য মাঝে মাঝে সক্রেটিসের পদদ্বয় পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সে তার পায়ের তলদেশে জোরে চাপ দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সক্রেটিস তার চাপকে অনুভব করতে পারছেন কিনা। সক্রেটিস জবাব দিলেন : ‘না’ তখন সে ক্রমান্বয়ে পায়ের উপরের দিকে চাপ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল। ক্রমান্বয়েই দেহের ঊধ্বদিক অসাড় হয়ে আসতে লাগল। কারাপাল পরীক্ষা করে বলল, “বিষ যখন হৃদযন্ত্রে পৌঁছে যাবে অন্তিম মুহূর্ত তখনি উপস্থিত হবে। কোমর অবধি তখন তার দেহ অসাড় এবং ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পূর্বে সক্রেটিস নিজের মুখমণ্ডলকে নিজেই আবৃত করে দিয়েছিলেন। এবার তিনি মুখের আচ্ছাদন সরিয়ে বললেন, ‘ক্রিটো এ্যাসক্লেপিয়াসের নিকট আমি একটি মোরগের ঋণে ঋণী রয়েছি। তুমি দয়া করে ঋণটি পরিশোধ করে দিও। ঋণ পরিশোধ করা হবে, সক্রেটিস। আর কিছু কি বলবে? এ প্রশ্নের আর জবাব আসে নি। কিন্তু মিনিট দু’একের মধ্যে একটা আলোড়নের শব্দ শোনা গেল। কারাভৃত্যগণ তাঁর মুখের আচ্ছাদন সরিয়ে নিল। আমরা দেখলাম : দুটি চোখ তার নিস্পলক। ক্রিটো সক্রেটিসের চোখের পাতা আর মুখখানিকে বন্ধ করে দিলেন।

একিক্রাটিস! আমাদের প্রিয়তম বন্ধুর জীবনের অবসান এমনি করেই ঘটেছিল। তার সম্বন্ধে আমি যথার্থই বলতে পারি, তার যুগের মানুষকে আমি দেখেছি তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচাইতে জ্ঞানী, সবার অধিক ন্যায়পরায়ণ এবং সর্বোত্তম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *