শ্যারনের ডায়েরি – তিন গোয়েন্দা

শ্যারনের ডায়েরি

টিপু কিবরিয়া রচিত ‘অতৃপ্ত প্রেতাত্মা’ কাহিনিটিকে তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব।

প্রথম প্রকাশ: ২০১১

এক

আমি যে-স্কুলে পড়ি, তার অডিটোরিয়ামের বেজমেণ্টে থাকত এক ‘প্রেতাত্মা’। মিথ্যে নয়, সত্যিকারের ‘প্রেতাত্মা’। প্রায় বিশ বছর ধরে সেখানে ছিল ওটা, কেউ জানত না। জানা দূরে থাক, কারও কোনও ধারণাই ছিল না সে-ব্যাপারে। আমি আর আমার সহপাঠী কিশোর, আচমকা একদিন আবিষ্কার করে বসলাম প্রেতাত্মাটিকে। জানি, অনেকেই বিশ্বাস করবে না এ কাহিনি। তবে তাতে যে এমন কিছু এসে যাবে, তা-ও না। আমি যা সত্য বলে জানি, লিখছি।

আমাদের স্কুলের বার্ষিক নাটক ‘প্রেতাত্মা’র রিহার্সাল চলছিল সে-সময়ে। এই নাটকের পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস ছিল, সেটা প্রথম রিহার্সালের দিন সুইটি ম্যাডাম আমাদের বলেছিলেন।

যেদিন সত্যি সত্যি প্রেতাত্মার মুখোমুখি হলাম, সেদিন বুঝলাম কতবড় এক নির্মম সত্য ছিল সুইটি ম্যাডামের সে-গল্পে:

যে-বছর আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও বছর দুয়েক আগে এই নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যায় একটা ছেলে। ফলে নাটকটা আর মঞ্চস্থ হয়নি। স্কুল শুরু হওয়ার প্রথম দিকে, আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে, এই ‘প্রেতাত্মা’ নাটকটা অভিনীত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। হতে পারেনি। সে- সময়ে নাটকে যার প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল, শো শুরু হওয়ার মুহূর্তে আচমকা উধাও হয়ে যায় সেই ছেলেটা। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কাজেই, এরপর নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার প্রশ্নই আর আসেনি।

এবার, দুই দশক পর আমরা সেই ‘প্রেতাত্মা’ নাটক আবার মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর ঠিক তখনই দেখা দিল প্রেতাত্মাটা, রিহার্সাল চলার সময়, এক রাতে। সে-রাতটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং দুঃস্বপ্নের রাত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

রকি বিচ হাই স্কুলের সিক্সথ গ্রেডের ছাত্রী আমি। ক্লাস-ফ্রেন্ড কিশোর পাশা, ওরফে গোয়েন্দা কিশোর আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। স্কুল ছুটির পর প্রায়ই একসাথে বাসায় ফিরি, সেই সূত্রে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ আমরা।

কিশোর ফার্স্ট বয়, সে-জন্যে হয়তো ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ক্লাসের মেয়েরা ভাল চোখে দেখে না। আড়ালে আবডালে এ নিয়ে আমার অনেক সমালোচনা হয়, টের পাই, কিন্তু পাত্তা দিই না।

কিছু মেয়ে আছে, যারা খুব হিংসুটে হয়। যাক, ও নিয়ে আর কিছু লিখতে চাই না। প্রেতাত্মার যে-কাহিনি আজ লিখব তা এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। কখনও কখনও নিজের কাছেই ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে। কিন্তু নিজের চোখে সেই প্রেতাত্মা দেখেছি, এমন কী তার সাথে কথাও হয়েছে আমার; কী করে তা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব?

হপ্তা দুয়েক ধরে প্রেতাত্মা নিয়ে আমাদের স্কুলে নানান গুঞ্জন আর উত্তেজনা চলছে।

সেদিন ছিল শুক্রবার, সপ্তাহের শেষ দিন। স্কুল ছুটির পর আমার লকার খোলার চেষ্টা করছি, বার বার কম্বিনেশন ডায়াল ঘুরিয়েও কাজ হচ্ছে না। লটা প্রায় সময়ই জ্যাম হয়ে থাকে, কাজ করে না ঠিকমত। যাচ্ছে তা-ই!

যা-ই হোক, চারবার কম্বিনেশন ডায়াল ঘুরিয়ে তবে খুলতে পারলাম। বইগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিলাম দরজা। পুরো দু’দিন স্কুল ছুটি। আমাদের স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন—শনি ও রবিবার।

ঘুরে দাঁড়াতে যাব, পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

‘তুমি যাও, রবিন, আমরা আসছি।’

বুঝলাম গলাটা কার। কিশোর।

ঘুরতেই ওর হাসিমাখা চোখ দুটো দেখতে পেলাম।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম আমিও।

কথাটা মনে পড়ল আমার, ‘আরে হ্যাঁ, ভাল কথা, আমরা সিনেমা দেখতে যাচ্ছি তো কালকে?’

হরর ছায়াছবি কখনোই মিস করি না আমি। গা ছম্‌ছম্ করা ওসব ছায়াছবি দেখতে কী যে ভাল লাগে!

‘সে গুড়ে বালি তোমার,’ বলল কিশোর, ‘আগামী দুই দিন বাসা থেকে বের হতে পারবে না মুসা। গতকাল বেজবল খেলে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে মুসার, রেগে আগুন আঙ্কেল। হুকুম জারি করে দিয়েছেন—শনি আর রবিবার বন্দি থাকতে হবে ওকে।’

ব্যাকপ্যাক কাঁধ বদল করে বলল কিশোর, ‘হরর ছায়াছবির কথা আপাতত ভুলে যাও। অবশ্য তুমি গেলে যেতে পারো; রবিন, রেমন আর আমি ঠিক করেছি মুসা যখন নেই তো সিনেমা দেখতে যাব ‘না।’

‘তা হলে আমিও যাব না, বললাম। ‘বন্ধুকে রেখে সিনেমা দেখতে গেলে মন ছোট হবে আমার।’

কিশোর বলল, ‘কিন্তু, কী ব্যাপার, যা ভোলার কথা নয়, তাই যে দিব্যি ভুলে বসে আছ?’

‘মানে?’ কপাল কুঁচকে উঠল আমার। চিন্তা করেও কিছু স্মরণ করতে পারলাম না। শেষে জানতে চাইলাম, ‘কী ভুলে গেছি?’

‘চিন্তা করো।’

কীসের কথা বলছে কিশোর, বুঝতে পারলাম না। চিন্তার ফাঁকে কব্জি থেকে হেয়ার ব্যাণ্ড খুলে চুলগুলো পনিটেইল করে বেঁধে ফেললাম। সব সময় আমার হাতের কব্জিতে হেয়ার বাণ্ড থাকে। প্রায়ই দরকার পড়ে, তাই মজুত রাখি।

‘না, কিশোর, মনে করতে পারছি না,’ বললাম আমি হতাশ কণ্ঠে। ‘ব্যাপারটা কী বলো তো!’

‘চরিত্র-তালিকা,’ অবশেষে বলল ও।

‘হায়-হায়!’ বলে উঠলাম। এতবড় একটা ব্যাপার কীভাবে ভুলে গেলাম? গত দুই সপ্তাহ ধরে স্কুলের বার্ষিক নাটকে চান্স পাওয়ার অপেক্ষায় আছি আমরা।

নাটকে যারা অভিনয়ের সুযোগ পাবে, তাদের নাম আজ বুলেটিন বোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়ার কথা। একজন অভিনয়প্রার্থী হয়ে আমি কিনা তাই ভুলে বসে আছি?

‘জলদি এসো,’ বলেই কিশোরের হাত ধরে টানতে টানতে অডিটোরিয়ামের দিকে ছুটলাম।

আমরা দু’জনই অভিনয়ে খুব আগ্রহী। গতবছরের নাটকে কিশোর বড় একটা চরিত্র পেয়েছিল, আর ছোটখাটো একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম আমি। সুইটি ম্যাডাম বলেছেন, এবার এমন এক নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে, যা দেখে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে।

কথাটা শোনার পর বহুগুণ বেড়ে গেছে আমাদের আগ্রহ। এমন নাটকে অভিনয়ের সুযোগ না পেলে জীবনটাই বৃথা।

বুলেটিন বোর্ডের সামনে রীতিমত ভিড় লেগে আছে। ছেলে- মেয়েরা ঠেলাঠেলি করে ওটার আরও কাছে যেতে চাইছে, পড়ার চেষ্টা করছে তালিকার নামগুলো।

নার্ভাস হয়ে পড়লাম আমি। আমার নাম ওতে আছে কি না কে জানে।

‘আমার ভয় করছে,’ চাপা কণ্ঠে বললাম কিশোরকে। ‘তুমি দেখো।’

কিশোর বলল, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জটলা ঠেলে সামনে এগোলাম আমরা।

দুই

কিশোরকে দেখে হাত দিয়ে বুলেটিন বোর্ড দেখাল রবিন। চিৎকার করছে। কী বলছে বোঝা গেল না, ভিড়ের ধাক্কায় সরে গেল ও বোর্ডের সামনে থেকে। কাছে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে বুলেটিন বোর্ড পড়তে শুরু করল কিশোর। তারপর সরে আমাকে জায়গা দিল। দেখলাম নামগুলো। একবার নয়, দু’বার নয়, তিন তিনবার পড়লাম পুরো তালিকা। যা দেখলাম, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হলো না।

‘কিশোর! রবিন!’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘কিশোর, আমরা দু’জনই স্টার বনে গেছি!’ রবিন আর কিশোর হাসছে।

খুশিতে বাগবাগ্ হয়ে বললাম আমি, ‘মূল চরিত্র দুটো আমরাই পেয়েছি। কিশোর, তুমি আর আমি। প্রেতাত্মার চরিত্রে তোমাকে নেয়া হয়েছে।’

‘শ্যারন মিথ্যে বলেনি, কিশোর,’ পেছনে শোনা গেল একটা কণ্ঠ। কণ্ঠটা মারিয়া টরেস্কো। আমাদের ক্লাসেই পড়ে। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো সে।

আমার ধারণা মারিয়া মেয়েটা আমাকে একটুও পছন্দ করে না। ওকে আমি খুব ভাল করে চিনি। ভীষণ হিংসুটে স্বভাবের।

‘আমাকে নেয়া হয়েছে ডরোথির চরিত্রে,’ বললাম আমি। ‘চরিত্রটা কি প্রেতাত্মার মার? নাকি তার স্ত্রীর, যে উঠে এসেছে মৃত্যুর ওপার থেকে?’

‘কী যে বলো!’ ঠোঁট উল্টে বলল মারিয়া। ‘ডরোথি সামান্য এক থিয়েটার মালিকের মেয়ে।’ ওর কথার ধরনে মনে হলো খুবই নগণ্য চরিত্র পেয়েছি বুঝি আমি।

‘তুমি কোনও চরিত্র পেলে?’ হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।

মারিয়া টরেস্কোর চেহারা বলে দিল, আমার প্রশ্নে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছে ও। সবাই জবাব শোনার জন্যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আমি এক্সট্রা। তোমার বিকল্প, কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল মারিয়া। ‘তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো কিংবা অন্য কোনও কারণে অভিনয় করতে না পারো, তা হলে ডরোথির চরিত্রে অভিনয় করব আমি। মঞ্চ সজ্জার দায়িত্বও দেয়া হয়েছে আমাকে।’

ওকে অপমান করার মোক্ষম একটা সুযোগ এখন আমার সামনে। এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর সামনে ইচ্ছে করলে এখন আমি মারিয়া টরেস্কোর অহঙ্কার ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি। সে হলে এই সুযোগ হাতছাড়া করত না কিছুতেই। কিন্তু আমি অতটা নীচ নই। শুধু বাঁকা দৃষ্টিতে মারিয়াকে দেখলাম এক পলক। ঘুরলাম কিশোরের দিকে। ডেনিম জ্যাকেটের জিপার তুলে দিয়ে ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝোলালাম।

‘চলো, প্রেতাত্মা সাহেব!’ বলে কিশোরের একটা হাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম।

.

সোমবার বিকেল থেকে শুরু হলো আমাদের রিহার্সালের প্রাথমিক আয়োজন। নাটক মঞ্চস্থ করার পুরো দায়িত্ব সুইটি ম্যাডামকে দেয়া হয়েছে। অডিটোরিয়ামের মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম, হাতে স্ক্রিপ্ট। স্কুলের রেওয়াজ অনুযায়ী মহিলা টিচারদের আমরা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করি

ম্যাডামের চোখ দুটো কুচকুচে কালো, লম্বা চুল। কাঠির মতো ভীষণ শুকনো তিনি। একেবারে পাটকাঠির মত। মেজাজ কিছুটা কড়া। অবশ্য টিচার হিসেবে খুব ভাল। সবার পছন্দের।

আমরা নাটকের পাত্র-পাত্রীরা দর্শকের আসনে বসে আছি। তৃতীয় সারিতে পাশাপাশি বসেছি আমি আর কিশোর।

অন্য সবার ওপর চোখ বোলালাম আমি। নিচু স্বরে কথা বলছে সবাই। সবার মধ্যেই উত্তেজনা।

‘নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানো কিছু?’ আমাকে প্রশ্ন করল শয়তানের হাড্ডি টাকি। আমার বাবার চরিত্রে অভিনয় করবে ও।

‘না,’ শ্রাগ করে বললাম। ‘কাউকে এখনও বিষয়বস্তু জানানো হয়নি। তবে শুনেছি নাটকটার কাহিনি নাকি ভৌতিক ধরনের। ‘

‘কেউ না জানলেও আমি কিন্তু জানি,’ উঁচু কণ্ঠে ঘোষণা করল মারিয়া টরেস্কো।

ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। ‘কীভাবে জানলে? ম্যাডাম তো এখনও কাউকে স্ক্রিপ্টের কপিই দেননি!’

‘আমার আপন চাচা এই স্কুলের ছাত্র ছিল। তার কাছ থেকে শুধু বিষয়বস্তুই নয়, ‘প্রেতাত্মা’ নাটকটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টিং আরও অনেক কিছুই শুনেছি।’

সদম্ভে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, চেহারা দেখে মনে হলো, জানতে চাইলে দয়া করে জানাবে। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ফের বলে উঠল, ‘আমার চাচা বলেছে, এটা একটা অভিশপ্ত নাটক।

নিশ্চুপ হয়ে গেল পুরো অডিটোরিয়াম। এমন কী আমিও। সুইটি ম্যাডামও।

খুক খুক করে কাশল কিশোর। উত্তেজনায় ওর চোখ চকচক করছে। ‘অভিশপ্ত!’ ফিসফিস করে বলল। ‘মজার ব্যাপার তো!’

মাথা নেড়ে সায় দিলাম কিশোরের মন্তব্যে, ‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।’

‘এই নাটক সম্পর্কে আমার ছোট চাচার মুখে রোমহর্ষক এক গল্প শুনেছি,’ আবার বলল মারিয়া। ‘ও বলেছে এই স্কুলে নাকি একটা প্রেতাত্মা আছে। সত্যিকারের প্রেতাত্মা, যে…’

মুসার দিকে তাকালাম, রক্ত সরে গেছে ওর মুখ থেকে। রবিন, কিশোর আর রেমনকে দেখে মনে হলো শুনতে আগ্রহী।

‘মারিয়া!’ ধমকে উঠলেন ম্যাডাম। কয়েক পা এগিয়ে মঞ্চের কিনারে এসে দাঁড়ালেন। কটমট করে মারিয়া টরেস্কোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চুপ করো, ওই গল্প এখানে না বললেও চলবে।’

‘কেন, ম্যাডাম?’ বলে উঠল মেয়েটা।

কিশোর ওকে সমর্থন করল। ‘বললে অসুবিধে কী, ম্যাডাম?’

‘একটা শুভ কাজ শুরু করার সময় অশুভ কোনও গল্প নিয়ে মাথা না ঘামানো ঠিক নয়। আজ তোমাদের স্ক্রিপ্ট দেয়া হবে, এবং…’

‘না, ম্যাডাম, গল্পটা আমাদের শোনাতেই হবে,’ আবদার করে বলল কয়েকটা ছেলে।

পরক্ষণেই একসাথে অনেকগুলো কণ্ঠের চেঁচামেচি শোনা গেল, ‘বলুন, ম্যাডাম, বলুন। প্লিজ!’

চুপ করে থাকলেন ম্যাডাম। কথা নেই মুখে। চেহারা চিন্তিত। মনে হলো মহা ফাঁপরে পড়ে গেছেন বুঝি। তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত চেহারা দেখে অবাক হলাম আমরা।

তিন

‘বলুন না, ম্যাডাম, প্লিজ!’ চেঁচামেচি করে চলেছে ছাত্র-ছাত্রীরা।

ম্যাডাম হাত তুলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো।

এবার প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে একসঙ্গে হল্লা শুরু করে দিল।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে!’ উপায় না দেখে হার স্বীকার করলেন সুইটি ম্যাডাম। কিন্তু মনে রেখো, এটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা, তার বেশি কিছু নয়। আমি চাই না গল্পটা শুনে ভয় পাও তোমরা।’

‘না, ম্যাডাম, একটুও ভয় পাব না আমরা,’ কিশোর নিশ্চয়তা দিয়ে বলল।

‘না শুনলে কী হতো!’ বিড়বিড় করে বলল মুসা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম ম্যাডামের দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গল্পটা আমাদের শোনাতে যাচ্ছেন তিনি 1

মারিয়া টরেস্কোর মুখ কালো হয়ে গেছে, ওকে পাত্তা না দিয়ে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই শুনতে চায়।

ম্যাডাম সবসময় বলেন, কোনও বিষয়ে কারও কিছু জানার থাকলে আমরা যেন তাঁর কাছে যাই। তাঁকে প্রশ্ন করি। অথচ সেই সুইটি ম্যাডাম কেন আজ ‘প্রেতাত্মা’ নাটকের পেছনের ‘অশুভ’ কাহিনি বলতে এত দ্বিধা করছেন, আমার মাথায় ঢুকল না।

‘কাহিনির শুরু বাইশ বছর আগে,’ অবশেষে শুরু করলেন তিনি। ‘তখনও এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমার ধারণা মারিয়া টরেস্কোর, চাচা এই স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।’

‘জ্বি,’ মাথা দোলাল মারিয়া, মুখ কালো। টিচারদের সামনে ভদ্রতা করে কথা বলে, কিন্তু আড়ালে সম্মান দেয় না। আস্ত একটা বেয়াদব মেয়ে আসলে। ওর মন খারাপ হয়ে গেছে গল্পটা নিজে বলতে পারছে না তাই।

‘তখনও এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়নি,’ বলে চলেছেন ম্যাডাম। ‘তবে এই অডিটোরিয়ামটা ছিল। এটার মালিক ছিলেন রিচার্ড ম্যালন : নামের এক ভদ্রলোক। ছোটদের একটা থিয়েটার গ্রুপ ছিল তাঁর। ছোটদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল গ্রুপটা। এই অডিটোরিয়ামে নিয়মিত নাটক করত এই গ্রুপ। রিচার্ড ম্যালনের লেখা ‘প্রেতাত্মা’ নাটকটি যেদিন প্রথম মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল, সেদিন ঘটে গেল একটা দুর্ঘটনা। প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয় করছিল রিচার্ড ম্যালনেরই ছেলে। একটা দৃশ্য ছিল এমন, প্রেতাত্মা দড়ি ধরে থাকবে। আড়াল থেকে কপিকলের সাহায্যে দড়িটা ধীরে ধীরে টেনে তোলা হবে। লাইটিঙের কারসাজিতে দড়িটা দেখতে পাবে না দর্শক। তারা মনে করবে প্রেতাত্মা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওই দৃশ্যে অভিনয়ের সময় ঘটল দুর্ঘটনা। স্টেজ থেকে যখন বেশ অনেকটা ওপরে দড়ি ধরে ঝুলছিল ছেলেটা, সেই সময় হাত ফসকে পড়ে যায় সে আচমকা। বেকায়দায় পড়ে ঘাড় মটকে যাওয়ায় স্টেজেই মারা যায় ও। ভীষণ মুষড়ে পড়েন ভদ্রলোক। পৃথিবীতে আপন বলতে ওই ছেলে ছাড়া কেউ ছিল না তাঁর। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা চলছিল বেশ আগে থেকেই। রিচার্ড ম্যালন অডিটোরিয়ামসহ তাঁর এক একর জায়গা স্কুলের জন্যে দান করে কোথায় যেন চলে গেলেন। তখন থেকেই স্কুলের অডিটোরিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটা।’ থামলেন ম্যাডাম। টানটান হয়ে বসেছি আমরা।

মাথা নেড়ে আবার শুরু করলেন ম্যাডাম, ‘স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ছাত্ররা একটা নাটক করতে চাইল। ‘প্রেতাত্মা’ নাটকটিই মঞ্চস্থ হবে বলে ঠিক হলো।

‘নাটকের কাহিনি ভৌতিক। এক রহস্যময় প্রেতাত্মা একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে। নাটকে এমন কিছু স্পেশাল ভিজ্যুয়াল এফেক্টের ব্যাপার-স্যাপার ছিল, যা দর্শকদের খুবই পছন্দ হবে বলে ধারণা করলেন টিচাররা।’

উত্তেজিত দৃষ্টি বিনিময় করলাম কিশোরের সাথে। স্পেশাল এফেক্ট দারুণ পছন্দ করে মুসা, কিন্তু একদম চুপচাপ ও।

শুরু হলো ‘প্রেতাত্মা’ নাটকের রিহার্সাল,’ বলে চলেছেন ম্যাডাম। ‘স্কুলের সেরা ছাত্রটিকে মনোনীত করা হলো প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে।’

সবার চোখ এখন আটকে আছে কিশোরের দিকে।

‘প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর নাটকের রিহার্সাল চলতে লাগল। নাটকটা সফল করার জন্যে কারও কাজেই কোনও গাফিলতি ছিল না। সুন্দরভাবে কাজ এগিয়ে চলছিল, কিন্তু…’

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেলেন সুইটি ম্যাডাম।

‘থামলেন কেন, ম্যাডাম?’ শোরগোল উঠল অডিটোরিয়ামে।

‘আমি আবার তোমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, গল্পটা অন্যভাবে নিয়ো না তোমরা,’ বললেন তিনি। ‘ওটা কোনও ভৌতিক ব্যাপার নয়, স্রেফ একটা ঘটনা।’

নীরবে মাথা দোলালাম আমরা।

গলা খাকারি দিয়ে আবার শুরু করলেন ম্যাডাম, ‘যে রাতে নাটক মঞ্চস্থ হবে, সে-রাতের কথা। পোশাক-আশাক পরে পাত্র-পাত্রীরা তৈরি। অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীতে পুরো অডিটোরিয়াম ভর্তি।

‘পাত্র-পাত্রীদের শেষ পরামর্শ দেয়ার জন্যে পরিচালক সবাইকে কাছে ডাকলেন। সেই সময় দেখা গেল প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল যে-ছেলেটির, তার খোঁজ নেই। হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে গেছে সে। সবাই ডাকাডাকি করল। তন্ত্র-তন্ন করে খুঁজে দেখা হলো সারা স্কুল। কিন্তু নাটকের মূল আকর্ষণ প্রেতাত্মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। নেই তো নেই-ই। যেন উবে গেছে সে কর্পূরের মত। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন ‘প্রেতাত্মা’ নাটকের প্রেতাত্মা।

‘অনেকক্ষণ ধরে চলল খোঁজাখুঁজি। কিন্তু পাওয়াই গেল না ছেলেটাকে। বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল পুরো অডিটোরিয়াম। নাটক বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সেই সময় ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার ভেসে এলো অডিটোরিয়ামের কোনও এক জায়গা থেকে। শোনা যায়, শব্দটা অনেকটা নেকড়ের আর্তনাদের মত ছিল। ঠিক কোন্ জায়গা থেকে এসেছে ওটা, কেউ ধরতে পারেনি। দ্বিতীয়বার আর শব্দ শোনা যায়নি। আবার খোঁজা হলো সারা স্কুল। কিন্তু ফল হলো সেই একই।’ থামলেন ম্যাডাম।

সারা অডিটোরিয়ামে পিন-পতন নীরবতা। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছি আমরা।

‘আর কখনও দেখা যায়নি ছেলেটাকে,’ বললেন ম্যাডাম। ‘মনে হয় তোমরা ভাবছ ছেলেটা সত্যিকারের প্রেতাত্মা হয়ে গেছে। আসলে স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছিল ও! আমার ধারণা, মঞ্চভীতি চেপে ধরায় পালিয়েছিল। ‘প্রেতাত্মা’ নাটকও আর কখনও মঞ্চস্থ হয়নি।’

থেমে দম নিলেন ম্যাডাম। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো দেখলেন।

‘অবিশ্বাস্য!’ আমার পেছনে কেউ একজন বলল।

‘তোমার কী মনে হয় এটা সত্যি ঘটনা?’ আমার সামনের সারিতে একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

‘খাইছে! খাইছে! ইয়াল্লাহ্!’ হঠাৎ আমার পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল মুসা। ‘ওই তো সে, ওই তো প্রেতাত্মা!’ দরজার দিকে আঙুল তুলল ও।

সেদিকে ঘুরে গেল সবার দৃষ্টি। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে প্রেতাত্মা!

চার

তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল একটা মেয়ে।

আর্তনাদ করে উঠল আরও অনেকে। মনে হলো মারিয়া টরেস্কো চেঁচিয়ে উঠল বুঝি।

হলের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে বিদঘুটে হাসি হাসছে প্রেতাত্মাটা। মাথায় এলোমেলো কালো চুল। চোখের মণিদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এমনভাবে হাঁ করে আছে, মনে হচ্ছে গিলে খাবে সবাইকে। শজারুর কাঁটার মত ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো দেখলেই পিলে চমকে ওঠে। ‘কালো সুতোর মত কী দিয়ে যেন সারা মুখ সেলাই করা। দগদগে

ঘায়ে ভরে আছে সারা মুখ। বীভৎস!

‘হাউ-উ-উ-উ!’ পিলে চমকানো ভয়ঙ্কর গর্জন ছাড়ল ওটা।

মুহূর্তে ভয়ে আধমরা সবাই। ম্যাডামও মনে হলো ঘাবড়ে গেছেন। গড়গড় করে এক নাগাড়ে দোয়া-দরুদ পড়ছে মুসা।

কিন্তু আমি হাসছি। কারণ আমি জানি ওটা প্রেতাত্মা নয়। এই সাজে কিশোরকে আজ সকালেই দেখেছি। স্কুলে আসার আগে ও এই পোশাকে প্রেতাত্মা সেজে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। অবাক হয়ে ভাবলাম, একটু আগে সিট থেকে উঠে চলে গেছে ও। দু’মিনিটের মধ্যে পোশাকটা পরে হাজির হলো কী করে ও!

‘অনেক হয়েছে, কিশোর,’ উঁচু স্বরে বললাম আমি।

মুখোশ খুলে ফেলল কিশোর। হাসছে ও। কৌতুক করে রীতিমত মজা পেয়েছে।

অবাক চোখে কিশোরকে দেখল সবাই। তারপর অডিটোরিয়ামে হাসির রোল উঠল। হি-হি, হা-হা সবাই হাসছে।

‘কিশোর, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?’ চোখ পাকিয়ে বললেন সুইটি ম্যাডাম। অবাক হয়েছেন তিনি। কিশোরের মত এমন শান্তশিষ্ট ছেলে এরকম হালকা রসিকতা করবে, তা যেন ভাবতেই পারেননি। সাবধান করলেন ওকে, ‘প্রেতাত্মা যেন আর আমাদের সামনে না আসে।’

আমার পাশে এসে নিজের সিটে বসল কিশোর। ম্যাডামের গল্পে এতই বিভোর হয়ে পড়েছিল সবাই, সেই সুযোগে একটু মজা করে নিল ও।

‘সবাইকে ভয় দেখাতে ভাল লাগে বুঝি তোমার!’ বলল মুসা।

হাসল কিশোর। জবাব দিল না।

‘তা হলে আমরা আবার সেই ‘প্রেতাত্মা’ নাটকটাই মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছি, তা-ই না ম্যাডাম?’ প্রশ্ন করল ও।

‘হ্যাঁ,’ মাথা দুলিয়ে বললেন সুইটি ম্যাডাম। ‘দু’-দু’বার দুর্ঘটনা ঘটার পর কেউ নাটকটা করার সাহস পায়নি। কুসংস্কার আর কাকে বলে! আমরাই প্রথম এই নাটক মঞ্চস্থ করে দেখিয়ে দেব, সত্যি সত্যি প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই।’

গুঞ্জন উঠল, সবার চোখেমুখে পরিষ্কার উত্তেজনা।

‘এখন শোনো,’ বললেন ম্যাডাম। ‘এই নাটক করতে গিয়ে আবার দুর্ঘটনা ঘটবে এমন কথা কখনও মনে স্থান দিয়ো না যেন তোমরা। একটা ভৌতিক নাটক মঞ্চস্থ করছি আমরা। তাই ভৌতিক আবহ সৃষ্টির জন্যে কাহিনি দুটো তোমাদের কাজে লাগবে।’

‘কিন্তু ম্যাডাম,’ আমি বললাম, ‘মারিয়া বলছে নাটকটা নাকি সত্যিই অভিশপ্ত!’

‘হ্যাঁ,’ সাথে সাথে বলে উঠল মারিয়া টরেস্কো। ‘আমার ছোট চাচা তাই বলেছে। এই স্কুলে একটা প্রেতাত্মা আছে। সে চায় না প্রেতাত্মা নাটক মঞ্চস্থ হোক। এখনও নাকি সে আছে। কেউ তাকে দেখতে না পেলেও, সে এই স্কুলেই বাস করে।’

‘হয়তো আমাদের ক্লাসেই আছে, ছাত্র হিসেবে!’ হাসল কিশোর।

হাসছে কেউ কেউ। কারও মুখে আবার ভয়ের ছায়া।

ঢোক গিলছে মুসা।

গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ম্যাডাম, ‘যাকগে ওসব, গল্প অনেক হলো, এবার কাজে নামা যাক। স্ক্রিপ্ট বিলাতে আমাকে সাহায্য করবে কে? যারা অভিনয় করবে, প্রত্যেককে এককপি করে স্ক্রিপ্ট দেয়া হবে। তোমরা বাসায় গিয়ে যার যার পার্ট মুখস্থ করবে।’

কিশোর আর আমি উঠে গেলাম ম্যাডামকে সাহায্য করার জন্যে। বেশ কিছু স্ক্রিপ্ট আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। ওগুলো নিয়ে নেমে এলাম মঞ্চ থেকে। বিলাতে লাগলাম পাত্র- পাত্রীদের মধ্যে। মুসার সামনে যখন এলাম, ও বলল, ‘কিশোর, সত্যি সত্যিই যদি প্রেতাত্মা এখানে থেকে থাকে?’

মুসার প্রশ্ন ম্যাডামের কানে গেছে।

‘আহ্, মুসা,’ বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। ‘বাজে কথা রাখো তো! প্রচুর কাজ আছে আমাদের হাতে। আর…’

শেষ করতে পারলেন না তিনি।

হঠাৎ শোনা গেল ম্যাডামের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। ঘুরে মঞ্চের দিকে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমরা উপস্থিত সবাই।

সুইটি ম্যাডাম নেই!

অথচ একমুহূর্ত আগে তিনি মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের সবার চোখের সামনে।

হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন যেন সুইটি ম্যাডাম।

পাঁচ

স্ক্রিপ্ট খসে পড়ে গেল আমার হাত থেকে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছে সবাই।

‘ম্যাডাম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

‘তাই তো দেখছি!’ বলল কেউ। ‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব?’

কিশোর, রবিন, রেমন, মুসা আর আমি দৌড়ে মঞ্চে উঠে গেলাম।

‘আপনি কোথায়, ম্যাডাম?’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘ম্যাডাম! ম্যাডাম!!’

‘ম্যাডাম… আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’ ডাকল কিশোরও।

‘আমি এখানে, নীচে,’ হঠাৎ ম্যাডামের অস্পষ্ট কান্নার মত গলা শোনা গেল।

‘নীচে কোথায়?’ কিশোর বলল।

‘এখানে।’

মনে হচ্ছে মঞ্চের নীচ থেকে ম্যাডামের গলার স্বর ভেসে আসছে।

‘আমাকে তোলো, জলদি!’

এসব কী ঘটছে? ধাঁধায় পড়ে গেছি আমি। ম্যাডামের গলা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না কেন?

কিশোরই প্রথম মঞ্চের মাঝখানে ট্র্যাপডোর ধরনের চারকোনা গর্তটা আবিষ্কার করল। ওটার কাছে চলে গেলাম আমরা। গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম নীচে।

আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ম্যাডাম। ভীত- সন্ত্রস্ত চেহারা। মঞ্চ থেকে দশ ফুট নীচে একটা চারকোনা প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

‘লিফটটা ওপরে তোলো,’ বললেন আতঙ্কিত ম্যাডাম।

বোঝা গেল, একটা লিফটের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম। ‘কীভাবে?’ এবার জানতে চাইল মুসা।

‘ডানদিকের উইঙের পাশে এই লিফট্ ওঠানো-নামানোর বোতাম আছে। ওটায় চাপ দাও।’

‘পেয়েছি,’ ম্যাডামের কথা শেষ হতেই বলে উঠল মুসা। সুইচে চাপ দিল ও।

ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠল প্রথমে। তারপর ঘসর-ঘসর ঘর্ষণের শব্দ।

ধীরে ধীরে উঠে আসছে লিফ্‌ট্।

মঞ্চে উঠে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ম্যাডাম, বোকার মত। চেহারার আতঙ্ক এখনও পুরো কাটেনি।

‘লেগেছে, ম্যাডাম?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘সামান্য। এই লিফটের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম, ‘ বললেন তিনি। ‘ভাগ্যিস, মাত্র দশফুট নীচে পড়েছি—আমার হাত-পা ভেঙে যেতে পারত, মারাও যেতে পারতাম!’

বুজে গেছে গর্তটা, চারদিকে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

ম্যাডাম বললেন, ‘শুধু আমি কেন, এটার কথা সবাই ভুলে গেছে। বাইশ বছর আগে যখন ‘প্রেতাত্মা’ নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল, তখনই এই ট্র্যাপডোর তৈরি করা হয়, নাটকেরই প্রয়োজনে—প্রেতাত্মা যাতে ভোজবাজির মত উদয় হতে বা অদৃশ্য হতে পারে। মঞ্চে স্পেশাল এফেক্ট সৃষ্টির জন্যে ট্র্যাপডোরটা খুবই জরুরি। এরপর অনেক নাটক হয়েছে এই মঞ্চে। কিন্তু এই ট্র্যাপডোর কখনও ব্যবহার হয়নি। প্রয়োজন হয়নি। হঠাৎ আজ এই ট্র্যাপডোর খুলল কে?’ নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন ম্যাডাম নিজেই, ‘কখন বোতামে কার হাতের টিপ লেগে হয়তো নীচে নেমে গেছে ওটা, খেয়ালই করেনি কেউ।’

কিশোর নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন।

‘এটা তা হলে একমাত্র আমার ব্যবহারের জন্যেই?’ বলল ও, ‘ম্যাডাম, এখনই একবার ভেলকি দেখাব?

‘খবরদার,’ কিশোরকে ওদিকে এগোতে দেখে বললেন ম্যাডাম, ‘আগে লিফটটা ভাল মত পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যতক্ষণ না তা করা হচ্ছে, এটার ধারেকাছেও কেউ আসবে না।’

আবার ঝুঁকে পড়েছে কিশোর, নিচু হয়ে দেখছে কী সুন্দর ভাবে মিশে আছে লিফটটা স্টেজের সঙ্গে। মনে হলো সুইটি ম্যাডামের সতর্কবাণী শুনতে পায়নি ও।

‘কী বললাম, কানে যাচ্ছে না?’ ধমকে উঠলেন ম্যাডাম।

‘সরি, ম্যাডাম,’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল কিশোর।

‘সবাই যার যার সিটে গিয়ে বসো,’ বললেন ম্যাডাম। পুরো স্ক্রিপ্ট এখন আমি পড়ে শোনাব। প্রথমেই নাটকের কাহিনি জানা দরকার তোমাদের।’

মঞ্চ থেকে নেমে সবাই যার যার সিটে গিয়ে বসলাম। কিশোরের উত্তেজনা অনুভব করতে পারছি আমি। রীতিমত ছটফট করছে ও। আগে কখনও ওকে এত উত্তেজিত হতে দেখিনি। নাটকে নিজের চরিত্র নিয়ে কিশোর যে গভীরভাবে ভাবছে, তা ওকে দেখলেই বেশ বোঝা যায়।

পুরো স্ক্রিপ্ট পড়তে ম্যাডামের এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেল। প্রেতাত্মা! সত্যিই ভয়ঙ্কর এক নাটক।

ডরোথির সংলাপগুলো যখন ম্যাডাম পড়ছিলেন, শিহরিত হলাম আমি। চোখের সামনে নিজেকে মঞ্চে অভিনয়রত দেখতে পেলাম।

পেছনে মারিয়া টরেস্কোর দিকে তাকালাম। ডরোথির সংলাপ বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে ও।

যখন দেখল আমি ওর দিকে চেয়ে আছি, চট্ করে থেমে গেল। সবসময় যেমন তাকায়, তেমনি বাঁকা, হিংসুটে চোখে তাকিয়ে থাকল।

সত্যি, মেয়েটা আচ্ছা হিংসুটে তো! ডরোথির চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে ও, আমার সৌভাগ্যে হিংসে হচ্ছে ওর।

ওকে নিয়ে অত ভাবার সময় নেই আমার এখন। অনেক সংলাপ মুখস্থ করতে হবে। কারণ আমি অভিনয় করছি অন্যতম প্রধান চরিত্রে।

‘ঠিক আছে, এবার বাড়ি যাও সবাই,’ সুইটি ম্যাডাম বললেন, ‘যার যার সংলাপ ভাল করে মুখস্থ করবে। আগামীকাল আবার দেখা হবে।’

দরজার দিকে এগোতে গিয়ে টের পেলাম পেছন থেকে একটা হাত আমার জ্যাকেট টেনে ধরেছে। পেছনে তাকাতেই দেখলাম কিশোর একটা পিলারের আড়ালে যেতে ইশারা করছে। রবিন, মুসা সরে গেছে ওই পিলারের আড়ালে।

‘কী ব্যাপার, কিশোর?’

‘শ্-শ্-শ্,’ ঠোঁটে তর্জনী ঠেকাল ও। উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করল, ‘আগে সবাই চলে যাক, তারপর বলছি।’

‘কিন্তু কেন? এখানে লুকিয়ে থাকব কেন আমরা?’ প্রশ্ন করলাম।

‘ওই লিফটটা পরীক্ষা করতে হবে,’ হেসে বলল কিশোর।

‘কী?’ বিষম খেলাম।

‘হ্যাঁ, চলো এবার। সবাই চলে গেছে।’

শূন্য, অন্ধকার অডিটোরিয়ামটা ভুতুড়ে লাগছে।

ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা।

ছয়

মঞ্চে উঠে পড়লাম। চারদিকটা আগের চেয়েও অন্ধকার। শীত শীত করছে আমার।

আমাদের পায়ের শব্দ উঠল ফ্লোরবোর্ডে। সারা অডিটোরিয়ামে সে-শব্দ জোরাল প্রতিধ্বনি তুলছে। গা ছমছমে একটা পরিবেশ।

‘এমন একটা ভৌতিক ট্র্যাপডোর শুধু আমারই জন্যে অপেক্ষা করছে;’ হাসতে হাসতে রসিয়ে রসিয়ে বলল কিশোর, ‘সত্যিই তোমরা দুর্ভাগা, এটা ব্যবহার করতে পারবে না। এটা শুধু আমার জন্যে!’

মুসা শুকনো গলায় বলল, ‘এত আনন্দের কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না আমি।’

‘আমিও না,’ বলল রবিন। ‘তবু দেখা যাক কী করে কিশোর।’ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম।

হঠাৎ বুঝলাম হাঁচি আসছে আমার। আমার অ্যালার্জি আছে, একটুতেই হাঁচি শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে ধুলোবালি যদি কোনও ভাবে নাকে ঢোকে, তা হলে তো কথাই নেই। একটানা হাঁচতে হাঁচতে কাহিল হয়ে পড়ি। কখনও আবার এমনি-এমনিই হাঁচি হয়। আর একবার উঠলে সহজে থামতে চায় না। একটানা সতেরোবার হাঁচি দেয়ার রেকর্ড আছে আমার।

আমার হাঁচি গুনতে শুরু করল কিশোর। হাসছে। এমন ভৌতিক পরিবেশেও মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁচি গুনতে শুরু করল ও, ‘সাত…আট… নয়…’

দশবার হাঁচির পর রেহাই পেলাম এ-যাত্রা। রুমালে নাক মুছে কড়া চোখে কিশোরের দিকে তাকালাম।

‘প্রথমে চারকোনা লিফট ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে,’ কিশোর বলল। ‘আমি করছি। মুসা, ওটার কন্ট্রোল সুইচটা পরীক্ষা করো।’

ট্র্যাপডোরের ওপর দাঁড়াল ও। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সুইচটা খুঁজল মুসা। হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা।

‘পেয়েছি!’ উত্তেজিত গলায় একটু জোরেই বলে ফেলল মুসা।

ভীত চোখে অন্ধকার অডিটোরিয়ামে চোখ বোলালাম আমি।

‘আস্তে,’ চাপা গলায় বলল কিশোর। ‘কেউ শুনে ফেললে বিপদ হবে।

‘সরি,’ বলল মুসা।

বুঝলাম আবার হাঁচি আসছে আমার। যতটা সম্ভব আস্তে হাঁচি দিলাম।

‘চার! পাঁচ!!’ গুনে যাচ্ছে কিশোর। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও দায়িত্ব পালন করছে।

ভাগ্য ভাল, সাতে গিয়ে থামল হাঁচি।

‘সুইচে চাপ দিয়েই লিফটের ওপর চলে এসো তোমরা,’ বলল কিশোর।

তাই করলাম আমরা।

ঘড়-ঘড় আওয়াজ উঠল প্রথমে। তারপর ঘস ঘস ঘর্ষণের শব্দ। চারকোনা ট্র্যাপডোর মৃদু দুলুনির সাথে নামতে শুরু করল একটু একটু করে।

‘চারদিকের দেয়াল ছাড়া আজব এক লিফট,’ বলল মুসা।

‘ভয় লাগছে?’ বলল কিশোর।

দূর, একটুও না,’ হাসতে চেষ্টা করল মুসা। তবে প্রেতাত্মাটা…’

ঘর্ষণের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমাদের নিয়ে নেমে যাচ্ছে লিফট।

নামছে! নামছে!! নামছে!!!

একসময় মঞ্চ পুরোপুরি চোখের আড়ালে চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাগরে যেন তলিয়ে গেলাম আমরা।

মঞ্চের একটু নীচে এসেই লিফটের থেমে যাওয়ার কথা, সুইটি ম্যাডাম পড়েছিলেন দশফুট নীচে। ওখানেই দাঁড়িয়েছিল ওটা।

এবার কেন যেন তা হলো না। হলো অন্যরকম।

নামছে তো নামছেই। থামার কোনও নাম নেই ওটার।

‘কী ব্যাপার?’ রীতিমত ঘাবড়ে গেল মুসা।

‘আর কত নীচে নামবে এই হতচ্ছাড়া?’ ভয় পেয়েছি আমিও। কথাটা বোধহয় পুরো শেষ করতে পারিনি আমি, আচমকা প্রচণ্ড শব্দে কোনও কিছুর সাথে বাড়ি খেয়ে থেমে গেল লিফ্‌ট্।

‘ওফ্!’ চিৎকার করে উঠলাম। হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি।

পরমুহূর্তে লিফট থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমরা।

চট্ করে উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকালাম ভয়ে ভয়ে। ‘তোমরা ঠিক আছো তো?’ জানতে চাইল মুসা।

‘পায়ে ব্যথা পেয়েছি,’ বললাম।

‘মনে হয় ঠিক আছি আমি,’ বলল কিশোর।

‘আমিও।’ উঠে দাঁড়াল রবিন।

দেখা না গেলেও অনুমান করলাম গভীর, দীর্ঘ কোনও সুড়ঙ্গের মধ্যে রয়েছি এখন আমরা।

অন্ধকার! নীরব!!

হঠাৎ অস্বস্তিকর একটা আওয়াজ এলো আমার কানে। ধক্ করে উঠল বুক। বুকের খাঁচায় দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ওটা বুঝি সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলছে। যে-কোনও সময় ছিঁড়ে যেতে পারে সুতো।

শব্দটা কীসের?

শ্বাস-প্রশ্বাসের মত।

হ্যাঁ, সেরকমই শোনাচ্ছে আওয়াজটা। আমার খুব কাছ থেকে আসছে।

ডানদিক থেকে!

মুসা!

‘অত শব্দ করে দম নিচ্ছ কেন?’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।

‘কেন?’ ফিসফিস করে বলল মুসা।

‘ঠিক আছে, কিছু মনে কোরো না,’ একটু পর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল কিশোর। আসলে ভয়ে, উত্তেজনায় নিজের অজান্তেই ওভাবে জোরে জোরে দম নিচ্ছে মুসা।

সবাই ভয় পেয়েছি। ভয় পাওয়ারই কথা। পরস্পরের আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম আমরা।

ওপর দিকে তাকালাম। অনেক ওপরে চারকোনা একটা হালকা আলোর আভাস। বুঝলাম, অডিটোরিয়ামের ছাদ ওটা। ট্র্যাপডোরের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে ওটা বুঝি আমাদের থেকে কয়েক মাইল দূরে, ধরা- ছোঁয়ার বাইরে।

‘আমরা কোথায়?’ কাঁপা গলায় বলল মুসা। ‘খাইছে, প্রেতাত্মার কবরে এসে পড়লাম নাকি!’

‘হয়তো মঞ্চের এক মাইল নীচে,’ আমার গলায় তীব্র হতাশা আর আতঙ্ক ফুটল।

‘এত হতাশ হচ্ছ কেন?’ বলল কিশোর।

বললাম, ‘ঠিক আছে, শার্লক হোমস, তা হলে তুমিই বলো, আমরা কোথায়?’

‘আমার মনে হয় না এটা স্কুলের বেজমেণ্ট,’ কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল কিশোর। ‘বেজমেন্ট থেকে অনেক নীচে কোথাও আছি আমরা।’

‘সুড়ঙ্গ হতে পারে,’ বলল মুসা।

‘চলো, আমরা সবাই চিৎকার করি,’ বললাম।

কেউ কোনও কথা বলল না।

বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল কিশোর। তারপর বলল, ‘লাভ হবে না।’

আসলে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করছি আমি। চিৎকার করতে চাই না। মুসার মতো নই। গা শিরশির করা পরিবেশ আমার ভালই লাগে, মাথার চুল দাঁড়িয়ে যাবে, গা ছম্ছম্ করে উঠবে, চোখ বড় বড় হয়ে যাবে, শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসবে, এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পছন্দ করি আমি। সেই আমিও এখন ভয় পাচ্ছি।

‘পরেরবার যখন এখানে আসব, সাথে টর্চ লাইট নিয়ে আসব,’ বলল কিশোর।

‘হ্যাঁ!’ মুখে বললাম বটে, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই নরকে আমি আর আসছি না।

‘লিফটটা এত নীচে নেমে এলো কেন?’ বলল মুসা।

‘জানি না,’ চিন্তিত গলায় বলল কিশোর। ‘হয়তো প্রেতাত্মা বাবাজির…’

কেমন যেন লাগছে এখন। মজা করার সাধ মিটে গেছে অনেক আগেই। এখন প্রাণটা নিয়ে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। নির্দোষ উৎসাহ দমন করতে না পেরে কী বিপদেই যে পড়লাম!

কিশোরের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘এখন প্রেতাত্মা নিয়ে কোনও কৌতুক নয়, কিশোর।’

‘আমারও একই কথা,’ বলল মুসা। ‘এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের।’

মনে মনে বললাম, সত্যিই যদি প্রেতাত্মা থেকে থাকে, এটাই তার বসবাসের আদর্শ জায়গা।

‘এবার বেরোতে হবে,’ মাথার ওপরে আলোর আভাস, তাকিয়ে আছে কিশোর। ‘সময়মত ডিনারের টেবিলে না বসলে চাচীর বকা খেতে হবে।’

‘ডিনারের টেবিলে তো সুযোগ হলে বসতেই পারবে,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু মিস্টার সবজান্তা, একটা প্রশ্ন।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘এখান থেকে বের হওয়া যায় কীভাবে?’

কিছুক্ষণ কথা সরল না কিশোরের মুখে। মুক্তি পাওয়ার উপায় নিয়ে ভাবছে নিশ্চয়ই। আমিও ভাবলাম সমস্যাটা নিয়ে।

হঠাৎ হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ে লিফটের ওপরে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল কিশোর। বলল, ‘এটার সাথে হয়তো কোনও সুইচ আছে। দেখি, খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।’

‘ভুলে যাচ্ছ ওটা মঞ্চের দেয়ালে আছে,’ স্মরণ করিয়ে দিলাম। ‘তা হলেও কোনও লিভার কিংবা বোতাম থাকতে পারে এটাকে ওপরে তোলার জন্যে!’ বলল মুসা।

‘কিন্তু কোথায়? কোথায় থাকতে পারে?’ বললাম। ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে।

একটা কিছু পাওয়ার আশায় সারা লিফট তন্ন-তন্ন করে খুঁজলাম আমরা। অন্ধের মত হাতড়াতে লাগলাম। কিন্তু তেমন কিছু আমাদের হাতে বাধল না। নেই ওসব।

কয়েক মিনিট পর খোঁজা বাদ দিয়ে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। মুসা ফিসফিস করে বলল, ‘খাইছে! মরেছি আমরা!’

‘কিশোর, আমরা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি,’ কেঁপে উঠল আমার গলা।

সাত

‘তোমার দোষেই এতবড় বিপদে পড়লাম,’ কেমন এক ঘোরের মধ্যে বলে বসলাম আমি।

কথাটা কেন বললাম নিজেই জানি না, বোধহয় মাথা বিগড়ে গেছে। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছে, সারা শরীর। এরকম মুহূর্তে কী করা বা বলা উচিত, মাথায় খেলছে না।

জোর করে হাসল কিশোর।

ড্যাম কেয়ার ভাব করে বলল মুসা, ‘ভয় করছে তোমার? আমার কিন্তু করছে না। বের হওয়ার পথ ঠিকই পেয়ে যাব, দেখো!’ ওর কণ্ঠের কাঁপুনি ওর মনের অবস্থা ফাঁস করে দিল।

‘ঠিক বলেছ তুমি, মুসা,’ বলল রবিন। ‘একটা না একটা পথ বের হবেই।’

‘এখানে আসাই উচিত হয়নি আমাদের,’ বলল কিশোর।

‘এখন উদ্ধার পেলে বাঁচি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী আসার একটুও ইচ্ছে ছিল না, শ্যারন?’

‘একটুও না,’ ভীত গলায় বললাম। ‘ম্যাডাম বলেছেন জায়গাটা নিরাপদ নয়। এখন যদি বের হতে না পারি কী হবে? এখানে আটকে থাকতে হয় যদি? হয়তো সারা জীবন…’

‘যতক্ষণ না ইঁদুরের পেটে যাচ্ছি আমরা!’ এই পরিস্থিতিতেও কিশোর কৌতুক করছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

‘রসিকতা রাখো তো!’ রেগে বললাম।

সাথে সাথে ঘড়ঘড় শব্দ উঠল।

কিশোর বলল, ‘তা হলে রওনা হয়ে যাই!’

‘মানে!’ বলে উঠল মুসা।

‘তুমি কি লেভারটা পেয়েছ, কিশোর?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

কড়াৎ করে একটা শব্দ হলো। আমরা বুঝে ফেলেছি তখন, কিশোর লেভার পেয়েছে আগেই, দেখছিল আমরা কী করি।

মাঝে মাঝে যে কী সব পাগলামি করে ও!

‘কিশোর!’ খেপে গিয়ে বললাম, ‘এটা কী হলো?’

‘দেখছিলাম আরকী, বলল কিশোর।

ঠিক তখনই নড়ে উঠল লিফট। ঘস ঘস ঘর্ষণের শব্দ উঠল। স্তব্ধ পাতালপুরিতে ভয়াবহ শোনাল আওয়াজটা। আমাদের নিয়ে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছে লিফট।

সরসর করে উঠে চলেছে লিফট। প্রায় পৌছে গেছি আমরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফর শেষ হলো না।

হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল লিফট। ব্যাপার কী! মঞ্চ এখনও দশ ফুট ওপরে। ম্যাডামকে নিয়ে তখন যে উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিল এটা, সেখানে এসেই থেমে গেছে লিফট।

লিফটের খাটো ওই লেভারে চাপ দিল আবার কিশোর। নড়ল না লিফ্‌ট্। আশঙ্কা করলাম নড়বে না আর।

‘একজন বসে পড়ো,’ বলল এবার মুসা। ‘আমি উঠে গিয়ে সুইচ টিপে লিফ্‌ট্ চালু করে ফেলব। যদি সেটা না করতে পারি, তাও কোনও সমস্যা নেই। দড়ি নিয়ে এসে টেনে তুলে ফেলব তোমাদের।’

এক হাতের আঙুলের ফাঁকে অন্য হাতের আঙুল ভরে শক্ত করে ধরে থাকল কিশোর। সেখানে পা রেখে কিশোরের কাঁধে উঠে পড়ল মুসা, তারপর একহাতে দেয়াল ধরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

সহজেই মঞ্চের মেঝের নাগাল পেয়ে গেল মুসার হাত। কিনারা ধরে মুহূর্তখানেক ঝুলে থাকল, তারপর দু’হাতে জোর এক ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে তুলে নিল ওপরে।

দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ও। মঞ্চের ওপরে ওর পায়ের শব্দ পেলাম। অপেক্ষায় থাকলাম। ওপরের সুইচে চাপ দিলেই লিফটা আমাদের নিয়ে জায়গামত পৌছে যাবে।

পুরো একটা মিনিট পেরিয়ে গেল। নড়ার লক্ষণ দেখা গেল না লিফটের।

‘মুসা?’ চাপা কণ্ঠে ডাকল কিশোর।

বিরক্ত হয়ে ডাকলাম, ‘মুসা? কী হলো?’

কান পেতে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা।

কিন্তু ওপর থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছে না। মুসার হলো কী? ওর পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

‘মুসা, কোথায় তুমি?’ ডাকলাম। ‘লিফ্‌ট্ ওপরে তোলো।’

মুসা কোথায় গেল?

আরও এক মিনিট পেরিয়ে গেল। একেকটা মিনিট এখন একেক যুগের মত মনে হচ্ছে আমাদের।

মুসার সাড়া নেই।

‘মুসা!’ আবার চেঁচিয়ে ডাকলাম আমি। ‘আমাদের ওপরে তোলো!’

অবশেষে একটা হাত নেমে এলো। আবছা আলোয় দেখতে পেলাম মুসার মুখ। ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। এমন লাগছে কেন ওকে? উদ্ভ্রান্তের মত লাগছে। নিজের মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখলে মানুষের যেমন ভূতের-তাড়া-খাওয়া চেহারা হয়, তেমনি দেখাচ্ছে এখন ওকে।

দু’হাতে আমার কোমর ধরে উপরে তুলে ধরল কিশোর।

মুসার বাড়িয়ে দেয়া হাত জাপটে ধরলাম। বহুকষ্টে আমাকে ওপরে টেনে তুলল ও।

মঞ্চে উঠে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। অডিটোরিয়ামের আবছা আলোয় চোখ সয়ে আসতে কিছু সময় নিল। মুসাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে কথা গলায় আটকে গেল। যে আমাকে ওপরে তুলেছে, সে মুসা নয়, আর কেউ!

ভীতিকর একজোড়া কালো কুতকুতে চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে সে। রাগে ফেটে পড়ছে যেন তার দু’চোখ।

আট

আঁতকে উঠলাম। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।

অদ্ভুত চেহারার অচেনা, বেঁটে এক লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরনে তার ধূসর প্যান্ট ও ঢিলেঢালা ধূসর সোয়েটার। রাগে বিকৃত হয়ে আছে চেহারা।

মাথায় উস্কোখুস্কো ঘন চুল তার, দেখলে কাকের বাসার কথা মনে পড়ে যায়। যে মুখোশ পরে কিশোর ‘প্রেতাত্মা’ নাটকে অভিনয় করবে, সেটায় যেমন ক্ষতচিহ্ন রয়েছে, এর মুখেও রয়েছে তেমনি ক্ষতচিহ্ন।

আবছা আঁধারে লোকটাকে বেশ বয়স্ক মনে হলো। বেশ খাটো ও হালকা-পাতলা, ঠিক বাচ্চা ছেলেদের মত। কিশোরের চেয়ে বড়জোর এক-দেড় ইঞ্চি লম্বা হবে অদ্ভুত লোকটা।

দেখতে ঠিক একটা প্রেতাত্মার মত লাগছে। ভাবতেই প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেলাম। আমার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে, পারলে এখনই গিলে খাবে।

তারই মধ্যে ভাবলাম, সুইচটা টিপে লিফট চালু করল না কেন সে। ওটা টিপলে এখনই উঠে আসবে কিশোর আর রবিন, কিন্তু নড়ার সাহস পেলাম না।

‘আ…আপনি কে?’ কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম।

কারেন্ট নেই বলে লিফ্‌ট্ তোলা যাচ্ছে না,’ বিদঘুটে গলায় বলল বলল লোকটা। ‘আমি মিলার্ড, নাইট গার্ড।’

‘তুলুন!’ বলে উঠল কিশোর।

‘বসে থাকো,’ বলল লোকটা। ‘পরে তুলব।’

‘আমার বন্ধু মুসা কোথায়?’ কেঁদে ফেললাম প্রায়।

‘এখানে, শ্যারন, পেছনে শুনতে পেলাম মুসার গলা।

চট্ করে পেছনে ফিরলাম। ট্র্যাপডোরের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো। বোঝা গেল, এই বিদঘুটে লোকটাকে দেখে গা ঢাকা দিয়েছিল।

‘মুসা,’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘কী হচ্ছে এসব?’

‘স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কর্কশ কণ্ঠে বলল নাইট গার্ড, ‘এখানে কী করছ তোমরা?’

মুসা আর আমি দৃষ্টি বিনিময় করলাম। এক পা এগিয়ে এলো ও।

‘আমরা… আমরা নাটকের রিহার্সাল করছিলাম,’ বলল আমতা আমতা করে।

‘হ্যাঁ,’ আমিও সায় দিলাম দ্রুত। ‘রিহার্সাল করতে গিয়ে বেখেয়ালে একটু দেরি হয়ে গেছে।’

‘নাটকের রিহার্সাল?’ দাঁত খিঁচিয়ে বলল লোকটা। ‘তা হলে বাকিরা কোথায়?’

ইতস্তত করতে লাগলাম। লোকটা আমাকে এতই ভয় পাইয়ে দিয়েছে যে, আমার পা রীতিমত ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে।

‘আমরাও… মানে,’ একটা ঢোক গিলে কোনওমতে বললাম, ‘ভুলে জ্যাকেটটা ফেলে গিয়েছিলাম। ওটা নিতে এসেছিলাম।’

লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আমার মিথ্যে কথাটাকে সমর্থন জানাচ্ছে মুসা।

‘এই ট্র্যাপডোর সম্পর্কে জানলে কীভাবে?’ শীতল গলায় জানতে চাইল নাইট গার্ড।

ইতস্তত করছি আমি। ওকে আগে কখনও স্কুলে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না আমার।

‘সুইটি ম্যাডামের কাছ থেকে জেনেছি, মুসা বলল। বোঝা যাচ্ছে আমার মতই ভয় পেয়েছে।

লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এলো কয়েক পা। আরও পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওর বিদঘুটে চেহারা।

‘তোমরা জানো না এটা বিপজ্জনক?’ চাপা গলায় বলল সে।

এবার প্রায় আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল ভয়ঙ্কর লোকটা। ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে আমার মুখে। ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেলাম।

‘জানো না এটা কত বিপজ্জনক?’ আবার বলল সে।

.

রাতে টেলিফোনে কথা হলো কিশোরের সাথে। ‘লোকটা আমাদেরকে সাবধান করার বদলে ভয় দেখাচ্ছিল,’ বললাম আমি। ‘ওই নাইট গার্ডকে আগে কখনও দেখিনি কেন আমরা?’

‘কারণ ও নাইট গার্ড নয়, আসলে প্রেতাত্মা,’ হাসল কিশোর।

অন্যসময় হলে হেসে ফেলতাম হয়তো। কিন্তু হাসতে পারলাম না। চিন্তিত গলায় বললাম, ‘সত্যিই লোকটা আমাদেরকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছিল।’

আর আলাপ জমল না আমাদের। একটু চুপচাপ হয়ে গেল কিশোর। কী ভাবছে বুঝতে পারলাম না। একটু পর বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

নয়

মঙ্গলবার সকাল।

প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আমার ছোটভাই জর্জকে ওর স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যাই আমি।

আজও একসাথেই বেরিয়েছি দু’ভাই-বোন। চলতে চলতে গল্প করছি নাটক প্রসঙ্গে।

ও আমাদের ‘প্রেতাত্মা’ নাটকের পুরো কাহিনি জানে। কিন্তু ট্র্যাপডোরটার কথা জানাইনি এখনও ওকে, গোপন রেখেছি। ম্যাডাম বলেছেন নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে যেন ওটার কথা কেউ প্রকাশ না করি।

‘সত্যিই নাটকটা ভৌতিক?’ জানতে চাইল জর্জ। ওর বয়স সাত। কেউ যদি ওর কানের কাছে ‘হাউ…’ শব্দ করে ওঠে, তা হলেই সেরেছে। ভয়ে জর্জের দম বন্ধ হয়ে যায়। ওকে নিয়ে একবার একটা ভৌতিক ছায়াছবি দেখেছিলাম। তারপর বহুদিন রাতে ঘুমের মধ্যে ‘ভূত!’

‘ভূত!’ বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে ও।

‘হ্যাঁ, ভৌতিক,’ বললাম আমি। ‘তবে তোমাকে নিয়ে যে ছায়াছবিটা দেখেছিলাম অতটা মারাত্মক নয় কাহিনি।’

মনে হলো কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে জর্জ। ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে এমন সবকিছু এড়িয়ে চলে ও।

রহস্যমাখা গলায় বললাম, ‘আমাদের ‘প্রেতাত্মা’ নাটকে একটা সারপ্রাইজ আছে দর্শকদের জন্যে।’

‘যেমন?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল জর্জ।

‘আগেই বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকল কোথায়?’ জর্জের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম আমি।

জর্জকে ‘ওর স্কুলে পৌঁছে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে নিজের স্কুলের দিকে হাঁটা ধরলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি নাটকে আমার চরিত্র নিয়ে। অত সংলাপ মনে রাখতে পারব কি না, ভেবে ভয় পাচ্ছি রীতিমত।

গত বছরের নাটকে আমি সংলাপ গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তবে আমার উপস্থিত বুদ্ধিতে তা বুঝতে পারেননি দর্শকরা। বানিয়ে কিছু সংলাপ বলেছিলাম। ওতে নাকি আমার ছোট চরিত্রটা আরও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। টিচাররা খুব প্রশংসা করেছিলেন। সে- কারণেই এবার আমাকে এতবড় একটা চরিত্র দেয়া হয়েছে।

ক্লাসরুমে এসে আমার ডেস্কের সামনে থমকে দাঁড়ালাম।

অপরিচিত এক ছেলে বসে আছে আমার ডেস্কে। চেহারায় বুদ্ধির ঝিলিক। চমৎকার হলুদ জ্যাকেট পরেছে ছেলেটা। স্মার্ট লাগছে দেখতে। আগে কখনও দেখিনি একে আমি।

ডেস্কের ওপর ছড়িয়ে আছে ওর বই-খাতা। যেন স্কুল নয়, বাসায় বসে পড়াশুনো করছে সে।

‘আমার জায়গায় বসেছ তুমি,’ ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বললাম।

বই থেকে মুখ তুলল ও। গভীর চোখে তাকাল আমার দিকে। বলল, ‘মনে হয় ঠিক জায়গাতেই বসেছি আমি। এটা আমার ডেস্ক।

‘তোমার ভুল হচ্ছে,’ ধীরে, তবে দৃঢ় গলায় বললাম।

‘সুইটি ম্যাডামের দেখিয়ে দেয়া জায়গাতেই আমি বসেছি। আমার ডেস্কের পেছনেই একটা খালি ডেস্ক দেখতে পেলাম। ‘ম্যাডাম মনে হয় তোমাকে ওই ডেস্কে বসতে বলেছেন, ‘ পেছনেরটা দেখিয়ে বললাম। ‘কিশোরের পাশের এই ডেস্কে আমি সবসময় বসি।’ কিশোরের ডেস্কের দিকে আঙুল তুললাম। ওটা এখনও খালি

‘সরি,’ লাল হয়ে গেল ছেলেটার ফর্সা মুখ। বই-খাতা নিয়ে পেছনের ডেস্কে চলে গেল।

‘নতুন ভর্তি হয়েছ বুঝি?’ জানতে চাইলাম।

‘হ্যাঁ,’ বলল ছেলেটি। ‘আগে আমরা নিউ ইয়র্কে থাকতাম। বাবা রকি বিচে বদলি হয়ে এসেছেন। আমার নাম পার্থস। তুমি শ্যারন, তা-ই না?’ তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল পার্থস। ‘এবারের বার্ষিক নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছ, ঠিক বলিনি?’

‘অন্যতম প্রধান চরিত্রে,’ স্বীকার করলাম। ‘জানলে কীভাবে?’

‘স্কুলে আসার পথে বাসে ছেলে-মেয়েরা বলাবলি করছিল। মনে হয় তুমি খুব ভাল অভিনয় করো।’

‘কী জানি, তবে মাঝে মাঝে খুব ঘাবড়ে যাই।’

হ্যাঁ, ঘাবড়ে যাই বটে আমি, তবে দর্শকদের তা বুঝতে দিই না। কায়দা করে নার্ভাস ভাবটা ঢেকে ফেলি। তাই বাবা-মা বলে, বড় হয়ে আমি ভাল অভিনেত্রী হব।

‘নিউ ইয়র্কে থাকতে স্কুলের সব নাটকে আমি অভিনয় করেছি, কিছুটা লাল হলো পার্থসের গাল। তবে প্রধান চরিত্রে কখনও অভিনয়ের সুযোগ পাইনি। ইস্, আর কিছুদিন আগে ভর্তি হলে আমিও ‘প্রেতাত্মা’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেতাম।’

কল্পনার চোখে ছেলেটাকে মঞ্চে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। মনেই হয় না ও অভিনয় করতে পারে। দেখে বোঝা যায়, ভীষণ ভীরু আর লাজুক প্রকৃতির ছেলে পার্থস। আমার সাথে কথা বলতেই লজ্জায় কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে বারবার।

তবু ছেলেটাকে সবমিলিয়ে ভালই লেগে গেল আমার। মনে হচ্ছে বন্ধু হিসেবে ও মন্দ হবে না।

‘পার্থস, আজ বিকেলে রিহার্সালের সময় আমার সাথে থেকো, কেমন?’ বললাম আমি। ‘দেখি ম্যাডামকে বলে তোমাকে ছোটখাটো একটা চরিত্র পাইয়ে দেয়া যায় কি না। চরিত্র যদি না-ই পাওয়া যায়, তোমাকে অন্য কোনওভাবে নাটকের সাথে জড়িত করার চেষ্টা করব আমি।’

খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠল পার্থসের চোখ।

‘সত্যি?’ চোখ বড় করে জানতে চাইল ও।

‘শিয়োর,’ বললাম আমি। ‘যদি ভাগ্য ভাল হয় ছোটখাটো কোনও চরিত্র পেয়েও যেতে পারো।’

ক্লাসরুমে ঢুকে নিজের সিটের দিকে এগিয়ে এলো কিশোর। ম্যাডামের ডেস্কের দিকে ওর চোখ।

পার্থসের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

ক্লাসে ঢুকলেন সুইটি ম্যাডাম। দরজা বন্ধ করে এগিয়ে গেলেন তাঁর ডেস্কের দিকে। ক্লাস শুরু হতে চলেছে।

তাড়াতাড়ি নিজের ডেস্কে বসল কিশোর।

এদিকে আমি পড়েছি এক মুশকিলে। ডেস্ক খুলে দেখি বিজ্ঞানের নোট বইটা নেই। নিশ্চয়ই লকারে ফেলে এসেছি ওটা।

‘একমিনিট, ম্যাডাম, বিজ্ঞানের নোট বই লকারে রয়েছে, নিয়ে আসি,’ বলেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে লকারের দিকে ছুটলাম।

কিন্তু লকারের সামনে এসে অবাক হয়ে গেলাম। লকার খোলা। অথচ পরিষ্কার মনে আছে ক্লাসে যাওয়ার আগে লকার বন্ধ করেই গিয়েছি আমি। কে খুলল? তা ছাড়া আমার কম্বিনেশন নাম্বার আমি ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়। তা হলে?

আধখোলা আলমারির দরজাটা পুরোপুরি খুলে ফেললাম একটানে। পরক্ষণে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম ভয়ে।

লকারের ভেতরে একটা মাথা দেখা যাচ্ছে। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে!

দশ

আমার দিকে চেয়ে হাসছে মাথাটা। পৈশাচিক হাসি।

চট্ করে হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেললাম। তারপরই কিছু একটা খেয়াল হতে হেসে ফেললাম আমি

মনে পড়ল কিশোরের কথা এবং ওর ভয়ঙ্কর মুখোশটার কথা।

‘দুঃখিত, কিশোর,’ আপনমনে মাথা দুলিয়ে বললাম। ‘আমাকে এ-যাত্রা একটুও ভয় দেখাতে পারোনি তুমি।’

মুখোশের পাশেই একটা ভাঁজ করা কাগজ চোখে পড়ল আমার।

দ্রুত কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে তুলে ধরলাম। লাল গোটা গোটা অক্ষরে কী যেন লেখা আছে ওতে। লাল কেন? কালি? নাকি রক্ত? পড়লাম লেখাটা:

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
আমাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডু চিবিয়ে খাব।
আমার ঘাঁটি ছেড়ে সরে যাও,
সরে যাও।

‘চমৎকার কিশোর, চমৎকার,’ আপনমনে বললাম। নোট বুকটা নিয়ে লকার বন্ধ করে ক্লাসরুমে ফিরে এলাম। ততক্ষণে সবার সাথে পার্থসকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পালা শেষ করেছেন ম্যাডাম।

‘আমাকে একটুও ভয় দেখাতে পারোনি তুমি, কিশোর,’ সিটে বসতে বসতে নিচু স্বরে বললাম কিশোরকে।

অঙ্কের নোটবুক থেকে মুখ তুলল ও।

‘কী?’ আমার কথা যেন বুঝতে পারেনি একদম।

‘তোমার মুখোশ,’ চাপা গলায় বললাম। ‘একটুও ভয় পাইনি ওটা দেখে। মাঠে মারা গেছে তোমার পরিকল্পনা।’

‘মুখোশ মানে? কীসের মুখোশ?’ যেন আকাশ থেকে পড়ল ও। অবাক হয়ে দেখছে আমাকে।

‘অভিনয় ভালই করতে পারো তুমি। সাবধানবাণীটাও খুব সাদামাঠা হয়ে গেছে। আরও জমানো যেত ওটা, একটু চিন্তা করলেই।’

‘সাবধানবাণী! কী বলছ তুমি এসব, শ্যারন?’

‘বলতে চাও, আমার লকারে ভরে রাখা প্রেতাত্মার মুখোশ আর চিরকুট সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি, তা-ই না?’

‘কী বলছ, শ্যারন, আমাকে অঙ্কটা শেষ করতে দাও,’ বলে ডেস্কের ওপর উপুড় হলো কিশোর।

‘তা হলে নিশ্চয়ই ওটা সত্যিকারের প্রেতাত্মার কাজ?’ ঠোঁট উল্টে বললাম।

আমার কথায় কান না দিয়ে অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কিশোর।

আমি শিওর, কাজটা ও ছাড়া আর কারও হতেই পারে না।

.

ছুটির পর পার্থসকে নিয়ে অডিটোরিয়ামে হাজির হলাম। কেন যেন ওকে মঞ্চে ওঠাতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। যদিও ছেলেটা অসম্ভব লাজুক।

‘ম্যাডাম, আমাদের নতুন বন্ধু পার্থসকে দেয়ার মত ছোটখাটো কোনও চরিত্র আছে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘নাটকে অভিনয় করতে খুবই আগ্রহী ও।

হাতে ধরা স্ক্রিপ্ট থেকে চোখ তুললেন সুইটি ম্যাডাম। তাকালেন ওর দিকে।

‘দুঃখিত, পার্থস,’ মাথা নাড়িয়ে বললেন ম্যাডাম। ‘কোনও চরিত্রই অবশিষ্ট নেই।

রাঙা হলো ছেলেটার গাল। আমি কখনও লজ্জায় কারও গাল এত লাল হতে দেখিনি।

‘কোনও চরিত্রে আমাকে বিকল্প রাখা যায় না?’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল পার্থস, ‘আমি সংলাপ খুব ভাল মনে রাখতে পারি। একসাথে দু’তিনটে চরিত্রের সংলাপও মনে রাখতে পারি।’

‘দুঃখিত,’ বললেন ম্যাডাম। ‘তবে ইচ্ছে করলে তুমি মঞ্চ-সজ্জায় মারিয়াকে সাহায্য করতে পারো।’

‘চমৎকার,’ মনে হলো নাটকের অন্যতম প্রধান কোনও চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে, এমনই চেহারা করে হাসল পার্থস।

‘ওখানে মারিয়া আছে, ওর সাথে দেখা করো,’ বলে মঞ্চের পেছনের দেয়ালে ব্যস্ত এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন সুইটি ম্যাডাম।

ব্যাক গ্রাউন্ডের কোথায় কী আঁকতে হবে, সঙ্গীদের তা দেখিয়ে দিচ্ছে মারিয়া। নেতা নেতা ভাব তার। পার্থস খুশিতে ব্যস্ত পায়ে চলে গেল মারিয়া টরেস্কো দিকে।

অডিটোরিয়ামের একটা সিটে বসে আমি আমার চরিত্রের সংলাপ মুখস্থ করতে লেগে পড়লাম। নাটকের প্রতিটি দৃশ্যেই আমি আছি। এত সংলাপ কীভাবে মনে রাখব ভাবতে গিয়ে এই হাড় কাঁপানো শীতেও রীতিমত ঘামছি।

আমার তৃতীয় সংলাপ মুখস্থ করার কসরতে ব্যস্ত আমি। ওটা এরকম: ‘এই ছেলেটা যে ভয়ঙ্কর, তার কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’ পুরো বাক্য শেষ হওয়ার আগেই আচমকা অডিটোরিয়ামের সব বাতি নিভে গেল দপ্ করে। আলকাতরার মত কালো অন্ধকার গিলে ফেলল পুরো অডিটোরিয়াম।

চিৎকার করে উঠল ছেলে-মেয়েরা।

‘অ্যাই, কী হলো? কার কাজ এটা?’ বলে উঠল একটা মেয়ে।

‘কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,’ দ্বিতীয় গলা—এটা ছেলে।

‘কী ব্যাপার? কী হলো?’ বলে উঠলেন সুইটি ম্যাডাম।

মূর্তির মত সিটে জমে বসে আছি আমি। নড়ার সাহস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে অন্ধ হয়ে গেছি।

হঠাৎ সবার কলজে কাঁপিয়ে দিল ভয়ঙ্কর, অপার্থিব এক চিৎকার। ঠিক যেন আহত নেকড়ের আর্তনাদ।

অন্ধকার ভেদ করে শব্দটা ভেসে আসছে। অডিটোরিয়ামের চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ক্রমেই জোরাল হচ্ছে আওয়াজটা। কাঁপছে অডিটোরিয়াম। কাঁপছি আমরা সবাই।

‘না! না!!’ টাকির গগনবিদারী চিৎকার শোনা গেল। মনে হলো জ্ঞান হারিয়েছে ও।

টাকির চিৎকারের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই শোনা গেল অন্য এক কণ্ঠের করুণ কান্নার আওয়াজ। মৃত্যুর ওপার থেকে যেন আসছে শব্দটা।

প্লী-ই-জ, কেউ লাইট জ্বেলে দাও,’ চিৎকার করে হল ফাটাবার যোগাড় করল আরেকটা কণ্ঠ।

‘কে কাঁদছে?’ বলতে গিয়ে প্রশ্নকারী নিজেই কেঁদে ফেলল।

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ একসাথে কয়েকটা গলার চিৎকার উঠল।

যেমন নিভে গিয়েছিল, তেমনি আচমকা জ্বলে উঠল আলো। ঝল্‌মল্ করে হেসে উঠল অডিটোরিয়াম। সেই মুহূর্তে আবার শোনা গেল ওই পৈশাচিক আর্তনাদ। টানা। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল সবার।

‘ওই আসছে!’ বলতে গিয়ে তীব্র আতঙ্কে কেঁদে উঠল কে যেন। ‘ক্যাটওয়াক বেয়ে নেমে আসছে ওটা!’

‘না! না…আ…আ…আ…!’ এটা আরেক কণ্ঠ

প্রলম্বিত চিৎকারটা হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক শকের কাজ করল আমার ওপর, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। চোখের কোণে, স্টেজের ওপর দিকে একটা নড়াচড়া ধরা পড়তে মুখ তুলে সেদিকে তাকালাম।

এবং জমে গেলাম জায়গায়।

ওটাকে দেখতে পেয়েছি আমি।

সেই প্রেতাত্মা!

সবুজ-নীল রঙের মুখোশ পরা অদ্ভুত একটা কিছু মঞ্চের একেবারে ওপরের ক্যাটওয়াক থেকে নেমে আসা মোটা দড়ি ধরে দোল খেতে খেতে নেমে আসছে সরসর করে।

ওর মধ্যেই আকাশের দিকে মুখ তুলে রক্ত হিম করা বিকট হাসিতে ফেটে পড়ল সে।

সব ভুলে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি।

এগারো

বুট জুতো পরা পায়ে সশব্দে মঞ্চে নামল ওটা।

হাতের দড়ি ছেড়ে দিল। জুতো দিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত করল ফ্লোর-বোর্ডে।

ভয়ঙ্কর, ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল একবার চারদিকে।

মারিয়া ও তার সঙ্গীরা মঞ্চের পেছনের দেয়ালের সাথে সেঁটে আছে। নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে ওরা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে প্রেতাত্মার দিকে।

জুতো দিয়ে আবার সে শব্দ তুলল ফ্লোর-বোর্ডে। লক্ষ করলাম ওটার উচ্চতা কিশোরের চেয়ে তিন-চার ইঞ্চি বেশি হতে পারে। অথবা ঠিক কিশোরের সমানই হবে হয়তো—কারণ ওটা কিশোর।

‘কিশোর! এই কিশোর!!’ চিৎকার করে উঠলাম আমি।

মুখোশ পরা মুখটা ঝুঁকে দর্শকদের দিকে তাকাল।

তারপর হঠাৎ করেই ডুবে যেতে শুরু করল যেন। প্রথমে পা অদৃশ্য হয়ে গেল তার, তারপর তার দেহ—নামছে, নীচে নেমে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর মূর্তিটা।

‘কিশোর!’ চিৎকার দিয়ে মঞ্চের দিকে ছুটলাম আমি। ‘কিশোর, তুমি একটা….’

কথা শেষ করতে পারলাম না। অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা তার আগেই।

মঞ্চে উঠে ট্র্যাপডোরের দিকে এগিয়ে উঁকি দিলাম। একরাশ অন্ধকারে চোখে পড়ল না কিছুই।

আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন সুইটি ম্যাডাম। রাগে দাঁত কিড়মিড় করছেন তিনি।

‘কে ওটা, কিশোর না?’ রাগে ফেটে পড়লেন তিনি। ‘বলো শ্যারন, ও কিশোর?’

‘আমি… আমি ঠিক বলতে পারছি না, ম্যাডাম,’ আমতা আমতা করে বললাম। ‘তবে কিশোরের মতই মনে হলো।’

‘কিশোর!’ গর্তের কাছে ঝুঁকে হাঁক ছাড়লেন ম্যাডাম, ‘এক্ষুণি উঠে এসো!’

কোনও সাড়া নেই।

লিফটের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, শুধুই অন্ধকার। একচুলও এগোয় না দৃষ্টি।

ট্র্যাপডোরের চারদিকে এসে জড়ো হয়েছে সবাই। ফিফিস্ করে কথা বলছে। জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে সবাই।

‘ওটা কে ছিল? কিশোর?আমার উদ্দেশে প্রশ্ন করল মুসা। ‘ওই কুৎসিত মুখোশটা আবার পরেছে ও?’

‘ওর মতলবটা কী?’ রাগে ফুঁসে উঠলেন ম্যাডাম। ‘রিহার্সাল কী বানচাল করতে চায় ও?’

উত্তর দিতে পারলাম না আমি। শ্রাগ করলাম শুধু। কিশোরের ওপর রাগ হচ্ছে খুব।

‘না-ও হতে পারে, ম্যাডাম,’ ভীত গলায় বলল মুসা। ‘হয়তো আর কেউ হবে।’

‘ওটা কিশোর না হয়েই যায় না,’ ম্যাডাম বললেন। ‘কিশোর… আমার কথা কানে যাচ্ছে না?’ ট্র্যাপডোরের গর্ত দিয়ে নীচে ধমকে উঠলেন তিনি। ‘উঠে এসো!’

সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ম্যাডাম। তীক্ষ্ণ চোখে সারা অডিটোরিয়ামে দৃষ্টি বুলিয়ে আবার ঝুঁকলেন গর্তের দিকে, ‘কিশোর, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?’

কোনও সাড়া এলো না।

‘কিশোর তোমার বন্ধু,’ ভ্রূ কুঁচকে আমাকে বলল মারিয়া, ‘তোমার নিশ্চয়ই বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয় ওটা কিশোর কি না। আমাদের নাটক বানচাল করার কোনও অধিকার নেই তোমার বন্ধুর।

রাগে শরীর জ্বলে গেল আমার। কিন্তু কী বলব? এক্ষেত্রে আমার বলার কী-ই বা আছে?

তবু ভাবলাম আমি, কিশোর আমার বন্ধু হতে পারে, তাই বলে ওর বাঁদরামির জন্যে আমাকে দোষারোপ করা অন্যায়।

সুযোগ পেলেই আমাকে হেয় করা মারিয়া টরেস্কোর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাকে হটিয়ে ডরোথির চরিত্রটা বাগাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে ও, বুঝি আমি।

‘ওকে, মারিয়া,’ বললেন ম্যাডাম। ‘কাজে যাও। কিশোরের সাথে পরে বোঝাপড়া হবে। বাকিরা…’

কথা শেষ করতে পারলেন না ম্যাডাম।

হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দে চমকে উঠলাম সবাই। তারপর ঘস-ঘস ঘর্ষণের শব্দ।

‘লিফটটা উঠে আসছে!’ গর্তের দিকে আঙুল তুলে বললাম আমি।

‘গুড,’ বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে হাত রেখে বললেন ম্যাডাম। চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকলেন গর্তটার দিকে। ‘আমাদের সাথে কৌতুক করে কেমন লাগল, ওর কাছ থেকে শুনব আমি,’ বললেন তিনি। ‘মজা, হ্যাঁ, এটাই ওর শেষ মজা করা। এরপরের মজা আমি দেখাব।’

শিউরে উঠলাম কিশোরের কথা ভেবে।

সহজে রাগেন না সুইটি ম্যাডাম। কিন্তু যখন রাগেন, ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন।

কিশোরের কপালে খারাবি আছে আজ। কোনও সন্দেহ নেই।

খুব বুঝতে পারছি আমাদের সাথে কৌতুক করার জন্যেই কর্মটা ঘটিয়েছে কিশোর। মাঝে মাঝেই উদ্ভট কিছু করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ও।

কিশোর আমাদেরকে ভয় দেখাচ্ছে, জানি। আজ যে ও অতিরিক্ত করে ফেলেছে, তা-ও বুঝতে পারছি। কিন্তু ব্যাপারটা কেন যেন ঠিক মিলছে না। এরকম বেয়াড়া আচরণ ওর দেখিনি কোনদিন।

অপেক্ষা করছেন ম্যাডাম। বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে হাত। চোখ পিট্‌পিট্ করছেন। এগুলো তাঁর রাগের লক্ষণ। দাঁড়ানোর ভঙ্গি আক্রমণাত্মক।

নাটক থেকে কিশোরকে কী বাদ দেবেন ম্যাডাম? ভাবছি আনমনে। নাকি পিটিয়ে বেত ভাঙবেন ওর পিঠে?

এগিয়ে আসছে লিফট।

কেঁপে কেঁপে উঠছে মঞ্চ।

একটা আওয়াজ শুনে বুঝলাম মঞ্চের মেঝে থেকে দশ ফুট নীচের সেই জায়গাটায় পৌঁছে আবারও থেমে গেছে লিফট।

‘কিশোর!’ বিড়বিড় করে বললাম নিজেকে। কপালে তোমার আজ কী যে আছে, কে জানে!’

আমি জানি, লিফটের ওপর কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। ও জানে না একটু পরেই কী ঘটতে যাচ্ছে।

এতক্ষণ কিশোর আমাদের নিয়ে মজা করেছে।

এবার ওকে নিয়ে মজা করবেন সুইটি ম্যাডাম।

এক পা এগিয়ে উঁকি দিলাম কিশোরকে দেখার জন্যে। এ কী! নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি!

বারো

লিফটটা শূন্য। কোথায় কিশোর?

কিশোর, অথবা সেই প্রেতাত্মা অন্ধকার সুড়ঙ্গে নেমে শূন্য লিফ্‌ট্ পাঠিয়ে দিয়েছে?

মঞ্চ থেকে অনেক অনেক নীচের রহস্যময় আঁধারের রাজ্যে মিলিয়ে গেছে সে?

কিশোর অমন কাজ কিছুতেই করতে পারে না-নিজেকে বললাম। ওই রহস্যময় সুড়ঙ্গে কী আছে না আছে ও জানে না। টর্চ লাইট ছাড়া কিশোর কিছুতেই ওই অন্ধকার মৃত্যুপুরিতে নামতে পারে

না। একা অন্তত নয়।

না, পারে—পরমুহূর্তে নিজেকে সংশোধন করলাম. আমি। আমাদের সবাইকে চমকে দেয়ার জন্যে হেন কাজ নেই যা ও করতে পারে না। ওর মাথার কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে।

রিহার্সাল আজকের মত বাতিল করে দিলেন সুইটি ম্যাডাম। তবে মারিয়াকে ওর কাজ চালিয়ে যেতে বললেন। বাকিদেরকে নির্দেশ দিলেন বাসায় চলে যেতে।

‘ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে,’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন ম্যাডাম। দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

ধীরে ধীরে বাসার দিকে হাঁটছি আমি। খুব খারাপ লাগছে কিশোরের কথা ভেবে। ওর আচরণ কেমন রহস্যময় লাগছে।

একবার ভাবছি ওটা কিশোর না হয়েই পারে না। আবার ভাবছি ওটা কিশোর না-ও হতে পারে। কিন্তু… কিশোর না হলে কে ওটা?

জাঙ্ক ইয়ার্ডের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম।

কিশোরদের গাড়িটাকে ভেতরে ঢুকতে দেখলাম। কিশোর পেছনের সিটে বসে আছে। গাড়ির পিছন পিছন আমিও ঢুকে গেলাম ভেতরে।

‘কিশোর!’ ডাকলাম জোরের সাথে।

গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো কিশোর। মেরি চাচী গাড়ি থেকে নেমে আমাকে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

কিশোরকে এখানে এভাবে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।

‘আজকের রিহার্সাল কেমন হলো?’ জানতে চাইল ও। ‘এত তাড়াতাড়িই ফিরলে যে!’

‘দারুণ দেখালে তুমি, কিশোর,’ বললাম আমি।

‘কী?’ যেন কিছুই বুঝতে পারছে না ও।

‘আজ কিন্তু তুমি আমাকে একটুও ভয় দেখাতে পারোনি,’ বললাম। ‘অন্যরা হয়তো ভয় পেয়েছে, তবে তোমার জন্যে ভয়াবহ খবর হলো, ম্যাডাম তোমাকে এবার ছাড়বেন না। হয়তো নাটকে অভিনয়ের সুযোগ হারাবে।

ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল ও। এমন ভাব করল যেন আকাশ থেকে পড়েছে। সত্যি, অভিনয় করতে পারে বটে কিশোর।

‘কোন্ ব্যাপারে বলছ, শ্যারন? ম্যাডাম আমাকে দেখে নেবেন মানে? আমি তো আজ রিহার্সালে ছিলামই না!’

‘ছিলে, অনেকক্ষণ ছিলে।’

আনমনে মাথা নাড়ল কিশোর। চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। বাতাসে উড়ছে ওর চুল।

‘না, ছিলাম না,’ জোর দিয়ে বলল ও। ‘ম্যাডামকে আগেই বলেছিলাম আজ রিহার্সালে থাকতে পারব না।’

‘কেন? যাতে প্রেতাত্মা সেজে আমাদেরকে ভয় দেখাতে সুবিধে হয়, সেই জন্যে?’

‘না, দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাব, আগেই বলেছিলাম ম্যাডামকে।’

কিশোরের কথায় অবাক না হয়ে পারলাম না। হাঁ হয়ে গেল আমার মুখ।

‘না, তেমন কিছু হয়নি, দাঁত চেকআপ করাতে গিয়েছিলাম,’ আমাকে অবাক হতে দেখে বলল ও।

‘তুমি… তুমি তা হলে সত্যিই আজ অডিটোরিয়ামে ছিলে না?’ কম্পিত গলায় জানতে চাইলাম।

‘বিশ্বাস না হলে চাচীকে জিজ্ঞেস করে দেখো না।’

‘তা হলে ওই প্রেতাত্মা?’ দুর্বল কণ্ঠে বললাম, ‘যে ক্যাটওয়াক থেকে নেমে ট্র্যাপডোর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, ওটা কে?

রহস্যময় চোখে তাকাল কিশোর।

‘আবার তুমি আমার সাথে মশকরা করছ,’ ঝাঁঝের সাথে বললাম। ‘তুমি-ই প্রেতাত্মার অভিনয় করে আমাদের ভয় দেখিয়েছ। না, আমাকে নয়, অন্যদের। তারপর গেছ ডাক্তারের কাছে। ভুল ‘বললাম?’

কিছু না বলে নীরব থাকল কিশোর। একটা কিছু বলবে না ঠিক করলে বলবেই না ও। বিরক্ত হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলাম।

জানি, চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও।

.

পরদিন বিকেলে পার্থসকে নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম। জিন্সের প্যান্ট ও জ্যাকেটে দারুণ মানিয়েছে আজ ওকে।

‘মারিয়া টরেস্কোর সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?’ জানতে চাইলাম।

‘ভালই,’ হেসে বলল পার্থস। ‘তবে একটু বেশি বেশি নেতাগিরি ফলায় মেয়েটা। তা নিয়ে অবশ্য অভিযোগ নেই আমার। নাটকে কাজ করতে পারছি, তাতেই আমি খুশি।

আমরা অডিটোরিয়ামে ঢোকার সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন। আমাকে দেখে সৌজন্যসূচক মাথা ঝাঁকাল ওরা। ডরোথির চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাবার পর থেকে মারিয়া ছাড়া সবাই আমাকে বেশ সমীহ করে চলছে।

‘ম্যাডামের সাথে কিশোরের বোঝাপড়া কি হয়ে গেছে?’ বলল পার্থস। ‘সকালে ম্যাডামের সাথে ওকে কথা বলতে দেখলাম।’

‘মনে হয়,’ মাথা নেড়ে বললাম। হয়তো এবারের মত ওকে মাফ করে দিয়েছেন ম্যাডাম।’ আজ আর এ-ব্যাপারে আমার একটা কথাও হয়নি কিশোরের সঙ্গে।

‘তোমার কি মনে হয়, শ্যারন, কালকের ওই প্রেতাত্মা কিশোরই ছিল?’

‘হ্যাঁ, কিশোর ইদানীং মানুষকে চমকে দেবার চেষ্টা করে। গতকালও আসলে ও ভয় দেখাতে চেয়েছে। আমার মনে হয় অডিটোরিয়ামে সত্যিই একটা প্রেতাত্মা আছে, এমন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে ও। সত্যি কাল সবাইকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল কিশোর। তবে আমি অত সহজে ভয় পাওয়ার বান্দা নই।’

.

রিহার্সাল শুরু হয়েছে একটু আগে। কিশোর আর আমাকে মঞ্চে ডাকলেন ম্যাডাম।

অভিনয়ের খুঁটিনাটি ব্যাপার বোঝাতে লাগলেন তিনি। কোথায় দাঁড়াতে হবে, কীভাবে সংলাপ বলতে হবে সব দেখিয়ে দিলেন। ব্যাপারটাকে ম্যাডাম ব্লকিং’ বললেন।

ম্যাডাম কিশোরের বিকল্প এব হ্যারিংটন আর আমার বিকল্প মারিয়াকেও ডাকলেন। ‘ব্লকিং সম্পর্কে তোমাদেরও জেনে রাখতে হবে, প্রয়োজন হতে পারে।’

প্রয়োজন হতে পারে? ভাবলাম। চট্ করে মনে পড়ল মারিয়া টরেস্কোর সতর্ক বাণী: ‘তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো কিংবা অন্য কোনও কারণে অভিনয় করতে না পারো, তবে আমি ডরোথির চরিত্রে অভিনয় করব।’

হাহ্, মারিয়া, তোমাকে আমি এমনি এমনি পার পেতে দেব না। মনে মনে ভাবলাম। অভিনয়ের খায়েশ তো মিটবেই না তোমার, উল্টে এতদিন সুযোগ পেলেই যে হেনস্তা করেছ আমাকে, তার প্রতিশোধ খানিকটা হলেও নেব। জেদ চেপেছে আমার। চমৎকার অভিনয় করে সবাইকে মুগ্ধ করতে হবে। মারিয়াকে অপমান করার এটাই সবচেয়ে সুন্দর পথ।

ম্যাডাম দেখিয়ে দিচ্ছেন কিশোরকে কোথায় দাঁড়াতে হবে।

মারিয়া আর আমি মঞ্চের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি।

‘সকালে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে কিশোর ম্যাডামের সাথে কথা বলছিল, কথাগুলো কানে এসেছে আমার,’ আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল মারিয়া টরেস্কো। ‘কিশোর বলছিল, গতকাল দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কারণে বিকেলে রিহার্সালে আসতে পারেনি ও। তাই যদি সত্যি হয়, তা হলে কালকের ওটা নিশ্চয়ই সত্যিকারের প্রেতাত্মা ছিল?’

ততক্ষণে আমার ডাক পড়েছে। ইশারায় থামতে বললাম মারিয়াকে, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ম্যাডাম আমাকে আগেও একবার ডেকেছেন, যখন আমি মারিয়া টরেস্কোর কথা শুনছিলাম, খেয়াল করিনি।

‘শ্যারন,’ রেগে দ্বিতীয়বার ডাকলেন ম্যাডাম। ‘কী হচ্ছে ওখানে? আসছ না কেন?’

‘ধন্যবাদ, মারিয়া, চাপা কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাসে বললাম। ‘তোমার মতলব খারাপ’

বলেই ছুটলাম মঞ্চে, কিশোরের পাশে। পেছন ফিরে দেখলাম মুচকে হাসছে বজ্জাত মারিয়া টরেস্কোটা।

ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আমার মাথা গুলিয়ে দেয়াই ওর উদ্দেশ্য ছিল। সে-কারণেই সময়মত অযথা বক্ শুরু করেছিল।

এবং সফল হয়েছে বদমাশটা। ম্যাডামের ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গেছি আমি। কোথায় দাঁড়াতে হবে বুঝতে পারছি না। কী সংলাপ বলতে হবে, তা-ও ভুলে গেছি। কারণ কিশোর যখন তার শেষ সংলাপ বলছিল, ঠিক তখনই মারিয়া টরেস্কো আমার মনোযোগ নষ্ট করার ধান্দায় ছিল। ওর দিকে কান দিতে গিয়ে এখন আমার সংলাপের শুরুটা খেয়াল করতে পারলাম না। গোলমাল হয়ে গেল।

মনে আসছে না। হায়, হায়, এখন কী হবে?

উদ্বিগ্ন চোখে দর্শকদের আসনে বসা ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালাম। অভিনয় করছে না, এমন অনেক ছেলে-মেয়ে রিহার্সাল দেখতে এসেছে। অধীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তারা। আমার সংলাপ শোনার জন্যে যেন উদগ্রীব সবাই।

মুখ খুললাম বটে, তবে একটা কথাও স্পষ্ট বেরোল না। সব জড়িয়ে যাচ্ছে।

আমার সমস্যা আরও জটিল করে তোলার জন্যেই সময় বুঝে মুখ খুলল মারিয়া। মঞ্চের আড়াল থেকে ভেসে এলো ওর গলা, ‘তোমার সংলাপ হচ্ছে: ‘ওখানে নীচে কে?’‘ বলেই হেসে উঠল বজ্জাতটা।

আমাকে ছোট করার জন্যে মেয়েটা সব কিছুই করতে পারে, ভাবলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ও চাইছে ম্যাডাম আমাকে বাদ দিয়ে যেন ওকেই অভিনয়ের সুযোগ দেন।

রাগে আমার শরীর কাঁপছে। লজ্জায়, অপমানে মাথা ঝিম্‌ ঝিম্‌ করছে। ভাবতে পারছি না কিছু। সংলাপটা আউড়ে জোরে দম নিলাম। অপেক্ষা করছি।

পরের সংলাপ কিশোরের। এখন ও মঞ্চে এসে ডরোথিকে ভয় দেখাবে।

কিন্তু মঞ্চের আশপাশে নেই কিশোর! কোথাও নেই সে!

চারপাশে তাকালাম। মঞ্চের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম। এক হাতে ধরে আছেন আরেক হাতের কব্জি। শক্ত মেঝে পায়ের আঙুল দিয়ে খুঁটছেন।

সারা অডিটোরিয়াম নীরবতার সাগরে ডুবে গেছে যেন। সবার চেহারায় প্রতীক্ষার ছাপ।

‘কিশোর কোথায়?’ কঠিন কণ্ঠে জানতে চাইলেন ম্যাডাম। ‘করছে কী ও? প্রেতাত্মা হয়ে উদয় হবে নাকি?’

কথাটা বিশ্বাস করলাম। ভাবলাম সেটাই ঘটতে যাচ্ছে।

হঠাৎ শোনা গেল পরিচিত সেই ঘড়ঘড় শব্দ। তারপর ঘস ঘস ঘর্ষণের আওয়াজ।

ট্র্যাপডোর লিফট! উঠে আসছে!

‘ওই তো আসছে কিশোর!’ ম্যাডামকে বললাম কম্পিত গলায়।

বলতে না বলতেই অন্ধকার গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো গতকালকের সেই ভয়ঙ্কর চেহারা!

হ্যাঁ, সেই প্রেতাত্মার উদয় হয়েছে আবার মঞ্চে!

আঁধার ফুঁড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো তার পুরো শরীর।

থেমে গেল লিফট। কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল প্রেতাত্মা। ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে আছে অডিটোরিয়ামের দিকে।

কিশোর পেয়েছেটা কী? যা খুশি তা-ই করবে আর আমরা ওর সব অত্যাচার এভাবে সহ্য করব? ওর ওপর সত্যিই এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। সত্যিই কিশোরকে নাটক থেকে বাদ দেয়া উচিত। রীতিমত বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এতটা সহ্য করা কঠিন।

আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ছদ্মবেশী কিশোর।

মুখোশের পেছনে ভয়ঙ্কর চোখদুটো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ওর সংলাপ শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি, এই সময় আমার কাঁধ চেপে ধরল ও, ভীষণ জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল।

‘আস্তে, কিশোর,’ ফিসফিস করে বললাম। ‘এটা রিহার্সাল।’

‘শীগির ভাগো,’ হিংস্র গলায় ফিসফিস করে বলল ও, ‘পালাও এখান থেকে।’

পরের সংলাপ বলতে গিয়েই জমে গেলাম।

দেখলাম মঞ্চের এক কোনায় কেউ একজন হাত নেড়ে ইশারায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

ওটা আর কেউ নয়, কিশোর!

তেরো

মাথা খারাপ হওয়ার দশা হলো আমার। বুঝতে পারছি কী ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি আমি। কিশোর যদি মঞ্চের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তা হলে এটা কে, যে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে? ভয়ঙ্কর মুখোশের আড়ালে আমার দিকে চেয়ে কুৎসিত হাসি হাসছে, কে সে?

‘বাঁচাও! কে আছ, বাঁচাও!’ পিশাচটার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে প্রাণপণ চিৎকার জুড়ে দিলাম।

‘হলো না, শ্যারন,’ বলে উঠলেন ম্যাডাম। ‘তোমার সংলাপ হবে: ‘বাঁচাও, বাবা! বাঁচাও!’‘

ম্যাডাম টেরই পাননি মঞ্চে আসলে এখন কী হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেননি সত্যিকারের প্রেতাত্মা আমার কাঁধ চেপে ধরে আছে সবার চোখের সামনে। আমি সংলাপ বলছি না, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে চেঁচাচ্ছি।

হঠাৎ প্রেতাত্মাটা আমার কানের কাছে ঝুঁকে ফিফিস্ করে বলল, ‘আমাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডু চিবিয়ে খাবো। আমার ঘাঁটি ছেড়ে সরে যাও, সরে যাও।’

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওটার চোখের দিকে তাকালাম। চোখদুটো খুব পরিচিত লাগছে। কে ও? মনে হচ্ছে আগে একে দেখেছি কোথাও। কিন্তু কিছুতেই স্মরণ করতে পারছি না।

চট্ করে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল প্রেতাত্মাটা। গট্ করে নেমে গেল মঞ্চ থেকে। দ্রুত এগোল অডিটোরিয়ামের দরজার দিকে।

বিস্ফারিত চোখে দরজা দিয়ে তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখলাম। হাসির শব্দ এলো দর্শকদের সারি থেকে।

মারিয়া টরেস্কোর গলা ভেসে এলো আমার কানে, ‘সংলাপ গুলিয়ে ফেলেছে, ওকে দিয়ে হবে না।’

আমার কাছে দৌড়ে এলো কিশোর।

‘তুমি ঠিক আছো তো?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

‘জানি না,’ ঘোরের মধ্যে জবাব দিলাম। মনে হচ্ছে আমার চারপাশে পৃথিবী বনবন করে ঘুরছে।

মঞ্চ অতিক্রম করে এগিয়ে এলেন সুইটি ম্যাডাম। এক হাতে ক্লিপবোর্ড ধরা। কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে তাঁকে, ‘একটু আগে এখানে যা ঘটল তার ব্যাখ্যা কী কেউ দিতে পারবে?’ জানতে চাইলেন তিনি। কিশোরকে বললেন, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে!’

‘পানি খেতে, ম্যাডাম,’ বলল কিশোর। ‘এসে দেখি ওই ছেলেটা মঞ্চে!’

.

‘সত্যিই আমাদের স্কুলে প্রেতাত্মা আছে,’ আমার দিকে চেয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল কিশোর।

দর্শকদের আসনে প্রথম সারিতে বসে আছি আমরা। আমার দু’পাশে বসেছে কিশোর আর পার্থস। ঘোর কিছুটা কেটে গেছে আমার।

কিশোরকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করলাম আমি।

অডিটোরিয়ামের অর্ধেক বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। রিহার্সাল শেষ হয়েছে কয়েক মিনিট আগে। অডিটোরিয়ামের বাইরে ছেলে- মেয়েদের হই-চই শোনা যাচ্ছে এখনও।

ম্যাডামও চলে গেছেন এইমাত্র। যাবার আগে বকাঝকা যা করার, করে গেছেন কিশোরকে।

‘আমার দিকে ওভাবে চেয়ে আছো কেন?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘ভেবে অবাক হচ্ছি তুমি এতটা উচ্ছন্নে গেলে কীভাবে। সত্যি করে বলো তো নাটকে অভিনয় করার ইচ্ছে তোমার আছে কি না!’ গম্ভীর গলায় বললাম।

‘অবশ্যই,’ জোর দিয়ে বলল কিশোর। ‘আচ্ছা বোকা, আমি কীভাবে একসঙ্গে একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে পারি? উত্তর দাও।’

‘হ্যাঁ, পারো,’ জেদ করে বললাম।

কিশোর কিছু বলার আগেই শার্টে লেগে থাকা একদলা রঙের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল পার্থস, ‘আচ্ছা, এই রঙ তুলব কীভাবে, বলো তো।’

‘ধুলে উঠবে না?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘আমি কী জানি?’ জবাব দিল পার্থস। ‘ক্যানের লেবেলে কী লেখা ছিল পড়িনি। তুমি পড়েছ?’ আমার দিকে তাকাল ও।

‘না’ বললাম।

‘আসল কথায় এসো,’ বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর, ‘তোমরা ভাবছ আমাদের স্কুলে সত্যিই প্রেতাত্মা আছে?’

‘তাতে কোনও ভুল নেই,’ বলল মুসা, ‘যে-কারণেই হোক সে আমাদের নাটক বানচাল করতে চাইছে।’

আমি এখনও লক্ষ করছি কিশোরকে।

‘হতে তো পারে আসলেই আমাদের স্কুলে আছে ওই প্রেতাত্মা,’ আবার বলল মুসা। মনে হলো কথাটা সত্যিই বিশ্বাস করে।

‘আজ সকালে টাকির সাথে কথা বলতে দেখেছি তোমাকে, কিশোর,’ বললাম। এই সত্যি ‘প্রেতাত্মা’ নিয়ে হয়তো কোনও ফন্দি এঁটেছে টাকি। ওকে প্রেতাত্মার পোশাক আর মুখোশ দিয়েছিলে তুমি?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। ‘ওরকম একটা বাজে কাজ করতে যাব কেন আমি?’ চেহারা দেখে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে ও।

‘টাকির সঙ্গে যখন কথা বলল কিশোর, তখন আমাদের সঙ্গেই ছিল ও,’ বলল রবিন।

টাকি একটা বাজে ছেলে সেটা আমরা জানি,’ বলল মুসা। ‘তুমি বোকার মতো কথা বলে ফেললে, শ্যারন।’

‘হয়তো টাকি আর তার বন্ধুরা মিলে সবাইকে ভয় দেখাতে চেয়েছে,’ বললাম। ‘যাতে আমরা ভাবি সত্যিই একটা প্রেতাত্মা এখানে আছে।’

‘হয়তো,’ গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। ‘তবে কল্পনা করলে আমাদের চলবে না, শ্যারন। আগে থাকতে হবে প্রমাণ। একটু আগেই তুমি বলছিলে টাকির কথা। আমি বলছি তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। টাকি আর আমি কোনও ফন্দি আঁটিনি। তা ছাড়া, একটু আগে স্টেজের পেছনে ছিল টাকি। তা হলে…’ চুপ হয়ে গেল কিশোর।

ওদিকে কাজ শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছে মারিয়া টরেস্কো। আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।

চুপ করে থাকলাম। লজ্জা লাগছে এখন বন্ধুদের সন্দেহ করছিলাম ভেবে।

‘ভীষণ ভয় পেয়েছিলে,’ শীতল গলায় আমাকে বলল টরেস্কো, ‘এখন ভাল তো?’

‘ভয় পেয়েছিলাম মানে?’ রেগে গেলাম। ‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘মঞ্চে তোমাকে দেখে যা মনে হয়েছিল, সেটাই বলেছি। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়োনি তো? চারদিকে কিন্তু খুব ফ্লু হচ্ছে।’

‘আমি সুস্থ আছি। এ-ব্যাপারে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।’

‘এই রঙ উঠবে তো?’ মারিয়া টরেস্কোর কাছে জানতে চাইল পার্থস।

শ্রাগ করল মারিয়া। ‘জানি না। তবে ধুয়ে দেখতে পারো। উঠলেও উঠতে পারে। তবে পার্থস, তুমি কিন্তু সুন্দর কাজ করছ। আমি খুব খুশি তোমার কাজে।’ বলেই চট্ করে আমার দিকে ঘুরে রহস্যময় গলায় ও বলল, ‘তবে আরও একজন এই নাটকেও খুব সুন্দরভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।’

আমি কিছু বলার আগেই হাঁটা ধরল মারিয়া টরেস্কো। হন্হন্ করে বেরিয়ে গেল অডিটোরিয়াম থেকে

রাগের সঙ্গে বললাম, ‘ও খোদার কাছে প্রার্থনা করছে যেন সময়মত আমি ফ্লুতে ঘায়েল হই, আর আমার রোলটা ওকে দেয়া হয়।’

কোনও জবাব দিল না কেউ। কিশোরকে দেখে মনে হলো, হয়তো প্রেতাত্মা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। মনে হলো আমার কথা শুনতেই পায়নি। নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে আপন মনে।

‘তোমার কী মনে হয় মারিয়া টরেস্কো এই ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটাতে পারে?’ মুসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ‘হয়তো আমাকে হটিয়ে ডরোথির চরিত্রটা বাগাতে চায় ও।’

‘তা কী করে সম্ভব?’ চাপা গলায় বলল মুসা। ‘এসব আসলে প্রেতাত্মার কাজ।’

পার্থস ওর হাতের কালো রঙ ডলে ডলে ওঠানোর চেষ্টা করছে।

‘এবার ফেরা যাক,’ হঠাৎ বললাম। ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রেতাত্মা নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।’ উঠে দাঁড়ালাম আমি।

আমার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। উঠল না। ‘তুমি এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না, তাই না?’ বলল ও। ‘এখনও কী তোমার ধারণা তোমাকে ভয় দেখাবার জন্যে আমি ওসব ঘটিয়েছি?’

‘সত্যি কোন্‌টা আমি জানি না,’ বাধ্য হয়ে বললাম, ‘হয়তো ঘটাওনি।’ দরজার দিকে এগোতে এগোতে ভাবলাম আমি, আসলে কী যে ঘটেছে এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।

পার্থস আমাকে অনুসরণ করল।

পেছন ফিরে তাকালাম। বসেই আছে কিশোর।

‘আজ রাতে এখানেই থাকবে নাকি?’ বললাম।

‘না,’ বলে উঠে দাঁড়াল ও। এগোতে শুরু করে হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওহ্, ভুলে গেছি!’

‘কী?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। ডিনারের সময় ঘনিয়ে আসছে। বাসায় ফেরার তাড়া আমার ভেতরে।

‘আমার অঙ্ক বই,’ বলে উঠল কিশোর। অফিসরুমে আছে। রিহার্সালের পর ভুলে বইটা অডিটোরিয়ামে ফেলে গিয়েছিলাম কাল। কেউ হয়তো ওটা পেয়ে অফিসরুমে জমা দিয়ে এসেছে।’

‘কালকে দেখা হবে,’ বলে বেরিয়ে গেল পার্থস অডিটোরিয়াম থেকে।

‘কোথায় ফেলে গিয়েছিলে?’ প্রশ্ন করল মুসা।

আঙুল তুলে অডিটোরিয়ামের দক্ষিণ দিকের একটা জায়গা দেখাল কিশোর। আমাকে বলল, ‘কাল দেখা হবে।’ বলেই দরজার দিকে এগোল। নিজের কাজে যাচ্ছে। আমার দিকে খেয়াল নেই। ওর পিছু নিল রবিন আর মুসা।

ওদের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম। ইচ্ছে ছিল, কিশোরের সঙ্গে আলাপ করতে করতে বাসায় ফিরব।

অফিসরুমে আলো জ্বলছে। কেউ নেই, সেক্রেটারি ম্যালকম রিচার্ড ছাড়া। তিনিও কাজ শেষ করে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আমার অঙ্ক বইটা কাল ফেলে গিয়েছিলাম। কেউ কি অফিসরুমে জমা দিয়েছে ওটা?’ ম্যালকম রিচার্ডের কাছে জানতে চাইল কিশোর। ‘রিহার্সালের পর ভুলে অডিটোরিয়ামে ফেলে গিয়েছিলাম।’

‘অঙ্ক বই!’ অবাক হয়েছেন যেন সেক্রেটারি।

‘মিলার্ড বা অন্য কেউ ওটা এখানে জমা দেয়নি?’

‘মিলার্ড? মিলার্ড কে?’

‘আপনি তাকে চেনেন,’ বলল কিশোর। ‘আমাদের স্কুলের নাইট গার্ড মিলার্ডের কথা বলছি। বেঁটে, প্রায় আমার সমান, একমাথা ঘন চুল।’

মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়লেন সেক্রেটারি ম্যালকম রিচার্ড। বললেন, ‘দুঃখিত, ভুল করছ তুমি, মিলার্ড নামের কেউ এই স্কুলে কাজ করে না। আমাদের কোনও নাইট গার্ডই নেই!’

পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর, মুসা ও রবিন।

এবার বাড়ির পথে দ্রুতপায়ে রওনা হয়ে গেলাম আমি, ঠিক করে ফেলেছি কিশোর যদি কিছু বলে তো শুনব তখন, তার আগে পর্যন্ত মুখ বন্ধ করে রাখব।

চোদ্দ

রাতে মারিয়া টরেস্কোর ফোন এলো।

‘তুমি কেমন আছ জানার জন্যে ফোন করেছি,’ বলল সে। ‘সত্যি রিহার্সালের সময় তোমাকে খুবই দুর্বল লাগছিল। মনে হচ্ছিল জ্বরে পড়তে যাচ্ছ বুঝি তুমি।’

‘তোমার ধারণা ভুল,’ উঁচু গলায় বললাম আমি।

‘তোমাকে বেশ কয়েকবার হাঁচি দিতেও দেখেছি কাল,’ বলল সে।

‘আমার অ্যালার্জি আছে, একটুতেই হাঁচি হয়। আর একবার শুরু হলে একটানা অনেকগুলো হাঁচি হয়,’ জবাবে বললাম। ‘বাই, মারিয়া।’

আমি রিসিভার রাখার আগেই দ্রুত বলে উঠল মারিয়া, ‘এক মিনিট, আজ বিকেলে যে প্রেতাত্মাটা স্টেজ থেকে লাফিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল, সে কে?’

‘জানি না,’ বললাম। ‘সত্যি আমি…’

‘তোমাকে ভয় দেখাবার জন্যে কেউ করেছে মনে হয় কাজটা,’ বলল মারিয়া। ‘ঘাবড়িয়ো না।’

‘কালকে দেখা হবে,’ বলেই খুট করে রিসিভার রেখে দিলাম। মেয়েটা সত্যিই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বিরক্তিকর!

.

কিশোর টেলিফোন করল এর একটু পর। ‘সেই মিলার্ড আমাদের মিথ্যে কথা বলেছে,’ বলল কিশোর। ‘আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে লোকটা।’

‘হয়তো,’ বললাম আমি।

ঠিক হলো, পরদিন তাড়াতাড়ি স্কুলে গিয়ে মিলার্ড সম্পর্কে ম্যাডামকে জানাব আমরা।

রাতে নাটকের স্বপ্ন দেখলাম।

স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন।

মঞ্চের ওপরে আমি। সবগুলো স্পট লাইট আমার ওপর। অডিটোরিয়াম ভর্তি দর্শকদের দিকে তাকালাম। নীরব হয়ে আছে সারা হল। ডরোথির কথা শোনার জন্যে উদ্‌গ্রীব সবাই।

মুখ খুলেই টের পেলাম আবারও সংলাপ গুলিয়ে ফেলেছি।

ঘাবড়ে গিয়ে দর্শকদের দিকে তাকালাম।

সব ভুলে গেছি! প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য।

পাখি যেভাবে বাসা থেকে উড়ে যায়, তেমনি প্রতিটি মুখস্থ শব্দ আমার মাথা থেকে ডানা মেলে উড়ে গেছে।

মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছি। নড়তে পারছি না। ঠোঁট দুটো যেন সেলাই করে দিয়েছে কেউ। কথা বলতে পারছি না।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। উত্তেজনায় কাঁপছে সারা শরীর। মনে হচ্ছে দেহের প্রতিটি মাংসপেশিতে গিঁট লেগে গেছে। তীব্র শীতেও ঘামে ভিজে একাকার। গা থেকে কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

কী ভয়ানক দুঃস্বপ্ন!

ভোর হয়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুঃস্বপ্নটা ভুলে যেতে চাইলাম।

তাড়াতাড়ি স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। কিশোরের সাথে কথা আছে, আজ তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌছুতে হবে। সুইটি ম্যাডামকে জানাতে হবে রহস্যময় মিলার্ডের ব্যাপারটা।

জর্জকে ওর স্কুলে পৌঁছে দেয়ার পথে প্রতিদিনের মত নাটক নিয়ে এটা-ওটা প্রশ্ন করল ও। প্রেতাত্মা সম্পর্কে জানতে চাইছে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা নিয়ে আমি কথা বলতে আগ্রহ বোধ করলাম না।

বারবার মনে পড়ছে রাতে দেখা দুঃস্বপ্নটার কথা। তিনশো দর্শকের সামনে হতভম্বের মত আমার মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভুলতে পারছি না কিছুতেই।

স্কুলে পৌছে দেখি ক্লাসরুমের দরজার সামনে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে কিশোর। কয়েকবার ওকে হাতঘড়ির দিকে তাকাতে দেখলাম।

‘সরি, দেরি হয়ে গেল,’ বললাম।

হাত ইশারা করে ক্লাসরুমে ঢুকল ও। পিছু নিলাম। লকার থেকে বইপত্র আনার সুযোগ নেই দেখলাম।

ক্লাস শুরু হতে বেশি দেরি নেই। ডেস্কে বসে আছেন সুইটি ম্যাডাম।

আমরা তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের তাঁর দিকেই এগোতে দেখে মৃদু হাসলেন তিনি।

কিন্তু দু’জনের বিষণ্ণ মুখ দেখে মুহূর্তে তাঁর হাসি মিলিয়ে গেল। ‘কী ব্যাপার?’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন ম্যাডাম।

‘আপনার সাথে কিছু কথা ছিল, ম্যাডাম,’ নিচু কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘সবার সামনে বলা যাবে না।’ উপস্থিত সহপাঠীদের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে এলো ওর দৃষ্টি। রবিন-মুসা এখনও আসেনি।

দেয়াল-ঘড়ির দিকে তাকালেন ম্যাডাম। ‘এখন? ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র দু’মিনিট আছে।’

‘আমরা মাত্র একমিনিট কথা বলব,’ বলল কিশোর। ‘খুবই জরুরি কথা, ম্যাডাম।’

‘এসো তা হলে,’ ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ম্যাডাম। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম।

বারান্দার রেইলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন ম্যাডাম। আমাদের দু’জনকে পালা করে দেখলেন কয়েকবার। ‘ঘটনাটা কী?’

কিশোর কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ‘আমাদের স্কুলে একটা প্রেতাত্মা আছে। সত্যিকারের প্রেতাত্মা।’

বুক ভরে দম নিয়ে বলল কিশোর, ‘শ্যারন আর আমি কাউকে দেখেছি।’

‘দূর,’ চুপ করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে দু’হাত তুললেন ম্যাডাম।

‘না, ম্যাডাম, সত্যি,’ বললাম আমি। ‘আমরা তাকে দেখেছি। সত্যিকারের প্রেতাত্মা। ট্র্যাপডোর দিয়ে নীচে নেমেছিলাম আমরা।

‘কী?’ ভ্রূ কুঁচকে আমাদের দেখলেন ম্যাডাম।

‘শ্যারন, আমাকে বলতে দাও!’ পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সামাল দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম। শ্যারনের মাথা গুলিয়ে গেছে, এক কথা বলতে গিয়ে আরেক কথা বলে ফেলেছে।’

‘সত্যিকারের প্রেতাত্মা আছে আমাদের স্কুলে,’ পাত্তা না দিয়ে আবারও জোর গলায় বললাম আমি। ‘এবং সে আমাদের ভয় দেখিয়ে নাটকটা বানচাল করতে চাইছে।’

‘ম্যাডাম, আমি জানি, আপনারা ভাবছেন আমি প্রেতাত্মার অভিনয় করে সবাইকে ভয় দেখাতে চাইছি,’ দ্রুত যোগ করল কিশোর। ‘কিন্তু সেটা ঠিক নয়।’

‘ওটা সত্যিকারের প্রেতাত্মাই,’ বললাম আমি, ‘সে…’

হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন ম্যাডাম। কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। প্রচণ্ড শব্দে আমাদের মাথার ওপর বেল বেজে উঠল। ক্লাস শুরুর বেল।

কান চেপে ধরলাম আমি আর কিশোর।

বেলের শব্দ থেমে গেলে ক্লাসরুমের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন ম্যাডাম। ক্লাসের ভেতরে হই-চই করছে ছেলে-মেয়েরা।

‘তোমাদের মনে অবান্তর ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে আমি দুঃখিত,’ বললেন তিনি।

‘জ্বি?’ একসাথে বলে উঠলাম আমরা।

‘প্রেতাত্মা নাটকের পেছনের গল্প তোমাদের বলা আমার উচিত হয়নি,’ বললেন ম্যাডাম। ‘মনে হচ্ছে অনেকে সেই ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারোনি তোমরা। কেউ কেউ ভয়ও পেয়েছ।’

‘না, ম্যাডাম, আমরা ভয় পাইনি,’ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল কিশোর।

আমি জোরের সাথে বললাম আবার, ‘সত্যিই আমরা প্রেতাত্মা দেখেছি, ম্যাডাম।’

‘রাতে নিশ্চয়ই তোমরা প্রেতাত্মাকে স্বপ্নে দেখো?’ প্রশ্ন করলেন আচমকা ম্যাডাম।

না, সুইটি ম্যাডাম আমাদের কথার একটা বর্ণও বিশ্বাস করেননি বোঝা গেল। তিনি কেন, কেউ বিশ্বাস করবেন না এসব কথা। কিন্তু আমরা যে সত্যি সত্যি প্রেতাত্মা দেখেছি! কিশোর যদি সত্যিই দুষ্টুমি না করে থাকে, তা হলে ওটা যে সত্যিকারের প্রেতাত্মা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ম্যাডামকে কীভাবে সেটা বিশ্বাস করাব?

‘ম্যাডাম, দাঁড়ান,’ অনুনয়ের সুরে বললাম আমি।

কিন্তু কথা শেষ করতে পরলাম না। ক্লাসরুমে ভীষণ হই-চই হচ্ছে। এখনও ম্যাডাম ক্লাসে যাচ্ছেন না বলে ওরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

‘চলো, ভেতরে চলো,’ বলেই কিশোরের দিকে ঘুরলেন তিনি। ‘শোনো কিশোর, এ নিয়ে আর কোনও আলোচনা নয়, ঠিক আছে? আমরা চাই আমাদের নাটক দেখে দর্শকরা প্রশংসা করুক, তাই না?’

আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে ক্লাসরুমে ঢুকে গেলেন ম্যাডাম।

.

‘আমি এখানে কী করছি?’ হঠাৎ বলল পার্থস।

‘আমরা তোমাকে সাথে করে এনেছি, কারণ তুমি আমাদের খুব ভাল একজন বন্ধু,’ বললাম আমি।

‘না, আমি আসলে একটা গাধা,’ বলল পার্থস।

রাতের আকস্মিক অভিযানের আইডিয়াটা কিশোরের। রবিন আর মুসা আসতে পারেনি। চাকরি নিয়েছে রেমন, কাজেই ও-ও আসতে পারবে না। মিথ্যে বলে চাচা-চাচীর পারমিশন জোগাড় করে বেরিয়েছে কিশোর, বলেছে রাতেও রিহার্সাল হবে। আমার বাসায় আমার বাবা-মাকেও একই কথা বলেছে। ওঁরা জানেন, সামনেই আমাদের বার্ষিক নাটক। তাই ধরে নিয়েছেন সত্যিই বলেছে কিশোর। কাজেই বাধা দেননি আমাকে। কিশোরের সাথে বেরিয়ে পড়লাম।

পার্থসকে আগেই একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে রেখেছিল কিশোর। জায়গাতেই পাওয়া গেল ওকে। সেখান থেকে পার্থসকে সাথে নিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা ধরলাম আমরা।

‘আমার এখনও অবাক লাগছে, ম্যাডাম আমাদের একটা কথাও বিশ্বাস করেননি,’ হতাশ কণ্ঠে বললাম।

‘তোমাকেও যদি কেউ এ-ধরনের কথা বলত, তুমিও বিশ্বাস করতে না,’ বলল কিশোর। সেজন্যেই তো সত্যিকারের প্রেতাত্মার খোঁজে চলেছি আজ। দেখা যাক আছে নাকি সেই প্রেতাত্মা।’

‘প্রমাণ করতেই হবে, আমরা মিথ্যে বলিনি,’ দৃঢ় গলায় বললাম। ‘এ-ছাড়া আমাদের আর কোনও পথ নেই। ম্যাডামের কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। যা করার আমাদেরকেই করতে হবে।’

‘তুমিও শার্লক হোম্‌স্ হয়ে গেলে মনে হচ্ছে!’ হাসল কিশোর। – কিশোরের দিকে তাকালাম, ‘তোমার যদি ইচ্ছে না থাকে, তবে…’

আমাকে কথা শেষ করতে দিল না পাৰ্থস। ‘কিন্তু আমি এখানে কী করছি?’ সামনেই আঁধারে ডুবে থাকা স্কুল বিল্ডিং-এর দিকে তাকাল সে।

‘আমাদের একজন সঙ্গী দরকার, পার্থস, তাই তোমাকে আনা হয়েছে,’ বলল কিশোর।

কিশোরের হাত টান দিয়ে বললাম, ‘চলো চলো। কে ভয় পায় আর কে পায় না তোমাদের দেখিয়ে দেব আজ।’

‘আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি,’ জানাল পার্থস। ‘যদি আমরা ধরা পড়ে যাই?’

‘কে ধরবে?’ পার্থসকে সাহস দিল কিশোর। ‘সেক্রেটারি বলেছেন আমাদের স্কুলে কোনও নাইট গার্ড নেই।’

‘কিন্তু যদি কোনও অ্যালার্ম-ট্যালার্ম থাকে?’ পার্থসের ভয় দূর হচ্ছে না।

‘নেই,’ জোর দিয়ে বললাম। ‘আমি জানি। কোনও গুপ্তধন নেই আমাদের স্কুলে যে অ্যালার্ম থাকতে হবে।’

‘কিন্তু স্কুলে ঢুকব কোন্‌দিক দিয়ে?’ পার্থস জানতে চাইল। ‘সাইড ডোর থাকতে পারে,’ বলল কিশোর। ‘সেদিক দিয়ে ঢুকতে হবে।’

স্কুল বিল্ডিং-এর একপাশে চলে গেলাম আমরা।

আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে স্কুলের শূন্য, নীরব খেলার মাঠ অর্ধেক চাঁদের ভুতুড়ে আলোয় রুপোলি লাগছে ঘাসগুলো।

সাইড ডোর বন্ধ।

ব্যাক ডোরও বন্ধ।

ছাদের দিকে তাকালাম আমি।

চাঁদের আবছা আলোয় স্কুল বিল্ডিংটাকে ভৌতিক একটা কাঠামোর মত লাগছে। রুপোলি আলো প্রতিফলিত হচ্ছে জানালায়।

‘অ্যাই,’ ফিফিস্ করে বলল কিশোর, ‘জানালা খোলা।’

নিচতলার একটা ক্লাসরুমের আধখোলা জানালার দিকে দ্রুত দৌড়ালাম সবাই। হোম ইকোনমিক্‌স্-এর ক্লাসরুম ওটা। ক্লাস টিচার মার্গারেট ম্যাডাম হয়তো ইচ্ছে করেই খোলা রেখে গেছেন জানালা। আজ দুপুরে ওই রুমে একধরনের কেক তৈরির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ছিল আমাদের। কেক বানিয়েছি আমরা, কেমন কেক, সে-কথা না-ই বা বললাম। সবাই মিলে উৎকট দুর্গন্ধে ভরিয়ে দিয়েছিলাম রুম। হয়তো সেই দূষিত বাতাস বের করার জন্যেই জানালা খোলা রেখে গেছেন মার্গারেট ম্যাডাম।

উইন্ডো লেজ-এ হাত রেখে নিজেকে ওপরে তুলল কিশোর। তারপর জানালাটা পুরোপুরি খুলে ফেলল। ক্লাসরুমের ভেতরে লাফিয়ে পড়ল।

আমরা দু’জন অনুসরণ করলাম কিশোরকে।

দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে ছুটলাম আমরা।

বুক ধক্কক্ করছে আমার। রাতে এভাবে চুপি চুপি চোরের মত স্কুলে ঢুকেছি, জানাজানি হলে কী হবে জানাই আছে। স্কুল থেকে সোজা বের করে দেয়া হবে তিনজনকেই।

আর প্রেতাত্মার ভয় তো আছেই। দুশ্চিন্তায় আমার ভাল লাগছে না। পার্থসের অবস্থা আরও কাহিল। কেবল কিশোরকে যা একটু শক্ত মনে হচ্ছে।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই, শ্যারন, নিজেকে বললাম আমি। এটা তোমার চিরপরিচিত স্কুল। এখানকার সবকিছু তোমার চেনা। এই পথ দিয়ে তুমি বহুবার চলাচল করেছ। তা ছাড়া এখানে তোমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। অতএব ভয় কী?

‘ধ্যাত্তেরি! আমার কিছুই ভাল লাগছে না,’ ফিফিস্ করে কাঁদো কাঁদো স্বরে ঘোষণা দিল পার্থস। ‘ভয় করছে খুব।’

‘মনে করো আমরা কোনও ভৌতিক ছায়াছবিতে অভিনয় করছি,’ পার্থসকে সাহস দিল কিশোর। ‘মনে করো এটা একটা ছায়াছবির দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।’

‘কিন্তু আমি ভৌতিক সিনেমা পছন্দ করি না,’ প্রতিবাদ করল পাৰ্থস।

‘শ্-শ-শ্, হঠাৎ ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে আমাদের সতর্ক করে দিল কিশোর। থেমে গেছে ও। ওর সাথে ধাক্কা খেলাম বেশ জোরে। চোখ মেলে সামনে তাকালাম। একরাশ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না।

অডিটোরিয়ামের সামনে পৌঁছে গেছি আমরা।

সবচেয়ে কাছের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে ফেলল কিশোর। ভেতরে উঁকি দিলাম তিনজন একসাথে।

অন্ধকার।

ভেতরের শীতল, বদ্ধ বাতাস এসে লাগল আমাদের চোখে- মুখে।

ভাবলাম, একটা প্রেতাত্মার বসবাসের আদর্শ জায়গা এটা।

ভাবতেই বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

অডিটোরিয়ামের দেয়াল হাতড়ে সুইচ টিপে একটা মাত্র বাতি জ্বেলে দিল কিশোর।

মৃদু আলোয় মঞ্চটা চোখে পড়ল। নীরব, শূন্য। ভয়াবহ লাগছে।

চেনা মঞ্চটা এ-মুহূর্তে কেমন অচেনা লাগছে!

অডিটোরিয়ামের একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা মই রেখেছে কেউ। মইয়ের একপাশে কতগুলো রঙের ক্যান দেখা যাচ্ছে।

‘সবগুলো বাতি জ্বেলে দিলে হতো না?’ ভীত গলায় পরামর্শ দিল পার্থস। সত্যিই ছেলেটা ভীষণ ভয় পাচ্ছে।

‘না,’ বলল কিশোর, দৃষ্টি ওর মঞ্চের দিকে। ‘আমরা চমকে দিতে চাই প্রেতাত্মাকে। আগেভাগেই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাই না। তা হলে ও সতর্ক হয়ে যাবে।’

ধীর, কাঁপা পায়ে মঞ্চের দিকে এগোলাম আমরা। মৃদু আলোয় আমাদের ভৌতিক, বিশাল ছায়া পড়েছে দর্শকদের আসনে।

কোনও ছায়া কি নড়ে উঠল মঞ্চের ওপর?

না।

নিজেকে বললাম, বাজে চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দাও, শ্যারন। উদ্ভট চিন্তা কোরো না, অন্তত আজ রাতে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকালাম। না, কোনও ছায়াই ওখানে নড়ে ওঠেনি।

পেছন ফিরে পুরো অডিটোরিয়ামে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম একবার। আবছা আলোয় অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না।

কিন্তু সে কোথায়? কোথায় প্রেতাত্মা?

সে কি মঞ্চের নীচের ওই রহস্যময় অন্ধকার পাতালপুরিতে

আছে?

আমরা যখন মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছলাম, তখনই কানে এলো একটা আওয়াজ।

পায়ের শব্দ?

জমে গেছি তিনজনই। আমাদের কানে এসেছে শব্দটা।

খামচে ধরলাম আমি কিশোরের বাহু। আবছা আলোতেও দেখতে পেলাম সাদা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে পার্থসের চেহারা। তীব্র আতঙ্কে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর।

আরেকটা শব্দ এলো কানে। কাশির শব্দ।

‘এ… এখানে আ… আমরা ছাড়াও আরও কে… কেউ আ… আছে!’ তোতলাতে লাগলাম।

পনেরো

‘ও… ওখানে ক্… কে?’ বহু কষ্টে গলা দিয়ে কথা ফোটাতে সক্ষম হলাম।

‘কেউ আছেন ওখানে?’ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। কোনও সাড়া নেই।

আরেকটা পায়ের শব্দ শোনা গেল।

দর্শকদের একটা আসন আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে পার্থস।

‘প্রেতাত্মা!’ কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললাম। গলা দিয়ে সহজে কথা বেরোচ্ছে না আমার। ‘ওপরে উঠে এসেছে।’

‘কিন্তু ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’ মঞ্চের দিকে তাকাল কিশোর।

আরেকটা কাশির শব্দ শুনতেই লাফিয়ে উঠলাম আমি।

তখনই মঞ্চ থেকে ভেসে এলো ঘড় ঘড় শব্দ।

শব্দটা ভয়াবহ প্রতিধ্বনি তুলল সারা অডিটোরিয়ামে।

বুঝতে পারলাম লিট্ নড়ছে।

কেউ ওপরে আসছে? আমাদের চোখের সামনে উদয় হতে যাচ্ছে প্রেতাত্মা?

গোটানো ব্যাকড্রপটা হঠাৎ করে ধীরে ধীরে মেলতে শুরু করল। নীচে নামছে ওটা।

চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আমার গলা চিরে।

ঘস-ঘস ঘর্ষণের শব্দ আগের চেয়েও বেড়ে গেছে।

ব্যাকড্রপটা খুলছে ধীরে ধীরে।

‘কার কাজ ওটা?’ চাপা স্বরে বললাম। ‘কে খুলছে ব্যাকড্রপ?’

বিস্ফারিত চোখে নেমে আসতে থাকা ব্যাকড্রপের দিকে চেয়ে আছে কিশোর আর পার্থস। বোবা হয়ে গেছে দু’জনই।

একটা চেয়ারের পেছনের অংশ জাপটে ধরেছে পার্থস।

ব্যাকড্রপটা পুরো নেমে এলো।

ইঁটের তৈরি একটা দেয়াল আঁকা হয়েছিল ওখানে। পার্থস আর ওর সঙ্গীরা কয়েকদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে ওটা এঁকেছিল।

‘হায়-হায়! আমার পেইন্টিং-এর এই দশা করল কে?’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল পার্থস।

কিশোর আর আমার গলা দিয়ে টু শব্দটি বেরল না।

লাল রঙের প্রলেপ দিয়ে ধূসর ইঁটের দেয়ালটা ঢেকে ফেলা হয়েছে। তার ওপর ছুরি দিয়ে পুরো ব্যাকড্রপ কেটে-চিরে একাকার করা হয়েছে।

‘একদম বরবাদ হয়ে গেছে ওটা,’ পার্থস প্রায় কেঁদেই ফেলল।

কিশোর সাহসে ভর করে মঞ্চের দিকে এগোতে শুরু করল। আমরাও ভীরু পায়ে ওকে অনুসরণ করলাম।

‘কে?’ মঞ্চে উঠে হাঁক ছাড়ল কিশোর। ‘কে এখানে?’

সাড়া নেই।

আমি নিশ্চিত জানি, কেউ আছে এখানে। সে-ই আমাদের চোখের সামনে ব্যাকড্রপ নামিয়ে দিয়েছে।

‘এখানে কে? আপনি কোথায়?’ চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

না, কোনও সাড়া এলো না এবারও।

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে করে ব্যাকড্রপের দিকে ধীরে ধীরে এগোলাম আমরা।

বেশ খানিকটা কাছে যেতে লেখাটা চোখে পড়ল আমাদের। ব্যাকড্রপের নীচের দিকে লাল কালিতে লেখা:

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
আমাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডু চিবিয়ে খাব।
আমার ঘাঁটি ছেড়ে সরে যাও,
সরে যাও।

একটা শীতল অনুভূতি আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নীচে নেমে গেল।

ঠিক তখনই অডিটোরিয়ামের সামনের দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।

মুহূর্তে ঘুরে তাকালাম সেদিকে সবাই।

একটা ছায়ামূর্তি নড়ে উঠতে দেখলাম।

ভাল করে ওটার দিকে তাকাতেই মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল আমাদের।

ষোলো

কট্‌মট্ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সুইটি ম্যাডাম। চোখ দিয়ে যা দেখছেন, তা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না কিছুতেই।

‘এতবড় সাহস তোমাদের?’ রাগে কাঁপছেন ম্যাডাম।

শব্দ করে ঢোক গিললাম। জিভ দিয়ে শুকনো খটখটে ঠোঁট চাটলাম। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না একজনেরও।

কিশোর আর পার্থসও আমার মত মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘তোমাদের দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছি,’ মঞ্চে উঠে এসে বললেন ম্যাডাম। ‘স্কুলের আইন-কানুন ভাঙা কতবড় অপরাধ, জানো তোমরা? এর জন্যে তোমাদের পস্তাতে হবে।’

পরক্ষণে ব্যাকড্রপের দিকে চোখ পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন ম্যাডাম। মুহূর্তে রক্তবর্ণ ধারণ করল তাঁর সারা মুখ। জ্বলে উঠল চোখ।

‘যিযাস!’ উত্তেজনায়, রাগে থরথর করে কাঁপছেন ম্যাডাম। আমার মনে হলো তাঁর সরু দেহটা যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে।

‘এত সাহস কোথায় পেলে তোমরা?’ বলেই গট্ করে ব্যাকড্রপের কাছে চলে গেলেন ম্যাডাম। বিস্ফারিত চোখে কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘এটা নষ্ট করার দুঃসাহস তোমাদের কে দিয়েছে? জানো, কত ছাত্র-ছাত্রী কত পরিশ্রম করে এটা তৈরি করেছে? এতবড় জঘন্য কাজ কেন করলে তোমরা?’

‘আমরা করিনি, ম্যাডাম,’ নরম স্বরে জবাব দিল কিশোর।

‘আমরা না, ম্যাডাম,’ কান্না চেপে বললাম।

জোরের সাথে মাথা ঝাঁকালেন ম্যাডাম। ‘হাতে-নাতে ধরেছি তোমাদের,’ দুঃখে, হতাশায় কাঁপছেন তিনি। বিন্দু বিন্দু অশ্রু দেখা গেল তাঁর চোখের কোণে। ‘আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি তোমাদের টিচার।’

‘সত্যি ম্যাডাম, আমরা…’

হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন ম্যাডাম। ‘নাটকের চেয়ে তামাশাটাই তোমাদের কাছে বড় হয়ে গেল?’ আবেগে কেঁপে উঠল তাঁর গলা।

‘ম্যাডাম…’

‘আমাদের স্কুলে সত্যিকারের প্রেতাত্মা আছে—সেটা প্রতিষ্ঠিত করা কি নাটকের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ তোমাদের কাছে? নিয়ম ভেঙে চোরের মত স্কুলে ঢোকার মত মারাত্মক অপরাধ করাই কি বেশি গুরুত্ববহ? নাটকের ব্যাকড্রপ নষ্ট করে ফেলেছ—কেমন ধরনের তামাশা এগুলো?’

কাছে গিয়ে ব্যাকড্রপের লাল রঙের ওপর আঙুল ঘষলেন তিনি। রং আঙুলে লেগে গেল। কাঁচা রং! অবিশ্বাস্য!

‘রং এখনও শুকোয়নি,’ আমার দিকে আগুন-চোখে তাকিয়ে বললেন ম্যাডাম। ‘তোমরা ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। তারপরও বলছ তোমরা করোনি এ-কাজ?’

‘আপনি যদি আমাদের কিছু বলার…’

কিশোরকে থামিয়ে দিয়ে পার্থসের দিকে ফিরলেন ম্যাডাম। ‘তুমিই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছ! মাত্র এক হপ্তা হলো তুমি ভর্তি হয়েছ, এত তাড়াতাড়ি এতখানি দুঃসাহস না দেখালেও পারতে।’

লাল হয়ে গেল পার্থস। মাথা নিচু করে অনড় দাঁড়িয়ে রইল। যেন সে-ই আসল দোষী।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম আমি, ‘ম্যাডাম, আমাকে কিছু বলতে দিন, প্লিজ। সত্যিই আমরা এ-কাজ করিনি। ব্যাকড্রপটা এভাবেই পেয়েছি আমরা। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।’

কিছু বলার জন্যে মুখ খুললেন ম্যাডাম। কিন্তু চট্ করে মত পাল্টে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, বলে যাও। তবে একবর্ণ মিথ্যে বলবে না।’

‘অবশ্যই না,’ বললাম। ‘আমরা দরজা ভেঙে স্কুলে ঢুকিনি, ম্যাডাম। একটা খোলা জানালা দিয়ে ঢুকেছি।’

‘কেন?’ ঝাঁঝের সাথে বললেন ম্যাডাম। ‘কী করতে ঢুকেছ এখানে? এখন তোমাদের যার যার বাসায় থাকার কথা।’

‘আমরা সত্যিকারের প্রেতাত্মার খোঁজে এসেছি,’ অনেকক্ষণ পর কথা বলল কিশোর। ‘আজ সকালে আমরা আপনাকে প্রেতাত্মার ব্যাপারে বলেছিলাম। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেননি।’

‘কেন করব?’ ঝাঁঝের সাথে বললেন ম্যাডাম। ‘এখনও করি না। পুরানো একটা কাহিনি শুনে তোমরা এতটা বেহাল হয়ে পড়বে জানলে আমি কিছুতেই গল্পটা তোমাদের বলতাম না।’ ভ্রূ কুঁচকে কিশোরের দিকে চাইলেন তিনি।

হতাশায় ডুবে গেল যেন কিশোর। তবু মরিয়া কণ্ঠে বলল, ‘প্রেতাত্মাকে আমরা দেখেছি, ম্যাডাম। আমি আর শ্যারন— দু’জনই দেখেছি। ওই প্রেতাত্মাই এই ব্যাকড্রপ নষ্ট করেছে, আমরা না। ট্র্যাপডোর দিয়ে উঠে এসে ওই প্রেতাত্মাই রিহার্সালের সময় শ্যারনকে আক্রমণ করেছিল।’

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি, ‘কেন আমি এমন আজব কথা বিশ্বাস করতে যাব?’

‘কারণ এটাই সত্যি,’ বললাম আমি। ‘কিশোর, পার্থস আর আমি ওই প্রেতাত্মার খোঁজেই অডিটোরিয়ামে ঢুকেছি, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়।’

‘কিন্তু ওকে ধরার জন্যে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

‘সম্ভবত মঞ্চের নীচে!’

‘কী? ওই ট্র্যাপডোরে চড়ে নীচে নামবে তোমরা?’

‘হয়তো, ম্যাডাম। যদি নামার দরকার হয়।’

‘কিন্তু আমি তোমাদের সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছি, ট্র্যাপডোর থেকে দূরে থাকতে বলেছি,’ বললেন ম্যাডাম। ‘বলিনি?’

‘বলেছেন,’ আমি বললাম। ‘আমি দুঃখিত। আমরা সবাই দুঃখিত। আমরা আসলে সত্যিকারের প্রেতাত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাই। প্রমাণ করতে চাই মিথ্যে বলছি না আমরা।’

ম্যাডামের চেহারা থেকে কাঠিন্য দূর হয়নি এতটুকু। ‘আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা কোরো না তোমরা।’

শরীরের ভর এক পা থেকে আরেক পায়ে নিয়ে বলল কিশোর, ‘আমরা অডিটোরিয়ামে ঢুকে কিছু অদ্ভুত শব্দ শুনেছিলাম। পায়ের শব্দ, কাশির শব্দ, ট্র্যাপডোরের ঘড়ঘড় শব্দও শোনা গেছে।

‘এবং ব্যাকড্রপটা আমাদের চোখের সামনে কারও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে নেমে এসেছে,’ যোগ করল পার্থস ক্ষীণ গলায়। ‘আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম ওটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও একবর্ণ মিথ্যে বলছি না।’

এবার যেন ম্যাডাম কিছুটা নরম হলেন বলে মনে হলো। এমন ভাবে কথাগুলো বলেছে পার্থস, মনে হলো ম্যাডাম ওকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারছেন না।

‘এই ব্যাকড্রপের পেছনে বহু কষ্ট করেছে যারা, আমিও তাদের একজন,’ বলে চলেছে পার্থস। ‘এই স্কুলে এটাই আমার প্রথম কাজ। কাজটা ভাল করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। নিজের শ্রমের ফসল নিয়ে আমি অন্তত এমন বিশ্রী তামাশা করতে পারি না, ম্যাডাম।’

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। লাজুক, ভীরু ছেলেটাও এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে!

বুকের ওপরে আড়াআড়ি ধরা হাতদুটো নামালেন ম্যাডাম। আমাদের ওপর নজর বোলালেন আরেকবার। তারপর ব্যাকড্রপের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে পড়লেন লেখাগুলো।

পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন তিনি। তারপর ঘুরে আমাদের দিকে চাইলেন।

‘তোমাদের কথা বিশ্বাস করতে চাই,’ নরম সুরে বললেন। ‘কিন্তু কীভাবে বিশ্বাস করব বুঝে উঠতে পারছি না।’

আমাদের সামনে পায়চারি শুরু করলেন ম্যাডাম। ‘তোমাদের অঙ্কের টেস্ট পেপার ভুলে ফেলে যাওয়ায় আবার স্কুলে এসেছিলাম আমি। অডিটোরিয়ামে তোমাদের কথা শুনে এসেছি এখানে। ব্যাকড্রপটা পুরোপুরি নষ্ট। এবং তোমরা আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছ যে বাইশ বছর আগের এক রহস্যময় প্রেতাত্মা এর জন্যে দায়ী?’

কোনও শব্দ যোগাল না আমার মুখে। কিশোর আর পার্থসও নীরব। আমাদের আর কিছু বলার নেই।

‘তবে আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি,’ ম্যাডামের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসির রেখা। ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাসায় তোমাদের বাবা-মা চিন্তা করছেন। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। দরকার হলে তদন্তের জন্যে আগামীকাল প্রিন্সিপাল স্যরের সাথে আলাপ করব আমি। আমাদের নাটক যে বানচাল করতে চাইছে, তিনি হয়তো সেই কালপ্রিটকে শনাক্ত করতে পারবেন।’

রক্ষে করো! মনে মনে আঁতকে উঠলাম আমি। ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল স্যরের কানে গেলেই সেরেছে! নির্ঘাত তিনি নাটক বাতিল করে দেবেন।

কিন্তু ম্যাডামকে কিছু বলতে পারলাম না।

কিশোর-পার্থসও নিশ্চুপ।

ততক্ষণে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে শুরু করেছেন ম্যাডাম। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম।

আশার কথা, ম্যাডাম আমাদেরকে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।

আরও কয়েকটা বাতি জ্বেলে দিলেন তিনি। আলোর বন্যায় ভেসে গেল পুরো অডিটোরিয়াম।

ম্যাডামের পেছনে পেছনে হাঁটছি আমরা।

হঠাৎ প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।

মেঝেতে লাল রঙের বিন্দু বিন্দু দাগ চোখে পড়েছে সবার। লাল রঙের একটা ধারা। সোজা চলে গেছে বাইরের দিকে হয়তো।

‘ওয়েল!’ খুশি হয়ে উঠলেন যেন ম্যাডাম। ‘আমাদের চিত্রশিল্পী বেশ অসাবধানী মনে হচ্ছে। তাকে অনুসরণে আমাদের সাহায্য করার জন্যে চিহ্ন রেখে গেছে দেখছি বেচারা।’

আরও বাতি জ্বেলে দিলেন ম্যাডাম।

লাল রঙের ধারা অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম আমরা। পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেছে অপরাধী।

‘বিশ্বাস হচ্ছে না,’ আমার কানে কানে বলল কিশোর, ‘কাজটা ইচ্ছেকৃত নয়তো?’

‘আমি খুশি, নিচু স্বরে উত্তর দিলাম। ‘ইচ্ছেকৃত হোক, অনিচ্ছাকৃত হোক, বদমাশটাকে ধরার একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছি আমরা।

‘তুমি বলতে চাইছ প্রেতাত্মাকে ধরার সুযোগ পেয়েছি আমরা? চাপা গলায় প্রশ্ন করল কিশোর।

‘অন্তত এতে প্রমাণ হবে যে আমরা সত্যি কথা বলছি,’ পাৰ্থস বলল। ‘ব্যাকড্রপটা আমরা নষ্ট করিনি।’

হঠাৎ করেই একটা লকারের সামনে এসে রঙের দাগ শেষ হয়ে গেছে।

‘হ্যাঁ,’ চিন্তান্বিত গলায় বললেন ম্যাডাম। ‘ধারাটা এই লকারের সামনেই শেষ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।’

হতবাক হয়ে বলল কিশোর, ‘ব্যাপার কী? এটা তো আমার লকার!’

সতেরো

কয়েক মুহূর্ত কারও মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। কিশোরের দিকে ঘুরলাম। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওর শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। অবাক চোখে নিজের লকারের দিকে চেয়ে আছে ও। বাইরে থেকেই যেন দেখতে পাচ্ছে ভেতরে কী আছে।

‘লকার খোলো, কিশোর,’ গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন ম্যাডাম।

‘জ্বি?’ ম্যাডামের কথা যেন বুঝতে পারেনি, লকারের সামনের মেঝেতে রঙের ফোঁটাগুলোর দিকে চেয়ে আছে কিশোর একদৃষ্টিতে।

‘গো অ্যাহেড, লকার খোলো,’ আবার বললেন ম্যাডাম। হঠাৎ করে ক্লান্ত দেখাল তাঁকে।

ইতস্তত করছে কিশোর। ‘কিন্তু ম্যাডাম, ভেতরে আর কিছু নেই, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল ও, ‘বই ছাড়া।’

‘প্লিজ,’ কম্বিনেশন লক ইশারা করলেন ম্যাডাম। ‘প্লিজ কিশোর, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘কিন্তু, ম্যাডাম,’ তবু দ্বিধা যায় না কিশোরের।

‘কোনও কিন্তু নয়,’ কঠিন কণ্ঠে বললেন এবার ম্যাডাম। লক ইশারা করলেন আবার।

‘কেউ হয়তো প্রমাণ করতে চাইছে কিশোর ব্যাকড্রপটা নষ্ট করেছে,’ মৃদু কণ্ঠে বললাম। ‘তাই ইচ্ছে করেই সে দাগটা এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।’

‘হয়তো,’ জবাব দিলেন ম্যাডাম। ‘সেটা বোঝার জন্যেই তো আমি লকার খুলতে বলছি।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ বিড়বিড় করে বলল কিশোর। ওর কম্পিত হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কম্বিনেশন লকের দিকে। ঝুঁকে ডায়াল ঘোরাল।

‘আলো ছাড়ো, দেখতে দাও,’ কাঁপা গলায় আমাকে বলল।

‘সরি,’ বলে সরে গেলাম। আমার জন্যে বাধা পাচ্ছিল আলো।

তাকালাম পার্থসের দিকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। লকার নিয়ে ব্যস্ত কিশোরের হাতের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।

ক্লিক্ শব্দে খুলে গেল লকার।

হাতল উঠিয়ে দরজা টেনে খুলে ফেলল কিশোর।

ম্যাডাম আর আমি একসাথে নিচু হয়ে উঁকি দিলাম লকারের ভেতরে। আরেকটু হলেই আমার মাথা ঠুকে যেত ম্যাডামের সাথে।

লকারের ভেতরে রঙের ক্যানটা একসাথে দেখতে পেলাম আমি আর ম্যাডাম।

ক্যান বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে কিছু রং। এখনও কাঁচা, শুকায়নি।

‘কিন্তু এটা আমার না,’ অবাক হয়ে বলল কিশোর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ম্যাডাম। ‘আমি দুঃখিত, কিশোর।

‘আমি এর কিছুই জানি না, ম্যাডাম,’ আস্তে করে বলল ও।

‘তোমার চাচা-চাচীকে ডাকছি আমি। ওঁদের সাথে কথা বলতে হবে,’ নীচের ঠোঁট কামড়ে বললেন ম্যাডাম। ‘এবং অবশ্যই তুমি আর নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছ না।’

‘কিন্তু ম্যাডাম…’ থেমে গেল কিশোর। হতাশায় মুষড়ে পড়েছে। বুঝে ফেলেছে যে আর ওকে নাটকে সুযোগ দেয়া হবে না।

রাগী চোখে ওকে দেখলেন ম্যাডাম। ঘুরলেন পার্থস আর আমার দিকে। ‘সত্যি কথা বলো, তোমরাও কি এর সাথে জড়িত?’

‘না,’ একসাথে আর্তনাদ করে উঠলাম দু’জন। ‘আমরা এটা করিনি,’ যোগ করলাম আমি। ‘আমরা জানি, কিশোরও করেনি।’

কিন্তু ঘটনা তখন আমাদের আওতার বাইরে চলে গেছে। কিশোরের লকারে পাওয়া রঙের ক্যান জ্বলন্ত একটা প্রমাণ। এ-নিয়ে কোনও তর্ক চলে না।

সেদ্ধ করা হাঁসের মত দেখাচ্ছে এখন কিশোরকে।

‘তোমরা কিশোরকে সহায়তা করেছ তা প্রমাণ হলে নাটক থেকে তোমরাও বাদ পড়বে। তোমাদের বাবা-মাকেও ডাকা হবে।’ ধমকে উঠলেন ম্যাডাম। ‘যাও! বাড়ি যাও এখন সবাই!’

নীরবে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলাম তিনজন।

পরনের কাপড় ভেদ করে রাতের শীতল হাওয়ায় শরীরে কাঁপন ধরাল। থেকে থেকে শিউরে উঠছি আমি।

এক টুকরো ধূসর মেঘে ঢেকে গেছে আকাশের চাঁদ।

ভৌতিক একটা কাঠামো যেন গ্রাস করেছে চাঁদটাকে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম আমরা। দমকা বাতাস আমার জ্যাকেট মানছে না।

‘তুমি বিশ্বাস করছ ম্যাডামের অভিযোগ?’ আমাকে লক্ষ করে বলল কিশোর, ‘বলো, বিশ্বাস করেছ?

‘না,’ সোজা সাপটা জবাব দিলাম।

ভীষণ খারাপ লাগছে বেচারার কথা ভেবে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি একেবারে ভেঙে পড়েছে ও। সত্যি যদি ম্যাডাম কিশোরের চাচা-চাচীকে স্কুলে তলব করেই বসেন, সেটা হবে ওর জন্যে ভয়াবহ এক ব্যাপার।

‘তোমার লকারে গেল কীভাবে ওটা?’ কিশোরকে বলল পার্থস।

চট্ করে পার্থসের দিকে ঘুরল ও। ‘আমি জানব কীভাবে?’ রাগ চেপে জবাব দিল।

ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা।

সামনে একটা ইঁটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে ক্ষোভের সাথে লাথি মেরে ওটাকে রাস্তার মাঝখানে পাঠিয়ে দিল কিশোর।

‘যাই,’ বলে নিজের বাসার পথ ধরল পার্থস।

‘কালকে হয়তো দেখা হবে,’ বলে কিশোর হাঁটার গতি বাড়াতে গেল।

পেছন থেকে বললাম, ‘একসাথেই যাই না কেন আমরা?’

‘না, ভাল্লাগছে না কিছুই, আমি একাই চললাম,’ বলে হন্হন্ করে হেঁটে আঁধারে হারিয়ে গেল কিশোর।

ফুটপাথ ধরে একা একা হাঁটছি। গভীর চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছি। কী থেকে কী হয়ে গেল এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।

হঠাৎ একটুকরো হালকা আলো আমার গায়ে পড়তেই চিন্তায় ছেদ পড়ল।

আলোটা ধীরে ধীরে বড় হলো। বুঝলাম বাইসাইকেলের হেডলাইট ওটা।

স্কুল পার্কিং থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে ওটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

আরও কাছে এগিয়ে আসতেই আরোহীকে চিনে ফেললাম। ‘মারিয়া!’ বিস্ময়ের ঘোরে বললাম, ‘এখানে কী করছ?’

সাইকেল থামাল ও। স্ট্রিট-ল্যাম্পের আলোয় মারিয়া টরেস্কোর মুখ পরিষ্কার দেখতে পেলাম। হাসছে। হাসিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক।

‘তুমিই বা এখানে কী করছ?’ মারিয়া টরেস্কো পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘যাচ্ছ কোথায়?’

ও কী স্কুলে ছিল? ভাবলাম আমি। স্কুল থেকেই কি বেরিয়ে এলো মারিয়া?

‘কোত্থেকে আসছ, মারিয়া?’ আবার প্রশ্ন করলাম।

ওর মুখের অদ্ভুত হাসিটা আরও চওড়া হলো। ‘বন্ধুর বাসা থেকে,’ বলল মারিয়া, ‘বিশেষ একটা কাজে লরাদের বাসায় গিয়েছিলাম।’

‘কিন্তু তুমি স্কুল থেকে বেরোলে বলে মনে হলো যে!’ মনের সন্দেহ দূর করতে পারলাম না কিছুতেই।

‘স্কুল?’ অবাক হলো ও। ‘এতরাতে স্কুলে কী করব?’ বলেই শরীরের ওজন সাইকেলের ওপর রেখে প্যাডেলে পা রাখল মারিয়া।

‘জ্যাকেটের জিপটা উঠিয়ে দাও, শ্যারন,’ প্যাডেলে চাপ দেয়ার আগে বলল ও। ‘তোমার না ঠাণ্ডার ধাত, নিউমোনিয়া চাও নাকি?’

আঠারো

শনিবার সারাদিন ধরে চলল আমাদের রিহার্সাল। আর মাত্র এক হপ্তা পর মঞ্চস্থ হবে ‘প্রেতাত্মা’।

আন্তরিকতার সাথেই কাজ করে চলেছি সবাই। দু’বার মাত্র আমার সংলাপ ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও অঘটন ঘটেনি।

কিন্তু কাজ করে আমি কোনও আনন্দ পাচ্ছি না। কারণ কিশোর নেই। ওকে বাদ দিয়ে প্রেতাত্মার চরিত্র দেয়া হয়েছে হ্যারিংটনকে। ছেলেটাকে আমি অপছন্দ করি না, তবে ভীষণ গম্ভীর। হাসি-ঠাট্টা পছন্দ নয় ওর। এই বয়সেই কথা-বার্তা, চলন-বলনে কেমন একটা বুড়োটে বুড়োটে ভাব।

তা ছাড়া নাটকের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই হ্যারিংটনের। আর কাউকে না পেয়ে এক রকম জোর করেই চরিত্রটা দেয়া হয়েছে ওকে।

লাঞ্চের পর একসাথে রিহার্সাল করছে হ্যারিংটন আর টাকি। সুইটি ম্যাডাম লাঞ্চ করে তখনও ফেরেননি।

পার্থসের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। হাতে ওর তুলি। নতুন ব্যাকড্রপের ওপর ঝুঁকে আছে। ধূসর ইঁটের দেয়ালের ওপর ফাইনাল টাচ্‌ দিচ্ছে।

‘দারুণ!’ বলেই আস্তে করে পার্থসের পিঠে চাপড় মারলাম।

‘সত্যি?’ কাজ থেকে মুখ না তুলেই বলল পার্থস।

‘অবশ্যই।’

‘হ্যারিংটন খারাপ অভিনয় করবে না, কী বলো?’ বলল পার্থস তুলি বোলাতে বোলাতে।

‘হ্যাঁ,’ একমত হলাম আমি। ‘তবে কিশোরের জন্যে খুব খারাপ লাগছে।’

মৃদু মাথা দোলাল ও। তারপর মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। ‘তোমার কী মনে হয়? কিশোরকে প্রেতাত্মা চরিত্র থেকে সরানোর পর আর কোনও অঘটন ঘটেনি। কেউ কোনও মশকরা করেনি। ভয় দেখাতে চেষ্টাও করেনি কেউ কাউকে। আর কোনও ব্যাকড্রপ নষ্ট হয়নি। কোনও সাবধান বাণীও লেখা হয়নি কোথাও। কিছুই হয়নি। ম্যাডাম কিশোরকে সরিয়ে দেয়ার পর সব চলছে ঠিকঠাক্।

হ্যাঁ, ভুল বলেনি পার্থস। সত্যিই এখন আর কোথাও কোনও গোলমাল নেই। সত্যিকারের প্রেতাত্মা যেন গা ঢাকা দিয়েছে।

তা হলে কিশোরই কী সেই ‘প্রেতাত্মা’? সে-ই কি এতগুলো রোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছে? আমি তা বিশ্বাস করি না।

‘আচ্ছা, কিশোরের চাচা-চাচীকে সুইটি ম্যাডাম স্কুলে ডাকার পর থেকে ছেলেটা আর স্কুলে আসছে না কেন?’ ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইল পার্থস। ‘কী শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে ওর জন্যে?’

‘এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি,’ বললাম আমি। ‘ওর চাচা-চাচী ওকে ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না।’

চাপা হাসি হাসল পার্থস। ‘ছেলেটা হয়তো খুব বড় একটা শাস্তি পেয়ে গেল,’ বলল সে।

‘ওকে, চিলড্রেন,’ ম্যাডামের গলা শোনা গেল হঠাৎ। লাঞ্চ সেরে ফিরে এসেছেন তিনি। ‘এখন আমরা দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম থেকে মহড়া শুরু করব। দ্বিতীয় অঙ্কের পুরোটা।’

পার্থসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মঞ্চের সামনের দিকে চলে এলাম। এই অঙ্কের প্রতিটা দৃশ্যেই ডরোথি আছে। এতদিনে নিজের ওপর আস্থা অনেকটা ফিরে এসেছে আমার। আসল সময়ে ভুল হবে – না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

মঞ্চের মাঝখানে হ্যারিংটনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মঞ্চের এক পাশে রাখা টেবিল থেকে নাটকের স্ক্রিপ্ট তুলে নিলেন ম্যাডাম। দ্বিতীয় অঙ্ক বের করার জন্যে পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়েই কঠিন হয়ে উঠল তাঁর মুখ। রাগে, অপমানে মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ম্যাডামের গলা চিরে। আরও দ্রুত ওল্টাতে চেষ্টা করলেন পুরু স্ক্রিপ্টের পৃষ্ঠা।

‘হ্যাঁ,’ রাগে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘এবারের কৌতুক- অভিনেতাটি কে? কে করেছে এ-কাজ?’

‘কী হয়েছে, ম্যাডাম?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল হ্যারিংটন।

স্ক্রিপ্ট আমাদের দিকে ঘুরিয়ে উঁচু করে ধরলেন ম্যাডাম। ‘স্ক্রিপ্টের পাতা একটার সাথে আরেকটা আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়েছে,’ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন তিনি।

কয়েক মুহূর্ত মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে রইলেন ম্যাডাম, তারপর ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন তিনি, ‘ঠিক আছে,’ স্ক্রিপ্ট ছুঁড়ে মারলেন মঞ্চের ওপর। ‘শুনে রাখো তোমরা, এটাই শেষ জোক। নাটক বাতিল ঘোষণা করা হলো। সবাই বাড়ি ফিরে যাও। নাটক হবে না।’

উনিশ

‘হঠাৎ করেই ম্যাডাম মত বদলালেন?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

মাথা নাড়ালাম আমি। হ্যাঁ। ‘নাটক বাতিল’ ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পরেই আবার বললেন ‘নাটক চালানো যেতে পারে’। তবে বাকি সময় যতক্ষণ রিহার্সাল হয়েছে, ভীষণ গম্ভীর আর চুপচাপ ছিলেন তিনি।’

কিশোর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক্! এবার অন্তত আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারছেন না ম্যাডাম।’ হাতের টেনিস বলটা বেডরুমের দিকে ছুঁড়ে মারল ও। ওটার পেছনে ধেয়ে গেল ওর কুকুর বাঘা।

স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী জানাবার জন্যে কিশোরের বাসায় এসেছি আমি আর পার্থস। বেশ কয়েকদিন ঘর থেকে বেরোতে পারছে না, কিশোর। অন্যায় না করেও অনর্থক শাস্তি পাচ্ছে ও। নাটক থেকে ওকে বাদ দেয়া হয়েছে, এটা কম বড় শাস্তি নয়। তার ওপর এভাবে ‘গৃহবন্দি’ হয়ে থাকা–খুব খারাপ লাগছে আমার ভাবতেই।

বাসায় কিশোর ছাড়া কেউ নেই। জাঙ্ক ইয়ার্ডের কাজে হলিউডে গেছেন চাচা-চাচী।

টেনিস বল নিয়ে ফিরে এলো বাঘা। পার্থসের দিকে চেয়ে তারস্বরে ঘেউ-ঘেউ করতে শুরু করল।

হেসে উঠল কিশোর। ‘বাঘা মনে হয় তোমাকে পছন্দ করছে না, ‘ বলটা নিয়ে আবার কার্পেটের আরেক মাথায় ছুঁড়ে মারল ও।

কিন্তু এবার ওটা নিয়ে আসার গরজ দেখাল না বাঘা। পার্থসের দিকে তাকিয়ে ঘেউ-ঘেউ করে চলেছে বিকট শব্দে।

যথারীতি লজ্জায় লাল হলো পার্থস। আদর করার জন্যে কুকুরটার দিকে এগিয়ে গেল। ‘এমন করছেন কেন আপনি? আমি তো খারাপ বন্ধু নই! ‘

কিন্তু পার্থস যতই এগোয় ওটাও ততই পিছায়। খুব সম্ভব বলের খোঁজে সটকেই পড়ল বাঘা শেষ পর্যন্ত।

‘ভাল,’ বলল কিশোর, ‘ভালই হলো। এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে সব কুকর্ম আমি একাই ঘটাইনি।’ কিশোরের মুখ গম্ভীর। সত্যিকারের প্রেতাত্মা আছে, এবং ওটা আমি নই,’ বলে চলেছে ও। ‘সবাই ভাবছে আমি মিথ্যেবাদী। সুইটি ম্যাডামের ধারণা আমিই নাটক বানচাল করতে চেয়েছিলাম। এমন কী চাচাও ম্যাডামের অভিযোগ শুনে ভাবতে শুরু করেছেন, সত্যিই আমি বখাটে হয়ে গেছি। একমাত্র আমার চাচী…’ কথাটা শেষ না করে চুপ হয়ে গেল কিশোর। চোখ দুটো ছলছল করছে।

‘তুমি হ্যারিংটনের চেয়ে অনেক ভাল প্রেতাত্মা ছিলে,’ বললাম কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে। ‘আর মাত্র একহপ্তা পর নাটক মঞ্চস্থ হবে। অথচ এখনও সংলাপ ভুল করে ছেলেটা। তবে ওর দোষই বা দিই কীভাবে! এত কম সময়ের প্রস্তুতিতে এতবড় চরিত্র ফুটিয়ে তোলা সত্যিই কঠিন। তবে এটাও ঠিক, অভিনয়ের ব্যাপারে তোমার অর্ধেক আগ্রহও নেই হ্যারিংটনের মধ্যে।

হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল কিশোর। ‘এখনও সুযোগ আছে। যদি প্রমাণ করতে পারি, আমি প্রেতাত্মা সেজে কোনও অকাজ করিনি, তা হলে সুইটি ম্যাডামের কাছে আমার চরিত্র ফিরিয়ে দেয়ার জোরালো দাবি জানানোর একটা সুযোগ পাওয়া যাবে।’

‘কী?’ অদ্ভুত শব্দ বেরোল পার্থসের গলা দিয়ে। এরপর কী বলবে কিশোর, বুঝে গেছে সে।

‘চলো যাই, স্কুলে,’ উত্তেজনায় চোখ বড় হয়ে গেছে কিশোরের। ‘আজ সত্যিকারের প্রেতাত্মাকে যেভাবেই হোক ধরব। সত্যিই আমি আমার কেড়ে নেয়া চরিত্র ফিরে পেতে চাই।’

মাথা এপাশ-ওপাশ করলাম। ‘কিন্তু সেটা এভাবে সম্ভব নয়, কিশোর।’

‘আমি প্রমাণ করে দেখাতে চাই নাটক বানচাল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না,’ বলল ও।

বাঘার দিকে টেনিস বল ছুঁড়ে দিল পার্থস। ‘কিন্তু তোমার ঘর থেকে বেরোনো নিষেধ, সেটা মনে হয় ভুলে গেছ,’ বলল সে।

শ্রাগ করল কিশোর। ‘যদি আমরা প্রেতাত্মাকে শনাক্ত করতে পারি এবং প্রমাণ করতে পারি আমি নির্দোষ, তা হলে ঘর থেকে বেরিয়েছি শুনলে খুশিই হবেন চাচা-চাচী। এবং তখন অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন। চলো, ‘শ্যারন। আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।’

কিশোরের দিকে তাকিয়ে বিষয়টা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ওর পরিকল্পনায় সায় দিতে বা অংশ নিতে বাধছে। সে-রাতে চুপি চুপি অডিটোরিয়ামে ঢুকে কতবড় ঝামেলায় পড়েছিলাম ভাবতেই কাঁটা দিয়ে উঠল আমার শরীর।

তা ছাড়া পার্থসের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম, দ্বিতীয়বার ওখানে যাওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর।

কিন্তু কীভাবে মুখের ওপর না করি কিশোরকে? দুর্দিনে ওর পাশে যদি না-ই থাকলাম, তা হলে কেমন বন্ধু আমি ওর?

.

কনকনে ঠাণ্ডা রাত। হাড় কাঁপানো বাতাস বইছে। পুরু জ্যাকেটেও শীত মানছে না। কাঁপছি ঠক্‌ঠক্ করে।

নীরবে স্কুলের দিকে হেঁটে চলেছি আমরা। কিছুক্ষণ পর স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় হঠাৎ একটা ব্যাপার চোখে পড়তে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল আমার। মনে হলো আজব ধরনের কিছু ছায়া যেন অনুসরণ করে চলেছে আমাদের। কার বা কাদের ছায়া বুঝতে পারছি না। আশপাশে অন্য কেউ নেই যে তার ছায়া পড়বে মাটিতে। অথচ তারপরও আছে ছায়া। কিন্তু যেই ঘুরে তাকাই, চট্ করে অদৃশ্য হয়ে যায় ওগুলো।

।মনে মনে নিজেকে বললাম, শ্যারন, বড্ড কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েছ তুমি। কিন্তু বললে কী হবে, বুক ধক্কক্ করছে আমার। এক ধরনের অস্বস্তিতে ছেয়ে গেছে মন।

আমাদের হাতে সময় খুব কম। চাচা-চাচী ফেরার আগেই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে হবে কিশোরকে।

দরজা খোলার চেষ্টা করে সময় নষ্ট করলাম না আমরা। আগের সেই জানালা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

তারপর এগিয়ে চললাম অন্ধকার, ভুতুড়ে অডিটোরিয়ামের দিকে। পা ফেলছি নিঃশব্দে।

আমাদের তিনজনের হাতেই টর্চলাইট আছে। কিন্তু কেউ আলো জ্বাললাম না তখনই। প্রয়োজনের সময় ছাড়া কেউ লাইট জ্বালব না ঠিক করেই এসেছি।

দূর থেকে আধিভৌতিক, দৈত্যাকার কিছু একটার মত লাগছে মঞ্চটাকে। সেদিকে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম আমরা।

কিশোর আছে সবার আগে। ওর পেছনে আমি, তারপর পার্থস। পথ দেখে নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গাঢ় অন্ধকারের জন্যে, তাই কিশোরের টর্চ একটু পর পর জ্বলে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যাচ্ছে চট করে।

পার্থসও টর্চ জ্বালিয়ে দর্শকের আসনের ওপর ধীরে ধীরে ঘোরাতে লাগল।

আমার টর্চের আলো গিয়ে পড়ল মঞ্চের ওপর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ঘুরে এলো এক চক্কর।

মঞ্চে কেউ নেই। অস্বাভাবিকতার কোনও চিহ্ন নেই কোথাও।

‘আমরা সময় নষ্ট করছি, কিশোর,’ বললাম আমি নিচু গলায়, যদিও আমার কথা শোনার মত কেউ আছে বলে মনে হলো না অডিটোরিয়ামে।

তবু ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়াল কিশোর। বলল, ‘মঞ্চের নীচে যাব আমরা। এবার ওকে ধরবই, শ্যারন। এবার আর ব্যর্থ হব না।’

ওকে এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিনি আর কখনও। ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে। কিন্তু কিশোরের সাথে কোনও ব্যাপারেই দ্বিমত প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।

‘আমি মঞ্চের ওপরে থাকব,’ ভয়ার্ত গলায় বলল পার্থস। ‘তোমরা যাও। তোমাদের পাহারা দেব আমি।’

‘কীসের পাহারা?’ টর্চের আলো পার্থসের মুখে ধরল কিশোর। ‘কে আসছে এখানে?

পার্থসের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ‘কেউ এসে পড়তে পারে যে-কোনও সময়,’ দুর্বল গলায় বলল।

‘আমরা তিনজনই নীচে নামব,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘যদি সত্যি সত্যি ওকে দেখা যায়, দু’জন সাক্ষী রাখতে চাই আমি।

‘কিন্তু ওটা তো ভূত,’ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল পার্থস। ‘ভূতকে কখনও দেখা যায় না।’

কিশোর কড়া চোখে তাকাল পার্থসের দিকে। ‘ওকে দেখতে পাব আমরা। শ্যারন আর আমি আগেও ওকে দেখেছি একবার।’

হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল পার্থস। মনে হলো, কিশোরের সাথে তর্কে হেরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করল।

ট্র্যাপডোরের দিকে এগোবার সময় ভুতুড়ে শব্দ উঠল মঞ্চের ফ্লোর-বোর্ডে।

টর্চলাইট জ্বেলে চারকোনা প্ল্যাটফর্মটা দেখে নিলাম আমরা।

পার্থস আর আমি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে প্ল্যাটফর্মের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সুইচে চাপ দিয়েই আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর।

পরিচিত ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পেলাম প্রথমে।

তারপর লিফটের নীচে নামা শুরু হতেই সেই ঘস ঘস আওয়াজ।

ধীরে ধীরে মঞ্চ ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমরা নীচে নামছি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অন্ধকারের সাগরে তলিয়ে গেলাম আমরা। মনে হচ্ছে চারদিকে অন্ধকারের দেয়াল।

নীচে নামছি। নামছি তো নামছিই।

মনে হচ্ছে আমার নাড়ি-ভুঁড়ি যেন ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠে আসছে। বিমান এয়ারপকেটে পড়ে ঝপ্ করে নীচে নামার সময় পেটের ভেতরে যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনি।

লিফটের ওপর পরস্পরের আরও কাছাকাছি চলে এলাম আমরা। ঘস ঘস আর ঘর্ষণের জোরালো শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়।

অবশেষে তলায় একটা কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেল লিফ্‌ট্।

কয়েক সেকেন্ড কেউ নড়াচড়া করলাম না।

লিফ্‌ট্ থেকে প্রথমে নামল কিশোর। টর্চ তুলে ধীরে ধীরে আলোটা ঘোরাতে লাগল।

একটা বিরাট শূন্য ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ঘরটার উত্তর আর দক্ষিণ দিকে দুটো সুড়ঙ্গ দেখা যাচ্ছে টর্চ লাইটের আলোয়।

‘প্রেতাত্মা, কোথায় তুমি?’ চিৎকার করে ডাকল কিশোর, ঠিক যেন ওর কুকুর বাঘাকে ডাকছে। ‘চলে এসো! আমরা এখানে, তুমি কোথায়?’ রীতিমত সুর করে ডাকতে শুরু করেছে ও।

লিফ্‌ট্ থেকে নেমে আস্তে করে ধাক্কা দিলাম কিশোরকে। ‘পাগল হলে নাকি?’ বললাম শুকনো গলায়। ‘প্রেতাত্মার সাথে ইয়ার্কি? মনে করেছিলাম এই ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস। এখন দেখছি এই মৃত্যুপুরিতে এসেও তামাশা করছ।’

‘তোমাদের ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করছি,’ বলল কিশোর। কিন্তু বুঝে ফেললাম সত্যি কথাটা ও দিব্যি চেপে যাচ্ছে। আসলে নিজের ভয় তাড়াতেই ব্যস্ত কিশোর।

পিছিয়ে পার্থসের পাশে এসে দাঁড়ালাম। ভয়ে কুঁকড়ে আছে ছেলেটা।

‘এখানে কেউ নেই,’ যতটা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করছে পার্থস। ‘এবার নিশ্চয়ই আমরা ওপরে উঠব?’

‘না,’ ঝট্পট্ বলল কিশোর। ‘আমার পেছনে পেছনে এসো।’ কিশোরের পেছনে পাশাপাশি হাঁটছি আমি আর পার্থস। দক্ষিণ দিকের সুড়ঙ্গের দিকে এগোচ্ছে কিশোর।

একটুখানি এগিয়ে থামল ও। আমরাও থামলাম। কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করল আমাদের নেতা।

চারদিকে নীরবতা।

পা কাঁপছে আমার। সত্যি কথা বলতে কী, আমার পুরো শরীরই কাঁপছে। কিন্তু কিশোরকে বাইরে থেকে দেখলে শক্তই মনে হয়। ভয় পেলেও সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে ও। এবং এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে। তবে আমি ওর মত ভয় চেপে রাখতে পারছি না কিছুতেই।

‘সুড়ঙ্গ কোথায় শেষ হয়েছে কে জানে?’ সামনে টর্চের আলো ফেলে ফিফিস্ করে বলল পার্থস। ‘মনে হচ্ছে সারা জীবন হেঁটেও ও-মাথায় পৌঁছুতে পারব না।’

আরও কয়েক পা এগিয়ে থামতে বাধ্য হলাম আমরা। হঠাৎ পেছনে শোনা গেল একটা শব্দ।

প্রথমে ঘস-ঘস, তারপর তীব্র ঘর্ষণের ঘসর-ঘসর শব্দ।

‘সেরেছে!’ কেঁদেই ফেলল বুঝি পার্থস। ‘ট্র্যাপডোর…’ কথা শেষ হলো না ওর।

চরকির মত ঘুরেই তিনজন পড়িমরি ছুটলাম লিফটের দিকে। অন্ধকার সুড়ঙ্গে আমাদের পায়ের শব্দ ভৌতিক প্রতিধ্বনি তুলল।

লিফটের কাছে এসে হাঁপাতে লাগলাম তিনজন।

‘ওটা উঠে যাচ্ছে!’ উত্তেজিত গলায় বলল কিশোর।

অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে ওপরে উঠতে থাকা লিফটের দিকে চেয়ে থাকলাম আমরা। আমাদের মাথার অনেক ওপরে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে ওটা ততক্ষণে। মঞ্চের দিকে উঠে যাচ্ছে আমাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।

আমাদের মাথার অনেক ওপরে সশব্দে থেমে গেল লিফ্‌ট্। বরফের মত জমে নীরবে একরাশ আঁধারে হাঁ করে ওপরে তাকিয়ে রইলাম আমরা।

‘ফাঁদে পড়েছি এবার,’ গলা দিয়ে আমার কোনও রকমে বেরোল বাক্যটা। ‘ওপরে ওঠার আর কোনও পথ নেই। আমরা বন্দি!’

বিশ

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম কেউ নীচে নামে কিনা। না। বারবার লিভার টানল কিশোর। আর নামছে না লিফট। বৃথা সময় নষ্ট। লিফটটা যেন চিরতরে থেমে গেছে ওপরে গিয়ে।

আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম আমরা। লিভার নাড়ল কিশোর বারবার। লিভার টেনে কোনও কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পার্থস। ‘আমাদের নীচে আটক রাখার জন্যেই করা হয়েছে কাজটা,’ বলল কাঁপা কণ্ঠে। ‘সময়মত সুইচ টিপে ওটা আমাদের নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’

‘প্রেতাত্মার কাজ!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ঘুরলাম কিশোরের দিকে। ‘এখন কী হবে?’

কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। ‘বুঝতে পারছি না। আপাতত এ-ব্যাপারে আমাদের করার কিছু দেখছি না। তবে মনে হচ্ছে, এখান থেকে বের হতে চাইলে প্রথমে প্রেতাত্মাকে খুঁজে বের করতে হবে।’

তিনটে টর্চ থেকে হলুদ আলোর তিনটে বৃত্ত পড়ল মেঝেতে। আবার এগোলাম সবাই সুড়ঙ্গের দিকে।

সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকতেই পায়ের নীচের মাটি শক্ত মনে হলো। জমাট বাঁধা শীতল বাতাসের ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগল নাকে।

কিশোর-পার্থস আর আমার মাঝে দূরত্ব বেড়ে গেছে। আমি পিছিয়ে পড়েছি। প্রায় দৌড়ে দূরত্ব কমিয়ে ফেললাম। বিড়বিড় করে কী সব বলছে কিশোর। ওর টর্চ ঘন ঘন জ্বলছে আর নিভছে।

হঠাৎ অদ্ভুত গানের সুর ভেসে এলো। কয়েক মুহূর্ত লাগল আমার শব্দের উৎস বুঝতে। গুনগুন করে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে কিশোর।

ঘাবড়িয়ো না কিশোর, ভাবলাম আমি। তোমার ভয় এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এতক্ষণ চেপে রেখেছ। গুনগুন করে গান গেয়ে আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছ। কিন্তু জানি, আমার চেয়ে একটুও কম ভয় পাওনি তুমি।

হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। একটা বন্ধ দরজা সামনে। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা।

এক পা পিছিয়ে গেল পার্থস, ভয়ে। তবে কিশোর আর আমি দরজার দিকে এগিয়ে টর্চের আলো ফেললাম।

‘ভেতরে কেউ আছেন?’ বলে উঠল কিশোর।

কিন্তু ওর কথার জবাবে ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।

এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল কিশোর।

ক্যাঁচ্‌ক্যাঁচ্ শব্দ করে খুলে গেল ওটা।

আলো ফেলে একসাথে ভেতরে উঁকি দিলাম কিশোর আর আমি।

একটা রুম। নির্জন। ভেতরে মানুষ বসবাসের উপযোগী কিছু আসবাব-পত্র আছে। তবে সবই পুরানো। দেখলে মনে হয় ফেলে দেয়া হয়েছে। একটা ফোল্ডিং চেয়ার দেখলাম আমি। একপাশে একটা কাউচ আছে, তার ওপরে কুশন নেই। রুমের এক দেয়াল জোড়া বইয়ের তাকও আছে দেখলাম। সেটাও পুরানো। ভেতরে পোকায় খাওয়া দু’চারটে বইও আছে।

ছোট একটা টেবিলের ওপর স্থির হলো আমার টর্চের আলো। ওটার ওপর কতগুলো থালা-বাসন ছড়িয়ে আছে। দ্রুত টর্চের আলো ঘোরাতে লাগলাম। দেয়াল ঘেঁষে একটা বিছানা চোখে পড়ল। অগোছালো।

ভেতরে ঢুকলাম আমরা। ঘরের প্রতিটি জিনিসের ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগল আমাদের আলো।

‘অবিশ্বাস্য!’ চোখ বড় হয়ে গেল পার্থসের। ‘কেউ থাকে এখানে!

‘মনে হয় প্রেতাত্মার ঘর আবিষ্কার করে ফেলেছি,’ ফিফিস্ করে বললাম আমি।

থালা-বাসনের টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল পার্থস। জিনিসগুলোর ওপর টর্চের আলো ফেলে দেখল কিছু। প্লেটে অভুক্ত কিছু খাবার পড়ে আছে। ‘একটু আগেও এখানে ছিল প্রেতাত্মা। খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেছে।’

‘আশ্চর্য!’ ফিসফিস করে বললাম, ‘মাটির নীচে এই পাতাল পুরিতে সত্যিই কেউ থাকে তা হলে!’

হঠাৎ করে থেমে গেলাম। কারণ আমার হাঁচি আসছে।

বহু চেষ্টা করলাম হাঁচি আটকে রাখতে। কিন্তু পারলাম না। হাঁচতে শুরু করলাম।

এক… দুই… তিন… চার…

‘শ্যারন, থামো!’আঁতকে উঠল পার্থস। ‘প্রেতাত্মা শুনে ফেলবে।’

‘শুনতে দাও, আমরা ওকে দেখতে চাই,’ সাথে সাথে কিশোর বলল।

সাতবার হাঁচি দিলাম একটানা। একটু থেমে আরও দু’বার।

‘প্রেতাত্মা শুনে ফেলবে,’ আবার বলল পার্থস। ভয়ে ওর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

হঠাৎ ভয়াবহ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ড একলাফে গলার কাছে চলে এসেছে। প্রতিটা মাংসপেশি গিঁট পাকিয়ে গেছে।

একসাথে দরজার দিকে ঘুরলাম আমরা।

কেউ ওটা বন্ধ করে দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। বাতাসে বন্ধ হয়নি। দরজার দিকে এগোল কিশোর। টর্চের আলো ফেলল ওটার ওপর।

নব ধরে জোরে ধাক্কা দিল পার্থস।

একচুল নড়ল না দরজার পাল্লা।

দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে প্রাণপণে ঠেলা দিল ও। কিন্তু বিফল চেষ্টা। এক ইঞ্চিও খুলল না দরজাটা।

একটু জিরিয়ে নিয়ে কাঁধ দিয়ে একের পর এক ধাক্কা মারতে শুরু করল ও। তাতেও লাভ হলো না। দরজা অনড়।

হতাশ হয়ে আমাদের দিকে ঘুরল ও। হাঁপাচ্ছে।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। এই প্রথমবারের মত ভয়ের পরিষ্কার ছায়া পড়েছে ওর চেহারায়।

‘আমরা… আমরা আটকা পড়েছি,’ ক্ষীণ গলায় বলল ও। ‘এবার বোধহয় জন্মের মত।’

একুশ

পার্থসের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘তিনজন একসাথে চেষ্টা করলে কেমন হয়?’ পরামর্শ দিলাম।

‘হ্যাঁ, চেষ্টা করে দেখি,’ বলে আমার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। ‘তিনজন একসাথে চেষ্টা করলে পুরানো দরজাটা ভেঙে যেতেও পারে।’

‘পারে,’ বলল পার্থস।

অবাক হলাম পার্থসের কথায়। ওকে যতদূর চিনেছি, তাতে আমার ধারণা, এতক্ষণে জ্ঞান হারানোর কথা ওর। তা তো হয়নি, বরং সাহস জোগাচ্ছে আমাদের!

এক লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দেয়ার প্রস্তুতি নিলাম তিনজন।

বড় করে দম নিলাম একটা। শক্তি অর্জনের চেষ্টা করলাম।

ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা ভাবছি আমি। এই ভুতুড়ে ঘর থেকে বেরোতে না পারলে বাকি জীবন এখানেই থাকতে হবে। মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যেন হাজার হাজার মাইল দূরে কোথাও এসে আটকা পড়েছি আমরা।

সবাই আমাদের খুঁজবে হন্যে হয়ে, কিন্তু পাবে না। আমরা গলা ছেড়ে চিৎকার করলেও কারও কানে যাবে না তা।

এখানেই ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে। দীর্ঘশ্বাস বেরোল আমার বুক চিরে।

কিশোর বলে উঠল, ‘রেডি! ওয়ান… টু…’

‘দাঁড়াও,’ হঠাৎ থামিয়ে দিলাম ওকে। টর্চের আলো ফেলে তীক্ষ্ণ চোখে দরজার দিকে তাকালাম। তখনই ভুলটা চোখে পড়ল, খুশি হয়ে উঠলাম। ‘দরজাটা বাইরের দিকে ধাক্কা দিচ্ছি, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ, তাতে হয়েছে কী?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল পার্থস।

‘ভুল করছি,’ খুশি হয়ে বললাম। ‘দেখছ না এ-দরজা ভেতর দিকে খোলে? ঘরের ভেতর থেকে বাইরের দিকে ধাক্কা দিলে খুলবে কেন? দরজাটা ভেতরের দিকে টানতে হবে।’

মাথা নাড়ল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, ‘আরে, তাই তো! ঠিক বলেছ।

পার্থস বলে উঠল, ‘আমি একটা আস্ত বুদ্ধ!’

নব মুঠো করে ধরলাম। ভেতরের দিকে টানতেই দরজা খুলে গেল। এবং খুলতেই এক পা পিছিয়ে এলাম।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে কে যেন।

আমার টর্চের আলো সোজা লোকটার মুখে গিয়ে পড়ল। চিনে ফেললাম ওকে।

মিলার্ড! বেঁটে, ঘন চুলের সেই লোকটা, যে নিজেকে স্কুলের নাইট গার্ড বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিল।

আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

বিদঘুটে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।

‘চলো, পালাই,’ বললাম বটে আমি, কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে পারলাম না।

কারণ লোকটা দরজা জুড়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত চোখে ধূসর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।

‘আমাদের যেতে দিন,’ আকুতি ঝরল আমার গলায়। ‘প্লিজ!’

ওর কুৎসিত চেহারা রাগে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে আমাদের টর্চের আলো ওকে কিছুটা ভীত-বিহ্বল করে তুলেছে বলে মনে হলো।

দরজা থেকে একচুল নড়ল না সে।

‘এখানে কেন এসেছ তোমরা?’ ফ্যাসফেঁসে গলায় জানতে চাইল লোকটা। ‘আমার ঘরে কী করছ?’

কিছু না ভেবে মুখ ফসকে বললাম, ‘আপনিই তা হলে প্রেতাত্মা?’

বিস্ময়ে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকাল সে। ‘প্রেতাত্মা?’ চিন্তিত দেখাচ্ছে এখন তাকে। ‘হ্যাঁ… তা বলতে পারো। প্রেতাত্মার বন্ধু আমি। প্রেতাত্মার সাথেই বসবাস করছি এখানে। চোখে দেখিনি বটে, তবে রহস্যময় খুট্‌ট্ আওয়াজ আর করুণ কান্না শুনি প্ৰায় সময়।’

পার্থসের কান্নার মৃদু শব্দ কানে এলো।

বিরক্তির সাথে বলল লোকটা, ‘এটা আমার ঘর। এখানে এসেছ কেন তোমরা? আমার সাবধান বাণী তোমাদের কানে যায়নি?’

‘সাবধান বাণী আপনার?’ অবাক হলাম আমি। উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছি। আমার কাঁপুনির সাথে তাল মিলিয়ে আমার টর্চের আলোও লোকটার মুখের ওপর কাঁপছে।

‘তোমাদেরকে আমার আশ্রয় থেকে দূরে রাখার জন্যে আমার পক্ষে যতদূর করা সম্ভব, করেছি আমি,’ হতাশা মাখা কণ্ঠে বলল সে।

‘ব্যাকড্রপ নষ্ট করার কথা বোঝাতে চাইছেন আপনি?’ বলে উঠল কিশোর। ট্র্যাপডোর দিয়ে বেরিয়ে রিহার্সালের সময় আপনিই সেদিন শ্যারনকে হুমকি দিয়েছিলেন?’

‘আমার লকারে ভয়ঙ্কর মুখোশ আর সাবধান বাণী কে রেখে এসেছিল, আপনি?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললাম বিস্ময়ের ঘোরে।

নীরবে মাথা দোলাল প্রেতাত্মা।

‘বিশ বছর আগে এক নাটককে কেন্দ্র করে কী ঘটেছিল এই স্কুলে, জানেন?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর। ‘নাটকটা যখন দ্বিতীয়বারের মত মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল, কী ঘটেছিল তখন? আপনি ওই রাতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন কেন?’

মুখের ভাব বদলে গেল মিলার্ডের। দ্বিধার ভাব ফুটল তার চোখে-মুখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল সে, ‘আমি… আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোমার কথা।’

‘বিশ বছর আগে,’ আবার বলল কিশোর। ‘কিছু মনে নেই?’

ধীরে ধীরে হাসির আভাস ফুটল লোকটার মুখে। আমার চোখে ভয়ঙ্কর দেখাল সেটা। ‘ভুল হচ্ছে তোমাদের।

‘তা হলে আপনি প্রেতাত্মা নন?’ বলল কিশোর অবাক হয়ে।

মাথা এপাশ-ওপাশ করল মিলার্ড। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘কীসের প্রেতাত্মার কথা বলছ তোমরা এতক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি,’ বলল সে। ‘বিশ বছর আগে নাটক করতে গিয়ে একটা ছেলে ট্র্যাপডোর দিয়ে নীচে পড়ে যায়। লাশটা আমি পাই। আমার থাকার জায়গা সবাই দেখে ফেলবে, সেই ভয়ে সাথে সাথে লাশটা লুকিয়ে ফেলি অন্ধকার সুড়ঙ্গে। সরে পড়ি এখান থেকে কিছুদিনের জন্যে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে আবার ফিরে আসি। কঙ্কালটা এখনও আছে ওখানেই। দেখবে তোমরা?’

‘ওরে বাপ-রে!’ বলেই আমার হাত আঁকড়ে ধরল পার্থস।

লোকটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে বলছে বোঝার জন্যে কয়েক মুহূর্ত ধরে তাকে পরখ করলাম তিনজন। কেন যেন আমার মনে হলো সত্যি বলছে সে।

‘আশ্চর্য! স্কুলের নীচে এখানে আপনি কীভাবে বাস করছেন?’ আমার প্রশ্ন। ‘এই ঘরের খোঁজ পেলেন কীভাবে?’

‘আমার বাবা অডিটোরিয়ামের ঝাড়ুদার ছিল। বাবার সাথে বহুবার এখানে এসেছি আমি। স্কুলের পেছন দিকে একটা সিঁড়ি আছে এই রুমে আসার। অডিটোরিয়াম ঝাঁট দেয়ার জন্যে ঝাড়ু-টাডু এখানে থাকত সে-কালে। এখন ব্যবহার হয় না রুমটা। এখনকার কেউ এই রুমের কথা জানে বলে মনে হয় না।’

‘তারপর?’ সবিস্ময়ে বলে উঠল কিশোর।

‘তখন অডিটোরিয়ামের মালিক ছিলেন রিচার্ড ম্যালন। তিনি স্কুলকে অডিটোরিয়ামটা দান করে চলে গেলেন। বাবার চাকরি গেল। কিছুদিন পর মারা যান তিনি। ফুটপাথে দিন কাটতে লাগল আমার। হঠাৎ এই ঘরটার কথা মনে পড়ায় এসে উঠলাম।’

‘কতদিন আগে?’ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।

‘বিশ-একুশ বছর হবে হয়তো। স্কুলের নির্মাণ-কাজ চলছিল তখন,’ চিন্তিত মুখে মাথার চুলে চিরুনির মত পাঁচ আঙুল চালিয়ে দিল মিলার্ড। ‘এখন কোথায় যাব আমি?’ নিজেকেই প্রশ্ন করল। ‘কোথায় থাকব?’

‘আপনাকে চলে যেতে হলে সত্যি খুব দুঃখজনক ব্যাপার হবে,’ সহানুভূতি প্রকাশ পেল কিশোরের কণ্ঠে। আরও কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল, সময় হলো না।

হঠাৎ ধক্ করে জ্বলে উঠল মিলার্ডের দু’চোখ। দ্রুত এক পা এগোল সে। রাগে ফুঁসছে। ‘তোমরা আমার আশ্রয় চিনে ফেলেছ। এখন আবার পথে ফিরে যেতে হবে আমাকে, খোলা আকাশের নীচে থাকতে হবে।’ বাইরে একটা আওয়াজ উঠতে আরও দু’পা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মিলার্ড।

বাইশ

একটা শব্দ আমারও কানে এলো। সুড়ঙ্গের ওপর দিক থেকে আসছে শব্দটা। ঘড়ঘড় শব্দ।

চট্ করে ঘুরলাম কিশোর আর পার্থসের দিকে। ওরাও শুনেছে আওয়াজটা।

ট্র্যাপডোর! নীচে নেমে আসছে ওটা!

আমার ধারণা কিশোর আর পার্থস জানে এখন আমাদের কী করা উচিত।

এখন ট্র্যাপডোরের দিকে একসাথে খিঁচে দৌড় দেয়া উচিত আমাদের। এ ছাড়া বাঁচার আর কোনও পথ নেই।

‘তোমরা আমার সব শেষ করে দিয়েছ,’ আবার বলল মিলার্ড। রেগে গেছে আরও। ‘কেন তোমরা আমার সাবধানবাণী শুনলে না?’

বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা তিনজন একযোগে ঝেড়ে দৌড় লাগালাম দরজা লক্ষ্য করে। দু’পা যেতে না যেতেই বাধা পেলাম আমি।

‘উফ্,’ চিৎকার করে উঠলাম মিলার্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে। আরেকটু হলে ছিটকে পড়েই যেতাম।

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লোকটা আমাকে ধরার কোনও চেষ্টাই করল না দেখে অবাক হলাম। এমন কী আমাকে থামানোরও চেষ্টা করল না। সে। হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই আশ্রয় ছেড়ে চলে যাবে।

দৌড়ে বেরিয়ে এলাম সবাই ঘর থেকে। যত জোরে সম্ভব দৌড়াচ্ছি। তবু মনে হচ্ছে গতি নেই। যেন পায়ের পাতায় কেউ চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছে, প্রয়োজনমত দ্রুত পা উঠছে না। তবু ছুটে চলেছি আমরা অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে।

পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। টের পাচ্ছি আমার সামনে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে কিশোর আর পার্থস।

পেছনে লোকটার বিকট গলা ভয়াবহ প্রতিধ্বনি তুলল সুড়ঙ্গ পথে, ‘তোমরা আমার সব শেষ করে দিলে। সব… সব…’

মিলার্ড কি পিছু ধেয়ে আসছে?

অত কিছু চিন্তা করার সময় নেই এখন। শুধুই সামনে দৌড়াতে হবে। যে-কোনোভাবে লিফটের ওপরে গিয়ে উঠতে হবে। বেরিয়ে যেতে হবে এই ভৌতিক পাতালপুরি থেকে।

অন্ধের মত দৌড়াচ্ছি এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ ধরে। জুতো পা থেকে কখন খসে গেছে মনে নেই। সুড়ঙ্গের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে পড়েও গিয়েছি বার দুয়েক। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে আবার দৌড়।

অবশেষে যেন বহু যুগ পর ওপর থেকে নেমে আসা আলোর একটা স্তম্ভ দেখতে পেলাম। সেই সাথে চোখে পড়ল ট্র্যাপডোর লিট্।

‘ওখানে কী করছ তোমরা?’ শোনা গেল একটা কণ্ঠ। কিশোরের চাচার গলা ওটা।

‘কিশোর, কোথায় তুই!’ এটা মেরি চাচীর কণ্ঠ।

লাফ দিয়ে লিফটের ওপরে, ওঁদের পাশে উঠে পড়লাম আমরা। তিনজনেই হাঁপাচ্ছি ফোঁস ফোঁস করে। কিশোরকে জড়িয়ে ধরলেন চাচী, যেন হারানো মাণিক ফিরে পেয়েছেন।

‘কী হচ্ছে এসব?’ আমাদের তাড়াহুড়ো দেখে উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলেন কিশোরের চাচা। ‘ওদিকে কার গলা শোনা গেল?’

‘ওপরে!’ আমার গলা দিয়ে কোনরকমে বেরোল কথাগুলো। ‘শীগগির আমাদের ওপরে তুলুন।

লিফ্‌ট্ থেকে নেমে লেভার চাপ দিয়েই আমার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর।

ঝাঁকি খেয়ে ঘর্ষণের ভয়ানক শব্দ তুলে ওপরে উঠতে শুরু করল লিফট।

শেষবারের মত সুড়ঙ্গ পথের দিকে তাকালাম। মিলার্ড কি অনুসরণ করছে আমাদের?

না, তেমন কোনও লক্ষণ নেই। তা ছাড়া লিফট ছাড়া আসবেই বা কী করে?

সত্যিই অদ্ভুত!

‘একটা পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেলাম যেন,’ কিশোরের চাচা আবার জানতে চাইলেন। ‘কে ওটা?’

‘ঘরহীন অসহায় একজন মানুষ,’ বলল কিশোর। ‘মঞ্চের নীচে থাকে সে অনেক বছর ধরে।’

ওপরে উঠে সব খুলে বললাম আমরা চাচা-চাচীকে। কিছুদিন ধরে লোকটা নাটক বানচাল করার জন্যে আমাদেরকে কীভাবে ভয় দেখিয়েছে, সব বললাম।

‘চাচা, তুমি কীভাবে জানলে আমরা এখানে?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘তোমার ঘরে থাকার কথা ছিল,’ ভাতিজার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। কারণ তুমি গৃহবন্দি। বাসায় ফিরে তোমাকে না পেয়েই তোমার চাচী বললেন, নিশ্চয়ই এখানে এসেছ।’

‘সময়মতই এসে পড়েছিলেন আপনারা, আঙ্কেল-আন্টি,’ খুশি হয়ে বললাম। ‘আরেকটু দেরি করলেই কী যে হতো!’

পুলিশে খবর দিলেন তাড়াতাড়ি কিশোরের চাচা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপটেন ইয়ান ফ্লেচারের নেতৃত্বে ছয়-সাতজন পুলিশ এলো আমাদের স্কুলে।

রহস্যময় লোকটার কথা জানানো হলো তাঁদের।

ট্র্যাপডোর দিয়ে নীচে নেমে গেলেন ক্যাপটেন কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে। মঞ্চে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম মিলার্ডকে পাকড়াও করে তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন ওঁরা।

পুলিশ চীফ জানালেন, ‘নীচে কেউ নেই। মানুষের কোনও চিহ্নই নেই ওখানে, শুধু একটা বিছানা আর কিছু আসবাবপত্র পড়ে থাকতে দেখেছি।’

‘লোকটার থালা-বাসন, খাবার?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘কিচ্ছু নেই,’ জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন। ‘আমরা যাওয়ার আগেই মনে হয় তোমাদের প্রেতাত্মা সব নিয়ে কেটে পড়েছে। বেজমেন্টের দরজাটা খোলা।’

রাশেদ আঙ্কেলকে সরিয়ে নিয়ে কী যেন বলছেন ক্যাপ্টেন, শুনে ফেললাম কয়েকটা কথা: ‘কঙ্কালটা পেয়েছি আমরা। আমাদের লোক সরিয়ে নেবে ওটা।’

পুলিশ চলে গেল। এরপর পার্থসও আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

কিশোরদের গাড়িতে উঠে বসলাম আমি আর কিশোর। গাড়ি ছেড়ে দিলেন রাশেদ আঙ্কেল।

পেছনে বসেছি কিশোর আর আমি।

কিশোরের দিকে ঘুরলাম আমি। ‘ওটাই নিশ্চয়ই তোমার সেই প্রেতাত্মা,’ বললাম কিছুটা হতাশার সুরে। ‘গরীব চাল-চুলোহীন এক রক্ত মাংসের মানুষ। কোনও ভূত-টুত নয়।

‘ঠিক তাই,’ ভ্রূ কুঁচকে বলল কিশোর। ‘সত্যিকারের প্রেতাত্মার সাথে দেখা করার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার।’ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ। ‘সে যাই হোক, এবার বিশ্বাস করতেই হবে সুইটি ম্যাডামকে। এবার প্রেতাত্মার চরিত্র আমাকে ফিরিয়ে দেবেন তিনি।’

নাটক! নাটকের কথা পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছে কিশোর, ভাবলাম আমি। কিশোর অবশ্যই ওর চরিত্র ফিরে পাবে। হ্যারিংটনের চেয়ে অনেক ভাল অভিনেতা ও।

তা ছাড়া হ্যারিংটনও খুশি হবে নিষ্কৃতি পেয়ে। নাটকের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর।

সত্যিকারের প্রেতাত্মা তা হলে ছিল না ওখানে!

বাকি কয়েকটা দিন নির্বিঘ্নে রিহার্সাল চালানো যাবে ভেবে খুশি আমি। শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ করতে পারব আমরা ‘প্রেতাত্মা’। সেই খুশিতে নেচে উঠল মন।

তেইশ

আজ সেই রাত। অডিটোরিয়াম ভর্তি কয়েকশ’ উৎসুক দর্শকের চোখের সামনে ড্রপ সীন উঠবে আমাদের স্কুলের বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানের। নাটকের নাম—’প্রেতাত্মা’।

মেয়েদের ড্রেসিং রুমের প্রকাণ্ড আয়নার সামনে বসে নিজেই নিজের মেক-আপ নেয়ার চেষ্টা করছি আমি। আগে কখনও একা এ- কাজ করিনি। আজই প্রথম। স্টেজ মেক-আপের বেলায় মুখে একধরনের তেলতেলে তরল প্রলেপ মাখতে হয়, যাতে মুখে আলো পড়লে চেহারা উজ্জ্বল দেখায়। কিন্তু ওই জিনিস প্রথমে মাখতে চাইনি। ওটা দিলে মনে হয় সারা মুখে যেন চিটেগুড় মেখেছি। খুব চচ করে। এমন বিচ্ছিরি লাগে না, কী বলব।

কিন্তু পারা গেল না। সুইটি ম্যাডামের চোখে বিষয়টা ধরা পড়তেই হুকুম হলো, ওই জিনিস মাখতেই হবে। কি আর করা!

ওদিকে অন্য মেয়ে শিল্পীরা হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। সবাই অনভ্যস্ত এ-কাজে। কেউ হয়তো মেক-আপ করতে গিয়ে চেহারা এমনই থেবড়ে দিয়েছে যে চেনাই মুশকিল। কেউ আবার হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে কস্টিউম পাজামার এক পায়ের মধ্যে দু’পা ভরে দিয়ে ফেঁসে গেছে। উদ্ধার পাওয়ার জন্যে তারস্বরে চেঁচিয়ে মাথায় তুলছে ছোট্ট রুমটা।

ফি গ্রেডের শ্যান্টি ও পলা ছোট দুটো চরিত্রে অভিনয় করছে। কিন্তু ওদের মেক-আপ নেয়ার বাহার দেখে মনে হচ্ছে ওরাই বুঝি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে চলেছে। বড় আয়নায় দাঁড়িয়ে ওরা পরস্পরকে ভেংচি কাটছে।

শেষবারের মত নাটকের সংলাপগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছি আমি। একটু পর স্টেজ-ম্যানেজারের গলা শুনতে পেলাম, ‘যার যার জায়গায় যাও! যার যার জায়াগায়, কুইক!’

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল আমার।

শান্ত হও, শ্যারন, বোঝালাম নিজেকে। ঘাবড়িয়ো না, খারাপ করবে না তুমি।

ধীর পায়ে ড্রেসিং-রুম থেকে বেরিয়ে হল অতিক্রম করে মঞ্চে উঠে গেলাম। মঞ্চের এক-কোণে আমার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

মঞ্চের সামনে পর্দা ঝুলছে। দর্শকদের মধ্যে নানান গুঞ্জন চলছে। পর্দা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাতেই ঘাবড়ে গেলাম রীতিমত। লোকে লোকারণ্য। আসন না পেয়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। বুকের মধ্যে ধুকপুক্ শুরু হয়ে গেল আমার। কানে আসছে সে-আওয়াজ স্পষ্ট।

একে একে নিভে যাচ্ছে লাইট। নীরব হয়ে আসছে পুরো অডিটোরিয়াম। স্টেজ-লাইট জ্বলে উঠেছে। নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেজে উঠল।

এগিয়ে যাও শ্যারন, উৎসাহ দিলাম নিজেকে। ভয়ের কিছু নেই।

.

প্রথম অঙ্ক ভালভাবেই উৎরে গেল। সবাই মোটামুটি নির্ভুল অভিনয় করেছি। এবার জমবে নাটক।

উঠে গেল পর্দা। রুদ্ধশ্বাসে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে দর্শক।

আমার ‘বাবা’ টাকির হাত ধরে মঞ্চে ঢুকলাম আমি।

‘সাবধান, ডরোথি,’ বলল টাকি। ‘তোমার বন্ধু আসলে একটা প্রেতাত্মা, ভয়াবহ, কুৎসিত! মানুষের রূপ ধরেছে।

‘বিশ্বাস করি না বাবা,’ বললাম ডরোথিরূপী আমি। ‘আসলে তুমি অহেতুক এসব কথা বলছ আমাকে।’

মনে হলো ভালই উপভোগ করছে দর্শক। হাসির দৃশ্যে হাসছে তারা। কিছুক্ষণ পর পরই পর পরই হাত-তালিতে হাত-তালিতে মুখরিত হচ্ছে অডিটোরিয়াম।

চমৎকার! ভাবলাম আমি। একটুও ঘাবড়াইনি। বরং নিজের অভিনয়ে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছি।

নাটকের আসল আকর্ষণ শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

হঠাৎ করে হালকা কুয়াশায় ছেয়ে গেল সারা মঞ্চ। প্রকাণ্ড কয়েকটা পেডেস্টাল ফ্যানের ঝোড়ো বাতাসের সাহায্যে শুকনো বরফের গুঁড়ো উড়িয়ে দিয়ে কুয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে। মঞ্চের ওপর মন্থর গতি মেঘের মত ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশা। তারওপর কড়া নীল আলো ফেলা হলো। সে-আলোয় মেঘটাকে ভীতিকর, অশুভ লাগছে। অপার্থিব এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে মঞ্চে।

ট্র্যাপডোরের ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পেলাম। আমি জানি প্রেতাত্মারূপী কিশোরকে নিয়ে উঠে আসছে লিফ্‌ট্।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসবে ভয়ঙ্কর এক প্রেতাত্মা।

দর্শক ভয়ে মুগ্ধ হবে, ভাবলাম আমি, আমার হলুদ পোশাকের চারদিকে উড়তে থাকা নীল কুয়াশা দেখতে দেখতে অনেকেই আড়ষ্ট হবে।

‘তুমি কি প্রেতাত্মা?’ সংলাপ বললাম। ‘আমাকে দেখতে আসছ!’ কুয়াশার মাঝে প্রেতাত্মার নীল-সবুজ মুখোশ উদয় হলো। তারপর কাঁধ। বুক… তারপর…

ও কে? হঠাৎ নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কে?

‘একটা নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে আমাকে মনোনীত করা হয়েছিল; যেন মরণের ওপার থেকে ফ্যাসফেঁসে কণ্ঠে বলে উঠল প্রেতাত্মা। ‘এই মঞ্চে অভিনয়ের জন্যে। ওই রাতটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারত।’

বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রেতাত্মা।

ভীষণভাবে চমকে উঠলাম আমি। সংলাপ বলছে না ও, কোনও ভুল নেই তাতে। ওগুলো সংলাপ নয়।

কী বলছে ও?

‘কিন্তু তা হয়নি। ওই রাত আমার জীবনে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না!’ বলে চলেছে প্রেতাত্মা আমার হাত ধরে। ‘আমার প্রিয় ডরোথি, নাটক শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এই মঞ্চের নীচে পড়ে যাই আমি। তারপর…‘

বরফের মত জমে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করছে ফুসফুস। একচুল নড়তে সাহস হচ্ছে না। ট্র্যাপডোরটার দিকে আঙুল তুলল প্রেতাত্মা, ‘ওই… ওখান দিয়ে… পড়ে গেলাম… তারপর…’

পরিষ্কার বুঝে গেছি কে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে ‘অভিনয়’ করছে। এ সেই ছেলে! বিশ বছর আগে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ‘প্রেতাত্মা’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেই ছেলে! প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে যাকে বাছাই করা হয়েছিল! উধাও হয়ে গিয়েছিল ছেলেটি! খুঁজে পাওয়া যায়নি আর! এই ছেলেটিরই লাশ লুকিয়ে ফেলেছিল মিলার্ড।

এই মুহূর্তে সেই একই মঞ্চে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। কীভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সে, তা আমাকে বলার জন্যেই যেন বিশ বছর পর ফিরে এসেছে সে।

‘ওখানে!’ মঞ্চের গর্তটা দেখাল সে, প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে চলল, ‘ওখান দিয়েই আমি পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অমন তো কথা ছিল না! তিন ফুট নীচে লিফট থাকার কথা ছিল। কিন্তু অত নীচে নেমে গেল ওটা কীভাবে? সুইচে চাপ পড়েছিল, হয়তো কোনওভাবে। অথবা বিগড়ে গিয়েছিল ওটা। ওই গর্ত দিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম নীচে, যেখানে ওত পেতে ছিল আমার মৃত্যু! কী দুর্ভাগ্য আমার! আমি পড়ে গেলাম নীচে। পাশের দেয়ালে বাড়ি খেলাম। সুইচ অন হয়ে লিফ্‌ট্ ওপরে উঠে গেল। মঞ্চ থেকে সামান্য নীচে থেমে গেল, যেখানে থাকার কথা ছিল ওটার। ফলে আমার লাশ খুঁজে পায়নি কেউ। তারপর প্রেতাত্মা হয়ে যাই আমি। ওখানেই আস্তানা গেড়ে থাকতে শুরু করি। শুরু হয় আজকের রাতের মত একটি রাতের জন্যে আমার অপেক্ষার পালা, যে-রাতে আমি আমার চরিত্রে চূড়ান্ত অভিনয়ের সুযোগ পাব। হ্যাঁ, আমার সাধ পূরণ হলো, সেই সাথে বাঁচিয়ে দিলাম আরেকটা ছেলের জীবন।’

ওর ‘সংলাপ’ শেষ হতেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল দর্শক। হাততালিতে মুখর হলো অডিটোরিয়াম। প্রেতাত্মার সাবলীল ‘অভিনয়’ দেখে প্রত্যেকে মহাখুশি।

আমি বুঝতে পারছি দর্শকরা ভাবছে, নাটকেরই অংশ বুঝি এটা।

প্রেতাত্মার বলা কথাগুলোর পেছনের সত্যিকারের ব্যথার কথা জানে না তারা। তারা জানে না, সত্যিকারের এক প্রেতাত্মা নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া চরম এক কাহিনি প্রকাশ করছে সবার সামনে দাঁড়িয়ে।

কথা শেষ করে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে নত হলো প্রেতাত্মা। আরও জোরে হাততালি পড়ল।

আমার আর ওর চারদিকে কুয়াশা উড়ছে। ঘন হয়ে আসছে। কে? কে ও? আমার অন্তরাত্মা নীরবে চিৎকার করে উঠল মাথায় একটা প্রশ্ন কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে।

উত্তরটা আমাকে পেতেই হবে। আমাকে জানতে হবে কে এই প্রেতাত্মা। ওর আসল পরিচয় কী?

অভিবাদন শেষে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।

ওরু মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েই আচমকা ওর মুখোশ ধরে টান মারলাম আমি।

চব্বিশ

ঘন কুয়াশার কারণে চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না।

তা ছাড়া উজ্জ্বল স্পট লাইট ঠিক আমার চোখের ওপর আলো ফেলছে। পুরোপুরি অন্ধ মনে হলো নিজেকে।

মুখোশ খুলে যেতেই চট্ করে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে ও।

এগিয়ে গিয়ে মুখ থেকে ওর হাত সরাতে চাইলাম।

‘না!’ আর্তনাদ করে উঠল প্রেতাত্মা। ‘কোরো না! ও চেষ্টা কোরো না তুমি, ডরোথি।’ পিছিয়ে গেল ও।

‘না… না…’ বারবার একই কথা বলতে বলতে পিছিয়ে যাচ্ছে ও। ‘ও চেষ্টা কোরো না।’

পিছাতে পিছাতে হঠাৎ খোলা ট্র্যাপডোরের ভেতরে লাফ দিল ও।

অদৃশ্য হয়ে গেল ভাসমান নীল কুয়াশার মাঝে।

নীরবতা!

অসহ্য নীরবতা চারদিকে!

সংবিৎ ফিরে পেতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল দর্শকদের। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল তারা, সমস্বরে বাহবা জানাচ্ছে আমাদের।

দর্শক ভেবেছে নাটকেরই অংশ ছিল বুঝি ওটা।

কিন্তু আমি জানি কী ছিল।

আমি জানি বিশ বছর পর সাধ পূরণ হয়েছে এক অতৃপ্ত প্রেতাত্মার। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ তার মঞ্চে অভিনয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

এবং তারপরই যেন আবার মৃত্যু হলো তার, নতুন করে।

পর্দা নেমে গেছে।

উত্তেজিত দর্শকদের প্রশংসা কানে আসছে ওপাশ থেকে।

মঞ্চের গর্তের পাশে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বসে আছি।

কিছু বলতে পারছি না, নড়তে পারছি না।

গর্তের দিকে চেয়ে আছি একদৃষ্টিতে। একরাশ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ধীরে ধীরে মাথা তুললাম।

সুইটি ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল, আরও কয়েকজন টিচার এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। নাটকের পাত্র-পাত্রীরাও এসে দাঁড়িয়েছে।

‘চমৎকার, চমৎকার!’ আমার পিঠ চাপড়ে বললেন প্রিন্সিপাল স্যর। ‘দারুণ অভিনয় করলে তোমরা দু’জন।’

‘অন্যভাবে শেষ করে নাটকে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে কিশোর,’ প্রশংসা ঝরে পড়ল সুইটি ম্যাডামের কণ্ঠে। ‘একটা জুয়েল ও। কোথায় কিশোর? ট্র্যাপডোর থেকে উঠে আসছে না কেন?’ বলে ঝুঁকলেন ম্যাডাম গর্তের ওপর।

‘আশ্চর্য!’ আঁতকে উঠলেন তিনি। ‘কিশোর কোথায়! লিফটটা দেখা যাচ্ছে না কেন? কিশোর!’ গলা ছেড়ে ডেকে উঠলেন ম্যাডাম।

সেই সময় পেছন দিক থেকে ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। ওর সঙ্গে রবিন, মুসা আর রেমন।

‘এই তো কিশোর, কখন উঠে এলে ওখান থেকে?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে চললেন ম্যাডাম, ‘তোমার অভিনয়ের তুলনা হয় না, কিশোর।

‘আমি অভিনয় করিনি!’ মুখ তেতো করে বলল ও।

‘কী?’ ম্যাডামের গলায় অবিশ্বাস।

‘জ্বি, ম্যাডাম,’ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম আমি। ঘোর কিছুটা কেটেছে আমার। ‘বিশ বছর আগে যে ছেলেটি প্রেতাত্মা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, সে-ই অভিনয় করে গেল একটু আগে।’

‘আবার ঠাট্টা?’

‘না, ম্যাডাম,’ বলল কিশোর। ‘মিথ্যে বলেনি শ্যারন। মেক-আপ নেয়ার পর বেরিয়ে আসব, এমন সময় দরজা আটকে দিল কে যেন। কানের কাছে ফিফিস্ করে যেন বলল কেউ, ‘তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম, ওই গর্ত দিয়ে পড়ে মারা যেতে তুমি আজ।’ তারপর থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করেছি। দড়াম দড়াম করে আওয়াজ করেছি। মিনিট পাঁচেক আগে দরজাটা খুলেছে রবিন আর মুসা।’

অবিশ্বাস ভরা চোখে ম্যাডাম চেয়ে আছেন কিশোরের দিকে। মূর্তির মত গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কথা যোগাচ্ছে না মুখে।

কী বলবেন তিনি?

আবারও ম্যাডাম উঁকি দিলেন নীচে। তিন ফুট নীচে লিফটটা থাকার কথা। কোথায় ওটা? প্রেতাত্মা হয়ে মঞ্চে উদয়ের আগে লাফ দিয়ে ওখানে নামার কথা ছিল কিশোরের। যদি লাফ দিত!

উঁকি দিলাম আমিও, যেখান দিয়ে একটু আগে লাফ দিয়েছে দীর্ঘদিনের এক অতৃপ্ত প্রেতাত্মা, পরম তৃপ্তি নিয়ে। নিজের অজান্তে কাঁটা দিল আমার শরীর।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *