ড্রাকুলার কফিন – তিন গোয়েন্দা

ড্রাকুলার কফিন – শামসুদ্দীন নওয়াব

প্রথম প্রকাশ: ২০১১

এক

মিসেস হকিন্স প্রথম যখন গ্রীনহিলস স্কুলে এলেন এ গল্প তখনকার। তিনি কেন এবং কীভাবে এখানে এলেন এ কাহিনি তারই।

.

‘বেচারী মিসেস ডিডির জন্যে খারাপ লাগে,’ বলল মুসা। ক্লাসের আরও কয়েকজন সায় দিল ওর কথায়।

‘তিনি তাঁর যা প্রাপ্য পেয়েছেন,’ বলল রিকি স্পেন্সার। ক্লাসের সবচাইতে দুষ্টু ছেলে।

মুসা রিকির দিকে ফিরল।

‘তুমি ওরকম না করলেই পারতে। একটু ভদ্র ব্যবহার করলে ওঁর মাথাটা বিগড়াত না।’

‘দোষটা আমার নয়,’ বলল রিকি। ক্লাসের কেউই তাঁর সাথে ভদ্র ব্যবহার করেনি।’

কথাটা সত্যি। ফোর্থ গ্রেডে একজনও নির্দোষ ছাত্র-ছাত্রী নেই। প্রত্যেকে জোরে জোরে কথা বলে কিংবা কাগজের গোলা ছুঁড়ে খেপিয়ে তুলেছিল টিচারকে। শেষমেশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ভদ্রমহিলা, যখন তাঁর ডেস্কের টপ ড্রয়ার ভর্তি শেভিং ফোম পান।

.

পেন্সিলের খোঁজে হাত ঢুকিয়েছিলেন ড্রয়ারে। ফলে হাতে মেখে যায় মিণ্ট-গন্ধী শেভিং ফোম।

‘এসব আর সহ্য করতে পারছি না আমি!’ চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। ফোমমাখা হাত তুলে কামরার চারপাশে নজর বুলান তিনি। চোখে ফুটে ওঠে বুনো দৃষ্টি।

‘কাজটা কে করেছে জানি না, কিন্তু এর জন্যে একদিন পস্তাতে হবে তোমাদের। তোমরা আমার সাথে যা করেছ, কেউ না কেউ একদিন এ ধরনের কাজ তোমাদের সাথেও করবে!’ তারপর পাগলাটে হাসি হেসে উঠে ক্লাস ত্যাগ করেন তিনি।

.

ফোর্থ গ্রেডের কেউ আর কখনও মিসেস ডিডিকে দেখেনি। শোনা গেছে, তিনি নাকি আলাস্কার দূরতম কোণে ছোট্ট এক শহরে চলে গেছেন।

আজকে ক্লাসে নতুন টিচার আসবেন। কেউই তাঁকে এখন পর্যন্ত দেখেনি এবং সবাই কম-বেশি উদ্বিগ্ন।

‘যদি কুস্তিগীর আসে?’ বলল মুসা। ‘আমার কাজিনদের টিচার চলে যাওয়ার পর নতুন টিচার হিসেবে একজন কুস্তিগীর এসেছে।’

‘ঠাট্টা কোরো না, মুসা,’ হেসে উঠল রবিন। ‘কুস্তিগীররা টিচিং করে না!’

‘মোটেই ঠাট্টা করছি না। তার ওজন অন্তত তিনশো পাউণ্ড। হাতের মাল্ তো নয় যেন তরমুজ। হুমকি দিয়েছে কেউ দুষ্টামি করলে পেন্সিল বক্সের ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে দেবে।’

‘রেখেছে?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘না। রাখতে হয়নি। সবাই এমনিতেই সিধে হয়ে গেছে,’ জানাল মুসা। সবাই একমত হলো, মিসেস ডিডির বদলে কোন পুরুষ কুস্তিগীর এলে ব্যাপারটা খারাপই হবে।

এসময় কিশোর কথা বলে উঠল 1

‘কে যে আসবে আল্লাহই জানে।’

‘ভয় পেয়ো না, সগর্বে বলল রিকি। ‘যে-ই আসুক আমি ঠাণ্ডা করে ফেলব—এমনকী কুস্তিগীর হলেও!’

হল-এ পায়ের শব্দ উঠলে সবাই তড়িঘড়ি যার যার সিটে গিয়ে বসে পড়ল। পদশব্দ ক্লাসরুমের বাইরে থেমে গেলে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল ক্লাসের মধ্যে। ডোরনব ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকলে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে গভীর শ্বাস টানল।

দুই

ওদের প্রিন্সিপাল মি. ডেনিস সুন্দরী এক মহিলাকে নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকলেন।

‘গুড মর্নিং, স্টুডেন্টস,’ বললেন প্রিন্সিপাল। মি. ডেনিসকে দেখতে হাম্পটি ডাম্পটির মত। চোখে চশমা, মাথাজোড়া টাক। ‘তোমাদের নতুন টিচার মিসেস হকিন্সের সাথে পরিচিত হও।’

মিসেস হকিন্স ক্লাসের উদ্দেশে মৃদু হেসে অদ্ভুত উচ্চারণে বললেন, ‘তোমাদের এখানে আসতে পেরে আমি খুবই খুশি। আমি নিশ্চিত সারাটা বছর একসাথে আমাদের ভাল কাটবে।’

নতুন টিচারের অদ্ভুত বাচনভঙ্গি শুনে পিছন দিকের কয়েকটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। কড়া চোখে ওদের দিকে চাইলেন মি. ডেনিস।

‘কেউ যদি আপনাকে বিরক্ত করে তা হলে আমাকে জানাবেন, মিসেস হকিন্স,’ বললেন তিনি।

ধন্যবাদ, মিস্টার ডেনিস। আমি জানি কোন অসুবিধে হবে না,’ আধো হাসি হেসে বললেন মিসেস হকিন্স।

দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রিন্সিপাল। বাইশটা ছেলে- মেয়ে চাইল মিসেস হকিন্সের দিকে। মহিলা খাটো। লম্বা, লাল চুল পিছনে টেনে বেগুনী এক ব্যারেট দিয়ে বাঁধা। পরনে সাদা ব্লাউজ, উঁচু কলার। গলায় সবুজ এক লকেট। জিনিসটা যেন দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কালো স্কার্টটা কালো, চোখা, ফিতে বাঁধা জুতোর ডগা ছুঁয়েছে।

সবাই চেয়ে রয়েছে তাঁর দিকে, তিনি কামরার চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। কয়েকজন চিউইংগাম চিবোচ্ছিল। সবাই গা এলিয়ে বসে রয়েছে চেয়ারে। হোঁতকা ম্যাকনামারা নাক খুঁটছে। পিছনের আসনের এক মেয়ে লম্বা, সোনালী চুল আঁচড়াচ্ছে। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে আলগা কাগজ আর বই।

মিসেস হকিন্স গলা খাঁকরে নিয়ে কথা বললেন।

‘আমি এখন তোমাদের টিচার। আমরা গ্রাউণ্ড ওয়র্ক দিয়ে শুরু করব। তোমাদেরকে কয়েকটা নিয়ম মেনে চলতে হবে।’

ক্লাসের কয়েকজন ছেলে-মেয়ে গুঙিয়ে উঠল

‘ভয় পেয়ো না। এগুলো কঠিন নিয়ম নয়। তোমরা হয়তো ইতিমধ্যেই এগুলো ফলো করছ। আমরা সবচাইতে জরুরীগুলো দিয়ে শুরু করব।’ কথা কটা বলে মিসেস হকিন্স বোর্ডে তিনটে নিয়ম লিখে দিলেন।

১. টিচার ও সহপাঠীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার।

২. যথাসময়ে কথা।

৩. হাঁটা।

বাতাসে হাত নাড়ল রিকি।

‘আমরা যদি এগুলো না মানি? কী হবে?’ প্রশ্ন করল।

মিসেস হকিন্স মুচকি হাসলেন। সবুজ চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল তাঁর।

‘সেটা যেন তোমাদের জানতে না হয়।’

মিসেস হকিন্স এবার ক্লাসের কাজ শুরু করলেন। মি. ডেনিসের সাবধানবাণী মনে ছিল সবারই, ফলে সকালটা নির্বিঘ্নে কেটে গেল। মিসেস হকিন্সকে বেশ মজার মানুষ বলেই মনে হলো। তিনি এমনকী ওদেরকে নিজের দেশের কথাও বললেন।

মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন তিনি।

‘আমি রোমানিয়া থেকে এসেছি,’ একটা গ্লোব তুলে নিয়ে ঘুরালেন। ওদেরকে দেখালেন রোমানিয়া কোথায়।

‘হকিন্স নামটা তো রোমানিয়ার নাম বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল, কিশোর।

মিসেস হকিন্স ওর উদ্দেশে চোখজোড়া ঝলসালেন।

‘আমার আসল নাম উচ্চারণ করা কঠিন। তাই আমেরিকা এসে নামটা পাল্টে নিয়েছি।’

সবাই ঝুঁকে পড়ল তাঁর কথা শুনতে। এমনকী রিকি, যে সবসময় ভাব দেখায় ক্লাসে মন দিচ্ছে না, সে-ও কনুইতে ভর দিয়ে উৎকর্ণ হলো।

‘রাশিয়া আর কৃষ্ণসাগরের পাশে ছোট এক দেশ রোমানিয়া। আমি ট্রানসিলভেনিয়ান আল্পসের পাদদেশে আমাদের পারিবারিক বাড়িতে বড় হয়েছি। চমৎকার জীবন ছিল সেটা যদ্দিন না…’

‘যদ্দিন না কী?’ বলে উঠল মুসা।

ঝলসে উঠল মিসেস হকিন্সের চোখ দুটি।

‘যদ্দিন না আমার পরিবার রোমানিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়।’

‘বাধ্য হলো কেন?’ রবিনের প্রশ্ন।

লকেটটা স্পর্শ করলেন মিসেস হকিন্স।

‘সেটা জরুরী কিছু না,’ আধো হেসে বললেন। এবার রিসেসের জন্য ক্লাস ডিসমিস করে দিলেন।

তিন

খেলার মাঠে, গাছের নীচে জড় হলো ফোর্থ গ্রেডাররা। গাছটার ডাল- পালাগুলো ওদের মাথার উপরে তাঁবুর মত ঝুলে রয়েছে। সোনালী পাতা ভেদ করে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

‘মহিলা কিন্তু অদ্ভুত,’ বলল মুসা। ‘আধো হাসিটা দেখেছ?’

‘উনি ভাল মানুষ বলেই হাসেন, বলল কিশোর। ‘আর ওঁর উচ্চারণ ভঙ্গিও চমৎকার।’

‘আমার কাছে ওঁর উচ্চারণ আজব মনে হয়েছে,’ বলল রবিন। ‘আর রোমানিয়ার গল্পটা কেমন লাগল?’

জুলি মাথা নাড়ল।

‘পরিবারটাকে দেশ ছাড়তে হলো কেন? ওরা ক্রিমিনাল নয় তো?’

মুসার চোখ বিস্ফারিত।

‘খাইছে, ওরা হয়তো রত্নচোর। সবুজ লকেটটা মনে হয় চোরাই মাল। মহিলা কীভাবে ওটাকে ঘষে খেয়াল করেছ?’

রিকি বাঁকা হাসল।

‘হ্যাঁ, উনি খুনীও হতে পারেন। হয়তো, আগের ক্লাসের সব ছেলে-মেয়েদেরকে খুন করে এসেছেন!’

ওকে ঠেলা দিল রবিন।

‘ঠাট্টা কোরো না। মিসেস হকিন্সের সাথে আমরা কেমন ব্যবহার করব ঠিক করতে হবে।’

চোখ ঘুরাল রিকি।

‘আমার ধারণা মিসেস হকিন্স অন্যদের মতই সাধারণ এক টিচার। খুব সহজেই আমরা ওঁকে ম্যানেজ করে ফেলতে পারব!’

‘তোমার কেন মনে হলো একথা?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

ওক গাছটার রুক্ষ গুঁড়িতে হেলান দিয়ে একে একে সবার চোখের দিকে চাইল রিকি।

‘লক্ষ করনি উনি আজকে একবারও গলা চড়াননি! নিয়মগুলোও উনি ফোর্স করতে পারবেন না। শুধু বোকার মত হাসলেই হলো?’ বলল ও।

‘তা হলে কী করবে ভাবছ?’ মুসার জিজ্ঞাসা।

‘সহজ, বলল রিকি। ‘একেও আমরা মিসেস ডিডির মতন খসিয়ে ফেলব।’

সবাই ওর দিকে চাইল।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন 1

‘না, রিকি, তুমি এবার ভুল করছ। কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে চমক অপেক্ষা করছে!’

পরে, বাড়ি ফেরার পথে ফরেস্ট লেনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল রিকি, মুসা, রবিন আর ফোর্থ গ্রেডের কয়েকটা ছেলে-মেয়ে।

‘খাইছে, কে যেন কাসলার এস্টেটে উঠছে। আমাকে দশ লাখ ডলার দিলেও আমি, বাবা, ওখানে উঠব না!’ শিউরে উঠে বলল মুসা।

‘জায়গাটা ভুতুড়ে,’ বলল রিকি। ‘হানাবাড়ি।’

মাথা নাড়ল মুসা।

‘কেউ ওখানে থাকবে বিশ্বাস করা যায় না। নিশ্চয়ই পাগল-টাগল হবে।’

এসময় পিছন থেকে একটি কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠল পুরো দল।

‘গুড আফটারনুন, বাছারা। আমার নতুন বাসা কেমন দেখছ?’

সবাই ঘুরে দাঁড়াল। মিসেস হকিন্স ওদের দিকে চেয়ে আধো হাসলেন।

‘আপনি এখানে থাকবেন?’ রবিন জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, সুন্দর না বাড়িটা? ভেতরে চলো না, ঘুরে দেখবে,’ বললেন মিসেস হকিন্স।

‘খাইছে, ধন্যবাদ,’ ঝটপট বলল মুসা। ‘আমাকে বাড়ি যেতে হবে। হোমওয়র্ক করব।’

‘বোকার মত কথা বোলো না। আমি আজকে তোমাদের কোন হোমওয়র্ক দিইনি।’ বলে রিকি আর মুসার হাত ধরে ভারী কাঠের দরজার দিকে আলতোভাবে টেনে নিয়ে গেলেন নতুন টিচার। অন্যরা তড়িঘড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়াল। হঠাৎই যেন মায়ের ডাক শুনতে পেয়েছে ওরা।

‘মানুষের সঙ্গ ভাল লাগে আমার। মাঝে মাঝে ভীষণ একা লাগে,’ বললেন মিসেস হকিন্স। দু’জন লোককে যাওয়ার জায়গা দিতে পথ থেকে সরে গেলেন।

‘আপনি কি একা থাকেন, মিসেস হকিন্স?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। মুচকি হাসলেন মিসেস হকিন্স। লোক দুটো লম্বা একটা কাঠের বাক্স বয়ে বেসমেন্টের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল।

‘ঠিক একা নয়, তবে বেশিরভাগ সময় নীরবে কেটে যায়, কথা বলার মত কাউকে পাই না।’

প্রকাণ্ড বাড়িটার ফ্রণ্ট হল-এ অনিচ্ছুক ছেলে দুটিকে টেনে নিয়ে গেলেন টিচার। উঁচু ছাদ থেকে ঝুলছে মাকড়সার ঝুলমাখা এক ড্রাকুলার কফিন ঝাড়বাতি। ধুলোটে, রক্ত লাল কার্পেটের সঙ্গে নেমে এসে মিশেছে বাঁকা এক কাঠের সিঁড়ি। দেয়ালে ঝুলছে মাকড়সার ঝুল। বাতাসে ধুলোময়, ভাপসা গন্ধ।

‘সুন্দর না?’ প্রশ্ন করলেন মিসেস হকিন্স। ‘জানি সাজাতে- গোছাতে হবে, তবে তারপর এর চেহারা খুলে যাবে।’

‘উম, হ্যাঁ, সুন্দর,’ মিথ্যে বলল মুসা।

‘অন্য ঘরগুলো দেখবে না?’ মিসেস হকিন্স বললেন।

‘পরে দেখব না হয়,’ রিকি ঝটপট বলল। ‘আপনি এখন হয়তো গোছগাছ করবেন। কালকে দেখা হবে, মিসেস হকিন্স।’ বলেই মুসার বাহু চেপে ধরে দরজা দিয়ে টেনে বের করে আনল রিকি।

ওরা রাস্তার ওপাশে পৌঁছনোর পর কড়া চোখে রিকির দিকে চাইল মুসা।

‘বলেছিলাম না মিসেস হকিন্স আজব ধরনের মানুষ? এবার বিশ্বাস হলো?’

‘মানলাম উনি থাকার জন্যে উদ্ভট একটা জায়গা বেছে নিয়েছেন, কিন্তু তার মানে এই না যে উনি অদ্ভুত ধরনের মানুষ, বলল রিকি।

‘খাইছে, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওঁর ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকা দরকার,’ বলল মুসা।

চার

পরদিন ক্লাসে আসতে দেরি করলেন মিসেস হকিন্স। ছেলে-মেয়েরা সিটে বসে উদ্বেগের সঙ্গে ওঁর পদশব্দের অপেক্ষায় রইল।

‘উনি হয়তো চলে গেছেন,’ বাতলে দিল কিশোর।

‘কেন যাবেন?’ প্রশ্ন করল রিকি। ‘এখানে এসেছেন মাত্র এক দিন হয়। এখনও তো আমাদের খেলা শুরু হয়নি!’

‘উনি যাবেন না,’ ফিসফিস করে বলল রবিন। ওঁকে আমরা কালকে কাসলার হাউসে উঠতে দেখেছি!’

‘বলো কী? কাসলার হাউস!’ কয়েকটি ছেলে-মেয়ে আঁতকে উঠল।

‘জায়গাটা চিরদিন খালি দেখে আসছি,’ বলল জুলি। ‘শুনেছি বাড়িটা ভুতুড়ে।’

‘ওঁকে হয়তো ভূতে খেয়ে ফেলেছে,’ বলল ম্যাকনামারা। ‘কিংবা হয়তো ভ্যাম্পায়ার কামড়ে দিয়েছে!’

‘ঠিক বলেছ!’ বলে উঠল মুসা। ‘কালকে লেবারদেরকে বেসমেন্টে একটা বাক্স ঢুকাতে দেখেছি।’

‘তো!’ একসঙ্গে কয়েকজন প্রশ্ন করল।

‘তো…বাক্সটা ছিল লম্বা-পাতলা-অনেকটা কফিনের মতন!’

‘উনি নাকি ট্রানসিলভেনিয়া থেকে এসেছেন,’ বলল রবিন। ‘কাউন্ট ড্রাকুলা ওখানেই থাকত না?’

এসময় ডোরনব ধীরে ধীরে মোচড় খেলে কামরার মধ্যে ভৌতিক নিস্তব্ধতা নেমে এল। মিসেস হকিন্স ঘরে প্রবেশ করলেন। মুহূর্তে সবাই মনোযোগী হলো।

‘গুড মর্নিং, ক্লাস,’ তাঁর বিজাতীয় উচ্চারণে বললেন মিসেস হকিন্স। ‘দেরি হলো বলে দুঃখিত। আসলে কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি আমার।’

চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মুসার। আর চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের।

‘খাইছে, ভ্যাম্পায়াররা রাতে ঘুমায় না,’ ফিসফিস করে কিশোরকে বলল মুসা।

কিশোর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ভ্যাম্পায়াররা পোলকা ডটস পরে না।’

সবাই চাইল টিচারের দিকে। কথাটা সত্যি। আজকে ওঁকে দেখে মোটেই ভ্যাম্পায়ার মনে হচ্ছে না। গোলাপী-সবুজ পোলকা ডটেড ড্রেস তাঁর পরনে। লাল চুলে বাঁধা উজ্জ্বল সবুজ এক রিবন। নখে সবুজ নেলপলিশ। গলায় সবুজ লকেট।

‘আমরা এবার পড়ায় মন দিই,’ প্রস্তাব করলেন মিসেস হকিন্স। ‘বীজগণিত দিয়ে শুরু করা যাক।’

বই খুলল সবাই। টিচার বোর্ডে চক দিয়ে লেখা শুরু করলে ঘরে পিন পতন নীরবতা নেমে এল। সহপাঠীদের দিকে চাইল রিকি সবাই নিশ্চুপ। অসহ্য লেগে উঠল ওর।

ম্যাথ পেপার মুচড়াতে লাগল রিকি। খসখসে শব্দটা নীরবতা ভঙ্গ করল। কেউ-কেউ শ্বাস চেপে রিকির দিকে চাইল। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা গেল না মিসেস হকিন্সের মধ্যে।

ঠুক-ঠুক-ঠুক। ডেস্কে পেন্সিল ঠুকল রিকি। মিসেস হকিন্স ফিরেও তাকালেন না। বোর্ডে আরেকটি প্রবলেম লিখলেন।

এবার শিস দিতে শুরু করল রিকি। ওর আশপাশের ছেলে- মেয়েরা ভয়ে মাথা নোয়াল, কিন্তু খেয়াল করলেন না মিসেস হকিন্স। তিন মিনিট কেটে গেল। পাত্তাই দিলেন না টিচার। অপমানিত বোধ করল রিকি। অবহেলা সইতে পারে না সে, বিশেষ করে টিচারদের।

এবার ম্যাথ বইটা শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল রিকি।

থপাস!

সবাই চমকে উঠল, কিন্তু মিসেস হকিন্স নির্বিকার। বোর্ডে ব্যস্ত তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নখ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে আঁচড় কাটতে লাগলেন। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নেমে গেল রিকির।

ঘুরে দাঁড়ালেন মিসেস হকিন্স। একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন রিকির দিকে। এবার ফিসফিসে স্বরে, অদ্ভুত উচ্চারণে বললেন, ‘অনেক হয়েছে, আর না।’

পাঁচ

ক্লাসের সবাই যেন ভাল হয়ে গেছে। হৈ-চৈ নেই, কাগজ ছোড়াছুঁড়ি নেই। ব্যাপারটা ভাল লাগছে না রিকির। গোলমাল না করলে পেটের ভাত হজম হয় না ওর।

ঝুঁকে পড়ে রবিনকে খোঁচা মারল ও।

‘শশশ!’ ওকে কথা বলতে দিল না রবিন।

বিরক্তি বোধ করল রিকি। সবাইকে যেন বশ করে ফেলেছেন মিসেস হকিন্স।

রিয়ার পিগটেইল ধরে টানল রিকি।

‘আমি কিন্তু মিসেস হকিন্সকে বলে দেব,’ বলল মেয়েটা।

‘বলো না, কে কেয়ার করে,’ বলল রিকি।

এবার ক্লাসের সামনে হেঁটে গিয়ে কোমর দোলাল রিকি। দু’তিনটে মেয়ে হেসে উঠল। এতে খুশি হতে পারল না ও।

নতুন বুদ্ধি খেলল ওর মাথায়। হাত থেকে পেন্সিল ফেলে দিয়ে গোটা ক্লাসরুমে গুড়ি মেরে খুঁজতে লাগল। অন্ধের মত বাড়ি খেতে লাগল চেয়ারে। সবাই লক্ষ করছে ওকে। কেউ কেউ হাসছে। বেশ মজা পাচ্ছিল রিকি, যতক্ষণ না ওর কাঁধে কারও হাত পড়ল।

নখে সবুজ নেলপলিশ, কাঁধে চাপ দিয়ে ওকে মেঝে থেকে তুলল হাতটা। সরাসরি মিসেস হকিন্সের চোখের দিকে চেয়ে রইল রিকি। ঝিক করে উঠল টিচারের সবুজ চোখজোড়া।

‘অনেক হয়েছে,’ নরম কণ্ঠে বললেন তিনি।

ছয়

দিনের বাকি সময়টুকু শান্ত থাকল রিকি। মিসেস হকিন্সকে আর ঘাঁটাল না। ক্লাসের বাদবাকিরাও একটা চোখ রাখল নতুন টিচারের উপরে। অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে তাঁর মধ্যে। সবাই দেখেছে রিকির উদ্দেশে কীভাবে ঝিকিয়ে উঠেছিল তাঁর চোখজোড়া।

শেষমেশ বেল বাজলে স্বভাবসিদ্ধ আধো হাসিটা হাসলেন মিসেস হকিন্স।

‘আজকের মত ছুটি,’ বললেন।

কিশোর হাত তুলল।

‘হোমওয়র্ক দেবেন না, মিসেস হকিন্স?’

কারও মুখে টু শব্দটি নেই। ক্লাসের দিকে চাইলেন টিচার। জবাব শোনার অপেক্ষায় সবাই সিধে হয়ে বসে।

‘আজকের জন্যে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। আর কোন হোমওয়র্কের দরকার নেই। তোমরা এখন যেতে পারো।’

কয়েকজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, কিন্তু বিল্ডিং ত্যাগের আগে কেউ আর মুখ খুলল না।

বাইরে বেরিয়ে খেলার মাঠে জড় হলো ওরা। কয়েকটা ঝরা পাতা মুড়-মুড় করে ভাঙল ওদের পায়ের নীচে।

‘মহিলা সত্যিই অদ্ভুত,’ বলল মুসা। ‘খাইছে, যেভাবে রিকির দিকে তাকাল বাপরে বাপ। মহিলা সমস্যা করবে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল নথি।

‘আমিও তাই মনে করি।’

‘তোমরা কী নিয়ে কথা বলছ? মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে গেছ!’ বলল রিকি।

‘তুমিও তো আজকে ভয় পেয়েছ!’ বলল রবিন।

‘প্রশ্নই ওঠে না। কোন টিচার আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না!’ জোর গলায় ঘোষণা করল রিকি।

‘ভয় না পেলে দুষ্টামি বন্ধ করলে কেন?’ মুসা জবাব চাইল।

‘উনি তোমার কাঁধে হাত রাখলে চেহারা সাদা হয়ে গেল কেন?’ রবিনের জিজ্ঞাসা।

‘আমি ভয় পাইনি। স্রেফ শরীরটা খারাপ লাগছিল। মনে হয় জ্বর আসবে,’ বলল রিকি।

মুসা ঘাসের উপর বসে হেসে ফেলল।

‘তুমি ভূত দেখার মত ভয় পেয়েছিলে, রিকি।’

মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল রিকির।

‘মোটেই না. এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দেব!’

সবাই ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

‘যা বলছ জেনে বুঝে বলছ তো?’ কিশোর প্রশ্ন করল।

‘আমি তোমাদের মত ডরপুক নই এবং আমি তার প্রমাণ দেব। কী ভাবে প্রমাণ চাও বলো!’ বলল রিকি।

রবিন সবার আগে কথা বলল। সাবধানে শব্দ চয়ন করল ও।

‘ওঁর বেসমেন্টে যে কালো বাক্সটা আছে তার মধ্যে কী আছে জানতে হবে তোমাকে। তা হলেই আমরা বিশ্বাস করব তুমি চাপাবাজি করছ না।’

সবাই চাইল রবিনের দিকে।

‘তুমি কি পাগল হয়েছ, রবিন?’ বলল কিশোর।

‘বাক্সের ভেতরে কী আছে জানতে হলে ওকে ওঁর বেসমেন্টে চুরি করে ঢুকতে হবে।’

‘দেখা যাক না ওর সাহসে কুলোয় কি না,’ বলল নথি

‘আমি চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি। ওই বাক্সের ভিতরে কী আছে জেনে আসব আমি,’ বলল রিকি।

চিন্তিত চোখে ওর দিকে চাইল মুসা।

‘তুমি যে কাজটা করেছ আমরা জানব কীভাবে?’

‘তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো না?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রিকি।

‘না, কেউ করে না,’ বলল মুসা।

‘সেক্ষেত্রে তোমরাও আমার সাথে যেতে পারো। তা হলেই

বুঝতে পারবে মিথ্যে বলছি কিনা! নাকি ভয় পাচ্ছ?’

কটমট করে রিকির দিকে চাইল মুসা।

‘ঠিক আছে, আজ রাতেই যাব।’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল হন হন করে।

সাত

সে রাতে রিকি বাড়ি থেকে আলগোছে বেরিয়ে এসে মুসার সঙ্গে মিলিত হলো কাসলার হাউসের সামনে।

‘কোথায় ছিলে তুমি?’ হিসিয়ে উঠল মুসা। ‘তোমার জন্য দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি!’

‘বাবা না ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। যাকগে, ফ্ল্যাশলাইট এনেছ?’

কোটের পকেটে ফুলে রয়েছে, হাত চাপড়াল মুসা।

‘এখানে আছে। চলো।’

রিকি টার্টলনেক টেনে তুলল গলা অবধি। প্রাচীন বাড়িটার দিকে মুখ তুলে চাইল ও। বেশির ভাগ শাটার নেই এবং প্রতিটা জানালা অন্ধকার। রাস্তার আলো ছায়া ফেলেছে বাড়িটার উপরে। আলো ঘিরে বাদুড় উড়তে দেখল রিকি। দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল, ‘আমি রেডি!’

সন্তর্পণে বেসমেন্টের দরজার কাছে চলে এল ওরা। দরজার একটা কাঁচের শার্সি ফাটা এবং আরেকটা পুরোপুরি ভাঙা। ভাঙা জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে দরজা খুলল রিকি। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেলে জমে গেল ওরা, কিন্তু বাকি বাড়ি নিথর।

ফ্ল্যাশলাইট বের করতে গিয়ে কেঁপে গেল মুসার হাত। ‘কাজটা ঝটপট সেরে ফেলা যাক,’ ফিসফিস করে বলল। ‘এখানে এলেই ভয় করে আমার।’

ঠিক আছে, তুমি আগে যাও। তোমার কাছে ফ্ল্যাশলাইট আছে,’ বলল রিকি।

‘এই নাও ধরো,’ বলে ফ্ল্যাশলাইটটা রিকির বুকে ঠেসে ধরল মুসা।

‘ধন্যবাদ,’ বলল রিকি। বেসমেন্টে চলে-যাওয়া অন্ধকার গতটায় আলো ফেলল ও। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় মুখে পরশ বুলাল মাকড়সার জাল।

‘কী বিশ্রী গন্ধ, বাপ রে!’ অভিযোগ করল মুসা।

‘হয়তো লাশ-টাশ আছে,’ বলল রিকি 1

‘ঠাট্টা কোরো না।’

‘করছি না, আমি সিরিয়াস।’

ধুলোটে বেসমেন্টের চারপাশে আলো বুলাল রিকি। ভেজা মেঝেতে ডাঁই হয়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ার আর কার্ডবোর্ডের বাক্স। দূর কোণে রাখা কাঠের লম্বা বাক্সটা।

‘ওই যে,’ ফিসফিস করে বলল রিকি।

‘ওটা কি সত্যিই কফিন?’

‘হতে পারে। সত্যিই দেখতে চাও?’ প্রশ্ন করল রিকি।

‘ভয় পাচ্ছ?’

‘আমি না! তুমি পাচ্ছ কিনা জানতে চাইছি,’ বলল রিকি।

‘আমি ভীতু নই, রিকি,’ বলল মুসা।

‘আমিও না!’ রিকি জঞ্জালের পাশ দিয়ে পথ করে নিয়ে বাক্সের কাছে চলে এল। নিঃশব্দে অনুসরণ করল মুসা। বাক্সটার দিকে চাইল ওরা। পূর্ণবয়স্ক এক লোক শুয়ে থাকার মত লম্বা।

‘কে খুলবে?’ প্রশ্ন করল রিকি

‘একসাথে খুলব, জানাল মুসা।

ঢাকনায় হাত রেখে তুলতে চেষ্টা করল ওরা।

‘খুলছে না,’ বলল মুসা।

‘মনে হয় লক করা,’ ঢাকনার মধ্যে ল্যাচ খুঁজল রিকি। ‘লক

দেখতে পাচ্ছি না। ‘

কোনার দিকে হাত বুলিয়ে ল্যাচ খুঁজল মুসা।

‘আমিও না। ভিতর থেকে বন্ধ না তো?’

‘বোকার মত কথা বোলো না। ভিতর থেকে লড্ হবে কীভাবে? যদি না…’

‘যদি না ভিতরে কেউ থাকে,’ বাক্যটা শেষ করল মুসা। ড্রাকুলার কফিন

পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল ওরা। এবার বাক্সটার দিকে চাইল। কারও মুখে কথা নেই। ভুতুড়ে নিস্তব্ধতায় ধুপ করে একটা শব্দ হলো।

‘কীসের শব্দ?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘শশশ! জানি না। কিন্তু যা-ই হোক, শব্দটা ভাল না!’

‘কোত্থেকে এল?’ মুসার জিজ্ঞাসা।

‘মনে হয় বাক্সটা থেকে,’ সভয়ে বলল রিকি।

‘এখান থেকে পালাই চলো। নইলে ভ্যাম্পায়ারের কামড় খেতে হবে।’ রিকির হাত চেপে ধরে দরজার দিকে টানল মুসা। ভাঙা ফার্নিচার এড়িয়ে, বাক্সের উপর দিয়ে লাফিয়ে, উড়ে পার হলো সিঁড়ির ধাপগুলো। দরজা বন্ধ করার ধার ধারল না। এক দৌড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

নিরাপদে রাস্তার ওপাশে পৌছে, দম ফিরে পেতে থমকে দাঁড়াল ওরা।

‘দেখো!’ কাসলার হাউসের দিকে তর্জনী তাক করল রিকি। উপরতলার এক জানালায় আলো জ্বলে উঠেছে। এক ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিল ওরা। বাড়িতে একের পর এক বাতি জ্বলতে দেখল। ভুতুড়ে চেহারার এক মহিলা ফ্রন্ট ডোর খুলে ওদের গুপ্তস্থানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল। ওদের কল্পনা-নাকি সত্যি সত্যি রাতের আঁধারে সবুজ কোন জিনিস চমকাতে দেখল ওরা?

আট

‘কী ছিল বাক্সের ভিতরে?’ প্রশ্ন করল কিশোর।

‘মৃতদেহ?’ রবিন মন্তব্য করল।

‘নাকি ভ্যাম্পায়ার?’ জ্বলির জিজ্ঞাসা।

খেলার মাঠে জড় হয়েছে ওরা। স্কুল বসতে এখনও প্রায় পনেরো মিনিট বাকি। মাটিতে তুষারের স্তর। ছেলে-মেয়েদের মুখে হুল ফুটাচ্ছে ঠাণ্ডা বাতাস।

পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল রিকি আর মুসা। নার্ভাস। বন্ধুদেরকে কী বলবে ঠিক করতে পারেনি ওরা।

‘ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে,’ শেষমেশ বলল রবিন। ‘দেখো, কিছুই বলতে পারছে না।’

‘আমার মনে হয় যায়ইনি,’ বলল জুলি।

‘গেছিলাম। ওঁর বেসমেন্টে ঢুকেছিলাম আমরা,’ জোর গলায় জানাল মুসা।

‘আমরা কাপুরুষ নই!’ যোগ করল রিকি।

‘তা হলে কী দেখেছ বলছ না কেন?’ দাবি করল নথি।

তালা বন্ধ বাক্স, ভিতরে ধুপ করে শব্দ হওয়া সবই খুলে বলল রিকি।

‘শব্দটা হওয়ার পর ভাবলাম ওখানে আর থাকা ঠিক হবে না,’

বলল ও।

‘তারমানে মিসেস হকিন্স ভ্যাম্পায়ার। উনি ওটার ভিতরেই রাতে ঘুমান,’ বলল জুলি। ভয়ে ফ্যাকাসে মুখের চেহারা।

‘মনে হয় না,’ বলল রিকি। ঝোপের আড়ালে লুকানোর পর উপরতলায় বাতি জ্বলা এবং মিসেস হকিন্সের দরজা খোলার কথা জানাল ও। ‘উনি ভ্যাম্পায়ার হলে উপরতলায় আলো জ্বালল কে?’

‘তা ছাড়া ভ্যাম্পায়াররা রাতে ঘুমায় না,’ বলল নথি। ছেলে-মেয়েরা গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।

‘ওঁর স্বামী হয়তো ভ্যাম্পায়ার। উনি হয়তো মাঝরাতের আগে বাক্স থেকে বেরোন না!’ বলল কিশোর।

‘খাইছে। আমার ধারণা ওঁর স্বামী কাউন্ট ড্রাকুলা, এবং ওঁকে বশ করে রেখেছেন।’ উত্তেজনায় প্রায় চেঁচাতে লাগল মুসা।

‘গুড মর্নিং, চিলড্রেন। এত হৈ-হল্লা কীসের?’ ওদের অজান্তেই কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন মিসেস হকিন্স। তাঁর পরনে কালো পোশাক, হাতে বাদুড় মার্কা ব্রেসলেট। গলায় আজব সেই ড্রাকুলার কফিন লকেট।

লজ্জা পেল মুসা।

‘তেমন কিছু না, মিসেস হকিন্স। কাল রাতে দেখা টিভি শো নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।’

‘আমি কখনওই টিভি দেখার সুযোগ পাই না। আমাকে অনেক কাজ করতে হয়,’ বললেন মিসেস হকিন্স। ‘এখুনি স্কুল বসবে। চলো- ভেতরে যাই।’ কিশোরকে পাশে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন তিনি।

‘আমি এর আগে কখনও বাদুড়মার্কা ব্রেসলেট দেখিনি,’ কিশোর বলল ওঁকে। ‘কোথায় পেয়েছেন এটা?’

‘আমার স্বামী দিয়েছিলেন।’

‘উনি এখন কোথায়?’

‘মারা গেছেন।’

‘ওহ, আমি দুঃখিত,’ বলল কিশোর।

‘না, ঠিক আছে। কখনও কখনও মনে হয় তিনি আমার সাথেই আছেন,’ খোশমেজাজে বললেন মিসেস হকিন্স।

সবাই চেয়ে রইল তাঁর দিকে। ওদের মনে হলো সন্দেহটা বুঝি সত্যি হতে চলেছে!

নয়

‘কালরাতে আমার বাসায় চোর ঢুকেছিল,’ ক্লাসে বললেন মিসেস হকিন্স। ‘তাই ভাল ঘুম হয়নি।’ কামরার চারধারে নজর বুলিয়ে নিলেন। সবুজ চোখজোড়া এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো মুসা আর রিকির উপর। এবার চোখের পাতা ফেলে হাসলেন তিনি। তবে কোন ক্ষতি হয়নি। কাজেই ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছি আমি। আশা করি এধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। এবার তোমরা ইংরেজি বই খোলো।’

মুসার হাত কাঁপছে, রিকির দিকে চাইল ও। রিকির দৃষ্টি বইয়ের উপর নিবদ্ধ। ঘরে পিন পতন নিস্তব্ধতা, মিসেস হকিন্স নাউন আর ভার্ব পড়াতে শুরু করলেন।

ঝটপট কেটে গেল বাকি সকালটা। দুপুর নাগাদ ফোর্থ গ্রেডাররা তাদের অ্যাসাইনমেন্টগুলো শেষ করে ফেলল। এরপর ক্যাফেটেরিয়াতে গেল ওরা।

‘আজকে কী হয়েছে তোমাদের?’ ফিফ্থ্ গ্রেডের জনি চড়া গলায় প্রশ্ন করল। ‘সবাই এত চুপচাপ!’

‘আস্তে কথা বলো। মিসেস হকিন্স শুনে ফেলবেন,’ বলল রবিন।

‘কী ব্যাপার? তোমরা কি টিচারের চামচা হয়ে গেছ নাকি?’

‘প্রশ্নই ওঠে না!’ হিসিয়ে উঠল রিকি।

‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে,’ খোঁচা মেরে বলল জনি। একটু পরে লাঞ্চ ট্রে খালি করার জন্য উঠে পড়ল ফোর্থ আর ফিফথ দুটো ক্লাসই।

ক্লাসে ফিরে চিন্তামগ্ন হলো রিকি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। টিচারের কথা শুনে চলার বান্দা নয় ও। ব্যাপারটাকে এখানেই থামাতে হবে। মিসেস হকিন্সকে বুঝিয়ে দিতে হবে কে বস।

দশ

কাজে নেমে পড়ল রিকি। টিচারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। বড় করে এক বাবুল ফোলাল ও। কিন্তু মিসেস হকিন্স খেয়াল করলেন না। পেপার গ্রেডিং করে চলেছেন একমনে।

রিকির বাবুল ফুলানো দেখে হেসে উঠল জুলি। গোলাপী, স্বচ্ছ বা ভেদ করে টিচারকে দেখতে পাচ্ছে রিকি।

এতক্ষণে দৃষ্টি পড়ল মিসেস হকিন্সের।

চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল তাঁর। সবুজ লকেটটা আলতোভাবে ঘষলেন। এবার ডান হাত তুলে তর্জনী তাক করলেন রিকির দিকে। পরমুহূর্তে, ফট্ করে ফেটে গেল বাটা। রিকির মুখে আর চুলে লেপ্টে গেল গোলাপী আঠা।

মিসেস হকিন্স আধো হাসিটা হেসে গ্রেডিং করে চললেন। ছেলে- মেয়েদের চোয়াল ঝুলে পড়ল। মিসেস হকিন্স চেয়ার ছেড়ে নড়েননি, অথচ ফাটিয়ে দিয়েছেন রিকির বাল্!

ভ্রূ থেকে আঠা ছাড়াচ্ছে রিকি, হেসে উঠল রবিন আর মুসা।

‘এত হাসির কী আছে?’ কানের ডগা থেকে আঠা খসিয়ে বলল রিকি।

রবিন ফের পড়ায় মন দিলেও মুসা হাসি থামাতে পারল না।

‘উনি এবার পেয়ে বসেছেন তোমাকে,’ বলল ও।

‘কী সব ফালতু কথা বলছ! ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয়!’ বলল রিকি।

মুসা মাথা নেড়ে পড়ায় মন দিল। বিশ্বাস করেনি রিকির কথা। নাক আর চিবুক থেকে আঠা তুলল রিকি। ঠিক করল বাড়ি ফিরে চুল কেটে বাকি আঠাটুকু ছাড়াবে।

এবার ডেস্কে তবলা বাজাতে শুরু করল ও। উল্টেপাল্টে ভেবে দেখছে কী ঘটেছে। ওর পরিকল্পনা খাটেনি। মিসেস হকিন্সকে উত্ত্যক্ত তো করতে পারেইনি, বরং সবার সামনে অপদস্থ হতে হয়েছে ওকে। এর বদলা নিতে হবে।

রিকি এরপর কী করবে তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে, মিসেস হকিন্স এসময় গলা খাঁকরালেন।

‘আমি তোমাদের কাজে খুশি হয়েছি। তাই ঠিক করেছি আমরা এখন ম্যাথ রিলে খেলব।’

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।

খেলা শুরু হলো। নিজের পালা আসেনি তবুও চিৎকার করে ভুল জবাব দিল রিকি। লাথি মারল একটা চেয়ারে। পাত্তাই দিল না টিচারকে।

মিসেস হকিন্স লকেট ঘষতে লাগলেন, যতক্ষণ না ওটা উজ্জ্বল সবুজ আভা ছড়াল।

‘যথেষ্ট হয়েছে,’ কঠোর গলায় বললেন তিনি।

রিকি এমন ভান করল যেন শুনতেই পায়নি, কিন্তু লকেটটা দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে ওর। মিসেস হকিন্স যতই ঘষছেন ততই দীপ্তি ছড়াচ্ছে ওটা। রিকি ওটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।

‘খেলা চলতে থাকুক,’ বললেন মিসেস হকিন্স। আর কেউ অভদ্রের মতন বাধা দিতে পারবে না।’

সবার দৃষ্টি এখন রিকির দিকে। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ও, চোখ মিসেস হকিন্সের সবুজ লকেটের উপর স্থির।

শেষমেশ, বেল বাজল। ক্লাসের সবাই সার বেঁধে দাঁড়ালে, মিসেস হকিন্স এগিয়ে এলেন রিকির কাছে। বাঁ হাতটা লকেটে রেখে, রিকির মুখের সামনে আঙুল ফুটালেন।

‘আমরা আর খেলব না?’ জোরে বলে উঠল রিকি।

এগারো

খেলার মাঠে জড় হলো ফোর্থ গ্রেডাররা।

‘খাইছে, মিসেস হকিন্স রিকির কী হাল করেছিলেন দেখেছ?’ বলে উঠল মুসা।

‘বিশ্বাসই হচ্ছিল না,’ বলল ডানা। ‘তুমি ঠিক আছ তো, রিকি?’

‘তোমরা এসব কী বলছ? উনি আমার কিছুই করেননি। আমি খুন করলেও ফিরে তাকাবেন না উনি,’ বলল রিকি।

‘রিকি, উনি তোমাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিলেন। আর তুমি সেটা টেরও পাওনি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

‘কীসব আবোল তাবোল বকছ? মিসেস হকিন্স কোন্ ছার? হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল? কালকে ওঁকে এমন শিক্ষা দেব যে জীবনেও ভুলবেন না।’

‘রিকি, তুমি কি পাগল হয়েছ?’ রবিন বলল। ‘মিসেস হকিন্স ডাইনী কিংবা ভ্যাম্পায়ার ধরনের কিছু। ওঁকে খেপিয়ে তুললে কী হবে ভাবতেও পারছ না তুমি।’

‘কী যা তা বলছ! কালকে দেখবে মিসেস হকিন্সের কী দশা করে ছাড়ি,’ বলল রিকি। ‘দেখবে ক্লাস থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে।’

রবিনের দিকে চাইল মুসা।

‘মিসেস হকিন্সের ব্যাপারে আমাদের কিছু একটা করা উচিত। উনি এভাবে কাউকে হিপনোটাইয করতে পারেন না।

‘হ্যাঁ, কিন্তু কাকে বলব? মিস্টার ডেনিস তো হেসে উড়িয়ে দেবেন,’ বলল নথি।

‘সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের ওপরই আস্থা রাখতে হবে,’ বলল মুসা।

‘ওঁর সাথে এঁটে উঠতে পারলে হয়,’ বলল রবিন।

‘আমিও তাই ভাবছি,’ সায় জানাল মুসা।

পরদিন মুসা আর রবিন খেলার মাঠে, গাছের নীচে দেখা করল। বুকব্যাগ থেকে বড়সড় এক বই বের করল রবিন।

‘কাল রাতে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে কী জোগাড় করেছি দেখো,’ একটা বই তুলে ধরল রবিন। বইটার নাম: ভ্যাম্পায়ার্স অ্যাণ্ড উইচেস: দ্য ট্রু স্টোরি।

‘কিছু জানতে পেরেছ?’ মুসার জিজ্ঞাসা।

‘রাত জেগে ভ্যাম্পায়ারের অংশটা পড়েছি। ভ্যাম্পায়ারের হাত থেকে বাঁচার উপায় জেনে নিয়েছি আমি।’

‘এখন কী করতে হবে আমাদের?’ বইটার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল মুসা।

কর্তৃত্বের সঙ্গে কথা বলল রবিন।

‘ভ্যাম্পায়াররা ক্রস আর রসুন সহ্য করতে পারে না।’ জ্যাকেট সরাল নথি। দেখা গেল সোনার ইয়াবড় এক ক্রস ওর গলায় ঝুলছে।

‘রসুনও এনেছ নাকি?’ মুসার প্রশ্ন।

‘বাসায় রসুন পাইনি, তাই এটা এনেছি।’ খুদে এক প্লাস্টিকের শিশি তুলে ধরল রবিন। লেবেল সাঁটা: গারলিক সল্ট।

‘এতে কাজ হবে?’

‘চেষ্টা তো করে দেখা যেতে পারে,’ বলল রবিন। ‘চলো, এটা আমরা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে দিই। নইলে রিকির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’

‘চলো,’ বলল মুসা। পা টিপে টিপে স্কুলে প্রবেশ করল ওরা। শ্বাস চেপে ক্লাসরুমের দরজা খুলল।

‘ভাল, উনি এখনও আসেননি,’ গলা খাদে নামিয়ে বলল নথি। তারপর গারলিক সল্ট ছিটাতে লাগল ঘরময়, বিশেষ করে রিকির ডেস্কের চারপাশে। কাজ শেষ করেছে এমনিসময় ক্লাস রুমের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। ভিতরে পা রাখলেন মিসেস হকিন্স।

‘কী ব্যাপার? এত সকাল-সকাল তোমরা এখানে কী করছ?’ স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন তিনি।

রবিন চট করে গারলিক সল্টের খালি শিশিটা পকেটে চালান করে দিয়ে জবাব দিল।

‘ভাবলাম ঘরটা গোছগাছ করে দিই,’ বলল ও।

‘হ্যাঁ,’ সুর মেলাল মুসা।

লকেটটা মৃদুভাবে ঘষলেন মিসেস হকিন্স।

‘খুব ভাল। এখুনি শুরু করো।’

পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ছেলেরা। তারপর কাজে লেগে পড়ল।

বারো

রিকি ক্লাসে ঢোকার পর সমস্যা শুরু হলো।

‘এই, গন্ধটা কীসের? নাস্তায় স্প্যাঘেটি খেয়েছে কে?’ বলে উঠল ও।

রবিন আর মুসা ওকে চুপ থাকতে ইশারা করল, কিন্তু ও পাত্তাই দিল না। তার বদলে, কামরার পিছনদিকে গিয়ে বইয়ের ব্যাগটা উল্টে দিল। অন্তত বিশটা কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল। বাদবাকি ছাত্র-ছাত্রীরা ঘরে প্রবেশ করলে নিশানা তাক করল রিকি। কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে বেড়াতে লাগল ঘরময়।

মিসেস হকিন্স নাক ঝাড়তে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন, রিকির প্লেন লক্ষ করলেন না। কিন্তু ক্লাসের সবাই যখন টের পেল রিকি কী করছে, তখন প্লেনগুলোকে গোলা পাকিয়ে ফেলে দিল ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে।

‘অ্যাই, কী করছ তোমরা?’ অভিযোগ করল রিকি।

কজন ছেলে-মেয়ে ওর দিকে চেয়ে ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল। ‘শশশ!’

ওরা সবাই যার যার আসনে গিয়ে সিধে হয়ে বসল। মনোযোগ দিল মিসেস হকিন্সের প্রতি। শুধু রিকি বাদে। তাকের সমস্ত বই নিয়ে মেঝেতে ছড়াতে লাগল ও। মিসেস হকিন্স হাঁচির পর হাঁচি দিয়ে চলেছেন খেয়াল করল না ও।

‘হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো, এক্সকিউজ মি, ক্লাস। কিছু একটাতে অ্যালার্জি হচ্ছে আমার…হ্যাঁচ্চো!’ বললেন মিসেস হকিন্স। ডেস্কের বক্স থেকে টিসু বের করে নাক ঝাড়লেন। চোখ লাল। কোনা বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।

কিশোর হাত তুলল।

‘আমি গিয়ে কাস্টোডিয়ানকে ডেকে আনি। ধুলো পরিষ্কার করলে আপনার হাঁচি থামতে পারে।’

ওর বাহুতে চিমটি কাটল মুসা।

মিসেস হকিন্স কিশোরের দিকে চাইলেন।

‘তার দরকার পড়বে না, কিশোর। হ্যাঁচ্চো। কীসের জন্য হাঁচি হচ্ছে বুঝতে পেরেছি আমি। এঘরে রসুন এল কোত্থেকে বুঝতে পারছি না।’

শ্বাস চাপল রবিন, আর ডেস্ক হাতড়ে বই বের করতে ব্যস্ত হলো মুসা। দু’জনের কেউই লক্ষ করল না মিসেস হকিন্সের অশ্রুসজল চোখ দুটি কীভাবে সবুজ আভা ছড়াচ্ছে।

ওদিকে রিকি তাকের বই ফেলা বন্ধ করেছে। মিসেস হকিন্সের দিকে চাইল ও। তাঁকে নাক ঝাড়তে দেখল। নাহ, সব চেষ্টা মাঠে মারা গেল। মিসেস হকিন্স নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, ওর দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই তাঁর। নিজের চেয়ারে গিয়ে রসল ও।

‘আপনি ইনফেকশন নিয়ে স্কুলে এলেন কেন? আপনি তো আমাদের মধ্যে জার্ম ছড়াচ্ছেন!’ বলে উঠল রিকি।

রবিনের চোখ কপালে উঠল। ঢোক গিলল কিশোর। কিন্তু মিসেস হকিন্সের কানে যেন কথাগুলো ঢোকেনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে বোর্ডে মর্নিং অ্যাসাইনমেণ্ট লিখতে লাগলেন। বারবার হাঁচির জন্য থামতে হলো তাঁকে, তবে শীঘ্রি বোর্ড ভরে উঠল এবং ক্লাসের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বিরক্ত হয়ে উঠল রিকি। পেন্সিলের খসখসানি আর মিসেস হকিন্সের হাঁচি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। গুন-গুন করল ও, শিস দিল, ঢেকুর তুলল, কিন্তু টিচার নাক ঝাড়তে এতটাই ব্যস্ত, ওর দিকে ফিরেও চাইলেন না। যে করে হোক টিচারের দৃষ্টি কাড়তে হবে, ক্যাফেটেরিয়ায় যাওয়ার সময় ভাবল ও।

নিজের লাঞ্চ ট্রে নিয়ে রবিন আর মুসার পাশে বসল রিকি।

‘কী ব্যাপার বলো তো? তোমরা সব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র-ছাত্রী হয়ে গেলে নাকি? মিসেস হকিন্সকে জ্বালানোর এত চেষ্টা করছি, কেউ ড্রাকুলার কফিন একটু সাহায্যও করছ না!’

মাথা নাড়ল মুসা।

‘উনি সাধারণ টিচার নন, রিকি। তুমি সাবধান হয়ে যাও, নইলে উনি তোমাকে হয়তো ব্যাঙ বানিয়ে দেবেন। উনি হয় ডাইনী আর নয়তো ভ্যাম্পায়ার।’

হেসে ফেলল রিকি

‘তুমি বেশি-বেশি টিভি দেখছ। ডাইনী কিংবা ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু নেই,’ বলল ও।

‘তা হলে বলো, মিসেস হকিন্স রসুন সইতে পারেন না কেন?’ রবিন প্রশ্ন করল। ‘ভ্যাম্পায়াররা রসুন অপছন্দ করে!’

‘আমিও তো অপছন্দ করি, তাই বলে আমিও ভ্যাম্পায়ার নাকি?’ বলল রিকি। ‘তোমরা সাহায্য না করলে না করো। আমি এই মহিলাকে তাড়িয়েই ছাড়ব। সে আমাদেরকে দিয়ে ক্লাস পরিষ্কার করাচ্ছে, পড়া করিয়ে নিচ্ছে, চুপ থাকতে বাধ্য করছে। এসব সহ্য করা যায় না!’ রিকি ট্রে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল।

মাথা নেড়ে ট্রে সরিয়ে রাখল মুসা।

‘খিদে নষ্ট হয়ে গেছে,’ বলল।

‘আমারও,’ বলল রবিন। ‘কেন জানি ভয় করছে!’

তেরো

রিকি ধেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। আরও দুষ্টামি করতে তৈরি। কাস্টোডিয়ান বেরিয়ে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে ধাক্কা খেল।

মিসেস হকিন্স কাস্টোডিয়ান মি. গিবসনকে ধন্যবাদ জানালেন ঘর মুছে দেওয়ার জন্য।

‘আশা করি আমার আর অসুবিধা হবে না,’ বললেন।

মুসা আর রবিন পরস্পর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বিনিময় করল। রিকির চেয়ারের উদ্দেশে ঝুঁকে পড়ল রবিন।

‘তোমাকে একটা কথা বলি।’

‘কী?’

‘রসুন নেই। মিসেস হকিন্স সুস্থ বোধ করছেন,’ বলল রবিন।

মিসেস হকিন্স এখন আর নাক ঝাড়ছেন না, কিংবা হাঁচি দিচ্ছেন না। নাক লাল হয়ে রয়েছে তাঁর, তবে সবুজ চোখজোড়া স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু রিকি দমবার পাত্র নয়। একটা বল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল মিসেস হকিন্সের উদ্দেশে। টিচারের ডেস্কের ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়ল ওটা।

‘বিংগো!’ দাঁত বের করে হাসল রিকি।

মিসেস হকিন্স উঠে দাঁড়ালেন। মুখ খুলতে যাবেন, আরেকটা গোলা তাঁর গালের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল ব্ল্যাকবোর্ডে।

রিকির খুশি ধরে না। ওয়ার্ল্ড সিরিজ জিতে গেছে যেন। ‘দেখলে, উনি কিছুই বলছেন না,’ রবিনকে বলল ও। গোটা ক্লাস নীরব। সবাই চেয়ে টিচারের দিকে।

‘অনেক সহ্য করেছি।’ বললেন মিসেস হকিন্স। তাঁর সবুজ চোখজোড়া ঝলসে উঠল, দীপ্তি ছড়াল লকেটটা, রিকির দিকে হেঁটে এলেন তিনি। কাঁপা হাতে রিকির বাহু চেপে ধরলেন। ‘এসো আমার সাথে,’ জোর গলায় হুকুম করলেন।

রিকি তোতলাতে লাগল।

‘আ-আ-আমি দু-দুঃখিত, মিসেস হকিন্স। আর এমন ক-করব না।’

মিসেস হকিন্স রিকিকে ডেস্ক থেকে টেনে তুললেন।

‘হল-এ চলো, তোমার সাথে কথা আছে।’

সবার সামনে রিকিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ধপ করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

‘কী করবে রিকিকে?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করল মুসা।

‘জানি না,’ সভয়ে বলল রবিন। ‘আমাকে ধরেনি আমি তাতেই খুশি।’

সবাই মাথা ঝাঁকাল। মেঝে থেকে জিনিসপত্র তুলতে লাগল সবাই। ব্ল্যাকবোর্ড পরিষ্কার করল। তারপর ডেস্কে বসে ঝটপট কাজে মন দিল।

দরজাটা আবারও ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে যেতেই মুখ তুলে চাইল ওরা। মিসেস হকিন্সকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, কিন্তু রিকির মুখের চেহারা মড়ার মতন সাদা।

.

ছুটির পর খেলার মাঠে মিলিত হলো ছেলে-মেয়েরা। সবার আগে কথা বলল মুসা।

‘উনি তোমাকে কী করেছিলেন, রিকি?’

‘তোমার মুখে তো একদম তালা পড়ে গেছিল,’ বলল রবিন।

মাথা ঝাঁকাল রিকি, তবে মুখ খুলল না।

জুলি বলল, ‘ওঁর কি ড্রাকুলার মত দাঁত বেরিয়ে এসেছিল? ঘাড়ে কামড়ে দিয়েছে তোমাকে?’

‘বোকার মত কথা বোলো না,’ বলে উঠল রবিন। ‘উনি ওকে কামড়াননি…কামড়েছেন?’

সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল রিকির দিকে। শিউরে উঠে কর্কশ গলায়

কথা বলতে শুরু করল ও।

‘আমি শুধু এটুকু বলব তোমাদের কথাই ঠিক। মিসেস হকিন্স সাধারণ কোন টিচার নন।’

‘উনি কি ভ্যাম্পায়ার?’ জুলির প্রশ্ন।

রিকির বাহু চেপে ধরল রবিন।

‘আমাদেরকে সব খুলে বলো, রিকি।’

কিন্তু রিকি কী ঘটেছিল ওদেরকে বলল না।

‘আমি ওঁকে আর কখনও খেপাব না, ও শুধু এটুকুই বলল।

.

বছরের বাকি সময়টা রিকি তার কথা রাখল। আসলে ফোর্থ গ্রেডের কেউই মিসেস হকিন্সকে ঘাঁটাতে সাহস পেল না। মিসেস হকিন্সের সবুজ লকেট আর ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়নি, যদিও প্রতিদিনই তিনি ওটা পরে এসেছেন।

স্কুলের শেষ দিন, খেলার মাঠে জড় হলো ছেলে-মেয়েরা।

‘বছরটা শেষ হয়েছে ভাবা যায় না,’ বলল কিশোর।

‘বেঁচে যে আছি বিশ্বাস করা কঠিন, বলল রিকি

‘মিসেস হকিন্স কিন্তু খুব একটা খারাপ নন,’ বলল মুসা।

রবিন বলল, ‘তেমন একটা অদ্ভুত মনে হয়নি তাঁকে।’

হেসে উঠল মুসা।

‘আমরা খামোকা ওঁকে ভ্যাম্পায়ার ভেবেছিলাম!’

হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ার কখনও পলকা ডটস পরে না,’ সায় জানিয়ে বলল কিশোর।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *