৮
যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই ঘটল এক সময়। এ জঙ্গল মোটেই নিরুপদ্রব নয়। ঘোর দুপুরে হাজির হলো তিনজন মানুষ।
তাদের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ চেহারার মধ্যবয়স্ক, ধুতি, ও হাফ হাতা পাঞ্জাবি পরা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, দু’কানে সোনার রিং, ভুরু দুটো কোঁচকানো। এর চোখ দেখলে মনে হয় যে–কোনো রকমের নিষ্ঠুরতাতেই এর বেশ আনন্দ। লোকটি বাঙালি নয়, তবে কোথাকার ঠিক বোঝা যায় না। তার সঙ্গের একজন বাঙালি, প্যান্ট–শার্ট পরা, বছর পঁয়তিরিশেক বয়েস, চোখে চশমা, শক্ত চোয়াল। আর একজন এদের দেহরক্ষী, তার হাতে অবশ্য বন্দুক নেই, লাঠি!
এই জঙ্গলের মধ্যে কোথাও রাস্তা আছে, শোনা গিয়েছিল একটা জিপের শব্দ। সেটাকে পুলিশের গাড়ি বলে সন্দেহ করা হয়েছিল, কিন্তু গোবিন্দ না ফিরলে এই জায়গাটা ছেড়ে যাবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, বাচ্চা সমেত ময়নাকেও এখন সরানো যাবে না, সেইজন্য কেউ পালায়নি।
জিপটা এদেরই। খানিকটা দূরে সেটা থামিয়ে পায়ে হেঁটে এসেছে। কৌতূহলী বাচ্চারা এগিয়ে দেখতে গিয়েছিল। লাঠিয়াল সম্পর্কে তাদের সহজাত বিভীষিকা আছে, তারাই আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে খবর দিয়েছে।
সুশীলাদি ময়নাকে নিয়ে ব্যস্ত, সে একজন ধাত্রীও বটে, গরমজল দিয়ে পরিষ্কার করছে সব কিছু। এই আগন্তুকদের খবর পেয়েও সে বিচলিত হলো না, এখন ময়না ও তার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখাই তার প্রধান কাজ।
বড়কাকা হতবুদ্ধির মতন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। অন্যান্যরা সবাই চুপ। আমি মনে মনে ভাবলুম মাত্র তিনজন মানুষকে দেখে এতগুলো গ্রামবাসীর খুব একটা ভয় পাবার কারণ আছে কি, এরা তো পুলিশ নয়!
বলিষ্ঠ লোকটির পায়ে পাম্পশু, সেই জুতো মশমশিয়ে এসে সে রান্নার জায়গাটার কাছে এক হাতে ধুতির খুট ও অন্য হাত কোমরে রেখে অধিপতির মতন দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল পরিস্থিতি।
তারপর সে বড়কাকাকেই কথা বলার যোগ্য হিসেবে বেছে নিয়ে বলল, এই, তুরা এখানে কী করছিস? এই জঙ্গলে কেন এসেছিস?
বড়কাকা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। কেন এসেছে, তা কী করে বলবে? কেউ কি নিজের মুখে স্বীকার করতে পারে যে পুলিশের ভয়ে গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে এসে লুকোবার চেষ্টা করেছে?
লোকটি আবার বলল, কী রে, কোথা বলছিস না কেন? এ জঙ্গল হামার আছে। তুরা এখানে কার হুকুমে এসেছিস? কে ভেজিয়েছে তুদের, শ্যামলাল?
বাঙালিটি মাথা নেড়ে বলল, না, শ্যামলালজী এ কাজ করবে না।
তারপর সে সবার উদ্দেশে বলল, এই তোরা শোন, ইনি হচ্ছেন রামদেওজী, ইনি এই জঙ্গল ইজারা নিয়েছেন। এখানে তো তোরা কাঠ কাটতে পারবি না। সেটা বে–আইনী হবে। তোরা যা, এখান থেকে চলে যা।
এবার বড়কাকা বলল, বাবু, আমরা কাঠ কাটতে আসিনি। এমনিই এসেছি, দু’দিন বাদে চলে যাব।
রামদেওজী উনুনের পাশে পড়ে থাকা একগুচ্ছ লকড়িতে লাথি মেরে বলল, ই তো কেটেছিস! শাল গাছ তোড়িয়েছিস! শাল গাছ নোষ্ট করা ফরেস্ট ডিপাট– এর মানা আছে। হামার নামে দোষ দিবে!
শুধু শুকনো পাতায় রান্না হয় না, রান্নার জন্য কিছু গাছের ডাল কাটা হয়েছে ঠিকই। এ জঙ্গলে শাল গাছই বেশি, আরও দু’চার জাতের গাছ আছে, সে–সব আমি চিনি না। নদীর ধারে দেখেছি কয়েক সারি ইউক্যালিপটাস, অল্প কিছুদিন আগে লাগানো। কয়েকটা ঝাঁকড়া মহুয়া গাছও আছে।
জঙ্গল ইজারা নিলেও সবরকম গাছ কাটা যায় না। এক এক জায়গায় এক একরকম গাছ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা থাকে, এটা আমিও ক্ষীণভাবে শুনেছি। তবে কন্ট্রাকটাররা যে সব নিয়ম মানে না, তাও সবাই জানে।
রামদেওজীর কথার মধ্যে দৃঢ়তা আছে, কিন্তু চ্যাঁচামেচি করছে না। তার মুখে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের ছাপ।
রামদেওজীর ব্যক্তিত্বের কাছে কাচুমাচু হয়ে গেছে বড়কাকা। গাছ কাটার কৈফিয়ৎ সে দিতে পারছে না।
—তুরা কোন গাঁও থেকে এসেছিস?
বড়কাকা আমতা আমতা করে বলল, আংড়া…
রামদেওজী তার বাঙালি সহচরটির দিকে ফিরে বলল, সে কিধার আছে? আংড়া তো নাম শুনিনি!
বাঙালিটি একটু ভুরু তুলে ভেবে নিয়ে বলল, আংড়া, হ্যাঁ একটা আংড়া আছে খাঁড়িখোলার পাশে। তোরা সেখান থেকে এই জঙ্গলে এসেছিস কেন?
বড়কাকা বলল, গাঁয়ে খাবার নেই, হাতে কোনো কাজ নেই, এবার বৃষ্টি হলো না, জমিতে কাজ–কাম শুরু হলো না, তাই কী করি…
—সেইজন্য এখানে চলে এলি? এখানে কে তোদের খাবার দেবে?
রামদেওজী একটি অতি শস্তা ব্র্যাণ্ডের সিগারেটের প্যাকেট বার করে, একটা বেশ দামি লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে সে বলল, শুন, তুরা সব ক্ষেতি জমির কাম করিস, জঙ্গলে তুদের কাম নেই। এ হামার জঙ্গল আছে, তুরা ভেগে যা। আর যদি শামলাল তুদের ভেজিয়ে থাকে তবে সে শালাকে বলিস, আমি তার মুখে মুতে দি!
আমি শুয়ে আছি একটা কুসুমগাছের নীচে, একটু দূরে। আমাকে ওরা এখনো দেখেনি।
এই শ্যামলাল চরিত্রটা কে? এই রামদেওজীর কোনো প্রতিপক্ষ কন্ট্রাকটার? জঙ্গলের ইজারা নিয়ে বিভিন্ন কন্ট্রাকটারের মধ্যে রেষারেষি থাকা স্বাভাবিক। এদের দেখা যাচ্ছে বেশ নগ্ন প্রতিযোগিতা।
অস্থায়ী উনুন দুটিতে এখনও কিছুটা আঁচ আছে। একটা উনুনে লাথি মেরে পাথরগুলো ছড়িয়ে দিয়ে রামদেওজী বলল, এ তুষারবাবু, এ লোকগুলাকে ভাগিয়ে দে! ঝুট–ঝামেলা হামি পছন্দ করি না।
বড়কাকা হাতজোড় করে বলল, বাবু, আমাদের আজকের রাতটা অন্তত থাকতে দিন। কাল চলে যাব!
অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে রামদেওজী হাত নেড়ে নেড়ে বলল, যা যা যা! ঐ শালা শামলালের ভি জঙ্গল আছে, সেখানে যা। আভি নিকাল –
এবারে আমি উঠে বসলুম। বাঙালি–অবাঙালির ব্যাপার নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাই না। বাঙালিরা সবাই বিশ্বপ্রেমিক। কলকাতা শহরটা অবাঙালি ব্যবসায়ীরা কব্জা করে নিয়েছে, আমরা প্রতিবাদ করি না। গ্রামেরও এই অবস্থা নাকি? পুরুলিয়া শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক বন্ধু একটা বড় বাড়ির দিকে হাত দেখিয়ে বলেছিল, জানো, এই শহরে এই একটাই বাঙালিদের ভালো বাড়ি। আর সব যত বড় বড় বাড়ি দেখবে, সেগুলো সব মাড়োয়ারিদের!
মেদিনীপুর জেলার একটি জঙ্গলে এখানকার গ্রামের মানুষদের আসবার অধিকার নেই, সেই জঙ্গলের অধিকার থাকবে হাজার মাইল দূর থেকে আসা একজন মানুষের? এ কী ধরনের ব্যবস্থা।
কাছে এসে বাঙালি ভদ্রলোকটিকে আমি বললুম, আপনারা এ জমি ইজারা নিয়েছেন, তা বলে এই জঙ্গলে কেউ বেড়াতেও আসতে পারবে না? এরকম কোনো আইন আছে নাকি?
আমি একটু নার্ভাস বোধ করছিলুম, বাইরের লোকজনের সঙ্গে চোটপাট করে কথা বলা আমার স্বভাব নয়। আমার গলার আওয়াজটা বেশি জোর হয়ে গেল, একটু কেঁপেও গেল। শব্দ নির্বাচনেও ভুল হয়েছে আমার। বেড়াতে আসার কথাটা এখানে খাটে না। একটা গোটা গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা কোথাও বেড়াতে যায় না, তারা যেখানেই যাক, প্রয়োজনে যায়, বাধ্য হয়ে যায়।
আমার চেহারা বা পোশাক দেখে কিছু বোঝা না গেলেও উচ্চারণ শুনেই ওরা ধরে ফেলল যে আমি আংড়া গ্রামের মানুষ নই।
তুষার নামের লোকটি বেশ খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল, তুই কে? তুই এখানে কী করে এলি? কে তোকে পাঠিয়েছে?
এই ধরনের মানুষগুলো গ্রামের সব লোকদেরই তুই–তুকারি করে কথা বলে। কিন্তু আমি এই তুষারের চেয়ে কম কিছু ভদ্রলোক নই, আমাকে ওর আপনি বলা উচিত ছিল। আমার আরও রাগ চড়ে গেল।
–আমি যেই হই না কেন, আমি যা জিজ্ঞেস করলুম তার উত্তর দিন! এই জঙ্গলে তো বেড়া দেওয়া নেই। এখানে লোক ইচ্ছেমতন এমনি এমনি আসতে পারবে না?
–আসতে পারবে না কেন, সে কথা বলেছি? এরা চুরি করে কাঠ কাটতে এসেছে!
—মোটেই এরা কাঠ কাটতে আসেনি। এরা চাষী, এরা কাঠুরে নয়।
—আলবৎ এরা কাঠ কেটেছে। এই তো রান্নার জন্য কতগুলো ডাল কেটেছে। রামদেওজী সিগারেট টানতে টানতে লকড়ির স্তূপে আর একটা লাথি মেরে বলল, ই সব কাঠ কেটেছে। কম–সে–কম পঁচাশ রূপিয়া দাম হোবে
তারপর সে বড়কাকার দিকে ফিরে ধমক দিয়ে বলল, এ বুড়া, দে পঁচাশ টাকা দে! না দিবি তো তুর ঘাড় ভাঙব।
রামদেওজীর ভাষা অনেকটা আদিবাসীদের ভাষার সঙ্গে ভাঙা হিন্দি মেশানো। সম্ভবত সে মাড়োয়ারি নয়। মাড়োয়ারিদের কণ্ঠস্বর এত কর্কশ হয় না।
পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে শুনে বড়কাকার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে। অন্যরা একেবারে নিঃশব্দ। হয়তো আগেকার অভিজ্ঞতায় এরা জানে, রামদেওজীর মতন ক্ষমতাবান মানুষদের কথার প্রতিবাদ করা যায় না। এই ধরনের জোতদার– ব্যবসায়ীদের কাছেই ওদের কাজ চাইবার জন্য হাত কচলাতে হয়।
ভবেনটা অন্য সময় এত গলাবাজি করে, এখন সে–ও একটা কথা বলছে না। কাছাকাছি কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে।
রামদেওজী আবার বলল, এ বুড়া, চুপসে ঠার রইলি কেন? হামার জঙ্গলের কাঠ নোষ্ট করেছিস, দে, রূপিয়া দে!
আমি বড়কাকাকে বললুম, না, কক্ষনো দেবেন না!
তারপর তুষারকে বললুম, এইটুকু কাঠের দাম পঞ্চাশ টাকা? ইয়ার্কি পেয়েছেন? রান্নার জন্য দু’একটা ডাল ভাঙলে সেটা মোটেই কিছু দোষের নয়।
তুষার এবার আমার দিকে কুটিল চোখে তাকিয়ে বলল, জঙ্গলের মধ্যে এসে কে ওদের রান্না করতে বলেছে? এটা কি ওদের বাপের তালুক? সরকারি ইজারার জঙ্গলে উইদাউট পারমিশান রান্না করা বেআইনী!
রামদেওজী উপহাসের হাসি দিয়ে বলল, এ তুষারবাবু, এ ছোকরা কৌন আছে? নোক্শাল আছে বুঝি?
তুষার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, আরে ওসব নক্শাল ফক্শাল আমি গ্ৰাহ্য করি না। সেভেন্টি ওয়ানে কত নক্শাল ঠাণ্ডা করেছি।
—এ ছোকরাকে নিয়ে চল…
সঙ্গে সঙ্গে তুষার আমার ঘাড় আঁকড়ে ধরল। লাঠিওয়ালা লোকটা চেপে ধরল আমার হাত।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলুম। এতগুলো লোকের সামনে এরা আমার গায়ে হাত দিচ্ছে? কী সাহস! আমি ওদের সঙ্গে যুক্তি তর্ক করছিলুম, সেটা ওরা গায়ের জোরে থামিয়ে দিতে চায়?
আমি বড়কাকা, হারু, সুবল এদের দিকে তাকালুম। কেউ আমাকে সাহায্য করার জন্য একটা আঙুলও তুলল না।
আমি মাথাটা ছটফটিয়ে বললুম, ছেড়ে দিন, আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন, ছেড়ে দিন আমাকে!
রামদেওজী বলল, চল শালা, তুকে পুলিশের হাতে জিম্মা করে দিবো! তারপর সে বড়কাকাদের দিকে তড়পে বলল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ভেগে যা! জঙ্গল ছোড়কে চলা যা! নেহি তো লাঠিসে ভাগাবো! জগদীশ, ইসব উনান বগেরা তোড় দে!
লাঠিওয়ালা লোকটি শুধু উনুনই ভাঙল না, ভেঙে দিল ওদের কয়েকটা মাটির হাঁড়ি। তুষার আমাকে ঠেলতে লাগল সামনের দিকে।
আমি প্রতি মুহূর্তে ভাবছি আংড়া গ্রামের লোকগুলো ক্ষেপে উঠবে। ওদের কাছেও টাঙ্গি আছে, কুড়ুল, লাঠি আছে। এই তিনটে লোককে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারবে না?
কিন্তু কেউ একটা শব্দ করছে না, কেউ এক পা এগিয়ে আসছে না। ওদের ভাত–রান্নার হাঁড়ি ভেঙে দিল, তাতেও রাগ নেই?
ডাকাতি করার জন্য যেমন আগে ট্রেনিং নিতে হয়, সেইরকম গ্রামের মানুষকে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে হয় কীভাবে, তাও নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন ধরে শেখার ব্যাপার। আমি ধরেই নিয়েছিলুম, এতগুলো মানুষ যখন আছে, তখন এই তিনটে অমানুষকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারবে। আমাকে তুষার আর জগদীশ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, তাও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাকে এতগুলো লোকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া সত্যি সম্ভব?
এরই মধ্যে আমার খানিকটা অভিমান হলো। আমাকে ওরা নিজের লোক বলে মনে করে না! একটু আগে আমি ওদের সঙ্গে বসে খেলুম, খেয়ে উঠে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সারা বছরের কাজকর্ম সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল, এখন ওরা আমাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল? আমার জন্য ওরা কোনো ঝঞ্ঝাটে জড়াতে চায় না। ওরা বোধহয় রামদেওজীকে আগে দেখেছে, এর শক্তির কথা জানে, রামদেওজীর হুকুম অমান্য করে এই জঙ্গলে যে আর থাকা যাবে না, তাও বুঝে গেছে!
আংড়া গ্রামের মানুষের সঙ্গে এইভাবে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল? সিনেমার নায়কদের মতন আমার অলৌকিক শক্তি নেই যে একা লড়ে গিয়ে এই তিনজনকে কাবু করে ফেলব। রামদেওজী নিজেই আমাকে পেড়ে ফেলতে পারে। তুষারও বেশ শক্তিশালী, আর জগদীশের চাকরিই তো গায়ের জোর ফলানো।
গ্রামবাসীদের যে প্রতিবাদ করার সাহস নেই, তা রামদেও নিশ্চয়ই আগে থেকেই ভালো করে জানে। তাই সে এদের তাড়াবার জন্য মাত্র দু’জন লোক সঙ্গে নিয়ে এসেছে। হয়তো রামদেও–র কোমরে রিভলভার আছে, এদের থাকে। সরকার এদেরই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়।
জিপটার কাছে এনে তুষার আমাকে এক ধাক্কায় ফেলে দিল মাটিতে। রামদেও বলল, এ তুষার ই হারামীকা কেয়া মতলোব দেখ্। ই কাঁহাসে এসেছে?
বাঙালি তুষার এই রামদেওর বিশ্বস্ত অনুচর। প্রভুভক্ত শিকারী কুকুরের মতন তার একটা অদৃশ্য লেজ নড়ছে। সে আমাকে ক্যাৎ করে একটা লাথি কষিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুই কোথা থেকে এসছিস? কেন এসেছিস এদিকে? বল শালা…
আমার সারা শরীরে ত্রাস এসে গেল। এরা সাধারণ ধর্মভীরু গ্রামের মানুষ নয়, এরা পোড়–খাওয়া, শ্রমিকের রক্তচোষা ব্যবসাদার, জঙ্গল কেটে উজাড় করে দিতে এদের যেমন বিবেকে লাগে না, সেইরকম মানুষ মারতেও এদের হাত কাঁপার কথা নয়। এরা ভাতে মারে, গাড়ি চাপা দিয়ে মারে, দরকার হলে লাঠি– বন্দুক চালাতেও দ্বিধা নেই।
এই তুষারটা গুণ্ডা ধরনের। ও আমাকে নক্শাল ভেবেছে, উনিশশো একাত্তরে নক্শাল মেরে হাত পাকিয়েছে, উনিশশো সাতাশিতে সে আরও সহজে মারতে পারবে। নক্শাল ছেলেদের মৃত্যুভয় ছিল না, কিন্তু আমার বেঁচে থাকার খুবই ইচ্ছে।
মাটিতে কাৎ হয়ে পড়ে আমি মিনমিনে গলায় বললুম, আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে চান, নিয়ে চলুন, আমি তো আপত্তি করছি না।
রামদেও বলল, আরে বেহুদা, তু কুন পাট্টি পহেলে বল্! হামি দু’দুটা পাট্টিকে চান্দা দেই, লিডারলোগ হামার কোঠিতে এসে খানাপিনা করে, তু কৌন রে!
–আমি কোনো পার্টি করি না, বিশ্বাস করুন। আমি এমনি বেড়াতে বেড়াতে এদিকে এসেছি। এই জঙ্গলে ঢোকা যে নিষেধ, তা আমি জানতুম না।
—ঠিক বাত বল! হামার দিমাগ খারাব করে দিস না!
তুষার বলল, তুই এই গ্রামের লোকগুলোকে ক্ষেপিয়ে জঙ্গলে নিয়ে এসেছিস কেন?
—আমি ওদের আনিনি। সত্যি কথা বলছি। ওরা নিজেরাই এসেছে!
—ওরা নিজেরাই এসেছে, এমনি এমনি? তবে তুই ওদের হয়ে তড়পাচ্ছিলি কেন?
–আমি কিছু বলিনি তো, এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। এখানকার নিয়মকানুন তো ঠিক জানি না! আমাকে দয়া করে একটু থানায় পৌঁছে দিন।
রামদেও তার বিশাল মুখখানা আমার কাছে ঝুঁকিয়ে এনে বলল, তু উই বুঢ়াকে রূপিয়া দিতে না বললি। হামার মুখের উপর কোথা বললি! তুকে থানায় দিব, হাঁ দিব, তার আগে তুর হাঁথদুটো ভাঙ্গে দিব! কব্জী উলাট দিব, আর কভি মাস্তানি করবি না।
আমার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এ লোকটা মিথ্যে ভয় দেখায় না। এ আমার হাতদুটো ভেঙে দেবে বলছে!
পেছনে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর শুনে রামদেও ঘাড় ঘোরালো, তারপর বলল, উ ভিখারিগুলো আসছে। জগদীশ, তৈয়ার…
সুশীলাদিরা যদি আসতে আর দু’এক মিনিট দেরি করত, তা হলে আমাকে হয়তো পঙ্গু হয়ে থাকতে হতো সারাজীবন! দরদর করে ঘাম ঝরছে আমার সারা শরীরে।
সুশীলাদি আরও আট ন’জন মহিলাকে নিয়ে ছুটে এসেছে। সঙ্গে বাচ্চাদের দল। পুরুষরা অনেক পেছনে।
জগদীশ লাঠি তুলে তাদের আটকাতে গেলেও সেই মহিলা ও শিশুবাহিনী ঘিরে ফেলল জিপখানা। সুশীলাদি ব্যাকুলভাবে হাতজোড় করে বলল, ও বাবু, আমরা জঙ্গল ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এ মানুষটাকে তোমরা ছেড়ে দাও! আমরা এক্ষুনি চলে যাব!
তুষার বলল, তোরা তো জঙ্গল ছেড়ে যাবিই। এ লোকটাকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব।
জগদীশকে ঠেলে সরিয়ে আমার আর রামদেও’র মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে পাগলাটে গলায় সুশীলাদি বলল, না, ওকে নিতে দেব না! আমাদের না মেরে নিতে পারবে না! মারবে আমাদের? মারো।
জগদীশ সুশীলাদির হাত ধরে টেনে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, রামদেও তাকে এক ধমক দিয়ে বলল, জেনানার গায়ে হাঁথ দিবি না!
এইসব লোকদের এক বিচিত্র পাপ–পুণ্য জ্ঞান আছে। এরা কোনো রমণীকে যখন তখন বিধবা করে দিতে দ্বিধা করে না, অথচ নারী জাতিকে সম্মান করে। এরা শিশুদের আদর করে, কিন্তু এক হুকুমে চার পাঁচটি শিশু পিতৃহীন হয়ে গেলে এদের কিছু যায় আসে না।
এই নারীবাহিনীকে দেখে রামদেও’র মুখের ভাব অনেক নরম হয়ে গেল। সে সুশীলাদিকে জিজ্ঞেস করল, এ ছোকরা কৌন আছে?
সুশীলাদি বলল, এ আমার ভাই হয়। শহরে চাকরি করে। আর সবাইকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো!
অতি ধূর্ত রামদেও বিশ্বাস করল না একথা। সুশীলাদি মিথ্যেটা বলতেও পারেনি ভালো করে। কিন্তু রামদেও এই বিষয়ে আর চাপ দিল না, সে এখন নারী জাতিকে দয়া দেখাতে চায়।
সামান্য ভর্ৎসনার সুরে সে বলল, তুলোগ হামার জঙ্গলের কাঠ কেটেছিস। আগ জ্বালিয়েছিস। ফরেস্ট ডিপাটে হামাকে ফাইন দিতে হোবে!
–আর কাঠ কাটব না, ও বাবু, মা মনসার দিব্যি, এবারের মতন মাপ করে দাও। তোমার কত আছে, আমরা তো মোটে দুটো গাছের ডাল কেটেছি।
–তব যা, চলে যা, ঘর যা। বাল–বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে কেনো আসিস?
–বাবু, আমরা ঠিক চলে যাব। আমাদের একজন লোক বাজারে গেছে, সে ফিরে এলেই চলে যাব। এখন গেলে সে আমাদের খুঁজে পাবে না। বাবু, রাত পর্যন্ত সময় দাও। কথা দিচ্ছি, আর আগুন জ্বালব না, রান্না করব না! বিশ্বাস করো, কথা দিচ্ছি।
রামদেও এ প্রার্থনাও অনুমোদন করে জিপ গাড়িটায় উঠতে গেল। তুষার আরও একটু কর্তব্য দেখাবার জন্য চোখ রাঙিয়ে বলল, ঠিক এই রাত্তিরের মধ্যে চলে যাবি কিন্তু। আমরা আবার আসব, তখনও যদি তোদের দেখি, পিটিয়ে লাশ ফেলে দেব!
তুষারই এই জিপের ড্রাইভার। জিপটা হুস করে বেরিয়ে গেল একটু বাদে।
সুশীলাদির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা শুধু আমার হাতদুটোকে বাঁচিয়ে দেবার জন্যই নয়। শেষ মুহূর্তে আমি ভেবেছিলাম, রামদেও’র পা জড়িয়ে ধরে দয়া চাইব যদি তাই–ই করতে হতো, তাহলে সারাজীবনে সেই গ্লানি আমার মুছত না। মানুষ অনেকরকম ভাবেই বেঁচে থাকে, কিন্তু জীবনের একটা কিছু না কিছু মহিমা তো থাকা দরকার। আত্মসম্মান একবার বিসর্জন দিলে সে মহিমা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
মৌখিক কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো মানে হয় না সুশীলাদিকে। আমার মুখে কোনো কথাও আসছে না। আমি ঝিম মেরে বসে রইলুম।
জিপটা চলে যেতেই সুশীলাদি বড়কাকাকে মুখঝামটা দিয়ে বলল, ছি ছি ছি, তোমরা কী গো? তোমাদের সুমুখ থেকে এই মানুষটাকে ধরে নিয়ে এলো, আর তোমরা কিছু বললে না? আমাকে একটা খপর দিতে পারলে না? আমাকে পাঁচীর মা ঠিক সময়ে গিয়ে বলল তাই…
বড়কাকা মাথা চুলকে বলল, কী করব বল, শেঠ যে ঐটুকুনি কাঠ কাটার জন্য পঞ্চাশ টাকা চেয়ে বসল। তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম। কাঠের দাম নয়, আমার জীবনের দাম পঞ্চাশ টাকা! আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বলে রামদেও আর কাঠের দামের জন্য জোর করেনি।
অবশ্য, কলকাতায় পঞ্চাশ টাকা আর এই গ্রামের মানুষের কাছে পঞ্চাশ টাকার যে কত তফাত তা হয়তো আমরা কোনোদিনই বুঝতে পারব না।
সুশীলাদি আবার গঞ্জনার সুরে বলল, এ মানুষটা তো আমাদের হয়েই ঝগড়া করতে গেসল ওদের সঙ্গে। ছি ছি ছি! এ মানুষটাকে আমরা বাস থেকে জোর করে নামিয়ে এনিছি, এখন ওকে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া আমাদেরই কর্তব্য নয়? ওর যদি মন্দ কিছু হয়ে যেত, তা হলে আমাদের পাপের বোঝা আরও বাড়ত না?
একজন বৃদ্ধ বলল, এটা ঠিক কথা বটে! এটা বড় ভুল হয়েছে গো আমাদের!
পাপ শব্দটার কতরকম ব্যাখ্যা! যাদের নিজেদেরই বাড়ি ফেরার ব্যাপারে চরম অনিশ্চয়তা, তারা এখন আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেবার জন্য চিন্তিত। এর নাম কর্তব্যজ্ঞান!
বড়কাকা এবার আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, কিন্তু রামদেও শেঠের মুখের ওপর কোনো কথা বলে কী লাভ হতো কিছু? ওর তাঁবে আড়াইশো–তিনশো লোক খাটে। পিটিয়ে ছাতু করে দিত না আমাদের?
এবার ভবেন বলল, আমি রামদেওবাবুকে খুব ভালো করেই চিনি। ও ব্যাটার একেবারে বাঘের মতন মেজাজ। একবার এক সাঁওতাল ওর ছেলেকে মারতে গেসল, তখন এই রামদেও জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে সেই সাঁওতালটার হাত পা বেঁধে ফেলে দিল আগুন। সবাইকে বলল, সাঁওতালটা হাঁড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে আগুনে পুড়ে মরছে। ঝাড়গ্রামে গিয়ে যে–কোনো লোককে জিজ্ঞেস করো না, সবাই এ কথা জানে।
আর একজন কে বলল, আমরা বাঘের পাল্লায় পড়িছি। এখনই এ জঙ্গল না ছাড়লে উপায় নেই।
ভবেন বলল, রামদেও শেঠ কিন্তু একটা কথা ঠিকই বলেছে। জঙ্গলে আগুন জ্বালা বে–আইনী!
সুশীলাদি বলল, সে কথা আগে বলিসনি কেন? তা হলে নদীর ধারে গিয়ে উনুন পাতা হতো!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, যেন আমার কাছেই পরামর্শ চাইছে এমন ভাবে সুশীলাদি বলল, এখন কী করি বলো তো? গোবিন্দ না এলে তো যেতেও পারি না। কিন্তু গোবিন্দ কখন যে ফিরবে ….
ভবেন বলল, একটা কথা বলি সুশীলাদি। রামদেও শেঠ যদি দলবল নিয়ে ফিরে এসে আবার আমাদের দেখে তা হলে কিন্তু রক্ষে রাখবে না। গোবিন্দর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। চলো ভেগে পড়ি…
—কোথায় যাব?
এই সরল প্রশ্নটির উত্তর কেউ দিতে পারল না। এই জঙ্গলের পর আর কোথায় নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া যায়, তা কেউ চিন্তা করেনি।
একজন বৃদ্ধ বলল, চল সুশীলা, আমরা গ্রামেই আবার ফিরে যাই। মরতে হয় তো নিজের ভিটেতেই মরব।
ভবেন বলল, পুলিশ টের পেলে আর নিজের ভিটেতেও মরতে দেবে না গো, জ্যাঠা। ধরে নিয়ে গিয়ে গারদে ভরবে আর শুয়োর–মারা মারবে!
সুশীলাদি বলল, গোবিন্দ এখানেই থাকতে বলে গেছে। তা হলে এক কাজ করি। আমরা নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকি না কেন! নদী তো আর কেউ ইজারা নেয়নি! লোকে দেখবে তো দেখুক। এ তল্লাটে কাউর কি আর জানতে বাকি আছে?
সবাই পায়ে পায়ে ফিরে এলো আগের জায়গায়।
ছেলেকে পাশে নিয়ে গভীর তৃপ্তির ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে ময়না। তার পাশেই একটা এঁটো শালপাতা। এর মধ্যেই ময়নাকে খিচুড়ি খাইয়ে দেওয়া হয়েছে খানিকটা। নার্সিংহোমে সদ্য মায়েদের জ্ঞানই ফেরে অনেক পরে। সে–বেলা তাদের কিছু খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখানে সবকিছুই আলাদা। ময়না সন্তান প্রসব করেছে সজ্ঞানে। একটু দূরের একটা বাঁশবন থেকে কঞ্চি তুলে এনে তা দিয়ে তার নাড়ি কাটা হয়েছে। ময়না ছেলেকে স্তন্য পান করিয়েছে, নিজে খাবার খেয়েছে, বেশ কয়েক পা হেঁটে সে নাকি বাথরুম করতেও গিয়েছিল।
যে–যার পোঁটলা–পুঁটলি গুছিয়ে নিচ্ছে। গোবিন্দ কিছু খেয়ে যায়নি, তাই সুশীলাদি তার জন্য রেখে দিয়েছে খানিকটা খিচুড়ি। তিনটে হাঁড়ির মধ্যে দুটো ওরা ভেঙে দিয়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত যেটাতে কিছু খিচুড়ি রাখা আছে, সেটাই ভাঙেনি। হাঁড়িটা হাতে তুলে নিল সুশীলাদি। এবার ময়নাকে জাগাতে হবে।
তার অবশ্য দরকার হলো না। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে পায়ের শব্দ করতে করতে তখনই ফিরে এলো গোবিন্দ। বিষণ্ন, থমথমে তার মুখ। মাথা নীচু করে পা টেনে টেনে হাঁটছে।
সুশীলাদি চেঁচিয়ে উঠল, গোবিন্দ, গোবিন্দ!