শেষ দেখা হয়নি – ৫

বিকেলের দিকে একটা বড়গোছের ব্যাপার ঘটল।

সারা দুপুর শুয়ে রইলাম খাটিয়ায়। আর কেউ এসে বিরক্ত করেনি। অনেকেই বোধহয় ভাত–ঘুম ঘুমোচ্ছিল। আমার ঘুম আসার প্রশ্নই ওঠে না, তবে মাঝে মাঝে একটু তন্দ্রা আসছিল। তাতে আমি শুধু সমুদ্রের দৃশ্য দেখছিলাম। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ, উত্তাল জলরাশি। মাঝে মাঝে জলের ছিটে এসে যেন লাগছে আমার মুখে।

সমুদ্রে অত জল, তবু তা পান করা যায় না। এইটাই কি আমার তন্দ্রার মর্ম? ভাতের বাটিটা সুশীলাদি নিয়ে গেলেও জলের মগটা রয়ে গেছে। তবু আমি জল খাইনি এখনো। খুব কষ্ট হলে এক চুমুক খাব ঠিকই। জলটা আছে, সেটাই প্রধান ভরসা। ধুলো ময়লা যাতে না পড়ে সেইজন্য মগটার ওপর আমার জামাটা চাপা দিয়ে রেখেছি।

পারা যায়, জল না খেয়ে দু’একদিন কাটিয়ে দেওয়া যায় ঠিকই। একসময় যে বুক ফেটে যাবার মতন কষ্ট হচ্ছিল, এখন তো আর সেরকম কষ্ট নেই। ছটফটানি হচ্ছে বরং সিগারেটের জন্য। শরীর নিকোটিন দাবি করছে। কিন্তু সিগারেট পাওয়ার তো কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভবেন গাইনের বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধ পাবার পরেই চনমন করছে মনটা

জীবনে আর কি কখনো সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়া হবে? আর কোনোদিন যাওয়া হবে না দিকশূন্যপুরে?

একসময় একটা বেশ জোর হৈ চৈ–এর শব্দ পাওয়া গেল। চ্যাঁচামেচিটা দূর থেকে কাছে চলে আসছে। এবার কি পুলিশ এলো? আবার ওরা আমাকে কম্বল চাপা দেবে?

জানলাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছোট ছেলেমেয়েদের গলার শব্দই বেশি। তাতে কোনো আতঙ্কের চিহ্ন নেই।

ভালো করে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম। এক দঙ্গল বাচ্চা একজন কাকে যেন ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে। চোর ধরা পড়েছে নাকি? এইরকম একটা হতদরিদ্র গ্রামেও চোর ঢোকে।

একটু কাছে আসার পর দেখা গেল চোর একটি যুবতী মেয়ে। তার বুকের কাছে একটা কাপড়ের পুঁটুলি। একে আগে দেখিনি। এই গ্রামে এই প্রথম একটি সত্যিকারের যুবতী দেখলাম। মুখে দারিদ্র্যের ছাপ আছে ঠিকই, কিন্তু তার স্বাস্থ্য খারাপ নয়। তার কোমরে খাঁজ আছে, বুকে নারীত্ব আছে।

সুশীলা, বড়কাকা, আরও কয়েকজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো কাছাকাছি বাড়ি থেকে। বাচ্চারা তাদের দেখে চেঁচিয়ে উঠল, পালাচ্ছিল! পালাচ্ছিল! মাঠ দিয়ে দৌড়োচ্ছিল! আমরা ধরে এনেছি!

যুবতীটির মুখে লজ্জা, রাগ, বিরক্তি, অসহায়তা এক সঙ্গে মেশানো। বড়রা যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন বাচ্চাদের ওপর গ্রাম পাহারা দেবার কাজ দেওয় হয়েছিল মনে হচ্ছে। বাচ্ছারা তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছে, তারা একটি চোর ধরে এনেছে।

একটু বাদেই আমার ভুল ভাঙ্গল। এই মেয়েটি অন্য গ্রামের চোর নয়। একে সবাই চেনে।

বাচ্ছাদের কোলাহল থামিয়ে সুশীলা গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিলি, ময়না? আমাদের কারুকে কিছু না বলে…

যুবতীটির মুখখানা কুঁকড়ে গেল। সে কোনো কথা বলল না।

বড়কাকা বলল, পালিয়ে যাচ্ছিল? এ তো বড় আশ্চর্যের কথা। এই বিপদের সময় কেউ একলা একলা গাঁ ছেড়ে যায়? সঙ্গে ঐ পুঁটুলিতে কী?

সুশীলা যুবতীটির হাত ধরে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিলি, বল না! কী হয়েছে তোর!

একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠল, দৌড়ে পালাচ্ছিল। আমি ধরতে গেলাম, প্রথমে আমাকে ঠেলে ফেলে দিল!

সুশীলা বলল, এই তোরা যা এখন এখেন থেকে।

বড়কাকা বলল, ছোটগুলো তো বেশ বড় কাজ করেছে। ময়না বউ পালিয়ে যাচ্ছিল…

সুশীলা আবার সহানুভূতির সুরে বলল, এই ময়না, চুপ মেরে রইলি কেন? হাতে পুঁটুলি নিয়ে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিলি?

ময়না এবার বলল, আমার বাপের বাড়িতে।

বড়কাকা ভুরু তুলে বলল, বাপের বাড়ি? সে তো সেই বিনপুর! অদ্দূরে একলা একলা… এই খারাপ টাইমে…

সুশীলা এখনও নরম গলায় বলল, বাপের বাড়ি যাচ্ছিলি? আমাদের কারুক্কে কিছুটি না বলে…তখন একসঙ্গে খেতে বসলি, তখনও তো কিছু বললি না আমাকে? বাপের বাড়িতে যাবি কেন?

ময়না মুখ নিচু করে বলল, এখানে আমার ভালো লাগছে না!

–আমরা সবাই রয়েছি, আমাদেরই কি ভালো লাগছে? সবসময় একটা ভয়…তা বলে নিজেদের লোকজন ছেড়ে… কী হয়েছে সত্যি করে বল তো? অন্য একজন বয়স্ক লোক বলল, রতনের বউ চুপি চুপি গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিল, এ তো ভালো কথা নয়! রতন ওর সঙ্গে কিছু সাঁট করে যায়নি তো?

সুশীলা বলল, আঃ, তোমরা চুপ করো না। আমি তো শুধোচ্ছি। বল্, ময়না, তুই বিনপুরে যাচ্ছিলি কেন?

—দুপুরে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি, আমার মায়ের খুব অসুখ। বাড়াবাড়ি!

–তোর মায়ের তো সারা বছরই অসুখ।

—এখন বাড়াবাড়ি হতে পারে না? বললাম তো, আমার ভালো লাগছে না!

–মায়ের অসুখ স্বপ্ন দেখিছিস বলে তুই একা একা যাবি কেন? আমাদের বলে গেলে দোষ কী হতো? যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেতি, তা হলে আমাদের সবার হাতে যে দড়ি পড়ত!

ময়না আর কোনো উত্তর দিল না।

অন্য একজন স্ত্রীলোক বলল, ও সুশীলাদি, ব্যাপার সুবিধে মনে হচ্ছে না! ও বিনপুর যাচ্ছিল না জামসেদপুর পালাচ্ছিল?

সুশীলা এবারে ময়নার গালে এক চড় কষিয়ে বলল, এই হারামজাদী, কোথায় যাচ্ছিলি ঠিক করে বল!

ময়না হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

তিন–চারজন এক সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, ওকে ধরে রাখো। হাত–পা বেঁধে রাখো।

কেউ গলা চড়িয়ে বলল, আমি আগে থেকেই জানি, এ মাগিটা ভালো না!

সুশীলা ঠাঁই ঠাঁই করে ময়নাকে আরও দুটো চড় মেরে বলল, সর্বনাশী, তুই আমাদের সব্বাইকে বিপদে ফেলতে চাস? তোর চোখের চামড়া নেই!

ময়নার বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ গুরুতর। ময়নার স্বামী রতন ডাকাতির সব গয়না বিক্রি করবার জন্য জামসেদপুরে গেছে। এখন অনেকে বলছে, তাকে একা যেতে দেওয়া উচিত হয়নি। কাল রাতে অবশ্য গোবিন্দ ছাড়া আর কেউ রতনের সঙ্গে যেতে সাহসও করেনি। গোবিন্দকে যেতে দেওয়া হয়নি, কারণ পুলিশ–টুলিশ এলে সামলাবার জন্য গোবিন্দর উপস্থিত থাকা দরকার।

এখন বোঝা যাচ্ছে, রতনকে কেউ কেউ সন্দেহ করে। গয়না বিক্রির টাকা নিয়ে সে যদি ফিরে না আসে! গয়না বিক্রির টাকাই তো অনেক টাকা। ভিড়ের চ্যাঁচামেচিতেই আমি শুনতে পেলাম, বাসের লোকজনের কাছ থেকে ওরা পেয়েছে দু’ হাজার তিনশো সতেরো টাকা, গয়না বিক্রি করে ওরা অন্তত দশ হাজার টাকা আশা করে।

সেই টাকা যদি রতন একা আত্মসাৎ করে দেয়? ওর বউয়ের পালাবার চেষ্টায় সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। হয়তো সেরকম কথা রতন তার বউকে আগে থেকেই বলে গিয়েছিল।

আবার এমনও তো হতে পারে, বউটি তার মায়ের সম্পর্কে সত্যিই খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। অন্যদের বলতে গেলে কেউই তাকে এখন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে দিত না। বেশির ভাগ লোক ঘুমোচ্ছে, তবু বাচ্ছারা যে তাকে ধরে ফেলবে, তা সে কল্পনাই করেনি। গোটা পনেরো–কুড়ি বাচ্ছার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

মায়ের জন্য তার মন উতলা তো হতেই পারে। এখানে সর্বক্ষণ একটা উদ্বেগ সেটা তার সহ্য হচ্ছিল না।

একথাও ঠিক, এ গ্রাম থেকে যে–ই পালাবে, সে–ই বিশ্বাসঘাতক। সে ডাকাতির দায় এড়াতে চায়, নিরাপদ কোনো জায়গায় যেতে চায়।

সবাই মিলে টানতে টানতে ময়নাকে এই বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলো। এ বাড়িতে বন্দীর সংখ্যা আর একটি বাড়ল। সুশীলার বাড়িটিই প্রধান ঘাঁটি দেখা যাচ্ছে।

বাচ্ছাদের দূরে হঠিয়ে কয়েকজন মুরুব্বি গোছের লোক ময়নাকে জেরা করতে লাগল আমার ঠিক সামনের ঘরটায়। মাটির দেয়াল ভেদ করে সব কথা শোনা যায়। গোবিন্দ কোথায় গেল, এইরকম একটা সংকটের সময় সে উপস্থিত নেই কেন? সে এখনো ঘুমোচ্ছে?

পাশের ঘরে একজন কেউ ময়নাকে জিজ্ঞেস করল, রতন তোকে কী বলে গেছে সত্যি করে বল! বল!

ময়না বলল, কিচ্ছু বলে যায়নি। সে কোথায় গেছে আমি জানিই না!

– থাবড়া খাবি! গায়ে লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দেব। এখনো সত্যি কথা বল!

–সে কোথায় গেছে আমি জানি না।

—তবে চলে যাচ্ছিলি কেন গ্রাম ছেড়ে!

–বেশ করিছি! আমি কাউর কছে দাসখৎ দিইনি যে এখানে থাকতেই হবে!

—হারামজাদী, তুই আমাদের সবাইকে হাতে–দড়ি পরাতে চাস? আমরা ধরা পড়লে তুই বাঁচতি!

—আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও, আমি মায়ের কাছে যাব।

–মায়ের ওপর যদি তোর অত টান, তবে গত এক বছরের মধ্যে একবারও বিনপুরে যাসনি কেন? গত মাসে তোর ভাই এসেছিল, তখনও তো তুই গেলি না। আজই হঠাৎ তোর মায়ের ওপর দরদ একেবারে উথলে উঠল? কোথায় যাচ্ছিলি, কেন যাচ্ছিলি, সত্যি করে বল…

আবার কয়েকটা চড়চাপড় মারার শব্দ। ময়না কিন্তু কাঁদছে না। মার খেয়েও চুপ করে থাকছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, ময়না ঠিকমতন যুক্তি দেখাতে পারছে না। তার মায়ের অসুখের ছুতোটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না ঠিক। বেশি বয়েস হলে তো মানুষের অসুখবিসুখ হবেই এবং একদিন মরেও যাবে, তাতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই, অন্যদের কথার মধ্যে ফুটে উঠছে এই সুর।

এবারে ভবেন গাইনের গলা পাওয়া গেল। সে শুধু এ গ্রামের জামাই নয়, সে লেখাপড়া জানা লোক, অফিসে চাকরি করেছে, সে কথা বলতে শুরু করলে সবাই থেমে যায়।

ভরেন বলল, শোনো, শোনো, সবাই শোনো, রতনের এতক্ষণ ফিরে আসা উচিত ছিল না? ও ব্যাটা নির্ঘাৎ টাকাগুলো মেরে দেবার মতলব করেছে।

সুশীলাদি বলল, যাঃ, ও কথা বলিসনি, ভবেন। রতন এর মধ্যে ফিরবে কী করে? জামসেদপুর কি কম দূর? তার ওপর জিনিসগুলো বিক্কিরি করার ব্যাপার আছে। ঠিক মতন সুলুকসন্ধান করে বেচতে হবে তো! আজকের দিনটা লেগে যাবে। হয়তো আরও দু’একটা দিন লেগে যেতে পারে। রতন ঠিক সময় মতন আসবে।

ভবেন বলল, সে গুড়ে বালি! আমি বলে দিচ্ছি, শুনে নাও, ঐ রতন আর ফিরবে না।

বড়কাকা বলল, না–না, রতন সেরকম ছেলেই না। সে একটা দায়িত্ব নিয়েছে, সে ঠিক ফিরে আসবে।

—শোনো বড়কাকা, দশ–বারো হাজার টাকা কখনো চোখে দেখেছ? অতগুলো টাকা হাতে পেলে আচ্ছা আচ্ছা মানুষেরও মাথা ঘুরে যায়। ঐ টাকা নিয়ে সে যদি বোম্বাই পালিয়ে যায়, কেউ তাকে ধরতে পারবে? ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে। হোটেলে খাবে, সিনেমা দেখবে! বউটা তো ভেগে যাচ্ছিল সেইজন্যই। ঐ টাকায় দু’জনে মজা লুটবে!

সুশীলাদি বলল, তা কখনো হয় নাকি রে? রতন আর গোবিন্দর কথা শুনেই তো আমরা বাস আটকালুম, না হলে ঐরকম চিন্তা কি আমাদের মাথায় আসত? ও বড়কাকা, তুমিই বলো না ঠিক বলছি কি না! এখন আমাদের এই বিপদের মধ্যে ফেলে রতন চলে যাবে? যাঃ, কী যে আকথা–কুকথা বলিস তোরা! রতন গ্রামের মানুষের সুখে–দুঃখে সব সময় পাশে দাঁড়ায়। তোর শ্বশুরকে যখন সাপে কাটল, তখন রতনই তো…

—তাহলে ওর বউটা কেন পালাচ্ছিল বলো? আগে থেকে সাঁট না থাকলে এমন চুপি চুপি ভেগে পড়ার আর কী মানে হয়! এক কাজ করো তবে, একটা খুন্তি গরম করে এনে ওকে ছ্যাঁকা দাও। দ্যাখো, সত্যি কথাটা বলে কি না!

সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল।

ভবেন আবার প্রবল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাকে যেন আদেশ করল। এই কুঁচি, বাইরের উনুনে এখনও আঁচ আছে, একটা খুন্তি গরম করে নিয়ে আয় তো। আমি দেখছি, এ মাগির পেট থেকে কথা বার করা যায় কি না।

এই ভবেনটা সত্যিই একটা সাইকোলজিক্যাল কেস। রতনের বউ ময়নার একটি বিশেষ অঙ্গে সে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেবে ভেবেই তার গলায় বেশ একটা উল্লাসের সুর ফুটে উঠেছে। বড়লোক, ব্যবসায়ী, জোতদার, পুলিশরা যেমন গরিবদের ওপর অত্যাচার করে, তেমনি গরিবরাও গরিবদের ওপর কম অত্যাচার করে না।

একজন কে যেন মিনমিন করে বলল, রতন যদি ফিরে আসে, তারপর যদি সে শোনে যে তার বউকে মারধোর করা হয়েছে?

ভবেন হুংকার দিয়ে বলল, সে ফিরবে না! যদি সে ফেরেও, তার কাছ থেকেও কৈফিয়ৎ চাওয়া হবে, কেন তার বউ পালাচ্ছিল! তাহলে বউটারই কোনো বদ মতলব আছে!

বড়কাকা এবার একটু খুকখুক করে কেশে বলল, শোনো ভবেন, আমি বলি কি, এখনই এতটা করা ঠিক হবে না। রতনের ফিরে আসার টাইম পেরিয়ে যায়নি। সুশীলাদি প্রায় হাহাকার করে বলে উঠল, রতনের ফেরার টাইম হয়নি বলছ কি গো? রতন না ফিরলে আমাদের কী গতি হবে? আবার তো সেই আমরা না খেয়ে মরব! রতনকে ফিরতেই হবে!

বড়কাকা বলল, আমি তো সেই কথাই বলছি। রতনের জন্য অপেক্ষা করা যাক। ততক্ষণ ওর বউকে কোথাও আটকে রাখো। রতন ফিরলে ময়নার বিচার হবে!

সুশীলাদি বলল, এইটা তুমি ঠিক কথা বলেছ বড়কাকা। এই ভবো, তোর বাড়িতে ময়নাকে বন্ধ করে রেখে দে।

ভবো নামের লোকটি আঁতকে উঠে বলল, আমার বাড়িতে? মাফ করো গো, সুশীলাদি। সন্ধেবেলা ট্রাক ধরে যদি রতন ফিরে আসে আর শোনে যে আমার বাড়িতে ময়নাকে আটকে রেখেছি, তা হলে প্রথমেই সে আমাকে পেটাবে!

সুশীলাদি বলল, তা হলে নিতাই, তোর বাড়িতে রাখ!

নিতাই বলল, আমায় বুঝি রতন পেটাবে না? আমার ওপর তার এমনিতেই একটা ব্যাপারে রাগ আছে। তারচে, সুশীলাদি, এক কাজ করো না। তোমার ঐ ঘরে যে কলকাতার ছোঁড়াটা আছে, সেইখানেই ময়নাকে রেখে দাও না!

ভবেন বলল, বা–বা–বা–বা–বা–বা! ব্যাটাছেলে আর মেয়েছেলে এক ঘরে থাকবে? কী আক্কেল রে তোদের? পুলিশের গারদেও মদ্দা–মেয়েমানুষদের এক জায়গায় রাখে না!

বড়কাকা বলল, আহা, তাতে কী হয়েছে। আমরা চোখে চোখে রাখব এখন। রাত্তির বেলা অন্য ব্যবস্থা করা যাবে! রতন হঠাৎ করে এখন ফিরে এলেও সুশীলার ওপর বেশি রাগ করবে না। সুশীলাকে সে মান্যি করে।

সুশীলাদি বলল, তোমরা সব কিছুই আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছ?

বড়কাকা বলল, এই বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে রে, সুশীলা। হুটহাট করে কিছু একটা করে বসা ঠিক না! রতনের ব্যাপারটা মনের মধ্যে একটা খটকা লাগিয়ে দিল!

কয়েকজন মিলে ঠেলে ঠেলে ময়নাকে ঢুকিয়ে দিল ‘আমার’ ঘরের মধ্যে। ময়না দু’ হাতে তার পুঁটলিটা ধরে আছে বুকের কাছে। তার চোখদুটি ভয় পাওয়া বেড়ালের মতন। সে দাঁড়িয়ে রইল দেয়ালের এক কোণে। সুশীলাদিরা আবার বাইরে গিয়ে ফিসফাস করে কী সব আলোচনায় মেতে গেল।

আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গেল হঠাৎ। ময়নাকে এ ঘরে রাখা আরও খারাপ হলো আমার পক্ষে। আমার ধারণা, রতন ঠিকই ফিরে আসবে। তাকে যতটুকু দেখেছি, সে বেশ মারকুট্টে ধরনের হলেও, বিশ্বাসঘাতক টাইপ বলে মনে হয় না। সে নেতাগিরি করতে ভালেবাসে মনে হয়। নেতা হবার অনেকগুলো লক্ষণ আছে তার মধ্যে। আমাকে মারার ব্যাপারে তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। এখনই যদি সে ফিরে আসে এবং তার বউকে ও আমাকে একঘরে দেখে, তা হলে আমাকে খুন করার আরও বেশি উৎসাহ পেয়ে যাবে সে। শহরের লোকের প্রতি রাগের সঙ্গে যুক্ত হবে আমার প্রতি তার ব্যক্তিগত ক্রোধ!

জীবনে আর কখনো কোনো নারীর সান্নিধ্য এমন অবাঞ্ছিত মনে হয়নি আমার ময়না আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সে আমার সম্পর্কে কী ভাবছে কে জানে! গ্রাম্য মেয়েদের তুলনায় সে বেশ লম্বা। স্মিতা পাতিলের মতন অভিনেত্রীরা যখন গ্রামের গরিব মেয়ে সাজে, তখন এই ময়নার মতন দেখায়। আবার উল্টো করেও বলা যায়, ময়নাকে ভালো শাড়ি পরালে ও মুখে স্নো–পাউডার মাখলে শহুরে– সমাজেও খুব একটা বেমানান লাগবে না। রতনেরও বেশ শক্তসমর্থ চেহারা।

একই খাঁচার মধ্যে দু’ জায়গার দুটো পাখিকে আটকে রাখলে তারা কি নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় শুরু করে? ময়না কেন চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছিল, সে সম্পর্কে জানতে আমারও খুব কৌতূহল হচ্ছে। কিন্তু ময়নার সঙ্গে আমার যেচে কথা বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

পাশের ঘরে তর্ক শুরু হয়ে গেছে, দু’বেলাই ভাত খাওয়া হবে কি না সেই বিষয়ে। অধিকাংশেরই মত, বিকেলে আবার রান্না হোক। এমনকি বড়কাকাও তাই চায়। সুশীলার এতে ঘোর আপত্তি। দু’বেলা খাওয়া শুরু করলে এই কটা টাকায় কদ্দিন চলবে? আগে তো একেবারেই ভাত জুটছিল না, এখন একবেলা খাওয়াই যথেষ্ট। একজন কে চেঁচিয়ে বলল, শুধু চাল–ডাল ছাড়া আর কিছু আনা হয় নি। এক বস্তা চিঁড়ে কিংবা মুড়ি আনলেও তো হতো। রাত্তিরে কি উপোস করে থাকব?

বড়কাকা বলল, হ্যাঁ রে সুশীলা, ভবো ঠিকই বলেছে। ঘরে চাল না থাকলে অগত্যা না খেয়ে থাকতেই হয়। কিন্তু চাল জমা রয়েছে, অথচ রাত্তিরে দুটি খাব না, এ আবার কেমন ধারা কথা! রাত্তিরে যে ঘুম হবে না!

সুশীলা বলল, তোমাদের রাক্ষুসে পেট! দু’দিনেই সব ফুরিয়ে ফেলবে, তারপর কী বসে বসে আঙুল চুষবে?

কেউ একজন তেড়িয়া ভাবে বলল, কেন, আমরা আবার একটা বাস থামাব!

আর একজন বলল, বাস কেন, চালের বস্তা ভর্তি ভর্তি লরি যায়। একখানা লরি কব্জা করতে পারলে এই খরাটা পার হয়ে যাবে!

–রোজই চালের লরি যায়, আমি দেখিছি।

—গ্রামে চাল না থাকলে কী হয়, শহরের লোক প্রত্যেকদিন দু’বেলা ভাত খায়।

—লরি করে যে অত চাল যাচ্ছে, কোথা থেকে আসে গো? আমাদের ইদিকে তো গত বছরেও ভালো ধান হয়নি। এ বছরে,জমিতে এখনও লাঙল পড়ল না, বীজতলা হলো না…

ওসব হচ্ছে গভর্নমেন্টের চাল। গুদোমে জমা থাকে।

সুশীলা বলল, তোরা আবার বাস থামাবি, লরি থামাবি বলছিস, বারবার পুলিশ আমাদের ছেড়ে দেবে? যদি অতই সহজ হতো, তা হলে গ্রামে আর কেউ না খেয়ে থাকত না।

—তুমি অত ভয় পেয়ো না তো, সুশীলাদি! এবারে একখানা চালের লরি আটকাবই। তারপর পুলিশের গুলি খেয়ে মরি কি জেল খাটি সেও ভি আচ্ছা, তার আগে শালা কটা দিন পেট পুরে দু’বেলা ভাত খাব। এমন শালা কপাল করে জন্মেছি, জীবনে পর পর কটা দিন দু’বেলা ভাত পেয়েছি বলো তো?

—আজ প্রথম দিনটা অন্তত দু’বেলা ভাত খেয়ে নিই। সুশীলাদি, তুমি না বলো না!

বেশ কয়েকজন হৈ হৈ করে সমর্থন জানাল এই প্রস্তাবে।

একটু পরে সুশীলাদি এসে ঢুকল এই ঘরে। দরজাটা ভেজিয়ে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে একবার আমাকে, একবার ময়নাকে দেখল। খাঁচার পাখিরা তবু নড়াচড়া করে, আমরা দু’জন ঘরের দু’কোণ থেকে একটুও নড়িনি।

সুশীলাদি মিনতিমাখা গলায় জিজ্ঞেস করল, ও ময়না, তুই কোথায় যাচ্ছিলি, আমাকে বল? লক্ষ্মীটি, আমাকে শুধু বল তুই।

ময়না ঝট করে একবার তাকাল আমার দিকে।

সুশীলাদি বলল, ও থাক না, ও শুনলেও ক্ষতি নেই, ও তো আর পাঁচজনকে বলতে যাচ্ছে না!

ময়না তবু কিছু বলল না।

এবারে সুশীলাদি ধৈর্যের শেষ সীমায় গিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ও ময়না, বল, আমাকে বল, তোর হাতে ধরছি, সত্যি কথাটা বল, পাঁচজনে তোর নামে যা তা বলছে…

এবারে ময়নাও হু হু করে কেঁদে উঠল। সুশীলাদির কাঁধের ওপর মাথা রেখে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলল, তোমরা…আমার ঘরের মানুষটাকে…একা অত দূরে পাঠালে…যদি তার কোনো বিপদ হয়? সঙ্গে আর কেউ গেল না…ওর কাছে অত দামী জিনিসপত্তর, যদি কেউ ওকে মেরে ধরে কেড়ে নেয়…তোমরা কেউ সেই কথাটা একবার ভাবলে না? নিজেরা সবাই ভাত খেলে, সে কি কিছু খেয়েছে?

—তুই রতনকে খুঁজতে যাচ্ছিলি?

ময়না শুধু কেঁদে ভাসাতে লাগল সুশীলাদির কাঁধ। ময়নার এই কান্নার মধ্যে মিথ্যে নেই। রতনকে এরা বেশ বিপজ্জনক কাজে পাঠিয়েছে ঠিকই। স্বামীর বিপদের কথা তার স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে অনুভব করবে? স্বামীর চিন্তায় উতলা হয়ে ময়না যদি তার খোঁজ করতে যেতে চায়, সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু জামসেদপুরের মতন বড় শহরে ময়না কোথায় খুঁজে পেত রতনকে?

সুশীলাদি ময়নাকে সান্ত্বনা দিল কিছুক্ষণ। বারবার বলতে লাগল, রতন ঠিক ফিরে আসবে, তার কোনো বিপদ হবে না। সে বুদ্ধিমান, তার গায়ে জোর আছে…

একসময় ময়নার চোখ মুছিয়ে সুশীলাদি তাকে নিয়ে গেল বাইরে। পাশের ঘরটা এখন খালি, অনেকেই জমা হয়েছে বাইরের গাছতলার বেদির কাছে। ময়নাকে দেখেই আবার চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। সুশীলাদি ময়নার পক্ষ নিয়ে জোর গলায় বলতে গেলেও বিশেষ লাভ হলো না। ওখানে বেশ কয়েকজন রতনকে অপছন্দ করে বোঝা যাচ্ছে, এরকম একটি মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী ও চলনসই চেহারার স্ত্রী আছে বলে তারা বোধহয় রতনকে ঈর্ষা করে। ভবেনের গলাটাই বেশি শোনা যাচ্ছে।

অনেকটা প্রায় জনতার রোষ থেকে বাঁচাবার জন্যই সুশীলাদি আবার ময়নাকে ফিরিয়ে আনল এ–ঘরে।

একটু বাদেই গলা শোনা গেল গোবিন্দর। তিন–চারজন একসঙ্গে তাকে শোনাল ময়নার বৃত্তান্ত। গোবিন্দ প্রথমে অবাক তারপর ক্রুদ্ধ হয়ে শুরু করল বকাবকি। রতন তার বন্ধু, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সে ঐ মালপত্রগুলো নিয়ে টাটানগর গেছে, তবু কোন্ নিমকহারাম তাকে সন্দেহ করে? কোন্ শুয়োরের বাচ্চা, সে গোবিন্দর সামনে এসে কথা বলুক তো!

চ্যাঁচামেচি তবু থামল না। গোবিন্দর নেতৃত্ব সবাই মেনে নিতে চাইছে না। ময়নার পালাবার চেষ্টাটাকে অনেকের কাছেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। গোবিন্দর গলা সপ্তমে চড়ে গেল, অন্যরাও কম যায় না।

আমার মনে হলো, ময়নাকে কেন্দ্র করে এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে এবার দলাদলি ও ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে। ওরা সবাই মিলে ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে, ওরা শেষপর্যন্ত এককাট্টা হয়ে থাকতে পারলে তবু বাঁচতে পারবে। কিন্তু গ্রামের লোকেদের মধ্যে একতা, শুধু গ্রামের লোক কেন, বাঙালি জাতির যে–কোনো কাজেই একতা অতি দুর্লভ বস্তু। আর যে–কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে নারীর স্থান একনম্বর।

সেই নারীটি এবার বসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। জানলার বাইরে কী নিয়ে যে গণ্ডগোল চলছে, তাতে তার যেন কোনো আগ্রহই নেই। সে তার কাপড়ের পুঁটুলিটা খুলল। একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো থেকে বেরুল পান!

আজ সকাল পর্যন্ত ওদের এখানে ভাতের টান ছিল, তবু ময়না পান জোগাড় করল কী করে? এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতেও তার পান না খেলে চলছে না?

ওরা ময়নাকে এ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে খুবই অন্যায় করেছে। ওরা আমাকে আর সব ব্যাপারেই বঞ্চিত করলেও মাঝে মাঝে নির্জনতার সুখও দেবে না? কাছাকাছি আর একটি মেয়ে বসে থাকলে সেদিকে মনোযোগ চলে যাবেই!

আমার পানের নেশা নেই, কিন্তু ময়নাকে পান খেতে দেখে আমার জল তেষ্টাটা ফিরে এলো। জলের মগটা এখনো রয়েছে। তবু সেটা আমি ছুঁলাম না। এইটুকুই আমার মনের জোরের পরীক্ষা।

ময়নার দিকে পেছন ফিরে আমি গিয়ে দাঁড়ালুম জানলার কাছে।

বড়কাকা দু’হাত তুলে, এই চুপ কর, চুপ কর, শোন আমার কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কান দিচ্ছে না তার কথায়। ভবেন আর গোবিন্দর মধ্যে চলছে গালাগালির তরজা–লড়াই।

একটি নারীর জন্য ওদের বিভেদ সৃষ্টি হলেও আর একটি নারীই ওদের সামলাল। সুশীলাদি গিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সরিয়ে দিল ভবেনকে। গোবিন্দর গাল চেপে ধরে বলল, মুখ সামলাবি কিনা, হারামজাদা? নইলে বঁটি দিয়ে তোর গলা কেটে ফেলব, দেখবি, দেখবি?

এই গ্রামে সুশীলাদিরই একমাত্র নেত্রী হবার যোগ্যতা আছে। যে–কোনো পরিবেশে গিয়ে পড়লেই এই ধরনের মেয়েরা নিজেদের ব্যক্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারে। সুশীলাদি কিন্তু পুরুষালি, জাঁদরেল ধরনের নয়, সে মাঝে মাঝে কেঁদেও ফেলে, কিন্তু তার কথার মধ্যে বিশ্বাসের জোর আছে।

সবাই একটু শান্ত হলে সুশীলাদি বলল, আগে কী ঠিক করা হয়েছিল মনে নেই? যে যা খুশি বলবে, যার যেমন ইচ্ছে পথে চলবে, এরকম কথা ছিল? এতদিন তো এই করে করে মরেছি। কাল দুপুরে আমরা কী ঠিক করেছি? বড়কাকা আমাদের মোড়ল, সে যা বলবে সব্বাইকে মেনে নিতে হবে! এখন বড়কাকার মুখের ওপর কথা বলছিস যে তোরা? ছাতারে পাখির মতন একসঙ্গে চিলুবিলু করছিস!

কে একজন ফোড়ন কাটল, বড়কাকা যখন এবেলা ভাত খাওয়ার কথা বলল, তুমিই তো তখন বাগড়া দিলে সুশীলাদি?

—শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছি না কি? ওবেলার ভাত হজম হতে না হতেই এবেলা খাওয়ার কথা! বকরাক্ষস এক একটা!

–তা হলে বড়কাকা, তুমি কী বলবে বলো! রতনের বউ বলেই তার ছাড়াছুড়িন নেই!

বড়কাকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, আমি কি অনেয্য কিছু বলেছি? ময়না বউ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, তাকে ধরে রাখা হয়েছে। ও এখন সেই রকমই ধরা থাক। রতন ফিরলে তারপর ওর বিচার হবে!

– আর রতন যদি না ফেরে?

—অমন আকথা–কুকথা যে এখন থেকে বলবে, তাকে ধরে পেটানো হবে, এই আমি বলে রাখছি। রতন ফিরবে না কেন, আলবাৎ ফিরবে। বউটার মাথা খারাপ বলে কি রতনেরও মাথা খারাপ হবে? ব্যস, চুপ। আর ও সম্পর্কে এখন কোনো কথা হবে না। ময়না থাকবে সুশীলার জিম্মায়। দে ভবেন, একটা বিড়ি দে!

গোবিন্দ বলল, বড়কাকা, এই আমি বলে রাখলুম, রতনের বউয়ের গায়ে যদি কেউ হাত তোলে তবে আমি তাকে ছাড়ব না!

সুশীলাদি বলল, আঃ গোবিন্দ, আমি রয়েছি না! হ্যাঁরে, ছিরু বলল— হাঁড়িখোলা গ্রামে কী নাকি গণ্ডগোল হয়েছে!

গোবিন্দ বলল, সেই কথাটাই তো আমি বলতে এয়েছিলুম। সবাই মিলে এমন বাজে হাঙ্গামা শুরু করলে…

—কী হয়েছে রে, কী হয়েছে?

—খুব খারাপ খবর। হাঁড়িখোলায় আজ ভোরবেলা পুলিশ এসেছিল! –তুই কোথ থেকে শুনলি?

–নদীর ওধারের জঙ্গলটায় আমি ছাতু খুঁজতে গিসলুম। দেখি যে মাদখেরিয়ার হাসা শবর আর ধীরু শবর দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ওদের মুখেই শুনলুম যে ভোরবেলা হাঁড়িখোলায় শবরদের গ্রামে পুলিশ এসে তছনছ করেছে।

বড়কাকা বলল, যায় শত্রু পরে পরে। তবে তো ভালোই হয়েছে রে! পুলিশ শবরদের সন্দেহ করেছে। ও শালারা তো সবাই চোর।

সুশীলাদি উদ্বিগ্ন ভাবে বলল, ওদের কাছে পুলিশ কী পাবে? ওদের অবস্থা তো আমাদের চেয়েও খারাপ রে। ওদের গ্রামে একটা কলাই করা বাসনও নেই কারুর বাড়িতে!

গোবিন্দ বলল, পুলিশ কিছু পাক না পাক, কয়েকখানা বাড়ি ভাঙচুর করেছে, পাঁচ–ছ’জন ব্যাটাছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে।

বড়কাকা তৃপ্তির সঙ্গে বলল, যাক আপদ গেছে। পুলিশ আর তাহলে এদিকে আসবে না।

গোবিন্দ বলল, আগেই অত ঢেঁকুর তুলো না বড়কাকা। সবটা শোনো। হাসা শবর আমার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, তোরা গাঁ শুদ্ধ সবাই বড় সড়কের দিকে গতকালকে গেছিলি কেন রে? পলাশবুনির হাট থেকে তোরা শুনলুম এক বস্তা চাল কিনেছিস সকালবেলা! টাকা পেলি কোথা?

ভবেন বলল, হাসা এই কথা বলল তোকে? এক কোপে তার গলাটা উড়িয়ে দিলি না কেন? দাওটা সঙ্গে নিয়ে যাসনি?

গোবিন্দ তার দিকে রক্তচক্ষে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, অত সোজা, না? শবরদের একজনের গায়ে হাত উঠালে ওরা ছেড়ে কথা কইবে? দল বেঁধে এসে আমাদের গাঁ জ্বালিয়ে দেবে। তা ছাড়া হাসা কি একা শুনেছে ঐকথা? এতক্ষণে মুখে মুখে চাউর হয়ে গিয়েছে। তোমাদের তখনই বলেছিলুম, এক সঙ্গে অতখানি চাল কিনো না। অল্প অল্প করে কেনো, নইলে লোকে সন্দেহ করবে। আংড়া গ্রামে কে কবে একবারে পাঁচ সেরের বেশি চাল কিনেছে?

বড়কাকা বলল, এখন কেউ আর বড় সড়কের দিকে যেও না। গাঁয়ের বাইরে যেও না। একটু চাপাচাপির মধ্যে থাকো। পুলিশ আর এদিকে আসবে না মনে হয়। আমরা সাতপুরুষের চাষাভুষো, পুলিশ আমাদের মিছিমিছি সন্দেহ করবে কেন? পুলিশ ঐ শবর, লোধাদেরই পেটাবে!

–ওরা আমাদের কথা বলে দেবে।

–ওদের কথা বিশ্বাস করবে কে? হেঃ, ও ব্যাটাদের কথার কোনো মা–বাপ আছে?

–বড়কাকা, তুমি চক্ষু বুজে থাকলেই কি সব সেরে যাবে? পুলিশ যখন এদিকে একবার নজর দিয়েছে, তখন কিছু মালকড়ি না পেলে ছাড়বে না। এই গ্রামেও ঢুঁ মারবে।

– আসুক না, এলেও বা কী পাবে এখানে? সেইজন্যই তো রতন বুদ্ধি বাৎলে দিল…

—পুলিশ যদি সুশীলাদিকে জিজ্ঞেস করে, এত চাল এলো কোথা থেকে তাছাড়া, তা ছাড়া…

নাটকীয় ভাবে ঘুরে গিয়ে, একটা হাত তুলে এই ঘরের জানলার দিকে দেখিয়ে গোবিন্দ বলল, তাছাড়া, ঐ লোকটাকে পুষে রেখেছ, পুলিশ এসে যদি কোনো ক্রমে ওর কথা টের পায়, তাহলে কী জবাবদিহি করবে? তখনই বলেছিলুম, ওকে নিকেশ করো!

আমি চট করে সরে এলুম জানলার কাছ থেকে। গোবিন্দর কথাগুলো যেন তীরের মতন ফুটতে লাগল আমার গায়ে। আমাকে ভুলতে পারছে না গোবিন্দ, ঘুরেফিরে সে আমার প্রসঙ্গে এসে পড়বেই। ওর চোখের দিকে আমার তাকাতে ইচ্ছে করে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *