শেষের শুরু

শেষের শুরু

সেদিন উনিশবারের মতো ‘খুবই দুঃখিত’ বলে ঘাড় পর্যন্ত মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাওয়ার পর আমি নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম-অন্তত লোকমুখে তাই শুনেছি।

ঘটনাটা ঘটেছিল এক বিয়ার-গার্ডেনে। সেখানে আমি তখন পার্ট টাইম চাকরি করছিলাম। এরকম ঘটার পেছনের কারণটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কেউ যদি প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খালিপেটে একটানা কাজ করতে থাকে, তবে তার ক্ষেত্রেও এরকম ঘটবে। জ্ঞান ফিরে পাবার বেখেয়ালির মতো ঐ শরীর টেনে টেনেই আমি নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেলাম। কিন্তু চোখ দুটো এতটাই যন্ত্রণা করছিল যে, মনে হচ্ছিল কেউ ধারালো নখ দিয়ে আমার চোখ দুটো কোটর থেকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাই হাসপাতালে যেতে বাধ্য হলাম।

ইমার্জেন্সি রুমে যেতে ট্যাক্সি নেয়ায় আমার অর্থনৈতিক অবস্থা আরও বাজে দিকে মোড় নিল। সেই সাথে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা এর মতো অবস্থা হলো আমার, যখন বিয়ার গার্ডেনের মালিক আমাকে কিছুদিন কাজ থেকে ছুটি নিতে বলল। তার মানে আমাকে আরও কাটছাঁট করে চলতে হবে। কিন্তু কাটছাঁট করার মতো অবস্থাও নেই এখন আমার। শেষ কবে যে পেটভরে খেতে পেরেছিলাম, তা মনে পড়ছে না। চারমাস ধরে দাড়িগোঁফ কাটাচ্ছি না। দুই শীত আগের কেনা একটা জামা দিয়েই কাপড়চোপড়ের চাহিদা মেটাচ্ছি। কলেজে ভর্তি হবার পর কোথাও আড্ডা দিতে বা ঘুরতেও যেতে পারিনি।

বাবা-মায়ের কাছে হাত না পাতার পেছনে আমার কিছু কারণ ছিল। তাই আমার সব খরচ আমাকেই মেটাতে হতো।

সিডি আর বইগুলো বিক্রি করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রত্যেকটা বই আর সিডি একদম বাছাই করে কেনা। কিন্তু যে বাসাতে কোনো কম্পিউটার বা টিভি নেই-সেখানে এসব বিলাসিতা বাদে আর কিছুই না।

ওগুলোকে বিদায় জানানোর আগে সিদ্ধান্ত নিলাম, সবগুলো সিডি একবার করে বাজিয়ে দেখব। কানে হেডফোন লাগিয়ে টাটামির (জাপানিজ স্টাইলের ঘরগুলোর মেঝেতে নরম টাটামি মেঝে হিসেবে, এমনকি বিছানা হিসেবেও কাজ করত) ওপর শুয়ে গান চালিয়ে দিলাম। সেকেন্ডহ্যান্ড দোকান থেকে একটা নীল রঙের পাখাওয়ালা টেবিল ফ্যান কিনেছিলাম। হাত বাড়িয়ে সেটার সুইচও টিপে দিলাম। মাঝেমধ্যে বিরতি নিতে রান্নাঘরে গিয়ে মগে পানিভর্তি করে আনছিলাম।

এই প্রথম বোধহয় আমি কলেজে ক্লাস মিস দিলাম। অবশ্য আমি অনুপস্থিত থাকলে কারো কিছু আসে যায় না। হয়তো আমি যে আসিনি, সেটাই কেউ লক্ষ্য করবে না।

একে একে গানের সিডিগুলো শোনার পর বামপাশের স্তূপে সরিয়ে রাখছিলাম আমি।

তখন গ্রীষ্মকাল চলছিল। বয়স আমার বিশ। কিন্তু পল নিজান (ফরাসি দার্শনিক) লিখে গিয়েছেন, “বিশ বছর বয়স সে জীবনের সেরা সময়, সেটা কাউকে আমি বলতে দেব না।”

আমাদের যখন বিশ বছর বয়স হবে, তখন আমাদের জন্য কিছু একটা ঘটবে। অসাধারণ কিছু। আর তখনই আমরা বলতে পারব, হ্যাঁ, আজ বেঁচে রয়েছি বলে আমরা অনেক খুশি।

হিমেনো দশ বছর আগে এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিল।

ভবিষ্যৎবাণীটা পুরোপুরি ভুল ছিল। এখন পর্যন্ত একটা ভালো কিছু আমার সাথে ঘটেনি, সামনেও ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখছিনা।

হিমেনো এখন কেমন আছে?

হঠাৎ করে জানতে ইচ্ছে করল। ফোর্থ গ্রেডে পড়ার সময় তার পরিবার এখান থেকে চলে গিয়েছিল। এরপর তাকে আমি আর দেখিনি।

এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না।

হয়তো যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। এভাবে চলে যাওয়ার কারণে আমার এভাবে দিনদিন পতন তাকে দেখতে হচ্ছে না। স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ পাড়ি দিতে দিতে আজ আমি অত্যন্ত বিরক্তিকর আর পানসে এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছি।

অবশ্য আরেক ভাবেও কিন্তু ভাবা যায়। আমার ছোটবেলার বন্ধু যদি এভাবে হুট করে বাসা পাল্টিয়ে চলে না যেত, তাহলে হয়তো আমার এরকম অবস্থাও হতো না। যতদিন সে আমার পাশে ছিল, আমি ভালো ছিলাম-’আজকের আমি’ থেকে ভালো ছিলাম। যদি আমি বোকার মতো কিছু করে বসতাম, সে আমার ওপর হাসত। আর হাসার মতো কিছু করলে সে বিরক্ত হতো। এরকম কারণেই আমি তখন ঠিক পথে ছিলাম বলে আমার ধারণা।

গত কয়েকবছর ধরেই এই চিন্তাটা আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

যদি আমার দশ বছরের আমি ‘আজকের আমি’কে দেখতে পেত, সে কী ভাবত?

তিনদিন ধরে শোনার পর সবচেয়ে প্রিয় সিডিগুলো আলাদা করে রেখে দিলাম। বাকিগুলো একটা বাদামি রঙের প্যাকেটে পুরে নিলাম। আমার অন্য ব্যাগটা ইতোমধ্যে পুরোনো বই দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছি। দুইহাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ গনগনে সূর্যের নিচে হাঁটার পর কান ভনভন করতে শুরু করল। ভনভনটা আমাকে সিকাডার গুঞ্জনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল, একটা সিকাডা (একধরনের পোকা) বোধহয় আমার কানের কাছে এসে ভনভন করছে।

গত গ্রীষ্মে, কলেজ শুরু করবার কয়েক মাস পর আমি প্রথমবারের মতো এক পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম। এলাকাটা আমার তখনো চেনাজানা হয়ে ওঠেনি, তাই পথটা সেবার হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এক গলির ভেতর ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পর অবশেষে বইয়ের দোকানটা চোখে পড়ল। এরপর বেশ কয়েকবার ওখানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কীভাবে যেন রাস্তাটা ভুলে গিয়েছি আমি। কোনোভাবেই বের করতে পারিনি বইয়ের দোকানটাকে। নেটে খুঁজতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দোকানের নামটাই যে মনে পড়ছিল না! আমি ওটাকে খুঁজতে খুঁজতে পথ হারিয়ে ফেললে তবেই দোকানটার দেখা মিলত। মনে হচ্ছিল, দোকানটার আলাদা একটা সত্ত্বা আছে; ইচ্ছে হলে কারো সামনে দেখা দেয়, কাউকে দেয় না। এই প্রথম আমি রাস্তা না হারিয়েই দোকানটাকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিলাম।

দোকানটার সামনে উপস্থিত হবার পর লক্ষ্য করলাম, দোকানের বাইরে বেশ কিছু মর্নি গ্লোরি ফুল ফুটে রয়েছে। দরজার বাইরে সস্তায় বিক্রি করে দেয়ার জন্য এক স্তূপ বই রাখা ছিল। অভ্যাসবশত সবচাইতে সস্তা বইগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলাম।

দোকানের ভেতরটা টিমটিমে আলোয় আলোকিত ছিল। পুরোনো কাগজের গন্ধে পূর্ণ ছিল দোকানটা। দোকানের পেছন থেকে রেডিও এর শব্দ ভেসে আসছিল।

বইয়ের তাকগুলো এতটাই সরু ছিল যে, কায়দা করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে হাঁটতে হলো। অবশেষে দোকানের বুড়ো মালিককে খুঁজে পেলাম। সে এক স্তূপ বইয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। বুড়োর মুখে কোনোদিন এক চিলতে হাসি পর্যন্ত দেখিনি। বাছাই শেষে বইগুলো নিয়ে তাঁর সামনে গেলে তিনি বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কাগজের তাড়া থেকে দামগুলো পড়ে শোনাতেন।

কিন্তু আজকের দিনটা ছিল ভিন্ন। আমি যখন বললাম যে, আমি বই ‘বিক্রি’ করতে এসেছি, তিনি মাথা উঁচু করে সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকালেন।

তাঁর চোখেমুখে একটা শক খাওয়ার ভাব বেশ ভালোমতোই টের পাচ্ছি। অবশ্য তা অযৌক্তিক না। যেসব বই আমি বিক্রি করতে নিয়ে এসেছি, সেগুলো যেনতেন বই না। এসব বই ডজনখানেক বার পড়ে ফেলার পরেও বিক্রির কথা কেউ ভাবে না। একজন সত্যিকারের পাঠকের কাছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

“তুমি কি বাসা পাল্টাচ্ছ বা এমন কিছু?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন। পরিষ্কার গলায় তাকে কথা বলতে শুনে বেশ অবাকই হলাম।

“না।”

“তাহলে,” আমার আনা বইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরকম অযৌক্তিক কাজ কেন করতে চাইছ?”

“এসব কাগজ দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটানো যায় না, ভিটামিন তো দূরের কথা।”

বুড়ো আমার ঠাট্টাটা ধরতে পারল। মুখ চোখ কুঁচকে গেল তাঁর। “টাকাপয়সার সমস্যা চলছে তাহলে।”

মাথা নাড়তেই তিনি হাত দুটো ভাঁজ করে কী যেন ভাবতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললেন তিনি, “ত্রিশ মিনিট লাগবে এসবের দাম হিসাব করতে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইগুলো সব কাউন্টারের পেছনের ঘরটায় নিয়ে গেলেন।

আমি বাইরে এসে রাস্তার পাশে থাকা বুলেটিন বোর্ডটার দিকে তাকালাম। বোর্ডটা ক্ষয়ে গিয়েছে অনেকাংশে। সেখানে গ্রীষ্মের উৎসব, জোনাকি পোকা দেখার এক আয়োজন আরও টুকিটাকি জিনিসের পোস্টার লাগানো ছিল। বোর্ডের পেছনের জায়গা থেকে আগরবাতি, টাটামি ম্যাট, কাঠ আর মানুষের গায়ের গন্ধের এক পরিচিত গন্ধ এসে ধাক্কা দিল নাকে।

দূরবর্তী কোনো এক বাসা থেকে উইন্ড-চাইম (বাতাসে নড়ে উঠে মধুর টুংটাং শব্দ প্রস্তুত করা একধরনের যন্ত্র) এর শব্দ ভেসে এল।

বুড়োর সব হিসাব শেষে আমাকে যে পরিমাণ টাকা হাতে ধরিয়ে দিল, তা কিন্তু হিসেবের তুলনায় কমই ছিল। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কম।

বুড়ো বলল, “তোমাকে একটা জিনিস বলতে চাচ্ছিলাম।”

“কী?”

“তোমার টাকার প্রয়োজন, তাই না?”

“সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না,” প্রশ্নটাকে এড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু বুড়ো নাছোড়বান্দা।

“তুমি কতটা গরিব বা কীভাবে গরিব হলে, সেটা জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই,” বলে তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। “তুমি কি তোমার আয়ু বিক্রি করতে চাও?”

প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে যেতে বাধ্য হলাম।

“আয়ু?” ঠিক শুনেছি কিনা সেটা নিশ্চিত হবার জন্য শব্দটা আবার পুনরাবৃত্তি করলাম আমি।

“হ্যাঁ, আয়ু। অবশ্য আমি সেটা কিনব না। কিন্তু বিক্রি করতে চাইলে সেটা অনেক দামে বিক্রি করতে পারবে।”

ভেবেছিলাম গরমে ভুলভাল শুনছি, কিন্তু না। এত গরম পড়েনি যে পরিষ্কার কথাগুলো শুনতে আমার সমস্যা হবে।

ভেবে দেখলাম কথাগুলো।

প্রাথমিকভাবে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম : বুড়ো মৃত্যুভয়ে এসব ভুলভাল বকছে।

আমার ভাবভঙ্গিতে বোধহয় সেরকমই কিছু একটা প্রকাশ পাচ্ছিল, কারণ বুড়ো বলল, “আমি তোমার সাথে ঠগবাজি করছি কিনা, সেই প্রশ্নটা তোমার মনে আসা স্বাভাবিক। আমাকে পাগল ভাবলেও অবাক হব না। কিন্তু আমি তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি : এই বুড়ো ভামের কথা অনুযায়ী ঐ জায়গায় যাও। তখনই টের পাবে, আমি সত্যি বলছি নাকি মিথ্যা বলছি।”

তারপর তিনি যা যা শোনালেন, তা খানিকটা যাচাই-বাছাই করে যা বুঝলাম তা হলো এই-

এখান থেকে কাছেই একটা বিল্ডিং এর চারতলায় একটা দোকান আছে, যেখানে আয়ু বেচাকেনা করা হয়। আয়ুর দামটা অবশ্য মানুষভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। কারো ভবিষ্যতের জীবন যতটা সফল হবে, তার আয়ুর দামটাও তত বেশি হবে।

“তোমার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখায় ভালোমানুষই মনে হচ্ছে। আর তাছাড়া তোমার বইয়ের পছন্দ ভালো। হয়তো তুমি ভালো দামও পেতে পার।”

ঠিক এই সময়েই আমার স্কুলজীবনের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

বুড়োর কথামতে, শুধু আয়ু না, আয়ুর পাশাপাশি তুমি ‘সময়’ আর ‘স্বাস্থ্য’ও বিক্রি করতে পারবে সেখানে।

“সময় আর আয়ুর পার্থক্যটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম। “স্বাস্থ্যের সাথে আয়ুর সম্পর্কটাও ঠিক বোধগম্য হলো না আমার কাছে।”

“বিস্তারিত আমারও জানা নেই। আমি তাদের কাছে কোনোদিন কিছু বিক্রি করতে যাইনি। কিন্তু-আচ্ছা, এমন মানুষ দেখেছ না, যারা সারাজীবন অসুস্থ থাকার পরেও যুগের পর যুগ বেঁচে থাকে-কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষজন হুট করে মারা যায়? বোধহয় সুস্বাস্থ্য আর আয়ুর সাথে মিল এখানেই। তবে ‘সময়’ ও ‘আয়ু’র পার্থক্যটা আমিও বুঝি না।”

সে একটা মেমো কাগজে ছোট্ট করে একটা ম্যাপ এঁকে দিল। নিচে একটা ফোন নম্বরও লিখল। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম আমি।

কিন্তু আমার মতো একই উপসংহারে আসতে বাধ্য হবে বেশিরভাগ মানুষ : ‘আয়ু বেচাকেনার দোকান’ ঐ বুড়োর কল্পনাতে বানানো দোকান বাদে আর কিছুই না। মৃত্যু তাঁর নিকটবর্তী হওয়ায় তিনি ওরকম একটা দোকানের কথা কল্পনা করে নিয়েছিলেন। এমন একটা দোকান যেখানে আয়ু বেচাকেনা হয়—এই তথ্যটাই বোধহয় তাকে এখনও মানসিকভাবে সুস্থ রেখেছিল।

ঠিক তাই তো, তাই না? এরকম ‘দরকারি’ দোকান বাস্তবে থাকাটাই অস্বাভাবিক।

***

আমার প্রত্যাশায় যা ছিল, তার অর্ধেকটা সত্য হয়েছিল।
নাহ, ব্যাপারটা মোটেও সহজ কোনো কাজ ছিল না।
কিন্তু প্রত্যাশার বাকি অর্ধেকটা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
আসলেই একটা দোকান ছিল যেখানে আয়ু বেচাকেনা করা হতো।

বইগুলো বিক্রি করার পর এলাকার এক সিডির দোকানে চলে গেলাম। রাস্তার পিচ গরমে উত্তপ্ত হয়ে যে পরিমাণ তাপ বিকিরণ করছিল, তা ছিল অবর্ণনীয়। গায়ের প্রতিটা লোমকূপ থেকে ঘাম বের হতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত বোধ করছিলাম আমি। কিন্তু ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা কোল্ড ড্রিংক্স কেনার জন্য বাড়তি টাকাটাও আমার পকেটে ছিল না। বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

সিডির দোকানটায় এয়ার-কন্ডিশনিং ছিল ভাগ্যিস। অটোমেটিক দরজাগুলো খুলে গিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাসটা আমার শরীরটাকে জাপটে ধরল, মনে হচ্ছিল শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছি। শীতল বাতাসটা ঢোক দিয়ে গেলার চেষ্টা করলাম, যাতে এই ঠান্ডাটুকু আমার শরীরের ভেতরেও প্রবেশ করে। দোকানটায় একটা পুরোনো গান বাজছিল। আমি যখন এলিমেন্টারি স্কুলে ছিলাম, তখন বোধহয় গানটা জনপ্রিয় ছিল।

কাউন্টারে গিয়ে চুল ব্লিচ করা কর্মচারীকে ডাক দিলাম। তারপর আমার অন্য হাতের ব্যাগটা তাকে দেখালাম। সন্দেহ জেগে উঠল তার চোখ জোড়ায়। পরক্ষণেই অবশ্য সেটা দূর হয়ে গেল। এখন একটু আগে দেখে আসা প্রতিক্রিয়া খেলা করছে, ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ একসাথে এই সিডিগুলো বিক্রির কথা ভাবে’।

ঠিক যেরকম প্রতিক্রিয়া বইয়ের দোকানের বুড়োর চোখে দেখেছিলাম।

***

“ঘটনা কী ভাই?” ঢুলুঢুলু চোখে কর্মচারী জিজ্ঞেস করল আমাকে। গায়ে গতরে একদমই হালকা পাতলা গড়ন ছেলেটার। একটা রক-ব্যান্ডের ছবি দেয়া টি-শার্ট আর জিন্স পরনে ছিল তার। হাতের আঙুলগুলো সবসময়ের মতো আজও অক্লান্তভাবে নড়াচড়া করছিল।

বইয়ের দোকানে যে কথা বলেছিলাম, এখানেও তাই বললাম। ব্যাখ্যা শোনার পর কর্মচারীটা তালি মেরে বসল। “তাহলে ভাই আপনাকে একটা জিনিস শোনাতে চাই। আশা করি আপনার কাজে লাগবে। আপনাকে বলা আমার ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু আপনার পছন্দের গানগুলোর সিডিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, আপনি ভালো মানুষ। তাই বলেই ফেলি।”

একদম ‘মানুষকে বোকা বানানোর ১০০ উপায়’ বই থেকে কথাগুলো ঝেড়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে। ঐ বুড়ো আর এই কর্মচারী দুজনেই

সে জানাল, “এই শহরেই একটা জায়গা আছে যেখানে আয়ু বেচাকেনা করা যায়।”

“আয়ু?” পুনরাবৃত্তি করলাম। ঠিক এভাবেই বুড়োকে প্রশ্ন করেছিলাম। এবারো নিজেকে সামলাতে পারলাম না, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

“হ্যাঁ।” সে কিন্তু একদম গম্ভীর। “আয়ু।”

মানে বুঝতে পারলাম না- আজকাল কি গরিব মানুষদের ওপর মজা নেয়া ট্রেন্ডিং কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে?

ভাবছিলাম কী জবাব দেব, এমন সময় কর্মচারীটা চটপট ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। অনেকটা বইয়ের দোকানের বুড়োর মতোই কথাবার্তা সব, তবে এর কথাবার্তায় একটু অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে নিজেই ওখানে গিয়েছিল। গিয়ে আয়ু বিক্রি করে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কত ইয়েন পেয়েছে সে ওখান থেকে। সে এড়িয়ে গেল, ‘বলতে চাচ্ছি না।’

একটা ম্যাপ এঁকে আর ফোন নম্বরটা নিচে লিখে সে কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। যা ভেবেছিলাম, একই ম্যাপ, একই নম্বর।

আমি তাকে কাষ্ঠলভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। দোকান থেকে বের হতেই নিষ্ঠুর, প্রাণঘাতক সূর্যের তাপ আমাকে আবার জাপটে ধরল। একটা ড্রিংক্স খেলে সমস্যা হবে না, নিজেকে বোঝালাম আমি। তারপর কয়েক পা দূরের একটা ভেন্ডিং মেশিনে কয়েন ঢুকিয়ে আপেল সাইডারের একটা ক্যান বের করে আনলাম।

ক্যান’টা হাত দুটো দিয়ে ধরে সেটার শীতলতাটা উপভোগ করলাম। তারপর ক্যানটা খুলে ধীরেসুস্থে পান করতে থাকলাম আমি। সফট ড্রিংক্সটার হালকা কিন্তু অন্যরকম মিষ্টি স্বাদটা আমার মুখটার ভেতরটা মিষ্টি করে দিল। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে আমি কার্বনেটেড কোনো ড্রিংক্স খাই না, তাই প্রতিটা ঢোক গেলার সময় গলার পেছনটায় তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা টের পাচ্ছিলাম। শেষ হবার পর খালি ক্যানটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেললাম।

পকেট থেকে দুটো ম্যাপই বের করলাম। জায়গাটায় হেঁটে চলে যাওয়া যাবে।

ওদের কথা অনুযায়ী, আমি এখানে গেলে তারা টাকার বিনিময়ে আমার খানিকটা আয়ু বা স্বাস্থ্য নিয়ে নেবে।

যত্তসব গাঁজাখুরি কথা

বিরক্তিতে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিলাম ম্যাপদুটো।

.

তা সত্ত্বেও কীভাবে জানি নিজেকে বিল্ডিংটার সামনে আবিষ্কার করলাম।

পুরোনো একটা বিল্ডিং। তাতে কালের ছাপ এতটাই লক্ষণীয় যে, দেয়ালের রং আগে কী ছিল সেটা হয়তো সবাই ভুলে গিয়েছে। হয়তো বিল্ডিংটা নিজেও ভুলে গিয়েছে। দুপাশে থাকা বিল্ডিংগুলো চাপ দিয়ে এর জায়গাটা সঙ্কুচিত করে দিয়েছে।

আয়ু বেচাকেনার গপ্পোটা আমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু অন্যভাবে এর মানে বের করার চেষ্টা করেছি। আমার ধারণা, এখানে এমন কোনো চাকরি দেয়া হয় যা স্বাস্থ্য ও জীবন দুটোর জন্যই ক্ষতিকর-কিন্তু টাকাপয়সা ভালোই দেয়া হয়।

চারতলায় গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজায় কোনো ধরনের চিহ্ন নেই। কোনো সাইনবোর্ড নেই। কিন্তু কেন জানি মনে হলো, এটাই খুঁজছি আমি।

পাঁচ সেকেন্ড ধরে দরজার নবটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আবিষ্কার করলাম, নবটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি আমি।

দরজার ওপাশের জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। এটা যে বিল্ডিং এর ভেতরের অংশ, তা বাইরের সাথে তুলনা করলে বিশ্বাসই হবে না। কিন্তু সেটা আমাকে চমকায়নি ।

ঘরটার একদম মধ্যে একটা ফাঁকা ডিসপ্লে কেস রাখা। দেয়ালেও ফাঁকা শেলফ বানিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এসবকিছুও আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি।

আসলে দোকান বলতে আমরা কী বুঝি? কোনো ধরনের পণ্য বিক্রির জন্য রাখা হবে। যেমন জুয়েলারির দোকানে অলংকার থাকবে। চশমার দোকানে চশমা থাকবে-এই দোকানে সেটার অভাব ছিল। মনে হচ্ছিল, বইশূন্য এক বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়েছি।

গলার আওয়াজটা না শুনতে পেলে টেরই পেতাম না যে, আমার পাশেই একজন মানুষ বসে আছে।

“স্বাগতম।”

শব্দ যেদিক থেকে এল, সেদিকে তাকালাম। দেখলাম, একজন মহিলা স্যুট পরে বসে আছেন। চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

এ দোকানের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করার আগেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন।

“সময়? স্বাস্থ্য? আয়ু?”

ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত।

যদি এরপরে আমার উত্তরটা শুনে কেউ আমাকে বুদ্ধু ভেবে থাকেন, ভাবুন। যা ইচ্ছে ভাবুন।

“আয়ু,” বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দিলাম।

আমি পুরোটা পথই পাড়ি দিতে যাচ্ছি। এখন আমার হারানোর মতো আর কিছুই বাকি নেই।

***

আমার একটা আবছা আবছা ধারণা ছিল : আমি হয়তো আর কেবল ষাট বছর বাঁচব। তার মানে সেটার মূল্য ছয়শত মিলিয়নের আশপাশে হবে। হ্যাঁ, এলিমেন্টারি স্কুলে থাকতে যতটা আত্মবিশ্বাস ছিল, ততটুকু হয়তো আজ নেই। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি, সাধারণ কোনো মানুষের জীবনের থেকে আমার জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি মূল্যবান। তাই আমি ভেবেছিলাম, আমার জীবনের প্রত্যেকটা বছরের জন্য আমি গড়ে দশ মিলিয়ন ইয়েন করে পাব।

জীবনের এরকম পর্যায়ে এসেও আমি এখনও ঐ চিন্তাটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছি।

এই চিন্তাটার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। আমি শুধু অতীতের কিছু সাফল্যকে সম্বল করে এই চিন্তাটাকে বাস্তব ধরে নিচ্ছি। আমার জীবনের দুর্ভাগ্যগুলোকে একদমই না দেখার ভান করে অনবরত আমি নিজেকে বোঝাচ্ছি : এই তো, অতি শীঘ্রই আমি সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় পৌঁছে যাব। আর তখন এই নষ্ট করা সময়গুলোকে কিছুই মনে হবে না।

প্রতিবছর আমার বয়স বাড়ে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে আমার স্বপ্নে দেখা সাফল্যের আকারও বাড়ে। মানুষ আবদ্ধ থাকা অবস্থায় তার সাফল্যটাকেও আবদ্ধ স্থানের ভেতরেই কল্পনা করে নেয়। মানুষের চরিত্রই এরকম। আর কেউ যখন একদম তলানিতে থাকে, তার জন্য আবার এরকম ঝুঁকিহীনভাবে স্বপ্ন দেখা সময়ের অপচয় বাদে আর কিছুই না। কারণ, এতে তার বিন্দুমাত্র লাভ হবে না। এর থেকে তার বড় বড় স্বপ্নের পিছে ছুটতে হবে, যেগুলোর সাফল্যের হার অত্যন্ত কম।

এক সময় আমি অনন্তকাল গৌরবের অধিকারী হতে চেয়েছিলাম। এমন কোনো সাফল্য লাভ করতে চেয়েছিলাম, যেখানে সকলেই আমার নাম জানবে। এমন একটা সাফল্য, যা কেউ ভুলবে না; কালের অতলে হারিয়ে যাবে না। জীবনের এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম যে, ওরকম একটা সাফল্য আমার সামনে এসে ধরা না দিলে আমার জীবনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

আমার মতো মানুষের জীবনটাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য বোধহয় এমন একজন মানুষকে প্রয়োজন, যে আমার এসব ভুল ধারণা ও ভ্রান্তিগুলো দূর করে দেবে। আমাকে নিঃস্ব করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে নেয়া উচিত, যেখানে আমার হারানোর মতো কিছুই থাকবে না।

এই কারণে আমার মনে হয়েছিল, আয়ু বিক্রি করে দেয়াটা আমার জন্য সঠিক একটা পদক্ষেপ হবে।

কারণ, এই জায়গাতে এসেই আমি আবিষ্কার করেছিলাম, আমি শুধু যে আমার অতীতটাকে নষ্ট করেছি তাই নয়, আমার ভবিষ্যৎটাও ঠিক ওরকমই নষ্ট করেই কেটে যাবে।

ভালোমতো দেখে বুঝতে পারলাম, যাকে শুরুতে মহিলা ভেবেছিলাম, তার বয়স খুব একটা বেশি নয়। বোধহয় আঠারো থেকে চব্বিশের আশপাশে হবে।

তিনি আমাকে জানালেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়ে ঘণ্টা তিনেক লেগে যাবে। তখনো তিনি পাশে রাখা কম্পিউটারে টাইপ করে যাচ্ছিলেন। ভেবেছিলাম এরকম একটা কাজে অনেক কাগজপত্র পূরণ করা লাগবে, কিন্তু সেরকম কিছুই করা লাগল না। তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন, আমার নামটাও তাকে দেয়া লাগবে না। মাত্র তিনঘণ্টার মধ্যেই তিনি আমাকে আমার কাছে ‘অমূল্য’ জীবনটার মূল্য জানিয়ে দেবেন। দামটা তারা নির্ধারণ করলেও ওটাই আমার নির্দিষ্ট মূল্য না, দামাদামি করাও সম্ভব। তবে এটাকে আদর্শ মান হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

বিল্ডিং থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করলাম। আকাশটা মেঘলা হতে শুরু করেছে। পা দুটো ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে পড়ে এমন অবস্থা, জবর ক্ষুধাও পেয়েছে। খুব ইচ্ছে করছিল একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করে সেখানে একটু জিরোই। কিন্তু সেরকম টাকাপয়সা আমার নেই।

সৌভাগ্যক্রমে শপিং এলাকার একটা বেঞ্চে একটা সেভেন-স্টার সিগারেট আর সস্তা (একশো ইয়েন দাম) সিগারেট লাইটার পেয়ে গেলাম। আশপাশে তাকালাম, না, কেউ নেই। ধীরেসুস্থে বেঞ্চে বসে সেগুলো চুপিসারে পকেটে চালান করে দিলাম। তারপর উঠে গিয়ে এক অন্ধকার সরু গলিতে সিগারেটটা ধরালাম। ফেলে দেয়া আবর্জনাতে গলিটা একদম ভর্তি। শেষ কবে যে সিগারেট ধরিয়েছিলাম, মনেই পড়ছে না। অনেকদিন পর বুকভরে সিগারেটের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে গিয়ে টের পেলাম, গলাটা ব্যথা করছে।

সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দাবিয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিলাম। স্টেশনের দিকে যেতে শুরু করলাম আমি। আবার পানির পিপাসা শুরু হয়েছে।

ট্রেন স্টেশনের ঠিক বাইরের খোলা জায়গায় একটা বেঞ্চে বসে আমি কবুতর দেখছিলাম। রাস্তার অপর পাশের এক বেঞ্চে এক মধ্যবয়স্ক নারী কবুতরগুলোকে পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। তার পরনে জামাকাপড় ঠিক তার বয়সের সাথে মানাচ্ছে না, অল্পবয়স্ক মেয়েদের জামাকাপড় ওগুলো। পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে মারার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল, তিনি বেশ চিন্তিত। দৃশ্যটা দেখে আমার কেমন লাগছিল, তা হয়তো বোঝাতে পারব না। কিন্তু কবুতরগুলোকে পাউরুটির টুকরো খেতে দেখে আমি টের পেলাম, পেটের ভেতরের ক্ষুধার্ত রাক্ষসটার সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আরেকটু হলেই হয়তো আমি কবুতরদের সাথে ঠেলাঠেলি করতে করতে পাউরুটি খেতে শুরু করে দিতাম।

আমার দামটা যেন বেশ ভালো হয়, মনে মনে প্রার্থনা করলাম।

মানুষজন যখন নিজের কোনো জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অন্য কারো কাছে দেয় তখন মনে মনে জিনিসটার দাম কমিয়েই ধরে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। নিজের মূল্যটাকে আমিও কমিয়ে ধরেছিলাম। প্রাথমিকভাবে আমি ছয়শো মিলিয়ন ইয়েন ধরে রেখেছিলাম। পরে যাতে কষ্ট না পাই, সেজন্য দাম আরও কমিয়ে ধরলাম।

তিনশো মিলিয়ন ইয়েন।

ছোটবেলায় আমি ভেবেছিলাম, আমার মূল্য হবে তিন বিলিয়ন ইয়েন। সেটার সাথে তুলনা করলে-ঠিকই আছে।

কিন্তু নিজের মূল্য সম্পর্কে আমি এখনও সন্দিহান। আমার মনে আছে, ক্লাসে হিমোনো বলেছিল-একজন জাপানিজ চাকরিজীবী গড়ে সারাজীবনে দুই থেকে তিনশো মিলিয়ন ইয়েন আয় করে। এই কথাটার পরে ক্লাসের গোমড়ামুখী সেই চরিত্রটা শিক্ষিকার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। ঐ যে, বলেছিলাম না তার ব্যাপারে? আমি তখন ভেবেছিলাম, ওর মতো জীবন হলে হয়তো আমিও তাই বলতাম। আমি নিজেও তখন নিজের জীবনের ওপর মূল্য বসাতে পারতাম না, ক্ষতিতেই বিক্রি করতে হতো।

.

আগেভাগেই দোকানটায় চলে গেলাম। সোফায় বসে ঢুলতে শুরু করেছি, এমন সময় মেয়েটা আমার নাম ধরে ডেকে আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল।

তার হিসাবনিকাশ শেষ হিয়েছে।

“মিস্টার কুসুনোকি।” আশ্চর্যের ব্যাপার, তাকে তো আমার নামধাম কিছুই দিইনি। তার মানে এসব জানারও পদ্ধতি আছে তাদের।

এই জায়গাটায় এমন কিছু একটা রয়েছে যা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার বাইরে।

কোনোরকম যুক্তি না থাকা সত্ত্বেও এখানে ফিরে আসার আগে নিজেকে জোর করে বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে, আসলেই টাকার বিনিময়ে আয়ু কিনে নেয়া সম্ভব। অনেক কিছুই হিসেবে এনেছি, কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ঐ মেয়েটা।

মাত্র দেখা হওয়া কারো ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়তো ঠিক না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, তার কাজে কোনোধরনের ছলচাতুরি নেই। কেন যেন সেটা অনুভব করতে পারছিলাম। কিছু মানুষ রয়েছে আমাদের আশপাশেই, যারা অসৎ চিন্তা, অন্যায় (সেটা নিজ স্বার্থের জন্য মঙ্গলজনক হলেও) কে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। আমার মনে হচ্ছিল, মেয়েটা ঠিক ঐ দলেরই একজন মানুষ।

পরে যখন এই মুহূর্তটার কথা ভেবে দেখেছি, তখনই টের পেয়েছি আমার ভাবনা চিন্তা কতটা দুর্বল।

আমার জীবনের মূল্য নির্ধারণে ফিরে আসা যাক-

মেয়েটার মুখে ‘তিন’ শব্দটা শুনতে পাওয়ার সাথে সাথে মনের ভেতরের যে অংশটুকু এখনও আশা ‘তিন বিলিয়ন ইয়েন’ এর আশা ছেড়ে দেয়নি, সে লাফিয়ে উঠল। তার মানে ছোটবেলায় আমার হিসেব ভুল ছিল না।

মেয়েটা আমার এরকম উৎসাহী মুখভঙ্গি দেখে একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আঙুল দিয়ে তার গালটা একটু চুলকাল। তার বোধহয় মনে হচ্ছে, পুরো সংখ্যাটা মুখে না বলাটাই ঠিক হবে। তাই সে কম্পিউটারে কী যেন একটা টাইপ করে সেটা প্রিন্ট করিয়ে কাউন্টারে রাখল।

“হিসাবনিকাশের ফলাফল এই। আপনার সিদ্ধান্ত জানান।”

কাগজে যখন দেখতে পেলাম সংখ্যাটা তিনশো হাজার ইয়েন, ধরে নিয়েছিলাম এটা আমার জীবনের প্রত্যেকটা বছরের গড় মূল্য।

যদি জীবনটা চুরাশি বছরের হয়, তবে জীবনের মোট মূল্য দাঁড়াবে চব্বিশ মিলিয়ন ইয়েনে।

চব্বিশ মিলিয়ন ইয়েন।

আমার মনের ভেতর পুনরাবৃত্তি করলাম সংখ্যাটা। মনে হচ্ছিল, দেহ থেকে সবটুকু শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনটা এতটাই সস্তা?

এই পর্যায়ে এসে এই জায়গাটার প্রতি আমার সন্দেহ জাগতে শুরু করল আবার। হয়তো এই জায়গাটা টিভির শো এর জন্য প্র্যাংক হিসেবে বানানো হয়েছে। কিংবা কোনো ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা চালানো হচ্ছে এখানে। হয়তো—এই দোকানটা পুরোপুরি ভুয়া-

কিন্তু কোনো যুক্তিই অবশ্য দরকার ছিল না। দামটা দেখে যে অবিশ্বাস হচ্ছিল, সেটা কেবল আমার বাহ্যিক বিশ্বাস। সেটা বাদে আমার প্রত্যেকটা অঙ্গ আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল বারবার : ‘হ্যাঁ, এটাই তোর মূল্য। মেয়েটা যা বলছে, ঠিকই বলছে।’ জীবনে উদ্ভট কোনো পরিস্থিতির শিকার হলে তাই আমি আমার বাহ্যিক চিন্তাভাবনা তেমন একটা গুরুত্ব দিই না।

আমাকে মেনে নিতে হবে যে, আমার জীবনের মূল্য সবমিলিয়ে চব্বিশ মিলিয়ন ইয়েন। সেটা মেনে নিতে বেশ সাহসের পরিচয় দিতে হল।

ঠিক তখনই মেয়েটা আরও কঠিন একটা সত্য আমার হাতে ধরিয়ে দিল। “এর মানে হলো, আপনার জীবনের প্রত্যেকটা বছরের মূল্য সর্বোচ্চ দশ হাজার ইয়েন। আপনার আয়ু আছে তেত্রিশ বছর তিন মাস। তাই আপনি এখান থেকে সর্বোচ্চ তিনশো হাজার ইয়েন নিয়ে বের হতে পারবেন।”

নিজেকে তখন সামলাতে না পেরে তার সামনে হেসে দিলাম।

নাহ, তার কথাগুলো আমার কাছে হাসির মনে হয়নি।

জীবনটাই যে অর্থহীন একটা জোকসে পরিণত হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, আমার জীবনের মূল্য আমার হিসেবের তুলনায় অনেক অনেক কম।

“অবশ্য এটাই যে আদর্শ মান তা কিন্তু নয়। আমাদের আদর্শ মানের সাথে তুলনা করে এই হিসেবে এসেছি আমরা,” মেয়েটা ব্যাখ্যা করল।

“আপনাদের এই ‘আদর্শ’ মানের ব্যাপারে আরেকটু জানতে চাই,” আমি বললাম। মেয়েটা কেন জানি বিকৃত মুখ করে কথা বলতে শুরু করল। হয়তো এই বাক্যটা ইতোমধ্যে সে হাজারবার শুনেছে।

“এই হিসাব বা তুলনা সবই অন্য কেউ করে থাকে, যার সম্পর্কে আমি খুব একটা অবগত নই। তবে যতটুকু জানি, কিছু কিছু ক্ষেত্রের ওপর এই দামটা ওঠানামা করে। যেমন—সৌভাগ্য, সন্তুষ্ট হওয়ার ক্ষমতা, অবদান-সহজ কথায় বাকি জীবন আপনি কতটা সুখী থাকবেন, অন্যদের কতটা সুখী রাখবেন, স্বপ্ন পূরণ করবেন নাকি করবেন না, সমাজের অন্যদের জীবনের একটা অংশ হতে পারবেন কিনা-ইত্যাদি জিনিসের পরিমাপ করা হয়।”

ব্যাখাটা আমাকে একদম ভেঙে দিল।

যদি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ‘আমি’ কেন্দ্রিক হতো, তাহলে মেনে নেয়া যেত। যদি আমিই সুখী না হতে পারি, কিংবা আমি নিজের স্বপ্নপূরণ করতে না পারি, অথবা আমি সমাজে কোনো অবদান রাখতে না পারি-যেকোনো একটাতে ব্যর্থ হলে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু একই সাথে আমি নিজে দুঃখী, স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ, অন্যদের সুখী করতে অক্ষম, সমাজে আমার কোনো অবদান নেই-একসাথে এতকিছু? আমার কি আদৌ জীবন রেখে লাভ আছে?

আর বিশ বছর বয়সের একটা মানুষ আমি, আমার হাতে কেবল আর ত্রিশ বছর বাকি রয়েছে? এত কম সময়? আমি কি অসুস্থ হয়ে মারা যাব? নাকি কোনো দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হবে?

সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, “আমার জীবন এত সংক্ষিপ্ত কেন?”

“দুঃখিত,” মাথা নুইয়ে সে দুঃখ প্রকাশ করল, “এসব তথ্য আমরা কেবল কাস্টমার হবার পরেই খোলাসা করতে পারব। এর আগে নয়।”

আমি তার কপালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কথাটা হজম করার চেষ্টা করলাম। “এক মিনিট দিন আমাকে। ভেবে দেখছি ব্যাপারটা।”

“সময় নিন, তাড়া নেই,” মুখে এই কথাটা বললেও মেয়েটার কথা বলার সুর থেকে বুঝতে পারলাম, আমাকে সে তাড়া দিচ্ছে।

.

অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, শেষ তিনমাস বাকি রেখে তেত্রিশ বছরের পুরোটাই বিক্রি করে দেব। দিনের পর দিন কষ্টকর, ভবিষ্যতহীন চাকরি করে, প্রিয় বই আর সিডিগুলো বিক্রি করে দেবার পর নিজের জীবনটাকেও সস্তায় বিক্রি করতে খুব একটা গায়ে বাঁধল না।

মেয়েটা যখন পুরো চুক্তিটা পড়ে শোনাচ্ছিল আমাকে, আমি শুধু হু-হা করে জানান দিচ্ছিলাম, হ্যাঁ আমি শুনছি। কিন্তু মনটা একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল আমার। পড়ে শোনানোর পর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কোনো প্রশ্ন আছে আপনার?”

“নাহ, কোনো প্রশ্ন নেই।”

আমি যতদ্রুত সম্ভব এখানের কাজটুকু শেষ করে এখান থেকে মুক্তি পেতে চাই।

জীবন থেকেও মুক্তি চাই।

“আপনি সর্বোচ্চ তিনবার এখানে বেচাকেনা করতে পারবেন,” মেয়েটার ব্যাখ্যা তখনো শেষ হয়নি। “এর মানে, আপনার হাতে আরও দু’বার সুযোগ থাকছে আয়ু, স্বাস্থ্য, সময় কেনা বা বিক্রি করার।”

আমি তার হাত থেকে তিনশো হাজার ইয়েনের খামটা নিয়ে বিল্ডিং থেকে বের হলাম।

জানি না তারা কীভাবে কাজটা করল, তবে বের হবার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই আর। জীবনের যে অংশটুকু মনটাকে বাঁচিয়ে রাখে, তার প্রায় নব্বই ভাগ মনে হচ্ছে কেউ কেটে বের করে নিয়েছে। শুনেছিলাম, গলা কেটে ফেলার পরেও মুরগিরা অনেকক্ষণ দৌড়াতে পারে। মনে হচ্ছিল, আমি ঠিক সেভাবেই নড়াচড়া করছি এখন। আমাকে লাশ বললেও ভুল কিছু বলা হবে না।

আমি একুশ বছরে পা দেবার আগেই মারা যাব এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আশি বছর বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সব খুইয়ে এই দেহ এখন অস্থির হয়ে পড়েছে, ‘কখন সময় শেষ হবে?’ প্রত্যেকটা সেকেন্ড পার হচ্ছে, আর মনে হচ্ছে দেহের ওজন বেড়ে যাচ্ছে। আগে যখন আমি ভাবতাম আমি আশি বছর বাঁচব, আরও ষাট বছর হাতে আছে আমার-তখন আপনাআপনি অবচেতন মনে একটা উদ্ধত ভাব জেগে উঠত। আর এখন সেই ষাট বছর পরিণত হয়েছে মাত্র তিন মাসে। আগে সবসময় মনে হতো, এটা করা উচিত ছিল, ওটা করা উচিত ছিল।

এখন আমার কিছু করার ইচ্ছে জাগছে না। বাসায় গিয়ে আমি ঘুমাতে চাই। সারাদিন ধরে হেঁটে হেঁটে আমি ক্লান্ত। একটানা ঘুমানোর পর পরিষ্কার মাথা নিয়ে এসব নিয়ে ভাবতে চাই।

ফেরার পথে এক অদ্ভুত মানুষের দেখা মিলল। বয়স হয়তো বিশের একটু বেশি হবে। মুখভর্তি হাসি, যেন ভেতরের আনন্দটাকে আটকেই রাখতে পারছে না।

জিনিসটা আমাকে প্রচণ্ড ক্ষিপ্র করে দিল।

শপিং এরিয়ার এক মদের দোকান থেকে চার ক্যান বিয়ার কিনলাম। কাছেই একটা দোকান থেকে পাঁচটা ‘ইয়াকিতোরি চিকেন’ অর্ডার দিলাম। খেতে খেতে বাসায় ফিরলাম আমি।

আমার হাতে কেবল তিন মাস রয়েছে। টাকার কোনো প্রয়োজনই নেই আমার।

অনেকদিন পর মদ খাচ্ছি। বোধহয় মন খারাপ থাকা অবস্থায় এসব খাওয়া ঠিক হচ্ছে না। খুব দ্রুতই মাতাল হয়ে গেলাম আমি। বাসায় ফেরার ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বমি করে সবকিছু ভাসিয়ে দিলাম।

এভাবেই আমার শেষ তিনমাসের শুরু হলো।

এর থেকে খারাপভাবে কোনোকিছু শুরু হওয়া বোধহয় কোনোমতেই সম্ভব নয়।

[অনুবাদকের ফুটনোট-তিনশো হাজার ইয়েন মানে বাংলাদেশি টাকায় দুই লক্ষ পনেরো হাজার টাকার মতো।]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *