দশ
ঘরের ভেতর রাধা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ নগ্ন সে। তাকে দেখাচ্ছে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো। নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় সেই ‘অন্ধকার’ কখনও স্পষ্ট হচ্ছে, কখনও অস্পষ্ট। হাত, পা, স্তন, কটিদেশ, নিতম্ব ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠে ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। একেকটা সময় মনে হচ্ছে, এই মানবী রক্তমাংসের নয়, অন্ধকারের মানবী।
একটা লম্বা রকিং চেয়ারে বসে আছেন বাসুদেব চৌধুরি। পা দুটো সামনে ছড়িয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। হাতদুটো মাথার পিছনে। আবছা আলো এবং অন্ধকার দুটোই তার শরীরে পড়েছে। পা আলোয়, মুখ অন্ধকারে। সেই অন্ধকার থেকেই তিনি রাধার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। শরীর জুড়ে একটা অবসন্ন ভাব। তিনি ক্লান্ত। তবে অন্ধকারে চিন্তা বা ক্লান্তি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে প্রৌঢ় এক লম্পট থাবায় ভর দিয়ে ওত পেতে আছে পশুর মতো। অপেক্ষা করছে কখন ক্ষুধা জেগে উঠবে বা যদি জেগে ওঠে।
ফিসফিস ধরনের চাপা আওয়াজ করে এসি চলছে। গায়ে কিছু না থাকার কারণে রাধার ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু সে বুঝতে দিচ্ছে না। সহজ ভঙ্গিতে চলাফেরা করছে।
উদোম হলে নারী শরীরে এক ধরনের অতিরিক্ত কমনীয়তা তৈরি হয়। রাধার বেলায় তা হয়নি। কাপড় পরেও সে যেমন কঠিন, পুরুষালি, আবরণ সরালেও একইরকম। বাসুদেব চৌধুরি তার স্ত্রীকে দেখভালের কাজে রাধাকে যে নিয়োগ করেছেন এই চেহারাই তার আসল কারণ। পুরুষালি, কিন্তু পুরুষ নয়। নইলে নার্সিং বা আয়ার কাজে রাধার কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। পেশাদারভাবে সে এই কাজ অতীতে কখন করেওনি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছিল। তখন এই বাড়ি এক জটিল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই অল্পবয়সি এক নার্সের গলা টিপে ধরেছিলেন ভারতী। মেয়েটি আর্তনাদ করতেও পারছিল না। অনেক চেষ্টার পর নিজেকে যখন মুক্ত করল তখন অবস্থা সংকটজনক। গভীর রাতে নার্সিংহোমে নিয়ে ছুটতে হল। তারপর থেকেই পেশাদার নার্স, আয়ারা ‘পাগলবাড়ি’-তে আসা বন্ধ করল। বাসুদেব চৌধুরি পড়লেন অথই জলে। এই পেশেন্টকে সর্বক্ষণ নজরে না রেখে উপায় নেই। বাধা দিতে গেলে আঁচড়ে কামড়ে, মেরে ধরে হইচই শুরু করবে। হাতের কাছে যা পাবেন ছুড়বেন এই সময় রোগীকে আগে ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করতে হয়। তারপর হয় ওষুধ, নয় ইনজেকশন। জলে গুলে ওষুধ খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়াও একটা কঠিন কাজ। কথায় বলে, উন্মাদের শরীরে অসুরের বল আসে। ভারতী দেবীর বেলাতেও তার অন্যথা হয়নি। বাগে আনতে কম করে দুজন মানুষের প্রয়োজন। দুজন না হোক, একজন তো বটেই। রোগীকে জাপটে ধরতে হয়। উলঙ্গ একজন মহিলাকে জাপটে ধরার জন্য পুরুষ আয়া বা পুরুষ নার্স রাখা যায় না। উলঙ্গ না হলেও যায় না। দীর্ঘদিন মহিলাদের রেখেই স্ত্রীকে সামলানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন বাসুদেব। কেউই বেশিদিন টিকতে পারত না। দুদিন-চারদিন থেকেই পালাত। খুব বেশি হলে সপ্তাহখানেক বা দিন দশেক। আবার নতুন কেউ আসত। ক্লিনিক আর নার্স, আয়াদের সেন্টারগুলোতে পেশেন্টের মারধর আঁচড়, কামড়ের খবর ছড়িয়ে ছিল আগে থেকেই। গলা টেপার ঘটনায় আগুনে যেন ঘি পড়ল। দ্বিগুণ টাকাতেও তাদের রাজি করানো গেল না। বাসুদেব বাধ্য হয়ে নাম ঠিকানা গোপন রেখে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। টাকার লোভে অনেক ভিড় করল, তারাও টিকল না। যদিও ভারতী দেবী যে সবসময় এই উত্তেজনা আর হিংস্র অবস্থার মধ্যে থাকেন এমন নয়। দিন কয়েক খারাপ থাকার পর, ধীরে ধীরে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। কিছুদিনের জন্য শান্ত হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক ভাবে ঘুরে ফিরে বেড়ান, শান্ত গলায় কথা বলেন, কথা শোনেন। মনে হয় পুরো স্বাভাবিক না হলেও মানুষটা স্বাভাবিকের কাছাকাছি। আবার বৃত্তের মতো সমস্যা ফিরে আসে। একটা সময় ডাক্তাররা বলতেন ‘স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকতার এই বৃত্তটাকে বড় করাই হবে আমাদের চিকিৎসার লক্ষ্য।’ যাই হোক, নার্স, আয়ারা পালিয়ে যাওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে বাসুদেব চৌধুরি এমন সমস্যায় পড়লেন যে কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। সারাক্ষণই মাথার টেনশন, এই বুঝি বাড়ি থেকে টেলিফোন এল—
‘বড়বাবু এখনই চলে আসুন, বড়মার শরীর খারাপ হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন।’
এরকম একটা সময় রাধাকে পাওয়া গেল।
তিরিশোর্ধ্ব এই মহিলা সুশ্রী তো নয়ই, উলটোটাই। শরীরে কাঠিন্য ভাব স্পষ্ট। গায়ের রং প্রথমে ময়লা মনে হয়, পরে বোঝা গেল কালো। আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় লম্বা চওড়া দুটোতেই বেশি। ঠোঁটদুটো মোটা। শাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা হাতদুটো শক্তপোক্ত। মোটা মোটা আঙুলে কড়া। বুকদুটো ভারী। তারা আকর্ষণের থেকে শক্তির কথা বেশি ঘোষণা করে। সব মিলিয়ে ভারতী দেবীর মতো রোগীর জন্য উপযুক্ত। বাসুদেব আশা করেছিলেন, এই মেয়ে হয়তো পারবে।
রাধা ভালোরকমই পেরেছে, তাকে ছাড়া এখন একটা দিনও ভারতীদেবীর সম্ভব নয়। শুধু ভারতী দেবীরই নয়, এ বাড়ির সম্ভব নয়। একজন বদ্ধ উন্মাদ মহিলার সর্বক্ষণের সঙ্গ হওয়া কত কঠিন কাজ দীর্ঘদিন ধরে টের পেয়েছে সকলে। সেই কঠিন কাজ রাধা সুন্দরভাবে সামলাচ্ছে। ঘড়ি ধরে ওষুধ দেওয়া স্নান করানো, ছাদে বা বাগানে নিয়ে বেড়ানো, খাবার খাওয়ানোর মতো যাবতীয় সেবাযত্নের পাশাপাশি ‘বড়মা’র আচরণের অস্থিরতা, অস্বাভাবিকতা লক্ষ করাটা তার ডিউটি। সেরকম কিছু মনে হলেই রোগীকে সে আগে আড়াইতলায় নিজের এলাকায় ঢুকিয়ে নেয়, তালা আটকায় ঘরে, সিঁড়িতে।
রাধা ঝুঁকে পড়ে কাবার্ডের পাল্লা খুলল। তার লম্বা চুল কাঁধের ওপর থেকে সামনে এসে ঝুলে পড়েছে। স্থুলকায়া স্তনদুটি নেমে এসেছে বুক ছেড়ে নীচে। ভারী নিতম্ব উঁচু হয়ে আছে, যেন থমকে গেছে শূন্যে। লম্বা ঘাড়, প্রশস্ত পিঠ, চওড়া কোমর ছুঁয়ে সুতোর মতো আলোর রেখা গড়িয়ে নামছে; তারপর ঊরু হাঁটু, গোড়ালি হয়ে চলে যাচ্ছে পায়ের পাতা পর্যন্ত। ছবির আউট লাইনের মতো। অন্ধকারে আলোর আউট লাইন।
বাসুদেব চৌধুরি তার চেয়ারে অল্প অল্প দোল খাচ্ছেন। তার দৃষ্টি রাধার আলো ছায়ার স্তন, নিতম্ব, জঙ্ঘা, যোনিদেশের দিকে। তবে সেসব যে খুব আগ্রহভাবে দেখছেন এমন নয়, বরং খানিকটা অন্যমনস্কই।
বাইরে সহজ থাকলেও রাধার ভেতরে খানিকটা অস্বস্তিই রয়েছে। মানুষটা বেশিরভাগ সময়ে এরকমই করে। কাপড়চোপড় খুলিয়ে সামনে বসিয়ে রাখে, দূর থেকে দেখে। প্রথম প্রথম মনে হত, স্বভাবটাই এই, এক ধরনের অক্ষম বিকৃতি। মেয়েমানুষের নেংটা শরীর দেখে সুখ পায়। ক’দিন পরে মনে হল, তাও পুরোটা নয়। সেভাবে দেখার হলে ঘরের আলোগুলো জ্বলতে দিত। বুড়োটা তাও দেয় না। নাইট ল্যাম্পের আবছা অন্ধকারে ঘাঁটাঘাঁটি যা করার করেছে। কখনও অল্প স্পর্শ করে মুখ ফিরিয়েছে, কখনও দুমড়ে মুচড়ে মর্দন করেছে। কঠিন চোয়ালে জোরে জোরে মুখ ঘষেছে স্তনে, নাভিতে ঊরুর আনাচেকানাচে। বৃদ্ধ আঙুলে আঁচড় বসিয়েছে পিঠে, নড়বড়ে দাঁতে নিতম্বে কামড় দিতে চেয়েছে। বেশিক্ষণ পারেনি খানিক পরেই হাঁপিয়ে রাধাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিস্মিত, অতৃপ্ত রাধা চেষ্টা করেছে আবার। আঁচড় কামড়ের জ্বালা শরীরে নিয়েই বসে থাকা ‘বড়বাবু’র কোমড়ের দুপাশে পা রেখে টানটান হয়ে দাঁড়িয়েছে দানবের মতো। উত্তেজনায় হাত বাড়িয়েছে। ফিসফিসিয়ে বলেছে, ‘আসুন বড়বাবু।’
মাথা ফিরিয়ে নিয়ে বাসুদেব কঠিন গলায় বলেছেন, ‘না। তুমি এবার যেতে পারো রাধা।’
প্রতিবারই রাধা নিজেকে সংযত করেছে। থাক, এগিয়ে লাভ নেই। যেটুকু পাচ্ছে সেটুকুই আপাতত থাকুক। চটালে তারই ক্ষতি । ধনী মানুষের মেয়েছেলের অভাব হবে না। হয়তো বাইরে আছেও। তবু মাসে এক, দুদিন তার মতো কাঠখোট্টা চেহারার মেয়েমানুষকে যে ঘরে ডেকে নিচ্ছে এই যথেষ্ট। প্রথমদিন তো বিস্মিত হয়েছিল। ঘরে ডেকেছে বলে বিস্ময় নয়, বিস্ময় তাকে ডেকেছে বলে। বাইরে যদি কারবার না থাকে তা হলে বুঝতে হবে দীর্ঘদিন খিদে চেপে আছে বুড়ো। মেয়েমানুষের প্রয়োজন আশ্চর্যের কিছু নয়, কিন্তু যে অমন রূপবতী স্ত্রীর শরীরের স্বাদ পেয়েছে, তার এই কালোকুলো, খসখসে, কঠিন চেহারায় মন ভরবে কেন?’ ‘বড়মা’কে নাঙ্গা অবস্থায়ও বহুবার দেখা হয়ে গেছে তার। মহিলা আজও যে সৌন্দর্যটুকু ধরে রেখেছে দেখলে অবাক হতে হয়। উজ্জ্বল ত্বক এখনও মাখনের মতো মসৃণ, ঝলমলে। তলপেটে অল্প মেদ জমলেও বুকদুটো শান্তভাবে উন্মাদিনীর শরীরে লেগে আছে আলগোছে। আকৃতিতে আজও তারা যেন তরুণী। রাধা যখন তেল, সাবান, ক্রিম মাখিয়ে দেয় বুঝতে পারে এই মহিলাকে দেখে ‘বড়বাবু কেন খেপে উঠেছিল। ভারতী দেবীর মতো পাওয়া না গেলেও বাজারে সুন্দরীর অভাব নেই। ইচ্ছে করলেই নিত্যনতুন একজনকে বিছানায় তুলতে পারে বাসুদেব চৌধুরি। তা না করে তাকে!
রাধা বুঝে নিয়েছে অপেক্ষা করতে হবে তাকে। বুড়ো যতটুকু নিচ্ছে, ততটুকুই পাওনা বলে মেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। দিনে ‘বড়মা’-র নগ্নতা গোপন করার জন্য যে টাকা সে পায়, রাতে নিজে নগ্ন হওয়ার জন্য তার তুলনায় খুব কম কিছু পায় না। প্রথমদিন ডেকেই পরিস্কার করে দিয়েছিলেন বাসুদেব চৌধুরি।
‘তোমায় যদি মাঝে-মাঝে ঘরে ডাকি তোমার কি কোনও অসুবিধে আছে? আই উইল পে ফর দ্যাট। আলাদা টাকা দেব।’ ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চমকে ওঠে রাধা। জড়োসড়ো হয়ে বলে, ‘টাকা তো আপনি দেন বড়বাবু।’
আর দরকার নেই?’
রাধার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এ বাড়ির রোগীর তাকে প্রয়োজন, এবার যদি বাড়ির মালিকেরও তাকে প্রয়োজন হয় তা হলে তো সোনায় সোহাগা। ফেলে আসা জীবনের পুরোটাই কেটেছে চরম দুর্দশায়। মাত্র কয়েকদিনের ভাবভালোবাসায় চালচুলোহীন যে লোকটার সঙ্গে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল, বিয়ের পরপরই জানতে পারল, লোকটার শরীরে ভয়ংকর ব্যাধি। বুক, পেট ঝাঁঝরা হয়ে আছে। জেনেশুনে তাকে ঠকিয়েছে। ভালোবাসার গল্প পুরোটাই বানানো, মতলব ছিল অন্য। আসলে চেয়েছিল, বউয়ের নামে দাসী হয়ে কেউ একজন তার সেবাযত্ন করুক। বিনিপয়সায় এ কাজের জন্য বউ ছাড়া আর কাকে পাওয়া যাবে? তা ছাড়া এই মেয়ের যা চেহারা তাতে অন্য কোনও পুরুষের হাত ধরে চট করে যে ঘর ছাড়বে সে উপায়ও নেই। কয়েকমাস কাটতে না কাটতে সেই লোকের মূত্রাশয়ে ক্যানসার ধরা পড়ল। রাধার মাথায় আকাশ ভাঙে। সামান্য কাঠমিস্ত্রি। একদিন কাজে না গেলেই রোজগার বন্ধ। এই মারাত্মক রোগের চিকিৎসা হবে কী করে? গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করলে ভাইরা সাড়া শব্দও দিল না। কুশ্রী দিদি পালিয়ে বিয়ে করতে তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। দিশেহারা রাধা কী করবে বুঝতে পারছিল না। স্বামী যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করে বস্তির ঘর মাথায় তুলত দিশেহারা রাধা ভাবত গলায় দড়ি দিলে কেমন হয়? বস্তির প্রতিবেশী কমলা শেষ পর্যন্ত হদিস দিল। শেষ পর্যন্ত এক লোকের খোঁজ পাওয়া গেল। এক প্রতিবেশীর মামা না কাকা, মেডিকেল কলেজের কর্মচারী। খুবই সামান্য কর্মচারী। মর্গে কাজ করে। দিনে কটা লাশ এল ও গেল তার হিসেব রাখে। পার্টি এলে ট্রে ধরে টান মেরে ‘বডি’ দেখায়। রাধা গিয়ে তার হাতে পায়ে পড়ল, হাসপাতালে যদি একটা জায়গা হয়। বেড-টেড কিছু লাগবে না, বারান্দায় কোণে ফেলে রাখলেও চলবে। চিকিৎসা না হলেও ক্ষতি নেই, ঘরে বসে এই যন্ত্রণা সহ্য করা অসম্ভব। সেই লোক ক’দিন রাধাকে ঘুরিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, কাল হয়ে যাবে। আজ আটটার পর একবার আসিস। ওই সময় হালকা থাকি।’ পরদিন গেলে মর্গের পিছনে, অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে দাঁত খুঁটতে-খুঁটতে লোকটা স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘নে, কাপড় তোল, হাতে টেইম নেই। যে-কোনও সময় মড়া চলে আসবে।’
মর্গের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল রাধার। বমি সামলে সে আদেশ শুনেছিল মরা মানুষের মতো। ‘কাজ’ শেষ হলে মুখ কুঁচকে লোকটা বলেছিল, ‘ধুস শালা, মরদের মতো শক্ত শরীর। যা এখন ভাগ, কাল সকালে পেশেন্টকে নিয়ে আসিস।
তারপর রাধার গায়ের কাছেই থুতু ফেলেছিল একদলা।
স্বামীকে হাসপাতালে কোনওরকমে ঠাঁই করে দিলেও ওই লোক আর কোনওদিন ডাকেনি রাধাকে। এখন ডাকছেন বাসুদেব চৌধুরি। বুক ধক করে উঠবে না?’
রাধা ঘাড় কাত করল। বাসুদেব শান্ত গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে।’
রাধা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘কবে আসব বড়বাবু?’
‘আমি ডেকে নেব।’
রাধা কাবার্ড থেকে পেট মোটা মদের বোতল বের করল। বাসুদেব চৌধুরির পাশে নীচু কাঠের টেবিলটা টেনে দিয়ে গ্লাস, জল রাখল। কাচে কাচে ঘষা লেগে সামান্য টুংটাং আওয়াজ হয়।
‘আমি কি ঢেলে দেব?’
‘না, তুমি বোসো।’
রাধা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল বাসুদেবের।
‘ভারতী ঘুমিয়ে পড়েছে?’
রাধা ঘাড় কাত করে বলল, ‘অনেকক্ষণ।’
‘সেদিনকার মতো জেগে উঠবে না তো?’
‘আমি তালা দিয়ে এসেছি। তা ছাড়া ক’টাদিন তো বড়মা ভালোই আছেন। গোলমাল কিছু করেননি।’ রাধার কন্ঠস্বর তার শরীরের মতোই ভারী।
বাসুদেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কতদিন?’
‘দিন কুড়ি-বাইশ হতে চলল।’
বাসুদেব বোতল খুলে গ্লাসে সামান্য মদ ঢাললেন। তিনি সামান্যই খান। কোনও কোনওদিন খানও না, গ্লাসে ঢেলে হাতে নিয়ে বসে থাকেন শুধু।
‘একটানা এতদিন তোমার বড়মা তো গোলমাল না করে থাকেন না। কী হল!’
অন্ধকারেই রাধার ভুরু কুঁচকোল। বুড়োর গলা কেমন যেন লাগছে। স্ত্রীর ভালো থাকার খবরে লোকটা কি খুশি নয়? সে চাপা গলায় বলল, ‘বড়বাবু, আমি তো বেশিদিন নেই, এই হপ্তা শেষ হলে আট পুরিয়ে ন’মাস হবে। আগে কী হয়েছে বলতে পারব না। তবে আমি আসার পর একটানা এতদিন ভালো দেখিনি।’
‘ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘তিন-চারদিন অন্তর রিপোর্ট করি। এবারও বলেছি।’
হাতে গ্লাস নিয়েই বাসুদেব চেয়ারে হেলান দিলেন। আধশোয়া অবস্থায় বললেন, ‘ডাক্তার কী বলল?’
‘মনে হল খুশি হয়েছেন। বললেন, আরও ক’টাদিন দ্যাখো।’
পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে রাধা। তার পরেও হাতদুটো কোলের ওপর রাখা। বুক থেকে চুল সরিয়ে দিয়েছে পিঠে। আকারে স্থুল স্তনদুটি অন্ধকারে আরও ঘন হয়ে উঠেছে। এতদিনে খুব বেশি হলে সাত থেকে আটবার রাধাকে ঘরে ডেকেছেন বাসুদেব। রাতে, গোটা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়বার পর।
‘সুস্থ থাকলে তোমাদের বড়মা আজকাল কী বিষয় নিয়ে কথা বলছে? নাকি চুপ করে থাকে?’ শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন বাসুদেব।
রাধা হাসল। হাসলে তাকে ভালো দেখায় না। দাঁতের একটা অংশ উঁচু। মাড়ি বেরিয়ে পড়ে। যদিও অন্ধকারে হাসি তেমন করে বোঝা গেল না।
‘ভালো থাকলে বড়মার মতো মানুষ হয় না। কতরকম যে গল্প করে। চারুর মাকে সেদিন ডেকে রান্নার কথা বললে।’
‘রান্না!’
গ্লাসে আবার চুমুক দিলেন বাসুদেব। ভারতী এখন রান্নার কথা বলছে। কত বছর পর? বাসুদেবের গলায় বিস্ময় রাধা সম্ভবত বুঝতে পারল। মনে মনে হেসে পা বদল করল। ইচ্ছে করেই করল।
‘হ্যাঁ, বলল, আপনার রান্নায় ঝালমশলা যেন কম দেয়।’
‘আমার রান্নায়!’ বাসুদেব সোজা হতে গিয়েও নিজেকে সামলালেন, তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
‘বললে, তোদের বড়বাবুর বয়স হচ্ছে, বুঝেসুঝে রাঁধবি। চারুর মা তো থ।’ তারপর বড়মা বললে, একদিন ঘুগনি করবি। উনি ঘুগনি খেতে ভালোবাসেন। ছোট ছোট করে আলু কাটবি, দুটো কাঁচালংকা ভেঙে দিবি, ধনেপাতা ছড়াবি।’
বাসুদেব নড়েচড়ে বসলেন। শুধু ঝালমশালার কমের কথা নয়, রাঁধুনিকে রেসিপিও বলছে ভারতী! কই তিনি এসব কিছুই জানতে পারেননি। দু-একদিন বাদ দিলে সকালে সন্ধেতে, রোজই তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথাও হচ্ছে। শহরের বাইরে না গেলে এই কাজ তিনি করছেন দীর্ঘ পঁচিশ বছর। অভ্যেসের মতো। যত দিন গেছে সেই কথা বাঁধা গতের মতো দু-চারখানার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ‘কেমন আছ?’ ‘রাতে ঘুম হয়েছে?’ ‘কিছু লাগলে জানিও।’—ব্যস এইটুকু। বহুবছর পর সেদিন স্বর্ণর কথা তোলায় চমকে উঠেছিলেন। রেগেও গিয়েছিলেন। নিজেকে সামলাতে পারেননি। স্ত্রীর অসুখের কথা যেন কিছুক্ষণের জন্য মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে খারাপও লেগেছে। এখন রাধার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার কোনও অন্যায় হয়নি। ভারতীর স্বাভাবিক ভঙ্গির তর্কই সেদিন তার অসুখের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল।
‘আর কী বলছে? হাতের গ্লাস শেষ করে ঝুঁকে পড়ে বোতলের মুখ খুললেন বাসুদেব।
রাধা তার নগ্ন হাত প্রসারিত করে বলল, ‘দিন আমি ঢালি। বরফ দেব?’
রাধার কথায় আমল না দিয়ে বাসুদেব গ্লাস ভরতে ভরতে বললেন, ‘আর কী বলছে তোমার বড়মা?’ তার গলা সামান্য আনমনা। একটু কঠিনও।
রাধা ঠোঁট কামড়াল। তার এবার ঠান্ডা লাগছে। গা খালি করে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগারই কথা। লাগুক। সামান্য ঠান্ডা গরম নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। একদিনে হতকুচ্ছিত শক্তপোক্ত শরীর দিয়ে সে পাগলের দায়িত্ব পালন করছে, অন্যদিকে সেই শরীর দিয়েই এই মানুষটাকে জাঁতাকলের মতো ধীরে ধীরে চেপে ধরছে। শরীরের এই রোজগার অনন্তকাল থাকবে না। গতমাসে সে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। ইচ্ছে আছে পোস্টাপিসেও টাকা রাখবে। সে দু-হাত আড়াআড়ি করে বুক ঢাকার ভান করল। পুরুষ উত্তেজিত করার রংঢং তার জানা নেই। এই চেহারায় তার যে কখনও দরকার হতে পারে, ভাবেওনি। ফলে নিজের মতো চেষ্টা চালায়। নীচু গলায় বলল, ‘আপনাদের বিয়ের গল্প বললেন।’
‘কীরকম গল্প সেটা?’
‘কীভাবে হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন বরানগরে—এইসব কথা।’
বাসুদেব বিস্মিত গলায় বললেন, ‘এতসব মনে করে বলছে।’
‘বড়মার মনে আগেও পড়ত, তবে বলতে গেলে সব জড়িয়ে যেত। ক’টাদিন দেখছি স্পষ্ট করে বলতে পারছে। শুধু পুরোনো কথা নয়, বড়মা নতুন কথাও বলছেন, ওই তো রান্নার কথা বললাম, সেদিন সকালে গাছ নিয়ে অনেক কথা বললেন। সার, পোকামাকড়ের ওষুধ। নিতাই বড়মার কথা শুনে খুব খুশি।’
বাসুদেব মাথা নামিয়ে বসে রইলেন। বাইরের লোকের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলা শুরু করেছে ভারতী! চাপা গলায় বললেন, ‘আর কিছু?’
‘আর ছোটবাবুর কথা বলেন।’
বাসুদেব চমকে মুখ তুলে বললেন, ‘ছোটবাবু! স্বর্ণ? স্বর্ণর কথা কী বলে ভারতী?’
ছেলেবেলার গল্প। ছোটবাবু নাকি বোর্ডিং থেকে এলে মা-মা করে কান্নাকাটি করত। একবার নাকি খুব ঝামেলা করেছিল। বড়মার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি বলে নিজেই দরজা আটকে বসেছিল সারাদিন।’
‘আর কিছু বলে? আরও আগের কথা?’
‘না, একেবারে কোলের সময়ের কথা মনে করতে পারে না। জিগ্যেস করলে চুপ করে থাকে।’
গ্লাসের মদটুকু গলায় পুরো ঢেলে বাসুদেব চুপ করে রইলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হালকা, কিন্তু করছে। তিনি রাধার চোখের দিকে তাকালেন। অন্ধকারে চোখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, তাও তাকালেন। এই মেয়ে কতটা জেনেছে? যতটা বলছে, ততটা, নাকি তার থেকেও বেশি? বেশি ধরে নেওয়াটাই ভালো। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা ভারতী। যা শুনলেন তার কিছুটাও যদি সত্যি হয়…ভারতী কি সুস্থ হয়ে উঠছে? পুরোটা না হোক, খানিকটা? যতটায় সে একটানা বেশ কিছুদিন শান্ত থাকতে পারবে, পুরোনো কথা মনে করে বলতে পারবে? বিয়ে, সংসার, সন্তানের কথা? এখন সর্বক্ষণ যে পাশে থাকে তাকে বলতে শুরু করেছে, এরপর বাকিদের বলবে। আজ স্বর্ণর শৈশব বলতে পারছে না, কাল পারবে না কে বলতে পারে? তাহলে?
তা হলে কী সেটা ভাবতে হবে, খুব দ্রুত ভেবে নিতে হবে।
বাসুদেব ইশারা করলে রাধা উঠে, বোতল, গ্লাস সরাল। এবার যেতে হবে। যাওয়ার আগে এসে দাঁড়াবে ‘বড়বাবু’র সামনে। যদি ইচ্ছে হয়, তবে শরীর ছুঁয়ে দেখবেন। বেশিরভাগ সময়েই দেখেন না। আজ দেখলেন। চেয়ারের আরাম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাউসকোটের দড়ি খুলে নিজেকে উন্মুক্ত করলেন বাসুদেব। তারপর রাধার শরীরে নিজের পুরুষত্ব ঘষতে লাগলেন উন্মত্তের মতো। ‘বড়বাবু’র কাঁধ চেপে ধরে স্থির হয়ে রইল রাধা। তার মনে হল, মানুষটা তার নগ্নতায় তাকে খুঁজছে না, অন্যকিছু অন্য কাউকে খুঁজছে। কঠিন শরীর ভেজাতে ভেজাতে সে ধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইল, যদি জেগে ওঠে। যদি একবার জেগে ওঠে মানুষটা।
বিছানায় শুয়েও বহুক্ষণ ঘুম এল না বাসুদেব চৌধুরির। একটা আচ্ছন্ন ভাব। সম্ভবত মদের কারণেই। এতটা খাওয়ার অভ্যেস নেই। আচ্ছন্ন অবস্থাতেই বাসুদেবের মনে হতে লাগল, একটা জাল তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেই জাল স্বচ্ছ, প্রায় অদৃশ্য। আলোয় দেখা যায় না, অন্ধকারে অনুভব করা যায়। এই জাল তিনি নিজেই বুনেছেন, তাকে নিজেই কাটতে হবে। এর জন্য যতটা প্রয়োজন তার থেকেও যদি বেশি নিষ্ঠুর হতে হয় তাই হতে হবে। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার মতো নিষ্ঠুরতাও তার কাছে নতুন কিছু নয়। শুধু বাইরের সৌন্দর্য্য নয়, এক সময়ে ভারতীকে তিনি সত্যি ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন। ঠিক তখনই তার অসুখ মাথা চাড়া দিল। বীভৎস অসুখ। উলঙ্গ হয়ে সে যেন স্বামীর অতীতকেই উলঙ্গ করতে চাইল। এই আঘাতের কথা দু:স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি বাসুদেব। তবু তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন ভারতী যাতে সুস্থ হয়ে ওঠে। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। অর্থ, চিকিৎসা, সুন্দর বাড়ি কোনও কিছুর কার্পণ্য করেননি। লাভ হয়নি। তখন স্বর্ণকে আনলেন। কাজটা সহজ ছিল না। অনেক কাকুতিমিনতি, অনেক প্রলোভন, অনেক মিথ্যে ছিল সেই ঘটনায়। ভেবেছিলেন, ছেলেটাকে নিয়েই বাঁচবেন। তাও কি হবে না? ভেঙে যাবে? তিল তিল করে যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন, বারবার তাতে ধাক্কা এসেছে। তাকে সামলাতে হয়েছে কখনও সহজে, কখনও বাঁকা পথে। এবারও তাই করবেন। অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে যেখানে তিনি পৌঁছেছেন তা কাড়ার অধিকার কারও নেই। এমনকী ভারতীরও নয়।
ঘুমের ঠিক প্রাক মুহূর্তে একটা চরম সত্য অনুভব করলেন বাসুদেব। তিনি আর চান না ভারতী সুস্থ হোক।
এগারো
কলকাতা শহর দ্রুত পালটাচ্ছে। প্রাচীন পথের ওপর ময়াল সাপের মতো কংক্রিটের ফ্লাইওভার হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একটার পর একটা। পুরোনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে গগনচুম্বি চকচকে ইমারত। দুপাশে ঘোর লাগা দোকান, বাজার, সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ নিত্যনতুন পসরা সাজিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। ঠেলাগাড়ি, রিকশা আর ক্লান্ত মিছিলের ফাঁকফোঁকর গলে নি:শব্দে চলে যাচ্ছে বিদেশি গাড়ি। পালটাচ্ছে শহরের মানুষগুলোও। গরম তাওয়ায় বসানো রুটির মতো ক্ষণে ক্ষণে নিজেদের এপিঠ-ওপিঠ করে সেঁকতে সেঁকতে সর্বক্ষণ ছুটছে পড়িমড়ি করে। কানে মোবাইল লাগিয়ে যেন অনবরত জানতে চাইছে, ‘সামনে গর্ত কত বড়? লাফ মারলে হবে না কি হোঁচট খেতে হবে?’ ফুটপাতে হতদরিদ্র ভিখিরি মা শিশুর মুখে শুকনো বুক গুঁজে রেডিয়োতে এফ এম চালিয়ে শুয়ে থাকে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভঙ্গিতে। ভিক্ষে দিলে ভালো, না দিলে ক্ষতি নেই। মোড়ে মোড়ে এটিএম কাউন্টার নষ্ট মেয়ের ঠোঁটে লেগে থাকা থ্যাবড়া লিপস্টিকের মতো জ্বলজ্বল করে।
যে সামান্য কয়েকটা জিনিস থমকে আছে, তাদের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন কিছু গণিকালয় আর দেশি মদের আড্ডা। গলি ঘুপচির মধ্যে এদের আস্তানা। অন্ধকার আর নিভু-নিভু হলুদ আলোর মধ্যে কোথাও ফেলা আছে তেল চিটচিটে তোশক ফেলা তক্তাপোশ, কোথাও টানা বেঞ্চ সাজানো। দরজা ঠেলে ঢুকলে মনে থাকে না, বাইরে কলকাতা নামে একটা শহর ছুটছে।
জায়গাটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল স্বর্ণর। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউকে ডানহাতে রেখে আঁকাবাঁকা গলির মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। পায়ে পায়ে আবর্জনা। ভাঙা লোহার টুকরো, ছেঁড়া প্যাকিংবাক্স, বাতিল প্লাস্টিকের মোড়কের মাঝে কাপড়ের টুকরো, ছেঁড়া কাগজ, ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন। স্বর্ণ সতর্কভাবে পা ফেলছে। পানশালার কোনও সাইনবোর্ড নেই। দরজাটাও আলাদা কিছু নয়, গৃহস্থ বাড়ির মতো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্বর্ণ খানিকটা ধন্দে পড়ল। একপাশে ছোলা, চানা, তেঁতুল জলের হাঁড়ি সাজিয়ে টুল পেতে নির্বিকার মুখে বসে আছে ফুটফুটে চেহারার এক কিশোর। জিগ্যেস করায় হাত দিয়ে দরজা দেখাল। সামান্য ঝুঁকে গলা নামিয়ে বলল, ‘ছোলা লাগবে? চাট? ভালো স্কুল গার্ল আছে।’
ছোট ঘরটা লোকে ভরতি। ধোঁয়া আর অন্ধকার চোখ সওয়া হলে স্বর্ণ দেখল, সারি সারি চেয়ার টেবিলে অস্পষ্ট মানুষরা বসে আছে। মিনিট খানেক কাটতেই পরিচিত গলা কানে এল।
‘এই যে ব্রাদার, এদিকে।’
স্বর্ণ মুখ ফেরাল। চিমসে চেহারার একজন তার দিকে চেয়ে আছে। মিটিমিটি হাসছে। চেহারা দেখলে বোঝা যাচ্ছে, বয়স বেশি, কিন্তু কতটা চট করে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তা হলে এই সেই লোক?
স্বর্ণ এগিয়ে যেতে লোকটা আবার হাসল। কম আলোতেও স্বর্ণ দেখতে পেল, লোকটার দাঁতে ছোপ-ছোপ দাগ। মাথার চুল অধিকাংশ পাকা। দুটো গালই তোবড়ানো। মাঝেমধ্যেই মুদ্রাদোষের মতো তোবড়ানো গালে হাত বোলাচ্ছে। কম আলোর কারণে জামাকাপড়ের রং বোঝা যাচ্ছে না, তবে সেগুলোর অবস্থা যে সুবিধে নয় সেটা বোঝা যাচ্ছে।
‘গুড বয়, অন টাইম এসেছে। বসে পড়ো।’
জায়গার জন্য স্বর্ণ বিরক্ত। এই মানুষের মুখে ‘গুড বয়’ শুনে সেই বিরক্তি বাড়ল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, ‘আমি টাইম মেইনটেইন করি।’
‘তোমার বাবাও করত। বাসুদেবও কখনও সময় ফেল করেনি। যখনকার কাজ তখনই সেরেছে।’
লোকটার গলা জড়ানো। জড়ানো হওয়াটাই স্বাভাবিক। কতখানি খেয়ে নিয়েছে কে জানে। টেবিলে বেঁটে-বেঁটে দুটো বোতল। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এবার দেশি মদ, সিগারেট বিড়ির উৎকট গন্ধে স্বর্ণর গা গুলিয়ে উঠল। সে নীচু গলায় বলল, ‘কাজের কথায় আসুন।’
মানুষটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় হেসে বলল, ‘আরে বাবা তাড়া করো কেন? কাজের কথায় আসব বইকি। আগে বলো কী খাবে? একটা ওমলেট বলি?
‘আমি কিছু খাব না।’
বুড়োটা মুখের সামনে ডান হাতের মুঠো ধরে বারকয়েক কাশল। কাশি চিনতে পারল স্বর্ণ। টেলিফোনে শুনেছে। লোকটার কি টিবি ধরনের কোনও অসুখ আছে? হতে পারে।
‘তা কি হয়? আত্মীয় বলে কথা। কিছু না খেলে চলে?’
‘আত্মীয়!’
বুড়ো বিচ্ছিরি হেসে হেঁচকি তুলল। টেবিলে রাখা সস্তা কাচের গ্লাস তুলে গলায় ঢেলে বলল, ‘বন্ধুপুত্র আত্মীয় ছাড়া কী?’
স্বর্ণ ভুরু কোঁচকাল। বলল, আপনার নাম কী?’
লোকটা এবার মুখ শক্ত করল। সামনের প্টে থেকে খানকতক ছোলা তুলে মুখে নিয়ে বলল, ‘নাম জেনে তোমার কী প্রয়োজন নেই। যার প্রয়োজন সে জানলেই হল। তোমার বাবার কথা বলছি।’
‘বাবা! বাবার সঙ্গেও আপনি যোগাযোগ করেছেন?’
বুড়ো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘খানিকটা করেছি, পুরোটা করিনি। পুরোটা করব ক’দিন পরে। আগে তোমার সঙ্গে কাজটা সেরে ফেলি তারপর করব। তোমার বাবা কি সহজ মানুষ ব্রাদার, তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আয়োজন লাগে।’
স্বর্ণ আজ মনে জোর নিয়ে এসেছে। কঠিন গলায় বলল, ‘আপনি সোজাভাবে কথা বলুন।’
লোকটা হাতের গ্লাসটা টেবিলের ওপর ঠুকতে ঠুকতে নিজের মনেই যেন হাসল। চাপা গলায় বলল, ‘বলব, বলব বইকি ব্রাদার। এতদিন ধরে তোমার মনটাকে একটু একটু করে তৈরি করার পর আজ যখন ডেকেছি তখন সোজা বাঁকা সব কথা বলব। কিন্তু কোন সোজা কথাটা দিয়ে শুরু করব সেটাই ভাবছি। কীভাবে বাসুদেব চৌধুরি তার এক সরলসিধে বন্ধুকে ভুল পথে ঠেলে তার সর্বনাশ করেছিল সেই সোজা কথাটা? নাকি কেমন করে কালোকুলো, বোকাসোকা, অশিক্ষিত একটা মেয়েকে বিয়ে করার যৌতুক হিসেবে শ্বশুরমশাইয়ের সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিল সেই বাঁকা কথাটা? আর একটা দিয়েও শুরু করা যায়। কনককে ছেড়ে চলে আসার কথাটা দিয়ে।’
‘কনক!’ স্বর্ণ ভুরু কুঁচকে তাকাল।
‘চমকে গেলে মনে হচ্ছে ব্রাদার নামটা চেনা চেনা ঠেকছে না? ঠেকবেই। নিজের কোম্পানির নাম চেনা ঠেকবে না? কনক গার্মেন্স। কী এবার আমায় বিশ্বাস হচ্ছে তো?’
স্বর্ণ মাথা নামিয়ে টেবিলের কোণদুটো চেপে ধরল। নিজের মনেই ফিসফিস করে উঠল, ‘ইমপসিবল।’
‘দ্যাখো ছোকরা, তোমার বাপ এরকম অনেক ইমপসিবল কাজ করেছে। যে দু-একটা পারেনি তার একটা হল কনককে দিয়ে ডিভোর্সের কাগজে সই করাতে পারেনি। কেন পারেনি সে কথা তো তোমাকে আমি আগেই জানিয়েছি। কনকের বাবা পরেশ মাইতি লোকটা ছিল হাড়ে বজ্জাত। সম্পত্তি দেওয়ার সময় মোক্ষম প্যাঁচ মেরে রেখেছিল। কন্ডিশন রেখেছিল, কোনওদিন মেয়ে-জামাইয়ের ছাড়াছাড়ি হলে মেয়েকে বিজনেসের আদ্দেকটা ছেড়ে দিতে হবে। ব্যবসায়ী মানুষ সাধারণত সাবধানী হয়। আমার বাপটা ছিল বেশি সাবধানী। এইটুকু যে খেলে রাখবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? তাছাড়া সম্ভবত তার ভাবী জামাইটি সম্পর্কে কিছু সন্দেহ ছিল। যতই হোক তার গুণধর পুত্রেরই তো বন্ধু।’ কথা শেষ করে আবার আওয়াজ করে হাসল মানুষটা।
‘আপনার বাবা?’
‘আবার চমকালে তো? ইয়েস ব্রাদার, বাসুদেব চৌধুরি আমার বোনকেই বিয়ে করেছিল। তবে তুমি যদি বাপু আমাকে আইনকানুনের কথা জিগ্যেস করো তাহলে বলতে পারব না। পেটে মদ আছে, বিদ্যে বুদ্ধি নেই। তোমার বাপের গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। শয়তানি বুদ্ধি। আমাকে ধরে নিজে ফকির থেকে রাজা হয়ে গেল, আর আমাকে বসাল পথে। হারামজাদা আমার পয়সায় পায়ের ওপর পা তুলে ফুটুনি মারে।’
স্বর্ণ মাথা নামাল। তার বিশ্রী লাগছে। মনে হচ্ছে, সে খানিকটা পুতিগন্ধময় পাঁকের মধ্যে বসে আসে। সেই পাঁক তাকে ভেতর দিকে টানছে।
‘আমাকে বিপদে ফেলে বাসুদেব ভাবল আর চিন্তা নেই। কিন্তু ঘটনা ঘটল উলটো। একটা সময় বেটা পড়ল মহাবিপদে। ব্যাবসাপাতি করে কয়েক বছরে পয়সাকড়ি হল। গাড়ি কিনল, ফ্ল্যাট নিল। চারপাশে হল। সুন্দর সুন্দর ছেলে, সুন্দর সুন্দর মেয়ে। তাদের সামনে গাঁইয়া কুচ্ছিত বউটাকে হাজির করে কী করে? কী করে বলে, তোমরা সবাই শোনো এই মেয়ের বাপের পয়সাতেই আমার এত ঠাটবাট? এত ফুটানি। এ তো বাপু সিনেমা, থিয়েটার নয়। তা ছাড়া আর একটা সত্যি কথা আছে…থাক, পুত্র হয়ে তোমার আর সেই সত্যি শুনে কাজ নেই।’
কথা থামিয়ে চোখ নাচাল মানুষটা। স্বর্ণর মনে হল, টেবিলের ওপর চাপড় মেরে ধমক দেয়। হাত মুঠো করে নিজেকে সামলাল। রাগ দেখাতে সে এখানে আসেনি। চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আপনি অবান্তর কথা বাদ দিন।’
বোতল শেষ করে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছল বুড়ো। চোয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে স্বর্ণর দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘বাদ দিলে চলবে কেন ব্রাদার? বলব বলেই তো এতদিন অপেক্ষা করে আছি বাবা। এত বছর। তুমিও শুনবে বলে ছুটে এসেছ। যদি বলো, থেমে যাই। তুমি কেটে পড়ো। আমি তো তোমাকে জোর করে ধরে আনিনি বাছা। তোমার ধমক শুনব কেন?’
স্বর্ণ ভুলটা বুঝতে পারল। সত্যিই তো, সে শুনতেই এসেছে। বাকি জীবনটা যদি বিচ্ছিন্ন ভাবে বাঁচতে হয়, তা হলে নিজের শিকড় জেনেই বাঁচতে হবে। সে মাথা নামিয়ে বলল, ‘আপনি বলুন।’
‘এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতো কথা। বাসুদেবের বিপদ হল সেখানেই। সেই সময় ব্যাবসার আদ্দেক ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ সাপলুডোর খেলার মতো। সাপের মুখে পড়ে আবার হড়কে নামতে হবে একশো ঘর নীচে। বউকে সে রাখতেও পারছে না, ছাড়তেও পারছে না। এর মধ্যে আবার ভারতী নামে এক রূপবতীর সঙ্গে দুম করে দেখা হয়ে গেল। মাথা গেল ঘুরে। তখন নিশ্চয় আগের বউ নিয়ে গোপনে উকিল-টুকিলের সঙ্গে পরামর্শও করেছে। আমি ঠিক জানি না। তারা হয়তো বলেছিল, কনককে ব্যাবসার শেয়ার ছেড়ে দিয়ে মুক্তি নাও। তোমার অর্থলোভী পিতৃদেব সেটা মেনে নিতে পারেনি। সুতরাং পথ খোলা রইল একটাই। কনককে ম্যানেজ করা।
স্বর্ণ ইতস্তত করে বলল, ‘কত টাকা নিয়েছিলেন উনি?’
বুড়ো লোকটা স্বর্ণর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুটা সময়। তারপর মুখে একটা আপশোসের আওয়াজ করে বলল, ‘এইটাই তো হল সমস্যা। শুনেছি, আমার গাধা বোনটি টাকাপয়সার থেকে সেদিন নাকি কান্নাকাটি বেশি করেছিল। তারপর যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকু নিয়েই নিজেকে সরিয়ে নিল। মনে হল সে মেয়েমানুষের চরম ভুলটা করে ফেলেছিল, সি ফেল ইন লাভ উইথ দ্যাট স্ক্রাউন্ড্রেল। তোমার বাবাকে ভালোবেসে ফেলেছিল গাধাটা।’
স্বর্ণ চোখ তুলে কঠিন গলায় বলল, ‘আর আপনি? আপনি কী করছিলেন? বোনকে বোঝাতে পারেননি?’
চোখ দুটো ক্ষণিকের জন্য যেন জ্বলজ্বল করে উঠল মানুষটার। শীর্ণ হাত তুলে স্বর্ণর পিঠে চাপড় দিল।
‘শাবাশ, এই তো চাই। এই রাগটার জন্যই তো আমার এতদিনের অপেক্ষা। আমি তখন এখানে ছিলাম না ব্রাদার। তোমার বাবা আমাকে দেশছাড়া করতে পারেনি, তবে ঘরছাড়া করেছিল। পুরোটাই যে তার দোষ ছিল এমনটা বলব না, আমারও কিছু ছিল। বাপের টাকায় মদ, মেয়েছেলেতে জমে ছিলাম। বাসুদেব সেই আগুন উসকে দিল। তবে সে অন্য আর এক বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। আমি যদি সেদিন আমার বোনের পাশে থাকতাম, এ বোকামি তাকে কিছুতেই করতে দিতাম না। পাছায় লাথ মেরে…।’
মানুষটা টলমল পায়ে কাউন্টারে গিয়ে আবার একটা মদের বোতল নিয়ে এল।
‘স্বর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপনি কি ফিরে এসে সব জেনেছেন?’
‘না, কনক আমাকে কিছুই বলেনি। বছরের পর বছর এ শহর ও শহর ঘুরে বেড়ানোর পর যখন ফিরে এলাম তখন দেখি কনক দেশের বাড়ির পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছে। আমার ধারণা তোমার বাবাই তাকে সরিয়ে দেয়। অনেক কষ্ট করে সেই ঠিকানা আমি জোগাড় করে যখন পৌঁছোই, কনক তখন আমাকে কিছু বলা তো দূরের কথা, সামনে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেয়নি।’
‘কেন?’
বুড়ো লোকটা সামান্য হেসে বলল, ‘কেন আবার? মেয়েছেলের মরণের বুদ্ধি। হারামজাদির নিশ্চয় রাগ হয়েছে। বিপদের সময় পাশে না থাকার ক্ষোভ দু:খ। কিন্তু আমি তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। দূর থেকেই খোঁজখবর নিলাম। বাসুদেব চৌধুরির কীর্তি একটা করে জানতেও পারলাম। তার পরই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। পিতার দুষ্কর্ম পুত্রকে বিশ্বাস করানো সহজ কাজ নয়, হুটোপাটি করলে চলে না। সময় নিয়ে করতে হয়। আমি সময় নিয়েছি।’
স্বর্ণর মাথা ঝিমঝিম করছে। তার মনে হচ্ছে, এতটা সে নিতে পারছে না। তবু মনে জোর এনে বলল, ‘ঘটনা যদি সত্যি হয় আপনার বোনের উচিত ছিল মামলা করা।’
বুড়োটা ফের স্বর্ণর দিকে ঝুঁকে পড়ল। গালে দু-হাত বুলিয়ে বলল, ‘ছিল কেন? এখনও সময় আছে আর আমি চাই সেটা তুমি কনককে বোঝাবে। তাকে কোর্টে যেতে বলবে। সি উইল গেট অল দ্য সিমপ্যাথি। সকলের সামনে বাসুদেব চৌধুরির মুখোশ টেনে খুলে দিতে তার কোনও তা সুবিধে হবে না।’
স্বর্ণ একটু যেন শিউরে উঠল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বদলে আপনি কী চান?’
‘কিস্যু না। সফল বিজনেসম্যান বাসুদেব চৌধুরি, সকলের চোখের মণি, দু:খীর পরিত্রাতা, উন্মাদ স্ত্রীকে যে মাথায় করে রেখেছে সেই লোকটা সবার সামনে উলঙ্গ হয়ে যাক, ব্যস এইটুকু। সবাই জানুক সে কীভাবে একটা অসহায় মেয়েকে ঠকিয়েছে। একবার মামলা শুরু হলে খবরের কাগজে যাতে ফলাও করে সবটা বের হয় তার ব্যবস্থা আমি করব স্বর্ণ। ডোন্ট ওয়ারি।’
স্বর্ণ শান্ত গলায় বলল, ‘আমি যদি না করি?’
মানুষটা ছোপ-ছোপ দাঁত বের করে মুচকি হেসে বলল, ‘আমি জানি তুমি করবে। কারণ একটা না একটা সময় কনকের পাশে তোমাকে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে স্বর্ণ।’
স্বর্ণ চুপ করে বলল, ‘অনেক হয়েছে, এবার ঠিকানাটা বলুন।’
‘বলব না, আমি তোমাকে নিজে নিয়ে যাব। কনকও দেখুক আমি আসলে তার সম্পত্তি চাই না, ভালো চাই।’
স্বর্ণ চাপা উত্তেজনায় বলল, ‘কবে যাবেন? আজ?’
‘ধীরে ব্রাদার ধীরে। আজ নয়, বারো তারিখ, টুয়েলভথ। তুমি ফাঁকা আছ তো?’
‘কেন? বারো তারিখ কেন?’
‘ব্রাদার ওই দিনটিতে বাসুদেব চৌধুরির সঙ্গে কনক দেবীর যে বিবাহ হয়েছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে নয়, পুরুত ডেকে নমো-নমো বিয়ে। বারো তারিখ তুমি ওখানে গেলে একটা ড্রামার মতো হবে। নাটকীয় প্রবেশ।’
আওয়াজ করে হাসতে লাগল মানুষটা। এপাশ-ওপাশের টেবিলে বসা খদ্দেরটা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
সকাল দশটায় সেদিন তুমি আমার জন্য হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করবে।’
‘হাওড়া স্টেশনে! কোথায় যেতে হবে?’
‘বেশি দূর নয়, ট্রেনে ঘণ্টাতিনেকের জার্নি। দেরি কোরো না। দশটা এগারোর গাড়ি মিস করলে, গাড়ি আবার সেই দুপুরের পর। রাতে ফিরতে পারবে না। এমনিও কি পারবে? মনে হয় না।’
‘মানে?’
বুড়ো চোখদুটো আধবোজা করে মাথা নাড়াতে-নাড়াতে বলল, ‘মানে আর কী, কনক কি তোমায় ছাড়বে ব্রাদার? না কি তুমি ছাড়বে? গিয়েই একবার দ্যাখো না।’
বারো
খানিকটা চুপ করে থাকার পর বাসুদেব চৌধুরি সহজ ভাবে বললেন, ‘দুলালের ঠিকানাটা আমার চাই বিকাশ।
বিকাশ মুখ তুলে ‘চুক চুক’ ধরনের আওয়াজ করল। বলল, ‘ইস সেদিন ফলো করলেই জানা যেত। কিন্তু বিষ্ণুকে বলা হয়েছিল। শুধু স্বর্ণবাবুর ওপর নজর রাখতে উনি বেরিয়ে পড়তে, সে-ও বেরিয়ে আসে। কিন্তু স্যার, আপনি কি শিওর ওই লোকটাই আপনার সেই দুলাল?’
বাসুদেব ভাঙা গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, শিওর। কলেজে পড়বার সময় দুলাল খানিকটা থলথলে ধরনের ছিল। এতদিন পালিয়ে থাকায় চেহারা যে ভেঙে গেছে তাতে আর আশ্চর্য কী! তারও বয়স হয়েছে। আমার মতোই বুড়িয়ে যাওয়ার কথা। আর হ্যাঁ, দুলাল কথায় কথায় নিজের গালে হাত বোলাত। তোমার ওই বিষ্ণু ছেলেটি আর কী শুনেছে?’
বিকাশ সামনে খুলে রাখা ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আর বেশি কিছু নয়, জায়গাটায় হট্টগোল ছিল। দেশি মদের দোকান যেমন হয়। তা ছাড়া বিষ্ণু জায়গাও পেয়েছিল ওদের থেকে খানিকটা দূরে। নীচু গলায় ওরা কী বলছিল অনেকটাই বোঝা যায়নি। স্বর্ণবাবুর কথা তো একটাও নয়। তবে হ্যাঁ, লোকটা স্বর্ণবাবুকে ‘ব্রাদার’ বলে ডাকছিল। হি ওয়াজ টোটালি ড্রাঙ্ক।’
বাসুদেব চৌধুরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিকাশের মনে হয়, মানুষটা খানিকটা অসহায় বোধ করছেন।
স্যার, এবার আমাদের পুলিশে কমপ্লেইন করার সময় হয়ে গেছে।’
বাসুদেব ম্লান হেসে বললে, ‘কমপ্লেইনটা কী হবে? আমার সাবালক ছেলে দেশি মদের দোকানে বসে একজন বুড়ো লোকের সঙ্গে গল্প করছে? কার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন? স্বর্ণ না দুলাল?’
বিকাশ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘না আমরা যদি খামের ঘটনাটা জানাই? থ্রেট কলটাও বলব।’
‘তুমি মনে করছ ফাঁকা খামগুলোও দুলালের কাজ?’
‘অবশ্যই স্যার, ইটস আ সট অব ব্ল্যাকমেলিং। অনেক আগে থেকে হুমকি দিচ্ছিল। সস্তা ধরনের গল্প।’
‘দুলালের এই গল্প বানানোর কারণ কী?’
‘আপনাকে ডিসটার্বেন্সের মধ্যে রাখা। আমরা স্যার পুলিশে জানাই, আজই আমি সেন্ট্রাল ডিভিশনের ডিসির সঙ্গে কথা বলছি। তা ছাড়া হি ইজ আ মার্ডারার।’
‘চিঠি তো কিছু দেয়নি বিকাশ, খালি একটা খামের ওপর কি নালিশ হবে? তুমি যদি দুলালের টেলিফোনটার কথা বলো, সেটাও পুলিশের কাছে মিনিংলেস, কার ছেলে কোন কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে তাই নিয়ে ওরা কী করবে? আর অত দিন আগের সামান্য একটা প্রস্টিটিউট খুন নিয়ে পুলিশ এখন আবার লাফালাফি শুরু করবে বলে মনে করছ?
বিকাশ একটু ভেবে বলল, স্যার, আপনি যদি বলেন, পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স কাজে লাগাতে পারি। বুড়োটাকে দু-চার ঘা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে অসুবিধে হবে না।
‘স্বপ্নদ্বীপ প্রকল্প নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের যে কোম্পানি টাকা ঢালবে বলেছিল, তারা জমি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আসলে নিশ্চিত হতে চায়, ভবিষ্যতে কোনও ঝুট ঝামেলা হবে না। জমিজমার ব্যাপারে আজকাল অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। টাকা ঢালার পর পিছিয়ে প্রজেক্ট বাতিল হচ্ছে। সমস্যাটা নিয়েই বাসুদেব চৌধুরি আজ বসেছিলেন। জেনালের ম্যানেজার বৈদ্য, ফাইনান্সের অঞ্জন মিত্র ছাড়াও প্রজেক্ট ইনচার্জ, সাইট ম্যানেজার, প্রজেক্ট ডিজাইনার, আর্টিটেক্ট সকলেই ছিল। মিটিং দুপুরে শুরু হয়ে সন্ধে পর্যন্ত গড়িয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বৈদ্যকে নিয়ে বাসুদেব নিজে মুম্বাই যাবেন। বিদেশি কোম্পানিকে বুঝিয়ে বলবেন, তারা আঁটঘাঁট বেঁধেই কাজে নামছেন। বৈদ্য বলেছিলেন, স্যার, আপনি না গেলেও চলত। আমরা যেতাম।’
বাসুদেব চৌধুরি বললেন, ‘আমি যাব। শুধু টাকার জন্য, নয় আমি কোনওভাবেই চাই না, প্রজেক্টটা আটকে যাক। আপনারা এয়ার টিকিট, হোটেলের ব্যবস্থা করুন।’
মাঝখানেই বিকাশ খবর পাঠিয়েছিল, সে দেখা করবে। মিটিঙের পর তাকে ডেকে নিলেন বাসুদেব। মালবিকাকে বললেন, ‘তুমি বাড়ি যাও।’ মালবিকা বলল, ‘আমি আরও একটু থেকে যেতে পারি স্যার। এখন তো মোটে আটটা।’
বাসুদেব বললেন, ‘না, তুমি চলে যাও। ফোনের লাইনগুলো আমার ঘরে ডাইরেক্ট করে দিতে বলো।’
মালবিকা কিছুটা চিন্তিত হয়েই বেরোল। তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, মানুষটা সেই টেলিফোনটার জন্য এখনও অপেক্ষা করেন। যদিও মুখে কিছু বলেন না। স্যারকে জিগ্যেস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই ক’টা বছরে অন্তত এইটুকু সে বুঝছে, বাসুদেব চৌধুরীর তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনওরকম কৌতূহল বা আলোচনা পছন্দ করেন না। কেউ শুরু করলে, হুঁ হাঁ বলে এড়িয়ে যান। কেউ তাকে কখনও তার অসুস্থ স্ত্রীর কথাও জিগ্যেস করে না।
বিকাশ খুব অল্প কথায় ‘বস’কে স্বর্ণর গতিবিধির খবর জানাল। গত কয়েকদিন সে কোথায় গেছে, কার সঙ্গে দেখা করেছে, কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কখন ঢুকেছে—এই সব। ইউনিভার্সিটি, কফিহাউস, লাইব্রেরি, প্রফেসরের কাছে পড়তে যাওয়া থেকে শুরু করে রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে বেড়ানো পর্যন্ত। প্রীতির কথা শুনে চোখ তুললেন বাসুদেব। বিকাশ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, ওরা দুজন গঙ্গার কাছে একটা রেস্তোরাঁতেও যাতায়াত করে।’
বাসুদেবের ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসির ঝিলিক এসেও মিলিয়ে গেল।
‘মেয়েটি কেমন?’
বিকাশ নড়েচড়ে বসল। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। বাবাকে ছেলের বান্ধবী সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে অস্বস্তি হওয়ারই কথা।
‘কেমন বলা একটু কঠিন স্যার, দূর থেকে দেখা, তবে আমার লোক যেটুকু জানিয়েছে, তাতে মেয়েটি সম্ভবত স্বর্ণবাবুর সঙ্গে পড়াশোনা করে। বাইরে থেকে যতটা বোঝা গেছে আচার আচরণ, সাজপোশাকও ভদ্রসভ্য।’
‘আর দেখতে? দেখতে কিছু বলেছে?’ কথাটা বলেই বাসুদেব বুঝতে পারলেন ঠিক হল না। এই কৌতূহল না দেখালেই পারতেন।
বিকাশ ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লেখা আছে ফেয়ার কমপ্লেকশন, ডিসেন্ট লুকিং।’
বাসুদেব নিশ্চিন্ত হলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘তারপর বলো।’
বিকাশ তখন মদের আড্ডার খবর দেয়। জানায় বুড়ো চিমসে ধরনের একটা লোকের সঙ্গে দেখা করে স্বর্ণ দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। ঘড়ি ধরে পাক্কা বিয়াল্লিশ মিনিট। বিকাশের অ্যাপয়েন্ট করা ছেলে বিষ্ণু স্বর্ণকে ফলো করে সেই আড্ডায় ঢোকে। দুজনের সব কথা শুনতে না পেলেও শুনছে, বারো তারিখ কোথাও একটা যাওয়ার জন্য দুজনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। হাওড়া স্টেশনের সামনে জেটিঘাটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
বিকাশ নীচু গলায় বলল, স্যার, আপনি যদি পারমিশন দেন, কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারি। সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় পার্টি করে এমন লোক চেনা আছে। ওদের ছেলেপিলে লোকটাকে ধরে পিটিয়ে দেবে। ওই মদের ঠেকে বেটার নিশ্চয় যাতায়াত আছে। বিষ্ণু দূর থেকে চিনিয়ে দেবে। অসুবিধে কিছু হবে না। খুব বেশি খরচেরও ব্যাপার নেই। আজকাল এই সব কাজ অল্প খরচেই হয়ে যায়।’
বাসুদেব ঠান্ডা গলায় মাথা নেড়ে বললেন, ‘সমস্যটা শুধু দুলাল নয়, সমস্যাটা স্বর্ণও। আর সেটাই আসল। আমি জানি না কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, আদৌ সম্ভব কি না। এরকম যে কিছু একটা ঘটতে পারে আঁচ করেছিলাম। দুলালের টেলিফোনটা আসার পর থেকেই আমি অ্যালার্ট হই। ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষাও করেছি। বাট হি নেভার কল মি এগেইন। হয়তো পরে করবে, নাও করতে পারে। সেই কারণেই ওর ঠিকানাটা পাওয়া দরকার। ওর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলতে হবে। এটা পুলিশ বা গুন্ডা লেলিয়ে হবে না। বুঝতে পারছ?’
বিকাশ মাথা নাড়ল, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। অনেকগুলো জায়গাই তার কাছে অস্পষ্ট। স্বর্ণ কেন দুলাল নামের ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করছে? লোকটা কী চায়? স্বর্ণই বা কী চাইছে?
‘স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওই জায়গায় ছেলে বসিয়ে দিচ্ছি। লোকটার হদিস ঠিক পাওয়া যাবে। কিন্তু একটা জিনিস স্যার ক্লিয়ার হচ্ছে না, লোকটা কী ধরনের ঝামেলা পাকাতে পারে?’
বাসুদেব চৌধুরি বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘সে স্বর্ণকে একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারে। এমন একজন যার কাছ থেকে আমি আমার ছেলেকে দীর্ঘ বাইশ বছর সরিয়ে রেখেছি। এর বেশি জানতে চেও না বিকাশ। এর বেশি আমি বলতে পারব না।’
এরকম অবস্থার মধ্যে বিকাশ আগে কখনও পড়েনি। গুপ্তচরবৃত্তির কাজ তার ছেলেরা আজ করেছে না, অনেকদিন ধরেই করছে। আজ মনে হচ্ছে, স্বর্ণ চৌধুরির কাজটা করতে গিয়ে সে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। সামনে আলো দেখতে পেলেও সেখানে পৌঁছোনোর কোনও অধিকার তার নেই, আবার অন্ধকারেই ফিরে আসতে হবে।
‘স্যার, এবার কি আমি উঠতে পারি?’
বাসুদেব খানিকটা যেন চমকে উঠলেন। অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি যাও। তবে তার আগে দুটো জিনিস জেনে নিই। খামের বিষয়টা কিছু জানতে পারলে? শূন্য খাম।’
বিকাশ মাথা চুলকে বলল, ‘না স্যার। এখনও পাকাপাকিভাবে জানতে পারিনি। তবে আপনাকে তো বললাম, বুঝতে পেরেছি, কাজটা ওই দুলালেরই।
বাসুদেব এ কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, ‘হলে ভালো। আর রাধার ব্যাপারটা?’
‘ওটায় স্যার নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। আগে যা জেনেছিলাম ওইটুকুই। ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে চিৎপুর থানায় যে কমপ্লেইন হয়, সেটা নিয়ে পুলিশ এগোয়নি। এগোনোর কথাও নয়। লোকটা একেবারে ডেথবেডে ছিল। বিনা চিকিৎসার অভিযোগটা অর্থহীন। যদি বলেন, মেয়েটার গ্রামে খোঁজখবর করাতে পারি স্যার, পুরোনো অ্যান্টিসিডেন্স যদি কিছু থাকে।’
বাসুদেব বললেন, ‘না, তার দরকার নেই।’
বিকাশ বেরিয়ে যাওয়ার পর বাসুদেব ঘড়ি দেখলেন। প্রায় ন’টা বাজতে চলল। তিনি ইন্টারকম তুলে অফিসের গেট ধরলেন। গাড়ি বের করতে বললেন। তারপর মোবাইল থেকে ডাক্তার সেনের নম্বর টিপলেন।
ডাক্তার সেনের গলায় খুশি স্পষ্ট।
বিকেলেই আপনার বাড়ি ঘুরে এসেছি। মিসেস চৌধুরি অনেকটা ভালো আছেন।’
বাসুদেব শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনি এটাকে ইমপ্রুভমেন্ট বলবেন?’
‘হান্ড্রেড টাইমস বলব। যে পেশেন্ট ওরকম ভায়োলেন্ট, সে যদি টানা এতদিন শান্ত থাকতে পারে তাকে ইমপ্রুভমেন্ট বলব না? সি টকস লজিক্যালি অলসো। আগে যে একেবারে বলতেন না, এমন নয়, আপনি আমার থেকে ভালো জানেন, তবে এখন সেটা অনেক পরিষ্কার।’
মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বাসুদেব বললেন, ‘থ্যাঙ্কু ডক্টর সেন। আপনার জন্যই এতখানি সম্ভব হল। এটা কতদিন পারসিস্ট করবে বলে আপনার মনে হচ্ছে?’
ফোনের ওপাশে ডাক্তারবাবু সামান্য হাসলেন।
‘এটা বলা কঠিন। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার এটাই কঠিন অংশ। এই ধরনের মানসিক রোগী সবসময়ই একটা বর্ডার লাইন ধরে চলাফেরা করে। ভালো আর খারাপ থাকার সাইকেলটা বড় করাই আমাদের চেষ্টা। আমি ওষুধ একটু অদলবদল করে দিয়েছি। আপনাদের ওই মেয়েটি খুবই ভালো। এই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে কেয়ারটা মোস্ট ইমর্পটান্ট। ঠিকমতো ওষুধটা কনটিনিউ করতে হয়। কী যেন নাম মেয়েটির?’
‘আপনি কি রাধার কথা বলছেন?’
‘ইয়েস রাধা; আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি উইদাউট এনি ট্রেনিং অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স… যাক, ওকে আরও কেয়ারফুল থাকতে বলবেন। মেডিসিন যেন ঠিকমতো পড়ে। আমি কয়েকটা বদলে দিয়ে এসেছি। ডিপ্রেশন কাটাতে একটা নতুন ওষুধ দিলাম। এত ঝিমিয়ে থাকা ভাবটা আরও কেটে যাবে। উনি নরমাল অ্যাকটিভিটির জন্যও ভেতর থেকে খানিকটা আর্জ ফিল করবেন। তবে এখনই সেটা অ্যালাউ করা যাবে না। আর একটু দেখি।’
বাসুদেব চিন্তিত গলায় বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার কি মনে হচ্ছে ভারতী উইল বি কমপ্টিলি কিওরড? ও কি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে?’
‘না, মিস্টার চৌধুরি আমি তা মনে করছি না। এতদিনের কমপ্লিকেটেড একটা অসুখ একেবারে ঠিক হয়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক নয়। মেডিকেল সায়েন্সে এরকম কোনও ইনস্টানস নেই। তবে পার্টলি হয়তো হবেন। আংশিক সুস্থ অথবা হয়তো সুস্থ থাকার সময়টা লেনদি হবে। আগে দশ দিন থাকতেন, এখন হয়তো সেটা বেড়ে মাসখানেক হবে। উত্তেজনার ধরনটাও কমে আসবে। ওর পক্ষে সেটাই অনেক। তাই না?’
বাসুদেব নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘অবশ্যই তাই।’
তেরো
অনেকক্ষণ নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল স্বর্ণ। তারপর বদ্যিনাথকে খবর দিল।
তার মাথার যন্ত্রণাটা শুরু হয় সকালে ঘুম ভাঙার পর, আজ বিকেলের পর থেকেই হচ্ছে। প্রীতি বলেছিল, পাঁচটায় ক্লাস শেষ হলে একবার দেখা করবে, কিছু নোটস দেবে। একেই পড়াশোনা কিছুই হচ্ছে না। বইপত্র, নোটস, সাজেশনস প্রীতি যেটুকু যা ব্যবস্থা করার করে দেয়। প্রীতিকে কিছু না জানিয়ে মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল স্বর্ণ। খানিকক্ষণ বিধান সরণি ধরে হাঁটল। ভেবেছিল খোলা হাওয়ায় হয়তো ভালো লাগবে। লাগল না। কিছুই ভালো লাগল না। কপালে ছড়ানো ব্যথা নিয়ে সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরে এল সে।
এত তাড়াতাড়ি ‘ছোটবাবু’কে ফিরতে দেখে গেটের সিকিউরিটিরা বিস্মিত হয়। উঠে দাঁড়িয়ে, টুপি ঠিক করে সেলাম ঠোকে। স্বর্ণ তাদের অবজ্ঞা করে।
সাধারণত স্বর্ণ ভারতী দেবীর সঙ্গে সকালেই দেখা করে। রাতে সে বাড়ি ফেরার আগেই ভারতী দেবী ওষুধপত্র খেয়ে শুয়ে পড়েন। যে দিনগুলোতে অসুস্থতা বেশি থাকে সেসব দিনে সকালেও দেখা হয় না। ছোটবেলায় তাকে বলা হত সিঁড়ির কোলাপসেবলে তালা থাকলে সে যেন ওপরে না ওঠে। এমনকী উঁকিঝুঁকিতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। আবছা মনে আছে, ভারতী দেবী খুব চিৎকার চেঁচামেচি করলে বুড়ি আয়ামাসি তাকে নিয়ে ঘরে দরজা দিত। বুড়ি গল্প বলত ভারী চমৎকার। যত না গল্প বলত তার থেকে বেশি চোখ মুখ নেড়ে ভঙ্গি করত। মায়ের কাছে যাওয়া নিয়ে স্বর্ণ কোনওদিন বায়না করেছে বলে মনে পড়ে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে বুঝতে পেরেছে, ‘মায়ের কাছে যাব’ কথাটা তার জন্য নয়। তবু একদিন, ভারতী দেবীর গোঙানি শুনে সবার চোখ এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়েছিল। কত বয়স তবে তখন? ছয়? সাত? না কি আর একটু বেশি?
কোলাপসেবলের গায়ে ঝোলানো ভারী পরদা সরিয়ে বিস্ময়ে, আতঙ্কে হতবাক হয়ে পড়েছিল ছোট্ট স্বর্ণ। ছুটে নেমে যেতে চেয়েছিল সে, পালাতে চেয়েছিল, পারেনি। মনে হচ্ছিল, পা দুটো সে যেন শক্ত করে আটকে দিয়েছে সিঁড়ির সঙ্গে।
উলঙ্গ ভারতীদেবী তখন আড়াইতলার বারান্দায় ছুটোছুটি করছেন। চোখ টকটকে লাল, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। খোলা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে, বুকে, মুখের ওপর। ছুটতে-ছুটতে কখনও চিৎকার করছেন, কখনও গ্রিলের ওপর মাথা ঠুকে আর্তনাদ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন। চাপা গোঙানির মতো সেই কান্নার আওয়াজ সিঁড়িতে দাঁড়ানো স্বর্ণকে ঘিরে পাক খেতে লাগল, খেতেই লাগল।
সেদিন রাতেই তুমুল জ্বর এসেছিল স্বর্ণর। সঙ্গে ডিলিরিয়াম। ঘটনা শুনে পরদিনই বাড়ির সবক’জন কাজের লোককে ছাড়িয়ে দিলেন বাসুদেব চৌধুরি। বুড়ি আয়া থেকে শুরু রান্নার ঠাকুর, ঘর ধোয়ামোছার মহিলা, ভারতী দেবীর সর্বক্ষণের নার্স সবাইকে। ছাড়ানোর সময় তিনমাসের অগ্রিম বেতন ধরিয়ে দিলেন হাতে। রাতারাতি নতুন লোক ঢুকল। সেই ট্রমা কাটাতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল স্বর্ণর। চোখ বুজলেই উলঙ্গ ভারতী দেবীকে দেখতে পেত সে। ভয়ে কঁকিয়ে, শিউরে উঠত।
এতদিনে পরিস্থিতি বদলেছে। ভারতী দেবীর উত্তেজিত হয়ে পড়বার গ্যাপগুলো বেড়েছে। স্বর্ণও বড় হয়েছে। তবুও তালা বন্ধ থাকলে কোনওদিনই সে ওপরে যায়নি। আগে খবর নিয়েছে।
আজও বদ্যিনাথকে ডেকেছে। তবে দরজা আটকানোর খবর নিতে নয়, ডেকেছে অন্য কারণে।
বদ্যিনাথ ‘বড়বাবু’-র জন্য অপেক্ষা করছিল। ‘বড়বাবু’-র ফিরতে দেরি হচ্ছে। ক’দিন ধরেই এরকম চলছে। বদ্যিনাথ আজ ভেতরে-ভেতরে বেশ খানিকটা উত্তেজিত। উত্তেজনা চেপে সে মুখটা চিন্তিত করে রেখেছে। উত্তেজনার কারণ অবশ্য ‘বড়বাবু’র দেরি করে ফেরা নয়, কারণ অনেকগুলো। তার বোধবুদ্ধির একটা অংশ তাকে যেন বলছে, এই পাগলবাড়িতে কিছু একটা ঘটছে। কী ঘটছে স্পষ্ট জানে না, তবে কিছু একটা ঘটছে। বাসুদেব চৌধুরির মুখ সর্বক্ষণই গম্ভীর। কিছু একটা চিন্তা করেই চলেছেন। ধনী মানুষ ব্যাবসাপাতি নিয়ে যে চিন্তায় থাকবে তার আর আশ্চর্য কী? তার ওপর পাগল বউ, ঝিম ধরা ছেলে। কিন্তু তা সত্বেও ঘরবাড়ি সংসার নিয়ে মানুষটার উৎসাহ কম নয়। এত সমস্যার মধ্যে ঘরের সবদিকে নজর। সেখানে কোথায় যেন ছেদ পড়েছে! লোকজনদের ওপর রাগারাগিও করছেন। তবে মারাত্মক ব্যাপার হল, কিছুদিন আগে বদ্যিনাথ রাধার অভিসারের কথা টের পেয়েছে। গভীর রাতে পিছনের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারস থেকে তার মূল বাড়িতে আসার কথা নয়। সেদিন খাওয়ার জল নিতে এসেছিল। সিঁড়ির তলায় পৌঁছোতেই দোতলায় পায়ের খসখস আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ায়। এই রাতে কে হাঁটাহাঁটি করে! বড়মা? সে যেন সাবধানে পা ফেলছে। সিঁড়ির মুখে সরে আসে বদ্যিনাথ। অন্ধকারে দাঁড়ায় এবং তখনই রাধাকে দেখতে পায়। দোতলা থেকে বেরিয়ে রাধা পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে যাচ্ছে। কোথায় গিয়েছিল এই মেয়ে! বড়বাবুর ঘরে? পা টিপে নিজের ঘরে ফেরে সে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকে তক্তাপোশের ওপর।
এইসব মিলিয়ে বদ্যিনাথের উত্তেজনা। স্বর্ণ ডাকতে সে প্রায় ছুটেই গেল।
‘বদ্যিনাথদা, শুনলাম মা কয়েকদিন হল ভালো আছেন?’
বদ্যিনাথ উৎসাহের সঙ্গে বলল, সত্যি ছোটবাবু, বড়মা ক’দিন একদম ঝামেলা করেনি। তালাও দিতে হয় না।’
স্বর্ণ ভুরু কুঁচকে রইল। কথাটা সে আজ দুপুরে শুনেছে। শুনেছে না বলে, কানে এসেছে বলা উচিত। রাধা ঘর ঝাড়পোঁছের মেয়েটিকে চাপা গলায় ধমক দিচ্ছিল।
‘ইস, বাড়ি ঘরের কী ছিরি করে রেখেছিস! সিঁড়ির কোনায় ধুলো জমেছে দেখতে পাস না? দাঁড়া, ক’দিন পরেই ঠেলা বুঝতে পারবি। বড়মা ভালো হয়ে উঠল বলে, তখন ঘাড় ধরে একেকটাকে বাড়ি ছাড়া করবে।’
মেয়েটির খুশি খুশি গলায় বলে, ‘সত্যি রাধাদি?’
রাধা খিঁচিয়ে ওঠে, ‘সত্যি না তো কী? আমি মিছে বলছি? দেখছিস না, ক’দিন কোনও চেঁচামেচি নেই? এতদিন বাড়িতে আছিস; নিজেরা বুঝতে পারিস না?’
এরপর স্বর্ণকে দেখতে পেয়ে দুজনে চুপ করে যায়। প্রথমে খুব একটা খেয়াল করেনি স্বর্ণ। পরে মাথার ভেতর কথাগুলো ঘুরতে থাকে। মা ভালো হয়ে উঠছে! তা কী করে হয়? এতদিনের একটা অসুখ দুম করে ঠিক হয়ে যাবে? ভারতী দেবীর মাঝেমধ্যে শান্ত হয়ে থাকা নতুন নয়, অসুখটাই এরকমই। বাইরের উত্তেজনা কমিয়ে ভেতরে গুম হয়ে থাকা। কিন্তু সেটা কি ভালো থাকা?
বদ্যিনাথ হাত কচলে বলল, ‘আজ ডাক্তারবাবু দেখে গেছেন। বলেছেন, ইচ্ছে করলে বড়মা একটু একটু টিভিও দেখতে পারেন।’
স্বর্ণ বলল, ‘আমি ওপরে যাব বদ্যিনাথদা। ওই মহিলাকে খবর দাও, সে যেন না থাকে। আমি মায়ের সঙ্গে একা খানিকক্ষণ কথা বলতে চাই।’
শেষের কথাটা বলার দরকার ছিল না। স্বামী-পুত্র গেলে রাধা নিজে থেকেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তবু ইচ্ছে করেই স্বর্ণ বলল, ব্যবস্থাটায় যেন জোর দিতে চাইল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে স্বর্ণ দেখল, মাথায় খানিকটা ঘোমটার মতো টেনে রাধা নেমে আসছে। স্বর্ণকে দেখে সরে দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকে ভারতী দেবীকে দেখে স্বর্ণ সামান্য চমকে ওঠে।
হালকা তুঁতে রঙের পাট ভাঙা একটা শাড়ি পরে বিছানায় বসে আছেন ভারতী দেবী। চুলগুলো টেনে বাঁধা। চোখে চশমা, কোলের ওপর বই। বই! মাকে কখনও সে বই হাতে দেখেনি। উজ্জ্বল নিওনের আলো ভারতী দেবীর মুখে পড়েছে। ঝলমল করছে। মানুষটাকে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ক্লান্তির পর ঘুম ভেঙে উঠল।
পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে স্বর্ণর দিকে তাকালেন ভারতী দেবী।
‘আয়। চেয়ারটা নিয়ে বস।’
চেয়ার নিল না স্বর্ণ খাটের ওপরেই বসল।
ভারতী দেবী হাতের বইটা ভাঁজ করতে করতে মৃদু হেসে বললেন, ‘ক’দিন ওপরে আসিসনি কেন?’
স্বর্ণ আবছা হেসে বলল, ‘ক’দিন কোথায়? তিন-চারদিন। সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়। যখন উঠি তুমি স্নানে ঢুকে গেছ, আমিও ইউনিভার্সিটি ছুটি। আর রাতে যখন ফিরি, তুমি তখন ঘুমোচ্ছ।’
ভারতী দেবী চশমা খুলতে-খুলতে হেসে বললেন, ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই তো জীবনটা পার করে দিলাম। হয় চোখ খুলে ঘুমোলাম, নয় চোখ বুজে। তাই না?’
স্বর্ণ একটু থমকে গেল। এমন স্পষ্ট, অর্থপূর্ণ কথা সে মায়ের মুখ থেকে শেষ কবে শুনেছে মনে করতে পারছে না। ক’দিন আগেও সকালে যখন ঘরে এসে ঢুঁ মেরে গেছে কই কিছুই তো বুঝতে পারেনি। অবশ্য বোঝার মতো সময়ও দেয়নি। সব মানুষকেই বুঝতে সময় লাগে। সত্যি কি এতটাই উন্নতি হয়েছে? হলে সেটার পরিমাণ কতটা? যতটাই হোক তাকে সুযোগ নিতে হবে। এখনই নিতে হবে। কাল পরশু থেকেই হয়তো আবার বাড়াবাড়ি শুরু হবে। শান্ত সুন্দর মানুষটা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। গায়ের কাপড় খুলে মাথা ঠুকবে দেওয়ালে।
নিজেকে সামলে স্বর্ণ বলল, ‘এই তো বেশ আছ। চোখ-মুখ একেবারে ফ্রেশ। শুনলাম ডাক্তারও বলে গেছে।’
ভারতী দেবী ঠোঁটের পাশে হাসি রেখে বললেন, ‘ভালো থাকার চেষ্টা করছি, কতদিন পারব জানি না।’
‘অনেকদিন পারবে। কেমন বই পড়ছ। আমি তো অবাক হয়ে গেছি। দেখি কী বই?’
ভারতী দেবী লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘দূর, এ তো রান্নার বই। রাধাকে দিয়ে আনিয়েছি। নিজে হাতে রান্নাবান্না করা তো ভুলে গেছি, দেখি বই পড়ে মনে পড়ে কি না। নিরামিষ রান্না তোর বাবা খুব পছন্দ করত। একটা সময় ছিল তার নিত্যনতুন একটা না একটা কিছু চাই।’
বাবার কথা ওঠায় ক্ষণিকের জন্য চোয়াল কঠিন হয়ে গেল স্বর্ণর। এই মহিলা এখনও বাসুদেব চৌধুরির পছন্দ অপছন্দ নিয়ে মাথা ঘামায়! ভারতী দেবী বললেন, ‘ডাক্তারবাবুকে আজ বলেছি, একটু আধটু রান্নাঘরে যাওয়ার যদি অনুমতি পেতাম, উনি বললেন, আরও ক’টাদিন ভালো থাকুন, তারপর যাবেন।’
স্বর্ণ চোখ নামিয়ে আঙুল দিয়ে চাদরের ওপর আঁকিবুঁকি কাটতে-কাটতে বলল, ‘মা, একটা কথা জিগ্যেস করব?’
ভারতী দেবী হেসে চিবুক ধরে ছেলের মুখটা তুলে বললেন, ‘ওমা! আমার সঙ্গে কথা বলবি তার জন্য আবার অনুমতি কী!’
‘তোমার কী পুরোনো দিনের কথা মনে আছে?’
ভারতী দেবী নিজের ভেতরে একটু যেন কেঁপে উঠলেন। এই প্রশ্ন স্বর্ণ আগে কখনও করেনি। অবশ্য এভাবে দুজনে মুখোমুখি কথা বলতে বসেছেনই বা কবে? শরীর ভালো থাকলে হয় মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে দু-একটা কথা বলে চলে গেছে, নয়তো চেয়ার নিয়ে খাটের পাশে বসে থেকেছে চুপ করে। একটু পরেই বলেছে, ‘এবার যাই? তিনি বলেছেন, ‘ভালো আছিস তো বাবা?’ স্বর্ণ মাথা নেড়েছে। তিনি জিগ্যেস করেছেন, ‘খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছিস?’ স্বর্ণ আবার মাথা নেড়েছে। ব্যস এই পর্যন্তই। স্কুল বয়েসে এতটুকু কথারও সুযোগ ছিল না। ঘরে কখনও একা আসত না স্বর্ণ, কেউ না কেউ তার সঙ্গে থেকেছে। এত প্রশ্ন করার সুযোগ কোথায় ছিল? অথবা কে জানে হয়তো করেছে। অসুস্থতার কারণে সে-ই প্রশ্ন তিনি বুঝতে পারেননি।
‘পুরোনো দিনের কথা মানে?’
স্বর্ণ মুহূর্তখানেক ভাবল। তারপর সহজ ভাবে বলল, ‘মানে আবার কী, এই ধরো বাবার কী খেতে ভালো লাগত, তুমি কী রান্না করতে এইসব। তারপর ধরো, তোমার বাগান করার গল্প। শুনেছি তুমি নাকি গাছের জন্য বিরাট হইচই করতে। সত্যি?’
কথা বলতে দুটো পা-ই ওপরে তুলে বসল স্বর্ণ। এই খাটে কি কখনও সে এভাবে বসেছে? বাল্য বা কৈশোরে? মনে পড়ছে না।
‘হইচই কোথায়? নিজের বাড়িতে তো আর বাগান করার জায়গা ছিল না। একটুখানি তো মোটে কোয়ার্টার। তোর বাবার ওখানে যখন এলাম সেখানেও দেখি এক অবস্থা, ফ্ল্যাট বড়, কিন্তু বাগান নেই। বারান্দা আর ছাদেই টব বসিয়ে যতটুকু হয়।’
‘কী ফুল হত?’
‘বেশি কিছু নয়, তবে একবার ডালিয়া করেছিলাম। কী যেন নাম…কী যেন…।’
ভারতী দেবী চোখ বুজে নাম মনে করার চেষ্টা করলেন। স্বর্ণ সতর্ক হয়ে বলল, ‘থাক, তোমাকে মনে করতে হবে না। তুমি এবার অন্য গল্প বলো।’
ভারতী দেবী হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো? ধেড়ে ছেলে গল্প গল্প করছিস?’
স্বর্ণ বিস্ময়ের ভান করে বলল, ‘বা: করব না! খোকা যখন ছিলাম তখন তো তোমার কাছে গল্প শোনার চান্সই পাইনি। তোমরা ধরে বেঁধে বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দিলে। এখন ধাড়ি হয়ে সুযোগ পেয়েছি।’
ভারতী দেবী একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তোর বাবা ভালোই করেছিল, আমার শরীর তখন খুব খারাপ। ওইটুকু ছেলেকে বাড়িতে রাখা যায় না।’
স্বর্ণ ডানহাতটা বাড়িয়ে ভারতী দেবীর হাঁটু ছুঁল।
‘তোমার শরীর খারাপের কথা রাখো তো। এখন তো ভালো আছ, তাহলেই হবে। আমি কি ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম মা? কান্নাকাটি করতাম?’
ভারতী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বললেন, ‘তোর কান্নাকাটি করার বয়সটা আমার মনে নেই স্বর্ণ। তখন আমার অবস্থা খারাপ। অসুখের শুরুর দিক, তা ছাড়া করলেও বা কী? কাছে নিয়ে তো আর থামাতে পারতাম না।’
‘কেন?’
ভারতী দেবী স্বর্ণর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ভারী মায়াময় সেই হাসি।
‘ওমা! বাচ্চা ছেলেকে কেউ পাগল মানুষের কাছে দেয়? কী করতে কী করে ফেলব তার নেই ঠিক। আদর করার বদলে হয়তো দুটো চড়ই লাগিয়ে দিতাম।’
‘দিলে দিতে। জানো স্কুলে যখন সবাই বাবা-মায়ের বকাঝকার কথা বলত, আমার খুব হিংসে হত। মনে হত ইস আমিও যদি ওদের মতো বকুনি খেতাম।’
স্বর্ণ হাসতে লাগল। ইচ্ছে করেই হাসতে লাগল। সে আসল কথায় আসার আগে, পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইছে।
ভারতী দেবী ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন। খোলা জানলা দিয়ে অল্প অল্প ঠান্ডা আসছে। শীত কতদূরে? একটা সময় শীত খুব পছন্দের সময় ছিল। তারপর শীত গ্রীষ্ম সব মিলেমিশে গেল। আচ্ছা, স্বর্ণকে আজ সব বলে দিলে কেমন হয়? সে কি তার কথা বিশ্বাস করবে? সেই সময় কি এসেছে?
ভারতী দেবী দ্বিধা জড়ানো গলায় বললেন, ‘তোর শিশুকালটা আমার তেমন মনে নেই স্বর্ণ।’
স্বর্ণ তাড়াতাড়ি বলল, ‘থাক, মনে করতে হবে না। তুমি আমাকে এখন কতটা ভালোবাস সেইটা বলো।’
ভারতী দেবী মুখ না ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না রে, রাগ ভালোবাসা এসব অনেকদিনই কেমন গোলমাল হয়ে গেছে।’
স্বর্ণর মনে হচ্ছে, আর দেরি করা ঠিক হবে না। দ্রুত আসল প্রসঙ্গ আসা উচিত!
‘ঠিক আছে আমারটা না হয় গুলিয়ে গেছে, কিন্তু বাবারটা? বাবারটা তো মনে আছে? সত্যি করে বলো তো মা, তুমি বাবাকে কতটা ভালোবাসতে? আমার থেকে বেশি না?’
ভারতী দেবী মুখ ফেরালেন। বললেন, ‘আমি কতটা ভালোবাসতাম জানি না, তবে ওই মানুষটা যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসত এটা বুঝতে পারতাম। প্রথম দেখা হওয়ার পর রোজ যেত। আমি লজ্জায় মরে যেতাম। ভয়ও করত।’
‘ভয় করত! কেন ভয় করত কেন?’
‘বা: করবে না। অত বড় একটা মানুষ। বয়সেও বড়। মস্ত গাড়ি নিয়ে হাজির হচ্ছে। গাড়িটা গলিতে ঢুকত না। দূরে রেখে হেঁটে আসত। যেদিন বিয়ের কথা বললেন আমি তো ঘেমে নেয়ে একসা। বললাম, আমি কিছু জানি না, বাবাকে বলুন।’
‘বা: এই তো তোমার সব মনে পড়ছে।’
স্বর্ণর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।
ভারতী দেবী মলিন হেসে বললেন, ‘আবার অনেককিছু মনে নেই। অথবা কে জানে ইচ্ছে করে হয়তো ভুলে থাকি।
স্বর্ণ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কী ভুলে থাকো মা?’
ভারতী দেবী মাথা নামিয়ে একটু থামলেন। বললেন, ‘যা ভুলে থাকলে তোদের ভালো হয়।’
‘আর তোমার? তোমার ভালো হয় না?’ স্বর্ণ ভুরু কোঁচকালো।
‘আমার ভালো’র জন্য তোর বাবা কম চেষ্টা করেনি। কী না করেছে সে? চিকিৎসার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করেছে। একদিন দুদিন নয়, এতগুলো বছর এতটুকু অযত্ন হতে দেয়নি। বছরের পর বছর পাগল মানুষকে কেউ ঘরে তুলে রাখে? পাগলাগারদে ফেলে আসে আবর্জনার মতো। অনেক কষ্ট, অপমানের পর যে সুখ শান্তি, মর্যাদার জন্য মানুষটা আমাকে বিয়ে করেছিল তার কিছুই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। দুটো বছর কাটতে না কাটতে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। যে-সে অসুখ নয়, পাগলামির অসুখ। সবাই জানল, বাসুদেব চৌধুরি একজন পাগলিকে বিয়ে করেছে।’
ভারতী দেবী থামলেন। বিস্মিত স্বর্ণ চুপ করে আছে। ওই বিশ্রী মানুষটার জন্য এই মহিলার বুকে এত ভালোবাসা। এত দরদ! অবশ্য বাসুদেব চৌধুরির কীর্তির কতটুকুই বা এই মহিলা জানে? আদৌ কি কিছু জানে?
ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসলেন ভারতী দেবী। তারপর স্বর্ণকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি। সবটা না জানলেও কিছু তো জানি।’
‘কী জানো?’ স্থির চোখে স্বর্ণ বলল।
ভারতী দেবী সামান্য থমকালেন। তিনি কি স্বর্ণকে বলবেন? নাকি আরও অপেক্ষা করবেন? অপেক্ষার সুযোগ কি তিনি পাবেন? হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আবার সব তালগোল পাকিয়ে যাবে, এলোমেলো হয়ে যাবে স্মৃতি। সুস্থ থাকার এই সময়টুকুই তো সবথেকে ভালো। স্বর্ণ তাকে বিশ্বাস করছে। স্বর্ণ আবার বলল, ‘বলো কী জানো।’ তার গলায় অধৈর্য ভাব।
ভারতী দেবীর চোখ তুলে স্বর্ণর চোখের দিকে তাকালেন। নরম গলায় বললেন, ‘জানি সে ভালো মন্দ যা-ই করেছে আমার জন্যই করেছে। ভেবেছিল তোকে এনে দিলে, আমি হয়তো ভালো হয়ে যাব। নিশ্চয় তাকে কেউ পরামর্শ দিয়েছিল, অথবা সে-ই ভেবেছিল, মা না হতে পারাটাই আমার অসুখের মূল কারণ। সেই শূন্যতা ভরাতে পারলে আমি আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠব।’
‘কাকে এনে দিল? আমাকে!’ সোজা হয়ে বসল স্বর্ণ।
‘তোকে যখন তোর বাবা আমার কাছে নিয়ে আসে তখন তোর বয়স…আমি সেভাবে কিছুই বুঝতে পারলাম না, শরীরের এই অবস্থায় বোঝার কথাও ছিল না। দু-একদিন তোকে নিয়ে পুতুলের মতো খেলে মুখ ফিরিয়ে ফের নিজের জগতে ঢুকে গেলাম। উন্মাদের জগৎ। অসুস্থ অবস্থাতেই তোর বাবাকে ডেকে বললাম, স্বর্ণকে তুমি ফিরিয়ে দিয়ে এসো।’
ভারতী দেবী চুপ করলেন। মাথার ভেতর একটা অস্বস্তি শুরু হচ্ছে। শরীর কি আবার খারাপ হবে?’
টানটান পিঠে পাথরের মূর্তির মতো নিথর বসে থাকা স্বর্ণ ফিসফিস করে বলল, ‘তারপর?’
তোর বাবা বলেছিল, ফিরিয়ে দিয়েছি, পরে জানলাম, দেয়নি, বোর্ডিং-এ পাঠিয়েছে। জিগ্যেই করতে বলল, যেখান থেকে এনেছি, সেখানে ফেরালে মানুষ হতে পারবে না। আরও বলল।’
স্বর্ণর মনে হল হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও সে নড়তে পারবে না। কাঁপা গলায় বলল, ‘কী?
‘বলল, ছেলে তো আমারও, তুমি তাকে গ্রহণ করতে পারোনি, আমি তো পেরেছি। আমাকে রাখতে দাও। কোনও জটিলতা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার তখন ছিল না। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিগুলো জট পাকিয়ে যেত। আমি বুঝতে না পেরে চুপ করে গেলাম।’
কী বলবে, কী করবে, স্বর্ণ বুঝতে পারছে না। তার শরীর কাঁপছে। সে খাটের একপাশ আঁকড়ে বসে আছে। সামনে বসা এই মহিলা তার মা নয়? বাসুদেব চৌধুরি তার বাবা নয়? এ কি সত্যি? নাকি উন্মাদ মানুষের প্রলাপ? তাই হবে। প্রলাপই হবে। আর যদি প্রলাপ না হয়? শিউরে উঠল স্বর্ণ। একটা সময় মনে হল মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে। একদম ফাঁকা। সে কিছু ভাবতে পারছে না।
ভারতী দেবী স্বর্ণর হাত ধরে কাঁপা গলায় বললেন, ‘এত বড় কথাটা আমার মুখ থেকে না শুনলেই হয়তো তোর ভালো হত স্বর্ণ। আমি চেয়েছিলাম, তোর বাবাই জানাক। সে পারেনি, চায়ওনি। অথচ তোকে না বলাটা যে কতবড় অন্যায় হত, শুধু তোর কাছে নয়, যে তার জন্ম দিয়েছে তার কাছেও।’
থামলেন ভারতী দেবী। ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলালেন।
‘ওই মানুষটাকে দোষ দিস না স্বর্ণ। সুস্থ মানুষ অনেক কিছু পারে না। পাগলের সে-ই অসুবিধে নেই, সে অনেক কিছু পারে। এই দেখ না কত কঠিন একটা কথা তোকে বলেও কেমন হাসিমুখে বসে আছি। নে মুখ তোল।’
স্বর্ণ মুখ তুলল। সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। প্রবল ঝড়ের পর প্রকৃতি যে ধরনের ঘোর পায় অনেকটা সেরকম। সেই ঘোর থেকেই বলল, ‘তুমি কি জানো সে কে?’
ভারতী দেবী হাত তুলে চোখের জল মুছলেন, ‘না কিছুই জানি না। নাম-ঠিকানা কিছুই না। তবে এইটুকু জানি তুই ঠিক তাকে খুঁজে বের করবি। তুই পারবি।’
রাধা দরজার বাইরে থেকে টোকা দিয়ে নীচু গলায়, ‘বড়মার ওষুধ খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে ছোটবাবু। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’
চোদ্দো
বাসুদেব চৌধুরি বললেন, ‘তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলে রাধা?
‘সিঁড়ির পাশে বড়বাবু।’
‘সিঁড়ির পাশ থেকে ঘরের ভেতরের কথা শোনা যায়?’
চকিতে মুখ তুলল রাধা। আড়িপাতার কারণে বাসুদেব কি তার ওপর বিরক্ত হয়েছে? বুড়োটা অদ্ভুত তো! সব শোনার পর বিরক্তি দেখাচ্ছে! বিরক্ত হওয়ার মতো এমন কিছু সে শোনেনি। যেটুকু শুনেছে তাতেও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেনি। এতে বিরক্ত হওয়ার কী আছে? তার ওপর বুড়োটাই তো শুনতে চাইল। সে শুধু বলেছিল, ‘ছোটবাবু, আজ সন্ধের পর বড়মার কাছে গিয়েছিলেন।’
বাসুদেব অবাক হয়ে বললেন, ‘সন্ধের পর! সন্ধের পর স্বর্ণ তো কখনও ওপরে যায় না।’
বাসুদেব চৌধুরির বিস্ময় দেখে রাধা খুশি হল। আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আজ গিয়েছিলেন। তার আগে বদ্যিনাথদাকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে বললেন, বড়মার সঙ্গে একা কথা বলবেন।’
‘একা কথা বলবে!’
রাধা খুশি হল। আসল কথাটা বলে সে মানুষটার কৌতূহল বাড়িয়েছে। এ বাড়ির সবাই জানে বাপ বেটার সম্পর্কে গোলমাল আছে। মুখ ফুটে কেউ বলে না। সে-ও বলে না। শুধু গোলমালটা জানতে চায়। ভেতরের গোলমাল জানা থাকলে সুবিধে। আচার ব্যবহারে ভুল কম হয়। তার যে খুব বড় ধরনের কোনও উদ্দেশ্য আছে এমন নয়। যদি এই মানুষটার কাছ থেকে আরও খানিকটা আদায় করে নেওয়া যায় তাহলেই হবে। রাধা কেটে-কেটে বলে, ‘বদ্যিনাথদা এসে তাই তো বললে।’
রকিং চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় বাসুদেব বললেন, ‘তুমি কী করলে?
‘আমি নেমেই আসছিলাম, ছোটবাবু উঠে যাওয়ার পর আবার গিয়ে সিঁড়ির মুখটায় উঠে দাঁড়ালাম।’
‘ওদের কথা শুনতে?’
রাধা একটু থমকে বলল, ‘না, হঠাৎ যদি বড়মা কিছু করে বসেন। বলা যায় না।’
রাধা আজও ‘বড়বাবু’র ঘরে ঢুকে গায়ের কাপড় খুলতে গিয়েছিল। বাসুদেব হাত তুলে বারণ করেন। বলেন, ‘থাক, আজ আমি একটা অন্য কারণে তোমাকে ডেকেছি রাধা।’
রাধা বিস্মিত হল। অন্য কারণ আবার কী! বিস্ময় চেপে বলল, ‘গ্লাস বের করব বড়বাবু?’
বাসুদেব চৌধুরি কোনও উত্তর দেন না। রাধার অস্বস্তি বাড়ে। কী কথা বলবে?
‘ভারতী ঠিক আছে?’
রাধা মাথা নাড়ে। বলে, ‘হ্যাঁ, আজ আরও ভালো আছে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ টিভি দেখেছে, সন্ধেরও সময় বইও পড়েছে। রান্নার বই। আমি এনে দিলাম। তারপর ছোটবাবু ওপরে গেলেন। বড়মার সঙ্গে কথা বললেন।’
বাসুদেব চৌধুরি এবার সোজা হয়ে বসেন। বিস্ময় মাখা গলায় বলেন, ‘তুমি সেই কথার কিছু শুনেছ?’
রাধা ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘পুরোটা শুনতে পাইনি দরজা দেওয়া ছিল। একটু একটু শুনেছি। বড়মা ছোটবাবুর ছেলেবেলার গল্প বলছিলেন, একসময় শুনলাম, উনি বলছেন, তুই খুঁজে বের করবি, তুই ঠিক পারবি।’
নিমেষে বাসুদেব চৌধুরির মুখ কঠিন হয়ে গেল। রাধা অবশ্য সেই কঠিন মুখ দেখতে পেল না। রাতের যে সময়টুকু ‘বড়বাবু’র সঙ্গে কাটায় কখনওই মানুষটার চোখমুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারে না। সম্ভবত ঘর অন্ধকার রাখার এটাও একটা কারণ। ফলে তার শরীরে মানুষটা খুশি না অখুশি তৃপ্ত না অতৃপ্ত সবটাই ভাসা ভাসা ধারণা করতে হয়। যে অল্প ক’টা দিন আঁচড়ে কামড়ে দেখে, তখন তৃপ্তি বা সুখের থেকেও যেন মানুষটার ক্রোধ বেশি ধরা পড়ে। কীসের ক্রোধ? চেনা শরীর না খুঁজে পাওয়ার? স্পষ্ট হয় না, ধন্দে থাকে রাধা। রোজই ভয়, আজই শেষ, আর রাতে তার ডাক পড়বে না।
একটু চুপ করে রাধা বলল, ‘কাকে খোঁজার কথা বড়মা বললেন বুঝতে পারিনি।’
বাসুদেব খানিকটা থম মেরে বসে রইলেন। সম্ভবত ভেতরের উত্তেজনা সামলানোর জন্য নিজেকেই সময় দিলেন। তারপর নিরুদ্বিগ্ন, ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘রাধা, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আজ আমার সঙ্গে ডক্টর সেনের কথা হয়েছে, তিনি পেশেন্টের ইনপ্রুভমেন্টে খুশি। কিছুটা এক্সাইটেডও। সেটাই স্বাভাবিক। এত বছরের অসুখ, চিকিৎসা তো কম হয়নি, কত ডাক্তার দেখেছে। শেষ পর্যন্ত যদি তার হাতে উন্নতি হয়… তিনি তোমার কথাও বললেন।’
রাধা বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার কথা।’
‘হ্যাঁ, পেশেন্টের প্রতি তোমার নার্সিং, কেয়ার, অ্যাটেনশন তাকে খুশি করেছে।’
ভেতরে ভেতরে পুলকিত হয়ে উঠল রাধা। এই পাগলবাড়িতে পাকাপাকি জায়গা পেতে গেলে এই সার্টিফিকেট তার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। এতদিন শুধু টাকাপয়সা, সুযোগ সুবিধের কথা ভেবেছিল, এবার নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হবে। রাধা ভেতরের উচ্ছ্বাস দমন করল। পা ফেলতে হবে সাবধানে। এই বুড়ো একই সঙ্গে অনেকরকম। কখনও শিশুর মতো সহজ, কখনও উদার, কখনও আবার চতুর নিষ্ঠুর। মাস ছ’য়েক আগে, দেশের বাড়িতে ঘর সারাবে বলে বুড়োর কাছে অনেকটা ধার চেয়েছে। টাকাটা চাই।’
রাধা গদগদ বলল, ‘আপনার দয়া বড়বাবু। আমি তো এ কাজ কিছুই জানতাম না। সুযোগ দিয়েছিলেন বলেই…বড়মাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এখন না হয় কয়েকদিন ভালো আছেন, কিন্তু মিথ্যে বলব না, বাড়াবাড়ির সময়েও আমি বললে কথা শুনেছেন।’
বাসুদেব চৌধুরি চুপ করে রাধার কথা শুনলেন। গল্পের ঢঙে বললেন, ‘তখন পাগলের মতো লোক খুঁজছিলাম। বেশি টাকাপয়সাতেও কাজ হয়নি। আসলে কী জানো সবসময় টাকাপয়সাতে কাজ হয় না। অন্য কেউ হলে পেশেন্টকে অ্যাসাইলামে রেখে আসত। আমার ক্ষেত্রেও সেটা উচিত ছিল। কিন্তু আমি পারিনি। এই সময় তুমি এলে অ্যান্ড ইউ হ্যাভ ডান ইওর ডিউটি প্রপারলি। তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিকঠিক ভাবেই পালন করেছ।’
কিছু বলতে গিয়েও রাধা চুপ করে গেল। পুরুষমানুষের শরীরের আবেগ সে বুঝতে পারে, মনের আবেগ নয়। একবার বুঝতে গিয়ে বড় ভুল হয়েছে। অন্ধকারে দেখা না গেলেও বাসুদেব সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘চুপ করে আছ কেন? আমি কি ভুল বলছি?’
রাধা অস্ফুটে বলল, ‘বড়মার সেবা করে আমি শান্তি পাই। উনি যদি সত্যি সত্যি একেবারে ভালো হয়ে ওঠেন খুব খুশি হব।’
বাসুদেব মুহূর্তে এলিয়ে থাকা শরীর সোজা করলেন এবং চাপা গলায় বললেন, নো, নেভার। ভারতীর ভালো হয়ে ওঠা চলবে না।’
রাধা চমকে উঠল। মানুষটা বলে কী? ‘বড়মা’র ভালো হওয়া চলবে না মানে! সে ঠিক শুনছে তো? নিশ্চয় না।
বাসুদেব চৌধুরি ফিসফিস করে বললেন, ‘রাধা, রোগীকে কীভাবে মেরে ফেলতে হয় তুমি জানো। জানো না?’
রাধার মনে হল কে যেন তার গালে সপাটে চড় কষাল। নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় লাগল তার।
‘কী বলছেন বড়বাবু!’
‘ঠিকই বলছি। তোমার অসুস্থ স্বামীর মৃত্যুর পর তার বাড়ির লোক তোমার নামে অভিযোগ করেছিল। হাসপাতাল থেকে ফেরত এনে শেষ ক’দিন তুমি রোগীর দিকে ফিরেও তাকাওনি। অবহেলা এবং বিনা চিকিৎসায় মানুষটা দ্রুত মারা যায়। ইট ওয়াজ প্রি-প্ল্যানড তুমি ভেবেচিন্তেই করেছিল। পুলিশের পক্ষে বিষয়টা প্রমাণ করা অসম্ভব ছিল, তাই তারা কেসটা প্রায় নেয়নি বললেই চলে। তোমাকে একবার থানায় ডেকে পাঠিয়েই দায়িত্ব সেরেছিল। কিন্তু ঘটনা সত্যি রাধা। তুমি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চেয়েছিলে। নতুন করে সেই অভিযোগের খাতা আবার খোলা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তোমার শ্বশুরবাড়ির দু-একজনকে খুঁজে বের করে কিছু টাকাপয়সা খরচ করলেই তদন্ত আবার শুরু করা যায়। পুলিশ রাজি না হলে কোর্টকাছারি পর্যন্ত যাওয়া যাবে। ইচ্ছাকৃত অবহেলাও একধরনের খুন।’
রাধা কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না।
বাসুদেব থেমে দম নিলেন, এবার গলা নরম করে বললেন, ‘রাধা তুমি নিশ্চয় জানো খুনের মামলা কখনও তামাদি হয় না।’
রাধা প্রস্তরমূর্তির মতো বসে আছে। এই আক্রমণের জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। লোকটা এতদূর পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছে! সে ভাবতেও পারছে না। অভিযোগ সত্যি নয়, আবার পুরোটা মিথ্যেও নয়। সত্যি যদি সে মুমূর্ষু স্বামীর চিকিৎসায় কোনও ফাঁকি দিয়ে থাকে তাতে তার দোষ কোথায়? মানুষটার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পুরুষ হিসেবেও লোকটা ছিল জালিয়াত। প্রথম রাতেই হাঁচড় পাঁচড় করে ছেড়ে দিয়েছিল। এই লোকের চিকিৎসার জন্য যতটুকু সে করেছে ততটাই কি যথেষ্ট নয়? আর কতদিন পচা গলা মানুষটাকে আগলে বসে থাকত? আগে কেউ আসেনি, মরার পর দেওররা এসে হম্বিতম্বি শুরু করল। থানায় পর্যন্ত কেস লেখাল। পুলিশ কীভাবে বুঝবে, শেষ ক’দিন কেমন করে খাওয়া ওষুধ বন্ধ করে যাবতীয় যন্ত্রণা দ্রুত শেষ করতে চেয়েছিল সে? একে কি খুন বলে? নাকি বাঁচানো? নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা মানুষকে মৃত্যুর দিকে আরও একটু দ্রুত ঠেলে দেওয়া কি খুন? বাসুদেব চৌধুরি তাকে বিশ্বাস করবে? মনে হয় না। নিশ্চয় অনেক ঘুঁটি সাজিয়ে তবে আজ তাকে ডেকেছে। কে জানে হয়তো ইতিমধ্যে তার শ্বশুরবাড়ির দিকের দু-একটা লোকের সঙ্গে কথাও সেরে ফেলেছে। টাকাওয়ালা মানুষ অনেককিছু পারে। জেলে পুরতে না পারলেও বিপদে ফেলতে পারবে তো বটেই। এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে আবার অন্ধকারে ডুবতে হবে রাধাকে। রাধার কান্না পেল।
‘এসব ঠিক না বড়বাবু, মানুষটা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। একদিন না একদিন তো মরতই…। ডাক্তারও জবাব দিয়েছিল। ওই অসুখ সারার ছিল না।’
বাসুদেব চৌধুরি খুশি হলেন। তিনি জানতেন, রাধা মেনে নেবে, কিন্তু সেটা যে দ্রুত হবে তিনি আশা করেননি। এই মেয়ের লোভ, লালসা সম্পর্কে তার ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। এ বাড়ির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সে অতিরিক্তরকম কৌতূহলী হয়ে উঠেছে সেটাও তিনি বুঝতে পারছিলেন। অন্য যে কেউ হলে এতদিনে কাজ ছেড়ে চলে যেতে হত। কিন্তু এই মেয়ে ‘অন্য কেউ’ নয়, সে ভারতীর আব্রু। তাকে তিনি দুম করে তাড়ান কী করে? এরপরই তিনি বিকাশকে রাধার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেন।
বাসুদেব মৃদু হেসে বলেন, ‘তোমার স্বামীর মতো ভারতীর অসুখও সারবার নয় রাধা।’
মাথা নীচু করে বসে আছে রাধা। পুরুষালি চেহারার শক্ত সমর্থ মেয়েটা তার সব শক্তি হারিয়ে নুইয়ে পড়েছে যেন। অস্ফুট গলায় বলল, ‘আমায় কি করতে হবে?’
‘কিছুই নয়, ডাক্তার সেনের ওষুধে শুধু একটা গোলমাল করে দিতে হবে। তাও অল্প ক’দিনের জন্য। রোগীর ওষুধে গোলমাল কী করে করতে হয় সেই অভিজ্ঞতা তোমার আছে। যে স্মৃতি ভারতী ফিরে পাচ্ছে, তা যেন কয়েকদিনের জন্য ফের ঝাপসা হয়ে যায়। আরও কিছুদিন। আমি একটু সময় চাই।’
রাধা বিস্ফারিত চোখে মুখ তুলল।
‘তবে সেবা যত্নের যেন কোনও অভাব না হয়। স্নান, খাওয়া, বাগানে বেড়ানোর কোথাও ফাঁক না থাকে। ভারতীর প্রতি কোনওরকম অযত্ন আমি সহ্য করতে পারি না।’ বাসুদেব একটু থামলেন। তারপর নিজের মনের ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তাকে ভালোবাসি, পাপ পুণ্য, ভালো মন্দ যা কিছু করেছি তাকে ভালোবেসেই করেছি, যা করব তাও ভালোবেসেই করব।’
এতদিনের যাবতীয় চিন্তাভাবনা তালগোল পাকিয়ে গেছে রাধার। বুঝতে পারছে, যে ‘পাগলবাড়ি’কে সে চেপে ধরবে ভেবেছিল, সেই বাড়িই এখন তার গলা টিপে ধরছে। সে খড়কুটো চেপে ধরার মতো করে বলল, ‘আমাকে কি আপনি ছাড়িয়ে দেবেন বড়বাবু?’
বাসুদেব লম্বা করে শ্বাস নিলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ দেব। তবে এখনই নয়। চিন্তা কোরো না, কিছুদিন যাতে চালাতে পারো তার ব্যবস্থা করব। বাসুদেব চৌধুরি কাউকে নি:স্ব করে তাড়ায় না। নি:স্ব থাকার অপমান সে জানে। তোমার বাড়ির জন্য টাকা চেয়েছিলে না? কত টাকা জানিও। নাও এবার পোশাক খোলো রাধা। অনেক কথা বলেছি ক্লান্ত লাগছে।’
আবছা আলো, আবছা অন্ধকারে নগ্ন রাধা বসে আছে মাথা নীচু করে। বাসুদেব চৌধুরি মাথা এলিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন তাকিয়ে আছেন নিজের পাপের দিকে। না কি নির্বন্ধ? নিজের নির্বন্ধের সঙ্গে খেলছেন? যেমন দুই ষাঁড় লড়াইয়ের প্রাক মুহূর্তে তাকিয়ে থাকে পরস্পরের প্রতি। আত্মরতির মতো গোপন, গভীর এই খেলার খবর সবাই জানতে পারে না। এমনকী যে খেলে সে-ও নয়।