শাহ্ মকবুল
গল্প আমি সাধারণত এক বৈঠকে লেখার চেষ্টা করি। গল্প আমার কাছে হচ্ছে একটা রঙিন সুতা দিয়ে নকশা তৈরি করা। নকশা তৈরির কাজ কয়েক বৈঠকে করলে নকশার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। শাহ মকবুল গল্প নিয়ে আমি কতবার যে বসেছি তা আল্লাহ মাবুদ জানেন। শেষটায় ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে- গল্পটা ফেলে দিয়েছি।
শাওনের অনেক বিচিত্র স্বভাবের একটি হচ্ছে আমার ফেলে দেয়া গল্প, অসমাপ্ত নাটক যত্ন করে তুলে রাখা। এর জন্যে তার একটা বড় টিনের ট্রাংক আছে। ট্রাংকটা আড়ং থেকে কেনা, লতা পাতা ফুল আঁকা। শাওনের ধারণা আমার ফেলে দেয়া গল্প এবং নাটকগুলো নাকি বেশি ভাল। শাহ মকবুলকে উদ্ধার করা হয়েছে শাওনের ট্রাংক থেকে। অসমাপ্ত অংশ শেষ করেছি। কি দাঁড়িয়েছে কে জানে।
*
স্যার, আমার নাম মকবুল। শাহ্ মকবুল। নামের আগে শাহ্ কী কারণে আছে জানি না। মনে হয় আমরা শাহ বংশ। আমার পিতার নাম শাহ্ জলিল। দাদার নাম শাহ্ মুদচ্ছের। আমি এই পর্যন্তই নাম জানি, এর বেশি জানি না। শাহ্ বংশ বলে কিছু আছে কি-না আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আপনি লেখক মানুষ। লেখকরা অনেক কিছু জানেন। আমি একজন প্রুফ রিডার। আপনার মতো অনেক লেখকের লেখার প্রুফ আমি দেখি। মাঝে মাঝে এমন চমক খাই। একবার এক লেখকের লেখায় পড়লাম উইপোকা জন্মান্ধ। এক জীবনে কত উইপোকা দেখেছি, কিন্তু কখনো জানতাম না তারা জন্মান্ধ। আমি যে অশিক্ষিত, মূর্খ তাও না, বিএ পাস করেছি। রেজাল্ট ভালো হয় নি। তারপরেও বিএ ডিগ্রির আলাদা ইজ্জত আছে। গ্র্যাজুয়েট হওয়া সহজ বিষয় না। স্যার, আমি কি ভুল বললাম?
আমি হাই চাপতে চাপতে বললাম, না।
শাহ মকবুল আমার সামনে বসা। প্রুফ নিয়ে এসেছে। বাইরে সৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। আমি ভদ্রতা করে তাকে চা খেতে বলে বিপদে পড়ে গেছি। সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গল্প শুরু করেছে। আমি গল্পের মাঝখানে উঠে যেতে পারছি না। এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো যাচ্ছে না। আমি নিজে গল্প লিখি। কোনো পাঠক আমার গল্পের শুরুটা পড়ে উঠে গেলে আমার যেমন খারাপ লাগবে, শাহ মকবুলের নিশ্চয়ই ততটাই খারাপ লাগবে।
স্যার, আপনার কি কোনো জরুরি কাজ আছে?
আমি বললাম, খুব জরুরি কাজ অবশ্যি একটা আছে।
শাহ্ মকবুল বলল, আমি চা-টা শেষ করেই চলে যাব। আমার কারণে আপনার কাজের ক্ষতি হয়ে গেল।
আমি বললাম, তেমন কিছু ক্ষতি হয় নি। তুমি ধীরে সুস্থে চা শেষ করো।
আর এক চুমুক দিলেই চা শেষ হয়ে যাবে। শেষ চুমুকটা দেয়ার আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করব যদি বেয়াদবী না নেন। স্যার, আপনার সঙ্গে তো আমার প্রায় এক বছরের উপর পরিচয়। আপনার দু’টা বইয়ের সেকেণ্ড প্রুফ আমি দেখেছি। আপনার কি কখনো মনে হয়েছে আমি পাগল?
অবশ্যই না।
কথা একটু বেশি বলি। কথা বেশি বলা পাগলের লক্ষণ না। অনেকেই বেশি কথা বলে। পাগলরা বরং কম কথা বলে।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, তুমি পাগল না। এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
শাহ্ মকবুল বলল, এটা কি স্যার আপনি লিখিতভাবে বলবেন?
কেন বলো তো?
আমি-বিশিষ্টজনদের সার্টিফিকেট জোগাড় করছি। অনেকেই লিখিতভাবে দিয়েছেন। আজাদ পাবলিকেশনের মালিক আব্দুস সোবাহান সাহেব দিয়েছেন। উনার মেজোমেয়ের জামাই নুরুন নবি বার এট ল, উনিও দিয়েছেন। একজন ব্যারিস্টারের সার্টিফিকেট পাওয়া তো সহজ কথা নয়। স্যার কী বলেন?
অবশ্যই।
কবি-সাহিত্যিকদের সার্টিফিকেটও আমার অনেক জোগাড় হয়েছে।
আচ্ছা যাও আমি লিখিতভাবেই দিব। যেটা বিশ্বাস করি, সেটা লিখিতভাবে বলতে আমার অসুবিধা নেই।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র শাহ মকবুল পাঞ্জাবির পকেট থেকে কম্পিউটারে কম্পোজ করা A4 সাইজের একটা কাগজ বের করল। সেখানে লেখা–
যার জন্যে প্রযোজ্য
শাহ্ মকবুল,
পিতা : শাহ্ জলিল,
গ্রাম : নিষিন্দা,
জেলা : নেত্রকোনা। আমার পূর্ব পরিচিত। সে পাগল নহে।
(পূর্ণ নাম)
ঠিকানা :
পেশা :
তারিখ :
আমি নাম সই করতে করতে কৌতূহলী হয়ে বললাম, কী করবে এই সার্টিফিকেট দিয়ে?
শাহ্ মকবুল বলল, আমার একটা শখ। শখের তোলা আশি টাকা। স্যার আপনার কি একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে? ছবিটাও ফরমটার সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকে রাখব। দস্তখত দেখে মানুষ চেনা যায় না। ছবি দিয়ে চেনা যায়।
আমি খুঁজে পেতে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবিও এনে দিলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। শাহ মকবুল বিদায় হলো। যাবার আগে তার বিশেষ কায়দায় কদমবুসি করল। পা স্পর্শ না করে পায়ের সামনের মেঝে স্পর্শ করে সালাম। কদমবুসি না বলে মেঝেঝুলি বলা যেতে পারে।
মানুষের বিচিত্র শখ নিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হবার বয়স আমার না। সেই শখের তোলা আশি টাকা হলেও না। আমি আমার এক জীবনে বহু বিচিত্র শখের মানুষ দেখেছি। চিটাগং রেলওয়ে কলোনিতে জয়নাল নামের এক রেলওয়ে কর্মচারী ছিলেন, যার শখ খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর মাগুর মাছের মাথা (যেদিন মাগুর মাছ রান্না হয় সেদিন} ধুয়ে মুছে জমা করে রাখা। তার সঞ্চয়ে তিনশ’র ওপর মাগুর মাছের মাথা ছিল। মাগুর মাছের মাথা জমানো যেমন নির্দোষ শখ, আমি পাগল না’-জাতীয় সার্টিফিকেট জমানোও নির্দোষ শখ। নির্দোষ শখ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমি শাহ্ মকবুলের কথা ভুলেই গেলাম। সে প্রফ নিয়ে আসা-যাওয়া করে, আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না।
একদিন একটু অন্যভাবে দেখা হয়ে গেল। আমার স্ত্রী (শাওন) আগ্রহ নিয়ে কী একটা নাটক দেখছে দেখে আমি পাশে বসলাম। প্রেমবিষয়ক যে সব নাটক হয় সেরকমই একটা নাটক। নায়ক-নায়িকা ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে ফুচকা নিয়ে খাচ্ছে। খুবই অস্বাভাবিক সব ডায়ালগ দিচ্ছে। যেমন নায়ক বলছে– আমার জীবনটাই ফুচকা 1 কামড়ে কামড়ে কে যেন শেষ করে দিচ্ছে। নায়িকা বলল- তাহলে এখন থেকে তোমাকে আমি ডাকব ফুচকা কুমার। বলেই সে বিকট হাঁ করল। নায়ক তার মুখে আস্ত একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দিল। নায়িকা কামড় দিল নায়কের আঙুলে।
পুরো বিষয়টাই হাস্যকর। কিন্তু আমার নজর আটকে গেল অন্য জায়গায়, ফুচকাওয়ালার দিকে। ফুচকাওয়ালা আমাদের শাহ্ মকবুল। নায়ক-নায়িকার কথা শোনা ছাড়া তার করণীয় কিছুই নেই। কিন্তু এই কাজটা সে করল প্রফেশনাল অভিনেতাদের মতো। মাঝে মাঝে আগ্রহ নিয়ে নায়ক নায়িকার কথা শোনে। মুচকি হাসে। একটা ফুচকা বানিয়ে এক ফাঁক খেয়ে ফেলল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। ধরাবে কী ধরাবে না কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার পকেটে রেখে দিল। ডিরেক্টর সাহেব যদি এসব তাকে বলে দিয়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে তিনি বড় ডিরেক্টর। নায়ক-নায়িকার অভিনয় দেখে আমার অবশ্যি সেরকম কিছু মনে হলো না।
পরের বার শাহ্ মকবুল যখন প্রুফ নিয়ে এলো, আমি বললাম, এই তুমি অভিনয় করো না-কি?
মকবুল মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, টুকটাক করি স্যার।
তোমার অভিনয় কিন্তু ভালো।
ভালো পার্ট পাই না স্যার। ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা এইসব পাই।
তোমার ফুচকাওয়ালার একটা অভিনয় দেখেছি, নাটকের নাম জানি না। সেখানে তুমি ফুচকা বিক্রি করার সময় যে কাজগুলো করেছ, সেগুলো কি তোমাকে ডিরেক্টর শিখিয়ে দিয়েছেন, না নিজে নিজে করেছ?
শাহ মকবুল মাথা নিচু করে বলল, ডিরেক্টর সাহেব তো নায়ক-নায়িকা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা কে? যা করার নিজে নিজেই করেছি। নাটকের নাম– হৃদয়ের ভগ্ন জানালা।
নাটক কেমন হয়েছে জানি না। তোমার অভিনয় ভালো হয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে।
শাহ মকবুল তার বিশেষ কায়দায় কদমবুসি করল। অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার তো অনেক জানাশোনা। যদি একজনকে বলে দেন ভায়ালগ আছে এমন একটা পার্ট যদি দেয়। সারাজীবন আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।
কেনা গোলাম হবার দরকার নেই, আমি বলে দেব।
ডাইরেক্টর মিজান ভাইকে যদি বলে দেন। উনি আপনার বিশেষ ভক্ত।
আমি বলে দেব।
উনার মোবাইল নাম্বারটা কি আপনাকে লিখে দিয়ে যাব স্যার?
দিয়ে যাও।
শাহ্ মকবুল মোবাইল নাম্বার লিখে দিয়ে চলে গেল। আমার টেলিফোন করা হলো না। ত্রুটিটা আমার না। ত্রুটি শাহ্ মকবুলের। শাহ্ মকবুল সেই শ্রেণীর মানুষ চোখের সামনে থেকে সরে গেলে যাদের কথা মনে থাকে না।
মাঝারি আকৃতির ছোটখাটো মানুষ। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটে। নিঃশব্দে চলাফেরা করে। তার চলাফেরা কথাবার্তায় একটি জিনিসই প্রকাশ পায়– আমি অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ। রাস্তায় সিএনজি বেবিটেক্সিগুলোর মতো। যাদের পেছনে লেখা থাকে–
আমি ছোট। আমাকে ধাক্কা দেবেন না। এক ছুটির দিনের কথা। বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছি। আয়োজন করে চা খাচ্ছি। হাতে পত্রিকা। মামারারি-কাটাকাটির খবর দিয়ে যেন দিনের শুরু না হয় সেজন্যে ভিতরের দিকের পাতা পড়ছি। সংস্কৃতি সংবাদ। এক মডেল কন্যার বিশাল ছবি ছাপা হয়েছে। স্লিভলেস জামা গায়ের এই নায়িকার বয়স সতের। তিনি ইন্টার পাস করেছেন। তার পছন্দ-অপছন্দের বিশাল তালিকা ছাপা হয়েছে। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। তিনি জানাচ্ছেন যে, অশ্লীল ছবিতে তিনি কখনোই অভিনয় করবেন না। ভালো সামাজিক ছবিতে অভিনয় করবেন। এবং ছবির স্বার্থে চুম্বন দৃশ্য করতে তিনি রাজি আছেন। তাঁর আদর্শ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ), প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান। প্রিয় লেখক শেক্সপিয়র, কার্লমার্কস এবং ভিক্টর হুগো। ভিক্টর হুগোর কোন্ কোন্ বই পড়েছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, প্রায় সব বই-ই পড়েছেন, তবে এই মুহূর্তে বইয়ের নাম মনে করতে পারছেন না। মডেল কন্যার প্রিয় রঙ নীল। প্রিয় খাদ্য চেপা শুঁটকি এবং পিজা।
মডেল কন্যার শখ এবং প্রিয় অপ্রিয়ের তালিকা পড়ে যথেষ্টই আনন্দ পেলাম। এরকম আনন্দদায়ক আইটেম আরো আছে কি-না দেখতে গিয়ে শাহ্ মকবুলের ছবির দিকে চোখ আটকে গেল। সে এই প্রান্তিকের সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিচ্ছে। মিজানুর রহমানের মেগা সিরিয়েল হলুদ কাল নীল-এ সে মতি পাগলের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছে। মতি পাগলের একটা ডায়ালগ সুপার হিট করেছে। লোকজনের মুখে মুখে ফিরছে। ডায়ালগটা হচ্ছে- ভাত খামু না চাপায় বেদনা। বেশ কিছু রিকশা, বেবিটেক্সি এবং বাসের পেছনে এখন নাকি এই কথা লেখা।
আমি ঘর থেকে বিশেষ বের হই না বলে ‘ভাত খামু না চাপায় বেদনা লেখা আমার দেখা হয় নি। তবে শাহ্ মকবুল যে অভিনয় নিয়ে যথেষ্টই ব্যস্ত এটা বুঝলাম যখন দেখলাম প্রুফ নিয়ে সে আসা-যাওয়া করছে না। অন্য একজনকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অবসর সময়ে টিভি দেখার অভ্যাসও আমার নেই। কাজেই শাহ্ মকবুল অভিনয় কেমন করছে তাও জানি না।
একদিন শাওন খুবই উত্তেজিত গলায় বলল, তোমার ঐ লোক তো ফাটাফাটি অভিনয় করে।
আমার কোন লোক?
ঐ যে প্রফ রিডার মকসুদ না মকবুল কী নাম। মতি পাগলার ভুমিকায় অভিনয় করছে দেখে মনেই হয় না অভিনয়। দেখে মনে হয় সত্যি সত্যি কোনো এক পাগলকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। গলার মডুলেশন এত চমৎকার।
‘ভাত খামু না চাপায় বেদনা’ যে সত্যি হিট করেছে তার একটা প্রমাণ পেলাম। গাড়ি করে গাজীপুর যাচ্ছি। সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। ফুল বিক্রি করে ছেলেমেয়েরা প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আট’ন বছর বয়েসী একটা মেয়ের চেহারা এতই মায়াকাড়া। তার হাতে ছোট ছোট হলুদ রঙের কয়েকটা গোলাপ। গোলাপের চেয়েও মেয়েটার চেহারা সুন্দর লাগছে। গোলাপগুচ্ছের দাম পনেরো টাকা। আমি তাকে বিশ টাকার নোট দিয়ে বললাম, এই টেকা দিয়া রুটি কিনা খামু। ভাত খামু না চাপায় বেদনা। বলেই সে ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি ধরেই নিলাম প্রুফ রিডার মতির দেখা আর পাওয়া যায় না। সে প্রুফ ভালো দেখত তাতে সন্দেহ নেই। আমার মতো বানানে দুর্বল লেখকের জন্যে এটা দুঃসংবাদ। নতুন প্রফ রিডার আবদুস সাত্তার নানান যন্ত্রণা করছে, কথ্য কথাবার্তা সে নিজ দায়িত্বে সাধুভাষা করে দিচ্ছে। উদাহরণ দেই–আমি লিখলাম, বিরাট ভুখ লাগছে। চা খামু না। ভাত দেও।
সে শুদ্ধ করে ঠিক করল– খুব ক্ষুধা লেগেছে। চা পান করব না। ভাত দাও।
আমার মাথায় বাড়ি। সে শুধু যে ভাষা ঠিক করছে তা-না। কিছু কিছু অংশ ফেলেও দিচ্ছে। কাজটা কেন করছে জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। এর চেহারাও সন্ত্রাসীর মতো কঠিন ধমক দিতে ভয় লাগে। আমার লেখালেখি বন্ধ হবার জোগাড়।
দিন দশেকের মাথায় সমস্যার সমাধান হলো। এক সকালে চা খাচ্ছি শাহ মকবুল কাটা প্রুফ নিয়ে উপস্থিত। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, আরে মকবুল তুমি?
মকবুল বলল, স্যার অভিনয় ছেড়ে দিয়েছি। আমার পুষল না।
পুষল না কেন?
সবাই পাগলের চরিত্র করতে বলে। আমি পাগল করব না। রাস্তায় যখন বের হই, লোকে ভাবে পাগল।
অভিনয় যে ভালো করছ এটা তার প্রমাণ।
সবাই পাগল বললে একসময় পাগল হয়ে যাব। জগতের এটাই নিয়ম। মানুষের মুখে যা রটে তাই হয়।
কে বলল এই কথা?
আপনার লেখার মধ্যেই পড়েছি স্যার। আপনি লিখেছেন, মানুষের মুখে জয় মানুষের মুখে ক্ষয়। কোন লেখা সেটা মনে নাই। এটার অর্থ মানুষ যাকে নিয়ে জয় জয় করে তার জয় হয়। আর যাকে নিয়ে ক্ষয় ক্ষয় করে তার ক্ষয় হয়। অর্থটা কি স্যার ঠিক আছে?
হ্যাঁ, ঠিকই আছে।
শুটিং-এ যখন যাই তখন ডিরেক্টর সাহেব বলেন, এই পাগলাটারে এক কাপ চা দে। মনটা এত খারাপ হয়। প্রডাকশনের ছেলেপেলেরা আমাকে ডাকে পাগলা স্যার।
আমি বললাম, আমাদের সমাজে পাগল বা পাগলা আদর অর্থে ব্যবহার হয়। আমরা যখন বলি, ছেলেটা পাগলা আছে তখন বুঝাতে হয় ছেলের কাজকর্ম মজার।
স্যার, আমি পাগলের আর কোনো চরিত্র করব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। চা খাও।
সে চা খেতে কাটা প্রুফ মিলাতে বসল। ঘণ্টাখানিক লাগবে। কাজ শেষ করে আমাকে দেখিয়ে চলে যাবে। আমি শোবার ঘরে চলে এলাম। নতুন একটা রকিং চেয়ার কেনা হয়েছে। দোল খেতে খেতে টিভির চ্যানেল বদলাতে মজা লাগে। দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল বদলাচ্ছে। ঠিকমতো সিনক্রোনাইজ করতে পারলে আনন্দময় ব্যাপার। দুলুনি থামতে হলো, কারণ কাজের ছেলে এসে বলল, ‘লোকটা কানতেছে।’ আমি তৎক্ষণাৎ উঠে গেলাম। শাহ মকবুল লাল নীল পেনসিল নিয়ে মেঝেতে উবু হয়ে বসেছে। প্রুফ দেখছে যথেষ্ট মন লাগিয়ে, একই সঙ্গে টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আমি বললাম, মকবুল, কী হয়েছে?
মকবুল আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, মনটা খারাপ।
কেন?
আপনার একটা লাইন পড়ে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়েছে। আর ঠিক হচ্ছে না। আমার এরকম হয়।
কোন লাইনটা?
মকবুল লাল কালিতে দাগ দিয়ে প্রুফ আমার হাতে দিয়ে চোখ মুছতে লাগল। মন খারাপ করার মতো কোনো লাইন না। লেখা আছে– সালমা বলল, তুমি মনে করে একটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ কিনে এনো। মনে থাকবে তো? তোমার তো আবার কিছুই মনে থাকে না।
আমি বললাম, সালমা নামের পরিচিত কেউ কি আছে?
মকবুল বলল, জি-না স্যার। স্বামীর-স্ত্রীর মিল মুহাব্বতের কথা কী সুন্দর করে লিখেছেন।
আমি বললাম, মকবুল, তুমি বিয়ে করছ?
মকবুল বলল, জি-না স্যার। বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হবার দুই মাস পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মেয়ের নাম জাহেদা। বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আর বিয়ে করি নাই।
কত বছর আগে বিএ পাস করেছ?
পনেরো বছর আগে।
জাহেদা কি খুব রূপবতী ছিল?
স্যার, আমি দেখি নাই। আমার বড়খালা দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন মেয়ে শ্যামলা, তবে মুখের কাটিং ভালো। মাথায় চুল আছে। ইন্টার পাস। গ্রামের মধ্যে ইন্টার পাস মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তারচে’ বড় কথা শ্যামলা মেয়ের অন্তর হয় ফর্সা, আর ফর্সা মেয়ের অন্তর হয় শ্যামলা।
কে বলেছে?
আপনার এক লেখাতে পড়েছি।
বিয়েটা ভাঙল কেন?
মকবুল ধরা গলায় বলল, বিরাট হিস্টোরি স্যার। শুনলে আপনার খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগলে লাগবে। শুনি তোমার গল্প।
আপনি যদি লিখে ফেলেন বিরাট বেইজ্জত হব।
আমি লিখব না। শোনা গল্প আমি কখনো লিখি না।
আর লিখলেও ক্ষতি নাই। কেউ তো আর বুঝবে না আপনি আমার মতো অধমরে নিয়া লিখছেন। ঠিক বলেছি স্যার?
ঠিকই বলেছ।
গল্পটা শুরু করি স্যার। আমার বাবারে দিয়া শুরু করি। আসলে এই গল্প উনারই। আমি কেউ না। আমার বাবা ছিলেন পাগল। আমার বিবাহে বরযাত্রী হয়ে বাবা সঙ্গে গিয়েছিলেন। সব ঠিকঠাক ছিল। বাবা ছিলেন শান্ত। সবার থেকে সামান্য দূরে একটা কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন। কাজি আসতে বিলম্ব করছিল এই জন্য অপেক্ষা। দিনটা ছিল শুক্রবার। এই দিনে গ্রামাঞ্চলে অনেক বিয়ে শাদি পড়ানো হয়। কাজিরা থাকেন ব্যস্ত। কপালের ফের এরেই বলে। কাজি যদি দেরি না করতেন, তাহলে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। এত দিনে তিন চারটা ছেলেমেয়ে হয়ে যেত। যদিও সরকার বলছে ছেলে হোক মেয়ে হোক একটি সন্তানই যথেষ্ট, কিন্তু আমার বাড়িভর্তি ছেলেমেয়ের শখ। ছেলেমেয়েরা চিল্লাপাল্লা করবে আমোদ ফুর্তি করবে। তাদের মাতা চড় থাপ্পড় মারবে এর নাম সংসার।
মকবুল, তুমি বাড়তি কথা না বলে মূল গল্পটা বলো। বিয়েটা কীভাবে ভাঙল।
আমার বাবা শাহ জলিল একটু দূরে কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন। কন্যার পিতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পান খাবেন কি-না। বাবা বলেন, আমি চা-পান বিড়ি সিগারেট এইসব খাই না।
কন্যার পিতা বললেন, লেবুর সরবত করে দেই, সরবত খান। বাবা বললেন, আচ্ছা।
কন্যার পিতার সরবত আনতে গেলেন, তখন হঠাৎ বাবার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি চিৎকার শুরু করেন—’আমি বিবাহ করব না। আমি বিবাহ করব না।’
চারদিকে হাসাহাসি পড়ে গেল। পাগলের যে-কোনো কথায় লোকজন হাসে। আর এই পাগল হাসির কথাই বলছে। ছেলেকে বিবাহ করাতে এসে বলছে- আমি বিবাহ করব না। বিরাট বেইজ্জতি ব্যাপার।
কন্যার এক মামা বিডিআর-এ কাজ করেন। নন কমিশন্ড অফিসার। সুন্দর চেহারা, কথাবার্তায় অতি ভদ্র। তিনি এসে হাতজোড় করে বললেন, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন, কন্যার মা কান্নাকাটি করতেছেন। তিনি এইখানে মেয়ে বিবাহ দিবেন না।
আমাদের সঙ্গেও ভালো ভালো লোকজন ছিল। নেত্রকোনা কোর্টের উকিল অধর বাবু ছিলেন। দেওয়ানি ফৌজদারি দুই মামলাতেই তিনি মারাত্মক। তিনি একবার এক সাক্ষিকে এমন জেরা করলেন যে, সাক্ষি এজলাসে পেসাব-পায়খানা করে ফেলল। জজ সাহেব বিরক্ত হয়ে অধর বাবুকে দশ টাকা ফাইন করলেন। মেথর দিয়ে এজলাস পরিষ্কার করার খরচও অধর বাবুকে দেয়া লাগল।
মকবুল, মূল গল্পটা বলো। শাখা-প্রশাখা বাদ দাও।
কন্যার মামার কথা শুনে অধর বাবু গেলেন ক্ষেপে। তিনি বললেন, কন্যার মা এইখানে কন্যার বিবাহ দিবেন না, ভালো কথা। মা হিসাবে এই কথা বলার অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে। আমরা তাঁর কথাকে সম্মান করি। কিন্তু এই কথা তিনি আগে কেন বললেন না। শেষ সময়ে কেন বললেন। ছেলের বাবার মাথা যে সামান্য গরম এই কথা তো কন্যার মাতা আগেই জানতেন। এমন তো না যে আজ প্রথম খবর পেয়েছেন। আমরা ছেলে বিবাহ দিতে এসেছি। ছেলে বিবাহ দিব। কন্যা ছাড়া গ্রামের ফিরে বেইজ্জত হব না। আপনারা যদি বিবাহ না দেন– দুই তিনটা ধারায় ফৌজদারি মামলা হবে। কারোর কারোর চার-পাঁচ বছরের জেল জরিমানা হবে। এখন বুঝে দেখেন। আমি অধর উকিল। আইনের কথা বুঝি। আইন ছাড়া কিছু বুঝি না।
বিরাট তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। হৈচৈ চিৎকার। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছেন শুধু অধর বাবু।
অধর বাবুর বক্তৃতায় কাজ হলো। এদিকে বাপজান সামান্য ঠাণ্ডা হয়েছেন। চেয়ারে এসে বসেছেন। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছিলেন, সেই পাঞ্জাবি আবার পরেছেন। কাজি সাহেবও চলে এসেছেন। কন্যার বাবা বললেন, বিবাহ হবে– দুইজন আসেন। মেয়ের এজিন নিয়ে যান।
আমাদের দুই মুরব্বি এজিন আনতে গেলেন। অধর বাবুও সঙ্গে গেলেন। উনি বিচক্ষণ লোক। উনি দেখবেন সব ঠিকঠাক হচ্ছে কি-না।
হঠাৎ শুনি ভিতর থেকে চিৎকার। হৈচৈ। মনে হচ্ছে মারামারি শুরু হয়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই এক দল লাঠিসোঠা নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। কী যে ভয়ঙ্কর অবস্থায়। ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের জোয়ান ছেলেপুলে। কন্যার বাবা এবং মামা মারামারি থামানোর চেষ্টা করছেন। ছোটাছুটি করছেন। কোনো লাভ হচ্ছে না। এই সময় তারা এসে আমার গলা চেপে ধরল। আমাকে মেরেই ফেলত। তখন বিয়ের কন্যা জাহেদা ছুটে এলো। সে না এলে আমাকে মেরে ফেলত।
আমি বললাম, তুমি বলেছিলে বিয়ের কন্যা জাহেদাকে আগে দেখ নি। তোমার বড় খালা দেখেছিলেন।
স্যার, মিথ্যা বলেছিলাম।
কেন? মানুষ উদ্দেশ্য ছাড়া মিথ্যা বলে না। তোমার উদ্দেশ্যটা কী?
স্যার, আপনি জ্ঞানী মানুষ।
আপনি উদ্দেশ্য খুঁজে বের করেন। আমি উদ্দেশ্য জানি না। জাহেদাকে দেখেছি এটা বলতে আমার লজ্জা লাগে বলেই বলি দেখি নাই।
লজ্জা লাগবে কেন?
বিয়ে হওয়ার কথা ছিল হয় নাই, এইটাই লজ্জা। সব মানুষ তো এক রকম হয় না স্যার। একেক মানুষ হয় একেক রকম।
তারপর কী হয়েছে বলো।
শাহ্ মকবুল স্বাভাবিক গলায় বলল, দুইজন মানুষ মারা গিয়েছিল। অধর বাবুর ঠ্যাং ভেঙে জন্মের মতো লুলা করে দিয়েছিল।
বলো কী?
দুইজন এজিন আনতে গিয়েছিল। দুইজনেই শেষ। একজনকে গলায় ছুরি বসায়ে গরু জবাই করার মতো জবাই করেছে।
সর্বনাশ!
অনেক পত্রপত্রিকায় এই ঘটনা উঠেছে। ইত্তেফাঁকে লেখা হয়েছে– বিয়ের আসরে কারবালা। নিহত দুই। আহত শতাধিক।
এরপর শুরু হলো মামলা-মোকদ্দমা। অধর বাবু মামলা সাজালেন। প্রধান আসামি তিনজন। বিয়ের কন্যা জাহেদা, তার বাবা এবং তার মা। অধর বাবু নিজে একজন সাক্ষি। তিনি বললেন যে, তিনি নিজে দেখেছেন, জাহেদা গলায় ছুরি বসাচ্ছে। বাকি দুইজন চেপে ধরে আছে।
অথচ স্যার এই তিনজন কিছুই করে নাই। আটকানোর চেষ্টা করেছে। জাহেদা যদি ছুটে এসে আমাকে না আটকাত, তাহলে আমাকেও মেরে ফেলত।
তুমি সাক্ষি দাও নি?
দিয়েছি। সত্য কথা বলেছি। আমি একা বলেছি একধরনের কথা, বাকি চল্লিশজন সাক্ষি বলেছে ভিন্ন কথা। আমার সাক্ষি কোর্ট গ্রহণ করে নাই। উকিল প্রমাণ করেছে যে, আমি পাগল। আমার বাবা পাগল, আমি ও পাগল। পাগল বলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছি।
শাস্তি কী হয়েছিল?
স্যার তিনজনেরই ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। জাহেদার অল্প বয়সের কারণে এবং মেয়ে হবার কারণে হাইকোর্ট পরে যাবজ্জীবন দিয়েছে।
তুমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে যাও?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যাই স্যার। প্রায়ই যাই। আমরা এমনভাবে কথা বলি যেন আমাদের আসলেই বিয়ে হয়েছে। আমরা স্বামী স্ত্রী। সে আমাকে তুমি তুমি করে বলে, আমিও তাকে তুমি তুমি করে বলি। দুইজন আবার রাগারাগি ঝগড়াঝাটিও করি।
কী নিয়ে ঝগড়াঝাটি করো?
নাটকে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছি শুনে রাগারাগি করল। তারপর একদিন রাগারাগি করল ছেলেমেয়েদের নাম রাখা নিয়ে।
ছেলেমেয়েদের নাম মানে?
কোনো এক দিন তো জাহেদা জেল থেকে বের হবে। আমরা বিয়ে করব। আল্লাহপাকের দয়া হলে আমাদের ছেলেমেয়ে হবে। বিভিন্ন নাম নিয়ে জাহেদার সঙ্গে কথা বলি। আমার কোনো নামই তার পছন্দ হয় না। এই নিয়ে ঝগড়া। স্যার, আপনি কি আমার বড় মেয়েটার নাম রেখে দিবেন? আমি স্বপ্ন দেখেছি আমার প্রথম সন্তান মেয়ে। জাহেদাও একই স্বপ্ন দেখেছে।
শাহ্ মকবুল শব্দ করে কাঁদছে। আমি তার পিঠে হাত রেখে বললাম, তোমাদের বড় মেয়ের নাম অবশ্যই আমি রেখে দেব। পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর নামটা তার জন্যে। তোমার মেয়ের নাম চন্দ্রাবতী। নাম পছন্দ হয়েছে?
শাহ্ মকবুল মেঝেতে কদমবুসি করে বলল, খুব পছন্দ হয়েছে স্যার। মেয়ের মায়েরও পছন্দ হবে ইনশাল্লাহ।
Sundor