গন্ধ
‘গন্ধ’ গল্পটি এক বৈঠকে লেখা। আমার পছন্দের গল্প। আমার ধারণা এই সংকলনের সবচে ভাল গল্প। পাঠক বিবেচনা করুন।
*
আব্দুল করিম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল রাত শেষ হলেই তার ফাঁসি হবে। ফাঁসিগুলো সাধারণত ফজরের আজানের আগে আগে হয়। ফাঁসি হয়ে যাবার পর জল্লাদ অজু করে ফজরের নামায পড়ে। সেই হিসেবে আব্দুল করিমের হাতে দশ ঘণ্টা সময় আছে।
জেলার নিজে এসেছেন। সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। তিনি নার্ভাস ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিচ্ছেন। তিনি সরাসরি করিমের চোখের দিকে তাকাচ্ছেনও না।
করিম।
জি স্যার?
সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে? সিগারেট খাবেন?
করিম বলল, জি স্যার খাব।
জেলার সিগারেটের প্যাকেট গরাদের ভেতর দিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, প্যাকেটটা রেখে দিন।
করিম বলল, শুকরিয়া।
রাতে কী খেতে ইচ্ছা করছে বলুন তো?
করিম বলল, স্যার আজই কি ফাঁসি হবে?
জেলার সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, সেটাতো বলতে পারছি না।
করিম বলল, কী খেতে চাই জানতে চাচ্ছেন এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
জেলার নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললেন, আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে যাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে তাদের কিছু খাওয়াতে ইচ্ছা করে– এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
আলু ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে।
শুধু আলুভাজি?
জি স্যার! আলুভাজির সঙ্গে শুকনা মরিচ ভাজি আর দুই চামচ গাওয়া ঘি।
মাছ মাংস কিছু না?
যদি সম্ভব হয় ডিমওয়ালা শিং মাছের ঝোল।
অবশ্যই সম্ভব হবে। কেন সম্ভব হবে না? কাউকে কিছু কি জানাতে হবে? আমাকে বলতে পারেন। আমি অবশ্যই জানাব।
কাউকে কিছু জানাতে হবে না স্যার। আপনার অনেক মেহেরবানি।
রাত ন’টার মধ্যে খাবার চলে আসবে।
শুকরিয়া।
জেলার সাহেব চলে গেছেন। সিগারেটের প্যাকেট হাতে আব্দুল করিম মেঝেতে পাতা কম্বলের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। সিগারেট সে এখনো ধরায় নি। তার সঙ্গে দেয়াশলাই নেই। ফাঁসির সেলের কয়েদিদের দেয়াশলাই লাইটার রাখতে দেয় না। তবে সিগারেট ধরানো কোনো বিষয় না। গার্ডকে বললেই ধরিয়ে দেবে।
প্যাকেটে সিগারেট আছে আঠারোটা। দশ ঘণ্টার জন্য আঠারোটা সিগারেট। ঘণ্টায় দু’টা করে সিগারেট খাওয়া যাবে। করিম বিছানা থেকে উঠে গরাদ ধরে দাঁড়ালো। গার্ড সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত। ফাঁসির আসামিকে শেষ সময়ে গার্ডরা যথেষ্ট মায়া-মমতা দেখায়।
করিম বলল, একটা সিগারেট ধরাব।
গার্ডের কাছে লাইটার ছিল না, সে দৌড়ে কোত্থেকে লাইটার নিয়ে এল। করিম বলল, বাংলা মাস কী জানেন?
অগ্রহায়ণ মাস।
করিম সিগারেটে টান দিল। গ্রামের দিকে অগ্রহায়ণ মাসে তীব্র শীত পড়ে। কথায় মানে না এমন শীত। অথচ ঢাকা শহরে শীত নেই। জেলখানায় শীত আরো কম। দেড় বছরের উপরে সে জেল হাজতে আছে। শীতকাল বলে যে একটা ঋতু আছে বুঝতেই পারে নি। জেলাখানায় একটাই ঋত–গরম কাল।
গার্ড বলল, পান খাবেন? একটা পান এনে দেই?
করিম বলল, এখন পান খাব না। ভাত খাওয়ার পরে একটা খাব।
গার্ড বলল, কোনো চিন্তা নাই। জর্দা দিয়ে ডাবল পান এনে দিব।
করিম বলল, শুকরিয়া।
শুকরিয়া বলা সে শিখেছে যমুনার কাছ থেকে। মুন্সি মাওলানারা কথায় কথায় শুকরিয়া বলে। তার স্ত্রী যমুনা কোনো মুন্সি মাওলানা বা মাওলানা ঘরের মেয়েও না। কার কাছ থেকে সে শুকরিয়া বলা শিখেছিল কে জানে! একদিন করিম জিজ্ঞাসা করেছিল। যমুনা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল– বলব না।
বলব না বলাও তার আরেক রোগ। কিছু জানতে চাইলেই বলতো বলব না।
একদিন দুপুরে বাসায় খেতে বসে দেখে এলাহি আয়োজন। পোলাও, কোর্মা, খাসির রেজালা। অথচ ছুটির দিন বলে সে সকালে নিজেই বাজার করেছে টেংরা মাছ, কচুর লতি এবং ছোট চিংড়ি। করিম বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কী?
যমুনা যথারীতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, বলব না। ঘটনা কী রাতে জানা গেল। তাদের বিয়ের দিন। করিম বিয়ের প্রথম বছরেই এই দিনটা ভুলে গেল। আফসোস।
তাদের বিয়ে হয়েছিল পৌষ মাসে। নেত্রকোনার পৌষ মাসের শীত যে কী জিনিস যারা সেই সময় নেত্রকোনায় যাবে না তারা কোনোদিনই জানবে না। মেয়ের বাড়িতেই বাসর হলো। ফুল দিয়ে সাজানো পুরনো আমলের খাট। আয়োজনের কোনো কমতি নেই। সমস্যা একটাই, গায়ে দেবার জন্যে পাতলা ফুল তোলা একটা কথা ছাড়া কিছু নেই। যে দেশে ডাবল লেপে শীত মানে না সেই দেশে নতুন জামাইকে দেয়া হয়েছে পাতলা একটা কথা।
করিম নববধূকে বলল, তোমাদের বাড়িতে লেপ নেই?
যমুনা বলল, অবশ্যই আছে। বাপজানে বিয়ার জন্যে শিমুল তুলার নয়া ডাবল লেপ বানাইছে।
তাহলে কাঁথা কেন?
যমুনা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, বলব না।
কাঁথার রহস্য জানা গেল অনেক দিন পর। পুরো ব্যাপারটা করেছেন। যমুনার দাদিজান। তিনি নাতিন জামাই-এর সঙ্গে সামান্য মশকরা করেছেন।
বিয়ের প্রথম রাতে যে পুরুষের শীত লাগে সে না-কি পুরুষের জাতই না। যমুনার দাদিজান পরীক্ষা করে দেখেছেন করিম পুরুষের জাতে পড়ে কি-না। পরীক্ষায় করিম পাস করতে পারে নি। শেষ রাতে যমুনাকে লেপ আনতে বাড়ির ভেতর যেতে হয়েছিল। করিম কথা গায়ে দিয়ে থরথর করে কাঁপছে এই দৃশ্য যমুনা মেনে নিতে পারে নি।
আজ রাত শেষ হবার আগেই করিমের ফাঁসি হবে তার স্ত্রীকে গলা টিপে খুন করার জন্য। অথচ খুনটা সে করে নাই। ঐদিন দুপুরে তার প্রচণ্ড মাথা ধরল। কপালে হাত দিয়ে মনে হল জ্বর আসছে। অফিস কামাই দেয়া তার স্বভাব না। জ্বর নিয়েই সে অপেক্ষা করতে লাগল কখন চারটা বাজবে। এই সময় বাড়িওয়ালার বাসা থেকে তার কাছে একটা টেলিফোন এল। বড় সাহেবের চেম্বারে গিয়ে টেলিফোন ধরতে হল। করিমের খুবই সংকোচ লাগছিল কারণ তার টেলিফোনে কর্মচারীদের কল এলে তিনি খুব রাগ করেন। ভাগ্য ভালো সেদিন বড় সাহেব অফিসে ছিলেন না। যমুনা টেলিফোনে ভীত গলায় বলল, এক্ষুণি বাসায় আসতে পারবে?
করিম বলল, কেন?
যমুন বলল, বলব না। এক্ষুণি বাসায় আস।
কোনো সমস্যা?
বলব না।
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে করিম রিকশা করে বাড়ি ফিরল। তার বাসা চারতলার তিন কামরায় একটা ফ্লাটে, সে আর যমুনা থাকে। বারো-তের বছরের একটা কাজের মেয়েও থাকে। মেয়েটার নাম জাহেদা। করিমের শাশুড়ির নাম জাহেদা হবার কারণে মেয়েটাকে ডাকা হতো ফুলি।
করিম সিঁড়ি থেকে চারতলায় উঠল। অনেক্ষণ কলিংবেল টিপল। কেউ দরজা খুলল না। সবসময় একবার কলিং বেল টিপলেই যমুনা ছুটে এসে দরজা খোলে।
করিম দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। সে ঘরে ঢুকল। শোবার ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে যমুনা ঘুমিয়ে আছে। তার ঠোঁটে রক্ত জমে কালো হয়ে আছে। কিছুক্ষণ সে হতভম্বের মত যমুনার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অতি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামল। দারোয়ান গেট খুলে দিল। সে দৌড়ে চলে গেল রাস্তায়।
কোর্টে উকিল সাহেব তাকে অস্থির করে তুলছেন। উকিল সাহেব হালকা পাতলা মানুষ। গায়ের রং গাউনের মতোই কালো। তাঁর দাঁত এবং চোখের সাদা অংশ অস্বাভাবিক সাদা। সব সময় ঝনঝন করছে। তার চোখে চশমা কিন্তু প্রশ্ন করার সময় চশমাটা হাতে নিয়ে নেন। চশমার উঁটি আঙুলের মতো তুলে প্রশ্ন করেন। বেশির ভাগ প্রশ্নেরই কোনো আগামাথা নেই।
আপনার বাসার কাজের মেয়েটির বয়স কত?
বারো তের হবে। সঠিক জানি না।
তার সঙ্গে আপনার যৌন সম্পর্ক কত দিনের?
ছিঃ জনাব। মেয়েটা আমাকে চাচা ডাকে।
এ দেশে প্রচুর চাচা আছে যারা নিকট এবং দূরের ভাতিজিদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে। করে না?
জনাব আমি জানি না।
আপনাদের এই যৌন সম্পর্কের বিষয়টি আপনার স্ত্রী কখন জানতে পারেন?
এই জাতীয় কোনো কিছুই হয় নাই।
আপনার স্ত্রী অকারণেই আপনাকে সন্দেহ করতেন।
আমার বিষয়ে কখনোই তার কোনো সন্দেহ ছিল না।
ঘটনার আগের দিন আপনি কাজের মেয়েটিকে ছুটি দেন। সেটা কি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সুবিধা হয় এই কারণে?
মেয়েটার বাবা অসুস্থ। সে দেশের বাড়িতে যাবে এই কারণে ছুটি চেয়েছিল। আমার স্ত্রী তাকে ছুটি দিয়েছিলেন। আমি না।
উকিল সাহেব বললেন, আপনার স্ত্রীকে আদালতে এনে জিজ্ঞাসা করা যাবে না যে ছুটি কে দিয়েছে। এটাই সমস্যা। সমস্যা না?
জি জনাব।
উকিল সাহেব এই পর্যায়ে জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, পুলিশ জাহেদা নামের মেয়েটাকে শ্যামগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে। সে বলেছে সে কখনো ছুটি চায় নাই। তাকে হঠাৎ ছুটি দেয়া হয়। মেয়েটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে যে আসামির সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। আমরা যথাসময়ে মেয়েটিকে উপস্থিত করবো। এখন আমরা আসামির কাছে ফিরে যাই।
আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আপনি ঘরে ঢুকে দেখেন যে আপনার স্ত্রী খুন হয়েছে?
জি।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পর আপনার উচিত ছিল প্রতিবেশীদের জানানো। তা না করে আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। রাত তিনটায় পুলিশ আপনাকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করে। এটা কি সত্যি?
জি সত্যি।
তখনো আপনার হাতে রক্তের দাগ লেগেছিল এটা কি সত্যি?
জি সত্যি। যমুনার ঠোঁটে রক্ত ছিল সেই রক্ত হাতে লেগে গিয়েছিল।
আপনার বাসা থেকে কোনো কিছুই খোয়া যায় নাই এটা কি সত্যি?
জি সত্যি।
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে ডাকাতির উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় নাই। আমার যুক্তি ঠিক আছে?
জি।
আপানার স্ত্রী যমুনার পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এমন আলামত পাওয়া যায় নি। হত্যাকারী টাকা-পয়সার লোভেও হত্যা করে নি আবার ধর্ষণের জন্যও হত্যা করে নি। তার মোটিভ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। যাই হোক হত্যাকাণ্ডের পর আপনি কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে ছিলেন কেন?
জানি না।
কেন জানবেন না? আপনার পকেটে বাহাদুরাবাদ ঘাটের একটা টিকিট পাওয়া গেছে। টিকিট কাটা হয়েছে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। আমি ভুল বলছি?
জি না জনাব।
আপনি কি পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন?
জি না জনাব।
তাহলে ময়মনসিংহের টিকিট কেন কেটেছিলেন? রিলাক্স করতে যাবার জন্য?
উকিল সাহেবের কথায় করিম আহত হয়েছে কিন্তু রাগ করে নি। মনে কষ্ট পায় নি। উনি উনার কাজ করবেন। অপরাধী ধরবেন। তার যেন কঠিন শাস্তি হয় সেই ব্যবস্থা করবেন। এই কারণেই তাকে টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। করিম মনে কষ্ট পেয়েছে জাহেদার কথায়। মেয়েটারে এত স্নেহ করতেন। মা ডাকতেন। এই নিয়ে যমুনা রাগ করতো।
কাজের মেয়েকে মা ডাকো কেন? নাম ধরে ডাকো। বেশি আদর করলে এরা মাথায় উঠে।
বাচ্চা মেয়ে, কত কাজ করে। মেয়েটাকে স্নেহ করি।
সেই মেয়ে এজলাসে উঠে এটা কী করল! লজ্জায় করিমের মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা।
তুমি উনাকে চেন?
চিনি।
উনার নাম বলো।
আব্দুল করিম।
উনার বাসায় তুমি কত দিন ধরে আছ?
এক বছর।
তোমাকে নিয়ে উনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতো?
হুঁ।
হুঁ না। পরিষ্কার করে বলো। প্রায়ই ঝগড়া হতো?
জি হইত।
উনার স্ত্রী সন্দেহ করতো যে উনার সঙ্গে তোমার খারাপ সম্পর্ক আছে?
হুঁ।
করিমের উকিল এই পর্যায়ে বললেন, জেরা ঠিক হচ্ছে না। সাক্ষীর মুখে তুলে দেয়া হচ্ছে।
তার উত্তর উকিল সাহেব বললেন, কিছু কিছু কথা মুখে তুলে দিতে হবে। বাচ্চা একটা মেয়ে নিজ থেকে গড়গড় করে নোংরা কথা বলতে পারে না।
করিমের মুখ ইচ্ছা করছিল মেয়েটাকে বলে, মাগো এই মিথ্যা কথাগুলো তুমি কেন বলছ? জিজ্ঞাস করা হয় নি। লজ্জাতেই জিজ্ঞাস করতে পারে নি। মেয়েটার মিথ্যা বলার একটা কারণ করিম অনেক পরে বের করেছে। মেয়েটার ধারণা করিম যমুনাকে খুন করেছে। মেয়েটা চাচ্ছে করিমের কঠিন শাস্তি হোক।
রাত নটা। জেলার সাহেবের বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এসেছে। করিম যা যা বলেছে সবই এসেছে। করিম আগ্রহ করে খেতে বসল। আলুভাজি, ডিওয়ালা শিং মাছ তার পছন্দের খাবার তা কিন্তু না। যমুনার পছন্দের খাবার। সে তাকে বলেছে বেহেশতে সে আল্লাহ পাকের কাছে এই খাবারই দুই বেলা খেতে চাইবে।
করিম বলেছিল, বেহেশতে তুমি আলুভাজি পেতে পার, শিং মাছের ঝোল পাবে না।
যমুনা বলল, কেন পাব না?
করিম বলল, শিং মাছের প্রাণ আছে। শিং মাছের ঝোল রাঁধতে হলে শিং মাছের প্রাণ নষ্ট করতে হবে। বেহেশতের মতো জায়গায় কোনো প্রাণ নষ্ট করা যাবে না।
তোমাকে কে বলেছে?
কেউ বলে নাই। আমি চিন্তা করে বের করেছি।
যমুনা মুগ্ধ গলায় বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার কথা ঠিক। কাজেই শিং মাছ যা খাবার আমি দুনিয়াতেই খেয়ে যাব। সপ্তাহে
একদিন অবশ্যই আমার জন্য শিং মাছ কিনে আনবে।
.
গার্ড জর্দা দিয়ে পান নিয়ে এসেছে। পানটা খেতে করিমের খুবই ভালো লাগল। সে নিজেই একটা সিগারেট ধরালো, গার্ডকে একটা দিল। গার্ড বলল, ভাই সাহেব মনে সাহস রাখবেন।
করিম বলল, রাখব। সাহস রাখার চেষ্টা করব। পারব কিনা জানি না। আচ্ছা ভাই আমাকে যে ফাঁসি দিবে তার নাম কী?
গার্ড বলল, দুই ভাই আছে। যাবজ্জীবন হয়েছে। তারাই ফাঁসি দেয়। এক ভাইয়ের নাম রমজান। আরেক ভাইয়ের নাম আলী। দুই ভাই-ই এখানে আছে। কে ফাঁসি দিবে জানি না।
কে ফাঁসি দিবে জানলে ভালো হতো।
কেন?
একজন নিরপরাধ মানুষের ফাঁসি দেয়ার কারণে তার কিছু পাপ হবে। সেই পাপ যেন না হয় তার জন্যে দোয়া করা দরকার। সে তো আর জানে না আমি নির্দোষ।
গার্ড বলল, ফাঁসির সব আসামি বলে সে নির্দোষ। যখন ফাঁসি দেবার জন্যে কালো টুপি দিয়ে তার মুখ ঢেকে দেয় তখনি সে বুঝে যে নির্দোষ না। অনেকেই চিৎকার করে বলে আমি দোষ করেছি আল্লাহপাক ক্ষমা করো। আপনি কি আরেকটা পান খাবেন, এনে দিব?
দেন, আপনার অনেক মেহেরবানি।
কোরান মজিদ পড়বেন?
আরবি পড়তে পারি না।
সিগারেট আছে, আর লাগবে না। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসও আমার নাই। জেলার সাহেব দিয়েছেন বলে খাচ্ছি।
দ্বিতীয় পানে জর্দা বেশি ছিল। খাওয়ার পর করিমের মাথা ঘুরাতে লাগলো। কাঁচা সুপারির পান খেয়ে যমুনার একবার এরকম হল। মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে গেল। ঘামে শরীর গেল ভিজে। যমুনা বলল, এই শোন আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমার হাত ধরে বসে থাকো। তুমি নড়বা না। খবরদার নড়বা না। আহারে কী ছেলেমানুষী! মানুষ কি এত সহজে মরে? মানুষের মৃত্যু কঠিন ব্যাপার। অনেক আয়োজন লাগে। ভোরবেলায় তার মৃত্যু হবে। অনেক আয়োজন লাগবে, অনেক চিন্তার বিষয়ও আছে।
করিম রাত এগারোটার দিকে কম্বলে ঘুমাতে গেল। সে জানে ঘুম আসবে না। তার পরেও সময়টাতো পার করতে হবে। যমুনার কথা চিন্তা করলে সময়টা সুন্দর পার হয়ে যাবে। চিন্তা করার কত কিছু আছে। কত ঘটনা। একবার সে যমুনাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে, হঠাৎ শোনে রাগ করে সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কী কারণে রাগ করেছে তা জানা যাচ্ছে না। দুপুরে সে কিছু খেল না। রাতেও না। যমুনার মা শুরু করলেন কান্না। এতদিন পরে মেয়ে এসেছে। খাওয়া-দাওয়ার কত আয়োজন অথচ মেয়ে উপোস। তিনি বারবার বলছেন, মারে আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। মানুষ ভুল করে না? তামাশা করে একটা কথা বললাম। মাফ করে দে মা।
যমুনা ঘাড় শক্ত করে বলল, মাফ করব না। কাল সকালে আমি চলে যাব। লোকজনের অনুরোধ, চোখের পানি কিছুই কাজ করল না।
রাগের ঘটনা করিম জেনেছে অনেক দিন পর। তার শাশুড়ি না-কি বলেছিলেন, যমুনার জামাইটা বোকা কিসিমের।
এটা রাগ করার কোনো বিষয়? সে বোকা এটাতো সত্যি। শাশুড়ি আম্মা একটা সত্যি কথা বলছিলেন। এই নিয়ে কোন মেয়ে এত রাগ করে?
করিম ভেবেছিল তার ঘুম আসবে না। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর গাঢ় ঘুম। ঘুম ভাঙল জেলখানার মাওলানা সাহেব যখন ডেকে তুললেন। তাকে গোসল দেয়া হবে। তওবা পড়ানো হবে। মাওলানা সাহেব জেলখানায় পরিষ্কার পায়জামা ফতুয়া নিয়ে এসেছেন। এই কাপড় পরেই তার যাত্রী। করিম বলল, মাওলানা সাহেব একটা প্রশ্ন ছিল।
বলেন কী প্রশ্ন?
বেহেশতে কি শিং মাছের ঝোল পাওয়া যাবে?
মাওলানা প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হলেন না। ফাঁসির আসামি তওবা পড়ানোর আগে অনেক উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে। মাওলানা বললেন, বেহেশতে মানুষ যে খানাই খেতে চাবে তাই দেয়া হবে। সেই খানার স্বাদ হবে পৃথিবীর খানার স্বাদের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি। বলেন সোবাহানাল্লাহ।
করিম বলল, সোবাহানাল্লাহ।
করিমকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দু’জন পুলিশ দুদিক থেকে তাকে ধরে রেখেছে। তার হাত পেছন দিকে বাধা। তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। করিম কোনো হৈচৈ করছে না। অনেকেই করে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়। জেলার সাহেব তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন। করিম তার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার যে আমার ফাঁসি দিবে তার নামটা কী বলবেন।
কী হবে নাম জেনে।
কৌতূহল আর কিছু না।
তার নাম রমজান। রমজান মিয়া।
নামটা বলার জন্যে স্যার শুকরিয়া।
করিমের মনে পড়ল তার ফ্ল্যাট বাড়ির দারোয়ানের নামও রমজান মিয়া। অতি বিনয়ী। বিশাল শরীর সেই তুলনায় মাথাটা ছোট। কথা বলতো মাটির দিকে তাকিয়ে। হাতের বিড়ি অদ্ভুত কায়দায় লুকিয়ে ফেলত। সবার সঙ্গে দু’একটা কথা সে বলতই স্যার ভালো আছেন? কী বাজার করছেন? ইলিশ মাছ? দাম কত নিল? মাছ আর খাওয়া যাবে না। খানা খাদ্য দেশ থাইকা উইঠা যাবে। মাটি খায়া থাকতে হবে।
করিম ভেবে পেল না এত মানুষ থাকতে মৃত্যুর আগে আগে রমজান মিয়ার কথা তার মনে পড়ছে কেন?
কাঠের পাটাতনে করিমকে দাঁড়া করানো হয়েছে। মচমচ শব্দ হচ্ছে। শব্দটা অদ্ভুত লাগছে। কেন অদ্ভুত লাগছে এটাও সে বুঝতে পারছে না। করিমের মাথায় কালো টুপি পরিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে যমুনার রহস্য ভেদ করল।
দারোয়ান রমজান মিয়া সব সময় তার সঙ্গে অনেক কথা বলে কিন্তু যমুনার মৃত্যুর দিন সে পাগলের মতো ছুটে বের হচ্ছে, রমজান মিয়া গেট খুলে দিল একটা কথাও বলল না।
যমুনা বলছিল, এই শোন ফুলিকে আমি রাখব না। বিদায় করে দেব। ও প্রায়ই দারোয়ানটার সঙ্গে গল্প করতে চায়।
করিম বলেছিল, থাক না। রমজান মিয়াইতো দেশের বাড়ি থেকে মেয়েটাকে এনে দিয়েছে। তার আপনা লোক। ফুলি দারোয়ানের কাছ থেকে যখন ফিরে তখন তার গায়ে থাকে বিড়ির গন্ধ।
করিম যমুনার গায়ের উপর থেকে যখন চাদর সরিয়েছিল তখন কড়া বিড়ির গন্ধ পেয়েছিল। রমজানের হাতের বিড়ির গন্ধ লেগেছিল যমুনার গায়ে। কত সহজ সমাধান।
করিম বিড়ির গন্ধ আবার পাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যমুনার চুলের মিষ্টি গন্ধটা মনে করতে। মৃত্যুর সময় যমুনার চুলের মায়াবী গন্ধটা একবার যদি মনে পড়ত! বিড়ির উৎকট গন্ধ সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জেলার সাহেব হাতের ইশারায় ফাঁসি কার্যকর করার সিগনাল দিলেন।