শহিদের মা

শহিদের মা

শরীরের মধ্যে যেন কেঁপে উঠল। বিমলা চোখ বুজলেন। তাঁর যেন স্পষ্ট মনে হল, পেটের মধ্যে কী একটা নড়ে উঠল। চোখ বুজে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে পেটের মধ্যে নড়ে ওঠাটা অনুভব করতে চাইলেন। সামনের উনোনে তরকারি চাপানো, চড়বড় করে শব্দ হচ্ছে। জল নেই, এখুনি কড়ায় লেগে পুড়ে যাবে বিমলা তথাপি নড়তে পারলেন না। সমস্ত অনুভূতি দিয়ে নিজের গর্ভে যেন কান পেতে রইলেন, আর তাঁর বুকের মধ্যে যেন নিঃশব্দে বাজতে লাগল, বাদল! বাদল রয়েছিস?.পরমুহূর্তেই তাঁর শরীরটা আর একবার কেঁপে উঠল। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল। চোখ খুলে উনোন থেকে কড়াটা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চোখের দৃষ্টিতে একটা ব্যাকুল অস্থিরতা। বাইরের দিকে কান পেতে কিছু যেন শুনতে চাইলেন। তারপরে দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তরকারিটা ওভাবে ফেলে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। উনোনের কাছে নামানো কড়াটার দিকে একবার তাকালেন। কিন্তু বিমলা স্থির থাকতে পারলেন না। নষ্ট হয় তোক। কাঁচা থাকুক, ছাই হয়ে যাক। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রান্না ঘরের বাইরে এলেন।

আকাশে ঘন মেঘ। পুবে বাতাস বইছে। উঠোনের এক ধারে টগর গাছটা বাতাসের ঝাপটায় নুয়ে পড়ছে। এক বছরের শিউলি গাছটাও মাটিতে নুয়ে পড়তে চাইছে। বাড়িটা নিঝুম। কাঠের ফ্রেম, টিনের দেওয়াল, মাথায় টিনের চাল। মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই। তথাপি বিমলা যেন পা টিপে টিপে উঠোনে নেমে এলেন। পাশের বাড়িতে কণার মা যেন কাকে কী বলছে। বিমলা ফণিমনসার বেড়া ডিঙিয়ে সেদিকে একবার দেখলেন। কণাদের বাড়িটা দেখা যায়। লোকজন দেখা যায় না। তিনি চোখ ফিরিয়ে আবার ঘরের দরজা খোলা বাড়িটার দিকে তাকালেন। কারোর কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাতাসে তাঁর মাথার চুল কপালে পড়ছে। দূর থেকে দেখলে কাঁচা চুল বলে মনে হয়। কিন্তু পাক ধরেছে। চওড়া সিথেয় বাসি সিদুরের দাগ। হাতে শাঁখা নোয়া আর বিবর্ণ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি। শেমিজের ওপরে খয়েরি পাড়ের সাদা শাড়ি। ময়লা হয়েছে, হলুদের দাগ লেগেছে। প্রৌঢ় বয়সেও, শরীর বেশ শক্ত। মুখের রেখাতেই বয়সটা যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখলে মনে হয়, অল্প বয়সে সুশ্রী আর সবল ছিলেন। এখন তাঁর চওড়া শরীর যেন শক্ত আর কঠিন।

বিমলা কয়েক মুহূর্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরে সামনের দিকে না গিয়ে রান্নাঘরের পিছনে গেলেন। ফণিমনসার বেড়া ঘেঁষে বাড়ির পিছন দিকে এগিয়ে চললেন। ঘরগুলোর পিছন দিকের সব জানালাই বন্ধ। ঘর যেখানে শেষ, কোণে একটা জবা ফুলের গাছ। বিমলা দাঁড়ালেন। সামনে রাস্তা, উত্তর দক্ষিণে লম্বা। কলোনির রাস্তা, পাকা না, ঘেঁস ছাইয়ের রাস্তা। বিমলা উত্তর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। উত্তর দিকে রাস্তা যেখানে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে সেই দিকে তাকালেন। যেখানে মোড়ের এক পাশে কয়েকটা ইট এক জায়গায় এখনও জড়ো হয়ে পড়ে আছে, সেইখানটা দেখলেন। ওখানে শহিদ বেদি হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যে ভাঙতে ভাঙতে গোটা কয়েক ইটে এসে ঠেকেছে। কেউ তুলে নিয়ে গেলেই আর কোনও চিহ্ন থাকবে না। কারা বেদিটা ভাঙল, ইটগুলো কোথায় গেল, কেউ জানে না। বিমলা দেখেছেন, প্রথম প্রথম পাড়ার একটা কুকুর বেদিটার গা ঘেঁষে শুয়ে থাকত। এখন থাকে না। গোটা কয়েক ইট ছাড়া এখন আর কিছু নেই।

বিমলা আপন মনে মাথা নাড়লেন। তাঁর ঠোঁট নড়ল। না,বাদল ওখানে নেই। বাদলকে শ্মশানেই দাহ করা হয়েছিল। মাস তিনেক আগে, বেদিটা যখন তৈরি হল, তখন ওরা বিমলাকে ডাকতে এসেছিল, বাদলের মা বিমলা, শহিদের মা। তাই ওরা ডাকতে এসেছিল, ৰাদলের বন্ধুরা, পার্টির ছেলেরা। শুধু বিমলাকেই ওরা ডাকতে এসেছিল। এ বাড়িতে আর কাউকে না। বাদলের বাবাকে না, বাদলের দুই দাদাকেও না। বাদলের বাবা হরপ্রসাদ অন্য পার্টির লোক। দুই দাদা কৃপাল আর দয়াল, দুজনেই দুটো আলাদা আলাদা পার্টির মেম্বার। চারজন চার পার্টির লোক। বাদলের দলের ছেলেরা কেবল বিমলাকেই ডাকতে এসেছিল। শহিদের মাকে।

বিমলা গিয়েছিলেন। ওইখানে, ওই একটু দূরে, পশ্চিমের মোড়ে, রাস্তার ধারে, এখন যেখানে কয়েকটা ইট জড়ো হয়ে পড়ে আছে। শহিদ বেদির শেষ চিহ্ন। কেন গিয়েছিলেন বিমলা জানেন না। বাদলের পার্টির ছেলেরা এসে বলেছিল, মাসিমা আপনি একবার চলুন। বিমলা গিয়েছিলেন যেন ঘোর লাগা আচ্ছন্নের মতো। তার দুদিন আগে, আঠারো বছরের বাদলকে ওইখানেই কারা পিটিয়ে মেরেছিল। বিমলার চোখের সামনে এখনও স্পষ্ট। ক্ষতবিক্ষত বাদল। মুখে মাথায় শরীরের নানান জায়গায় রক্ত জমাট। নিথর বাদলকে এ বাড়ির উঠোনে ওরা নিয়ে এসেছিল। বাদল সব থেকে ছোট ছেলে। বিমলার শেষ সন্তান না। তারপরেও দুটি হয়েছিল, বাঁচেনি। বাদলের পরে আর কেউ ছিল না।

নিহত বাদলকে দেখে বিমলা একবার চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন। উঠোনে পড়ে বাদলকে একবার জড়িয়ে ধরেছিলেন। আপন মনেই কেঁদে উঠে বলেছিলেন, কো তোকে এমন করে মারল। ওরে বাদল।…উঠোন জুড়ে মানুষের মেলা। কিছুক্ষণ পরে চালিতে করে ফুল ছড়িয়ে মালা জড়িয়ে ওরা বাদলকে নিয়ে গিয়েছিল। হরি বল ধ্বনি দেয়নি। শ্লোগান দিয়েছিল। কমরেড বাদল, জিন্দাবাদ! খুন কা বদলা খুন।…কিন্তু বিমলা আর ভাল করে কাঁদতে পারেননি। ডাক ছেড়ে কান্না যাকে বলে, তেমন করে কাঁদতে পারেননি। সময়ে অসময়ে, কাজে অকাজে, হঠাৎ চোখে জল এসে পড়েছে। জল মুছেছেন।

দু দিন পরে ওই বেদিটা তৈরি হয়েছিল। বাদল যেদিন খুন হয়, সেদিন কলোনির স্কুলের মাঠে একটা সভা হচ্ছিল। অন্য কোনও দলের সভা, বাদলের না। সেখান থেকেই কী একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠেছিল। সঠিক কথা কেউ কিছু বলতে পারেনি। সন্ধের ঘোরে বাদলকে নাকি কারা তাড়া করেছিল। বাদল বাড়ির দিকে দৌড়েছিল। কিন্তু মোড় পেরিয়ে আসতে পারেনি। কেউ বলে, বাদল একলা ফিরছিল। ওর খুনিরা আগে থেকেই মোড়ে অপেক্ষা করছিল। আরও অনেক রকম কথা। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, বিমলা বুঝতে পারেন না। বাদলের চিৎকারে লোকজন ছুটে গিয়েছিল। যখন গিয়েছিল, তখন সব শেষ। রক্তাক্ত নিহত বাদল ছাড়া, সন্ধের ঘোরে সেখানে আর কাউকে দেখতে পাওয়া যায়নি। পুলিশ এসেছিল। বাদলের পার্টির লোকেরা নাকি কার নাম বলেছিল। তাদের কাউকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। হত্যাকারী বলে যাদের নাম করা হয়েছিল, তাদের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তারা এখন সকলেই জামিনে খালাস পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেস চলছে। কেস চলছে অথচ যেন ব্যাপারটা কিছুই না।

বাদল খুন হবার দু দিন পরে শহিদ বেদি তৈরি হয়েছিল। এই দু দিনের মধ্যেও ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছে। একটা দোকানঘর পুড়ে ছাই হয়েছিল। কেন, তা বিমলা জানেন না। বিমলা কেন শহিদবেদির কাছে গিয়েছিলেন তাও জানেন না। গিয়ে একবার দাঁড়িয়েছিলেন। পনের ষোলোটা ইট ধাপে ধাপে সাজিয়ে চুনসুরকি দিয়ে গাঁথা হয়েছিল। চুন দিয়ে লেপে সাদা বেদির গায়ে বাদলের নাম লেখা হয়েছিল। বিমলাকে ঘিরে বাদলের পার্টির ছেলেরা সেই একই শ্লোগান দিয়েছিল, কমরেড বাদল জিন্দাবাদ। খুন কা বদলা খুন.ইত্যাদি। কে একটি ছেলে যেন বাদলের নাম করে কী সব বক্তৃতা করেছিল। সব কথা বিমলার কানে যায়নি। তিনি আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। আবার আচ্ছন্নের মতোই বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধতে বসেছিলেন। বাড়িতে আর কেউ নেই। হরপ্রসাদ, কৃপাল, দয়াল খাবে, রান্না না করলে চলবে কেন। যেমন আচ্ছন্নের মতো গিয়েছিলেন, তেমনিভাবেই এসে রান্নার কাজে লেগেছিলেন। কিন্তু কারোর সঙ্গে কথা বলেননি। কৃপাল দয়ালের সঙ্গে না, হরপ্রসাদের সঙ্গেও না। হরপ্রসাদ নিজে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন। যেন খানিকটা আপন মনেই বলেছিলেন, কত দিন বলেছি, ওই দলটার সঙ্গে মিশিস না। কথা শুনলে তো।

বিমলা কোনও জবাব দেননি। হরপ্রসাদ তবু দাঁড়িয়েছিলেন। একটু থেমে, একটা নিশ্বাস ফেলে আবার বলেছিলেন, এখনকার এ সব পার্টি, খুনখারাপি ছাড়া কিছু জানে না। কিন্তু যার গেল, তার গেল, কেউ দেখতে আসবে না। বাদলকে তো আর ফিরে পাব না।

হরপ্রসাদ চুপ করেছিলেন। বিমলা কোনও জবাব দেননি। উনোনের দিকে ঝুঁকে বসেছিলেন। হরপ্রসাদ যেন একটা নিশ্বাস ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, যাই হোক, মনকে শক্ত করো। এ ছাড়া আর কী করবার আছে। আমার দেরি হয়ে গেছে, অফিসে চলে যাচ্ছি। খাবার একদম ইচ্ছে নেই।

হরপ্রসাদ চলে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনও কথা হয়নি। তবে এই তিন মাসে মাঝেমধ্যেই ওই কথাটা বলেছেন, মনকে শক্ত করো। বাদলকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

বিমলা সে কথার কোনও জবাব দেননি। সংসারের কথা বলেছেন। দৈনন্দিন জীবনে, কী দরকার, কী আনতে নিতে হবে, এই সব কথা। কিন্তু বাদলের বিষয়ে কোনও কথা বলেননি। কৃপাল দয়াল কোনও কথাই বিমলাকে বলেনি। কৃপাল চাকরি করে। দয়াল বেকার। ওরা ভিন্ন ভিন্ন দলের লোক। বাড়িতে ওরা নিজেদের মধ্যে কম কথা বলে। গামছা-তেল-সাবান, চান করার কথা বলে, সিনেমা থিয়েটারের কথাও বলে। দলের কথা একেবারে না। খিদে পেলে বিমলার কাছে শুধু খেতে চায়। দোকান বাজার করে দেয়। কী আনতে হবে না হবে, জিজ্ঞেস করে। বাদলের বিষয়ে কোনও কথা হয় না। যেন ওদের ভাই মরেনি। অন্য পার্টির একটা ছেলে মরেছে। হয়তো নিজেদের পার্টির লোকের সঙ্গে কথা হয়। বাড়িতে কোনও কথাই নেই।

বিমলা জবা গাছের গা ঘেঁষে ভাঙা বেদির দিকে দেখছেন। বাদল ওখানে নেই। বাদলকে শ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। কিন্তু বাদল আজ বিমলার সারা শরীরে জেগে রয়েছে। আজ উনিশে শ্রাবণ। আজ সেই দিন। এখন এগারোটা বাজে। আঠারো বছর আগে এই দিনে, এ সময়ে বাদল পৃথিবীর মুখ দেখবার জন্য বিমলার পেটে অশান্ত হয়ে উঠছে।

বাড়িতে তখন কেউ নেই। বিমলা একলা। পূর্ণ গর্ভ, যে কোনও সময়েই বাদল ভূমিষ্ঠ হতে পারে। এ সময়েই ব্যথা উঠেছিল। ডাক্তার কবিরাজের দরকার ছিল না। বিমলা নিঃশঙ্ক। তিনি সবই বুঝতে পারছিলেন। অভিজ্ঞতা তাঁর শরীরের প্রতিটি অনুভূতির মধ্যে। ব্যথা উঠতেই বুঝতে পেরেছিলেন, সেটা নিষ্ফল ব্যথা না। সময় আসন্ন। আঠারো বছর আগে এই দিনে, এই সময়ে উপরঝান্তি বৃষ্টি পড়ছিল। একেবারে একলা থাকা উচিত না। বিমলা কোনওরকমে পাশের বাড়িতে কণার মায়ের কাছে গিয়েছিলেন। ব্যথায় রুদ্ধ চুপি চুপি স্বরে বলেছিলেন, দিদি, আর সময় নেই।

কণার মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি সব কাজ ফেলে বিমলার সঙ্গে চলে এসেছিল। কণা তখন ছ সাত বছরের মেয়ে। তাকে পাঠিয়েছিলেন মেঘুর মা বিধবা বুড়িকে ডাকতে। আজকালকার মতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিমলাদের প্রসব হত না। মেঘুর মা-ই খালাস করাত। মেঘুর মা বুড়ি এসেছিল। বিমলাকে দেখেছিল। বলেছিল, হ্যাঁ, আসল ব্যথা। আর বেশি দেরি নেই।

কণার মা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর খালি করে দিয়েছিল। সেই ঘরেই বাদল হয়েছিল। তখন এ বাড়ির চেহারা অন্যরকম ছিল। টিনের দেওয়াল ছিল না। পাকা মেঝে ছিল না। হেঁচা বেড়ার দেওয়াল। মাথায় তখনও টিনের চাল, কাঁচা মাটির মেঝে। বিমলা রান্নাঘরে মাদুরের ওপর শুয়ে বসে ব্যথার তীব্রতা সহ্য করছিলেন। কণার মা কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তারও যেন ব্যথা উঠেছিল। বিমলা নিশ্বাস বন্ধ করে ব্যথা খাচ্ছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে স্থির থাকবার চেষ্টা করছিলেন। তার মধ্যেও ভেবেছিলেন, কী আসছে। ছেলে না মেয়ে। হরপ্রসাদের সাধ ছিল, মেয়ে হয় যেন। হরপ্রসাদের সাধ, বিমলারও সাধ। দুই ছেলের পরে একটি মেয়ে। কিন্তু তার শেষ গোঙানির সঙ্গে, যে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে ছেলে। মেঘুর মায়ের হাত, বিমলার পেটে চেপেছিল। তখনও ফুল পড়েনি, আর একটি ব্যথার অপেক্ষা। তার মধ্যেই, বিমলা লহমায় দেখে নিয়েছিলেন। রক্তে আর লালায় মাখানো একটি ছেলে। তখনও গলায় কান্না ফোটেনি। ছোটখাটো এক-আধটা গোঙানি মাত্র। ফুল পড়ার পরে প্রথম গম্ভীরস্বরে কেঁদে উঠেছিল, ওঁয়া ওঁয়া।

মেঘুর মা নাড়ি কাটতে কাটতে বলেছিল, কত বড়। যেন পেট থেকেই এক বছরের ছেলে বেরুলো। দেখে মনে হচ্ছে, মাতৃমুখী।

মাতৃমুখী। বিমলা আবার তাকিয়ে দেখেছিলেন। বুঝতে পারেননি। মেঘুর মায়ের কোলের দিকে তাকিয়েছিলেন আর হঠাৎই নিজের কোলটা বড় ফাঁকা মনে হয়েছিল। মেয়ে না হোক, নাড়ি ছেঁড়া ধন। কোলে নিতে ইচ্ছা করেছিল। সে কথা বলতে পারেননি। মনে মনে বলেছিলেন, মাতৃমুখী ছেলে সুখী হয়।

বাইরে তখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কণার মা বিমলাকে সাব্যস্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। দুধ গরম করে খেতে দিয়েছিল। মেঘুর মা নতুন শিশুকে গরম জল দিয়ে ধুয়ে মুছিয়ে, কাঁথায় মুড়ে বিমলার কোলে দিয়েছিল। বলেছিল, বুঝেছি রে বাপু। জলের তোড়ে এলি, বাপের যেন এরকম তোড়ে টাকা আসে। কী বাদুলে ছেলে বাবা, জগৎ ডোবানো বিষ্টি মাথায় করে এল।

জগৎ সংসার ভাসানো বৃষ্টিই বটে। উঠোনটা জলে থইথই করছিল। তখন রান্নাঘরের অবস্থাই বা কী। এখন তো, অনেক পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা। তখন মাথার ওপরে ক্যানেস্তারার গোঁজামিলের চাল। ঘরের এখানে সেখানে টপ টপ করে জল পড়ে। বিমলা একটা কোণ বেছে নিয়ে ছেলেকে বুকের কাছে ঢেকে শুয়েছিলেন। কণার মা চলে গিয়েছিল। তার তো সংসারের কাজ। মেঘুর মা ছিল। তার ওটাই কাজ। নবজাতককে বুকের কাছে নিয়েও কৃপাল দয়ালের কথা বিমলার মনে পড়েছিল। ওরা তখন স্কুলে গিয়েছিল। বিমলার দুশ্চিন্তা, যা দুরন্ত তাঁর ছেলেরা। বৃষ্টি মাথায় করে, স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়েছে কি না কে জানে। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হলে, মাস্টারমশাইরা কি আর ধরে রাখতে পারবে। হরপ্রসাদের কথা মনে পড়েছিল। অফিসে যাবার ইচ্ছা ছিল না। বিমলা-ই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হরপ্রসাদ বাড়িতে থেকে কী করবে। খানিকটা ছটফট করা ছাড়া করার কিছুই নেই। তার চেয়ে অফিসের কাজে থাকলে ভাল থাকবে। এদিককার ব্যবস্থা যা করবার বিমলাই করে রেখেছিল। কণার মাকে খবর দেওয়া। মেঘুর মাকে ডেকে নিয়ে আসা। এমন কিছু হাতিঘোড়া ব্যাপার তো নয়। পোয়াতি মেয়েমানুষ ছেলে বিয়োবে, তার জন্য পাড়া দূরের কথা, বাড়ি মাথায় করার কিছুই নেই। ভালভাবেই সব হয়ে গিয়েছিল। কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে, আশেপাশের কেউ নতুন ছেলের কান্নাও শুনতে পায়নি।

বিমলা নবজাতককে স্তন চেনাবার চেষ্টায় মুখের কাছে ছুঁইয়ে দিচ্ছিলেন। প্রথমটা একটু ধরিয়ে দিতে হয়। শিশুর মুখের দিকে চেয়ে ভেবেছিলেন, এটি আবার কেমন হবে, কে জানে। সকলের বেলাতেই এই কথাটি মনে হয়েছে। কৃপাল দয়ালের বেলাতেও। সব মায়ের কি এমনি মনে হয়? কে জানে। কৃপাল দয়ালের পরে আরও দুটি হয়েছিল। তারা বেঁচে নেই। এটি কী করবে, কে জানে। ভাবতে ভাবতে, বুকের কাছে আরও চেপে ধরেছিলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন। মেঘুর মা বলেছে, মাতৃমুখ। বলেছে, খুব দুষ্টু হবে এই ছেলে। মাতৃমুখী ছেলে কেবল সুখী হয় না, দুষ্টুও হয়। কী দুষ্টুমি করবে? বিমলাকে জ্বালাতন করবে?

বিমলা মনে মনে হেসেছিলেন। কোন ছেলেটা না জ্বালিয়েছে। কৃপাল দয়াল যে রকম দুরন্ত, এও সেইরকম হবে। একই গাছের ফল তো। তা হোক, ছেলেপিলে তো দুরন্ত হবেই। তার জন্য বকুনি খাবে, মার খাবে, আবার ভুলেও যাবে। কৃপাল দয়াল যেরকম করে। ওদের দৌরাত্ম্যে এক এক সময় অস্থির হয়ে পড়েন। তখন না মেরে উপায় থাকে না। এও দুষ্টুমি করলে মার খাবে।

নবজাতক কেঁদে উঠেছিল। বিমলা মনে মনে হেসেছিলেন, বলেছিলেন, এখন তো মারছি না, কাঁদছিস কেন। বড় হ, তখন দেখব।

বলতে বলতে বুকের কাছে তুলে, স্তন গুঁজে দিয়েছিলেন। সদ্যোজাত শিশু তা নিতে পারেনি। তখন দুধেতে পলতে ভিজিয়ে মুখে দিয়েছিলেন। চুষে চুষে খেয়েছিল। বিমলা কোনও কথাই ভোলেননি। এই তত যেন সেদিনের কথা। প্রত্যেকটা কথাই স্পষ্ট মনে আছে। কৃপাল দয়ালের কথাও মনে আছে। ওরা জন্মেছিল পদ্মার ওপারে, নিজেদের ভিটেয়। বাদল এই বাড়িতে জন্মেছিল।

বৃষ্টি একটু ধরতেই, কাক ভেজা হয়ে, কৃপাল আর দয়াল বাড়ি এসেছিল। আঁতুড় মানতে চায়নি, আগেই ভাইকে দেখতে এসেছিল। দয়াল তো বায়না ধরেছিল, সে ভাইকে কোলে নেবে। মেঘুর মা ধমক দিয়েছিল। বিমলা সস্নেহে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে নিরস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, কাল চান করবার আগে ভাইকে কোলে নিস।

সন্ধেবেলা হরপ্রসাদ বাড়িতে এসে আগেই আঁতুড়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। গলা খাঁকারি দিয়েছিলেন। দরজাটা বন্ধ ছিল। বিমলা বুঝতে পেরে মেঘুর মাকে বলেছিলেন, কৃপার বাবা এসেছে, দরজাটা খুলে দাও।

মেঘুর মা দরজা খুলে দিয়েছিল। হরপ্রসাদ বিমলাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কেমন আছ?

বিমলা সে কথার কোনও জবাব দেননি। হ্যারিকেনের আলোর সামনে ছেলেকে তুলে ধরেছিলেন। হরপ্রসাদ গম্ভীরভাবে শব্দ করেছিলেন হুম! তারপরে হঠাৎ হেসে বলেছিলেন, রূপবান ছেলে হয়েছে মনে হচ্ছে। এ ব্যাটা বাপের মতো হয়নি।

বিমলা ও-সব কথা ভোলেন না। সব কথা মনে থাকে, আছেও। হরপ্রসাদ কেন ও কথা বলেছিলেন, তাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। একবার হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বাপের খুশি মুখ দেখলে বোঝা যায়। হরপ্রসাদ খুশিই হয়েছিলেন। বিমলা একটু গর্ব বোধ করেছিলেন। ভেবেছিলেন, এই মুখ দেখে হরপ্রসাদ এখন আর মেয়ের কথা মনে রাখেনি।

মেঘুর মা বলেছিল, রূপবান তো হবেই, মাতৃমুখ যে।

তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। হরপ্রসাদ রান্না ঘরের দরজায় ছাতা মাথায় দিয়েই দাঁড়িয়েছিলেন। নামটা তখনই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ব্যাটা জবর বাদুলে, একেবারে বাদলা।

ইতিমধ্যে বীণা এসে পড়েছিল। কলোনিরই বিধবা মেয়ে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। বিমলার প্রসব হলে সে রান্না বান্না করবে। বীণা বড় ঘরের বারান্দায় রান্না চাপিয়েছিল। হরপ্রসাদ কৃপাল আর দয়ালকে নিয়ে গল্পে মেতেছিলেন। সেদিন আর ওদের পড়তে বসতে বলা হয়নি। বিমলা সবই শুনতে পাচ্ছিলেন। এদিকে মেঘুর মা নানানখানা বকবক করছিল। বিমলা বুকে সন্তান নিয়ে কেমন একটা নিবিড় স্বস্তি বোধ করছিলেন।

আজ সেই দিন। আঠারো বছর আগের সেই দিন এখন, বেলা এগারোটা। চুপ করে বসে, চোখ বুজলে, বিমলা চমকে চমকে উঠছেন। পেটের মধ্যে যেন কিছু নড়েচড়ে উঠছে। বাদল নাকি? বাদল! ঘরের কোণে জবা গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন বিমলা। ভাঙা শহিদ বেদির দিকে তাকিয়ে চোখ বুজলেন। হ্যাঁ, আবার, আবার মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে জ্বণ নড়ছে। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে, বুকের কাছে হাত দুটো জড়ো করলেন। এ আবার কী, এরকম মনে হচ্ছে কেন? সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা তাঁর, অনেককাল গত হয়েছে। আজ কে এমন করে তাঁর গর্ভের মধ্যে নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে। বাদল কি তাঁর শরীরের মধ্যে মিশে আছে। তিনি মনে মনে ডাকলেন, বাদল, বাদল।

মা! ও মা।

কৃপালের গলা। কৃপাল ডাকছে, বিমলা সাড়া দিলেন না, নড়লেন না। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মুখ শক্ত হয়ে উঠল। সমস্ত শরীরটাই শক্ত হয়ে উঠল। দৃষ্টি, ভাঙা শহিদ বেদির দিকে। ছেলেদের ডাকে কোনও দিন সাড়া দিতে ভোলেন না। আজ বিমলার মুখে সাড়া নেই। আজ তিনি সাড়া দেবেন না।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে তাঁর মনে পড়ল, কৃপাল দয়াল ভাইকে নিয়ে ছেলেবেলায় কেমন খেলা করত। কৃপাল-দয়াল পিঠোপিঠি ছিল। বাদলের বয়স কম ছিল। মাঝখানে দুজন মারা গিয়েছিল। দয়ালের প্রায় সাত বছরের ঘোট বাদল। বাদলকে ওরা কোলে করে বেড়িয়েছে। মায়ের কাজের সময় দেখাশোনা করেছে। ছোট্ট ভাইকে কিছু না দিয়ে দুজনে দুখে তুলত না। পিঠোপিঠি হলে তা হত না। কৃপাল দয়ালের তো রোজ ঝগড়া মারামারি লেগে ছিল। ওরা দুজনে ছিল সমানে। ওদের মারামারি থামাতে বিমলাকে লাঠি তুলতে হত। হরপ্রসাদও শাসন করতেন। কিন্তু বাদলকে নিয়ে দুজনেই কাড়াকাড়ি। সব কথাই মনে আছে বিমলার। বাদল যখন কথা বলতে শিখেছিল তখন কৃপাল দয়াল জিজ্ঞেস করত, বাদল কাকে বেশি ভালবাসে। কার কাছে থাকতে চাইত। লোভী শিশু, সে বুঝতে পারত, কাউকেই সে হারাতে চায় না। দুই দাদারই মন জুগিয়ে কথা বলত। বিমলা আড়ালে মুখ টিপে হাসতেন, মনে মনে বলতেন, একফোঁটা ছেলের চালাকি দেখ।

হরপ্রসাদও ছোট ছেলেটিকে ভালবাসতেন। কৃপাল দয়াল যত না আদর কাড়তে পেরেছে, কোলে চাপতে পেরেছে, বাদল সব কিছুই বেশি পেয়েছে। কিন্তু সে সবই ছেলেবেলার কথা। তখন সংসারের চেহারা ছিল অন্য রকম। হরপ্রসাদ চাকরি করতেন আর প্রকাশ্যেই রাজনীতি করতেন। অবসর সময়ে, নিজের দল নিয়ে মেতে থাকতেন। বিমলার তাতে কোনওদিন কিছু যায় আসেনি। পুরুষ মানুষ কত কী নিয়ে থাকে। মেয়েদের সে সব ভাবতে গেলে চলে না। বিমলা বরং মনে মনে খুশিই ছিলেন। হরপ্রসাদ দশজনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সভা-সমিতি করছে। তবু নেশা ভাঙ করে বাজে আড্ডায় তো সময় নষ্ট করে না। টাকাও নষ্ট করে না। সবাই হরপ্রসাদ বলে ডেকে নিয়ে যায়। পাড়ার একজন গণ্যমান্য লোক বাইরে বাইরের মতো, সংসারে সংসারের মতো। স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে, গরিব কবিত্তের জমজমাট পরিবার।

আস্তে আস্তে কৃপাল দয়াল বড় হয়ে উঠতে লাগল। ওদের পিছনে বাদল যত বড় হয়ে উঠতে লাগল সবাই যেন কেমন বদলে যেতে লাগল। বাদল দাদাদের সঙ্গ আর পাচ্ছিল না। ওরা তখন বাইরের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। ওদের কোথায় কী দল, বন্ধু, সেসব নিয়েই ব্যস্ত। বাড়িতে ওদের দেখা পাওয়া ভার। বাদলও ওর জগৎ খুঁজে নিয়েছিল। ওরও বন্ধু ছিল, খেলাধূলা ছিল। বিমলা এ সব দেখেছেন, বিশেষ করে কখনও কিছু ভাবেননি, বরং মনে হয়েছে, এরকমই হয়। সকলেরই হয়। বড় হচ্ছে তো সব। সকলেই যে যার আলাদা পথে ফিরছে।

কেবল হরপ্রসাদ বিরক্ত হচ্ছিলেন। কখনও রাগ, কখনও ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছিল। বিশেষ করে কৃপাল আর দয়ালের ওপরে। বিমলা হরপ্রসাদের কাছেই শুনতেন, কৃপাল দয়াল কলেজে ঢুকে নাকি রাজনীতি করছে। ছাত্ররা সবাই করে। কৃপাল দয়ালের কী দোষ বিমলা ভেবে পেতেন না। একটা কথা বুঝতে পারতেন, হরপ্রসাদ যে রাজনীতি করে কৃপাল দয়াল তা করে না। বিমলা বলতেন, কলেজে ওরা কী করছে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?

হরপ্রসাদ রেগে জবাব দিতেন, ও সব রাজনীতির নামে গুণ্ডামি। আমার পয়সায় কলেজে পড়ে ও সব চলবে না। তোমার ছেলেদের এ কথা জানিয়ে দিও।

হরপ্রসাদের কথার ধরনে বিমলা মনে মনে রুষ্ট হতেন। আবার ভাবতেন, বাবা যে রকম বলে ছেলেদের সে রকম চলাই উচিত। তা হলে আর সংসারে কোনও গোলমাল থাকে না। কৃপাল দয়ালকে তিনি বলেছেন, কলেজে যাস পড়তে, সেখানে আবার ওসব কী। তোদের বাবা পছন্দ করে না।

ওদের এক জবাব, ওসব তুমি বুঝবে না মা।

একমাত্র বাদলকে নিয়ে তখন কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। হরপ্রসাদেরও কোনও অভিযোগ ছিল না। মায়ের সঙ্গেই বাদলের ভাব বেশি। সংসারের কাজে কর্মে, বাদলকেই পেতেন। বকে ধমকেই করাতে হত, তবু করত। কিন্তু দিনে দিনে সংসারের চেহারাটা বদলে যাচ্ছিল।

কৃপালের সঙ্গেই প্রথম হরপ্রসাদের লাগল। বাইরের বিবাদ ঘরে এসে ঢুকেছিল। কেবল তর্কাতর্কিতেই সব শেষ হত না। হরপ্রসাদ খেপে উঠতেন। খেপে উঠে যা তা বলতেন। কৃপাল মাথা নোয়ত না। সে হরপ্রসাদের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে থাকত। বিমলা এসে কৃপালকে সরিয়ে দিতেন, সরে যা এখান থেকে। বাপের মুখে মুখে কথা বলতে লজ্জা করে না!

বিমলা হরপ্রসাদের ওপর খুশি হতেন না। কৃপাল তো ওঁর ছেলে, বাইরের শত্রু না। কিন্তু কথা শুনলে সেই রকমই মনে হত। কেবল কৃপালের সঙ্গে না, দয়ালের সঙ্গেও হরপ্রসাদের একই ব্যাপার ঘটত। বিমলা মনে করতেন, কৃপাল দয়াল একই দল করে।

বিমলার সে ভুল ভাঙতেও দেরি হয়নি, যখন দেখেছিলেন, দুজনের মধ্যে তর্ক ঝগড়া। নিতান্ত বাড়ির মধ্যে, আর বিমলা সামনে থাকতেন বলে ওরা মারামারিটা করতে পারত না। এত দলাদলি কীসের, বিমলা বুঝতে পারতেন না। সবাই মিলে একটা দল করলেই তো সব মিটে যায়। কিন্তু বাড়িতে তখন তিনটে দল। হরপ্রসাদ, কৃপাল, দয়াল। আর এক দলে বিমলা আর বাদল। তবে বাদল একেবারে নিরপেক্ষ ছিল না। ছোড়দা দয়ালের দিকে ওর টান বেশি। বলত, ছোড়দা ঠিক বলে।

বিমলা জিজ্ঞেস করতেন, কেন?

বাদল বলত, আমাদের স্কুলের সব ওপর ক্লাসের ছেলেরা ছোড়দাকে মানে। ছোড়দা গেটে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলে সব ছেলেরা ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসে।

তুই বুঝি ছোড়দার মতো হবি!

সে বিষয়ে বাদল কিছু বলত না। ওর জবাব ছিল, তা আমি কী করে জানব।

 বিমলা বলতেন, তুই ওসবের মধ্যে যাসনি। দেখছিস না, বাড়িতে কী রকম অশান্তি।

যত দিন যাচ্ছিল, অশান্তির চেহারাটা বদলে গিয়েছিল। হরপ্রসাদ, কৃপাল, দয়াল কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলত না। বিমলা রান্নাবান্না করেন, ওরা এসে খায়। রাত্রে শোয়। কৃপাল দয়াল রোজ রাত্রে বাড়িতেও থাকত না। পড়াশোনা হচ্ছিল না। কৃপাল একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়েছিল। দয়ালেরও সেই অবস্থা। পড়া হবে না। কিন্তু কেবল পার্টি করলে চলবে না। ওরও একটা চাকরি চাই।

ইতিমধ্যে বাদল বড় হয়ে উঠেছিল। ক্লাস টেনে পড়বার সময় ওর টাইফয়েড হয়েছিল। বিমলার ভেতরটা ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল। নানা অশুভ চিন্তা তাঁর মাথায় এসেছিল। এতখানি বড় বয়সে কোনও সন্তান তাঁকে হারাতে হয়নি। এমন ভারী রোগও কারোর হয়নি। তখন দেখা গিয়েছিল, কৃপাল ডাক্তার ডেকে এনেছিল। দয়াল বসে বসে বাদলের মাথায় বরফ দিয়েছে। রক্ত বিষ্ঠা পরীক্ষা করবার জন্য নিয়ে গিয়েছে। হরপ্রসাদ উদ্বিগ্ন মুখে, বাদলের বিছানার সামনে বসে থেকেছেন।

তখন তো বাদল কোনও পার্টি করে না। করলে কী চেহারা হত, কে জানে।

বিমলার চোখের সামনে ভেসে উঠল শ্মশানযাত্রার ছবি। এ বাড়ির উঠোন থেকেই, ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাদলকে শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহ ঘিরে ছিল বাদলের বন্ধুরাই, ওর পার্টির লোকেরা। কৃপাল দয়াল সেখানে এসে দাঁড়ায়নি। বোধহয় দাঁড়াতে পারেনি। হরপ্রসাদ একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে কেউ একটা কথা বলেনি। তিনিও বলেননি। বাদলকে ওর বন্ধুরাই কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিল। বাবা নয়, ভাইয়েরা নয়, পার্টির ছেলেদের কাঁধে, বাদলের মৃতদেহ শ্মশানে গিয়েছিল। হরপ্রসাদ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। দাদারা বাড়িতে ছিল না।

টাইফয়েডের সময়, বাদল যদি পার্টি করত, তা হলে কী হত কে জানে। শ্মশানযাত্রার মতোই হয় তো, বাবা দাদারা দূরে সরে থাকত। পার্টির কাছে বাবা ছেলে ভাই বলে কিছু নেই। পার্টির পরিচয়ই একমাত্র পরিচয়। একে কেমন পার্টি করা বলে, বিমলা বোঝেন না। বিমলা শুধু সংসারটা মাথায় করে রেখেছেন।

কিন্তু পাটিই তা হলে সব। বিমলার চোখে যেন আগুনের আঁচ লাগে। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর দৃষ্টি ফিরে আসে শহিদ বেদি থেকে। তিনি বাড়ির দিকে ফিরে তাকান। ঘাড় ফিরিয়ে, পিছনে তাকিয়ে গোটা বাড়িটাকে যেন একবার দেখে নেবার চেষ্টা করেন।

.

কোথায় গেলে, অ্যাঁ? শুনছ।

হরপ্রসাদের গলা। বিমলাকে ডাকছেন। বিমলা সাড়া দিলেন না। মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আবার তাকালেন ভাঙা শহিদ বেদির দিকে। তাঁর মনে পড়ল, আজ যেন কীসের ছুটি। কৃপাল, হরপ্রসাদ কেউ-ই কাজে যায়নি। কিন্তু বিমলা সাড়া দেবেন না। আজ আর এ সময়ে তিনি সাড়া দিতে পারছেন না। তাঁর ভিতরে কী যেন ঘটছে। আঠারো বছর আগে, এই দিনে, এই সময়ে যা ঘটেছিল, তাঁর সারা শরীরে যেন সেই ভাব। ওই বেদিতে না, শ্মশানে না, বাদল যেন তাঁর ভিতরে রয়েছে। বাদল পৃথিবীতে আসতে চাইছে।

বাদল যখন টাইফয়েড থেকে সেরে উঠেছিল, তখন ছেলেটা বড় রুগ্ণ হয়ে গিয়েছিল। মনে হত, ওকে শিশুর মতো কোলে নেওয়া যায়। প্রায় একটা বছর পড়া নষ্ট হয়েছিল। তা হোক, তবু প্রাণে বেঁচেছিল, বিমলার সেটাই সান্ত্বনা। কৃপাল দয়ালের অসুখ হলেও সেই রকমই হত। হরপ্রসাদের অল্পস্বল্প অসুখ করলেও বিমলা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। লোকটা যাই করে বেড়াক, শরীরের দিক থেকে খুব শক্ত না। তা ছাড়া, হরপ্রসাদই তো একমাত্র কাণ্ডারি। স্বামীকে তিনি কখনও কোনও কারণে অযত্ন করেননি।

বাদল রুগণতা কাটিয়ে আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠেছিল। আগের মতো স্বাস্থ্য না, তার চেয়েও যেন সুন্দর হয়ে উঠেছিল। ও বরাবরই একটু কথা কম বলত। বিমলার মতো। বিমলা কথা কম বলেন। বেশি বলবার অবকাশ এ সংসার তাঁকে দেয়নি। সারাটা সংসার তাঁর মাথায়। স্বামী পুত্রদের খাওয়া-দাওয়া দেখা-শোনা। বাসন মাজা আর ঘর পরিষ্কার করা ছাড়া, সবই তাঁর নিজের হাতে।

বাদল কথা কম বলত। বিমলা মনে করতেন, বাদল, কৃপাল দয়ালের পথ ধরবে না। বাড়িতে তিনটি পার্টির লোক। কারোর সঙ্গে কারোর সদ্ভাব নেই, কথাবার্তা বন্ধ। বাদল সব দেখেছে শুনেছে। দেশে শুনে ও আর ও পথে যাবে না।

বিমলা ভুল ভেবেছিলেন। কলেজে ঢোকবার আগেই বিমলার কানে এল, বাদল আর একটা পার্টিতে ঢুকেছে। বিমলা বলেছিলেন, তুইও ওসব পার্টি করতে যাচ্ছিস।

বাদলের কথা কম। সে মায়ের কথার জবাব দেয়নি। কিন্তু হরপ্রসাদ ছাড়েননি। কৃপাল দয়ালের সঙ্গে যে রকম ঝগড়া করেছেন, তেমনই করেই বাদলকে বকেছেন, ধমকেছেন। বলেছেন, তুই গিয়ে একটা খুনি পার্টির সঙ্গে জুটেছিস।

বিমলা অবাক হয়ে শুনেছিলেন, বাদল ওর বাবাকে বলছে, আমাদের পার্টি খুনি পার্টি না।

হরপ্রসাদ চিৎকার করে বলেছেন, আলবত খুনি পার্টি। কতগুলো গুণ্ডা বদমাইস লোচ্চা ছাড়া ও পার্টিতে কোনও ছেলে নেই। তুই আমাকে শেখাতে আসিস না।

বাদল বলেছিল, আমি কাউকেই কিছু শেখাতে যাচ্ছি না।

বিমলার মনে হয়েছিল, বাদলকে তিনি যেন চিনতে পারছেন না। ও শান্ত আর গম্ভীর ভাবে ওর বাবার কথার জবাব দিচ্ছিল। কৃপাল দয়ালের মতো গলা চড়িয়ে, উত্তেজিত হয়ে কথা বলেনি। বিমলা

অবাক হয়ে ভেবেছিলেন, বাদল কবে থেকে ওরকম কথা বলতে শিখল। ও যেন কত বড় হয়ে গিয়েছে, কত কী বোঝে। অবাক হওয়ার সঙ্গে, একটু একটু রাগও হয়েছিল। বাদল যদি ছেলেমানুষের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করত, তা হলেই যেন বিমলা খুশি হতেন। অথচ, আবার, বাদল ওরকম করে কথা বলেছিল বলে, একটা কেবল গর্ববোধও করেছিলেন।

কিন্তু হরপ্রসাদ দু রকম কথা জানতেন না। ঠিক যেমন ভাবে কৃপাল দয়ালকে বলেছিলেন, তেমনি ভাবেই বাদলকে বলেছিলেন, ওসব কোনও কথা আমি শুনতে চাই না। এ বাড়িতে থাকতে হলে, তোকে ওই পার্টি ছাড়তে হবে।

হরপ্রসাদের এ ধরনের কথা, বিমলার কখনও ভাল লাগে না। মানুষটা কথায় কথায় বাড়িতে থাকার খোঁটা দেয় কেন। বাদল ওর বাবার সে কথার কোনও জবাব দেয়নি। সামনে থেকে সরে গিয়েছিল। হরপ্রসাদ নিজের মনেই গজগজ করছিলেন, যারা দেশ গড়তে জানে না, কেবল ধ্বংস করতে চায়, তাদের আমি আমার বাড়িতে চাই না। তারা যে যার নিজের রাস্তা দেখে নিক গিয়ে…। এমনি অনেক কথা বলেছিলেন। বিমলাও হরপ্রসাদের সামনে থেকে সরে গিয়েছিলেন। লোকটা কেবল বকতে ধমকাতেই জানে। কখনও দেখা গেল না, মাথা ঠাণ্ডা করে ছেলেদের কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। যেমন কৃপাল দয়ালের সঙ্গে করেছে, বাদলের সঙ্গেও সেই এরকম করে কথা বলেছিল।

বিমলার বুক ভরা অশান্তি আর উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত বাদলের ওপরেই তাঁর রাগ হয়েছিল। সংসারে এত কিছু থাকতে পার্টি ছাড়া, আর কি কিছু করার নেই। বাদলটাও শেষ পর্যন্ত সেই একই পথে চলে গেল। তিনি বাদলকে বলেছিলেন, তুই লেখাপড়া করবি, খাবি দাবি খেলা করবি। তুই কেন আবার পার্টি করতে গেলি?

বাদল শান্তভাবেই বলেছিল, আমি তো কারোর কোনও ক্ষতি করছি না।

বিমলা রেগে বলেছিলেন, ওসব ক্ষতি-উতি জানি না। একটা সংসারের মধ্যে, তোরা সব এক একটা পার্টি নিয়ে থাকবি, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করবি, এ সব আর আমি সহ্য করতে পারছি না। তুই ওসব পার্টি-টার্টি ছাড়।

বাদল গম্ভীরভাবে বলেছিল, আমি বাড়িতে কারোর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে চাই না। পার্টি আমি ছাড়তে পারব না।

বিমলা বলেছিলেন, তা ছাড়বি কেন। তা হলে যে আমার একটু সুখ হয়। বুঝেছি রে, বুঝেছি, আমি না মরলে তোরা বাপ ভাইয়েরা কেউ পার্টি ছাড়বি না। এ আমি কোথায় আছি। এটা কি একটা সংসার। কতগুলো পার্টি ছাড়া এ বাড়িতে কিছু নেই।

বিমলার গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল। চোখে জল এসে পড়েছিল। আবার বলেছিলেন, এবার আমাকেও একটা পার্টিতে গিয়ে ঢুকতে হবে।

মায়ের কথা শুনে বাদল বোধহয় একটু বিচলিত হয়েছিল। বলেছিল, তুমি এ রকম করছ কেন। বলেছি তো, আমি বাবা দাদাদের কারোর সঙ্গে লড়তে যাচ্ছি না।

কিন্তু বাদলের সেকথা টেঁকেনি। কখনও কৃপাল, কখনও দয়াল, কখনও বা হরপ্রসাদের সঙ্গে, তর্কাতর্কি বিবাদ লেগেই ছিল। বাইরের অশান্তি বাড়িতে দানা বেঁধে উঠেছিল। বাইরের যত গোলমাল, বাড়িতে এসে তার বোঝাঁপড়া চলছিল। সকলেই আলাদা আলাদা করে, বাদলের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করছিল। বিমলা সেই সব কথা থেকেই বুঝতে পারতেন, বাদল রীতিমতো পার্টির কাজ করছে। লেখাপড়া ওর মাথায় ছিল না।

প্রথম কৃপালই একদিন বিমলাকে বলেছিল, বাদলা খুব বেড়ে উঠেছে। ওকে সাবধান করে দিও। কোনদিন একটা কী ঘটে যাবে, তখন আর কিছু করার থাকবে না।

বিমলা বলেছিলেন, আমাকে বলতে এসেছিস কেন। নিজের ভাইকে নিজেরা বোঝাতে পারিস না।

ও বোঝবার বাইরে চলে গেছে।

বিমলা তিক্ত করেই জবাব দিয়েছিলেন, আর তোরা বুঝি ভেতরে আছিস। তুই নিজে পার্টি ছাড়তে পারিস না?

কৃপাল বলেছিল, আমার যা বলবার বলে দিলাম। বাদলা আগুন নিয়ে খেলা করছে। রোজ মাস্তানি আর মারামারি করে বেড়াচ্ছে।

সকলেরই সকলের বিরুদ্ধে এক অভিযোগ। বিমলার সামনে এসে কৃপালই যে কেবল বাদলের বিরুদ্ধে শাসিয়েছে, তা না। দয়ালও একইভাবে শাসিয়েছে। বিমলার সব থেকে অবাক লেগেছিল, হরপ্রসাদও যখন একরম ভাবেই শাসিয়েছে। বলেছে, তোমার ছোট ছেলেকে বলে দিও, এখনও সময় আছে। ও যেন সাবধান হয়ে যায়। ওর বড় পাখনা গজিয়েছে। ও পাখনা পুড়ে যাবে।

বিমলার বুকের মধ্যে সেদিন একবার কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু হরপ্রসাদের ওপর রাগও হয়েছিল। বলেছিলেন, নিজের ছেলেকে নিজে বোঝাতে পারো না। তুমি তো আর ছেলেমানুষ নও। তুমি পার্টি ছাড়তে পারো না? তারপরে ছেলেকে বলতে পার না? সবাই এসে আমার কাছে বলছ?

হরপ্রসাদ বলেছিলেন, তুমি ওসব বুঝবে না। আমার পার্টি ছাড়ার কিছু নেই। আমি ওদের মতো গুণ্ডা পার্টি করছি না। কিন্তু বাদলা যেভাবে বাড়িয়ে তুলেছে, ও একটা কিছু না ঘটিয়ে ছাড়বে না।

বিমলা তিক্ত রাগে বলেছিলেন, আমাকে ওসব কথা বলে লাভ নেই। আমি তোমাদের সংসারে একটা দাসী বাঁদী আছি। তোমাদের খেসমত খাটছি। আর তোমরা লড়াই করছ। এবার আমাকে তোমরা রেহাই দাও।

বিমলা হরপ্রসাদের কাছ থেকে সরে গিয়েছিলেন। শুনেছিলেন, তারপরেও হরপ্রসাদ আপনমনে বকবক করছিলেন, বাদলার মরণ ধরেছে। পার্টির নেতাদের উসকানিতে, ও নিজেকে কী একটা ভাবতে আরম্ভ করেছে।

বিমলার বুকের মধ্যে আবার কেঁপে উঠেছিল। বাবা হয়ে হরপ্রসাদ কেমন করে বলেছিল, ছেলেটার মরণ ধরেছে। কেবল বাদলের বেলায় না। হরপ্রসাদ সকলের বেলাতেই ও কথা বলেছেন। কৃপাল দয়ালের কথাতেও বলেছেন, ওদের মরণ ধরেছে। হরপ্রসাদ কি ছেলেদের বাবা নয়? পিতৃত্বের থেকেও পার্টি কি বড়? ওদের কি ভ্রাতৃত্ব বলতে কিছু নেই? পার্টি কি তার ওপরে? এই সংসারের মাঝখানে বসে, এ কথাটা কোনওদিন তিনি বুঝতে পারেননি। কেবল ভেবেছেন, তাঁর ঘরে কেন এত অশান্তি? বাপছেলেরা মিলে, একটা সুখের সংসার কি ওরা গড়তে পারত না। তার বদলে ওরা এক একজন, এক একজনের বিরুদ্ধে কেবল মরণ ধরাটাই দেখতে পেয়েছে।

বিমলা বাদলকে বলেছিলেন, তোর বাবা দাদারা সবাই তোর নামে নালিশ করছে। তুই কি একটা বিপদ আপদ না ঘটিয়ে ছাড়বি না?

বাদল বলেছে, বিপদ আপদ আবার কী। ওরা চায়, ওরা পার্টি করবে, আমি চুপচাপ বসে থাকব। তা আমি থাকব কেন? ওদের শাসানিকে আমি কাঁচকলা ভয় পাই। বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করতে এলে, আমরাও ছেড়ে কথা বলব না।

বিমলা তবু ধমকে বলেছেন, তুই কেন ওদের সঙ্গে লড়তে যাস?

 বাদল বলেছিল, আমি কেন লাগতে যাব। ওরাই আমাদের সঙ্গে লাগতে আসে।

কেন, তুই বাবা দাদাদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে পারিস না?

বাবা দাদারা বুঝি মিলে মিশে আছে? পার্টির ব্যাপারে কারোর সঙ্গে কারোর মিল মিশ হবে না। একটু চুপ করে থেকে, আবার বলেছে, পার্টির সঙ্গে আমি বেইমানি করতে পারব না। তা বাবা আর দাদারা আমাকে যতই শাসাক। সবাই তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে, আমার বেলাতেই খালি শাসানি। আমি কারোর পরোয়া করি না।

বিমলা তারপরেও মোক্ষম কথাটি বলতে ছাড়েননি, বাপের অমতে এ সব করছিস। এর পরে যদি তোর বাবা তোকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে?

বাদল অনায়াসে জবাব দিয়েছে, বের করে দেয়, চলে যাব। তা বলে বাবাকে, বাবার পার্টিকে সমর্থন করতে পারব না।

বিমলা যেন শাঁখের করাতের তলায় পড়েছিলেন। কোনওদিকে তাঁর শান্তি ছিল না। স্বামী পুত্রদের কারোকে তিনি বোঝাতে পারেননি। সংসারের মধ্যে চারটি পার্টির লড়াই চলছিল। এক সঙ্গে বাবা ছেলেদের খাওয়া উঠে গিয়েছিল। যদি বা কোনওদিন সবাইকে এক সঙ্গে খেতে দিতেন, কেউ কারোর সঙ্গে একটি কথা বলত না। কলের পুতুলের মতো, সবাই নিঃশব্দে খেয়ে উঠে যেত।

মা। মা কোথায় গেলে?

এখন দয়াল ডাকছে। এর আগে কৃপাল ডেকেছে। হরপ্রসাদও ডাকাডাকি করেছে। বিমলা কোনও সাড়া দেননি। এবারও সাড়া দিলেন না। ওদের সকলের ডাকে চিরদিন সাড়া দিয়ে এসেছেন। আজ তিনি ওদের ডাকে সাড়া দেবেন না। এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই মোড়ের অবহেলিত ভাঙা শহিদবেদির দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ওইখানেই বাদলকে খুন করে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। শনশন পুবে বাতাসের সঙ্গে এবার ইলশেগুঁড়ি ছাটের মতো নেমে এল। জবা গাছটা ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে বিমলার গায়ে মুখে পড়তে লাগল। তিনি নড়লেন না। তিনি আর ওই রান্না ঘরটায় গিয়ে ঢুকতে পারছেন না। আঠারো বছর আগে, বাদলের ওই আঁতুড় ঘরে গিয়ে ঢুকলেই, তাঁর সমস্ত শরীরের মধ্যে কেমন করছে। বিমলা স্থির থাকতে পারছেন না। তাঁর পেটের মধ্যে যেন কেবলই কী নড়ে চড়ে উঠছে। বাদল নাকি? বাদল কি এখনও তাঁর গর্ভে!

বিমলা চোখ বুজে ঠোঁটে ঠোঁট টিপলেন। ব্যথা উঠছে নাকি তাঁর পেটে! তাঁর চোখের সামনে বাদলের সেই চেহারাটাই আবার ভেসে উঠল। ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত মৃত বাদল। সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে, সকলের শাসানির কথা তাঁর মনে পড়েছিল। এই তিন মাস ধরে, বারে বারে মনে মনে জিজ্ঞেস করেছেন, কারা মেরেছে বাদলকে। কৃপালের দল? দয়ালের দল, না হরপ্রসাদের দল? সবাই অস্বীকার করেছে, তাদের দল বাদলকে মারেনি। পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করেছে, তারাও অস্বীকার করেছে, বাদলকে তারা মারেনি। অথচ সবাই শাসিয়েছে, সাবধান করে দিয়েছে। কৃপাল দয়াল হরপ্রসাদের পার্টি ছাড়াও, আরও পার্টি আছে। কিন্তু স্বীকার করেনি, বাদলকে কারা মেরেছে। বিমলাও জানেন না, কাদের হাতে বাদলের রক্ত লেগে আছে।

যতই অস্বীকার করুক, কোনও না কোনও পার্টির হাতেই বাদলের রক্ত লেগে আছে। সেটা কোন পার্টি? কৃপাল, দয়াল, হরপ্রসাদের কথাই আগে মনে আসে। ওরা সকলেই বলেছে, বাদলের মরণ ধরেছে। অথচ তারা বিমলার স্বামী পুত্র। বাদল কি হরপ্রসাদের ছেলে ছিল না? কৃপাল দয়ালের ভাই ছিল না? কেবল কি একটা পার্টির ছেলে। ওদের বিরুদ্ধ পার্টির ছেলে একটা? বাদল কি এই সংসারে একমাত্র বিমলারই ছেলে? তা-ই যদি হয়, তবে বিমলা আজ ওদের ডাকে সাড়া দেবেন না।

বিমলা শুনতে পাচ্ছেন, ওরা সবাই তাঁকে ডাকাডাকি করছে। কৃপাল ডাকছে, দয়াল ডাকছে, হরপ্রসাদও ডাকছেন। ওরা নিজেরা কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না। আলাদা আলাদা ডেকে চলেছে।

মা, ও মা।

 মা কোথায় গেলে?

কই গো শুনছ, কোথায় গেলে?

বিমলা টের পাচ্ছেন, উঠোনে, ঘরে ঘরে, রান্না ঘরে, সবাই তাঁকে ডাকাডাকি করছে। বৃষ্টির ছাটে। ছুটোছুটি করছে। শুনতে পাচ্ছেন, দয়াল রান্নাঘরের কাছ থেকে কণার মাকে চিৎকার করে ডাকছে, মাসিমা, ও মাসিমা।

কণার মায়ের জবাব শোনা গেল, কী বলছিস রে দয়াল।

মা কি আপনাদের বাড়িতে আছে?

না তো। সকাল থেকে একবারও আসেনি তো। কোথায় গেল তোর মা?

কী জানি, দেখতে পাচ্ছি না। রান্না ঘরের দরজা খোলা। কুকুর ঢুকে, কড়ার তরকারি খেয়ে গেছে। রান্নাবান্না কিছু হয়নি।

কণার মায়ের উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল, সে কী রে। তোর মায়ের তো এ রকম কখনও হয় না। দ্যাখ খুঁজে, কোথায় গেল। আমিও দেখছি।

কোথাও যাননি বিমলা। বাড়িতেই আছেন। ভাঙা শহিদ বেদির দিকে দেখছেন। যারা বেদি তৈরি করেছিল, তারাই বা আজ কোথায়। একটা শহিদবেদি করেছিল। তিন মাসের মধ্যেই সেটা ভেঙে পড়েছে। তাদেরই বা কী হারিয়েছে। তারা সেই যে শহিদবেদিতে বিমলাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপরে আর আসেনি। তারা যেমন পার্টি করছিল, তেমনি করছে। এ বাড়ির বাবা ছেলেরাও করছে।

বিমলারই শুধু হারিয়েছে। দশ মাস বাদলকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তাঁর নাড়ি ছিঁড়ে বাদল এই পৃথিবীতে এসেছিল। আঠারো বছর আগে, এতক্ষণে বাদল পৃথিবীতে এসেছে। এতক্ষণে মেঘুর মা বাদলকে ধুয়ে মুছে, তাঁর বুকের কাছে তুলে দিয়েছে। গম্ভীর স্বরে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। বিমলা তাকে স্তন চেনাবার চেষ্টা করছেন।

বিমলার গায়ের মধ্যে কেঁপে উঠল। বাদলকে তিনি যেন বুকের মধ্যে অনুভব করছেন। বাদল কোথাও নেই, শ্মশানে না, শহিদবেদিতে না। তাঁর বুকেই আছে।

বড় বউ।

হরপ্রসাদ ছাতা মাথায় দিয়ে এসে দাঁড়ালেন। বিমলার শরীর শক্ত হয়ে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রইলেন। হরপ্রসাদ তার ভাইদের মধ্যে সকলের বড়। পূর্ববঙ্গে, একান্নবর্তী পরিবারে, বিমলাকে বড় বউ বলেই ডাকা হত। হরপ্রসাদ কখনও কখনও তাঁকে ওই নামে ডাকেন। বিমলা কোনও জবাব দিলেন না।

 হরপ্রসাদ বললেন, আমরা তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

সে কথা হরপ্রসাদকে বলবার দরকার নেই। বিমলা জানেন, আজ বাদলের জন্মদিন, হরপ্রসাদের সে কথা মনে নেই। ছেলেদেরও কারোর মনে থাকে না। বিমলা ভুলতে পারেন না, কবে কোন ছেলেকে তিনি প্রসব করেছেন। মুখে কিছু বলেন না। কেবল তিন ছেলের জন্মদিনে, ওদের একটু পায়েস রান্না করে খাইয়ে দেন। এতকাল দিয়ে এসেছেন। গত বছরও এই দিনে, বাদলকে পায়েস রান্না করে খাইয়েছিলেন। বাদলের জন্য আর তাঁকে পায়েস রান্না করতে হবে না।

হরপ্রসাদের গলায় অসহায় বিস্ময়, কারণ তিনি বিমলার কিছুই বুঝতে পারছেন না। বলেই চলেছেন, রান্না বান্না কিছু করনি। আধ কাঁচা তরকারি কুকুরে খেয়ে গেছে। কী ব্যাপার তোমার?

হরপ্রসাদ ব্যাপার কিছুই বুঝবেন না। বিমলা কিছুই বলতে চান না। তাঁর চোখের সামনে শিশু বাদল খেলা করে বেড়াচ্ছে। দুরন্ত দুই ছেলে ছুটে বেড়াচ্ছে। গায়ে হাত পায়ে কাদা মাখা। তারপরে বাদল বড় হচ্ছে। কিশোর বাদল স্কুলে যাচ্ছে। মায়ের কাছে দুটো পয়সার জন্য হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। বাদল ছাড়া বিমলার কাছে এখন আর কিছু নেই। বাদল বাদল বাদল। সকলের কাছে ও ছিল একটা পার্টির ছেলে। সন্তান শুধু বিমলার।

হরপ্রসাদের গলার শব্দে কৃপাল দয়ালও এসে দাঁড়াল। ওরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ওরা কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না। নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করতে পারছে না। বিমলাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থ হয়ে গিয়েছে।

কৃপাল বলল, মা, তুমি এখানে কী করছ?

দয়াল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

সবাই অবাক। সবাই বিমলাকে বুঝতে চাইছে। কিন্তু ওদের বোঝার কিছু নেই। এরা তাঁর স্বামী পুত্র। এদের ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। কিন্তু আজ তিনি ওদের সঙ্গে নেই। আজ ওরা সারাদিন পার্টি করতে চলে যাক। বিমলা আজ বাদলকে নিয়ে থাকবেন। বাদল এখন তাঁর বুকে।

হরপ্রসাদ বলল, ঘরে চলো বড় বউ। এখানে দাঁড়িয়ে ভিজো না।

 বিমলার দৃষ্টি মোড়ের ভাঙা বেদির দিকে। স্পষ্ট করে বললেন, যাব না।

তিন পার্টির নোক নিজেদের মধ্যে অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। কৃপাল বলল, রান্না বান্না করনি, আমরা খাব কী?

বিমলা নিচু পরিষ্কার গলায় বললেন, আজ আমি খেতে দিতে পারব না।

তিনটে পার্টির নোক অবাক। বিমলা তাদের কাছে পার্টির থেকেও যেন জটিল হয়ে উঠেছে। দয়াল বলে উঠল, আমরা তবে কী করব এখন?

বিমলা বললেন, তোরা আজ তোদের পার্টির কাজে যা। আমাকে ডাকিস না।

অন্তহীন বিস্ময়ে তিনজনেই চুপ। বিমলা ওদের সামনে থেকে সরে গিয়ে ফণীমনসার বেড়া ঘেঁষে দাঁড়ালেন। তিনজনেই দেখল। তিনজনের চোখেই অপরিচয়ের দৃষ্টি। যেন স্বামী চিনতে পারছে না স্ত্রীকে। ছেলেরা মাকে। অথচ কোনও কথা বলতেও যেন আর তাদের সাহস হচ্ছে না। এই প্রথম, তারা শুধু, অবাক না, বিমলাকে যেন তাদের কেমন ভয় করছে।

তিনজনেই আরও একটু সময় দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসের ঝাপটায় আর বৃষ্টির ছাটে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তিনজনেই একটা অসহায় অস্বস্তি আর বিস্ময় নিয়ে একে একে চলে গেল।

বিমলা তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্টির ছাটে ধুয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বুকের কাছে এখন কিছু ঠেলে উঠছে, গলার কাছে উঠে আসছে। তাঁর চোখে এখন জল আসছে, বৃষ্টির জলে গাল ধুয়ে যাচ্ছে। তিনি বুকের কাছে হাত রেখে মনে মনে ডাকলেন, বাদল, বাদল, তুই আমার কাছেই রয়েছিস। আমার কাছে থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *