দৈনন্দিন

দৈনন্দিন

বিক্ষোভ ক্রমেই দানা বাঁধতে লাগল। বিকেল প্রায় চারটে থেকে ট্রেন বন্ধ। আপ-এ দু-একটা গাড়ি চললেও, ডাউনে একটা গাড়িরও পাত্তা নেই। আদপে কোনও গাড়ি আসবে কি না, সে কথা কেউ বলতে পারছে না। আধ ঘণ্টা আগেও, ইস্টিশনের মাইকে মাঝে মাঝে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিল, কয়েকটি ইস্টিশন আগে, ওভারহেড লাইনের তার কেটে নেওয়ায়, ডাউনের গাড়ি আসতে পারছে না। তার যোজনার কাজ নাকি আরম্ভ হয়েছে। হয়ে গেলেই নিয়মিত গাড়ি চলাচল শুরু হবে।

কারা তার কেটে নিয়ে গিয়েছে, এবং দিনে দুপুরে একটা শহরতলির জনসমৃদ্ধ ব্যস্ত অঞ্চলে, কী করেই বা তা সম্ভব, এসব কথা আজকাল আর কেউ জিজ্ঞেস করে না। বোধহয়, এ ধরনের স্বাভাবিক প্রশ্ন, আজকাল আর কারোর মনে উদয়ই হয় না। সাধারণ মানুষ তো অনেক দূরের কথা, কর্তৃপক্ষ বা সংবাদপত্র, কোনও মহলেই, এ বিষয়ে কোনও জিজ্ঞাসা নেই। কেবল সংবাদ পরিবেশন এবং ঘোষণাতেই সব কিছু সমাপ্ত। অমুক জায়গায় তার কেটে নিয়েছে, অতএব গাড়ি চলাচল বন্ধ।

আধ ঘণ্টা ধরে, ইস্টিশনের মাইক মৌনব্রত অবলম্বন করেছে। কোনও সাড়া-শব্দ নেই। না থাকার কারণও নিশ্চয় যথেষ্টই আছে। ইস্টিশনের কর্মীরা ইস্টিশনেই আছে। সংবাদের জন্য, একমাত্র টেলিফোন তাদের ভরসা। টেলিফোনে কোনও সংবাদ না পেলে, তাদের ঘোষণার কিছু থাকে না। এদিকে প্ল্যাটফরমে ক্রমাগত ভিড় বাড়ছে। চিৎকার হই-হট্টগোল ক্রমেই যেন একটা বিক্ষোভের আকার নিচ্ছে। দু-ঘণ্টা পার হতে চলেছে। ছটা বাজে। সন্ধ্যা আসন্ন। সূর্য ডুবে গিয়েছে। প্রায় পাঁচটা ট্রেনের যাত্রী, প্ল্যাটফরমে জমেছে। দেখে মনে হচ্ছে, প্ল্যাটফরমেও আর জায়গা নেই। তাই অনেকে, প্ল্যাটফরমের আশেপাশে, খোলা জায়গায়, রেল লাইনের ওপরে নেমে পড়েছে, বসে পড়েছে।

সেই সকালে যারা কলকাতা থেকে, দূরের শহরতলিতে কাজে এসেছিল, এবং আগামীকাল সকালেই আবার আসতে হবে, তাদের আর ধৈর্য না থাকবারই কথা। তারা ছাড়াও, এরকম একটা বড় ইস্টিশনে, ডাউনের প্ল্যাটফরমে, এখন প্রায় কয়েক হাজার যাত্রী অপেক্ষমাণ। একটা অনিশ্চিত অবস্থায় আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। ক্ষুধা, ব্যাধি, সংসার, নানা কাজকর্ম এবং অনেকের কাজের শেষে বাড়ি ফেরা। অনেকের হয়তো, অনেক জরুরি কাজ রয়েছে, বহু উদ্বেগ রয়েছে। অথচ কে কী করবে, কিছুই স্থির করতে পারছে না। কেউ জানে না, এরকম অচল অবস্থায় কতক্ষণ থাকতে হবে। এরকম অবস্থায়, মানুষ ঠিক মতো কিছু চিন্তা করতে পারে না। ক্রমে বিরক্তি বাড়তে থাকে। বিরক্তির পরে রাগ জমতে থাকে। রাগ ক্রমে বিক্ষোভের আকার নিতে থাকে।

এখন অবস্থা ক্রমাগত বিক্ষোভের দিকেই এগিয়ে চলেছে। ইস্টিশনের অফিসের দিকে তাকিয়ে, কটুক্তি আর গালিগালাজ শুরু হয়েছে। আমি বা আমার মতো আরও অনেকেই বুঝতে পারছে, এক্ষেত্রে ইস্টিশনের কর্মীদের কিছু করণীয় নেই। তারা রেল চালায় না। কেবিনে কেবিনে আর অন্যান্য ইস্টিশনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা ছাড়া, তারা কিছুই করতে পারে না। তারা অসহায়। কিন্তু অসহায় আর অবুঝ বিক্ষোভ প্রকাশের কেন্দ্র হয়ে, এই ইস্টিশন আর তার কর্মীরাই, চোখের সামনে রয়েছে। ক্রুদ্ধ যাত্রী সাধারণ আর কারোকেই তাদের সামনে পাচ্ছে না, এই ইমারত আর অফিস ছাড়া, আর কিছুই পাচ্ছে না। অতএব বিক্ষোভের লক্ষ্য ক্রমে সেদিকেই দানা বাঁধছে। ইতিমধ্যেই অনেকে, ইস্টিশন মাস্টার এবং অ্যাসিস্টান্ট মাস্টারের অফিস ঘিরে ধরেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। খিস্তি খেউড় আর গালাগাল চলছে। ইস্টিশনটা ক্রমেই যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে।

ইতিমধ্যে কিছু যাত্রী মোটরবাসের শরণাপন্ন হয়েছে। যাত্রীরা অনেকে বলাবলিও করল, এখানকার রুটে বাসের সংখ্যা নাকি ইতিমধ্যেই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই আশায় অনেকেই ইস্টিশনের বাইরে, শহরের রাস্তায় চলে গিয়েছে। যদিও প্ল্যাটফরমের দিকে তাকিয়ে, যাত্রীসংখ্যার কমতি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আরও যেন উপছে পড়ছে, ঢেউয়ের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। চিৎকার এবং গোলমাল আরও বাড়ছে। বিশেষ করে মেয়েদের দুর্দশার অন্ত নেই। শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ।

এর মধ্যেই, লক্ষ করলে, আরও অনেক কিছুই চোখে পড়তে পারে।…মেয়েদের সম্পর্কে উৎসাহী ছেলের দল, অথবা ছেলেদের সম্পর্কে উৎসাহী মেয়েরা, এরকম একটা পরিস্থিতিতে, সময়টা যেন মন্দ কাটছে না। তাদের চোখে-মুখে তেমন উদ্বেগ বা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে না। কিংবা, এ অবস্থার মধ্যেও, যারা তাস নিয়ে বসে পড়তে পেরেছে, তাদের সময়টাও কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেউ হয়তো ঘড়ি দেখছে। দেখেও আবার খেলায় মেতে যাচ্ছে। বিভিন্ন দিকে, বিভিন্ন গুচ্ছ, সমান আলোচনায় মেতে আছে। একটু কান পাতলেই শোনা যায়, রাজনীতি আর সিনেমাই বেশির ভাগ আলোচনার বিষয়বস্তু। অফিসের বা কারখানার আলোচনাও আছে। এক রকম মন্দ না। তবু এরকম একটা অবস্থায়, খানিকটা অন্যমনস্ক থাকা যাচ্ছে।

কিন্তু আরও আধ ঘণ্টা পরে, পরিণতি যা ঘটবার, তাই ঘটল। এক দল লোক, ইস্টিশন মাস্টারের ঘর, বুকিং অফিস তছনছ শুরু করে দিল। ওয়েটিং রুম, গুডস অফিস, কিছুই বাদ গেল না। টেলিফোনের তার ছিঁড়ে, আসবাবপত্র ভেঙে-চুরে একাকার করতে লাগল। কর্মীরা, যারা বাধা দিতে গেল, তারা প্রহৃত হল। বুকিং অফিসের টাকাপয়সাও লুঠ হয়ে গেল। আমি অবিশ্যি বুঝতে পারছি না, কেবল মাত্র বিক্ষুব্ধ যাত্রীরাই এসব করছে কি না। রাগে এবং ক্ষোভে ভাঙচুর করাটা খুব আশ্চর্যের না। কিন্তু বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা নিশ্চয়ই গুণ্ডা বা তস্কর না।

পরের মুহূর্তেই দেখা গেল, একদল লোক ইস্টিশনে আগুন লাগাবার চেষ্টা করছে। পাথর-ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। তাসের বা অন্যান্য আসর সব ভেঙে গিয়েছে। যাত্রীরা তখন চারদিকে ছুটোছুটি করছে। মেয়েরা শিশুদের নিয়ে নিরাপদ জায়গার খোঁজে, দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটছে। প্ল্যাটফরমের ফ্যান লাইট সব ভাঙচুর আরম্ভ হয়েছে।

ইস্টিশনটা খুব ছোট না। জি. আর. পি-র থানা আর লক-আপ আছে। সশস্ত্র প্রহরী আছে। তারা সবাই ছুটে এল। কোথা থেকে, আর. পি. এফ-এর কয়েকজন বন্দুকধারীও এসে পড়ল। লাঠি চালনা শুরু হল। সাধারণ যাত্রীরা ভয়ে ছুটতে লাগল। বিক্ষোভকারীরা পিছু হটে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পুলিশ তার নিজের পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। তারপরেও, কিছুক্ষণ পাথর ছোঁড়াছুড়ির পর, অবস্থা যেন একটু শান্ত হল।

আমি একদল যাত্রীর সঙ্গে, ইস্টিশনের কাছেই, রেল কোয়ার্টারের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আগুন ধরানো যায়নি। অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে বলেই মনেই হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। অত যাত্রী, কোথায় কোন দিকে চলে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না। এত বড় ইস্টিশনটা প্রায় অন্ধকার। এখানে-ওখানে কয়েকটা মাত্র আলো জ্বলছে। সশস্ত্র প্রহরীর সংখ্যা, ইতিমধ্যেই আরও বাড়ানো হয়েছে। ইস্টিশনটাকে যেন শ্মশানের মতো দেখাচ্ছে।

গোলমালের পরে, একটা আপ ট্রেন পাস করেছে। মোট প্রায় চার ঘণ্টা পরে, মুখে চোঙা লাগানো স্বরের ঘোষণা শোনা গেল, ডাউন ট্রেন আসছে। আমরা ইতিমধ্যে অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে এসে জড়ো হয়েছিলাম। যাত্রীরা সব গেল কোথায়, সেটাই আশ্চর্য। ঘোষণার পরে, খানিকটা ভিড় হলেও, তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা বেশ কম। অন্যান্য অগুনতি যাত্রীরা নিশ্চয় কোনও না কোনও ভাবে চলে গিয়েছে। বাস লরি টেম্পো কাজে লাগানো হয়েছে। কাছাকাছি যারা থাকে, তারা হয়তো পায়ে হেঁটেই চলে গিয়েছে।

গভীর উদ্বেগের পরে, এখন রীতিমতো অবসন্ন বোধ করছি। ঘামে ধুলোয় শরীর ভরা। মুখের ভিতরটা শুকনো। জলের কল খুঁজে নিয়ে, মুখ ধুলাম, জল খেলাম। প্ল্যাটফরমে পুলিশ টহল দিচ্ছে। দূরে, ডাউন লাইনে, আলোর বিন্দু জেগে উঠল। আশ্বস্ত বোধ করলাম। সকলেই করছে, এবং আলোর বিন্দুটিকে সকলেই উঁকি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে।

একটু পরেই, গাড়ি এসে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। ভেবেছিলাম, যাত্রীতে ঠাসাঠাসি হয়ে আসবে। দেখলাম, তা না, গাড়ি বেশ ফাঁকা। দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি না চলায়, অধিকাংশ যাত্রীরাই হতাশ হয়ে চলে গিয়েছে। সব ইস্টিশনে, আমাদের মতো কিছু যাত্রী রয়ে গিয়েছে। ইলেকট্রিক ট্রেন, কলকাতায় পৌঁছুতে বেশি সময় লাগবে না। সামনের দিকে একটা কমপার্টমেন্টে উঠে বুঝলাম, ফার্স্ট ক্লাসে উঠেছি। একটি মাত্র আলো আছে। ফ্যান একটিও নেই। কামরার এক দিকে, কাঠের সিটের ওপর মলমূত্র ত্যাগ করে রেখেছে। দুর্গন্ধে ওদিকে কেউ গেল না। অন্য দিকেই সবাই গায়ে গা ঠেকিয়ে বসলাম। পনেরো-ষোলো জনের বেশি যাত্রী নেই।

হুইসল বাজল, গাড়ি ছাড়ল। চলন্ত গাড়িতে তিনজন লাফিয়ে উঠল। একেবারে শেষ মুহূর্তের যাত্রী। তারা তিনজনেই কামরার ফাঁকা অংশটা দেখে নিল। তারপরে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। যদিও বসবার জায়গা নেই। তিনজনেই যুবক। প্যান্ট শার্ট আর স্যান্ডেল পায়ে। একটি মাত্র আলোয়, কামরার কারোর মুখই স্পষ্ট না।

তিনজনেই এগিয়ে এসে, আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারা যেন বসতে আসেনি। প্রত্যেকের মুখের দিকেই এমনভাবে তাকিয়ে দেখছে, যেন তারা কাউকে খুঁজছে। তাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, একটু যেন সন্দিগ্ধ। আমার মনে হচ্ছিল, তাদের চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। যাত্রীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। তিনজনের দিকে তাকিয়ে, সবাই সকলের দিকে দেখতে চাইছে, অথচ অন্যমনস্ক হবার ভাব করে, কিছুটা নিস্পৃহ থাকবার চেষ্টা করছে।

তারা তিনজন পরস্পরের দিকে একবার তাকাল। যেন চোখে চোখে তাদের মধ্যে ইশারা হয়ে গেল। একজন দরজার দিকে সরে গেল। একজনের হাতে কিছু একটা ঝলকে উঠতেই দেখা গেল, সেটা ছুরি। আর একজনের হাতে চিক চিক করে উঠল একটি রিভলবার।

ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার পাশের যাত্রী উঠে দাঁড়াল। দেখলাম, মাঝবয়সি লোকটি কাঁপছে। সে এক পা এগোতেই, যার হাতে রিভলবার, সে বলে উঠল, কোথায় যাবেন?

কথা বেশ স্পষ্ট। যাত্রীটি স্খলিত গলায় বলল, আমি সামনের ইস্টিশনে নামব।

রিভলবার হাতে যুবক বলল, এখন কোথাও নামা হবে না। যেখানে বসে আছেন, বসে থাকুন। তা না হলে গোলমাল হয়ে যাবে।

যাত্রীটি একবার সকলের দিকে তাকাল। ভরসার জন্য তাকিয়ে থাকলে, লোকটি ভুল করেছে। একটি রিভলবার আর একটি ছুরির সামনে, পনেরো-ষোলোজন যাত্রীর, সকলের অবস্থাই সমান। সকলেই আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। কেউ নড়তে পারছি না, কথা বলতে পারছি না। কেউ কারোর দিকে তাকাতেও যেন ভরসা পাচ্ছি না, পাছে সেটাকে অন্য কিছু ভাবা হয়। যাত্রীটি কাঁপতে কাঁপতেই বসে পড়ল।

এইটুকু সময়ের মধ্যেই, আমি ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম, এরা বোধহয় বিশেষ কারোকে খুঁজছে। তাহলে বাকি যাত্রীদের কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু রিভলবার হাতে যুবকটি বলে উঠল, কার কাছে কী আছে, তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। টাকা পয়সা, ঘড়ি আংটি বোতাম। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। দেরি করবেন না।

এক মুহূর্ত সকলেই যেন পাথর হয়ে গেল। গোটা কামরাটার যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সব মৃত।

কী হল, কথা কানে যাচ্ছে না কারোর?

রিভলবার হাতে যার, সে ধমক দিয়ে উঠল। সব থেকে কাছের লোকটিকে, অস্ত্র দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল, বসে কেন, যা বলছি শুনুন। তা না হলে কেউ বাঁচবে না।

যার হাতে ছুরি, সে এবার যাত্রীদের কাছে এগিয়ে এল। ছোরা উদ্যত করে সে বলে উঠল, ছাড়ুন ছাড়ুন, তাড়াতাড়ি মাল ছাড়ুন।

সে নিজেই কয়েকজনের হাত থেকে ঘড়ি খুলে নিল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে পার্স বা আলগা টাকাপয়সা যা পেল, তুলে নিতে লাগল। কিছু খুচরো পয়সা এলোমলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিল না। প্রত্যেকের বুকেই একবার করে ছুরি চেপে ধরতে লাগল।

এ সময়ে গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এল। সামনে ইস্টিশন আসছে। যাত্রীদের চোখে যেন একটা ঝিলিক দেখা গেল। যাদের টাকা বা আংটি ইত্যাদি তখনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়নি, তাদের চোখে যেন একটু আশার আলো ফুটল। এই মুহূর্তে আমার বুকে ছুরির ফলাটা ঠেকল। আর একজন যাত্রী উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম হল, বসে পড়ুন।

লোকটি বলল, আমি এখানে নামব।

না, এখানে কারোরই নামা হবে না।

 গাড়িটা ইস্টিশনে ঢুকল। ফাঁকা ফাঁকা, যাত্রী বেশ কম। তবু, আলো জ্বলছে, কিছু লোকের মুখ দেখা যাচ্ছে। আবার শোনা গেল, কেউ চেঁচালেই তাকে গুলি করে মারব।

গাড়ি থামল। আমি আশা করছি, কয়েকজন নতুন যাত্রী নিশ্চয় উঠবে। যদিও তাতেই বা আশার কী আছে। যারা আসবে, তারাও এদেরই শিকার হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে আমার পার্সটা পকেট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। একটা কথাও বলতে পারছি না। একজন, আর একজনের অবস্থা দেখছে। ছুরির ফলাটা এখনও বুকের কাছে ঠেকানো। একটু চাপ দিলেই, জামা ভেদ করে মাংসে ঢুকবে।

কী হল, ঘড়িটা খুলে দেওয়া যাচ্ছে না?

যেন সে আমাকে একটা আঘাত করবে, এইভাবে হাত তুলে, আমার চামড়ার ব্যান্ডওয়ালা ঘড়িটা এক টানে ছিঁড়ে নিল। আমার হাতটা ছিটকে, আর একজনের গায়ে গিয়ে পড়ল। সে চমকে নড়ে উঠল।

দরজার কাছে শোনা গেল, পথ আটকাচ্ছেন কেন, উঠতে দিন না।

জবাব শোনা গেল, অন্য কামরায় যান।

তারপরেই কী হল, বোঝা গেল না। একটি আর্ত অস্ফুট শব্দ শোনা গেল, ওরে বাবা, না না, চলে যাচ্ছি।

এবার দু-তিনজন যাত্রীর গলা একসঙ্গে দরজার কাছে শোনা গেল। কথা বলতে বলতে উঠে আসছিল। তারপরেই তাদের কথা শোনা গেল। পরমুহূর্তেই শোনা গেল, ক্ষীতীশ, এখানে উঠো না, চলে এসো।

কামরার ভিতরে ছিনিয়ে নেবার কাজ একভাবেই চলেছে। আমাদের দিকে রিভলবার একভাবেই উদ্যত এবং যার হাতে অস্ত্রটি রয়েছে, সে আমাদের দিকে একভাবেই তাকিয়ে দেখছে। অন্যদিকে চোখ ফেরায়নি। গাড়ি আবার চলতে আরম্ভ করেছে।

একজন লোক ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছিল। যাত্রীটির কাছে অনেকগুলো টাকা ছিল। কত টাকা বলতে পারব না। নোটের বান্ডিল দেখে অনুমান হয়েছিল, তিন-চার হাজারের কম না। যাত্রীটিকে দেখে একবারের জন্যও বোঝা যায়নি, তার কাছে এত টাকা থাকতে পারে। তাকে দেখলে মনে হয়, নিরীহ গরিব গোছের মানুষ, কিছুটা গ্রাম। সে তার আধময়লা কোঁচা দিয়ে চোখ মুছছে, আর কাঁদছে। আমরা কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু একটা রিভলবার আর ছুরির মুখে, আমরা পনেরো-ষোলোজন তোক অবশ হয়ে বসে আছি।

একজন মাত্র মহিলাই এই কামরায় রয়েছেন। বিবাহিতা মহিলা, সঙ্গে তাঁর স্বামী আর শিশু পুত্র। ছুরি হাতে যুবক তাঁর কাছে এগিয়ে যাবার আগেই, তিনি হাতের বালা আর গলার হার খুলে ফেললেন। ছুঁড়ে দিলেন যুবকের দিকে। তিন বছরের শিশুটিকে বুকের কাছে টেনে নিলেন।

রিভলবার হাতে যুবকটি আমাদের দিকে চোখ রেখে বলল, তাড়াতাড়ি কর।

সকলের সব কিছু নেওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কার কত টাকা গেল সঠিক বোঝা গেল না। ওই একটি লোকেরই সব থেকে বেশি গিয়েছে। ছুরি হাতে যুবকটির দুটো পকেট, হাওয়াই শার্টের বুকপকেট ফুলে উঠেছে।

ভয় একটা সংক্রামক রোগের মতত। এবং এ রোগ, পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্কে চকিতে আক্রমণ করে, নিশ্চল করে দেয়। আমরা সবাই এখন সেই রোগে আক্রান্ত। তথাপি একটা ঘৃণা যেন ভিতরে ফুঁসছে। অসহায় রাগে, নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করছে। এমন কথাও আমার একবার মনে হল, রিভলবারে সত্যি গুলি আছে কিনা, তার কোনও পরীক্ষা হল না। তিনজনের ওপরেই যদি আমরা সবাই যুগপৎ ঝাঁপিয়ে পড়ি, তা হলেও কি ওদের কাবু করতে পারব না?

এ কথা ভাবতে ভাবতেই, চোখ তুলতে, উদ্যত রিভলবারওয়ালার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল। মোটা ভুরুর নীচে, তার নেকড়ের মতো চোখ দুটো আমার চোখে। যেন মনে হল, সে আমার মনের কথাটা জানতে পেরেছে। আমি শুধু অস্বস্তি বোধ করলাম না, সত্যি বলতে কী, সন্দেহ আর ভয়ের একটা ঝিলিক খেলে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে চোখ সরিয়ে, আর এক জনের দিকে তাকাল।

ছুরিওয়ালা রিভলবারওয়ালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ফিনিশ।

ব্যাপারটা বেশ তাড়াতাড়িই ঘটল। মোট পাঁচ ছ মিনিটের বেশি না। বোঝা গেল, এরা নতুন করছে না এ সব। প্রায় একটা ছকে বাঁধা, নাটকীয় দৃশ্যের মতো ঘটনাটা ঘটে গেল। যেন আগে থেকেই সব ঠিকঠাক ছিল। কুশীলবেরা এল, যে যার ভূমিকায় পাকা অভিনয় করে গেল। আমরা নিঃস্ব দর্শকেরা বসে আছি, দেখছি। সর্বগ্রাসী ভয়ের মধ্যে, আমাদের মনে এখন খানিকটা কৌতূহল জাগছে, পরবর্তী ধাপটা কী হবে। এখন আর কারোরই কিছু হারাবার ভয় নেই। যা যাবার তা গিয়েছে। যারা থরথরিয়ে কাঁপছিল, তাঁদের কাঁপুনিও অনেক কমে গিয়েছে।

রিভলবারওয়ালা ডাকল, দু নম্বর।

দরজার কাছ থেকে জবাব এল, বল।

 এদিকে।

দুনম্বর এগিয়ে এল। দেখা গেল, তার হাতে একটা পাইপ গান। তিনজনেই একটু সরে গিয়ে, সারি দিয়ে দাঁড়াল। রিভলবারওয়ালা পাইপগানওয়ালাকে যেন ফিসফিস করে কী বলল, এবং একজন যাত্রীর দিকে ইশারা করে দেখাল। পাইপওয়ালা মাথা নাড়ল। রিভলবারওয়ালা আঙুল তুলে ডাকল, এই যে, এই যে তুমি, হ্যাঁ তোমাকে বলছি, তুমি এদিকে চলে এসো।

তাকিয়ে দেখলাম, শার্ট-প্যান্ট পরা, চশমা চোখে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমি?

হ্যাঁ। তোমার মুখটা চেনা চেনা লাগছে। তুমি আমাদের চেন?

ভদ্রলোক হাত নেড়ে, ঘাড় নেড়ে বললেন, না না, আমি তোমাদের চিনি না, আমি তোমাদের কোনওদিন দেখিনি।

রিভলবারওয়ালা বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। এখন তুমি এদিকে এসো।

ভদ্রলোক কামরার সকলের দিকে একবার দেখলেন, বললেন, কেন, আমি ওখানে গিয়ে কী করব?

তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে। চলে এসো।

 গাড়ির গতি কমছে, সামনে ইস্টিশন। ভদ্রলোক বসে আছেন। কলকল করে ঘামছেন, চশমার কাচটা যেন ঘষা দেখাচ্ছে। বললেন, বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের চিনি না।

রিভলবারওয়ালা ঝাঁজিয়ে বলল, সেটা যাচাই হবে। গাড়ি থামছে, তাড়াতাড়ি এসো।

ভদ্রলোক যেন এবার একটু মরিয়া হয়ে বললেন, না যাব না।

রিভলবারওয়ালা ছুরিওয়ালাকে ইশারা করল। গাড়ি প্ল্যাটফরমে ঢুকছে। ছুরিওয়ালা ছুটে এসে ভদ্রলোকের জামার কলার ধরে টেনে ওঠাল।

ভদ্রলোক তবু জোর করে বসবার চেষ্টা করলেন। বললেন, তোমরা আমাকে মারতে চাও তো এখানেই মারো, আমি কোথাও যাব না।

এটা বোধহয় কেউ-ই আশা করেনি। আমরা না, ওরা তিনজনেও না। সমস্ত ব্যাপারটা বাধাহীন ভাবে ঘটে যাবে, এটাই ধরে নেওয়া গিয়েছিল। ভদ্রলোককে নামিয়ে নিয়ে যেতে পারলে, তাঁর কী পরিমাণ হবে, সেটা সকলেই আন্দাজ করতে পারছে।

রিভলবারওয়ালা চিৎকার করে হুকুম দিল, টেনে নিয়ে আয়।

 সেই মুহূর্তেই কে যেন বলে উঠল, কেন ওঁকে নিয়ে যাচ্ছ?

কী ঘটে গেল মনের মধ্যে, জানি না। দেখলাম, আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-তিনজন। যন্ত্রের কর্কশ আর্তনাদে, গাড়ি তখন দাঁড়াচ্ছে। আমরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম, ওঁকে ছেড়ে দাও।

এই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা কামরাটা চিৎকার করে উঠল, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

সেই চিৎকার ছাপিয়ে, রিভলবারওয়ালার হুকুম শোনা গেল, তিননম্বর, চলে আয়।

তখন প্ল্যাটফরমে লোক জমে গিয়েছে, অনেকেই আমাদের কামরার কাছে ছুটে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যেই আর একটা ঘটনা ঘটে গেল। যে যাত্রীটি টাকার শোকে কাঁদছিল, সে হঠাৎ চলে যেতে উদ্যত ছুরিওয়ালার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রায় কান্না ব্যাকুল স্বরেই আর্তনাদ করে উঠল, ওরে আমার টাকা দিয়ে যা।

কিছু বুঝে ওঠবার আগেই, গুডুম করে শব্দ হল দুবার। যাত্রীটি আচমকা আর্তনাদ করে উঠল। নিমেষে ছুরিওয়ালা দরজার দিকে ছুটল। আবার রিভলবারের গুলির শব্দ হল। প্ল্যাটফরমের যাত্রীরা ছুটোছুটি করছে। কিন্তু যাদের সরে পড়ার, তারা ততক্ষণে সরে পড়েছে। কেবল চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ওই যে, ওদিকে-ওদিক দিয়ে যাচ্ছে।

টাকার জন্যে শোকগ্রস্ত লোকটি তখন লুটিয়ে পড়েছে, রক্তে ভাসছে। আমরা সবাই তাকে ধরাধরি করে, কামরার খোলা জায়গায় শুইয়ে দিলাম। দেখা গেল, আঘাত সেরকম মারাত্মক নয়। কাঁধে আর ডানায় কেটে গিয়েছে।

আমাদের কামরায় এখন অনেক লোক। আহত লোকটিকে সাহায্যের জন্য সবাই উদগ্রীব। এখন যত তাড়াতাড়ি কলকাতায় পৌঁছুনো যায়, লোকটিকে হাসপাতালে দেওয়া যায়, ততই ভাল।

কিন্তু লোকটি তখনও বলছে, টাকা গেল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল…সর্বনাশ…

কে যেন বলল, টাকা গেছে, প্রাণটা তো বেঁচেছে।

লোকটি গোঙানো স্বরে বলল, টাকার সঙ্গে আমার প্রাণ চলে গেছে এ প্রাণ নিয়ে এখন কী করব। আমার সারা জীবনের ধন…।

এখন প্রাণের ভয়টা যেন বড় কথা না। বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই বড় হয়ে উঠছে। কেমন একটা বিকৃত লজ্জায়, মাথাটা নত হয়ে আসছে। এই আদিম ভয়টাকে মানুষ কবে নিঃশেষে জয় করতে পারবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *