2 of 3

শনির দশা

শনির দশা

শনির দশা বা শনির দৃষ্টি কথাটি ব্যবহৃত হয় অতি দুঃসময় বা চরম দুর্দশা বুঝাতে।

নবগ্রহের সপ্তম গ্রহ শনি। সূর্যের অন্যতমা স্ত্রী ছায়ার গর্ভে শনির জন্ম (পদ্মপুরাণ)। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণমতে সূর্যের সারথি চিত্ররথের মেয়ের সাথে শনির বিয়ে হয়। একদিন শনি ধ্যানমগ্ন হয়ে তপস্যারত ছিলেন। ঐ সময় তার স্ত্রী ঋতুস্নান (ঋতুমতী হবার পর চতুর্থদিনে স্নানরূপ সংস্কার) করে সুন্দরভাবে সেজে শনির কাছে আসেন ও সঙ্গম প্রার্থনা করেন। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না এবং তার কামনাও পূরণ করলেন না। এতে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে শনিকে তার স্ত্রী অভিশাপ দিলেন যে, তিনি যার দিকে দৃষ্টি দিবেন সেই বিনষ্ট হবে।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের গণেশখণ্ড অনুযায়ী পার্বতীপুত্র গণেশ জন্মগ্রহণ করলে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সব স্থান থেকে দেবতারা নবজাত শিশুকে দেখার জন্য উপস্থিত হন কৈলাসে। শনিও এলেন। স্ত্রীর অভিশাপের কথা স্মরণ করে নবজাতকের দিকে না তাকিয়ে নিচুমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পার্বতী গণেশের দিকে তাকাতে অনুরোধ করলে শনি তাকে সেই অভিশাপের কথা বলেন। সব বিবরণ শুনেও শিবপত্নী পার্বতী শনিকে নবজাতকের মুখদর্শন করতে বললেন। শিশু গণেশের দিকে দৃষ্টিপাত করা মাত্র তার দেহ থেকে মুণ্ড উড়ে গেল। অবশ্য পরে বিষ্ণুর চেষ্টায় গণেশের ঘাড়ে হাতির মাথা স্থাপন করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু দেবী পার্বতী শনিকে অভিশাপ দিয়ে খোঁড়া করে দিলেন

পদ্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের গল্পের পর আসি আরেকটি উপাখ্যানে যা নিয়ে আজও আমাদের ঘরে ঘরে শনির পাঁচালি পড়া হয়। গল্পটি নিম্নরূপ-

অযোধ্যার রাজা চিত্রবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র শ্রীবৎস রাজা হলেন। চিত্রসেনের পরম রূপবতী কন্যা চিন্তাদেবী ছিলেন তার স্ত্রী। যাগযজ্ঞ, দানধ্যান এবং ন্যায়নীতির সাথে প্রজাপালন করে বেশ সুখে রাজ্যভোগ করছিলেন শ্রীবৎস। বিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সুবিচারক হিসেবে তার খ্যাতি চতুর্দিক বিস্তৃত ছিল।

একদিন শনি ও লক্ষ্মীদেবী এসে হাজির রাজা শ্রীবৎসের কাছে। তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ-এই বিচার করে দেবার জন্য রাজাকে অনুরোধ করলেন তারা। রাজা তখন স্নানের জন্য ব্যস্ত থাকায় শনি ও লক্ষ্মীকে অনুরোধ করলেন পরদিন পর্যন্ত সময় দিতে। তারা দু’জন রাজি হয়ে চলে গেলেন।

শ্রীবৎস পড়লেন মহা সমস্যায়। মর্ত্যলোকে দেবতাদের বিবাদ নিয়ে বিচার করা সমীচীন নয় বলে পাত্রমিত্ররা জানালেন রাজাকে। এর ফলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা প্রবল। এ অবস্থায় পাত্রমিত্র ও মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করে একটি উপায় বের করলেন রাজা।

পরদিন রাজদরবার প্রস্তুত। রাজার সিংহাসনের ডান দিকে চাদর দিয়ে ঢাকা সোনার সিংহাসন এবং বামদিকে চাদর দিয়ে ঢাকা রূপার সিংহাসন। যথাসময়ে শনি ও লক্ষ্মীদেবী দরবারে উপস্থিত হতেই রাজা যথাযোগ্য সম্মানের সাথে তাদের বরণ করে ইচ্ছেমতো আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। তারা আপন আপন ইচ্ছেয় রাজার দু’পাশের দু’টি সিংহাসনে বসলেন। কিছুক্ষণ পর শনি ও লক্ষ্মী শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

রাজা জানালেন যে, তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বিচার তারা নিজেরাই করেছেন। কারণ রাজার ডানদিকে স্বর্ণসিংহাসনে বসেছেন লক্ষ্মী এবং বামদিকে রৌপ্যসিংহাসনে বসেছেন শনি। সাধারণত রাজার ডানদিকে সিংহাসনে বসেন বামপাশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ব্যক্তি। এক্ষেত্রে লক্ষ্মীদেবীই শ্রেষ্ঠ হন। রাজার ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন শনি ও লক্ষ্মী। নিজেরাই নিজেদের আসন বেছে নিলেও শনির মনে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হলো। শ্রীবৎসকে শাস্তি দেবার জন্য ছলছুতো খুঁজতে লাগলেন শনি। পেয়েও গেলেন অজুহাত।

একদিন শ্রীবৎস রাজা স্নান সেরেছেন। হঠাৎ এক কালো কুকুর এসে তার গা-ধোয়া জলের কিছু অংশ চাটতেই শনিদেব রাজার শরীরে প্রবেশ করলেন (ভিন্নমতে রাজা খাবার পর পা ধুতে ভুলে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটে)। শনির প্রভাবে ক্রমে ক্রমে রাজার বুদ্ধিভ্রংশ, রাজ্যধ্বংস, দুর্ভিক্ষ ও বড় বড় অনিষ্ট হতে লাগলো। অবশেষে সর্বস্বান্ত হয়ে সস্ত্রীক বনবাসে যেতে বাধ্য হলেন তিনি। স্ত্রী চিন্তাদেবীকে বাবার বাড়ি পাঠাতে চাইলেও তিনি স্বামীকে ছাড়লেন না, বরং স্বামীর সাথে কষ্ট ভাগ করতে মনস্থ করলেন।

সম্বল হিসেবে রাণী সাথে নিয়েছিলেন কিছু ধনরত্ন, কাপড়চোপড় ও কাঁথা। পথে শনিদেব সৃষ্টি করেন এক মায়ানদী। মাঝির ছদ্মবেশে ভাঙ্গাচুরা এক নৌকা নিয়ে উপস্থিত হন শনি। নৌকায় একত্রে সবকিছু পার করা সম্ভব নয় বলে শনির কৌশলে প্রথমে কাঁথায় জড়ানো ধনরত্ন অন্যপারে নেবার জন্য তোলা হলো নৌকায়। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ করে সম্বলসহ উধাও হয়ে গেল মায়ানদী, মায়ানৌকা এবং মাঝি। নিঃসম্বল রাজা-রাণী বিষম অবস্থায় পড়লেন।

ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে ঘুরতে ঘুরতে তারা এলেন চিত্রধ্বজ বনে। জেলেদের কাছ থেকে একটি শোল (শকুন) মাছ চেয়ে নিয়ে আগুনে পোড়ালেন তারা। অতঃপর মাছের গায়ে লেগে থাকা ছাই পরিষ্কার করতে সরোবরে গেলেন। শনির চাতুর্যে রাণীর হাত থেকে হঠাৎ পোড়া মাছ ভাজা হয়ে হারিয়ে গেল সরোবরজলে। অভুক্ত রাজা-রাণী নিরুপায় হয়ে নারায়ণের কথা স্মরণ করলেন। লক্ষ্মীপতি নারায়ণ তাদের উদ্দেশে দৈববাণীতে জানালেন যে, এই বনে বিচরণকালে তাদের কোনো ক্ষতি না হয় তা তিনি দেখবেন।

নারায়ণের আশ্বাসে শ্রীবৎস-চিন্তা কিছুদিন গাছের ফলমূল খেয়ে ঐ বনেই বাস করতে লাগলেন। বেশ কিছুকাল পরে সেখানে ফলমূলেরও অভাব ঘটলো। তারা নগরের দিকে গেলেন। নগরের উত্তরদিকে বাস করে ধনীরা আর দক্ষিণদিকে গরিব মানুষেরা। তারা নগরের দক্ষিণপ্রান্তে এক গরিব কাঠুরিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন এবং তাদের সাথে কাজ করে কিছুকাল কাটালেন।

কাঠুরিয়াদের সাথে একদিন কাঠ সংগ্রহ করতে বনে গেছেন শ্রীবৎস। ঐদিন ওখানকার নদীর চড়ায় আটকে গেল এক সওদাগরের বাণিজ্যতরী 1 সেখানে গণকরূপে আবির্ভূত শনি সওদাগরকে বললেন যে, কাঠুরিয়াপল্লীতে বসবাসকারী পরমসতী চিন্তা যদি ঐ নৌকা স্পর্শ করে তবে আটকে যাওয়া নৌকা চলতে শুরু করবে। সুতরাং সওদাগর অনেক অনুনয় বিনয় করায় স্বামীর অনুপস্থিতিতেই চিন্তাদেবী নৌকার কাছে গেলেন। চিন্তার স্পর্শে নৌকা সচল হলো। কিন্তু আবার যদি কোথাও নৌকা আটকে যায় সেজন্য সওদাগর তার নৌকায় চিন্তাকে তুলে নিয়েই যাত্রা করলেন।

পতিপরায়ণা চিন্তা ও শ্রীবৎসকে শনির কোপে বিচ্ছিন্ন হতে হলো। উভয়ে উভয়ের বিরহে কাতর হয়ে পড়লেন। সওদাগরের হাত থেকে সতীত্ব রক্ষার জন্য চিন্তাদেবী সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন যাতে তিনি কুরূপা হয়ে যান। অতঃপর সূর্যদেবের আশীর্বাদে চিন্তা হতশ্রী হলেন। তার আর সতীত্ব হারানোর ভয় রইলো না। তবে যথাসময়ে প্রয়োজনমতো তিনি আবার পূর্বরূপ ফিরে পাবার বরও লাভ করলেন সূর্যদেবের কাছে।

স্ত্রীকে হারিয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন শ্রীবৎস। অবশেষে চিত্তানন্দ নামক বনে গিয়ে সেখানে সুরভিদেবীর আশ্রমে আশ্রয় নিলেন। সুরভিদেবী সান্ত্বনা দিয়ে পুত্রবৎ নিজের আশ্রমে রাখলেন শ্রীবৎসকে। সুরভিকন্যা নন্দিনীর পান করার পর মুখ থেকে পড়ে যাওয়া দুধে ভেজা মাটি দিয়ে দুটি পাট তৈরি করে নিজ অনুচর তালবেতালের নাম স্মরণ করলেন এবং নিজের ও চিন্তাদেবীর নামকরণে ঐ দুটি পাট একত্র করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা স্বর্ণপাটে পরিণত হলো। এভাবে অসংখ্য পাট তৈরি করে শ্রীবৎস স্তূপাকারে রাখলেন।

একদিন পূর্বোক্ত সেই সওদাগর নিকটবর্তী নদীপথে যাচ্ছেন। স্বর্ণপাট ব্যবসার প্রস্তাব দিয়ে শ্রীবৎস তার সাথে যেতে চাইলেন। সওদাগর সোনার পাটসহ তাকে নৌকায় তুলে নিলেন। কিছুদূর যাবার পর সওদাগরের মনে জেগে উঠলো সোনার পাটগুলি আত্মসাৎ করার প্রবৃত্তি। রাজাকে বেঁধে তিনি নদীতে ফেলে দিলেন। স্ত্রী চিন্তা ও তালবেতালের নাম ধরে চিৎকার দিতে থাকেন শ্রীবৎস। ঐ নৌকাতেই ছিলেন চিন্তা। কোনো উপায় না দেখে তিনি একটি বালিশ ফেলে দিলেন নদীতে। এর মধ্যে হাজির হলো তালবেতাল। ভেলা হয়ে তালবেতাল রাজাকে বালিশসহ তুলে ভাসিয়ে নিয়ে চললো।

বালিশ ও ভেলার সাহায্যে রাজা শ্রীবৎস ভাসতে ভাসতে পৌঁছালেন সৌতিপুর নামক স্থানে। আশ্রয় নিলেন এক বৃদ্ধ মালাকরপত্নীর বাড়িতে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর সেদেশের রাজা বাহুদেবের মেয়েকে স্বয়ংবর সভা থেকে বিয়ে করলেন। বাহুদেবের মেয়ে ভদ্রা দৈবযোগে শ্রীবৎসের আসল পরিচয় পেয়ে স্বয়ংবর সভায় তার গলায় বরমাল্য দিয়েছিলেন। কিন্তু আর কেউ তার পরিচয় না জানায় দীনহীন গরিব অবস্থার শ্রীবৎসকে রাজা আদর না করে কন্যাসহ ত্যাগ করলেন। কিন্তু রানী তাদের জন্য নিকটের এক বনে কুটির তৈরি করে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। এভাবে কেটে গেল বহুদিন।

বার বছরে শনির ভোগ শেষ হয়ে এলো। রাজকন্যার সাহায্যে রাজা বাহুদেবকে অনুরোধ করিয়ে শ্রীবৎস সেখানকার ক্ষীরোদ নদীর তীরে বাণিজ্যতরীর শুল্ক সংগ্রাহকের পদে নিযুক্ত হলেন। অনেকদিন অনুসন্ধানের পর দেখা পাওয়া গেল সেই সওদাগরের নৌকার। সেই নৌকায় রয়েছেন চিন্তা। শ্রীবৎস ঐ নৌকা আটক করে স্বর্ণপাটগুলো উঠিয়ে নিলেন।

সওদাগর শ্রীবৎসের নামে নালিশ করলেন রাজা বাহুদেবের আদালতে। রাজা জামাতার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ডাকলেন। শ্বশুরের কাছে আদ্যোপান্ত সবকথা খুলে বললেন শ্রীবৎস। রাজা বাহুদেব শ্রীবৎসের আসল পরিচয় পেয়ে পূর্বের আচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে অনুতাপ করতে লাগলেন।

অতঃপর সওদাগরের নৌকা থেকে চিন্তাকে উদ্ধার করা হলো। সূর্যদেবের কৃপায় তিনি ফিরে পেলেন পূর্বের রূপলাবণ্য। চিন্তা ও ভদ্রাসহ শ্রীবৎসের জীবনে সুখ ফিরে এল। লক্ষ্মীর কৃপায় রাজা শ্রীবৎস রাজত্ব ফিরে পেলেন।

এই কাহিনী এবং পূর্বোক্ত কাহিনীর ফলে সৃষ্টি হয়েছে শনির দৃষ্টি, শনির কোপ, শনির দশা, গ্রহের ফের, শনির দৃষ্টি হলে পোড়া শোল পালায় ইত্যাদি প্ৰবাদকথা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *