পরিশিষ্ট

শকুন্তলা ও সীতা : দু’টি দুঃখ-ধোয়া জীবন

শকুন্তলা ও সীতা : দু’টি দুঃখ-ধোয়া জীবন

সৌরীন ভট্টাচার্য

১৭ অক্টোবর, ১৯৭২ তারিখের ভূমিকা কথনে গোপাল হালদার লিখছেন: ‘শিক্ষাপ্রয়াসে বিদ্যাসাগর সামান্যই সাফল্যলাভ করেছিলেন,— অথচ এখনো তাঁর শিক্ষানীতি অচল নয়। সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের সাফল্য আরও সামান্য— আর তাঁর প্রয়াসও আজ মনে হয় মূলত বড় কিছু ছিল না। কিন্তু যে সাহিত্যকর্মে বিদ্যাসাগর বিশেষ আত্মনিয়োগ করতে পারেন নি, আজ আমরা দেখছি সেখানেই তাঁর সাফল্য অবিসংবাদিত এবং শাশ্বত’। এ অনেক পরবর্তী কালের বিচার এবং রায় বেশ কঠিন। বিদ্যাসাগরের জীবনে এই তিনটি প্রধান কর্মকাণ্ড। শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্য। সমাজ সংস্কারে চেষ্টা ও নিষ্ঠা সব সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের সাফল্যের প্রশ্নে আজ আর কারও খুব ভুল ধারণা নেই। বাঙালি সমাজের যে অংশে বিধবাবিবাহের প্রচলন করার আন্দোলনে বিদ্যাসাগর অত কাণ্ড করলেন সমাজের সে অংশে বাঙালি ঘরের বিধবা মেয়ের বিবাহ আজও খুব সহজে চালু হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। আজ নিশ্চয়ই সমাজের ভ্রুকুটি আগের তুলনায় কম, তবে বাঁকা চাউনির হাত থেকে এখনও ঠিক মুক্তি ঘটেনি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের সময়ে যে-বয়সের মেয়ের বৈধব্য নিয়ে সংকট তৈরি হত আজ আর সেই বয়সের মেয়ের বিয়েই হয় না সাধারণত, কাজেই সমস্যার তীব্রতা আর তেমন করে পীড়া দেয় না আমাদের। তখন এই প্রশ্নের সঙ্গে বাল্যবিবাহের প্রশ্ন ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল। বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কৌলীন্যপ্রথা ও বহুবিবাহের প্রশ্ন। সে প্রশ্ন আজ আর সেভাবে নেই। বঙ্কিম তখনই বলেছিলেন, কালের নিয়মে এ প্রথা এমনিতেই বিলীয়মান হয়ে আসছে। কাজেই তা নিয়েও অত আলোড়নের দরকার নেই।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বহুবিবাহ’ প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রণের সময় একটি ছোট ভূমিকাংশে এইরকম বলেছিলেন:

স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বারা প্রবর্ত্তিত বহুবিবাহবিষয়ক আন্দোলনের সময়ে বঙ্গদর্শনে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়প্রণীত বহুবিবাহ সম্বন্ধীয় দ্বিতীয় পুস্তকের কিছু তীব্র সমালোচনায় আমি কর্ত্তব্যানুরোধে বাধ্য হইয়াছিলাম। তাহাতে তিনি কিছু বিরক্তও হইয়াছিলেন। তাই আমি এ প্রবন্ধ আর পুনর্মুদ্রিত করি নাই। এই আন্দোলন ভ্রান্তিজনিত, ইহাই প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল, সে উদ্দেশ্য সফল হইয়াছিল। অতএব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবদ্দশায় ইহা পুনর্মুদ্রিত করিয়া দ্বিতীয়বার তাঁহার বিরক্তি উৎপাদন করিতে আমি ইচ্ছা করি নাই। এক্ষণে তিনি অনুরক্তি বিরক্তির অতীত। তথাপি দেশস্থ সকল লোকেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে, এবং আমিও তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, এজন্য ইহা এক্ষণে পুনর্মুদ্রিত করার ঔচিত্য বিষয়ে অনেক বিচার করিয়াছি। বিচার করিয়া যে অংশে সেই তীব্র সমালোচনা ছিল, তাহা উঠাইয়া দিয়াছি। কোন না কোন দিন কথাটা উঠিবে, দোষ তাঁহার, না আমার। সুবিচার জন্য প্রবন্ধটির প্রথমাংশ পুনর্মুদ্রিত করিলাম। ইচ্ছা ছিল যে, এ সময়ে উহা পুনর্মুদ্রিত করিব না, কিন্তু তাহা না করিলে আমার জীবদ্দশায় উহা আর পুনর্মুদ্রিত হইবে কিনা সন্দেহ। উহা বিলুপ্ত করাও অবৈধ; কেন না, ভাল হউক, মন্দ হউক, উহা আমাদের দেশে আধুনিক সমাজসংস্কারের ইতিহাসের অংশ হইয়া পড়িয়াছে— উহার দ্বারাই বহুবিবাহবিষয়ক আন্দোলন নির্ব্বাপিত হয়, এইরূপ প্রসিদ্ধি।

সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগরের সমস্ত আন্তরিক চেষ্টা শেষপর্যন্ত বোধহয় সমাজ কাঠামোতে মাথা খুঁড়ে মরে। অশোক সেন তাঁর বিখ্যাত বই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অ্যান্ড হিজ় ইলুসিভ্‌ মাইলস্টোন্‌স্‌-এ বিদ্যাসাগরের সংস্কার প্রচেষ্টা ও সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোর বিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে নতুন করে এপিলোগ লিখতে গিয়ে তিনি লিখছেন:

সেখানে [বইয়ের আগের সংস্করণে] আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার উপরে পশ্চিমি অভিঘাত বিষয়ে আমাদের উনিশ শতকী অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। পশ্চিমের জ্ঞান বিজ্ঞানের যুক্তিবাদী প্রভাবে বিদ্যাসাগরের নিজের ব্যক্তিগত সাড়া ছিল যেমন সাহসী তেমনি সৃষ্টিশীল। তিনি নিজে ছিলেন বড় মাপের একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তা সত্ত্বেও তিনি ইংরেজির জ্ঞান এবং বিজ্ঞান শিক্ষার উপর জোর দিয়ে প্রাচীনপন্থী শিক্ষার মোট পরিসর কমাতেই চেয়েছিলেন। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের উপরে জোর দেওয়ায় তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অগ্রগণ্য।

পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের কর্মপ্রচেষ্টার বিচার বিবেচনা করতে গেলে তাঁর মনের এই যুক্তিবাদী ঝোঁক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না। উপরের উদ্ধৃতিতে যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কথা বলা হয়েছে তার চেহারা এবং বিদ্যাসাগরের হাতে তার প্রয়োগের বিশিষ্টতার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হচ্ছে। স্বাভাবিক যে, একটা নাড়াচাড়া আমাদের মনোজগতে পড়বে। তাতে অনেক উচ্চকিত ধরনধারণের সন্ধানও আমরা পাব। ইয়ং বেঙ্গলের কাহিনি খানিকটা সেই উচ্চকিত চেহারার পরিচয় বহন করে। যেকোনও জাতির মনোগত ইতিহাসের অনেক জটিল স্তর থাকে। ঔপনিবেশিক সমাজের ক্ষেত্রে এইসব জটিলতার চেহারা স্বভাবত অনেক স্বতন্ত্র। বিশেষত ভারতের মতো প্রাচীন একটা দেশে। নানা সংস্কৃতির মিশ্রণের মধ্যে দিয়ে গড়ে-ওঠা বহু স্তরান্বিত তার সাংস্কৃতিক কাঠামো। এত যে বিভিন্ন উপাদান, তার অনেক কিছুকে বাদ দিয়ে কোনও একদিকে ঝোঁক বেশি পড়ে গেলে বিপদ অনিবার্য। কোন সময়-সংযোগে কার বিপদ কখন কোন দিক দিয়ে যে আসবে তা আগে থেকে আন্দাজ করাও শক্ত। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে অন্তত রাষ্ট্রিক মঞ্চের স্তরে ভারতের প্রাচীন গৌরবগাথাকে যে-একাধিপত্যের আসনে বসাবার রাজনৈতিক আয়োজন চলছে তাতে অনেকেই ত্রস্ত। এবং অনেকের তত্ত্বপ্রকল্প অনুসারে যুক্তির পথ থেকে সরে আসা, সে যেকোনও ক্ষেত্রেই হোক-না-কেন, কাজের কথা হবে না। এই কারণে আমাদের ভারতীয় নবজাগরণ বলে যে-চিন্তাপ্রক্রিয়াকে নির্দেশ করা হয় তার কোনওরকম সমালোচনাত্মক দৃষ্টিকে তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। বস্তুজগতে আধুনিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে লাগোয়া যেমন একটা বাস্তুচ্যুতির দিক আছে, তেমনই ঔপনিবেশিক সমাজের মনোজগতের বিকাশে একটা আত্মচ্যুতির বিপদ আছে। প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক জীবনের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান নির্বিচারে আমাদের ব্যাবহারিক জীবনের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে বর্জিতের তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ে। অথচ তার অনেক কিছুর মধ্যে প্রাণের স্পন্দন তখনও হয়তো একেবারে নিভে যায়নি, অন্তত তার অনেক উপাদানকে কালোপযোগী করে ঘষে-মেজে নিতে পারলে আজও তাদের জীবন্ত প্রাণের শরিক করে তোলা যেতে পারে। আজ যে নানা দেশের নানা সংস্কৃতির উপাদান বেছে বেছে বিকল্প চিকিৎসার কথা ভাবা হচ্ছে তা এইরকমই এক উদাহরণ। বিকল্প কৃষি চিন্তাও আজ এমন কিছু দুরধিগম্য নয়। আজকের পরিবেশ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে এরকম নানা বিকল্পের কথা ভাবতে হচ্ছে মানুষকে। সত্যি কথা বলতে কী, আধুনিক বিশ্বায়নের একরঙা প্রলেপের সামনে মানুষ অস্থির হয়ে বিচিত্রমুখী সন্ধানের পথে এগোচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য রকমের এক দুনিয়া যে সম্ভব সে স্লোগানও চিন্তারাজ্যে বেশ জায়গা করে নিচ্ছে।

এই দিক থেকে ভাবতে গেলে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাভাবনার কোনও কোনও অবস্থান নিয়ে আজ প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য তাঁর ভাবনা যত জরুরি, সে ব্যাপারে তাঁর উদ্যমও তত প্রশংসনীয়। তেমনি শুধু ‘দেশি’ শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং সে ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন জগতে প্রবেশের আয়োজনও অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ। কিন্তু এই পর্বে তাঁর মনে বাসা বেঁধেছিল এই ধারণা যে, সত্য দুই প্রকার হয় না, সত্য কেবল এক প্রকার। আর সম্ভবত এই ধারণার প্রসারণ হিসেবে পাচ্ছি এই অবস্থান যে, ভারতীয় দর্শনের অনেকগুলি প্রকরণ আছে যা ভ্রান্ত, তা পড়াবার দরকার নেই, তবে বাস্তব বিবেচনায় এখনই না পড়িয়ে হয়তো পারা যাবে না, কিন্তু তার প্রতিষেধক হিসেবে সুবিবেচনার সঙ্গে অন্যান্য গ্রন্থ পড়ানো প্রয়োজন।

শিক্ষা পরিষদের আহ্বানে কাশীর সরকারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে.আর. ব্যালান্টাইন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম বিষয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন তাতে নির্দেশিত পাঠ্যপুস্তক বিষয়ে অনেক জায়গায় বিদ্যাসাগরের মতভেদ ছিল। মিল-এর লজিক প্রসঙ্গে ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাব ছিল তাঁর নিজের রচিত মিল-এর লজিকের সংক্ষিপ্তসার পাঠ্য করা হোক। বিদ্যাসাগরের বক্তব্য: ‘বর্ত্তমান অবস্থায়, আমার মতে, সংস্কৃত কলেজে মিলের গ্রন্থ পড়ান একান্ত প্রয়োজন। মিলের পুস্তকের মূল্য অধিক;— ডা. ব্যালান্টাইনের সংক্ষিপ্তসারের প্রচলন প্রস্তাবের প্রধান কারণ ইহাই মনে হয়। আমাদের ছাত্রদের প্রামাণিক গ্রন্থসমূহ একটু বেশী দাম দিয়াও কিনিবার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে; কাজেই মূল্যাধিক্যের জন্য এই উৎকৃষ্ট গ্রন্থের প্রচলন হইতে বিরত থাকিবার কারণ নাই। ডা. ব্যালান্টাইন বলেন, তাঁহার সংক্ষিপ্তসার মিলের লজিকের মুখবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করা যাইতে পারে। কিন্তু মিল নিজে তাঁহার পুস্তকের ভূমিকায় বিশেষভাবে লিখিয়া গিয়াছেন যে, আর্চবিশপ হোয়েট্‌লির তর্কশাস্ত্রসম্বন্ধীয় গ্রন্থই তাঁহার লজিকের সর্বোৎকৃষ্ট উপক্রমণিকা।’ ডা. ব্যালান্টাইন-এর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধের আরও জায়গা ছিল। কিন্তু খেয়াল করা দরকার যে, এই দু’জনের ফারাক শুধু এই বইয়ের বদলে সেই বইয়ের পছন্দ, এরকম বাইরের ব্যাপার নয়। মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল বলেই মনে হয়। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাব ছিল, ইংরেজি অনুবাদ সমেত বেদান্ত, এবং ন্যায় ও সাংখ্য দর্শন পড়ানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের অবস্থান— বেদান্তসার সংস্কৃত কলেজে আগে থেকেই পড়ানো হয়, এর ইংরেজি অনুবাদ পড়ানো যেতে পারে। আর অন্য দু’টি বিষয়ে প্রস্তাবিত তর্কসংগ্রহ ও তত্ত্বসমাস বই দু’টি ‘নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর গ্রন্থ’।বিদ্যাসাগর মনে করেন কলেজের পাঠ্যসূচিতে এই বইয়ের চেয়ে ভাল বই ইতিমধ্যেই নির্দেশিত আছে। কিন্তু আরও গুরুতর মতভেদ বার্কলে নিয়ে। বিদ্যাসাগরের মতে—

বিশপ বার্কলের Inquiry সম্বন্ধে আমার মত এই যে, পাঠ্যপুস্তকরূপে ইহার প্রবর্ত্তনে সুফল অপেক্ষা কুফলের সম্ভাবনাই অধিক। কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে সাংখ্য ও বেদান্ত না পড়াইয়া উপায় নাই। সে সকল কারণের উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন, এ সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈধ নাই। মিথ্যা হইলেও হিন্দুদের কাছে এই দুই দর্শন অসাধারণ শ্রদ্ধার জিনিস। সংস্কৃতে যখন এগুলি শিখাইতেই হইবে, ইহাদের প্রভাব কাটাইয়া তুলিতে প্রতিষেধকরূপে ইংরেজিতে ছাত্রদের যথার্থ দর্শন পড়ান দরকার। বার্কলের Inquiry বেদান্ত বা সাংখ্যের মত একই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছে; ইউরোপেও এখন আর ইহা খাঁটি দর্শন বলিয়া বিবেচিত হয় না, কাজেই ইহাতে কোন ক্রমেই সে কাজ চলিবে না। তা ছাড়া হিন্দু-শিক্ষার্থীরা যখন দেখিবে, বেদান্ত ও সাংখ্য-দর্শনের মত একজন ইউরোপীয় দার্শনিকের মতের অনুরূপ, তখন এই দুই দর্শনের প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধা কমা দূরে থাকুক, বরং আরো বাড়িয়া যাইবে। এ অবস্থায় বিশপ বার্কলের গ্রন্থ পাঠ্য পুস্তকরূপে প্রচলন করিতে আমি ডা. ব্যালান্টাইনের সহিত একমত নহি।

এইসব তাত্ত্বিক অবস্থানের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মনের র‌্যাশনালিস্ট বা যুক্তিপ্রাধান্যবাদী চেহারার পরিচয় ধরা পড়ে। এই কথাটিকে যদি আমরা শুধু যুক্তিবাদী এই অর্থে গ্রহণ করি তা হলে মুশকিল হবে। কারণ সেক্ষেত্রে র‌্যাশনালিজ়মের যেকোনও সমালোচনার অর্থ দাঁড়াতে পারে যেন যুক্তির বদলে অযুক্তির প্রবর্তনার কথা বলা হচ্ছে। তা কিন্তু আদপেই নয়। প্রশ্ন যুক্তি কিংবা অযুক্তির নয়। র‌্যাশনালিস্ট ধাঁচের চিন্তায় যুক্তিকে যে নির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করা হয় প্রশ্ন সেই নির্দিষ্ট রকমের ব্যবহার নিয়ে। এই যেমন, যুক্তি-অযুক্তি, সত্য-মিথ্যা, সংস্কার-কুসংস্কার, এমনকী ভাল-মন্দ, এই ধরনের জোড়া-লাগানো শব্দগুলিকে নিয়ে বেশ সমস্যা আছে। এর বেশিরভাগ শব্দই একটি ধারণা ও তার বিপরীতে আর একটি উলটো ধারণার যোগ করা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন এই যে, যেকোনও ধারণার থেকে আরম্ভ করে তার একেবারে বিপরীতে গিয়ে পৌঁছতে হলে আমাদের বস্তুত অনেকগুলো স্তর কিন্তু পেরতে হয়। নইলে ভাবতে হয় যে একলাফে আমরা একটা অবস্থা থেকে তার বিপরীত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছচ্ছি। অনেকগুলো স্তর পেরনোর কথায় এসে পড়ে একটা ক্রমবিবর্তনের কথা। একটা ধারণা বদলাতে বদলাতে অন্যপারে যেন গিয়ে পৌঁছয়। তা হলে বাস্তব জীবনে এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই থাকে যে, একটা ধারণা ঠিক সত্য বলা হয়তো যাচ্ছে না, কিন্তু তাই বলেই সেটা অতএব মিথ্যা হয়ে যায় না। এই যে ‘অতএব’ সূত্রে বিপরীতে পৌঁছনো, এটা এক ধরনের চিন্তার আদল। এই আদলে ক আর ক-এর অস্বীকৃতি— এর ভিতরে কোনও মধ্যবর্তী অবস্থানের কল্পনার অবকাশ নেই। যুক্তি প্রয়োগের যে আদলে এই ধাঁচটা ব্যবহার করা হয় সেই ধাঁচে যুক্তির কলকব্‌জাগুলো খুব বেশি নমনীয় থাকে না। ক আর ক-এর অস্বীকৃতির মধ্যে যদি একাধিক স্তরের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় তা হলে প্রয়োজনে ওই দুই ধারণার মধ্যবর্তী স্তরগুলিকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে আমরা আরও নানা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের যুক্তিক্রম তাতে করে অন্য অনেক সম্ভাবনাকে গ্রহণ করায় সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। এরকম হলেই যে আমরা যুক্তির পথ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছি তা বলা সংগত হবে না। কিন্তু ওই যে নানা সম্ভাবনাকে গ্রহণ করার পথে পা বাড়ানোর একটা জায়গা করে নেওয়া গেল তার সুবাদে আমরা আমাদের পরিচিত জগৎ থেকে অন্য অনেক রকমের উপাদান ব্যবহার করতে পারি। আবেগ অনুভব অনুমান বোধ আন্দাজ ইত্যাদি নানা জিনিসের সমারোহে আমাদের আলোচনার ধরন জীবনের বিচিত্রতাকে ছুঁতে পারার জন্য আরও একটু বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে হয়তো। এতে যুক্তি বর্জন করার প্রস্তাব নেই, যুক্তিসর্বস্বতাকে একটু হয়তো খর্ব করার কথা আছে। তাই র‌্যাশনালিস্ট ধাঁচের যে কাঠামো থেকে সরে আসার কথা চিন্তা করছি আমরা সেটাকে বলা যেতে পারে যুক্তিপ্রাধান্যবাদী ধরন। বিদ্যাসাগর যখন ভারতীয় দর্শনের কোনও কোনও শাখাকে ভ্রান্ত দর্শন বলে বর্ণনা করছেন তখন মনে হয় তিনি এইরকম কোনও যুক্তিপ্রাধান্যবাদী চিন্তাকাঠামোর প্রভাবে তা করছেন।

বিদ্যাসাগরের সময়কালে এইরকম আদলে চিন্তা করার একটা আবহ তৈরি হচ্ছিল এবং নির্দিষ্ট বোধগম্য একটা পরিপ্রেক্ষিত রচিত হয়েই ছিল। তখনকার সংস্কৃত ভাষাশ্রিত দর্শন ও জ্ঞান চর্চার একটা বড় অংশের মধ্যে পূর্বাচার্যদের কর্তৃত্বের ছাপ-লাগা সূত্রের যে প্রবল প্রতাপান্বিত অবস্থান তার সামনে দাঁড়িয়ে নবলব্ধ ইউরোপীয় বিদ্যার দিকে হাত বাড়িয়ে শুধু যুক্তির দ্বারস্থ হওয়ার মধ্যে একটা নতুন দিশা সন্ধানের চেষ্টা ছিল এমন মনে করা অসম্ভব নয়। বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রথম প্রস্তাবের শুরুতে এরকম বিবাহ কর্তব্যকর্ম কি না তা বিচার করার কথা বলতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্যকর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্যকর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্যকর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্যকর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন’ (বাঁকা হরফ আমাদের)।

আমাদের বলার কথাটা এই যে, যুক্তিমাত্র অবলম্বন না করে তিনি যে শাস্ত্রীয় বিচারের পথে পা বাড়ালেন তাতেও কিন্তু তিনি অযুক্তির পথে যাচ্ছেন না। শুধু যুক্তি প্রয়োগের আর একটা প্রকরণ ব্যবহার করছেন। এই সম্ভাবনাগুলোকে তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম বিবেচনার সময়ে আর ঠিক পূর্ণ মর্যাদায় স্বীকৃতি দিতে পারছেন না। আসলে প্রথাবদ্ধতার অন্ধকার পেরিয়ে অন্য সম্ভাবনা তখনই ঠিক তাঁর মনে ধরা দিতে পারেনি। তাই সংস্কৃতের বিপরীতে ইংরেজি শিক্ষার প্রশ্নে তিনি হয়তো একটু বেশি একদিকে টাল খেয়েছিলেন। আজকের অনুভব ও অভিজ্ঞতায় দাঁড়িয়ে আমরা যেভাবে খানিকটা সহজ দৃষ্টিতে হয়তো-বা সাংখ্য-বেদান্তের দিকে তাকাতে পারব বিদ্যাসাগরের সময়ে সে সহজ দৃষ্টি তখনও তৈরি হয়নি। আমাদের কাছে আজ এই বিতর্ক দুই বিদ্যাব্যাপারের বিতর্ক, সেকালে তখনও এটা ছিল দুই ভিন্ন জীবনাদর্শের বিতর্ক। তার সঙ্গে জড়িয়ে অনেক আবেগ, স্মৃতি এবং আপ্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচরণের অনিষ্টকারী কর্মফলের ভয়। বিদ্যাসাগরের লড়াই শুধু বিদ্যাক্ষেত্রের লড়াই ছিল না, তা ছিল রীতিমতো এক অন্যপ্রকার জীবনযাপনের লড়াই।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত এবং ইংরেজির ভারসাম্যের সমস্যা ছাড়াও আরও অন্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শিক্ষা নিয়ে সরকারের খুব সুচিন্তিত পরিকল্পনা কিছু ছিল না। সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় শিক্ষার জন্য সরকার কিছু খরচ করতেন এই পর্যন্ত। ‘ভারতবাসী জনসাধারণের মধ্যে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রচারই ব্রিটিশ-রাজের মহৎ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এবং শিক্ষা বাবদ সকল মঞ্জুরী অর্থ শুধু ইংরেজী শিক্ষার জন্য ব্যয় করিলেই ভাল হয়’। ১৮৩৫-এ গবর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্ক-এর মিনিট-এ এই মর্মে সরকারি নীতির এক অবস্থান জানা গেল। সবমিলিয়ে ইংরেজি, সংস্কৃত, আরবি, এই তিন ভাষায় শিক্ষার খানিক চেষ্টা নাহয় হল। কিন্তু আপামর দেশীয় জনসাধারণের শিক্ষাসমস্যার সমাধান এতে হবে কেন? তার জন্য চাই দেশি ভাষায় শিক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে স্যার হেনরি হার্ডিঞ্জ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৮৪৪-এর অক্টোবরে মাসিক ১৮৬৫ টাকা ব্যয়ে বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার নানা স্থানে ১০১টি পল্লি পাঠশালা স্থাপন করেন। এইসব পাঠশালার শিক্ষক নির্বাচনের ভার ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারি মার্শাল এবং বিদ্যাসাগরের উপরে।

কিন্তু এইসব পাঠশালা স্থাপনে বিশেষ ফললাভ হল না। উপযুক্ত বই নেই, শিক্ষক নেই, তত্ত্ববধায়কের অভাব। সবমিলিয়ে অল্পদিনের মধ্যে বোঝা গেল এই পদ্ধতিতে বিশেষ ফললাভের সম্ভাবনা নেই। সরকারও এদিকে আর বেশি উৎসাহ দেখাননি। পরে ১৮৫৩-৫৪ সালে আবার বাংলা ভাষায় শিক্ষাবিস্তার নিয়ে সরকারি মহলে নাড়াচাড়া পড়ল। ১ মে ১৮৫৪-তে বাংলায় ছোটলাটের পদ সৃষ্টি হল। প্রথম ছোটলাট নিযুক্ত হলেন ফ্রেডারিক জে. হ্যালিডে। ইনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের বিশেষ গুণগ্রাহী। বিদ্যাসাগর ইতিমধ্যেই দেশীয় ভাষায় শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারে চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। হ্যালিডে সরকারি প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগরকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু শিক্ষা পরিষদের অনেকের সে-ব্যাপারে দ্বিধা থাকায় সে-প্রচেষ্টা খুব ফলবতী হয়নি।

ক্রমে ক্রমে প্রশাসনিক কাঠামোতেও অনেক পরিবর্তন দেখা দিল। শিক্ষাসংক্রান্ত বিখ্যাত উড্‌স্‌ ডেসপ্যাচ (১৮৫৪) অনুসারে এখানকার শিক্ষা পরিকাঠামোতে বদল এল। শিক্ষা পরিষদের বদলে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্‌স্‌ট্রাকশনের পদ সৃষ্টি হল। প্রাথমিক তথা দেশীয় ভাষার মধ্য দিয়ে শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা অনেকাংশে সরকারি নিয়মকানুনে বাঁধা পড়ায় হ্যালিডে-র ব্যক্তিগত উদ্যম বা বিদ্যাসাগরের আন্তরিক আবেগতপ্ত ভূমিকা মনে হয় খানিকটা সংকুচিত হয়ে এল। ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে নিজ উদ্যমেই অনেক দূর এগিয়েছিলেন। ১৮৫৭-র নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র মে মাসের মধ্যে তিনি মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।৯ সরকারি সাহায্যের প্রত্যাশা ছিল, সে-সাহায্য শেষপর্যন্ত পেয়েওছিলেন, কিন্তু টানা-পোড়েন কিছু কম ছিল না। সবমিলিয়ে সরকারি চিন্তা ও ধরনধারণের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের দূরত্ব বেড়ে চলছিল। সরকারি কর্মকাণ্ডের চৌহদ্দিতে নিজের কর্মপ্রকল্পের স্বচ্ছন্দ বিকাশের অবকাশ ক্রমশই কমে আসছিল। বিদ্যাসাগর সরকারি কাজ থেকে অব্যাহতির পথে গেলেন। ১৮৫৮-র নভেম্বরে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তখন তাঁর বয়স ৩৮ বছর। শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। পদত্যাগপত্রে স্বাস্থ্যভঙ্গের কথা ছিল। কিন্তু সেখানে একটা জরুরি কথা ছিল এইরকম: ‘যে মুহূর্ত্তে স্বাস্থ্য পুনয়ায় ফিরিয়া পাইব, আমার ইচ্ছা, তন্মুহূর্ত্ত হইতে আমার সময় এবং চেষ্টা প্রয়োজনীয় বাংলা পুস্তক প্রণয়নে এবং সঙ্কলনে নিয়োগ করিব। স্বদেশবাসীর জ্ঞানবিস্তার সম্পর্কে সরকারী কর্ম্মের সহিত আমার সাক্ষাৎ যোগ ছিন্ন হইয়া যাইতেছে সত্য, তবুও আমার অবশিষ্ট জীবন এই মহৎ এবং পবিত্র কর্ম্মের অনুষ্ঠানেই ব্যয়িত হইবে। এ বিষয়ে আমার গভীর ও আন্তরিক অনুরাগ কেবল আমার জীবনের সহিত অবসান লাভ করিতে পারে’।১০

সারাজীবন ধরে নানা কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে এই কাজের মানুষটি এসে পৌঁছলেন বাংলা সাহিত্যের তীরে। সম্ভবত এখানেই তাঁর জীবনের সফলতম পরিণতি। এই যে এত কাজ তিনি করতে চান অথচ নানা সংকটের মোকাবিলায় বারবার তাঁকে সেসব থেকে সরে আসতে হচ্ছে এর মধ্যেই তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডির বীজ অঙ্কুরিত। আমাদের প্রচলিত ভাবমূর্তিতে বিদ্যাসাগর এক আপসহীন উন্নতশির প্রতিবাদী, সনাতনী প্রথার তোয়াক্কা-না-করা দুর্জয় বীর। এই বীরপুরুষের মুখে কোনও বিষাদের কালো ছায়া আমরা ঠিক দেখতে চাই না কখনও। অথচ এরই মধ্যে তাঁর মনের সংবেদন। আমরা সে-জিনিসকে ভেবেছি করুণাঘন পরোপকারের মহৎ ব্রত পালনের আঙ্গিকে। তাতে করে প্রাতঃস্মরণীয়ের কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে আমাদের সুবিধা হয়। আমাদের বিচারবোধের উপরে তাতে কোনও চাপ পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সরাসরি চলে এসেছেন তাঁর সাহিত্যের খোঁজে। ১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ অপরাহ্ণে বিদ্যাসাগর স্মরণার্থসভার সাংবৎসরিক অধিবেশনে এমারল্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে পঠিত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্বের উপরে জোর দিয়ে শুরু করেছেন। তার পরেই তিনি বলেন: ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনো সাহিত্য-সম্পদে ঐশ্বর্যশালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষয় ভাবজননীরূপে মানব-সভ্যতার ধাত্রীগণের ও মাতৃগণের মধ্যে গণ্য হয়— যদি এই ভাষা পৃথিবীর শোকদুঃখের মধ্যে এক নূতন সান্ত্বনাস্থল, সংসারের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে এক মহত্ত্বের আদর্শলোক, দৈনন্দিন মানবজীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে সৌন্দর্যের এক নিভৃত নিকুঞ্জবন রচনা করিতে পারে, তবেই তাঁহার এই কীর্তি তাঁহার উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারিবে’।১১

প্রকৃত সাহিত্যরচয়িতার কাছ থেকে কী আমাদের প্রত্যাশা হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথ এই ছোট উদ্ধৃতিতে তার প্রায় একটা যেন সূচি বানিয়ে দিয়েছেন। এবং এই সূচি প্রণয়নের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নিজের আশাদৃষ্টিও উদ্ঘাটিত হয়ে পড়েছে। সাহিত্য কী করে? ‘পৃথিবীর শোকদুঃখের মধ্যে এক নূতন সান্ত্বনাস্থল’ হবে আমাদের এ ভাষা। বিদ্যাসাগরকে ছুঁয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষার দিগ্‌বলয় কতদূর বাড়িয়ে নিয়ে গেলেন! সংসারের ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার মধ্যে আমাদের ভাষা এক মহৎ আদর্শলোক স্থাপন করবে। মানুষের জীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে সে-ভাষা সৌন্দর্যের এক নিভৃত নিকুঞ্জবন রচনা করে দিয়ে যাবে। এত আমাদের করার আছে! এ আমরা ধারণ করব কেমন করে! বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে ট্র্যাজিক বিষাদের ছায়ার কথা বলেছি রবীন্দ্রনাথ কি এখানেই তার বীজের সন্ধান পেতে চান? ‘সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন’।১২

শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগরের এই নির্বাসনের দুই আশ্রয়স্থল। এক তাঁর বাংলা সাহিত্য রচনা আর অন্যটা কার্মাটাঁড়ের সরল জীবনের স্বেচ্ছানির্বাচন। অনেক পরের এক অনুজ বাংলা সাহিত্যসেবী নিজের বোধের মুখোমুখি হতে গিয়ে প্রশ্নটা তুলেছিলেন:

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!

কে থামিতে পারে এই আলো আঁধারে

সহজ লোকের মতো!

অথবা,

হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?

বাল্‌টিতে টানি নি কি জল?১৩

বিদ্যাসাগরেরও ছিল কি কোনও অভিমানী গ্লানিবোধ। বিষণ্ণ অস্তিত্বের মোকাবিলায় তাঁকেও দাঁড়াতে হয়েছিল নিজের বোধের মুখোমুখি। রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর ছিলেন একেবারে একক। বঙ্গদেশে তাঁর মতো আর কেউ ছিল না। ‘এদেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন’।

মার্কিন গবেষক ব্রায়ান হ্যাচার বিদ্যাসাগরের জীবন ও উত্তর-জীবন একসঙ্গে বিবেচনা করার যে প্রস্তাব কার্যকর করার চেষ্টা করেছেন তার তাৎপর্য সম্ভবত এখানে যে, এই দুই পর্বই একসঙ্গে না দেখতে পারলে বিদ্যাসাগরের হদিশ করা যাবে না।১৪ উত্তর-জীবন মানে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে আমাদের যে অলংকৃত কাহিনিমালা রচিত হয়েছে তার সবটুকু। লেখক একটা রূপকল্প ব্যবহার করেছেন। কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের নন্দন কানন বাড়িতে যে মূর্তি স্থাপিত হয়েছে তার চারপাশ এত সুন্দর গাছ-গাছালিতে সাজানো যে মূর্তিটিকেই নাকি দেখতে এবং খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধা হয়।১৫ ব্রায়ান হ্যাচার যত মালমশলার খতিয়ান দিয়েছেন তাতে বিদ্যাসাগরের সাহিত্য রচনাবলিও যেন অন্তর্ভুক্ত।

বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিমূর্তি পুনরুদ্ধার করা আপাতত আমাদের লক্ষ্য নয়। তাঁর সাহিত্য রচনা আমাদের কাছে বর্তমানে কোনও অন্য গবেষণার উপকরণ নয়। সে-রচনার সাহিত্য চরিত্রই আমাদের বিচার্য। যদিও সাহিত্য চরিত্র বলতেই-বা কী বোঝায় সে-প্রশ্ন অত সহজে মীমাংসা করা যাবে বলে মনে হয় না। এখন তার দরকারও নেই। তবে একটা কথা পরিষ্কার বলে নেওয়া ভাল। বিদ্যাসাগরের সাহিত্য গদ্যে রচিত। আমরা তাঁর সাহিত্যের আলোচনা বলতে তাঁর গদ্যশৈলী নিয়ে আলোচনাকেও বোঝাচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে বিদ্যাসাগরের গদ্য নিয়ে আমাদের লেখালেখিতে কথাবার্তা একেবারে নেই তা নয়। বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব যথেষ্ট স্বীকৃত। আমরা গদ্যশৈলী বাদ দিয়ে তাঁর সাহিত্যশৈলী নিয়ে কিছু কথা তুলতে চাই। সাহিত্যের ইতিহাসকার সুকুমার সেন লিখছেন: ‘অনুবাদ তর্কাতর্কি পাঠ্যপুস্তক ও সাময়িক পত্রিকার চলার বেগে বাঙ্গালা গদ্যের রাস্তা জাগিয়া উঠিতেছিল। সেই পদবী বা চলার-পথকে রথ্যা বা রাজপথে পরিণত করিয়া দিলেন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র, পরে সেই কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)। এই কাজ করিতে পারিয়াছিলেন তিনি নিজের গুণপনায়। বাঙ্গালা ভাষার পিতামহী-ধাত্রী সংস্কৃত ভাষার তিনি নাড়ীনক্ষত্র অবগত ছিলেন। তাঁহার সাহিত্যবোধও অত্যন্ত সূক্ষ্ম প্রগাঢ় ছিল। এই দুই কারণে তিনি বাঙ্গালা গদ্য রচনায় সমতল মসৃণ ও মনোহর সরণীর পত্তন করিতে পারিয়াছিলেন।’১৬ সুকুমার সেন যথার্থ বলেছেন। গদ্যশৈলী নিশ্চয়ই সাহিত্য রচনার বড় উপকরণ। তবে তা কখনওই একমাত্র উপকরণ হতে পারে না। প্রাণে গান না থাকলে যেমন বাঁশিতে গান বাজে না, তেমনি অন্তরে সাহিত্যবোধ না থাকলে শুধু গদ্যে সাহিত্যের সুর ধরা পড়ে না।

একটু ভাবলে দেখা যাবে যে বাঙালি অনেক কিছু করেনি। রবীন্দ্রনাথের তালিকায় আছে— সে কোনও কাজ আরম্ভ করে, শেষ করে না। বিদ্যাসাগরের সাহিত্য ব্যাপারটায় আমরা তেমন মনোযোগ দেওয়া আরম্ভই করিনি, শেষ করা তো দূরের কথা। আমরা তাঁকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতা ঠাউরে তাঁর লেখালেখির দিকে মনই দিইনি আর কী! তাঁর সংস্কারধর্মী রচনাগুলিকে দেখেছি বড়জোর তাঁর প্রচারপুস্তিকা হিসেবে। সেসব রচনারও শৈলীবিচার করা আমরা তেমন জরুরি মনে করিনি, এমনকী যুক্তিবিচারেও তেমন মন দেওয়া হয়নি।

শকুন্তলা ও সীতার বনবাস বিদ্যাসাগরের দু’টি প্রধান সাহিত্যকর্ম। আমরা প্রথমেই লক্ষ করতে চাইব যে, বিদ্যাসাগর তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে জীবনে যেটুকু অবসর পেয়েছেন তার মধ্যে সাহিত্য রচনার জন্য বেছে নিয়েছেন আমাদের দু’টি দুঃখিনী মেয়ের কথা। দু’জনেই রাজরানি। কিন্তু অসীম দুঃখের পথ পার হতে হয়েছে তাঁদের। একজন তো যখন সুখের মুখ দেখলেন তখন নাটক শেষ হয়ে গেল। আর অন্যজন সুখের মুখ দেখলেনই না এই জন্মে। দু’জনেরই দুঃখের মধ্যে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাঁদের অহেতুক অবমাননা। নানাভাবে মেয়েদের সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিদ্যাসাগরের সারাজীবনের কাজ। বিধবাবিবাহ প্রচলন করা ও স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার করা তাঁর জীবনের দুই শ্রেষ্ঠ সামাজিক কর্ম। সাহিত্যেও যে তিনি শকুন্তলা ও সীতাকে নিয়ে দুঃখের কাহিনিই লেখেন এর মধ্যে একটা বৃত্ত পূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত আছে। হয়তো কোনও সচেতন সিদ্ধান্তে হয় না এসব জিনিস। নাটক হিসেবে কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌ স্বাভাবিকভাবে বিদ্যাসাগরের অতি প্রিয় নাটক। এ নাটকের কথা তিনি বিস্তারে লিখেছেন তাঁর সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাবে। এই প্রস্তাব ১৮৫৩ সালের রচনা। অর্থাৎ শকুন্তলা-র এক বছর আগে। এই প্রস্তাবের আলোচনা থেকে বোঝা যায় বিদ্যাসাগর সাহিত্য রচনাকে সাহিত্য হিসেবেই বিচার করতে কতটা পারঙ্গম ছিলেন। সমাজ সংসারের অন্য কোনও মহৎ ব্রত সাধনের চেয়ে সৌন্দর্যসৃষ্টি যে কোনও উপেক্ষণীয় কাজ নয় এ বোধ বিদ্যাসাগরের বিলক্ষণ ছিল। এবং এই সৌন্দর্যসৃষ্টিকে তিনি রসের ঘরেই দেখতে চেয়েছেন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র তাঁর অধিগত। শকুন্তলা-কে তিনি আদিরসের কাব্য হিসেবেই দেখেন, আর ভবভূতির উত্তরচরিত-কে দেখেন করুণরসের সৃষ্টি হিসেবে। শকুন্তলা নিয়ে তাঁর অবস্থান হল: ‘সংস্কৃতভাষায় যত নাটক আছে, শকুন্তলা সে সকল অপেক্ষা সর্বাংশে উৎকৃষ্ট, তাহার সন্দেহ নাই’।১৭ শকুন্তলা নাটকের বিষয়বস্তুর বর্ণনা দিয়ে তাঁর শেষ বিচার এই যে, রাজার সঙ্গে তপোবন-কন্যার প্রণয় মিলন ও বিরহের চিত্র উপস্থাপিত করায় ‘কালিদাস স্বীয় অলৌকিক কবিত্বশক্তির একশেষ প্রদর্শন করিয়াছেন’। বিদ্যাসাগর যেমন অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর কবিত্বশক্তির অলৌকিকত্বের কথা বলেছেন, তেমনই চন্দ্রনাথ বসু আবার এই নাটকের নাটকত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিশেষভাবে। চন্দ্রনাথ বসু তাঁর শকুন্তলাতত্ত্ব পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন: ‘বঙ্কিম! তুমি আমাকে সহোদরের ন্যায় ভালবাস বলিয়া আমার এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানি তোমার নামে উৎসর্গ করিতেছি না। তোমার ভারতভূমির প্রতি ভালবাসা দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি বলিয়াই এই গ্রন্থখানি তোমাকে উপহার দিলাম। ইহাতে তোমার ভারতের এবং আমাদের জগতের একখানি অনুপম রত্ন সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা বলিয়াছি’।১৮ এই উৎসর্গের বয়ান থেকে অনুমান করা যায় যে, চন্দ্রনাথ বসুর দৃষ্টিতে এই নাটক নিয়ে একটা ভারত মাত্রার কথা কাজ করেছিল। যদিও তিনি জগতের কথাও বিস্মৃত হননি। বিদ্যাসাগরও নাটকটিকে সংস্কৃত ভাষা পরিসরের মধ্যে দেখছেন কিন্তু একটানে স্যার উইলিয়াম জোন্স-এর অনুবাদ মারফত ফর্স্টার-কৃত জর্মন অনুবাদের ভিত্তিতে পরিচয় গ্রহণ-করা গ্যয়টে-র প্রশস্তির কথা তুলছেন ভারতপরিধির বাইরে থেকে। আমাদের সংস্কৃতি ও জাতীয়তার চর্চার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই সূক্ষ্ম ফারাক খেয়াল করা দরকার। ভারত বনাম পাশ্চাত্যের বাঁধা সড়কের বাইরে নিজেদের স্থাপিত করেও দুই দৃশ্যপটেই নজর দেওয়া সম্ভব এবং তা প্রয়োজনীয়, এই পদ্ধতিগত অবস্থান বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকা জরুরি।

আমাদের একালের লেখক শিশিরকুমার দাশ তাঁর অলৌকিক সংলাপ নামের চমৎকার বইটিতে আরিস্ততল ও কালিদাসের মধ্যে এক সত্যিকারের অলৌকিক সংলাপের আয়োজন ফেঁদেছেন।১৯ আরিস্ততল একদিন কালিদাসকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ব্যাপারটা এক নাটকের প্রতিযোগিতা নিয়ে। সেখানে কালিদাসের লেখা অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌ নামের একটা নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। আরিস্ততল-এর মনে হচ্ছে নাটকটি নিয়ে তাঁর কিছু সমস্যা আছে। সেই সমস্যা নিয়ে তিনি কালিদাসের সঙ্গে একটু আলোচনা করতে চান। তাঁর নাট্যতত্ত্বের সঙ্গে এই নাটকটিকে তিনি মেলাতে পারছেন না। কালিদাসের বিনীত বক্তব্য, সেক্ষেত্রে এই নাটককে পুরস্কার না দিলেই তো হয়। আরিস্ততল-এর সেখানেই সমস্যা হচ্ছে। কারণ এ নাটক তিনি অস্বীকারও করতে পারছেন না।

এই শকুন্তলা নাটক বিদ্যাসাগরকে খুব সহজে মুক্তি দেয়নি। ১৮৫৪-তে তিনি এর উপাখ্যানভাগ নিয়ে নিজের মতো বই লিখলেন। নিজের মতো, তবে অবশ্যই কালিদাসের হাত ধরে। অনেক জায়গায় ব্যাপারটা অনুবাদেরই মতো। কিন্তু অনুবাদ হলেও তাঁর স্বকীয়তা এত স্পষ্ট যে, এ বই স্বচ্ছন্দে সাহিত্যপাঠকের স্বাধীন মনোযোগের দাবিদার হতে পারে। কিন্তু এর পরেও ১৮৭১-এ তিনি আবার নতুন করে অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌-এর এক সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। শকুন্তলা নাটকের বঙ্গদেশে প্রচলিত সংস্করণ আর ভারতের অন্যত্র প্রচলিত সংস্করণের তুলনামূলক বিচার করে প্রস্তুত করা হয় সেই সংস্করণ। সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত গৌরীনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত সংস্করণ প্রস্তুত করতে দেবনাগরী, বাংলা, দক্ষিণ ভারতের সংস্করণ ও কাশ্মীরের সংস্করণ মিলিয়ে মোট এগারোটি সংস্করণের বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে।২০ বিদ্যাসাগরের সম্পাদিত সংস্করণের উপরে এরকম গবেষণাকর্ম হাতে পেলে নাটক শকুন্তলা বুঝতে আমাদের আরও সুবিধা হবে। গৌড়ীয় সংস্করণ ও দেবনাগরী সংস্করণের পার্থক্য বিষয়ে মনিয়র উইলিয়মস্‌ অনেকটা বিস্তারে আলোচনা করেছেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তৃতীয় অঙ্কের কথা। সেখানে রাজার ও শকুন্তলার প্রণয় বর্ণনায় গৌড়ীয় পাঠের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে দেবনাগরী পাঠের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি আর সে বিবরণে কল্পনার দৈন্যও প্রকট। বঙ্গদেশীয় পাঠে এমনকী নাম-টামগুলোও বদলে গেছে। দুষ্যন্তের জায়গায় দুষ্মন্ত, অনসূয়ার জায়গায় অনুসূয়া, সানুমতীর জায়গায় মিশ্রকেশী, তরলিকার জায়গায় পিঙ্গলিকা ইত্যাদি।২১ সাহিত্য অকাদেমি সংস্করণে পাঠভেদের বিস্তারিত তালিকা দেওয়া আছে। সে-প্রসঙ্গে আমাদের এখন যাবার দরকার নেই।

বাংলায় শকুন্তলা-র উপাখ্যানভাগ সংকলন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর যথেষ্ট সংকোচের সঙ্গে জানাচ্ছেন:

যাঁহারা অভিজ্ঞানশকুন্তল পাঠ করিয়াছেন, এবং এই উপাখ্যান পাঠ করিবেন, চমৎকারিত্ব বিষয়ে উভয়ের কত অন্তর, তাঁহারা অনায়াসে তাহা বুঝিতে পারিবেন; এবং সংস্কৃতানভিজ্ঞ পাঠকবর্গের নিকট, কালিদাসের ও অভিজ্ঞানশকুন্তলের এই রূপে পরিচয় দিলাম বলিয়া, মনে মনে, কত শত বার, আমায় তিরস্কার করিবেন। বস্তুতঃ, বাঙ্গালায় এই উপাখ্যানের সঙ্কলন করিয়া, আমি কালিদাসের ও অভিজ্ঞানশকুন্তলের অবমাননা করিয়াছি।২২

এই বিনয়বচন থেকেও বোঝা যায় শকুন্তলাকে বিদ্যাসাগর কী চোখে দেখতেন। এবং এখানে এ কথাও খেয়াল করা দরকার যে, বিদ্যাসাগর তাঁর এই রচনাকে এক রকমের স্বাধীন রচনা বলেই দেখতে চাইছেন। অন্তত কালিদাসের মহিমায় তাকে তরিয়ে দেবার চিন্তা তাঁর মাথায় নেই। তারজন্য তিরস্কার মাথা পেতে নিতেও তিনি কুণ্ঠিত নন। দ্বিতীয় কথাটা এই যে, তা সত্ত্বেও শকুন্তলার কথা তিনি শোনাতেই চান। আমি ভাবতে চাই এখানে তাঁর একটা অন্তরের তাগিদ আছে। যে তাগিদ থেকে কোনও লেখক আদৌ কিছু লেখেন।

আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে বলব যে, বিদ্যাসাগরের সবই তো আমরা পাঠ্যপুস্তকের হিসেবে দেখতে চেয়েছি। এমনকী এই শকুন্তলাকেও। আমি তাতেও কৃতজ্ঞ বোধ করব। কেননা চতুর্থ অঙ্কের শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা ওই শিরোনামে আমরা পাঠ্যের তালিকায় পেয়েছিলাম। আজ মনে হয় ভাগ্যিস পেয়েছিলাম! সাহিত্যের ওই স্বাদ কে দিত আমাকে সেদিন? অবশ্য চতুর্থ অঙ্কের সবটুকুই যে পাঠ্যের তালিকায় থাকত সবসময়ে তা নয়। তবে এর যে অংশটুকু থাকত তা নিশ্চয় খুব লক্ষ করার মতো। আজ মনে হয় শুধু রচনাসৌকর্য ছাড়াও তপোবনের যে শান্ত স্নিগ্ধ চেহারা ফুটে ওঠে ওই অংশে, তা আজকের জীবনপটে একান্ত জরুরি। এই পর্বেই আমরা পেয়ে যাই সেই অপরূপ বাক্যটি। আজ শকুন্তলা পতিগৃহে যাবেন। সবাই প্রস্তুত হচ্ছে। সবার মন খারাপ। এই সবার মানে কার? তপোবনবাসী প্রত্যেকের। মহর্ষি কণ্ব থেকে শুরু। আজ তিনিও বুঝতে পারছেন, ‘স্নেহ অতি বিষম বস্তু’। আজ তাঁর মন উৎকণ্ঠিত, নয়ন অনবরত বাষ্পবারিতে পরিপূরিত, কণ্ঠরোধ হয়ে বাক্‌শক্তিরহিত এবং তিনি জড়তায় নিতান্ত অভিভূত। তিনি জানেন, বনবাসী হয়েও তাঁর যদি ‘ঈদৃশ বৈক্লব্য’ উপস্থিত হয় তা হলে, সংসারীদের এ অবস্থায় কী দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করতে হয়। মেয়ে বাপের ঘর ছেড়ে যাচ্ছে, এ সংসারচিত্র আমরা দেখছি তপোবনে। তাই কি তার অভিঘাতও আরও তীব্র। কণ্ব শকুন্তলাকে বললেন, বৎস, বেলা হয়ে যাচ্ছে, এবার প্রস্থান করো। ‘আর অনর্থ কালহরণ করিতেছ কেন’? কণ্ব জানেন মেয়ে আর এ ঘরে থাকবে না, তাকে যেতে দিতে হবে, তা হলে আর সময় নষ্ট করে বেলা বাড়িয়ে লাভ কী! এর পরে মহর্ষি সম্বোধন করলেন তপোবনতরুদের। সেই অমোঘ বাক্যটি। ‘হে সন্নিহিত তরুগণ! যিনি, তোমাদের জলসেচন না করিয়া কদাচ জলপান করিতেন না; যিনি, ভূষণপ্রিয়া হইয়াও, স্নেহবশতঃ, কদাচ তোমাদের পল্লবভঙ্গ করিতেন না; তোমাদের কুসুমপ্রসবের সময় উপস্থিত হইলে, যাঁহার আনন্দের সীমা থাকিত না; অদ্য সেই শকুন্তলা পতিগৃহে যাইতেছেন, তোমরা সকলে অনুমোদন কর’ (পৃ. ৫১)। ওই লতাপাতারা অনুমোদন না করলে শকুন্তলা যাবেন কেমন করে। প্রকৃতি-অপ্রকৃতি, চেতন-অচেতন, প্রাণী-অপ্রাণী এইসব জড়িয়ে নিয়ে এমন এক সমাহার, একালে একান্ত দুর্লভ, এই দৃষ্টিতে আজ আমরা আবার পৌঁছতে পারব।

এর পরেই সিনেমার পরিভাষায় ক্যামেরা প্যান করে। শকুন্তলা প্রিয়ংবদাকে বলছেন, তাঁর এসব ছেড়ে যেতে আর পা ওঠে না। প্রিয়ংবদা বললেন, তুমি যাবে বলে এদের কী অবস্থা হচ্ছে দেখো। হরিণেরা খাওয়া বন্ধ করেছে, মুখের থেকে খাবার খসে পড়ছে, ময়ূর-ময়ূরী নাচ বন্ধ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে, কোকিলেরা আমের মঞ্জরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নীরবে আছে, মধুকর মধুকরী মধুপানে বিরত। ক্যামেরা সরে যায়। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কণ্ব তাড়া দিচ্ছেন। শকুন্তলা তা সত্ত্বেও বলেন, বনতোষিণীকে সম্ভাষণ না করে তিনি যাবেন না। এই বলে তিনি বনতোষিণীকে আদর করে বলেন, তার শাখাবাহু দিয়ে তাঁকে যেন সে আলিঙ্গন করে। আজ থেকে আমি দূরে চলে যাচ্ছি, বনতোষিণীকে এই কথা বলে তিনি দুই প্রিয় সখীর দিকে ফিরে বলেন, এখন থেকে এর ভার তোমাদের উপরে রইল। সখীদের প্রশ্ন, তাদের ভার কার উপরে, এই বলে সকলে মিলে অশ্রুবর্ষণ করতে থাকলেন। কণ্ব আবার তাড়া দিলেন।

ক্যামেরা আবার সরে গেল। এক পূর্ণগর্ভা হরিণী শুয়ে আছে কুটিরের প্রান্তে। ‘শকুন্তলা কণ্বকে কহিলেন, তাত! এই হরিণী নির্বিঘ্নে প্রসব হইলে, আমায় সংবাদ দিবে, ভুলিবে না বল? কণ্ব কহিলেন, না বৎসে! আমি কখনই ভুলিব না’ (পৃ. ৫২)। স্নেহে প্রেমে জড়ানো এই আশ্রমের জীবন। বনতোষিণীর থেকে হরিণী, কেউ কারও পর নয় এখানে। এই নিঃশর্ত আপনজ্ঞান। আজকের তপ্ত কুটিল সমাজজীবনে এ এক দুর্লভ সামগ্রী। আর বিদ্যাসাগরের কথনরীতিও এখানে খেয়াল না করে উপায় নেই। সাধে কি আর তাঁকে বলা হয় বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক শিল্পী?

এর পরে আসবে সেই মাতৃহীনা হরিণশিশুর দৃশ্য। যার মা মারা গেলে শকুন্তলা যাকে মায়ের স্নেহে প্রতিপালন করেছিল। তার জন্য সে শ্যামাক আহরণ করে আনত। একবার কুশের আঘাতে সেই শিশুর মুখে কেটে গিয়েছিল। শকুন্তলা তার শুশ্রূষার জন্য ইঙ্গুদীতেল মাখিয়ে তাকে সারিয়ে তুলেছিল। সেই হরিণশিশু আজ শকুন্তলার গতি রোধ করেছে। বলার ইচ্ছে, ‘যেতে নাহি দিব’। ‘শকুন্তলা তাহার গাত্রে হস্তপ্রদান করিয়া কহিলেন, বাছা! আর আমার সঙ্গে আইস কেন, ফিরিয়া যাও; আমি তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছি। তুমি মাতৃহীন হইলে, আমি তোমায় প্রতিপালন করিয়াছিলাম; এখন আমি চলিলাম; অতঃপর, পিতা তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। এই বলিয়া শকুন্তলা রোদন করিতে লাগিলেন’ (পৃ. ৫২)।

এই যে আশ্রমচিত্র, তার সহজ মানবিকতা, তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণময়তা, তার দুঃখকাতরতা, এইসব নিয়ে এ আমাদের আধুনিক ইউটোপিয়া চর্চার বিষয় হতে পারে। আসলে আমাদের বর্তমান সময়ের চিন্তার ধাঁচে ইউটোপিয়া চিন্তার জায়গা বড়ই সংকুচিত। ইউটোপিয়া, যা হয়তো কোনওদিনই অর্জিত হবে না, তা শুধুই কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনারও একটা বড় রকমের তাৎপর্য থাকে। কল্পনা যা-ই হোক-না-কেন তাকে আমি চিন্তায় ধারণ করছি আমার বর্তমানে দাঁড়িয়ে। তাই তা বর্তমানের সঙ্গে, আমার এই এখানে ও এখনের সঙ্গে একেবারে সম্পর্করহিত তা নয়। ফলে কোথায় দাঁড়িয়ে, কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কী কল্পনা করছি তার একটা তাৎপর্য থেকেই যায়।

কালিদাসের নাটকটির চতুর্থ অঙ্কের এক বিশেষ জায়গা রয়েছে। শকুন্তলা সর্বনাশের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এখন। তাই তার যাওয়া এমন ঘটা করে দেখাতে হচ্ছে। আর সেই একইসঙ্গে আশ্রমজীবনের এক নিবিড় পরিচয় তুলে ধরা হল। স্নেহটানে বেঁধে-থাকা যে জীবন তার চেহারা আজ আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি। আমাদের একালের স্নেহ-ভালবাসা এবং তার প্রকাশ, সবই হয়তো এখন অন্য মুদ্রায় দেখতে অভ্যস্ত আমরা। তবে আমরা যারা দেখতে দেখতে সেকালের মানুষ হয়ে গেলাম তাদের স্মৃতিতে এখনও দিব্যি ধরা আছে মেয়ের বাপের বাড়ি ছেড়ে যাবার দৃশ্য। সে এক ব্যাপার ছিল এককালে। কাজেই শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা শুধু নেহাত সাহিত্য বর্ণনামাত্র নয়। তা এক কালের সমাজদর্পণও বটে। আর ওই যে আশ্রমজীবন এবং তার ইউটোপিয়া চরিত্র, তারও আছে নানা ধরন। সীতার বনবাসে আমরা তার আর এক চেহারা পাব, আসছি সে কথায় একটু পরে।

ইতিমধ্যে সেই তৃতীয় দৃশ্যের ব্যাপারটা দেখা যাক। দুষ্যন্ত যখন আশ্রমে এসেছিলেন তখন মহর্ষি কণ্ব তো সেখানে ছিলেন না। আশ্রমের তপস্বীরা রাজাকে মহর্ষির অনুপস্থিতকালে আরও কিছুদিন থেকে যেতে বললেন। কেননা নিশাচরেরা তপস্বীদের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। রাজা এটাকে বেশ একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তাঁর চিত্ত শকুন্তলার জন্য ব্যাকুল। শকুন্তলাকে দেখার পর থেকে তাঁর আর অন্য ধ্যানজ্ঞান কিছু নেই। তিনি বয়স্য মাধব্যকে সৈন্যসামন্তের সঙ্গে রাজধানীতে ফেরত পাঠিয়ে নিজে এখানে কয়েকদিনের জন্য থেকে গেলেন। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি শকুন্তলার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ফিকির খুঁজছিলেন। পরে যেমন তিনি শকুন্তলাকে ভুলে যাবেন, এখনও তেমনি তিনি রাজপুরী, রাজমহিষী সবই যেন ভুলে গেছেন। অতীত কোনও নারী এই মুহূর্তে তাঁকে বিব্রত করছে না আদৌ। এখন তাঁর মন জুড়ে শকুন্তলা। ‘এ দিকে, শকুন্তলাও, রাজদর্শনদিবস অবধি দুঃসহ বিরহবেদনায় সাতিশয় কাতর হইয়াছিলেন। ফলতঃ, তাঁহার ও রাজার অবস্থার, কোনও অংশে, কোনও প্রভেদ ছিল না’ (পৃ. ৩৭)। আমরা বলি প্রভেদ ছিল। রাজা মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন, শিকার তাঁর লক্ষ্য। যে শরসন্ধান থেকে আশ্রমমৃগ রেহাই পেয়েছিল তা থেকে আশ্রমকন্যার রেহাই মেলেনি। সে বিদ্ধ। তার নারীজীবনের জন্য এখন অপেক্ষা করে আছে দুস্তর ক্লেশক্লিষ্ট পথ। তার মধ্যে আছে অনেক অবমাননা। শকুন্তলার অভ্যস্ত আশ্রমজীবনে এসব কুটিলতার লেশমাত্র কোথাও ছিল না। দুর্বাসার যে-অভিশাপ তার জীবনে সর্বনাশের বীজ বুনে দিয়ে গেল সে তারও কোনও খবর পায়নি। সে তো মগ্ন ছিল রাজার কল্পনায়। রাজাই তখন তার ধ্যানের ধন।

রাজা আন্দাজে আন্দাজে চলে এসেছেন মালিনীতীরের ‘শীতল লতামণ্ডপে’। এখন গরমকাল। ঠান্ডার সন্ধানে এখানে শকুন্তলা আসতেই পারে, এই আন্দাজে, এর চেয়ে বেশি কিছু না। শকুন্তলা কিন্তু রাজার বিরহে রীতিমতো অসুস্থ। অনসূয়া, প্রিয়ংবদা সখীকে শুশ্রূষার জন্য নিয়ে গেছে নদীতীরে নিকুঞ্জবনে। শীতল শিলাতলে তাকে শুইয়ে দিয়েছে। ‘নবপল্লব ও জলার্দ্র নলিনীদলে’ শয্যা প্রস্তুত হয়েছে। রাজা আসছেন গোপনে চুপি চুপি চোরের মতো দেখবেন বলে। কোথাও কোনও রাজসমারোহ নেই, প্রেমের সমারোহ তো নেইই। ‘এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে’, সে একেবারে অন্য জিনিস। রাজা নিকুঞ্জবনের কাছাকাছি এসে পায়ের ছাপ থেকে আন্দাজ করছেন শকুন্তলা নিশ্চয় এখানে আছে। একটু এগিয়ে প্রিয়াকে তিনি দেখতে পেলেন। তিন সখী নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। রাজা লোভ সামলাতে পারলেন না। আড়ি পেতে অন্যদের কথাও শুনলেন এবং দু’চোখ ভরে শকুন্তলাকে দেখে নিলেন। এই রাজার মধ্যে আর যা-ই হোক রাজকীয়তা নেই। তারপর সখীদের প্রশ্নের উত্তরে শকুন্তলা তার রাজদর্শনাবধি বিরহকাতরতার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি করল। আড়াল থেকে শুনে রাজার তাপিত প্রাণ শীতল হল এবং রাজা আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হলেন। সখীরা ছল করে রাজাকে আর শকুন্তলাকে একলা রেখে অন্যত্র চলে গেল।

এখানে দুটো ঘটনা ঘটল। শকুন্তলাও খানিকটা ছল করে বাইরে গেল। কিন্তু তার আগে রাজা তার হাত ধরে তাকে নিবারণ করার চেষ্টা করেছেন। একাধিক বার রাজা শকুন্তলার হাত ধরেছেন। সে রাজাকে কৃত্রিম তিরস্কার করেছে। শেষপর্যন্ত রাজাকে ছেড়ে শকুন্তলা বাইরে বেরিয়ে গেল। রাজার মনে হল তা হলে আর এখানে থেকে লাভ কী। হঠাৎ চোখে পড়ল শকুন্তলার মৃণাল বলয় মাটিতে পড়ে রয়েছে। রাজা তুলে নিলেন। শকুন্তলা আবার ছল করে যেন ওই মৃণাল বলয়ের সন্ধানে ফিরে এলেন। এবার রাজা তার অনুমতি নিয়ে ওই বলয় তাকে পরিয়ে দেবেন। কিন্তু এই পরিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা ঘটল অনেক বিলম্বিত লয়ে। তাও পরিয়ে দিয়ে রাজা যখন শকুন্তলাকে বললেন, দেখো কেমন সুন্দর হয়েছে। শকুন্তলা বললেন, দেখব কী, আমার চোখে কর্ণোৎপলরেণু পড়েছে, তাই দেখতে পাচ্ছি না। রাজা তখন আবার তার অনুমতি নিয়ে চোখ থেকে ফুঁ দিয়ে রেণু বের করে দিলেন। তা করতে গিয়ে তাঁকে শকুন্তলার চিবুকে ও মাথায় হাত দিয়ে ধরতে হয়েছিল। তারজন্য আবার তার অনুমতি নিতে হয়েছিল। শকুন্তলা রহস্য করে অনুমতি দিয়েও বলেছিল, রাজাকে তার অত দূর বিশ্বাস হয় না। এই সেই রুচিসম্মত প্রণয়দৃশ্য। বিদ্যাসাগর ঘনিষ্ঠভাবে দেবনাগরী পাঠ অনুসরণ করেছেন। বলা চলে স্বাধীন অনুবাদ।

উপরে আমি যে কাটাছাঁটা বিবরণ দিলাম তার থেকে এটুকু বলা চলে যে, এই বিদ্যাসাগরের মেজাজ আমাদের চেনা বিদ্যাসাগরের মেজাজের থেকে আলাদা। আমরা কাজের মানুষ বিদ্যাসাগর বা সমাজ সংস্কারক যে বিদ্যাসাগরকে চিনি তিনি তো ব্যস্তসমস্ত মানুষ। তার তো কোথাও দাঁড়াবার ফুরসত নেই। তিনি টালবাহানা সইতে পারেন না। অথচ এখানে তিনি দিব্যি রসজ্ঞ মানুষের মতো রাজার প্রণয়পদক্ষেপের প্রতিটি খুঁটিনাটি ধীর লয়ে বর্ণনা করে চলেছেন পরিমিতি বোধ বজায় রেখে। এ তো লেখকের কাজ। নিশ্চিতভাবে শিল্পীর হাতের ছোঁয়া। আর ওই অনুপম গদ্য রচনা, তার কথা বাদ দিলাম।

সীতার বনবাস (১৮৬০) আসছে শকুন্তলা-র ছ’ বছর পরে। এখন বিদ্যাসাগর এক অর্থে আরও স্বাধীন মানুষ। তিনি আর এখন সরকারি চাকুরে নন। তাই বলে কি কাজের ব্যস্ততা কিছু কম? তা না, কাজ আছে, বিশেষত শিক্ষাবিস্তারের অনেক কাজ হাতে নিয়েছেন তিনি। কর্মজগতের থেকে তাঁর কি আর অত সহজে ছুটি হবে? তবে এখন সাহিত্যের দিকে আরও একটু মনোযোগ বোধহয় দিতে পারবেন।

শকুন্তলা-র চেয়েও অনেক মন্থর রীতিতে লিখলেন সীতার বনবাস। আরও একটু স্বাধীনভাবে। প্রথম দিকে ভবভূতির উত্তরচরিত-এর আদলে, পরে আরও নানা উৎসের ব্যবহার করলেন নিজের মতো। গড়ে উঠল নিটোল এক দুঃখের গল্প, হয়তো হৃদয়হীনতার গল্পও। ১লা বৈশাখ, সংবৎ ১৯১৮ [১৯১৭] তারিখে কলিকাতায় লিখিত বিজ্ঞাপনে ঈশ্বরচন্দ্র জানাচ্ছেন, ‘এই পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অধিকাংশ ভবভূতিপ্রণীত উত্তরচরিত নাটকের প্রথম অঙ্ক হইতে পরিগৃহীত; অবশিষ্ট পরিচ্ছেদ সকল পুস্তকবিশেষ হইতে পরিগৃহীত নহে, রামায়ণ-এর উত্তরকাণ্ড অবলম্বন পূর্ব্বক সঙ্কলিত হইয়াছে। ঈদৃশ করুণরসোদ্‌বোধক বিষয় যে রূপে সঙ্কলিত হওয়া উচিত, এই পুস্তকে সেরূপ হওয়া সম্ভবিত নহে; সুতরাং সহৃদয় লোকে পাঠ করিয়া সন্তোষলাভ করিবেন, এরূপ প্রত্যাশা করিতে পারি না’।২৩

অনুরূপ কথা শকুন্তলার বিজ্ঞাপনেও বলেছিলেন। তাঁর এই রচনাগুলি নিয়ে বিদ্যাসাগরের এক ধরনের দ্বিধা ছিল মনে হয়। কিন্তু কেন? মূলের স্বাদ পৌঁছে দিতে পারছেন কি না তাই নিয়ে সংশয়? সে তো ন্যায্য কথা। কিন্তু বাংলায় এই সাহিত্য পরিবেশন করে যে-জরুরি কাজের সূত্রপাত ঘটাচ্ছেন তার গুরুত্ব বিদ্যাসাগরের কাছে ধরা না পড়ে পারে না। তা সত্ত্বেও বলতে হয় কিছু-একটা ওঁর মাথায় ছিল। কী তা জানি না। সত্যি কথা বলতে কী, বিদ্যাসাগরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজও আমরা সে ব্যাপারে সাবালক বা স্বাবলম্বী কিছুই হতে পারিনি। আমাদের যা পড়ার দরকার ও যা আমাদের পাঠাভ্যাসের অন্তর্গত তার অনেক কিছুই আমরা এখনও বাংলা ভাষায় হাতে পাইনি। ইতিমধ্যে জীবন অন্যরকমের বাঁক নিয়ে নিচ্ছে। বিদ্যাসাগরের ঋণ শোধ করতে আরও অনেক দেরি আছে বলেই মনে হয়।

সীতার বনবাস আরম্ভ হচ্ছে খুব ধীর লয়ে, বিশ্রাম কক্ষে। যুদ্ধের লঙ্কাকাণ্ড শেষ। সকলে অযোধ্যায় ফিরে এসেছেন। রাম নিশ্চিন্তমনে রাজত্ব করছেন। জানকী এখন পূর্ণগর্ভা। বাড়ির অন্যেরা ঋষ্যশৃঙ্গের আমন্ত্রণে তাঁর যজ্ঞে যোগ দিতে গেছেন। জানকীর গর্ভাবস্থার জন্যই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আর তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য রাম নিজে তো আছেনই, লক্ষ্মণও থেকে গেছেন। লক্ষ্মণ এর মধ্যে এক চিত্রকরকে দিয়ে ওঁদের বনবাসের সময়কার ছবি আঁকিয়েছিলেন। সেই ছবি নিয়ে এসেছেন শিল্পী। এখন তারিয়ে তারিয়ে সেই ছবির সিরিজ দেখা হবে।

সব কিছু শান্তভাবে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে সূক্ষ্ম হাতে দুটো বেসুরো কথা আমাদের জানানো হল। এক, রাম জিজ্ঞাসা করলেন, এই সিরিজে কোন ঘটনা পর্যন্ত ছবি আঁকা হয়েছে। লক্ষ্মণের উত্তর: ‘আর্য্যা জানকীর অগ্নিপরিশুদ্ধিকাণ্ড পর্যন্ত’ (পৃ. ১৫)। ওই অগ্নিপরিশুদ্ধিকাণ্ড শুনে রাম বিরক্ত হলেন। ওই কথায় তিনি খুব কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হন। ওরকম লজ্জার কথা তিনি আর দ্বিতীয়বার শুনতেও চান না। অন্য বেসুর এর আগেই বেজে গেছে প্রায় অলক্ষ্যে। মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম থেকে অষ্টাবক্র মুনি এসেছেন। তিনি বশিষ্ঠের আশীর্বচন নিয়ে এসেছেন এঁদের জন্য। উত্তরে রাম তাঁকে বললেন: ‘তাঁহার আদেশ ও উপদেশ সর্ব্বদাই আমার শিরোধার্য্য। আপনি তাঁহার চরণারবিন্দে আমার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত জানাইয়া বলিবেন, যদি প্রজালোকের সর্ব্বাঙ্গীণ অনুরঞ্জনের জন্য, আমার স্নেহ, দয়া বা সুখভোগে বিসর্জ্জন দিতে হয়, অথবা প্রাণপ্রিয়া জানকীর মায়া পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাতেও আমি কিছুমাত্র কাতর হইব না।’ আজকের এই শান্ত সুখের দিনে রামের মুখ দিয়ে জানকীর মায়া পরিত্যাগ করার অলক্ষুণে কথাটা বেরিয়ে গেল তো। আমরা জানি ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে।

এখনও পর্যন্ত ভূমিকম্পের কোনও লক্ষণ নেই। চিত্রকর ছবি দেখাবেন। এক-একটা দৃশ্য আঁকা ছবি তুলে ধরা হচ্ছে আর রাম লক্ষ্মণ সীতা পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করছেন। এমনকী ছোটখাটো খুনসুটিরও মধুর পারিবারিক ছবি ফুটছে। ‘চিত্রপটের স্থলান্তরে অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া, লক্ষ্মণ বলিলেন, এই আর্য্যা, এই আর্য্যা মাণ্ডবী, এই বধূ শ্রুতকীর্তি; কিন্তু তিনি লজ্জাবশতঃ, ঊর্ম্মিলার উল্লেখ করিলেন না। সীতা বুঝিতে পারিয়া, কৌতুক করিবার নিমিত্ত, হাস্যমুখে ঊর্ম্মিলার দিকে অঙ্গুলিপ্রয়োগ করিয়া, লক্ষ্মণকে জিজ্ঞাসিলেন, বৎস! এ দিকে এ কে চিত্রিত রহিয়াছে? লক্ষ্মণ কোনও উত্তর না দিয়া, ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, দেবি! দেখুন দেখুন, হরশরাসনের ভঙ্গবার্ত্তাশ্রবণে ক্রোধে অধীর হইয়া’ (পৃ. ১৬) ইত্যাদি। লক্ষ্মণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। এমন বাস্তবোচিত অনুপুঙ্খের বর্ণনা লেখকের হাতেই মানায় বটে।

এই আলেখ্যদর্শন পর্বেই আমরা সেই বাক্য পেয়ে যাব যা অপুর প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের শ্রুতিলিখনের সুবাদে আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। দক্ষিণারণ্যপ্রবেশের চিত্র। সীতা সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে নিতান্ত ক্লান্ত। রাম তালবৃন্ত দিয়ে ঢেকে সীতাকে রোদ্দুর থেকে আড়াল করছেন। এখানে চারদিকে তপোবন। সংসারী মানুষেরা বানপ্রস্থে এসে এই স্থানে বিশ্রামসুখে দিন কাটান। এর পরে লক্ষ্মণ বললেন, ‘আর্য্য! এই সেই জনস্থলমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত’ (পৃ.১৮); আমি এখন উদ্ধৃতির জন্য ব্যবহার করছি বিদ্যাসাগরের জীবৎকালের শেষ পঞ্চবিংশতি সংস্করণানুসারী একটি মুদ্রিতরূপ। আমার কানে যেন ‘জলধরপটল সংযোগে’ এই বাক্যবন্ধ লেগে আছে। পথের পাঁচালী-র যে সংস্করণ আমার হাতের কাছে আছে তাতে বাক্যটি এইভাবে আছে: ‘এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্ত্তী প্রস্রবণ-গিরি। ইহার শিখরদেশে আকাশপথে সতত-সমীর-সঞ্চরমাণ-জলধর-পটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত—’ ইত্যাদি। তবে ওই পঁচিশটি সংস্করণ জুড়ে ভাষা সহজতর হয়েছে, এমন কথা তো বলা হয়েই থাকে। কী জানি! কিন্তু ‘নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত’, এই বাক্যাংশ প্রবাদের মর্যাদায় পৌঁছে গেছে, কোনও সন্দেহ নেই। এবং আশ্চর্যের কথা এই যে, ‘নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত’ দিব্যি মানিয়ে যাচ্ছে একালের কবিতার বইয়ের নাম হিসেবেও।২৪ বিদ্যাসাগর আছেন, আমাদের সচল সাহিত্যেরই মধ্যে আছেন।

আলেখ্যদর্শনের ধীর ললিতরাগের রেশ কেটে যাবে। দুর্লক্ষণ দেখা দিচ্ছে পা টিপে টিপে। ছবি দেখা শেষ হল। জানকী ক্লান্ত বলে লক্ষ্মণ আপাতত ছবির পর্ব এখানে মিটিয়ে নিজে বিদায় নিচ্ছেন। সীতা বললেন, অনেকদিনের ইচ্ছে মুনিপত্নীদের সঙ্গে আর-একবার মিলিত হয়ে তপোবনে বিহার ও নির্মল ভাগীরথীসলিলে অবগাহন করবেন। রাম এককথায় রাজি, লক্ষ্মণকে বললেন ব্যবস্থা করতে।

রাম আর সীতা দু’জনে এবার বিশ্রামভবনে বিশ্রাম করতে গেলেন। মধুর প্রেমালাপে দু’জনেই স্নিগ্ধ সুখে মোহাবিষ্ট। সীতা নিদ্রাভিভূত। কাল সকালেই সীতার অভিলষিত তপোবনদর্শন। ঠিক এইসময় দরজায় দুর্মুখের আগমন। তার কাজ প্রচ্ছন্ন খবর সংগ্রহ করা। রাজ্যশাসন বিষয়ে ভাল-মন্দ যা সে জানতে পারে রাজাকে রোজ জানিয়ে যাওয়া তার দায়িত্ব। সে সাধারণত ভাল ভাল কথাই রাজার গোচরে আনে। অপ্রিয় কথার জন্য রাজা তাকে একটু পীড়াপীড়ি করে জানতে পারেন এক ভয়ানক কথা। রাজমহিষীসংক্রান্ত জনাপবাদ। রামের হাতে মাথা রেখে সীতা সেখানে ঘুমন্ত। দুর্মুখের মুখ থেকে দুর্বাক্য সেখানে শোনা অসম্ভব। রাম আস্তে আস্তে সীতার মাথা তাঁর হাত থেকে নামিয়ে অন্য ঘরে গেলেন। অনেক সংকোচে দুর্মুখ শেষপর্যন্ত যা বলল তা এই: ‘একাকিনী সীতা এতকাল রাবণগৃহে রহিলেন; তিনি, তাহাতে কোনও দ্বৈধ বা দোষবোধ না করিয়া, অনায়াসে তাঁহারে গৃহে আনিলেন। অতঃপর, আমাদের গৃহে স্ত্রীলোকদিগের চরিত্রে দোষ ঘটিলে, তাহাদের শাসন করা সহজ হইবেক না; শাসন করিতে গেলে, তাহারা, রাজমহিষীর উল্লেখ করিয়া আমাদিগকে নিরুত্তর করিবেক’ (পৃ. ২৬)। এই সেই সমস্যা। ভূমিকম্পের সূত্রপাত। ‘চরিত্র’, ‘চরিত্রের দোষ’, ‘শাসন’, অর্থাৎ, বশে রাখা, এইসব ধারণা ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল। কানাকানি জনমনে। সমাজের এই মূল্যবোধ। প্রজানুরঞ্জন রাম এখন অসহায়। এই রামরাজ্যে রামও নতজানু। সামাজিক মূল্যমানের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।

দুর্মুখের প্রস্থান। রাম একাকী নির্জনে বিলাপ করতে থাকলেন। এই বিলাপের মধ্যে আরও একটা নতুন সামাজিক মাত্রা এসে গেল। রামেরই মুখে। কুলকলঙ্কের কথাটা রামের মাথাতেই ধরা দিল। রাজার এখন উভয়সংকট। ‘এই অপবাদে উপেক্ষা প্রদর্শন করি; অথবা, এ জন্মের মত নিরপরাধা জানকীরে বিসর্জ্জন দিয়া কুলের কলঙ্কবিমোচন করি’ (পৃ. ২৭)। দু’তরফে সংকটের চেহারা একটু কিন্তু বদলে গেল। প্রজাদের মাথায় হাত, ঘর সামলাই কী করে, আর রাজার সংকট আমার ইক্ষ্বাকু বংশের কী হবে। বংশের সুনাম, রাজ্যের সুশাসন, সামাজিক শৃঙ্খলা, পারিবারিক শান্তি, এরকম সব ভারী ভারী ধারণা আসলে কী নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ‘নারীচরিত্র’ নামে চিহ্নিত এক দুর্লভ সামগ্রীর উপরে। এই বিলাপের মধ্যেই কিন্তু তলায় তলায় রামের মনে সীতা বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গেছে। তারজন্য আবার নিজেকে অপরূপ ভাষায় ভর্ৎসনা করছেন। ‘তুমি এমন দুরাচারের, এমন নরাধমের, এমন হতভাগ্যের হস্তে পড়িয়াছিলে, যে কিঞ্চিৎ কালের নিমিত্তেও, তোমার ভাগ্যে সুখভোগ ঘটিয়া উঠিল না। তুমি, চন্দনতরুবোধে দুর্ব্বিপাক বিষবৃক্ষের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলে’ (পৃ. ২৮)।

চন্দনতরু আর বিষবৃক্ষের বৈপরীত্য অবশ্যই সীতার দৃষ্টিকোণ। বাক্যটি আসছে রামের বিলাপের অংশে। কিন্তু সীতার দৃষ্টিকোণ ব্যাবহারিক আচারে এর পর থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে। রামের রাজোচিত সিদ্ধান্তে সেটা হেলে যাবে প্রজাদের দিকে। প্রজাদের তুষ্ট করতে গেলে জানকীকে বিসর্জন দিতে হবে। তাই দেওয়া হবে। তবে বড় বেশি ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে। অসহায় মেয়েটির সামনে রাজাসন কেঁপে গেছে। বিসর্জন দেবার কাজটা রাম পেরে উঠবেন না। কাজটা করতে হবে অনুগত ভাইকে। লক্ষ্মণকে ডেকে সে বিষয়ে যা বলার বলা হয়ে গেছে। লক্ষ্মণ স্তম্ভিত। কিন্তু তিনিও অসহায়। যা করার তা তাঁকে করতে হবে। তবুও লক্ষ্মণ কিন্তু সবিনয়ে রামকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সর্বসমক্ষে আর্যা জানকীর অলৌকিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। তিনি শুদ্ধচারিণী বলে প্রতিপন্ন করেছেন নিজেকে। সে পরীক্ষায় উপস্থিত ছিলেন রাম লক্ষ্মণ দু’জনেই, তা ছাড়াও ছিলেন তাঁদের ‘সেনা ও সেনাপতিগণ, এবং যাবতীয় দেবগণ, দেবর্ষিগণ, ও মহর্ষিগণ’ (পৃ. ৩৪)। লক্ষ্মণ কিন্তু অগ্রজকে আরও অনেকটা বলেছিলেন। তাঁর স্পষ্ট অভিমত ছিল এ কাজে ‘ধর্ম্মতঃ বিবেচনা করিতে গেলে, আমাদিগকে দুরপনেয় পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইবেক’ (পৃ. ৩৪)। কিন্তু কোনও কিছুতেই কোনও কাজ হয়নি। রামের কাছে ইতিমধ্যে সামাজিক মানবিক ও নৈতিক যুক্তির উপরে স্থান করে নিয়েছে একমাত্র রাজনৈতিক যুক্তি। প্রজার মন জুগিয়ে চলাই এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। লক্ষ্মণ তাও সাধারণের অবিবেচক অযৌক্তিক অবস্থানের সামনে ‘ভবাদৃশ মহানুভবদিগের বিচলিত’ হওয়ার ঔচিত্যের প্রশ্নও তুলেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতন্ত্র পরিচালনায় ত্রুটিহীন আনুগত্যের সঙ্গে যৌক্তিক সমালোচনার যে মিশেল লক্ষ্মণের অবস্থানের মধ্যে টের পাওয়া যায় তা আজও আমাদের কাছে পালনীয় আদর্শ হতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বৈরতন্ত্র যে মাথা চাড়া দেয় অনেক সময়ে সে এইরকম উপযুক্ত মিশেলের অভাবে।

রাম নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন এই বলে যে, সীতার আগের পরীক্ষা যদি অযোধ্যায় ফিরে এখানকার লোকসমক্ষে করা যেত তা হলে আজকের বিপদ এড়ানো যেত। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি রাজাদেশ বলে লক্ষ্মণকে এই কাজের ভার দিলেন। ‘ইতঃপূর্ব্বেই, সীতা তপোবনদর্শনের অভিলাষ করিয়াছেন; সেই ব্যপদেশে, তুমি তাঁহারে লইয়া গিয়া মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে রাখিয়া আইস; তাহা হইলে আমার প্রীতিসম্পাদন করা হয়’ (পৃ. ৩৬)। অনাবিল রাজছলনা। রাম লক্ষ্মণকে আরও একটু সাবধান করেছিলেন। তিনি জানতেন ভাইয়ের হৃদয় ‘কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ’, তাই ভাল করে বলে দিলেন, ভাগীরথী পার হওয়ার আগে যেন জানকী কিছু জানতে না পারেন।

পরদিন সকালে সীতা অসন্দিগ্ধচিত্তে লক্ষ্মণের সঙ্গে সাজানো রথে চড়ে বসলেন তাঁর সর্বনাশের যাত্রায়। অযোধ্যা ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেই তাঁর ডান চোখ নেচেছিল। তিনি অমঙ্গলের আশঙ্কায় ব্যাকুল হয়েছিলেন। স্বপ্নেও ভাবেননি নিজের সর্বনাশের কথা। আর্যপুত্রের কুশল নিয়ে উদ্বিগ্ন। যাই হোক, অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা ভাগীরথীর অপর পারে এসে পৌঁছলেন। এবার জানকীকে ছেড়ে আসতে হবে, কথাটা তাঁকে জানাতেও হবে। বেচারা লক্ষ্মণ!

এই সেই বাল্মীকির আশ্রম। কথাটা বলতে গিয়ে লক্ষ্মণ অচৈতন্য, আর সব কথা শুনে সীতাও অচৈতন্য। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন? জীবন এইরকমই। লক্ষ্মণকে এবার ফিরে আসতে হবে। চতুর্থ পরিচ্ছেদের এই বিদায়বেলার বর্ণনা বিদ্যাসাগরের নিজের বয়ানে পড়ার আর কোনও বিকল্প নেই। আমি যে আর এক তপোবনের কথা বলেছিলাম সেই কথা একটু বলে এবার শেষ করব।

লক্ষ্মণের রথ ফিরে গেছে। সীতা আশ্রমের বাইরে কাতরভাবে কাঁদছেন। কয়েকজন ঋষিকুমার সমিধ সংগ্রহে এসে এই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে বাল্মীকিকে খবর দিয়েছেন। মহর্ষিও তৎক্ষণাৎ ভাগীরথীতীরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি সীতার কাছে গিয়ে সস্নেহবচনে বললেন, তোমার আসার আগেই আমি সব জানি। তোমার পরিচয় আমি জানি। তোমার দুঃখের কথা সব আমি জানি। তুমি আসন্নপ্রসবা, আমি তাও জানি। আমার সঙ্গে চলো। এখানে তোমার কোনও ক্লেশ হবে না। ‘জনপদবাসীরা, বন, এই শব্দ শুনিলে ভয়াকুল হয়; কিন্তু তপোবনে ভয়ের কোনও সম্ভাবনা নাই। ঋষিদের তপস্যার প্রভাবে, হিংস্র জন্তুরাও স্বভাবসিদ্ধ হিংসাপ্রবৃত্তি দূরীকৃত করিয়া পরস্পর, সৌহৃদ্যভাবে কালহরণ করে’ (পৃ. ৫৪)।

আমাদের ইউটোপিয়া চর্চায় এদিকে দৃষ্টি দেবার কথা প্রস্তাব করতে চেয়েছিলাম আমি। আমি আগেই সব জানি, এ কথা আধুনিক কানে অলৌকিক লাগে। তবে একটু সহানুভূতিতে অনেক কথাই কি জানা যায় না? আর হিংস্রতা কতটা পারিপার্শ্বিকের দান তা কি আমরা সত্যি স্পষ্ট করে জানি?

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. গোপাল হালদার, ‘ভূমিকা’, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ৩য় খণ্ড (কলকাতা: বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২), পৃ. তেইশ।

. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৩৯৫), পৃ. ৩১৪।

. Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar & His Elusive Milestones, 2nd Edition (Ranikhet: Permanent Black, 2016), p. 187.

. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, ১৮-১৯, (কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৮৮ ব.), পৃ. ৩২।

. তদেব।

. তদেব, পৃ. ৩২-৩৩।

. বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতির বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড, ১৯৭২, পৃ. ২১।

. দ্র. (৪), উদ্ধৃত, পৃ. ৪২।

. তদেব, পৃ. ৬৩।

১০. তদেব, পৃ. ৮১।

১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্র-রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৯, পৃ. ১৭২।

১২. তদেব, পৃ. ১৮৫।

১৩. জীবনানন্দ দাশ, ‘বোধ’, ধূসর পাণ্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় (স.) (কলকাতা: ভারবি, ১৯৯৩), পৃ. ১১০, ১১২।

১৪. Brian Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian, Routledge, 2014.

১৫. তদেব, ভূমিকা, পৃ. xx.

১৬. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.), পৃ. ৩৪।

১৭. বিদ্যাসাগর, সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২, পৃ. ১২২।

১৮. চন্দ্রনাথ বসু, শকুন্তলাতত্ত্ব, (প্রথম প্রকাশ ১২৮৮, দ্বিতীয় সংস্করণ ১২৯৬, কলকাতা: সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ১৩৯০)।

১৯. শিশিরকুমার দাশ, অলৌকিক সংলাপ (কলকাতা: প্রমা প্রকাশনী, ১৯৯৬)।

২০. Abhijnana-Sakuntalam of Kalidasa, ed. Gaurinath Sastri (New Delhi: Sahitya Akademi, 1983).

২১. মনিয়র উইলিয়ম্‌স্‌ অনূদিত শকুন্তলার মুখবন্ধ, পৃ. vii-viii, উদ্ধৃত, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (স.) শকুন্তলা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ২০১৯, ভূমিকা।

২২. সংবৎ ১৯১১ তারিখে লিখিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা স্বাক্ষরিত শকুন্তলার বিজ্ঞাপন, কলিকাতা।

২৩. ‘বিজ্ঞাপন’, সীতার বনবাস, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (স.), ১৪১১ ব.।

২৪. অরবিন্দ গুহ-র কবিতার বইয়ের নাম। ইনি ইন্দ্রমিত্র নামে বিদ্যাসাগর গবেষণার জন্য বিখ্যাত। তাঁর প্রধান বইয়ের নাম করুণাসাগর বিদ্যাসাগর ।

 শকুন্তলা ও সীতার বনবাস দু’টি বইয়ের ক্ষেত্রেই আমি ব্যবহার করেছি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ সংস্করণ। এই সংস্করণ দু’টি যথাক্রমে ১৮৮৫-তে মুদ্রিত চতুর্দশ এবং ১৮৯০-তে প্রকাশিত ২৫তম সংস্করণের ভিত্তিতে প্রস্তুত। তাই উদ্ধৃতির বেলায় শুধু পৃষ্ঠা সংখ্যা উল্লেখ করেছি।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার: গৌতম সেনগুপ্ত ও সুস্মিতা দাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *