লালন ফকির : সাধনা

লালন ফকির : সাধনা

লালন ফকির সংগীতকে তাঁর সাধনার অঙ্গ হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। অসংখ্য গানের মধ্যে দিয়ে লালন নিজস্ব দর্শনচিন্তাকে পরিস্ফুটিত করে গেছেন। ভাবতে ভালো লাগে, আজও গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে উদাত্ত কণ্ঠস্বরে লালন গান গীত হয়। অতি সম্প্রতি নানা কারণে সারা বঙ্গদেশ জুড়ে লালন সম্পর্ক ঔৎসুক্য অনেক বেড়ে গেছে। বুদ্ধিজীবী মহলে নতুন করে শুরু হয়েছে লালন চর্চা। লালন যে আপাত গৌণ প্রান্তিক ধর্মের প্রতীক ছিলেন, সেই ধর্মের পরিকাঠামো নিয়েও দেখা দিয়েছে ঔৎসুক্য।

লালনের সাধনমার্গ কী ধরনের? তিনি কি হিন্দু-মুসলমান সংহতির প্রতীক ছিলেন? নাকি তাঁর গানে ইসলামি সুফিতত্ত্বের উদ্বোধন ঘটে গেছে? এসব অত্যন্ত বিতর্কিত এবং জটিল প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করতে গেলে প্রথমেই লালনের কালটিকে যথার্থভাবে অনুধাবন করতে হবে। আমরা জানি, যে কোনো মানুষের জীবনের ওপর সমকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সেই সঙ্গে আলোকপাত করতে হবে তদানীন্তন সমাজ-চিন্তন, রাজনৈতিক বাতাবরণ এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর। তবেই আমরা লালন সাধনতত্ত্বের অত্যন্ত কঠিন রহস্য সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করতে পারব।

লালন এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। তিনি যখন আবির্ভূত হন, তখন বাংলা দেশে নবজাগরণের উন্মেষ পর্ব সূচিত হয়েছে। ভাবতে ভালো লাগে, লালন যে বছর পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, সেবছরেই নব্য ভারতের প্রতিনিধি রাজা রামমোহন রায় পৃথিবীতে আসেন। এটি হয়তো এক ঐতিহাসিক সমাপতন। তবে লালন এবং রামমোহন ছিলেন ভিন্ন পথের পথিক। দু’জনের পরিমণ্ডল ছিল একেবারে আলাদা। রাজা রামমোহন রায় বুদ্ধিজীবী সমাজকে সংগঠিত করেছিলেন। তিনি এক উন্নত চেতনা, ধর্মসমন্বয় এবং স্বাদেশিক আবেগের সমীকরণ তৈরি করেন। রামমোহন যে নতুন ধর্মের কথা উচ্চারণ করেছিলেন, সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সুর ধ্বনিত।

অপরপক্ষে লালন নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ্যে বিচরণ করেন। সমাজের তথাকথিত উচ্চ-শিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সেই সমাজ দ্বারা তিনি বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হননি। এ আমাদের পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

লালন যখন পৃথিবীর বুকে তাঁর লীলাখেলা শেষ করেন তখন বঙ্গদেশীয় নবজাগরণ যথেষ্ট পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার উজ্জ্বল আলোক প্রভায় ভারতসত্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা পৃথিবীর চিন্তনের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে ধর্ম অন্বেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। একদিকে রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার ও কেশবচন্দ্রের আগমন, তাঁদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নৈর্ব্যক্তিক ধর্মভাবনা, অন্যদিকে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বিজয়কৃষ্ণের আবির্ভাব এবং ভক্তিবাদী আন্দোলনের নবমূল্যায়ন—সব মিলিয়ে তখন বাঙালির ধর্মচিন্তা নতুন খাতে বইতে শুরু করেছে।

তদানীন্তন ধর্মান্বেষকেরা যুক্তির প্রাবল্য অথবা ভাবোন্মাদনার আতিশয্যকে আয়ূধ করে এসেছিলেন। ছিল সাকার এবং নিরাকারের সমস্যা। পৌত্তালিকতাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরার প্রয়াস। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, পরলোকতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন করে অন্বেষণা, শাস্ত্রজ্ঞানের ওপর আলোকপাত, মানুষের জীবনে গুরুবাদের প্রয়োজনীয়তা ও সার্থকতা ইত্যাদি নানাবিধ অন্বেষণায় বাঙালির চিন্তন নানা খাতে বইতে থাকে। দিল্লির বুকে তখন শুরু হয়েছে অবক্ষয়ের বাতাবরণ। মোগল সূর্য অস্তাচলে, বাংলাদেশে নবাবি শাসনের ব্যর্থতা চোখে পড়ছে। সমাজ জীর্ণ হচ্ছে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল হুংকার সাধারণ মানুষকে করছে ভীতসন্ত্রস্ত। মুসলমান কাঠমোল্লাদের হৃদয়হীন আচরণের প্রতিবাদ কোথাও ধ্বনিত হচ্ছে না। এই সময় অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো একটি লৌকিক গৌণধর্ম তার রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। মূলত নিরক্ষর এবং অসহায় দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান এই ধর্মবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আসলে তাদের হারাবার কিছু ছিল না। চিন্তার জগতে তারা বিচ্ছিন্ন। সামাজিক পটভূমিকায় ব্রাত্য। তারাই দলে দলে ওই গৌণধর্মকে অবলম্বন করে। লালনপন্থা এই ধর্মের এক উজ্জ্বল উদ্ধার।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লালন অন্বেষণা করতে গিয়ে এই কথাটির ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি লালন গানের অন্তরালে নিহিত যে মৌলিক সত্য, তা উদভাসিত করেন। তিনি তাঁর একাধিক ভাষণে একাধিক ভাষণে তাই লালনকে বাংলার গৌণ ধর্মের অন্যতম প্রচারক হিসাবে তুলে ধরেছিলেন চর্যাগান থেকে যে পরম্পরার সূত্রপাত, বৈষ্ণব গান, শাক্তগানের মাধ্যমে যার পরিস্ফুটন লালন গানে তা বৃহত্তর পরিব্যাপ্তি লাভ করে। ভাবতে খারাপ লাগে, দুই বাংলার পাঠ্যাংশে নানাবিধ গানের উল্লেখ আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লালন গান এখনও পর্যন্ত সেভাবে পরিচিত হয়নি। ভয় লাগে, আধুনিক প্রজন্মের পাঠক-পাঠিকারা কি লালনকে ভুলে যাবেন? ভুলে যাবেন গৌণধর্ম প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার কথা? মনে প্রশ্ন জাগে, ইদানিং আমরা যেভাবে লালন উৎসাহী হয়ে উঠেছি, আজ থেকে পঞ্চাশ অথবা একশো বছর আগে যদি সেই অন্বেষণা থাকত, তা হলে হয়তো অবিভক্ত বঙ্গদেশে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হত না। হিন্দু-মুসলমান একে অন্যের পরিপূণক হিসাবে শান্তির বাতাবরণ বজায় রাখতে পারত। অবশ্য এ এক অন্যতর প্রসঙ্গ। আমরা আবার আমাদের মূল প্রতিপাদ্য অর্থাৎ লালন সাধনার বিষয়ে ফিরে আসছি।

লালনের জন্ম হয়েছিল নদীয়া জেলায়। তখন নদীয়ার আয়তন ছিল অনেক বেশি। ১৮৭১ সালের নদীয়ার এলাকা ছিল ৩,৪১৪ বর্গমাইল, আগেকার অখণ্ড নদীয়ায় বর্ধমান, চাব্বিশ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি এবং যশোহরেরং কিছু অংশ ছিল। এই বিস্তৃত জনপদে ব্রাহ্মণ্য এবং শূদ্র সংস্কৃতির পারস্পরিক বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। ছিল তান্ত্রিক পরম্পরা, শৈব এবং বৌদ্ধ সহজিয়াদের অবশেষ। জনপদের একটা বড়ো অংশ ধর্মান্তরিত মুসলমান। এমনকী ১৮৩৪ সালে নদীয়াতে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টমন্ডলী গড়ে ওঠে।

ঊনিশ শতকে নদীয়া জেলায় বেশ কয়েকটি নিম্মবর্গ আশ্রিত গৌণধর্মের সৃষ্টি হয়। এই নদীয়া জেলাতেই ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর অন্যতম সহযোগী অদ্বৈতাচার্য ছিলেন শান্তিপুরের মানুষ। নিত্যানন্দ প্রভুর কর্মভূমি ছিল নদীয়ার বিভিন্ন গ্রাম। সমস্ত ষোড়শ শতকে এবং তার পরবর্তী শতকের প্রথম দিকে নবদ্বীপ, শান্তিপুর কাটোয়া, বাগনা পাড়া, কালনা, শ্রীখণ্ড অঞ্চলে বৈষ্ণব মতাদর্শ বিশেষ ভাবে পরিস্ফুটিত হয়। বিভিন্ন বৈষ্ণব সাধকেরা একাধিক আখড়া এবং আশ্রম স্থাপন করেন। তার কিছু কিছু এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

শ্রীচৈতন্যকে কি আমরা লালনের পূর্বসূরী বলতে পারি? শ্রীচৈতন্য যে মহামিলনের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ সেই উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দেন। তাঁর পরিকল্পিত উদার বৈষ্ণব ধর্মের ভাব আন্দোলনের স্রোত সমস্ত নদীয়াকে গ্রাস করে। এক নতুনতর চেতনায় নিম্নবর্গীয় জনসমাজ জেগে ওঠে, লালন হয়তো অজ্ঞাতসারে সেই ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে আত্মস্থ করেছিলেন।

অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং ঊনবিংশ শতকের সূচনায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম শূদ্রজাতির ওপর অন্যায় অত্যাচার করতে থাকে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে বর্ণাশ্রম প্রথার কট্টর সমর্থক ছিলেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে তথাকথিত শূদ্রদের সমাজচ্যূত করা হয়। বাউল ধর্মের ওপর নেমে আসে নির্ম্মম আঘাত।

অপরদিকে কুষ্টিয়া-যশোর সন্নিহিত অঞ্চলে ইসলামী মোল্লাতন্ত্রের ধর্মান্ধতা ক্রমশ বেড়ে চলে। সুফী প্রচারকরা গ্রাম গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েন। আসেন হেরাজতুল্লাহ, খোন্দকার হোসেন শাহ, বরখান গাজী, মামুদ জাহির, কিনুশাহ ফকির প্রমুখেরা। তাঁদের ব্যাপক প্রচার নিম্নবর্গীয় মুসলমান জনসমাজকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল।

নদীয়া সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করে গেছেন। তাঁরা সকলে স্বীকার করেছেন যে, বাংলা বাউল গানের ভিত্তিভূমি হল নদীয়া। এই সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক মুহম্মদ এনামুল হকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন ”—পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখিয়া এবং ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করিয়া আমাদের ধারণা জন্মিয়াছে যে, নদীয়া জেলাই বাউল মতের উদ্ভবের স্থান। ঈশ্বরপুরী, চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্যের কথা বাদ দিয়াও, নদীয়ায় আরও কয়েকজন প্রাচীনতম বাউলের নাম জানিতে পারা যায়; তাঁহারা হরিগুরু বনচারী, সেবাক মলিনি ও অখিলচাঁদ। নদীয়াই বাংলাদেশে বাউল মতের জন্মদাতা। এ জেলা হইতে জ্ঞানের কথা, শাস্ত্রের কথা যেমন জন্ম লইয়াছে, তেমনই মর্মের কথা, প্রেমের কথা ও জন্ম লওয়া নিতান্তই সম্ভবপর। এক নদীয়ার মধ্যেই গোবরা, হজরত, খুশি বিশ্বাস প্রমুখ মুলসমান এবং আউলচাঁদ, বীরভদ্র প্রমুখ হিন্দুর চেষ্টায় যে ভাব-বিদ্রোহী দলগুলি গড়িয়া উঠে—তাহাদের প্রভাব নিতান্তই কম নহে।”

তাহলে? সত্যি সত্যি কি বাউল ধর্মের উদ্গাতা নদীয়া জেলা? এই প্রসঙ্গে আমরা চারটি গৌণধর্মের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করব। আঠারো শতকে এইসব গৌণধর্মগুলির উদ্ভব ঘটে, প্রসার ঘটে উনিশ শতকে। এই চারটি স্রোতের উৎসস্বরূপ বিরাজ করছেন এমন চারজন মানুষ, যাঁদের আমরা তথাকথিত শূদ্র বা নিম্মবর্গীয় বলে থাকি। জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে তাঁরা স্বসৃষ্ট ভাবধারাকে সমাজের এক বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এঁদের মধ্যে প্রথমেই আমরা সাহেবধনী সম্প্রদায়ের কথা বলব। নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া থানার শালিগ্রাম দোগাছিয়া গ্রামে এই মতের সূচনা হয়। দীনেশচন্দ্র সেন থেকে আহমদ শরীফ পর্যন্ত বিশিষ্ট পণ্ডিতগণের ব্যাপক সাধনায় জানা গেছে যে, সাহেবধনী সম্প্রদায়ের উৎসে ছিলেন কোনো এক অজানা মুসলমান ফকির। অক্ষয়কুমার দত্তের লেখা ‘ভারতবষীর্য় উপাসক’ সম্প্রদায় গ্রন্থে বলা হয়েছে—”বাগাড়ে নিবাসী রঘুনাথ দাস, দোগাছিয়ার নিবাসী দুঃখীরাম পাল এবং হিন্দু মতাবলম্বী অপর কয়েকব্যক্তি ও একজন মুসলমান তাঁহার শিষ্য হয়।”

সাহেবধনীরা যথার্থভাবে আত্মপ্রকাশ করে চরণ পাল নামে এক গোপজাতীয় মানুষের নেতৃত্বে। চরণ পালের জন্ম ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে। দোগাছিয়া গ্রামের প্রান্তবর্তী জলাঙ্গী নদীর পূর্ব পারে বৃত্তিহুদা গ্রামে তাঁর বাস্তু আজও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে সাহেব ধনীদের উপাস্য দীনদয়ালের সাধনগৃহও আছে। সাহেব ধনীদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ে। সাহেবধনীদের গান আজ প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। এইসব গানে এক সমন্বয়ী চিন্তার স্ফুরণ দেখা দেয়। কুবির গোঁসাই এবং যাদু বিন্দু প্রধান গীতিকার।

এবার আমরা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা বলব। কর্তাভজাদের উৎস লুকিয়ে আছে আউলচাঁদ নামে এক ফকিরের মধ্যে। ১৭৫৬ সালে তিনি কল্যাণীর অন্তর্গত ঘোষপাড়াতে আসেন। সেখানে সদগোপ জাতীয় রামশরণ পালকে দীক্ষিত করেন। আউলচাঁদের শিষ্য ছড়িয়ে আছে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মধ্যে। তাঁদের সংক্ষেপে বাইশ ফকির বলা হয়। রামশরণ পালের স্ত্রী সতীমা এবং দুলাল চাঁদ এই কর্তাভজাদের সংগঠিত করেছিলেন। দুলাল চাঁদ শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ভাবের গীত নামে একধরনের গানের স্রষ্টা। আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষ পরম আনন্দে এই গানগুলি গেয়ে থাকেন।

রামশরণ পালের জন্ম কবে হয়েছিল, তা আমরা জানি না। মৃত্যু হয় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে। দুলালচাঁদের জীবন প্রবাহিত হয় ১৭৭৩-১৮৩৩ সাল পর্যন্ত। সতীমার মৃত্যু হয় ১৮৪০ সালে।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। কলকাতাতেও এক সময় এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্মপ্রচারে মেতে উঠেছিলেন। এমন কি ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে খ্রিস্টান মিশনারী ও তথাকথিত নৈষ্ঠিক হিন্দুরা পর্যন্ত এই ধর্মসম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করতে তাকে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে এই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ আজও বসবাস করেন। বাংলাদেশের কোনো কোনো উপজেলাতেও তাঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। এই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাংগঠনিক দক্ষতা আমাদের অবাক করে দেয়। ভাবতে ভালো লাগে, এই ধর্মের আবেদন কিন্তু নিম্নবর্গীয় মানুষদের ছাড়িয়ে উচ্চবর্গীয়দেরও যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা কোনো বিগ্রহকে পুজো করেন না। সত্যের উপাসনা করাই তাঁদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য।

গৌণ ধর্মের তৃতীয় শাখাটি লালন ফকিরকে কেন্দ্র করে পরিস্ফুটিত হয়। তাঁদের আমরা লালন পন্থী বলতে পারি। লালনপন্থীরা লালন গানের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। তাঁরা লালন ভাবধারাকেই জীবনের একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে অবলম্বন করেন। চরণ পাল বা রামশরণ পালের প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই। কিন্তু লালনকে চোখে দেখেছেন এবং তাঁর গান শুনেছেন এমন অনেক মানুষের সন্ধান আমরা পেয়েছি। আমাদের সৌভাগ্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের একটি প্রতিকৃতিও আমরা পেয়েছি। পাওয়া গেছে তার গানের অনুলিপি। শুধু পাওয়া যায়নি লালন ফকিরের নির্ভরযোগ্য এবং ইতিহাস আশ্রিত জীবন-ইতিহাস।

লালনকে আমরা ফকির সম্প্রদায়ভুক্ত করতে পারি। তবে এখানেও বিতর্কের অবকাশ আছে। তাঁর ঘরানায় ফকিরি দীক্ষা নিলে সন্তান জন্ম নিরোধ করতে হয়। লালনশাহীরা বিশ্বাস করেন, শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরায়। তাঁরা সন্তান পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করেন।

লালন শাহী মতের বিশ্বাসীরা আছেন পূর্ব এবং উত্তরবঙ্গে। তাঁদের বেশিরভাগ আগে ইসলামধর্মাবলম্বী ছিলেন। নিম্নবর্গের শূদ্র হিন্দুদের অনেকে লালনশাহী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। তবে উচ্চবর্ণের কোনো হিন্দু অথবা মুসলমান এই ফকিরি মতের সমর্থক হননি। এখানে আর একটি ভাবনার বিষয় উল্লেখযোগ্য। তাহ’ল লালনের মতবাদ এখন ক্রমশ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর গান শিক্ষিত সমাজকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে। ভাবতে ভয় লাগে, আগামীদিনে লালনশাহীরা কি পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে, আরও বেশি জনপ্রিয়তা এবং প্রসার পাবে লালনসংগীত?

এবার আমরা চতুর্থ গৌন ধর্ম বলরামী বা বলাহারি সম্প্রদায়ের কথা বলব। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলরাম হাড়ি। মেহেরপুরের এক অভিজাত পরিবারে তিনি দারোয়ানের কাজ করতেন। তাঁকে চুরির অপবাদে চাকরিচ্যূত করা হয়। শুধু তাই নয় সকলের কাছে অপমানিত হয়ে তিনি গ্রাম ত্যাগ করেন। বেশ কয়েক বছর বাদে বৈরাগীর বেশে গ্রামে ফিরে আসেন। নিম্নবর্গীয়দের সংগঠিত করে এক প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর সম্প্রদায়ের কুড়ি হাজার শিষ্য ছিল।

বলাহারি সম্প্রদায় বলরামকে উপাসনা করে। এই ধর্ম মূলত গৃহধর্ম। ব্রাহ্মণ এবং বৈষ্ণব বিরোধী। বলরামীদের লক্ষ্য যৌন নিয়ন্ত্রণ এবং শুদ্ধ জীবনযাপন।

অন্য লোকধর্মের সঙ্গে বলরামী ধর্মের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বলরাম নিজেকে বাচক অর্থাৎ বাকপটু হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রবচন এবং প্রবাদ ববহার করতেন। ইসলামী প্রভাব এই ধর্মে খুব একটা চোখে পড়ে না। বরং বলা যায় নাথ যোগীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি এই ধর্মকে একটি আলাদা দ্যোতনা দিয়েছে।

এইভাবে আঠারো এবং ঊনিশ শতকে নানা গৌন সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। ব্রাহ্মণের জায়গায় নেতৃত্বে আসেন শূদ্র বংশীয়রা। দীর্ঘদিন ধরে যাঁদের নানা কারণে অত্যাচারিত হতে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ঘটে যায় ধর্মীয় জনজাগরণ। যেসব শূদ্রদের চিরকাল নির্যাতিত হতে হয় তাঁরাই হয়ে ওঠেন এইসব ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক। মানুষের মনে বিকল্প ধারণার উদ্ভব ঘটে। মুর্তির বদলে মানুষ ভজন শুরু হয়। ভাববাদের বদলে দেষবাদ এবং যন্ত্রের বদলে গান—এভাবেই নীরব বিপ্লব ঘটে যায় বাঙালির চিন্তন ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।

লালন হয়তো অজ্ঞাতসারে এইসব গৌণধর্মের দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত উদার জীবনবোধের ধারণা তাঁকে পরিপ্লাবিত করেছিল অন্যতর আনন্দে। নবাগত সুফীদের চিন্তন ও প্রগতিশীল মনন তাঁকে দিয়েছিল আত্মার মুক্তি। ইসলাম ধর্ম দিয়েছিল মূর্তিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তির স্বাধীনতা। বৌদ্ধচিন্তার বীজ লুকিয়ে ছিল তাঁর মনন এবং চেতনে।

আর এরই সঙ্গে কাজ করেছিল নদীয়ার বিচিত্র জনবিন্যাস। ১৮৭৫ সালে ডবলিউ. ডবলিউ. হান্টার তাঁর A Statistical Account of Bengal. বইতে বিভিন্ন জাতির তালিকা দিয়েছেন। এতে স্পৃশ্য এবং অস্পৃশ্য এই দুটি বর্গকে আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, নদীয়াতে কৈবর্ত এবং মাহিষ্যের সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল। এই জেলায় ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই ছিলেন ওই দুই সম্প্রদায়ভুক্ত। একজন গবেষক মনে করেন, নদীয়ায় গৌণ ধর্মের উদ্ভবের আসল কারণ হল নির্যাতিত নিম্নশ্রেণীর বঞ্চিত মানুষের গণ উদ্মাদনা। ইসলামে ধর্মের মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের যে আহ্বান আছে, সেইডাকে অনেকেই সাড়া দিয়েছিলেন। মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।

লালনের অনেক গানে তাঁর পূর্বসুরীদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, লালন কি তাঁদের গান শুনেছিলেন? নাকি অজ্ঞাতসারে তিনি এইভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন? সাহেবধনীদের গীতিকার কুবীর গোঁসাই লিখেছিলেন—

হরিষষ্ঠী মনসা মাখাল
মিছে কাঠের ছবি মাটির ঢিবি সাক্ষীগোপাল
বস্তুহীন পাষাণে কেন মাথা কুটে মরো?
মানুষে কর না ভেদাভেদ
করো ধর্মযাজন মানুষভজন
ছেড়ে দাও রে বেদ
মানুষ সত্যতত্ত্ব জেনে
মানুষের উদ্দেশ্যে ফের।

অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে তা অবিলম্বে দূরর করতে হবে। বৈদিক শাস্ত্র ব্যবস্থাকে বিসর্জন দিতে হবে। বস্তুহীন পাষাণ মূর্তির কাছে মাথা খুঁড়ে কী লাভ? সেই পাষাণ মূর্তি কি তোমার মনের দুর্ভাবনা দূর করতে পারবে? এরই পাশাপাশি তিনি হরিষষ্ঠী মনসা মাকাল প্রভৃতি অপদেবতা পূজোর বিরোধিতা করেছেন। মানুষকেই ঈশ্বর অর্থে সেবা করতে হবে। অর্থাৎ মানুষের অবয়বের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান।

লালন একই কথা উচ্চারণ করেছেন তাঁর নিম্নোক্ত গানে—

 মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
 সে কি অন্য তত্ত্ব মানে?
 মাটির ঢিবি কাঠের ছবি
 ভূত ভাবি সব দেব আর দেবী
 ভোলে না যে এসব রূপে
 ও যে মানুষরতন চেনে।

একই ভাবে লালন তথাকথিত দেবতাদের পূজার্চনার বিরোধিতা করেছেন। মানুষকেই সর্বোত্তম দেবতা হিসাবে স্বীকার করেছেন।

এই দুটি গান পাশাপাশি রাখলে মনে হয় লালন বোধহয় কুবীর গোঁসাইয়ের গান শুনেছিলেন। তবে আমাদের হাতে যে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ আছে, তাদের বিচার করে বলতে পারি। তিনি হয়তো এই গানটি শোনেননি। তার মানে সমস্ত বাউল আর ফকির কি একই ধর্মমতে বিশ্বাসী? তাঁরা সকলেই উদার প্রগতিশীল মানবতাবাদের প্রচারক। তথাকথিত জাতসমস্যা লালনকে বিব্রত এবং বিরক্ত করেছিল। অনেকে বলে থাকে, এই জাত ধর্ম পরিত্যাগ করার জন্যই তিনি ফকিরি মতবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। যদি জন্মসূত্রে তিনি হিন্দু হয়ে থাকেন এবং নিম্নবর্গীয় মানুষ হন তাহলে তাঁকে অভিশপ্ত জাতপ্রথার শিকার হতে হয়েছিল। তাই বোধহয় পরবর্তীকালে একাধিক গানে জাতভেদের ওপর তীব্র আক্রমণ করেছেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলেছেন—

 জাত না গেলে পাইনে হরি
 কী ছার জাতের গৌরব করি
 ছুঁসনে বলিয়ে?

 অথবা

 সৃষ্টিকর্তা যে হোক বটে
 নবদ্বীপে গৌর রূপে সকল জাত ছেঁটে
 করলেন একচেটে।

চৈতন্য সম্পর্কে এমন সুন্দর এবং সহজ বর্ণনা আর কেউ করতে পেরেছেন কি? লালন চৈতন্যদেবের প্রচারিত মতবাদকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। চৈতন্য হলেন সেই মহাপুরুষ, যিনি প্রথাসিদ্ধ পথের পথিক হননি। তিনি বলেছিলেন হরিনাম সংকীর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা সঠিক ঈশ্বরকে চিনতে পারব। ঈশ্বর আমাদের সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন। এই জাতভেদ মানুষেরই সৃষ্টি।

লালনের সমসাময়িক আর এক ফকিরের নাম পাঞ্জু শাহ। তিনি বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর একাধিক গানে লালনের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। তিনি বলেছেন—

 এক জেতের বোঝা লয়ে
 মিছে মলাম বয়ে
 চিরকাল কাটালাম মানী মানুষ হয়ে
 মানের গৌরব কুলের গৌরব ধন্দবাজি সব দেখি
 জেতে অন্ন নাহি দিবে রোগে না সারিবে
 পাপ করিলে কোম্পানি জাত ধরে নিয়ে যাবে
 মৃত্যু হলে যাব চলে
 জেতের উপায় হবে কী?

তাঁর কবিতা বাস্তববাদী। সত্যি তো, আমরা কোনো অন্যায় করলে সরকার কি আমাদের ছেড়ে দেবে?

লালনের পরবর্তী বিশিষ্ট গীতিকার গোঁসাই গোপাল একইরকম ভাবে জাতপ্রথা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। জীবনের একটা পর্বে গোপাল কলকাতায় চাকরি করেছেন। পরে ভাবসাধনার পথে আসেন। অন্ত্যজ বর্ণের অনেক হিন্দু এবং মুসলমান স্বইচ্ছায় তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। গোপালের গানে ইসলামী তত্ত্বের প্রভাব আছে। লালনপন্থীদের মতো গীতিকার গোপাল গোঁসাই প্রশ্ন তুলেছেন—

 আল্লা হরি কী জাত ছিল
 মরি মনোদুঃখে চর্মচক্ষে তারে দর্শন না হল
 কেউ বলে মোর আল্লা বড়ো
 কেউ বলে মোর হরি বড়ো
 দেখ গঙ্গার জল আর পুষ্করিণীর জল
 ইহার মধ্যে দ্বৈত বাধিল।

অর্থাৎ গঙ্গা অথবা পুষ্করিণীর জলের উৎস এক এবং অভিন্ন। এই সম্পর্কে চেতনা না থাকলে আমরা মিছে লড়াইয়ের মধ্যে অবতীর্ণ হব।

লালনের শিষ্য দুদ্দু শাহ মানুষের বানানো জাতিতত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন। শাণিত ভাষায় তিনি লিখেছেন—

 অজ্ঞ মানুষ জাতি বানিয়ে
 আজন্ম ঘুরিয়া মরে স্বজাতি খুঁজিয়া
 শিয়াল কুকুর পশু যারা
 এক জাতি এক গোত্র তারা
 মানুষ শুধু জাতির ভারা মরে বহিয়ে।

লালন বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের সৃষ্ট জাতি হল মাত্র দুটি—পুরুষজাতি এবং স্ত্রীজাতি। তাঁদের যে অনুসৃত ধর্ম, সেটি হল পৌরুষ এবং নারীত্ব। এই পৌরুষ আর নারীত্বের সহবাসের ফলেই প্রাণের উৎপত্তি। পুরুষ হল বীজ আর নারী হল জমি। তাই দু’জনকেই মানসম্মান দেখাতে হবে। তবে সন্তান উৎপাদন এবং প্রজননে নারীর মান্যতা বেশি। কারণ একাধারে নারী সৃষ্টিকর্ত্রী এবং পালিকা।

লালন এই ক্ষেত্রে যে যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন, তা ভালোভাবে বোঝা দরকার। লালন বলে, জেতের কীরূপ দেখলেম না এ নজরে—এখানে জাত বলতে তিনি বোধহয় caste শব্দটিকে বোঝাননি। তিনি হয়তো religion অর্থে জাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

লালন বলেছেন—আমার কী জাত, সে প্রশ্ন নিস্ফল। কারণ আমি জাতের চেহারা কখনো চোখে দেখতে পাইনি। জাতের স্বতন্ত্র চিহ্ন কিছু নেই। সুন্নত দিলে যদি মুসলমান হয়, এবং পৈতে পরলে ব্রাহ্মণ, তবে তাদের স্ত্রীদের প্রতীক রূপ কী হবে? তাই লালন ডাক দিয়েছেন সমগ্র মানবসমাজকে তিনি বলেছেন—এসো, এই জাতের আক্রমণ থেকে সমস্ত সমাজকে রক্ষা করো। ভ্রান্ত জাতিতত্ত্বকে বর্জন করে মুক্ত মানবিকতার জয়গান গাও।

লালন রিলিজিয়ান বা ধর্ম সম্প্রদায় এবং জাত বা কাস্ট কোনো কিছুই বিশ্বাস করতেন না। তিনি শুধুমাত্র জৈবিক ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল রেখেছিলেন। তিনি জানতেন নারী এবং পুরুষের মধ্যে এক অদম্য আকর্ষণ আছে। এই আকর্ষণ থেকেই তারা সহবাসে অংশ নেয় এবং বংশধারাকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফকিরি পন্থা এই শরীরী ধর্মকে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু অবাধ যৌন সঙ্গমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে শারীরধর্মকে বাঁধতে চায় সংযমের বাঁধনে। আর ফকিরি ধর্মের আর একটি লক্ষ্য হল সন্তানহীনতার পরম্পরা বহন করা। মনে প্রশ্ন জাগে, সকলেই যদি এই ধর্মের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে, তাহলে পৃথিবী কি জীবশূন্য অর্থাৎ মানুষ শূন্য হবে?

দেহধর্মকে মেনে নিয়মিত সঙ্গমে অংশ গ্রহণ করে আমরা কী ভাবে সন্তান সৃষ্টি সম্পর্কে নিষ্পৃহ থাকব? এই বিষয়টা কি মানব জীবনের পরিপন্থী নয়? প্রত্যেক মানুষ আকাঙ্খা করে তার মৃত্যুর পর তারই অনুরূপ একটি সন্তান পৃথিবীতে বিচরণ করবে। এই ভাবে এক মহান পরম্পরা রচিত হবে। লালন পন্থীরা কিন্তু এমতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁরা সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারীকে বরণ করেছেন, নারীর সঙ্গে সঙ্গম করেছেন দুরূহ সাধনার একটি পর্ব অনুশীলন করতে, কিন্তু নারীর মাধ্যমে কখনোই সন্তান সৃষ্টি করতে চাননি।

লালনের বিশ্বাসের জগত ছিল দিগন্ত পরিব্যাপ্ত। তিনি কি ইসলামবাদী ছিলেন? ছিলেন সুফী পন্থী? তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার রূপরেখা নির্ধারণ করতে গেলে আমরা বুঝতে পারি সুফী পন্থার সঙ্গে তাঁর আপাত যোগাযোগ ছিল না। তবে সুফী তত্ত্বের বেশ কিছু ইতিবাচক দিককে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। লালনের সাধনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট তাত্ত্বিক রমাকান্ত চক্রবর্তী একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তিনি তাঁর লেখা ‘লালন তত্ত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন—অভ্যাসের ক্ষেত্রে তিনি antinomian, এই ইংরাজি কথাটির অর্থ যে সেই ব্যক্তি, যিনি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা অনুসারে বিশ্বাসকে নৈতিকতার ওপরে স্থান দেন, কারণ তার মতে বিশ্বাসেই মুক্তির উপায় নিহিত আছে। ঐতিহাসিক বিচারে ভারতের প্রথম antinomian ছিলেন আজীবক সম্প্রদায়ের গুরু গোসাল,পুরণ কসষল এবং পরমাণুবাদী দার্শনিক পকুড় কচ্চায়ন, তাঁদের ধারাই অন্যভাবে বহন করেছেন ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী চার্বাক মতাবলম্বীগণ।

এই antinomian মতবাদ খ্রিস্টীয় ধর্ম ভাবনার সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত। ১৫৩৫ সালে জার্মানির এক গৌণ সম্প্রদায় এই নামে বিখ্যাত হয়েছিল। এই ধর্মমতের মূল কথা কী? এই ধর্মমতের মূল কথা হল, সাধারণ নৈতিক বিচারবুদ্ধির বিরোধিতা করা। ফকিরিপন্থার সঙ্গে এই ধর্মমতের অনেক মিল আছে। লালন হয়তো এই ধর্মমতেরই সমর্থন ছিলেন।

লালনের জীবনকালের ওপর আলোকপাত করলে আমরা তাঁর দর্শন সম্পর্কে বেশ কিছু কথা জানতে পারি। আঠারো শতকের শেষ থেকে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত অখণ্ড বাংলায় ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র শাসনের প্রাধান্য চোখে পড়ে। বৈষ্ণবদের মধ্যে দেখা দেয় নানা অবক্ষয়। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণের আলোকে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বাঙালি সমাজ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। অনেক হিন্দু ঔদার্য এবং প্রগতিবাদের ধ্বজা তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি সারা বঙ্গদেশে ছিল নিম্নবর্গকে অকারণে আচ্ছন্ন করে রাখার অপপ্রয়াস। খ্রিস্টান পাদরিরা অকারণে যিশুর মহিমা সংকীর্তন করতে থাকেন। নিম্নবর্গীয়দের নানাভাবে আকর্ষণ করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ, কারামত আলী জৌনপুরী, দুদু মিঞা এবং মুনসি মেহের উল্লাহের মতো মৌলবাদী মুসলমানরা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে আল্লাহর কথা প্রচার করতে থাকেন। এইসব ঘটনাগুলিকে প্রতিহত করার মতো সাহস বা সামর্থ লালনপন্থীদের ছিল না। এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে লালন তাঁর ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। তাই বোধ হয় তিনি গানকেই বেছে নিয়েছিলেন আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে। তিনি জানতেন সংগীতের প্রভাব অপরিসীম। সংগীত মানুষকে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিকে পরিণত করতে পারে। কাপুরুষ হয়ে ওঠে সাহসী।

লালন বলেছেন—

 ব্রহ্মজ্ঞানী আর খ্রিস্টানেরা
 নামব্রহ্মসার বলেন তারা
 দরবেশে কয় বস্তু কোথায়
 দেখ নারে।

আবারে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন—

 নয়নে রূপ না দেখতে পায়
 নাম মন্ত্র জপিলে কী হয়?
 নামের তুল্য নাম পাওয়া যায়।
 রূপের তুল্য রূপ আছে কার?

লালন ব্রাহ্মিক এবং খ্রিস্ট ভক্তদের আক্রমণ করেছেন। তিনি বস্তুবাদী সাধনার প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। তবে তাঁর মনোভাব এবং মতবাদ যে ইসলামী ধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। তাঁর একাধিক গানে নামাজ, রোজা, হজরব্রত ইত্যাদি শব্দগুলির প্রবেশ ঘটে গেছে। কিন্তু তিনি ইসলামী ধর্মের সবকিছুকে অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেননি। অনেক সময় ইসলামী ধর্মের কিছু কিছু বিষয়কে আক্রমণ করেছেন শাণিত ভাষায়। এই বিষয়গুলি দেখে অনেক গবেষক বলেছেন, লালন ইসলাম বিরোধী। এই ধারণা কিন্তু সঠিক নয়। তিনি বলেছেন—”নির্বোধের মতো নামাজ রোজা পালন করলে আল্লা পাওয়া যায় না। অথচ মৌলবাদীরা এই দিকেই বেশি দৃকপাত করছেন। তাঁরা নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের দারিদ্র দূরীকরণে সচেষ্ট হচ্ছেন না। হাজার হাজার মুসলিম নারীকে বোরখা পরিয়ে রাখা হয়েছে। এ শাস্ত্রবিরোধী। এভাবেই পুরুষতন্ত্র তার আভিজাত্য প্রকাশ করতে চাইছে।

নিজেকে ভুলে গিয়ে শুধু পশ্চিমদিকে মুখ করে নামাজ পড়লেই আত্মশুদ্ধি বা আত্মোন্নয়ন সম্ভব নয়। কোরানেই বলা হয়েছে—”তুমি পূর্ব দিকে মুখ ফেরালেই কী পশ্চিম দিকে মুখ ফেরালে তার মধ্যে পুণ্য নেই। তুমি যেদিকেই তাকাবে আল্লাহর মুখমণ্ডল দেখতে পাবে।”

নামাজ পড়া হল অহং-এর বিসর্জন দেওয়া। কিন্তু বেশিরভাগ নামাজি কি সেই অর্থে নারাজ পড়েন? ক্ষুব্ধচিত্তে ব্যথিত কণ্ঠস্বরে লালন এই প্রশ্ন তুলেছেন।

লালন জানতে চেয়েছেন—আমার আপন খবর আপনার হয় না। আছিস তুই যেখানে সেও সেখানে, খুঁজে বেড়াও কারে? লালন কয়, নিজ মকাম ধরো, বহু দূরে নাই। অর্থাৎ নিজের মকাম ধরো, নিজের আত্মোপলব্ধির পথ নাও। বৃথা পথেপ্রান্তরে ঘুরে কী লাভ?

মাছরাঙা যেমন স্থির লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে উন্মুখ হয়ে, তোমাকেও সেইভাবে ভগবানের প্রতি হৃদয়কে উন্মুখ, সংযত এবং সংস্থাপিত করতে হবে।

লালন বলেছেন—

 বাহ্য কাম ত্যাজ্য করে
 ওই থাকতে হবে নিরীখ ধরে
 মাছরাঙা পাখি যেমন রয়।

লালনের গানের আর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল বিজ্ঞানসম্মত চেতনার বহিঃপ্রকাশ। লালন যখন বলেন—আমাদের দেহ এক খাঁচা, সেখানে অচিন পাখির যাতায়াত, তখন আমরা অবাক হয়ে যাই। তখন মনে হয় তিনি শারীরবৃত্তীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে কতখানি অবহিত ছিলেন। শারীর বিজ্ঞানীরাও আমাদের দেহকে একটি খাঁচার সঙ্গে তুলনা করেন। এই খাঁচার কাঠামোটি হাড়ের ওপর নির্মিত। তারই ভেতর প্রাণের অবস্থিতি। লালন যাকে অচিন পাখি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। লালন গেয়েছেন—

 হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি
 ভেদ পরিচয় দেয় না আমায় ওই খেদে ঝোরে আঁখি
 পাখি বুলি বলে শুনতে পাই
 রূপ কেমন দেখিতে না পাই
 এ তো বিষম ঘোর দেখি।

ভেদ পরিচয় অর্থাৎ নিজের বহির্সত্তার সঙ্গে অন্তর্সত্তার দ্বন্দ্ব। এই ভেদ পরিচয় আমরা করতে পারি না। আমরা ওই পাখির স্বরূপ বুঝতে পারি না। এভাবেই আমাদের সমস্ত জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়।

লালন লিখেছেন—

 আঁখির কোণায় পাখির বাসা
 দেখতে নারি কী তামাসা
 যারে সাথে লয়ে ফিরি
 তারে যদি চিনতে নারি
 লালন কয় অধর ধরি
 কেমন ধ্বজায়।

সত্যিই তো, আমরা কি সত্যি সত্যি নিজেকে চিনতে পারি? চিনতে পারলে কি আমরা এমন আচরণ করতাম? আমারা বুঝতে পারতাম, এই জগত সংসার সবই শূন্য। আমরা বিশ্বচৈতন্যের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণামাত্র। কোথাও আবার লালন পাখির বদলে মাছকে উপজীব্য করেছেন। মাছ গ্রামবাংলার একটি অতি পরিচিত প্রতীক। হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মে মাছ পবিত্রতার প্রতীক।

লালন লিখেছেন—

 আমি বঁড়শি ফেলেছি সাঁই-এর জলে
 খাও বা না-খাও ঠোক দিয়ে যাও
 যদি মন বলে।

সাঁই-এর জলে, অর্থাৎ গুরুর জলে। লালন বঁড়শি পেতে বসে আছেন, মন কখন গুরুর প্রতি নিবেদিত হবে, সেই আশায়। সম্পূর্ণ নিবেদন হয়তো হবে না, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? সহজ সরল ভাবে ও ভাষায় তিনি বলেছেন—শুধু একবার ঠোকরালেই আমি খুশি। অর্থাৎ এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের মনে ঈশ্বর ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটে যাবে।

লালন বলেছেন—

 নৌকো ঠিক নয় বিনা পারায়
 নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়?

অর্থাৎ নৌকো যদি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জলের মধ্যে, তবে তার সার্থকতা কোথায়? আমরা নৌকো কেন ব্যবহার করি? এপার থেকে ওপারে যাব বলে। দুই পারের মধ্যে নৌকো হল এক সচল সাঁকো। সে-ই সেতু বন্ধন করে।

নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়? এই শব্দগুলির আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। মারফতি সাধক ইসলামী আকিদা মেনে কোনো অসম্ভব অবস্থানে যেতে ইচ্ছুক নয়। অর্থাৎ লালনের লক্ষ্য সাকার, নিরাকার নয়। তিনি দেহ নৌকোকে আশ্রয় করে পারাপার করতে চাইছেন। সেই নৌকোতে বসে আছেন এমন এক মাঝি বা গুরু, যাকে বর্জখ বা বরজখ বলা হয়।

পদটি এবার সম্পূর্ণ এভাবে হয়েছে—

 নৌকো ঠিক নয় বিনা পারায়
 নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়
 লালন মিছে ঘুরে বেড়ায়
 অধর ধরতে চায় বর্জখ বিনে।

মুর্শিদ বা গুরু হলেন ওই বর্জখ। তিনি নৌকোর হাল ধরে বসে আছেন। নদীর স্রোত কামনার প্রতীক আর সাধকের দেহ হল এই নৌকোটি।

বর্জখ শব্দটিকে লালনপন্থীরা নতুনভাবে ও অর্থে প্রয়োগ করেছেন। বর্জখ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হল ব্যবধান বা অন্তরাল। কোরানের ভাষ্য অনুসারে বর্জখ বলতে বোঝায় মানুষের মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিনে পুনর্জীবন পাওয়া পর্যন্ত সময়। কোরানের মতানুসারে আমাদের জীবনে তিনটি স্তর আছে—এই পৃথিবীর জীবন, মৃত্যুর পর মধ্যবর্তী স্তর বর্জখ এবং পুনর্জীবনের সময় আর এক জীবনের সূচনা।

সুফীরা এই বর্জখ শব্দটিকে আবার অন্যভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ঈশ্বর উপলব্ধির চূড়ান্ত স্তরের আগে যে আড়াল ঈশ্বর আর প্রেমিককে বিচ্ছিন্ন করে রাখে,সেটি হল বর্জখ। বর্জখের ব্যবধান পার হলে তবে আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারব। বাউলরা ওই ভাবনাটুকুকে সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা মুর্শিদকে বর্জখের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন—আমাদের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য হল মুর্শিদের স্তরকে অতিক্রম করে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা।

এইভাবে লালনপন্থীরা মুর্শিদকে যথেষ্ট মান্যতা দিয়েছেন। তাঁরা এমন একটি মতবাদের প্রবর্তন করেছেন, যা অনৈইসলামিক। এইভাবে এক সমান্তরাল পরম্পরা গড়ে উঠেছে। মুর্শিদের অবশ্যম্ভাবী স্বীকৃতি দিয়ে লালন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

লালন অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন—শরিয়তি বিনে বল কোথায় দাঁড়াবি? অর্থাৎ তিনি শরিয়তের বিরোধিতা করতে চান না। শরিয়তে জন্ম, মারফতে কর্ম, লালন ফলের প্রত্যাশী। ফলহীন কোনো কর্মে তাঁর আস্থা নেই। তিনি বলেছেন— শরীয়তি গাছ রয়েছে

৭। মারফতি ফল ধরেছে
 সেই গাছ যার দখলে আছে
 তারে ফেলে ফল কেমনে খাবি?
 বেআইনে দখল করলে
 শাস্তি হবে তোর কপালে।

তার মানে লালন একটির পর একটি স্তরকে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় অতিক্রম করেছেন। ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেননি। যুক্তি তর্কের জাল বুনেছেন। এই গানটি শুনলে আমরা বুঝতে পারি যে, তথাকথিত শরীয়তি ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা কত পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ ছিল। তিনি বলেছেন, প্রথমে শরিয়তের দখলদারি চাই, তার পর আসবে মারফতির দখল, আগে আমরা গাছ লাগাব, তার পরিচর্যা করব, তবে উপযুক্ত সময়ে সেখানে ফল পাব। কেউ কেউ অতি অল্পে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। কিছুদিন গুরুর কাছে থেকে ভাবেন, আমার এখনও ঈশ্বর অনুভূতি হল না কেন? তাঁরা হয়তো অনেকে শুধু গাছের পরিচর্যা করতেই ব্যস্ত থাকেন। ফল সম্পর্কে আগ্রহী হন না। লালন এই দুটি পন্থারই বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন—

 ও মন শেখ ফরিদ আউলিয়া ছিল
 সত্তর সাল জঙ্গলে ছিল
 কত কষ্ট উঠাইল জানো না
 খিদায় না খাদ্য খাইল
 ওই আল্লার নাম জপিল
 তবু না হাসিল হইল
 লালন কয়, শেখ ফরিদের হইল না।

কেন? শেখ ফরিদ জীবনের চলার পথে এত কঠিন কঠোর তপস্যা করেছিলেন, তবুও তিনি কেন ফল লাভ করতে পারলেন না? তিনি তাঁর বন্দেগিকে হাসিল করেননি কেন? কারণ তিনি মুর্শিদ অর্থাৎ গুরুকে ধরেননি। তাই লালনপন্থীরা বিশ্বাস করেন—এবাবদও বন্দেগি করা মুর্শিদ বিনে হবে না। অর্থাৎ মুর্শিদ কিংবা গুরু ছাড়া জীবনের পথে তুমি সফলই হবে না। মুর্শিদ হলেন আত্মজ্ঞানী, তিনি আমাদের পথনির্দেশক এবং দিশারী।

তাই লালন বারবার বলেছেন,

 মুর্শিদ জ্ঞানের দাতা জ্ঞান ছাড়া ভজন কথা বৃথা
 আছে প্রেম যথা তথা গুরুর ভজন চাই
 ধর্মজ্ঞানী গুরু হলে জ্ঞানে জ্ঞান বাড়ায়
 নদীর জল বর্ষা হলে খারাপ জল ভালো হয়।

তার মানে? একজন সৎ গুরু যে কোনো মানুষকে পরিশুদ্ধির পথ দেখাতে পারেন।

লালন যে ইসলামের সব রীতিকে গ্রহণ করেননি, তার আর একটু পরিচয় দেওয়া যাক। লালন বলেছেন—নয়ন জলে চরণ ধুইতে হয়, কিন্তু আল্লা তো নিরাকার। যাঁর দেহ নেই, যার চরণ ধোব কী করে? এই দ্বন্দ্বিকতার সমাধান তিনি নিজেই করেছেন। তিনি বলেছেন—

 যেহি মুর্শিদ সেহি খোদা
 মনে কেহ রেখো না জুদা (ভেদ)

মুর্শিদই খোদা, অর্থাৎ খোদার আসনে তিনি গুরুকে বসিয়েছেন কিন্তু আল্লার কি কোনো দোসর থাকতে পারে?

 লালনের ভাষায়—

 রসুল্লুল আর খোদাতায়ালা
 ভিন্ন নয় সে একই আল্লা।

ইসলামের আকিদায় বলা হয়েছে, আল্লার কোনো শরিক নেই, মহম্মদ বা সুল আল্লার বান্দা বা তাঁর প্রেরিত পুরুষ। ফকিরপন্থা এবং লালনীয় মতবাদ কিন্তু একটি অন্য ক্রম নির্ধারণ করেছে। এই ক্রমানুসারে বলা হয়েছে আল্লা রসুল থেকেই আদম বা দেহধারী নরের আবির্ভাব। আদম মুর্শিদের কাছে নতজানু হয়েছে। এই মুর্শিদকে জানলে তবেই আমরা খোদাকে জানতে পারব। শাস্ত্র, কলমা, নামাজ, রোজা, হজ এবং জাকাতের পথে খোদার স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।

ইসলামে ভক্ত এবং ভগবানের সম্পর্ক নিয়ে তিনটি পৃথক ধারার কথা উল্লিখিত হয়েছে। প্রথম ধারার মধ্যে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের আরিফ বলা হয়। তাঁদের জ্ঞানের মধ্যেমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে চান। তাঁদের কাছে জ্ঞানই সর্বশক্তিসম্পন্ন। কারণ, জ্ঞানের ভেতর অকারণ ভাবাবেগের কোনো স্থান নেই।

দ্বিতীয় ধারায় আসিক বা এমন মানুষদের বলা হয়েছে যাঁরা ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবে ঈশ্বরকে পেতে চান। তৃতীয় ধারায় আছেন সালিখ, তাঁরা প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে চান।

লালনপন্থার ভেতর প্রথম এবং তৃতীয় ধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মুর্শিদ হলেন জ্ঞান এবং প্রেমের সমন্বয় সাধক।

লালনের একটি গানে এই দুটি ধারার যোগসূত্রতা প্রকাশ হয়েছে এইভাবে—

 আমি ডুব দিয়া রূপ দেখিলাম প্রেম নদীতে
 আল্লা আদম মোহম্মদ তিনজনা এক নুরেতে
 সে সাগর অকুলেরও
 আদি অন্ত নাই তাহারও
 নিঃশব্দ ছিল সিন্ধু আদিতে আদিতে
 আচানক দিয়া নাড়া সেই শব্দ করলেন খাড়া
 সেই সৃষ্টির গোড়া আদিতে আদিতে
 শব্দ হইল কুন জানো তার বিবরণ
 নিঃশব্দ ছিল যে সিন্ধু আদিতে আদিতে।

এই গানটির মধ্যে এক অসাধারণ বিজ্ঞানসম্মত চেতনা লুকিয়ে আছে। আমরা জানি মহাসমুদ্রের মধ্যেই প্রথম এককোষী প্রাণীর আবির্ভাব হয়। ধীরে ধীরে সেই এক কোষী প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি। সৃষ্টির আদিকালে হয়তো সাগর ছিল নিস্তব্ধ, প্রাণপ্রাচুর্যের চঞ্চলতা সেখানে ছিল না। লালনের মতো এক অশিক্ষিত মানুষ সৃষ্টিতত্ত্ব রহস্যের এই বিষয়গুলি জানলেন কী করে? তবে কি তিনি ছিলেন জন্মান্তরী কোনো মহাসত্তা? গত জন্মের শেষ না হওয়া কাজগুলোকে এভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন?

এই বিবরণের মধ্যে ইসলামী প্রভাব আছে, কিন্তু ইসলামী আকিদা বা বিশ্বাস নেই। নুর অর্থাৎ আল্লার পবিত্র জ্যোতি বা দ্যূতি থেকে বিশ্বের সৃষ্টি, একথা ইসলামীয়রা মনে করে থাকেন। কিন্তু একই নুরের ভেতর আল্লা মোহম্মদ আদম সহাবস্থান করছেন, এমন কল্পনা কোনো ইসলাম কখনো করতে পারেন? এই কল্পনা হল লালনের নিজস্ব নির্মাণ। এই নির্মাণ কুশলতাকে সর্বসমক্ষে পেশ করার জন্য তিনি এমন এক নিঃশব্দ সমুদ্রের কল্পনা করেছেন, যা আদি অন্তহীন। সহসা এক অলৌকিক সঞ্চালনে সেই সমুদ্রের মধ্যে প্রচণ্ড প্লাবনের সৃষ্টি হয়, সমুদ্রের মৌনতার মধ্যে থেকে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত ধ্বনি ব্রহ্ম—কুন, অর্থাৎ হয়ে ওঠো (being)

লালনের এই কল্পনার ভেতর দার্শনিক অভিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের মিলন ঘটে গেছে। তিনি এক রহস্য তন্ময়তার জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এই জগতের বাসিন্দা হয়ে লালন মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, আমি ধর্মের ক্ষেত্রে অনুমানবাদী নই, ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে আমি আবার মরমি। অর্থাৎ আমার কাছে সত্য হল সেই বিষয়, যা আমাদের হৃদয়কে পরিব্যাপ্ত করে। আমি সেই সত্যের সাধক হব, যেখানে ধর্মের অকারণ প্রাচুর্য থাকবে না, থাকবে না ভাবাবেগের অভিমান, সেই সত্য ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

লালনের সৃষ্টি এবং বিশ্বাসের মানস ইসলামীয় ধারণা থেকে সূত্র সন্ধান করেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মধ্যে এমন এক অস্ফুট রহস্যের দ্যোতনাকে প্রকাশ করেছে যা ইসলামীয়দের কাছে ছিল অচেনা অজানা। তবে কি তিনি হিন্দু সৃষ্টিরহস্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? জন্মসূত্রে যদি তিনি হিন্দু হয়ে থাকেন তাহলে কি তাঁর ওপর গতজন্মের কোনো প্রভাব পড়েছিল? প্রারদ্ধ কাজের ফল তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

লালন লিখেছেন—

 জল নাই দেখি সদ্য
 ভাসে পদ্ম সেই পুকুরে

 অথবা

 খাঁচায় কৌতুহল নাই তার
 উড়ছে পাখি নিরন্তরে

 কিংবা

 যখন নিঃশব্দ শব্দেরে খাবে
 তখন ভাবের খেলা ভেঙে যাবে।

এক অসাধারণ গীতিমাধুর্য। বিষণ্ণ বিপন্ন বিপর্যয় এবং রহস্যের অস্ফুট দ্যোতনা যখন তাঁর মন আচ্ছন্ন তখন তিনি এইসব কথাগুলি উচ্চারণ করেন। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনিও নবজাগরণকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তবে ভিন্নতর পরিস্থিতি এবং পরিবেশে। তথাকথিত শাহরিক সভ্যতার সংস্পর্শে না আসার ফলে তাঁর প্রতীক একান্ত ভাবে গ্রামীণ হয়ে উঠেছে। যা অতি সহজে সমাজের তথাকথিত অশিক্ষিত নিম্নবর্গীয় মানুষদের আকর্ষণ করে। যে সব মানুষ কোনোদিন রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ অথবা কেশবচন্দ্রের নাম শোনেনি তাদের কাছে লালন হয়ে ওঠেন আত্মার আত্মীয় এবং পরমবন্ধু।

ফকির পন্থার মদ্যে যে মগ্ন চৈতন্যের আভাস দেখা যায়, লালন সেই পন্থাকে পরিস্ফুটিত করেছেন। ফকির পন্থার ভেতর এক ধরনের সাধকের অবস্থিতি, যাঁরা অন্তর্লীন সূক্ষ্ম অনুভবে মানুষ, নিসর্গ, স্রষ্টা, সব কিছুকে একাকার করেছেন। লালন কিন্তু সাধনার সেই স্তরে উপনীত হতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, মাটির মানুষের কাছাকাছি থাকতে। শুধু গান আর গানের মাধ্যমে এমন এক জগত সৃষ্টি করতে যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের আকৃষ্ট করবে।

লালনের গান রচনার অন্তরালে কোনো শিক্ষিত মননের প্রেরণা ছিল না। তিনি গান লিখেছেন অশিক্ষিত অন্ত্যজ মানুষদের জন্যে। আপন খেয়ালে বিশাল প্রকৃতির চন্দ্রাতপ তলে বসে তাঁর সৃষ্টি। বেশির ভাগ গানই মুখে মুখে বলা হয়েছে। হয়তো অনেক গান হারিয়ে গেছে, বিস্মৃতির অতলে কত কিছু তলিয়ে গেছে। তবু যা আছে, তাই বা কম কি?

লালন বলেছেন—

 ভাবশূন্য থাকিলে হৃদয়
 বেদ পড়িলে কী ফল হয়?
 ভাবের ভাবি থাকলে সদয়
 গুপ্ত ব্যক্ত সব জানা যাবে।

অর্থাৎ তিনি আমাদের ভাবের জগতের বাসিন্দা হতে বলেছেন।

ভাবের পরে আসে রূপ বা দেহ। লালন উচ্চারণ করেছেন।

 লালন বলে ভাবুক যারা
 রূপের বাতি দিয়া তারা চরণ পাবে।

লালন পন্থায় ভাব থেকে রূপে যাবার যে পদ্ধতি, সেই পদ্ধতিতে মানুষ এক অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ। তাই লালন দৃপ্তকণ্ঠে মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বলেছেন —

ভাব দিয়ে খোলো ভাবের তালা
 দেখবিরে মানুষের খেলা

এইভাবে তিনি মানুষ তত্ত্বকে কায়েম করার চেষ্টা করেছেন। লালন কিন্তু কখনো নারী জাতির অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করেন নি। কোনো কোনো ফকিরের মতো তিনি নারীকে নরকের দ্বার বলে সম্ভাষণ করেননি। বরং তিনি বলেছেন—নারীরা হলেন এই বিরাট বিশ্বজগতের মাতা। নারী না থাকলে সন্তান উৎপাদন এবং সন্তান প্রতিপালন সম্ভব হত না। পৃথিবীর সব নারীর মধ্যেই মাতৃত্ব ভাবের জাগরণ ঘটে যায়। লালন বলেছেন—

 এই ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে
 শুনি ভাণ্ডেও তা আছে
 তাই লালন বলে, অজুত ভাণ্ড করো খণ্ড
 দেহের মধ্যে কে আছে?

এখানেও এক আশ্চর্য বিজ্ঞানচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেছে। সত্যিই তো, বিশাল এই ব্রহ্মাণ্ডকে আমরা অণ্ড বা ডিমের সঙ্গে তুলনা করেছি। এই ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে, ছোট্ট একটি ভাঁড়ের মধ্যে তা-ই আছে। অর্থাৎ এই মহা পৃথিবী মহাশূন্য এবং ছোট্ট একটি ভাঁড় একই বস্তু দিয়ে তৈরি। লালন তাই ওই বস্তুটিকে খণ্ড বিখণ্ড করতে বলেছেন। এভাবেই তিনি হয়তো পারমাণবিক ধ্যান ধারণার কথা বলেছেন। লালন যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন পরমাণু সম্পর্কে আমাদের সামান্যতম ধারণা ছিল না। লালন বোধহয় দার্শনিক অভিজ্ঞানের মাধ্যমে পদার্থের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন একদিন বিজ্ঞানীরা এক কণাগুলিকে বিশ্লিষ্ট করতে পারবেন।

কীভাবে আমরা কাম থেকে নিষ্কাম হব? কেন? যদি আমরা সংগীতের আশ্রয় নিতে পারি, তাহলে কাম ভাবনা অনেক স্তিমিত এবং শান্ত হবে। আমরা সংগীতের মাধ্যমে কামনার এক-একটি বিষাক্ত ছোবলকে প্রতিহত করতে পরব।

লালন ইঙ্গিতে বলেছেন—

 পাথরেতে অগ্নি থাকে
 বের করতে হয় ঠুকানি ঠুকে

অর্থাৎ পাথরের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। কীভাবে আমরা সেই সম্ভাবনাকে সকলের সামনে বের করব? আমাদেরও একটি ঠুকনি দরকার। এই ঠুকনি কে দেবেন? দেবেন মুর্শিদ বা গুরু। তাই মুর্শিদকে কখনো নবি, কখনো খোদা বলেছেন। তিনি বলেছেন—অদৃশ্য খোদার বদলে সামনে উপস্থিত মুর্শিদের ভজনা এবং শরণাগতি সহজ সাধন। ভক্তের নয়নজলে চরণ ধুইয়ে মুর্শিদকে আপন করতে হবে। লালনের উচ্চারণ—

 দেখবি যদি সে চাঁদেরে
 যা যা কারণ সমুদ্রের পারে।

অর্থাৎ আমরা আলোক সরণীর প্রত্যাশী হব। আমারা সেই চাঁদের উদয় দেখব, যা আমাদের আত্মাকে আলোকিত করবে।

এমন অসংখ্য প্রতীক ব্যবহার করে লালন তাঁর সাধন তত্ত্বটিকে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন—

মরার আগে মলে শমন জ্বালা ঘুচে যায় অথবা ধররে চাঁদেরে অধরে অধর দিয়ে, কিংবা অহর্নিশি পাশাপাশি থেকে দিশে হয় মোরে।

তার মানে লালনের বিশ্বাস এবং চেতনার জগত মানুষের সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গেছে। তাঁর জীবনের ভেতর যে অন্তর্মুখীনতা লুকিয়ে ছিল, সেই জীবন মানুষকে একান্ত কাছে এনে দিয়েছে। বিশিষ্ট গবেষক এবং সাহিত্যবোদ্ধারা লালনগীতি সম্পর্কে নানা কথা বলেছেন। এমনকী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লালনগীতির রহস্য সন্ধানে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। আজও লালন আমাদের কাছে এক জীবন্ত বিস্ময় হিসাবে অবস্থান করছেন। কারণ লালন সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণিমুক্তো সংগ্রহ করা সহজ নয়। শুধু তাই নয়, লালন সমুদ্রে ডোবার মতো ডুবুরির অভাব।

বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বড়ো শূন্যতা এভাবে সৃষ্টি হয়েছে। যে লালনকে আমরা অন্ত্যজ সংস্কৃতির মহান ব্যক্তি বলে থাকি তাঁর সাধনরহস্য সম্পর্কে সব কথা না জানলে আমাদের চলবে কেন? আজ নতুনভাবে গবেষণা শুরু হয়েছে। আমরা জানি ভক্তিবাদী বৈষ্ণব ধর্ম এবং পদাবলী মধ্যযুগীয় সাহিত্যচর্চায় ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম সম্পর্কে উচ্চবর্ণের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু লালন সম্পর্কে সেই ধরনের মোহমুগ্ধতা কি সৃষ্টি হতে পেরেছে? এমনকী আমরা ভারতচন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা করি, আমরা বলি ভারতচন্দ্র মধ্যযুগীয় সাহিত্য স্রষ্টাদের মধ্যে একক প্রতিভায় ভাস্বর, কিন্তু লালন সম্পর্কে সেই মূল্যায়ন কবে হবে।

লালন সাধনার আর একটি বড়ো বিষয় হল এককীত্ব বা নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে ভালোবাসতেন। লালনের জীবনকাহিনী বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, বারে বারে তাঁকে নানা বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এইসব বিপর্যয় থেকেই কি তিনি নৈঃশব্দ্যের গান শুনতে পেয়েছিলেন? লালন কেন প্রকৃতিকেই বিশ্বমাতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন? সমাজের কাছ থেকে অনভিপ্রেত আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত লালন প্রকৃতি মায়ের কাছে শেষ আশ্রয় চেয়েছিলেন। প্রকৃতি মাতা পরম মমতায় তার খ্যাপা বাউলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। লালন লিখেছেন—

 গোরের কিনারে যখন লয়ে যায়
 কাঁদিয়ে তখন সবে জীবন ছাড়তে চায়
 লালন বলে, কারো গোরে কেউ তো থাকে না
 থাকতে হয় একাকী।

একটি অসাধারণ দৃশ্য কাব্য। সত্যিই তো, মৃত্যুর পর কি আমরা বন্ধুবান্ধব প্রেমিক প্রিয়জনকে সঙ্গে পাই? সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় আমাদের চলে যেতে হয়। তাহলে জীবনে চলার পথে এত পরিচিত প্রিয়জনদের কী দরকার?

লালন কিন্তু উদাসীন, ত্যাগব্রতী ধ্যানমগ্ন এক যোগী ছিলেন না। তাঁর ছিল ব্যাপক সংগঠন। তিনি জানতেন প্রশাসনিক দক্ষতার উত্তুঙ্গ শিখরে আরোহণ না করলে সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তখন লালনপন্থা ব্যাপক শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। লালন একটি ইচ্ছাপত্র ঘোষণা করেন। এই নির্দেশনামাতে তিনি তাঁর সম্পত্তি ও সঞ্চিত অর্থের বিতরণ কেমন হবে সেকথা লিখে গেছেন। প্রতি বছর শীতকালে লালন একটি ভাণ্ডারা বা মহোৎসব দিতেন। তাতে সহস্রাধিক শিষ্যগণ ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হয়ে সংগীত ও আলোচনা করত। তাতে তার পাঁচ ছয় শত টাকা ব্যয় হত।

তখনকার দিয়ে পাঁচ ছশো টাকা খরচ করা খুব একটা সহজ নয়। মৃত্যুকালে লালনের হাতে দু-হাজার টাকা নগদ ছিল। তিনি কিছু টাকা তাঁর স্ত্রীকে দিতে বলেছেন, এইসব তথ্যগুলি আমাদের অবাক করে দেয়। তিনি সাংগঠনিক বুদ্ধিসম্পন্ন এক ধর্মনেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রংপুরের কাছাকাছি উত্তরবঙ্গে লালনপন্থীদের গুরুত্ব এত বেড়ে গিয়েছিল যে, শরিয়তী মুসলমান মৌলবীরা এই পন্থা ধ্বংসের ফতোয়া জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, লালন পন্থীদের নানা ভাবে লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহের ঘটনাও ঘটে যায়।

লালন বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু গান গাইলেই হবে না, সেই গান যাতে মানুষের মর্মস্থলে প্রবেশ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য একটি সমৃদ্ধ সংগঠন দরকার। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তথাকথিত উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন। নবীতত্ত্ব এবং গুরুতত্ত্বকে যেমন তিনি নতুন আলোকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তেমনভাবেই সমাজের বিভিন্ন আপত্তিকর রীতিনীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। লালন যেভাবে নারীকে মুক্ত মনের সঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন তা অনেক নীতিবাগীশ মানুষকে আঘাত করেছিল। তাদের চোখে লালন ছিলেন লাম্পট্যের প্রতীক। লালন জোর করে ভদ্রবাড়ির রমণীদের ফুঁসলে নিয়ে আসেন এবং নিজের কাম চরিতার্থ করেন—এমন কথা তাঁরা বারবার উচ্চারণ করেছেন।

লালন জানতেন নিজস্ব মতবাদকে প্রচার করতে হলে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে। তিনি ছিলেন এক ভ্রমণশীল মানুষ। তদানীন্তন শিক্ষিত সমাজের অনেকের কাছে তাঁর আকর্ষণ ছিল অপ্রতিরোধ্য। এই প্রসঙ্গে কুমারখালির বিশিষ্ট সাংবাদিক হরিনাথের কথা বলা উচিত। তিনি কাঙাল হরিনাথ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁকে কেন্দ্র করে নব্যশিক্ষিতদের একটি আড্ডাখানা গড়ে ওঠে। হরিনাথ তাঁর প্রেস থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে দ্বিধাহীন চিত্তে তদানীন্তন জমিদারদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করতেন। এমনকী ঠাকুর বংশীয় জমিদারদের প্রজাপীড়নের কথাও তাঁর পত্রিকার পাতায় বারবার প্রকাশিত হয়েছে। কুমারখালি থেকে হিতকরী নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত, যার পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন। এই দুজন মানুষকে সামনে রেখে আরও অনেক বুদ্ধিজীবী ওই সারস্বত বলয়ে যোগ দিয়েছিলেন। এসেছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এবং জলধর সেন। কলকাতার চিন্তাশীল সমাজের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

লালন মাঝে মধ্যেই কুমারখালিতে যেতেন। এই সারস্বত সম্মেলনে যোগ দিতেন। লালনের বিশিষ্টতা বাকি সকলকে মুগ্ধ করত।

এই সূত্রেই হয়তো তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের একটি পেনসিল স্কেচ এঁকেছিলেন, যেটি রবীন্দ্রভারতীর সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। স্কেচটির গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা আছে—শিলাইদহ বোটে লালন ফকির, ৫ মে ১৮৮৯। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালনের জীবনাবসান ঘটে। অর্থাৎ এই স্কেচটি যখন আঁকা হয়, তখন লালনের বয়স ১১৫ বছর। সামনের চেয়ারে বসে জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ এই স্কেচটি এঁকেছিলেন। মৃত্যুর সতেরো মাস আগে। হাতে লাঠি বা ফকিড়ি দণ্ড, লম্বা চুল এবং দাড়ি। পরনে পিরান ও তহবন। এটাই লালনের একমাত্র বাস্তব প্রতিকৃতি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা লালনের কোনো ফটো হাতে পাইনি। হরিনাথ মীর মোশাররফ, অক্ষয় মৈত্রেয় সকলেরই ফটো আছে, কিন্তু লালনের ফটো কেন নেই? হয়তো ফটো তোলার ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত আপত্তি ছিল। অথবা সমাজের যে নিম্নবর্গে তাঁর অবস্থান, সেখানে ফটো তোলার মতো উৎসাহ কেউ দেখাননি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কেন এই ছবিটি এঁকেছিলেন? আমরা জানি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এক বিচিত্র শখ ছিল, মানুষের স্কেচ আঁকা। ১৮৭০-১৯২৫ সাল পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রায় আঠারো শো মানুষের মুখাবয়ব এঁকে গেছেন। তিনি কি লালন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? লালন যে কতবড়ো মাপের মানুষ সেকথা জেনেই ছবি এঁকেছিলেন? নাকি লালনকে দেখে এবং তাঁর চেহারার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত করে তিনি ওই ছবিটি আঁকেন?

এই ছবি দেখে আমরা বুঝতে পারি যে, শিলাইদহ বোটে লালনের অবাধ গতিবিধি ছিল। হয়তো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখে তিনি ছিলেন এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তি।

এখন দেখা যাক লালন সাধন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন। অনেক গবেষক বলে থাকেন যে, বিশ্বকবির সাথে লালনের একাধিকবার সাক্ষাত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের হাতে যে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ আছে, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি, এ হল কষ্টকল্পনা। হয় তো লালন এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বাস্তব সাক্ষাৎ কখনো ঘটেনি রবীন্দ্রনাথ কিন্তু লালনের নাম শুনেছিলেন। ১৯০৯ সালে একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন—”আর একটি বিষয়—সেটা আমার বিশেষ ঔৎসুক্যের বিষয়। সেটা ছোটো ছোটো নতুন ধর্মপ্রচারকদের জীবনী ও বক্তব্য বিষয় সংগ্রহ করা। মফঃস্বলে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিতে পাই যে, হয়তো পল্লীর নিভৃত ছায়ায় কোনো ব্যক্তি এক নতুন ধর্মসম্প্রদায় সংগঠন করিতেছেন। তাঁহারা ভদ্রসমাজে বিশেষ পরিজ্ঞাত শহেন, কিন্তু সমাজের মধ্যে তাঁহারা কী বলিতে এসেছেন, কী বলছেন তা জানা উচিত, এগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে সমস্ত ভরতবর্ষের মধ্যে যেসমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত আছে, অজ্ঞাতে অলক্ষিতে যে সকল শক্তি সমাজের মধ্যে কাজ করিতেছে, তাহা অনেকটা বোঝা যাইবে। আমি এইরূপ একজন ধর্মপ্রচারকের বিষয়ে কিছু জানি, তাহার নাম লালন ফকির। এই লালন ফকিরের মত মুসলমান জৈনমত—সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিস তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ বিষয়ে সকলেরই মন দেওয়া উচিত।

এই ভাষণটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লালন প্রবর্তিত ধর্মমত সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে গৌণধর্মের উৎপত্তি চোখে পড়ছে। হয়তো এইসব গৌণধর্মের ব্যাপ্তি ও বিশালতা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু কিছু মানুষ কীসের টানে এই ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন? তাঁরা কেন বৃহত্তর ধর্মবৃত্তের বাইরে যাবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছেন? এরফলে তাঁদের হয়তো শারীরিকভাবে অনেক নিগ্রহ সহ্য করতে হবে। বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁরা ভেঙে পড়বেন। তাসত্বেও তাঁরা কেন নতুন ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন?

তখনও পর্যন্ত লালনের গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের খুব একটা ভালো দারণা ছিল না। হয়তো তিনি লালন গীতি শোনেননি। কিন্তু ১৯০৭ সালে প্রকাশিত গোরা উপন্যাসে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটির প্রথম অংশ উদ্ধৃত করেছেন। কলকাতায় আলখাল্লা পরা এক বাউল এই গান গাইছেন—তিনি লিখেছেন। গানটির প্রসঙ্গ এবং উদ্ধৃতি তিনি অন্যত্র ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এই গানটি যে লালনের গাওয়া সেকথা কখনো বলেননি। কেউ কেউ তাই সন্দেহ করে থাকেন যে, সম্ভবত এটি লালনের গান নয়। পরবর্তী কালে তিনি অবশ্য লালন গানের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ছেঁউরিয়া আশ্রম থেকে লালনের গানের খাতা সেরেস্তার কর্মচারীকে দিয়ে অনুলিখন করে আনেন। সংগ্রহ করেন লালনের আর একটি গানের খাতা, যা শেষ পর্যন্ত ফেরত যায়নি।

লালনের মৃত্যুর পর মতিলাল দাস এবং উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামে দুই লালন গবেষক লালন গীতির খোঁজে ছেঁউরিয়াতে গিয়েছিলেন। লালনের এক উত্তরসুরী ভোলাই শাহ তাঁদের কাছে অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের গুরুর গানের খাতা ফেরত দেননি। বোলপুর এবং কলকাতায় বারবার পত্রাঘাত করা হয়েছে, কিন্তু এই আবেদনের কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তারপর তাঁরা মন্তব্য করেছেন, লালন গানের বেশ কিছু অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান লিখেছেন।

সাঁইজির আসল খাতা সত্যিই ফেরত যায়নি, রবীন্দ্রভবনে যে অনুলিখিত খাতা আছে, সেটি কিন্তু আসল খাতা নয়। অবশেষে কৃষ্ণ কৃপালনীর পরিত্যক্ত কাগজপত্র থেকে আসল খাতা খুঁজে পেয়েছেন লোকসাহিত্যের গবেষক শক্তিনাথ ঝা।

এর ফলে ভোলাই শাহদের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রবাসী পত্রিকায় ১৩২২ সালের আশ্বিন থেকে মাঘ সংখ্যায় ‘হারামণি’ শিরোনামে লালনের কুড়িটি গান রবীন্দ্রনাথ ছেপে দিয়েছিলেন। এইভাবেই তিনি বঙ্গদেশীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে লালনকে পরিচিত করান। লালনকে সর্বজনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য তাঁর এই প্রয়াস অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। এই কুড়িটি গানের মধ্যে বারোটি গান রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত খাতায় পাওয়া যায়নি। আসল খাতা থেকে সেগুলির হদিস মিলেছে। প্রবাসীতে ছাপা কুড়িটি গানের মধ্যে আটটি গান দুটি খাতাতে আছে। বাকি বারোটি গান আছে শক্তিনাথ ঝা—র আবিষ্কৃত খাতায়।

তাহলে? সত্যি সত্যি কি রবীন্দ্রনাথ গানের খাতাটি ফেরত দেননি? নাকি এর মধ্যে তথ্যগত কোনো অসঙ্গতি আছে? রবীন্দ্রনাথ কেন লালনগীতি সম্পর্কে আরও বিস্তৃত এবং যুক্তিনির্ভর গবেষণা করলেন না? তিনি কি এক বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন খেয়ালে লালন গানগুলি প্রকাশ করেছিলেন? নাকি এর অন্তরালে অন্যতর কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল?

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো এই বিবাদ বিতর্ককে নিয়ে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক। তবু মনের ভেতর খেদ থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ যদি সত্যি সত্যি লালনের সাথে মিলিত হতে পারতেন, তাহলে হয়তো বৃহত্তর বঙ্গসমাজে লালনের পরিচিতি আরও আগেই ঘটে যেত। তাঁকে এতকাল অপেক্ষা করতে হত না।

লালনের যে সাধনা প্রসঙ্গে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম, সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে যে তা অভিনন্দিত হয়েছিল এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং সমাজের এক বৃহৎ অংশ নানাভাবে লালনপন্থাকে আক্রমণ করে। তারা বলে যে লালনপন্থা এবং কর্তাভজা মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাদের চোখে এই দুটি দল কদাচারী ও ঘৃণার যোগ্য। তাঁরা এমন সাধন ভজনের কথা বলছেন, যা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক।

লালন প্রসঙ্গে কর্তাভজাদের কথা কেন বারবার উচ্চারিত হয়েছে? গৌণ ধর্মের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী মানুষের যোগসূত্রতা স্থাপিত হলে সর্বজনের কাছে তার আবেদন অনেক বেড়ে যায়। কর্তাভজা গৌণধর্মের ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল। উচ্চবর্গের মানুষদের সঙ্গে কর্তাভজাদের ব্যাপক সখ্যতা ছিল। ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল এই মতবাদের সমর্থক ছিলেন। কর্তাভজাদের তাত্ত্বিক এবং সংগঠক দুলাল চাঁদের পার্ষদ ছিলেন রামানন্দ মজুমদার, নীলকণ্ঠ মজুমদার, শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য ও কাশীনাথ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। উনিশ শতক থেকে আজ অব্দি ঘোষপাড়ায় সতীমার খ্যাতি একই রকম আছে। এখানে দোল উৎসবের সময় নিম্নবর্গের পাশাপাশি উচ্চবর্গের মানুষরাও সাগ্রহে যোগ দেন। কলকাতার বহু ব্যবসায়ী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি কর্তাভজা মতে প্রকাশ্যে সাধন ভজন করেন। একসময় ডাফ মার্শম্যান প্রভৃতি পাদরিরা এই কর্তাভজা সম্প্রদায় সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। ব্রাহ্ম সেবক শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত ছিলেন কর্তাভজাদের প্রতি অনুরক্ত।

১৮৯৩ সালে শিকাগোর প্রসিদ্ধ ধর্মসম্মেলনে কর্তাভজাদের ধর্মনেতা দুলাল চাঁদকে সদস্য হিসাবে মনোনীত করা হয়। দুলালচাঁদ অবশ্য তার আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন। এই গৌণ লোকধর্ম যে ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়ে ছিল, তার অন্তরালে আছে উচ্চবর্গীয় মানুষদের স্বীকৃতি।

অবশ্য কেউ কেউ কর্তাভজা সম্পর্কে কঠিন কঠোর মন্তব্য করে গেছেন। যে মানুষকে কেন্দ্র করে ভারত তথা বাংলাদেশের ধার্মিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, সেই রামকৃষ্ণ কর্তাভজাদের সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছেন। দাশুরথি রায়ের মতো বিশিষ্ট পাঁচালীকার কর্তাভজাদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গমুখর পাঁচালী লিখেছেন। জেলেপাড়ার সং-এ বারবার কর্তাভজাদের বিদ্রূপ করা হয়েছে। বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী কিন্তু কর্তাভজাদের সম্পর্কে কৌতুহলী ছিলেন।

লালন শাহী মতবাদ তাঁর মৃত্যুর পর ভেঙে যায়। ছেঁউরিয়া আশ্রম জীর্ণ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা সর্বত্র শারিয়তবাদীরা লালনপন্থীদের সম্পর্কে মারমুখী হয়ে ওঠে। এর কারণ কী? অনেকে বলে থাকেন, লালনের নিজস্ব জীবনের নির্লিপ্ততা এবং নিঃসঙ্গতাই এর জন্য দায়ী। উত্তর পুরুষদের জন্য তিনি কী রেখে গিয়েছিলেন? অসামান্য সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু স্মরণযোগ্য এবং গীতযোগ্য গান ছাড়া আর কোনো পার্থিব সম্পদ রেখে যাননি। লালনতত্ত্ব এবং দর্শন প্রচারের জন্য তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে কেউ থাকলেন না। তিনি কি গুরুশিষ্য পরম্পরা বিশ্বাস করতেন না? সিরাজ সাঁইয়ের কাছ থেকে যে তত্ত্ব আত্মস্থ করেছিলেন, জীবনব্যাপী সাধনায় যে তত্ত্বকে সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করেন, সেই তত্ত্বের পরিণতি কী হবে? এই প্রশ্ন কেন লালনের মনে জাগে নি? জীবনের সায়াহ্ন বেলায় তিনি কি নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছিলেন? তাঁর মুখমণ্ডলে দেখা দিয়েছিল বিরক্তির ছাপ। কিন্তু কেন? জীবনে কি তিনি সবকিছু পাননি? কোথাও কি ছিল অতৃপ্তির বেদনা? তিনি কি চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিচালিত ধর্মমতের অবলুপ্তি ঘটে যাক?

জীবিতকালে লালন প্রচারের আলোর সামনে আসতে চাননি। তাঁর মধ্যে প্রচারমনস্কতার অভাব চোখে পড়েছে। তাই তাঁর সম্প্রদায় একটি বৃত্তের মদ্যে বন্দী থাকতে বাধ্য হয়। বিশিষ্ট গবেষক রমাকান্ত চক্রবর্তী বলেছেন—”তান্ত্রিকদের মধ্যে অভিনব গুপ্তের মতো ভারত বিখ্যাত আচার্য ছিলেন, বহু বড়ো বড়ো শৈবাচার্য ছিলেন, সহজিয়া বৌদ্ধদের মধ্যে সরহের মতো অসাধারণ প্রতিভাশালী কবি এবং সিদ্ধ ছিলেন, বৈষ্ণবদের মধ্যে রামানুজ, মধ্ব, নিম্বার্ক, সনাতন গোস্বামী, রূপ ও জীব গোস্বামী ছিলেন, গরীব অবহেলিত সহজিয়া বৈষ্ণবদের এবং বাউল ফকিদের এরকমের কোনো উচ্চস্তরের ভাষ্যকার ছিলেন না, থাকলে সহজিয়া তত্ত্ব ফকির বাউল তত্ত্ব জাতে উঠত। জাত বিচারকে লালন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, তাই সম্ভবত তাঁর দলে কোনো পণ্ডিত বা সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ যোগ দেননি। ব্রাহ্মণরা দলে ঢুকলে, লালনতত্ত্ব নিয়ে মস্ত বড়ো ধর্মতত্ত্ব তৈরি হত।”

এই অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ যথার্থ। সত্যিই তো তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের সস্নেহ ভালোবাসা লালন কখনো পাননি। বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন বুদ্ধিজীবী অবশ্য তাঁকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করে গেছেন।

লালনের অসামান্য কবি প্রতিভার কথা বলতে গিয়ে ওই গবেষক মন্তব্য করেছেন—”তিনি যে একজন প্রতিভাশালী কবি এবং উচ্চস্তরের সাধক ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু সামাজিক বিচারে তাঁর কোনো জাত ছিল না, তাই তিনি রামপ্রসাদ অথবা কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের মতো সম্মানজনক স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু যে প্রতিভা তাঁর গীতাবলীতে দেখা যায়, তা যদি তিনি আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতেন, কিংবা নিজের ঢাক পেটাতেন, তবে তিনি অমন অখ্যাত এবং অবজ্ঞাত হয়ে থাকতেন না।

যে লালন তাঁর জীবনকালে প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, আজ তাঁর নামে অসংখ্যা গান সংকলিত হয়ে বাজারে প্রচলিত হচ্ছে। এমন কিছু গান যাকে লালনের গান বলে ঘোষণা করা হচ্ছে, যার ভাষা এবং সুর অত্যন্ত নিম্নমানের। সেখানে এমন কিছু কিছু অতি আধুনিক শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যা লালনের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এটাই বোধ হয় লালনের সব থেকে বড়ো দুর্ভাগ্য। অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার ফলেই এমন ঘটনা ঘটেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

লুৎফর রহমান সাহেব লালনগীতির একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এই সংকলনের অনেকগুলি গান লালনের লেখা নয়। যেমন বলা হয়েছে—

 কেমন ন্যায়বিচারক খোদা বলো গো আমায়
 তাহা হলে ধনী গরীব কেন এ ভুবনে রয়।
 ভালোমন্দ সমান হলে
 আমরা কেন পড়ি তলে
 কেউ দালানকোঠায় কোলে
 শুয়ে আরাম পায়।
 সেই আমরা মরণের পরে
 যাব নাকি স্বর্গপুরে
 কে মানিবে এসব হেরে
 এই দুনিয়ায়।

অর্থাৎ লালন যে সাম্যবাদী ছিলেন তা প্রমাণ করার এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা। লালনের লেখায় সমাজ বিভাজনের কথা সেভাবে আছে কি? তিনি জাতিগত বিভাজন সম্পর্কে চিন্তা করেছেন কিন্তু অর্থনৈতিক বিভাজনের ওপর আলোকপাত করতে চাননি। হয়তো লালনের মনে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাপারটির অনুপ্রবেশ ঘটেনি বলেই তিনি এই বিষয়ে কোনো গান রচনা করেননি।

লালনের দুর্ভাগ্য প্রথমে তাঁকে প্রচারহীনতার আঘাতে রক্তাক্ত হতে হয়। আর এখন আহতও আক্রান্ত হতে হচ্ছে অপপ্রচারের বিভ্রান্তিতে।

শুধু তাই নয়, লালনের মৃত্যুস্থল আজ একটি ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর জন্য সত্যিকারের লালনপন্থীরা এখনও খুবই ক্ষুব্ধ। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ফকির মন্টু শাহ কুষ্টিয়ার এক মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন—”আমরা বাউল, আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না মুসলমান, না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজী লালনসাঁই। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজীর মাজার আমাদের তীর্থভূমি আমরা যাঁরা তাঁর ভক্ত, আমরা সকলেই এক বিশেষ নিয়মে ভেক গ্রহণ করি। আমাদের সৃষ্টি নেই, মানে বিবাহ নেই—সন্তান জন্ম নেই। আমাদের গুরুই রসুল।

 যেহি তো মুর্শিদ সে কি তো রসুল
 এই দুইয়ে নেই কোনো ভুল
 মুর্শিদ খোদা ভাবলে জুদা
 তুই পড়বি প্যাঁচে।

ডঃ সাহেব অর্থাৎ উক্ত মুসলমান অধ্যাপক আমাদের এই তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মের কাজে বাধা দেন। কোরান তেলওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন, মিলাদ মাহফিল করে থাকেন, এসবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটা জাতি, আমাদের কলেমাও আলাদা, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ লালনরসুতুল্লাহ।”

এই ফকিরের মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্তরালে যে সত্যটি লুকিয়ে আছে, সেদিকে একবার দৃকপাত করা যাক। লালনের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যে তাঁকে রসুল অর্থাৎ আল্লার প্রেরিত পুরুষে পরিণত করা হয়েছে। নিজের জীবৎকালে লালন কিন্তু কখনও এতবড়ো পদের দাবীদার ছিলেন না। এমন কি তিনি তাঁর জীবনযাত্রায় এই ধরনের কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেননি, বরং তিনি বলেছিলেন যে, আল্লা যিনি, তিনিই রসুল, তিনিই নবী। যাঁরা আল্লাকে স্বীকার করেন, আবার আল্লার গুরুত্বসহ অন্যান্য অংশ বা শরীরকে স্বীকার করেন তারা হলেন বহুত্ববাদী। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে লালন তত্ত্বকে মুশরিক বলা হয়ে থাকে। বিধিশাস্ত্রকে বিশ্বাস করাকে বলে আকিদা।

ইসলামি বিধিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোন কাজটি ফরজ অর্থাৎ বৈধ, কোন কাজটি হারাম অর্থাৎ অবৈধ, কোনটি পাক অর্থাৎ পবিত্র এবং কোনটি না-পাক অর্থাৎ অপবিত্র।

ফকিররা সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে ইসলামবিরোধী ধর্মমত প্রচারের কাজে নেমেছিলেন। তাই মোল্লাদের কর্তব্য হল এই ফকিরদের ধর্মপ্রচারকে আঘাতে করা। আঘাত করতে গিয়ে তাঁরা মাঝে মধ্যে হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলেন।

উত্তরবঙ্গে লালন ফকির সম্প্রদায়কে নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। লালন যেহেতু বেঁচে নেই, এই ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের অভাবে তাঁর ভক্তমণ্ডলী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। অনেকে আবার সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে বাধ্য হয়। অনেকে অরণ্যাঞ্চলে নিভৃত নিরালায় গিয়ে বিষণ্ণ হৃদয়ে লালনপন্থা অনুসরণ করতে থাকে। এর ফলে লালনপন্থীরা একটি সংগঠিত আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারেনি।

ব্রিটিশ আমলে সরকারি সহায়তায় বাউল দমনের অভিযান চলতে থাকে। এই বাউল দমন কেন করা হয়েছিল? ব্রিটিশরা চেয়েছিল, ভারতবর্ষের বুকে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে চিরতরে কায়েম রাখতে। তারা জানত, যদি হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়, তাহলে এই কাজ করা অসম্ভব। কারণ হিন্দু—মুসলিম মিলিত শক্তি ব্রিটিশদের এদেশ থেকে উৎপাটিত করতে পারবে। অতি সূক্ষ্মভাবে তাই তারা দ্বিজাতি তত্ত্বকে মেনে চলে। সাংস্কৃতিক জগতে বিভাজন ঘটিয়ে দেয়। হিন্দু এবং মুসলমানকে পরস্পরের শত্রু হিসাবে পরিণত করতে চায়। যে ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যসম্পন্ন সভ্যতার ক্রমবিকাশে হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সমান অবদান ছিল, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বৈরীতা সম্পন্ন দাঙ্গায় অবতীর্ণ হয়। ধূর্ত চতুর শৃগালের মতো ব্রিটিশরা দূরে বসে আনন্দে মত্ত হয়ে ওঠে।

যেহেতু বাউল বা ফকিরপন্থীরা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের স্বপ্নে বিভোর, যেহেতু তারা তথাকথিত ধর্মের বিধিনিষেধগুলির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, তাই ব্রিটিশ প্রশসকদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাউল পন্থীদের দমন করা। এজন্য তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে হাতিয়ার করেছিল। ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক দিক থেকেও এমন অবস্থা সৃষ্টি করে, যাতে বাউল এবং ফকিরপন্থীদের জীবন অত্যন্ত দুঃখে কষ্টে অতিবাহিত হয়।

তাসত্ত্বেও বেশ কিছু দৃঢ়চেতা ফকির এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁদের সামর্থ্য ছিল সীমিত, অর্থবল ছিল না, সমাজের বিত্তবানরা ব্রিটিশের বশংবদ হয়ে যান। স্বীয় সম্পত্তি রক্ষাকল্পে তাঁরা এই পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। এতে আমরা দোষের কিছু দেখছি না।

শুধু তাই নয়, ফকির এবং বাউল আন্দোলন যদি সংগঠিত হত, তাহলে অবিভক্ত বঙ্গদেশের বুকে একটি ধার্মিক বিপ্লব ঘটে যেত। এর ফল হত সুদূরপ্রসারী। হয়তো আমরা বঙ্গবিভাজনের মতো একটির রক্তাক্ত ঘটনার সাক্ষী থাকতাম না।

বাউল দমনের জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তি কেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল? তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলজাদির পত্রিকার ‘বাউল একটি ফেতনা’ নামে প্রবন্ধের দিকে চোখ রাখতে হবে। ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়া থেকে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদক মহম্মদ আতিয়ার রহমান। এই পত্রিকায় প্রবন্ধকার স্পষ্টভাবে বলেছেন ফকির নামের অন্তরালে কিছু মানুষ হিন্দুদের অংশীবাদ, জন্মান্তরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, অহংবাদ ইত্যাদি মতবাদ ইসলামের মধ্যে ঢুকিয়ে ইসলামের মূলনীতিতে ফাটল ধরাত স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সমাজের লোকদের কাছে সাধু আচরণ দেখিয়ে গান গীতির অন্তরালে ইসলামের বিরোধিতা করতে থাকে।

একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে কি এইভাবে উৎপাটিত করা যায়? একথা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই যে, বাউলের একতারা শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এই এক তারা হয়ে উঠেছিল রুদ্ধ সংগীতের প্রতীক এবং প্রতিবাদ। লালনের শিষ্য দুদ্দু তাই লিখেছেন—

 গান করিলে যদি অপরাধ হয়
 কোরাণ মজিদ কেন ভিন্ন এলহানে গায়
 রাগরাগিনী সুর
 রাহিনী বলিয়া মশহুর
 এত আলাপন আছে নিরাপন
 তাতে কেন হারাম নয়।

এই যুক্তিতে অবশ্য মৌলবাদীদের কঠিন কঠোর মন বিন্দুমাত্র পালটায় নি। তাই আসাদউল্লা নামে এক নীতিবাগীশ গানকে হারাম ও বেয়াদাত ঘোষণা করে লিখেছিলেন—

 কোন কোন পীর লোক বাজনা বাজায়
 সুর দিয়া গান করে হাত তালি দেয়।

আবদুর রসিদ চিস্তি নামে এক বিশিষ্ট ইসলাম গবেষক লিখছেন—যে গানের সাহায্যে আল্লাও রসুলের প্রতি আসক্তি জন্মে, তাহাকে ধর্ম সংগীত বলে, কিন্তু মৌলবী সাহেবদিগের ফতোয়া অনুসারে যদি তাহাও বেদায়াৎ হয়, তবে মৌলবী সাহেবরা শুয়াজের মজলিসে মওলানা রূমের মসনবী, দেওয়ান হাফেজ, দেওয়ান শামস তবরেজ, দেওয়ান লোৎক, দেওয়ান মইনুদ্দিন চিস্তি, দেওয়ান জামি প্রমুখ শিক্ষিত পুরুষদিগের দেওয়ান ও মসনবীর বয়াত গাহিয়া ওয়াজ করেন কেন? যত দোষ কি কেবল বাংলা গানের বেলায়?”

সত্যি এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইসলামী ভাবাশ্রিত গজল শুনে ইসলাম ভক্তদের চোখে জল আসে, তাহলে?

আসলে মৌলবাদীরা একটা বিষয় চিন্তা করে শঙ্কিত এবং আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। লালনের মৃত্যুর পর লালনপন্থীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। তাসত্ত্বেও নিম্নবর্গীয় মুসলমানরা দলে দলে বিভিন্ন গৌণদর্মের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। এতে তথাকথিত মৌলবাদী এবং শরিয়তপন্থী মুসলিমরা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, এখনই কিছু একটা করতে হবে না হলে মুসলিম সমাজের মূলে আঘাত আরও প্রবল আকার ধারণ করবে।

বাউল এবং ফকিরপন্থীদের নানা অসামাজিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার হয়ে উঠলেন। তাঁরা এমন কিছু ফতোয়ার কথা বললেন, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে মনে করিয়ে দেয়। এই ফতোয়া অনুসারে বলা হয়েছিল, কোনো মুসলমান যদি ফকিরিতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে তাকে তিনদিন কয়েক করে রাখতে হবে। তাকে আবার মুসলমান ধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। তাতেও যদি সে রাজী না হয়, তাহলে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে হবে। আর যদি কোনো স্ত্রীলোক এমন কাজ করে থাকে, তাহলে তাকে সারাজীবন কারারুদ্ধ করে রাখা উচিত।

ফকির বা পীরদের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে পর্দানসীন মুসলমান মেয়েদের অনেকেই এই ধর্ম গ্রহণ করে। এর আড়ালে কতগুলি সামাজিক কারণ ছিল। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম রমণীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের জাগ্রত সত্তার দিকে কেউ দৃষ্টিপাত করেনি। তাদের মনের আকাশে দীর্ঘদিন বঞ্চনার মেঘ জমছিল। এখন লালনপন্থী ফকিরদের আহ্বানে সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। মুসলিম রমণীরা আর আন্তঃপুরের মধ্যে বন্দিনী থাকতে রাজী হল না। তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকল নীল আকাশ, ডাকল বসন্ত বাতাস, ডাকল ফকির ধর্মের উদরনৈতিক চিন্তাধারা।

এই ঘটনা মুসলিম সমাজের ভিত্তিমূলকে আঘাত করেছিল। যেসব কঠিন কঠোর নিয়মনীতির ওপর এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত তার অন্যতম হল মেয়েদের পর্দানসীনা করে রাখা। এক গীতিকারের বর্ণনায় এই অবস্থাটির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এইভাবে—

 যুবতী আওরত যত
 ফকির হইল কত
 স্বামী ছাড়ি পীরের সঙ্গে যায়।

গ্রাম্য সমাজে পীরের সঙ্গে মুসলমান অন্তঃপুরিকাদের গৃহত্যাগ একটি সাংঘাতিক ঘটনা। এছাড়া মুসলমান সমাজে হিন্দু সংস্কৃতির বেশ কিছু চিহ্ন ঢুকে পড়ে। মুনসী সমিরউদ্দিন দেশের মুসলমান সমাজের নানা অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে লিখেছেন—

 দেশের বেদাত থোড়া হৈল ফের মনে
 তাহার বয়ান কহি শুন সর্বজনে।
 হুলি দেওলিআর জিরিয়া দুতিয়া
 বাউনি সাঁকরাত করে এছলাম হইয়া
 ভাইফোঁটা গোরু পরব করে মোছলমানে
 লক্ষ্মীবারে কর্জ্জ দিবা লিবাতে বারন
 দেশের বেদাত এইছ কহিব কায়।

বেদাত কথাটার মানে বোঝা দরকার। বেদাত বলতে বোঝায় সুন্নাতে যার কোনো ভিত্তি নেই। সুন্নাত মানে হল পন্থা। আল্লার নির্দেশ এবং রসুলের বাণী অনুসারে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জীবন কাটে। মুসলমানের পালনীয় জীবন আদর্শকেই সুন্নাত বলা হয়। দীন মানে হল ধর্ম। আল্লার নির্দেশ রসুলের বাণী ও ইসলামের ধর্মে হোলি দেওয়ালি ভ্রাতৃদ্বিতীয়া খড়ের বাউনি বাঁধা, বৃহস্পতিবারে ধার না দেওয়ার বিধান নেই। পরবর্তীকালে ফকিরি ধর্মের প্রবল আক্রমণে হিন্দুদের এই রীতিনীতিগুলি মুসলমান সমাজে প্রবেশ করেছে। এগুলি হয়তো ঠিক ধর্মীয় কৃত্যক নয়, এগুলিকে আমরা লোকাচারের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।

আসলে আরব দেশের রুক্ষ্ম প্রান্তরে যে ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল, বাংলার শস্য-শ্যামলা ভূমিতে পদার্পণ করে সেই ধর্ম দিশেহারা হয়ে যায়। এখানে প্রকৃতি এত উদার এবং স্নেহময়ী, প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন এমন অঙ্গাগীভাবে জড়িত যে সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতি পূজা মহাপাপ নয়। যেভাবে আমরা মাতৃ আরাধনা করে মায়ের প্রতি অপরিশোধ্য ঋণ শোধ করার সামান্যতম প্রয়াসে মগ্ন হই, সেভাবেই আমরা প্রকৃতি পূজায় মেতে উঠি। এতে যদি হিন্দুয়ানির গন্ধ থাকে, সাধারণ মুসলমানের তাতে কীইবা এসে যায়?

যেহেতু লালন খোদা এবং মুর্শিদ অর্থাৎ গুরুকে একই আসনে বসিয়েছেন, তাই প্রাচীনপন্থীরা তাঁকে মোরতেদ বা কাফের আখ্যা দিয়েছেন। ফতোয়ায় স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে—খোদার শরিক করিও না। শেরেক অর্থাৎ অংশী বা সর্বপ্রধান গোণাহ বা পাপ। কোনো পয়গম্বর অলি অর্থাৎ আল্লার সাধক দরবেশ ফেরশতা খোদা হইতে পারে না।

লালন কিন্তু একটির পর একটি যুক্তিজাল বুনেছেন আপন মনে। গানের মাধ্যমে তাঁর ধর্মচেতনাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ভাবনা চিন্তার মধ্যে একদিকে যেমন প্রবল যুক্তিবাদের উপস্থিতি আমাদের অবাক করে দেয়, তারই পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদের দ্যোতনাও মনকে নাড়া দেয় বৈকি।

লালন বলেছেন—

শুনতে নাই আন্দাজী কথা
বর্তমানে জানো হেথা।

অর্থাৎ কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করে পথ চলা উচিত নয়। চোখের সামনে যা ঘটছে তাকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। তিনি বলেছেন—

 গুরু ছেড়ে গৌর ভজে
 তাতে নরকে মজে

অর্থাৎ আমরা সবসময় একজন গুরুকে আশ্রয় করে অধ্যাত্ম পথের পথিক হব।

 গুড় বললে কি মুখ মিঠা হয়,
 দিন না জানলে আঁধার কী দেয়?
 তেমনি যেন হরি বলায়,
 হরি কী পাবে।

অর্থাৎ সবকিছু বিচার বিবেচনা করে তবেই এই পথের পথিক হতে হয়। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ যদি ধর্মসরণীতে এগোতে যায়, তাহলে সেই পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

লালনগীতির অন্তরালে যে দার্শনিক ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে, সেখান আত্মতত্ত্বকেই সব থেকে বড়ো স্থান দেওয়া হয়েছে। সেই বিস্তারে এসেছে পরতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব এবং বস্তু তত্ত্ব। বেশির ভাগ গানের দ্যোতনার মধ্যে এমন কিছু আছে যা পিতৃবস্তু অর্থাৎ সংরক্ষণীয়। অযথা ব্যবহারের তা নষ্ট করতে নেই। সেই দিক থেকে তাঁর সাধনা হল লা শরিকের সাধনা, অর্থাৎ পিতৃ বস্তুকে রক্ষা করার সাধনা।

ফকিরি তন্ত্রে শব্দ নিয়ে নানা ধরনের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে এক একটি প্রতীককে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত করা হয়। লালনও তাই করেছেন। নানা প্রতীককে তিনি ব্যবহার করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। কখনো একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে যৌবনের প্রতিচ্ছবি, কখনো মৃত্যুর দ্যোতক, আবার কখনো নিরবচ্ছিন্ন জীবনপ্রবাহের ধারা। লালন লিখেছেন—

 কেন ঝাঁপ দিলিরে মন
 বাবার পুকুরে—
 কামে চিত্ত পাগলপ্রায় তোর এ
 কেনরে মন এমন হলি
 যাতে জন্ম তাইতে মলি?
 সিরাজ শা দরবেশে কয়
 শক্তিরূপে ত্রিজগৎময়
 কেন লালন ঘোরে বৃথাই
 আত্মতত্ত্ব নাসে রে।

আমরা জানি নারী শক্তির মধ্যেই ঈশ্বরের মহিমা লুকিয়ে আছে। লালন পন্থা সেই শক্তিরও জয়গান গেয়েছে। লালন বলেছেন—

 যেখানে সাঁই-র বারামখানা
 শুনিয়ে প্রাণ চমকে ওঠে
 দেখে যেন ভূজঙ্গনা।
 না ছুঁইলে প্রাণে মরি
 এ জগতে তাইতে তরি
 আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে
 দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে।

লালন এভাবেই দর্শনের এক একটি গূঢ় বিষয়কে সহজ সরল ভাষায় তাঁর প্রায় নিরক্ষর অশিক্ষিত শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তাই বোধহয় লালনের গান আজও আমাদের কাছে একই রকম ভাবে জনপ্রিয় হয়ে আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বস্তুতান্ত্রিক মানসিকতাতেও লালনগীতির আবেদন অপ্রতিরোধ্য

লালন সাধনার আর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল বাস্তবমুখীতা। জীবনে যা সত্য তাকে লালন মেনে নিয়েছেন। অযথা নৈতিকতার বাঁধনে মনকে বেঁধে কী লাভ? মানুষ পৃথিবীতে কেন আসে? নিজেকে অনুসন্ধান করার জন্য। প্রজননের মাধ্যমে বংশগতিকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবহনের জন্য। লালন এই দুটি সত্যকেই মেনে নিয়েছেন। তাই তো তিনি গেয়েছেন—

 তীর্থে যাবি সেখানে কি পাপী নেইরে?

 ও কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলেতে যায়

 স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়?

 কে ঠেকায় রে?

অত্যন্ত খাঁটি কথা। এর মাধ্যমে জীবনবিজ্ঞানের একটি চিরসত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী নারী সংসর্গ পরিত্যাগের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তাকি সম্ভব? এই পৃথিবীতে নারী এবং পুরুষ দুটি ভিন্ন সত্তা একে অন্যকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ অমোঘ। একে উপেক্ষা করার সাহস বা ক্ষমতা কোনোকিছুই আমাদের নেই। তাহলে আমরা নারীকে কেন ত্যজ্য বলে মনে করব?

তথাকথিত তীর্থযাত্রাকে লালন শাণিত তরবারির মতো ভাষায় আক্রমণ করেছেন। অনেকে সারাজীবন পাপকাজে নিযুক্ত থাকে। কাশী কিংবা মক্কায় গিয়ে পুণ্য অর্জন করে। এই দ্বিচারিতা সর্বত্র বর্জনীয়। লালন উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন—

 কাশী কিংবা মক্কায় যাও রে মন
 দেখতে পাবে মানুষের বদন
 ধ্যানধারণা ভজন পূজন মানুষ সর্ব ঠাঁই।

একক ভাবে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে স্বার্থপর হয়ে যায়।

এই হল লালনের সাধনা। লালন বলেছেন—

 মরি কেন দরগাতলায় হত্যে দিয়ে মন
 সকল দরগায় গোড়া
 চিনলি নে সেই মানুষ রতন!

সত্যিই তো, মানুষ ঈশ্বরের এক অপরূপ সৃষ্টি। অনেক সুকৃতির ফলে মানবজন্ম পাওয়া যায়। সেই মানুষকে না চিনে আমরা শুধুই নামাজ পড়লে কি আল্লাহ আমাদের ওপর দয়া করবেন?

ভাবতে ভালো লাগে, বাংলার লোকায়ত সাধনা এবং গৌণ ধর্মের ক্ষেত্রে লালন একটি বিপ্লব সংগঠিত করেছিলেন। সীমিত সামর্থ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একক উচ্চারণে এমন কিছু গান লিখেছেন, যার আবেদন চিরকালীন। এই ভাবেই বোধহয় লালন ফকির স্বসৃষ্ট সাঙ্গীতিক ধারার অন্যতম প্রচারক হয়ে ওঠেন। আমাদের দুর্ভাগ্য লালনের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর এই ধারাটি ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। বহুদিন বাদে আজ ভিন্নতর পরিস্থিতিতে সারা দেশে লালন চর্চা শুরু হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষকরা লালন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। নানা ভাষায় লালনগীতির অনুবাদ শুরু হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ গবেষকরা লালনকে নিয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকছেন। কাটাচ্ছেন অতন্দ্র রাত। আগামী দিনে হয়তো নতুন এক পরিপ্রেক্ষিতে লালন সত্তা আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হবে। ছেঁউরিয়ার সেই বাউল-ফকিরকে আমরা বিচার করব নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। নতুন ভাবে আলোকিত হবে তাঁর আপাত রহস্যময় জীবন। তিনি কোন বংশে জন্মেছিলেন, হিন্দু না মুসলমান, কায়স্থ না ব্রাহ্মণ—এসব গৌণ প্রশ্ন চাপা পড়ে যাবে। তীব্র ঔৎসুক্যের আলোকে উদভাসিত হবেন ওই মহামানুষটি। আজ সন্ত্রাসদীর্ণ এই পথিবীতে লালনের মতো মানুষদের বড়ো প্রয়োজন। না হলে আমরা আমাদের সাধের বসুন্ধরাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। সম্প্রদায়িক হানাহানি, জাতিভেদ প্রথা, নারীত্বের অবমাননা—এসব এখনও আছে আমাদের সমাজে। অবশ্য প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের ফলে হয়তো তাদের রক্তলোলুপ আগ্রাসী মনোভাব অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে এই বিভাজন এবং হানাহানি বেঁচে থাকবে, ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন লালন ফকির। তিনি আকাশের মতো উদার। বাতাসের মতো বহমান। পর্বতের মতো সহনশীল তাঁর মৃত্যু নেই। অমোঘ উচ্চারণে তিনি চিরদিনই আমাদের আত্মাকে উদ্বুদ্ধ করবেন। গাইবেন সেই গান—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…. অথবা

লালন বলে জাতের বাহার দেখলেম না এ জগতে…..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *