লালন ফকির এবং তাঁর গান সম্পর্কে ইদানিং আমাদের আগ্রহ হয়েছে আকাশচুম্বী। এর অন্তরালে অনেকগুলি কারণ আছে। তাঁর মিথ মিশ্রিত জীবনকথাকে আশ্রয় করে দুই বাংলায় দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাই বোধ হয় শিক্ষিত জনমণ্ডলী লালন সম্পর্কে আগের থেকে আরও বেশি আগ্রাহী হয়ে উঠেছেন। একেই বোধহয় ইতিহাসের এক পরিহাস বলা যায়।
লালন লিখিত গানের খাতাটি আর পাওয়া যায় না। সেই খাতায় লালনের যে গানগুলি আছে, তার অন্তর্নিহিত দার্শনিক চিন্তা আমাদের অবাক করে দেয়। যতদূর জানা যায়, লালন খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসাবেই তাঁর আবির্ভাব। তাঁর জীবনরহস্য নানা ঘটনার ঘনঘটায় ভরা ঘাত-প্রতিঘাতে রক্তাক্ত সেই লালন কীভাবে এমন দেহ তত্ত্বের গান লিখলেন, তা গবেষকদের বিবেচনার বিষয়বস্তু। গানের মাধ্যমে তিনি সহজভাষায় দার্শনিক অভীপ্সার কথা বর্ণনা করেছেন। নরনারীর চিরন্তন মিলনাকাঙ্খাকে এক ঐশ্বরিক রূপে পরিবেশন করেছেন। অনেকে বলে থাকেন বাংলার সংগীতজগতের ইতিহাসে লালনের যথার্থ মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত হয়নি। হয়তো তাঁরা ঠিক কথাই বলেন।
এই পর্বে আমরা লালনের জন্মরহস্য বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, তাহল বাঙালিরা সাধারণত আবেগপ্রবণ এবং অভিমানী হয়ে থাকেন। তাঁরা সত্যান্বেষণার থেকে বেশি নির্ভর করেন মিথ বা কষ্ট কল্পনার ওপর। বাঙালির মনন এবং মানসিকতায় যে কটি মিথ বদ্ধমূল হয়ে আছে, তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু বা অন্তর্ধান রহস্য। এই ঘটনার পর প্রায় ছটি দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। আজও অনেক বাঙালি মনে করেন যে সুভাষ নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। যোগসাধনায় নিমগ্ন আছেন। যথাসময়ে তিনি আবার উদিত হবেন। সুভাষের তথাকথিত মৃত্যুরহস্য নিয়ে অনেক বাকবিতন্ডা হয়েছে। আলাপ আলোচনা হয়েছে। সরকারের তরফে একাধিক কমিশন বসানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, সুভাষ তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কেউ বলেছেন, তাঁকে রাশিয়া বন্দী করে সাইবেরিয়ার জেলে নিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার এ মন্তব্য করেছেন যে, লালকেল্লার মধ্যে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমরা এখনও পর্যন্ত জানিনা, শেষ অব্দি ভারতের মুক্তিসূর্য সুভাষের কী হয়েছিল। তাই সুভাষ আমাদের দৈনন্দিন আলোচনার একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং বিতর্কিত বিষয়।
বাঙালির আর একটি মিথ মহাপ্রভু চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। শোনা যায়, তিনি নাকি নীল সমুদ্রের জলের ভেতর কৃষ্ণের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। ভাবানুরাগে সেই অসীম অনন্ত সমুদ্রকেই আশ্রয় করেছিলেন। আবার এর বিরুদ্ধ মন্তব্যও প্রচলিত আছে। অনেক গবেষক দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে একটি সত্য উদঘাটন করেছেন। তা হল শ্রী শ্রী চৈতন্যের অসামান্য জনপ্রিয়তায় পুরীর কিছু সন্ন্যাসী অত্যন্ত বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। তাঁরা বুঝতে পারেন, এই গৌরকান্তি সন্ন্যাসী প্রবরকে অচিরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হবে না। তাই গুপ্তঘাতকের হাতে চৈতন্যকে নিহত হতে হয়।
এই দুটি মিথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লালন ফকিরের জন্ম রহস্যটি। দীর্ঘদিন ধরে আমরা মনের ভেতর একটি ভাবনাকে সযত্নে পোষণ করতাম। তা হল, লালন এক হিন্দু বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি মহাব্যাধিতে আক্রান্ত হন। আত্মীয়স্বজন তাঁকে ফেলে চলে যায়। এক মুসলমান রমণী কর্তৃক তিনি শুশ্রূষা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে লালন ফকির ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। নিজের জাত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকতেন। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি আনতেন। হয়তো নিজের বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত জীবনে জাতের অস্তিত্ব মানতে চাইতেন না তিনি। এভাবেই তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
বেশ কিছু দিন ধরে বাংলা দেশের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে লালনকে জন্মগতভাবে মুসলমান প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। তাঁদের এই অপচেষ্টার অন্তরালে কী ধরনের ষড়যন্ত্র কাজ করছে, তা হয়তো আমরা খানিকটা অনুমান করতে পারি। লালনকে আত্মসাৎ করে তাঁরা বোঝাতে চাইছেন যে বাংলা ভাষার ইসলামি সাহিত্যের ধারাটি খুব একটা নিকৃষ্ট হয়। শুধু মাত্র আরাকান রাজসভার গণ্ডির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না। অবশ্য বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁরা এই আলোচনা বৃত্তের বাইরে রাখতেই ভালোবাসেন। কারণ কাজী নজরুল ইসলাম মানবতাবাদী ধর্মমতে বিশ্বাস করতেন। সঠিক ইসলাম বলতে যা বোঝায়, তিনি তা কখনোই ছিলেন না। তাই বোধহয় এমন ভাবমিশ্রিত শব্দের মাধ্যমে শ্যামা মাকে বন্দনা করতে পেরেছেন।
এই পর্বে আমরা সন্ধানী দৃষ্টি মেলে দেব লালন ফকিরের জন্মরহস্যের দিকে। আমরা বিভিন্ন গবেষকের উদ্ধৃতি তুলে ধরব। আমরা দেখব, সত্যি তিনি কী ভাবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে মানুষ বেঁচে থাকে তার সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে—সাহিত্যে, শিল্পে, রাজনীতিতে, সংগীত চর্চায়। কোন জাত থেকে সে এসেছে বা কী ভাবে তার জন্ম হয়েছে, এসব একেবারে গৌণ প্রশ্ন।
কিন্তু যেহেতু লালনকে কেন্দ্র করে একটি বিষময় চক্রান্ত অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, তাই যে কোনো মানুষের উচিত স্বচ্ছ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাঁর জন্মরহস্য বিশ্লেষণ করা। হয়তো এর মাধ্যমে প্রহেলিকায় ঢাকা সকালের কুয়াশা হারিয়ে যাবে। সত্য উদভাসিত হবে সূর্যের আলোক শিখায়।
ভাবতে অবাক লাগে যে লালনের জন্মসাল বা জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে না থাকলেও আমরা তাঁর মৃত্যু তারিখ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক) কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে ছেঁউরিয়ার আখড়ায় লালন ফকির দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকার একটি বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধে। এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন মীর মোশাররফ হোসেন, যাঁকে আমরা বাংলা ভাষার এক শক্তিশালী লেখক হিসাবে চিহ্নিত করে থাকি। সম্পাদক হিসাবে কারোর নাম প্রকাশিত হত না। ১৫ কার্তিক পত্রিকার প্রথমভাগ ১৩ সংখ্যায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল যে, ”লালন ফকির ১১৬ বছর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সংবরণ করিয়াছেন।”
এই একশো ষোলো বছরের হিসাব মেনে অনেক লালন গবেষক বলে থাকেন লালনের জন্ম ১৭৭৪ সালে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো প্রামাণ্য দলিল আমাদের হাতে না থাকায় আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি না।
এবার দেখা যাক লালন কোন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা আবুল আহসান চৌধুরীর বই ‘লালনচর্চার ইতিহাস’-এর প্রতি দৃকপাত করব। লালনের জীবিতকালে ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে গ্রামবার্তা প্রকাশিকতায় ‘জাতি’ নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ঐ নিবন্ধে লালনের ধর্মমত সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে এইভাবে—
”লালন শা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। তিন চার বৎসরের মধ্যেই এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করেন না, সে কথা বলা বাহুল্য।”
কে এই নিবন্ধের রচয়িতা? গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার প্রসিদ্ধ সাংবাদিক হরিনাথ মজুমদার। আমাদের কাছে তিনি কাঙাল হরিনাথ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। ১৮৩৩ সালে কাঙাল হরিনাথের জন্ম হয়। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন লালনের বন্ধু এবং সমর্থক। তিনিই কি এই অস্বাক্ষরিত নিবন্ধটির রচনাকার?
১২৯২ বঙ্গাব্দে হরিনাথ কাঙালের ‘ব্রহ্মাণ্ড বেদ’ নাম একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম সংখ্যায় লালন সম্পর্কে বলা হয়েছে—”হৃদয় নির্মলা হইলে ভগবানের ভাব প্রস্ফুটিত হয়, ইঁহারই নাম তাঁহার আকার, প্রকাশ, আবির্ভাব, দর্শন প্রভৃতি শব্দে সাধক ও ভক্তগণ উল্লেখ করিয়া থাকেন। ভগবত ভক্ত ব্যতীত এই প্রকার দর্শন আর কাহারও ভাগ্যে ঘটে না। লালন ফকির নামে জনৈক ভক্ত এই সম্বন্ধে যে একটি গান প্রস্তুত করিয়াছেন তাহা আমরা নিম্নে প্রকাশ করিলাম—
কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা
দেখিয়া সব পুঁথির পালা।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এটি হল লালনের জীবিতকালে প্রথম মুদ্রিত লেখা।
কাঙাল হরিনাথও কিন্তু লালনের জন্মরহস্য অন্বেষণায় খুব একটা আন্তরিক প্রয়াসী ছিলেন না। হয়তো এই দিকটি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কথা তাঁর মনে হয়নি। বরং তিনি লালনকে অনুসরণ করে বেশ কিছু গান লিখেছিলেন। ফকির চাঁদ ভণিতায় এই গানগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। এই গানগুলি পড়লে আমরা বুঝতে পারি তাঁর ভাবাদর্শে লালনের স্থান ছিল কত উঁচুতে।
লালনের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার যে বর্ণনা হিতকারী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটি পড়লেও আমরা বুঝতে পারি লালন মনে প্রাণে মানবতাবাদী ছিলেন। ওই পত্রিকায় লেখা হয়েছে—
”মৃত্যুকালে কোনো সম্প্রদায়ের মতানুসারে তাঁহার অন্তিমকার্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছু লাগে নাই। গঙ্গাজল হরে রাম নামও দরকার নাই। তাঁহারই উপদেশানুসারে আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁহার সমাধি হইয়াছে। শ্রাদ্ধাদি কিছুই হইবে না।”
এই উক্তি থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে নিজের অন্তিম সংস্কার কেমন হবে, সে বিষয়ে লালনের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামী ভক্তরা এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। আসলে লালন প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন বলেই বোধহয় এমনটি করা সম্ভব হয়েছে। যদি তিনি তথাকথিত উচ্চবর্গীয় সমাজের মানুষ হতেন, তাহলে তাঁর নির্দেশ হয়তো অমান্য করা হত। সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে তাঁর শিষ্য এবং অনুচররা মহাসাড়ম্বরে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। কোনো একটি ধর্মের প্রতীক স্বরূপ উড়িয়ে দিতেন অহংকারের ধ্বজা।
মৃত্যুর পর তাঁকে কেন্দ্র করে একটি বাউলচচ্চর্চার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছেঁউরিয়া আকড়ায় তাঁর সমাধি সৌধ স্থাপিত হয়। সেক্ষেত্রেও একটি সূক্ষ্ম স্বার্থবুদ্ধি কাজ করেছে। এই প্রসঙ্গে আমরা লালনশাহ বইটির দিকে নজর দেব। এই বইতে বলা হয়েছে—
”ছেঁউরিয়া মৌজায় লালন ভক্ত মলন শাহ কারিকর লালন ফকিরকে প্রায় সাড়ে ১৬ বিঘা জমি দান করেন। এই দানকৃত জমির প্রায় অর্ধাংশে লালনের আখড়া গড়ে ওঠে। স্থানীয় কারিকর শ্রেণীর ভক্তবৃন্দ লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য এই আখড়ার চতুর্দিকে বারান্দা যুক্ত একটি পূর্ব দুয়ারি চারচালা বড়ো খড়ের ঘর তৈরি করে দেন। লালন পরে, যেখানে এখন তাঁর সমাধি আছে, সেখানে একটি গোলাকৃতি বড়ো খড়ের ঘর তৈরি করে বাস করতে থাকেন। এই ঘরেই তাঁর ভজন সাধন চলত। মৃত্যুর পর এখানেই তিনি সমাধিস্থ হন।”
তবে লালনের মৃত্যুর পর যে, তাঁর সহচর বৃন্দের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ দেখা দেয়নি, একথা বলা চরম ভুল। মৃত্যুর পরই লালন শিষ্যদের মধ্যে দারুণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। লালন শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি সকাতর আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলেন। এই আবেদনপত্রটি পড়লে আমরা বুঝতে পারব যে, লালনের উত্তরাধিকার গ্রহণ করার জন্য তাদের মধ্যে কী ধরনের ঝগড়া সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি লালনের সমাধিতে একটি পাকাবাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
মনিরুদ্দিন লিখেছেন—”আজ এই দরখাস্ত দ্বারা আবেদন করিতেছি যে, আমার পরমারাধ্য গুরু লালন শাহ ছায়েবের সমাধি পাকা ইমারত করাইবার অনুমতি হুজুরের সরকার হইতে পাইয়াছিলাম। হুজুর বিলাত হইতে আসিয়া শ্রীযুক্ত মাননীয় নগেন্দ্রবাবু মহাশয়ের প্রতি ভার অর্পণ করিয়াছিলেন। তিনি স্বয়ং সমাধিস্থানে গমন পূর্বক দৈর্ঘ্য প্রস্থের পরিমাপ করিয়া আসিয়া ছিলেন এবং এসটিমেট প্রস্তুত করাইয়া লইয়া ছিলেন। দুর্ব্বৎসর দেখিয়া শিলাইদহের কাছারির কর্মচারী মহাশয়দিগেরা কয়েক মাসের জন্য সমাধি পাকা করানোর বিষয়ে স্থাগিত রাখিয়াছেন।”
ইতিমধ্যে ভোলাই এবং শীতল শাহ মাটির কাদা দিয়ে গাঁথনি করে একটি ঘর বানিয়ে ফেলেছেন। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে সেই সমাধি সৌধের দক্ষিণ দিকের অংশটি একেবার ভেঙে যায়। ১৯৪৯ সালে লালন শাহ আখড়া কমিটির পক্ষ থেকে ভেঙে পড়া সৌধ আবার তৈরি করার চেষ্টা চলে। কিন্তু টাকার অভাবে এই প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত সরকার লালন শাহ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পরবর্তী এক দশক অর্থাৎ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত লালনের সমাধি স্থানের দিকে কারো নজর পড়েনি। অনাদৃত অবহেলিত অবস্থায় থেকে যায় এই সমাধি স্থানটি। এবার এগিয়ে এলেন দেবীপ্রসাদ চক্রবর্তী নামে এক ব্রাহ্মণ সন্তান। তিনি মোহিনী মিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টার পদে কাজ করতেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রয়াসে তখনকার দিনে আট হাজার টাকা খরচ করে একটি সৌধ নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ব্যবস্থাপনায় নতুন বাড়ি তৈরি হবে বলে আগেকার সৌধটি একেবারে ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেবীপ্রসাদবাবু তাঁর এই স্বপ্ন সফল করতে পারেননি। কী সেই কারণ, সে সম্পর্কে যথেষ্ট অনুসন্ধান করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সেই রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারিনি। হয়তো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। এর অন্তরাল কি সাম্প্রদায়িকতার ছায়া ছিল? অবশ্য এসব আমাদের অনুমান—ঐতিহাসিক সত্য জানা সম্ভব নয়।
এর পরেই হঠাৎ পরিবেশ এবং বাতাবরণ পালটে যায়। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের প্রস্তাবে ১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠে লালন শাহের সুদৃশ্য সৌধ এবং মাজার। লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্রের জয়যাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করেন। গণ পূর্ত বিভাগের বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ এম এ হাই-এর নকশা অনুসারে ওই বিশাল সমাধিক্ষেত্রটি গড়ে ওঠে। এই সমাধি ক্ষেত্রটি দেখলে দিল্লির মুসলমান সাধক হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মকবরার কথা মনে পড়ে যায়। অনেকে বলে থাকেন, এভাবেই পাকিস্তান সরকার লালন ফকিরের ইসলামিকরণের কাজ শুরু করে দেয়।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লালন গবেষক এ এইচ এম ইমামউদ্দিন তাঁর ‘বাউল মতবাদ ও ইসলাম’ গ্রন্থে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন ”—কতিপয় লালন ভক্ত সুধী ব্যক্তির চেষ্টার বিলুপ্ত প্রায় লালন শাহের আখড়া নবজীবন লাভ করিল, গড়িয়া উঠিল লালন স্মৃতিসৌধ। আখড়া পরিণত হইল মাজার শরীফে এবং লালন শাহ উন্নীত হইলেন মহাসুফী সাধক পদে।”
মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিক থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, লালন লোক সাহিত্য কেন্দ্র স্থাপন করা বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের পক্ষে এক সসম্মানীয় প্রয়াস। তবে আজ পর্যন্ত এই লোকসাহিত্য কেন্দ্রের তরফে সৃষ্টিশীল কোনো গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়নি শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের নামবদল হয়েছে। ১৯৬৩ সালের লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র ১৯৭৬ সাল থেকে লালন অ্যাকাডেমি নামে পরিচিত। কিন্তু এখানে লালন গীতির একটি নির্ভরযোগ্য সংকলন কি থাকতে পারত না? কেন প্রকাশিত হয়নি লালনের ঘটনাবহুল জীবনের ইতিবৃত্ত?
ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকে লালন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লালনের হিন্দু উৎস সম্পর্কে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। ১২৯৭ সালে হিতকারীর সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি যে, লালন জন্মগতভাবে ছিলেন হিন্দু পরিবারের সন্তান।
১৩৩৫ বঙ্গাব্দে বসন্ত কুমার পাল লালন ফকিরের পরিচিতি লেখেন বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকায়। পরে তিনি লালনের জীবন অবলম্বনের পূর্ণাঙ্গ বই ‘মহাত্মা লালন ফকির’ লেখেন ১৩৬২ বঙ্গাব্দে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মতিলাল দাস, মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন প্রমুখ লালন গবেষকরা এই জীবন বিবরণকে সত্য বলে মানতেন। তাঁরা সকলেই জানতেন, যে লালন ভাঁড়ারা অর্থাৎ কুষ্টিয়ার মানুষ। জন্মসূত্রে হিন্দু, কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় জাতি বিশ্বাসহীন গৌণধর্মী ফকির হয়ে যান।
হঠাৎ একদল নতুন গবেষক বলতে চাইলেন যে লালন জন্মসূত্রে মুসলমান। তাঁদের এই অপপ্রয়াস লক্ষ্য করে ব্যথিত চিত্তে মনসুরউদ্দিন ১৩৭১ বঙ্গাব্দে লিখেছেন ”—ইদানিং এখানে দেখা যাইতেছে অনেকেই প্রাণান্ত পরিশ্রম করিয়া লালন শাহকে জন্মকাল হইতে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিতে চেষ্টা করিতেছেন ও লালন শাহের জন্মস্থান যশোহরে বলিয়া উল্লেখ করিতেছেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসরকাল ইঁহারা সকলেই তুষ্ণীভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন।”
মনসুরউদ্দিনের প্রতিবাদ পড়ে তরুণ গবেষক লুৎফর রহমান ১৯৮৪ সালে তাঁর ‘লালন জিজ্ঞাসা বইতে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন ”—প্রাণান্ত পরিশ্রম করলেই কি কোনো মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়? লালন শাহ জন্মগতভাব মুসলিম সন্তান, একথা তিনি স্বীকার না করলেও সত্য। লালনের জন্মস্থান যে ভাঁড়ারা নয়, যশোর জেলার হরিশপুরে—সেকথাও সত্য। তার প্রমাণ দুদ্দুশাহের বর্ণনায়, মরহুম আবদুল ওয়ালি লিখিত প্রবন্ধে। এসব তথ্য বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত, প্রমাণের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই।
এখন দেখা যাক, লুৎফর রহমান যে দুদ্দু শাহের কথা বলেছেন, তাঁর কী পরিচয়।
তাঁকে আমরা লালন পরবর্তী এক শক্তিশালী গীতিকার হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। লুৎফর রহমান তাঁর লেখা একটি কলমী পুঁথি নিজ প্রয়াসে মুদ্রিত করেন। অনেক গবেষক এই পুঁথিটিকে জাল বলে মনে করেন।
আবদুল ওয়ালি কে ছিলেন? তিনি ছিলেন ইংরেজ আমলে যশোরের শৈলকুপার সাব রেজিস্ট্রার। ৩০ নভেম্বর ১৮৯৮ সালে তিনি বোম্বাইয়ের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণের বিষয় ছিল, বাংলার ফকির সম্প্রদায়ের কিছু অপ্রচলিত প্রথা। এই প্রবন্ধটি পরে ১৯০০ সালে পঞ্চম খণ্ডের চতুর্থ সংখ্যায় সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে আবদুল ওয়ালি বলেছেন, যে লালন এবং তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই যশোর জেলার হরিশপুরের মানুষ। তবে লালনকে তিনি ‘নোন অ্যাজ কায়স্থ’ বলে একটি সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ যশোর জেলার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও লালন জন্মসূত্রে হিন্দু—এই কথা স্বীকার করেছেন আবদুল ওয়ালি।
লালন ফকিরের ইসলামিকরণের অন্তরালে কোন ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ছিল? অনেক গবেষক এই প্রসঙ্গে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতি সমস্যার কথা বলতে চান। দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় হীনমন্যতা শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের এই জাতীয় মনোভাবের অন্তরালে অনেকগুলি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ ছিল। পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ ভূমিখণ্ড হিন্দু জমিদারদের অধীনে ছিল। উচ্চ বংশীয় হিন্দু জমিদাররা নানাভাবে নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং বিধমী মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করতেন। কখনো তাদের দিকে সুনজরে দেখতেন না। লেঠেল এবং পাইক বরকন্দাজ দিয়ে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন। এর ফলে তাদের প্রতি বৈরীতার ভাব জন্ম হয়। এই অবস্থায় মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুকে তাদের জাতশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেন।
হয়তো এই সব বিষয়গুলিকে আলাদাভাবে বিচার বিবেচনা করা উচিত। ভাবতে অবাক লাগে, লালনের মহাপ্রয়াণের দীর্ঘকাল পরেও তাঁকে মুসলমান বলে গণ্য করার স্বপক্ষে কোনো দলিল দস্তাবেজে তুলে ধরা হয়নি। গবেষকরাও এ বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন। ১৮৯০ সাল অর্থাৎ লালনের মৃত্যুবর্ষ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে কোনো চর্চা হয়নি। লালন যে মুসলমান, একথা প্রথম বলেছিলেন মুহম্মদ আবু তালিব। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রকাশিত ‘লালন পরিচিতি’ বইতে তিনি জানিয়েছেন—
”বর্তমান লেখকই সর্বপ্রথমে লালনের সত্য জীবনের প্রতি সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তিনিই সর্ব প্রথমে লালনকে যশোহর জেলারে হরিশপুর নিবাসী এবং জন্মগতভাবে মুসলিম সন্তান হিসাবে দাবি করেন। ১৩৬০ সালের (১৯৫৩ ঈসায়ীর আগস্ট) ভাদ্র সংখ্যা মাহেনাও পত্রিকায় তিনি সমস্ত প্রচলিত ধারণার প্রতিবাদ করে বলেন—আনুমানিক ১১৭৩ (১৭৬৬ ইংরাজি) সালে যশোহর জেলার অধীন হরিনাথকুঞ্জ থানার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রামের এক খোনকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লালন শাহ।”
লালন কি সত্যি খোনকার বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের মতো এক বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ১৩০২ বঙ্গাব্দে কুষ্টিয়ার কুমারখালি অঞ্চলে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন উৎসাহী গবেষক। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই বিষয়ে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা লিপিবদ্ধ হয় ভারতী পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন—
লালনের ধর্মমত অতি সরল ও উদার ছিল। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, শা উপাধি মুসলমান জাতীয়—সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন—
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন ভাবে, জাতির কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।”
লালন কেন তাঁর জাতের কথা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করতেন না? এর অন্তরালে হয়তো অনেকগুলি কারণ আছে। প্রসঙ্গত আমরা লালনের বিশেষ পরিচিত কাঙাল হরিনাথের কথা বলব। হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন—
”লালন নিজের কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাঁহার আচার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাঁহাকে মুসলমান মনে করিত। বৈষ্ণব ধর্মের মত পোষণ করিত দেখিয়া হিন্দু ইঁহাকে বৈষ্ণব ঠাওড়াইত।”
লালনের চরিত্রের এই উদার নির্ভীকতা আমাদের অবাক করে দেয়। সব অর্থে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল মানবতাবাদী। নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সাহস এবং সামর্থ ছিল তাঁর জন্মগত। এখানে একটি প্রশ্ন করা যেতে পারে, তাহল, যদি জন্মগতভাবে লালন মুসলমান হতেন, তাহলে সর্বসমক্ষে তা গোপন করবেন কেন? কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি ইসলামী আচার ত্যাগ করে অনুভববাদী মারফতি ফকির হয়ে অবস্থান করছিলেন। এই জাতীয় অনেক ফকির পূর্ব বাংলায় আসেন। তাঁরা কিন্তু তাঁদের জন্ম পরিচয়ের কথা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন। এর জন্য তাঁরা মৌলবাদীদের হাতে বারবার লাঞ্ছিত ও অবহেলিত হয়েছেন, তবুও সত্যকে গোপন করেন নি।
লালনের সমসাময়িক ভাবসাধক গীতিকার পাগলা কানাইয়ের মৃত্যু হলে তাঁর শোক মিছিলে মৌলবীরা যোগ দেন নি। লালন বোধহয় এসব খবর জানতেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর কোনো ধর্মমতে তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হবে না।
কুষ্টিয়াবাসী মুসলমান এ. এইচ. এম. ইমামউদ্দিন তাঁর ”বাউল মতবাদ ও ইসলাম” বইতে লালনের জন্ম—পরিচয় সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন—
”ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে
তার কাছে জাতের বিচার নাই।
এই আলোচনায় একথা বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, লালন জাতিতে বিশ্বাস করিতেন না। ছেঁউড়িয়ার যে পল্লীতে তিনি বাসা বাঁধিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশ মোমিন সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান। তিনি এক মুসলমান মেয়েকে নিকাহ করিয়া ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি মুসলমান, একথা প্রকাশ করিতে তাঁহার ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। তবুও তিনি জাতিত্বের পরিচয় প্রকাশ করেন নাই, তাহা হইলে কি লালন তাঁর জাতিত্বের আসল পরিচয় গোপন করিয়াছিলেন?”
এই বক্তব্যের শেষ শব্দ ক’টি যথেষ্ট রহস্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী। এর থেকেই হয়তো ওই গবেষক বলতে চেয়েছিলেন যে, জন্মগতভাবে লালন ছিলেন হিন্দু।
ইমামউদ্দিন সাহেব আর একটি ভালো প্রশ্ন করেছেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলেছেন যে, ”লালন জীবিতকালে যে জাতের গণ্ডিতে আবদ্ধ হইতে চাহেন নাই, এখান তাঁহাকে জাতের সীমারেখায় আবদ্ধ করিলে কি তাঁহার উপর অন্যায় ও অবিচার জুলুম করা হইবে না?”
এ প্রশ্ন শুধু নির্মোহী গবেষক ইমামউদ্দিনের নয় আরও অনেক সত্যান্বেষী গবেষক বারবার এই প্রশ্ন করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের গবেষকরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে পারস্পরিক বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন। একদল সত্যান্বেষক চাইছেন, লালনের জাত বিচার করার অপচেষ্টা থেকে দূরে থাকতে। অন্য আর একদল গবেষক সরকারি অর্থানুকূল্যে গবেষণা করে লালনের পূর্ব পরিচয় জানতে আগ্রহী। তাঁরা সমবেতভাবে এই কথা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেছেন যে, লালন জন্মগতভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আজও লালন ফকিরের কোনো তথ্যানুসারী জীবনপঞ্জী রচনা করা সম্ভব হয় নি। নিজের পূর্ব জীবন সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ মৌলাবলম্বন করতেন। হয়তো সেখানে ছিল দারুণ জ্বালা। তাই তিনি এই জীবনের কথা স্মরণ করতে চাইতেন না। এর ফলে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছেও লালনের পূর্ব জীবনের ইতিহাস ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।
অনুমান সম্বল বেশ কিছু গুজব লালনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমরা জানি বাঙালিরা আবেগপ্রবণ এক হুজুগে জাতি, এই স্বভাব আজও আমরা সযত্নে বহন করে চলেছি। যে কোনো মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ বা কষ্টকল্পনা গড়ে ওঠে, আমরা সেদিকেই বেশি আকর্ষণ বোধ করি। রহস্য প্রহেলিকা সরিয়ে সত্যসূর্যের সন্ধান করতে চাই না। লালনের কথা একই কথা প্রযোজ্য।
লালনের জীবন অন্বেষণ করতে গিয়ে তাঁর নরম সুহৃদ কাঙাল হরিনাথ যথেষ্ট পরিশ্রম করে ছিলেন। লালনের মহাপ্রয়াণের পর ১৮৯০ সালে ৩১ অক্টোবর হিতকরী পত্রিকাতে একটি অস্বাক্ষরীয় সম্পাদকীয়তে তাঁর ফেলে আসা দিন যাপনের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই সম্পাদকীয়টি পড়লে আমরা জানতে পারি যে, ”সাধারণে প্রকাশ, লালন ফকির জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। কুষ্টিয়ার অধীনই চাপড়া ভৌমিক বংশীয়েরা ইঁহার জ্ঞাতি। ইঁহার কোনো অত্মীয় জীবিত নাই। ইনি নাকি তীর্থগমনকালে পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েন। মুমূর্ষু অবস্থায় একটি মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবনলাভ করিয়া ফকির হয়েন। ইঁহার মুখে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান ছিল।”
এই অংশটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, লেখক নিজে লালনের পূর্বপরিচয় সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তাই নাকি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কীভাবে তিনি জানতে পারলেন যে, লালন জাতিতে কায়স্থ ছিলেন? লোকমুখে প্রচারিত সংবাদ শুনেছেন? বাচনিক কিংবদন্তীর ওপর নির্ভর করেছেন? নাকি কোনো একটি পরিকল্পিত রটনার ওপর নির্ভর করেছেন?
১৮৯৫ সালে ঠাকুর বাড়ির উদ্যোগে প্রকাশিত ভারতীতে লালনের এক জীবন পরিচয় প্রকাশিত হয়। এটি লিখেছিলেন রাজশাহীর অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। আমরা আগেই বলেছি তিনি লালনের সাধনপীঠ কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার কুমারখালি অঞ্চলে দীর্ঘদিন কাটিয়ে ছিলেন। তিনি লিখেছেন—
”লালন ফকিরের সকল কথা ফলাও করিয়া জানি না, যাহা জানি তাহাও কিংবদন্তীমূলক। লালন নিজে অতি অল্প লোককে আত্মকাহিনী বলিতেন, তাঁহার শিষ্যরাও বেশি কিছু সন্ধান করিতে পারেন না। লালন জাতিতে কায়স্থ, কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী চাপড়া গ্রামের ভৌমিকরা তাঁহার স্বজাতীয়।”
তার মানে অক্ষয়কুমার কাঙাল হরিনাথের সম্পাদিত পত্রিকার বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। তিনি কিন্তু কোনো কিংবদন্তীর ওপর নির্ভর করতে চাননি। তিনি এই নিবন্ধে লালন সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—
”দশ-বারো বছর বয়সে বারুণী গঙ্গাস্নান উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে যান। তথায় উৎকট বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া মুমূর্ষু দশায় পিতামাতা কর্তৃক গঙ্গাতীরে পরিত্যক্ত হন।”
প্রসঙ্গত বলা যায় হিতকরীতে বলা হয়েছে ‘সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিলেন।
অক্ষয়কুমার এই ব্যাপারে জনশ্রুতি বা লোকবিশ্বাসের কথা বলেছেন। এই লোক শ্রুতির ওপর নির্ভর করে তিনি মন্তব্য করেছেন ”—শ্মশানবাসী লালনকে একজন মুসলমান ফকির সেবাশুশ্রূষায় আরোগ্য করিয়া লালন পালন করেন এবং ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন। এই ফকিরের নাম সিরাজ শা, জাতিতে মুসলমান। লালনের প্রণীত অনেক গানে এই সিরজা শা দীক্ষাগুরুর উল্লেখ আছে।”
অক্ষয়কুমার লালনের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করে লিখেছেন—
”তাঁর সুদীর্ঘ দেহ, উন্নত লালট, উজ্জ্বল চক্ষু, গৌরবর্ণ মুখশ্রী এবং প্রশান্ত ভাব দেখিয়া তাঁহাকে হিন্দু বলিয়া চিনিতে পারা যাইত।”
আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, লালনের এই শারীরিক বৈশিষ্ট্য অক্ষয়কুমার কীভাবে দেখলেন? হিতকরীর কোনো সম্পাদকীয়তে লালন সম্পর্কে এত কথা প্রকাশিত হয়নি। অক্ষয়কুমারের এই অনুসন্ধানের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ অস্মিতা প্রকাশিত হয়। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, অত্যন্ত সুপুরুষ লালন জন্মগতভাবে হিন্দু ছিলেন।
আবদুল ওয়ালির নিবন্ধ থেকেও আমরা লালনের জন্মপরিচয় সম্পর্কে অনেক খবর জানতে পেরেছি। The Journal of the Anthropological Society of Bombay-এর ১৯০০ সালর ৫ম খণ্ডে তিনি লালনের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, লালন যখন জগন্নাথের মন্দিরে গিয়েছিলেন, তখনই ফকিরি ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। উনি কিন্তু মুসলমান ফকিরের আনুকূল্যে লালনের বেঁচে ওঠা এবং সিরাজ সাঁই-এর কাছে ফকিরি মতে দীক্ষা গ্রহণ করার ঘটনাকে সমর্থন করেননি। তবে জগন্নাথ দর্শন এবং কায়স্থ বর্গের উল্লেখ করে নিবন্ধকার লালনের হিন্দু উৎস মেনে নিয়েছেন। আমরা জানি যে, জগন্নাথের মন্দিরে কোনো অহিন্দুর প্রবেশ নিষেধ।
ওয়ালির এই নিবন্ধটিকেও সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারণ এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে ওয়ালি জনশ্রুতি এবং কিংবদন্তীর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এবার আমরা লালনের জন্মরহস্য সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মতামতের ওপর আলোকপাত করব। ১৯০৯ সালে তিনি একটি ভাষণে লালন সম্পর্কে নানা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন—
আমি এইরূপ একজন ধর্মপ্রচারকের বিষয়ে কিছু জানি—তাহার নাম লালন ফকির। লালন ফকির কুষ্টিয়ার নিকটে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন—এইরূপ শোনা যায় যে, তাঁহার বাপ-মা তীর্থযাত্রা কালে পথিমধ্যে তাঁহার বসন্ত রোগ হওয়াতে তাঁহাকে রাস্তায় ফেলিয়া চলিয়া যান। সেই সময় একজন মুসলমান ফকির দ্বারা তিনি পালিত ও দীক্ষিত হন। এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান জৈন মত সকলে একত্র করিয়া এমন একটি জিনিস তৈয়ার হয়েছে, যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ বিষয়ে সকলেরই মন দেওয়া উচিত।”
এই অভিভাষণটির মধ্যেও কোনো নতুনত্ব নেই। রবীন্দ্রনাথের এই মৌখিক ভাষণটি শুনে আমরা বুঝতে পারছি যে, তিনি স্থানীয় জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা আগে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তিনি লালনের ধর্মমত সম্পর্কে নতুন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন—
”লালনের যে গৌণধর্ম, তাতে মুসলমান ও জৈনধর্মের স্রোত মিলে গেছে।” তখনও পর্যন্ত হয়তো লালনের গানের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটেনি। তাই তিনি লালনসঙ্গীত সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আর একটি কথা লক্ষণীয়, তা হল রবীন্দ্রনাথ কিন্তু লালনকে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত বলে মনে করেননি।
এরপর লালন সম্পর্কে গবেষণায় ভাটা পড়তে থাকে। আসলে তখন অবিভক্ত বঙ্গদেশে শুরু হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার লেগেছে সর্বত্র। দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক উন্মাদনা। জীবন এবং জীবিকা হয়েছে বিপর্যস্ত। সেখানে ছেঁউরিয়া আশ্রমের এক ফকিরকে নিয়ে কে গবেষণার করার মতো সুযোগ পাবেন?
অবশ্য এই বিষয়ে নানা খবর আমাদের কানে আসে। লালনের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক সংঘর্ষ। লালন শিষ্য মনিবুদ্দিন ফকিরের সঙ্গে ভোলাই এবং শীতল শাহের তীব্র বিবাদ চলেছে। এইসব শিষ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী পত্রিকার হারামণি বিভাগে লালনের কুড়িটি গান ছাপেন। তখন থেকেই লালন বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে।
প্রসঙ্গত বিশিষ্ট সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলা উচিত। তিনি দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া মহকুমার শাসক ছিলেন। অথচ লালন বিষয়ে উৎসাহ দেখাননি। এর কারণ কী? লালনপন্থীরা কি তখন এক ঘরে হয়ে গিয়েছিলেন? নাকি নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্গীয় বুদ্ধিজীবীরা কোনো ঔৎসুক্য দেখাতেন না? অন্তরঙ্গ আলপচারিতায় অন্নদাশঙ্কর স্বীকার করেছেন।
”আমি কুষ্টিয়া ছেড়েছি ১৯৩৬ সালে। পূর্ববঙ্গ থেকে বিদায় নিয়েছি ১৯৪৭ সালে। লালনের নাম আমি কুষ্টিয়াতে থাকতেই শুনেছিলুম। কিন্তু কোনোদিন তাঁর আখড়ায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যদিও মাইল দেড়েকের ব্যবধান।”
এগিয়ে এলেন বিশিষ্ট গবেষক মনসুরউদ্দিন। উনি ১৯৩০ থেকে ১৯৬৪ সাল প্রায় তিন দশক লালনের জীবনের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন। বহু মানুষের সঙ্গে লালন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর লালনের একটি তথ্যনিষ্ঠ জীবনী লেখায় প্রয়াসী হন।
তিনি লিখেছেন ”—লালন ফকির অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার অন্তর্গত কুমারখালি সংলগ্ন গড়াই নদীর তীরে ভাঁড়ারা (চাপড়া) গ্রামে জন্মান। তাঁর জন্ম কায়স্থ পরিবারে। পদবি কর (মতান্তরে রায়)। বাবা ও মায়ের নাম মাধব ও পদ্মাবতী। বাবা মার একমাত্র সন্তান লালন শৈশবে বাবাকে হারান এবং সেই কারণে বিধিবদ্ধ বিদ্যালয়ে শিক্ষা পাননি। তাঁর মাতুল বংশ ছিল চাপড়ার ভৌমিকরা। দুই গ্রামেরই ছিল লোকঐতিহ্যের সগর্ব পরম্পরা এবং গানের ধারা ছোটোবেলা থেকে লালন ভালবাসতেন গান বাজনার পরিমণ্ডল, বিশেষত কীর্ত্তন ও কবি গান। ধর্মভাবও ছিল স্বভাবগত। অল্পবয়সে পিতৃহীনতার ফলে লালন অকারণেই সংসারে জড়িয়ে পড়েন এবং বিবাহিত হন। কিন্তু আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে বিরোধ বিতর্কে বিরক্ত হয়ে স্ত্রী এবং মাকে নিয়ে নিজের গ্রামেই দাসপাড়া অঞ্চলে আলাদা বাসস্থান বানান। পরবর্তী কোনো সময় দাসপাড়ার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে তিনি বহরমপুরে গঙ্গাস্নানে যান এবং বাড়ি ফেরার পথে আক্রান্ত হন বসন্ত রোগে। আচ্ছন্ন ও চৈতন্য লালনকে ফেলে সম্ভবত রোগের ভয়ে সঙ্গীরা পালিয়ে আসেন গ্রামে এবং লালনের মৃত্যুর খবর রটিয়ে দেন। তাঁরা হয়তো লালনকে মৃত মনে করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।”
এরপর উনি আরও লিখেছেন—”মৃতকল্প সংজ্ঞাহীন লালনের দেহ নদীর জলে ভাসমান দেখতে পেয়ে একজন স্নেহশীলা মুসলমানা নারী উদ্যম করে তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে সেবা করে বাঁচিয়ে তোলেন। কেবল বসন্তরোগ রেখে যায় তার অনপনেয় দাগ। কিন্তু আরও বড়ো হৃদয় ক্ষত লালনের জন্য অপেক্ষা করছিল। সুস্থ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে সমাজের কঠোর নির্দেশে নিজের পরিবারে লালন স্থান পেলেন না। কেননা বাড়িতে তাঁর শ্রাদ্ধকার্য হয়েছে এবং তিনি মুসলমানের অন্ন খেয়েছেন। ব্যথিত সন্তপ্ত লালন জাতি সম্পর্কে আস্থা হারালেন।
সিরাজন শাহ নামে এক তত্ত্বজ্ঞের কাছে লোকায়ত মতে দীক্ষা নিয়ে সবরকম সাম্প্রদায়িক ধর্ম সম্পর্কে অনুৎসাহী হয়ে পড়েন। পরে সিরাজের নির্দেশে কুষ্টিয়ার সন্নিহিত ছেঁউরিয়া গ্রামে ১৮২৩ আখড়া বানান। আশেপাশের কারিকর সম্প্রদায় তাঁকে বরাবর পোষকতা করেছেন। নিভৃত সাধনায় ও নির্জনতায় লালন একরকমের সিদ্ধতা অর্জন করেন, যার রূপায়ক হতে থাকে। অন্তরস্বভাবী বহুতর নিগূঢ় মর্মের গানে। হিন্দু-মুসলমান দুই তরফ থেকে তাঁর শিষ্য সেবক জুটতে থাকে। লালন পূর্ব এবং উত্তরবঙ্গের নানা বংশে ভ্রমণশীল হন। বাউল বা মারফতি সাধন হিসাবে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ঘটে। অবশেষে ১৮৯০ সালে তাঁর তিরোধান ঘটে।”
এই জীবন ইতিহাসটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, মনসুরউদ্দিন যথেষ্ট খেটে এটি লিখেছিলেন। তিনি প্রথম বলেছেন যে লালন কর পদবিযুক্ত। তিনি লালনের হিন্দু উৎসের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। এর অন্তরালে হয়তো কিছু জনশ্রুতি কাজ করেছে। কিন্তু তাঁর এই প্রয়াসকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাব।
এই প্রসঙ্গে আর এক লালন গবেষকের নাম বলব। তিনি হলেন বসন্ত কুমার পাল। লালন জীবন এবং লালন সংগীতের অন্তরালে যে দর্শন চিন্তা কাজ করছে—এই দুই বিষয়ে বসন্তবাবু উল্লেখযোগ্য গবেষণা করে গেছেন। ১৯২৫ সালে তিনি প্রবাসী পত্রে ‘ফকির লালন শাহ’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এই নিবন্ধেও তিনি লালনের হিন্দু উৎসের কথা স্বীকার করে গেছেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, লালনের জন্মভিটা নামে কথিত ভাঁড়ারার ধর্মপাড়ায় বসন্তকুমারে ভিটে। তাই তিনি ক্ষেত্রানুসন্ধান করতে গিয়ে কোনো বাধাবিপত্তির সম্মুহীন হননি। লালনের বিচরণ ক্ষেত্রের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় ছিল।
লালনের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে অনেকে আবারে নানা নতুন তথ্য জুড়ে দিয়েছেন। যেমন, আনোয়ারুল করিম। তিনি কুষ্টিয়া কালেকটরেটের রেকর্ড রুমে গিয়ে লালন সম্পর্কে একাধিক তথ্য অনুসন্ধান করেন। ১৯২২ সালের এক পুরোনো খতিয়ান দেখে বলেন, তেলব্যবসায়ী লালন কলু হলেন লালন ফকির। তাঁর মতে লালনের পিতা হলেন আনন্দ শা এবং সাকিন ভাড়ারা।
১৯৭৪ সালে আবুল আহাসন চৌধুরী এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ”—লালন কলু বাউল সাধক লালন অপেক্ষা প্রায় পঞ্চাশ বছরের ছোটো ছিলেন। সাধক লালন দেহত্যাগ করেন ১৮৯০ সালে। আর কলু লালন ১৯৩০ সালেও জীবিত ছিলেন। সাধক লালনকে ছেঁউরিয়ায় সমাধিস্থ করা হয়। পক্ষান্তরে লালন কলুর কবর ভাঁড়ারায় অবস্থিত। সব থেকে বিস্ময়ের ব্যাপার লালন কলুর স্ত্রী এখনও (১৯৭৪) পর্যন্ত জীবিত—তাঁর বয়স অনুর্ধ্ব ষাট। লালন ফকিরের মৃত্যু তেইশ বছর পরে তাঁর স্ত্রী জন্মগ্রহণ করেন বা মৃত লালনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন—গবেষণা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, লালন জীবন সম্পর্কে কত মিথ আমাদের চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন এবং আবিষ্ট করেছে।”
এবার দেখা যাক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট অধ্যাপকরা লালন সম্পর্কে কী মত প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমরা প্রথমেই অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথা বলল। অন্নদাশঙ্কর রায় বারবার স্বীকার করেছেন যে, যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছেঁউরিয়াতে যাননি। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার পদার্পণ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। লালন সম্পর্কে অনেক খবর তিনি শুনেছিলেন। লালনের সমাধিভূমি পরিদর্শন করতে তিনি কেন যাননি? এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, লালন সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট নেতিবাচক মনোভাব নিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘লালন ও তাঁর গান’ শীর্ষক বইতে লালন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন—
সম্ভবত তিনি জন্মসূত্রে হিন্দুই ছিলেন। হিন্দুরা তাঁকে ত্যাগ করেছিনে মুসলিম সংসর্গের দরুণ। জন্মসূত্রে মুসলমান হলে বিদ্রোহের সুর শোনা যেত না—এ হল এক অতি সরলীকৃত ধারণা। মুসলমান সম্প্রদায় বিদ্রোহী হয়ে উঠবেন না—পরিণত মনস্ক বুদ্ধিজীবী হয়ে অন্নদাশঙ্কর এই মন্তব্য কী করে করলেন?
ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ একটি বহু পঠিত এবং বহু চর্চিত বই। দীর্ঘ পরিশ্রম করে তিনি এই বইটি রচনা করেছেন। এই বইতে লালন ফকির সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ আছে এই ভাবে—
”রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের বাউল গান অত্যন্ত ভালোবাসিতেন। তাঁহার জন্যই লালনের গান সম্বন্ধে আধুনিককালে শিক্ষিত সমাজ কৌতুহলী হইয়া ওঠেন। খুব সম্ভব রবীন্দ্রনাথ লালনকে চোখে দেখেন নাই। কারণ জমিদারি কার্যোপলক্ষে তাঁহার শিলাইদহে যাইবার পূর্বেই লালনের তিরোধান হয়। তাঁহার পদে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মসংক্রান্ত যে সমস্ত ইঙ্গিত ও উল্লেখ আছে তাহাতে তাঁহাকে একজন মনিষী পণ্ডিত ব্যক্তি বলিয়াই বোধ হয়। লালন নাম তাঁহার প্রকৃত কৌলিক নাম অথবা বাউল ফকিরি দীক্ষালাভের পর তিনি এই নামে পরিচিত হন, তাহা জানা যাইতেছে না। লালন বাহ্যত মুসলমান ফকিরবৎ আচরণ করিলেও খুব সম্ভব আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই, করিলে হিন্দু সমাজে তিনি এতটা শ্রদ্ধালাভ করিতে পারিতেন না।”
এই মন্তব্যটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি অসিতবাবু সম্পূর্ণ একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে লালনের ধর্মমতের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। এখানেও তিনি হিন্দু মুসলমানের সেই প্রাচীন বিভাজন তত্ত্বটিকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে যদি লালন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তাহলে হিন্দু সমাজ তাঁকে ব্রাত্য হিসাবেই গণ্য করত।
এই ভাবে তিনি একটি সামাজিক সমস্যার ওপর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইতে লালন সম্পর্কে লিখেছেন—
”উনবিংশ শতাব্দীর বাউল কবিদের মধ্যে লালন ফকিরের স্থান খুব উচ্চে। রবীন্দ্রনাথ ইঁহাকে খুব শ্রদ্ধা করিতেন। লালন থাকিতেন কালীগঙ্গার ধারে ঠাকুরদের জমিদারির বিরাহিমপুর পরগণার ছেঁউরিয়া গ্রামে। শোনা যায়, ইনি কায়স্থের ঘরে জন্মিয়াছিলেন। ইঁহার শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই-ই ছিল।”
লালন কি সত্যি সত্যি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন? এই নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। লালন সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করে গেছে। এসেছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, বসন্তকুমার পাল, শশীভূষণ দাসগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোহম্মদ মনসুরউদ্দিন, সৈয়দ মুস্তাজা আলি, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান প্রমুখ।
তাঁদের গবেষণা থেকে লালনের চারটি জন্মস্থান চিহ্নিত হয়েছে। এতে আমাদের বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। যেমন, আবদুল ওয়ালির মতে, লালন জন্মেছিলেন যশোহরের ঝিনাইদহ মহকুমার হরিশপুর গ্রামে। কাঙাল হরিনাথ বলেছেন, লালনের জন্ম কুষ্টয়ার অন্তর্গত ঘোড়াই গ্রাম। আবার বসন্ত কুমার পাল বিভিন্ন জনশ্রুতি বিচার বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালির অন্তর্গত ভাঁড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এ কে নূর বলেছেন, লালনের জন্ম যশোহর জেলায় ফুলবাড়ি গ্রামে।
জন্মস্থান ঘটিত এই বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যে আর একটি মারাত্মক প্রশ্নের উদ্রেক করে। তাহল, লালেন নামে কি একাধিক গায়ক কবি ছিলেন? হরিশপুরে নাকি আর এক লালন থাকতেন। একথা আমরা জানতে পারছি বসন্তকুমার পালের লেখা একটি চিঠি থেকে। তিনি লিখেছেন—
”হরিশপুরে লালন ফকির নামে যিনি প্রকট হইতেছেন, তিনি আমার লিখিত পুস্তকে মহাত্মা লালন ফকির নহেন। যাহাতে এই দুই লালন একত্রে মিশিয়া না যায়, এ জন্য তারাপদ শাস্ত্রী মহাশয় আমাকে সাবধান করিয়া দেন।”
এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল আবুল আহসান চৌধুরীর ‘লালন শাহ’ গ্রন্থে। এই বইটি ঢাকা থেকে ১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোহর ও খুলনার ইতিহাস’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, ‘যেসব লোকে এসব মতে (গুরুর সত্য গীত) গান রচনা করিয়াছেন, তন্মধ্যে যশোহরের লালন ফকির এবং ঈশান ফকির প্রধান।
এবার আমরা দুদ্দুশাহের কথা বলল। দুদ্দুশাহের জন্ম ১৮৪১ সালে। তাঁর মৃত্যু ১৯১১ সালে। তিনি ছিলেন লালনের শিষ্য। লুৎফর রহমান নামে এক গবেষক ‘লালন চরিত’ নামে একটি কলমী পুঁথি প্রকাশ প্রকাশ করেন। এই লালন চরিত পয়ারে লেখা ১৪৮ পংক্তি লালন জীবনী, এটি নাকি দুদ্দু শাহের লেখা। এই পুঁথিটি পরলে আমরা বুঝতে পারি যে, লালন জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন। তিনি সিরাজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি তাঁর পিতামাতার নাম এবং হরিশপুরে জন্ম—সবই এখানে সংগৃহীত হয়েছে।
১৩০৩ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক ছেঁউরিয়া আখড়াতে বসে তিনি গুরুর জীবনী লিখতে শুরু করেন। অর্থাৎ লালনের মহাপ্রয়াণের ছ-বছর বাদেই তাঁর জীবনী লেখা শুরু হয়েছিল। গুরুর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি কেন জীবনী লিখেছিলেন? এই বিষয়ে শিষ্যের মন্তব্য—
”বহুদিন সেই কথা রাখিনু ঢাকিয়া সাঁইজীর ছিল মানা নাই প্রকাশি বা নাহি জানি কবে আমি যাইব চলিয়া। তাঁর আত্মকথা যাইবে গোপন হইয়া। একারণে শেষকালে লঙ্গি তাঁর বাণী। একান্ত বিনয়ে লিখি তাঁর জীবনী।”
এই পুঁথিটি পড়লে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন এসে জড়ো হয়।
লালনের ঘনিষ্ঠ সেবক শিষ্য ভোলাই, শীতল, মহরম, মানিক বা বুধুশা লালন সম্পর্কে অনেক কথা জানতেন বলে দুদ্দুশা তাঁর পুঁথিতে বলেছেন। তাঁরা কিন্তু দুদ্দুর কাছে লালনের ফেলে আসা জীবনের অনেক সংবাদ সরবরাহ করেছেন।
পুঁথির রচনাকাল ১৩০৩ বঙ্গাব্দ। কিন্তু পুঁথিটি হারিয়ে যায়। বহুদিন বাদে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপের উলটো পারে চরব্রহ্মনগরে জনৈক রামচন্দ্র মণ্ডলের কাছ থেকে এই পুঁথিটি উদ্ধার করা হয়। রামচন্দ্র নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত এক বৈষ্ণব। দেশ ভাগের আগে তিনি যশোর জেলায় বাস করতেন। তারপর চরব্রহ্মনগরে চলে আসেন।
কীভাবে এই পুঁথি তাঁর হাতে আসে? তিনি বলেছেন ”—বিশাইকালি গ্রামের এক মুদির দোকানে পুরোনো কাগজপত্রের সঙ্গে তাঁর হাতে এই পুঁথিটি আসে। পূর্বপাকিস্তানের বাসিন্দা শাহ আবদুল লতিফ আফী আনহু এই পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৩৭১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে লুৎফর রহমান আনহুর কাছ থেকে পুঁথিটি নকল করেন এবং ১৩৭৪ বঙ্গাব্দে এটি প্রকাশ করেন।”
প্রবীণ বাউল তাত্ত্বিক এবং লালনপন্থী সাধু কবিরাজ মনোরঞ্জন বসু ১৯৯১ সালের ১৭ অক্টোবর আবুল আহসান চৌদুরীর কাছে একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন ”—তাঁর বন্ধু শাহ আবদুল লতিফ আফী আনহু আবিষ্কৃত এই লালনজীবনীর পুঁথিটি জাল। আফী আনহু এই পুঁথিটি রচনা করেছেন। কোনো একটি মিথ্যেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সত্যে পরিণত করার জন্যই এই পুঁথিটি লেখা হয়েছিল।”
আবু তালিব নামে এক বিশিষ্ট গবেষক এই পুঁথিটিকে প্রামাণ্য দলিল বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর ‘লালন শাহ—মত ও পথ নিবন্ধে এই সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে। এই নিবন্ধটি সাহিত্যিকী পত্রিকায় ১৩৭৩ সালের শরৎ-বসন্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে ছিল। আবার রহমান বলেছেন যে, আবু তালিব মূল পুঁথিটি দেখেননি। তাহলে তিনি এজাতীয় একটি প্রবন্ধ করে লিখলেন? তিনি রহমানের লালন জীবনকে ভিত্তি করেই তাঁর নিবন্ধটি লিখেছেন। লুৎফর রহমান ‘লালন জিজ্ঞাসা’ বইয়ের শেষে আবু তালিব এবং আফী আনহুর দুটি প্রাসঙ্গিক চিঠির ফটো কপি ছেপে দিয়েছেন। এই চিঠি দুটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি লালন সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে বাংলা দেশের গবেষকরা কী ধরনের বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। প্রথম চিঠিতে আবু তালিব শাহ লতিফ আফী আনহুকে লিখেছেন—
”যথাসম্ভব শিগগির লিখিত লালন জীবনীর একটি কপি পাঠিয়ে সুখী করব। দুদ্দুশাহ সম্পর্কে এ পূর্ণাঙ্গ আলোচনা লিপিবদ্ধ করার বাসনা হয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত মতামতও সেই সঙ্গে জানিয়ে সুখী করবে।
আচ্ছা, পুঁথিখানির পৃষ্ঠা সংখ্যা কি মাত্র চার? ছত্রসংখ্যা কত? দুদ্দুশাহ কত বছর বয়সে এটি রচনা করেন? আচ্ছা, লালন শাহের দাদাপীরের নাম আমানত উল্লাহ শাহ—একথা কি দুদ্দুশাহ তাঁর পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ করেছেন, আমানত উল্লাহ শাহের কোনো পরিচয় দিতে পারো?”
এই চিঠির মধ্যে যে দাদাপীরের কথা বলা আছে, সে বিষয়ে বোঝা দরকার। লুৎফর রহমন এম.এ. পরীক্ষার জন্য একটি পত্র জমা দিয়েছিলেন। এটি তিনি ১৯৬৫ সলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। এই গবেষণা পত্রটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে লালন জীবনী সংক্রান্ত কিছু ভুল তথ্য পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যতে তাঁরই বিশেষ পত্র থেকে অন্যে মালমশলা সংগ্রহ করে খ্যাতি অর্জন করতে পারে। রহমানের অনুমান সে আশঙ্কাটি সত্যি হয়েছে। আমানত উল্লাহ প্রসঙ্গে রহন লিখেছেন—
”অভি সন্দর্পে লালন গুরু সিরাজ শাহের গুরু আমানত উল্লাহ শাহের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তথায় তাঁর কোনো পরিচয় প্রদত্ত হয়নি।” আলোচ্য গ্রন্থটির উক্ত তথ্যটি গ্রহণ করে জনাব আবুল তালিব আমানত উল্লাহ শাহের পরিচয় জানার জন্য শাহ লতিফ আফী আনহুকে চিঠি লেখেন। তিনি তাঁকে এ বিষয়ে কী তথ্য সরবরাহ করেছেন জানি না। তবে লক্ষণীয় যে লেখক ‘লালন শাহ—পথ ও পথ’ (১৯৬৫) প্রবন্ধে আমানত উল্লাহ শাহের কোনো পরিচয় প্রদান করেননি। কিন্তু ‘লালন শাহ ও লালন গীতিকা’ দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯৬৬) লিখেছেন—
আমানত উল্লাহ শকহর চট্টগ্রাম নিবাসী ছিলেন।”
বলা বাহুল্য চট্টগ্রামে আমানত উল্লাহ শাহ উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক। তাঁর সঙ্গে সিরাজগুরু আমানত উল্লাহ শাহ ওরফে আমিনুদ্দিন নেড়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
চট্টগ্রামের চিস্তিয়া তরিকার ফকির আমানত উল্লাহ শাহকে যশোরের ভিন্ন তরিকান্তগত সিরাজ শাহের মাথায় বসিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে কিছু উত্তম গজমুণ্ড গণেশের সৃষ্টি করা হয়েছে—এমনকি কে পূর্ববতী এবং কে পরবর্তী, সে অনুসন্ধান করার কোনো প্রয়োজন হয়নি।”
এই মন্তব্যটি পড়লেও আমরা লালন গবেষণা সম্পর্কে বিশৃঙ্খল অবস্থার পূর্ণ পরিচয় পাই।
এার আমরা আফী আনহুর চিঠিখানির কথা বলব। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৬ জুন স্পষ্টভাষায় লিখেছেন—
”পরম প্রীতিভাজনেষু শুভেচ্ছা নেবেন। আপনার ইংরাজি ১৭/৬/৬৭ তারিখের চিঠি পেয়ে সবিশেষ অবগত হয়েছি। নানা কাজের জন্য জবাব দিতে দেরি হয়ে গেল। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবু তালিম সাহেবকে আমার সংগৃহীত আচার্য দুদ্দু শাহ লিখিত লালন শাহর জীবনী সংক্রান্ত পাণ্ডুলিপি কখনও দেখাইনি বা তিনি কখনও দেখেননি।”
এর থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, আবু তালিব দুদ্দু শাহের কলমী চোখেই দেখেননি। এইভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষক লালনকে মুসলিম হিসাবে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁর বাড়ি যশোহরের হরিশপুরে, তিনি বাউল নন একজন সুফী সাধক—এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এসেছিলেন আবু তালিব, এস এম লুৎফর রহমান এবং রিয়াজুল হক। এর সঙ্গে শাহ লতিফ আফী আনহুর নামও যুক্ত করা উচিত। লালন জীবনীর বিতর্কিত পুঁথিটি তাঁরই আবিষ্কার।
এই পুঁথিটি যে জাল, সে কথা স্বীকার করেছেন, প্রখ্যাত বাউল বিশেষজ্ঞ আহমদ শরীফ। তিনি একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটির বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ”এ আত্মকথা যে বানানো, তার সব থেকে বড়ো প্রমাণ, চব্বিশ পরগণা বিভক্ত হয়ে ১৮৮৬ সালে যশোহর জেলা গঠিত হয়। দুদ্দু বলছেন, ১৮৮৯ সালের পয়লা কার্তিক লালনের জন্ম হয়। অর্থাৎ ১৭৭২ সনে বা খ্রিস্টাব্দে। তাহলে লালনের জন্ম হয় চব্বিশ পরগণা জেলার খুলনা মহকুমায় (১৮৬০-৬১ সনে গঠিত) এবং খুলনা জেলার রূপ পায় ১৮৮২ সনে। ১৮৮৩ সনে নদীয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে বনগাঁওকে যশোরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। উনিশ শতকের শেষ দশকে বৃদ্ধ দুদ্দুর এসব খবর থাকা উচিত ছিল। ছিনাইদহ প্রথমে খুলনা মহকুমাভুক্ত থাকে, পরে যশোহর জেলাভুক্ত হয়—এসব কারণে দুদ্দুর নামে একালের কোনো স্বল্পবুদ্ধি যশোহরী ও ইসলাম গৌরব গর্বী গবেষকের জীবনী তৈরি করেছেন বলে আমাদের ধারণা এতে ছিঁউরিয়ার, হিন্দুর ও বাউলের দাবী অগ্রাহ্য করে ঝিনাইদহের, হরিশপুরের যে ও সুফীর দাবি প্রতিষ্ঠা সম্ভব ও সহজ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছে।
ঐ পুঁথি যে দুদ্দু শাহর রচনা নয়, সেকথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞরা। কারণ দুদ্দু শাহ ছিলেন লালনপন্থার এক নামী গীতিকার। তাঁর গানের ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিমার মধ্যে আধুনিকতা ও মানবিকতা ধর্ম লুকিয়ে ছিল। তথাকথিত এই পুঁথিতে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত নীচু মানের। সেখানে উৎকৃষ্ট কবিত্বের কোনো চিহ্ন নেই। এমনকি মৌলিক কাব্য রচনা কুশলতার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।
দুদ্দু শাহ নামে প্রচারিত পুঁথিতে লালনের পিতৃ পরিচয় লেখা আছে—”দবী রুল্লাহ দেওয়ান তাঁর আব্বাজীর নাম। এই প্রসঙ্গে এ এইচ এম ইমামউদ্দিন বলেছেন ”—ষাট সত্তর বছর আগে গ্রাম বাংলায় আব্বা শব্দটি মোটেই প্রচলিত ছিল না। পল্লীর সাধারণ ঘরের তো দূরের কথা, শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারেও উহা ব্যবহার হইত কিনা সন্দেহ। এই শব্দটি অতি আধুনিককালে প্রচলিত হইয়াছে।”
দুদ্দু শাহের সমসাময়িক কোনো গ্রাম্যকবির কবিতা দূরের কথা, কোনো খ্যাতনামা কবির কবিতাতেও আব্বা শব্দের ব্যবহারের নজির নেই। দুদ্দুশাহের তথাকথিত পুঁথি অবলম্বন করে লালন সম্পর্কে যে নতুন মিথ তৈরি হয়েছে, সেটিও একবার জেনে নেওয়া দরকার। এটি না জানলে আমরা লালন সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটন করতে পারব না। এই মিথ বা কষ্টকল্পনানুসারে বলা হয়—
”১১৭৯ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক যশোহর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার অধীন হরিশপুরে লালনের জন্ম হয়। তিনি মুসলমান বংশীয়। তাঁর দাদাজীর নাম গোলাম কাদের, পিতা দবীরুউল্লাহ দেওয়ান এবং মাতা আমিনা খাতুন।
তিনি শৈশবেই মা ও বাবাকে হারিয়েছিলেন। এক বৈশাখ মাসে লালন যখন পথে বসেছিলেন, তখন সিরাজ শা দরবেশ তাঁকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেন, শিষ্য করেন ও মানুষতত্ত্বে দীক্ষা দেন। লালনের বয়স যখন ছাব্বিশ বছর, তখন সিরাজ শা মারা গেলে তিনি ফকিরের বেশে নবদ্বীপে চলে যান। সেখানে পদ্মাবতী নামে একজন নারী তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তারপর একদিন নবদ্বীপে পণ্ডিত সভায় কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখিয়ে লালন চমক সৃষ্টি করেন। প্রথমে যেসব পণ্ডিত তাঁকে অবজ্ঞা করছিলেন, তাঁরা মার্জনা চান। তারপরে কাশী-বৃন্দাবনে গেলে ভক্তরা সবাই তাঁকে যুগাবতার আখ্যা দেন। এবার তিনি ভ্রমণ করতে গেলেন খেতুরি। সেখান থেকে গেলেন দক্ষিণ পূর্ব দেশে। সেখানে লালনের ভয়ংকর বসন্ত ব্যাধি হয়েছিল। ভক্তবৃন্দ সঙ্গে না থাকায় মাঝিরা তাঁকে নদীতে ফেলে দেয়।
ভাসতে ভাসতে তিনি অচেতন ভাবে উপস্থিত হলেন কালীগঙ্গার তীরে ছেঁউরিয়া গ্রামের পাশে। অচেতন ভাসমান তাঁর দেহ দেখে মলম নামে একজন তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁর একমাস সেবা করেন। একদিন মলম যখন কোরাণ পাঠ করছিলেন তখন লালন তাঁর ভুল ধরে দেন। বিস্মিত চমকিত মলম-এর জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন তাঁর কোনো লেখাপড়া নেই। মুরশিদের কাছ থেকে যেটুকু শিক্ষা তাঁর, তাতে যা কিছু বয়ান করেন। মলম শা লালনকে গুরু বলে মেনে নিলেন। বাড়ির তেঁতুলতলায় মুরশিদের সেবাসত্র বানিয়ে দিয়ে মলম এবং তাঁর পত্নী লালনের সেবাকাজে রত হলেন।
ইত্যবসরে লালনের বয়স হয়েছে তেতাল্লিশ। নানাদিক থেকে আসতে লাগল বহু বহু ভক্ত শিষ্য-সেবক। কেউ কেউ ধর্মীয় বাহাস বা তর্ক করতেও আসতেন। এমনতর যেসব শিষ্য সেবক তাঁর ছিল তাদের নাম চক্কর, ফক্কর, মানিক, মলম, কোরবান, মনিরুদ্দিন এবং আরও বহুতর গোলাম। আর স্বয়ং দুদ্দু শাহ? তিনি লালনের সঙ্গে বাহাস করতে গিয়ে বায়াত বা শিষ্য বনে গেলেন। অতঃপর ১২৯৫ বাংলা সালের পয়লা কার্তিক শুক্রবার দিনে লালনের জীবনাবসান।”
এই জীবন তথ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে কয়েকটি জায়গা যে বানানো, তা আমরা বুঝতে পারি। দুদ্দুর মতো লালনের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ পয়লা কার্তিক। সিরাজ সংসর্গ, সিরাজের মৃত্যু, সবই বানিয়ে তোলা। তেতাল্লিশ বছর বয়সে লালন ছেঁউরিয়াতে এসেছিলেন, ১১৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে লালন কী করেছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য এই তথাকথিত জীবনীর মধ্যে নেই। এমনকি এখানে লালন লিখিত সংগীতের কথাও আলোচিত হয়নি।
আহমদ শরীফ তাই লিখেছেন—”একে প্রয়োজনে পরিকল্পিত দলিল বলেই মনে করি। মতলবে দলিল বানানোর জন্য যেসব কথা আবশ্যিক বিবেচিত হয়েছে, ঠিক সেই কথাগুলিই রয়েছে। অথচ স্বতোস্ফূর্ত রচনা হলে ভক্তহৃদয়ের আবেগ উচ্ছ্বাসনয় অলৌকিক কিছু গল্প কাহিনী ঘটনা থাকত। জীবিতকালেই যাঁর পরিচিতি গোপন রইল, মৃত্যুর পরে তা জানানোর প্রয়োজনটাই বা কী ছিল? কার আগ্রহ ও প্রয়োজনে এ প্রয়াস প্রকাশ? এমনই অনেক জিজ্ঞাসা জাগে।”
লালনকে শুধু ইসলামধর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেই চলবে না তিনি যে মানবতাবাদী বাউল ছিলেন, এ সত্যটা অস্বীকার করতে হবে। বলতে হবে, তিনি ছিলেন এক ইসলাম সুফী। এই ব্যাপারেও কিছু কিছু গবেষক সুপরিকল্পিত ভাবে গবেষণা করেছেন। যেমন, তালিব লিখেছেন—”সত্যি কথা বলতে কী লালন একজন কামিল দরবেশ ছিলেন। আমার তো মনে হয় লালন শাহী গীতিধারা বাংলা সাহিত্যে ফারসি সুফী সাহিত্যের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই লালন শাহকে উনিশ শতকীয় বাংলা সাহিত্যের রুমী বলা যেতে পারে।”
আবু তালিব আরও মন্তব্য করেছে—”তথাকথিত বাউলমত ও সাধনতত্ত্ব থেকে লালন শাহ তাঁর অনুসারী সম্প্রদায়ের মত সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই মত আসলে ইসলামী সুফী সাধনারই অনুকূল।”
—ধরতে গেলে, বাংলা সাহিত্যে গজল গীতিরও আদ্যগুরু ছিলেন লালন শাহ। লালনগীতি মূলত ফারসি গজল গীতিরই নামান্তর। এদিক থেকে তিনি ফারসি কবি হাফিজ, উমর-খয়াম রুম প্রভৃতির ওয়ারিশ। উল্লেখযোগ্য যে, লালন গীতি শুধুমাত্র গান নয়, এটি সাধনতত্ত্ব— সাধকের অধ্যাত্মজীবনবোধের প্রতীক। সুফী সাধকরা যাকে ‘সিমা’ সঙ্গীত বলেছেন লালনগীতি আসলে তাই। এই গান তাদের যিকরের অন্তর্গত।”
ওই গ্রন্থে তাকলব আর একটি ভয়ংকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন—”শুধু গানের ধারাতেই নয়, ভাবে-ভাষায়-রূপে-রসে, লালন গীতি বাংলা সাহিত্যে অপূর্ব ফসলের ইশারা বয়ে এনেছে। এর এক ধারায় যেমন গজল গীতি উৎসারিত হয়েছে, অন্য ধারায় আধুনিক বাউলগীতি নামে এক অভিনব গীতিধারার জন্ম হয়েছে। প্রথম ধারার উত্তর সুরী যেমন নজরুল ইসলাম, দ্বিতীয় ধারার শ্রেষ্ঠ গীতিকার তেমন রবীন্দ্রনাথ।”
তবে সবাই যে নিছক সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট ছিলেন, সেই কথা ভাবলে সত্যের অপলাপ করা হবে। বাংলাদেশে এমন অনেক মুক্ত মনের স্বাধীন গবেষক আছেন, যাঁরা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে লালনকে বিচার করার চেষ্টা করে চলেছেন। নানাভাবে তাঁদের প্রয়াসকে প্রতিহত করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তাঁরা একেবারে হতোদ্যম হয়ে ওঠেননি।
এই প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ওয়াকিল আহমদের কথা বলব। তিনি আবু তালিবের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন ”—তিনি দাবি করেন, লালন মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মধ্যযুগের মুসলমান গীতিকাররা রাধাকৃষ্ণবিষয়ক বৈষ্ণবপদ লিখেছেন। নজরুল পীরপরিবারে জন্মগ্রহণ করে উত্তম শ্যামাসংগীত লিখেছেন। লালন শাহ হিন্দুয়ানি বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছেন, এমন এক উদেশ্যে যেখানে সমাজ-সংস্কৃতি ধর্মগতভাবে হিন্দু ও মুসলমানের মিলন কামনা করেছেন। এসব যুক্তির ভিত্তিতে আবু তালিবের দাবির যথার্থতা দেখতে হবে।”
তাই আশা জাগে, লালনকে ইসলামী ধর্মসঞ্জাত সুফী সাধক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার যে অপপ্রয়াস শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে এখনও কিছু প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সোচ্চার আছে। আগামী দিনের গবেষকরা হয়তো সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে লালনের গানের ওপর বিচার বিবেচনা করবেন। জন্মসূত্রে লালন হিন্দু বা মুসলমান ছিলেন সেবিষয় অনাবশ্যক আলোচনা থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। তখন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা লালন দর্শনের ওপর আলোকপাত করতে পারব। লালন যে সত্যি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জ্বলন্ত প্রতীক ছিলেন—একথা মেনে নেওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে। না হলে লালন আবার এক ভুল তথ্যের কারাগারে বন্দী থাকতে বাধ্য হবেন। আমরা শুধুই তাঁর ধর্ম নিয়ে আলোকপাত করব। তিনি যে কত বড়ো মাপের সাধক ছিলেন, মানবতাবাদী মহান দরদী হিসাবে পৃথিবীতে এসেছিলেন, জীবনে চলার পথে তাঁকে যে কত রক্তাক্ত অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল, তা সত্ত্বেও হতোদ্যম হননি বা ভেঙে পড়েননি—এইসব উজ্জ্বল দিকচিহ্নগুলি অনাদৃত অবহেলিত থেকে যাবে। ইতিহাস তাহলে আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।
__