লাফানে ব্যাঙ
রাজার মতো রসিকতা উপভোগ করার মানসিক শক্তি আমি অন্য কারোর মধ্যে দেখিনি। ওঁর জীবনে প্রিয়তম বস্তুই ছিল ঐ রসিকতা। ওঁর আনুকূল্য পাবার সর্বোত্তম পন্থা ছিল যে কোন মজার গল্প ওঁকে সুন্দর করে শোনানো। হয়তো এরই জন্যে ওঁর সাত সাতজন মন্ত্রীই ভঁড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁরা সবাই রাজার মত বেশ নাদুসনুদুস্ তেল চক্চকে দেহের অধিকারী আর রসিকতা প্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি জানিনে রসিকতা করতে গিয়ে মানুষ মোটাসোটা হয় না দেহের মধ্যে চর্বি বেশি হলে মানুষ রসিক হয়ে ওঠে। তবে এ আমি জানি যে রোগা পাতলা রসিক মানুষ দুর্লভ।
ওই মন্ত্রীদের রাজা রসিকপ্রবর মনে করতেন আর রসিকতার মধ্যে শালীনতার প্রশ্ন তার কাছে কোনদিনই বড় ছিল না। তাই খুব বড় রকমের রসিকতা উপভোগের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা রাজার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। এ বিষয়ে কলাসম্মত সূক্ষ্মতা প্রভৃতি তার ভালোই লাগতো না তাই ভলতেয়ারের ‘জাডিগ’ তাঁর ভালো লাগতো না, লাগত রাবোর ‘গারগাতুয়া অনেক বেশী ভালো। তা ছাড়া মৌখিক বা বাচনিক রসিকতার চাইতে তার আকর্ষণ ছিল রসিকতাপূর্ণ ঘটনার ওপর অনেক বেশী।
আমি যে সময়ের ঘটনা বর্ণনা করছি তখনো বৃত্তিধারী ভাড়ের রাজদরবারের নিয়মমাফিক কাজ করে চলছিলেন। ইয়োরোপের বহু রাজা তখনো ভাড় পুষছিলেন। সেই সব ভাড়েরা আগেই মতই ময়লা পোষাকের ওপর ঘণ্টা বাঁধছে আর কোমরবন্ধ ব্যবহার করছে পূর্বপ্রথারই অনুসরণে। রাজাদের অনুগ্রহের দান কুড়িয়ে নিতে তখনো ওরা তাদের মনোরঞ্জনের আশায় মজার মজার কাজ করবার জন্যে প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকছে।
আমাদের গল্পের নায়ক যে রাজা তিনিও প্রথানুযায়ী ভাড় রেখেছিলেন একজন। ওঁর যে সাতজন মন্ত্রী গুরুগম্ভীর উপদেশাবলী বর্ষন করতেন তাদের সেই জ্ঞানগর্ভ বিষয়গুলির ভার কমানোর জন্যই বোধহয় তিনি ভাড়টির কাছ থেকে কিছু হাল্কা কথাবার্তা আশা করতেন। মনোরঞ্জনের জন্য নিযুক্ত ঐ ব্যক্তিটি শুধু ভাড় বলেই যে রাজার প্রিয়পাত্র ছিল তা নয়, সে তার স্নেহ বেশী করে আকর্ষণ করেছিল খর্বকায় বিকৃতাঙ্গ মানুষ বলে। রাজদরবারে খর্বকায় মানুষের আধিক্যও দেখা যেত, রাজদরবারের দীর্ঘ কর্মবহুল সময় এই সব বেঁটেখাটো মানুষ আর ভাড়দের সঙ্গ ছাড়া তাদের কাটতোনা। ভাড়দের সঙ্গে এক হয়ে তারা এই বামনদের হাসিঠাট্টা করতেন। আমি আগেই বলেছি যে পরিহাসপ্রিয় মানুষেরা মোটাই হন শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রে। মনে হয় আমাদের কাহিনীর রাজা এই জন্যেই আত্মপ্রসাদ বোধ করতেন যে তার ভাড়ের একই সঙ্গে তিনটি গুণ আছে। প্রসঙ্গত বলি, এই ভাড়টিকে তিনি ‘লাফানে ব্যাঙ,” বলেই সম্বোধন করতেন।
আমি হলফ করে বলতে পারি যে ঐ ভঁড়টিকে এই ‘লাফানে ব্যাঙ’ নামটি তার জন্মের পর নামকরণের সময় দেওয়া হয়নি। আসলে এ লোকটি সাধারণ অন্য দশজন মানুষের মত স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারতো না বলে মন্ত্রীসপ্তকের পরামর্শক্রমে এই বিশেষ নামটি ভাড়টিকে দেওয়া হয়েছিল। লোকটি লাফিয়ে লাফিয়ে অদ্ভুতভাবে চলত আর ঐ ভাবে চলবার সময় যে সব শব্দ করত তাতেই কাজ হোত। রাজার ছিল প্রকাণ্ড ভুড়ি আর বিরাট একটা মাথা। তবু দরবারের সবাই রাজার অপূর্ব সুন্দর শরীরের প্রশংসা করত। রাজা তাই তাঁর দরবারে এই বিকলাঙ্গ মানুষটিকে দেখে অসীম আনন্দ অনুভব করতেন।
আমাদের লাফানে ব্যাঙের পাগুলো ছিল বিকৃত। পথে বা ঘরের মেঝেতে চলতে হলে তার তাই খুব কষ্ট হোত। বেচারার এই ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য প্রকৃতি ওর হাতগুলোকে অদ্ভুত শক্তিশালী করে গড়ে দিয়েছিল। গাছে চড়ে বা দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার কাজে ও যে দক্ষতার পরিচয় দিত তা ছিল দেখবার মত। লাফানে ব্যাঙের দেশ কোথায় জানিনে তবে এটুকু জানি যে বহু দূরের কোন অনুন্নত দেশ থেকেই সে এসেছে। রাজার কোন এক শক্তিমান ও বহু যুদ্ধজয়ী সেনাপতি কোন দূর দেশ থেকে এই মানুষটিকে আর একটি বালিকাকে জোর করে নিয়ে এসে এই রাজাকে উপহার দেন। বালিকাটি বেঁটে খাটো চেহারার হলেও কুৎসিত-দর্শন ছিল না। বরং তার হাত পা খুবই সুন্দর ছিল আর নাচিয়ে হিসেবে সে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
দুই বন্দীর মধ্যে তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই একটি অত্যন্ত হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বস্তুত সেই সম্পর্ক তারা পরস্পর স্বীকার করে নিয়েছিল। লাফানে ব্যাঙ অনেক কায়দা কসরৎ করেও কারো মনোরঞ্জন করতে পারতোনা তাই ট্রিপেট্টার কোন সাহায্যেও আসতো সে। অপরপক্ষে ট্রিপেট্টা তার ছোট শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে সকলেরই প্রীতির পাত্রী হয়ে উঠেছিল আর রাজদরবারে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। এর ফলে লাফানে ব্যাঙকে সাহায্য করার কোন সুযোগ পেলেই সে তার সদ্ব্যবহার করত।
ঠিক মনে নেই কেন, তবে কোন এক ঘটনা উপলক্ষে রাজা একবার মুখোশ পরা বলনাচের ব্যবস্থা করলেন। মুখোশ নাচ বা ঐ রকমের কোন আনন্দোৎসবের আয়োজন হলেই তার সাফল্যের জন্য অনেক খানি দায়িত্ব নিতে হোত লাফানে ব্যাঙ আর ট্রিপেট্টাকে। এসব ব্যাপারে আবার লাফানে ব্যাঙের যে উদ্ভাবনী প্রতিভা ছিল তা অস্বাভাবিক। মূকাভিনয়ের আয়োজন, নতুন নতুন চরিত্র সৃষ্টি, অপূর্ব দর্শন পোষাকের পরিকল্পনা–সবকিছুতে ও ছিল অসাধারণ। তাই লাফানে ব্যাঙ ছাড়া এই ধরনের উৎসব কল্পনাই করা যেতো না।
মুখোশনাচের রাতের জন্য ট্রিপেট্টার ব্যক্তিগত তত্ত্ববধানে অপূর্ব সজ্জায় সজ্জিত হোল একটি হলঘর। উৎসবকে সফল করতে পারে এমন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা থেকে কেউই বিরত:,রইল না। রাজসভার প্রতিটি মানুষ নতুন কিছুর আশায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। কে কোন মুখোশ পরে কোন চরিত্রে অভিনয় করবে সে কথা স্থির হয়েছিল একসপ্তাহ, কোন কোন ক্ষেত্রে একমাস আগেই। সু সিদ্ধান্তের অভাব কোথাও বিন্দুমাত্রও ছিল না, শুধু রাজা আর তার সাতজন মন্ত্রী কী করবেন সেইটি তারা স্থির করতে পারছিলেন না। এ যে কেন পারছিলেন না তারা তা বলা শক্ত তবে মনে হয় বড় বাধা এসেছিল তাদের অস্বাভাবিক আকারের মোটা শরীরের দিক থেকে। যাই হোক তাঁরা শেষ পর্যন্ত পরামর্শের জন্যে লাফানে ব্যাঙ আর ট্রিপেট্টাকে ডেকে পাঠালেন।
দুটি ছোট্ট বন্ধ যখন রাজ দরবারে হাজির হোল তখন রাজা মন্ত্রীদের নিয়ে মদ্যপানে নিরত। তবু রাজার মেজাজ যে ভাল নেই তা দেখেই বোঝা গেল। রাজা জানতেন লাফানে ব্যাঙ মদ খায় না। মদ খেলে ও এত বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ত যা তার ছোট্ট শরীরের পক্ষে নিতান্তই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত। তবু রাজা তাকে মদ খেতে আদেশ করলেন। রাজা কিন্তু এই ধরনের রসিকতাই পছন্দ করতেন তাই ব্যাঙকে বাধ্য করলেন মদ খেতে।
ব্যাঙ, অর ট্রিপেট্টা দরবারে প্রবেশ করতেই রাজা বলে উঠলেন, ব্যাঙ নাও দেখি এই এক পাত্র মদ, চট করে তোমার অনুপস্থিত বন্ধুদের স্বাস্থ্য কামনা করে গিলে ফেল আর তারপর একটু চিন্তা করে বল দেখি কী করা যায়। আমরা চাই নতুন নতুন চরিত্র, বুঝলে, শুধু চরিত্র। সেগুলো এমন হবে যা একেবারে অসাধারণ। একঘেয়ে চরিত্র দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। মদটা খেলে তবেই তোমার বুদ্ধি খুলে যাবে।
সাধারণত এই রকম পরিস্থিতিতে ব্যাঙ রাজার কথা নিয়ে রসিকতাই করে, কিন্তু আজকের পরিবেশটাই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। দিনটি ছিল ব্যাঙের জন্মদিন তাই অনুপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে মদ খেতে গিয়ে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। অত্যাচারী রাজার হাত থেকে সবিনয়ে মদের গেলাসটি ধরে নেবার পর উষ্ণ কয়েক ফোঁটা চোখের জল ওরই মধ্যে ঝরে পড়ল।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেঁটে মানুষটি যখন মদটুকু গলায় ঢেলে দিচ্ছিল তখন রাজা হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘ব্যাস, এবার দেখ, ভালো এক গেলাস মদ কী বিরাট কাজ করতে পারে। এই তোত, তোমার চোখ চক্ চক্ করতে শুরু করেছে। হতভাগ্য ব্যাঙের চোখ কিন্তু চক্ চক্ নয় বরং মৃদুই হয়ে আসছিল মদের তীব্র ক্রিয়ায়। মদের গেলাসটা টেবিলে রেখে ও এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল প্রায় উন্মাদের মতোই। রাজার রসিকতা খুব ভালো কাজ করেছে দেখে মন্ত্রীদের তখন কী আনন্দ।
সব চাইতে মেদবহুল ছিলেন প্রধান মন্ত্রী। তিনি বলে উঠলেন, ‘এবার কাজের কথা হোক।’ রাজা বললেন, ‘নিশ্চয়ই। এবার বল দেখি ব্যাঙ কী করা যায়। আমরা ভালো ভালো চরিত্র চাই, হ্যাঁ চরিত্রই। রাজা আবার হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসলো ব্যাঙও কিন্তু সে হাসির মধ্যে স্বাভাবিকতা ছিলনা, কেমন যেন অর্থহীন হাসি।
রাজা প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছেন তখন। বললেন, ‘বল, বল, তাড়াতাড়ি বল, কী ভাবতে পারছ না কিছু?
–আজ্ঞে না। আমি কিন্তু খুব নতুন কিছু ভাবতে চেষ্টা করছি । ব্যাঙ কথা বলল কিছুটা দুর্বোধ্য ভঙ্গীতে। মদের ঘোরে সে যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
–চেষ্টা করছি মানেটা কী? চেঁচিয়ে উঠলেন বদরাগী রাজা। পরক্ষণেই বললেন, ‘ও বুঝতে পেরেছি। তুমি একটা গোমড়ামুখো মানুষ। তোমার আরও মদ দরকার। এই নাও, আরো খানিকটা গিলে ফেল।’ বলেই রাজা গেলাসে বেশ খানিকটা মদ ঢেলে বিকলাঙ্গ মানুষটির দিকে এগিয়ে দিলেন। বেচারার তখন দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে শুধু বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
দৈত্যের মত হুঙ্কার ছেড়ে রাজা বলে উঠলেন ‘খাচ্ছে না যে? শীগগির খাও বলছি, না হলে তখন কিন্তু ব্যাঙ ইতস্তত করছে।
রাজা রাগে লাল হয়ে উঠেছেন তখন। মন্ত্রীরা বোকা হাসি হাসছেন আর ওদিকে ট্রিপেট্টার মুখ প্রাণহীন পাণ্ডুর হয়ে উঠেছে। সে ধীরে ধীরে রাজার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বন্ধুর জন্য মার্জনা ভিক্ষা করল।
মেয়েটির স্পর্ধায় রাজা কিছুটা বিস্মিত হলেন। কিভাবে নিজের ঘৃণা প্রকাশ করবেন, সেই চিন্তাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত কোন কথা না বলে উনি মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আর তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন গেলাসের সবটুকু মদ।
একটি দীর্ঘশ্বাসও ফেলল না মেয়েটি। একবার উঠে দাঁড়িয়ে পূর্বের মতই টেবিলের তলায় হাঁটু গেড়ে বসল সে।
সারা হলঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধে উঠল এমন ভাবে যে একটা পাতা বা পালক খসে পড়লেও তার শব্দ অনায়াসে শোনা যেত। কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভেতর থেকে একটা খরখরে কর্কশ শব্দ শোনা গেল শুধু। বেঁটে লোকটির দিকে ফিরে উত্তেজিত কণ্ঠে রাজা প্রশ্ন করলেন, “কেন, কেন ওরকম শব্দ করছ তুমি?
মদের ঝোঁক তখন অনেকখানি কমে এসেছে। ক্রুদ্ধ রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘আমি? আজ্ঞে না, আমার সে সাহস মোটেই নেই। একজন মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয় শব্দটা বাইরে থেকেই আসছে। যতদূর মনে হয় ওখানে একটা টিয়া পাখী তার খাঁচাটায় ঠোঁট ঘষছে।
ঘটনাটার একটা মনের মত ব্যাখ্যা পেয়ে রাজা খুশী হলেন। তবুও তিনি বলে উঠলেন, ‘ঠিকই, তবে কি জানেন, আমি মনে করছিলাম ঐ শয়তানটা দাঁত কড়মড় করছে।
এবার ব্যাঙ, হো হো করে হেসে উঠল আর সেই সুযোগে তার বড় বড় আর কুৎসিত দাঁতগুলো সব বেরিয়ে পড়ল। রাজা ত নিজেই ভাঁড়ের মত কাজ করছিলেন তাই অন্যের হাসিতে আপত্তি করার শক্তিও ছিল না তাঁর। তাছাড়া মদও গিলেছিলেন প্রচুর। এবার তিনি শান্ত হলেন আর আরো একগেলাস মদ অবলীলা
ক্রমে গলায় ঢেলে ফেললেন। ততক্ষণে ব্যাঙ, প্রকৃতিস্থ হয়েছে আর মুখোশনাচের মতলব তার মাথায় এসে গিয়েছে।
যেন মদ সে ছোয়নি এমনি শান্ত ভাবেই ব্যাঙ বলে উঠল, ‘ঠিক কী ভাবে ধারণাটা মাথায় এলো বলতে পারিনে কিন্তু আপনি যখন মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আর জানালার ওপাশে টিয়ে পাখী কিম্ভুতকিমাকার শব্দ করে উঠল তখনি অন্য একটা চিন্তা আমার মাথায় এসে গেল। আমরা যখন মুখোশ নাচে নাচি তখন কিন্তু এই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করি। কিন্তু সে যাই হোক এক্ষেত্রে অসুবিধে হোল এই যে এর জন্যে দরকার আটজনালোক আর–
বেঁটের উদ্ভাবনী শক্তিতে রাজা তখন ভীষণ প্রীত। উনি হেসে বললেন, ‘কেন? আমরা ত আটজনই আছি এখানে, সাতজন মন্ত্রী আর আমি। এখন বল দেখি তোমার চিন্তাটা কী?
বিকলাঙ্গটি বলে উঠল, ‘আমরা একে শৃঙ্খলাবদ্ধ আটটি ওরাঙ, ওটাঙ, বলি। ঠিকমত অভিনয় করলে এ একেবারে তুলনাহীন।
‘আমরা তাই করব, ঐটেই অভিনয় করব আমরা বেশ শান্ত ভাবে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলেন রাজা।
লাফানে ব্যাঙ, বলল, ‘এই অভিনয়টার সৌন্দর্য কোথায় জানেন, তা হোল ওটায় মেয়েদের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়, সেইখানে।
‘বাঃ, সুন্দর’-রাজা আর মন্ত্রীরা একই সঙ্গে বলে উঠলেন।
ব্যাঙ বলে চলল, ‘আপনাদের ওরাং ওটাঙ সাজানোর ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। ও আমি এমন নিখুঁত ভাবেই করে দেব যে এখানে যারা আসবে তারা আপনাদের জন্তু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না। এতে ওরা বিস্মিত হবে আর ভয়ও পাবে ভীষণ।
রাজা ভীষণ খুশী হলেন আর বললেন, ‘এ একেবারে অতুলনীয়। জানো লাফানে ব্যাঙ, আমি তোমার ভাগ্য ফিরিয়ে দোব, মানুষের মত মানুষ বানিয়ে দোব তোমাকে। আমরা যে চেনটা ব্যবহার করব তার ঝন্ ঝন শব্দ সব কিছুকে আরো দুর্বোধ্য করে তুলবে। আপনারা এমন ভাব করবেন, যেন মালিকের কাছ থেকে
একসঙ্গে সবাই পালিয়ে এসেছেন। যেখানে সুন্দর সুন্দর পোষাক পরা উঁচুদরের ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারা জমায়েত হন, সেখানে এই মুখোশ নাচটা যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আপনারা অনুমানই করতে পারবেন না। এর বৈসাদৃশ্যটি অসাধারণ।
‘এইটিই করব আমরা’–বললেন রাজা। তারপর বেলা হয়ে যাচ্ছিল বলে সবাই উঠে পড়লেন আর ব্যাঙের প্রস্তাবটিকে কার্যকরী করে তোলার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
আটজনকে ওরা, ওটাঙসাজানো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার ছিল না কিন্তু উদ্দেশ্য সাধনের দিক থেকে পরিকল্পনাটি বাস্তবিকই অপূর্ব হয়েছিল। আমি যে সময়ের কাহিনী বলছি তখন সভ্যদেশে ঐ জন্তু দেখা যেতো না। বেঁটে মানুষটি যেভাবে ওদের সাজিয়েছিল তাতে আকৃতিগত সাধ তো ঘটেছিলই কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা ওঁরা সৃজন করেছিলেন একটা ভয়াবহ ঘৃণ্য পরিবেশ।
রাজা আর মন্ত্রীদের প্রথমে খুব আঁটসাট পোষাক পরিয়ে তার ওপর আলকাতরা লাগানো হোল। এর পর কেউ কেউ বললেন তার ওপর পালক লাগালে বেশ মজার হবে। প্রস্তাবটা কিন্তু ব্যাঙ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিল ও বলল জন্তুগুলোর গায়ের লোম সম্পর্কে ধারণা দিতে গেলে এ ক্ষেত্রে শণই ব্যবহার করতে হবে। আলকাতরার ওপর পুরু করে শণ বসিয়ে দেওয়া হোল। এর পর আনা হোল মস্ত বড় একটা শেকল, ওটাকে প্রথমে রাজার কোমরে বাঁধা হোল তারপর এক এক করে বাকী সাতজন মন্ত্রীকে বাঁধা হোল ঐটেতে। আটজন শেকলে বাঁধা অবস্থায় যখন দাঁড়ালেন তখন একটা বৃত্তই সৃষ্ট হোল।
সিম্পাঞ্জী বা ঐ ধরণের বড় বড় বাঁদর ধরে বাঁধার জন্যে বোর্নিও প্রভৃতি দ্বীপের লোকেরা যে ধরনের বাঁধন ব্যবহার করে, ব্যাঙ শেকলের শেষ অংশটুকু নিয়ে ঐ ভাবে ওঁদের আটজনকে বেঁধে ফেলল। এতে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক লাগল দেখতে।
যে বিরাট হলঘরটাতে মুখোশ নাচের ব্যবস্থা হয়েছিল সেটি ছিল গোলাকার। ঘরটির দেওয়াল খুব উঁচু আর ওপরের একটি জানালা দিয়েই সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়ত। একটা বিরাট ঝাড়লণ্ঠন শেকল দিয়ে ঘরের মাঝখানে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটার ভারসাম্য ঠিক রাখবার জন্য একটা ভারি জিনিস ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু ঘরের মধ্যে ওটা থাকলে বিশ্রী দেখাবে বলেই ওটাকে গম্বুজের ওপর ছাদে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
হলঘরটাকে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ট্রিপেট্রার ওপর। কতকগুলো খুটিনাটি ব্যবহারে সে অবশ্য বেঁটের পরামর্শ নিয়েছিল। তারই পরামর্শমত এই মুখোশনাচ দিনটির জন্যে ঝাড়লণ্ঠনটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল এই যে ঘরে খুব ভিড় হবেই আর তাই বহু লোক ঘরের মাঝখানে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। ঝড় লণ্ঠন থেকে গরমের দিনে মোম গলে পড়ে ওঁদের দামী পোশাক সব মাটি করে দেবে। তার বদলে হলের মধ্যে কিছু দেওয়ালগিরি বসানো হয়েছিল আর ঘরের দেওয়ালে গোটা পঞ্চাশ ষাট যে মূর্তি ছিল তাদের ডান হাতে সুগন্ধি জ্বলন্ত মশাল রেখে দেওয়া হয়েছিল।
লাফানে ব্যাঙের পরামর্শমতই দুপুর রাত পর্যন্ত ঐ আটজন ওরাঙ, ওটাঙ, বাইরে অপেক্ষা করছিল। ও চেয়েছিল এই যে ঘরটা মুখোশনাচের লোকে ভরে উঠুক তার পর ওরা ঢুকবে। রাত বারোটা বাজার ধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়ল–বরং বলা উচিত শেকলে বাঁধা ছিল বলে ওরা আটজন গড়িয়ে এসে পড়ল হলের ভেতর।
মুখোশনাচের আসরে যারা এসেছিল তাদের উত্তেজনা আর রাজার আনন্দ সবই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অপর্যাপ্ত। ওখানে এমন লোক প্রায় ছিলই না বলা যায় যারা ওই আটজনকে ওরঙ, ওটাঙ, বা ঐ ধরনের কোন জন্তু ভাবেনি। অবশ্য এই রকম আশাই করা গিয়ে ছিল। মেয়েদের অধিকাংশই জ্ঞান হারালেন। রাজা আগেই আসরে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আসা বারণ করে দিয়েছিলেন। তা না করলে ওঁদের এই মজা দেখানোর বদলে হয়ত অনেক রক্তই ঝরে পড়ত সেদিন।
সবাই এবার দৌড় দিতে শুরু করল দরজার দিকে। ওদিকেও পথ ছিল বন্ধ, রাজা আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন ওঁরা ঢুকে পড়ার পরই যেন দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা লাফানে ব্যাঙের কাছে জমা দিয়ে দেওয়া হয়।
সবাই যখন আত্মরক্ষার জন্যে ব্যস্ত তখন বোধ হয় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলোবার শেকলটার দিকে নজর পড়ল অনেকের। ওটা ওপর থেকে তলায় নেমে এসেছিল আর ওর আংটাটি মেঝে থেকে ফুট তিনেক ওপরে ঝুলছিল।
রাজা আর তার সাত সঙ্গী হলঘরের চারদিকে পাক খেয়ে এসে পৌঁছনো মাত্রই সেই ঝাড়লণ্ঠনের শেকলটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। লাফানে ব্যাঙ, ওঁদের অলক্ষে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। যেই রাজা আর মন্ত্রীদের শেকল ঝাড়লণ্ঠনের শেকলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল অমনি ব্যাঙ, এমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লণ্ঠনের শেকল ধরে টান লাগালো যাতে ওটা আরও খানিক উপরে উঠে গেল আর আটজন একসঙ্গে জড় হয়ে গিয়ে পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে পড়লেন।
ততক্ষণে মুখোশধারীরা কিছু পরিমাণে ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে আর পুরো ঘটনাটার মজা উপভোগ করতে আরম্ভ করেছে। ওরা তখন বাঁদরগুলোর বিবাদ দেখে হো হো করে হাসতেও শুরু করেছে। ওদের হাসির ভেতর থেকেই হঠাৎ ব্যাঙের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন দেখি। আমি বোধ হয় ওঁদের সবাইকে চিনিয়ে দিতে পারব। তবে কিনা ওঁদের একটু ভাল করে দেখতে হবে আমাকে।
ভিড় পেরিয়ে ব্যাঙ, গিয়ে পৌঁছল দেয়ালের কাছে। একটা মূর্তির হাত থেকে জ্বলন্ত মশাল তুলে নিয়ে ও এসে গেল হলঘরের মাঝখানে। তারপর বাঁদরের মত অবলীলাক্রমে লাফিয়ে রাজার মাথায় পৌঁছে সেখান থেকে ঝাড়লণ্ঠনের শেকলটা ধরে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল সে। সেখান থেকে জ্বলন্ত মশালটা ওরাঙ, ওটাঙ, দলের ওপর ঝুলিয়ে ব্যাঙ, চেঁচিয়ে বললে, “দাঁড়ান, এবার ঠিক বলতে পারব কোনটি কে।
ব্যাঙের এই রসিকতায় ওরাঙ ওটাঙরা আর অন্যেরা তখন হেসেই অস্থির। এমন সময় ব্যাঙ, তীক্ষ্ণ একটা শিস দিয়ে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠনের শেকলটা প্রায় ফুট ত্রিশ ওপরে উঠে গেল। শেকলটা এতটা উঠে যাবার পরও ব্যাঙ, আর আটটি ওরাং ওটাঙের মধ্যে দূরত্ব একই রইল আর তখনো ওদের চিনিয়ে দেবার জন্যে সে সমানে জ্বলন্ত মশাল রাজা আর তার সাত জন সঙ্গীর ওপর দুলিয়ে চলেছে।
উত্তেজিত ভাড়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, ঠিক, আমি ঠিক মতোই চিনতে পেরেছি এঁদের। এঁরা কারা এখন আর চিনতে বাকী নেই আমার। চেনবার চেষ্টা করছে এ রকম ভান করে সে তখন মশাল দুলিয়ে চলেছে। পর মুহূর্তে রাজাকে খুটিয়ে দেখার উদ্দেশ্যেই যেন, মশালটি তার ওপর নামিয়ে আনল ব্যাঙ। সঙ্গে সঙ্গে আলকাতরা মাখা শনের জামায় আগুন লেগে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আটটি ওরাঙ, ওটাঙ, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আর দর্শকেরা আর্তনাদ করে উঠল ভীষণ ভাবে। তলা থেকে কোন সাহায্যই ওদের কাছে পৌঁছে দেবার উপায় ছিল না।
আগুন আরো যখন বেড়ে উঠল তখন ব্যাঙ, শেকল বেয়ে আরও খানিক ওপরে উঠে গেল। সে তখন সকলের নাগালে বাইরে। যখন ব্যাঙ, ওই ভাবে শেকল বেয়ে উঠে যাচ্ছিল তখন হলঘরের মধ্যে সবাই নীরবে ঘটনাটা লক্ষ্য করছিলেন। এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে সে আবার বলে উঠল, এখন আমি নির্ভুল ভাবেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি কী ধরনের মানুষ ওঁরা। এঁরা হলেন মহামান্য রাজা আর তার সাতজন মাননীয় মন্ত্রী-যে রাজা আত্মরক্ষায় অসমর্থ একটি মেয়েকে নির্মম ভাবে আঘাত করেন আর যে মন্ত্রীরা সেই জঘন্য কাজে রাজাকে আনন্দের সঙ্গে সাহায্য করেন। আমি? আমি হলাম লাফানে ব্যাঙ, একটা ভাড় মাত্র, আর এইটিই আমার শেষ ভাড়ামী।’
আলকাতরা আর শনের অসম্ভব পরিমানে দহনশীলতার জন্যেই ব্যাতৈর ছোট্ট বক্তৃতা শেষ হতে না-হতেই আটটি বীভৎস দগ্ধ মৃতদেহ একটি বিরাট কৃষ্ণকায় পিণ্ডের মত দুলতে লাগল। ওটা থেকে কাউকেই তখন আর চেনবার উপায় ছিল না। বিকলাঙ্গ মানুষটি ওই শবপুঞ্জের ওপর জ্বলন্ত মশালটি ছুঁড়ে ফেলে ধীর স্থির গতিতে শেকল বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই অনুমান করেন যে এই জ্বলন্ত প্রতিহিংসার জন্য সহায়তা করেছিল ট্রিপেট্টা আর এই জন্যেই সে হলঘরের ছাদে কোথাও লুকিয়ে ছিল নিশ্চয়ই। এই ঘটনার পর ওদের কাউকেই আর ও অঞ্চলে দেখা যায়নি। মনে হয় ওরা দুজন ওদের দেশেই পালিয়ে গিয়েছিল।