ঘূর্ণাবর্তের অতলে
সব চাইতে উঁচু পাহাড়ের চূড়োয় আমরা তখন পৌঁছে গেছি। বৃদ্ধ বড্ড বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মিনিট তিনি কোন কথাই বলতে পারছিলেন না।
‘খুব বেশী দিন আগের কথা নয়’, বৃদ্ধ বলে উঠলেন, তোমাকে, এমন কি আমার কনিষ্ঠ পুত্রটিকেও আমি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আসতে অনায়াসে সাহায্য করতে পারতাম। বছর তিনেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মানুষের জীবনে অতবড় দুর্ঘটনা কখনও ঘটে না, ঘটে থাকলে তার বর্ণনা দেবার জন্যে সে বেঁচে থাকেনা। ঘণ্টা ছয় ধরে যে ভয়ঙ্কর পরিবেশের সঙ্গে আমাকে লড়াই করতে হয়েছিল তাতেই আমার দেহমন পুরো ভেঙে পড়েছে। আমাকে যতটা বৃদ্ধ মনে হচ্ছে আসলে আমি ততটা বৃদ্ধ নই। পুরো চব্বিশ ঘণ্টাও লাগেনি তারও আগে আমার ঘন কালো চুল সাদা হয়ে গেল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়ে গেল শিথিল আর স্নায়ুর দৌর্বল্য আমাকে– পুরো পেড়ে ফেলল। আজ আমি অল্প পরিশ্রমে ভেঙে পড়ি, ছায়া দেখলেও শঙ্কিত হই। এখান থেকে তলার দিকে তাকালে আজ আমার মাথা ঘুরে যায়, এ তুমি বিশ্বাস করতে পার?
পাহাড়ের যে ছোট্ট চুড়োটার ওপর তিনি অত্যন্ত অসাবধানে নিজের ভারি শরীরটাকে বিশ্রামের জন্য টেনে এনে ফেলেছিলেন, সেটার ওপর তার শরীরখানা আলতোভাবে ঝুলে ছিল। কনুই দিয়ে পিছল চুড়ো থেকে পতনের সম্ভাবনাটাকে তিনি কোনরকমে রোধ করছিলেন। যেটাকে আমি ছোট চূড়ো বলছি সেটা ছিল একটা কালো চকচকে গিরিচূড়া। উচ্চতায় পনেরো থেকে ষোল শ’ ফুট। এই চুড়োটা অনেকগুলো চূড়োর রাজ্যে বেশ খানিকটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে গজ ছয়েক দূরে সমতল অংশটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গী যে বিপজ্জনক অবস্থায় বসেছিলেন সেইটের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই উত্তেজনার ফলে আকস্মিকভাবেই আমি পিছলে পড়লাম, আর বহু কষ্টে পাশের ঝোঁপঝাড়গুলোকে আঁকড়ে ধরে একেবারে নীচে গড়িয়ে পড়ার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলাম। উঁচুতে আকাশের দিকে তাকানোর মত সাহস তখন আর আমার ছিলনা। মনে হচ্ছিল বাতাসের প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ের ভিতটাই কেঁপে উঠছে যেন। একটু পরে দুর্বলতা কাটিয়ে আর সাহস সঞ্চয় করে আমি উঠে বসলাম আর দূরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।
আমার পথপ্রদর্শক বললেন, ‘তোমার ওই অলস কল্পনাগুলোকে জয় করা উচিত। ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল সেই জায়গাটা যাতে তুমি পুরোপুরি দেখতে পাও সেজন্যেই তোমাকে আমি এখানে এনেছি। তুমি জায়গাটি দেখবে আর সেই সঙ্গে তোমাকে আমি কাহিনীটি শোনাব।’
যে বিশিষ্ট ভঙ্গীতে কথা বলার জন্য তিনি অন্যান্যদের থেকে পৃথক, সেই বিশেষ ভঙ্গীতেই তিনি বলে উঠলেন, নরওয়ের যে এলাকা অক্ষাংশ থেকে আটষট্টি ডিগ্রী দূরে, বিখ্যাত সেই নডল্যাণ্ড এলাকার নির্জন নিরানন্দ অঞ্চল লফোডেনে এসেছি আমরা। মেঘাচ্ছন্ন যে পর্বতচূড়ায় আমরা বসে আছি সেটার নাম হেসেগুগেন। যদি নীচের দিকে তাকাতে তোমার ভয় করে বা মাথা ঘোরে তাহলে ঘাসগুলো ধরে তুমি একটু মাথা তুলে দেখ, তোমার সামনেই কুয়াশা ঘেরা সমুদ্র।
আমার মাথা ঝিম ঝিম করছিল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সমুদ্রের বিশাল বিস্তার। ঘন কালির মত এই দৃশ্য দেখে মুবিয়ানের ভূগোলে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমুদ্রের বর্ণনা আছে সেইটে হঠাৎ আমার মনে পড়ল। এর চাইতে নিরানন্দকর আর শোচনীয় ভাবে নির্জন দৃশ্য মানুষ কোনদিনই কল্পনা করতে পারবে না। ডাইনে বাঁয়ে যেদিকেই চোখ ফেরাই সেদিকেই দেখি অসীম বিস্তৃত সমুদ্র। পৃথিবীর চারদিকে প্রাচীরের মত কালো ভয়ঙ্কর বড় বড় পাহাড় দাঁড়িয়েছিল আর তারই পটভূমিতে বিষাদময় চিত্র এঁকে চলেছিল সমুদ্রতরঙ্গের ওপরে জেগে থাকা সাদা রঙের ফেনা। তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সমুদ্রের অবিরাম তীক্ষ্ণ উন্মাদ আর্তনাদ। আমাদের পর্বতচূড়াটা থেকে পাঁচ ছ’ মাইল দূরে সমুদ্রের বুকে ঘোট কালো ফোঁটার মত একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল। ওটার চারদিকে তরঙ্গের প্রচণ্ড বিক্ষোভই ওটাকে ভালো করে চিনিয়ে দিচ্ছিল। সমুদ্রের তীর থেকে মাইল দুয়েকের মধ্যেও একটা আরও ছোট আর অজস্র পাহাড়ে পরিপূর্ণ নিষ্প্রাণ দ্বীপ ছিল। ওটার বুকের ওপর একটুখানি অন্তর বেশ কয়েকটা করে কালো রঙের পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল।
দূরের দ্বীপ আর তীরভূমির মধ্যেকার সমুদ্রকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বলে মনে হচ্ছিল। আমরা যখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তার কিছুক্ষণ আগে থেকে তীরের দিকে প্রবল ঝড় বয়ে আসছিল। দূরে দেখা যাচ্ছিল দু’পালওয়ালা একটা জাহাজকে। উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ওটার অধিকাংশ দেহটাই চোখের আড়ালে চলে চাচ্ছিল মধ্যে মধ্যে। সমুদ্রে যে প্রচণ্ড জোয়ার এসেছিল তা নয়, তবু তার ঘোট ঘোট ঢেউগুলো বাতাসের আঘাতে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল আর যেখানে যা পাচ্ছিল তারই ওপর আছড়ে পড়ছিল। পাশের পাহাড়গুলোর ওপর ছাড়া ফেনা কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না।
বৃদ্ধ তাঁর বক্তব্য আবার শুরু করলেন, “দূরের দ্বীপটাকে নরওয়ের লোকেরা ভার্গ বলে। মাঝখানেরটাকে বলে মস্কো। উত্তর দিকে মাইল খানেক দূরে আছে আম্বারেণ। আরো দূরে ওদিকে আছে ইফেসেন, হোইহোমু, কিয়েল্ডহোম, সোয়ারভেন আর বাহোম। আরও বেশ দূরে মস্কো আর ভাগের মধ্যে আছে অটার হোম, ফ্লিমেন, স্যাণ্ড ফ্লেসেন আর স্কারহোম। এ সবই ওই দ্বীপগুলোরই নাম কিন্তু ওগুলোর নামকরণের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল তা তুমি বা আমি কেউই বুঝতে পারবোনা। কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছ তুমি? সমুদ্রের কোন পরিবর্তন কি চোখে পড়ছে?
মিনিট দশেক হল আমরা হেলসেগগগনের চূড়ায় এসে বসেছি। আসবার সময় আমরা লোফোডেনের ভেতরদিক দিয়ে উঠে এসেছি বলে সমুদ্র আমাদের মোটেই চোখে পড়েনি। এখন পাহাড়ের চুড়া থেকে পুরো সমুদ্রটা আমাদের চোখে পড়ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলার পর একটা ক্রমবর্ধমান তীব্র শব্দ সম্পর্কে আমি ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠতে লাগলাম। আমেরিকার কোন এক তৃণাচ্ছন্ন প্রান্তরের মধ্যে একপাল মহিষের চীৎকারের সঙ্গেই শুধু তার তুলনা চলে। নাবিকেরা সমুদ্রের যে চরিত্রকে ধ্বংসশীল বলে বর্ণনা করে সেই চরিত্র আমি পালটে যেতে দেখলাম। মনে হল ঢেউয়ের উত্তাল থেমে গিয়ে দ্রুতগতিতে একটা বিরাট শ্রোতোধারা পূর্বমুখী হয়ে ছুটে চলেছে। দেখতে দেখতে তার গতি অকল্পনীয় প্রচণ্ডতা লাভ করে প্রতিমুহূর্তে ভীষণ থেকে ভীষণতর হয়ে উঠতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভাগ পর্যন্ত পুরো সমুদ্রটা অশান্ত উন্মত্ততায় বীভৎস হয়ে উঠল। অবশ্য এই বীভৎসরূপের চরম প্রকাশ ঘটল মস্কো আর তীরভূমির মধ্যে। এদের ভেতরকার সমুদ্র হঠাৎ প্রবল স্রোতে ছুটে চলল পূর্বমুখী হয়ে আর তার সেই উন্মত্ত দ্রুতগামিতার সঙ্গে গর্জন আর উচ্ছ্বাস মিশে গিয়ে যে ভীষণরূপ ধারণ করল, সাধারণত ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া অন্য কোথাও ওরকমের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায় না।
পরের কয়েক মিনিটের মধ্যে দৃশ্যটার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেল। জলের ওপর যে আলোড়ন দেখা যাচ্ছিল তা অনেকখানি থেমে গেল আর তার পরিবর্তে মাঝে মাঝে অনেকখানি করে ফেনা জমে উঠল। পরমুহূর্তে সেই ফেনপুঞ্জগুলি অনেকদূর ছড়িয়ে পড়ে একটি ঘূর্ণাবর্তের আকর্ষণে আবর্তিত হতে থাকল আর সৃষ্টি করল একটি বিশালতর ঘূর্ণাবর্তের। একটু পরেই হঠাৎ স্পষ্টতর হয়ে উঠল প্রায় আধ মাইলের বেশী: ব্যাসের একটা বিরাট আবর্ত। এই ঘূর্ণাবর্তের মাঝখানটা গড়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর একটা ফানেলের মত আর এর প্রান্ত ভাগ বেশ চওড়া হয়ে জল ছড়াতে ছড়াতে ছুটে চলেছিল তীব্র বেগে। ভেতরের দিকে যতদূর দৃষ্টি চলে তাতে দেখা যাচ্ছিল কালো মসৃণ চকচকে জলরাশি, আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণ করে দিচক্রবালের দিকে বেঁকে উঠে গেছে আর প্রবল বেগে আবর্তিত হয়ে চলেছে। সেই আবর্তনের বিপুল আবেগে কিছুটা আর্তনাদের আর কিছুটা গর্জনের মত এমন একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে আকাশে উখিত হচ্ছিল যার কাছে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের ধ্বনিও ম্লান হয়ে যায়।
পাহাড়টার ভিত্তিমূল কেঁপে উঠছিল আর দোল খাচ্ছিল তার উপরকার পাথরগুলো। প্রচণ্ড স্নায়বিক আলোড়নে আমি পাহাড়ের চূড়ায় শুয়ে পড়লাম আর কাছেই ছোটখাটো যে দু’ একটা বোপ ছিল সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে ভয়ের হাত থেকে মুক্ত করতে চাইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটু সামলে নিয়ে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে আমি বলে উঠলাম, ‘এ সেই উপকূলবর্তী বিখ্যাত জলাবর্ত ছাড়া আর কিছু নয়।
–হ্যাঁ একে তাই বলে বটে। মস্কো দ্বীপ আর উপকুলের মাঝ খানে এর উৎপত্তি বলে আমরা নরওয়ের অধিবাসীরা একে মস্কো আবর্ত বলি।
আগে এই ঘূর্ণাবর্ত সম্পর্কে কিছু জানলেও আজকের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। জোনাস রেমাসের বর্ণনা যতই নিখুঁত হোক না কেন আজকের এই দৃশ্যের বিরাটত্ব বা ভয়াবহতার ক্ষীণতম ধারণাও তা আমাদের দিতে পারেনা। এঈ দৃশ্যের অভিনবত্ব আর হিংস্রতা মানুষকে সম্পূর্ণরূপেই বিভ্রান্ত করে ফেলে। আমি জানিনে লেখক কোথা থেকে আর কোন সময় এই ঘূর্ণাবর্তের দৃশ্য দেখেছিলেন। তবে এ কথা নিশ্চয়ই যে ঝড়ের সময় হেলসেগগেনের চুড়ো থেকে তাকে তিনি দেখেননি। তার বর্ণনা থেকে কয়েকটা অনুচ্ছেদ উদ্ধত করে এর খুঁটিনাটি দিকগুলো বোঝনোর চেষ্টা করা যায় ঠিকই, তবু এই দৃশ্যের প্রকৃত স্বরূপটিকে পাঠকের উপলব্ধির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না।
তিনি বলেছেন, ‘লোফোডেন আর মস্কোর মধ্যবর্তী অংশে সমুদ্রের গভীরতা দু’শ থেকে আড়াইশ’ ফুটের মত। ভার্গের দিকে গভীরতা ক্রমশ কমে এসেছে। সে দিকটায় জাহাজ যাতায়াতের পক্ষেও যথেষ্ট গভীরতা নেই। খুব শান্ত আবহাওয়ার মধ্যেও ওদিকটায় পাহাড়ে ধাক্কা খাবার ভয় থাকে জাহাজগুলোর। বন্যার সময় লোফোডেন আর মস্কোর মধ্যে জল বেড়ে দ্বীপগুলোর অনেক খানি অংশ ডুবিয়ে ফেলে। কিন্তু ভাটার সময় যে প্রচণ্ড গর্জনে জল ছুটে যায় তার সঙ্গে জলপ্রপাতের প্রবল গর্জনেরও তুলনা হয় না। সে গর্জন শোনা যায় বহু দূর থেকেই। এই সময় যে ভয়ানক ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে কোন জাহাজও যদি গিয়ে পড়ে, সেটা অবলীলায় জলের তলায় তলিয়ে যায়। ঘূর্ণির আবর্তে পড়ে সেটি ডুবন্ত পাহাড়ের ওপর আছাড় খায়, আর চুরমার হয়ে যায়। ঘূর্ণির এই উদ্দামতা যখন শান্ত হয়ে আসে তখন জাহাজের এই ভাঙা টুকরোগুলো ভেসে ওঠে। কিছু কিছু এসে তটভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের সমুদ্রের শান্ত অবস্থাটি শুধু জোয়ার আর ভাটার মাঝখানে মাত্র দেখতে পাওয়া যায়। সেটি তাই স্থায়ী হয় প্রায় মিনিট পনেরোর মত। তার পরেই তার তীব্রতা ফিরে আসতে শুরু করে। এর পর যখন তার মত্ততা প্রবল হয়ে ওঠে তখন যদি ঝড়ে হাওয়া বইতে থাকে তা হলে ওর কয়েক মাইল দূরত্বের মধ্যেও তখন আসা নিরাপদ নয়। এর থেকে নিরাপদ দূরত্বে না-থাকার দরুণ বহু নৌকো, বোট, জাহাজ এর কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় বড় তিমিগুলোও এর আওতার মধ্যে এসে কাবু হয়ে পড়েছে। তখন তাদের বেঁচে থাকবার জন্যে যে কি প্রাণান্তকর ব্যর্থ চেষ্টা। একবার লোফোডেন থেকে একটা ভালুক সঁতরে আসছিল মস্কো দ্বীপটার দিকে। বেচারা গিয়ে পড়ে ঘূর্ণির মধ্যে আর তলিয়ে যায়। তখন তার আর্ত চীৎকার উপকূল অঞ্চলে স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল। পাইন আর ফার গাছ প্রচুর সংখ্যায় এই ঘূর্ণির মধ্যে গিয়ে পড়ে। স্রোতের ভয়ঙ্কর আবর্তে সেগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যখন ভেসে ওঠে তখন জলের ওপরটা ওদের টুকরোতে ভর্তি হয়ে থাকে। এ থেকে অনুমান করে নেওয়া সহজ যে এই অঞ্চলে জলের তলায় অজস্র পাহাড় আছে। আবর্তের মধ্যে যা কিছু পড়ে ডুবে যায়, সেগুলো গিয়ে এদিকে ওদিকে ওদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়। এই অঞ্চলে প্রতি ছ’ ঘণ্টা অন্তর জোয়ার ভাটা। ১৬৪৫ খ্রীষ্টাব্দের এক উৎসবের দিনে রোববারে এই ঘূর্ণির প্রচণ্ডতা আর গর্জন এমন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল যে উপকুলের কয়েকটা বাড়ীঘরের দেয়ালই ভেঙে পড়েছিল।
ঘূর্ণির খুব কাছাকাছি এলাকার গভীরতা কী ভাবে স্থিরীকৃত হয়েছিল জানিনে। দু’শ থেকে আড়াই’শ ফুট’ বলে গভীরতার যে পরিমাণ উল্লিখিত হয়েছে, তা লোফোডেন বা মস্কোর তীরভূমি বরাবর যে প্রণালীগুলো রয়েছে তারই গভীরতা হয়তো বা। মস্কো ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্র অঞ্চলের গভীরতা যে পরিমাপের বাইরে তাতে সন্দেহ কি! হেলসেগগেনের উচ্চতর চূড়ো থেকে ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে দেখেই যা বোঝা যায় তার চাইতে বেশী নির্ভরযোগ্য প্রমাণের প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে ওঠে না। প্রকৃতপক্ষে এই চূড়া থেকে ঐ ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্তের দিকে তাকিয়ে জোনাস রেয়াসের সহজ সবল বর্ণনা আর তিমি ভালুকের কাহিনী অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকরই মনে হয়েছে। এ কথা প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা যে সমুদ্রগামী বৃহত্তর জাহাজও যদি এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গিয়ে পড়ে, মুহূর্তের মধ্যে তা ঝড়ের মুখে পালকের মতে তলিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
এই বর্ণনা যখন অতীতে আমি পড়েছিলাম তখন অনেকখানি বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছিল, আজ চোখের সামনে এ দৃশ্য দেখে ঐ বর্ণনাকে নিতান্তই ভিন্ন আর অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল। এই বিশাল আবর্তটি আর ফেরো দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে যে আরো তিনটি ছোট ঘোট আবর্ত আছে সেগুলো সম্পর্কে সাধারণ অভিমত এই যে জোয়ার ভাটার সময় জলমগ্ন শৈলশ্রেণীর সঙ্গে উত্তাল তরঙ্গের যে সংঘর্ষ ঘটে তারই ফলে স্বাভাবিক ভাবে জলপ্রবাহের উচ্চাবচ অবস্থাটি এই ঘূর্ণি সৃষ্টি করে। অস্বাভাবিক পরিমাণে বিশালকায় চোষণ ছাড়া এই ঘূর্ণির অন্য কোন পরীক্ষিত কারণ নেই। কথা গুলো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার। কিরচার এবং অন্যান্যেরা মনে করেন যে এই ঘূর্ণাবর্তের অতল গহ্বর পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত আর এই প্রসঙ্গে বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত বোথনিয়া উপসাগরের সঙ্গে এর সম্পর্কের কথা এক জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিতও হয়েছে। এই সব মন্তব্য কতখানি সমর্থনযোগ্য সে সন্দেহ আমার চিরদিনই ছিল, তবু আজ পর্বতচূড়ার উচ্চতম স্থান থেকে ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ঐ ধারণা একান্ত সত্য। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জানালাম আমার তদানীন্তন মনের কথা। উনি সব শুনে যা বললেন তাতে আমি রীতিমতো বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। উনি বললেন, এই অভিমত নরওয়েবাসীরা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিলেও, উনি স্বয়ং এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। ঘূর্ণির কারণ সম্বন্ধে যে ধারণা উল্লিখিত হয়েছে সে সম্পর্কেও তিনি যে আস্থাহীন তাও অকপটেই প্রকাশ করলেন।
‘এখন তুমি ঘর্নিটা আরও ভালোভাবেই দেখতে পাবে’, বললেন বৃদ্ধ। আর যদি চূড়োটার ওদিকে ঘুরে গিয়ে এই প্রচণ্ড শব্দটাকে কিছু পরিমাণে আড়াল করতে পার তা হলে আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পটা শুনলে তবে গিয়ে তুমি বিশ্বাস করবে যে এই ঘূর্ণাবর্ত সম্পর্কে আমার সত্যিকারের কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
বাতাস যে দিক থেকে বইছিল আমরা সেই দিকে ঘুরে গেলাম আর উনি তার কাহিনী শুরু করলেন।
‘আমার আর আমার দু’ভায়ের একটা প্রায় সত্তর টন ওজনের মাল বওয়ার উপযোগী দু’পাল-ওয়ালা বড় নৌকো ছিল। ওটা নিয়ে আমরা মস্কো পেরিয়ে ভাগের কাছাকাছি এলাকায় মাছ ধরতে যেতাম। একটু সাহস নিয়ে ওদিকের উত্তাল সমুদ্রে যেতে পারলে মাছ পাওয়া যেত প্রচুর। লোফোডেন উপকূলভাগের যারা বাসিন্দা তাদের মধ্যে আমরাই শুধু প্রায় নিয়মিত ভাবেই ও এলাকায় যেতাম। মাছ পাওয়ার অঞ্চলটা ছিল বেশ খানিকটা দক্ষিণদিকে। খুব একটা বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে ওখানে সারাদিন মাছ ধরা যেত। আমরা তাই ওই এলাকাটাকেই বেশী পছন্দ করতাম। ওখানকার পাহাড়গুলোর মধ্যে আমাদের একটা বেশ পছন্দসই জায়গা ছিল। মাছ ওখানে ধরা পড়ত প্রচুর। ওখানে একদিনে আমরা খুব ভালো জাতের মাছ যে পরিমাণে পেতাম, অন্য জায়গায় এক সপ্তাহেও তা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। পরিশ্রমের কথা ছেড়ে দিয়েও বলা যায় যে মরণ-বাচনের প্রশ্ন থাকলেও ওখানে মাছ ধরতে যাওয়াটা আমাদের প্রায় নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের সাহসিকতার জন্য পুরস্কারও পেতাম প্রচুর।
‘শান্ত আবহাওয়ার সময় ওখানকার উপকূল থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে ছোট্ট খাড়ির ভেতর নৌকোটাকে নিয়ে গিয়ে জোয়ার আর ভাটার মধ্যে যে মিনিট পনেরো সময় সমুদ্র শান্ত থাকে তারই মধ্যে মস্কো ঘূর্ণির কাছ বরাবর গিয়ে পড়তাম, আর অটার হোম বা স্যাণ্ডফ্লেসেনের কাছে নোঙর নামিয়ে দিতাম। ওখানকার ঘজিল অন্য জায়গার মতো বেশী ভয়ঙ্কর মনে হতো না। ঘূর্ণি থেমে যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতাম, তারপর রওনা হতাম বাড়ীর দিকে। আমরা প্রত্যেকবারেই বাতাসের সুযোগ নিতাম। আর এই বাতাসের সুযোগ প্রতিবারই এমন সুন্দর ভাবে গ্রহণ করতাম যে যাওয়া আসার পথে কোনদিনই কোন অসুবিধে আমাদের হয়নি। গত ছ’ বছরের মধ্যে বাতাসহীন থমথমে আবহাওয়ার দরুণ আমাদের দু’রাত ও এলাকায় কাটাতে হয়েছিল। আর একবার এমন অদ্ভুত ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম যে প্রায় অনাহারে সপ্তাহখানেক আমাদের বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল ওই এলাকায়। ঝড় আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঘর্ণির দিকে আর তার পরিবর্তনশীল স্রোতের মধ্যে পড়ে একদিন দু’দিন করে এখানে ওখানে আমরা নিরুপায় অবস্থায় ভেসে চলেছিলাম। নোঙর ফেলেও তা থেকে আমরা রক্ষা পাইনি। শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে ঐ স্রোতেরই বেগ ফ্লিমেনের একটা খাঁড়ির মধ্যে আমাদের নিয়ে ফেলে আর আমরা সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে যাই।
‘ওখানে সে সময় আমরা ঠিক কতখানি বিপন্ন হয়েছিলাম, তার বিশভাগের একভাগও আমি বর্ণনা করতে পারলাম না। ভাল আবহাওয়াতেও ও জায়গাটা খুব নিরাপদ ছিল না। আমরা কিন্তু ঐ মস্কো-ঘূর্ণির কাছাকাছি প্রায়ই যেতাম আর কোন দুর্ঘটনার মুখো মুখী না হয়েই প্রত্যেকবার ফিরে আসতাম। দু’একবার অবশ্য ঠিক সময়ের এক মিনিট আগে বা পরে ঘুর্ণির কাছে গিয়ে পড়ার দরুণ আমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। বাতাস ঠিক যত জোরে বইবে বলে হিসেব করে বেরিয়েছি, শেষ পর্যন্ত তার সে গতিবেগ কমে গেছে, আর আমরা পৌঁছতে দেরী করে ফেলেছি। ইতিমধ্যে স্রোত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে আর আমাদের নৌকোটা তার মধ্যে পড়ে বিপন্ন হয়েছে। আমার বড় ভায়ের ছিল এক ছেলে। তার বয়স হয়েছিল আঠারো বছর। আমার ছিল দুটি খুব স্বাস্থ্যবান ছেলে। এরা নৌকো আটকাতে আর মাছ ধরতে অনেক সাহায্য করত আমাদের। যাই বলিনা কেন সমুদ্রে কিছু বিপদের ঝুঁকি তত ছিলই, তাই ছেলেদের নিয়ে যেতে আমাদের মন চাইত না। বিপদ বিপদই আর তা মিথ্যে নয় মোটেই।
‘যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি তোমাকে, সেটি ঘটেছিল বছর তিনেক আগে। ১৮সালের দশই জুলাইয়ের ঘটনা। সে দিনের কথা পৃথিবীর এই অংশের মানুষ কোনো দিনই ভুলবে না, ভোলা সম্ভবও নয়। এতবড় ভয়ঙ্কর ঝড় এর আগে কোন দিনই ঊলোক থেকে এই অঞ্চলের ওপর নেমে আসেনি। তবু কিন্তু সকালের দিকটা, এমন কি বলা যায় সন্ধ্যে পর্যন্ত আবহাওয়া প্রায় শান্তই ছিল, আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সুন্দর বাতাস একটানা বয়ে চলেছিল।
আকাশে সূর্য রোজকার মততই উজ্জ্বল ছিল আর আমাদের মত অভিজ্ঞ সমুদ্রযাত্রীরাও কল্পনা করতে পারেনি যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে চলেছে।
‘বিকেল দু’টো নাগাদ আমার দু’ভাই আর আমি, আমরা তিনজন ওদিকের দ্বীপটার কাছাকাছি গিয়ে পৌচেছিলাম, পথে আমরা ভালো জাতের এত মাছ পেয়েছিলাম যে ওরকম মাছ আগে কোনদিন ধরেছি বলে মনেই পড়ে না। ভাটা শুরু হলে আটটা নাগাদ সন্ধ্যের দিকে ঘুর্ণি আরম্ভ হয়, তাই আমার ঘড়িতে যখন সাতটা তখন আমরা বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছিলাম। পালে চমৎকার হাওয়া পেয়েছিলাম তাই নৌকোও চলেছিল বেশ বেগে। বিপদের ক্ষীণতম সম্ভাবনাও আমরা কেউ কল্পনা করিনি। হঠাৎ হেলসেগগেনের দিক থেকে হাওয়া বইতে শুরু করল। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে না বুঝলেও বড় অস্বস্তি বোধ করলাম। বাতাসটার সাহায্য যতটুকু পারি নিয়ে এগোবার হাজার চেষ্টা করেও আমরা এগোতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত মনে হোল আমরা যেখানটায় নোঙর করে থাকি সেখানে ফিরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়ল আমাদের। সারা আকাশ জুড়ে তখন তামাটে রঙের মেঘ হুহু করে উঠে আসছিল।
‘হঠাৎ এক সময় বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। আমরাও নির্দিষ্ট গতি হারিয়ে সমুদ্রের বুকে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু আমরা কোন অবস্থার মুখোমুখী হচ্ছি সে কথা ভাববার মত অবসরই পেলাম না। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঝড় এসে পড়ল আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে এমন ঘন কালো অন্ধকার নেমে এলো যে নৌকোর ভেতর আমরা পরস্পরের মুখও দেখতে পাচ্ছিলাম না।
‘সে ঝড়ের বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। নরওয়ের সবচেয়ে বৃদ্ধ নাবিকও নাকি এ ধরণের ঝড় দেখেননি জীবনে। আমাদের পালগুলো নামিয়ে ফেলার আগেই ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় মাস্তুলগুলো এমনভাবে ভেঙে পড়ল যেন কেউ করাত দিয়ে ওগুলোকে কেটে ফেলেছে। ছোট ভাই বড় মাস্তুলটা আঁকড়ে ঝড় থেকে বাঁচতে চাইছিল। মাস্তুলের সঙ্গে সে সমুদ্রে ছিটকে পড়ল।
‘আমাদের নৌকোটা ছিল খুব হালকা। ওটা প্রায় পালকের মত জলের ওপর ভাসছিল। ওটার ওপর একটা পাটাতন ছিল আর ছিল তার মাথার দিকটায় একটুখানি ফাঁকা জায়গা। ঝড়ের মুখে পড়লে আমরা ঢেউয়ের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্যে ওটা বন্ধই করে দিতাম। আমরা কিন্তু তখন এরকম একটা অবস্থার মধ্যে ছিলাম যে কোন কিছু করাই সম্ভব হচ্ছিল না। আমার বড় ভাই কী করে বেঁচে ছিলেন জানিনা, সে খোঁজ নেবার সুযোগই হয়নি আমার। পাল সহ মাস্তুল ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়েছিলাম আর সামনের মাস্তুলটার তলায় একটা লোহার আংটা ধরে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আমি ওভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু এ কথাও ঠিক যে ওই পদ্ধতিটা খুবই নির্ভরযোগ্য ছিল।
‘আমরা তখন পুরোপুরি জলের তলায়। প্রাণপণে দম আটকে রেখে লোহার আংটাটি আঁকড়ে ধরেছি আমি। ব্যাপারটা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো তখন আমি ঐ অবস্থায় হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথাটা তুলে দম নিতে চাইলাম। জল থেকে উঠে আসার সময় কুকুরগুলো যেভাবে শরীরটাকে নাড়া দেয়, আমাদের নৌকোটায় সেই রকম একটা প্রবল ঝাঁকি লাগল। আমার তখন কেমন যেন আচ্ছন্ন অবস্থা। তবু প্রাণপণ শক্তিতে ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রেখে অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করছি আমি। হঠাৎ মনে হোল কে যেন আমার হাত ধরেছে। ভীষণ আনন্দ হোল আমার। আমি জানতাম আমার দাদা তখনো নৌকোয় আছেন। কিন্তু এ আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হোল না। দাদা কানের কাছে মুখ এনে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মস্কো-আবর্ত’।
‘সেই মুহূর্তে আমার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল সে খবর আজ আর কারোর জানার কথা নয়। একটা দুঃসহ যন্ত্রণায় আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত থর থর করে কেঁপে উঠল। ঐ একটি শব্দ উচ্চারণ করে দাদা ঠিক কী বোঝাতে চাইছিলেন, মুহূর্তের মধ্যেই তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি। বাতাসের পরিবর্তিত গতি তখন আমাদের টেনে নিয়ে চলেছিল সেই ঘূর্ণাবর্তেরই দিকে। কারোর শক্তি ছিল না যে আমাদের বাঁচায়।
‘তোমাকে বলেছি যে ঘূর্ণির এলাকা ছাড়িয়ে আমরা সাধারণত বেশ খানিকটা উজানে চলে গিয়ে ভাটার জন্যে অপেক্ষা করতাম। আবহাওয়া যখন শান্ত থাকত, আমাদের কাজের ধরণই ছিল ঐ রকম। এখন কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় আমরা সোজাসুজি ঘণাবর্তের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। একবার মনে হোল ভাটার টান শুরু হতে এখনো দেরী আছে। এই মুহূর্তে নিরাশ হবার মত কিছুই নেই। পরমুহূর্তে মনে হোল, আমি মূখের মতই আশা করছি । আমাদের সব শেষ হয়ে যেতে চলেছে, বিশাল আকৃতির যুদ্ধ জাহাজ থাকলেও এই মুহূর্তে রক্ষা পাওয়ার প্রশ্ন উঠত না।
‘মনে হোল ঝড়ের বেগ একটু কমেছে। হয়ত বা ঝড়ের আঘাতে অনুভূতি আর বিচারবুদ্ধিই লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তবে সমুদ্রের চেহারা যে বদলে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। অনেকখানি শান্ত আর ফেনবহুল সমুদ্র যেন বিরাট পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠছিল। পরিবর্তন এসেছিল ওপরের আকাশেও। সেখানে ঘন কালো মেঘের মাঝখানে ছোট্ট একটা গোলাকার জায়গা থেকে মেঘ সরে গিয়ে গাঢ় নীলাকাশ আর পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ বেরিয়ে পড়ল। চাঁদের এত আলো আমি বোধ হয় এর আগে কোন দিনই দেখিনি। চার পাশের সব কিছুই সেই আলোর স্পর্শে স্পষ্টতর হয়ে উঠল আর ভগবানই জানেন কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমার চোখের সামনে উদঘাটিত হোল!
‘দাদাকে দু’একটা কী যেন কথা বলতে ইচ্ছে হোল, বললামও কিছু দু’একবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রচণ্ড গর্জনের মধ্যে সে কথা কোথায় ডুবে গেল। আমি অবশ্য ওঁর কানের কাছেই প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিলাম। দেখলাম মৃত ব্যক্তির মত দাদার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। একটা আঙুল উচিয়ে উনি চীৎকার করে উঠলেন, ‘শুনছ?
‘প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারিনি কোনটা শোনার কথা উনি বলছেন, পরমুহূর্তেই কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর চিন্তায় আমি যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। পকেট থেকে ঘড়িটা টেনে বার করে এনে সময়টা দেখতে চাইলাম। হায় ভগবান! ঘড়িটা সেই সাতটার সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাটার সময়ের অনেক পরে আমরা এখানে এসে পড়েছি, আর ঘূর্ণাবর্ত তার সমস্তটুকু প্রচণ্ডতা নিয়ে আমাদের আকর্ষণ করছে। কেঁদে উঠে আমি ঘড়িটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম জলে।
‘নৌকো যদি পাকাঁপোক্ত করে বানানো হয় আর বেশী বোঝ। চাপানো না থাকে তাহলে প্রবল ঝড়ের সময়ও সমুদ্রের ঢেউগুলো তার তলা দিয়ে পিছলে যায়। ডাঙার মানুষদের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকবে হয়ত কিন্তু নাবিকদের ভাষায় একেই ‘রাইডিং’ বা ঢেউতে দোল খাওয়া বলে।
‘এতক্ষণ আমরা ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দোল খেয়ে চলেছিলাম। বড় একটা অসুবিধে হয়নি, হঠাৎ এক সময় নৌকোটা যেন ঢেউয়ের মাথায় চেপে শূন্যে আকাশের দিকে উঠে গেল। সে উচ্চতা আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। ঠিক পর মুহূর্তেই আমরা যেন পিছলে নেমে চললাম অত্যন্ত দ্রুতবেগে বিরাট একটা গহ্বরের মধ্যে। স্বপ্নে উঁচু পাহাড় থেকে তলায় পড়বার সময় যেমন হয় আমার তেমন মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছিল। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম দেহে মনে। নৌকোটা যখন উঁচুতে ছিল তখনই আমি এক পলক দেখে নিয়েছিলাম পুরো অবস্থাটা। আর তাতেই পরিস্থিতির গুরুত্ব আমি পরিষ্কার ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। মস্কো আবর্ত থেকে আমরা তখন বড় জোর সিকিমাইল দূরে। সাধারণ আবর্ত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা কম ছিল না। কিন্তু এটা যে তা ছিল তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। সে একটা অভূতপূর্ব আবর্ত। তার সর্বধ্বংসী স্বরূপ মানুষের স্বপ্নেরও অগোচর। আমরা কোথায় আর কীইবা আমাদের ভাগ্যে ঘটতে চলেছে, সব কিছু যেন আমি স্পষ্টই ভেবে নিতে পারছিলাম। ভীতির অস্বাভাবিক প্রচণ্ডতায় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার চোখগুলো বন্ধ হয়ে এলো। দৈহিক আক্ষেপের সময় যেমন হয়, অনেকটা প্রায় সেইরকম, আমার চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে চেপে বসে গেল।
‘মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ঢেউ শান্ত হয়ে এলো আর পুরো এলাকাটা ফেনায় ভরে গেল। আমাদের নৌকোটা হঠাৎ বাঁদিকে মোড় নিয়ে ভিন্ন একটা দিকে বিদ্যুতের মত ছুটে চলল। তীব্র আর তীক্ষ্ণ প্রচণ্ড একটা শব্দের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন তলিয়ে গেল। ওরকম শব্দের কোন তুলনা নেই। হাজার হাজার জাহাজ যদি একই মুহূর্তে তাদের জলের পাইপগুলো খুলে দেয় আর সেই সঙ্গে ছেড়ে দেয় জমে ওঠা বাষ্প, তাহলে যে ধরণের শব্দ হতে পারে সেইটে ভেবে নাও। ঘূর্ণাবর্তের চারদিকে যে ডুবো পাহাড়ের অঞ্চল আমরা তখন সেইখানে। যে অবিশ্বাস্য গতিতে আমাদের নৌকো ছুটে চলেছে তাতে আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে আমরা আবর্তের তলায় তলিয়ে যাব, তা বুঝতে আর কোন অসুবিধেই ছিল না। নৌকোটা না ডুবে জলের ওপর বুদ্বুদের মত উঁচু ঢেউয়ের ওপর ভেসে চলেছিল। নৌকোটার সবদিকেই ছিল সেই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্ত, তার বিরাট আকৃতির আড়ালে দিচক্র বালও হারিয়ে গিয়েছিল।
‘অসম্ভব মনে হলেও কথাটা ঠিক যে ঐ বিরাট আবর্তের মুখোমুখি এসেও আমি অনেকখানি মানসিক স্থৈর্য বজায় রাখতে পেরেছিলাম। যে ভীতি আমার বিচারবুদ্ধিকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, মৃত্যু অবধারিত জেনেও তার বোঝ যেন মনের ওপর থেকে নেবে গেল। হতে পারে যে চূড়ান্ত হতাশাই আমাকে কিছুটা মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছিল।
‘অহঙ্কার নয়, সত্যিই মনে হোল যে এই বিরাট নৈসর্গিক ঘটনার মধ্যে মৃত্যুরও একটা গৌরব আছে। ঐশ্বরিক শক্তির এই অকল্পনীয় বিশালতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তা চিন্তা করাই মূর্খত। হঠাৎ ঐ ঘূর্ণিটার সম্পর্কেই ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম আমি। চরম ত্যাগের মূল্যেও ওর তলদেশে পৌঁছে সব কিছু আবিষ্কার করার একটা বাসনা মনের মধ্যে আকস্মিকভাবে জেগে উঠল। দুঃখ হচ্ছিল একটা কারণেই আমার এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বরূপ কোনদিনই কাউকে বর্ণনা করে বোঝাতে পারব না। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ ধরণের চিন্তা বোধহয় বাতুলেও করে না, তবু বারবার মনে হয় সেদিন আবর্তের চারদিকে নৌকোয় প্রদক্ষিণ করতে করতে আমি হালকা ভাবেই অনেক কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম।
‘বাতাস পুরো থেমে গিয়েছিল। তা ছাড়া ঘূর্ণাবর্তের ভেতরে যে গভীরতার সৃষ্টি হয়, সমুদ্রের অত নীচে বাতাস গিয়ে পৌঁছতেও পারে না। হয়তো এর জন্যেও আমার চিন্তার মধ্যে কিছুটা স্থৈর্য এসেছিল। আমাদের চারদিকে আবর্তের বহিবৃত্তটি তখন কালো পাহাড়ের মত আকাশচুম্বী উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝড়ের সময় সমুদ্রের ভেতর ঢেউয়ের প্রচণ্ডতা আর ছড়িয়ে পড়া জলের অজস্রতা সাধারণ ভাবেই যে কোন মানুষকে বিহ্বল করে ফেলে। সে অবস্থা
অনুমান করাও সম্ভব নয়। ওরকম অবস্থা মানুষকে শুধু অন্ধ আর বধিরই করে তা নয়, মানুষের সে অবস্থায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে, কর্ম আর চিন্তাশক্তিও নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের কিন্তু তা হয়নি। হয়ত বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদের যেভাবে সেলের মধ্যে ওদের খুশী। মতো যে কোন কাজই করতে দেওয়া হয়, অন্য বন্দীদের মতে বাধা নিষেধ আরোপিত হয় না, আমাদেরও সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
‘আমরা আবর্তের মতো ক’টা পাক খাচ্ছিলাম তা মনে রাখা বা বলা সম্ভব ছিল না। ঠিক ভাসমান না বলে বরং বলা চলে উড়ন্ত অবস্থায় পাক খাচ্ছিলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। আর পাক খেতে
খেতে ঘূর্ণির ভীতিপ্রদ তলার দিকে নেবে চলেছিলাম। লোহার আংটাটা তখন আমি ছেড়ে দিইনি। আমার দাদা ছিলেন নৌকোর পেছনের দিকে। উনি জলরাখা একটা মস্ত বড় খালি পিপে আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। নৌকোর পাটাতনের ওপর আর কোন বস্তুই ছিল না। পিপেটা খুব শক্ত করেই পাটাতনের সঙ্গে বাঁধা ছিল। ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় ঐ পিপেটা ছাড়া অন্য সব জিনিসই সমুদ্রে ভেসে গিয়েছিল । আমরা যখন আরও তলায় নেমে যাচ্ছি হঠাৎ দাদা পিপেটা ছেড়ে দিয়ে আমি যে রিংটা ধরে ছিলাম সেইটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আংটাটা খুবই ছোট ছিল। দু’জনের পক্ষে ওটা ধরা সম্ভব ছিল না।’ দাদা ভয়ের তাড়নায় আমার হাতটা খুলে দিয়ে নিজেই রিংটা ধরতে চাইলেন। ও অবস্থায় মানুষ সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। দাদার ব্যবহারে সেই রকম বিচারবুদ্ধিহীন উন্মত্ততাই প্রকাশ পাচ্ছিল। অস্বীকার করব না, দাদার ওরকম আচরণ দেখে সে মুহূর্তে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম। আত্মরক্ষার ঐ অবলম্বনটুকু নিয়ে দাদার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার কোন প্রশ্ন আমার দিক থেকে ছিলই না। মনে হচ্ছিল, আমাদের মধ্যে যে কেউ একজন ওটা ধরে বাঁচার চেষ্টা করুক, তাতে ক্ষতি কী? দাদাকে আংটাটা ছেড়ে দিয়ে আমি পিপেটার দিকে চলে গেলাম। আবর্তের প্রচণ্ড ঘূর্ণির মধ্যে নৌকোটা যেন উড়ে চলেছিল। মাঝে মাঝে ভীষণভাবে দোল খেলেও পিপেটার দিকে চলে যেতে আমার খুব অসুবিধা হয়নি। ওখানে পৌঁছবার পরই হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে নৌকোটা ডানদিকে ঘুরে গেল আর তীব্র বেগে আবর্তের তলায় নেমে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হল, এবার সব শেষ! নীরবে আমি শেষবারের মত ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম।
‘পাতালে নেমে যাবার সেই সুতীব্ৰ গতি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি চোখ বন্ধ করে প্রাণপণ শক্তিতে পিপেটা আঁকড়ে পড়ে থাকলাম। চোখ খুলে কোন কিছু দেখবার মত সাহস আমার ছিল না। মৃত্যু যে অনিবার্য তা জেনেছিলাম। কিন্তু তখনো জলের তলায় গিয়ে পড়িনি আর মরণ-লড়াই শুরু হয়নি কেন সেইটেই বরং তখন আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। বেশ কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল কিন্তু তখনও আমি জীবিত। আমরা যে কোথাও ভীষণ বেগে নেমে যাচ্ছি, এই অনুভূতিটা চলে গিয়েছিল। নৌকোটা এখন আড়াআড়ি ভাবে পাক খেয়ে চলেছিল। একটুখানি সাহস সঞ্চয় করে দৃশ্যটাকে আর একবার আমি দেখে নেবার চেষ্টা করলাম।
‘আমার চারদিকের দৃশ্যাবলীকে কী পরিমাণ বিস্ময়, ভীতি আর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সেদিন দেখেছিলাম তা আমি জীবনে ভুলবো না। কালো রঙের একটা অবিশ্বাস্য আয়তনের ফানেলের মসৃন উজ্জ্বল ঘূর্ণায়মান দেহের মধ্যে আমরা দ্রুতবেগে পাক খাচ্ছিলাম। স্বল্পায়তন মেঘনিমুক্ত আকাশ থেকে পূর্ণচাঁদের আলো ঝরে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল অতলস্পর্শী গহ্বরের তলদেশ পর্যন্ত কালে দেয়ালের ওপর সোনালী আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
‘সব কিছু খুঁটিয়ে দেখবার মত শক্তি বোধহয় আমার প্রথমটা ছিল না। তার জন্য দায়ী আমার তদানীন্তন বিভ্রান্ত অবস্থা। ভয়াবহ সৌন্দর্যের মহৎ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই তখন চোখে পড়েনি। একটু সামলে নেবার পর আমার দৃষ্টি পড়ল নীচের দিকে। নৌকোটা জলের দেয়ালে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, তাই নীচের দিকে তাকাতে আমার সামনে কোন বাধাই ছিলনা। প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোনে নৌকোটা ঝুলছিল আর পাক খাচ্ছিল প্রচণ্ড বেগে। তাই পিপেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেও ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল আমার।
‘চাঁদ তার আলো পাঠিয়ে ঘূর্ণাবর্তের তলদেশ পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে চাইছিল কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। আমিও তলার দিকে একটা ঘন কুয়াশার আস্তরণের জন্যে কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই কুয়াশা বা জলকণাবাহী বাতাস সম্পর্কে এইটুকুই বোধহয় বলা যায় যে ঘূর্ণাবর্তের প্রচণ্ড আঘাতে তার তলদেশেই এর সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু সেই গাঢ় কুয়াশার ভেতর থেকে স্বৰ্গমুখী যে বিপুল আর্তনাদ উত্থিত হচ্ছিল তার কোন বর্ণনা দেবার চেষ্টাই আমি করব না।
‘সমুদ্রের ফেনবহুল উপরিভাগ থেকে আবর্তের তলায় আমরা অনেকখানি দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছি বটে, কিন্তু বাকী পথটুকু ঠিক ঐ হারে নামছিলাম না। দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে আমরা পাক খেয়ে তলায় নামছিলাম। এর ফলে কখনো চলেছিলাম কয়েকশ’ ফুট কখনও বা পুরো আবর্তটাকেই একবার প্রদক্ষিণ করে আসছিলাম। এখনকার গতি তুলনামূলক ভাবে ছিল মন্থর কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তকে অনুভব করতে পারছিলাম নিবিড় ভাবে।
‘বিশাল পরিধির কালো জলাবর্তের মধ্যে যখন আমরা এইভাবে বাহিত হয়ে চলেছিলাম তখন আমার চারদিকে তাকিয়ে একসময় দেখলাম যে ঘূর্ণায়মান বস্তু শুধুমাত্র আমার নৌকোটাই নয়, ওপরে আর নীচে বহু ভাঙাচোরা বস্তুই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার নজরের মধ্যে আসছিল নৌকোর বড় বড় কাঠ, গাছের গুঁড়ি আর সঙ্গে অনেক ছোট ঘোট জিনিস, যেমন ভাঙা আসবাব, বাক্স তোরঙ্গ, লাঠি, পিপে এমনি ধারা কত কি। ভয়ের পরিবর্তে তখন আমার মনে অস্বাভাবিক কৌতূহল। ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সুনিশ্চিত মুহূর্তের দিকে যতই আমি অগ্রসর হচ্ছিলাম ততই যেন ক্রমশ বেশী পরিমাণে ঔৎসুক্য বেড়ে চলেছিল আমার। আমাদের সঙ্গে আর যে সব জিনিস ঘুর্ণাবর্তের তলায় নেমে চলেছিল সেগুলো অদ্ভুত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিয়ে দেখছিলাম আমি। কোন কোন জিনিস ঠিক কতখানি বেগে নেমে চলছিল সেইটে লক্ষ্য করে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। সম্ভবত আমি উন্মাদই হয়ে গিয়েছিলাম। এক সময় বোধহয় বলে উঠলাম, এ ফার গাছটা এইবার ঠিক ভীষণ একটা ডুব দিয়ে তলিয়ে যাবে–ওটাকে আর দেখাই যাবে না। আমি দেখলাম যে আমার হিসেব মিললো না। একটা জাহাজের ভাঙা অংশ কোত্থেকে হঠাৎ এসে পড়ল আর ফার গাছটার আগেই ওটা ছুটে গিয়ে ঘণাবর্তের তলায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেল। অনুমানের পর অনুমান করে চলেছি আর আমারই হিসেবের ভুলে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমি হেরে যাচ্ছি, ঠিক এমনি অবস্থায় আবার আমি ভয়ে প্রায় আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম।
‘এ ভীতি নতুন কিছু নয় কিন্তু তারই সঙ্গে হঠাৎ একটা নতুন আশার আলোও যেন দেখলাম আমি। এই মুহূর্তে যে সব ঘটনা খুঁটিয়ে দেখছিলাম সেগুলো আর আমার পূর্বস্মৃতি এই আশা গড়ে তুলছিল। লোফোডেন দ্বীপের উপকূলে যে সব ভেসে থাকার উপযোগী বস্তুকে ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি, সেগুলোই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে যে মস্কো-আবর্ত বহু জিনিস টেনে নেয় ঠিকই কিন্তু পরে সেগুলোকে তীরভূমিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। জিনিস গুলোর অধিকাংশই অস্বাভাবিক ভাবে ভাঙাচোরা অবস্থায় ফিরে আসে কিন্তু কিছু জিনিস দেখেছি, যেগুলির গায়ে আঁচড়ের দাগও পড়েনি। এর অর্থ আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছি, এমন হতে পারে যে কিছু জিনিস এত ধীরে ধীরে আবর্তের ভেতর দিয়ে নেমেছে যে শেষ পর্যন্ত সেগুলো তলায় পৌঁছয়নি অথচ ইতিমধ্যে জোয়ার এসে গেছে। হয়ত এগুলো আবর্তের মধ্যে এসেছে কিছু পরে। অন্যদিকে যে জিনিসগুলো প্রথমেই ওর ভয়ঙ্কর আবর্তের মধ্যে এসে পড়েছে সেগুলো একেবারে তলিয়ে গিয়েছিল, তাই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছে। ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন এ কথাও আমার মনে হয়েছে যে সেই আবর্ত সব জিনিসই আবার সমুদ্রের ওপর টেনে তুলেছে। আরও তিনটি মূল্যবান বিষয় আমি সাবধানতার সঙ্গেই লক্ষ্য করেছিলাম। প্রথমত বড় জিনিসগুলো ঘণাবর্তের তলায় নামে সবচাইতে তাড়াতাড়ি, দ্বিতীয়ত একই ওজনের জিনিস হলেও গোলাকার বস্তু অধিকতর দ্রুতবেগে তলদেশে নেমে যায় আর তৃতীয়ত লম্বা বা বেলনাকার জিনিস নামে সব চাইতে মন্থরগতিতে।
‘বেঁচে ফিরে আসার পর আমি এখানকার একজন স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনায় বসেছি। প্রকৃতপক্ষে গোলাকার’ ‘বেলনাকার’ এ শব্দগুলো আমি ওঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। যদিও আমি ব্যাখ্যাগুলো সবই ভুলে গিয়েছি, উনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আকৃতি স্বাভাবিকভাবেই গতি নিয়ন্ত্রিত করে। উনিই বলেছিলেন যে লম্বা বা বেলনের মত জিনিস যদি আবর্তের মধ্যে পড়ে তাহলে সেটাই চোষণের পথে সবচাইতে বেশী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অন্য যে কোন আকারের বস্তু অনেক সহজে চোষণের বলি হয়ে যায়।
‘একটা বিস্ময়কর পরিবেশই মূলত আমাকে এইসব খুটিনাটি জিনিসগুলোকে সযত্নে লক্ষ্য করতে উৎসাহিত করেছিল। আমরা যখন আমাদের নৌকো নিয়ে পাক খেয়ে চলেছিলাম তখন প্রত্যেকবার আবর্তনের সময় আমি পিপে, নৌকোর ভগ্নাংশ ইত্যাদি নানাধরণের জিনিস আমাদের পাশে পাশে দেখছিলাম। একটু পরে দেখেছি ওগুলো অনেক ওপরে থেকেই গিয়েছে। এত ওপরে যে মনে হয়েছে ওগুলো আদপে নামেইনি।
‘সেই সঙ্কটজনক মুহূর্তে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আমি একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। স্থির করলাম নৌকোর বাঁধন থেকে পিপেটাকে আলগা করে দিয়ে ওটাকে অবলম্বন করেই ভেসে যাব। পাশ দিয়ে একটা পিপে ভেসে চলেছিল। দাদার দৃষ্টি ওটার দিকে আকর্ষণ করে ওঁকে নানারকম ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলাম যে আমি পিপেটাকে নিয়ে ভেসে পড়তে চাইছি। অনেক চেষ্টার পর মনে হল তিনি ব্যাপারটা বুঝলেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক নৌকোর লোহার অংশটা ছেড়ে উনি অন্য কোন অবলম্বন গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। মাথা নেড়ে ওঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন আমাকে। জোর করে তাকে দিয়ে কিছু করানোর প্রশ্নই ছিল না তখন। ব্যাপারটা এমনি গুরুতর যে বিন্দুমাত্র বিলম্বও তখন বিপজ্জনক। যে দড়িগুলো দিয়ে পিপেটা বাঁধা ছিল তাড়াতাড়ি সেইগুলো খুলে নিয়ে ওগুলো দিয়েই নিজেকে পিপের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম.। এরপর দাদাকে তার ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে পরমুহূর্তেই জলে গড়িয়ে পড়লাম।
‘আমি যা আশা করেছিলাম, ফলটা মোটামুটি দাঁড়ালো সেই রকমই। বুঝতেই পারছ যে আমি রক্ষা পেয়ে গেলাম আর সেই জন্যেই আজ এখানে বসে তোমাকে আমার অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে পারছি। কী ভাবে আমি রক্ষা পেলাম সেটা তুমি নিশ্চয় এখন অনুমান করতে পারছ। আর অল্প কয়েকটা কথা বলেই আমি কাহিনীটা শেষ করছি। মনে হয় নৌকো থেকে গড়িয়ে পড়ার পর ঘণ্টাখানেক পরে নৌকোটা হঠাৎ সোজা আবর্তের তলার দিকে দ্রুতবেগে নেমে গেল আর আমার দাদাকে নিয়ে ওর নিঃসীম গভীরতার মধ্যে তিন চারবার পাক খেয়ে চিরদিনের মত তলিয়ে গেল। এদিকে আমি যেখানটায় নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম সেখান থেকে আবর্তের তলার যতখানি দূরত্ব, এই এক ঘণ্টার মধ্যে আমি তার বড় জোর অর্ধেকটা পাক খেয়ে এসেছি মাত্র। ইতিমধ্যে আবর্তের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম আমি। ফানেলের মত ঘূর্ণাবর্তের খাড়াই অংশটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এলো আর সেই সঙ্গে যে উন্মত্ত গতিবেগে সমুদ্রের জল এতক্ষণ আবর্তিত হচ্ছিল তার গতিও যেন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এলো। সেই ঘন কুয়াশা, সেই রামধনু সবই কোথায় মিলিয়ে গেল আর আবর্তের নীচের অংশটা হু হু করে উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। আকাশ তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আর বাতাস পুরোপুরি থেমে গেছে। পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে তখনো কিন্তু অকৃপণ ভাবেই আলো ছড়িয়ে চলেছে। হঠাৎ মনে হোল আমি সমুদ্রের ওপর এসে পড়েছি আর একটু দূরেই দেখতে পাচ্ছি লোফোডেন দ্বীপটাকে। কিছুক্ষণ আগে অবধি মস্কো-ঘূর্ণাবর্তটা যেখানে ছিল সে জায়গাটাকেও আমি বেশ চিনতে পারছিলাম। তখন ভাটার সময়, তবু ঝড়ের দরুণ যে বিশাল ঢেউ তৈরী হয়েছিল তারই সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি আমি উপকুলে এসে পড়লাম। একটা নৌকো যখন আমাকে জল থেকে তুলে নেয় তখন কিন্তু আমি ক্লান্ত আর বাক্শূন্য। এর কারণ হয়ত বা পরিবেশের ভয়াবহতা। যারা আমাকে টেনে তুলেছিল তারা আমার চিরদিনের সঙ্গী, আমার পুরোনো বন্ধু। কিন্তু মৃত্যুর রাজ্য থেকে প্রত্যাবৃত আমাকে চেনা তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। একদিন আগে যে চুল দাঁড়কাকের মত মিশমিশে কালো ছিল সে সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। ওরা বলে যে আমার মুখের আকৃতিটাই নাকি পুরো বদলে গিয়েছে। ওদের আমি এ কাহিনী শুনিয়েছি কিন্তু ওরা এর একবর্ণও বিশ্বাস করতে পারেনি। আজ আমার কাছ থেকে এ কাহিনী শোনার পর তুমিও লোফোডেনের জেলেদের মত একে অবিশ্বাস্য ভাববে কিনা জানিনা।