রত্নদীপ – ২য় খণ্ড

দ্বিতীয় খণ্ড

০১. সোণার হরিণ

চৈত্রমাসের প্রথম সপ্তাহ, কিন্তু ইতিমধ্যেই এবার বেশ গ্রীষ্ম পড়িয়া গিয়াছে।

বেলা দশটার সময়, কলিকাতার উত্তরাংশের কোনও সদর রাস্তা দিয়া রেশমী ছাতা মাথায় এক যুবক ধীরে ধীরে চলিতেছিল। লোকটি অত্যন্ত সুপুরুষ–মুখে চক্ষে রূপ যেন ঝলমল করিতেছে। তাহার বেশবিন্যাসেও বাহারের ছড়াছড়ি। মস্তকে তরঙ্গায়িত কেশের বড় বাহার, অঙ্গে পাঞ্জাবী পিরিহানের বাহার, পায়ে লপেটা জুতার বাহার, জুতার উপর বসনের সুকুঞ্চিত প্রান্তভাগের বাহার যেন লুটাপুটি খাইতেছে। লোকটির বয়স বত্রিশ–বড় জোর তেত্রিশ হইতে পারে।

যুবকের নাম খগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতা কলিকাতা সমাজের একজন বিখ্যাত ধনী ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে, অল্পবয়সেই খগেন্দ্র তাহার অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হয়। কিন্তু সে সব গিয়াছে, খগেন্দ্র এখন এক প্রকার নিঃস্ব। লক্ষ টাকা খরচ করিয়া একটা থিয়েটার খুলিয়াছিল, সে থিয়েটার ফেল হইয়া গিয়াছে। এক সময়, একরাত্রে খগেন্দ্র পাঁচশত টাকা বাগান–খরচ করিত, সে সকল এখন তাহার স্বপ্নবৎ। এখন দায়ে পড়িয়া সে অপেক্ষাকৃত সংযত–চরিত্র–কিন্তু অর্থলালসা তাহার মনে রাবণের চিতার মত জ্বলিতেছে। গত বৎসর একটা বড় রকম জাল করিয়া বেঙ্গল–ব্যাঙ্ক হইতে অনেক টাকা আত্মসাৎ করিবার চেষ্টায় ছিল–ধরাও পড়িয়া যায়। পুলিশ–কোর্টে সঙ্গীন মোকদ্দমা উপস্থিত হয়, তথা হইতে দায়রা সোপর্দ হইয়াছিল। কিন্তু পিতৃপুণ্যে অনেক কষ্টে অব্যাহতি পাইয়াছে। –হা ভগবান! যাহার বহিরাবরণ এমন শ্রীমণ্ডিত করিয়া পাঠাইয়াছ, তাহার অন্তরদেশ এমন অসার পদার্থে গঠিত করিলে কেন?  

কিয়দ্দূর চলিয়া খগেন্দ্র গলির মোড় পাইল। মাথা তুলিয়া গলির নামটি পাঠ করিল। পকেট হইতে একখানি কাগজ বাহির করিয়া একবার মাত্র দেখিয়া, সেই গলির পথে নম্বর খুঁজিতে খুঁজিতে অগ্রসর হইল। ক্রমে একটি পীতবর্ণের দ্বিতলবাটীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া, পকেট হইতে কাগজখানি বাহির করিয়া আবার নম্বরটি মিলাইল। উপরিতলের কক্ষ হইতে খোলা জানালা দিয়া হার্মোনিয়মের সুরলহরী ভাসিয়া আসিতেছিল। খগেন্দ্র বদ্ধদ্বারে করাঘাত করিতে লাগিল।

ভিতর হইতে শব্দ আসিল–কে গা?

খগেন্দ্র বলিল, খুলেই দেখ না।

দ্বার খুলিয়া একজন ঝি আত্মপ্রকাশ করিল। খগেন্দ্র মুখপানে চাহিয়াই বিস্ময়ে সে কিয়ৎক্ষণ অবাক হইয়া রহিল।

খগেন্দ্র বলিল, কনক এ বাড়ীতে থাকে?

ঝি অস্ফুটস্বরে বলিল, আপনি কে?

আমি যে–ই হই না। কনকের এই বাড়ী?

হ্যাঁ।

খগেন্দ্র ভিতরে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইল।

ঝি আত্মসম্বরণ করিয়া বলিল, দাঁড়ান। আপনি কি চান?

যা চাই তা তোমার মনিবের কাছে বলব। –বলিয়া খগেন্দ্র আরও দুইপদ অগ্রসর হইল।

ঝি বলিল, এখন একটু এখানে থাকুন। আমি আগে খবর দিই। আপনার নাম কি বলুন।

খগেন্দ্র একটু চিন্তা করিয়া বলিল, নাম না বললে উপরে যেতে পাব না?

না।

তোমার মনিব যে দেখছি মস্ত মেমসাহেব হয়েছেন। বলগে যাও–সোণার হরিণ।

ঝি বলিল, সোণার হরিণ!আপনার নাম বলব সোণার হরিণ?

খগেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, এক সময় ও দলে আমি সোণার হরিণ বলেই বিখ্যাত ছিলাম। বলগে–বললেই চিনতে পারবে।

পাশে একটি ক্ষুদ্র কক্ষে টেবিল ও খানদুই চেয়ার রাখা ছিল। ঝি খগেন্দ্রকে সেইখানে বসিতে অনুরোধ করিয়া, ভিতরে গেল। খগেন্দ্র না বসিয়া, সেই হার্মোনিয়মের সুরসঙ্গতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাইয়া গুণ–গুণ স্বরে গান গাহিতে লাগিল।

কয়েক মুহূর্ত পরে হার্মোনিয়ম থামিয়া গেল। ঝি নামিয়া আসিয়া বলিল, উপরে চলুন।

খগেন্দ্র উপরে গিয়া দেখিল সদ্যস্নাতা আলুলায়িতকুন্তলা কনকলতা হার্মোনিয়মের টুল ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেছে। প্রবেশমাত্র সে বলিয়া উঠিল, আসুন–আসুন। আজ কি সুপ্রভাত! কেমন আছেন?

ভাল আছি। তুমি এ গলির ভিতর–এ খনির তিমিরগর্ভে–আশ্রয় নিয়েছ কতদিন?

এই বছরখানেক হল। সে বাড়ীতে থাকতে লোকে ভারি বিরক্ত করত। আপনি জানেনই ত, অভিনেত্রী হলেও, আমার মনের গতি একটু অন্যরকম। আমি গোলমাল ভালবাসিনে।

বেশ বেশ। দুটো পান আনতে বল ত।

কনক উঠিয়া গিয়া, উপরের বারান্দায় দাঁড়াইয়া, ঝিকে পান আনিতে আদেশ করিল। ফিরিয়া আসিয়া বলিল–তামাক দেবে কি?

না, আমার কাছে সিগারেট আছে। –বলিয়া, স্বর্ণনির্মিত একটি সিগারেটকেস পকেট হইতে বাহির করিয়া খগেন্দ্র একটি সিগারেট কনকলতাকে দিল, একটি নিজে ধরাইল।

রূপার ডিবায় ভরিয়া ঝি পাণ আনিয়া দিল, কিয়ৎক্ষণ গ্রীস্মাধিক্য ও অন্যান্য বিষয়ক কথোপকথনের পর খগেন্দ্র বলিল, আজকাল কি করছ তুমি?

বেকার বসে আছি। মাসখানেক হল থিয়েটারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।

হ্যাঁ, তাই শুনলাম যদুর কাছে। কি হয়েছিল?

ম্যানেজারের সঙ্গে বকাবকি হয়েছিল?

কেন? ব্যাপারটা কি?

হয়েছিল কি জানেন? সাজাহানের রিহার্সাল হচ্ছিল। আমাকে দিয়েছিল জাহানারার পার্ট। সুরুতেই এক যায়গায় সাজাহান আমাকে বলছে বেচারী মাতৃহীনা পুত্রকন্যারা আমার! তাদের শাসন করবো কোন্ প্রাণে জাহানারা? ঐ চেয়ে দেখ ঐ ফটিকে গঠিত দীর্ঘনিশ্বাস–ঐ তাজমহলের দিকে চেয়ে দেখ–এখন কবি, তাজমহলকেই স্ফটিকে গঠিত দীর্ঘনিশ্বাস বলে বর্ণনা করেছেন, কেমন কি না?

খগেন্দ্র বলিল, হ্যাঁ, ইংরাজিতেও তাজমহলকে মৰ্ম্মরগঠিত স্বপ্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই ত। তেমনি, বাঙ্গালী কবি, ভাবের রঙ আরও একটু চড়িয়ে, স্ফটিকে গঠিত দীর্ঘনিশ্বাস বললেন! শোক যেন মূর্তি ধারণ করেছে। চমৎকার না?

নিশ্চয়।

এখন, হয়েছে কি জানেন? ছাপাখানার ভূতেরা, ছাপার বইখানিতে, ঐ দীর্ঘনিশ্বাস কথাটির দুপাশে দুটি বন্ধনী ছেপে দিয়েছে–অর্থাৎ ওটা যেন (পতন ও মূৰ্ছা) কিম্বা (বেগে প্রবেশ), ঐ জাতীয় একটা ব্যাপার। তাই মনে করে, ম্যানেজার মহাশয় সাজাহানকে শেখাচ্ছেন, ঐ স্ফটিকে গঠিত পৰ্য্যন্ত বলে, উস্–হুঁস করে একটা বড় রকম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে হবে–তার পর আবার বলে যেতে হবে, ঐ তাজমহলের দিকে চেয়ে দেখ ইত্যাদি আচ্ছা এটা বাঁদরামি নয়?

অবশ্য।

অপরাধের মধ্যে, আমি তাই ম্যানেজারকে বলেছিলাম। এই না শুনে ম্যানেজার একবারে চটে লাল। এতবড় আস্পর্ধা, আমায় তুই বাঁদর বললি!–বলে চেঁচামেচি আরম্ভ করে দিলে। আমার মেজাজটিও, রাজা ও রাণীর ভাষায় বলতে গেলে নিতান্ত মধুমত্ত মধুকরের মত নয়–জানেনই ত। আমিও খুব কড়া কড়া শুনিয়ে দিয়ে, চাকরিতে লাথি মেরে, বাড়ী চলে এলাম।

তার পর?

তারপর লোকের পর লোক পাঠাতে লাগল। কিন্তু আমি আর কিছুতেই নড়ছিনে। আমি বসে আছি গম্ভীর হিমালয়ের মত। –বলিয়া অভিনেত্রী নিজ মুখভাব অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া কয়েক মুহূর্ত নতনেত্রে বসিয়া রহিল। এই ক্ষণিক অভিনয়টুকু শেষ করিয়া খিল খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল, খগেন্দ্রও সে হাসিতে যোগ দিল।

হাসি থামিলে কনক বলিল, তারপরে–আজ কি মনে করে আগমন বলুন দেখি? বোধ হয় দুবছর আপনারা দেখা পাইনি।

একটু কাজেই এসেছি। একজন ভাল অভিনেত্রী খুঁজছি।

কনক উচ্ছ্বসিত স্বরে বলিল, আবার থিয়েটার খুলবেন নাকি?

খগেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া বলিল, যদি খুলি, তুমি আমার থিয়েটারে চাকরি নেবে?

নেব না? নিশ্চয়–নিশ্চয়। আপনার থিয়েটারেই ত প্রথম আমার হাতেখড়ি। তখন ত আমার নামও কেউ জানত না। সত্যি খুলবেন?

খগেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া বলিল, না, এবার থিয়েটার নয়।

তবে অভিনেত্রী খুঁজছেন কেন?

একটু কাজ উদ্ধার করবার জন্যে। তুমি বেকার বসে আছ শুনে তোমারই কাছে এসেছি। যতদিন আমার কাজে থাকবে, আমি মাসে দুশো টাকা করে তোমায় মাইনে দেব। যদি আমার কাজটি সফল করে দিতে পার, তাহলে বেশ ভারি রকম বকশিস পাবে।

ব্যাপারটা কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কনক সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, আমায় কি করতে হবে?

বেশী কিছু নয়। পাড়াগাঁয়ে মাসকতক একজন বড়লোকের পুত্রবধূর সহচরী হয়ে তোমায় থাকতে হবে।

অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিল, কার সহচরী হতে হবে? ব্যাপার কি?

খগেন্দ্র তখন পকেট হইতে একখানা বাঙ্গালা সংবাদপত্র বাহির করিয়া, একটা বিজ্ঞাপন কনকলতাকে পাঠ করিতে দিল। বিজ্ঞাপনটি এইরূপ

কৰ্ম্মখালি
অত্র এষ্টেটের শ্রীযুক্তেশ্বরী বধূরাণী মহোদয়ার জন্য একজন সৎকুলজাতা সহচরীর প্রয়োজন। যিনি ভাল রকম বাঙ্গালা লেখাপড়া জানেন এবং অবসর সময়ে চিত্তবিনোদনের জন্য সঙ্গীতাদি করিতে সুপটু, অথচ নিষ্ঠাবতী হিন্দুরমনী [নিঃসন্তান বিধবা হইলে আরও ভাল হয়] তাহার আবেদনই সর্বাগ্রে গ্রাহ্য হইবে। অশন বসন ব্ৰতাদি নিয়ম প্রভৃতির উপযুক্ত ব্যয় অত্র এষ্টেট হইতে নিৰ্বাহ হইবে, তাহা ছাড়া মাসিক ২৫ হিসাবে জলপানি দেওয়া যাইবে। কৰ্ম্মপ্রার্থিনীগণ দুইজন পদস্থ ব্যক্তির স্বাক্ষরিত প্রতিষ্ঠানসহ সত্বর আবেদন করুন।
শ্রীরঘুনাথ মজুমদার
ম্যানেজার বাশুলিপাড়া এষ্টেট।
পোঃ দেওয়ানগঞ্জ, জেলা নদীয়া।

কনকের পাঠ শেষ হইলে খগেন বলিল, আমি চাই, তুমি ঐ পদের জন্যে দরখাস্ত কর, তারপর সেখানে গিয়ে মাসকতক সহচরী হয়ে থাক।

কুঞ্চিত করিয়া কনক বলিল, আমি কিছু বুঝতে পারছিনে! আপনার মতলব কি? ঐ বধূরাণী আপনার কেউ হয় নাকি?

হয় না–যদি হইয়ে দিতে পার, তা হলেই আমার কার্যসিদ্ধি হয়।

কি হইয়ে দিতে পারি?

স্ত্রী। সে বিধবা, যদি তার সঙ্গে আমার বিবাহ ঘটিয়ে দিতে পার তাহলে ভাল রকম ঘটকালি পাবে।

শুনিয়া কনক গালে হাত দিয়া বলিল, ওমা! বিধবা–বিবাহ করবেন? এতদিন বিয়ে করে শেষে এই কায? আপনার এ মতি কেন হল, খগেনবাবু? দেখতে কি বড় সুন্দরী নাকি?

তাকে আমি কখন চক্ষেও দেখিনি।

তবে–যদি সে কালো কুৎসিত হয়?

হলোই বা কুৎসিত, কালো কুৎসিত মেয়েকে কেউ কি বিয়ে করে না?

একটি অঙ্গুলি গালের উপর স্থাপন করিয়া, নতনেত্রে কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ থাকিবার পর মৃদুহাসি হাসিয়া চক্ষু তুলিয়া কনকলতা বলিল, অনেক টাকা আছে বুঝি? আপনি একটা দাও মারবার চেষ্টায় আছেন–নয়? ।

পাগল! আমি সেই চরিত্রের লোক? আমি শুধু বিধবা–বিবাহ করে বাংলাদেশকে একটা দৃষ্টান্ত দেখাব মনে করেছি।

মাথা নাড়িয়া কনক বলিল, বকেন কেন? বাংলাদেশের জন্যে ত রাত্রে আপনার ঘুম হচ্ছে না। বলি ঐ বউরাণী কি অত্র এষ্টেটের মালিক?

ষোল আনার।

আয় কত?

বছরে লাখখানেক টাকা হবে।

কনক তখন বিজয়িনীর ন্যায় হাস্য করিয়া বলিল, তাই বলুন–এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। তা, সে হিন্দুঘরের বিধবা, অমনি চট করে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?

চট করে রাজি হলে তোমার দ্বারস্থ হয়েছি কেন? তোমার সেখানে গিয়ে, তার মনটির উপর ধীরে ধীরে অল্পে অল্পে নিজের অধিকার বিস্তার করতে হবে। খুব সাবধানে, তোমায় অগ্রসর হতে হবে। প্রথমে বিধবা–বিবাহের সমর্থক খানকতক উপন্যাস, যেমন রমেশ দত্তের সংসার, এইগুলো পড়ে শোনাতে হবে। কথাপ্রসঙ্গে বিধবা–বিবাহ জিনিষটাকে বেশ ভাল রঙ দিয়েই চিত্রিত করে, তার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে তোমায় ধরতে হবে। কলকাতায় এখন কত বড়–বড়–ভাল ভাল লোক বিধবা–বিবাহ সমর্থন করছেন, এই সব সংবাদ কথাকৌশলে তাকে জানাতে হবে। এই রকম করে তিলে তিলে তার প্রতিকূল মনকে অনুকূল করে আনতে হবে। এ বড় কঠিন কায–প্রথম শ্রেণীর আর্টিষ্ট ভিন্ন অন্য কেউ পারবে না। তাই কনক আমি তোমার শরণ নিয়েছি।

অভিনেত্রী এ কথায় একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করিল ৷ বলিল–আচ্ছা, আমি চেষ্টা করব। কোনও রকম দায়ে বিপদে পড়ব না তা খগেনবাবু?

দায় বিপদ কিসের? তোমায় খুনও করতে হবে না, জালও করতে হবে না, চুরিও করতে হবে না–দায় কিসের? তুমি মুখের কথা বলবে মাত্র। আমার ভাগ্য যদি নিতান্ত মন্দ হয়, তবে বড় জোর সে তোমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তোমায় বিদায় করে দেবে। করে করবে, তুমি ঘরের ছেলে–অর্থাৎ ঘরের মেয়ে–ঘরে ফিরে আসবে।

কনক বসিয়া ভাবিতে লাগিল। খগেন্দ্র সিগারেট–কেসটি খুলিয়া আর একটি সিগারেট কনককে দিল, একটি নিজে আবার ধরাইল।

এই ভাবে নীরবে প্রায় দুই তিন মিনিট কাটিল। কনক তখন জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, তার বয়স কত শুনেছেন?

খবর পেয়েছি–তেইশ চব্বিশ।

কতদিন বিধবা হয়েছে?

বলতে গেলে আজন্ম বিধবা। যখন আট বৎসর বয়স, তখন তার বিবাহ হয়। মাস দুই পরে তার বালক স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার পর থেকে চৌদ্দ বছর সে সধবার বেশেই ছিল। দুই বৎসর হল তার শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছে। শ্রাদ্ধে বড় বড় পণ্ডিতেরা এসেছিলেন, তাঁরা বিধান দিলেন, যে ব্যক্তি চৌদ্দ বছর নিরুদ্দেশ, সে মরে গেছেই ধরতে হবে! কুশপুত্তল দাহ করে তার শ্রাদ্ধ করা আবশ্যক। তাই হল। সেই অবধি, অর্থাৎ দুবছর বউরাণী বিধবা বেশ ধারণ করেছে।

সংসারে আর কে কে আছে?

এক বুড়ো শাশুড়ী। একটি দেওর ছিল, সেও মরে গেছে। আর কেউ নেই। একলা থাকতে পারে না, তাই কাগজে ঐ বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

কনকলতা সংবাদপত্রখানি উঠাইয়া বিজ্ঞাপনটি দ্বিতীয়বার পাঠ করিল। বলিল–আচ্ছা–আমি না হয় নিষ্ঠাবতী হিন্দুবিধবা সেজে দরখাস্ত করলাম। আমাকেই চাকরি দেবে তার স্থিরতা কি?

স্থিরতা অবশ্য নেই। তবে সম্ভাবনা খুব বেশী। যদি ব্রাহ্ম বা খৃষ্টান মেয়ে চাইত, তা হলে ভাল লেখাপড়া জানে, গাইতে বাজাতে পারে, অথচ গরীবের ঘরের ভাল মেয়ে, পেতে পারত। কিন্তু নিষ্ঠাবতী হিন্দুবিধবাটিও হবে, অথচ ভাল লেখাপড়া গান বাজনা জানবে, এমন সোণার পাথরবাটি কোথায় আছে? তুমি দরখাস্ত করলে নিশ্চয়ই তোমার হবে।

আচ্ছা–২৫, জলপানি বলেছে কেন?

বেতন বললে পাছে রূঢ় শোনায়–হিঁদুর মেয়ে রাজি না হয়।

দুজন বড় বড় লোকের প্রতিষ্ঠাপত্র চাই যে লিখেছে–তার কি হবে?

আমি যোগাড় করে দেব–তার জন্যে চিন্তা নেই।

কবে দরখাস্ত করতে হবে?

যত শীঘ্ন হয়। আমি একটা মুসাবিদা প্রস্তুত করে এনেছি। –বলিয়া খগেন্দ্র চারি পৃষ্ঠা লেখা একখানি চিঠির কাগজ বাহির করিয়া কনকের হাতে দিল।

কনক সেটি পাঠ করিতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে হাসিয়া উঠিতে লাগিল। বলিল–উঃ–এত মিথ্যে কথাও আপনি লিখেছেন খগেনবাবু!

কনকের পাঠ শেষ হইলে খগেন্দ্র বলিল, বল, তুমি রাজি?

কনক বলিল, আমায় আজ সারাদিনটা সময় দিন। আমি ভেবে চিন্তে সন্ধ্যেবেলায় আপনাকে বলব।

খগেন্দ্র ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিল, প্রায় সাড়ে এগারটা। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–বেশ–মুসাবিদাটা তুমি রাখ। ভেবেচিন্তে দেখ। যদি দরখাস্ত করাই স্থির কর, তবে ওটা ভাল করে নকল করে রেখ। সন্ধ্যেবেলা এসে নিয়ে যাব।

কনকলতাও উঠিয়া দাঁড়াইল। হাসিতে হাসিতে বলিল–আচ্ছা–ভেবে দেখি। বসুন বসুন, বরফ দিয়ে একগ্লাস সরবৎ আনতে বলেছি। খেয়ে যান। যদি এ কাযে হাত দিই, আর সফলই হই, তা হলে ঘটকালিটে কি পাব বলুন দেখি?

খগেন্দ্র বলিল, তুমিই বল।

কনক চাপাহাসির সহিত বলিল, বিশ হাজার–আর, কলকাতায় একখানা ভাল বাড়ী।

তথাস্তু। –বলিয়া খগেন্দ্র ঝির হাত হইতে সরবতের গ্লাস লইল

কনক বলিল, আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। আর একটা সিগারেট দিন।

সিগারেট দিয়া সরবৎ পানান্তে খগেন্দ্র প্রস্থান করিল।

বৈকালে একটু ঘুরিয়া দুইখানি প্রতিষ্ঠাপত্র সংগ্রহ করিয়া, সন্ধ্যারপর খগেন আবার ফিরিয়া আসিল। দেখিল, কনক দরখাস্তখানি নকল করিয়া রাখিয়াছে। সেখানি লইয়া বলিল–আমার মুসাবিদাটা?

কনক বলিল, ওটা আমার কাছে থাক না!

তুমি নিয়ে কি করবে?

আমি রেখে দেব।

খগেন্দ্র একটু হাসিল। বলিল–যদি বেইমানি করে তোমার ঘটকালি ফাঁকি দিই, তাই আমার হাতের লেখায় আমার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ সংগ্রহ করে রেখে দিলে?

কনক হাসিয়া বলিল, না খগেনবাবু, তা নয়। আপনার হাতের একটা চিহ্ন থাকল।

খগেন্দ্র বলিল, বেশ রেখে দাও। কোনও ভয় কোরো না, তোমায় আমি ফাঁকি দেব না কনক। জেনো, চোরের মধ্যেও বিশ্বাস বলে একটা জিনিষ আছে, নইলে কি চোরেরই ব্যবসা চলে? –বলিয়া খগেন্দ্র বিদায় গ্রহণ করিল।

০২. এ আবার কে?

গঙ্গার উপরেই বাশুলিপাড়ার বাবুদেব সুপ্রশস্ত বাসভবন। বাটীর পশ্চাতে, অনেকটা স্থান ঘিরিয়া অন্তঃপুরের বাগান। তাহাতে দেশী ও বিলাতী ছোট–বড় নানাজাতীয় ফল ফুলের গাছ, পাতাবাহারের গাছ, লতামণ্ডপ শোভা পাইতেছে। বাগানটি গঙ্গাতীর পর্যন্ত প্রসারিত। ফল ও ফুলগাছ ছাড়া অনেকগুলি অন্যান্য গাছও আছে, বরং গঙ্গার কাছাকাছি এই সকল গাছেরই প্রাচুর্য। স্থানে স্থানে মর্মরমণ্ডিত আসন–বেদিকা।

ভোর হইবামাত্র একটি বিধবা যুবতী অন্তঃপুরের দ্বার খুলিয়া বাহির হইলেন।

তাহার পরিধানে একখানি শ্বেতবস্ত্র, গাত্রে নামাবলী জড়ান। যুবতীর মুখের উপর ঊষার আলোক পড়িয়া সেই কমনীয় মূৰ্ত্তি কমনীয়তর করিয়া তুলিল। তাঁহার দক্ষিণহস্তে একটি ফুলের সাজি, বামহস্ত রিক্ত। ইনি আর কেহ নহেন, বাশুলিপাড়ার জমিদারবাটীর বধূরানী শ্রীমতী ইন্দুমতী দেবী, আপাততঃ সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারিণী। তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রৌঢ়বয়স্কা একজন ঝিও বাহির হইল। তাহার হস্তে বস্ত্রাদি ও গামছা রহিয়াছে

বউরাণী ধীরে ধীরে বাগানের পথ অতিক্রম করিয়া ঘাটের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। ঝিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। উভয়েই নীরব। গাছে গাছে পক্ষিকুল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রভাতী গাহিতেছে। মৃদু সমীরণ ফুলবাস আহরণ করিয়া দিকে দিকে খেলিয়া বেড়াইতেছে।

বাগানের প্রান্তভাগে পরস্পর–সংলগ্ন দুইটি বাঁধা ঘাট। একটি পুরুষদিগের জন্য, অন্যটি অন্তঃপুরিকাগণের ব্যবহারার্থ। প্রস্তরনির্মিত সোপানাবলী অবতরণ করিয়া। জলমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। উভয় ঘাটের মধ্যভাগে পাথরে গাঁথা উচ্চ ব্যবধান।

বউরাণী যখন ঘাটের প্রথম সোপানে পৌঁছিলেন, তখনও ঊষালোক অস্পষ্ট। সেখানে দাঁড়াইয়া দেখিতে পাইলেন, জল হইতে দুই তিনটি সোপান উর্দ্ধে কি একটা পদার্থ যেন পড়িয়া রহিয়াছে। তাহা মনুষ্য কি কোনও জন্তু কি কাষ্ঠখণ্ড, ভাল নজর হইল না। বউরাণীর মনে একটু ভয়ও হইল। সেইখানে থমকিয়া দাঁড়াইয়া মুখ ফিরাইয়া ঝিকে বলিলেন–হাবার মা–শীগগির আয়!

হাবার মা সেখান হইতে দশবারো হাত পশ্চাতে ছিল। এই কথা শুনিয়া দ্রুতগতি আসিয়া বলিল, কেন বউরাণী?

বউরাণী অঙ্গুলির দ্বারা জলের দিকে দেখাইয়া বলিলেন, ওটা কি পড়ে রয়েছে বল দেখি?

হাবার মার বয়স পঞ্চাশ পার হইয়াছিল। সে কেবল দেখিল, কালো রকম লম্বা রকম কি একটা পড়িয়া রহিয়াছে। বলিল–ওমা তাই ত! ওটা কি গো বউরাণী?

আমি তোকেই ত জিজ্ঞাসা করছি। যা দিকিন, কাছে গিয়ে দেখে আয় পড়ে রয়েছে। ওটা কি?

হাবার মা চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিল, না মা, আমি যেতে পারবনি মা। কামড়ায় যদি?

বউরাণী একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আ মরণ! কামড়াবে কেন? বাঘও নয় ভালুকও নয়।

তবে কি ওটা?

আচ্ছা, তুই না পারিস, আমি গিয়ে দেখছি। –বলিয়া বউরাণী সোপান অবতরণ করিতে উদ্যত হইলেন।

ঝি তাঁহার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, যেওনি মা, যেওনি। ওটা কোনও জানোয়ার; জলে ভেসে এসেছে, কি হয়ত কুমীর ডাঙ্গায় উঠে গা শুকুচ্ছে। যদি কামড়ায় ত আর বাঁচবে না।

বউরাণী সবলে ঝির হস্ত হইতে অঞ্চল মুক্ত করিয়া লইয়া, সাবধানে সোপান অবতরণ করিতে লাগিলেন। ঝিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চারি পাঁচটা সিঁড়ির ব্যবধানে নামিতে লাগিল।

বউরাণী যত অগ্রসর হইতে লাগিলেন, ততই সেই পদার্থটি স্পষ্টতর হইয়া, মনুষ্যমূৰ্ত্তিবৎ প্রতীয়মান হইল। নিকটে গিয়া দেখিলেন একজন স্ত্রীলোক। তাহার মুক্তকেশ মুখ–বক্ষের উপর পতিত রহিয়াছে।

বউরাণী ডাকিলেন, ওগো–কে গা তুমি?

কোন উত্তর নাই।

ঝি পৌঁছিয়া বলিল, ওমা, যা মনে করেছি তাই! জলে মড়া ভেসে এসেছে। তা হতভাগী ছারকপালী! ভেসে ডাঙ্গায় ওঠবার আর জায়গা পেলিনি? উঠলি কি না শেষে আমাদের ঘাটে?

বউরাণী বলিলেন, ঝি, বোধ হয় মরেনি। ঐ দ্যাখ বুকের উপর যে চুলগুলি পড়ে রয়েছে সেগুলি একটু একটু উঠছে নামছে। বুকটি বোধ হয় ধুক ধুক করছে।

হাবার মার ক্ষীণচক্ষু স্পন্দনটুকু দেখিতে পাইল না। বলিল–হ্যাঁ, বউরাণীর যেমন কথা! ও নাকি বেঁচে আছে!

বউরাণী আরও কাছে গিয়া স্ত্রীলোকটির ললাট ও বুক হইতে চুল সরাইয়া হস্ত দ্বারা পরীক্ষা করিলেন। দেখিলেন, দেহে এখনও উত্তাপ আছে। বুকটি বাস্তবিকই ধুক ধুক করিতেছে। বলিলেন–হাবার মা, এ বেঁচে আছে। শীগগির দৌড়ে বাড়ী যা। একে বাড়ীতে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে লোকজন ডেকে আন; আর, কাউকে ছুটিয়ে দে ডাক্তার আনবার জন্যে। যা শীগগির যা, যত শীগগির পারিস।

হাবার মা তখন, ওমা কি বিপদ হল গো! হে হরি রক্ষে কর!–বলিতে বলিতে বাগানের ভিতর দিয়া সাধ্যানুসারে দৌড়িতে আরম্ভ করিল।

হাবার মা গামছা ও বস্ত্রাদি ঘাটের উপর ফেলিয়া গিয়াছিল। বউরাণী সেগুলি লইয়া আসিয়া, স্ত্রীলোকটির সিক্তবস্ত্র কষ্টে মোচন করিয়া লইলেন। গামছা দিয়া যথাসাধ্য তাহার গাত্র মার্জনা করিয়া একখানি শুষ্ক বস্ত্র তাহাকে পরাইয়া দিলেন। তাহার পর স্বীয় অঞ্চল দিয়া আবার তাহার সর্বাঙ্গ ঘর্ষণ করিতে লাগিলেন। ততক্ষণ একটু আলো হইয়াছিল। দেখিলেন, তাহার গ্রীবার পশ্চাদ্ভাগ ব্যাপিয়া মাল্যের আকারে একটা রক্তবর্ণ চিহ্ন পড়িয়াছে, চর্মে স্থানে স্থানে ক্ষত হইয়া অল্প অল্প রক্তপাতও হইতেছে।

ইতিমধ্যে হুম হুম্ করিয়া চারিজন বেহারা একটা পাল্কী আনিয়া ফেলিল। বউরাণীর ইঙ্গিত পাইয়া, মৃতকল্প স্ত্রীলোকটিকে পাল্কীতে উঠাইয়া তাহারা বাটীর দিকে ছুটিল। বউরাণীও ক্ষিপ্রচরণে তাহাদের পশ্চাামিনী হইলেন।

০৩. অভাগিনী

এক সপ্তাহ অতীত হইয়াছে।

অপরাহ্নে অন্ত্বঃপুরসংলগ্ন উদ্যানে একটি বকুলগাছের ছায়ায় মৰ্ম্মরবেদিকার উপর পূৰ্ব্বকথিত স্ত্রীলোকটি উপবিষ্ট রহিয়াছে। এ কয়দিন জ্বরভোগের পর আজ সে একটু সুস্থকায়; তাই বউরাণী তাহাকে বাগানে বায়ুসেবনার্থ পাঠাইয়াছেন।

স্ত্রীলোকটির বয়স অনুমান বিংশতি বর্ষ। তাহার বিশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ মুখখানিতে বিষাদের ঘনছায়া পরিব্যাপ্ত। চক্ষু দুইটি সৰ্ব্বদা আনত ও সজল। দেখিলে মনে হয় বুঝি অনেক কষ্টে রোদন সম্বরণ করিয়া রহিয়াছে। পরিধানে সাদা সেমিজের উপর একখানি লালপাড় শাড়ী। ইহা বউরাণী দিয়াছেন। প্রকোষ্ঠযুগলে স্বর্ণবলয়, বামহস্তে সধবার চিহ্নও বৰ্ত্তমান। এগুলি পূৰ্ব্ব হইতেই ছিল। ঝুরু ঝুরু বাতাসেই দুই চারিটি করিয়া বকুলের ফুল ঝরিয়া এই যুবতীর গাত্রে, চারিপাশে পতিত হইতেছে। সে মাঝে মাঝে একটি ফুল তুলিয়া লইতেছে, আবার ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনে তাহা ভুতলে নিক্ষেপ করিতেছে।

বসিয়া বসিয়া, যুবতী কিয়ৎক্ষণ পরে সেই বেদিকার উপর শয়ন করিল। কিয়ৎপরে উঠিয়া বসিয়া, করতলে কপোল রক্ষা করিয়া চিন্তা করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে বক্ষ কাঁপাইয়া এক একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়িতেছে। আহা, এ রমণী বড় দুঃখিনী।

অন্তঃপুর হইতে একজন দাসী বাহির হইয়া আসিল। তাহার বাম কক্ষতলে একখানি শতরঞ্জ ও একটি বালিস, দক্ষিণ হস্তে কাঁসার গেলাস ভরা কতকটা গরম দুধ। কাছে আসিয়া বিছানা নামাইয়া রাখিয়া দাসী বলিল, দুধ খাও।

রমণী বলিল, এখন দুধ কেন ঝি?

বউরাণী পাঠিয়ে দিলেন। বললেন অনেক কুইনান খেয়েছে, একটু বেশী করে দুধ না খেলে মাথা ঘুরবে। তুমি দুধটুকু ততক্ষণ খাও, আমি বিছানাটা পেতে দিই।

রমণী ঝির হাত হইতে দুধের গেলাস লইয়া বলিল, আহা কেন আবার কষ্ট করে বিছানা আনতে গেলে? আমি এই শানের উপরেই শুতাম এখন–খাসা ঠাণ্ডা।

বউরাণী বললেন, যে বসে থাকতে বোধ হয় কষ্ট হচ্ছে, একটা বিছানা–টিছানা পেতে দিয়ে এস, আমি একটু পরেই আসছি।

দুগ্ধ পান করিতে করিতে রমণী বলিল, তোমাদের বউরাণী মানুষ নয় ঝি, উনি দেবতা।

ঝি তখন এদিক ওদিক চাহিয়া চুপে চুপে জিজ্ঞাসা করিল, দিদিঠাকরুণ, তোমাদের বাড়ী কোথা গো?

এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়া ঝি তাহার কর্ত্রীর আজ্ঞা লঙ্ন করিল। সেদিন গঙ্গাতীর হইতে উঠাইয়া আনিবার পর ডাক্তার অনেক কষ্টে এই রমণীর চেতনা সম্পাদন করিয়াছেন, কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই সে প্রবল জ্বরে অভিভূত হইয়া পড়ে। জ্বরের কিঞ্চিৎ উপশম হইলে পরদিন বউরাণী তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। দুই তিনবার জিজ্ঞাসা করার পর, যেন অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া রমণী বলিয়াছিল, আমার নাম, সুরবালা। কি জাত জিজ্ঞাসা করায় অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া রমণী বলিয়াছিল, আমরা ব্রাহ্মণ। –বাপের বাড়ী কোথা, শ্বশুরালয় কোথা, এ সব পরিচয় জিজ্ঞাসায় রমণী কাঁদিতে আরম্ভ করে, কোনও উত্তর দেয় নাই। তৎপরদিন বউরাণীর অনুপস্থিতিতে তাঁহার শ্বশ্রূঠাকুরাণীও পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতেও উক্তরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল। এ কথা বউরাণীর কাণে যায়। ইহাতে তিনি বিবেচনা করিলেন, উহার পিত্রালয় বা শ্বশুরালয়ের স্মৃতির সঙ্গে কোনও মহাদুঃখ জড়িত আছে। এ দিকে এই গঙ্গায় ভাসিয়া–আসা স্ত্রীলোকটির পরিচয় জানিবার জন্য বাটীর দাস–দাসী সকলেই অত্যন্ত উগ্রীব হইয়া উঠিয়াছিল, কিছুতেই তাহারা কৌতূহল দমন করিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। তাই বউরাণী সকলকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন, কেহ যেন এই রমণীর পরিচয়সূচক কোনও প্রশ্ন তাহাকে না জিজ্ঞাসা করে। তাই সাবধানে চারিদিক চাহিয়া দেখিয়া সভয়ে ঝি প্রশ্ন করিল, দিদি ঠাকরুণ, তোমাদের বাড়ী কোথা গো?

সুরবালা একটু বিরক্তির সহিত বলিল, শ্মশান।

উত্তরটা শুনিয়া ঝি চমকিয়া উঠিল। সুরবালার কঙ্কালসার দেহখানির পানে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। মুখের পানে চাহিল। সেই সময়টা, সূৰ্য্য একটু নামিয়া যাওয়াতে সে স্থানটায় রৌদ্র আসিয়া পতিত হইল। ঝি তখন বলিল, না দিদিঠাকরুণ, তুমি তা নও।  

সুরবালা জিজ্ঞাসা করিল, আমি কি নই?

তুমি তা নও। এই যে তোমার ছায়া পড়েছে দিদিঠাকরুণ।

বড় দুঃখের সময়ও সুরবালার মুখে হাসি আসিল। বলিল–না, আমি তা নই। আমি তোমাদেরই মত মাটীর মানুষ।

ঝি তখন সুরবালাকে বিছানায় শয়ন করাইয়া বলিল, বউরাণী কি করছেন দেখিগে। –বলিয়া সে প্রস্থান করিল।

কিয়ৎপরে সুরবালা দেখিল, বউরাণী বাগানের দিকে আসিতেছেন। তিনি নিকটবর্তী হইলে সে উঠিয়া বসিল।

বউরাণী বলিলেন, তুমি শোও শোও–উঠ না।

সুরবালা বলিল, না, আমি বেশ বসতে পারব। এতক্ষণ ত বসেই ছিলাম। এইমাত্র শুয়েছি।

বউরাণী বলিলেন, তুমি কাহিল মানুষ, শুয়ে থাক। আমি তোমার কাছে বসছি। বেশীক্ষণ বসে থাকলে তোমার কষ্ট হবে। –বলিয়া তিনি শতরঞ্জের একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। হাসিতে হাসিতে সুরবালার স্কন্ধে হস্তাৰ্পণ করিয়া তাহাকে শোয়াইয়া দিলেন।

সুরবালা আকুলনয়নে বউরাণীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। বলিল–আপনি বসে রইলেন, আমি শুলাম, এটা ত ভাল হল না!

কেন, দোষ কি? তুমি রোগী, আমি ত রোগী নই। আর দেখ, আমি তোমায় তুমি বলি, তুমি আমায় আপনি বল কেন?

একথা শুনিয়া সুরবালার সেই ছলছল চক্ষু আরও যেন ভারি হইল। রুদ্ধকণ্ঠে বলিল–আপনি স্নেহ করেন বলেইতো ও কথা বলছেন। আপনারা রাজাতুল্য লোক। আমি আপনার দাসীর যোগ্যও নই। তা সত্ত্বেও, সে সব কিছু মনে না করে, আমার অসুখের সময় আপনি যে সেবাটা নিজে হাতে আমায় করেছেন, লোকের মা বোনেও সে রকম পারে না। তবে–না করলেই ভাল করতেন।

বউরাণী তাহার মনের ভাব বুঝিয়াছিলেন। আজ প্রথম নহে, এ কয়দিনই লক্ষ্য করিতেছেন, বাঁচিয়া উঠিয়াছে বলিয়া এ রমনী নিজ অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতেছে। ইহার পরিচয় ত জানিতে পারেন নাই, ইহার কিসের এত দুঃখ তাহাও কিছুমাত্র নির্ণয় করিতে পারেন নাই। এ কয়দিন সুরবালার সহিত বিশ্রম্ভালাপের সুযোগও তিনি পান নাই। আজ প্রথম দুইজনে নিরালায় কথোপকথন। অথচ এ অভাগিনীর দুঃখের কারণ অবগত হইবার জন্য যদি সম্ভব হয় সে দুঃখভার কিয়দংশও লাঘব করিবার জন্য, বউরাণীর পুষ্পকোমল হৃদয়খানি উন্মুখ হইয়া রহিয়াছে। তাহার মুখে এ কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–তোমায় বাঁচাতে চেষ্টা করে কি ভাল করিনি?

সুরবালা বলিল, আমার মত হতভাগিনীর পক্ষে মৃত্যুই ভাল ছিল।

অনুযোগের স্বরে বউরানী বলিলেন, ছি–ও কথা কি বলতে আছে? নিজের মরণ কামনা কি করতে আছে? ভগবান যে জীবন দিয়েছেন, সে তার মহাদান। সে জীবনে তাচ্ছিল্য করা–তারই অপমান করা।

সুরবালা বলিল, জীবন দিয়েছিলেন বেশ করেছিলেন। কিন্তু জীবনের সঙ্গে সঙ্গে এত দুঃখ দিলেন কেন?

তিনি যা ভাল বুঝেছেন তাই তিনি করেছেন। তাঁর কাযে দোষ দেখা, ছল ধরা কি আমাদের সাজে? তিনি দুঃখ যা দিয়েছেন, তাও আমাদের মাথা পেতে নিতে হবে।

সুরবালা অন্যদিকে চাহিয়া নীরব হইয়া রহিল। সূৰ্য্য অনেকক্ষণ অস্ত গিয়াছেন। দিবালোক অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে। বাগানের যত পাখী গঙ্গার বেলাভূমিতে চরিতে গিয়াছিল, তাহারা ফিরিয়া কলকোলাহলে আকাশ পূর্ণ করিয়া ফেলিতেছে।

একটু পরে বউরাণী বলিলেন, তোমার কি দুঃখ, আমায় তুমি বলবে? –বলিয়া সস্নেহে তিনি সুরবালার একখানি হাত, নিজের হাতের মধ্যে লইলেন

সুরবালা কিন্তু কোনও উত্তর করিল না। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া তাহার চক্ষুযুগল হইতে অবিরল ধারায় অশ্রুবন্যা প্রবাহিত হইল।

বউরাণী বলিলেন, থাক্ থাক্‌ কেঁদ না কেঁদ না। সে কথা মনে করতেও যদি তোমার এত দুঃখ, তাহলে বলে কায নেই। আমি আর এ প্রসঙ্গ তুলব না। শুধু একটি শেষকথা জিজ্ঞাসা করি।

সুরবালা তাহার অশ্রুসিক্ত চক্ষু দুইটি বউরাণীর দিকে ফিরাইল।

বউরাণী নিজ বাঞ্চল দিয়া সযত্নে তাহার চক্ষু ও কপোলযুগল মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ কোথাও আছেন কি না, তা আমরা কিছুই জানিনে, তুমি কিছুই বলনি। তুমি আজ আটদিন এখানে রয়েছ। তোমার খবর না পেয়ে তারা হয়ত কত ভাবছেন। তাঁদের কোনও খবর দেওয়া উচিত নয় কি? তারা জানতে পারলে হয়ত এসে তোমায় নিয়ে যেতে পারতেন।

সুরবালা ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। বলিল–বউরাণী–এ পৃথিবীতে আমার আর এমন কেউ নেই, যে আমার খবর না পেয়ে ভাবিত হবে–কিম্বা খবর পেলে খুসী হবে–কিম্বা এসে আমায় নিয়ে যাবে। আমার দুর্ভাগ্যের সীমা নেই। তাই আমার নিজের কোনও পরিচয় আপনার কাছে বলিনি। সামান্য যা বলেছি তাও কাল্পনিক–যথার্থ নয়। এটুকু আপনাকে জানিয়ে রাখলাম, কারণ আপনার সঙ্গে এ চাতুরীটুকু করে ভারি অন্যায় করেছি, অকৃতজ্ঞের কায করেছি। আপনি যদি আমায় জীবন দিলেন, তবে আমার কাছে আর একটি প্রার্থনা আছে। –বলিয়া সুরবালা, বউরাণীর পদযুগল ধারণ করি

ওকি কর–ওকি কর ভাই!–বলিয়া বউরানী তাহার হাত দুইটি সবলে টানিয়া লইলেন।

সুরবালা কাতরস্বরে বলিতে লাগিল–আমার প্রার্থনা এই। আপনাদের এ সংসার ত রাজসংসার। ভগবানের কৃপায় আপনাদের কোনও বিষয়ের অভাব ত নেই। আমি যতদিন বাঁচি–এই সংসারে আমাকে আশ্রয় দিয়ে রাখুন। কত দাসদাসীকে আপনি ত প্রতিপালন করছেন; সেইরকম আমাকেও প্রতিপালন করুন। আমায় ত্যাগ করবেন না।

এই মর্মভেদী কথাগুলি শুনিয়া বউরাণী কয়েক মুহুৰ্ত্ত স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। নিজ বাঞ্চল দিয়া আবার সুরবালার চক্ষু মুছাইয়া বলিলেন–এই কথা? –তা, এর জন্যে তুমি এত কাতর হয়েছ কেন ভাই? তোমায় ত্যাগ করব, এমন কথা ত আমি বলিনি। আমি তোমায় এইখানেই রাখব কোথাও যেতে দেব না। কেমন? এখন শান্ত হও, চুপ কর–আর কেঁদ না।

কিন্তু সুরবালার চক্ষু বারণ মানে না। অনেক করিয়া বউরাণী তাহাকে কতকটা শান্ত করিলেন।

সন্ধ্যা হইল। উভয়ে তখন উঠিয়া অন্তঃপুর অভিমুখে চলিলেন। পথে যাইতে যাইতে শ্রান্ত হইয়া সুরবালা একটা কাষ্ঠাসনে বসিয়া পড়িল।

বউরাণীও বসিলেন, আকাশে তখন দুই একটি করিয়া নক্ষত্র দেখা দিতে লাগিল। দুইজনে কথাবার্তা হইতে লাগিল।

বউরাণী বলিলেন, দেখ ভাই, আমি একলাটি থাকি, কোনও সমবয়সী সঙ্গী সাথী নেই, দিন আমার কাটে না, তাই আমার দেওয়ান–তাকে আমি কাকা বলি–আমার একজন সহচরীর জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আমি ভাবছি কি, বাইরে থেকে অন্য কোন লোক এনে আর কি হবে, তুমিই আমার সহচরী হয়ে থাক। আমি কাকাকে বলব–কি বল?

সুরবালা মৃদুস্বরে বলিল, আপনার দয়া আমি কখনও ভুলব না।

অতঃপর দুইজনে অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

০৪. “মা তুমি দয়াময়ী!”

পরদিন প্রভাতে গঙ্গাস্নান ও পূজার্চনা শেষ করিয়া বউরাণী দেওয়ানজিকে ডাকিয়া পাঠাইবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন, এমন সময় সংবাদ আসিল, দেওয়ান স্বয়ং দর্শনপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

শ্ৰীযুক্ত রঘুনাথ মজুমদার মহাশয় এই জমিদারবংশের পুরুষানুক্রমিক দেওয়ান। তাঁহার বয়স ষষ্টিবৎসরেরও উপর হইয়াছে, কিন্তু তথাপি এখনও বেশ কার্যক্ষম আছেন। খৰ্বায়ত শ্যামবর্ণ বৃদ্ধ, দেহখানিও দেওয়ানোচিত হৃষ্টপুষ্ট। স্বর্গীয় কর্তা মহাশয় হঁহাকে যথেষ্ট স্নেহ ও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন। জাতিতে বৈদ্য হইলেও ইনি পরিবারস্থ সকলের নিকট আত্মীয়বৎ। বউরাণী বঁহাকে পিতৃব্য সম্বোধন করিয়া থাকেন, তাহা পূৰ্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

অন্তঃপুরের মধ্যে একটি কক্ষ, বউরাণীর আফিসঘরস্বরূপ সজ্জিত ছিল। চেয়ার টেবিল আলমারি প্রভৃতি, টানাপাখা, এই কক্ষে ছিল। বউরাণীকে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে অথবা কোনও কাগজপত্রে তাহার দস্তখত লইবার জন্য দেওয়ানজি যখন অন্তঃপুরে আগমন করিতেন, তখন এই কক্ষ–খানিতেই তাঁহাকে বসিতে হইত। বউরাণী কিন্তু হিন্দুপুরমহিলাসুলভ লজ্জাবশতঃ দেওয়ানজির সমক্ষে কোনও দিন চেয়ারে উপবেশন করেন নাই, পরিচারিকাসহ আসিয়া অৰ্দ্ধাবগুণ্ঠনে দেওয়ানজির আসনের কিয়দ্দূরে দাঁড়াইয়া থাকিতেন। অদ্যও তাহাই করিলেন।

দেওয়ানজি পূৰ্ব্ব হইতেই সেই কক্ষে বসিয়া ছিলেন; বউরাণী প্রবেশ করিবামাত্র তিনি সসম্মানে দণ্ডায়মান হইলেন।

কাকা–বসুন–বলিয়া বউরাণী তাঁহার যথাস্থানে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

মা, তোমার শরীর বেশ ভাল আছে?

হ্যা কাকা, আমি বেশ ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন ত?

হা মা, বেশ আছি। আচ্ছা, তুমি যে গঙ্গার ঘাটে সেদিন সেই মেয়েটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে, তার পরিচয় কিছু জানতে পেরেছ?

না কাকা, সে কিছু বলে না। কিছু বলবে, এমন আশাও নেই।

পুলিশে ত একটা খবর দেওয়া উচিত? কোথা থেকে কে এল, শেষকালে ওকে নিয়ে কোন বিপদ না উপস্থিত হয়।

এর জন্যে আর থানা পুলিশ কেন কাকা? একজন অনাথা স্ত্রীলোক, বোধ হয় নৌকা থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল, ভেসে এসেছে; তাকে আমরা আশ্রয় দিয়ে রেখেছি, এর জন্যে আর বিপদ আপদ কি? পুলিশে জানালেই তারা এসে বেচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, আমি তা চাইনে।  

দেওয়ানজি একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, সে জন্যে নয়। তবে শুনেছিলাম তার গলায় একটা দড়ির দাগ আছে; হয়ত কেউ তাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, নয়ত সে আপনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, উভয় অবস্থাতেই ব্যাপারটা পুলিশের তদন্তযোগ্য। কিন্তু তোমার যখন অমত–তখন খবর দেব না–থাক্। গলার সে চিহ্নটা কি এখনও আছে?

অতি সামান্য। আর দুচারদিনেই মিলিয়ে যাবে।

তা বেশ। আজ আমি এসেছিলাম, তোমার সহচরীর জন্যে কাগজে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, তার উত্তরে এই কতকগুলো আবেদন এসেছে। –বলিয়া দেওয়ানজি হস্তস্থিত ডাকের চিঠিগুলি গণনা করিয়া বলিলেন–পাঁচখানা।

কুড়ান স্ত্রীলোকটিকেই নিজ সহচরী নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব বউরাণীর ওষ্ঠযুগলের নিকট পর্যন্ত আসিল, কিন্তু লজ্জা ও সঙ্কোচবশতঃ বলিবলি করিয়া তিনি বলিতে পারিলেন না। ভাবিলেন আবেদনপত্রগুলির কথা প্রথমে শুনিয়া লই, তারপর সে প্রস্তাবটি উপস্থিত করিব।

দেওয়ানজি চিঠিগুলির উপরিভাগে চক্ষু রাখিয়া বলিলেন, এর মধ্যে চারখানি তেমন সুবিধে নয়। একজনের আবেদন পড়ে মনে হচ্ছে, তার দ্বারা বোধ হয় কায চলতে পারে। সব আবেদনগুলি পড়ে শোনাব কি?

বউরাণী বলিলেন, বেশ ত।

দেওয়ানজি তখন প্রথমখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন। কলিকাতা শ্যামবাজারের একজন বয়সী বিধবার আবেদন–তিনি রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া শুনাইতে পারেন, লিখিয়াছেন। সঙ্গীতাদির বিষয়ে তাদৃশ্য ক্ষমতা নাই। সন্তানাদি নাই, ভাসুরপোর আশ্রয়ে বাস করেন। সেই ভাসুরপো অত্যন্ত স্ত্রীবশ–ইহাকে গ্রাহ্যই করেন না। কাশী বা বৃন্দাবনে গিয়া বাস করিবার মলবই ছিল। এ কাৰ্য্যাটি যদি মিলে, তবে তীর্থযাত্রা আপাততঃ স্থগিত রাখিতে প্রস্তুত আছেন। –পত্রপাঠ শেষ করিয়া দেওয়ানজি বলিলেন, আমরা যে রকমটি খুঁজছি–এটি সে রকম বলে মনে হয় কি? তোমার একজন সমবয়সীর মত হয়, তোমার সঙ্গে গল্প–গুজব আমোদ–প্রমোদ করে, তোমার মনটি বেশ প্রফুল্ল থাকে, এই রকমটিই আবশ্যক। কেমন মা, তাই না?

বউরাণী সঙ্কোচের সহিত বলিলেন, হ্যা কাকা।

অতঃপর দেওয়ানজি দ্বিতীয় পত্রখানি পাঠ করিলেন। এই আবেদনকারিণী লেখাপড়া জানেন না, তবে মুখে মুখে দাশুরায়ের ছড়া, অঙ্গদের রায়বার ইত্যাদি আবৃত্তি করিতে পারেন। ইঁহারও বয়স হইয়াছে–রন্ধনবিদ্যা ও অন্যান্য গৃহকাৰ্য্যে অত্যন্ত পটীয়সী বলিয়া নিজেকে বর্ণনা করিয়াছেন। এ আবেদনও দেওয়ানজি অমনোনীত করিলেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ পত্রও ঐ জাতীয় কারণে অগ্রাহ্য হইল। তখন দেওয়ানজি শেষ পত্রখানি খুলিয়া, চশমাটি চোখে ভাল করিয়া লাগাইয়া স্মিতমুখে বলিলেন, এই স্ত্রীলোকটি যে ভাল রকম লেখা পড়া জানে–তা এর হাতের হরপ দেখলেই বোঝা যায়। রচনাও দিব্যি। –বলিয়া পাঠ আরম্ভ করিলেন।

কলিকাতা
৬ই চৈত্র।
 মান্যবর শ্রীযুক্ত রঘুনাথ মজুমদার
বাশুলিপাড়া এষ্টেটের ম্যানেজার মহাশয়
সমীপেষু।
মহাশয়,
আপনি ৫ই চৈত্র তারিখের দেশবন্ধু সংবাদপত্রে কর্মখালির যে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা পাঠ করিয়া আমার এই আবেদনপত্রখানি আপনার সকাশে পাঠাইতে সাহসী হইতেছি। কৃপাবলোকনে ইহার আদ্যন্ত দৃষ্টি করিলে কৃতার্থ হইব।
আমার পিতার নাম যোগজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়–নিবাস বহরমপুরে ছিল। আমি বাঙ্গালা সাহিত্য রীতিমত অধ্যয়ন করিয়াছি। রামায়ণ মহাভারত হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তমান কালের জীবিত কবি নাট্যকার ও ঔপন্যাসিকগণের গ্রন্থাবলীর সহিত সম্যগভাবে পরিচিতা। আমি স্বয়ং একখানি নাটকও রচনা করিয়াছি, কিন্তু অর্থাভাবে এতবাৎ কালাবধি মুদ্রিত করিতে পারি নাই। এক সময় আমি সঙ্গীত–বিদ্যারও যথেষ্ট অনুশীলনে করিয়াছিলাম। নিপুণ ওস্তাদগণের নিকট আমার শিক্ষা, তাহার পর হইতে আমি স্বয়ং চর্চা করিয়া কিঞ্চিৎ সফলতাও লাভ করিয়াছি। যন্ত্রাদির মধ্যে পিয়ানো, হার্মোনিয়ম, এস্রাজ এবং বেহালা বাজাইতে শিখিয়াছিলাম। অধূনা দারিদ্র্যবশতঃ ঐ সকল যন্ত্রাভাবে আমার সে বিদ্যা নিশ্চয়ই নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে, কিছুদিন অভ্যাসের সুযোগ পাইলেই পুনৰ্ব্বার তাহা আমার করায়ত্ত হইবে সন্দেহ নাই। আমি হিন্দুকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম–গোঁড়া হিন্দু পরিবারে আমার দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত হইয়াছিল, এখন এই কলিকাতা সহরে একজন অবলা রমণীর পক্ষে হিন্দু আচার পালন যতদূর সম্ভব তাহা করিতেছি। যতদূর সম্ভব বলিবার তাৎপর্য এই যে, এখানে বাধ্য হইয়া আমাকে কলের জল পান করিতে হয়। এমন সঙ্গতি নাই যে ভৃত্য নিযুক্ত করিয়া গঙ্গা হইতে প্রত্যহ পানীয় জল আনয়ন করি।
আমি অন্তঃপুরবাসিনী হিন্দুরমণী হইয়াও উক্ত বিদ্যাগুলি কিরূপে লাভ করিলাম, তাহা বুঝাইতে হইলে, সক্ষেপে আমার জীবনকাহিনী মহাশয়ের গোচর করিতে হয়। সুতরাং নিমে তাহা নিবেদন করিতেছি।
বিংশতি বৎসর পূৰ্ব্বে, বহরমপুরে, আমার জন্ম। আমার পিতামহ মহাশয় কিঞ্চিৎ ভূসম্পত্তি রাখিয়া যান, আমার পিতা ও দুইজন পিতৃব্য তাহা সমান অংশে ভাগ করিয়া লইয়া ভোগ দখল করিতেন; কিন্তু সকলেই একান্নে ছিলেন। আমি যখন সাত বৎসরের, তখন আমাকে এবং আমার পঞ্চদশবর্ষীয় জ্যেষ্ঠ সহোদরকে রাখিয়া আমার মাতৃদেবী স্বর্গারোহণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর, পিতৃদেব গৃহে বড় থাকিতেন না, অধিকাংশ সময়ই কলিকাতায় যাপন করিতেন। কয়েক মাস পরে ৩০০ বেতনে তিনি কোনও ইংরাজি হাউসে খাজাঞ্চির কর্মে নিযুক্ত হন। এই কম্মটি পাইবার জন্য যাহা কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, সমস্তই জামিন স্বরূপ রাখিতে হইয়াছিল। চাকরি গ্রহণ করিয়া কলিকাতার বাসায় তিনি আমাদের দুই ভাইবোনকে লইয়া আসেন এবং আমাদের এক বৃদ্ধা পিসিমাও সঙ্গে আসেন।
কলিকাতায় বাসকালীন পিতৃদেবের ধর্ম ও সামাজিক মতাদির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছিল (যদিও তিনি কখনও ধৰ্মান্তরে দীক্ষিত হন নাই, আজীবন হিন্দুসমাজভুক্তই ছিলেন)। দাদা বিদ্যালয়ে পাঠ অভ্যাস করিতে লাগিলেন এবং আমাকে লেখাপড়া শিল্পকর্ম ও গীতবাদ্য শিক্ষা দিবার জন্য পিতৃদেব উপযুক্ত শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দিলেন। আমি যখন দশ এগারো বৎসরের হইলাম তখন আমাদের দেশের আত্মীয়গণ এবং কলিকাতায় পিসিমাতা ঠাকুরাণী, আমার বিবাহ দিবার জন্য পিতৃদেবকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। তিনি কিন্তু বলিলেন, অত ছোট মেয়ে বিবাহ দিব না। ও এখন লেখাপড়া শিখুক। যখন ষোল বৎসরের হইবে তখন বিবাহ দিব। সুতরাং আমার লেখাপড়া, গীতবাদ্যচর্চা পূৰ্ব্বমতই চলিতে লাগিল। এইরূপে যখন আমার বয়ঃক্রম চতুর্দশ হইল, তখন পিতৃদেবের এক মহা বিপদ উপস্থিত হইল। তাহার কোনও অধস্তন কর্মচারীর দোষে হাউসের তহবিল হইতে অনেক টাকা তস্রপ হইয়া যায়, তজ্জন্য পিতাঠাকুরকেই সম্পূর্ণ দায়ী হইতে হইল। তাঁহার চাকরী গেল, বিষয় সম্পত্তির সমস্তই বিক্রয় হইয়া গেল। ইহার ছয়মাস পরেই আমাদিগকে অকূল শোকসাগরে ভাসাইয়া তিনি স্বর্গারোহণ করিলেন। দেশ হইতে আমার পিতৃব্যগণ আসিয়া আমাকে লইয়া গেলেন। এবং অনেক চেষ্টা করিয়া আমার বিবাহ দিলেন। বিবাহোচিত বয়স আমি অতিক্রম করিয়াছিলাম বলিয়া, আমার বিবাহে তাহাদিগকে বিলক্ষণ বেগ পাইতে হইয়াছিল। আমি যে ঘরে পড়িলাম তাঁহারা সকুলজাত হইলেও হীনাবস্থ। ধনী পিতার আদরের কন্যাস্বরূপে প্রতিপালিত হইলেও, তাহাদের সংসারে গিয়া আমি, কায়মনোবাক্যে পতি ও অন্যান্য গুরুজনের সেবা করিতে লাগিলাম। যে আমি পিতৃভবনে নিজের কাপড় নিজে কখনও কাচি নাই, সেই আমি শ্বশুরালয়ে হাস্যমুখে বড় বড় তৌলহাঁড়ি করিয়া ধান সিদ্ধ করিতে লাগিলাম। কিন্তু পূৰ্ব্বজন্মে আমি মহাপাপিনা ছিলাম–তাই আমার সৌভাগ্যশশী অকালেই অস্তমিত হইল। কাল বিসূচীকা রোগ আসিয়া আমার সীমন্তের সিন্দুর মুছিয়া লইল, আমি বিধবা হইলাম। ইহা তিন বৎসরের কথা।
আমার শ্বশুরকুল দরিদ্র পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি। অন্ন বস্ত্রাভাবে সেখান হইতে আমায় চলিয়া আসিতে হইল। আমার দাদা এই কলিকাতা সহরে তখন ৪০ টাকা বেতনের একটি মাষ্টারি করিয়া আইন অধ্যায়ন করিতেছিলেন। সে ৪০ টাকার উপর নির্ভর করিয়া আমরা তিনটি প্রাণী কায়ক্লেশে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে লাগিলাম। গত পৌষ–সংক্রান্তির দিন আমার পিসি–মাতাও গঙ্গালাভ করিলেন। দাদা এই বৎসর আইন পাশ হইয়াছেন। তাঁহার ইচ্ছা, পশ্চিমের কোনও ভাল জেলায় গিয়া ওকালতী ব্যবসায় আরম্ভ করেন। কিন্তু আমাকে তিনি এখানে ফেলিয়া যাইতে পারেন না, সঙ্গে করিয়া পশ্চিম লইয়া যাওয়াও একান্ত অসুবিধাজনক। দাদা অবিবাহিত। আমি সেই বিদেশে গিয়া দাদার বাসায় একাকী থাকিব কেমন করিয়া? এই সকল কারণে তিনি নড়িতে পারিতেছেন না। আমি তাঁহার জীবনের উন্নতির বিঘ্নস্বরূপিণী হইয়া রহিয়াছি। এমন সময় মহাশয়ের প্রদত্ত বিজ্ঞাপনটি পাঠ করিয়া মনে হইল, বুঝি ভগবান দয়া করিয়া এই অকূলে কূল দিলেন।
আপনি যদি এই কর্মটিতে আমাকে নিযুক্ত করেন তবে একজন অনাথা ব্রাহ্মণ। কন্যার অশেষ উপকার করা হয়। আমি সৰ্ব্বদা শ্রীযুক্তা বধূরাণী মহোদয়ার চিত্তবিনোদনে সচেষ্ট থাকিব। তিনি যদি দয়া করিয়া আমায় স্মরণ করেন, তবে দাদামহাশয়কে সঙ্গে লইয়া অচিরাৎ বাশুলিপাড়া যাত্রা করিব। উত্তরের আশায় রহিলাম।
বিনীতা নিবেদিকা
শ্রীমতী কনকলতা দেবী

পাঠ শেষ করিয়া দেওয়ানজি বলিলেন, আমার ভারি ইচ্ছে এই মেয়েটিকেই নিযুক্ত করি। তুমি কি বল মা?

এই দুঃখ কাহিনী শ্রবণ করিতে করিতে বউরাণীর হৃদয়খানি করুণায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিলাম। তিনি বিবেচনা করিলেন, বেশ ত আসুক। এও আসুক, সুরবালাও থাকুক। ঈশ্বরের ইচ্ছায়, আমার ত কোনও অভাব নেই। –প্রকাশ্যে বলিলেন–বেশ। আপনি যা ভাল বিবেচনা করবেন তাই হবে কাকা। ওঁকেই নিযুক্ত করুন।

দেওয়ানজি বলিলেন, তবে আজই চিঠি লিখে দিই।

বউরাণী একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, আচ্ছা কাকা, এঁদের রাহাখরচ কিছু পাঠান আবশ্যক ত?

দেওয়ানজি বলিলেন, রাহাখরচ? প্রথম কৰ্ম্মে যে প্রবৃত্ত হয় সে নিজের খরচেই আসে। এই নিয়ম।

বউরাণী মিনতির স্বরে বলিলেন, কিন্তু ইনি স্ত্রীলোক যে–আর অবস্থাও

দেওয়ানজি একটু মুচকী হাসিলেন। বলিলেন–তা বেশ; তুমি যখন বলছ, তখন রাহাখরচ হিসাব করে পাঠিয়ে দেব।

বউরাণী সহজে ছাড়িবার পাত্রী নহেন। বলিলেন–আর মেয়েটির কাপড়–চোপড় অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিষের জন্যেও ত কিছু পাঠান উচিত? যে রকম কষ্টের সংসার লিখেছে, তার কাপড়–চোপড়ের অবস্থা যে বড় ভাল হবে এমন ত বোধ হয় না।

দেওয়ানজি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন–আচ্ছা, সে বাবদ না হয় কিছু পাঠাব।

কত পাঠাবেন কাকা? ।

দেওয়ানজি হাসিয়া বলিলেন, তুমি কত বল মা?

গোটা পঞ্চাশ–আর রাহাখরচ হিসাব করে যা হয়।

তাই হবে। মা, তুমি দয়াময়ী!–বলিয়া দেওয়ানজি বিদায় গ্রহণ করিলেন।

০৫. জাল উকীল

যথাসময়ে দেওয়ানজি কনকলতার নামে নিয়োগপত্র ও মনিঅর্ডার পাঠাইয়া দিলেন। কয়েকদিন পরেইদাদাকে সঙ্গে লইয়া কনক আসিয়া পৌঁছিল। দাদা আর কেহ নহে, সেই সোণার হরিণ খগেন্দ্রনাথ।

গাড়ী হইতে নামিয়া খগেন্দ্র বৈঠকখানা বাড়ীতে প্রবেশ করিল, কনকলতা অন্তঃপুরে নীত হইল।

খগেনের রূপ দেখিয়া বৈঠকখানার সকল লোক চমকিত হইয়া উঠিল। এমন সুপুরুষ সে গ্রামে কেহ নাই, আর কোথাও কখনও কেহ দেখিয়াছে কিনা তাহাই সকলে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল। কর্মচারীরা বলাবলি করিতে লাগিল, এ এত সুন্দর, এর বোন, যে বউরাণীর সহচরী হয়ে এসেছে, সে না জানি কেমন সুন্দরী!

হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া, জলযোগ সারিয়া খগেন বসিয়া আছে, এমন সময় দেওয়ানজি আসিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া নিজ আপিস কক্ষে লইয়া গেলেন। নিকটে বসাইয়া, পথে কোন কষ্ট হইয়াছে কি না, কলিকাতায় আর কতদিন থাকা হইবে, পশ্চিমে কোথায় গিয়া ওকালতী ব্যবসায় আরম্ভ করিবার ইচ্ছা, ইত্যাদি প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।

খগেন চালাকি করিয়া বলিল, আমি যদি পশ্চিমে না গিয়ে কৃষ্ণনগরে বসি, তা হলে আপনাদের এষ্টেটের মোকদ্দমাগুলো পেতে পারি কি?

দেওয়ানজি বলিলেন, আমাদের এষ্টেটের মোকদ্দমা? আমরা মোকদ্দমা–টোকদ্দমা বড় বেশী করিনে। কোথাও কোনও গোলযোগের সূত্রপাত হলেই আপোষে নিষ্পত্তি করে ফেলবারই চেষ্টা করি। যখন কোন মোকদ্দমা হয়, সদরে আমাদের নিযুক্ত উকীল আছেন, তাঁর কাছে যাই।

খগেন মনে মনে হাসিয়া ভাবিল, পাড়াগাঁয়ে বুড়া, অত সহজে আমায় ঝাড়িয়া ফেলিতে পারিবে না। আর একটু মজাই দেখি না কেন!–প্রকাশ্যে বলিল–আপনাদের উকীল ত আছেনই। বড় বড় মোকদ্দমা যখন হয়, একজনের বেশী উকীলও ত দরকার হয়। সে সময় আমায় নিযুক্ত করবেন যদি এমন ভরসা পাই, তবে কৃষ্ণনগরে সম্বন্ধে বিবেচনা করি। যদিও আমি নতুন উকীল, তা হলেও আইন টাইনগুলো একটি বিশেষ রকম মেহনৎ করেই পড়েছি। নিজমুখে আর কি বলব, যদি সুযোগ দেন ত কাযেই দেখিয়ে দেব। –বলিয়া খগেন গম্ভীরভাবে বসিয়া দেওয়ানজির মুখভাব লক্ষ্য করিতে লাগিল।

দেওয়ানজি একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, আপাততঃ এষ্টেটের কোনও বড় মোকদ্দমা ত দেখিনে। তবে আমার নিজের এষ্টেটে–দেশে আমার ভাইরা আছেন তারাই দেখেন শোনেন–একটা বড় মোকদ্দমা শীঘ্রই দায়ের হবে। অবস্থাটা শুনবেন?

খগেন উৎসাহের সহিত বলিল, বলুন না।

দেওয়ানজি বলিলেন, ব্যাপারটা একটু জটিল। মন দিয়ে শুনুন। শুনে আপনার মত বলুন দেখি। আমি এ বিষয়ে কৃষ্ণনগরের উকীলদের পরামর্শ নিয়েছি, হাইকোর্টের উকীলদেরও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু কৃষ্ণনগরের উকীলদের সঙ্গে হাইকোর্টের উকীলদের মতের ঐক্য হয় না। আপনিই বা কি বলেন শোনা যাক।

খগেন মনে মনে প্রমাদ গণিল। মোকর্দমার অবস্থা শুনিয়া আবার মত দিতে হইবে–ইহা সে ভাবে নাই। দেওয়ানজি আবার বলিতেছে ব্যাপারটা জটিল!

দেওয়ানজি মোকদ্দমার অবস্থা ধীরে ধীরে বর্ণনা করিতে লাগিলেন। এক নিঃসন্তান ধনী ব্যক্তি উইল করিয়া স্ত্রীকে দত্তকপুত্র গ্রহণের ক্ষমতা দিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে আবার কতকগুলা কি সৰ্ত্ত, বাধা ও বিধান ছিল; স্ত্রী যদি দত্তক গ্রহণের পূৰ্বেই মরিয়া যান অথবা আইন অনুসারে দত্তক অসিদ্ধ হয় তাহা হইলেই বা কি হইবে, দত্তক যদি স্বয়ং অপুত্রক অবস্থায় মরিয়া যায় তাহা হইলেই বা কি হইবে–বিরাজমোহন ও মোহিনীমোহন ভ্রাতৃযুগলকে উইলের অছি নিযুক্ত করিয়া যান, কি কি অবস্থা ঘটিলে উক্ত বিষয় এই ভ্রাতৃযুগলকে বর্তিবে ইত্যাদি ইত্যাদি কত কি দেওয়ানজি বলিয়া যাইতে লাগিলেন, আর মাঝে মাঝে খগেনকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, বেশ বুঝতে পারছেন ত?

খগেন ঘাড় নাড়িয়া জানাইতে লাগিল সে বুঝিতেছে, যদিও মাথামুণ্ড কিছুই সে বোঝে নাই। কিছুতেই সে মনস্থির করিতে পারিতেছিল না। খানিক শোনে, আবার ভাবে–ভাল বিপদেই পড়া গিয়াছে, কি মতই বা দিব? যাহা মুখে আসিবে তাহাই বলিয়া দিব। এখন বুড়া যদি আবার মতের সমর্থক যুক্তি জিজ্ঞাসা করিয়া বসে তাহা হইলেই বেয়াকুব বনিয়া যাইতে হইবে। –খগেন এই প্রকার ভাবে, আর গল্পের সূত্র হারাইয়া ফেলে। আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করিতে করিতে তাহার গৌরবর্ণ ললাটে ঘৰ্ম্মবিন্দু সঞ্চিত হইয়া ধারাকারে অধোগতি লাভ করিল, তাহার জিহ্বা ও তালু শুকাইয়া উঠিল।

বর্ণনা শেষ করিয়া দেওয়ানজি বলিলেন, এখন ঐ বিরাজমোহন মোহিনীমোহনের নির্ব্যূঢ়স্বত্ত্ব হবে, না জীবনস্বত্ত্ব?

এখন নির্ব্যূঢ় কথাটা আজ এই প্রথম খগেনের কর্ণগোচর হইল। তাহার পিতা বিষয়ী লোক হইলেও, কোম্পানীর কাগজ ও কলিকাতার বাড়ী লইয়াই ধনবান ছিলেন। জমিদারী সংক্রান্ত বিষয়ে খগেন একেবারেই অজ্ঞ। অনিশ্চিতের মধ্যে পদক্ষেপ না করিয়া তাই সে উত্তর দিল, জীবনস্বত্ত্ব।

দেওয়ানজি বলিল, জীবনস্বত্ত্ব? হাইকোর্টের উকীলরাও তাই বলেন।

শুনিয়া খগেনের বুক দশহাত হইল। কৃষ্ণনগরের উকীলরা মূর্খ, হাইকোর্টের উকীলের সঙ্গে তাহার মত মিলিয়া গিয়াছে। ভাবিল, কেমন চালাকি করিয়াছি! পাড়াগাঁয়ের লোকেরা কি সহসা আমাদের ঠকাইতে পারে?

কিন্তু হায়, তাহার গৰ্ব্ব বড়ই ক্ষণস্থায়ী হইল। পর মুহূর্তেই দেওয়ানজি জিজ্ঞাসা করিলেন, আচ্ছা, জীবনসত্ত্বই যদি হয়, তবে ওদের অবর্তমানে বিষয়টা কাকে অর্শাবে? সুবল পাবে, না রতনমণি পাবে?

উত্তর দিয়াও নিষ্কৃতি নাই! দেওয়ানজির বক্তৃতার সময় সুবল এবং রতনমণি এই নাম দুইটা কয়েকবার তাহার কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহারা যে কে এবং সেই মোকদ্দমার সঙ্গে তাহাদের সম্পর্কই বা কি, খগেন তাহা কিছুই স্মরণ করিতে পারিল। তথাপি কপাল ঠুকিয়া বলিয়া দিল–ওরা দুজনেই পাবে–ভাগাভাগি করে।

উত্তর শুনিয়া দেওয়ানজি ফ্যাল ফ্যাল করিয়া এই জাল–উকীলটির মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। কোন উকীল বা মোক্তার ত দূরের কথা–জমিদারী সেরেস্তার কোনও হুঁশিয়ার আমলাও এমন অসম্ভব হাস্যকর মত প্রকাশ করিত না।

তাঁহার মুখভাব দেখিয়া খগেন্দ্র বুঝিতে পারিল, কিছু গোল হইয়াছে। তাড়াতাড়ি বলিল–বইটইগুলো, নজির–উজিরগুলো না দেখে মত প্রকাশ করা ঠিক নয়। একটু কাগজে বরং আপনি ঐ কথাগুলো নোট করে দেবেন, আমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমার মত আপনাকে লিখে পাঠাব।  

দেওয়ানজি অত্যন্ত ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে খগেনের পানে চাহিয়া রহিলেন। বলিলেন–থাক্‌, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

খগেন লজ্জায় অধোবদন হইয়া বসিয়া রহিল।

দেওয়ানজি একজন ভৃত্যকে দেখিয়া বলিলেন, ওরে, বাবুর স্নানের জন্যে তেল–টেল এনে দে না।

ভৃত্য বলিল, বাবু আসুন।

খগেন উঠিয়া গেল। যে কয়দিন বাশুলিপাড়ায় ছিল, দেওয়ানজির ত্রিসীমানায় আর সে ঘেঁসে নাই।

০৬. নূতন ষড়যন্ত্র

কনকলতার সহিত খগেন্দ্র পরামর্শ করিয়া আসিয়াছিল, কয়েকদিন বাশুলিপাড়ায় থাকিয়া, কোনও সুযোগে বউরাণীর সহিত সে সাক্ষাৎ পরিচয় লাভের চেষ্টা করিবে। কনক বলিয়াছিল, সে যদি আপনার চেহারাখানা একবার দেখে, তবে আমার কাযটুকু অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে আসবে। কনকের বিশ্বাস এ সোণার হরিণকে যে স্ত্রীলোক দেখিবে সে–ই ইহাকে লাভ করিবার জন্য পাগল হইবে।

কিন্তু একদিন দুইদিন তিনদিন কাটিল, বউরাণীর সহিত সাক্ষাৎ পরিচয়ের কোনও সুযোগই খগেন দেখিল না। কনক আসিয়াই অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। খগেন বৈঠকখানার বাড়ীতে পড়িয়া আছে। আহারাদির জন্যও অন্তঃপুরে যাইতে হয় না। বাহিরের লোকের জন্য বহিৰ্বাটীতেই পাকাদির সমস্ত বন্দোবস্ত। অন্তঃপুর উচ্চ প্রাচীরের দ্বারায় অবরুদ্ধ। ছাদটা দেখা যায় বটে কিন্তু ছাদেও উচ্চ আলিসা। সে। আলিসা রময় বটে, কিন্তু ছাদে মানুষ আছে কিনা দেখা যায় না। মানুষ ছাদ হইতে বাহিরের লোককে দেখিতে পায়। এ কয়দিনে বউরাণী কোনও দিন ছাদে উঠিয়া খগেনকে দেখিতে পাইয়াছেন কি না তাহাই খগেন মনে মনে চিন্তা করে। যেখানে থাকিলে ছাদের মানুষের লক্ষ্যগোচর হইতে পারে, সেই সকল স্থানে খগেন বৈকালে বেড়াইতে থাকে। বউরাণী তাহাকে দেখিয়াছেন কি না এবং যদি দেখিয়া থাকেন তবে তাহার সেই কন্দর্পতুল্য রূপ, বউরাণীর মনে কোনও দাগ বসাইতে সমর্থ হইল কি না, এই সকল অনুমান করিতে করিতে খগেন ক্লান্ত হইয়া পড়িল। চতুর্থ দিন স্নানের পূর্বে নায়েব মহাশয়কে গিয়া বলিল, আমার ভগ্নীর সঙ্গে কিছু কথা আছে, একবার দেখা হতে পারে কি?

নায়েব বলিলেন, বেশ। বউরাণীর কাছে আমি এত্তেলা পাঠাচ্ছি। তার অনুমতি হলেই আপনি অন্দরে দিয়ে আপনার ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।

খগেন ভাবিল, বাবা!–আবার এত্তেলা হবে! অনুমতি চাই!–এ বড় কঠিন ঠাঁই দেখছি।

 এত্তেলা হইল। অনুমতি আসিল, আজ দ্বিপ্রহরের পর খগেন গিয়া তাহারভগ্নীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিবে।

আহারান্তে খগেন তাহার মস্তকের সেই তরঙ্গায়িত কেশরাশি সাবধানে সুবিন্যস্ত করিয়া লইল। তাহার সবচেয়ে বাহারী পাঞ্জাবী পিরিহানটি পরিধান করিল। সবচেয়ে ভাল ধুতিখানি, ভাল জুতায়োড়াটি পরিয়া প্রস্তুত হইল–অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে, বউরাণীর দৃষ্টিপথে সে পড়িয়া যাইতে পারে ত!

যথাসময়ে একজন ভূত্য আসিয়া খগেনকে লইয়া গেল। সে অন্তঃপুরের দ্বারে পৌঁছিয়া, একজন ঝির হস্তে সমৰ্পণ করিল।

ঝি, খগেনকে লইয়া, দুই তিনটা বারান্দা ও কক্ষ অতিক্রম করিয়া একটি সুসজ্জিত কক্ষে উপস্থিত হইয়া বলিল, আপনি এইখানে বসুন। আপনার বোনকে আমি নিয়ে আসছি।

খগেন একখানি চেয়ারে বসিয়া, কক্ষটির চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। ইহা বউরাণীর সেই আপিস কক্ষ। কিয়ৎক্ষণ পরে কনকলতা আসিয়া প্রবেশ করিল।

খগেন বলিলএস কনক, কেমন আছ?

কনক খগেনের কাছে একখানি চেয়ার লইয়া বসিয়া বলিল, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন দাদা? –বলিয়া কনক একটু মুচকি হাসিল। একবার দ্বারের দিকে দৃষ্টিপাত করিল–কেহ নাই।

উভয়ে নিমস্বরে কথাবার্তা কহিতে লাগিল। খগেন বলিল, তোমার বউরাণী কেমন?

কি কেমন? রূপ? আহামরিও নয়, ছিছিও নয়।

না, রূপের কথা জিজ্ঞাসা করছিনে। মানুষটা কেমন, বোকাসোকা রকমের, না বেশ চালাক–চতুর?

না বোকা নয়। বেশ চালাক চতুর। আমরা আগে যেমন মনে করতাম পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা সব এক একটি গোরু, তা নয়।

খগেন হাসিয়া বলিলসকল রকমই আছে। তা তোমার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করছে?

বেশ ভালই ব্যবহার করছে। এত যে বড়মানুষ, কিছু যদি দেমাক আছে। ও যে মনিব আমি যে চাকর, ওর ব্যবহারে তা বোঝাই যায় না। এ কদিনে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেছে।

কনকলতা তখন, তাহার পৌঁছিবার সময় হইতে এ পর্যন্ত যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, বউরাণীর সহিত তাহার যে সকল কথোপকথন হইয়াছিল, সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া কহিল, মানুষটা চমৎকার–স্বভাবটিও বড় মিষ্টি। কেবল ধরণ–ধারণ একটু সেকেলে গোছের। , আমি যখন হাতে নিয়েছি, তখন ক্ৰমে ওকে মানুষ করে তুলব।

কি রকম? সেকেলে ধরণ কি দেখলে?

আমি এসেই দেখলাম, ওর বসবার, দাঁড়াবার, বিশ্রাম করবার উপযুক্ত তেমন ভাল সাজান ঘর একখানিও নেই। একখানি স্বতন্ত্র শোবার ঘর পর্যন্ত নেই–বুড়ো শাশুড়ীর সঙ্গে এক ঘরে শোয়।

খগেন বলিল, তাই শোয়াই ত উচিত।

সে যা হোক, একখানি নিজস্ব বসবার ঘর থাকা ত দরকার? যত ঘর আছে, সব ঘরেই বাড়ীর সকল মেয়ের অবাধ গতি। তাই আমি পিছন দিকের একখানি ঘর পছন্দ করে, সেইখানিকে সাজিয়ে বউরাণীর বসবার মত করব মনে করেছি।

খগেন ব্যঙ্গস্বরে বলিল, এত্তেলা করেছ? –অনুমতি পেয়েছ–এখানে এত্তেলা করে অনুমতি না পেলে কিছুই হবার যো নেই।

হ্যাঁ, অনুমতি পেয়েছি বইকি। বউরাণী বলেছে, বেশ তুমি ফর্দ কর, আমি কাকাকে বলে কলকাতা থেকে সব জিনিসপত্তর আনিয়ে দিচ্ছি, তুমি মনের মত করে ঘর সাজাও। তাই আমি জিনিষের ফর্দ তৈরি করছি। সখের জিনিস–টিনিষ কিছু নেই। থাকবার মধ্যে আছে, কোন্ মান্ধাতার আমলের একটা পুরাণো হার্মোনিয়ম, তারও পর্দাগুলো বেসুর বাজে।

হাৰ্ম্মোনিয়ম বাজাতে পারে নাকি?

রামচন্দ্র! সা–রে–গা–মাও চেনে না!

গাইতে পারে?

অমনি একরকম। আমি ত এসে অবধি রোজই গান শোনাচ্ছি। কাল আমি ওকে খুব জিদ করলাম, আপনাকে একটা গান আজ গাইতে হবে। বললে, আমি ত তোমাদের মত ও সব নব্য গান–টান জানিনে; আমি যা জানি সে সব সেকেলে গান। আমি বললাম, সেকেলে গান কি কিছু তুচ্ছ করবার জিনিষ? এই রাম বসুর গান, নিধুবাবুর গান, কীৰ্ত্তনাঙ্গ সব গান–তেমন গান আজকাল কোথায়? শেষে গাইলে। বললে না বিশ্বাস করবেন খগেনবাবু, এক্কেবারে রামযাত্রার গান!–বলিয়া কনকলতা মুখ বিকৃত করিয়া, মাথা নাড়িয়া নাড়িয়া, ভেঙ্গাইয়া গাহিল

চরণ ধরি জলদবরণ ধরে দাও।
সোণার হরিণী আমায়।

গাহিয়া মুখে কাপড় দিয়া কনক হাসিতে লাগিল। শেষে বলিল–আপনার কাছেই হাসলাম। তার কাছে হাসি চেপে ছিলাম, কিন্তু খগেনবাবু! ভাগ্যিস্ আমি অভিনেত্রী–তাই গান শুনে যেন কত মুগ্ধ হয়ে গেছি, এই রকম ভাবটাই দেখালাম। অন্য কেউ হলে হাসি রাখতে পারত না। –বলিয়া কনক আবার পূৰ্ব্ববৎ ভেঙ্গাইয়া গাহিল

চরণ ধরি জলদবরণ ধরে দাও
সোণার হরিণী আমায়।

খগেন মৃদু হাসিয়া বলিল, সোণার হরিণী ধরে দিতে বলেছে? খুব কাণ ঘেঁসে গেছে বল?

দ্বারের দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করিয়া, চুপি চুপি কনক বলিল, যা বলেছেন। শুনেই ও কথা আমার মনে হয়েছিল। তখনই আমি ভেবেছি, হরিণী পারি না পারি, একটা সোণার হরিণ তোমায় ধরে দেবার চেষ্টায় আছি। এখন সোণার হরিণের কপাল আর আমার হাতযশ!

উভয়ে হাসিতে লাগিল। শেষে খগেন বলিল, তুমি কি গান গেয়েছিলে?

আমি প্রথমে দুটো ব্রহ্মসঙ্গীত ঝেড়ে দিলাম। বললে বেশ গান। তারপর একটা কীৰ্ত্তন গাইলাম। ভারী খুসী। পরদিন আমায় বললে–থিয়েটারের গান জান না? আমি বললাম, হ্যাঁ, তাও জানি দু–চারটা।

খগেন হাসিতে হাসিতে বলিল, দু–চারটে! বেশী নয় ত?

কৃত্রিম ক্রোধের সহিত কনক বলিল, আমায় ডিফেন্ করবেন না খগেনবাবু। আমি একজন নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা তা আপনি জানেন?

তুমি ভাটপাড়ার মা–গোঁসাই। তারপর বল।

হ্যাঁ–তারপর, আমি একটা থিয়েটারের গান গাইলাম; ইচ্ছে করে, বেছে বেছে, একটা বেশ লপেটি ধরনের, বুঝেছেন? আমার উদ্দেশ্য ছিল–একটু টোপ ফেলে দেখা আর কি। ও মশায়!–গান শুনে তার মুখ কাণ রাঙা হয়ে উঠল–গম্ভীর হয়ে বসে রইল। দেখলাম বেজায় চটেছে। বললে–এসব গান কোথায় শিখলে? –আমি নেকু সেজে বললাম–কেন, থিয়েটারে। আপনি যে থিয়েটারের গান গাইতে বললেন। আমি ছেলেবেলায় একবার থিয়েটার শুনতে গিয়েছিলাম–তাই শিখেছিলাম। –বললেশুনেছিলাম থিয়েটারের গান খুব ভাল। এই যদি থিয়েটারের গান তবে আমার কাছে। থিয়েটারের গান আর গেও না। ছি, এ সব থিয়েটার ভদ্রলোকের মেয়েরা শুনতে যায়? –আমি বললাম, হ্যাঁ যায় বই কি। –বললে চুলোয় যায়। তুমি একটা ভাল গান গাও, আমার কাণের তিতো কেটে যাক। –আমি তখন রবি ঠাকুরের একটি গান গাইলাম–আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি, সেই গানটা। শুনে বললে–সুন্দর গান। এই রকম গানই আমার পছন্দ।

খগেন পকেট হইতে ঘড়ি খুলিয়া দেখিল। বলিল–যা হোক। আমরা যে পরামর্শ করে এসেছিলাম তার কি হল? বউরাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় দূরে থাকুক, একবার চোখোচোখীও ত হল না। ও আমাকে দেখেছে ছাদ–টাদ থেকে?

না।

ছাদে ওঠে না?

না।

তুমি বলতে পার না? আমি এ কদিন বিকেলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি–আর ভাবছি, হয়ত তুমি তাকে নিয়ে ছাদে উঠেছ–হয়ত আমাকে দেখাচ্ছ!

কনক হাসিয়া বলিল, আপনি যে বটতলার বিদ্যাসুন্দরের ছবি মনে পড়িয়ে দিলেন খগেনবাবু! বাঞ্ছারাম কৰ্ম্মকার কর্তৃক খোদিত সেই ছবি–বিদ্যা, সখীর সঙ্গে এলোচুলে ছাদে দাঁড়িয়ে, আর সুন্দর নীচে চাপকান পরে পাগড়ি মাথায় দিয়ে, একটি গোলাপফুল হাতে করে দাঁড়িয়ে–কাছে একখানা রথ, তাতে কাঠের দুটো ঘোড়া যোতা–পা তুলেই রয়েছে।

খগেন হাসিতে লাগিল। বলিল–আমার চাপকানও নেই, পাগড়িও নেই, রথও নেই। থাকবার মধ্যে এক মালিনী মাসী তুমি আছ। যা হোক একটা উপায় কর।

আমি কি জানি আপনি আনাচে–কানাচে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আচ্ছা আজ থেকে বিকেলে বউরাণীকে ছাদে নিয়ে যাব এখন। কিন্তু আপনি বোধ হয় তাকে দেখতে পাবেন না। আলসের ফাঁক দিয়ে বউরাণী যাতে আপনাকে দেখতে পায়, সে বন্দোবস্ত আমি করব। কিন্তু খবর্দার আপনি যেন ছাদের দিকে চাইবেন না। তা হলে বউরাণীর মনে হতে পারে, লোকটা ভাল নয়, মেয়েদের ছাদের পানে চায় কেন?

বেশ, আমি চাব না।

কনক কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। শেষে বলিল–আমি আরও একটা উপায় ভাবছি।

কি বল দেখি?

অন্দরে দু–চারবার আপনি যদি যাওয়া আসা করেন, তা হলে দু–একবার বউরাণীর চোখে পড়ে যাবেনই যাবেন। আমি না হয় এক কায করি। –বলিয়া কনক ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে লাগিল।

খগেন অপেক্ষা করিয়া রহিল। শেষে কনক বলিল–কাল, এমনি সময়, হঠাৎ আমার ফিট হবে। হলে, সবাই অবিশ্যি আমার মুখে চোখে জল দেবে, হাওয়া করবে, অন্য রকম শুশ্রূষা করবে। শেষে আমি চোখ অর্ধেক খুলে, ক্ষীণস্বরে বলব, দাদা–দাদা–আমার দাদা কই? আমার দাদাকে তোমরা ডেকে দাও গো। –তা হলেই আপনাকে ডেকে নিয়ে আসবে। পরশু বাদ দিয়ে, তার পরদিন আবার ফিট হবে। আবার আপনাকে ডাকিয়ে আনাব। আবার, যাবার দিন, কিম্বা ধরুন, তার পরদিনই যেন আপনাকে যেতে হবে–আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। যাবার সময় আপনি বরং কোনও ঝিকে বলবেন–ঝি, আমি ত চলোম, আমার বোনটি রইল। কখনও বাড়ী ছেড়ে থাকেনি, যদি বউরাণীর অনুমতি পাই তবে চিকের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার বোন সম্বন্ধে তাঁকে দু–চারটি কথা বলে যেতে চাই–তা হলেই আপনি অনুমতি পাবেন। বউরাণী যে ঘরে থাকবে, সেই ঘরে চিকের বাইরে দাঁড়িয়ে আপনি আমার সম্বন্ধে, আমার অসুখ সম্বন্ধে যা হয় কতকগুলো বিনয়পূর্ণ কথা বলে যাবেন। তা হলেই বউরাণীর সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ পরিচয় না হোক–অন্ততঃ চিক–পরিচয়টা হয়ে যাবে। আপনার মুখ দেখে আপনার কণ্ঠস্বর শুনে, আপনার বিনয় দেখে নিশ্চয় সে আপনার পক্ষপাতী হয়ে পড়বে। তার পর আমি আছি।

খগেন হাসিয়া বলিল, বুদ্ধি করেছ ভাল! আচ্ছা তাই হবে। তিনটে বাজে, এখন তবে উঠি। লোকে মনে করবে, এদের ভাইবোনের কথা যে দেখছি ফুরোয় না!

কনকলতা দাঁড়াইয়া বলিল, আসুন তবে। হা–আর একটা কথা বলি! এটা আমি কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি। আপনি গিয়ে আপনার একখানা ভাল ফটোগ্রাফ তুলিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আমি বউরাণীর জন্যে যে ঘর সাজাব, সেই ঘরে, অন্য সব ছবির সঙ্গে আপনার ফটোগ্রাফখানিও টাঙ্গিয়ে রেখে দেব। তাতেও কিছু কায হতে পারে।

বেশ! পাঠাব। তবে আসি।

কনক ঝিকে ডাকিয়া আনিল। ঝির পশ্চাৎ পশ্চাৎ খগেন অন্তঃপুর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

০৭. সোণার হরিণের পত্র

একমাস পরে একদিন সন্ধ্যার পর, অন্তঃপুরের একটি সুসজ্জিত কক্ষে, বউরাণী কনকলতার সহিত বসিয়া আছেন।

এই কক্ষটিই বউরাণীর বিশ্রামের জন্য কনকলতা নিজের পছন্দ অনুসারে সাজাইয়াছে। ভিত্তিগাত্রে কয়েকখানি প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিলাতী ছবি এবং বারাণসী প্রভৃতি তীর্থস্থানের মন্দিরাদির ছবি শোভা পাইতেছে। তাহার মধ্যে রূপার কার্য করা ফ্রেমে বদ্ধ, হপ সিং কোম্পানীর বাড়ীতে তোলা সুন্দর একখানি ফোটোগ্রাফ–সোণার হরিণের প্রতিমূর্তি। শেষোক্ত ছবিখানি আসিলে, এই কক্ষে সেটি টাঙ্গাইবার জন্য কনকলতা বউরাণীর অনুমতি প্রার্থনা করিলে প্রথমতঃ তিনি অস্বীকৃত হইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন–তোমার দাদার ছবি–তোমার নিজের ঘরেই এখানি টাঙ্গিয়ে রাখ। –তাহাতে কনক অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলে, আমি সারাদিন আপনার কাছে এই ঘরেই ত থাকব, আমায় যে ঘর দিয়েছেন, রাত্রিটি সেখানে শুয়ে থাকি মাত্র–রাত্রে অন্ধকারে আমি দাদার ছবি আর কি দেখব? –এখানে থাকলে তবু সারাদিন দাদাকে দেখতে পেতাম। আমার মা নেই, বাপ নেই, দাদা ছাড়া পৃথিবীতে আর আমার কে আছে? –বলিতে বলিতে ছদ্মবেশিনী অভিনেত্রীর চোখের পাতা ভিজিয়া আসিয়াছিল। –বউরাণী তখন ইহার কপট বেদনায় ব্যথিত হইয়া, ছবিখানি এখানেই টাঙ্গাইবার অনুমতি দিয়াছিলেন।

কক্ষের মেঝেটি মির্জাপুরী গালিচায় সম্পূর্ণভাবে আবৃত। সবুজ মখমলে মণ্ডিত কয়েকখানি ঝকমকে কেদারা ও সোফা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। একটি নূতন বৃহৎ হার্মোনিয়ম আসিয়াছে, পশমের জমির উপর রেশমের কায করা একখানি আবরণে সেটি আচ্ছাদিত। একস্থানে মেহগনি কাষ্ঠনির্মিত একটি পুস্তকাধার, কাঁচের ভিতর দিয়া সারি সারি বাঙ্গালা পুস্তকের পৃষ্ঠভাগ দেখা যাইতেছে। অধিকাংশই উপন্যাস, কাব্য ও নাটক–জীবনচরিত, ভ্রমণ–বৃত্তান্ত ও ইতিহাসও কিছু কিছু আছে। নিকটে একটি টেবিলের উপর থাকে ভিন্ন ভিন্ন সচিত্র মাসিক পত্র গোছান রহিয়াছে। জানালার কাছে চিঠি লিখিবার ডেস্ক, টেবিল, উপরে খোপে খোপে বিচিত্রবর্ণের নানা আকারের চিঠির কাগজ ও খাম। ভিত্তিগাত্রে একটি বেলোয়ারী ঝাড়, তাহার চারিটি শাখায় চারিটি মোমবাতি জ্বলিতেছে। মধ্যস্থলে নীল রেশমের ঝালরযুক্ত একটি টানাপাখা, ভিত্তি–লগ্ন পিত্তল–চক্র বহিয়া, কক্ষতল ভেদ করিয়া, টানিবার রঙ্কুটি নিমে নামিয়া গিয়াছে, সেখানে অদৃশ্যে বসিয়া ভৃত্য পাখা টানিতেছে। এই কক্ষটি অন্তঃপুরের একবারে প্রান্তভাগে অবস্থিত, ইহার পরই অন্তঃপুরের বাগান। বাগানের দিকে তিনটি বড় বড় জানালা খুলিয়াছে–এখানে বসিয়া গান গাহিলেও, সে স্বর বহিৰ্বাটীতে পৌঁছিবার কোনও আশঙ্কা নাই।

বউরাণীর পরিধানে একখানি ধবধবে সাদা থান, গায়ে হাপহাতা একটি শাদা জ্যাকেট–তাহাতে লেশ নাই, কোন কায নাই। কেশদাম এলায়িত, বিকালে গঙ্গাস্নান করিয়াছেন–প্রত্যহই করেন। কনকলতার বেশও এতদনুরূপ, তবে কেশ বেণীবদ্ধ।

জানালার পথে মৃদু মৃদু বাতাস আসিতেছিল। বউরাণী বলিলেন, কাউকে বলে দাও –নীচে গিয়ে পাখা বন্ধ করতে বলে আসুক।

কনক বলিল, টানুক না। মাইনে নেবে–মেহন করবে না?

পাখা টেনে টেনে বেচারির হাত বোধ হয় ব্যথা হয়ে যায়। বেশ বাতাস আসছে, এখন দরকার কি? যাও–হাবার মাকে বল, নীচে গিয়ে বলে আসুক।

কনকলতা তখন সে অনুরোধ পালন করিতে বাধ্য হইল। –দুইদিনের পরিচয়ের পর সোণার হরিণের কাছে বউরাণীকে সে মাটির মানুষ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিল। এই একমাসে কনক আবিষ্কার করিয়াছে, সে বর্ণনাটি ঠিক নহে। ধনগৱঁই নাই, সে হিসাবে মাটির মানুষ বটে; কিন্তু সে মাটিতে যথেষ্ট দৃঢ়তা আছে। বউরাণী নিজে ভাল বুঝিয়া যে স্থানটি নিৰ্বাচন করিয়া লন, সে স্থান হইতে কেহই তাহাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতে পারে না। যখন কোনও আজ্ঞা প্রচার করেন, তাহা বিনীত অনুরোধের মতই শুনায়, অথচ সে অনুরোধ কেহ উপেক্ষা করিতে সাহস করে না।

শুক্লপক্ষ দশমীর চাঁদ জলস্থলকে আলোকে প্লাবিত করিতেছে। পূবের জানালা দিয়া খানিকটা জ্যোৎস্না কক্ষখানিতেও আসিয়া পড়িয়াছে।

বউরাণী বলিলেন, আজ বড় সুন্দর রাত্রি–একটি গান গাও।

কনক বলিল, কোন্ গানটি গাই বলুন।

যেটি তোমার ইচ্ছে। রবিবাবুর একটি গাও।

রবিবাবুর গান? বেশ। –বলিয়া কনক হার্মোনিয়ামের কাছে গেল। ঝাড়টির পানে চাহিয়া বলিল–বাতিগুলো নিবিয়ে দেব? বাতির আলো যেন চাঁদের আলোকে উপহাস করছে।

নিবিয়ে দাও।

বাতি নিবাইবামাত্র কক্ষলুষ্ঠিত সেই জ্যোৎস্না যেন বেশী করিয়া হাসিয়া উঠিল। হার্মোনিয়ামের কাছে বসিয়া কনক গাহিল

 চাঁদ, হাস হাস!
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
কত দুঃখে কত দূরে       আঁধার সাগর ঘুরে
সোণার তরণী দুটি তীরে এসেছে।
মিলন দেখিবে বলে,       ফিরে বায়ু কুতূহলে
চারিধারে ফুলগুলি ঘিরে এসেছে।
চাঁদ হাস হাস,
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।

গান শেষ হইলে কনক দেখিল, বউরাণী বাম হস্তে কপোল রক্ষা করিয়া জানালার কাছে বসিয়া বাহিরের পানে চাহিয়া আছেন। কাছে গিয়া কনক বলিল, কি ভাবছেন?

বউরাণী বলিলেন, ভাবছি, এ গান গেয়ে আমাদের ফল কি? আমাদের সোণার তরণী ত কখনও তীরে আসবে না। আমারও না–তোমারও না।

কনক একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, কি জানি!

তাহার উত্তরে বউরাণী আশ্চর্য্য হইলেন। বলিলেন–সে কি!

কনক চুপ করিয়া রহিল। একটু পরে একটি গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–আমি বড় অভাগিনী! তাহার স্বর যেন আর্দ্র।

বউরাণী সমবেদনার স্বরে বলিলেন, কেন? কি হয়েছে?

কনক কথা কহে না। বউরাণী তাহাকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। বলিলেন–আজ যখন তুমি কলকাতার চিঠি পেয়েছ, তখন থেকেই তোমায় বিমর্ষ দেখছি। তোমার দাদা ভাল আছেন ত?

আছেন।

তবে? দেখ, তোমার মন কেন খারাপ হয়েছে আমায় বলতে যদি তোমার কোন আপত্তি থাকে, তবে বলে কায নেই। কিন্তু যদি কিছু হয়ে থাকে, যার কোনও প্রতিকার আমার দ্বারায় সম্ভব তা হলে আমি প্রতিকার করতে পারি।

কনক বলিল, দাদার চিঠি পেয়ে, আমি এক বিষম সমস্যায় পড়ে গেছি।

কি সমস্যা? আমায় বলতে কোনও বাধা আছে কি?

বাধা কিছু নেই। বরং দাদা আপনাকে জানাতে, আপনার উপদেশ চাইতেই আমায় বলেছেন। চিঠিখানি আনি। –বলিয়া কনক উঠিয়া, নিজের ঘরে গিয়া চিঠি লইয়া আসিল। আলো জ্বালিয়া চিঠিখানি বউরাণীকে দিল।

চিঠিখানি হাতে করিয়া বউরাণী প্রথমটা একটু ইতস্ততঃ করিলেন। তাহার পর, খুলিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। তাহাতে এইরূপ লেখা ছিল

কলিকাতা
১২ই বৈশাখ।
স্নেহের বোনটি আমার,
গতকল্য তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি ভাল আছ, বউরাণী তোমায় আদর যত্নে রাখিয়াছেন, শুনিয়া সুখী হইলাম। হইবে না কেন? তিনি ত মানবী নহেন–দেবী। তোমার পরম সৌভাগ্য যে তুমি তাঁহার মত উদার–হৃদয়া সুশিক্ষিতা সৰ্বগুণসম্পন্না মহিলার আশ্রয়লাভ করিয়াছ। তোমাকে তিনি এত স্নেহ করেন, যত্ন করেন, এজন্য আমি যে তাহার নিকট কতদূর কৃতজ্ঞ তাহা লিখিয়া জানাইতে পারি না। আমার মনে হয়, পূৰ্ব্বজন্মে তিনি আমাদের কোনও পরমাত্মীয়া ছিলেন।
আমার পশ্চিমে যাওয়া এখনও স্থির হয় নাই। বিশেষ এ সময়টা ওদিকে ভয়ঙ্কর গরম–বর্ষার প্রারম্ভে কোনও স্থানে গিয়া বসিব।
সে কথা এখন যাউক। আজ যে জন্য তোমায় বিশেষ করিয়া পত্র লিখিতে বসিয়াছি, তাহাই এখন উত্থাপন করি।
আমি তোমায় বাল্যকাল হইতে কত স্নেহ করি তাহা তুমি অবগত আছ। আমরা বাল্যকালে মাতৃহীন হই–সাত বৎসর বয়স হইতেই তুমি মাতৃহারা। মার অভাবে পাছে। তুমি কোনও কষ্ট পাও–এই জন্য বাল্যকাল হইতেই আমি কত প্রকারে তোমার চিত্ত বিনোদনের চেষ্টা করিয়াছি। পিতৃদেব যখন মারা যান, তখন তোমাকে তিনি আমার হাতে সঁপিয়া দিয়া গিয়াছিলেন। বড় আশা করিয়া তোমার বিবাহ দিয়াছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনটি বৎসর যাইতে না যাইতেই তুমি বিধবা হইলে। তুমি যখন বৈধব্য বেশ পরিয়া বাড়ী আসিলে, তখন আমার বুকে যে আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, সে আগুন আজও নিবে নাই। পলে পলে দিবানিশি আমায় দগ্ধ করিতেছে। আমি যে অদ্যাপি বিবাহ করি নাই, এই দারুণ শোকই তাহার প্রধান কারণ। দিদি, তোমার শুষ্ক মলিন মুখখানি যখনই দেখি–তখনই সংসারসুখে আমার স্পৃহা চলিয়া যায়। আমর পরম স্নেহের পাত্রী ছোট বোনটিকে বৈধব্যের অনলে পুড়িতে দেখিয়া আমি কি বিবাহিত জীবনের সুখাকাক্ষী হইতে পারি? এমন তরুণ বয়সে বিধবা হইলে, আর সে বিবাহ করিতে পারিবে না–এ বৰ্ব্বর নিয়ম পোড়া বঙ্গদেশ ছাড়া আর কোনও সভ্যদেশে নাই। এমন কি হিন্দু–শাস্ত্রেও স্পষ্টাক্ষরে বিধবা–বিবাহের বিধান রহিয়াছে, এ কথা বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রমুখ পণ্ডিতগণ নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন। ইহা কেবল লোকাচারের বিরুদ্ধ। বিধবা যদি পুনরায় বিবাহ করে, তবে তাহার ধৰ্ম্মহানি হয় না। শাস্ত্র লঙ্নেই ধৰ্ম্মহানি–লোকাঁচার লঙ্ঘনে কোন পাপ নাই। তাই দিদি আমার বিশেষ অনুরোধ–তুমি বিবাহ কর। পূৰ্ব্বে পূর্বে বিধবা–বিবাহ হইলে সমাজে যেরূপ হুলুস্থুল পড়িয়া যাইত, যেরূপ নিন্দা হইত, এখন আর সেরূপ নাই। এখন অনেক নড় বড় লোক–ধনে, মানে, জ্ঞানে সমাজের যাঁহারা শীর্ষস্থানীয়–তাহারাও কেহ কেহ নিজে বিধবা কন্যার বিবাহ দিতেছেন। সুতরাং আমরাই বা কেন পশ্চাৎপদ হই।
এ প্রস্তাব পূৰ্ব্বেও আমি তোমার নিকট করিয়াছি। কিন্তু তুমি বলিতে, এরূপ করিলে তোমার ধৰ্ম্মহানি হইবে; অদ্য ডাকে আমি তোমাকে দুইখানি পুস্তক পাঠাইয়া দিতেছি, সেই দুইখানি তুমি পাঠ করিয়া দেখিও–দেখিতে পাইবে হিন্দুশাস্ত্র সম্পূর্ণভাবেই বিধবা বিবাহ সমর্থন করে। সব স্থান যদি তুমি ভাল করিয়া বুঝিতে না পার–বউরাণীকে জিজ্ঞাসা করিও। তিনি যেরূপ সুশিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী–অনায়াসেই তোমায় ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিতে পারেন।
আমাদের পাড়ার সেই সুশীলবাবু, তিনি বহুদিন হইতেই তোমার হস্তাকাতক্ষী–এ কথা তুমি জান না এমন নহে। তাহার মত উচ্চহৃদয়সম্পন্ন সচ্চরিত্র সুশ্রী যুবাপুরুষ খুঁজিয়া সহজে পাওয়া যায় না। আমার ইচ্ছা, সুশীলবাবুর সঙ্গেই তোমার বিবাহ দিই। তিনি তোমায় প্রাণের সহিত ভালবাসেন। আমি তাঁহার কোনও বন্ধুর নিকট শুনিয়াছি–তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, যদি তোমায় পান, তবেই তিনি বিবাহ করিবেন, নচেৎ চিরজীবন কৌমারব্রত অবলম্বন করিয়া থাকিবেন।
দিদি, তোমার এখনও অল্প বয়স। সমস্ত জীবন তোমার সম্মুখে বিস্তৃত। মিছামিছি একটা ভ্রান্ত মতের অধীন হইয়া এমন দুর্লভ জীবন কি নষ্ট করিতে আছে? মূর্খ সমাজের চক্ষে যাহাই হউক, সেই দয়াময় প্রেমময় ঈশ্বরের চক্ষে ইহা মহাপাপ। শুষ্ক পৃথিবীকে সুখময় শোভাময় ফলপুস্পময় করিবার জন্য যিনি নদ–নদীর সৃষ্টি করিয়াছেন, আকাশ হইতে অজস্র বারিধারা বর্ষণের নিয়ম করিয়াছেন–মানুষ আপনার জীবনভূমিকে স্বেচ্ছায় মরুময় করিয়া তুলিলে তিনি কি সম্ভষ্ট হইবেন?
স্নেহের কনকলতা–আমার মিনতি রাখ। বিবাহ করিতে সম্মত হও। আমি তোমার নবীন হৃদয়ে আবার সুখের হিল্লোল বহিতে দেখিয়া জীবন সার্থক করি। ইহাতে কোনও দোষ নাই, কোনও পাপ নাই। আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, তুমি বরং বউরাণীকে জিজ্ঞাসা করিও। তিনি তোমায় যেরূপ ভালবাসেন, কখনই তিনি তোমার জীবনকে স্বেচ্ছায় মরুভূমি করিয়া রাখিতে পরামর্শ দিবেন না। পুস্তক দুইখানি পাঠ করিলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিশ্চয়ই তিনি বলিবেন, এ কাৰ্য্যে দোষ কিছুমাত্র নাই। তাঁহার পরামর্শ লইয়াই তুমি কায কর। তিনি যেরূপ উদারহৃদয়া ও বুদ্ধিমতী–নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে বিবাহ করিতেই উপদেশ দিবেন।
আমরা ভাল আছি। বউরাণী মহাশয়ার সহিত পরামর্শ করিয়া, তাঁহার মতামত যত শীঘ্র পার আমায় জানাইবে। আমি তৃষিত চাতকের মত উত্তরের প্রত্যাশায় রহিলাম। ইতি
তোমার স্নেহের দাদা
খগেন।

বউরাণী যতক্ষণ পাঠ করিতেছিলেন, কনক মাঝে মাঝে তাঁহার মুখভাব লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। দেখিল, তাহার মুখে ক্রমে অপ্রসন্নতার ভাব ফুটিয়া উঠিল। পত্র যখন শেষ হইল, তখন তাঁহার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত, চক্ষু হইতে বিরক্তি ও ঘৃণা উছলিয়া পড়িতেছে। কনক কম্পিত হস্তে পুস্তক দুইখানি তাহার নিকট রাখিয়া দিয়া বলিল, এই বই দু–খানা পাঠিয়ে দিয়েছে।

বউরাণী তাচ্ছিল্যের সহিত পত্ৰখানা মেঝের উপর ফেলিয়া দিলেন। পুস্তক দুইখানির পানে চাহিয়া বলিলেন–এই বই? –বলিয়া সেই দুটি তুলিয়া লইয়া জানালা গলাইয়া, ছুড়িয়া বাগানে ফেলিয়া দিলেন। উঠিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন।

কনক সভয়ে বলিল, কোথায় যাচ্ছেন?

বউরাণী তীব্রস্বরে বলিলেন, গঙ্গাজলে হাত ধুতে যাচ্ছি–আমার হাত অপবিত্র হয়ে গেছে!

০৮. বউরাণী ও সুরবালা

রাত্রে শয্যায় শয়ন করিয়া অনেকক্ষণ অবধি বউরাণী সন্ধ্যাকালের ঘটনাটি মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন।

শয়নকক্ষটি পূৰ্ব্ববর্ণিত বসিবার কক্ষের পার্শ্বেই অবস্থিত। দুইদিকে দুইখানি পালঙ্ক–একখানিতে বউরাণী, অপরখানিতে তাঁহার দেবী–গৃহিণী ঠাকুরাণী শয়ন করিয়া আছেন। সারি সারি তিনটি বড় বড় জানালা খোলা রহিয়াছে। তাহা দিয়া মৃদু বায়ুহিল্লোল এবং অস্পষ্ট চন্দ্রালোক কক্ষখানিতে প্রবেশ করিতেছে।

রাত্রি দশটার সময় ইঁহারা শয়ন করিয়াছিলেন। এখন এগারটা বাজিয়া গিয়াছে–গৃহিণী অনেকক্ষণ নিদ্রাভিভূতা হইয়াছেন কিন্তু বউরাণীর চক্ষে ঘুম আসিতেছে না। তিনি কেবল ভাবিতেছেন–আহা, আজ কনকের সহিত বড় রূঢ় আচরণ করিয়াছি–সে বোধ হয় মনে বড় ব্যথা পাইয়াছে।

সহসা যে আজ বউরাণী অত রাগিয়া উঠিলেন–আত্মসংযম হারাইয়া ফেলিলেন–তজ্জন্য তিনি ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও লজ্জিত। তাহার কারণও অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। কনকেরদাদা চিঠিতে যে ধরিয়া লইয়াছিলেন বউরাণীও তাহার স্বদলভুক্ত–তিনিও ঐ ঘৃণিত মতের পোষকতা করিবেন–এই কারণেই হঠাৎ তাঁহার ক্রোধ জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। মুহূর্তের উত্তেজনায় বিস্মৃত হইয়াছিলেন যে, সকল মানুষের শিক্ষা, দীক্ষা, আদর্শ ও আকাক্ষা এক প্রকার নহে–পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের স্থান আছে। কাহারও সহিত আমার মতের মিল হইল না বলিয়াই যে রাগে আত্মহারা হইতে হবে–তাহার মাথায় লাঠি মারিতে হইবে–এমন কি কথা!

ভাবিতে ভাবিতে বউরাণী আর একটু গভীরতর কারণের সন্ধান পাইলেন। তাহা এই–কিছুদিন পূৰ্ব্বে হইতেই কনকের প্রতি শ্রদ্ধা হারাইতেছিলেন। বিশেষ কোন ব্যবহারের জন্য নয়–ক্রমে ক্রমে, অল্পে অল্পে তিনি এটা লক্ষ্য করিয়াছেন, মৃত স্বামীর প্রতি গাঢ় নিষ্ঠার একটা ভাব কনকের মনের মধ্যে নাই। বউরাণী যেরূপ জানেন, চতুর্দশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে কনকের বিবাহ হইয়াছিল; তিন বৎসরকাল শ্বশুর–ঘর করিবার পর সে বিধবা হইয়াছে। এ বয়সে, তিনটি বৎসর ধরিয়া স্বামীসাহচৰ্য্যলাভের সুযোগ যে স্ত্রী পাইয়াছে–তাহার মধ্যে, সাধ্বী পন্ত্রিতা হিন্দুরমণীর অন্তরবাসিনী সে তপস্বিনী। কই? অশনে, বসনে, আচরণে কনক যতই বাহ্য শুচিতা ও নিষ্ঠুর অভিনয় করুক না কেন, ভিতরে এই আসল জিনিষটির অভাব বউরাণীর চক্ষে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। তাই যখন শুনিলেন কনকের আবার বিবাহ দিবার জন্য তাহারদাদা আগ্রহান্বিত এবং কনকও যেন সেইদিকে একটু ঢলিয়াছে–আর তিনি ধৈৰ্য্য রক্ষা করিতে পারিলেন না।

পার্শ্বস্থ ঘড়িতে অর্ধঘণ্টা বাজিল, সাড়ে এগারোটা। সমস্ত পৃথিবী নিস্তব্ধ–নিসুপ্ত। কনকের কথা হইতে বউরাণী ক্রমে নিজের কথায় উপনীত হইলেন। মনে মনে, নিজের সঙ্গে তাহার তুলনায় ব্যাপৃত হইলেন। প্রথম যখন বধূবেশে এ বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিলেন তখন তিনি অষ্টমবর্ষীয়া বালিকা, স্বামীর বয়স তখন চতুর্দশ। সপ্তাহমাত্র এখানে ছিলেন। কিন্তু এই এক সপ্তাহে, স্বামীর মুখখানি ভাল করিয়া দেখা একবারও ঘটিয়া উঠে নাই। লজ্জায় তিনি সেদিকে চাহিতেই পারিতেন না। এ সাতদিনে, স্বামীর সহিত তাহার কথাবার্তা যাহা হইয়াছিল, তাহার মধ্যে দুই চারিটি বরঞ্চ মনে আছে–কিন্তু তাঁহার মুখখানির স্মৃতি একান্ত অস্পষ্ট। পিত্রালয়ে ফিরিয়া যাইবার মাসদুই পরেই সংবাদ আসিল, স্বামী নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। তাহার পর ক্রমে যখন তাহার বয়স হইল–জ্ঞান–বুদ্ধি জন্মিল–তখন হইতে সৰ্ব্বদাই তিনি নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর মুখখানি চিন্তা করিতে লাগিলেন। যতদিন আশা ছিল হয়ত তিনি বাঁচিয়া আছেন, হয়ত একদিন গৃহে ফিরিবেন–ততদিন বউরাণী তাঁহাকে পৃথিবীর মানবরূপেই ভাবনা করিতেন। এই কক্ষে তিনি শয়ন করিতেন, এইখানে বসিয়া ভোজন করিতেন, এইটি তাঁহার পাঠগৃহ ছিল, এইখানে তাঁহার পারাবত থাকিত, ঐ বাগানে একদিন কুকুর লইয়া ছুটাছুটি করিয়াছিলেন, গঙ্গাস্নান করিয়া বাগানের এইখান দিয়া তিনি ফিরিয়া আসিতেন। –ক্রমে যখন বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল, কোনও উদ্দেশ পাওয়া গেল না, সকলে হতাশ্বাস হইয়া পড়িলেন, পিতামাতা পর্যন্ত বলিলেন, আর সে বাঁচিয়া নাই–থাকিলে কি এতদিন কোনও সংবাদ পাওয়া যাইত না? তখন হইতে বউরাণী স্বামীকে পৃথিবীর মানুষ বলিয়া আর কল্পনা করিতেন না। মনশ্চক্ষে এই গৃহে ঐ বাগানে তাহাকে দেখিতেন না;–স্বর্গে, যেখানে দেবতারা, দেহান্তে পুণ্যাত্মারা বাস করেন, রামায়ণে মহাভারতে যে অমরাপুরীর বর্ণনা আছে–সেইখানেই যেন স্বামীকে বিরাজিত দেখিতে পাইতেন। তাহার মস্তক আলোকময় কিরীটমণ্ডিত, সৰ্বাঙ্গ হইতে যেন পবিত্র দীপ্তি বাহির হইতেছে। তিনি যেন প্রাতে উঠিয়া মন্দাকিনী ধারায় অবগাহন করিয়া, নন্দনবন হইতে পুষ্পচয়নান্তে, বৈকুণ্ঠে গিয়া নারায়ণ ও লক্ষ্মীদেবীর পাদবন্দনা করেন। স্বামী যেন সেই অমরলোকে, বউরাণীর জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছেন। যখন সময় হইবে, এ পৃথিবী হইতে যখন ছুটি পাইবেন, এ দীর্ঘ বিরহের অবসান হইবে, স্বামী তখন নিজ পুণ্যবলে তাঁহাকে সেখানে লইয়া যাইবেন–দুজনের পুনর্মিলন হইবে।

এইরূপে স্বামীর কথা ভাবিতে ভাবিতে, বউরাণী তন্ময় হইয়া পড়িলেন, কনকলতা প্রভৃতির কথা একেবারে মন হইতে মুছিয়া গেল। তাহার মনে বিমল শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। অল্পে অল্পে তন্দ্রাবেশ হইল। পার্শ্বের কক্ষে ঘড়িতে টং টং করিয়া দুইটা বাজিলে বউরাণী চমকিয়া চক্ষু খুলিলেন। জানালা পথে বাহিরে চাহিয়া দেখিলেন, দশমীর চন্দ্র গঙ্গার পরপারস্থ বনরেখার নিকট নামিয়াছে। তিনি আবার চক্ষু মুদিত করিলেন। ফুলের গন্ধমাখা বাতাস, বাগান হইতে আসিয়া তাঁহাকে মৃদু মৃদু বীজন করিতে লাগিল। বউরাণী ক্রমে সুপ্তিমগ্না হইলেন।

.

প্রভাতে ঘুম ভাঙ্গিলে বউরাণী দেখিলেন, অন্য দিন অপেক্ষা বিলম্ব হইয়া গিয়াছে, সূৰ্য্য উঠিয়াছে।

তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করিয়া, গঙ্গাস্নানে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। ঝি (হাবার মা) আসিল। জিজ্ঞাসা করিলেন–মা কোথা?

তিনি চান করতে গেছেন।

আমাকে ওঠাসনি কেন? আজ একাদশী, আজ অনুদয়ে স্নান হল না!

গিন্নী–মা যে বারণ করলেন। বললেন আহা ঘুমুচ্ছে, ওঠাসনি।

মার সঙ্গে কে গেছে?

বামুন ঠাকরুণ আর কনকদিদি।

কনকের নাম কর্ণে যাইবামাত্র, বউরাণীর মুখ অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। আবার ইহাও ভাবিলেন, অন্যদিন কনক তাঁহারই সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যায়, আজ পূৰ্ব্বে গিয়াছে, ভালই হইয়াছে।

বস্ত্রাদি হস্তে সুরবালা এই সময় বাহিরের বারান্দা দিয়া যাইতেছিল, দেখিতে পাইয়া বউরাণী তাহাকে ডাকিলেন।

সুরবালা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সসঙ্কোচে বলিল, কেন বউরাণী?

গঙ্গাস্নানে যাচ্ছ? –চল আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

গঙ্গায় ভাসিয়া আসা অবধি আজ পর্যন্ত, বউরাণীর সহিত একত্র স্নান করিতে যাইবার সৌভাগ্য সুরবালার একদিনও হয় নাই। আত্মপরিচয় দানে অসম্মত বলিয়া, বউরাণী ইচ্ছা করিয়াই তাহার সহিত বেশী কথাবার্তা কহিতেন না–পাছে সে অকারণ সঙ্কোচ অনুভব করে। তাহার দুঃখে বউরাণী যথার্থই দুঃখিত এবং সে দুঃখ দূর করিবার কোন উপায়ও তাহার হাতে নাই, ইহা তাঁহার অধিকতর আক্ষেপের বিষয়। আবার, বউরাণীর সদয় সস্নেহ ব্যবহার সত্ত্বেও সুরবালা নিজেকে দূরে দূরেই রাখিয়াছে। এ বাড়ীতে তাহার পদশব্দ, কণ্ঠস্বর কেহ বড় শুনিতে পায় না, যেন সে কত অপরাধের অপরাধী। আজ সুরবালা, বউরাণীর সঙ্গে স্নানে যাইবার প্রস্তাবে যেন কৃতার্থ হইল। বলিল–আপনার সঙ্গে আমি যাব?

বউরাণী সুরবালার প্রতি সহাস্য কটাক্ষ করিলেন। সুরবালা একটু সলজ্জ মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে যাব? –তাহাকে আপনি না বলিয়া তুমি বলিবার জন্য কয়েকবার অনুরোধ করিয়াছিলেন, তাহা সত্ত্বেও সুরবালা মাঝে মাঝে ভুলিয়া আপনি বলিয়া ফেলে।

বউরাণী বলিলেন, হ্যাঁ–চল, আজ আমরা দুজনে একসঙ্গে স্নান করতে যাই। –বলিয়া বউরাণী জানালার পথে বাগানের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাঁহার শ্বদেবী কনকলতা সহ স্নানান্তে ফিরিতেছেন।

উভয়ে নামিয়া বাগানে প্রবেশ করিলেন।

কনকলতা বলিল, আপনি আজ অনেক দেরীতে উঠেছেন।

বউরাণী বলিলেন, হ্যাঁ–আজ আমার একটু বেলা হয়ে গেছে।

আপনার দেরী হবে জেনে আজ আমি গিন্নীমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম।

তাব বেশ করেছ। –বলিয়া বউরাণী একটু হাসিলেন। চেষ্টা করিয়া মুখভাব একটু প্রসন্ন করিয়া হাসিলেন। কনকের প্রতি গতরাত্রির বিরক্তিটুকু তাঁহার মন হইতে তিরোহিত হইয়াছে–ইহাই কনককে বুঝান তাঁহার উদ্দেশ্য। কল্য তাহার মনে ব্যথা দিয়াছেন বলিয়া এখনও বউরাণী অনুতপ্ত।

শুষ্ক বস্ত্রাদি লইয়া হাবার মা তীরে বসিয়া রহিল, ইঁহারা দুইজনে স্নান করিতে নামিলেন। প্রভাতের রৌদ্র পড়িয়া গঙ্গাবক্ষ ঝম করিতেছে। দূরে, মধ্যভাগ দিয়া একখানা নৌকা যাইতেছে, দাড়ীমাঝিরা সারিগান গাহিতেছে। আজ অনেকক্ষণ ধরিয়া বউরাণী স্নান করিতে লাগিলেন।

আজ বউরাণী অনেক কথা কহিতেছিলেন, সুরবালার সঙ্গে এতকথা কোনও দিন কহেন নাই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন–সুরাবালা, তুমি সাঁতার জান?

সুরবালা বলিল, সাঁতার না জানলে কি তোমায় পেতাম?

তুমি কি সাঁতার কেটে এ ঘাটে এসেছিলে?

হ্যাঁ।

তখন বউরাণীর মনে হইল, এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা ভাল হয় নাই। ইহার অতি কাছাকাছি সুরবালার ব্যথাভরা বুক। কথা ঘুরাইয়া লইবার ছলে বলিলেন–আচ্ছা সুরবালা, তুমি রাত্রে স্বপ্ন দেখ?

হ্যাঁ, দেখি বইকি।

প্রায়ই দেখ?

মাঝে মাঝে দেখি।

আচ্ছা, তোমার স্বপ্ন কখনও সত্যি হয়ে গেছে?

সুরবালা বলিল, ভোরের রাত্রে যদি স্বপ্ন দেখা যায়, তা হলে নাকি সে স্বপ্ন সত্যি হয়। আমার একবার হয়েছিল।

কি রকম বল ত শুনি।

আমি একবার যখন বাপের বাড়ীতে ছিলাম, ভোর রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, যেন পিয়ন এসে আমার নামের একখানা চিঠি দিয়ে গেল আমার স্বামীর চিঠি। ঠিক সেইদিন চিঠি এল। ভোর রাত্রের স্বপ্ন সত্যি হয়।

বউরাণী পরপারের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিলেন।

সুরবালা বলিল, তুমি স্বপ্ন দেখ?

বউরাণী তাহার পানে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, কখনও কখনও। আমি আজ ভোরেই একটি স্বপ্ন দেখেছি।

সুরবালা বলিল, নিশ্চয়ই ফল পাবে।

ফলবে ভাই; কিন্তু তোমার যেমন সদ্য সদ্য ফলে গিয়েছিল আমার তা হবে না–আমার দেরী আছে।

কি স্বপ্ন?

বলব। এখন নয়–আজ দুপুরবেলা তোমায় বলব। তুমি আমার সব কথা শুনেছ ত?

সুরবালা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, শুনেছি। ভগবান তোমাকে এত গুণ দিয়েছেন, এত বুদ্ধি দিয়েছেন, এত ঐশ্বৰ্য্য দিয়েছেন–তার সঙ্গে সঙ্গে এত দুঃখ কেন দিলেন, আমি ভেবে পাইনে; আমাকে যে দুঃখ দিয়েছেন, তার হেতু আছে–সেটা তাঁর অবিচার হয়েছে বলতে পারিনে। কিন্তু তোমার।

বউরাণী বাধা দিয়া বলিলেন, না ভাই আমার প্রতিও তিনি অবিচার করেন নি। তিনি অবিচারে কাউকে কষ্ট দেবেন, এ কি সম্ভব? আমরা এখন দুঃখ পাই, তার হেতু যথেষ্টই থাকে–তবে অনেক সময় আমরা সেটা বুঝতে পারিনে বা জানতে পারিনে, সে অন্য কথা। আর এও নিশ্চয়, এই দুঃখ কষ্টের শেষ ফল ভালই।

সুরবালা অবাক হইয়া বউরাণীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। শেষে বলিল–আমি যদি তোমার মত অমন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারতাম, তা হলে মনে শান্তি পেতাম।

বউরাণী করুণাপূর্ন নয়নে সুরবালার পানে চাহিয়া রহিলেন। কিছু জিজ্ঞাসা করিতে ভয় হয়–অথচ এই অভাগিনীর হৃদয়ের ভাব লাঘব করিবার জন্য প্রবল আকুলতা।

০৯. কনকের শিরঃপীড়া

আজ দ্বিপ্রহর হইতে কনকলতার ভারি মাথা ধরিয়াছে। একাদশীর দিন হইলেই কনকের মাথা ধরিয়া যায়। বউরাণীর কাছে আসিয়া এই কথা বলিয়া সে ছুটি লইল। ঘর অন্ধকার করিয়া দুই তিন ঘণ্টা চুপ করিয়া শুইয়া থাকিলে তবে তাহার মাথাধরা ছাড়ে। এ বাড়ীতে আসিয়া অবধি প্রতি একাদশীর দিনই কনকের এরূপ হইয়াছে। আশ্চর্য্য কি? একাদশীর দিন হইতে বাতরোগীর বাত বৃদ্ধি হয়–শরীর রসস্থ হয় বলিয়া। কনকেরও, বোধ করি, সেইরূপ রসের মাথা ধরা।

কনক নিজ শয়নকক্ষে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল। জানালাগুলিও বন্ধ করিয়া দিয়া, বিছানায় শুইয়া রহিল।

শুইয়া শুইয়া কনক এপাশ ওপাশ করিতে লাগিল। মাথা ধরিলে কি মানুষ ঘুমাইতে পারে?

এ পাশ ও পাশ করিতে করিতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়া গেল। একটা বাজিয়াছে। এখনও বাড়ীর সকলের আহারাদি শেষ হয় নাই। এখনও বারান্দায় সকলের কণ্ঠস্বর, যাতায়াতের পদশব্দ শুনা যাইতেছে।

ক্রমে শব্দ কমিয়া আসিল। আরও আধঘণ্টা কাটিল। না, আর শব্দমাত্র নাই। সকলে বোধ হয় এতক্ষণ বিশ্রাম করিতেছে।

ও কি? অন্ধকারের মধ্যে কনকের ঘরে শব্দ কিসের? বোধ হয় বিড়াল–টিড়াল হইবে।

কুট কুট কটাং–ও কি শব্দ? তোরঙ্গ খোলার শব্দ কি? নাহঁদুরে বোধ হয় কিছু কাটিতেছে।

খট্ খট্ করিয়া নড়ে কি? আবার ঐ শোন–ধীরে ধীরে মৃদু মৃদু চপ চপ শব্দ হইতে লাগিল। কেহ কি সন্দেশ খাইতেছে? ঠিক যেন সেই মতই শব্দ না? এমন সময় এই অন্ধকারে সন্দেশ খাইবে কে? কনক ছাড়া এ ঘরে আর ত কেহ নাই! আজ একাদশী, কনক নিষ্ঠাবতী বিধবা। উহা তবে সন্দেশ খাওয়ার শব্দ হইতেই পারে না–বিড়ালে বোধ হয় ইঁদুর ধরিয়াছিল, তাহাই খাইতেছে।

আবার ও কি? কলসী হইতে কি জল গড়াইতেছে? যেন সেইরূপই শব্দ–ধক্ ধ ধ। এখন কে জল গড়াইবে? বিড়ালটাই বোধ হয় নিদ্রা যাইতেছে, ও শব্দ উহার তৃপ্তিসুখজনিত নাসিকাধ্বনি।

না, তাহা কখনই হইতে পারে না। কনক সম্বন্ধে কোনও প্রকার সন্দেহ অমূলক। সন্দেশ রসগোল্লা রেকাবী সাজাইয়া আজ কেহ ত তাহাকে জলখাবার দিয়া যাই নাই।

অন্য দিনের খাবার হইতে কিছু কিছু জমাইয়া, সে কি আর বাক্সে তুলিয়া রাখিতে গিয়াছিল, যে আজ বাহির করিয়া খাইতেছে? এ কথা বিশ্বাসযোগ্যই নহে।

কনকের খাট নড়িবার শব্দ হইল। আহা, বোধহয় বেচারীর মাথা ছাড়ে নাই–তাই এখনও এপাশ ওপাশ করিতেছে। রসের মাথাধরা কি অত সহজেই ছাড়ে?

চারিটা বাজিলে পর কনক জাগিয়া উঠিল। দুয়ার জানালা খুলিয়া দিল। চক্ষু মুছিতে মুছিতে বাহিরে আসিয়া হাবার মাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–বউরাণী কোথায়?

তিনি বাগানে ফলসা গাছের তলায় বিছানা পেতে ঠাণ্ডায় শুয়ে আছেন। মহাভারত শুনছেন।

মহাভারত শুনছেন? পড়ছে কে?

সুরোদিদি।

আর কেউ সেখানে আছে?

আর কেউ নেই। আমি প্রথমে কিছুক্ষণ ছিলাম–আমায় বউরাণী বললেন, তুই যা, এখন কিছু দরকার নেই।

কতক্ষণ গেছেন?

ঘণ্টাখানেক হল। হ্যাঁ কনকদিদি, তোমার মাথা ছাড়ল?

কনক মাথা টিপিয়া বলিল, হ্যাঁ, ছেড়েছে অনেকটা–একটু একটু আছে।

ঝি নিজকার্যে চলিয়া গেল। কনক বাক্স হইতে কাগজ প্রভৃতি বাহির করিয়া, দাদাকে একখানি চিঠি লিখিত বসিল।

১০. শাঁখ বাজিল

হাবার মা চলিয়া গেলে সুরবালা বলিল, কই বউরাণী, কি স্বপ্ন দেখেছিলে তা ত আমায় বললে না? কার বিষয় স্বপ্ন দেখেছ ভাই?

বউরাণী বালিসে হেলান দিয়া, অর্ধশয়ান অবস্থায় ছিলেন। বলিলেন–আমার স্বামীর বিষয়।

কি স্বপ্ন?

বউরাণী তখন বলিতে লাগিলেন–কাল রাত্রে কোনো কারণে আমার মনটা কিছু খারাপ ছিল। দশটার সময় মা আর আমি দুজনে শুতে গেলাম। একটু পরেই মা তার খাটে ঘুমিয়ে পড়লেন, কিন্তু আমার ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে আমি কত কথা ভাবতে লাগলাম। ক্রমে আমার স্বামীর কথা মনে হতে লাগল। অনেকক্ষণ তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার মন অনেকটা শান্ত হল। এইরকম করে ক্রমে বারোটা–একটা–দুটো বেজে গেল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপরে ভাই যেন স্বপ্ন দেখলাম, আমি গায়ে এক গা গহনা পরেছি, লাল চেলী পরেছি, আমার কপালে যেন চন্দন দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে বিয়ের সময় যেমন হয়েছিল ঠিক যেন তাই। যেন একটা ঘরে বসে আছি, কত মেয়ে বউ ঝি যেন আমায় ঘিরে বসে রয়েছে, তারা মনের আনন্দে কত হাসি তামাসা করছে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে–ঘরে যেন বাতি জ্বলছে। এমন সময় ভাই, বাইরে যেন গোল উঠল–বর এসেছে–বর এসেছে–আর ঘন ঘন শাঁখ বাজতে লাগল।

–বলিয়া বউরাণী চুপ করিলেন!

সুরবালা বলিল, তারপর?

তারপর ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি–ফরসা হয়ে এসেছে, পূর্বদিকে শুকতারা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে!

সুরবালার মুখে বিষাদমাখা হাসি ফুটিয়া উঠিল। মুখ নত করিয়া বলিল–বড় মিষ্টি স্বপ্ন–না? –বলিয়া বউরাণীর মুখ পানে চাহিয়া দেখিল, তাঁহার দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ, চক্ষু দুইটি জলে ভরিয়া উঠিয়াছে।

বউরাণী দৃষ্টি না ফিরাইয়া বলিলেন, বড় মিষ্টি স্বপ্ন। আমার সবচেয়ে মিষ্টি কি লেগেছে জান ভাই?

কি?

 ঐ শাঁখের শব্দ। প্রতিদিন দুবেলা ত শাঁখের শব্দ শুনি–কিন্তু স্বপ্নে যেমন শুনলাম, অমনি মিষ্টি শখ জীবনে আর কখনও শুনিনি। সে শাঁখের শব্দ আমার কাণে যেন মধু ঢেলে দিয়েছে।

সুরবালা চক্ষু নত করিয়া ভাবিতে লাগিল। শেষে একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–এ স্বপ্ন আর কি করে সত্যি হবে?

বউরাণী বলিলেন, কেন হবে না ভাই? তবে হ্যাঁ, এ জীবনে হবে না। তাই ত আমি তোমায় সকালবেলা বলেছিলাম, আমার স্বপ্ন সদ্য সদ্য ফলবে না। –দেরীতে ফলবে। এ জন্মে আর হল না।

তবে কবে? পরজন্মে?

না অত দেরীতেই বা কেন? পরলোকে আমার স্বামী যেখানে আছেন, সেখানে। স্বর্গে। আমার যদিও স্বর্গে যাবার মত সম্বল নেই–তিনি কি আমায় নিয়ে যাবেন না? নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন। আমি যখন সেখানে যাব, সেখানকার রীতি অনুসারে আবার আমাদের বিবাহ হবে। আমায় কনে সাজতে হবে–তিনি আসবেন–শাখ বাজবে–সবই হবে।

সুরবালা চাহিয়া দেখিল, কিছুপূৰ্ব্বে তাঁহারই বর্ণিত নিশান্তের শুক্র তারকার মত, বউরাণীর মুখখানিও আশায় আনন্দে জ্বল জ্বল করিয়া জ্বলিতেছে। বিস্ময়ে অবাক হইয়া সুরবালা এই সতীর মুখজ্যোতি: দর্শন করিতে লাগিল।

কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বউরাণী বলিলেন, তাই যদি না হবে, সে শাখের শব্দ অমন মধুর শোনাবে কেন? আমাদের এ শাঁখ ত নয় ভাই। স্বর্গের শাঁখ বোধ হয় ঐ রকম মিষ্টি।

সুরবালা বলিল, তাই হোক। ভগবান তাই যেন করেন। আর আমাকে তুমি আশির্বাদ কর, আমারও কপালে একদিন যেন সে সৌভাগ্য হয়। –বলিয়া বউরাণীর পদধূলি গ্রহণ করিল।

এই কাৰ্যটিতে বউরাণীর যেন সমাধি ভঙ্গ হইল, তিনি আবার এ মাটির পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিলেন। ব্যস্ত হইয়া বলিলেন–ও কি, পায়ে হাত দাও কেন ভাই?

সুরবালা বলিল, আমার জীবনকাহিনীও একদিন আমি তোমাকে বলব। আমি তোমার পায়ের ধূলোরও যোগ্য নই।

উভয়ে কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে বসিয়া রহিলেন। ক্রমে, মহাভারতখানি লইয়া বউরাণী নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন। বলিলেন–মহাভারত পড়া হল না!

সুরবালা বলিল, কোনখানটা পড়ব বল।

বউরাণী বনপৰ্ব্ব খুলিয়া বলিলেন, দময়ন্তীর স্বয়ম্বর পড়।

সুরবালা পাঠ করিতে লাগিল, ক্রমে সূৰ্য্যদেব পশ্চিমকাশে ঢলিয়া পড়িলেন।

ক্রমে সূর্যরশ্মি রক্তাভ হইয়া আসিল। অস্তের আর অধিক বিলম্ব নাই।

এমন সময় একটা অধ্যায় শেষ হইল। সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃপুরের মধ্য হইতে একটা সোরগোল–একটা আনন্দধ্বনি উত্থিত হইল যেন।

বউরাণী ও সুরবালা উভয়েই উৎকর্ণ হইয়া সে দিকে চাহিলেন।

পরমুহূর্তে ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। উভয়ে মহা বিস্ময়ে পরস্পরের মুখাবলোকন করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। মহাভারতখানি হাতে লইয়া বউরাণী ক্ষিপ্রচরণে গৃহাভিমুখী হইলেন। সুরবালা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।

অঙ্গনে প্রবেশ করিবামাত্র হাবার মা ছুটিয়া আসিয়া অসম্বদ্ধভাবে বলিল–বউরাণী–ও বউরাণী–আমি যা বলেছিলাম তাই। হাবার মা সব জানে; কেবল মরবে কবে গো তাই জানে না। কাঙালের কথা বাসি হলে মিষ্টি নাগে গো, বাসি হলে মিষ্টি নাগে। আমি বলিনি? বলুক পাঁচজনে! এখন আমায় কি বকশিস্ দেবে দাও। তখন কেউ গ্ৰাজ্যিই করলে না গো, গ্রাজ্যিই করলে না। আমি ছোটনোকের মেয়ে বটে–

ইতিমধ্যে একজন পুরাঙ্গনা একটা সিন্দুরের কৌটা হাতে করিয়া ছুটিয়া আসিলেন। হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিলেন–বড়বাবু বেঁচে আছেন–চিঠি এসেছে। –বলিতে বলিতে কম্পিতহস্তে বউরাণীর সীমন্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ সিন্দুর লেপন করিতে লাগিলেন।

বউরাণীও দাঁড়াইয়া নদীস্রোতে বেতসীলতার মত কপিতেছিলেন। –সুরবালা তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া না ফেলিলে সেইখানেই পড়িয়া গিয়া আঘাত পাইতেন। তাঁহার মূর্ছিত দেহ দুইজনে ধরাধরি করিয়া লইয়া অগ্রসর হইল। হাবার মা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করিয়া, কোমরে কাপড় জড়াইয়া রণরঙ্গে নৃত্য করিতে করিতে বলিতে লাগিল, আমি বলিনি? হাজার বার করে বলেছি–ছেরাদ্দ কোরো না করো না! কেউ শুনলে? কাঙালের কথা ভাল নাগবে কেন গো, নাগবে কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *