রত্নদীপ – ১ম খণ্ড

রত্নদীপ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড

০১. রাখাল বাড়ী যাইতেছে

রাখাল ভট্টাচাৰ্য্য খুস্রুপুর ষ্টেশনের ছোটবাবু–বাড়ী বর্ধমান জেলার ময়নামতী গ্রামে। বয়স অনুমান ত্রিংশৎবর্ষ, শ্যামবর্ণ সুশ্রী যুবাপুরুষ। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল করিয়া রেলে ঢুকিয়াছিল, পাঁচ ছয় বৎসর চাকরি করিতেছে। বেতন মাত্র পঁচিশটি টাকা। তবে মাঝে মাঝে টাকাটা সিকিটা উপরি যে না পাওয়া যায় এমন নহে।

রাখাল যখন ছোট ছিল, সেই সময়ে তাহার পিতৃবিয়োগ হয়। তখন তাহারা দুই ভাই। পিতার মৃত্যুর দুই বৎসর পরেই ছোট ভাইটি মারা গেল। বিধবা মাতা কষ্টেসৃষ্টে রাখালকে মানুষ করিতে লাগিলেন। গ্রাম হইতে এক ক্রোশ দূরে একটি মাইনর স্কুল আছে, সেইখানে রাখালকে ভর্তি করিয়া দিলেন। মাইনর পাশ করিয়া, চারি টাকা মাসিক বৃত্তি পাইয়া, বর্ধমানে মামার বাসায় থাকিয়া রাখাল প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়িয়াছিল। মামা বর্ধমানের মোক্তার।

যথাসময়ে রাখালের বিবাহ হইল। তাহার শ্বশুরবাড়ী গ্রাম হইতে অধিক দূর নহে–তিন ক্রোশ ব্যবধান। বধূর মুখ দেখিয়া বিধবা বৎসর দুই বাঁচিয়া ছিলেন, পৌত্রমুখ দেখা আর তাহার ভাগ্যে ঘটে নাই। মাতার মৃত্যুর পর রাখাল চাকরি অন্বেষণে বাহির হয়।

খুস্রুপুর ষ্টেশনে রাখাল বৎসরখানেক আছে। থাকিবার জন্য সরকারী বাসা পাইয়াছে। সেটি এত ক্ষুদ্র যে বাসা বলিলেও হয়, খাঁচা বলিলেও চলে। ষ্টেশনের পানিপাঁড়ে তাহাকে দুইবেলা দুইটি রাঁধিয়া দেয়–এজন্য তাহাকে বেতন বল, বখশিস বল, মাসে দুইটি টাকা দিতে হয়। পাঁড়েজি রহড়কা দাল এবং আলুকা ভুঞ্জি ছাড়া আর কিছু রাঁধিতে জানেন না। তাহাও, দাল কোন দিন কাঁচা থাকে, কোন দিন ধরিয়াও যায়; তরকারীতে কোন দিন লবণ থাকে, কোন দিন থাকেও না। রাখালের বড় কষ্ট।

রাখালের স্ত্রী লীলাবতীর বয়স এখন ঊনবিংশ বর্ষ। লোকে তাহাকে বলে, এত কষ্ট পাইতেছ, স্ত্রীকে লইয়া আস না কেন? রাখাল বলে, এইবার আনিব। আসল কথা, তাহার স্ত্রী বিদেশে আসিয়া থাকিতে চাহে না। দুই বৎসর পূর্বে রাখাল যখন জামুই ষ্টেশনে ছিল, তখন অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া স্ত্রীকে একবার লইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু দিন পনেরো থাকিয়াই লীলাবতী এমন কান্নাকাটি আরম্ভ করে যে, টেলিগ্রাফ করিয়া শ্বশুরকে আনাইয়া, তাহাকে ফিরিয়া পাঠাইতে হয়। লীলা নিজ পিত্রালয়ে থাকে, ময়নামতীতে বড় একটা আসে না; শাশুড়ী নাই, আনিবেই বা কে? বাড়ীতে কেবল রাখালের এক জাঠতুতো ভাই সপরিবারে বাস করেন।

স্বামী ও স্ত্রীর প্রণয় ভালবাসার কথা রাখাল উপন্যাসেই পাঠ করে, বন্ধুবান্ধবের মুখে গল্প শোনে–নিজ জীবনে সে রসাস্বাদন কখনও করে নাই। বিবাহের পর রাখাল যখন বাড়ী ছিল, লীলাবতী তখন বালিকা; উভয়ের মধ্যে সর্বদা দেখা সাক্ষাতের সুযোগও তখন ছিল না। তাহার পর হইতে সে বিদেশী। উমেদারীতে কিছুকাল গিয়াছিল। পাঁচ ছয় বছর ত চাকরিই করিতেছে। প্রতি বৎসরেই অন্ততঃ একবার করিয়া–হয় ছুটি লইয়া, নয় পীড়ার ভান করিয়া–রাখাল দেশে গিয়াছে। দীর্ঘকাল পরে স্বামীকে পাইলে, স্ত্রীর যেরূপ আহ্লাদ হওয়ার কথা, লীলাবতীর সে ভাব, কই, রাখাল ত কখনও দেখে নাই। কই, ফিরিয়া আসিবার সময় সে কখনও রাখালকে ত বলে নাই, আর দুইদিন থাক, কিংবা, আবার কবে আসিবে? স্বামীর প্রতি লীলাবতীর যেন কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব। লেখাপড়া জানে, রাখাল তাহাকে মাঝে মাঝে পত্রও লিখিয়া থাকে। রাখালের দুই–তিনখানি পত্রের পর লীলা একখানি উত্তর লেখে–তাহাও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত; তুমি কেমন আছ, আমরা ভাল আছি–এইরূপ দুই চারিটা মামুলি কথা মাত্র। রাখাল এক একবার ভাবে, এতদিন উভয়ে একত্রবাসের যথেষ্ট সুযোগ হয় নাই বলিয়াই লীলাবতীর মনে বয়সোচিত অনুরাগ সঞ্চার হয় নাই–কিছুদিন একত্র থাকিতে থাকিতেই তাহাদের সম্বন্ধটি স্বাভাবিক মধুরতা প্রাপ্ত হইবে। —

এবার রাখাল স্ত্রীকে আনিবার উদ্যোগ করিতেছে–দিনস্থির হইয়াছে ১৭ই মাঘ। পিত্রালয়ে থাকিলে পাছে বাড়ীর লোকের কুমন্ত্রণায় আসিবার সময় বাঁকিয়া বসে, তাই তাহাকে ২রা মাঘ নিজেদের বাড়ীতে আনাইয়া রাখিয়াছে। তারিখ হিসাব করিয়া রাখাল একসপ্তাহ ছুটির দরখাস্ত করিয়াছিল, কিন্তু ছুটি মঞ্জুর হয় নাই। রেলের চাকরিতে ছুটি আবশ্যকমত প্রায়ই পাওয়া যায় না। একবার একব্যক্তি পিতার মৃত্যুর পর, বাড়ী গিয়া আদ্যশ্রাদ্ধ করিবে বলিয়া ছুটি চাহিয়াছিল; সাহেব হুকুম দিলেন, এখন ছাড়িতে পারি না, দুইমাস পরে শ্রাদ্ধ করিও। এরূপ অবস্থায়, রেলের সকল চাকর যাহা করিয়া থাকে, রাখালও তাহাই করিবে স্থির করিয়াছে। একদিন পূৰ্ব্বে, ১৬ই মাঘ সিক রিপোর্ট অর্থাৎ পীড়ার ভান করিয়া, সন্ধ্যার গাড়ীতে বাড়ী যাইবে। পরদিন স্ত্রীকে লইয়া যাত্রা করিয়া, তৎপরদিন, অর্থাৎ ১৮ই মাঘ বেলা নয়টার গাড়ীতে আসিয়া পৌঁছিবে। স্টেশনমাষ্টার সম্মতি দিয়াছেন, রেলের ডাক্তারবাবুটিও অত্যন্ত সদাশয় ব্যক্তি, তিনিও সার্টিফিকেট দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।

দেখিতে দেখিতে রাখালের বাড়ী যাইবার ধার্য দিন উপস্থিত হইল। বেলা তিনটার সময় ষ্টেশনে গিয়া সে সিক্ রিপোর্ট করিল–বড়বাবু সংবাদ যথানিয়মে তারযোগে হেড অফিসে এবং ডাক্তারবাবুকে জানাইলেন। জিনিস পত্র গুছাইয়া, বিছানা বাঁধিয়া, সন্ধ্যা ৭টার প্যাসেঞ্জারে রাখাল রওনা হইবে। পানিপাঁড়ে খানকতক রুটি এবং আলু বেগুণ ভাজা প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিল, তাহাই রাখাল শালপাতায় জড়াইয়া তোয়ালেতে বাঁধিয়া লইল, গাড়ীতে খাইবে। সঙ্গে এক সোরাই জলও লইল। বড়বাবুর স্ত্রী পাণ সাজিয়া ভিজা নেকড়ায় জড়াইয়া দিয়াছিলেন, গাড়ীতে উঠিবার সময় বড়বাবু তাহা রাখালের হাতে দিলেন এবং অনুরোধ করিলেন, যদি অসুবিধা না হয় তবে এক নাগরী ভাল খেজুরগুড় যেন রাখাল তাঁহার জন্য লইয়া আসে।

গাড়ী ছাড়িয়া দিল।

০২. স্ত্রী কোথায়?

রাখালের বাড়ী ময়নামতী গ্রাম, মেমারি স্টেশন হইতে আড়াই ক্রোশ পথ। গাড়ী হইতে নামিয়া একজন মুটিয়ার মাথায় ব্যাগ দিয়া, বেলা নয়টার পূর্বেই রাখাল বাড়ী পৌঁছিল।

অঙ্গনে প্রবেশ করিয়া রাখাল দেখিল, সকলের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর ও বিষণ্ণ। একটা অজ্ঞাত বিপদাশঙ্কায় তাহার সর্বাঙ্গ হঠাৎ শিহরিয়া উঠিল।

বউদিদি তখন গোহালের বাহিরে দাঁড়াইয়া গাই দুহাইতেছিলেন, রাখালের কণ্ঠস্বর শুনিয়াও মুখ ফিরিয়া চাহিলেন না। দাদার বৃদ্ধা শাশুড়ী নামাবলী গায়ে দিয়া সাজি হস্তে উঠানের প্রান্তস্থিত করবী গাছ হইতে ফুল তুলিতেছিলেন, তিনি মুখ ফিরাইয়া রাখালের পানে এক নজর মাত্র চাহিয়া আবার স্বকার্যে মনোনিবেশ করিলেন। ঝি হারাণীর মা জলের ঘড়া কাঁখে করিয়া রাখালের সম্মুখ দিয়াই চলিয়া গেল, একবার মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসাও করিল না, দাদাবাবু ভাল ত? কেবল তাহার ভ্রাতুস্পুত্রী দশমবর্ষীয়া বালিকা স্বর্ণলতা ধীরে ধীরে আসিয়া রাখালের হাতখানি ধরিয়া স্নেহভরে বলিল, ছোটকাকা!

রাখাল শঙ্কিতস্বরে বলিল, খুকী, সবাই কেমন আছে?

ভাল আছে।

তোর বাবা কোথায়?

কি জানি!

কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন নাকি?

হ্যাঁ।

আমার চিঠি তোরা পেয়েছিলি? –বলিতে বলিতে রাখাল বড় ঘরের বারান্দায় উঠিল। একবার উৎসুক হইয়া চারিদিকে নেত্রপাত করিল। যাহা খুঁজিতেছিল তাহার কোনও চিহ্ন কোথাও দেখিল না। এমন সময় তাহার বধূঠাকুরাণী আসিয়া দাঁড়াইলেন।

রাখাল তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, ভাল আছ বউদিদি?

আছি। বউদিদির স্বর বিষণ্ণ, চক্ষু আনত।

আমি আজ এসে পৌঁছব বলে চিঠি লিখেছিলাম, সে চিঠি কি তোমরা পাওনি?

পেয়েছিলাম।

দাদা কোথায়?

কোথা বেরিয়েছেন।

ছোট খোকা ভাল আছে? –বলিতে বলিতে রাখাল বড় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।

ভাল আছে।

বড় তেষ্টা পেয়েছে বউদিদি–এক গেলাস জল দাও ত।

তুমি হাত পা ধুয়ে ফেল, আমি জলখাবার আনি। –বলিয়া বধূঠাকুরাণী প্রস্থান করিলেন।

রাখাল তৎপশ্চাৎ বারান্দায় আসিয়া হস্তপদাদি প্রক্ষালন করিল। আবার ঘরে আসিয়া, তক্তপোষের উপর বসিল। উৎসুক নয়নে দ্বারের পানে চাহিয়া রহিল; তাহার মনে আশা ছিল, বউদিদি বোধ হয় লীলাবতীর হাতেই জলখাবার পাঠাইয়া দিবেন।

কিন্তু কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিতেই তাহার সে আশা ভঙ্গ হইল। বউদিদিই জলখাবার লইয়া প্রবেশ করিলেন। একটি রেকাবিতে দুইটি রসগোল্লা, আর এক গেলাস জল।

স্বর্ণলতা একটি ডিবার খোলে দুইটি পান রাখিয়া চলিয়া গেল। রাখাল রসগোল্লা খাইতে লাগিল। বধূঠাকুরাণী নীরবে উদাস দৃষ্টিতে বাহিরের পানে চাহিয়া রহিলেন।

জল পান করিয়া, গেলাস নামাইয়া রাখিয়া, রাখাল বলিল, দাদা কতক্ষণে ফিরবেন, বউদিদি?

কি জানি।

একখানা গরুর গাড়ী এখন থেকে বলে রাখতে হবে ত? বেলা চারটের সময় রওয়ানা হতে হবে। সাহেব ছুটি ত দিলে না, ব্যারাম হয়েছে বলে চলে এসেছি। এ দিকের সব গোছান আছে ত?

বউদিদি রাখালের পানে না চাহিয়া, ঘাড় নাড়িয়া জানাইলেন–না। তাহার চক্ষুযুগল হইতে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।

দেখিয়া রাখাল বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিল, কি হয়েছে বউদিদি?

বউদিদি নীরব।

রাখাল তখন তক্তপোষ হইতে নামিয়া, বউদিদির কাছে দাঁড়াইয়া কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, সে কি বেঁচে নেই?

বউদিদি রাখালের পানে না চাহিয়াই বলিলেন, এমন কি সৌভাগ্য তার?

তবে? কি হয়েছে বল বউদিদি?

কি হয়েছে তা ত জানিনে, আজ ভোর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

শুনিয়া রাখালের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। রূদ্ধশ্বাসে বলিল–পাওয়া যাচ্ছে না! বল কি? কোথা গেল?

ভগবান জানেন। তোমার দাদা খুঁজতে বেরিয়েছে।

ক্ষণমাত্র চিন্তা করিয়া রাখাল বলিল, ঝগড়াঝাটি কিছু হয়েছিল?

কই, তেমন কিছুই ত হয়নি।

তবু?

কাল সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ হাতে করে রান্নাঘরে যাচ্ছিল, পথের মধ্যে প্রদীপটা হাত থেকে পড়ে গেল–

তুমি তাকে বকলে?

আমি শুধু বললাম, ছোটবউ, এক প্রদীপ তেল ফেলে দিলে, আসে কোথা থেকে বল দেখি? এই টানাটানির সংসার, একটু সাবধান হয়ে চলাফেরা করতে হয়! এই শুধু বলেছিলাম।

তারপর?

তারপর আর কি? সারা সন্ধ্যেবেলা মুখ গোঁজ করে রইল। রাত্রে ভাল করে খেলে না।

রাখাল ভাবিল, ঘটনাটা বউদিদি যত লঘুভাবে বর্ণনা করিলেন, আসলে তত লঘুভাবে শেষ হয় নাই। বোধ হয়, বউদিদি তাহাকে খুব কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিয়াছিলেন। অভিমানিনী নিশ্চয়ই জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল–কাল রাত্রে সে কোথায় শুয়েছিল?

ও ঘরে।

সেখানে আর কে শুয়েছিল?

সে আর খুকী এক বিছানায় শুয়েছিল।

তারপর, কতক্ষণে উঠে গেল?

তা ত খুকী বলতে পারে না। ছেলেমানুষ, রাত্রে শুয়েছে একবারে সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গেছে। জেগে উঠে আর তাকে দেখতে পায়নি।

বাড়ীর কোনও দরজা সকালে উঠে খোলা পেয়েছিলে?

খিড়কীর দরজা খোলা পেয়েছিলাম।

রাখাল কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া শুষ্ককণ্ঠে বলিয়া উঠিল,  বউদিদি, নিশ্চয়ই সে পুকুরে ডুবে মরেছে। আমি জেলেদের ডেকে আনি। –বলিয়া রাখাল জুতা পরিতে লাগিল।

বউদিদি তাহার জামা চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, থাম থাম ঠাকুরপো, এখন গোলমাল কোরো না। যদি ডুবেই থাকে, এখন জেলে ডেকে জাল ফেলালে তাকে কি বাঁচাতে পারবে? জলে মানুষ ডুবলে এতক্ষণ কি প্রাণ থাকে? যদি তাই হয়ে থাকে, আজ দিনের মধ্যেই ভেসে উঠবে। তা যদি না হয়, তা হলে রটনা করতে হবে, তার বাপের বাড়ীর ঝি কাল রাত্রে এসেছিল, ভোরবেলা তাকে নিয়ে গেছে।

কথা শুনিয়া রাখালের দেহের ভিতর দিয়া যেন বেদনার একটা বিদ্যুৎ বহিয়া গেল। সে বুঝিতে পারিল, বউদিদির কি সন্দেহ। ভাবিল তাহা হইতেই পারে না, অসম্ভব–অসম্ভব। বলিল–বউদিদি, তুমি যা মনে করেছ, তা কখনই নয়। হয়ত, সে অভিমানে জলে ডুবে মরেছে, নয়, সে সত্যি সত্যিই বাপের বাড়ী পালিয়ে গেছে। আমি গোল করব না, কিন্তু একবার খিড়কীর পুকুরের চারিধারটা ঘুরে আসি। যদি সে ডুবে মরে থাকে তবে কোন না কোনও চিহ্ন দেখিতে পাব। –বলিয়া রাখাল বাহির হইয়া গেল।

রাখাল গিয়া পুষ্করিণীর চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইল, কিন্তু কোথাও কোনও প্রকার চিহ্ন বা সন্দেহজনক কিছুই দেখিল না। তখন ভাবিল যদি ডুবিয়াই থাকে, তবে খিড়কীর এ ক্ষুদ্র পুষ্করিণীতে ডুবিবে এমন কি কথা? হয়ত ডুব–জলও ইহাতে নাই। সুতরাং বাটীর অনতিদূরে সাধারণের ব্যবহার্য যে পুষ্করিণী আছে, সেখানে অন্বেষণ করা আবশ্যক।

কিন্তু পুষ্করিণীতে অন্বেষণ করিতে গিয়া বিপদ এই হইল, ক্রমাগত পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতে লাগিল। কি রাখালদা, কখন এলে? –কি রাখালকাকা, হঠাৎ যে? –রাখাল যে; বাবাজি ভাল আছ ত? –ইত্যাকার প্রশ্নে পদে পদে সে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। স্নানের বেলা; কেহ তৈলমর্দন করিয়া গামছা কাঁধে লইয়া স্নানে যাইতেছে, কেহ স্নান সমাপন করিয়া ফিরিতেছে; সুতরাং এরূপ অবস্থায় পুষ্করিণীর চারি পাশে ঘুরিয়া বেড়ান রাখালের পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল। তাই সে বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া ভগ্নহৃদয়ে তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িল।

অল্পক্ষণ পরে, স্বর্ণলতা আসিয়া, রাখালের পাশে বসিয়া, স্নেহভরে তাহার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। নীরবে চিন্তা করিতে করিতে রাখালের দুই চক্ষু সজল হইয়া উঠিল। এটুকু, বালিকার চক্ষু এড়াইল না। কি বলিয়া কাকাকে সান্ত্বনা করিবে? কাকার ব্যথা কোথায়, তাহাও সে বুঝিতে পারিয়াছে; কিন্তু অবোধ বালিকা ত কথা জানে না। আর কিছু ভাবিয়া না পাইয়া সে বলিল, কাকা, তামাক সেজে দেব?

রাখাল সে কথার উত্তর না দিয়া স্বীয় সজল নেত্রযুগল বালিকার পানে ফিরাইয়া বলিল, খুকী, তোর ছোটকাকীর কি হল?

করুণকণ্ঠে খুকী বলিল, তা ত জানিনে কাকা। বোধ হয় বাপের বাড়ী চলে গেছেন।

রাখাল আগ্রহসহকারে বলিল, হ্যা খুকী, আমারও তাই বিশ্বাস। নিশ্চয়ই সে বাপের বাড়ী গেছে। আচ্ছা খুকী, তোরা যে বিছানায় শুয়েছিলি, সে বিছানায় কোনও চিঠি কি কাগজ সকালে উঠে দেখিসনি?

না কাকা, কোনও চিঠি ত দেখিনি?

সে বিছানা কোথা? ও

ঘরে গুটানো আছে।

আচ্ছা চল দেখি বিছানাটা একবার ভাল করে খুঁজি। –রাখাল শুনিয়াছিল, আত্মহত্যা করিবার বা নিরুদ্দেশ হইবার পূৰ্ব্বে অনেকে কারণটা চিঠিতে লিখিয়া রাখিয়া যায়।

দুইজনে তখন উঠিয়া গিয়া বিছানার মধ্যে অনেক বিফল অনুসন্ধান করিল। বালিসগুলার ওয়াড় পর্যন্ত খুলিয়া দেখিল, কোথাও কিছু নাই।

ঘর হইতে বাহির হইয়া, রাখাল তখন শুধুপায়ে পাগলের মত উঠানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, বুকের ভিতরটায় যেন কে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে।

বউদিদি রান্নাঘরের রকে বসিয়া কুটনা কুটিতেছেন, ঝি অল্পদূরে বসিয়া ছোট খুকীকে দুধ খাওয়াইয়া দিতেছে। এ সকল দৃশ্য যেন রাখালের চক্ষে কায়াশূন্য স্বপ্নের মত প্রতিভাত হইতে লাগিল।

বারান্দায় দাঁড়াইয়া খুকী ডাকিল, কাকা, তামাক সেজেছি। –কলিকাটি হাতে করিয়া খুকী ফুঁ দিতেছে।

খুকীর সান্ত্বনাপূর্ণ করুণ কণ্ঠধ্বনি রাখালের মনে পিপাসার জলের মত অনুভূত হইল। এ দুঃখের সময়, বাড়ীর আর কেহ তাহার পানে ফিরিয়াও চাহিতেছে না–একমাত্র খুকীই তাহার ব্যথার অংশ বুক পাতিয়া লইয়াছে।  

রাখাল তখন বারান্দায় উঠিয়া ভূমির উপর বসিয়া দেওয়ালে পিঠ দিয়া তামাক খাইতে আরম্ভ করিল।

কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে, রাখালের দাদা চটিজুতা ফট ফট করিতে করিতে বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন। তিনি রাখালের অপেক্ষা দশ বছরের বড়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপে দেহখানি কৃশ, চক্ষু কোটরগত, দেখিলে বয়সের অপেক্ষা আরও পাঁচ সাত বৎসর অধিক বলিয়া মনে হয়।

দাদাকে দেখিয়া রাখাল হুঁকা নামাইয়া, তাহাকে প্রণাম করিল। কুশল প্রশ্নাদির পর হুঁকাটি টানিতে টানিতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সব শুনেছ ত?

শুনেছি। কোনও খোঁজ পেলেন?

কিছু না। কাউকে ত মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে পারিনে, মুস্কিল হয়েছে এই কিনা!

রাখালের বউদিদি আসিয়া দাঁড়াইলেন। সকল শুনিয়া বলিলেন–এখন উপায়? গ্রামে যে এখনই টী টী পড়ে যাবে!

দাদা বলিলেন, আমি পাড়ায় বলে এসেছি, বউমার মায়ের হঠাৎ ব্যারাম হয়েছে বলে, বসন্তপুর থেকে লোক এসে রাত থাকতে পাল্কী করে তাকে নিয়ে গেছে।

রাখাল বলিল, দাদা, আমার বোধ হয় সত্যি সত্যিই সে সেখানে গিয়েছে।

বউদিদি বলিলেন, কার সঙ্গে গেল?

একলাই গিয়ে থাকবে। জান ত, পশ্চিমে যেতে বরাবরই তার ঘোর আপত্তি। নিতে আসছি, এবার নিয়ে যাবই, সেই ভয়ে সে পালিয়ে বাপের বাড়ী গিয়েছে।

বউদিদি বলিলেন, তোমার যেমন কথা! বউমানুষ, একলা, রাত্তির কাল–এই তিন ক্রোশ পথ হেঁটে কখনও বসন্তপুর যেতে পারে?

রাখাল বলিল, মানুষটা ভারি একগুয়ে। জানই ত বউদিদি!

বউদিদি বিরক্তির স্বরে বলিলেন, জানিনে আবার? হাড়ে হাড়ে জানতে পেরেছি! এই পনেরো দিনেই আমার হাড় জ্বালিয়ে তুলেছিল। বলি হ্যাঁগা, রাখাল না হয় ছেলেমানুষ, তোমার ত বয়স হয়েছে, তোমার কি মনে হয় ছোট বউ হেঁটে একলা বাপের বাড়ী গেছে?

দাদা, স্ত্রীর কথার সমর্থন বা প্রতিবাদ কিছুই করিতে না পারিয়া বলিলেন, যদি তাই গিয়ে থাকেন, তা হলেই কি কাজটা ভাল হয়েছে? লোকে শুনলে কি বলবে? ছি। ছি–গেরস্তের মেয়ের কি এই ব্যাভার?

বউদিদি বলিলেন, সে কখনো বাপের বাড়ী যায়নি, ডুবেও মরেনি। আমাদেরই ডুবিয়ে গেছে।

দাদা গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন।

রাখাল বলিল, খাওয়া দাওয়া করে, আমি বসন্তপুর চলে যাই। দেখি কি ব্যাপার।

বউদিদি ঝঙ্কার দিয়া বলিলেন, তা, গিয়ে দেখ। কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি ঠাকুরপো, সে যদি সেখানে গিয়েই থাকে, তবে আর কখনও তাকে এ বাড়িতে এনো না। সঙ্গে করে তাকে পশ্চিমে নিয়ে যেও, যেখানে খুসি নিয়ে যেও। কিন্তু এ বাড়ীতে আর যেন সে না ঢোকে। আমরা গরীব গেরস্ত মানুষ–অমন দজ্জাল মেয়েকে বউ বলে পরিচয় দিয়ে ঘরে রাখতে পারব না।

রাখাল নীরবে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া রহিল।

০৩. এমন স্ত্রী লইয়া কি হইবে?

প্রায় অর্ধঘণ্টাকাল রাখাল এইরূপ মুহ্যমান হইয়া বসিয়া থাকিবার পর তাহার বউদিদি আসিয়া বলিলেন, ঠাকুরপো, যদি বসন্তপুর যেতে হয় তবে স্নান করে খেয়ে বেড়িয়ে পড়, বসে বসে ভাবলে কি হবে? বেলা ত কম হয়নি।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া রাখাল উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল–তেল কোথায়?

তেলের বাটি ঐ কুলঙ্গিতে রয়েছে। –বলিয়া বউদিদি আবার রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

ব্যাগ খুলিয়া রাখাল তাহার গামছাখানি বাহির করিল। মাথায় কিঞ্চিৎ তৈলমর্দন করিয়া, গামছাখানি কাঁধে ফেলিয়া উঠানে নামিতেই সদর দরজা হইতে শব্দ আসিল, দাদাঠাউর বাড়ী আছেন?

রাখালের দাদা উঠানে আমগাছতলায় মোড়া পাতিয়া বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন। বলিলেন– কে ও?

আমি–বছিরদ্দি সেখ।

কেন?

দরজা খোলেন–একটা জরুরি কথা আছে।

বছিরউদ্দিন গ্রামের চৌকিদার। তাহার জরুরি কথা কি, জানিবার জন্য মুহূর্তের মধ্যে বাড়ীশুদ্ধ লোক চঞ্চল হইয়া উঠিল। রাখালও দাঁড়াইল।

দাদা তাড়াতাড়ি গিয়া দরজা খুলিয়া দিয়া বলিলেন, এস বছিরদিন, এস, খবর কি?

প্রৌঢ়বয়স্ক, উন্নতকায়, বলিষ্ঠদেহ বছিরদ্দিন, মাথায় নীল পাগড়ি, হস্তে এক প্রকাণ্ড লাঠি, অঙ্গনমধ্যে প্রবেশ করিয়া দাঁড়াইল। বাটীর স্ত্রীলোকেরা একটু অন্তরে দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া রহিল।

বছিরদ্দিন বলিল, দাদাঠাউর, আপনাদের ছোটবউকে কাল আত্রে কি তেনার বাপের বাড়ী পেঠিয়েছেন?

দাদা বলিলেন, হ্যাঁ–কেন?

তবে সে মাগী ঠিকই কয়েছেলো। কাল, দাদাঠাউর, এক পওর রাত বাকী থাকতে, রোঁদ দিতে বেরিয়েছিনু। দিব্যি ফুটফুটে চাঁদনী রাত। যখন গেরাম ছেড়িয়ে পেরায় কোশখানেক পথ গেছি, গাজনতলার সরহদ্দের কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখন দেখি যে রাস্তা দিয়ে দুইঝনা বিটীছাওয়া যাচ্ছে। একঝন বেওয়া, একঝন সধবা। যে বেওয়া সে বুড়ী, যে সধবা সে মুখে ঘোমটা দিয়ে ছেলো, বয়সটা ঠাওর পেনু না। অত আত্রে, মাঠের পথে দুইঝন বিটীছাওয়া, সাথে কেউ মরদ নেই, দেখে আমার মনে কেমন সন্দ হল। তাই বন্নু–এত আত্রে কে যায়? –হাঁক দিতেই তারা থমকে দাঁড়াল। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কন্নু–কে তোরা? –কোথা যাস? –যে বেওয়া, সে বল্লেওগো আমরা যাচ্ছি গাজনতলা। –জিগাস কন্নু–গাজনতলা কার বাড়ী যাস? –বললে–ভচার্য্যি বাড়ী। আমি বন্নু–ভস্চায্যি বাড়ী? গাজনতলায় ত ভস্চায্যি কেউ নেই। –মাগী চুপ করে রইল। তাই দেখে দাদাঠাউর, সন্দটা আমার মনে আরও দেঢ়ো হল। জিগাস কন্নু–কে তোরা, কোথা যাচ্ছিস, সত্যিবল, নইলে ধরে থানায় নিয়ে যাব। আমার নাম বছিরউদ্দিন সেখ চৌকিদার। –এই না বলে দাদাঠাউর, হাত পাঁচ ছয় পিছু হটে, এই নাঠিটে মাথার উপর তুলে বন বন করে ঘোরাতে নাগনু। মাগী তখন কাঁপতে কাঁপতে বললে দোহাই বাবা চৌকিদার আমাদের মের না, আমরা চোর নই হেঁচড় নই। আমি সৈরভির মা, বাড়ী বসন্তপুর। বসন্তপুরে এইবউটির বাপের বাড়ী কিনা, কেষ্টদাস ঘোষাল এর বাপ। বউটিকে বাপের বাড়ী নিয়ে যাচ্ছি। আমি বন্নু–তবে যে বল্লি গাজনতলায় ভস্চাৰ্য্যি বাড়ী যাব? –সে বল্লে–না বাবা ভুলে বলেছি। ময়নামতীর ভস্চায্যি বাড়ী থেকে আসছি। এ সেই বাড়ীর ছোটবউ। এই কথা শুনে তাদের ছেড়ে দিনু। কিন্তু মনের সন্দটা কিছুতেই গেল না দাদাঠাউর; তাই বাড়ী ফিরে ভাবনু, যাই দাদাঠাউরকেই জিগাস করে আসি। মাগী যা বল্লে ঠিক ত দাদাঠাউর?

দাদা গম্ভীরভাবে বলিলেন, ঠিক বলেছে।

আচ্ছা তবে আসি। সেলাম দাদাঠাউর।

চৌকিদার চলিয়া গেলে, বাড়ীর লোকের মন হইতে যেন একটা বিষম বোঝা নামিয়া গেল। ছোটবউ তবে পিত্রালয়েই গিয়াছে। পলাইয়া যাইলেও যাহা আশঙ্কা ছিল তাহার তুলনায় শতগুণে সহস্রগুণে ভাল। সৈরভির মা এ বাটীর বিশেষ পরিচিত, পূৰ্ব্বে কতবার আসিয়াছে। আর কোনও ভয় নাই। লোকে একটু নিন্দা করিবে–তা করুক। যে নিন্দার উপক্রম হইয়া উঠিয়াছিল, ভগবান তাহা হইতে রক্ষা করিয়াছেন। সকলে যেন নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। রাখালের দুর্ভাবনা দূর হইয়া মনটা বেশ খুসী হইয়া উঠিল।

দাদা কিন্তু রাগ করিতে লাগিলেন ৷ বলিলেন–ছি ছি কেলেঙ্কারি কেলেঙ্কারি! দেখ দেখি একবার কাণ্ডখানা! বাপের বাড়ীই যদি যেতে হয়, আমাদের বলে কয়ে গেলেই ত হত। আমরা বাড়ীসুদ্ধ লোক এতক্ষণ চোখে যে সর্ষেফুল দেখছিলাম! আর কিছু নয়, বউমা নিশ্চয়ই কাদাকাটা করে মাকে চিঠি লিখেছিলেন–এরা ত আমায় যেতে দেবে না, চুপি চুপি সৈভির মাকে পাঠিয়ে দিও, আমি চুপি চুপি তার সঙ্গে যাব। বউমা না হয় ছেলেমানুষ–বুদ্ধি নেই। তার মা ত ছেলেমানুষ নন! বুড়ো হয়েছেন, তার এ আক্কেল হল না যে, ও রকম করে আমার মেয়ে যদি রাত্রে পালিয়ে আসে ত লোকে কি বলবে? ছি ছি কেলেঙ্কারি কেলেঙ্কারি!

রাখাল স্নান করিতে গেল। তখন প্রায় দ্বিপ্রহর, স্নানের ঘাটে আর লোকজন নাই। রাখাল অনেকক্ষণ ধরিয়া স্নান করিল। স্নান করিতে লাগিল–আর ভাবিতে লাগিল।

চৌকিদারের কথিত বৃত্তান্ত শুনিয়া রাখালের মনে প্রথমটা যে আনন্দের লহরী উঠিয়াছিল, তাহা অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না। প্রথমটা, সেটা পরিত্রাণের আনন্দ; মুখে সে যাহাই বলুক, যে সন্দেহ বউদিদির মনে প্রবেশ করিয়াছিল, সেই বিষম সন্দেহ সর্পের মত রাখালের মনকেও দংশন করিয়াছিল। তাহার প্রথম অনুভূতি–একটা জীবনব্যাপী লজ্জা ও অপমানের হস্ত হইতে অব্যাহতি লাভের আনন্দ। এখন স্নান করিতে করিতে আবার তাহার মনে অল্পে অল্পে অবসাদ আসিতে লাগিল। এই স্ত্রী! স্ত্রীর এই স্নেহ, এই ভালবাসা! পাছে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যাইতে হয়, তাই পলায়ন! এমন করিয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পলায়ন! এমন স্ত্রী লইয়া কি হইবে? জোর করিয়া ধরিয়া বাধিয়া লইয়া গেলেই বা কি হইবে? এমন স্ত্রী হইতে সাংসারিক সুখের আশা দুরাশা মাত্র। একবার দেখা করিবার জন্যও অপেক্ষা করিল না? না হয় সঙ্গে নাই যাইত–এতদিনের পর, একবার দেখাটা হইলে ক্ষতি ছিল কি? –ক্রোধে অভিমানে রাখাল সেই জলের মধ্যে ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। ভাবিতে লাগিল, দূর হইক, শ্বশুরবাড়ী যাইব না, তাহার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখিব না! আমি আবার বিবাহ করিব। এই সকল কথা চিন্তা করিতে করিতে স্নান সারিয়া রাখাল গৃহে ফিরিয়া আসিল।

আহারাদির পর, শয্যায় শয়ন করিয়া রাখাল ভাবিতে লাগিল। আজ ত আর তাহার খুস্রুপুরে ফিরিয়া যাওয়া হয় না–কল্য বৈকালের গাড়ীতে যাইবে। পুনরায় বিবাহ করিবে, সে ইতিমধ্যে একপ্রকার স্থিরই করিয়া ফেলিয়াছে। ভাবিল, তথাপি লীলাবতীর সঙ্গে একবার শেষ কথাটা হওয়া উচিত। আজ বসন্তপুরে গিয়া তাহার সহিত খোলাখুলি কথাবার্তা কহিবে। বলিবে, আর পাঁচজনের স্ত্রী যেমন, তুমিও যদি সেইরূপ আমার স্ত্রী হইতে সম্মত হও, তবে আমার সঙ্গে চল। যদি তোমার অনিচ্ছা থাকে, তবে আমাকে আজ স্পষ্ট করিয়া জবাব দাও, আমি অন্যত্র বিবাহ করিয়া সংসারধর্ম করি।

রাখাল ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, বেলা তখন দুইটা। উঠিয়া কাপড় পরিয়া ছাতা ও ব্যাগটি মাত্র হাতে করিয়া, পদব্রজে শ্বশুরালয়ে যাত্রা করিল।

যখন সে দরজার বাহির হইতেছে, তখন স্বর্ণলতা কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া নিজ ক্ষুদ্র হাতটি তুলিয়া বলিল, কাকা!

কি স্বর্ণ?

আমার একটি কথা রাখবে?

রাখাল একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, কি কথা স্বর্ণ? বল, রাখব।

কাকা, কাকীমাকে বেশী বোকো না। –বকবে?

এই দুঃখের সময়ও একটু মুচকি হাসিয়া রাখাল বলিল, আচ্ছা, বেশী বকব না।

শুনিয়া বালিকার মুখখানি প্রফুল্ল হইল। আদরের স্বরে বলিল–কবে আসবে কাকা?

কাল আসব মা!–বলিয়া রাখাল সস্নেহে তাহার চিবুকাগ্রভাবে স্পর্শ করিয়া, পথে নামিয়া পড়িল।

০৪. শ্বশুরালয়ে

বসন্তপুর গ্রামখানি ক্ষুদ্র হইলেও শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন। বাবু সারদাচরণ রায় ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ এই গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী কয়েকখানি গ্রামের পত্তনিদার, কিন্তু সাধারণতঃ লোকে ইহাদের জমিদারই বলিয়া থাকে। রাখালের শ্বশুর কৃষ্ণাদাস ঘোষালও সম্পন্ন ব্যক্তি এবং জমিদার পরিবারের সহিত বন্ধুত্ব ও কুটুম্বিতাসূত্রে আবদ্ধ।

সেদিন অপরাহ্নে, দিবানিদ্রা সমাপন করিয়া, কৃষ্ণদাসবাবু বৈঠকখানায় আসিয়া তক্তপোষের উপর বসিয়াছেন। ডাকপিয়ন আসিয়া একখানি বাঙ্গালা সংবাদপত্র দুইখানি চিঠি দিয়া গেল। চিঠিগুলি পাঠ করিতেছেন, এমন সময় প্রতিবেশী মুখুয্যে মহাশয় হাতকাটা পিরাণ গায়ে দিয়া খড়ম পায়ে খট খট করিতে করিতে বারান্দায় উঠিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, কাগজ এল?

কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, হ্যাঁ, এসেছে। আসুন।

মুখুয্যে মহাশয় তক্তপোষে উপবেশন করিয়া, কাগজখানি কোলে তুলিয়া লইলেন। পিরাণের পকেট হইতে চশমা বাহির করিয়া, কোঁচার কাপড়ে কাচ দুইখানি বেশ করিয়া পরিষ্কার করিলেন। তখন চশমাটি চোখে লাগাইয়া, কাগজখানি খুলিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পাঠ আরম্ভ করিলেন।

বাঙ্গালা সংবাদপত্রের এরূপ বুভুক্ষু পাঠক, এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয় নাই। প্রতি শনিবারে তীর্থের কাকের ন্যায় ইনি কৃষ্ণদাসবাবুর কাগজখানির জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকেন। শনি ও রবি এই দুইদিনে সমস্ত কাগজখানি মায় বিজ্ঞাপন, তন্ন তন্ন করিয়া পাঠ করিয়া ফেলেন। স্মরণশক্তিও ইহার অসাধারণ। পাঁচ বৎসর পূৰ্ব্বে কবে কোন্ সহরে আগুন লাগিয়া কত লক্ষ টাকা ক্ষতি হইয়া গিয়াছিল, বলিয়া দিতে পারেন। উপস্থিত, ইনি বুয়র–যুদ্ধ সংবাদে মশগুল হইয়া আছেন। প্রতি সপ্তাহের যুদ্ধসংবাদ তাহার নখদর্পণে। শুধুই কি তাই? সমরকৌশলের ইনি একজন অক্লান্ত সমালোচক। পাঠ করিতে করিতে উভয় পক্ষের সৈন্যসংস্থাপন কাগজ পেন্সিল লইয়া আঁকিতে বসিয়া যান। কোনও পক্ষ কোনও যুদ্ধে পরাজিত রইলে, কি ভ্রমের জন্য পরাজয়টি ঘটিয়াছে, তাহার একটা সূক্ষ্ম তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়া ফেলেন। কাগজে আঁকিয়া বলেন, হায় হায় হায়–জেনেরাল অমুক যদি এই রকম না করে এই রকম করত, তা হলে কি এ যুদ্ধে ওদের হার হয়? –কি ভুলটাই করেছে! এটুকু বুদ্ধি নেই, বেটা জেনারালগিরি করতে এসেছিস?

প্রায় অর্ধঘণ্টাকাল মনে মনে পাঠ করিবার পর মুখুয্যে মহাশয় বলিলেন, যুদ্ধসংবাদটা পড়ব নাকি?

কৃষ্ণদাসবাবু স্বয়ং যুদ্ধসংবাদ পড়িয়া সব কথা ভাল বুঝিতে পারেন না, তাই প্রতি শনিবারে তাহাকে বুঝাইবার ভার মুখুয্যে মহাশয় গ্রহণ করিয়াছেন।

কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, পড়ুন।

মুখুয্যে মহাশয় তখন অত্যন্ত ধীরে ধীরে যুদ্ধসংবাদ পড়িতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে কাগজখানি নামাইয়া, টীকাটিপ্পনি করিয়া কৃষ্ণদাসবাবুকে ব্যাপারটা বুঝাইতে লাগিলেন। এমন সময় শুষ্কমুখ, ঘর্মাক্তকলেবর ধূলিধূসরিত রাখাল ব্যাগ হাতে করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।

হঠাৎ জামাতাকে এ অবস্থায় দেখিয়া কৃষ্ণদাসবাবু একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, বাবা রাখাল এসেছ? এস এস, বস। বাড়ীর সব ভাল ত?

আজ্ঞে হ্যাঁ। –বলিয়া রাখাল ব্যাগটি নামাইয়া, ছাতাটি রাখিয়া, শ্বশুরকে প্রণাম করিল।

বস বাবা সব। জুতো খুলে ফেল। ওরে, পা ধোবার জল নিয়ে আয়। ইস্–ভারি ঘেমে উঠেছ যে! হেঁটে এলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

খুস্রুপুর থেকে কবে এসেছ?

আজ সকালেই এসে পৌঁছেছি।

ওরে, বাড়ীর ভিতর খবর দে, জামাইবাবু এসেছেন। তা বাবা এসেছ তবু দেখাটা হল। আজই না লীলাকে খুস্রুপুরে নিয়ে যাবার দিনস্থির করেছিলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তবে, আজ যাওয়া হল না?

আজ্ঞে না, কাল যাব।

বেশ বেশ। তা বাবা, যদি আমাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেই এলে, লীলাকেও অমনি সঙ্গে করে আনতে হয়। তার গর্ভধারিণী আজও দুঃখ করছিলেন, বলছিলেন, আহা বাছা আমার আজ পশ্চিমে চলে যাবে, আবার কতদিনে আসবে তারও ঠিক নেই, যাবার সময় একটিবার বাছাকে দেখতেও পেলাম না!

এই কথা শুনিয়া রাখালের মাথায় যেন বজ্রঘাত হইল। তাহার নাসিকা কর্ণ দিয়া আগুন ছুটিতে লাগিল। মাথা ঝিম্ ঝিম্ করিয়া উঠিল, চক্ষে যেন সকলই অন্ধকার হইয়া আসিল। তখনই সংজ্ঞা হারাইয়া, সেই তক্তপোষ হইতে সশব্দে মেঝের উপর পড়িয়া গেল।

কি হল? কি হল? –বলিয়া তাহার শ্বশুর চীকার করিয়া উঠিলেন। একজন ছুটিয়া গিয়া অন্তঃপুরে সংবাদ দিল। বাড়ীর মধ্য হইতে লোকজন ছুটিয়া আসিল। জল আন, পাখা আন্–বলিয়া একটা খুব সোরগোল পড়িয়া গেল। একজন রাখালের কোটের বোতাম খুলিতে লাগিল, একজন তাহার মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগিল, একজন মুখুয্যে মহাশয়ের হস্ত হইতে সংবাদপত্রখানা কাড়িয়া লইয়া রাখালের মাথার কাছে বাতাস করিতে লাগিল। রাখালের শাশুড়ী অন্তঃপুরের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দিদিশাশুড়ী কোনও বাধা না মানিয়া, বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া রাখালের মস্তক কোলে তুলিয়া লইয়া বসিলেন; এবং তাহার মুখের দিকে সজল নেত্রে চাহিয়া কম্পিতস্বরে বারম্বার বলিতে লাগিলেন, হে মধুসূদন, হে হরি, দোহাই বাবা, সাত দোহাই তোমার–বাছাকে আমার ভাল করে দাও।

ডাক্তার নিকটেই থাকিতেন, একজন তাঁহাকে সংবাদ দিতে ছুটিয়াছিল। ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েছে?

কৃষ্ণদাসবাবু সংক্ষেপে ব্যাপারটা বর্ণনা করিলেন।

ডাক্তারবাবু তখন রাখালের চেতনা সম্পাদন করিতে যত্নবান হইলেন। শীঘ্র ফলও দর্শিল।

রাখাল চক্ষু মেলিয়া বিস্মিতভাবে চারদিকে চাহিতে লাগিল।

কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, কেমন আছ বাবা? একটু ভাল বোধ হচ্ছে?

ক্ষীণস্বরে রাখাল বলিল, কি হয়েছে?

কৃষ্ণদাসবাবু আবার বলিলেন, কেমন আছ?

ভাল আছি।

বসতে পারবে? উঠে বস দেখি।

রাখাল উঠিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। তাহার দেহ যেন ছয়মাসের রোগীর মত দুৰ্বল হইয়া পড়িয়াছে। দুইজনে ধরাধরি করিয়া তাহাকে উঠাইয়া তক্তপোষের উপর শোয়াইয়া দিল।

তাহার জামা কাপড় জলে ভিজিয়া গিয়াছিল। একজন পাখার বাতাস করিতে লাগিল।

কিয়ৎক্ষণ পরে রাখাল বলিল, শীত করছে।

পাখা বন্ধ হইল। কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, এই রৌদ্রে এতখানি পথ হেঁটে এসে, সর্দিগৰ্ম্মি হয়েছে।

দিদিশাশুড়ী বলিলেন, কেন দাদা এমন কর্ম করলে? একখানা গোরুর গাড়ী ভাড়া করে আসতে হয়! সুখী শরীর, পথ চলা মোটে অভ্যেস নেই, সইবে কেন?

মুখুয্যে মশাই বলিলেন, আর এখানে কেন? বাড়ীর মধ্যে নিয়ে গিয়ে কাপড় জামা ছাড়িয়ে দিয়ে, বাবাজিকে শুইয়ে দাও। –বুয়র–যুদ্ধের মাঝখানে এইরূপ অভাবনীয় বাধা উপস্থিত হওয়াতে, মুখুয্যে মহাশয় অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িয়াছিলেন। ধৈৰ্যরক্ষা তাহার পক্ষে উত্তরোত্তর কঠিন হইয়া উঠিতেছিল।

ডাক্তারবাবুও সেই পরামর্শ দিয়া, বিদায় গ্রহণ করিলেন।

রাখাল তখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়াছিল। দুইদিকে দুইজনে ধরিয়া তাহাকে অন্তঃপুরে লইয়া গেল। কৃষ্ণদাসবাবুও সঙ্গে সঙ্গে যাইতে লাগিলেন।

মুখুয্যে মহাশয়ই একা বসিয়া তখন যুদ্ধসংবাদে মনোনিবেশ করিলেন। দুই চারি ছত্র পড়িতেই, পদশব্দ শুনিয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিলেন, রামজীবন রায় আসিতেছেন। ইনি জমিদার মহাশয়ের একজন প্রধান কর্মচারী–একটু দূর সম্পর্কও আছে।

রামজীবন প্রবেশ করিয়া বলিলেন, ঘোষাল মশায় কোথা?

এই বাড়ীর ভিতরে গেলেন। জামাইটি এসেছিল, এসেই অসুখ হয়ে পড়েছে। –বলিয়া সকল বৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে কৃষ্ণদাসবাবুও বাহির হইয়া আসিলেন। রাখাল কেমন আছে উভয়ে জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, গা–টা ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। বোধ হয় জ্বর হবে।

দুই একটা কথার পর কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, হ্যা জীবন, নবীনের কোনও খবর পেলে?

নবীন, জমিদারবাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। গত রাত্রি হইতে হঠাৎ সে নিরুদ্দেশ। চারিদিকে অনুসন্ধান চলিতেছে।

রামজীবন বলিলেন, কোথা গেছেন কিছুই ত বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমরা এইটুকু সন্ধান পেয়েছি, কাল রাত দুপুরের পর তাকে আর দুলেদের সৈরভির মাকে গাজনতলার হাটের কাছ দিয়ে যেতে একজন দেখেছে। তাই শুনে আমরা সৈরভির মাকে ডাকিয়ে আজ জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। কিন্তু সে ত ছোটবাবুর সঙ্গে যাওয়ার কথা স্বীকারই করে না। বললে করিমগঞ্জে তার এক বোনপো আছে, তার ভারি ব্যারাম শুনে কাল রাত্রে তাকে দেখতে গিয়েছিল, আজ ভোরে ফিরে এসেছে। করিমগঞ্জ যেতে হলে গাজনতলার কাছ দিয়েই যেতে হয় বটে। যা হোক, চারিদিকে অনেক লোক পাঠান হয়েছে, দেখা যাক কোনও সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। বাড়ীতে ত গিন্নীমা ভারি কাদাকাটি আরম্ভ করেছেন।

কৃষ্ণদাসবাবু বলিলেন, তিনি ত কাদাকাটা করবেনই। আমাদের বাড়ীর এরা শুনে অবধি কেবল হায় হায় করছে। ভাল খবরটি পেলেই পাঁচসিকে হরিনুট দেবে মানৎ করেছে। বাড়ীতে আসত যেত, গিন্নি তাকে ছেলের মতই দেখেন–দূর সম্পর্ক হলে কি হয়? কোথায় গেল ছোকরা, কি দুর্বুদ্ধি হল! এখন প্রাণে প্রাণে বেঁচে থাকলেই মঙ্গল।

এইরূপ কথোপকথনে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। বন্ধুগণকে বিদায় দিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া কৃষ্ণদাসবাবু দেখিলেন, জ্বরঘোরে রাখাল অচেতন হইয়া পড়িয়াছে।

০৫. রাখাল বড় দুঃখী

সমস্ত দিন আকাশটা মেঘে আচ্ছন্ন ছিল, সন্ধ্যার পূৰ্ব্বে বৃষ্টি আরম্ভ হইল।

রাখাল খুস্রুপুরে তাহার সেই খাঁচার মত বাসাটিতে, মলিন শয্যার উপর বসিয়া, গালে হাত দিয়া ভাবিতেছে। খোলা জানালাপথে জলের ছাট আসিয়া বিছানাটার একপ্রান্ত ভিজিয়া যাইতেছে, কিন্তু সেদিকে তাহার ক্ষেপও নাই।

রাখালের কি সর্বনাশ হইয়াছে–তাহা কি আর খুলিয়া বলিতে হইবে? আবার সৰ্ব্বনাশের উপর সৰ্ব্বনাশ! শ্বশুরালয়ে পৌঁছিয়াই রাখাল জ্বরে পড়িয়াছিল, পাঁচদিন পরে আরোগ্যলাভ করিল। ইতিমধ্যে সকল কথাই সে জানিতে পারিল। শ্বশুরালয় হইতে নিজগ্রামে গিয়া দেখিল, সেখানেও টী–টী পড়িয়া গিয়াছে। একদিন মাত্র বাড়ীতে থাকিয়া, খুস্রুপুরে ফিরিয়া আসিল। পৌঁছিয়া শুনিল, ইতিমধ্যে ইনস্পেক্টার সাহেব আসিয়াছিলেন, পীড়ার ভান করিয়া তাহার পলায়নের কথা সমস্তই ধরিয়া ফেলিয়াছেন, হেড অফিস হইতে চিঠি আসিয়াছে, এক মাসের নোটিসে রাখালকে কৰ্ম্মচ্যুত করা হইল।

নোটিশের একমাত্র উত্তীর্ণপ্রায়, দুইটি দিন মাত্র বাকী আছে। একমাস পূর্বে রাখালকে যাঁহারা দেখিয়াছিলেন, আজ দেখিলেই হঠাৎ তাহাকে চিনিতে পারিবেন না। এ একমাসে দুশ্চিন্তায় তাহার দেহখানি শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, চক্ষুর কোলে কালিমা পড়িয়াছে।

গৃহখানির আসবাব যৎসামান্য। একখানি দড়ির খাঁটিয়া, তাহার উপর রাখাল বসিয়া রহিয়াছে। দেওয়ালের নিকট একটা বড় প্যাকিং কেস–আড়ভাবে স্থাপিত। তাহার উপর একটি পীতবর্ণ পুরাতন তোরঙ্গ, তাহার উপর কালো টিনের একটি হাত–বাক্স, তাহার উপর বটতলার দুইখানা ডিটেকটিভ উপন্যাস। প্যাকিং কেসটির ভিতর পিতল কাসার খানকতক বাসন। ঘরের এক কোণে একটা কাঠের টুল, তাহাতে E.I.R. অক্ষরগুলি ক্ষোদিত। তাহার উপর একটা জলের সোরাই। অপর কোণে পেরেকে বাঁধা একটা দড়ির আলনায় কয়েকটা কাপড় জামা ঝুলিতেছে। একখানা বড় পেষ্টবোর্ডের উপর সিগারেটবাক্সের অনেকগুলি ছবি গঁদ দিয়া আঁটা, তাহাই ভিত্তিগাত্রে গৃহস্বামীর শিল্পরুচির পরিচয়স্বরূপ ঝুলিতেছে।

বৃষ্টি পড়িতে লাগিল, ক্রমে দিবালোকও অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া আসিল। মাঝে মাঝে সন্ সন করিয়া দমকা বাতাস বহিয়া বৃষ্টিপতনশব্দকে তীব্রতর করিয়া তুলিতেছে। রাখাল বসিয়া বসিয়া অকুল পাথার চিন্তা করিতে লাগিল। আর দুইটি দিন মাত্র তাহার চাকরির মিয়াদ, এই দুইদিন পরে সে কোথায় যাইবে, কি করিবে, কি খাইবে, ইহাই তাহার প্রধান চিন্তার বিষয়। এরূপ অবস্থায় পড়িলে লোকে বাড়ী যায়, আপন আত্মীয়স্বজনের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সে পথও তাহার পক্ষে বন্ধ। এ কলঙ্কের পর, দেশে গিয়া লোকের কাছে মুখ দেখাইবে কেমন করিয়া? তাহাও না হয় যাইত, কিন্তু আসিবার পুর্বে বাড়ীতে তাহার বউদিদির ব্যবহার স্মরণ করিয়া দেশে যাইবার কল্পনামাত্র তাহার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। এত দুঃখে বউদিদির কাছ হইতে সে বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি পাই নাই। শ্বশুরবাড়ী হইতে ফিরিয়া যে একটি দিনমাত্র বাড়ীতে সে ছিল, সেই সময়টুকুর মধ্যেই বউদিদি তাহাকে অনেক মর্মান্তিক কথা শুনাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছিলেন, তুমি যদি এ আপদকে আমাদের বাড়ী আনাইয়া না রাখিতে, তাহা হইলে ত এ কেলেঙ্কারি হইতে পাইত না। এখন তুমি ত মজা করিয়া পশ্চিম চলিয়া যাইবে, টাকা রোজগার করিবে, আবার বিবাহ করিবে, সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকিবে। আমাদের বাড়ীর এই যে অখ্যাতিটা রটিল, আমার মেয়েদের বিবাহ হইবে কেমন করিয়া? ভুগিতে আমরাই ভুগিব, তোমার আর কি? –বাড়ী গিয়া দাদার অন্নদাস হইয়া, বউদিদির মুখনাড়া খাইতে কিছুতেই রাখালের প্রবৃত্তি হইতেছিল না। আর আত্মীয়স্বজনও নাই। এ দুইদিন পরে রাখাল কোথায় যাইবে?

এক–কলিকাতায় যাওয়া, সেখানে কোনোও মেসের বাসায় থাকিয়া অন্য একটা চাকরির চেষ্টা করা। লেখাপড়াও তেমন শিখে নাই–চট্‌ করিয়া যে আবার একটা চাকরি হইবে, তাহারই বা ভরসা কি? যতদিন চাকরি না হইবে, ততদিন বাসাখরচ চলিবে কোথা হইতে? পোষ্ট আফিসে তাহার গুটিকতক টাকা আছে, বাজার দেনা শোধ করিবার পর বড় বেশী অবশিষ্ট থাকিবে না। রেলের প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে তাহার কিছু টাকা আছে–কিন্তু ডিসমিস হইয়াছে বলিয়া, সে টাকার অর্ধেকের উপর তাহারা কাটিয়া লইবে। সে টাকা বাহির হইতেও তিন চারিমাস বিলম্ব। এ তিন চারিমাস কাটিবে কেমন করিয়া? শেষে কি অনাহারে মরিতে হইবে। নিজের জীবনটা সেই মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যার মতই অন্ধকার বলিয়া রাখালের মনে হইতে লাগিল।

খুস্রুপুরে পৌঁছিয়া অবধি প্রতিদিনই সে এই প্রকার চিন্তা করিয়াছে। চিন্তা করিয়া আজিও কোন কুলকিনারা পায় নাই। জীবনটা তাহার কাছে অতি বিস্বাদ, অতি তিক্ত হইয়া পড়িয়াছে। এক এক সময় নৈরাশ্যের প্রাবল্যে তাহার ইচ্ছা করিত দূর হউক, সংসার ধৰ্ম্মে আমার কোন প্রয়োজন নাই–আমি সন্ন্যাসী হইয়া যাইব। সন্ন্যাসী হইয়া, কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব, আহারের অভাব হইবে না। কয়েকদিন পূর্বে স্টেশন–মাষ্টারবাবু যখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আফিস হইতে পত্র আসিয়াছে, কোন্ স্টেশন অবধি আপনার পাস আবশ্যক? –তখন রাখালের মনে উক্ত ভাবই প্রবল ছিল, সুতরাং সে কাশীর পাসই চাহিয়াছিল। তবে এ বিষয়ে এখনও সে কৃতনিশ্চয় হয় নাই।

জল একটু থামিয়াছে। ষ্টেশনে ছয়টার ঘণ্টা বাজিল। পানিপাঁড়ে আসিয়া, রাখালের কাছে দিয়াশলাই চাহিয়া, কেরোসিনের বাতিটি জ্বালিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিল। শেষে বলিল–বাবু, সিধা বাহির করিয়া দিন।

রাখাল অন্যমনস্কভাবে বলিল, থাক আজ আর রাত্রে কিছু খাইব না।

পাঁড়ে বলিল, কিছুই খাইবেন না?

রাখাল বলিল, ক্ষুধা নাই। যদি দরকার হয় ষ্টেশনেই দুই চারি পয়সার লুচি কিনিয়া খাইব এখন।

মা নহে, স্ত্রী নহে, ভগিনী নহে যে খাওয়াইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিবে। আচ্ছা বাবু, বলিয়া আনন্দে পাঁড়েজি প্রস্থান করিল। এই বাদলের রাত্রে তাহার একটা ঝঞ্ঝাট বাঁচিয়া গেল।

সন্ধ্যা ছয়টা হইতে সমস্ত রাত্রি রাখালের ডিউটি। টেলিগ্রাফের কৰ্ম্ম, টিকিট বিক্রয়, গাড়ী পাস করা, সকলই তাহাকে একাকী করিতে হয়। তবে রাত্রি বারোটার পর কাযকৰ্ম্ম আর বড় থাকে না। বারোটার সময় শেষ প্যাসেঞ্জার গাড়ী আসে, তাহার পর সে একটু ঘুমাইতে পায়। টেলিগ্রাফের কলে ঘণ্টা লাগাইয়া, ব্যাটারি বাক্সের উপর বিছানা বিছাইয়া প্রতিরাত্রে সে নিদ্রা যায়।

সাড়ে ছয়টা হইল। রাখাল তখন একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে উঠিল। তাহার আফিসের পোষাক, শাদা পালুন ও কালো কোট–কাঁধের উপর ফেলিয়া, বগলে ছাতা, হাতে সরকারী লণ্ঠন লইয়া বাহির হইয়া, ঘরের দুয়ারে চাবি বন্ধ করিল। তাহার পর ধীরে ধীরে ষ্টেশনে গেল।

বড়বাবু তখন বাসা হইতে জলযোগ সারিয়া আসিয়া, পাণ চিবাইতে চিবাইতে গড়গড়ায় ধূমপান করিতেছে। একটু পরেই আফিসের চিঠিপত্র লিখিতে বসিবেন। রাত্রি আটটা অবধি চিঠিপত্র লিখিয়া তিনি বাসায় ফিরিয়া যান। রাখালকে দেখিয়াই বলিলেন, ওহে, তোমার পাস এসেছে, এই নাও। –বলিয়া পাসখানি বাহির করিয়া রাখালের হাতে দিলেন। বলিলেন–এখন গিয়ে কাশীতেই থাকবে নাকি?

হ্যাঁ, দিনকতক তাই থাকব।

কতদিনে বাড়ী যাবে?

এখনও কিছু ঠিক করিনি। –বলিয়া রাখাল নীরবে আপন নির্দিষ্ট কাযকর্মগুলি করিতে বসিল।

০৬. ট্রেনে লাস

রাত্রি বারোটার প্যাসেঞ্জার ছাড়িল। সিগন্যালম্যান ঘণ্টা বাজাইয়া দিয়া ফুকারিল, চলো মোসাফির পূরবকে যানেওয়ালা টিকস্ লো!

টিকিটের জানালা খুলিয়া রাখাল খানকতক টিকিট বিক্রয় করিল। এই ঝড় জলে এত রাত্রে আরোহী অধিক নাই।

টিকিট বিক্রয় শেষ করিয়া, পাৎলুন এবং কালো কোট পরিয়া মখমলের টুপী মাথায় দিয়া, লণ্ঠন হস্তে গাড়ী পাস করিবার জন্য রাখাল বাহির হইল।

মেঘে আকাশ তখনও আচ্ছন্ন। উত্তরপশ্চিম কোণে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকিতেছে। প্ল্যাটফর্মের উপর গুটিকয়েক লণ্ঠন জ্বলিতেছে, কিন্তু যে ক্ষীণ আলোক, এ গভীর অন্ধকার তাহাতে কিছুতেই দূর হইতেছে না।

দেখিতে দেখিতে, বিপুলকায় ত্রিনেত্র নিশাচরের ন্যায় ভীমগর্জনে প্যাসেঞ্জার আসিয়া দাঁড়াইল। আজ বৃষ্টির জন্য পাণ–সিগারেটওয়ালা আসে নাই, পুরী মিঠাইওয়ালাও নিজ কুটীরে আরামে নিদ্রামগ্ন। রাখাল এবং সিগন্যালম্যান ছাড়া, মাত্র আর গুটি–চারেক খালাসী আছে।

ট্রেণখানি ষ্টেশনে দাঁড়াইবামাত্র ইন্টারমিডিয়েট গাড়ী হইতে একটা বিষম কোলাহল উথিত হইল। জনকতক লোক ব্যস্ত হইয়া নামিয়া পড়িয়া বাবুবাবু–গার্ডসাহেব বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল।

গোলমাল শুনিয়া লণ্ঠনহস্তে রাখাল সেদিকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ক্যা হুয়া–ক্যা হুয়া?

তিন চারিজন সমস্বরে বলিয়া উঠিল, একঠো আদমি মর গিয়া বাবু।

–কাহা–কাহা? –বলিয়া রাখাল গাড়ীর কাছে গেল।

দেখিয়ে না। –বলিয়া তাহারা গাড়ী দেখাইয়া দিল।

রাখাল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া, খোলা দরজাপথে উঁকি দিয়া দেখিল, গাড়ীর মেঝের উপর সন্নাসীবেশধারী কাহার মৃতদেহ পড়িয়া আছে। কামরার ভিতরে প্রবেশ করিতে তাহার সাহস হইল না।

অন্যান্য গাড়ী হইতেও লোক নামিয়া আসিয়া সেখানে ভীড় করিয়া দাঁড়াইল। রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, কেমন করিয়া মরিল?

আরোহীরা বলিল, ফতুয়া স্টেশন অবধি বাবাজী বেশ আসিয়াছিলেন, আমাদের সঙ্গে কত গল্পগুজব করিয়াছেন। গাড়ী ফতুয়া ছাড়িলেই, গাঁজা সাজিবেন বলিয়া ছিলিম বাহির করিলেন, থলি হইতে গাঁজা বাহির করিতে করিতে তাহার সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। ক্রমে কাঁপুনি অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। ভয়ানক জোরে হাত পা ছুড়িতে লাগিলেন। দুই একজন তাহার হাত ধরিতে গিয়াছিল, কিন্তু সামলাইতে পারিল না। তাহার পর বাবাজী গাড়ীর মেঝের উপর পড়িয়া গেলেন। মুখে ফেনা ভাঙ্গিতে লাগিল। তাহার পর সমস্ত থামিয়া গেল। আমরা নাকে হাত দিয়া দেখিলাম, নিশ্বাস নাই।

রাখাল বলিল, কতক্ষণ এরূপ হইয়াছে?

দশ মিনিট–কিম্বা আরও বেশী।

ইতিমধ্যে গার্ডসাহেব আসিয়া পৌঁছিলেন। সকল কথা শুনিয়া তিনি রাখালকে বলিলেন, লাস নামাইয়া লউন।

রাখাল বলিল, এখানে লাস নামাইয়া কি হইবে? এখানে ডাক্তার নাই, পুলিস নাই।

গার্ড বলিলেন , সে হইবে না। গাড়ীতে মৃতদেহ রাখিবার নিয়ম নাই। পুলিসকে, ডাক্তারকে যথারীতি অ্যাকসিডেন্ট মেসেজ দিলেই তাহারা আসিবে।

অগত্যা রাখাল তখন লাস নামাইতে বাধ্য হইল। চারিজন খালাসী কামরার ভিতর প্রবেশ করিয়া সন্ন্যাসীর মৃতদেহ নামাইল।

গার্ডসাহেব আরোহীগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, গাড়ীতে ইহার জিনিসপত্র কি কি আছে?

আরোহীরা একটা ট্রাঙ্ক, একটা কমণ্ডলু এবং একখানা কম্বল দেখাইয়া দিল।

জিনিষগুলি নামাইয়া সেগুলির দুইটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া, একখানিতে রাখালের সহি লইয়া গার্ডসাহেব আপনার কাছে রাখিলেন, একখানি নিজে সহি করিয়া রাখালকে দিলেন। এই সমস্ত করিয়া গাড়ী ছাড়িতে প্রায় পনেরো মিনিট বিলম্ব হইয়া গেল। সেই ইন্টারমিডিয়েট গাড়ী হইতে সকল আরোহী নামিয়া ইতিমধ্যে অন্যান্য গাড়ীতে উঠিয়া পড়িয়াছিল।

গাড়ী ছাড়িলে, পরবর্তী ষ্টেশনে সংবাদ দিয়া রাখাল আবার প্ল্যাটফর্মে বাহির হইয়া আসিল। সিগন্যালম্যানকে জিজ্ঞাসা করিল–লাস কোথা রাখা যায়? প্ল্যাটফর্মে ফেলিয়া রাখা উচিত নহে, শিয়াল কুকুর টানাটানি করিবে।

সিগন্যালম্যান বলিল, পার্শেল গুদামে?

সেই ভাল। –বলিয়া রাখাল চাবি আনিয়া পার্শেল গুদাম খুলিয়া সন্ন্যাসীর মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিল। তাহারা জিনিসপত্র সেখানে রাখাইয়া গুদাম বন্ধ করিয়া আপিসে ফিরিয়া অ্যাকসিডেন্ট মেসেজ লিখিতে বসিল।

খালাসীরা আসিয়া বলিল, বাবু, মড়া ছুঁইয়াছি, বাড়ী গিয়া স্নান করিতে হইবে।

রাখাল বলিল, যাও।

সিগন্যালম্যান আসিয়া বলিল, বাবু, এখন কোনও মালগাড়ী আছে কি?

রাখাল দুইদিকের ষ্টেশনে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, কোনও গাড়ী নাই। তাহা শুনিয়া সিগন্যালম্যান বলিল, তবে যদি হুকুম দেন ত একবার বাসায় যাই। আমার স্ত্রীর ব্যারাম। দুইটার সময় আসিব।

রাখাল বলিল, যাও।

অ্যাকসিডেন্ট মেসেজ দিয়া, টেলিগ্রাফের কলে ঘণ্টা লাগাইয়া রাখাল শয়ন করিল।

বাহিরে মাঝে মাঝে মেঘগর্জন হইতেছে। রাখালের ঘুম আসিল না। সে একবার নিজের কথা, একবার মৃত সন্ন্যাসীর কথা চিন্তা করিতে লাগিল।

ভাবিল, কে এ সন্ন্যাসী? বাঙ্গালী কি? না, বোধ হয় হিন্দুস্থানী। আকার প্রকার যেন হিন্দুস্থানীর মত। কোথায় যাইতেছিল কে জানে। বোধ হয় বৈদ্যনাথ কি পুরীতে যাইতেছিল। কল্য প্রাতের ট্রেণে যখন মোকামা হইতে পুলিস আসিবে, তল্লাসী করিবে, তখন উহার টিকিটখানি দেখিলেই বুঝা যাইবে।

নিজের কথা ভাবিল, কাশীর পাস লইয়া মুস্কিল করিয়াছি। কাশীতে গিয়া আমি কী করিব? সন্ন্যাসী হইব? বড় কষ্টের জীবন। এই যে একজন সন্ন্যাসী গাড়ীতে বিঘোরে প্রাণ হারাইল; ইহার সম্ভবতঃ এমন কেহ নাই যে, মরিয়াছে বলিয়া দুইবিন্দু অশ্রুপাত করে। তা–আমারই বা কে আছে? আমি মরিলেই বা কে কাঁদিবে? আমি ত এখন সন্ন্যাসী হইয়াও সন্ন্যাসী, ফকির–একেবারে ফকির। একমাস বসিয়া খাইবার সংস্থান আমার নাই। যাই, কাশীতে যাই, মা অন্নপূর্ণা আছেন, সেখানে না খাইয়া কেহই মরে না শুনিয়াছি। অদৃষ্টে কি শেষে এই লেখা ছিল?

আবার সন্ন্যাসীর কথা আলোচনা করিতে লাগিল, ঐ সন্ন্যাসীও কি আমারই মত ফকির, আমারই মত নিঃস্ব? বোধ হয় না। ও ত তৃতীয় শ্রেণীতে যাইতেছিল না–দেড়া মাশুলের গাড়ীতে যাইতেছিল। পশ্চিমের লোক একটু সম্পন্ন না হইলে আর দেড়া মাশুলের টিকিট ক্রয় করে না। অনেক অর্থশালী সন্ন্যাসীও ত আছে শুনিয়াছি। সন্ন্যাসী হইলেই সকলেই কিছু ফকির হয় না! আচ্ছা ইহার বাক্সে যদি টাকা থাকে? কত টাকা আছে কে জানে! একশত, না দুইশত, না হাজার? না তাহারও বেশী? কল্য পুলিশ আসিয়া বাক্স খুলিবে–তখন জানা যাইবে; টাকাগুলো কতক পুলিশ খাইয়া ফেলিবে, কতক সরকারে জমা দিবে।

এমন সময়ে, হঠাৎ একটা কথা রাখালের মস্তিষ্কে উদিত হইল। তখন বাহিরে দেবতা গর্জন করিয়া উঠিলেন। সে শব্দ শুনিয়া রাখাল আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিল।

কিছুক্ষণ আবার নিজের আসন্ন অবস্থার কথা ভাবিল। সেই গোপনীয় কথাটি আবার তাহার মনে নানা দিক দিয়া উঁকি দিতে লাগিল।

ভাবিল, এ সন্ন্যাসীর বাক্সে যদি অনেক টাকাকড়ি থাকে আমিই কেন তা লই না? পুলিশে কেন খাইবে? সরকারের অফুরন্ত ভাণ্ডারে কেন তাহা যাইবে?

কই, এবার ত অন্তর্যামী দেবতা ক্রোধে গৰ্জন করিয়া উঠিলেন না?

রাখাল মনে মনে তর্ক করিতে লাগিল–যদি লই, তাহাতে দোষ কি? যাহার টাকা, সে ত আর তাহা ভোগ করিতে পাইবে না! কাহারও ত অনিষ্ট করিতেছি না! আমি যদি পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়া একটা মস্ত হীরা কুড়াইয়া পাই, লই না কি? কেন লইব না? উত্তম সুযোগও উপস্থিত হইয়াছে। ষ্টেশনে কেহই ত এখন নাই। যাই, পার্শেল গুদাম খুলিয়া সন্ন্যাসীর দেহ অনুসন্ধান করি, নিশ্চয়ই বাক্সের চাবি পাইব।

এই সময় আবার বৃষ্টি আরম্ভ হইল। ষ্টেশনের টিনের ছাদের উপর বড় বড় ফোঁটা পড়িয়া ঠং ঠং করিয়া শব্দ হইতে লাগিল।

রাখাল ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করিল। জুতা পায়ে দিয়া, চাবি ও লণ্ঠন লইয়া, আপিস হইতে বাহির হইয়া, দুইবার সমস্ত বারান্দাটায় পায়চারি করিল। কেহ কোথাও নাই। এমন অন্ধকার, এমন বৃষ্টি, চোরের পক্ষে এমন সুযোগ আর কি হইতে পারে?

রাখাল তখন পা টিপিয়া টিপিয়া পার্শেল গুদামের সম্মুখে উপস্থিত হইল। বাতি নামাইয়া রাখিয়া তালা খুলিবার জন্য তাহা বামহস্তে ধরিল। কিন্তু তাহার হাত ঠক্ ঠক্‌ করিয়া কাপিতে লাগিল। দক্ষিণ হস্ত হইতে চাবিগুচ্ছ পড়িয়া ঝন করিয়া শব্দ হইল।

দাঁড়াইয়া রাখাল ভাবিতে লাগিল, দ্বার খুলিয়া যদি দেখি সন্ন্যাসী দানা পাইয়া উঠিয়া বসিয়া আছে? যদি আমাকে দেখিয়া সে খস্ খস্ করিয়া হাসিয়া উঠে? ভয়ে রাখালের বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তখন চাবি ও বাতি উঠাইয়া, কম্পিত পদে আবার সে আপিস কক্ষে ফিরিয়া গেল।

চেয়ারে বসিয়া কয়েক মিনিট রাখাল চিন্তা করিল। নিজের দুর্বলতায় লজ্জিত হইয়া মনে মনে বলিল, আমি কি বালক, না স্ত্রীলোক, না অজ্ঞ গ্রাম্য কৃষক যে ভূতের ভয়ে পলাইয়া আসিলাম? যে মরিয়াছে, সে আবার দানা পাইয়া উঠিয়া বসিবে কেমন করিয়া? আমার হাতের কাছে এই একটি সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে, আমি কি এইরূপ ছেলেমানুষী করিয়া তাহা হারাইব? না তাহা কখনই হইবে না। আমি যাইব–দেখিব অদৃষ্টে কি আছে।

ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিল, দুইটা বাজিতে কুড়ি মিনিট বাকি। আর অধিক সময় নাই, দুইটার সময় সিগন্যালম্যান আসিয়া উপস্থিত হইবে; তখন সমস্তই পণ্ড হইয়া যাইবে।

রাখাল তখন দৃঢ়চিত্ত হইয়া, চাবি ও লণ্ঠন দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করিয়া আবার পার্শেল গুদামে র দ্বারে উপস্থিত হইল। চাবি খুলিয়া গুদামে প্রবেশ করিয়া, ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

নানা আকারের ছোট বড় পার্শেল, ফলের টুকরী, মুখ–আঁটা টিনের ক্যানেস্তারা প্রভৃতি মেঝের উপর চারিদিকে ছড়ান রহিয়াছে। মধ্যস্থলে গৈরিকবস্ত্রপরিহিত সেই মেতৃদহ। লণ্ঠনের আলোক মৃত–সন্ন্যাসীর মুখের উপর ফেলিয়া, দূর হইতে রাখাল কিয়ৎক্ষণ তৎপ্রতি চাহিয়া রহিল।

যখন দেখিল সে দেহে স্পন্দনমাত্র নাই, তখন সে জুতা পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে অগ্ররস হইল।

কাছে দাঁড়াইয়া সন্ন্যাসীর মুখের প্রতি আবার দৃষ্টিপাত করিল। লোকটির বয়স ত্রিশ বৎসর বলিয়া অনুমান হইল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ সুশ্রী পুরুষ, মাথায় বড় বড় চুল; জটা পাকাইয়া গিয়াছে। মুখে গোঁফদাড়ি রহিয়াছে; কিন্তু তাহা পরিমাণে তেমনাধিক নয়। চক্ষু দুইটি উল্টাইয়া রহিয়াছে। সেই ভুলুণ্ঠিত জটাজাল, সেই নিমেষবর্জিত শূন্য চাহনি, বর্তিকালোকে দেখিতে দেখিতে রাখালের মনে আবার কেমন আতঙ্ক সঞ্চার হইল। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায় বল সংগ্রহ করিয়া, হাঁটু গাড়িয়া রাখাল সেখানে বসিল। মৃতদেহ হইতে বস্ত্রাবরণ উন্মোচন করিয়া, কোমরে হাত দিয়া চাবি খুঁজিতে লাগিল। দেখিল, সন্ন্যাসীর কটিবস্ত্রে একটি রেশমী কাপড়ে বাটুয়া বাঁধা রহিয়াছে। বাটুয়ার ফাঁশ খুলিয়া দেখিল, তাহাতে দুইটি চাবি, একখানি টিকিট এবং কিছু টাকা ও রেজকি রহিয়াছে।

চাবি দুইটি বাহির করিয়া, তাহাদের সাহায্যে তোরঙ্গটি রাখাল খুলিয়া ফেলিল। ভিতর হইতে নানা বিচিত্র জিনিষ বাহির হইতে লাগিল, যথা দুইখানি গেরুয়া রেশমী কাপড়, একটি মশারি, একখানি গোল আয়না, সোণার চেনসুদ্ধ একটি ওয়াচ, একযোড়া গৈরিকবর্ণ পশমী চাদর, একটি মোমবাতি, দুইটি দিয়াশালাই, একটি জলখাবার ঘটি, একখানি হিন্দী ভাগবত, একখানি রামায়ণ এবং সর্বশেষে একটি বড় থলি বেশ ভারি বোধ হইল; এবং অষ্টে–পৃষ্ঠে দড়ি জড়ান খেরুয়াবস্ত্রে বাঁধা একটি দপ্তর।

থলিটি ও দপ্তরটি বাহিরে রাখিয়া, বাকী সমস্ত জিনিস রাখাল আবার বাক্সে ভরিয়া দিল। থলিটিতে রাখালের প্রয়োজনীয় দ্রব্যই আছে, বেশ ঝম্ ঝম্ করিতেছে। ভাবিল, কে জানে, ইহাতে সবই রূপার টাকা–না মোহরও আছে? দপ্তরটিতে কাগজ আছে–টিপিয়া বোঝা যায়–নোট থাকিতে পারে ত? যদি নোট থাকে, সবগুলিই নোট হয়–তবে কত হাজার টাকা কে জানে? –বাক্স বন্ধ করিয়া, চাবি বাটুয়াতে পুনঃস্থাপিত করিয়া, টিকিটখানি রাখাল আবার পরীক্ষা করিয়া দেখিল। সন্ন্যাসী সিরাথু হইতে আসিতেছে, হাওড়া যাইতেছিল। বাটুয়ার মুখ বন্ধ করিয়া, দেহটি পূৰ্ব্বমত বস্ত্রাচ্ছাদিত করিয়া, বগলে দপ্তর এবং বামহস্তে থলি লইয়া রাখাল উঠিয়া দাঁড়াইল। লণ্ঠনটি মৃতের মুখের দিকে আবার ফিরাইয়া, চকিতনেত্রে কয়েক মুহূর্ত চাহিয়া রহিল। কিন্তু এ কি!–কি সর্বনাশ! সন্ন্যাসী হাসিতেছে! পূৰ্ব্বে তাহার ওষ্ঠযুগল সংযুক্ত ছিল, তাহা ফাঁক হইয়া গিয়াছে। দুইপাটি দন্ত দেখা যাইতেছে। রাখাল তীরবেগে দরজার পানে ছুটিল–দরজা খুলিয়া জুতা বাহির করিয়া লইয়া, কম্পিত হস্তেসশব্দে কপাট বন্ধ করিয়া দিল। কম্পিত হস্তে কোনও মতে তালা বন্ধ করিয়া, কম্পিত দ্রুতপদে আফিস কক্ষে ফিরিয়া গেল। একটা দেরাজ টানিয়া থলি ও দপ্তর লুকাইয়া রাখিয়া, সোরাই হইতে জল ঢালিয়া ঢক ঢক্‌ করিয়া রাখাল দুই গেলাস জল পান করিয়া ফেলিল।

তাহার সর্বাঙ্গ হইতে ঘৰ্ম্ম ঝরিতেছে। আফিস–কক্ষ অত্যন্ত গরম বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু বাহিরে গিয়া একটু বেড়াইতেও সাহস হইল না, বাহিরে অন্ধকার–ভীষণ অন্ধকার। আর বাহিরে সেই–যে হাসিয়াছে–যদি আসে, এইখানে আসিয়া উপস্থিত হয়–বলে আমার টাকার থলি দাও আমার নোটের বস্তা দাও? তবে কি হইবে? না, তা কি আসিতে পারে? দরজায় তালা বন্ধ আছে যে। কিন্তু উহারা তালা দরজা মানে কি?

হঠাৎ বাহিরে পদশব্দ হইল।

কে আসে? –ভয়ে রাখালের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল; বিস্ফারিত–নেত্রে মুক্ত দ্বার পানে মুখ ফিরাইল। দেখিল মৃতসন্ন্যাসী নহে–প্রেত নহে–সিগন্যালম্যান মহাবীর সিং।

তাহাকে দেখিয়া, রাখালের দেহে যেন প্রাণ ফিরিয়া আসিল। বলিল–মহাবীর সিং, এত দেরী করিয়া আসিলে?

মহাবীর সিং ঘড়ির পানে চাহিয়া বলিল, না বাবু–এই ত দুইটা বাজিল। আপনি ত আমাকে দুইটা অবধি ছুটি দিয়াছিলেন।

রাখাল বিকৃতস্বরে বলিল, হ্যাঁ, ছুটি ত দিয়াছিলাম। কিন্তু গুদামে একটা মড়া পড়িয়া রহিয়াছে। আফিসে আমি একলা; একটু শীঘ্র শীঘ্র আসিতে হয় না?

মহাবীর সিং হা হা করিয়া হাসিয়া বলিল, বাবু আপনি কি ভয় পাইয়াছেন? ভয় কি? জ্যান্ত মানুষ কি মরা মানুষকে ভয় করিবে? কিছু ভয় নাই বাবু। আপনি শয়ন করুন।

রাখালের অনুরোধক্রমে সিগন্যালম্যান আফিস কক্ষের মেঝেতেই শয়ন করিয়া রহিল।

০৭. লাস তদারক

সিগন্যালম্যান ত দশমিনিটের মধ্যেই নাসিকাগর্জন আরম্ভ করিল, কিন্তু রাখালের চক্ষু হইতে যেন আগুন ছুটিয়া বাহির হইতেছে। ব্যাটারি বাক্সের উপর নিজ শয্যায় শয়ন করিয়া কিছুক্ষণ সে আড়ষ্ট হইয়া পড়িয়া রহিল। যে দেরাজটিতে থলি ও দপ্তর রহিয়াছে, তাহা চাবিবন্ধ নাই। হঠাৎ রাখালের মনে হইল, কি জানি যদি সিগন্যালম্যান রাত্রিতে উঠিয়া ঐ দেরাজ টানিয়া খুলে? উহার চাবিও নাই যে বন্ধ করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবে। জিনিষগুলা বাসায় রাখিয়া আসিলে হয়, কিন্তু দেরাজ টানিয়া খুলিবার শব্দে যদি লোকটা জাগিয়া উঠে এবং থলি বাহির করিতে দেখিতে পায়, কিংবা নাড়াচাড়ায় ঝম্ ঝম্ শব্দ শুনিতে পায়? তাহা হইলেই ত উহার মনে সন্দেহ হইবে, তখন কি বিভ্রাট ঘটিবে কে জানে? যেখানে মাথা রাখিয়া রাখাল শয়ন করিয়াছিল, সেখান হইতে দেরাজটা আবার দেখাও যায় না। তাই সে বালিশটা পায়ের দিকে আনিয়া ঘুরিয়া শুইল। একদৃষ্টে দেরাজটির পানে চাহিয়া রহিল।

রাখাল ভাবিতে লাগিল, কে জানে কত টাকা সবসুদ্ধ আছে; থলিটা ত পাঁচ ছয়সের ভারি–যদি সবই রূপার টাকা থাকে, তবে পাঁচশতের কাছাকাছি। হ্যাঁ, তবে যদি উহার মধ্যে মোহর থাকে; কতগুলা মোহর আছে, কেজানে! আচ্ছা, যদি সবগুলাই মোহর হয়, যদিও তাহা অসম্ভব, তথাপি হিসাব করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি? রূপার টাকার অন্ততঃ কুড়িগুণ মূল্য ত হইবে! দশ হাজার টাকা! আর ঐ খেরো বাধা দপ্তরে, নোট আছে কি? না কেবল বাজে কাগজ? যদি নোট থাকে, কে জানে কত টাকার নোট! সবগুলা যদি নোট হয়, তবে লক্ষ টাকা হইতেও আটক নাই; রাখাল এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিল, আর তাহার শোণিত ক্রমে উষ্ণ হইতে উষ্ণতর হইয়া তাহার মস্তিষ্ককে জ্বালাময় করিয়া তুলিল।

এইরূপে দেড়ঘণ্টা কাটিল। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা। বৃষ্টি বোধ হয় থামিয়া গিয়াছে, বায়ুর শব্দও আর শুনা যাইতেছে না। অত্যন্ত গরম বোধ হওয়াতে রাখাল উঠিয়া

একটি দরজা খুলিয়া দিল। শীতল বায়ু আসিয়া তাহার দুই চোখে লাগিতে লাগিল।

আরাম পাইয়া সে আরও একটু বাহিরে গিয়া দাঁড়াইল। আকাশের পানে চাহিয়া দেখিল, নক্ষত্র ফুটিয়াছে, কিন্তু শেষরাত্রি বলিয়া তেমন জ্যোতি আর নাই। ঐ কিছুদূরে যেখানটা খুব অন্ধকার জমিয়াছে, সেখানে দুইটা বড় বড় আমগাছ আছে, উহার আড়ালেই রাখালের বাসা। মৃদু শীতল বায়ু তাহার সর্বাঙ্গ হইতে উত্তাপ যেন মুছিয়া মুছিয়া লইতে লাগিল। রাখাল ক্রমে প্রকৃতিস্থ হইল। লক্ষ টাকার স্বপ্ন তখন বাতুলের কল্পনা বলিয়া তাহার মনে হইল। ভাবিল, চারি পাঁচশত টাকা আছে, যতদিন অন্য একটা চাকরি বাকরি না জুটে, ততদিন কোনও ক্রমে কাটাইয়া দিতে পারিব।

এমন সময় টেলিগ্রাফের ঘণ্টা টং টং করিয়া বাজিয়া উঠিল। রাখাল গিয়া কল ধরিল; একটু পরেই হাঁকিল, মহাবীর সিং, এ মহাবীর সিং, উঠো উঠো ফতুয়া মালগাড়ী ছোঁড়া।

মহাবীর সিং উঠিয়া বসিল। একটি হাই তুলিয়া, তুড়ি দিয়া বলিল, সীতারাম সীতারাম। কৌন লম্বর বাবু?

ছাব্বিশ নম্বর।

গাড়ী তো নেহি কাটেগা?

নেহি।

দ্বিতীয়বার হাই তুলিয়া স্থলিত পাগড়ি মাথায় ভাল করিয়া বাধিতে বাঁধিতে মহাবীর সিংহ সিগন্যাল ফেলিবার জন্য বাহির হইয়া গেল। রাখাল এই সুযোগটির প্রতীক্ষায় ছিল। সে বাহির হইবামাত্র, রাখাল দেরাজ খুলিয়া থলি ও দপ্তর বাহির করিয়া, আলোয়ানের ভিতর লুকাইয়া দ্রুতবেগে আপনার বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। শয়নকক্ষের তালা খুলিয়া আলো জ্বালিয়া, থলিটির মুখ শিথিল করিয়া বিছানার উপর উবুড় করিয়া ধরিল। যাহা বাহির হইল, সবই শাদা শাদা, একটুও হলুদের আভা নাই। শীতল বাতাস খাইয়া রাখাল যতই প্রকৃতিস্থ হইয়া থাকুক, একটি নৈরাশ্যের দীর্ঘ নিশ্বাস কিন্তু পড়িল।

তখন রাখাল বিছানায় বসিয়া দপ্তরটির দড়ি খুলিতে লাগিল। সে দড়ি কি সহজে খুলে? খানিকটা খুলে, আবার একটা গ্রন্থি বাহির হয়। যাহা হউক, অনেক কষ্টে রাখাল সেই খেরুয়ার আবরণ উন্মোচন করিল। বাহির হইল, কেবল হিজিবিজি লেখা কাগজের রাশি; কোথায় বা নোট, কোথায় বা লক্ষটাকা! অনেকগুলো চিঠিপত্র–কতক নূতন কতক পুরাতন; ছেঁড়া ছেঁড়া খবরের কাগজ; আর দুইখানি মোটা মোটা খাতা। রাখাল দেখিল, খাতাগুলোয় বাঙ্গালা লেখা, ছিন্ন সংবাদপত্রেও বঙ্গভাষা। একখানা খামে দেখিল ইংরেজিতে ঠিকানা লেখা রহিয়াছে।

শ্রীশ্রীমোহান্ত ভজনানন্দ গিরি,
তিতারিয়া মাঠ
মহাদেওপুর পোষ্ট,
ভায়া সিরাথু, ই, আই, আর।

রাখাল তখন অস্পষ্টস্বরে বলিল, স্বামীজী দেখছি বাঙ্গালী। আমি ভেবেছিলাম খোট্টা। খাতা দুইখানি পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তাহা গ্রন্থাকারে লিখিত। রাখাল একটি বিদ্রুপের হাসির সহিত অস্ফুটস্বরে বলিল, ও বাবা! বড় কেউকেটা নয়, বাঙ্গলা গ্রন্থকার! কলকাতায় যাওয়া হচ্ছিল কি বই ছাপাতে নাকি? বলিতে বলিতে একখানি খাতার প্রথম পৃষ্ঠা খুলিয়া দেখিল, লেখা আছে–আত্মজীবনচরিত প্রথম খণ্ড–গার্হস্থ্য জীবন। অপরখানির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা আছে, দ্বিতীয় খণ্ড–সন্ন্যাস জীবন।

এমন সময় ষ্টেশনে ঢং ঢং করিয়া ছাব্বিশ নম্বরের দোসরা ঘণ্টা পড়িল। এখনি সিগন্যালম্যান গ্রীণ দিবার জন্য হুকুম চাহিবে! রাখাল তাড়াতাড়ি টাকাগুলি থলিতে ভরিয়া, দপ্তরটা যেমন তেমন করিয়া জড়াইয়া, তোরঙ্গের ভিতর পুরিয়া চাবি বন্ধ করিল। ঘরের দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া, দ্রুতপদে ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইল।

.

প্রভাত হইল। বখতিয়ারপুর হইতে প্যাসেঞ্জার ছাড়িল। এই গাড়ীতে মোকামার পুলিশ প্রভৃতি আসিয়া পৌঁছিবে। রাখাল খালাসী পাঠাইয়া বড়বাবুকে ডাকাইয়া আনাইল।

রাত্রে গাড়ী হইতে মড়া নামিয়াছে, এ সংবাদ ইতিমধ্যেই চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তামাসা দেখিবার জন্য বাজারের অনেক লোক ষ্টেশনে আসিয়াছে। ট্রেণ বাহির হইয়া গেলেই তাহারা পিল্ পিল করিয়া প্ল্যাটফর্মে ঢুকিয়া পড়িল। খালাসীরা মাঝে মাঝে হট যাও হট যাও করিয়া তাহাদের উপর তর্জন গর্জন করিল, কিন্তু কে শোনে!

পার্শেল গুদাম খুলিয়া মৃতদেহকে বাহিরে আনিয়া রাখা হইল। ওয়েটিংরুম হইতে খালাসীরা খানকতক চেয়ার আনিয়া মৃতদেহের নিকট স্থাপন করিল। দারোগাবাবু, ষ্টেশনের বাবুরা উপবেশন করিলেন। পুলিশের অনুরোধক্রমে ডাক্তারবাবু তাহার সর্বাঙ্গ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন; কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেল না। স্বাভাবিক মৃত্যু বলিয়া ডাক্তারবাবু তখন মত প্রকাশ করিলেন।

দারোগা বলিল, সন্দেহজনক কিছু নাই তো?

ডাক্তার বলিলেন, না, সন্দেজনক কিছু নাই।

তবে সার্টিফিকেট লিখিয়া দেন।

ডাক্তারবাবু কাগজ কলম আনাইয়া যথারীতি সার্টিফিকেট লিখিয়া দিলেন যে স্বাভাবিক মৃত্যু হইয়াছে।

দারোগার আজ্ঞানুসারে একজন কনেষ্টবল তখন সন্ন্যাসীর কোমর হইতে চাবি অনুসন্ধান করিয়া, তোরঙ্গটি খুলিল। সমস্ত জিনিসপত্রের মধ্যে, বহু গবেষণাসত্ত্বেও সন্ন্যাসীর নাম–ধামের কিছুই কিনারা হইল না। কেবল, বাটুয়ার মধ্যে টিকিটখানি যাহা পাওয়া গিয়াছিল, তাহা হইতে এইমাত্র নির্ণয় হইল, সন্ন্যাসী সিরাথু হইতে কলিকাতা যাইতেছিল। বাটুয়া হইতে টিকিট ছাড়া নগদ দশটাকা কয়েক আনাও বাহির হইল।

দারোগা বলিলেন, ভালই হইল, ইহাতে দাহকার্য সমাধা হইবে; নহিলে সরকার হইতে খরচটা লাগিত।

মৃতদেহকে দাহ করে কে? দারোগা সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এ বাবাজী কোন দেশের লোক বলিয়া বোধ?

রাখাল শুনিয়াই বলিয়া উঠিল, বাঙ্গালী। –বলিয়াই তাহার মনে হইল–কেন বলিলাম? বলাটা ভাল হয় নাই!

দারোগা জিজ্ঞাস করিলেন, কেমন করিয়া জানিলেন বাঙ্গালী?

রাখাল একটু থতমত খাইয়া বলিল, কি জানি, তবে মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছিল–বোধ হয় বাঙ্গালী। মুখটা যেন বাঙ্গালী ধরনের।

এই কথা বলিতেই উপস্থিত সকলে একটু মনোযোগের সহিত মৃত ব্যক্তির মুখের পানে চাহিল। বাজারের একজন মহাজন রামখেলাওন সাও, হঠাৎ বলিয়া উঠিল, এ সন্ন্যাসী কি আমাদের ছোটবাবুর ভাই? দুজনের মুখ ঠিক এক রকম।

সকলে তখন পর্যায়ক্রমে রাখালের ও মৃত সন্ন্যাসীর মুখের পানে চাহিতে লাগিল। অপর একজন মহাজন বলিল, ঠিক বলিয়াছ সাওজি। মাথায় জটা ও মুখে দাড়ি না থাকিলে, ঠিক আমাদের ছোটবাবুর মত দেখাইত।

বড়বাবু বলিলেন, দুজনের বয়স, গায়ের রঙ প্রায় একই রকম। মুখের ছাঁচও কতকটা মেলে।

দারোগাবাবু বলিলেন, হ্যা বেশ মেলে। কপাল, ভুরু, নাক, দুজনের একই রকম। কেবল, রাখালবাবুর ঠোঁট, সন্ন্যাসীর চেয়ে পালা। দাড়ির কাছটাও মেলে।

দারোগা তখন হা হা করিয়া হাসিয়া বলিলেন, ছোটবাবু–সন্ন্যাসী যদি আপনার ভাই–ই হয়, তবে আপনিই এই দাহকৰ্ম্মের ভার নিন না। আমি কোথায় এখন লোক খুঁজে বেড়াব?

অনেকে হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাখাল, না না–বলিয়া সলজ্জভাবে ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেল।

০৮. রাখাল মরিল

দ্বিপ্রহর পানিপাঁড়ে ও ভৃত্য চলিয়া যাইবার পর, রাখাল সদর দরজায় খিল বন্ধ করিয়া, শয়নকক্ষের জানালা বন্ধ করিয়া, তোরঙ্গটি খুলিয়া সন্ন্যাসীর থলিটি বাহির করিল। শব্দ না হয়, এমন সাবধানতার সহিত, টাকাগুলি বাহির করিয়া, বিছানায় বসিয়া গণিতে লাগিল। কুড়ি কুড়ি টাকার থাক সাজাইয়া, ঠিক পঁচিশ থাক হইল–পাঁচশত টাকা।

রাখালের মনটা, অনেক দিন পরে আজ বেশ প্রফুল্ল। সে ভাবিতে লাগিল–এই পাঁচশত টাকা, এবং পোষ্ট অফিসে যাহা আছে, এবং প্রভিডেন্ট ফাণ্ড হইতে যাহা পাওয়া যাইবে, তাহাতে তাহার তিন চারি বৎসর বেশ কাটিয়া যাইবে, কাহারও গলগ্রহ হইতে হইবে না; কাশী দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ন্যাসী সাজিয়া ভিক্ষাও করিতে হইবে না। এই তিন চারি বৎসরে একটা কোনও কাযকৰ্ম্ম কি সে জুটাইয়া লইতে পারিবে না? –অবশ্যই পারিবে। কিংবা এই টাকা লইয়া কোনও একটা ছোটখাট দোকান করিলেও হয়। দোকান ফাদিয়া, শেষে মূলধন নষ্ট হইবে না ত? দোকান না হউক, কোনও রূপ ব্যবসা–চালানী কারবার। এই খুস্রুপুরেই বেশ ভাল খাটী সস্তা ঘি পাওয়া যায়–হাজারখানেক টাকার সেই ঘৃত যদি কিনিয়া কলিকাতায় লইয়া যাওয়া যায়, তবে খরচ বাদ কোন না দুইশত টাকা মুনাফা থাকে? লাভ কিছু কম হইতে পারে, টাকাটা নিশ্চয়ই ডুবিবে না। কিংবা, কয়লার খনিতে গিয়া ঠিকাদারী লওয়া যাইতে পারে। কিংবা, কলিকাতা হইতে পাঁচ সাত বাক্স তৈয়ারী জামা, কোট, বডিস প্রভৃতি ও বাঙ্গালীপছন্দ পাড়ের ধুতি শাড়ী এই সব আনিয়া, লাইনের প্রত্যেক ষ্টেশনে নামিয়া নামিয়া একদিন করিয়া থাকিয়া, বিক্রয় করিলেও বেশ লাভ হইতে পারে। রেলের ছোট ষ্টেশনে যে সকল বাঙ্গালী কর্মচারীরা থাকে, তাহারা কাপড় জামার অভাবটা বড়ই অনুভব করে। স্থানীয় দোকানে পছন্দমত জিনিষ পাওয়া যায় না–এক, কলিকাতা হইতে আনাইয়া লওয়া, তাহাও সব সময় সুবিধা হয় না; এবং নিজের চোখে দেখিয়া জিনিষ পছন্দ করার উপায় থাকে না। রাখাল ভাবিতে লাগিল, তাই করিব–চাকরি আর করিব না। চাকরি করিয়া কে কবে বড়লোক হইয়াছে? হ্যাঁ, ব্যবসায় করিয়া অনেকে বড়লোক হইয়াছে বটে!

টাকাগুলি থলিতে ভরিয়া তোরঙ্গে রাখিয়া রাখাল একটু নিদ্রার আয়োজন করিল। কিন্তু বিছানায় শুইয়া, চক্ষু বুজিয়া সে কেবল কল্পনায় নিজের ব্যবসায়ের উন্নতি এবং সঙ্গে সঙ্গে জমিদারী ক্রয়, বাগানওয়ালা দ্বিতল ত্রিতল অট্টালিকা নির্মাণ প্রভৃতি হৃদয়গ্রাহী কার্যে এক ঘণ্টা কাটাইয়া দিল। তাহার মাথা গরম হইয়া উঠিল, নিদ্রালাভের আশু সম্ভাবনা রহিল না।

নিজের পাগলামিতে নিজে লজ্জিত হইয়া রাখাল তখন উঠিয়া বসিল সোরাই হইতে জল ঢালিয়া মাথা, কান ও মুখ ধুইয়া ফেলিল। একটি সিগারেট, ধরাইয়া ভাবিল, একখানা বই–টই পড়ি–পড়িতে পড়িতে ঘুম আসিবে এখন। বটতলার একখানা ডিটেকটিভ উপন্যাস হাতে করিয়া তুলিয়া ভাবিল–এ পড়া বই, আবার পড়িতে ভাল লাগিবে কি? তার চেয়ে বরং সন্ন্যাসীঠাকুরের আত্মজীবনচরিতখানাই পড়া যাউক না! দেখি না লোকটা কে–কি প্রকৃতির মানুষ ছিল।

এই ভাবিয়া, তোরঙ্গ হইতে খেরুয়া বাঁধা দপ্তরটি বাহির করিয়া, বিছানায় শুইয়া শুইয়া রাখাল সেটি খুলিল।

প্রথমে চিঠিগুলো খাম হইতে বাহির করিয়া দেখিল, সবগুলা হিন্দী চিঠি, একখানাও পড়িতে পারিল না।

ছিন্ন সংবাদপত্র একখানি হাতে তুলিয়া দেখিতে লাগিল। হঠাৎ, চারিদিকে লালকালীর চিহ্ন দেওয়া একটা অংশে তাহার দৃষ্টি পতিত হইল। সে অংশ মফঃস্বল  সংবাদের অন্তর্গত। রাখাল পাঠ করিল :

নদীয়া–বাশুলিপাড়া। বিগত ১২ই জ্যৈষ্ঠ অত্ৰত্য স্বনামধন্য জমিদার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের আদ্যশ্রাদ্ধক্রিয়া মহাসমারোহে সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের জ্যেষ্ঠপুত্র বহুবৎসর যাবৎ নিরুদ্দিষ্ট থাকায়, তদীয় কনিষ্ঠপুত্র শ্রীমান দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় শ্রাদ্ধাধিকারী হইয়াছিলেন। বৃষোৎসর্গ ও দানসাগর যথারীতি সম্পন্ন হইয়াছিল। দিবসত্রয়ব্যাপী কাঙ্গালী–ভোজনে অন্যূন দুই সহস্র কাঙ্গালী। ভোজন করিয়াছে। নবদ্বীপ, ভট্টপল্লী, বিক্রমপুর, রঙ্গপুর প্রভৃতি স্থানের বড় বড় অধ্যাপক পণ্ডিতগণ নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়া সভার শোভাবৃদ্ধি করিয়াছিলেন।

রাখাল কাগজখানি পরীক্ষা করিয়া দেখিল, ইহা প্রায় দুই বৎসরের পুরাতন।

আর এক খানি ছিন্ন সংবাদপত্র পরীক্ষা করিতে রাখাল দেখিতে পাইল, বিজ্ঞাপন স্তম্ভের ভিতর নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটির চতুর্দিকে রেখাঙ্কিত?

১০০ পুরস্কার
গত বৃহস্পতিবার ১৯শে পৌষ মদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান ভবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় গৃহ হইতে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। শ্রীমাণের বয়ঃক্রম ১৪ বৎসর, শ্যামবর্ণ একহারা চেহারা, মাথায় বড় বড় চুল, গায়ে কালো সার্জের কোট, নেবুরঙের ডুরিদার শাল পরিধানে দেশী লাল ফিতাপাড় ধুতি, পায়ে চিনাবাড়ীর স্প্রিংদার বার্গিস জুতা। যদি কেহ উক্ত বালকের সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন, তবে তিনি উপরে লিখিত পুরস্কার পাইবেন।
শ্রীনগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
জমিদার–বাশুলিপাড়া গ্রাম
পোঃ দেওয়ানগঞ্জ জেলা নদীয়া।

অনুসন্ধান করিয়া রাখাল দেখিল, সেখানি ১৬ বৎসর পূর্বে প্রকাশিত একখানি বঙ্গবাসী। মনে মনে বলিল, বাবাজী দেখছি ছেলেবেলায় বাড়ী থেকে পালিয়ে এসে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। বড়লোকের ছেলে। এতদিন পরে বোধ হয় বাড়ী যাওয়া। হচ্ছিল–কেন? বিষয় সম্পত্তি দখল করবার জন্যে নাকি? জীবনচরিতটা তা হলে ত ভাল করে পড়তে হল!

রাখাল তখন অলসভাবে জীনচরিতের পাতাগুলা উল্টাইতে লাগিল। দেখিল, প্রথম খণ্ডটা গল্পাকারে বিবৃত, দ্বিতীয় খণ্ডটা সমস্ত ডায়েরীর আকারে লেখা। তবে, প্রত্যেক তারিখের উল্লেখ নাই, মাঝে মাঝে ফাঁক আছে। পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে রাখাল বলিল, বাবা এ যে মহাভারত বিশেষ! লিখেছে ত কম নয়! এত কে পড়ে? বরং শেষ দিকটা দেখা যাক–কি উদ্দেশ্যে বাবাজী কলকাতা যাচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় খণ্ডের শেষাংশে পড়িতে পড়িতে রাখাল দেখিল, একমাস পূর্বে তারিখ দেওয়া নিম্নলিখিত কয়েক ছত্র লেখা আছে–স্থির করিয়াছি এ ব্যর্থ সন্ন্যাস পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় গৃহস্থাশ্রমে ফিরিয়া যাইব। কিন্তু একটু দেখিয়া শুনিয়া যাইতে হইবে। দেখিবার প্রধান বিষয়, আমার স্ত্রী বাঁচিয়া আছে কি না, এবং যদি বাঁচিয়া থাকে, তবে সে কি অবস্থায় আছে যখন গৃহত্যাগ করিয়াছিলাম, তখন সে অষ্টমবর্ষীয়া বালিকা; এখন সে চতুর্বিংশবর্ষীয়া পূর্ণযুবতী। এই দীর্ঘকাল সে নিজেকে পবিত্র রাখিতে পারিয়াছে কি? ইহা ত সহসা বিশ্বাস হয় না। সুতরাং স্থির করিয়াছি, বাড়ী যাইব। এই ছদ্মবেশে গিয়া, কিছুদিন গ্রামে থাকিব, ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইব। সকল সংবাদ জানিতে পারিব। মঠের কি বন্দোবস্ত করিব তাহাই ভাবিতেছি।

পাঠ শেষ করিয়া রাখাল কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। বিছানায় একটু উচ্চ হইয়া উঠিয়া, বালিসের উপর বামহস্তের ভর দিয়া, রাখাল গভীর চিন্তায় মগ্ন হইল।

কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হইলে, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া আবার রাখাল চিৎ হইয়া শয়ন করিল। দ্বিতীয় খণ্ডখানির একস্থানে হঠাৎ খুলিয়া এই অংশটি পাঠ করিল

অদ্য বঙ্গবাসীতে দেখিলাম, গৃহস্থাশ্রমে যিনি আমার পিতা ছিলেন, তিনি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। মহাসমারোহে তাহার শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এই সংবাদটি পাঠ করিয়া, আজ আমার বুকে দারুণ ব্যথা বাজিয়া উঠিয়াছে। পূৰ্ব্বকথা সমস্ত মনে পড়িতেছে। কত সময় ভাবিয়াছি, গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করিয়া আমি কি ভাল করিয়াছিলাম? আমার আধ্যাত্মিক জীবন যেরূপে পরিণতি প্রাপ্ত হইবে আশা করিয়াছিলাম, তাহার কিছুই ত হইল না। এদিকে পুরাদস্তুর বিষয়ী হইয়া উঠিয়াছি। মঠের বিষয়–সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করিতেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়। নিজের চরিত্রও নিষ্কলঙ্ক রাখিতে সমর্থ হই নাই। তবে কেন এ ভূতের বোঝা বহিয়া মরি? কোন রিপুই দমন করিতে কৃতকার্য হই নাই। সেদিন ভৃত্য তামাকু দিতে বিলম্ব করিয়াছিল, এই কারণে ক্রোধে অন্ধ হইয়া তাহাকে খড়ম ছুড়িয়া মারিয়াছিলাম। গত বৎসর মঠের এস্টেটের তহশিলদার যখন এক হাজার টাকা তছরুপ করিয়া পলায়ন করে, তখন সেই হাজার টাকার শোকে দুই তিনদিন ভাল করিয়া ঘুমাই নাই, আহার করিতে পারি নাই! উৎকৃষ্ট পুরাতন বাসমতী চাউলের অন্ন, সুগন্ধি গব্যঘৃত ভিন্ন আমার আহার হয় না। তিনসের দুগ্ধ জ্বাল দিয়া একসের করিয়া, সমস্ত দিনে তাহার উপর যে সরটুকু পড়ে, সেই সরে মিশ্রির গুঁড়া মিশাইয়া বৈকালে জলযোগ করিয়া থাকি। আমি মোহান্ত? লোকে পরোক্ষে ভজনানন্দ স্থলে আমাকে ভোজনানন্দ বলিয়া উপহাস করে, শুনিয়া আমি কত রাগ করিয়াছি–কিন্তু কথাটা ত বড় মিথ্যা নহে। –আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছি, মোকদ্দমা জিতিবার জন্য জাল দলিল পৰ্য্যন্ত নিজের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করিয়াছি। কোন পাপটা করি নাই? আমার জীবনে ধিক্।

তাহার পর রাখাল পড়িয়া যাইতে লাগিল। পড়িতে পড়িতে দেখিল, মঠের জীবনে সন্ন্যাসীর ধিক্কার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হইতেছে। শেষ হইবার কিছু পূৰ্ব্বে পড়িল

আজ বঙ্গবাসী আসিয়াছে। খুলিয়া অভ্যাস মত প্রথমেই মফঃস্বল স্তম্ভ অন্বেষণ করিলাম, বাশুলিপাড়ার কোনও সংবাদ আছে কিনা। দেখিলাম, আছে–নিদারুণ সংবাদই আছে। আমার কনিষ্ঠভ্রাতা দেবেন্দ্র আর ইহলোকে নাই। আমি যখন গৃহত্যাগ করিয়াছিলাম তখন সে এক বৎসরের শিশু। ভাবিতাম, আমি চলিয়া আসিয়াছি, সে ত আছে; তাহার দ্বারাই পিতার বংশরক্ষা হইবে, বিষয় রক্ষা হইবে। সে গেল–এখন বৃদ্ধা জননীকে কে সান্ত্বনা দিবে? কে সংসার দেখিবে? আমার পৈতৃক সম্পত্তিবাৎসরিক লক্ষাধিক টাকা মুনাফার সম্পত্তিকে ভোগ করিবে? আমি কি চিরদিন এই মঠে বসিয়া এই বিড়ম্বিত জীবন যাপন করিতে থাকিব? কোথায় সাধন? কোথায় ভজন? কেবল বিষয়–বিষয়–বিষয় চিন্তা–রসনার সেবা–এই মাটির দেহের সহস্র বিধানে পরিচৰ্য্যা–আর ভণ্ডামি। যদি বিষয় চিন্তাতেই জীবন অতিবাহিত করিতে হয়, তবে আমার পৈতৃক বিষয়–যাহা এই মঠের বিষয়ের অন্তত বিশগুণ–সে বিষয় কি অপরাধ করিয়াছিল? কি করিব? এসব ছাড়িয়া–ছুড়িয়া বাড়ী ফিরিয়া যাইব কি? আজ সমস্ত দিন তাহাই চিন্তা করিতেছি; কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না।

ইহা দুইমাস পূৰ্ব্বে লিখিত। দুই তিন পৃষ্ঠার পরেই লেখা শেষ হইয়াছে, সন্ন্যাসী নিজ পত্নীর চরিত্র পরীক্ষা করিবার মানসে, গ্রামে গিয়া কিছুদিন ঘুরিয়া বেড়াইবার সঙ্কল্প পূৰ্ব্বোদ্ধৃত মত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

রাখাল খাতা বন্ধ করিয়া বিছানা হইতে উঠিল। সেই স্বল্পায়তন কক্ষ–খানির মধ্যে পদচারণা করিতে করিতে অনেকক্ষণ চিন্তা করিল। এক একবার খোলা জানালার কাছে দাঁড়াইয়া, বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকে; কিন্তু তাহার চক্ষু বাহিরের কিছুই দেখিতে পায় না। একবার তাহার মুখে যেন বিষাদের ছায়া ঘনাইয়া আসে–আবার যেন সে আশঙ্কায় অভিভূত হইয়া পড়ে, আবার একটু প্রফুল্লভাব ধারণ করে–তাহার মুখে যেন একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়া উঠে।

প্রায় এক ঘণ্টাকাল অতীত হইলে, রাখাল আবার শয্যার উপর বসিল। নিজ অবনত মস্তক দুই হস্তে চাপিয়া ধরিয়া মনে মনে বলিল, আমি যাব, এ বিষম প্রলোভন দমন করা আমার সাধ্য নয়। লক্ষটাকা আয়ের জমিদারী–যুবতী স্ত্রী–একটা মিথ্যা কথার দ্বারাই আমি লাভ করতে পারি। যে এতক্ষণ চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার বয়স, তার গায়ের রং, তার চেহারা–সমস্তই আমার মত। ষোলবৎসর অদর্শনের পর কার সাধ্য আমার জুয়াচুরি ধরে? তার জীবনচরিত্র আমার হাতে–তাতে প্রত্যেক খুটিনাটি কথাটি পর্যন্ত লেখা আছে। সেখানা আমি মুখস্থ করে নিলে, কার সাধ্য আমায় সন্দেহ করে? রাখাল, তুমি মর–তুমি মর–মরে, ভবেন্দ্র হয়ে জন্মগ্রহণ কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *