রণ-কুয়াসা

রণ-কুয়াসা 

এই বিদ্যুৎলতাকে কেন্দ্র করিয়াই বিপ্লবের দলটি গড়িয়া উঠিতেছিল। ছেলেরা বলিত, মক্ষিদিদি,—বড়রা বলিত মক্ষিরাণী। এ নামটি দেওয়া জীমূতবাহনের। 

চার মাসের মেয়ে রাখিয়া সাত দিন আগে-পিছু মা-বাপ দু’জনেই বৈতরণী পাড়ি দেন। জীমূত তখন বছর দশেকের। তারপর হইতেই ছোট বোনটিকে তিনি যেন কোলে- পিঠে করিয়া মানুষ করিতেছিলেন। কুড়ি বছরের যৌবনোচ্ছল, লাবণ্য-ঢল-ঢল মেয়ে, কিন্তু ঠিক যেন সেই কচিটিই আজও রহিয়া গেছে। 

চোখে যৌবনের আগুন হয়তো জ্বলে কিন্তু ছোট মেয়ের কলহাস্যও অক্ষয় আছে। 

কুড়ি বছরের মেয়ে, কিন্তু ইহারই শাসনে বড় হইতে ছোট পর্যন্ত সবাই ত্রস্ত। বাধা মানে না কেবল সমীরণ। বাহির হইতে তার কোনো দীপ্তিই প্রকাশ পায় না, কিন্তু এত সহজে পাশ দিয়া লঘুচ্ছন্দে সে বহিয়া যায় যে, সবাই বুঝে কোনো বন্ধনেই ইহাকে বাঁধিবার উপায় নাই। 

মক্ষিরাণী ঝঙ্কার দিয়া বলে, মেজদা, তোমার আদুরে দুলালটিকে নিয়ে পারিনে বাপু। ওর যখন যা খুশি তাই করবে, বললে কথা শোনে না। 

জীমূতবাহন হাসেন, বলেন,–বেশ তো, করুক না যা খুশি। অন্যায় তো কিছু করে নি।

আদর করিবার জন্য মেজদা মক্ষিরাণীর দিকে হাত বাড়ান। কিন্তু হাত ঠেলিয়া ফেলিয়া অভিমানিনী বলে,—না, কিছু অন্যায় করে নি। তোমার ‘মধ্যমণি’ কখনো অন্যায় করতে পারে? একবার জিগ্যেস করতো, সকাল থেকে ও কিছু খেয়েছে কি না? 

হাসিয়া মেজদা বলেন,–এই! আচ্ছা, আমি জিগ্যেস করছি। মণি, মণি— 

ডাকিবার ভঙ্গী দেখিয়া মক্ষিরাণী রাগিয়া বলে,—ডাকো, তোমার মণিকে। আমার অন্য কাজ আছে, আমি চললাম। 

মেজদার স্নেহের অংশ লইয়া সমীরণের উপর বিদ্যুতের যে হিংসার ভাব আছে, মেজদার চোখে তাহা অনেক দিনই ধরা পড়িয়াছে। তা ছাড়া এমনি করিয়া সমীরণকে সামলাইবার জন্য বিদ্যুৎকে বারম্বার মেজদার শরণ লইতে হয়। হিংসা ছাড়া সমীরণের ওপর রাগের এও একটা কারণ। 

ব্যাপার দেখিয়া হাসেন কেবল পণ্ডিত মহাশয়। দলের মধ্যে বয়স হিসাবে ইনিই সর্বাপেক্ষা প্রবীণ এবং একদফা সংসারাশ্রম সারিয়া তবে এই দলে আশ্রয় লইয়াছেন। বয়স চল্লিশ পার হইয়াছে, একটু নাদুস-নুদুস দেখিতে; কিন্তু হাতের পেশীগুলা লোহার মতো শক্ত। 

তিনি বলেন-ও ছোঁড়া থাকগে বোসে ভাই মক্ষিরাণী, তুই কেন ওর জন্যে বোসে থাকিস? তুই খেয়ে নিগে। মার্কসিজমে পেট ভরে কিনা আজ বরং ওর সেই শিক্ষাই হোক 

বিদ্যুৎ হাসিয়া বলে,—মেয়ে মানুষে তাই কখনো পারে পণ্ডিত মশাই? 

ঘাড় নাড়িয়া পণ্ডিত মহাশয় বলেন, কিন্তু যে মেয়েকে কালকে নিজের হাতে কেল্লা ওড়াতে হবে তাকে পারতেই যে হবে। 

বিদ্যুৎ হাসিয়া বলে,—আপনার সঙ্গে তর্কে পারবার জো নেই। 

বিদ্যুৎ খাইতে চলিয়া যায়, তবু যাইবার সময় অনাবশ্যক ভাবে সমীরণের ঘরের সামনে দিয়া শব্দ করিয়া যায়। 

সমীরণ তখনও ধ্যানমগ্ন। 

এমন সময় তেতালার একটা অন্ধকার কুঠুরী হইতে অতি সন্তর্পণে গুটি তিনেক ছেলে বাহির হইয়া আসিয়া দরজা তালাবন্ধ করিয়া দিল এবং হাসিতে হাসিতে সমীরণের ঘরে প্রবেশ করিল। 

বিমল সায়েন্স কলেজে পড়ে, সমীরণের সমবয়সী। বেশী পড়া সে মোটে সহিতে পারে না। সমীরণের সুমুখের বইখানা ছুঁড়িয়া তাকের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল,—শুধু থিওরী, শুধু থিওরী। কাজ করো—থিওরীতে কিছু হবে না। 

সমীরণ হাসিয়া বলিল—হয়ে গেল? 

বিমল বুকে তিনটা চাপড় দিয়া বলিল,—হবে না? একেবারে ফার্স্ট ক্লাস জিনিস,—most up to date. কিন্তু সে বিকেলে দেখবে এখন। ভয়ানক ক্ষিধে পেয়েছে। আগে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। 

সবাই উঠিয়া বাহির হইয়া গেল। 

.

কয়দিন হইতে জীমূতবাহন একেবারে যেন শান্ত হইয়া গেছেন। ছোট-ছোট ছেলেদের সঙ্গে হাস্য-পরিহাস, ক্রীড়া-কৌতুক সব বন্ধ করিয়া, কি জানি কেন, তেতালার ঘরে অর্গল রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। 

প্রথম-প্রথম কেহ বড় কিছু লক্ষ্য করে নাই। কিন্তু দিন কতক পরে সবাই চঞ্চল হইয়া উঠিল। 

জীমূতবাহন যে এতদিন বেশী কিছু করিতেন তাও নয়। কিন্তু এতদিনে সবাই টের পাইল, সুস্নিগ্ধ রঙ্গ-কৌতুকের মধ্য দিয়াই এই একটি লোক প্রত্যেকের প্রতিদিনের এবং নিত্যকারের জীবনে কতখানি শক্তি সঞ্চার করিতেন। 

বিদ্যুৎ বার কয়েক তেতালার ঘরে হানা দিল। ইচ্ছা ছিল, অভিমান করিয়া, আবদার করিয়া ইঁহাকে তেতালার কোটর হইতে বাহিরে আনে। কিন্তু এই শান্ত তপস্বী এমন করিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া পরম স্নেহে মস্তক স্পর্শ করিলেন যে, অত বড় চঞ্চল মেয়েও মুহূর্তের মধ্যে শান্ত হইয়া পড়িল। মানুষ যেমন করিয়া মুগ্ধ চোখে ধ্রুবতারার প্রতি চাহিয়া থাকে, তেমনি ইঁহার চোখের পানে সে শুধু চাহিয়া রহিল। 

ইচ্ছা ছিল, তর্ক করে। বাহিরে অনন্ত কাজ যাঁহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, কেবল যাত্রা সুরু করিয়াই তাঁহার নিজেকে এমন করিয়া গুটাইয়া লওয়া চলে না, যে ক’টি তরুণ যৌবনের উম্মেষেই সর্বস্ব ছাড়িয়া পথে দাঁড়াইয়াছে, তাহাদের ত্যাগ করা ভালো দেখায় না, ইচ্ছা ছিল এই কথাটা বুঝাইয়া দিয়া যায়। 

কিন্তু তর্কের যে ভুজঙ্গ আঁকিয়া-বাঁকিয়া মনের মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল, মেজদার করস্পর্শে সে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবার কুণ্ডলী পাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল। কি চলে এবং কি চলে না, কি ভালো দেখায় এবং কি ভালো দেখায় না, সে প্রশ্ন যেন ইঁহার সম্মুখে তোলাই যায় না। 

সে আবার দোতলায় ফিরিয়া আসিল। 

পণ্ডিত মহাশয়েরও যেন পরিবর্তন আসিল। রাজনীতি ছাড়িয়া দিয়া তিনিও কোথা হইতে এক গাদা সংস্কৃত বই আনিয়া তাহার মধ্যে ডুব দিলেন। 

এই সময়ে সমীরণ যেন গা-ঝাড়া দিয়া উঠিল। ছেলেগুলোকে এক সঙ্গে জড় করিয়া সে বলিল,—ব্যাপার দেখছ তো? 

বিমল বিস্মিত হইয়া বলিল,—কি ব্যাপার? 

জীমূতবাহনের পাশের ঘরেই ইহারা একটা নূতন এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত ছিল। নাওয়া- খাওয়ার সময় ছাড়া বাহির হইবারও অবকাশ পায় নাই। কোনো আলোচনা করিবারও সময় পায় নাই। 

সমীরণ বলিল,—মেজদা তেতালায় যোগে বসেছেন! 

বিমল বিস্মিত হইয়া বলিল,–যোগে! 

—হ্যাঁ যোগে। পণ্ডিত মশাইকেও বোধ হয় তারই ছোঁয়াচ লেগেছে। তিনিও দেখি খানকতক সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে ব্যস্ত। এখন কি করা উচিত? 

সবাই বলিল,—তা, মক্ষিদিদিকে একবার- 

বোধ হয় মক্ষিদিদিকে একবার জিজ্ঞাসা করিবার কথাই তাহারা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সমীরণ যে রকম দীপ্ত চক্ষে তাহাদের পানে চাহিল, তাহাতে কথা আর শেষ হইতে পারিল না। 

সমীরণ কাটিয়া কাটিয়া আস্তে-আস্তে বলিল,—মক্ষিদিদির কথা নয়। তোমাদের কথা তোমরা বল, এর পরে তোমরা কি করবে। নেতা নেই, তবু পথ চলবার সাহস আছে? পথ চেনা নেই, জানা নেই, একলা- হাত ধরাধরি করে সবাই মিলে চলতে যাওয়া সোজা কথা নয়। এ সব বুঝে, ভেবে- 

বিমল এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল। মধ্য পথে সমীরণকে বাধা দিয়া বলিল,—কিন্তু মক্ষিরাণীর মতও জানতে হবে। চলতে যদি হয়ই, তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। যেতে যদি সে চায়, তাকে ফেলে যাই কি করে! 

সমীরণ হাসিয়া বলিল,—মস্ত সমস্যা! 

বিমল কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু তাহাকে বাধা দিয়া সমীরণ বলিতে লাগিল,—মক্ষিরাণীকে নিয়ে তোমাকে চলতে যদি হয়ই, তুমি তাই চলো। কিন্তু আমাদের আরও জোরে চলতে হবে, আরও শীগগির। আমাদের অপেক্ষা করার সময় কই? 

নারীর শক্তির প্রতি সমীরণের যে অবজ্ঞা আছে, তা বিমল জানে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে অনেক তর্ক হইয়া গেছে। সে তর্ক আর নূতন করিয়া না তুলিয়া সে শুধু সমীরণের পিঠে একটা চাপড় দিয়া বলিল, বেশ তো, আগে তো চলাই সুরু হোক। তারপরে আমরা যদি সামনে চলতে না-ই পারি, তুমি না হয় আগেই যাবে। 

এ পরিহাসে ছেলের দল হাসিয়া উঠিল। 

শুধু দরজার গোড়ায় দাঁড়াইয়া বিদ্যুৎ ক্রোধে ফুলিতে লাগিল। সে যে কখন আসিয়া ওখানে দাঁড়াইয়াছে তাহা কেহ টেরও পায় নাই। 

মক্ষিরাণীর উপর সর্বাগ্রে দৃষ্টি পড়িল সমীরণের। 

সে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া শুধু বলিল,—এসো মক্ষিরাণী। তোমার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। এরা বলছিল—

কিন্তু মক্ষিরাণী ততক্ষণে নিজেকে সামলাইয়া লইয়াছে। এরা কি বলিতেছিল, তাহা সে নিজের কানেই শুনিয়াছে। তাই সে কথা শুনিবার আগ্রহ প্রকাশ না করিয়া সে শুধু শান্তস্বরে বিমলকে বলিল,—তুমি একবার চেষ্টা করবে বিমল, মেজদার যদি ধ্যান ভাঙে? 

বিমল বলিল,—সে কি হবে? তুমি তো চেষ্টা করেছ। 

—চেষ্টা ঠিক করতে পারি নি। তবে এ-কথা বুঝেছি, তাঁকে আর নামানো সম্ভব বে না। 

—তবে? 

সমীরণ বলিল, কিন্তু তুমি কি একলা চলতে ভয় পাও, মক্ষি? 

মক্ষিরাণী ইচ্ছা করিয়াই সমীরণকে অপমান করিল। বিদ্বেষ সহা যায়, কিন্তু অবজ্ঞা সহা যায় না। 

সে যেন তার প্রশ্ন শুনিতেই পাইল না। বিমলকে প্রশ্ন করিল, বিমল, তোমার একলা চলার সাহস আছে? 

—আছে। কিন্তু তোমায়ও তো ছাড়তে পারিনে। 

মক্ষি একেবারে ছোট মেয়ের মতো হাসিয়া উঠিল। 

বলিল,—ছাড়তে কে বলেছে? আর তোমরা ছাড়তে বললেও আমিই বা তোমাদের ছাড়বো কেন? তোমরা ছাড়াতে চাইলেও কি আমাকে ছাড়াতে পারো? 

মক্ষির চোখে একটা ক্রূর হিংসা খেলিয়া গেল। 

সমীরণের পানে না চাহিয়াই সে বলিল,—বিমল ভাই, তোমরা যাই মনে কর, আমরা, মানে মেয়েরা, যে মানুষ এ বিষয়ে কোন ভুল নেই। 

সমীরণ মুখ নিচু করিয়া একটু হাসিল। 

বিমল তাড়াতাড়ি বলিল,—সে-কথা কে বলে? আমি অন্তত সে-কথা বলি না, তার প্রমাণ এই যে, আমি স্থির করেছি, তোমাকেই আমাদের সামনে দাঁড়াতে হবে। জয়- পরাজয় যাই হোক, আসছে সংগ্রামে তুমিই আমাদের নেতা। 

এত বড় আহ্বানের জন্য মক্ষিরাণী প্রস্তুত ছিল না। সে প্রথমে খানিকটা বিব্রত হইয়া উঠিল। একবার মনে হইল, প্রতিবাদ করে, এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু কিছুই বলিতে পারিল না। শুধু সকলের মুখের পানে বারবার চাহিতে লাগিল। 

ততক্ষণে সমস্ত ছেলে উঠিয়া একেবারে তার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে গভীর স্নেহে সব চেয়ে ছোটটির শিরস্পর্শ করিল। 

অনেকক্ষণ পরে কি ভাবিয়া একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—বেশ।

অকস্মাৎ তার সমীরণের কথা মনে পড়িল। 

বলিল,—কিন্তু সমীরণ, তুমি? 

সমীরণ ভালো করিয়া মাথা তুলিয়া বলিল, আমি কি, বল? 

—তুমি আমার নেত্রীত্ব মেনে নেবে? 

—নোব। 

—কিন্তু তুমি তো, তোমার তো আমার শক্তিতে যথেষ্ট বিশ্বাস নেই। 

—তা নেই। 

—তবে? 

সমীরণ এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। শুধু দূরের পানে চাহিয়া আপন মনেই একটু হাসিল। 

মক্ষি আবার বলিল,—কিন্তু আজকে থেকে আমায় যদি সামনে দাঁড়াতেই হয়, একটা কথা জানা দরকার। আচ্ছা, আমার শক্তির ‘পরে তোমার এ অনাস্থা এলো কোথা থেকে? আমি কি কোন দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছি? 

সমীরণ অকস্মাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,—না, মক্ষিরাণী; না। তুমি কোথাও কোনো দুর্বলতার পরিচয় দাওনি। কিন্তু আমি জানি, শেষ পর্যন্ত তুমি সবল থাকতে পারো না। তুমি না, কোনো মেয়ে না,–মেয়েরা তা পারে না। 

সমীরণ আর দাঁড়াইল না। বাহিরে চলিয়া গেল। 

.

কিন্তু মক্ষি যে রকম আশঙ্কা করিতেছিল, তেমন কিছুই হইল না; অর্থাৎ সমীরণ সম্পূর্ণভাবে ওর বশ্যতা মানিয়া লইল। তবু সমীরণের প্রতি একটা সন্দেহ ও আশঙ্কার ভাব মক্ষির রহিয়াই গেল। 

বিমলের মধ্যে যে তৎপরতা আছে, তা সমীরণের মধ্যে নাই। তথাপি মক্ষির কেবলি সমীরণকে আরও কাছে টানিতে লোভ হয়। মাঝে-মাঝে নানা প্রকারে চেষ্টা যে না করে তা নয়, কিন্তু সমীরণের মুখে-চোখে এমন একটা শান্ত দৃঢ়তা আছে—যা আঘাত দিলেও টলে না। 

সমীরণ যে বশ্যতা স্বীকার করিল, সে কেমন?—

মক্ষি হুকুম দিল, মেদিনীপুরে একটা কেন্দ্র স্থাপন করিতে হইবে। সমীরণ তলপী- তলপা বাঁধিয়া মেদিনীপুর রওনা হইল এবং দিন পনেরো পরে ফিরিয়া আসিয়া একটা লম্বা রিপোর্ট দিল। তারপরে আবার যে লেনিন লইয়া বসিল, বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন উঠিল না। 

এইটে মক্ষিরাণীর ভালো লাগে না। মক্ষি মেদিনীপুরের ব্যাপার লইয়া একটা গল্প জমাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু সমীরণ যা বলিয়াছিল, তার বেশী আর কিছুই বলিল না। সুতরাং গল্প জমিল না। 

তখন মক্ষিরাণীকে তেতালায় বিমলের ঘরে গিয়াই বসিতে হয়। বিমল এক্সপেরিমেন্টের ফাঁকে-ফাঁকে তাকে আনন্দ দিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। বিজ্ঞানের সাহায্যে পৃথিবীতে কত অঘটন ঘটিতেছে, কত রকম নূতন নূতন মারণাস্ত্র তৈরী হইতেছে, পরমোৎসাহে সে-কথা বুঝাইতে যায়। কিন্তু বক্তার উৎসাহ শ্রোতার মধ্যে সঞ্চারিত হয় না। বিমল হাতে-হেতেড়ে কাজ করিতে পারে, মুখ কম চলে। 

সুতরাং মক্ষিরাণী আবার নীচে চলিয়া আসে। 

বসন্ত ছেলেটিকে তার ভাল লাগে। বছর চৌদ্দ-পনেরো বয়স। বিমল তাহাকে উড়িষ্যার জঙ্গল হইতে সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে। এইখানেই খায়দায় থাকে এবং নামমাত্র মেট্রোপলিটানে পড়ে। আসলে সে বিপ্লবীদেরই একজন একনিষ্ঠ কর্মী। 

বসন্তর জীবনের পিছনে একটা করুণ ইতিহাস আছে। তারই ছাপ ওর মুখে-চোখে ভাসে এবং মক্ষির কঠোর মনেও মমতা জাগায়। 

মক্ষিকে দেখিলেই ও কেমন ফ্যাল ফ্যাল করিয়া অনিমেষে চাহিয়া থাকে, যেন ভুলিয়া যাওয়া কিছু ভাবিবার চেষ্টা করে। সকল দিন সেদিকে নজর দিবার মতো অবসর মক্ষির থাকে না। কিন্তু সেদিনে কি কারণে সে হঠাৎ বসন্তকে লইয়াই গল্প জমাইল। 

ও কি রে, অমন করে চেয়ে আছিস যে! 

বসন্ত লজ্জায় মুখ লুকাইল। 

মক্ষি একটু হাসিয়া বসন্তকে কাছে টানিয়া লইল। 

বলিল,—তুই আমার পানে চেয়ে কি ভাবিস রে বসন্ত? 

বসন্ত কিছুতেই বলিবে না। শেষে অনেক পীড়াপীড়িতে কোনো রকমে মুখ নামাইয়া বলিল,—তোমাকে দেখলে আমার মাকে মনে পড়ে, মক্ষিদিদি। 

মক্ষিদিদি লোকের মাথা কাটিয়া আনিবার হুকুম দেয়, অবলীলাক্রমে। তবু সেদিন সেই বিশেষ রঙের সূর্যাস্ত বেলায় বসন্তর কথা তার মনকে স্পর্শ করিল। 

—তোর মা কি আমার মতো দেখতে ছিলেন? 

বসন্ত ম্লান হাসিয়া বলিল,—কি করে বলবো, মক্ষিদিদি। তাঁকে তো দেখিনি কখনও। তবু কেমন মনে হয়, তিনি তোমার মতোই ছিলেন, বোধহয়। 

মক্ষি হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, তুই একটা পাগল। 

বসন্ত দৃঢ়ভাবে বলিল,—পাগল না গো মক্ষিদিদি। কিন্তু আমার কেমন যেন তাই মনে হয়। বেশী মেয়ে তো দেখিনি—এক দেখেছি মামীমাকে, যে আমায় শীতের রাত্রে ঘরের বার করে দিয়েছিল। আর দেখলাম তোমায়। 

মক্ষিও তার নিজের মাকে দেখে নাই। সে বোধ হয় আপন মনে সেই কথাই ভাবিতেছিল। 

বসন্ত আপন মনে বলিয়া চলিল—যদি কোনো দিন তাঁর দেখা পাই মক্ষিদিদি, তোমায় এনে দেখাবো তিনি ঠিক তোমার মতো। 

—তুই কি তাঁকে খুঁজিস নাকি? 

—খুঁজি মক্ষিদিদি, রোজ খুঁজি। সমরদা বলছিল, বাজারে যারা বাজার করতে আসে তাদের অনেকেই নাকি বেশ্যা। ওদের মধ্যে রোজই আমি খুঁজি, যদি আমার মা-টিকে পাওয়া যায়। 

অত্যন্ত সরল শিশু। বেশ্যা কাহাকে বলে তাই হয়তো জানে না। শোনা কথা। তাহার মায়ের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে যতটুকু সে শুনিয়াছে, ততটুকু মাত্র সম্বল করিয়া অবোধ শিশু এই জনারণ্যে তাহার হারানো মায়ের সন্ধান করিতে চায়! 

দুজনে একই সঙ্গে গভীর নিঃশ্বাস ফেলিল। 

বসন্ত বলিল, কিন্তু বাজার তো একটা নয়। যারা বাজার করতে আসে তাদের সংখ্যাও কম নয়। কবে যে দেখা পাব, কে জানে? 

—কিন্তু দেখা পেলেই বা তুই তাঁকে চিনবি কি কোরে? 

বসন্ত সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল,—যদি কোনো দিন দেখা পাই মক্ষিদিদি, দেখে নিও, আমি ঠিক চিনে নোব। এক মিনিট বিলম্ব হবে না। 

ঠিক তখন দত্ত বাবুদের বাড়ীর আড়ালে সূর্য অস্ত গেল। 

কিন্তু যে মাকে কখনও দেখে নাই, এই চৌদ্দ বছরের ছেলে কি করিয়া এক মিনিটে তাহাকে চিনিয়া লইবে, ভাবিয়া না পাইয়া মক্ষি তার মুখের পানে বিস্মিত নয়নে চাহিয়া রহিল। 

.

ইতিমধ্যে যে দলকে বাঁকুড়ায় ডাকাতির জন্য পাঠানো হইয়াছিল, তাহারা ফিরিয়া আসিল। 

সকলেরই চোখ-মুখ বসিয়া গিয়াছে এবং দোতালায় আসিয়া যখন তাহারা বসিল, মনে হইল, পুলিশ হেপাজতে ইহাদিগকে টানিয়া আনা হইয়াছে। 

কোনোমতে স্নানাহার সারিয়া ইহারা নিদ্রা গেল। নিদ্রা ভালো হইল না। ক্ষণে-ক্ষণে স্বপ্ন দেখিয়া চীৎকার করিয়া ওঠে। তবু বিকালের দিকে শরীর অনেকটা সুস্থ হইল, মনও অনেকটা প্রফুল্ল হইল। 

তারপরে সন্ধ্যাবেলা জ্যোৎস্নালোকে ছাদের উপর সভা বসিল। 

বাঁকুড়া জেলার সেই গ্রামে যে ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা এই—

দামোদরের তীরে বর্ধিষ্ণু একটা গ্রাম। রাত্রি এগারোটার সময় তারা জন দশ-পনেরো সেখানে গিয়া পৌঁছিল। তখন অন্ধকার হইয়া গেছে। পাড়াগাঁয়ের লোক এগারোটার সময় বড় একটা জাগিয়া বসিয়া থাকে না। 

সদর দরজা খোলার বিশেষ অসুবিধা হইল না। দ্বার ভিতর হইতেই খুলিয়া গেল। সে ব্যবস্থা আগে হইতেই করা হইয়াছিল। 

দ্বার খোলামাত্র একদল ভিতরে প্রবেশ করিল, আর একদল ঘাঁটি আগলাইতে লাগিল, এবং রে রে করিয়া মশাল জ্বালিয়া, লাঠি ঘুরাইয়া ছুটাছুটি করিতে লাগিল। 

পাশের বাড়ীর দু’চারটি লোক ব্যাপার না বুঝিয়া দরজা খুলিয়াছিল, কিন্তু ডাকাতেরা একটা ধমক দিতেই তাহারা সভয়ে অর্গল বন্ধ করিয়া দুর্গানাম জপিতে লাগিল। বাধা দিবে কে? কারও ঘরে কি কিছু আছে? ওরই মধ্যে যাহাদের ঘরে এক আধখানা লাঠি আছে তাহারাও লাঠি ঘুরাইতে জানে না। 

একটু দূরেই একটা তরুণ সমিতির আখড়া আছে। কিন্তু রিভলবারের সুমুখে তারাও বড় সাহস পাইল না। 

একটা ঘরে বুড়ার ছেলে সস্ত্রীক ঘুমাইতেছিল। গোটা কতক আঘাত দিতেই দরজা ভাঙিয়া গেল, বুড়ার ছেলেকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলা হইল। কিন্তু তার তখন এমন অবস্থা যে, কান ধরিয়া টানিবার এবং পা ধরিয়া ছেঁচড়াইবার পরেও তার মুখ দিয়া একটা কথা বাহির হইল না। 

তার স্ত্রী তখন মূর্ছা গিয়াছেন। তাঁরই গায়ের গোটা কয়েক গহনা মিলিল।

ও-ঘরে তখন বুড়া ও তার স্ত্রীকে লইয়াও তুমুল কাণ্ড চলিতেছিল! 

ডাকাতেরা বৃদ্ধা মহিলাকে সশ্রদ্ধভাবে মাতৃসম্বোধন করিয়া তাঁর গায়ের সমস্ত গহনাগুলি চাহিল। মায়ের মনে তথাপি এই মুখোসপরা, মশাল এবং অস্ত্রধারী সন্তানগুলির প্রতি বাৎসল্য আসিল না! তিনি সমানে ডাকাতদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করিতে লাগিলেন। কিন্তু একখানি গহনাও রক্ষা হইল না, লাভের মধ্যে বাঁ হাতের দুইটা আঙুল ভাঙিয়া গেল। 

খোয়ার হইল বুড়ারই সবচেয়ে বেশী। মশালের ছ্যাঁকা, লাঠির আঘাত এবং অশেষ প্রকার নির্যাতনের পরেও বুড়া সবিনয়ে জানাইল, তাহার কাছে একটি তামা মিলিবে না, মারিয়া ফেলিলেও না। আয়রণ সেফ খুলিয়া একগাদা বন্ধকী দলিল ও হ্যান্ডনোট ছাড়া নগদ গোটা চল্লিশ টাকা পাওয়া গেল। রাত তখন তিনটা। সুতরাং তাহাই লইয়া ডাকাতেরা সরিয়া পড়িল। 

নৌকা ঘাটে বাঁধাই ছিল। নিজেদের একবার গণিয়া লইয়া ‘দুর্গা’ বলিয়া বাঁধন খুলিয়া দিল। 

পরের দিন পুলিশ আসিল তদন্তে। বুড়া কাঁদিতে কাঁদিতে বিশ হাজার টাকা চুরি যাওয়ার এক ফর্দ দিল এবং যত কিছু বন্ধকী গহনা তাহার কাছে ছিল, সবই যে ডাকাতে লইয়া গিয়াছে একথা পুনঃ পুনঃ জানাইয়া দিল। পুলিশ বাড়ীর চারিদিক একবার ঘুরিয়া আসিল, সমস্ত দিন গ্রামের ছেলে- বুড়া সকলকে সহস্র রকমের প্রশ্ন করিল এবং সন্ধ্যার পর বুড়াকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া শুধাইল,—আচ্ছা এই যে তরুণ সমিতি করেছে, এরা সব কেমন? 

বুড়া মাথা চুলকাইতে লাগিল এবং একটু ইতস্তত করিয়া চুপ করিয়া গেল।

উৎসাহ পাইয়া পুলিশ বলিল,—এরা কি করে? কতকগুলো জিমনাস্টিক বার, লাঠি- সোঁটা তো দেখলাম। 

বুড়া বলিল,—তা খেলে, লাঠি-টাঠি খেলে, ডাং-পিটেও আছে। 

পুলিশ আর কোনো প্রশ্ন করিল না। রাত্রির মধ্যে তরুণ সমিতির সমস্ত ছেলের বাড়ী ঘেরাও করিয়া এবং খানাতল্লাস করিয়া সন্দেহজনক কিছু পাইল না বটে, তথাপি গুটি তিনেক ছেলেকে বাঁধিয়া থানায় লইয়া গেল। 

.

জ্যোৎস্নালোকে ছাদের উপর যে সভা বসিল, তাহাতে বাঁকুড়া অভিযানের নেতা বলিল—নগদে গহনায় যা পাওয়া গেছে তা চার হাজারের বেশী হবে না। 

সবাই সমস্বরে বলিল,—মোটে! 

অবনী হাসিয়া বলিল,—মোটে নয়। সে বুড়োকে তো দেখো নি। ওই যা হয়েছে তাই ঢের। বুড়ো মরবে তবু টাকা বের করবে না। 

মক্ষির চোখ দুটো দপ্ দপ্ করিতে লাগিল। তার আশা ছিল অন্তত হাজার বিশেক পাওয়া যাবেই। সে বলিল,—দিলে না কেন বুড়োকে শেষ করে? 

অবনী হাসিয়া বলিল,—কি হোতো। খুন করলেও আর একটি পয়সা বের হোত না। 

অবনী বলিতে লাগল, ওখানকার কাজ বেশ নির্বিঘ্নেই হোয়ে গেল। কিন্তু রাস্তায় পুলিশ পিছু নিল। মধ্যিখানে এক জায়গায়,—তখন বেলা তিনটে, ক্ষিদেয় প্রাণ ফেটে যাচ্ছে—লাগালাম নৌকো। কিছু খাবার কিনতে ওরা গেল গ্রামের মধ্যে, আমরা জন বারো নৌকোয় বসে রয়েছি। খানিক পরে দেখি ওরা ছুটতে ছুটতে আসছে, পিছনে এক ব্যাটা কনস্টেবল ওদের তাড়া করছে। লাফ দিয়ে ওরাও পড়লো নৌকোয়, কনস্টেবলটাও পড়লো নৌকোয়। নৌকো তখন ছেড়ে দিইছি। কনস্টেবলটার মুখ বেঁধে দিলাম চিৎ করে শুইয়ে। 

খুব জোরেই নৌকো চালিয়েছি। স্টেশনে পৌঁছুতে আরও ঘণ্টা তিনেক দেরী! কনস্টেবলটা কেবল কাকুতি করে। কিন্তু আমরা দেখলাম, ওকে ছাড়িই বা কি কোরে। যেখানে ছাড়বো, সেইখানেই তো ও সব কথা বলে দেবে। 

পরামর্শ সভা বসলো। স্থির হোলো ওকে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ও সমস্ত কথাই শুনতে পাচ্ছিলো। ওকে বললাম, আর এক ঘণ্টা পরে তোমাকে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ওর মুখ বাঁধা। শুনে একবার ও শিউরে উঠলো। তার পরে এক ঘণ্টার মধ্যে ওর চোখ বসে গেল, গাল ভেঙে গেল, হাত-পা অসাড় হোয়ে গেল, এমন কি চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত যেন ঝাপসা হোয়ে গেল। 

যখন ফেলতে যাচ্ছি, তখন প্রাণপণে একবার পা দুটো জড়িয়ে ধরতে এলো। কিন্তু পারলে না। 

সবাই হাসিতে লাগিল। 

মক্ষি বলিল-কি কোরে ফেললে? 

—সম্পূর্ণ অহিংসভাবে। ছোরা মারলাম না, গুলি করলাম না, কোথাও এক ফোঁটা রক্ত পড়লো না,—একটি বড় বস্তার মধ্যে হাত-পা গুটিয়ে পুরে মুখ বন্ধ কোরে একেবারে দামোদরের জলে টুপ্। 

মক্ষি উল্লসিত হইয়া উঠিল। বলিল, বেশ করেছ। 

সবাই হাসিল। 

কেবল একখানি মেঘের আড়ালে চাঁদ যেখানে ডুব-সাঁতার দিতেছিল, সমীরণ একদৃষ্টে সেদিকে চাহিয়া রহিল। কি যেন একটা কথা একবার বলিতে গিয়া থামিয়া গেল। 

তার পানে দৃষ্টি পড়িতেই মক্ষি ব্যঙ্গ করিয়া বলিল,—সমীরণ কাঁদছো? 

মুখ না ফিরাইয়াই সমীরণ একটু হাসিয়া বলিল,—না, কাঁদিনি। সে সৌভাগ্য কি করেছি! 

—তবে? 

—ভাবছিলাম, এর পরে কি? টাকার প্রয়োজন আছে মানি, কিন্তু সে প্রয়োজন মেটাবার এই কি পথ? 

মক্ষি হাসিয়া বিদ্রুপ করিয়া বলিল, তবে কি পথ বলো? 

সমীরণ তার দিকে শান্তভাবে চাহিয়া বলিল, কি যে পথ সে আমিও জানি নে। কিন্তু এতে লোকের আমাদের ‘পরে যে মনোভাব হবে, তা উদ্দেশ্য-সিদ্ধির অনুকূল কিছুতেই নয়। 

মক্ষি বলিল,—না-ই হল অনুকূল। যাদের বাড়ীতে ডাকাতি হবে তাদের সংখ্যা দশ হাজারে একজন। যদি তারা প্রতিকূলে যায়-ই, তাতেই বা কি হবে? 

সমীরণ বলিল,—তাতেও অনেক হবে। ডাকাতি রাজনীতিকই হোক, আর অর্থনীতিকই হোক, সাধারণ লোকের ওপর তার একই রকম ছাপ পড়ে। 

মক্ষি প্রতিবাদে ভালো রকম কি একটা বলিতে যাইতেছিল। কিন্তু সমীরণের মনে বোধ হয় কোথাও ব্যথা জমিয়াছিল। সে বাধা দিয়া বলিল,–কেন যে পড়ে সে তুমি বুঝবে না, মক্ষিরাণী। আমারও আজ বোঝাবার মতো মনের অবস্থা নয়। এ তর্কের মীমাংসা বরং আর একদিন হবে। 

বলিয়াই সে আর দাঁড়াইল না। তর্ তর্ করিয়া সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল। 

সমীরণের সঙ্গে কাহারো মতের মিল নাই। রক্তের নেশায় সবাই ইহারা পাগল। উদ্দাম যা-কিছু, তারি কথায় এদের রক্তে নাচন লাগে। তথাপি, কি জানি কেন, সমীরণ চলিয়া আসার পর সভা আর জমিল না। 

বিমল সভায় উল্লাস সঞ্চার করিবার একটা চেষ্টা করিল। একটা ছোটখাটো বক্তৃতাও দিতে গেল। কিন্তু মধ্যপথেই মক্ষি উঠিয়া পড়িয়া বলিল,—আচ্ছা, আজকে সব বিশ্রাম করো গে। কাল সকালে কালকের প্রোগ্রাম স্থির হবে। 

ঘরে আসিয়াও মক্ষি স্থির হইতে পারিল না। একবার ঘুমাইবার চেষ্টা করিল; ঘুম আসিল না। একখানি বই লইয়া পড়িতে বসিল; ভালো লাগিল না। শেষে ঘরের মধ্যেই খানিকটা পায়চারি করিতে লাগিল। 

সমীরণকে সে আজও বুঝিতে পারিল না। কি চায় সে? উৎসাহের মধ্যখানে সকল- কিছুর উপর এমন করিয়া জল ছিটাইয়া দেয় কেন? তার কি নেতৃত্বের লোভ আছে? মাঝে মাঝে এমন করিয়া সে মক্ষিকে অপদস্থ করে, এমন করিয়া বুঝাইয়া দেয় যে, এ নিতান্ত ছেলেখেলা, এবং তারপরে এমন করিয়া বিজয়গর্বে সরিয়া পড়ে যে, রাগে মক্ষি ভাষা খুঁজিয়া পায় না। 

কখনো কখনো মক্ষি সমস্ত ব্যাপারটিকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করে। সমীরণের মেয়েমানুষ হওয়া উচিত ছিল এই ভাবিয়া হাসিতে চেষ্টা করে; পারে না। সমীরণের একটা কোমলতা আছে, কিন্তু তা মেয়েলি নয়। 

ঘরের মধ্যে মক্ষি থাকিতে পারিল না। দ্বার খুলিয়া ছাদে চলিল। 

গিয়া দেখে, সমীরণ একটা আলিসার উপর বসিয়া দূরের দিকে নির্নিমেষে চাহিয়া আছে,—হাঁটুর উপর হাত দুইটা বদ্ধাঞ্জলি। 

মক্ষির একবার মনে হইল ফিরিয়া যায়। আবার মনে হইল, ভালই হইয়াছে। সমীরণকে নির্জনে তার একবার পাওয়া দরকার ছিল, তার অভিমত স্পষ্ট করিয়া জানা প্রয়োজন। 

সুমুখে গিয়ে দাঁড়াইতেই সমীরণ যেন অকস্মাৎ চমকিয়া উঠিল। বলিল,—কে, মক্ষি? বোসো। 

সমীরণকে কড়া কথা শোনাইবার জন্য মক্ষি কেবল প্রস্তুত হইতেছিল। কিন্তু তার এই চমকিত ভাবে যেন সহজ অবস্থা ফিরিয়া আসিল। 

হাসিয়া বলিল, কি ভাবছিলে? মানুষে মানুষের রক্তপাত কি কোরে করে, তাই?

—রক্তপাত? ও, না, না, আমি ভাবছিলাম,—সমীরণ অকস্মাৎ থামিয়া পড়িল।

সমীরণের ভাবনার কথা জানিতে চাহিবে কি না মক্ষি তাহা ভাবিতে ভাবিতে সমীরণ বলিল, চাঁদনী রাত্রে আমি রোজ ছাদে আসি। চাঁদের আলোর কেমন একটা যাদু আছে। একটু থামিয়া আবার বলিল,—ভাবছিলাম, এই চাঁদের আলোয় যদি আমার পূর্ব জন্মের প্রিয়া কৌমুদীর ঢেউ ঠেলে আজকে হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি বোধ হয় চিনতে পারি। 

সমীরণের চিন্তার বহর দেখিয়া মক্ষি বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া তার দিকে শুধু চাহিয়া রহিল। 

মক্ষির পানে না চাহিয়াই সমীরণ বলিতে লাগিল, যেন ঘুমের ঘোরে-ঘোরে,—এরও আগে লক্ষ দেশে, লক্ষরূপে লক্ষবার জন্মেছি। লক্ষবারই আমার চিরন্তনী প্রিয়া এসে সুমুখে দাঁড়িয়েছে,—একটি বারও চিনতে ভুল হয় নি। আজও যদি আসে—

সমীরণের স্বপ্নবিহ্বল চোখ অকস্মাৎ মক্ষির মুখের উপর নিবদ্ধ হইল, আর ফিরিতে চাহিল না। 

সে দৃষ্টিতে মক্ষির কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হইল। আপনার অজ্ঞাতেই শাড়ীর আঁচল মাথায় দিবার জন্য টান দিল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিয়া বলিল,—নিশ্চিন্ত থাকো সমীরণ, আজকে অন্তত সে আর আসছে না। কিন্তু এ দল তুমি ছাড়ো। 

অকস্মাৎ সমীরণের যেন সম্বিৎ ফিরিল। সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, হুঁ। আচ্ছা মক্ষিরাণী, তুমি কি বিশ্বাস করো, আমাদের দ্বারা ভারত উদ্ধার হবে? 

—করি। 

—আমিও করি। 

মক্ষি এইবার জোর দিয়া বলিল, না তুমি করো না। তোমার মাঝে-মাঝে দুর্বলতা আসে; মাঝে-মাঝে ভয় পাও। 

সমীরণ হাসিয়া বলিল,—দুর্বলতা আসে না, ভয়ও পাই না। মাঝে-মাঝে আমার মধ্যে কেমন যেন সংশয় আসে, কেমন যেন মনে হয়, এ পথ ঠিক নয়। 

—তবে কেন তুমি এ দলে থাকো? 

—কারণ, এর চেয়ে ভালো পথ জানা নেই। আচ্ছা, মক্ষি, তোমাকে হরবিলাসের কথা বলেছি?—মেদিনীপুরের হরবিলাস? 

—না। 

—তাহোলে শোনো- 

সমীরণ ছাদের আলিসার উপর আবার বসিল। মক্ষি বসিল মেঝেতেই। 

—শালবনীর ওদিকে একটা ছোট গ্রামে সে থাকে। কেমন গ্রাম জানো? বড় জোর ২০/৩০ ঘর লোকের বাস। সবাই চাষী। বামুন যারা তারাও করে চাষ। গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি মাত্র রাস্তা, তারই দু’পাশে মাটির ঘরের সারি। রাস্তায় বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা, আর বাকী সময় এক হাঁটু-ধুলো। 

না, গ্রামে মিউনিসিপ্যালিটি নেই এবং জেলাবোর্ডের নজর অতদূর চলে না।

এমনি গ্রামে হরবিলাস থাকে। একখানি দু’কুঠুরী ঘর। তার একখানিতে সে শোয়, আর একখানি-একাধারে রান্নাঘর এবং গোয়াল। 

মক্ষি সবিস্ময়ে বলিল,—গোয়াল? ও কি গরুও পুষেছে না কি? 

—পুষেছে। কেনারাম মণ্ডল তার মুমূর্ষু গাইটিকে ওরই হাতে সমর্পণ করেছে। হরবিলাস প্রাণপণে তার সেবা করে। ওটি ওর একসঙ্গে “গৃহিণী সচিবঃ সখীমিথঃ।” “ললিত কলাও” কিছু কিছু জানা আছে, মনে হোল। 

—দুধ দেয়? 

—না। সে বয়েস তার বহুদিন পার হোয়ে গেছে। হরবিলাসের কিন্তু এখনও আশা আর একটু মোটা করতে পারলে দুধ ও দেবে। সেই অসাধ্য সাধনে ও লেগে গেছে।

ও রাঁধতে রাঁধতে গীতা পড়ে, গাইটি বড় বড় নীল চোখ মেলে ওর পানে চেয়ে থাকে। মাঝে-মাঝে উঠে এসে ও গরুটির কপালে-পিঠে হাত বুলোয়, কত আদরের কথা বলে। রাত্রে ও ঘুমোয়, গরুটি তখন চোখ বুজে রোমন্থন করে। তিন দিন ছিলাম, রোমন্থনের শব্দে চোখের পাতা বুজতে পারিনি। 

বললাম,—যার গরু তাকে ওটি ফিরিয়ে দিও হরবিলাস। মিথ্যে পণ্ডশ্রম কোরো না।

ও বললে,—কি যে বলেন সমীরণদা। এবারে এসে দেখবেন ও ঠিক তিন সের কোরে দুধ দিচ্ছে। আমি গাই চিনি নে? ও কি যে-সে জাতের গরু? ওর মা কত দুধ দিত জানেন? 

আমি বললাম,—ওর মায়ের আমলে টাকায় এক মণ দুধ আর আট মণ চাল পাওয়া যেত। সে তো আজকের কথা নয়। কিন্তু ওর যে দুধ দেবার বয়েস বহুদিন পার হোয়ে গেছে। ও যে বেঁচে আছে এই ঢের। 

আমার কথা ও বিশ্বাস করলে না। 

সমীরণ মৃদু হাসিয়া চুপ করিল। 

তার পর ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল,—কেমন জায়গায় কেমন ভাবে সে থাকে, সে না দেখলে বোঝা যাবে না। মাঝে-মাঝে ভাবি, হরবিলাস তো এক নয়, এমনি হাজার- হাজার সন্তান যে নিজেদের সর্ববিধ আরাম থেকে বঞ্চিত রেখেছে, সমস্ত কামনার দ্বার রুদ্ধ কোরে যারা শুধু দেশপ্রীতির আগুনই বড় করে জ্বালালো, তাদের তপস্যা কি একেবারেই ব্যর্থ হবে? কোথাও কোনো ভরসা যখন পাইনে, তখন ওদের পানে চাই, মনে হয় আশা এখনো রয়েছে। 

চাঁদ তখন পশ্চিমের দিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে। সিঁড়ির দিকে ছাদের উপর কার যেন ছায়া পড়িল, একটি মাথা একবার উকি মারিয়াই অন্তরালে ডুব দিল। 

সমীরণ বলিল, কে রে? 

লোকটা সাড়া দিল না দেখিয়া সমীরণ উঠিতে যাইতেছিল। মক্ষি তার হাত ধরিয়া বাধা দিয়া বলিল,—থাক, আর উঠতে হবে না। আমি জানি ও কে.

সমীরণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার পানে চাহিয়া রহিল। 

মক্ষিরাণী বলিল,—পণ্ডিত মশাই। আমি আরও কয়েকবার দেখেছি, তোমাতে আমাতে এক জায়গায় থাকলেই উনি আড়ি পাততে আসেন। 

সমীরণ বিস্মিতভাবে বলিল,—কেন? 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—সে তো আমার জানার কথা নয়। সকালে বরং ওঁকেই জিজ্ঞেস কোরো। 

জিজ্ঞাসা করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এই বয়সের দুটি নর-নারীকে নিভৃতে দেখিয়া কেহ আড়ি পাতিলে তাহার মনোভাব বুঝিতে কাহারও দেরী হয় না। ‘কেন’ প্রশ্নটি সমীরণ এমনি করিয়া বসিয়াছিল। 

তথাপি এই ঘটনায় সে স্তব্ধভাবে খানিক পায়চারি করিতে লাগিল। কি তার চিন্তা সেই জানে। অকস্মাৎ ছাদের ও-কোণ হইতে মক্ষির সুমুখে আসিয়া বলিল,—কিন্তু আমার চাঁদের আলোর কথায় তুমি অপমানিত হওনি তো? 

মক্ষি বিব্রত ভাবে বলিল—অপমানিত হবো কেন? 

সমীরণ অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে তার ডান হাতে একটি ঝাঁকি দিয়া বলিল,—তুমি বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে অপমান করবার জন্যে কোনো কথা বলি নি। তুমি এমন একটা মুহূর্তে এসেছিলে, যে মুহূর্তে তোমার আসা উচিত হয় নি। তুমি- 

সমীরণ কথাটা শেষ করিতে পারিল না। চঞ্চল হইলে একস্থানে সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে না। ছুটিয়া নীচে চলিয়া গেল। 

.

কাল সমস্ত রাত এক রকম জাগিয়াই গেছে। নিজের ঘরে আসিয়াও মক্ষি ক্রমাগত আবোল-তাবোল ভাবিয়াছে। ভোরের দিকে কখন একটু ঘুম আসিয়াছিল সে নিজেও জানে না। যখন ঘুম ভাঙিল তখন বেলা অনেক হইয়াছে। তবু তার উঠিতে ইচ্ছা করিল না। পাশ ফিরিয়া শুইয়া গত রাত্রের ভুলিয়া-যাওয়া স্বপ্ন একবার মনে করিবার চেষ্টা করিল। ঠিক মনে পড়িল না। যতদূর মনে পড়িল চাঁদ ছিল, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আকাশ ছিল এবং আরও কি কি ছিল। 

দোরের কাছে বসন্ত কয়বারই আসিয়া উঁকি মারিয়া ফিরিয়া গেছে। এবারে উঁকি মারিতেই একেবারে মক্ষির সহিত চোখা চোখি হইয়া গেল। অপ্রস্তুতভাবে সে পলাইবার উপক্রম করিতেই মক্ষি তাকে ডাক দিল! 

বসন্ত আস্তে আস্তে খাটের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মক্ষি কিন্তু কোনো কথাই তাহাকে বলিল না, চোখ বুজিয়া শুইয়া রহিল। 

মক্ষিকে কেমন যেন শ্রান্ত দেখাইতেছিল। 

বসন্ত বলিল,—তোমার কি অসুখ করেছে, মক্ষিদিদি? 

অসুখ ঠিক নয়। তথাপি মক্ষি বলিল,—হ্যাঁ। 

বসন্ত মাথার দিকে বিছানার উপর বসিয়া বলিল,—মাথা কি ব্যথা করছে? টিপে দোব একটু? 

—দে। 

বসন্ত ধীরে ধীরে মক্ষির মাথা টিপিতে লাগিল। জীবনে সে কখনও সেবা পায় নাই। অসুখ তার কমই হইয়াছে। যে কয়বারও হইয়াছে, মেজ-দা কাছে বসিবার সময় বড় পান নাই। তাঁর হাতে চিরদিনই এত কাজ যে, বসিয়া থাকিবার সময় বড় থাকিত না। বসন্তর সেবায় তার যেন ঘুম আসিতেছিল। মাথা তার ধরে নাই, জ্বরও হয় নাই। তবু মনে হইল, মাথা ধরিলেই বুঝি ভালো হইত। 

এমনি ধারা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কাটিল।

হঠাৎ এক সময় বসন্ত ডাকিল,—মক্ষিদিদি! 

এমন স্নিগ্ধস্বরে ডাক মক্ষি কখনও শোনে নাই। একখানি শিথিল বাহু বসন্তর কোলের উপর ফেলিয়া সে শুধু চোখ মেলিয়া চাহিল, কোনো কথা কহিল না। 

বসন্ত বলিল,—সমীরণ-দাকে একবার ডেকে দোবো? 

মক্ষি তার কোলের উপর হইতে হাত সরাইয়া লইয়া বিস্মিতভাবে বলিল, কেন রে?

পণ্ডিত মহাশয়ের মারফৎ গত রাত্রের অনেক কথাই প্রচারিত হইয়াছে। ছেলেমানুষ হইলেও এইটুকু সে বুঝিয়াছে, এই সময় সমীরণ আসিলে মক্ষি হয়তো খুশীই হইবে। 

সে বলিল,—চুপি চুপি? আনবো ডেকে? 

এতক্ষণে মক্ষির গত রাত্রের সমস্ত কথা মনে পড়িল। বুঝিল, কাল রাত্রে চাঁদের আলোয় যে মাথা উঠিয়াছিল, সে বৃথাই ওঠে নাই। 

তথাপি সাধারণ মেয়ের মতো সে উত্তেজিত হইল না। বরং উঠিয়া বসিয়া শ্লথ কবরী ঠিক করিতে করিতে ঠোঁটে হাসি টানিয়া বলিল,—কেন রে? কি হয়েছে আমার? 

—তবে যে বলছিলে তোমার মাথা ধরেছে, অসুখ করেছে? 

মক্ষি হাসিয়া বলিল, তা কি? তোর সমীরণ-দা কি ডাক্তার, যে তাকে ডাকতে হবে? 

এ কথার বসন্ত কোনো উত্তর দিতে পারিল না, মুখ নামাইয়া বসিয়া রহিল।

খানিক পরে বসন্ত বলিল,—ওরা যে বলছিলো, তুমি সমীরণ-দাকে ভালোবাসো?

ভালো তো তোকেও বাসি রে। তা নিয়ে কেউ হিংসে করে না? 

মক্ষি খাট হইতে নামিয়া বলিল,—তোর পড়া তৈরী হয়েছে? 

পড়াশুনার উপর বসন্তর কোনোদিনই স্পৃহা নাই। সে মুখ নীচু করিল। 

মক্ষি বলিল,—আমি মুখ-হাত ধুয়ে আসছি। এই ঘরে বই নিয়ে এসে পড়া তৈরী করো। বুঝলে? 

বসন্ত খানিকটা অনিচ্ছার সঙ্গেই ও-ঘর হইতে বই আনিতে গেল। 

মক্ষির ফিরিয়া আসিতে পনেরো মিনিটের বেশী দেরী হইল না। তখন বসন্ত সুমুখে গ্রামার খুলিয়া রাখিয়া অন্য কথা ভাবিতেছে। 

মক্ষিকে দেখিয়াই বসন্ত বলিল,—সত্যি, ওরা ভারি হিংসুটে, মক্ষিদিদি। তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, এটাও ওরা সইতে পারে না। 

মক্ষি তোয়ালেয় মুখ মুছিতে মুছিতে বলিল,—তাই নাকি? 

বসন্ত জোরের সঙ্গে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ। ওরা আমাকে কি বোলে ঠাট্টা করে জানো? 

কি বলিয়া ঠাট্টা করিতে পারে তাহাই অনুমানে বুঝিয়া মক্ষির মুখ ভয়ে বিবর্ণ হইয়া উঠিল! 

—ওরা বলে আমার নাকি বাপের ঠিক নেই। 

মক্ষি উত্তেজিত ভাবে বলিল,—মিথ্যে বলে। ওরা জানে না। 

নিবিড় মমতায় বসন্তর কাছে বসিয়া তার মাথার চুল ঠিক করিয়া দিতে দিতে মক্ষি বলিল,—কেউ জানুক, না জানুক ভাই, প্রত্যেকেরই বাপের ঠিক আছে। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি এবং সঙ্কীর্ণতর মন নিয়ে মানুষ আর পৃথিবীর কতটুকু খবর রাখতে পারে? যা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তাই যদি উড়িয়ে দিতে হয় তাহলে অর্ধেক বিষয়-বস্তুই বাদ পড়ে যায়। সংসারে পিতৃ-পরিচয়ই সব চেয়ে বড় পরিচয় নয়, বসন্ত। মানুষকে দাঁড়াতে হয় তার নিজের পরিচয়ের ওপর। তা যদি না হতো, তাহলে যীশুর আজ স্থান কোথায়? 

সান্ত্বনায় ও স্নেহস্পর্শে বসন্তর চোখ ফাটিয়া জল পড়িতেছিল। 

মক্ষি আবার বলিল,–কোথাও কুণ্ঠা রাখিস নে ভাই, কিন্তু তোর মধ্যে তোর বাপের কোনো পরিচয় যদি থাকে, তাহলে আমি বলছি, তোর বাপ কারো বাপের চেয়ে ছোট নন। 

কথাগুাল মক্ষি জোরে-জোরেই বলিতেছিল। তার ঘরের সুমুখ দিয়া কজনই যাওয়া-আসা করিল। তাদের মধ্যে বিমলকে ডাক দিতেই বিমল ঘরে আসিয়া বলিল,—তোমার আজ উঠতে দেরী হয়েছে। শরীর খারাপ নাকি? 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—খারাপ ঠিক নয়। কালকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত ছাদে ছিলাম, বোধ হয় সেই জন্যে। 

বিমল শুধু বলিল,—ও। 

মক্ষি বলিল,—দেখ, তুমি কি সমীরণের কাছে যাচ্ছ?

—সমীরণের? না তো। 

—তুমি সমীরণকে একবার এ ঘরে ডেকে দেবে? তার সঙ্গে একটা গোপন পরামর্শ আছে। 

বিমল যাইতে-যাইতে বলিল,—দিচ্ছি পাঠিয়ে। 

কিন্তু তখনই আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল,—তোমাকে বড় শ্রান্ত দেখাচ্ছে, মক্ষিরাণী। তুমি বরং কিছুদিন বিশ্রাম নাও। 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—বিশ্রাম? বিশ্রামের দিন তো এখনো আসে নি। যেদিন আসবে সেদিন নিজেই চেয়ে নোব। আপাতত তুমি সমীরণকে একবার ডেকে দাও। 

তারপরে আপন মনেই বলিল,—সেও বোধ হয় ওঠে নি। দু’জনেই ছাদে ছিলাম কি না। 

বিমল চলিয়া গেল। সকাল বেলায় যে-কথা সে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে শুনিয়াছে তারপরে এমন করিয়া সমীরণকে ডাকিতে বলার স্পর্ধা তাহাকে একটু বিস্মিতও করিল। 

এতক্ষণ ধরিয়া বসন্তু মক্ষির কথাগুলা আপনার মনে অসীম আনন্দে রোমন্থন করিয়াছে আর কাঁদিয়াছে। যে পিতাকে সে কখনও দেখে নাই, যাঁর পরিচয় তার জন্য কেবল লজ্জাই বহন করিয়া আনিয়াছে তাঁরই প্রশংসায় তার চোখের জল আর বাধা মানিতেছিল না। 

কি এক অজানা আকর্ষণে সে মক্ষির কাছে আরও ঘেঁসিয়া আসিল। তার মুখের দিকে চাহিয়া তার কেমন ইচ্ছা হইল, বলিয়া ফেলিল,—মক্ষিদিদি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। 

এতবড় কথা এমন করিয়া আর যেন কখনও শোনে নাই এমনি আগ্রহে সে বসন্তর মাথা বুকের কাছে টানিয়া তার চুলে গোটা দুই নিঃশব্দে চুম্বন দিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল,—সে আমি জানি, জানি। 

.

কয়দিনের মধ্যে মক্ষির একটা পরিবর্তন আসিল। তার চলার ভঙ্গিতে, কথায়, হাস্যে এমন একটা কমনীয়তা ও নমনীয়তা আসিল, যা সকলেরই চোখে পড়ে। সে যেন অনেকটা সহজ হইয়া আসিল। তার দেহের গঠনে, আর চোখের ও ঠোটের দৃঢ়তায়, তার চলার বেগে যে পৌরুষ ছিল এখন যেন তা স্বাভাবিক মনে হইতে লাগিল। 

জীবনের বড় অংশ তার যাদের মধ্যে, যে আবেষ্টনীতে গঠিত হইয়াছে তাহাতে নিজেকে চিনিবার বড় বেশী সুযোগ সে পায় নাই। সকলের সঙ্গে সে জিমন্যাস্টিক করিয়াছে, গদা ঘুরাইয়াছে, দৌড়-ঝাঁপ খেলিয়াছে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পুরুষে হার মানিয়াছে। ভগিনীর পৌরুষে মেজ-দা গর্ব অনুভব করিয়াছেন। সে গর্বের আনন্দ তারও মনকে স্পর্শ করিয়াছে। সে আরও উৎসাহে খেলায় যোগ দিয়াছে। 

জীবনে নারীর সংস্পর্শলাভ কখনও তার ঘটে নাই। নারীমনের স্নেহস্পর্শও পায় নাই। নিজের পানে চাহিয়া দেখে নাই, দেখিবার অবসর পায় নাই। বিশ্বপ্রকৃতির দিকে সে কেবল রিভলভার উঁচাইয়া ফিরিয়াছে। 

এমন সময় বসন্ত তাকে যে পৃথিবীর সন্ধান দিল তাহা তার জীবনে একেবারে অপূর্ব ও অভিনব। এ পৃথিবীতে একটা জাতি আর একটা জাতির বুকের উপর চাপিয়া পিষিয়া মারিতে উদ্যত হয় না, কাহারো কোনো বিদ্বেষ নাই, প্রতিযোগিতা নাই, এখানে একজন শুধু আর একজনের কাছে ঘেঁসিয়া আসিতে চায়, পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে, মুক্ত আকাশের তলে শুধু ক্ষণকালের সঙ্গ মাগে। এ পৃথিবীর পানে পিস্তল উঁচাইয়া চলা শুধু নিষ্ঠুরতা নয়, অত্যন্ত কদর্যতার চিহ্ন। 

আজ তার মেজ-দাকে মনে পড়িল। যেদিন তিনি তেতালার ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হন, সেদিন তার বুকে এতটুকু বাজে নাই। তখন গগনস্পর্শী স্পর্ধা তাকে এমনই করিয়া ভর করিয়াছিল। আকারে-ইঙ্গিতে সে তখন এই ভাবই প্রকাশ করিয়াছে যে, যাইতেছ, যাও; কিন্তু তোমার পথ যে ভ্রান্ত এ আমি দু’দিনে প্রমাণ করিব। 

মত তার আজও বদলায় নাই। নিজের মতের উপর শ্রদ্ধাও এতটুকু কমে নাই। তথাপি, যে-অশ্রুকে সে চিরদিন বিদ্রুপ করিয়া আসিয়াছে নিরুদ্দিষ্ট মেজ-দার কথা স্মরণ করিয়া তারই দুইবিন্দু চোখের কোণে জমিয়া উঠিল। তাহার গলার হারের লকেটে মেজ- দার যে ছোট ছবিটি ছিল তাহাই বারম্বার কপালে ঠেকাইয়া বলিল,—তুমি যেন ভালো থাকো, তুমি যেন ভাল থাকো। বাংলার দুর্দান্ত বিপ্লবী দলের রাণী আজ অতি সাধারণ মেয়ের মতো তার মেজ-দার দেহের কল্যাণই কামনা করিয়া বসিল। 

দুর্বলতাকে সে শুধু বিদ্রুপ নয়, ভয়ও করিয়া আসিয়াছে। তাই নিজের মধ্যে কোথাও দুর্বলতা দেখিলে সে যেন নিজের ‘পরে প্রতিশোধ লইবার জন্য দ্বিগুণ কঠোর হইয়াছে। এমন কঠোর হইয়াছে যে, তত কঠোর হওয়া পুরুষেরও মানায় না। তার মনে পড়িল, তার অতি কঠোরতায় মেজ-দা মৃদু মৃদু হাসিতেন, কিন্তু মুখে কিছু বলিতেন না। মেজ- দার হাসি দেখেই সে রাগই করিত। 

অতীত স্মৃতি লইয়া নাড়া-চাড়া করিতে করিতে মেজ-দার এই হাসি তার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। সে একেবারে মুঠা বদ্ধ করিয়া সোজা হইয়া বসিল। উপেক্ষা সে কখনো সহিতে পারে না, সস্নেহ উপেক্ষাও না। 

নিজের ঘর হইতে সটান সভাগৃহে গিয়া সকলকে ডাক দিল। 

সবাই তখন উপরে বসিয়া তারই সম্বন্ধে অপ্রীতিকর আলোচনা করিতেছিল। যে বিমল সমীরণের মতের বিরুদ্ধে একরূপ জোর করিয়াই মক্ষিকে নেত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে, কি জানি কেন, সেই সব চেয়ে বেশী ক্রুদ্ধ হইয়াছে। কতকটা বিমলের বক্তৃতায় এবং কতটা মক্ষির প্রতি বিতৃষ্ণায় স্থির হইল, অতঃপর পণ্ডিত মহাশয়কেই নেতৃপদে অভিষিক্ত করা হইবে। 

কিন্তু পণ্ডিত মহাশয়ের কি একটা আপত্তি ছিল। তিনি বিমলের নাম প্রস্তাব করিলেন। বিমল একটু ইতস্তত করিয়া শেষ পর্যন্ত রাজিই হইল। 

এমন সময় মক্ষির ডাক আসিল। প্রথমটা সবাই গুম হইয়া বসিয়া রহিল। তারপরে কখন যে একে-একে সকলেই সভাগৃহে উপস্থিত হইল তাহা নিজেরাই জানিতে পারিল না। 

কিন্তু এত কথা মক্ষি জানিত না। এ সমস্ত সংবাদ রাখিবার কোনো প্রবৃত্তিও তার ছিল না, এবং এতগুলি লোক যে ভিতরে-ভিতরে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে সে সন্দেহও তার মনে আসে নাই। 

প্রথমে সে সমীরণকে প্রশ্ন করিল,—কত ছেলে তুমি সংগ্রহ কোরেছ তার একটা হিসাব এখন দিতে পারো? 

—প্রায় তিন শো। 

—প্রায় তিন শো।-তারপরে বিমলের দিকে চাহিয়া বলিল-তোমার আয়োজন কি রকম? 

বিমল বলিল,—এখনই হিসাব দেওয়া মুশকিল। 

তার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া মক্ষি কি-যেন একটু ভাবিল, তারপর বলিল,—আজ দুপুরে সে হিসাব আমার চাই। আচ্ছা, এই তিন শো ছেলে নিয়ে আর তোমার যা আয়োজন আছে তার সাহায্যে তুমি কি কাজ করতে পারো? 

বিমল চুপ করিয়া রহিল। 

মক্ষি আবার বলিল, মনে কর, যদি তোমার ওপরই ভার দেওয়া হয়?

বিমল বীরদর্পে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,—এই সৈন্যদল নিয়ে আমি সম্মুখ যুদ্ধ পর্যন্ত করতে পারি। 

সমীরণ বিস্মিত ভাবে বলিল,—সম্মুখ যুদ্ধ? 

সমীরণের পরিহাসে বিমল ক্রোধে আত্মহারা হইল, বলিল,—হ্যাঁ, সম্মুখ যুদ্ধ। তুমি যা পারো না, তা অনেকে পারে, যারা মরণের ভয় রাখে না! আমরা চাঁদের আলোর স্বপ্ন দেখিনে; রক্তের সমুদ্রে সাঁতার দেওয়া ছাড়া আর কোনো কামনা আমাদের নেই! 

বিমল হাঁপাইতে লাগিল। তারপর নিজেকে শান্ত করিয়া বলিল,—সম্মুখ যুদ্ধ মানে, গরিলা যুদ্ধই আমি মনে করেছি। ইংরাজের কামান-বন্দুক এরোপ্লেনের বিরুদ্ধে সামনা- সামনি যুদ্ধ করতে চাইব এমন বোকা আমি নই, যদিও তাও আমি পারি। 

মক্ষি বলিল,—এ সম্বন্ধে তোমার কোনো পাকা স্কীম আছে? 

—আছে। 

—আচ্ছা, আজ সন্ধ্যেয় ছাদের ওপর আবার আমাদের সভা বসবে, সেইখানে তোমার স্কীম নিয়ে আলোচনা করা হবে। 

তারপর পণ্ডিত মহাশয়ের পানে চাহিয়া বলিল,—পণ্ডিত মশাই, আপনার কি মত?

পণ্ডিত মহাশয় কোনো মতই জানাইলেন না। 

মক্ষি সমীরণের দিকে চাহিয়া তাহাকে কিছু বলিবার ইঙ্গিত করিল। 

সমীরণ বলিল,—ইংরাজের সঙ্গে সম্মুখে অথবা পশ্চাতে কোনোদিন সত্যিকার যুদ্ধ হবে একথা আমি ভাবিও নি। এ দেশ পরাধীন অবস্থায় কোনোদিন তার যোগ্য হবে না। আমি যা ভেবেছি সে এই যে, আমাদের সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে শুধু ইংরাজকে ভয় দেখাবো, দেশে একটা অশান্তি সৃষ্টি করবো, যেখানে পাবো সরকারী তহবিল লুঠ করে শাসন-যন্ত্র অচল করে তুলব। 

পণ্ডিত মহাশয় টিপ্পনী কাটিলেন, এবং তারপরে দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে সবার ওপর এমন অত্যাচার হবে যাতে করে দেশের প্রত্যেকের জীবন দুর্বহ হয়ে উঠবে এবং তাদের সমবেত অভিশাপে দেশের নামে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি দু’দিনে শূন্যে মিলিয়ে যাবে। 

সশস্ত্র বিপ্লবে আন্তরিক শ্রদ্ধা আছে। সে উত্তেজিতভাবে বলিল,—তা হলে তো বিপ্লব আন্দোলন করাই চলে না। 

পণ্ডিত মহাশয় হাসিয়া বলিলেন,—চলেই না তো। মেজ-দা চলে গেলেন, কিন্তু শুধু এই কথাটা বোঝাবার জন্যে আজও আমি রয়ে গেলাম। 

 তীরের বেগে দাঁড়াইয়া সমীরণ বলিল,—আপনি তাহলে এ পথ সমর্থন করেন না?

পণ্ডিত মহাশয় তেমনি হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন,—না ভাই, না। আমি এ পথ বিশ্বাসই করি না। 

চক্ষের পলকে বিমলের রিভলবার তাঁর মাথার দিকে উঁচু হইয়া উঠিল।

মক্ষি ইঙ্গিতে তাহাকে বসিতে বলিল। 

পণ্ডিত মহাশয় বলিতে লাগিলেন,—ভয় দেখাতে চাও দেখাও, কিন্তু তোমরা তো জানো, আমি ওতে ভয় পাই নে। পেলে এ পথ মাড়াতাম না। আমি উঠলাম। কিন্তু আজ সমস্ত দুপুর ভেবে দেখে তবে ইতিকর্তব্য স্থির কোরো। 

পণ্ডিত মহাশয় উঠিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। সভা নিস্তব্ধ। 

এবং সে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া মক্ষি আদেশ দিল,—এখন এই থাক। সন্ধ্যের সময় আবার সভা বসবে। সে সভায় পণ্ডিত মহাশয়েরও থাকা প্রয়োজন। তিনি যেন বাইরে না যান। 

কিন্তু বাহিরে যাওয়ারই প্রয়োজন হইল, শুধু তাঁর নয় সকলেরই। 

ঠিক সূর্যাস্ত বেলার কাছাকাছি সংবাদ আসিল, পুলিশ কাল ভোরেই বাড়ী ঘেরাও করিবে। 

সংবাদটি এতই আকস্মিক যে, পণ্ডিত মহাশয় হইতে আরম্ভ করিয়া সকলেরই মুখ শুকাইয়া উঠিল। ঘটনা এমন কিছু নয়। ধরা পড়িবার সম্ভাবনা এবং তাহার পরের প্রক্রিয়াগুলির জন্য সকলেই বরাবর অল্প-বিস্তর প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু আজই যে তাহারা ধরা পড়িতে পারে এই কথাটি বোধ হয় কেহ ভাবে নাই। 

কাল সকালে ঘেরাও করিলেও এখন হইতেই পুলিশে বাড়ীটির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিতেছে। আগে হইতেই সমস্ত ব্যাপার তাহারা জানিতে পারিয়াছে বাহিরে তাহার কোনো লক্ষণ দেখাইলে চলিবে না। 

স্থির হইল, ছোটদের এক এক করিয়া বাহিরে পাঠাইয়া দেওয়া হইবে। তারপরে সময় থাকে বড়রা পলাইবে। নতুনবা এইখানেই একটা খণ্ডযুদ্ধ হইয়া যাইবে। জয়- পরাজয় যাহা কপালে আছে তাহাই হইবে। 

যাওয়ার সময় বসন্তটা বড় কাঁদিল। তথাপি তাহাকে যাইতেই হইল। সকলেরই বুক অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু করিতেছিল। ভালো করিয়া বিদায় দিবার এবং বিদায় লইবার মতো মনের অবস্থা কাহারও নয়। 

রাত্রি ন’টার সময় যখন জানা গেল, ছেলেরা নির্বিঘ্নে স্ব-স্ব গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়াছে, তখন সকলেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল। আর জন দশেক বাকী রহিল, এইবারে তাহাদের ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হইবে। 

অস্ত্রশস্ত্র, গুলি-বারুদ যেখানে আছে সেখান হইতে বাহির করিতে পুলিশের দশ বৎসর লাগিবে। সেগুলি সেইখানেই রহিল। সকলে কেবল আত্মরক্ষার উপযোগী অস্ত্রশস্ত্ৰ নিজের নিজের কাছে রাখিল। স্থির হইল, এইবারে তাহারা নিজেরা পলায়নের পথ দেখিবে। 

পথ আর নূতন কিছু নয়। পাশের বাড়ীগুলির ছাদের উপর দিয়া ও-রাস্তায় পড়িতে হইবে এবং সেখান হইতে ট্যাক্সি করিয়া সটান হাওড়া স্টেশন 

রাত তখন একটা। 

এমন সময় বাহিরের দরজায় কে কড়া নাড়িল। বারান্দা দিয়া উঁকি মারিয়া বিমল দেখিল- সুমুখের দিকটা লাল পাগড়ী মাথায় পুলিশ গিস গিস্ করিতেছে। আগে হইতেই উহারা বোধ করি ব্যাপারটার আঁচ পাইয়াছিল। 

ঘরের মধ্যে যাহারা পলায়নের আয়োজন করিতেছিল একমুহূর্তে তাহারা স্তব্ধ হইয়া গেল। 

পুলিশ নীচে তখন কড়া নাড়া ছাড়িয়া দিয়া দরজা ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে।

এদিকে নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া এই কয়টি লোকের রূপ একেবারে বদলাইয়া গেল। 

কেহ না বলিলেও বোঝা গেল, যুদ্ধ ছাড়া উপায় নাই এবং পাঁচজনকে বাঁচাইতে হইলে আর পাঁচজনকে মরিতেই হইবে। নহিলে কাহারও নিষ্কৃতি নাই। 

এক মুহূর্তে সকলের চোখে ধক ধক করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল। এবং নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিমল যে কাণ্ড করিয়া বসিল তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। 

অকস্মাৎ মক্ষির একখানা হাত তার আবেগ-কম্পিত করতলে গ্রহণ করিয়া সে বলিল,—এই নিশ্চিত মৃত্যুর পূর্বাহ্ণে একটা চুমু দেবে মক্ষি,–একটি মাত্র? আমি জানি- 

কিন্তু কি যে সে জানে তাহা আর শেষ করিল না। বোধ হয় সমীরণের প্রতি মক্ষির প্রেমের কথাই বলিতে যাইতেছিল। তার স্পর্শে মক্ষির চোখের আগুন মলিন হইয়া গেল, তার সমস্ত দেহ মার্বেলের মতো ঠাণ্ডা হইয়া উঠিল, এবং বিমল যেন একটা মর্মর মূর্তিকে গভীর আবেগে আলিঙ্গন করিয়া সকলের চোখের সুমুখে সেই পাণ্ডুর, মৃতের মত শীতল ওষ্ঠে, কপোলে এবং ললাটে উপর্যুপরি কয়েকটা উত্তপ্ত চুম্বন আঁকিয়া দিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। রহিল কেবল সমীরণ আর বিপ্লবীদের রাণীর অসাড় নিস্পন্দ দেহ। 

মুহূর্তের মধ্যে নীচে গুডুম গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ উঠিল এবং বহু কণ্ঠের চীৎকারে ও ধোঁয়ায় নিশীথ রাত্রির রূপ কদর্য হইয়া উঠিল। 

আর এক মিনিট অপেক্ষা করা চলে না। সমীরণের চোখ দুইটা বাঘের মতো জ্বলিয়া উঠিল। চক্ষের পলকে সে মক্ষির দেহ দুই বাহুর মধ্যে তুলিয়া লইয়া পাশের বাড়ীর ছাদে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেও লাফাইয়া পড়িল। 

নীচে তখনও চলিতেছে—গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম। 

মাটিতে আঘাত পাইয়া মক্ষি যেন সচেতন হইল। 

ত্বরিতে দাঁড়াইয়া উঠিয়া দু’জনে পর-পর গোটা কয়েক বাড়ীর ছাদে কোথাও লাফাইয়া উঠিয়া, কোথাও লাফ দিয়া পড়িয়া ও-রাস্তায় পৌঁছিতেই সুমুখে পুলিশ। 

সে বেচারা গলির মোড়ে লাঠিতে ভর দিয়া ঝিমাইতেছিল। লাফ দেওয়ার শব্দ পাইয়াই ছুটিয়া সেই অন্ধকার গলির মধ্যে উপস্থিত হইল। 

মক্ষি রিভলবার বাহির করিতে-না-করিতে সমীরণ পুলিশটার রগ ঘেঁষিয়া এমন একটা ঘুসি মারিল যে কোনো শব্দ করিবার পূর্বেই গোটা দুই পাক খাইয়া সে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। বেচারা এই অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। 

এই অবসরে তাহারা ছুটিয়া বড় রাস্তায় পড়িল এবং একখানা ট্যাক্সি করিয়া সটান সহরের বাহিরের একটা স্টেশনে দৌড় দিল। 

ট্যাক্সি বিদায় করিয়া দু’জনে স্টেশনের বাহিরে অন্ধকারে বসিয়া বসিয়া কতক্ষণ প্রহর গণিল কে জানে, তার পরে টিকিটের ঘণ্টা বাজিল। 

.

বহুদূরের একটা স্টেশনের টিকিট কিনিয়া দু’জনে যখন গাড়ীতে উঠিল তখন দেহ যেন আর বয় না। 

চাঁদের আলোয় কোথাও উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর দিয়া, কোথাও জঙ্গলের মধ্য দিয়া, কোথাও টানেলের অন্ধকার ভেদ করিয়া ট্রেন চলিল। এ চাঁদের আলো তাহাদের চোখে পরিচিত মনে হইল না। এমন জ্যোৎস্না তাহারা যেন কখনও দেখে নাই। এ যেন এ পৃথিবীর নয়। 

এ কোন্ মৃত্যু-জগতের মধ্য দিয়া মৃতের জীবন যাপন করিতে চলিয়াছে তাহারা!

ট্রেন চলিয়াছে- 

ভোর হইল। 

কিছু পরে বেলা বাড়িল। 

দু’ধারে লাল প্রস্তরাকীর্ণ মাঠ। তারই উপর অপরিচিত জগতের ততোধিক অপরিচিত মধ্যাহ্ন—তীব্র, রুক্ষ, নিষ্ঠুর। 

গাড়ী দুলিয়া দুলিয়া চলে। তারই সঙ্গে তাদের চিত্তও অভিনব আশঙ্কায় দুলিয়া- দুলিয়া ওঠে। 

মাঝে মাঝে গাড়ী-বদলও করিতে হয়। 

নূতন ট্রেন আবার তাহাদের নূতন লোকে বহিয়া লইয়া চলে। 

তখনও তাহাদের কানে বাজিতেছে গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম। মনে হয়, তাহাদেরই পাশে-পাশে সমান্তরালভাবে সেই কয়টি মৃত্যু পথযাত্রীর গাড়ীও চলিয়াছে। দুইটা গাড়ী কোথায় মিলিবে কে জানে! 

চোখের সম্মুখে ধূলিয়ান অপরাহ্ণ। এ জগতে যেন কিছুই স্পষ্ট করিয়া দেখা যায় না,—সবই ঝাপসা। 

গভীর রাত্রে একটা স্টেশনে তাহারা হঠাৎ নামিয়া পড়িল। ছোট স্টেশন; দু’ধারে ঘন অরণ্য চাঁদের আলোয় মৃত্যুর দিকে হাতছানি দিয়া পথিককে ডাকে। 

সেই অরণ্যের মধ্য দিয়া দু’জনে নিঃশব্দে চলিল। 

পাহাড়ে পথ, ক্রমাগত আকাশের দিকে চলিয়াছে। নীচে দু’পাশে নিবিড় বন।

রাত্রি কত কেহ জানে না। কত পথ যে আরও বাকী আছে তাহাও অজ্ঞাত।

দূরে কোথাও পাহাড়ের উপর, কোথাও নীচু জমিতে মাঝে-মাঝে আগুন জ্বলিতেছে। লোক দেখা যায় না, শুধু আগুনের শিখাই নজরে পড়ে। পথ চলিতে চলিতে দুটি মুসাফের চাহিয়া-চাহিয়া দেখে। কিসের আগুন বুঝিতে পারে না। দিকে-দিকে এত আগুন কাহারা ছড়াইল জানিতে ইচ্ছা হয়। 

চারিদিকে শব্দ ওঠে খট, খট্। কাঠুরিয়ার কাঠ কাটার শব্দ। 

ইহারা অবাক হইয়া ভাবে, এই নিস্তব্ধ রাত্রে ইহারা কি সকলের অগোচরে পৃথবীটাকে রাতারাতি ভাঙিয়া ফেলিতে চাহে? 

মাঝে-মাঝে ওদিক হইতে কাহারা যেন ডাক দেয়। এদিক হইতে তাহার সাড়া যায়। আবার এদিক হইতে ডাকে ওদিক হইতে সাড়া আসে। যেন বলিতে চায়, ভয় নাই, এখনও বাঁচিয়া আছি, বাঁচিয়া আছি। 

ইহাদের ইচ্ছা হয়, ইহারাও সে ডাকের সাড়া দেয়, জানায় যে, ইহারাও বাঁচিয়া আছে। 

কিন্তু সাড়া দিতে পারে না, কণ্ঠে স্বর ফোটে না। 

শুধু নিঃশব্দে পথ চলে। 

.

পাহাড়ের চূড়ায় যখন পৌঁছিল তখন ভোর হওয়ার বেশী দেরী নাই। 

একখণ্ড পাথরের উপর সমীরণ বলিয়া পড়িল। 

মক্ষির দেহ তখন ভাঙিয়া পড়িয়াছে! তার চোখে যেন কোন্ স্বপ্নলোকের শ্রান্তি। চিরটা কাল সে নারীর স্নায়ু পুরুষের ধনুকে যোজনা করিয়া পুরুষেরও আগে দাঁড়াইয়া কেবলি টঙ্কার দিয়া ফিরিয়াছে। জ্যা-মুক্ত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সে বুঝিল, তাহার স্নায়ুতে কতটা টান বাজিয়াছে। দেহ পুরুষের মতো বলিষ্ঠ, সাহস অপার, কর্মশক্তি প্রচুর; কিন্তু অত সূক্ষ্ম স্নায়ু, অত বেশী টান সহিতে পারে না। সে একেবারে এলাইয়া পড়িল। 

নিজের অসীম শ্রান্তির মধ্যেই সমীরণ তার শ্রান্ত দেহ কোলের উপর তুলিয়া লইল। মক্ষি বাধা দিল না, একবার সেই পাণ্ডুর দুর্বল চন্দ্রালোকের পানে চাহিয়া চোখ বন্ধ করিল। সমীরণ অঞ্চল দিয়া তার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল; নিজের কপালের ঘামও ক্লান্তভাবে মুছিল। তারও শরীর ঢলিয়া পড়িতেছিল। সেদিন সমস্ত দিন-রাত্রি এবং পূর্বদিনের সমস্ত রাত্রি সম্পূর্ণ অনাহারে কাটিয়াছে। কিন্তু ক্ষুধাতৃষ্ণার চিহ্নমাত্র ছিল না। ট্রেনে কামরার এক কোণে চোখ বুজিয়া সেই যে মক্ষি বসিয়াছিল আর চোখ মেলে নাই। কোথাও সম্পূর্ণ ঠেসাঠেসি, কোথাও সম্পূর্ণ নির্জন কামরা, কিন্তু কেহ কাহারো সহিত একটা কথাও কহে নাই। স্টেশনের পর স্টেশন আসিয়াছে, আবার অদৃশ্য হইয়া গেছে। কিন্তু সমীরণ সেই যে জানালার বাহিরে সুমুখের দিগন্তপ্রসারিত মাঠ ও বনানীর পানে চাহিয়া একধারে বসিয়াছিল তারপর মাঝে-মাঝে ট্রেন-বদলের সময় ছাড়া আর একবারও ওঠে নাই, চোখের পাতা একবারও বুজিয়াছিল কিনা তাহাও মনে করিতে পারে না। তার চোখ জ্বালা করিতেছিল। পিছনের একটা পাথরে ঠেসান দিয়া সেও ঢুলিয়া পড়িল। 

যখন তন্দ্রা ছুটিল, তখন সবে সূর্য উঠিতেছিল। 

তার মনে হইল, এতক্ষণে কাল-রাত্রির অবসান হইল বুঝি। ওই বুঝি নবজীবনের সূর্য উঠিল। 

এই নবপ্রভাতের সম্মুখে তার কেমন লোভ হইল, অতি ধীরে মক্ষির মসৃণ ললাটে একটি চুম্বন দিল। 

সে চুম্বনে মক্ষি জাগিয়া উঠিয়া বড়-বড় চোখ মেলিয়া চাহিল। একবার পাশ ফিরিয়া শুইবার চেষ্টা করিল। পরক্ষণেই পূর্বাকাশের পানে চাহিয়া যেন নিজের মনেই বলিল, 

—এতক্ষণ ভোর হোল? 

তার কথার পুনরাবৃত্তি করিয়া সমীরণ বলিল,—এতক্ষণে ভোর হোল। 

দু’জনেই কিছুক্ষণ সূর্যোদয়ের পানে নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। 

মক্ষি বলিল,—তোমার কোলে শুয়ে আরও একটু ঘুমুবো? 

—আরও ঘুমুবে? এবারে কি- 

মক্ষি তার দিকে ফিরিয়া চিরকালের নারীর মতো দুটি বাহু দিয়া তার কটি বেষ্টন করিয়া বলিল, না, ঘুম নয়। আর ঘুম আসবে না। তোমার কোলে শুয়ে আমার আরও একটু যেন বিশ্রাম চাই। 

মক্ষির চোখ বন্ধ হইয়া আসিল। তার মুখে তখনও অনশনখিন্ন ব্রতচারিণীর পাণ্ডুরতা। সে সুষমার পানে সমীরণ মুগ্ধ চোখে নির্নিমেষে চাহিয়া রহিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *