নিশিভোর

নিশিভোর 

অবশেষে কাল-রাত্রির অবসান হইল। 

আরও কিছুদিন কখনও বনে-জঙ্গলে, কখনও লোকালয়ে ঘোরাঘুরির পর মধ্যপ্রদেশের একটা ছোটো সহরে তাহারা বাসা বাঁধিল। 

কলিকাতার খণ্ড যুদ্ধে বিমল, পণ্ডিত মহাশয় প্রভৃতি সকলেই, কেহ পুলিশের গুলিতে, কেহ বা আত্মহত্যা করিয়া মানুষের বিচারের হাত হইতে অব্যাহতি পায়। কেবল একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশে গ্রেপ্তার করে এবং তাহারই বিকারের টুকরা-টুকরা উক্তি হইতে প্রথমে পাঁচজনকে, তারপর আরও বিশজনকে গ্রেপ্তার করে। 

এই পঁচিশ জনেরই বিচার চলিতেছিল। এবং প্রতিদিন সংবাদপত্রে সরকারী সাক্ষীর মুখে এমন-এমন রহস্য প্রকাশিত হইতেছিল যাহা বিপ্লবীদলের কেহ কখনো কল্পনাও করে নাই। 

এমনি অবস্থায় সমীরণ ও মক্ষি বাসা বাঁধিল মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট সহরে।

বাজারের মধ্যে খাপরার একখানি ছোট বাড়ী। বাহিরের ঘরে একখানি কাপড়ের দোকান, সেখানে থাকে সমীরণ, আর ভিতরে রান্নাঘরে থাকে মক্ষি, রাঁধে, বাড়ে, খায়। 

তাম্রকূট সেবনের লোভে পুলিশগুলি মাঝে-মাঝে আসে। সমীরণ পরম সমাদরে বাহিরে গোটা কয়েক টুল পাতিয়া তাহাদের বসায়, তামাকু’ সেবন করায় এবং নানাবিধ সুখ-দুঃখের গল্প করে। 

মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পরে বড় দারোগাবাবুও আসেন। মারাঠার দেশে বহু মারাঠার ভিড়ের ভিতর দিয়া এই বাঙ্গালীটি কেমন করিয়া এত বড় পদ পাইলেন এই প্রায় নিরক্ষর, নবাগত বাঙ্গালীটিকে তাহা প্রায়ই বুঝাইয়া দেন। 

এত বড়-বড় কথা যেন ঠিক বুঝিতে পারিতেছে না এমনি ভাবে সমীরণ হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে। আর তার বিস্ফারিত চোখের সুমুখে বড় দারোগাবাবু ভুঁড়ি দুলাইয়া-দুলাইয়া ফিলজফি হইতে কেমিস্ট্রি পর্যন্ত সমস্ত শাস্ত্রের আদ্যশ্রাদ্ধ করিয়া চলেন। 

কথার মাঝে সমীরণ বলে,—তবেই দেখুন বড়বাবু, আপনারা এল. এ., বি.এ. পাশ, তাও চাকুরী পেতে কষ্ট। আর আমরা মুরুক্ষু-সুরুক্ষু মানুষ, আমাদের তো—হেঁঃ হেঁঃ—সমীরণ বোকার মতো দাঁত বাহির করিয়া হাসে। 

বড় দারোগাবাবু ভারিক্কি চালে মাথা নাড়েন। 

সমীরণ তাঁহার করুণা উদ্রিক্ত করিয়া বলে,–দেশে আর ভাত মিললো না বড়বাবু। ভাবলাম, মিথ্যে পড়ে-পড়ে উপোস কোরে লাভ নেই। মেটে ঘরের মায়া না করে দিলাম ‘জয় দুর্গা’ বলে পাড়ি। কোনো রকমে এই কাপড়ের দোকানখানি তো করেছি, গহনা- পত্তর যা ছিল সব বিক্রি করে। এটি যদি যায় তাহলেই তো—

সমীরণ হাতের তালু উল্টাইয়া অদৃষ্টের স্বরূপ বর্ণনা করে। 

—সেই তো মুশকিল হে। তা, তুমি কি মেয়েছেলে সব নিয়েই এসেছ?

বড়বাবু জানালার ফাঁক দিয়া ভিতরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার চেষ্টা করেন।

সমীরণ দাঁত বাহির করিয়া বলে,—কাজেই। সেদিকেও সব সাবাড় কিনা। ন মাতা, ন পিতা, কেউ কোথাও নেই,—হেঁঃ হেঁঃ- 

বড়বাবু করুণা-মাখানো গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলেন,—তাই তো হে, গোপাল—

সমীরণ নিজের কথা পাল্টাইয়া দিয়া আবার বড়বাবুর প্রসঙ্গ আনে। 

বড়বাবু বলেন,—আমারও এ ছাই আর ভালো লাগে না। কেবল একে ধরো, ওকে মারো, এসব আমি পারিও না, করিও না। কিন্তু চাকরী তো রাখতে হবে? না, কি বল?

সমীরণ আবার এক কলিকা তামাক সাজিয়া আনিয়া বলে,—কি যে বলেন বড়বাবু, আপনাদের তো সুখের চাকুরী; রাজার মতো আছেন। এমন চাকরী ছাড়ে? 

বড়বাবু উৎফুল্ল হইয়া বলেন,—তা ঠিক। 

পরক্ষণেই গলা নামাইয়া বলেন,—তবে কি জানো? দিনকাল বড় খারাপ পড়েছে। ছোঁড়াগুলো গোলা-গুলি নিয়ে ক্ষেপে দাঁড়িয়েছে। চাকরী তো বেশ ভালই ছিল, তারাই যত গোল পাকিয়েছে। তাও বলি, তোদের বাপু- 

বড়বাবুর মুখের কথা লুফিয়া সমীরণ বলে,—এই কথা, বড়বাবু। চাল আক্রা, ডাল আক্রা, তার মধ্যে তোরা আবার ঝঞ্ঝাট বাড়াস কেন বাবা। লেখাপড়া শিখছিস শেখ, না শিখছিস নেই নেই,—চাকরী-বাকরী দেখ, বাপ-মায়ের দুঃখ দূর কর। তা নয়- 

সমীরণের সরলতায় বড়বাবু হো হো করিয়া হাসিয়া ওঠেন। বলেন, ওহে গোপাল, সবাই যদি তোমার মতো হত তাহলে আর ভাবনা ছিল কোথায়? কিন্তু তাও বলি, তোমার ওপরও প্রথমে নজর পড়েছিল। আমারই ওপর তো ভার। আমি তোমাকে দেখেই বুঝলাম, হুঁ হুঁ বাবা, এই করতে করতে পঞ্চাশ বছর পার করলাম। 

তারপরে গলার স্বরে গাম্ভীর্য আনিয়া কহিলেন,–তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিই। যার নাক দেখবে বড়, একেবারে ঠোঁটের ওপর ঝুলে পড়েছে তার সঙ্গে মিশবে না-কদাপি না—

বলিয়া টুলটার উপর নড়িয়া-চড়িয়া বসিলেন। 

—কলকাতায় যারা ধরা পড়েছে তাদের দেখে এলাম কি না, প্রত্যেকের নাক বড়, আর ইয়া-ইয়া গোঁপ,—যেন এক-একটা ডাকাত। 

হাওয়া লাগিয়া জানালায় খুট করিয়া শব্দ হইতেই বড়বাবু সেদিকে একবার আড়চোখে তাকাইয়া লইলেন এবং কলিকাতার ডাকাতদলের কথা ভুলিয়া গিয়া কহিলেন,—বড় নাকওয়ালা লোক, বুঝেছ,—

সমীরণ সাগ্রহে বলিল, ও আর বলতে হবে না বড়বাবু। বড় নাকওয়ালা লোককে আমি আর চৌকাঠ মাড়াতে দিচ্ছি নে। কাপড় কিনতে চাও, বাহিরে বোসো, কাপড় কেনো, নগদ দামটি ফেলে দাও—ব্যস। 

বলিয়া চট্‌ করিয়া একখানি ছোট ডুরে শাড়ী বাহির করিয়া সেখানিকে অতি যত্নে ভাঁজ করিয়া বড়বাবুর হাতে দিল। 

—এখানি মা-লক্ষ্মীর জন্যই আনানো। ক’দিন থেকেই ভাবছি, পাঠিয়ে দোব। তা আজ যখন আপনি নিজেই এলেন—

বড়বাবু ঈষৎ একটু আপত্তি জানাইতেই সমীরণ তাহাকে বাধা দিয়া কহিল,—আজ্ঞে না, আপত্তি করতে পাবেন না। আমার মা-লক্ষ্মীকে আমি যা খুশী তাই দোব, তাতে আপনার আপত্তির কি আছে বলুন তো? 

বড়বাবু যেন অপ্রস্তুত হইয়া গেলেন, এমনিভাবে হাসিলেন। 

অকস্মাৎ সমীরণের দুই চোখ ছল ছল করিয়া উঠিল। সে বাষ্পগদগদ কণ্ঠে কহিল,—দিই কি সাধে বড়বাবু? দেশে আমার একটি ভাইঝি আছে, অবিকল অমনি,—অমনি গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে কুট কুট করে কথা বলে। 

সমীরণ কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিল। 

এ অশ্রুতে বড়বাবুরও চোখে জল আসিল। তিনি যেন লজ্জিত হইয়া বলিলেন,—না, না, নোব না কেন, নোব না কেন? কি জান, পুলিশের লোক, একটুতেই—বুঝলে না? 

বড়বাবু এইবার আস্তে আস্তে উঠিলেন। সমীরণ তাঁহাকে সিঁড়ি পর্যন্ত আগাইয়া দিল। সিঁড়ির কাছে আসিয়া জোড় হস্তে বলিল,—আর একটি নিবেদন ছিল, বড়বাবু। 

—কি? 

—এই দোকানটির ওপর একটু কৃপাদৃষ্টি রাখবেন। বিক্রি-সিক্রি তো তেমন—

বড়বাবু বাইসিকলে চড়িয়া চলিতে চলিতে বলিয়া গেলেন—সে হবে, সে হবে। 

.

মক্ষি পাশের ঘরেই বসিয়াছিল। সমীরণ ঘরে ঢুকিতেই বলিল,—ফিলজফি শেষ হলো? বাবাঃ, কী গল্পই পেড়েছিলে! শেষ আর হতে চায় না। 

সমীরণ হাসিতে হাসিতে বলিল,—তুমি বুঝি এই ঘরে বসে? 

মক্ষি চাবির রিং-বাঁধা আঁচলটা দুলাইতে দুলাইতে বলিল, হ্যাঁ। ঘি আনতে হবে, ভাবলাম, তোমাকে বলে আসি। এসে দেখি, ওমা, তুমি বড়বাবুর সঙ্গে আলাপে একেবারে মশগুল! 

সমীরণ হাসিতে লাগিল। 

মক্ষি বলিল,—আচ্ছা, অতক্ষণ ওর সঙ্গে কি করে আলাপ করছিলে তুমি? বিরক্ত লাগছিলো না? 

—না, না। তুমি আমাদের বড়বাবুর নিন্দা কোরো না। বড়বাবু লোক ভালো, কেবল একটু বোকা। 

সে খাটের উপর শুইয়া পড়িয়া একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-আঃ!

পিঠের নীচে যে-বইখানি চাপা পড়িয়াছিল সেখানি বাঁ হাত দিয়া বাহির করিয়া সমীরণ কহিল, ওরে বাবা, কিপলিং পড়া হচ্ছে? 

মক্ষি বইখানি টানিয়া লইবার জন্য হাত বাড়াইল। বলিল,—আজ্ঞে হ্যাঁ। দিন তো ওখানা। 

যে পাতাটি খোলা ছিল তাহারই ক’টি লাইন সমীরণের চোখে পড়িল, 

“Enough for me in dreams to see 
And touch thy garment’s hem. 
Thy feet have trod to near so God
I dare not follow them.” 

মক্ষি বলিল, তুমি এ সব কথাটা বিশ্বাস করো? 

সমীরণের চোখের তারা দুইটি কাঁপিতেছিল। একবার হাত দিয়া সে যেন ওর পা দুটি স্পর্শ করিতে চাহিল। পরক্ষণেই হাত সরাইয়া লইল, বুঝি সাহসে কুলাইল না। 

মক্ষি মাথায় ঝাঁকি দিয়া বলিল,—সব বাজে, বাজে, বাজে। খালি রোমান্সের খাতিরে বড় বড় কথা বলা। শুধু নারী ভোলাবার ছল। 

সমীরণ ইহার প্রতিবাদে ব্যস্ত হইয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মক্ষি সেদিকে না চাহিয়াই বলিতে লাগিল,—তোমার শাড়ীর আঁচলটুকু স্বপ্নে যদি ছুঁতে পাই সেই আমার ঢের হয় তো তার পেছনে আবার কেন ছোটো? তার দেহকে পাওয়ার লোভে কেন বিয়ের মন্ত্র পড়ো?—মক্ষি উত্তেজিত হইয়া বলিল,—সব বাজে! আমি ওর এক বর্ণও বিশ্বাস করিনে। 

সমীরণের মুখে ব্যথার চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। তার কেমন মনে হইল, এ কথা বুঝি তাহাকেই ঠেস দিয়া বলা হইল। 

সে বলিল,—কেন বিশ্বাস করো না? এ কি মিথ্যে? 

—হ্যাঁ মিথ্যে। তোমাদের সহস্র রকমের কাজ আছে, তারই ফাঁকে, বিশ্রামের অবসরে তোমরা প্রেমচর্চা করো। তখন তোমরা কবিতার পেখম তুলে নারীর সুমুখে নৃত্য করো। সে নৃত্যে নারী গলে পড়ে, নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেই কখন আত্মসমর্পণ করে বসে। প্রেম তোমাদের একটা বিলাস। যেমন তোমরা আফিস যাও, মোটর রাখো, হাওয়া বদলাতে সিমলা যাও, যেমন তোমরা প্রাইভেট টিউটর রাখো, তেমনি তোমরা প্রেম করো। 

সমীরণ সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল,—তেমন নয়। আমি নিজে যে জানি, গভীর অরণ্যে আমলকী গাছের নীচে তুমি ক্লান্ত তনু আমার কোলে ঢেলে দিয়েছো, আমি সমস্ত রাত্রি পেছনের গাছে ঠেস দিয়ে জেগে কাটিয়েছি। যদি কখনও একটু তন্দ্ৰা এসেছে, পাতার মর্মরে তখুনি চমকে জেগে উঠেছি। ভাবছি, এই শেষ! পুলিশ এলো বলে, আর নিষ্কৃতি নেই। তবু তোমায় স্পর্শ করতে পারিনি। শুধু মনে হত, আমার অন্তিম-ক্ষণে জীবনের শেষ রাত্রিটি তোমার মাথা কোলে করে জাগতে পেরেছি এই আমার ঢের। এর বেশী চাইতে আমার সাহসই হয়নি। 

কথাটা ঠিক সত্য নয়। তথাপি মক্ষি লজ্জায় প্রথম দিনের ঘটনার উল্লেখ করিতে পারিল না। 

সমীরণ বলিল,–এই খাটখানিতে তুমি যখন পা ঝুলিয়ে বসে থাকো, মনে হয়, তোমার পায়ের তলায় পা দু’খানি কোলে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি। অনন্তকাল আমাদের ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ঢেউ দিয়ে-দিয়ে দুলিয়ে যাক। সেই ঝুলনের দিনে আমি বলবো- 

“Being your slave, what should I do but tend 
Upon the house and times of your desire?
I have no precious time at all to spend,
Nor services to do, till you require.” 

সমীরণের চোখ হইতে আনন্দ উছলিয়া উঠিল। বলিল, কিন্তু তাই বা বলতে পারলাম কই? তোমার সুমুখে আমার সমস্ত ইচ্ছা মূক হয়ে পড়ে। 

আনন্দে মক্ষির চোখ দুইটা তখন বুজিয়া আসিয়াছে। মনে হইল, সে বুঝি এখুনি কাঁদিয়া ফেলিবে। 

অস্ফুট স্বরে সে কোনো মতে বলিল,—কেন পার না? আমি তো কখনো বাধা দিই নি, কখনো কিছুতে ‘না’ বলিনি। 

মক্ষি মিথ্যা বলে নাই। সমীরণকে কখনও সে বাধা দেয় নাই। সুদীর্ঘ দিন ক্রমাগত বনে-জঙ্গলে ঘুরিয়া তার মধ্যে শ্রান্তি যেমন তার দেহকেই খিন্ন করিয়াছে তেমনি তার মনকেও সুস্নিগ্ধ করিয়াছে। এখন যেন সে একটু ছায়া চায়, যেখানে বাহুর ‘পরে মাথা রাখিয়া বিশ্রাম করা চলে। 

এই বাড়ীটা ভাড়া নিয়া সমীরণ বলিয়াছিল,—এতদিনে তোমায় পেলাম, মক্ষি।

সমীরণের এত বড় স্পর্ধার উত্তরে মক্ষি একটা কথাও কহে নাই। তার ঠোটের কোণে বরং একটু সাহস-জাগানো হাসিই খেলিয়া গিয়াছিল। 

গোধূলি ক্ষণে একান্ত নিভৃতে দুটা কথা কহিলেই পাওয়া যাইবে এমন সুলভ নারী মক্ষি নয়। তাহাকে উপেক্ষা করা চলে না, এবং মিষ্টি কথা কহিলেই কৃতার্থ হইবে এমন আশা আর যাহার কাছেই চলুক, তাহার কাছে নয়। 

তথাপি সমীরণের ঔদ্ধত্য তাহাকে বিদ্ধ করে নাই। মৃদু হাসিয়া সে বরং তাহা মানিয়াই লইয়াছিল। 

তার সমস্ত জীবন কেমন ওলট-পালট হইয়া গেছে। আগের সঙ্গে সে নিজেই যেন আর মিল খুঁজিয়া পায় না। ও যেন কোন্ দুস্তর মরুভূমির মধ্য দিয়া পথ হাঁটিতে হাঁটিতে মধ্য পথেই ঘুমাইয়া পড়ে। জাগিয়া উঠিয়া দেখে, এ আবার এক নূতন লোক। মরুভূমি কোথায় মিলাইয়া গেছে, এখন তাহা স্বপ্নের মত মনে হয়। 

মাঝে-মাঝে আগের কথাও ভাবিতে চেষ্টা করে। সেই চির পুরাতন বিপ্লব-কেন্দ্ৰ, সেই রক্ত-লোলুপ উন্মাদনা। সেখানে সে ছিল রাণী, সমস্ত লোক তার আদেশের অপেক্ষায় নতশিরে দাঁড়াইয়া থাকিত। পশ্চিমের ছোট সহরের খাপরার ঘরের মধ্যে বসিয়া সে বিহ্বল নেত্রে চাহিয়া থাকে, আর চোখের সুমুখ দিয়া তার সহকর্মীদের মুখ বয়োস্কোপের ছবির মতো ভাসিয়া-ভাসিয়া মিলাইয়া যায়। 

বসন্তকে তার দেখিতে বড় ইচ্ছা করে। শশকের ছানার মতো সে একটু নিরালা পাইলেই যেন তাহার হাত হইতে খাবার লোভে কাছটিতে আসিয়া বসিত। তাহার নিষ্কলঙ্ক, সরল মুখের উপর গাঢ় করিয়া যে-কুণ্ঠার ছাপ পড়িয়াছে তাহাতে তাহার করুণা জাগিত। 

বিপ্লবের একনিষ্ঠ সেবক বিমলও আর নাই, তাহার জন্যও মক্ষির চোখে দু-ফোঁটা জল জমিল। 

তথাপি এই প্রসঙ্গটিই দু’জনে দু’জনের কাছে প্রাণপণে এড়াইয়া চলে। যে কেন্দ্রটিকে ঘিরিয়া এতগুলি লোক একরূপ অভিন্ন হৃদয় হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার প্রসঙ্গে কোথায় যে কুণ্ঠা তার কারণ নির্ণয় করা কঠিন। 

তাহারা দুইজন ছাড়া সকলেই সম্মুখ সমরে প্রাণ দিয়াছে। সেই বাঞ্ছিত মৃত্যু ছাড়িয়া কেন যে তাহারা পলায়ন করিল, কিসের লোভে তাহাদের বাঁচিবার প্রয়োজন এত বেশী হইল আজ তাহাই ভাবিতে বিস্ময় লাগে। অথচ শুধু কোনোমতে প্রাণরক্ষার জন্যই যে তাহারা পলায় নাই, তাহাদের বাঁচিয়া থাকার একটা কোন সার্থকতা যে সেদিন মনে উঠিয়াছিল, ইহাও নিশ্চয়। 

কিন্তু আজ অতীত বিপ্লবী জীবনের জের টানিয়া চলিবার কোন প্রয়োজনই যেন ইহাদের মনে আসে না। বরঞ্চ গত জন্মের স্মৃতি তাহারা যেন সবলে মুছিয়া ফেলিতে চায়। 

মাঝে-মাঝে এক-একটা কথা মনে পড়িয়া দু’জনেরই চোখের দৃষ্টি একাগ্র হইয়া ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই আপনাকে সম্বরণ করিয়া লয়। এবং যদিচ একের গোপন করিবার চেষ্টা অপরের চোখে ধরা পড়ে, কথাটি তথাপি গোপনই থাকিয়া যায়। 

শুধু ইহাই নয়। চারিদিক দিয়াই যেন কুণ্ঠার একটা ধোঁয়াটে পর্দা দু’জনের মধ্যে সারাক্ষণ টাঙানোই রহিয়াছে। উঠানে একটা খাটিয়া বিছাইয়া সমীরণ সন্ধ্যার পরে শুইয়া থাকে। ইচ্ছা করে, তাহারই একপাশে মক্ষি আসিয়া বসে। মক্ষিরও একটু ইচ্ছা যে হয়না তা নয়। তবু পারে না, দাওয়ার উপর উঠানে পা ঝুলাইয়া সে আসিয়া বসে। 

তারপরে কথা ভালো জমে না। দু’জনেরই মনের মধ্যে কি একটা কামনা কেবলি ঘোলাইয়া ওঠে। তখন একজন চিৎ হইয়া নির্বিকার ভাবে খাটের উপর শুইয়া থাকে, আর একজন পায়ের বুড়া আঙুল দিয়া উঠানের উপর কি যে নক্সা কাটে তাহা সেও জানে না,—তাহার আঁচল পায়ের কাছে লুটাইতে থাকে। 

এমন করিয়া ক’দিন কাটে? 

পাশের বাড়ীর গোপালকৃষ্ণ ভিড়ের বৌ কয়েক বারই পাঁচিলের ওদিক হইতে আলাপ জমাইবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু সাহস করিয়া আলাপ করিতে পারে নাই। চোখাচোখি হইবার উপক্রম হইলেই মুখ সরাইয়া লইয়াছে। 

মক্ষিও কোনদিন ওদিকে বড় তাকায় নাই। সেদিন কিন্তু হঠাৎ চোখাচোখি হইয়া গেল। 

মেয়েটি দেখিতে মন্দ নয়। রং খুবই ফর্সা, কিন্তু মলিন বস্ত্রে বড় ম্লান লাগে। বয়স ষোলর বেশী নয়। 

চোখে চোখ পড়িতেই মেয়েটি যেরূপ সন্ত্রস্তভাবে সরিয়া গেল তাহাতে মক্ষি অবাক হইয়া ভাবিতে লাগিল, মেয়েটি পাগল না কি? 

পরক্ষণেই সেই মুখখানিকে উঁকি মারিতে দেখা গেল। এবারে মক্ষি তাহাকে হাত ইসারায় ডাকিতেই মেয়েটি আর সরিয়া গেল না, দাঁড়াইয়া-দাঁড়াইয়া কুণ্ঠিতভাবে হাসিতে লাগিল। 

মক্ষি হিন্দিতে বলিল,—তোমরা কি এই বাড়ীতে থাক নাকি? 

মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ। 

—কই, তোমাকে তো আর কোনোদিন দেখি নি? 

মেয়েটি হাসিতে লাগিল। 

হাসির রকম দেখিয়া মক্ষির গা জ্বলিয়া যাইতেছিল। তথাপি এই প্রতিবেশিনীর সাহচর্যের উপর লোভও কম হইল না। 

মক্ষি বলিল, তুমি দুপুর বেলায় আসবে আমাদের বাড়ী? 

এমন সময় একটা ভারী মেয়েলি গলায় বৌটাকে কে যেন কি প্রশ্ন করিল। বোঁটাও ঘাড় ফিরাইয়া তাহার কথার উত্তর দিল। সম্ভবত বৌটি কাহার সহিত কথা কহিতেছে তাহাই জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল। কিন্তু মারাঠি ভাষায় কথা, মক্ষি কিছুই বুঝিল না। তার মনে হইল একটা ফাঁপা লোহার একখানা করগেট শিটের উপর দিয়া চলিয়া গেল। 

মেয়েটি বলিল,—যাবো দুপুর বেলায়। 

দুপুর বেলায় মেয়েটি বেড়াইতে আসিল। সঙ্গে দুটি ছেলে, একটি বছর তিনেকের আর একটি বছর দেড়েকের। দামাল ছেলে দুইটি লইয়া মেয়েটি বিব্রত হইয়া থাকে। কথা কহিতে দেয় না। 

বড়টি পিছন হইতে এমন জোরে গলা টিপিয়া ধরে যে মায়ের দম বন্ধ হইবার মতো হয়, চোখ কপালে ওঠে। ছোটটি অতটা পারে না, সে ছোট-ছোট দুটি হাত দিয়া মায়ের অধরে থাবা মারে। 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—বড় দুরন্ত ছেলে। 

মেয়েটি হাসিয়া বড় ছেলেটিকে পিছন হইতে টানিয়া দুম্ করিয়া সুমুখের দিকে বসাইয়া দিল। 

মক্ষি বলিল,–তোমার নাম কি? 

—সত্যবতী। 

সত্যবতী বলিতে লাগিল,—ছেলে দুটা অত্যন্ত দুরন্ত। ইহাদের অত্যাচারে তাহার নাহিবার-খাইবার সময় নাই। বাবু তো দিন-রাত্রি দোকান লইয়া থাকে, ছেলের ঝক্কি তাহাকে পোহাইতে হয় না। সমস্ত তাল পড়ে তাহার উপর। 

বলিল,—মাগো, মানুষের আবার ছেলে হয়! 

মক্ষি অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সত্যবতী মুখে যাহাই বলুক, ছেলে দুটি যে তাহার আনন্দের বিঘ্নস্বরূপ হইয়াছে তাহার স্মিত মুখের ভাব দেখিয়া তাহা মোটে বোঝা গেল না। 

সত্যবতী হাসিয়া বলিল,—আমার শাশুড়ীর জন্যে এদের গায়ে কি কারো হাত দেবার উপায় আছে? তাই তো এমনি হয়েছে। 

মক্ষি বড় ছেলেটিকে কাছে টানিয়া আনিয়া তাহার মাথার বড় বড় কোঁকড়া চুলে হাত বুলাইতে-বুলাইতে বলিল,—তুমি কি পাগল নাকি? এত ছোট ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে? ক বছর বয়স এর? 

—তিন বছরের হোল। 

কিন্তু তিন বছরের মতো লাগে না। এমন লম্বা-চওড়া মোটা-সোটা গড়ন।

মক্ষি বিশ্বাস করিতে পারিল না। বলিল,—তোমার বয়স কত? 

সত্যবতী বলিল-ষোল বছর। 

মক্ষি অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। 

—তোমার কি তেরো বছরে ছেলে হয়েছিলো? 

সত্যবতী উত্তর দিল না, মুখ নামাইয়া বসিয়া রহিল। 

এত অল্প বয়সে এমন স্বাস্থ্যবান সন্তানের মাতা হইতে পারা যায় এ কথা কোন বইতে লেখা নাই। বরং মক্ষি চিরদিন শুনিয়া আসিয়াছে এবং পড়িয়া আসিয়াছে যে, অল্প বয়সের মাতার সন্তান বলিয়াই এই জাতির দেহ শীর্ণ, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ এবং পরমায়ু স্বল্প। পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকরাও ভারতবাসীর সর্বাধিক দৈন্যের ইহাই মূল কারণ বলিয়া রায় দিয়াছেন। 

আজ মক্ষির এই রায়ে সন্দেহ জাগিল। ষোল বছর বয়সে দুইটি সন্তানের মাতা হওয়ার পরেও সত্যবতীর স্বাস্থ্য এবং দেহের গঠন অটুট আছে। ছেলে দুইটিও চারু, সুকুমার ও বলিষ্ঠ। মক্ষির কৌতূহল প্রবল হইল। একটি-একটি করিয়া নানা প্রশ্ন করিয়া বুঝিল, সত্যবতীর ছেলেরা হর্লিকস খায় না, প্রচুর পরিমাণে গো-দুগ্ধ পান করে। পোসাক- পরিচ্ছদের বালাই নাই, দিনরাত্রি জামা-কাপড় পরিয়া আয়ার কোলে কোলেও ফেরে না। ধূলায়-বালিতে সর্বক্ষণ মাটি-মার স্নেহস্পর্শ লাভ করে। 

মক্ষির নিজের স্বাস্থ্য ভালো। বাঙ্গালীর কুব্জপৃষ্ঠ, ক্ষীণদৃষ্টি মেয়েদের দল দেখিয়া সমগ্র মেয়ে জাতের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জাগিয়াছিল। এই স্বাস্থ্যবতী মেয়েটিকে তার ভালোই লাগিল। কিন্তু লেখাপড়া বিশেষ জানে না। 

মক্ষি বলিল,—লেখাপড়া শেখোনি কেন? 

—আমাদের মেয়েদের লেখাপড়া শিখতে নেই।

—কেন? 

সত্যবতীদের পূর্বপুরুষ ভোঁসলা রাজসরকারে কি একটা বড় কাজ করিতেন। অবস্থা মলিন হইয়া আসিয়াছে বটে, কিন্তু এখনও তাহাদের বংশের কেহ সাধারণের সঙ্গে একাসনে বসে না। পাঠশালে গেলে সকলের সঙ্গে বসিতে হয় বলিয়া তাহাদের বংশের ছেলেমেয়ে কেহ পাঠশালে যায় না। একটু-আধটু কাজ চলার মত বাড়ীতেই শিখিয়া লয়। 

মক্ষি প্রশ্ন করিল, তুমি সমস্ত দিন কি কর তবে? 

সত্যবতী হাসিয়া বলিল,—কাজের কি আর অন্ত আছে দিদি? সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দুই শাশুড়ী-বৌতে খেটেও কাজ শেষ করতে পারিনে। বিকেল বেলায় বসে বসে আপনি কত বই পড়েন দেখি। কিন্তু আমি যদি অমন বই পড়তে জানতাম তবুও অমন করে বই পড়বার ফুরসৎ পেতাম না,—এত আমার কাজ। 

সংসারে উহাদের কয়জনই বা লোক। সত্যবতীরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন, দুটি ছেলে আর বুড়ি শাশুড়ী। ইহাদের এমন কি কাজ থাকিতে পারে যাহাতে এক ঘণ্টা বই পড়িবারও সময় নাই? ইহাদের সংসার-যাত্রা দেখিবার জন্য মক্ষির অত্যন্ত লোভ হইল। 

সে বলিল,—তোমার বাড়ী কালকে যাব, কেমন? 

মেয়েটি কৃতার্থ হইয়া বলিল,—আসবেন কালকে? দুপুর বেলায় আসবেন, কেউ থাকে না সে সময়। 

বেলা তখন তিনটে বাজে। ছেলে দুটিকে টানিয়া তুলিতে তুলিতে সত্যবতী বলিল,—আজকে উঠলাম ভাই। কালকে যেন যাবেন নিশ্চয়। 

বড় ছেলেটি মায়ের একটি হাত ধরিয়া আগে-আগে টানিয়া লইয়া চলিল। মক্ষি একদৃষ্টে তাহাদের চলিয়া যাওয়া দেখিতে দেখিতে বলিল,—যাবো।

কি একটা বিশেষ কাজ থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে সমীরণ চা-পানের জন্য ভিতরে আসিতে পারে নাই। যখন আসিল তখন সন্ধ্যার বড় বেশী বাকী নাই। 

কিন্তু তখনও মক্ষি সেই একভাবে ঠায় সেখানে বসিয়া আছে। তখন পর্যন্ত সন্ধ্যার জন্য দীপদানের আয়োজনও করা হয় নাই। তাহার কিছুই ভালো লাগিতেছিল না। দেশ ছাড়িয়া সুদূর প্রবাসে যে বাসা বাঁধিয়াছে ইহা নিতান্ত বিড়ম্বনা মনে হইতে লাগিল। ইহার যে কোনো মানে নাই, কোনো সঙ্গতিও নাই। এই পৃথিবী, ইহার ফলে, ফুলে, তুণে ভরা মাঠ, ইহার প্রভাত ও সন্ধ্যা, তাহার সহিতই বা তার যোগ কোথায়? যে মাটি মাথায় নিয়ে বোমা ও পিস্তল হাতে কেবলই কসরৎ করিয়া বেড়াইল তাহার টানও যেন অন্তর পর্যন্ত পৌঁছায় না। 

এ পৃথিবীতে তাহার আকর্ষণ বলিতে কি-ই বা আছে? আজও মরে নাই বলিয়া বাঁচিয়া থাকা, কেবলই একটা দুঃখের সঙ্গে আর একটা দুঃখের গিট বাঁধিয়া চলা। 

এমন করিয়া বসিয়া থাকিতে সমীরণ মক্ষিকে কখনো দেখে নাই। চিরদিন এই বিদ্যুৎলতা আপন তেজে ও তীব্রতায় চমক দিয়া ফিরিয়াছে। নিজে কোনো দিন ম্লান হয় নাই, যার উপর তার আলো পড়িয়াছে তাকেও চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে। ইহার কাছে গিয়া ধ্যান ভাঙাইতে তার সাহসই হইল না। কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া সে আপনমনেই পায়চারী করিতে লাগিল। 

কতক্ষণ পরে তার ধ্যান ভাঙিল। প্রথমটা সে অবাক হইয়া সমীরণের চোখে চোখ রাখিয়া স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। তারপরে চেতনা ফিরিয়া আসিতেই সে কতকটা লজ্জিত হইয়াই উঠিল দাঁড়াইল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলাইয়া লইয়া বলিল,—তোমার আজ চা খেতে এত দেরী যে? 

এতক্ষণে সমীরণের সাহস ফিরিয়া আসিল। সে হাসিয়া বলিল,—বড় দারোগাবাবু এসেছিলেন কি না। তাঁর কাছে কিঞ্চিৎ ফিলজফির উপদেশ নেওয়া গেল। 

মক্ষিও হাসিয়া বলিল,—তাহলে তোমার দোকান থেকে আর একখানা ডুরে শাড়ীও বিদায় হোল নিশ্চয়ই, তোমার মা-লক্ষ্মীর জন্যে। 

সমীরণ সুমুখের খাটে বসিতে বসিতে বলিল,—না, না, লোভের বেশী প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তোমার চা খাওয়া হয়ে গেছে? উনোন তো বয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গটা যে কোন সময় আসিয়া উনানে আগুন দিয়া গেছে সেদিকে মক্ষির খেয়ালই হয় নাই। সে, তাড়াতাড়ি বলিল,—এই মাত্র উনোন ধরলো। 

চা তৈয়ারী করিয়া আনিয়া মক্ষি বলিল, কিন্তু এমনি করে কতদিন আরও চলবে? তুমি কি কিছু ঠিক করেছ? 

সমীরণ চিন্তিত ভাবে বলিল—এখন কিছুদিন এমনি করেই চালাতে হবে বোধ হয়। তা ছাড়া আর কি কিছু উপায় আছে? 

—সে আমিও জানিনে। কিন্তু এমন করেও আর ভালো লাগে না। বরং- 

কিন্তু কথাটা বলিতে গিয়া মক্ষি থামিয়া গেল। সে বলিতে যাইতেছিল,—বরং আমাকে রেহাই দাও। বলিতে গিয়াই মনে পড়িল তাহাকে তো কেহ বাঁধিয়া রাখে নাই। তার চারদিকে যদি কোনো বন্ধন জমিয়া থাকে সে বন্ধন-জাল সৃষ্টি করিয়াছে সে নিজেই। ইহাতে অন্য কাহারও হাত নাই। 

তথাপি অকারণেই উত্তেজিত হইয়া মক্ষি বলিল,—তুমি কেন পালিয়ে এলে? সামনা- সামনি যুদ্ধ করে মরতাম সেই তো ছিল ভালো। এ কি একটা জীবন? এমনি করে বাঁচা যায়? 

মক্ষির উত্তেজনায় ঈষৎ হাসিয়া সমীরণ বলিল,—তুমি আজ কেন উত্তেজিত হয়েছ জানিনে। কিন্তু পালিয়ে এলেও তোমার মরবার পথ আটকেছি এমন অপবাদ তুমি দিতে পারো না। শত্রুও পালায়নি, তোমারও রিভলবারে গুলি আছে। 

তবে আমরা কেন এমন করে হাত গুটিয়ে বসে থাকি? আর একবার ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না? এখানে আমাদের কি কাজ? 

একটু ভাবিয়া সমীরণ বলিল,—ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। কিন্তু আমার জীবনে অন্য মোহ এসেছে। তুমি আমায় ঘৃণা করতে চাও কোরো, কিন্তু সে মোহ যে কিসের তা তুমিও জানো। 

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সমীরণ সশঙ্কচিত্তে একটা কড়া উত্তর আশা করিতে লাগিল। কিন্তু সেরূপ কোনো উত্তর আসিল না দেখিয়া একটু সাহস পাইল। 

সে বলিতে লাগিল,—তুমি বলছ, এই কি একটা জীবন! কিন্তু এই জীবনের প্রতিই আমার লোভের সীমা নেই। অথচ কি-ই বা পেয়েছি! 

একটু থামিয়া বলিল,—বিমল মরতে পেরেছিলো, কারণ তার একদিকে ছিল অতি বৃদ্ধ পৃথিবী, আর একদিকে ছিলে অনন্ত-যৌবনা তুমি। তার প্রেমও ছিল ভীরু, দুর্বল। আমি পারিনি, আমার সুমুখে ছিল শ্যামা ধরণী, আর তারই মাঝে যৌবনের নবমঞ্জরী হাতে তুমি ছিলে দাঁড়িয়ে। আমার তাই মৃত্যুকে এড়াতে হোল। এ কি দোষের? 

যে-মেয়ে নিজের হাতে কেল্লা উড়াইবার স্বপ্ন দেখে সে কিন্তু এই আলোচনার তোড়ে একেবারে এলাইয়া পড়িল। সে হাঁ, না, কোন উত্তরই দিল না। 

সমীরণ বলিল, মেজ-দা তোমার নাম রেখেছিলেন মক্ষিরাণী। মেজ-দার অন্তর্দৃষ্টি ছিল। তিনি জানতেন, আমাদের বিপ্লবীদলের এতগুলো ছেলে শুধু তোমাকেই কেন্দ্ৰ করে চক্র দেয়। তোমার প্রতিভা আমি অস্বীকার করিনে। বরং তোমার যে প্রতিভা আছে তা খুব কম পুরুষেরই থাকে। তবু তোমায় কেন্দ্র করে যে এতগুলি ছেলে ঘুরতো, সে তোমার প্রতিভার আকর্ষণে ততখানি নয় যতখানি তোমার দেহের আকর্ষণে। কথাটা খুব কুৎসিৎ শোনাচ্ছে, কিন্তু তোমার একটি কথায় যে-ভাবে এরা মরতে পারতো এমন বুঝি মেজ-দার কথাতেও পারতো না। তুমি বলবে, নারীকে যে তোমরা সকলের বেশী সম্মান দাও, সে কি এই? আমি বলব, সে এই এবং এ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আজ যদি ভগবান এসে বলেন, তুমি স্বর্গ চাও, না শ্রীমতী বিদ্যুৎলতাকে চাও? আমি নিঃসঙ্কোচে বলব, তোমার স্বর্গ তোমার থাক প্রভু, আমায় এই বিদ্যুৎলতাটি দাও। একেই নিয়ে আমি আমার স্বর্গ রচনা করব। আমায় ভীরু বল, কাপুরুষ বল, কিন্তু সবাই যে দুর্বল প্রণতি তোমায় দিয়েছে আমি তার চেয়ে ঢের বেশী দিয়েছি প্রেম। 

সমীরণ আস্তে-আস্তে মক্ষির একখানি হাত নিজের হাতের মধ্যে লইয়া বলিল,—তুমি কি রাগ করলে? 

মক্ষি হাতখানি ধীরে-ধীরে টানিয়া লইয়া বলিল,—না। 

রাগ সে করে নাই। সন্ধ্যাকাশের পানে চাহিয়া সে শুধু ভাবিতেছিল, এই নূতন কথা তাহার জীবনে কতখানি সত্য। সে শক্তিমতী, সে প্রতিভাশালিনী, কিন্তু সে তার চেয়েও বেশী–সে নারী। এ কথা এমন করিয়া সে কখনও ভাবে নাই। এ কথা বুঝতে তাহার দেরী লাগিবারই কথা। 

.

দুটা বাজিবার পূর্বেই মক্ষি ভিড়েদের বাড়ী যাইবার জন্য আয়োজন আরম্ভ করিল।

ভীড়েদের বাড়ী গিয়া তাহাদের জীবনযাত্রা দেখিবার জন্য তাহার মন সকাল হইতেই উসখুস করিতেছিল। পূর্বে যে বধূটিকে সে দেখিয়াছে তাহাকে বিশেষত্বহীন বলিলে মিথ্যা বলা হয় না,—এমনই সে সৌষ্ঠববিহীন, অশিক্ষিতা, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। এমন কি বিধাতা যে-রূপ তাহার দেহে ছড়াইয়া দিয়াছেন তাহাকে মাজিয়া-ঘষিয়া বজায় রাখিবার মতো মার্জিত রুচিও তাহার নাই। 

কিন্তু মক্ষি কখনো কোনো গৃহস্থের সংসার দেখে নাই। শুনিয়াছে, মেয়েদের ছোট বয়সে বিবাহ হয়, তারপর স্বামীর ঘর করিতে চলিয়া যায় এবং যাহাদের তাহারা ইতিপূর্বে কখনও দেখে নাই সারা জীবন অসীম মমতায় তাহাদেরই ঘিরিয়া-ঘিরিয়া লূতাতন্তু বুনিয়া চলে। এই প্রথার পক্ষে এবং বিপক্ষে বহুবার বহু তর্কই সে করিয়াছে। এবারে আর তর্ক নয়। সে নিজের চোখে এই অতি দুর্ভাগা নারীদের জীবনযাত্রা দেখিয়া আসিতে চাহে,—নিজের চোখে। 

এই কৌতূহল সকাল হইতেই ক্রমাগত তাহাকে অঙ্কুশ মারিতে লাগিল এবং দুটা বাজিবার পূর্বেই বাক্স খুলিয়া বাহিরে যাইবার পোসাক বাছিতে বসিল। 

এটা-ওটা-সেটা করিয়া একবার একখানা বাসন্তী রঙের শাড়ী ও ফিকা নীল ব্লাউজ বাহির করিল। আবার কি ভাবিয়া সেগুলা বাক্সে পুরিয়া একখানা নীল শাড়ী ও নীল ব্লাউজ পছন্দ করিল। কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলাও ছুঁড়িয়া বাক্সের উপর ফেলিয়া দিয়া অলসভাবে খাটের উপর শুইয়া পড়িল। 

মানুষ নীড় বাঁধে নীড় বাঁধিবার আনন্দে; মধুচক্র রচনা করে মধু সঞ্চয়ের আনন্দে। এই আনন্দে মাটির পৃথিবীর জন্ম হইয়াছে। এই আনন্দেই কাহারও প্রিয়া উদয়াস্ত পিপীলিকার মতো অক্লান্ত পরিশ্রম করে;- কাহারও প্রিয়া চাঁদিনী রাত্রে সুরের ইন্দ্রধনু রচনা করে। কিন্তু তাহাতে তাহার দেখিবার কি আছে? তাহার এ কৌতূহল কেন? যাহারা তরু-মূলে-মূলে নিয়ত স্নেহরস ঢালিয়া ফুল ফোটায়, ধরণীকে শ্যামলা করে সে তো তাহাদের কেহ নয়। সে মৃত পৃথিবীর বুকে জীবনের স্পন্দন আনিবে। ফুল-ফুটানোর সাধনা তো তাহার নয়, সে যে শব-সাধনায় মগ্ন 

কি হইবে তাহার জানিয়া কেমন করিয়া এতটুকু বালিকা দেখিতে দেখিতে পুরুষের উদ্দাম, দুরন্ত যৌবনকে পাকে পাকে বাঁধিয়া ফেলে? পরের মেয়ে অপরিচিত সংসারে আসিয়া খাটিয়া-খাটিয়া কেন দেহপাত করে তাহা জানিয়া তাহার কি লাভ? চাঁদের কৌমুদী তো তাহার নয়, শ্মশানের আগুন অন্ধকারেই মানায় ভালো। 

না, না, না, চাঁদের কৌমুদী তাহার নয়। ওই তো একটা লোক দুটি চোখের অঞ্জলি পাতিয়া কেবলই তাহার চারিদিকে ভিক্ষুকের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহাকেই বা কি দিতে পারিল সে? কি দিতে পারে সে? বুকে যাহার বৈশাখের খর রৌদ্র জ্বলিতেছে তাহার কাছে ছায়া পাওয়ার, স্নিগ্ধতা পাওয়ার আশা কেনই বা করে ও? ও কি আজও তাহাকে চিনিতে পারে নাই? 

ভুল, ভুল। বিমল তাহাকে ভুল বুঝিয়াছিল, সমীরণও তাহাকে ভুল বুঝিয়াছে। নীড় বাঁধিবার বস্তু তাহার নাই। তথাপি এত লোক ছাড়িয়া তাহাকেই লইয়া কেন সমীরণ ঘুরিয়া মরে? 

সে স্থির করিল সমীরণকে আর প্রশ্রয় দেওয়া চলিবে না। তাহাকে সকল কথা স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে। কিন্তু মায়া লাগে যে! ওর মুখের পানে চাহিলে শক্ত করিয়া কিছুই যে বলিতে পারা যায় না। 

মক্ষি হতাশভাবে আর একবার পাশ ফিরিয়া শুইল। এমন সময় পাঁচীলের ওপার হইতে কে যেন অতি মৃদু কণ্ঠে ডাকিল,—বহিন। 

জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া মক্ষি দেখিল সত্যবতী সহাস্যমুখে পাঁচীলের ওপারে দাঁড়াইয়া আছে। এবং দেখা না গেলেও বেশ বোঝা গেল তার, বোধ হয়, বড় ছেলেটি নীচ হইতে কাপড় ধরিয়া টানিয়া তাহাকে বিব্রত করিতেছে। 

মক্ষি তাড়াতাড়ি বলিল,—যাচ্ছি। এবং কোনো বেশভূষা না করিয়াই খিড়কী দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। 

ভিড়েদের বাড়ীটি অবিকল তাহাদেরই মতো;-দুখানি শয়ন কক্ষ, একটি রান্নাঘর আর সামনে এক ফালি উঠান। ভিড়ের বৃদ্ধা জননী তখন উঠানে একটা পা ছড়াইয়া জাঁতায় গম পিষিতেছিলেন এবং তাঁহারই সুমুখে ভিড়ের বড় ছেলেটি একটা তিন-পা- ওয়ালা মাটির ঘোড়াকে দাঁড় করাইবার অসাধ্য সাধনে নিমগ্ন ছিল। উঠানটি ঠিক সমতল নয়, তার উপর তিনখানি মাত্র পা সম্বল করিয়া বেচারা ঘোড়ার দাঁড়াইবার কোনো উপায় ছিল না। 

এমন সময় মক্ষি আসিল। ঘোড়া বেচারা বাঁচিয়া গেল। বড় ছেলেটি মাটির ঘোড়া মাটিতে ফেলিয়া রাখিয়া ছুটিয়া গিয়া মক্ষির হাত ধরিয়া সাদরে এমন একটি টান দিল যে, মক্ষি ছাড়া অপর কোনো মেয়ে হইলে সেইখানেই তাহাকে ভূ-শয্যা গ্রহণ করিতে হইত। ছোটটি মায়ের পিছু-পিছু অকারণ ঘুরিতেছিল। জ্যেষ্ঠের দেখাদেখি সেও সুমুখের দুটি কচি বাহু বাড়াইয়া দিয়া টলিতে-টলিতেই মক্ষির দিকে ছুটিতে লাগিল। 

ভিড়ের বৃদ্ধা জননীও ফোকলা দাঁত বাহির করিয়া সম্বর্ধনা-সূচক কি যেন বলিলেন, কিন্তু ছেলেদের কাকলীর ভিতর তাহার এক বর্ণও বোঝা গেল না। শুধু বোঝা গেল, মক্ষির আগমনে তিনি অত্যন্ত প্রীত হইয়াছেন। 

ব্যস্ত হইয়া উঠিল সত্যবতী। সে একবার বড় ছেলেটিকে ধমক দিল,–এই দিবাকর! একবার ছোটটিতে ধমক দিল,—এই প্রভাকর! কিন্তু তাহাতে অবস্থার কোন পরিবর্তন হইল না দেখিয়া মক্ষির একখানি হাত ধরিয়া টানিতে-টানিতে ঘরের ভিতর লইয়া গেল। বাড়ীটিকে ইহারা যেন দেবমন্দির করিয়া রাখিয়াছে। উঠান হইতে ঘরের ভিতর পর্যন্ত কোথাও এতটুকু জঞ্জাল জমিয়া নাই, যেন সিন্দুর পড়িলে তুলিয়া লওয়া যায়। 

উঠানের এক কোণে একখানা খাটিয়া দেওয়ালে ঠেসান দিয়া রাখা হইয়াছে। বারান্দার একধারে একখানি বেতের দোলনা দুলিতেছে। ঘরের মধ্যে খাট-পালঙ্কের কোনো বালাই নাই,—একধারে বাক্সগুলি এবং একধারে গুটানো বিছানাগুলি সুবিন্যস্তভাবে সাজানো। 

মক্ষি বলিল,— এখানি বুঝি তোমার শোবার ঘর? 

উত্তরে সত্যবতী যে রকম সলজ্জভাবে সায় দিল, তাহাতে মক্ষিও বুঝিল, একবচনের প্রয়োগ সুষ্ঠু হয় নাই। সেও ঈষৎ না হাসিয়া থাকিতে পারিল না। 

একখানি ছোট ঘরের একধারে একই দুগ্ধফেননিভ শয্যায় দুটি নরনারী পরস্পরের একান্ত সন্নিকটে রাত্রিযাপন করে,—এত সন্নিকটে যে ঘুমের ঘোরেও একে অন্যের স্পর্শ পায়। 

সত্যবতী তখনও লজ্জানত চোখ তুলিতে পারে নাই। ইহারই মধ্যে মক্ষির মনে কি ঝড় বহিয়া গেল, সে একেবারে তার গলা জড়াইয়া ধরিয়া প্রশ্ন করিল,—তুমি কি বেশ সুখে আছ? কোনো কষ্ট তোমার নেই? 

মক্ষির মনে কি প্রশ্ন জাগিয়াছিল তাহা সত্যবতী বুঝিল না। তবু শুধু অকারণ আনন্দে এবং লজ্জায় তার মাথা মক্ষির বুকের কাছে আরও ঝুঁকিয়া পড়িল। 

তার পিঠে হাত বুলাইতে- বুলাইতে মক্ষি বলিল,—কোথায় আনন্দ সেইটে আমি বুঝি না। সে সংসারে তুমি খেটে মরছ, তাতে তোমার কোনো অধিকার নেই। একটি পুরুষ তোমায় খেতে দিচ্ছে, আর অবসর সময়ে খুশি হলে একটু সোহাগ জানিয়ে যাচ্ছে। এতেই তুমি আহ্লাদে গলে পড়ছ, আর দ্বিগুণ উৎসাহে খেটে সারা হচ্ছ। আবার পান থেকে চুন খসলে তারও শাস্তি আছে। 

একটু থামিয়া মক্ষি বলিল,—ঠিক পোষা কুকুরের মতো। বেত খেলেই আর্তনাদ করতে-করতে ছোটে, আবার তখুনি আদর করে ডাকলেই কাছে এসে আহ্লাদে লেজ নাড়ে। 

মক্ষির কথা শুনিয়া সত্যবতী গভীর বিস্ময়ে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়াছে। কিন্তু মক্ষির সেদিকে খেয়াল নাই। সে অন্যদিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল,—আচ্ছা, তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার কোনোদিন ঝগড়া হয়নি? কোনো দিন তোমার স্বামী তোমার সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করেন নি? তার পরেও তোমার স্বামীর ‘পরে শ্রদ্ধা রইল? মানুষের শ্রদ্ধা কি চার যুগে অমর? 

সত্যবতী সবিস্ময়ে কহিল, এ সব কি কথা আপনি জিগ্যেস করছেন? এক সঙ্গে ঘর করতে গেলে ঝগড়া আবার কার না হয়? আপনার স্বামীই কি কখনও আপনার সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করেন নি? তার জন্যে কি কখনও আপনার স্বামীর ‘পরে শ্রদ্ধা কমেছে? 

“আপনার স্বামী” কথাটায় মক্ষির যেন চমক ভাঙিল। প্রসঙ্গটিকে সহজ করিবার জন্য সে একটু হাসিয়া বলিল,—কমে না? 

এতক্ষণে সত্যবতী যেন অকূলে কূল পাইল! এবং এত বড় একটা পরিহাস ধরিতে পারে নাই ভাবিয়া অপ্রস্তুতভাবে হাসিয়া মক্ষিকে একটা ঠেলা দিয়া বলিল,—আপনি যেন কি, দিদি! সত্যি আমার এমন ভয় ধরেছিলো! আমি ভেবেছিলাম—

সত্যবতী কথাটা আর শেষ করিল না, টিপিয়া-টিপিয়া কটাক্ষে হাসিতে লাগিল।

একটু পরে সত্যবতী বলিল,—কিন্তু সত্যি দিদি, অকারণে এসে যখন বকে তখন বড় রাগ হয়, মনে হয় আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না। একদিনকার কথা আপনাকে বলি, শুনুন, বলিয়া নড়িয়া চড়িয়া বিজয়িনীর মতো বসিয়া বলিতে লাগিল,—

রান্না হতে একদিন একটু দেরী হয়েছে, এই আর যাবে কোথায়? রেগে-মেগে চীৎকার করে এমনি কথা বলতে লাগলো যে, আমাদের দুই শাশুড়ী-বৌকে নাকের-জলে চোখের জলে করে ছাড়লে। ভাবলাম, মারেই বুঝি। এমন মনটা খারাপ হয়ে গেল তা আর আপনাকে কি বলবো। আমি কি মাইনে-করা রাঁধুনী, না ঝি! সে কথা আপনি শোনেন নি, একেবারে বংশ পর্যন্ত তুলে। ভাবলাম, ওর মুখ আর দেখবো না। বিকেল বেলায় দেখি, এক বাক্স সাবান, এক শিশি তেল কিনে এনে কেবলি এঘর-ওঘর ঘোরা-ঘুরি করছে। আমি তো একেবারে শাশুড়ির পেছনে রান্নাঘরে বসে। শাশুড়ী খাবারটা দিয়ে আসবার জন্যে বার দুই বললেন; আমি কিন্তু কোনো সাড়া দিলাম না। শেষে তিনি নিজেই গিয়ে দিয়ে এলেন। সন্ধ্যেবেলাটাও এমনি করেই কাটলো। অনেক রাত্রে যখন শুতে গেলাম, তখন মাথাটা ভয়ানক ধরেছে। আস্তে আস্তে আর একদিকে মাদুর পেতে শুয়ে পড়লাম। 

তারপরে কি জ্বর! উঃ! দু’দিন কোনো জ্ঞানই ছিল না। যখন জ্ঞান হল দেখি, নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। ওর চোখ বসে গেছে, মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। আমার শিয়রে বসে কেবলি কাঁদছে। আপনিই বলুন দিদি, তখন আর রাগ থাকে? পাশ ফিরে শুতে পারি না, তবু দু’হাত বাড়িয়ে- 

বলিয়া সত্যবতী মক্ষিরই দু’খানি হাত জড়াইয়া ধরিল। 

অত্যন্ত মামুলি গল্প। শতকরা একশত জন স্বামী-স্ত্রীর এমনি ঝগড়া হয়। দিনে বহু আড়ম্বরে কলহ বাধে এবং রাত্রে অতি সহজেই তার নিষ্পত্তি হইতেও দেরী হয় না। এ সম্বন্ধে অনেক তর্কই তোলা যায়। কিন্তু মক্ষি ‘ফ্রয়েড’ পড়ে নাই। 

তার মনে অন্য প্রশ্ন জাগিতেছিল। সে বলিল,—কিন্তু তোমার পতিদেবতা কালকে যদি অন্য ফুলের মধুর নেশায় মত্ত হয়ে ওঠেন, তাহলেও কি এই শ্রদ্ধা রাখা সম্ভব হবে? 

সত্যবতীর মুখ পাংশু হইয়া উঠিল। সে শুষ্ককণ্ঠে বলিল,—সে আশঙ্কা আজও মনে আসে নি দিদি। আমার অদৃষ্টে তাই যদি থাকে, তাহলে কি যে কোরব তাও জানিনে। 

একটু ভাবিয়া লইয়া বলিল,—কিন্তু তাহলেও কি-ই বা করতে পারি? ছেলে দুটো রয়েছে যে। ওদের মর্যাদা বাঁচাতে গেলে এইখানেই আমায় পড়ে থাকতে হবে। অন্যের আশ্রয়ে ওদের মুখ নামিয়ে থাকতে হবে সে আমি সইতে পারবো না। 

রাগে মক্ষির সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল। বলিল,—শুধু এই? আর কোনো প্রতিশোধ তুমি নিতে পার না?—অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অত্যন্ত রূঢ়, কোনো প্রতিশোধ? 

কথাটা সত্যবতী বুঝিতেই পারিল না। অবাক হইয়া সে মক্ষির জ্বলন্ত চোখ দুইটার পানে চাহিয়া কহিল,—এমন কি প্রতিশোধ নিতে পারি? 

পরক্ষণেই চোখ নামাইয়া নিম্নস্বরে কহিল, কিন্তু তোমার কাছে বলে ফেলেছি দিদি, আমার বড়দার স্বভাব বড় ভালো নয়। এই নিয়ে বৌদি যে কি ভাবে দিন কাটায় সে আমি চোখের সামনে দেখেছি। বড়দাকে যে বাঁধতে পারলো না এই লজ্জায় বৌদি কাউকে মুখ দেখাতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে সে নিজে আমাকে এ কথা বলেছে। বড়দাকে নিয়ে লজ্জা কি আমাদেরই কম, দিদি? তার ‘পরে শ্রদ্ধাও কি তেমন আছে? তবু স্নেহ তো কমে নি। তার অমঙ্গলের কথা ভাবতে গেলেও বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। জানালার ফাঁক দিয়া এক টুকরা রোদ ওপাশের দেওয়ালে আসিয়া পড়িয়াছিল। তাহারই আভায় সত্যবতীর অশ্রুসজল মুখখানি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। মক্ষি নির্নিমেষে সেদিকে চাহিয়া রহিল। 

সেদিকে কোনো লক্ষ্য না করিয়াই সত্যবতী কহিতে লাগিল,—সব এক, সব এক, দিদি। ভালো যে বেসেছে, তার বাঁচবার কোনো উপায় নেই। তাই সহস্র সতীন নিয়েও নারী গভীর প্রেমেই নিজেকে স্বামীর বাহুবন্ধনে সঁপে দেয়, আর সহস্র পুরুষের উপভোগ্য যে নারী তারও পদমূলে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পুরুষের বাধে না। দিদি, গুণের হিসাব করে যদি ভালোবাসতে হয়, তাহলে দুনিয়াতে ক’জন পুরুষ আছে যাদের সর্বান্তঃকরণে ভালোবাসতে পারা যায়? 

কিন্তু পরক্ষণেই সকাতরে বলিল,—দোহাই দিদি এসব কথা থাক। এসব আলোচনা মনে-মনেও করতে নেই। 

মক্ষি অবাক হইয়া দেখিল, সত্যবতীর মুখে ব্যথার গভীর রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে,—এত গভীর যে, ছেলে দুটির পর্যন্ত চোখে পড়িয়াছে। প্রভাকর মায়ের কোলের উপর হাঁটু গাড়িয়া দুটি ছোট-ছোট হাত দিয়া তার মুখখানিকে ফিরাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে এবং দিবাকর খেলা ভুলিয়া দেওয়ালে পিঠ দিয়া স্তব্ধ, ব্যথিত নেত্রে মায়ের পানে ঠায় চাহিয়া আছে। 

এমন দশ্য মক্ষি কখনো দেখে নাই। তার শরীরের গ্রন্থি যেন ক্রমশ শিথিল হইয়া আসিতেছিল, আর মনে হইতেছিল, পক্ষাঘাত যেন অজগর সর্পের মতো তার কুশাগ্রশাণিত বুদ্ধিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করিতেছে। সে অলসভাবে পিছনের দেওয়ালে ঠেস দিয়া বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল। 

অনেকক্ষণ পরে সোহাগ মাখানো অভিমানের ভঙ্গিতে সত্যবতী বলিল,—আপনি মানুষকে মিছামিছি ভারী কাঁদাতে পারেন! আপনি ভারী দুষ্টু! 

মক্ষির চিন্তাধারা বহু দূরের পথ খুঁজিতেছিল। কিন্তু গতি তার লুপ্ত হইয়া গেছে। সে চিন্তা ভগ্নকটি সাপের মতো শুধু একই স্থানে আঁকিয়া-বাঁকিয়া, নিজেকেই পীড়িত ও ক্লান্ত করিতেছিল। 

সত্যবতীর অভিমানের সুরটুকুই শুধু তার কানে গেল। তার বুকের পুঞ্জীভূত ব্যথা একবার ঠোটের কোণে কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু সেদিকে পথ না পাইয়া অতি মৃদু দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বাহির হইয়া গেল। মক্ষি কোনো কথাই কহিতে পারিল না। সে শুধু তার ডান হাতখানি বাড়াইয়া দিয়া সত্যবতী পিঠের উপর রাখিল। 

বহুক্ষণ ধরিয়া দিবাকর মায়ের চোখে জল দেখিয়া আপনার মনেই রাগে ফুলিতেছিল। এই অতি ক্ষুদ্র বিসুবিয়াসটি অকস্মাৎ অগ্ন্যুদগার করিয়া উঠিল। ঝগড়ার স্বাভাবিক যে প্রক্রিয়া তার কোনোটিই তার চোখে পড়ে নাই। কিন্তু ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি না থাকায় সে অতি সহজেই অনুমান করিল, মক্ষিই তাহার মাকে কাঁদাইয়াছে। অত বড় মেয়ের সামনে তথাপি সে ধৈর্য ধরিয়াই ছিল। কিন্তু সে সংযমের বাঁধ সে কোনোক্রমেই আর রাখিতে পারিল না, এই পুরুষ-শিশু লাফাইয়া মক্ষির সুমুখে আসিয়া হাতের খেলনা উঁচাইয়া দাঁড়াইল। 

এক মুহূর্তে ঘরের গুমট কাটিয়া গেল। দুইটি মেয়েই এই কাণ্ড দেখিয়া অত্যন্ত জোরে হাসিয়া উঠিল এবং ক্রোধে কম্পমান বিসুবিয়াস হাতের খেলনা দূরে ফেলিয়া দিয়া মায়ের কোলে আছড়াইয়া পড়িয়া এমনি জোরে পা ছুঁড়িতে লাগিল যে, মায়ের পক্ষে সে তাল সামলানো কঠিন হইয়া উঠিল। রাগে ছেলেটার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু কাঁদে না শুধু মেঝের ওপর পা ছোঁড়ে। 

অনেকক্ষণ পরে রাগ থামিল, এবং রাগ যে থামিয়াছে তার চিহ্নস্বরূপ দিগ্বিজয়ী রাজার মতো মক্ষির কোলের উপর বিজয়-গর্বে গিয়া বসিল। একপশলা বৃষ্টি হইয়া গেছে, তথাপি তার মুখের উপর থেকে গুমটের চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছিয়া যায় নাই। মক্ষি অতৃপ্তভাবে সেই মুখখানিকে বারম্বার চুম্বন করিতে লাগিল। 

প্রভাকর দূরে সরিয়া অবাক হইয়া দাদার রণকৌশল দেখিতেছিল। দিবাকর যখন মায়ের কোলে আছাড়ি-পিছাড়ি করিতেছিল সে বিজ্ঞের মত সরিয়া গিয়াছিল। বুঝিয়াছিল, সরিয়া না গেলে এ তোড়ের মুখে সে কুটার মতো ভাসিয়া যাইবে। এখন জোয়ার কাটিয়া যাইতে সে অগ্রজের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হইয়া উঠিল এবং আপনার ন্যায্য অংশ গ্রহণ করিবার জন্য মক্ষির মুখের কাছে মুখ বাড়াইয়া দিল। 

কচি শিশুর ঠোটে এত মধু! মক্ষির যেন আর তৃপ্তির শেষ হইতেছিল না। কিন্তু প্রভাকর অতি সুবিবেচক ব্যক্তি। নিজের ন্যায্য অংশ বুঝিয়া পাইতেই সে মক্ষির মুখখানি মায়ের দিকে ফিরাইয়া মায়ের ঠোঁট দুখানির দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল। 

মক্ষির আজ কি হইয়াছে কে জানে, সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া সত্যবতীকে জড়াইয়া ধরিল, এবং তাহার যথেষ্ট অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মুখখানি টানিয়া তুলিয়া সেখানে গোটা কয়েক চুমু আঁকিয়া দিল Į 

মুখ সরাইয়া লইয়া সত্যবতী বলিল,—দিদি যেন কী! 

ফিরিবার পথে মক্ষির মনে হইল তাহার দেহের ওজন একেবারে হাল্কা হইয়া গেছে। পা যেন মাটি ছুঁইয়াও ছোঁয় না। 

বেলা তখন চারটার বেশী হইবে। মক্ষি তাড়াতাড়ি চা তৈরী করিতে বসিল। কিন্তু চায়ের জল ফুটিয়া-ফুটিয়া নিঃশেষ হইয়া গেল, তথাপি সমীরণের আসিবার নামটি নাই। মক্ষি রীতিমত অধৈর্য হইয়া উঠিল। 

একবার গিয়া দোকান ঘরের ভিতরের দিকের দরজায় কান পাতিল। সমীরণ তখন একজন গ্রাহকের সঙ্গে কয় আনা পয়সা লইয়া একরকম ধস্তাধস্তি বাধাইয়া দিয়াছে। ব্যাপার দেখিয়া মক্ষির হাসি আসিল। দোকানদারী যে সমীরণকে এমন করিয়া পাইয়া বসিতে পারে তাহা সে ভাবিতেই পারে নাই। মুহূর্তের মধ্যে তার মনে পড়িয়া গেল অতীতের দিনের সেই ঘটনাটি, যেদিন সমীরণ ছাদে চাঁদের আলোয় বসিয়া গত জন্মের প্রিয়াকে তন্ময় হইয়া স্বপ্ন দেখিতেছিল। কথাটা ভাবিতেই মক্ষির সর্বাঙ্গে যেন পুলকের বিদ্যুৎ বহিয়া গেল। চোখের সামনে সমীরণের সেই তন্দ্রা-জড়িত আবেশমাখা চোখ দুটি ভাসিয়া উঠিল। সেদিন তার পানে চাহিয়া সমীরণের যেন আর চোখের পলক পড়িতে চাহিতেছিল না। তার মধ্যে কি দেখিয়াছিল সে? 

মক্ষির দেহলতা প্রদীপের শিখার মতো কাঁপিয়া উঠিল। মনে হইল, সে বুঝি আর দাঁড়াইতে পারে না। কেহ আসিয়া যদি তাহাকে সর্বাঙ্গ দিয়া বেষ্টন করিয়া ধরে সে বাঁচিয়া যায়। 

কতক্ষণ পরে তাহার যেন মনে হইল, দোকানের গণ্ডগোল থামিয়া গেল। গ্রাহকটি আপন মনেই বিড় বিড় করিতে করিতে চলিয়া যাইতেছে এবং টাকা বাজাইতে বাজাইতে সমীরণ মধুর কণ্ঠে তাহাকে বুঝাইয়া দিতেছে যে, যত সস্তায় সে কাপড় লইয়া গেল এত সস্তায় কেহ কোনদিন পায় নাই। গ্রাহক মহাশয়ের বিশেষ খাতিরেই সে অত সস্তায় মাল ছাড়িয়া দিল। 

আপনাকে সামলাইয়া মক্ষি আবার রান্নাঘরে ফিরিয়া আসিল। চায়ের কেলী হইতে তখন প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া উঠিতেছিল। ঊর্ধ্বায়মান ধোঁয়ার কুণ্ডলীর পানে চাহিয়া সেও ভাবিতে লাগিল,—সে ভাবনার কোনো কূলকিনারা নাই,—ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট, অথচ সূক্ষ্ম এলোমেলো ভাবনা, যা তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে একাকার করিয়া দিল। আর তারই মাঝে রহিয়া রহিয়া অতি অস্পষ্ট আশার আলো এমন করিয়া ঝিলিক মারিতে লাগিল যে, নিজেকে সামলাইয়া রাখা কঠিন হইয়া পড়িল। 

এমন সময় সমীরণ আসিয়া পরিহাসের ভঙ্গিতে বলিল,—নমস্কার! গ্রাহককে ঠকাইয়া সমীরণ বোধ হয় অত্যধিক খুশি হইয়া উঠিয়াছিল। 

প্রত্যুত্তরে মক্ষিও একটা নমস্কার করিয়া ফেলিয়া অপ্রস্তুত ভাবে হাসিতে লাগিল। মক্ষিকে এমন করিয়া হাসিতে সমীরণ কখনও দেখে নাই। তার সমস্ত দেহ হাসির আনন্দে নদীর তরঙ্গের মতো হিল্লোলিত হইয়া উঠিতেছিল। সমীরণ অবাক হইয়া সে দিকে চাহিয়া রহিল। কথার আনন্দে মানুষ হাসে, কিন্তু সে অন্য। ও যেন হাসির আনন্দেই অফুরন্ত হাসিয়া চলিয়াছে। 

উঠানে খাটিয়ার নীচে একবাটি চা রাখিয়া মক্ষি বলিল,—এইখানে বোসে চা-টুকু খাও দিকি। আজকে তোমার দেরী করার মজা দেখাচ্ছি। খাবার তৈরী হবে, সেই খাবার খেয়ে তবে বেরুতে পাবে। ততক্ষণ ওইখানে চুপ করে বসে থাক। 

এ কথার সমীরণ কোনো জবাব দিল না। বিস্ময় তার তখনও কাটে নাই। তার কেবলি মনে হইতেছিল, এ বুঝি অন্য মেয়ে মক্ষির মুখ দিয়া কথা কহিতেছে। দুটি ভীরু, বুভুক্ষু চক্ষু দিয়া সে মক্ষির গতিভঙ্গি দেখিতে লাগিল। 

ছোট রান্নাঘরখানির মধ্যে মক্ষির গতি অপরূপ লীলাভঙ্গে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। ফুল-বাগিচায় ছোট গণ্ডীর মধ্যে ভ্রমরের পাখায় যেমন অফুরন্ত গতির স্পন্দন জাগে তেমনি,—চলিতে পারে না, শুধু তীব্র গতিবেগে কাঁপিয়া সারা হয়। 

মক্ষি চিরদিন এমনি,—দুর্দম তার গতি। বাধা মানিতে চাহে না। সমস্ত শক্তি নিয়া সে প্রবল বেগে বাঁধের উপর আছড়াইয়া পড়ে। এত প্রচুর, এত প্রবল এবং এত তীব্র শক্তি তাহার নারী-দেহ ও নারী-মন বহিতে পারে না, সহিতে পারে না। ভূমিকম্পে বসুন্ধরা যেমন করিয়া কাঁপে, তার দেহ-মন তেমনি করিয়া কাঁপিয়া ওঠে, ভয় হয় সব সুদ্ধ এখনি ভাঙিয়া পড়িল বুঝি। 

খাবার তৈরী করিতে মক্ষির আধ ঘণ্টার বেশী লাগিল না। একখানি রেকাবীতে অতি পরিপাটি করিয়া খাবার সাজাইয়া সমীরণের কাছে দিতে যাইবার সময় তার যেন পা চলিতে চাহিল না। একবার মনে হইল, যেন বাড়াবাড়ি হইতেছে। সমীরণ হয়তো কি ভাবিয়া বসিবে। কিন্তু বাহিরের পানে আড়চোখে চাহিতেই দেখিল, সমীরণ তারই পানে চাহিয়া আছে। ত্রুটি সংশোধনের অবসর আর মিলিল না। সমস্ত দ্বিধা সবলে সরাইয়া সে খাবার আনিয়া সমীরণের সুমুখে রাখিল। কিন্তু সমীরণের পানে চোখ তুলিয়া আর চাহিতে পারিল না। 

—একটু দাঁড়াও, জল আনছি। 

ত্বরিত পদে এক গ্লাস জল আনিয়া সে একরকম জোর করিয়াই সমীরণের পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল। এবং গভীর উত্তেজনায় ঘামিতে লাগিল। 

খাবারের পরিমাণ দেখিয়া সমীরণের হাসি আসিল। গম্ভীরভাবে বলিল,—আজ রাত্রে কি রান্না হবে না? 

—হবে না কেন! 

—বিকেলের জলখাবারের যা আয়োজন দেখছি তার পরে রাত্রে রান্না করার কি দরকার হবে? 

এই লঘু পরিহাসে মক্ষির অবস্থা যেন সহজ হইয়া আসিল। 

সে কৌতুকে ঘাড় নাড়িয়া বলিল,—হয়েছে, আর বাহাদুরী করতে হবে না।ঠোঁট উলটাইয়া মক্ষি বলিল,—ভারি তো খাবার! 

সমীরণ খাবার খাইতে খাইতে বলিল,—তা ঠিক। বঙ্কিমের জীবানন্দ একাই একটা কাঁঠাল খেয়েছিল,—তার ওপর পান্তা ভাতের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। 

—তবে? 

সমীরণ গম্ভীরভাবে বলিল,—কিন্তু তার জন্য যে জীবানন্দের পেটের অসুখ হয় নি, এমন কথা ‘আনন্দমঠে কোথাও লেখা নেই। 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—তা নেই। কিন্তু পেটের অসুখ যে হয়েছিল তারও কোনো প্রমাণ নেই। 

কথাটা সমীরণ মানিয়া লইল। বলিল,—তা নেই। 

—তবে? 

—হুঁ। সুতরাং আমাকেও সমস্তগুলোই খেতে হবে। নইলে হেরে যাব। কি বল?

মক্ষি হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। 

সমীরণ বলিল,—তাহলে বুঝলে মক্ষি, ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর কেন হয়েছিল? 

এই গবেষণায় মক্ষি হাসিয়া উঠিল। বলিল,—গবেষণা মৌলিক বটে, কিন্তু ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম না। 

সমীরণ বিস্মিতভাবে বলিল,—বলো কি! একটা লোক, যার পেছনে সরকারী ফৌজ তাড়া করেছে এবং দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে হাতকড়ি দেবে, সে একটা কাঁঠাল নির্বিবাদে খেয়ে ফেললে! এর পরেও তোমার হৃদয়ঙ্গম করতে দেরী হচ্ছে, কেন ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর হয়েছিল? 

—কিন্তু এখন, যখন একখানা নিমকী আর একটা রসগোল্লা খেলেই মানুষের অম্বল হয়, এখনই বা মন্বন্তর অবসান হল কই? 

—তা হল না বটে। 

একটু পরে সমীরণ হঠাৎ বলিল, কিন্তু নিমিটা সত্যিই পোড়ামুখী। 

—নিমির অপরাধ? 

সমীরণ হাতের খাবার নামাইয়া রাখিয়া উত্তেজনার ভঙ্গিতে খাটিয়ায় একটা চাপড় মারিতেই মক্ষি শশব্যস্তে তাহাকে বাধা দিয়া বলিল,—কিন্তু নিমির যদি অপরাধ হয়েই থাকে, তার জন্যে দুর্বল খাটিয়াকে কেন দুঃখ দেওয়া? ও কি তোমার চাপড় লইতে পারবে? 

—কিন্তু নিমির অপরাধটা শোনো—সে খেতে দিতেই জানে না।—বুঝতে পারলে না?

—না মহাশয়। 

সমীরণ সোজা হইয়া বসিয়া বলিল,—আরে, শান্তি রইলো আড়ালে, আর নিমি বসলো ভাইকে খাওয়াতে। তার যদি কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকতো, তাহলে শান্তিকেই সামনে বসিয়ে রেখে নিজে একটা কোন ছুতোয় উঠে যেত। হলোও তেমনি, ভীমের দ্বাদশীর পারণ। আরে রামঃ! ওকে কি খাওয়া বলে? ও শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তি মাত্র। 

মক্ষি হাসিয়া বলিল,—তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে খাওয়া এবং ক্ষুন্নিবৃত্তি দুটি পৃথক পদার্থ। 

—আজ্ঞে হ্যাঁ মহাশয়। ওর চেয়ে বরং রবীন্দ্রনাথ ভালো। বিমলা সন্দীপকে যখন খেতে দিল, তখন শুধু অন্ন নয়, তার সঙ্গে অন্নপূর্ণাও উপস্থিত ছিলেন। সন্দীপের সেই কথাটি মনে আছে তো?-”আমাকে পেটুক ঠাওরাবেন না, আমি খাবার লোভে এখানে আসিনি। আমার লোভ কেবল আপনি ডেকেছেন বলে।’ এতে করে, স্থূল বৃত্তিগুলো তলায় পড়ে যায় এবং খাওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় সময় হরণের উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য যে কি সে না বললেও চলে। 

কথার স্রোত নিমির দিক হইতে বিমলার দিকে মোড় ফিরিতে মক্ষি কেমন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। সহজ ভাবে এই প্রসঙ্গে যোগ দিতে পারিল না, শুধু গভীর আশঙ্কায় রুদ্ধনিশ্বাসে কথার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে লাগিল। 

সমীরণ বলিতে লাগিল,—কিন্তু সব চেয়ে বেশী ফুটিয়েছেন শরৎচন্দ্র। ‘পল্লীসমাজে’ রমা যখন রমেশকে খাওয়াচ্ছে 

উত্তেজনার আবেগে সমীরণ দুইটা হাত ঘসিতে-ঘসিতে বলিল, কিন্তু সে জায়গাটা তোমাকে আমি পড়ে শোনাচ্ছি দাঁড়াও। 

এক মিনিটের মধ্যে সমীরণ একখানা ‘পল্লীসমাজ’ আনিয়া পড়িতে লাগিল,—

সম্মুখে বসিয়া আহার করাইয়া, পান দিয়া, বিশ্রামের জন্য নিজের হাতে সতরঞ্চি পাতিয়া দিয়া, রমা কক্ষান্তরে গেল।…রমা বিশেষ কিছুই এখানে তাহার আহারের জন্য সংগ্রহ করিতে পারে নাই। নিতান্তই সাধারণ ভোজ্য ও পেয় দিয়া তাহাকে খাওয়াইতে হইয়াছে। এইজন্য তাহার বড় ভাবনা ছিল, পাছে তাহার খাওয়া না হয় এবং পরের কাছে নিন্দা হয়। হায় রে পর! হায় রে তাদের নিন্দা! খাওয়া না হইবার দুর্ভাবনা তাহার নিজেরই কত আপনার!…এই আহার্যের স্বল্পতার ত্রুটি শুধু যত্ন দিয়া পূর্ণ করিয়া লইবার জন্যই সে সম্মুখে আসিয়া বসিল। আহার নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল, গভীর পরিতৃপ্তির যে নিশ্বাসটুকু রমার নিজের বুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল, তাহা রমেশের নিজের চেয়ে যে কত বেশী, তাহা আর কেহ যদি না জানিল, যিনি সব জানেন, তাঁহার কাছে ত গোপন রহিল না।

সমীরণ আড়চোখে একবার মক্ষির পানে চাহিয়া দেখিল, তার মাথা যেন মাটির সঙ্গে মিশিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। সে পড়িতে লাগিল,—

প্রত্যুত্তরে রমেশ শুধু একটা নিশ্বাস ফেলিল। খানিক পরে রমার মত ধীরে ধীরে বলিল,—”কিন্তু তোমাকে স্মরণ ক’রে বলছি, আজ আমার এ কথা কোন মতেই মনে হচ্ছে না। আমি তোমার তো কেউ নয় রমা, বরং তোমার পথের কাঁটা। তবু প্রতিবেশী ব’লে আজ তোমার কাছে যে যত্ন পেলুম, সংসারে ঢুকে এ যত্ন যারা আপনার লোকের কাছে পায়, আমার তো মনে হয়, পরের দুঃখ-কষ্ট দেখলে তারা পাগল হ’য়ে ছোটে। এই মাত্র আমি একা ব’সে চুপ ক’রে ভাবছিলুম, আমার সমস্ত জীবনটি যেন তুমি এই একটা বেলার মধ্যে আগাগোড়া ব’দলে দিয়েচ। এমন ক’রে আমাকে কেউ কখনও খেতে বলেনি, এত যত্ন ক’রে আমাকে কেউ কোনদিন খাওয়ায় নি। খাওয়ার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে, আজ তোমার কাছে প্রথম জানলাম, রমা।” 

সমীরণ আর পড়িতে পারিল না। দুর্দম আবেগে উঠিয়া একেবারে মক্ষির অতি সন্নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। মক্ষির সমস্ত দেহ তখন থর থর করিয়া কাঁপিতেছিল এবং যেন কিসের প্রতীক্ষায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। কিন্তু সমীরণ প্রাণপণ বলে আপনাকে সামলাইয়া লইয়া বলিল,—আমার বাইরে নিমন্ত্রণ আছে। রাত্রে আর খাব না। ফিরতে দশটা হবে। 

এক নিঃশ্বাসে কোনোমতে এই কয়টা কথা বলিয়াই সমীরণ চলিয়া গেল, আর একমুহূর্ত দাঁড়াইতে সাহস করিল না। 

ধীরে-ধীরে সমীরণের পদশব্দ মিলাইয়া গেল। মক্ষি সেদিকে না চাহিয়াও বুঝিল, সমীরণ চলিয়া গেছে। তথাপি তাহার ঘোর কাটিতে চাহিল না। 

বহুক্ষণ পরে সে যখন মাথা তুলিল, তার চোখের পাতা ভারি হইয়া উঠিয়াছে, ভালো করিয়া মেলিতে পারে না। চারিদিকে একবার চাহিয়া দেখিল। সমীরণ নাই, তবু ভয় গেল না। কিছুক্ষণ পরে সমীরণের পাতের উপর দৃষ্টি পড়িল। দেখিল, কিছুই খাওয়া হয় নাই, সবই প্রায় পড়িয়া আছে। কিন্তু তার জন্য তাহার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়াও উঠিল না, চোখ ফাটিয়া দরদর ধারে অশ্রুও গড়াইয়া পড়িল না। বুকের ভিতরটা তাহার এমন করিয়া টিপ্‌ টিপ্‌ করিতেছিল যে, আর সমস্ত অনুভূতিই যেন নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। 

সে ধীরে-ধীরে সমীরণের চায়ের বাটি ও খাবারের রেকাবী রান্নাঘরে লইয়া আসিল। উনানে গন্ গন্ করিয়া কয়লা জ্বালিতেছিল। কিন্তু শুধু নিজের জন্য রাঁধিতে তাহার ইচ্ছা করিল না। উনানের আগুন নিভাইয়া, রান্নাঘরের শিকল টানিয়া দিয়া সে সমীরণের ঘরে আসিল, বোধ হয় ‘পল্লীসমাজ’ খানি যথাস্থানে রাখিয়া দিতেই। কিন্তু কি ভাবিয়া অলসভাবে সমীরণের বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বইখানির পাতা উল্টাইতে লাগিল। 

সত্যবতী জানে, সমীরণ মক্ষির স্বামী। মক্ষি আপন মনেই একটু হাসিল। এখানে সবাই তাই জানে, সেইরকমই জানানো হইয়াছে। না জানাইলে কি রক্ষা ছিল! শত কৌতূহলী চক্ষু প্রচুর অধ্যবসায়ের সঙ্গে এই দিকে ধাবিত হইত। 

কিন্তু কথাটা মিথ্যা তো নয়। সমীরণই তো তাহার স্বামী। মন্ত্র পড়ে নাই, বিবাহও হয় নাই, কিন্তু সুদীর্ঘ দিনের একত্রবাসে যে একে অন্যের মন জয় করিয়াছে ইহা তো সত্য। 

মক্ষি পাশ ফিরিয়া শুইল। বইখানি পিছনে পড়িয়া রহিল। 

এই শয্যাই তাহার সত্যকার শয্যা। ইহার উপর তাহার অধিকার আছে। সে অধিকার সে যদি প্রতিষ্ঠিত করে কেহ বাধা দিতে পারে না। লজ্জা? হ্যাঁ, লজ্জা একটু করে বই কি! মেয়েদের লজ্জা করিবে না? কিন্তু 

মক্ষির সমীরণের উপর রাগ হইল। 

সমীরণের এত লজ্জা কেন? সে কি কিছুই বুঝিতে পারে না? সে কি ভাবিয়াছে, মক্ষি নিজে হইতে তাহার বাহুতে ধরা দিবে? তা কি হয়? মেয়েরা কখনও উপযাচিকা হইয়া ধরা দিতে পারে? 

কিন্তু সমীরণ অমনিই চিরদিন। কোথাও কাহারও উপর জোর খাটায় না,—কোথাও নিজের জোরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহে না। অন্তরের সমস্ত বেদনার বিরুদ্ধে একাকী অতি গোপনে সে সংগ্রাম করিবে, তবু মুখ ফুটিয়া কাহারও অনুগ্রহ ভিক্ষা করিবে না,—অমনিই চিরদিন। 

তাও তো করিয়াছে। কতদিন কতভাবে আপনার অন্তরের কথা নিবেদন করিতে বাকী তো রাখে নাই। সে-ই সাড়া দিতে পারে নাই। 

বইখানি পিঠের নীচে পড়িয়া যাওয়ায় মক্ষির কেমন অস্বস্তি লাগিতেছিল। বাঁ হাত দিয়া বইখানা তুলিয়া সুমুখে আনিল এবং অনাবশ্যক ভাবে আবার তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। 

কিন্তু তাই কি কোনো মেয়ে পারে? সে তো কখনও প্রত্যাখ্যান করে নাই। কখনও তো বলে নাই, সমীরণ, এ তোমার অন্যায় স্পর্ধা! আবার কি করিয়া সে মনের কথা প্রকাশ করিতে পারে? এই কি যথেষ্ট নয়? 

সত্যবতীর ছেলে দুটি বেশ। অমন ছেলে যে-কোনো মায়ের কাছে ঐশ্বর্য। ছেলেদের ছেলেমী ভারী সুন্দর। 

দিবাকর প্রভাকরের দ্বিপ্রহরের কাণ্ড মনে করিয়া অজ্ঞাতেই মক্ষির ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা খেলিয়া গেল। 

বেশ আছে সত্যবতী। অমনি সুন্দর দুটি ছেলে দিনরাত্রি পায়ে পায়ে ফিরিলে কাজ করিতেও আনন্দ লাগে। তার স্বামীকে মক্ষি দেখে নাই। তবু মনে হইল, স্বামীর প্রেমে মেয়েটি বিভোর হইয়াই আছে। 

সত্যবতী ঠিকই বলিয়াছে। অঙ্ক কষিয়া, চুল চিরিয়া অধিকার বিভাগ করিয়া হয়তো ঘর করা যাইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা যায় না। স্বামীর স্ত্রীর উপর ঠিক কতখানি অধিকার থাকিবে, কোথায় তাহার সীমারেখা অতিক্রম করিলে স্বামীকে কি ভাবে শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে, এ তর্ক আর যারই মনে উঠুক প্রণয়ীর মনে ওঠে না। ওঠে তখনই যখন প্রেম শিথিল হইয়া আসে। তখন অতি তুচ্ছ কারণকে উপলক্ষ্য করিয়া উভয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়, আর তারই ঢেউ খবরের কাগজে পর্যন্ত ফেনিয়ে ওঠে। 

দোষ-ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি মানুষের হয়। কোনো দিন কোনো ত্রুটি করিবে না এমন গ্যারান্টি দিয়া কে মাল্যদান করিতে পারে? সে ত্রুটি ক্ষমা করা ছাড়া উপায় কি? যার প্রেম যত বড়, তার ক্ষমা করিবার শক্তিও তত বড়। 

কিন্তু বিবাহকে সে কোনো মতেই বড় আসন দিতে পারে না। ওটা একটা অনুষ্ঠান মাত্র, যার কোনো প্রয়োজনই নাই। কিছু প্রয়োজন যদিই বা থাকে তা অতি সামান্য। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি,’ এই কথাটাই সব চেয়ে বড়। অগ্নিসাক্ষী করিয়া শপথ করা নিষ্প্রয়োজন এবং আদালতে গিয়া রেজেস্ট্রি করা প্রেমের অপমান। 

মানুষের জীবনে ভালোবাসিতে পারার চেয়ে সার্থকতা আর আছে? অথচ, ইহারই জন্য কত লজ্জা, কতই না সঙ্কোচ! 

ঠিক এমনি সময়ে বাহিরে সমীরণের পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং যে লজ্জা ও যে সঙ্কোচকে মক্ষি এই মাত্র আপনার মনে ধিক্কার দিতেছিল, তাহাই তাহাকে এমন করিয়া পাইয়া বসিল যে, সমীরণের অতর্কিত আগমনে কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া তাড়াতাড়ি পাশের চাদরটা টানিয়া আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া এক কোণে জড়-সড় হইয়া শুইয়া পড়িল। 

সমীরণেরও বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলিতেছিল। মক্ষির একান্ত সন্নিকটে দাঁড়াইয়াও সে যে কি করিয়া আপনাকে সম্বরণ করিয়াছে সে কথা সে ভিন্ন আর কেহ বুঝিবে না। কিন্তু ধাক্কাটার ওইখানেই শেষ হয় নাই। 

সমস্ত পথ এবং নিমন্ত্রণ বাড়ীতে বসিয়াও তাহার কেবলই মনে হইতেছিল, এমন করিয়া আর কতদিন তিল তিল করিয়া নিঃশব্দে নিজেকে দগ্ধ করিবে সে? এত বড় বিড়ম্বনা আর কতদিন সহা যায়? আজ সে দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছে, মক্ষির কাছে স্পষ্ট কথা শুনিয়া লইবে। তারপর? তারপর অনন্ত পৃথিবী এবং অনন্ত কাল সুমুখে পড়িয়া আছে। তারই মধ্যে সে কি নিজেকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে পারিবে না? 

এত বড় সঙ্কল্প লইয়াই সে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। এবং প্রবেশ মাত্র চোখে পড়িল, মক্ষি আপাদমস্তক আবৃত করিয়া তাহারই শয্যার এক প্রান্তে কাঠ হইয়া শুইয়া আছে। 

সঙ্কল্পের দৃঢ়তা এক নিমিষে কোথায় উড়িয়া গেল। অজানা আশঙ্কায় তাহার বুক দুরু দুরু করিয়া উঠিল, মক্ষি কি অসুস্থ? 

ছুটিয়া আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া সে মক্ষির ললাটে হাত দিল,—উত্তাপ স্বাভাবিক। 

কিন্তু মক্ষির স্পর্শে কিছু বুঝি ছিল। তারপরে কি হইল তাহা সমীরণও বুঝিতে পারিল না। যখন বুঝিল, তখন একই শয্যায় দু’জনে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ। ধীরে ধীরে সমীরণ একবার চোখ মেলিয়া চাহিল এবং মক্ষির কানের কাছে মুখ লইয়া অতি অস্ফুট স্বরে কহিল,—এই দিনটির জন্যে কত যুগ থেকে অপেক্ষা করে আছি। 

মক্ষি কিন্তু চোখ মেলিতে পারিল না। তাহার সর্বাঙ্গ আরও সঙ্কুচিত হইয়া আসিল। শুধু ঠোঁট দুটি একবার কাঁপিয়া উঠিল। বুঝি বলিতে চাহিল,—আমিও। 

কিন্তু পারিল না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *