যে মানুষটা পাল্টে গিয়েছিল,
যে মানুষটা পাল্টাতে পারেনি
সকালবেলাতেও বৃষ্টি পড়া থামেনি। এরকম কড়া বৃষ্টিকে অজুহাত হিসেবে ধরে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠাই যায়। তবে ঘুম আসল না। বরং সে সময়টাকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বানাতে কাজে লাগালাম।
শুয়ে শুয়েই আমার বানানো তালিকাটার প্রতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মিয়াগি আমার পাশে এসে দাঁড়াল, “আজ আপনি কীভাবে সময় কাটাবেন?” তার থেকে খারাপ সংবাদ পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, তাই মুখ শক্ত করে রাখার চেষ্টা করলাম। তার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন, মুখে তার কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে দেয়া যাবে না। কিন্তু মিয়াগি আর কিছুই বলল না, সেও আমার তালিকার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মানে তার প্রশ্নটার মধ্যে কোনো গূঢ়াৰ্থ নেই।
.
সকালের আলোয় মিয়াগিকে নতুন চোখে দেখলাম।
প্রথমবার তার সাথে দেখা হবার সময় আমার মনে হয়েছিল, মেয়েটা দেখতে মন্দ না। বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে সে।
পরিষ্কার করেই বলি। দৈহিক গঠনের (হ্যাঁ, শুধুমাত্র দৈহিক কাঠামোর কথা হিসেবে নিলেই) দিক থেকে সে পুরোপুরি আমার পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী। শান্ত দুজোড়া চোখ; গোমড়া দেখায় এমন ভ্রু; গোলাকৃতি ঠোঁট; নরম, রেশমি চুল; টানটান থাকা আঙুল, ধবল সাদা ঊরু-যদি আমার পছন্দের সবকিছু তালিকা করতে শুরু করি, তবে আমি বোধহয় আর থামতে পারব না।
সেজন্যই সে আমার ঘরে পা ফেলার পর থেকেই এতটা আত্মসচেতন বোধ করছি আমি। আমার পছন্দের সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটা মানুষের সামনে আমাকে যাতে বোকাসোকা না লাগে, সে ভয়ে আছি আমি। নিজের সব বদভ্যাস এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও আমি তার সামনে আড়াল করতে চাইছিলাম।
“সম্পূর্ণ নিজ আগ্রহ থেকে জানতে চাইছি,” মিয়াগি মুখ খুলল, “আসলেই আপনি এই তালিকার কাজগুলো করতে চান?”
“আমি নিজেও সেটা নিয়েই ভাবছিলাম।”
“বলতে খারাপ লাগছে, তবে আপনার তালিকাটা বোধহয় অন্য কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত। আমার মনে হচ্ছে, একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ মৃত্যুর আগে যেসব কাজ করার তালিকা বানায়, আপনি সেটাই হুবহু করতে চাইছেন।”
“ভুল বলেননি,” স্বীকার করলাম। “সত্যি বলতে কী, এমনও হতে পারে, ঐ তালিকার একটা কাজও আমি করলাম না। কিন্তু একদম খালি হাতে, কর্মশূন্য অবস্থায় তো বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই অন্যের কাজগুলো কপি করে এই তালিকা বানিয়েছি।”
“তা সত্ত্বেও আমার মনে হয় আপনার উপযুক্ত কাজ চাইলেই বের করা যাবে,” হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষায় কথা বলে সে ঘরের কোণে ফিরে গেল।
ঐ দিন সকালবেলাতেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম।
আমার ভেতরের কুৎসিত, প্যাঁচালো কামনাবাসনাগুলোর প্রতি আমার সদয় হতে হবে। সামনের এই শেষ তিনমাসে আমাকে আরও স্বার্থপর, আরও অশ্লীল, প্রবৃত্তির প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে।
এই পর্যায়ে এসে আমার হারানোর আর কীই-বা বাকি আছে? কোনো কিছু রক্ষা কিংবা বাঁচানোর মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তালিকাটার দিকে আবার আড়চোখে তাকালাম। কোনোমতে শক্তি জোগাড় করে পরিচিত একজনকে ফোন দিলাম
কয়েকবার রিং হতেই মানুষটা ফোন ধরল।
***
স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। হাতে ছাতা নিয়ে বের হয়েছিলাম, অথচ সেটা ব্যবহার করতে হলো না বললেই চলে। এটাও আমার দুর্ভাগ্যের একটা নমুনা। সময়মতো কাজ না করার দৃষ্টান্তের ঝুলিতে আরেকটা দৃষ্টান্ত যোগ হলো। মেঘের আড়ালে থাকা আকাশকে সরিয়ে দিয়ে ঝকঝকে নীলাকাশ জায়গা করে নিয়েছে। তাই আমার হাতে ছাতা দেখলে যে কারো সেটা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে। অনেকটা স্কেটিং এর জুতো পরে রাস্তায় এখন হাঁটলে যেরকম লাগার কথা, ছাতা হাতে সেরকমই লাগছে।
ভেজা রাস্তার পিচে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। গরম থেকে বাঁচতে স্টেশনের ভেতর ঢুকে পড়লাম, কিন্তু ভেতরেও একই অবস্থা।
অনেকদিন হয়ে গিয়েছে ট্রেনে চড়ি না। প্লাটফর্মের ওয়েটিং এরিয়াতে ঢুকে ডাস্টবিনের পাশে থাকা একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে কোলা কিনলাম এরপর ওয়েটিং এরিয়ায় বসে তিন ঢোকে সেটাকে খতম করে দিলাম আমি। মিয়াগি একটা পানির বোতল কিনেছে। চোখ বন্ধ করে গলায় ঢেলে দিচ্ছে সেটা।
জানালা থেকে আকাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। দূরে একটা রংধনু আকাশে ঝুলে রয়েছে।
রংধনু বলতেও যে কিছু একটা রয়েছে, তা ভুলেই গিয়েছিলাম। জানতাম-মনে রাখা দরকার ছিল রংধনুর কথা, কখন সেটা দেখা যায় আর মানুষজন সেটা দেখলে কীরকম প্রতিক্রিয়া করে।
কিন্তু এটা একদম নিখাদ সত্য যে, রংধনু বলেও যে কিছু একটা রয়েছে এই পৃথিবীতে, সেই তথ্যটা আমার মস্তিষ্ক থেকে একসময় বিদায় নিয়েছিল।
নতুন চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা নতুন জিনিস উপলব্ধি করলাম। এই বিশাল আকারের রংধনুর কেবল পাঁচটা রং আমার চোখে ধরা পড়ছে, দুটা কম দেখতে পাচ্ছি আমি। লাল, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি। কোন দুটা দেখতে পাচ্ছি না আমি? একটা রঙের প্যালেট কল্পনা করতে হলো আমাকে, তারপরেই বুঝতে পারলাম-কমলা আর আসমানি রং।
“হুম, আপনার ওটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখা উচিত,” মিয়াগি পাশ থেকে বলে উঠল। “হয়তো এটাই আপনার জীবনের দেখা শেষ রংধনু হতে পারে।”
“তা ঠিক,” আমি বললাম। “এমনও হতে পারে যে, আমি এই ওয়েটিং এরিয়াতে সর্বশেষ বারের মতো এসেছি, হয়তো সর্বশেষ বারের মতো কোলা খাচ্ছি, এমনকি সর্বশেষবারের মতো কোলার খালি ক্যান ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছি।”
বলে হালকা-নীল রঙের ডাস্টবিনে সোডা ক্যানটা ছুঁড়ে মারলাম। ক্যানের ধাতব ঝনঝন শব্দ ওয়েটিং এরিয়া জুড়ে শোনা গেল।
“সবকিছুই আমার জন্য শেষবার হতে পারে। কিন্তু সেটা তো আয়ু বিক্রি করে দেবার আগে থেকেই সত্য,” আমি বললাম। কিন্তু মিয়াগির কথাগুলো ভেতরটা অস্থির করে দিল।
রংধনু, ওয়েটিং রুম আর খালি সোডা ক্যানের স্মৃতি নাহয় বুঝলাম। কিন্তু মৃত্যুর আগে আমি একটা সিডি কতবার শুনতে পারব? কতগুলো বই পড়তে পারব? কতগুলো সিগারেট খেতে পারব?
.
এসব চিন্তা আমার মনে ঝড় তুলছিল।
মৃত্যু মানে মৃত্যু বাদে বাকি সবকিছুকে বিদায় জানানো।
ট্রেন থেকে নেমে পনেরো মিনিট বাসযাত্রার পর নারুসের সাথে যেখানে দেখা করতে যাচ্ছি, সেই রেস্তোরাঁয় উপস্থিত হলাম।
নারুসে আমার হাইস্কুলের বন্ধু। গড়পড়তা উচ্চতা, কিংবা তার থেকে খানিকটা কমও হতে পারে। আর চেহারাটা দেখলে মনে হবে কেউ বোধহয় পাথর কুঁদে তাকে বানিয়েছে। দ্রুত চিন্তাভাবনা করতে সে পারদর্শী, সেই সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারার বিশাল বড় ক্ষমতা আছে তার। তাই মানুষজন তাকে বেশ পছন্দ করত। আসলে এখন ভাবতে বেশ অদ্ভুতই লাগছে, আমার মতো নিঃসঙ্গ একটা মানুষেরও বন্ধু সে।
আমাদের মধ্যে একটা জিনিসেরই মিল ছিল : আমরা গোটা দুনিয়ার মোটামুটি সবকিছুকেই হেসে উড়িয়ে দিতে পারতাম। হাইস্কুলে থাকতে একটা ফাস্টফুডে রেস্তোরাঁয় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম আমরা। প্রত্যেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে করতে জিনিসটাকে একদম পানসে বানিয়ে ফেলতাম।
খুব ইচ্ছে করছিল ওভাবে আগের মতো সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিতে। আমার প্রথম লক্ষ্য এটাই।
কিন্তু তার সাথে দেখা করার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল।
নারুসের জন্য অপেক্ষা করার সময় মিয়াগি পাশে এসে বসল। মাঝেমধ্যে আমাদের চোখাচোখি হলেও কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে দেখা গেল না।
যেখানেই আমি যাই না কেন, মিয়াগি আমাকে পেছন থেকে অনুসরণ করবে, আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে-আশা করছি নারুসে এসব ব্যাপার লক্ষ্য করে ভুল অর্থটা ধরে নেবে।
হ্যাঁ, আমার কাজকর্ম একদম নিচু লেভেলের হচ্ছে আমি স্বীকার করছি। কিন্তু এই কাজটাই আমি মন থেকে করতে চাইছি, তাই ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিলাম। বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু আয়ু বিক্রি করে দেবার পর এই কাজটাই প্রথম নিজে থেকে করতে মন চাইল।
“মিস পর্যবেক্ষক, শুনছেন?” মিয়াগিকে বললাম।
“কী হয়েছে?”
গলার পেছনের দিকটা চুলকাতে চুলকাতে বলতে যাচ্ছিলাম, “আমার একটা কাজ—”
আমি চাইছিলাম, নারুসে তাকে যাই জিজ্ঞেস করুক না কেন, সে যেন সবকিছু এড়িয়ে যায় কিংবা সেসব প্রশ্ন মাথায় না রাখে। ঠিক ঐ মুহূর্তে একজন ওয়েট্রেস হাসিহাসি মুখ করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
“মাফ করবেন, কী খাবেন ঠিক করেছেন?”
নিরুপায় হয়ে একটা কফির অর্ডার দিলাম। মিয়াগিকেও জিজ্ঞেস করলাম এই ফাঁকে, “আপনার কিছু লাগবে না?”
মিয়াগি একটু বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, “ইয়ে-অন্যদের সামনে আমার সাথে কথা বলাটা আপনার জন্য ঠিক হবে না।”
“কেন, সমস্যা কোথায়?”
“একদম শুরুতেই আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম আপনাকে, এতটুকু হলেও মনে রাখা উচিত ছিল আপনার-আমার মতো পর্যবেক্ষকদের অস্তিত্ব কারো চোখে ধরা পড়ে না-যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সে বাদে আর কেউ আমাদের লক্ষ্য করে না। এই যে দেখুন।”
মিয়াগি হাত বাড়িয়ে ওয়েট্রেস এর জামার হাতা ধরে টান দিল। সে ঠিকই বলেছিল, ওয়েট্রেস কিছুই টের পেল না।
“আমার দ্বারা অন্যের ওপর কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়াই তৈরি করা সম্ভব না,” মিয়াগি ব্যাখ্যা করতে লাগল। একটা গ্লাস সে হাতে নিয়ে ওপরে উঠাল। “তাই আমি যদি এই গ্লাসটা ওপরে উঠাই, হয়তো ওয়েট্রেস দেখবে গ্লাসটা আপনাআপনি শূন্যে ভাসছে কিংবা ওটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে-না, এরকম কিছুই ঘটবে না। বরং সে ভুলেই যাবে গ্লাসটার অস্তিত্বের কথা। যাই ঘটুক না কেন, তার ওপর কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া হবে না। আমার অস্তিত্বই যদি সে টের না পায়, তাহলে আমার থাকা কিংবা না-থাকায় কোনো সমস্যাই হবে না। তবে একটা ব্যতিক্রম রয়েছে যে আমাকে দেখতে পাচ্ছে অর্থাৎ যাকে পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে, সে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে একটা প্রতিক্রিয়া কিন্তু তৈরি হবে। সহজ করে বলি, আপনি এই মাত্র আমার সাথে কথা বললেন না? ওয়েট্রেস কিন্তু দেখল, আপনি ফাঁকা একটা স্থানের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন।”
আড়চোখে ওয়েট্রেসের দিকে তাকালাম। আসলেই তো। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে চোখের সামনে একটা পাগল দেখতে পারছে।
কিছুক্ষণ পর টেবিলে কফি চলে আসার পর সেটায় চুমুক দিতে দিতে ভাবলাম, কফিটা শেষ করে বাসায় ফিরে যাই।
ঠিক তখনই রেস্তোরাঁয় নারুসের আগমন ঘটল।
যদি আর মিনিটখানেক দেরি করত, হয়তো সত্যি সত্যিই বের হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু কাচের দরজা দিয়ে তাকে আসতে দেখে পরিকল্পনাটা ধামাচাপা দিলাম। উপায় না দেখে তাকে হাত নেড়ে কাছে ডাকলাম।
সিটে বসতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে অত্যধিক খুশি হবার মুখভঙ্গি করল। স্বাভাবিকভাবেই আমার পাশেই বসে থাকা মিয়াগিকে সে দেখতে পেল না।
“দোস্ত, অনেকদিন পর দেখা হলো তোর সাথে। কেমন আছিস?” নারুসে জিজ্ঞেস করল।
“জানিসই তো কেমন আছি। বেশ ভালো আছি রে।”
আর মাত্র কয়েক মাস পর মৃত্যু হবে এমন মানুষের মুখে এরকম কথা মানায় না, আমি মনে মনে ভাবলাম।
একে অপরের খোঁজখবর নেবার পর কথাবার্তা বলতে বলতে ধীরে ধীরে টের পেলাম, হাইস্কুলের সেই দিনগুলোতে যেন ফিরে যাচ্ছি। কী নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা ঠিক মনে পড়ছে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে আড্ডা দিইনি এটুকু নিশ্চিত। একদম তুচ্ছ জিনিস নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম আমরা। এতটাই তুচ্ছ যে, সেটা নিয়ে মজা নেবার পর মুহূর্তেই সেটার কথা ভুলে গেলাম আমরা।
আমার আয়ু নিয়ে একটা কথাও বলিনি তাকে। প্রথমত, সে আমার কথা বিশ্বাস নাও করতে পারে। আর তাছাড়া আমাদের আনন্দটাকে মাটি করতে চাই না আমি। যদি নারুসে কোনোভাবে জানতে পারে যে, আমি আর মাত্র কয়েক মাস বাঁচব, তাহলে সে সতর্কভাবে কথাবার্তা বলবে যাতে আমি দুঃখ না পাই। অনেক জোকস চেপে যাবে সে, হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দিতেও শুরু করে দিতে পারে। আমি ওরকম ‘ফালতু’ জিনিস নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে দিতে চাই না।
হয়তো পুরো সময়টাই আনন্দে কাটত, একটা ‘কথা’ সেই আনন্দে খানিকটা ব্যাঘাত ঘটাল।
“যাই হোক, কুসুনোকি,” নারুসে যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। “এখনও কি আঁকাআঁকি করিস?”
“না,” সাথে সাথে জবাব দিলাম। বলার সাথে সাথে টের পেলাম, কথাটায় বেশি জোর দিয়ে ফেলেছি। “কলেজে ঢোকার পর-কিছুই আঁকিনি আমি।”
“যা ভেবেছিলাম,” হেসে ফেলল নারুসে। “তুই আঁকাআঁকি চালিয়ে গেলেই বরং তোর জন্য চিন্তা হতো দোস্ত।”
প্রসঙ্গটার ওখানেই সমাপ্তি ঘটল।
আমি জানি কথাটা পাগলের মতো শোনাবে, কিন্তু এই ছোট্ট একটা দশ সেকেন্ডের কথার কারণে তিনবছর ধরে নারুসের প্রতি গড়ে ওঠা বন্ধুত্বভাবটা একদম ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে। কী তুচ্ছ! কী দুর্বল!
আরও কিছু ঠাট্টা করে সে প্রসঙ্গটা পাল্টানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আমি কিছু বললাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম,
নারুসে, শোন।
এই জিনিসটা নিয়েই কেবল হাসা উচিত ছিল না তোর।
আমি জানি আমি তোর সামনেই স্বীকার করেছি। কিন্তু তার মানে এই না যে, সেটা নিয়ে তোর হাসিঠাট্টা করা উচিত।
ভেবেছিলাম, কেউ যদি অন্তত আমাকে বুঝতে পারে, সে হচ্ছিস তুই।
ধীরে ধীরে নারুসের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা আমার মুখটা একটা ফাঁপা মুখোশে পরিণত হলো। সিগারেট ধরিয়ে আমি শুধু ‘হু হা’ করতে লাগলাম।
পাশে বসে থাকা মিয়াগি অকস্মাৎ বলতে শুরু করল, “এবার-তাহলে ভবিষ্যতটা দেখা যাক।”
আমি মাথা নেড়ে তাকে থামাতে চাইলাম, কিন্তু সে থামল না।
“নারুসের প্রতি আপনার এখন সামান্য ঘৃণা জমছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, নারুসে আপনাকে খুব একটা পছন্দ কোনোদিনও করেনি। আজ থেকে দুইবছর পর এরকম এক ভাবে তার সাথে আড্ডা দেয়ার সময় তুচ্ছ কিছু নিয়ে রাগারাগি হবে আপনাদের মধ্যে। যার ফলে আপনি আর বাকি জীবন ওর সাথে কথা বলবেন না-আমার মতে এই বন্ধুত্বটা আরও আগেই ভেঙে দেয়া উচিত। ওর ওপর আশা ভরসা রেখে কোনো লাভই হবে না।”
আমার বন্ধুর ব্যাপারে খারাপ কথা বলছে দেখে আমি মিয়াগির ওপর ক্ষেপে যাইনি। আমি জানতে চাইনি এমন কিছু আমাকে সে জানিয়ে দিয়েছে কিংবা তিক্ত স্বরে সে আমাকে কথাগুলো শোনাচ্ছে-এর কোনোটাই আমাকে ক্ষেপায়নি। এমনকি নারুসে আমার পুরোনো স্বপ্ন নিয়ে হাসি ঠাট্টা করায় যে ক্ষোভ জন্মেছে, সেটার ঝাল আমি মিয়াগির ওপর ঝেড়ে দিচ্ছি-না, তাও ঘটেনি।
তাহলে কী কারণে আমি রেগে গিয়েছিলাম? বেশ কঠিন একটা প্রশ্ন। আমার ঠিক সামনাসামনি বসে নারুসে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বকেই যাচ্ছে, আরেক কানে মিয়াগি নৈরাশ্যজনক কথা ঢেলেই যাচ্ছে, অপর পাশের সিটে দুজন যুবতি তীক্ষ্ণস্বরে কথাবার্তা চালাচ্ছে, একদল থিয়েটার পাগল ছেলেপিলে আমার পেছনের সিটে বসে জোরে জোরে অর্থহীন বিষয় নিয়ে তর্ক করছে, আর কোণে একদল ছেলেমেয়ে দলবদ্ধ হয়ে চিৎকারের পাশাপাশি হাততালি দিচ্ছে-আর সহ্য করতে পারলাম না।
চুপ! আমি ভাবলাম। এত জোরে কেন কথা বলতে হবে?
পরের মুহূর্তে মিয়াগির পাশের দেয়ালে আমার হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ভেঙে ফেললাম।
যতটা ভেবেছিলাম, তার থেকেও অনেক জোরে শব্দ হলো। চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে গেল গ্লাসটা। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। রেস্তোরাঁর সবাই এক সেকেন্ডের জন্য চুপ করেছিল, পরের সেকেন্ডেই আবার দ্বিগুণ জোরে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল।
নারুসে আমার কাণ্ড দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। দেখতে পেলাম, রেস্তোরাঁর একজন কর্মচারী দ্রুত এখানে ছুটে আসছে। মিয়াগি জোরে নিঃশ্বাস ফেলল।
আমি কী করছি?
টেবিলে কয়েকটা হাজার ইয়েনের নোট রেখে প্রায় দৌড়ে বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে।
বাসে করে ট্রেন স্টেশনে ফেরার পথে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা পুরো ব্যাটিং সেন্টার দেখতে পেলাম। বাসের ‘স্টপ’ বাটনে চাপ দিয়ে বাস থামিয়ে নেমে গেলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম, তিনশোবার ব্যাট সুইং করব।
***
ব্যাট যখন নামিয়ে রেখেছি, তখন টের পেলাম হাত অবশ হয়ে গিয়েছে, কয়েক জায়গা থেকে রক্তও বের হচ্ছে। আর আমি একদম পশুর মতো ঘামছি।
ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা পোকারি সোয়েট স্পোর্টস ড্রিংক কিনে বেঞ্চে বসলাম। ধীরে ধীরে বোতলে চুমুক দিতে দিতে ব্যাটিং সেন্টারে আসা মানুষদের দেখতে থাকলাম আমি। এরা বেশিরভাগই চাকরি শেষে বাসায় ফেরার পথে এখানে ঢুকে পড়েছে শুধুমাত্র কয়েকবার ব্যাট সুইং করে বল পেটাবে বলে। হয়তো ব্যাটিং সেন্টারটার আলোয় কিছু একটা বিশেষত্ব ছিল, কারণ কেন জানি নীল দেখাচ্ছিল আশপাশের সবকিছুকে।
নারুসে’কে ওভাবে পেছনে ফেলে আসতে তেমন একটা গায়ে বাঁধছে না। এতক্ষণে আমার মনে এই প্রশ্নেরও উদয় হয়েছে, আদৌ কি আমি কখনো তাকে পছন্দ করতাম? হয়তো নারুসের চরিত্র, আচার-আচরণ আমার কোনোদিনও ভালো লাগেনি। বোধহয় আরেকজন মানুষ আমার চিন্তাভাবনার সাথে মিল রেখে সেই একই ভাবে কথাবার্তা বলছে, সেটাই আমার ভালো লাগত।
সময়ের প্রবাহে নারুসে পাল্টে গিয়েছে। আমি পারিনি।
যদি দুজনের কেউ ঠিক হয়ে থাকে, তবে নারুসেই ঠিক।
ব্যাটিং সেন্টার থেকে বের হয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। প্লাটফর্মে পৌঁছাতেই একটা ট্রেন এসে থামল। স্কুল থেকে একঝাঁক ক্লাবের কার্যক্রম শেষ করে ফেরা শিক্ষার্থীতে টইটম্বুর ছিল গোটা ট্রেন। তাদের ভিড়ে কেন জানি নিজেকে বুড়ো বুড়ো লাগতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করে ট্রেনের ভেতরের শব্দে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
ইতোমধ্যে রাত হয়ে গিয়েছে। ফেরার পথে দোকান থেকে ঘুরে এলাম আমি। কয়েকটা বিয়ার আর স্ন্যাকস হাতে নিয়ে রেজিস্টারের সামনে দাঁড়ালাম। এক জোড়া ট্র্যাকস্যুট আর স্যান্ডেল পরে থাকা কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েও আমার মতো ঠিক একই জিনিস কিনছে।
বাড়ি ফিরে ক্যানের বার্বিকিউ মাংস আর স্প্রিং অনিয়ন গরম করে বিয়ারের সাথে খেতে লাগলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, মৃত্যুর আগে কত পাইন্ট মদ খেতে পারব আমি? কেন জানি না, মনে জাগা প্রশ্নটার কারণে বিয়ারটাকে আরও সুস্বাদু মনে হতে লাগল।
“পর্যবেক্ষক, শুনছেন?” মিয়াগিকে ডাকলাম আমি। “একটু আগের কার্যকলাপের জন্য আমি দুঃখিত। আমার মনে হয়, আমার মাথায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তখন। মাঝেমধ্যে রেগে গিয়ে এরকম আচরণ করে বসি আমি।”
“হ্যাঁ, আমি জানি,” মিয়াগি জবাব দিল। টের পেলাম, আমার দিকে তাকানোর সময় কেমন জানি একটা সতর্কের ভাব ছিল তার মধ্যে। কথার মাঝখানে গ্লাস দেয়ালে ছুঁড়ে মারা মানুষটার আশপাশে থাকা যে কেউই এরপর থেকে সতর্ক হবে।
“আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন?”
“দুর্ভাগ্যবশত না, পাইনি।”
“দেখুন, এ কাজের জন্য আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে।”
“সমস্যা নেই। আপনি আমাকে তো আঘাত করেননি।”
“পর্যবেক্ষণ ডায়েরির কাজ শেষ হলে আমার সাথে বসে বিয়ার খাবেন?”
“একসাথে মাতাল হতে বলছেন আমাকে?”
ওরকম প্রতিক্রিয়া আসলে আশা করছিলাম না তার কাছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, ওরকম মুহূর্তে সত্যটা বলাই ভালো। “হ্যাঁ বলছি। আমি খুব নিঃসঙ্গ একটা মানুষ।”
“আচ্ছা। দুঃখিত, আমি এখন কাজে ব্যস্ত রয়েছি।”
“তাহলে সেটা আগে বললেই হতো।”
“দুঃখিত। আসলে আমাকে কেন এই প্রশ্ন করলেন, সেটা জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছিল।”
“পৃথিবীর অন্যান্য মানুষদের মতো আমারও একাকী বোধ হয়। আমার আগে আপনি যেসব মানুষদের পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন তারাও নিশ্চয়ই মৃত্যুর আগে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, ঠিক না?”
“আমার ঠিক মনে পড়ছে না,” মিয়াগি জবাব দিল।
বিয়ার ক্যানগুলো খতম করে, গরম পানিতে গোসল সেরে, দাঁত মেজে টের পেলাম, চমৎকার একটা ঘুম ঘুম ভাব আমাকে জাপটে ধরেছে। এসব ঐ ব্যাটিং সেন্টারে পরিশ্রমের ফলাফল।
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
আবিষ্কার করলাম, কিছু জিনিস আমাকে আবার প্রথম থেকে ভাবতে হবে।
মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তার মানে এই না যে গোটা পৃথিবী হঠাৎ করে আমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করবে। যারা ইতোমধ্যে এ জগৎ ছেড়ে চলে গিয়েছে, মানুষ কেবল তাদের সাথে এরকম আচরণ করে থাকে (যদি এরকম করার ইচ্ছে থাকে তাদের)। আমার এসব আগে থেকে জানা উচিত ছিল। কিন্তু ছোট ছোট স্বপ্নগুলোর আশা ছাড়তে আমি অপারগ ছিলাম। তাই হয়তো আমি মনের গভীরে এমন আশা পুষে রেখেছিলাম, আমার দৈনন্দিন জীবনটা হয়তো এখন একটু সহজভাবে কাটবে।