যীশুর কাঠের মূর্তি – ১

কার্সিকা দ্বীপের বোনিফেসিও বন্দর থেকে এবার ভাইকিং বন্ধুরা ফ্রান্সিসকে দেশে ফেরার জন্য বারবার বলতে লাগল। দেশ ছেড়ে এসেছে অনেকদিন। ওরা প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু ফ্রান্সিসকে রাজি করাতে না পারলে কিছুই হবে না। বন্ধুরা মারিয়াকেও বারবার অনুরোধ করতে লাগল, রাজকুমারী–আপনি ফ্রান্সিসকে রাজি করান।

মারিয়ার নিজেরও এইসব বিদেশ বিভুইয়ে পড়ে থাকতে মন চাইছিল না। তবু সাবধানে কথাটা পাড়ল। ফ্রান্সিসকে বলল, এবার দেশেই ফিরে চলো। পরে আবার না হয় সমুদ্রযাত্রায় বেরুনো যাবে।

ফ্রান্সিস হেসে বলল, মারিয়া, দেশের টান সকলেরই থাকে। আমারও আছে। কিন্তু দেশে ফিরে ঐ যে সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন–এ আমার ভালো লাগেনা। তবু তোমাদের বিশেষ করে তোমার অনুরোধে দেশের দিকে জাহাজ চালাতেই বলছি ফ্লাইজারকে। কিন্তু আবার যদি কোনো রহস্যের সন্ধান পাই তবে আবার লেগে পড়বো।

বেশ তো–দেখাই যাক। ফেরার পথে আবার কোনো রহস্যের সন্ধান নাও তো পেতে পারো। মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দেখা যাক।

মারিয়া বলল, তোমার বন্ধুরা কেউ কেউ বলছিল পিসায় নেমে স্থলপথে দেশে ফিরে যাওয়া যায়।

ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, না, না। স্থলপথে যেতে অনেক বেশি সময় লাগবে। তার ওপরে স্থলপথে বিপদ-আপদ অনেক বেশি। পরিষ্কার আকাশ আর তেজি হাওয়া পেলে জাহাজে অনেক তাড়াতাড়ি দেশে পৌঁছোনো যাবে।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ তখন বন্দর থেকে অনেকটা দূরে মাঝসমুদ্রে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে ফ্লাইজারকে বলল, দিক ঠিক রেখে দেশের দিকে জাহাজ চালাও। ভাইকিং বন্ধুদের তখন আনন্দ দেখে কে! সবাই ছুটোছুটি করে সব পালগুলো টানাটানি করে দড়ি বেঁধেছেদে জাহাজের গতি বাড়াতে লাগল। পালগুলো যথেষ্ট হাওয়া পাচ্ছে। তবু সাত-আটজন ভাইকিং দাঁড়ঘরে নেমে এলো। দাঁড় বাইতে লাগল। গতি চাই, আরো গতি। জাহাজ দ্রুত জল কেটে ঢেউ ভেঙে চলল।

তিন-চারদিন নির্বিঘ্নেই কাটল। ভাইকিংরা দেশে ফেরার চিন্তায় খুব খুশি। যার সবচেয়ে বেশি সাবধানী হওয়া উচিত ছিল সেই নজরদার পেড্রোও খুশিতে ওর কাজে ঢিলে দিল। এক রাতে মাস্তুলের মাথায় ওর নির্দিষ্ট জায়গায় বসে নজর রাখল না। ডেক-এ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিজেও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবল, অল্পক্ষণ ঘুমিয়ে নজরদারির জায়গায় গিয়ে বসবে। পেড্রোর এই ভুলের জন্যে সবাইকে তার খেসারত দিতে হলো।

তখন ভোর হয় হয়। পেড্রোর ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠে বসতেই সামনে দেখল কি খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক কাফ্রি। পেড্রো ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকাল। দেখল ওদের জাহাজের গায়ে গা লাগিয়ে আর একটা জাহাজও চলেছে। ডেক-এ যেখানে সেখানে ওর বন্ধুরা শুয়ে ঘুমুচ্ছে তাদের সকলের সামনে একজন করে খোলা তলোয়ার হাতে কাফ্রি দাঁড়িয়ে। কাফ্রিরা নিঃশব্দে ওদেরক রাভেল জাহাজ থেকে এই জাহাজে উঠে এসে জাহাজ দখল করে নিয়েছে।

ভোরের আধো আলো, আধো অন্ধকারে পেড্রো বোকার মতো তাকিয়ে রইল কাফ্রিটার দিকে। একবার ভাবল, চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। কিন্তু কাফ্রিটা ওর মনোভাব বুঝতে পেরে তলোয়ারের ডগাটা পেড্রোর গলায় ঠেকিয়ে মাথা দুলিয়ে হাসল। ঐ কুচকুচে কালো মুখে সাদা দাঁতগুলো চৰ্চ করে উঠল।

ভোর হলো। ডেক-এ শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকিংদের ঘুম ভাঙতে লাগল। চোখ। মেলে সবাই দেখল খোলা তলোয়ার হাতে কাফ্রি যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। ওরা অসহায় চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল। ওদের তখন একটাই ভাবনা কেবিনঘরে বোধহয় ফ্রান্সিস হ্যারিরা নিরাপদেই আছে।

একটু পরেই ভোরের নরম আলো পড়ল সমুদ্রে জাহাজ দুটোয়। তখনই ডেকঘর থেকে একে একে উঠে আসতে লাগল ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারিরা। প্রত্যেকের পেছনেই কাফ্রি যোদ্ধারা। ফর্সা গা আরবীয় যোদ্ধারাও আছে তাদের মধ্যে। এত নিঃশব্দে এই কাফ্রি যোদ্ধারা জাহাজটা দখল করে ফেলল যে ভাইকিংরা এতটুকুও বুঝতে পারল না।

ফ্রান্সিসরা ডেক-এ উঠে আসতে একটি আরবীয় যোদ্ধা গ্রীক ভাষায় বলল, সবাই জাহাজের রেলিঙের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়াও। ভাইকিংরা গ্রীকভাষা কিছুই বুঝল না। তখন হ্যারি গলা চড়িয়ে ওদের ভাষায় কথাটা বুঝিয়ে বলল। এবার ভাইকিংরা রেলিঙের ধারে সারি বেঁধে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস এবার ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে পেড্রোকে খুঁজতে লাগল। দেখলও পেড্রোকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পেড্রো। ফ্রান্সিস ডাকল, পেড্রো। পেড্রো চমকে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর ছুটে এসে ফ্রান্সিসের দুই হাত জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমরা এভাবে বন্দি হবো। ফ্রান্সিস, আমার কর্তব্যে অবহেলার জন্যে আমাকে যে শাস্তি দিতে চাও, দাও।

এখন ওসব কথা অর্থহীন। এখন এরা আমাদের নিয়ে কী করবে সেই কথা ভাবো। ফ্রান্সিস বলল।

একজন আরবী সৈন্য এসে পেড্রোর পিঠে তলোয়ারের খোঁচা দিল। পেড্রো সারির মধ্যে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। দু’তিনজন ভাইকিং চিৎকার করে বলে উঠল, ফ্রান্সিস, পেড্রোকে ফাঁসিতে লটকাও। অনেকে ছিঃ ছিঃ করতে লাগল। ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে শান্ত হয়ে থাকতে বলল। এইভাবে বিনা বাধায় বন্দি হওয়াটা ভাইকিংরা মেনে নিতে পারল না। সবাই মনে মনে গজরাতে লাগল।

তখন সকাল হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় রোদ ঝিকিয়ে উঠছে। জোর হাওয়া বইছে। সাগরপাখির তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যাচ্ছে। দুটো জাহাজই পাশাপাশি চলেছে।

ক্যারাভেল জাহাজ থেকে এক আরবীয় যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের জাহাজের রেলিং ধরে উঠে এলো। আরবী ভাষায় গলা চড়িয়ে কী বলল। যোদ্ধাদের মধ্যে বেশ তৎপরতা দেখা গেল। বোঝা গেল কেউ একজন ফ্রান্সিসদের জাহাজে আসবে এবং সে যে দলপতি এটাও বোঝা গেল।

একটু পরেই ক্যারাভেল জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো একজন আরবীয়। মাথায় কান-ঢাকা কালো বিড় বাঁধা পাগড়ি মতো। সে দু’একজন যোদ্ধার সাহায্যে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। ফ্রান্সিসদের সারির কাছে এলো। দলপতির গোঁফ আছে। চিবুকের কাছে অল্প দাড়ি। গায়ের রং ফর্সা। শরীরটা রোগাই।

দলপতি এবার ফ্রান্সিসদের দেখে খুব খুশি হলো। দু’তিনজন যোদ্ধা অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে খুশিমুখে হাসল।ফ্রান্সিস তখনও ভেবে পাচ্ছেনা এরা কারা?ফ্রান্সিসদের দেখে দলপতির এত খুশি হবার কারণ কী?

এবার দলপতি গ্রীক ভাষায় বলল, তোমাদের দেখেই তো বুঝতে পারছি তোমরা এই ভূমধ্যসাগরের এলাকার লোক নও–তোমরা বিদেশী। এক হ্যারি বাদে ফ্রান্সিসরা কেউই কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না। হ্যারি গ্রীক ভাষা মোটামুটি বোঝে। বলতেও পারে। হ্যারি ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল, আমরা ভাইকিং। বীরের জাতি।

দলপতি এবার হ্যারির কাছে এলো। হেসে বলল, হ্যাঁ তোমাদের ভাইকিং জাতির নাম আমরা শুনেছি। জাহাজ চালাতে দক্ষ তোমরা, আবার লুঠপাটও করো।

না–আমরা জলদস্যুতা করি না। হ্যারি বলল।

 যাক গে–শোনো–আমার নাম আল জাহিরি–আমি বণিক। দলপতি বলল।

আপনার কীসের ব্যবসা? হ্যারি বলল।

মানুষ কেনাবেচা। আল জাহিরি কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠল। হ্যারি বুঝল–খুবই বিপদে পড়েছে ওরা। আল জাহিরির জাহাজে নিশ্চয়ই কয়েদখানা মতো আছে। সেটাতে মানুষদের বন্দি করে রাখা হয়। তারপর ক্রীতদাসদের বিকিকিনির হাটে বিক্রি করা হয়। হ্যারি বলল, বুঝেছি–আপনি আমাদের ক্রীতদাসেরহাটে বিক্রি করবেন।

ঠিক তাই–আল জাহিরি হেসে বলল, এটাই আমার ব্যবসা।

হ্যারি দেখল, আল জাহিরির গায়ে বেশ দামী রেশমি কাপড়ের সোনালি জরি বসানো পোশাক। গলায় মুক্তোর মালা। হ্যারি একটু হেসে বলল, তাহলে আপনার ব্যবসা বেশ ভালোই চলছে?

আল জাহিরিও হাসল। বলল, হ্যাঁ–তবে এবার খুব ভালো দাম পাবো।

 কেন? হ্যারি জানতে চাইল।

 কারণ–ইউরোপীয় মানুষ আমরা কমই পাই। এবার এতগুলি যুবক ইউরোপীয় ওঃ অনেক দাম পাবো। আল জাহিরি বলল। তারপর মারিয়াকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, এটার জন্যেই যা দাম পাবো তাতে কয়েক বছর আর মানুষ না ধরলেও চলবে।

হ্যারি বলল, মুখ সামলে কথা বলুন–ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী মারিয়া। আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী।

আল জাহিরি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, রাজকুমারী, বাব্বা-তাহলে তো দর আরও চড়াতে হবে।

হ্যারি কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। চুপ করে রইল। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে আল জাহিরি সঙ্গে ওর যা কথাবার্তা হয়েছে সবই বলল।

সব শুনে ফ্রান্সিস গভীর চিন্তায় পড়ল। ফ্রান্সিসরা জানে ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা কী নির্মম নিষ্ঠুর হয়। দয়া মায়া বলে কোনো বোধই থাকে না। বন্দি মানুষদের দেখে পশুর মতো।

আল জাহিরি চিৎকার করে বলতে লাগল, সব কটাকে আমাদের ক্যারাভেল-এ নিয়ে যাও। কয়েদখানায় বন্দি করে রাখো। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ইনি নাকি রাজকুমারী। ইনি মুক্ত থাকবেন।

হ্যারি বলে উঠল, না ইনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।

তা কি করে হয়–আল জাহিরি বলল, একে কত যত্নে রাখতে হবে। কয়েদখানায় থাকলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে যে। না, না-রাজকুমারী আলাদা কেবিনঘরে থাকবে।

হ্যারি ফ্রান্সিসকে কথাগুলো বুঝিয়ে বললো। অন্য ভাইকিং বন্ধুরা শুনল সে কথা। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো।

হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল, আল জাহিরি, দেখছেন তো রাজকুমারীকে আলাদা করে রাখতে কেউ রাজি নয়। রাজকুমারী আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

আল জাহিরি ভাইকিংদের ক্রুদ্ধ চেহারা আর ধ্বনি শুনে একটু ভাবনায় পড়ল। ভাইকিংরা নিরস্ত্র। ওর পাহারাদারদের হুকুম দিলে অল্পক্ষণের মধ্যেই নিরস্ত্র ভাইকিংদের মেরে ফেলা যায়। কিন্তু তাতে কী লাভ? বরং বাঁচিয়ে রাখলে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা পাবে। শুধু রাজকুমারীকে বিক্রি করলেই হাজার কয়েক স্বর্ণমুদ্রা মিলবে। কাজেই আল জাহিরি কোনো গোলমালে যেতে চাইল না। মারিয়াকে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল, রাজকুমারী, আপনি কি কয়েদখানার অন্ধকারে পচতে চান না কোনো কেবিনঘরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকতে চান?

মারিয়া বলল, আমি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য চাই না। আমার স্বামী আর তার বন্ধুরা যেখানে যেভাবে থাকবে আমিও সেখানে থাকবো।

কী মুশকিল–তাতে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ক্রীতদাসের হাটে আপনার দাম কমে যাবে যে। আল জাহিরি মাথা নেড়ে নেড়ে বলল।

সেসব আমি বুঝি না। মারিয়া বলল।

আল জাহিরির ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় কথা বিস্কো শাঙ্কোরা বুঝল। ওরা আবার একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো।

এবার আল জাহিরি বলল, আমি ব্যবসাদার লোক মারামারি কাটাকাটির মধ্যে নেই। তোমরা সবাই ক্যারাভেলের কয়েদখানায় থাকবে। মনে থাকে যেন, পালাবার চেষ্টা করলে মরবে।

আল জাহিরি নিজেদের ক্যারাভেলে চলে গেল। কাফ্রি আর আরবী পাহারাদার এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে গ্রীক ভাষায় চিৎকার করে বলল, ক্যরাভেলে চলো সব। কেউ চালাকি দেখাতে গেলেই মরবে।

হ্যারি ওদের দেশীয় ভাষায় কথাগুলি বন্ধুদের বুঝিয়ে বলল।

শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, আমাদের জাহাজ ছেড়ে আমরা যাবো না। বন্ধুরা হৈহৈ করে শাঙ্কোকে সমর্থন করল। পাহারাদার সৈন্যরা বুঝল ওরা ক্যারাভেল-এ যেতে আপত্তি করছে। ওরা খোলা তলোয়ার হাতে ফ্রান্সিসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো।

ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে সৈন্যদের থামাল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ভাইসব, আমরা ভালো করে জানি আল জাহিরি আমাদের মেরে ফেলবে না। তাতে ওর ব্যবসারই ক্ষতি। তবে নিরস্ত্র অবস্থায় লড়াইয়ে নামলে আমরা অনেকেই আহত হবো। আমি এটা চাই না। এখন লড়াই নয়। মাথা ঠাণ্ডা রেখে ক্যারাভেল-এ চলো। বন্দিজীবন মেনে নাও। সময় সুযোগ বুঝে যা করবার করা যাবে। ক্যারাভেল-এ চলো সব।

ভাইকিং বন্ধুরা বুঝল যে এই অবস্থায় ফ্রান্সিসের কথাই মেনে নিতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পাহারাদারদের নির্দেশমতো ক্যারাভেল-এ গিয়ে উঠতে লাগল।

আল জাহিরির সৈন্যদের পাহারার মধ্যে ভাইকিংরা ক্যারাভেল-এ গিয়ে উঠল। ক্যারাভেল-এর সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নীচের কয়েদখানার সামনে এলো সবাই। কয়েদখানার লোহার দরজার সামনে তলোয়ার হাতে দু’তিনজন পাহারাদার। একজন। গিয়ে লোহার দরজা খুলে দিল। ঠনঠন্ শব্দে দরজা ঠেলে খুলে ভাইকিংদের ঢোকানো হতে লাগল।

এরকম কয়েদখানা ভাইকিংরা আগেও দেখেছে। কিন্তু মারিয়া তো দেখেনি। লোহার মোটা মোটা গরাদ দেওয়া। মারিয়া এইবার প্রথম বেশ ভীত হলো। এখানে তো পশুর মতো থাকতে হবে। মারিয়া এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। ফ্রান্সিস মারিয়ার মনের অবস্থা ভালোই বুঝতে পারল। মারিয়ার হাতে চাপ দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ভয়ের কিছু নেই। তবে কষ্ট হবে তোমার। তুমি যদি ওপরের কেবিনঘরে থাকতে চাও–

মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না–আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। কয়েদঘরে ঢুকে দেখল আগে থেকেও পাঁচ-ছ’জন বন্দি রয়েছে। সবাই কাফ্রি। শুধু একজন শ্বেতাঙ্গ। বোধহয় এই এলাকার লোক। জোব্বামতো চাষীদের পোশাক পরনে। একটা ব্যাপার দেখে ফ্রান্সিস খুশি হলো যে এই কয়েদ ঘরে ওদের হাত বেঁধে রাখা হলো না। তার কারণটাও ফ্রান্সিস ঠিক বুঝতে পারল হাত-পা অনেকদিন বেঁধে রাখলে কড়া পড়ে যায়। ক্রীতদাস বিক্রির হাটে দাম কমে যায়। সুস্থ সবল মানুষ চাই। তবে না দাম উঠবে।

ভাইকিংদের মধ্যে কিছু বসে পড়ল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল কাঠের পাটাতনে, কেউ কেউ ছোটো জায়গাতেই পায়চারি করতে লাগল।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া এককোণায় বসল। হ্যারি এসে ওদের পাশে বসল। তিনজনেই চুপচাপ বসে রইল। এমনভাবে এত দ্রুত ওরা বন্দি হয়ে যাবে এটা গল্পনাও করেনি।

কিছু পরে লোহার দরজা শব্দ তুলে খোলা হলো। তিনজন কাফ্রি খাবার নিয়ে এলো। এক মস্তবড়ো কাঠের থালায় গোল করে কাটা রুটি। মস্তবড় গামলায় আলু টমেটোর ও মাংস ছড়ানো স্যুপ। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। আজ ফ্রান্সিস কিন্তু সেই কথাটা বলতে পারল না–পেট পুরে খাও–খেতে ভালো না লাগলেও খাও। সত্যিই আজ ফ্রান্সিসের মন চিন্তাভারাক্রান্ত। এই তলার ডেক-এর কয়েদখানায় থাকার অভিজ্ঞতা ওদের আছে। কিন্তু মারিয়া কি এই কঠোর জীবন কাটাতে পারবে? তার ওপর অসুখ থেকে উঠে মারিয়া এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। হঠাৎ-ই ফ্রান্সিসদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে ও চুপ করে বসে রইল। ওর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হলো মারিয়ার জন্যে।

একসময় বিস্কো উঠে এলো। ভালো লাগছেনা। এভাবে বন্দি হওয়া স্বপ্নেও ভাবেনি। সময় কাটাবার জন্যে পুরনো বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বিস্কো ওদের কাছে গেল। কাফ্রি ক’জনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। সবই বৃথা। কাফ্রিগুলো যে ভাষায় কথা বলল, সে তো অবোধ্য। কথা বলার সময় ওদের অঙ্গভঙ্গি দেখে যা কিছু বুঝল সেটাও তেমন কিছু নয়। অনেকদিন আগে আল জাহিরির দল নাকি ওদের গ্রাম থেকে ধরে এনেছে। ভাগ্যে কী আছে ওরা জানে না।

শুধু একজন শ্বেতাঙ্গ অল্পস্বল্প স্প্যানিস ভাষা বলতে পারে। তার সঙ্গেই বিস্কো কথাবার্তা বলতে লাগল। সে তার নাম বলল পারিসি। পারিসি বিস্কোকে বলল, তোমরা তো দেখছি এই ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের লোক নও। তোমরা এখানে কেন এসেছো? ধরাই বা পড়লে কীভাবে? বিস্কো তখন ওদের কথা, ফ্রান্সিসের কথা–কোন্ দ্বীপ থেকে ফ্রান্সিস কী উদ্ধার করেছে সবকিছুই সংক্ষেপে বলল। পারিসি বলল, আমিও একটা খুব দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ উদ্ধার করেছিলাম। দিয়েছিলাম সাইপ্রাসের বর্তমান শাসক গী দ্য লুসিগনানেকে। সেই গ্রন্থের প্রথম পাতায় আঁকা ছিল যীশুর একটি ছবি। এবার লুসিগনান চাইল সেই যীশুর মূর্তিটা। নিশ্চয়ই আমিই সেই মূর্তিটা লুকিয়ে রেখেছি এই সন্দেহ করে আমার ওপরে চলল অত্যাচার। পারিসি থামল।

তারপর? বিস্কো জানতে চাইল।

আমাকে আবার সেই দুরারোহ জেরস পাহাড়ে পাঠাল। আমি সুযোগ বুঝে পালালাম। চলে এলাম কেরিনিয়া বন্দরে। পর্তুগীজদের একটা জাহাজে উঠে পড়লাম। জাহাজটা তখন পর্তুগাল যাচ্ছিল। হঠাৎই আল জাহিরি আমাদের জাহাজ আটকাল। লড়াইহলো। নৃশংস আল জাহিরি প্রায় সবাইকে মেরে ফেলল। কয়েকজন সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা মেরিই জানে হাঙরের পেটে গেল না পালাল। আমাকে আর ঐ কাফ্রি কয়েকজনকে রেহাই দিল। এরমধ্যে অবশ্য একজন কাফ্রি পালাতে গিয়ে মারা গেল। পারিসি থামল।

বিস্কো বলল, তুমি কী একটা গ্রন্থের ছবি যীশুর মূর্তি এসবের কথা বললে।

সে অনেক কথা। পারিসি বলল। বিস্কো উঠে দাঁড়াল। বলল, আমার বন্ধু ফ্রান্সিসকে নিয়ে আসছি। তুমি তাকে ব্যাপারটা বলো তো।

একটু পরেই বিস্কো, ফ্রান্সিস, হ্যারি আর মারিয়াকে সেখানে নিয়ে এলো। পারিসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ফ্রান্সিস বলল, তোমার কথা বিস্কোর কাছে কিছু শুনলাম। এবার সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো তো।

পারিসি বলল, সাইপ্রাস দ্বীপের নাম শুনেছেন?ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। হ্যারি বলল– শুনেছি।

মারিয়া বলল, সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরের পুবদিকের শেষ দ্বীপ।

ঠিক বলেছেন। পারিসি বলল। তারপর বলল, সাইপ্রাসের একটু ইতিহাস বলি। তৃতীয় ধর্মযুদ্ধ শেষ করে প্রথম রিচার্ড ফেরার পথে সাইপ্রাসে আসেন। তখনকার শাসক, আইজাক কমেনাসের কাছে দাবি জানালেন, এখানে তার যে জাহাজগুলো আছে সেসব আর তার দেশের নাবিকদের ফেরৎ দিতে হবে। আইজাক মানল না সেই দাবি। প্রথম রিচার্ড সাইপ্রাসবাসীদের যুদ্ধে হারিয়ে সাইপ্রাস দখল করলেন। তার অনুগত গী দ্য লুসিগনানকে সাইপ্রাসের শাসক নিযুক্ত করে তিনি চলে গেলেন। গী দ্য লুসিগনানও আইজাকের মতো সাইপ্রাসবাদীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন। পারিসি থামল।

আসল কথাটা বলো। ফ্রান্সিস বলল। সেটাই বলছি–পারিসি বলল, এবার একজন প্রকৃত খ্রীস্টিয় সাধুর কথা বলি। তার নাম নিওফিতস। ছোটোবেলা থেকেই তিনি খ্রীস্টিয় সাধু হতে চেয়েছেন। উত্তর সাইপ্রাসের বন্দর-নগর কেরিনিয়ার কাছে একগির্জা তৈরি করিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে লোকজনের ভিড়ে বিরক্ত হয়ে তিনি জেরস পাহাড়ে এক গুহায় একেবারে নির্জনে বাস করতে লাগলেন।

তারপর? হ্যারি বলল।

সাত বছর ধরে এক কষ্টকর জীবন কাটালেন তিনি। ধারেকাছের পাহাড়ি গাঁয়ের লোকেরা তাকে খাদ্য, পানীয়, জল দিয়ে আসতো। নিওফিতস নিজে কারো কাছে কিছু চাইতেন না। এদিকে মহান সাধুপুরুষ হিসেবে দেশবাসীর কাছে পরিচিত হন তিনি। এখন ঐ এলাকার নাম পাফোঁস। পাফোসের গীর্জার পাদ্রীরা নিওফিতসকে বারবার অনুরোধ জানাতে তিনি সেই গুহার আবাস ছেড়ে নীচে নেমে আসেন। শুরু হলো নিওফিতসের নতুন জীবন। খ্রীস্টিয়মণ্ডলীর কাজেকর্মে তিনিই নিয়মশৃঙ্খলা আনেন এবং এই নিয়ে তিনি বই লিখতে শুরু করেন।

ঐ বইটাই বোধহয় তুমি পেয়েছো। ফ্রান্সিস বলল।

না, কারণ তখন সবেমাত্র নিওফিতস লিখতে শুরু করেছিলেন। পারিসি বলতে লাগল, অদ্ভুত মানুষ এই নিওফিতস। এত খ্যাতি, এত জনপ্রিয়তা তার সহ্য হলো না। তিনি আবার গুহাবাসী হলেন। জেরস পাহাড়ের যে গুহায় ছিলেন, এই গুহাটা সেটার চেয়েও অনেক উঁচুতে। প্রায় অসম্ভব সেই গুহায় যাওয়া। নিওফিতস কোনোভাবে সেই গুহায় গিয়ে উঠলেন। নিজেই ওখানে বসে বসে শুকনো ঘাস, গাছের ডাল দিয়ে একটা মই করলেন। প্রতিদিন সকালে সেই মই নামিয়ে দিতেন নীচের একটু সমতলমতো একটা জায়গায়। পাহাড়ি গাঁয়ের লোকেরা খাবার-টাবার রেখে আসত সেখানে। সবাই চলে গেলে নিওফিতস দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে খাবার নিতেন তারপর উঠে যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে দড়ির মইটাও টেনে তুলে নিতেন যাতে কেউ ঐ মই বেয়ে তার গুহায় যেতে না পারে, তাকে বিরক্ত করতে না পারে। পারিসি থামল।

তারপর? মারিয়া জিজ্ঞেস করল।

পারিসি বলতে লাগল–নিওফিতস যে খ্রীস্টমণ্ডলীর পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে বই লিখেছেন–এটা এখানকার সব বিশপ ধর্মযাজকরা জানতেন। তাঁরা আমাকে দায়িত্ব দিলেন নিওফিতসের বইটা নিয়ে আসতে। একটু থেমে পারিসি বলতে লাগল, আমি অনেক কষ্টে সমতলমতো জায়গাটায় পৌঁছলাম। কিন্তু নিওফিতসের গুহায় উঠতে পারলাম না। নীচের যে সমতল জায়গায় পাহাড়ি গাঁয়ের লোকেরা খাবার রেখে যেত, আমি সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সেখানে। কাঠকুটো জ্বেলে আমি রাত কাটাতাম। পারিসি একুট থেমে বলতে লাগল–আমি কয়েকদিন পরে পরেই দেখতাম দড়ির মই ফেলে নিওফিতস খাবার-টাবার নিয়ে যেতেন। আশ্চর্য! জলভরা পাত্র নিতেন না। বুঝলাম নিশ্চয়ই ঐ গুহার কাছে পাহাড়ি ঝর্ণা আছে। একদিন লিওফিতস মইটা তুলে নেবার আগে আমি মইয়ের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে দিলাম। নিওফিতস সেটা বুঝলেন না। তিনি উপরে উঠে মই টেনে তুলে নিলেন। দড়িটা ঝুলতে লাগল। পারিসি থামল।

তাহলে মই নামিয়ে তুমি তো উঠতে পারতে। ফ্রান্সিস বলল।

হা–আমি তাই করেছিলাম। একনাগাড়ে প্রায় দিন সাতেকনিওফিতস নীচে নামলেন না। তখন তার বয়েস সত্তরেরও বেশি। বুঝলাম, তিনি নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি আর অপেক্ষা না করে দড়িতে বাঁধা মইটা টেনে নামালাম। খাবার-টাবার নিয়ে মই বেয়ে সেই গুহার মুখে উঠে এলাম। বাইরে ঝকঝকে রোদ। গুহার ভেতরটা কিন্তু অন্ধকার। আমি আস্তে আস্তে গুহার মধ্যে ঢুকলাম। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতে দেখলাম গুহার গায়ে মশাল বসানো। কিন্তু তখন নিভে গেছে। অস্পষ্টভাবে দেখলাম এবড়োখেবড়ো মেঝেয় মোটা কাপড়ের বিছানা। তারপরেই একটা অগ্নিকুণ্ড। কিন্তু এখন নিভে গেছে। বিছানায় অসাড় হয়ে আছেন নিওফিতস। প্রথম দেখে বুঝলাম না। বেঁচে আছেন কিনা। একটু থেমে পারিসি বলতে লাগল– আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে তার দুই পা চুম্বন করলাম। মোটা কাপড়ে ঢাকা একটা পা যেন একটু নড়ল। আমি তাড়াতাড়ি এসে নিওফিতসের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। দেখি নিওফিতস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সর্দিসা গলায় খুব আস্তে বললেন– তুমি কে? আমি বললাম আমি পারিসি। আপনার সেবা করতে এসেছি।

আমার সেবার প্রয়োজন নেই। সেই একইভাবে বললেন।

আমি মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বললাম, আপনার সেবা করতে পারলে আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। যীশুর নামে বলছি–আমাকে এটুকু সুযোগ দিন। নিওফিস কী। ভাবলেন। তারপর কাশতে লাগলেন। আমি আস্তে আস্তে তার বুকে হাত বুলোতে। লাগলম। কাশির কষ্টটা কমতে আগের মতোই মৃদুস্বরে বললেন–বইটা শেষ করতে পারিনি। বইটা শেষ করার জন্য আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। কিন্তু শরীরে জোর পাচ্ছি না। ওরকম এক মহাপুরুষের এমন অসহায় অবস্থা দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলবো।

কিন্তু এই ঠাণ্ডায় এখানে তুমি থাকবে কী করে? উনি বললেন। আমি বললাম– আমার জন্য ভাববেন না। খাবার এনেছি। অনুমতি দিন–আপনাকে যেন খাওয়াতে পারি।

বেশ বেশনিওফিতস বললেন। একটু থেমে পারিসি বলতে লাগল–আমি দেখলাম নিভে যাওয়া অগ্নিকুণ্ডের ধারে চকমকি পাথর রয়েছে। গুহার একপাশে বেশ শুকনো ডালপালা পাতা কাঠ রয়েছে। আমি কিছু কাঠ ডালপাতা দিয়ে অগ্নিকুণ্ড সাজালাম। তারপর চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালোম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠল। সেখান থেকে আগুন নিয়ে পাথরের খাঁজে রাখা মশাল জ্বালোম। এতক্ষণে গুহার ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। আমার কোমরের ফেট্টির কাপড়টা খুলে আগুনে গরম করে করে সেই মহাপুরুষের পায়ে-হাতে-বুকে সেঁক দিতে লাগলাম। গুহাটাও ততক্ষণে বেশ গরম হয়ে গেছে। নিওফিস এবার অসাড় হাত পা শরীরে সাড়া পেলেন। হাত-পা নাড়লেন। উঠে বসার চেষ্টা করলেন। আমি পিঠে দু’হাত জড়িয়ে আস্তে আস্তে তাকে বসালাম। খেতে দিলাম। উনি আস্তে আস্তে খেতে লাগলেন। আমার সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারবো না। এবার জল খাওয়ানো। জল তো আমি আনিনি। পারিসি থামলো।

ধারে কাছে নিশ্চয়ই পাহাড়ি ঝর্ণা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক তাই–পারিসি বলল, উনি বললেন, এই গুহার শেষে গিয়ে দেখো একটা পাহাড়ি ঝর্ণা পাবে। সেখান থেকে জল নিয়ে এসো। আমি গুহার শেষে এসে দেখলাম গুহার ছোট্ট মুখ। তারপরেই একটা বড়ো ঝর্ণা। সেই জল নিয়ে এসে নিওফিতসকে খাওয়ালাম, নিজেও খেলাম। নিওফিতস আবার শুয়ে পড়লেন। আমিও খাওয়া সেরে ঐ এবড়োখেবড়ো মেঝের একপাশে শুয়ে পড়লাম।

তারপর? হ্যারি বলল।

এভাবেই সেবা-শুশ্রূষা করে নিওফিতসকে অনেকটা সুস্থ করে তুললাম। উনি কাগজ কলম নিয়ে প্রত্যেকদিনই গ্রন্থটি লিখতেন। বোধহয় শেষ হয়ে যেত লেখা। কিন্তু শীতকাল পড়তেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তিনি দেহ রাখলেন। আমি সারারাত কাঁদলাম। তারপর সেই শেষ না হওয়া গ্রন্থটা নিয়ে নীচে নেমে এলাম।

গ্রন্থ পেয়ে তো সাইপ্রাসের শাসকের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কী এমন ঘটল যে তোমাকে পালাতে হলো? ফ্রান্সিস বলল।

সেটাই সমস্যা। গ্রন্থটির প্রথম পাতায় সাধু নিওফিতস যীশুর একটি কাঠের মূর্তি এঁকেছিলেন। এত জীবন্ত ছবি খুব কম দেখা যায়। এখন সাইপ্রাসের শাসক গী দ্য লুসিগনান সন্দেহ করল যে সেই কাঠের মূর্তিটা নিওফিতস সত্যি সত্যিই নিজের হাতে বানিয়েছিলেন। আমি সেটা চুরি করেছি। আমি বারবার বললাম, আমি সেই কাঠের মূর্তি চোখেই দেখিনি। লুসিগনান বলল, ঐ গ্রন্থের ভূমিকাতেই নাকি সাধু নিওফিতস ঐ মূর্তি নিজের হাতেই তৈরি করার কথা বলেছেন। কাজেই আমাকে আবার কয়েকজন সৈন্যের সঙ্গে সেই গুহায় পাঠানো হল। আমি সুযোগ বুঝে পালালাম।

ঐ কাঠের যীশুমূর্তি কি সত্যিই নিওফিতস তৈরি করেছিলেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

আমি অতদিন গুহায় ছিলাম। কোনোদিন কাঠের তৈরি যীশৃমূর্তি কোথাও দেখিনি। পারিসি বলল।

আচ্ছা–ঐরকম কাঠের যীশুমূর্তি সম্পর্কে নিওফিতস কি কখনো তোমাকে কিছু বলেছিল? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

না। তবে মাঝে মাঝে যখন ঝর্ণার জলে গা ধুতে যেতেন–বলতেন যীশুও আমার। সঙ্গে স্নান করবেন। পারিসি বলল।

এ কথার মানে কী? হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

এটা ঐ গুহা, ঝর্ণার চারপাশ ভালো করে না দেখে বলা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল।

ডঢং ঢং শব্দে কয়েদঘরের দরজা খুলল। রক্ষীরা খাবার নিয়ে ঢুকল। খাবার দেখে ভাইকিংরা একটু অবাক হলো। মাখন মাখানো কাটা গোল রুটি, শাকসজির জুস আর কাঠের থালাভর্তি মাংস। খুবই সুস্বাদু খাবার। সবাই পেট পুরে খেলো। ফ্রান্সিস মনে মনে হাসল ক্রীতদাসেরহাটে নীরোগ সুস্থ স্বাস্থ্যবান যুবকদের দাম বেশি। তাই সবাইকে সুস্থ রাখতে হবে। তাই কয়েদীদের জন্যে এই রাজকীয় খানা।

আল জাহিরির ক্যারাভেল জাহাজ চলেছে। পেছনে কাছি দিয়ে বাঁধা ফ্রান্সিসদের জাহাজ।

এর মধ্যে দু’বার ঝড়ের পাল্লায় পড়তে হয়েছে। ঝড়ের সময় সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় কয়েদঘরের বন্দিদের। জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনিতে একবার কয়েদঘরের এই মাথায়, পরক্ষণেই গড়িয়ে গিয়ে ঐ মাথায়। ফ্রান্সিসরা এসবে অভ্যস্ত। কিন্তু মারিয়া তো এ জীবন কখনও কাটায়নি। ওর কষ্ট হলো সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয়বারঝড়ের সময় জাহাজের কাঠে মাথায় ধাক্কা লেগে মারিয়া প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এই ঝড়ের সময় ফ্রান্সিস সমস্ত শরীর দিয়ে মারিয়াকে চেপে ধরে রাখে। গড়াগড়ি খায়। মেঝেয় কাঠের দেয়ালে যা ধাক্কা লাগার ফ্রান্সিসের শরীরেই লাগে। মারিয়ার শরীর অক্ষত থাকে। তবু মাথায় লেগেছিল। অবশ্য ভেন-এর চিকিৎসায় মারিয়া সুস্থ হলো।

ক্যারাভেল আর জাহাজ চলেছে। ফ্রান্সিসদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝতে পারছে না। কয়েদঘরের রক্ষীদের কয়েকদিনই হ্যারি জিজ্ঞেস করেছে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের? রক্ষীরা চুপ করে নিজেদের কাজ করে যায়। কোনো কথা বলে না। একজন রক্ষী একদিন বলেছিল–আল জাহিরি কী করেন তা আগে থেকে কাউকে বলেন না। ব্যস এইটুকুই জেনেছে ওরা।

একদিন সকালের খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা শুয়ে-বসে আছে, হঠাৎ রক্ষীদের মধ্যে খুব তৎপরতা দেখা গেল।

একটু পরেই আল জাহিরি গরাদের কাছে এসে দাঁড়াল। কাষ্ঠহাসি হেসে স্পেনীয় ভাষায় বলল-খাওয়াদাওয়া ভালো পাচ্ছো তো?

হা–হ্যারি বলল, কিন্তু আমরা এখনও জানি না আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

সাইপ্রাসের উত্তরে কেরিনিয়া বন্দরে। ক্রীতদাস কেনাবেচার বড়ো হাট বসে ওখানে। ওখানে দরে না পোষালে আবার অন্য হাটে নিয়ে যাবো। আল জাহিরি বলল।

তাহলে ক্রীতদাস হিসেবে আমাদের বিক্রি করবেনই। হ্যারি বলল।

আল জাহিরি হো হো করে হেসে উঠল–তা না হলে ভালো ভালো খাবার খাইয়ে “ তোমাদের এত যত্নে রেখেছি কেন।

হ্যারি আর কোনো কথা বলল না। ঐ নরপশুটার সঙ্গে ওর আর কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না। যা কথা হলো হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস বলল–আর কোনো কথা বলো না। এরা সব হৃদয়হীন মানুষ। কথা বলারও অযোগ্য এরা। আল জাহিরি চলে গেল।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল, ফ্রান্সিস এখান থেকে পালানোর উপায় বের করো।

হ্যারি, ফ্রান্সিস বলল, এখান থেকে পালানোর কোনো নিশ্চিত উপায় আমি ভেবে পাচ্ছিনা। পালানো সম্ভব কিন্তু তাতে কিছু বন্ধুর প্রাণ যাবে, কারণ লড়াই করতেই হবে। তার চেয়েও বড়ো কথা মারিয়া। মারিয়া এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। লড়াইয়ে নামলে সব কিছু সারতে হবে অতি দ্রুত। মারিয়া তা পারবে না। হয়তো মারিয়ার জীবন বিপন্ন হবে। তাই আমি কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, পারিসিকে এখানে নিয়ে এসো।

হ্যারি পারিসিকে ডাকতে গেল। মারিয়া বলল, ফ্রান্সিস আমার জন্যেই তোমাদের এই ভোগান্তি ভুগতে হচ্ছে।

ফ্রান্সিস হেসে বলল, ও কথা বলছো কেন? তোমার কী দোষ?

আমার জন্যেই তো পালাতে পারছে না। মারিয়া বলল।

তোমার জন্যে নয়, লড়াই করে পালাতে গেলেই বন্ধুদের প্রাণহানি ঘটবে। এটা আমি চাই না। পালাবার অন্য কোনো উপায়ও ভাবতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।

পারিসিকে সঙ্গে নিয়ে হ্যারি এলো। ফ্রান্সিস বলল, আচ্ছা, পারিসি, তুমি তো সাইপ্রাসের অধিবাসী। কেরিনিয়া বন্দর কেমন? খুব বড়ো বন্দর না ছোটো?

খুব বড়ো বন্দর নয়। মাঝারি রকমের বন্দর শহর। পারিসি বলল।

এখন সাইপ্রাসের শাসক তো গী দ্য লুসিগনান। ফ্রান্সিস বলল।

হা। পারিসি বলল।

নিওফিতসের গ্রন্থটি তো তুমি উদ্ধার করে গী দ্য লুসিগনানকে দিয়েছিলে। ফ্রান্সিস বলল।

হা। পারিসি মাথা ওঠানামা করে বলল।

কাঠের যীশুমূর্তিটা গী দ্য লুসিগনান তোমাকেই উদ্ধার করতে পাঠিয়েছিল আর তুমি তখন পালিয়েছিলে।

হ্যাঁ, আমি ওরকম মূর্তি ওখানে কোনোদিন দেখিনি। পারিসি বলল।

আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস ওরকম একটা যীশুমূর্তি আছে। ফ্রান্সিস বলল।

হতে পারে, আমি জানি না। পারিসি বলল।

দেখো পারিসি–ফ্রান্সিস বলল, তুমি বলেছিলে ঐ গ্রন্থটির প্রথম পাতায় যীশুর যে ছবিটি দেখেছিলে সেটা খুব সুন্দর ছবি ছিল।

শুধু সুন্দর নয়–পারিসি বলল, প্রভু যীশুর ওরকম জীবন্ত ছবি আমি কোথাও দেখিনি।

এমন ছবি যিনি আঁকতে পারেন–ফ্রান্সিস বলল–তিনি কাঠ কুঁদে কুঁদে ওরকমই একটা কাঠের মূর্তিও তৈরি করতে পারেন। নিওফিতস শুধু ধর্মপ্রাণ সাধুই ছিলেন না– প্রতিভাবান শিল্পীও ছিলেন।

তা ঠিক। পারিসি ঘাড় নেড়ে বলল।

এবার হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস এখন কী করবে?

কিছুই করার নেই–ফ্রান্সিস বলল, কেরিনিয়া পৌঁছে রাজা গী দ্য লুসিগনানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারপর যীশুর কাঠের মূর্তি উদ্ধার করে আনবো, এই প্রস্তাব দেব।

কাঠের মূর্তিটা নিয়ে সবাই এত ভাবছে কেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। পারিসি বলল।

ফ্রান্সিস হেসে বলল, সত্যিই সেই মূর্তিটা কাঠের। কারণ নিওফিতস এত ধনবান ছিলেন না যে সোনা হীরে মানিক দিয়ে অত উঁচুতে গুহায় থেকে মূর্তি গড়বেন। কাজেই হাতের কাছে হয়তো ওক বা চেস্টনাট গাছ পেয়েছিলেন। তার ডাল কুঁদে কুঁদে মূর্তিটা গড়েছিলেন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, পারিসি–মূর্তিটা মূল্যবান অন্য কারণে। ভেবে দেখো একজন মহান সর্বত্যাগী সাধুপুরুষ সেই মূর্তিটা তিলে তিলে গড়েছিলেন। তাহলেই বুঝতে পারছো কী পবিত্র সেই মূর্তি। এই জন্যেই গী দ্য লুসিগনান মূর্তিটা উদ্ধার করার জন্যে তোমাকে পাঠিয়েছিল। তুমি সুযোগ বুঝে পালিয়ে এলে। তারপরেও হয়তো আরো লোক পাঠানো হয়েছিল। বোধহয় কেউই মূর্তিটা উদ্ধার করতে পারেনি।

আপনি পারবেন? পারিসি বলল।

দেখি। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।

একদিন ভোর ভোর সময়ে আল জাহিরি ক্যারাভেল আর ফ্রান্সিসদের জাহাজ কেরিনিয়া বন্দরে এসে ভিড়ল। ঘড় ঘড় শব্দে নোঙর ফেলার শব্দ হলো। কয়েদঘরের অনেক ভাইকিংদের ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিসেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হ্যারিকে ডাকল, হ্যারি। হ্যারি চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল, আমরা বোধহয় কেরিনিয়া বন্দরে এলাম।

তাই তো মনে হচ্ছে–হ্যারি বলল, দেখি পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করে।

 দু’তিনজন পাহারাদার সকালের খাবার নিয়ে ঢুকল। ভাইকিংদের খেতে দিল। খেতে খেতে হ্যারি একজন পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করল, জাহাজ কোন্ বন্দরে ভিড়ল।

কেরিনিয়া বন্দরে। এখানে তোমাদের বিক্রি করা হবে। সবাই পেট ভরে খাও। সবাই পেট পুরে খাও শরীর ঠিক রাখো। পাহারাদারটি ঠাট্রা সুরে বলল।

ফ্রান্সিস খাওয়া থামিয়ে হ্যারিকে বলল, পাহারাদারটি ঠাট্টার সুরে কী বলল?

ও কিছু না। হ্যারি বলল।

তবু বলো। ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল। হ্যারি বুঝল যে ঠাট্টার সুরে পাহারাদারটি যা বলেছে তা শুনলে ফ্রান্সিস ভীষণ রেগে যাবে। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল, হ্যারি– বলো। এবার হ্যারি আস্তে আস্তে বলল, বলল যে এখানে তোমাদের বিক্রি করা হবে। পেট ভরে খাও শরীর ঠিক রাখো। কথাটা হ্যারি বলে শেষ করতে না করতে ফ্রান্সিস এক লাফে উঠে দাঁড়াল। ছুটে গিয়ে সেই পাহারাদারটির ঘাড়ে এক রদ্দা কষাল। পাহারাদারটি ‘আঁ’ শব্দ তুলে কাঠের পাটাতনে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস পাহারাদারের কোমরে ঝোলানো তলোয়ারটা এক হ্যাঁচকা টানে খুলে নিল। এসব দেখে অন্য পাহারাদাররা খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে এলো। কাঠের পাটাতনে ছিটকে পড়া পাহারাদারটি উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ওর গলায় তলোয়ারের ধারালো ডগাটা চেপে ধরে বলল, হ্যারি, এই রসিকটি ঠাট্টা করে যা বলেছে তার জন্যে তাকে ক্ষমা চাইতে বলো।

হ্যারি দ্রুত পাহাদারটিকে গ্রীক ভাষায় কথাটা বলল। ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা ও চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকল। ততক্ষণে আট-দশজন সৈন্য কয়েদঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সবার হাতেই খোলা তলোয়ার। ফ্রান্সিস ওদিকে রুদ্রমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অস্ফুটস্বরে ফ্রান্সিস বলল, সব কটাকে নিকেশ করবো।

হ্যারি কথাটা শুনে ভয়ে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল–ফ্রান্সিস শান্ত হও। তুমি। লড়াইয়ে নামলে আমরা কেউ বাঁচবোনা। মারিয়া এতক্ষণে অবাক চোখে ফ্রান্সিসের রাগের চেহারা দেখছিল। এবার হ্যারি রাজকুমারীকে বলল, আপনি ফ্রান্সিসকে শান্ত হতে বলুন।

মারিয়া বলে উঠল–ফ্রান্সিস, শান্ত হও। আমাদের কথা ভুলে যেও না। ফ্রান্সিসের দৃঢ়ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটা এবার নড়ল। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে তলোয়ারটা কাঠের মেঝেতে ফেলে দিল। আস্তে আস্তে বসে পড়ল কাঠের থালাটা টেনে নিয়ে আধখাওয়া খাবার আবার খেতে লাগল।

এবার হ্যারি গ্রীক ভাষায় পাহারাদারদের বলল, তোমরা আর যাই করো, আমাদের এই বন্দিদশা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করো না। ফ্রান্সিসকে তোমরা চেন না। ওর হাতে তলোয়ার থাকলে তোমাদের মতো আট-দশজনকে একাই নিকেশ করতে পারে। কাজেই সাবধান, ফ্রান্সিসকে অনেক কষ্টে শান্ত করেছি আমরা। বাজে ঠাট্টা-রসিকতা করো না। এতক্ষণে সৈন্যরাও ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝল। ওরা চলে গেল। পাহারাদাররাও এঁটো কাঠের থালা গ্লাস নিয়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পাহারাদারদের মধ্যে তৎপরতা দেখা গেল। কয়েকজন সৈন্যও এলো। একটু পরেই আল জাহিরি কয়েদখানার গরাদের সামনে এলো। মুখে হাসির ভঙ্গ করে এনে স্পেনীয় ভাষায় বললো, আসার পথে তোমরা গোলমাল করোনি এজন্য ধন্যবাদ। এবার তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে ক্রীতদাস কুটিরে। বিরাট ঘর। তোমরা আরামে। থাকতে পারবে। তোমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব ব্যবস্থাই রয়েছে ওখানে। কোনোরকম চালাকি করো না, পালাবার চেষ্টা করো না। আমার মানুষ মারতে ইচ্ছে করে না। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতেই চাই আমি।

ক্রীতদাস হিসেবে–তাই না? ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।

আল জাহিরি আবার কাষ্ঠহাসি হাসল। বলল, কী করি। এটাই তো আমার ব্যবসা। হ্যারির ভয় হলো ফ্রান্সিস না আবার চটে যায়।

হ্যারি তাই বলল, আল জাহিরি–আপনার কথামতোই আমরা চলবো।

আল জাহিরি চলে গেল।

সেদিন তখনও রাতের খাওয়া হয়নি। ফ্রান্সিস এতক্ষণে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল। এবার উঠে বসল। ডাকল–হ্যারি? হ্যারিও আধশোয়া হয়েছিল। উঠে বসল। বলল, কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, ভেবে দেখলাম–পারিসি যে খ্রীস্টমূর্তির কথা বলেছে সেটা উদ্ধার করতে আমাকে যেতে হবে। কিন্তু আল জাহিরি যেতে দেবে না। ওর মতো একটা নরপশুকে আমি এজন্য অনুরোধও করবো না। যে করেই হোক পারিসিকে নিয়ে আমি একা পালাবো। পারিসি এই সাইপ্রাসের লোক। ওর সাহায্যে আমি রাজা গী দ্য লুসিগনানের সঙ্গে দেখা করবো। আমার বন্ধুদের মুক্তি দিতে হবে এই শর্তে যীশুর মূর্তি উদ্ধার করতে যাবো।

কিন্তু পারিসি বলছিল ঐ গুহার এলাকায় নাকি অসম্ভব শীত। ঠাণ্ডায় ঝর্ণার জল পর্যন্ত জমে যায়। হ্যারি বলল।

সেটা শীতকালে। এখন বসন্তকাল। খুব ঠাণ্ডা পড়বে না–ফ্রান্সিস বলল, ঠাণ্ডার জন্যে ভাবি না–ভাবছি ওরকম কাঠের মূর্তি আছে কিনা। যদি থাকে আপ্রাণ চেষ্টা করবো খুঁজে বের করতে। এছাড়া আমাদের মুক্তির কোনো আশা নেই। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে তুমি একাই পালাবে? হ্যারি বলল।

একা নয় পারিসিকেও সঙ্গে নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর পারিসিকে কাছে। আসতে বলল। পারিসিকে পালাবার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বলল। এবার মারিয়াকে বলল, আমি আর পারিসি পালাবো। তুমি কোনোরকম দুশ্চিন্তা করো না। তুমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হওনি। দুশ্চিন্তা হলে তোমার শরীর খারাপ হবে।

না–আমি কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবো না। তুমি সফল হও–এই কামনা করি। মারিয়া আস্তে আস্তে বলল। ফ্রান্সিস অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো।

তখন রাত হয়েছে। ডাং ঢং শব্দ করে কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। দু’জন পাহারাদার খাবার নিয়ে ঢুকল। সবাই বসে খেতে লাগল। ফ্রান্সিস আর পারিসি দরজার কাছে পায়চারি করতে করতে খেতে লাগল।

হঠাৎ ফ্রান্সিস ভেজানো লোহার দরজাটা দ্রুত হাতে খুলে বাইরে চলে এলো। পেছনে পারিসি। আচমকা এই ঘটনায় দরজার কাছে দাঁড়ানো দুই পাহারাদার হতবাক। ওর মধ্যে একজন ফ্রান্সিসের দিকে ছুটে এলো। ও কোমর থেকে তলোয়ার খুলছে তখনি ফ্রান্সিস ওর বুকে লাথি মারল। পাহারাদার ছিটকে কয়েদঘরের মেঝেয় পড়ে গেল। হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। অন্য পাহারাদারটি কাছে আসার আগেই ফ্রান্সিস কাঠের থালা ছুঁড়ে মারল কাঁচে ঢাকা বাতিটার দিকে। কাঁচে ঢাকা বাতি ভেঙে চৌচির। অন্ধকার হয়ে গেল জায়গাটা। পাহারাদার অন্ধকারে ফ্রান্সিসদের দেখতে পেল না। পারিসির হাত ধরে ফ্রান্সিস ছুটল সিঁড়ির দিকে। কয়েদঘরের পাহারাদাররা চিৎকার চাঁচামেচি করতে লাগল। কিন্তু সেই শব্দ ওপরে ডেক পর্যন্ত এলো না। কাজেই ডেক এ দাঁড়ানো সৈন্যরা কিছুই বুঝল না।

সিঁড়ি দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফ্রান্সিস পারিসিকে নিয়ে উঠ এলো ডেক-এ। ডেক এর সৈন্যদের দু’একজনের হাতে তলোয়ার। বাকিরা গল্পগুজব করছে। ফ্রান্সিস আর পারিসিকে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে দেখে দু’একজন সৈন্য ছুটে এলো। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই ফ্রান্সিস পারিসির হাত ধরে বলল, আমার সঙ্গে লাফ দাও। দু’জনে একসঙ্গে লাফ দিয়ে রেলিং ডিঙিয়ে ঝপাৎ করে সমুদ্রের জলে পড়ল।

সব সৈন্য পাহারাদাররা ডেক-এর ধারে এসে রেলিং ধরে চিৎকার চাঁচামেচি করতে লাগল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস আর পারিসি ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ফ্রান্সিস আর পারিসি ডুব সাঁতার দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে আস্তে আস্তে জলের ওপর মাথা তুলল। পেছনে তাকিয়ে দেখল ক্যারাভেল-এর ডেক-এ আল জাহিরি এসে দাঁড়িয়েছে।

ফ্রান্সিস পারিসিকে বলল, কোনোরকম শব্দ না করে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে চলো। একটু দূরে গিয়ে আমরা সমুদ্রতীরে উঠবো। দু’জনেই আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে চলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তীরে পৌঁছল। পেছল পাথর বালির ওপর দিয়ে হেঁটে এসে তীরে উঠল। মাথার জল ঝাড়তে ঝাড়তে ফ্রান্সিস বলল, পারিসি,এই জলেভেজা অবস্থায় কোথাও একটু একটু আশ্রয় তো নিতে হবে।

কিছু ভাববেন না। আমার বাড়িটা তো আছে। পারিসি বলল।

 তোমার বাড়িতে কে আছে? ফ্রান্সিস বলল।

আমার বুড়ি মা। তবে বেশ কয়েক মাস তো আমি বাইরে বাইরে। মা’র কী অবস্থা জানি না। পারিসি বলল।

চলো তো। একটা মাথা গোঁজার আস্তানা পেলেই হলো। ফ্রান্সিস বলল।

কেরিনিয়া বন্দুর-শহরের রাস্তা দিয়ে ওরা চলল। রাত হয়েছে। রাস্তা নির্জন। রাস্তার এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। বাড়িঘর অন্ধকারে ডুবে আছে। সবাই ঘুমুচ্ছে বোধহয়।

প্রায় আধঘণ্টার ওপর হাঁটতে হাঁটতে ওরা পারিসির বাড়ির দোরগোড়ায় এলো। পারিসি দরজার শেকলটা দরজায় ঠুকতে ঠুকতে ডাকল–মা, মা। বারকয়েক ডাকার পর সাড়া পাওয়া গেল। বুড়ির ভাঙা গলায় কেউ বলছে–কে রে?

আমি পারিসি–মা দরজা খুলে দাও। পারিসি বলল। ঠক্ ঠক্ শব্দে কাঠের দরজা খুলল। মোমবাতি হাতে একজন বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। পারিসিকে দেখে ফোকলা দাঁতে হাসল। বলল, তুই কী করেছিস? রাজার সৈন্যরা তোর খোঁজে তিন-চার দিন এসেছিল।

ওসব নিয়ে ভেবো না। আমি অন্যায় কিছু করিনি। পারিসি বলল। ফ্রান্সিস, পারিসি আর ওর মার কথা গ্রীক ভাষায় বলে কিছুই বুঝছিল না। পারিসি ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল। তারপর মাকে বলল–আমার এক বিদেশি বন্ধু এসেছে। আমাদের কিছু খেতে দাও।

এত রাতে, কী দেব। ভালো পিঠে আছে–খাবি? মা বলল।

কেন খাবো না। চলো ভেতরে। খেতে দাও। পারিসি বলল। ফ্রান্সিস আর পারিসি তো আধপেটা খেয়েই পালিয়েছিলে। কাজেই যখন একটা মাটির থালায় পরিসির মা পিঠে খেতে দিল তখন দু’জনেই হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিল। জলটল খেয়ে এতক্ষণে ওদের স্বস্তি হলো। দু’জনে ভেজা পোশাক পালটাল। তারপর ঐ ঘরেই দু’জনে মেঝেয় শুয়ে পড়ল। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে ফ্রান্সিস বলল, পারিসি-বর্তমান শাসক গী দ্য লুসিগনানের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। তুমি এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করো।

মুশকিল হয়েছে যে আমি তো জেরস পাহাড় থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে পেয়ে কয়েদখানায় পাঠাবে। পারিসি বলল।

ঠিক আছে–ফ্রান্সিস বলল, আমাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি রাজসভায় চলো। তোমাকে যাতে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয় সে ব্যবস্থা আমি করবো।

আমাদের তো রাজধানী নিকোশিয়ায় যেতে হবে। পারিসি বলল।

তাই চলো। তুমি একাট চাষীদের শস্যটানা গাড়ির ব্যবস্থা করো। ফ্রান্সিস বলল।

দেখি। পারিসি এই কথা বলে বেরিয়ে গেল।

 কিছুক্ষণ পরে পারিসিফিরে এলো। বলল–গাড়ি পেয়েছি। কিন্তু এতদূর পথ যেতে অর্ধ স্বর্ণমুদ্রার অর্থ চাইছে। ফ্রান্সি বলল, পারিসি, তোমার জানাশুনো কোনো স্বর্ণকার আছে?

তা আছে। পারিসি বলল।

তাহলে গাড়িতে চড়ে আগে সেখানে চলো। আমার বিয়ের আংটিটা বন্ধক রেখে স্বর্ণমুদ্রার অর্থ নেব। গাড়িভাড়া দেব। ফ্রান্সিস বলল।

পারিসির মা’র হাতে তৈরি আরো পিঠে খেল দু’জনে। বাড়িতে তৈরি এত সুস্বাদু পিঠে ফ্রান্সিস যে কতদিন খায়নি। পিঠে খেতে খেতে ফ্রান্সিসের বারবার মা’র কথা মনে পড়তে লাগল।

ওরা চাষীর গাড়িতে চড়ে বসল। পথে এক স্বর্ণকারের দোকানে ঢুকল ওরা। পারিসির পরিচিত দোকানদার। আংটি বন্ধক রেখে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিল। ফ্রান্সিস বারবার বলল, আমি কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। এর মধ্যে সোনার আংটিটা গালিয়ে ফেলবেন না কিন্তু। দোকানদার মাথা নেড়ে বলল, না–না। অন্তত বছর খানেকের আগে আমরা বন্ধকী জিনিস গলাই না।

এবার নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়িতে উঠল দু’জনে। গাড়ি চলল রাজধানী নিকোশিয়ার দিকে।