যীশুর কাঠের মূর্তি – ৩

রাতের খাবার খেল না মারিয়া। মাথা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। জ্বর বেড়েই চলেছে। মারিয়া বুঝল–অসুখের কথা আর গোপন করা চলবে না। জ্বর বাড়তে বাড়তে ও হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। ভেনকে খবর দিতে হয়। মারিয়া ঠিক করল ও নিজেই ভেনকে ডেকে আনবে। আর কাউকে জানতে দেবে না। যদি ভাইকিং বন্ধুরা জানতে পারে যে মারিয়া অসুস্থ তাহলে ওরা খুবই চিন্তায় পড়ে ঘাবে। আবার ফ্রান্সিসও এখানে নেই। ওদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়বে।

রাত বাড়ল। মারিয়া বুঝল আর দেরি করা উচিত হবে না। মারিয়া আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠল। যে মোটা কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে ছিল সেটা গায়ে দিয়ে চলল। মাথার যন্ত্রণায় ভালো করে তাকাতে পারছে না। কানের দু’পাশ ঝা ঝা করছে। দরজার কাছে যেতেই মাথা ঘুরে উঠল। দরজা চেপে ধরে টাল সামলাল।

একটা ঝুলন্ত কাঁচে-ঢাকা আলো জ্বলছে বাইরে। ঐ সামান্য আলোতেই দেখে দেখে ভেন-এর কেবিনঘরের দরজার সামনে মারিয়া এলো। দরজা খোলাই ছিল। মারিয়া কেবিনঘরে ঢুকে,ঢুকল–ভেন-ভেন। ভেন-এর ঘুম ভেঙে গেল।ও উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল-কে? রাজকুমারী?

-হ্যাঁ। একবার এসো তো। একটু জ্বরমতো হয়েছে। মারিয়া বলল।

 –সে কি! এই সেদিন অসুখ থেকে উঠলেন। ভেন বলল।

 ঐ কেবিনঘরে বিস্কোও থাকে। বিস্কোর ঘুম ভেঙে গেল। বলল-রাজকুমারীর কী হয়েছে?

–একটু জ্বর হয়েছে–ওষুধ পড়লেই সেরে যাবে। মারিয়া বলল। বিস্কো বিছানা থেকে নেমে এলো। বলল–চলুন আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি–ভেনকে বলল ভেন–তুমি ওষুধ নিয়ে এসো।বিস্কো মারিয়াকেসঙ্গে নিয়ে চলল মারিয়ার কেবিনঘরের দিকে। এতক্ষণ মারিয়া শরীরের ব্যথা বেদনা মাথার অসহ্য যন্ত্রণা প্রবল জ্বর অনেক কষ্টে সহ্য করেছিল। আর পারল না। নিজের কেবিনঘরের দরজার কাছে এসে মাথা ঘুরে মেঝেয় পড়ে গেল। বিস্কো তো অবাক। সামান্য জ্বরে মারিয়া এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ও মারিয়ার পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে মারিয়াকে উঠে বসাল। তারপর মারিয়াকে পাঁজাকোলা করে তুলল। এইবার বিস্কো বুঝল–রাজকুমারীর শরীর প্রচণ্ড জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে। বিস্কো আস্তে আস্তে মারিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিল।

মারিয়ার গলা থেকে ঘোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল।বিস্কো মারিয়ার মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

ভেন ঢুকল। হাতের ওষুধের বোয়ামটা বিছানায় রাখল। মারিয়ার কপালে গলায় হাত রেখে জ্বরের তাপ দেখল। তারপর চোখ দেখল। হাতের নাড়ির গতি দেখল। তারপর মেঝেয় গিয়ে বসল। বোয়ামটা নিল। বোয়াম থেকে সবুজ রঙের আঠালো একটা ওষুধ বের করল। হাত দিয়ে চারটে বড়ি করল। বিস্কোকে বলল-জল এনে ওষুধের একটা বড়ি রাজকুমারীকে খাইয়ে দাও। বিস্কো কাঠের গ্লাসে জল এনে মারিয়াকে মৃদুস্বরে বলল রাজকুমারী এই ওষুধটা খেয়ে নিন। এটা খেলে কষ্ট কমবে। মারিয়া তখন প্রায় অজ্ঞানের মতো। বিস্কো বুঝল সেটা। তবুওষুধটা খাওয়াতে হবেই। বিস্কো মারিয়ার পিঠে হাত রেখে মাথাটা উঁচু করল। জলের গ্লাস থেকে মুখে জল ঢালল। মারিয়া জল খেল। বিস্কো এবার একটা বড়ি খাইয়ে দিল। তারপর মারিয়াকে শুইয়ে দিল।

বিস্কো ভেনকে বলল-ভেন তুমি চলে যেও না। ভেন বলল–আমাকে এখানে সারারাতই জেগে থাকতে হবে।

–আমি হ্যারিকে ডেকে আনছি। বিস্কো বলল। তারপর দ্রুত পায়ে কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একটু পরেই হ্যারি এলো। সঙ্গে শাঙ্কো। হ্যারি এগিয়ে গিয়ে মারিয়ার কপালে হাত রাখল। গলায় হাত রাখল। বলল–ভেনজুর খুব বেশি–তাই না?

ভেন বলল– হা। ওষুধ দিয়েছি। জ্বর কমবে।

ভেন বিছানায় বসল। মাঝে মাঝে মারিয়ার কপালে হাত দিয়ে দেখতে লাগল। হ্যারিরা মেঝেয় বসে রইল। হ্যারি ভাবছিল এই বিপদের সময় ফ্রান্সিস নেই। ফ্রান্সিস থাকলে মনে অনেক জোর পাওয়া যেত।

ততক্ষণে ভাইকিংরা খবর পেয়েছে রাজকুমারী ভীষণ অসুস্থ। ওরা কেবিনঘরের বাইরে ভিড় করল।

শেষ রাতের দিকে মারিয়াকে পরীক্ষা করে ভেন বলল–হ্যারি-জ্বর অনেকটা কমেছে। হ্যারি মারিয়ার কপালে হাত রাখল। হ্যাঁজুর অনেক কম।

ভোর হল। ভেন আর হ্যারিরা তখনও বসে আছে। রাতে কেউ আর ঘুমোয় নি।

হ্যারি ভেনকে বলল–তোমার কি মনে হয় এই ওষুধেই রাজকুমারী সুস্থ হবেন?

–ঠিক বলতে পারছি না। কয়েকদিন যাক–তখন বলতে পারবো। ভেন বলল।

 বিকেল হতেই মারিয়ার আবার জ্বর এলো। জ্বর বাড়তে লাগল। জ্বর এত বাড়ল যে মারিয়া প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেল। হ্যারি ভেনকে ডেকে নিয়ে এলো। ভেন মারিয়ার কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখল। ভেন-এর মুখ চিন্তাকুল হল।

ভেন মেঝেয় বসল। যে ঝোলাটা এনেছিল সেটা থেকে একটা শুকনো শেকড় বের করল। তারপর বের করল দুটো পাথর। বিস্কোকে জল আনতে বলল। বিস্কো কাঠের গ্লাশে জল ভরে দিল। ভেন শেকড়টা কিছুক্ষণ জলে ভিজিয়ে রাখল। তারপর শেকড়টা একটা পাথরের ওপর রাখল। অন্য পাথরটা দিয়ে শেকড়টা ঘষতে লাগল। হলুদ রঙের রস বেরোতে লাগল। সেই রসটা কাঠের গ্লাশের জলের সঙ্গে মেশাল। হ্যারিকে বলল–হলুদ জলটুকু রাজকুমারীকে খাইয়ে দাও।

হ্যারি সবধানে মারিয়ার মাথাটা দু’হাতে তুলে ধরল। আস্তে আস্তে মারিয়াকে ওঠাতে ওঠাতে বলল–রাজকুমারী–কষ্ট করে ওষুধটা খেয়ে নিন। মারিয়া দু’একবার দম নিয়ে ওষুধটা খেল। হ্যারি সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিল। এবার জ্বর কমে কিনা তার। জন্য প্রতীক্ষা করা।

সন্ধে হল। রাত বাড়তে লাগল। ভেন মাঝে মাঝেই মারিয়ার গলায় কপালে হাত দিয়ে জ্বর বাড়ছে না কমছে তা দেখতে লাগল।

একসময় ভেন হ্যারিকে বলল–আমি এখানে আছি। তোমরা গিয়ে খেয়ে এসো। হ্যারিরা খেতে গেল। কিন্তু কেউই বেশি খেতে পারল না।

ওরা কেবিনঘরে ফিরে এলো।

হ্যারিরা মেঝেয় বসে রইল। কারো চোখেই ঘুম নেই।

শেষ রাতের দিকে মারিয়ার শরীর আরো খারাপ হল। জ্বর এত বাড়ল যে মারিয়া অজ্ঞান হয়ে গেল।

ভেন মারিয়ার চোখ দেখল। কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখল। পা ও হাত চেপে দেখল। মৃদুগলায় ডাকল–হ্যারি। হ্যারির একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। ডাক কানে যেতেই ও দ্রুত ভেন-এর কাছে এলো। ভেন বলল–হ্যারি আমার জ্ঞান বুদ্ধিমতো চিকিৎসা আমি করেছি। আমার আর কিছু করার নেই। এখন কেরনিয়া নগরে ভালো বৈদ্যের খোঁজ কর। তাকে দেখাও। এছাড়া আর কিছু করার নেই।

ভোরবেলা। মারিয়ার জ্বর একটু কমল। কষ্টও একটু কমল।

হ্যারি বিস্কোকে ডেকে বলল–চলো–ভালো বৈদ্যের খোঁজে কেরিনিয়ায় নগরে আমাদের যেতে হবে।

–কিন্তু বৈদ্যের খোঁজ পাব কী করে? বিস্কো বলল।

-দেখি। যে ভদ্রলোকের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম তাকেই জিজ্ঞেস করবো। চলো। হ্যারি বলল।

ওরা দু’জন জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। হ্যারি দেখল–এখানে-ওখানে ভাইকিং বন্ধুরা দল বেঁধে বসে আছে। গতরাতে কেউই বোধহয় ঘুমোয় নি।

দু-একজন ভাইকিং বন্ধু হ্যারির কাছে এগিয়ে এলো। বলল–হ্যারি রাজকুমারী এখন কেমন আছেন?

–ভালো না–আমরা ভালো বৈদ্যের সন্ধানে যাচ্ছি।

হ্যারি আর রিস্কো জাহাজ থেকে নেমে এলো। মারিয়ার শিয়রের কাছে ভেন বসে রইল। মেঝেয় বসে রইল শাঙ্কো। ভাইকিং বন্ধুরা মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যাচ্ছে। মারিয়া তখন জ্বরে অজ্ঞান।

হ্যারি আর রিস্কো অ্যান্তিকের সামনে এলো। পেতলের কড়াটা দরজায় ঠুকে শব্দ করল। দরজা খুলে গেল।

অ্যান্তিকো দাঁড়িয়ে। বললেন কী ব্যাপার? হ্যারি বলল–আমাদের দেশের রাজকুমারী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার চিকিৎসার জন্যে একজন ভালো বৈদ্যের খোঁজ দিতে পারেন?

–আমি পেশায় বৈদ্য। তোমরা রাজকুমারীকে নিয়ে এসো। আমিই চিকিৎসা করবো। কোনো ভয় নেই। অ্যান্তিকো বললেন।

হ্যারি আর বিস্কো দু’জনেই নিশ্চিন্ত হল। খুশিও হল।

ওরা অ্যান্তিকোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। হ্যারি বলল–বিস্কো একটা কৃকদের শস্যটানা গাড়ি জোগাড় করতে হবে।

দু’জনে বাজার এলোকায় এলো।খুঁজে খুঁজে একাট গাড়ি পেল। ভাড়া করল গাড়িটা। গাড়িট চেপে দু’জন জাহাজঘাটায় এলো। জাহাজে উঠল। কেবিনঘরে ঢুকে দেখল ভেন বসে আছে। ভেন বলল–বৈদ্যের খোঁজ পেলে?

–হ্যাঁ–হ্যারি বলল রাজকুমারীকে নিয়ে যাওয়া যাবে?

 –হা–তবে সাবধানে গাড়ি করে নিয়ে যাবে। ভেন বলল।

 –আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। হ্যারি বলল।

 তখন বেলা হয়েছে। হ্যারি মারিয়ার মুখের কাছে মুখ এনে বলল–রাজকুমারী ভালো চিকিৎসার জন্যে আপনাকে নিয়ে যাবো। গাড়িতে করে। একটু কষ্ট হবে। সহ্য করবেন।

বিস্কো বিছানার কাছে গেল। মারিয়ার পিঠে বাঁ হাতটা রাখল। ডান হাত পায়ের নীচে দিয়ে আস্তে আস্তে মারিয়াকে তুলে পাঁজাকোলা করল। আস্তে আস্তে কেবিনঘরের বাইরে নিয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। পেছনে হ্যারি।

মারিয়ার দুই চোখ বোজা। এবার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল। মারিয়ার এই কষ্ট দেখে বিস্কোও সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু মারিয়াকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার জন্যে মারিয়াকে তো এই কষ্ট মেনে নিতেই হবে।

বিস্কো মারিয়াকে নিয়ে জাহাজ থেকে জাহাজঘাটায় পেতে রাখা কাঠের তক্তায় উঠল। একজনের যাওয়ার জন্যে তক্তা। বিস্কো সাবধানে মারিয়াকে নিয়ে তক্তায় উঠল। তারপর পা টিপ টিপ করে তক্তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলল। তক্তা শেষ। বিস্কো জাহাজঘাটায় নামল। বিস্কোর আগেই হ্যারি এটা বড়ো মোটা কাপড় আর বালিশমতো নিয়ে এসেছিল। সেসব ঐ গাড়িতে আগেই পেতে রেখেছিল হ্যারি।

বিস্কোকে এত সন্তর্পণে মারিয়াকে আনতে হল যে বিস্কোর দু’হাত ধরে এলো। হাত দুটোয় ব্যথা করতে লাগল।

বিস্কো মারিয়াকে আস্তে আস্তে গাড়ির মধ্যে পাতা কাপড়ে শুইয়ে দিল। বালিশমতো পুঁটুলিটা মাথার নীচে দিল। মারিয়ার তখনও চোখ বোজা। গোঙানিটা কমেছে।

হ্যারি আর বিস্কো গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ির চালককে গাড়ি চালাতে বলল। ঘর ঘর শব্দ তুলে এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে মারিয়ার কষ্ট বাড়ল। মুখ থেকে জোরে গোঙানির শব্দ ভেসে আসতে লাগল। হ্যারি চালককে বলল–এমনভাবে গাড়ি চালাও যাতে ঝাঁকুনি কম হয়। চালক এবার আস্তে আস্তে চালাতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি অ্যান্তিকোর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। হ্যারি গাড়ি থেকে নেমে দরজার পেতলের কড়াটা দরজায় ঠুকল। দরজা খুলে দাঁড়ালেন অ্যান্তিকোর স্ত্রী। বললেন–তোমরা রোগীকে এনেছো?

–হ্যাঁ। হ্যারি বলল।

 –বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দাও। ভদ্রমহিলা বললেন।

এবার হ্যারি আর বিস্কো দু’জনেই মারিয়াকে তুলে আস্তে আস্তে বাইরের ঘরে নিয়ে এলো। ঘরে লম্বা তক্তপোষমতো পাতা। ওপরে বিছানা পাতা। দু’জনে মারিয়াকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিয়ে হ্যারি বাইরে এলো। চালকের দাম মেটাল। মোটা কাপড় আর বালিশ গাড়ি থেকে নিয়ে এলো। মারিয়ার মাথার নীচে বালিশটা দিয়ে দিল হ্যারি। মোট কাপড়টা একপাশে রাখল।

দু’জনে ঐ বিছানায় বসল। একটু পরেই অ্যান্তিকো এলেন। খুব মনোযোগ দিয়ে মারিয়াকে নানাভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপর পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে মৃদুস্বরে কিছু বললেন। স্ত্রী বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে একটি চিনেমাটির ছোটো বোয়াম নিয়ে এলেন। অ্যান্তিকো বোয়ামের মুখ খুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কালো রঙের আঠামতো ওষুধ বের করলেন। মারিয়ার মুখ একটু খুলে ওষুধটা মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। মারিয়ার চোখ মুখ কুঁচকে গেল। বোঝা গেল ওষুধটা তেতো। তবে মারিয়া ওষুধটা ফেলে দিল না। আস্তে আস্তে খেয়ে নিল।

অ্যান্তিকো বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হ্যারিদের দিকে তাকিয়ে বললেন– আজকের রাতটা কাটলেই উনি আস্তে আস্তে সুস্থ হবেন। এখন আপনারা চলে যেতে পারেন।হ্যারি বলল–আমরা দুপুরে একবার খেতে যাবো। তারপর দুপুরের পর থেকে সারারাত এখানেই থাকবো।

–বেশ। তাহলে ভালোই হয়। রোগীকে রাতে দু’বার দুটো ওষুধ খাওয়াতে হবে। আপনারা থাকলে ওষুধ দুটো আপনারাই খাওয়াতে পারবেন। অ্যান্তিকো বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। বোয়ামটা নিয়ে অ্যান্তিকোর স্ত্রী ভেতরে চলে গেলেন।

হ্যারি আর বিস্কো বিছানার একপাশে বসে রইল।

দুশ্চিন্তায় গত রাতটা ওরা দু’চোখের পাতা এক করেনি। হ্যারির শরীর বরাবরই দুর্বল। রাত জাগার ক্লান্তিতে হ্যারির মাথা টিটি করতে লাগল। নিজেকে বেশ দুর্বল মনে হতে লাগল। বিস্কো বুঝল সেটা। ও বলল হ্যারি তুমি একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে নাও। আম তো জেগে আছি। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল–না। বিস্কো ধমকের সুরে বলল–পাগলামি করো না। তুমি যে শরীরের দিক থেকে খুব দুর্বল সেটা আমরা জানি। এবার তোমার কিছু হলে আমাদের বিপদই বাড়বে। কথা শোনো-ঘুমিয়ে নাও। দুপুরে খেতে যাবার সময় তোমাকে ডেকে নেব। হ্যারি বুঝল–না ঘুমলে শরীরের দুর্বলতা যাবে না। হ্যারি বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো জ্বালা করছে। মাথাটাও টিটি করছে। দেখা যাক–শরীরের এই অবস্থায় ঘুম আসে কি না।

একটু পরেই হারি ঘুমিয়ে পড়ল।

 দুপুরে বিস্কো হ্যারির ঘুম ভাঙাল। হ্যারি উঠে বসল। চোখ কচলাল। তারপর মারিয়ার কপালে হাত রাখল গলায় হাত রাখল। জ্বর অনেক কমে গেছে। খুশির চোখে বিস্কোর দিকে তাকিয়ে বলল–বিস্কো জ্বর অনেক কমে গেছে। তখনই দেখল–মারিয়ার চোখ খোলা। ওর দিকে তাকিয়ে মারিয়া দুর্বল স্বরে বলল–আমার জন্যে তোমাদের ভোগান্তির শেষ নেই।

হ্যারি বলে উঠল। ওসব নিয়ে ভাববেন না। আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হোন। তারপরে এসব কথা ভাববেন। বিস্কো বলল-রাজকুমারী–আমরা এখন খেতে যাচ্ছি। কতটা খেতে পারবো জানি না। তবু আমাদের তো সুস্থ থাকতে হবে।

দু’জনে এবার চলল জাহাজঘাটার দিকে। জাহাজে উঠতেই বন্ধুরা ছুটে এল। হ্যারি একটু গলা চড়িয়ে বলল –ভাইসব রাজকুমারীর জ্বর কমেছে। এখন অনেকটা ভালো আছেন। সবাই আনন্দের ধ্বনি তুলল– ও হো হো।

খাওয়া-দাওয়া সেরে হ্যারি আর বিস্কো আবার অ্যান্তিকোর বাড়িতে ফিরে এলো। রাজকুমারী বেশ দুর্বলস্বরে আস্তে আস্তে বলল–অ্যান্তিকোর স্ত্রী মায়ের মত আমাকে দুপুরে ফলের রস খাইয়েছেন। ওষুধ খাইয়েছেন। হ্যারি বিস্কো শুনে আশ্বস্ত হল।

ওদিকে কয়েদঘরের পেছনে থেকে আল জাহিরির যে সৈন্যটা মারিয়ার দিকে নজর রাখছিল সে সবই দেখল। অসুস্থ মারিয়াকে গাড়িতে তোলা হল। গাড়িতে দু’জন ভাইকিং চলল। গাড়িটা যেহেতু খুব জোরে যাচ্ছিল না সৈন্যটি একটু জোরে হেঁটে গাড়ির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলল।

অ্যান্তিকোর বাড়িতে ঢোকা এসবুই সৈন্যটি দেখল। তারপর পিছু ফিরে ও চলল জেলেপাড়ার দিকে। সমুদ্রতীরে এসে একটা জেলেনৌকোয় চড়ে ও জাহাজের দিকে চলল।

জাহাজে উঠে চলল আল জাহিরির কেবিনঘরের দিকে। আল জাহিরিকে ও সব বলল। আল জাহিরি তখন সৈন্যটিকে বলল–তুই আবার যা। শুধু লক্ষ্য রাখবি কখন ভাইকিং দু’জন নিজেদের জাহাজে খেতে যায়। ঐ সময় রাজকুমারী একা থাকবে। সেই সুযোগটাই তখন কাজে লাগাতে হবে। তুই সেই সময়ে আসবি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

সৈন্যটি এবার চলল নৌকোয় চড়ে তীরের দিকে।

অ্যান্তিকোর বাড়ির সামনে গিয়ে সৈন্যটি দাঁড়াল। নজর রাখল কখন ভাইকিং দু’জন বেরোয়।

হ্যারি গভীর রাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। বিস্কো একটানা জেগে রইল। অ্যান্তিকোর নির্দেশমতো মারিয়াকে ওষুধ খাওয়াল।

পরদিন সকালে মারিয়া অনেকটা সুস্থ বোধ করল। অ্যান্তিকোর স্ত্রী মারিয়াকে ওষুধ ও খাইয়ে গেলেন।

কিছু পরে অ্যান্তিকো এলেন। মারিয়াকে পরীক্ষা করে দেখে হ্যারিকে বললেন– আপনাদের রাজকুমারীর বিপদ কেটে গেছে। উনি এবার আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন। হ্যারি আর বিস্কো মারিয়ার দিকে তাকিয়ে খুশির হাসি হাসল।

মারিয়া আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসল। হ্যারিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল। তখনও দুর্বলতা কাটেনি।

একটু বেলায় হ্যারি আর বিস্কো খেতে চলল। ওরা রাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই নজরদার সৈন্যটি বাজার এলাকা থেকে একটা শস্যটানা গাড়ি ভাড়া করে দ্রুত গিয়ে জেলেপাড়ায় উঠল। আল জাহিরিকে বলল–পাহারাদার দু’জন ভাইকিংই ওদের জাহাজে খেতে চলে গেছে।

আল জাহিরি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ল। বলল–চারজন আমার সঙ্গে চল। যে নৌকোয় পাহারাদার এসেছিল সেই নৌকোয় চড়ে সবাই তীরে এলো। যে গাড়িটায় পাহারাদর এসেছিল সেই গাড়িতে চড়ে ওরা দ্রুত চলল অ্যান্তিকোর বাড়ির দিকে।

অ্যান্তিকের বাড়িতে পৌঁছে দরজায় পেতলের কড়া দিয়ে ঠক্ঠক্‌শব্দ করল। দরজা খুলে দাঁড়ালেন অ্যান্তিকোর স্ত্রী। আল জাহিরি তাকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকল। চলল বাইরের ঘরের দিকে। অ্যান্তিকোর স্ত্রী বললেন–আপনারা কারা? কী চান? আল জাহিরি হেসে বলল–আমরা আমাদের রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে এসেছি।

–কিন্তু রাজকুমারী এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। অ্যান্তিকোর স্ত্রী বললেন।

–জাহাজে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। আল জাহিরি বলল।

 সৈন্য নিয়ে আল জাহিরি বাইরের ঘরে ঢুকল। দেখল মারিয়া বিছানায় শুয়ে আছে। আল জাহিরিকে দেখে মারিয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানায় উঠে বসল। বলল কী চাই তোমাদের? আল জাহিরি হেসে বলল–কোনো কথা নয়। আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। যদি যেতে না চান চিৎকার চাচামেচি করেন তাহলে বুকে তলোয়ার বিধিয়ে দেব। একটু থেমে বলল–উঠে বসুন।

–আমি যাবো না। বেশ চড়া গলায় মারিয়া বলল। আল জাহিরি বলল চাঁচাতে মানা করেছি। দু’জন সৈন্যকে বলল–যা ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তোল।

দু’জন সৈন্য মারিয়ার দু’হাত ধরে দাঁড় করাল। আল জাহিরি তলোয়ার বের করল। তরোয়ালের ডগা মারিয়ার পিঠে ঠেকিয়ে বলল–আর একটা কথা বলেছেন কি তলোয়ার বিঁধিয়ে দেব। মারিয়া বুঝল এখন ওকে বাঁচাবার কেউ নেই। অ্যান্তিকো বা তার স্ত্রী কিছুই করতে পারবেন না। মারিয়া চুপ করে রইল। আল জাহিরি পিঠে তলোয়ারের চাপ বাড়াল। বলল–চলুন।

মারিয়া দুর্বল পায়ে হেঁটে চলল বাইরের দরজার দিকে। অ্যান্তিকো আর তার স্ত্রী দু’জন ছুটে এলেন। অ্যান্তিকো বললেন–আপনারা কারা? আল জাহিরি বলল– আমরা ভাইকিং। আমাদের রাজকুমারীকে জাহাজে নিয়ে যাচ্ছি। মারিয়া বলে উঠল– ও মিথ্যে কথা। অ্যান্তিকো বললেন–এই তো রাজকুমারী বলছেন আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আল জাহিরি রাগতস্বরে বলে উঠল–সত্য মিথ্যে জানি না। আমরা রাজকুমারীকে নিয়ে যাবোই। বাধা দিতে এলে আপনারা দুজনেই খতম হয়ে যাবেন।

–কিন্তু রাজকুমারীর অসুখ এখনও সম্পূর্ণ সারেনি। অ্যান্তিকো বললেন।

–আমাদের জাহাজের বৈদ্য চিকিৎসা করবে। তাতেই ভালো হয়ে যাবে। আল জাহিরি বলল।

মারিয়াকে নিয়ে আল জাহিরি বাড়ির বাইরে এলো। মারিয়াকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিল। সঙ্গের সৈন্যরাও গাড়িতে উঠল। আল জাহিরি গাড়িতে উঠে হুকুম দিল– জেলেপাড়ায় চল–জ্লদি।

গাড়ি চলল। দুপুর নাগাদ গাড়ি সমুদ্রতীরে জেলেপাড়ায় পৌঁছল। আল জাহিরি নিশ্চিন্ত হল যে পাহারাদার ভাইকিং দু’জন ফেরার আগেই রাজকুমারীকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে।

মারিয়াকে ধরে ধরে নৌকোয় তোলা হল। সবাই নৌকোয় উঠলে নৌকো বেয়ে চলল একজন সৈন্য। মারিয়া একবার ভাবল যে চাঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করে। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হবে না। কেউ ওকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে না। বরং তাতে আল জাহিরি ক্রুদ্ধ হবে। এরা যা নৃশংস। হয়তো তাকে মেরেও ফেলতে পারে। মারিয়া চুপ করে নৌকোয় বসে রইল।

নৌকো গিয়ে জাহাজে লাগল। হালের দিকে ঝোলা দড়ি ধরে দড়ির মই বেয়ে সবাই জাহাজে উঠে গেল। একজন সৈন্য নৌকোয় রইল। জাহাজ থেকে দড়ির জাল ফেলা হল। সেই সৈন্যটি মারিয়াকে দড়ির জালে ধরে ধরে বসিয়ে দিল। জাহাজ থেকে দড়ির জাল টেনে তোলা হল। মারিয়া ডেক-এ নামতেই আল জাহিরি বলল–রাজকুমারীকে আমার পাশের কেবিনঘরে নিয়ে যা আর বৈদ্যকে বল রাজকুমারীর চিকিৎসা করতে।

মারিয়াকে দু’জন সৈন্য ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামাল। নির্দিষ্ট কেবিনঘরে ঢুকিয়ে দিল। দুর্বল শরীর নিয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এলোমেলো বিছানাটায় শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরে গোঁফ দাড়িওয়ালা জাহাজের বৈদ্য এলো। মারিয়াকে পরীক্ষা করল। হেসে বলল কিছু চিন্তা নেই ভালো হয়ে যাবেন। কথাটা গ্রীক ভাষায় বলল। মারিয়া কিছুই বুঝল না। বৈদ্যকে হাসতে দেখে বুঝল ও অনেকটা সুস্থ হয়েছে।

যখন মারিয়াকে গাড়ি থেকে নৌকোয় তোলা হচ্ছিল তখন জেলেরা ভিড় করে দেখছিল। ওরা বুঝতে পারছিল না এই একেবারে অন্যরকম পোশাক পরা মেয়েটি কোন্ দেশের? মারিয়াকে নিয়ে নৌকোটা চলল জাহাজের দিকে। তখনও জেলেরা জটলা করে নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে কথা বলছিল। তারপর ভিড় ভেঙে গেল। যে যার কাজে চলে গেল।

ওদিকে হ্যারি আর বিস্কো জাহাজে খাওয়াদাওয়া সেরে অ্যান্তিকের বাড়িতে এলো। দরজার কড়াঠুকে শব্দ করতে অ্যান্তিকোর স্ত্রী দরজা খুরলেন।হ্যারিদের দেখে বললেন– কী ব্যাপার বলো তো। একটা লোক কয়েকজন সৈন্য নিয়ে এসেছিল। বলল যে ওরা ভাইকিং। ওরা জোর করে রাজকুমারীকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছে।

হ্যারি আর বিস্কো পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। হ্যারি বলল, ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে ওরা।

ততক্ষণে অ্যান্তিকোও এলো। স্ত্রী যা বলেছেন উনিও তাই বললেন। হ্যারি তখনও ভাবছে এভাবে রাজকুমারীকে নিয়ে গেল কারা?

হ্যারি বলল–আচ্ছা দলনেতা লোকটা দেখতে কেমন? অ্যান্তিকো বললেন লোকটার গায়ের রং ফর্সা। মুখের চিবুকে অল্প দাড়ি। গোঁফ আছে। মাথায় কালো বিড়ের মতো পাগড়ি। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–এ আল জাহিরি।

–কিন্তু আল জাহিরিকে তো শাঙ্কো ওর জাহাজের কয়েদখানায় বন্দি করে রেখে এসেছিল। বিস্কো বলল।

–ওর পাহারাদার কিছু সৈন্য আমাদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় পালিয়েছিল। তারাই একত্র হয়ে আল জাহিরিকে তাদের জাহাজের কয়েদঘর থেকে মুক্ত করেছে। হ্যারি বলল।

–তাহলে তো আবার ওরা ওদের জাহাজে গিয়ে জড়ো হয়েছে। বিস্কো বলল।

–ঠিক তাই হ্যারি বলল–এবার ঐ জাহাজটা খুঁজে বের করতে হবে।

–একটা কথা মনে হচ্ছে–বিস্কো বলল–রাজকুমারীকে যখন বন্দি করে নিয়ে গেছে তখন জাহাজটা ঘাটের কাছেই কোথাও আছে। বিস্কো বলল।

–আল জাহিরি রাজকুমারীকে বন্দি করেছে এইজন্যে যে ক্রীতদাস বিক্রির হাটে রাজকুমারীকে অনেক স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করতে পারবে। হ্যারি বলল।

–তাহলে তো এক্ষুণি সেই জাহাজটা কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে হয়। বিস্কো বলল।

-হা এক্ষুণি। নইলে আল জাহিরি রাজকুমারীকে নিয়ে. জাহাজ চালিয়ে চলে যাবে। হ্যারি বলল।

ওরা দু’জনে অ্যান্তিকো আর তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জাহাজঘাটার দিকে চলল।

দু’জনে জাহাজে উঠতেই সব ভাইকিং বন্ধুরা এগিয়ে এলো। ওরা জানতে চায় রাজকুমারী কেমন আছেন। এবার হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–রাজকুমারী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আল জাহিরি রাজকুমারীকে বন্দি করে তার জাহাজে নিয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে এবার সমুদ্রতীরে ছড়িয়ে পড়তে হবে। আল জাহিরির ক্যারাভেল জাহাজটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপরে প্রয়োজনে লড়াই করে রাজকুমারীকে মুক্ত করতে হবে। হ্যারির কথা শেষ হতেই সবাই সমুদ্রতীরে নেমে এলো। ছড়িয়ে পড়ে আল জাহিরির ক্যারাভেল জাহাজটা খুঁজতে লাগল।

হ্যারি গলা চড়িয়ে পেস্রোকে ডাকল। পেড্রো মাস্তুল বেয়ে দড়ি ধরে নেমে এলো। হ্যারি বলল–পেড্রো-আল জাহিরির ক্যারাভেলটা দেখেছো। পেড্রো মাথা নেড়ে বলল–না। তবে বাঁ দিকে দূরে সমুদ্রতীরটা বাঁক নিয়েছে। ঐ বাঁকে যদি কোনো জাহাজ থাকে তবে আমি দেখতে পাবো না। হ্যারি বলল–আমরা সমুদ্রতীর ধরে অনেকটা যাবো। বিশেষ করে দূরে যে সমুদ্রের বাঁকটা আছে সেখানে যাবো। কারণ এখান থেকে বাঁকের জন্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হ্যারি আর বিস্কো সমুদ্রতীর ধরে চলল। যেতে যেতে জেলেপাড়া পার হয়ে এলো। এখান থেকেই শুরু হয়েছে বাঁকটা। বাঁকটা ছাড়তেই একটু দূরে দেখল আল জাহিরির ক্যারাভেল জাহাজটা নোঙর করা।

দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। দু তিনটে নারকোল গাছের আড়ালে দাঁড়াল। আড়াল থেকে ওরা দেখল আল জাহিরির চার-পাঁচজন সৈন্য জাহাজের ডেক-এ শুয়ে বসে। আছে। হ্যারি বলল-রাজকুমারীকে নিশ্চয়ই এই জাহাজে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

–আমারও তাই মনে হয়। বিস্কো বলল। তারপর বলল–এখন কী করবে? হ্যারি বলল–

–আল জাহিরির জাহাজে কত সৈন্য রয়েছে আমরা সেটা সঠিক জানি না। শুধু তুমি আর আমি তিন-চারজন সৈন্যের সঙ্গে লড়তে পারি। তার বেশি হলে পিরবো না। আমরা দুজন যদি এখন আক্রমণ করি তাহলে আল জাহিরি জেনে যাবে যে আমরা ওর জাহাজ খুঁজে পেয়েছি। তখন আল জাহিরি সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীকে নিয়ে জাহাজ চালিয়ে পালিয়ে যাবে। কাজেই আজ রাতে সবাই মিলে আক্রমণ করতে হবে। হ্যারি বলল।

–যদি রাজকুমারীকে এই জাহাজে না পাওয়া যায়? বিস্কো বলল। হ্যারি বলল তখন আল জাহিরিকে বন্দি করে রাজকুমারীকে কোথায় বন্দি করে রেখেছে সেটা জানতে হবে। এখন জাহাজে ফিরে চলো। জাহাজে ফিরে হ্যারি সবাইকে ডেকে বলল–ভাইসব, আল জাহিরির জাহাজ আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল জাহিরির ক্যারাভেলেই রাজকুমরীকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আর দেরি করা চলবে না। আজ রাতেই আমরা আল জাহিরির জাহাজ আক্রণ করবো। সবাই রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরি থাকবে।

রাতের খাওয়াটা সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল।

তিন-চারজন মিলে নোঙর খুলে দিল। হ্যারির নির্দেশে জাহাজ চলল ঐ বাঁকের দিকে। চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। বেশ কিছুদূর পর্যন্ত সমুদ্র, সমুদ্রতীর দেখা যাচ্ছে।

বাঁকের কাছে এসে হ্যারিরা আল জাহিরির ক্যারাভেল দেখতে পেল না। হ্যারি আর বিস্কো যেখানে জাহাজটা দেখে গিয়েছিল সেখানে জাহাজটা নেই।

তখনই মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রো চিৎকার করে বলল–হ্যারি আল জাহিরি ক্যারাভেল জাহাজ চালিয়ে পালাচ্ছে। এখনও বেশিদূর যেতে পারি নি। পিছু ধাওয়া করো। হ্যারিরা মনোযোগ দিয়ে দেখল সত্যিই ক্যারাভেলটা দ্রুত চলেছে। একটু আগে কুয়াশার জন্যে ক্যারাভেলটা ওরা দেখতে পায় নি। কুয়াশা কেটে যেতেই ক্যারাভেলটা দেখল। এবার গতি চাই। ক্যারাভেলটা ধরতে হবে। হ্যারি চিৎকার করে বলল–ভাইসব-পশ্চিম দিকে দেখো ক্যারাভেলটা পালাচ্ছে। যে করেই হোক ঐ ক্যারাভেলটাকে ধরতে হবে। একদল পাল খাটাতে উঠে যাও। সবগুলো পাল খুলে দাও। আর একদল চলে যাও দাঁড় টানতে। জাহাজের গতি বাড়াও। ঐ ক্যারাভেলটা ধরতেই হবে।

একদল দড়ি ধরে উঠলো পালগুলোর কাছে। সব পাল খুলে দিল। জোরে হাওয়া বইছে তখন। পালগুলো সব ফুলে উঠল। আর একদল দাঁড়ঘরে গেল। জলে দাঁড় পড়তে লাগল–ছপছপ। জাহাজের গতি অনেক বেড়ে গেল।কয়েকজন ভাইকিং এদিক ওদিকপাল ঘুরিয়ে পালে যেতে বেশি বাতাস লাগে তার ব্যবস্থা করল।দাঁড়ঘরে দাঁড়িরাও প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগল। ক্যারাভেলের সঙ্গে হ্যারিদের জাহাজের দূরত্ব কমে আসতে লাগল। সমুদ্রের বুকে কোথাও কোথাও কুয়াশা জমেছে। মাঝে মাঝেই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ক্যারাভেলটা। হ্যারি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্যারাভেল জাহাজটার দিকে। চাঁদের আলোয় দেখে বুঝল ক্যারাভেল থেকে ওদের জাহাজটা বেশি গতিতে চলছে।

ফ্রান্সিসদের জাহাজটা যেন জলের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ক্যারাভেলের কাছে চলে এলো হ্যারিদের জাহাজটা। হ্যারি গলা চড়িয়ে জাহাজচালক ফ্লেজারকে বলল–ক্যারাভেল জাহাজের গায়ে গায়ে লাগাও।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হ্যারিদের জাহাজটা ক্যারাভেল জাহাজের গায়ে লাগল। হ্যারি দেখল আল জাহিরির ক্যারাভেলের ডেক-এ পনেরোজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি গলা চড়িয়ে চড়িয়ে বলল–তোমাদের চেয়ে আমরা সংখ্যায় বেশি। একবার লড়াইয়ে নামলে তোমরা কেউ বাঁচবে না। আল জাহিরির জন্যে তোমরা কেন মরতে যাবে। তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। সৈন্যরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু অস্ত্র ত্যাগ করল না।

তখনই ক্যারাভেলের ডেক-এ উঠে এলো আল জাহিরি। সৈন্যদের ধমক দিয়ে বলল–এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন–ওদের আক্রমণ কর।

কিন্তু সৈন্যরা কেউ নড়ল না। হ্যারি বলে উঠল–আল জাহিরি তোমাদের জাহাজে আমাদের রাজকুমারীকে বন্দি করে রেখেছে।

–তোমাদের রাজকুমারীকে আমি বন্দি করে রাখিনি। আল জাহিরি গলা চড়িয়ে বলল।

–তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না। রাজকুমারীকে তোমাদের জাহাজেই বন্দি করে রেখেছে।

–বললাম তো রাজকুমারীকে আমরা বন্দি করে রাখিনি। আল জাহিরি বলল। হ্যারি বলল–আবার বলছি মিথ্যে কথা বলো না। রাজকুমারী তোমাদের জাহাজেই বন্দি আছেন। রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে আসতে দাও। রাজকুমারী মুক্ত হলে আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আমরা আমাদের জাহাজ চালিয়ে চলে যাবো।

রাজকুমারী কেরিনিয়ার কয়েদখানায় রয়েছে। আল জাহিরি বলল।

–মিথ্যে কথা। তোমাকে আর তোমার সৈন্যদের বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছিলাম। সেই সুযোগ কাজে লাগালে না। এবার মরার জন্যে তৈরি হও। হ্যারি বলল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–সবাই অস্ত্র হাতে নাও। এবার লড়াই। ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল–ওহোহো। তারপর সবাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে অস্ত্রঘর থেকে অস্ত্র নিয়ে এলো। প্রথমবারে আট-দশজন লাফিয়ে ক্যারাভেলের ডেক-এ উঠে এলো। শুরু হল আল জাহিরির সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই। আবার একদল ভাইকিং লাফিয়ে ক্যারাভেল এ উঠল। তারাও লড়াই শুরু করল। আবার একদল গিয়ে লাফিয়ে ক্যারাভেল-এ উঠল। আল জাহিরির সৈন্যরা হার স্বীকার করতে লাগল।

হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব, কাউকে হত্যা করো না। আহত করো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আল জাহিরির সৈন্যরা আহত হয়ে ডেক-এর ওপর শুয়ে পড়ল। গোঙাতে লাগল।

তখনই আল জাহিরি নীচের কেবিনঘর থেকে মারিয়াকে নিয়ে ডেক-এর ওপর উঠে এলো। হাতের তলোয়ারটা মারিয়ার পিঠে ঠেকিয়ে বলল–তোমরা এক্ষুণি আমার জাহাজ ছেড়ে চলে যাও। যদি না যাও রাজকুমারীর পিঠে আমি তলোয়ার ঢুকিয়ে দেব।

হ্যারি বুঝল–এই নরপশুটা এখন রাজকুমারীকে যেকোনো মুহূর্তে মেরে ফেলতে পারে। হ্যারি চেঁচিয়ে বলল–ভাইসব–সবাই আমাদের জাহাজে চলে এসো। আর লড়াই নয়।

ভাইকিংরা রাজকুমারীর বিপদ ভালো করেই বুঝল। সবাই লাফিয়ে নিজেদের জাহাজে ফিরে এলো।

হ্যারি ইশারায় শাঙ্কোকে কাছে ডাকল। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল–আল জাহিরি– তিরের নিশানা।শাঙ্কো কোনো কথা না বলে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। তারপর দ্রুত পায়ে অস্ত্রঘরে এলো। তীর ধনুক নিল। নিজের কেবিনে এসে বিছানায় পাতা মোটা কাপড়টাকে গায়ে জড়াল। তির ধনুক ঢাকা পড়ে গেল। শাঙ্কো সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডেক-এ এলো। তারপর আস্তে আস্তে মাস্তুলের পেছনে চলে এলো। তারপর গা থেকে কাপড় খুলে ফেলল। ডেক-এ হাঁটু গেড়ে বসে মাস্তুলের আড়াল থেকে ধনুক তুলল। তির পেরিয়ে মাস্তুলের পাশে সরে এলো। আল জাহিরিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আল জাহিরি তখন তলোয়ারের ডগাটা মারিয়ার গলায় চেপে ধরে বলে উঠল–একটু সময় দাও। আমরা এক্ষুণি জাহাজ চালিয়ে চলে যাবো। আল জাহিরি নিশ্চিন্ত হল।

শাঙ্কো তির নিশানা করল। তারপর তির ছুঁড়ল। নিখুঁত নিশানা। তির গিয়ে লাগল আল জাহিরির ডান বাহুতে। ঐ হাতেই আল জাহিরি তলোয়ার ধরেছিল। আল জাহিরি আর্ত চিৎকার করে উঠল। তারপরই হাতের তলোয়ার ফেলে বাহু বাঁ হাতে চেপে ধরল। তারপর টেনে তিরটা খুলল। গল্প করে রক্ত বেরিয়ে এলো। আল জাহিরি ডেক-এ বসে পড়ল।

হ্যারি চিৎকার করে বলল–রাজকুমারী চলে আসুন। মারিয়া দ্রুত ছুটে এলো হ্যারিদের জাহাজের দিকে। বিস্কো আর কয়েকজন ভাইকিং ছুটে গিয়ে মারিয়াকে ধরে ওদের জাহাজে নিয়ে এলো। মারিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ডেক-এর ওপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। একে দুর্বল শরীর তারসঙ্গে মৃত্যুভী—িমারিয়া এসব সহ্য করতে পারল না।

হ্যারি ডাকল–ভেন-রাজকুমারীকে দেখো। বৈদ্য ভেন এগিয়ে এলো। বসে রাজকুমারীর নাড়ি দেখল। চোখ টেনে দেখল। বলল–ভয়ের কিছুই নেই। শুধু ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কেবিনঘরে নিয়ে চলো।

মারিয়াকে কেবিনঘরে ধরাধরি করে আনা হল। ভেনও নিজের কেবিনঘর থেকে ওষুধ নিয়ে এলো।

হ্যারিদের জাহাজ ফিরে চলল কেরিনিয়া বন্দরের দিকে

ওদিকে ফ্রান্সিসকে আর পারিসি গাড়িতে চড়ে এক সন্ধ্যায় নিকোশিয়ায় পৌঁছল। রাজধানী নিকোশিয়া বেশ বড়ো শহর। গরিব লোকজন আছে, তেমনি ঝলমলে পোশাক পরা অভিজাত ধনীর মানুষরাও আছে। নতুন শহর। সাজানোগুছানো সুন্দর শহর। কত লোক। কিন্তু ফ্রান্সিসের সেসব দিকে চোখ নেই। পারিসি বলল, রাজধানী শহর আপনি তো আগে দেখেননি। চলুন ঘুরে ঘুরে দেখবেন। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল, বন্ধুরা, মারিয়া–সবাই ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি হবে। আমার এখন এক চিন্তা কী করে সবাইকে মুক্ত করবো। অন্য কোনোদিকে তাকাবার অবকাশ নেই আমার। এবার পারিসি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝলো। কোনো কথা বলল না।

সেই রাতটা ওরা একটা সরাইখানায় কাটালো। সকালে ফ্রান্সিস বলল, গী দ্য লুসিগনানের বিচারসভা কখন বসে?

একটু বেলায়। পারিসি বলল।

তাহলে সকালের খাবার খেয়ে চলো বিচারসভায় যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

একটু বেলায় রাজার বিচারসভায় দু’জনে পৌঁছল। তখন বিচারের কাজ চলছিল। কাঠের জমকালো সিংহাসনের সবুজ কাপড়ে মোড়া আসনে গী দ্য লুসিগনান বসে ছিল। একটা বিচারের কী রায় দিল লুসিগনান। বাচ্চাকোলে এক মা হাসতে হাসতে চলে গেল। পেছনে পেছনে গেল তার স্বামীই বোধহয়।

সেনাপতি খুবই ধূর্ত। পারিসি তার নজরে পড়ল। সেনাপতি আসন থেকে উঠে লুসিগনানকে কী বলল। তারপর আঙুল তুলে পারিসিকে দেখিয়ে দ্বাররক্ষীদের হুকুম দিল পারিসিকে বন্দি করার জন্য। দ্বাররক্ষীরা ছুটে এসে পারিসিকে ধরতে গেল। ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে ওদের থামতে বলল। দ্বাররক্ষীরা দাঁড়িয়ে পড়ল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।

ফ্রান্সিস পারিসিকে বলল,তুমি লুসিগনানকে বুঝিয়ে বলো যে আমি ভাইকিং, বিদেশি, বিশেষ একটা প্রয়োজনে রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমাকে যা বলার রাজা লুসিগনান যেন স্পেনীয় ভাষায় বলে। আমি গ্রীক ভাষা জানি না। এবার পারিসি ফ্রান্সিসের শেখানো কথাগুলো পর পর বলে গেল। সব শুনে গী দ্য লুসিগনান ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। স্পেনীয় ভাষায় বলল, তুমি এই সাইপ্রাস দ্বীপে এসছো কেন?

সে অনেক কথা। শুধু এইটুকু বলি আল জাহিরি আমাদের জাহাজ দখল করে এখানে বন্দি করে নিয়ে এসেছে। আমাদের সকলকে সে ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করবে বলে এনেছে। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ, কেরিনিয়া বন্দরের কাছে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসে। যারা কেনাবেচা করে সেই ব্যবসায়ীরা আমার অনুমতির জন্য আমাদের প্রাপ্য স্বর্ণমুদ্রা দেয়। তুমি একা কী করে এলে? লুসিগনান বলল।

পালিয়ে এসেছি। আমার একটা আর্জি আপনাকে জানাতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।

কী আর্জি? লুসিগনান বলল।

পারিসির কাছে দেবতুল্য একজন মানুষ নিওফিতসের কথা শুনেছি। নিওফিতস খ্রীস্টান সমাজ পরিচালনার রীতি পদ্ধতি যে গ্রন্থটিতে লিখে রেখেছিলেন, সেই গ্রন্থ পারিসি আপনাদের দিয়েছে।

হ্যাঁ দিয়েছে। কিন্তু সেই গ্রন্থে যীশুর একটি মূর্তি আঁকা আছে। লুসিগনান বলল।

ফ্রান্সিস বলল, আপনাদের বিশ্বাস নিওফিতস ঐ রকম একটি কাঠের মূর্তি নিজের হাতে কাঠ কুঁদে কুঁদে তৈরি করেছিলেন। পারিসি সেটা কোনোদিন দেখেনি।

লুসিগনান বলে উঠল–পারিসি মিথ্যেবাদী।

না, না, পারিসি জানে না কোথায় আছে সেই কাঠের মূর্তি। ফ্রান্সিস বলল, ভেবে দেখুন মান্যবর রাজা–পারিসি নিওফিতসের গ্রন্থটা নিয়েও পালাতে পারতো কিন্তু সে তা করেনি। আপনাকে দিয়েছে। মূর্তি পেলে নিশ্চয়ই দিয়ে দিতো। মূর্তি চুরি করে কী লাভ ওর? তাছাড়া মূর্তি বিক্রি করতে গেলেও ধরা পড়তো।

রাজা গী দ্য লুসিগনান মাথা নেড়ে বলল, নানা–ওকে আমি আবার জেরস পাহাড়ে পাঠাবো।

বেশ। এবার আমার আর্জিটা জানাই মান্যবর রাজা–পারিসির সঙ্গে আমিও জেরস পাহাড়ের চূড়ার কাছে সেই গুহায় মূর্তি খুঁজতে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

লুসিগনান বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলল–তুমি পারবে ঐ কাঠের মূর্তি উদ্ধার করতে?

সেটা আমি গুহা পাহাড় এসব দেখে-টেখে বলতে পারবো। এজন্যে আপনার অনুমতি চাইছি। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ তো তুমিও যাও। লুসিগনান বলল।

মাননীয় রাজা, আমার বিনীত অনুরোধ যদি আমি সেই মূর্তিটা উদ্ধার করতে পারি তাহলে আল জাহিরির হাতে বন্দি আমাদের দেশের রাজকন্যা ও বন্ধুদের মুক্তি দিতে হবে। পারিসিকেও কোনো শাস্তি দেবেন না।

ঠিক আছে–আগে তো মূর্তিটা উদ্ধার করো। রাজা বলল।

সেক্ষেত্রে আমার শর্তটা কিন্তু মানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক আছে–দেরি না করে কাজে লেগে পড়ো। রাজা লুসিগনান বলল।

আমরা আজকেই জেরস পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করবো। ফ্রান্সিস বলল।

 কিন্তু তোমাদের পাহারা দেবার জন্যে চারজন রক্ষী যাবে। যদি তোমরা কাঠের মূর্তি নিয়ে পালিয়ে যাও। রাজা বলল।

মান্যবর রাজা, আমার স্ত্রী ও বন্ধুরা এখনও আল জাহিরির হাতে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে–ওদের ফেলে রেখে আমি পালাতে পারি? ফ্রান্সিস বলল।

হু। রাজা গী দ্য লুসিগনান পাশের আসনে বসা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ করল। তারপর বলল, ঠিক আছে অনুমতি দিলাম। কিন্তু মূর্তি উদ্ধার করে মূর্তি নিয়ে পালালে তোমাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।

সেরকম কিছু ঘটলে যেকোনো শাস্তি মেনে নেব। ফ্রান্সিস বলল।

এবার ফ্রান্সিস বলল, মাননীয় রাজা, সাধু নিওফিতসের গ্রন্থটা একবার দেখতে পারি?

গ্রন্থটি আমার গ্রন্থাগারে সযত্নে রক্ষিত আছে। যদি দেখতে চাও তবে গ্রন্থাগারে যেতে হবে। লুসিগনান বলল।

আপনি অনুমতি দিলে এখুনি যেতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ যাও। কথাটা বলে লুসিগনান একজন দ্বাররক্ষীকে ইঙ্গিতে ডাল। মৃদুস্বরে রক্ষীকে কী নির্দেশ দিল। রক্ষীটী ফ্রান্সিসদের আসতে বলে রাজসভাঘরের বাইরের দিকে চলল। ফ্রান্সিস আর পারিসিও চলল।

রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন একটা পাথরের ঘরের সামনে এসে রক্ষীটা দাঁড়াল। কাঠের বিরাট দরজা বন্ধ। রক্ষীটা পেতলের কড়া কাঠের দরজায় ঠুকে শব্দ করল। দরজার একটা পাল্লা খুলে গেল। এক টাকমাথা বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। পরনে দামি কাপড়ের আলখাল্লা মতো। বোঝা গেল ইনিই রাজার গ্রন্থাগারটির দেখাশুনো করেন। রক্ষীর সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি হেসে ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের ভেতরে আসতে বললেন।

ফ্রান্সিসরা দরজা পেরিয়ে ঢুকল। এই দিনের বেলায়ও ঘরটা বেশ অন্ধকার। কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে। এবার গ্রন্থাগারিক গ্রীক ভাষায় কিছু বললেন। ফ্রান্সিস বুঝল না। তখন উনি পরিষ্কার স্পেনীয় ভাষায় বললেন, আপনি কি শুধু সাধু নিওফিতসের গ্রন্থটিই দেখবেন?

হা–ফ্রান্সিস বলল, গ্রীক ভাষায় লেখা। আমি কিছুই বুঝবো না। শুধু গ্রন্থটির প্রথম পাতায় যীশুখ্রিস্টের যে ছবিটা আছে সেটা দেখবো।

শুধুছবিটা দেখবেন? এই কথা বলে গ্রন্থাগারিক একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে চললেন।

হ্যাঁ, রাজা গী দ্য লুসিগনানের বিশ্বাস সাধু নিওফিস ঐ ছবির মতো একটি কাঠের মূর্তিও তৈরি করেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

অসম্ভব নয়–ছবিটা এত জীবন্ত যে অবাক হতে হয়, গ্রন্থাগারিক বললেন। কাঠের পাটাতনে রাখা আশেপাশের বড়ো বড়ো গ্রন্থগুলি পরে কোণার দিকের এক কাঠের পাটাতনের সামনে এসে গ্রন্থাগারিক বললেন, সাধু নিওফিতসের লেখা এই গ্রন্থটি।

ফ্রান্সিস মোটা চামড়া-বাঁধাই হাতে লেখা মোটা গ্রন্থটির মলাট ওল্টালো। দেখল– যীশুর ছবি আঁকা। সত্যিই ছবিটি জীবন্ত মনে হচ্ছে। পাতা উল্টে দেখল গ্রীক ভাষায় লেখা। ফ্রান্সিস কিছুই বুঝল না। গ্রন্থাগারিক জিজ্ঞেস করল, গ্রন্থটি কী বিষয় নিয়ে লেখা?

খ্রীস্টিয় ধর্মমণ্ডলী কীভাবে পরিচালিত হবে তার নির্দেশ। সাধু নিওফিতস বেশ কয়েক বছর ধরে গুহার নির্জনতায় আশ্রয় নিয়ে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন গ্রন্থাগারিক বললেন।

কিন্তু লেখা শেষ করে যেতে পারেননি। পারিসি বলল।

হ্যাঁ, শেষ নেই। হয়তো আরো কিছু তার লেখার ইচ্ছে ছিল গ্রন্থাগারিক বললেন।

ফ্রান্সিস গ্রন্থাগারিককে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি মনে হয় সাধু নিওফিতস ঠিক এই ছবির মতো একটি কাঠের যীশুমূর্তির বানিয়েছিলেন?

তা বলতে পারবো না। তবে রাজা গী দ্য লুসিগনান বিশ্বাস করেন সাধু নিওফিতস। একটা এই ছবির মতো মূর্তি গড়েছিলেন। গ্রান্থাগারিক বললেন।

কোন ঘটনার জন্যে তার এই বিশ্বাস হয়েছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। গ্রন্থাগারিক তখন গ্রন্থের ছবিটা দেখিয়ে বললেন, যীশুর স্নানের জল পবিত্র–এই কথা দিয়েই পুস্তকটি শুরু হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো পুস্তকের আঁকা যীশুকে তো স্নান করানো সম্ভব নয়। তাই সাধু নিওফিতস এমনি একটা মূর্তি গড়েছিলেন, হয়তো সেই মূর্তিটিকেই স্নান করাতেন। সে জলটুকু নিশ্চয়ই পবিত্র জল। তাই আমরা বিশ্বাস করি এমনি একটি মূর্তি নিশ্চয়ই সাধু নিওফিতস তৈরি করেছিলেন এবং সেটা সেই গুহাতে বা তার আশেপাশে কোথাও আছে।

ফ্রান্সিস পারিসিকে দেখিয়ে বলল, এর নাম পারিসি। সাধু নিওফিতসের শেষ সময় পারিসি বেশ কিছুকাল তার সেবা-শুশ্রূষা করেছিল। কিন্তু পারিসিক্যে তিনি কোনোদিন কোনো মূর্তির কথা বলেননি।

গ্রন্থাগারিক বললেন, এই পরিসির কথা আমরা জানি। পারিসিই এই গ্রন্থটি উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল।

ফ্রান্সিস বলল, তাই আমরা মূর্তিটা খুঁজে বের করতে জেরস পাহাড়ে যাচ্ছি।

খুব ভালো কথা। সাধু নিওফিতসের নিজের হাতে তৈরি মূর্তি তো আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। যীশুর কাছে প্রার্থনা করি আপনারা সফল হোন।

ফ্রান্সিস আর পারিসি গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে এলো।

.

এবার কাজে নামা। বাইরে এসো চাষী গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে এসেছিল সেই গাড়ি চড়ে বাজারে এসে এক সরাইখানায় খেয়ে নিল। এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনল। পশমী পোশাক বেশি কিনল। পারিসি বারবারই ঐ গুহার এলাকায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কথা বলছিল। খাবার-দাবারও কিনল সব গুছিয়ে দু’জনে দুই বোঁচকামতো বাঁধল। গাড়িতে রাখল। গাড়োয়ান চাষীটিকে ফ্রান্সিস পুরো একটা স্বর্ণমুদ্রা দিল। বলল, জেরস পাহাড়ের নিচে আমাদের পৌঁছে দাও। চাষী স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে খুব খুশি। ফ্রান্সিস আর পারিসি গাড়িতে উঠল। গাড়োয়ান চাষী গাড়ি চালাল জেরস পাহাড়ে উদ্দেশে।

জেরস পাহাড়ের নিচে যখন পৌঁছল তখন বিকেল। ফ্রান্সিস আর পারিসি মালপত্র নামিয়ে নিলে। গাড়ি ছেড়ে দিল।

দু’জনে বোঁচকা কাঁধে পাহাড়ে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য অস্ত গেল। ওরা একটা পাহাড়ি মানুষদের বস্তিতে পৌঁছল। বস্তির মানুষের ওদের দেখে খুশিই হলো। পারিসিকে এর আগে অনেকেই দেখেছো। জানে যে নিওফিতসের জীবনের শেষ সময় পরিসি সেই মহাপুরুষকে সেবা-শুশ্রূষা করেছে।

সেই রাতটা ওরা বস্তিতেই কাটালো।

পরদিন সকালে আবার বোঁচকা কাঁধে পাহাড়ে উঠতে লাগল। দুপুরে একটা চেস্টনাস্ট গাছের নিচে বসে দু’জনে বোঁচকা থেকে শুকনো খাবার বের করে খেয়ে নিল। তারপর আবার উঠতে লাগল।

গত দু’দিন একটু রাস্তামতে পেয়েছে। বিকেল নাগাদ দেখল রাস্তা বলে আর কিছু নেই। পাথরের চাঙ-এর ওপর পা রেখে রেখে ওঠা। শুরু হলো কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। দু’জনেই মাথাটাকা পশমের পোশাক পরে নিল।

সন্ধ্যে নাগাদ একটা ছোট্ট পাহাড়ি মানুষদের বস্তি পেল।

সেই বস্তিতেই খেয়েদেয়ে রাত কাটাল।

পরদিন সকাল থেকেই যাত্রা শুরু করল। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার বেগ বাড়লো। গা মাথা ভালো করে গরম কাপড়ে জড়িয়ে ওরা উঠতে লাগল।

দুপুর নাগাদ একটা গুহার সামনে এলো। পারিসি বলল, মহাপুরুষ নিওফিতস এই গুহাটায় প্রথমে ছিলেন। পরে আরো উঁচুতে এক গুহায় চলে যান।

ওরা গুহাটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস গুহাটা দেখতে দেখতে বলল, আজকে বিশ্রাম নেব এখানে। রাতটা কাটিয়ে কাল আবার ওঠা শুরু করবো।

দু’জনে গুহাটার এবড়েঅখেবড়ো মেঝের কাপড় পেতে বসল। খাওয়া দাওয়া সারল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। অনেক চিন্তা মাথায়। যীশুর মূর্তি আদৌ নিওফিতস তৈরিকরেছিলেন কি না। করলে মূর্তিটা কোথায় রেখেছিলেন? আরো চিন্তা হাতে সময় খুব কম। আল জাহিরি ক্রীতদাস ব্যবসায়ী। ও তাড়াতাড়ি মারিয়াকে, বন্ধুদের বিক্রি করে দিতে চাইবে। তার আগেই মূর্তি উদ্ধার করতে হবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *