2 of 2

যা হয়, তা হয়

যা হয়, তা হয়

মুখে পানের খিলি ঠুসে, সেজে গুঁজে চল্লে কোথায় দিদিমণি?

আহা? কথার ছিরি দেখো। বউ আবার কবে থেকে দিদিমণি হল! বয়েস না হতেই ভীমরতি?

তোমার ওই হুমদো মুখটা দেখলেই, কেন জানি না, ভোরের স্কুলের দিদিমণির কথা মনে পড়ে যায়। কী করব বলো!

একটা ছুঁচলোমুখোকে বিয়ে করলেই পারতে। ওইরকম এক জনের সঙ্গে অনেকটা এগিয়েও তো ছিলে। লেঙ্গি খেয়ে ফিরে এসেছ। এখন আর পস্তালে কী হবে খোকা!

তোমার মুখেরও একটা ভাস্কর্য ছিল, ওই ফ্রিজ আসার পর থেকে পুডিং খেয়ে খেয়ে তোমার মুখটাও পুডিং-এর মতো হয়ে গেছে।

আর নিজের মুখটা! বাড়িতে বড় আয়নার তো অভাব নেই। একবার তাকিয়ে দেখতে পারো তো! বুলডগ কেটে বসানো। হাসলে মনে হয় হায়না হাসছে।

আমাকে তোক চরিয়ে খেতে হয়। ভয়াল ভয়ংকর মুখ আমার প্রফেশানের অ্যাসেট। কিন্তু। তোমার মুখ দেখলে কবিতার লাইন শুকিয়ে যায়।

সারা জীবনে ওই এক লাইন কবিতাই তো মুখস্থ দেখলুম, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। ও আর শুকোবে কী? শুকিয়েই তো আছে। এদিকে যে ক-গাছা চুল ছিল তাও তোমাদের এখানকার জলের গুণে টাক পড়ে গেল। কবে থেকে বলছি, চুল গজাবার নানারকম মলম না তেল না কী সব ভালো ভালো জিনিস বাজারে বেরিয়েছে, নিয়ে এসো, তা একান দিয়ে ঢুকছে ওকান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার কথা তো কানে যাবে না। ওই পাশের বাড়ির প্রেমা বললে, ধিতিং ধিতিং করে ছুটতে। একেই বলে স্ত্রী আর পরস্ত্রী। বাঙালির সেই আদি ব্যামো আর গেল না।

কথাটা যখন তুললে তখন অঙ্কে তুমি কতটা মাথামোটা বুঝিয়ে দিই। প্রত্যেকেরই স্ত্রী অন্যের পরস্ত্রী। যেমন তুমি আমার স্ত্রী; কিন্তু প্রেমার স্বামীর কাছে তুমি পরস্ত্রী। স্ত্রী না থাকলে পরস্ত্রী আসে কোথা থেকে? সহজ-সরল হিসেব।

তুমি মাথার তেল আনবে? তোমার জ্ঞানের কথা আমি অনেক শুনেছি। শুনে শুনে কান পচে গেছে। আমার এখন চুল চাই। চুল।

তুমি জীবনে শুনেছ টাকে কখনও চুল গজায়! টাকে যে চুল গজিয়ে দিতে পারবে সে নোবেল পুবস্কার পাবে। টাকে চুল গজায় না বুড়ি। ও সব কথার কথা।

তোমার ওই প্রেমাঠাকুরানির সামনেটা ফাঁকা হয়ে আসছিল, দেড়শো টাকা দিয়ে অমিয়বাবু একটা ফর্মুলা করিয়ে এনে দিয়েছেন, তাতে ওই ভাইটালাইজার আছে, ভিটামিন-ই আছে, আরও সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক মশলা আছে। সাত দিন লাগাতে না লাগাতেই বিন বিন করে চুল বেরোতে শুরু করেছে।

তোমার মাথা। মনে নেই যৌবনে একবার ফরসা হতে গিয়ে তুমি আমার হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে ছেড়েছিলে। ভিটেমাটি চাঁটি হওয়ার উপক্রম। শেষে আফগান ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ। মুখে এমন এক ফর্মুলা ঘষলে, মুখটা ব্যাঙের পিঠের মতো হয়ে গেল। ফোসকা ফোসকা গোটা গোটা। সেই চর্মরোগ সারাতে চোখে সরষে ফুল। তুমি আর এই বয়সে টাকে চুল গজাতে যেয়ো না মাধু। কী আর হবে? তোমার কি আর প্রেমে পড়ার বয়েস আছে? কেউ আর ফিরে তাকাবেও না শঙ্করী। নাম করো। বালিকে নাম করো। হরের্নামৈব কেবলম। হিসেব মেলাতে বসে যাও ভবসুন্দরী। শমন আসার সময় হয়েছে।

ভোলানাথ, পাড়ার সকলের ভোলাদা। পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। স্ত্রী মাধুরী বয়সে বছর দশেকের ছোট। এক সময় ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। চল্লিশে পা রেখে ক্রমশই মোটা হতে শুরু করেছেন। ছেলেপুলে নেই। দুজনের ছোট্ট সংসার। মাঝারি মাপের নতুন ঝকঝকে একটি বাড়ি। সুখের সংসার বলা চলে। দুঃখ একটাই। ছেলেপুলে হল না।

তা না হোক। ভোলানাথের তেমন দুঃখ নেই। আজকালকার ছেলে-মেয়ে আনন্দের চেয়ে। নিরানন্দেরই কারণ। বাপ-মায়ের তোয়াক্কা করে না। বদমেজাজি। অসভ্য। অবাধ্য। পাড়ার দাদার কথা মানবে বেদবাক্যের মতো। বাপ-মায়ের কথা উড়িয়ে দেবে ফুঃ করে। বলবে, তোমরা কী বোঝো। চুপ করে বসে টিভি দ্যাখো।

ভোলানাথ মাঝারি গোছের অ্যাডভোকেট। এলেম যথেষ্ট ছিল। আর একটু খাটলে এক নম্বর অ্যাডভোকেট হওয়া অসম্ভব ছিল না। তেমন লোভ নেই। চলে গেলেই হল। আর ঈশ্বরের কৃপায় ভালোই চলছে।

ভোলানাথের গুরু স্বামী কৃপানন্দ শিষ্যকে বলেছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যত কিছু সবই জানবে পাপ। তোমার লোভ বাড়াবে। জীবনটা নষ্ট করে দেবে। ঈশ্বর মানে আনন্দ। পরমানন্দ। ধন নয়, জন নয়। যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি নয়। চাইবি আনন্দ, আনন্দ। কেবলানন্দ।

আনন্দ কাকে বলে, সে বিষয়ে ভোলানাথের ইদানীং অনেক সংশয় দেখা দিয়েছে। যুবকরা প্রেম করে আনন্দ পায়। সিনেমায় বিবসনা সুন্দরীর নৃত্য দেখে আনন্দ পায়। মাধুরী টাকে চুল গজাবে ভেবে আনন্দ পায়। ভোলানাথের কীসে আনন্দ তিনি নিজেই জানেন না। জটিল কোনও মামলা পেলে তাঁর আনন্দ হয়। কিন্তু তেমন জটিল মামলা আজকাল আর আসে না। তিনি ক্রিমিন্যাল সাইডে আছেন। ক্রাইমও বেড়েছে। মামলা নেই। মানুষ খুন আজকাল আর ধর্তব্যেই আসে না। কেস ওঠে। সাক্ষীর অভাবে ফেঁসে যায়।

পুরোনো আমলের একটা গাড়ি ভোলানাথের বাহন। গাড়ি চালান ব্রজবাবু। গাড়ির মতোই প্রাচীন। তবে হাত ভালো। রাতে তেমন চোখ চলে না। সন্ধের মুখে গাড়ি গ্যারেজ হয়ে যায়। সেই কারণে ভোলানাথ নৈশ আনন্দ উপভোগ করতে পারেন না। বাড়িতে বসে আইন ওলটাতে হয়। তাতে জ্ঞান যেমন বাড়ছে আনন্দ সেই অনুপাতে কমছে। বউ পুরোনো হলে বিশ্বস্ত হয় ঠিকই, কিন্তু আনন্দের নয়। রসের কথা কওয়া যায় না। বলে, যত বয়েস বাড়ছে তত ভীমরতি হচ্ছে। ঠাকুর-দেবতার বই আছে। বাজে সময় নষ্ট না করে পড়োনা। পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করো। একেবারে খালি হাতে গিয়ে দাঁড়াবে! ভালো লাগে না, তা-ও ভোলানাথকে গীতার কর্মযোগ ওলটাতে হয়। সে যে কী ভীষণ শাস্তি!

গুরু কৃপানন্দকে একবার প্রশ্ন করেছিল, বাবা মনকে কী করে বশে আনা যায়?

গুরু বলেছিলেন, ব্যায়াম করে।

তার মানে ডন, বৈঠক, কুস্তি?

দেহটাকে খালি খাঁটিয়ে যা ক্রীতদাসের মতো। আরাম হারাম হ্যায়।

আর কোনও উপায় নেই প্রভু?

আর একটা উপায় আছে বাপ। সেটি হল মনটাকে শক্ত করা।

কীভাবে?

যেমন ধর, কাউকে নিমন্ত্রণ করে সামনে বসে, তুই যা ভালোবাসিস খাওয়াবি গান্ডেপিন্ডে। নিজে কিছু স্পর্শ করবি না। সুন্দরী রমণীর সঙ্গ করবি, দেহ স্পর্শ করবি না। সুযোগ পেলেই যাকে-তাকে এটা-ওটা দান করবি। তোর মনটাকে উপবাসে রাখবি। তিন বছর এইভাবে চালাতে পারলে মন হয়ে যাবে চেন-বাঁধা-কুকুর। মন তোর প্রভু নয়। তুই মনের প্রভু।

ভোলানাথ মাঝে মাঝে কসরত করে। করলেও মন এখনও তার প্রভু। যা বলে তা না শুনে উপায় থাকে না। যেমন আজ সকাল থেকেই মন বলছে, বিমলার কাছে যা। খুব আনন্দ পাবি।

অনেকক্ষণ ধরেই বলছে। ভোলানাথ শুনেও শুনছেন না। তবু মন বলছে, সন্ধের দিকে ঘণ্টা দুয়েক ভালোই কাটবে। কী ম্যাদামারা হয়ে আছিস! শরীরের যেমন আয়রন, ভিটামিন, মিনারেলস, মনের তেমনি ফুর্তি। আরে বাবা, আজ আছিস, কাল থাকবি না। পুরুষ আর প্রকৃতির খেলাটা দেখ।

বাঙালি মন মাঝে মাঝে আবার ইংরেজি বলে, এনজয় লাইফ।

তা ঠিক। কে বলতে পারে! কালই হয় তো ফটাস করে বেলুন ফেটে যাবে। হার্টের অসুখ। ক্যানসার। দু-পক্ষের রাজনৈতিক বোমাবাজির মাঝখানে আচমকা পড়ে যাওয়া, দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। জীবন-মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে!

আদালতের দিকে গাড়ি এগোচ্ছে। সারাজীবন সেই একঘেয়ে ব্যাপার—মামলা, মক্কেল, এজলাস, জজসায়েব। মি লর্ড, মাই প্লেণ্টিফ। আইনের হাজার কচকচি।

না, আজ সন্ধেবেলা বিমলা। আজ একটু অন্যরকম ব্যাপার হবেই। এমন সুন্দর বসন্ত। ভোলানাথ মনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেললেন।

আদালতের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ব্রজকে বললেন, আজ আর গাড়ি এনোনা। গ্যারেজ করে দাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।

ব্রজবাবু বললেন, সময়টা বলুন না। মা আবার রাগ করবেন আমার ওপর।

রাগ করবে কেন?

আপনার বয়েস হচ্ছে। বাড়ি না-ফেরা পর্যন্ত মা ছটফট করেন। তিনটের পর থেকেই ঘর-বার করতে থাকেন। বলেন, দিনকাল ভালো নয়। যত দেরিই হোক সময়টা আমাকে বলুন। গাড়ি নিয়ে আসব।

সময়টাই তো আমি বলতে পারছি না। একটা কঠিন মামলা আছে। একটা আপিলের ড্রাফট করতে হবে। তুমি মাকে বোলো আমি আনন্দর গাড়িতে ফিরে যাব। চিন্তার কোনও কারণ নেই। বুঝলে।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ভোলানাথ বিশাল বিশ্রী আদালতবাড়িতে ঢুকে গেল। ব্রজ দুমিনিট অপেক্ষা করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তার কিছু করার নেই। মুহুরি অরবিন্দ বললেন, কেসটা একবার পড়বেন না!

ক-টায় উঠবে?

বারোটার আগে নয়।

কার এজলাসে?

জাস্টিস তারাপদ বোসের এজলাসে উঠবে।

তুমি একবার সুপ্রিয়কে পাঠিয়ে দাও।

জুনিয়ার সুপ্রিয় এসে গেল। স্মার্ট ছেলে। চোখে-মুখে কথা বলে। এই লাইনের উপযুক্ত। মেয়ে থাকলে ভোলানাথ জামাই করত। যাক, সে পথ ঈশ্বর মেরে দিয়েছেন।

সুপ্রিয় নন্দদুলাল সরকারের কেসটা নাটশেলে বলো তো।

নন্দদুলাল সরকার পয়সাওলা লোক। বাড়ি-গাড়ির মালিক। ওষুধের হোলসেলার। দুটো রিটেল দোকান আছে শহরের দু-প্রান্তে।

বয়েস?

ফিফটি ফাইভ।

তারপর?

বাইশ বছর বয়েসে নন্দদুলালের বিয়ে হয় বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে।

কোথায়?

উত্তরবঙ্গে।

কী রকম বড়লোক?

কাঠের ব্যবসায়ী। একসময় চা-বাগান ছিল। এখন আর নেই।

 জীবিত না মৃত?

দু-বছর আগে মারা গেছেন।

কীভাবে?

মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান ও শারীরিক অত্যাচারে।

বয়েস?

প্রায় পঁচাত্তর।

রাইপ ওল্ড এজ।

হ্যাঁ স্যার।

ও পক্ষে লড়ছে কে?

বড় ছেলে?

কী করে?

বাপের পয়সা ওড়ায়।

বেশ, নন্দলুলালে ফিরে এসো।

নন্দদুলালের ব্যবসা এখন জমজমাট। শহরের অন্যতম ধনী। গোটাতিনেক গাড়ি, কিন্তু নিঃসন্তান। নন্দদুলালকে সবাই মানী লোক বলেই জানে। প্রভাবপ্রতিপত্তিও যথেষ্ট।

নন্দদুলাল এখন কোথায়? বেল পেয়েছে?

না।

পুলিশ কী কী চার্জ এনেছে?

স্ট্রেট মার্ডার চার্জ।

আজকাল এই এক রেওয়াজ হয়েছে। স্ত্রী আত্মহত্যা করলেও মার্ডার চার্জ আনবে। কারুর স্ত্রী আত্মহত্যা করতে পারে না? আগে করত না!

করত স্যার। তবে দু-ধরনের আত্মহত্যা আছে। এক, মানসিক অবসাদে। আর এক মানসিক অত্যাচারে। নন্দদুলাল আর তার স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। আদর্শ দম্পতি। সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে দুজনকে দেখা যেত। হাসিখুশি। মহিলা খুব মিশুক ছিলেন। সদালাপী। মানসিক অবসাদের কোনও চিহ্ন ছিল না। সুতরাং প্রথম কারণে আত্মহত্যার থিয়োরি দাঁড় করানো মুশকিল।

তুমি তাহলে কী বলতে চাও?

এটা হত্যা স্যার। সেন্ট পারসেন্ট হত্যা।

কীরকম?

কাজটা নন্দদুলাল খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা অনুসারে পথঘাট বেঁধে করেছে।

কীরকম?

নবমীর দিন সবাই যখন পুজোর আনন্দে মেতে আছে, সবাই যখন উৎসবের মেজাজে, সেই সময় নন্দদুলাল জানলাবন্ধ রান্নাঘরে বেশ কিছুক্ষণ গ্যাস খুলে রেখে, সিলিন্ডারের মুখ বন্ধ করে, দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে ফিরে এল।

সময়?

সকাল। প্রায় ছটা।

তারপর?

নন্দদুলাল ফিরে এসে স্ত্রী-র ঘুম ভাঙিয়ে বললে, ওঠো ওঠো, শিগগির চা চাপাও, আমাদের যেতে হবে না!

কোথায় যেতে হবে?

ঠিক ছিল বাই রোড দার্জিলিং যাবে।

অক্টোবরে দার্জিলিং।

সেপ্টেম্বরের শেষে।

হ্যাঁ। এবার ছিল আরলি পুজো। তারপর?

নন্দদুলাল স্ত্রীকে তাড়া দিয়ে চা চাপাতে পাঠাল। মহিলার পরনে ছিল ফিনফিনে নাইলনের নাইটি। ঘরে ঢুকে ঘুম চোখে দেশলাই জ্বালানোমাত্রই পুরো ঘরটা দপ করে জ্বলে উঠল। মহিলা ছুটে বেরোতে গিয়ে দেখলেন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

তারপর?

তারপর অভিনয়। মৃত্যু সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়ে নন্দদুলাল দরজা খুলে চিৎকার চেঁচামেচি করে, নিজেকে সামান্য সামান্য পুড়িয়ে এক হইহই কাণ্ড করে বসল। পাশের পুজোপ্যান্ডেলে তখন ঢাক বাজছে।

তারপর?

তারপর নন্দদুলাল পড়ে রইল হাসপাতালে। বেশ কিছুদিন।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট?

ভেরি সিম্পল। বার্ন ইনজুরি। সেই রাতেই ক্রিমেশান হয়ে গেল।

তা এইসব তথ্য আসছে কোথা থেকে! বানানো গল্প? রহস্য-রোমাঞ্চ?

না, নন্দদুলালের কনফেশান?

কনফেশান? কার কাছে?

হাসপাতালের নার্সের কাছে।

তবে আর কী! ঝুলিয়ে দিলেই হয়।

না। তা হয় না। আমরা তাহলে আছি কী করতে। নন্দদুলাল সুস্থ হয়ে উঠে স্বীকারোক্তি অস্বীকার করেছে। সে অত সহজে মরতে চায় না।

আমাদের তাহলে কী করতে হবে?

হত্যাকে আত্মহত্যা করতে হবে।

করে দেব। ফি পেলেই আমরা হয়কে নয় নয়কে হয় করব।

চারটের সময় ভোলানাথ বেরিয়ে এলেন আদালত থেকে। গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। মনে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। নন্দদুলাল হয়ে যেতে কতক্ষণ? বিমলা, এই ধরনের প্রায় প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটা করে বিমলা থাকবেই।

সিগারেটে দুটো টান মেরে ফেলে দিলেন। এগিয়ে গেলেন পথের দিকে।

একী ব্রজ? তুমি? গাড়ি গ্যারেজ করোনি?

না। মা বলেছেন, যত রাতই হোক আপনাকে ফেরত নিয়ে যেতে হবে। দিনকাল ভালো নয়। আপনার হার্টের অবস্থাও ভালো নয়।

ভোলানাথ গাড়িতে উঠলেন।

স্বামী কৃপানন্দ বলেছেন, সংসার হল সোনার খাঁচা। দানাপানি পাবে। নিভৃত একটা আলয় পাবে। অন্য পাখির ঠোক্করের হাত থেকে বাঁচবে। নীল আকাশের দামালপনা সংসারীর নয়। ওই খাঁচায় বসে নামগান করো। আর প্রার্থনা করো জীবন্মুক্তির। সহধর্মিনীতে সন্তুষ্ট থাকো। নারী নরকস্য। দ্বার।

ভোলানাথ বললেন, ব্রজ, ওই সামন্তর দোকানের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাও।

ভোলানাথ নামলেন। সামন্ত হাতজোড় করে বললে, আসুন, আসুন।

হ্যাঁ হে, চুল গজাবার কী সব লোশান বেরিয়েছে আজকাল?

বেরিয়েছে। বেরিয়েছে।

সামন্ত দুরকমের দুটো ফাইল সামনে রাখল।

আপনার জন্যে নেবেন স্যার?

আমার? টাকই তো আমার বিউটি। গৃহিণীর জন্যে।

এর সঙ্গে দু-অ্যাম্পুল ভিটামিন-ই মিশিয়ে নিলে খুব কাজ হয় শুনেছি। প্ল্যাসেনট্রেক্স-ও মেশাতে পারেন।

গাড়িতে উঠলেন ভোলানাথ। বেশ সরেস লাগছে। খাঁচার পাখি খাঁচাতেই সুখে থাকে। বিশ বছরের জীবন আগামী দশ-বিশ বছরের ভবিষ্যৎ তৈরি করেই রেখেছে।

ব্রজ টাকে চুল গজায়?

কী জানি স্যার!

আমার গজাবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

ধুর, টাকে কখনও চুল গজায়? যা হয়ে যায়, তা হয়ে যায় এই হল দুনিয়ার নিয়ম।

ভোলানাথ হো হো করে হাসতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *