মৃগয়া – পার্ট ৪

দক্ষিণের বারান্দায় সেই আগের চেয়ারে বাবা সোজা হয়ে বসলেন। চাঁদের আলোয় জেলখানার থালার মতো খানকতক রুটি, বঁটির কালো কষ লাগা এক চিলতে আম। পাশেই আর একটা থালায় আরও কয়েক চাকলা আম, বাবা এইমাত্র রাখলেন। প্রভাত, বাবার গলাটা ভারী শোনাল। তোমার কি মনে হয় আমি ভুল পথে চলছি, আমি স্বার্থপর, শয়তান। প্রভাতকাকা বেঞ্চিতে বসেছিলেন চাঁদের আলোধোয়া নির্জন রাস্তার দিকে তাকিয়ে। মুখ না—ফিরিয়েই বললেন—এরা ঠিক ধরতে পারছে না, বুঝতে পারছে না অবস্থাটা। তা ছাড়া মেয়েরা একটু হিংসুটে হয়। রাইট ইউ আর। হিংসের খেলা চলেছে। কিন্তু প্রভাত। কথাটা শেষ না—করে বাবা চাঁদের আলো—মাখা রুটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু প্রভাত আজ তো চোখের সামনেই একটা অন্যায় হয়ে গেল। এটাকে তুমি নিশ্চয় গুড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলবে না? এর জন্য নিশ্চয় আমি দায়ী নই? —না, আপনি কেন দায়ী হবেন? তাহলে দায়ী কে? শশী, শশী চোর? ঠিক চোর নয় ছোড়দা। সব মা—ই চায় তার ছেলেমেয়েদের দিকে একটু বেশি টানতে, এটা সেই কেস। এর জন্যে অপরাধী মাতৃস্নেহ। তুমি শশীর অতীত জানো? জানো না। জানা সম্ভবও নয়। পেটুক বলে ওর একটা বদনামও ছিল। বোনেদের মধ্যে ও ছিল সবচেয়ে ছোটো। ভাগ্যটাও খারাপ। তখন ছিল এক পরিস্থিতি, এখন অন্য পরিস্থিতি, এটা ওকে বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে।

বাবা গম্ভীর গলায় ডাকলেন—শশী! প্রভাতকাকা বাধা দিলেন—আপনি না, আপনি না। বোঝাবার ভার আমার। —বেশ তোমার। তুমিই বুঝিয়ো। তবে আমি কি বলছিলুম জানো প্রভাত? —বলুন ছোড়দা। তুমি আর আমাদের সঙ্গে কেন কষ্ট করবে। আমাদের দিন তো এইভাবেই চলবে, আরও খারাপ হবে, আরও খারাপ। তুমি তো এই ফ্যামিলির কেউ নও, তোমার চলে যাবার উপায় আছে, সরে পড়ার উপায় আছে, এই দুঃখের দিনে তুমি শুধু কেন কষ্ট করবে?

প্রভাতকাকা ঘুরে বসলেন। হাতের কনুই দুটো টেবিলের ওপর। দু—হাতের তালুর মধ্যে মুখ—ছোড়দা রক্তের সম্পর্ক হয়তো নেই, কিন্তু পূর্বজন্ম থেকে আপনারাই আমার ছোড়দা, মেজদা, আমি ব্যাচেলার বাউন্ডুলে মানুষ। আজ এখানে, কাল সেখানে। দুঃখের দিনে আপনার পাশে দাঁড়াই। দেখি না কিছু করা যায় কি না। যেই সুখের দিন আসবে বলতেও হবে না সরে পড়ব। তখন দুঃখী পরিবার কোথাও—না—কোথাও থাকবে, ঠিক খুঁজে নেব।

বাবা যেন অভিভূত হলেন—ঠিকই বলেছ প্রভাত। পূর্বজন্মে তুমি আমাদের ভাই ছিলে। কীসব দিনে তুমি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছ। মেজদার অসুখ, বিল্টুর মা—র অসুখ, জ্যাঠাইমা—র অসুখ। কীসব ভোগান্তি। একবছর, দু—বছর, পাঁচ বছর পড়ে আছে সব বিছানায়। তোমার সেই ঘটনাটা মনে আছে প্রভাত? —কোনটা ছোড়দা? —সেই বিল্টুর মা—র ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, বারণ করা সত্ত্বেও তুমি রাত দশটার সময় সাইকেল নিয়ে বেরুলে শ্রীরামপুর থেকে ওষুধ আনার জন্যে। তারপর সেই বালির ব্রিজে।

প্রভাতকাকা উঃ বলে একটা শব্দ করলেন। ভারী বুটের শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে বিটের পুলিশ যাচ্ছিল, মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাল। উঃ, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গাটায় একটা লোক রেলিং—এ ঠেসান দিয়ে পা মুড়ে বসে আছে। অন্ধকারে একটা লোক। ভালো জামাকাপড় পরা। সন্দেহ হল।

—তুমি ভেবেছিলে মাতাল কিংবা সুইসাইড করবে। ঠিক বলেছেন। সাইকেল থেকে নেমে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—ও মশাই, ও মশাই। সাড়াশব্দ নেই। বাবা বললেন—থাক থাক আর বোলো না। এরা ভয় পাবে! প্রভাতকাকা তবু বলে চললেন—তারপর যেই না গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা মেরেছি, ও মশাই। ধড় থেকে মুণ্ডুটা খুলে পড়ে গেল। —ওঃ হরিবল, হরিবল! খুব বেঁচে গেছ। খুব বাঁচা বেঁনেচ্ছে। —শশী। বাবা ডাকলেন—সরা এগুলো। এক গেলাস জল দে তো। কোনোদিন কাউকে হুকুম করি না। দে—আজ একটু লাটসাহেবি করি। খেয়েছিস? খাসনি। আর কখন খাবি?

জলের গেলাসটা শব্দ না—করে বাবা টেবিলে রাখলেন। ঢেউ খেলানো কাচের গেলাস চাঁদের আলো পড়ে স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে। —যাক অতীত বাদ দাও। এখন বর্তমানে ফিরে এসো। এই আয়ের মধ্যে সংসারটাকে কী করে গোছানো যায়। তুমি দেখ, সরে পড়তে চাইলে, আমিও কিন্তু সরে পড়তে পারি। তোমারও যেমন সংসার নেই, আমারও তো তেমনি সব গেছে। ছেলেটাকে নিয়ে ইজিলি পালাতে পারি না? সেটা কিন্তু মানুষের কাজ হবে না। ফাইট। ফাইট উই মাস্ট। টিউশনি নিয়েছি। তারপর দেখ চুল আর বাইরে কাটাব না। তোমাকে দিয়ে কাঁচি চিরুনি আনিয়েছি। জুতো বাইরে মেরামত হবে না। সেলাই, হাফসোল, গোড়ালি সব বাড়িতে। ছেলেদের চুল আমি কাটতে পারব। আমারটা তুমি একটু পারবে না প্রভাত? তাহলে ধোপা—নাপিত একদম বন্ধ। জুতো সারাই, তাও বন্ধ। মাসে অন্তত টাকা চারেক বাঁচবে।

প্রভাত কাকা প্রচণ্ড উৎসাহে বললেন—কেন পারব না। চুলছাঁটা কী এমন শক্ত কাজ। ধাপে ধাপে কেটে কেটে উপরে উঠব। পাহাড়ের জঙ্গল সাফ করার কায়দা। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, কাল থেকে আমি নিজে হোটেল চালাবার কায়দায় সংসার চালাব। এই আয়ের মধ্যে সকলের সমান খাওয়াপরা। বাবা বললেন, একটা জিনিস, একটা জিনিস প্রভাত। সবসময় মনে রাখবে, যারা মাথার কাজ করে, যারা বেড়ে উঠছে, তাদের ওরই মধ্যে একটু ভালো খাবার দিতে হবে আর মনে রাখবে, মেয়েরা একটু কম খেলেও মরবে না। এই কথা মনে রেখে তুমি কাল থেকে চালাও তো দেখি। বেটাছেলের হাতে না—পড়লে এ—সমস্যার সমাধান হবে না। আর হ্যাঁ, তোমার ব্যবসার কী হল? একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কিছু লাগাও প্রভাত। বাণিজ্য ছাড়া লক্ষ্মী লাভ হয় না। কিছু ভেবে পেলে?

প্রভাতকাকা উদাস গলায় বললেন—সাইকেল দোকান এদিকে চলবে না ছোড়দা। অন্য কিছু মাথায় আসছে না। একটা মিষ্টির দোকান করলে কীরকম হয়। ধরুন জনাই থেকে কারিগর আনিয়ে মনোহর তৈরি করলুম, কৃষ্ণনগর থেকে কারিগর আনিয়ে সরভাজা—সরপুরিয়া, ওদিকে শক্তিগড়ের ল্যাংচা, পানিহাটির গুপো, রামচাকি শ্রীরামপুরের গুটকে। —ও হবে না, হবে না, বাবা ভীষণ প্রতিবাদ করলেন—ও তোমার লাইন নয়। তোমাকে কম পয়সায় কিছু ভাবতে হবে। তুমি আমার লেখার কালিটা বাজারে চালাও না। এ ক্লাস কালি। বিলিতি স্টিফেন্স সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। ও—রকম ব্লু—ব্ল্যাক তুমি বাজারে পাবে না। প্রভাতকাকা খুঁতখুঁত করে বললেন—কালি চলবে না ছোড়দা। যা বাজার, মানুষকে সস্তায় খাবার দিতে হবে। ওই লাইনে কিছু বলুন।

—না, না তাহলে এক কাজ করো, খাবারের কথাই যখন তুললে তখন আর একটা আইডিয়া মাথায় এসে গেল—দাঁত। দাঁত হল সবার আগে। দেখছ তো সারাজীবন তুমি আর আমি দাঁত নিয়ে নাকাল। বাঙালির দাঁতের অবস্থা বড়ো খারাপ। সস্তায় একাট মাজন বাজারে ছাড়লে কেমন হয়। আমার কাছে সাংঘাতিক একটা ফর্মুলা আছে।

মন্দ বলেননি। মাজনটা ভেবে দেখা যেতে পারে। ঠিক আছে আমি একবার কোষ্ঠীটা কাল বিচার করে দেখি। বাবা চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, এই সময় প্রচুর খুদিখুদি কাঁকড়া হয়। ইলিশেরও সময়। এর মধ্যে আবার গ্রহ নক্ষত্র ঢোকাবে। তাহলেই সব বিশবাঁও জলে। প্রভাতকাকা বসে বসেই বললেন—না ছোড়দা—ভগাং ফলতি সর্বত্রং। এর আগে আমার ষোলোটা ব্যবসা লাটে উঠেছে। এবার পথঘাট সব বেঁধে নামতে হবে।

.

কাচ ভাঙার শব্দে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। মনে হল মুনশিদের নাচঘরে ঝাড়লন্ঠনটা ভেঙে পড়ে গেল। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলুম। আকাশের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, ভোরের প্রথম কাকটা কর্কশ গলায় ডাকাডাকি করে অন্য পাখিদের জাগাতে চাইছে। বস্তিবাড়ির একটা মুরগি উদাত্ত স্বরে ডাকতে শুরু করেছে। মাথার দিকের দরজাটা পুরো খোলা। রাতে হাওয়া বেশি থাকলে দরজাটা নানা কায়দায় বন্ধ করে বাবা হাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। কখনো আধখোলা, কখনো সিকিখোলা। এর জন্য একটা কাঠের টুকরো আছে—সারাপরিবারে সেই কাষ্ঠখণ্ডটি নৌকার কাঠ নামে খ্যাতি অর্জন করেছে। বয়স যখন আরও কম ছিল, বাবা আমাকে একটা নৌকো করে দেবার জন্যে ওই কাঠের টুকরোটায় খোদাইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। ইঞ্চিখানেক কাজ এগিয়ে, সংসারের চাপে, পড়ানোর চাপে নৌকো আর জলে ভাসার অবস্থায় এল না। এখন হাওয়া নিয়ন্ত্রণের একমাত্র হাতিয়ার।

মেঝের বিছানা। পাশেই বাবা। শুয়ে নয়। বসে আছেন ধ্যানস্থ। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম—কী যেন সব ভেঙে পড়ল। কাচ ভাঙার মতো শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। মুখ দেখে মনে হল—সারারাত একটুও ঘুমোননি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—সব গেল। হায় প্রভু। —কী গেল বাবা? বাবা বললেন—তুই ঘুমো। ও নিয়ে মাথা ঘামাসনি। মনে কর সরাইখানায় মাতাল ঢুকেছে। কথা শেষ হতে—না—হতেই আবার। শব্দটা আসছে জ্যাঠাইমার ঘর থেকে। বাবা বললেন—আলমারিটা গেল ওঃ—ওর মধ্যে দামি দামি বহু কেমিক্যালস আছে রে। আমার কালি তৈরির মালমশলা। সেন্ট তৈরির আতর। সিরাপ তৈরির এসেন্স। সব গেল! সারারাত ধরে চলছে। তুই ঘুমো।

—একবার যাব বাবা? —কোথায় যাবি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! আমার আর একটা ভয় হচ্ছে, কী জানিস? বাবু মার্ডারড! ছেলেটাকে মনে হয় খুন করে ফেলেছে। তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওই একটা মাত্র পথের কাঁটা ছিল। শেষ করে দিতে পারলেই ঝাড়া হাত—পা। গোড়া থেকেই তো মেনটালি আনব্যালেন্সড।

—প্রভাতকাকাকে ডাকব? —প্রভাতকাকা, প্রভাতকাকা কোরো না। এটা আমাদের ব্যাপার! সকাল হোক থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করতে হবে। জীবনে সবচেয়ে যেটাকে ঘৃণা করি, সেই থানা পুলিশই করতে হল।

বাবুর কথা, জ্যাঠামশাইয়ের কথা, সংসারের কথা চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম আবার! কে যেন ভীষণ চিৎকার করছে! ঘুম ভেঙে গেল। কানে এল—আরে তোমরা কীহে এখন পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ! অ্যাঁ। আরে ও শঙ্কর, শঙ্কর। বাবাও মনে হয় সারারাতের পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ধড়মড় করে উঠে বললেন—আরে এসো ন—মামা।

মশারির বাইরে মাথার কাছে ন—দাদু এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ন—হাতি ধুতি, হাঁটুর নীচে এসে শেষ হয়েছে। সামনে কোঁচা ঝুলছে। বেশ বড়ো বড়ো পা। জীবনে তেল না পড়ে পড়ে রুক্ষ। কাপড়টা তেমন ফর্সা নয়। সাদা মোটা একটা জামা গায়ে। বুকের বোতাম খোলা। মুখে একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। বাবার চেহারার সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। দুজনের গলার স্বরেও যথেষ্ট মিল। ন—দাদু একটু বেশি নস্যি নেন বলে স্বর একটু নাকি।

—এখন ঘুমোচ্ছ কেন? এটা কি ঘুমোবার সময়। ওঠো ওঠো! বিল্টু তুমিও কি লেট—রাইজার!

প্রায় একইসঙ্গে মশারির ডানদিক তুলে বাবা, বাঁদিক তুলে আমি বেরিয়ে এলুম। বাবা তাকালেন ঠাকুরদার ছবির দিকে। আমি ভয়ে ভয়ে তাকালুম অন্ধকার ঘরের দিকে। অন্ধকার ঘরটা আরও অন্ধকার। জ্যাঠাইমার ঘরের দরজা বন্ধ। কী হয়ে আছে ওই বন্ধ ঘরে কে জানে? সারাবাড়ি থমথমে। উত্তরের বারান্দায় রেলিংয়ে বসে একটা কাক খাঁ খাঁ করে ডাকছে। ডাকটা এতই অমঙ্গলের যে গা ছমছম করে উঠে।

ন—দাদুর বগলে একটা মোটা বই! আত্মভোলা বোটানিস্টের মতো দেখাচ্ছে। পাশপকেট থেকে লাল খেরো বাঁধানো আর একটা বই বেরুল। সেই বইটা আমার হাতে দিয়ে বললেন—এই নাও তোমার অমরকোষ। অমরকোষ না—পড়লে বাংলা শেখা যায়? আচ্ছা বলো তো কৃতঘ্ন শব্দটা কোথা থেকে এসেছে? কীভাবে হয়েছে?

তখনও ভালো করে ঘুম ছাড়েনি। বাবা মশারির দড়ি খুলছেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার হাতে অমরকোষ, মাথায় জ্যাঠাইমার বন্ধ ঘরের দুশ্চিন্তা, সামনে ন—দাদুর সাংঘাতিক প্রশ্ন। উত্তর একটা দিতেই হল। বললুম, নিমকহারাম। ন—দাদুর গোঁফদাড়িওলা মুখে শিশুর মতো হাসি—হে—হে—হে, ওটা তো হল মানে, আমি জিজ্ঞেস করেছি উৎপত্তি। শঙ্কর কৃতঘ্নর উৎপত্তি বলতে পার?

মশারি পাট করে বিছানা রোল করলে করতে বাবা বললেন—যদ্দূর মনে হয় কৃতপূর্বক হন ধাতুর অ। ন—দাদু খুব খুশি—ঠিক বলেছ। তুমি জানো, তোমার ছেলে কিন্তু জানে না। তুমি বললে নিমকহারাম। নিমকহারাম শব্দটা কোথা থেকে এসেছে বিল্টু? ফারসি, নিমক মানে নুন, আরবি হারাম মানে শূকর দুয়ে মিলে নিমকহারাম। তুমি সাতটা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ আর নিমকহারাম বলতে পারছ না! শঙ্কর ভোরবেলা একে ঠেলে তুলে দেবে, এই ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে মুখস্থ করবে। শব্দরূপ, ধাতুরূপ, কৃৎ প্রত্যয়, তদ্ধিত প্রত্যয়।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন—তোমার বগলে ওই মোটা বইটা কী ন—মামা? —তুমি ভুলে গেলে শঙ্কর, এটা বোটানি। কথা ছিল না, তোমার বাগানের ফার্ন চিনবে। চলো, চলো, বাগানে চলো। দেখি তোমার অন্য গাছপালা কেমন হল। মুখ পরে ধোবে। বাগানে নামার এই তো সময়!

বাবা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছেন। বাগানে নেমে ভাঙা পাঁচিলের গায়ে, স্যাঁতসেঁতে জায়গায় গজিয়ে ওঠা ঝিরিঝিরি পাতা ফার্ন চেনার মতো অবস্থা তাঁর নেই। ওদিকের বন্ধ ঘরে ভয়াবহ কিছু ঘটে আছে। দেখা দরকার। সত্যি থানা পুলিশ করতে হবে কি না কে জানে! ন—দাদুকে বলতেও পারছেন না। আত্মভোলা জ্ঞানপাগল মানুষ। সংসার—টংসারের ধার ধারেন না। বাবা বললেন, তুমি একটু বাইরের চেয়ারে বোসো। চা—টা খেয়ে নামা যাবে! এসব রবিবারে হলে ভালো হয় না?

ন—দাদু হইহই করে উঠলেন—তোমার ওই দোষ শঙ্কর। চা। একদিন চা না—খেলে কী হয়? অফিস! সারাজীবনই তো অফিস আছে। একদিন অফিস না গেলে কী হয়! তোমার জন্যে অফিস অচল হয়ে যাবে না।

বাবার হাতে টুথব্রাশ, টুথপেস্ট। ন—দাদুর চাপে পড়ে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন মনে হচ্ছে। —আচ্ছা, পাঁচ মিনিট সময় দাও। মুখটা অন্তত ধুয়ে নিই। ন—দাদু আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে ঘাড় নাড়লেন যেন তোমাকে আর তোমার বাবাকে দিয়ে কিসু হবে না। তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, ওয়াকিং ফার্ন কাকে বলে জান? যে—ফার্ন চলে বেড়ায়। তোমাদের বাগান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, ঝুলনতলা দিয়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে, সোজা কায়েনদের বাগানের মধ্যে দিয়ে একেবারে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে গিয়ে হাজির হল। এর জন্ম কোথায় জান! আমেরিকা। তবে তোমাদের বাগানেও থাকতে পারে।

হঠাৎ জ্যাঠাইমার ঘরের দরজা খুলে গেল। অন্ধকার ঘরের লাল মেঝেতে আলো লুটিয়ে পড়ল। প্রথমে মনে হল এক দৌড়ে রান্নাঘরে পালাই। এখুনি রক্তমাখা খুনি বেরিয়ে আসবে। জ্যাঠাইমা বেরিয়ে এলেন। কোঁকড়া চুল এলো। মুখের সামনে ঝুলে আছে কয়েকটা গুচ্ছ। গায়ে জামা নেই। শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে পেছনে। হাতে ছোটোমতো একটা পেতলের ঘট। চোখমুখের দৃষ্টি উদাস। মুখে গানের কলি—রাই জাগো, রাই জাগো বলে ডাকে শুক—শারি। যত কাছে এগিয়ে আসছেন ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ন—দাদুকে দেখে মাথায় ঘোমটা দিলেন না।

ন—দাদু একবার মাত্র তাকিয়ে বললেন—স্টাগ হর্ন ফার্ন কাকে বলে জান? এরা হল গলা টেপা ফার্ন। ধরো তোমার পায়ের কাছে হয়েছে। তুমি সরছ না। তোমাকে জড়াতে জড়াতে ওপর দিকে উঠছে। ব্যস, যেই তোমার গলার কাছে এসেছে—একেবারে টুঁটি টিপে শেষ করে দেবে। ন—দাদু যখন টুঁটি বলছেন, সামনের ঝকঝকে দুটো দাঁত গোঁফদাড়ির ভেতর থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এসেছে যেন জ্যান্ত মুরগির গলায় দাঁত বসাচ্ছেন, আর ঠিক তখনই জ্যাঠাইমা আমার কাছাকাছি এসে, জলভরতি একটা ঘট আমার পায়ের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন—এইটা হল বিছের জালি। শয়তানের শয়তান। দেখ না তোর কী করে দিলুম। খোঁড়া হয়ে যাবি। খোঁড়া ল্যাং—ল্যাং—ল্যাং। ঘটটা জোরে ছুড়েছেন। পায়ের সামনের হাড়ে এসে লেগেছে। বেশ লেগেছে। ফুল, বেলপাতা, গঙ্গার জল পায়ের ওপর থকথক করছে।

ন—দাদু বললেন—কী হল? পড়ে গেল বুঝি! স্ট্যাগ হর্ন তুমি পাবে আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায়। গরমের গাছ। পাতার তলায় সরু সরু রোঁয়া। রসকষ সব শুষে নেবে। স্ট্যাগ হর্নের কীর্তি শুনলে তোমার গায়ে কাঁটা দেবে!

ঘটটা ঠন করে মেঝেতে পড়ে গড়াতে গড়াতে নর্দমার দিকে চলে গেছে। জ্যাঠাইমা খপ করে ন—দাদুর হাত ধরেছেন—ন—ঠাকুর দেখবেন আসুন, আপনার মেজো ভাগনের কী অবস্থা করেছি। ন—দাদু অন্যমনস্কভাবে বললেন—ঘুম থেকে উঠেছে! জ্যাঠাইমা হাত ছাড়েননি, টানতে টানতে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে চলেছেন—হ্যাঁ চিরনিদ্রা ঘুচিয়ে দিয়েছি। মটকা মেরে আর কতকাল পড়ে থাকবে! দেখবেন আসুন না, কী করে দিয়েছি। ঘুচিয়ে দিয়েছি মটকা।

ন—দাদুর জগৎ আলাদা, জ্যাঠাইমার জগৎ আলাদা। ন—দাদুর জগতে, গাছপালা, প্রত্যয়, প্রকরণ, জ্যামিতি, অঙ্ক, হাতের কাজ। জ্যাঠাইমার জগৎটা কী, বাবা বলেন, দেবাঃ ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যাঃ। ন—দাদু জ্যাঠাইমার টানে নেচে নেচে চলেছেন, বগলে বটানি। আর সেই মুহূর্তে বাবা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমে বাবা বুঝতেই পারিনি। গায়ে এক ফোঁটা জল পড়তে টের পেয়েছি। আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—এ কী?

আমি কেঁদে ফেললুম। কাঁদতে কাঁদতে বললুম, আমাকে খোঁড়া করে দিয়েছেন। বাবা অবাক হয়ে বললেন—কে খাঁড়া করে দিয়েছে? —জ্যাঠাইমা। ওই দেখুন ঠাকুরের ঘট পায়ে ছুড়ে মেরে বললেন, আমি খোঁড়া হয়ে যাব। বাবা ঘটটার দিকে তাকিয়ে বললেন—স্কাউন্ড্রেল। কই হাঁটো তো।

সারাঘরটা গোল হয়ে হেঁটে এলুম। ডান পায়ের ওপর যে—জায়গাটায় ঘটটা সজোরে লেগেছিল, সেই জায়গাটায় অল্প একটু ব্যথা ছাড়া খোঁড়া হয়ে যাবার আর কোনো লক্ষণ দেখলুম না। বাবা উদগ্রীব হয়ে আমার হাঁটা দেখছেন। —যেন জুতোর দোকানে নতুন জুতো পায়ে হাঁটছি। —কী বুঝলে? খোঁড়া হয়েছ? —আজ্ঞে না। হবে না। অসভ্যতার কোনো ক্ষমা নেই। আমি এর চূড়ান্ত দেখতে চাই। আমি আজই এর শেষ দেখতে চাই।

বাবা গামছাটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। ভীষণ মুহূর্ত এগিয়ে আসছে। সারারাত ঘুমোননি। চোখ লাল। একদিন অন্তর দাড়ি কামান। আজ দাড়ি কামাবার দিন।

খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর বিন্দু বিন্দু জল। হন হন করে জ্যাঠাইমার ঘরের দিকে এগোলেন। কিছুদূর গিয়ে বড়ো চৌকাঠটা ডিঙোতে গিয়ে কী ভেবে থেমে পড়লেন।

একটু ইতস্তত ভাব। বোধহয় ন—দাদুর উপস্থিতিতে কিছু করতে চান না। ফিরে এলেন। ফিরে এসে যে—ঘটটা মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল সেটাকে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটু টোল খেয়েছে। উবু হয়ে বসে ফুল বেল পাতা সব ভরে ফেললেন ভেতরে। বসে বসেই বললেন, যাও হাত—পা মুখ সব ধুয়ে এসো। তোমার কাজ তুমি করো। হ্যাঁ, যাওয়ার আগে, তুমি সাবধানে একটা কাজ করে যাও—দরজার পাশ থেকে উঁকি মেরে শুধু দেখে এসো ঘরের ভেতরে অবস্থাটা কী! ভয় পাবে না। কী বোল্ড!

দরজার পাশ থেকে ঘরের ভেতরে তাকাবার সময় মনে হচ্ছিল আমি কোনো বকের গুহা দেখতে চলেছি। ঘরের মেঝেতে ফিনকি ফিনকি কাচের টুকরো। জ্যাঠামশাইয়ের ছবিটা চিত হয়ে পড়ে আছে। সারাছবিতে নখের আঁচড়। ছবিটা যে—দেওয়ালে ঝোলানো ছিল, সেই পেরেকে ঝুলছে শ্রীগৌরাঙ্গের ছবি। ন—দাদু সামনে ঝুঁকে পড়ে ছবিটা দেখতে দেখতে বলছেন—কে তুলেছিল বউমা, ক্যামেরা চালাতেই জানে না। আউট অফ ফোকাস। ভালো করে ওয়াশ করতেও পারেনি। জ্যাঠাইমা বলছেন—শ্রীগৌরাঙ্গ আমার প্রাণরে। ন—দাদু বলছেন—তুমি আবার ওদের দলে ঢুকলে কবে। অ্যাঁ! সব বেটা ভণ্ড।

জ্যাঠাইমা আরও সুরেলা গলায় গাইলেন—গৌরউউর আমার প্রাণরে। ন—দাদু বললেন—বেশ করেছ, আউট অফ ফোকাস ছবি ভেঙে ছিঁড়ে ফেলেছ বেশ করেছ, তবে তোমার গৌরাঙ্গের মুখটা বাপু ঠিক আঁকতে পারেনি। মনে হচ্ছে, আমাদের সুবল গালে পান—জর্দা ঠুসে বসে আছে। আর্টিস্টের কোনো প্রোপোরশন জ্ঞান নেই। আজানুলম্বিত হাত ছিল ঠিকই কিন্তু হাত মাথার উপর থেকে নীচে নামলে ওরাং—ওটাংয়ের মতো মাটি ছোঁবে। ছবি আঁকা অত সোজা নাকি! আমি মা দুর্গা এঁকেছি দেখে এসো একদিন। অষ্টভুজা।

জানালার গরাদ ধরে বাবু চুপটি করে দাঁড়িয়ে। কপালের ডানদিকটা ফুলে লাল হয়ে আছে। ক—দিন অসুখে ভুগছে। মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। গায়ে ঢলঢলে একটা গেঞ্জি। ইজেরটা নেমে এসেছে পেটের নীচে। জ্যাঠাইমা গান থামিয়ে হঠাৎ বললেন—ন—ঠাকুর এদের দু—ভাইকে ঠিক আপনার মতো দেখতে। নাকটা উঁচু বটে, সামনের দিকটা টিয়া পাখির মতো বাঁকা। হি হি টিয়াপাখির মতো বাঁকা। কেউ বিশ্বাস করবে এই বাপের ওই ছেলে। শনিবার ঘোর অমাবস্যায় জন্মেছে। প্রভাত ঠাকুরপো বলেছে চোর হবে। ন—দাদু বললেন, তুমি বুঝি জানো না বউমা—নরানাং মাতুলক্রমঃ।

বাবা হঠাৎ সিস সিস করে উঠলেন। চমকে ফিরে তাকালুম। অধৈর্যের হাত নেড়ে বললেন—চলে এসো। কী দেখলে? প্রথমেই যেটা বলা দরকার মনে হল—বাবু বেঁচে আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারের জানালায়। কপালের ডান পাশটা ফুলে আছে লাল হয়ে। —আর ভাঙাভাঙির কী দেখলে! —জ্যাঠামশাইয়ের ছবিটা ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। আলমারিটার কী অবস্থা দেখলে! —ওটা দেখতে পেলুম না। এদিকের দেওয়ালেতে! —বিপদে পড়েছে ন—মামা! বাবুকে মনে হয় বেরুতে দিচ্ছে না? বেঁধে রেখেছে কি না দেখলে? এই সময় ওর একটা ওষুধ পড়ার কথা ছিল। আর এক পুরিয়া পড়লেই পেটটা ধরে যেত! কিন্তু কে এখন ওকে রেসকিউ করবে।

—টিইইই, প্রভাতকাকা ঘরে ঢুকলেন। আদুর গা। পইতে ঝুলছে। প্রভাত কাকার বুকে চুল নেই। মসৃণ গা। মালকোঁচা মারা কাপড়। একটা ফুল হাতা শার্ট, হাত দুটো সামনে কোমরের ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পেছনে বাঁধা। জামার পিঠের দিকটা সামনে অ্যাপ্রনের মতো ঝুলছে। হাতে একটা কাঁসার থালায় দু—কাপ চা।

—বিল্টু ব্রেকফাস্ট রেডি! বাবু ব্রেকফাস্ট রেডি! চা টেবিলে ছোড়দা?

—তাই দাও। তুমি ও—ঘরের অবস্থা কিছু জানো প্রভাত?

টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে প্রভাতকাকা বললেন—জানি ছোড়দা, টিয়াপাখির মতো বাঁকা। —কী করে জানলে? দরজা তো বন্ধ ছিল?

—কেন, আমি ওই কার্নিশের দরজা খুলে, কার্নিশের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জানালার বাইরে থেকে দেখে এসেছি। —সেকী ভাঙা কার্নিশ! পড়ে মরোনি, কী ভাগ্য! আমি তো মরব না ছোড়দা! আপনার মনে আছে সুইসাইড করব বলে একতাল আফিং খেয়ে ট্রেনে উঠেছিলুম। হরিদ্বারে সুইপাররা ধরাধরি করে বাঙ্ক থেকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিল। এক সন্ন্যাসী এসে জল ছিটিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন। তিনমাস পরে সাধুর ডেরা থেকে ফিরে এলুম, হিপনোটিজম শিখে। নিন চা খান। চায়ে গরম।

প্রভাতকাকা চা হেঁকে চলে যাচ্ছিলেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন—আমার আলমারিটা প্রভাত ঠিক আছে?

—একটা কাচ গেছে ছোড়দা। —যাবার আগে তুমি দুটো অসহায় প্রাণীকে উদ্ধার করার সাহস রাখো!

থালাটাকে বুকের কাছে ঢালের মতো ধরে প্রভাতকাকা বাবার মুখের দিকে তাকালেন। বুঝতে পারেননি, বাবার কথা।

—ও—ঘরে ন—মামা আর বাবু আটকা পড়েছে। কোনোরকমে রেসকিউ করে আনতে পার? —খুব পারি। —তবে দেখ ন—মামা বাইরের লোক, তার সামনে সংসারের কেচ্ছা যত কম প্রকাশ হয়ে পড়ে ততই ভালো। একটু কায়দা করে করতে হবে।

প্রভাতকাকা থালাটা একপাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। শরীরের সামনের ঝালরটা খুলে ফেললেন। ভাঙা আলমারি থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া গীতাটা বের করলেন। ঘরের মেঝেতে একটা থেঁতলানো করবী ফুল পড়ে ছিল, বাবা সবগুলো ঠিক তুলতে পারেননি। সেই ফুলটা ডান কানে গুঁজলেন। ঠিক গোঁসাই ঠাকুরের মতো দেখাচ্ছে। চোখ দুটো নিমেষে ঢুলু—ঢুলু হয়ে গেল।

—যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত, অন্ধকার—ঘরের চৌকাঠ ডিঙোলেন। অভ্যুত্থানমধর্মস্য এবার খোলা দরজার সামনে। তদাত্মানং সৃজাম্যহম। ঘরে ঢুকে পড়েছেন। হে ভারত! যখন, যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সময়ে আপনাকে সৃষ্টি করি। এ—ঘরে বিধর্মী যাঁরা আছেন সরে পড়ুন। গীতাপাঠ হবে। ন—মামা আপনি তো শাক্ত, চলে যান, ওই বাইরের টেবিলে আর এক শাক্ত বসে আছেন ওখানে। চলে যাও বাবু সোজা রান্নাঘরে—স্যাংচুমারি খ্যাংখেল—সোজা রান্নাঘরে। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্র সমবেতা যুযুৎসবঃ, ওরে সমবেত যুযুৎসবঃ, মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বতঃ সঞ্জয়। ঠেঙিয়ে শেষ করে দাও অর্জুন। তুলোধোনা করে দাও কৌরবপক্ষকে। না, কৃষ্ণ সখা আমার! তা তো পারব না, এঁরা আমার জ্যাঠা খুড়োর দল। কী বললি রাসকেল, আমার কথায় অমান্য। রইল তোর রথ, রইল তোর ঘোড়া। জানিস আমি কে! আমি কৃষ্ণ। ভক্তরা আমায় কেষ্ট বলে। এ তোর রবীন্দ্রনাথের চোর কেষ্ট নয়। রইল তোর গীতা।

ন—দাদু আর বাবু আগেই বেরিয়ে এসেছে। প্রভাতকাকা বাইরে এসেই পাশ থেকে দরজার খিল তুলে দিয়ে, যাত্রাদলের অভিনেতার মতো হাহা, হাহা করে হেসে বললেন, একটু পরেই কুরুক্ষেত্রে! আমি গরম ফুলুরি আর চা পাঠাচ্ছি। কোনোরকম গোলমাল করলেই বিশ্ব দর্শন করাব। আমি এই ঘোর কলির অবতার প্রভাত, মরণ মারণ উচাটন ঝাড়ফুঁক সব জানি। দাঙ্গার সময় সাতটার পেট উসকে দিয়েছি, আমি সাতমারি সহস্রমারি পালোয়ান। পারি না এমন কাজ নেই। যদা যদা হি ধর্মস্য, হাহা হাঃ হাঃ হিইই।

প্রভাতকাকা এ—ঘরে এসে জামাটা আবার আগের মতো করে পরে ফেললেন। থালাটা তুলে নিলেন। বাবার মুখ দেখে মনে হল অনেক প্রশ্ন জমে আছে। ন—দাদুর চাপে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। ন—দাদু আবার বটানির রাজ্যে ফিরে এসেছেন—বুঝলে শঙ্কর, ন—হাজার রকমের ফার্ন আছে। জানো তো এদের বীজ হয় না। পৃথিবীর প্রাচীনতম গাছ। কোল এজে এদের খুব বাড়বাড়ন্ত ছিল। ন—দাদু খুব শব্দ করে চা খান। প্রতিটি চুমুকে ফড়াস ফড়াস করে আওয়াজ করছেন। বুঝতেই পারছি বাবা ভীষণ অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। ন—দাদু বলছেন, সবচেয়ে সুন্দর ফার্ন কী জানো শঙ্কর—হোলিফার্ন। যেমন করেই হোক আমাকে একটা সংগ্রহ করতে হবে। কত টাকা দাম নেবে। কত টাকা দাম নেবে। বিলেত থেকে আনব, সুইজারল্যান্ডে পাওয়া যেতে পারে কি বল?

বাবা অতিকষ্টে, ন—দাদুর অনবরত কথার ফাঁকে কোনোরকমে একটু ফাঁক খুঁজে নিয়ে বললেন—আজকে ফার্ন থাক। বড়ো বিব্রত হয়ে রয়েছি। দেখলে তা বউদির অবস্থা। রবিবার ছুটির দিন হবে। বেশ ধীরে সুস্থে। বাবার কথা শেষ হতে—না—হতেই, ঘরের রাস্তার দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে জ্যাঠাইমা ডাকছেন—সন্তোষ ঠাকুরপো ও সন্তোষ ঠাকুরপো!

বাবার মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠছে। নিজের মনেই বললেন—সেরেছে। সন্তোষদার দোকানে তখন প্রচুর খদ্দের। সকালের রাস্তা, লোক গিজগিজ করছে। সন্তোষদার দোকানের সামনের বেঞ্চিতে মুনশিদের দারোয়ান বিশাল নাগেশ্বর বসে আছে। হাতে পেতল বাঁধানো ইয়া মোটা লাঠি। সেই লোকটি স্নান করতে চলেছেন, যার একটা পা কাঠের। যুদ্ধে গিয়েছিলেন। শুনেছি ক্যাপ্টেন ছিলেন। সেই সময় ডান পা—টা গিয়েছে। সন্তোষদা চিৎকার করে বললেন—জয় গুরু। লোকটি মন্ত্র পড়তে পড়তে আসছিলেন। মন্ত্র থামিয়ে উত্তর দিলেন—জয় গুরু।

জ্যাঠাইমা গলাটাকে আর একটু চড়িয়ে দিলেন, এবার ঠাকুরপো বাদ, সন্তোষ ও সন্তোষ! বাবার পরামর্শ ন—দাদুর মনঃপূত হয়নি। আপন মনে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। বাবার স্বগতোক্তি মান—সম্মান আর কিছু রইল না। রাস্তার গোলমাল পেরিয়ে শেষ ডাকটা সন্তোষদার কানে যেতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দোকান থেকে মুখ বের করে ওপর দিকে তাকাতে চাইলেন। আর সেটাই হল কাল। পাশে—পেছনে চতুর্দিকে ধাপে ধাপে কাঠের তাক। তিন সারি, চার সারি। থাকে থাকে সাজানো, মোয়া, আইসক্রিম, লেমোনেডের বোতল, সিগারেটের টিন, প্যাকেট, দেশলাই। লাফিয়ে উঠতেই মাথাটা গিয়ে লেগেছে পেছনের তাকে। ছোটোখাটো একটা ভূমিকম্প মতো হয়ে গেল। ঠংয়াঠং, ঠংয়াঠং করে সিগারেটের টিন পড়ছে। দু—হাত দিয়ে মাথা ঢেকে সন্তোষদা কোনোরকমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। পালাবার তো পথ নেই।

এর মধ্যে নাগেশ্বর এক কাণ্ড করে বসল। বেঞ্চির পায়ার ফাঁকে পা গলিয়ে, সামনে কোলের ওপর ভুঁড়িটা রেখে আরাম করে খইনি ডলছিল। সোডার বোতল ফাটার ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পালাতে গেল। পালাবে কী করে। গোদা পা তো, বেঞ্চির পায়ার ফাঁকে আটকে গেল। নাগেশ্বর উঠল, সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চি উঠল। তারপর পেতল মোড়া লাঠি, বেঞ্চি, খইনি সবসুদ্ধ নিয়ে কেতরে রাস্তার উপর শুয়ে পড়ল। পাশেই রাজেনবাবুর চায়ের দোকানের সামনে পাড়ার বিখ্যাত শম্ভু ষাঁড়। গত পরশুই যে থানার দারোগাবাবুকে গুঁতিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। একটা লেড়ো বিস্কুটের দাবিতে ঘোঁড়ৎ ঘোঁড়ৎ শব্দ করছিল। শম্ভুর হঠাৎ মনে হল, দেখি আর একটা শম্ভু বেঞ্চি বুকে নিয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে কী কারণে। ষাঁড় জাতির ওপর কোনো অত্যাচার শম্ভু একেবারেই সহ্য করতে পারে না। শম্ভু দুলকি চালে নাগেশ্বরকে দেখতে আসছে। ‘বেঞ্চি কল’—এ ধেড়ে ইঁদুরের মতো নাগেশ্বর আটকে গেছে। শুয়ে শুয়ে চিৎকার করছে—জয় শিব শম্ভু। জয় শিব শম্ভু। এ সন্তোষবাবু কুছ তো কিজিয়ে। জয় শিবশম্ভু। সন্তোষদা দোকানে সিটে বসে বসেই করছেন—পেরভু, পেরভু, পেরভু।

জ্যাঠাইমা সমানে চিৎকার করছেন—সন্তোষ ও সন্তোষ। বাবা, ন—দাদুকে বলছেন—আজ ফার্ন থাক। দেখছ তো অবস্থা। একটা কিছু করতে না—পারলে পাড়ায় ঢিঢি পড়ে যাবে।

ন—দাদু বোধহয় অবস্থাটা বুঝলেন, বললেন—শঙ্কর, তোমার মনে আছে আমাদের আর্টিস্ট ভূপেনকে একবার পরিতে পেয়েছিল। বউমাকে মনে হয় ভূতে পেয়েছে। আমি বরং নিবারণ ওঝাকে একবার পাঠিয়ে দিই। সরষে পোড়া মারলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাবা বললেন—উঁহু উঁহু ওঝা—টোঝার দরকার হবে না। পারলে প্রভাতই পারবে। ওর অনেক ঝাড়ফুঁক জানা আছে। ন—দাদু বললেন—জানো তো শঙ্কর, মুড়ি আর ভুঁড়ি দুটোর মধ্যে ভীষণ যোগ। তুমি ডাবের জল আর জটামাংসীর জল একসঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াও। তবে চারু কী বলছিল জানো—এ—বাড়িতে একটা শান্তি স্বস্ত্যয়ন দরকার। পর পর এতগুলো মৃত্যু হয়ে গেল। বাড়িটা তোমাদের ঠিক সহ্য হল না। বহুদিন ধরেই আমরা শুনে আসছি—এটা ভূতের বাড়ি।

রাজেনবাবু দুটো লাঠি—বিস্কুট হাতে শম্ভুকে ডাকছেন—মহারাজ এদিকে এসো, এদিকে এসো। সন্তোষদা টিন, সোডার বোতল ঠেলে ওঠার চেষ্টা করছেন। বিড়ি বাঁধা বন্ধ রেখে, মামা নেমে এসেছেন। নাগেশ্বরকে ধরে তোলার ক্ষমতা তাঁর নেই। নাগেশ্বরের পাশে মামা শিশু। মামা বলছেন—দমকল ডাকতে হবে। বেঞ্চির পায়ের সঙ্গে নাগেশ্বরের পা জড়িয়ে গেছে। রাজেনবাবু ডাকছেন, আয় শম্ভু আয়। জ্যাঠাইমা সমানে ডেকে চলেছেন—সন্তোষ ও সন্তোষ। সন্তোষদা বিশ্রী একটা গালাগাল দিলেন। একটা বোতল গড়িয়ে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল আর শম্ভু ঠিক তখনই বেগধারণ করতে না—পেরে, ছর ছর করে জল ছাড়তে শুরু করল। নাগেশ্বরও একটা গালাগাল দিয়েই বুঝল শিবের বাহনকে গালাগাল দেওয়া ঠিক হল না, তারস্বরে বলতে লাগল—জয় শিবশম্ভু।

গালাগাল দুটোই বাবার কানে গেছে। আমাকে বসে বসেই জিজ্ঞাসা করলেন—কীসের এত হইহই বাইরে? কাকে গালাগালি দিল? তুমিই—বা ওখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছ?

—নাগেশ্বর বেঞ্চি নিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েছে। সন্তোষদার দোকানের সমস্ত তাক ভেঙে পড়ে গেছে। সোডার বোতলকে গালাগাল দিচ্ছেন। বাবা রাগরাগ গলায় বললেন—সকালটা তুমি এইভাবেই মজা দেখে উড়িয়ে দেবে ভেবেছ; সরে এসো ওখান থেকে। যাও খেয়েদেয়ে পড়তে বোসো। প্রভাতকে একবার পাঠিয়ে দিয়ো।

ন—দাদু বই বগলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছেন—সরষে—পড়াকে তুমি যা তা ভেবো না শঙ্কর। সাদা সরষে চাই। শ্বেতসর্ষপ। ওঁ অপসর্পন্তু তে ভূতা যে ভূতা ভূবি সংস্থিতাঃ। যেভূতা বিঘ্নকর্তারস্তে নশ্যন্তু শিবাজ্ঞয়া। হাবুর মাকে মনে আছে শঙ্কর। প্রায় ভূতে ধরত। ওঁ বেতালাশ্চ পিশাচখচ রাক্ষসাশ্চ সরীসৃপঃ। অপসর্পন্তু তে সর্বে নারসিংহেন তাড়িতাঃ। বাইরে রাস্তায় সন্তোষদার গলা—শালার বেটা শালা। বাঁশ পেটানোর শব্দ। শম্ভু দৌড়োচ্ছে। বাবা বললেন—পাড়াটা ক্রমশই ছোটোলোকের পাড়া হয়ে উঠছে। এইবার একদিন প্যাঁদানি খাবে আমার কাছে। প্যাঁদানি বললেই বুঝতে হবে বাবা খুব রেগে গেছেন।

বাঃ, বাঃ, রান্নাঘরের চেহারাটাই পালটে গেছে। একটা সকালেই এত পরিবর্তন। লম্বা টেবিলটা ঘরের মাঝখানে খাবার টেবিল হয়ে গেছে। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। দুটো রেকাবিতে, দু—খানা করে ফুলো ফুলো পোড়া খড়খড়ে রুটি। পাশেই এক কাপ করে চা। উনুনের কাছে প্রভাতকাকা হাত দিয়ে ডাল নাড়ছেন। চমৎকার গন্ধ বেরুচ্ছে। বহুদিন পরে এত সুন্দর ডালের গন্ধ নাকে লাগল। প্রভাতকাকা বললেন, আজকের মেনুটা দেখে নাও। দেওয়ালে সাঁটা আছে।

ব্রেকফাস্টে—কড়া সেঁকা দুটো ডাঙকেক, এক কাপ চা। ব্র্যাকেটে, চিনি চাইলে দুঃখিত। লাঞ্চে—ভাত, মাখম শিম দিয়ে মুগের ডাল, ঝিঙে পোস্ত, একটা কাঁচা লংকা, একটু নুন, চাইলে এক গাঁট কাঁচা তেঁতুল। ব্র্যাকেটে, খুঁতখুঁত করলে গলা ধাক্কা। ইভনিং টি—ভেলি গুড় উইথ ছোটো একবাটি মুড়ি, নো সরষের তেল, নো পেঁয়াজ। পছন্দ না—হলে গেট আউট। ব্র্যাকেটে। ডিনার—গোদা রুটি, অড়হর ডাল, উইদাউট ঘি। তলায় প্রভাতকাকার সই, তারিখ। বিশেষ দ্রষ্টব্য : এর ওপর কারুর কিছু প্রয়োজন হলে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল।

পিসিমা শিলে পোস্ত বাটছেন দুলে দুলে। প্রভাতকাকা বললেন—তোমার ভাগটা তুমি মেরে দিয়ে সরে পড়ো। আর একটা বাবুর। সে কোথায়? —বাবা আপনাকে একবার ডাকছেন। আমার এখন যাবার সময় নেই। বাবুদের অফিসের ভাত দিতে হবে। কঁড় কৌচি। জানি না। —ছোড়দাকে এখানে আসতে বল—আমার রান্না স্পয়েলড হয়ে যাবে। প্রভাতকাকা ভীষণ চিৎকার করে বললেন—ছোড়দি কিমাটা তৈরি হয়েছে। মালা পোয়াটাক কিশমিশ ভিজিয়ে দে। গদাই মাছটা বের করে পাতকো—তলায় ফ্যালো।

পিসিমা অবাক হয়ে বললন—এসব কোথায় প্রভাত?

—স্বপ্নে, স্বপ্নে, সব স্বপ্নে! —তবে বলছ যে। —বলব না। আশেপাশে বাড়িকে শোনাতে হবে তো। ভেতরের অবস্থা জানতে দেব কেন। ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন, বাইরে কোঁচার পত্তন। ওরে দইটা জমেছে কিনা দ্যাখ।

ছাদের সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে বাবু চুপ করে বসে আছে। কপালটা কাছ থেকে দেখলুম। থেঁতলে গেছে। শরতের অতি—নীল আকাশ থেকে মেঘ চুঁইয়ে রোদ ঝরছে ফিনকি দিয়ে। তোর কপালটা এইভাবে কাটল কী করে রে।

—মা দেওয়ালে ঠুকে দিয়েছে দাদাভাই।

—সে কী রে। মা—র কী হয়েছে বল তো?

—খুব রেগে গেছেন মনে হয়।

বাবু কড়মড়ে রুটিতে একটা কামড় দিয়ে বললে—বেশ সুন্দর খেতে হয়েছে। এরকম রোজ হলে ভালো হয়। রোজই তো হবে। প্রভাতকাকা ভার নিয়েছেন। দেখিসনি রান্নাঘরের চেহারাটাই পালটে গেছে। আর দুপুরের ডালটা যখন খাব দেখবি কী সুন্দর। মাখম শিম দেওয়া।—আমাদের গাছের শিম? তাই হবে মনে হয়।

বাবুর হাতে আধখানা রুটি। মুখে কুড়ুর মুড়ুর আওয়াজ। বাবু হঠাৎ বললে—আমার বাবা নেই তো, তাই মা—র এত রাগ। তোমার কেমন বাবা আছে। —আমার যে তেমনি মা নেই। বদলাবদলি, কী বল। —মা না—থাকলে কী হয়। আসল তো বাবা, বল দাদাভাই।

রান্নাঘরের কাছে বাবার গলা—প্রভাত। আমাদের সুখদুঃখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। —বাবা তুমি যে একেবারে পাকা বাবুর্চি হয়ে গেলে। বাঃ, রান্নাঘরের চেহারাই পালটে দিয়েছে। দেখেছ একেই বলে বেটাছেলের হাত। কিন্তু ওদিকে তো ধরে রাখা যাচ্ছে না প্রভাত। ছি ছি সারাপাড়া ঢিঢি হয়ে গেল। রাস্তার দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে, সন্তোষ সন্তোষ করছে। গান গাইছে। রাজেনবাবুকে বলছে—চা পাঠাও। ও—ঘর থেকে তো সরাতে হবে।

—সরাব কী করে ছোড়দা। দরজা খুললেই তো বেরিয়ে পড়বেন। সে তো আর এক বিপদ হবে। প্রভাতকাকার কথা শুনে মনে হল, জ্যাঠামা যেন বেড়াল। ছেড়ে দিলেই পালাবেন। বাবা বললেন যেমন করেই হোক কায়দা করে, প্রয়োজন হলে বাই ফোর্স, ও—ঘর থেকে বের করে অন্ধকার ঘরে পুরতে হবে। আর আমি লিখে দিচ্ছি, তুমি বরং শ্যামনগরে একটা টেলিগ্রাম করে দাও, ওর ভাই এসে নিয়ে যাক। এখানে তুমি পাগলকে রাখবে কোথায়? সেখানে তবু মাঠ ময়দান আছে, যা খুশি করে বেড়াক।

বাবু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—মা পাগল হয়ে গেছে দাদাভাই। ভোমলার মতো। সন্তোষদার দোকানের সামনে ভোমলা বসে থাকে। কথায় কথায় বলে—ভগবানের যেমন বরাত। আজ আর কিছু খাওয়া জুটল না। ভগবানের বরাত কথাটা শুনলে বাবা খুব খুশি হন। ও তো প্রচ্ছন্ন সাধক। তোমরা কেউ বুঝবে না। এত বড়ো কথা যে বলতে পারে, সে সাধক। বাবা একদিন ভোমলাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেইদিন খাওয়া দেখেছিলুম। খাচ্ছে, খাচ্ছে, খেয়েই চলেছে। ইয়া তার স্বাস্থ্য, গায়ের চামড়া তেল চুকচুকো। এক হাঁড়ি ভাত শেষ। শেষে বললে—ভগবানের যেমন বরাত, একটুর জন্যে পেটটা ভরল না। সমস্ত রুটি শেষ, বাবার স্টকের আম শেষ, তবু ভোমলার পেট ভরল না। বাবা বললেন—কী বুঝলে। আমার অহংকার গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। ও হল বামন অবতার, আমি হলুম রাজা বলী। মাত্র ত্রি—পাদ পরিমিত জমি চেয়েছিল। দিতে পারেননি। আমিও পারলাম না ওর পেট ভরাতে। সন্তোষদা মজা দেখেন। যেই বলেন, ভোমলা ফায়ার, ভোমলা তখন প্রথমে সামনে ঝুঁকে, তারপরই পেছন দিকে হেলে পড়ে, ফায়ারিং—এর শব্দ—দুম, ফটাস, দুম, ফটাস। সঙ্গে সঙ্গে রাজেনবাবু খুশি হয়ে চা, সন্তোষদা বিস্কুট, বিড়ি। ভোমলা বোমারুর মতো মুখ করে রকে বসে থাকে। জানে, ফায়ারিং না—করলে সারাদিন উপোস।

পাগল শুনেই বাবুর ভোমলার কথা মনে পড়েছে। বাবু রুটিটা হঠাৎ ছুড়ে ছাদে ফেলে দিল। একইসঙ্গে উড়ে এল দুটো কাক, দুটো শালিক। জোর ঝটাপটি। দু—পক্ষই শক্তিশালী। খেলি না কেন? —আর ভালো লাগছে না। —এই বললি খুব ভালো লাগছে। বাবু উদাসমুখে জিজ্ঞেস করল—দাদাভাই ওরা মাকে মারবে, না! —মারবে কী রে? মাকে কেউ মারে? ওপাশের ঘর থেকে মাঝের ঘরে আনবে। মাঝে অন্ধকার ঘরটা বেশি নিরিবিলি, ঠান্ডা, তাই না? —চল না দেখে আসি।

আমার খুব ইচ্ছে করছিল দেখবার। কিন্তু কেন জানি না মনে হল,, বাবুকে আটতে রাখতে হবে। ধাক্কাধাক্কি হতে পারে, ঠেলাঠেলি হতে পারে। বাবুর দেখা উচিত হবে না। —কী দরকার ভাই ওসব অশান্তির মধ্যে। তার চেয়ে চল, ছাদের ওই ছায়া ছায়া জায়গাটায় গিয়ে বসি। ওই দেখ একটা পাছাপাড় ঘুড়ি উড়ছে।

ঘুড়ির ব্যাপারে অন্যদিন বাবুর কত উৎসাহ। আজ যেন মিইয়ে গেছে। ঘুড়িটার দিকে তাকাল, কিছু বলল না। —আদ্দে না, একতে বল তো? দুজনে ছাদে এসেছি। সারি সারি টবে তেজি চন্দ্রমল্লিকা। কাঁকড়িকাটা ভেলভেটের মতো ঝোলা ঝোলা পাতা। দুটো ছোটো ছোটো প্রজাপতি হইহই করে উড়ছে। নিমগাছে অসংখ্য ডালপালা হাত তুলে, ঢলে ঢলে যেন হরিনাম করছে। সকালে নিমগাছটা দেখলেই কেন জানি না নিমাইয়ের কথা মনে হয়। বহুদূর আকাশে একটা চিল উড়োজাহাজের মতো ভাসছে। সকলেরই কত সুখ! পৃথিবীটা কত সুন্দর! যত সুন্দর সব আমাদের মনে। —জানিস বাবু আজ পূর্ণিমা। রাতে খুব চাঁদের আলো হবে। দেখবি কী মজা! বাবু হঠাৎ আমাদের বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই আমি জ্যাঠামশাইকে যেন দেখতে পেলুম। শীতের রবিবারে ছাদে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। রোদে দুটো পা। কালো চামড়ার ব্যান্ড দেওয়া চটি দু—পাটি একটু দূরে খোলা রয়েছে। অসম্ভব রোগা হয়ে গেয়েছেন। গায়ে বিস্কুট রঙের শাল। চওড়া কপালের দু—পাশে দড়ির মতো শির, পাকিয়ে পাকিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে। কোলের ওপর খোলাসুদ্ধ আধখানা কমলালেবু। সেই চটি দু—পাটি এখনও আছে। নিমগাছটা তখন ছিল পাঁচিলের মাথায় মাথায়। এখন পাঁচিল ছাড়িয়ে কোথায় কত দূরে উঠে গেছে।

অন্ধকার ঘরের উত্তরের ছোটো জানালাটা খুলছে পেছনের সেই ঘুটঘুটে সিঁড়িটার দিকে। যেটা নেমে গেছে পাতকো—তলায় শ্যাওলাধরা উঠোনের দিকে। সেই জানালায় জ্যাঠাইমার ফর্সা টুকটুকে মুখে। ঘর থেকে বাবার দুটো বড়ো মুগুর, ডাম্বেল, কাঠের বড়ো আলনাটা বের করে এনে আমাদের বড়ো ঘরে রাখা হয়েছে। ও—ঘরে এখন শুধু জ্যাঠাইমা আর কুলুঙ্গিতে সিঁদুরমাখা মা—লক্ষ্মী, মা—দুর্গার ছবি, একটা ফুটো শাঁখ, একটা তেলচিটে প্রদীপ! আর জানালার তলায় একরাশ পুরোনো, ডেলা পাকানো তুলো। বাবা একটা তুলোধোনা যন্ত্র উদ্ভাবন করছেন। যন্ত্রটা তৈরি হলেই এক রবিবার তুলোগুলো সব লেপ হয়ে যাবে।

বারান্দার দিকে যাকেই যেতে দেখছেন, তাকেই জ্যাঠাইমা বলছেন—ওরে আমাকে একটু বেরোতে দে না। আমার যে অনেক কাজ পড়ে আছে! সকলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে, কেউ কিছু করতে পারছে না। করার সাহসও নেই। ঘরে তালা, চাবি পিসিমার কাছে। জ্যাঠাইমা মাঝে মাঝে একটু করে তুলো নিয়ে পিঁজে পিঁজে, জানালা দিয়ে ফুঁ করে উড়িয়ে দিচ্ছেন। পুরোনো তুলো। ওজনে ভারী। বেশিদূর উড়তে পারছে না। সারা সিঁড়ি একটু একটু করে তুলোয় ভরে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিমেন্টের সিঁড়ি, গদির সিঁড়ি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

বাবু জানালার বাইরে থেকে মা—র দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। দু—বার, মা মা বলে ডাকল। জ্যাঠাইমা একটু তুলো মুখের সামনে ফুঁ দেবার জন্যে ধরে রেখে বললেন—তুই তো ওদের দলে। সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে বিটলে, শয়তান। কথাটা বাদ দিলে, জ্যাঠাইমার এই ভঙ্গিটা, আমার ইতিহাসের পাতায় নুরজাহানের ছবিটার মতো। নাকের কাছে গোলাপ ফুলের বদলে, তুলো।

এই সেই জ্যাঠাইমা। মাত্র কয়েক বছর আগে যেদিন প্রথম এ—বাড়িতে এলেন—গোলাপি বেনারসি—পরা গোলাপি শরীর। ওপাশের ঘরে বসে আছেন। কে যেন আমাকে জ্যাঠাইমার নরম কোলে বসিয়ে দিয়ে বলে গেল—এই তোমার ছেলে। পাড়ার সব গ্রাম্য প্রতিবেশীরা যেন চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছে। আসছে যাচ্ছে। কত কথা। দরজার বাইরে, দুই বুড়িতে ফিসির ফিসির করে কথা হচ্ছে। কাদের বাড়ির কে জানে? এখনও ভুলিনি সেই কথা। একজন বলছে—আহা এমন বউয়ের অমন বুড়ো বর! কী হবে মাগো। আর একজন খ্যানখ্যান করে হেসে বলছে—দেবরটার চেহারা দেখেছ! এইবার বুঝে নাও।

জ্যাঠাইমা মালাদিকে ডাকছেন—এই মালা, মালা। দরজাটা তোর মাকে খুলে দিতে বল না রে। মালাদি বললে—মা বাড়ি নেই। —কোথায় গেছে, তোর মামার সঙ্গে অফিসে?—অফিসে যাবে কেন? তোমার মাথাটা মাইমা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। —তবে পোস্টাপিসে গেছে? —পোস্টাপিসে কী করতে যাবে? —টাকা জমা দিতে। ওই তো একটু আগে পুরোনো বাসনঅলা ডেকে এ—বাড়ির সব ঘটিবাটি বিক্রি করে অনেক টাকা পেলি। —ওমা! কী মিথ্যে কথা! দাঁড়াও প্রভাতমামা আসুক।

—প্রভাত বুঝি তোদের বাপ? প্রভাত বাবা, হি, হি।

জ্যাঠাইমার হাসিটা স্বাভাবিক হাসি নয়। কথা তো নয়ই। কী জানি মানুষ যে হঠাৎ এমন করে পাগল হয়ে যায়। জ্যাঠাইমার কথা শুনে মালাদি ভীষণ চটে গেল। —দেখলি বিল্টু কী যা—তা বলছে। পরের কথাটা চিৎকার করে জ্যাঠাইমাকে বলল—ছোটোমামা আসুক বটেক। সব কথা বলব। জ্যাঠাইমা ফুঁ দিয়ে একটু তুলো উড়িয়ে দিয়ে বললেন—ছোটোমামা! বাবা, বড়ো ভয় করছে, ওই ছেলেটার বাবা তো, যাঃ যাঃ তোর ছোটমামাকে আমি ট্যাঁকে রাখি।

মালাদিকে নিয়ে সদরের দিকে সরে গেলুম। বাবু গুম হয়ে বেঞ্চিতে বসে আছে। বাড়িতে একজনও বড়ো মানুষ নেই। পিসিমা গেছেন অধীরবাবুর কাছে গদাইকে সঙ্গে নিয়ে, ভরতির তদবিরের জন্যে। প্রভাতকাকা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেছেন, টেলিগ্রাম আরও কী কী সব করতে। মালাদিকে আজ বেশ বড়োসড়ো লাগছে। শাড়ি পরেছে ফ্রক ছেড়ে।

আমরা সদরের দিকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলুম প্রভাতকাকা। উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছি। অনেকদিন পরে শরৎবাবু এলেন।

গোলগাল চেহারা। আদ্দির পাঞ্জাবি। কালো চওড়া পাড়। ফিনফিনে ধুতি। আন্ডারওয়্যারের পটি ফুটে উঠেছে। পায়ের চকচকে কালো নিউকাট জুতো দুটো যেন চেয়ে আছে। মুখে সেই টিপি টিপি হাসি। আগে আরও দুপুরে আসতেন। জ্যাঠাইমার ঘরে জ্যাঠামশাইয়ের ইজিচেয়ারে বসে সন্ধে অবধি খুব গল্প চলত। সিগারেটের পর সিগারেট। ঘরটা পোড়া তামাকের গন্ধ আর ফিকে ধোঁয়ায় ভরে যেত। কত হাসি, কত গল্প। জ্যাঠাইমার সম্পর্কে কীরকম যেন জামাইবাবু। মিঠি মিঠি ডাক—নন্দু, তোমার এই মনে পড়ে, তোমার এই মনে পড়ে। তোমার কী সুন্দর গানের গলা। গাও না একটা গান? জ্যাঠাইমা অমনি ভাবে বিভোর হয়ে গাইতেন—তোমায় ঠাকুর, বলব নিঠুর, কোন মুখে? শাসন তোমার যতই গুরু ততই টেনে লও বুকে। শরৎবাবু অমনি মাথা নেড়ে নেড়ে হাতের আঙুলের আংটি দিয়ে ইজিচেয়ারের হাতলে তবলা বাজাতে শুরু করতেন। গান শেষ হলে, জ্যাঠাইমার গালে টোকা মেরে বলতেন, দুষ্টু মেয়ে।

শরৎবাবুর সিঁড়ি দিয়ে ওঠাটা কেমন যেন পা টিপে টিপে চোরের মতন। সন্ধের পরে বাড়ি ফিরলে বাবার ভয়ে আমরা এইভাবে উঠি। ওপরে উঠে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন—জ্যাঠাইমা কোথায়? এইভাবেই শরৎবাবু কথা বলেন। যত না কথা বলেন, তার চেয়ে বেশি হাসেন। ভদ্রলোকটিকে দেখলেই রাগ ধরে যায়। জ্যাঠামশাইয়ের ইজিচেয়ারে কেন বসবেন? ওই চেয়ারটা কতবড়ো একটা স্মৃতি! কেন আমাকে বলবেন—একটা পান নিয়ে এসো তো সামনের দোকান থেকে।

আবার ফিসফিসে গলায় প্রশ্ন করলেন—তোমার জ্যাঠাইমা কোথায়? কী উত্তর দেব! মালাদির মুখের দিকে তাকালুম। বাবু হঠাৎ বললে—মা—র মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শরৎবাবুর বিশ্বাস হল না, বাবুর কাছে সরে গিয়ে বললেন—মিথ্যে কথা বলতে নেই বাবা। মা কোথাও বেড়াতে গেছে বুঝি? বাবু মাথা ঝাঁকিয়ে বললে—না, না, ওই তো ও—ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। শরৎবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে বড়ো ঘরের দিকে তাকালেন। নিজের মনেই বললেন—সে কী! মাথা খারাপ হয়ে গেল! জানতে চাইলেন—কীরকম মাথা খারাপ! আমরা কিছু বলার আগেই বাবু বলল—ভোমলার মতো নয়—সে আবার কে? শরৎবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন—সে আবার কে? এবার মালাদি উত্তর দিল—সে একজন আছে বটেক। তাহলে কার মতো। কী করে বুঝলে মাথা খারাপ! মাথা খারাপ হলেই হল। মাথায় ছিট না—থাকলে, হঠাৎ একেবারেই মাথা খারাপ হয় নাকি! কই চল তো দেখি একবার।

বাবু বললে—প্রভাতকাকা ঘরে তালা দিয়ে রেখেছেন। —সে আবার কে হে? মালাদি বললে—প্রভাতমামা বটেক। —এই বলছে কাকা, এই বলছে মামা, মহা মুশকিল তো! শরৎবাবুকে ভীষণ বিব্রত মনে হল। আর ঠিক সেই সময়, জ্যাঠাইমা দক্ষিণের ঘরের দিকের দরজায় গদাম গদাম করে কিল মারতে শুরু করলে—তোরা খুলবি কি না বল, ডাক তোদের প্রভাত না কে তাকে। চালাকি পেয়েছিস তোরা, ভেবেছিস আমাকে ঘরে পুরে রেখে সব বিক্রি করে খাবি। আমি জজসাহেবের কাছে নালিশ করব।

শরৎবাবু ভয় ভয় মুখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন—আমি তাহলে চলি। সিঁড়ি দিয়ে চোরের মতো নামছেন।

জ্যাঠাইমা বলছেন—সব মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরবি। শরৎবাবু নামতে নামতে পেছনের দিকে তাকালেন, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন—বেরিয়ে আসবে না তো। শরৎবাবুর কথা চাপা পড়ে গেল দরজায় কিল, চড়, লাথির প্রচণ্ড শব্দে।

আমরা তিনজনেই জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম—শরৎবাবু হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছেন দূর থেকে দূরে।

উনুনে আগুন পড়েছে। টিনের চাল গলে হুহু ধোঁয়া উঠছে সন্ধ্যার ম্রিয়মাণ আকাশের নীচে। নীচের বাগানে একগাদা পিঁপড়ের ডানা বেরিয়েছে মরবার জন্য। হুহু করে ওপরদিকে উঠছে। থিরিথিরি পাখার কাঁপন। ডুমুর গাছে আমার বাঁধা কলসিটার মুখের কাছে বসে আছে দোয়েল। দোয়েলই বোধহয় সবশেষে বাসায় ঢোকে। খুব শিস দিচ্ছে। পিড়িক পিড়িক করে ন্যাজ নাচাচ্ছে। মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে না—পেরে ছোঁ মেরে উড়ন্ত পিঁপড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

পাশের বস্তিবাড়িতেও আগুন পড়েছে। চতুর্দিক থেকে ধোঁয়া উঠছে আকাশের দিকে। পশ্চিম আকাশটা আগুনে লাল থেকে ক্রমশ বেগুনি হয়ে আসছে। পেয়ারা গাছের পাতাগুলো জমাট কালো হয়ে উঠেছে। উত্তরের সবজি বাগান অঞ্চলে টিপ টিপ করে আলো জ্বলে উঠছে। ওপাশের বাড়ির গোয়ালে গোরু ডাকছে হামমা, হামমা করে। কে এ মহিলা বলছেন—যাচ্ছিরে মঙ্গলা, যাচ্ছি।

ছাদে ওঠার সিঁড়ির ধাপে বসে, শাড়িটাকে হাঁটুর ওপরে তুলে মালাদি প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছে ঊরুর ওপর হাত ঘষে ঘষে। প্রভাতকাকা পাতকো—তলায় হুড় হুড় করে জল ঢেলে স্নান করছেন, আর মাঝে মাঝে ধেই ধেই করে নাচছেন। সঙ্গে গানও আছে— গোদা রোটি খাও, হরিকে গুণ গাও। আরে গোদা রোটি খাও ভাই। পিসিমা আটা মাখছেন। বাবু বসে আছে সামনে।

প্রভাতকাকা ওপরে এলে জ্যাঠাইমার ঘর খোলা হবে। ঠাকুরের কাছে প্রদীপ দেওয়া হবে। ফুটো শাঁখ বেজে উঠবে। প্রভাতকাকা বলেছেন, জ্যাঠাইমাকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে আছে। খেলার মাঠ থেকে শেষ ছেলেটিও চলে গেছে। সারা পাড়াটা যেন গুটিয়ে আসছে একটু একটু করে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। সকালে প্রভাতকাকার সঙ্গে গঙ্গায় চান করতে গিয়ে ইটে ঠোক্কর খেয়ে নখটা একটু উঠে গিয়েছিল। তার ওপরে ঢুকেছে গঙ্গামাটি। জায়গাটা একটু একটু করে ফুলে উঠেছে।

প্রভাতকাকার জলঝরা শরীরটা ওপরে উঠে এল। হাত—পা ছুড়ে, শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে জল ঝাড়লেন। একটামাত্র গামছা, গা মুছবেন কী করে। ভিজে গামছা ছেড়ে কাপড় পরলেন। পাতলা চুলে হাত বুলিয়ে জলসুদ্ধই কপালের ওপর সমান করে নিলেন। আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয়ের মতো দেখাচ্ছে। বারান্দা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিংড়োলেন। ছর ছর করে জল পড়ল নীচের উঠোনে। চ্যাঁক চ্যাঁক শব্দ করে একটা ছুঁচো ছুটে পালাল।

গামছাটা দড়িতে মেলে দিয়ে প্রভাতকাকা মালাদিকে বললেন—দে, সলতে দে, দেশলাই দে। কাপড়টা ভিজে গিয়ে পাছার সঙ্গে জায়গায় জায়গায় লেপটে গেছে। সলতে আর দেশলাই হাতে প্রভাতকাকা জ্যাঠাইমার ঘরের সামনে। এইবার তালা খুলবেন। আমরা সব দম বন্ধ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি ভয়ে ভয়ে। কী হয়, কী হয়। বাবু লেপটে আছে আমার গায়ের সঙ্গে। হাতের ওপর নিশ্বাস পড়ছে। গরম। ভ্যাট করে একটা শব্দ হতেই আমরা চমকে উঠেছি। জোর শব্দ।

না, আমরা ভয়ে ছিলুম বলেই ভয় পেয়েছি। শব্দটা ঘরে হয়নি। হয়েছে রাস্তার সন্তোষদার দোকানে। সোডার বোতল খোলার শব্দ। বাবু আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার হাত আবার আলগা হয়ে এল। প্রভাতকাকা তালা খুলছেন। এইবার শিকল নামছে। এখুনি দরজা খুলে যাবে। তারপর কী যে হবে!

প্রভাতকাকা দরজাটা ঠেললেন। খুলল না। এবার জোরে ঠেললেন, তাও খুলল না। ভেতর থেকে জ্যাঠাইমা খিল তুলে দিয়েছেন। প্রভাতকাকা ডাকলেন, বউদি দরজা খুলুন। কোনো সাড়া নেই।—বউদি, বউদি। প্রভাতকাকা যেন একটু ভয় পেয়েছেন। নিজের মনেই বললেন—কী হল! গলায় দড়ি দেননি তো!

ভর সন্ধেবেলা। গলায় দড়ির নাম শুনে বাবু আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে ডাকল—দাদাভাই! প্রভাতকাকা এইবার দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে ডাকছেন—বউদি, বউদি। হঠাৎ ভেতর থেকে জ্যাঠাইমা বলে উঠলেন—কেমন মজা, কেমন মজা। এইবার কী করে তোমরা ঢোক দেখব! ভেবেছিলে রাত হলেই ছুরি হাতে ঢুকে আমাকে খতম করে দেবে তাই না! অত সহজ নয়! আমি বাঁচতে জানি।

—দরজা খুলুন বউদি। খাবার এনেছি। প্রভাতকাকা মিষ্টি করে বললেন। জ্যাঠাইমা বললেন ও আর এক ষড়যন্ত্র। খাবারের মধ্যে বিষ দেবে ভেবেছ। তা হচ্ছে না। —খাবার নয়, খাবার নয়, পাঠবাড়ির প্রসাদ এনেছি। গৌরাঙ্গদেবের প্রসাদ। প্রসাদ খেতে হয়, না করতে নেই।

হঠাৎ ঠকাস করে খিলটা খুলে গেল। আমরা দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে পালাবার জন্যে প্রস্তুত। জ্যাঠাইমা হুট করে বেরিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন। প্রভাতকাকা বুক আর দু—হাত দিয়ে আটকে ফেললেন একটু ধস্তাধস্তির মতো হয়ে গেল। জ্যাঠাইমার হাতের চুড়ি বেজে উঠল। প্রভাতকাকা কায়দা করে ফেলেছেন। ঘরের ভেতর থেকে বললেন—ছোড়দি শিকলটা তুলে দিন।

অন্ধকার ঘরে দেশলাইয়ের আলো কেঁপে উঠল। প্রভাতকাকা গান গাইছেন—হরের্নামৈব, হরের্নামৈব কেবলম। মনে হল প্রদীপটা জ্বলে উঠেছে। শব্দটার এমনই শক্তি, আমাদেরও শরীর অবশ হয়ে আসছে, বারান্দা থেকে আমরা সব পায়ে পায়ে, গুটিগুটি দরজার কাছে সরে এসেছি, প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় বন্ধ ঘরে প্রভাতকাকা কাপালিকের মতো গর্জন করছেন। জ্যাঠাইমা মাঝে মাঝে একবার একটু হেসে উঠেছিলেন। এখন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিস্তব্ধ ঘরের বাইরে আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করছি—কী হচ্ছে ঘরের ভেতরে। বাইরে সন্তোষদার দোকানে রেডিয়োতে হিন্দি গান হচ্ছে।

দক্ষিণের ঘরের মেঝেতে আমাদের বিছানাটা গোল করে গুটোনো রয়েছে দেওয়ালের পাশে। গাছের গুঁড়ির মতো সেই বিছানায় আমরা পাশাপাশি বসে আছি। আমার ডান পাশে মালাদি, বাঁ—পাশে বাবু। গদাইদা বসে আছে বাইরের বেঞ্চিতে। মালাদি হঠাৎ আমার গালে একটু চুমু খেয়ে বললে—লক্ষ্মীছেলে। গালটা একটু ভিজে ভিজে লাগল। কেন মালাদি হঠাৎ চুমু খেল। কেনই বা লক্ষ্মীছেলে বলল। সারাশরীরটা অদ্ভুত একটা ভালোলাগার ভাবে শিরশির করে উঠল। চুমু তো ভালোবাসার লক্ষণ। কেউ ভালোবাসলে কত ভালো লাগে। মালাদি বললে—পড়তে বসবি না?

পড়তে তো বসতেই হবে। কিন্তু বসি কী করে! মনটা বড়ো খাপছাড়া হয়ে আছে। মালাদি বললে—পড়তে বস ভাই, তা নাহলে ছোটোমামা এসে আবার বকবেন! মালাদি মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলা একটু খাবলা—খাবলা করে দিতে দিতে বলল—তোর কী ঘন চুল রে! পায়ের আঙুলের মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ মন হল, জ্যাঠাইমা ঘট ছুড়ে মেরে বলেছিলেন—খোঁড়া হয়ে যাবি। পা—টা সেপটিক হয়ে তাই হবে না তো। কাকে জিজ্ঞেস করি। একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *