মৃগয়া – পার্ট ২

আর একদিন আমাদের খাবার সময় আমার পোষা বেড়াল মঙ্গলা জ্যাঠাইমার পাতের কাছে মাছের বায়না করছিল। জ্যাঠাইমা বাঁ—হাত দিয়ে বেড়ালের মুখটা মেঝেতে জোরে ঠুকে দিলেন। মঙ্গলা যখন মুখ তুলল তখন তার মাছ খাবার লোভ চলে গেছে। এতটুকু নরম নাকটা আরও থেবড়ে গেছে। মেঝেতে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। চিটচিটে লালরক্তের ফোঁটা ফেলতে ফেলতে লোভী বেড়ালটা সেই যে চলে গেল আর ফিরে এল না। আমরা কেউ আর সেদিন খেতে পারলুম না। জ্যাঠাইমা কিন্তু পাতের সামনে দগদগে সেই রক্তের ফোঁটা রেখে অম্লানবদনে হুসহাস করে ভেটকিমাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে গেলেন।

মাননীয় মানুষের অপমান সহ্য করা যায় না। বাবার বিব্রত অসহায় মুখ। তিনি যেন সাময়িকভাবে চুপসে গেলেন। ছোটোদের সামনে তাঁকে এইভাবে আঘাত করা উচিত হয়নি। বাবার হাত ধরে বললুম, চলুন, আমরা পড়ার ঘরে যাই। বাবা যেন বহু দূর থেকে বললেন, তাই চলো। সেই মুহূর্তে সংসার আবর্ত থেকে আমরা যেন পৃথক হয়ে গেলুম। শাসক আর শাসিতদের মধ্যে একটা অদৃশ্য পাঁচিল উঠে গেল। বোঝাপড়ার দিন শেষ।

পড়ার ঘরের টেবিলে এসে বসলেন। বারেবারে একটু একটু চা খেতে ভালোবাসেন। অনেক আশার মুখের চা, চিনি, শূন্য তিক্ততার কেয়ার অফ নান হয়ে রান্নাঘরে পড়ে রইল। সাধ্য আর সামর্থ্য থাকলে এক চামচে চিনি মিশিয়ে এককাপ চা এই মুহূর্তে এনে দিতুম। কিন্তু ইচ্ছে প্রবল হলেও উপায় নেই। রাম থেকে ভূত যত দূরে, চিনি থেকে আমি তার চেয়ে বেশি দূরে। চিনির বেহিসেবি খরচ সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, তা হল জ্যাঠাইমার শরবত প্রীতি। ঢাল চিনি, মার জল, ফেল গলায়। আঃ, পেট ঠান্ডা। ভুঁড়ির সঙ্গে মুড়ির যোগ। তারপরই ভূমিশয্যায় অসুখীর সুখনিদ্রা!

হাতের সামনে, টেবিলের ওপরে পড়েছিল ঈশপস ফেবলস। পাতা উলটে উলটে বাবা একটা জায়গায় এসে থেমে পড়লেন। কিছুটা অন্যমনস্ক। উলটোদিকে বসে, আমার চোখে পড়ছে, রঙিন ছবি, সুন্দর, বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফ। চকচকে পাতা। বইটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, গল্পটা গুছিয়ে বল;

বাইরে শীতের রাত। বাতাসে হিমের কামড়। তুষারের কম্বলের তলায় প্রকৃতি কাঁপছে। একটা ছোট্ট কুটিরের জানালায় ফ্যাকাশে হলুদ আলো। আশ্রয়হীন এক উট শীতে কাঁপতে কাঁপতে কুটিরের সামনে এসে দাঁড়াল। একটু আশ্রয় চাই। জানালার কাচে নাকটা ঠেকাল। নিশ্বাসের বাষ্প জমে গেল কাচে। গৃহস্বামী জানলা খুলে জিজ্ঞেস করলেন—কী চাই?

শীতে জমে যাচ্ছি। একটু আশ্রয়।

এখানে জায়গা কোথায়। এই এতটুকু ঘর।

একটু দয়া। এই হি—হি শীতের রাতে বাইরে থাকলে আমার যে মৃত্যু হবে। সকালে উঠে দেখবে, দরজার বাইরে আমার হিম মৃতদেহ পড়ে আছে। তখন কিন্তু তোমার দুঃখ হবে।

কিন্তু এখানে তুমি থাকবে কী করে?

আচ্ছা বেশ, তবে একটা রফা হোক। শীতে আমার নাকটাই বড়ো কষ্ট পাচ্ছে। জানো তো, যত শীত সব নাকে। তুমি যেমন আছো থাকো, আমাকে শুধু নাকটা একটু ভেতরে রাখতে দাও।

বেশ তাই রাখো।

নাক থেকে মাথা, মাথা থেকে গলা, গলা থেকে কাঁধ, কাঁধ থেকে ক্রমে ক্রমে সারাশরীরটাই ভেতরে চলে এল। গৃহস্বামী বললেন, এটা কী হল? এবার আমি কোথায় যাব?

অমায়িক হেসে উট বললে, হে আমার উপকারী আশ্রয়দাতা, তোমার যদি খুব অসুবিধে হয় তাহলে তুমি বরং বাইরে চলে যাও। এর বেশি আমি আর কী করতে পারি!

বাবা গুম হয়ে কিছুক্ষণ জানলার লেপটানো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছোট্ট নস্যির ডিবেটা অন্যমনস্কভাবে টেনে নিলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ উদাসদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই হল জগৎ! বুঝেছ। এই হল তোমার জগৎ। উটের সংসার! গিভ দেম অ্যান ইঞ্চ, দে উইল আস্ক ফর অ্যান এল। যেই এক ইঞ্চি দেবে, সঙ্গে সঙ্গে এক বিঘত চাইবে, তারপরই এক হাত। নিবৃত্তি নেই। আরও চাই, আরও, আরও, আরও।

উত্তেজনাটা আবার ফিরে আসছে। ফোঁ করে নস্যি নিলেন। এক টিপে হল না। আর এক টিপ হাতে ধরা। সেই টিপ—ধরা আঙুল নেড়ে—নেড়ে বললেন, বিশ্ব জুড়ে অনাহত ওংকার ধ্বনি নয়, দেহি, দেহি রব উঠেছে। সেই গানটা, তোমার মামার সেই গানটা মনে পড়ে—’ভিখারি বাসনা করিতে চায় লক্ষপতি, লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি, ইন্দ্রত্বও লভিলে সে শিবত্ব করে কামনা।’ সন্তুষ্টি নেই। কোথায়, সেই কনটেন্টমেন্ট। লেলিহান লোভ দাউ দাউ করে জ্বলছে। হায় মানুষ, হায় মানুষ, হায় হায় হায়!

হায়, হায় উচ্চারণের নিশ্বাসের ধাক্কায় কিনা জানি না, আলোটা হঠাৎ আলেয়ার মতো দপ—দপ করে লাফাতে শুরু করল। বাবা বললেন—কমাও, কমাও। পলতে কমাবার কলটা আমার দিকেই ছিল। তাড়াতাড়িতে কমাতে গিয়ে তেড়ে বাড়িয়ে ফেললুম। আলোটা ভপ করে লাফিয়ে উঠে নিভে গেল। কেরোসিনের ঝাঁজালো ধোঁয়ায় গলা বুজে আসছে। নাকে নস্যির রুমাল চেপে ধরে বললেন, পালাও, পালাও। জানালার ধারে উঠে গিয়ে মুক্ত বাতাসের দিকে নাকের ফুটো দুটো মেলে দিলুম। বাবা শব্দ করে চেয়ারটা পেছিয়ে নিলেন। পেছনে একগাদা জুতো ছিল। চেয়ারের একটা পায়া একপাটি জুতোর ওপরে উঠে পড়েছে। চেয়ারটা বসতেই ঢকঢক করে উঠল। ব্যাপারটা বোঝার জন্যে আরও বেশ কয়েকবার সামনে—পেছনে দোল খেলেন। যেন কাঠের ঘোড়া। চেয়ারটাকে আবার সামনে টেনে নিলেন। এবারেও সেই ঢকঢক। পেছনে ঠেললেন। অবস্থার কোনো উন্নতি হল না। তখন নীচু হয়ে অন্ধকারেই পর্যবেক্ষণ—

—আই সি! তুমি জুতো পরে বসে আছো। তাই বলি। এটা কার জুতো?

জানলার কাছ থেকে সরে এলুম অপরাধী জুতোর শনাক্তকরণের জন্যে। চেয়ারের একটা পায়ায় ঝকঝকে একপাটি কালো নিউকাট, ভয়ে ভয়ে বললুম—প্রভাতকাকা।

—প্রভাতের জুতো!

ভাগ্যিস আমার জুতো নয়। জুতো রাখার জন্যে একটা র‍্যাক আছে। সমস্ত জুতো র‍্যাকে সাজিয়ে রাখাই নিয়ম।

—ওটা কার?

পাশেই একজোড়া ক্ষয়া ক্ষয়া স্লিপার। বাবার লক্ষ্য এবার সেটার দিকে।

—ওটা জ্যাঠাইমার।

উঠে দাঁড়ালেন। একপায়ে জুতো পরা চেয়ারটার দিকে মিনিটখানেক চিন্তিত মুখে চেয়ে থেকে বললেন,

—ঠিক আছে। তবে তাই হোক। এদিকে এসো।

এসেই তো আছি। আর কতটা আসব। এখন নতুন নির্দেশের অপেক্ষা।

—লাগাও।

কী লাগাতে বলছেন? প্রশ্ন করারও সাহস নেই।

—হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না। একটু চটপটে হবার চেষ্টা করো। ভুলে যেয়ো না, তুমি বাঙালি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত প্রাণী। জানো তো, হিটলার যুদ্ধের সময় একজন বাঙালিকে চিড়িয়াখানার খাঁচায় ভরে রেখেছিল, প্রদর্শনী হিসাবে। তথ্যটা জানা ছিল না, বাবার মুখে শুনে বেশ মজা লাগল। মজা লাগলে তো চলবে না, এখন নির্দেশ অনুসারে লাগাতে হবে।

—কী লাগাব বাবা?

—জুতো লাগাও জুতো। চারপায়ে চারটে নিউকাট। আমারটাও নিয়ে এসো। ভেবো না, ভাবনার কিছু নেই, যস্মিন দেশে যদাচার। আর ওনার ওই চটি দু—পাটি একসঙ্গে করে মাথার বালিশের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে এসো।

জিনিসটা মন্দ হত না। জুতো পরা চেয়ার, বালিশ চাপা চটি। সব আয়োজনই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ রান্নাঘরে হুড়মুড় করে একটা ভীষণ শব্দ হল। বাবা চমকে উঠলেন—যাও, যাও, দেখে এসো কে মরল। তোমার প্রভাতকাকাকে বলো হসপিটালে নিয়ে যেতে।

পিসিমারা আসার আগে আমাদের পোড়োবাড়ির এই উত্তরমহলে অন্ধকারে একা আসতে বেশ সাহসের দরকার হত। উত্তর আর দক্ষিণ মহল একটা ঝুলবারান্দা নিয়ে যোগ করা ছিল। বাঁদিকে তিন হাত ব্যবধানে দুটো সিঁড়ি। একটা দু—বার মোচড় খেয়ে ঘোরো, ঘন অন্ধকার স্যাঁৎসেঁতে একতলায় গিয়ে নেমেছে। আর দ্বিতীয় সিঁড়িটা দু—বার বাঁক খেয়ে উঠে গিয়েছে ওপরে ন্যাড়াছাদে। এই দুটো জায়গাই মারাত্মক ভয়ের। সবসময় মনে হয় নীচে থেকে কেউ উঠে আসছে, না হয় ওপর থেকে কেউ নেমে আসছে। এখন আর ততটা ভয় নেই।

রান্নাঘরের সামনের বারন্দায় জলে থইথই করছে, সেই জলেই লাইট হাউসের মতো মিটমিটে একটা হ্যারিকেন। জলের বন্যাটা জ্যাঠাইমার দিকেই বেশি। তিনি যেমন ঘুমোচ্ছিলেন তেমনই ঘুমোচ্ছেন। বিশাল জালাটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিসিমা ছোটোমেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছেন। প্রভাতকাকা বোধহয় ছাদে ছিলেন, আমার মতোই শব্দ শুনে সবে নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে দেখেই বললেন—নাও ধরো। সুর করে গেয়ে উঠলেন, ‘বন্যা আয় সব গিয়েছে মা ভেসে…..’।

ভুলেই গিয়েছিলুম, বাবা ওদিকে অন্ধকারে বসে আছেন খবরের জন্যে। এদিককার মজা এত জোর জমেছে সবকিছু খেয়াল রাখাই মুশকিল। জ্যাঠাইমাকে জল থেকে জাগাবার চেষ্টা চলছে। ঘুমন্ত হাত থেকে খসে—পড়া পাখাটা ভাসতে ভাসতে কিছু দূরে বাটনাবাটা শিলের কাছে আটকে গেছে। শিলটা আবার দেওয়ালে এমনভাবে খাড়া করা, কোনোভাবে একটু হাত লাগলেই উলটে পড়বে। উনুনের কাছে কাঠের পিঁড়েটা ছিল, সেটাও বেশ ভেসে উঠে অল্প অল্প দুলছে, কোনদিকে যাবে ভেবে পাচ্ছে না।

পিসিমা ডাকছেন, বউদি ওঠো, ওঠো, জলে সব ভিজে গেল।

প্রভাতকাকা ডাকছেন, বউদি উঠুন, উঠুন। ভিজে গেলেন যে।

ডাকাডাকি শুনে বাবা ভেবেছেন—বারান্দার ওই অংশটা যেসব কড়ি—বরগার ওপর ঝুলছে, সেগুলো ঘুণ ধরে গেছে। জ্যাঠাইমা শুয়েছিলেন ওই অংশটাতেই, সবসুদ্ধ হয়তো ভেঙে নীচেই পড়ে গেছেন। বাবা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছেন—কী হল প্রভাত, ও প্রভাত?

—ডেকে কিছু হবে না, নাকের কাছে হাত দিয়ে দ্যাখো, বেঁচে আছে না মরে গেছে।

বাবা যাতে শুনতে পান এইরকম গলায় আমি জানালুম, বেঁচেই আছেন, ঘুমোচ্ছেন।

—তাহলে ডাকাডাকি করে জাগাচ্ছ কেন? বেশ তো আছে, শান্তিতে আছে, থাক না। শব্দটা কীসের হল!

প্রভাতকাকা এবার উত্তর দিলেন—জালা উলটে গেছে ছোড়দা! বন্যায় সব গিয়েছে মা ভেসে—

—এটা আনন্দের সময় নয় প্রভাত। এই সেদিন জালাটাকে সিমেন্ট দিয়ে আমি রিপেয়ার করেছি। ওর বয়স হল মোর দ্যান টেন ইয়ারস। কে এই উপকারটি করলেন।

পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝলুম, বাবা নিজেই বন্যাঞ্চল পরিদর্শনে আসছেন। পিসিমা চাপা গলায় কোলের মেয়েকে বললেন—শত্তুর, সব শত্তুর। দোব গলায় পা তুলে শেষ করে।

যতটা সম্ভব আশেপাশে সরে গিয়ে, বাবাকে পথ করে দেওয়া হল। ডাকাডাকির চোটে জ্যাঠাইমা সবে উঠে বসেছেন, বসেই বললেন—বাঃ, বেশ ভালো বৃষ্টি হয়েছে। কখন হল প্রভাত ঠাকুরপো!

উত্তর প্রভাতকাকা দিলেন না, দিলেন বাবা—হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তুমি এখন সরে পড়ো।

জ্যাঠাইমা কী—একটা খুঁজছেন—আমার পাখাটা, পাখাটা।

বাবা তাড়াতাড়ি বললেন, পাখাটা, পাখাটা, হাতে ধরিয়ে দাও, এক্ষুনি ধরিয়ে দাও, প্রাণবায়ু তা না—হলে বেরিয়ে যাবে।

বাবাকে ঠেলে সামনে এগোতে পারছি না। সরু বারান্দা। একপাশে, খোলা দিকটায় কাঠের ফাঁক ফাঁক রেলিং। জায়গায় জায়গায় টুকরো কাঠের জোড়। বাবার হাতের কাজ। কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। পেছন থেকেই বললুম, পাখাটা ওই যে শিলের কাছে। জ্যাঠাইমা পাখাটা ধরে টানতেই শিল আর দেওয়ালের মাঝের নোড়াটা নড়ে উঠল। বাবা হইহই করে উঠলেন—গেল গেল, শিলটা এইবার গেল।

ভিজে হাতপাখাটা নাড়তে নাড়তে জ্যাঠাইমা বললেন—তোমার সবেতেই গেল গেল। যাবেও না, থাকবেও না, কী বলো ঠাকুরপো।

প্রভাত ঠাকুরপো আর কী বলবেন। তার আগেই হ্যারিকেনের চিমনিটা চিঁ ফ্যাট করে ফেটে গেল। জ্যাঠাইমার পাখায় প্রচুর জল ছিল। পাখা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই জল ছিটকে এসে গরম কাচে লেগেছে। এবার বাবা আর হইচই করলেন না, খুব চাপা গলায় বললেন—ভালগার! তারপর আলোটা হাতে তুলেই বুঝলেন, একটু আগে জালার জলে অবগাহনও করেছে। নিজের মনেই বললেন—সব যাবে। বাতি আর জ্বলবে না এ—বাড়িতে। জার্মানির ইফার আলো। এসব আর পাওয়া যাবে! আলোটাকে সিঁড়িতে ধাপে রাখতে কী হয়। হাতে সব পক্ষাঘাত হয়েছে, না বুদ্ধিশুদ্ধি সব গোরুর মতো হয়ে গেছে!

সিঁড়ির ধাপে আলোটা রাখতেই ফাটা কাচের একটা টুকরো ফুস করে মেঝেতে খুলে পড়ে গেল। ছোট্ট মতো একটা গর্ত দিয়ে প্রচুর হাওয়া ঢুকে আলোটা কাঁপছে। বাবা প্রভাতকাকাকে বললেন, উনিও গেলেন, ইনিও গেলেন। এখন কী করবে দ্যাখো।

প্রভাতকাকা কাচের টুকরোটা তুলতে যাচ্ছিলেন। বাবা উঁহু উঁহু করে উঠলেন—হাতটা পুড়বে প্রভাত।

—কিচ্ছু হবে না ছোড়দা। প্রভাতকাকা কাচটা তুলে ফুটোর জায়গায় মাপে মাপে বসিয়ে, টিপে দিলেন। হাওয়া লেগে আলোর কাঁপুনিটা তখনকার মতো বন্ধ হল।

বাবা খুব খুশি—বাঃ, বেশ লাগালে তো। একেই বলে পুরুষ আর মেয়েছেলে। কত তফাত! অ্যাঁ, কত তফাত! পৃথিবীটা পুরুষ—শূন্য হলে কী অবস্থা হত প্রভাত।

প্রভাতকাকা একটু চিন্তা করে বললেন—তাহলে কোনা মিষ্টির দোকান আর স্যাকরার দোকান থাকত না, বড়ো বড়ো রাজভোগ, ল্যাংচা, স্পঞ্জ রসগোল্লা।

—ঠিক ঠিক বলেছ। বড়ো বড়ো হালুইকর—পুরুষ, বড়ো বড়ো মিষ্টিওলা—পুরুষ, ভীমনাগ, নবীন ময়রা, রামলাল, দ্বারিক। দ্বারিকের ছোলার ডাল, আমেরিকা থেকে এসে চেটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে। ওদিকে এম. বি. সরকার, পি সি চন্দ্র। করুক দেখি তোমাদের মেয়েরা। সব দাঁত ছিরকুটে পড়বে। এমনকী আমাদের গবা। কই কর তো দেখি বাবা গবার মতো ফুলুরি, আলুর চপ। কর তো দেখি মূলচাঁদের মতো হালুয়া।

জ্যাঠাইমা একটু সুর করে ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, কেন, তোমার বামুনদি কী হল। এই তো বলতে, বামুনদির হাতে যা পড়বে তাই খুলে যাবে! বামুনদি মেয়ে না ছেলে! কী বলো ঠাকুরপো?

বাবা মোটেই দমলেন না, বললেন—ওসব হল ব্যতিক্রম। সর্বগুণের বউদি নিজের হাতে করে শিখিয়ে গিয়েছিলেন, তার সঙ্গে নিজের চেষ্টা। সে তো শেকসপিয়রে একজন মহিলা আইনজীবীর উল্লেখ আছে। তা বলে মেয়েছেলে সি আর দাশ হবে, না বিধান রায় হবে?

জ্যাঠাইমার পাখা সমানে চলছে, বসে আছেন জলে। সেই ঘুম জড়ানো গলাতেই বললেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল সকালে একটু সরষে বেটে দিয়ো তো শিলে। দেখব সব হিম্মত কত!

বাবা আর কথা বাড়ালেন না। রাত বেড়ে যাচ্ছে। থানার পেটা ঘড়িতে এইমাত্র দশটা বাজল। অবশ্য দশটার রাত বাবার কাছে কিছুই নয়। প্রভাতকাকাকে জিজ্ঞেস করলেন—জালাটা গেছে তো! আবার দশ টাকার ধাক্কা।

জালাটা একটা কোণে দুটো ইটের ওপরে বসানো ছিল। আমার ছোটো পিসতুতো বোন, ঘুমের ঘোরে দেওয়ালের বাইরের দিকের ইটটা পা দিয়ে সরিয়ে দিতেই, জালা কাত। প্রভাতকাকা জালাটা সোজা করে ইটের ওপরে বসিয়েছেন। এমনি তো মনে হচ্ছে কিছু হয়নি। তবে ফেটে গেছে কি না কে জানে! প্রভাতকাকা একটা লোহার শিক তুলে নিয়ে জালাটার শব্দ পরীক্ষা করলেন। টাং টাং করে শব্দ হল।

শব্দ শুনে বাবা বললেন—মনে হচ্ছে বেঁচে গেছে। থাক থাক, ছেড়ে দাও, আর বাজিয়ো না। এখন জলের কী করবে দ্যাখো। এতক্ষণে জ্যাঠাইমার খেয়াল হল—কী হয়েছে প্রভাত ঠাকুরপো?

—জালা উলটে গেছে বউদি!

—সে কী! কাল সকালে রান্নার জলের কী হবে? বদ্যিনাথ তো একদিন অন্তর জল দেয়। আজ দিয়েছে, কাল তো আর দেবে না। কে ওলটালে? ঠাকুরপো বুঝি কিছু করতে গিয়েছিল?

বেশ মজা, এ—বাড়িতে যা কিছু অপকীর্তি হয়, বাবা ভাবেন জ্যাঠাইমার কাজ, জ্যাঠাইমা ভাবেন বাবার কাজ।

প্রভাতকাকা উনুনখোঁচানো শিকটা দিয়ে, জ্যাঠাইমার পাশের ঝাঁঝরি বসানো ছোটো নর্দমার মুখে খোঁচাখুঁচি শুরু করলেন। জলটা যাতে বেরিয়ে যায়। জানেন না, ওটা কোনোকালেই সচল ছিল না। মেহনত দেখে বাবা বললেন—ছেড়ে দাও, ব্যর্থ চেষ্টা। ও বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং। জল কখনো ওপরদিকে ওঠে শুনেছ!

—আজ্ঞে না।

—ওখানে সেই কায়দাই হয়ে আছে। এলবো আর পাইপ এমন কায়দা হয়ে আছে, বাঁকটা ওপরদিকে।

প্রভাতকাকা তবু খোঁচাচ্ছেন। একটু একগুঁয়ে আছেন। বাবা রেগে গেলেন—শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ কেন বলো তো প্রভাত? হবে না বাপু। স্বয়ং বিশ্বকর্মা এলেও ওই নর্দমা দিয়ে একফোঁটা জল বের করতে পারবে না। তুমি বরং হাতে—পায়ে ধরে ওই মহিলাকে ওঠাও আর শশীদের বলো, ঝাঁট দিয়ে জলটা এই নর্দমা দিয়ে বের করে দিতে।

মেয়েমহল থেকে বাবা প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন, কী ভেবে ফিরে এলেন। একটু ইতস্তত করে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করেই বললেন, ওই হ্যারিকেনটায় তেল নেই। কেরোসিনের টিনটা তোমরা কেউ দিতে পারবে। উত্তরটা জ্যাঠাইমার দিক থেকেই এল। কেরোসিন! টিন ঢন ঢন। যা ছিল তুমি ঢেলে নিয়েছ।

—আনানো হয়নি কেন?

জ্যাঠাইমা উঠে দাঁড়িয়েছেন, পায়ের পাতা দিয়ে জলে ঢেউ দিতে দিতে বললেন, তেল আনার মালিক তোমরা! দেখলেই তো টিন খালি, নিয়ে এলেই পারতে। বেলা তিনটেয় লাইন দিলে এতক্ষণে পেয়ে যেতে।

বাবা গুম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর, জানা রইল, বলে ধীর পায়ে দক্ষিণ মহলের দিকে চলতে শুরু করলেন। প্রভাতকাকা বললেন, ছোড়দা, ইলেকট্রিকটা এবার নিয়ে নিন।

দূর থেকে বাবা বললেন, আমার ক্ষমতায় তো হল না, এখন তোমাদের চেষ্টায় কী হয় দ্যাখো।

জ্যাঠাইমা চলে যেতে যেতে বললেন—তোমার মেয়ে জালা উলটেছে, কাল সকালে রান্নার জলের ব্যবস্থা তুমি করবে। তা না—হলে পাতকোর জলে রান্না করে রেখে দোব। পয়সার মুরোদ নেই, বাবুদের সব হাজার রকমের বায়নাক্কা। যাই ছেলেটাকে তুলে খাওয়াই।

 পিসিমা শুকনো জায়গায় মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন, ও প্রভাত, জলের কী হবে! এখন তো রাস্তার কলেও জল নেই।

প্রভাতকাকা বললেন—কিচ্ছু ভাববেন না ছোড়দি। গদা বালতি নিয়ে আয়।

—ও প্রভাত, বালতি কী হবে। এখন তো কলে জল নেই।

—নদী থেকে জল তুলব।

—ও প্রভাত, গঙ্গার জলে রান্না হয়েছে শুনলে ছোড়দা খাবে না।

—গঙ্গা নয় ছোড়দি, গঙ্গা নয়। সরোবর থেকে ছেঁকে ছেঁকে তুলব, গামছা লে আও। জালার জল জালাতেই ফিরিয়ে দেব। জলের দাম নেই, মাগনা আসে।

—না প্রভাত। ওটা তুলো না। ওর চেয়ে পাতকোর জল ভালো।

—ফুটপাত দেখেছেন। হাইড্রান্ট দেখেছেন?

—ফুটপাথ দেখেছি, ওই পরেরটা কী বললে, ওটা তো দেখিনি।

আগে উচ্চারণ করুন। বলুন হাই।

—পারব না প্রভাত, মুখ্যু মানুষ।

—হাই তুলতে পারেন, আর হাই বলতে পারবেন না। বলতেই হবে, বলুন হাই।

—ও সেই হাই।

—এই তো হয়েছে। বলুন হাইড্রান্ট…..

—হাইড্রাম!

—ওইতেই হবে। সেই হাইড্রামের জলে ফুটপাথের নোংরায় শয়ে শয়ে লোক রাঁধছে, খাচ্ছে। আমরা কী এমন লাটসাহেব! এই জলেই রান্না হবে। স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য করে সবক—টাই তো অকালে পরলোকে। এইবার ভালো করে স্বাস্থ্য করাচ্ছি। গদা বালতি নিকাল।

প্রভাতকাকা, জলটা সত্যি সত্যি তুলে নিতেন কিনা জানি না। দক্ষিণের বারান্দা থেকে বাবার ডাক শোনা গেল—প্রভাত, প্রভাত। প্রভাতকাকা মার্চ করার কায়দায় লেফট—রাইট করতে করতে চলে গেলেন। মেঘের ফাটল থেকে চাঁদের এক চিলতে মুখ বেরিয়েছে। চাঁদটা প্রায় আকাশের মাঝামাঝি এসে গেছে। বারান্দার ঢেউ খেলানো টিনের চালের ফাঁক দিয়ে পথ করে নিয়ে, একটা রেখা জলের ওপর এসে পড়েছে। ঝলমল ঝলমল করছে, কেউ জানে না, কেউ জানবেও না ওই জলে কী আছে। বারান্দার ওই অংশটুকু, ওই জলটুকুতেই আমার জীবনের অতীত, মিষ্টির রসের মতো গুলে আছে। থাক না, জলটা সারারাত, চাঁদের আলোয় ওইভাবেই যদি থাকে ক্ষতি কী!

অত শৈশবের কথা মনে থাকা উচিত নয়, তবু ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কিছু দৃশ্য মনের আকাশে আসে আর যায়। পুরো হাত, গাঢ় নীল একটা সোয়েটার পরে, মাথায় সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে আমার মা খুব ভোরে জামতাড়ার মাঠে আমাকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। দৃশ্যটা যত দিন যাচ্ছে ততই যেন উজ্জ্বল হচ্ছে। দক্ষিণে রাস্তার দিকের যে—ঘরটা এখন জ্যাঠাইমার, সেই ঘরটা মা—র সময় আমাদের ছিল। দুপুরবেলা মা আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ঘুম কি সহজে আসে। অল্পসল্প দুষ্টুমি অবাধ্যতা চলছে। অনেকক্ষণ সহ্যের পর মায়ের মতো মায়েরও অসহ্য লাগল। পিঠে গুম গুম করে গোটা দুয়েক কিল পড়ল। তারপর ঘরের বাইরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে, দরজায় মুখ রেখে হুঁউউ করে ভয় দেখাতে লাগলেন। তারস্বরে কাঁদছি, মা দৌড়ে এসে জলে ভেজা গালে, নিজের ঠান্ডা গালটা রেখে প্রহার আর ভয় দেখানোর দুঃখে নিজেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন। মনে থাকার কথা নয়! তবু কেন মনে আছে, অনেক ঘটনার এই একটা ঘটনা। আর মনে আছে, শেষ দিন, যে দিন নিজে হাতে আমাকে চান করিয়ে দিচ্ছিলেন। তারপর আর উঠতে পারেননি। বারান্দার ঠিক ওই অংশটা জল জমে ছোটো একটা পুকুর মতো হয়েছে। তেল মাখা শরীর নিয়ে মাছের মতো মেঝেতে একটু পিছলে পিছলে খেলা হয়েছে। মা করুণ মুখে বলছেন, আজ আর পারছি না রে, আয় জল ঢেলে গা—টা রগড়ে দিই। ওরে ঠান্ডা লেগে যাবে রে! চারদিকে কী উজ্জ্বল রোদ। মা—র ফর্সা মুখ, খাড়া নাক, নীল চোখ, ঝুঁকে আছে আমার উঁচু করে তোলা মুখের ওপর। কানের পাশের, গলার তলার জল মুছে দিচ্ছেন। ঠিক পাশের কী—একটা গাছে এতবড়ো একটা কালো ভীমরুল ভোঁ—ভোঁ করছে। আর ঠিক তখনই রেঙ্গুনের জ্যাঠাইমা ডাকলেন—তুলসী তাড়াতাড়ি আয়, ডাক্তারবাবু এসেছেন। দুটো গাছই বাজে পুড়ে গেছে। তবু জীর্ণ হলেও বারান্দার ওই নিভৃত পুব মুখ অংশটা আছে। সেই স্নানের সময় যে জলটা জমত সেটা হঠাৎ আবার আজ জমেছে। মা নেই কিন্তু চাঁদের আলো মা—র স্নেহের মতোই ঝিলমিল করছে।

খেয়াল করিনি, ছাদে ওঠার সিঁড়ির ধাপে আমার পাশে গদাই এসে বসেছে। বয়েসে আমার চেয়ে বছরখানেক বড়ো। আস্তে আস্তে বলছে—তোমার খিদে পায়নি?

ভোরবেলাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশের মুখ গোমড়া। মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ বেরোবার চেষ্টা করছে। একটু আগেই কয়লাওয়ালা কয়লা দিতে এসে নীচের পেছল উঠোনে দমাস করে আছাড় খেয়ে বলে গেছে, উঠোন পরিষ্কার না—করলে সে আর কয়লা দিতে আসবে না। এত বাড়িতে কয়লা দেয়, কোনো বড়িতে এইরকম উঠোন নেই। বাবা একটু দেরিতে ওঠেন তাই! তা না—হলে উঠোন পরিষ্কার নিয়ে একটা কাণ্ড হতই। মাসখানেক হয়ে গেল চুন এনে রেখেছেন, রাতে শোবার আগে ছড়িয়ে দিলেই হয়। কে দেয়? আসলে কেউ মনেই করে না যে এ—বাড়ির একটা নীচের তলা আছে।

জ্যাঠাইমা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ফুলে ফুলে খুব হাসছেন, আর মাঝেমাঝেই সকলকে বলছেন—লোকটা কীরকম পড়ল! ঠিক যেন নৌকোর মতো পিছলে গেল—দুম। ঠিক সেদিনকার ভিখিরিটার মতো। চোখের সামনে আমিও দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু হাসি পাচ্ছে না, ভীষণ লজ্জা করছে।

মাথায় এতবড়ো একটা ভারী বোঝা। যতই অভ্যাস থাক, সরু ঘাড়টা ওজনের ভারে লগবগ করছে। পরনে একটা লুঙ্গি। তলা থেকে ভাঁজ করে হাঁটুর ওপরে তোলা। গায়ে একটা ছেঁড়া—ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি। পেছল উঠোনে পা রেখে, বোঝাসুদ্ধ নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখার কী চেষ্টা। রোগা রোগা, শির—বের—করা দুটো হাতই মাথার বস্তাটা ধরে রেখেছে। সারামুখে ভীষণ একটা আতঙ্ক। শেষে তাকে পড়তেই হল। বিশ্রীভাবে পড়ে গেল চিত হয়ে। কয়লার বস্তাটা ধপাস করে উঠোনের নর্দমায় গিয়ে পড়ল। কিছু কয়লা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ভাঁজ করা লুঙ্গি এমন জায়গা উঠল, যেখানে না উঠলে লোকটা হয়তো এত লজ্জা পেত না। বড়ো মানুষ, মেয়েদের সামনে পড়ে যাওয়াটাই লজ্জার, তার ওপর যদি লুঙ্গি স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তা আরও লজ্জার।

ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দর্শকরা সব হাসছে। অসম্ভব পেছল উঠোনে লোকটি পশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। জল, কাদা, সাবানের ফেনা, ভাতের ফেন, মানুষের ত্যাগ করা জল, সব মিলিয়ে সভ্যমানুষের নিজের হাতে তৈরি নরক। এক সিকি মুটে ভাড়ার জন্যে একটা মানুষের কত কষ্ট—স্বীকার। নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল সে। নর্দমা থেকে রোগা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বস্তাটা উঠিয়ে, সিঁড়ির ঘরে খালি করে দিল। ছড়ানো কয়লা সব তুলে ফেলল। তারপর ঘামে ভেজা মুখ, কাদা—মাখা শরীর নিয়ে ওপরের বাবুদের দিকে তাকিয়ে, হাত পেতে দাঁড়াল।

বারান্দায় সেকালের কোনো জমিদারবাবু দাঁড়িয়ে থাকলে হাসিমুখে বলতেন, খুব আনন্দ দিয়েছ হে ছোকরা। তোমাকে দেখে আজ মালুম হল, মানুষে আর পশুতে তফাত হল টাকার। টাকা থাকলে মানুষ, না—থাকলে পশু। এই নাও সিকির বদলে গিনি।

সিকিটা নিয়ে লোকটি সবে চলে গেছে। শ্যাওলার ওপর তখনও পুরো একটা মানুষের ছাপ, হাঁচর—পাঁচর করার নানা দাগ। জ্যাঠাইমার হাসিটাও মরে এসেছে। রান্নাঘরের সামনে ছোটো একটা আনাজের চুবড়িকে ঘিরে ছোটোখাটো একটা অশান্তি দানা পাকিয়ে উঠেছে। একপাশে জ্যাঠাইমা আর একপাশে পিসিমা। জ্যাঠাইমা বলছেন—এই তো, এই ক—টা আলু, দুটো গুলি গুলি উচ্ছে, কয়েকটা পটল। নাও, কী খাবে খাও! ওই বাপ—ছেলেকে যা হয় ফুটিয়ে দিয়ে উনুনে জল ঢেলে দাও। বাজারের কথা বলতে গেলেই তো উনি তারিখ দেওয়া হিসাবের খাতা বের করে বলবেন, তিনদিনের বাজার একদিনে শেষ হয় কী করে! তোমার সাহসে কুলোয় তুমি যাও।

জ্যাঠাইমার বোলচাল বেশি। এ—বাড়ির দু—নম্বর মেজোবউ। ফর্সা সুন্দরী। বাপের বাড়ি পড়তি জমিদার। তবু জমিদার তো। পিসিমা, বাবার বোন। স্কুলশিক্ষকের মেয়ে। পাড়াগাঁ—র বউ। গায়ের রং ময়লা। অসহায়। সম্বলহীন বিধবা। ভাইয়ের গলগ্রহ। খাটো, খাও। বঁটিতে আলু ছুলতে ছুলতে পিসিমা জিজ্ঞেস করলেন, ভাজা না ডালনা?

জ্যাঠাইমা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ভাজা? তোমার ভাইয়ের ভাজা খাবার মুরোদ আছে! একপলা তেল। দু—ফোঁটা দুই নাকের গর্তে, দু—ফোঁটা দু—কানে, এক ফোঁটা নাইকুণ্ডুলে, রইল বাকি এক। ভাজতে পারো ভাজার কোটো। বাপের জন্মে এইভাবে সংসার করিনি, করতেও পারব না। তোমরা চিরকেলে, দুকচেটে, সেখানেও জুটত না, এখানেও জুটছে না। ঠাকুরজামাই তো রেস খেলে, মদ খেয়ে সব পথে বসিয়ে গেছে। কী আর করবে বলো। গতর আছে, পারো তো খেটে খাও।

সিঁড়ির কাছে পুবের রোদে বসে কেডসে খড়ি মাখাতে মাখাতে জ্যাঠাইমার কথা শুনছি। পিসিমার বিষণ্ণ শুকনো মুখ, লজ্জায় অপমানে এতটুকু হয়ে গেছে। অন্যমনস্ক, বঁটির ফলায় একটা বেঁটে পটল ধরে আছেন। ক্যাঁচ করে দু—আধখানা করবে, না ফ্যাঁস করে লম্বালম্বি দু—ফালা করবেন বুঝতে পারছেন না।

জ্যাঠাইমার কথার মারপ্যাঁচ থেকে পিসিমা এইটাই বুঝলেন, ভাজা হবে না। অন্য যা হয় কিছু হবে। পটলটা সবে দু—আধখানা করেছেন, উঠোনে দুম করে আবার একটা শব্দ হল। পিসিমার বড়োমেয়ে মালা চিৎকার করে উঠল—মাথা ফাটা পড়েছে বটেক। পিসিমা বঁটি ফেলে লাফিয়ে বারান্দায় এলেন, পরপর আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেছি, গদাইয়ের পতন দেখতে। পিসিমা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন—মড়া, ওখানে মরতে গেছ কেন?

আরও হয়তো কিছু বলতেন, বলা হল না। গঙ্গায় স্নান সেরে বাবা উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন। একেবারে গদাইয়ের পেছনে। একটু উঁচু করে পরা গেরুয়া রঙের লুঙ্গি। সামনে ঝুলছে ভাঁজ করা ভিজে লাল গামছা। চওড়া বুকের ওপর আড়াআড়ি পড়ে আছে মোটা পইতে। ঠোঁট দুটো ঝিঁঝি পালকের মতো কাঁপছে। মন্ত্র জপ করছেন। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন, কিন্তু উদাস। দূর থেকে দেখলেও মনে হয় শরীরের সঙ্গে মনও শীতল হয়েছে স্নানের পর। কিন্তু গদাইয়ের অবস্থা দেখে এখুনি জ্বলে উঠলেন বলে।

গদাই যেন সামনে বাঘ দেখেছে। করুণ গলায় বললে, ছোটোমামা পড়ে গেছি।

—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন উঠে পড়।

গদাই ওঠার চেষ্টা করে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। বরং আরও খানিকটা হড়হড়ে নর্দমার দিকে চলে গেল।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তোর প্যান্টের পকেট থেকে হলদে কী বেরোচ্ছে ওটা।

—ডিম, ছোটোমামা।

—ডিম, ডিম নিয়ে এই ভাগাড়ে কী করতে এসেছিস, তা দিতে?

উত্তরটা ওপরের বারান্দা থেকে জ্যাঠাইমা বুঝিয়ে দিলেন—তোমার ডিম।

—আমার ডিম! বাবা অবাক হয়ে ওপরদিকে তাকালেন। আমার ডিম মানে?

—রাজেনের দোকান থেকে ডিম এসেছিল। পচা বেরিয়েছে। তাই পালটে আনতে গিয়েছিল।

—তোর হাতে ঠোঙায় ওটা কী?

—ডালবড়া ছোটোমামা।

—ডালবড়া, কে খাবে?

—মেজোমাইমা।

বাবা ওপরের দিকে না—তাকিয়েই বললেন, শশী, ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা না—দেখে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যা। একটা লাঠি এনে দূর থেকে বাড়িয়ে দে ধরে উঠুক। তারপর কুয়োতলায় ফেলে জল ঢাল।

উঠোনের স্বভাব যারা জানে তারাই চেনে কোন অংশটা নিরাপদ। বাবা তার মধ্যে একজন। নিরাপদ অংশটা দিয়ে তিনি বাঁধানো কুয়োতলায় এসে উঠলেন। ঠোঁট আবার দ্রুত নাড়তে শুরু করেছে। দড়ি বাঁধা বালতিটা পাতকোয়ায় নামাতে নামাতে একচিলতে বাগানের কোণে ঝাঁকড়া ডুমুরগাছটার দিকে তাকালেন। গঙ্গায় এই পাটকরা গামছা থেকে পায়ের কাছে অজস্র কাঁকড়া পড়ে বিড় বিড় করছে।

জ্যাঠাইমা রান্নাঘরের দিকে আসতে আসতে বললেন—ঠাকুরঝি ছেলেটা একেবারে ঢ্যাঁড়শ। কোনো কম্মের নয়। এখন ঠাকুরপোকে কী দিয়ে ভাত দেব। তোমার ঠেলা তুমি সামলাও।

মালা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, জ্যাঠাইমার কথা শুনে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল—বাঃ, বেশ বলছ বটেক মাইমা! সব দোষ আমাদের বটেক। বাবা মরে গেছে বলে পেছল উঠোনে ছোটোছেলে পড়ে যাবে না। পড়ে গেলে ডিম ভাঙবে না। চলো মা, আমরা বেলেঘাটার লাবুদের বাড়ি চলে যাই বটেক।

—কোন চুলোয় যাবি? তোদের যাবার কোনো চুলো আছে। যেমন পেতনির মতো চেহারা, তেমনি ছোটোলোকের মতো মুখ। যা না, যা, তোদের সম্পত্তি—টম্পত্তি নিয়ে চলে যা। দেখি কে রাখে এই রাবণের গুষ্টিকে।

মালার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নিঃশব্দ ধারায় জল নেমে আসছে ভাঙাগাল বেয়ে। বাবা উঠে আসছেন ওপরে। লাল টকটকে গামছাটা পরছেন। কাঁধের ওপর গেরুয়া লুঙ্গি। যেন এক সন্ন্যাসী। হেমকুণ্ড থেকে উঠে এলেন। সামনেই মালা। স্পষ্ট চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ভিজে।

বাবা নরম গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন? এই তো সবে শুরু রে। তোর মাকে দেখে শেখ। সারাজীবন শুধু ধাক্কা খেয়ে গেল। তোরা জানিস না, আমি জানি। গরিবের মেয়ে, রূপ নেই, বিয়ে হল যার সঙ্গে—থাক আর বলে লাভ নেই। তুই না বড়োমেয়ে।

বাবার একটা হাত মালার মাথায়, আর এক হাতে ভিজে লুঙ্গি। শুকনো মেয়েটার চোখ মুছিয়ে দিলেন। জ্যাঠাইমা পেছন থেকে বললেন—কষ্ট তোমার বোনই শুধু করেছে। আমরা সব লাক্সারিতে ডুবে আছি, একচোখো কোথাকার।

—তুমি আর কষ্ট করলে কোথায় বউদি? তোমার কত অহংকার, রূপ, জমিদারি, বড়ো বড়ো আত্মীয়স্বজন।

—তাই নাকি?

চুলপাড় শাড়ির খানিকটা অংশ ফরফর করে কোমরের কাছ থেকে খুলে বাবার চোখের সামনে উর্বশীর মতো মেলে ধরলেন—এই তো কন্ট্রোলের গুন চট। পেটে একবেলাও ভালো করে জোটে না। নিজে তো খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যান। অন্যের খবর কিছু রাখেন আপনি!

রোদে ভিজে লুঙ্গিটা মেলে দিতে দিতে বললেন—মেজদার অসুখে ফতুর হয়ে গেছি, সামলাতে—না—সামলাতেই চাপের ওপর চাপ, তার আগে দু—বউ শেষ করে দিয়ে গেছে। ওই মোটা কাপড় আর রেশনের চাল জুটছে, এর জন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও।

—কী কেবল মেজদার অসুখ, মেজদার অসুখ দেখাও। ঘোড়ার ডিমের চিকিৎসা। বিনা পয়সায় হাতুড়ে ডাক্তার বিশু ঠাকুরপো। না একটা ভালো ডাক্তার, না ভালো ওষুধপথ্য, তাও তো সেসব প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায়। মেজদার অসুখ দেখাচ্ছেন উঠতে—বসতে। বাবা হাত দিয়ে টেনে টেনে লুঙ্গিটা নিখুঁত নিভাঁজ করে দিলেন। দরজার সামনে দু—ভাঁজ করে রাখা চটে পা মুছে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন—জানা রইল মরার আগে আর চাকরি ছাড়ার আগেই প্রভিডেন্ট ফান্ড পাওয়া যায়। আমার যতদূর মনে পড়ে অনেক লেখালেখি করে, যতীকে দিয়ে সাহেবকে ধরাধরি করে এই সেদিন মেজদার প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি পাওয়া গেছে। যা পাওয়া গেছে, সবই তোমার নামে পোস্ট অফিসে জমা করে দিয়েছি। মাঝে মাঝে তুলছ আর গবার তেলেভাজা খাচ্ছ। দুঃখু হয় ওই আর একটা দুর্ভাগার জন্যে। পড়া নেই, শোনা নেই, সকাল ন—টা প্রায় বাজল, এখনও পড়ে ঘুমোচ্ছে।

—ওর ভাবনা আর তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি যা ভাববে জানা আছে। তোমার কেবল গেল, গেল, মল মল।

বাবার কথা শুনে জ্যাঠাইমার হঠাৎ ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা প্রবল হয়ে উঠল। দু—হাত দিয়ে বাবুকে ঝাঁকাতে লাগলেন—এই বাবু ওঠ, ওঠ, ওঠ, ওঠ। কাল সন্ধে সাতটা থেকে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিস, সকাল ন—টা বাজল।

আমাদের বড়োঘরটাকে একটা হলঘরই বলা চলে। পূর্ব—পশ্চিমে লম্বা। পুবে কোনো জানালা নেই।

জানালা—ফোটাবার আইন নেই। আইনে আটকাবে। চার ফুট না—ছেড়েই, গায়ে গায়ে আর একটা বাড়ি। বাড়ি নয়, খানকতক বস্তিবাড়ি। সুন্দর পুবদিকটা মাঠেই মারা গেছে। সেই পুবদিকের দেওয়ালে একটা নোনা ধরা কুলুঙ্গি আছে। প্রত্যেক তলে কাগজ বিছিয়ে পরিপাটি করার চেষ্টা হয়েছিল। অনবরতই সে—দেওয়ালে ঝুরঝুর করে বালি ঝরছে। কান পাতলেই বালি ঝরার শব্দ, সেই কুলুঙ্গি কতই—বা পরিষ্কার থাকবে।

নীচের তাকে একটা ছোটো আয়না, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। কাচটা আড়াআড়ি ফেটে গেছে। হাতল—ওলা বুরুশে পুরুষদের একটা চিরুনি খাড়া করে গোঁজা। আরও সব নানা জিনিস, তিনটে তাকে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে। বাবা খুব দ্রুত ভিজে গামছাটা পরেই পুবের তাকটার দিকে গুমগুম করে এগিয়ে গেলেন। এইটাই অবশ্য তাঁর রোজের পদ্ধতি। ওখানে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার উপায় নেই। অন্ধকারের মতো জায়গা, কালো ছোপ—ধরা আয়না। আয়নাটা হাতে নিয়ে উত্তরের বারান্দায় পুবধারে বেরিয়ে এলেন। সেখানে ছ—টা ঘুলঘুলি দিয়ে রোদ ঢুকছে। টিনের চাল, গড়িয়ে বাগানের দিকে নেমে গেছে। গোটাকতক পেয়ারাডাল বারান্দায় নড়বড়ে কাঠের রেলিংয়ে খোঁচা মারছে। এইখানে দাঁড়িয়ে মাথাটা সামনে ঘুরিয়ে বাঁ—হাতে আয়না ধরে চুলে চিরুনি বুলোতে লাগলেন। ছিটকে ছিটকে জল পড়ছে আয়নার কাচে।

সকাল থেকে অফিস বেরোনো পর্যন্ত বাবার সমস্ত কিছু সুন্দর নিয়মে বাঁধা। শুতে যেমন দেরি হয়, উঠতেও তেমন একটু দেরি হয়ে যায়। যখনই দেখা যাবে জুতো বুরুশ করে, গোড়ালির ওপর খাড়া করে খটাস খটাস তখনই বুঝতে হবে মিনিটখানেকের মধ্যেই সদরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবেন গঙ্গার স্নানে।

যখনই দেখা যাবে পুবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একহাতে আয়না নিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন, তখনই ওই লম্বা ঘরে, উত্তরের জানালা ঘেঁষে খাবার আসন পাততে হবে। ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে এক গেলাস জল। যেখানে থালা থাকবে সেখানে একটু জল ছিটিয়ে হাত দিয়ে মেঝেটা মুছে দিতে হবে। খাবার যেমনই হোক, এইসব নিয়মের ব্যতিক্রম বর্বরতার শামিল।

চুল আঁচড়ানো হয়ে গেল, আসন কিন্তু পড়ল না আজ। ঘড়ি গোলমাল হয়ে গেছে। পিসিমা বাবার নির্দেশমতো কুয়োতলায় গদাইদার গায়ে বালতি বালতি জল ঢালছেন। জ্যাঠাইমার রাগ হয়েছে। বাবুকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলেই পড়তে বসিয়েছেন। মুখ ধোবারও অবসর দেননি। মাছের ইংরেজি কী? ফিশ মাছ আর দেখলি কোথায় বল, যে ইংরেজি বলবি। সে—মাছ দেখেছি আমরা। দক্ষিণের বড়ো পুকুরটায় বাবা রোজ সকালে জাল ফেলতেন—কালবোস, মৃগেল, রুই। মালা ছাদের সিঁড়ির ধাপে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো বৃদ্ধা বসে আছে।

বাবার কাপড় পরা হয়ে গেল। এইবার সিল্কটুইলের সাদা পুরো হাতা শার্ট পরবেন। তার ওপর বুক খোলা গ্যাবার্ডিনের কোট। হাতে থাকবে ছোটোমতো সাদা একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগে থাকবে এইসব জিনিস—চশমা, চাবি, খাবার পান। আর থাকবে কালো বেতের বাঁটের বারোমেসে ছাতা।

আমার যেমন মা নেই, বাবারও তো তেমন স্ত্রী নেই। কে দেখবে বাবাকে? বাবা সংসার থেকে যেটুকু পান, তার কোনোটাই ভালোবাসার পাওনা নয়। ভয়ের দান। ব্যাগ গুছিয়ে দেবার দায়িত্বটা আমার। আগে প্রায়ই ভুল হত। চশমা ঢুকল তো চাবি পড়ে রইল। শেষ মুহূর্তে টিফিনের মোড়কটা রান্নাঘর থেকে হয়তো এলই না।

ব্যাগে চশমা ঢুকিয়েছি। কালো খাপে শৌখিন সোনালি চশমা। একতাড়া ঝকঝকে চাবি। অফিসের আলমারির। চৌকো অ্যালুমিনিয়ামের পানের ডিবেটা আছে। সাজা পান নেই। খাবার নেই। শীতকাল নয়, মাফলার এমনিই বাতিল। ছাতাটা চেয়ারের পেছনে ঝুলছে। বাবা একদম রেডি। ঠাকুরদার ছবিতে প্রণাম করছেন। জুতোটা গাদা থেকে একটু আলাদা হয়ে ঝকঝকে একজোড়া কালো নিউকাট, প্রফুল্লবাবুর ঝকঝকে কালোগাড়ির মতো আরোহীর অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনছে।

জ্যাঠাইমা নিজের ঘরে ঠ্যাং তুলে শুয়ে হাতপাখা নেড়ে নেড়ে বাবুকে কাঁঠালের ইংরেজি শেখাচ্ছেন। বল জ্যাকফ্রুট। আমাদের জ্যাঠামশাইয়ের কাঁঠালবাগানের ভুঁই কাঁঠালের গাছ ছিল জানিস। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে দেওয়া হত আর রাতে আসত শেয়াল। শেয়াল আসত বলেই জ্যাঠাইমা খুঁক খুঁক করে হাসছেন। আমি ঘরে ঢুকে বললুম—বাবার তো সব হয়ে গেছে, বেরিয়ে যাচ্ছেন, খেতে দেবেন না।

হাসিটা থামল, পাখা নাড়াটা বন্ধ হল না। হাতপাখার হাওয়া খেতে খেতেই বললেন—খেতে দেবার অনেক লোক আছে, তাদের দিতে বল, প্রাণের লোক, মনের লোক, আপনার লোক।

জ্যাঠাইমা প্রায় গান গাইবার মতো সুর করে শেষের কথাগুলো বললেন—বাবু অবাক হয়ে মা—র মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মাছের ঠেলা সামলে সে এখন কাঁঠালবাগানের শেয়ালের ধাক্কায় পড়েছে।

উত্তর মহলে পিসিমার দিকে দৌড়োলুম। সারাদিনের মতো একটা মানুষ না—খেয়ে বেরিয়ে যাবেন। গদাই ভিজে জামা—প্যান্ট পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। পিসিমা মালাদির একটা ফ্রক হাতে নিয়ে ছেলেকে বোঝাচ্ছেন—এইটা এখন পর বাবা। আর তো জামা—প্যান্ট নেই। রোদে দিয়ে দিই, এখুনি শুকিয়ে যাবে।

—ও আমি পরবক নাই বটেক। গদাই ঘাড় বেঁকিয়ে গোঁ ধরেছে।

পিসিমা এবার খুব রেগে গেছেন—তবে ল্যাংটা হয়ে থাকগে যা বটেক!

পিসিমা করুণ মুখে আমার দিকে তাকাতেই বললুম—বাবা যে না—খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাবা ওদিকে সদরের সিঁড়ি থেকে বলছেন—কই বল, দুর্গা দুর্গা! পিসিমা আর আমি দু—জনেই দৌড়োলুম।

—ও ছোড়দা, না—খেয়ে যেয়ো না। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

—তুই কী ব্যবস্থা করবি শশী। ভগবান আজ মাপাননি। ভগবান না—দিলে মানুষ কী করবে বল?

—তা কি হয় ছোড়দা! তুমি খেয়ে যাও।

বাবা সিঁড়ির একটা ধাপ নেমে বললেন—বল দুর্গা, দুর্গা।

দুর্গা দুর্গা হল স্টার্ট দেবার মন্ত্র! ওটা কিছুতেই বলব না। বাবা আর একধাপ নেমে বললেন—বল দুর্গে, দুর্গতিনাশিনী। হঠাৎ শোনা গেল প্রভাতকাকার গলা। নীচে থেকে ওপরে উঠছেন। সকাল থেকে দেখিনি। প্রভাতকাকা উঠছেন আর বলছেন—ওরে, আমি বড্ড বিজি প্রফেশান্যাল ম্যান, বড্ড বিজি প্রফেশান্যাল ম্যান, স্যাংচু মারি খ্যাং খেলি, কী দিয়ে তুই ভাত খেলি। কী দিয়ে তুই ভাত খেলি।

একেবারে বাবার মুখোমুখি, বাবা নামছেন। কাকা উঠছেন। পিসিমা প্রবল আকুতি—মেশানো গলায় বলছেন—ও ছোড়দা খেয়ে যাও। প্রভাতকাকা বড়ো পইঠেতে সরে গিয়ে বাবাকে পথ করে দিতে যাচ্ছিলেন। যেই শুনলেন খেয়ে যাও, পথ জুড়ে দাঁড়ালেন। বাঘবন্দি। এইবার কী হয়! গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, ফর্সা লোটানো কাপড়। এক হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। দুটো হাত দু—দিকে বাড়িয়ে প্রভাতকাকা আদেশের সুরে বললেন—উঠুন ওপরে। ফিরে চলো, ফিরে চলো আপন ঘরে।

—আমার কতকগুলো নিয়ম আছে প্রভাত। বেরোনোর জন্যে, দুর্গা—দুর্গা বলে একবার সামনে মুখ করলে আমি তো আর পেছনে ফিরে তাকাতে পারি না। সোজা আমাকে নেমে যেতে হবে। তারপর রাস্তায় প্রথমেই আমাকে ডান পা ফেলে বেরোতে হবে।

—দেখুন তো ছোড়দা, এখন আপনার কোন নাকে শ্বাস প্রবল।

—দক্ষিণ নাসিকায়।

—তবে! ভোজ্য, স্নানে ব্যবহারে ত্রূ«রে দীপ্তে রবিঃ শুভঃ ভোজন স্নান এবং শত্রুর সহিত যুদ্ধাদি, শত্রুর অনিষ্ট সাধনাদি যতরকম ত্রূ«র কর্ম আছে তাহা দক্ষিণ নাসিকায় শ্বাসপ্রবাহকালে অনুষ্ঠিত হইলে সুসিদ্ধ হয়। শাস্ত্রই এ—কথা বলেছে ছোড়দা। অতএব এখন আপনার ভোজনের সময়। চলুন, উঠুন।

—আমি পেছনে ফিরতে পারব না প্রভাত।

—ফিরতে হবে না আপনাকে। নিন, পেছনে উঠুন।

প্রভাতকাকা সামনের দিক থেকে বাবার দুটো হাতের ওপরদিকটা ধরে, সাবধানে তিনটে সিঁড়ি তুলে দিলেন। তুলে দিয়ে বললেন—নিন জুতো খুলুন। কোটটা খুলুন। ছাতা আর ঝোলাটা রাখুন। জামার হাতা গোটান। খেতে বসুন, ছোড়দি!

—এই যে প্রভাত।

—ঠাঁই করুন।

বাবা ছাতাটা চেয়ারে ঝুলিয়ে বললেন—খুব মুশকিলে ফেললে প্রভাত। দেরি হয়ে যাবে!

—মানুষ দুটো খাবার জন্যে খুন করছে, মা ছেলে বিক্রি করছে, আপনার একটু দেরি হবে ছোড়দা, হোক না, কত আর দেরি হবে দশ মিনিট, পনেরো মিনিট। আমি সাইকেলের পেছনে বসিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসব। লেট মেকআপ হয়ে যাবে।

—মাপ কর প্রভাত। সাইকেলের পেছনে আমি যেতে পারব না। উলটে পড়ে যাব।

কথা বলতে বলতে জুতো খুলে ফেললেন। প্রভাতকাকা ঝটপট করতে করতে ঘরে ঢুকলেন। পিসিমা ফিসফিস করে বললেন, ও প্রভাত! শুধু তো ভাত আর ডাল হয়েছে। আর তো কিছু হয়নি। কী দিয়ে ভাত দেব!

—বাঃ, সারা সকালে দু—জনে মিলে এই করেছ। ওরে আমার নন্দরানি।

প্রভাতকাকা পিসিমার নাকটা নেড়ে দিলেন! —ওই দিয়েই বসিয়ে দিন। আমি রাজেনের দোকান থেকে ঝপ করে একটা মামলেট মেরে আনি। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে পেছল উঠোন পেরিয়ে প্রভাতকাকা ছুটলেন রাজেনের দোকানে।

বাবা খেতে বসেছেন। গণ্ডূষ হয়ে গেল। পাতের পাশে মেঝেতে ভাগে ভাগে ভাত সাজালেন, তার ওপর জল ঢাললেন থালার চারপাশে জলের বেড় পড়ল। আচমন হল। ভাত ভেঙে ডাল ঢালতেই মুখের চেহারা পালটে গেল। থালায় যে—জিনিসটা রয়েছে তাকে ভাত না—বলাই ভালো। সঙ্ঘবদ্ধ অন্ন। আঠা—আঠা দলাপাকানো একটা তাল। কিছু তিল ছড়ালেই পিণ্ডি। ডাল ঢেলেছেন, যেন শিবের মাথায় হলুদ জল। পাশ কাটিয়ে পালাতে চাইছে। এদিক—ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—এটা কী!

পিসিমা বললেন—রেশানে এবার ওই দিয়েছে ছোড়দা।

প্রভাতকাকা ডিশে করে মামলেটটা থালার পাশে রাখতে রাখতে বললেন—মিলিটারি চাল। গরমজলে শুধু ভেজালেই ভাত। কতক্ষণ ফুটিয়েছেন ছোড়দি?

ছোড়দি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। কেরামতিটা জ্যাঠাইমার। এদিকে বাবা যতবার গ্রাস তুলতে চান চটচটে ভাতের ডেলা থালাটাকে মেঝে থেকে দু—তিন ইঞ্চি ওপরে উঠিয়ে একসময় ধপাস করে ফেলে দিচ্ছে। পাতের পাশে, ভাত ঘিরে, ডালের মারাঠা ডিচ থেকে, ডালের জল ছিটকে ছিটকে বাবার গেঞ্জিতে, হাঁটুর ওপরের কাপড়ে লাগছে। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে জামাটা খুলে ফেলেছিলেন। বাবা বললেন, এঃ, আবার চান করতে হবে প্রভাত।

প্রভাতকাকা বললেন—ছোড়দা এ ভাত লোহার থালা থেকে খাওয়া উচিত। দাঁড়ান, থালাটার ওয়েট বাড়িয়ে দিই। কাঠের আলমারির তলায় কিছু লোহার বাটখারা ছিল। সবচেয়ে ওজনদার যেটা সেটা হাতে নিয়ে প্রভাতকাকা এগিয়ে এলেন। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—ওটা কী হবে প্রভাত?

—এটা থালা—ওয়েট। থালার মাঝখানে এটাকে বসিয়ে দেখুন তো কী হয়!

বাবা হাসলেন—তোমার ব্রেন আছে প্রভাত। তবে আমি প্রায় মেরে এনেছি।

প্রভাতকাকা বললেন—বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য নির্বুদ্ধেস্ত কুতঃ বলং।

—ডিমভাজাটা তুমি কোত্থেকে পেলে। ডিমটা তো গদাইয়ের প্যান্টের পকেটে ছিল।

আপনাকে ভাবতে হবে না। দেওয়া হয়েছে খেয়ে নেবেন।

—দেওয়া হয়েছে মানে। তুমি কি হাঁস যে ইচ্ছে করলেই ডিম দেবে। আমার একটা হিসেব আছে, বাজেট আছে।

—আমি রাজহংস পরমহংস। ওসব বাজেট, হিসেব ঘোর সংসারী জিনিস—

—তুমি কে?

—আমি কে জানতে হবে। এখন ঈশ্বর আপনাকে যা মাপিয়েছেন তাই খেয়ে উঠে পড়ুন।

দ্বিতীয় যাত্রার জন্যে বাবা সিঁড়ির মুখে প্রস্তুত। পনেরো মিনিট লেট। প্রভাতকাকা জিজ্ঞেস করলেন, কোন নাকে পড়ছে। সেই দক্ষিণ—নাসায়।

প্রভাতকাকা বললেন—বামাচারে প্রবহেন না গচ্ছেৎ পূর্ব—উত্তরে, দক্ষিণাড়ী প্রবাহ তু না গচ্ছেৎ যাম্য পশ্চিমে। বাম নাসিকায় শ্বাসপ্রবাহের সময় পূর্ব—উত্তরে যাত্রা করিবে না। দক্ষিণ—নাসায় শ্বাসবহনকালে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে যাত্রা করিবে না। আপনি যাবেন পুবে। ঠিক আছে, দুর্গা দুর্গা।

আমরা কোরাসে বললুম—দুর্গা, দুর্গা সিদ্ধিদাতা গণেশ, দুর্গে, দুর্গতনাশিনী।

দিদির ফ্রক পরে গদাইদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে—চলে গেছেন বটেক।

—হ্যাঁ চলে গেছেন।

গদাইদা মুখটা করুণ করে জিজ্ঞাসা করল—তোমার খিদে পায় নাই বটেক?

উত্তর দিতে হল না। প্রভাতকাকা গদাইয়ের বেশ দেখে হি—হি করে হেসে বললেন, গদাইয়ের স্ত্রীলিঙ্গ কী হবে? জানিস না তো? নদ, নদী, গদাই—গদী। তোর প্যান্ট—জামা নেই?

—একটা ছিল, কেচে দেওয়া হয়েছে মামা।

প্রভাতকাকা ঝট করে নিজের পইতেটা খুলে ফেললেন, আয় এদিকে। এগিয়ে আয় এদিকে।

দর্জি যেভাবে ফিতে ধরে মাপ নেবার জন্যে প্রভাতকাকা সেইভাবে মেঝেতে একহাতে পইতেটা ঝুলিয়ে বসলেন।

—আয় এদিকে আয়, গদা, গদাই, গদী। গদাইদা দূরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। শেষে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল।

—তোল, তোল তোর ফ্রকটা। প্যান্টের মাপ নেব। তুই কী করে মেয়েদের ফ্রক পরলি? তুই না পুরুষ মানুষ। প্রভাতকাকা গদাইকে বকছেন আর মাপ নিচ্ছেন। প্রথমে কোমর। তারপর ঝুল। ঝুলের মাপ নেবার সময় হাঁটুটা কোথায় দেখার জন্যে ফ্রকটা ফস করে ওপরদিকে ওঠাতে যাচ্ছিলেন, গদাইদা সামনের দিকে বাঁশপাতার মতো নুয়ে পড়ে ফ্রকটার সামনেটা দু—হাতে চেপে ধরে আহত মানুষের মতো আর্তনাদ করে উঠল—

—ও প্রভাতমামা, না না না।

প্রভাতকাকা চমকে উঠে বললেন—কী হল রে। ঘা—টা আছে নাকি, দাদ, কাউর?

—না মামা, তলায় আমার কিচ্ছু পরা নেই বটেক।

—ইয়া আল্লা। তোবা তোবা। প্রভাতকাকা পেছনদিকে উলটে, মেঝেতে কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়লেন। ফুলে ফুলে হাসছেন। বহু রকমের হাসি খ্যা, খ্যা, হি, হি, হি, হো, হো। হঠাৎ হাসি থেমে গেল। আলো জ্বালা আর নেভার মতো। উঠে বসলেন। অসম্ভব গম্ভীর মুখ চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। উঠে দাঁড়ালেন। চোখের কোণে জলের বিন্দুটা মুক্তোর দানার মতো বড়ো হচ্ছে।

আমি অবাক, গদাই অবাক। কী হল হঠাৎ। এই তো হাসছিলেন। গদাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল প্রভাতমামা? প্রভাতকাকা সাদা আদ্দির পাঞ্জাবিটা পরতে পরতে বললেন, সে তুই বুঝবি না গদাই। পৃথিবীটা বড়ো বিচিত্র জায়গা রে। আমার পোশাকটা দেখেছিস, একে বলে রাজবেশ। তোরটা দেখেছিস, তোর মা—র কাপড়টা দেখেছিস, তোর দিদির জামাটা দেখেছিস।

আমরা সকলেই সকলের দিতে তাকিয়ে দেখলাম। একই পরিবারে এক—একজনের এক—এক অবস্থা। জ্যাঠাইমা পাখা হাতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এদিকে—ওদিকে তাকিয়ে বললেন, বেরিয়ে গেছে। পড়ে—থাকা এঁটো থালাটার দিকে তাকিয়ে একটু সুরেলা গলায় বললেন, সেই তো মান খসালি লোককে কেন হাসালি।

প্রভাতকাকা জুতো পরতে পরতে বললেন,—উফ, মেয়েছেলে কী চিজ রে বাবা!

জ্যাঠাইমা হাসি হাসি মুখে বললেন, বিয়ে না—করেই বুঝে গেছ দেখছি।

প্রভাতকাকা একধাপ সিঁড়ি নেমেছেন, জ্যাঠাইমা বললেন—ছোড়দা ছোড়দা করে খুব তো আদিখ্যেতা করলে প্রভাত ঠাকুরপো, এখন আমাদের গেলার কী ব্যবস্থা হবে? প্রভাতকাকা থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন—চালাও ফুলুরি ঝাল দিয়ে ভাত।

—মন্দ বলোনি। বেশ ঝাল—ঝাল ভালোই জমবে। তবে এত বেলায় গবার ফুলুরি কি পাবে!

জ্যাঠাইমা সব জানেন। গবা কখন কী ভাজে, কখন কী ফুরোয়। সকাল আটটার মধ্যে ফুলুরি শেষ, ন—টার মধ্যে ডালবড়া, এই ন—টা—সাড়ে ন—টার সময় পড়ে আছে চপ আর বেগুনি কিংবা পটুলি। পলতার বড়া গোটাকতক থাকতে পারে। বাবা কী সাধে বলেন গবার বাড়িটা হয়েছে জ্যাঠাইমার জন্যে। এইবার দোতলা হবে, তিনতলা হবে। জ্যাঠামশাইয়ের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তোলো আর খাও।

জ্যাঠাইমার কথায় কান না—দিয়ে প্রভাতকাকা বললেন—গদাই গুনে ফেল তো আমরা ক—জন। গদাই গুনে—গেঁথে বললে, আটজন মামা। ঠিক করে গোন, আটের বেশি। আমি ঠিক গুনেছি বটেক। না বটেক, এই দেখ, গোন ভালো করে, আমি প্রভাত, তুই গদাই, ছোড়দি, শশী, বউদি নন্দিনী ক—জন হল এইখানেই তো আটজন হয়ে গেল, আরও আটজন হবে। মোট ষোলো জন। গদাইদা একটু ভেবে বললে—হ্যাঁ চালাকি বটেক। একই নাম আপনি দুটো করে দিচ্ছেন। আমি আর প্রভাত এক লোক বটেক?

—তুই আর প্রভাত এক লোক বটেক! এ কি তোর গ্রামদেশ পেয়েছিস?

বাবা আর তোর কাকা এক হয়ে, কাকার বিষয়টা মেরে দিল।

—তুই না, তুই না, আমি আর প্রভাত এক বটেক।

—আবার আমি আর প্রভাত এক বলছিস! আমি আমি। প্রভাত প্রভাত। তুই আর আমি এক হব কী করে। আমার মতো তোর দাঁত আছে? তোর ট্যাঁকে ক—পয়সা আছে, বের কর দেখি।

গদাই ঘাবড়ে গেল। ট্যাঁকই নেই তো ট্যাঁকে পয়সা। গদাই অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল। প্রভাতকাকা পাঞ্জাবির ভেতর পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করলেন, এই দেখ। নোট দ্যাখ আর দাঁত দ্যাখ।

সামনের দুটো বড়ো দাঁত বের করে নোটের গোছাটা চোখের সামনে নাচাতে নাচাতে বললেন—তবু বলবি আমি আর প্রভাত এক? গদাইদা হার স্বীকার করে বললে—আমি আর প্রভাত, এক না বটেক।

—তাই বল। প্রভাতকাকা নোটের গোছা থেকে কিছু নোট নিজের পকেটে রেখে পিসিমাকে ডাকলেন, ছোড়দি, এদিকে আসুন। পিসিমা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলেন। বাকি নোটগুলো এগিয়ে দিয়ে প্রভাতকাকা বললেন—আপনার কাছে রাখুন। একটাও যেন না—হারায়। হারালেই পুলিশে দোব। পিসিমা নোটগুলো হাতে ধরেছেন। বেশ দেখতে পাচ্ছি হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। মুখটা ভয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। পিসিমা বললেন—ও প্রভাত, এতগুলো কোথায় রাখব? আমার যে কিচ্ছু নেই।

কিছু নেই বলেই তো কিছু এসেছে। সব হারালেই তো সব পাওয়া যায়। প্রথমে টাকা ধরতে শিখুন, তারপর শিখবেন ওড়াতে। নিন গুনুন তো, ক—টাকা আছে।

—প্রভাত, এগুলো সব বড়ো নোট।

—হ্যাঁ, বড়ো বটে, কিন্তু কত বড়ো।

—মুখ্যু মানুষ প্রভাত। অত বুঝি না।

জ্যাঠাইমা পাশে দাঁড়িয়ে বললেন—নোট চেন না কি হা—ঘরে মেয়েমানুষ? ওগুলো সব দশ টাকার নোট। এত টাকা কোত্থেকে পেলে প্রভাত ঠাকুরপো?

—ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে। আজ আমি মদ খাব, মাংস খাব। ওরে আমি মদ খাব, মাংস খাব।

পিসিমা ভয়ে ভয়ে বললেন—না প্রভাত, সব খাও, ওই মদটি খেয়ো না প্রভাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *