মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার
পেরিক্লিসীয় এথেস্, রিনেসাঁসের ইটালি ও অষ্টাদশ শতকের ফরাসিদেশ এই সভ্যতাত্রয়ের যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়–মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব। এই দুই বৈশিষ্ট্য যে সবসময় আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে তা নয়, প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। যুক্তিবিচারদৃঢ় মূল্যবোধ ও মূল্যবোধস্নিগ্ধ যুক্তিবিচার প্রতি সভ্যতায়ই এই দুই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
এখানে প্রশ্ন হবে : মূল্যবোধ কাকে বলে, আর যুক্তিবিচার জিনিসটাই বা কী?–নিকটবর্তী স্কুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সূক্ষ্ম সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা–এসবই মূল্যবোধের লক্ষণ; আর এ সকলের অভাবই মূল্যবোধের অভাব। যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব বলতে বোঝায় জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা। যুক্তিবিচার সকলের ভেতরেই কিছু-না-কিছু থাকে, কিন্তু এই সাধারণভাবে থাকা নয়, বিশেষ ও ব্যাপকভাবে থাকার কথাই বলা হচ্ছে। এ যেন যুক্তিবিচারের পূজা, অর্থাৎ তার আদেশ পালন, কার্যসিদ্ধির জন্য তার নামমাত্র ব্যবহার নয়। নিরঞ্জন শুভবুদ্ধিই যুক্তিবিচার স্বার্থের দাগ লাগা বুদ্ধিকে যুক্তিবিচারের সম্মান দেওয়া যায় না। তখন সে আর প্রভু নয়, গোলাম–আমাদের স্বার্থের মোট বয়ে বেড়ানো তার কাজ। সচরাচর আমরা যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে থাকি সে এই স্বার্থের মোটবওয়া গোলামবুদ্ধি, মুক্ত নিরঞ্জন প্রভুবুদ্ধি নয়।
বুদ্ধি কী করে স্বার্থকলঙ্কিত হয়ে তার নিরঞ্জনত্ব হারিয়ে বসে, যত্রতত্রই তার নজির পাওয়া যায়–সেজন্য বিশেষ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না। তথাপি একটা দৃষ্টান্ত দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছিনে। সেদিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ধর্ম, রাজনীতি, হিন্দু মুসলমান সমস্যা ইত্যাদি আলোচনা করছিলুম। কথায় কথায় একজন বলে উঠলেন : আরে ছেঃ! হিন্দু মুসলমানের মিলনের কথা আর তুলো না, তা কখনো সম্ভব হতে পারে না। যারা আমাদের এতটা অবজ্ঞা করে যে, আমাদের নামগুলো পর্যন্ত শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে কি লিখতে পারে না, তাদের সঙ্গে মিল হতে পারে কী করে? অথচ দেখ না, আমরা কত সহজে তাদের নামগুলি, শুধু তাই নয়, তাদের দেবতাদের নামগুলি পর্যন্ত, লিখে যেতে পারি–কোথাও একটুকুবানান ভুল না করে–উপস্থিত সকলেই কথাটায় সায় দিলেন, আমিও বাদ রইলুম না। কিন্তু নির্জনে চিন্তা করতে গিয়ে যখন নিরঞ্জন শুভ্রবুদ্ধির আলোক লাভ করলুম তখন বুঝতে পারলুম ভুল হয়ে গেছে, না-ভেবেচিন্তে তখন কথাটায় সায় দেওয়া ঠিক হয়নি। মুসলমান যে হিন্দুর নামগুলো যথাযথ বানান ও উচ্চারণ করতে পারে, সে মুসলমানের গুণ নয়; কেননা বাংলা মুসলমানের মাতৃভাষা, আর হিন্দুর নামকরণ সে ভাষাতেই হয়ে থাকে, আর হিন্দু-যে মুসলমানের নামগুলো বিশুদ্ধভাবে বানান ও উচ্চারণ করতে পারে না, সে হিন্দুর দোষ নয়–কেননা মুসলমানের নামকরণ সাধারণত যে-দুটি ভাষায় হয়ে থাকে, সেই আরবি ও ফারসি ভাষা হিন্দুর মাতৃভাষা নয়। (হিদুর কথা না হয় থাক, শতকরা কজন মুসলমান মুসলমানের নামগুলি–সেসবের মধ্যে নিজেদেরগুলোও অন্তর্ভুক্ত–ঠিকমতো বানান ও উচ্চারণ করতে পারে, তা ভেবে দেখবার বিষয়। অবশ্য ইচ্ছাকৃত ত্রুটি যে নেই তা নয়, কিন্তু বেশিরভাগই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি।
পরদিন কথাটা বন্ধুদের বললুম, কিন্তু তাদের অপ্রসন্নতাব্যঞ্জক মুখভঙ্গি দেখে ও সম্বন্ধে অধিক আলাপ করা আর সঙ্গত মনে হল না। সত্যের জন্য যাদের উমুখতা নেই, তাদের সত্য জানানোর চেষ্টা বিড়ম্বনা মাত্র। তর্ক করে লাভ নেই, তাতে খাকা মন বিগড়ে যায় এবং শেষপর্যন্ত সত্যকে পাওয়ার আগ্রহ তলিয়ে গিয়ে জয়ের ইচ্ছাই বড় হয়ে ওঠে। এরূপ ক্ষেত্রে বুদ্ধির জগৎ ছেড়ে প্রাণের জগতে নেমে আসা স্বাস্থ্যকর। আমিও তাই করলুম। তর্ক ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা শুরু করলুম।
যাক, যা বলছিলাম। সঙ্কীর্ণবুদ্ধি তথা যুক্তিতর্ক নয়, উদারবুদ্ধি তথা যুক্তিবিচার সভ্যতা, আর তার অভাবই বর্বরতা। তাই বুদ্ধিকে নিজের কাজে না লাগিয়ে নিজেকে বুদ্ধির কাজে লাগানো দরকার। নইলে বুদ্ধির শুভ্রতা নষ্ট হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও অবনতি ঘটে। প্রয়োগভেদে বুদ্ধির মূল্যভেদ হয়ে থাকে। একই বুদ্ধি সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তির সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করে মনীষার উচ্চস্তরে উন্নীত হয়, আবার মদ মাৎসর্য, লোভ ইত্যাদি অসুন্দর বৃত্তির সংস্পর্শে এসে চালাকির নিম্নস্তরে নেমে আসে। রবীন্দ্রনাথ যদি তার বুদ্ধিকে সাহিত্য, শিল্প ও বিশ্বচিন্তায় না লাগিয়ে ব্যারিস্টারি কাজে লাগাতেন তো তাঁর বুদ্ধির উন্নয়ন না হয়ে অবনতিই ঘটত এবং তিনিও মনীষার মর্যাদা না পেয়ে একজন সুচতুর আইনজীবীর সম্মান লাভ করতেন। তাহলে বলতে পারা যায়, মানুষের মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে বুদ্ধির প্রাচুর্য নয়, উৎকর্ষই গণনার বিষয়। কার কী পরিমাণ বুদ্ধি আছে, তা দেখে লাভ নেই কে কতখানি বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন করেছে, তাই দেখার বিষয়। বুদ্ধির অপ্রতুলতা কি প্রাচুর্যের জন্য মানুষের নিন্দা কি প্রশংসা করা ঠিক নয়। কেননা তা প্রকৃতির দান, আর প্রকৃতির খেয়ালের ওপর কারো হাত নেই। আমরা ইচ্ছা করলেই বুদ্ধির পরিমাণ বাড়াতে পারিনে, কিন্তু উৎকর্ষ বাড়াতে পারি। শিক্ষার কাজই হচ্ছে বুদ্ধির উৎকর্ষবৃদ্ধি, পরিমাণবৃদ্ধি নয়।
বুদ্ধিজীবীরা-যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের মতো মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা পান না তার হেতুও এখানে। বুদ্ধির প্রাচুর্যের দিক দিয়ে তারা যে কারো চেয়ে কম যান তা নয়-হয়তো অনেক ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিকদের বহু পশ্চাতেও ফেলে যান কিন্তু সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেমের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করে চলেন না বলে উৎকর্ষের দিক দিয়ে তারা অনেক পেছনে পড়ে থাকেন। তাই প্রচুর বুদ্ধির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মনীষা আখ্যা তাদের ভাগ্যে জোটে না। কেননা, সংস্কৃত সুন্দর বুদ্ধিই মনীষা, অসংস্কৃত অসুন্দর বুদ্ধি মনীষা নয়–চাতুর্য। উভয়ে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। একটি নোংরামিমুক্ত, নির্মল আত্মার সরোবরে ডুব দিয়ে যেন সুন্দর হয়ে উঠেছে; আরেকটা নোংরা, কুশ্রী ন্যক্কারজনকতার দরুন তার দিকে তাকানোই যায় না। অসংস্কৃত, অসুন্দর বুদ্ধিকে সংস্কৃত ও সুন্দর করে তোলা শিক্ষার একটি বড় উদ্দেশ্য। না, ভুল বলেছি, শিক্ষার মানেই তাই। বিবিধ জ্ঞানানুশীলন সত্ত্বেও বুদ্ধির সংস্কার না হলে শিক্ষা সার্থক হয়েছে বলা যায় না। বুদ্ধির সংস্কার মানে মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতনতা; আর সৌন্দর্য, আনন্দ, প্রেম প্রভৃতির সুকুমারবৃত্তির সংস্পর্শে এসেই মূল্যবোধের উষেষ হয়।
মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব সামাজিক নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। নিরাপত্তার অভাবহেতু অসভ্যদের ভেবেচিন্তে চলার সময় নেই। পরিবার ও আত্মরক্ষার জন্য সকল সময়ই তাদের সহজপ্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। সহজপ্রবৃত্তি যা আদেশ করে, তাই তারা নিরুপায়ের মতো যো হুকুম বলে তামিল করে-সহজপ্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে যে মন তার কোনো খবরই রাখে না। তাই প্রয়োজনের কারাগারে তারা আবদ্ধ–অপ্রয়োজনের মুক্ত প্রান্তরে বিচরণ করতে অক্ষম। একটি সুন্দর সনেট যে একটি সুস্বাদু ভাজা ডিমের চেয়ে মূল্যবান, এ ধারণা অসভ্যদের নেই। শুধু অসভ্যদের কথাই বা বলি কেন, নিম্নস্তরের সভ্যদের মধ্যেও এ ধারণার অভাব। যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে সুকুমারবিদ্যা শ্রেষ্ঠ–অন্নবস্ত্রের চিন্তায় অস্থির মানুষকে এ-কথা বুঝাতে যাওয়া বাতুলতা। প্রয়োজনের নিগড়েই যাকে সারাক্ষণ আবদ্ধ থাকতে হয়, প্রয়োজনাতিরিক্তের প্রতি নজর দেওয়ার তার সময় কোথায়? কাজ নিয়েই তার সময় কাটে, লীলারস সম্ভোগের অবসর জোটে না। তাই সভ্যতাসম্মত মনোবৃত্তির পরিচয় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সভ্যতার জন্য অবসরের প্রয়োজন প্রশ্নাতীত, আর নিরাপত্তা অবসরের লালয়িত্রী। যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে মূল্যবোধ ও বিচারশীলতা নেই, আর মূল্যবোধ ও বিচারশীলতার অভাব মানে–সুসভ্যতার অভাব।
নিরাপত্তা সভ্যতার সহায়। কিন্তু তাই বলে নিরাপত্তা অথবা তার উপায়কে সভ্যতা বলা যায় না। এই যে আমি নিশ্চিন্ত মনে বসে বসে রচনা লিখছি, এর পেছনে রয়েছে পুলিশের অস্তিত্ব। পুলিশ না থাকলে তা কখনো সম্ভব হত না–নিয়ত আমাকে পরিবার ও আত্মরক্ষার্থে ব্যস্ত থাকতে হত। কিন্তু তাই বলে পুলিশ সভ্যতা নয়, সভ্যতার রক্ষক মাত্র। গোলাপের সঙ্গে কাটার যে-সম্বন্ধ সভ্যতার সঙ্গেও পুলিশের সেই সম্বন্ধ–উভয়ই আত্মরক্ষার উপায়, আত্মবিকাশের উপায় নয়। তবু সঙ্গিন কন্দুক, কামান বারুদকে অনেকে সভ্যতা বলে ভুল করে।
প্রকৃতিবিজয়ের ফলে যা আসে তা সভ্যতা নয়, আত্মমার্জিতির ফলে যা পাওয়া যায়, তাই সভ্যতা। প্রকৃতিবিজয়ের মত্ততাহেতু মানুষ আত্মমার্জনার কথা একরকম ভুলেই যাচ্ছে। তাই মনে হয়, প্রকৃতিবিজয় মানুষের জীবনে আশীর্বাদের মতো না এসে মহা অভিশাপের মতোই আবির্ভূত হয়েছে। বিজিতের চরণে সেলাম ঠুকে বিজেতা অসহায়ের মতো দাসখত দিতে দ্বিধা করেনি। ফলে মূল্যবোধ তিরোহিত হল, বিচারবুদ্ধি স্বার্থসিদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো বড় কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পেল না। অতএব বলতে ইচ্ছে হয়, প্রকৃতিবিজয় না হলেই যেন ভালো হত; কেননা, তাহলে বিজিগীষু মানুষ স্থূল বস্তুজগতের পরিবর্তে অন্যকোনো সূক্ষ্মজগৎ জয় করবার প্রেরণা লাভ করত এবং ধ্যান-কল্পনার পূজা করে ইতরতামুক্ত হতে পারত।
মনে রাখা দরকার, যা দিয়ে বাঁচা যায় তা সভ্যতা নয়; যার জন্য বাঁচা হয়, তা-ই সভ্যতা। তাই ভাত-কাপড়ের যোগাড়কে সভ্যতা না বলে সৌন্দর্য ও আনন্দের আয়োজনকেই সভ্যতা বলা সঙ্গত। মূল্যবোধের অভাবে মানুষ একথা উপলব্দি করতে পারছে না বলে ক্রমবিকাশ ব্যাহত হচ্ছে মানুষ যে তিমিরে তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। উপায়কে উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করার এই শাস্তি। এই শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন থাকা দরকার। মূল্যবোধের সচেতনতা মানে সৌন্দর্য ও আনন্দ সম্বন্ধে সচেতনতা।
কিন্তু আনন্দ আজ অবজ্ঞাত, আরাম তার স্থান দখল করে বসেছে। আরামের আয়োজনকেই আনন্দের আয়োজন মনে করে লোকে ভুল করছে। ও দুব-যে এক চিজ নয়, সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, সে সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে না পারলে সমূহ ক্ষতি। আনন্দ মানসিক ব্যাপার, আরাম শারীরিক। আরামের জয়ে শরীরেরই জয় হচ্ছে; মন বেচারি কোণঠাসা হয়ে কোনোপ্রকারে দিনগুজরান করছে মাত্র। তার দিন ফিরিয়ে আনতে না পারলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, সংগ্রাম আরামের জন্যই হয়ে থাকে, আনন্দের জন্য হয় না। আনন্দ একান্তভাবে বস্তুনির্ভর নয়, আরাম একান্তভাবে বস্তুনির্ভর। আর বন্ধুর জন্যই যুদ্ধ। তাই পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হলে আরামের চেয়ে আনন্দ তথা শরীরের চেয়ে মনকে বড় করে তোলা দরকার। নইলে যুদ্ধবিরতির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দৃষ্টিভঙ্গিই ইটানিষ্টের মূল। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তথা মূল্যবোধের প্রতি দৃষ্টি না রেখে সমাজপরিবর্তনের চেষ্টা করলে আশাপ্রদ ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মূল্যবোধ লক্ষ্য, সমাজপরিবর্তন উপলক্ষ, এ কথাটা ভালো করে মনে রাখা চাই। নইলে সমাজপরিবর্তন আমাদের বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে না। শেষপর্যন্ত রাজতোরণে এসেও রাজার দেখা না পেয়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে। যারা বলেন, সমাজপরিবর্তন হলে মূল্যবোধ আপনাআপনি সৃষ্টি হবে, সেজন্য পূর্ব থেকে সচেতনতা বা প্রয়াসের প্রয়োজন নেই, তাদের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারিনে এইজন্য যে, মনুষ্যত্বকে তারা যতটা সস্তা মনে করেন আসলে তা ততটা সস্তা তথা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। সেজন্য সদাজাগৃতির প্রয়োজন; আর মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য ও আনন্দ সম্বন্ধে সচেতনতা সদাজাগৃতির লক্ষণ। মনুষ্যত্বকে যারা সমাজপরিবর্তনের by product মনে করেন, তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারলুম না বলে দুঃখিত।
মূল্যবোধের অভাবের দরুন আমরা আসলকে নকল, কলকে আসল, লক্ষ্যকে উপায়, উপায়কে লক্ষ্য মনে করছি। তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে। কোন জিনিসের উপর কোন জিনিস স্থাপিত হওয়া দরকার, কোটা জীবনের পাদপীঠ, কোষ্টা শিরোপা, তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলে জীবনকে শিল্পের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অন্নবস্ত্রের আয়োজন আনন্দ উপভোগের উপায় না হয়ে আনন্দ উপভোগই অন্নবস্ত্র উপার্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকেরা যখন সৌন্দর্য ও আনন্দের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে তখন বিজ্ঞের মতো বলে থাকে : আরে একটু আনন্দ উপভোগ না করলে কর্ম-উদ্যম বজায় থাকবে কী করে? আর কর্ম-উদ্যম বজায় না থাকলে আমরা জগতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কোন উপায়ে?–যেন কর্ম-উদ্যম বজায় রাখবার জন্যই আনন্দের প্রয়োজন, তার নিজস্ব কোনো সার্থকতা নেই। উপায়কে লক্ষ্য আর লক্ষ্যকে উপায় করে দেখার এ চমৎকার নিদর্শন। বিজ্ঞজনরা আনন্দ কথাটা ব্যবহার করে বটে, কিন্তু আসলে তারা যা বুঝাতে চায় তা হচ্ছে ফুর্তি। জীবনের গভীরতার সঙ্গে পরিচয় নেই বলে আনন্দ কী বস্তু তা তারা ধারণা করতেই পারে না। পারলে তাকে উপায় না করে লক্ষ্যই করত।
বহির্জীবনের চেয়ে অন্তরজীবন বড়এই মূল্যবোধের শিক্ষা। তাই বাইরের জন্য ভেতরকে, স্কুলের জন্য সূক্ষ্মকে বলি দেওয়া মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের মনঃপূত নয়। সুকুমারবৃত্তির বিকাশেই জীবনের চরিতার্থতা, স্থূল ভোগে নয়–এই বিশ্বাস আছে বলে সূক্ষ্ম উপভোগের দিকেই তার ঝোঁক। প্রয়োজনের দাবির চেয়ে অপ্রয়োজনের দাবিই তার কাছে বড়। কিন্তু তাই বলে। প্রয়োজনের দাবিও সে অস্বীকার করে না। দেহের জন্য আত্মা বিক্রয় যেমন তার কাছে মহাঅপরাধ তেমনি প্রয়োজনবোধে জীবনধারণের জন্য আত্মা বিক্রয় না-করাও মহাপাতক। বেঁচে থাকার দাবিই তার কাছে সর্বাগ্রগণ্য। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। জীবনধারণের জন্য আত্ম বিক্রয় সমর্থন করলেও সাংসারিক উন্নতির জন্য আত্ম বিক্রয় সে কোনোদিন সমর্থন করে না। সে জানে সংস্কৃতির যদি কোনো শত্রু থাকে তো সে এই সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা। কেননা, সংস্কৃতি মানে সুকুমারবৃত্তিসমূহের উৎকর্ষসাধন, আর সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা শিলাবৃষ্টির মতো সুকুমারবৃত্তির বিকাশ-উন্মুখ মুকুলগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। আগে জীবন, পরে সংস্কৃতি–একথা সে মানে কিন্তু আগে সাংসারিক উন্নতি, পরে সংস্কৃতি–এ কথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা সংস্কৃতি-কামনাকে এমনভাবে দাবিয়ে রাখে যে, তা আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না–আলো হাওয়ার স্পর্শবঞ্চিত ফুলের মতো অবচেতনের অন্ধকারে আবদ্ধ থেকে তা ধীরে ধীরে শুকিয়ে ঝরে যায়। লক্ষ্মীসরস্বতীর প্রাবাদিক কোন্দল ভিত্তিহীন হয়। ধন আর মন একসঙ্গে যায় না। ধনকে যে চেয়েছে মনকে সে পর করেছে, আর মনকে যে কামনা করেছে ধন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি–এ তো সচরাচরই দেখতে পাওয়া যায়। তাই লক্ষ্মীর ধনভাণ্ডারকে সমভাবে বেঁটে দেওয়ার উদ্যম সত্যই প্রশংসনীয়। অতিভোগ ও ভোগহীনতার পাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার এ-ই একমাত্র পথ। কিন্তু তা করতে হবে সরস্বতীর প্রতি দৃষ্টি রেখে, লক্ষ্মীর দিকে নজর রেখে নয়। ধনসাম্যের উদ্দেশ্য হোক সার্বজনীন সরস্বতী পূজা :তবেই তা মানুষের সত্যিকার মুক্তির বাহন হতে পারবে। বলাবাহুল্য, লক্ষ্মী মানে কল্যাণ আর সরস্বতী মানে সৌন্দর্য। কল্যাণের জগৎ থেকে সৌন্দর্যের জগতে গমন প্রাণের পক্ষে অধিরোহণই, অবরোহণ নয়। আর কল্যাণের জগতে থেকে যাওয়াকে অবরোহণ বলা গেলেও অধিরো বলা যায় না। তাই কল্যাণকে সৌন্দর্যের বাহন করে তোলা দরকার, নইলে প্রগতি একটা তাৎপর্যহীন বাত-কি-বাত হয়ে দাঁড়ায়।
মূল্যবোধ সম্বন্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে দুটি কারণে। প্রথমত আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ হতে চলেছে, আর আমেরিকা জাত হিসেবে স্থূলবুদ্ধি। গভীর জীবনের স্বাদ তারা পেতে চায় না। তারা যা চায় তা আনন্দ নয়, স্ফূর্তি। ভোগেই তারা পটু, উপভোগ নয়। ছন্দো ও সুষমাময় জীবন তারা কল্পনাই করতে পারে না। সমস্ত দিন ব্যাঙ্কের লেজারের উপরে ঝুঁকে পড়ে হিসাব মিলানো আর সন্ধ্যাবেলা সুরামত্ত হয়ে সারাদিনের পরিশ্রমজনিত দুঃখ লাঘবের প্রয়াস–এই তাদের কাছে জীবন। কোনোপ্রকার গভীর অনুভূতি কি সুন্দর কল্পনা তাদের জীবনে সাড়া জাগাতে পারে না। সুখের আত্যন্তিক প্রয়া-যে সুখের অন্তরায়, এ-ধারণা তাদের নেই। অর্থকামনার চাকার নিচে জীবনের সুকুমারবৃত্তিগুলি মাড়িয়ে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। তাই আমেরিকা সভ্য হয়েই রইল, সুসভ্য হতে পারলে না। অবশ্য এসব কথা বলবার অধিকার আমার নেই এবং বলতুমও না যদি বাট্রান্ড রাসেল প্রমুখ চিন্তাশীলদের রচনার সঙ্গে পরিচয় না ঘটত। রাসেল তো মাঝে মাঝে আমেরিকার প্রতি রাগে লাল হয়ে ওঠেন। তার দুঃখ এই যে, আমেরিকার মনোবৃত্তি সমগ্র পৃথিবীর মনোবৃত্তি হতে চলেছে অচিরে সমস্ত দেশ আমেরিকার মতো আনন্দবোধহীন ও স্থূলবুদ্ধি হয়ে পড়বে, এমনকি, এমন যে তার প্রিয় দেশ চীন–যা তার মতে চিন্তার স্বাধীনতা ও জীবনবোধের দেশ–তাও বাদ পড়বে না। কেননা, সকল দেশই আধুনিক হতে চলেছে, আর আধুনিক হওয়া মানে মার্কিন হওয়া। মূল্যবোধের অভাবের দরুন আমেরিকার প্রভাবে পৃথিবীর কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি। তাই সাবধান হওয়া দরকার।
আত্মিক ব্যাপারে অতৃপ্তি ভালো, তা জানার সীমানা ডিঙিয়ে অজানার রাজ্যে উঁকি দেওয়ার প্রেরণা যোগায়। কিন্তু বাস্তব ব্যাপারে অতৃপ্তিবোধ মারাত্মক, তা আত্মার সৃজনীশক্তিকে পঙ্গু ও অথর্ব করে রাখে–তাকে স্বচ্ছন্দগতি হতে দেয় না। A dissatisfied Socrates is thousand times better than a satisfied pig-43 the যে-অতৃপ্তির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, তা এই আত্মিক অতৃপ্তি-divine discontent বস্তুগত অতৃপ্তি নয়। আত্মিক অতৃপ্তি একপ্রকারের সুখ–পরমবেদনা, বস্তুগত অতৃপ্তি নির্জলা দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নয়, তা সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় না, ব্যাহত করে। তাই তা পরিত্যাজ্য। A happy man is he whoknows what he wants. বস্তুত কী চাই, তা ভালো করে জানা থাকলে মানুষ সহজেই সুখী হতে পারে। কিন্তু মুশকিল এই যে, আমেরিকানদের তথা আধুনিকদের অভাববোধের অন্ত নেই। তারা কেবলই ‘আরো চাই’ ‘আরো চাই’ করছে। কী তাদের দরকার, কী না হলেও চলে, তা জানা নেই বলে সবকিছুই তারা চায়, আর সবকিছু চাওয়া মানে জীবনে দুঃখকে দাওয়াত করা। অভাবের মাত্রা বাড়িয়ে চলা আর দুঃখের মাত্রা বাড়িয়ে চলা এক কথা। বস্তুসাধনার উদ্দেশ্য বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া। প্রবল বস্তুসাধনা সত্ত্বেও আমেরিকা বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তি পাচ্ছে না এই উদগ্র ক্ষুধার জন্য। আরো চাই ‘আরো চাই’ মনোবৃত্তি তাকে উন্নত ও সুন্দর জীবনের স্বাদ পেতে দিচ্ছে না। অমৃতের কামনা নেই বলে সে কেবলই বস্তুর দাস হয়ে পড়ছে। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য This far and no further–এই পর্যন্তই, এর বেশি নয়–এই বাণীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যে জাতি বা দেশ শুধু মুখে উচ্চারণ করে নয়; জীবনে রূপায়িত করে এই বাণী প্রচার করবে, তার দ্বারাই জগতের কল্যাণ সাধিত হবে। অতিভোগ ও ভোগহীনতার বর্বরতা থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা তারই আছে। কিন্তু একটি কথা, তারও মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই।
দ্বিতীয়ত আমরা নতুন রাষ্ট্রের অধিবাসী আর নতুন রাষ্ট্র ও যুদ্ধকালীন রাষ্ট্র মূল্যবোধকে তলিয়ে দিয়ে প্রয়োজনবোধকে ওপরে তুলে ধরে। যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দাবিকে ভয়ের চোখেই দেখা হয়। তাই তাকে দমিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের জন্য জানকোরবানের বাণীকে লোভনীয় করে তুলে ধরা হয়। বাকচাতুর্যের দ্বারা বীরত্ববোধ ও উগ্র স্বদেশপ্রেমের কাছে আবেদন জানানো হয় বলে বুদ্ধিবৃত্তি সহজেই কাবু হয়ে পড়ে সমালোচনাশক্তি একেবারেই পঙ্গু হয়ে যায়। আরে ছেঃ ছেঃ নিজের জীবনটা ভোগ করতে চাও? নিজের জীবন তো সকলেই ভোগ করে; তাতে কী মহত্ত্ব আছে? মহত্ত্ব রয়েছে জীবন দেওয়ায়। যদি জাতির জন্য, ধর্মের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য জীবন দিতে পারো তো বুঝব তোমার ধমনিতে দামি রক্ত প্রবাহিত, নইলে আর তোমার জীবনের মূল্য কী? ব্যস তরুণ সম্প্রদায়কে বোকা বানাবার পক্ষে এই যথেষ্ট। বহ্নিবিবিক্ষু পতঙ্গের মতো সমরানলে পুড়ে মরবার জন্য অমনি তারা দলে দলে ছুটে চলবে। তাদের এই প্রাণদানে জগতের কতটুকু লাভ হবে, তা একবারও ভেবে দেখবে না। সত্যি বলতে কি, যুদ্ধ জিনিসটা তরুণ সম্প্রদায়ের বোকামির উপর নির্ভর করেই আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে। আবেগের প্রাবল্য কমিয়ে দিয়ে তারা যদি একটুখানি সচেতনবুদ্ধির চর্চা করত, তবে তা বহুপূর্বেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। যুদ্ধে, যে তরুণদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি-আবেগের প্রাবল্যের দরুন তারা তা সহজে উপলব্ধি করতে পারে না।
যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রের এই চিত্র। নতুন রাষ্ট্রের চিত্রও অনেকটা এরই মতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্ভাব না থাকলে এখানেও যুদ্ধের বাণী বড় হয়ে ওঠে, নইলে কর্মের বাণী প্রাধান্য লাভ করে। কর্ম করো, কর্ম করো–হে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকগণ। নিজের ভোগের দিকে না-তাকিয়ে অনবরত রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য কাজ করে চলো। ওইযে গুবরেপোকা, সেও তো নিজের জন্যই জীবনধারণ করছে। তাহলে তার জীবনে আর তোমাদের জীবনে পার্থক্য কোথায়? নিঃস্বার্থ কর্মই মনুষ্যত্ব। অতএব, স্বার্থলেশহীন হয়ে কাজ করে যাও, স্বার্থের কথা ভেবে না-হক জীবনকে কলঙ্কিত কোরো না-কর্মের বাণীর সঙ্গে একটা মতবাদ বা আদর্শও মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মানুষকে আত্মচেতনাহীন করে তুলবার উদ্দেশ্যে। তখন পুতুলনাচের পুতুলের মতো তাকে যদৃচ্ছা চালনা করা সহজ হয়ে পড়ে।
নতুন রাষ্ট্রের সবচাইতে বড় ত্রুটি এই যে, তাতে সুকুমারবিদ্যার চেয়ে কেজোবিদ্যা প্রাধান্য লাভ করে, আর কেজোবিদ্যা ধীরে ধীরে সুকুমারবৃত্তির ধারগুলি বেমালুম ভেঁতা করে দিয়ে মানুষকে অনুভূতিহীন মাংসপিণ্ডে পরিণত করে। কেজোবিদ্যার বিরুদ্ধে আমাদের বলবার কিছুই নেই, তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সে যদি সুকুমারবিদ্যাকে গলা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তার গদিটি দখল করে বসতে চায় তো আপত্তি না-জানালে অন্যায় করা হবে। শিক্ষার একটা বড় উদ্দেশ্য জীবন উপভোগের ক্ষমতাবর্ধন। কেজোবিদ্যার দাবি বড় হয়ে উঠলে সে উদ্দেশ্যটি চাপা পড়ে যায় শিক্ষা জীবনার্জনের উপায় না হয়ে জীবিকা উপার্জনের উপায় হয়ে ওঠে। ফলে সূক্ষ্ম উপভোগের অভাবে বর্বরতার সীমানা ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না–মানুষ আত্মিক জগতে উন্নীত হয়ে যেতে পারে–বস্তুর সে ক্ষমতা নেই প্রয়োজনের তাগিদে নতুন রাষ্ট্রের কর্তারা সে-কথাটা ভুলে যান। তাই নতুন রাষ্ট্রে মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন থাকার বিশেষ প্রয়োজন।
চূড়ার দিকে নজর রেখেই গোড়ার কথা ভাবা দরকার, নইলে গোড়াতেই আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়–চূড়ায় ওঠা আর সম্ভব হয় না। মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্র গড়ে তোলা দরকার, নইলে শেষপর্যন্ত তা মানুষের মুক্তির উপায় না হয়ে বন্ধনের রজ্জ্ব হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের পুতুলপূজার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। মানুষের বিকাশের জন্যই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। অতএব, লক্ষ্যের প্রতি নিবদ্ধদৃষ্টি হওয়া দরকার। নতুবা বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছুই লাভ হবে না। মানুষের মুক্তির জন্যই রাষ্ট্র আর মুক্তি মানে বস্তুর বন্ধনমুক্ত হয়ে সৌন্দর্য ও আনন্দলোকে উন্নয়ন। মানুষ ব্যক্তি হিসেবে অনেকদূর এগিয়ে গেছে–সূক্ষ থেকে সূক্ষ্মতর জগতে তার অভিযান চলেছে, কিন্তু জাতি হিসেবে সে বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। রাষ্ট্রের কাজ বস্তুর বন্ধন মুক্ত করে দিয়ে মানুষের ক্রমবিকাশে সহায়তা করা। এ ব্যাপারে কেজোবিদ্যার দান অপরিসীম। কিন্তু মুক্তির মানে কেবল বস্তুর থেকে নিষ্কৃতি নয়, আর কিছু। বস্তুর বন্ধনমুক্ত হয়ে ধ্যানকল্পনার জগতে যেতে না পারলে সত্যিকার মুক্তিলাভ হয় না। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন ইত্যাদির সংস্পর্শে এসে মানবমনের যে ক্রমিক উন্মোচন, তারই নাম মুক্তি। এ ব্যাপারে সুকুমারবিদ্যার একচেটে অধিকার, কেজোবিদ্যা এখানে দাঁত ফোটাতে পারে না। তাই সুকমারবিদ্যার এত প্রয়োজন। সুকুমারবিদ্যাকে অবজ্ঞা করা আর মূল্যবোধহীনতার পরিচয় দেওয়া এক কথা।
যুক্তিবিচার আর মূল্যবোধে-যে খুব পার্থক্য আছে, তা নয়। মূল্যবোধকে যাচাই করে নেওয়ার পদ্ধতিই যুক্তিবিচার। একই বস্তু অনুভূতিলোকে একরূপ, বুদ্ধিলোকে অন্যরূপ লাভ করছে, এই যা প্রভেদ। কিন্তু উভয়েই মূলত এক। মূল্যবোধকে সংশ্লিষ্ট যুক্তিবিচার, আর যুক্তিবিচারকে বিশ্লিষ্ট মূল্যবোধ বললে ভুল বলা হবে না। তাই যুক্তিবিচার সম্বন্ধে আর বেশিকিছু বলা সঙ্গত মনে হল না।
পরিশেষে আমার বক্তব্য এই যে, জীবনমান নয়; মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারই জীবনসমৃদ্ধির পরিমাপক। এই দুই গুণের পরিচয় যিনি যতবেশি দিতে পেরেছেন, তিনি ততবেশি উন্নত বলে পরিগণিত হয়েছেন যুগে যুগে; কালে কালে মানুষ তারই মহিমাকীর্তন করেছে ও করবে। তাই তাদের জয় কামনা করে আমি বক্তব্য সমাপ্ত করছি। যুক্তিবিচার আর মূল্যবোধ–এই দুটি কথা আমাদের জপমন্ত্র হোক; তাহলেই আমরা বর্বরতামুক্ত হয়ে সুন্দর ও সুসভ্য হতে পারব–চাই কি, যাকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ দিব্যসত্তা, তার সঙ্গেও আমাদের মুলাকাত হয়ে যেতে পারে।
.
পরিশিষ্ট
মূল্যবোধ সম্বন্ধে অনেক কিছু বলা হলেও কি মূল্যবান, কি মূল্যবান নয়–সে সম্বন্ধে বিশদভাবে কিছুই বলা হয়নি-সামান্য ইঙ্গিত মাত্র করা হয়েছে। এখানে সে অভাবটুকু পূরণ করবার চেষ্টা করছি। প্রথমত বলা দরকার, মানবজীবনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত কোনো ব্যাপারকেই মূল্যহীন বলা যায় না। তবে মূল্যের কমবেশ আছে। তাই মূল্যবোধের মানে মূল্যের কমবেশ সম্বন্ধে ধারণা। সাধারণভাবে মন্তব্য করা যায় প্রয়োজনীয় জিনিসের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যই বেশি। কেননা, প্রয়োজনীয় জিনিস দেহের তৃপ্তি মাত্র; আত্মার তৃপ্তি নয়–আত্মার তৃপ্তি অপ্রয়োজনীয় জিনিসে। তাই একটি সুস্বাদু ভাজা ডিমের চেয়ে একটি সনেটের মূল্য বেশি। এখন প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় এ-দুয়ের সংজ্ঞা দেওয়া যায় কী করে? যা না-পেলে তীব্র দুঃখ, কিন্তু পেলে মামুলি সুখ, গভীর আনন্দ নয়, তা-ই প্রয়োজনীয়; আর যা না পেলে তেমন দুঃখ হয় না, কিন্তু পেলে গভীর আনন্দ, তা-ই অপ্রয়োজনীয়। নিচের দৃষ্টান্তগুলির দিকে নজর দিলেই কথাটির সত্যতা প্রমাণিত হবে। ভাত না-খেলে তীব্র দুঃখ অনুভূত হয়, কিন্তু খেলে গভীর আনন্দ পাওয়া যায় না। একটা সুন্দর সনেট না পড়লে দুঃখ নেই, কিন্তু পড়লে খুশিতে মন ভরে ওঠে। দৈনিক পত্রিকা না পড়লে দিনটা মাটি হল বলে মনে হয়, কিন্তু পড়লে তেমন তৃপ্তি পাওয়া যায় না। একটা ভালো সাহিত্যের বই না পড়লেও চলে, কিন্তু পড়লে মন আনন্দে নেচে ওঠে–জীবনকে সার্থক বলে অভিনন্দিত করতে ইচ্ছে হয়। এমনি আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, কিন্তু বাহুল্য ভয়ে তা আর দেওয়া হল না। তাহলে দেখতে পাওয়া গেল, যা না হলে চলে না তা-ই কম মূল্যের, আর যা না হলেও চলে তা-ই বেশি মূল্যের। অথবা অন্যভাবে দেখতে গেলে, যা শারীরিক অথবা নিম্নস্তরের মনের ব্যাপার (যেমন দৈনিক পত্রিকা-পাঠ) তারই মূল্য কম, যা মানসিক তারই মূল্য বেশি। শরীর-ব্যাপার বলে কামের মূল্য কম, আত্মর ব্যাপার বলে প্রেমের মূল্য বেশি। তবে প্রেম বলে আলাদা কিছু বোধহয় নেই, কামই যখন আত্মার রঙ লেগে সুন্দর ও শালীন হয়ে ওঠে তখনই তা প্রেম নামে অভিহিত হয়। প্রেম কামেরই উধ্বমুখীন সুন্দর প্রকাশ। তাই জঠরের চেয়ে কম বড়–Sex is more spiritual than belly. আত্মার সঙ্গে সম্বন্ধ আছে বলে কামের ঊর্ধ্বগতি আছে, জঠরের নেই। তাই কাম এত কাব্য-সাহিত্যের উপজীব্য হয়েছে, জঠর হয়নি। জঠর মানে ইতর ব্যাপার, তার কোনো সৌন্দর্য নেই। কেবল টিকে থাকবার জন্য তার প্রয়োজন। কিন্তু কাম ইতর ব্যাপার নয়, শ্রদ্ধেয় ব্যাপার। সৌন্দর্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, মহত্ত্বের সঙ্গেও। শ্রদ্ধেয় ব্যাপার বলেই তার বেলা এত আঁটাআঁটি, এত সাবধানতা। পূজালয়ে প্রবেশ করতে হলে যে-শ্রদ্ধা আর নিষ্ঠার প্রয়োজন, এখানেও তাই আবশ্যক।* [* বলা হয়েছে, জঠর ইতর ব্যাপার। তাই মানুষকে ইতরতামুক্ত করতে হলে জঠরের সমস্যার সমাধান সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয়।]
(এই নিবন্ধে জীবনের বাইরের কোনো ব্যাপারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি। জীবনের ভেতরেই যে শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট, সুন্দর-অসুন্দর রয়েছে তারি প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। জীবনশিল্পের মানেই এই উৎকর্ষ অপকর্ষ সম্বন্ধে সচেতনতা। জীবনশিল্পীরা উৎকৃষ্ট অপকৃষ্ট উভয়কে মেনে নিয়ে জীবনকে শিল্পের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে দেন। মূল্যবোধ সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ সচেতন থাকেন। প্রয়োজনের দিকটা প্রধান দিক হলেও যে শ্রেষ্ঠ দিক নয়, শ্রেষ্ঠ দিক অপ্রয়োজনের দিক, কেননা তাতেই মানুষের মুক্তি–এই বোধ না থাকলে সত্যকার জীবনশিল্পী হওয়া যায় না।
সমাজশিল্প জীবনশিল্পের বুনিয়াদ। আর জীবনশিল্প মূল্যবোধেরই অভিব্যক্তি। দার্শনিক যাকে superstructure বলেছেন, তার গোড়ায়ও মূল্যবোধ। তাই তা অবহেলিত হওয়ার মতো জিনিস নয়। বরং superstructure-এর দিকে লক্ষ্য রেখেই main structure গড়ে তোলা দরকার। নইলে সমাজ-পরিবর্তন মানুষকে বেশিদূর এগিয়ে দিতে সক্ষম হবে না। গ্রিসে superstructure (সৌন্দর্যজগৎ) প্রাধান্য লাভ করেছিল।*[* শিল্প ও জ্ঞানের জন্য যদি পৃথিবীতে কোনো জাতি বেঁচে থাকে, তবে তা ঠিক জাতি। গ্রিসে প্রতি তিন ব্যক্তির মধ্যে এক ব্যক্তি হয় ভাস্কর, নয় ভাস্করের সহকর্মী ছিল। আর্ট ও কালচার তাদের কাছে উপরি পাওনা ছিল না, ছিল জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তাই তারা চমৎকার সভ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।] রিনেসাঁসের ইটালিতেও। কিন্তু তাদের main structure তথা কল্যাণের জগৎ ত্রুটিবিহীন ছিল না। অনেক নিষ্ঠুরতা ও ব্যভিচারের কাহিনী তাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। অধুনা কল্যাণের জগৎটি যথাসম্ভব ত্রুটিবিমুক্ত ও নিষ্কলুষ করে গড়ে তুলবার চেষ্টা চলেছে। সে ভালো কথা। কিন্তু superstructure-এর দিকে লক্ষ্য রাখা চাই। কেননা, তা-ই সভ্যতা। আর সভ্যতা আপনাআপনি সৃষ্ট হয় না, তার জন্য বিশেষ আগ্রহ ও যত্নের প্রয়োজন।* [ * কয়েক বছর আগে ক্লাইভ বেলকে অনুসরণ করে বিভিন্ন পত্রিকায় আমি সভ্যতা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। সেগুলিতে বেল সাহেবের কথাই ছিল বেশি, আমার কথা সামান্য। বর্তমান প্রবন্ধে বেল সাহেবের কথা সামান্য, আমার কথাই বেশি। তথাপি প্রেরণা ক্লাইভ বেল থেকে নেওয়া হয়েছে স্বীকার করা দরকার। নইলে বিবেকদংশনের জ্বালা ভোগ করতে হবে।]