মনুষ্যত্ব
মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা–জীব-সত্তা আর মানব-সত্তা। জীব-সত্তার কাজ প্রাণধারণ আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা। এখানে মানুষ বৈশিষ্ট্যহীন, প্রাণীজগতেরই একজন-অপরাপর প্রাণীদের মতো ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ছোটাছুটি করা তার কাজ। কী করে বাঁচা যায় ও সন্তানসন্ততিদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চিন্তায় সে অস্থির। কিন্তু প্রাণী হলেও মানুষ অপরাপর প্রাণীদের পশ্চাতে ফেলে এসেছে এবং নিজের মধ্যে অনুভব করেছে এক নতুন সত্তা। এই নব-অনুভূত সত্তার নামই মানব-সত্তা, আর এখানেই মানুষ অপরাপর প্রাণী থেকে আলাদা। আত্মরক্ষা কি বংশরক্ষা নয়, মুক্তির আনন্দ উপভোগই এখানে বড় হয়ে ওঠে। মুক্তি মানে অস্তিত্বের চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি; শুধু তাই নয়, এক নব সূক্ষ্ম অস্তিত্বের উপলব্বি। ব্যাপারটা আসলে ঋণাত্মক নয়, ধনাত্মক। সাহিত্যশিল্পের মারফতেই এই মুক্তির আনন্দ আস্বাদন করা যায়, তাই তাদের এত মূল্য।
প্রাণধারণের জন্য সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি, তা যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, মনুষ্যত্ব নয়, প্রাণি আর অবসর সময়ে সাহিত্যশিল্পের রস-আস্বাদান, তা যতই অপ্রয়োজনীয় হোক না কেন, মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব রসের ব্যাপার, তাই রসিকরাই বেশি মানুষ। জাতিধর্ম ও আদর্শ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে বেমালুম মিশে যেতে পারেন বলে রসিকরাই মনুষ্যত্বকে সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেন–কোনো বাধাই তাদের উপলব্ধির পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে না। (এখানেই মতবাদীর সঙ্গে রসিকের পার্থক্য; মতবাদী যতই মানুষের উপকারের জন্য চিৎকার করুক না কেন, কখনো মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না মতবাদের নেশাই তার উপলব্বির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর রসিক যত অকাজেরই হোক না কেন, মনুষ্যত্বের পূর্ণ উপলধির সৌভাগ্য তারই। অপ্রয়োজনের জগৎই মনুষ্যত্বের জগৎ এখানেই মানুষ আত্মার লাবণ্য উপভোগ করে। প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দ না হলেও প্রাণধারণের ক্ষতি হয় না; বাঁচার জন্য এরা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু মানুষের মতো বাঁচতে হলে এসব না হলে চলে না। তাই একান্ত প্রয়োজনীয় না হলেও প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। এসব নিয়ে মানুষ বাঁচে না, কিন্তু এসবের জন্য বাঁচে।
সাহিত্য ও শিল্পের জগৎ প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দের জগৎ। তাই এখানে অস্তিত্ব তথা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথা বড় হয়ে ওঠে না, প্রেম ও সহানুভূতির কথা বড় হয়ে ওঠে। প্রেম ও সহানুভূতি আত্মার ইন্দ্রিয়, আর এই ইন্দ্রিয়ের সহায়তায়ই মানুষ মানবসত্তাকে উপলব্ধি করে।
মনুষ্যত্ব তথা মুক্তির আকাক্ষা মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ দিক হলেও প্রাণিত্বকে অবহেলা করা যায় না, বরং মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়েও চলা যায়, কিন্তু প্রাণিত্বকে বাদ দিয়ে চলা কঠিন। তাই মানুষকে প্রাণিত্বের সাধনাই করতে হচ্ছে বেশি। রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি প্রাণিত্বের সাধনারই নিদর্শন, আর তারই ফলে মানুষের জীবনধারণ আর আদিম জৈব ব্যাপার ন-থেকে ধীরে ধীরে মানবিক ব্যাপার হয়ে ওঠে। মানবিক হওয়ার অর্থ জৈব ব্যাপারটাই মনুষ্যত্বের পর্যায়ে উন্নীত হওয়া নয়, মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া–মানবোচিত হওয়া।
মানুষ তার বুদ্ধি ও কল্পনার সহায়তায় জৈব ব্যাপারটি সুনিয়ন্ত্রিত করতে চাচ্ছে সেজন্য পৃথিবীজুড়ে বিরাট আয়োজন চলেছে। খুব আশা ও আনন্দের কথা। কিন্তু লক্ষ্যের দিকে নজর না রাখলে শেষপর্যন্ত সমস্ত চেষ্টাই ভণ্ডুল হতে বাধ্য। লক্ষ্য হচ্ছে মুক্তি-আত্মার লাবণ্য উপভোগ। শারীরিক চিন্তা থেকে মুক্তি চাই আত্মার জগতে প্রবেশের জন্য, এ-কথা মনে না রাখলে জীবনের উন্নয়ন সম্ভব হয় না।
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীব-সত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানব-সত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীব-সত্তার ঘর থেকে মাব-সত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানব-সত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীব-সত্তার ঘরেও সে কাজ করে ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলা তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায়, শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনের দিকও আছে, আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক। সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়, কী ক’রে মনের মালিক হয়ে অনুভূতি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়।
শিক্ষার এই দিকটা যে বড় হয়ে ওঠে না, তার কারণ ভুল শিক্ষা ও নিচের তলায় বিশৃখলা। জীব-সত্তার ঘরটি এমন বিশৃঙ্খল হয়ে আছে যে, হতভাগ্য মানুষকে সব সময়ই সেসম্বন্ধে সচেতন থাকতে হয় উপরের তলার কথা সে মনেই আনতে পারে না। অর্থচিন্তার নিগড়ে সকলে বন্দী। ধনী-দরিদ্র সকলেরই অন্তরে সেই একই ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে: চাই, চাই, আরো চাই। তাই অন্নচিন্তা তথা অর্থচিন্তা থেকে মানুষ মুক্তি না পেলে, অর্থসাধনাই জীবনসাধনা নয়– একথা মানুষকে ভালো করে বুঝতে না পারলে মানবজীবনে শিক্ষা সোনা ফলাতে পারবে না। ফলে শিক্ষার সুফল হবে ব্যক্তিগত, এখানেসেখানে দু-একটি মানুষ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটি উপলব্ধি করতে পারবে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই যে-তিমিরে সে তিমিরে থেকে যাবে।
তাই অন্নচিন্তার নিগড় থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার যে চেষ্টা চলেছে তা অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতন না থাকলে সে চেষ্টাও মানুষকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। কারারুদ্ধ আহার-তৃপ্ত মানুষের মূল্য কতটুকু? প্রচুর অন্নবস্ত্র পেলে আলো-হাওয়ার স্বাদ-বঞ্চিত মানুষ কারাগারকেই স্বর্গতুল্য মনে করে গান ধরবে :
আগর ফেরদৌস বরোয়ে জমিন আস্ত।
হামিন আস্ত, হামিন আন্ত, হামিন আস্ত।
(স্বর্গ যদি কোথাও থাকে ধরণীর পরে
তবে তা এখানে, এখানে, এখানে।)
কিন্তু তাই বলে যে তা সত্য সত্যই স্বর্গ হয়ে যাবে, তা নয়। বাইরের আলো-হাওয়ার স্বাদ-পাওয়া মানুষ প্রচুর অন্নবস্ত্র পেলেও কারাগারকে কারাগারই মনে করবে, এবং কী করে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাই হবে তার একমাত্র চিন্তা। আকাশ বাতাসের ডাকে যে-পক্ষী আকুল, সে কি খাঁচায় বন্দী হবে সহজে দানাপানি পাওয়ার লোভে? অন্নবস্ত্রের প্রাচুর্যের চেয়েও মুক্তি বড়, এই বোধটি মানুষের মুনষ্যত্বের পরিচয়। চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে নেই, সেখানে মুক্তি নেই। মানুষের অন্নবস্ত্রের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে এই মুক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর মানুষটিকে তৃপ্ত রাখতে না পারলে আত্মার অমৃত উপলব্দি করা যায় না বলেই ক্ষুৎপিপাসার তৃপ্তির প্রয়োজন। একটা বড় লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখেই অন্নবরে সমাধান করা ভালো, নইলে তা আমাদের বেশিদূর নিয়ে যাবে না।
তাই মুক্তির জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করতে হবে। একটি অন্নবশ্বের চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা, আরেকটি শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা মানুষকে মনুষ্যত্বের স্বাদ পাওয়ানোর সাধনা। এই উভয়বিধ চেষ্টার ফলেই মানবজীবনের উন্নয়ন সম্ভব। শুধু অন্নবস্ত্রের সমস্যাকে বড় করে তুললে সুফল পাওয়া যাবে না। আবার শুধু শিক্ষার উপর নির্ভর করলে সুদীর্ঘ সময়ের দরকার। মনুষ্যত্বের স্বাদ না-পেলে অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েও মানুষ যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকতে পারে, আবার শিক্ষাদীক্ষার মারফতে মনুষ্যত্বের স্বাদ পেলেও অন্নবস্ত্রের দুশ্চিন্তায় মনুষ্যত্বের সাধনা ব্যর্থ হওয়া অসম্ভব নয়।
কোনো ভারী জিনিসকে ওপরে তুলতে হলে তাকে নিচের থেকে ঠেলতে হয়, আবার ওপর থেকে টানতেও হয় শুধু নিচের থেকে ঠেললে তাকে আশানুরূপ ওপরে উঠানো যায় না। মানবউন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা সেই ওপর থেকে টানা, আর সুখল সমাজব্যবস্থা নিচের থেকে ঠেলা। অনেকে মিলে খুব জোরে ওপরের থেকে টানলে নিচের ঠেলা ছাড়াও কোনো জিনিস ওপরে ওঠানো যায় কিন্তু শুধু নিচের ঠেলায় বেশিদুর ওঠানো যায় না। তেমনি আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার দ্বারাই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব, কিন্তু শুধু সমাজব্যবস্থার সুশৃঙ্খলতার দ্বারা তা সম্ভব নয়। শিক্ষাদীক্ষার ফলে সত্যিকার মনুষ্যত্বের স্বাদ পেলে অন্নবশ্বের সমাধান সহজেই হতে পারে; কেননা অন্নবস্ত্রের অব্যবস্থার মূলে লোভ, আর শিক্ষাদীক্ষার ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কথাটা বুলিমাত্র নয়, সত্য। লোভের ফলে যে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে–অনুভূতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে শিক্ষা মানুষকে সে-কথা জানিয়ে দেয় বলে মানুষ লোভের ফাঁদে ধরা দিতে ভয় পায়। ছোট জিনিসের মোহে বড় জিনিস হারাতে যে দুঃখ বোধ করে না, সে আর যা-ই হোক, শিক্ষিত নয়। শিক্ষা তার বাইরের ব্যাপার, অন্তরের ব্যাপার হয়ে ওঠেনি। লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসাবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবানের মূল্য দেওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই।
শিক্ষার মারফতে মূল্যবোধ তথা মনুষ্যত্ব লাভ করা যায়; তথাপি অবশ্বের সুব্যবস্থাও প্রয়োজনীয়। তা না হলে জীবনের উন্নয়নে অনেক বিলম্ব ঘটবে। মনুষ্যত্বের তাগিদে মানুষকে উন্নত করে তোলার চেষ্টা ভালো; কিন্তু প্রাণিত্বের বাধন থেকে মুক্তি না পেলে মনুষ্যত্বের আহ্বান মানুষের মর্মে গিয়ে পৌঁছতে দেরি হয় বলে অন্নবন্ত্রের সমস্যার সমাধান একান্ত প্রয়োজনীয়। পায়ের কাঁটার দিকে বারবার নজর দিতে হলে হাঁটার আনন্দ উপভোগ করা যায় না, তেমনি অন্নবরে চিন্তায় হামেশা বিব্রত হতে হলে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই দুদিক থেকেই কাজ চলা দরকার। একদিকে অন্নবরে চিন্তার বেড়ী উন্মোচন, অপরদিক মনুষ্যত্বের আহ্বান, উভয়ই প্রয়োজনীয়। নইলে বেড়ীমুক্ত হয়েও মানুষ ওপরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করবে না, অথবা মনুষ্যত্বের আহ্বান সত্ত্বেও ওপরে যাওয়ার স্বাধীনতার অভাব বোধ করবে–পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো উড়বার আকাঙ্ক্ষায় পাখা ঝাঁপটাবে কিন্তু উড়তে পারবে না।
আত্মার জগতের স্বাদ পাওয়া যায় সাহিত্যে, শিল্পে। তাই সাহিত্যশিল্পের সহায়তায়ই মানুষের মনের উন্নয়ন সম্ভব হয়। গল্প-উপন্যাস ও কবিতা পড়তে পড়তে কী করে যে মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয় মানুষ নিজেই তা টের পায় না। এখন থেকে সে রূপ ও রসলোকের অধিবাসী এবং সেখান থেকে সমস্ত জীবন রাজার মতো শাসন করা তার কাজ। এতদিন তার চালক ছিল ইন্দ্রিয়, এখন চালক হচ্ছে রূপবোধ, রসবোধ অন্য কথায় মূল্যবোধ। নতুন রাজার শাসন মানতে-মানতে ইন্দ্রিয়গুলিও যে রূপান্তর লাভ করে! এতদিন তারা ছিল একক, এখন তাদের আরেকটি সঙ্গী এসে জুটেছে। এতদিন তারা তাদের আহার্য পেলেই খুশি হত, এখন থেকে সহজে খুশি হয়ে ওঠা ভার হয়ে উঠল। সঙ্গীর সত্তাটি যেন অশ্রুভেজা কন্ঠে বলতে থাকে : ভাই তোমরা তো খেলে, আমি তো উপোসী রইলুম, কই আমার দিকে একবার ফিরেও তো তাকালে না। সঙ্গীটির কথায় তারা এমন অভিভূত হয়ে পড়ে যে, তাকে উপোসী রেখে তাদের মুখে আর অন্ন রোচে না, ফলে অনেক সময় তাদের উপোসী থাকতে হয়। তারা কী করে যেন টের পায় : ভোগের চেয়ে সম্ভোগ বড়, আর একসঙ্গে ইন্দ্রিয় ও আত্মার যে ভোগ তা-ই সম্ভোগ। তাই আত্মাকে বাদ দিয়ে তারা কিছুই ভোগ করতে চায় না। আত্মার সংস্পর্শে এসে তাদের উন্নয়ন হয়, প্রেম ও সৌন্দর্য ব্যতীত ভোগ-যে একটা ইতর ব্যাপার, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে।
যে-সাহিত্য ও শিল্পের দৌলতে মানুষের এহেন উন্নয়ন, সে-সাহিত্যশিল্পকে প্রচারধর্মী করা হলে তাদের অবনতি ঘটে, আর সাহিত্যশিল্পের অবনতিতে পরিণামে মানুষেরই ক্ষতি। সাহিত্যশিল্পের কাজ সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশন, এবং তারই মারফতে ধীরে ধীরে মূল্যবোধ সৃষ্টি। তাই সাহিত্য ও শিল্প যদি অন্নবস্ত্রের সমাধান না করতে পারে, অথবা অন্নবশ্বের অভাবের কথা প্রচার করতে ত্রুটি করে তো তাকে ব্যর্থ বলে নিন্দিত করা অন্যায়। সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশনের অক্ষমতাতেই তার ব্যর্থতা, অন্য কোনোরূপ ব্যর্থতা ধৰ্য্য নয়। সাহিত্যের একটি নিজের জগৎ আছে সেই জগতের কাজ করে সে যদি অন্য জগতের কাজ করতে পারে তো তাতে কারো আপত্তি হতে পারে না, কিন্তু নিজের জগতের কাজটি ষোলো আনা করা চাই।
সাহিত্যিক আর শিল্পী আসলে প্রেমিক তারা ভালোবেসেছে এই রূপরসগন্ধস্পর্শময়ী ধরণীকে। প্রেমিক সুদিনে প্রিয়াকে খুশি করতে চায় গান গেয়ে, ছবি এঁকে; কিন্তু দুর্দিনে মাঝে মাঝে তাকে প্রিয়ার নাড়ি টিপেও দেখতে হয়। এটা তার পক্ষে সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়, দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তেমনি কালের গরজে যদি সাহিত্যিক ও শিল্পীকে social engineer কি ভিষক হতেই হয়, তথাপি তাদের মনে রাখা দরকার, সেটা তাদের আসল কাজ নয়, আসল কাজ সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশন। দুর্ভাগ্যকে যেন তারা সৌভাগ্য মনে না করে। প্রয়োজনের তাগিদে আসল উদ্দেশ্যটি ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক, তাই লক্ষ্যটি সম্বন্ধে বিশেষভাবে সচেতন থাকা দরকার। অস্তিত্বের স্থূলচিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে অনুভুতি ও কল্পনার সু। জগতে নিয়ে যাওয়াই কাজ; তাই উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দেয় বলে যে-রচনার অস্তিত্বের চিন্তা বড় হয়ে ওঠে সে-রচনা–তাতে যতই মস্তিষ্কের ঘি ঢালা হোক না কেন–উঁচুশ্রেণীর রচনা হতে পারে না। ঘড়া ঘড়া ঘি ঢাললেও শাক শাকই থেকে যায়, পোলাও হয় না। যে রচনা জীবনের অমৃতত্ব সম্বন্ধে সচেতন না করে মানুষকে ইতরজীবনের নাগপাশে বন্দি করে রাখে, তাকে কিছুতেই সার্থক রচনা বলা যায় না।
সাহিত্য ও শিল্পের ফলে মানুষের এহেন উন্নয়ন হয়, একথা ঠিক কিন্তু শরীর চিন্তা থেকে মুক্তি না পেলে সহজে সাহিত্যশিল্পের জগতে প্রবেশ করা যায় না। তাই নিচের তলার ঘরটি ভালো করে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। মানুষের চেহারার দিকে তাকালেই মনে হয়, কী একটা অসামঞ্জস্যের পীড়ায় যেন তার জীবন দ্বিধাবিত–জীবনের অটুটভাব সে হারিয়ে বসেছে; অখণ্ডতার আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত। সে যেন চেহারা দিয়েই গাইতে থাকে :
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুই তারে,
জীবন-বীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে।
অনেকে সমস্যাটির সমাধান করতে চান সরু তারটি ছিঁড়ে দিয়ে। কিন্তু সেটি সার্থক সমাধান নয়; মোটা তারটিকে সরু তারটির উপযুক্ত করে তোলাই সার্থক সমাধান। সমাজব্যবস্থাকে এমন সুশৃখল করা দরকার যেন তা সুকুমারজীবনের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। তাহলেই আমরা উপলব্দি কর, যোগ্যতমের উদ্বর্তন-নীতি অতীতকালের মন্ত্র, আর পেছনে ফেলে আসা প্রাণীযুগের মন্ত্র আওড়িয়ে লাভ নেই, লাভ ভবিষ্যৎ জীবনের মন্ত্র আওড়িয়ে; আর তা হচ্ছে : Expression of the beautiful–সুন্দরের বিকাশ। সম্মুখের মন্ত্র আমাদের সম্মুখে টেনে নিক, অতীতের মন্ত্র অতীত হয়ে যাক।
প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দই মানুষের মধ্যে মূল্যবান, তাই এদের জয় মনুষ্যত্বেরই জয়, আর এদের সঙ্গে যোগ্যতমের উদ্বর্তন নীতির বৈরীভাব সুবিদিত। জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বাদ পেতে হলে এই সর্বনাশা নীতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া চাই নইলে তা মাধ্যাকর্ষণের মতোই আমাদের ইতর জীবনে আবদ্ধ করে রাখবে, ওপরে উঠতে দেবে না। Expression of the beautiful-এর মন্ত্র ঊর্ধ্বকর্ষণের মন্ত্র–তা পঙ্কিল জীবন থেকে ঊর্ধ্বে টেনে নিয়ে আমাদের আত্মিক ক্রমবিকাশে সহায়তা করবে। তারই টানে বর্বরতামুক্ত হয়ে আমরা সুসভ্য হয়ে উঠব। আর সুসভ্যতাই মানুষের শ্রেষ্ঠ কাম্য।
সুসভ্যতার জন্য কল্যাণসৃষ্টি একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু তাই বলে কল্যাণই সুসভ্যতা নয়; তা সুসভ্যতার পাদপীঠ মাত্র। কল্যাণ প্রাণী-সত্তারই ব্যাপার, আর রূপ রস মানব-সত্তার। তাই রূপ ও রসের দিকে দৃষ্টি না রেখে কল্যাণ-সৃষ্টির সাধনা করলে শেষপর্যন্ত তা অন্ধগলি হয়ে দাঁড়ায়। রূপ ও রসের সাধনাই মনুষ্যত্ব তথা সভ্যতার সাধনা। কল্যাণের সাধনা তার সহায়ক, তার বেশিকিছু নয়, এ-কথা মনে না রাখলে অনেক সময় ঘোড়ার আগে গাড়ি সাজানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
রূপলোক ও রসলোকে আমাদের উন্নত করতে পারে শিক্ষা। তাই শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য, এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য মনের চোখ ও রসনা সৃষ্টি করা। যেখানে তা হয়নি সেখানে শিক্ষা ব্যর্থ। মনুষ্যত্বের সাধনা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনা, আর প্রেম সৌন্দর্য ও আনন্দের তাগিদেই আমরা লঘুভার হতে পারি। শিক্ষা আমাদের এই প্রেম-সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের সাধনায় তথা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনায় সহায়তা করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর রূপ ও রসের জন্য কল্যাণ, কল্যাণের জন্য রূপ ও রস নয়–এই বোধ থাকে না বলে শিল্প-সাহিত্যের এত অপব্যবহার ঘটে। শিক্ষার কাজ সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
প্রাণীমানুষটির চেয়েও যে একটা বড়মানুষ আমাদের জীবনে রয়েছে, তাকে না জানলে মনুষ্যত্বকে জানা হয় না। শিক্ষা আমাদের এই সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন রাখে, কিন্তু তাই বলে যে তা আমাদের একেবারে আলাদা করে রাখে, তা নয়। শিক্ষার ফলে আমরা জানিঃ রস ও সৌন্দর্যের দরুন আমরা প্রকৃত জগৎ তথা তরুলতা ও প্রাণীজগৎ থেকে আলাদা, আবার রস সৌন্দর্যের তাগিদে তার সঙ্গে বাধা, কেননা প্রকৃতি-জগতের সঙ্গে আত্মীয়তা উপলব্ধি করতে না পারলে সৌন্দর্য ও আনন্দ লাভ করা যায় না।
জীবনবৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ্য রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোনো মালী গাছের গোড়ায় জল ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে তোলবার জন্য নয়, মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ সম্বন্ধে চেতনা জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে। যখন এই চেতনা মানুষের চিত্তে জাগে তখন এক আধ্যাত্মিক সুষমায় তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারই প্রতিফলনে সমস্ত জগৎ আনন্দময় হয়ে দেখা দেয়। ফলে মানুষ ইতরজীবনের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে লঘুপক্ষ প্রজাপতির মতো হালকা মনে করে।
যেখানে কামে-প্রেমে প্রভেদ করা হয় না, সত্যে-সত্যে প্রভেদ অস্বীকৃত থাকে। অর্থাৎ নিম্নস্তরের সত্য ও উঁচুস্তরের সত্য বলে কোনো জিনিস থাকে না, যেখানে মুড়ি-মিছরির একদর, সেখানে সুসভ্যতার নিবাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আর যেখানে এর বিপরীতটি ঘটে সেখানে তা মুক্ত, স্বাধীন অবাধগতি। তার চলার ভঙ্গিতে ঝলমল করে ওঠে মানুষের দেহমন, হালকা হয়ে যায় জীবনের গুরুভার। সত্যের স্তরভেদে সুসভ্যরা বিশ্বাসী। তারা জানে সমাজগঠনের নীতি নিম্নস্তরের সত্য, জীবনগঠনের নীতি উঁচুস্তরের সত্য। এবং সমাজগঠনের নীতিকে যে-মূল্য দেওয়া উচিত তা তারা দেয়, কিন্তু কখনো তাকে জীবনগঠনের নীতির মর্যাদা দেয় না।