মুণ্ডক উপনিষদ
মঙ্গলাচরণ
ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভির্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥
অন্বয়: দেবাঃ (হে দেবগণ), কর্ণেভিঃ (কান দিয়ে); ভদ্রম্ (ভাল যা কিছু); শৃণুয়াম (যেন তাই শুনতে পাই); যজত্রাঃ (হে পূজ্য দেবগণ); অক্ষভিঃ (চোখ দিয়ে); ভদ্রম্ (যা কিছু ভাল); পশ্যেম (যেন তাই দেখতে পাই); স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তনূভিঃ (স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা); তুষ্টুবাংসঃ (যেন তোমাদের স্তুতি করতে পারি); দেবহিতং যৎ আয়ুঃ (দেবগণ যে আয়ু বিহিত করে দিয়েছেন); ব্যশেম (তা যেন লাভ করতে পারি); শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি-কৃত বিঘ্নের শান্তি])।
সরলার্থ: দেবতাদের কাছে আমাদের এই প্রার্থনা যে আমরা যেন যা কিছু ভাল শুধু তা-ই কান দিয়ে শুনি। দেবতাদের আমরা পুজো করি, আর তাঁদের কাছে এই প্রার্থনা করি যে, চোখ দিয়ে আমরা যেন শুধু ভাল জিনিসই দেখি। আরো প্রার্থনা, কায়মনোবাক্যে যেন তাদেরই জয়গান করি। তাঁদের যেমন ইচ্ছা ততদিনই যেন বেঁচে থাকি—বেশি নয়, কমও নয়। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
ব্যাখ্যা: আমরা যেন ভাল কথা শুনি। ‘ভাল’ বলতে কি বুঝায়? যা কল্যাণপ্রদ, যা অনুকূল। দর্শন একটা শক্ত বিষয়। এ বুঝতে গেলে গভীর মনোযোগ চাই। বাজে কথায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়। যা আমার পক্ষে কল্যাণকর, তাই শুধু আমরা দেখব। এতে আমাদের জ্ঞানার্জনের সুবিধা হবে এবং আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
এই প্রার্থনার মধ্যে আমাদের অঙ্গাদি স্থির থাকুক, এ কথাও বলা আছে। অঙ্গ বলতে শুধু বাইরের স্থূল অঙ্গ নয়, মনও ঐ সঙ্গে আছে বুঝতে হবে। শরীর ভাল থাকবে, মনও ভাল থাকবে। তবেই কাজে মন দিতে পারব। হয়তো শরীরের কোথাও একটা ব্যথা আছে। এতে মন বিক্ষিপ্ত থাকবে। মন যেন সর্বদা সজাগ থাকে; শরীরে বা মনে অবসাদ, জড়তা এসব কিছু যেন না থাকে। শরীর ও মন দুই-ই যেন স্থির থাকে, আর আমাদের আয়ত্তে থাকে।
আমরা এইভাবে চলব, তবে আমাদের আয়ু বিধাতার যেমন বিধান তেমনি হোক।
আমরা মুণ্ডক উপনিষদ পড়তে চলেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আমাদের শরীর-মন যেন সুস্থ থাকে। আমরা যেন আমাদের অধ্যয়নে ডুবে থাকতে পারি। বিধাতার যেমন ইচ্ছা ততদিন যেন এইভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
মুণ্ডক উপনিষদ
অন্যান্য উপনিষদের মতো মুণ্ডক উপনিষদও পরম সত্যের আলোচনা করেন। এই পরম সত্য কি? আচার্য শঙ্করের মতে, কয়েকটি মাত্র শব্দ দিয়েই এই সত্যকে বোঝানো যায়, ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’। অর্থাৎ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং এই জগৎ মিথ্যা। সত্য বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে, ‘যা চিরন্তন সত্য’। কোন একটি বিশেষ মুহূর্তে কোন বস্তু সত্য হতে পারে, কিন্তু বস্তুটির যদি সবসময় পরিবর্তন হতে থাকে তবে বস্তুটি সত্য নয় অর্থাৎ মিথ্যা। একই কথা স্থানের বেলাতেও খাটে। যদি কোন বস্তু একটি বিশেষ স্থানে সত্য হয়, কিন্তু অন্যত্র যদি না হয়, তবে মিথ্যা। ‘জগৎ মিথ্যা’—এই জগৎ বলতে যে জগৎকে আমরা এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি তাকে বোঝানো হয়েছে। আমরা সকলে এই জগৎকে দেখতে পাই। এমন কথা আমরা বলতে পারি না যে, এ জগৎকে দেখা যায় না। এই জগতের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু তা একটি বিশেষ মুহূর্তের জন্য সত্য। পরমুহূর্তেই এই জগতের পরিবর্তন হয় এবং তার আগের অস্তিত্ব লোপ পায়। জগতের ধর্মই এই এবং এই অর্থেই এ জগৎকে মিথ্যা বলা হয়েছে। যা সত্য তা নিত্য, অপরিবর্তনীয়, অবিনাশী এবং তিনিই ব্রহ্ম। তাই ব্রহ্মই একমাত্র সত্য—‘ব্রহ্ম সত্যম্’।
আমাদের সকলের মধ্যে যে আত্মা রয়েছেন অর্থাৎ এই জীবাত্মাও যে ব্রহ্ম, এটি উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা স্বরূপত ব্রহ্ম। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা সচেতন নই। এই অজ্ঞানতার জন্যই আমরা যাবতীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করে থাকি। উপনিষদ আমাদের এই অজ্ঞানতা দূর করতে সচেষ্ট। কারণ উপনিষদ বলেন, ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই সেই। অর্থাৎ তুমিই সেই পরমসত্তা, তুমিই ব্রহ্ম। তুমি এই দেহ নও, মন নও, তুমি সেই সত্য। তুমি অমর, অবিনাশী আত্মা। আত্মার মৃত্যু নেই, জন্মও নেই। তুমি অপরিবর্তনীয়, শোকদুঃখ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে না। তুমি আনন্দস্বরূপ। এই হল উপনিষদের বাণী। সব উপনিষদ বিশেষত মুণ্ডক উপনিষদ মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়ে থাকেন।
মুণ্ডক শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যিনি মুণ্ডিত। একদিক থেকে বলতে গেলে, মুণ্ডক উপনিষদে যে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে তা মুণ্ডিত মস্তক তথা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য। কিন্তু প্রসঙ্গত ‘মুণ্ডক’ কথাটির অন্য একটি অর্থও আছে—‘দূর করা’। এক্ষেত্রে এটিই প্রাসঙ্গিক। এই জ্ঞান আমাদের অজ্ঞতা দূর করে। কিসের অজ্ঞতা? নিজের এবং জগতের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমরা ব্রহ্ম, আমরা স্বরূপত দেবতা, যে কোন কারণেই হোক আমরা একথা জানি না। এই না জানাটাই অজ্ঞতা। আর এই অজ্ঞতা দূর করাই মুণ্ডক উপনিষদের লক্ষ্য।
প্রথম মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
ওঁ ব্রহ্মা দেবানাং প্রথমঃ সংবভূব
বিশ্বস্য কর্তা ভুবনস্য গোপ্তা।
স ব্ৰহ্মবিদ্যাং সর্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠা-
মথর্বায় জ্যেষ্ঠপুত্ৰায় প্ৰাহ॥১
অন্বয়: ব্রহ্মা (ব্রহ্মা); দেবানাম্ (দেবতাগণের মধ্যে); প্রথমঃ (প্রথমে); সংবভূব (সম্যক্-রূপে অভিব্যক্ত হলেন); সঃ (তিনি); বিশ্বস্য (জগতের); কর্তা (স্রষ্টা); ভুবনস্য (সৃষ্টির); গোপ্তা (পালয়িতা); সর্ববিদ্যা-প্রতিষ্ঠাম্ (সকল বিদ্যার আশ্রয় স্বরূপ); ব্রহ্মবিদ্যাম্ (ব্রহ্মবিদ্যা [তিনি]); জ্যেষ্ঠপুত্ৰায় (জ্যেষ্ঠপুত্র); অথর্বায় (অথর্বাকে); প্রাহ (বলেছিলেন)।
সরলার্থ: দেবগণের মধ্যে যিনি প্রথম প্রকাশিত তিনিই ব্রহ্মা। তিনিই এই জগৎ চরাচরের স্রষ্টা ও আশ্রয়। ব্রহ্মজ্ঞানই অপর সকল জ্ঞানের উৎস। ব্রহ্মা তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র অথর্বাকে এই জ্ঞান দান করেন।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। তিনি নামরূপহীন। তিনি বাক্যমনাতীত। তাঁকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি নির্গুণ এবং অব্যক্ত।
কিন্তু মায়াশক্তির দ্বারা তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। এই জগতে যা কিছু আছে তিনিই তার আদি কারণ এবং তাঁরই অপর নাম ব্রহ্মা বা প্রজাপতি। ব্রহ্মার জন্ম হয়নি। কারণ ব্রহ্মা ‘জাত’ হলে তাঁর নিশ্চয়ই পিতামাতা আছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই পিতামাতারও আবার পিতামাতা আছে। আবার তাঁরও আছে, এভাবে চলতেই থাকবে। ব্রহ্মাই ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ এবং দেবগণের মধ্যেও ইনি প্রথম। তিনিই এই জগৎকে সৃষ্টি করেছেন, পালন করছেন, আবার তাঁকে আশ্রয় করেই এ জগৎ রয়েছে।
যেহেতু বেদসমূহ ব্রহ্মার কাছ থেকে এসেছে সেহেতু ব্রহ্মবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞানের তিনিই উৎস। ঋষিদের মধ্যে অথর্বাই প্রথম ঋষি। তাই তাঁকে ব্রহ্মার প্রথম সন্তান বলা হয়। কথিত আছে, ব্রহ্মা এই জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) অথর্বাকে দান করেন। সকল জ্ঞানের উৎস বা ভিত্তি হল এই ব্রহ্মজ্ঞান। তাই তাকে ‘সর্ববিদ্যা-প্রতিষ্ঠাম্’ বলা হয়। ব্রহ্মই পরমসত্য। তিনিই সব কিছুর আশ্রয়। তিনি আছেন বলেই সব কিছু আছে। ব্রহ্মই সকল জ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ।
অথর্বণে যাং প্রবদেত ব্রহ্মাঽথর্বা
তাং পুরোবাচাঙ্গিরে ব্রহ্মবিদ্যাম্।
স ভারদ্বাজায় সত্যবহার প্রাহ
ভারদ্বাজোঽঙ্গিরসে পরাবরাম্॥২
অন্বয়: ব্রহ্মা (ব্রহ্মা); যাম্ (যে ব্রহ্মবিদ্যা); অথর্বণে (অথর্বাকে); প্রবদেত (বলেছিলেন); অথর্বা (অথর্বা); তাম্ (সেই); ব্রহ্মবিদ্যাম্ (ব্রহ্মবিদ্যা); অঙ্গিরে (অঙ্গিরকে); পুরা (পুরাকালে); উবাচ (বললেন); সঃ (তিনি); ভারদ্বাজায় (ভরদ্বাজ গোত্রীয়); সত্যবহায় (সত্যবহকে); প্রাহ (বললেন); ভারদ্বাজঃ (ভারদ্বাজ অর্থাৎ সত্যবহ); পরাবরাম্ ([পরা—শ্রেষ্ঠ, প্রবীণ, যেমন গুরু, এবং অবরাম্—নিকৃষ্ট, তরুণ, যেমন ছাত্র] গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরায়); অঙ্গিরসে [প্ৰাহী] (অঙ্গিরসকে বললেন)।
সরলার্থ: পুরাকালে ব্রহ্মা যে ব্রহ্মবিদ্যা অথর্বাকে দিয়েছিলেন, অথর্বা আবার সেই জ্ঞান ঋষি অঙ্গিরকে দিয়ে যান। অঙ্গির আবার সেই জ্ঞান ভরদ্বাজ-বংশীয় সত্যবহকে দেন। গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই জ্ঞান সত্যবহ আবার অঙ্গিরসকে দিয়ে যান।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মজ্ঞান গুরুমুখী বিদ্যা। এই জ্ঞান (এই মৌখিক বিদ্যা) পিতা থেকে পুত্রে, গুরু থেকে শিষ্যে, পরম্পরাক্রমে চলে আসছে। যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন তিনিই একমাত্র এই জ্ঞান দান করতে পারেন, কোন অজ্ঞ ব্যক্তি পারেন না। এ যেন একটা দীপ থেকে আর একটা দীপ জ্বালানো।
শিষ্যকে গুরুগৃহে বাস করতে হবে। গুরুর জীবন দেখে সে শিক্ষা লাভ করবে। ব্রহ্মজ্ঞান মানুষের জীবনকে পালটে দেয়। যিনি এই জ্ঞান লাভ করেছেন তিনি অন্য এক ব্যক্তিতে পরিণত হন। যীশুখ্রীষ্ট এদেরকেই পৃথিবীর সেরা মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন। এমন মানুষ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই এ পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এই জ্ঞানলাভই মানুষের জীবনের লক্ষ্য এবং আমরা তারই চেষ্টা করছি। আমাদের শাস্ত্রে বলে বই পড়া জ্ঞানই সব নয়। বই পড়ে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায় না। সৎ-গুরুই একমাত্র এই জ্ঞান দিতে পারেন। সৎ-গুরুর নির্দেশেই এই ইন্দ্রিয়াতীত অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়।
শৌনকো হ বৈ মহাশালোঽঙ্গিরসং
বিধিবদুপসন্নঃ পপ্রচ্ছ।
কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং
বিজ্ঞাতং ভবতীতি॥৩
অন্বয়: মহাশালঃ (বিশিষ্ট গৃহস্থ); শৌনকঃ (শুনক পুত্র); হ বৈ (প্রসিদ্ধি অর্থে); বিধিবৎ (শাস্ত্র বিধি অনুসারে); অঙ্গিরসম্ উপসন্নঃ (অঙ্গিরসের কাছে উপস্থিত হয়ে); পপ্রচ্ছ (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবঃ (হে ভগবান); কস্মিন্ নু বিজ্ঞাতে (কি জানলে); ইদম্ (এই); সর্বম্ (সব কিছু); বিজ্ঞাতং ভবতি ইতি (জানা যায়)।
সরলার্থ: শাস্ত্রবিধি অনুসারে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য বিশিষ্ট গৃহী শৌনক ঋষি অঙ্গিরসের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে প্রভু, কি জানলে বা কোন্ বস্তুকে জানলে, সব কিছুকে (এই জগৎ) বিশেষ রূপে জানা যায়?’
ব্যাখ্যা: শৌনক উত্তম গৃহী। যিনি সকল কর্তব্য ঠিক ঠিকভাবে সম্পন্ন করেছেন, এবং পরম জ্ঞান লাভের জন্য যাঁর মন প্রস্তুত, তিনিই উত্তম গৃহী। এই পরম জ্ঞান শুধু ঋষি এবং সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্যই নয়। সংসারের সকল কর্তব্য যথাবিধি করেছেন এমন গৃহীও এই জ্ঞানলাভের অধিকারী। গৃহী ব্যক্তি যখন নিখুঁতভাবে কর্তব্য পালন করেন তখন তাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়। তিনি তখন বুঝতে পারেন তিনি এই দেহ নন। মনও তখন তাঁর বশে। এই হল পরম জ্ঞান লাভের উপযুক্ত ক্ষণ।
এই জ্ঞান অর্জনের জন্য গুরুর কাছে যেতে হবে। তাই শৌনক বিধিমতে অর্থাৎ শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী যজ্ঞের কাঠ নিয়ে অঙ্গিরসের কাছে গেলেন। যজ্ঞের কাঠ হাতে নিয়ে গুরুর কাছে যাওয়া বিনয় ও আত্মসমর্পণের প্রতীক। গুরু সব শিষ্যকেই এই জ্ঞান দেন না। শিষ্যকে পরীক্ষা করে উপযুক্ত বলে মনে হলেই এই জ্ঞান দান করেন।
শৌনক গুরুকে একটি চমৎকার ও কঠিন প্রশ্ন করলেন: ‘কোন্ বস্তুকে জানলে এই জগৎ-চরাচরের সবকিছুকে জানা যায়? অনুগ্রহ করে আমাকে সেই শিক্ষা দিন, যার ফলে আমি এই জগৎকে জানতে পারি। কেউ কেউ বলেন যে, বিজ্ঞানকে জানতে গেলে গণিতবিদ্যাকে অবশ্যই জানতে হবে। কারণ অঙ্কই বিজ্ঞান জগতে ঢোকার চাবিকাঠি। অনুরূপভাবে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এমন কোন জ্ঞান আছে কি যা লাভ করলে আমি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে পারব? তাই কথোপকথন শুরু হচ্ছে সরাসরিভাবে—‘আমার কি করা উচিত? আমি আর ঘুরে বেড়াতে পারছি না। আমি সোজাসুজি সত্যকে জানতে চাই। কি জানলে বা কাকে জানলে এই দৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে আমি জানতে পারব? অনুগ্রহ করে আমাকে সেই শিক্ষা দিন।’ এটাই হল মূল জিজ্ঞাসা।
তস্মৈ স হোবাচ। দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে
ইতি হ স্ম যদ্ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ॥৪
অন্বয়: তস্মৈ (তাঁকে অর্থাৎ শৌনককে); সঃ (তিনি অর্থাৎ অঙ্গিরস); হ উবাচ (বললেন); ইতি হ স্ম (এই যে কথাটি); ব্রহ্মবিদঃ (ব্রহ্মজ্ঞানীরা); বদন্তি (বলেন); দ্বে (দুটি); বিদ্যে (বিদ্যা); বেদিতব্যে (জানতে হবে [বিদ্যা দুটি]); যৎ পরা (শ্রেষ্ঠ [আধ্যাত্মিক] জ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান [‘পরা পরম-আত্মা’, পরম অর্থাৎ পরমাত্মা]); চ এব (এবং); অপরা চ (নিকৃষ্ট [পার্থিব] জ্ঞান, এই দৃশ্যমান জগতের জ্ঞান)।
সরলার্থ: অঙ্গিরস শৌনককে বললেন, ‘ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলেন জ্ঞান দুই প্রকার, ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পরম-জ্ঞান; আর আপেক্ষিক জ্ঞান অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পকীয় জ্ঞান।’
ব্যাখ্যা: আধ্যাত্মিক ও জাগতিক এই দুই প্রকার জ্ঞানই অর্জন করতে হবে। জাগতিক জ্ঞান বলতে এই দৃশ্যমান জগৎ-সংক্রান্ত জ্ঞান বোঝায়, এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান বলতে ব্রহ্মজ্ঞানকে বোঝায়। জাগতিক জ্ঞান বহুর জ্ঞান; আধ্যাত্মিক জ্ঞান হল একের জ্ঞান। জাগতিক জ্ঞানের নিজস্ব কোন মূল্য নেই, আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের সহায়ক হিসাবে এর যা কিছু মূল্য। পার্থিব জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই দৃশ্যমান জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ। আর এই অর্থেই এ জগৎকে উপেক্ষা করা যায় না। জ্ঞান জ্ঞানই, তা পার্থিবই হোক বা আধ্যাত্মিকই হোক। কিন্তু জাগতিক জ্ঞান মানুষকে শান্তি বা আনন্দ দিতে পারে না। এই জ্ঞান আমাদের জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয় বটে কিন্তু তা চিরস্থায়ী নয়। পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের সাময়িক তৃপ্তি দিতে পারে কিন্তু অচিরেই সেই তৃপ্তির নাশ হয়। একমাত্র আধ্যাত্মিক জ্ঞানই আমাদের চিরস্থায়ী শান্তি ও আনন্দ দিতে পারে।
তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্ববেদঃ
শিক্ষা কল্লো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।
অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে॥৫
অন্বয়: তত্র (আধ্যাত্মিক ও জাগতিক—এই বিদ্যা দুটির মধ্যে); ঋগ্বেদঃ (ঋগ্বেদ); যজুর্বেদঃ (যজুর্বেদ); সামবেদঃ (সামবেদ); অথর্ববেদঃ (অথর্ববেদ); শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা); কল্পঃ (আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা); ব্যাকরণম্ (ব্যাকরণ বিদ্যা); নিরুক্তম্ (শব্দার্থ বিদ্যা); ছন্দঃ (ছন্দ বিদ্যা); জ্যোতিষম্ (জ্যোতিষ বিদ্যা); ইতি অপরা (এই সকল অপরা বিদ্যা); অথ পরা (আর পরাবিদ্যা হল); যয়া (যে বিদ্যার দ্বারা); তৎ অক্ষরম্ (যা ক্ষয়হীন বা নিত্য [ব্রহ্মকে]); অধিগম্যতে (জানা যায়)।
সরলার্থ: উপরোক্ত দুই শ্রেণীর বিদ্যা হল পরা বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হল : ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা), কল্প (অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ, জ্যোতিষ—এই দশটি। আর পরা বিদ্যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, যে ব্রহ্ম শাশ্বত ও নিত্য।
ব্যাখ্যা: জাগতিক অর্থাৎ অপরা বিদ্যার মধ্যে কি কি পড়ে? তা হল, চারটি বেদ—ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব; এ ছাড়া ছয়টি বেদাঙ্গ, যা বেদ পাঠে সাহায্য করে। এই ছয়টি বেদাঙ্গ হল—শিক্ষা (উচ্চারণ), কল্প (আচার-অনুষ্ঠান), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ এবং জ্যোতিষ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জগৎ সংক্রান্ত বিদ্যাই হল অপরা জ্ঞান বা অপরা বিদ্যা। বস্তুত এই জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান নয়। কারণ এর দ্বারা আমরা মুক্তি লাভ করতে পারি না। কথামৃতকার শ্ৰীম (শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) তাঁর নিজের স্ত্রী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যে মন্তব্য করেছিলেন আমরা সেকথা সকলেই জানি। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পত্নী অজ্ঞান।’ শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, ‘তা সে অজ্ঞান, আর তুমি বুঝি খুব জ্ঞানী?’ এর আগে জ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে শ্রীম-র মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। তাই তিনি ভেবেছিলেন, ‘অবশ্যই আমি জ্ঞানী। কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এছাড়া অনেক বইও আমি পড়েছি। তখন পর্যন্ত তিনি জানতেন লেখাপড়া শিখলে ও বই পড়তে পারলেই জ্ঞানলাভ হয়। এই প্রথম তিনি বুঝলেন, ঈশ্বরকে জানার নামই জ্ঞান, না জানাই অজ্ঞান।
আমরা বেদ, বেদাঙ্গ ও অন্যান্য বিষয় জানতে পারি। বস্তুত পার্থিব জীবনে এই সব জ্ঞান প্রয়োজনীয়। জীবন ধারণের জন্য এসব অপরিহার্য। কারণ মানুষকে স্বনির্ভর হতে হবে। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়, জীবনের লক্ষ্যও নয়। এই জাতীয় জ্ঞান কখনই আমাদের মুক্তি দিতে পারে না।
তবে প্রকৃত জ্ঞান কি? অঙ্গিরসকে শৌনক যে প্রশ্ন করেছিলেন আমরা আবার সেই মূল প্রশ্নে ফিরে যাই। প্রশ্নটি ছিল—‘কোন্ বস্তুকে জানলে সব কিছুকে জানা যায়?’ অঙ্গিরস উত্তরে বললেন, ‘এই পরা বিদ্যার দ্বারা আমরা অক্ষরকে জানতে পারি। অক্ষর অর্থাৎ যাঁর ক্ষয় নেই। তিনি অপরিবর্তনীয়, নিত্য এবং অবিনাশী। সেই অপরিবর্তনীয় বস্তুটি কী? ব্রহ্ম। যে বিদ্যার দ্বারা আমরা ব্রহ্মকে জানতে পারি তা হল পরাবিদ্যা বা প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানলাভই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণ-
মচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং
তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ॥৬
অন্বয়: তৎ যৎ (সেই অক্ষর ব্রহ্ম); অদ্রেশ্যম্ (অদৃশ্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ধরা যায় না); অগ্রাহ্যম্ (যাঁকে গ্রহণ করা যায় না); অগোত্রম্ (মূল বা উৎস নেই); অবর্ণম্ (রূপহীন); অচক্ষুঃশ্রোত্রম্ (চক্ষুকর্ণহীন); তৎ (সেই); অপাণিপাদম্ (হাত পা বর্জিত); নিত্যম্ (অবিনাশী); বিভুম্ (ব্যাপক); সর্বগতম্ (সর্বব্যাপী); সুসূক্ষ্মম্ (অতি সূক্ষ্ম); তৎ (সেই); অব্যয়ম্ (ক্ষয়হীন); যৎ (যিনি); ভূতযোনিম্ (সৃষ্টির উৎস); [সেই ব্ৰহ্মকে] ধীরাঃ (জ্ঞানী ব্যক্তিরা); পরিপশ্যন্তি (সর্বত্র দেখেন)।
সরলার্থ: যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভূ, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়) অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস—সেই ব্ৰহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন।
ব্যাখ্যা: এই ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় কি ভাবে? তিনি অবর্ণনীয়। প্রথমে উপনিষদ ব্রহ্মকে নেতিবাচক ভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘নেতি নেতি’—ব্রহ্ম এই নন, ব্রহ্ম সেই নন। ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না (অদ্রেশ্যম্)। তিনি জ্ঞেয় বস্তু নন। তিনি জ্ঞাতা, কাজেই তিনি দৃষ্টিগোচর হতে পারেন না। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন—অগ্রাহ্যম্। কোন বস্তুকে আমরা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারি কিন্তু ব্রহ্মকে পারি না। কারণ ব্রহ্ম নির্গুণ, যিনি কোন শর্তের অধীন নন। তিনি স্বয়ম্ভূ—অগোত্রম্। অর্থাৎ তিনি বংশ পরিচয়ের অতীত। তাঁর কোন রূপ নেই—অবর্ণম্। তাঁর কোন গুণ নেই। তিনি চোখ কান (অচক্ষুঃ শ্রোত্রম্), এবং হাত-পা (অপাণিপাদম্) বর্জিত। তিনি নিরাকার। তাই তাঁর কোন রূপ নেই। তাঁর যদি রূপ থাকত তবে তাঁকে আমরা দেখতে পেতাম, স্পর্শ করতে পারতাম, তাঁর কথা শুনতে পেতাম। কিন্তু যেহেতু তিনি অরূপ তাই আমরা বলতে পারি না, ‘আমি ব্ৰহ্মকে দেখেছি’।
এই জগতে দুটি জিনিস আছে—জ্ঞাতা (বিষয়ী) এবং জ্ঞেয়বস্তু (বিষয়)। আমি জ্ঞাতা আর এই টেবিলটি জ্ঞেয়বস্তু। আমার বাইরে যদি কোন বস্তু থাকে তবে আমি তাকে দেখতে পারি, স্পর্শ করতে পারি বা অনুভব করতে পারি। এই হল জ্ঞাতা-জ্ঞেয় (বিষয়ী-বিষয়) সম্পর্ক। কিন্তু যখন একটি মাত্র সত্তা থাকে অর্থাৎ জ্ঞাতা-জ্ঞেয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন জ্ঞাতাই বা কে আর জ্ঞেয় বস্তুই বা কি? যতক্ষণ আমাদের মধ্যে দুই বোধ থাকে ততক্ষণ জ্ঞাতা-জ্ঞেয় ভেদ থাকে। তখনই দুই-এর মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে: জ্ঞেয় বস্তুটি কি রকম? তাঁকে কি দেখা যায়? অনুভব করা যায়? এই জাতীয় নানা প্রশ্ন তখন মনে আসে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ জগতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। তিনি সৎ স্বরূপ, চিৎ স্বরূপ এবং আনন্দ স্বরূপ। জগতে সব অস্তিত্ব, সব জ্ঞান এবং সকল আনন্দ এই ব্রহ্মের কাছ থেকেই এসেছে। অর্থাৎ ব্রহ্মই সব কিছুর উৎস।
যেহেতু ব্ৰহ্ম সব কিছুর উৎস সেহেতু তিনি ইতিবাচক। প্রথমে উপনিষদ ব্রহ্মকে নেতি, নেতি করে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে ব্রহ্ম ইতিবাচক; যেমন, ব্রহ্ম নিত্য, সর্বব্যাপী, সর্বগত এবং সকল বস্তুতে বিরাজিত। ব্রহ্মা কেবলমাত্র আমার মধ্যেই আছেন আর অন্যের মধ্যে নেই—এমন কথা বলা চলে না। ব্ৰহ্ম সর্বব্যাপী অর্থাৎ তিনি সর্বত্র আছেন। আবার সকল বস্তুর মধ্যেও তিনিই রয়েছেন। ব্রহ্ম অণুর অণু অর্থাৎ সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্ম। তিনি ক্ষয় এবং পরিবর্তন রহিত। সকল সৃষ্টির তিনিই উৎস। সমগ্র জগতের মূল এই ব্রহ্মেই নিহিত রয়েছে। কিন্তু একথা কে উপলব্ধি করতে পারেন? জ্ঞানী এবং বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন পুরুষ। তিনি জানেন সবকিছুর মূলে রয়েছেন এই ব্রহ্ম।
উপনিষদ প্রথমে বলেছিলেন, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়ের অতীত। এখন উপনিষদ বলছেন, তিনি সর্বত্র বিরাজিত। তবে তাঁকে দেখা যায় না কেন? কারণ তিনি সর্বত্র রয়েছেন। তাঁকে স্পর্শ করা যায় না কেন? কারণ তিনি সবার মধ্যে বিরাজ করছেন। যখন কেউ বলে, ‘আমি এটি দেখতে চাই’—তখন আমি জ্ঞাতা, এবং যা আমি দেখতে চাই সেটি জ্ঞেয়। জ্ঞেয় বস্তুটি আমার বাইরে রয়েছে। আমাদের মধ্যে তখনও দুই বোধ থাকে। কিন্তু আসলে এক বৈ দুই নেই। আর সেই এক ও অদ্বিতীয় সত্তাই হলেন ব্রহ্ম। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: যদি একমাত্র ব্রহ্মই থাকেন, তবে দৃশ্যমান জগতে আমি ‘বহু’ দেখি কি করে? এই জীব জগই বা কোথা থেকে এল? এর স্রষ্টা কে? এই বৈচিত্রময় জগৎকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে কেমন করেই বা বলব এ জগতের কোন অস্তিত্ব নেই? এর ব্যাখ্যা কি?
যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্নতে চ
যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সংভবন্তি।
যথা সতঃ পুরুষাৎ কেশলোমানি
তথাঽক্ষরাৎ সংভবতীহ বিশ্বম্॥৭
অন্বয়: যথা (যেমন); ঊর্ণনাভিঃ (মাকড়সা দ্বারা); [জাল] সৃজতে (সৃষ্টি হয়), চ (এবং); গৃহ্নতে (জাল নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়); যথা (যেমন); পৃথিব্যাম্ (পৃথিবীর ওপরে); ওষধয়ঃ (বৃক্ষেরা); সংভবন্তি (জন্মায়); যথা (যেমন); সতঃ (সজীব); পুরুষাৎ (জীবদেহ থেকে); কেশলোমানি (কেশ এবং লোম); [সংভবন্তি (জন্মায়)]; তথা (সেইরূপ); অক্ষরাৎ (নিত্য ব্রহ্ম থেকে); ইহ (এই সংসারে); বিশ্বম্ (সমস্ত জগৎ); সংভবতি (উৎপন্ন হয়েছে)।
সরলার্থ: মাকড়সা নিজ দেহের ভিতর থেকে জাল বার করে এবং প্রয়োজনে সেই জাল আবার নিজ দেহের মধ্যেই গুটিয়ে নেয়। একইভাবে এই মাটিতে ফলমূল উৎপন্ন হয়, জীবন্ত মানুষের দেহ থেকে কেশ ও লোম রাশি বের হয়। অনুরূপ ভাবে অক্ষর এবং শাশ্বত ব্রহ্ম থেকেই এই জগতের উদ্ভব।
ব্যাখ্যা: এই জগতের উৎপত্তি হয়েছে কী ভাবে? ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে উপনিষদ এখানে একাধিক উপমার উল্লেখ করেছেন। উপনিষদ প্রথমে বলেছেন, মাকড়সা যেমন তার জাল নিজের শরীরের ভেতর থেকে বার করে, জগৎ সৃষ্টিও অনেকটা সেইরকম। কীটকে ফাঁদে ফেলবার জন্য মাকড়সা ঘরের কোণে জাল বোনে। এই মাকড়সার দেহ থেকেই বিরাট জাল বের হয়, আবার ইচ্ছা করলেই মাকড়সা তার জালটিকে নিজ দেহের ভিতর গুটিয়ে নিতে পারে। সেই রকমভাবে ব্ৰহ্ম এই জগৎকে নিজের ভেতর থেকে বাইরে বার করে আনেন আবার সেটিকে নিজের মধ্যেই ফিরিয়ে নেন। এই জগৎ ব্রহ্ম থেকে এসেছে আবার ব্রহ্মেই লয় হয়। কিন্তু এর দ্বারা কি ব্রহ্ম নিজে প্রভাবিত হন? না, তা হন না। জাল বোনার ফলে মাকড়সার যেমন কোন পরিবর্তন হয় না, ঠিক তেমনি এই জগৎ প্রকাশের দ্বারা ব্ৰহ্ম বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন না। ব্রহ্ম অবিচল। সকল অবস্থাতেই তিনি অচঞ্চল, পরিবর্তনরহিত। জগতের অস্তিত্ব থাক বা না থাক ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না, ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন। উপনিষদ আর একটি উপমা দিচ্ছেন, এই পৃথিবীর মাটিতেই উদ্ভিদের জন্ম। আমাদের চারপাশে ছোট বড় নানা রকম গাছপালা আমরা দেখে থাকি। এ সবই মাটি থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যতে সব মাটিতেই ফিরে যাবে। উপনিষদের আর একটি উপমা হল মানুষের দেহের কেশ ও লোম রাশি। দেহের চৈতন্য আছে বলেই আমাদের দেহ থেকে কেশ ও লোম রাশি জন্মাতে পারে।
একই ভাবে এই জগৎ ব্রহ্মের কাছ থেকেই এসেছে আবার ব্রহ্মেই ফিরে যাবে। এই জগৎ কারোর সৃষ্টি নয়। এ ব্রহ্মেরই প্রকাশমাত্র। বেদান্ত মতে, শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। সৃষ্টি বলে আসলে কিছুই নেই; যা আছে তা প্রকাশ মাত্র। ব্রহ্মই জগৎ রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। আবার তিনি জগৎকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন। এই প্রক্রিয়া নিরবধি ঘটে চলেছে। এ জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ দুই-ই ব্রহ্ম।
তপসা চীয়তে ব্রহ্ম ততোঽন্নমভিজায়তে।
অন্নাৎ প্রাণো মনঃ সত্যং লোকাঃ কর্মসু চামৃতম্॥৮
অন্বয়: ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); তপসা ([আক্ষরিক অর্থ হল তপস্যা, কিন্তু এখানে] মননের দ্বারা); চীয়তে (বিস্তৃত হলেন [অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করলেন]); ততঃ (তা থেকে [ব্রহ্ম]); অন্নম্ (অন্ন বা সৃষ্টির বীজ অর্থাৎ মায়া); অভিজায়তে (জন্মায়); অন্নাৎ (সেই হিরণ্যগর্ভ থেকে); প্রাণঃ (প্রাণ); মনঃ (মন); সত্যম্ (পঞ্চ মহাভূত); লোকাঃ (ভূ প্রভৃতি লোকসমূহ); [অভিজায়তে (ব্যক্ত হল বা সৃষ্টি হল)]; কর্মসু চ (এবং কর্ম থেকে); অমৃতম্ (কর্মফল সৃষ্টি হল])।
সরলার্থ: নিজ মনন শক্তি দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রথমে সৃষ্টির বীজ (অর্থাৎ মায়া) সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকে আসে প্রাণ (অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ—ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ), প্রাণ থেকে আসে মন, সমষ্টি মন। তারপর আসে পঞ্চভূত এবং শেষে এই জগৎ। কর্ম থাকলেই তার ফল থাকবে, তাই কর্মফল অনন্ত ও অবিনাশী।
ব্যাখ্যা: জাল বাইরে বার করার বা নিজের ভেতরে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য মাকড়সাকে কিছু চেষ্টা করতে হয়। জগৎকে প্রকাশ করতে ব্রহ্মকেও কি অনুরূপ চেষ্টা করতে হয়? না, তা হয় না। এই শ্লোকে এই সূত্রটির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
‘ব্রহ্ম চীয়তে’—ব্রহ্ম প্রসারিত হন এবং নিজেকে প্রকাশ করেন। কেমন করে? ‘তপসা’—মনন শক্তির দ্বারা। ‘তপসা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘কৃচ্ছ্র সাধনের দ্বারা’। কোন কাজ করতে গেলে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। হয়তো আমার কোন জরুরী কাজ পড়ে গেছে, আর সেকাজটি তখনই করতে হবে। সে জন্য সময় অভাবে আমার হয়তো খাওয়াই হল না, যদিও আমি খুবই ক্ষুধার্ত। এই হল কৃচ্ছ্র সাধন। কিন্তু ব্রহ্মের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোন চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্ম কেবলমাত্র নিজ চিন্তার দ্বারা এই জগৎকে প্রকাশ করেন। ব্রহ্ম শুধু চিন্তা করলেন—‘আমি এক, আমি বহু হতে চাই’ এবং সঙ্গে সঙ্গে বহুর সৃষ্টি হল। ব্রহ্মের ইচ্ছামাত্রই এই জগতের সৃষ্টি হল। এ ক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছাই এই সৃষ্টির কারণ।
কথাটিকে অন্যভাবেও বলা যেতে পারে: আমাদের সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম আছেন। আমরা সকলেই স্বরূপত ব্রহ্ম, কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা আমরা নিজেদের স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। আত্মসংযম, নিত্য-অনিত্য বস্তু বিচার, ধ্যান ধারণা, শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা ইত্যাদির সাহায্যে আমরা মনকে প্রস্তুত করে থাকি। আর মন প্রস্তুত হলে ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। আমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্ম প্রচ্ছন্ন ভাবে রয়েছেন, তাই আমরা সে সম্পর্কে অবহিত নই। দেহ এবং কামনা-বাসনা নিয়েই আমরা মত্ত। তাই কেউ আমাদের আঘাত করলে সেই মুহূর্তেই আমরা খুব রেগে যাই এবং প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আত্মসংযম অভ্যাস করলে আমাদের ভেতরের দৈবী ভাবটি ফুটে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই দৈবী গুণাবলী রয়েছে, কিন্তু যে-কারণেই হোক সেগুলি চাপা পড়ে আছে। তপস্যার দ্বারা সেই প্রচ্ছন্ন গুণগুলিকে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ব্রহ্মের ক্ষেত্রে কোন তপস্যার দরকার হয় না। এক্ষেত্রে ‘তপসা’ বলতে মনন শক্তিকে বোঝায়।
এই শ্লোকে প্রকাশের ক্রমও বলা হয়েছে। প্রথমে শুধু ব্রহ্ম, জগৎ বলে কিছুই নেই। এ অবস্থা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য; তবু ধরে নেওয়া যাক, কোন এক বিশেষ মুহূর্তে শুধু শুদ্ধচৈতন্য ব্রহ্মই আছেন। এর পর ব্রহ্ম চিন্তা করলেন, ‘আমি আমাকেই প্রকাশ করব।’ এ সবই আমাদের অনুমানের কথা। বস্তুত ব্রহ্ম কি করেন তা আমরা সত্যিই জানি না। কিন্তু নিজেদের অবস্থা দিয়েই আমরা তাঁকে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, কোন কাজ করবার আগে আমরা চিন্তা করি, আবার কেমন ভাবে সেই কাজ করব তার পরিকল্পনাও করি। অর্থাৎ চিন্তা সবসময়ই কর্মের পূর্ববর্তী। কোন ইঞ্জিনিয়ার যখন বাড়ী তৈরী করেন তখন তিনি মনে মনে তার একটা ছক এঁকে নেন। তারপর সেই ছকই ক্রমশ বাস্তব রূপ নেয়। তাই প্রথমে চিন্তা ও পরে কর্ম। তাই প্রথমেই ব্ৰহ্ম থেকে আসে মায়া। মায়ারই আর এক নাম প্রকৃতি। প্রকৃতি থেকে আসে প্রাণ বা হিরণ্যগর্ভ। হিরণ্যগর্ভ হল ব্রহ্মের প্রথম সমষ্টি প্রকাশ। তারপর আসে মন, এ কোন একক মন নয়, এ হল নিখিলমন। মন থেকে আসে ‘সত্যম্’ অর্থাৎ উপাদান (যথা—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী), এবং সত্যম্ থেকে আসে চতুর্দশ লোক বা জগৎ।
তারপর থাকে অমৃতম্। ‘অমৃতম্’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল—‘অমর’, কিন্তু এর আর এক অর্থ হল ‘কর্মফল’। কর্ম করলেই তার ফল থাকবে। আমরা ভাল কর্ম করলে ভাল ফল লাভ করে থাকি। শাস্ত্রমতে আমরা সবসময়ই যাগযজ্ঞ করে চলেছি। আমরা কে বা সমাজে আমাদের মান কি এ সব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে আমাদের জন্য কিছু কর্ম নির্দিষ্ট থাকে। এই কাজগুলি ঠিক ঠিকভাবে করতে পারলে তা-ই যজ্ঞের সমান। এর ফলে আমরা দীর্ঘ জীবন, প্রচুর ধন সম্পদ, বহু সুসন্তান, এবং মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ করে সুখ ভোগ করতে পারি। কিন্তু কিছু কাল পরে আবার আমরা এই পৃথিবীতেই ফিরে আসি এবং জীবন শুরু করি। একেই বলা হচ্ছে অমৃতম্ বা অমরত্ব। কিন্তু এই অমরত্ব চিরস্থায়ী নয়। এই অমরত্বের দ্বারা আমরা হয়তো স্বর্গলাভ করতে পারি এমনকি স্বর্গের দেবদেবীও হতে পারি। তখন কিছু সময়ের জন্য আমরা বিপুল শক্তির অধিকারী হই ঠিকই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না এই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। প্রকৃত অমরতার তুলনায় এই অমরতা অস্থায়ী, একটি বিশেষ মুহূর্তে সত্য। কিন্তু আমরা এ কথা ভুলে গিয়ে আপেক্ষিক অমরতা বা স্বর্গসুখের পেছনে ছুটি।
এই ভাবেই সূক্ষ্ম থেকে স্থূল জগতের প্রকাশ চলতে থাকে। প্রথম ব্রহ্ম, তারপর প্রকৃতি, পরে হিরণ্যগর্ভ, তারপর সমষ্টি-মন, পরে পঞ্চ মহাভূত, তারপর চতুর্দশ লোক বা জগৎ, এবং সর্বশেষে নিরবচ্ছিন্ন কর্ম ও তার ফলভোগ।
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ।
তস্মাদেতদ্ব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে॥৯
অন্বয়: যঃ (যিনি); সর্বজ্ঞঃ (সর্বজ্ঞ); সর্ববিৎ (সকল বিষয় [পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে] জানেন); যস্য (যাঁর); জ্ঞানময়ম্ (জ্ঞানময়); তপঃ (তপস্যা); তস্মাৎ (তা থেকে [পরব্রহ্ম]); এতৎ ব্রহ্ম (এই ব্রহ্ম [অপরা ব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ]); নাম (নাম); রূপম্ (রূপ); চ (এবং); অন্নম্ (নাম, রূপ ও অন্ন); জায়তে (জন্মায়)।
সরলার্থ: যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ—তিনি সব কিছু জানেন। ‘যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ’—জ্ঞানই তাঁর একমাত্র তপস্যা। ব্রহ্ম যেহেতু সর্ব ব্যাপী সেহেতু তিনি সবই জানেন এবং সবই বুঝতে পারেন। ব্রহ্ম যেন জ্ঞানের সমুদ্র। আর এই সৃষ্টি বা এই প্রকাশ যেন ঐ সমুদ্রের তরঙ্গ। জগৎ এই জ্ঞানসমুদ্রের একটি তরঙ্গ মাত্র। কিন্তু এই জগৎ প্রকাশে ব্রহ্মের কোন চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। তাঁর ক্ষুদ্র একটি চিন্তাই মুহূর্তের মধ্যে এই জগৎ রূপে নিজেকে প্রকাশ করে। এ জগতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তার একটি নাম ও রূপ আছে। আর আছে অন্ন অর্থাৎ খাদ্য। নাম, রূপ এবং খাদ্য সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। এই বৈচিত্রময় জগৎও ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ দুই-ই ব্রহ্ম। কেউ একজন ব্রহ্মকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরে সেই ব্রহ্মই জগৎকে সৃষ্টি করেন—এ কথাটি ঠিক নয়। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। নর, নারী, গাছপালা, জীবজন্তু, গ্রহনক্ষত্র, বাতাস, জল, আগুন ইত্যাদি নানারকমের বৈচিত্র আমরা দেখে থাকি। নামরূপ নিয়েই এই জগৎ। মাকড়সার জাল যেমন মাকড়সার দেহ থেকেই আসে, মাটি থেকে যেমন গাছপালা আসে, এবং জীবন্ত মানুষের দেহ থেকে যেমন কেশ ও লোম বার হয় ঠিক তেমনি সবকিছু এই ব্রহ্মের কাছ থেকেই আসে।
পরা ব্রহ্মই সর্বশ্রেষ্ঠ বা পরম। তিনি নির্গুণ তাই কোন বিশেষণ দ্বারা তাঁকে বিশেষিত করা যায় না। পরা ব্রহ্মের পরেই হল অপরা ব্রহ্ম। এই ব্রহ্ম সগুণ। এঁকে হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর বলা হয়ে থাকে।
মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম মুণ্ডকের প্রথম অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
প্রথম মুণ্ডক
দ্বিতীয় অধ্যায়
তদেতৎ সত্যম্—মন্ত্রেষু কর্মাণি কবয়ো
যান্যপশ্যংস্তানি ত্রেতায়াং বহুধা সন্ততানি।
তান্যাচরথ নিয়তং সত্যকামা।
এষ বঃ পন্থাঃ সুকৃতস্য লোকে॥১
অন্বয়: তদেতৎ (এই সেই); সত্যম্ (সত্য); কবয়ঃ (কবিগণ অর্থাৎ সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ); মন্ত্রেষু (মন্ত্রেতে); কর্মাণি (অগ্নিহোত্রাদি কর্ম); অপশ্যন্ (দেখেছিলেন); যানি (যেগুলি); ত্রেতায়াম্ (তিনটি বেদে); বহুধা (নানাভাবে); সন্ততানি (ব্যাখ্যা করা হয়েছে); তানি (তাদের অর্থাৎ সেই কর্মসমূহকে); নিয়তম্ (সবসময়); সত্যকামাঃ (শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী কর্মফল কামনা করে); আচরথ (আচরণ কর); সুকৃতস্য লোকে (ভাল কাজ করে যে লোকে যায়); এষঃ (এই); বঃ (তোমাদের); পন্থাঃ (পথ)।
সরলার্থ: এ-ই সত্য—বেদমন্ত্রে যে সব যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ আছে পণ্ডিত ব্যক্তিরা সেগুলি দেখেছেন। ঋক্, সাম, ও যজুঃ—এই তিনটি বেদে এই সব অনুষ্ঠান আবার নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে গেলে ওই সব যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান সবসময় করতে হবে। সৎ কর্ম করে মানুষ যে লোকে যায় সেই লোকে যাওয়ার এই হল উপায়।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম আমাদের অনেকেরই ধারণার অতীত এক তত্ত্ব। তিনি অনন্ত এবং অনন্তের ধারণা করা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন। এই জগতের মানুষ হিসেবে আমরা এমন কিছু চাই যা আমাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে, যা আমরা উপভোগ করতে পারি। মনে বাসনা রয়েছে, অথচ চোখ বন্ধ করে বলছি আমার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, তা কি হয়? আমি যা নই তা হওয়ার ভান করতে পারি না। নিজের কাছে নিজেকে সৎ থাকতে হবে। অন্তরে বাসনা থাকলে তা চরিতার্থ করার চেষ্টা করাই ভাল। তবে তা করার আগে ভাল করে চিন্তা করে নিতে হবে। তাই উপনিষদ বলছেন, ‘তৎ এতৎ সত্যম্’, এ-ই সত্য। এখানে সত্য বলতে বৈদিক যাগযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। শাস্ত্রে বহুপ্রকার যজ্ঞানুষ্ঠানের বর্ণনা পাওয়া যায়। শাস্ত্র তথা বেদের দুটি ভাগ: কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে নানা যাগযজ্ঞের কথা আছে। এখানে ‘কর্ম’ শব্দটির অর্থ যজ্ঞ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বৈদিক ক্রিয়াকর্ম। কর্মকাণ্ড বলে, আমাদের প্রতিটি কর্মের একটা ফল আছে; এবং বিশেষ বিশেষ যজ্ঞকর্ম করলে বিশেষ বিশেষ ফল পাওয়া যায়। যেমন, আমরা ধনসম্পদ, সুস্বাস্থ্য, সুসন্তান, স্বর্গলাভ প্রভৃতি কামনা করতে পারি। এর প্রত্যেকটিই আমাদের আকৃষ্ট করে। এই সব আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য শাস্ত্র কতগুলি নির্দিষ্ট যজ্ঞের বিধান দেন; এই সব যজ্ঞ ঠিক ঠিক করতে পারলে নির্দিষ্ট ফল লাভ হয়। এখনও এমন মানুষ আছেন যাঁরা এই সব যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। শত্রু দমন করার জন্যও আলাদা যজ্ঞ আছে। কিছু যজ্ঞ শুভ, আবার কিছু অশুভ। শুভ যজ্ঞে শুভ ফল পাওয়া যায়; যেমন, স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিমান সন্তান, অর্থ, দীর্ঘ ও সুখী জীবন ইত্যাদি। প্রতিটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। শাস্ত্রের মন্ত্রগুলিতে এই সব যজ্ঞের বিশদ বর্ণনা আছে।
‘সত্যকামাঃ’—যিনি ফল কামনা করেন। এখানে ‘সত্য’ কথাটির অর্থ ফল, ‘কামাঃ’র অর্থ কামনা। যদি ফললাভ করতে চাই, তবে এই সব যজ্ঞ নিরন্তর করে যেতে হবে। বহু মানুষ নিয়মিতভাবে এই সব যজ্ঞ করে থাকেন। তাঁদের বিশেষ কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা থাকে আর সেই ফল লাভের জন্যই তাঁরা যজ্ঞ করেন। যজ্ঞ কর্ম সম্পন্ন হলে তাঁরা বাঞ্ছিত ফল লাভও করে থাকেন।
যদা লেলায়তে হ্যর্চিঃ সমিদ্ধে হব্যবাহনে।
তদাঽঽজ্যভাগাবন্তরেণাঽঽহুতীঃ প্রতিপাদয়েৎ॥২
অন্বয়: যদা হি (যখনই); সমিদ্ধে হব্যবাহনে (সম্যক্ ভাবে প্রজ্বলিত অগ্নিতে); অর্চিঃ (শিখা); লেলায়তে (লেলিহান হয়); তদা (তখন); আজ্যভাগৌ (আজ্যভাগ দুটির অর্থাৎ অগ্নির দু-পাশের); অন্তরেণ (মধ্যভাগে); আহুতীঃ (আহুতি, ঘি); প্রতিপাদয়েৎ (অর্পণ করবে)।
সরলার্থ: লকলকে শিখাসহ অগ্নি যখন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে তখন তার দুপাশের মধ্যভাগে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ আরম্ভ করা উচিত।
ব্যাখ্যা: যজ্ঞ করতে গেলে প্রথমে যজ্ঞের অগ্নি জ্বালাতে হবে। যজ্ঞাগ্নি যেন দাউদাউ করে জ্বলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই অগ্নির দুটি পাশ থাকে—দক্ষিণ পাশ ও বাম পাশ। ঘৃতাহুতি দিতে হবে এই দুটি পাশের মধ্যভাগে যজ্ঞাগ্নির কেন্দ্রস্থলে। আহুতি দেওয়ার সময় অগ্নি যেন দীপ্ত এবং লেলিহান থাকে। যজ্ঞের আগুন যাতে নিভে না যায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। নিভে গেলে ব্রাহ্মণ ঋত্বিকের পক্ষে প্রত্যবায় হবে। সে ক্ষেত্রে যজ্ঞের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে, এবং ভালর চেয়ে যজমানের মন্দই হবে বেশী। এই জাতীয় বহু খুঁটিনাটি বিবরণ শাস্ত্রে পাওয়া যায়।
যস্যাগ্নিহোত্রমদর্শমপৌর্ণমাস-
মচাতুর্মাস্যমনাগ্রয়ণমতিথিবর্জিতং চ।
অহুতমবৈশ্বদেবমবিধিনা হুত-
মাসপ্তমাংস্তস্য লোকান্ হিনস্তি॥৩
অন্বয়: যস্য (যার অর্থাৎ যে যজমানের); অগ্নিহোত্রম্ (অগ্নিহোত্র যাগটি); অদর্শম্ (দর্শ নামক যাগ বর্জিত); অপৌর্ণমাসম্ অচাতুর্মাস্যম্ অনাগ্রয়ণম্ (পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য এবং আগ্রয়ণ কর্মবর্জিত); অতিথিবর্জিতম্ (অতিথি সৎকার না করে); অবৈশ্বদেবম্ (বৈশ্বদেব কর্মশূন্য); অহুতম্ (অকালে আহুতি দেওয়া); অবিধিনা (অশাস্ত্রীয় ভাবে); হুতম্ (আহুতি যুক্ত), তস্য (তার [সেই যজমানের]); আসপ্তমান্ লোকান্ (সপ্তলোক পর্যন্ত); হিনস্তি (বিনষ্ট করে [অর্থাৎ যজ্ঞের আনুষঙ্গিক যা-যা করণীয় সেগুলি না করার জন্যে যজমানের সপ্তলোক তার হাতের বাইরে চলে যায়])।
সরলার্থ: (শাস্ত্রের নিয়ম না মেনে অর্থাৎ) দর্শ, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য এবং আগ্রয়ণ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক যজ্ঞ সম্পন্ন না করে, অতিথি সৎকার না করে, অথবা বৈশ্যদেব আচার না মেনে যদি কেউ অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করেন তাহলে সেই যজ্ঞ যথাযথ হয় না। এর ফলে যজমানের সপ্তলোক পর্যন্ত নাশ হয়।
ব্যাখ্যা: ধরা যাক নিখুঁতভাবে যজ্ঞ করা সম্ভব হল না। এই শ্লোকে সেই বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সারা জীবন ধরে ব্রাহ্মণরা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করে থাকেন। এখনও অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার আছেন যাঁরা এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করেন। তাঁদের ঘরে পুরুষ পরম্পরা যজ্ঞাগ্নি জ্বলতে থাকে। প্রতিদিন এই অগ্নিতে আহুতি দিতে হয়। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ অতি দুরূহ। এই যজ্ঞ করতে গেলে শুধু অগ্নিহোত্র করলেই হবে না। অন্যান্য আনুষঙ্গিক যজ্ঞ যথা—দর্শ, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য, আগ্রয়ণ এবং বৈশ্বদেব অনুষ্ঠানও এর সঙ্গে পালন করতে হবে। আবার যজ্ঞ চলাকালীন অতিথি সৎকার অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু কেউ যদি এই অনুষ্ঠান আরম্ভ করেও শাস্ত্রের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হন? সে ক্ষেত্রে তাঁর কী হবে? ‘আসপ্তমান্ লোকান্ হিনস্তি’ অর্থাৎ পৃথিবী থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন সাতটি লোক তিনি হারাবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: কলিযুগে এই সব যজ্ঞ করা কঠিন। কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান এই যুগের উপযোগী নয়। এই যজ্ঞ একবার শুরু করলে এর সব নিয়মকানুন নিখুঁত ভাবে পালন করতে হয়। শাস্ত্রীয় বিধি লঙ্ঘন হলে যজমানের সর্বনাশ। শাস্ত্র বলেন, এর ফলে জীবনে যত পুণ্য কর্মের ফল সব নষ্ট হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : এ যুগে মানুষ এত ব্যস্ত যে, শাস্ত্রের কঠোর নিয়মকানুন পালন করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য। কিন্তু কর্ম সবাইকেই করতে হয়। আমরা যে চিন্তা করি তাও একপ্রকার কর্ম। কাজেই কর্মছাড়া আমরা এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। কিন্তু শাস্ত্রবিহিত কর্মযজ্ঞ করা এ যুগে আর সম্ভব নয়।
কালী করালী চ মনোজবা চ
সুললাহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী
লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহ্বাঃ॥৪
অন্বয়: কালী (কালী); করালী (করালী); চ (এবং); মনোজবা (মনোজবা); চ (এবং); সুলোহিতা (সুলোহিতা); যা চ সুধূম্রবর্ণা (এবং যা সুধূম্রবর্ণা [নামেও পরিচিত]); চ (এবং); স্ফুলিঙ্গিনী (স্ফুলিঙ্গিনী); চ (এবং); দেবী বিশ্বরুচী (জ্যোতির্ময়ী বিশ্বরুচী); ইতি (এই); সপ্ত (সাতটি); লেলায়মানাঃ (লেলিহান [অগ্নির]); জিহ্বাঃ (জিহ্বা)।
সরলার্থ: কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধুম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী এবং জ্যোতির্ময়ী বিশ্বরুচী—যজ্ঞাগ্নির এই সাতটি লেলিহান জিহ্বা (যা আহুতি গ্রহণ করে)।
ব্যাখ্যা: যজ্ঞাগ্নির সাতটি জিহ্বা এবং প্রতিটির পৃথক নাম আছে। প্রতিটি শিখাকে আলাদাভাবে স্মরণে রাখতে হবে, তাদের আহুতি দিতে হবে, এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একটি শিখাকেও উপেক্ষা করা চলবে না। সব নিয়ম ঠিক ঠিক পালন করা হলে যজমানের যজ্ঞ সাধন সার্থক হবে।
এতেষু যশ্চরতে ভ্ৰাজমানেষু
যথাকালং চাহুতয়ো হ্যাদদায়ন্।
তং নয়ন্ত্যেতাঃ সূর্যস্য রশ্ময়ো
যত্র দেবানাং পতিরেকোঽধিবাসঃ॥৫
অন্বয়: এতেষু (এই); ভ্ৰাজমানেষু (লেলিহান অগ্নিশিখাতে); যথাকালং হি (যথা সময়েই); যঃ (যিনি); চরতে (যজ্ঞ করেন); এতাঃ (এই); আহুতয়ঃ চ (আহুতি-সমূহ); সূর্যস্য রশ্ময়ঃ (সূর্যকিরণ [অর্থাৎ সূর্যকিরণ হয়ে]); তম্ (সেই যজমানকে); আদদায়ন্ (গ্রহণ করে); নয়ন্তি (নিয়ে যায়); যত্র (যেখানে); দেবানাম্ (দেবতাগণের); একঃ পতিঃ (অধিপতি [অর্থাৎ ইন্দ্র]); অধিবাসঃ (সবার উপরে বাস করেন)।
সরলার্থ: যথাসময়ে দীপ্ত লেলিহান অগ্নিশিখাসমূহে আহুতি দিয়ে যাঁরা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করেন, তাঁদের আহুতি সূর্যকিরণে রূপান্তরিত হয়ে তাঁদের দেবলোকে নিয়ে যায়। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র সবার উপরে বসে আছেন।
ব্যাখ্যা: ধরা যাক, ঋত্বিক সব শিখাতেই উপযুক্ত আহুতি দিয়েছেন, যজ্ঞের সব শর্ত পালন করেছেন এবং শাস্ত্রের নিয়ম মেনে যজ্ঞ করেছেন। যজমান তখন কি পুরস্কার পাবেন? তাঁর দেওয়া আহুতি সূর্যকিরণে পরিণত হবে, সূর্যকিরণের সঙ্গে এক হয়ে যাবে। এই সূর্যকিরণই তখন তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যাবে। যজ্ঞ সুসম্পন্ন করায় তিনি ইন্দ্রলোক অর্থাৎ যে-লোকে দেবরাজ ইন্দ্রের বাস সেই লোক প্রাপ্ত হবেন।
এহ্যেহীতি তমাহুতয়ঃ সুবর্চসঃ
সূর্যস্য রশ্মিভির্যজমানং বহন্তি।
প্রিয়াং বাচমভিবদন্ত্যোঽর্চয়ন্ত্য
এষ বঃ পুণ্যঃ সুকৃতো ব্রহ্মলোকঃ॥৬
অন্বয়: এহি এহি ইতি (এস এস এইরূপে); সুবৰ্চসঃ আহুতয়ঃ (দীপ্যমান আহুতি-সমূহ); তম্ (সেই); যজমানম্ (যজমানকে); সূর্যস্য (সূর্যের); রশ্মিভিঃ (কিরণ পথে); বহন্তি (বহন করে নিয়ে যায়); প্রিয়াং বাচম্ (স্তুতিবাক্য); অভিবদন্ত্যঃ (উচ্চারণ করতে করতে); অৰ্চয়ন্ত্যঃ (অর্চনা করতে করতে); এষঃ (এই); বঃ (তোমাদের); পুণ্যঃ (পুণ্য); সুকৃতঃ (সুকর্মের ফলস্বরূপ); ব্রহ্মলোকঃ (ব্রহ্মলোক অর্থাৎ স্বর্গলোক)।
সরলার্থ: ‘স্বাগত, স্বাগত। নিজ সুকৃতির দ্বারা তুমি পবিত্র স্বর্গলোক অর্জন করেছ’—এই সুবচনে অভিনন্দিত করে জ্বলন্ত আহুতিসমূহ যজমানকে সসম্মানে সূর্যের কিরণপথে (স্বর্গলোকে) নিয়ে যায়।
ব্যাখ্যা: যজ্ঞাগ্নির শিখাসমূহকে যদি ভালভাবে সেবা করা যায়, তাদের উদ্দেশে আহুতি দেওয়া যায়, তবে তারা যজমানের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়। যজমানের মৃত্যুর সময় এই সব আহুতি সূর্যরশ্মিতে পরিণত হয় এবং তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যায়। ঘরে অতিথি এলে যেভাবে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়, সেইভাবে মধুর বচনে আপ্যায়ন করতে করতে সূর্যরশ্মি যজমানকে স্বর্গে নিয়ে যায়।
প্লবা হ্যেতে অদৃঢ়া যজ্ঞরূপা
অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম।
এতচ্ছ্রেয়ো যেঽভিনন্দন্তি মূঢ়া
জরামৃত্যুং তে পুনরেবাপি যন্তি॥৭
অন্বয়: এতে হি (এই সকল); অষ্টাদশ যজ্ঞরূপাঃ প্লবাঃ (আঠারজন ব্যক্তির দ্বারা কৃত যজ্ঞরূপ ভেলাগুলি); অদৃঢ়াঃ (অদৃঢ়, অনিত্য); যেযু (যাতে অর্থাৎ যে আঠারজন ব্যক্তিকে আশ্রয় করে); অবরং কর্ম (নিকৃষ্ট কর্ম); উক্তম্ (শাস্ত্রে বলা হয়েছে); যে মূঢ়াঃ (যে অবিবেকী ব্যক্তিরা); এতৎ শ্রেয়ঃ অভিনন্দন্তি (শ্রেয়োলাভের উপায় রূপে প্রশস্তি করেন); তে পুনঃ এব (তাঁরা পুনরায়); জরামৃত্যুম্ অপিযন্তি (জরামৃত্যুকে প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: যজ্ঞে আঠারো জন ব্যক্তির প্রয়োজন : যজমান স্বয়ং, তাঁর পত্নী ও ষোলজন ঋত্বিক বা পুরোহিত। তাঁরা সকলেই মরণশীল, অতএব তাঁরা যা করেন তাও ক্ষণস্থায়ী ও বিনাশী। সেই অর্থে তাঁরা যে যজ্ঞ করেন তা নিকৃষ্ট কর্ম। ভেলার মতোই তাঁদের যজ্ঞকর্ম অনিত্য এবং (সংসার সমুদ্র পার করতে) অক্ষম। তবু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা এই কর্মকে শ্রেয়োলাভের উপায় বলে মনে করেন। বস্তুত এই কর্মের ফলে স্বর্গলাভ হতে পারে, কিন্তু এই স্বর্গসুখ নেহাতই সাময়িক। স্বর্গের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই তাঁদের পুনর্জন্ম হয়, এবং আবার তাঁরা জন্মমৃত্যুর চক্রে প্রবেশ করেন।
ব্যাখ্যা: অগ্নিহোত্র ও অন্যান্য যজ্ঞ সম্পাদন করতে আঠারোজন ব্যক্তির প্রয়োজন—যজমান, তাঁর পত্নী ও যোলজন পুরোহিত। এই যজ্ঞ খুবই জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাধ্য। সেকালে মানুষের অর্থও ছিল, অবসরও ছিল। আর ছিল এইসব ক্রিয়াকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা। সুতরাং জটিল হলেও তাঁরা এই যজ্ঞ করতে পিছপা হতেন না। কিন্তু শাস্ত্র বড় স্পষ্ট বক্তা। শাস্ত্র সরাসরি বলে দেন যে, এই জাতীয় অনুষ্ঠান সুখপ্রদ হতে পারে কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে না। জীবনের উদ্দেশ্য হল মোক্ষলাভ। মোক্ষ বলতে কি বোঝায়? এ এমন এক অবস্থা যেখানে আমি স্বয়ং আমার প্রভু, আমার কর্তা। আর কিছু আমাকেবিচলিত করতে পারে না। ধনী বা নির্ধন—উভয় অবস্থাতেই আমি সুখী। আমার কোন অভাব নেই, অভাববোধও নেই। কেউ হয়তো বলবেন, ‘এ যে দেখছি হেরেই বসে আছে। অর্থের অভাব, তাই বলছে “আঙুর ফল টক”।’ আসলে কিন্তু তা নয়। এ ব্যাপারে শাস্ত্র খুব স্পষ্ট। যদি আমার মনে বাসনা থাকে, আর তা পূরণের জন্য যজ্ঞ করতে চাই, তবে শাস্ত্র বলবেন, ‘তথাস্তু’। শাস্ত্র আপত্তি করবেন না, কিন্তু আমাদের সতর্ক করে দেবেন, ‘মনে রেখো, এই সুখভোগ বেশি দিনের জন্য নয়। একটা সময় আসবে যখন তুমি ক্লান্ত বোধ করবে, হয়তো বা ভোগের ক্ষমতাই থাকবে না। অথবা দেখবে সব সুখই হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গেছে, সুখের আর লেশমাত্র নেই।’ জীবন এভাবেই বয়ে চলে। একে হেরে যাওয়া বলে না; এ হল বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়া। আমরা যেন দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে বলছি, ‘সব ঠিক চলছে’। কিন্তু চলছে কি? পরিবর্তনই জগতের স্বভাব, একথা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। জগতে কোন বস্তুই চিরস্থায়ী নয়—বিবেকী ব্যক্তি একথা মনে রাখেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা ভুলে যায়। তারা বারবার বিষয়সুখের পিছনে ছোটে এবং পরিণামে দুঃখ পায়।
শাস্ত্র আচার-অনুষ্ঠানের নিন্দা করছেন না। শাস্ত্র বলেন, এইসব ক্রিয়াকর্ম আমাদের কিছু দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, আমাদের আত্মসংযম শেখায়, কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে না। যজ্ঞ করে বিত্ত, দীর্ঘ পরমায়ু, সৌন্দর্য, স্বর্গ এসব হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু মোক্ষ দিতে পারে একমাত্র আত্মজ্ঞান। উপনিষদ বলছেন, ‘মূঢ়াঃ অভিনন্দন্তি এতৎ শ্রেয়ঃ’—নির্বোধ ব্যক্তিরা এই ক্রিয়াকর্মের পথকেই শ্রেষ্ঠ বলে প্রশস্তি করে। কেন করে? কারণ এ পথে তারা স্বর্গে যেতে পারবে এবং দেবদেবী এমন-কি ইন্দ্রপদও লাভ করতে পারবে। কিন্তু এরা মূর্খ। যজ্ঞকর্ম যেন ‘অদৃঢ়া প্লবাঃ’—পলকা ভেলা মাত্র। সমুদ্র পার হতে গেলে প্রয়োজন একটি মজবুত নৌকা, তাতে ছিদ্র থাকলে চলবে না। মুমুক্ষু ব্যক্তি যদি যাগযজ্ঞ করে মোক্ষ পেতে চান তাহলে বুঝতে হবে বাহন হিসেবে তিনি এমন একটি নৌকা বেছে নিয়েছেন, যা অত্যন্ত পলকা এবং নিজেই ডুবতে বসেছে। এ পথ মোক্ষের পথ নয়। বেদান্ত বারবার বলছেন—একমাত্র আত্মজ্ঞানই মোক্ষ দিতে পারে। বেদান্ত আরও বলেন, নির্বোধ ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা করে না, অতএব জরামৃত্যুর অধীন হয়ে একই জায়গা থেকে তাকে বারবার শুরু করতে হয়—‘জরামৃত্যুং তে পুনঃ এব অপিযন্তি’।
এর অর্থ কি এই, যিনি মুক্ত যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর আর মৃত্যু হয় না? না, তা নয়। মোক্ষলাভ হলেও মানুষের মৃত্যু হবেই। কিন্তু আত্মজ্ঞ ব্যক্তির মৃত্যুবোধ থাকবে না। কারণ তিনি জানেন তিনি দেহ থেকে আলাদা। তাঁর কাছে মৃত্যুর কোন গুরুত্ব নেই। তিনি জানেন এ শুধু তাঁর দেহের মৃত্যু। দেহ জরা-ব্যাধিগ্রস্ত হলে তাকে পুরনো ছেঁড়া কাপড়ের মতো ত্যাগ করাই ভাল। এই দেহ তখন ছিন্নবস্ত্রের মতো। কিন্তু সাধারণ মানুষ মৃত্যুভয়ে কাতর। বস্তুত মৃত্যুর ধারণা তার কাছে ভয়াবহ। সে মরতে চায় না। অন্যদিকে, যাঁর মোক্ষলাভ হয়েছে তিনি জানেন মৃত্যুর অর্থ শরীরের মৃত্যু, তাঁর মৃত্যু নেই।
অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ
স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতং মন্যমানাঃ।
জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি মূঢ়া
অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ॥৮
অন্বয়: মূঢ়াঃ (অবিবেকী ব্যক্তিরা); অবিদ্যায়াম্ অন্তরে (অবিদ্যার মধ্যে অর্থাৎ অজ্ঞানতার মধ্যে); বর্তমানাঃ (থেকে); স্বয়ম্ (নিজেকে); ধীরাঃ পণ্ডিতম্ (বুদ্ধিমান পণ্ডিত); মন্যমানাঃ (মনে করেন [তাঁরা]); জঙ্ঘন্যমানাঃ (নানা অনর্থে বার বার পীড়িত হয়ে); যথা (যেমন); অন্ধেন (অন্ধব্যক্তির দ্বারা); নীয়মানাঃ (পরিচালিত হয়ে); অন্ধাঃ (অন্ধব্যক্তিগণ); পরিযন্তি (ঘুরপাক খেতে থাকেন)।
সরলার্থ: অজ্ঞানে নিমজ্জিত কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞ বলে মনে করেন। এমন ব্যক্তিরা একটার পর একটা অনর্থে পড়েন—ঠিক যেমন এক অন্ধের দ্বারা চালিত হয়ে অন্য অন্ধ ব্যক্তিরা শুধু ঘুরপাকই খেতে থাকেন।
ব্যাখ্যা: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করেন। কিন্তু আসলে তাঁরা অজ্ঞানতার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছেন। তাঁরা অজ্ঞান, কিন্তু ‘স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতং মন্যমানাঃ’, তাঁরা নিজেদের বিজ্ঞ ও পণ্ডিত বলে মনে করেন। ‘জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি’—তাঁরা এই জন্মমৃত্যুর নাগরদোলায় ঘুরতেই থাকেন। তাঁদের বারবার জন্ম হয়, বারবার মৃত্যু। ‘মূঢ়াঃ’—এই নির্বোধ ব্যক্তিরা পেণ্ডুলামের মতো জন্মমৃত্যুর মাঝে দুলছেন। ‘অন্ধাঃ’—তাঁরা অন্ধ, আবার আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে চান। এই অঘটন সবসময় ঘটে চলেছে। এই সব মানুষ গভীর চিন্তা করেন না, নিত্য-অনিত্য ভালমন্দ বিচার করেন না। ধীরে ধীরে তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে যান। এ তো আত্মহত্যার সামিল।
আবার কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন, বিবেকী এবং চিন্তাশীল। তাঁরা একবার দেখেই বস্তুর মর্মার্থ গ্রহণ করতে পারেন। এই জগৎ ক্ষণস্থায়ী তা তাঁরা জানেন। তাই তুচ্ছ সুখভোগে তাঁদের স্পৃহা নেই। কঠ উপনিষদের নচিকেতার চরিত্র এর দৃষ্টান্ত। অর্থ, দীর্ঘ পরমায়ু ও নানা ভোগের উপকরণ দিয়ে যম নচিকেতাকে বারবার প্রলুব্ধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু নচিকেতা জানতেন এসব ক্ষণস্থায়ী বস্তু তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারবে না। আর এই অতৃপ্তি মানুষের পক্ষে কল্যাণকর। এই অতৃপ্তিই মানুষকে ঈশ্বরের কাছে, সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে। এই রকম ব্যক্তি পরম সত্য ছাড়া অন্য কিছুই গ্রহণ করেন না।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিই অগভীর; তাঁরা বস্তুর মর্মস্থলে পৌঁছতে পারেন না। ‘অবিদ্যায়াম্ অন্তরে বর্তমানাঃ’—তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। একটু বিত্ত, একটু সাফল্য, একটু সৌন্দর্য, এবং অল্প বিদ্যালাভ হলেই অধিকাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। এঁদের বুদ্ধি শিশুর মতোই অপরিণত। তাঁরা কিন্তু মনে করেন তাঁরা খুব ভাল আছেন। উপনিষদকাররা এই সব মানুষদের জন্য দুঃখ বোধ করেন, এঁদের সতর্ক করে দিতে চান। তাই যাঁরা ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছুটছেন, এই শ্লোকে তাঁদের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।
অবিদ্যায়াং বহুধা বর্তমানা
বয়ং কৃতার্থা ইত্যভিমন্যন্তি বালাঃ।
যৎ কর্মিণো ন প্রবেদয়ন্তি রাগাৎ
তেনাতুরাঃ ক্ষীণলোকাশ্চ্যবন্তে॥৯
অন্বয়: বালাঃ (মূর্খব্যক্তিগণ); অবিদ্যায়াম্ (অবিদ্যাতে); বহুধা (নানাভাবে); বর্তমানাঃ (থেকে); বয়ম্ (আমরা); কৃতার্থাঃ (কৃতার্থ); ইতি (এইরূপ); অভিমন্যন্তি (অভিমান করেন অর্থাৎ অহঙ্কার করেন); যৎ (যেহেতু); রাগাৎ (কর্মফলে আসক্তিবশত); [এই মুর্খ] কর্মিণঃ (সকাম কর্মিগণ); প্রবেদয়ন্তি ন (প্রকৃত পথ [জ্ঞানের পথ] জানেন না); তেন (সেই হেতু); ক্ষীণলোকাঃ (কর্মফল-ভোগাবসানে); আতুরাঃ (পীড়িত হয়ে); চ্যবন্তে (স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন)।
সরলার্থ: কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন যাঁদের আচরণ শিশুসুলভ। বহু বিষয়েই তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তবু নিজেদের সর্বজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে জাহির করেন। তাঁরা নিজেদের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত বলে দাবী করেন। আসলে কর্মফলে আসক্তিবশত তাঁরা যাগযজ্ঞ নিয়ে মত্ত থাকেন। সঠিক পথ তাঁদের অজানা। তাই তাঁরা কিছুকাল স্বর্গসুখ ভোগ করেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন এবং অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করেন।
ব্যাখ্যা: এই অংশে উপনিষদ বলছেন, মানুষের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমটি জ্ঞানের পথ অর্থাৎ বিচারের পথ; অন্যটি যাগযজ্ঞ তথা সকাম কর্মের পথ। উপনিষদ বলছেন, যদি মোক্ষ উদ্দেশ্য হয় তাহলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। নিজের প্রকৃত স্বরূপ জানলে তবেই মুক্তিলাভ হয়। আত্মজ্ঞানী জানতে পারেন তাঁর ভেতরেই সব রয়েছে, তিনি বাইরে কোন কিছুর অধীন নন। তিনি নিজেই নিজের প্রভু, সদামুক্ত, সদাপ্রসন্ন।
কিন্তু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা সকাম কর্মের পথ (অর্থাৎ যাগযজ্ঞ) বেছে নেন। উপনিষদ বলছেন, তাঁরা ‘অবিদ্যায়াং বর্তমানাঃ’—অজ্ঞানতায় ডুবে আছেন, ‘বহুধা’—নানাভাবে। অর্থাৎ তাঁরা নিজেরাও জানেন না তাঁরা অজ্ঞান। তাঁরা মনে করেন, ‘বয়ং কৃতার্থাঃ’—আমরা সব পেয়েছি, আমরা কৃতার্থ। সন্তান, বিত্ত, রূপ, যৌবন, সবই তাঁদের আছে। তাই তাঁরা বলেন, ‘আমরা ভাল আছি।’ কিন্তু তাঁদের কিসের অভাব তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘উটের অবস্থা দেখ! তারা কাঁটাঘাস খেতে ভালবাসে। খেতে গিয়ে মুখ দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ে, কিন্তু ছাড়ে না।’ আমাদের অনেকের অবস্থাই এই রকম, জগতের অসার বস্তুর পিছনে ছুটে চলেছি। এই জন্যই একে বলে মায়া। এঁরা কেন এমন করেন তার ব্যাখ্যা মেলে না। তাঁরা যে একেবারেই অজ্ঞ তা নয়। তাঁরা জানেন এপথে দুঃখ অনিবার্য। তবু তাঁরা এই পথই বেছে নেন, এবং নিজেদের বিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে মনে করেন। উপনিষদ তাঁদের ‘বালাঃ’ অর্থাৎ শিশু বলে উল্লেখ করেছেন। শিশুদের মতোই তাঁরা অপরিণত-বুদ্ধি। অথচ অধিকাংশ মানুষই এইভাবে ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছোটে। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সারাজীবন ধরে যাগযজ্ঞ করেন—তাঁরাই হলেন ‘কর্মিণঃ’। ‘ন প্রবেদয়ন্তি’—তাঁরা চিন্তা করেন না, বিচার করেন না, কিছু ধারণা করতেও পারেন না। কিন্তু কেন? ‘রাগাৎ’—তাঁরা ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত। তাঁরা অন্ধ। তাঁদের জীবনের পরিণতি কি? ‘আতুরাঃ’—তাঁরা দুঃখভোগ করেন। দীর্ঘায়ু, মান-যশ এমনকি স্বর্গলোকও তাঁরা লাভ করতে পারেন, কিন্তু ‘ক্ষীণলোকাঃ’ অর্থাৎ তাঁদের পুণ্যকর্মের ফল ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে। এখানে ‘লোকাঃ’ শব্দটির অর্থ কর্মফল। যত সুকৃতিই থাকুক না কেন তার মূল্য অতি সামান্যই, কারণ তারা স্বল্পমেয়াদী। সেই সুকৃতির ফল অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন।
ইষ্টাপূর্তং মন্যমানা বরিষ্ঠং
নান্যচ্ছ্রেয়ো বেদয়ন্তে প্রমূঢ়াঃ।
নাকস্য পৃষ্ঠে তে সুকৃতেঽনুভূত্বে-
মং লোকং হীনতরং বা বিশন্তি॥১০
অন্বয়: প্রমূঢ়াঃ (অত্যন্ত মূঢ় ব্যক্তিরা); ইষ্টাপূর্তম্ (যাগযজ্ঞ এবং কূপ খনন প্রভৃতি পূর্তকর্মকে); বরিষ্ঠম্ (শ্রেষ্ঠ কর্ম); মন্যমানাঃ (মনে করেন); অন্যৎ (অন্য কিছুকে); শ্রেয়ঃ (শ্রেয়); ন বেদয়ন্তে (জানেন না); তে (তাঁরা); সুকৃতে (পুণ্যকর্ম করে); নাকস্য (স্বর্গের); পৃষ্ঠে (উপরিভাগে); অনুভূত্বা (তাঁদের কর্মফল ভোগ করেন); ইমং লোকম্ (এই মনুষ্য লোকে); হীনতরং বা (অথবা তার থেকেও হীনতর লোকে); বিশন্তি (প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চূড়ান্ত নির্বোধ। তাঁরা মনে করেন যাগযজ্ঞ এবং (কূপ, দীঘি খনন ইত্যাদি) জনহিতকর কর্মই সর্বোত্তম। এর চেয়ে মহত্তর কিছু থাকতে পারে তা তাঁরা জানেন না। এই সব সৎ কর্মের ফলে মৃত্যুর পর তাঁদের স্বর্গলাভ হয়, এবং নির্দিষ্ট কাল ব্যাপী তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগ করেন। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন (এবং মনুষ্যরূপে অথবা ইতর প্রাণী রূপে তাঁদের পুনর্জন্ম হয়)।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বারবার প্রশ্ন করছেন : আমরা কোন্ পথ বেছে নেব? বেদে দুটি পথের কথা বলা হয়েছে: কর্মকাণ্ড (কর্মের পথ) ও জ্ঞানকাণ্ড (জ্ঞানের পথ)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রবর্তিত আর্যসমাজের কথা আমরা অনেকেই জানি। তিনি বলতেন, ‘চলুন, আমরা কর্মকাণ্ডে ফিরে যাই, বৈদিক ক্রিয়াকর্ম করি।’ কিন্তু বেদান্ত বলেন, ‘যাঁরা ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত, তাঁদের জন্য কর্মকাণ্ড।’ এ পথে মোক্ষলাভ হয় না। মুক্তি পেতে গেলে জ্ঞানের পথ অনুসরণ করতে হবে; জ্ঞান ও বিচারের অনুশীলন করতে হবে। উপনিষদে প্রধানত জ্ঞানকাণ্ডের কথাই বলা হয়েছে।
বর্তমান উপনিষদে কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত দু-ধরনের কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে : ইষ্টম্ ও পূর্তম্। ইষ্টম্ বলতে যাগযজ্ঞ করাকে বোঝায়, আর পূর্তম্ বলতে বোঝায় জনহিতকর কর্ম—যেমন কূপ খনন, পথঘাট নির্মাণ ইত্যাদি। এই সব কার্য উত্তম ও নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এর দ্বারা মোক্ষলাভ করা যায় না। ‘ইষ্টাপূর্তং মন্যমানা বরিষ্ঠম্’—কিছু মানুষ আছেন যাঁরা এই সব কর্মকে ‘বরিষ্ঠ’ অর্থাৎ অতি উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করেন। উপনিষদ এই সব মানুষকে বলছেন ‘প্রমূঢ়া’ অর্থাৎ অসার, নির্বোধ এবং অজ্ঞ। ‘অন্যৎ শ্রেয়ঃ ন বেদয়ন্তি’—এর চেয়ে ভাল কোন কিছু তাঁদের জানা নেই। দরিদ্রসেবা, কূপ খনন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদি সুকৃতির বলে তাঁরা হয়তো স্বর্গলাভ করেন (নাকস্য পৃষ্ঠে)। কিছু কাল তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগও করেন (অনুভূত্বা); পাঁচ বছর, দশ বছর বা আরও বেশি। কিন্তু তারপর তাঁদের এই পৃথিবীতে (ইমং লোকম্) ফিরে আসতে হয় অথবা পৃথিবীর চেয়েও কোন নিম্নতর লোকে তাঁদের যেতে হয় (হীনতরং বা)। কেন তাঁদের এই নিম্নতর লোকে যেতে হয়? তাঁরা স্বর্গে গিয়েছিলেন তাঁদের সৎকর্মের জন্য, কিন্তু হয়তো তাঁরা কিছু অসৎ কর্মও করেছেন; সুতরাং এই অসৎ কর্মের ফলভোগও তাঁদের করতে হবে। আর সেইজন্যই তাঁদের হীনতর লোকে গমন করতে হয় (‘হীনতরং বিশন্তি’—অর্থাৎ প্রবিশন্তি বা প্রবেশ করেন)। এই সব মানুষ নির্বোধ ও অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেন (আতুরাঃ)। জন্মমৃত্যুর চক্রে তাঁরা বারবার বদ্ধ হন। এই চক্রের থেকে নিষ্কৃতি লাভ কিভাবে সম্ভব? কেবলমাত্র আত্মজ্ঞানের দ্বারা।
অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, জনহিতকর কার্য থেকে মানুষ বিরত থাকবে, অথবা কোন কর্মই সে করবে না। এখানে কর্ম বলতে শাস্ত্র সকাম কর্মকে বুঝিয়েছেন। নাম, যশ, সন্তান, বিত্তলাভ অথবা স্বর্গপ্রাপ্তি ইত্যাদি। কোন ফল আকাঙ্ক্ষা করে কর্ম করাকে সকাম কর্ম বলা হয়। এই যুগে এসব ফললাভের জন্য মানুষ যাগযজ্ঞ করে না। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা উপাসনা ইত্যাদি করতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা মোক্ষলাভ হয় না। আবার মানুষ নিষ্কাম কর্মও করতে পারে। কর্মফলে আসক্তি না রেখে কর্ম করাকে বলে নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মই ভগবদ্গীতার মূল বাণী—ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে সব কর্ম কর। সৎ কর্ম কর; যথাসাধ্য এবং আন্তরিকভাবে কর্ম কর। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সংবাদপত্রে নিজের নাম দেখার জন্য যদি জনহিতকর কর্মও করে থাক তবে তাও সকাম কর্ম। লোকহিতে কাজ উত্তম সন্দেহ নেই, কিন্তু তা তোমাকে মোক্ষের পথ দেখাতে পারবে না।
তাই শাস্ত্র মানুষকে পথের নির্দেশ দেন, কর্মফল ব্যাখ্যা করেন কিন্তু আসল দায়িত্ব মানুষের নিজের ওপর। সে ভালমন্দ, নিত্য-অনিত্য বিচার করবে। নিজের পথ সে বেছে নেবে। এককথায়, সে নিজেই হবে তার ভাগ্যবিধাতা।
তপঃশ্রদ্ধে যে হ্যুপবসন্ত্যরণ্যে
শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ।
সূর্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্রয়ান্তি
যত্রামৃতঃ স পুরুষো হ্যব্যয়াত্মা॥১১
অন্বয়: যে হি (যাঁরা); শান্তাঃ (সংযতেন্দ্রিয়); বিদ্বাংসঃ (জ্ঞানী ব্যক্তিগণ); ভৈক্ষ্যচর্যাম্ (ভিক্ষাবৃত্তি); চরন্তঃ (অবলম্বন করে); অরণ্যে (বনে); তপঃশ্রদ্ধে (তপস্যা ও শ্রদ্ধার অনুষ্ঠান করেন); উপবসন্তি (বাস করেন); তে (তাঁরা); বিরজাঃ (রজোগুণ শূন্য হয়ে); সূর্যদ্বারেণ (উত্তরায়ণ পথে); [তত্র] প্রয়ান্তি (প্রবেশ করেন); যত্র (যেখানে); সঃ (সেই); অমৃতঃ (অমর); অব্যয়াত্মা (অব্যয় আত্মা); পুরুষঃ (পুরুষ অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ [বাস করেন])।
সরলার্থ: কিছু সংযতেন্দ্রিয়, বিদ্বান ব্যক্তি আছেন যাঁরা অরণ্যে বাস করেন এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেন। পরম সত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা কৃচ্ছ্র সাধন ও তপস্যা করেন। এভাবে তাঁদের চিত্ত শুদ্ধ হয়। মৃত্যুর পর সূর্যদ্বার পথে (উত্তরায়ণ মার্গে) তাঁরা সেই লোকে যান যেখানে অবিনাশী অক্ষয় পুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন। একেই বলে ব্রহ্মলোক।
ব্যাখ্যা: এখানে উপনিষদ আর এক শ্রেণীর মানুষের কথা বলছেন। এই সব মানুষ গৃহীর জীবন যাপন করলেও বুঝে নিয়েছেন যে আত্মোপলব্ধিই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। পারিবারিক এবং সামাজিক, সর্বপ্রকার দায়িত্ব পালনের পর তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন। তাই তাঁরা সংসার থেকে অবসর নিয়ে বানপ্রস্থ হয়েছেন। অধিকাংশ উপনিষদ এই সব বানপ্রস্থদের রচনা। সংসারের অসারতা তাঁরা দেখেছেন, তাঁদের বিবেক-বৈরাগ্য জেগেছে; তাই তাঁরা অবসর নিয়েছেন। এ ছিল প্রাচীন ভারতের রীতি। ছেলে বড় হলে পরিবারের সকল দায়িত্ব পিতামাতা তার উপর অর্পণ করে নিজেরা বনবাসী হতেন, এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও ধ্যান-ধারণায় সময় কাটাতেন।
এই বানপ্রস্থগণ ছিলেন ‘শান্তাঃ’—তাঁদের অন্তরে ছিল শান্তি। তাঁদের সকল বাসনা দূর হয়েছে, তাঁরা সংযতেন্দ্রিয়। তাঁরা ‘বিদ্বাংসঃ’ অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ, বিদ্বান, পণ্ডিত, প্রাজ্ঞ এবং চিন্তাশীল। ‘বিরজাঃ’—তাঁদের সকল মলিনতা দূর হয়ে গেছে। কি এই মলিনতা? বাসনা এবং অহং-বুদ্ধি। ‘ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ’—যেদিন যা ভিক্ষা পাওয়া যেত তাই দিয়েই চলে যেত তাঁদের জীবন। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন বাসনামুক্ত। ‘যথেষ্ট ভোগ করেছি, আর নয়। এখন আধ্যাত্মিক জীবনচর্যার সময়। এই জীবনের অর্থ কি, উদ্দেশ্য কি, আমি জানতে চাই। কিভাবে শান্তি পাব?’— এই ছিল তাঁদের মনোভাব।
আমরা অধিকাংশ মানুষই জানি না কখন সংসার ত্যাগ করতে হয় বা কখন অবসর নিতে হয়। আর সেইজন্যই এত দুঃখ পাই। জীবনে একটা সময় আসে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, ‘এই সংসারে যথেষ্ট হয়েছে। এখন অবসর নেব।’ এর অর্থ এই নয় যে, তুমি জীবন থেকে পালিয়ে যাচ্ছ অথবা দীর্ঘ অবকাশ কাটাতে চলেছ। এ আর একরকমের জীবন, যে-জীবন আরও কঠিন, আরও সংগ্রামের। হয়তো কোন ব্যক্তি সংসারে ধনী ছিলেন, বিলাসিতায় অভ্যস্ত ছিলেন। এখন এই বনবাসে আরামের কোন অবকাশই নেই। কিন্তু অচিরেই দেখা যায় এর জন্য তাঁর মনে কোন অভাববোধও নেই। আপন অন্তরের সম্পদ তিনি আবিষ্কার করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের দুজন ইংলণ্ডের শিষ্য ছিলেন—ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও তাঁর পত্নী শ্রীমতী সেভিয়ার। তাঁরা স্বামীজীর সঙ্গে ভারতে এসে মায়াবতীতে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক বছরের মধ্যে স্বামীজীর ও ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মৃত্যু হয়। তখন সকলেই ভাবলেন শ্রীমতী সেভিয়ার আর মায়াবতীতে থাকতে পারবেন না। স্থানটি যেমন দুর্গম, তেমনি নির্জন। সেখানে আরামের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। তিনি কিন্তু খুশী হয়েই সেখানে থেকে গেলেন। একবার তাঁর কাছে একজন জানতে চেয়েছিলেন ওই নির্জন জীবন তিনি সহ্য করছেন কেমন করে! উত্তরে শ্রীমতী সেভিয়ার জানান, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বহু স্মৃতি আমার মনে সঞ্চিত রয়েছে। সেই স্মৃতির আনন্দ এবং প্রেরণাই কি আমার বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’ বহুবছর তিনি মায়াবতীতে একক জীবন অতিবাহিত করেছেন; শেষের দিকে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তখন সকলের পরামর্শে তিনি ইংলণ্ডে ফিরে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
অধিকাংশ মানুষই এরকম জীবন যাপনকে অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করবেন। কঠ উপনিষদ বলছেন, ঈশ্বর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে স্বভাবতই তারা বহির্মুখী। চোখ, কান ইত্যাদি সকল ইন্দ্রিয়ই বাইরের দিকে দেখছে। যদি ওই ইন্দ্রিয়গুলিকে ভিতরদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, দেখব অন্য এক জগৎ। বর্তমানে আমরা সেই জগৎ সম্পর্কে সচেতন নই, যদিও সেই অন্তর্জগৎ বাইরের জগতের মতোই সত্য। বরং কোন কোন মানুষের কাছে এই অন্তর্জগৎই বেশী সত্য। ধ্যানের দ্বারা এই জগতের বিভিন্ন দিক তাঁরা আবিষ্কার করেন। আনন্দ, প্রেরণা এবং শক্তির নিত্য নতুন উৎস সেখানে খুঁজে পান। আরাম, আনন্দ বা শক্তির জন্য তাঁরা বাইরের জগতের অপেক্ষা করেন না। সব সম্পদ তাঁদের অন্তরেই রয়েছে। উপনিষদ বলেন : ‘আত্মাই সকল বস্তুর উৎস।’
এখন কেউ বলতে পারেন যে, বাইরের বস্তুতে অবশ্যই আনন্দ আছে। কিন্তু বেদান্ত বলেন: যদি তাই হয়, তবে কেন একই বস্তু একজনের কাছে সুখপ্রদ আবার অন্যের কাছে দুঃখজনক। আনন্দ যদি সেই বস্তুরই ধর্ম হয়, তবে তা সর্বত্র সকলের কাছেই আনন্দদায়ক হবে। ধরা যাক—ক্ষেতে একজন কাজ করছে আর তুমি তাকে একটি কবিতা পড়ে শোনাচ্ছ। সে বলে উঠতে পারে: ‘কি যা তা সব পড়ে যাচ্ছ।’ অন্যান্য ব্যাপারে সে হয়তো বুদ্ধিমান কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তু সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আবার কোন দর্শকের কাছে আধুনিক চিত্রকলা অর্থহীন বলে মনে হতে পারে; কিন্তু আর একজন হয়তো বলছে, ‘চমৎকার হয়েছে’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আনন্দ বাইরের বস্তুতে নেই। আনন্দ রয়েছে আমাদের অন্তরে।
কিভাবে এইসব গৃহীরা জেনেছেন যে আনন্দ বা শান্তি বাইরের জগতে নেই, কেমন করেই বা তাঁরা তাঁদের মনকে অন্তর্মুখী করেছেন তার বর্ণনা উপনিষদে পাই। উপনিষদ বলেন, মৃত্যুর পর এই সব মানুষ সূর্যদ্বার পথে অর্থাৎ উত্তরায়ণ মার্গে যান। এই বানপ্রস্থগণ প্রাজ্ঞ, তাই তাঁরা আলোর পথ অর্থাৎ সূর্যের পথ অনুসরণ করেন। কোথায় যান তাঁরা? হিরণ্যগর্ভ তথা ব্রহ্মলোকে। অবশ্য তখনও তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত নন। তখনও তাঁদের মোক্ষলাভ হয়নি, তবে মোক্ষের পথে চলেছেন। এ এক মধ্যবর্তী অবস্থা, মোক্ষের কাছাকাছি তাঁরা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা না চাইলে ফিরে আসতে হয় না। কালে ব্রহ্মলোকে তাঁদের পরাগতি অর্থাৎ মোক্ষলাভ হয়।
পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো
নির্বেদমায়ান্নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন।
তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ
সমিৎপাণিঃ শ্ৰোত্ৰিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্॥১২
অন্বয়: কর্মচিতান্ (কর্মের দ্বারা অর্থাৎ যাগযজ্ঞের দ্বারা লব্ধ); লোকান্ (লোকসকলকে); পরীক্ষ্য (পরীক্ষা করে); ব্রাহ্মণঃ (ব্রাহ্মণ যিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসু); নির্বেদম্ (বৈরাগ্য); আয়াৎ (অভ্যাস করবেন); [যেহেতু] কৃতেন (কর্মের দ্বারা); অকৃতঃ (অকৃত অর্থাৎ নিত্যবস্তু); ন অস্তি (হয় না; লাভ হয় না); তৎ (সেই নিত্যবস্তু); বিজ্ঞানার্থম্ (জানবার জন্য); সঃ (তিনি); সমিৎপাণিঃ (সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে); শ্রোত্রিয়ম্ (বেদজ্ঞ); ব্রহ্মনিষ্ঠম্ গুরুম্ (ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর কাছে); এব অভিগচ্ছেৎ (যান)।
সরলার্থ: আনুষ্ঠানিক উপাসনাদির ফল যে ক্ষণস্থায়ী একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাঁকে আকর্ষণ করে না। যা নিত্য তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, একথা তিনি জানেন। এই জন্যই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ আচার্যের অনুসন্ধান করেন। নম্রতার প্রতীক হিসেবে সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে তিনি আচার্যের নিকট উপস্থিত হন।
ব্যাখ্যা: ‘পরীক্ষ্য’ কথাটির অর্থ পরীক্ষা করা, বিবেচনা করা, পরিমাপ করা। নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে। কি পরীক্ষা করব? ‘কর্মচিতান্’—কর্মফল। ‘অকৃতঃ’—কথাটির অর্থ যার সৃষ্টি নেই। আত্মার সৃষ্টি নেই। এখানে উপনিষদ বলছেন, যজ্ঞাদি অনিত্য কর্মের দ্বারা (কৃতেন) অকৃতকে অর্থাৎ নিত্যকে পাওয়া যায় না। সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করে আমরা কি ফল পাব তা আগে বিবেচনা করে দেখতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে : ‘এর দ্বারা কি মনের শান্তি পাওয়া যাবে? আমার কি মোক্ষলাভ হবে?’ এইভাবে বিচার করলে তবেই ‘নির্বেদম্ আয়াৎ’ অর্থাৎ বৈরাগ্য আসবে। তখন সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। কঠ উপনিষদের নচিকেতার উপাখ্যান এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যখন নানা উপচারে যম নচিকেতাকে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন, তখন নচিকেতা নিজেকে প্রশ্ন করলেন ‘এই সব বস্তু কি আমাকে মুক্তি দিতে পারে? অথবা মনের শান্তি?’ যখন উত্তর পেলেন ‘না, তা পারে না’ তৎক্ষণাৎ সেই সব বস্তু প্রত্যাখ্যান করলেন। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দকে কিছু অলৌকিক শক্তি (অষ্ট সিদ্ধি) দিতে চান; স্বামীজী জিজ্ঞাসা করেন এই সব শক্তির দ্বারা মোক্ষ তথা আত্মজ্ঞান লাভ করা যাবে কি না। প্রত্যুত্তরে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ জানালেন—‘না তা যাবে না’ তখন স্বামীজী বললেন : ‘তবে ওসবে আমার প্রয়োজন নেই।’ এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন নির্মম, আপসহীন। একূল ওকূল দুকূল রাখতে গেলে কোন দিকই রক্ষা পায় না, দুকূলই ভেসে যায়। তাই মোক্ষলাভের জন্য চাই আপসহীন তীব্র ব্যাকুলতা—‘আমি আত্মজ্ঞান চাই, আর কিছুই চাই না। এই দেহের যা হয় হোক, আমি সত্যকে জানবই।
উপনিষদ বার বার জোর দিয়ে বলছেন, নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে, যুক্তিতর্ক ধ্যান-ধারণা করতে হবে। উপনিষদের ভাষায়—শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন। শ্রবণ—এর অর্থ শোনা। আচার্য বলছেন, ‘তত্ত্বমসি’—সে-ই তুমি; তুমিই সেই পরমতত্ত্ব; তুমিই পরমাত্মা। প্রথমে এই মহাবাক্য শুনতে হবে। তারপর এই তত্ত্বের মর্মার্থ মনে মনে আলোচনা করতে হবে—মনন। এর পর নিদিধ্যাসন, তত্ত্বটি নিয়ে গভীর ধ্যানে (চিন্তায়) মগ্ন হতে হবে।
সুতরাং এই পরমসত্য শোনার জন্য আচার্যের কাছে যেতে হবে। আচার্য কিরকম হবেন? ব্রহ্মনিষ্ঠম্—অর্থাৎ ব্রহ্মে যাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা। তিনি ব্রহ্ম তথা পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেছেন, তিনি সত্য জ্ঞান লাভ করেছেন। তা যদি তিনি নাকরে থাকেন, স্বয়ং আচার্যই যদি অজ্ঞান হন, তবে শিষ্যকে তিনি কিভাবে সাহায্য করবেন? কি শিক্ষা দেবেন তাকে? উপযুক্ত আচার্যের কাছে ‘সমিৎপাণি’—অর্থাৎ সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে যেতে হবে। এটি শিষ্যের নম্রতার নিদর্শন।
তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্
প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়।
যেনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং
প্রোবাচ তাং তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্॥১৩
অন্বয়: সঃ বিদ্বান্ (সেই ব্রহ্মজ্ঞ গুরু); সম্যক্ (সম্যক্-রূপে); প্রশান্তচিত্তায় (সংযতচিত্ত); শমান্বিতায় (সংযতেন্দ্রিয়); উপসন্নায় তস্মৈ (তাঁর কাছে যে এসেছে সেই শিষ্যকে); তাং ব্রহ্মবিদ্যাম্ (সেই ব্রহ্মবিদ্যা); তত্ত্বতঃ (স্বরূপত); প্রোবাচ (প্রকৃষ্টরূপে বললেন); যেন (যার দ্বারা অর্থাৎ যে বিদ্যার দ্বারা); সত্যম্ (সত্যস্বরূপ); অক্ষরম্ (বিনাশহীন); পুরুষম্ (অন্তর্যামীকে; পুরুষকে); বেদ (জানা যায়)।
সরলার্থ: সর্বপ্রথম শিষ্যকে নিজের মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তারপর তিনি ব্রহ্মজ্ঞ আচার্যের কাছে যাবেন। সেই আচার্য তখন শিষ্যকে ব্রহ্মের স্বরূপজ্ঞান দান করবেন।
ব্যাখ্যা: যখন কোন ব্যক্তি কোন আচার্যের নিকট উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মজ্ঞান প্রার্থনা করেন, তখন প্রথমেই আচার্য শিষ্যকে পরীক্ষা করেন। শিষ্য প্রশান্তচিত্ত কি না অর্থাৎ সে আত্মসংযম আয়ত্ত করেছে কি না তা আচার্য পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি জানতে চান শিষ্য সংযম অভ্যাস করেছে কি না—‘শমান্বিতায়’। নিজেকে আত্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করে তুলতে বেদান্ত ছয়টি প্রয়োজনীয় সাধন-সম্পদের কথা বলেছেন: (১) শম—মনের সংযম, (২) দম—ইন্দ্রিয় সংযম, (৩) তিতিক্ষা—সহিষ্ণুতা, অধ্যবসায়, (৪) উপরতি—ত্যাগ, বৈরাগ্য, (৫) শ্রদ্ধা—বিশ্বাস, (৬) সমাধান—একাগ্রতা। অভ্যাসের দ্বারা এই ষট্ সম্পদ আয়ত্ত হলে বুঝতে হবে, শিষ্য এই পথে অনেক এগিয়ে গেছেন এবং আত্মজ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বেদান্ত বলছেন: ‘এই প্রস্তুতি যেখানে নেই, সেখানে ব্রহ্মবিদ্যা দান নিরর্থক। বাইবেলেও আমরা দেখছি যীশুখ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদের বলছেন : ‘শুয়োরের সামনে মুক্তো ছড়িও না।’ ধরা যাক একদল শুয়োরের সামনে মুক্তো ছড়ানো হল। তারা মুক্তো সম্বন্ধে কিই বা জানে? একইভাবে যার আত্মতত্ত্ব ধারণা করার প্রস্তুতি নেই সেই শিষ্যকে আচার্য ব্রহ্মবিদ্যা দান করেন না। এই হল বেদান্তের ‘অধিকারী ভেদ’। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ক্ষমতাও ভিন্ন ভিন্ন। সব মানুষ এক রকম হয় না। শিক্ষাদানকালে আচার্য ছাত্রদের মধ্য থেকে যোগ্য অধিকারী নিবার্চন করেন।
উপযুক্ত শিষ্য পেলে আচার্য প্রসন্ন হন। তখন তিনি শিষ্যকে পুরুষ তথা আত্মা তথা ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেন। আচার্য স্বয়ং সেই পুরুষকে জেনেছেন। কালে তিনি সেই ব্রহ্মজ্ঞান শিষ্যকে দান করেন, ‘তত্ত্বতঃ’ অর্থাৎ শাস্ত্র অনুসারে।
মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম মুণ্ডকের দ্বিতীয় অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
দ্বিতীয় মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
তদেতৎ সত্যম্-যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাদ্
বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ।
তথাঽক্ষরাদ্ বিবিধাঃ সোম্য ভাবাঃ
প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপিযন্তি॥১
অন্বয়: তৎ এতৎ (সেই অক্ষর পুরুষই); সত্যম্ (সত্যস্বরূপ); যথা (যেভাবে); সুদীপ্তাৎ পাবকাৎ (প্রদীপ্ত অগ্নি থেকে); সরূপাঃ বিস্ফুলিঙ্গাঃ (সমান রূপ বিশিষ্ট স্ফুলিঙ্গগুলি); সহস্রশঃ প্রভবন্তে (সহস্র সহস্র উৎপন্ন হয়); সোম্য (হে সৌম্য); তথা (সেইরূপ); অক্ষরাৎ (অক্ষর পুরুষ থেকে); বিবিধাঃ ভাবাঃ (বিভিন্ন বস্তু ও জীব সমূহ); প্রজায়ন্তে (জন্মায়); তত্র চ এব অপিযন্তি (তাতেই আবার লয় হয়)।
সরলার্থ: সেই ব্রহ্মই সত্য। জুলন্ত অগ্নি থেকে যেমন অগ্নিময় স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, হে সৌম্য, সেই ভাবেই ব্ৰহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায়।
ব্যাখ্যা: এখন প্রশ্ন হল—জগতের সঙ্গে ব্রহ্মের সম্পর্ক কি? আমাদের হয়তো মনে আছে, এই উপনিষদের সূচনা হয়েছিল আচার্যের প্রতি শিষ্যের একটি প্রশ্ন দিয়ে, ‘কস্মিন্ নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বম্ ইদং বিজ্ঞাতং ভবতি’—‘হে প্রভু, কি জানলে বা কোন্ বস্তুকে জানলে (কস্মিন্ নু বিজ্ঞাতে) এই সব কিছুকে (সর্বম্ ইদম্) জানা যায় (বিজ্ঞাতং ভবতি)?’ ‘এই সব’ (সর্বম্ ইদম্) বলতে কি বোঝায়? এই দৃশ্যমান জগৎকে, এই বিশ্বকে বোঝায়। ‘কি জানলে বা কাকে জানলে আমি সমগ্র জগৎকে জানতে পারি?’ উপনিষদের মতে, একমাত্র পরমাত্মাকে জানলেই সমগ্র জগৎকে জানা যায়। পরমাত্মাই এই জগতের মধ্য দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করেছেন, এবং এই জগৎ পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈশ্বরের সঙ্গে জীব ও জগতের সম্পর্ক কি এই নিয়ে যুগ যুগ ধরে তুমুল বিতর্ক চলে আসছে। হিন্দুদর্শন অনুযায়ী, এই জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। এই ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ব্রহ্ম যেন জগতের কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছেন। এই জন্যই ঈশ্বরকে বলা হয় অন্তরাত্মন্ বা অন্তর্যামী—তিনিই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি অন্তরেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। অর্থাৎ তিনি সর্বত্র রয়েছেন।
এই শ্লোকে উপনিষদ বলছেন, ‘তৎ এতৎ সত্যম্’—এ-ই সত্য। একেই সত্য বলে জান। আচার্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে চলেছেন। ‘যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাৎ’—যেমন জ্বলন্ত অগ্নি থেকে; ‘বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে’—সহস্র স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়; ‘সরূপাঃ’—তাদের সব লক্ষণ অগ্নিরই মতো। ‘অক্ষর’ বলতে পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে বোঝানো হয়েছে। কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘অক্ষয়’। আত্মা নিত্য, অবিকারী এবং অপরিবর্তনীয়। ‘বিবিধাঃ ভাবাঃ প্রজায়ন্তে’—বিভিন্ন বস্তু এবং ব্যক্তি ব্ৰহ্ম থেকে উদ্ভূত হয়। ‘তত্র চ এব অপিযন্তি’—এবং তারা সেখানেই ফিরে যায়। অর্থাৎ তারা ব্ৰহ্ম থেকেই আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। এ-ই তাদের সম্পর্ক। এর আগে উপনিষদ মাকড়সা এবং তার জালের দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন। মাকড়সা নিজের ভেতর থেকে জাল বের করে, আবার নিজের মধ্যেই সেই জাল গুটিয়ে নেয়। এই শ্লোকে উপনিষদ আগুন ও তার স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আগুন ছাড়া স্ফুলিঙ্গের কোন অস্তিত্বই নেই। ব্রহ্ম ও জগতের সম্পর্কও সেই রকম। ব্রহ্মই এই জগতের উৎস, এই জগতের মূল। ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম সকল বস্তু ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, এবং ব্রহ্মেই ফিরে যাবে। একটি কথা সবসময় মনে রাখতে হবে তা হল, বেদান্ত মতে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। ‘শূন্য’ থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে একথা বেদান্ত স্বীকার করেন না। জগৎ সৃষ্টি হয়নি, প্রকাশিত হয়েছে—এই হল বেদান্তের কথা। ব্রহ্মই জগতের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছেন।
ব্রহ্ম আছেন বলেই জগতে সব কিছু আছে। ব্রহ্ম নিত্য বিদ্যমান, সৎস্বরূপ। তাই ব্রহ্মকে সৎ বলা হয়। তাঁকে চৈতন্য বা চিৎও বলা হয়—তিনি শুদ্ধ চৈতন্য। ব্রহ্ম স্বরূপত সৎ এবং চিৎ। আমরা কোন ব্যক্তিকে দেখি, আবার একই সঙ্গে দেখি তিনি চলাফেরাও করছেন। অর্থাৎ তিনি চৈতন্যযুক্ত। এই চৈতন্য কোথা থেকে আসে? ব্রহ্ম থেকে। ব্রহ্মই তাঁর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছেন। ব্যক্তিটি যেন তাঁর প্রকাশের একটি মাধ্যম, যেমন বৈদ্যুতিক আলো বা বাতির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকাশিত হয়। কিছু বাতি যেমন বেশি শক্তি-সম্পন্ন, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ বেশী শক্তিমান। আবার কিছু বাতির আলো ক্ষীণ, দুর্বল; তেমনি মানুষের মধ্যেও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা দুর্বল। হিন্দু দর্শন বলে, যা কিছু আছে সবই চৈতন্য। চৈতন্য ছাড়া আর কিছুই নেই। এই চৈতন্য কোথাও প্রকাশিত, কোথাও বা অপ্রকাশিত। একটি কাঠের টুকরোকে আমরা জড় বলি। কিন্তু হিন্দু দর্শন মতে, ‘এ জড় নয়, চেতন। তবে চৈতন্য এখানে অপ্রকাশিত অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন রয়েছে।’ চৈতন্য সর্বত্র এবং সতত বিদ্যমান। এ জগৎ চৈতন্যে পূর্ণ। এই সর্বব্যাপী চৈতন্যই জগতের প্রাণ। চৈতন্যের প্রকাশের তারতম্যেই বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এই চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই দেহকে সচল রাখে। আত্মা বেরিয়ে গেলে হাত আর কাজ করে না, হৃদ্যন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়, শাসক্রিয়া স্তব্ধ হয়। এহেন অবস্থায় ব্যক্তিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। আত্মা দেহকে সক্রিয় রাখে। আত্মাই এই দেহের আশ্রয়। আত্মা নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে এই দেহের মৃত্যু হয়; দেহটি তখন খসে পড়ে। কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা যেমন আমরা পরিত্যাগ করি, আত্মার দেহত্যাগও সেই রকম। একেই বলে মৃত্যু। আসলে আত্মার কিন্তু মৃত্যু হয় না।
জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ এক একটি জীবাত্মা। কিন্তু পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। নামরূপ আরোপিত হয়ে এক পরমাত্মা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হন। নামরূপের জন্যই আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। বস্তুত আমরা আলাদা নই, সেই এক পরমাত্মা। একথা কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। উদ্ভিদ, প্রাণিকুল, এককথায় সব কিছুই এই নামরূপের বৈচিত্র মাত্র। নামরূপই পরমাত্মাকে সীমাবদ্ধ করে। নামরূপের কারণেই আমরা নিজেদের খণ্ডিত বলে মনে করি। সেহেতু আমাদের পরিচয়ও স্বতন্ত্র। কিন্তু নামরূপ তুলে নিলে থাকে শুধু এক ও অভিন্ন সত্তা, পরমাত্মা। যেমন স্ফুলিঙ্গ অগ্নির প্রকাশ, ঠিক তেমনি সকল জীবাত্মা সেই অভিন্ন পরমাত্মা তথা ব্রহ্মেরই প্রকাশ।
দিব্যো হ্যমূর্তঃ পুরুষঃ সবাহ্যাভ্যন্তরো হ্যজঃ।
অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রো হ্যক্ষরাৎপরতঃ পরঃ॥২
অন্বয়: [সঃ] দিব্যঃ (জ্যোতির্ময়); পুরুষঃ (পুরুষ); হি অমূর্তঃ (রূপহীন); সবাহ্যাভ্যন্তরঃ (বাইরে এবং ভিতরে); হি অজঃ (জন্মরহিত); অপ্রাণঃ (প্রাণ-রহিত [নিঃশ্বাস গ্রহণ করেন না]); হি অমনাঃ (মন বর্জিত); শুভ্রঃ (বিশুদ্ধ); হি অক্ষরাৎ (অক্ষর বা কার্য ব্রহ্ম থেকে); পরতঃ পরঃ (শ্রেষ্ঠ থেকেও শ্রেষ্ঠতর)।
সরলার্থ: এই জ্যোতির্ময় পুরুষের কোন রূপ নেই (অর্থাৎ তিনি নির্বিশেষ)। ইনি সর্বব্যাপী—বাইরেও আছেন, ভিতরেও আছেন। ইনি অজাত (অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টি হয়নি)। ইনি প্রাণবায়ু বর্জিত (কারণ ইনি দেহহীন, যেহেতু দেহ থাকলেই দেহের পরিবর্তন থাকবে), এঁর মনও নেই। ইনি শুদ্ধ (নির্গুণ)। এই স্থূল মায়া জগতের (নামরূপের জগৎ) ঊর্ধ্বে তিনি। এমনকি তিনি জগতের বীজরূপ অব্যক্ত প্রকৃতিরও ঊর্ধ্বে।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের স্বরূপ কি? ‘দিব্যঃ’—জ্যোতির্ময়, দীপ্ত, উজ্জ্বল, এবং ‘অমূর্তঃ’—এঁর কোন রূপ নেই, ‘পুরুষঃ’—ব্রহ্ম সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। ‘সবাহ্যাভ্যন্তরঃ’—তিনি সকল বস্তুর ভিতরেও আছেন বাইরেও আছেন। তিনি সর্বব্যাপী। ‘অজঃ’—তাঁর জন্ম নেই। আবার যাঁর জন্ম নেই তাঁর মৃত্যুও নেই। জীব হিসেবে আমরা সকলেই জন্মমৃত্যুর অধীন। কিন্তু পরমাত্মার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। ‘অপ্রাণঃ’—এর আক্ষরিক অর্থ যাঁর প্রাণবায়ু নেই। এর অন্য অর্থ— নিষ্ক্রিয়, দৈহিক কর্মবিহীন এবং অচঞ্চল। নিজে নিষ্ক্রিয় হয়েও ব্রহ্মই সকল কর্ম নিয়ন্ত্রিত করেন। একই ভাবে, ‘অমনাঃ’ কথাটির একটি অর্থ যাঁর মন নেই, মন বর্জিত; এর অপর অর্থ মনের ক্রিয়া যাঁর স্তব্ধ। ‘শুভ্রঃ’—অর্থাৎ নির্মল, শুদ্ধ এবং নির্বিশেষ। ব্রহ্ম তথা পরমাত্মা স্বাধীন, নির্গুণ, অপরিবর্তিত এবং অপরিবর্তনীয়। আমরা কিন্তু বাইরের অবস্থার উপর নির্ভরশীল। যেমন, আলোতে আমরা দেখতে পাই; কিন্তু রাতের অন্ধকারে আমরা অন্ধ। পরমাত্মা কিন্তু বাইরের কোন অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হন না।
‘অক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ’—সেই নির্গুণ ব্রহ্ম সগুণ ব্রহ্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্ম একযোগে সগুণ এবং নির্গুণ। ব্রহ্মকে যখন এই জগৎ-রূপে চিন্তা করি, তখন তাঁকে বলি সগুণ ব্রহ্ম। সগুণ ব্রহ্মই এই জগৎ হয়েছেন। কিন্তু যখন জগতের কথা বাদ দিয়ে শুদ্ধ ব্ৰহ্মকে চিন্তা করি তখন তিনি পরঃ অর্থাৎ পরম্। তখন তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। আসলে দুই-ই অভিন্ন। ব্রহ্মকে গুণের দ্বারা বিশেষিত করলে তিনি সগুণ, আর গুণবর্জিত অর্থাৎ নির্বিশেষ রূপে চিন্তা করলে ব্রহ্ম নির্গুণ। অক্ষর বলতে সগুণ ব্রহ্মকে বোঝায়, যদিও এই সব গুণ তখনও বীজাকারে রয়েছে। অক্ষরকে অব্যক্ত বা প্রকৃতিও বলা হয়। সগুণ ব্রহ্ম নিজেকে এই স্থূল নামরূপের জগৎ-রূপে পূর্ণ প্রকাশ করেন এবং অক্ষর এই জগতের ঊর্ধ্বে। ব্রহ্ম তথা পুরুষ আবার এই অক্ষরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। ইনি-ই শুদ্ধ চৈতন্য তথা নির্গুণ ব্রহ্ম।
এই পরম সত্যকে কিভাবে বর্ণনা করব তা আমরা জানি না। আর সেই জন্যেই আমরা তাঁর উপর নানা গুণ আরোপ করি। আমরা বলি ঈশ্বর মঙ্গলময়। কিন্তু কেমন করে বুঝব তিনি মঙ্গলময়? বস্তুত তা আমরা বুঝতে পারি না। এই গুণ আমরা ঈশ্বরের উপর আরোপ করি মাত্র। এইভাবে গুণের দ্বারা বিশেষিত না করে আমরা ঈশ্বর বা আত্মা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারি না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এই জগতের কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমরা ঈশ্বরের উপর সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা আরোপ করি। আমরা বলি, তিনিই জগৎকে প্রকাশ করেছেন। তিনি তখন সগুণ। আমরা তাঁকে বিশেষিত করছি। আবার যখন উপনিষদ বলেন যে, জ্বলন্ত আগুন থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয় তেমন ভাবেই এই জগৎ ও তার সব বস্তু ব্রহ্ম থেকে আসে, তখন এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্ম। নির্গুণ ব্রহ্মকে কোনভাবেই জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছু বলতে পারি না। এই জন্যই এখানে উপনিষদ বলছেন— ‘অক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ’। নির্গুণ ব্রহ্মই পরম এবং সর্বোচ্চ।
এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ।
খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবী বিশ্বস্য ধারিণী॥৩
অন্বয়: এতস্মাৎ (এর থেকে অর্থাৎ অক্ষর ব্রহ্ম থেকে); প্রাণঃ (প্রাণ); মনঃ (মন); সর্বেন্দ্রিয়াণি (সকল ইন্দ্রিয়); খম্ (আকাশ); বায়ুঃ (বায়ু); জ্যোতিঃ (তেজ); আপঃ (জল); চ (এবং); বিশ্বস্য (বিশ্বের); ধারিণী (ধারক); পৃথিবী (পৃথিবী); জায়তে (উদ্ভূত হয়েছে)।
সরলার্থ: প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় এই পৃথিবী, সব এর থেকেই (অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে) এসেছে।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলছেন, সব কিছু এসেছে এর থেকে (এতস্মাৎ) অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে। প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, জ্যোতি (অগ্নি), জল এবং পৃথিবী—এককথায় পঞ্চভূত এই সগুণ ব্রহ্ম থেকে এসেছে। পৃথিবীকে বলা হচ্ছে ‘বিশ্বস্য ধারিণী’ অর্থাৎ সর্ববস্তুর আশ্রয়। এই দৃশ্যমান সমগ্র জগৎ ও তার অন্তর্গত নরনারী, উদ্ভিদ, পশু, সব কিছুকে পৃথিবী ধারণ করে আছে। পৃথিবী এই দৃশ্যমান জগতের প্রতিষ্ঠাভূমি। কিন্তু মূলত সকল বস্তুই এসেছে ব্রহ্ম থেকে। ব্রহ্মই সকল বস্তুর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, এই জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত। বেদান্তে একটি সহজ উপমা পাই—রজ্জু-সর্পের উপমা। মাটিতে দড়ি পড়ে আছে, অন্ধকারে দেখে মনে হল সাপ। ভয়ে চীৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সেটা আদৌ সাপ ছিল না, দড়ি ছিল। কিন্তু ভুলবশত মনে করেছি সাপ। এই জগৎও সেই রকম। সাপ যেমন দড়িতে আরোপিত, ঠিক তেমনি এই জগৎও ব্রহ্মে আরোপিত। আসল কথা, ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর একটি উপমা দেওয়া যেতে পারে। সম্ভবত এই উপমাটি বেশী উপযুক্ত—পর্দায় ফেলা চলমান ছায়াছবি। দর্শকের আসনে বসে আমরা পর্দার উপর কত বিচিত্র দৃশ্যই না দেখি। তা কখনও হাস্যকর, কখনও বা সংঘাতের। সেগুলি দেখে মনে নানাপ্রকার আবেগের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সব দৃশ্য তো সত্য নয়। তবে সত্য কি? পেছনের পর্দাটিই সত্য। পর্দা আধার, আর চলমান ছবিগুলি তার উপর আরোপিত। পর্দা ছাড়া এই সব ছবির কোন অস্তিত্বই নেই। একই ভাবে বলা যায়, ব্রহ্ম ছাড়া, পরমাত্মা ছাড়া এ জগতের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পরমাত্মাই প্রতিষ্ঠাভূমি, পরমাত্মাই আশ্রয়, আর সমগ্র জগৎ তাঁতে আশ্রিত। আত্মাকে সরিয়ে নিলে জগতের কোন অস্তিত্বই থাকে না। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘১’ সংখ্যার উদাহরণ দিতেন। একের পিঠে একটি শূন্য যোগ করলে পাই ১০, আর একটি যোগ করলে পাই ১০০, তারপর ১০০০। কিন্তু ১ সংখ্যাটি সরিয়ে নিলে থাকে শুধুই শূন্য, অর্থাৎ কিছুই থাকে না। সেই ‘১’ সংখ্যাটি হল ব্রহ্ম। ব্রহ্মকে বাদ দিলে জগৎ বলতে আর কিছুই থাকে না।
অগ্নির্মূর্ধা চক্ষুষী চন্দ্ৰসূর্যৌ
দিশঃ শ্রোত্রে বাগ্নিবৃতাশ্চ বেদাঃ।
বায়ুঃ প্রাণো হৃদয়ং বিশ্বমস্য
পদ্ভ্যাং পৃথিবী হ্যেষ সর্বভূতান্তরাত্মা॥৪
অন্বয়: অস্য (যাঁর); অগ্নিঃ (দ্যুলোক); মূর্ধা (মস্তক); চন্দ্ৰসূর্যৌ (চাঁদ এবং সূর্য); চক্ষুষী (দুটি চোখ); দিশঃ (দিক সমূহ); শ্রোত্রে (দুটি কান); চ (এবং); বিবৃতাঃ বেদাঃ (প্রকটিত বেদ সমূহ); বাক্ (বাক্য); বায়ুঃ (বায়ু); প্রাণঃ (প্রাণ); বিশ্বম্ (বিশ্ব); হৃদয়ম্ (হৃদয়); পৃথিবী (পৃথিবী); পদ্ভ্যাম্ (দুটি পায়ের জন্য [অর্থাৎ দুটি পায়ের জন্যই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে]); এষঃ হি (ইনিই); সর্বভূতান্তরাত্মা (সর্বভূতের অন্তরাত্মা)।
সরলার্থ: স্বর্গ তাঁর মস্তক, চন্দ্র সূর্য তাঁর দুই চোখ, দিক সকল তাঁর দুই কান, প্রকটিত বেদসমূহ তাঁর বাক্য, বায়ু তাঁর নিঃশ্বাস, বিশ্ব তাঁর হৃদয় এবং তাঁর চরণ-যুগলের জন্যই এই পৃথিবী। তিনিই সর্বভূতের অন্তরতম আত্মা।
ব্যাখ্যা: আমাদের সম্মুখে ছড়ানো রয়েছে এই সুন্দর পৃথিবী। কিন্তু পৃথিবীর সামগ্রিক রূপ আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। এর সামান্য অংশ মাত্র আমরা দেখতে পাই। আমরা জানি, আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে অন্যান্য বহু ছায়াপথ রয়েছে। সূর্যকে দেখে আমাদের মনে হয়: ‘আহা! কি অপূর্ব!’ কিন্তু আবার একথাও জানি যে, এই সূর্যের চেয়ে বৃহত্তর এবং আরও শক্তিশালী অনেক সূর্য আছে। উপনিষদ আমাদের কল্পনা করতে বলছেন, দ্যুলোক (অগ্নিঃ) ব্রহ্মের মস্তক (মূর্ধা) মাত্র। চন্দ্রাতপ সদৃশ নক্ষত্র-খচিত আকাশ তাঁর শির, সূর্য এবং চন্দ্র তাঁর দুই চোখ, চারটি দিক (দিশঃ) তাঁর কান। ‘বিবৃতাঃ বেদাঃ’—ব্রহ্মের বাক্-রূপে বেদসমূহের প্রকাশ। ‘বায়ুঃ প্রাণঃ’—বাতাস তাঁর প্রাণবায়ু এবং এই বিশ্ব তাঁর হৃদয়। ‘পদ্ভ্যাং পৃথিবী’—তাঁর পদযুগলের জন্য এই পৃথিবী। ‘এষঃ সর্বভূতান্তরাত্মা’—তিনিই সর্ববস্তুর অন্তরাত্মা, আদি কারণ, সারাৎসার। জগতে সকল অস্তিত্বের মূল এই ব্রহ্মোই প্রতিষ্ঠিত।
তস্মাদগ্নিঃ সমিধো যস্য সূর্যঃ।
সোমাৎপর্জন্য ওষধয়ঃ পৃথিব্যাম্।
পুমান্ রেতঃ সিঞ্চতি যোষিতায়াং
বহ্বীঃ প্রজাঃ পুরুষাৎসংপ্রসূতাঃ॥৫
অন্বয়: তস্মাৎ (তাঁর থেকে [অর্থাৎ সেই পুরুষ থেকে]); অগ্নিঃ (দ্যুলোক [জন্ম নেয়]); যস্য (যার অর্থাৎ এই দ্যুলোকের); সমিধঃ (ইন্ধন [হল]); সূর্যঃ (সূর্য); সোমাৎ ([দ্যুলোক থেকে যার জন্ম] সেই চন্দ্র থেকে); পর্জন্যঃ (মেঘ [অর্থাৎ বৃষ্টি হয়]); পৃথিব্যাম্ (পৃথিবীতে); ওষধয়ঃ (ওষধি বৃক্ষসমূহ); [জন্মায়] পুমান্ (মানুষ); যোষিতায়াম্ (স্ত্রীতে); রেতঃ (শুক্র); সিঞ্চতি (সিঞ্চন করে); [এই রূপে] পুরুষাৎ (পরমপুরুষ অক্ষর থেকে); বহ্বীঃ (অনেক); প্রজাঃ ( জীবসমূহ); সংপ্রসূতাঃ (জন্ম নেয়)।
সরলার্থ: সূর্য যেন ওই অগ্নির (অর্থাৎ দ্যুলোকের) ইন্ধন। ওই অগ্নি বা দ্যুলোক এই মহান পুরুষ থেকে এসেছে। চন্দ্র এসেছে দ্যুলোক থেকে এবং বৃষ্টি চন্দ্র থেকে। আবার এই বৃষ্টি থেকে পৃথিবীতে শস্যাদির জন্ম। শস্য থেকে উৎপন্ন পুরুষবীর্য রমণীতে সিঞ্চিত হয়। এইভাবে সেই মহান পুরুষ (হিরণ্যগর্ভ, সগুণ ব্রহ্ম, পরমাত্মা) থেকে পরম্পরাক্রমে সর্ব বস্তুর উদ্ভব।
ব্যাখ্যা: ধরা যাক, কোন সৎ ব্যক্তি যজ্ঞকর্ম সম্পাদন করেছেন। মৃত্যুর পরে তিনি স্বর্গলোকে যাবেন এবং কিছু কাল স্বর্গসুখ ভোগ করবেন। কিন্তু সৎকর্মের ফল নিঃশেষিত হলে তাঁকে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে। এই প্রত্যাবর্তন কি ভাবে হয়? উপনিষদ বলেন, মৃত্যুর পর মানুষ প্রথমে মেঘলোকে যায়। মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি হয় তখন সেই বৃষ্টিধারার সঙ্গে সে পৃথিবীতে নেমে আসে। সেই বৃষ্টির জল উদ্ভিদ শোষণ করে। সেই সঙ্গে জীবের সূক্ষ্ম দেহও উদ্ভিদে প্রবেশ করে। সেই উদ্ভিদজাত শস্য নরনারী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। সেখান থেকেই আবার মানুষের পুনর্জন্ম হয়। পুনর্জন্ম প্রক্রিয়াটি এখানে এই ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ব্যাখ্যাটি বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, অতএব অগ্রাহ্য। কিন্তু এখানে মূল কথাটি হল, মানুষের পুনর্জন্ম হয় এবং এর থেকে তার সহজে নিস্তার নেই। কিভাবে পুনর্জন্ম ঘটে সে প্রসঙ্গ আলাদা।
‘প্রজাঃ’ অর্থাৎ যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে; ‘বহ্বীঃ’—বহু। এই সব কিছু কোথা থেকে আসে? পুরুষ তথা ব্রহ্ম থেকে। মাকড়সা যেমন জাল বিস্তার করে এবং সেই জাল ক্রমশ বড় হতে থাকে ঠিক তেমনি ব্রহ্ম যেন নিজেকে বিস্তার করেছেন। এই ভাবে প্রাণী পরম্পরার মধ্য দিয়ে ব্রহ্ম আপনাকে প্রকাশ করেন।
তস্মাদৃচঃ সাম যজূংষি দীক্ষা
যজ্ঞাশ্চ সর্বে ক্রতবো দক্ষিণাশ্চ।
সংবৎসরশ্চ যজমানশ্চ লোকাঃ
সোমো যত্র পবতে যত্র সূর্যঃ॥৬
অন্বয়: তস্মাৎ (তাঁর থেকে [সেই পুরুষ থেকে]); ঋচঃ (ঋক্-বেদ); সাম (সাম বেদ); যজূংষি (যজুর্বেদ); দীক্ষা ([যজ্ঞকর্ম আরম্ভ করার পূর্বে] দীক্ষা); যজ্ঞাঃ (অগ্নিহোত্রাদি কর্ম); চ (এবং) সর্বে ক্রতবঃ (যজ্ঞসমূহ [যেখানে পশুবলি দেওয়া হয়]); চ (এবং); দক্ষিণাঃ ([দিক্ষিণাসমূহ যা যজ্ঞের অঙ্গ]); চ (এবং); সংবৎসরঃ (শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী যজ্ঞের কাল); যজমানঃ (যজমান); চ (এবং); লোকাঃ (কর্মফলরূপ লোকসমূহ); যত্র (যেখানে বা যে লোকে); সোমঃ (চন্দ্র); পবতে (পবিত্র করে); যত্র সূর্যঃ (যেখানে বা যে লোকে সূর্য); [তপতে (তাপ দেয়, আলোকিত করে)।
সরলার্থ: সেই পুরুষ থেকে সবকিছুর উৎপত্তি। যথা: ঋক্, সাম এবং যজুঃ বেদ, দীক্ষা (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ শুরু করার আগে যে মঙ্গলাচরণ করা হয়) সম্বন্ধে জ্ঞান, পশুবলি, দক্ষিণা দান (যা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ; অর্থ বা পশু ইত্যাদি দক্ষিণা যা ঋত্বিককে দেওয়া হয়), শাস্ত্রমতে যজ্ঞের সময় সীমা, যজমানের যজ্ঞ করার যোগ্যতা এবং যজ্ঞকর্মের ফল রূপ লোকসমূহ। চন্দ্র যেসব লোক পবিত্র করে (যেমন দেবলোক) এবং সূর্য যেসব লোক (যথা পিতৃলোক) আলোকিত করে সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে।
ব্যাখ্যা: এই উপনিষদের প্রথম প্রশ্ন ছিল—‘কি বা কাকে জানলে সব কিছুকে জানা যায়?’ উপনিষদের উত্তর : ব্রহ্ম, কারণ ব্রহ্ম থেকেই সব কিছু আসে। ‘তস্মাৎ’—তাঁর থেকে অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে বেদসকল যথা ঋক্-বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ এসেছে। বেদসমূহের পর এসেছে ‘দীক্ষা’, যার অর্থ যজ্ঞ করার অধিকার অর্জনের জন্য দীক্ষা পাওয়া। দীক্ষার অপর অর্থ যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রাক্ প্রস্তুতি রূপে যজ্ঞের পূর্বে অন্যান্য অনুষ্ঠান করা—যেমন সঙ্কল্প গ্রহণ অর্থাৎ যজ্ঞ সম্পাদনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ‘ক্রতবঃ’—পশুবলি সহ অনুষ্ঠান; ‘দক্ষিণাঃ’— ব্রাহ্মণকে দান না করে কোন যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয় না। অর্থদান, বস্ত্রদান, গোদান এসবই দক্ষিণার অন্তর্গত। ‘সম্বৎসরঃ’—যজ্ঞের যথাবিধি সময়সীমা। এমন যজ্ঞ আছে যা শেষ করতে বছর ঘুরে যায়। আবার কিছু যজ্ঞ এক ঘণ্টা বা কয়েক ঘণ্টায় সম্পন্ন হয়। ‘যজমান’—যিনি যজ্ঞ করেন। ‘লোকাঃ’—বিভিন্ন লোক (স্বর্গলোক, চন্দ্রলোক ইত্যাদি)। যজ্ঞের ফল অনুযায়ী মৃত্যুর পর যজমান বিশেষ বিশেষ লোকে যান। উপনিষদে সোম অর্থাৎ চন্দ্রলোক এবং সূর্যলোকের উল্লেখ আছে। বেদসমূহ, যজ্ঞাদি, যজমান এবং যজ্ঞফল সবই ব্ৰহ্ম থেকে উদ্ভূত — এই হল উপনিষদের বক্তব্য।
উপনিষদে একই কথার পুনরাবৃত্তি আমাদের কিছুটা বিস্মিত করে। কিন্তু উপনিষদ মনে করেন, বারবার আমাদের একথা স্মরণ করিয়ে না দিলে আমরা ভুলে যেতে পারি। কেন আমরা ভুলে যাই? কঠ উপনিষদ বলছেন, চোখ কান ইত্যাদি সকল ইন্দ্রিয়ই স্বভাবত বহির্মুখী। সেই কারণে বাইরের জগতের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই এবং একই সঙ্গে এই আকর্ষণের মূল উৎসকে আমরা ভুলে যাই। এই জন্য উপনিষদ বলছেন : ‘হ্যাঁ, এই জগৎ বড় সুন্দর, বড় চমৎকার। কিন্তু মনে রেখো, ব্রহ্ম আছেন বলেই জগৎকে এত সুন্দর লাগে, কারণ সব বস্তুর মধ্যে ব্রহ্মই রয়েছেন।’ জগতের সকল অস্তিত্ব ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। যদি এ সত্যকে অস্বীকার করি, ব্রহ্মকে যদি দেখতে না পাই, তবে সে ভুল আমাদের। এই মূল সত্যের দিকেই উপনিষদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। সেই জন্যই উপনিষদকার বহু যত্নে এই দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করেছেন। নয়তো আমরা মূল সত্যটি ভুলে যাব।
এক জায়গায় উপনিষদ পর্বতের গা বেয়ে বৃষ্টিধারা নেমে আসার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। যে কোন পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের সময়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। পর্বতের ঢাল বেয়ে শত শত জলধারা নেমে আসে। পরে সেগুলি একত্র হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। তারপর দীর্ঘ পথ পার হয়ে শেষে সাগরে বিলীন হয়। এই জলধারাগুলির বৈচিত্র লক্ষ্য করার মতো। এক একটি জলধারা এক একজন মানুষের প্রতীক। এই জগতে বহু মানুষের বাস এবং প্রত্যেকেরই নাম ও রূপ স্বতন্ত্র। এর উপর আবার আছে নানা উপাধি অর্থাৎ গুণ। কেউ ফরসা, কেউ কালো; কেউ বিদ্বান, কেউ বা অশিক্ষিত। কিন্তু এ সবই উপাধি। উপনিষদের মতে, এই সব খুঁটিনাটি একেবারেই গৌণ। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে আছেন শুধু ব্রহ্ম। লম্বা-বেঁটে, ফরসা-কালো, নারী-পুরুষ—সবই সেই এক ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই এক ব্রহ্মই নানা রূপে, নানা নামে, নানা উপাধিতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
উপনিষদ আবার বলছেন, ‘এই জগতের বৈচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখ—সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, অগ্নি সব নিয়ে এই বিশাল জগৎ। এর স্বরূপ কি? স্বরূপত এই জগৎ ব্ৰহ্ম বৈ কিছু নয়।’ স্ফুলিঙ্গ যেমন জ্বলন্ত আগুন থেকে বেরোয় এই জগৎও তেমনি ব্রহ্ম থেকে বেরিয়েছে। সর্বত্র সেই একই আত্মা বিরাজিত। নরনারী, উদ্ভিদ, প্রাণিকুল, আকাশ-বাতাস সর্বত্র সেই এক পুরুষ, এক অন্তরাত্মা বিদ্যমান—একই ব্রহ্ম নানারূপে। পশু, মানুষ, নারী এভাবে পৃথক করে না দেখে সবাইকে ব্রহ্মরূপে দেখতে হবে। এমন করে যিনি দেখতে পারেন তাঁরই জ্ঞান হয়েছে। যদি এক ব্রহ্মকে না দেখে বহু দেখি তবে সেটা আমার ভুল। ‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ’—সকলের মধ্যে এক অন্তরাত্মাকে দেখ। তবেই তুমি মুক্ত। তুমি যথার্থ জ্ঞানী। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বহু দেখি। আর সেহেতু একজনকে বলি বন্ধু, আর একজনকে শত্রু। এইভাবে আমরা অনুরাগ-বিরাগের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হই। অধিকাংশ মানুষের জীবন এভাবেই কেটে যায়। কিন্তু উপনিষদ আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, বৈচিত্রের মধ্যে বহুর মধ্যে সেই এককে দেখতে হবে। এই এক জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান।
উপনিষদ আমাদের আরও একটি নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাদের ফিরে তাকাতে বলছেন মূল উৎসের দিকে। ধরা যাক কোন বই পড়ে আমি অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। লেখকের পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু উপনিষদ বলছেন: ‘একেবারে উৎসমুখে চলে যাও। গ্রন্থকার কোথা থেকে এ জ্ঞান লাভ করলেন? ব্রহ্ম থেকে।’ গ্রন্থকার ও তাঁর লেখা বই থেকে যে জ্ঞান আমার মধ্যে এসেছে তার উৎস সেই একই ব্রহ্ম, একথা যেন ভুলে না যাই।
তস্মাচ্চ দেবা বহুধা সংপ্রসূতাঃ
সাধ্যা মনুষ্যাঃ পশবো বয়াংসি।
প্রাণাপানৌ ব্রীহিযবৌ তপশ্চ
শ্রদ্ধা সত্যং ব্রহ্মচর্যং বিধিশ্চ॥৭
অন্বয়: তস্মাৎ চ (এবং তাঁর থেকে [অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে]); বহুধা (বহু প্রকার); দেবাঃ ([বসু প্রভৃতি] দেবতাগণ); সংপ্রসূতাঃ (সম্যক্-রূপে উৎপন্ন হয়েছে); সাধ্যাঃ (সাধ্য দেবতাগণ); মনুষ্যাঃ (মানুষেরা); পশবঃ (পশুসমূহ); বয়াংসি (পাখীরা); প্রাণাপানৌ (প্রাণ এবং অপানবায়ু; ব্রীহিযবৌ (ধান ও যব); তপঃ (তপস্যা); শ্রদ্ধা (আস্তিক্য বুদ্ধি; বিশ্বাস); সত্যম্ (সত্য); ব্রহ্মচর্যম্ (ব্রহ্মচর্য); চ (এবং); বিধিঃ (শাস্ত্রের নিয়ম [সম্যক্-রূপে উৎপন্ন হয়েছে])।
সরলার্থ: সেই পুরুষ (হিরণ্যগর্ভ) থেকে বিবিধ দেবদেবী ও বসুগণ এসেছেন। এভাবে পরপর এসেছেন সাধ্যগণ (অন্যান্য দেবদেবীর চেয়ে উচ্চস্তরের দেবতা, সংখ্যায় বারজন), মানুষ, প্রাণী বর্গ, পক্ষিকুল, প্রাণ ও অপানরূপ শ্বাসবায়ু, ধান-গম, তপস্যা, শ্রদ্ধা, সত্য, ব্রহ্মচর্য, এবং শাস্ত্রবিধি সকল।
ব্যাখ্যা: এই সব কিছু, জগৎ ও তার সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়সকল ব্রহ্ম থেকে এসেছে। উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মকে জানলেই সব জানা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা দিচ্ছেন—হাঁড়িতে ভাত রান্না হচ্ছে। ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা জানতে গেলে এক কণা ভাত টিপে দেখলেই যথেষ্ট; নরম হলে বোঝা যায় ভাত তৈরী। হাঁড়ির সব ভাত আলাদাভাবে টিপে দেখার প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্মের বেলাতেও একই কথা খাটে। উপনিষদ বলছেন, জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় জানার প্রয়োজন নেই। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, দেবদেবী, পঞ্চভূত, নরনারী, জীবজন্তু, উদ্ভিদ জগৎ—এই সব কিছুর মধ্য দিয়েই ব্রহ্মের প্রকাশ। সেইজন্য ব্রহ্মকে জানলেই সব জানা হয়ে যায়।
সপ্ত প্রাণাঃ প্রভবন্তি তস্মাৎ
সপ্তার্চিষঃ সমিধঃ সপ্ত হোমাঃ।
সপ্ত ইমে লোকা যেষু চরন্তি প্রাণা
গুহাশয়া নিহিতাঃ সপ্ত সপ্ত॥৮
অন্বয়: তস্মাৎ (তাঁর থেকে [অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে]); সপ্ত প্রাণাঃ (সাতটি ইন্দ্রিয় [দুই চোখ; দুই নাসারন্ধ্র; দুই কান এবং মুখ]); প্রভবন্তি (উদ্ভূত হয়েছে); সপ্ত অর্চিষঃ ([এই ইন্দ্রিয়গুলির] সাতটি বিষয়); সমিধঃ (ইন্ধন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু); সপ্ত (সাতটি); হোমাঃ (এইসব বিষয়ের জ্ঞান); ইমে সপ্ত লোকাঃ (প্রাণী-দেহের অভ্যন্তরে সাতটি ইন্দ্রিয়ের যে অবস্থান); যেযু (যাতে); সপ্ত সপ্ত নিহিতাঃ (সাতটি সাতটি করে এই ইন্দ্রিয়গুলি [ঈশ্বর] প্রাণী-দেহে স্থাপন করেছেন); গুহাশয়াঃ ([সুষুপ্তিতে] হৃদয়ে লীন হয়ে থাকে); প্রাণাঃ (সাতটি ইন্দ্রিয়); চরন্তি (বিচরণ করে)।
সরলার্থ: সেই ব্রহ্ম থেকেই সাতটি ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব। এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি বিষয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল, সাত প্রকার বিষয় জ্ঞান, জীবদেহে এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি অধিষ্ঠান—এ সবই ব্ৰহ্ম থেকে এসেছে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল আত্মায় বিলীন হয়। আত্মা তখন (যেমন সুষুপ্তিকালে) হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন।
ব্যাখ্যা: সাতটি প্রাণ কি কি? এগুলি হল ইন্দ্রিয়—দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র এবং জিভ। এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘অর্চিষঃ’—কথাটির অর্থ শিখা, আলো বা কিরণ। এই ইন্দ্রিয়গুলির যেন শিখা বা কিরণ রয়েছে এবং তারা অনুভব করতে পারে। যেমন, আমরা যখন জিভ দিয়ে কোন স্বাদ গ্রহণ করি তখন আমরা কিসের স্বাদ পাচ্ছি তা বুঝতে পারি। ‘সমিধঃ’ বলতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে ‘সমিধঃ’ কথাটির অর্থ ইন্ধন। যেমন, আগুন জ্বালাতে ইন্ধন লাগে। ইন্দ্রিয়গুলি যেন যজ্ঞ করছে। কি ভাবে? ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা যা কিছু করি তা এক ধরনের যজ্ঞ। গীতাতেও একটি শ্লোকে আছে, ‘ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ…’ অর্থাৎ আমরা যা কিছু করি তা ব্রহ্মের উদ্দেশে যজ্ঞ বিশেষ। সবকিছু ব্রহ্ম থেকে আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। যা কিছু দেখি সবই ব্রহ্ম। যজ্ঞের কুশি (অর্থাৎ তামার পাত্র বিশেষ যা দিয়ে আহুতি দেওয়া হয়), যজ্ঞের আহুতি, যজ্ঞাগ্নি এবং ঋত্বিক—সব ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বৈ আর কিছুই নেই। ‘সব কিছু ব্রহ্মে সমর্পিত’, এই সত্যকে যদি ধ্যান করা যায়, যদি স্বয়ং ব্রহ্মরূপে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা যায় তবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। ইন্দ্রিয়গুলি যে কেবলমাত্র ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে তা নয়, তারা যা কিছু গ্রহণ করে তাও ব্রহ্মের উদ্দেশে নিবেদন করে। এমন নয় যে, আমি ব্রহ্মকে ঘ্রাণে গ্রহণ করছি, ব্রহ্মই ব্ৰহ্মকে আঘ্রাণ করছেন। একইভাবে ব্রহ্মই ব্রহ্মকে দেখছেন, ব্রহ্মই ব্রহ্মকে খাচ্ছেন। ওই ব্রহ্ম চলেছেন। কোথায় চলেছেন? ব্রহ্ম ব্রহ্মের কাছেই যাচ্ছেন। ব্রহ্মেই যাত্রার আরম্ভ, আবার ব্রহ্মেই পরিসমাপ্তি। এক ব্রহ্মই কেবল আছেন।
যেহেতু আমরা যা কিছু করি তা-ই যজ্ঞ, সেহেতু আমাদের সকল কর্মই উপাসনা। আমাদের কোন কিছুই ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়। সবই আধ্যাত্মিক। সুতরাং সব কাজ আমাদের অতি যত্ন সহকারে করতে হবে। এমন ভাবে কাজ করতে হবে যা আমাদের আত্মজ্ঞানের লক্ষ্যে এগিয়ে দেয়।
অতঃ সমুদ্রা গিরয়শ্চ সর্বেঽস্মাৎ
স্যন্দন্তে সিন্ধবঃ সৰ্বরূপাঃ।
অতশ্চ সব ওষধয়ো রসশ্চ
যেনৈষ ভূতৈস্তিষ্ঠতে হ্যন্তরাত্মা॥৯
অন্বয়: অতঃ (এই পুরুষ [ব্রহ্ম] থেকে); সর্বে (সকল); সমুদ্রাঃ (সমুদ্র সমূহ); চ (এবং); গিরয়ঃ (পর্বত সমূহ [জন্মেছে]); অস্মাৎ (এই পুরুষ থেকে); সর্বরূপঃ সিন্ধবঃ (ছোট বড় নদী সমূহ); স্যন্দন্তে (প্রবাহিত হয়); অতঃ চ (এবং এই পুরুষ থেকে); সর্বাঃ (সকল); ওষধয়ঃ (ধানযব বৃক্ষলতা ইত্যাদি); চ (এবং); রসঃ (সব রস); যেন হি (যাঁর দ্বারা); এষঃ অন্তরাত্মা (এই অন্তরাত্মা); ভূতৈঃ (পঞ্চভূতের দ্বারা বেষ্টিত); তিষ্টতে (থাকেন)।
সরলার্থ: এই ব্রহ্ম থেকেই বিশাল সমুদ্র ও পর্বতমালা এসেছে এবং নদীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। ধানযবাদি সমুদয় বৃক্ষলতা এবং মধু ইত্যাদি সকল প্রকার খাদ্যরস এই ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন। ব্রহ্ম আছেন বলেই সব কিছু আছে। ব্রহ্মই সকল বস্তুকে একসঙ্গে ধরে রেখেছেন। সূক্ষ্ম কোষ রূপে খাদ্যরসই অন্তরাত্মাকে বেষ্টন করে আছে।
ব্যাখ্যা: অন্তরাত্মা বলতে কী বোঝায়? আমাদের এই দেহ স্থূল। স্থূল শরীরের মধ্যে আছে সূক্ষ্ম শরীর। এই সূক্ষ্ম শরীরকে অন্তরাত্মাও বলা হয়। পঞ্চভূত ছাড়া স্থূলদেহ থাকতে পারে না। অর্থাৎ খাদ্য পানীয় ছাড়া স্থূলদেহ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই জন্যই স্থূলদেহকে অন্নময় কোষ বলা হয়। খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে স্থূলদেহের মৃত্যু হয়। খাদ্য পানীয় রূপে পঞ্চভূত এই স্থূলদেহকে পরিপুষ্ট করে। আর এই দেহের অভ্যন্তরে আছেন অন্তরাত্মা। স্থূলদেহ ও আত্মার মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম শরীরই অন্তরাত্মা। সূক্ষ্মরূপে পঞ্চভূত [অর্থাৎ তন্মাত্রা] এই অন্তরাত্মাকে ধারণ করে আছে।
পুরুষ এবেদং বিশ্বং কর্ম তপো ব্রহ্ম পরামৃতম্।
এতদ্যো বেদ নিহিতং গুহায়াং সোঽবিদ্যাগ্রন্থিং
বিকিরতীহ সোম্য॥১০
অন্বয়: পুরুষঃ এব (সেই পুরুষই); ইদম্ (এই); বিশ্বম্ (বিশ্ব); কর্ম (যজ্ঞাদি কর্ম); তপঃ (তপস্যা); [তিনিই] ব্ৰহ্ম (ব্রহ্ম); পর অমৃতম্ (পরম অমৃত); এতৎ পরামৃতং ব্রহ্ম (এই পরম, আনন্দঘন ব্রহ্মকে); যঃ (যিনি); গুহায়াম্ (হৃদয়গুহাতে); নিহিতম্ (নিহিত রূপে); বেদ (জানেন); সঃ (তিনি); সোম্য (হে সৌম্য); ইহ (ইহলোকেই); অবিদ্যাগ্রন্থিম্ (অবিদ্যারূপ বন্ধনকে); বিকিরতি (অতিক্রম করেন)।
সরলার্থ: এই ব্রহ্মই বিশ্ব। তিনিই অগ্নিহোত্রাদি সকল প্রকার কর্ম। তিনি জ্ঞান, তিনিই পরম। তিনি অবিনাশী এবং আনন্দঘন। সকল হৃদয়ে তিনি লুকিয়ে রয়েছেন। হে সৌম্য, যিনি একথা জানেন, তিনি এই জীবনেই অবিদ্যার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে এখানে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরুষ কেন? এই দেহ হল পুর (নগর), এবং যিনি এখানে বাস করেন তিনিই পুরুষ। পুরুষ বলতে আত্মা এবং ব্রহ্মকেও বোঝায়। পুরুষ নিজেকে এই নিখিল বিশ্বরূপে (ইদং বিশ্বম্) প্রকাশ করেন। সকল প্রকার কর্মও এই পুরুষের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তপঃ’ বলতে বোঝায় তপস্যা, কৃচ্ছ্রতা। এও ব্রহ্মেরই প্রকাশ। বস্তুত ভাল মন্দ যা কিছু আমরা করি, সব ব্রহ্মেরই প্রকাশ। আমরা ব্রহ্মেই রয়েছি, আমাদের সত্তা ব্রহ্মেই প্রতিষ্ঠিত। এই ব্রহ্ম অদ্বিতীয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম। ‘অমৃতম্’, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি আনন্দস্বরূপ।
গুহা বলতে কি বোঝায়? মানুষের হৃদয়। গুহা শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ পর্বতকন্দর। গুহার অভ্যন্তরে কোন পশু থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে এত অন্ধকার যে, আমরা পশুটিকে দেখতে পাই না। একই ভাবে, ব্ৰহ্ম আমাদের হৃদয়ে আছেন, কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। ‘নিহিতম্’—বাস করা। ব্রহ্ম আমাদের অন্তরে বাস করছেন। উপনিষদ বলছেন যে, যদি কেউ নিজ হৃদয়ে ব্রহ্মকে দর্শন করেন তবে ‘অবিদ্যাগ্রন্থিং বিকিরতি’, তিনি অজ্ঞানতার বন্ধন ছিন্ন করেন। তাঁর সব গ্রন্থি শিথিল হয়ে যায়, শৃঙ্খল ভেঙ্গে যায়।
প্রকৃত সত্যকে আমরা দেখতে পাই না; যা দেখি তা সত্যের বাহ্যরূপ। আমরা নিজেদের নাম-রূপের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখি। ধরা যাক, একটি বালক বাঁদরের মুখোশ পরে আছে। তার দিকে চেয়ে আমরা বলি, ‘ওই যে একটা বাঁদর’। আসলে মুখোশের আড়ালে রয়েছে সেই ছেলেটি। উপনিষদ তাই বলছেন যে, মানুষ যদি প্রকৃত সত্যকে জানতে পারে, তবে তার অজ্ঞানতার সব বন্ধন ছিঁড়ে যায়। সে আর কোনদিনই মোহগ্রস্ত হয় না।
শ্রীমদ্ভাগবতে জড়ভরতের কাহিনী আছে। তিনি ছিলেন মুক্ত পুরুষ, কিন্তু বোবা ও জড়ের ভান করে থাকতেন। সকলেই তাঁকে জড়বুদ্ধি বলে মনে করত। একবার পালকিতে চড়ে এক রাজা চলেছেন। জড়ভরতকে পালকি বইতে বাধ্য করা হয়েছে। জড়ভরতের দেহ সবল ছিল ঠিকই, কিন্তু পালকি কাঁধে চলতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না; তাই তিনি অন্যান্য বাহকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলেন না। ফলে পালকি অস্বাভাবিক রকম দুলছিল। অবশেষে রাজা তাঁকে তিরস্কার করতে শুরু করলেন : ‘হে নির্বোধ, ব্যাপারটা কি? তুমি কি ক্লান্ত? যদি ক্লান্তই হয়ে থাক, তবে বিশ্রাম করতে চাইছ না কেন? তোমার উল্টো-পাল্টা পা ফেলার জন্য আমি পালকির ভেতর সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছি না।’ এর আগে পর্যন্ত জড়ভরত সবসময় নির্বাক থাকতেন। কিন্তু সেই মুহুর্তে হঠাৎ গভীর জ্ঞানগর্ভ সব কথা তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল, ‘কাকে আপনি নির্বোধ বলে সম্বোধন করছেন? এই দেহটাকে? কিন্তু আমি তো দেহ নই। আমি সেই আত্মা যিনি আপনার মধ্যেও রয়েছেন। সুতরাং আপনার “নির্বোধ” সম্বোধন কার উদ্দেশে? আপনি আর আমি যে অভিন্ন।’
এখানে উপনিষদ সেই মূল ঐক্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আমরা ‘বহু’ দেখি কিন্তু উপনিষদ বলেন, ‘না, বহু নেই, এক। এক ব্রহ্ম তথা পরমাত্মাই বহুরূপে প্রতিভাত। এই এককে দেখার চেষ্টা কর।’ জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক এবং অভিন্ন, বৈচিত্র শুধুমাত্র নাম এবং রূপে। এই নাম-রূপ পরমাত্মার উপর আরোপিত। প্রকৃত সত্য এই বৈচিত্রের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। সত্য এক। মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, আকাশ সব কিছুর মধ্য দিয়ে এক ব্ৰহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সেই একত্ব দর্শন হলে মানুষ মুক্ত হয়ে যায়।
মুণ্ডক উপনিষদের দ্বিতীয় মুণ্ডকের প্রথম অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
দ্বিতীয় মুণ্ডক
দ্বিতীয় অধ্যায়
আবিঃ সন্নিহিতং গুহাচরং নাম
মহৎপদমত্ৰৈতৎ সমর্পিতম্।
এজৎপ্রাণন্নিমিষচ্চ যদেতজ্জানথ সদসদ্বরেণ্যং
পরং বিজ্ঞানাদ্যদ্বরিষ্ঠং প্রজানাম্॥১
অন্বয়: আবিঃ (ব্রহ্ম প্রকাশমান); সন্নিহিতম্ (প্রাণিগণের অন্তরস্থ); গুহাচরং নাম (গুহাচর বলে খ্যাত); মহৎ পদম্ (মহান আশ্রয়); অত্র (ইঁহাতে); এজৎ (সচল); প্রাণৎ (প্রাণযুক্ত); চ (এবং); নিমিষৎ (যাদের চোখে পলক পড়ে); যৎ এতৎ (এই যা কিছু); সমর্পিতম্ (সমর্পিত); এতৎ (এই ব্রহ্ম); সৎ (দৃশ্য); অসৎ (অদৃশ্য); প্রজানাম্ (প্রাণিগণের); বিজ্ঞানাৎ পরম্ (ইন্দ্রিয়ের অতীত); বরেণ্যম্ (বরণীয়); বরিষ্ঠম্ (শ্রেষ্ঠ); [তৎ] জানথ (তাঁকে জান)।
সরলার্থ: ব্রহ্ম স্বভাবতই স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি সকলের হৃদয় গুহায় বাস করেন। তাই তিনি গুহাচর বলে খ্যাত। তিনি সর্বভূতের মহান আশ্রয়। এই ব্রহ্মে সচল-অচল, সজীব-নির্জীব, স্পন্দনযুক্ত অথবা স্পন্দনহীন, এই সমস্ত কিছুই সমর্পিত রয়েছে। (হে সৌম্য) এই ব্রহ্ম একাধারে আমাদের দৃষ্টিগোচর, আবার অদৃশ্যও বটে। তিনি সর্বজনবরেণ্য। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে অনুভব করা যায় না। নিজ আত্মার সাথে তাঁকে অভিন্ন বলে জান।
ব্যাখ্যা: এই ব্রহ্মকে বলা হয় ‘গুহাচরম্’ অর্থাৎ তাঁর বিচরণ হৃদয়গুহায়। তিনি ‘আবিঃ’, স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি জ্যোতির্ময়, দীপ্ত এবং উজ্জ্বল। শ্রীরামকৃষ্ণ দৃষ্টান্ত দিতেন: ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। ওই প্রদীপটিকে দেখতে চাইলে কি আর একটি প্রদীপের প্রয়োজন হয়? না, তা হয় না। একথা ব্ৰহ্ম সম্পর্কেও প্রযোজ্য। ব্রহ্মকে দেখার জন্য আর কোন আলোর প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্ম স্বয়ংপ্রকাশ, স্বয়ম্প্রভ ও স্বয়ং-জ্যোতি। তিনি চৈতন্যস্বরূপ। আবার তিনি ‘সন্নিহিতম্’, পূর্ণভাবে বিরাজমান।
আবার ব্রহ্মকে ‘মহৎ পদম্’ও বলা হয়, যার অর্থ মহৎ অধিষ্ঠান, মহৎ আশ্রয়, মহৎ প্রতিষ্ঠাভূমি’। এই মহান অবলম্বনকে কেন্দ্র করেই সবকিছু রয়েছে। তিনিই সব কিছুর আশ্রয়। ‘অত্র এতৎ সমর্পিতম্’—এখানে ‘অত্র’ শব্দটির অর্থ ‘এই ব্রহ্মে’ এবং ‘এতৎ’ হল ‘এই বিশ্ব’। ‘সমর্পিতম্’ বলতে আশ্রিত বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ ব্রহ্মে এই বিশ্ব সমর্পিত। ‘এজৎ’—যা কিছু চলাফেরা করে, গতিশীল অর্থাৎ সকল প্রাণী; ‘প্রাণৎ’—যা কিছু শ্বাস গ্রহণ করে; ‘নিমিষৎ’—যাদের চোখে পলক পড়ে; ব্রহ্ম এই সবকিছুর অধিষ্ঠান।
এক কথায়, উপনিষদ আমাদের জ্ঞান লাভ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিসের জ্ঞান? সৎ-অসৎ জ্ঞান। আক্ষরিক অর্থে ‘সৎ’ বলতে বোঝায় ‘যা আছে’ ও ‘অসৎ’ বলতে বোঝায় ‘যা নেই’। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে ‘সৎ’ বলতে যা দৃষ্টিগোচর, এবং ‘অসৎ’ বলতে যা দৃষ্টিগোচর নয় তাকেই বোঝানো হয়েছে। সৎ শব্দের আর একটি অর্থ ‘যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য’, আর অসৎ হল ‘যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়’। বীজাণু যেমন সর্বত্র রয়েছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় আমাদের কাছে তা অসৎ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীজাণুগুলি জীবন্ত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। এই সৎ এবং অসৎ উভয়ই ব্রহ্মের ওপর নির্ভরশীল। সব কিছু এই ‘বরেণ্যম্’ অর্থাৎ পরম সত্যকে আশ্রয় করে আছে। ‘পরং বিজ্ঞানাৎ’—‘পরম্’ অর্থ ঊর্ধ্বে, ‘পরং বিজ্ঞানাৎ’ অর্থ যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের অতীত। বহু বস্তুই আছে যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করা যায় না। কারণ ইন্দ্রিয়গুলি যন্ত্র হিসাবে দুর্বল, এবং এদের শক্তি সীমিত। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, আমাদের এই পৃথিবী থেকে বহু দূরে কোন গ্রহ থাকতে পারে যা আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, গ্রহটির অস্তিত্ব নেই। উপনিষদ বলছেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে যা কিছু রয়েছে তাও ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, ব্রহ্মকেই আশ্রয় করে আছে। ছোট-বড়, দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছুর অস্তিত্বই ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মই সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম, ব্রহ্মই বরিষ্ঠ।
তাই উপনিষদ আমাদের ব্রহ্মকে জানার জন্য সচেষ্ট হতে বলছেন। বস্তুর বাহ্যরূপের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে তলিয়ে দেখতে বলছেন। সব কিছুর মধ্যে ব্রহ্মকে, সত্যকে আবিষ্কার করতে বলছেন। ব্রহ্মই সত্য। আর যা কিছু, সব ব্রহ্মে আরোপিত। এই ব্রহ্মকেই নিজ আত্মা বলে জানতে হবে—এই উপনিষদের নির্দেশ।
যদৰ্চিমদ্যদণুভ্যোঽণু চ
যস্মিঁল্লোকা নিহিতা লোকিনশ্চ।
তদেতদক্ষরং ব্ৰহ্ম স প্রাণস্তদু বাঙ্মনঃ
তদেতৎসত্যং তদমৃতং তদ্বেদ্ধব্যং সোম্য বিদ্ধি॥২
অন্বয়: যৎ (যিনি); অৰ্চিমৎ (জ্যোতির্ময়); যৎ (যিনি); অণুভ্যঃ অণু (সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর); চ (এবং); যস্মিন্ (যাঁতে); লোকাঃ (লোকসমূহ); চ (এবং); লোকিনঃ (বিভিন্ন লোকবাসিগণ); নিহিতাঃ (নিহিত রয়েছে); তৎ এতৎ অক্ষরং ব্রহ্ম (এই সেই অক্ষর.ব্রহ্ম); সঃ (তিনি); প্রাণঃ (প্রাণ [প্রাণবায়ু]); তৎ উ (তিনিই); বা মনঃ (বাক্য এবং মন); তৎ এতৎ সত্যম্ (তিনিই সত্য); তৎ অমৃতম্ (তিনি অবিনাশী); সোম্য (হে সৌম্য); তৎ (তিনি); বেদ্ধব্যম্ (তাঁকে ভেদ করতে হবে অর্থাৎ তিনি মূল লক্ষ্যস্থল); বিদ্ধি (তাঁকে ভেদ কর অর্থাৎ জান)।
সরলার্থ: তিনি জ্যোতির্ময় এবং সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর। সেই অক্ষর ব্রহ্ম বিভিন্ন লোকসমূহ এবং ঐসব লোকের অধিবাসীদেরও আশ্রয়। তিনিই প্রাণ। বাক্য এবং মনও তিনি। সেই ব্রহ্মই সত্য, তিনিই নিত্য। তাঁকে ভেদ করতে হবে অর্থাৎ তাঁকে স্বরূপত জানতে হবে।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম এই জগতের আশ্রয়। দেহ, মন এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয় ব্রহ্মেই আশ্রিত। ব্রহ্মকে বাদ দিয়ে কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়। শুধু জড় বস্তুই নয়, নৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। যেমন, সত্যও ব্রহ্মকে আশ্রয় করে আছে। ব্রহ্ম নিত্য এবং সকল বস্তুর উৎস। সবকিছু ব্ৰহ্ম থেকে এসেছে, ব্রহ্মই সকল বস্তুর অধিষ্ঠান আবার অন্তে সব ব্রহ্মেই লয় পাবে।
এই ব্রহ্মকে স্বরূপত জানাই জীবনের লক্ষ্য। অর্থাৎ নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বলে জানতে হবে।
ধনুর্গৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং
শরং হ্যুপাসানিশিতং সন্ধয়ীত।
আয়ম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা
লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি॥৩
অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); ঔপনিষদম্ (উপনিষদের বাণী); মহাস্ত্রম্ (মহাস্ত্ররূপ); ধনুঃ (ধনু অর্থাৎ প্রণব মন্ত্র); গৃহীত্বা (গ্রহণ করে); উপাসা-নিশিতং শরম্ (উপাসনা অর্থাৎ একাগ্র ধ্যানের দ্বারা শাণিত তীর); সন্ধয়ীত ([তীর] যোজনা [করে]); আয়ম্য (ধনুর গুণ টেনে); তদ্ভাবগতেন চেতসা (তদ্গত ভাবে মন ব্রহ্মে স্থির রেখে); লক্ষ্যম্ (লক্ষ্যে); তৎ অক্ষরম্ এব (সেই অক্ষর ব্রহ্ম); বিদ্ধি (ভেদ কর, জান)।
সরলার্থ: উপনিষদের বাণী (অর্থাৎ প্রণবের বাণী) যেন এক বিরাট ধনুক, আর জীবাত্মা এই ধনুকের শর। ধ্যানের দ্বারা এই শরকে শাণিত কর। এরপর সবলে ধনুকের জ্যা আকর্ষণ করে, অর্থাৎ পার্থিব বিষয় থেকে মনকে নিবৃত্ত করে, সেই মনকে তোমার লক্ষ্যে অর্থাৎ ব্রহ্মে স্থির কর; তারপর সেই মনের দ্বারা ব্রহ্মকে বিদ্ধ কর।
ব্যাখ্যা: উপনিষদের বাণী কি? ‘তত্ত্বমসি’–তুমিই সেই অর্থাৎ তুমিই ব্রহ্ম। ‘ঔপনিষদম্’, অর্থাৎ উপনিষদের বাণীকে ‘মহাস্ত্র’, এক মহাশক্তিশালী অস্ত্র বলা হয়েছে। সেই অস্ত্রকে উপনিষদ ধনুকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শরটি কি? জীবাত্মা। লক্ষ্যবস্তু কি? স্বয়ং ব্রহ্ম। জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য ভেদ করতে হলে শাণিত শরের প্রয়োজন। ‘উপাসা নি শিতম্’—অর্থাৎ শরটিকে ধ্যান যোগে শাণিত করতে হবে। কিসের ধ্যান? ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, আমিই ব্রহ্ম—এই তত্ত্ব গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। এখন আমরা নিজেদের অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে একাত্ম করে দেখি। আমরা বলি আমি শ্রীযুক্ত অমুক, অমুক অফিসে কাজ করি ইত্যাদি। উপনিষদ বলছেন, ‘আমিই ব্রহ্ম’, একথা বারবার স্মরণ করতে হয়। এইভাবে ধ্যান করতে করতে আমার শরটি শাণিত হয়ে ওঠে এবং আমি ব্রহ্মে লীন হবার যোগ্যতা অর্জন করি। প্রথমে ধনুকটি তুলে নিতে হবে। তারপর লক্ষ্য স্থির রেখে জ্যা ধরে আকর্ষণ করতে হবে, অর্থাৎ আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। মনকে বাইরের বস্তু থেকে নিবৃত্ত করে লক্ষ্য বস্তুতে স্থির করতে হবে। ‘তদ্ভাবগতেন চেতসা’—‘আমিই স্বয়ং ব্রহ্ম’, এই চিন্তায় যেন মন মগ্ন হয়ে থাকে। এরপর ব্রহ্মরূপ লক্ষ্যকে ভেদ করতে হবে। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন হোক, তারা এক হয়ে যাক—এই আমাদের সাধনার লক্ষ্য। উপনিষদ আমাদের এই কঠিন সাধনায় ব্রতী হবার নির্দেশ দিচ্ছেন।
প্রণবো ধনুঃ শরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তস্ময়ো ভবেৎ॥৪
অন্বয়: প্রণবঃ (ওঁকার মন্ত্র); ধনুঃ (ধনুক); আত্মা হি (জীবাত্মাই); শরঃ (বাণ); ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); তৎ লক্ষ্যম্ (সেই শরের লক্ষ্য); উচ্যতে (কথিত হয়); অপ্রমত্তেন (অপ্রমত্ত হয়ে, নির্ভুল ভাবে); বেদ্ধব্যম্ (ভেদ করা উচিৎ [এবং]); শরবৎ (সেই বাণের মতো); তন্ময়ঃ (লক্ষ্যের সঙ্গে অভিন্নরূপে); ভবেৎ (থাকবে [অর্থাৎ জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলে এক হয়ে যাবে])।
সরলার্থ: ওঁকার ধনুক, জীবাত্মা শর, এবং ব্রহ্ম সেই শরের লক্ষ্যবস্তু বলে কথিত। নির্ভুলভাবে সেই লক্ষ্যকে শরবিদ্ধ করতে হবে। তাহলে সেই শর (জীবাত্মা) লক্ষ্যের (ব্রহ্মের) সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। অর্থাৎ জীবাত্মা নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন বোধ করবে।
ব্যাখ্যা: উপনিষদের বাণী হল এই ওম্ (প্রণব)। উপনিষদ এখানে বলছেন, আমাদের ‘ওম্’কে ধ্যান করতে হবে। শর হল জীবাত্মা, ওম্ হল ধনুক এবং লক্ষ্য স্বয়ং ব্রহ্ম। ধনুকটি তুলে লক্ষ্যভেদে সচেষ্ট হতে হবে। ‘অপ্রমত্তেন’—নির্ভুল ভাবে। শরটিকে অভ্রান্তভাবে লক্ষ্যে স্থির করতে হবে। অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে শরনিক্ষেপ করতে হবে। ব্রহ্মচিন্তায় শরটি যেন তন্ময় থাকে। জীবাত্মা তখন ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাবে।
যস্মিন্দ্যৌঃ পৃথিবী চান্তরিক্ষমোতং
মনঃ সহ প্রাণৈশ্চ সর্বৈঃ।
তমেবৈকং জানথ আত্মানমন্যা
বাচো বিমুঞ্চথামৃতস্যৈষ সেতুঃ॥৫
অন্বয়: যস্মিন্ (যে অক্ষরে); দ্যৌঃ (দ্যুলোক); পৃথিবী (পৃথিবী); চ (এবং); অন্তরিক্ষম্ (পৃথিবী ও দ্যুলোকের অন্তর্বর্তী স্থান); সর্বৈঃ প্রাণৈঃ সহ মনঃ চ (মন ও ইন্দ্রিয়সকল); ওতম্ (সমর্পিত); তম্ (সেই); একম্ (অদ্বিতীয়); আত্মানম্ এব (আত্মাকেই); জানথ (জান); অন্যাঃ বাচঃ (অন্য সব কথা); বিমুঞ্চথ (পরিত্যাগ কর); এষঃ (এই আত্মজ্ঞান); অমৃতস্য (অমৃতের অর্থাৎ নিত্যকে লাভ করার); সেতুঃ (উপায়, সেতু)।
সরলার্থ: স্বর্গ, মর্ত, অন্তরীক্ষ, ইন্দ্রিয় ও প্রাণসহ মন, সবই এই পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত। এই এক ও অভিন্ন আত্মাকে জানেনা। আত্মজ্ঞানই অমরত্বের পথে সেতুস্বরূপ। অন্য অসার আলোচনায় সময় অপচয় করো না।
ব্যাখ্যা: ‘অন্যাঃ বাচঃ বিমুঞ্চথ’—অসার আলাপ-আলোচনা বন্ধ কর, অন্য সব কথা ভুলে যাও। তুমি এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন—এই উপনিষদের মূল সুর। এই তত্ত্বটিতে মন একাগ্র কর, আর অন্য সব বিষয় ভুলে যাও। অন্য সব কিছু অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয়। ‘এষঃ অমৃতস্য সেতুঃ’—এটিই অমৃতের সেতু, অমৃতের পথ। ব্রহ্মজ্ঞানই সেই সেতু যা মানুষকে মৃত্যুর পারে অমৃতলোকে নিয়ে যায়। অমরত্ব লাভের আর অন্য কোন উপায় নেই।
অরা ইব রথনাভৌ সংহতা যত্র নাড্যঃ
স এষোঽন্তশ্চরতে বহুধা জায়মানঃ।
ওমিত্যেবং ধ্যায়থ আত্মানং
স্বস্তি বঃ পারায় তমসঃ পরস্তাৎ॥৬
অন্বয়: রথনাভৌ (রথচক্রের নাভিতে অর্থাৎ কেন্দ্রে); অরাঃ ইব (চক্র শলাকার মতো); যত্র (যেখানে); নাড্যঃ (নাড়ীসমূহ); সংহতাঃ (একত্র হয়); স এষঃ (সেই তিনি); বহুধা জায়মানঃ (নানা রূপে প্রকাশিত হয়ে); অন্তঃ (হৃদয় মধ্যে); চরতে (বিচরণ করেন); আত্মানম্ (আত্মাকে); ওম্ ইত্যেবম্ (ওঁকার রূপে); ধ্যায়থ (চিন্তা কর বা ধ্যান কর); তমসঃ (অন্ধকার থেকে অর্থাৎ অজ্ঞানতা থেকে); পরস্তাৎ (পারে); পারায় (উত্তীর্ণ হওয়ার নিমিত্ত); বঃ (তোমাদের); স্বস্তি (মঙ্গল হোক)।
সরলার্থ: রথচক্রের কেন্দ্রে বহু শলাকা সংযুক্ত থাকে; একই ভাবে, বহু ধমনী হৃদ্যন্ত্রে যুক্ত থাকে। পরমাত্মা সেই হৃদয়ের মধ্যে নানা রূপে (যথা ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদি রূপে) নিজেকে প্রকাশ করে অন্তরে বিচরণ করেন। অন্ধকারের পারে যাওয়ার জন্য সেই আত্মায় ধ্যানমগ্ন হও। তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।
ব্যাখ্যা: এই জগতের সঙ্গে ব্রহ্মের কি সম্পর্ক বর্তমান উপনিষদ আবার সেই প্রসঙ্গ আলোচনা করছেন। এবার উপনিষদ রথচক্রের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। রথচক্রে বহু শলাকা থাকে; আর এইসব শলাকা চক্রের কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। চক্রের একটি কেন্দ্র বা নাভি থাকে আর সেই কেন্দ্র থেকেই সব শলাকা নির্গত হয়। কেন্দ্রটি না থাকলে শলাকাগুলিও থাকতে পারে না। একই ভাবে, সমগ্র জগৎ ব্রহ্মে আশ্রিত। ব্রহ্ম ছাড়া জগতের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এই শ্লোকে হৃদ্যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ধমনীগুলিকে চক্রের শলাকাগুলির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এই ধমনীগুলি হৃদ্যন্ত্রে কেন্দ্রীভূত।
এরপর উপনিষদ হৃদয়ে ‘ওম্’কে ধ্যান করার উপদেশ দিচ্ছেন। উজ্জ্বল, দীপ্ত, জ্যোর্ত্মিয় ‘ওম্’-এর উপর ধ্যান করতে হবে। আমাদের অন্তরস্থ আত্মাকে ‘ওম্’ বলে চিন্তা করতে হবে। যাঁরা যোগাভ্যাস করেন তাঁরা জানেন ধ্যেয় বস্তুকে জ্যোতির্ময় সত্তা রূপে কল্পনা করতে হয়। ব্রহ্মকে ধ্যান করা বড় কঠিন, কারণ ব্রহ্ম নিরাকার। তাই উপনিষদ সূচনাতে ‘ওম্’ তথা প্রণবকে ধ্যান করতে বলেছেন, কারণ ‘ওম্’ ব্রহ্মের প্রতীক। পরিণত সাধক পরবর্তীকালে ‘ওম্’কে অতিক্রম করেন। ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব বোধ হলে আর কোন রূপের ধ্যান করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সাধনার আরম্ভে অন্তরস্থ আত্মাকে উজ্জ্বল ওঁকার রূপে ধ্যান করার নির্দেশ দিচ্ছেন উপনিষদ। এই ভাবে ধ্যান করার অভ্যাস করলে মানুষ অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের পারে যেতে সক্ষম হন। শিষ্য যেন সেই অবস্থা প্রাপ্ত হন, এখানে গুরু তাঁকে সেই আশীর্বাদই করছেন।
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্যস্যৈষ মহিমা ভুবি।
দিব্যে ব্রহ্মপুরে হ্যেষ ব্যোম্ন্যাত্মা প্রতিষ্ঠিতঃ॥
মনোময়ঃ প্রাণশরীরনেতা
প্রতিষ্ঠিতোঽন্নে হৃদয়ং সন্নিধায়।
তদ্বিজ্ঞানেন পরিপশ্যন্তি ধীরা
আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি॥৭
অন্বয়: যঃ (যিনি); সর্বজ্ঞঃ (সাধারণ ভাবে সব বিষয় জানেন); সর্ববিৎ (বিশেষ রূপে সকল বিষয় জানেন); ভুবি (জগতে); যস্য (যাঁর); এষঃ মহিমা (এইরূপ মহিমা); এষঃ আত্মা হি (এই আত্মাই); দিব্যে (জ্যোতির্ময়); ব্রহ্মপুরে ব্যোম্নি (ব্রহ্মের আবাস হৃদয়াকাশে); প্রতিষ্ঠিতঃ (অবস্থিত); [তিনি] হৃদয়ং সন্নিধায় (হৃদয়ে থেকে); মনোময়ঃ (মনোময়); প্রাণশরীরনেতা (প্রাণবায়ু ও সূক্ষ্ম শরীরের নিয়ামক); অন্নে (অন্নময় অর্থাৎ স্থূল শরীরে প্রকাশিত); প্রতিষ্ঠিতঃ (আশ্রয়স্থল); ধীরাঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ); তদ্বিজ্ঞানেন (তাঁর সঙ্গে অভিন্নভাবে নিজেকে জেনে) যৎ আনন্দরূপম্ অমৃতম্ (যিনি আনন্দস্বরূপ ও নিত্য); বিভাতি (প্রকাশিত হন); পরিপশ্যন্তি (তাঁরা [আত্মাকে] সম্যক্-রূপে জানেন)।
সরলার্থ: যিনি সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে সব কিছু জানেন, এ জগতের সকল বস্তুই যাঁর মহিমার প্রকাশ, সেই পরমাত্মা জ্যোতির্ময় হৃদয়াকাশে অবস্থান করেন। তাই হৃদয়াকাশের আর এক নাম ব্রহ্মপুর। মন রূপে প্রকাশিত এবং প্রাণ ও সূক্ষ্মদেহের চালক হিসেবে পরমাত্মা স্থূলদেহের অভ্যন্তরে হৃদয়ে বাস করেন। বিবেকী পুরুষরা এই অবিনাশী ও আনন্দস্বরূপ আত্মাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আত্মাকে এইভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তাঁকে সম্যক্ ভাবে জানা যায়।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে কি ভাবে বর্ণনা করা যায়? তিনি ‘সর্বজ্ঞ’, সব কিছু জানেন এবং ‘সর্ববিৎ’, সব কিছু বোঝেন। ‘যস্য এষঃ মহিমা ভুবি’—এই বিশ্ব তাঁরই মহিমা। কোন্ অর্থে? এর অর্থ, সকল বস্তুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। যা কিছু আমরা দেখি সবই ব্রহ্ম। তিনি বাইরে আছেন, আবার ভিতরেও আছেন। তিনি একযোগে বিশ্বগত এবং বিশ্বাতীত। সমগ্র জগৎ তাঁর দ্বারা আচ্ছাদিত। আবার তিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। ব্রহ্মপুরে অর্থাৎ ব্রহ্মের আবাসে তথা হৃদয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত।
হৃৎপদ্মের মধ্যে রয়েছে শূন্য আকাশ। বাইরেও আছে সেই একই আকাশ। এই হৃদয়াকাশেই ব্রহ্মের অবস্থান। তাই এর নাম ব্রহ্মপুর। হৃদয়াকাশ জ্যোতির্ময় বলে একে দিব্য বলা হয়। আমাদের আবেগ ও অনুভূতিগুলি হৃদয়েই হয়ে থাকে। এই সব অনুভূতির দ্বারাই ব্রহ্মের উপস্থিতি বোধ করা যায়। যোগিগণ ব্রহ্মকে নিজ হৃদয়স্থ আত্মারূপে কল্পনা করেন।
ধরা যাক, কোন ব্যক্তি ব্যবহারিক জগতের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। আসলে তিনি কোথায় গেছেন? কোথাও যাননি। এই জগৎ তাঁর নিজেরই মহিমা, এরূপ তিনি বোধে বোধ করেছেন। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, সমুদ্র সব চক্রাকারে ঘুরছে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তারা চলে। একই ভাবে দেশকালও নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যাঁর স্বরূপ জ্ঞান হয়েছে, তিনি এই সমগ্র দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এই জগতের আশ্চর্য সব ঘটনাকে তিনি তাঁর নিজের গৌরব বলে অনুভব করেন। সব কিছুই তাঁর মধ্যে রয়েছে, বাইরে আর কিছুই নেই।
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে॥৮
অন্বয়: তস্মিন্ পরাবরে দৃষ্টে (কারণ ও কার্য উভয়রূপে ব্রহ্মকে জানলে); অস্য (সেই তত্ত্বজ্ঞানীর); হৃদয়গ্রন্থিঃ (হৃদয়ের অবিদ্যারূপ বন্ধন); ভিদ্যতে (ছিন্ন হয় অর্থাৎ বিনষ্ট হয়); সর্বসংশয়াঃ (সকল সংশয়); ছিদ্যন্তে (ছিন্ন হয়); কর্মাণি চ (কর্মফলসমূহও); ক্ষীয়ন্তে (ক্ষয়প্রাপ্ত হয়)।
সরলার্থ: যিনি কারণ ব্রহ্ম ও কার্য ব্রহ্ম উভয়কেই নিজ আত্মারূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, তাঁর হৃদয়ের সকল জটিলতা দূর হয়, তাঁর সকল সংশয় নাশ হয়, তাঁর কর্মফলও ক্ষয় হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা: স্বরূপজ্ঞান হলে কি হয় এখানে সেকথাই বলা হয়েছে। তখন নিজেকে সব কিছুর কারণ ও কার্য বলে বোধ হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র অহং বা ‘কাঁচা আমি’র বিনাশ হয়। ব্রহ্মকে জানার আগে পর্যন্ত মানুষ নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে। মানুষ তখন দেহ-মনের সঙ্গে অভিন্ন বোধ করে। স্বভাবতই দেহ-মনের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সে আবদ্ধ করে ফেলে। আর এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। কামনা-বাসনা তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আশা-নিরাশার দোলায় মানুষ তখন মনের স্থিরতা হারায়। এক কথায়, তখন আর তাকে স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না। তার চরিত্রে নানা অঙ্কট-বঙ্কট অর্থাৎ গোলমাল দেখা দেয়। নিজের স্বরূপ না জানার ফলেই এসব অঘটন ঘটে। যখন মানুষ নিজেকে পরমাত্মা তথা সর্বভূতের অন্তরাত্মা বলে জানতে পারে তখন তার দুই-বোধ চিরতরে ঘুচে যায়। এই জগৎ কার্য-কারণের সমষ্টি। কার্য ও কারণ এক ও অভিন্ন, আর মানুষই সেই অভিন্ন সত্তা। মানুষই ব্রহ্ম। এই অবস্থায় তার আর কোন কর্ম থাকে না। অতএব কর্মফলও থাকে না। অন্ধকার ঘরে একটি দেশলাই কাঠি জ্বালালে যেমন বহুযুগের অন্ধকার দূর হয় তেমনি আত্মজ্ঞান হলে সঞ্চিত কর্ম ক্ষয় হয়ে যায়। তখন কর্তব্য কর্ম আর কিছু থাকে না, কারণ মানুষের অহংবুদ্ধি পুরোপুরি মুছে যায়। যদিও প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ যে কর্ম ফল দিতে শুরু করেছে তা চলতেই থাকে, কিন্তু আসলে তিনি মুক্ত।
‘পর’ অর্থ হল উৎকৃষ্ট আর ‘অবর’ অর্থ নিকৃষ্ট। কারণ হিসাবে ব্রহ্ম (অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্ম) উৎকৃষ্ট, তাই তাঁকে ‘পর’ বলা হয়। আবার তাঁকে ‘অবর’ বলা হয়, যেহেতু কার্য হিসাবে (অর্থাৎ জগৎ-রূপে প্রকাশিত) ব্ৰহ্ম নিকৃষ্ট।
হিরন্ময়ে পরে কোশে বিরজং ব্রহ্ম নিষ্কলম্।
তচ্ছুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ্যদাত্মবিদো বিদুঃ॥৯
অন্বয়: হিরন্ময়ে (জ্যোতির্ময়); পরে (শ্রেষ্ঠ); কোশে (কোষের মধ্যে অর্থাৎ হৃদয় মধ্যে); বিরজম্ (শুদ্ধ, নিরঞ্জন); নিষ্কলম্ (যাঁর কলা নেই [অর্থাৎ নিরাকার]); তৎ ব্রহ্ম (সেই ব্রহ্ম); শুভ্রম্ (শুদ্ধ); তৎ জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ (জ্যোতির জ্যোতিস্বরূপ); যৎ (যা); আত্মবিদঃ (আত্মজ্ঞানীরা); বিদুঃ (জানেন)।
সরলার্থ: ব্রহ্ম নিষ্কলঙ্ক এবং নিরাকার। হৃদয়ের জ্যোতির্ময় শ্রেষ্ঠ কক্ষে তাঁর আবাস। সেই ব্ৰহ্ম শুদ্ধ এবং আলোর চেয়েও উজ্জ্বল। যিনি আত্মাকে জানেন তিনি ব্রহ্মকেও জানেন।
ব্যাখ্যা: খাপের মধ্যে যেমন তলোয়ার থাকে, হৃদয়েও তেমনি ব্রহ্ম লুকিয়ে আছেন। হৃদয়েই ব্রহ্মের উপলব্ধি হয়। সেই জন্য হৃদয়কে ব্রহ্মের ‘কক্ষ’ বলা হয়েছে। এই কক্ষকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশেষিত করা হয়েছে, কারণ দেহের অন্তরতম প্রদেশে এই কক্ষের অবস্থান। আত্মা জ্যোতির্ময়; তিনিই মনকে আলোকিত করেন। আবার তিনি আলোর চেয়েও উজ্জ্বল কারণ তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানের উৎস। মন আমাদের যে আলো দান করে তা ব্রহ্ম থেকেই আসে। ব্রহ্ম শুদ্ধ, কারণ তিনি জ্ঞানস্বরূপ। অজ্ঞানতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোঽয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি॥১০
অন্বয়: তত্র (সেই ব্রহ্মে); সূর্যঃ (সূর্য); ন ভাতি (দীপ্তি পায় না); ন চন্দ্রতারকম্ (চন্দ্রতারাও না); ইমাঃ বিদ্যুতঃ (এই বিদ্যুৎ); ন ভান্তি (দীপ্তি পায় না); অয়ম্ অগ্নিঃ কুতঃ (এই অগ্নি কি করে প্রকাশ পাবে); তম্ এব ভান্তম্ (তিনি দীপ্যমান হলে); সর্বম্ (সব কিছু); অনুভাতি (তাঁর আলোতেই প্রকাশিত হয়); তস্য ভাসা (তাঁর জ্যোতিতেই); সর্বমিদম্ (এই সব কিছু); বিভাতি (জ্যোতির্ময়)।
সরলার্থ: ব্রহ্মের উপস্থিতিতে সূর্য, চন্দ্র, তারা কেউই কিরণ দান করে না। এমন-কি বিদ্যুৎও তার উজ্জ্বলতা হারায়। এমন অবস্থায় অগ্নি কি করে দীপ্তি পাবে? ব্রহ্মের জ্যোতিতেই এই সব কিছু জ্যোতির্ময়। ব্রহ্মের আলোকেই সব আলোকিত।
ব্যাখ্যা: সূর্যকিরণ সব বস্তুকে প্রকাশ করে, ব্রহ্মকে প্রকাশ করতে পারে না। চন্দ্র, তারা ও অন্যান্য উজ্জ্বল বস্তু সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। এই সব বস্তুর মধ্যে কোনটিরই নিজস্ব জ্যোতি নেই। এরা ব্রহ্মের জ্যোতিতেই জ্যোতিষ্মান। একমাত্র ব্রহ্মই স্বয়ং-প্রকাশ। দীপের আলোর মতো ব্রহ্মও নিজেকে নিজেই প্রকাশ করেন। ব্রহ্ম সব কিছুর উৎস। ব্রহ্ম আছেন, তাই অন্যান্য বস্তুরও অস্তিত্ব আছে। ব্রহ্মকে বাদ দিয়ে কোন কিছুরই অস্তিত্ব সম্ভব নয়। সেই ব্রহ্মের অধিষ্ঠান আমাদের হৃদয়ে। অর্থাৎ আমিই সেই ব্রহ্ম।
ব্রহ্মৈবেদমমৃতং পুরস্তাদ্ব্রহ্ম
পশ্চাদ্ব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ।
অধশ্চোর্ধ্বং চ প্রসৃতং
ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্॥১১
অন্বয়: ইদম্ অমৃতম্ (এই আনন্দস্বরূপ); ব্রহ্ম এব (ব্রহ্মই); পুরস্তাদ্ ব্ৰহ্ম (সম্মুখে ব্রহ্ম); পশ্চাৎ (পিছনে); দক্ষিণতঃ (দক্ষিণে অর্থাৎ ডাইনে); চ (এবং); উত্তরেণ (উত্তরে); ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); অধঃ (নীচে); ঊর্ধ্বং চ (উপরেও); ইদং ব্রহ্ম এব প্রসৃতম্ (এই ব্রহ্মই ব্যাপ্ত আছেন); ইদং বিশ্বং বরিষ্ঠম্ (এই জগৎ ব্রহ্ম [শ্রেষ্ঠ ])।
সরলার্থ: আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম তোমার সম্মুখে; তিনি আবার তোমার পিছনেও বটে। দক্ষিণে, উত্তরে, উপরে, নীচে সর্বত্রই তিনি। তিনি সর্বব্যাপী। এ জগৎ স্বয়ং ব্রহ্ম।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। তিনি স্বয়ং-প্রকাশ। তিনিই একমাত্র অধিষ্ঠান যাঁর উপর সব কিছু আরোপিত উপাধি মাত্র। উপাধিগুলি সত্য নয়। যেমন রজ্জুতে আরোপিত সর্প অথবা মরুভূমিতে আরোপিত মরীচিকা সত্য নয়, এ-ও ঠিক তেমনি।
কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে, এই দৃশ্যমান জগৎ মিথ্যা। এ জগৎ আপেক্ষিক ভাবে সত্য; একটি বিশেষ দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে সত্য। দেশ-কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই জগতের লয় হয়।
অন্ধকারে রজ্জুতে সর্পদর্শনে, সাপটিকে যে সত্য বলে মনে হয় তার কারণ সাপটি দড়ির উপরে অর্থাৎ একটি সত্য বস্তুর উপর আরোপিত। দড়ি সরিয়ে নিলে সাপও অদৃশ্য হয়। তেমনি ব্রহ্মকে আশ্রয় করে আছে বলেই জগৎকে সত্য বলে মনে হয়।
ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্রহ্ম সর্বত্র রয়েছেন। তিনি সর্বব্যাপী। তিনিই একমাত্র সত্য। সব কিছুকে ব্রহ্মের প্রকাশ রূপে দেখতে হবে। এ-ই যথার্থ জ্ঞান। জগৎকে জগৎ রূপে দেখার নামই অজ্ঞানতা।
মুণ্ডক উপনিষদের দ্বিতীয় মুণ্ডকের দ্বিতীয় অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
তৃতীয় মুণ্ডক
প্রথম অধ্যায়
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য-
নশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি॥১
অন্বয়: সযুজা (সর্বদা একসাথে); সখায়া (একরকম); দ্বা সুপর্ণা (সুন্দর পালক যুক্ত দুটি পাখি); সমানং বৃক্ষম্ (একই বৃক্ষে); পরিষস্বজাতে (পরস্পর আলিঙ্গন করে আছে); তয়োঃ (তাদের মধ্যে); অন্যঃ (একটি); স্বাদু পিপ্পলম্ (মিষ্টি ফল); অত্তি (খায়); অন্যঃ (অন্যটি); অনশ্নন্ অভিচাকশীতি ([ফল] খাওয়ার বদলে কেবল দেখে)।
সরলার্থ: সুন্দর পালকযুক্ত একই রকম দেখতে দুটি পাখি সবসময় একই গাছে থাকে। তাদের মধ্যে একটি পাখি সুমিষ্ট ফল খাচ্ছে এবং অন্যটি কিছু না খেয়ে কেবল দেখছে।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চাইছেন কিভাবে জীবাত্মা ও পরমাত্মা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এখানে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে একই গাছের দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ‘দ্বা সুপণা’—দুটি পাখি। ‘সুপর্ণা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘সুন্দর পালক’। এই পাখি দুটি ‘সযুজা’—পরস্পর অন্তরঙ্গ, এবং ‘সখায়া’—পরস্পর সদৃশ। তারা দেখতে একইরকম এবং পরস্পর অন্তরঙ্গ। ‘সমানং বৃক্ষম্’—একই বৃক্ষে তারা বসে আছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি (অর্থাৎ জীবাত্মা) টক মিষ্টি ইত্যাদি নানা স্বাদের ফল খাচ্ছে। অন্য পাখিটি কিছুই খাচ্ছে না, চুপচাপ বসে আছে। সে শান্ত এবং অচঞ্চল। ‘অভিচাকশীতি’—সে শুধু দেখছে। যে পাখিটি ফল খেতে মত্ত সে কখনও সুখী, কখনও অসুখী। কিন্তু অন্য পাখিটি নির্লিপ্ত, সাক্ষী, দ্রষ্টা।
অনুরূপভাবে পরমাত্মা সবসময়ই শান্ত, আত্মস্থ। তিনি সাক্ষী-মাত্র। অপরদিকে জীবাত্মা চঞ্চল, অস্থির। সে বাসনা দ্বারা তাড়িত এবং নিজ অভিজ্ঞতা অনুসারে কখনও সুখী, কখনও দুঃখী। জীবাত্মা নানা পরিস্থিতির অধীন; আর এই জন্যই সে সবসময় সুখদুঃখের দোলায় দুলছে। এইভাবে জীবাত্মার পরিবর্তন হয়ে চলেছে। আপাতদৃষ্টিতে পাখি দুটিকে আলাদা বলে মনে হলেও এরা কিন্তু ভিন্ন নয়। তাদের আচরণের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আসলে তারা এক ও অভিন্ন।
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্লোঽ-
নীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য
মহিমানমিতি বীতশোকঃ॥২
অন্বয়: পুরুষঃ (জীবাত্মা [জীব]); সমানে (একই); বৃক্ষে (বৃক্ষে অর্থাৎ দেহে); নিমগ্নঃ (অবস্থিত হয়ে); অনীশয়া (নিজের দেবত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়); মুহ্যমানঃ (অজ্ঞানতার মোহে আচ্ছন্ন); শোচতি (শোক করে); যদা (যখন); জুষ্টম্ ([যোগিগণের দ্বারা] সেবিত হয়ে); অন্যম্ ঈশম্ (দেহ ব্যতীত পরমাত্মাকে [ঈশ্বরকে]); পশ্যতি (দেখে); অস্য (তাঁর [পরমাত্মার]); ইতি (এই); মহিমানম্ (মহিমাকে); [তদা (তখন)]; বীতশোকঃ ([এই জগতের] শোকদুঃখ থেকে মুক্ত)।
সরলার্থ: জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে (অর্থাৎ একই দেহে) থাকলেও জীবাত্মা তার নিজ স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। এই কারণে তাকে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যখন তার স্বরূপজ্ঞান হয় তখন সে সুখদুঃখের পারে চলে যায় এবং নিজ মহিমা উপলব্ধি করে।
ব্যাখ্যা: ‘পুরুষ’ শব্দটির নানা অর্থ আছে। কোন্ প্রসঙ্গে শব্দটির উল্লেখ করা হয়েছে তার ওপরই এর অর্থ নির্ভর করছে। এখানে শব্দটির অর্থ জীবাত্মা। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আচার্য শঙ্কর একটি চমৎকার উদাহরণ দিচ্ছেন: জীবাত্মা যেন একটি অলাবু অর্থাৎ লাউ। সেটি সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে এবং তরঙ্গের আঘাতে দুলছে। সেটি পুরোপুরি তরঙ্গের অধীন। স্রোতের তাড়নায় সেটি ‘নিমগ্ন’ অর্থাৎ কখনও লাউটি জলের গভীরে যাচ্ছে, আবার কখনও জলের ওপরে ভাসছে, কখনও এদিকে কখনও বা অন্যদিকে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে জীবাত্মা যেন জীবন সমুদ্রে ডুবে আছে। আমাদের কখনও কখনও এ জীবনকে সুখপ্রদ বলে মনে হয়। যখন আমরা নিজেদের সুখী বলে মনে করি তখন অসুখী মানুষেরা আমাদের করুণার পাত্র। কিন্তু আবার এমনও হতে পারে মুহূর্তের মধ্যে কোন বিপর্যয়ের ফলে আমাদের জীবনটা বদলে গেল। আমাদের মুখের হাসি, সকল আশা-ভরসা তখন মিলিয়ে যায়। থাকে শুধুই চোখের জল। মানুষের জীবনটা এমনই, তাই শঙ্কর এখানে এরকম উপমা দিয়েছেন। ‘অলাবু’কে যদি ফল বলে মানতেই হয় তবে এটি একটি নিকৃষ্ট ফল মাত্র।
‘অনীশয়া’—জীবাত্মা নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করে না। সে যে স্বরূপত দেবতা—একথা সে জানে না। আমাদের সকলের অবস্থাই এই রকম। আমরা ভাবি, ‘হায়! আমি অক্ষম, অপদার্থ, নির্বোধ।’ শঙ্কর একেই ‘দীনভাব’ বলেছেন। এ যেন নিজেকে অসহায় বলে মনে করা। এরূপ মনোভাব আত্মহত্যার সমান। এই সব ব্যক্তি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে (শোচতি মুহ্যমানঃ)। এই ‘অনীশয়া’ তার অশেষ দুঃখকষ্টের কারণ হয়। কিন্তু এই ব্যক্তিই আবার অন্য মানুষে পরিণত হতে পারে। তা কি করে সম্ভব হয়? সত্যনিষ্ঠা, পবিত্রতা ও আত্মসংযমের মতো আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দ্বারা এই পরিবর্তন লাভ করা যায়। ‘যদা’ শব্দটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এ যেন মোড় ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। নিরন্তর আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকলে মানুষের চিত্তশুদ্ধি ও আত্মসংযম লাভ হয়। তখন সে আত্মজ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। তার জীবনে তখন কি ঘটে? ‘পশ্যতি’—সে দেখে। কি দেখে? ‘অন্যম্ ঈশম্’—সে নিজহৃদয়ে ঈশ্বরকে দেখে। সে নিজ আত্মাকেই ঈশ্বর বলে মনে করে। ‘অন্যম্’—এ তার সত্তার আর একটি দিক। ‘জুষ্টম্—কে ‘জুষ্টম্’? শঙ্করের মতে, যিনি যোগিগণের আরাধ্য তিনিই ‘জুষ্টম্’। তিনি কে? তিনিই ঈশ্বর—‘ঈশম্’। ‘জুষ্টম্’ কথাটির অপর অর্থ হল ‘কোন কিছুর খোঁজে বের হওয়া’ অথবা ‘বহুজন পূজিত’।
জীবাত্মা এখন তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানেন। এর আগে তিনি নিজেকে অক্ষম, অপদার্থ বলে মনে করতেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে তিনি এখন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি জানেন যে, তিনি ও পরমাত্মা এক এবং অভিন্ন। চিত্তশুদ্ধি হলে এই জ্ঞান আপনা আপনিই ফুটে ওঠে। এমন নয় যে, মানুষটির সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে। তিনি আগে অপদার্থ ছিলেন এখন দেবতা হয়েছেন, একথা ঠিক নয়। তিনি সবসময়ই দেবতা ছিলেন, শুধু একথা তিনি জানতেন না। উপনিষদের বাণী থেকে আমরা এই সত্যই লাভ করে থাকি।
যখন কোন ব্যক্তি ‘অন্যম্ ঈশম্’—ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি ‘অস্য মহিমানম্’—এই বিশ্বের মহিমাকে নিজের মহিমা বলে উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি তখন ঈশ্বর। এই জগৎ অর্থাৎ সব কিছুর সাথে তিনি একাত্ম বোধ করেন। ‘বীতশোকঃ’—তিনি তখন সুখদুঃখের পারে চলে যান। তিনি কেবল দুঃখকেই জয় করেন না, সুখকেও জয় করেন। এই হল প্রকৃত মুক্তি।
যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং
কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্।
তদা বিদ্বান্পুণ্যপাপে বিধূয়
নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি॥৩
অন্বয়: যদা (যখন); পশ্যঃ (তাঁর নিজ স্বরূপকে সাধক উপলব্ধি করেন); রুক্মবর্ণম্ (উজ্জ্বল); কর্তারম্ (স্রষ্টা); ব্রহ্মযোনিম্ (ব্রহ্মার কারণ [হিরণ্যগর্ভ ]); ঈশম্ (প্রভু); পুরুষ (পরমপুরুষ); পশ্যতে (দেখেন [উপলব্ধি করেন]); তদা (তখন); বিদ্বান্ (সেই সাধক যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); পুণ্যপাপে বিধূয় (পুণ্য ও পাপ ত্যাগ করে); নিরঞ্জনঃ (পবিত্র); পরমম্ (পরম); সাম্যম্ (একত্ব বোধ); উপৈতি (প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: সাধক যখন এই জ্যোতির্ময় স্রষ্টা, ব্রহ্মার কারণ (হিরণ্যগর্ভ), সেই পরমপুরুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি পাপপুণ্যের ঊর্ধ্বে চলে যান এবং নির্লিপ্ত ও পবিত্র হয়ে পরম সাম্য লাভ করেন। অর্থাৎ সাধক তখন সব কিছুর সাথে একাত্মতা অনুভব করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মজ্ঞান লাভ করলে কিরকম অবস্থা হয় উপনিষদ এখানে আমাদের সেকথা বলছেন। ‘যদা পশ্যঃ পশ্যতে’—যখন সাধক দেখেন। ‘পশ্য’ কথাটির অর্থ দ্রষ্টা, ‘পশ্যতে’ কথাটির অর্থ ‘দেখে’। এ দেখা কিন্তু সাধারণ দেখা নয়। এ ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা নয়, এক অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। সাধক তখন দেখেন অর্থাৎ উপলব্ধি করেন। কি দেখেন? ‘রুক্মবর্ণম্’—হৃদয়স্থিত স্বয়ং প্রকাশিত, স্বয়ং জ্যোতিস্বরূপ আত্মাকে। এই কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘সোনার বরণ’। কিন্তু এখানে পরমাত্মা সোনালী রঙের এক উজ্জ্বল সত্তা এমন কথা বলা হচ্ছে না। পরমাত্মা, জ্যোতিস্বরূপ একথা বোঝাতেই কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
‘কর্তারম্’—তিনি কর্তা, প্রকৃত প্রভু এবং পরিচালক। তিনিই একমাত্র শাসক। তিনি কারণ, আর সব কিছুই কার্য। তিনিই পুরুষ। তিনি সকলের মধ্যে আছেন। সব রূপই তাঁর রূপ। ‘ব্রহ্মযোনিম্’—তাঁর মধ্যেই সব কিছু রয়েছে। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সবকিছু ব্রহ্মের কাছ থেকে এসেছে এবং তিনিই সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। যিনি এই ব্রহ্মকে অর্থাৎ আত্মাকে জানেন তিনি পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দের ঊর্ধ্বে চলে যান। শুধুমাত্র পাপই যে বন্ধন তা নয়, পুণ্যও এক রকমের বন্ধন। একথা আমরা সকলেই জানি যে, পাপ করলে তার যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে। কিন্তু পুণ্যও বন্ধন—এ কেমন করে হয়? কারণ পুণ্য কাজ করলে আমাদের পুনর্জন্ম হবে না—এমন কথা কিন্তু শাস্ত্রে নেই। সোনার শিকলও শিকল, অর্থাৎ লোহার শিকলের মতো সোনার শিকলও আমাদের বদ্ধ করে। আমরা মুক্ত হতে চাই এবং একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভের দ্বারাই তা সম্ভব। যখন আমি নিজেকে জানি অর্থাৎ যখন আমার স্বরূপজ্ঞান হয় তখন আর পাপ-পুণ্য বোধ থাকে না। সব কর্মফল তখন ক্ষয় হয়। কর্মফল পুরোপুরি ক্ষয় হলে নির্বাণ লাভ হয়।
মানুষ যখন এই অবস্থা লাভ করেন তখন আর কোন মলিনতা, কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। অর্থাৎ তিনি তখন শুদ্ধ নিরঞ্জন পুরুষে পরিণত হন। ‘সাম্যম্ উপৈতি’—এমন একটি সাম্য অবস্থায় তিনি পৌঁছান যখন এ জগতের সব কিছুর সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। আমরা ভালবাসার কথা বলি, কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা কিরকম? এক জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়। অর্থাৎ যখন আমরা সকলের মধ্যে সেই এক আত্মা বা এক ঈশ্বরকে দেখি, যখন ‘আমি-তুমি’ বোধ চিরতরে ঘুচে যায়। তখনই আমরা যথার্থ ভালবাসতে পারি। এই একত্বের বোধ থেকেই আসে সমদর্শিতা অর্থাৎ সকলকে সমানভাবে দেখা।
আমাদের সব দুঃখকষ্টের মূলে রয়েছে এই ‘দুই’-বোধ। আমরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে পৃথক বলে মনে করি। আমরা মনে করি, আমরা অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তিমানুষ অর্থাৎ জীবাত্মা, আর পরমাত্মা হলেন অন্য কিছু। দেহ, নাম, বংশ-মর্যাদা প্রভৃতির সঙ্গে আমরা নিজেদের এক করে ফেলি। কিন্তু এ সবই আমাদের উপাধিমাত্র। অজ্ঞানতা বা অবিদ্যার জন্যই এই সব উপাধিকে আমরা ‘আমি’ বলে মনে করি। এই অজ্ঞানতার জন্যই আমরা নিজেদের পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে করি। এর ফলে আমরা নানা দুঃখকষ্ট ভোগ করে থাকি। আমাদের অবস্থা হল এই টক-মিষ্টি ফল ভোগকারী পাখিটির মতো। কিন্তু স্বরূপত আমরা সকলেই নির্গুণ। কিন্তু আমরা তা বুঝব কেমন করে? আত্মসংযম অভ্যাসের দ্বারা। জড়জগৎ যখন আর আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে না, যখন আমি উপলব্ধি করি সব কিছু আমার ভেতরেই রয়েছে, তখনই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি—আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। তখন আমি জানি গাছের অন্য পাখিটির মতো আমি সব সময় এক। জগতের কোন পরিবর্তন আমাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না। আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী, সকল শুভাশুভের ঊর্ধ্বে। শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য, জীবন-মৃত্যু—এ সবই আপেক্ষিক। পরব্রহ্মে কোন দুই-বোধ নেই। সব কিছুর মধ্যে সেই একই ব্ৰহ্ম রয়েছেন। তিনিই আত্মা। একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভেই আমরা উপলব্ধি করি যে, আমরা সকলে এক ও অভিন্ন। আত্মজ্ঞান লাভই জীবনের উদ্দেশ্য—একথাই উপনিষদ আমাদের নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
প্রাণো হ্যেষ যঃ সর্বভূতৈর্বিভাতি
বিজানন্ বিদ্বান্ ভবতে নাতিবাদী।
আত্মক্রীড় আত্মরতিঃ ক্রিয়াবান্
এষ ব্রহ্মবিদাং বরিষ্ঠঃ॥৪
অন্বয়: যঃ (যিনি [ঈশ্বর]); সর্বভূতৈঃ (সকল ভূতে); বিভাতি (প্রকাশ পান); এষঃ হি প্রাণঃ (তিনিই প্রাণস্বরূপ); বিদ্বান্ (জ্ঞানী ব্যক্তি); বিজানন্ ([তাঁকে] জেনে); অতিবাদী ন ভবতে ([আত্মা ছাড়া] অন্য কোন কথা বলেন না); আত্মক্রীড়ঃ (নিজের সাথে খেলা করেন); আত্মরতিঃ (আত্মাই তাঁর আনন্দের উৎস); ক্রিয়াবান্ (ক্রিয়াশীল [ধ্যান ধারণা, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদিতে মগ্ন]); এষঃ (তিনি); ব্রহ্মবিদাম্ (ব্রহ্মবিদ্গণের মধ্যে); বরিষ্ঠঃ (শ্রেষ্ঠ)।
সরলার্থ: ঈশ্বর সব বস্তুর মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং সব প্রাণীর তিনিই প্রাণ-স্বরূপ। যখন কোন ব্যক্তি একথা জানেন, তখন তিনি কেবল ব্রহ্মেরই (অর্থাৎ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ) আলোচনা করেন। তিনি নিজেই নিজের সাথে খেলা করেন। আনন্দস্বরূপ তিনি। ধ্যান ও অন্যান্য অধ্যাত্ম সাধনে তিনি মগ্ন। সকল ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ।
ব্যাখ্যা: এই পরমাত্মা অর্থাৎ ঈশ্বরই সর্ববস্তুর প্রাণস্বরূপ। প্রাণের উৎসও তিনি। ‘সর্বভূতৈর্বিভাতি’—তাঁর আলোতেই সব বস্তু আলোকিত। সব বস্তুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। ‘তপসা চীয়তে ব্রহ্ম’—শুধুমাত্র মনন বা চিন্তার দ্বারাই ব্ৰহ্ম নিজেকে প্রসারিত করেন। ব্রহ্ম যেন চিন্তা করলেন, ‘একঃ অহং বহুস্যাম্’—আমি এক, আমি বহু হব। এইভাবে ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করলেন। তাঁর চিন্তামাত্রই এই জগতের সৃষ্টি হল। ‘সর্বভূতানি’—এই জগৎ সংসারের সব কিছুর মধ্যে তিনিই রয়েছেন। ‘তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’—তাঁর জ্যোতিতেই সব বস্তু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সকল আলোকের উৎসও তিনি। বেদান্ত-শাস্ত্রে স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁরা উভয়েই ব্রহ্ম।
‘বিজানন্ বিদ্বান্ ভবতে’—প্রথমেই জানতে হবে, অর্থাৎ উপনিষদের চর্চা করে ও গুরুর কাছ থেকে ব্রহ্মের স্বরূপ শুনে, বুদ্ধি দিয়ে তা ধারণা করতে হবে। আচার্য বলবেন: ‘তত্ত্বমসি—তুমিই সেই।’ গুরুর এই উপদেশ প্রথমে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হবে। অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা প্রথমে শব্দার্থকে বুঝতে হবে। তারপর সেই শব্দার্থকে নিজ হৃদয়ে উপলব্ধি করতে হবে। যিনি এই পরমসত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম তিনিই জ্ঞানী ব্যক্তি। আমরা নানা রকমের পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু সেগুলিকে যদি নিজের জীবনে প্রয়োগ না করি তবে তা বৃথা হয়ে যায়। তবলার ‘বোল’ লোকে বেশ মুখস্থ বলতে পারে কিন্তু হাতে আনা বড় শক্ত। সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। ‘ন অতিবাদী’—যিনি এই সত্যকে উপলব্ধি করেছেন তিনি ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ভিন্ন অন্য কোন কথা বলেন না। অজ্ঞানতা দূর হয়ে আমাদের যখন স্বরূপজ্ঞান হয় তখন আর আমাদের ভুল হয় না। যে জ্ঞান আমরা বুদ্ধির দ্বারা অর্জন করে থাকি ভবিষ্যতে তা হয়তো ভুলেও যেতে পারি। কিন্তু এই জ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধির কচ্কচানি নয়, এ এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। যখন কোন ব্যক্তি জানেন ‘তিনিই স্বয়ং আত্মা’, তখন তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, যে কাজই করুন না কেন, নিজ স্বরূপ সম্পর্কে তিনি সবসময়ই সজাগ। এই বিশ্বাস তাঁর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
তখন কি হয়? ‘আত্মক্রীড়ঃ’—সাধক তখন নিজেই নিজের সঙ্গে খেলা করেন। আমরা হয়তো বলব, এসব কি ব্যাপার! এও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আত্মা ছাড়া তিনি আর কিছুই জানেন না। সাধক তখন অনুভব করেন এক আত্মা বা এক ঈশ্বরই সবার মধ্যে রয়েছেন। তাঁর কাছে এক বৈ দুই নেই। ‘আত্মরতিঃ’—সাধক তখন নিজ আত্মাতে লীন হন। তিনি নিজের আনন্দে নিজেই বিভোর। কারণ সমগ্র বিশ্বচরাচর যে তাঁর ভেতরেই রয়েছে, বাইরে নয়। সাধক যখন আত্মার সাথে মিলিত হন, তখন তিনিই বরিষ্ঠ, সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। ‘এক’ জ্ঞানই জ্ঞান, আর ‘দুই’ জ্ঞান অজ্ঞান—এটা উপলব্ধি করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।
সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ আত্মা
সম্যগ্জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্যেণ নিত্যম্।
অন্তঃশরীরে জ্যোতির্ময়ো হি শুভ্রো
যং পশ্যন্তি যতয়ঃ ক্ষীণদোষাঃ॥৫
অন্বয়: এষঃ জ্যোতির্ময়ঃ শুভ্রঃ হি আত্মা (এই জ্যোতির্ময় শুভ্র আত্মা); অন্তঃশরীরে (দেহের অভ্যন্তরে); নিত্যম্ (সর্বদা); সত্যেন (কথায় ও কাজে সত্যনিষ্ঠার দ্বারা); তপসা (আত্মসংযমের দ্বারা); ব্রহ্মচর্যেণ (ব্রহ্মচর্যের দ্বারা); সমগ্জ্ঞানেন (যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা); লভ্যঃ (লাভ করা যায়); [ন অন্যথা (অন্য উপায়ের দ্বারা নয়)]; যম্ (আত্মাকে); ক্ষীণদোষাঃ (যাঁদের মন শুদ্ধ ও অনাসক্ত); যতয়ঃ (সাধকগণ); পশ্যন্তি (অনুভব করেন)।
সরলার্থ: দেহের মধ্যে হৃৎপদ্মে এই শুদ্ধ ও জ্যোতির্ময় পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে। কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুসরণ, স্বরূপ চিন্তা এবং আত্মসংযম ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাসের দ্বারাই আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মোপলব্ধির জন্য সাধককে যেসব ধাপ অতিক্রম করতে হয়, এই শ্লোকে সেকথাই বলা হয়েছে। প্রথমত এবং প্রধানত সাধক কায়মনোবাক্যে (অর্থাৎ কথায়, কাজে এবং আচরণে) সত্যনিষ্ঠ হবেন। সত্যকে তিনি সবার ওপরে স্থান দেন। সত্য রক্ষার জন্য তিনি কোন কিছুর সাথে আপস করেন না। কারণ, সত্যই তাঁর ঈশ্বর। সাধককে কঠোর তপস্যা করতে হবে, এবং সব সময় আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকতে হবে। কৃচ্ছ্রতা বলতে কিন্তু আচার-অনুষ্ঠানকে বোঝায় না, এর অর্থ আত্মসংযম। দেহ এবং মন তখন সাধকের বশে থাকে। খুব সহজ কাজ নয়, কিন্তু একাজ খুবই জরুরী। সাধক বহু বছরের কঠোর সংগ্রামের ফলে এই আত্মসংযম লাভ করেন। এই সংগ্রামই হচ্ছে কৃচ্ছ্রতা। আত্মসংযমের আর একটি তাৎপর্য হল মনঃসংযোগ। সাধক লক্ষ্যে অবিচল থেকে তাঁতে মনকে একাগ্র করেন।
আত্মজ্ঞান লাভ করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য; কিন্তু কোথায় আছেন এই আত্মা? এর প্রকৃতিই বা কেমন? সকলের হৃৎপদ্মে এই আত্মা বিরাজিত। আত্মা স্বয়ং প্রকাশিত ও শুদ্ধ। যেসব যোগিগণের মন রাগ-দ্বেষ, লোভ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মলিনতা থেকে মুক্ত তাঁরা নিজ হৃদয়ে আত্মাকে উপলব্ধি করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে সাধক সত্যকে বুঝতে পারেন। ‘সত্য’ বলতে এখানে ‘পরম সত্য’কে বোঝানো হয়েছে। এই পরম সত্য যে কি তা কেউ জানে না। এই মুহূর্তে আমরা সত্য বলতে যা বুঝি সেই আপেক্ষিক সত্যকে ধরেই পরম সত্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই সত্যনিষ্ঠাই ধর্মীয় জীবনের মূল কথা।
সত্যমেব জয়তে নানৃতং
সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।
যেনাক্রমন্তষয়ো হ্যাপ্তকামা
যত্র তৎসত্যস্য পরমং নিধানম্॥৬
অন্বয়: সত্যমেব (সত্যেরই); জয়তে (জয় হয়); অনৃতং ন (মিথ্যার নয়); সত্যেন (সত্যের দ্বারা); বিততঃ (বিস্তৃত); দেবযানঃ পন্থাঃ (দেবযান নামক পথ); যেন হি (যার দ্বারাই); আপ্তকামাঃ (বিগতস্পৃহ); ঋষয়ঃ (ঋষিগণ); আক্রমন্তি (যান); যত্র (যেখানে); তৎ (সেই); সত্যস্য (সত্যের মধ্যে); পরমম্ (শ্রেষ্ঠ); নিধানম্ (ফল নিহিত)।
সরলার্থ: একমাত্র সত্যেরই জয় হয়, অসত্যের জয় হয় না। কারণ স্বর্গদ্বারে পৌঁছবার প্রশস্ত পথটি সত্যের দ্বারাই লাভ করা যায়। পূর্ণকাম ঋষিরা (যাঁদের কোন কামনা বাসনা নেই) সত্যের মাধ্যমেই তাঁদের পরম লক্ষ্যে পৌঁছান।
ব্যাখ্যা: আমরা সকলেই জানি, সত্যেরই জয় হয়, অসত্যের হয় না। কোন ধার্মিক ব্যক্তি অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রথমে হয়তো পরাস্ত হতে পারেন, কিন্তু পরিণামে সত্যেরই জয় হবে। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হয় ব্যক্তিটি তো বেশ সুখেই আছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার পতন অনিবার্য। তার অপকর্ম বেশিদিন গোপন থাকে না। তখন সমাজ তাকে ত্যাগ করে। তার সমস্ত চালাকি শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
আধ্যাত্মিক জীবনের শুরুতেও সত্য, শেষেও সত্য। অধ্যাত্ম পথে সাধক সবসময় সত্যকে ধরে থাকেন। তিনি সত্যের জন্য সব কিছুকে ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করেন না। তাঁদের কাছে উপায়ও উদ্দেশ্যর মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই সত্যের পথই হচ্ছে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা। কোন অবস্থাতেই সাধক এই সত্য থেকে সরে আসেন না। যে কোন মূল্যে তিনি এই পথকে ধরে থাকেন। আর শেষে তিনি সেই লক্ষ্যে পৌঁছান যা পূর্ণকাম, আপ্তকাম ঋষিরা লাভ করে থাকেন। এই লক্ষ্য হল—আত্মজ্ঞান বা মুক্তি। আত্মজ্ঞান লাভে সাধক অনন্ত শান্তি ও অপার আনন্দ লাভ করেন। সত্যই আধ্যাত্মিক জীবনের মূল চাবিকাঠি।
বৃহচ্চ তদ্ দিব্যমচিন্ত্যরূপং
সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি।
দূরাৎ সুদুরে তদিহান্তিকে চ
পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্॥৭
অন্বয়: তৎ (তিনি অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম); বৃহৎ (সর্বব্যাপী); চ (এবং); দিব্যম্ (জ্যোতিস্বরূপ); অচিন্ত্যরূপম্ (চিন্তার অতীত); তৎ সূক্ষ্মাৎ চ সূক্ষ্মতরম্ (তিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর); [রূপে] বিভাতি (বিবিধ রূপে প্রকাশ পান); তৎ (তিনি); দূরাৎ (দূর থেকে); সুদূরে (আরও দূরে); অন্তিকে চ ইহ (এই দেহে; অতি কাছে); পশ্যৎসু (দ্রষ্টাদের কাছে); ইহ এব গুহায়াম্ (এই গুহাতে অর্থাৎ হৃদয়ে); নিহিতম্ (নিহিত আছেন)।
সরলার্থ: ব্ৰহ্ম অনন্ত, ইন্দ্রিয়াতীত এবং কল্পনার অতীত। ইনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম (সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্মতর), তিনি দূরতমের চেয়েও দূরে রয়েছেন আবার একই সাথে খুব কাছেও রয়েছেন। মানুষের হৃদয়-পদ্মেই তিনি বিরাজ করেন।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম বলতে আমরা কি বুঝি? ব্রহ্মের স্বরূপই বা কি? ব্রহ্ম কথাটির অর্থ ‘বৃহৎ’ বা ‘বৃহত্তম’। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে কথায় ও কাজে সত্যকে ধরে থাকতে হবে। ব্রহ্ম বাক্যমনাতীত। ব্রহ্মকে কল্পনা করা যায় না। ইনি স্বয়ংপ্রকাশ এবং আকাশের চেয়ে সূক্ষ্ম। প্রকৃতপক্ষে তিনি আছেন বলেই এই জগতের সব কিছুর অস্তিত্ব আছে। সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য উজ্জ্বল বস্তুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। ব্রহ্মই এসব বস্তুর কারণ। সকল প্রাণীর হৃদয়ে ব্রহ্ম বিরাজ করেন। কিন্তু তিনি আমাদের হৃদয়ে থাকলেও অবিদ্যার জন্য আমরা তা বুঝতে পারি না। যোগিগণ নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। তাঁরা নিজ হৃদয়ে ব্রহ্মের উপস্থিতি অনুভব করে ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যান।
ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা
নান্যৈর্দেবৈস্তপসা কর্মণা বা।
জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্ব-
স্ততস্তু তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মানঃ॥৮
অন্বয়: [তৎ] চক্ষুষা ন গৃহ্যতে (সেই ব্রহ্মকে চোখের দ্বারা দেখা যায় না); বাচা অপি ন (বাক্যের দ্বারাও নয়); অন্যৈঃ দেবৈঃ ন (অন্য কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারাও নয়); তপসা কর্মণা বা [ন] (তপস্যা বা কর্মের দ্বারাও নয়); জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্বঃ (নির্মলজ্ঞানের দ্বারা যাঁর মন শুদ্ধ হয়েছে); ততঃ (তারপর); [সাধকঃ] ধ্যায়মানঃ (সেই সাধক ধ্যান করতে করতে); তং নিষ্কলম্ (সেই নির্গুণ ব্রহ্মকে); পশ্যতে (দর্শন করেন)।
সরলার্থ: আত্মা নিরাকার তাই তাঁকে দেখা যায় না। ভাষা দিয়েও তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। তপস্যা বা যাগযজ্ঞের দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায় না। সাধক যখন ইন্দ্রিয়সুখে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হন তখন তাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন তিনি নিরাকার ব্রহ্মের অর্থাৎ আত্মার দর্শন লাভ করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মা অনন্য, তাঁকে উপলব্ধি করবার উপায়ও অনন্য। আত্মার কোন রূপ নেই, তাই তাঁকে দেখা যায় না। আত্মা অনির্বচনীয়। অর্থাৎ ভাষা দ্বারাও তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। সংক্ষেপে বলা যায় আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নন। আত্মা অসীম কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি সসীম। এমনকি আমাদের মনও সসীম। সসীম কি কখনও অসীমকে ধরতে পারে? এমনকি তপস্যা ও যাগযজ্ঞ দ্বারাও আত্মাকে লাভ করা যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, আত্মোপলব্ধির সেই অনন্য উপায়টি কি? চিত্তশুদ্ধি। আত্মা আমাদের ভেতরেই রয়েছেন। আমাদের হৃদয়ই আত্মার আবাস—এ কথা উপনিষদ বারবার বলছেন। যে-মন স্বভাবতই চঞ্চল ও ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত সেই মন শুদ্ধ নয়। মন যেন একটি তরঙ্গায়িত হ্রদ। তরঙ্গের জন্যই হ্রদের গভীরে কি আছে তা আমরা দেখতে পাই না। একইভাবে, অশান্ত মনে পরমাত্মা নিজেকে ধরা দেন না। আমাদের মনে যখন কামনা বাসনার লেশমাত্র থাকে না তখন মন শান্ত হয়। আর সেই শান্ত মনেই পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। এখানে আরো একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। আয়নার উপরে ধুলো জমা থাকলে সেই আয়নাতে নিজেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। নিজেকে ভালভাবে দেখতে হলে ধুলো সরিয়ে আয়নাকে পরিষ্কার করতে হয়। শান্ত, স্থির ও বাসনামুক্ত মনেই আত্মার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
সুতরাং আত্মজ্ঞান লাভের অনন্য উপায়টি হল —মনঃসংযম।
এষোঽণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যো
যস্মিন্ প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং
যস্মিন্ বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা॥৯
অন্বয়: এষঃ অণুঃ আত্মা (এই সূক্ষ্ম আত্মা); চেতসা (শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা); বেদিতব্যঃ (জ্ঞাতব্য); যস্মিন্ (যে শরীরে); প্রাণঃ (প্রাণ বায়ু); পঞ্চধা (পাঁচ প্রকারে); সংবিবেশ (প্রবেশ করেছে); প্রাণৈঃ (প্রাণের দ্বারা); প্রজানাম্ (প্রাণিগণের); সর্বং চিত্তম্ ([প্রাণীদের] সমগ্র হৃদয়); ওতম্ (ব্যাপ্ত); যস্মিন্ বিশুদ্ধে (যে চিত্ত শুদ্ধ হলে); এষঃ আত্মা (উক্ত আত্মা); বিভবতি (নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন)।
সরলার্থ: প্রাণবায়ু পাঁচভাগে ভাগ হয়ে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একই দেহে সূক্ষ্ম আত্মাও রয়েছেন যা শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। এ কথা সত্য যে, সকল বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও শুদ্ধ চৈতন্য (আত্মা) বিরাজ করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মা তখন নিজেকে প্রকাশ করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মা স্বভাবতই সূক্ষ্ম। শুদ্ধ মনে তিনি নিজেকে ধরা দেন। কিন্তু আত্মার অবস্থান কোথায়? দেহ মধ্যস্থ হৃৎপদ্মে তিনি বিরাজ করেন। আবার একই দেহের ভিতর পঞ্চবায়ুও (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান) রয়েছে। সাধক কিভাবে এই আত্মাকে আবিষ্কার করেন? চিত্তশুদ্ধির দ্বারা। চিত্তশুদ্ধি হয় কি ভাবে? ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, নিত্য-অনিত্য এই বিচারের দ্বারা। এর ফলে নিত্য-অনিত্যের মধ্য থেকে সাধক নিত্য. বস্তুকেই গ্রহণ করেন। মাখন দুধের সব অংশ জুড়ে থাকলেও দুধ থেকে তাকে পৃথক করা যায়। সেই রকম ভাবে জ্বালানির সর্বত্র আগুন থাকলেও আগুনকে জ্বালানি থেকে পৃথক করা যায়। শরীরের সর্বত্র আত্মা রয়েছেন। প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সকলের সঙ্গেও আত্মা যুক্ত। মুঞ্জা ঘাস থেকে যেমন মাঝের ডগাটিকে (ইষিকা) আলাদা করা যায় তেমনি বিচার বুদ্ধির দ্বারা আত্মাকেও শরীর থেকে পৃথক করা যায়। নিজেকে স্পষ্টভাবে দেখতে হলে যেমন পরিষ্কার আয়না লাগে ঠিক তেমনি শুদ্ধ মনে আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। চিত্তশুদ্ধি না হলে আত্মজ্ঞান লাভ করা যায় না।
যং যং লোকং মনসা সংবিভাতি
বিশুদ্ধসত্ত্বঃ কাময়তে যাংশ্চ কামান্।
তং তং লোকং জয়তে তাংশ্চ কামাং-
স্তস্মাদাত্মজ্ঞং হ্যর্চয়েদ্ ভূতিকামঃ॥১০
অন্বয়: বিশুদ্ধসত্ত্বঃ (যে ব্যক্তির মন শুদ্ধ [এবং সেহেতু আত্মাকে জানেন]); মনসা (মনের দ্বারা); যং যং লোকং সংবিভাতি (যে যে লোক পেতে ইচ্ছা করেন [নিজের জন্য বা অপরের জন্য]); যান্ কামান্ চ (যে সকল কাম্য বস্তুও); কাময়তে (কামনা করেন); তং তং লোকং জয়তে ( সেই সেই লোক জয় করেন) তান্ চ কামান্ (সেই সকল কাম্য বস্তুও); [লভতে—প্রাপ্ত হন]; তস্মাৎ (সেই হেতু); ভূতিকামঃ (কল্যাণেচ্ছু ব্যক্তিরা); আত্মজ্ঞং হি (আত্মজ্ঞ পুরুষকেই); অৰ্চয়েৎ (অর্চনা করবেন)।
সরলার্থ: যিনি শুদ্ধ মনের অধিকারী তিনি যে যে লোক বা যে সকল বস্তু পেতে ইচ্ছা করেন, সেই সকল লোক ও কাম্য বস্তু তিনি লাভ করে থাকেন। এই কারণে কল্যাণকামী বা ঐশ্বর্যপ্রার্থী ব্যক্তি এরকম পুরুষের পূজা করবেন।
ব্যাখ্যা: যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তিনি সকলের মধ্যে নিজ আত্মাকে দেখেন। অর্থাৎ এ নিখিল জগতের সাথে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। তাঁর মনে কোন ইচ্ছা জাগা মাত্রই তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়। তাঁর এই ইচ্ছা নিজের জন্যও হতে পারে আবার অন্যের জন্যও হয়ে থাকে। কারণ সকলের মধ্যে তিনি তখন নিজেকেই দেখেন। অন্যের সুখে তিনি সুখী, অন্যের দুঃখে তিনি দুঃখী। তিনি অন্যের থেকে স্বতন্ত্র নন, অন্যেরাও তাঁর থেকে পৃথক নয়।
মুণ্ডক উপনিষদের তৃতীয় মুণ্ডকের প্রথম অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
তৃতীয় মুণ্ডক
দ্বিতীয় অধ্যায়
স বেদৈতৎ পরমং ব্রহ্মধাম
যত্র বিশ্বং নিহিতং ভাতি শুভ্রম্।
উপাসতে পুরুষং যে হ্যকামাস্তে
শুক্ৰমেতদতিবর্তন্তি ধীরাঃ॥১
অন্বয়: সঃ (যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); এতৎ পরমং ব্রহ্মধাম (এই পরম আশ্রয় ব্রহ্মকে); বেদ (জানেন); যত্র (যাঁতে); বিশ্বম্ (জগৎ); নিহিতম্ (নিহিত আছে); শুভ্রং ভাতি (যিনি শুদ্ধ ও প্রকাশিত); যে অকামাঃ ধীরাঃ হি (যে নিষ্কাম জ্ঞানী ব্যক্তিরা); পুরুষম্ উপাসতে (সেই পুরুষের উপাসনা করেন); তে (তাঁরা); এতৎ (এই); শুক্রম্ (শুক্র সম্ভূত শরীরকে); অতিবর্তন্তি (অতিক্রম করেন)।
সরলার্থ: যে-ব্যক্তি নিজ আত্মাকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকেও জানেন—যে-ব্রহ্ম জগৎকে ধারণ করে রেখেছেন। তিনি একথাও জানেন—এই জগৎকে যে দেখা যায় তার কারণ এ জগৎ ব্রহ্মে আশ্রিত। যে-সকল সাধক নিষ্কামভাবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের উপাসনা করেন, তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না।
ব্যাখ্যা: ‘সঃ বেদ’—যখন কোন ব্যক্তি জানেন। কি জানেন? ‘এতৎ পরমং ব্রহ্মধাম’—এই পরম ব্রহ্মকে জানেন। ব্রহ্মই পরম, সর্বোচ্চ। কোন বিশেষণে তাঁকে বিশেষিত করা যায় না। ‘ব্রহ্মধাম’ বলতে ব্রহ্মের আবাসকে বোঝায়। এ ব্ৰহ্মত্বের অবস্থা অর্থাৎ যে অবস্থায় সাধক ব্রহ্মের সঙ্গে একহয়ে যান। সমগ্র বিশ্ব এই ব্রহ্মধামেই নিহিত আছে। যাঁরা একথা জানেন তাঁরা জন্ম-মৃত্যুর পারে চলে যান। এই শ্লোকে ‘অতিবর্তন্তি’ শব্দটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিণামে আমরা সবাই এই অবস্থাই লাভ করব। ‘অতি’ শব্দটির অর্থ হল অতিক্রম করা আর ‘বর্তন’ অর্থ অস্তিত্ব। ‘শুক্রম্’ বলতে প্রাণবীজকে বোঝানো হয়েছে। তাঁরা প্রাণবীজকে অতিক্রম করেন। প্রাণবীজকে অতিক্রম করার অর্থ মৃত্যুর পারে যাওয়া। মানুষ যখন জন্ম-মৃত্যুর পরে যায় তখনই সে মুক্ত হয়। বর্তমানে আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ। বারে বারে আমরা এই পৃথিবীতে ফিরে আসি। কিন্তু ব্রহ্মধামে একবার প্রবেশ করতে পারলে, একবার ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্নতা অনুভব করতে পারলে আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রকে অতিক্রম করে মুক্ত হয়ে যাই।
কামান্ যঃ কাময়তে মন্যমানঃ
স কামভির্জায়তে তত্র তত্র।
পর্যাপ্তকামস্য কৃতাত্মনস্তু
ইহৈব সর্বে প্রবিলীয়ন্তি কামাঃ॥২
অন্বয়: যঃ (যে ব্যক্তি); কামান্ মন্যমানঃ (কাম্য বস্তুসমূহের চিন্তা করে); কাময়তে ([তা] আকাঙ্ক্ষা করে); সঃ (সেই ব্যক্তি); কামভিঃ (সেই সকল কামনার দ্বারা); তত্র তত্র (সেই সেই স্থানে [যেখানে কাম্যবিষয় সকল ভোগ করতে পারবে]); জায়তে (জন্মগ্রহণ করে); পর্যাপ্তকামস্য (যাঁর কামনা পূর্ণ হয়েছে); কৃতাত্মনঃ তু (এবং আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন); [তাঁর] ইহৈব (এই জন্মেই); সর্বে কামাঃ (সমস্ত কামনা); প্রবিলীয়ন্তি (বিলীন হয়ে যায়)।
সরলার্থ: যে-সকল ব্যক্তি বাসনা তাড়িত হয়ে ভোগ্য বস্তু লাভের আশায় তার পেছনে ছোটে সেই সব ব্যক্তি কাম্য বিষয়ের মধ্যেই পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। অপর দিকে, যিনি আপ্তকাম (অর্থাৎ যে-ব্যক্তির সকল কামনা বাসনা পূর্ণ হয়েছে) তিনি এই জীবনেই নিজ আত্মাকে উপলব্ধি করেন, এবং তাঁর সকল বাসনার নিবৃত্তি হয়।
ব্যাখ্যা: যথার্থ জ্ঞানী ব্যক্তি কখনও ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হন না। সকল অনিত্য বস্তুকে তিনি এড়িয়ে চলেন। তিনি নিত্য অর্থাৎ যা চিরস্থায়ী, অবিনাশী সেই সব বস্তুই কামনা করেন। তিনি জানেন যে, ত্যাগই আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি। কিন্তু ধরা যাক, কোন ব্যক্তি কামনা বাসনার দ্বারা তাড়িত—সেই ব্যক্তি মৃত্যুর পর এমন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে তিনি কাম্য বস্তুগুলি ভোগ করতে পারেন। ‘সঃ কামভিঃ জায়তে তত্র তত্র’—কামনা বাসনা অনুযায়ী তাঁর পুনর্জন্ম হয়। এই কামনা বাসনাই আমাদের পুনর্জন্মের জন্য দায়ী। আমরা অর্থ, ক্ষমতা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা এসব লাভ করতে চাই। আমরা যা কামনা করি সেই কামনা অনুযায়ী আমরা আবার জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তার আর কোন কামনা বাসনা থাকে না। ‘পর্যাপ্তকামস্য’—যাঁর সকল কামনা পূর্ণ হয়েছে। ‘কৃতাত্মনঃ’—ত্যাগ ও চিত্তশুদ্ধির দ্বারা তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন। তখন তাঁর কেমন অবস্থা হয়? উপনিষদ বলেছেন যে, ‘ইহ এব’—এখানেই, এ জীবনেই; ‘সর্বে কামাঃ প্রবিলীয়ন্তি’—তাঁর সকল কামনা বাসনা সমূলে বিনষ্ট হয়। তিনি পূর্ণকাম, আপ্তকাম। তিনি তাঁর আত্মাতেই তৃপ্ত। তিনি তখন আত্মা বহির্ভূত অন্য কোন বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
ইদানীং আমরা মনোবিজ্ঞানীদের বলতে শুনি যে, এ যুগে আমরা নিজেরাই নিজেদের অপরিচিত। আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের ভেতরে নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। আমার মস্তিষ্ক আমারই হৃদয়ের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত, আবার আমার কর্ম হয়তো আমার চিন্তার বিরোধী। সামঞ্জস্যের অভাবে আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু বহু প্রাচীন কালেই ভারতীয় ঋষিরা এই সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন: ‘কৃতাত্মা’—আত্মাতে স্থিত হও। নিজ আত্মাকে জয় করো। ব্রহ্মধামে প্রবেশ করলে সাধক নিজেকে জানতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনিই সেই একও অদ্বিতীয় আত্মা। তিনিই পরম অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ। আত্মজ্ঞানেই সব দ্বন্দ্বের অবসান।
নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো
ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ
আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্॥৩
অন্বয়: অয়মাত্মা (এই আত্মা); প্রবচনেন (শাস্ত্র অধ্যয়নের দ্বারা); ন লভ্যঃ (লাভ করা যায় না); ন মেধয়া (বুদ্ধি বা বিচারশক্তির দ্বারা নয়); বহুনা (বার-বার); শ্রুতেন ন (শাস্ত্র-শ্রবণের দ্বারাও নয়); [যিনি] এষঃ (সে (সাধক]); যম্ এব (সেই পরমাত্মাকেই); বৃণুতে ( পেতে ইচ্ছা করেন); তেন (সেই [আন্তরিক] ইচ্ছার দ্বারাই); লভ্যঃ (লাভ করা যায়); তস্য (তাঁর [সেই সাধকের] কাছে); এষঃ আত্মা (এই আত্মা); স্বাম্ (নিজের); তনুম্ (স্বরূপ); বিবৃণুতে (প্রকাশ করেন)।
সরলার্থ: পাণ্ডিত্যের দ্বারা আত্মাকে লাভ করা যায় না, বুদ্ধি বা বিচার শক্তির দ্বারাও নয়। আবার শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায় না। সাধকের আন্তরিক ইচ্ছার দ্বারাই তাঁকে লাভ করা যায়। সেই সাধকের কাছে তিনি নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন।
ব্যাখ্যা: যা আয়ত্ত করা যেতে পারে, এমন বস্তু আত্মা নন। আবার আত্মা আমার থেকে পৃথক কোন বস্তুও নন। সুতরাং আত্মাকে অর্জন করাও যায় না। বস্তুকে যেভাবে আয়ত্ত করা হয় সেভাবে আত্মাকে আয়ত্ত করা যায় না। কারণ, যাকে আয়ত্ত করা হয় তাকে একদিন না একদিন ছেড়েও দিতে হয়। আমি আমার থেকে পৃথক কোন বস্তুকে অর্জন করতে পারি। কিন্তু আমি আমাকে অর্জন করব কেমন করে? আমাদের অন্তরতম সত্তাই হলেন এই আত্মা।
‘নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ’—যুক্তিতর্কের দ্বারা এই আত্মাকে লাভ করা যায়। ‘মেধয়া’—বুদ্ধির দ্বারাও নয়। ‘ন বহুনা শুতেন’—আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে অনেক শোনার পরেও তা দুর্বোধ্য বলে মনে হতে পারে। তবে তাঁকে কেমন করে পাওয়া যায়? ‘যম্ এব এষঃ বৃণুতে তেন লভ্যঃ’। এখানে ‘যম্’ বলতে আত্মাকে এবং ‘এষঃ’ বলতে সাধককে বোঝানো হয়েছে। সাধক যদি আন্তরিকভাবে এবং নিষ্ঠা সহকারে একমাত্র আত্মাকেই লাভ করতে চান তবে ‘তেন লভ্যঃ’—তার দ্বারা তিনি আত্মাকে উপলব্ধি করেন। অর্থাৎ আন্তরিকভাবে আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আত্মজ্ঞান লাভ হয় ততক্ষণ এই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আত্মাকে বাইরে নয় নিজের ভেতরে খুঁজতে হবে6। হৃদয়দুয়ার যদি বন্ধ থাকে তবে সেই দরজায় করাঘাত করতে হবে। তবে একদিন না সেই দরজা খুলে যাবেই।
‘তস্য এষঃ আত্মা বিবৃণুতে তনুম্ স্বাম্’—সেই সাধকের কাছে (তস্য) আত্মা তখন নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন। আত্মা তখন নিজেকেই প্রকাশ করেন। এর ফলে সহসা যেন আমি আমাকেই আবিষ্কার করি। এ যেন দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখে বলছি, ‘হায়! আমি দেখতে পাচ্ছি না।’ তখন কেউ এসে আমার হাতটা সরিয়ে দেন। তিনি গুরু হতে পারেন, শাস্ত্র হতে পারেন কিংবা কোন উপলব্ধিও হতে পারে। কিন্তু যে-মুহূর্তে হাত দুটো সরে যায় সেই মুহূর্তেই দেখা যায়। আত্মসাক্ষাৎকার ঠিক এভাবেই হয়।
নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যো
ন চ প্রমাদাত্তপসো বাঽপ্যলিঙ্গাৎ।
এতৈরুপায়ৈর্যততে যস্তু বিদ্বাং-
স্তস্যৈষ আত্মা বিশতে ব্রহ্মধাম॥৪
অন্বয়: অয়মাত্মা (এই [আলোচ্য] আত্মা); বলহীনেন (দুর্বল ব্যক্তির দ্বারা [যাঁরা আত্মাতে নিজেকে উৎসর্গ করেন না); ন লভ্যঃ (লভ্য নয়); প্রমাদাৎ ন চ (অমনোযোগী হলেও তাঁকে লাভ করা যায় না); অলিঙ্গাৎ তপসঃ বা অপি ন (বৈরাগ্যহীন তপস্যা দ্বারাও তাঁকে লাভ করা যায় না); যঃ বিদ্বান্ (যিনি জ্ঞানী); তু (কিন্তু); এতৈঃ উপায়ৈঃ যততে (এই সকল উপায় সযত্নে চেষ্টা করেন); তস্য (তাঁর [অর্থাৎ ঐ জ্ঞানী ব্যক্তির]); এষঃ আত্মা (এই আত্মা); ব্রহ্মধাম (ব্রহ্মরূপ আশ্রয়ে); বিশতে (প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: দুর্বল ব্যক্তি কখনও আত্মাকে জানতে পারেন না। আবার যাঁরা আত্মনিষ্ঠ নন তাঁরাও আত্মাকে জানতে পারেন না। একই ভাবে বলা যায় যে, ত্যাগ-বৈরাগ্য-হীন কঠোর পরিশ্রমের (দৈহিক অথবা মানসিক) দ্বারাও তাঁকে লাভ করা যায় না। কিন্তু যে-সকল জ্ঞানী ব্যক্তিরা কঠোর পরিশ্রমের সাথে এই সব উপায়গুলিকে অভ্যাস করেন, তাঁরাই আত্মাকে জানতে সক্ষম হন। অর্থাৎ তাঁরা ব্রহ্মধামে প্রবেশ করেন এবং এই নিখিল বিশ্বের সাথে এক হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: কঠ উপনিষদে আত্মজ্ঞান লাভের পথকে ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের মতোই এ পথ দুর্গম। এ পথ দুর্বলের জন্য নয়। সাধককে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বলে বলীয়ান হতে হবে। আচার্য শঙ্কর বলেন যে, যারা সংসারে আসক্ত এবং ইন্দ্রিয়সুখে মত্ত তারাই বলহীন অর্থাৎ দুর্বল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এ কথা বলতে পারি। একই সাথে ঈশ্বর ও তাঁর ঐশ্বর্যকে (অর্থাৎ জগৎকে) লাভ করা যায় না। আমাদের যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে। যদি আত্মাকে চাই, তবে শুধুমাত্র আত্মাকেই উপাসনা করতে হবে। এখানে কোন রকম আপস করা চলবে না।
‘ন চ প্রমাদাৎ’—প্রমাদ বলতে এখানে আলস্য, অবহেলা এবং অযত্নকে বোঝানো হয়েছে। এর আর এক অর্থ হল ইন্দ্রিয়সুখকে প্রশ্রয় দেওয়া। অর্থাৎ আরামপ্রিয় সুখী ব্যক্তি অলস জীবন যাপন করে। এখানে ‘তপসঃ’ কথাটির অর্থ জ্ঞান—জ্ঞান বলতে ত্যাগহীন (অলিঙ্গাৎ) শুষ্ক পাণ্ডিত্যকে বোঝানো হয়েছে। আমি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বা সুবক্তা হতে পারি, আমার অনেক উদ্ভাবনী শক্তিও থাকতে পারে, কিন্তু তা যদি আমি বাস্তবে প্রয়োগ না করি, আমার যদি ত্যাগ না থাকে তবে সেই জ্ঞান বৃথা।
কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি ত্যাগ, বৈরাগ্য ও কঠোর পরিশ্রমের সাথে এই সব শর্ত পূরণে সক্ষম হন (এতৈঃ উপায়ৈঃ যততে) অর্থাৎ তিনি যদি শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক সব অবস্থাতেই দৃঢ় হন, তখন তিনি কি অবস্থা লাভ করেন? ‘বিদ্বান্ তস্য এষঃ আত্মা বিশতে ব্রহ্মধাম’, তিনি ব্রহ্মধামে প্রবেশ করেন (বিশতে)। সাধক যখন নিজ আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিতে (বিদ্বান্) পরিণত হন।
সংপ্রাপ্যৈনমৃষয়ো জ্ঞানতৃপ্তাঃ
কৃতাত্মানো বীতরাগাঃ প্রশান্তাঃ।
তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা
যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি॥৫
অন্বয়: ঋষয়ঃ (ঋষিরা [যাঁরা আত্মাকে জেনেছেন]); এনম্ (এঁকে [পরমাত্মাকে]); সংপ্রাপ্য (সম্যক্-ভাবে জেনে); জ্ঞানতৃপ্তাঃ (সেই আত্মজ্ঞানের দ্বারা তৃপ্ত হয়ে); কৃতাত্মানঃ (আত্মস্বরূপ হয়ে); বীতরাগাঃ (নিরাসক্ত); প্রশান্তাঃ [ভবন্তি] (সংযতেন্দ্রিয় [হন]); যুক্তাত্মানঃ তে ধীরাঃ (এই সকল নিত্য সমাহিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা); সর্বগম্ (সর্বব্যাপী ব্রহ্মকে); সর্বতঃ প্রাপ্য (সর্বত্র প্রাপ্ত হয়ে); সর্বম্ এব আবিশন্তি (পূর্ণব্রহ্মে প্রবেশ করেন)।
সরলার্থ: সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞানে তৃপ্ত হন। এর ফলে তাঁদের বিষয়াসক্তি দূর হয় এবং তাঁরা প্রশান্তি লাভ করেন। এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সর্বব্যাপী ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। ব্রহ্মে লীন হয়ে তাঁরা সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে অবস্থান করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মাকে বোধে বোধ হলে ঋষিগণের আর কিছু জানবার থাকে না। তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই ডুবে যান—‘আত্মতৃপ্ত’। এ অবস্থায় তাঁরা সকল দ্বিধা এবং সংশয়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। উপনিষদ পূর্বেই এ কথা বলেছেন, ‘ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্ব সংশয়াঃ’, অর্থাৎ তাঁর হৃদয়ের সমস্ত জটিলতা দূর হয় এবং সকল সংশয় নাশ হয়। ঋষিগণ ‘বীতরাগাঃ’ অর্থাৎ আসক্তিমুক্ত হন, এবং ‘প্রশান্তাঃ’—অর্থাৎ তাঁদের মন তখন ধীর স্থির ও শান্ত। এমন অবস্থায় কোন বিরোধ বা উদ্বেগের অবকাশ থাকে না; ঋষিরা তখন পরম শান্তি লাভ করেন। এমন ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সকল সংযত এবং তাঁর কোন আবেগ বা উচ্ছ্বাস থাকে না। তিনি শিশুর মতো সদা প্রফুল্ল ও আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকেন। সাধুদের ‘বালবৎ’ বলা হয়ে থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বুদ্ধি দিয়ে এই প্রশান্ত অবস্থার ব্যাখ্যা করা চলে না। একমাত্র যিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন তিনিই পরম শান্তি অনুভব করে থাকেন।
‘সর্বগম্’ বলতে কি বোঝায়? এর অর্থ ব্ৰহ্ম, আত্মা। আকাশের মতো ব্রহ্মও সর্বত্র বিরাজ করেন। একমাত্র আকাশকেই ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কারণ উভয়েই সর্বব্যাপী।
‘ধীরাঃ’—প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, ‘সর্বতঃ প্রাপ্য’ অর্থাৎ আত্মাকে সম্পূর্ণভাবে জেনে, আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যান (যুক্তাত্মানঃ)। অর্থাৎ আত্মাই হয়ে যান। তারপর ‘সর্বম্ এব আবিশন্তি’—সর্ববস্তুতে তাঁরা নিজেদেরকেই দেখেন। তখন ‘আমি-তুমি’র (অম্মদ্-যুম্মদ্) ভেদ চিরতরে ঘুচে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গলার ঘা (ক্যানসার) যখন তীব্র হয় তখন তাঁর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শিষ্যরা কাকুতি মিনতি করে তাঁকে বলেন : ‘মা (ভবতারিণী) তো আপনার কথা খুব শোনেন, আপনি একবার মাকে বলুন না, যাতে আপনার খাওয়াটা বন্ধ না হয়।’ কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেব এই প্রস্তাবে রাজী হন না। শিষ্যরা তখন বলতে থাকেন: ‘অন্তত আমাদের মুখ চেয়ে আপনি মাকে একথা বলুন।’ শেষপর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের কাছে এই প্রার্থনা জানালে মা তাঁকে দেখান, তিনি শত মুখে খাচ্ছেন। অর্থাৎ এক আত্মাই সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে বিরাজ করছেন। ‘সবম্’ বলতে এ অবস্থাকেই বোঝানো হয়। মানুষ তখন সর্বত্র নিজেকেই দর্শন করে।
বেদান্তবিজ্ঞানসুনিশ্চিতর্থাঃ
সন্ন্যাসযোগাদ্যতয়ঃ শুদ্ধসত্ত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে
পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্বে॥৬
অন্বয়: বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিতার্থাঃ (বেদান্তশাস্ত্রের দ্বারা যাঁদের প্রতিপাদ্য সুনিশ্চিত হয়েছে); সন্ন্যাসযোগাৎ শুদ্ধসত্ত্বাঃ (সন্ন্যাস বা ত্যাগ-বৈরাগ্যের দ্বারা যাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে); তে সর্বে যতয়ঃ (সেই সকল সাধকরা); পরামৃতাঃ ([আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে] অমৃতত্ব লাভ করেন); পরান্তকালে (দেহত্যাগের সময়ে); ব্রহ্মলোকেষু (ব্রহ্মলোকসমূহ প্রাপ্ত হয়ে); পরিমুচ্যন্তি (মুক্ত হন)।
সরলার্থ: যাঁরা বেদান্তশাস্ত্রের মর্মার্থ জেনেছেন, ত্যাগ বৈরাগ্য অভ্যাসের ফলে যাঁদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে এবং যাঁদের স্বার্থবুদ্ধি চিরতরে ঘুচে গেছে সে সকল সাধকরা এই জীবনেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন এবং মৃত্যুকালে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হন।
ব্যাখ্যা: যখন আমি ‘আমাকে’ আবিষ্কার করি তখন আমি সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত হই। কখনও কখনও আমরা ‘হস্তামলকবৎ’ শব্দটি বলে থাকি। এই কথাটির অর্থ হল আমার হাতের মুঠোর মধ্যে একটি ফল আছে। স্বাভাবিক ভাবেই, আমি ফলটিকে দেখতে পাই ও অনুভবও করে থাকি। ফলটি যে আমার হাতের মুঠোতেই আছে এ ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। ঠিক এ ভাবেই আমরা যখন জানতে পারি আত্মজ্ঞান লাভই জীবনের লক্ষ্য এবং বেদান্ত আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় তখন আর কোন সংশয় বা বিভ্রান্তি থাকে না। অর্থাৎ তখন আমি আমাকে জানতে সচেষ্ট হই। আত্মজ্ঞান ছাড়া পৃথিবীর কোন কিছুই আর তখন আমাকে আকৃষ্ট করে না।
‘সন্ন্যাস’ কথাটির অর্থ কি? সন্ন্যাস অর্থাৎ ‘সম্যক্ ন্যাস্’। ‘ন্যাস্’ অর্থাৎ ত্যাগ, বৈরাগ্য আর ‘সম্যক্’ অর্থ পুরোপুরি। অর্থাৎ যিনি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন। কি ত্যাগ করেন? এই জগৎ সংসারকে। বর্তমানে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই আমি সত্য বলে মনে করি। কিন্তু এই জগতের ঊর্ধ্বে আরও কিছু আছে যা আমার অজানা। কিন্তু যখন আমি এই জগতের প্রতিষ্ঠাভূমি অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানতে পারি, তখন এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংসারকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। তখন আমি উপলব্ধি করি এ জগৎ অনিত্য অর্থাৎ মিথ্যা। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। যিনি নিত্য সত্যকে লাভ করেছেন, আপেক্ষিক সত্য আর তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। সাধক তখন নিত্য-অনিত্য বস্তু বিচার করে অনিত্য বস্তু ত্যাগ ও নিত্য বস্তু গ্রহণ করেন। একেই বলা হয় সন্ন্যাসযোগ। দীর্ঘকাল ধরে ত্যাগ-বৈরাগ্য অনুশীলনের দ্বারা সাধকের চিত্তশুদ্ধি হয়। অর্থাৎ তিনি শুদ্ধ-সত্ত্ব হন।
‘যতয়ঃ’ বলতে আত্মজ্ঞান লাভে সচেষ্ট তপস্বীদের বোঝায়, তাঁরা শুদ্ধ ও পবিত্র। দীর্ঘকাল ধরে ত্যাগ অভ্যাসের ফলে তাঁদের সকল কামনা বাসনা সমূলে বিনষ্ট হয়। ‘পরান্তকালে’—পরা এবং অন্তকালে। ‘অন্তকাল’ কথাটির অর্থ মৃত্যু এবং ‘পরা’ কথাটির অর্থ ‘চুড়ান্ত’। ব্রহ্মজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে ‘পরান্তকালে’ বলতে অন্তিম মৃত্যুকে অর্থাৎ শেষ জন্ম বোঝায়। যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তখন সে মৃত্যু আর একটি জীবনের সূচনা করে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এর ব্যতিক্রম। মৃত্যুর পর তাঁরা আর এ পৃথিবীতে ফিরে আসেন। না। ‘পরামৃতাঃ’—তাঁরা অমর হন। ‘পরিমুচ্যন্তি’ অর্থাৎ তিনি মোক্ষ লাভ করেন। একেই নির্বাণ বলা হয়। আচার্য শঙ্কর নির্বাণ অবস্থাকে নিভে যাওয়া প্রদীপ বা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাওয়া মাটির পাত্রের সাথে তুলনা করেছেন। সাধক যখন মোক্ষ লাভ করেন তিনি তখন স্বর্গ বা অন্য কোথাও যান না। তিনি তখন ব্রহ্মে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যান। ব্রহ্ম বলতে কোন ‘লোক’ বোঝায় না। মুক্ত পুরুষ তাঁর গন্তব্য পথের কোথাও কোন পদচিহ্ন রেখে যান না। যেমন, পাখি যখন ওড়ে এবং মাছ যখন জলে সাঁতার কাটে তখন পাখির পাখার দাগ বাতাসে বা মাছের ডানার দাগ জলে পড়ে না। মুক্ত পুরুষের আর আসা যাওয়া থাকে না।
গতাঃ কলাঃ পঞ্চদশ প্রতিষ্ঠা
দেবাশ্চ সর্বে প্রতিদেবতাসু।
কর্মাণি বিজ্ঞানময়শ্চ আত্মা
পরেঽব্যয়ে সর্ব একীভবন্তি॥৭
অম্বয়: [তেষাম] পঞ্চদশ কলাঃ ([তাঁদের] পনেরটি অংশ); প্রতিষ্ঠাঃ গতাঃ (তাঁদের কারণ অবস্থায় ফিরে যায়) সর্বে দেবাশ্চ (এবং সকল ইন্দ্রিয়সমূহ); প্রতি-দেবতাসু (নিজ নিজ অধিষ্ঠাত্রী দেবতায় প্রবেশ করে); কর্মাণি (কর্মসকল); বিজ্ঞানময়ঃ চ আত্মা (এবং বিজ্ঞানময় আত্মা); সর্বে (সকল); পরে অব্যয়ে একীভবন্তি (অব্যয় পরব্রহ্মে একত্ব লাভ করে)।
সরলার্থ: তখন দেহের পনেরটি অংশ তাদের মূল কারণাবস্থায় ফিরে যায়। ইন্দ্রিয়গুলিও তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতায় লীন হয়। কেবলমাত্র সঞ্চিত কর্ম যা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি এবং বিজ্ঞানময় আত্মা অব্যয় পরব্রহ্মে একত্ব লাভ করে।
ব্যাখ্যা: সাধক যখন জ্ঞান লাভ করেন, যখন জানেন ‘তিনি কে’ তখন তিনি কি অবস্থা প্রাপ্ত হন? কি ধরনের অভিজ্ঞতাই বা তাঁর হয়ে থাকে? ‘একীভবন্তি’ এক হয়ে যান। সব কিছু তখন একে লীন হয়। ‘কলাঃ’ অর্থ খণ্ড বা অংশ। যখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করি তখন এই অংশগুলি তাদের উৎসে ফিরে যায়। উপনিষদ বলছেন যে, এরকম পনেরটি অংশ আছে। আক্ষরিক অর্থে এগুলিকে ঠিক অংশ বলা যায় না। এই কলাসমূহ একই আত্মার প্রকাশ মাত্র। সেগুলি কি কি? ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ হল প্রাণ, দ্বিতীয় শ্রদ্ধা। অন্যগুলি যথাক্রমে ‘পঞ্চভূত’—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং পৃথিবী; ‘পঞ্চ ইন্দ্রিয়’, মন, খাদ্য, বীর্য, তপস্যা, বেদসমূহ, যাগ-যজ্ঞ, লোকাদি এবং তাদের নাম সমূহ। জীবাত্মাতে এই সব উপাদানই রয়েছে। কিন্তু আত্মোপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এই উপাদান সকল অদৃশ্য হয় অর্থাৎ এগুলি তাদের উৎসে ফিরে যায়।
‘দেব’ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘দেব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ, ‘যা প্রকাশ করে’। এর দ্বারা ‘পঞ্চেন্দ্রিয়’ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বককে বোঝায়। এই সব ইন্দ্রিয় (তথা দেব) তাদের মূল উৎসে (অর্থাৎ প্রতিদেবে) ফিরে আসে। হিন্দুমতে ‘পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়’ সমষ্টি উপাদান থেকেই এসেছে। জীবাত্মার বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার অংশ তাদের সমষ্টি উৎসে ফিরে যায়।
তারপর হল কর্ম। হিন্দু দর্শনে কর্মের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। যদি প্রশ্ন করা যায়: ‘আমি গরীব কেন?’ হিন্দু দর্শন অনুযায়ী আমার কর্মফল এর জন্য দায়ী। আমাদের চরিত্র, জীবনের মান, এ সব কর্মফলের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কর্মই আমাদের বদ্ধ করে। আবার এমন কিছু কর্ম থাকতে পারে যা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি। এগুলিকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম। আত্মাকে জানতে পারলে এ জাতীয় কর্মের নাশ হয়।
বিজ্ঞানময় আত্মা বলতে এখানে জীবাত্মাকে বোঝানো হচ্ছে। জীবাত্মারও লয় হয়। তখন এই সব বস্তু অর্থাৎ জীবাত্মা কোথায় যায়? পরমাত্মায় ফিরে যায়। তখন জীবাত্মা পরমাত্মা হয়ে যান। পরমাত্মা থেকে পৃথক স্বতন্ত্র জীবরূপে তাঁর আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। আচার্য শঙ্কর পরমাত্মার মহত্ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে কতগুলি সুন্দর শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন ব্রহ্ম হচ্ছেন পরা অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ; ‘অনন্তর’—অসীম; ‘অদ্বয়’—এক ও অদ্বিতীয়; শিব, শান্ত ও সমাহিত। সবশেষে আচার্য বলেছেন, সবকিছুই ব্রহ্ম।
সাধক যখন ব্রহ্মে লীন হন তখন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। আমরা ব্রহ্ম হয়েই আছি কিন্তু অবিদ্যার জন্য আমরা তা বুঝি না। শরীর অসুস্থ হলেই মনে করি আমিই অসুস্থ। আবার এই মুহূর্তে আমি হয়তো সুখী, ঠিক পর মুহূর্তেই দুঃখী। কারণ দেহমনের সঙ্গে আমরা নিজেদের এক করে ফেলি। ফলে দেহমনের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমিও যেন পরিবর্তিত হতে থাকি। আমি হয়ে যাই সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে যাওয়াই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। এই যে পরিবর্তন ঘটে তার কারণ আমি আমার প্রভু নই, আমি এখনও নিজেকে জয় করতে পারিনি। নিজেকে জয় করা যায় কিভাবে? একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভেই তা সম্ভব।
আবার নিজেকে যখন পরমাত্মা বলে বোধ হয়, তখন দেখি অন্যদের মধ্যেও সেই আমিই রয়েছি। একরূপে আমি এখানে বসে আছি আবার অন্যরূপে আমিই ঘুরে বেড়াচ্ছি; আর একরূপে আমি হয়তো গান গাইছি, আবার কোথাও বা আমি লিখছি। নানা রূপে নানা পরিস্থিতিতে ও নানা কর্মের মধ্যে দিয়ে একই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। সর্বত্র সেই একই আত্মা রয়েছেন। একথা সত্য যে, জগৎ বৈচিত্রময় এবং এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৈচিত্রের পেছনে ঐক্য রয়েছে।
উপনিষদ বলছেন: ‘একীভবন্তি’, তারা এক হয়ে যায়। অর্থাৎ কার্য ও কারণ অভিন্ন হয়ে যায়। সূর্য এক কিন্তু তার প্রতিবিম্ব অনেক। প্রতিবিম্বগুলি বিভিন্ন পাত্রে প্রতিফলিত হয়। এখন পাত্রগুলি যদি সরিয়ে নেওয়া যায় তবে প্রতিবিম্বগুলি সূর্যেই ফিরে যায়। তখন সূর্য ও তার প্রতিবিম্বের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না; তারা এক হয়ে যায়। এই জন্যই বলা হয় যে, এক দেখাই জ্ঞান আর বহু দেখাই অজ্ঞান।
যথা ন্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে-
ঽস্তং গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়।
তথা বিদ্বান্নামরূপাদ্বিমুক্তঃ
পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্॥৮
অন্বয়: যথা (যেরূপ); স্যন্দমানাঃ নদঃ (প্রবহমান নদী); নামরূপে (নাম এবং রূপ); বিহায় (ত্যাগ করে); সমুদ্রে (সমুদ্রে); অস্তম্ (অস্ত অর্থাৎ মিশে); গচ্ছন্তি (যায়); তথা (সেইরূপ); বিদ্বান্ (ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ); নামরূপাৎ (নাম ও রূপ থেকে); বিমুক্তঃ [সন] (মুক্ত হয়ে); পরাৎ পরম্ (সর্বশ্রেষ্ঠ [হিরণ্যগর্ভ, ঈশ্বর, ব্রহ্মা ইত্যাদি]); দিব্যম্ (জ্যোতিস্বরূপ); পুরুষম্ (পরমাত্মাকে); উপৈতি (প্রাপ্ত হন)।
সরলার্থ: বহমান নদীগুলি নিজেদের নামরূপ ত্যাগ করে অবশেষে সমুদ্রে মিশে যায়। অনুরূপভাবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ নামরূপ থেকে মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মায় লীন হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: ‘যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ’—যেমন বহমান নদীগুলি; ‘সমুদ্রে অস্তং গচ্ছন্তি’—সমুদ্রে মিলিত হয়। নদীগুলি সমুদ্রে মিলে গেলে কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়? তারা নামরূপের পারে চলে যায়। তখন বলা যায় না যে, সমুদ্রের এই অংশটি গঙ্গা, আর ওই অংশটি যমুনা। তখন শুধুই জল। নদীগুলি তাদের স্বতন্ত্রতা হারিয়ে সাগরে মিশে যায়—‘একীভবন্তি’। অর্থাৎ নদীগুলি সমুদ্রেই পরিণত হয়। আত্মজ্ঞান লাভে আমরা অনুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হই। এখন আমি নিজেকে পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে করি—‘আমি শ্ৰীযুক্ত অমুক, বা শ্ৰীমতী অমুক’। আমরা সকলেই এরকম মনে করে থাকি। আর এই দুই-বোধ থেকে নানা সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এমনকি বন্ধুরাও একে অপরকে হিংসা ও সন্দেহ করতে থাকে। নিজের স্বরূপ না জানার ফলেই এইসব অঘটন ঘটে।
স্বভাবতই নামরূপের গণ্ডির মধ্যে আমরা নিজেদের বদ্ধ করে ফেলি। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক যুবককে ‘ক্যাবলা’ বলে ডাকেন। যুবকটি তাঁকে বলে: আপনি আমাকে ‘ক্যাবলা’ বলছেন কেন? ওটা তো আমার নাম নয়। এর উত্তরে স্বামীজী বললেন: নামে কী আসে যায়? আমার নাম স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাকে অন্য যে কোন নামে ডাকতে পার। তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ ‘আমি’ তো নাম নই।—এটিই মূল কথা। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি হয়তো লম্বা কেউ আবার বেঁটে, কেউ হয়তো ফরসা, আবার কেউ বা কালো হতে পারেন, কিন্তু এসবই উপাধি মাত্র। আর উপাধির জন্যই আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। আমাদের এই দেহও একটা উপাধিমাত্র।
‘নামবদপে বিহায়’—নিজেদের নাম রূপ হারিয়ে; ‘সমুদ্রে অস্তং গচ্ছত্তি’—নদীগুলি সমুদ্রে মিলিত হয়। ‘তথা’—সেই ভাবে, ‘বিদ্বান্’—যিনি নিজ আত্মাকে জানেন অর্থাৎ যাঁর বোধে বোধ হয়েছে তিনি। ‘নামরূপাৎ বিমুক্তঃ’—নামরূপের বন্ধন থেকে মুক্ত হন। অর্থাৎ সকল বন্ধন থেকেই তিনি মুক্ত। একেই নির্বাণ বলা হয়। ‘উপৈতি’—তিনি পৌঁছান অর্থাৎ পরমাত্মায় লীন হন। ‘পরাৎ পরম্’—এমনকি আত্মা পরমের থেকেও শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘দিব্যম্’—আত্মা শুদ্ধ এবং জ্যোতির্ময়। ‘পুরুষম্’—আত্মাকে পুরুষও বলা হয় কারণ ইনি সর্বব্যাপী। এই আত্মা সর্বত্র ও সকলের মধ্যে বিরাজ করেন। ইনিই সকলের অন্তরস্থ আত্মা।
স যো হ বৈ তৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ
ব্ৰহ্মৈব ভবতি নাস্যাব্রহ্মবিৎ কুলে ভবতি।
তরতি শোকং তরতি পাপ্মানং
গুহাগ্রন্থিভ্যো বিমুক্তোঽমৃতে ভবতি॥৯
অন্বয়: যঃ হ বৈ (যে কেউ); তৎ (সেই); পরমং ব্রহ্ম (পরব্রহ্মকে); বেদ (জানেন); সঃ (তিনি); ব্রহ্ম এব (ব্রহ্মই); ভবতি (হন); অস্য (এঁর); কুলে (বংশে); অব্ৰহ্মবিৎ ন ভবতি (কেউই অব্রহ্মবিদ্ হন না); সঃ (তিনি); শোকং তরতি (শোককে অতিক্রম করেন); পাপ্মানং তরতি (পাপকে অতিক্রম করেন); গুহাগ্রন্থিভ্যঃ (হৃদয়ের অজ্ঞানরূপ গ্রন্থি থেকে); বিমুক্তঃ [সন্] (সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে); অমৃতঃ (অমর); ভবতি (হন)।
সরলার্থ: যিনি পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান, এবং তাঁর বংশে কেউ ‘অব্রহ্মবিদ্’ জন্মায় না। তিনি সব শোকদুঃখের পারে চলে যান। হৃদয়ের অজ্ঞানতাজনিত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন।
ব্যাখ্যা: ‘সঃ যঃ হ বৈ ব্রহ্ম বেদ ব্ৰহ্মৈব ভবতি’—যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। এই উপনিষদের শুরুতে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল এই শ্লোকে তারই উত্তর দেওয়া হল। প্রশ্নটি ছিল : কি জানলে বা কাকে জানলে সব কিছুকে জানা যায়। এর উত্তরে উপনিষদ বলছেন : ‘যদি আমি ব্ৰহ্মকে জানি, তবে আমি ব্রহ্মাই হয়ে যাই। এবং তখনই আমি সবকিছুকে জানতে পারি।’
‘নাস্যাব্রহ্মবিৎ কুলে ভবতি’—পিতা যদি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হন তবে তাঁর বংশের সকলেই ব্রহ্মজ্ঞ হবেন। এ কেমন করে সম্ভব? কারণ পিতার প্রভাব তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে ঘিরে যাঁরা থাকেন তাঁরাও তখন ব্রহ্ম হয়ে যান। এই পরিবারের সকলেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। এই জ্ঞান চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে প্রদীপ জ্বলছে তার চারপাশে কোথাও অন্ধকার থাকতে পারে কি? অনুরূপভাবে যখন আমি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি তখন আমার চারপাশের মানুষও এই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়। এখানে একথাটিই বোঝানো হয়েছে।
‘শোকং তরতি’—তিনি শোকদুঃখের পারে যান। শুধুমাত্র দুঃখই নয়, তিনি সুখেরও পারে চলে যান। ‘পাপ্মানং তরতি’—তিনি পাপকে অতিক্রম করেন। একই সঙ্গে তিনি পুণ্যকেও অতিক্রম করেন। ‘গুহাগ্রন্থিভ্যঃ’, গুহা বলতে এখানে হৃদয়কে বোঝানো হয়েছে। আত্মার অবস্থান তো এই হৃদয়ে। আমার স্বরূপজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত আমি অজ্ঞানতার জালে বদ্ধ।
‘অমৃতঃ ভবতি’—তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন। তিনি অমর হন, কারণ তিনি যে ব্রহ্মই হয়ে গেছেন। এ অনেকটা সাগরে জলবিন্দু পড়ার মতো। সাগরে জলবিন্দু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সাগরের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সেইভাবে মানুষ যখন ব্রহ্মকে জানেন তখন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। এই জন্যই উপনিষদ সকলকে আত্মজ্ঞান লাভে সচেষ্ট হতে বলছেন। আমাদের সকল সমস্যার মূলে আছে অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতাকে দূর করতে পারলেই মুক্তির পথ খুলে যায়। এই অবস্থায় মানুষ পরম শান্তি ও আনন্দ লাভ করেন।
তদেতদৃচাঽভ্যুক্তম্—
ক্রিয়াবন্তঃ শ্রোত্রিয়া ব্ৰহ্মনিষ্ঠাঃ
স্বয়ং জুহ্বত একৰ্ষিং শ্রদ্ধয়ন্তঃ।
তেষামেবৈতাং ব্রহ্মবিদ্যাং বদেত
শিরোব্রতং বিধিবদ্ যৈস্তু চীর্ণম্॥১০
অন্বয়: ঋচা (ঋক্-মন্ত্র দ্বারা); তৎ এতৎ (এই যে [সত্য]); অভ্যুক্তম্ ( প্রকাশিত হল); [যে] ক্রিয়াবন্তঃ (শাস্ত্রের নিয়ম মেনে যাঁরা কাজ করেছেন); শ্রোত্রিয়াঃ (বেদজ্ঞ); ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ [পুরুষঃ] (ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষরা); শ্রদ্ধয়ন্তঃ (শ্রদ্ধাবান হয়ে); স্বয়ম্ (নিজেই); একৰ্ষিম্ (একর্ষি নামক অগ্নিতে); জুহ্বতে (আহুতি দেন); যৈঃ তু (যাঁদের দ্বারা); বিধিবৎ (যথা বিধি); শিরোব্ৰতম্ (মস্তকে অগ্নি ধারণ পূর্বক যে ব্রত); চীৰ্ণম্ (অনুষ্ঠিত হয়েছে); তেষাম্ এব (তাঁদের কাছেই); এতাম্ (এই); ব্রহ্মবিদ্যাম্ (ব্রহ্মবিদ্যাকে); বদেত (বলবে)।
সরলার্থ: শাস্ত্র বলেন : যিনি শাস্ত্রের নিয়ম মেনে কর্ম করেন, শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, ব্রহ্মনিষ্ঠ হন, একৰ্ষি যজ্ঞানুষ্ঠান করেন এবং শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী মস্তকে অগ্নি ধারণ করেন, তিনিই একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যালাভের পক্ষে উপযুক্ত; অন্যরা নয়।
ব্যাখ্যা: ‘তৎ এতৎ ঋচা অভুক্ত’—ঋক্-বেদে একথাই বলা হয়েছে। উপনিষদ এখানে আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, এই জ্ঞান সকলের জন্য নয়। তখনকার দিনে আচার্যরা এই জ্ঞানদানের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যোগ্যতা সকলের থাকে না। কে এই জ্ঞানলাভে সক্ষম? ‘ক্রিয়াবন্তঃ’—যাঁরা শাস্ত্র নির্দেশিত কর্ম সম্পন্ন করেছেন; ‘শ্রোত্রিয়াঃ’—যাঁরা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন; ‘ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ’—যাঁদের মন ব্রহ্মে সমর্পিত; ‘স্বয়ং জুহুতে একৰ্ষিম্’—যাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে একৰ্ষি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছেন। একৰ্ষি যজ্ঞ সম্বন্ধে আমরা এখন কিছুই জানি না, শুধু জানা যায় যজ্ঞটি বড়ই দুরূহ। ‘শ্ৰদ্ধয়ন্তঃ’—যাঁরা আন্তরিকতা সম্পন্ন। ‘শিরোব্রতম্’—যে যজ্ঞে যজমানকে মস্তকে অগ্নি ধারণ করতে হয়। ‘বিধিবৎ যৈঃ তু চীর্ণম্’—যাঁরা এই সব যজ্ঞ বিধি মতে পালন করেছেন। উপনিষদের মতে কেবলমাত্র এই সব মানুষই ব্রহ্মবিদ্যালাভের পক্ষে উপযুক্ত। সাধককে তাঁর কর্তব্য পালন করতে হবে এবং শ্রদ্ধা আন্তরিকতার সাথে এই বিদ্যার্জনে আগ্রহী হতে হবে। মূল কথাটি হল, যদি আমি সত্যিই ব্রহ্মকে জানতে চাই তবে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং কষ্টকে মেনে নিতে হবে। এভাবেই সাধক নিজেকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য প্রস্তুত করেন। এর ফলে সাধকের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর জ্ঞান তখন আপনা আপনিই প্রকাশ পায়।
তদেতৎসত্যমৃষিরঙ্গিরাঃ পুরোবাচ নৈতদচীর্ণব্রতোঽধীতে।
নমঃ পরমঋষিভ্যো নমঃ পরমঋষিভ্যঃ॥১১
অন্বয়: পুরা (প্রাচীন কালে); ঋষিঃ অঙ্গিরাঃ (অঙ্গিরা নামক ঋষি); তৎ এতৎ সত্যম্ উবাচ (সেই সত্যকে বলেছিলেন [তাঁর শিষ্য শৌনককে]); অচীর্ণব্রতঃ (যিনি ব্রত আচরণ করেননি); এতৎ ন অধীতে (তিনি এই [উপনিষদ] পাঠ করেন না); পরমঋষিভ্যঃ (ব্রহ্মবিদ্ ঋষিগণকে); নমঃ (নমস্কার); পরমঋষিভ্যঃ (ব্রহ্মবিদ্ ঋষিগণকে); নমঃ (নমস্কার)।
সরলার্থ: পুরাকালে ঋষি অঙ্গিরা শৌনককে পরম সত্যের অর্থাৎ এই ব্রহ্মতত্ত্বের শিক্ষা দান করেছিলেন। যে সব মানুষ যাগযজ্ঞ করেন না, তাঁরা উপনিষদও পাঠ করেন না। যাঁরা এই জ্ঞান দান করেন সেই পরম ঋষিদের বারবার নমস্কার করি।
ব্যাখ্যা: ঋষি অঙ্গিরা শিষ্য শৌনককে এই উপনিষদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। শৌনক যথাবিধি গুরুর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল শর্ত তিনি পালন করেছিলেন। এই জ্ঞান গুরু থেকে শিষ্যে, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। এই ধারাকেই বলে পরম্পরা। এই জ্ঞানলাভের শর্তগুলি সবসময়েই এক। জ্ঞানের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ যদিও এই জ্ঞান অর্জন করা কঠিন, কিন্তু এই জ্ঞানই সর্বোচ্চ। গুরু কোন অযোগ্য শিষ্যকে এই জ্ঞান দান করতে পারেন কিন্তু এই জ্ঞান তার কোন কাজে লাগে না। কিন্তু যখন সৎ গুরু যোগ্য শিষ্যকে এই শিক্ষা দান করেন তখন সেই শিক্ষাদান সার্থক হয়।
যে সব আচার্য এই ব্রহ্মবিদ্যা দান করেন তাঁরা অতি উচ্চকোটির সাধক। সেই পরম ঋষিদের বারবার নমস্কার করি।
মুণ্ডক উপনিষদের তৃতীয় মুণ্ডকের দ্বিতীয় অধ্যায় এইখানে সমাপ্ত।
ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভি-
র্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥