তৈত্তিরীয় উপনিষদ

তৈত্তিরীয় উপনিষদ

মঙ্গলাচরণ

ওঁ শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ। শং নো ভবত্বৰ্যমা। শং ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ। শং নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ। নমো ব্ৰহ্মণে। নমস্তে বায়ো। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বামেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি। ঋতং বদিষ্যামি। সত্যং বদিষ্যামি। তন্মামবতু। তদ্বক্তারমবতু। অবতু মাম্। অবতু বক্তারম্৷ ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ॥

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

(অন্বয়, সরলার্থ ও ব্যাখ্যার জন্য শ্লোক ১।১।১ এবং ২।১।১ দ্রষ্টব্য)

তৈত্তিরীয় উপনিষদ

তৈত্তিরীয় উপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত। ‘তৈত্তিরীয়’ শব্দটি এসেছে ‘তিত্তির’ থেকে। ‘তিত্তির’ হল এক ধরনের পাখি। তৈত্তিরীয় নামের পেছনে একটি কাহিনী আছে। এক সময়ে গুরু বৈশম্পায়ন শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যের আচরণে অসন্তুষ্ট হন। যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ও পণ্ডিত। কিন্তু অহঙ্কারী। তাঁর অহঙ্কারের জন্য গুরু বৈশম্পায়ন বিরক্ত। তিনি তাঁর অহঙ্কার দেখে একদিন বললেন: ‘আমি তোমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছি। তুমি সেসব আমাকে এখনই ফিরিয়ে দাও। তুমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।’ এই কথা শুনে যাজ্ঞবল্ক্য গুরুপ্রদত্ত সমস্ত জ্ঞান বমি করে ফেলে দিলেন।

কিন্তু এই জ্ঞান অতি পবিত্র এবং মূল্যবান। এ জ্ঞান নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তাই বৈশম্পায়ন তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের বললেন: ‘মাটিতে যে জ্ঞান পড়ে রয়েছে তা তোমরা খেয়ে নাও। তাঁরা তাই করলেন। তিত্তির পাখির রূপ ধরে ঐ বমি করা জ্ঞান খেয়ে নিলেন। এই ঘটনা দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইছেন যে, জ্ঞান সবসময়ই পবিত্র। যেহেতু আত্মজ্ঞান সর্বশ্রেষ্ঠ—সেহেতু, এই জ্ঞানকে কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। যেভাবেই হোক এই জ্ঞান রক্ষা করা উচিত।

যজুর্বেদ দুটি অংশে বিভক্ত—কৃষ্ণ এবং শুক্ল। কৃষ্ণ কথার অর্থ হল কালো অর্থাৎ অপবিত্র। কিন্তু জ্ঞান কখনও অপবিত্র হতে পারে না। তবে জ্ঞানের আধার অর্থাৎ যিনি সকলের মধ্যে এই জ্ঞান বিতরণ করেন, তিনি অপবিত্র হলেও হতে পারেন। এরকম ব্যক্তি যে জ্ঞান দান করেন তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। এখানে তিত্তির জাতীয় পাখিরা (বৈশম্পায়নের অন্যান্য শিষ্যরা) যে জ্ঞান পেয়েছেন তা অপবিত্র, কারণ তাঁরা নিজেরাই অপবিত্র। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য এর ব্যতিক্রম। তিনি অন্য শিষ্যদের মতো নন। তিনি বেদের এই জ্ঞানকে পুনরায় লাভ করার জন্য সূর্যের উপাসনা করে সূর্যের মতো পবিত্র হলেন। আর এই অবস্থায় যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন তা শুক্ল অর্থাৎ শুদ্ধ।

এই উপনিষদে তিনটি বল্লী রয়েছে। প্রথমেই আছে শীক্ষাবল্লী—উচ্চারণ ও ধ্বনিই (মন্ত্রোচ্চারণের বিজ্ঞান) এর প্রধান আলোচ্য বিষয়। সেযুগে শিষ্যদের ঠিক ঠিক ভাবে বেদমন্ত্র আবৃত্তি করতে শেখানো হত। এটি খুবই দরকারী। কারণ, উচ্চারণ ও আবৃত্তি ঠিক না হলে বেদমন্ত্রের অর্থটাই হয়তো বদলে গেল। কেমন করে প্রার্থনা করতে হয়, কোন্ পথে ইন্দ্রিয়গুলিকে চালনা করতে হয়, যেমন, চোখ দিয়ে আমরা কি দেখব, পা-কে নিয়ে কোথায় যাব ইত্যাদি—এই অংশে তারও বিশদ আলোচনা রয়েছে। উপনিষদের কথা মেনে প্রার্থনা করলে নানাবিধ বর যেমন—সন্তান, সম্পদ, স্বর্গ এমনকি আত্মজ্ঞানও লাভ করা যায়। এখানে দেহমনের শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। উপযুক্ত দেহমনের যিনি অধিকারী তিনি সবকিছুকে লাভ করতে পারেন।

শীক্ষাবল্লীতে ‘ওম্’ উপাসনার প্রশংসা করা হয়েছে। কারণ ‘ওম্’ ব্রহ্মেরই প্রতীক। ‘ওম্’ শুধুমাত্র প্রতীক নয়, ‘ওম্’ জগতের এক বস্তুর সাথে অপর এক বস্তুর মিলন সেতুও বটে। ‘ওম্’ই জগৎকে ধারণ করে রেখেছেন। এই ‘ওম্’-এর উপাসনার দ্বারা মানুষ একাধারে সম্পদ ও মেধা দুই-ই লাভ করেন। তাই তখন চারদিক থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে এসে ভিড় করে। এই বল্লী বেদের অন্যান্য উপাসনা পদ্ধতিকেও মেনে চলার নির্দেশ দেন। প্রতিটি উপাসনা পদ্ধতির লক্ষ্যই হচ্ছে আত্মজ্ঞান লাভ করা।

এই বল্লীতে সর্ব মোট এগারটি অধ্যায় আছে। কিভাবে জ্ঞানলাভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, আচার্য শঙ্কর প্রতিটি অধ্যায়ে তাঁর ভাষ্যে সেই আলোচনাই করেছেন। এই সব আলোচনা কালে বহু প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে এবং তা নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। এদের মধ্যে প্রধান আলোচ্য বিষয় হল জ্ঞান ও কর্মের সহাবস্থান। সব শেষে সিদ্ধান্ত হল জ্ঞান স্বতন্ত্র এবং জ্ঞান কারোর সৃষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও শাস্ত্রে যে সমস্ত আচার অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে তা পালন করা উচিত।

এছাড়াও এখানে কিছু মূলনীতির কথা বলা হয়েছে যা থেকে আমরা কখনই সরে যাব না। এদের মধ্যে প্রধান দুটি নীতি হল সত্যে নিষ্ঠা এবং সৎ হওয়া। গৃহস্থ হিসাবে বাবা মা ও গুরুকে শ্রদ্ধা করতে হবে, অতিথিকে যথাযথ আপ্যায়ন করতে হবে, উপযুক্ত সম্মান সহ অপরকে সাহায্য করতে হবে।

এইসব আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, আত্মজ্ঞান লাভে সকলেরই সমান অধিকার। আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় বা আমরা কি করি—আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে এসব জানার কোন দরকার নেই। এর জন্য একমাত্র প্রয়োজন হল তীব্র আধ্যাত্মিক সাধন এবং আত্মসংযম। এর ফলে চিত্তশুদ্ধি হয় এবং জ্ঞান তখন আপনা আপনিই প্রকাশ পায়।

শেষ উপদেশটি দেওয়া হয় সেই সব ছাত্রদের যারা গুরুগৃহে পাঠ শেষ করে বাড়ী ফিরে যাচ্ছেন। এমনকি এখনও কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী ছাত্রদের অনুরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে।

এই উপনিষদের দ্বিতীয় অংশ হল ব্রহ্মানন্দ বল্লী। ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা বোধ হলে যে আনন্দ তাই ব্রহ্মানন্দ। আমাদের সকলের অন্তরস্থ আত্মা হলেন এই ব্রহ্ম। কিন্তু এই আত্মাকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না কারণ, এক কোষের মধ্যে আর এক কোষ, এভাবে একাধিক কোষ এই আত্মাকে ঢেকে রেখেছে। এ যেন খাপের ভেতরে রাখা তরবারির মতো। এই কোষরূপ আবরণগুলিকে সরিয়ে আমাদের আত্মাকে আবিষ্কার করতে হবে।

কিন্তু এই কোষগুলি কি কি? প্রথমে আছে অন্নময় কোষ। এটি জড় এবং স্থূলতম। দ্বিতীয় কোষ প্রাণময়। তারপরে যথাক্রমে মনোময়, বিজ্ঞানময় এবং সবশেষে হচ্ছে আনন্দময়। স্থুল থেকে সূক্ষ্ম—এই ক্রমে কোষগুলি একটির ভেতর আর একটি রয়েছে। এই কোষগুলি হল চৈতন্যের এক একটি ধাপ। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ধাপ হল ব্রহ্মানন্দ। জীবনের লক্ষ্য হল এই ব্রহ্মানন্দ লাভ করা। অর্থাৎ ‘আমি ব্ৰহ্ম’, এটা উপলব্ধি করে ব্রহ্মে লীন হওয়া।

এই সব কোষ কিভাবে সত্য বলে প্রতিভাত হয় উপনিষদে তা আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত এইসব কোষ এতই সত্য যে, আমরা নিজেদেরকে কোষের সাথে অভিন্ন বলে মনে করি। উপনিষদ আমাদের এই কোষগুলিকে অস্বীকার করতে বলেন না। দেহ উপেক্ষার বিষয় এমন কথা উপনিষদ কখনও বলেন না, বরং বলেন, সবকিছুকে এমনকি যা স্থূল, যা জড় তাকেও ব্রহ্মরূপে গ্রহণ করতে হবে। এই দেহও ব্রহ্ম। কারণ, শরীর ব্রহ্মেরই প্রতিবিম্ব। আত্মজ্ঞান লাভের এটাই প্রবেশদ্বার। সুস্থ সবল শরীর ছাড়া আধ্যাত্মিক পথে এগোনো বড়ই কঠিন। শুধু শরীরই নয় আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে সুস্থ মন ও তীক্ষ্ণ মেধারও প্রয়োজন। দেহ, মন, ইন্দ্রিয় সবই আত্মজ্ঞান লাভের যন্ত্র মাত্র। এই যন্ত্রগুলো আমাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে, না এর দ্বারা আমাদের কল্যাণ হবে, তা নির্ভর করে আমাদের ওপর। অর্থাৎ কোন্ পথে আমরা এই সব দেহ, ইন্দ্রিয়কে চালনা করব তার উপর। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভে এদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রহ্মানন্দ বল্লীর মূল কথা হল: যখন কেউ ব্রহ্মকে জানেন তখন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। অর্থাৎ তিনি সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করেন। ব্ৰহ্ম সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত। এই সকল শব্দকে কি ব্রহ্মের গুণ বোঝতে ব্যবহার করা হয়েছে? না। ব্রহ্ম যদি এক না হয়ে বহু হতেন তখন একটি ব্রহ্ম থেকে অপর ব্রহ্মের পার্থক্য বোঝাতে এইসব বিশেষণ ব্যবহার করা হত। কিন্তু ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়—যিনি একই সাথে সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত স্বরূপ। অর্থাৎ ব্রহ্মই সত্য, ব্রহ্মই জ্ঞান আবার ব্রহ্মই অনন্ত।

শাস্ত্র বলেন, সবকিছুর অন্তরস্থ যিনি, তিনিই আত্মা, তিনিই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম থেকেই সব কিছুর উদ্ভব। ব্রহ্ম নির্গুণ ও নিরাকার। একই ব্ৰহ্ম কোথাও জ্ঞাতা, কোথাও জ্ঞেয় আবার কোথাও বা জ্ঞান। একমাত্র ব্রহ্মই একসাথে এই তিন সত্তা হতে পারেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে ব্রহ্মই সবকিছু, আবার সবকিছুই হচ্ছে এই ব্রহ্ম।

এই বল্লী অবশ্য বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, বেদান্তের তত্ত্বটি হল, স্রষ্টা কোন কিছু সৃষ্টি করেন এবং তারপর তার মধ্যে নিজে প্রবেশ করেন। এ কেমন করে সম্ভব? বেদান্ত বলেন, একই আত্মা সকলের মধ্যে এবং সবকিছুর মধ্যে রয়েছেন। সুতরাং আত্মা কিছু সৃষ্টি করছেন এবং তারপর আবার তাতে প্রবেশ করছেন, এ দুই-ই মিথ্যা। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে, সবকিছুর মধ্যে একই আত্মা রয়েছেন, ভিতরে আছেন, আবার বাইরেও আছেন। তিনিই সব। সবকিছুই তাঁর ওপর ন্যস্ত।

এই উপনিষদের তৃতীয় অংশ—ভৃগুবল্লীতে কোষসমূহের প্রশংসা করা হয়েছে। ভৃগুবল্লী শুরু হয়েছে একটি গল্প দিয়ে। ঋষি বরুণের ভৃগু নামে এক মেধাবী পুত্র ছিল। একদিন ভৃগু তাঁর বাবার কাছে এসে ব্রহ্মবিদ্যা শিখতে চাইলেন। উত্তম আচার্য বরুণ মনে মনে উপলব্ধি করলেন যে, সব কিছু একবারে শেখানো যায় না। তাই তিনি ভৃগুকে ধাপে ধাপে ব্রহ্মজ্ঞানের দিকে এগিয়ে নিয়ে চললেন।

প্রথমে বরুণ তাঁর পুত্রকে বললেন, সবকিছুর উৎস এই ব্রহ্মকে ধ্যান কর। ভৃগু মনে করলেন এই জগৎই ব্রহ্ম। পিতা সে কথায় কোন আপত্তি না করে পুত্রকে ধ্যানে মগ্ন হতে বললেন। ভৃগু ধ্যানমগ্ন হয়ে শেষে আবিষ্কার করলেন এই জড়জগৎই শুধুমাত্র ব্রহ্ম নন, প্রাণবায়ু, মন, বুদ্ধি, আনন্দ এসবের উৎসও হচ্ছে ব্রহ্ম। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য আর সবকিছুই ব্রহ্মের ওপর আরোপিত মাত্র।

প্রথম খণ্ড – শীক্ষাবল্লী

প্রথম অধ্যায়

ওঁ শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ। শং নো ভবত্বৰ্যমা। শং ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ। শং নো বিষ্ণুরুরুক্ৰমঃ। নমো ব্ৰহ্মণে। নমস্তে বায়ো। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বামেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি। ঋতং বদিষ্যামি। সত্যং বদিষ্যামি। তন্মামবতু। তদ্বক্তারমবতু। অবতু মাম্। অবতু বক্তারম্। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥১

ইতি প্রথমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: মিত্রঃ (মিত্র, সূর্য); নঃ (আমাদের প্রতি); শম্ (অনুকূল [হোন]); বরুণঃ (নিঃশ্বাস ও রাত্রির নিয়ামক দেবতা); শম্ ([আমাদের প্রতি] অনুকূল হোন); অর্যমা (অর্যমন, চক্ষু ও সূর্যের নিয়ামক দেবতা); ভবতু (হোন); শম্ (অনুকূল); নঃ (আমাদের প্রতি); ইন্দ্রঃ (ইন্দ্র, শক্তির প্রতীক যে দেবতা); বৃহস্পতিঃ (বৃহস্পতি, বাক্ ও মেধার প্রতীক যে দেবতা); নঃ শম্ (আমাদের প্রতি অনুকূল [হোন]); বিষ্ণুঃ উরুক্রমঃ (বিষ্ণু, যিনি দীর্ঘ পদক্ষেপে বিচরণ করেন এবং শক্তির প্রতীক); নঃ শম্ (আমাদের প্রতি অনুকূল [হোন]); ব্ৰহ্মণে নমঃ (ব্রহ্মকে নমস্কার); বায়ো নমঃ তে (বায়ু, আপনাকে প্রণাম করি); ত্বম্ এব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম অসি (আপনি ব্রহ্ম ব্যতীত অপর কেউ নন); ত্বাম্ এব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি; (আমি ঘোষণা করব যে, আপনিই প্রকৃত ব্রহ্ম); ঋতং বদিষ্যামি (আমি আপনাকে সত্যস্বরূপ বলে ঘোষণা করব); সত্যং বদিষ্যামি (আমি আপনাকে সত্য বলেও ঘোষণা করব); তৎ মাম্ অবতু (সেই [ব্ৰহ্ম] যেন আমাকে রক্ষা করেন); তৎ বক্তারম্ অবতু (সেই [ব্রহ্ম] যেন বক্তাকে [আচার্যকে] রক্ষা করেন); অবতু মাম্ ([ব্রহ্ম] আমাকে রক্ষা করুন); অবতু বক্তারম্ ([ব্রহ্ম] বক্তাকে [আচার্যকে] রক্ষা করুন)।

শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি-কৃত-বিঘ্নের শান্তি])।

ইতি প্রথমঃ অনুবাকঃ (এখানে প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: মিত্র অর্থাৎ সূর্যদেব আমাদের কল্যাণ করুন। বরুণ আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। অর্যমন (সূর্য ও চক্ষুর দেবতা) আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। ইন্দ্র আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। বৃহস্পতি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। বিষ্ণু যিনি দীর্ঘ পদক্ষেপে চলেন তিনি আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। ব্রহ্মকে নমস্কার। হে বায়ু আপনাকেও নমস্কার করি। আপনি ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নন। আমি ঘোষণা করব আপনিই প্রকৃত ব্রহ্ম। আমি আরো বলব আপনি ঋতস্বরূপ; অর্থাৎ, আপনিই স্বয়ং সত্য। বায়ুরূপী ব্রহ্ম আমাকে রক্ষা করুন। আপনি আচার্যকে রক্ষা করুন। আমাকে রক্ষা করুন, বক্তাকে (আচার্য) রক্ষা করুন। ওঁ শান্তি! শান্তি! শান্তি!

ব্যাখ্যা: বহু দেবতার উদ্দেশেই এই প্রার্থনা। আমরা অত্যন্ত কঠিন কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। বেদান্ত পাঠ অতি দুরূহ আবার একই সঙ্গে লোভনীয়। এই জন্য আমাদের সকল দেবতার আশীর্বাদ, শুভ কামনা ও সমর্থন একান্ত প্রয়োজন। ‘শম্’ কথাটির অর্থ হল ‘অনুকূল হোন’, ‘প্রসন্ন হোন’, ‘সহায়ক হোন’।

মিত্র এবং বরুণ দেবতাদের মধ্যে প্রধান। সূর্যকে অনেক সময়ই মিত্র বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সূর্য হলেন দিনের বেলার দেবতা। বরুণ হলেন রাতের দেবতা। অর্যমন হলেন সমগ্র সৌরমণ্ডল ও চোখের নিয়ামক দেবতা। বিষ্ণুকে বলা হয় ‘উরুক্রমঃ’, যিনি দীর্ঘ পদক্ষেপে চলেন। এই স্তোত্রে বলা হয়েছে দেবতারা ছোট থেকে মহৎ দেবতায় পরিণত হচ্ছেন। বিষ্ণু হচ্ছেন বৃহৎ, তিনি বরুণ ও মিত্রের তুলনায় বিরাট।

বায়ুও খুব গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। যেহেতু বায়ু সর্বত্র রয়েছেন সেহেতু বায়ুকেও এখানে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ হল বৃহত্তম। উপনিষদ এখানে বলছেন যে, বায়ু ব্রহ্মের প্রতীক এবং বায়ুকে অনুভব করা যায়। তিনি অপরোক্ষ।

‘ঋতং’ ও ‘সত্যং’ শব্দ দুটির অর্থ প্রায় এক। কিন্তু এদের মধ্যে সামান্য একটু পার্থক্য আছে। ‘ঋতং’ শব্দটির অর্থ হল ‘নৈতিক শৃঙ্খলা’, ‘সততা’। নৈতিক শৃঙ্খলা বোধ না থাকলে কোন সমাজ, সভ্যতা এমনকি জগৎও টিকে থাকতে পারে না। ‘সত্যম্’ অর্থ হল সত্য। শিষ্য বলছেন, ‘আমি আপনাকে ঋতস্বরূপ, সত্যস্বরূপ বলব।’

‘তৎ মাম্ অবতু তৎ বক্তারম্ অবতু’—অনুগ্রহ করে আমাকে এবং আমার আচার্যকে রক্ষা করুন। আচার্য এবং শিষ্য উভয়কেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ ও দৃঢ় হতে হবে। শিষ্য যদি নির্বোধ হন তবে তিনি কোন কিছুই শিখতে পারবেন না। ঠিক তেমনি আচার্য যদি অযোগ্য হন তবে তিনিও কিছু শেখাতে পারবেন না। অতএব দুজনকেই শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে যোগ্য হতে হবে।

‘শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’। মানুষের জীবনে তিন রকমের বিঘ্ন আসতে পারে। আধ্যাত্মিক বিঘ্ন—শারীরিক ও মানসিক বিপদ, রোগাদি; আধিদৈবিক বিঘ্ন—দৈব বিপদ, আকস্মিক প্রাকৃতিক ঘটনা ইত্যাদি এবং আধিভৌতিক বিঘ্ন—হিংস্র প্রাণীদের হিংসা ইত্যাদি। তাই প্রার্থনায় তিনবার ‘শান্তি’ কথাটি বলা হয় যাতে কোন দিক থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা না থাকে।

দ্বিতীয় অধ্যায়

ওঁ শীক্ষাং ব্যাখ্যাস্যামঃ। বর্ণঃ স্বরঃ। মাত্রা বলম্। সাম সন্তানঃ। ইত্যুক্তঃ শীক্ষাধ্যায়ঃ॥১॥ ইতি দ্বিতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: শীক্ষাম্‌ (উচ্চারণ); ব্যাখ্যাস্যামঃ (আমরা আলোচনা করব); বর্ণঃ (বর্ণের শব্দ); স্বরঃ (উচ্চারণ ভঙ্গি); মাত্রাঃ (গলার উঁচু নীচু); বলম্ (গলার শক্তি); সামঃ (সুরের উঁচু নীচু); সন্তানঃ (উচ্চারণের সমতা); ইতি শীক্ষাধ্যায়ঃ উক্তঃ (এ সবই শীক্ষা অধ্যায়ে বলা হয়েছে); ইতি দ্বিতীয়ঃ অনুবাকঃ (দ্বিতীয় অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (এখন) আমরা উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করব (কাকে বলে)। বর্ণ উচ্চারণের প্রণালী, উদাত্তাদি স্বর, হ্রস্ব-দীর্ঘাদি মাত্রা, কথা বলার সময়ে যে সমতা বজায় রাখা হয়, স্বরশক্তি, ছন্দ এবং স্বরস্থিতি—এগুলি শিক্ষার বিষয়। উচ্চারণ সংক্রান্ত অধ্যায়ে এই সবই আলোচনা করা হয়ে থাকে।

ব্যাখ্যা: একথা সত্য যে, অর্থ না বুঝে উপনিষদ পাঠের কোন মূল্যই নেই। কিন্তু এর প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ যদি ঠিকমতো না হয় তবে এর আসল অর্থটা অনেক সময়ই বদলে যায়। তাই শব্দ সমূহের শুদ্ধ উচ্চারণ আয়ত্ত করতে হলে কোন্ কোন্ বিষয় শিখতে হবে এই শ্রুতিতে সেকথাই বলা আছে। শিক্ষার যে অংশে উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করা হয় তা হল সংহিতা। যেহেতু উপনিষদ পাঠে এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই একে উপনিষদেরই অঙ্গ বলে মনে করা হয়।

তৃতীয় অধ্যায়

সহ নৌ যশঃ। সহ নৌ ব্রহ্মবৰ্চসম্। অথাতঃ সংহিতায়া উপনিষদং ব্যাখ্যাস্যামঃ। পঞ্চস্বধিকরণেষু। অধিলোকমধিজ্যৌতিষমধিবিদ্যমধিপ্রজমধ্যাত্মম্। তা মহাসংহিতা ইত্যাচক্ষতে। অথাধিলোকম্। পৃথিবী পূর্বরূপম্। দ্যোরুত্তররূপম্। আকাশঃ সন্ধিঃ॥১

বায়ুঃ সন্ধানম্। ইত্যধিলোকম্। অথাধিজ্যৌতিষম্। অগ্নিঃ পূর্বরূপম্। আদিত্য উত্তররূপম্। আপঃ সন্ধিঃ। বৈদ্যুতঃ সন্ধানম্। ইত্যধিজ্যৌতিষম্। অথাধিবিদ্যম্। আচার্যঃ পূর্বরূপম্॥২

অন্তেবাস্যুত্তররূপম্। বিদ্যা সন্ধিঃ। প্রবচনং সন্ধানম্। ইত্যধিবিদ্যম্। অথাধিপ্রজম্। মাতা পূর্বরূপম্। পিতোত্তররূপম্। প্রজা সন্ধিঃ। প্রজননং সন্ধানম্। ইত্যধিপ্রজম্॥৩

অথাধ্যাত্মম্। অধরা হনুঃ পূর্বরূপম্। উত্তরা হনুরুত্তররূপম্। বাক্ সন্ধিঃ। জিহ্বা সন্ধানম্। ইত্যধ্যাত্মম্। ইতীমা মহাসংহিতাঃ। য এবমেতা মহাসংহিতা ব্যাখ্যাতা বেদ। সংধীয়তে প্রজয়া পশুভিঃ। ব্রহ্মবৰ্চসেনান্নাদ্যেন সুবর্গ্যেণ লোকেন॥৪॥ ইতি তৃতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: নৌ (আমরা উভয়েই [আচার্য এবং শিষ্য]); সহ (সমভাবে); যশঃ (খ্যাতি [বৃদ্ধি পায়]); নৌ সহ ব্রহ্মবৰ্চসম্ (আমরা যেন সমভাবে ব্রহ্মগৌরব প্রাপ্ত হই); অতঃ (এই কারণে); অথ (এখন থেকে); অধিলোকম্ (এই পৃথিবী ও অন্যান্য লোকসংক্রান্ত সব কিছু); অধিজ্যৌতিষম্ (অগ্নি ও অন্যান্য উজ্জ্বল বস্তু সংক্রান্ত সব কিছু); অধিবিদ্যম্ (আচার্য ও শিক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত সব কিছু); অধিপ্রজম্ (পিতা মাতা ও সন্তান সংক্রান্ত বিষয়); অধ্যাত্মম্ (দেহ ও মন সংক্রান্ত বিষয়); পঞ্চসু অধিকরণেষু (এই পাঁচটি বিষয় অবলম্বনে); সংহিতায়াঃ (এই সব আনুষঙ্গিক বিষয় [এক ধরনের নির্মাণ করে]); উপনিষদম্ (উপনিষদ [এবং তার অন্তর্নিহিত দর্শন]); ব্যাখ্যাস্যামঃ (আমরা ব্যাখ্যা করব); তাঃ মহাসংহিতাঃ ইতি আচক্ষতে (সে সবই মহাসংহিতা বলে পরিচিত [কারণ সেগুলির আলোচ্য বিষয় গুরুত্বপূর্ণ]); অথ (এখন); অধিলোকম্ (বিভিন্ন লোক সংক্রান্ত দর্শন [ব্যাখ্যাত হচ্ছে]); পৃথিবী পূর্বরূপম্ ([অধিলোক সংহিতার] প্রথম অংশটিকে পৃথিবী-রূপে [ধ্যান কর]); দ্যৌঃ উত্তররূপম্ (শেষ অংশটি স্বর্গ); আকাশঃ সন্ধিঃ (আকাশ যেন উভয়কে মিলিত করেছে)।

বায়ুঃ সন্ধানম্ (বায়ু তাদের যুক্ত করে); ইতি অধিলোকম্ (বিভিন্ন লোক বিষয়ক দার্শনিক মতবাদ); অথ অধিজ্যৌতিষম্ (এর পর দীপ্যমান বস্তু সংক্রান্ত দর্শন); অগ্নিঃ পূর্বরূপম্ (প্রথম অংশটি অগ্নিরূপে বিবেচিত [এবং সেই অনুযায়ী ধ্যানযুক্ত হও]); আদিত্য উত্তররূপম্ (শেষ অংশটি আদিত্য তথা সূর্য রূপে বিবেচ্য); আপঃ সন্ধিঃ (জলই মিলন সেতু); বৈদ্যুতঃ সন্ধানম্ (বিদ্যুতের সার তাদের যুক্ত করে); ইতি অধিজ্যৌতিষম্ (এই উজ্জ্বল বস্তু সংক্রান্ত দর্শন); অথ অধিবিদ্যম্ (এরপর বিদ্যা বিষয়ক দর্শন বলা হচ্ছে); আচার্যঃ পূর্বরূপম্ (প্রথম অংশ আচার্য সংক্রান্ত)।

অন্তেবাসী উত্তররূপম্ (আবাসিক শিষ্য হল শেষ অংশ); বিদ্যা সন্ধিঃ (বিদ্যাশিক্ষা এদের মিলনক্ষেত্ৰ); প্রবচনং সন্ধানম্ (আচার্য ও শিষ্যের সম্মেলক আবৃত্তি তাঁদের যুক্ত করে); ইতি অধিবিদ্যম্ (এই হল বিদ্যাশিক্ষা সংক্রান্ত দর্শন); অথ অধিপ্রজম্ (এখন বংশধর সংক্রান্ত); মাতা পূর্বরূপম্ (মা হলেন প্রথম অংশ); পিতা উত্তররূপম্ (পিতা হলেন শেষাংশ); প্রজা সন্ধিঃ (সন্তান মিলন ক্ষেত্র); প্রজননং সন্ধানম্ (সন্তান উৎপাদন তাঁদের মিলিত করে); ইতি অধিপ্রজম্ (এই হল বংশধর সংক্রান্ত দর্শন)।

অথ অধ্যাত্মম্ (এবার দেহমন সংক্রান্ত কথা); অধরা হনুঃ পূর্বরূপম্ (নিম্ন চোয়াল হল প্রথম অংশ); উত্তরা হনুঃ উত্তররূপম্ (ঊর্ধ্ব চোয়াল হল শেষ অংশ); বাক্ সন্ধিঃ (বাগিন্দ্রিয় হল মিলন ক্ষেত্র); জিহ্বা সন্ধানম্ (জিহ্বা [অগ্রভাগ থেকে মূল পর্যন্ত] তাদের যুক্ত করে); ইতি অধ্যাত্মম্ (এই হল দেহ মন সংক্রান্ত দর্শন); ইতি ইমাঃ মহাসংহিতাঃ (এই সব মিলে মহাসংহিতা গঠিত); যঃ এবম্ এতাঃ মহাসংহিতাঃ ব্যাখ্যাতাঃ বেদ (যিনি ব্যাখ্যা সহ এই মহাসংহিতা জানেন); প্রজয়া পশুভিঃ ব্রহ্মবৰ্চসেন অন্নাদ্যেন সুবর্গ্যেন লোকেন সংধীয়তে (তিনি সন্তান, পশু সম্পদ, ব্রহ্মজ্যোতি, খাদ্য এবং স্বর্গ প্রভৃতির অধিকারী হন); ইতি তৃতীয়ঃ অনুবাকঃ (তৃতীয় অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (১-৪) শিক্ষাদানের গৌরবে আচার্য এবং বিদ্যাগ্রহণের যোগ্যতায় শিষ্য—আমাদের উভয়েরই যশ সমভাবে বৃদ্ধি পাক। আমাদের উভয়েরই ব্রহ্মজ্যোতি সমভাবে প্রকাশিত হোক।

ব্যাখ্যা: (পাণ্ডিত্য হয়তো আমাদের কোন বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু পাণ্ডিত্যের দ্বারা পরম সত্যের জ্ঞানলাভ নাও হতে পারে।) এইজন্য পঞ্চক্ষেত্রের মধ্যে যে দর্শন লুকিয়ে আছে তার ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এই পঞ্চক্ষেত্রগুলি হল—পৃথিবী ইত্যাদি বিষয়ক, অগ্নি প্রভৃতি জ্যোতির্বিষয়ক, আচার্য ও বিদ্যাবিষয়ক, মাতা ও সন্তানবিষয়ক এবং মানব দেহসংক্রান্ত। এই সকল বিষয়গুলিকে একযোগে মহান উপনিষদ বলা হয়। বিষয় সকলের গুরুত্বের জন্যই একে ‘মহান’ বলা হয়।

আমরা আমাদের আলোচনা শুরু করব পৃথিবী ও অন্যান্য লোক সংক্রান্ত উপনিষদ দিয়ে। এই সংহিতায় প্রথম অংশটি হল পৃথিবী এবং শেষ অংশটি স্বর্গ। আর এই দুইয়ের মাঝে আছে আকাশ। বায়ু এদেরকে যুক্ত করে। আমরা যদি এই লোকসমূহের ধ্যান করতে চাই তবে এই পরম্পরাক্রমেই তা করতে হবে।

এরপরে আসছে অগ্নি ও অন্যান্য জ্যোতির্ময় বস্তুর ধ্যান। এই সংহিতার প্রথম অংশ হল অগ্নি ও শেষ অংশ হল আদিত্য অর্থাৎ সূর্য। এদের মাঝে আছে জল। বিদ্যুৎই এদেরকে মিলিত করে। এইভাবেই জ্যোতির্ময় বস্তুর ধ্যান করা উচিত।

এরপর হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণ সংক্রান্ত ধ্যান। এই সংহিতার প্রথমেই আছেন আচার্য, শেষে আছেন আবাসিক শিষ্য (গুরুগৃহে বাস)। এদের দুজনের মাঝে রয়েছে শিক্ষাগ্রহণ। আচার্য ও শিষ্যকে যুক্ত করে তাঁদের মিলিত আবৃত্তি। এইভাবে শিক্ষাবিষয়ক ধ্যান করতে হয়।

এর পরবর্তী ধ্যান বংশধর সংক্রান্ত। এই সংহিতার প্রথমে আছেন মা, শেষে আছেন বাবা। আর এঁদের মাঝে আছে সন্তান। প্রজননে তাঁরা মিলিত। এই হল বংশধরসংক্রান্ত ধ্যান।

তারপর দেহ ও মনের ধ্যান। এই সংহিতার প্রথম ভাগ হল নিম্ন চোয়াল ও শেষ ভাগ হল ঊর্ধ্ব চোয়াল। এদের মধ্যে আছে বাগিন্দ্রিয়—জিভের দ্বারা এরা পরস্পর যুক্ত। এই হচ্ছে দেহমন সংক্রান্ত ধ্যান।

এই সবগুলিকে একসাথে মহাসংহিতা অর্থাৎ মহৎ সাহিত্য বলা হয়। যিনি মহাসংহিতা জানেন অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে জেনে এর উপাসনা করেন কালে তিনি সন্তান, প্রাণী-সম্পদ, ব্রহ্মজ্যোতি, অন্ন এবং স্বর্গ লাভ করে থাকেন।

এখানে ‘অথ’ কথাটির অর্থ হল ‘এরপর’। কিন্তু কিসের পর? অনেক বই পড়ার পর। বই পড়া ও পাণ্ডিত্য নিশ্চয়ই দরকার কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। তাই উপনিষদ আমাদের এই জগৎ ও অন্যান্য চারটি লোক সংক্রান্ত ধ্যানের পরামর্শ দিচ্ছেন। এইসব লোকের সাথে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কেমনভাবে এই ধ্যান করতে হয় তা মহাসংহিতায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মহাসংহিতাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাই এটি উপনিষদের অন্তর্গত।

কেমন করে আমরা ধ্যান করব? বস্তুর জড় ধর্ম কিন্তু ধ্যানের বিষয় নয়। এইসব বস্তু যে-দেবতাদের প্রতীক তাঁদের ধ্যান করতে হবে। কেউ যখন শালগ্রাম শিলাকে ভগবান বিষ্ণুরূপে উপাসনা করেন তখন তিনি কিন্তু বিষ্ণুরই ধ্যান করেন, শালগ্রাম শিলার নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা পৃথিবী, অন্যান্য লোক ও জ্যোতির্ময় বস্তু ইত্যাদি জড় বস্তুর ধ্যান করি না। এইসব বস্তু যেসব দেবতাদের প্রতীক তাঁদেরই ধ্যান করি এবং মনকে তাঁদের ওপরই একাগ্র করি। এই সাকার ধ্যানের মধ্য দিয়েই এইসব রূপ যে-অধ্যাত্মশক্তির প্রতীক সেই শক্তিকে লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। এই সব অধ্যাত্মশক্তি ব্রহ্মের কাছ থেকেই আসে। তাই ধ্যান করতে করতে আমরা ব্রহ্মের সাথে অভিন্নতা উপলব্ধি করে থাকি। এই ধ্যানই আমাদের ব্রহ্মের দিকে নিয়ে যায়। এখানে এটাই হল সংহিতার বাণী।

চতুর্থ অধ্যায়

যশ্ছন্দসামৃষভো বিশ্বরূপঃ। ছন্দোভ্যোঽধ্যমৃতাৎসংবভূব। স মেন্দ্রো মেধয়া স্পৃণোতু। অমৃতস্য দেব ধারণো ভূয়াসম্। শরীরং মে বিচৰ্ষণম্। জিহ্বা মে মধুমত্তমা। কর্ণাভ্যাং ভূরি বিশ্রুবম্। ব্ৰহ্মণঃ কোশোঽসি মেধয়া পিহিতঃ। শ্রুতং মে গোপায়। আবহন্তী বিতন্বানা॥১

কুর্বানাঽচীরমাত্মনঃ। বাসাংসি মম গাবশ্চ। অন্নপানে চ সর্বদা। ততো মে শ্রিয়মাবহ। লোমশাং পশুভিঃ সহ স্বাহা। আমায়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা। বিমাঽঽয়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা। প্ৰমাঽঽয়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা। দমায়ন্তু ব্ৰহ্মচারিণঃ স্বাহা। শমায়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা॥২

অন্বয়: যঃ ছন্দসাম্ (যা [অর্থাৎ ওম্] বেদমন্ত্রের মধ্যে); ঋষভঃ (সর্বোত্তম [আক্ষরিক অর্থে, বৃষ]); বিশ্বরূপঃ (সর্বত্র বিরাজমান [প্রত্যেক বাক্-রীতিতে]); ছন্দোভ্যঃ অমৃতাৎ (জ্ঞানার্জনের পন্থাসমূহ থেকে অর্থাৎ বেদ থেকে); অধিসংবভূব (উন্মেষিত [অর্থাৎ এসেছে]); সঃ (সেই [ওম্]); ইন্দ্রঃ (দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ [যিনি তোমাকে যে কোন কাম্য বস্তু দান করতে সক্ষম]); মেধয়া মা স্পৃণোতু (আমাকে মেধাবী করুন); দেব (হে প্রভু); অমৃতস্য ধারণঃ ভূয়াসম্ (আমি যেন অমৃতত্ব লাভ করতে পারি); মে শরীরং বিচৰ্ষণম্ (আমার দেহ আত্মজ্ঞান অর্জনের উপযুক্ত হোক); মে জিহ্বা মধুমত্তমা (আমি যেন মিষ্টভাষী হই); কর্ণাভ্যাং ভূরি বিশ্রুবম্ (আত্মতত্ত্ব বিষয়ক প্রসঙ্গ শুনতে আমার কান দুটি আমাকে প্রভূত সহায়তা করুক); [হে ওম্] মেধয়া (লৌকিক প্রত্যক্ষের দ্বারা); পিহিতঃ (আবৃত); ব্ৰহ্মণঃ কোশঃ অসি (আপনি ব্রহ্মের প্রতীক); মে শ্রুতং গোপায় (যতটুকু আমি শিখেছি অনুগ্রহ করে তা রক্ষা করুন); আত্মনঃ মম (আপনার অনুগ্রহে আমি যেন পাই); চিরং বাসাংসি (প্রচুর বস্ত্র); গাবঃ (গবাদি পশু); চ অন্ন-পানে চ (খাদ্য এবং পানীয়); সর্বদা (সর্বদা); আবহন্তী (আমাকে এনে দিন); বিতন্বানা (বিস্তার করেন); কুর্বাণা (এ ধরনের প্রাচুর্য হোক); লোমশাম্ (দীর্ঘ লোমসম্পন্ন ছাগ ও মেষ); পশুভিঃ (অন্যান্য পশু); সহ (সহ); শ্রিয়ম্ (প্রাচুর্য); ততঃ (পরে [উন্নত মেধার অধিকারী হবার পর]); মে আবহ (আমার কাছে নিয়ে আসুন); স্বাহা (স্বাহা [যে শব্দটি আহুতি দান সম্পন্ন করে উচ্চারণ করতে হয়]); আ মা আয়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা (চর্তুদিক থেকে ছাত্রদলও যেন আমার কাছে আসে); বি মা আয়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা (সকল সম্ভাব্য উপায়ে ছাত্রদল যেন আমার কাছে আসে); প্র মা আয়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা (ন্যায্যপথে ছাত্রদল যেন আমার কাছে আসে); দমায়ন্তু ব্রহ্মচারিণঃ স্বাহা (শারীরিক সংযম তথা ব্রহ্মচর্য সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করবার পর ছাত্রদল যেন আমার কাছে আসে); শমায়ন্তু ব্ৰহ্মচারিণঃ স্বাহা (মানসিক সংযম সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করবার পর ছাত্রদল যেন আমার কাছে আসে)।

সরলার্থ: (১-২) বেদের সারাৎসারই ‘ওম্’ এবং সর্বপ্রকার বাক্-রীতিতে অর্থাৎ সব শব্দের মধ্যে এই ‘ওম্’ রয়েছেন। বেদ আমাদের আত্মজ্ঞানের পথ দেখায় এবং ওম্ সেই বেদের কাছ থেকেই এসেছেন। আমাদের সকল কামনা বাসনা যিনি পূর্ণ করেন সেই পরমেশ্বর ইন্দ্র ও ‘ওম্’ এক ও অভিন্ন। প্রার্থনা করি, ‘ওম্’ যেন আমাকে তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি দান করেন। পরমেশ্বরের [ওম্] কাছে প্রার্থনা করি, আমি যেন অমর হতে পারি। আমার দেহ যেন আত্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত হয়। আমি যেন মিষ্টভাষী হই এবং কর্ণদ্বয় যেন আমাকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভে সাহায্য করে। আপনিই ব্রহ্মের প্রতীক। কিন্তু ইন্দ্রিয়সকল এই তত্ত্বকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। কৃপা করে যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছি তা রক্ষা করুন।

[ওম্] অনুগ্রহ করে আমাকে প্রাচুর্য দান করুন। আমাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বস্ত্র, গাভী, অন্ন এবং পানীয় দান করুন। আর এই সব জিনিস যেন নানারকমের হয় এবং এদের সংখ্যা যেন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আমি যেন দীর্ঘ কেশ যুক্ত ছাগল, মহিষ ও অন্যান্য পশুও লাভ করতে পারি। তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি অর্জন করার পর আমি যেন এই সব প্রাচুর্য লাভ করি। স্বাহা।

চারদিক থেকে ছাত্ররা আমার কাছে আসুক। স্বাহা। সম্ভাব্য সব পথ দিয়ে ছাত্ররা আমার কাছে আসুক। স্বাহা। ন্যায্যপথে অর্থাৎ বিধিসম্মতভাবে ছাত্ররা আমার কাছে আসুক। স্বাহা। সম্পূর্ণ শারীরিক সংযম অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য অর্জনের পর ছাত্ররা যেন আমার কাছে আসে। স্বাহা। পুরোপুরি মনকে বশে আনার পর ছাত্ররা যেন আমার কাছে আসে। স্বাহা।

ব্যাখ্যা: সব বেদমন্ত্রের মধ্যে ‘ওম্’ই শ্রেষ্ঠ। সকল শব্দের মধ্যে এই ‘ওম্’ রয়েছে। এখানে ‘ওম্‌’কে একটি লাঠির সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এই লাঠি যেন একটা গাছের পাতার স্তূপকে ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ‘ওম্’কে বৃষের মতো শক্তিশালী বলা হয়েছে। এই ‘ওম্’ ইন্দ্র এবং ব্রহ্মের প্রতীক। যাঁরা তীক্ষ্ণ মেধা লাভ করতে চান তাঁদের এই মন্ত্র বারবার আবৃত্তি করার কথা বলা হয়েছে। এরই ফলে তাঁরা প্রাচুর্যও লাভ করে থাকেন।

প্রথমে আমরা উন্নত মেধা যাতে লাভ করতে পারি সেই প্রার্থনাই করি। কারণ উন্নত মেধা না থাকলে যে সব মূল্যবান জিনিস আমরা অর্জন করেছি তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা এই বুদ্ধি বিচার প্রয়োগ করেই আমাদের অর্জিত সম্পত্তি রক্ষা করে থাকি। কেমন করে প্রার্থনা করতে হয় এবং কি প্রার্থনা করতে হয় তা-ও এখানে বলা হয়েছে। উপনিষদ এই প্রার্থনাগুলি হোমের (যজ্ঞের) মাধ্যমে করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই কারণের জন্যই ‘স্বাহা’ শব্দটি বলা হয়েছে। যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দেওয়ার সময় এই স্বাহা শব্দটি উচ্চারিত হয়ে থাকে।

যশো জনেঽসানি স্বাহা। শ্রেয়ান্ বস্যসোঽসানি স্বাহা। তং ত্বা ভগ প্রবিশানি স্বাহা। স মা ভগ প্রবিশ স্বাহা। তস্মিন্ সহস্রশাখে নিভগাহং ত্বয়ি মৃজে স্বাহা। যথাঽঽপঃ প্রবতা যন্তি যথা মাসা অহর্জরম্। এবং মাং ব্রহ্মচারিণঃ। ধাতরায়ন্তু সর্বতঃ স্বাহা। প্রতিবেশোঽসি প্র মা ভাহি প্র মা পদ্যস্ব॥৩॥ ইতি চতুর্থোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: জনে (সমাজে); যশঃ অসানি (আমি যেন বিখ্যাত হই); শ্রেয়ান্ বস্যসঃ অসানি (ধনীব্যক্তিদের মধ্যে আমি যেন শীর্ষস্থানের অধিকারী হই); ভগ ([অর্থাৎ ভগবান] হে প্রভু); তম্ ত্বা ([ব্রহ্মের প্রতীক] আপনাতে); প্রবিশানি (যেন প্রবেশ করতে পারি); ভগ (হে প্রভু); সঃ (সেই [অর্থাৎ আপনি, ব্রহ্মের প্রতীক]); মা (আমাতে); প্রবিশ (প্রবেশ করুন [অর্থাৎ আমার সঙ্গে একাত্ম হোন]); তস্মিন্ সহস্রশাখে (তাঁতে যাঁর বহুরূপ); ত্বয়ি (আপনার মধ্যে); অহং নি-মৃজে ([তার দ্বারা] আমি সম্পূর্ণ আমার পাপ থেকে মুক্ত); আপঃ যথা প্রবতা যন্তি (জল যেমন নিম্নগামী); যথা মাসাঃ অহর্জরম্ (মাস যেমন বৎসরে মিলিত হয়); এবম্ (সেই ভাবে); মাং ব্রহ্মচারিণঃ আয়ন্তু সর্বতঃ (চতুর্দিক থেকে ছাত্রদল যেন আমার কাছে আসে); ধাতঃ (হে প্রভু); প্রতিবেশঃ অসি (আপনি [সকলের] আশ্রয়); মা প্রভাহি (অনুগ্রহ করে আপনার স্বরূপ আমার কাছে প্রকাশ করুন); মা প্রপদ্যস্ব (অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে একাত্ম হোন [আমি আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি])। ইতি চতুর্থঃ অনুবাকঃ (এখানে চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: আমি যেন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হই। স্বাহা। ধনীদের মধ্যে আমি যেন শ্রেষ্ঠ হই। স্বাহা। আপনি ব্রহ্মের প্রতীক। আমি যেন আপনার মধ্যে লীন হয়ে যাই। স্বাহা। আপনিও আমাতে প্রবেশ করুন। স্বাহা। হে প্রভু, আপনার অনেক রূপ। আপনাতে যেন আমার সকল পাপ ধুয়ে যায়। স্বাহা। জল যেমন নিম্নগামী এবং মাস যেমন বছরে পরিণত হয়, সেইভাবে, হে প্রভু, চারদিক থেকে ছাত্ররা যেন আমার কাছে আসে। স্বাহা। আপনি সকলের আশ্রয়দাতা। আমি আপনার শরণাগত। কৃপা করে আমার কাছে আপনার স্বরূপ প্রকাশ করুন এবং আমাতে প্রবেশ করুন।

ব্যাখ্যা: এখানে যেমন যশ ও সম্পদের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে, আবার একই সাথে ব্রহ্মের সাথে যাতে একাত্ম হতে পারি সেই প্রার্থনাও করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্রহ্মও যেন আমার সঙ্গে একাত্ম হন এমন প্রার্থনাও করা হচ্ছে। আমাদের নানারকমের ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। ব্রহ্মের সাথে নিজ অভিন্নতা উপলব্ধি করতে পারলে সব ত্রুটি বিচ্যুতি দূর হয়ে যায়। জলরাশি যেমন ক্রমশ নিম্নদিকে বয়ে চলে, মাস যেমন বছরে মিলিত হয় ঠিক সেইভাবেই, সবদিক থেকে ছাত্ররা আমার কাছেই আসুক। ‘আমি যেন ব্রহ্মের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারি’—এই আমার সর্বশেষ প্রার্থনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি অর্থ কামনা করছি কেন? কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের জন্য। কিন্তু কর্তব্যকর্মী বা করব কেন? যাতে আমার সঞ্চিত সকল পাপ ধুয়ে যায়। এর ফলে আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর তখন জ্ঞান আপনা আপনিই প্রকাশ পায়। আচার্য শঙ্কর একটি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাচ্ছেন: ‘আয়নার উপরে যদি কোন ময়লা না থাকে অর্থাৎ পরিষ্কার আয়নাতে নিজেকে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়।’ সেইভাবে, শুদ্ধ ও পবিত্র মন ছাড়া আত্মজ্ঞান লাভ করা যায় না। এটাই হল প্রার্থনার লক্ষ্য।

পঞ্চম অধ্যায়

ভূর্ভুবঃ সুবরিতি বা এতাস্তিস্রো ব্যাহৃতয়ঃ। তাসামু হ স্মৈতাং চতুর্থীম্। মাহাচমস্যঃ প্রবেদয়তে। মহ ইতি। তদ্‌ব্রহ্ম। স আত্মা। অঙ্গান্যন্যা দেবতাঃ। ভূরিতি বা অয়ং লোক। ভুব ইত্যন্তরিক্ষম্। সুবরিত্যসৌ লোকঃ॥১

মহ ইত্যাদিত্যঃ। আদিত্যেন বাব সর্বে লোকা মহীয়ন্তে। ভূরিতি বা অগ্নিঃ। ভুব ইতি বায়ুঃ। সুবরিত্যাদিত্যঃ। মহ ইতি চন্দ্ৰমাঃ। চন্দ্রমসা বাব সর্বাণি জ্যোতীংষি মহীয়ন্তে। ভূরিতি বা ঋচঃ। ভুব ইতি সামানি। সুবরিতি যজুংসি॥২

মহ ইতি ব্রহ্ম। ব্ৰহ্মণা বাব সর্বে বেদা মহীয়ন্তে। ভূরিতি বৈ প্রাণঃ। ভুব ইত্যপানঃ। সুবরিতি ব্যানঃ। মহ ইত্যন্নম্। অন্নেন বাব সর্বে প্রাণা মহীয়ন্তে। তা বা এতাশ্চতস্রশ্চতুর্ধা। চতস্রশ্চতস্রো ব্যাহৃতয়ঃ। তা যো বেদ। স বেদ ব্রহ্ম। সর্বেঽস্মৈ দেবা বলিমাবহন্তি॥৩॥ ইতি পঞ্চমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: ভূঃ (পৃথিবী); ভুবঃ (পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যবর্তী আকাশ); সুবঃ (স্বর্গ); ইতি (এই ভাবে); এতাঃ (এই সব); তিস্রঃ ([তথাকথিত] তিন); ব্যাহৃতয়ঃ (ব্যাহৃতি [গুহ্য উচ্চারণ, যা সকল বাধা দূর করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়]); তাসাম্ উ হ চতুর্থীম্ (এগুলি চতুর্থকে অনুসরণ করে); মহঃ ইতি (মহ নামে [পরিচিত]); মাহাচমস্যঃ (ঋষি মহাচমসের পুত্র); প্রবেদয়তে স্ম এতাম্ (একে আবিষ্কার করেছিলেন); তৎ (সেই [স্বয়ংপ্রকাশ মহ]); ব্ৰহ্ম (ব্রহ্ম [দেশাতীত ও কালাতীত]); সঃ আত্মা (তিনিই আত্মা); অন্যাঃ (অন্যেরা [ভূঃ, ভুবঃ এবং সুবঃ]); দেবতাঃ ([অধিষ্ঠাত্রী] দেবগণ); অঙ্গানি (তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ); ভূঃ ইতি বৈ অয়ং লোকঃ (ভূঃ হল এই পৃথিবী); ভুবঃ ইতি অন্তরিক্ষম্ (ভুবঃ হল পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যবর্তী আকাশ); অসৌ লোকঃ সুবঃ ইতি (তার ওপরের আকাশ হল স্বর্গ, সুবঃ)।

আদিত্যঃ মহঃ ইতি (আদিত্য [সূর্য] হলেন মহ); আদিত্যেন বাব সর্বে লোকাঃ মহীয়ন্তে (যদি সকল লোকই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় [অথবা তাদের অভ্যস্ত কর্মসম্পাদনে সক্ষম হয়], তবে তা আদিত্যের কারণেই); ভূঃ ইতি বৈ অগ্নিঃ (অগ্নিই ভূঃ); ভুবঃ ইতি বায়ুঃ (বায়ুই ভুবঃ); সুবঃ ইতি আদিত্যঃ (আদিত্যই [সূর্য] সুবঃ); মহঃ ইতি চন্দ্ৰমাঃ (চন্দ্ৰই মহ); চন্দ্রমসা বাব সর্বাণি জ্যোতীংসি মহীয়ন্তে (সকল জ্যোতির্ময় বস্তুই বর্ধিত হয় [অথবা তাদের অভ্যস্ত কর্ম সম্পাদনে সমর্থ] চন্দ্রের কারণে); ভূঃ ইতি বৈ ঋচঃ (ঋক বেদই ভূঃ); ভুবঃ ইতি সামানি (সাম বেদই ভুবঃ); সুবঃ ইতি যজুংসি (যজুর্বেদই সুবঃ)।

মহঃ ইতি ব্রহ্ম (ব্রহ্মই [ওম্] মহ); ব্ৰহ্মণা বাব (ব্রহ্মের কারণে); সর্বে বেদাঃ মহীয়ন্তে (বেদ সকল শক্তি লাভ করে); ভূঃ ইতি বৈ প্রাণঃ (প্রাণই [প্রশ্বাস বায়ু] ভূঃ); ভুবঃ ইতি অপানঃ (অপানই [নিঃশ্বাস বায়ু] ভুবঃ); সুবঃ ইতি ব্যানঃ (ব্যানই [যে বায়ু দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে] সুবঃ); মহঃ ইতি অন্নম্ (খাদ্যই মহ); অন্নেন বাব সর্বে প্রাণাঃ মহীয়ন্তে (কারণ খাদ্যই সকল প্রাণে [অর্থাৎ শ্বাসবায়ুর সকল প্রকারে] বল দান করে); তাঃ বৈ এতাঃ চতস্রঃ (এই চারটি); ব্যাহৃতয়ঃ (ব্যাহৃতি [উচ্চারণ সকল]); চতস্রঃ চতস্রঃ চতুর্ধা (চারটি শ্রেণীতে বর্ণিত); তাঃ যঃ বেদ (যিনি এই চারটিকে (ব্যাহৃতি) জানেন); সঃ বেদ ব্রহ্ম (তিনি ব্রহ্মকে জানেন); সর্বে অস্মৈ দেবাঃ (তাঁর নিকট সকল দেবতাই); বলিম্ আবহন্তি (অর্ঘ্য আনয়ন করেন); ইতি পঞ্চমঃ অনুবাকঃ (এখানে পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (১-৩) ভূঃ, ভুবঃ এবং সুবঃ—এই ধর্মীয় শব্দ তিনটিকে ব্যাহৃতি বলা হয়। ঋষি মহাচমসের পুত্র মাহাচমস্য চতুর্থ ব্যাহৃতি তথা ‘মহ’কে আবিষ্কার করেছিলেন। মহ-ই ব্রহ্ম, আত্মা। ভূঃ, ভুবঃ এবং সুবঃ ও তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা—সকলেই ব্রহ্মের অংশ। ভূঃ হল পৃথিবী, ভুবঃ হল পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যবর্তী আকাশ এবং সুবঃ [বা স্বঃ] হচ্ছে স্বর্গ। ‘মহ’ হলেন সমষ্টি প্রাণের উৎস আদিত্য। অন্যান্য লোকেও আদিত্য শক্তি দান করেন।

ব্যাখ্যা: ভূঃ হলেন অগ্নি, ভুবঃ হচ্ছেন বায়ু এবং সুবঃ হচ্ছেন আদিত্য বা সূর্য। মহ হলেন চন্দ্র। চন্দ্রের আলোতেই সব বস্তু আলোকিত। ভূঃ—ঋগ্বেদ, ভুবঃ—সামবেদ এবং সুবঃ—যজুর্বেদ বলে খ্যাত। ‘মহ’ হলেন ব্রহ্ম [ওম্]। এই ব্রহ্মের কাছ থেকেই বেদসকল তাঁদের শক্তি লাভ করে থাকেন।

‘ভূঃ’ হলেন প্রাণবায়ু (প্রশ্বাস বায়ু), ‘ভুবঃ’ হচ্ছেন অপান বায়ু (নিঃশ্বাস বায়ু) এবং ‘সুবঃ’ হচ্ছেন ব্যান [এই বায়ু দেহের সর্বত্র রয়েছেন]। আবার ‘মহ’ই অন্ন বা খাদ্য। কারণ প্রাণবায়ুর সব কাজ সম্পন্ন করার জন্য যে-শক্তির দরকার তা অন্নের কাছ থেকেই আসে। এই চারটি ব্যাহৃতির প্রত্যেকটি আবার চারভাগে বিভক্ত। যিনি এই ব্যাহৃতি সমূহের প্রকৃত তাৎপর্য জানেন তিনি ব্রহ্মকেও জানেন। সকল দেবতাদের কাছ থেকে তাঁরা তখন বর লাভ করেন।

পূর্বে [তৃতীয় অধ্যায়ে] সংহিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সংহিতায় ধ্যানের উপযোগিতার কথা বলা হয়েছে। যাঁরা তীক্ষ্ণ মেধা ও ধন সম্পদ লাভ করতে চান তাঁরা কোন্ কোন্ মন্ত্র জপ করবেন এ কথাও সংহিতায় আছে।

আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে কেমন করে ভূঃ, ভুবঃ এবং সুবঃ ইত্যাদির ধ্যান করতে হয়, এই অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া ‘মহ’-এর গুরুত্বই বা কি সেকথাও এখানে বলা হয়েছে। উপনিষদ বলছেন যে, ঋষি মাহাচমস্য উপলব্ধি করেছিলেন, মহ এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন। ভূঃ, ভুবঃ, সুবঃ—এঁরা ব্রহ্মেরই (মহ) অংশ। এঁদেরকে ব্রহ্মরূপে ধ্যান করা উচিত। সংক্ষেপে বলা যায়, সাধক যদি এই ব্যাহৃতি সমূহকে ঠিক ঠিক ভাবে জানেন তবে তিনি ব্রহ্মকেও উপলব্ধি করতে পারবেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা হয়তো গৌণ দেবতার প্রতীক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরাও ব্রহ্ম।

ষষ্ঠ অধ্যায়

স য এষোঽন্তর্হৃদয় আকাশঃ। তস্মিন্নয়ং পুরুষো মনোময়ঃ। অমৃতো হিরণ্ময়ঃ। অন্তরেণ তালুকে। য এষ স্তন ইবাবলম্বতে। সেন্দ্রযোনিঃ। যত্রাসৌ কেশান্তো বিবর্ততে। ব্যপোহ্য শীর্ষকপালে। ভুরিত্যগ্নৌ প্রতিতিষ্ঠতি। ভুব ইতি বায়ৌ॥১

সুবরিত্যাদিত্যে। মহ ইতি ব্রহ্মণি। আপ্নোতি স্বরাজ্যম্। আপ্নোতি মনসম্পতিম্। বাক্‌পতিশ্চক্ষুষ্পতিঃ। শ্রোত্রপতির্বিজ্ঞানপতিঃ। এতত্ততো ভবতি। আকাশশরীরং ব্রহ্ম। সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দম্। শান্তিসমৃদ্ধমমৃতম্। ইতি প্রাচীনয়োগ্যোপাস্‌স্ব॥২॥ ইতি ষষ্ঠোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: অন্তঃ হৃদয়ে (হৃদয়ের অভ্যন্তরে); যঃ এষঃ আকাশঃ ([যে] শূন্য, আকাশ যেখানে আছে); তস্মিন্ (তাতে [আকাশ]); সঃ অয়ম্ (এটি আছে); মনোময়ঃ (সমষ্টি মন [চিহ্নিত করছে]); অমৃতঃ (অমর); হিরণ্ময়ঃ (জ্যোতির্ময়); পুরুষঃ (আত্মা [আছেন]); অন্তরেণ তালুকে (দুই তালুর মধ্যবর্তী); যঃ এষঃ (যে [মাংস খণ্ড যা]); স্তন ইব (স্তনের ন্যায়); অবলম্বতে (ঝুলছে); যত্র (যেখানে); অসৌ কেশান্ত (কেশমূল); বিবর্ততে (বিভক্ত হয়েছে [সুষুম্নানাড়ী]); ব্যপোহ্য (বিদীর্ণ করে যায়); শীর্ষকপালে (মাথার দুটি তালু); সা (এই [সুষুম্নানাড়ী]); ইন্দ্ৰযোনিঃ (যেখানে ইন্দ্র [অর্থাৎ ব্রহ্ম] নিজেকে প্রকাশ করেন [সুষুম্নার মধ্য দিয়ে পুরুষ তথা আত্মা বেরিয়ে যান]); ভূঃ ইতি অগ্নৌ প্রতিতিষ্ঠতি (অগ্নি অর্থাৎ ভূঃতে বিলীন হন); ভুবঃ ইতি বায়ৌ ([এবং] বায়ুতেও যা ভুবঃ)।

সুবঃ ইতি আদিত্যে (আদিত্যে [সূর্যে] যা সুবঃ); মহ ইতি ব্রহ্মণি (ব্রহ্মে যিনি হলেন মহ); স্বরাজ্যম্ আপ্নোতি (তিনি ব্রহ্মের সঙ্গে নিজ অভিন্নতা উপলব্ধি করেন); মনসস্পতিম্ আপ্নোতি (তিনি সেই ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা উপলব্ধি করেন যিনি মন ও তার সব কাজ কর্মের নিয়ামক) বাক্‌পতিঃ চক্ষুষ্পতিঃ শ্ৰোত্ৰপতিঃ বিজ্ঞানপতিঃ (যিনি বাক্, চক্ষু, কর্ণ, এবং মন [অর্থাৎ সকল ইন্দ্রিয়]-কে নিয়ন্ত্রণ করেন); ততঃ এতৎ ভবতি (এরপর তিনি হয়ে ওঠেন); আকাশ-শরীরম্ (সর্বব্যাপী আকাশের মতো শরীর সহ); ব্রহ্ম ([তিনি হয়ে যান] ব্রহ্ম); সত্যাত্মা (তিনি সত্যস্বরূপ হয়ে ওঠেন); প্রাণারামম্ (তিনি আত্মতুষ্ট); মনঃ, আনন্দম্ (তাঁর মন আনন্দে পূর্ণ); শান্তিসমৃদ্ধম্ (শান্তিসমৃদ্ধ); অমৃতম্ (অমরত্ব); প্রাচীনযোগ্য (হে প্রাচীনযোগ্য [হে কালাতীত সত্তা]); উপাস্‌স্ব (উপাসনা কর [সেই ব্রহ্মকে]); ইতি ষষ্ঠঃ অনুবাকঃ (এখানে ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (১-২) সমষ্টি মনের প্রতিনিধিরূপী জ্যোতির্ময় ও অবিনাশী আত্মা হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন। দুই তালুর মধ্যবর্তী স্থানে একটি মাংসখণ্ড ঝুলছে যা আকৃতিতে স্তন সদৃশ। এখানেই কেশ সমূহের মূল বিভক্ত হয়েছে। এই স্তনের মধ্য দিয়েই সুষুম্না নাড়ী চলাচল করে যেটি করোটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। এই নাড়ী হল ইন্দ্রযোনি যেখানে ইন্দ্র নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তিনি [তাঁর আত্মা] এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যান এবং তারপর তিনি অগ্নিতে লীন হন এবং ভূঃ-এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এরপর তিনি লীন হন বায়ুতে এবং ভুবঃ-এর সাথে এক হয়ে যান। তারপর তিনি আদিত্যে লীন হয়ে সুবঃ-এর সাথে এক হয়ে যান। শেষে তিনি ব্রহ্মে লীন হয়ে যান যে-ব্রহ্ম হলেন মহ। তখন তিনি ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন এবং মন তাঁর বশে থাকে। মনের অধিপতিরূপে তিনি অনুভব করেন যে, সকল ইন্দ্রিয় যেমন, বাক্ চক্ষু, কর্ণ, এবং চেতনাও তাঁর অধীন। আকাশের মতো তিনি সর্বব্যাপী। তিনি সত্যস্বরূপ এবং আত্মাতেই তিনি স্থিত। তাঁর মন আনন্দে পূর্ণ। তিনিই সেই ব্রহ্ম যিনি শান্তি ও আনন্দের প্রতিমূর্তি ও অমর। হে প্রাচীনযোগ্য! এই ব্রহ্মের উপাসনা কর।

ব্যাখ্যা: আমাদের হৃৎপদ্মের অভ্যন্তরে যে শূন্যস্থান আছে সেখানেই আত্মা রয়েছেন। আত্মাকে এখানে ‘পুরুষ’ বলা হয়েছে যা সবকিছুকে পূর্ণ করেন। ‘পুরুষ’ কথাটির অর্থ হল ‘পুরে শয়ান’ অর্থাৎ আত্মার অবস্থান হৃদয়ে। তাই হৃদয়ই পুরুষের ‘পুর’ বা আবাস। আবার আত্মাকে ‘মনোময়’ও বলা হয়। কারণ আত্মাই সমষ্টি মন এবং চৈতন্য স্বরূপ। এই আত্মা অবিনাশী ও জ্যোতির্ময়।

কিন্তু এই আত্মাকে উপলব্ধি করা যায় কিভাবে? যোগশাস্ত্র মতে, সুষুম্না নামে এক নাড়ী আছে যা হৃদয় থেকে মস্তক অভিমুখী। সুষুম্না নাড়ী করোটির দুপাশের কেন্দ্রস্থল ভেদ করে ঢোকে। এই পথকে বলা হয় ইন্দ্ৰযোনি। ‘ইন্দ্র’ কথাটির অর্থ ব্রহ্ম। আর ব্রহ্ম যেখানে নিজেকে প্রকাশ করেন তাই ইন্দ্রযোনি। এখানেই সাধক উপলব্ধি করেন ‘তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই পরমাত্মা’। এই তত্ত্ব উপলব্ধি হলে সাধক শরীর ত্যাগ করে এই দৃশ্যমান জগৎ তথা অগ্নিতে লীন হন। অর্থাৎ সাধক তখন ভূঃ’-এর সাথে মিলিত হন। তারপর তিনি বায়ু বা ‘ভুবঃ’ এবং আদিত্য (সূর্য) তথা ‘সুবঃ’-এর সাথে মিলিত হন। শেষে তিনি ব্রহ্মে লীন হন, যে ব্রহ্ম হলেন চতুর্থ ব্যাহৃতি, মহ। এখানে আমাদের বোঝাতে চাইছেন যে, সাধক প্রথমে অগ্নি ও অন্যান্য দেবতায় লীন হন। ব্যাহৃতি ও তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাসকল ব্রহ্মে লীন হন।

ব্রহ্মই পরম বা সর্বোচ্চ। তাই আত্মজ্ঞান লাভের পর সাধক অনুভব করেন, নিজ মন, ইন্দ্রিয় ও অন্যান্য সবকিছুর তিনিই প্রভু। সাধক তখন অসীম, অনন্ত হয়ে যান। আকাশের মতো তিনি সর্বব্যাপী ও সর্ব বন্ধন থেকে মুক্ত। তিনি সত্যস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ। তিনি পূর্ণ। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এই অবস্থাই লাভ করেন।

‘আমরাই স্বয়ং ব্রহ্ম’ —এই ধ্যান আমাদের সবসময় করা উচিত।

সপ্তম অধ্যায়

পৃথিব্যন্তরিক্ষং দৌৰ্দিশোঽবান্তরদিশাঃ। অগ্নির্বায়ুরাদিত্যশ্চন্দ্রমা নক্ষত্রাণি। আপ ওষধয়ো বনস্পতয় আকাশ আত্মা। ইত্যধিভূতম্। অথাধ্যাত্মম্। প্রাণো ব্যানোঽপান উদানঃ সমানঃ। চক্ষুঃ শ্রোত্রং মনো বাক্ ত্বক্। চর্ম মাংসং স্নাবাস্থি মজ্জা। এতদধিবিধায় ঋষিরবোচৎ। পাঙ্‌ক্তং বা ইদং সর্বম্। পাঙ্‌ক্তেনৈব পাঙ্‌ক্তং স্পৃণোতীতি॥১॥ ইতি সপ্তমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: পৃথিবী (পৃথিবী); অন্তরিক্ষং (মধ্যবর্তী অঞ্চল); দ্যৌঃ (স্বর্গ); দিশঃ (দিকসমূহ [পূর্ব, পশ্চিম ইত্যাদি]); অবান্তরদিশাঃ (অন্তর্বর্তী দিক-সমূহ [পূর্বোল্লিখিত ব্যাহৃতি সদৃশ চতুর্বিধ দেবতা]); অগ্নিঃ (অগ্নি); বায়ুঃ (বায়ু); আদিত্যঃ (সূর্য); চন্দ্ৰমাঃ (চন্দ্র); নক্ষত্রাণি (তারকাসমূহ); আপঃ (জল); ওষধয়ঃ (ওষধি); বনস্পতয়ঃ (বৃক্ষাদি [যে গাছের ফল হয় ফুল হয় না]); আকাশঃ (আকাশ); আত্মা (শরীর); ইতি অধিভূতম্ (এই সব পঞ্চভূত); অথ অধ্যাত্মম্ (এখন দেহ বিষয়ে); প্রাণঃ (গৃহীত প্রশ্বাস বায়ু); ব্যানঃ (দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে); অপানঃ (বহির্গামী নিঃশ্বাস বায়ু); উদানঃ (যে বাতাস বস্তুকে ঊর্ধ্বমুখী করে); সমানঃ (যে বাতাস জীর্ণ খাদ্যকে রক্ত ইত্যাদি রসে পরিণত করে); চক্ষুঃ (চোখ); শ্রোত্রম্ (কান); মনঃ (মন); বাক্ (বাগিন্দ্রিয়); ত্বক্ (স্পর্শেন্দ্রিয়); চর্ম (চামড়া); মাংসম্ (পেশী); স্নাবা (স্নায়ু [তথা নাড়ী]); অস্থি (হাড়); মজ্জা (মজ্জা); ঋষিঃ (বেদজ্ঞ); এতৎ (এই [পাঙ্‌ক্ত উপাসনা]); অধিবিধায় (বিধান করে); অবোচৎ (বলেছিলেন); পাঙ্‌ক্তং বৈ ইদং সর্বম্ (এই সমস্তই পাঙ্‌ক্ত); পাঙ্‌ক্তেন এব পাঙ্‌ক্তং স্পৃণোতি ইতি (পাঙ্‌ক্ত দ্বারাই পাঙ্‌ক্তকে পূর্ণ করে); ইতি সপ্তমঃ অনুবাকঃ (এখানে সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: পৃথিবী (ভূঃ), পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যবর্তী আকাশ (ভুবঃ), স্বর্গ (সুবঃ), চারটি দিক (পূর্ব, পশ্চিমাদি), চারটি উপদিক (উত্তরপূর্ব, উত্তরপশ্চিম ইত্যাদি)—এই পাঁচটি লোক-পাঙ্‌ক্ত। অগ্নি, বায়ু, আদিত্য (সূর্য), চন্দ্র ও নক্ষত্র সমূহ—এই পাঁচটি দেবতা-পাঙ্‌ক্ত। জল, ওষধি (ছোট গাছ), বনস্পতি (বড়গাছ—যার ফল হয় ফুল হয় না), আকাশ, এবং দেহ—এই পাঁচটি ভূত-পাঙ্‌ক্ত। এখানে এই তিন প্রকার পাঙ্‌ক্তের কথা বলা হয়েছে। এই সব পাঙ্‌ক্তের মাধ্যমে ব্রহ্মের উপাসনাকে বলা হয় অধিভূত উপাসনা—অর্থাৎ, জড়বস্তুর উপাসনা। এখন অধ্যাত্ম উপাসনা অর্থাৎ দেহের উপাসনার কথা বলা হচ্ছে। প্রাণ (গৃহীত প্রশ্বাস বায়ু), ব্যান (প্রাণ ও অপানের মধ্যবর্তী বায়ু), অপান (নিঃশ্বাস বায়ু যা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়), উদান (যে বায়ু বস্তুকে ঊর্ধ্বগামী করে), সমান (যে বায়ু জীর্ণ খাদ্যকে রক্ত ও অন্যান্য রসে পরিণত করে)—এই পাঁচটি হল প্রাণ-পাঙ্‌ক্ত বা প্রাণাদি বায়ু-পাঙ্‌ক্ত। চক্ষু, কর্ণ, মন, বাগিন্দ্রিয় ও স্পর্শেন্দ্রিয়—এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়-পাঙ্‌ক্ত। চর্ম, মাংস, স্নায়ু, অস্থি ও মজ্জা—এরা (এই পাঁচটি) ধাতু-পাঙ্‌ক্ত। কোন এক ঋষি পাঙ্‌ক্ত রূপে ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেছেন। প্রতিটি পাঙ্‌ক্ত আবার পাঁচটি পদার্থকে নিয়ে গঠিত। এরা একে অপরের পরিপূরক। বস্তুত এরা এক ও অভিন্ন।

ব্যাখ্যা: পূর্বে ব্রহ্মকে চার রকমের ব্যাহৃতি বলে কল্পনা করা হয়েছিল। এই শ্লোকে পাঙ্‌ক্ত হিসাবে ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলা হয়েছে। এখানে অস্তিত্বের ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাইরে বা অভ্যন্তরে, পাঙ্‌ক্ত বা অন্য কিছু—এ সব গৌণ ব্যাপার। মুখ্য বক্তব্যটি হল বস্তুর ঐক্য। কোন ব্যক্তি যখন এই ঐক্যকে (অর্থাৎ এক আত্মাই সকলের মধ্যে রয়েছেন) উপলব্ধি করেন তখন তিনিই এই বিশ্বের প্রভু; কারণ তিনি তখন ব্রহ্মই হয়ে যান।

অষ্টম অধ্যায়

ওমিতি ব্রহ্ম। ওমিতীদং সর্বম। ওমিত্যেতদনুকৃতির্হ স্ম বা অপ্যো শ্রাবয়েত্যাশ্রাবয়ন্তি। ওমিতি সামানি গায়ন্তি। ওংশোমিতি শস্ত্রাণি শংসন্তি। ওমিত্যধ্বর্যুঃ প্ৰতি-গরং প্রতিগৃণাতি। ওমিতি ব্রহ্মা প্রসৌতি। ওমিত্যগ্নিহোত্রমনুজানাতি। ওমিতি ব্রাহ্মণঃ প্ৰবক্ষ্যন্নাহ ব্ৰহ্মোপাপ্নবানীতি। ব্ৰহ্মৈবোপাপ্নোতি॥১॥ ইতি অষ্টমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: ওম্ ইতি ব্রহ্ম (ওম্ শব্দটি স্বয়ং ব্রহ্ম); ওম্ ইতি ইদং সর্বম্ ([কারণ] ওম্-ই সর্ববস্তু); ওম্ ইতি এতৎ অনুকৃতিঃ হ স্ম বৈ (ওম্ শব্দটি সম্মতিজ্ঞাপক); অপি (ও); ওম্ শ্রাবয় ইতি আশ্রাবয়ন্তি (পুরোহিতবর্গ তখনই ‘ওম্’ বলেন, যখন তাঁরা অন্য পুরোহিতকে স্তোত্র আবৃত্তি [দেবদেবীর উদ্দেশে] করতে আজ্ঞা করেন); ওম্ ইতি সামানি গায়ন্তি (সামস্তোত্র আবৃত্তির সূচনায় পুরোহিতবর্গ ‘ওম্’ বলেন); ওম্ শোম্ ইতি (তাঁরা ‘ওম্ শোম্’ বলেন); শাস্ত্রাণি ([সঙ্গীত হীন] ঋগ্বেদীয় স্ত্রোত্র [যা শাস্ত্র বলে পরিচিত]); শংসন্তি (গান আরম্ভ করেন); অধ্বর্যুঃ (যজুঃ-যজ্ঞের পুরোহিত); প্রতিগৃণাতি প্রতিগরম্ ওম্ ইতি (যা কিছু তিনি করেন তিনি বলেন ‘ওম্‌’); ব্রহ্মা (অন্য প্রকার পুরোহিত); ওম্ ইতি প্রসৌতি (কোন কিছুকে অনুমোদন করতে বলেন ‘ওম্’); ওম্ ইতি অগ্নিহোত্রম্ অনুজানাতি (যাঁরা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ সম্পন্ন করেন তাঁরা যজ্ঞ আরম্ভ করেন ‘ওম্’ই ব্ৰহ্ম বলে); ওম্ ইতি ব্রাহ্মণঃ প্রবক্ষ্যন্ আহ ব্রহ্ম উপাপ্নবানি ইতি (একজন ব্রাহ্মণ যখন ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য বেদপাঠের ইচ্ছা করেন তখন তিনি ‘ওম্’ উচ্চারণ করেন); ব্রহ্ম এব উপাপ্নোতি (তিনি ঘটনাচক্রে ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন); ইতি অষ্টমঃ অনুবাকঃ (এখানে অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ‘ওম্’ই ব্রহ্ম। কারণ সর্ববস্তুর প্রতীক হচ্ছেন ওম্। ‘ওম্’ শব্দটি সম্মতি বোঝাতেও বলা হয়ে থাকে। যখন একদল পুরোহিত অন্য পুরোহিতদের দেবদেবীর উদ্দেশে স্তোত্র আবৃত্তি করতে বলেন তখন তাঁরা ‘ওম্’ দিয়েই শুরু করেন। পুরোহিতরা ‘ওম্’ মন্ত্রটি উচ্চারণের পর সামস্তোত্র আবৃত্তি শুরু করেন। (একইভাবে) শাস্ত্র আবৃত্তি শুরু করার আগে তাঁরা ‘ওম্ শোম্’ শব্দটি বলে থাকেন। অধ্বর্যু পুরোহিত (যজুর্বেদের পুরোহিতরা) যে কোন কাজ করার সময়ই ‘ওম্’ মন্ত্র জপ করেন। আবার ব্রহ্মা নামক পুরোহিত কোন কিছুর সম্মতি বোঝাতে ‘ওম্’ শব্দটি বলেন। অগ্নিহোত্র যজ্ঞকারী ‘ওম্’ মন্ত্রটি উচ্চারণের পর যজ্ঞ শুরু করেন। ব্রহ্মকে জানার জন্য ব্রাহ্মণরা বেদ অধ্যয়ন করেন। এই বেদ পাঠের শুরুতে তাঁরা ‘ওম্’ উচ্চারণ করেন। এর ফলে তাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন।

ব্যাখ্যা: পূর্বে ব্রহ্মের প্রতীকরূপে ব্যাহৃতিসমূহ ও পাঁচটি উপকরণের উল্লেখ করা হয়েছে এবং ব্রহ্মের প্রতীক মনে করে এগুলিকে ধ্যান করতে বলা হয়েছে। এখানে ‘ওম্’ শুধুমাত্র ব্রহ্মের প্রতীকই নন তিনিই স্বয়ং ব্রহ্ম। ব্রহ্মের মতো এ জগতের সবকিছুই হলেন এই ‘ওম্’। পরব্রহ্ম (নির্গুণ ব্রহ্ম) ও অপরব্রহ্ম (সগুণ ব্রহ্ম) এই দুই-ই হলেন ‘ওম্’।

এই অধ্যায়ে ‘ইতি’ শব্দটি ‘ওম্’কে অনুসরণ করে। ‘ইতি’ শব্দটির দ্বারা ‘ওম্’-এর প্রকৃত স্বরূপকে বোঝানো হয়েছে। ‘ওম্’ই ব্ৰহ্ম—এভাবেই ‘ওম্’-এর ধ্যান করা উচিত। সব শব্দ ‘ওম্’-এর অন্তর্গত যেমন এই জগৎ ব্রহ্মের অন্তর্গত।

‘ওম্’ শব্দটিকে পার্থিব ও ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হয়। শাস্ত্রপাঠ শুরুর আগে ‘ওম্’ উচ্চারণ করা হয়ে থাকে। ‘ওম্’ই সাধককে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। কারণ সাধকের লক্ষ্যই তো হচ্ছে ‘ওম্’। সুতরাং ‘ওম্’ ও ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন।

নবম অধ্যায়

ঋতং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। সত্যং চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। ত পশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। দমশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। শমশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নয়শ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নিহোত্রং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অতিথয়শ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। মানুষং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। প্রজা চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। প্রজনশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। প্রজাতিশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। সত্যমিতি সত্যবচা রাথীতরঃ। তপ ইতি তপোনিত্যঃ পৌরুশিষ্টিঃ। স্বাধ্যায়প্রবচনে এবেতি নাকো মৌদ্‌গল্যঃ। তদ্ধি তপস্তদ্ধি তপঃ॥১॥ ইতি নবমোহনুবাকঃ॥

অন্বয়: ঋতম্ (অনুসারে); চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ (এবং শাস্ত্র অধ্যয়নে ও অধ্যাপনায় রত হও); সত্যম্ ([কায়মনোবাক্যে] সৎ হও); চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ (এবং শাস্ত্র অধ্যয়নে ও অধ্যাপনায় রত হও); তপঃ চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ (তপস্যা কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়নে ও অধ্যাপনায় রত হও); দমঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (বহিরিন্দ্রিয় দমন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); শমঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (অন্তরিন্দ্রিয় দমন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); অগ্নয়ঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (ত্রি-অগ্নি [গার্হপত্য, আহবনীয়, এবং দক্ষিণাগ্নি প্রজ্বলিত কর] এবং অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); অগ্নিহোত্রং চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (অগ্নিহোত্র যজ্ঞ সম্পাদন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); অতিথয়ঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (অতিথিকে শ্রদ্ধা কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); মনুষং চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (স্বাভাবিক জীবন যাপন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); প্রজা চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (সন্তান উৎপাদন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); প্রজনঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (বংশধারা অব্যাহত রাখ এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); প্রজাতিঃ চ স্বাধ্যায় [ইত্যাদি] (পৌত্রাদি উৎপাদন কর [অর্থাৎ সন্তানের বিবাহ ব্যবস্থা কর] এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন [ইত্যাদি]); রাথীতরঃ সত্যবচাঃ (রথীতর পরিবারের সত্যবচা [মনে করেন]); সত্যম্ ইতি (সত্যই সব); পৌরুশিষ্টিঃ তপোনিত্যঃ (পুরুশিষ্টির পুত্র পৌরুশিষ্টি যিনি তপোনিত্য বলেও পরিচিত [মনে করেন]); তপঃ ইতি (কৃচ্ছ্র সাধনই কর্তব্য); নাকঃ মৌদ্‌গল্যঃ (মুদ্‌গল পুত্র নাক [তাঁর মতানুযায়ী]); স্বাধ্যায়প্রবচনে এব ইতি (শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা [একমাত্র উপায়]); তৎ হি তপঃ তৎ হি তপঃ (একমাত্র সেটিই যথার্থ তপস্যা, একমাত্র সেটিই যথার্থ তপস্যা); ইতি নবমঃ অনুবাকঃ (নবম অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: শাস্ত্রের নির্দেশমতো নিজ কর্তব্য পালন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। কায়মনোবাক্যে সৎ হও এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। কৃচ্ছ্রসাধনায় জীবন অতিবাহিত কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। বহিরিন্দ্রিয়কে দমন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। অন্তরিন্দ্রিয়কে সংযত কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। যজ্ঞাগ্নি (অগ্নিহোত্র যজ্ঞে ব্যবহৃত তিনটি অগ্নি—গার্হপত্য, আহবনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি) জ্বালিয়ে রাখ এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ প্রতিদিন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। শ্রদ্ধার সাথে অতিথি আপ্যায়ন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। স্বাভাবিক জীবন যাপন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। সন্তান উৎপাদন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। বংশধারা অব্যাহত রাখ এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। পৌত্রাদি লাভের জন্য সন্তানের বিবাহ দাও এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। রথীতর বংশের সত্যবচার মতে সত্যই সব। পুরুশিষ্টির পুত্র পৌরুশিষ্টি যিনি তপোনিত্য বলেও পরিচিত তিনি বলেন, তপস্যায় মনঃসংযোগ করা উচিত। মুদ্‌গল পুত্র নাকের মতে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাই একমাত্র উপায়। এটিই যথার্থ তপস্যা। এটিই একমাত্র তপস্যা।

ব্যাখ্যা: একথা আগেই বলা হয়েছে যে, একমাত্র আত্মজ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষলাভ করা যায়। এর ফলে লোকের মনে হতে পারে কর্মের (অর্থাৎ শাস্ত্র নির্দেশিত কর্তব্য) কোন প্রয়োজন নেই। পাছে মানুষের এই ভুল হয় সেজন্য কর্ম বা কর্তব্যের কথা এখানে বলা হয়েছে। ঠিক ঠিক ভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হয়। চিত্তশুদ্ধি হলে জ্ঞান (আত্মজ্ঞান) আপনা আপনিই প্রকাশ পায়।

সন্ন্যাসী অথবা গৃহী প্রত্যেককেই আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে গৃহী এখনও প্রস্তুত নয়। তাই প্রথমেই তাকে সংসারের অর্থাৎ পার্থিব জীবনের তিক্ত ফল আস্বাদ করতে হয়, যাতে এই অনিত্য সংসারের প্রতি তার বিরক্তি জন্মায়। এর ফলে সে নিত্য-অনিত্য বস্তু বিচার করে। এভাবেই মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়। পরিণামে ইন্দ্রিয়সুখ তাকে আর কোনভাবে আকৃষ্ট করতে পারে না। সাধক তখন নিত্য বস্তু অর্থাৎ আত্মাকে জানার জন্য ব্যাকুল হয়। শাস্ত্রের নির্দেশ মেনে জীবন কাটাতে পারলে লক্ষ্যের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া যায়।

কোন কোন পণ্ডিতের মতে, শাস্ত্র নির্দেশিত কর্তব্য কর্মের চেয়ে সত্যনিষ্ঠা বা তপশ্চর্যা অথবা কায়মনোবাক্যে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করাই অধিকতর উপযোগী।

দশম অধ্যায়

অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। ঊর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্॥১॥ ইতি দশমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: অহং বৃক্ষস্য রেরিবা (আমি এই বৃক্ষের [অর্থাৎ এই পৃথিবীর] প্রেরয়িতা); গিরেঃ পৃষ্ঠম্ ইব কীর্তিঃ (পর্বত শৃঙ্গের মতোই উন্নত [আমার] গৌরব); ঊর্ধ্বপবিত্রঃ ([অর্থাৎ, ঊর্ধ্বম্—উৎস, পবিত্রম্—শুদ্ধ, কারণ তা জ্ঞানপ্রদ] আমার উৎস পরব্রহ্ম); বাজিনি (সূৰ্যমধ্যে [এরূপ নাম, কারণ সূর্য খাদ্য তথা ‘রাজম্’ দান করে]); ইব (অনুরূপ); সু (শুদ্ধ); অমৃতম্ (মোক্ষ তথা আত্মজ্ঞান); অস্মি (আমি অর্জন করেছি); দ্রবিণং সবর্চসম্ (অর্থের মতো আমি মূল্যবান [আত্মার মতো আমি স্বয়ংপ্রকাশ]); সুমেধাঃ (আমি উত্তম মেধাসম্পন্ন); অমৃতঃ (আমি মৃত্যুভয়হীন); অক্ষিতঃ (আমি ক্ষয়রহিত [অর্থাৎ আমি সতত অভিন্ন]); ইতি ত্রিশঙ্কোঃ বেদানুবচনম্ (আত্মোপলব্ধির পর ঋষি ত্রিশঙ্কু এই তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন); ইতি দশমঃ অনুবাকঃ (দশম অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: সংসার নামক বৃক্ষের আমিই উৎসাহদাতা। পর্বত শিখরের ন্যায় উন্নত আমার কীর্তি। সূর্য সকলকে খাদ্য দেন এবং তার দ্বারা সকলকে অমরত্ব দান করেন। সূর্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে (পৃথিবীরও) এবং শুদ্ধ। আমি মহান ও শুদ্ধ কারণ আমিই পরব্রহ্ম। (পরব্রহ্ম সবসময়ই আমার চেতনায় রয়েছেন)। অর্থের মতোই আমি মূল্যবান এবং আত্মার মতোই আমি উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময়। আমি বুদ্ধিমান। মৃত্যুভয় আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমি অপরিবর্তনীয়। আত্মজ্ঞানলাভের পর ঋষি ত্রিশঙ্কু এই কথাই বলেছিলেন।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে আত্মার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকটিকে বারবার পাঠ করতে বলা হচ্ছে। এই পুনরাবৃত্তি আত্মোপলব্ধির জন্য মনকে প্রস্তুত করে।

জগৎ সংসারের মূল আত্মায় নিহিত। আত্মা শুদ্ধ এবং পরম। আত্মা সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধুমাত্র আত্মজ্ঞানলাভেই প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায়, অর্থ বা অন্য কিছুতে নয়। আত্মা শুদ্ধবুদ্ধির গোচর। আত্মা স্বয়ং প্রকাশিত, অমর এবং যে কোন প্রকার ব্যাধি বা পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে। ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি ত্রিশঙ্কু এভাবেই আত্মার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন।

এই শ্লোক বারবার আবৃত্তি কর এবং অনাসক্ত ভাবে কাজ করে যাও। এই হল আত্মজ্ঞানলাভের উপায়।

একাদশ অধ্যায়

বেদমনূচ্যাচাৰ্যোঽন্তেবাসিনমনুশাস্তি। সত্যং বদ। ধমং চর। স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ। আচার্যায় প্রিয়ং ধনমাহৃত্য প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ। সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্। ধর্মান্ন প্রমদিতব্যম্। কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্। ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্। স্বাধ্যায়প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্॥১

অন্বয়: আচার্যঃ অন্তেবাসিনং বেদম্ অনূচ্য (শিষ্যকে বেদশিক্ষাদানের পর আচার্য); অনুশাস্তি (তাকে [নিম্নলিখিত] উপদেশ দান করেন); সত্যং বদ (সত্য কথা বল [যুক্তি বিচারের দ্বারা যতখানি সম্ভব]); ধর্মং চর (শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে আচরণ কর); স্বাধ্যায়াৎ মা প্রমদঃ (বেদাধ্যায়নের অভ্যাস ত্যাগ করো না); আচার্যায় প্রিয়ং ধনম্ আহৃত্য (আচার্যকে তাঁর প্রিয় জিনিস দান কর [আর তারপর, তাঁর নির্দেশ মতো]); প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ (বংশধারা অব্যাহত রেখো); সত্যাৎ ন প্রমদিতব্যম্ (সত্য থেকে কখনও বিচ্যুত হয়ো না); ধর্মাৎ ন প্রমদিতব্যম্ (ধর্ম [শাস্ত্রানুসারী কর্তব্য সম্পাদন] থেকে কখনও বিচ্যুত হয়ো না); কুশলাৎ ন প্রমদিতব্যম্ (আত্মরক্ষায় অবহেলা করো না); ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্ (নিজ স্বার্থরক্ষায় অবহেলা করো না); স্বাধ্যায়প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্ (বেদ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় অবহেলা করো না [উপরোক্ত বিধিসমূহ সঠিক এবং সম্পূর্ণরূপে পালন করতে যত্নশীল হও])।

সরলার্থ: আচার্য প্রথমে শিষ্যকে বেদ শিক্ষা দেন এবং পরে নিম্নলিখিত উপদেশ দেন:

নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সর্বদা সত্য কথা বল। শাস্ত্রের নির্দেশ মেনে ধর্মের আচরণ কর। বেদ অধ্যয়নে কখনও অবহেলা করো না। আচার্যকে তাঁর পছন্দ ও প্রয়োজন মতো জিনিস দক্ষিণাস্বরূপ দিও। (আচার্যের নির্দেশ মতো বিয়ে করে স্ত্রী-পুত্ৰাদি নিয়ে সংসার করো)। বংশধারা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখো। সত্য থেকে কখনও বিচ্যুত হয়ো না। শাস্ত্রে যে কর্তব্য কর্মের কথা বলা হয়েছে তা সম্পাদনে অবহেলা করো না। আত্মরক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করো এবং নিজের উন্নতি সাধনে যত্নবান হয়ো। আবার বলি, শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা বিষয়ে অমনোযোগী হয়ো না। (এইসব নির্দেশ যথাসম্ভব মেনে চলো)।

ব্যাখ্যা: ভারতে প্রাচীনকালে বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুকুল পদ্ধতির প্রচলন ছিল। বিভিন্ন পরিবার থেকে আগত ছাত্ররা একজন গুরু তথা আচার্যকে বেছে নিতেন এবং শিক্ষা চলাকালীন বহুবছর তাঁরা গুরুগৃহে বাস করতেন। এই গুরুগৃহে বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষেই তাঁরা গুরুর সান্নিধ্যলাভ করতেন না, গুরু সবসময়ই তাঁদের সাথে থাকতেন। ছাত্ররা তাই প্রতিমুহূর্তেই শিক্ষাগ্রহণ করতেন। গুরু-পরিবারের অঙ্গ হিসাবে সন্তানের মতোই তাঁরা গুরুগৃহে বাস করতেন। পরিবারের সকলের জন্য একইরকম আহারের ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররাও গুরুর সুখদুঃখের অংশীদার হতেন। তাঁদের সম্পর্ক কেবলমাত্র শিক্ষক-ছাত্র স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। গুরুর সঙ্গে সবসময় ওঠাবসার ফলে তাঁর প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা শিক্ষালাভ করতেন। গুরুগৃহে বাস করার ফলে শিষ্য নিপুণভাবে লক্ষ্য করতেন গুরুর দৈনন্দিন জীবনচর্যা—কেমন করে তিনি শাস্ত্র পাঠ করেন, কিভাবে অবসর সময় কাটান ইত্যাদি।

আচার্য তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিষ্যদের মধ্যে তা বিতরণ করেন। শিষ্যকেও এই জ্ঞানলাভের যোগ্য অধিকারী হতে হয়। গুরু—সেবার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। এখানে সেবা বলতে বিনয় এবং শ্রদ্ধাকে বোঝানো হয়েছে। গুরু এবং তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের প্রতি শিষ্যকে শ্রদ্ধাসম্পন্ন হতে হবে। আচার্য প্রসন্ন হলে শিষ্যকে সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেন। শিষ্যকে নিজ জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে আচার্য নিজেই আনন্দিত হন।

বর্তমানে জ্ঞান বলতে আমরা পুঁথিগত বিদ্যাকে বুঝি। এছাড়া হয়তো আমাদের উপায়ও নেই। জ্ঞান অনাদি, অনন্ত। কিন্তু বই পড়ে আমরা কতটুকু জ্ঞান লাভ করতে পারি? খুবই সামান্য। অভিজ্ঞতায় প্রবীণ যে-সমস্ত ব্যক্তি আমাদের চারপাশে বাস করেন তাঁরাই জীবন্ত গ্রন্থ। আচার্য হলেন শিক্ষক। আচার্য কে? যিনি শাস্ত্রের মর্মার্থ গ্রহণ করেন এবং ব্যবহারিক জীবনে তা প্রয়োগ করেন। এভাবেই তিনি শাস্ত্রের জীবন্ত ভাষ্য হয়ে ওঠেন। প্রকৃত আচার্য যা শেখান তা নিজ জীবনে আচরণ করেন। এই হল প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষক যদি অন্যের ধার করা বুলির পুনরাবৃত্তি করেন তবে তিনি যেন টেপরেকর্ডারেরই কাজ করছেন। ছাত্ররা সেই শিক্ষকের দ্বারা প্রভাবিত হন না। কারণ তিনি যা শেখান তা তিনি নিজ জীবনে উপলব্ধি করেননি। সুতরাং তাঁর শেখানোর মধ্যে ফাঁক থেকে যায়। শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় শিক্ষকের গুণে। যিনি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করেছেন তিনিই শাস্ত্র শিক্ষা দেওয়ার যোগ্য। সত্যের উপলব্ধি ব্যতীত প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায় না।

শিক্ষাদান সমাপ্ত হলে আচার্য শিষ্যদের কিছু মূল্যবান উপদেশ দেন। আচার্য বলেন: ‘দেখ, আমি নিজে যা জানি সে সবই তোমাদের শিখিয়েছি। তা কেবলমাত্র বুদ্ধি দিয়ে বুঝলেই চলবে না তাকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করবে। মনকেও সেভাবে চালিত করবে। এখন থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করবে।’

আচার্য প্রথমেই বললেন : ‘সত্যং বদ’—সত্য কথা বল। সত্য বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আচার্য শঙ্করের মতে, যাকে সত্য বলে মনে হয় এবং নিজ অভিজ্ঞতাও যাকে সমর্থন করে তাই প্রকৃত সত্য। নিজ জীবনে যাকে সত্য বলে উপলব্ধি করেছো কেবলমাত্র তাকেই সত্য বলে গ্রহণ করো। গুজব বা জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে কিছু বলো না। মানুষ গালগল্প শুনতে ভালবাসে। কিন্তু সেগুলিকে সত্য বলে চালিয়ে দিও না।

গুরুর পরবর্তী নির্দেশ হল: ‘ধর্মং চর’—সেই কর্ম সম্পাদন কর যা করা উচিত। শিষ্যদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কোন্ কাজ করা উচিত তা জানব কেমন করে? তার উত্তরে গুরু বলছেন : প্রথমে শাস্ত্রের সাহায্য নাও। শাস্ত্রে বলা আছে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। এরপরও যদি সন্দেহ থাকে তবে নিজের বিচারবুদ্ধিকে প্রয়োগ কর। কিন্তু তাতেও যদি সমস্যার সমাধান না হয় তবে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির পদাঙ্ক অনুসরণ কর। তাঁরা যা করেন তুমিও তাই করার চেষ্টা কর।

‘স্বাধ্যায়াৎ মা প্রমদঃ’—এর আক্ষরিক অর্থ হল শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা থেকে কখনও বিরত হয়ো না। শিষ্যদের বলছেন, ভুলে যেও না, আত্মজ্ঞান—লাভই জীবনের লক্ষ্য। এই সত্যলাভের ব্যাকুলতায় যেন কোন ঘাটতি না পড়ে। তুমি আচার্যের কাছে যেতে পার, শাস্ত্ৰচর্চাও করতে পার, কিন্তু আত্মাকে বোধে বোধ করার চেষ্টা যেন নিরন্তর চলতে থাকে। শাস্ত্রচর্চা করলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এইজন্যই উপনিষদে শাস্ত্রচর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

‘আচার্যায় প্রিয়ং ধনম্ আহৃত্য’—আচার্যকে তাঁর পছন্দ ও প্রয়োজন মতো জিনিস দক্ষিণাস্বরূপ দাও। আচার্য তোমাকে প্রভূত জ্ঞান দান করেছেন। এখন তাঁর প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পালা। তিনি হয়তো খুবই দরিদ্র। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় বস্তু তাঁর কাম্য নয়। এমন বস্তু তাঁকে দিও না। তাঁর খাদ্যের প্রয়োজন থাকলে তাঁকে খাদ্য দাও। বস্ত্রের অভাব থাকলে, তাঁকে বস্ত্র দাও। ‘আচার্যের সব ঋণ আমি পরিশোধ করে দিয়েছি, তাঁকে আর আমার দেবার কিছু নেই’—এমন কথা তুমি ভুলেও ভেবো না।

‘প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ’—বংশধারা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখো। তোমার শিক্ষা শেষ হয়েছে। গৃহে ফিরে তুমি এখন গৃহস্থ জীবন যাপন কর। গুরু আরো বলেছেন, গৃহী হিসাবে বিয়ে করে স্ত্রী-পুত্ৰাদি নিয়ে সংসার করা তোমার কর্তব্য। দেখ, বংশধারায় যেন ছেদ না পড়ে।

‘ধর্মাৎ ন প্রমদিতব্যম্’—ন্যায়ের পথ অবলম্বন কর। ‘ন্যায়’ কথাটির অর্থ হল যা সকলের পক্ষে কল্যাণকর।

‘কুশলাৎ’ কথাটির অর্থ নিজ কল্যাণ, ‘ভূতৈঃ’ অর্থ ধনসম্পদ। আচার্য বলছেন: গৃহী হিসাবে ধনসম্পদ লাভের অধিকার তোমার আছে। তোমার অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং ধর্ম ও সত্যপথে অবিচল থেকে নিজ উন্নতি সাধনে যত্নবান হও।

দেবপিতৃকাৰ্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্। মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেব ভব। আচার্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব। যান্যনবদ্যানি কর্মাণি। তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি। যান্যস্মাকং সুচরিতানি। তানি ত্বয়োপাস্যানি॥২

নো ইতরাণি। যে কে চাস্মচ্ছ্রেয়াংসো ব্রাহ্মণাঃ। তেষাং ত্বয়াঽঽসনেন প্রশ্বসিতব্যম্। শ্রদ্ধয়া দেয়ম্। অশ্রদ্ধয়াঽদেয়ম্। শ্রিয়া দেয়ম্। হ্রিয়া দেয়ম্। ভিয়া দেয়ম্। সংবিদা দেয়ম্। অথ যদি তে কর্মবিচিকিৎসা বা বৃত্তবিচিকিৎসা বা স্যাৎ॥৩

যে তত্র ব্রাহ্মণাঃ সংমর্শিনঃ। যুক্তা আযুক্তাঃ। অলূক্ষা ধর্মকামাঃ স্যুঃ। যথা তে তত্র বর্তেরন্। তথা তত্র বর্তেথাঃ। অথাভ্যাখ্যাতেষু। যে তত্র ব্রাক্ষণাঃ সংমর্শিনঃ। যুক্তা আযুক্তাঃ। অলূক্ষা ধর্মকামাঃ স্যুঃ। যথা তে তেষু বর্তেরন্। তথা তেষু বর্তেথাঃ। এষ আদেশঃ। এষ উপদেশঃ। এষা বেদোপনিষৎ এতদনুশাসনম্। এবমুপাসিতব্যম্। এবমু চৈতদুপাস্যম্॥৪॥ ইতি একাদশোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: দেবপিতৃকার্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্ (দেবতা ও পিতৃপুরুষের প্রতি নিজ কর্তব্যে অবহেলা করো না); মাতৃদেবঃ ভব (মাতাকে দেবতাজ্ঞানে সেবা কর); পিতৃদেবঃ ভব (পিতাকে দেবতাজ্ঞানে সেবা কর); আচার্যদেবঃ ভব (আচার্যকে দেবতাজ্ঞানে সেবা কর); অতিথিদেবঃ ভব (অতিথিকে দেবতাজ্ঞানে আপ্যায়ন কর); যানি কর্মাণি অনবদ্যানি (যে সকল কাজ অনিন্দনীয়); তানি সেবিতব্যানি (সেগুলিই করণীয়); নো ইতরাণি (অন্য কোন কাজ নয়); যানি অস্মাকং সুচরিতানি (যা কিছু উত্তম কাজ আমরা [অর্থাৎ আচার্যগণ] করি); তানি ত্বয়া উপাস্যানি (তোমাদের করা উচিত)।

ইতরাণি (অন্যান্য বস্তু [অর্থাৎ শাস্ত্রে যা অনুমোদিত নয়, কিন্তু আচার্যের দ্বারা কৃত]); ন [উপাস্যানি] (করা উচিত নয়); যে কে চ ব্রাহ্মণাঃ (সেই সব ব্রাহ্মণ যাঁরা); অস্মাৎ শ্রেয়াংসঃ (আমাদের চেয়ে উন্নততর); ত্বয়া (তোমার দ্বারা); তেষাম্ আসনেন (তাঁদের আসন দান করে); প্রশ্বসিতব্যম্ (এইভাবে তাঁদের সৎকার করা উচিত); শ্রদ্ধয়া দেয়ম্ ([কাউকে কিছু দান করতে হলে] শ্রদ্ধার সঙ্গে দাও); অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্ (যদি শ্রদ্ধার সঙ্গে দিতে না পার, তবে আদৌ দিও না); শ্রিয়া দেয়ম্ (শ্ৰীসম্পন্নভাবে দান কর); হ্রিয়া দেয়ম্ (নম্রতার সঙ্গে দান কর); ভিয়া দেয়ম্ (ভয়ের সাথে দান কর [পাছে গ্রহীতা ক্ষুণ্ণ হন]); সংবিদা দেয়ম্ (সদিচ্ছার সঙ্গে দান কর); অথ যদি তে কর্মবিচিকিৎসা বা বৃত্তবিচিকিৎসা বা স্যাৎ (নিজ কর্মের বা কর্ম পদ্ধতির ঔচিত্য বিষয়ে যদি তোমার সংশয় থাকে)।

যে তত্র ব্রাহ্মণাঃ সংমর্শিনঃ (সে সময়ে যদি সেখানে প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা থাকেন, যাঁরা); যুক্তাঃ (কর্তব্যপরায়ণ); আযুক্তাঃ (উচিত কর্ম সম্পাদনে আগ্রহী); অলূক্ষাঃ (দয়ালু); ধর্মকামাঃ (পুণ্যবান); স্যুঃ (উপস্থিত থাকেন); তে তত্র যথা বর্তেরন্ (তাঁরা ঐ কর্ম ও আচারে যেরকম রত থাকেন [তুমিও]); তত্র তথা বর্তেথাঃ (সেখানে সেইভাবেই আচরণ করো); অথ অভ্যাখ্যাতেষু (তখন যদি কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করেন যে ঐ সব ব্যক্তি কি আচরণ করছেন); যে তত্র ব্রাহ্মণাঃ সংমর্শিনঃ (সেখানে সে সময়ে যদি প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা থাকেন যাঁরা); যুক্তাঃ (কর্তব্যপরায়ণ); আযুক্তাঃ (উচিত কর্ম সম্পাদনে উৎসাহী); অলূক্ষাঃ (দয়ালু); ধর্মকামাঃ (পুণ্যবান); স্যুঃ (উপস্থিত থাকেন); তে তেষু যথা বৰ্তেরন্ (তাঁরা ঐ কর্ম ও আচরণে যে রকম রত থাকেন [তুমিও]); তথা তেষু বর্তেথাঃ (সেখানে সেই ভাবেই আচরণ করো); এষঃ আদেশঃ (এই হল নির্দেশ); এষঃ উপদেশঃ (এই হল উপদেশ); এষা বেদ-উপনিষৎ (এই হল বেদের শিক্ষা); এতৎ অনুশাসনম্ (এই হল অনুশাসন); এবম্ উপাসিতব্যম্ (এই হল আদর্শ); এবম্ উ চ এতৎ উপাস্যম্ (এটি অভ্যাস করা উচিত); ইতি একাদশঃ অনুবাকঃ (এখানে একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (২-৪) দেবতা ও পিতৃপুরুষের প্রতি নিজ কর্তব্যপালনে অবহেলা করো না। দেবতাজ্ঞানে মাতৃসেবা কর। দেবতাজ্ঞানে পিতৃসেবা কর। দেবতাজ্ঞানে অতিথি সৎকার কর। কেবলমাত্র সেই সব কাজই কর যা তুমি সঠিকভাবে করতে পারবে, আর অন্য সব কাজ পরিহার কর। যে সব ভাল কাজ আমরা (তোমার আচার্যরা) করি, তা তোমারও করা উচিত। কিন্তু এছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত কাজ আমরা করি (যা শাস্ত্র অনুমোদিত নয়) তা তোমার করা উচিত নয়। আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের নিজ আসন দান করবে এবং তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে লক্ষ্য রাখবে। শ্রদ্ধা সহকারে দান করবে। শ্রদ্ধা ছাড়া দান করো না। নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দান করবে। পাছে গ্রহীতা ক্ষুণ্ণ হন সেজন্য বিনয়, সম্ভ্রম এবং আন্তরিকতার সাথে দান করবে।

নিজ কর্ম বা কর্মপদ্ধতি (আচরণ) নিয়ে যদি কোন সংশয় জাগে তবে সেখানে যে সব ব্রাহ্মণেরা আছেন—যাঁরা জ্ঞানী, কর্তব্যপরায়ণ, কর্তব্যকর্ম করতে সদা আগ্রহী, দয়ালু এবং নিঃস্বার্থপর, তাঁদের কর্মরীতি অনুসরণ করো। আবার তাঁদের (সেই সকল ব্রাহ্মণের) কারোর আচরণ বিষয়ে কেউ যদি অভিযোগ বা সংশয় প্রকাশ করে তবে সেখানে যদি প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা থাকেন যাঁরা কর্তব্যনিষ্ঠ, যাঁরা স্বেচ্ছায় কর্তব্য কর্ম সম্পাদনে আগ্রহী, যাঁরা দয়ালু ও নিঃস্বার্থপর, তাঁরা যা করবেন তারই অনুসরণ করো। এই হল বেদের নির্দেশ, উপদেশ এবং বাণী। এ ঈশ্বরের আদেশ। এই হল আদর্শ। এই আদর্শ দ্বারাই তোমার নিজের জীবন গড়ে তোলা উচিত।

ব্যাখ্যা: তখনকার দিনে যাগযজ্ঞ করা গৃহীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে মনে করা হত। বিভিন্ন দেবদেবী ও পিতৃপুরুষের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। প্রতিদিন আমরা তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব এবং তাঁদের সম্মানার্থে আমরা উন্নত জীবন যাপন করব। দৃষ্টান্তস্বরূপ গুরু বলছেন: মনে কর তোমার পরিবারে একজন মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আশা করবেন তুমি সৎভাবে জীবন কাটাবে। কারণ পিতৃপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁদের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করা তো তোমার কর্তব্য। অনুরূপভাবে, নির্দিষ্ট কিছু দেবদেবী আছেন যাঁরা তোমার পরিবারের অভিভাবক। তোমাদের কাজকর্মের ওপর তাঁরা নজর রাখেন এবং তোমাদের সবসময় রক্ষা করেন। তোমরা অবশ্যই তাঁদের অসম্মান করবে না।

‘মাতৃদেবঃ ভব। পিতৃদেবঃ ভব।’ এখানে প্রথমেই ‘মা’কে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। ‘মা’কে অবশ্যই দেবীজ্ঞানে সেবা করবে। আবার পিতা এবং আচার্যকেও দেবতাজ্ঞানে পূজা করবে। পিতামাতা তোমাকে এই দেহ দিয়েছেন। কিন্তু আচার্য তোমাকে জ্ঞান দান করেছেন। তিনি তোমার মন-বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করেছেন। গৃহী হিসাবে অতিথিকে ভোজন করানো ও তার যথাসম্ভব আপ্যায়ন করাও তোমার কর্তব্য। গুরু আরো বলছেন, অতিথিকে দেবতাজ্ঞানে ও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আপ্যায়ন করবে।

এরপর উপনিষদ বলছেন, শুধুমাত্র সেইসব কর্মই করবে যা নিন্দনীয় নয় এবং দোষত্রুটিমুক্ত (অনবদ্যামি)। ‘নো ইতরাণি’—এছাড়া অন্য কর্ম করবে না। কেউ আপত্তি করতে পারে এমন কোন আচরণ করবে না। ‘অনবদ্য’ শব্দটির অপর অর্থ হল সুন্দর বা নিষ্কলঙ্ক। কেবলমাত্র ভাল কাজই আমাদের করা উচিত।

‘যানি অস্মাকং সুচরিতানি’। আচার্য বিনয়ের প্রতিমূর্তি। তিনি শিষ্যদের বলছেন: আমরা অনেক কিছু করে থাকি। কেবলমাত্র আমার গুণটিকে তুমি গ্রহণ করবে। কারণ আমারও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। শত হলেও আমি তো মানুষ। যদি আমি ভুল করি তবুও কি তুমি আমাকে অন্ধের মতো অনুকরণ করবে? তাই বলছি, নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে শুধু আমার ভাল কাজেরই অনুসরণ কর। ‘তানি ত্বয়া উপাস্যানি’—শুধুমাত্র এই সব কাজই তুমি কর। ‘নো ইতরাণি’—অন্য কিছু নয়। আচার্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করা উচিত। সাধারণত আচার্য যা করেন তোমারও তাই করা উচিত। কিন্তু আচার্য যদি ভুল করেন তবে তোমার সে কাজ করা উচিত নয়।

‘যে কে চ অস্মাৎ শ্রেয়াংসঃ ব্রাহ্মণাঃ’—মনে কর, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অথবা বিদ্যা ও নানা বিষয়ে তোমার চেয়ে পারদর্শী কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তোমার কাছে এসেছেন। তিনি হয়তো খুবই ক্লান্ত। তুমি তখন নিজের আসনটি ছেড়ে তাঁকে বসবার জন্য অনুরোধ করবে। অর্থাৎ তুমি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেবে।

‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম্’—শ্রদ্ধার সঙ্গে দান করবে। অশ্রদ্ধা বা অভক্তি ভরে কোন কিছু দেবে না। যদি কোন ব্যক্তিকে তুমি অসতর্কভাবে বা অশ্রদ্ধার সাথে কিছু দাও তবে গ্রহীতা আহত বা অপমানিত বোধ করবেন। যদি আন্তরিকতার সাথে দিতে না পার তবে বরং দান করো না। কারণ কিভাবে তুমি দান করছ তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাই আচার্য বললেন : ‘শ্রিয়া দেয়ম্’। আচার্য শঙ্করের মতে, দাতা তার সামর্থ্য অনুযায়ী মুক্তহস্তে দান করবে। এর আর একটি অর্থ হল দান যেন সুন্দরভাবে করা হয়। কারণ ‘শ্রিয়া’ শব্দটির আর একটি অর্থ হল সুন্দর। দাতা যখন কোন কিছু কাউকে দেবেন তখন তাঁর হাতের ভঙ্গি এমন সুন্দর হবে যাতে গ্রহীতা তা গ্রহণ করতে আনন্দ পায়। অর্থাৎ দানের ভঙ্গিতে যেন বিনয় ও আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। তুমি নিশ্চয় দেখেছ উপাসক সুন্দর ও নিখুঁতভাবে দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। ঠিক সেইভাবেই তুমি যেন ঈশ্বরকেই অর্ঘ্য দিচ্ছ এই মনোভাব নিয়ে দান করবে।

‘হ্রিয়া দেয়ম্’—লজ্জা ও বিনয়ের সাথে দান কর। এর চেয়ে আরো বেশী অথবা এর চেয়ে আরো ভাল জিনিস দিতে না পারার জন্য তুমি যেন লজ্জিত। কোন কিছু দেওয়ার সময় অনেকেরই দম্ভ প্রকাশ পায়। তোমার টাকাপয়সা চাই? আমার অনেক অর্থ আছে। চলে এসো। এইভাবে দান করা সঙ্গত নয়। বরং দাতার মনে করা উচিত: ‘আমি তাঁকে ঠিক জিনিসটি দিতে পারলাম তো? আমার এই দান যথেষ্ট হল তো?’

ব্ৰহ্মদেশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। তাঁরা ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে প্রতিটি বাড়ীর সামনে দাঁড়ান। তাঁরা আসার আগেই গৃহবধূরা অন্নপাত্র হাতে নিয়ে তাঁদের জন্য বাড়ীর বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। কি বিনয় আর শ্রদ্ধার সঙ্গেই না তাঁরা ভিক্ষাদান করেন। এতে তাঁরা দুজনেই আশীর্বাদ লাভ করেন। সুতরাং দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েই প্রসন্ন হন।

হিন্দুসমাজে দানের অন্যতম শর্ত হল নিঃশব্দে দান। তুমি কাউকে কিছু দিচ্ছ এ কথা যেন অন্য কেউ জানতে না পারে। এখানে একজন মানুষের কথা বলা হয়েছে যিনি গরীবদের সাহায্য করতে উদ্‌গ্রীব। তিনি দান করতে ভালবাসেন। কিন্তু অধিক পরিমাণে আরো উৎকৃষ্ট মানের জিনিস দিতে না পারার জন্য তিনি নিজেকে অপরাধী বলে মনে করবেন। একাজ তিনি সবার অগোচরে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেন। তিনি এসব কাজ কাউকে জানিয়ে করতে চান না। কিন্তু আবার এমনও মানুষ আছেন যাঁরা দান করেন এবং পরদিনই খবরের কাগজে দাতার তালিকায় নিজের নামটি দেখতে চান।

‘ভিয়া দেয়ম্’—সভয়ে দান কর। এখানে ‘ভয়’ কথাটি বলা হচ্ছে কেন? কারণ তুমি যেন ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছ, সেকথা ভেবে তুমি অবশ্যই সতর্ক থাকবে। আচার্য বলছেন, পাছে গ্রহীতা আহত বা ক্ষুণ্ণ হন, পাছে তুমি তাঁকে অমর্যাদার সাথে দান কর সেজন্য তুমি সবসময় সচেতন থাকবে অর্থাৎ শ্রদ্ধার সাথে দান করবে।

‘সংবিদা দেয়ম্’—আচার্য শঙ্করের মতে, ‘সংবিদা’ কথাটির অর্থ মৈত্রী। মৈত্রী বলতে সদিচ্ছা, বন্ধুত্ব বা প্রীতি বোঝায়। এখানে বোঝাতে চাইছেন, তুমি শুধু বস্তুটিকেই দান করছ না সেইসঙ্গে তোমার স্নেহ-ভালবাসাও তার প্রতি প্রকাশ পাচ্ছে।

অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সকলেই একথা বলতে পারি, যখন মা বা মায়ের মতো কোন প্রিয়জন আমাদের খেতে দেন তখন তা আমরা আনন্দ ও তৃপ্তির সঙ্গে গ্রহণ করি। আমজাদ নামে এক মুসলমান যুবক শ্ৰীশ্ৰীমা’র কাছে আসত। একদিন মায়ের নির্দেশমতো তাঁর ভাইঝি আমজাদকে খাবার পরিবেশন করছিল। একটু পরেই মা লক্ষ্য করলেন যে, ভাইঝি দূর থেকে ছুড়ে ছুড়ে আমজাদের থালায় খাবার দিচ্ছে। মা তাকে তিরস্কার করে বললেন : ‘ঐভাবে দিলে কেউ কি খেতে পারে?’ শুধু তাই নয়, তারপর তিনি নিজেই তাকে খেতে দিলেন।

‘বিচিকিৎসা’ কথাটির অর্থ সংশয়। ধরা যাক, নিজের কর্ম বা আচরণ (বৃত্তি) নিয়ে তোমার মনে কোন সংশয় উপস্থিত হয়েছে। তুমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছ না, কোন্‌টি তোমার করা উচিত আর কোন্‌টি উচিত নয়। তুমি তখন কি করবে? আচার্য বলছেন, যাঁরা চিন্তাশীল ব্যক্তি তাঁরা নিজেদের বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করেন। তাঁরা কেবলমাত্র ভাল কাজ করেন। কারণ ভাল কাজ করতেই তাঁদের আনন্দ। তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করেন, কোন জোরের কাছে তাঁরা নতি স্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁরা ‘অলূক্ষা’—নম্র ও শান্ত, কখনই রূঢ় বা উদ্ধত নন। তাঁরা হবেন ‘ধর্মকামাঃ’ অর্থাৎ ধার্মিক। আচার্য বলছেন, তোমার কি করণীয় তা যদি বুঝতে না পার তবে মহত্ত্বে ও মেধায় যিনি তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাঁকে অনুসরণ কর।

সবশেষে আচার্য বলছেন—আমি তোমাকে যা কিছু শিখিয়েছি এই হল তার সারকথা। এই নির্দেশই শাস্ত্রের ও গুরুবাক্যের মূলভিত্তি। তুমি এখন গার্হস্থ জীবনে প্রবেশ করতে চলেছ। সুতরাং এই সব নির্দেশ তোমার পালন করা কর্তব্য।

দ্বাদশ অধ্যায়

শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ। শং নো ভবত্বর্যমা। শং ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ। শং নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ। নমো ব্ৰহ্মণে। নমস্তে বায়ো। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাবাদিষম্। ঋতমবাদিষম্। সত্যমবাদিষম্। তন্মামাবীৎ। তদ্বক্তারমাবীৎ। আবীন্মাম্। আবীদ্ বক্তারম্। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥১॥ ইতি দ্বাদশোঽনুবাকঃ।

(এই প্রার্থনা প্রথম অধ্যায়ের প্রার্থনার অনুরূপ। পার্থক্য হল: এই শ্লোকের শেষের ক্রিয়াপদগুলিতে অতীতকাল ব্যবহার করা হয়েছে)

মিত্র অর্থাৎ সূর্যদেব আমাদের কল্যাণ করুন। বরুণ আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। অৰ্যমন (সূর্য ও চক্ষুর দেবতা) আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। ইন্দ্র আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। বিষ্ণু যিনি দীর্ঘ পদক্ষেপে চলেন তিনি আমাদের প্রতি অনুকূল হোন। ব্রহ্মকে নমস্কার। হে বায়ু আপনাকে নমস্কার করি। আপনি ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নন। আমি ঘোষণা করেছি, ‘আপনিই প্রকৃত ব্রহ্ম’। আমি আরো বলেছি, ‘আপনি ঋতস্বরূপ, আপনিই স্বয়ং সত্য।’ বায়ুরূপে ব্ৰহ্ম আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনি আচার্যকেও রক্ষা করেছেন। আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনি আচার্যকে রক্ষা করেছেন। শান্তি! শান্তি! শান্তি!

॥শীক্ষাবল্লী এখানেই সমাপ্ত॥

দ্বিতীয় খণ্ড – ব্রহ্মানন্দবল্লী

প্রথম অধ্যায়

ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।

তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ॥

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

অন্বয়: [ব্রহ্ম] নৌ (আমাদের অর্থাৎ গুরু ও শিষ্য উভয়কে); সহ (সমানভাবে); অবতু (রক্ষা করুন); নৌ (উভয়কে); সহ (সমভাবে); ভুনক্তু (বিদ্যার সুফল প্রদান করুন [অর্থাৎ গ্রহণ করার যোগ্যতা দান করুন]); সহ (সমানভাবে); বীর্যম্ ([বিদ্যালাভের] সামর্থ্য, শক্তি); করবাবহৈ ([যেন] লাভ করতে পারি); নৌ (আমাদের দুজনের); অধীতম্ (লব্ধবিদ্যা); তেজস্বি (বীর্যশালী, ফলপ্রসূ); অস্তু (হোক); মা বিদ্বিষাবহৈ (পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত না হই); শান্তিঃ (আধ্যাত্মিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শান্তি]); শান্তিঃ (আধিদৈবিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ পরিবেশ বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার শান্তি]); শান্তিঃ (আধিভৌতিক বিঘ্নের শান্তি হোক [অর্থাৎ হিংস্র প্রাণী প্রভৃতি-কৃত বিঘ্নের শান্তি])।

সরলার্থ: ব্রহ্মের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন গুরু ও শিষ্য আমাদের উভয়কেই সমানভাবে রক্ষা করেন। আমরা উভয়ে যেন সমানভাবে এই জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আমরা উভয়েই এই বিদ্যা লাভের জন্য যেন কঠোর পরিশ্রম করি। আমাদের শিক্ষা যেন সমানভাবে আমাদের কাছে ফলপ্রসূ হয়। পরস্পরের প্রতি আমাদের যেন বিদ্বেষ না থাকে। ওঁ শান্তি! শান্তি! শান্তি!

ব্যাখ্যা: গুরু এবং শিষ্য উভয়ে প্রার্থনা করছেন : অনুগ্রহ করে আমাদের উভয়কে রক্ষা করুন।

সহ নৌ ভুনক্তু—আমরা যেন সমানভাবে এই জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আবার যা শিখলাম তার তাৎপর্যও যেন সমানভাবে ধরতে পারি। এই বিদ্যার সর্বাধিক সুফল আমরা উভয়ে যেন সমানভাবে লাভ করি। ‘ভুনক্তু’ শব্দটি এসেছে ‘ভুজ্’ ধাতু থেকে। ‘ভুজ’ অর্থ হল ‘উপভোগ করা’। উপনিষদ পাঠ আমরা যেন একসঙ্গে উপভোগ করতে পারি।

সহ বীর্যং করবাবহৈ—আমাদের সমানভাবে বলিষ্ঠ করুন, সমান কর্মদক্ষতা দিন যাতে সম্পূর্ণভাবে আমরা নিজেদের শাস্ত্রপাঠে নিয়োগ করি।

তেজস্বি নৌ অধীতম্ অস্তু—আমরা যেন পরিপূর্ণ উৎসাহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে শাস্ত্র অধ্যয়নে যত্নবান হই। আমাদের ধারণাশক্তি যেন গভীর হয়। আমাদের অধীত বিদ্যা যেন সমানভাবে আমাদের কাছে ফলপ্রসূ হয়।

মা বিদ্বিষাবহৈ—আমরা যেন পরস্পরের প্রতি কোন বিদ্বেষ পোষণ না করি। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মধ্যে কখনও কখনও সংঘর্ষ বা তিক্ততা এসে পড়তে পারে। তাই এই প্রার্থনা—আমাদের সম্পর্ক যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়। গুরু-শিষ্য সম্পর্ক যদি আন্তরিক হয়, পরস্পরের প্রতি যদি শ্রদ্ধা ও অনুরাগ থাকে তাহলে শিষ্যের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। শিষ্য যদি উদাসীন হন তাহলে গুরু কিভাবে শিক্ষা দেবেন? সেক্ষেত্রে শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। আবার মেধাবী শিষ্যের কঠিন প্রশ্নের উত্তর গুরু যদি দিতে না পারেন? সেক্ষেত্রে শিষ্যের প্রতি গুরুর ঈর্ষা হতে পারে। তাই গুরু-শিষ্যের মিলিত প্রার্থনা : আমাদের সম্পর্ক সুন্দর হোক। পরস্পরের প্রতি যেন আমাদের অনুরাগ থাকে। পরস্পরকে যেন আমরা সাহায্য করতে পারি।

ওঁ ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্। তদেষাঽভ্যুক্তা। সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। যো বেদ নিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোমন্। সোঽশ্নুতে সর্বান্ কামান্ সহ। ব্ৰহ্মণা বিপশ্চিতেতি।

তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সংভূতঃ। আকাশাদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ। অদ্‌ভ্যঃ পৃথিবী। পৃথিব্যা ওষধয়ঃ। ওষধীভ্যোঽন্নম্। অন্নাৎপুরুষঃ। স বা এষ পুরুষোঽন্নরসময়ঃ। তস্যেদমেব শিরঃ। অয়ং দক্ষিণঃ পক্ষঃ। অয়মুত্তরঃ পক্ষঃ। অয়মাত্মা। ইদং পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি প্রথমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: ব্রহ্মবিৎ পরম্ আপ্নোতি (ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি পরব্রহ্মকে লাভ করেন); তৎ এষা অভ্যুক্তা (এ বিষয়ে একটি ঋক্-মন্ত্রে এই কথাই আছে), সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম (ব্রহ্ম সত্য [অর্থাৎ নিত্য], জ্ঞান-স্বরূপ ও অনন্ত); যঃ পরমে ব্যোমন্ গুহায়াং নিহিতং বেদ (হৃদয়স্থ পরম আকাশে বুদ্ধিরূপ গুহায় নিহিত [ব্রহ্মকে] যিনি জানেন); সঃ অশ্নুতে (তিনি ভোগ করেন); সর্বান্ কামান্ (সকল ভোগ্য বস্তু); বিপশ্চিতা ব্ৰহ্মণা সহ (সর্বজ্ঞ ব্রহ্মের সঙ্গে)।

তস্মাৎ বৈ এতস্মাৎ আত্মনঃ (সেই আত্মা থেকে [তথা ব্রহ্ম থেকে]); আকাশঃ সম্ভূতঃ (আকাশের উদ্ভব); আকাশাৎ (আকাশ থেকে); বায়ুঃ ([এল] বাতাস), বায়োঃ অগ্নিঃ (বায়ু থেকে [এল] অগ্নি); অগ্নেঃ (অগ্নি থেকে); আপঃ (জল); অদ্‌ভ্যঃ (জল থেকে); পৃথিবী (পৃথিবী); পৃথিব্যাঃ (পৃথিবী থেকে); ওষধয়ঃ (উদ্ভিদ ও গুল্ম); ওষধিভ্যঃ (উদ্ভিদ ও গুল্ম থেকে); অন্নম্ (খাদ্য); অন্নাৎ (খাদ্য থেকে); পুরুষঃ (মানুষ); সঃ বৈ এষঃ পুরুষঃ অন্ন-রস-ময়ঃ (সেই পুরুষ খাদ্যজাত বস্তু); তস্য ইদম্ এব শিরঃ (এই সেই মানুষের মস্তক); অয়ং দক্ষিণঃ পক্ষঃ (এই [অর্থাৎ দক্ষিণ বাহু হল] ডান দিকের ডানা), অয়ম্ উত্তরঃ পক্ষঃ (এই [বাম বাহু] হল বাম পক্ষ); অয়ম্ (এই [দেহের মধ্য অংশ]); আত্মা (আত্মা [দেহের কেন্দ্রীয় অংশ]); ইদম্ (এই [দেহের নিম্নাংশ]); পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা (পুচ্ছ বা লেজ যা ধারণ করে); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে); ইতি প্রথমঃ অনুবাকঃ (এখানে প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি বস্তুত পরব্রহ্মকে জানেন। এই বিষয়ে একটি মন্ত্র আছে: ‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম্ ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। আমাদের গুহারূপ হৃদয়াকাশে (অর্থাৎ বুদ্ধিতে) তাঁর অধিষ্ঠান। যিনি হৃদয়ে এই আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তিনি যে শুধু সর্বজ্ঞ ব্রহ্মকেই উপলব্ধি করেন তা নয় তিনি যা কামনা করেন তাই লাভ করেন।

এই আত্মা থেকে আসে আকাশ। আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম, উদ্ভিদাদি থেকে খাদ্য এবং খাদ্য থেকে আসে মানুষ। বস্তুত মনুষ্যদেহ খাদ্য থেকেই উৎপন্ন। মানুষের মাথা আছে। তার ডান হাত হল (পাখীর) ডান দিকের ডানা, বাঁ হাত বাঁ দিকের ডানা; দেহের উপরিভাগ হল (পাখীর) শরীর এবং নিম্নভাগ হল পুচ্ছ বা লেজ যা দেহকে ধারণ করে রাখে। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে জানতে আমরা সচেষ্ট হব কেন? ব্রহ্মকে জানলে আমাদের কি সুবিধে হবে? উত্তর হল, ‘ব্রহ্মবিৎ আপ্নোতি পরম্’, যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি সর্বোচ্চকে লাভ করেন। এ-ই হল পরম প্রাপ্তি। উপনিষদ এখানে আমাদের যেন প্ররোচিত করছেন।

প্রাচীন সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন : ব্রহ্ম হল ‘সত্যং জ্ঞানম্‌ অনন্তম্’। এগুলি ব্রহ্মের গুণ নয়। বস্তু ও বস্তুর ধর্ম দুটি আলাদা জিনিস। যেমন, আমরা বলতে পারি ‘এই একটি সাদা ফুল’— ধবলত্ব একটি গুণ যা ফুলের উপর আরোপ করা হল। এই ধবলত্ব অন্য যে কোন বস্তুর উপর আরোপ করা যেতে পারে। আবার এই ফুলটা সাদা হলেও আর একটি ফুল লাল হতে পারে। এই সব বিশেষণ কিন্তু ব্রহ্মকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। ব্রহ্মের স্বরূপই হল সত্য, জ্ঞান এবং অনন্ত।

এর অর্থ এই নয় যে, ব্রহ্ম একসময় সত্য, একসময় জ্ঞান এবং আর একসময় অনন্ত। না, তা নয়। ব্রহ্ম একযোগে সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত।

মানুষ সীমিত মনের অধিকারী। এই সসীম মন নিরাকার, ইন্দ্রিয়াতীত, এবং অসীম কোন কিছুকে ধারণা করতে পারে না। সেইজন্য ব্রহ্মকে বোঝাতে আমরা কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আমরা সবসময় জানি ব্রহ্মকে কোন শব্দ দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না।

কিন্তু এই ব্রহ্ম কোথায় আছেন? ‘নিহিতং গুহায়াম্’—এখানে গুহা মানে হৃদয়। গুহার ভিতরে কিছু থাকলে তা যেমন বাইরে থেকে দেখা যায় না, ব্রহ্মও তেমনি হৃদয়গুহায় লুকিয়ে আছেন। তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা, সর্ববস্তুর সারাৎসার। শঙ্করাচার্য বলেন, ‘গুহা’ বলতে বুদ্ধিকেও বোঝায়, কারণ বুদ্ধির দ্বারাই আমরা সব কিছু ধারণা করতে পারি।

‘নিহিতম্’ শব্দটির দুটি অর্থ। ‘হিতম্’ অর্থ ‘বাস করা’; আর ‘নি’ শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর একটি অর্থ হতে পারে নিত্য, শাশ্বত; শুধু বর্তমান বা এই মুহূর্তের জন্য নয়। তিনি হৃদয়ে সর্বদা রয়েছেন। সর্বভূতের অন্তরাত্মা রূপে তিনি নিত্য বিরাজমান। ‘নি’ শব্দটির আর একটি অর্থ হল ‘নিগূঢ়ত্বেন’—গূঢ়ভাবে, অতল গভীরে। তিনি সকল বস্তুর অন্তরতম সত্তা। হৃদয়ের নিভৃততম প্রদেশে তিনি বিরাজ করেন। ব্রহ্মাকে ছাড়া আমাদের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই।

‘গুহা’ তথা হৃদয়কে পরম ব্যোমও বলা হয়। ‘ব্যোম’ কথাটির অর্থ আকাশ। ভিতরে ও বাইরে একই আকাশ। আমরা অনেক সময় হৃদয়াকাশের কথা উল্লেখ করে থাকি। ব্রহ্মকে আমরা কোথায় উপলব্ধি করি? ব্রহ্ম কি আমার থেকে আলাদা কোন বস্তু যাকে আমি দেখতে পাই বা স্পর্শ করতে পারি? না। ব্রহ্ম আমার অন্তরে, আমার হৃদয়ে রয়েছেন। হৃদয়কে ‘পরম’ও বলা হয়ে থাকে। পরম অর্থ সর্বোচ্চ, পবিত্র। ব্রহ্মের পবিত্র উপলব্ধি প্রথমে এই হৃদয়েই হয়ে থাকে। এই উপলব্ধি হলে বুঝতে পারি ভিতরে যে আকাশ বাইরেও সেই একই আকাশ। অর্থাৎ তখন আমরা সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন বোধ করি।

‘সর্বান্ কামান্ অশ্নুতে’—যখন মানুষের ব্রহ্ম উপলব্ধি হয় তখন সবকিছুর মধ্যেই তিনি আনন্দ উপভোগ করেন। যেখানে যত আনন্দ আছে সব একত্র করেও এই আনন্দের সঙ্গে তুলনা হয় না। এই অভিজ্ঞতা হলে সাধক তার সত্তার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পূর্ণতা বোধ করেন। শঙ্করাচার্য বলেন, এটি ক্রমিক প্রক্রিয়া নয়। এমন নয় যে, একটা আনন্দের পর আর একটা আনন্দ আসে। এই অভিজ্ঞতা হলে সাধক সহসা আনন্দে প্লাবিত হয়ে যান।

একটা উজ্জ্বল আলো যদি পরপর কয়েকটি আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে তাহলে আলোটিকে অত্যন্ত ক্ষীণ দেখায়। আমাদের বর্তমান অবস্থাও সেইরকম। আমরা এখন শরীর ইত্যাদি বিভিন্ন কোষের সঙ্গে নিজেদের অভিন্ন বোধ করি। তাই আমাদের আনন্দ-অনুভব নামে মাত্র। কিন্তু কোনভাবে এই সব আবরণ ভেদ করে গেলে আমরা হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে যাব। ব্রহ্ম তথা আত্মা আমাদের অন্তরে জ্বলজ্বল করছেন। তার আলো বর্তমানে নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। ব্রহ্মকে উপলব্ধি করলে আমরা লাভ করব অসীম ব্রহ্মানন্দ। তখন যে আনন্দ অনুভব করি তাতে আমরা অভিভূত হয়ে যাই। যেখানে যত আনন্দ আছে সব তখন এই ব্রহ্মানন্দে মিলে যায়।

এরপর উপনিষদ এই জগৎ বিবর্তনের বর্ণনা দিচ্ছেন—কিভাবে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল জগতের বিবর্তন হল। প্রথমে এক ব্রহ্ম, সর্বব্যাপী। তখন নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম—নামরূপহীন, অনির্বচনীয়। ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ হল আকাশ। আকাশও সর্বব্যাপী। তারপর আকাশ থেকে আসে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, এবং জল থেকে এই পৃথিবী।

পৃথিবী থেকে জন্মায় ওষধি (শস্য)। ওষধি থেকে অন্ন। তারপর জীবের (পুরুষ) প্রকাশ। খাদ্যই আগে আসে কারণ খাদ্য ছাড়া কোন প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। শরীরকে বলা হয় অন্নরসময়, খাদ্যের সারপদার্থ দিয়ে তৈরী। শরীর খাদ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই খাদ্য শুক্রবীজাকারে পিতা থেকে সন্তানে সঞ্চারিত হয়। তার থেকেই দেহ গঠিত হয়। এই দেহকে ছাঁচে ঢালা গলানো তামার সঙ্গেও তুলনা করা হয়। কারণ, আমরা আমাদের পিতা-মাতারই প্রতিচ্ছবি। পিতামাতা থেকে যে খাদ্যবীজ আসে তাই হল গলিত তামা।

শঙ্করাচার্য বলেন, এখানে ‘পুরুষ’ শব্দটির দ্বারা মানুষ বোঝানো হয়েছে। কারণ, জীবজগতে মানুষের স্থান সর্বোচ্চ। তাঁর মতে মানুষ দুটি ব্যাপারে পশুর থেকে আলাদা—জ্ঞান এবং কর্মে। আমাদের ধারণাশক্তি আছে, আমরা শিখতে পারি এবং পরবর্তী প্রজন্মে সেই জ্ঞান পৌঁছেও দিতে পারি। তাছাড়া আমরা ভালমন্দ বিচার করতে পারি। ‘এটি করব আর ওটি করব না’—এই সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি।

এরপর উপনিষদ মানুষের দেহকে পাখীর সঙ্গে তুলনা করছেন। হয়তো বিবর্তনের কোন এক পর্যায়ে আমরা পাখী ছিলাম। আমাদের দুই হাত পাখীর দুটি ডানার সঙ্গে এবং শরীরের নিম্নভাগ পাখীর লেজ বা পুচ্ছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। লেজ ছাড়া পাখী উড়তে পারে না। তাই পাখীর লেজ তথা পুচ্ছকে বলা হয় ‘প্রতিষ্ঠা’ অর্থাৎ আশ্রয়। পাখীর দেহও বিমানের মতো ভারসাম্য নির্ভর। বিমানের পাখা বা লেজ না থাকলে বিমানও উড়তে পারে না।

এই হল মানুষের দেহ অর্থাৎ অন্নময় কোষের বর্ণনা।

দ্বিতীয় অধ্যায়

অন্নাদ্বৈ প্রজাঃ প্রজায়ন্তে। যাঃ কাশ্চ পৃথিবীংশ্রিতাঃ। অথো অন্নেনৈব জীবন্তি। অথৈনদপি যন্ত্যন্ততঃ। অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে। সর্বং বৈ তেঽন্নমাপ্নুবন্তি। যেঽন্নং ব্রহ্মোপাসতে। অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে। অন্নাদ্ ভূতানি জায়ন্তে। জাতান্যন্নেন বর্ধন্তে। অদ্যতেঽত্তি চ ভূতানি। তস্মাদন্নং তদুচ্যত ইতি।

তস্মাদ্বা এতস্মাদন্নরসময়াৎ। অন্যোঽন্তর আত্মা প্রাণময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ। স বা এষ পুরুষবিধ এব। তস্য পুরুষবিধতাম্। অন্বয়ং পুরুষবিধঃ। তস্য প্রাণ এব শিরঃ। ব্যানো দক্ষিণঃ পক্ষঃ। অপান উত্তরঃ পক্ষঃ। আকাশ আত্মা। পৃথিবী পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি দ্বিতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: যাঃ কাঃ চ প্রজাঃ পৃথিবীং শ্রিতাঃ (জগতের যত প্রাণী); অন্নাৎ বৈ প্রজায়ন্তে (তারা সকলেই খাদ্য থেকে উৎপন্ন); অথ অন্নেন এব জীবন্তি (তারা সকলেই খাদ্যের দ্বারা পুষ্ট); অথ (অধিকন্তু); অন্ততঃ (পরিশেষে, মৃত্যুকালে); এনৎ অপিয়ন্তি (তারা এতে [খাদ্যে] লীন হয়ে যায়); হি (কারণ); অন্নম্ [এই] খাদ্য), ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্ (প্রাণিকুলের অগ্রদূত); তস্মাৎ (সেইজন্য) সর্বৌষধম্ উচ্চতে ([খাদ্য] সকল ব্যাধির [ক্ষুধা ইত্যাদির] ঔষধ বলা হয়ে থাকে); যে (যে সব ব্যক্তি); অন্নং ব্রহ্ম উপিসতে (খাদ্যরূপে ব্রহ্মকে উপাসনা করেন [অর্থাৎ সকল বস্তুর উৎস, আশ্রয় ও গতিরূপে]); তে (তাঁরা); সর্বম্ অন্নম্ বৈ আপ্নুবন্তি (যাবতীয় খাদ্য (অর্থাৎ সকল ভোগ্যবস্তু] প্রাপ্ত হন); হি (যেহেতু); অন্নং ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্ (প্রাণিকুলের পূর্বে খাদ্য আসে); তস্মাৎ সর্বৌষধম্ উচ্যতে (সে জন্য তাকে বলা হয় প্রাণিকুলের সকল ব্যাধির প্রতিকার [সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আয়ত্ত করার মতো]); অন্নাৎ ভূতানি জায়ন্তে (প্রাণী উৎপন্ন হয় খাদ্য থেকে); জাতানি অন্নেন বর্ধন্তে (জন্মের পর তারা খাদ্যের দ্বারা বর্ধিত হয়); অদ্যতে (খাদ্য প্রাণিকুলের ভক্ষ্য); চ ভূতানি অত্তি (প্রাণিকুল আবার খাদ্যের [তথাকথিত খাদ্য] ভক্ষ্য); তস্মাৎ (সেইজন্য); তৎ অন্নম্ উচ্যতে ইতি (একে অন্ন [তথা খাদ্য] বলা হয় [অন্ন শব্দটির মূল ধাতু হল ‘অদ্’, যার অর্থ ‘ভোজন করা’])।

তস্মাৎ বৈ এতস্মাৎ অন্নরসময়াৎ অন্যঃ (উপরোক্ত অন্নময় কোষ থেকে স্বতন্ত্র [কিন্তু]); অন্তরঃ (সেই দেহের ভিতরে); প্রাণময়ঃ (বায়ুরূপে); আত্মা (যাকে তোমার নিজ আত্মার অংশ রূপে অনুভব কর [এটি পৃথক কোষের মতো]); তেন (এর [বায়ুর কোষ তথা প্রাণময় কোষ] দ্বারা); এষঃ (এই [স্থূল-শরীর তথা অন্নময় কোষ]); পূর্ণঃ (পূর্ণ); সঃ বৈ এষঃ (এই [প্রাণময় কোষ]); পুরুষবিধঃ এব (মানবদেহ সদৃশ [সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহ সম্পূর্ণ]); তস্য (তার [স্থূলশরীরের]); পুরুষবিধতাম্ (মানবদেহ রূপে); অনু (প্রতিরূপ); অয়ম্ (এই প্রাণময় কোষ); পুরুষবিধঃ (মানুষের শরীররূপে); তস্য (তার [প্রাণময় কোষের]); প্রাণঃ এব (শ্বাসবায়ু [যা মুখবিবর ও নাসারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে বয়]); শিরঃ (মস্তক); ব্যানঃ দক্ষিণঃ পক্ষঃ (ব্যান [সমগ্র দেহব্যাপী যে বায়ু] হল ডান পাখা); অপানঃ উত্তরঃ পক্ষঃ (অপান [নিঃশ্বাস বায়ু, যা ত্যাগ করা হয়] হল বাম পাখা); আকাশঃ আত্মা (আকাশ [অর্থাৎ সমান বায়ু বা খাদ্য জীর্ণকারী শ্বাসবায়ু] হল দেহের মধ্যভাগ); পৃথিবী (দেহের আশ্রয় যে দেবতা [অর্থাৎ উদান বা যে বায়ু শরীরের ঊর্ধ্বগমন প্রতিরোধ করে]); পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা (লেজ যা দেহের ভারসাম্য বজায় রাখে); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে); ইতি দ্বিতীয়ঃ অনুবাকঃ (এখানে দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: এই জগতে যত প্রাণী আছে সব খাদ্য থেকে উৎপন্ন। খাদ্যের দ্বারা তারা পুষ্ট হয় এবং অন্তে তারা খাদ্যেই বিলীন হয়। এর কারণ প্রাণীর আগে খাদ্য আসে। সেইজন্য খাদ্যকে জীবের সকল রোগের ঔষধ বলা হয়। যাঁরা খাদ্যকে ব্রহ্মরূপে (অর্থাৎ সবকিছুর উৎস, প্রতিষ্ঠা এবং গন্তব্যরূপে) উপাসনা করেন তাঁরা যাবতীয় খাদ্যই প্রাপ্ত হন। প্রাণীর আগে খাদ্যের সৃষ্টি। তাই খাদ্যকে সকল প্রাণীর ঔষধ বলা হয়। অন্ন থেকে জীবের জন্ম আবার অন্নের দ্বারাই জীব পুষ্ট হয়। অন্ন প্রাণীদের খাদ্য আবার এই অন্নও প্রাণীদের খায়। এইজন্যই খাদ্যকে বলা হয় অন্ন অর্থাৎ যা আহার করে।

খাদ্য দ্বারা গঠিত যে আত্মার (অন্নময় কোষ) কথা আগে বলা হয়েছে তার থেকে স্বতন্ত্র আর এক আত্মা আছে। অন্নময় কোষের অভ্যন্তরে তাকে বলা হয় প্রাণময় কোষ (এটি বায়ুর দ্বারা গঠিত এবং কোষরূপে রয়েছে)। এই কোষ অন্ননির্মিত স্থূলদেহকে পূর্ণ করে থাকে এবং তার নিজের আকারও মানুষের মতো। মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট এই প্রাণময় কোষ অন্নময় কোষেরই প্রতিচ্ছবি। প্রাণবায়ু (যে শ্বাসবায়ু আমরা গ্রহণ করি) তার মাথা; ব্যান বায়ু (সমগ্র দেহে যা ছড়িয়ে আছে) হল ডান দিকের ডানা বা দক্ষিণ পক্ষ; অপান বায়ু (যে নিঃশ্বাস আমরা ছাড়ি) বাঁ দিকের ডানা বা বাম পক্ষ; আকাশ (অর্থাৎ সমান বায়ু যা খাদ্য পরিপাক করে) দেহের মধ্যভাগ এবং পৃথিবী (অর্থাৎ উদান যা দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে) হল পুচ্ছ। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: সকল প্রাণীর উৎপত্তি খাদ্য থেকে এবং খাদ্যের দ্বারাই তারা পুষ্ট। খাদ্য ব্যতীত আমাদের অস্তিত্ব অসম্ভব। ভারতে বর্তমানে বাঘ প্রভৃতি নানা প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে কারণ তারা খাদ্য পায় না। প্রাণীর বংশবৃদ্ধি এবং বংশ পরম্পরা খাদ্যের জন্যই সম্ভব হয়ে থাকে।

আবার মৃত্যুর পর আমরাও খাদ্য হয়ে যাই। পোকামাকড় ও অন্যান্য জীব আমাদের দেহটাকে খেয়ে ফেলে। খাদ্য থেকে আমরা এসেছি, খাদ্যের দ্বারা পুষ্টিলাভ করেছি আবার খাদ্যেই ফিরে যাই। এইভাবে বৃত্তাকারে চলতে থাকে।

খাদ্যকে বলা হয় ‘জ্যেষ্ঠম্‌’, সকল বস্তুর আদি কারণ। খাদ্য থাকলে তবেই প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব। ‘ভূতানাম্’ এর অর্থ হল জীবকুল। হিন্দুশাস্ত্রমতে চার প্রকার জীব আছে: জরায়ুজ—যারা মাতৃগর্ভজাত; অণ্ডজ—যারা ডিমজাত; স্বেদজ—যারা স্বেদ বা আর্দ্রতা জাত (মশা জাতীয় কীটকে সেকালে সরাসরি জল থেকে উৎপন্ন বলে মনে করা হত) এবং উদ্ভিজ্জ—উদ্ভিদ যা পৃথিবী থেকে জাত। এই সব শ্রেণীর জীবেরই প্রয়োজন হল খাদ্য। অন্যথায় এদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না।

খাদ্যকে ‘সর্বৌষধম্’ও বলা হয়, কারণ সকল জীবের পক্ষে খাদ্যই সর্বরোগহর। খাদ্য আমাদের ক্ষুধা-পিপাসা মেটায়, আমাদের স্বস্তি দান করে।

ধরা যাক কোন ব্যক্তি অন্নকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে। এর অর্থ হল সেই ব্যক্তি শরীরের ভজনা করে। কিছু মানুষ তাদের শরীর নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তাদের কাছে দেহই পরম এবং একমাত্র সত্য। এমন মানুষের কি হয়? যার যা ভাব সে তাই পায়। দেহের ভজনা করলে সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহ লাভ হয়। দেহের অতিরিক্ত কিছু যদি আমি না জানি তবে স্বভাবতই আমার সকল উন্নতি হবে দেহকে কেন্দ্র করে।

কিন্তু উপনিষদ আদৌ শরীরকে ব্রহ্মরূপে ধ্যান করার কথা কেন বলছেন? শঙ্করাচার্য বলেন, কোন একটি জায়গা থেকে আমাদের শুরু করতে হবে। প্রতিটি কোষই ব্রহ্ম, কিন্তু পরব্রহ্ম নয়। স্থূলশরীর থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে সাধকের উত্তরণ ঘটে। তখন স্থূলদেহ থেকে সূক্ষ্মদেহে, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দেহে সাধক এগোতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মার সাক্ষাৎকার হয়।

খাদ্যকে অন্ন বলা হয় কেন? অন্ন শব্দটি এসেছে ‘অদ্’ ধাতু থেকে, যার অর্থ হল ‘আহার করা’। উপনিষদ বলেন, আমরা খাদ্য খাই, খাদ্যও আমাদের খায়। খাদ্য খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি আবার আমরাই অন্যের খাদ্যে পরিণত হই।

এই শরীরকে বলা হয় ‘অন্নরস’, খাদ্যের সার, কারণ এই শরীর খাদ্যেরই রূপান্তর মাত্র। আমরা যা খাই তা রক্ত মাংস হাড় ইত্যাদিতে পরিণত হয়। অন্নময় কোষকে স্থূলশরীরও বলা হয়। এই স্থূলশরীরের অভ্যন্তরে থাকে সূক্ষ্মশরীর। সূক্ষ্মশরীরে কতগুলি কোষ থাকে। প্রথমটিকে বলা হয় প্রাণময় কোষ যা প্রাণ অর্থাৎ প্রাণবায়ু দিয়ে তৈরী। পরবর্তী হল মনোময় কোষ, যা মনের স্তর এবং সবশেষে বিজ্ঞানময় কোষ, যা বুদ্ধির স্তর। এইভাবে স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যেতে থাকে। অবশেষে এই সূক্ষ্মদেহকেও অতিক্রম করে সূক্ষ্মতর অবস্থা বা আনন্দময় কোষ, যা আনন্দের স্তর।

বস্তুত এসব কোষ আমাদেরই ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন স্তর। কখনও আমাদের অবস্থান স্থূলশরীরে। তখন আমরা ভাল খাদ্য গ্রহণ করে আনন্দ পাই। কখনও বা আমরা থাকি মনের স্তরে—তখন আমরা চিন্তাশীল এবং কল্পনাপ্রবণ। আবার কখনও আমরা থাকি বুদ্ধির স্তরে। তখন আমাদের বই ভাল লাগে, বিদ্যার প্রতি অনুরাগ জাগে। তবে এইসব স্তরে থাকার জন্য আমাদের বাহ্যবস্তুর উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু যখন আমরা আনন্দময় কোষে থাকি তখন শুধুই আনন্দ। এই স্তরে আমরা দেহ, মন বা বুদ্ধি সম্পর্কে সচেতন থাকি না। এই আনন্দ বাইরের কোন বস্তুর উপর নির্ভর করে না। আমরা তখন সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন।

যখন কেউ বলে ভূত দেখেছে তখন আসলে সে কারো সূক্ষ্মশরীর দেখেছে। প্রেত মাত্রেই ক্ষতিকারক নয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ যখন বৃন্দাবনে ছিলেন তখন মধ্যরাত্রে শয্যাত্যাগ করে তিনি ধ্যান করতেন। তখন দেখতেন এক ঋষির প্রেতও তাঁর পাশে বসে ধ্যান করত। একদিন রাত্রে তাঁর ঘুম ভাঙ্গেনি। সেই প্রেতটি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বলছে, ‘ওঠ, ধ্যানের সময় হয়েছে।’

উপনিষদ এখন প্রাণময় কোষ নিয়ে আলোচনা করছেন। স্থূলশরীরের অভ্যন্তরে কিন্তু স্থূলশরীর থেকে স্বতন্ত্রভাবে এই কোষের অবস্থান। এটি জীবাত্মার মতো, স্থূলশরীরের আত্মস্বরূপ।

এই প্রাণ যে কেবল দেহের একটি মাত্র অংশে রয়েছে তা নয়। এর অবস্থান দেহের সর্বত্র, সর্বাংশে। এ দেহ প্রাণবায়ুতে পূর্ণ। আচার্য শঙ্কর একে হাপরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কামার যখন কিছু গলাতে চায় তখন সে হাপরের সাহায্যে হাওয়া করে, যাতে আগুন ভালভাবে জ্বলতে পারে। হাওয়া হাপরের সর্বাংশে ভরে থাকে। সেইরকম প্রাণবায়ুও শরীরের সর্বাংশ পূর্ণ করে থাকে।

যদিও প্রাণের অবস্থান সারা শরীর জুড়ে, এর পাঁচটি স্বতন্ত্র কাজ আছে। এই পাঁচটি কাজকে বলা হয়—প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান। প্রাণের পাঁচটি কাজকে উপনিষদ পাখীর দেহের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রাণ অর্থাৎ শ্বাসের সঙ্গে যে বায়ু আমরা গ্রহণ করি তা ঊর্ধ্বগামী তাই একে পাখীর মাথার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অপান হল নিঃশ্বাস বায়ু যা আমরা ত্যাগ করি। বাঁ দিকের নাসারন্ধ্র দিয়ে এই অপান বায়ু বেরিয়ে যায়। তাই একে পাখীর বাঁ দিকের ডানার (বাম পক্ষ) সঙ্গে তুলনা করা হয়। ব্যান বায়ু সারা শরীরে ব্যাপ্ত থাকে। ব্যান হল পাখীর ডানদিকের ডানা (বা দক্ষিণ পক্ষ)। সমান বায়ু খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। তাই একে পাখীর দেহের মধ্যভাগের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আর উদান বায়ু আমাদের ধারণ করে এবং আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই একে বলা হয় পাখীর লেজ (পুচ্ছ)। উদান না থাকলে আমাদের দেহ হয়। উপরে উঠে যেত, না হয় নিজের ভারে নীচে পড়ে যেত।

এই কোষতত্ত্বের আলোচনা কি কারণে করা হচ্ছে? আচার্য শঙ্কর আমাদের আত্মাকে এক দানা চালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। চাল পেতে হলে যেমন ধানের খোসা ছাড়িয়ে যেতে হবে ঠিক তেমনি আত্মাকে পেতে গেলে প্রথমেই বিভিন্ন কোষগুলি সরিয়ে ফেলা আবশ্যক।

শঙ্করাচার্য আরও বলেন, আত্মা হলেন অন্তরতম সত্তা। এ যেন প্রাসাদে রাজসন্দর্শনে যাওয়া। একটার পর একটা ঘর পার হয়ে সব থেকে ভিতরের ঘরটিতে প্রাসাদের অধিপতি রাজার দর্শন পাওয়া যায়। এই ঘরগুলি যেন কোষ এবং রাজা হলেন আত্মা। আর একটি দৃষ্টান্ত হল : কোষগুলি তলোয়ারের খাপের মতো। খাপের ভেতর তলোয়ার রয়েছে। আত্মা স্বয়ং সেই তলোয়ার।

তৃতীয় অধ্যায়

প্রাণং দেবা অনু প্রাণন্তি। মনুষ্যাঃ পশবশ্চ যে। প্রাণো হি ভূতানামায়ুঃ। তস্মাৎ সর্বায়ুষমুচ্যতে। সর্বমেব ত আয়ুৰ্যন্তি। যে প্রাণং ব্রহ্মোপাসতে। প্রাণো হি ভূতানামায়ুঃ। তস্মাৎ সর্বায়ুষমুচ্যত ইতি।

তস্যৈষ এব শারীর আত্মা। যঃ পূর্বস্য। তস্মাদ্বা এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ। অন্যোঽন্তর আত্মা মনোময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ। স বা এষ পুরুষবিধ এব। তস্য পুরুষবিধতাম্। অন্বয়ং পুরুষবিধঃ। তস্য যজুরেব শিরঃ। ঋগ্দক্ষিণঃ পক্ষঃ। সামোত্তরঃ পক্ষঃ। আদেশ আত্মা। অথর্বাঙ্গিরসঃ পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি তৃতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: দেবাঃ (ইন্দ্রিয়সকল); প্রাণম্ (প্রাণ তথা শ্বাসবায়ুরূপ আত্মা); অনু প্রাণন্তি (প্রাণের দ্বারা অনুপ্রাণিত, এবং সেহেতু নিজ নিজ কর্তব্য সম্পাদনে সক্ষম); [তথা] যে মনুষ্যাঃ (একই সূত্র মানুষেও প্রযোজ্য); পশবঃ চ(পশুতেও); হি (সে কারণে); প্রাণঃ ভূতানাম্ আয়ুঃ (সর্বভূতের জীবনের কারণ প্রাণ); তস্মাৎ সর্বায়ুষম্ উচ্যতে (এই কারণে একে বলা হয় ‘সকল জীবনের জীবন’); যে প্রাণং ব্রহ্ম উপাসতে (যে সব মানুষ ব্রহ্মকে প্রাণরূপে উপাসনা করেন); তে সর্বম্ এব আয়ুঃ যন্তি (পূর্ণ আয়ু অর্জন করেন); হি প্রাণঃ ভূতানাম্ আয়ুঃ (প্রাণ সকল সত্তার জীবন); তস্মাৎ সর্বায়ুষম্ উচ্যতে ইতি (এবং সেইজন্যই একে বলা হয় ‘সকল জীবনের জীবন’)।

তস্য পূর্বস্য যঃ এষঃ এব শারীরঃ আত্মা (এই [প্রাণময় কোষ] পূর্বোক্ত কোষের [অন্নময় কোষ] অন্তরাত্মা); তস্মাৎ এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ বৈ অন্যঃ অন্তরঃ আত্মা মনোময়ঃ (প্রাণময় কোষের গভীরে তার থেকে পৃথক যে আত্মা তাকে বলা হয় মনোময় কোষ [মানস স্তর]); তেন (এর [মন তথা মনোময় কোষের দ্বারা]); এষঃ (এই [প্রাণময়] কোষ); পূর্ণঃ (পূর্ণ); সঃ এষঃ বৈ পুরুষবিধঃ এব (এই [মনোময়] আত্মারও মানুষের আকার); তস্য পুরুষবিধতাম্ অনু অয়ং পুরুষবিধঃ (যেরূপ সেটির [প্রাণময় আত্মা] মানবাকৃতি, একই রূপে এটিরও [মনোময় আত্মা] মানবের আকৃতি); যজুঃ এব তস্য শিরঃ (যজুঃ মন্ত্র তার মস্তক); ঋগ্ দক্ষিণঃ পক্ষঃ (ঋক্-মন্ত্র এর ডান পক্ষ); সাম উত্তরঃ পক্ষঃ (সাম এর বাম পক্ষ); আদেশঃ (বেদের ব্রাহ্মণ অংশ); আত্মা (দেহের মধ্যভাগ); অথর্বাঙ্গিরসঃ প্রতিষ্ঠা পুচ্ছম্ (অথর্ব অঙ্গিরস এর লেজ তথা পুচ্ছ); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে); ইতি তৃতীয়ঃ অনুবাকঃ (এখানে তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ইন্দ্রিয়সকল প্রাণকে অনুসরণ করে। এর ফলেই সেগুলি নিজের নিজের কর্তব্য সম্পাদনে সক্ষম হয়। কি মানুষের ক্ষেত্রে কি পশুর ক্ষেত্রে, এই একই কথা প্রযোজ্য। প্রাণ সকল প্রাণীকে জীবন দান করে। সেজন্য প্রাণকে ‘সর্বায়ুষম্’ অর্থাৎ সকল প্রাণীর ‘জীবন’ বলা হয়। যাঁরা প্রাণকে ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করেন তাঁরা পূর্ণ আয়ু লাভ করেন। প্রাণই সকল জীবের আয়ু; যতদিন দেহে প্রাণ থাকে ততদিনই জীব বেঁচে থাকে। তাই প্রাণকে ‘সর্বায়ুষম্’ বলা হয়। অন্নময় কোষের অন্তরস্থ আত্মা হল এই প্রাণ।

প্রাণময় কোষেরও গভীরে রয়েছে মনোময় কোষ। মনোময় কোষ সমগ্র প্রাণময় কোষকে পূর্ণ করে আছে। যেমন প্রাণময় কোষের আকৃতি মানুষের মতো, সেই অনুযায়ী মনোময় কোষেরও আকার মানুষের মতো। যজুঃ মন্ত্র এর (পাখীর) মস্তক, ঋক্-মন্ত্র এর ডান দিকের ডানা (দক্ষিণ পক্ষ), এবং সামবেদ এর বাঁ দিকের ডানা (বাম পক্ষ)। ব্রাহ্মণ অংশ হল শরীরের মধ্যভাগ, এবং অথর্ব অঙ্গিরস এর পুচ্ছ বা লেজ। এবিষয়েও একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ‘দেব’ শব্দের অর্থ যা উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময়। সাধারণভাবে এর দ্বারা দেবতাকে বোঝায়। কিন্তু এখানে দেব বলতে ইন্দ্রিয়সমূহকে বোঝানো হয়েছে। এর কারণ কি? ইন্দ্রিয়গুলিই বাইরের বস্তুকে আমাদের কাছে প্রকাশ করে। যেমন চোখ দিয়ে আমরা বাইরের সব জিনিস দেখতে পাই। চোখই যেন বস্তুকে আলোকিত করে আমাদের কাছে তাকে প্রকাশ করে।

কেউ মারা গেলে আমরা অনেক সময় দেখি তার ইন্দ্রিয়গুলি অক্ষত রয়েছে। চোখ, কান, সবই রয়েছে, কিন্তু সেগুলি কাজ করছে না। তাহলে কিসের অভাব ঘটল? অভাব হল প্রাণ অর্থাৎ জীবনীশক্তির। দেহে প্রাণ না থাকলে ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করতে পারে না। প্রাণ শুধু মানুষের নয়, সকল জীবেরই আয়ু।

উপনিষদ বলছেন, এই প্রাণকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করলে পূর্ণ আয়ু লাভ হয় (সর্বায়ুঃ)। এখানে আয়ু বলতে জীবৎকাল অর্থাৎ পরমায়ু বোঝাচ্ছে। আচার্য শঙ্করের মতে পূর্ণ আয়ু হল একশ বছর (শত বর্ষাণি)। কিন্তু এটি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণীয় নয়। মূল কথা হল—যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ। কোন বিষয়ে সম্পূর্ণ মনোসংযোগ করতে পারলে সেটি সহজেই পাওয়া যায়। আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘যদ্‌গুণকং ব্রহ্মোপাস্তে স তদ্‌গুণভাগ্‌ভবতি’—যদি কেউ ব্রহ্মকে বিশেষ গুণ রূপে উপাসনা করেন তবে তিনি সেই গুণ লাভ করেন। সবকিছু ব্রহ্মেই রয়েছে। অতএব ব্রহ্মকে সৌন্দর্য রূপে ধ্যান করলে মানুষ সৌন্দর্য লাভ করে। আবার বীর্যবত্তা, পবিত্রতা বা জ্ঞানরূপে ব্রহ্মকে উপাসনা করলে সেই সেই গুণ লাভ হয়। উপাসক তখন ব্রহ্মসদৃশ হয়ে ওঠেন।

প্রশ্ন হল, এই জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেউ যদি মনে করেন, এ জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই তাহলে তাঁর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে ‘যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার স্বরূপ জ্ঞান হয় ততক্ষণ আমি বাঁচতে চাই। আমি নিজেকে জানব—এই আমার জীবনের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমি মরতে চাই না।’

প্রাণময় কোষের ভিতরে আছে মনোময় কোষ অর্থাৎ মনের স্তর। প্রাণময় কোষ যেমন অন্নময় কোষকে পূর্ণ করে রাখে তেমনি মনোময় কোষও প্রাণময় কোষকে পূর্ণ করে থাকে। এই মনোময় কোষের আকারও প্রাণময় কোষের মতো।

উপনিষদ আবার পাখীর দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মাথা। এখানে যজুর্বেদকে পাখীর মাথা বলা হয়েছে। কেন? যজুর্বেদের মন্ত্রগুলির ছন্দ অনিয়মিত। সামবেদ অত্যন্ত সুরেলা এবং সুর করে গাওয়া যায়। বস্তুত সামবেদকে ভারতীয় সঙ্গীতের উৎস বলে ধরা হয়। কিন্তু যজুর্বেদের মন্ত্রগুলি গাওয়া সম্ভব নয়। তথাপি এই বেদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শঙ্করাচার্য বলেন, অধিকাংশ বৈদিক ক্রিয়াকর্ম যজুর্বেদ-ভিত্তিক। যজ্ঞের আহুতি দেওয়ার সময় যেসব মন্ত্র উচ্চারিত হয় তার অধিকাংশই যজুর্বেদের অন্তর্গত। যজুর্বেদ সাধককে বেদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়।

একমাত্র জ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়—আচার্য শঙ্করের এই ঘোষণা সত্ত্বেও কর্মকাণ্ডকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। মনে বাসনা থাকলে যে ভাবেই হোক তাকে জয় করতে হবে। যতক্ষণ বাসনা থাকবে ততক্ষণ চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্তব্য কর্ম করে যেতেই হবে। কর্মের দ্বারা দীর্ঘায়ু, ধনসম্পদ এবং স্বর্গলাভ করা যায়। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী কর্ম করলে ধীরে ধীরে চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন মানুষ বোঝে তার সকল দুঃখের মূলে রয়েছে এই বাসনা, কারণ এ জগৎ অনিত্য। তখন যা নিত্য, যা অবিনাশী তাকে লাভ করার আকাঙক্ষা জাগে। ইহকাল ও পরকালে সকল প্রকার ভোগ সুখ প্রত্যাখ্যান করে মানুষ তখন আত্মজ্ঞান লাভ করতে চায়।

প্রশ্ন হল মনোময় কোষের সঙ্গে বেদকে যুক্ত করা হল কেন? আচার্য শঙ্কর বলছেন, বেদের মন্ত্র আবৃত্তি করা কোন যান্ত্রিক ব্যাপার নয়, তা মানসিক। আমরা যখন জপ করি তা মন দিয়েই করা উচিত। জপের সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রতিক্রিয়া বা অনুভূতি জাগে। তেমনি বেদের প্রতিটি শব্দের একটা অর্থ আছে; সেই অর্থ বুঝে মন্ত্র উচ্চারণ করলে মনে কতগুলি চিন্তার উদ্রেক হয়। মন্ত্রের অর্থ ধ্যান করতে করতে মনে কিছু প্রতিক্রিয়া বা অনুভূতি জাগে (মনোবৃত্তি)। এইভাবে বারবার অভ্যাস করতে হবে। শুরুতে যা একটা ধারণামাত্র ছিল পুনঃ পুনঃ মন্ত্র উচ্চারণের ফলে তা রূপ ধরে মূর্ত হয়ে উঠবে। এর আশু ফলস্বরূপ সাধক দীর্ঘ জীবন, ধনসম্পদ ইত্যাদি লাভ করেন, কিন্তু পরিণামে সব অজ্ঞানতার বন্ধন কেটে গিয়ে আত্মজ্ঞান লাভ হয়।

আচার্য শঙ্কর শাস্ত্র থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছেন : ‘সর্বে বেদা যত্ৰৈকং ভবন্তি স মানসীন আত্মা’—সকল বেদের একই লক্ষ্য (অর্থাৎ তারা একটি বিষয়ে একমত)—মনেই আত্মা রয়েছে।

কর্মকাণ্ডের যাগযজ্ঞ, জ্ঞানকাণ্ডের জ্ঞান অনুসন্ধান অথবা ঋক্ সাম ইত্যাদি বেদ অধ্যয়ন, যাই করি না কেন বেদের লক্ষ্য কিন্তু একই। তা হল আত্মজ্ঞান লাভ। কর্মকাণ্ড সাধককে একটু ঘুরপথে নিয়ে যায়। কিন্তু এইসব ক্রিয়াকর্ম করতে করতেই সাধক ধীরে ধীরে এগুলিকে অতিক্রম করেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁর আর এসব যাগযজ্ঞের প্রয়োজন নেই।

বেদের ব্রাহ্মণ অংশকে বলা হয় (পাখীর) দেহের মধ্যভাগ। কারণ এই অংশেই যাগযজ্ঞের নিয়মাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। আদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে এই সব নির্দেশ দেওয়া আছে। তাই এগুলিকে বলা হয় ‘আদেশ’। অথর্ব ও ঋষি অঙ্গিরস প্রদত্ত নির্দেশসমূহকে বলা হয়েছে পাখীর পুচ্ছ বা লেজ। আচার্য শঙ্করের মতে এইসব নির্দেশ মেনে কর্ম অনুষ্ঠান করলে সাধক শান্তি সমৃদ্ধি ইত্যাদি লাভ করেন (শান্তিকপৌষ্টিকাদি)। এগুলি জীবনকে ধারণ করে রাখে। তাই এরা পাখীর পুচ্ছের মতো, যার দ্বারা পাখীর দেহের ভারসাম্য বজায় থাকে।

চতুর্থ অধ্যায়

যতো বাচো নিবর্তন্তে। অপ্রাপ্য মনসা সহ। আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্। ন বিভেতি কদাচনেতি।

তস্যৈষ এব শারীর আত্মা। যঃ পূর্বস্য। তস্মাদ্বা এতস্মান্মনোময়াৎ। অন্যোঽন্তর আত্মা বিজ্ঞানময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ। স বা এষ পুরুষবিধ এব। তস্য পুরুষবিধতাম্। অন্বয়ং পুরুষবিধঃ। তস্য শ্রদ্ধেব শিরঃ। ঋতং দক্ষিণঃ পক্ষঃ। সত্যমুত্তরঃ পক্ষঃ। যোগ আত্মা। মহঃ পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি চতুর্থোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: বাচঃ (বাক্যসকল); মনসা সহ (মন সহ); অপ্রাপ্য (না পেয়ে); যতঃ (তাঁর [ব্রহ্ম] থেকে); নিবর্তন্তে (ফিরে আসে); ব্ৰহ্মণঃ বিদ্বান্ আনন্দম্ (যিনি ব্রহ্মের আনন্দকে জানেন); কদাচন ন বিভেতি ([কোনও ব্যক্তি বা বস্তুর কারণে] কখনও ভীত হন না)।

তস্য পূর্বস্য যঃ এষঃ এব শারীরঃ আত্মা (এই [মনোময়] কোষ পূর্বোক্ত [প্রাণময়] কোষের অন্তরস্থ আত্মা); তস্মাৎ বৈ এতস্মাৎ মনোময়াৎ অন্যঃ অন্তরঃ আত্মা (এই মনোময় কোষের গভীরে এবং এর থেকে পৃথক আর এক আত্মা); বিজ্ঞানময়ঃ (বিজ্ঞানময় কোষ [বুদ্ধির কোষ] [কথিত হয়]); তেন এষঃ পূর্ণঃ (তার [বিজ্ঞানময় কোষ] দ্বারা এটি [মনোময় কোষ] পূর্ণ); সঃ বৈ এষঃ (সেই [বিজ্ঞানময় কোষ]); পুরুষবিধঃ এব (মনুষ্য আকার সম্পন্ন); তস্য পুরুষবিধতাম্ অনু অয়ং পুরুষবিধঃ (যেভাবে সেই [মনোময়] কোষ মানবাকৃতি সম্পন্ন, সেইভাবেই এই [বিজ্ঞানময়] কোষও মানবাকৃতি সম্পন্ন); তস্য (তার [বিজ্ঞানময় কোষের]); শ্রদ্ধা (শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা); এব শিরঃ (এর মস্তক); ঋতম্ (শাস্ত্ৰাৰ্থ মনন); দক্ষিণঃ পক্ষঃ (এর দক্ষিণ তথা ডান পক্ষ); সত্যম্ (শাস্ত্র বিধি অনুসারে বাক্য ও কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস); উত্তরঃ পক্ষঃ (এর বামপক্ষ); যোগঃ (নির্ভুলভাবে শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে চলা); আত্মা (দেহের মধ্যভাগ); মহঃ (হিরণ্যগর্ভ [প্রথমজাত]); পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা (ভারসাম্য রক্ষাকারী পুচ্ছ তথা লেজ); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে [ব্রাহ্মণ অংশে]); ইতি চতুর্থ অনুবাকঃ (এখানে চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: বাক্য এবং মন ব্রহ্মের কাছে পৌঁছতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। যিনি ব্রহ্মানন্দ অনুভব করেছেন তিনি কখনও (জন্ম-মৃত্যুর ভয়ে) ভীত হন না (অর্থাৎ তিনি অমরত্ব লাভ করেন)।

এই মনোময় কোষ প্রাণময় কোষের আত্মা। মনোময় কোষের অভ্যন্তরে আর একটি কোষ আছে যা বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধির স্তর) বলে পরিচিত। এই মনোময় কোষ বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা পূর্ণ। বিজ্ঞানময় কোষও মানবাকৃতি। ঠিক যেমন মনোময় কোষের আকৃতি মানুষের মতো, অনুরূপভাবে বিজ্ঞানময় কোষের আকারও মানুষের মতো। এই কোষে শ্রদ্ধা (অর্থাৎ শাস্ত্র ও নিজের প্রতি শ্রদ্ধা) মস্তকের প্রতীক; ঋত (অর্থাৎ শাস্ত্রের অর্থ মনন করা) ডান দিকের ডানা (বা দক্ষিণ পক্ষ); সত্য এর বাঁ দিকের ডানা (অর্থাৎ বাম পক্ষ) এবং যোগ হল আত্মার প্রতীক যা দেহের মধ্যভাগ। ‘মহঃ’ অথবা হিরণ্যগর্ভ হল লেজ বা পুচ্ছ যা (পাখীর) দেহকে ধরে রাখে। ব্রাহ্মণে এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: বাক্য এবং মন উভয়ই মনোময় কোষস্থিত পরব্রহ্মকে ধারণা করতে বা প্রকাশ করতে অক্ষম। বাক্য ও মন সসীম, কিন্তু ব্ৰহ্ম অসীম। ব্রহ্ম হল বাক্য-মনের অতীত এক সূক্ষ্ম তত্ত্ব। উপরন্তু বাক্ এবং মন একযোগে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় উভয়ই হতে পারে না।

এখানে ‘বিদ্বান’ শব্দটির অর্থ ‘যাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছে’, অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের পরমানন্দ যিনি অনুভব করেছেন। তিনি আর কোন কিছুকে ভয় পান না। কেন? কারণ এক আত্মাই আছেন, আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। কাকে তিনি ভয় করবেন? দুই বোধ থেকেই ভয়ের জন্ম। আসলে যা কিছু আছে সব এক আত্মার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

মনোময় কোষের অভ্যন্তরে, মনোময় কোষের থেকে পৃথকভাবে আছে বিজ্ঞানময় কোষ তথা বুদ্ধির কোষ। একে বলা হয় মনোময় কোষের আত্মা। একে আবার ‘শারীর’ও বলা হয়ে থাকে কারণ এটি মনোময় শরীরকে অধিকার করে থাকে। ‘শারীর’ শব্দটি শরীরের বিশেষণ। যা শরীরকে অধিকার করে থাকে তাই ‘শারীর’। বিজ্ঞানময় কোষ যেন মনোময় কোষেরই অবিকল প্রতিরূপ।

বিজ্ঞানময় বলতে বুদ্ধির স্তরকে বোঝায়। এটি সিদ্ধান্ত বা সঙ্কল্প গ্রহণ করার স্তর। মনের স্তরে সবসময় সঙ্কল্প-বিকল্প থাকে; ‘করব কি করব না’, এই সংশয় থাকে। কিন্তু বুদ্ধি স্থিরসঙ্কল্প। ‘হ্যাঁ, এটা করব’—এ সিদ্ধান্ত বুদ্ধিই নিতে পারে।

কোন কিছুর সঠিক তাৎপর্য কি তা বুদ্ধির সাহায্যেই আমরা বুঝতে পারি। বেদে অনেক কথা আছে, কিন্তু তার মর্মার্থ আমাদের বুঝতে হবে। অনেকে আছেন যাঁরা কোন কিছুই তলিয়ে দেখতে চান না। শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হন।

উপনিষদে দেবরাজ ইন্দ্র এবং অসুররাজ বিরোচন সম্পর্কে একটি উপাখ্যান আছে। তাঁরা দুজনে প্রজাপতির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আত্মা কি? আমরা যে আত্মার কথা শুনি সেই আত্মা কি এবং তিনি কোথায় আছেন?’ প্রজাপতি উত্তর দিলেন, ‘ওই নদীর ধারে যাও। জলে নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য কর। ওই তোমার আত্মা।’ বিরোচন তাই করলেন। জলে নিজদেহের প্রতিবিম্ব দেখে ভাবলেন, ‘ওঃ, তাহলে এই দেহই আত্মা!’ সন্তুষ্টচিত্তে তিনি ফিরে গেলেন। প্রথমে ইন্দ্রও তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, ‘শরীর কি আত্মা হতে পারে? শরীরের পরিবর্তন আছে। এই শরীর কখনও যুবক, কখনও বৃদ্ধ; কখনও রোগগ্রস্ত, কখনও সুস্থ। কিন্তু আত্মা নিত্য, অপরিবর্তনীয়। অতএব এই শরীর কখনও আত্মা হতে পারে না।’ এইভাবে বহু বছরের আত্মজিজ্ঞাসা ও ধ্যানের পর অবশেষে তিনি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করলেন।

উপনিষদ বিজ্ঞানময় কোষকেও পাখীর দেহের সঙ্গে তুলনা করছেন। যদি এই কোষকে পাখী রূপে কল্পনা করা যায় তাহলে তার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ মাথা কোন্‌টি? উপনিষদ বলছেন, শ্রদ্ধা এই পাখীর মাথা। শ্রদ্ধা অর্থ হল শাস্ত্র এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস। এর আর এক অর্থ আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই আত্মবিশ্বাস হারানো বড়ই ক্ষতিকর।

‘ঋতম্’ বা ন্যায়পরায়ণতা পাখীর দক্ষিণ পক্ষ অর্থাৎ ডান দিকের ডানা। বুদ্ধি দিয়ে আমরা ন্যায় অন্যায় বিচার করতে পারি এবং আমাদের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকি। পাখীর বাঁ দিকের ডানা বা বাম পক্ষ হল ‘সত্যম্’ অর্থাৎ মন-মুখ এক করে কর্ম করা। সত্য এবং ন্যায়পরায়ণতা, এই দুটি বুদ্ধির স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি পশু ভালমন্দ বিচার করবে তা কেউ আশা করে না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই গুণগুলি অপরিহার্য।

পাখীর দেহকে বলা হচ্ছে ‘যোগ’। শঙ্করাচার্যের মতে যোগের অর্থ ‘একাগ্রতা’, আত্মার সঙ্গে অভিন্নতাবোধ—‘যোগঃ যুক্তিঃ সমাধানম্’।

আত্মতত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম। কিভাবে এই আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়? ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং একাগ্রতা—এই তিন গুণের সমন্বয় ঘটলে আত্মজ্ঞান লাভ হয়। এই তিনটি আয়ত্ত হলে বুদ্ধিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়। তখন চিত্তশুদ্ধি হয় এবং আত্মতত্ত্ব ধারণা করার শক্তি জন্মায়।

ধরা যাক একজন ব্যক্তি অত্যন্ত বুদ্ধিমান কিন্তু সৎ নন, ন্যায়-অন্যায় বিচার করে কাজ করেন না। যেমন, সম্প্রতি একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে গেল। ডাকাতির ঘটনাটি এত সুপরিকল্পিত, সুসংগঠিত এবং সুপরিচালিত যে ডাকাতদের প্রশংসা করতেই হয়। পুলিশ একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা ডাকাতদের কোন হদিস পাচ্ছে না, কারণ ডাকাতরা কোন সূত্র রেখে যায়নি। বিনা রক্তপাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। তাই উপনিষদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, শুধু বুদ্ধি থাকলেই হবে না, সেই বুদ্ধিকে সঠিকপথে চালিত করা চাই। সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, এ দুটি জিনিস মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে।

এরপর উপনিষদ বলছেন, পাখীর পুচ্ছ বা প্রতিষ্ঠা হল ‘মহঃ’। ‘মহঃ’ কথাটির অর্থ হল মহত্তম বা হিরণ্যগর্ভ, যা ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। শঙ্কর বলছেন, ‘কারণং হি কার্যানাং প্রতিষ্ঠা’—কার্য কারণকেই আশ্রয় করে থাকে। অর্থাৎ কারণ ছাড়া কার্য হয় না। তেমনি ‘মহঃ’কে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানময় কোষ কাজ করতে পারে না, বুদ্ধির বিকাশও হয় না। শঙ্করাচার্য একে পৃথিবীর বৃক্ষ-লতাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন (যথা বৃক্ষবীরুধাং পৃথিবী)। পৃথিবীই বৃক্ষ-লতার অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। পৃথিবী ছাড়া বৃক্ষ লতা ইত্যাদি থাকতে পারে না। সেই রকম হিরণ্যগর্ভও সকল বস্তুর আশ্রয়।

পঞ্চম অধ্যায়

বিজ্ঞানং যজ্ঞং তনুতে। কর্মাণি তনুতেঽপি চ। বিজ্ঞানং দেবাঃ সর্বে। ব্রহ্ম জ্যেষ্ঠমুপাসতে। বিজ্ঞানং ব্রহ্ম চেদ্বেদ। তস্মাচ্চেন্ন প্রমাদ্যতি। শরীরে পাপ্মনো হিত্বা। সর্বান্ কামান্ সমশ্নুত ইতি।

তস্যৈষ এব শারীর আত্মা। যঃ পূর্বস্য। তস্মাদ্বা এতস্মাদ্বিজ্ঞানময়াৎ। অন্যোঽন্তর আত্মাঽঽনন্দময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ। স বা এষ পুরুষবিধ এব। তস্য পুরুষবিধতাম্। অন্বয়ং পুরুষবিধঃ। তস্য প্রিয়মেব শিরঃ। মোদো দক্ষিণঃ পক্ষঃ। প্রমোদ উত্তরঃ পক্ষঃ। আনন্দ আত্মা। ব্রহ্ম পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি পঞ্চমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: বিজ্ঞানম্ (বুদ্ধিরূপ আত্মা); যজ্ঞম্ (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান); তনুতে (সম্পাদন করে); কর্মাণি (দৈনন্দিন কর্তব্য কর্ম); অপি চ তনুতে (সম্পাদনও করে); সর্বে দেবাঃ (ইন্দ্রিয়সকল [অথবা তাদের অধিপতি দেবতা]); জ্যেষ্ঠম্ (প্রথমজাত); বিজ্ঞানং ব্রহ্ম (বুদ্ধিরূপে ব্রহ্ম); উপাসতে (ধ্যান করেন); চেৎ (যদি); বিজ্ঞানং ব্রহ্ম বেদ (কোন ব্যক্তি বুদ্ধিকে ব্রহ্মরূপে জানেন); চেৎ ([এবং] যদি); তস্মাৎ (তার [অর্থাৎ বুদ্ধিরূপে ব্রহ্মকে উপাসনা করা] থেকে); ন প্রমাদ্যতি (তিনি কখনও বিচ্যুত না হন); শরীরে পাপ্মনঃ হিত্বা (দেহ ও দেহাভিমানজনিত পাপ ত্যাগ করে); সর্বান্ কামান্ সমশ্নুতে ইতি (সকল কাম্য বস্তু লাভ করেন)।

তস্য পূর্বস্য যঃ এষঃ এব শারীরঃ আত্মা (এই [বিজ্ঞানময়] কোষ পূর্বোক্ত [মনোময়] কোষের অন্তরস্থিত আত্মা); তস্মাৎ বৈ এতস্মাৎ বিজ্ঞানময়াৎ অন্যঃ অন্তরঃ আত্মা (এই বিজ্ঞানময় কোষের গভীরে এবং এর থেকে পৃথক এক আত্মা আছেন); আনন্দময়ঃ (আনন্দময় কোষ [হিসাবে পরিচিত]): তেন এষঃ পূর্ণঃ (ঐ [আনন্দময়] কোষ দ্বারা এই [বিজ্ঞানময়] কোষ পূর্ণ); সঃ বৈ এষঃ (ঐ [আনন্দময়] কোষ); পুরুষবিধঃ এব (মনুষ্য আকৃতিসম্পন্ন); তস্য পুরুষবিধতাম্ অনু অয়ং পুরুষবিধঃ (যেভাবে ঐ [বিজ্ঞান] কোষ মনুষ্য আকৃতিসম্পন্ন, ঠিক সেইভাবে এই [আনন্দময়] কোষও মনুষ্য আকারসম্পন্ন); তস্য (তার [আনন্দময় কোষের]); প্রিয়ম্ (আনন্দ [যেমন প্রিয়বস্তু দর্শন জাত]); এব শিরঃ (মস্তক); মোদঃ (সুখ [প্রিয়বস্তু প্রাপ্তিজাত]); দক্ষিণঃ পক্ষঃ (দক্ষিণ পক্ষ); প্রমোদঃ (কাম্য বস্তুর ভোগসুখ [যেমন ভাল খাবার খেয়ে হয়]); উত্তরঃ পক্ষঃ (বাম পক্ষ); আনন্দঃ আত্মা (আত্মাই আনন্দ [দেহের মধ্যবর্তী অংশ]); ব্রহ্ম পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা (ব্রহ্ম [যিনি দ্বিতীয় রহিত] আশ্রয়রূপী পুচ্ছ); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এ সম্পর্কে একটি শ্লোক আছে); ইতি পঞ্চমঃ অনুবাকঃ (এখানে পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: বুদ্ধিমান ব্যক্তি গভীর শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে যজ্ঞকর্ম করেন এবং নতুন নতুন কর্মের প্রবর্তনও করেন (তাঁর সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন কোন্ কাজ ভাল আর কোন্ কাজ মন্দ)। বুদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবদেবীগণ ব্রহ্মকে বুদ্ধিরূপে উপাসনা করেন। ব্রহ্মই সব চেয়ে বুদ্ধিমান। দেহ থাকলে মানুষের অনেক মলিনতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যদি ব্রহ্মকে জানেন এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন থাকেন তবে তাঁর সব মলিনতা ধুয়ে-মুছে যাবে। আবার তিনি তাঁর যা-যা কাম্য, তাও পেয়ে যাবেন। বুদ্ধিরূপে ব্রহ্মই বিজ্ঞানময় আত্মা। এই কোষ পূর্বোক্ত মনোময় কোষের আত্মা।

বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। এই কোষের অভ্যন্তরে আনন্দময় কোষ এবং তার মধ্যে আনন্দরূপ আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পূর্ণ। আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহের অনুরূপ। বিজ্ঞানময় কোষের আকৃতি যেরকম মানুষের মতো অনুরূপভাবে আনন্দময় কোষও মানুষের মতো। প্রিয় জিনিস দেখার যে আনন্দ তা যেন (পাখীর) মাথা, প্রিয়বস্তু লাভ করার আনন্দ এর ডান দিকের ডানা (দক্ষিণ পক্ষ), প্রিয়বস্তু ভোগ করার আনন্দ এর বাঁ দিকের ডানা (বাম পক্ষ), আর বিশুদ্ধ আনন্দ যেন আত্মা (দেহের মধ্যভাগ)। অদ্বয় ব্রহ্ম হলেন এর পুচ্ছ—যা এই দেহকে ধারণ করে রাখে। এই সম্পর্কে (ব্রাহ্মণে) একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ‘বিজ্ঞানং যজ্ঞং তনুতে’—‘বিজ্ঞান’ কথাটির অর্থ বুদ্ধি, মেধা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। ‘তনুতে’ অর্থ ইনি সম্পাদন করেন’। বুদ্ধির সাহায্যে আমরা বহু যজ্ঞকর্ম এবং অন্যান্য কর্তব্যকর্ম স্থির করি। বুদ্ধির দ্বারাই আমরা সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পশুরা প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়ে কাজ করে। ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার তারা করতে পারে না। কিন্তু মানুষ বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে তার কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে, কোন্‌টা উচিত কোন্‌টা অনুচিত বুঝতে পারে।

তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন ব্যক্তি প্রায় সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন। উপনিষদ বলছেন, এমনকি দেবতারাও বুদ্ধির উপাসনা করেন। কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা সবসময় আবেগ ও প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়ে কাজ করেন। তাঁরা কি করছেন একবার ভেবেও দেখেন না। কিন্তু যিনি বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করেন তিনি কদাচিৎ ভুল করেন। বুদ্ধি আমাদের পথপ্রদর্শক, অতএব বরেণ্য। একে প্রথম জাত বা জ্যেষ্ঠম্ বলা হয়ে থাকে। আমরা যেমন বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান দিই তেমনি বুদ্ধিকেও শ্রদ্ধা করি। এখানে বুদ্ধির মহিমা কীর্তন করা হচ্ছে। লক্ষণীয় এই যে, উপনিষদ বুদ্ধির উপরই সব থেকে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

ব্রহ্মকে কেন আমরা বুদ্ধিরূপে উপাসনা করব? কারণ এর দ্বারা বুদ্ধি আমাদের যে পথে চালিত করে তাতে অবিচল থাকতে পারব। উপনিষদ বলেন, বুদ্ধিকে অনুসরণ করলে সব দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা যায়। তখন আর শরীরের দাসত্ব করতে হয় না। সেন্ট ফ্রান্সিস নিজের দেহটাকে দেখিয়ে বলতেন, ‘আমার প্রিয় গাধা ভাই’ (Brother Ass)। গাধার বুদ্ধি নেই। সে নিজেকে চালাতে জানে না। অন্যে যেমন চালায়, সে তেমনি চলে। বুদ্ধির দ্বারা এই শরীরকে এমন ভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে আমরা কোন ভুল না করি। স্থূলদেহের স্তরগুলিকে ধীরে ধীরে অতিক্রম করে সূক্ষ্মের দিকে এগিয়ে যেতে উপনিষদ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। শরীর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া উচিত নয়। সাধারণত শরীরকে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে আমরা নির্বোধের মতো আচরণ করে থাকি।

তাহলে উপনিষদ কেন বলছেন, বুদ্ধির উপাসনা করলে সব কাম্যবস্তু ভোগ করা যায়? উপনিষদের বক্তব্য হল, আমরা যখন বুদ্ধি দিয়ে কিছু বোঝবার চেষ্টা করি তখন খুব আনন্দ পাই, অবশ্য বিষয়বস্তু যদি ভাল হয়। কিন্তু বাসনা ও আবেগ তাড়িত হয়ে কাজ করলে স্বভাবতই আমাদের ভুল-ভ্রান্তি ঘটবে। তখন আনন্দ পাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দেহসুখের বাসনা ও আবেগে বিভ্রান্ত না হয়ে যাঁরা লক্ষ্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে পারেন তাঁদের কাছে এ জীবন অনেক বেশী উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

এরপর উপনিষদ আনন্দময় কোষ (আনন্দের স্তর) নিয়ে আলোচনা করছেন। পূর্ববর্তী শ্লোকের মতো এখানেও একই তত্ত্ব বলা হয়েছে—এই কোষ বিজ্ঞানময় কোষ থেকে স্বতন্ত্র এবং মনুষ্যদেহের আকৃতি-সম্পন্ন।

এখন আনন্দময় কোষকে যদি পাখী রূপে কল্পনা করা যায় তবে সেই পাখীর মাথা কি হবে? ‘প্রিয়’ অর্থাৎ আনন্দ। আচার্য শঙ্কর তাঁর ব্যাখ্যায় বলছেন, প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হলে যে আনন্দ হয় সেই আনন্দই এই পাখীর মাথা। সন্তানের মুখদর্শনে পিতামাতা যে আনন্দ লাভ করেন, এ আনন্দ ঠিক সেইরকম। ধরা যাক, কারোর পুত্র দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে এখন দেশে ফিরে আসছে। পিতা অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। অবশেষে পিতা-পুত্রের মিলন হল। এই মিলনের আনন্দই ‘প্রিয়’।

‘মোদ’ হল পাখীর দক্ষিণ পক্ষ। শঙ্করাচার্য বলছেন: যা আমরা সবসময় পেতে চাইছি তা পেলে যে আনন্দ হয় সেই আনন্দই ‘মোদ’। বহুদিন যাবৎ, হয়তো আমার একটা গাড়ি কেনার ইচ্ছে। টাকা জমাচ্ছি। অপেক্ষা করছি কতদিনে প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয় হবে। অবশেষে একদিন গাড়িটি কেন সম্ভব হল। তখন যে ধরনের আনন্দ হয় তা-ই ‘মোদ’। পাখীর বাম পক্ষ হল ‘প্রমোদ’। আচার্য শঙ্কর এই জাতীয় আনন্দের কোন দৃষ্টান্ত দেননি। তিনি বলেছেন ‘প্রমোদ’ অর্থ হল ‘প্রকৃষ্ট হর্ষ’, অপার আনন্দ।

এই আনন্দময় কোষ কিন্তু প্রকৃত আত্মা নয়। এই স্তরে আমরা আত্মার খুব কাছাকাছি থাকি, কিন্তু তখনও দুয়ের মাঝে বাধা রয়েছে। হিমালয়ের দিকে যত এগোন যায় ততই শীত শীত করে, তেমনি আত্মার যত কাছাকাছি যাওয়া যায় ততই আনন্দ বোধ হয়। আনন্দকেই বলা হয় আত্মা তথা পাখীর মধ্যভাগ। আত্মা আছেন বলেই জীবাত্মা ও তাঁর সঙ্গে যুক্ত সব বস্তু আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। এই আত্মাকে জানার আনন্দ নিত্য এবং শাশ্বত। কেবলমাত্র বাসনামুক্ত শুদ্ধ মনের দ্বারাই এই আত্মাকে জানা যায়।

আচার্য শঙ্করের মতে, স্থূল জাগতিক বস্তু ভোগ করার যে আনন্দ তা ক্ষণস্থায়ী। তিনি বলছেন: যখন এই আনন্দের কারণটিই অনুপস্থিত থাকে, তখন কি হয়? যে পুত্রের জন্য পিতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সে হয়তো এল না; তখন পিতার আনন্দ থাকে কোথায়? অথবা বহু কষ্টে কেনা সেই গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল। তখন শুধুই নিরানন্দ।

কিন্তু আধ্যাত্মিক আনন্দ কোন বাহ্যবস্তুর উপর নির্ভরশীল নয়। বাইরের বস্তু থাক বা না থাক, আধ্যাত্মিক আনন্দ যিনি লাভ করেছেন তিনি সবসময় সুখী। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অপরিসীম রোগযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন, তখনও তাঁর মুখমণ্ডল ছিল দিব্য আনন্দে পূর্ণ। তাঁর সেই আনন্দ সকলকে স্পর্শ করত।

কিন্তু কোথা থেকে এত আনন্দ আসে? ব্রহ্ম থেকে। অতএব এই ব্রহ্ম তথা আত্মাকে ‘পুচ্ছ’, লেজ বা প্রতিষ্ঠা বলা হয়েছে। এই আত্মাই সকল আনন্দের উৎস। অতএব আত্মা থেকে যে আনন্দ আসে তা নিত্য। এই আত্মার নিত্য উপস্থিতিতে অন্যান্য বস্তুও আমাদের আনন্দ দান করে। গাড়ি, খাদ্য, সন্তান এরা কেন আমাদের আনন্দ দেয়? কারণ তারা আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের প্রকাশ। জগতে সকল বস্তু আনন্দেই প্রতিষ্ঠিত। নিজ সন্তানকেও ব্রহ্মরূপে দেখলে আর এক রকমের আনন্দ হয়। সে আনন্দ গভীরতর।

কিন্তু মানুষ যখন ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব উপলব্ধি করেন তখন তিনি পরমানন্দ লাভ করেন। আচার্য শঙ্কর বলেন, এই ব্রহ্ম ‘অভ্যন্তরম্’, অন্তর্নিহিত আত্মা। তিনি আছেন বলেই আমরা আছি। আমাদের সকল দুঃখ-দুর্দশার মূলে রয়েছে দুই বোধ। ব্রহ্মে এই দুই বোধের অবসান হয়। তখন আমরা আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যাই।

ষষ্ঠ অধ্যায়

অসন্নেব স ভবতি। অসদ্‌ব্রহ্মেতি বেদ চেৎ। অস্তি ব্রহ্মেতি চেদ্বেদ। সন্তমেনং ততো বিদুরিতি।

তস্যৈষ এব শারীর আত্মা। যঃ পূর্বস্য। অথাতোঽনুপ্রশ্নাঃ। উতাবিদ্বানমুং লোকং প্ৰেত্য কশ্চন গচ্ছতী ৩। আহো বিদ্বানমুং লোকং প্ৰেত্য কশ্চিৎ সমশ্নুতা ৩ উ।

সোহকাময়ত। বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা। ইদং সর্বমসৃজত। যদিদং কিংচ। তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ। তদনুপ্রবিশ্য। সচ্চ ত্যচ্চাভবৎ। নিরুক্তং চানিরুক্তং চ। নিলয়নং চানিলয়নং চ। বিজ্ঞানং চাবিজ্ঞানং চ। সত্যং চানৃতং চ সত্যমভবৎ। যদিদং কিংচ। তৎ সত্যমিত্যাচক্ষতে তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি ষষ্ঠোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: চেৎ (যদি); ব্রহ্ম অসৎ ইতি বেদ ([কোন ব্যক্তি] জানেন যে ব্রহ্মের অস্তিত্ব নেই); সঃ অসন্ এব ভবতি (তিনি নিজেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েন); ব্রহ্ম অস্তি (ব্রহ্ম আছেন); ইতি চেৎ বেদ (যদি কেউ জানেন); ততঃ (সে ক্ষেত্রে); [ব্রহ্মবিদঃ—যাঁরা ব্রহ্মকে জানেন]; এনং সন্তং বিদুঃ ইতি (তাঁকে সত্য বলে জানেন)।

যঃ (ওই [আনন্দময় কোষ); এষঃ এব তস্য পূর্বস্য শারীরঃ আত্মা (পূর্বোক্ত [বিজ্ঞানময়] আত্মার অন্তরস্থ আত্মা); অতঃ (সুতরাং); অথ (এরপর [অর্থাৎ শিষ্যের বিদ্যা লাভ সম্পূর্ণ হবার পর]); অনু ([আচার্য যা বলেছেন] তার আলোকে); প্রশ্নাঃ ([এইসব] প্রশ্ন উঠতে পারে]); কশ্চন অবিদ্বান্ (কোন অজ্ঞান ব্যক্তি [অর্থাৎ আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞান]); প্ৰেত্য (মৃত্যুর পর); অমুং লোকম্ (সেই লোক [অর্থাৎ পরমাত্মাকে]); গচ্ছতি (লাভ করেন); ‘৩’ (অথবা করেন না); উত আহো কশ্চিৎ বিদ্বান্ (অথবা যিনি আত্মাকে জানেন তিনি কি); প্ৰেত্য (মৃত্যুর পর); অমুং লোকম্ (সেই পরমাত্মাকে); সমশ্নুতা (লাভ করেন); ‘৩’ (অথবা করেন না?)।

সঃ (তিনি [পরমাত্মা]); অকাময়ত (ইচ্ছা করলেন [চিন্তা করলেন]); বহু স্যাং প্রজায়েয় ইতি (আমি বহুরূপে জাত হব); [এরপর] সঃ (তিনি [পরমাত্মা]); তপঃ অতপ্যত (ধ্যান করে সিদ্ধান্তে এলেন); সঃ তপঃ তপ্ত্বা (তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে); ইদং সবর্ম্ অসৃজত (এই সকল বস্তু সৃষ্টি করলেন); ইদং (এই [জীব এবং জড় জগৎ]); যৎ কিংচ (যা কিছু আছে); তৎ (এই জগৎ [জীব ও জড়বস্তুসহ]); সৃষ্ট্বা (সৃষ্টি করার পর); তৎ এব অনুপ্রবিশৎ (তিনি সকল বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করলেন); তৎ অনুপ্রবিশ্য সৎ অভবৎ (প্রবেশ করে তিনি রূপ পরিগ্রহ করলেন); ত্যৎ চ (এবং একযোগে নিরাকার হয়ে গেলেন); নিরুক্তং চ অনিরুক্তং চ ([দেশ ও কালের দ্বারা] বিশেষিত এবং [দেশকালের] ঊর্ধ্বে); নিলয়নং চ অনিলয়নং চ (যার আশ্রয় আছে অথবা নিরাশ্রয়); বিজ্ঞানং চ অবিজ্ঞানং চ (চেতন বা অচেতন); সত্যং চ অনৃতং চ (ব্যবহারিকভাবে সত্য ও তার বিপরীত); সত্যম্ অভবৎ ([কারণ] সেই সত্য [অর্থাৎ ব্রহ্ম] আপনাকে প্রকাশ করলেন); যৎ ইদং কিংচ (যা কিছু [আমাদের চারপাশে] আছে); তৎ সত্যম্ ইতি আচক্ষতে ([ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি] একে [অর্থাৎ ব্রহ্মকে] সত্য বলে উল্লেখ করেন); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই সম্পর্কে একটি শ্লোক আছে); ইতি ষষ্ঠঃ অনুবাকঃ (এখানে ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: যদি কেউ মনে করেন ব্রহ্মের অস্তিত্ব নেই তাহলে তাঁর নিজের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। (আবার) কেউ যদি জানেন ব্রহ্ম আছেন তাহলে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষরা তাঁকে ব্রহ্ম বলেই মনে করেন।

এই কোষ (আনন্দময় কোষ, আনন্দস্বরূপ আত্মা) পূর্বোক্ত কোষের (বিজ্ঞানময় কোষ, বুদ্ধির স্তর) অন্তরস্থ আত্মা। আচার্য এতক্ষণ যা শিক্ষা দিলেন, তার আলোকে শিষ্য জিজ্ঞাসা করতে পারেন: ‘যিনি আত্মাকে জানেন না, তিনি কি মৃত্যুর পর আত্মজ্ঞান লাভ করেন, না করেন না? আবার যিনি আত্মাকে জানেন, তিনি মৃত্যুর পর আত্মজ্ঞান লাভ করেন, না করেন না?’

পরমাত্মা চিন্তা করলেন, ‘আমি এক, বহু হতে চাই।’ তারপর তিনি তপস্যা করলেন। অর্থাৎ তিনি শুধু চিন্তা করলেন। তাঁর চিন্তামাত্রই চেতন-অচেতন বস্তু সহ সমগ্র জগতের সৃষ্টি হল। জগৎ সৃষ্টি করার পর তার মধ্যে তিনি প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করে কোথাও রূপ ধারণ করলেন, কোথাও নিরাকার হয়ে রইলেন। কোথাও দেশ-কালের দ্বারা বিশেষিত হলেন, কোথাও তার উর্ধ্বে রইলেন। কখনও কিছুকে আশ্রয় করে থাকলেন (অর্থাৎ আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে) আবার কখনও বা তিনি নিরাশ্রয় (নিরাকার, তাই আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই)। কখনও তিনি চেতন, আবার কখনও বা অচেতন। ব্রহ্ম, যিনি নিত্য সত্য, তিনি কোথাও আপেক্ষিক সত্যরূপে, কোথাও বা অসত্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করলেন। যেহেতু ব্ৰহ্ম সকল বস্তুতে নিজেকে প্রকাশ করেন সেহেতু ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁকে ‘সত্য’ বলে বর্ণনা করে থাকেন। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ‘চেৎ’ কথাটির অর্থ ‘যদি’। উপনিষদ বলেন যদি কেউ ব্রহ্মের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করেন তিনি বস্তুত নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছেন। তাঁর নিজের অস্তিত্বই যেন হারিয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, ‘ব্রহ্ম বলে কিছু নেই। এসব অর্থহীন কথা। ব্রহ্মকে তো দেখতে পাই না। কি করে বুঝব তিনি আছেন?’ তাঁরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু উপনিষদ এইসব মানুষদের অস্তিত্বহীন বলছেন কেন? কারণ ব্রহ্মই আমাদের প্রকৃত সত্তা। নিজের সত্তাকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? এ যেন বলা হচ্ছে, ‘আমার অস্তিত্ব নেই।’ আমরা প্রতিবাদ করে বলতে পারি, ‘আমি তো বলিনি আমার অস্তিত্ব নেই। আমি বলছি ব্ৰহ্ম বলে কিছু নেই। আমি সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা।’ কিন্তু উপনিষদ বলছেন, ‘তুমিই ব্রহ্ম।’ অর্থাৎ ব্রহ্ম ও আত্মা অভিন্ন—এ কথাই উপনিষদ বোঝাতে চাইছেন।

ধরা যাক, কেউ দৃঢ়তার সাথে বলছেন, ব্রহ্ম আছেন। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তখন সবাই বুঝতে পারে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করে তিনি ব্রহ্মই হয়ে গেছেন। এখানে ‘ততঃ’ শব্দটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ ‘তার থেকে’ অর্থাৎ ‘ব্রহ্মের অপরোক্ষ অনুভূতি থেকে’ বা ‘সেই ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা’। ‘ব্রহ্ম আছেন’ বা ‘ঈশ্বর আছেন’ একথা অনেকেই বলে থাকেন। বুদ্ধি দিয়ে তাঁদের এই ধারণা হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মকে আমাদের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে হবে। সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান।

স্বামী বিবেকানন্দ যখন প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসেন তখন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?’ এ প্রশ্ন তিনি আগেও অনেককে করেছেন। সবাই এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ দেখেছি বৈকি। তোমাকে যেভাবে দেখছি তার চেয়েও স্পষ্টভাবে দেখেছি। আর তুমি চাইলে তোমাকেও দেখাতে পারি।’ শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মানুষ যখন একথা বলেন তখন তা না মেনে কি উপায় আছে? তাঁর কথাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ।

এরপর কতগুলি প্রশ্ন (অনুপ্রশ্নাঃ) উঠেছে। ‘প্রশ্ন’ কথাটির অর্থ ‘জিজ্ঞাসা’ এবং ‘অনু’র অর্থ হল ‘অনুসরণ করে’ অথবা ‘এর পরবর্তী’। এতক্ষণ আচার্য ছাত্রদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এখন ছাত্ররা বিস্তারিতভাবে বুঝতে চাইছেন। প্রথম প্রশ্ন অজ্ঞান ব্যক্তি প্রসঙ্গে। ‘অবিদ্বান্‌’ বলতে এখানে ‘যাঁর আত্মজ্ঞান হয়নি’ তাঁকে বোঝানো হয়েছে। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে’ আছে যখন মাষ্টারমশাই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসেন তখন তিনি নিজের স্ত্রীকে অজ্ঞান বলে উল্লেখ করেন। তৎক্ষণাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ তীব্র ভৎর্সনার সুরে বলে ওঠেন, ‘আর তুমি বুঝি খুব জ্ঞানী?’ মাষ্টারমশাই ভেবেছিলেন, তাঁর কলেজের ডিগ্রী আছে, তাই তিনি বিদ্বান। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসে প্রথম জানতে পারলেন, ঈশ্বরকে জানার নামই জ্ঞান, যার না জানাই অজ্ঞান। অন্যান্য আর যা কিছু জ্ঞান তা অজ্ঞানতারই নামান্তর মাত্র।

এখানে ছাত্ররা জানতে চাইছে, যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়নি মৃত্যুর পর তাঁর কি অবস্থা হয়? তিনি কি ব্রহ্মে অর্থাৎ আনন্দলোকে প্রবেশ করেন? অনেকে মনে করেন: জ্ঞানলাভের পথে দেহ একটা বড় বাধা; দেহই সব বন্ধনের কারণ, আর দেহের বিনাশ হলেই মুক্তিলাভ হবে। এরূপ মনে করে অনেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছায় আত্মহত্যা করেন। কিন্তু বেদান্ত বলেন: শুধু দেহের নাশ হলেই মোক্ষলাভ হতে পারে না। দেহত্যাগের পরও বন্ধন থাকে। এর কারণ হল অবিদ্যা; নিজের স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতার জন্যে মানুষ বারবার জন্মায়, বারবার জন্মমৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ হয়। কেবল মাত্র আত্মজ্ঞান হলেই মানুষ মুক্তিলাভ করে।

মূল শ্লোকে আমরা ‘৩’ (3) সংখ্যাটি লক্ষ্য করেছি। এই চিহ্নকে বলে ‘প্লুতি’ যার অর্থ বিপরীত। মূল প্রশ্নটি ছিল, তাঁর কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়? এবং ‘৩’-এর অর্থ হল ‘না কি হয় না’?

আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটি হল, ‘ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির জন্য কি আত্মজ্ঞান প্রয়োজন?’ প্রশ্নটির তাৎপর্য হল : সূর্য কিংবা আকাশের মতো ব্রহ্ম যদি নিরপেক্ষ হন, তাহলে একমাত্র আত্মজ্ঞান দ্বারা তাঁকে লাভ করা যায় বলা হচ্ছে কেন? আমরা জ্ঞানী না অজ্ঞান তাতে কি আসে যায়? মৃত্যুর পর তো আমরা সবাই সমান। একটি ইংরাজী কবিতা আছে যেখানে মৃত্যুকে ‘সাম্যবাদী’ (Leveller) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজা-উজির, শাসক-শাসিত মৃত্যুর পরে সব একাকার হয়ে যায়। সকলে এক অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অনুরূপভাবে, জ্ঞানী অথবা অজ্ঞান, ব্রহ্মের দৃষ্টিতে সব সমান। তাহলে আমরা সবাই কেন ব্রহ্মপদ লাভ করব না? তাৎপর্য হল, হয় ব্রহ্ম পক্ষপাতিত্ব করেন, না হয় ব্রহ্ম বলে কিছু নেই, সুতরাং ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু বেদান্তের মূল কথা হল, আমরা জানি বা না জানি, আমরা সবসময়ই ব্রহ্ম। শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা দিতেন, ‘একটা পুকুরের মাঝ বরাবর একটা লাঠি ফেলে দাও। মনে হবে জলটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আসলে কিন্তু একই জল। অনুরূপভাবে, নামরূপের জন্য আমরা নিজেদের পরস্পর পৃথক এবং ব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্র সত্তা বলে মনে করি। কিন্তু যখন স্বরূপজ্ঞান হয়, দেহমনের থেকে নিজেকে ভিন্ন বলে বোধ হয়, তখন বুঝতে পারি কোনদিনই আমরা ব্রহ্ম থেকে পৃথক ছিলাম না।

আচার্য শঙ্কর এখানে ব্রহ্মের অস্তিত্বের প্রশ্নটি তুলেছেন। কেউ বিতর্ক তুলতে পারেন: যার অস্তিত্ব আছে, যেমন একটি পাত্র, তাকে দেখা যায়, অনুভব করা যায় অর্থাৎ বস্তুটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আবার যার অস্তিত্ব নেই, যেমন খরগোশের শিং তাকে দেখাও যায় না, অনুভবও করা যায় না। একইভাবে ব্রহ্মকেও দেখা যায় না বা স্পর্শ করা যায় না। তাহলে কেমন করে বুঝব ব্রহ্ম আছেন?

শঙ্করাচার্য উত্তর দিচ্ছেন, আকাশের মতো সূক্ষ্ম উপাদান থেকে শুরু করে এই বিশ্বে যা কিছু দেখা যায়, সব কিছুর পেছনেই একটা কারণ আছে। সব বস্তুকে কার্য-কারণ এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। একই বস্তু কখনও কারণ, কখনও কার্য। যেমন মাটি দিয়ে ঘট তৈরী হয়, আবার মাটির উৎপত্তি হয় অন্য কোন কারণ থেকে। অন্যান্য উপাদান থেকে যখন মাটি তৈরী হচ্ছে, তখন মাটি হল কার্য। অথচ এই মাটিই আবার ঘটের কারণ।

এইভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় কার্য-কারণ একটি শৃঙ্খল। কারণ-কার্য-কারণ, একটির পর আর একটি আসে যতক্ষণ না পর্যন্ত এই শৃঙ্খল সূক্ষ্মতম উপাদান আকাশে এসে মিলিত হয়। অবশ্য উপাদান হিসেবে আকাশও কোন কিছু থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

আচার্য শঙ্কর বলছেন, এই সকল বস্তু কি কোন অ-বস্তু থেকে আসতে পারে? ‘শূন্য’ থেকে কি কিছুর উৎপত্তি সম্ভব? অতএব, একটি আদি কারণ আছে মেনে নিতেই হয়। এই আদি কারণই ব্রহ্ম। এই ব্ৰহ্ম সকল বস্তুর উৎস। ব্রহ্মই পরম সত্য যার থেকে আর সব কিছু এসেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ‘১’ সংখ্যাটির দৃষ্টান্ত দিতেন। একের পিঠে একটি শূন্য বসালে হয় দশ, আরেকটি দিলে একশ, এইভাবে বাড়তে থাকে। কিন্তু ‘১’ সরিয়ে নিলে থাকে শুধুই শূন্য। ব্রহ্ম এই ‘১’ সংখ্যাটির মতো। ব্রহ্ম আছেন বলেই সব কিছু আছে। ব্রহ্ম থেকেই সব কিছু আসে।

এবার উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মের ইচ্ছে হল (সঃ অকাময়ত) : ‘বহু স্যাম্’—‘আমি বহু হব।’ এর অর্থ কি এই যে, ব্রহ্ম আমাদের মতোই মরণশীল জীব? জীবের বাসনা থাকে। আমরা বিত্ত, ক্ষমতা, সুস্বাস্থ্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠা কত কি কামনা করি। সেই বাসনা কখনও ভাল হতে পারে, কখনও মন্দ। কিন্তু আমাদের মধ্যে সবসময় একটা অভাব বা অতৃপ্তির বোধ রয়েছে। ব্রহ্ম যদি আমাদের মতোই হন তবে আমরা কেন ব্রহ্ম হতে চাইব?

শঙ্করাচার্য বলেন: না, ব্রহ্ম স্বতন্ত্র। তিনি নিজেই নিজের প্রভু। আমাদের বাসনা আছে বলেই আমরা স্বাধীন নই; বহু কিছুর উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। আমরা নিজেদের বাসনার দাস, আবার অন্য মানুষেরও দাস। সুতরাং আমরা যা কিছু করি বাধ্য হয়ে করি। কিন্তু ব্রহ্ম কোন কিছু করতে বাধ্য নন; তিনি নিজেই নিজের কর্তা।

পরবর্তী প্রশ্ন হল: এক ব্রহ্ম কিভাবে বহু হলেন? শঙ্কর বলছেন: ব্রহ্ম বাইরে কিছু সৃষ্টি করেননি। নিজের মধ্যে যা আছে তা-ই তিনি প্রকাশ করেছেন। নামরূপ তাঁর ভেতরেই রয়েছে। সেগুলির প্রকাশ হয় মাত্র। আর সেইজন্য আমরা মনে করি আমরা পরস্পর পৃথক এবং ব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্র সত্তা। বস্তুত একই সত্তা নাম-রূপের কারণে ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। নর, নারী, পশু, উদ্ভিদ—সবই সেই এক ব্রহ্ম। কিন্তু আমরা শুধু নামরূপই দেখি, ব্রহ্মকে দেখতে পাই না।

তাই উপনিষদ বলছেন: ব্রহ্ম শুধুমাত্র চিন্তা করলেন। এখানে ‘তপঃ’ কথাটির অর্থ ‘জ্ঞান’। এই জগৎ তাঁর চিন্তা বা ইচ্ছা মাত্র। সাধারণভাবে ‘তপঃ’ কথাটির অর্থ তপস্যা, কৃচ্ছ্রসাধন। আমরা যখন কিছু তৈরী করতে চাই, আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। বিভিন্ন যন্ত্রপাতিরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু ব্রহ্ম শুধু চিন্তা করেন। সেই চিন্তামাত্রই জগৎ সৃষ্টি হয়। ব্ৰহ্ম যেন বীজ। বীজ থেকে গাছ হয়। গাছ তৈরী করতে বীজকে কি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়? না, বীজ থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই গাছ বেরিয়ে আসে। একইভাবে এই সমগ্র জগৎ আর জগতের সকল বস্তু ব্রহ্ম থেকে নির্গত হয়। এই ব্রহ্মাণ্ডের একটি অংশমাত্র আমাদের দৃষ্টির গোচর। অধিকাংশই আমাদের দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু দৃশ্য-অদৃশ্য, সাকার-নিরাকার সব কিছু এক ব্রহ্ম থেকেই আসে।

এরপর উপনিষদ বলছেন, এই জগৎ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্ম তার মধ্যে প্রবেশ করেন। ‘অনুপ্রাবিশৎ’ কথাটির অর্থ ‘প্রবেশ করলেন’। মূল শ্লোকের এই অংশটি খুবই বিতর্কিত অংশ। শঙ্করাচার্য বিভিন্নভাবে এই শব্দটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ব্রহ্ম কেমন করে প্রবেশ করলেন? একটি আপত্তি হল: ধরা যাক একজন কুম্ভকার একটি মাটির ঘট তৈরী করেছেন। ঘটটি তৈরী করার পর তিনি কি তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন?

দ্বিতীয় যুক্তি হল: ‘ব্রহ্ম প্রবেশ করেছেন’ বললে তাঁর একটা রূপ ধারণা করা হয়। কে প্রবেশ করেন? যাঁর আকার আছে তিনিই প্রবেশ করতে সক্ষম। একটি বাড়ীতে একজন প্রবেশ করছেন। বাড়ীটি একটি বস্তু আবার যিনি প্রবেশ করছেন তিনিও আর একটি বস্তু। অথবা আমার এই হাত আমার মুখে প্রবেশ করছে। আমার একটি দেহ আছে। তার একটি অংশ হাত আর একটি অংশে অর্থাৎ মুখে প্রবেশ করছে।

শঙ্করাচার্য বলছেন: না, ব্যাপারটা এই রকম। ধরা যাক, অন্ধকার ঘরে একটি ঘট রয়েছে। ঘর অন্ধকার হওয়াতে ঘটটি দেখা যাচ্ছে না। আলো আনলে ঘটটি দেখা যাবে। ঘটটি সব সময় সেখানে ছিল। কিন্তু অন্ধকার তাকে আড়াল করে রেখেছিল। সেইরকম ব্ৰহ্ম সর্বত্র রয়েছেন। তোমার, আমার সবার মধ্যে রয়েছেন। অজ্ঞানতার কারণে তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। জ্ঞান হলে মনে হয় যেন ব্ৰহ্ম আমাদের মধ্যে প্রবেশ করলেন, যদিও তিনি প্রথম থেকেই সেখানে ছিলেন। জ্ঞানই সেই দীপের আলো, আর আমাদের অজ্ঞানতাই হল অন্ধকার।

সপ্তম অধ্যায়

অসদ্বা ইদমগ্র আসীৎ। ততো বৈ সদজায়ত। তদাত্মানং স্বয়মকুরুত। তস্মাত্তৎসুকৃতমুচ্যত ইতি।

যদ্বৈ তৎ সুকৃতম্। রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধ্বাঽঽনন্দী ভবতি। কো হ্যেবান্যাৎকঃ প্ৰাণ্যাৎ। যদেষ আকাশ আনন্দো নস্যাৎ। এষ হ্যেবাঽঽনন্দয়াতি। যদা হ্যেবৈষ এতস্মিন্নদৃশ্যেঽনাত্ম্যেঽনিরুক্তেঽনিলয়নেঽভয়ং প্রতিষ্ঠাং বিন্দতে। অথ সোঽভয়ং গতো ভবতি। যদা হ্যেবৈষ এতস্মিন্নূদরমন্তরং কুরুতে। অথ তস্য ভয়ং ভবতি। তত্ত্বেব ভয়ং বিদুষোঽমন্বানস্য। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥১॥ ইতি সপ্তমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: ইদম্ (এই [আপেক্ষিক জগৎ]); অগ্রে (আদিতে); অসৎ বৈ আসীৎ (অস্তিত্ব ছিল না [অর্থাৎ বস্তুত তা ছিল অব্যক্ত ব্ৰহ্ম]); ততঃ বৈ (তার [অব্যক্ত অবস্থার] থেকে); সৎ (বিচিত্র নামরূপসহ এই জগৎ); অজায়ত (নির্গত হয়েছে); তৎ (ওই [ব্ৰহ্ম]); স্বয়ম্ আত্মানম্ অকুরুত (আপনাকে প্রকাশ করলেন); তস্মাৎ (সেইজন্য); তৎ (ওই [ব্রহ্ম]); সুকৃতম্ (সুন্দর স্রষ্টা অথবা স্বয়ং স্রষ্টা); উচ্যতে ইতি ([ঋষিদের দ্বারা] অভিহিত হন)।

যৎ তৎ বৈ সুকৃতম্ (সেই যা সুকৃত); সঃ (তা-ই); রসঃ বৈ (সর্ব বস্তুতে রস তথা মাধুর্য রূপে); অয়ং হি রসম্ এব লব্ধ্বা (যে ব্যক্তির মধ্যে এই রস আছে [রসের উৎসরূপে আত্মাকে তিনি জানেন]); আনন্দী ভবতি (সুখী হন); আকাশে (হৃদয়াকাশে); এষঃ (এই [আত্মা]; যৎ আনন্দঃ ন স্যাৎ (যদি ইনি আনন্দের উৎস না হতেন); কঃ হি এব অন্যাৎ (শ্বাসগ্রহণের কষ্টটুকুই বা কে স্বীকার করত); কঃ প্রাণ্যাৎ (জীবনধারণ করবার ক্লেশটুকুই বা কে স্বীকার করত); হি (অতএব); এষঃ (এই [হৃদয় মধ্যস্থ আত্মা]); এব আনন্দয়াতি (আনন্দ দান করেন [সকলকে]); এষঃ (এই আত্মা); এব হি যদা (যখন); অদৃশ্যে (অদৃশ্য হন); অনাত্ম্যে (দেহত্যাগ করেন [এবং সেই কারণে]); অনিরুক্তে (একে বর্ণনা করা যায় না); অনিলয়নে (কোন আশ্রয় নেই [অর্থাৎ সকল বিকার মুক্ত]); এতস্মিন্ (এতে [এই আত্মায়]); অভয়ম্ (ভয়হীন [যেমন পুনর্জন্মের ভয়মুক্ত]); প্রতিষ্ঠাম্ (নিজ আত্মায় প্রতিষ্ঠিত); বিন্দতে (প্রাপ্ত হন); অথ (এরপর); সঃ (সেই ব্যক্তি [যিনি এই অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন]); অভয়ং গতঃ ভবতি ([পুনর্জন্মের] ভয় থাকে না); [অন্যদিকে] এষঃ (এই [ব্যক্তি]); এব যদা (যদি [সেই একই ব্যক্তি]); এতস্মিন্ (আত্মায়) উৎ অরম্ (একটুও); অন্তরম্ (পার্থক্য); কুরুতে (করে [অর্থাৎ পার্থক্য চিহ্নিত করে]); অথ (এর কারণে [পার্থক্যের কারণে]); তস্য (ব্যক্তিটির [যিনি পৃথক করেন]); ভয়ং ভবতি (তিনি ভীত হয়ে পড়েন); তু (কিন্তু); অমন্বানস্য (সেই নির্বোধ ব্যক্তিটির); বিদুষঃ (যে ব্যক্তি নিজেকে আত্মার থেকে পৃথক মনে করেন); তৎ এব (সেই [ব্ৰহ্ম] আবার); ভয়ম্ (ভয় [অর্থাৎ, ভয়ের কারণ]); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে); ইতি সপ্তমঃ অনুবাকঃ (এখানে সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: আদিতে জগৎ বলে কিছু ছিল না। কেবল ব্রহ্ম ছিলেন। এই জগৎ তখন অব্যক্ত ব্রহ্মরূপে ছিল। তারপর নামরূপের এই দৃশ্যমান জগৎ আত্মপ্রকাশ করল। ব্রহ্ম যেন নিজেই নিজেকে এভাবে সৃষ্টি করলেন। তাই তিনি ‘সুকৃত’ (অর্থাৎ ‘সুন্দর সৃষ্টি’ বা ‘স্বয়ংকর্তা’) বলে খ্যাত।

‘সুকৃত’ রূপে তিনিই আনন্দস্বরূপ। এই আনন্দস্বরূপকে যিনি লাভ করেন তিনি সুখী। আমাদের প্রত্যেকের অন্তরস্থ আত্মাই সকল আনন্দের উৎস। এই আনন্দ না থাকলে কেউ কি বাঁচতে চাইত? একটা নিঃশ্বাসও কি কেউ গ্রহণ করত? আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। তিনি স্বাধীন, ত্রিগুণাতীত। যে ব্যক্তি নির্ভয়ে এই আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হন, তিনি আর কোন কিছুকে ভয় করেন না। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরমাত্মার সঙ্গে নিজের সামান্যতম পার্থক্যও অনুভব করেন ততক্ষণ তনি ভয়মুক্ত নন। একজন ব্যক্তি পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি ব্রহ্ম থেকে নিজেকে পৃথক বলে মনে করেন তাহলে স্বয়ং ব্রহ্মই তাঁর ভীতির কারণ হয়ে ওঠেন (যদিও ব্রহ্মজ্ঞান মানুষকে ভয়ের পারে নিয়ে যায়)। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ এই শব্দ দুটি বিশেষ অর্থবহ। আক্ষরিকভাবে ‘সৎ’ কথাটির অর্থ ‘যা আছে’। সেই অর্থে কেবলমাত্র ব্রহ্মই ‘সৎ’; কারণ সব অবস্থাতেই ব্রহ্ম আছেন। ব্রহ্ম ছাড়া আর সব কিছুই ‘অসৎ’ অর্থাৎ অস্তিত্বহীন বা ক্ষণস্থায়ী। কারণ তারা স্থান-কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ। এখানে কিন্তু সৎ কথাটির অর্থ যা প্রকাশিত বা দৃষ্টিগোচর। অর্থাৎ এর দ্বারা দৃশ্যমান জগৎকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘অসৎ’ কথাটির অর্থ যা অপ্রকাশিত, অদৃশ্য অর্থাৎ অব্যক্ত ব্রহ্ম যা সব কিছুর আদি কারণ।

ধরা যাক, আমাদের সামনে একটা বিশাল বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছে অগণিত পাতা ও অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, গাছটি কোথা থেকে এল? বীজ থেকে। গাছটি বীজের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় ছিল। গাছটি ছিল না—একথা আমরা বলতে পারি না। অনুরূপভাবে, আদিতে এই জগৎ অব্যক্ত অবস্থায় (অসৎ) ছিল। বীজাকারে ব্রহ্মের মধ্যে ছিল। এখন ব্যক্তরূপ ধারণ করল (সৎ)।

‘ইদম্’–এই; ‘ততঃ’—তার থেকে। লক্ষণীয় এই যে, উপনিষদ এখানে ব্রহ্ম শব্দটি ব্যবহার করছেন না। বেদান্তে আমরা প্রায়শই ‘ইদম্’ এবং ‘তৎ’ এই শব্দ দুটির ব্যবহার দেখতে পাই। ‘ইদম্’ বলতে দৃশ্যমান জগৎকে বোঝায়—যে জগৎকে আমরা দেখতে পাই। ‘ইদম্’ অর্থাৎ ‘এই’ জগৎ সম্পর্কে আমরা খুবই সচেতন। কিন্তু ‘তৎ’ বা ‘সেই’ বলতে বোঝায় যা আমাদের সামনে নেই, যাকে আমরা দেখতে পাই না। সুতরাং উপনিষদ বলছেন, ‘এই’ জগৎ ‘সেই’ ব্রহ্ম থেকে এসেছে—যে ব্রহ্ম আমাদের দৃষ্টিগোচর নন।

কিন্তু ব্রহ্ম যদি এই জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে ব্রহ্মকে সৃষ্টি করল কে? উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মের কোন স্রষ্টা নেই। তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন (স্বয়ম্ অকুরুত)। অর্থাৎ তিনি স্বয়ং-প্রকাশ। লক্ষণীয় যে, এখানে কোন দ্বৈত ধারণা নেই। যিনি স্রষ্টা, তিনিই সৃষ্টি। ব্রহ্মের প্রকাশই তাঁর সৃষ্টি। ব্রহ্ম কি করে তাঁর সৃষ্টিতে প্রবেশ করেন এই নিয়ে পূর্ববর্তী শ্লোকে যে আপত্তি উঠেছিল এখানে তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। উপনিষদের মতে, স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি অভিন্ন। এখানে ‘সুকৃতম্’ কথাটির দুটি অর্থ। ‘সু-কৃতম্’, অর্থাৎ যা উত্তম বা উত্তমরূপে সম্পন্ন করা হয়েছে; অথবা ‘স্ব-কৃতম্’, স্বয়ং নিজেই সৃষ্টি করেছেন।

‘রসঃ বৈ সঃ’—ব্রহ্ম রস তথা আনন্দস্বরূপ। তিনিই সকল আনন্দের উৎস। বলতে চাইছেন, এমনকি দৈহিক সুখের কারণও ব্রহ্ম। দেহের সুখ আসে ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে। ভাল খাবার খেলে যে আনন্দ হয় তা আসে রসনার মাধ্যমে। আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে আনন্দ পেয়ে থাকি। এ জগৎ শুধুই দুঃখময়—উপনিষদ একথা বলেন না। একজন ব্যক্তি কখনও আনন্দ পাননি এ হতে পারে না। প্রত্যেকের আনন্দের ধারণা পৃথক হতে পারে। কেউ ভাল কবিতা পড়ে আনন্দ পান। আবার কেউ বা ভাল খাবার খেয়ে বা ভাল জামাকাপড় পরে আনন্দ পান। কিন্তু আনন্দের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, সব সেই এক ব্রহ্ম থেকেই আসে।

কারোর যদি একটা পোষা কুকুর থাকে তাহলে দেখা যায় প্রভুর সান্নিধ্যে কুকুরটির খুব আনন্দ হয়। আর এই আনন্দ থেকেই প্রমাণিত হয় কুকুরটির ভেতরও ব্রহ্ম আছেন। কুকুরটির আনন্দের উৎসও সেই এক ব্রহ্ম। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি জানেন, সব আনন্দের উৎস তাঁর নিজের ভেতরে, বাইরে নয়।

আমরা অর্থ উপার্জনের জন্য এত পরিশ্রম করি কেন? কেন আমরা ভাল খাবার, ভাল বই দেখলে ছুটে যাই? কারণ আমরা মনে করি, এগুলি আমাদের আনন্দ দেবে। আমরা সবসময় আনন্দ পেতে চাইছি। তার জন্য আমাদের কত সংগ্রাম! জীবনে কোন আনন্দ না পেলে কার বাঁচার ইচ্ছে থাকত? ধরা যাক, জীবন শুধুই দুঃখময়, সেখানে আনন্দের লেশমাত্রও নেই। সেক্ষেত্রে জীবনধারণ অসম্ভব হত। উপনিষদ বলছেন, তখন আমরা শ্বাস-গ্রহণের কষ্টটুকুও স্বীকার করতাম না। কিন্তু দৈহিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক যে আনন্দই হোক না কেন, আমরা সবসময়ই তার কিছু না কিছু পেয়ে থাকি। কারণ আনন্দের উৎস যিনি, সেই ব্রহ্ম আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন।

তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আমরা কখনও দুঃখ পাব না। দুঃখ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কখনও কখনও আনন্দ এসে আমাদের দুঃখকে ভুলিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আনন্দের জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়। কখনও এমনও মনে হয় যে সুখের চেয়ে আমাদের দুঃখের পাল্লাই ভারী। দুঃখের দিনে আমাদের মনে হয়, ‘জীবনে সুখ কাকে বলে জানলাম না। শুধু কষ্টই ভোগ করে গেলাম। আমার এ জীবন অভিশপ্ত।’ আবার যেই আমরা একটু সুখের মুখ দেখি অমনি দুঃখের দিনের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি ভুলে যাই। ব্ৰহ্ম যদি আনন্দস্বরূপ হন তবে আমাদের এত দুঃখ-বেদনা কোথা থেকে আসে? আমাদের সব দুঃখের মূলে রয়েছে আমাদের অজ্ঞানতা। ব্রহ্মকে জানলে সব দুঃখের অবসান হয়। তখন থাকে শুধু শুদ্ধ অমল আনন্দ—যা অনন্ত ও অপার।

ব্রহ্মকে এখানে ‘অদৃশ্য’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি দৃষ্টিগোচর নন। আবার তিনি ‘অনাত্মা’ অর্থাৎ নিরাকার। এখানে ‘আত্মা’ বলতে অন্তরাত্মাকে বোঝানো হচ্ছে না। এখানে এর অর্থ ‘রূপ’ বা ‘আকার’। ব্রহ্ম নিরাকার, অতএব অদৃশ্য। আবার ব্রহ্ম ‘অনিরুক্ত’, বাক্যের অতীত। তাঁকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না বা তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না। সব জিনিসকে কি ভাষায় বর্ণনা করা যায়? আমরা কি আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি? না, আমরা নির্বাক হয়ে থাকি। হৃদয় যখন পরিপূর্ণ, তখন আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। তারপর উপনিষদ বলছেন, ‘অনিলয়ম্’ অর্থাৎ নিরাশ্রয়। ব্রহ্ম এখানে আছেন বা ওখানে আছেন, এমন কথা বলা যায় না। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। তিনিই সকলের আশ্রয়, তাঁর আশ্রয় আবার কে হবে?

ব্ৰহ্মকে জানলে সাধকের কি অবস্থা হয়? তিনি অভয়পদ লাভ করেন। ‘অভয়ম্’—এই অভয় অবস্থাই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ। আর এই স্বরূপই ব্রহ্ম। ব্রহ্মই ‘প্রতিষ্ঠাম্’ অর্থাৎ আশ্রয়, অধিষ্ঠান। ব্রহ্মই আমাদের আত্মা। অতএব আমি কি আমাকে ভয় পেতে পারি?

‘প্রতিষ্ঠা’ শব্দটির অন্য অর্থও আছে—যথা স্বয়ং-সম্পূর্ণ, স্বতন্ত্র বা স্বাধীন। অর্থাৎ পরনির্ভর নয়। আমরা যখন কোন মানুষ বা পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি, তখন নিরাপত্তার অভাব বোধ করি। যেমন, কৃষককে প্রকৃতির খেয়ালের উপর নির্ভর করতে হয়। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি, উভয় অবস্থাতেই ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং উদ্বেগ আশঙ্কা সবসময় থেকেই যায়। আমরা এমন একটা অবস্থা লাভ করতে চাই যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রভু, বাইরের অবস্থার দাস নই। তাই আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাই। আমরা যে চাঁদে মহাকাশযান পাঠাই তা এই অনন্তের আহ্বানে। এ যে মানবাত্মার ডাক—যে আত্মা স্বয়ং ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মই আমাদের অন্তরাত্মা।

উপনিষদ বলছেন, সাধক যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্মের সঙ্গে সামান্যতম পার্থক্যও বোধ করেন, ততক্ষণ তিনি অজ্ঞান। ততদিন তিনি ভয়মুক্ত নন। তিনি হয়তো বলতে পারেন: ‘আমি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনও সফল হইনি। ব্রহ্মের সঙ্গে এখনও এক হয়ে যাইনি বটে, তবে খুব কাছাকাছি রয়েছি।’ কিন্তু তাঁর এই উক্তি উদ্ভট। হয় তিনি ব্রহ্ম, না হয় তিনি ব্রহ্ম নন—এ হল আত্মজ্ঞান তথা আত্মপ্রত্যয়ের প্রশ্ন। একবার যদি সাধক জানেন তিনি ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নন, তবে কোন কিছু তাঁকে আর সেই অবস্থা থেকে টলাতে পারে না। তিনি তখন সম্পূর্ণ ভয়মুক্ত।

শঙ্করাচার্য বলেন, ‘বহু’ দেখা অজ্ঞানতা এবং এই অজ্ঞানতাই আমাদের সর্বপ্রকার ভয়ের মূল কারণ। দুজন মানুষই হোক বা দুটি পদার্থই হোক, যতক্ষণ এই দুই-বোধ আছে ততক্ষণ সংঘাত বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবকাশ থাকবেই। আবার পরস্পর ভয়ও থাকবে। কিন্তু যখন সাধক বুঝতে পারেন তিনি এক ও অভিন্ন আত্মা, তখন তিনি আর দ্বিতীয় কোন বস্তু দেখেন না, শোনেন না বা জানেন না। তখন কেবল ‘আমি’। যতক্ষণ ‘তুমি-আমি’ বোধ থাকে ততক্ষণ তুমি আমার থেকে আলাদা এই পৃথক বোধও থাকে। তার অর্থ হল অজ্ঞানতা। কিন্তু যখন বোধ হয় এক আত্মা সর্বত্র বিরাজিত, নানা রূপে, নানা নামে এক ‘আমি’ই রয়েছি, তখন আর ভয়ের কোন কারণই থাকে না।

এই অজ্ঞানতাকে আচার্য শঙ্কর ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি হয়তো আকাশে দুটো চাঁদ দেখছেন। কিন্তু বস্তুত আকাশে কি দুটো চাঁদ থাকতে পারে? অবশ্যই না। কেউ দুটো চাঁদ দেখেছেন বলেই তা সত্য হতে পারে না। তেমনি অজ্ঞানতার কারণে মানুষ বহু দেখলেও ‘বহু’ই সত্য হয়ে যায় না।

শঙ্করাচার্য বলছেন, এহেন ব্যক্তি আক্ষেপ করেন, ‘ঈশ্বরঃ অন্যঃ মত্তঃ অহম্ অন্যঃ সংসারী’—ঈশ্বর আর আমি আলাদা। আমি পার্থিব জীব, পাপী এবং তাঁর থেকে ভিন্ন। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, নিজেকে পাপী মনে করাই সবচেয়ে বড় পাপ। ঈশ্বর আমাদের মধ্যে, আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন। তিনি যদি আমাদের মধ্যে থাকেন তবে তিনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারেন না। তিনি আমাদের ভিতরেও আছেন, বাইরেও আছেন। তিনি একযোগে বিশ্বগত এবং বিশ্বাতীত। তিনি সর্বত্র বিরাজমান।

অষ্টম অধ্যায়

ভীষাঽস্মাদ্বাতঃ পবতে। ভীষোদেতি সূর্যঃ। ভীষাঽস্মাদগ্নিশ্চেন্দ্ৰশ্চ। মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চম ইতি। সৈষাঽঽনন্দস্য মীমাংসা ভবতি। যুবা স্যাৎসাধুযুবাঽধ্যায়কঃ। আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ। তস্যেয়ং পৃথিবী সর্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ। স একো মানুষ আনন্দঃ। তে যে শতং মানুষা আনন্দাঃ॥১

স একো মনুষ্যগন্ধর্বাণামানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং মনুষ্যগন্ধর্বাণামানন্দাঃ। স একো দেবগন্ধর্বাণামানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং দেবগন্ধর্বাণামানন্দাঃ। স একঃ পিতৃণাং চিরলোকলোকানামানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং পিতৃণাং চিরলোকলোকানামানন্দাঃ। স এক আজানজানাং দেবানামানন্দঃ॥২

শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতমাজানজানাং দেবানামানন্দাঃ। স একঃ কর্মদেবানাং দেবানামানন্দঃ। যে কর্মণা দেবানপিযন্তি। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং কর্মদেবানাং দেবানামানন্দাঃ। স একো দেবানামানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং দেবানামানন্দাঃ। স এক ইন্দ্রস্যাঽঽনন্দঃ॥৩

শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতমিন্দ্রস্যাঽঽনন্দাঃ। স একো বৃহস্পতেরানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং বৃহস্পতেরানন্দাঃ। স একঃ প্রজাপতেরানন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য। তে যে শতং প্রজাপতেরানন্দাঃ। স একো ব্ৰহ্মণ আনন্দঃ। শ্রোত্রিয়স্য চাকামহতস্য॥৪

অন্বয়: বাতঃ (বাতাস); ভীষা (ভয় থেকে); অস্মাৎ (এর [অর্থাৎ ব্রহ্ম] থেকে); পবতে (বয়); সূর্যঃ (সূর্য); ভীষা উদেতি ([এর] ভয়ে উদিত হয়); অগ্নিঃ চ (অগ্নিও); ইন্দ্রঃ চ (ইন্দ্রও); মৃত্যুঃ পঞ্চমঃ ([এবং] মৃত্যু যা পঞ্চম স্থানীয়); অস্মাৎ ভীষা (এর ভয়ে); ধাবতি (প্রত্যেকে [নিজ কর্ম সম্পাদন করতে] ধাবমান); সা এষা আনন্দস্য মীমাংসা ভবতি (ব্রহ্মানন্দ এমনই [ঠিক যেমন]); যুবা স্যাৎ (একটি যুবক আছে); সাধু যুবা (সৎ যুবক); অধ্যায়কঃ (যিনি শাস্ত্রজ্ঞ); আশিষ্ঠঃ (নেতৃসুলভ ব্যক্তিত্ব); দ্রঢ়িষ্ঠঃ (সুগঠিত দেহ); বলিষ্ঠঃ (বলশালী); তস্য ইয়ং পৃথিবী সর্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ (সমগ্র জগতের সকল সম্পদ যদি তিনি অধিকার করতেন [অর্থাৎ, তিনি যদি সমগ্র জগতের অধীশ্বর হতেন]); সঃ মানুষঃ একঃ আনন্দঃ (সেই আনন্দ [যা মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ আনন্দ] মানব আনন্দের একটি একক); তে যে শতং মানুষাঃ আনন্দাঃ (সেই মানব আনন্দের শতগুণ)।

সঃ (সেই [আনন্দ]); মনুষ্য-গন্ধর্বাণাম্ একঃ আনন্দঃ (মানব গন্ধর্বের [অর্ধ স্বর্গীয় অবস্থায় উন্নীত নরনারী] আনন্দের একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের); তে যে শতং মনুষ্যগন্ধর্বাণাম্ আনন্দাঃ (মানব গন্ধর্বের আনন্দের শতগুণ আনন্দ); সঃ দেব-গন্ধর্বাণাম্ একঃ আনন্দঃ (দেব-গন্ধর্বের [দেবদেবীর আনুকূল্যে যে সব মানুষ অর্ধ স্বর্গীয় অবস্থায় উন্নীত] আনন্দের একটি একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত এক বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং দেব-গন্ধর্বাণাম্ আনন্দাঃ (সেই দেব-গন্ধর্বের আনন্দের শতগুণ) সঃ পিতৃণাং চিরলোকলোকানাম্ একঃ আনন্দঃ (নিত্যধামে [চিরলোক যা বর্তমান কল্পান্ত পর্যন্ত স্থায়ী] বাসকারী পিতৃপুরুষের আনন্দের একটি একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং পিতৃণাং চিরলোকলোকানাম্ আনন্দাঃ (চিরস্বর্গবাসী পিতৃপুরুষের সেই আনন্দের শতগুণ); সঃ আজানজানাং দেবানাম্ একঃ আনন্দঃ (আজান স্বর্গলোকজাত দেবদেবীগণের আনন্দের একক)।

শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত এক বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতম্ আজানজানাং দেবানাম্ আনন্দাঃ (স্বর্গলোকজাত দেবদেবীগণের আনন্দের শতগুণ); সঃ কর্মদেবানাং দেবানাম্ একঃ আনন্দাঃ যে কর্মণা দেবান্ অপিযন্তি (কর্মদেব তথা দেবদেবীগণ, যাঁরা বৈদিক কর্মাদি [যথা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ প্রভৃতি] সম্পাদনের মধ্য দিয়ে স্বর্গে পদমর্যাদা প্রাপ্ত); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং কর্মদেবানাং দেবানাম্ আনন্দাঃ (কর্মদেবগণের আনন্দের শতগুণ); সঃ দেবানাম্ একঃ আনন্দঃ (সেই হল দেবগণের [অর্থাৎ যাঁরা যজ্ঞাগ্নিতে প্রদত্ত আহুতি গ্রহণ করেন] আনন্দের একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং দেবানাম্ আনন্দাঃ (দেবগণের সেই আনন্দের শতগুণ অধিক); সঃ ইন্দ্রস্য একঃ আনন্দঃ (দেবরাজ ইন্দ্রের আনন্দের সেই হল একক)।

শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতম্ ইন্দ্রস্য আনন্দাঃ (ইন্দ্রের আনন্দের শতগুণ); সঃ বৃহস্পতেঃ একঃ আনন্দঃ (বৃহস্পতির [দেব পুরোহিত] আনন্দের সেই হল একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং বৃহস্পতেঃ আনন্দাঃ (বৃহস্পতির আনন্দের শত গুণ অধিক); সঃ প্রজাপতেঃ একঃ আনন্দঃ (সেই হল প্রজাপতির [অর্থাৎ বিরাট তথা সকল স্থূলবস্তুর সমষ্টি] আনন্দের একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের); তে যে শতং প্রজাপতেঃ আনন্দাঃ (প্রজাপতির আনন্দের শতগুণ অধিক); সঃ ব্ৰহ্মণ একঃ আনন্দঃ (সেই হল ব্রহ্মের [হিরণ্যগর্ভ, নিখিল মনের সমষ্টি] আনন্দের একক); শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য (এবং বাসনামুক্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতের)।

সরলার্থ: তাঁর (অর্থাৎ ব্রহ্মের) ভয়ে ভীত হয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়। সূর্যও তাঁর ভয়ে উদিত হয়। অগ্নি, ইন্দ্র এবং পঞ্চম স্থানীয় মৃত্যু তাঁরই ভয়ে ত্রস্ত হয়ে ধাবিত হয় অর্থাৎ স্ব স্ব কার্যে প্রবৃত্ত হয়।

ব্ৰহ্মনন্দ কি তার একটা ধারণা এখানে দেওয়া হয়েছে। এক যুবাপুরুষের দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। তিনি শুধু বয়সেই যুবা নন, উপরন্তু তিনি সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, শাস্ত্রজ্ঞ, সুগঠিত দেহযুক্ত এবং বলিষ্ঠ। ধনসমৃদ্ধ সসাগরা পৃথিবীর তিনি অধিকারী। তখন তাঁর যে আনন্দ হয় তা মানুষের পক্ষে সর্বোত্তম আনন্দ। সেই চূড়ান্ত আনন্দকে একক ধরে নিয়ে তাকে একশ গুণ বর্ধিত করা হল। সেই আনন্দ মনুষ্য-গন্ধর্বদের আনন্দের একটি একক এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সম পরিমাণ। মনুষ্য-গন্ধর্বদের আনন্দের শতগুণ দেব-গন্ধর্বদের আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সম পরিমাণ। দেব-গন্ধর্বদের আনন্দের শতগুণ চিরলোকবাসী (কল্পান্ত পর্যন্ত স্থায়ী) পিতৃপুরুষদের আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। চিরলোকবাসী পিতৃপুরুষগণের আনন্দের শতগুণ আজান-স্বর্গবাসী দেবতাদের আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। আজান-স্বর্গবাসী দেবতাদের আনন্দের শতগুণ কর্মদেবগণের (যাঁরা অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করে দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন) আনন্দ এবং কামনাশুন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। কর্মদেবগণের আনন্দের শতগুণ হল যজ্ঞের আহুতি গ্রহণকারী দেবতাদের (সংখ্যায় তেত্রিশ) এক (পূর্ণমাত্রা) আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। এই দেবগণের আনন্দের শতগুণ আবার দেবরাজ ইন্দ্রের আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। ইন্দ্রের আনন্দের শতগুণ যে আনন্দ তা-ই দেবগুরু বৃহস্পতির এক (পূর্ণমাত্রা) আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। বৃহস্পতির আনন্দের শতগুণ যে আনন্দ, তা-ই প্রজাপতির (অর্থাৎ বিরাটের) এক (পূর্ণমাত্রা) আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ। প্রজাপতির আনন্দ শতগুণ বর্ধিত হলে হয় ব্রহ্মার (বা হিরণ্যগর্ভের) এক আনন্দ এবং কামনাশূন্য বেদজ্ঞ পুরুষের আনন্দও সমপরিমাণ।

ব্যাখ্যা: বায়ু কার আদেশে বয়? ব্রহ্মের আদেশে। ব্রহ্মই কর্তা, রাজাধিরাজ। ঝড়ের তাণ্ডবের সময় বায়ুর প্রচণ্ডতা আমাদের হকচকিয়ে দেয়। কিন্তু এই বায়ুও স্বাধীন নয়। ব্রহ্মের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়।

বেদান্ত জোর দিয়ে বলেন, মুক্ত হওয়াই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু কোন না কোন অভাববোধ মানুষকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। তাই মুক্তির ইচ্ছা মানুষের সহজাত। আকাশে ওড়ার জন্য কেন আমরা বিমান তৈরী করি? কারণ মাটির পৃথিবীতে আমরা বদ্ধ হয়ে থাকতে চাই না। আমরা স্বাধীন হতে চাই। প্রকৃতির বন্ধনকেও আমরা মেনে নিতে চাই না; প্রতি মুহূর্তে তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করি।

উপনিষদ বলেন, এমনকি মৃত্যুও পরাধীন। আমরা অনেক সময় ‘সর্বগ্রাসী মৃত্যু’র কথা বলি। মৃত্যুর কবল থেকে কেউ মুক্ত নয়। মৃত্যুকে তাই সর্বশক্তিমান বলে মনে হয়। এই মৃত্যুকেও নিয়ন্ত্রণ করেন ব্রহ্ম। এ জগতে যা কিছু আছে, এমনকি যা মহাপরাক্রমশালী তাও ব্রহ্মের বলেই বলীয়ান—একথাই উপনিষদ বলতে চাইছেন।

কেন উপনিষদে একটি উপাখ্যান আছে। একবার দেবতারা অসুরদের জয় করে নিজেদের বীর্যবত্তার অহঙ্কার করছিলেন। হঠাৎ তাঁদের সামনে এক বিচিত্র মূর্তির আবির্ভাব হল। মূর্তিটি কে তা তাঁরা জানতেন না। তাই একে একে দেবতারা মূর্তিটির পরিচয় জানতে আগ্রহী হলেন। প্রথমে গেলেন অগ্নি। অগ্নি কিছু বলার আগেই ছায়ামূর্তি বলে উঠলেন, ‘তুমি কে?’ উত্তরে অগ্নি জানালেন, ‘আমি অগ্নি।’ প্রশ্ন হল, ‘তুমি কোন্ কাজে দক্ষ?’ অগ্নি উত্তর দিলেন, ‘আমি এই জগতে সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারি।’ ‘তাহলে এই খড়কুটোটি পোড়াও দেখি’—এই বলে সেই ছায়ামূর্তি অগ্নির সম্মুখে একটি খড়কুটো রাখলেন। অগ্নি বারবার খড়কুটোটি পোড়াতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। তখন বায়ু গেলেন সেই অদ্ভুত মূর্তির কাছে। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। বায়ু শত চেষ্টা সত্ত্বেও খড়কুটোটি ওড়াতে পারলেন না। এইভাবে দেবতারা পরাস্ত হয়ে ফিরে এলেন। সহসা সেই ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে সেখানে এক দেবীমূর্তির আবির্ভাব হল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই দেবীকে ছায়ামূর্তির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। দেবী জানালেন যে, তিনি সকল শক্তির উৎস ব্রহ্ম।

আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘সর্বং চ জগদ্ভয়বদ্ দৃশ্যতে।’ এই জগৎ ভয়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। মানুষ একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত, পরস্পরকে ভয় পায়। আজ যার স্থান সবার উপরে কাল সে ভূলুণ্ঠিত। অতএব সবসময় আমরা ত্রস্ত হয়ে আছি। এইভাবে ভয়তাড়িত হয়ে জীবন এগিয়ে চলে। ব্রহ্ম তাঁর ইচ্ছানুসারে আমাদের কর্ম করতে বাধ্য করেন। মূল কথাটি হল—সবকিছুর পেছনে সেই এক চৈতন্য বিরাজমান।

মানবদেহের কথাই ধরা যাক। দেহে কত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে। প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য একটি বিশেষ কাজ নির্দিষ্ট আছে। প্রতিটি অঙ্গ সুশৃঙ্খল এবং তারা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কাজ করে। কিন্তু কে তাদের সমন্বয় সাধন করে? কি করে তাদের কাজে সঙ্গতি রক্ষা হয়? উত্তর হল—চৈতন্য। আর মানবদেহ যেরকম চৈতন্যময় তেমনি এ জগৎও চৈতন্যে পূর্ণ। সবকিছুর পেছনে রয়েছে এক চৈতন্য। এই চৈতন্য না থাকলে সব ধ্বংস হয়ে যেত। এই চৈতন্যই ব্রহ্ম।

আজকাল বৈজ্ঞানিকরাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন এই জগৎ এক যন্ত্রবিশেষ। যন্ত্রের একটি অংশ বিকল হলে সেই যন্ত্র আর কাজ করে না। মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গকে আমরা উপদ্রব বলে মনে করি এবং নির্বিচারে তাদের ধ্বংস করি। কিন্তু এখন বৈজ্ঞানিকেরা বলছেন, এইভাবে মশককুল ধ্বংস হওয়ার ফলে প্রকৃতিতে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আমরা যে পরস্পর নির্ভরশীল সেকথা আমরা ভুলে যাই। আমরা স্বরূপত এক। সকলের বিনিময়ে শুধু জগতের একটি অংশ বেঁচে থাকবে তা হতে পারে না। এই জগৎ এক অভিন্ন সত্তা। এর প্রতিটি অংশেরই একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এমনকি মৃত্যুরও নিজস্ব ভূমিকা আছে। এ সবের নিয়ন্তা কে? ব্রহ্ম।

এরপর উপনিষদ আমাদের আনন্দের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে বলছেন। আমরা শুনি ব্রহ্মই সবকিছুর নিয়ন্তা ও উৎস। কিন্তু ব্রহ্ম কি আনন্দেরও উৎস? যদি হন, তবে সেই আনন্দ কিরকম? এখানে উপনিষদ ব্রহ্মানন্দের স্বরূপ বর্ণনা করে আমাদের আত্মজ্ঞান লাভে উৎসাহিত করছেন। বলছেন, ‘ও, তুমি ভাল খাবার খাওয়ার আনন্দকেই চূড়ান্ত আনন্দ বলে মনে করছ! কিন্তু সব আনন্দের সেরা আনন্দ যে আত্মজ্ঞান তা কি তুমি জান না—আচ্ছা, পরীক্ষা করে দেখা যাক।’

মানুষ সবচেয়ে বেশী কি চায়? এর উত্তরে অধিকাংশ মানুষই বলে থাকে, ‘আমি ধনী হতে চাই।’ কিন্তু ধনলাভই মানুষের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ, বৃদ্ধ হলে মানুষ ধনসম্পদ ভোগ করতে পারে না। তাই যৌবন চাই। আবার কেউ হয়তো বয়সে যুবা হলেও রুগ্ন, বেশী কাজকর্ম করতে পারে না। সুতরাং শুধু যৌবন থাকলেই চলবে না, স্বাস্থ্যও চাই। আবার একইসঙ্গে পরিণত জ্ঞানবুদ্ধিও থাকা চাই। বুদ্ধি থাকলেই অর্থের সদ্ব্যবহার সম্ভব; নতুবা অপচয়ে বিত্তনাশ অনিবার্য।

উপনিষদ এখানে ‘আশিষ্ঠঃ’, ‘দ্রঢ়িষ্ঠঃ’ এবং ‘বলিষ্ঠঃ’ এই শব্দ তিনটি ব্যবহার করেছেন। ‘আশিষ্ঠঃ’ কথাটির অর্থ যাঁর নেতৃসুলভ ব্যক্তিত্ব আছে। এর অন্য অর্থ হল কাজেকর্মে দক্ষ এবং চটপটে। এমন ব্যক্তি সপ্রতিভ ও নিয়মনিষ্ঠ হন। ‘দ্রঢ়িষ্ঠঃ’-এর অর্থ হল যাঁর দেহ সুগঠিত। ‘বলিষ্ঠঃ’ কথাটির অর্থ ‘শক্তিশালী’। এর আর একটি অর্থ হতে পারে ‘দৃঢ়চেতা’—যাঁর চিন্তা স্বচ্ছ এবং দৃঢ়—তিনি জানেন তিনি কি চান। যারা সবসময় সঙ্কল্প-বিকল্পের দোলায় দুলছে, তিনি তাদের মতো নন।

ধরা যাক, কোন ব্যক্তির উপরোক্ত সব গুণই আছে। তদুপরি তিনি ধনসমৃদ্ধ সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর। অধিকাংশ লোকই মনে করবেন, এর চেয়ে অধিক কাম্য আর কি হতে পারে? কিন্তু উপনিষদ বলছেন, এ শুধু এক রকমের আনন্দ। এই আনন্দের শতগুণ হল গন্ধর্বের আনন্দ। গন্ধর্বরা পূর্বজন্মে মানুষ ছিলেন। এখন উন্নত হয়ে স্বর্গে সঙ্গীত শিল্পীর পদ লাভ করেছেন। দেবদেবীদের গান শোনানোই তাঁদের কাজ। এ পদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেবতারা একত্র হলেই সেখানে সঙ্গীতের আসর বসে।

‘পিতৃ’ অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাঁরা নানা সদ্‌গুণের অধিকারী। তাঁরা ‘চিরলোক’ তথা নিত্যধামের অধিবাসী। কিন্তু তাঁদের অমরত্বও আপেক্ষিক। চিরলোকে তাঁরা কল্পান্ত পর্যন্ত বাস করতে পারেন। তারপর আছেন বিভিন্ন স্তরের দেবতারা। তাঁদের মধ্যে কেউ গৌণ, কেউ বা মুখ্য। প্রতিটি স্তরের আনন্দ তাঁর পূর্ববর্তী স্তরের আনন্দের শতগুণ। তারপর আছে দেবরাজ ইন্দ্র এবং দেবগুরু বৃহস্পতির আনন্দ।

ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু এইসব দেবতার নাম কার্যত এক একটি পদ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে যে কোন সজ্জন ব্যক্তি ইচ্ছে করলে এই পদে উন্নীত হতে পারেন। দেবদেবী বলতে কি বোঝায়? যাঁরা মহৎ প্রাণ তাঁরাই দেবদেবী। তা তিনি এই পৃথিবী বা অন্য যে কোন লোকের অধিবাসী হোন না কেন, সেসব প্রশ্ন অবান্তর।

দেখা যাচ্ছে মূল শ্লোকে একটি বাক্যের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, ‘শ্রোত্রিয়স্য চ অকামহতস্য’। ‘শ্ৰোত্ৰিয়’ অর্থ হল যিনি শাস্ত্রজ্ঞ এবং সত্যদ্রষ্টা। যেহেতু তিনি সত্যকে জেনেছেন সেহেতু তিনি ‘অকামহত’ অর্থাৎ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত। ‘অকামহত’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘যিনি বাসনার দ্বারা হত নন’। ‘হত’ অর্থ ‘নিহত’ অর্থাৎ ‘কামহত’ শব্দটির অর্থ ‘যিনি বাসনার দ্বারা নিহত’। বাসনা আমাদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ফলে আমরা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসনার দাস হয়ে উঠি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর এক বক্তৃতায় বলছেন, ‘তোমরা স্বাধীন ইচ্ছার কথা বল, কিন্তু তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা কোথায়? তোমাদের মন কি তোমাদের বশে আছে?’ মন যতক্ষণ বশে না আসে ততক্ষণ কেমন করে বলব আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে?

কিন্তু উপনিষদ বলছেন, শুধু নির্বাসনা হলেই হবে না। একটা টেবিলেরও কোন বাসনা নেই। আমরা কি সেইরকম হতে চাই? আমরা কি জড় হয়ে থাকতে চাই? না, আমরা ‘শ্রোত্রিয়’ অর্থাৎ বেদজ্ঞও হব। ‘শ্রোত্রিয়’ শব্দটি ‘শ্রুতি’ থেকে এসেছে। ‘শ্রুতি’ কথাটির অর্থ বেদ। আমাদের বেদজ্ঞ হতে বলেছেন কেন? কারণ বেদপাঠ করলে আমরা উচিত-অনুচিত, ভালমন্দ বিচার করতে পারব।

কখন মানুষ যথার্থ ‘অকামহত’ হয় অর্থাৎ নির্বাসনা লাভ করে? যখন সে তার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারে; সব বস্তুর উৎস ব্রহ্মের সঙ্গে সে যখন একত্ব অনুভব করে। তখন আনন্দের জন্য তাকে আর বাইরের বস্তুর উপর নির্ভর করতে হয় না। সে তখন আপ্তকাম, আত্মরতি।

সাধারণ মানুষের আনন্দ নির্ভর করে কোন বাসনা পূরণ বা উচ্চতর লোক প্রাপ্তির ওপর। কিন্তু বাসনামুক্ত মানুষ বাহ্যবস্তুর সম্পর্ক ছাড়াই এই পৃথিবীতে শাশ্বত আনন্দের অধিকারী হন।

আচার্য শঙ্কর বলছেন, সুখাদ্য, ভাল পোশাক, রাজনৈতিক ক্ষমতা এসব থেকে যে পার্থিব আনন্দ লাভ হয় তা-ও ব্রহ্ম থেকেই আসে। এই লৌকিক আনন্দ ব্রহ্মানন্দের একটি ক্ষীণধারা মাত্র। শঙ্করাচার্য বিষয়ানন্দকে বিক্ষিপ্ত জলবিন্দুর সঙ্গে এবং ব্রহ্মানন্দকে অতল সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। উভয় আনন্দই আনন্দ। কিন্তু বিষয়ানন্দ শুদ্ধ নয়। কারণ অশুদ্ধ মাধ্যমের ভেতর দিয়েই এই সুখ আসে। মাধ্যমটি সরিয়ে নিলে দেখা যায় আনন্দের উৎস আমাদের ভেতরেই রয়েছে। সেই আনন্দ থেকে আমি পৃথক নই। আমি আর আনন্দ এক ও অভিন্ন। জলবিন্দুগুলি সমুদ্রে গিয়ে পড়লে যেমন সমুদ্রই হয়ে যায় ঠিক তেমনি আমিও আনন্দের সাথে একাকার হয়ে যাই।

শঙ্করাচার্য বলছেন, পার্থিব আনন্দ ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ সেই আনন্দের অভিজ্ঞতা স্থায়ী হয়। যেমন, যতক্ষণ মিষ্টি খাচ্ছি ততক্ষণই সুখ। মিষ্টি খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই সুখেরও অবসান হয়। এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। আর এইজন্যই আমরা ধর্মের দিকে ঝুঁকি। নতুবা কে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতো? আমরা সকলে পরমানন্দকেই চাই। সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য লোক থেকে লোকান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করি; কিন্তু অসন্তোষ থেকেই যায়। যতক্ষণ না ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব অনুভব করছি, ততক্ষণ আমাদের অতৃপ্তি বোধ থাকবেই। ব্রহ্মই সকল আনন্দের উৎস। ব্রহ্মেই সকল অতৃপ্তির অবসান।

স যশ্চায়ং পুরুষে। যশ্চাসাবাদিত্যে। স একঃ। স য এবংবিৎ। অস্মাল্লোকাৎপ্ৰেত্য। এতমন্নময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং প্রাণময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং মনোময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। এতং বিজ্ঞানময়মাত্মান মুপসংক্রামতি। এতমানন্দময়মাত্মানমুপসংক্রামতি। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি॥৫॥ ইতি অষ্টমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: সঃ যঃ চ অয়ং পুরুষে (যিনি এই দেহের মধ্যে); যঃ চ অসৌ আদিত্যে (এবং যিনি ওই সূর্যের মধ্যে); সঃ একঃ (তিনি অভিন্ন); যঃ এবংবিৎ (যিনি এ কথা জানেন); সঃ (তিনি); অস্মাৎ লোকাৎ প্ৰেত্য (এই জগৎ ত্যাগ করে); এতম্ অন্নময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (স্থূলদেহের আত্মার সঙ্গে একত্বলাভ করেন); এতং প্রাণময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্ৰামতি (প্রাণরূপ আত্মার সঙ্গে একত্বলাভ করেন); এতং মনোময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (মনরূপ আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন); এতং বিজ্ঞানময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (বুদ্ধিরূপ আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন); এতম্ আনন্দময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রামতি (আনন্দময় আত্মার সাথে অভিন্ন বোধ করেন); তৎ অপি এষঃ শ্লোকঃ ভবতি (এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে); ইতি অষ্টমঃ অনুবাকঃ (এখানে অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: এই দেহের মধ্যে হৃদয়াকাশে যিনি, তিনিই আবার ওই সূর্যের মধ্যেও রয়েছেন। যে ব্যক্তি একথা জানেন এবং একই সঙ্গে যিনি জগৎ সম্পর্কে উদাসীন (কারণ তিনি বাসনামুক্ত), তিনি প্রথমে নিজেকে অন্নময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন বোধ করেন। এরপর যথাক্রমে প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় এবং আনন্দময় আত্মার সঙ্গে তিনি একত্ব বোধ করেন (তারপর তিনি পরমাত্মা তথা ব্রহ্মে লীন হয়ে যান)। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম কখনও প্রকাশিত অর্থাৎ ব্যক্ত; কখনও বা তিনি অব্যক্ত। ব্রহ্ম যখন নিজেকে জগৎ রূপে ব্যক্ত করেন তখন এই জগতের প্রতিটি অংশে তিনি বিরাজমান। কিন্তু ব্যক্ত বা অব্যক্ত উভয় অবস্থাতেই তিনি আনন্দরূপে সর্বত্র রয়েছেন। উপনিষদ এখানে সূর্য এবং মানুষের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। দূর আকাশে রয়েছে সুবিশাল ও মহা শক্তিশালী সূর্য, আর অন্যদিকে পৃথিবীর ক্ষুদ্র দুর্বল মানুষ। কিন্তু মানুষের এই ক্ষুদ্র দেহেও পরমাত্মা তথা ব্রহ্ম বিরাজ করেন। আবার আমাদের ভিতরে যিনি, সূর্যের ভিতরেও তিনি। একই আত্মা সর্বত্র বিরাজিত। শ্রীরামকৃষ্ণ বালিশের উপমা দিতেন। কোন বালিশ গোলাকৃতি, কোনটা লম্বা, কোনটা মাথার বালিশ আবার কোনটা বা পায়ের। কিন্তু আকৃতি যেমনই হোক না কেন প্রত্যেকটি বালিশের ভিতর একই উপাদান অর্থাৎ তুলো। অনুরুপভাবে, এক ব্রহ্ম তথা এক আত্মা নানা রূপে নানা নামে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

আচার্য শঙ্কর ঘটের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। ঘটের ভিতরে যে আকাশ (ঘটাকাশ), বাইরেও সেই একই আকাশ (পটাকাশ)। ঘটটি যেন আকাশকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে। আমরাও প্রত্যেকে এক একটি ঘটের মতো। আপনি একটি ঘট, আমি আর একটি ঘট। নামরূপের দ্বারা আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, কিন্তু স্বরূপত এক। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত চেতন-অচেতন যত বস্তু আছে সবই ব্রহ্ম। জীব (ব্যষ্টি) ও জগৎ (সমষ্টি) স্বরূপত এক ও অভিন্ন—এই বেদান্তের সিদ্ধান্ত।

‘সঃ য এবংবিৎ’—যিনি একথা জানেন। অর্থাৎ যিনি একথা জানেন তিনি ব্রহ্মকে জানেন। বেদান্তমতে, অজ্ঞানতার লক্ষণই হল ভেদবুদ্ধি অর্থাৎ ‘বহু দেখা’। ‘এক’ দেখাই জ্ঞান। এ তত্ত্ব শুধু বুদ্ধি দিয়ে জানলে হবে না, এ ‘জানা’র অর্থ ‘হয়ে ওঠা’—এই বেদান্তের অভিমত। শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বত্র এক দর্শন করতেন, সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন বোধ করতেন। প্রথমে অবশ্য এই তত্ত্বকে শুধু বুদ্ধি দিয়ে ধারণা করেও আমরা অগ্রসর হতে পারি। অন্যের প্রতি আমাদের মনোভাব তখন ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। তখন আর কাউকে আমরা আঘাত করতে পারি না। ‘অস্মাৎ লোকাৎ প্রেত্য’—এই দৃশ্যমান জগৎ থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। ‘প্ৰেত্য’ কথাটির অর্থ ‘প্রত্যাহার করা’। এই শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কথাটি এসেছে ‘প্র + ই’ থেকে—‘ই’ অর্থ হল ‘যাওয়া’ এবং ‘প্র’ মানে ‘আগে’ বা ‘ঊর্ধ্বে’। অর্থাৎ তিনি এই জগতের ঊর্ধ্বে উঠে যান, জগৎ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু এই দেহ থাকতে কিভাবে জগৎ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া যায়? শঙ্করাচার্য এখানে উপনিষদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলছেন: আমাদের অনাসক্ত হতে হবে। বৈরাগ্যের অর্থ হল ‘অনাসক্তি’, অর্থাৎ কোন কিছুতে আসক্ত না হওয়া। তুমি হয়তো প্রভূত সম্পদের অধিকারী। কিন্তু তোমার যদি কিছুতে আসক্তি না থাকে, তবে তুমি প্রকৃত বৈরাগ্যবান। মিথিলার রাজা জনক একবার বলেছিলেন, ‘মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে কিঞ্চিৎ প্রদহ্যতে’—‘সারা মিথিলা পুড়ে ছারখার হয়ে গেলেও তাতে আমার কিছু আসে যাবে না।’ তিনি উদাসীন, নির্লিপ্ত সাক্ষী-মাত্র! তিনি জীবন্মুক্ত।

আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, ‘এ জগৎই একমাত্র সত্য।’ এ জগৎ যে অনিত্য এবং পরিবর্তনশীল একথা আমরা বুঝতে পারি না। বেদান্ত বলেন, এ জগৎ ‘স্বপ্নবৎ’, স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন দেখার সময় আমরা বুঝি না আমরা স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে বুঝি, এতক্ষণ যা দেখছিলাম তা সত্য নয়। সেইরকম ভাবে যখন বুঝতে পারি স্বপ্নের মতো এ জগৎও মিথ্যা, তখনই আমরা নিজেদের জগৎ থেকে গুটিয়ে নিই। তখন আমরা বলি, ‘বাস্তবিক, এ জগতের স্বভাবই অনিত্য।’

বর্তমানে আমরা এই জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছি; জগতের সঙ্গেই একাত্ম বোধ করি। কিন্তু এর যথার্থ প্রকৃতি যখন আমাদের কাছে ধরা পড়ে তখন এই জগৎ ‘মজার কুটি’। শেক্সপিয়ার তাঁর ‘As You Like It’ নাটকে বলছেন : ‘সমগ্র পৃথিবী এক রঙ্গমঞ্চ। আর সকল নারী পুরুষ এখানে অভিনেতার ভূমিকায়। রঙ্গমঞ্চে ঢুকবার এবং বেরোবার দুটি দরজা থাকে। তার ভেতর দিয়ে অভিনেতারা ঢোকে, আবার বেরিয়ে যায়। এই জগৎও ঠিক সেইরকম।’

এখন কিছু লোক আপত্তি তুলতে পারেন, ‘তোমরা পলায়নী মনোবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছ।’ কিন্তু বস্তুত তা নয়। একে বলা চলে ‘বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী’। এ জগৎকে অনিত্য বলে বুঝতে পারলে আর একে সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। হতে পারে আজ আপনি স্বাস্থ্যবান যুবক বা খুব ধনী অথবা আপনার অনেক রাজনৈতিক ক্ষমতা। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন চিরকাল এরকমই চলবে তাহলে ভুল করবেন। একদিন এ স্বাস্থ্য আপনার থাকবে না, আপনি বৃদ্ধ হবেন। আর যে কোন দিন আপনার ধনসম্পদ বা ক্ষমতা আপনার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

এই পরিবর্তনকে যদি মেনে না নিই, তবে দুঃখভোগ অনিবার্য। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী—একথা মেনে নিলে অনাসক্তি আপনিই আসে। যখন উপলব্ধি হয় এক আত্মা সর্বত্র রয়েছেন তখন মন সম্পূর্ণ উদ্বেগশূন্য হয়।

এই অবস্থায় কি হয়? নিখিল বিশ্বের সাথে মানুষ একাত্ম বোধ করে। এমন-কি স্থূলদেহের স্তরেও এই একত্বের অনুভূতি হয়। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ একজনকে কোমল ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে দেখে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল লোকটি যেন তাঁর বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর একবার দুজন মাঝি ঝগড়া করতে করতে একজন আর একজনকে প্রহার করতে থাকে। তাই দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজ দেহে যন্ত্রণা অনুভব করেন। পরে দেখা গেল তাঁর দেহেও প্রহারের দাগ ফুটে উঠেছে। তিনি সমগ্র জগৎকে নিজের দেহ বলে মনে করতেন।

আবার মনের স্তরেও মানুষ তখন একত্ব অনুভব করে। আমাদের দেহ যেমন এক, তেমনি মনও এক। এই সমষ্টি মনকে কখনও কখনও হ্রদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। হ্রদের এক অংশে ছোট ঢেউ উঠলে ক্রমশ সেই ঢেউ সমগ্র হ্রদে ছড়িয়ে পড়ে। যোগীরা এই কারণেই অন্যের মনের কথা সহজে জানতে পারেন বলে দাবী করে থাকেন। একজন যা চিন্তা করে তা কোন না কোন ভাবে অন্যের মনেও অনুরূপ তরঙ্গের সৃষ্টি করে।

যোগীরা বলেন, আধ্যাত্মিক উন্নতির একটা বিশেষ স্তরে পৌঁছে অপরের মনের কথা জানা যায়। স্বামীজীর এই ক্ষমতা ছিল। গুডউইন যখন প্রথম স্বামীজীর ভাষণ লিখতে এলেন তখন দর্শন শাস্ত্রের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। একদিন তিনি স্বামীজীর সামনেই হিন্দুদর্শনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলেন। হঠাৎ স্বামীজীর সামনে গুডউইনের সমগ্র মনোজগৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ল। গুডউইনকে তিনি প্রথমে বালক ও পরে যুবকরূপে দেখতে পেলেন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁকে স্বামীজী দেখলেন। গুডউইনের সমগ্র জীবন ছায়াছবির মতো স্বামীজীর চোখের সামনে ভাসতে লাগল। তিনি গুডউইনকে বললেন, ‘ওহে, আমি তোমার কথায় একটুও অবাক হচ্ছি না। তুমি অতীতে কেমন ছিলে আমি জানি। তুমি এই এই করেছ। বল, তুমি এইরকম ছিলে না?’ এইভাবে বলে যেতে লাগলেন। গুডউইন তখন স্বামীজীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

শঙ্করাচার্য ‘উপসংক্রামতি’ কথাটি নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কের অবতারণা করেছেন। কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘তিনি কোন কিছুর ভিতরে প্রবেশ করেন’ অথবা ‘তিনি ভিতরে যান’। আচার্য শঙ্কর জানেন, এই শব্দার্থ শুনেই দ্বৈতবাদীরা বলবেন, ‘এর অর্থ হল একজন আছেন যিনি প্রবেশ করেন এবং তাঁর একটা গন্তব্যস্থলও আছে। অর্থাৎ দ্বিতত্ত্বই সত্য। এ যেন অনেকটা জোঁকের মতো। জোঁক এক পাতা থেকে অন্য পাতায় ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে। অদ্বৈত মতে ব্রহ্ম যদি সর্বত্র থাকেন তবে তাঁর পক্ষে কি স্থান পরিবর্তন করা সম্ভব? কিভাবে তিনি স্থান থেকে স্থানান্তরে যাবেন?’

কিন্তু শঙ্করাচার্য বলেন, ব্রহ্মে চলাফেরা বা স্থান পরিবর্তন বলে কিছু নেই। অজ্ঞানতার কারণে ব্রহ্মকে সচল বলে মনে হয়। অজ্ঞানতা দূর হলে আত্মজ্ঞান লাভ হয়। তখন সেই এক আত্মাকে সর্বত্র দেখা যায়। আর এক জায়গায় আচার্য শঙ্কর বলছেন : এটি উপলব্ধির বিষয়। চোখের অসুখ হলে কেউ আকাশে দুটো চাঁদ দেখতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, দ্বিতীয় চাঁদটিও সত্য। তেমনি সত্যকে জানলে মানুষ আর ‘বহু’ দেখে না, সর্বত্র তখন এক দর্শন হয়। সর্বভূতে এক আত্মা আছেন, এই তত্ত্ব তখন বোধে বোধ হয়।

নবম অধ্যায়

যতো বাচো নিবর্তন্তে। অপ্রাপ্য মনসা সহ। আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান্। ন বিভেতি কুতশ্চনেতি।

এতং হ বাব ন তপতি। কিমহং সাধু নাকরবম্। কিমহং পাপমকরবমিতি। স য এবং বিদ্বানেতে আত্মানং স্পৃণুতে। উভে হ্যেবৈষ এতে আত্মানং স্পৃণুতে। য এবং বেদ। ইত্যুপনিষৎ॥১॥ ইতি নবমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: বাচঃ (বাক্য); মনসা সহ (মন সহ); অপ্রাপ্য (না পেয়ে); যতঃ (তার [ব্ৰহ্ম] থেকে); নিবর্তন্তে (ফিরে আসে); ব্ৰহ্মণঃ ([যিনি] ব্রহ্মের); আনন্দং বিদ্বান্ (আনন্দকে [নিজের স্বরূপ বলে] জানেন); কুতশ্চন ন বিভেতি (কারো দ্বারা ভীত হন না [কারণ তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই])।

এতং হ বাব (এই জাতীয় চিন্তা); কিম্ (কেন); অহং সাধু ন অকরবম্ (আমি কোন সৎকাজ করিনি); কিম্ (কেন); অহং পাপম্ অকরবম্ (নিষিদ্ধ কর্ম করেছি); ইতি (এই [স্মৃতি]); ন তপতি (বিবেককে দংশন করে না); সঃ (সে); যঃ (যে); এতে (এই সব [অর্থাৎ সৎ কর্ম না করা আর নিষিদ্ধ কর্ম করা]); এবম্ (পূর্বে উল্লিখিত); বিদ্বান্ (জেনে [যে সেগুলি তার নিজ আত্মার প্রকাশ]); আত্মানং স্পৃণুতে (নিজেকে আশ্বস্ত করে); হি (কারণ); এষঃ (এই [ব্যক্তি যিনি বস্তুর একত্বকে জানেন]; এতে (এই দুই [অর্থাৎ সৎ কর্ম না করা ও নিষিদ্ধ কর্ম করা]); উভে এব (উভয়েই); আত্মানং স্পৃণুতে (আত্মার সাথে অভিন্ন [এই ব্যক্তিটি কে?]); যঃ এবং বেদ (যিনি নিজেকে [আত্মার সঙ্গে অভিন্ন] জানেন); ইতি উপনিষদ্ (এই হল উপনিষদ, তথা ব্রহ্মবিদ্যা বা গুহ্যতত্ত্ব); ইতি নবমঃ অনুবাকঃ (এখানে নবম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: বাক্য ও মন ব্রহ্মকে প্রকাশ করতে না পেরে তাঁর (ব্রহ্ম) থেকে ফিরে আসে। যিনি ব্রহ্মের আনন্দ উপলব্ধি করেছেন তিনি কোন কিছুকেই আর ভয় পান না (কারণ সর্বত্র ব্রহ্ম ব্যতীত তিনি অন্য কিছু দর্শন করেন না)।

‘আমি কেন সৎকাজ করিনি?’ অথবা, ‘কেন পাপকাজ করেছি?’—এই ধরনের প্রশ্ন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে কখনও বিচলিত করে না। ভালমন্দ তাঁর কাছে একাকার। কারণ তিনি জানেন ভাল বা মন্দ উভয়ের উৎসই ব্রহ্ম—যে ব্রহ্ম তাঁরই আত্মা। এই হল উপনিষদ অর্থাৎ গুহ্যতত্ত্ব।

ব্যাখ্যা: ‘যতঃ বাচঃ নিবর্তন্তে’—যাঁর থেকে বাক্য নিবৃত্ত হয়ে ফিরে আসে। আত্মাকে কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? সসীম কি অসীমকে বর্ণনা করতে পারে? না, পারে না। আত্মা বাক্যমনাতীত। ‘মনসা সহ’—মনও ব্রহ্মকে চিন্তা করতে সক্ষম হয় না। আমরা কেবল আমাদের পরিচিত বস্তুকেই চিন্তা করতে পারি। যার সম্বন্ধে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই তার কথা কেমন করে ভাবব? আমাদের চিন্তা আমাদের অভিজ্ঞতার গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ।

‘আনন্দং ব্ৰহ্মণঃ’—ব্রহ্মকে জানলে আনন্দ লাভ হয়। কারণ ব্রহ্মই আনন্দ আবার আনন্দই ব্রহ্ম। উপনিষদ বলেন, ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। সেইজন্য আমাদের সকল সুখ, এমনকি দেহসুখও ব্রহ্ম থেকে আসে। ব্রহ্মই সকল আনন্দের উৎস।

‘ন বিভেতি কুতশ্চন’—ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কোন কিছুকে ভয় করেন না। ব্রহ্মকে জানলে দুই-বোধ চিরতরে ঘুচে যায়। সুতরাং ভয়ের কারণও থাকে না। তখন সর্বত্র সেই এক ব্রহ্ম। আমাদের সকল ভয়ের উৎপত্তি দুই-বোধ থেকে অর্থাৎ ‘তুমি আর আমি আলাদা’ এই পৃথক বোধ থেকে। তখন মন সংশয়ের দোলায় দুলতে থাকে—‘তুমি আমার থেকে শক্তিমান; অতএব আমাকে আঘাত করতে পারো’। কিন্তু যখন সর্বত্র এক দর্শন হয় তখন কে কাকে আঘাত করবে?

কিন্তু মৃত্যুকালে কি হয়? উপনিষদ বলেন, মৃত্যুকালে সাধারণ মানুষ তার সারাজীবনের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে। তখন তার মনে দু’ধরনের অনুশোচনা হয়। তার মনে হয়, ‘কেন আমি সৎ কর্ম করিনি?’ হয়তো সে বহু সৎকাজ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কোন কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার আরও মনে হয়, ‘ওই মন্দ কাজগুলো কেন করতে গেলাম? এগুলো না করলেই তো হত।’ এই জাতীয় নানা চিন্তা তখন তাকে পীড়িত করে।

কিন্তু যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন পাপ-পুণ্যের চিন্তা তাঁকে আর বিচলিত করে না। কারণ তিনি তখন পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে। আচার্য শঙ্কর বলেন, আত্মজ্ঞ পুরুষের কাছে ভালমন্দ ভেদ থাকে না। ভালমন্দের ধারণা আপেক্ষিক। যতক্ষণ আমরা ব্যবহারিক জগতের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখি ততক্ষণ ভালমন্দের বোধও থাকে। কিন্তু আর এক অবস্থায় সকল দ্বৈত বুদ্ধি ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যায়। তখন থাকে শুধু এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, এই অবস্থায় ‘আমি আছি’ এই বোধটুকু মাত্র থাকে। আমি কে, আমি কোথায়, আমি কি করছি—এইসব ভাব আপেক্ষিক জগতের। এইসব চিন্তা থেমে গেলে কেবল ‘আমি আছি’ এই বোধ ছাড়া আর কিছু থাকে না। কিন্তু সগুণ ঈশ্বরে যাঁর অনুরাগ তাঁর কি হয়? তাঁরও অনুরূপ অভিজ্ঞতা হয়। তফাৎ শুধু এই যে, তিনি সবার মধ্যে নিজেকে না দেখে তাঁর প্রিয়তমকে, তাঁর প্রভুকে দেখতে পান। তাঁর আর কোন শত্রু নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ এক সাধুর গল্প বলতেন। সেই সাধু একবার কারোর প্রহারে অচৈতন্য হয়ে পড়েন। একথা জানতে পেরে তাঁর গুরুভাইরা গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে মঠে নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে গুরুভাইরা তাঁকে একটু দুধ খাওয়ান। তাঁর জ্ঞান কতটা ফিরেছে পরীক্ষা করার জন্য একজন গুরুভাই তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘কে আপনাকে দুধ খাওয়াচ্ছে চিনতে পারছেন কি?’ অসুস্থ সাধুটি উত্তর দিলেন, ‘যিনি আমাকে মেরেছিলেন, তিনিই এখন আমাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন।’ অর্থাৎ তাঁর কাছে এখন সবাই ভগবান। একই ঈশ্বর আগের মুহূর্তে তাঁকে আঘাত করেছেন, আবার পরমুহূর্তেই তাঁর সেবা করছেন।

ধরা যাক, কেউ সর্বত্র ব্রহ্ম দেখছেন। অর্থাৎ সর্বত্র নিজেকেই দেখছেন। যদি এক সওাই সর্বত্র বিরাজ করেন তবে ভালমন্দের কোন অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু ব্যবহারিক জগৎকে সত্য বলে মনে করলে ভালমন্দের পার্থক্যও মেনে নিতে হয়।

ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি দ্বৈত জগতের ব্যাপার। একজন মানুষ আর একজনকে ঠকায়, কারণ সে নিজেকে অন্যজনের থেকে পৃথক বলে মনে করে; অভিন্ন বোধ করলে আর ঠকাতে পারে না। আমি কি আমাকে ঠকাতে পারি? সুতরাং সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান যাঁর লাভ হয়েছে তিনি আর কোন মন্দ কাজ করতে পারেন না। তিনি যদি মন্দ কাজ করতেও চান, তবুও ব্যর্থ হন।

আচার্য শঙ্কর এই জ্ঞানকে ‘পরমরহস্যম্’ অর্থাৎ গুহ্যবিদ্যা বলেছেন। এই জ্ঞান সকলের জন্য নয়। সাধারণ মানুষ এসব কথা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে ভাবে, ‘ভালমন্দের তফাতই যদি না থাকে তাহলে সমাজব্যবস্থা চলবে কি করে?’ এখন প্রশ্ন হল : ভালমন্দের বিচার আমরা কি করে করব? শাস্ত্রের সাহায্যে। শাস্ত্র আমাদের বলে দেবে কোন্‌টা ভাল কোন্‌টা মন্দ। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের জীবন ও বাণীই হল শাস্ত্র। তাঁদের জীবনই আমাদের আদর্শ। যেহেতু তাঁরা সর্ব বস্তুতে নিজের আত্মাকেই দেখেন, সেহেতু তাঁরা যা করেন তা-ই আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।

॥ ব্রহ্মানন্দবল্লী এখানেই সমাপ্ত॥

তৃতীয় খণ্ড – ভৃগুবল্লী

প্রথম অধ্যায়

ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥

সরলার্থ: ব্রহ্ম যেন আমাদের উভয়কে সমভাবে রক্ষা করেন। এই বিদ্যার দ্বারা আমরা উভয়ে যেন সমভাবে উপকৃত হই। আমরা উভয়েই যেন সমভাবে এই বিদ্যাশিক্ষার জন্য কঠোর শ্রম স্বীকার করি। আমাদের অধীত বিদ্যা যেন সমভাবে উভয়কেই ফল দান করে। পরস্পরের প্রতি আমাদের যেন বিদ্বেষ না থাকে।

ওঁ শান্তি। শান্তি। শান্তি।

ভৃগুর্বৈ বারুণিঃ। বরুণং পিতরমুপসসার। অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি। তস্মা এতৎ প্রোবাচ। অন্নং প্রাণং চক্ষুঃ শ্রোত্ৰং মনো বাচমিতি। তং হোবাচ। যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে। যেন জাতানি জীবন্তি। যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব। তদ্ ব্রহ্মেতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা॥১॥ ইতি প্রথমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: ভৃগুঃ বৈ বারুণিঃ (বরুণপুত্র যিনি ভৃগু বলে পরিচিত); পিতরং বরুণম্ উপসসার ([ব্রহ্মজিজ্ঞাসু হয়ে] পিতা বরুণের সমীপবর্তী হলেন [যথাবিধি]); ইতি ([এবং] এ কথা বললেন); ভগবঃ (হে ভগবান); ব্রহ্ম অধীহি (অনুগ্রহ করে আমাকে ব্রহ্ম সম্পর্কে শিক্ষা দান করুন); তস্মৈ (তাঁকে [ভৃগুকে]); এতৎ প্রোবাচ ([তাঁর পিতা] একথা বললেন); অন্নম্ (খাদ্য [অর্থাৎ অন্নময় স্থূলদেহ]); প্রাণম্ (জীবনী-শক্তি তথা প্রাণ); চক্ষুঃ (চোখ); শ্রোত্রম্ (কান); মনঃ (মন); বাচম্ (বাক্ [বাগিন্দ্রিয়]); [এইসব ইন্দ্রিয়ের কার্য ব্যাখ্যা করে তিনি দেখালেন যে এরা কিভাবে ব্রহ্মোপলব্ধিতে সহায়তা করে]; তং হ উবাচ (তাঁকে [ব্রহ্ম কেমন] তাও বললেন); যতঃ (যাঁর থেকে [অর্থাৎ উৎসরূপ ব্রহ্ম থেকে]); বৈ (উদাহরণ হিসাবে); ইমানি (এই সব); ভূতানি ([ব্রহ্ম থেকে শুরু করে] সব বস্তু); জায়ন্তে (জন্মায়); জাতানি (জন্মগ্রহণ করে); যেন (যাঁর দ্বারা); জীবন্তি (জীবন ধারণ করে); প্রয়ন্তি (অভিমুখে অগ্রসর হয়); যৎ (যাঁর মধ্যে); অভিসংবিশন্তি (লীন হয়ে যায়); তৎ (তাঁর সম্বন্ধে [অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয় যাঁর মধ্যে হয়]); বিজিজ্ঞাসস্ব (বিশেষভাবে জিজ্ঞাসা কর); তৎ ব্রহ্ম ইতি (সে-ই ব্রহ্ম); [এই কথা শুনে] সঃ (সে [ভৃগু]); [ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য] তপঃ অতপ্যত (তপস্যা করতে শুরু করলেন); সঃ (তিনি [ভৃগু]); তপঃ তপ্তা (তপস্যা করে); ইতি প্রথমঃ অনুবাকঃ (প্রথম অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: বরুণ-পুত্র ভৃগু একবার তাঁর পিতার কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবান, আমাকে অনুগ্রহ করে ব্রহ্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিন।’ (বরুণের মনে হল, তাঁর পুত্র যথাবিধি তাঁর কাছে এই বিদ্যালাভের প্রার্থনা জানিয়েছেন, সুতরাং) তিনি পুত্রকে অন্ন (স্থূলদেহ রূপে), প্রাণ, চোখ, কান, মন এবং বাগিন্দ্রিয়ের কথা বললেন (যেহেতু ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে গেলে এইসব বিষয় জানা দরকার)। তারপর ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে তিনি পুত্রকে বললেন, ‘এই তত্ত্ব ধারণা করার চেষ্টা কর যে, এই সকল বস্তু ব্ৰহ্ম থেকে আসে, ব্রহ্মকে আশ্রয় করে থাকে এবং ব্রহ্মেই ফিরে যায়। তিনিই ব্রহ্ম।’ (এই কথা শুনে) ভৃগু তপস্যা শুরু করলেন। তপস্যা করে তিনি—

ব্যাখ্যা: পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ব্রহ্মানন্দের স্বরূপ আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে ব্রহ্মানন্দ লাভ করা যায় সেকথা আলোচনা করা হচ্ছে বর্তমান অধ্যায়ে। প্রসঙ্গ শুরু হয়েছে একটি কাহিনীর মাধ্যমে। ভৃগু তরুণ বালক, তিনি তাঁর পিতা বরুণের কাছে এসে বললেন, ‘অধীহি ভগবঃ ব্রহ্ম’—‘ভগবান, আমাকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করুন’। এখানে লক্ষণীয় যে, ভৃগু তাঁর পিতাকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করেননি। বরুণ খ্যাতনামা পণ্ডিত। ভৃগু তাঁর কাছে শিষ্য হয়ে এসেছেন। তাই ভৃগুর আচরণে নম্রতার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পিতা সম্বোধন না করে শ্রদ্ধেয় আচার্যকে যেভাবে সম্বোধন করা উচিত, ভৃগুও তাই করলেন। ‘ভগবান’ বলে সম্বোধন করলেন। এই সম্বোধন গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। এই উপনিষদে ব্যবহৃত শব্দগুলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘উপসসার’ শব্দটিও সম্মানসূচক। এর অর্থ ‘বিনম্রভাবে কাছে যাওয়া’। উপনিষদ কেন পিতাপুত্রের কাহিনী দিয়ে শুরু করেছেন? আচার্য শঙ্কর বলছেন যে, এই জ্ঞান কত মূল্যবান তা বোঝাতেই এই কাহিনীর অবতারণা। পিতা এই জ্ঞান উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্রকে দিয়ে যেতে চান। পিতা এই সর্বোচ্চ জ্ঞান পুত্রের জন্য সংরক্ষিত করেন। পুত্র নিজে পিতার কাছে এই জ্ঞান প্রার্থনা করলে পিতা খুশী হন।

কিন্তু বরুণ সরাসরি নির্গুণ ব্রহ্মের আলোচনায় প্রবেশ করেননি। উত্তম আচার্য সরলভাবে, শিষ্যের পরিচিত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করেন। খাদ্য, প্রাণবায়ু, চোখ, কান, বাক্ ও মনের গুরুত্ব কতটা তা আমাদের সকলেরই জানা। সেই কারণে বরুণ ভৃগুকে এই সব বিষয়ে চিন্তা করতে নির্দেশ দিলেন। শঙ্করাচার্য এগুলিকে ব্ৰহ্ম উপলব্ধির দ্বার বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ সবল দেহ, সুস্থ মন এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি না থাকলে ব্রহ্মকে জানা যায় না।

এই দেহ স্থূল। অতএব দেহ পরম সত্য হতে পারে না। কিন্তু এই দেহ না থাকলে আবার জ্ঞান লাভও হয় না। সুতরাং এই দেহের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাণ দেহকেই আশ্রয় করে থাকে। আবার প্রাণ না থাকলে মন এবং মন না থাকলে বুদ্ধি থাকতে পারে না। এই সবই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যন্ত্র বা হাতিয়ার। এই যন্ত্রগুলিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।

কিন্তু ব্রহ্ম কি? বরুণ বলছেন, ‘ব্রহ্ম এই সমস্ত অস্তিত্বের উৎস’, শঙ্করাচার্য যোগ করেছেন, ‘আব্রহ্মস্তম্ব (তৃণ থেকে ব্রহ্ম পর্যন্ত) সকলই ব্রহ্ম।’ আবার ব্রহ্ম সবকিছুকে ধারণ করে আছেন এবং অন্তে সব বস্তু ব্রহ্মেই লয় হয়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন এক বিশাল ব্রহ্মচক্র। এখানে জন্ম-মৃত্যু আছে। আর আছে কত বিচিত্র রূপের আসা-যাওয়া। কিন্তু সবকিছু ব্রহ্মের মধ্যেই রয়েছে। এই সব কিছু যেখান থেকে আসে আবার সেখানেই ফিরে যায়।

শঙ্করাচার্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে একটি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন (৪।৪।১৮)। এই শ্লোকে ব্রহ্মকে ‘প্রাণের প্রাণ’ বলা হয়েছে। প্রাণের পিছনেও ব্রহ্ম আছেন। ব্রহ্মকে বাদ দিয়ে প্রাণ কাজ করতে পারে না। অনুরূপভাবে ব্রহ্ম ‘চক্ষুষশ্চক্ষু’, চক্ষুর চক্ষু এবং ‘শ্রোত্রস্য শ্ৰোত্রম্’, কর্ণের কর্ণ। এই চোখ আর কানের পিছনে যে প্রকৃত চোখ আর কান আছে, তা-ই হল ব্রহ্ম। ব্রহ্ম আছেন বলেই সব ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে। শঙ্করাচার্য বলেন, ব্ৰহ্ম ‘পুরাণম্ অগ্র্যম্’, তিনি প্রাচীন, তিনিই সব কিছুর আদি কারণ। তিনিই সব কিছুর উৎস।

এরপর পিতা ভৃগুকে বলছেন, ‘বিজিজ্ঞাসস্ব’—বিশ্লেষণ কর, অনুসন্ধান কর। উ পনিষদ শুধু ‘জিজ্ঞাসস্ব’ অর্থাৎ ‘সন্ধান কর’ বলছেন না। বলছেন, ‘বিজিজ্ঞাসস্ব’—বিশ্লেষণ কর। ‘বি’ উপসর্গটির অর্থ ‘বিশদভাবে’। পিতা বলছেন, ‘ভাল করে বুঝে এই বিদ্যা অভ্যাস কর।’ তোমাকে স্বয়ং এই সত্য আবিষ্কার করতে হবে। অন্যে তোমার হয়ে করে দিতে পারবে না। পিতা পুত্রকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি জানেন ভৃগু যদি নিজে যত্নবান না হন, পূর্ণ মনোনিবেশ না করেন তবে সত্যের প্রকৃত স্বরূপ তাঁর কাছে ধরা পড়বে না। সুতরাং বরুণ বললেন, ‘আমি তোমাকে একটা ভাব (ধারণা) দিলাম। তুমি এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা কর।’

অতএব ভৃগু ফিরে গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। কি ধরনের তপস্যা? তিনি ধ্যান করলেন। আচার্য শঙ্কর এখানে মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘মনসশ্চেন্দ্রিয়াণাং চ হ্যৈকাগ্র্যং পরমং তপঃ’—মন এবং ইন্দ্রিয়ের একাগ্রতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। এই একাগ্রতার দ্বারাই সাধক মন, ইন্দ্রিয় এবং তাঁর সমগ্র সত্তাকে এক লক্ষ্যের দিকে চালিত করেন।

মন এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা আছে। চোখ, কান, বাক্ প্রত্যেকেরই এক একরকম ক্ষমতা। বর্তমানে শক্তিগুলি বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। এগুলিকে সংহত করে একটি কেন্দ্রে ‘একাগ্র’ না করলে মন ও ইন্দ্রিয়সকল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

ধরা যাক, আপনি বিজ্ঞানের কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। প্রথমে সমস্যাটি আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দেবে। কিন্তু আপনি জানেন আপনাকে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। আপনার মনোভাব হল, ‘যতক্ষণ সফল না হব ততক্ষণ আমি হাল ছাড়ব না।’ যদি আপনার সামনে কোন লক্ষ্য থাকে, জীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে তবে উঠে পড়ে লাগতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।

শঙ্করাচার্য আরও বলছেন, ‘তৎ জ্যায়ঃ সর্বধর্মেভ্যঃ’—একাগ্রতা সকল আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ‘সঃ ধর্মঃ পরঃ উচ্যতে’—এ-ই হল সব সাধনার শ্রেষ্ঠ সাধনা। শ্রীরামকৃষ্ণ ঝিনুকের মধ্যে মুক্তো তৈরীর দৃষ্টান্ত দিতেন। সাধারণ বিশ্বাস এই যে, ঝিনুক স্বাতী নক্ষত্রের এক ফোঁটা বৃষ্টির জলের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এক ফোঁটা জল পেলেই ঝিনুকের মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং মহাসাগরের অতলে ডুবে সে ধীরে ধীরে মুক্তো তৈরী করে। অনুরূপভাবে, প্রথমে কোন একটি ভাব আমাদের পেয়ে বসে। আমাদের সব চিন্তা ও কর্ম সেই ভাবটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। একেই বলে ‘তপস্যা’। আর যা কিছু সব অতিরিক্ত বলে মনে হয়। সেগুলি আপনা আপনি ত্যাগ হয়ে যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে এই ঘটনাই ঘটেছিল। লোকে বলে মা-কালী যেন তাঁকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছিলেন। মা-কালী যেন বাঘিনী এবং শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর শিকার। তাঁর হাত থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের নিষ্কৃতি নেই। আত্মোপলব্ধির জন্য এই জাতীয় ব্যাকুলতারই প্রয়োজন।

অতএব বৃষ্টির ফোঁটাসহ অতলে তলিয়ে যাওয়া শুক্তির মতো ভৃগুও তাঁর পিতার উপদেশ গ্রহণ করে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়

অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। অন্নাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। অন্নেন জাতানি জীবন্তি। অন্নং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি। তদ্বিজ্ঞায়। পুনরেব বরুণং পিতরমুপসসার। অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি। তং হোবাচ। তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব। তপো ব্রহ্মেতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা॥১॥ ইতি দ্বিতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: [তপশ্চর্যার অনুষ্ঠান করে ভৃগু] অন্নং ব্রহ্ম ইতি ব্যজানাৎ (জানতে পারেন যে অন্ন তথা খাদ্যই ব্রহ্ম); হি (কারণ); ইমানি ভূতানি (এই সব বস্তু [বৃহত্তম থেকে ক্ষুদ্রতম]); অন্নাৎ এব খলু জায়ন্তে (নিঃসংশয়ে খাদ্য থেকে উৎপন্ন); জাতানি (যারা জন্ম গ্রহণ করেছে); অন্নেন জীবন্তি (তারা খাদ্যের দ্বারা পুষ্ট হয়); প্রয়ন্তি (তারা সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হয়); অন্নং অভিসংবিশন্তি ইতি (পরিণামে তারা খাদ্যেই লয় প্রাপ্ত হয়); তৎ (সেই [অর্থাৎ সেই খাদ্যই ব্রহ্ম]); বিজ্ঞায় (জেনে [এখনও তাঁর সংশয় বর্তমান]); পুনঃ এব বরুণং পিতরম্ উপসসার (আবার তিনি পিতা বরুণের কাছে গেলেন); ভগবঃ ব্রহ্ম অধীহি ইতি (এবং বললেন, ‘হে দেব! অনুগ্রহ করে আমাকে [আরও] ব্ৰহ্ম সংক্রান্ত শিক্ষা দান করুন); তং হ উবাচ ([বরুণ] তাঁকে বললেন); তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব (তপশ্চর্যার [ব্রহ্মে একাগ্রতা] দ্বারা ব্রহ্মকে জানতে প্রয়াসী হও); তপঃ ব্রহ্ম ইতি (তপস্যা এবং ব্রহ্ম অভিন্ন); [এইভাবে উপদিষ্ট হয়ে] সঃ (তিনি [ভৃগু]); তপঃ অতপ্যত (তপশ্চর্যা পুনরায় আরম্ভ করলেন); সঃ (তিনি); তপঃ তপ্ত্বা (তপস্যা করে); ইতি দ্বিতীয়ঃ অনুবাকঃ (এখানে দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (ভৃগু তপস্যা করে) জানতে পারলেন খাদ্যই (অন্ন) ব্রহ্ম। (কেন?) কারণ অন্ন থেকেই সকল জীবের জন্ম, অন্নের দ্বারাই তারা পালিত হয়, আবার মৃত্যুর পরে তারা অন্নেই ফিরে যায়। ব্রহ্মকে এভাবে জেনে ভৃগু সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আবার (যথাবিহিত নিয়ম পালন করে) পিতার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমাকে ব্রহ্মোপদেশ দিন।’ তাঁর পিতা বললেন, ‘পুনরায় তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা কর। তপস্যাই ব্রহ্ম।’ ভৃগু পুনরায় তপস্যা করলেন। এবং তপস্যা করে তিনি—

ব্যাখ্যা: কিছুকাল গভীর ধ্যানে মগ্ন থেকে ভৃগু এই সিদ্ধান্তে এলেন—‘অন্নং ব্রহ্ম ইতি’, খাদ্যই (অন্ন) ব্রহ্ম। এই স্থূল জগৎ ব্রহ্মের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্ন থেকে যেমন এই দেহের উৎপত্তি, তেমনি এই জগৎও অন্ন থেকেই এসেছে। অন্নই এই জগৎকে ধারণ করে আছে আবার অন্নেই এই জগতের লয় হয়। মৃত্যুর পর এই দেহের কি গতি হয়? মাটিতে মিশে এই দেহ অন্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়।

সুতরাং ভৃগু পিতার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমি বুঝেছি খাদ্যই (অন্ন) ব্রহ্ম। এর অধিক যদি কিছু থাকে আমায় উপদেশ করুন।’ শঙ্করাচার্য বলছেন: কেন ভৃগুর মনে সংশয় ছিল? কারণ খাদ্যের উৎপত্তি আছে (অন্নস্য উৎপত্তি-দর্শনাৎ)। ব্রহ্মের কি উৎপত্তি হতে পারে? না পারে না। কারণ যার জন্ম আছে, তার মৃত্যুও আছে। অর্থাৎ সেই বস্তু বিনাশশীল। অতএব তা ব্রহ্ম হতে পারে না।

কিন্তু ভৃগুর পিতা তাঁকে সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি আবার বললেন, ‘যাও, তপস্যা কর।’ অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত দিলেন মাত্র। যোগ্য আচার্য শিষ্যের অন্তরে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেন। তিনি শিষ্যকে বিষয়ের একটা ধারণা মাত্র দেন। কারণ তিনি জানেন, প্রকৃত জ্ঞান শিষ্যের অন্তরেই নিহিত রয়েছে। চিত্তের একাগ্রতায় এই জ্ঞান আপনা আপনি ফুটে ওঠে।

উপনিষদ এখানে বলতে চাইছেন, আত্মজ্ঞান লাভ করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পরীক্ষায় পাস, মোকদ্দমা জেতা, চাকরি পাওয়া অথবা অর্থ উপার্জন করা ইত্যাদি কাজে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় সে অভিজ্ঞতা আমাদের সবার আছে। যে কোন কাজে সফল হতে গেলে তার যথার্থ মূল্য দিতে হয়। অতএব আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মজ্ঞান লাভ করতে গেলে আমাদের যে সমধিক মূল্য দিতে হবে সেকথা বলাই বাহুল্য। তাই আচার্য শঙ্কর বলছেন যে, আমাদের বারবার চেষ্টা করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু যতদিন না আমাদের সব সংশয়ের নিরসন হয় ততদিন আমাদের অসন্তোষ থেকেই যাবে। আর একমাত্র ব্রহ্মকে জানলেই সব সংশয়ের অবসান হয়।

মানুষকে কিরকম নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে সেকথাই উপনিষদ বলছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমে যেও না।’ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজের আত্মাকে না জানি, আমার আত্মাই যে সর্বভূতের অন্তরাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মরূপে আমিই সর্বত্র রয়েছি একথা না বুঝি ততক্ষণ পর্যন্ত এ চলার বিরাম নেই।

আমরা জানি বা না জানি সব কাজের মধ্য দিয়ে আমরা সেই পরম সত্যকে খুঁজে চলেছি। ছোট ছেলে বাজারে গিয়ে সেরা মার্বেলটি খোঁজে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক খোঁজ করেন সেরা গাড়ীটির। মননশীল মানুষ খোঁজেন ভাল বই বা ভাল গানের রেকর্ড। এইভাবে আমরা ক্রমাগত কিছু না কিছু খুঁজছি। কেবলমাত্র ব্রহ্মজ্ঞান লাভেই এ খোঁজার পরিসমাপ্তি ঘটে।

পুত্র পিতার কাছে ব্রহ্মজ্ঞান প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন, এই আখ্যায়িকার মাধ্যমে উপনিষদ আমাদের দৃষ্টি আমাদের স্বরূপের দিকে আকর্ষণ করছেন। আমরা ভুলবশত দেহ, মন বা বুদ্ধির সঙ্গে নিজেদের এক করে দেখি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের আত্মাই নিখিল জগতের অন্তরাত্মা।

এই এক আত্মাই আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছেন—কখনও স্থূল কখনও বা সূক্ষ্মরূপে। বাইরের রূপে আমাদের কত না বৈচিত্র, কিন্তু স্বরূপত আমরা এক ও অভিন্ন। এই একত্বকে উপলব্ধি করাই জীবনের লক্ষ্য।

তৃতীয় অধ্যায়

প্রাণো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। প্রাণাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। প্রাণেন জাতানি জীবন্তি। প্রাণং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি। তদ্বিজ্ঞায়। পুনরেব বরুণং পিতরমুপসসার। অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি। তং হোবাচ। তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব। তপো ব্রহ্মেতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা॥১॥ ইতি তৃতীয়োঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: [তপস্যার ফলে ভৃগু] প্রাণঃ ব্রহ্ম ইতি ব্যজানাৎ (জানতে পারলেন যে প্রাণই [জীবনী শক্তি] ব্ৰহ্ম); হি (কারণ); ইমানি ভূতানি খলু প্রাণাৎ এব জায়ন্তে (প্রাণ থেকেই এই সব বস্তুর উৎপত্তি); প্রাণেন জাতানি জীবন্তি (জন্মের পর তারা প্রাণের দ্বারাই প্রতিপালিত); প্রাণং প্রয়ন্তি অভিসংবিশন্তি ইতি (আবার তারা প্রাণেই ফিরে যায় এবং সেখানেই লীন হয়ে যায়); তৎ বিজ্ঞায় (একথা জেনে); পুনঃ এব পিতরং বরুণম্ উপসসার (তিনি আবার পিতা বরুণের কাছে ফিরে গেলেন); ভগবঃ অধীহি ব্ৰহ্ম ইতি (হে দেব, অনুগ্রহ করে আমাকে ব্রহ্ম সংক্রান্ত শিক্ষা দান করুন); তং হ উবাচ [তাঁর পিতা] তাঁকে বললেন); তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব (কঠোর তপশ্চর্যার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হও); তপঃ ব্রহ্ম ইতি (তপস্যা এবং ব্রহ্ম অভিন্ন); সঃ তপঃ অতপ্যত (তিনি [ভৃগু] আবার তপস্যা শুরু করলেন); সঃ তপঃ তপ্ত্বা (তপশ্চর্যার পর তিনি); ইতি তৃতীয়ঃ অনুবাকঃ (এখানে তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ভৃগু উপলব্ধি করলেন প্রাণই ব্রহ্ম। প্রাণ থেকেই এই সব ভূতবর্গ জন্মায়, প্রাণই তাদের ধারণ করে রাখে আবার মৃত্যুর পর প্রাণেই তাদের লয় হয়। এই তত্ত্ব জেনে ভৃগু আবার তাঁর পিতা বরুণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবান, ব্রহ্ম বিষয়ে আমাকে (আরও) উপদেশ দিন।’ পিতা বললেন, ‘কঠোর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা কর। তপস্যাই ব্ৰহ্ম।’ ভৃগু কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন এবং তপস্যা শেষ হলে তিনি—

চতুর্থ অধ্যায়

মনো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। মনসো হ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। মনসা জাতানি জীবন্তি। মনঃ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি। তদ্বিজ্ঞায়। পুনরেব বরুণং পিতরমুপসসার। অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি। তং হোবাচ। তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব। তপো ব্রহ্মেতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা॥১॥ ইতি চতুর্থোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: মনঃ ব্রহ্ম ইতি ব্যজানাৎ ([তিনি] উপলব্ধি করলেন যে মনই ব্রহ্ম); মনসঃ হি এব খলু (মন থেকেই); ইমানি ভূতানি জায়ন্তে (এই সব বস্তু জন্মেছে) মনসা জাতানি জীবন্তি (জন্মের পর তারা মনের দ্বারা পালিত হয়); মনঃ প্রয়ন্তি অভিসংবিশন্তি ইতি (তারা মনেই ফিরে যায়, এবং মনেই লীন হয়ে যায়); তৎ বিজ্ঞায় (এই তত্ত্ব জেনে); পুনঃ এব (আরও একবার); পিতরং বরুণম্ উপসসার (পিতা বরুণের কাছে ফিরে গেলেন); ভগবঃ অধীহি ব্রহ্ম ইতি ([এবং বললেন]) হে দেব, অনুগ্রহ করে আমাকে ব্রহ্ম সম্পর্কে শিক্ষাদান করুন); তং হ উবাচ ([তাঁর পিতা] তাঁকে বললেন); তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব (তপস্যার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মোপলব্ধি করতে সচেষ্ট হও); তপঃ ব্রহ্ম ইতি (তপশ্চর্যাই ব্রহ্ম); সঃ তপঃ অতপ্যত (তিনি [আবার] তপস্যায় নিরত হলেন); সঃ তপঃ তপ্ত্বা (তপস্যা অন্তে, তিনি); ইতি চতুর্থঃ অনুবাকঃ (এখানে চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ভৃগু উপলব্ধি করলেন মনই ব্রহ্ম। কারণ মন থেকেই সব বস্তুর উদ্ভব, মনই তাদের আশ্রয় আর মৃত্যুর পর মনেই তাদের লয় হয়। এই তত্ত্ব জেনে ভৃগু আবার তাঁর পিতা বরুণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবান, আমাকে ব্রহ্মতত্ত্ব শিক্ষা দিন।’ তাঁর পিতা বললেন, ‘তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ জানার চেষ্টা কর। তপস্যাই ব্রহ্ম।’ ভৃগু আরও তপস্যা করলেন। তপস্যা করে তিনি—

ব্যাখ্যা: ধীরে ধীরে ভৃগুর উচ্চতর উপলব্ধি হচ্ছে। তিনি স্থূল [অন্ন] স্তর থেকে শুরু করে প্রথমে প্রাণ এবং পরে মন রূপে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন। এই ভাবেই জ্ঞান ধাপে ধাপে আত্মপ্রকাশ করে।

কিন্তু ভৃগু এখনও সন্তুষ্ট নন। মন অবশ্যই খুব শক্তিশালী, কিন্তু মনেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মনে সঙ্কল্প-বিকল্প আছে। মন কখনও সুখী, কখনও দুঃখী। অতএব মন কখনই পরম সত্য হতে পারে না।

পঞ্চম অধ্যায়

বিজ্ঞানং ব্রহ্মেতি ব্যাজানাৎ। বিজ্ঞানাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। বিজ্ঞানেন জাতানি জীবন্তি। বিজ্ঞানং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি। তদ্বিজ্ঞায়। পুনরেব বরুণং পিতরমুপসসার। অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি। তং হোবাচ। তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব। তপো ব্রহ্মেতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা॥১॥ ইতি পঞ্চমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: বিজ্ঞানং ব্রহ্ম ইতি ব্যজানাৎ ([ভৃগু] উপলব্ধি করলেন যে বুদ্ধিই ব্রহ্ম); বিজ্ঞানাৎ হি এব খলু (স্বয়ং বুদ্ধি থেকেই); ইমানি ভূতানি জায়ন্তে (এই সব বস্তু জন্মেছে); বিজ্ঞানেন জাতানি জীবন্তি (জন্মের পর তারা বুদ্ধির দ্বারা পালিত হয়); বিজ্ঞানং প্রয়ন্তি অভিসংবিশন্তি ইতি (তারা বুদ্ধিতেই ফিরে যায়, এবং তাতেই লীন হয়ে যায়); তৎ বিজ্ঞায় (এই তত্ত্ব জেনে); পুনঃ এব (আবার); পিতরং বরুণম্ উপসসার (পিতা বরুণের কাছে ফিরে গেলেন); ভগবঃ অধীহি ব্ৰহ্ম ইতি ([এবং বললেন] হে দেব, অনুগ্রহ করে আমাকে ব্রহ্ম সম্পর্কে শিক্ষাদান করুন); তং হ উবাচ ([তাঁর পিতা] তাঁকে বললেন); তপসা ব্রহ্ম বিজিজ্ঞাসস্ব (তপস্যার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মোপলব্ধি করতে সচেষ্ট হও); তপঃ ব্রহ্ম ইতি (তপশ্চর্যাই ব্রহ্ম); সঃ তপঃ অতপ্যত (তিনি [আবার] তপস্যায় নিরত হলেন); সঃ তপঃ তপ্ত্বা (তপস্যা অন্তে, তিনি); ইতি পঞ্চমঃ অনুবাকঃ (এখানে পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ভৃগু তখন জানতে পারলেন বুদ্ধিই ব্রহ্ম। জগতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সব বুদ্ধি থেকেই জন্মায়। জন্মাবার পর বুদ্ধিই তাদের ধারণ করে রাখে। আবার মৃত্যুর পর তারা বুদ্ধিতেই লয়প্রাপ্ত হয়। এই তত্ত্ব জেনে ভৃগু তাঁর পিতা বরুণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবান আমাকে ব্রহ্ম বিষয়ে শিক্ষা দিন। বরুণ উত্তর দিলেন, ‘তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ জানার চেষ্টা কর। তপস্যা ব্ৰহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়।’ ভৃগু তপস্যা করলেন। তপস্যা করে তিনি—

ব্যাখ্যা: এক অর্থে বুদ্ধিও সত্য। ন্যায়-অন্যায়, ভালমন্দ এসবের বিচার বুদ্ধিই করে থাকে। কিন্তু বুদ্ধিও পরিবর্তনশীল। আজ যা উচিত বলে মনে হচ্ছে, কাল তা উচিত বলে মনে নাও হতে পারে। অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আমাদের উচিত-অনুচিতের ধারণাও বদলাতে থাকে। আমাদের বুদ্ধি আরও পরিণত হয়ে ওঠে। কিন্তু বয়স বাড়লেই বুদ্ধি বাড়বে এমন কোন কথা নেই। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দেন। আবার বয়সে নবীন হয়েও অনেকে চিন্তাশীল এবং পরিণত বুদ্ধির অধিকারী। সুতরাং পরিবর্তনশীল স্বভাবের কারণে বুদ্ধিও চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না।

ষষ্ঠ অধ্যায়

আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি। সৈষা ভার্গবী বারুণী বিদ্যা। পরমে ব্যোমন্‌প্রতিষ্ঠিতা। স য এবং বেদ প্রতিতিষ্ঠতি। অন্নবানন্নাদো ভবতি। মহান্‌ভবতি প্রজয়া পশুভির্ব্রহ্মবর্চসেন। মহান্ কীর্ত্যা॥১॥ ইতি ষষ্ঠোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: আনন্দঃ ব্রহ্ম ইতি ব্যজানাৎ ([ভৃগু] উপলব্ধি করলেন যে, আনন্দই ব্ৰহ্ম); আনন্দাৎ হি এব খলু (আনন্দ থেকেই); ইমানি ভূতানি জায়ন্তে (এই সব বস্তুর জন্ম হয়); আনন্দেন জাতানি জীবন্তি (জন্মের পর তারা আনন্দের দ্বারা পালিত হয়); আনন্দং প্রয়ন্তি অভিসংবিশন্তি ইতি (তারা আনন্দেই ফিরে যায়, এবং তাতেই লীন হয়ে যায়); সা এষা (এই সেই); ভার্গবী বারুণী বিদ্যা (যে জ্ঞান ভৃগু লাভ করেছিলেন এবং বরুণের থেকে যা অর্জন করেছিলেন); পরমে ব্যোমন্ প্রতিষ্ঠিতা (হৃদয়াকাশে অধিষ্ঠিত); যঃ এবং বেদ (যিনি [ব্রহ্মকে] এইভাবে জানেন); সঃ প্রতিতিষ্ঠতি ([ব্রহ্মে] দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত); অন্নবান্ অন্নাদঃ ভবতি (তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী এবং বহু অন্ন ভোক্তা হন [অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হওয়ায় স্থূলবস্তু থেকে সূক্ষ্ম আনন্দ পর্যন্ত সব কিছুই তাঁর আয়ত্তে]); মহান্ ভবতি (তিনি মহান হন); প্রজয়া (বহু সন্তান দ্বারা); পশুভিঃ (অনেক পশুর দ্বারা); ব্রহ্মবর্চসেন (ব্রহ্মের জ্যোতি দ্বারা); কীর্ত্যা মহান্ (তিনি প্রভূত যশের অধিকারী); ইতি ষষ্ঠঃ অনুবাকঃ (এখানে ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: ভৃগু উপলব্ধি করলেন যে, আনন্দই ব্রহ্ম। কেননা আনন্দ থেকেই এই সকল প্রাণীর জন্ম হয়। জন্মের পর তারা আনন্দের দ্বারাই বর্ধিত হয় এবং যখন তারা ধ্বংস হয়ে যায় তখন আনন্দেই ফিরে যায় এবং তাতেই লীন হয়। এই জ্ঞান ভৃগু লাভ করেছিলেন বরুণের কাছ থেকে এবং বরুণ তাঁকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই সত্য রয়েছে হৃদয়াকাশের নিভৃতে (স্থূল খাদ্যবস্তু থেকে সূক্ষ্ম আনন্দে এই সত্য পরিব্যাপ্ত)। যিনি এইরূপে ব্রহ্মকে জেনেছেন তিনি ব্রহ্মানন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী এবং প্রচুর অন্ন ভোগের ক্ষমতা-সম্পন্ন (অর্থাৎ, অগ্নির মতো তিনি সবকিছুই আত্মসাৎ করতে পারেন)। তাঁর বহু সন্তান এবং অনেক পশুধন রয়েছে। তিনি ব্রহ্মজ্যোতি বিকিরণ করেন। তিনি প্রকৃতই মহান। তাঁর যশ দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যাখ্যা: এইভাবে ধাপে ধাপে ভৃগু সত্যে উপনীত হলেন। উপনিষদের মূল কথা হল, যুক্তি এবং বুদ্ধির দ্বারা গ্রহণযোগ্য মনে না হলে আমরা যেন কোন বিষয় মেনে না নিই। আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে। তারপর সেই বিষয়ের উপর গভীর ভাবে মনন ও ধ্যান করতে হবে। আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘শনৈঃ শনৈঃ অন্তঃ অনুপ্রবিশ্য’—ধাপে ধাপে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। নিজের চেতনার গভীরে অনুসন্ধান করতে হবে, প্রবেশ (অনুপ্রবিশ্য) করতে হবে।

উপনিষদ কেন ‘তপস্যা’ কথাটি ব্যবহার করছেন? কেন শুধু ‘চিন্তা’ বা ‘ধ্যান’ করতে বলছেন না? কারণ উপনিষদ এখানে ‘সুনিয়ন্ত্রিত’ চিন্তার উপর জোর দিচ্ছেন। আমরা সকলেই চিন্তা করি। চিন্তা না করে আমরা পারি না। কিন্তু সে চিন্তা নিতান্তই ভাসা-ভাসা। আমরা ধাপে ধাপে এগোই না। আমাদের অধিকাংশ চিন্তা যুক্তিপূর্ণ নয়। মনকে আমরা সংযত করতে পারি না। তাই মন একাগ্র হয় না। সেইজন্য আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘শনৈঃ শনৈঃ’, ধাপে ধাপে চিন্তাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

ধরা যাক একজন বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যে রত। প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে প্রতিটি তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। সেই তথ্যগুলি বিবেচনা করতে হবে। কোনটিকে উপেক্ষা করলে চলবে না। এও এক ধরনের ‘তপস্যা’।

তপস্যাবলে ভৃগু উপলব্ধি করলেন, আনন্দই ব্রহ্ম। এবং সেই আনন্দ ‘পরমে ব্যোমন্’, হৃদয়স্থ পরম আকাশে প্রতিষ্ঠিত। শঙ্করাচার্য একেই বলেছেন অন্তরাত্মা, যা অন্তরতম, সত্তার গভীরে যা লুকিয়ে আছে।

যিনি এই আনন্দ উপলব্ধি করেছেন তাঁর কি হয়? উপনিষদ বলছেন, তিনি অন্নভোক্তা হন। অর্থাৎ তিনি যে শুধু ব্রহ্মানন্দ উপভোগ করেন তা নয়, এই স্থূল জগৎও তাঁর উপভোগ্য হয়ে ওঠে। জগতের সব কিছুতেই তিনি আনন্দ পান। আধ্যাত্মিক জ্ঞান মানুষকে দেয় আত্মপ্রত্যয়, মানসিক দৃঢ়তা ও ইচ্ছাশক্তি। আর এর দ্বারা তিনি সবকিছু লাভ করতে পারেন।

‘মহান্ ভবতি’—তিনি মহৎ হয়ে ওঠেন। কোন্ অর্থে মহৎ? উপনিষদ এখানে বলছেন, ‘সব অর্থে, এমনকি সন্তানসন্ততি এবং প্রাণী-সম্পদেও।’ সে যুগে পশুবলকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হত। তাই উপনিষদ বলছেন, এহেন ব্যক্তি ধনসম্পদেও মহান। আর উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার জ্ঞানের কিছু অংশ লাভ করে তাঁর সন্তানরাও মহৎ হয়।

কিন্তু এসবই ‘ব্রহ্মবর্চস’, ব্রহ্মজ্যোতি বা ব্রহ্মতেজের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। ‘ব্রহ্মবৰ্চস’ হল আধ্যাত্মিক জ্যোতি যা অন্তরস্থ আনন্দ থেকে উৎসারিত, বাইরের কোন বস্তু থেকে নয়। একবার স্বামী বিবেকানন্দের একটি ছবি দেখে একজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক মন্তব্য করেন, ‘এঁকে এত প্রফুল্ল দেখাচ্ছে কেন? জগতে এত দুঃখ থাকতে এঁকে এত আত্মতৃপ্ত মনে হচ্ছে কেন?’ অনেকেরই ধারণা সাধু-সন্ন্যাসীর চেহারা হবে বিষণ্ণ, চিন্তাক্লিষ্ট। জগতে দুঃখ আছে এ কথা সত্য। আর এ দুঃখ স্থায়ী হোক, তা কোন সন্ন্যাসীরই কাম্য নয়। কিন্তু জগতে যেমন দুঃখ আছে, তেমনি আনন্দও আছে। এই আনন্দই পরম সত্য। এই আনন্দ আমাদের সকলের মধ্যে রয়েছে। আত্মজ্ঞান লাভ হলে এই আনন্দের প্রকাশ হয়। জীবনের শেষ দিনগুলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে অসহ্য রোগ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডল সবসময় দিব্য আনন্দে পূর্ণ থাকত। শারীরিক কোন কষ্টই তাঁর সে আনন্দকে ম্লান করতে পারেনি।

যে-ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন আধ্যাত্মিক গুণাবলীতেও তিনি মহান হয়ে ওঠেন। এই গুণগুলি কি কি? শঙ্করাচার্য বলছেন: ‘শম-দম-জ্ঞানাদি’, অর্থাৎ সংযত মন, সংযত ইন্দ্রিয়, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। একজন ব্যক্তির আধ্যাত্মিকতার মাপকাঠি কি? কি করে বোঝা যাবে তিনি এই পথে কতদূর অগ্রসর হয়েছেন? আমরা কখনও কখনও অলৌকিকশক্তিসম্পন্ন মানুষের কথা শুনে থাকি। এরই নাম কি আধ্যাত্মিকতা? আচার্য শঙ্কর বলছেন, না, মানুষের জীবনই আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠ পরিমাপ। মানুষ তার নৈতিক চরিত্রেই মহৎ হয় (‘শুভপ্রচার-নিমিত্তয়া’)। এহেন ব্যক্তি সবসময় অপরের কল্যাণ সাধন করেন। শেষ বিচারে এই হল আধ্যাত্মিকতার মাপকাঠি। অন্য কোন পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন।

সপ্তম অধ্যায়

অন্নং ন নিন্দ্যাৎ। তদ্‌ব্রতম্। প্রাণো বা অন্নম্। শরীরমন্নাদম্। প্রাণে শরীরং প্রতিষ্ঠিতম্। শরীরে প্রাণঃ প্রতিষ্ঠিতঃ। তদেতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতম্। স য এতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতং বেদ প্রতিতিষ্ঠতি। অন্নবানন্নাদো ভবতি। মহান্ ভবতি প্রজয়া পশুভির্ব্রহ্মবর্চসেন। মহান্ কীর্ত্যা॥১॥ ইতি সপ্তমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: অন্নং ন নিন্দ্যাৎ (অন্নের [খাদ্যের] নিন্দা করবে না); তৎ ব্ৰতম্ ([ব্রহ্মজ্ঞের দৃষ্টিতে] এ এক পবিত্র নিয়ম); প্রাণঃ বৈ অন্নম্ (জীবনই অন্ন তথা খাদ্য [কারণ প্রাণ খাদ্যে আশ্রিত]); শরীরম্ অন্নাদম্ (শরীরই অন্নের ভোক্তা); প্রাণে শরীরং প্রতিষ্ঠিতম্ ([জীবনী শক্তি] শরীর প্রাণে প্রতিষ্ঠিত); শরীরে প্রাণঃ প্রতিষ্ঠিতঃ (শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত); তৎ এতৎ (এটি সেটির মতো [দেহ এবং প্রাণ উভয়ই]); অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতম্ (শরীর প্রাণের ওপর নির্ভরশীল); সঃ যঃ (যে কেউ); এতৎ বেদ (এ তত্ত্ব জানেন); অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতম্ (শরীর প্রাণের ওপর নির্ভরশীল); প্রতিতিষ্ঠতি (জগদ্বিখ্যাত হয়ে যান); অন্নবান্ অন্নাদঃ ভবতি (তিনি প্রচুর খাদ্যের বা অন্নের অধিকারী এবং অন্নভোক্তা হন); প্রজয়া পশুভিঃ ব্রহ্মবৰ্চসেন মহান্ ভবতি ([তিনি] সন্তান দ্বারা, পশুসমূহ দ্বারা, ব্রহ্মতেজ দ্বারা মহান হন); কীর্ত্যা মহান্ (তত্ত্বজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আচার্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেন); ইতি সপ্তমঃ অনুবাকঃ (সপ্তম অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন এবং অন্নের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন) তিনি কখনও অন্ন বা খাদ্যের নিন্দা করবেন না। এটি তাঁর কাছে ধর্মীয় শপথের তুল্য। প্রাণই খাদ্য। আবার প্রাণই সেই খাদ্যের ভোক্তা (তাই প্রাণকে অন্নদি বলা হয়)। প্রাণ আছে বলেই দেহ জীবিত আছে। সুতরাং দেহ প্রাণের ওপর নির্ভরশীল। আবার প্রাণও দেহের ওপর নির্ভরশীল। এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল (যেন এক ধরনের খাদ্য বা অন্ন আর এক ধরনের খাদ্য বা অন্নের ওপর নির্ভরশীল)। যিনি এই দুই প্রকার অন্নকে (দেহ এবং প্রাণ) পরস্পর নির্ভরশীল বলে জানেন তিনি জগতে বিখ্যাত হন। তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী এবং তিনি নানারকম খাদ্য ভোগ করেন। তিনি বহু সন্তান ও প্রভূত প্রাণী-সম্পদ লাভ করেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জ্যোতিতে তিনি ভাস্বর হয়ে ওঠেন। এই জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হন এবং তত্ত্বজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আচার্যরূপে খ্যাতি লাভ করেন।

ব্যাখ্যা: এখানে অন্নের প্রশংসা করা হয়েছে। ‘অন্ন’ শব্দটি এখানে দুই অর্থে ব্যবহৃত। এর আক্ষরিক অর্থ হল খাদ্য। আবার ‘অন্ন’ বলতে এই স্থূল জড় জগৎকেও বোঝানো হয়েছে। কারণ এই জগৎ তো অন্নেরই পরিণতি। সুতরাং উপনিষদ বলছেন, অন্নকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। অনেকেরই ধারণা বেদান্ত এই জগৎকে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয় ইহলোক ছেড়ে কেবলমাত্র পরলোকের চিন্তা করতেই বেদান্ত মানুষকে উপদেশ দেন। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাই যে, উপনিষদ বলছেন, এই জগৎও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীবনে এই জড়জগতেরও প্রয়োজন আছে। আমাদের যেমন শরীরের প্রয়োজন আছে, তেমনি আবার খাদ্যেরও প্রয়োজন আছে। শরীরকে অবহেলা না করে বরং তার যত্ন নেওয়াই আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য বা ব্রত।

‘প্রাণঃ বৈ অন্নম্’—এই প্রাণই অন্ন। দেহ এবং প্রাণশক্তি একে অপরের সাথে যুক্ত, অর্থাৎ পরস্পর নির্ভরশীল। দেহ ছাড়া যেমন প্রাণের কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না তেমনি প্রাণ ছাড়াও দেহ বাঁচতে পারে না। প্রাণহীন দেহ একতাল পচনশীল মাংসপিণ্ড মাত্র।

‘শরীরম্ অন্নাদম্’—দেহ খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকে। তাই দেহকে ‘অন্নাদম্’ বা ভোক্তা বলা হয়। প্রাণ এবং দেহ উভয়েই খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই খাদ্যকে তুচ্ছ বা উপেক্ষা করা উচিত নয়। যিনি খাদ্যের উপযোগিতা সম্বন্ধে সচেতন একমাত্র তিনিই জীবিত থাকেন।

এখানে খাদ্যের প্রতি এত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেন? আচার্য শঙ্করের মতে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের এটিই প্রবেশদ্বার। খাদ্য ছাড়া দেহকে সুস্থ রাখা যায় না। আর জীবনে উন্নতির জন্য সুস্থ সবল দেহের প্রয়োজন। ব্রহ্মজ্ঞান লাভের এটিই প্রথম সোপান।

অষ্টম অধ্যায়

অন্নং ন পরিচক্ষীত। তদ্‌ব্রতম্। আপো বা অন্নম্। জ্যোতিরন্নাদম্। অপ্সু জ্যোতিঃ প্রতিষ্ঠিতম্। জ্যোতিষ্যাপঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ। তদেতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতম্। স য এতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতং বেদ প্রতিতিষ্ঠতি। অন্নবানন্নাদো ভবতি। মহান্ ভবতি প্রজয়া পশুভির্ব্রহ্মবর্চসেন। মহান্ কীর্ত্যা॥১॥ ইতি অষ্টোমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: অন্নং ন পরিচক্ষীত (খাদ্য তথা অন্নকে অবহেলা করা উচিত নয়); তৎ ব্রতম্ (এটি ধর্মীয় ব্রত [কিন্তু অন্ন কী?]); আপঃ বৈ অন্নম্ (জলই অন্ন); জ্যোতিঃ অন্নাদম্ (শক্তি [তথা—অগ্নি ইত্যাদি] খাদ্য পরিপাক করে); অপ্সু জ্যোতিঃ প্রতিষ্ঠিতম্ ([একযোগে] জলে শক্তি অন্তর্নিহিত), আপঃ জ্যোতিষি প্রতিষ্ঠিতাঃ (জলও শক্তি তথা অগ্নিতে অন্তর্নিহিত); তৎ এতৎ অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতম্ (এই দুই প্রকার অন্নই পরস্পরনির্ভর); সঃ যঃ এতৎ অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতং বেদ (এক প্রকার অন্ন বা খাদ্য অন্য প্রকার অন্নের উপর নির্ভরশীল—এই গুহ্য তত্ত্ব যিনি জানেন); প্রতিতিষ্ঠতি (সাফল্য লাভ করেন); অন্নবান্ অন্নাদঃ ভবতি (তিনি খাদ্য বা অন্নের অধিকারী হন এবং অন্নভোক্তা হন); প্রজয়া পশুভিঃ ব্রহ্মবর্চসেন মহান্ ভবতি ([তিনি] সন্তান দ্বারা, পশুসমূহ দ্বারা, ব্রহ্মতেজ দ্বারা মহান হন); কীর্ত্যা মহান্ (অধ্যাত্মবিদ্যার আচার্যরূপে তিনি খ্যাতি লাভ করেন); ইতি অষ্টমঃ অনুবাকঃ (এখানে অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত)।

সরলার্থ: খাদ্যকে অবহেলা করা উচিত নয়। একে ধর্মীয় ব্রত বলে মনে করবে। (কিন্তু খাদ্য বলতে কি বোঝায়?) জল খাদ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অগ্নি খাদ্যকে পরিপাক করে (তাই অগ্নিকে অন্নাদম্ বলা হয়)। জলে অগ্নি (বা শক্তি) আছে। আবার অগ্নিতেও জল আছে। সুতরাং খাদ্য খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। ‘এক রকমের খাদ্য আর একরকমের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল’—যিনি এই তত্ত্বকে জানেন তিনি খুব খ্যাতি লাভ করেন। তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী এবং নানারকম খাদ্য ভোগ করেন। তিনি বহু সন্তানের ও প্রভূত প্রাণী-সম্পদেরও অধিকারী হন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জ্যোতিতে তিনি ভাস্বর হয়ে ওঠেন। এই কারণে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হন ও তত্ত্ব জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আচার্যরূপে খ্যাত হন।

ব্যাখ্যা: হিন্দুদর্শন অনুযায়ী, এই জড়জগৎ, পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। পঞ্চ উপাদানগুলি হল: আকাশ, বাতাস, অগ্নি, জল ও পৃথিবী। এই উপাদান-সকল পরস্পর সংশ্লিষ্ট। এরা একে অপরকে আশ্রয় করে রয়েছে। আমাদের কাছে প্রতিটি উপাদানই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি লাভের জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার। সাধকের বিশুদ্ধ বায়ু, বিশুব্ধ জল, বিশুদ্ধ খাদ্য ও আগুনের প্রয়োজন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, কোলাহলপূর্ণ, কিংবা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশ ধ্যানের পক্ষে অনুকূল নয়। সুন্দর, শান্ত পার্বত্য এলাকা বা ঐরূপ নদীতীরবর্তী অঞ্চল ধ্যানের প্রশস্ত জায়গা। এরকমস্থানে মন আপনিই শান্ত ও অন্তর্মুখ হয়।

‘অপ্সু জ্যোতিঃ প্রতিষ্ঠিতম্’—অগ্নি এবং জল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আর জলেই অগ্নি বিদ্যমান। একথা আমাদের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়। জলভরা মেঘে বিদ্যুতের খেলা দেখেই হয়তো একথা মানুষের মনে এসেছে। কিন্তু এখানে শক্তি বোঝাতে ‘জ্যোতি’ শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। জলে শক্তি আছে। বহমান জলধারা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে থাকে।

এখানে উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চাইছেন যে, জড়জগৎ অবহেলার বিষয় নয়। আধ্যাত্মিক আনন্দ লাভের চেষ্টা নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। কারণ এই আনন্দ লাভই তো আমাদের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু এই আনন্দ পেতে গেলে সুস্থ সবল দেহ ও উপযুক্ত পরিবেশ একান্তই জরুরী। তাই এই দৃশ্যমান জগতের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য। আবার উপনিষদ বলেন, এ জগৎ মিথ্যা। এর দ্বারা একথা বোঝানো হয় না যে, এ জগৎকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য বা বাতিল করতে হবে। এ জগতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু এ জগৎকে ব্রহ্মের প্রকাশরূপে দেখতে হবে।

এখানে উপনিষদ আমাদের বোঝাতে চাইছেন যে, খাদ্য, মন, পঞ্চভূতের এই জড়জগৎকে ব্রহ্মরূপে মনে করতে হবে। এগুলিকে ব্রহ্ম হিসাবে জেনে, তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও পরিচর্যা করতে হবে। এ জগৎ ব্ৰহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। সাধককে সকল বস্তুর প্রতি যত্নশীল হতে হবে। কারণ সাধকের আধ্যাত্মিক সংগ্রামের এই হল প্রতিষ্ঠাভূমি। আর এই সংগ্রামের দ্বারা তিনি কালে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবেন।

স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলতেন, উদ্দেশ্যের মতো উপায়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। উপায়ের প্রতি যত্নশীল হও। রাসায়নিক উপাদানগুলিকে মিশ্রিত করলে, তার ফল আপনিই পাওয়া যায়। আমাদের জীবনে পরিবেশ, দেহ, মন, বুদ্ধি এ সবেরই অসামান্য গুরুত্ব আছে। এগুলির সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে (ব্রহ্মজ্ঞান) পৌঁছুতে পারি।

নবম অধ্যায়

অন্নং বহু কুর্বীত। তদ্‌ব্রতম্। পৃথিবী বা অন্নম্। আকাশোঽন্নাদঃ। পৃথিব্যামাকাশঃ প্রতিষ্ঠিতঃ। আকাশে পৃথিবী প্রতিষ্ঠিতা। তদেতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতম্। স য এতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতং বেদ প্রতিতিষ্ঠতি। অন্নবানন্নাদো ভবতি। মহান্ ভবতি প্ৰজয়া পশুভির্ব্রহ্মবর্চসেন। মহান্ কীর্ত্যা॥১॥ ইতি নবমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: অন্নং বহু কুর্বীত (অন্ন [খাদ্য] উৎপাদন বর্ধিত করতে চেষ্টা কর); তৎ (এইরূপ করা); ব্ৰতম্ ([সকলের জন্য] ধর্মীয় কর্তব্য); [কিন্তু অন্ন কি?] পৃথিবী বৈ অন্নম্ (এই পৃথিবীই অন্ন তথা খাদ্য); আকাশঃ অন্নাদঃ (আকাশ অন্নভোক্তা [অর্থাৎ আচ্ছাদন করে]); আকাশঃ পৃথিব্যাং প্রতিষ্ঠিতঃ ([সর্বব্যাপী হওয়ার জন্য] আকাশ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত); পৃথিবী আকাশে প্রতিষ্ঠিতা (পৃথিবীও আকাশে প্রতিষ্ঠিত); তৎ এতৎ (এই ভাবে); অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতম্ (এক ধরনের অন্ন আর এক ধরনের অন্নের উপর নির্ভরশীল); সঃ যঃ এতৎ অন্নম্ অন্নে প্রতিষ্ঠিতং বেদ (এক জাতীয় অন্ন অন্য জাতীয় অন্নের ওপর নির্ভরশীল যিনি [এই গুহ্যতত্ত্ব] জানেন); প্রতিতিষ্ঠতি ([তিনি] জীবনে সাফল্য লাভ করেন); অন্নবান্ অন্নাদঃ ভবতি (তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী হন এবং অন্নভোক্তা হন); প্রজয়া পশুভির্ব্রহ্মবর্চসেন মহান্ ভবতি ([তিনি] সন্তান দ্বারা, পশুসমূহ দ্বারা, ব্রহ্মতেজ দ্বারা মহান হন); কীর্ত্যা মহান্ (অধ্যাত্ম বিদ্যার আচার্য হিসাবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন); ইতি নবমঃ অনুবাকঃ (নবম অধ্যায় এখানেই সমাপ্ত)।

সরলার্থ: সঞ্চিত খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এটি ধর্মীয় কর্তব্য। (কিন্তু খাদ্য কি?) পৃথিবীই খাদ্য, আকাশ এই খাদ্য গ্রহণ করে (তাই আকাশের আর এক নাম অন্নাদ বা ভোক্তা)। আকাশ পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। আবার পৃথিবীও আকাশের ওপর নির্ভরশীল। এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ‘এক জাতীয় খাদ্য আর এক রকমের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল’— যিনি এই তত্ত্বকে জানেন তিনি জীবনে খুব সাফল্য অর্জন করেন। তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী হন এবং নানা রকমের খাদ্য ভোগ করে থাকেন। তিনি বহু সন্তান ও প্রভূত প্রাণী-সম্পদও লাভ করেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জ্যোতিতে তিনি ভাস্বর হয়ে ওঠেন। এই জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হন এবং তত্ত্বজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আচার্যরূপে খ্যাতি লাভ করেন।

দশম অধ্যায়

ন কংচন বসতৌ প্রত্যাচক্ষীত। তদ্‌ব্রতম্। তস্মাদ্যয়া কয়া চ বিধয়া বহ্বন্নং প্রাপ্নুয়াৎ। অরাধ্যস্মা অন্নমিত্যাচক্ষতে। এতদ্বৈ মুখতোঽন্নং রাদ্ধম্। মুখতোঽস্মা অন্নং রাধ্যতে। এতদ্বৈ মধ্যতোঽন্নং রাদ্ধম্। মধ্যতোঽস্মা অন্নং রাধ্যতে। এতদ্বা অন্ততোঽন্নং রাদ্ধম্। অন্ততোঽস্মা অন্নং রাধ্যতে॥১

অন্বয়: বসতৌ কংচন (যদি কেউ আশ্রয়প্রার্থী হন [বাসের নিমিত্ত তোমার গৃহে]); ন প্রত্যাচক্ষীত (তাঁকে ফিরিয়ে দিও না); তৎ ব্রতম্ (এটি ধর্মীয় কর্তব্য); তস্মাৎ যয়া কয়া চ বিধয়া (সুতরাং যে কোন উপায়ে); বহু অন্নং প্রাপ্নুয়াৎ (প্রচুর খাদ্যের সংস্থান করা উচিত [যাতে আগত অতিথির সৎকার ব্যাহত না হয়]); [দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি অতিথি সৎকারের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করেছেন] অস্মৈ অন্নম্ অরাধি ইতি আচক্ষতে (তাঁদের বলবেন, আমি অন্ন রান্না [সঞ্চয়] করেছি [তাঁদের আসার সম্ভাবনার কথা মনে রেখে]); এতৎ বৈ অন্নম্ (এই খাদ্য [যা আমি আপনাদের দিচ্ছি]); মুখতঃ রাদ্ধম্ (নিজ অসামান্য যোগ্যতার বলে এ সঞ্চয় সম্ভব হয়েছিল [অথবা জীবনের প্রারম্ভে]); [যার ফলে] অস্মৈ (তাঁর প্রতি [অর্থাৎ গৃহস্বামীর প্রতি]); অন্নং মুখতঃ রাধ্যতে (একই যোগ্যতাবলে খাদ্য তাঁর কাছে ফিরে আসবে [অথবা জীবনের প্রারম্ভে]); এতৎ বৈ অন্নং মধ্যতঃ রাদ্ধম্ ([কিন্তু ধরা যাক] এই খাদ্য সৎ উপায়ে সংগৃহীত হয়নি); অস্মৈ অন্নং মধ্যতঃ রাধ্যতে (সেই খাদ্য তাঁর কাছে ঠিক সেইভাবেই ফিরে আসবে); এতৎ বৈ অন্নম্ অন্ততঃ রাদ্ধম্ ([কিন্তু ধরা যাক] এই খাদ্য সংগ্রহের পন্থা ছিল মন্দ); অস্মৈ অন্নম্ অন্ততঃ রাধ্যতে (খাদ্য তাঁর কাছে একই ভাবে ফিরে আসবে)।

সরলার্থ: আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এটি ধর্মীয় ব্রত। (এবং যদি অতিথি আসেন তবে তাঁকে যথাযথ আপ্যায়ন করতে হবে।) তাই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন, যে কোন উপায়ে খাদ্য সঞ্চয় করা উচিত। কারণ যে কোন দিন অতিথি এসে পড়তে পারেন। অতিথি এলে যেন ফিরিয়ে না দিতে হয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা এমন কথাই বলে থাকেন। অতিথিকে খাদ্যদানের সময়ে এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, উক্ত খাদ্য সৎ উপায়ে অর্জিত। অর্থাৎ নিজের যোগ্যতার দ্বারা অর্জিত। এই খাদ্যদানের জন্য তিনি উপযুক্ত পুরস্কার আশা করতে পারেন। তাঁর সততার গুণে সেই খাদ্যই আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে। কিন্তু এই সঞ্চিত খাদ্য যদি উত্তম উপায়ে সংগৃহীত না হয়ে থাকে অর্থাৎ খানিকটা নিজের যোগ্যতায় ও খানিকটা অসৎ উপায়ের দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকে তবে সেই খাদ্য তাঁর কাছে ঠিক সেভাবেই ফিরে আসবে। যদি অতিথিদের জন্য তিনি অসৎ উপায়ে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন, তবে সেই খাদ্য সেইভাবেই তাঁর কাছে ফিরে আসে। অর্থাৎ, সততা যেন বজায় থাকে।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ এইমাত্র বলেছেন যে, আকাশ এবং পৃথিবী একই উপাদানে গঠিত এবং তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর সবকিছুই পরস্পর নির্ভরশীল—যিনি একথা সঠিকভাবে জেনেছেন তিনি আর কখনও আশ্রয়প্রার্থী অতিথিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। আর অতিথিকে যথাসম্ভব আপ্যায়ন করা উচিত। উপনিষদ আমাদের বলছেন: আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। কখন আসবে তুমি, তাই আমি তোমার জন্য খাদ্যসামগ্রীও প্রস্তুত করে রেখেছি। এভাবেই অতিথিকে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সঞ্চয় করে রাখতে হবে যাতে অতিথি সৎকারে কোন বিঘ্ন না ঘটে।

অন্নদানের (বা খাদ্যদানের) নিজস্ব পুরস্কার আছে। কারণ যেসময়ে ও যেভাবে অন্নদান করা হয় প্রায় একই সময়ে ও একইভাবে সেই অন্নই দাতার কাছে ফিরে আসে। বস্তুত কোন দানই অপুরস্কৃত থাকে না। কিভাবে দান করা হয়েছে তা পুরস্কার দেখলেই বোঝা যায়।

য এবং বেদ। ক্ষেম ইতি বাচি। যোগক্ষেম ইতি প্রাণাপানয়োঃ। কর্মেতি হস্তয়োঃ। গতিরিতি পাদয়োঃ। বিমুক্তিরিতি পায়ৌ। ইতি মানুষীঃ সমাজ্ঞাঃ। অথ দৈবীঃ। তৃপ্তিরিতি বৃষ্টৌ। বলমিতি বিদ্যুতি॥২

অন্বয়: যঃ এবং বেদ (যিনি এই ভাবে [অর্থাৎ খাদ্যের গুরুত্ব ও অপরকে অন্নদানের পুণ্য] জানেন [তিনি পূর্বোক্তভাবে পুরস্কৃত হন]); [এখন ব্ৰহ্ম ও অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ সম্পকীয় আলোচনা]; ক্ষেমঃ (আত্মসংযম [আক্ষরিক অর্থে অর্জিত বস্তুর সঞ্চয়]); বাচি ইতি (বাক্যে যেমন প্রকাশিত [অর্থাৎ, তোমার সঞ্চিত দ্রব্যে ব্রহ্মোপলব্ধির চেষ্টা কর]); প্রাণাপানয়োঃ যোগক্ষেমঃ ইতি (প্রাণ ও অপান যোগক্ষেম অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি ও প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণরূপে); হস্তয়োঃ কর্ম ইতি (হাত দিয়ে যা কিছু কর সেইরূপে); পাদয়োঃ গতিঃ ইতি (পদদ্বয়ে গতিরূপে); পায়ৌ বিমুক্তিঃ ইতি (মলত্যাগে); ইতি মানুষীঃ সমাজ্ঞাঃ (এই সকল মানুষী কর্মে); অথ দৈবীঃ (পরে সকল অমর্ত্য [অর্থাৎ নৈসর্গিক] ঘটনাবলী); বৃষ্টৌ তৃপ্তিঃ ইতি (বৃষ্টিতে তৃপ্তিরূপে [উত্তম ফসল ও অন্যান্য বস্তু প্রাপ্ত হওয়া যায় বলে]); বিদ্যুতি বলম্ ইতি (বিদ্যুতে শক্তি রূপে)।

সরলার্থ: যিনি এভাবে (খাদ্যের গুরুত্ব এবং অপরকে খাদ্যদানের পুণ্য) জানেন তিনি পূর্বোক্তভাবে ফল লাভ করেন। আমাদের সব কর্মে ব্রহ্মকে দর্শনের চেষ্টা করা উচিত; যথা, বাক্ সংযম রূপে, প্রাণ ও অপান বায়ুতে যোগক্ষেম রূপে, হাতের দ্বারা যা কিছু করা হয় সেইরূপে, পায়ের গতি সঞ্চালনে এবং মলত্যাগে। (এই সব কিছুতে ব্রহ্ম রয়েছেন এবং) এই সব কর্ম মানুষের উপাসনার বিভিন্ন প্রণালী। এরপর দৈবী (প্রাকৃতিক শক্তিকে) উপাসনার কথা বলা হয়েছে। বৃষ্টির ফলে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় (যার জন্য ভাল ফসল ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায়) সেই তৃপ্তিতে এবং বিদ্যুতের শক্তিতে ব্রহ্মকে কল্পনা কর।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ এখানে ব্যবহারিক ধর্মের কথা বলেছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত দার্শনিক তত্ত্বসমূহের আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে সেই তত্ত্বকে আমরা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করব? তার উত্তরে উপনিষদ বলছেন, সব কিছুকে ব্রহ্ম বলে মনে করতে হবে।

এরপর উপনিষদ বলছেন যে, বাক্, শ্বাসকর্ম ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্যসহ যাবতীয় শারীরিক কাজকর্মকেই পবিত্র বলে মনে করতে হবে। আমরা যেমন আমাদের সম্পত্তিকে মূল্যবান মনে করে তা রক্ষা করার চেষ্টা করি ঠিক সেভাবেই বাক্ ও অন্যান্য শারীরিক কর্মকেও মূল্যবান বলে বিবেচনা করতে হবে। এগুলি সংরক্ষণের প্রয়োজন; অপচয় যেন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা যখন কোন সম্পদকে সংরক্ষণ করি তখন তা যাতে বৃদ্ধি পায় সেই চেষ্টাও করে থাকি। যেমন শ্বাসক্রিয়ার প্রসারণে আমাদের আয়ু বাড়ে এবং দৈহিক বলও বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে শ্বাসক্রিয়াকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হত। যথাযথভাবে শ্বাসগ্রহণ করলে শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দেহ সুস্থ ও সবল থাকে। এসবই আত্মজ্ঞান লাভে সাহায্য করে।

মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’—দুর্বল ব্যক্তি আত্মাকে জানতে পারে না। শারীরিকভাবে দুর্বল যে-ব্যক্তি তার উন্নতিলাভ করা সম্ভব নয়। এমনকি সে নিজের জীবিকা অর্জনেও অসমর্থ। আর আধ্যাত্মিক জীবনের সংগ্রাম জীবিকা অর্জনের চেয়ে অনেক বেশী দুরূহ। সুতরাং সুস্থ সবল দেহ ছাড়া আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

উপনিষদ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শরীরের সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। হাত-পা যেন কাজ করার উপযোগী হয়। এমনকি মলমূত্র ত্যাগের ইন্দ্রিয়গুলিও জরুরী। কারণ এগুলি যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।

‘মানুষীঃ’ কথাটির অর্থ হচ্ছে মানুষ বা মানুষের দেহ সংক্রান্ত। ‘সমাজ্ঞাঃ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল প্রত্যক্ষ করা। কিন্তু এখানে কথাটির অর্থ ধ্যান বা উপাসনা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাক্, হাত, পা অর্থাৎ সব ইন্দ্রিয়কে আত্মজ্ঞান লাভের উপযোগী করে তুলতে হবে। আর তা করতে পারলে যে কাজই আমরা করি না কেন তা পূজায় পরিণত হয়।

এখানে ‘দৈবীঃ’ কথাটির অর্থ প্রকৃতি সম্বন্ধীয়। বৃষ্টি ও বজ্রপাত হল প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রশ্ন হল, ব্রহ্মকে বাদ দিয়ে প্রকৃতির কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? না, প্রকৃতিও ব্রহ্ম। উপনিষদ বলছেন, এ জগতে যা কিছু ঘটে তা মানুষ সম্পর্কিতই হোক বা প্রকৃতি সম্বন্ধীয়ই হোক, সবই ব্রহ্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, পার্থিব বলে কিছুই নেই, সবই পারমার্থিক।

যশ ইতি পশুষু। জ্যোতিরিতি নক্ষত্রেষু। প্রজাতিরমৃতমানন্দ ইতি উপস্থে। সর্বমিত্যাকাশে। তৎ প্রতিষ্ঠেত্যুপাসীত। প্রতিষ্ঠাবান্ ভবতি। তম্মহ ইত্যুপাসীত। মহান্ ভবতি। তন্মহ ইত্যুপাসীত। মানবান্ ভবতি॥৩

অন্বয়: পশুষু যশঃ ইতি (পশুগণে যশরূপে); নক্ষত্রেষু, জ্যোতিঃ ইতি (নক্ষত্রসমূহে জ্যোতিরূপে); উপস্থে (জননেন্দ্রিয়ে); প্রজাতিঃ অমৃতম্ আনন্দঃ ইতি (সন্তানোৎপাদন রূপ অমৃতত্ব ও আনন্দরূপে [অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র ও সব কিছুতে বিরাজিত একথা চিন্তা করে সুখী হও]); আকাশে সর্বম্ ইতি (আকাশকে সবকিছুর আশ্রয়রূপে [অর্থাৎ যা কিছু আকাশে বিদ্যমান তাই ব্রহ্ম]); তৎ (সেই [ব্রহ্ম]); প্রতিষ্ঠা (সর্ববস্তুর আশ্রয়); ইতি উপাসীত (এইভাবে তাঁর উপাসনা কর); [এইভাবে উপাসনা করার ফলে] প্রতিষ্ঠাবান্ ভবতি ([যে ব্যক্তি এভাবে উপাসনা করেন] তিনি সকল বস্তুর ধারক হয়ে ওঠেন); তৎ (সেই [ব্রহ্ম]); মহঃ ইতি (মহত্তমরূপে); উপাসীত (উপাসনা কর); [তা করতে করতে] মহান্ ভবতি ([উপাসক] মহান হয়ে ওঠেন); তৎ (সেই [ব্রহ্ম]); মনঃ ইতি উপাসীত (মনরূপে উপাসনা কর); [আর তা করলে] মানবান্ ভবতি ([উপাসক] চিন্তাশীল ও বিবেকী হয়ে ওঠেন)। সরলার্থ: (সবকিছুর মধ্যে ব্রহ্ম রয়েছেন যথা) প্রভূত প্রাণী-সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির যশে, নক্ষত্রসমূহের আলোকে, জননেন্দ্রিয়ে অর্থাৎ সন্তান সন্ততির মাধ্যমে অমরত্ব লাভের আনন্দে। আকাশে সর্ববস্তুর আশ্রয়রূপে ব্রহ্ম প্রতিষ্ঠিত আছেন—এভাবে তাঁর উপাসনা করা উচিত। যদি কোন ব্যক্তি এভাবে ব্রহ্মকে উপাসনা করেন তবে তিনি স্বয়ং সকল বস্তুর আশ্রয় হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মকে মহত্তম রূপে উপাসনা করা উচিত। যিনি সেভাবে উপাসনা করেন তিনি নিজেই মহত্তম হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মকে মনরূপে উপাসনা করা উচিত। যিনি তা করেন তিনি চিন্তাশীল মনের অধিকারী হন।

ব্যাখ্যা: তখনকার দিনে প্রাণী-সম্পদ বিশেষ করে গবাদি পশু ছিল ধন-সম্পদের প্রতীক। এই সেদিন পর্যন্তও তাঁকেই ধনী বলা হত যিনি অনেক গরু, ঘোড়া ও হয়তো কয়েকটি হাতির মালিক। সেক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির খ্যাতি তাঁর প্রাণী সংখ্যার ওপর নির্ভর করত।

সন্তানাদি লাভকেও সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করা হত। কারণ এক অর্থে সন্তানই মানুষকে অমরত্ব দান করে। সন্তানের মাধ্যমেই বংশধারা অব্যাহত থাকে। এই কারণেই সন্তান লাভে মানুষ এত আনন্দ লাভ করে থাকেন।

সমগ্র জগৎ এই ব্রহ্মের ওপর আশ্রিত। তাই উপনিষদ আমাদের বলছেন, ব্রহ্মকে সর্ববস্তুর আশ্রয়রূপে, অধিষ্ঠানরূপে চিন্তা কর। যিনি এভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করেন তিনি নিজেই সর্ববস্তুর আশ্রয় স্বরূপ হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ সাধক তখন ব্রহ্মই হয়ে যান।

একইভাবে, ব্রহ্মকে যদি ‘মহ’ তথা মহান বলে উপাসনা করা যায় তবে উপাসক নিজেই মহান হয়ে ওঠেন। আমরা একথা স্বীকার করি বা না করি কিন্তু এই ভাবনাটি সত্যিই অপূর্ব। আচার্য শঙ্কর মুদ্‌গল উপনিষদ (৩।৩) থেকে একটি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন—‘তং যথা যথা উপাসতে তদেব ভবতি’। অর্থাৎ, যিনি যেভাবে তাঁকে উপাসনা করেন তিনি সেইভাবেই প্রাপ্ত হন—‘যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ’। যিনি ঈশ্বরকে করুণার মূর্ত প্রতীকরূপে কল্পনা করেন তিনি নিজেই দয়ার সাগর হয়ে যান।

আমরা ঈশ্বরকে কোন বিশেষ রূপে ভজনা করি কেন? কারণ আমরা ঈশ্বরের সেই রূপটির মতো হতে চাই। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের মতে : যদি আমরা কোন নির্দিষ্ট দেবতার চিন্তায় মগ্ন হই তবে আমরা ধীরে ধীরে তাঁর মতোই হয়ে উঠি। এ হয়ে ওঠা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকই নয়, শারীরিকও বটে। দৃষ্টান্তস্বরূপ কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতীক হিসাবে মহাদেব শিবের কথা মনে করা যাক। তিনি উদার, করুণাঘন, সতত ক্ষমাশীল, সরল এবং আত্মভোলা। আমরা শত দোষ করলেও তিনি তা ক্ষমা করে দেন। মনে করা যাক, আমি শিবের উপাসক এবং সারাক্ষণ তাঁরই স্মরণ-মনন করে থাকি। এর ফলে কালে আমি শিবের মতোই হয়ে উঠি। অর্থাৎ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি তখন আমার মধ্যে ফুটে ওঠে।

মনে করা যাক, সাধক ব্রহ্মকে মনরূপে বা বুদ্ধিরূপে উপাসনা করেন। এর ফলে তাঁর মনের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠেন।

জীবাত্মা দেহ, মন ও বুদ্ধির দ্বারা সীমাবদ্ধ। এসবের জন্যই আমরা নিজেদেরকে পরমাত্মার থেকে পৃথক বলে মনে করি। কিন্তু যখন আমরা দেহ, মন ও বুদ্ধিকে অতিক্রম করি তখন আমরা পরমাত্মার সাথে এক হয়ে যাই। আমাদের যেমন শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধির স্তর রয়েছে ব্রহ্মও তেমনি দেহ, মন ও বুদ্ধিরূপে রয়েছেন।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মানুষের দেহ কোটি কোটি কোষের সমবায়ে গঠিত। যদিও এইসব কোষগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে তবুও তারা একটি দেহের অংশ। সেই দেহের মৃত্যুর সাথে সাথে কোষগুলিরও মৃত্যু ঘটে। দেহ ছাড়া কোষগুলি জীবিত থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে, মানুষ, উদ্ভিদ ও পশু সবই হল ব্রহ্মের সমষ্টি-শরীরের অন্তর্গত অগণিত কোষরাশি। কিন্তু এ হল ব্রহ্মের শারীরিক স্তর। এরপর হল মনের স্তর অর্থাৎ সমষ্টি-মন। আমাদের প্রত্যেকেরই মন আছে। কিন্তু এছাড়াও একটি সমষ্টি-মন আছে। আমাদের সকলের মন সেই সমষ্টি-মনেরই অন্তর্গত।

আমাদের এই অনন্ত সত্তাকে আমরা উপলব্ধি করি না। আমরা নিজেদের এই ক্ষুদ্র দেহ মন নিয়েই মত্ত। কিন্তু হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করি আমার নিজের ভেতরেই চৈতন্যের বিভিন্ন স্তর রয়েছে যা ছিল এতদিন পর্যন্ত আমার অজানা। এই অবস্থায় আমরা অনেক সূক্ষ্মতত্ত্ব ধারণা করতে পারি যা এতদিন পর্যন্ত আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। বর্তমানে আমাদের মন হয়তো অহঙ্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু যখন আমরা আমাদের ‘কাঁচা আমি’-কে নিশ্চিহ্ন করে অহঙ্কারের পারে চলে যাই তখন আমরা এক উচ্চতর অবস্থা প্রাপ্ত হই। এই অবস্থায় আমরা নিখিল বিশ্বের সাথে এক হয়ে যাই।

তন্নম ইত্যুপাসীত। নম্যন্তেঽস্মৈ কামাঃ। তদ্‌ব্রহ্মেত্যুপোসীত। ব্রহ্মবান্ ভবতি। তদ্‌ব্রহ্মণঃ পরিমর ইত্যুপাসীত। পর্যেণেং ম্রিয়ন্তে দ্বিষন্তঃ সপত্নাঃ। পরি যেঽপ্রিয়া ভ্রাতৃব্যাঃ। স যশ্চায়ং পুরুষে। যশ্চাসাবাদিত্যে। স একঃ॥৪

অন্বয়: তৎ নমঃ ইতি উপাসীত (তাঁর প্রাপ্য শ্রদ্ধাসহ তাঁকে উপাসনা করা উচিত); অস্মৈ কামাঃ নম্যন্তে (এমন উপাসকের কাছে কাম্যবস্তু আপনিই আসে); তৎ ব্রহ্ম ইতি উপাসীতা (তাঁকে ব্রহ্মরূপেই উপাসনা করা উচিত); [যদি কেউ তা করেন] ব্রহ্মবান্ ভবতি (তিনি স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যান); তৎ (তাঁকে); ব্ৰহ্মণঃ পরিমরঃ ইতি উপাসীত (ব্রহ্মের পরিমর [তথা আকাশ] হিসাবে উপাসনা করা উচিত); এনং দ্বিষন্তঃ সপত্নাঃ (তাঁর প্রতি দ্বেষকারী শত্রু); পরি ম্রিয়ন্তে (বিনষ্ট হয়); যে অপ্রিয়াঃ ভ্রাতৃব্যাঃ পরি [ম্রিয়ন্তে] ([এবং যারা তাঁর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তারাও বিনাশ প্রাপ্ত হয়); সঃ যঃ চ অয়ং পুরুষে (এই দেহের মধ্যে যিনি আছেন); যঃ চ অসৌ আদিত্যে (যিনি সূর্যে আছেন); সঃ একঃ (তিনি সেই একই)।

সরলার্থ: পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁকে উপাসনা করা উচিত। যদি কেউ তা করেন তবে তাঁর যা কিছু কাম্য সবই তিনি লাভ করেন। তাঁকে পরম বা সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে উপাসনা করতে হবে। এরূপ উপাসনার ফলে সাধক নিজেই পরম হয়ে ওঠেন (অর্থাৎ তিনি মহত্তম তথা ব্রহ্মই হয়ে যান)। তাঁকে আকাশরূপে উপাসনা করা উচিত যেখানে সকল নৈসর্গিক শক্তি (বৃষ্টি, বজ্রপাত) ব্রহ্মে লীন হয়। এই প্রকার উপাসনার ফলে উপাসকের বিদ্বেষকারী শত্রুদের মৃত্যু ঘটে অথবা তাঁর অপ্রিয় শত্রুগণ বিনষ্ট হয়। যিনি এই দেহের অভ্যন্তরে রয়েছেন আর যিনি সূর্যের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা এক ও অভিন্ন।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলছেন যে, ব্রহ্মকে যদি ‘নম’ অর্থাৎ শ্রদ্ধা সহকারে উপাসনা করা যায় তবে সমস্ত কাম্য বস্তুই উপাসকের আয়ত্তে আসে। কাম্য বস্তুগুলি যেন উপাসকের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করে। সম্মান প্রদর্শন করে তারা যেন বলে ওঠে, ‘আমরা তোমার আজ্ঞাধীন।’ এ যেন ভাগ্যের পরিহাস। যখন অর্থ চাইছি তখন তা পাচ্ছি না, আবার যখন চাইছি না তখন তা পাচ্ছি। কিন্তু যখন আমরা একমাত্র ব্রহ্মকেই পেতে চাই অর্থাৎ তাঁকে বোধে বোধ করার জন্য মন যখন ছটফট করতে থাকে, তখন দেখা যায় সব কিছুই আমার দ্বারস্থ। এমন কেন হয়? কারণ ব্রহ্মই যে সব কিছুর উৎস।

স্বামী বিবেকানন্দ প্রায়ই বলতেন, আমরা সবাই ভিখারী। সবসময়ই আরো চাই আরো চাই করছি এবং সদা অপ্রসন্ন। আমরা আমাদের কামনা বাসনার দাস। কোন কিছু পেলেও আমরা তৃপ্ত হই না। আমরা আরো পেতে চাই। আমরা কখনই সন্তুষ্ট নই। কিন্তু যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন তিনি সদাপ্রসন্ন। তিনি বলেন, ‘আমি সব পেয়ে গেছি।’ মূল কথাটি হল, যিনি ব্রহ্মানন্দকে পেয়েছেন বিষয়ানন্দ তাঁর কাছে তুচ্ছ বলে বোধ হয়। এই তুচ্ছ বিষয়সকল তাঁর কাছে ভিড় করলেও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে তা টলাতে পারে না।

একসময় মহাবীর আলেকজান্ডার এক ভারতীয় যোগীকে গ্রীস দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছিলেন। কিন্তু কোন লোভই যোগীকে স্পর্শ করতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে তিনি ছিলেন নিঃস্ব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন পূর্ণ। অর্থাৎ সবই তাঁর ছিল। কারণ তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন। একটি ইংরেজি কবিতায় আছে: ‘কিছুই নেই অথচ সবই আছে।’ এমন মানুষ সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা: ‘কি নির্বোধই না মানুষটি। আদপে তাঁর কিছুই নেই অথচ মনে করছেন তাঁর সব আছে।’ এখন প্রশ্ন হল, এঁদেরকে বোকা ভেবে যারা নিজেদের বুদ্ধিমান ও চালাক বলে মনে করে তারা সকলেই সুখী তো? তারা তৃপ্ত তো?

‘তৎ ব্রহ্ম ইতি উপাসীতা ব্রহ্মবান্ ভবতি’—যিনি ব্রহ্মের উপাসনা করেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। এখানে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি শারীরিক অর্থে ব্যবহৃত। এ অবস্থায় সাধক মনে করেন তিনিই সর্বত্র রয়েছেন।

‘ব্ৰহ্মণঃ পরিমর’ কথার অর্থ হল ব্রহ্ম যেখানে ‘সংহার’ করেন। আচার্য শঙ্করের মতে, এটি হল আকাশ। যেহেতু বিদ্যুৎ, চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি প্রভৃতি সব প্রাকৃতিক ঘটনা আকাশেই লীন হয় সেহেতু মনে হয় ব্রহ্ম যেন আকাশেই এগুলিকে সংহার করেন।

আচার্য শঙ্কর এখানে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলছেন: যখন ভেদবুদ্ধি অর্থাৎ দুই-বোধ চিরতরে মুছে যায় তখন খাদ্যই বা কি আর খাদ্যের ভোক্তাই বা কে? দু-ই অভিন্ন। সাধকের তখন এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি তীব্র অনীহা জাগে। একসময় স্বামী বিবেকানন্দ ‘সবই ব্রহ্ম’ এ কথাটি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন। এর উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে একটিবার স্পর্শ করেছিলেন মাত্র এবং তখনই স্বামীজী সর্বভূতে ব্রহ্মকেই দেখতে লাগলেন। কয়েকদিন ধরে এই আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকার জন্য স্বামীজীর পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি খেতে বসেও দেখেন, তিনিও ব্রহ্ম আবার খাদ্যবস্তুও ব্রহ্ম। তাহলে তিনি নিজেই নিজেকে খান কি করে? আবার রাস্তায় চলাকালীন তিনি দেখতে লাগলেন যে, যানবাহন ও অন্যান্য সব বস্তুই ব্রহ্ম। তবে ব্রহ্ম কেন ব্রহ্মের পথ থেকে সরে আসবেন?

স য এবংবিৎ। অস্মাল্লোকাৎ প্রেত্য। এতমন্নময়মাত্মানমুপসংক্রম্য। এতং প্রাণময়মাত্মানমুপসংক্রম্য। এতং মনোময়মাত্মানমুপসংক্রম্য। এতং বিজ্ঞানময়মাত্মানমুপসংক্রম্য। এতমানন্দময়মাত্মানমুপসংক্রম্য। ইমাঁল্লোকান্‌কামান্নী কামরূপ্যনুসংচরন্। এতৎ সাম গায়ন্নাস্তে। হা৩বু হা৩বু হা৩বু॥৫

অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩ঽহমন্নাদো৩ঽহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোঽমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩ঽঽবাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্। সুবর্ন জ্যোতীঃ। য এবং বেদ। ইত্যুপনিষৎ॥৬॥ ইতি দশমোঽনুবাকঃ॥

অন্বয়: সঃ যঃ এবংবিৎ (যিনি একথা জানেন [অর্থাৎ পূর্ব-আলোচিত জ্ঞান যিনি অর্জন করেছেন]); অস্মাৎ লোকাৎ (এই জগৎ থেকে); প্ৰেত্য (ত্যাগ করে); এতম্ অন্নময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রম্য ([প্রথমে] নিজেকে অন্নময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন জেনে); এতং প্রাণময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রম্য ([পরে] নিজেকে শ্বাস কর্মে তথা প্রাণময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন জেনে); এতং মনোময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রম্য ([তারপর] নিজেকে মনোময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন জেনে); এতং বিজ্ঞানময়ম্ আত্মানম্, উপসংক্রম্য (নিজেকে বিজ্ঞানময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন জেনে); [এবং পরিশেষে] এতম্ আনন্দময়ম্ আত্মানম্ উপসংক্রম্য (নিজেকে আনন্দময় আত্মার সঙ্গে অভিন্ন জেনে); অনুসংচরন্ ইমান্ লোকান্ কামান্নী [অর্থাৎ, কাম + অন্নী] কামরূপী (তিনি ত্রিলোক বিচরণ করে নিজের রুচিমতো ‘অন্ন’ গ্রহণ করেন এবং নিজের খেয়াল খুশিতে কাজ করেন); এতৎ সাম গায়ন্ আস্তে (সব কিছু নিয়ে আনন্দে এবং বিস্ময়ে পূর্ণ হয়ে তিনি গান করতে থাকেন); হা-আ-আ-বু হা-আ-আ-বু হা-আ-আ-বু (ওঃ। ওঃ। ওঃ)।

অহম্ অন্নম্ (আমিই খাদ্য! [বিস্ময় প্রকাশের জন্য তিন বার উচ্চারিত]); অহম্ অন্নাদঃ (আমি অন্নভোক্তা! [একই কারণে তিনবার উচ্চারিত]); অহং শ্লোককৃৎ (আমিই সেই, যে খাদ্য ও খাদককে একত্রিত করে [এর দ্বারা সজীব দেহ নির্মাণ করে] [একই কারণে তিনবার উচ্চারিত]); অহং প্রথমজাঃ ঋতস্য অস্মি (আমিই সেই, যে এ জগতে অন্য সব কিছুর [দৃশ্য এবং অদৃশ্য] পূর্বে জন্মেছিল); দেবেভ্যঃ পূর্বম্ (দেবদেবীগণের পূর্বে আমার জন্ম); অমৃতস্য নাভায়ী ([আমি-ই] অমৃতের আশ্রয়); যঃ মা দদাতি ([খাদ্য হিসাবে] যিনি আমাকে দেন [যাঁর খাদ্যের প্রয়োজন]); সঃ (তিনি); ইৎ এব (এইভাবে); মা আবাঃ (আমাকে রক্ষা করেন); অন্নম্ অদন্তম্ ([অন্যদিকে] যিনি অন্নদান করেন না [তাঁকে]); অহম্ অন্নম্ অদ্মি (আমি অন্নরূপে ভক্ষণ করি); অহং বিশ্বং ভুবনম্ অভ্যভবাম্ (আমি সমগ্র বিশ্বকে ভক্ষণ করি); সুবঃ ন জ্যোতীঃ (আমি সর্বদাই সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল); যঃ এবং বেদ (যিনি এ তত্ত্ব জানেন [তিনি পূর্বোল্লিখিত সুফল অর্জন করেন]); ইতি উপনিষৎ (এই তো উপনিষদ); ইতি দশমঃ অনুবাকঃ (দশম অধ্যায় এখানে সমাপ্ত)।

সরলার্থ: (৫-৬) যিনি এই জ্ঞান লাভ করেছেন (অর্থাৎ অন্ন এবং অন্নাদ, খাদ্য এবং খাদ্যের ভোক্তার একত্ব জ্ঞান) তিনি আর এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হন না। তিনি নিজেকে যথাক্রমে দেহ, প্রাণ, মন, বুদ্ধি ও আনন্দের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। এই সময় তাঁর যেখানে যেতে ইচ্ছা করে সেখানেই যান এবং নিজের খেয়াল-খুশিমতো কাজ করেন। তখন তিনি ব্রহ্মানন্দে ভরপুর হয়ে যান। তাঁর এই আনন্দ ও বিস্ময়কে তিনি কতগুলি প্রায় অর্থহীন শব্দে প্রকাশ করেন: ‘ওঃ! ওঃ! ওঃ! আমিই খাদ্য, আমিই খাদ্য, আমিই খাদ্য। আমিই ভক্ষক, আমিই ভক্ষক, আমিই ভক্ষক। আমিই খাদ্য এবং খাদ্যের ভোক্তাকে একত্রিত করি এবং এর দ্বারা সজীব দেহ সৃষ্টি করি। আমিই প্রথমজাত। দৃশ্য ও অদৃশ্য উভয় জগতের আমিই পূর্বসূরী। সুতরাং আমি দেবতাদেরও পূর্ববর্তী। আমিই মোক্ষ (অমরত্ব) দাতা। যিনি ক্ষুধার্তকে খাদ্যরূপে আমাকে দান করেন তিনি পরোক্ষভাবে আমাকেই রক্ষা করেন। কিন্তু আমাকে খাদ্যরূপে জেনেও যিনি ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান না করেন তাঁকে আমিই খাদ্যরূপে আত্মসাৎ করি। আমি সমগ্র বিশ্বকে ভক্ষণ করি। সূর্যের মতোই আমি উজ্জ্বল এবং আমি জ্যোতিস্বরূপ।’ উপনিষদ এই কথাই আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন। যিনি উপনিষদের তত্ত্বকে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম তিনি পূর্বোক্ত ফল লাভ করে থাকেন।

ব্যাখ্যা: সাধককে স্থূল জড়জগৎ (খাদ্যের তথা অন্নময়) থেকে সূক্ষ্মতম জগতে (আনন্দের তথা আনন্দময়) পোঁছতে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়। এ যাত্রা শুধু দীর্ঘই নয়, এ পথ দুর্গম ও কষ্টকর। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও আনন্দ পেতে হলে এ ছাড়া আর অন্য কোন পথ নেই।

এই উপনিষদের শুরুতেই ভৃগু নামে এক যুবকের কথা বলা হয়েছে। ইনি তাঁর পিতা বরুণের কাছে ব্রহ্মতত্ত্ব জানতে চেয়েছিলেন। ভৃগুকে বারবারই তাঁর পিতার কাছে আসতে হত। এবং প্রতিবারই পিতা ভৃগুকে কঠোর থেকে কঠোরতর তপস্যা করার নির্দেশ দিতে থাকেন। বরুণ এ পর্যন্তও বলেছিলেন যে, তপস্যাই ব্রহ্ম। উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে যে কোন তফাৎ নেই তা বোঝাবার জন্যই পিতা পুত্রকে একথা বলেছিলেন। উপায় ঠিক থাকলে উদ্দেশ্য আপনিই উপায়কে অনুসরণ করে। দীপের আবরণকে সরিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তার আলো দেখা যায়। অনুরূপভাবে অহঙ্কার ইত্যাদি অবিদ্যাজনিত নানা বাধা দূর হলে আমাদের সকলের অন্তরস্থ আত্মা তখন স্বমহিমায় নিজেকে প্রকাশ করেন। এর জন্য চিত্তশুদ্ধির প্রয়োজন। তপস্যার দ্বারাই চিত্তশুদ্ধি লাভ হয়। এই জন্যই বরুণ তাঁর পুত্র ভৃগুকে ‘যাও এবং তপস্যা কর’—এই কথা বলে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

ভৃগু তপস্যা শুরু করলেন। প্রতিবারই পিতার কাছ থেকে ফিরে এসে ভৃগু নতুন প্রেরণায় তপস্যা শুরু করতেন এবং লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্রথমে তিনি নিজেকে এই স্থূলদেহ (অন্নময়) বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু তপস্যা করার পর তিনি উপলব্ধি করলেন যে, দেহ ছাড়াও তাঁর একটি সূক্ষ্ম অস্তিত্ব রয়েছে। তা হল প্রাণ (প্রাণময়) বা জীবনীশক্তি। এইভাবে তপস্যার দ্বারা তিনি স্থূল থেকে সূক্ষ্মের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরিশেষে তিনি আনন্দের সাথে এক হয়ে যান যা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ। সাধক যখন ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন তখন তিনি তাঁর লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেছেন বলতে হবে। তখন তিনি উপলব্ধি করেন, কেবলমাত্র তিনিই ব্রহ্ম নন। এ জগতের সব কিছুই ব্রহ্ম। অর্থাৎ ব্রহ্ম ছাড়া এ জগতে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এক বৈ দুই বলে কিছু নেই।

এখন প্রশ্ন হল, যদি দুই বলে কিছু না থাকে তবে খাদ্য এবং খাদ্যের ভোক্তার ধারণাই বা এল কোথা থেকে? এ ধারণা তো দুই-বোধ থেকেই সৃষ্ট। অদ্বৈত তত্ত্ব বিরোধী এই দ্বৈতবাদের কথা এখানে এলই বা কেন? ‘এক’ কি কখনও ‘বহু’র স্থান গ্রহণ করতে পারে?

এর উত্তরে আচার্য শঙ্কর বলছেন, তপস্যার ফলে দ্বৈতদৃষ্টি দূর হয় এবং ধীরে ধীরে একত্বের বোধ জাগ্রত হয়। প্রথমে অন্ন (খাদ্য) ও অন্নাদকে (খাদ্যের ভোক্তা) দুটি পৃথক সত্তা বলে মনে হয়। কিন্তু নিপুণভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় এই মুহূর্তে যা অন্ন পরমুহূর্তে তাই অন্নাদ। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবলমাত্র শব্দ প্রয়োগে। আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এক ও অদ্বিতীয় সত্তাই নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেন। মূলত আমরা সবাই এক এবং সেই ‘এক’ থেকেই সব কিছু এসেছে।

সাধক যখন এই একত্বকে বোধে বোধ করেন তখন তিনি জাতি, ধর্ম, দেশ, কাল ইত্যাদি সমস্ত বন্ধনের ঊর্ধ্বে চলে যান। এই নিখিল জগতের সবকিছুর সঙ্গে তিনি তখন একাত্ম বোধ করেন। তাঁর কাছে তখন সকলেই সমান। আনন্দের ঘনীভূত রূপই হচ্ছেন তিনি। এ-অবস্থায় সাধক তাঁর আনন্দ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পান না। এ আনন্দকে ভাষায় প্রকাশ করাও যায় না। তাঁর মুখমণ্ডল সবসময় দিব্য স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত। সদা প্রসন্ন তিনি।

॥ ভৃগুবল্লী এখানেই সমাপ্ত ॥

ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *