তৃতীয় দৃশ্য |
|
অন্তঃপুরে মহিষী |
|
মহিষী। | এখানেও নাই! মা গো, কী হবে আমার! কেবলি এমন করে কতদিন আর চোখে চোখে রাখি তারে, ভয়ে ভয়ে থাকি, রজনীতে ঘুম ভেঙে নাম ধ’রে ডাকি, জেগে জেগে উঠি। চোখের আড়াল হলে মনে শঙ্কা হয়, কোথা গেল বুঝি চলে আমার সে স্বপ্নস্বরূপিণী। যাই, খুঁজি, কোথা সে লুকায়ে আছে। |
[ প্রস্থান |
|
যুবরাজের সহিত রাজার প্রবেশ |
|
রাজা। | অবশেষে বুঝি দিতে হল নির্বাসন। যুবরাজ। না দেখি উপায়। ত্বরা যদি নাহি কর রাজ্য তবে যায় মহারাজ। সৈন্যগণ নগরপ্রহরী হয়েছে বিদ্রোহী। স্নেহমোহ পরিহরি কর্তব্য সাধন করো– দাও মালিনীরে অবিলম্বে নির্বাসন। |
রাজা। | ধীরে, বৎস, ধীরে। দিব তারে নির্বাসন,পুরাব প্রার্থনা, সাধিব কর্তব্য মোর। মনে করিয়ো না বৃদ্ধ আমি মোহমুগ্ধ, অন্তর দুর্বল, রাজধর্ম তুচ্ছ করি ফেলি অশ্রুজল। |
মহিষীর পুনঃপ্রবেশ |
|
মহিষী। | মহারাজ, মহারাজ, বলো সত্য করে কোথা লুকায়েছ তারে কাঁদাইতে মোরে? কোথায় সে? |
রাজা। | কে মহিষী? |
মহিষী। | মালিনী আমার। |
রাজা। | কোথায় সে? চলে গেছে? নাই ঘরে তার? |
মহিষী। | ওগো, নাই। যাও তুমি সৈন্যদল ল’য়ে খোঁজো তারে পথে পথে আলয়ে আলয়ে, করো ত্বরা। ওগো,তারে করিয়াছে চুরি তোমার প্রজারা মিলে। নিষ্ঠুর চাতুরী তাহাদের। দূর করে দাও সর্বজনে। শূন্য করে দাও এ নগরী, যতক্ষণে ফিরে নাহি দেয় মালিনীরে। |
রাজা। | গেছে চলে? প্রতিজ্ঞা করিনু আমি ফিরাইব কোলে কোলের কন্যারে মোর। রাজ্যে ধিক্ থাক্। ধিক্ ধর্মহীন রাজনীতি। ডাক্, ডাক্ সৈন্যদলে। |
[ যুবরাজের প্রস্থান |
|
মালিনীকে লইয়া সৈন্যগণ ও প্রজাগণের মশাল ও সমারোহ সহকারে প্রবেশ |
|
ব্রাহ্মণগণ। | জয় জয় শুভ্র পুণ্যরাশি, বিগ্রহিণী দয়া। |
ছুটিয়া গিয়া |
|
মহিষী। | ওমা, ওমা, সর্বনাশী, ও রাক্ষসী মেয়ে, আমার হৃদয়বাসী নির্দয় পাষাণী, এক পল করি না গো বুকের বাহির– তবু ফাঁকি দিয়ে, মা গো, কোথা গিয়েছিলি? প্রজাগণ। কোরো না গো তিরস্কার মহারানী! আমাদের ঘরে একবার গিয়েছিল আমাদের মাতা। |
চারুদত্ত। | কেহ নই আমরা কি ওগো রানী? দেবী দয়াময়ী শুধু তোমাদেরি? |
দেবদত্ত। | ফিরে তো এনেছি পুন পুণ্যবতী প্রাসাদলক্ষ্ণীরে। |
সোমাচার্য। | মা গো, শুন, আমাদের ভুলিয়ো না আর। মাঝে মাঝে শুনি যেন শ্রীমুখের বাণী, শুভকাজে পাই আশীর্বাদ, তা হলে পরান-তরী পথ পাবে পারাবারে– ধ্রুবতারা ধরি যাবে মুক্তিপারে। |
মালিনী। | তোমরা যেয়ো না দূরে এসেছ যাহারা। প্রতিদিন রাজপুরে দেখা দিয়ে যেয়ো। সকলেরে এনো ডাকি, সবারে দেখিতে চাহি আমি। হেথা থাকি রব আমি তোমাদেরি ঘরে পুরবাসী। |
সকলে। | মোরা আজি ধন্য সবে, ধন্য আজি কাশী। |
[প্রস্থান |
|
মালিনী। | ওগো পিতা, আজ আমি হয়েছি সবার। কী আনন্দ উচ্ছ্বসিল, জয়জয়কার উঠিল ধ্বনিয়া যবে সহস্র হৃদয় মুহূর্তে বিদীর্ণ করি। |
রাজা। | কী সৌন্দর্যময় আজিকার ছবি। সমুদ্রমন্থনে যবে লক্ষ্ণী উঠিলেন, তাঁরে ঘেরি কলরবে মাতিল উন্মাদনৃত্যে ঊর্মিগুলি সবে, সেইমতো উচ্ছ্বসিত জনপারাবার, মাঝে তুমি লোকলক্ষ্ণী মাতা। |
মালিনী। | মা আমার, এ প্রাচীরে মোরে আর নারিবে লুকাতে। তব অন্তঃপুরে আমি আনিয়াছি সাথে সর্বলোক– দেহ নাই মোর,বাধা নাই, আমি যেন এ বিশ্বের প্রাণ! |
মহিষী। | থাক্ তাই, বিশ্বপ্রাণ হয়ে আপন করিয়া সবে থাক্ মার কাছে। বাহিরে যেতে না হবে, হেথা নিয়ে আয় তোর বৃহৎ সংসার– মাতা কন্যা দোঁহে মিলি সেবা করি তার। অনেক হয়েছে রাত, বোস্ মা এখানে, শান্ত করো আপনারে– জ্বলিছে নয়ানে উদ্দীপ্ত প্রাণের জ্যোতি নিদ্রার আরাম দগ্ধ করি। একটুকু করো, মা, বিশ্রাম। মাতাকে আলিঙ্গন করিয়া |
মালিনী। | মা গো, শ্রান্ত এবে আমি। কাঁপিতেছে দেহ। কোথা গিয়েছিনু চলে ছাড়ি মার স্নেহ প্রকাণ্ড পৃথিবী-মাঝে! মা গো, নিদ্রা আন্ চক্ষে মোর। ধীরে ধীরে কর্ তুই গান শিশুকালে শুনিতাম যাহা। আজি মোর চক্ষে আসিতেছে জল, বিষাদের ঘোর ঘনাইছে প্রাণে। |
মহিষী। | বসুগণ, রুদ্রগণ, বিশ্বদেবগণ, সবে করহ রক্ষণ কন্যারে আমার। মর্তলোক, স্বর্গলোক হও অনুকূল– শুভ হোক, শুভ হোক কন্যার আমার। হে আদিত্য, হে পবন, করি প্রণিপাত, সর্ব দিক্পালগণ করো দূর মালিনীর সর্ব অকল্যাণ।– দেখিতে দেখিতে আহা শ্রান্ত দু-নয়ান মুদিয়া এসেছে ঘুমে। আহা, মরে যাই! দূর হোক, দূর হোক সকল বালাই। — ভয়ে অঙ্গ কাঁপে মোর। কন্যার তোমার এ কী খেলা মহারাজ? সমস্ত সংসার খেলার সামগ্রী তার–তারে রেখে দিবে আপনার গৃহকোণে, ঘুম পাড়াইবে পদ্মহস্ত পরশিয়া ললাটে তাহার! অবাক হয়েছি দেখে কাণ্ড বালিকার। যেমন খেলেনাখানি, তেমনি এ খেলা। মহারাজ, সাবধান হও এই বেলা। নবধর্ম, নবধর্ম কারে বল তুমি! কে আনিল নবধর্ম, কোথা তার ভূমি আকাশকুসুম? কোন্ মত্ততার স্রোতে ভেসে এল–কন্যারে মায়ের কোল হতে টানিয়া লইয়া যায়–ধর্ম বলে তায়? তুমিও দিয়ো না যোগ কন্যার খেলায় মহারাজ। বলে দাও, গ্রহবিপ্রগণ করুক সকলে মিলে শান্তিস্বস্ত্যয়ন দেবার্চনা। স্বয়ম্বরসভা আনো ডেকে মালিনীর তরে। মনোমত বর দেখে খেলা ভেঙে যোগ্য কণ্ঠে দিক বরমালা– দূর হবে নবধর্ম, জুড়াইবে জ্বালা। |