প্রথম দৃশ্য |
|
রাজান্তঃপুর মালিনী ও কাশ্যপ < |
|
কাশ্যপ। | ত্যাগ করো, বৎসে, ত্যাগ করো সুখ-আশা দুঃখভয় ; দূর করো বিষয়পিপাসা ; ছিন্ন করো সংসারবন্ধন ; পরিহর প্রমোদপ্রলাপ চঞ্চলতা ; চিত্তে ধরো ধ্রুবশান্ত সুনির্মল প্রজ্ঞার আলোক রাত্রিদিন– মোহশোক পরাভূত হোক। |
মালিনী। | ভগবন্, রুদ্ধ আমি, নাহি হেরি চোখে ; সন্ধ্যায় মুদ্রিতদল পদ্মের কোরকে আবদ্ধ ভ্রমরী- স্বর্ণরেণুরাশিমাঝে মৃত জড়প্রায়। তবু কানে এসে বাজে মুক্তির সংগীত, তুমি কৃপা কর যবে। |
কাশ্যপ। | আশীর্বাদ করিলাম, অবসান হবে বিভাবরী, জ্ঞানসূর্য-উদয়-উৎসবে জাগ্রত এ জগতের জয়জয়রবে শুভলগ্নে সুপ্রভাতে হবে উদ্ঘাটন পুষ্পকারাগার তব। সেই মহাক্ষণ এসেছে নিকটে। আমি তবে চলিলাম তীর্থপর্যটনে। |
মালিনী। | লহো দাসীর প্রণাম।
[ কাশ্যপের প্রস্থান p>মহাক্ষণ আসিয়াছে। অন্তর চঞ্চল |
রাজমহিষীর প্রবেশ < |
|
মহিষী। | মা গো মা, কী করি তোরে লয়ে। ওরে বাছা, এ-সব কি সাজে তোরে কভু, এই কাঁচা নবীন বয়সে? কোথা গেল বেশভূষা কোথা আভরণ? আমার সোনার উষা স্বর্ণপ্রভাহীনা, এও কি চোখের ‘পরে সহ্য হয় মার? |
মালিনী। | কখনো রাজার ঘরে জন্মে না কি ভিখারিনী? দরিদ্রের কূলে তুই যে, মা জন্মেছিস সে কি গেলি ভুলে রাজেশ্বরী? তোর সে বাপের দরিদ্রতা জগৎবিখ্যাত, বল্ মা, সে যাবে কোথা? তাই আমি ধরিয়াছি অলংকারসম তোমার বাপের দৈন্য সর্ব অঙ্গে মম, মা আমার। |
মহিষী। | ওগো, আপন বাপের গর্বে আমার বাপেরে দাও খোঁটা? তাই গর্ভে ধরেছিনু তোরে, ওরে অহংকারী মেয়ে? জানিস, আমার পিতা তোর পিতা চেয়ে শতগুণে ধনী, তাই, ধনরত্নমানে এত তাঁর হেলা। |
মালিনী। | সে তো সকলেই জানে। যেদিন পিতৃব্য তব, পিতৃধনলোভে বঞ্চিলেন পিতারে তোমার, মনঃক্ষোভে ছাড়িলেন গৃহ তিনি। সর্ব ধনজন সম্পদ সহায় করিলেন বিসর্জন অকাতর মনে ; শুধু সযত্নে আনিলা পৈতৃক দেবতামূর্তি শালগ্রামশিলা দরিদ্রকুটিরে। সেই তাঁর ধর্মখানি মোর জন্মকালে মোরে দিয়েছ, মা, আনি– আর কিছু নহে। থাক্-না মা, সর্বক্ষণ তব পিতৃভবনের দরিদ্রের ধন তোমারি কন্যার হৃদে। আমার পিতার যা-কিছু ঐশ্বর্য আছে ধনরত্নভার থাক্ রাজপুত্রতরে। |
মহিষী। | কে তোমারে বোঝে মা আমার ! কথা শুনে জানি না কেন যে চক্ষে আসে জল। যেদিন আসিলি কোলে বাক্যহীন মূঢ় শিশু, ক্রন্দনকল্লোলে মায়েরে ব্যাকুল করি, কে জানিত তবে সেই ক্ষুদ্র মুগ্ধ মুখ এত কথা কবে দুই দিন পরে। থাকি তোর মুখ চেয়ে, ভয়ে কাঁপে বুক। ও মোর সোনার মেয়ে, এ ধর্ম কোথায় পেলি, কী শাস্ত্রবচন? আমার পিতার ধর্ম সে তো পুরাতন অনাদি কালের। কিন্তু মা গো, এ যে তব সৃষ্টিছাড়া বেদছাড়া ধর্ম অভিনব আজিকার গড়া। কোথা হতে ঘরে আসে বিধর্মী সন্ন্যাসী? দেখে আমি মরি ত্রাসে ! কী মন্ত্র শিখায় তারা, সরল হৃদয় জড়ায় মিথ্যার জালে? লোকে না কি কয় বৌদ্ধেরা পিশাচপন্থী, জাদুবিদ্যা জানে, প্রেতসিদ্ধ তারা। মোর কথা লহ কানে, বাছা রে আমার ! ধর্ম কি খুঁজিতে হয় ? সুর্যের মতন ধর্ম চিরজ্যোতির্ময় চিরকাল আছে। ধরো তুমি সেই ধর্ম, সরল সে পথ। লহ ব্রতক্রিয়াকর্ম ভক্তিভরে। শিবপূজা করো দিনযামী, বর মাগি লহ, বাছা, তাঁরি মতো স্বামী। সেই পতি হবে তোর সমস্ত দেবতা, শাস্ত্র হবে তাঁরি বাক্য, সরল এ কথা। শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিতেরা মরুক ভাবিয়া সত্যাসত্য ধর্মাধর্ম কর্তাকর্মক্রিয়া অনুস্বার-চন্দ্রবিন্দু লয়ে। পুরুষের দেশভেদে কালভেদে প্রতিদিবসের স্বতন্ত্র নূতন ধর্ম ; সদা হাহা ক’রে ফিরে তারা শান্তি লাগি সন্দেহসাগরে, শাস্ত্র লয়ে করে কাটাকাটি। রমণীর ধর্ম থাকে বক্ষে কোলে চিরদিন স্থির পতিপুত্ররূপে। |
রাজার প্রবেশ < |
|
রাজা। | কন্যা, ক্ষান্ত হও এবে, কিছুদিন-তরে। উপরে আসিছে নেবে ঝটিকার মেঘ। |
মহিষী। | কোথা হতে মিথ্যা ভয় আনিয়াছ মহারাজ? |
রাজা। | বড়ো মিথ্যা নয়। হায় রে অবোধ মেয়ে, নব ধর্ম যদি ঘরেতে আনিতে চাস, সে কি বর্ষানদী একেবারে তট ভেঙে হইবে প্রকাশ দেশবিদেশের দৃষ্টিপথে? লজ্জাত্রাস নাহি তার? আপনার ধর্ম আপনারি, থাকে যেন সংগোপনে, সর্বনরনারী দেখে যেন নাহি করে দ্বেষ, পরিহাস না করে কঠোর। ধর্মেরে রাখিতে চাস রাখ্ মনে মনে। |
মহিষী। | ভর্ৎসনা করিছ কেন বাছারে আমার মহারাজ? কত যেন অপরাধী। কী শিক্ষা শিখাতে এলে আজ, পাপ রাষ্ট্রনীতি? লুকায়ে করিবে কাজ, ধর্ম দিবে চাপা! সে মেয়ে আমার নয়। সাধুসন্ন্যাসীর কাছে উপদেশ লয়, শুনে পুণ্যকথা, করে সজ্জনের সেবা– আমি তো বুঝি না তাহে দোষ দিবে কেবা, ভয় বা কাহারে। |
রাজা। | মহারানী, প্রজাগণ ক্ষুব্ধ অতিশয়। চাহে তারা নির্বাসন মালিনীর। |
মহিষী। | কী বলিলে! নির্বাসন কারে! মালিনীরে ? মহারাজ, তোমার কন্যারে? |
রাজা। | ধর্মনাশ-আশঙ্কায় ব্রাহ্মণের দল এক হয়ে- |
মহিষী। | ধর্ম জানে ব্রাহ্মণে কেবল? আর ধর্ম নাই ? তাদেরি পুঁথিতে লেখা সর্বসত্য, অন্য কোথা নাহি তার রেখা এ বিশ্বসংসারে ? ব্রাহ্মণেরা কোথা আছে ডেকে নিয়ে এস। আমার মেয়ের কাছে শিখে নিক ধর্ম কারে বলে। ফেলে দিক কীটে-কাটা ধর্ম তার, ধিক্ ধিক্ ধিক্।– ওরে বাছা, আমি লব নবমন্ত্র তোর, আমি ছিন্ন করে দেব জীর্ণ শাস্ত্রডোর ব্রাহ্মণের। তোমারে পাঠাবে নির্বাসনে?– নিশ্চিন্ত রয়েছ মহারাজ? ভাব মনে এ কন্যা তোমার কন্যা, সামান্য বালিকা! ওগো, তাহা নহে। এ যে দীপ্ত অগ্নিশিখা। আমি কহিলাম আজি শুনি লহো কথা– এ কন্যা মানবী নহে, এ কোন্ দেবতা, এসেছে তোমার ঘরে। করিয়ো না হেলা, কোন্ দিন অকস্মাৎ ভেঙে দিয়ে খেলা চলে যাবে– তখন করিবে হাহাকার, রাজ্যধন সব দিয়ে পাইবে না আর। |
মালিনী। | প্রজাদের পুরাও প্রার্থনা। মহাক্ষণ এসেছে নিকটে। দাও মোরে নির্বাসন পিতা। |
রাজা। | কেন বৎসে, পিতার ভবনে তোর কী অভাব? বাহিরের সংসার কঠোর দয়াহীন, সে কি বাছা পিতৃমাতৃক্রোড়? |
মালিনী। | শোনো পিতা– যারা চাহে নির্বাসন মোর তারা চাহে মোরে। ওগো মা, শোন্ মা কথা– বোঝাতে পারি নে মোর চিত্তব্যাকুলতা। আমারে ছাড়িয়া দে মা, বিনা দুঃখশোকে, শাখা হতে চ্যুত পত্রসম। সর্বলোকে যাব আমি– রাজদ্বারে মোরে যাচিয়াছে বাহির-সংসার। জানি না কী কাজ আছে, আসিয়াছে মহাক্ষণ। |
রাজা। | ওরে শিশুমতি, কী কথা বলিস। |
মালিনী। | পিতা, তুমি নরপতি, রাজার কর্তব্য করো। জননী আমার, আছে তোর পুত্রকন্যা এ ঘরসংসার, আমারে ছাড়িয়া দে মা। বাঁধিস নে আর স্নেহপাশে। |
মহিষী। | শোনো কথা শোনো একবার। বাক্য নাহি সরে মুখে, চেয়ে তোর পানে রয়েছি বিস্মিত। হাঁ গো, জন্মিলি যেখানে সেখানে কি স্থান নাই তোর? মা আমার, তুই কি জগৎলক্ষ্ণী, জগতের ভার পড়েছে কি তোরি ‘পরে? নিখিলসংসার তুই বিনা মাতৃহীনা, যাবি তারি কাছে নূতন আদরে– আমাদের মা কে আছে তুই চলে গেলে? |
মালিনী। | আমি স্বপ্ন দেখি জেগে, শুনি নিদ্রাঘোরে, যেন বায়ু বহে বেগে, নদীতে উঠিছে ঢেউ, রাত্রি অন্ধকার, নৌকাখানি তীরে বাঁধা– কে করিবে পার, কর্ণধার নাই– গৃহহীন যাত্রী সবে বসে আছে নিরাশ্বাস– মনে হয় তবে আমি যেন যেতে পারি, আমি যেন জানি তীরের সন্ধান– মোর স্পর্শে নৌকাখানি পাবে যেন প্রাণ, যাবে যেন আপনার পূর্ণ বলে– কোথা হতে বিশ্বাস আমার এল মনে? রাজকন্যা আমি, দেখি নাই বাহির-সংসার– বসে আছি এক ঠাঁই জন্মাবধি, চতুর্দিকে সুখের প্রাচীর, আমারে কে করে দেয় ঘরের বাহির কে জানে গো। বন্ধ কেটে দাও মহারাজ, ওগো, ছেড়ে দে মা, কন্যা আমি নহি আজ, নহি রাজসুতা– যে মোর অন্তরযামী অগ্নিময়ী মহাবাণী, সেই শুধু আমি। |
মহিষী। | শুনিলে তো মহারাজ? এ কথা কাহার? শুনিয়া বুঝিতে নারি। এ কি বালিকার? এই কি তোমার কন্যা? আমি কি আপনি ইহারে ধরেছি গর্ভে? |
রাজা। | যেমন রজনী উষারে জনম দেয়। কন্যা জ্যোতির্ময়ী রজনীর কেহ নহে, সে যে বিশ্বজয়ী বিশ্বে দেয় প্রাণ। |
মহিষী। | মহারাজ তাই বলি, খুঁজে দেখো কোথা আছে মায়ার শিকলি যাহে বাঁধা পড়ে যায় আলোকপ্রতিমা। কন্যার প্রতি মুখে খুলে পড়ে কেশ, এ কী বেশ! ছি মা ! আপনারে এত অনাদর! আয় দেখি, ভালো করে বেঁধে দিই। লোকে বলিবে কী দেখে তোরে? নির্বাসন! এই যদি হয় ধর্ম ব্রাহ্মণের, তবে হোক, মা, উদয় নবধর্ম– শিখে নিক তোরি কাছ হতে বিপ্রগণ। দেখি মুখ, আয় মা, আলোতে। |
[ মহিষী ও মালিনীর প্রস্থান < |
|
সেনাপতির প্রবেশ < |
|
সেনাপতি। | মহারাজ, বিদ্রোহী হয়েছে প্রজাগণ ব্রাহ্মণবচনে। তারা চায় নির্বাসন রাজকুমারীর। |
রাজা। | যাও তবে সেনাপতি, সামন্তনৃপতি সবে আনো দ্রুতগতি। |
[ রাজা ও সেনাপতির প্রস্থান |