১৩
ঘটনাটা ঘটল বিকেল পাঁচটার অল্প পরে।
সবেরগঞ্জ থেকে কলকাতা ফেরার বাসে উঠে বসেছে দোতারা আর বিহান। বিহানের খুব ইচ্ছে ছিল থেকে যাওয়ার। ‘নাওডুবি প্রজেক্ট’ দেখে তার পাগলের মতো অবস্থা। এত ভাল লেগেছে যে, নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিল না। শুধু ধানের খেত নয়, দোতারার বাবা বাড়িটা বড় চমৎকার বানিয়েছে। খোলামেলা ঘর, একটু বাগান, বাঁশের বেড়া, এক ফালি উঠোন। উঠোনের একপাশে একটা মাটির দেয়াল। একা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে চমকে উঠতে হয়। শিরীষ আঙ্কল জানালেন, ওটা আলাদা করে বানানো। কাপড় শুকোতে দেওয়া যায়, ঘুঁটে দেওয়া যেতে পারে, কেউ ইচ্ছে করলে ছবিও আঁকতে পারে। আবার কেউ যদি চায়, শীতের দুপুরে ওই দেওয়ালে হেলান দিয়ে বইও পড়তে পারে। দোতারা বলল, ওদের কসবার ফ্ল্যাটে নাকি একসময়ে এরকম একটা মাটির দেয়াল রাখা হয়েছিল। সেটা ছিল একটা স্কাল্পচারের মতো। তবে মাপে অনেক ছোট। আর এটা তো একবারে আসল। বাড়ির ঘরগুলো চমৎকার, গেস্টরুমটাও চমৎকার। ভোরের আলোয় ছবিও উঠত সবচেয়ে ভাল। খেতের পাশে, নাওডুবি সাঁকোতে, মাটির দেওয়ালের গায়ে দোতারাকে দাঁড় করাত আর প্রাণ ভোরে শট নিত। দোতারা চুল কেটে ছোট করে ফেলেছে। তাতে কোনও সমস্যা নেই। এখানে এসে বিহানের মনে হয়েছে, কে বলে কেশবতী মেয়েরাই শুধু রহস্যময়ী? ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিকমতো থাকলে সব মেয়েই রহস্যময়ী। চুল ছোট করে কাটা দোতারা তো বটেই, এমনকী শিরীষও চেয়েছিল, ওরা যাক। ত্রপাও বলেছে।
“দোতারা, তোমরা থেকে যাও। আমিও কাল চলে আসব।”
দোতারা রাজি হয়নি। তার এবং বিহান দু’জনেরই সামনে পরীক্ষা চলেছে। আবার পরে আসব বলে তারা ফিরে গিয়েছে।
সারাদিন চুটিয়ে আনন্দ হয়েছে। দোতারা আর বিহান একেবারে সকালে চলে এসেছে। এসে শিরীষকে চমকে দিয়েছে। বিহানের সঙ্গে শিরীষের এই প্রথম আলাপ।
“এই তো একজনকে পাওয়া গেল। ডাক্তারি পাশ করে মাঝেমধ্যে কিন্তু এখানে আসতে হবে। নাওডুবিতে তোমার ফ্রি ডিসপেনসারি চালু করব। রাজি?”
বিহান বলল, “অবশ্যই রাজি।”
বাবার প্রজেক্ট দেখে দোতারা শুধু মুগ্ধ হল না, তার গর্ব হতে লাগল। খেত জুড়ে যে সোনালি ধান ঝলমল করছে, সেটা তার বাবা চাষ করেছে ভাবতেই গা শিরশির করে উঠল। বাবা বলেছে, চাষের সবক’টি পর্যায়েই সে হাত লাগিয়েছে।
“আমিও এখানে সপ্তাহে একদিন করে এসে ফ্রি স্কুল শুরু করব।”
ত্রপা হাত তুলে বলল, “আমাকেও নিতে হবে।”
দোতারা তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “নিশ্চয় নেব।”
মেয়েটিকে দোতারার খুব পছন্দ হয়েছে। খুব লেখাপড়া জানা মেয়ে। সে যে শিরীষ মুখার্জির উপর গবেষণা করছে, সেটা জেনেই গর্বে বুক ভরে গেল দোতারার। মেয়েটি বাবাকে যেমন শ্রদ্ধা করে, তেমন ভালওবাসে। তাতে যদি কোথাও কোনওরকম প্রেম থাকে, ক্ষতি কী? বাবার এটা প্রাপ্য। সব ভালবাসা একরকম হয় না। সব ভালবাসা অন্যের ভালবাসাতে ভাগও বসায় না। সে থাকে নিজের মতো। ত্রপাকে নিয়ে মা ভুল বুঝেছে। খুব বড় ভুল।
ত্রপাই দুপুরে খিচুড়ি বেঁধে খাওয়াল। রান্না ভাল হয়নি, তারপরেও বিহান এত বেশি খেল যে, তার পেট আঁইঢাঁই করতে লাগল। সে আলের উপর মাদুর পেতে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নেওয়ার প্ল্যান করে। ত্রপা আটকে দেয়। সাপ আছে।
চলে যাওয়ার সময় শিরীষ তার মেয়েকে বলল, “তোর মাকে সব বলিস। বলিস তাকে আমি আসতে বলেছি। আমি জানি তোর মা প্রজেক্টটা একবার নিজের চোখে দেখলে সব রাগ ভুলে যাবে।”
দোতারা বাবার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “বলব।”
শিরীষ বলল, “ধান কাটা পর্যন্ত কলকাতায় যেতে পারব কিনা জানি না। চেষ্টা করব।”
দোতারা আদুরে গলায় বলল, “সে যেয়ো, তবে তার আগে এখানকার কাজ। ধান কাটার সময় আমরা কিন্তু এসে থাকব।”
শিরীষ হেসে বলল, “তোরাই তো কাটবি।”
দোতারা বলল, “পরীক্ষা থাকলেও ফিরব না।”
ত্রপা ছেলেমানুষের মতে বলল, “স্যার, আমি? আমি কাটব না?”
ত্রপা প্রথমে ঠিক করেছিল, দোতারালের সঙ্গেই রওনা হবে। তার গবেষণার কিছু কাজ বাকি ছিল। কালকেই একটা অংশ গাইডের কাছে জমা দিতে হবে। তাকে আরও ঘণ্টাখানেক থাকতে হল। আজ স্যারের মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়েছে। সে বলেছে, “আমার বাবার জন্য আমার গর্ব হচ্ছে। এই খ্যাপামি একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব। তবু আমি চাইব বাবা কিছুদিন করে অন্তত কলকাতায় গিয়ে থাকুক। এই খ্যাপা মানুষটাকে ভাগাভাগি করে ধানও পাক, সফট্ওয়্যারের অফিসও পাক।”
ত্রপা তার গবেষণার কাগজপত্র গুছিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বেরোল পাঁচটার অল্প পরে।
স্যারের বাড়ি থেকে খানিকটা ঢালু পথ ধরে যেতে হয়। তারপর বড় রাস্তা। একটু দাঁড়ালে সবেরগঞ্জ যাওয়ার ভ্যান পাওয়া যাবে। অশ্বথ গাছের তলায় স্যারের গাড়ি। স্যার বারবার করে বলেছিল, দোতারাদের গাড়িতে খানিকটা এগিয়ে দেবে। ওরা রাজি হয়নি। গাড়িতে উঠলে নাকি গোটা ট্যুরটাই নষ্ট। স্যার আর ঘাঁটাননি। ওরা নিজের মতো রওনা হয়েছে। দোতারা-বিতানের কী সুন্দরই না প্রেম! ঢালু পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মানে হাসল ত্ৰপা। সে তখনও দেখতে পায়নি বুড়ো অশ্বথ গাছের নীচে, আড়ালে ও ছায়ায় কতগুলো ছেলে মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শিরীষ। দেখে উঠোনে মাটির দেওয়ালটা কোমর ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ছুটে বাইরে যায়। বিস্ফারিত চোখে দেখে কয়েকজন তার বাঁশ দিয়ে বেড়া ভাঙছে, ঘরের চালা ভাঙছে। তাদের মুখে কাপড় বাঁধা, চেনা যাচ্ছে না। শিরীষ এগিয়ে যায়।
“এসব কী করছ! কে তোমরা?”
এবার দেখতে পায়, একই চেহারার ক’জন তার খেতে নেমে গিয়েছে। ফসলের উপর কেরোসিন ছড়াচ্ছে। এবার নিশ্চয় আগুন দেবে। শিরীষ ছুটে যায়। আর তখনই চিৎকার শুনতে পায়। ত্রপার চিৎকার।
“স্যার পালান, পালিয়ে যান, এরা আপনাকে মেরে ফেলবে…”
শিরীষ মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায় কয়েকজন মিলে ত্রপাকে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। একজন ত্রপার কামিজ ছিঁড়তে শুরু করেছে।
শিরীষ প্রাণপণ সেদিকে ছুটতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, “অ্যাই! তোমার ওকে ছেড়ে দাও… ছেড়ে দাও বলছি…”
ত্রপার কাছে পৌঁছোতে পারে না শিরীষ। তার আগেই তার মাথার পিছনে কেউ বাঁশ দিয়ে সজোরে আঘাত করে। হুমড়ি খেতে খেতে সে শুনতে পায়, কেউ একজন বলল, “চাষের নামে গ্রামে এসে মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি হচ্ছে,…শুয়োরের বাচ্চা!”
আর-একজন কেউ বলে উঠল, “যা শাল্লা! লোকটাকে মারলি কেন…এ তো মরেই যাবে…পালা এখনই।”
শিরীষ দু’হাত ছড়িয়ে মাটি আঁকড়ে জ্ঞান হারাল।
একটা মাটির দেওয়াল। তাকে ঘিরে চারজন লুকোচুরি খেলছে। নিজেকে চিনতে পারলেও বাকিদের চিনতে দেরি হল শিরীষের। ওটা কে? সোমদত্তা না? তাই তো, সোমদত্তাই তো! আর এই পাশ থেকে যে উঁকি দিচ্ছে? নিশ্চয় ত্রপা। ঠিক তাই! মেয়েটা ছেলেমানুষের মতো আওয়াজ করে হাসছে। আরে! এই তো দোতারা। এটা কি ছোটবেলা? নাকি বড়বেলা? কে একজন গম্ভীর গলায় বলল, “সাবধান, দেওয়ালটা মাটির কিন্তু। পড়ে যেন ভেঙে না যায়।”
ধীরে ধীরে চোখ খুলল শিরীষ। নার্সিহোমের নরম আলো। একজন গোল মুখের নার্স ঝুঁকে পড়লেন। সুন্দর হেসে বললেন, “এই তো জ্ঞান ফিরেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে?”
শিরীষ জড়ানো গলায় বলল, “সোমদত্তা এসেছে?”
গলা তো জড়াবেই। দু’ঘণ্টার অপারেশন তো ছোটখাটো বিষয় নয়। এত তাড়াতাড়ি কথা বলতে পারছেন, এটাই তো অনেক। ক্যাবিনের বাইরে এসে নার্স বললেন, “পেশেন্টের জ্ঞান ফিরছে। সোমদত্তা নামে কে আছেন?”
সোমদত্তা এগিয়ে গেল।
নার্স বলল, “যান, আপনাকে ডাকছে।”
দোতারা আর ত্রপা একটু সরে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের রেলিং ঘেঁষে। ত্রপা রুমাল দিয়ে ঘনঘন চোখ মুছছে।
দোতারা তার গায়ে হাত রেখে বলল, “ত্রপাদি, আর কাঁদছ কেন? বাবার জ্ঞান ফিরেছে। বাবা ভাল হয়ে যাবে। আর কেঁদো না।”
ত্রপা ফিসফিস করে বলল, “আমার খুব আনন্দ হচ্ছে দোতারা। প্লিজ়, আমাকে কাঁদতে দাও।