পালাচ্ছি।
পাণ্ডা পুরুত যাত্রী যজমান মহাপাপী আর মহাপুণ্যবান সবাই পালিয়ে যাচ্ছি প্রাণ নিয়ে। রইল পূজা করা, রইল ভোগ নিবেদন করা, রইল বাকি অনেকের নারকেল গাঁজা আর কঙ্কে ছোঁড়া। হুড়মুড় করে ছুটে পালাচ্ছি সবাই। যাদের তখনও নিজমুখে নিজেদের মহাপাপ কবুল করা হয়নি, যারা তখনও দেবতার কৃপাভিক্ষা করে হুকুম নিতে পারেনি, তারাও পালাচ্ছে। আর দরকার নেই, কারও মনের কোণে আর তিলমাত্র আকাঙ্ক্ষা নেই এই দেবতার করুণা ভিক্ষা করবার। দেবতা এ নয়-দেবতার আরবরণে নৃশংস দানব। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বুকের জ্বালা জুড়াবার জন্যে যার কাছে আমরা ছুটে এসেছি-সে ছদ্মবেশী পিশাচ। ওর নির্লজ্জ উলঙ্গ পরিচয় মর্মে মর্মে পেয়েছি আমরা। ভুল আমাদের ভেঙেছে–ক্ষমা কৃপা অনুকম্পা সমবেদনা এ সবের জন্যে ওর কাছে মাথা খোঁড়বার আর লেশমাত্র প্রবৃত্তি নেই আমাদের। দোষ ত্রুটি পাপ অপরাধ যা-কিছুই করে থাকি এ জীবনে, করেছি মানুষের কাছেই। সে-সবের মার্জনা পাবার জন্যে মানুষের পায়েই মাথা খুঁড়তে হবে। দেবতার কাছেও না, মনিবের কাছেও না। ওরা দুজনেই একই বস্তুর এপিঠ আর ওপিঠ। নিজেদের শক্তির দম্ভে ওরা এতদূর উন্মত্ত যে, মানুষের বুক-নিংড়ানো সুখ দুঃখ হাসি কান্না ওদের কাছে নিতান্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার, মানুষের স্তবস্তুতি দয়াভিক্ষা ওদের কাছে নগণ্য পরিহাসযোগ্য পাগলের প্রলাপ।
চোখ বুজে পালাচ্ছি।
প্রকাণ্ড হাঁ করে পিছনে তেড়ে আসছে রাক্ষস। ধরতে পারলে টপ করে ফেলে দেবে সেই হাঁ-এর মধ্যে। চিবোবেও না একবার-একেবারে গ্রাস করবে চক্ষের নিমেষে। পিছন ফিরে তাকাবার সাহসও নেই কারও, সে প্রয়োজনও নেই। স্পষ্ট পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে কানে। শুধু পায়ের শব্দ কেন, ওর উৎকট নির্লজ্জ হাসি কানের মধ্যে ঢুকছে, মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা মারছে, সেই হাসি শুনে বুকের রক্ত যাচ্ছে শুকিয়ে। শরীরের প্রতিটি তন্ত্রী থরথর করে কাঁপছে-সেই প্রেতের হাসি অনবরত ছোটাছুটি করছে পায়ের নখ থেকে মাথার তালু পর্যন্ত-”হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ-হা-হা-”
ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছি।
কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না। কে রইল পিছনে পড়ে আর কেইই বা গেল দানবের গ্রাসের মধ্যে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারও। দরকারও নেই। কোনো রকমে দূরে চলে যাওয়া দূরে, আরও দূরে আরও অনেক দূরে-যেখান থেকে নজরও পড়বে না ওই রাক্ষসের মুখের হাঁ। চোখ বুজেও দেখতে পাচ্ছি কালো থকথকে পুঁজ রক্ত ক্লেদ। বিরাট মুখব্যাদান করে আছে মহাপিশাচ, টগবগিয়ে ফুটছে সেই পুঁজ রক্ত ক্লেদ তার হাঁ-র মধ্যে। যুগ-যুগান্ত ধরে যাদের গ্রাস করেছে, ওই ঘন কালো রক্ত তাদের। হজম হয়নি। অত রক্ত হজম করার কথা নয়, তাই উপচে পড়ছে ওর মুখগহ্বরে। তবুও ওর ক্ষন্নিবৃত্তি হয়নি। কোনো কালে তৃপ্তি হবে না ওর নৃশংস লালসার। কোনও মহাবলি দিয়েই তুষ্ট করা যাবে না ওই দুর্দান্ত শত্রুকে। পালাও পালাও, যে ভাবে হোক যে করে হোক আগে বীভৎস দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলো নিজেকে। তারপর হিসেব করা যাবে-কে রইল কে কে গেল।
সবই পড়ে রইল সেখানে। তন্ত্রমন্ত্র দানদক্ষিণা নারকেল গাঁজা কলকে আর সেই মস্ত বড় পোড়া আটার ডেলাটা। কোনও কিছুর দিকেই ফিরে চাইলাম না আমরা। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য-আকাশের দিকে উঁচু করা হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত দু-খানা পা! থরথর করে কাঁপছে পা দু-খানা-কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গেল কাদার মধ্যে। ঠিক সেইখানে উঁচু হয়ে উঠল একটা ধামার মতো বুজকুড়ি, আবার সেটাও ঠিক সেইখানে ভেঙে মিলিয়ে গেল। কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল ব্যাপারটা এতজোড়া চোখের সামনে। কিছুই করতে পারলাম না আমরা, একটি আঙুলও তুলতে পারলাম না। পাষাণ হয়ে চেয়ে রইলাম সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের দিকে।
একটা প্রাণফাটা চিৎকার করে উঠল কুন্তী। সেই দিকে আমাদের সজোরে ধাক্কা মারলে। ধাক্কা খেয়ে সবাই ছিটকে পড়লাম পিছন দিকে, তার ফলে সেই মাটির পাহাড়ের গড়ানে গা বেয়ে গড়িয়ে হড়কে হুড়মুড় করে সকলে এসে পৌঁছে গেলাম নীচে। হাড়গোড় ভাঙল-চুরল কিনা সেদিকে কারও খেয়াল নেই। উঠে দাঁড়িয়েই আবার দৌড়। উঁচুনিচু ঢিবি-টিলা, খাল-খন্দ টপকে ডিঙিয়ে ছুটতে লাগলাম সবাই।
আর কিছু খেয়াল নেই। কী ভাবে কেমন করে যে উটের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম আর তারপর সামনের কুয়োর ধারে কখন গিয়ে উপস্থিত হলাম-সে সব কিছুমাত্র মনে নেই। শুধু মনে আছে, সেখানে পৌঁছেই চাদর মুড়ি দিয়ে একটা গাছতলায় আমি শুয়ে পড়ি।
যথাসময়ে সেই সর্বনাশের অশুভ দিনটা যথাস্থানে গড়িয়ে চলে গেছে, এসেছে সর্বদুঃখহারিণী রাত্রি। এসে গায়ে মাথায় সর্বাঙ্গে শীতল হাত বুলিয়ে সেই কালনিদ্ৰা থেকে জাগিয়ে তুললে। চাদর ফেলে চোখ মেলে উঠে বসলাম। কি হয়েছে, কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় এসেছি, এ-সব কোনো কিছুই খেয়াল করতে পারলাম না। মাথার ভিতরটা যেন ফোঁপরা হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে নিজে খুঁজে ফিরে পেতে। একটু একটু করে সবই আবার উদয় হল মনে। তখন চতুর্দিকে চেয়ে দেখলাম।
একটিমাত্র মূর্তি স্থির যে বসে ছিল মাথার কাছে। আর বাকি সবাই চারিদিকে ঘিরে শুয়ে পড়েছে। রাত যে তখন কত তা ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। উপর দিকে চেয়ে দেখলাম সন্ধ্যাতারাটা প্রায় মাথার উপর এসে পড়েছে।
আমাকে ঘেঁষে আমার ডানপাশে যে শুয়ে ছিল সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল। সবিস্ময়ে দেখলাম, সুখলাল-আমাদের ছোট ঠাকুরমশাই, পণ্ডিত সুখলাল পাণ্ডা, হিংলাজকা ছড়িওয়ালে। এতক্ষণে মনে পড়ে গেল, সেখানেই সে চন্দ্রকূপের মাথায় আমাকে জড়িয়ে ধরে শ্রীমান ভিরমি খায়। তারপর তাকে বুকে তুলে নিয়ে যে কেমন করে আমি নীচে এসে পৌঁছই সে-কথা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। উটের কাছে পৌঁছে তাকে বুড়ো গুলমহম্মদের হাতে দিয়ে তার কথা একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। সুখলাল আমার একখানা হাত তার ছোট্ট দুহাতে চেপে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল। একটি কথাও বেরুল না তার মুখ দিয়ে, শুধু তার কালো চোখ দুটো অন্ধকারের মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল।
ছেলেটার একমাথা কোঁকড়া চুলের মধ্যে নিঃশব্দে আঙুল চালাতে লাগলাম। তখন চাদর মুড়ি দিয়ে বসা মূর্তিটি নড়ে উঠল। চাদরের ভিতর থেকে চাপা গলায় শোনা গেল–”গুহ্যাতিগুহ্যগোপত্রী ত্বং গৃহাণাস্মৎকৃতং জপং।” মন্ত্রপাট সমাপ্ত করে চাদর খুলে ভৈরবী মালা-ঝুলি গলায় ঝুলিয়ে পাশের আলোটা উসকে দিলেন। সেই আলো তাঁর মুখে পড়াতে ভালো করে দেখতে পেলাম তাঁর মুখ। মনে হল তাঁর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে আর অবাধ্য ঠোঁটের কাঁপুনি তিনি কামড়ে ধরে থামবার চেষ্টা করছেন।
ততক্ষণে সুখলাল হাত ধরে টানাটানি জুড়ে দিয়েছে। এখনই কুয়োর কাছে যেতে হবে। সে জল তুলে দেবে আর সেই জলে আমি স্নান করে আসব।
গলাটা কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে ভৈরবী বললেন- “জল ওখানে তোলা আছে।”
বলে আলোটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বললাম, “আমায় জাগওনি কেন?”
কোনো উত্তর নেই।
আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “খেয়েছে সবাই?”
উত্তর দিলে সুখলাল-”আর সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে, আপনি আর মাতাজি শুধু বাকি।”
ভৈরবী একভাবে আলোর দিকে চেয়ে আছেন।
উঠে পড়লাম। শরীর বেশ ঝরঝরে বোধ হচ্ছে। মাথাটাও বেশ হাল্কা হয়ে গেছে। বললাম-”তোমাদের যেতে হবে না। কুয়োটা কোনদিকে?”
সুখলাল হাত ধরে টানতে লাগল–”চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।” বিনা বাক্যব্যয়ে ভৈরবী আলোটা হাতে করে পিছু পিছু চললেন।
কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই শুয়ে ঘুমুচ্ছে। একটু দূরে উট দুটো বসে আছে। ওদের কাছ দিয়ে যাবার সময় বুড়ো একবার উঠে বসল, নিজের কপালে হাতটাও ঠেকালে-কিন্তু মুখে কোন সম্ভাষণ নেই।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো পা আড়ষ্ট হয়ে গেল, কই-সে কই? ৷
পিছন থেকে ভৈরবী বললেন, “কি হল আবার দাঁড়ালেন কেন?”
“কুন্তী-কুন্তী কই?” কোনো রকমে কথাটা বেরুল গলা দিয়ে।
ভৈরবী বললেন, “ভালোই আছে। ওই ওধারে একলা শুয়েছে আজ। মেয়ে জাত–সহজে মরে না।
“কিন্তু খাওয়া দাওয়া? খেয়েছে ও কিছু?”
সুখলাল উত্তর দিলে-”একখানা রুটি খেয়েছে। পোপটলাল জোর করে খাইয়েছেন।”
অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার পা চালালাম। কুয়োটা বেশ দূরে কয়েকটা বড় বড় গাছের আড়ালে। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল উট ছাগলের জল খাবার কাঠের ডোঙাটা পরষ্কিার করে ধুয়ে জল ভরতি করে রাখা হয়েছে। সুখলাল আর ভৈরবী গাছতলায় বসল আলো নিয়ে, আমি স্নান-টান সেরে নিলাম।
ফিরে আসতে আসতে ভৈরবী বললেন-”চা খেতে খেতে ভাত হয়ে যাবে, আধ ঘণ্টাও লাগবে না। আজ দু-দুটো দিন ত পেটে কিছু পড়েনি।”
“সে কি! এখনও রান্না হয়নি তোমাদের!”
ভৈরবী চুপ করে রইলেন। সুখলাল বকবক করতে লাগল। তার কথা থেকে এইটুকু বুঝলাম যে, এখানে পৌঁছে সেই যে ভৈরবী মুখ বন্ধ করে চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছেন আর এই এতক্ষণে মুখে খুললেন। কারও সঙ্গে একটি বাক্যলাপ পর্যন্ত করেননি, কেউ আসেওনি ওঁকে ঘাঁটাতে। সন্ধ্যার সময় একবার মাত্র উঠে গিয়েছিলেন স্নান করে আসতে,-ফিরে এসে আবার ঠিক সেই এক জায়গাতেই বসেন চাদর মুড়ি দিয়ে। আমি উঠে বসতে তবে চাদরের ভিতর নড়ে উঠেছেন।
হাসি পেল। আরাম করে পড়ে ঘুমিয়েছি আমি আর একজন ঠায় বসে কাটিয়েছে একভাবে, জল পর্যন্ত মুখে না দিয়ে। খামকা দুর্ভোগ ভোগা আর কাকে বলে!
উট দুটোর এ-পাশে এসে দেখা গেল গাছতলায় আগুন জ্বেলে কে যেন কী চড়িয়েছে! ভৈরবী বললেন, “এখন আবার কার কি রান্নার দরকার হল ওখানে?”
আরও কাছে এসে দেখা গেল চুলো জ্বালিয়ে তার উপর ডেকচিটা বসানো হয়েছে আর তার সামনে দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে যে বসে আছে সে অন্য কেউ নয়-কুন্তী।
কাছে গিয়ে ভৈরবী বললেন, “তুই আবার উঠে এলি কেন? দুটো ভাত তো আমি রেধে নিতেই পারতাম।”
কুম্ভী খিল খিল করে হেসে উঠল। হাঁটুতে মুখ গোঁজা অবস্থাতেই জবাব দিলে, “কেন–হয়েছে কি আমার? আমি রান্না করে দিলে আপনারা খাবেন না নাকি?”
সেই হাসি কানে যেতে চমকে উঠলাম। সত্যিই তাহলে কিছুই হয়নি ওর? সবই সম্ভব-সৃষ্টিকর্তার আজব সৃষ্টি হচ্ছে মেয়েরা।
একে একে উঠে এল রূপলাল পোপটভাই গুলমহম্মদ আরও অনেকে। ওরা তাহলে কেউই ঘুমোয়নি। শুধু মটকা মেরে পড়েছিল এতক্ষণ। সবাই একে একে এসে বসল সামনে। কিন্তু মুখে কারও কথাটি নেই।
বিশ্রী কাণ্ড। এতগুলো লোক মুখোমুখি বসে আছি কিন্তু একটি কথা নেই কারও মুখে। শেষে গুলমহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি শেখ সাহেব, আর কদিন লাগবে হিংলাজ পৌঁছতে?”
এতক্ষণে পরে শেখ সাহেবের তন্দ্রা ছুটে গেল। ‘জি হুজুর’ বলে কপালে হাত ঠেকালে। আবার সেই একই প্রশ্ন করলাম তাকে, এবার মগজের মধ্যে ঢুকল কথাটা। একবার সকলের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে আরম্ভ করলে-”এই ধরুন না, কাল আমরা যেখানে পৌঁছব সেখান থেকে আমার বাড়ি বেশিদূর নয়। রাতে গিয়ে আবার ভোরবেলায় ফিরে আসা যায়-”
রূপলাল তেরিয়া হয়ে উঠল, “তা বলে আমরা একদিনও দেরি করতে পারব না সেখানে। সোজা চলে যাব হিংলাজ। এবার আর ও-সমস্ত আবদার চলবে না তা আগেই বলে রাখছি।”
বুড়ো একেবারে চুপ করে গেল। রূপলাল এবার আমার কথার জবাব দিলে।
‘কাল বেলা থাকতে থাকতে এখান থেকে ওঠা যাবে। বেশি রাত হবে না সামনের কুয়োর কাছে পৌঁছতে। সেখানে রাতটা ঘুমিয়ে ভোরবেলা আবার চলতে আরম্ভ করলে বেলাবেলি যেখানে পৌঁছব আমরা, সেখান থেকেই উট ছেড়ে দিতে হবে। তারপর
এবার পোপটভাই থামালেন তাকে-’এবার থামো। আগে উঠি এখান থেকে, তারপর যা হবার তখন হবে।”
কে একজন জিজ্ঞাসা করলে, “আজ ভোররাতে এখান থেকে ওঠা হবে না কেন?”
রূপলাল খিঁচিয়ে উঠল-”দেখতে পাচ্ছ না একটা লোক অসুস্থ, কাল সকালে যাওয়া যায় কি করে?”
বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আবার আর একজন পড়ল নাকি! লোকটি কে?
গুলমহম্মদ খাড়া হয়ে বসে এতক্ষণ পরে আবার কথা বললে, “জরুর আলবাত! যতক্ষণ না বাবার তবিয়ৎ ঠিক হচ্ছে ততক্ষণ এখান থেকে উঠছে কে?”
এবার সত্যই আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
“তার মানে? কার তবিয়ৎ খারাপ? কার জন্যে কাল সকালে যাওয়া বন্ধ থাকবে?”
একান্তে বিনীত ভাবে পোপটভাই জবাব দিলেন, “আজ্ঞে, আপনার কথা আমরা ভাবছিলাম।”
এতক্ষণ পরে সমস্ত বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলাম।–”আমার হয়েছে কি যে তোমরা মাথা ঘামাচ্ছ? সারাদিন ঘুমিয়ে এখন আমি এমন চাঙা হয়েছি যে, বলো তো এখনই রওনা দিতে পারি। আচ্ছা মুশকিল যা হোক-আমার জন্যে তোমরা এমন মন মরা হয়ে আছ!”
এইবার রূপলালও চাঙা হয়ে উঠল। হঠাৎ সেই অর্ধেক রাত্রে এক বিরাট হুঙ্কার দিয়ে উঠল সে-”জয় হিংলাজ মাতা রানি কি –“
যারা শুয়েছিল তারাও লাফিয়ে উঠে বসে উত্তর দিলে-”জয়!”
তারপরে ওরা কলকে ধরালে, আর সুখলাল এসে ডাক দিলে-ভাত বাড়া হয়ে গেছে।
খেতে বসলাম-সুখলালকে নিয়ে। সে তো কিছুতেই খাবে না। একবার সন্ধ্যার সময় রুটি খেয়েছে যে। ভৈরবী তাকে জোর করে বসালেন। সন্ধ্যা কেন, দিনের বেলাতেও কিছু খায়নি ছেলেটা, ঠায় আমার গা ঘেঁষে শুয়ে ছিল। পোপটলাল জোর করে বোধ হয় একখানা রুটি খাইয়েছেন।
পরিবেশন করছে কুন্তী। অনেকদিন পরে আজ আবার সে মাথা ঘষে স্নান করেছে। রুক্ষ চুল শুকনো মুখের দু-পাশ দিয়ে এসে পড়েছে তার বুকের উপর। লালপাড় শাড়িখানা আবার পরেছে আবার আজ। আধা-অন্ধকারে চলছে ফিরছে, কাজকর্ম করছে। লক্ষ করে দেখলাম যেন কোনো কিছুই হয়নি তার। এতটুকু আড়ষ্ট ভাব বা অবসাদ নেই তার চলাফেরার। যত দেখছি ততই একটা চিন্তা মাথায় আসছে আমার-এই স্বচ্ছন্দ চলাফেরার আড়ালে অন্য কিছু নেই তো? এই হাসিখুশি ভাবটার ঠিক তলায়-একটা অন্তঃসলিলা বিষের নদী বইছে না তো? ‘যাক বাঁচা গেল’ বলে কুন্তী কি তার মন থেকে সেই মর্মান্তিক ছবিটা মুছে ফেলতে পেরেছে? কি জানি-মেয়েরা হচ্ছে বিধাতার আজব সৃষ্টি!
তারপর ভৈরবী কুন্তীকে নিয়ে খেতে বসলেন।
সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার মাথার কাছে কম্বল বিছিয়ে শুয়েছেন ভৈরবী। চাপাগলায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা এখান থেকে ফেরবার কি কোনো উপায় নেই?”
এ আবার কি কথা! জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায়?”
“একেবারে করাচী।”
“তার মানে?”
“মানে আর এক পা এগোবার ইচ্ছে নেই আমার। মা হিংলাজ মাথায় থাকুন। এখন ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে বাঁচি।”
কেন? আমাদের কোন ক্ষতিটা হয়েছে? এ পর্যন্ত মা হিংলাজের দয়ায় গায়ে আঁচড়টুকু পর্যন্ত লাগেনি। যার কপালে যা ঘটবার ঘটেছে, তাতে আমাদের কি?”
“এইবার আমাদের কপালেও ঘটবে। দরকার নেই আর তীর্থ করে। কাল সকালে উটওয়ালাদের বলুন যে, একটা উট নিয়ে আমাদের করাচী পৌঁছে দিক। একটা উটের ভাড়া তো আমরাই দিয়েছি।”
“আমার তো আর মাথা খারাপ হয়নি যে, হিংলাজের দরজায় এসে মাকে দর্শন না করে ফিরে যাব! আর তা ভিন্ন দু-দুটো মেয়েমানুষ নিয়ে এই পথ দিয়ে মাত্র একজন লোকের সঙ্গে যাওয়া-এত বড় বুকের পাটাও আমার নেই।”
একটু চুপ করে থেকে ভৈরবী বললেন, “তবে আগে মাথাটা খারাপ হোক ষোলআনা তখন ফেরা যাবে। দু-দুটো মেয়ে মানুষ আবার কে? আমরা কাকেও সঙ্গে করে আনিনি, কারও ভার দায়িত্বও নেই আমাদের কাঁধে। যেতে হয় কাল আমরা দুজনেই যাব ফিরে। ডাকাতে মারে রাস্তায় সেও ভালো, তবুও এ যাত্রা আর এক পা ও আমি যাচ্ছি না। ওই আপদের হাত থেকে রেহাই না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, এ আমি আজই ভালো করে বুঝেছি।”
আবার একটু চুপ করে থেকে ভৈরবী আরম্ভ করলেন, “মাথা খারাপ হয়নি-আর হবার বাকি আছে কতটুকু? সারাটা দিন হুঁশ ছিল কোথায় আপনার? দলসুদ্ধ সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন না, সকলের প্রাণ উড়ে গিয়েছিল আপনার অবস্থা দেখে। একজন মাথা খারাপ হয়ে যেখানে যাবার গেছে, এবার আপনার পালা। ওই সর্বনেশে মেয়ে যার কাঁধে ভর করবে, তারই সর্বনাশ হবে এ আমি বলে রাখলুম।”
কাঠ হয়ে শুয়ে শুয়ে শুনছি। বলে কি! এবার কুন্তীকেও ফেলে যাবে নাকি?
একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলেন ভৈরবী, “সারাটা দিন এক আসনে বসে জপ করেছি আর মাকে জানিয়েছি। মা একবার মুখ তুলে চেয়েছেন। দলসুদ্ধ সবাই, এমনকি উটওয়ালারা পর্যন্ত একেবারে আশা ছেড়ে দিয়েছিল অবস্থা দেখে। সুস্থ মানুষ, কারও সঙ্গে কথাও বলে না, কোনো দিকে চেয়েও দেখে না, এতখানি পথ ঘুমোতে ঘুমোতে চলে এল-ঠিক এই রকম অবস্থাই হয়েছিল সেই ছোঁড়ার। সারাটা পথ আমি হাত ধরে নিয়ে এলাম আপনাকে, একবারের জন্যে আমাকেও চিনতে পারলেন না। মাথা খারাপ হতে আর বাকি আছে কতটুকু আপনার?”
ততক্ষণে আমি উঠে বসেছি। বসে হাঁ করে শুনছি সব কথা। এবার একটু একটু মনে হতে লাগল–আজ সারাদিন আমি কি করেছি, কি দেখেছি, কি শুনেছি। কিছু না, কিছুই করিনি, দেখিনি বা শুনিনি-সুখলালকে গুলমহম্মদের হাতে দিয়ে স্রেফ ঘুমিয়ে পড়েছি। হাঁ, হাঁ-এইবার সব মনে পড়েছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। শুধু আমার মাকে। একেবারে ছোটবেলাকার সব ঘটনা। বেদম দুরন্তপনা করছি। দুটো ছাগলছানা নিয়ে বাড়িঘর তোলপাড় করে বেড়াচ্ছি। মা এসে ধরলেন। ধরে বেঁধে রাখলেন খাটের পায়ার সঙ্গে দুখানা গামছা পাকিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে দেখি মা’র কাছে শুয়ে আছি, তখন অনেক রাত। ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আঁতকে উঠলাম। মা বললেন-পাজি ডাকাত-সারাদিন দস্যিপনা করে যখন জ্বালাস আমাকে, তখন মনে থাকে না রাতের কথা? অন্ধকার হয়েছে কি, ছেলে একেবারে আলাদা মানুষ হয়ে গেল। আঁচলের তলায় ঢুকে একেবারে কত ভালোমানুষটি এখন। যা না যা, ছাগলছানা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে সব ভেঙেচুরে তছনছ করগে যা।”
আমার মায়ের মুখখানি চোখের উপর ভেসে উঠল। সেই আধ হাত চওড়া লালপাড় শাড়ির ঘোমটার ভিতর এত বড় সিন্দুরের টিপ। সেই চোখ দুটি। যখন আমায় শাসন করতেন মা, তখনও সেই চোখ দুটির দৃষ্টি আমার গায়ে মাথায় সর্বাঙ্গে সে কি মিষ্টি স্পর্শ বুলিয়ে দিত। চোখ বুজে মনে করলে আমার মায়ের সেই দৃষ্টির পরশ আজও সর্বাঙ্গে অনুভব করি। আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মায়ের দু কানের, ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত অনেকগুলো সোনার মাকড়ি, আর একমুখ পানসুদ্ধ মায়ের সেই হাসি।
ভৈরবীর কথায় আর কান ছিল না। মাকে চাক্ষুস দেখতে দেখতে কোথায় কতদূরে চলে গিয়েছিলাম। স্পষ্ট, একেবারে সুস্পষ্ট মা’র গলার আওয়াজ কানে গেল। বলছেন, “এতদূর এসে তুই আমাকে দেখা না দিয়ে ফিরে যাবি?”
হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে এল। চিৎকার করে উঠলাম, “গুলমহম্মদ, গুলমহম্মদ!”
চিৎকার শুনে অনেকে উঠে বসল ৷ বুড়োও ওধার থেকে চিৎকার করে সাড়া দিলে। রূপলাল সামনে এসে দাঁড়াল।
আকাশের পশ্চিম দিকে চেয়ে দেখলাম “ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে বড় তারাটা। জ্বলুক-আর দেরি করা কাজের কথা নয়। বললাম, রূপলাল, দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হও সবাই। ওদের বলো, মালপত্র তুলুক। এখনই যাত্রা আরম্ভ হবে। আর এক মিনিটও কোথাও দেরি করা চলবে না। একেবারে সোজা চলো হিংলাজ!”
একসঙ্গে অনেকে চিৎকার করে উঠল, “হিংলাজ মায়ী কি একমাত্র আমিই শেষ করলাম কথাটি, “জয়!” সোজা চলো হিংলাজ!
কিন্তু হিংলাজের পথ সোজা নয়। সোজা নয় মা’র কোলে ওঠা, সহজ নয় মায়ের মুখের হাসি দেখা। তখন সবই সোজা সবই সহজ ছিল যখন নির্বিচারে দুষ্টামি করে মাকে সারাদিন জ্বালিয়েছি বিরক্তি করেছি-আবার ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মাকেই আঁকড়ে ধরেছি। সে সময় এ-সমস্ত সহজ ছিল, সোজা ছিল। তারপর জ্ঞানবুদ্ধি বাড়তে লাগল– মাতৃভক্তি সম্বন্ধে ভালো রচনা লিখে স্কুলে ভালো নম্বর পেলাম, বেশ করে শিখলাম কি ভাবে মায়ের সঙ্গে ব্যবহার করলে লোকে নিন্দে করবে না। মা’র সঙ্গে মেপেজুখে হিসাব করে কথা বলতে শিখলাম। খুবই সাবধান হয়ে চলতে শিখলাম যাতে মায়ের মর্যাদায় আঘাত দিয়ে না ফেলি। আর সেই সঙ্গে এও শিখলাম যে ভয় পেলে মাকে গিয়ে আঁকড়ে ধরা কতখানি লজ্জার কথা। তার চেয়ে ঢের ভালো, ঢের বড় কথা হচ্ছে-মা’র কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের বিচার বুদ্ধি ক্ষমতার উপর নির্ভর করে চলা। তাই-ই এতকাল করেছি, এড়িয়ে চলেছি মাকে, মাকে লুকিয়ে মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। কাজেই আর কিছু সহজ নয়, কিছুই সোজা নয়। সবই গোলমেলে বাঁকাচোরা গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যে-বুদ্ধি হয়েছে যে, জ্ঞানবিচার করতে শিখেছি কিনা–তাই মাও নিশ্চিন্ত হয়ে একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন; নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি কিনা, তাই আর গামছা পাকিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখার প্রয়োজন নেই মায়ের। ‘চরে খেতে শিখেছে, এবার চরেই খাক, বলেই জননী নিশ্চিন্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বসেছেন।
তাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি-কোনটা ভাল আর কোনটি মন্দ, কোনটা ভাল আর মন্দ, কোনটা পথ আর কোনটা বি-পথ। পথ দেখাবার, ভালোমন্দ চিনিয়ে দেবার ভার যাঁর উপর, সেই মা-ই নিশ্চিন্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বসেছেন। সোজা পথ আর সোজা নেই, বেঁকতে বেঁকতে করাচীর হাব নদী পার হয়ে এত বড় মরুভূমিটা ডিঙিয়ে অঘোর নদীর কিনারায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
নদীর নাম অঘোর।
সেই নদী পার হলেই মায়ের স্থানে। সেই নদীর এপারে সবই ঘোর সবই ভীষণ, সবাই বেহুঁশ সবাই অশান্ত। ওপারে শান্তিময়ী মায়ের স্থান। শান্তিময়ী জননী এপারে নেই-অঘোর নদীর ওপারে আছেন। সেই অঘোর নদীতে স্নান করে এপারের ধুলো ময়লা সব ধুয়ে ফেলে তবে মায়ের স্থানে গিয়ে উঠতে হবে।
কিন্তু এখনও অঘোর নদী বহুদূর।
পুব দিক ফর্সা হয়ে উঠেছে। পুবমুখোই চলেছি আমরা। বালির মধ্যেও চাষ আবাদ চলেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে চেষ্টার ত্রুটি করছে না মানুষ। বালি সরিয়ে মাটি বার করছে। কুয়ো খুঁড়ে জল বার করছে। পায়জামা হাঁটুর উপর তুলে নিচু হয়ে কোদাল চালাচ্ছে। উট দিয়ে আর যাই ই হোক, লাঙল টানানো যায় না নিশ্চয়ই। একানে ওখানে চাষ তো চলেছে দেখছি–একজোড়া উটকে লাঙল টানতে দেখলাম না কোথাও। উট ত আর গোরু নয়, লাঙল টানলে উটের মর্যাদায় আঘাত লাগবে হয়তো।
লাঙল না টানুক, কিন্তু দুধ দেয়। কয়েক ঘর লোকের বসতির পাশে এক কুয়া। তার ধারে এক মস্ত বড় তেঁতুলগাছ। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম ওগুলো তেঁতুলগাছ নয়, ঠিক তেঁতুলপাতার মতো ছোট ছোট পাতাওয়ালা আর এক জাতের গাছ। সেই গাছ তলায় থামা হল চা বানাবার জন্যে আর কলকে সাজাবার জন্যে। এক কলসি দুধ নিয়ে এক থুখড়ে বুড়ি উপস্থিত। এক কলসি উটের দুধ। দাম এক সের আটা। জলের মতো পাতলা দুধ। কেনা হয়ে গেল। কিন্তু তারপর? দুধ নেওয়া হবে কীসে? একটা কুঁজো খালি করে দুধ নেওয়া হল। সামনের আস্তানায় পৌঁছে জ্বাল দেওয়া হবে।
এধারের মানুষ কণ্টকগৃহে বাস করে না। করাত চালিয়ে কাঠ চিরে তাই দিয়ে ঘর বানিয়েছে। দেওয়ালে চাল কাঠ সব কাঠের তৈরি। কণ্টকগৃহ না হোক, আদর্শ জতুগৃহ বললে অন্যায় হবে না।
চাষ-আবাদ গৃহকর্ম করতে করতে অনেকেই গুলমহম্মদের সঙ্গে ‘সালাম আলেকুম’ সারতে লাগল। হেঁকে হেঁকে ওদের মধ্যে আলাপ করতে লাগল। কি বলছে ওরা? দিলমহম্মদ বুঝিয়ে দিল যে, ওরা প্রত্যেকেই আমাদের সবাইকে আজকে মতো এখানেই বিশ্রাম করতে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। তার হেতুটি কি তাও খুলে বললে রূপলাল।
“এত আদর-অভ্যর্থনা কেন জানেন তা-এখানে থেমে যদি আমরা রুটি পাকাই তো ব্যাটারা সকলের কাছ থেকে একখানা করে রুটি আদায় করবে। ব্যাটারা একেবারে ছিনে জোঁক। রুটির জন্যে এমন ঝামেলা জুড়বে তখন যে প্রাণ নিয়ে পালানো হবে দায়।”
হই চই করতে করতে চলছে সবাই। রাস্তা নেই কোথাও-কোথাও মাটি, কোথাও বালি, কোথাও কাঁটা, কোথাও কাদা। সব রকম উঁচু-নিচু খানাখন্দ সোজা পার হয়ে চলেছে উট। চষা জমি–তাই, তাই সই। জমির চারধারে কাঁটার বেড়া দিয়ে সীমানা নির্দেশ করা হয়েছে-কুছ পরোয়া নেই। সোজা চলল উর্বশীর মা, তার পিছন পিছন উর্বশীও। বেড়া ভেঙে রাস্তা করে চলেছে। তাদের পিছন পিছন আমরাও। কেউ কিছু বলেও না। আহা, কি দেশ! আর আমাদের ওখানে? চাষের পর আল থেকে খেতে নামলে কি আর রক্ষে আছে! একেবারে রামদা সড়কি লাঠি সব বেরুবে।
মানুষের বসতি চারিদিকে। মানুষের চেয়ে ঢের বেশি অবশ্য ছাগলের বসতি। ছাগল সর্বত্র-রাবণ-ছাগল। আমাদের দেশে যাদের আমরা রামছাগল বলি তাদের তিনগুণ বড়। সুতরাং এরা হচ্ছে রাবণ-ছাগল। এর এক জোড়ার কাঁধে লাঙল জুড়লে অনায়াসে চাষ করা চলে। পালে পালে রাবণ-ছাগলরা ঘুরে ঘুরে কাঁটাগাছের ঝোঁপ চিবোচ্ছে।
কুন্তী চিবোচ্ছে কুল-সুখলাল তার সহকারী। যেতে যেতে যে কুলগাছগুলো হাতের কাছে পড়ছে তা থেকে নিজেই দুহাতে ছিঁড়ে নিচ্ছে কুন্তী, আর দূরের গাছগুলো থেকে দৌড়ে গিয়ে ছিঁড়ে আনছে সুখলাল। একলা কুন্তী নয়, আরও অনেকের মুখ নড়ছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এখানে কুল ফলে। একটায় এক কামড় দিয়ে দেখলাম-না টক, না মিষ্টি–শুধু কষাটে। উটের উপর থেকে ভৈরবী ওদের ধমক দিলেন। অত কাঁচা কুল খেলে পেট কামড়ে মরবে যে। তৎক্ষণাৎ দিলমহম্মদ সে কথার প্রতিবাদ করলে, “না-বহুত হজমি জিনিস। এ ফল খেলে বোখারা পর্যন্ত ছুটে যায়।” কাজেই কুল চিবানো চলতেই লাগলো।
কিন্তু আরও আগে আরও ভাল ফল পাওয়া গেল। সাদা সাদা ফুটি। দশ-বারোটি কিশোর কিশোরী ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত। তাদের প্রত্যেকের হাতে দুটি তিনটি করে ওই ফল। সব কটি কিনতে হবে। প্রায় আধ ক্রোশ দূর থেকে ছুটে আসছে তারা। গুলমহম্মদ দেখিয়ে দিলে, ওই যে ডানধারে উঁচু বালির পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ওটার ওধারে নেমে গেলে এদের গ্রাম পাওয়া যাবে। সেখান থেকেই আসছে ওরা ওই ফল নিয়ে। কি করে সংবাদ পৌঁছল ওদের কাছে যে, একদল হিংলাজ-যাত্রী আসছে? নিশ্চয়ই কেউ ওই বালির টিলার উপর থেকে আমাদের দেখতে পেয়েছে। আমরা তো আর ওদের গ্রামের পাশ দিয়ে যাব না-কাজেই আধ ক্রোশ ছুটতে ছুটতে এসে ওরা আমাদের পাকড়াও করেছে।
তখন দরদস্তুর করা চলতে লাগল। চলতে চলতেই অবশ্য চলতে লাগল দরদস্তুর করা। আরও মাইল খানেক পথ তারা এল আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। মাল গছাতে গেলে আসতেই হবে। কারণ, আমরা তো আর থামব না। তারা যা চায় আমরা তা বুঝতে পারি না। তাদের হিসেব খুব সোজা-সবাইকে এক আনা করে দাও তাহলেই সকলে মাল দিয়ে ফিরে যাবে। কিন্তু আমরা এত সহজে মাল কিনি না। কুন্তী দর করছে। ছোটগুলো এক পয়সা করে, বড়গুলো দু-পয়সা করে আর তার চেয়ে যে-কটা বড় তার দাম তিন পয়সা। কিন্তু তাতে হচ্ছে মহা গণ্ডগোল, মানে বিক্রেতারা সবাই সমান পাচ্ছে না। দুটি ছোট ফল যে এনেছে সে পাচ্ছে মাত্র দু-পয়সা আর যে এনেছে দুটো বড় ফল সে পাচ্ছে ছ-পয়সা। কাজেই ওদের মুখ আরও লাল হয়ে উঠছে। আরও বেশ করে মাথার সোনালি চুল দু-হাতে চুলকোতে লাগল ওরা। শেষ পর্যন্ত ওদের মধ্যে চার-পাঁচটি মেয়ে কুন্তীর কাপড় টেনে ধরল। একটা নিষ্পত্তি না হলে আর পা বাড়াতে দেবে না।
তখন পোপটভাই এগিয়ে গিয়ে মধ্যস্থতা করে দিলেন। ওদের প্রত্যেককে এক আনা করে দিয়ে কিছুতেই আমরা কিনব না তাদের মাল। আমাদের হিসেব আরও সোজা। আমরা সবাই এক আনা করে দেব। ইচ্ছে হয় ওদের মাল দিক, আর না-হয় আবার দৌড়াক এই এক ক্রোশ পথ ওদের মাল নিয়ে।
কিন্তু তাতে বাধল আরও ফ্যাসাদ। আমাদের সবাই-এর কাছ থেকে এক আনা করে নিয়ে হল মোট চৌত্রিশ আনা। কিন্তু ওরা হচ্ছে তেরোজন। পোপটভাই চৌত্রিশ আনা ওদের একজনের হাতে দিতে গেলে তা সে কিছুতেই নেবে না। সবাই-এর হাতে সমান করে ভাগ করে দাও। সহজে কিছুতেই কোনো মীমাংসা হয় না। ওরা কুন্তীকে প্রাণপণে বোঝবার চেষ্টা করছে, এর চেয়ে ঢের সোজা সবাই-এর হাতে এক আনা করে দেওয়া। কুন্তীর কাপড় ধরে টানাটানি করছে। শেষে সুন্দরলাল আরও পাঁচ আনা দিলেন। তখন কুন্তী তিন আনা করে ভাগ করে দিয়ে তবে ছাড়া পেল। হাতের ফলগুলো কুন্তীর সামনে ফেলে চক্ষের নিমেষে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। ওদের বোকামি দেখে তো সুখলাল হেসে লুটোপুটি!
দিলমহম্মদ বললে “ফেরবার সময় আমরা ওদের গ্রামের ওপাশ দিয়ে ফিরব। তখন আবার ওরা এসে পাকড়াও করবে।“
সুন্দরলাল বললেন-”সে সময় আমরা এক রাত ওদের সঙ্গে থাকব।”
ভৈরবী আর পোপটভাই একবাক্যে সুন্দরলালকে সমর্থন করলেন। ছেলেমেয়েগুলিকে দেখে ওদের নেশা চড়ে গেছে। অমন রূপ, অমন স্বাস্থ্য, সোনালি চুল, টকটকে মুখ আর কটা-কটা চোখ, আর সেই চোখের দৃষ্টিতে মরুভূমির সরলতা-সব কিছু একসঙ্গে করলে যা হয় তা আমরা আমাদের সভ্য জগতের শহুরে ছেলেমেয়েদের কাছে পাই না। তেরো আনার চেয়ে চৌত্রিশ আনা ঢের বেশি এ তারা হামাগুড়ি দিতে-দিতেই শেখে। শিখে যখন পায়ে হেঁটে চলতে আরম্ভ করে, তখন তের আনার ঢের কম, মাত্র সাত আনা হাতে পেলেই দুপুরবেলা সিনেমার সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়
এতক্ষণ আমরা গাছপালা ঝোঁপজঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলছিলাম। এবার আবার ফাঁকায় বেরিয়ে এলাম, আরম্ভ হল মাঠ। বীরভূমের সব চেয়ে বড় মাঠ যেগুলি, পাঁচ ক্রোশ জমি ভাঙলে যে সব মাঠ পার হয়ে ওপারের গ্রামে গিয়ে ওঠা যায় সেই রকমের সব মাঠ। শুধু বালি আর বালি। মস্ত বড় বড় ঢেউ তুলেছে সেই বালির সমুদ্র। একটা ঢেউ-এর মাথায় উঠে গুলমহম্মদ দেখালেন-ওই যে ওই কালো-মতো এতটুকু দেখা যাচ্ছে, ওই বস্তিতে গিয়ে উঠব আমরা। ওখানে পৌঁছেই আজকের মতো বিরতি। তার মানে এই মাঠখানা ভাঙতে আরও আধঘণ্টা চারেকের ধাক্কা। তা হোক, আজ আর কারও দেহে-মনে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই শ্রান্তি নেই। সবাই-এর মুখ জ্বলজ্বল করছে। সবাইকে মাতিয়ে নিয়ে চলেছে একলা কুন্তী। গোমড়ামুখো গোকুলদাসও মাঝে মাঝে সবাই এর সঙ্গে হাস্যপরিহাসে যোগ দিচ্ছে। অন্যদিন কুন্তী ভৈরবীর উটের পাশে হাঁটে। আজ ভোর থেকেই সে চলেছে দলের সঙ্গে অনেক আগে হই-চই করতে করতে। তার হাঁটাচলা কথাবার্তা হাস্যপরিহাস সব কিছুই সহজ সরল এবং স্বাভাবিক। অনেক পিছন থেকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
তবু একবার পিছন ফিরে চেয়ে দেখলাম সেই উঁচু কালির ঢেউটার মাথা থেকে নেমে যাবার আগে। চেয়ে রইলাম সেইদিকে-আকাশ যেখানে বালির সঙ্গে মিশেছে সেইখানটায়। কিছু দেখা গেল না। শুধু আকাশ আর বালি, বালি আর আকাশ ভিন্ন কিছুই চোখে পড়ল না। দশ-পনেরো ক্রোশ-হয়তো আরও বেশি–পিছনে ফেলে এসেছি সেই মস্ত বড় চ্যাপটা মাথা মাটির নৈবেদ্যটাকে, আর-আর তার পেটের মধ্যে তাকে যাকে আরও ক্রোশ আষ্টেক পিছনে এক পাহাড়ের মধ্যে দলসুদ্ধ আমরা সবাই ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাড়িয়েছিলাম। পা থেমে গেল, চোখ বুজে গেল, আচম্বিতে চোখে উপর ভেসে উঠল আকাশের দিকে উঁচু করা হাঁটু পর্যন্ত দুখানা পা। পা দুখানা থরথর করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তলিয়ে গেল কাদার মধ্যে।
দিলমহম্মদ হাত ধরে টান দিল। চোখ মেলে দেখলাম-উটের উপর থেকে ভৈরবী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে।
বললাম, “চোখে আবার কি পড়ল” বলে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উর্বশীর পিছু পিছু নেমে গেলাম।
অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে বসা হয়েছে। বেশ একটা বড় ডোবার চারপাশে গাছের ছায়া। ভাগে ভাগে গাছগুলোর তলায় রান্না চাপানো হল। ডোবাটায় জল নেই, আছে শুধু বালি। জল আনা হল খানিকটা দূরে এক কুয়ো থেকে। কুয়াওয়ালা এসে লোক গুনে গেল। যতগুলো লোক ততখানা রুটি। আধ পোয়া ওজনের ভালো সেঁকা রুটি চাই। উটওয়ালারা দুজন আর পাণ্ডা দুজন এই চারজনের বাদ দিলে মোটমাট দাঁড়ায় ত্রিশখানা। একবার দু-বার তিনবার গুনলে সে আমাদের। তিনবার তিনরকম ফল বেরুল-আটাশ, ত্রিশ, তেত্রিশ। হাল ছেড়ে দিয়ে গুলমহম্মদের শরণাপন্ন হল। গুলমহম্মদ তখন খাঁটি কথা বললে। দলের দুজন মরে কমেছে, সুতরাং এখন রুটি পাবে মাত্র আটাশখানি। আদায়ের ভার গুলমহম্মদের উপর দিয়ে সে চলে গেল।
এল তার গিন্নী মুরগির আণ্ডা বেঁচতে। দিলমহম্মদ দশটা নিলে, নিয়ে বাপবেটা দুজনে কাঁচা সেগুলোকে খেয়ে ফেললে। দশটা মুরগির ডিমের মূল্য আরও চারখানা রুটি অথবা আধসের আটা, রুটি বানানো হলে চারখানা রুটিই দেবে এই বলে দিলমহম্মদ তাকে বিদেয় করলে।
কিন্তু রুটি সেদিন তাদের ভাগ্যে জুটল না। জুটল কয়েক মুঠো ভাত। অন্যদিন রুটি বানিয়ে দেয় কুন্তী। সে বেঁকে বসল। আর সে আমাদের সঙ্গে সে খাবে না, আমাদের জিনিসপত্র সে ছোঁবে না, সে ভিক্ষা করবে সকলের কাছে এক এক টুকরো রুটি। কতটুকুই বা তার প্রয়োজন। জনকতক তাদের রুটি থেকে একটুকরো করে ছিঁড়ে দিলেই তার দিন চলে যাবে।
অন্যদিনের মতো ভৈরবী নিশ্চিন্তে স্নান করে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে জপে বসলেন। তিনি জানেন কুন্তীই রান্নাবান্না করবে, সুখলাল করবে তাকে সাহায্য। উটওয়ালার দু জন আর আমরা চারজন একসঙ্গে খাব। জপ থেকে উঠে তিনি দেখলেন–উনুন জ্বলেনি, রান্না চড়েনি। ওই ওধারের এক গাছতলায় কুন্তী শুয়ে আছে একলা-আর সুখলাল তার দাদার সঙ্গে কাছের বস্তিতে গেছে বেড়াতে।
তাড়াতাড়ি তিনি গেলেন কুন্তীকে দেখতে। আবার অসুখ-বিসুখ হল না তো? কুন্তীর কাছে গিয়ে তার গায়ে-মাথায় হাত দিলেন। কই! কিছুই হয়নি তো। ডাকাডাকিতে কুন্তী চোখ মেলে উঠে বসল, আর জানাল যে, সে আর আমাদের সঙ্গে খাবে না, আমাদের জিনিসপত্র ছোঁবে না, সকলের কাছ থেকে ভিক্ষা করে নেবে তার রুটি। সকলের উচ্ছিষ্ট খেয়েই তার দিন চলে যাবে।
রাগে অভিমানে ক্ষোভে ভৈরবীর বাকরোধ হয়ে গেল। তিনি খানিকক্ষণ ওর হাত ধরে ওর মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন-তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তবুও কুন্তীর মন গলল না। সে কিছুতেই উঠে এল না। তখন চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এসে ভৈরবী আমাকে জানালেন ব্যাপারটা। বললেন
“এই জন্যে আজ দশ-দশটা দিন আর রাত ওকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছি, এই জন্যে দু’হাতে ওর গা থেকে রক্ত ধুয়ে দিয়েছি, এই জন্যে নিজের মুখের গ্রাস ওকে খাওয়াচ্ছি! এত বড় বেইমান যে সব ভুলে গেল!”
কি বলব? আর বলবারই বা আছে কি? কুন্তীর উপর জোর খাটাবার কোন অধিকার আছে আমাদের? জোর করতে গেলে উল্টো উৎপত্তি হবে, একবার তা হয়েও ছিল। শেরদিলের আড্ডায় কুন্তীকে থিরুমলের জন্যে রেখে আসতে চেয়েছিলাম বলে এতগুলি হিন্দু সন্তানের মুখপাত্র হয়ে রূপলাল চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কুন্তী তো শুধু আমার উপর নির্ভর করে যাচ্ছে না। সব কটি হিন্দু সন্তানের উপর নির্ভর করে সে যাচ্ছে। দলসুদ্ধ সব কটি হিন্দু সন্তানই তার অভিভাবক। সুতরাং চুপ করে রইলাম।
ভৈরবী কাঁদতে কাঁদকে ভাত চড়াতে গেলেন। গুলমহম্মদ দিলমহম্মদ সুখলাল সবাই ভাতই খেল ৷ ভৈরবীও খেতে বসলেন। কিন্তু চোখের জলে ভাতে মিশে এমন একাকার হয়ে গেল, সে ভাত আর তাঁর গলা দিয়ে নামল না। দূর থেকে লক্ষ করলাম, কুন্তী, দু-তিন জনের কাছ থেকে দু-তিনখানা রুটি ভিক্ষে করে নিলে, কিন্তু কখন খেলে তা আর দেখতে পেলাম না।
রাতের আঁধার আগেই ঢুকে পড়ল গাছতলায়। বহুদিন পরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ কানে এল। কাছাকাছি মানুষের বাস আছে। এখান থেকেই খুব কাছে গুলমহম্মদের বাড়ি, এক রাতের ভিতর যাওয়া-আসা যায়। কিন্তু ওরা আর সে কথা তুলতে সাহস পেল না। আমিই বুড়োকে কাছে ডেকে বললাম, ফেরবার পথে আমাদের সবাইকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। বুড়ো বারকতক “আলবত” আর “জরুর” বলে মাথা নাড়লে।
শুয়ে পড়লাম সবাই। কুন্তী তার শাড়ির আঁচল পেতে শুয়ে রইল ওধারের গাছতলায়। বুড়ো গুলমহম্মদ গিয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলে যে, একলা ওভাবে শোওয়া উচিত নয়, উঠে গিয়ে মাইজির কাছে শুয়ে ঘুমাও। কুন্তী উত্তরও দিলে না। চোখ বুজে পড়ে রইল।
চাদর মুড়ি দিয়ে আমিও পড়ে রইলাম। মাথার কাছে ভৈরবী শুলেন সুখলালকে নিয়ে। অনেকক্ষণ ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পেলাম তাঁর চাদরের ভিতর থেকে, তারপর আস্তে আস্তে তাঁর নাক-ডাকা আরম্ভ হল। দু দিন দু রাত পরে তিনি ঘুমোলেন।
ভয়ানক হাসি পেতে লাগল। অনর্থক ভৈরবী দুঃখভোগ করছেন। যেচে মান আর কেঁদে সোহাগ আদায় করা যায় না, উল্টে গাল বাড়িয়ে চড় খেতে হয়। ভালবাসার মর্মান্তিক বিয়োগান্ত একটা দিক আছে। তা হচ্ছে-যাকে নিজের গরজে ভালোবাসলাম তার কাছ থেকেও ভালোবাসার আশা করা। সে আমার মনের মতো হয়ে চলুক, একমাত্র আমার উপরই নির্ভর করুক, আমাকে ছাড়া সে যেন অন্য কিছু না জানে, এই রকমের সব দুরাশা মনে মনে পোষণ করলে তার অনিবার্য ফল হাতে হাতে পেতেই হবে। তখন চোখের জলে নাকের জলে ভাসতে ভাসতে মাথা খোঁড়া আর চুল ছেঁড়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল কিল-চড়-ঘুষো এই সমস্তর শব্দে। তার সঙ্গে চাপা গলায় শাসন- “খবরদার, টু শব্দটি করেছিস একেবারে মেরে ফেলব!” ডোবটার ওপারে ঘটছে ব্যাপারটা। দিলমহম্মদের গলার আওয়াজ পেলাম। সবাই চুপি চুপি কাজ সারছে। আর একজনের গলাও কানে এল, “যদি এতটুকু জানতে পারেন স্বামীজি মহারাজ, তাহলে তোকে এখানে পুঁতে ফেলব বালির মধ্যে” আবার গোটাকতক কিল-চড়-ঘুষোর শব্দ কানে এল।-কি ব্যাপার!
চাদরটা মুখের উপর থেকে সামান্য সরিয়ে নজর করে দেখবার চেষ্টা করলাম। একটা গাছের আড়াল পড়ায় কিছুই দেখা গেল না। কিন্তু আবার কানে এল দিলমহম্মদের চাপা গলার আওয়াজ। সে হুকুম করলে, “যাও, এখনি গিয়ে শুয়ে পড়ো মাইজির কাছে।” আবার গোটাকতক চড় থাপ্পড়ের শব্দ কানে এল। এবার শুনতে পেলাম পোপটলালের গলা-”যা ব্যাটা, মুখ বুজে শুয়ে থাক গে যা। খুব সাবধান, সাধু মহারাজের এখন মাথার ঠিক নেই, এ সময়ে যদি তিনি এসব কথা শুনতে পান, তবে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
অন্ধকারে মধ্যে চেয়ে দেখলাম, ডোবার ওধার দিয়ে ঘুরে কে আসছে এদিকে। যে এল সে ভৈরবীর ও-পাশে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। ওধারের কথাবার্তা চড় চাপড়ে আওয়াজ থেমে গেল। কান খাড়া করে শুয়ে রইলাম, শেষে শোনা গেল শোঁ শোঁ শব্দ। বড় কলকেয় টান দেওয়া হচ্ছে।
টান টান হয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলাম। কি দরকার আমার জানবার কি ঘটে গেল ওখানে। যে ব্যাপার এত যত্ন করে আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করা হচ্ছে তা না-জানাই না হয় রইল আমার। সহযাত্রীরাও মানুষ, পাছে আমার মনের শান্তি নষ্ট হয় এই জন্যে ওরা এত সচেষ্ট। ওদের বুদ্ধি-বিবেচনা আর আমার ওপর ভক্তিশ্রদ্ধার পূর্ণ মর্যাদা দিতে গেলে আমি কিছুই জানতে পারিনি এইটুকুই দেখানো উচিত। বড় যে সে চিরকালই বড় থাকতে পারে যদি না সব ব্যাপারে নাক গলাবার চেষ্টা করে। অনকে সময় দেখেও না দেখা, জেনেও না জানা, এই দুটি মিথ্যা ভান সংসারে বহু অশান্তির হাত থেকে রেহাই দেয়।
পরদিন বেশ বেলায় গুম ভাঙল কুন্তীর ডাকাডাকিতে। চোখ চেয়ে দেখলাম কে গেলাস চা হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। এত সকালেই সে স্নান করে ফেলেছে। ভিজে চুলে আর ভিজে চোখে তার মুখ বর্ষণমুখর বলে মনে হচ্ছে। একবার মাত্র তার মুখের দিকে চেয়ে গেলাসটা হাতে নিলাম। একটিও কথা বললাম না তাকে, পাছে তার জোর করে আটকে রাখা চোখের জল বাঁধ ভেঙে ছোটে।
চায়ের গেলাসটা হাতে করে উঠে গেলাম ডোবার ওধারে। সবাই উঠে পড়েছে। বড় কলকেয় আগুন চড়েছে। সকলকেই দেখতে গেলাম, শুধু একজন তখনও চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কে ও? এখনও শুয়ে কেন?
রূপলাল একান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলে-”ও হচ্ছে লম্বুষ গোকুলদাস। কাল রাত্রে অন্ধকারে গাছের ডালের সঙ্গে ওর মুখের ধাক্কা লাগে। উঁচু তো কম নয়। মাথা হেঁট না করে অন্ধকারে চলাফেরা করবার ফল। মুখ একেবারে থেঁতলে গেছে ব্যাটার। তাই চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে।”
আর সকলের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। কেউই আমার দিকে চোখ তুলে চায় না। পোপটলাল আকাশের দিকে চেয়ে আধখানা সিঁড়িতে কষে টান দিচ্ছেন। গুলমহম্মদ যথারীতি পাগড়ির মধ্যে আঙুল চালিয়ে উকুন খুঁচছে। দিলমহম্মদ একটা গাছের ডাল নিয়ে তার উপর টাঙি দিয়ে সূক্ষ্ণ কারুকার্য করতে ব্যস্ত।
আর দাঁড়ালাম না। রূপলালকে বললাম- “যাও ওখানে গুলমহম্মদকে নিয়ে চা খেয়ে এসো তোমরা।” বলে চলে গেলাম কুয়োর ধারে।
কথা ছিল আজ ভোরবেলা যাত্রা আরম্ভ হবে, কিন্তু তা হল না। সেখান থেকে আমরা উঠলাম দিনের অর্ধেকটা পার করে। খাওয়া-দাওয়ায় দেরি হয়ে গেল। কুন্তী আমাদের সঙ্গেই খেল, কাজকর্মও সব করলে। ভৈরবীর মনে আর কোনো দুঃখ নেই। কারও মনেই কিছুই নেই। আগের মতোই সব ঠিক চলছে। তবে গোকুলদাস অত্যধিক লম্বা মানুষ বলে গাছের ডালের সঙ্গে অন্ধকারে ঠোক্কর খেয়ে মুখ ঢেকে বেড়াচ্ছে। লোকে গায়ে ঠোক্কর খায়, গোকুলদাস খেয়েছে মুখে। ওই একই কথা। কিন্তু অতগুলো গাছের ডাল কি পর পর ঝুলে আছে কোথাও? গোকুলদাসের মুখের দিকে চেয়ে মনে হল, অন্তত পনেরো-বিশ বার ঠোক্কর না খেলে তার সারা মুখখানা অমনভাবে ফুলে কালশিটে পড়ে যেত না। কিন্তু গোকুলদাসকে তো কিছু জিজ্ঞাসা করা যায় না। সে সবাইকে এড়িয়ে ঘোমটা টেনে চলেছে একা একা নিজের কুঁজো নিয়ে। কি জানি কেন তার একান্ত অনুগত চিরঞ্জীও আজ তাকে এড়িয়ে চলেছে।
সেই কথাই হচ্ছিল পোপটলালের সঙ্গে। বললাম, “পোপটভাই, আমি থাকলে অতগুলো ঠোক্কর কিছুতেই খেতে দিতাম না গোকুলদাসকে, ওর উঁচু মাথা নিচু করিয়ে মুখখানা বাঁচিয়ে দিতাম। মানুষেই ভুল করে, অন্যায় করে, পাপ করে, আবার মানুষেই এই দুনিয়ায় কত ভালো কাজ করছে। কিন্তু ভুল অন্যায় বা পাপ করলেই যদি সেই মানুষটাকে খতম করে দেওয়া হয়, তবে দুনিয়ার ভালো ভালো কাজগুলো করবার জন্যে শেষে যে আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
মিনিটখানেক পোপটলাল আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। তারপর একটা ঢোক গিলে বললেন- “ও ব্যাটার কথা ছেড়ে দিন। ও একটা আস্ত জানোয়ার। নিজের কর্মফল হাতে হাতে পেয়েছে, বেশ হয়েছে।”
বললাম, “তাদের ভাগ্য ভালো যারা হাতে হাতে কর্মফল পায় না। তা যদি সবাই পেত তবে গোকুলদাসের মতো জানোয়ারকে কর্মফল দেবার জন্যে একখানা হাতও খুঁজে পাওয়া যেত না।”
পোপটলাল কিছুক্ষণ নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। তারপর ভেবেচিন্তে জবাব দিলেন, “কিন্তু হাতে হাতে ফল পেলে একটা কাজ হয়, যখন তখন ভেবেচিন্তে যেখানে সেখানে হ্যাংলামো করবার দুঃসাহস থাকে না।”
হেসে ফেললাম। তারপর একটি বিড়ি দিলাম পোপটভাইকে। দুজনের বিড়ি ধরানো জলে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, “ঠিক বলেছেন-যখন-তখন যেখানে সেখানে দুঃসাহসিক কিছু যদি কেউ না দেখায় তাহলেই হল। আর একেবারে কস্মিনকালে কোথাও যাদের কোনো কিছু করবার সাহস নেই তাদের তো আমরা মাথায় তুলে নাচি। লোকলজ্জা সমাজ পুলিশ আইনকানুন পাপ-পুণ্যের জ্ঞান আর সব চেয়ে মারাত্মক যেটি, ঠোক্কর খেয়ে হাড় গুঁড়ো হবার ভয়-এই এতগুলো শক্ত লাগাম কষে টেনে ধরে যে ভাগ্যবান তার ছ-ঘোড়ার রথখানাকে ওপারে নিয়ে পৌঁছতে পারল, তাকেই আমরা বাহবা দিই। তখন তার একটা সাদা পাথরের মূর্তি গড়িয়ে চৌরাস্তার মোড়ে বসিয়ে সেই পাথরের মানুষের গলায় ফুলের মালা ঝোলাই। কিন্তু যতকাল সে ছিল রক্তমাংসের গড়া মানুষ, ততক্ষণ বিন্দুমাত্র সহানুভূতি তাকে দেখাই না। আহা, বেচারা অতগুলো লাগাম টানতে টানতে আজীবন দগ্ধে ম’লো, এ কথা একবারও আমাদের মুখ দিয়ে বেরোয় না। বরং একটিবারের জন্যেও যদি তার হাতের মুঠি শিথিল হয় তাহলে আর রক্ষে নেই। ঠোক্কর মারতে মারতে তার অবস্থা এমন করে ছাড়ি যে, তখন বেচারির নিজের পায়ে খাড়া হবারই সামর্থ্য থাকে না ত সে বাগিয়ে লাগাম টানবে কি করে!”
পোপটভাই মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন, “ঠিক তাই, সাহস দুঃসাহস এর একটাও যে সারাজীবনে দেখাল না সে-ই হয়তো সব চেয়ে সাংঘাতিক পাপী। শুধু মৃত্যু পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে ম’লো।”
বললাম, “আবার এমন অনেকে রয়েছেন যে সারাজীবন হেসে-খেলে কাটিয়ে গেলেন। তাঁদের কিছুতেই লকলকে জিব দিয়ে লাল গড়াল না। সাহস দুঃসাহস এসব কোনো কিছুই দেখবার তাঁদের দরকারই হল না।”
পোপটলালের কপালের পাঁচ-পাঁচটা রেখা পরস্পর জড়িয়ে গেল। তাঁর ডাগর চোখ দুটো কুঁচকে এতটুকু হয়ে গেল। তিনি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-”কিন্তু তাঁদের চেনা যায় কি করে? দেখছেন তেমন একজনকে যাঁর ওই বিষের জ্বালা নেই?”
বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে বললাম, “দেখেছি প্যাটেল, তেমন লোক অনেক আমার চোখে পড়েছে। শুধু ঐ হ্যাংলামো ব্যাধিটিই যে তাঁদেরই নেই তা নয়, তাঁদের রাগদ্বেষও নেই। নিজে যা করতে পারছি না অপরে তা করে ফেললে তাঁরা হিংসেয় খেপে ওঠেন না। উল্টে দুঃখে তাঁদের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। ‘আহা রে, ও বেচারা নিজেকে সামলাতে পারলে না’, এই ভেবে তাঁরা তখন তাঁকে সাহস দিয়ে অভয় দিয়ে বললেন-”ভাই, ঘাবড়ে যাসনে, চেষ্টা কর, আরও চেষ্টা কর–একদিন তুই ওই হ্যাংলাপনা ব্যাধিটা থেকে মুক্তি নিশ্চয়ই পাবি।’ তখন সেই হতভাগাকে ঘুষিয়ে কিলিয়ে থেঁতো না করে তার হাতে ধরে তাকে পাঁকের ভিতর থেকে টেনে তোলেন তাঁরা। নিজেরা ব্যাধিমুক্ত, তাই তাঁরা অপরকেও ব্যাধিমুক্ত করতে পারেন।’
পোপটলাল আবার ঘাড় হেঁট করে কি ভাবতে লাগলেন। উটের উপর থেকে ভৈরবী চেঁচিয়ে বললেন-”আবার পাহাড় দেখা যাচ্ছে!”
আবার পাহাড়! শুনেই মনটা কেমন হয়ে গেল। চারিদিকে নজর করে দেখলাম কুন্তী কোথায়। ওই যে চলেছে সুখলালের সঙ্গে। আঁচল জড়িয়ে নিয়েছে কোমরে। মাথায় ঘোমটা নেই। পিঠের উপর পড়ে আছে লম্বা বেণী। রংচঙে জামাটা গায়ে দিয়েছে, পরেছে ওর ছাপানো শাড়িখানা। পিছন থেকে ওদের দুজনকে দেখে মনে হল দুটি ভাইবোন-নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক দুটি স্কুলের ছেলেমেয়ে আপন মনে গল্প করতে করতে আর কি চিবোতে চিবোতে চলেছে।
ভৈরবী উপর থেকেই চেঁচিয়ে ধমকাচ্ছেন ওদের-”আর খাসনে ওগুলো হজম হবে না। যেমন হয়েছে ছেলেটা তেমনি মেয়েটা-একটাও যদি কথা শোনে!”
তাঁর গলার আওয়াজ শুনে মনে হল ওরা যে তাঁর বারণ শুনছে না এতেই তিনি খুশি। ওরা ফিরেও চাইলে না। সুখলালের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কুন্তী আবার কি বার করে নিলে।
রূপলাল আরও সামনে থেকে চেঁচিয়ে বললে-”আমাদের বোন নেই, সেজন্যে আমাদের মা-বাপের দুঃখের অন্ত নেই। ভেবেছিলাম ফিরে গিয়ে মা’র কাছে বলব, “এই দেখো মা, একটা বোন নিয়ে এসেছি এবার হিংলাজ থেকে, কিন্তু দেখছি তা আর হবে না। কাঁচা কুল খাইয়ে খাইয়ে সুখলাল বোনটাকে মেরে ফেলবে।”
সুখলাল তৎক্ষণাৎ তীব্র প্রতিবাদ করলে, ‘কুল নয়, আখরোট।” মণিরাম, সুন্দরলাল, আরও পাঁচ-সাতজন একসঙ্গে গোলমাল করে উঠল-’কুন্তী বহিন-তুমি একলা তোমার ছোট ভাইটিকে নিয়ে আখরোট খাচ্ছ আর আমরা কি তোমার ভাই নই? আমাদের কথা ভুলে গেলে কি করে?”
পোপটভাই বললেন- “যে বহিন ভাইদের না দিয়ে খায় তাদের কি বলে?” সবাই হই হই করে একসঙ্গে কি বললে বোঝা গেল না ৷
কুন্তী দৌড়ে ফিরে এল ভৈরবীর উটের পাশে। বললে, দাও তো মা ঝোলাটা নামিয়ে। ভাইদের না দিলে ওরা আমাকেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে যে।”
ভৈরবী ঝোলাটা নামিয়ে দিলেন। দিলমহম্মদ সেটা ধরে নিয়ে কুন্তীর হাতে দিয়েই নিজে হাত পেতে দাঁড়াল। তার হাতে একমুঠো দিয়ে কুন্তী ছুটল সামনে, তার সব ভাই-কটিকে ভাগ করে দিতে।
বেশ খানিকটা সামনে দৌড়ে গিয়ে তবে কুন্তী তার ভাইদের পাকড়াও করলে। তারপর ওরা কাড়াকাড়ি করে কুন্তীর কাছ থেকে আখরোট বাদাম নিয়ে খেতে খেতে চলল। পিছন থেকে দেখলাম অতগুলো ভাই-এর একটিমাত্র বোন হওয়া সহজ কথা নয়-অতগুলো ভাই-এর আবদার অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করতে হয়। তা কুন্তী সে কাজটি সুশৃঙ্খলে করছে। কাউকে ধমকে, কাউকে চোখ রাঙিয়ে, কারও হাতের উপর চড় মেরে সবাইকে শান্ত করছে। দেখতে দেখতে কেন জানি না আমার দু-চোখ জলে ভার উঠল। ওদের হাসি ওদের ঝগড়া পিছনে ভেসে এসে কানে ঢুকছে আর ভাবছি অনেকগুলো বছর পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির কথা। না, আর একবার এ জীবনে কারও ভাই হবার যোগ্যতা একেবারে হারিয়েছি। বাবা, স্বামীজি মহারাজ, এই পদবীগুলি পাবার লোভে সে যোগ্যতা অনেকদিন আগে বলিদান দিয়ে এসেছি। এখন লোকে ভয় করে, ভক্তি করে, হয়তো সম্মানও করে, কিন্তু ভাই বলে কেউ আর ভালোবাসতে সাহস করে না।”
ভৈবরী বললেন-”এইভাবে হেসে-খেলে মেয়েটা করাচী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় তো বাঁচি।”
বললাম– “কেন? আমরা কাকেও সঙ্গে করে আনিনি, কারও দায়-দায়িত্ব নেই আমাদের কাঁধে। করাচী আমরা দু-জনই ফিরে যাব। যা হয় হোক ওর “
ভৈবরী মুখঝামটা দিয়ে উঠলেন, “থামুন তো! অমন অলুক্ষণে কথা মুখে আনবেন না।”
সুতরাং মুখ বন্ধ করে একটি বিড়ি ধরালাম।
সূর্যদেব অস্তাচলে বিশ্রাম নিতে গেলেন। পাঁচদিন আগে সে সূর্যদেব আসতেন যেতেন, এ তিনি নন। আজ আর কাল যে সূর্যদেবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল, ইনি যেমন ভদ্র তেমনি নিরীহ। এঁকে “আবার এসো” বলতে সাহস হয়। ইনি হলেন সেই বাবু-শ্রেণীর সূর্যিঠাকুর যিনি হুগলী চব্বিশ পরগনা নদীয়া জেলাগুলির উপর ঘোরাফেরা করেন।
আরও ঘণ্টাখানেক পরে অনেকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। আবার ঘেউ ঘেউ করতে করতে ফিরেও চলল আমাদের সঙ্গে। তারপর “সালাম আলেকুম” আর “আলেকুম সালাম” কানে এল। মানে গুলমহম্মদ উর্বশীর মায়ের নাকের দড়ি ধরে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে। অন্ধকারের ভিতর চলতে চলতে আমরাও এসে দাঁড়ালাম এক গৃহস্থের উঠানে। গৃহকর্তা অন্ধকারের মধ্যেই সকলকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, অনেকের সঙ্গে হাতে হাত মেলালেন। সেই উঠানেই আমরা কম্বল পাতলাম।
কাল সকালে আমরা চলে যাব অঘোর নদীর পারে। এখান থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। কিন্তু উট আর যাবে না। উট এখানেই থাকবে মালপত্র সমেত। এর আগে উট নিয়ে যাবার হুকুম নেই সরকারের। হিংলাজ দর্শন করে এখানে ফিরে এসে তবে আবার মালপত্র উট, কুঁজো সব পাওয়া যাবে। মা হিংলাজের পূজার উপাচার আর সেখানে নিজেদের পরবার জন্যে একখানা করে নতুন কাপড় সঙ্গে যাবে। তবে ইচ্ছে করলে একদিনের খাওয়ার মতো আটাও নেওয়া যায় সঙ্গে। কে নেবে? কেউ নিলে না কিছু। সারা দিনরাত নিরম্বু উপোস করে ভোররাতে ব্রাহ্মমুহূর্তে মাতৃদর্শন। তারপর মায়ের প্রসাদ মুখে দিয়ে এখানে ফিরে আসতে বেলা বারোটাও বাজবে না। সুতরাং কে আবার আটা বয়ে নিয়ে যাবে মায়ের স্থানে!
সে রাত্রেও আমাদের আর রান্না করতে হল না। শেঠ সুন্দরলাল নিমন্ত্রণ করলেন আমাদের ছ-জনকে।
মায়ের স্থানে নিয়ে যাবার পূজা-উপাচার গুছিয়ে রেখে সুন্দরলালের ডালরুটি আর চাটনি খেয়ে যখন শুলাম, তখন মাথার মধ্যে গুনগুন করে যে গানের সুরটি বাজতে লাগল তা হচ্ছে এই
“দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
জীবনে বাধায় গণ্ডগোল,
কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে–
কিছু নাই, আছে মা’র কোল
ভেবেছিনু আর কেহ বুঝি,
ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি,
তবে হাসি দেখে আজ বুঝি
তুমিই দিয়েছ মোরো দোল।
এ জীবন সদা দেয় নাড়া–
লয়ে তার সুখ দুখ ভয়;
কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া,–
সে-ই যেন মোর সমুদয়।
এ ঘোর কাটিয়া যাবে চোখে
নিমেষেই প্রভাত-আলোকে,
পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে,
থেমে যাবে সকল কল্লোল।”
— গীতাঞ্জলি
তখন প্রভাত হতে অনেক দেরি।
আমাদের সব-শেষের পথটুকু শেষ করবার জন্যে আমরা তৈরি হলাম। এইবার আমাদের পথ দেখাবে আমাদের ছড়িওয়ালা। তার কাঁধের ছড়ির উপর লক্ষ রেখে আমরা চলব তার পিছু পিছু। অতি পবিত্র হিংলাজের ছড়ি, নানা রঙের কাপড়ের ফালি ঝুলছে সেই ছড়িতে। ছড়ির মাথাটা ত্রিশূলের মতো আর ডগডগে করে সিন্দুর মাখানো তাতে।
কারও কাঁধে কুঁজো নেই। তার বদলে ঝুলছে ঝুলি প্রত্যেকের কাঁধে। মায় আমাদের সুখলালের কাঁধে পর্যন্ত। তাকে সাজিয়ে দিলে তার দাদা। আরও কয়েকটা বছর পরে এই ছোট্ট সুখলাল বড় হয়ে কত যাত্রীকে এখানে নিয়ে আসবে। এখান থেকে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে হিংলাজের গুহায়, মন্ত্র পড়বে, পিঠ চাপড়ে সুফল দান করবে, আশীর্বাদ করবে। আজ হচ্ছে তার প্রথম হাতেখড়ি। বড়ভাই ছোটভাই-এর ঝুলিতে গুছিয়ে দিলে ওদের নিজেদের সব পূজার সামগ্রী। লাল সালু, সিন্দুর, মাটির প্রদীপ, তেল-সলতে, ধূপ-ধুনা, ঘি, নারকেল, শুকনো মেওয়া, মিছরি আর দু-ছড়া পাথরের মালা। এই পাথরের মালা দু-ছড়া করে কিনে আনতে হয়েছে প্রত্যেক যাত্রীকে করাচী থেকে। এই জিনিসটিই হচ্ছে বিখ্যাত হিংলাজের ঠোংরা। ছোট্ট ছোট্ট লালচে পাথর। এক জাতের বেঁটে লালচে চাল হয় বীরভূম, বর্ধমানে, পাথরগুলো অনেকটা সেইরকম দেখতে। একগাছি সরু সুতো যেতে পারে এই রকম ছেঁদা করে সেই মালা গাঁথা হয়। অতটুকু পাথরে কি যন্ত্র দিয়ে এই রকম সরু ছেঁদা করে তা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। মা হিংলাজের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে তবে ওই মালা গলায় ধারণ করতে হবে। তার আগে গলায় দিলে নাকি মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে। আরও বহুরকমের বিধিনিষেধ আছে, অনেক ব্যাপার করতে হয় এই মালা ধারণ করবার আগে। কিন্তু সে সব করা হবে কাল, ব্রহ্মময়ীর ব্রহ্মরন্ধ্র মহাপীঠে জ্যোতিঃদর্শন করে বেরিয়ে আসবে যখন, তখন। এখন খুব সাবধান, আরও একবার না হয় ভালো করে দেখেশুনে নাও-কারও কিছু সঙ্গে নিতে ভুল হল কি না। সব নেওয়া হয়েছে তো? মা হিংলাজের ভোগের জিনিসপত্র আটা ঘি চিনি কিশমিশ পেস্তা বাদাম নারকেল মেওয়া মিছরি সবই তো আলাদা করে পবিত্রভাবে আনা হয়েছে? ঠোংরার মালা দু-গাছা আর নতুন কাপড়খানা? স্নান করে নতুন কাপড় পরে হিংলাজের গুহায় ঢুকতে হবে। কাঁচের বোতল একটা করে সকলেই সঙ্গে এনেছে। এটাও যেন ভুল না হয়। হিংলাজ দর্শনের পর আকাশগঙ্গায় গিয়ে সেখানকার পবিত্র জল ভরে নিতে হবে ওই বোতলে।
গুলমহম্মদ আর তার ছেলে বার করে দিলে ওদের নিজেদের পূজার সামগ্রী।
একখানা লাল সালু, একগোছা মহাসুগন্ধি ধূপবাতি আর অনেকগুলো লম্বা মোমবাতি। তার সঙ্গে আতর, এলাচদানা আর নগদ পাঁচসিকা। নানী-কি-হজে চড়াতে হবে। ওরা তো আর যাবে না, ওদের শিন্নি রূপলালই চড়াবে।
ভৈরবী সাজিয়ে দিলেন কুন্তীকে। একখানা নতুন গামছা দিয়ে ঝুলি বানানো হল কুন্তীর। তার ভিতর কুন্তীর জন্যে সব কিছু আলাদা করে দিয়ে দেওয়া হল, এমনকি দু-ছড়া মালা পর্যন্ত। কুন্তী আপত্তি করলে, তাকে দু-ছড়া মালা দিলে আমাদের যে কম পড়বে! বললাম, “আমি সন্ন্যাসী মানুষ-আমাকে ও মালা গলায় দিতে নেই।”
“তবে সঙ্গে এনেছেন কেন চার ছড়া মালা?”
“কি করি বলো-যে শেঠজি আমাদের জিনিসপত্র দিয়েছেন তিনি কিছুতেই ছাড়লেন না। “কাজেই চারগাছা সঙ্গে এসেছে।”
দক্ষিণের পাঁচসিকে পয়সাও দিতে ভুললেন না ভৈরবী কুন্তীর ঝুলিতে। তারপর নিজের ঝুলি নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে কুন্তীর হাত ধরে তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন।
এমন সময় কুন্তীর মনে পড়ে গেল বোতলের কথা। কই, বোতল নেওয়া হল না তো? আকাশগঙ্গার জল আসবে কিসে?
ভৈরবী তখন বুঝিয়ে বললেন কুন্তীকে। জল বয়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের লাভ কি? আমাদের তো ঘরবাড়ি কোথাও কিছুই নেই। জল নিয়ে গিয়ে আমরা রাখব কোথায়? সবাই ফিরে যাবে নিজের নিজের বাড়িতে। বাড়িতে নিয়ে ওই বোতলভরা জল পবিত্রভাবে রেখে দেবে হয়তো ঠাকুরঘরের কোণে। হিংলাজ থেকে ফিরে আসব আমরা ঘরে ফেরবার জন্যে নয়, পথে ঘোরবার জন্যে। পথ আর পথ। পথই আমাদের ঘর, পথই আমাদের সম্বল। আকাশগঙ্গার জল যত পবিত্রই হোক তা বোতলে ভরে নিয়ে কাঁধের ঝুলিতে করে চিরকাল বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়।
কুন্তী সত্যই আশ্চর্য হয়ে গেল। শুধু আশ্চর্য হল না, আমাদের কোথাও ঘর না থাকার দুঃখটা এমন করেই বাজল তার বুকে যে প্রায় কেঁদেই ফেলল। আবার সাহসই দিলে আমাদের। কুছ পরোয়া নেই। আর আমাদের ঘরের দুঃখ থাকবেই না। এখান থেকে ফিরে সে নিয়ে যাবে আমাদের তার বাবার কাছে। কুন্তীর বাবা মাটির মানুষ, আর তাঁর দয়াধর্মও খুব বেশি। আমাদের নিয়ে গিয়ে কুন্তী তার বাবাকে বলবে আমাদের একটা আশ্রম করে দিতে। দ্বারকায় বৃন্দাবনে জুনাগড়ে-যেখানে আমরা পছন্দ করব সেইখানেই জমি কিনে দেবে কুন্তীর বাবা। সেই জমিতে আশ্ৰম বাঁধব আমরা। কুন্তীও চিরকাল থাকবে কিনা সেই আশ্রমে সন্ন্যাসিনী হয়ে। সেই হবু আশ্রমের পূজার ঘরের এক কোণে পবিত্র আকাশগঙ্গার জল নিয়ে গিয়ে টাঙিয়ে রাখতে পারবে না বলে কুন্তীর আপশোসের অন্ত রইল না।
একটা আলোও সঙ্গে নেওয়া ঠিক হলো। আর সঙ্গে নেওয়া হল নিজের নিজের লোটা। ব্যাস, এইবার চলো সকলে।
“জয় শ্রীহিংলাজ মহারানি কি–“
“জয়!”
উঠলো ছড়ি রূপলালের কাঁধে। তার সামনে আলো হাতে চলল গুলমহম্মদ, খানিকটা এগিয়ে দিয়ে সে ফিরে আসবে। পথ ভুল হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সোজা পুবমুখো গেলেই নদী। রূপলাল আগে অন্তত বিশবার যাওয়া-আসা করেছে।
মুখ বুজে সবাই চলেছি। গাছপালার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে চাষের জমিতে পড়া গেল। তখন গুলমহম্মদ ফিরল একজনের হাতে আলো দিয়ে। বত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা আবার ফিরে আসব এখানে। তবুও বুড়োর গলায় একটা করুণ বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠল, তখন সে বার বার আমাদের সকলকে সাবধান করে দিয়ে বিদায় নিলে।
আমরা চললাম।
চাষের জমি শেষ হল। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, কি জন্যে উট নিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত যাওয়া যায় না। হোঁচট হোঁচট আর হোঁচট, সেই ভোররাতে আরম্ভ হল পদে পদে হোঁচট খাওয়া। শুধু অজস্র অফুরন্ত নোড়া-নুড়ি ঢিল-পাটকেল। তার উপর দিয়ে একবার খানিকটা উঠছি আবার নেমে যাচ্ছি অনেকটা। তখনও বেশ আঁধার রয়েছে। ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না কিছু। একে অপরের ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়ছি। সামনে থেকে রূপলাল চেঁচাচ্ছে, “হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার!’ আর ঠিক তার পরমুহূর্তে যেই পা ফেললাম অমনি পায়ের নীচ থেকে কতকগুলো নুড়ি গেল গড়গড় করে গড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পড়লাম সামনের কারও পিঠের উপর। তারপর আরম্ভ হল আলগা নুড়ির উপর দিয়ে উপর দিকে ওঠা। সে আরও কঠিন ব্যাপার। পা ফেললেই খানিক পিছিয়ে নেমে আসতে হয়।
এই করতে করতে সকাল হল। চতুর্দিকে স্পষ্ট পরিষ্কার দেখতে পাওয়া গেল তখন। দেখে একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। এত নোড়া-নুড়ি কি উদ্দেশ্যে জড়ো করা হয়েছে এখানে? পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ মনের সাধ মিটিয়ে টেবিলের উপরের কাগজ চাপা কুড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে এখান থেকে। রঙে আকারে গঠনবৈচিত্র্যে একটির সঙ্গে অপরটির কিছুমাত্র মিল নেই। এক রকমের একজোড়া কাগজ-চাপা খুঁজলেই মুশকিল, তা কিছুতেই মিলবে না এখানে।
সকলেই একটা-দুটো কুড়োতে লাগল। নিতে নিতে বোঝা ভারী হয়ে উঠল। তবুও বন্ধ হয় না নুড়ি কুড়োনো। কি করবে, এইমাত্র যেটি নজরে পড়ল সেটি যে আগেরগুলোর চেয়ে আরও অদ্ভুত ধরনের। টক করে তুলে না নিয়ে উপায় কি! তারপর আবার দু-পা না এগোতেই ওই আর একটি। আহা, এটি আরও অদ্ভুত। যেমন রং তেমনি জ্বলজ্বল করছে, সেটিকেও তুলে নিতে হল। এই করতে করতে শেষ পর্যন্ত সব কটি দিতে হল আঁচল থেকে ফেলে। কারণ তার পরেও যেগুলো চোখে পড়ছে, সেগুলো না নেওয়া একান্ত অন্যায় হবে। আবার ভরে উঠল আঁচল। কিন্তু আরও সামনে যেগুলো দেখতে পাওয়া গেল, তার কাছে আগের কুড়োনোগুলো সত্যিই একেবারে যাচ্ছেতাই বাজে জিনিস। সুতরাং আবার আঁচল খালি করবার দরকার হল।
হঠাৎ নুড়ির জগৎ গেল শেষ হয়ে। আরম্ভ হল বালি। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক নম্বরের সাদা বালি। রূপলাল তখন হাত তুলে দেখিয়ে দিলে, ওই ওখানে ওই পাহাড়ের কোল দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অঘোর নদী, আর নদীর ওপারে ওই পাহাড়েই মা হিংলাজের গুহা।
এবার পাহাড় দেখে কেউ জয়ধ্বনি দিলে না। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে শুয়ে পড়ল না কেউ। দণ্ড খাটতে খাটতে চললও না কোনো ভক্ত। উল্লাস-উচ্ছ্বাস লম্ফঝম্ফ কিছুই নেই। নীরবে সকলে নেমে পড়লাম সেই বালির সমুদ্রে। শেষবারের মতো এটাকেও পার হতে হবে। ওই দেখা যাচ্ছে কূল। এতদিনে কূল দেখা গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সাঁতরে চললাম আমরা সে বালির সমুদ্রে।
চোখে পড়ল জল। তরতর করে বয়ে যাচ্ছে কূলে কূলে ভরা এক নদী। ডান দিক দিয়ে নেমে এসে বাঁ দিকে চলে যাচ্ছে। এপারে বালি ওপারে পাথর। সেই পাথরের পাড় উপর দিকে মেঘ ভেদ করে চলে গেছে অনন্ত আকাশের মধ্যে।
এই নদীর নাম অঘোর। ওপারের ওই পাহাড়ের কোথাও আছে মা হিংলাজের গুহা। একান্ন মহাপীঠের প্রথম আর মহাপীঠ ওই পাহাড়ের মধ্যে, সেখানে বিষ্ণুচক্রে খণ্ডিত হয়ে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছে। এই মহাপীঠ দর্শন করে ভগবান রামচন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাতক থেকে মুক্ত হন।
নদীর পাড়ে বালুর মধ্যে পোঁতা হল হিংলাজের ছড়ি। কাঁধের ঝোলা নামিয়ে আমরাও বসে পড়লাম তার পাশে। চোদ্দ দিন চোদ্দ রাত পরে সত্যিই ফুরিয়ে গেল পথ। সেই সঙ্গে নিঃশেষ কোথায় মিলিয়ে গেল এই চোদ্দ দিনের উদ্যম-উৎসাহ আর পথের বিভীষিকা। এখন আমাদের কাছে পেরিয়ে-আসা পথের মূল্য এক কানাকড়িও নয়। বোধ হয় পথের কাছে আমাদেরও আর কানাকড়ির মূল্য নেই। হাব নদী থেকে অঘোর নদী-এই চোদ্দটা দিন আর রাত মনের অন্ধিসন্ধি জুড়ে ছিল এই পথ। হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল মনটা। পথ খতম-আমরাও যেন খতম হয়ে গেলাম সেই সঙ্গে।
বসে আছি নদীর দিকে চেয়ে। কানে যাচ্ছে নদীর স্রোতের কলকল ছলছল ধ্বনি। মন দিয়ে শুনছি কি বলছে নদী। হাঁ, বলছে-এইবার বেশ বুঝতে পারছি নদীর ভাষা-বলছে না শুধু; গাইতে গাইতে চলেছে
“নদীপারের এই আষাঢ়ের
প্রভাতখানি
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্ৰাণে টানি ৷
সবুজ নীলে সোনায় মিলে,
যে সুধা এই ছড়িয়ে দিলে
জাগিয়ে দিলে আকাশ তলে
গভীর বাণী–
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্ৰাণে টানি ৷
এমনি করে চলতে পথে
ভবের কূলে,
দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব
নিস রে তুলে।
সেগুলি তোর চেতনাতে
গেঁথে রাখিস দিবস রাতে
প্রতি দিনটি যতন করে
ভাগ্য মানি–
নে রে, ও মন, নে রে আপন
প্রাণে টানি।”
— গীতাঞ্জলি
“এই নিন আপনার দাঁতন।”
গানের উপর খাঁড়ার কোপ পড়ল। সুরের রেশটুকু কটাং করে দাঁত দিয়ে কেটে দিলে কে। কে আবার? কুন্তী ৷ দু-গাছা দাঁতন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“দাঁতন! দাঁতন কেন? বেশ তো চলছিল এতদিন বালি ঘষে দাঁত মাজা।”
‘এখানে তা চলবে না। এখানকার নিয়ম দাঁতন করা। ওই দেখুন সকলে দাঁতন ভাঙছে।”
নদীর পারে একেবারে জল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো ডাঁটা। পাতা নেই বললেই হয়। সেইগুলো সবাই দুটো করে ভেঙে আনছে। একটা দিয়ে দাঁতন করবে আর একটা পুঁতে দেবে সেইখানে। এটিও একটি তীর্থকর্ম, অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
অবশ্যপালনীয় কর্তব্য এই একটিই নয় এখানে, আরও অনেক রকমের কর্তব্য রয়েছে। মন্ত্র পড়ো, তর্পণ করো পিতৃপুরুষের, দান-দক্ষিণা দাও। এখানকার দান দক্ষিণা সব ওই ওঁর প্রাপ্য। ওই যে এসে দাঁড়িয়েছেন, ছাতার কাপড়ের আলখাল্লা পরে, বুক পর্যন্ত দাড়ি, হাতে জপের মালা–উনি হচ্ছেন হিংলাজের পুরোহিত, নানী কি-হজের পীরসাহেব, এই মহাপীঠের মোহন্ত মহারাজ। মহাতপা নাগনাথের গদির বর্তমান অধীশ্বর বাবা ধর্মনাথ মহারাজ। কিন্তু ওই ধর্মনাথ নাম উনি নিজেও বহুকাল ভুলে গেছেন। ভুলতেই হবে। ব্যবহার না করলে যত বড় ধারালো অস্ত্রই হোক না কেন তাতে মরচে ধরবেই। তেমনি নামের বেলাতেও। ঠাকুর্দা শিবভক্ত। নাতির নাম রাখলেন পঞ্চানন। অতি মহৎ উদ্দেশ্য। নাতিকে ডাকবেন আর ঠাকুরের নামও নেওয়া হবে। পিসি সেই পঞ্চাননকে আদর করে পাঁচু বলে ডাকতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেশসুদ্ধ লোক বললে পেঁচো। ওই পেঁচোই টিকল, পঞ্চাননকে সবাই গেল ভুলে।
হিংলাজের মোহন্ত মহারাজের বেলাও ঠিক তাই হয়েছে। কান ফাটিয়ে-নাথ সম্প্রদায়ের সাধুদের কানে ছেঁদা করে একটা কিছু পরতে হয় কানে-গেরুয়া পরে লম্বা কলকে সম্বল করে, মাত্র আটাশ বছর বয়সে নাথ সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসী হিংলাজ দর্শনে এসে আর ফিরতে চাইলেন না এখান থেকে। রয়ে গেলেন এই অঘোর নদীর কূলে। তাঁর সঙ্গে যাত্রীরা আর ছড়িওয়ালা তাঁর পায়ে মাথা খুঁড়েও তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলে না। একটা মানুষকে এই জনমানবহীন জায়গায় ফেলে রেখে তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে ফিরলেন করাচী। করাচীতে নাগনাথের আখড়ায় সবাই হায় হায় করতে লাগল। আহা, লোকটা না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরবে কিংবা বাম বাহেড়া বা নেকড়েতে খেয়ে ফেলবে! তারপর সবাই গেল সন্ন্যাসীর কথা ভুলে।
ছ-মাস পরে আবার ছড়ি এল করাচী থেকে। এল একদল যাত্রী আর ছড়িওয়ালা। এসে এইখানে এই অঘোর নদীর কূলে যখন বসেছে, তখন সামনে আবির্ভূত হল এক মূর্তি। আপাদমস্তক নগ্ন এক নরকঙ্কাল। তাকে দেখে তো সবাই-এর ভিরমি লাগাবার যোগাড়। তখন সেই মূর্তি কথা বললেন, অভয় দান করলেন। বললেন, “আমিও তোমাদের মতো মানুষ, মা হিংলাজের সেবায়েত। মা হিংলাজের আদেশে এখানে বাস করছি।”
সেই দিন এই নদীর কূলে সেই ভাগ্যবান যাত্রীদল আর তাদের ছড়িওয়ালা চিৎকার করে উঠেছিল, “জয় মোহন্ত মহারাজ কি জয়!” সেই যাত্রীদলই সর্বপ্রথম পূজা করল মোহন্ত মহারাজের। তারা যা দান-দক্ষিণা করলে এখানে, তাদের ছড়িওয়ালা তা আর নিলে না; মোহন্ত মহারাজের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলে যে, এখন থেকে অঘোর নদীর কূলে যাত্রীরা যা দেবে সে সমস্তই হবে মহারাজের প্রাপ্য। এসব ব্যাপার ঘটে অন্তত ষাট বছর আগে। কিন্তু সে নিয়ম আজও চলে আসছে। অঘোর নদীর কূলে যাত্রীরা হিংলাজের মোহন্তর হাতেই দান-দক্ষিণা করেন।
কিন্তু এই ষাট বছরে অনেক কিছু বদলেছে। ষাট বছর আগেকার আটাশ বছরের সন্ন্যাসী বাবা ধর্মনাথ নিজের নামটিও বোধ হয় ভুলে গেছেন। লাসবেলা রিয়াসতের সর্বত্র এখন ইনি ‘কোটরী পীর’ বলে বিখ্যাত। আর করাচীর নাগনাথের আখড়ায় ছড়িওয়ালারা ডাকে ‘অঘোরী বাবা’ বলে। এখানকার সরকার প্রতি বছর এঁকে নজরানা দেন। তাতেই সারা বছর এঁর বেশ সচ্ছল অবস্থায় চলে। কোটরী পীরের অসীম ক্ষমতা। এখানকার লোকে বিশ্বাস করে যে ইনি মড়া বাঁচাতে পারেন। এমনকি এঁর মুখের কথায় সরকার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত মুকুব করে দেন। অঘোর নদীর এপারে আরও ডানদিকে খানিকটা গেলে অঘোরী বাবার আস্তানা পাওয়া যাবে।
বসে বসে দাঁতন ঘষছি দাঁতে আর অঘোরী বাবার কাহিনী শুনছি রূপলালের কাছে। ওধারে একে একে সবাই স্নান করে গিয়ে অঘোরী বাবার হাতে দান-দক্ষিণা করছে। মেওয়া, মিছরি, আর নগদ টাকা-পয়সা। বাবা সকলের মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করছেন। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একমুখ সাদা চুলদাড়ির ভিতর তাঁর চোখ দুটি। চোখ দুটি দিয়ে যেন হাসি উথলে উঠছে। জগতে সবচেয়ে দুর্লভ বস্তুটির নাম কি? আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করলে আমি বিনা দ্বিধায় উত্তর দেব-”বস্তুটির নাম অনাবিল প্রসন্নতা।” বস্তুটি এতই দুর্লভ যে অনেকের ভাগ্যে সারা জীবনে ও জিনিসের দর্শনই মেলে না। কখনো কারও ভাগ্যে যদি দৈবাৎ মিলে যায় ওর সাক্ষাৎ, তখন ওর ছোঁয়া লেগে তার মন-প্রাণও ছলছলিয়ে ওঠে। সেদিন অঘোর নদীর কিনারায় অঘোরী বাবার দুই চোখ দিয়ে যে অমৃত ঝরে পড়ছিল তাতে স্নান করে দলসুদ্ধ সবাই-এর যেন মন-আত্মা জুড়িয়ে গেল।
সকলের শেষে স্নান করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ তুলে চেয়ে বাবা হাত পাতলেন। বললাম, “বাবা, আমার তো কিছুই নেই এ দুনিয়ায় যা তোমার হাতে দিতে পারি। আমি নিজেই ভিখারী। একমাত্র আমি নিজেকেই দিতে পারি তোমার পায়ে। নাও তুমি আমাকে যদি তোমার কোনো কাজে লাগে।” বলে বাবার দু পায়ে হাত দিলাম। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “যা –নদী পার হয়ে মায়ের স্থানে চলে যা। ব্রাহ্মমূহূর্তে আবার দেখা হবে।”
কাঁধের ঝোলাঝুলি পুঁটলি বেঁধে মাথায় তুলে সকলে জলে নামলাম। এধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। নদীর জল বেড়েছে। ভয়ানক টান। জল আমাদের কোমর ছাড়াল। শ্ৰীমান ছোট পাণ্ডা বাবাজির ছাড়াল গলা। তখন ভৈরবীর পুঁটলি এল আমার মাথায়। সুখলালকে পিঠে করে ভৈরবী অবলীলাক্রমে সাঁতার দিয়ে একেবারে ওপারে চলে গেলেন। আমরাও অনেক হেঁটে পার হয়ে এলাম। জল নদীর মাঝখানে আমাদের গলা পর্যন্ত পৌঁছল। এপারে এসে কানে এল কুন্তীর গলা। গলা-জলে দাঁড়িয়ে কুন্তী চিল-চেঁচাচ্ছে। স্রোতে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। একলা পোপটভাই তার হাত টেনে ধরে নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভৈরবী। সাঁতরে গিয়ে ধরলেন কুন্তীর হাত। কুন্তীর মাথা থেকে পুঁটুলিটা পোপটভাই নিলেন। অমনি একটানে কুন্তীকে এধারে এনে কোমর-জলে দাঁড় করিয়ে দিলে ভৈরবী। কুন্তী নাকানি-চোবানি খেয়ে ঢোক-দুই জল গিললে। বরিশাল না থাকলে রাজস্থান টানের চোটে ভেসেই যেত। শুকনো ডাঙ্গায় সব কারবারই চলতে পারে কিন্তু জলে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না।
কূলে উঠে কাপড় নিংড়ে নিয়ে ভিজে কাপড়েই ঢুকলাম আমরা মা’র খাসমহলে। ভিজে কাপড় শুকোতে ক-মিনিটই বা লাগবে এখানে! সকলের কাছে আর একখানি করে নতুন কাপড় আছে, যা পরে ভোরবেলা মাকে দর্শন করতে হবে।
তারপর নীরবে নিঃশব্দে মহলের পর মহল পার হয়ে চললাম আমরা। শুধু দুই চোখ দিয়ে গিলছি সেই রহস্যপুরীর অদ্ভুত দৃশ্য আর অপরূপ সাজসজ্জা। মা’র রত্ন ভাণ্ডারের রক্ষক হচ্ছেন যক্ষরাজ কুবের। এ সেই কুবেরের পুরী, মা’র কাছে পৌঁছতে হলে আগে এই যক্ষপুরী পার হতে হবে।
ডাইনে বাঁয়ে পাহাড়, যক্ষপুরীর গগনস্পর্শী পাষাণ-প্রাচীর। নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো গড়েছে এ পুরী যক্ষরা। যক্ষদের নিজস্ব নির্মাণকৌশল, তার উপর যক্ষ পদ্ধতির উন্মত্ত রঙের খেলা। রঙের উপর রং ঢেলে দিয়েছে, মিলল কি মিলল না যক্ষ-পদ্ধতিতে সে-সবের বাছ বিচার নেই। শুধু রূপে বর্ণে আলোয় আঁধারে এমনটি হওয়া চাই যা একই সঙ্গে আনন্দ বিস্ময় আর আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে, যা দেখে বাহ্যজ্ঞান পর্যন্ত লোপ পায়। তবেই হবে যক্ষ শিল্পকলার চরম সার্থকতা।
এ পুরী গড়া হয়েছে বেশ সোজা কায়দায়। নানা রঙের পাথর গলিয়ে শুধু ঢেলেছে আর ঢেলেছে। সেই গলা পাথর ইচ্ছেমতো গড়িয়ে গড়িয়ে মিশেছে, একাকার হয়ে কিম্ভূতকিমাকার রূপ গ্রহণ করেছ। বহু ঊর্ধ্বে আকাশ রঙের ছাত, সেখান থেকে নেমে এসেছে দু-পাশের পাষাণ-প্রাচীর। পায়ের তলার মাঝেও নানা রঙের গলানো পাথরে তৈরি। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে চলেছি তো চলেছিই। মোড় ঘুরলেই সব যাচ্ছে পালটে, দু-পাশের পাষাণ-প্রাচীরের গায়ে আরও ভয়ঙ্কর নব চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই সমস্ত অমানুষিক নকশার না আছে কোনো অর্থ না কোনও ছাঁদ-ছন্দ। গলানো পাথরের তৈরি সেই সব অতিকায় মূর্তি যে কাদের তা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।
এদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মাথাটা নেই। কেউ ঝুলছে, কেউ বসে আছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটা হাতির মতো, কোনোটা কুমিরের মতো, কোনোটা প্রকাণ্ড তালগাছের মতো। বিকটাকার দানব আর রাক্ষস সব পাষাণ হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দু-পাশের গগলস্পর্শী পাষাণ-প্রাচীরের গায়ে। আর মাঝখানের ফাঁকটি জুড়ে রয়েছে নিরেট নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। সেই প্রাণহীন নিস্তব্ধতার মধ্যে আমরা ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।
চলতে চলতে মনে হতে লাগল হয়তো এই মুহূর্তেই যক্ষাধিপতির অদৃশ্য অঙ্গুলিসঙ্কেতে এই সব পাষাণ-মূর্তিরা নড়েচেড়ে উঠবে। পাষাণ-প্রাচীরের গা থেকে নেমে এসে দাঁড়াবে আমাদের পথ জুড়ে। কিংবা জুড়ে দেবে নিজেদের মধ্যে হিংস্র উদ্দাম হাতাহাতি। তখন? তখনকার অবস্থা কল্পনা করতে গিয়ে ভয়ে চোখ বুজে ফেললাম।
চোখ বুজে চলতে চলতে বার বার মন দিয়ে শোনবার চেষ্টা করছি এই পাষাণ প্রাচীরের অন্তরালে বসে কাঁদছে নাকি কোনো বিরহিণী যক্ষপ্রিয়া! কিংবা বাজছে নাকি কোথাও যক্ষরমণীর পদ-শিঞ্জিণী বীণা মৃদঙ্গ মুরলীর তালে তালে। বার বার মনে হতে লাগল এই যক্ষপুরীর রক্ষকেরা অন্তরীক্ষ থেকে আমাদের উপর নজর রাখছে। অনেকে আবার চলেছেও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না। এ চোখ দিয়ে তাদের দেখা যায় না। শিপ্রা নদীর তীরে মহাকালকে তপস্যায় তুষ্ট করে কালিদাস যে দৃষ্টিলাভ করেছিলেন, সেই দৃষ্টি লাভ করলে যক্ষ-যক্ষণীদের চাক্ষুষ দেখা যায়। আর তখন যক্ষপুরীর এমন বর্ণনাই করা যায়-যা শুনে লোকে সেখানে না গিয়েও সেই যক্ষপুরীর প্রত্যক্ষ ধারণা করে আনন্দলাভ করতে পারে ৷
একসময় ডান পাশের দেওয়াল পিছু হটে সরে যেতে লাগল। পায়ের নীচে দেখা দিল মাটি, ভিজে নরম মাটি। রোদ আর ছায়া, ছায়া আর রোদের লুকোচুরি খেলা চলতে লাগল। দেখা দিল দূর্বাঘাসের সবুজ চাপড়া, সব শেষে মস্ত বড় বড় রক্তকরবীর ঝাড়। সেই রক্তকরবীর ঝাড়ের ওপাশে একটি ক্ষীণ নির্ঝরিণী কুলকুল করে বয়ে চলেছে।
জলের ধারে পৌঁছেই রূপলাল চিৎকার করে উঠল, “শ্রীহিংলাজ মহামায়া কি–”
মায়ের সব-কটি সন্তান সমবেত কণ্ঠে উত্তর দিলে, “জয়!”
সামনেই হিংলাজ।
দু-তিন হাত চওড়া জলাধারটির অপর পারে আর একটি খাড়া পাহাড়। সেই পাহাড়ের কোলে ঠিক আমাদের সামনেই এক বিরাট গহ্বর। মুখের দিকটা অন্তত তিনতলা সমান উঁচু। ছাত ক্রমে ভিতর দিকে নেমে গেছে। নীচে কি আছে দেখা গেল না। জলের ওপরেই কয়েক ঝাড়া করবী গাছের আড়াল পড়েছে।
কাউকে বলে দিতে হল না এই হিংলাজের গুগা। প্রকৃতিদেবী স্বহস্তে সাজিয়ে দিয়েছেন মায়ের স্থান। সাজিয়েছেন অতি অল্প উপাচারে। তরতর করে বয়ে চলেছে একটি ক্ষীণ নির্ঝরিণী, আর কয়েক ঝাড় রক্তকরবীর গাছ। টকটকে লাল ফুল রয়েছে গাছে। বইছে শীতল হাওয়া। এতক্ষণে যে সরু পথটা দিয়ে ঘুরে ঘুরে এলাম তার মধ্যে এতটুকু হাওয়া ছিল না। দুপাশে পাহাড় তেতে ভিতরের হাওয়া আগুন হয়ে উঠেছিল। অঘোর নদী থেকে উঠে ভিজে কাপড়ে আমরা ঢুকেছিলাম পাহাড়ের মধ্যে। কাপড় শুকিয়ে কখন খরখরে হয়ে গেছে তা টেরও পাইনি। এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হিংলাজের শীতল স্পর্শে দেহ মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এখানে এলে সকলের জ্বালা সকল জুড়োবেই। স্বয়ং দক্ষকন্যা পতিনিন্দার জ্বালা জুড়োবার জন্যে এখানে এসে লুকিয়েছেন। ত্রিতাপ-জ্বালা জুড়োবার এর চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর কোথাও আছে নাকি!
তখন রূপলাল কাঁধ থেকে ছড়ি নামিয়ে সেখানে পুঁতলে। ছড়ি আর যাবে না। ছড়ির ওপারে যাওয়া নিষেধ। ছড়ি পুঁতে জলে নামল রূপলাল। তার পিছন পিছন আমরাও।
জল পায়ের গোছ পর্যন্ত উঠল। কিন্তু সাবধানে পা টিপে টিপে পার হতে হল। পাথরের উপর শেওলা পড়েছে। পা ফেললেই পিছলে যায়। অপর কূলে পা দিয়েই আবার রূপলাল চিৎকার করে উঠল-জয় শ্রীহিংলাজ মহামায়ী কি আবার সকলে একযোগে জয়ধ্বনি দিলে। এবার কিন্তু সেই ধ্বনি তখনই মিলিয়ে গেল না। গুম গুম করে ছুটে বেড়াতে লাগল গুহার মধ্যে। সেই জয়ধ্বনি শতগুণ হয়ে ফিরে এল আমাদের কানে। রূপলালের পিছু পিছু দু-ঝাড় রক্তকরবীর মাঝখানের সরু পথ দিয়ে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আঙিনায়। মুখ তুলে দেখলাম অনেক উঁচুতে লালচে পাথরের ছাত ঝুলে আছে আঙিনার উপর। সামনে কয়েক থাক সিঁড়ির মতো উপরদিকে উঠে গেছে, তারপর অন্ধকার গুহা। তখন সেই আঙিনার উপর সবাই সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ল।
অবশেষে সত্যিই পৌঁছলাম।
দুঃখ-কষ্ট, লাভ-লোকসান, এমনকি প্রাণের মায়া পর্যন্ত তুচ্ছ করে যার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম মরুভূমির বুকে, যার বলে বলীয়ান হয়ে এই এক পক্ষ দিনরাত অহরহ যুঝেছি মরণের সঙ্গে, যার দুর্নিবার আকর্ষণ এই অসম্ভব সম্ভব করলে, তার চরণতলে পৌঁছে এতটুকু উত্তেজনা উচ্ছ্বাস নেই মনের কোণেও। বরং একটা পরম নিশ্চিন্ত ভাব যেন পেয়ে বসল। হাত-পা সর্বাঙ্গ এলিয়ে পড়ল। কাঁধের ঝুলিটা একপাশে নামিয়ে গুহার সিঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।
অত বড় মহাতীর্থে পৌঁছে একটি অতি সাধারণ সহজ সরল ঘটনা মনে পড়ে মনকে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেললে। একবার অনেকদিন পরে বাড়ি গিয়েছি! বাড়ি যাবার জন্যে মা বার বার চিঠি দিচ্ছিলেন। কিন্তু ছুটি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ছুটি পেলাম, পেয়েই রওয়ানা। স্টিমার থেকে নেমে নৌকা পেলাম না। তাতে বড় বয়েই গেল। সাঁতার কেটেই মেরে দিলাম ক্রোশ তিনেক পথ। বাড়িতে ঢুকে কাকেও দেখতে পেলাম না। মা বোধহয় তখন ঘাটে গিয়াছেন-কিংবা ওপাশের রান্নাঘরে কিছু করছেন। তা আর ডাকাডাকি করব কি, দাওয়ায় উঠে নিশ্চিন্তে শরীর এলিয়ে দিলাম ৷ মা আসবেনই এধারে, এখনই। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে গেল। মাথার চুলের মধ্যে আঙুলের স্পর্শ পেলাম কার। মটকা মেরে পড়ে রইলাম। এ স্পর্শ অন্য কারও হতেই পারে না। এ আমার মায়ের হাতের স্পর্শ। এইটুকুর লোভেই এতটা পথ ছুটে এসেছি। ভিটকিলিমি করে চোখ বুজে পড়ে আছি, তখন কানে এল মায়ের গলার স্বর, “কখন এলি বাবা? একটা খবর দিয়ে আসতে হয়-ঘাটে নৌকো পাঠাতাম।” তবু চোখ বুজে চুপটি করে শুয়ে আছি। যতক্ষণ এভাবে থাকব, ততক্ষণ মা মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেবেন।
আবার কানে এল, শরীর ভালো আছে তো-রে খোকা? এসেই দাওয়ার উপর শুধু মাটিতে এভাবে শুয়ে পড়েছিস!” চাপা উৎকণ্ঠা মা’র গলায়। আর থাকতে পারলাম না, তড়াক করে উঠে বসে মায়ের পা দু-খানিতে হাত বুলিয়ে কপালে মাথায় ঠেকালাম। বললাম, ‘ভয়ানক শরীর খারাপ হয়েছে মা, পেটের ভিতর বলে যাচ্ছে। তোমার ছেলের সারা শরীরের মধ্যে ওই একটা জায়গাতেই যা কিছু খারাপ ভালো হয়-আর তখন খালি তোমার কথা মনে পড়ে। দাও আগে কি খেতে দেবে দাও, নয়তো অনর্থ বাধিয়ে বসব।”
মা হেসে ফেললেন। আমার নিজস্ব সম্পদ আমার মায়ের মুখের সেই হাসি, যার সঙ্গে দুনিয়ার আর কারও মায়ের হাসি মেলেই না। হেসে ফেলে মা বললেন, “তবে উঠে পড় না, হাত মুখ ধুয়ে নে। সেই তো কাল সকালে ভাত খেয়েছিলি, এতটা পথ হেঁটে এলি, খিদে পাবে না!”
তবু উঠছি না, জ্বলুক পেটে, তবু যতক্ষণ মা’র কাছে বসে থাকা যায়।
অনেকদিন পরে আজ আবার চোখ বুজে শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছি নিশ্চিন্ত হয়ে। মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে একটি প্রত্যাশায়। আজ আবার মা এসে পাশে বসে মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেবেন। আমার মা’র চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পাব, “কখন এলি বাবা, শরীর খারাপ করে নি তো?” তখন চোখ মেলেই মায়ের মুখের হাসিটি দেখতে পাব, যে হাসির সঙ্গে অন্য কারও মায়ের হাসি মেলেই না, যে হাসি আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ।
“নিন, বিড়ি নিন একটা।”
চোখ চাইতে হল। মায়ের হাসি কোথায় মিলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “দাও।”
বিড়ি ধরানো হলে রূপলাল বললে, “একটা মহা অন্যায় করলাম। অঘোরী বাবা ভয়ানক চটে যাবেন।
আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন, কি হল আবার?”
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে রূপলাল বললে, “এই যে সোজা আপনাদের এনে তুললাম মায়ের স্থানে, এইটেই অন্যায় হয়ে গেছে। নিয়ম হচ্ছে, দিনের বেলা ঝরনার ওপারে থাকতে হবে। লক্ষ করেননি বোধ হয়, খানিকটা রাস্তার ধারে জঙ্গলের মধ্যে একখানা পাথরের ঘর আছে। ওখানেই সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের থাকতে হবে। সেখানে রান্না খাওয়া সেরে সন্ধ্যার পর ঝরনা পার হওয়া হচ্ছে নিয়ম। আর ভোররাতে ব্রাহ্মমুহূর্তে মায়ের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে তৎক্ষণাৎ ঝরনা পার হয়ে ওপারে চলে যেতে হবে।
বললাম, “তা নিয়ে গেলে না কেন আমাদের সেই জঙ্গলের মধ্যেকার ঘরে? বেশ তো, সন্ধ্যা পর্যন্ত না হয় আমরা সেখানেই কাটিয়ে আসতাম। কি দরকার ছিল বেআইনী কাজ করবার?”
রূপলাল একান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিলে, “আরে রেখে দিন আপনার আইন কানুন। এবারের যাত্রায় চন্দ্রকূপে সব নিয়ম আমরা বিসর্জন দিয়ে এসেছি। নিয়ম হচ্ছে চন্দ্রকূপ বাধা দিলে আর এগোনো যাবে না। কতকগুলো লোকের ত পূজোই হল না সেখানে, বাবার হুকুমও নেওয়া হল না। তা কাউকে কি আমরা ফেলে এসেছি নাকি ওখানে? অঘোরী বাবাকে চন্দ্রকূপের ঘটনা বলে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি করা উচিত? সবাই কি যেতে পারবে ওধারে? বাবা বললেন, ‘আলবত পারবে। সোজা সবাইকে নিয়ে যা মায়ের স্থানে। তুই ব্যাটা কালকের বাচ্চা, তুই নিয়মের কি বুঝবি?’ তখন সবাইকে নিয়ে অঘোর নদী পার হয়ে চলে এলাম। কিন্তু দিন থাকতেই যে মায়ের গুহায় চলে এলাম, এতে হয়তো অঘোরী বাবা ভয়ানক চটে যাবেন।” বললাম, “তা বেশ তো এখন আবার চলো, সবাই চলে যাই সেই পাথরের ঘরে; আবার সন্ধ্যার পর আসা যাবে।”
রূপলাল বললে, হ্যাঁ, এখন আবার কেউ যেতে রাজি হবে নাকি সেখানে। সেখানে গিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে করতেই সন্ধে হয়ে যাবে। তার চেয়ে এক কাজ করুন, অঘোরী বাবা যদি জিজ্ঞাসা করেন, কেন দিনের বেলা এলি এখানে, তখন আপনাকে আমি দেখিয়ে দেব, বলব কি করব, এই দলের মোহন্ত যদি জেদাজেদি করেন দিনের বেলা এখানে আসবার জন্যে, তখন আমি ছড়িদার পাণ্ডা মানুষ-আমি কি করতে পারি। তারপর আপনি সামলাবেন।”
কিছুক্ষণ চুপ করে ছোকরার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর বললাম, “বেশ, তাই হবে। অঘোরী বাবাকে আমি সামলাব। তুমি তোমার যাত্রীদের সামলাও। ঝরনার এপারে কেউ যেন থুতুও না ফেলে। যার যা দরকার হবে ওপারে গিয়ে করে আসবে।”
রূপলাল উঠে গেল সবাইকে সাবধান করতে। সুখলাল এসে বললে, “চলুন আবার ঝরনার ওপারে। ওখানে চা বানানো হয়ে গেছে।
“এখানেও চা বয়ে এনেছ তুমি?”
সুখলাল প্রসন্ন হাসি হেসে বললে, “শুধু চা কেন, মায়ীজি কিশমিশ খেজুর আখরোট সব এনেছেন চিরঞ্জীলালের ঘাড়ে চাপিয়ে। সবাই ওপারে চলে গেছে, সেখানে জল খেয়ে তবে আবার আসবে।”
উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখি একটি প্রাণীও নেই। শুধু ঝুলিগুলি পড়ে আছে। সুখলালের হাত ধরে শেওলা-পড়া পাথরের উপর সাবধানে পা ফেলে আবার সেই তিন হাত জল পার হলাম।
এপারের একটা পরিষ্কার জায়গায় কুন্তী চা চড়িয়েছে ছোট ডেকচিটায় ৷ তার পাশে ভৈরবী আঁচল পেতে শুয়ে পড়েছেন। আর সবাই চারিদিকে ঘিরে বসেছে। বড় কলকেয় আগুন দেয়া হয়েছে। বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত ভাব সবাই-এর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে–যেন ছুটির দিনে চড়ুইভাতি করতে এসেছে সবাই। পোপটভাই সাদর অভ্যর্থনা করলেন–”আসুন আসুন বসে পড়ুন এধারে।” বললাম, “তবে যে শুনেছিলাম আমরা আজ উপোস করে থাকব? শুয়ে শুয়েই ভৈরবী উত্তর দিলেন “কেন? উপোস করে মরতে যাব কেন গুষ্টিসুদ্ধ সবাই মায়ের স্থানে এসে? আজ ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করবার দিন। কিছু নেই সঙ্গে, তা আর কি করা যাবে। যা আছে তাই এক এক মুঠো খেয়ে জল খাওয়া যাক। সেই ভোররাতে দর্শন, ততক্ষণ না খেয়ে শুকিয়ে থেকে কি লাভ।
উপোস করে থাকলে কি লাভ হয় আমিও জানি না; উপোস-তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান আছে ডাক্তারদের, যাঁরা পঞ্জিকা ছাপান তাঁদের, আর দেশের সরকারি কর্তাদের। প্রথম দল বলেন, উপোস করলে রোগ সারে। দ্বিতীয় দল বিধান দেন, উপোসে পাপ কমে। আর তৃতীয় দল আইন বানান, কম খাও, উপোস করো, মুখ বুজে উপোস করে মরো, পেট ভরে খেতে চাওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তা আমি ওই তিনদলের কোনো দলে স্থান পাব না। কাজেই মাথা চুলকোতে লাগলাম।
শ্রীমতী কুন্তীদেবী একাই একশ। কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছুটোছুটি করছে। একে আরও দুটো খেজুর, ওকে কিশমিশ একমুঠো বেশি, আবার কাউকে বা শুধু মিষ্টি ধমক দিয়ে সন্তুষ্ট করছে। শুয়ে শুয়েই ভৈরবী সাবধান করে দিলেন, “সব দিয়ে ফেলিস না, সুখলালের জন্য কিছু যেন থাকে। রাতে আবার ওকে খাওয়াতে হবে।”
চায়ের গেলাস হাতে করে বসে বসে দেখছি আর ভাবছি, ফিরে গিয়ে কোথাও আশ্রম ফাঁদলে এ মেয়ে বেশ চালাতে পারবে। শুধু এ মেয়ে নয়, পৃথিবীসুদ্ধ মেয়েরাই এই একটিমাত্র কাজ সহজে সুশৃঙ্খলে অবলীলাক্রমে সমাধা করতে পারে, আর তা করে তৃপ্তিও পায়। যদি বলি গৃহের মধ্যে গৃহিণীপনা করাতেই নারীজীবনের চরম সার্থকতা, তাহলে আমারও যেমন বাড়াবাড়ি করা হবে, তেমনি অবিলম্বে লগুড় হাতে তেড়ে আসবেন আর একদল, যাঁরা কায়মনবাক্যে কামনা করেন যে ভবিষ্যৎ হাওড়া পুলের মাথাটা যখন জোড়া হবে, তখন সেখানে উঠে ঝুলতে ঝুলতে হাতুড়ি-ঠোকা কর্মটি দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী ভ্রাতাদের বদলে বেণী-ঝোলানো মেয়েরাই করবে। তা করুক, আর তাতে যদি মেয়ে-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে বিটকেল খেয়োখেয়িটা ঠাণ্ডা হয় তো হোক। তবু সবিনয়ে নিবেদন করব যে, যতদিন না সারা দুনিয়ার সবাই হোটেলে খেতে আর সরাইখানায় শুতে শুরু করছে ততদিন গৃহ থাকবেই। তখন গৃহ বাঁধলেই প্রয়োজন হবে গৃহিণীর। ওর একটিকে ছেড়ে অপরটির কোনো সার্থকতা নেই।
দেশময় বড় বড় হোটেল আর প্রসূতিভবন বানাতে পারলে রান্নাঘর আর আঁতুরঘরের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচব এ কথা আমিও মানি। ঘর-থেকে-মুক্তি-পাওয়া মেয়েরা কামান বন্দুক এরোপ্লেন চালিয়ে কত বড় বড় বীরত্ব দেখাচ্ছেন সে সব কাহিনী শুনতে শুনতে আমারও সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তখনকার গার্গী-মৈত্রেয়ী আর এখনকার অনারেবল মিনিস্টার শ্রীমতী লক্ষ্মীহীরা সুব্রহ্মণ্য আয়ার এম ডি, ডি টি এম, ডি এস-সি, পি এইচ ডি-এঁদের সকলের কাছেই আমি শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কথাও ভুলতে পারি না, যাঁরা কোটি কোটি গৃহের মধ্যে মা বোন স্ত্রী কন্যা রূপে নীরবে নিঃশব্দে সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন শুধু এত বড় মনুষ্যসমাজকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে। এঁরা ঘরে বন্ধ রয়েছেন এই দুঃখে কত ঘটি চোখের জল যে এ পর্যন্ত পড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও কত ঘটি পড়বে তার ইয়ত্তা নেই। তবু ভেবে পাই না এঁরা সবাই যেদিন ঘর ছেড়ে পথে নেমে দাঁড়াবেন, সেদিন ঘরের প্রাণ থাকবে কেমন করে! মা বোন স্ত্রী কন্যা এঁদের কাছে যা আমরা চাই আর পাই তা তখন পাওয়া যাবে কোথায়? এত বড় প্রয়োজনের দাবি সেদিন মেটাব কি দিয়ে? হাওড়া পুলের মাথায় দাড়ির বদলে বেণীকে হাতুড়ি ঠুকতে দেখেই কি তখন আমরা ঘরের অভাব ভুলতে পারব?
চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সেই কথাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আমাদের এই পুণ্যকামী দলটিতে একটি কুম্ভী বহিনের অভাব সত্যিই ছিল। ভাগ্যক্রমে কুম্ভী এসে জুটেছিল আমাদের সঙ্গে। তা না হলে এই মায়ের স্থানে এসে আজ আমরা গোমড়া মুখ করে কলকে হাতে নিয়ে আত্মচিন্তায় ডুবে থাকতাম, কিংবা কখন রাতটা শেষ হবে আর মায়ের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা এ স্থান থেকে বিদায় নেব সেই চিন্তায় ছটফট করতাম। তাতে তীর্থস্থানের মর্যাদা হয়তো ষোল আনাই রক্ষা পেত, কিন্তু এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে এখানে পৌঁছে কতটুকু শান্তি আর আনন্দ লাভ করতাম আমরা তা কে বলতে পারে। ওই যে ওই মেয়েটিকে ঘিরে বসে ছেলেমানুষের মত “কুন্তী বহিন, আমায় আরও দুটো খেজুর দাও, আমায় আরো দুটো আখরোট দাও” বলে হই-চই করছে সকলে, ও না এলে এ সমস্ত তো কিছুই হত না এখানে। বিজ্ঞ লোকে বলেন- “যদি ওই সমস্তই চাও, তবে অত কষ্ট করে অত বড় মহাতীর্থে কেন গেলে বাপু? লেকের ধারে গেলেই তো পারতে।” তাঁদের চেয়ে বিজ্ঞ যাঁরা, যাঁরা বলেন ‘নারী নরকের দ্বার’, তাঁরা নাক সিঁটকে বলে উঠবেন, ‘ছি ছি ছি, ওখানে গিয়েও ওই সব হ্যাংলামো গেল না?’ এঁদের কথা মাথা নিচু করে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু এই যে আজ এতগুলি সন্তানের হাসি চিৎকার আনন্দ উল্লাসে মায়ের স্থানটি গমগম করছে, জগৎজননীর কাছেও কি এর কোনো মূল্য নেই? মা কি সত্যই এ কামনা করেন যে, তাঁর প্রতিটি ছেলেমেয়ে অযথা জ্ঞানার্জন করে গোমড়ামুখো কাঠগোঁয়ার হয়ে উঠুক, হয় জননীর জাতকে ঘৃণা করতে শিখুক, নয় বিলাসের উপকরণ বলে মনে করুক? আমরা আজ আনন্দময়ী মায়ের স্থানে এসেও যদি একবার প্রাণ খুলে না হাসতাম, শুধু ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ ইত্যাদি বড় বড় তত্ত্ব আলোচনায় চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করে সময়টুকু কাটিয়ে দিতাম, তাহলে কি সত্যই জননী খুশি হতেন?
মা যে কিসে খুশি হন আর কিসে হন না এ এক সমস্যা বটে। সেই রাত্রেই হিংলাজের আঙিনায় শুয়ে বোধ হয় এ মহাসমস্যার একটা সহজ সমাধানও পেয়েছিলাম।
চাদর মুড়ি দিয়ে সকলেই শুয়ে পড়েছে মা’র আঙিনায়। শেষরাতের দিকে অঘোরী বাবা যখন আসবেন তখন উঠে স্নান করে নতুন কাপড় পরে ব্রাহ্মমুহূর্তে মায়ের গুহায় ঢুকতে হবে। নিশ্চিন্ত হয়ে সকলে শুয়ে বসে আছি। রূপলাল আর সুখলাল ওধারে মায়ের জন্যে ভোগ রাঁধছে। আমার পাশে বসে পোপটভাই আর ভৈরবী বকবক করছেন। সবই কানে আসছে।
প্যাটেল জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে কুন্তী কি আপনার সঙ্গেই থাকবে মা? ওকে নিয়ে গিয়ে কোথায় দেবেন আপনারা?
ভৈরবী বললেন, “ওমা, আমার কাছে থাকবে না তো বাছা যাবে কোথায়?”
একটু চুপ করে থেকে পোপটভাই বললেন, “কিন্তু আপনি জানেন তো, মেয়েটার জাত গেছে। স্বভাব চরিত্রও ভালো নয়। সেই ছোকরা থিরুমল ওর-”
ভৈরবী তাঁকে থামিয়ে বললেন- “জানি, সবই জানি বাবা। কিন্তু সে সমস্ত হাঙ্গামা তো আমার সঙ্গে দেখা হবার আগেই ঘটে গেছে ওর জীবনে। তার হিসেব নিয়ে আমার মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? সে হিসেব মায়েরা রাখে না। তা রাখলে কুন্তী এল কি করে এখানে? জগৎজননী সতী-মায়ের এই স্থান। সেই মা তো ওর উপর দয়া করলেন। তাঁর দয়ায়ও শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছল এখানে। এর পরেও কি ওর কোনো পাপ থাকতে পারে নাকি? আর জাতের কথা বলছ বাবা-মায়ের কাছে ছেলেমেয়ের কিছুতেই জাত যায় না। মায়ের কাছে সন্তানের আবার ভিন্ন ভিন্ন জাত আছে নাকি! মায়ের কাছে ছেলেরা হচ্ছে ছেলের জাত। আর ছেলের কাছে মায়েরা হচ্ছে মায়ের জাত। তা কুন্তী তো আমায় মা বলেছে। ওর জাত গেলে আমারও যে জাত থাকে না!”
পোপটভাই-এর আরও প্রশ্ন ছিল, “কিন্তু ওর কি কিছু হবে মা? দেখবেন আবার ও কারও সঙ্গে একটা কিছু করে আপনার অপমান করবে।”
শব্দ করে হেসে উঠলেন ভৈরবী। বললেন, ‘আমার আবার অপমান করবে কি ও বেটী? কারও সঙ্গে আবার যদি কিছু ঘটায় তাতে আমার কি ক্ষতি হবে? ও নিজেই আবার জ্বলেপুড়ে মরবে। যতদিন হেসে খেলে মেয়ের মতো আনন্দ করে থাকবে আমার কাছে, ততদিন আমি ওকে বুকে দিয়ে আগলে রাখব। যেদিন ও আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য কিছু নিয়ে মেতে উঠবে সেদিনও আমি বাধা দেব না। ছেলেমেয়েরা কি চিরকাল মাকে নিয়ে ভুলে থাকতে পারে বাবা? তা কখনো সম্ভব নয়। না হয় একটু ঘা খেয়েছে, তা বলে ওতেই ওর চিরকালের জন্যে সংসারের উপর ঘেন্না হয়ে গেছে? এতটা আমি আশা করব কেন? পাঁচজনের পাঁচরকম দেখে ও যদি তখন নিজের ভালোমন্দ বুঝে আবার কারও সঙ্গে পা বাড়ায়, তাতে আমার কি ক্ষতি হবে? যে কদিন ও আমার কাছে থেকে নিজে শান্তি পাবে, ততদিন আমিও শান্তি পাব ওকে নিয়ে। তারপর ও কোথাও ভালো ভাবে শান্তিতে আছে এইটুকু জানতে পারলেই আমার শাস্তি।”
আরও অনেকে কথাবার্তা হল ভৈরবীর সঙ্গে পোপটলালের। কিন্তু আর আমার কানে কিছু ঢুকল না। আমি তখন চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে মাকেই বার বার বলতে লাগলাম, ‘তাই করো মা, তাই করো। আমরা যেন কেউ কাকেও ছোট বা বড় না দেখি। ওই বরিশেলে অজমূর্খ ভৈরবীর মুখ দিয়ে যা তুমি আজ আমায় শোনালে, জগৎজোড়া তোমার সব কটি ছেলেমেয়ে যেন ওইটুকু মেনে চলে। মায়েরা হচ্ছে মায়ের জাত আর ছেলেরা হচ্ছে ছেলের জাত। ছেলেমেয়ে যতদিন মাকে নিয়ে ভুলে থাকে ততদিন মায়ের শান্তি। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ছেলেমেয়ের জাত গেলে মায়েরও যে জাত যায়। পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এই সব বিদঘুঁটে সমস্যার এর চেয়ে সহজ সরল সমাধান আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে!
ঘোর অন্ধকার।
রাত্রির শেষ প্রহর। ঝরনার জল ঘটি করে মাথায় ঢেলে স্নান করে নতুন কাপড় পরে অনেকগুলো ধাপ উঠে আমরা গুহার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। গুহার একেবারে শেষ সীমায় মা হিংলাজের বেদী, অনেক উঁচুতে ছাত। একটিমাত্র প্রদীপ জ্বলছে বেদীর উপর। তাতে ছাদের নীচে আর বেদীর চারপাশে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। প্রদীপের আলোয় দেখা যাচ্ছে লাল সালুতে মোড়া বেদী। মেওয়া মিছরি নারকেল সাজানো হয়েছে বেদীর উপর। মাঝখানে বসানো হয়েছে ঘি আটা চিনি আর মেওয়া দিয়ে বানানো মস্ত বড় লোটাটা। অনেকগুলো রক্তকরবী ফুল ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে চারপাশে। মোমবাতিগুলোও বসানো হয়েছে বেদীর চতুর্দিকে, এখনও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়নি। রূপলাল আর সুখলাল তখনও কি করছে বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে।
আমরা বেদীর সামনে জোড়হাতে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছি। বার বার নজর করে দেখবার চেষ্টা করেছি কি আছে বেধীর ওধারে! আরও কতদূর যাওয়া যায় ওই অন্ধকারের মধ্যে? বেদীর পিছনের ওই অন্ধকারের মধ্যেই কি জ্যোতিদর্শন হবে? চোখের পলক পড়ছে না, রুদ্ধ নিশ্বাসে চেয়ে আছি-কখন জ্যোতিদর্শন হবে!
অনেকক্ষণ ওই ভাবে কাটল। হঠাৎ কানে গেল, ‘বাচ্চা, এখন সময় হয়েছে। শরীরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কে বললে ও কথা? কিসের সময় হয়েছে? কি হবে এবার?
বেদীর উপর থেকে রূপলাল প্রদীপটা তুলে নিল। প্রদীপ হতে আমাদের সামনে দিয়ে বাঁ দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। এবার কানে এল রূপলালের গলার স্বর
“প্রথমে আসুন স্বামীজি মহারাজ। আপনি এই দলের মোহন্ত। আপনাকেই সর্বপ্রথম যেতে হবে মায়ের গুহার মধ্যে।”
এগিয়ে গেলাম রূপলালের কাছে। ভৈরবীও এসে পাশে দাঁড়ালেন।
হাতের প্রদীপটা রূপলাল নিচু করে ধরলে। তখন চোখে পড়ল প্রদীপের পিছনে দেওয়ালের গায়ে একটি ছোট গহ্বর।
সেই গহ্বরের মুখে প্রদীপ ধরে রূপলাল বললে-’এই হচ্ছে মা হিংলাজের গুহা। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে এই গুহার মধ্যে। এই গুহার এধারে একটা মুখ আর একটা মুখ বেদীর ওপাশে। এই গুহার উপরই বেদী, মায়ের আসন। কোনো ভয় নেই, সাবধানে আস্তে আস্তে যাবেন। মাথায় যেন পাথরের ঘা না লাগে। যান, ঢুকুন এবার।”
প্রদীপটা আরো একটু নামিয়ে ধরলে রূপলাল।
সেই অন্ধকার গুহার মধ্যে একবার চাইলাম। পিছন করে ভৈরবীর মুখের দিকে চাইলাম। অন্ধকারে তাঁর মুখ দেখা গেল না। প্রদীপশিখাটার দিকে চেয়ে রইলাম। আবার কানে এল রূপলালের গলা–
“যান, চলে যান এবার। মাকে দর্শন করে আসুন।”
‘মাকে দর্শন করে আসুন’ কথাটা শুনে সর্বশরীরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ ছুটে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের মুখখানি। সেই আধ হাত চওড়া লালপাড় শাড়ির ঘোমটা, কপালে ডগডগে সিন্দুরের ফোঁটা, একমুখ পানদোক্তাসুদ্ধ আমার মায়ের মুখের সেই হাসি, আমার মায়ের সেই চোখের দৃষ্টি! আমার দিকে চেয়ে মা হাসছেন। বসে পড়লাম হাঁটু গেড়ে গুহার মুখে। এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লাম।
বোধ হয় পাঁচ মিনিটও নয়। হঠাৎ বেরিয়ে এলাম বেদীর এপাশে। প্রদীপ হাতে রূপলাল এধারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার সে হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। কানে এল-”যা কিছু দেখতে পেয়েছিস গুহার মধ্যে, জীবনে তা কথা না প্রকাশ করিসনি কারও কাছে। সাবধান ব্যাটা, মায়ের এ আদেশ ভুলবি না।”
আবার চমকে উঠলাম। কে বললে এ কথা? এবার কিছুই ভুল হল না। অন্ধকারের মধ্যে নজর করে দেখতে পেলাম আমার দু হাত দূরেই বেদীর পাশে গুহার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অঘোরী বাবা মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কালো আলখাল্লায় তাঁর সর্বাঙ্গ ঢাকা। সাদা চুলদাঁড়ির জন্যে তাঁকে চেনা গেল ৷
রূপলাল বললে, “এবার স্পর্শ করুন মায়ের বেদী। আপনার মালা দুগাছা মায়ের বেদীর উপর দিন।”
দু-হাতে মায়ের বেদী স্পর্শ করলাম। মালা আমার নেই। সন্ন্যাসীর কিছুই থাকতে নেই যে। বেদীর উপর মাথা ঠেকিয়ে পিছিয়ে এলাম।
প্রদীপ হাতে আবার ওপাশে চলে গেল রূপলাল। এবার ভেরবীর পালা। পাঁচ মিনিট পরে ভৈরবীও বেরিয়ে এলেন একপাশের মুখ দিয়ে। দু-ছড়া মালা রাখলেন বেদীর উপর। তার একছড়া তুলে নিয়ে রূপলাল ভৈরবীর হাতে দিলে। বললে, “গলায় দিন মালা। এ মালা যতদিন গলায় থাকবে ততদিন মা হিংলাজের দয়ায় কোনো বিপদ-আপদ হবে না। মায়ের দয়ায় সমস্ত আশা পূর্ণ হবে।”
মালা গলায় দিয়ে কি জানি কেন ভৈরবী আমার পায়ে একটা প্রণাম করলেন।
রূপলালের গলা শোনা গেল, “কুন্তী বহিন, এসো এবার।” তারপর একে একে সকলের নাম ডাকা হতে লাগল। দাঁড়িয়ে আছি প্রদীপশিখার দিকে চেয়ে। চেয়ে থাকতে থাকতে একটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটল। প্রদীপশিখাটা আমার মধ্যে জ্বলতে আরম্ভ করল। আরও কিছুক্ষণ পরে আমি নিজেই সেই শিখার সঙ্গে মিলিয়ে গেলাম। এখন আর কিছুই নেই, শুধু সেই শিখাঁটি। স্থির অচঞ্চল এক আঙুল উঁচু সেই শিখা। ক্রমে সেই শিখার তেজ বাড়তে লাগল, বাড়তে বাড়তে তার উজ্জ্বলতা এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে তার দিকে চেয়েই থাকা যায় না। টপ করে চোখ বুজে ফেললাম। এবং এ জীবনের মারাত্মক ভুল হল সেই চোখ বুজে ফেলা। তৎক্ষণাৎ আমি আর প্রদীপশিখা আলাদা হয়ে গেলাম। সব শেষ হয়ে গেল। আবার যেখানকার মানুষ সেখানেই ফিরে এলাম।
ছড়িওয়ালা রূপলাল তখন বলছে, “এবার যান আপনারা, নিজের নিজের ঝোলা কাঁধে নিয়ে দাঁড়ান বাইরে গিয়ে। কোনো জিনিস যেন পড়ে না থাকে। সূর্যদেব উদয় হচ্ছেন। হিংলাজের মোহন্ত মহারাজ এবার আপনাদের এই তীর্থের সর্বশেষ দর্শন যেটি সেটি করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আপনারা হিংলাজের দিকে পিছনে ফিরে ঝরনা পার হয়ে ওপারে চলে যাবেন। সাবধান, কেউ ভুলেও মায়ের স্থানের দিকে আর ফিরে চাইবেন না–”
আর একবার শেষবারের মতো হিংলাজের বেদীর দিকে ফিরে চাইলাম। কিছুই নেই আর সেখানে। শুধু লাল সালুর উপর রক্তকরবী ফুলগুলি ছড়ানো রয়েছে। প্রদীপটিও নেই, তার বদলে বেদীর চতুর্দিকে জ্বলে উঠেছে অনেকগুলি মোমবাতি মোমবাতির আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল সব কিছু। বেদীর উপরের ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে, ত্রিশূলের পিছনেই পাথর। ওই পাথর আর পাথর আর পাথর-এবড়ো খেবড়ো পাথরের চাঙড়, কদর্য-বীভৎস। একেবারে উঠে গেছে ছাত পর্যন্ত মোমবাতির আলোয় সবই স্পষ্ট দেখা গেল। আর কোনোরকমে ভুল ধারণা করবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নেই। আর কিছুই আশা করা করবার নেই এখানে। এবার জলজ্যান্ত সত্যর জগতে ফিরে এলাম। মা হিংলাজের গুহার উপর ওই বেদী। মা হিংলাজের গুহা কিন্তু চিরঅন্ধকারময়। সেই অন্ধকার জগতে ফিরে যাওয়া যাবে না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বেদীর উপর কপাল ঠেকিয়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর ধাপগুলোর উপর দিয়ে নেমে এলাম আঙিনায় এবং ফেলে রেখে যাওয়া ঝোলাঝুলি আবার কাঁধে তুলে নিলাম।
“এবার সকলে চোখ তুলে চেয়ে দেখো এই পাহাড়ের চূড়ায়” বললেন অঘোরী বাবা। বাবা বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ধাপগুলোর মাথায় গুহার সামনে। মালাসুদ্ধ হাতটি উঠিয়ে আবার বললেন তিনি, “ঐ উপর দিকে চেয়ে দেখো। কী দেখছ?”
আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের মাথায়। আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখছি একখানা প্রকাণ্ড পাথর। পাথরখানা বেশ খানিকটা বেরিয়ে এসেছে পাহাড়ের গা থেকে।
‘দেখছ সকলে ভালো করে চেয়ে দেখ ওই পাথরের গায়ে কি আঁকা আছে। ওখানে পাহাড়ের গায়ে আঁকা আছে চন্দ্র আর সূর্য! ভগবান রামচন্দ্র এঁকে দিয়ে গেছেন নিজ হাতে। তিনি যে এখানে এসেছিলেন তার চিহ্ন রেখে গেছেন পাহাড়ের গায়ে চন্দ্র-সূর্য এঁকে দিয়ে। ভেবে দেখো, কি করে ওই অসম্ভব সম্ভব হল-কি করে ওই অত উঁচুতে পাথর কেটে চন্দ্র-সূর্য আঁকলেন তিনি। এ কি অন্য কারও দ্বারা সম্ভব? ওই অসম্ভব কাজ একমাত্র ভগবান রামচন্দ্রের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। এই পৃথিবীতে যতকাল চন্দ্র-সূর্য থাকবে ততকাল এই হিংলাজ পাহাড়ের চূড়ায় আঁকা চন্দ্র সূর্যও থাকবে। আর মানুষ এখানে এসে চাক্ষুষ প্রমাণ পাবে যে, একসময় ভগবান শ্রীরামচন্দ্রও এই তীর্থ দর্শন করতে এসেছিলেন। রাক্ষস রাবণ ছিল ব্রাহ্মণসন্তান। রাবণ বধ করে রামচন্দ্রের ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়েছিল। সেই পাপ থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন এখানে জ্যোতিদর্শন করে।”
অঘোরী বাবা থামলেন। আমরা আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে রইলাম পাহাড়ের কপালের উপর। হ্যাঁ, আছেই তো! গোল দুটো কি যেন আঁকা রয়েছে যেখানে। আলো এসে পড়েছে তার উপর। লাল হয়ে উঠেছে সেখানটা। ভগবান রামচন্দ্রের আঁকা চন্দ্র এসে পড়েছে তার উপর। লাল হয়ে উঠেছে সেখানটা। ভগবান রামচন্দ্রের আঁকা সূর্যের গা থেকে ছটা বেরুচ্ছে। সত্যই ভেবে পাওয়া যায় না ওখানে পৌঁছলেনই বা কি করে, আর পাহাড়ের গায়ে ছেনি দিয়ে হাতুড়ি ঠুকে ও-কাজ করলেনই বা কিসের উপর দাঁড়িয়ে! সবই সম্ভব। ভগবানদের দ্বারা সব সম্ভব। ছুঁচের গর্তে হাতী চালানো যখন সম্ভব, তখন কি সম্ভব তাঁর দ্বারা! শুধু মানুষের বুদ্ধিবিবেচনাগুলোকে একটু ভোঁতা করে নেওয়া চাই। তা হলেই হল। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
অঘোরী বাবা বলতে লাগলেন আর সকলে সমস্বরে আওড়াতে লাগল এক লম্বা ফিরিস্তি- আমি অমুকের ছেলে অমুকের নাতি-আমি হাব নদীর ধারে সন্ন্যাস নিয়ে তবে হিংলাজ দর্শনে যাত্রা করেছি। সে সন্ন্যাস আমি এখনও রক্ষা করছি। আমি গুরুশিষ্যের স্থানে জল দিয়েছি, চন্দ্রকূপে গিয়ে বাবার আদেশ নিয়েছি। আরও কত কি করেছি সে সব বলে শেষ করে তারপর হিংলাজের গুহায় ঢুকে মাকে দর্শন করেছি। সুতরাং আমার যাবতীয় জ্ঞাত অজ্ঞাত পাপ, সেই পাপেদের আর এক প্রস্থ লম্বা ফর্দ বলে তারপর বলতে হবে জন্ম-জন্মান্তরে পাপের কথা-সেই সমস্ত পাপ বিলকুল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল মাতৃদর্শনের ফলে।
অঘোরী বাবা মালসুদ্ধ ডান হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন, “তোমাদের জয় হোক। যাও, এবার বাড়ি ফিরে যাও।”
তিনবার জয়ধ্বনি দিয়ে আমরা পিছনে ফিরলাম। রক্তকরবীর ঝাড়ের মাঝখানে সরু পথ দিয়ে বেরিয়ে এসে ছোট ঝরনাটি পা টিপে টিপে সাবধানে পার হলাম।
মনটা ভয়ানক ভার হয়ে উঠল। কেন? এ ‘কেন’র উত্তর দেওয়া সহজ নয়। সব ‘কেন’র উত্তর খুঁজে পেলে দুনিয়ার সব কিছুর মূল্যও কমে এই এতটুকু হয়ে যেত।
হিংলাজ দর্শন করলে আকাশগঙ্গাও দর্শন করতে হয়। ঝরনার এপার এসে আবার আমরা কাঁধের ঝুলি নামালাম। রূপলাল কপালে সিন্দূর দিয়ে হাতে হিংলাজের প্রসাদ দিলে সকলকে-মেওয়া মিছরি নারকেল লোটের টুকরো। এবার চলো সকলে আকাশগঙ্গায়। এই পাহাড় ভেঙ্গে উঠতে হবে। এই পাহাড়ের মাথায় আকাশগঙ্গা। সেই আকাশগঙ্গার জলই নেমে আসছে ঝরনা দিয়ে। আকাশগঙ্গাও মহাতীর্থ 1 আকাশগঙ্গার ধারে আছে এক রকমের গাছ, যার ডাল নিয়ে আসতে হবে। সে জিনিস চক্ষুরোগের মহামূল্যবান ওষুধ; আকাশগঙ্গার জল দিয়ে সেই ডাল ঘষে চোখে অঞ্জন দিলে কানাও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।
তা পাক। কানাদের দৃষ্টিশক্তি ফেরাবার জন্যে আবার এখন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এই পাহাড়ের মাথার চড়বার শক্তিসামর্থ্য নেই ভৈরবীর। আকাশগঙ্গার জল নেবার মতো কিছু নেইও আমাদের সঙ্গে। খামকা আর কষ্ট না করে ভৈরবী এখানে বসেই একটু বিশ্রাম করবেন, যতক্ষণ না আমরা আকাশগঙ্গা থেকে ফিরে আসি।
রূপলাল বললে, “আমরা তো আর এধার দিয়ে ফিরব না। আকাশগঙ্গা থেকে আর একটা পথ আছে, অঘোর নদী পর্যন্ত। সেই পথেই আমরা নেমে যাব।”
কুন্তী বললে, “ঠিক হ্যায়। আমরাও একটু আরাম করে নিয়ে চলে যাচ্ছি নদীতে আমরা নদী পর্যন্ত যেতে পারব, এ পথ তো সোজা চলে গেছে নদীতে। কোনো কষ্ট হবে না আমাদের।”
সুতরাং আমিও বললাম, “তবে সেই ভালো। যাও তোমরা আকাশগঙ্গায়। আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব।”
রূপলাল বললে, “উহুঁ-অপেক্ষা করবেন কেন আমাদের জন্যে? আপনারা যেখানে নদী পার হবেন আমরা তো সেখানে পার হব না, তার অনেক উপরে নদী পার হব। আপনার নদী পার হয়ে অঘোরী বাবার স্থানে চলে আসবেন। আপনারা যেখানে পার হবেন নদী, সেখান থেকে নদীর উপর দিকে খানিকটা গেলেই অঘোরী বাবার স্থান। অঘোরী বাবার স্থানে আমরা আপনাদের জন্যে বসে থাকব।”
তখন ভৈরবী বার বার সাবধান করলেন, সুখলাল যেন কোথাও আছাড়টাছাড় না খায়। রূপলাল, পোপটভাই আমাদের সাবধান করলেন সাবধানে যেন আমরা যাই, নদীটা যেন সাবধানে পার হই, আর বেশি দেরি যেন না করি।
ওরা আর একবার জয়ধ্বনি দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরাও একটু পরে উঠে এলাম। তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে মায়ের প্রসাদ খাওয়া যাবে।
আবার সেই যক্ষপুরীর ভিতর ঘুরতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু এবার আর তত ভয়ঙ্কর মনে হল না দু-পাশের পাহাড়ের দৃশ্য। পথও চট করে ফুরিয়ে গেল। সামনেই অঘোর নদী। এ ঠিক সেই জায়গা যেখানে আমরা আসবার সময় নদী পার হয়েছিলাম।
এবার একটা মতলব ঠাওরানো হল যাতে কুন্তীকে আর নাকানি-চোবানি খেয়ে জল গিলতে না হয়। কুন্তী আমাদের মাঝখানে দুজনের কাঁধ ধরে ঝুলে থাকবে-সেই অবস্থায় তাকে নিয়ে আমরা নদী পার হয়ে যাব। তাই হল, সুশৃঙ্খলে নদী পার হওয়া গেল। শুধু নদীর মাঝখানে আমাদের দু-জনের কাঁধে ঝুলতে ঝুলতে কুন্তী বারকতক চিল-চেঁচালে।
নদীর এপারে উঠেও জল খাওয়া হল না। নদীর জলও খুব ঘোলা। ঠিক হল অঘোরী বাবার আশ্রমে পৌঁছে জল খাওয়া হবে, অঘোরী বাবার আশ্রমে নিশ্চয়ই পরিষ্কার জল মিলবে। তখন চলতে আরম্ভ করলাম নদীর উজানের দিকে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম সূর্য পোয়াটাক পথ এগিয়ে এসেছেন ৷
চলছি তো চলছিই। বার বার ডান দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছি। কই, কোথাও পিছু নেই! বালির পাড় ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। তখন বাধ্য হয়ে আমরা সেই উঁচু পাড়ের উপর উঠলাম। নদীর জল অনেক নীচে রয়ে গেল।
সেই উঁচু বালির পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে নজর করে দেখলাম। কই, কোথাও কিছু দেখা যায় না যে! অঘোরী বাবার আশ্রম কি তাহলে পিছনে ফেলে এলাম? হঠাৎ ভৈরবী চেঁচিয়ে উঠলেন-”ওই যে ওই–ওই দেখা যাচ্ছে কালো মতো!” নজর করে দেখলাম-ঠিকই, একটা বালির টিলার পাশ দিয়ে কালো মতো কি উঁচু হয়ে রয়েছে। নিশ্চয়ই অঘোরী বাবার আশ্রমের চাল। চললাম সেই দিকে এগিয়ে। তখন নদীর জলও চোখের আড়ালে চলে গেল।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে চলতে লাগলাম, সেই কালো মতো যা দেখেছিলাম তার দিকে। একবার একটা বালির টিলার মাথায় উঠি আবার নেমে যাই। আবার সামনের টিলাটার মাথায় উঠি।
বার বার মনে হতে লাগল, ওই তো দেখা যাচ্ছে অঘোরী বাবার আশ্রমের ছাত, সামনের ওই বালির টিলাটা পার হলেই হয়। শেষে একসময় খেয়াল হল-তাই তো, নদীর কাছ থেকে এতদূরে কি অঘোরী বাবার আশ্রম! ওই বুড়ো মানুষ, এত দূর থেকে নদীতে যান! এত দূর থেকে মা হিংলাজের স্থানে আসা-যাওয়া করেন! এ কখনই সম্ভব নয়, আমরা অনর্থক ভুল জায়গায় ঘুরে মরছি।
কথাটা বললাম ওদের। ভৈরবীর মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। কুন্তীর চোখে ফুটে উঠল ত্রাস। এই প্রথমবার কুন্তী বলল, “জল খাব।”
মাথার উপর চেয়ে দেখলাম সূর্যদেব অনেকটা পথ পার হয়েছেন। ভৈরবী তাঁর শুকনো ঠোঁট একবার জিব দিয়ে চাটলেন। বললেন-”সেই ভালো, চলুন নদীর ধারেই ফিরে যাই। নিশ্চয়ই আমরা ফেলে চলে এসেছি অঘোর বাবার আশ্রম। নদীর ধার খুঁজলেই পাওয়া যাবে।”
ফিরে চললাম আবার। আবার সেই একবার একটা বালির ঢেউ-এর মাথায় চড়া আবার নামা, আবার চড়া। ফিরছি তো ফিরছি। যতবার উঠছি একটা ঢেউ-এর মাথায় ততবার নজর করে দেখছি নদী দেখা যায় কিনা। না, দেখা যাচ্ছে না নদী। কিন্তু নিশ্চয়ই দেখা যাবে ওই সামনের ঢেউটার মাথায় চড়লে। মনে জোর এনে আবার পা চালাচ্ছি। আবার প্রাণপণে উঠছি সামনের টিলাটার মাথায়। কপালের উপর হাত রেখে রোদটাকে আড়াল করে দেখছি-কই, কোথায় নদী? শুধু ধূ ধূ করছে বালি আর বালি। আদিগম্ভ খাঁ খাঁ করছে। হঠাৎ খেয়াল হল হিংলাজ পাহাড়ের কথা নদীর এ-পাড় থেকে ও-পাড়ের পাহাড়টাকে দেখতে পাওয়া যায়। ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছনে কোনো দিকে কোথাও পাহাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। ভৈরবীর মুখের দিকে একবার চাইলাম, কুম্ভীর মুখের দিকেও। ওরা রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে আমার মুখ থেকে কিছু শোনবার জন্যে। কিন্তু কি বলব আমি, বলবার আছে কি! কোনো কথা যোগাল না মুখে। একটা ঢোক গিলতে গেলাম। ঢোক গিলব কি, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
মাথার উপর অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। চোখেও ঝাপসা দেখছি, পায়ের তলা পুড়ে যাচ্ছে। আবার একবার ওদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। কুন্তী কেমন যেন অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে আমার দিকে। ভৈরবী চোখ বুজে ফেলেছেন। যা হয়েছে তা আর মুখ ফুটে বলতে হল না। তিনজনেই তিনজনের বুকের ভিতর কি হচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। দ্বিতীয়বার কুন্তী উচ্চারণ করলে, “জল খাব।”
চোখ চেয়ে ভৈরবী বললেন, “জল কোথায়?” বলে রক্তবর্ণ চোখে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
সজোরে নিজের মাথায় একটা ঝাঁকানি দিলাম। চোখের দৃষ্টি একটু পরিষ্কার হল। দু-হাতে ওদের দু-জনের হাত ধরে টান দিলাম। “চলো-এগিয়ে চলো আমার সঙ্গে। সামনেই নদী, নদীর ধারে না গেলে জল পাবে কোথায়?”
কুন্তীর চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। সে তৃতীয়বার উচ্চারণ করলে, “জল খাব।”
চললাম আবার ওদের দুজনকে টেনে নিয়ে।
যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি তা নিজেও জানি না। কেন যাচ্ছি তাও জানি না। তবু যাচ্ছি, কারণ না গিয়ে করবই বা কি? যতক্ষণ শক্তিতে কুলোয় যাব। যেতে যেতে একসময় নিশ্চয়ই বালি শেষ হয়ে যাবে। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই এর শেষ আছে। সেইখান পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। তিনজনেই মুখ বুজে যাচ্ছি, ওরা হাত ছাড়াবার জন্যে জোর করছে না। মাঝে মাঝে শুধু ওদের হাত টান দিতে হচ্ছে। যখন টান দিচ্ছি তখন ওরা চোখ খুলে আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখছে। দেখে আবার চোখ বন্ধ করে হাঁটছে। কোনো আপত্তি নেই। আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যাবে কিন্তু আমি এদের কোথায় টেনে নিয়ে চলেছি!
ওদের হাত ছেড়ে দিলাম। ওরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। চতুর্থবার কুন্তী বলল, “জল খাব।” কিন্তু এবার আর চোখ চেয়ে বললে না। কি রকম যেন জড়িয়ে গেল তার কথা।
ভৈরবী চোখ চাইলেন। চতুর্দিকে নজর করে কি দেখতে লাগলেন। তারপরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ বুজে ফেললেন।
একটা ঢোক গিলবার চেষ্টা করলাম। নোনতা বিস্বাদ লাগল গলার মধ্যে। তবু গলার ভিতরটা একটু ভিজল। তখন বললাম ভৈরবীকে-”কি, হয়েছে কি আমাদের যে এরই মধ্যে আমরা জল জল করে এলিয়ে পড়েছি! শিবারাত্রির উপোস করে চব্বিশ ঘণ্টা জল না খেয়ে কাটাই। মহাষ্টমীর দিন কোনো কোনো বার ভোর হয়ে যায় জল খেতে। আর কাল অর্ধেক রাতে জল খেয়েছি, এখনও অর্ধেক দিন পার হল না, এর মধ্যে জল জল করে মরে যাচ্ছি? কেন, হয়েছে কি আমাদের?”
বাংলা কথা কুন্তী বুঝলে না। তবে কাজ হল। তার চোখের ঘোর কেটে গেল। ভৈরবীও একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলেন–”তবে কোথাও একটু বসা যাক না। মিছিমিছি ঘুরে মরছি কেন রোদের মধ্যে? রোদ কমলে আবার তখন হাঁটা যাবে।”
কুন্তী জিজ্ঞাসা করল, “কি হয়েছে?”
বললাম, কিছুই হয়নি। এই রোদের মধ্যে অনর্থক ঘুরে ঘুরে আরও তেষ্টা বেড়ে যাচ্ছে। চলো কোথাও একটু বসি। রোদ পড়ুক, তখন খুঁজে দেখা যাবে কোথায় নদী।”
কুন্তী আর কিছু বললে না। তখন চললাম আবার তিনজনে, যদি কোথাও একটু ছায়া পাওয়া যায় এই আশায়।
কোথায় ছায়া? একটি গাছপালা কোথাও নেই। তবু চলেছি। মনে হচ্ছে আর খানিকটা এগোলেই হঠাৎ চোখে পড়বে নদী; তরতর করে বয়ে যাচ্ছে জল, নদীর নাম অঘোর। আর একবার নজর করে দেখলাম, কোনো দিকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে না তো? পাহাড় দেখা গেলেই নদী পাওয়া যাবে। নদী বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের কোল দিয়ে। কোথায় পাহাড়, শুধু বালি আর রোদ, রোদ আর বালি। মাথার উপর মার্তণ্ডদেব কিছুতেই নড়লেন না।
তবু চলেছি। অন্তিম চেষ্টায় দাঁতে দাঁত দিয়ে চলেছি। আবার ওদের দুজনের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছি। একবার বসে পড়লে যদি আর উঠতে না পারি। যতক্ষণ চলব ততক্ষণ একটা না একটা কিছু ঘটবার আশা আছে, কোথাও না কোথাও পৌঁছবই শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বসে পড়া মানে একেবারে সব শেষ। আর কিছুই আশা করবার থাকবে না। বসে পড়লে আস্তে আস্তে যেখানে গিয়ে পৌঁছব সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।
একটা টিলা থেকে নামলাম। সামনেই আর একটা টিলা। জায়গাটা গর্তের মতো। ছায়া আছে, ভৈরবী জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেখানে বসে পড়লেন, “নাঃ আর এক পা-ও যাব না। অনর্থক ঘুরে মরবার কোনো মানে নেই। যতক্ষণ সূর্যাস্ত না হচ্ছে এখানেই পড়ে থাকব।”
কুন্তীর হাত ছেড়ে দিলাম। সেও বসে পড়ল। তখন ওদের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে আমিও বসে পড়লাম ওদের পাশে…
এইখানে হিংলাজ-কাহিনী বলা সমাপ্ত হল। সেদিন সেই বালির গর্তে বসে পড়বার পরে মরুতীর্থ সম্বন্ধে আর কিছুই বলার রইল না। এর পর যা যা ঘটেছিল তার সঙ্গে মহাতীর্থ হিংলাজের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, তা গুছিয়ে বলার শক্তিও আমার নেই। প্রবৃত্তি হয় না তার পরের ঘটনাগুলো মনে করবার। এখনও প্রাণপণ চেষ্টা করছি যদি কোনোরকমে ভুলতে পারি, একেবারে মুছে ফেলতে পারি মন থেকে যা কিছু ঘটেছিল তারপর। কিন্তু তা হবার উপায় নেই।
আজ উঠতে বসতে শত সহস্রবার নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছি সেদিন সেই বালির গর্তে বসে পড়েছিলাম বলে। তারও আগে হিংলাজের গুহা থেকে বেরিয়ে রূপলালের সঙ্গে আকাশগঙ্গায় যেতে চাননি বলে ভৈরবী এখনও লুকিয়ে নিজের কপাল নিজে ঠোকেন। এই যে চোখ দুটো কপালের উপর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, এই চোখ দুটোই সেদিন চরম বেইমানি করেছিল। ‘ওই অঘোরী বাবার আশ্রমের চাল দেখা যাচ্ছে’ এই বলে জলের কাছ থেকে, নদীর ধার ছেড়ে, মিথ্যে মরিচীৎকার পিছনে ছুটেছিলাম এই চোখ দুটির বেইমানির জন্যেই। বাজারে গিয়ে যখন চোখে পড়ে থরে থরে ডাব সাজানো রয়েছে, তার পাশে রয়েছে লাল টকটকে তরমুজ আনারস পেঁপে লেবু আম, তখন চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে। বরফ আর শরবতের দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটতে চাই না। ও সব এখন আমার দু চোখের বিষ। কেবলমাত্র একবার একটু ভাতের সঙ্গে ভিন্ন সারা দিন-রাতে তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেলেও ভৈরবী এক ফোঁটা জল মুখে ছোঁয়ান না। বন্ধুবান্ধব আত্মজন কারও বাড়ি গেলে যখন শুনি, “একটু জল খাও”, তখন কেন যে চমকে উঠি তা বলতে পারি না। আষাঢ়-শ্রাবণে যখন আকাশ ভেঙে নামে, তখন গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে জল পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে কেন যে পোড়া চোখ দুটোর জলে বালিশ ভিজতে থাকে, তার সঠিক কোনো অর্থ খুঁজে পাই না।
এখন যেদিকে তাকাই সেদিকেই জল। ফলে-ফুলে, আকাশে-বাতাসে লোকের চোখ-মুখে সর্বত্র জল। কিছুই শুকনো নয়। সবই সরস, সবই সজীব। দুনিয়ার এত জল-কিন্তু সেদিন এই পোড়া চোখ দুটোর বেইমানির জন্যে এক ফোঁটা জল কোথাও মিলল না।
জল।
অতি তুচ্ছ জিনিস। সকাল হবার আগেই পাইপ লাগিয়ে ফট ফট ফটাস শব্দে রাস্তায় ঢালতে থাকে, রাজপথ ধোয়া হয়। ঘুম থেকে উঠে কুলকুচো করতে লাগে দু ঘটি, সারাদিন পায়ে ঢালতে হয় দশ ঘটি, স্নান করতে কত ঘটি মাথায় ঢালি তার কি হিসেব আছে। সেদিন যখন সূর্যদেব শেষ পর্যন্ত সত্যই অস্ত গেলেন তখন আবার আমরা নিজেদের টেনে তুললাম, আবার চললাম জলের খোঁজে, আবার শুয়ে পড়লাম বালির উপর। তারপর ধমকানি খোশামুদি গালাগলি এই সমস্ত করে আবার উঠে দাঁড়ালাম সকলে, আবার খানিক ছোটাছুটি করে পড়লাম এক জায়গায়। কি করে যে সারারাত কাটল, কে কাকে কি বললাম, সে কাহিনী মনের মধ্যে গুছিয়ে রাখবার মতো কি অবস্থা ছিল তখন, না তার সরস বিবরণ দেওয়া আজ সম্ভব! সে রাতের চরম কথাটা হচ্ছে এই যে, যতক্ষণ উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্যটুকু ছিল শরীরে ততক্ষণ ছোটাছুটি করে কাটল সেই বালির সমুদ্রে। তারপর শেষবারের মতো শুয়ে পড়লাম তিনজনেই। তখন আমাদের অন্তিম অবস্থাটুকু দেখে আমোদ পাবার জন্যে সূর্যদেব ফিরে এলেন আকাশের গায়ে।
তার পরের ঘটনাটুকু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মনে আছে কুন্তী চলে যাচ্ছিল বলে তাকে চুল ধরে টেনে এনে ফেলেছিলাম। একবার ভৈরবীর চোখে দু ফোঁটা জলও দেখেছিলাম। আর একবার খাড়া হয়ে বসে যখন ধাক্কা দিয়েও ওদের দুজনকে জাগাতে পারলাম না, তখন তিনটে ঝোলার সমস্ত জিনিসপত্র ঢেলে কি যেন খুঁজেছিলাম। তারপর ভৈরবীর আর কুন্তীর মুখ তাদের আঁচল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম। নিজেও শুয়ে পড়েছিলাম তারপর তপ্ত বালির উপর মুখ গুঁজড়ে। ব্যাস-আর কিছু মনে নেই।
তলিয়ে যেতে লাগলাম। সে কি অন্ধকার! নেমে যাচ্ছি সেই আঁধারের মধ্যে। কোনো জ্বালা নেই যন্ত্রণা নেই। বরফের মতো ঠান্ডা অন্ধকারের মাঝে ডুবে যাচ্ছি। অনবরত নামছি, আর নামছি সেই আঁধার-সমুদ্রে। এর যেন আর তল নেই। অনন্তকাল ধরে শুধু নেমেই যাব। কতক্ষণ ধরে যে ডুবে রইলাম সেই আঁধারের মাঝে তা বলতে পারব না। হঠাৎ কিসে গিয়ে ঠেকলাম। তৎক্ষণাৎ দপ করে আলো জ্বলে উঠল। পরিষ্কার দিনের আলো। চোখ চেয়ে দেখলাম।
এ কি! এ সব কি দেখছি! কি করছে ও?
বাধা দিতে গেলাম। কুন্তী টেরই পেলে না। বার বার বুক ফাটিয়ে চিৎকার করলাম-কুন্তী শুনতেই পেলে না। সে তার নিজের কাজ করে যেতে লাগল।
ভৈরবীর মুখের আঁচল সরিয়ে তাঁর মাথাটা ধরে টানাটানি করতে লাগল। জোর করে চোখের পাতা ফাঁক করে কি দেখলে। মুখের মধ্যে আঙুল দেবার চেষ্টা করলে বার বার। তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা বালির উপর নামিয়ে রেখে আছড়ে এসে পড়ল আমার বুকের উপর। কি ভীবৎস দেখাচ্ছে কুন্তীর মুখ! ওর নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে কেন? চোখের জলে চুলে রক্ত মিশে কি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কে!
কুন্তী আমার মাথাটা কোলের উপর তুলে নিল। নিয়ে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে। কি কতকগুলো গজগজ করে বললে কাঁদতে কাঁদতে। বার বার আমার মুখের ভিতর আঙুল দিতে গেল। দু-হাতে নিজের দু-মুঠো চুল ছিঁড়ে ফেললে। তাতেও হল না, নিজের ডান হাতের পিট নিজের মুখে চেপে ধরল। ধরে দম বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ। হাতটা যখন মুখ থেকে নামাল তখন টপ টপ করে রক্ত পড়ছে হাতের পিঠ দিয়ে। কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে কুন্তী নিজের হাত থেকে।
আরও সব পাগলামো করতে লাগল সে। তাকে বাধা দিতে গেলাম, বুক ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, ধরলাম চেপে তার হাত। কুন্তী এবারও কিছুই টের পেলে না।
সে তখন তার জামাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললে গা থেকে। নিজের পরনের কাপড়খানাও খুলে ফালা ফালা করে ফেলে দিলে। আবার ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল আমার বুকের উপর। মুখের উপর তার স্তন দুটি জোর করে আমার মুখে গুঁজে দিতে চেষ্টা করতে লাগল। তাতেও যখন কিছু হল না, তখন ঠাস ঠাস করে গোটাকতক চড় লাগাল আমার দু-গালে। আমার মাথার চুল দু-হাতের মুঠোয় ধরে অনবরত ঝাঁকাতে লাগল। শেষে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইল আমার চোখের দিকে।
তারপর কুন্তী আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে আবার কি ভেবে একবার আমার উপর ঝুঁকে পড়ে কি কতকগুলো বললে। কিছুই বুঝতে পারলাম না তার কথা। তার সেই রক্তমাখা ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে চেয়ে রইলাম।
তখন কুন্তী আমাকে ছেড়ে দিয়ে উলঙ্গ অবস্থাতেই নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগল বালির উপর টিলার উপর।
শেষবারের মতো প্রাণপণে চিৎকার করলাম, “কুন্তী, যাসনি, ফেলে যাসনি আমাদের!’
কুন্তী শুনতেই পেলে না।
আবার তলিয়ে যেতে লাগলাম অন্ধকারের মাঝে, বরফের মতো ঠাণ্ডা আর জমাট বাধা অন্ধকার। ব্যাস আর কিছু মনে নেই।
হাঁ, মনে পড়ছে বটে, একবার যেন সেই অন্ধকারের তল থেকে ফিরেছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্যে। সেই সময় যেন গুলমহম্মদের চিৎকারও শুনেছিলাম। চোখ মেলে দেখেছিলাম আমার মুখের উপরে একটা উটের মুখ। উটটা নাক দিয়ে আমার মুখ শুঁকছে। আর কিছুই মনে পড়ছে না। আবার তলিয়ে গেলাম সেই অন্ধকার সমুদ্রে।
এরপর এক রাত্রে একবার ঘুম ভেঙেছিল। চোখ চেয়ে দেখলাম টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। মাথার কাছে বসে আছেন ভৈরবী। অতি কষ্টে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম–”আমরা কোথায়?” তিনি মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “শোনবেণী ধর্মশালায়”। বলে আমার চোখের উপর হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলেন। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম!
১৩৫৩ সাল, ভাদ্র মাস।
করাচীর আর একপ্রান্তে সমুদ্রের কিনারায় একদিন বিকেল তিনটের সময় শেঠ ভগবান দাসের প্রকাণ্ড গাড়ি থেকে আমরা নামলাম। ডানদিকে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে শত শত সি-প্লেন বালির উপর ডানা মেলে ঝিমোচ্ছে। বাঁদিকে ওই নীচে জলের ধারে সমুদ্রগামী প্রকাণ্ড পালের নৌকোটা ডাঙার দিকে কাত হয়ে রয়েছে।
ওই নৌকোতে ছ-দিন ছ-রাত সমুদ্রের বুকে পাড়ি দিয়ে কোটেশ্বর দর্শন করতে যাচ্ছি। কাছভুজের পশ্চিম দিকের শেষপ্রান্তে ভৈরব কোটেশ্বরের স্থান। মহাপীঠ হিংলাজ দর্শন করলে কোটেশ্বর দর্শন করতেই হবে। মা কামাখ্যার ভৈরব উমানন্দ, কালীর ভৈরব নকুলেশ্বর, তেমনি হিংলাজের ভৈরব কোটেশ্বর। ভৈরব দর্শন না করলে মহাপীঠ দর্শনের ফল হয় না।
লরিতে করে এল বড় বড় নতুন ছটা কলসি। কলসিতে আছে খাবার জল ছ দিনের। সমুদ্রের উপর ছ-দিন ওই জল খাব আমরা। মুখবন্ধ টিনে ঝুড়িতে টুকরিতে ফল মিষ্টি আরও কত কি। ছ-দিনের জন্যে ছ-মাসের খাদ্য নৌকোয় উঠছে।
শেঠজি, তাঁর পত্নী, করাচীর বন্ধুবান্ধবরা-যাঁরা আপ্রাণ চেষ্টায় আমাকে খাড়া করেছেন– তাঁরা সবাই এসেছেন নৌকোয় তুলে দিতে। ফুল, ফুলের মালা, প্রণামী, আতর, সিন্দূর-কুমকুমের ছড়াছড়ি। ক্লিক ক্লিক ফোটো উঠছে।
জোয়ার আসছে জলে। মাঝি-মাল্লারা নৌকার উপর ছুটাছুটি করছে। আমরা উঠে গেলাম। লম্বা কাঠখানা টেনে তুলে ফেললে নৌকোর উপর।
দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি ডাঙার দিকে চেয়ে। ভৈরবী কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “আর দুটো দিন করাচীতে থেকে গেলে হত। গুলমহম্মদ বলে গেছে যে সে কুন্তীর খবর নিয়ে ফিরে আসবে। তাদের দেশসুদ্ধ লোক কুম্ভীকে খুঁজছে। নিশ্চয়ই তাকে পাওয়া গেছে এতদিনে।
গোটাকতক পাল একসঙ্গে উঠে গেল উপরে দড়ির টানে। হই-হই করে উঠল নৌকোর লোকেরা। নৌকাখানাও হঠাৎ ঘুরে গেল। করাচীর ডাঙা চোখের আড়ালে চলে গেল।
তিরবেগে নৌকো ছুটল সমুদ্রের বুকে। পালে বেশ বাতাস ধরেছে।
*****
অবধূত (১৯১০ – ১৩ এপ্রিল, ১৯৭৮) বা কালিকানন্দ অবধূত ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও তন্ত্রসাধক। তাঁর প্রকৃতনাম দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে। পুত্র অমল মুখোপাধ্যায়ের জন্মের পর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হলে উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে সন্ন্যাস (অবধূত) গ্রহণ করেন। সন্ন্যাসজীবনে তাঁর নাম হয় কালিকানন্দ অবধূত। সন্ন্যাসজীবনে তাঁর ভৈরবী স্ত্রীও ছিল। হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় স্বপ্রতিষ্ঠিত রুদ্রচণ্ডী মঠে তাঁর মৃত্যু হয়।
অবধূত ছদ্মনামে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ নামক উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এই উপন্যাসটি অবলম্বনে একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন বিকাশ রায় ও উত্তমকুমার। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ উদ্ধারণপুরের ঘাট (১৯৬০)।
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “উদ্ভট কাহিনী-কল্পনা, বীভৎস রস, তান্ত্রিক ধর্মসাধনার গুহ্য রহস্য ও উৎকট যৌনাচার অবধূতের রচনার বৈশিষ্ট্য,–শক্তিমত্তা সত্ত্বেও শিথিল বিন্যাস ও যৌনতার আধিক্য ত্রুটিরূপে গণ্য।” শিশিরকুমার দাশের মতে, “তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য ভয়াবহ ও বীভৎস রসের আধিক্য। প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সমালোচক তাঁর বিষয়-নির্বাচন ও প্রয়োগরীতির প্রতি সংশয়ী ছিলেন।”
উপন্যাসতালিকা
অবধূত রচিত উপন্যাসগুলি হল :
মরুতীর্থ হিংলাজ (জুলাই, ১৯৫৪), হিংলাজের পরে, বশীকরণ, তাহার দুই তারা (১৯৫৯), উদ্ধারণপুরের ঘাট (১৯৬০), ক্রীম (১৯৬০), পিয়ারী (জুলাই, ১৯৬১), বহুব্রীহি, ভোরের গোধূলি, টপ্পা ঠুংরী (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), ভূমিকা লিপি পূর্ববৎ, কান পেতে রই, তুমি ভুল করেছিলে, অনাহত আহুতি, স্বামীঘাতিনী, ফক্করতন্ত্রম্ (১ম, ২য় ও ৩য় পর্ব), দুর্গম পন্থা (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ), নীলকণ্ঠ হিমালয়, মন মানে না, সাচ্চা দরবার, উত্তর রাম চরিত, সুমেরু কুমেরু, একটি মেয়ের আত্মকাহিনী।