উট চলল।
আজ অমাবস্যা। সন্ধ্যার পরেই আরম্ভ হল ঘোরতর নিশা। অন্য দিনের মতো ধীর-সুস্থে রয়ে-জিরিয়ে রাত্রি এল না। সন্ধ্যার পিছনেই রাত্রি দাঁড়িয়ে ছিল। সন্ধ্যা ত্রস্ত লঘু পদক্ষেপে পার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মিশকালো চাদরে আপাদমস্তক আবৃত করে রাত্রি দু হাত মেলে সামনে এসে দাঁড়াল। পায়ের নীচে বালু মাথার উপর আকাশ, মাঝখানের সমস্ত ফাঁকটি জুড়ে এক নিরেট নিশ্চিদ্র স্তব্ধতা থম্থম্ করতে লাগল।
অন্য দিন অসংখ্য প্রদীপ হাতে রাত্রির অনুচারীরা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে, আজ তারা কোথায় লুকাল কে জানে। বোধ হয় আজ আর রাত্রিতে পথ দেখাবার প্রয়োজন নেই বলেই তারা অনুপস্থিত। রাত্রি আজ চলছেও না, সামনেও এগুচ্ছে না। শুধু মুড়িসুড়ি দিয়ে চুপ করে বসে আছে, আর আমরা কটি প্রাণী উট দুটিকে নিয়ে সেই রূপহীন বর্ণহীন আঁধার সমুদ্রে সাঁতার দিতে লাগলাম।
রাত্রির একটি নিজস্ব ভাষা আছে। তবে তা শোনবার মতো কান থাকা চাই। না-শুধু কান থাকলেই হবে না শোন, সে ভাষা শোনার জন্যে যেতে হবে সেই সমস্ত স্থানে যেখানে রাত্রি কথা বলে। সর্বত্র তো রাত্রি কথা বলে না, আর যদিও বলে অন্য গোলমালে শুনতে পাওয়া যায় না সে কথা, খুবই চুপিচুপি বলে কিনা।
রাত্রির সেই মরমের ভাষা যদি শুনতে চাও, চলে যাও একখানা টাপুরে নৌকোয় চেপে মেঘনায় ভেসে ভেসে ভৈরবের পুল ছাড়িয়ে আরও নীচের দিকে। আপন ইচ্ছায় নৌকো ভেসে যাক–চুপ করে বসে থাকো চোখ বুজে। অনেক পরে শুনতে পাবে রাত্রি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে তোমায় শোনাচ্ছে তার গোপন কথা। কত বিচিত্র সে কাহিনী, তাতে কত ব্যথা, কত আনন্দ, কত রোমাঞ্চ, কত প্রহেলিকা। শুনতে শুনতে মনের জ্বালা জুড়িয়ে যাবে-কখন ঘুমিয়ে পড়বে জানতেও পারবে না।
কিংবা আর এ কাজ করতে পারো। মাঘ মাস-আকাশে চাঁদ নেই, বেশ কুয়াশা করেছে। এমনি এক রাতে মনে হচ্ছে যেন নিজেকে নিজে ধরতে পারছ, ছুঁতে পারছ। একখানা কম্বল জড়িয়ে নিরিবিলি বেরিয়ে পড়ো নিজেকে নিয়ে ৷ উদ্ধারণপুরের বড় শ্মশানের সামনে এসে বড় সড়কটার এধার ওধার একবার দেখে নাও। কেউ কোথাও আছে কিনা। এমন সময় সেখানে কারও থাকবার কথা নয়। হয়তো দেখা যাবে ওই ওধারে বড় পাকুড় গাছটার ডালে কাপড়-জড়ানো মড়া টাঙিয়ে রেখে গাছের গোড়ায় কয়েকটা ইট দিয়ে চুলো বানিয়ে রান্না চাপিয়েছে। দু একটা বোতলও দেখা যাবে দূর থেকে আগুনের আলোয় চকচক করতে। থাকুক ওরা ওধারে। আজ রাতে ওরা আর শ্মশানে ঢুকছে না। ওরা আসছে হয়তো পাঁচ সাত ক্রোশ দূর থেকে মড়া নিয়ে, সকালে শ্মশানে ঢুকে দাহকর্ম শেষ করে বাড়ি ফিরবে। ওরা জানতেও পারবে না, তুমি নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ো শ্মশানের মধ্যে। সাবধানে পা ফেলে নেমে যাও গঙ্গার কিনারায়।
ডান পাশে যে শেয়ালগুলো মড়া খাচ্ছিল তারা হয়তো খানিক খেঁকা খেঁকি করে উঠবে– কখনো কাছে আসবে না। হামদা কুকুরগুলো হয়তো চেঁচাতে চেঁচাতে পিছু পিছু আসবে। তাদের লাল চোখগুলো অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে দেখা যাবে। কিছুক্ষণ পরে তারা ফিরবে নিজের নিজের কাজে। পাড়ের তালগাছ-কটায় যে শকুনগুলো ঘুমোচ্ছে তাদের মধ্যে হয়তো একটা নাকী সুরে কেঁদে উঠবে। তারপর আবার সমস্ত গোলমাল থিতিয়ে যাবে, আর কোনো অশান্তি নেই। তখন গঙ্গার কিনারায় একটু খুঁজলেই এক-আধখানা চেটাই বা মাদুর মিলবেই। সেখানা জলের ধার ঘেঁষে বিছিয়ে বেশ আরাম করে বসো। আর গঙ্গার দিকে চেয়ে থাকো। কিছু ভেবো না, কোনো চিন্তার প্রয়োজনই নেই। একটু পরেই চুপি চুপি পা টিপে টিপে আসবে রাত্রি। এসে ঠিক তোমার পাশটিতে বসে ঘনিষ্ঠ আলাপ জুড়ে দেবে। এই জন্ম-মৃত্যুর কথা, আসা-যাওয়ার কাহিনী। সে সব কত না-জানা রহস্য। শুনতে শুনতে তোমার চোখের ঘুম যাবে পালিয়ে। তখন নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলবে সেই সব না-জানা ব্যাপারগুলোর মধ্যে।
আর যদি সত্যই জানতে চাও রাত্রির নিজের মনের কথা, তবে যেতে হবে অন্য এক জায়গায়। লামডিং-বদরপুর লাইনে হাফলং হিল নামে একটা স্টেশন আছে। ওখানে নেমে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ যেদিকে ইচ্ছা চলে যাও পায়ে চলা পাহাড়ে পথ ধরে। পাহাড়ে বাঁশের তলা দিয়ে পথ গেছে এঁকে বেঁকে, একবার ওপরে উঠে একবার নীচে নেমে। চলতে থাকো যতক্ষণ আকাশে আলো থাকে। চলছ তো চলছই। মাঝে মাঝে ওই দূরে পাহাড়ের গায়ে দু-একখানা ঘর দেখা যাবে, দেখা যাবে সেই সব ঘর থেকে ধোয়া বেরুতে তারপর এক সময় এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে যখন আর এগুবার উপায় থাকবে না। পায়ে চলা পথটা শেষ হয়েছে, সামনেই এক পাতাল প্রমাণ খাদ।
খাদের ওপারেই আর একটি পাহাড়, আকাশে তাঁর মাথা ঠেকেছে। তাঁর সারা শরীরে সে কি বিপুল সাজপোশাক, আর তার কত বিচিত্র বর্ণ। তার মুখ দেখতে পাবে না, মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে মুখ তুলে দেখতে গেলে নিজেরই ঘাড়ে ব্যথা লাগবে তবু দেখা যাবে না তাঁর মুখ। তিনি হয়তো তোমার স্পর্ধা দেখে তখন মুখ টিপে হাসছেন। তা তিনি যা ইচ্ছা করুন খাদের ওপারে দাঁড়িয়ে, ওইখানে একখানা জুতসই পাথর দেখে নিয়ে আরাম করে বসো!
সামনে অনেক নীচে খাদের ভিতর দিয়ে নানা জাতের শব্দ করে ছুটে চলেছে এক নদী, তাকেও যাবে না দেখা। শুনতে পাওয়া যাবে সেই ঝগড়াটে মেয়ের অনর্গল বকবকানি। থাকুক বকতে, কিছুক্ষণ পরে ওটা সহ্য হয়ে যাবে। সন্ধ্যা এগিয়ে আসবে পা টিপে টিপে পাতলা ওড়নাখানি গায়ে জড়িয়ে।
তোমায় এ হেন স্থানে একলা বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াবে। বিস্ময়ব্যাকুল চোখ দুটি তুলে ঘোমটার আড়াল থেকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকবে তোমার দিকে-নির্বাক নিস্তব্ধ। তারপর লজ্জায় শরমে লাল হয়ে ধীরে ধীরে চলে যাবে পাহাড়ের আড়ালে।
আর্বিভূতা হবে রাত্রি অনুচরীদের সঙ্গে নিয়ে। প্রদীপ হাতে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে তাকে ৷
চুপ করে বসে চেয়ে দেখো চারিদিকে কি ঘটছে। জীবন এতক্ষণ দিনের আলোয় ঘুমিয়ে ছিল, রাত্রির চরণস্পর্শে জেগে উঠল। সবই সজীব, সবই প্ৰাণচঞ্চল ৷
কাছাকাছি আসবে রাত্রি, শেষে তোমার পাশটিতে এসে বসে পড়বে নিবিড় হয়ে, তার কালো শাড়ির আঁচল দিয়ে তোমাকে ঢেকে নিয়ে। তখন তাঁর কাঁধে মাথা রেখে শোনো তার মনের কথা, তার অন্তরের বেদনার কাহিনী। তার কেশের নানারকম বনফুলের সুবাসে তোমার নিশ্বাস পূর্ণ হয়ে যাবে, বুক ভরে উঠবে। একান্ত করে রাত্রিকে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হবে। তার মনের কথায় তোমার মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠবে।
আকাশে যখন চাঁদ থাকে তখন রাত্রি কথা কয় না। কইলেও সে বড় গোলমেলে সব আলাপ। সে প্রগলভতা, সে ছলছলানি না শোনাই ভালো। মাথা খারাপ করে দেয়।
কিন্তু সেদিন সেই ঘোর অমাবস্যায় মরুসমুদ্রের মাঝে আলকাতরার মতো ঘন আঁধারে ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে রাত্রির অন্য জাতের আলাপ মর্মে গিয়ে বিঁধল। রাত্রি কাঁদছে, গুমরে গুমরে কাঁদছে। সে কান্নার কোনো মানে নেই, কোনো ভাষা নেই। সে শুধু অন্তহীন হতাশার চরম ব্যাকুলতা ভিন্ন আর কিছু নয়।
সমস্ত দলটি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সকলের গায়ের সঙ্গে গা ঠেকছে। উটের উপর থেকে ভৈরবী বললেন, “আমি নেমে হেঁটে যাব। এখানে ভালো লাগছে না।”
দিলমহম্মদ উর্বশীর গলার নীচে, আমি ডানপাশে। অন্য সকলে উটটাকে ঘিরে চলেছে। মাত্র হাত দুই তিন উপরে ভৈরবী, তবু তাঁর একলা একলা মনে হচ্ছে।
থিরুমলের এক হাত কুন্তী, এক হাত পোপটলাল ধরে নিয়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে কুন্তী হুমড়ি খেয়ে এসে আমার উপর পড়ছে, ঠিক আমার পেছনেই সে আছে কি না। সুখলালের হাত ধরে আছি আমি এবং ধরে আছি কিনা এ সংবাদটি মাঝে মাঝে ভৈরবী নিচ্ছেন। ছোট ছেলে সুখলাল, তার মা ছেলেকে এই প্রথম এই পথে বেরুতে দিয়েছেন এবং চুপি চুপি কয়েকটি কথা ভৈরবীকে বলেও দিয়েছেন।
সামনের বড় উটের গলার নীচে গুলমহম্মদ। অনেকক্ষণ তার কোন বাক্যলাপ শোনা যাচ্ছে না, এমনকি রূপলালের কন্ঠও স্তব্ধ। কোনো সাড়াশব্দ নেই, যদি বা কেউ কথা বলছে তা ফিসফিসিয়ে বলছে।
মহা মুশকিল হল তো! চীৎকার করে উঠলাম
“হিংলাজ মাতা-কি-–”
সমবেত কন্ঠে উত্তর হল- “জয়”
কিন্তু সে উত্তর নির্জীব, বড় প্রাণহীন।
সামনে থেকে গুলমহম্মদ অনেক কিছু বলে যেতে লাগল ছেলেকে। দিলমহম্মদ কোনো উত্তর দিলে না, মনে হল একটা গোলমাল নিশ্চয়ই ঘটতে চলেছে। জিজ্ঞাসা করলাম দিলমহম্মদকে, কি বললে তার বাবা।
সে উত্তর দিলে, “ঠিক বোঝা যাচ্ছে না আমরা কোন দিকে চলেছি।”
এতক্ষণ পরে রূপলাল কথা বললে, “তবে এখানেই থামলে হয়, আকাশে তারা উঠলে আবার চলা যাবে।”
গুলমহম্মদ উত্তর দিলে, “না তার দরকার নেই। হয়তো আজও তুফান উঠবে, উটের উপর নির্ভর করে এগিয়ে যাওয়া ঢের ভাল। আল্লা মুশকিল আসান করবেন।
তারপর উটকে আদর দিয়ে সাহস দিয়ে নানান কথা বলতে লাগল।
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যারিকেন লন্ঠন যে-কটা সঙ্গে আছে সব জ্বালিয়ে নেওয়া হোক।”
বুড়ো হেসে উত্তর দিলে, “জ্বেলে দেখো, তাতে আঁধার বারবে বই কমবে না। আর তখন লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখাবে কে? উট চলে নাকে গন্ধ শুঁকে। আলো জ্বাললে তখন ওই আলোর সঙ্গে ওরা চলবে। তখন পথ দেখাতে হবে আমাদের। যতক্ষণ না আকাশে তারা উঠে, আমরা জানব কি করে কোন দিকে যাচ্ছি।” বুঝলাম রাত্রে আকাশের রাতের তারা দেখে এরা দিক নিরূপণ করে।
না আকাশ না পাতাল-কোনো দিকে কূলকিনারা নেই, তবুও এগিয়ে চলেছি। এতক্ষণে শ্রীজয়াশঙ্কর পাণ্ডে মহাশয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। তিনি প্রাণভরে অপদার্থ ছড়িওয়ালাটার মুণ্ডুপাত করতে লাগলেন। একেবারে ভয়ানক ভয়ানক শাপ-শাপান্ত। মুখ বুজে শুনছে সকলে। কে উত্তর দেবে?
শেষে তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনের নাম করে সকরুণ বিলাপ। তার সঙ্গে নিজের মূর্খতার জন্যে মর্মবেদনা। কেন তিনি এই সর্বনাশের পথে পা বাড়ালেন, কেন তিনি সকলের নিষেধ না শুনে এই ভয়ঙ্কর দেশে বেঘোরে প্রাণটা দিতে এলেন, কেন এই অজাত পাণ্ডাদের উপর নির্ভর করতে গেলেন। এখন তাঁর উপায় হবে কি? তাঁর যে ঘরে এই আছে ওই আছে। এই সমস্ত ফিরিস্তি বলে তাঁর কাতর ক্রন্দন একটানা চলতে লাগল ৷
আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে পাণ্ডের মহাবিপত্তির কথাটি পোপটলাল জানালেন। বছর দুই পূর্বে ওঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। ওঁর বড় ছেলের ছেলেমেয়েতে সংসার ভরতি। তা হলে কি হবে-ওঁর মন বাঁধল না। আবার একটি বিবাহ করেছেন। হিংলাজ-মাতার কৃপাতেই এই বয়সে তা সম্ভব হয়েছে বলে ওঁর বিশ্বাস। সেই জন্যে মায়ের মানত পূজা দিতে চলেছেন। ঘরে নবপরিণীতা বধূ, কাজেই একটু বেশি বেসামাল উনি হবেন বৈকি।
শ্রীপাণ্ডের শিষ্যসেবকরা প্রভুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা থামল, কারণ প্রভুর পুনরায় জঙ্গলে যাবার প্রয়োজন হয়েছে। আমাদের সকলকেই থামতে হল। ভৈরবী ও নেমে এলেন। রূপলাল কলকেতে আগুন দিলে।
গুলমহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি বাপু, পথ ঠিক আছে তো?”
উত্তর : “খোদা কা মালুম।”
মাঝখান থেকে কুন্তী হঠাৎ বলে উঠল, “একেবারে চিরদিনের মতো আমরা হারিয়ে যাই তো বেশ হয়। সবসে আচ্ছা হয়। সারা জীবন এইভাবে ঘুরে ঘুরে কাটাই ৷ বাঁচা যায়।”
তার ভাগ্যে ভাল, পাণ্ডে ছিলেন না। কথাটা তাঁর কানে গেল না।
ভৈরবী আর উটের উপর উঠলেন না। উটের উপর শূন্যে খাঁটিয়া থাকাও ভয়ানক নিয়মবিরুদ্ধ। উটওয়ালারা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করে যে, উঠের পিঠে শূন্য আসন থাকলে তাতে জিন চড়ে বসে। আর মরুভূমির জিনেরা সাঙ্ঘাতিক বদ জাতের। সুবিধা পেলেই লোককে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মারে।
সুতরাং কুন্তী আর থিরুমলকে চড়িয়ে দেওয়া হল। পাণ্ডে ফিরে এলে আবার আমরা অগ্রসর হলাম।
এবার আমর চাদরের খুঁট এক হাতে বাগিয়ে ধরে আর এক হাত সুখলালের একখানা হাত ধরে ভৈরবী হাঁটতে লাগলেন। আবার সকলেই নীরব হয়ে পড়ল।
আরও অনেকটা চলার পর পিতা-পুত্রে কি-সমস্ত আলোচনা জুড়ে দিল। সে ভাষার বিন্দু-বিসর্গও বুঝলাম না বটে, তবে এটুকু বুঝতে কারও কষ্ট হল না যে, অমাবস্যার রাত্রে অতলস্পর্শী অন্ধকারের মাঝে আমরা হারিয়ে গিয়েছি!
হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা অনেক রকমে ঘটে থাকে। এক রকমের হারিয়ে যাওয়া আছে–সে বড় মজার ব্যাপার। কেউ হারিয়ে গেলে তার আত্মীয়স্বজন গাঁটের কড়ি খরচ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপান : “বাবা গোপাল এবার ফিরে এসো, তোমার ঠানদিদি মৃত্যুশয্যায়, শেষ দেখাটা দেখে যাও। টাকার প্রয়োজন হলে জানাও। ইতি তোমার পিসিমা।” কিংবা এ ধরনের লেখাও বেরোয়, “মানিক আমার, তোমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করেছি, সবাই ভুলে গেছে, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, ফিরে এসো।”
সন্ধ্যাবেলা রেডিওতে শোনা যায় : “পাঁচ ফুট পৌনে তিন ইঞ্চি লম্বা আর এক ফুট আড়াই ইঞ্চি বুকের ছাতি, মুখময় ব্রণ, এক চোখ ট্যারা, পরনে হাফ প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট-শ্রীমান নন্তু, বয়স মাত্র একুশ, গত একুশ দিন নিরুদ্দেশ। সংবাদ পেলে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টরের কাছে অথবা লালবাজারে ছুটে চলে আসুন।”
এ জাতের হারানোতে মজা আছে। খবরের কাগজে নাম ছাপা হল, রেডিওতে নাম শোনা গেল। তারপর টাকা পেয়ে বাড়ি ফিরে চর্বচষ্য আদর-আপ্যায়ন ত আছেই। দেখা গেল, যে সঙ্কটের জন্য গা ঢাকা দেওয়া প্রয়োজন হয়েছিল তাও বেমালুম মিটেসিটে গেছে।
আবার বড় বড় মেলায় গিয়ে হারিয়ে যাওয়া আছে। বহু লোকজন দোকানপত্রে চারদিক জমজমাট, তার ভিতর মাঝে মাঝে সকলের সকল রকম আওয়াজের ঊর্ধ্বে, ঘোষণা করা হচ্ছে, “কেওড়াতলার শ্রীকামিনীভল্লব আপনি এখনই আমাদের অফিসে চলে আসুন। আপনার স্ত্রী এখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে সারা হয়ে যাচ্ছেন।” এও বড় কম কথা নয়। মেলাসুদ্ধ সকলে জানল কেওড়াতলার শ্রীকামিনীভল্লবের নাম এবং তাঁর স্ত্রী যে তাঁর জন্যে চোখের জল ফেলছেন, সে কথাটাও।
আবার আর এক রকমের হারানো আছে, তাতে অনেকের জিভে জল এসে যায়। থানার বা আদালতের দেওয়ালে লটকে দেওয়া হল একখানি ছবি, সেই ছবির নীচে এক ঘোষণা। ঘোষণায় বলা হচ্ছে যে, যাঁর ছবি তিনি হারিয়েছেন এবং তাঁকে পাকড়াও করবার মতো নির্ভরযোগ্য সংবাদ দিতে পারলে সরকার এত হাজার টাকার পুরস্কার দেবেন। ওই টাকার অঙ্কটাই জিভে জল আনবার কারণ।
এ সমস্ত ছাড়াও এক রকমের হারানো আছে, সে একেবারে নির্ভেজাল হারানো। হারাধন বাবু একশ পঞ্চাশ টাকার কেরানি। বয়স হয়েছে। বড় ছেলেটি এবার বি.এ. দেবে। হারাধনবাবু সাহেবকে বলে রেখেছেন, পাস করলেই অফিসে ঢুকিয়ে দেবেন ছেলেকে। ছেলেটি পরীক্ষা দিলে ভালোভাবেই। ফল বেরুবার আগের দিন রাত্রে ছেলেটি ঘুমোতে ঘুমোতে কাশতে আরম্ভ করলে, কাশতে কাশতে বমি। তাড়াতাড়ি ছেলের মা গেলেন আলো নিয়ে। গিয়ে দেখলেন-শুধু বমি নয়, রক্ত বমি, হুড়হুড় করে কাঁচা রক্ত বমি বেরুচ্ছে, বন্ধই হয় না। যাক রাতে তো কোনও রকমে কাটল।
পরের দিন অফিসে বসে হারাধনবাবু ফাইল কাবার করছেন এমন সময় একটি ছোট্ট সংবাদ কানে গেল। বে অব বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হঠাৎ বেলা একটার সময় দরজা বন্ধ করেছে। হারাধনবাবুর আজীবনের সঞ্চয় আর তাঁর পিতার কাছ থেকে পাওয়া যা কিছু ওই ব্যাঙ্কেই জমা ছিল। ব্যাঙ্কটি ছিল শ্রী শ্রী ১০৮ শ্রীঅমুকানন্দ বাবার আশীর্বাদপূত, টাকাটাও হারাধন ওই ব্যাঙ্কে ভরসা করে রেখেছিলেন সেই কারণেই। হারাধনবাবু হারিয়ে গেলেন। নিজের অফিসে নিজের চেয়ারে বসে হারিয়ে গেলেন। এমন উধাও হয়ে হারিয়ে গেলেন যে, ইহলোকে কেউ আর তাঁর পাত্তা পেল না।
এই ভাবের নানা প্রকার হারানো পৃথিবীতে চালু আছে। কিন্তু সেই রাত্রে আমাদের একদল লোকের উট দুটি সহ হারানো হচ্ছে অন্য ব্যাপার। তার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না।
পা ফেলছি, এগিয়েও চলেছি, কিন্তু কোথা? কোন দিকে? কে তার উত্তর দেবে! উত্তর দিতে পারে উট, কিন্তু তারাও মাঝে মাঝে থেমে মাথা উঁচু করে এধার-ওধারে মুখ ঘুরিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে, মানে সন্দেহ জাগছে তাদের মনেও।
চারিদিকে-উপর নীচ সমস্ত লেপে পুঁছে একাকার হয়ে গিয়েছে। দু-হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না! আরও দূরে কি আছে, সমানে কিসের উপর গিয়ে পড়ব, কিসের ধাক্কা খাব বলতে পারি না। যদি উল্টো দিকেই আমাদের গতি হয় তবে সারারাত এইভাবে চলে কোথায় কত দূরে গিয়ে পড়ব তারই বা ঠিক কি। আবার যখন দিনের আলোয় ভুল বুঝতে পারা যাবে তখন সেই প্রখর তাপে কুয়োর কাছে ফিরে যাবার সামর্থ্য শরীরে থাকবে কিনা, কিংবা সেই পর্যন্ত কুঁজোর জলে চলবে কিনা তাই বা কে বলতে পারে! ওই অন্ধকারের উদরের মধ্যে কি যে আছে আমাদের ভাগ্যে–উল্টে-পাল্টে এই এক প্রশ্ন মনে মনে তোলাপাড়া করতে করতে সত্যিই নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেললাম।
মৃত্যু জিনিসটা ভালো না মন্দ, তেতো না মিষ্টি, এ ধরনের প্রশ্নের শানানো জবাব হয়তো দেওয়া যায়। শুনে প্রশ্নকর্তার মুখ বন্ধ হবেই তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মৃত্যু যে সত্যই কি পদার্থ তা জানবার অতৃপ্ত তৃষ্ণার নিবৃত্তি কিছুতেই হবে না। এই যে অজানা অন্ধকার জগৎট্টা, যার মধ্যে বাধ্য হয়ে এগিয়ে চলেছি পায়ে পায়ে, এই-ই মৃত্যু। একবার জানা হয়ে গেলে মৃত্যুর সমস্ত মহিমার ইতি হয় সেখানেই। অজানা আর অনাস্বাদিত থাকে বলেই মৃত্যুকে আমাদের এত সমীহ করে চলা, এত পাশ কাটাবার চেষ্টা। জানা হয়ে গেলে ওর মধ্যে আর কিছুই থাকে না।
দুর্নিবার আকর্ষণে আমরা ধীরে ধীরে সেই অজানা অনাস্বাদিতপূর্ব মৃত্যুর জগতে প্রবেশ করতে লাগলাম।
প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সারা অতীত কালটা তার সবটুকু মাধুর্য নিয়ে পা দুটি জড়িয়ে ধরতে লাগল। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলির খুঁটিনাটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ লাভ লোকসান প্রত্যেকটি বিরাট আকার ধারণ করে উপরে ভেসে উঠল যা এতকাল তলিয়ে ছিল বিস্মৃতির অতল তলে। যে জীবনটাকে কেবলমাত্র একটা মস্ত বড় ফাঁকি ভিন্ন অন্য কিছুই কোনো দিন মনে করতে পারিনি, সেই জীবন সাতরাজার ধন মানিক হয়ে এমন মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠল যে, তাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকাটাই চরম শান্তি বলে মনে হতে লাগল। আজ পর্যন্ত পথ চলতে যত ঠোক্কর খেয়েছি, সে সব আঘাত সে সমস্ত জ্বালার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। সারা জীবনভর না পাওয়ার ক্ষুব্ধ আক্রোশ, আর হাতে পেয়ে হারানোর জন্যে বুক চাপড়ে হাহাকার, এ সমস্তই কোথায় তলিয়ে গেল। পদ্মদীঘির হাস্যমুখী ফুলগুলির মতো চোখ জুড়িয়ে ভাসতে লাগল ক্ষণিকের জন্যে পাওয়া মধুময় মণিমুক্তাগুলি। আর সবই পাঁক-পানার মতো চোখের আড়ালে ডুবে রইল। নিজে নিজেকে এ হেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলাম যে, একে ছেড়ে যেতে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। হায় জীবন!
তবুও অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছি নিয়তির করাল গ্রাসের মধ্যে।
অসংখ্য ছোটবড় “যদি” চারিদিক থেকে মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। যদি কোনো রকমে আজ পরিত্রাণ পাওয়া যায়, যদি সামনেই হঠাৎ এমন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যার ফলে একটি সুশীতল জলের কুয়া আর মাথা গোঁজবার আশ্রয়স্থান দুই-ই যায় জুটে, যদি কোনো অপার্থিব ইঙ্গিত পাওয়া যায় যার অনুসরণ করে ঠিক পথটি আমরা ধরতে পারি, যদি মা হিংলাজ তাঁর কোনো চর-অনুচরের হাতে একটা মশাল দিয়ে পাঠিয়ে দেন যার আলোয় অন্ধকারের পরদাটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়! এই সমস্ত সম্ভাব্য অসম্ভাব্য ‘যদি’র পর ভবিষ্যৎ বলতে যদি কিছু থাকে–তবে সেই ভবিষ্যতের গর্ভে আছে মধু-শুধু মধু। মধু নয়, একেবারে অমৃত, অমৃতের নদী বয়ে যাবে সেই ভবিষ্যতে। সেই ভবিষ্যৎটাকে রূপে রসে বর্ণে গন্ধে এমন অপরূপ করে গড়ে তুললাম যে, তার ছটায় নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। আমারই সৃষ্টি আকাশ-কুসুমের সৌন্দর্য আর কারুকার্যের দিকে চেয়ে চেয়ে আমারই নেশা চড়ে যেতে লাগল।
সেই ভবিষ্যতেরঘৃণা নেই, ক্রোধ নেই, দ্বেষ-হিংসা, মারামারি খেয়োখেয়ি এ সমস্ত কোনো খুঁত নেই। হীরা-মাণিক্যের ইঁট দিয়ে গেঁথে সেই সোনার ভবিষ্যৎ সৌধটিকে আকাশচুম্বি করে তুললাম। তারপর অকস্মাৎ জীবন্ত বর্তমানের সঙ্গে লাগল এক বিষম ধাক্কা, নিমেষে আমার এত সাধের সোনার ভবিষ্যৎ ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
উটের উপরে কুম্ভী চাপা গলায় বলে উঠল-”উঃ, ছাড়ো-লাগে যে, ছিঃ!” উন্মাদ পিরুমল হি হি করে হেসে উঠল-লজ্জাহীন হাসি।
সামান্য ধস্তাধস্তির শব্দ কানে এল।
পুনরায় কুন্তী সামান্য কাতর শব্দ করলে। সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে একটি ছোট্ট চড়ের শব্দ কানে গেল।
আবার সেই হি হি করে হাস্যধ্বনি।
বর্তমানের বুকের চাপে ভবিষ্যতের নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।
হঠাৎ সামনে থেকে ব্যস্ত গুলমহম্মদ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল-”হুঁশিয়ার, তুফান!”
নিমেষে সমস্ত দলটার গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। কানে এল শোঁ শোঁ গোঁ গোঁ আওয়াজ। যেন একপাল বন্যজন্তু বহুদূর থেকে তেড়ে আসছে। আমরা গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
রূপলাল চেঁচাতে লাগল, “বসে পড়ো, বসে পড়ো সবাই, মাটি কামড়ে বসে পড়ো।”
দিলমহম্মদ ঊর্বশীকে বসাতে লাগল, “হা-হৈ-টা-টা!” ঊৰ্বশী বসতে না বসতে কুন্তী লাফিয়ে পড়ল মাটিতে ভৈরবীর পাশে। নেমেই ভৈরবীকে দু হাতে ঝাঁপটে ধরল।
মাথার উপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে চলে গেল এক বালির পাহাড়।
দিলমহম্মদ একটানে থিরুমলকে নামিয়ে আনল খাঁটিয়া থেকে। পোপটলাল তাকে চেপে ধরে বালির উপর শুয়ে পড়লেন। আমরা উপুর হয়ে পড়ে বালিতে মুখ গুঁজে দিলাম।
মহা হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেল আমাদের উপর। যেন হাজার হাজার মত্ত হস্তী মহাশূন্যে জ্ঞানশূন্য হয়ে লড়ছে। জাপটাজাপটি আছড়া-আছড়ির প্রলয়ঙ্কর শব্দ মুহূর্ত মধ্যে চরমসীমায় পৌঁছল। তার সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর দৈত্য কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে তার বিরাট থাবার সুতীক্ষ্ণ নখ দিয়ে নিরেট অন্ধকারটাকে চিরতে লাগল। একই সঙ্গে চলতে লাগল সব কিছু। নিশ্বাস বন্ধ করে আমরা পড়ে রইলাম বালিতে মুখ গুঁজে।
ছুটে এল কারা মহাশূন্য থেকে জল ঢালতে ঢালতে, চলেও গেল নিমেষের মধ্যে। আবার আর একদল এল, চলে গেল তৎক্ষণাৎ। দলে দলে বরুণদেবের অনুচরেরা মহাবিক্রমে জল ছুঁড়তে ছুঁড়তে করলে তাড়া, যারা অনর্থক কেলেঙ্কারি করছিল–সেই ঘূর্ণি আর বালুর ঝাঁপটাগুলোকে। ঝেঁটিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল তাদের একদিকে।
ধীরে ধীরে সকলে উঠে বসলাম। বসে প্রথমে দম নিলাম। শরীরের উপর রাশিকৃত বালি জমেছিল। তার উপর জল পড়ে সে এক জমাট আস্তরণ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর কিছুক্ষণ ধরে এ ব্যাপার চললে একেবারে জীবন্ত সমাধি হয়ে যেত। বালি ঝেড়ে সবাই উঠে দাঁড়ালাম। সব ঠিক আছে, সামান্য যা ভিজেছে তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং প্রাণ জুড়িয়ে গেছে বলা চলে।
দুটো হ্যারিকেন লন্ঠন জ্বালিয়ে মালপত্র পরীক্ষা করে দেখা হল। উটদের দাঁড় করিয়ে গুলমহম্মদ পরম আদরে তাদের গলায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সাবাস দিলে। আকাশে দেখা গেল-ঐ ছায়াপথ, ঐ ধ্রুবতারা। আমরা ঠিক পথেই এসেছি। কুয়ো আর বেশি দূরে নয়।
রূপলাল চেঁচিয়ে উঠল-”হিংলাজ মাতা দেবী কি–”, প্রাণভরে সবাই মুক্তকন্ঠে জবাব দিল–”জয়”, আবার আমরা অগ্রসর হলাম।
কুন্তী আর কিছুতেই থিরুমলের সঙ্গে চলতে রাজি নয়। সে আবার ভৈরবীর সঙ্গ ধরলে। হিংলাজ মাতাকে দর্শন করতে চলেছে সে, পথে কোনো পাপ কোনো অন্যায় যেন আর তাঁকে স্পর্শ করতে না পারে। কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল কুন্তী। যথেষ্ট লাঞ্ছনা হয়েছে তার, আর না। এবার তাকে বাঁচতে হবে। মায়ের স্থানে পৌঁছে মায়ের দর্শন পেলে তার সমস্ত কলুষ কালিমা নিঃশেষে ধুয়ে মুছে যাবে। আবার সে ফিরে পাবে আগেকার জীবন, ফিরে পাবে রাজস্থানের সম্মানী জোতদারের শান্ত পবিত্র কন্যার নিজস্ব স্থানটুকু। সম্মান, আশ্রয়, সমাজ-জীবন, সব কিছু আবার ফিরে পাবে সে মায়ের কৃপায়। আর তা যদি না হয় তবে চিরকালের জন্য ভৈরবীর আশ্রয়-ওই গেরুয়া ওই কমণ্ডুলু আর সিন্দুর মাখানো ত্রিশূল। ভৈরবীর পায়ের উপর আছড়ে পড়ল সে–পড়ে মাথা খুঁড়তে লাগল। তাকে বাঁচাতেই হবে। তাকে ওই পাপ থিরুমল আবার যদি স্পর্শ করে, তবে তার হিংলাজ-দর্শন ভাগ্যে ঘটবে না কিছুতেই ৷
কুন্তীকে নিয়ে ভৈরবী উটের পিঠে চড়লেন। থিরুমলকে নিয়ে পোপটলাল এগিয়ে গেলেন। তখনও সে সমানে ফিক ফিক করে হাসছে। তাকে নিয়ে সকলে যে ক্রুদ্ধ আলোচনা করছে সে সমস্ত তার কানেই ঢুকছে না। হিতাহিত জ্ঞানটুকু হারালে ওই একমাত্র শান্তি, লোকের নিন্দা-কটাক্ষের পরোয়াও থাকে না।
তারপর ‘আর বেশি দূর নয়’ যে কুয়ো, তার কাছে আমরা পৌঁছলাম আরও ঘণ্টা তিনেক পরে।
সেখানে একটা গাছের তলা পর্যন্ত জুটল না। কুয়োর ধারেই উঁচু জায়গায় ভাগে ভাগে আসন পাতা হল। কুন্তী আর সুখলালকে নিয়ে ভৈরবী একধারে কম্বল বিছালেন, আমার কম্বল তার সামনেই পাতা হল। ওদের মাথার দিকে উট দুটিকে বসিয়ে মালপত্র তার পাশে টাল দিয়ে রাখা হল। উটের ওপরে রূপলাল আর পোপটলাল থিরুমলকে নিয়ে শোবার ব্যবস্থা করলেন। অন্য সকলে কাছাকাছি কম্বল বিছাল।
শ্রীজয়াশঙ্কর তাঁর শিষ্য-সেবকদের নিয়ে কুয়োর ওপারে গুছিয়ে বসলেন। সকলের থেকে আলাদা থাকাই তাঁর প্রয়োজন। একে তাঁর তীক্ষ্ণ ব্রাহ্মণত্ব, তার উপরে শরীরের যা অবস্থা, তাতে বাকি রাতটুকুতে কতবার লোটা হাতে ছুটতে হবে তার ঠিক নেই ৷
গুলমহম্মদ সমস্ত ঠিকঠাক করে এসে আমার কাছে বসল। বললে, “হুজুর কেন গোসল করে নিলেন না? বালুর ঝড়েতে ভয়ানক তকলিফ হয়েছে নিশ্চয়ই। গোসল করলে আরাম পেতেন।”
বললাম, “তা তো পেতাম। কিন্তু এ সময় জল কোথায় পাব?”
সে বললে, “এখানে কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে জল তোলবার ব্যবস্থা আছে। চলুন জল উঠিয়ে দিচ্ছি।”
বুঝলাম নিশ্চয়ই চায়ের প্রয়োজন হয়েছে বুড়ো মানুষটির। বললাম, “তা চলো, তার আগে বরং দিলমহম্মদকে বলে দাও-একটু চায়ের জল গরম করতে, যদি ও সময় কাঠকুটো কিছু জোটে।”
এই-ই চাইছিল সে। বললে, “বহুত খুব। আগুন জ্বলবে না কেন? কি আফসোসের বাত। আমি আগুন জ্বালাচ্ছি, বাচ্চা আপনার জল তুলে দিক।” হাঁক দিয়ে ছেলেকে বোধ হয় সেই হুকুমই করলে।
ভৈরবীকে বললাম, “মাথা ধুয়ে ফেলতে চাও তো উঠে এসো।” দড়ি বালতি আর হাঁড়ি নিয়ে ভৈরবী এগিয়ে এলেন।
কুন্তী উঠে চলে গেল চা করতে। যত সামান্যই হোক, সকলের সেবায় সে সর্বদা প্রস্তুত। তবে আজ সে বড় গম্ভীর হয়ে পড়েছে। যে লীলাচঞ্চল ভাবটি এই এ কদিন বজায় ছিল, রাস্তার সেই ঘটনার পর থেকে সেটুকু কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে।
ওধারে তখন আগুন জ্বলে উঠেছে, সে আগুন অবশ্য জ্বলছে বড় কলকের মাথায়। এখানে কুয়োর ধারে একখানা বড় কাঠ পড়ে আছে, তার উপর দাঁড়িয়ে জল তোলা গেল। একটা ছোট কাঠের ডোঙাও আছে সেখানে। সেই ডোঙাতে উটে ছাগলে জল খায়। বালতি করে জল তুলে হাঁড়ির মুখে গামছা বেঁধে ছেঁকে নেওয়া হল। জলে বড় দুর্গন্ধ। যাক –তবুও ঠান্ডা জল, একরকম স্নান করেই এলাম আমরা
রূপলালকে ডেকে তার আর থিরুমলের চা নিয়ে যেতে বললাম। থিরুমল ঘুমিয়ে পড়েছে, পোপটলাল তো চা খানই না। আমি গুলমহম্মদ আর রূপলাল আরামসে আরাম করে সেই শেষরাত্রে চা-পান করলাম। তারপর শয়ন।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত করতে লাগল। মশারাও সেখানে থাকেন না। চোখ জুড়ে এল। ঘুম ভাঙল স্বপ্ন দেখতে দেখতে। চমৎকার মিঠা হাতের হারমোনিয়াম বাজছে কোথায়। অতি দ্রুত তালের একটি সুর। ঝড়ের বেগে একবার উঠছে চড়া পর্দায়, পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে খাদে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে তালে তালে আবার এগিয়ে আসছে। সুরের যেন জাল বুনে চলেছে, সুরের মূর্ছনায় মাদকতা আছে, বেশ ঘোর লেগে গেল। একটু পরে মনে হল, এ কি স্বপ্ন নয় তো, সত্যিই বাজনা শুনছি! চোখ চেয়ে উঠে বসলাম।
হাঁ, সত্যিই হারমোনিয়াম বাজছে, বাজাচ্ছে থিরুমল। সবাই তাকে ঘিরে বসেছে। সে চোখ বুজে হাত চালাচ্ছে সেই হারমোনিয়ামটার উপর।
ভৈরবী তখনও নিদ্রামগ্ন, তাঁর পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে কুন্তী। একদৃষ্টে সে চেয়ে আছে থিরুমলের দিকে। মাঝখান থেকে উট দুটি উঠে যাওয়ায় আর আড়াল নেই। কুন্তীর দুই চোখ থেকে দুটি জলের ধারা নেমেছে। গাল বেয়ে সেই অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে তার বুকে, টেরও পাচ্ছে না কুন্তী।
ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া তখনও বইছে, একটু পরেই সূর্যদেব উঠে আসবেন। তখন সমস্তই তেতে উঠবে। পায়ের তলার বালু, মথার উপরের আকাশ এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মেজাজও। কিন্তু আরও একটু বিলম্ব আছে তার।
গালে হাত দিয়ে বসা অশ্রুমুখী কুন্তীকে লাস্যময়ী এক তরুণীর আবরণে মমতাময়ী মায়ের মূর্তি, করুণার প্রতিমাখানি। চুপ করে বসে রইলাম, হারমোনিয়াম বেজেই চলল।
ওধারে হঠাৎ কি হল এই ভোরবেলায়! একসঙ্গে চিৎকার গালাগালি ঝগড়া সব মিলিয়ে মহা গোলমাল বেঁধে গেল। আমরা যেখানে শুয়ে-বসে রয়েছি সেখান থেকে ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানে একটা বালির টিলার আড়াল পড়েছে। অনেক
গলার আওয়াজের সঙ্গে মাঝে মাঝে গুলমহম্মদের গলাও শোনা যেতে লাগল। রূপলাল এবং আরও দু-চারজন উঠে গেল।
আঁচলে চোখের জল মুছে কুন্তী উঠে দাঁড়াল থিরুমলের সামনে। থামল বাজনা। মুখ তুলে কুন্তীর দিকে চেয়ে থিরুমল মধুর হাসি হাসলে। স্পষ্টই দেখতে পেলাম সে হাসি সে দৃষ্টি ইঙ্গিতমুখর, প্রাণময়-উন্মাদের অর্থহীন প্রলাপ নয়।
কুন্তী বললে, “উঠে এসো, মুখ হাত ধুয়ে নাও।”
হারমোনিয়াম ঠেলে রেখে থিরুমল উঠে দাঁড়াল। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“কেন, তুমি কি ভুলে গেলে নাকি আমরা হিংলাজ-মায়ের দর্শন করতে যাচ্ছি, তোমার মনে পড়ছে না?” এই বলে কুন্তী-বোধ করি মা হিংলাজের উদ্দেশেই-হাত জোড় করে কপালে ঠেকালে।
থিরুমল মাথা হেঁট করে পায়ের দিকে চেয়ে তার রুক্ষ চুলের ভিতর আঙুল চালাতে লাগল। কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে, খুঁজছে।
কুন্তী এগিয়ে এসে তার হাত ধরলে, “চলো এখন, মুখ হাত ধোবে।”
শান্ত ছেলেটির মতো চলে গেল থিরুমল কুন্তীর সঙ্গে। এক লোটা জল নিয়ে গেল কুন্তী ৷
ভৈরবী মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, “যাক, বাঁচা গেল। এবার ছেলেটা হুঁশ ফিরে পাচ্ছে। মা নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন-নয়তো মেয়েটার গতি হবে কি!”
বলেই তিনি উঠে বসলেন।
ওধারে গণ্ডগোলটা বেড়েই চলেছে। কার সঙ্গে কার ঝগড়া হচ্ছে আর কি নিয়েই বা লাগল ঝগড়া? ভাবছি উঠে যাব কিনা।
ভৈরবী বললেন, “কোথাও একগাছা খড়কুটো নেই এখানে। চারিদিকে একেবারে খাঁ খাঁ করছে। কে জানে আজ এখানে কি করে সারাদিন থাকা হবে!”
তাই-ই হল। রোদের তখন এত তেজ যে চোখ চাওয়া যায় না, বালিও তেতে আগুন, সূর্যদেব ঠিক মাথার উপরে এসে রক্তচক্ষু করে চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। সেই সময় আমাদের উঠতে হল সেখান থেকে ৷ না উঠে উপায় ছিল না।
বহু চেষ্টা করেও আগুন জ্বালাবার মতো কিছুই জুটলো না, তখন আটা জলে গুলে তার সঙ্গে গুঁড় মিশিয়ে যে যতটা পারলে গিললে। আমাদের বরাতে কাঁচা চিনাবাদাম আর খেজুর। সব চেয়ে বড় দুঃখ, ঊর্বশী আর তার মা স্রেফ জল খেয়ে রইল। জলও তেমনি, যেমন বিস্বাদ আর দুর্গন্ধ তেমনি নোংরা। তাই ছেঁকে ছেঁকে কুঁজো ভর্তি করা হল। প্রত্যেকের কুঁজোয় ভৈরবী সামান্য একটু করে কর্পূর দিয়ে দিলেন। আমি সহযাত্রীদের দুটো করে পেঁয়াজ নিতে অনুরোধ করলাম।
এই জ্বালানীর জন্যেই সকালে হাঙ্গামা বেঁধে গিয়েছিল এখানকার কুয়োওয়ালার সঙ্গে। লোকটিকে প্রেতের মতো দেখতে। লম্বায় সাধারণ একটা মানুষের দেড়গুণ হবে তার শরীর, কিন্তু সেই দীর্ঘ শরীর শুধু একখানা শুকনো কোঁচকানো চামড়া ঢাকা একটা প্রকাণ্ড কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু নয়।
সাজপোশাক বলতে যা কিছু ওর গায়ে ঝোলানো আর মাথায় জড়ানো রয়েছে তার কোনও নাম না দেওয়াই ভাল। ফালি ফালি লম্বা ছেঁড়া কতকগুলো ন্যাকড়ার টুকরো যা এককালে হয়তো ওর পায়জামাই ছিল-তাই কোমর থেকে ঝুলছে। এই একই অবস্থার একটা কিছু গলায় ঝোলানো আছে-তাতে সামনে পিছনে কিছুই ঢাকা পড়েনি। আর মাথায় যা জড়ানো আছে তাকে ন্যাকড়াও বলা চলে না। সব চেয়ে ভীষণ ওর কোটরগত চক্ষুর দৃষ্টি। সে দৃষ্টিতে জলজ্যান্ত ক্ষুধা বহুদূর থেকে লম্বা জিহ্বা লক লক করে ছুটে আসছে।
মহাদুর্ভিক্ষের এই জীবন্ত প্রতিমূর্তি কোথা থেকে কতকগুলো কাঁটার ডালপালা জুটিয়ে এনে একখানা কুঁড়ে বানিয়েছে। তার মধ্যে বুকে হেঁটে ঢুকতে বেরতে হয়। সেইভাবেই সেই কাঁটা দিয়ে বানানো গহ্বরের মধ্যে এই লোকটি বাস করে বেঁচে আছে। কোনো গৃহস্থ ওর কুয়োর জল নেয় না। কারণ গৃহস্থরা এই কুয়োর ত্রিসীমানায় বাস করে না। বাস করবে কি করে? তাদের উট ছাগল খাবে কি? কেউ যদি কখনো এই পথে যায় তবে উটকে খানিক জল খাওয়ায়। আর এই মনুষ্যসন্তান এখানে পড়ে আছে তার অন্তহীন ক্ষুধা নিয়ে। একমাত্র ক্ষুধা দিয়ে ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করা ভিন্ন এর আর অন্য কোনো উপায় নেই।
আমাদের মধ্যে কে গিয়ে ওর সেই কাঁটার ডালপালা ধরে টান দিয়েছিল। কি করে বুঝবে যে ওটা একটা বাসগৃহ। আর যাবে কোথা, একটা মানুষ নেকড়ে বেরিয়ে এল বুকে হেঁটে সেই কাঁটার স্তূপের নীচে থেকে। বেরিয়ে এসেই সেই লোকটির শরীর থেকে এক খাবল মাংস ছিঁড়ে নেবার জন্যে দাঁত বার করে তেড়ে এল। ভাগ্যে সেই সময় সেখানে গুলমহম্মদ গিয়ে পড়ে, নয়তো ভয়েই সে বেচারা অক্কা পেত নির্ঘাত।
তারপর শুরু হয় ঝগড়া, যার মীমাংসা কিছুতেই হল না। হবে কি করে মীমাংসা? টাকা-পয়সা দিতে যাওয়া হল, সে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আটা দিতে যাওয়া হল, আটা নিয়ে সে কি করবে? রুটি বানাবে সে কি দিয়ে? আগুন জ্বালাবার সরঞ্জাম কই? একমাত্র সে সন্তুষ্ট হবে রুটি পেলে। হায় রুটি! পোড়া পেটের জ্বালায় পোড়া রুটি ভিন্ন আর সব কিছুই তার কাছে মূল্যহীন আবর্জনা মাত্ৰ ৷
সেই রুটিই আমরা দিতে পারলাম না তাকে। কেউই তাকে দেয় না। কারণ কেউই কিছু বানায় না এখানে। বানাবার জন্যে আগুন কোথায়? কি বিড়ম্বনা!
ভৈরবী দিলেন তাকে চীনাবাদাম আর খেজুর। হিংস্র জন্তুর ভঙ্গিমায় তৎক্ষণাৎ সে খেতে আরম্ভ করলে। তার দৃষ্টি, তার সর্বেন্দ্রিয়, তার সমস্ত সত্তা হাউ হাউ করে চিবোতে লাগল, গিলতে লাগল। সে ভুলে গেল আমাদের কথা, ভুলে গেলে দুনিয়ার কথা। চুপি চুপি আমরা খানিক আটা রেখে দিয়ে পালিয়ে গেলাম।
পোপটলাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “ওকেও যদি সঙ্গে নেয়া যেত!”
একটা মানুষকে ওভাবে ওইখানে একলা ফেলে রেখে চলে যেতে কোথায় যেন টনটন করতে লাগল। কিন্তু কি করা যাবে?
বস্তা বস্তা আটা উটের পিঠে চলেছে। আর আমরা সকলে শূন্য উদরে সেই আটার পিছন পিছন হাঁটছি। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।
নিতান্ত কাবু হয়ে পড়েছেন জয়াশঙ্কর। মেজাজ তাঁর ততোধিক বিগড়ে উঠেছে। গত রাত থেকেই জঙ্গলে গেলে তাঁর শরীর থেকে রক্ত ছাড়া আর কিছুই বেরোয়নি। দুজনের কাঁধে ভর রেখে কোনো প্রকারে তিনি হাঁটছেন। তাঁর দিকে চাওয়াই যায় না। চাইলেই একটা বিশ্রী আশঙ্কায় প্রাণটা কেঁপে ওঠে। মাঝে মাঝে তিনি একটু করে জল খাচ্ছেন। তাঁর কাপড়েও রক্তের দাগ লেগেছে, অবস্থা এতই শোচনীয়।
ভয়ানক গম্ভীর হয়ে পড়েছেন সদাহাস্যমুখ পোপটলাল প্যাটেল। তাঁর দলের একটি জোয়ান ছেলে, নাম তার মণিরাম, তার জ্বর উঠেছে। সে কি সহজ জ্বর-তার মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, এখনই মুখ ফেটে রক্ত ছুটবে চারিদিকে। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুখে চোখে এসে জমা হয়েছে। হাঁসফাঁস করে হাঁফাচ্ছে সে। এই রোদে তাকে একরকম বয়েই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হাঁটছে থিরুমল, হাঁটছে কুন্তী। থিরুমলকে আজ আর হাত ধরে নিয়ে যেতে হচ্ছে না। ঘাড় গুঁজে একমনে কি চিন্তা করতে করতে সে চলেছে। মাথার উপর আগুন ঢেলে দিচ্ছে, পায়ের তলায় গনগনে আগুন, কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার, সে আপন চিন্তায় বিভোর।
একখানা গামছা ভিজিয়ে মাথায় মুখে চাপা দিয়েছিলাম। কয়েক পা চলতেই সেটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। জল-বার বার জল পান করছে সবাই। সেই উত্তপ্ত বিস্বাদ জল ঠোঁট পার হয়ে গলা দিয়ে যতদূর গিয়ে নামছে ততদূর জ্বালা করছে, শীতল হওয়া তো দূরের কথা। নিশ্বাস বেরুচ্ছে, তাও গরম আগুন। মাঝে মাঝে খানিক চোখ বন্ধ করে চলেছি; চোখ খুলে রাখলেও জ্বালা করছে, বন্ধ করে রাখলেও তাই। চতুর্দিকে মা ধরিত্রীর দেহ থেকে উত্তপ্ত বাষ্প উঠেছে, আর আকাশটাও যেন অনেক নীচে নেমে এসেছে। বাতাস বইছে, বেশ বেগেই বইছে বাতাস। সে বাতাস নাক দিয়ে ঢুকে ভিতরে পৌঁছে সেখানটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে!
একটু জল চাইলাম ভৈরবীর কাছে। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন পেঁয়াজের কথা, “জল আর গিলবেন না, একটা পেঁয়াজ চিবোন।”
আঁচলের মাথা মুখ চোখ ঢেকে কুন্তী হাঁটছিল আমার পিছনেই। এইবার সে টলতে লাগল। ভৈরবী উটের উপর থেকে দেখিয়ে দিলেন তার অবস্থা। কিন্তু ঊর্বশী চলেছে একেবারে উপবাস করে, তার পিঠে আর একজনকে নেবার কথা বলা যায় কি করে?
কুম্ভীকে বললাম একটা পেঁয়াজ চিবোতে। আমিও একটায় এক কামড় দিলাম। প্রথম কামড়টা যথানিয়মে উৎকট লাগল। কিন্তু চিবিয়ে রসটা একটু গলা দিয়ে নামতে বেশ স্বস্তি পাওয়া গেল। চর্বণ করতে লাগলাম কাঁচা পেঁয়াজ।
বৃষ্টি বর্ষা বাদল-আরও আদুরে নাম বাদর, আরও কত না সব নাম মনে পড়ছে! সব-কটি কথাতেই এমন একটা ঝরঝর ঝরে-পড়ার আমেজ পাওয়া যায় যাতে শরীর মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যায়। শুধু জড়িয়ে যাওয়া নয়, এলিয়ে পড়ে মন প্রাণ যখন ওই কথাগুলি মনে আওড়ানো যায়। তাই করছিলাম চোখ বুজে পেঁয়াজ চিবোতে চিবোতে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল দু-লাইন
“প্রেমের বাদল নামল, তুমি জান না হায় তাও কি,
আজ মেঘের ডাকে তোমার মনের ময়ূরকে নাচাও কি?”
এখানেও বাদল নেমেছে। কিন্তু প্রেমের নয়। এমনকি, সাদাসিধে জলের বাদলও নয়। অনলের বাদল নেমেছে। অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। মনের ময়ূরের পালক পাখা পুড়েই ছাই হয়ে গেছে অনেক আগে। বেচারা ঝলসে ঝলসে ছটফট করতে করতে মরছে। নাচাব কাকে?
গতরাত্রে এখানেও বাদল নেমেছিল, মেঘও ডেকেছিল, কিন্তু তাকে বাদল নামা বলা চলে না, আর সে মেঘের ডাকে ময়ূর নাচা তো দূরের কথা, প্রাণ খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড় হয়। বাংলা দেশের আকাশে বাতাসে, ঘাটে মাঠে, কুঁড়েঘরের চালে, গাছপালার মাথায়-ধীরে-সুস্থে ঘনিয়ে ওঠে যে গা-এলিয়ে-যাওয়া ভাবটি বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে, সে এখানে আকাশকুসুম। আকাশের জলের ধারায় মানুষের ভিতর বাহির সমস্ত ভিজে নরম হয়ে গলে গলে পড়ে না এখানে। এখানকার যে বর্ষার সঙ্গে পরিচয় হল তার আবির্ভাব আর অন্তর্ধানের ফাঁকটুকুতে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ওঠে। এ বর্ষা মেয়ে নয়, এ এক বুট-পট্টি-সাঁটা জঙ্গি জোয়ান। গটমট করে এসে হুড়মুড় করে আপন কার্য সেরে দুমদাম করে চলে গেলে, এর সঙ্গে কি তুলনা করা চলে বাংলা মায়ের বর্ষণমুখর রূপটিকে! এখানে কোথায় খুঁজে পাব বাংলার বর্ষার সেই বাঁধন-ছেঁড়া রাগিণীটিকে! কোথায় খুঁজে পাব সেই ক্রন্দনমুখী মেয়েটিকে এই মুখপোড়া মুল্লুকে!
হঠাৎ সব ঘুলিয়ে গেল। হঠাৎ কখন বর্ষা নেমে এল, নামল আমার মনে-প্রাণে আমার সমস্ত সত্তায়। মশগুল হয়ে গেলাম