ভেন্ডিং মেশিন দর্শনের পেছনের তর্ক
কমিউনিটি সেন্টার থেকে পাক্কা চার ঘণ্টা হাঁটার পর অবশেষে এপার্টমেন্টে পৌঁছালাম। নিজের ঘরের পরিচিত গন্ধটা খুবই স্বস্তি দিচ্ছিল আমাকে।
ঘামে ভিজে জবজব করছিল গোটা শরীর, পায়ে উঠেছে ফোঁড়া। কাপড়চোপড় খুলে গোসলের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি, এমন সময় আচমকা মনে হলো-মিয়াগি আগে গোসল করলেই বরং ভালো হবে। কিন্তু এভাবে যদি তাকে শ্রদ্ধা দেখানো কাজকর্ম করা শুরু করি, হয়তো আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব মিয়াগি স্বেচ্ছায় গড়ে তুলেছিল তা ভেস্তে যাবে।
বাথটাবের গরম পানিতে বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছেটা দমন করলাম। বরং ঝটপট গোসল সেরে, কাপচোপড় গায়ে দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি। পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে, আমি ঘুমাতে গেলেই কেবল মিয়াগির গোসল আর খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ মেলে। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরলাম। কিছুক্ষণ পরেই মিয়াগির প্রায় নিঃশব্দে বাথরুমের দিকে হেঁটে যাবার শব্দ কানে এলো। উঠে বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঠিক তখনই তার পায়ের আওয়াজটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুনলাম। তাড়াহুড়ো করে চোখ বন্ধ করলাম আবার।
“কুসুনোকি,” সে আমাকে ডাক দিল।
তার কথা না শোনার ভান করলাম।
“ঘুমিয়ে পড়েছ?” আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সে মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করল। “প্রশ্নটা করলাম, কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি ঘুমানোর ভান করছ। আর যদি তা সত্যি হয়ে থাকে, তবে আশা করি সেটা আমার কথা ভেবেই করছ-শুভরাত্রি। আমি তোমার বাথরুমটা একটু ব্যবহার করলাম।”
বাথরুমের দরজা বন্ধ হতেই আমি উঠে বসে ঘরের কোণে তাকালাম, যেখানে মিয়াগি আস্তানা গড়ে তুলেছিল। এখন অবশ্য সে ওখানে নেই। আজকেও কি ওখানেই ঘুমাবে ও? অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে বসে কয়েকমিনিট করে চোখ বন্ধ আর চোখ খুলে নির্ঘুম রাত পার করবে আজো?
পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমি ওখানে বসে ওরই ভঙ্গিতে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ পার হবার পরেও চোখে ঘুম আসল না। ইতোমধ্যে মিয়াগি গোসল সেরে ফিরে এসেছে। আমার কাঁধে টোকা দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী করছ তুমি? তোমার এখন বিছানায় থাকার কথা।”
“তুমি কেন আমার বিছানাটা ব্যবহার করছ না? এখানে যে তুমি ঘুমাও, সেটা ভাবতেও অবাক লাগে আমার কাছে।”
“অবাক হলেও আমার সমস্যা হচ্ছে না। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এতে।”
বিছানায় শুয়ে আমি একপ্রান্তে সরে গেলাম। “আমি বামপাশটায় শোব। যাই ঘটুক না কেন, আমি ডানদিকে ঘুণাক্ষরেও তাকাব না কিংবা অন্য কিছু করার চেষ্টা পর্যন্ত করব না। আমার পাশে শুয়ে থেকে আমাকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে তোমার জন্য। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোমার স্বাধীনতা, তবে আমি কিন্তু এখানেই শোব।”
আমার পাশে শোবার অফার সরাসরি দিলে হয়তো সে রাজি হবে না, তাই এভাবেই ভেবেচিন্তে তাকে অফারটা দিলাম।
“তুমি ঘুমের ঘোরে এসব কথা বলছ নাকি?” মিয়াগি নিশ্চিত হবার চেষ্টা করল।
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। বিশমিনিট পর টের পেলাম, মিয়াগি আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে। তার কিছুক্ষণ পরেই তার স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কানে এলো আমার। আজ সেও ক্লান্ত ছিল।
দুজনে পিঠে পিঠ লাগিয়ে বিছানাটা ভাগাভাগি করে নিলাম। আমি জানতাম, আমার এই পরিকল্পনাটা ছিল সম্পূর্ণই আমার স্বার্থের জন্য। এসব করে আমি শুধু মিয়াগির কাজের চাপ বাড়াচ্ছি। অন্য সময় হলে সে এসব করার কথা ভাবতও না। এতবছর ধরে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করতে করতে তাকে অনেক কঠোর হতে হয়েছে। তার প্রতি সদয় আচরণ করেই কেবল এই কঠোরতার খোলসটা ভাঙা সম্ভব। আর সে সদয় আচরণটা, হোক সেটা তুচ্ছ কোনো কাজ, যদি মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষের কাছ থেকে আসে, তবে সেটা আরও ভালো প্রভাব ফেলবে। অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগে না, বরং কষ্ট দেয়।
তা সত্ত্বেও মিয়াগি আমার উদারতা গ্রহণ করেছিল। ভেবে দেখলে মনে হবে কাজটা করে সে নিজেও আমার প্রতি সদয় আচরণ করেছে। কিংবা হয়তো এসবের কোনোটাই সত্যি না। হয়তো সে আজ খুবই ক্লান্ত ছিল বলে কোনো প্রতিবাদ না করে শুয়ে পড়েছে।
সূর্যাস্তের লালচে আভায় ঘুম ভাঙল আমার। ধরেই নিয়েছিলাম, মিয়াগি নিশ্চয়ই এর মধ্যে উঠে পড়েছে। কিন্তু না, আমার সাথে সাথেই ঘুম ভাঙল তার। উঠে বসে আলোর আভার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল সে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। সাথে সাথে আমরা দুজনেই চোখ সরিয়ে নিলাম। গভীর একটা ঘুমের পর তার চুল, জামাকাপড় সবই আলুথালু হয়ে গিয়েছিল। অরক্ষিত লাগছিল তাকে।
“আজ বেশ ক্লান্ত ছিলাম আমি,” সে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল। “আগামীকাল থেকে অবশ্য আগের জায়গাতেই ঘুমাব আমি।”
অবশ্য শেষে “তারপরেও ধন্যবাদ,” জানাল সে।
টলমলে পায়ে তার সাথে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে সিকাডারা দলবেঁধে গুঞ্জন করছিল।
বোধহয় এক বিছানায় শোবার কারণে মিয়াগি স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করছিল।
আমার যে অল্পকিছু সঞ্চয় ছিল, তা তুলতে বের হয়েছিলাম। টাকা তোলার সময় দেখলাম, এ মাসের বেতনটা একাউন্টে জমা হয়েছে।
এটাই আমার শেষ বাজেট হতে যাচ্ছে, ভাবলাম আমি। খুব সাবধানে খরচ করতে হবে এটা।
লালচে-বাদামি রঙের সেতুটায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর কাছেই অবস্থিত একটা বিফ-বোল এর দোকানে গেলাম। সস্তায় খাওয়া যায় সেখানে। এ দোকানে মেশিন থেকে টিকিট কিনে কাউন্টারে সেটা জমা দিয়ে খাবার অর্ডার করতে হয়। তাই মিয়াগি টিকিট কিনে সেটা আমাকে দিল, যাতে আমি তার খাবারটা কিনে দিতে পারি।
মিসো স্যুপের সবটুকু পেটে চালান করে দিয়ে আমি বললাম, “আর কিছু করার বাকি নেই আমার। আমার লিস্টের সবকিছু করে ফেলেছি। এখন আমার কী করা উচিত?”
“যা ইচ্ছে তাই করতে পার। তোমার নিশ্চয়ই কিছু শখ-টখ আছে, তাই না?”
“হ্যাঁ। গান শোনা আর বই পড়া-কিন্তু আজকাল মনে হয়, বেঁচে থাকার ইচ্ছে জোগাড় করার জন্যই ওসব করতাম আমি। এতদিন ধরে যে উদ্দেশ্যহীন, তুচ্ছ জীবনটা আমি পার করছিলাম, সেটার সাথে আপোস করার জন্য আমি এই গান শোনা আর বই পড়ার অভ্যাসটাকে ব্যবহার করে এসেছি। এখন ওসব করার কোনো দরকার নেই, তাই ওগুলোকে আর আগের মতো অতটা গুরুত্বপূর্ণ লাগছে না।”
“তাহলে যেভাবে ও দুটো জিনিস এতদিন উপভোগ করে এসেছ, সেই ধরনটা পাল্টে ফেল। এখন বরং ওগুলোর মধ্যে লুকায়িত সৌন্দর্যটা উপভোগ করা শুরু কর।”
“কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন জানি কোথাও গরমিল লাগছে। প্রত্যেকটা কাজ করতে গেলেই মনে হচ্ছে, ‘ওহ, এ কাজ করে আমার লাভ নেই।’ যেন এ পৃথিবীর সবকিছু যারা ‘বেঁচে আছে’ বা ‘বেঁচে থাকবে’, শুধুমাত্র তাদেরই জন্য। অবশ্য কথাটা কিন্তু ভুল নয়। মৃতপ্রায় কোনো মানুষের জন্য কেউ কিছু বানায় না।”
কাছাকাছি বসে থাকা পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন বাটির গরুর মাংস নাড়তে নাড়তে একলা বসে মৃত্যু নিয়ে বকবক করা ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকাল।
“একদম সহজ-সরল কিছু নেই, যা তুমি করতে ভালোবাস? উদাহরণ দিয়েই বলি, ধরো কেউ প্রত্নতত্ত্ব দেখতে, কেউ রেলওয়ে লাইনের পাশে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রত্যেকটা বোর্ডের সংখ্যা গুনতে, কেউ কয়েক যুগ পুরোনো, পরিত্যক্ত গেম সিস্টেমে গেম খেলতে পছন্দ করে—”
“উদাহরণগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট ছিল। আমার আগে পর্যবেক্ষণ করা মানুষগুলো কি এগুলোই করত?”
“হ্যাঁ। একজন ছিল সে তার পিকআপ ট্রাকের পেছনে বিছানা পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসত। তার জীবনের শেষ মাসটা সে এভাবেই কাটিয়েছিল। জীবন বিক্রির টাকাটা সে একদম দৈবক্রমে বেছে নেয়া এক বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমি চাই আপনি এই ট্রাকটা চালিয়ে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যান, সেখানে কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না।”
“শুনেই তো শান্তি শান্তি লাগছে। টাকাটা ব্যবহারের সবচেয়ে ভালো পথটাই বেছে নিয়েছিল সে।”
“আসলেই খুব আনন্দদায়ক ছিল সে ভ্রমণটা। সবকিছু পেছনের দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে-অভিজ্ঞতাটা বেশ দুর্দান্ত।”
আমি দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। দূরের কোনো একটা গ্রামের রাস্তা, মোলায়েম বাতাসের পরশ, ট্রাকের মৃদু কম্পন-চলছে তো চলছেই। সারাজীবনের সকল স্মৃতি, সকল অনুশোচনা আর যা কিছু আছে, সবই পেছনে ফেলে যাওয়া রাস্তার সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে পেছনে সবকিছু ফেলে যাওয়ার অনুভূতিটা আসলেই যে কোনো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জন্য মানানসই।
“ওটার ব্যাপারে আরও কিছু বলতে পারবে? যেটুকু বললে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না, সেটুকু শুনতেই রাজি আছি,” আমি বললাম।
“এপার্টমেন্টে ফিরে চলো। ওখানে মন খুলে সব বলব,” মিয়াগি বলল। “এখানে বকবক করলে লোকে সন্দেহের চোখে দেখবে।”
বাসায় ফেরার পথে সোজা রাস্তাটা না নিয়ে একটু লম্বা পথ বেছে নিলাম। প্রথমে একটা সূর্যমুখী ফুলভর্তি মাঠ ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলাম, এলিমেন্টারি স্কুলের পুরোনো বিল্ডিংটাকে পাশ কাটিয়ে উঁচু টিলায় স্থাপন করা গোরস্থানের পাশ দিয়ে ঘুরে গেলাম। স্কুলে বোধহয় কোনো ধরনের অনুষ্ঠান চলছিল, কারণ বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, গায়ে তাদের পোকা-নিরোধক স্প্রে আর সুগন্ধী স্প্রে এর সুঘ্রাণ।
আজকের রাতটা ছিল আর্দ্র, স্যাতস্যাতে বাতাসের রাত। মনে হচ্ছে গোটা গ্রীষ্মের সকল বৈশিষ্ট্য এক করে আজকের রাতটার জন্ম দিয়েছে।
এপার্টমেন্টে ফিরে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকিনি। মিয়াগিকে পেছনে বসিয়ে বাইকে করে আবার বের হলাম। দুজনেই পাতলা জামাকাপড় পরা ছিলাম, তাই মিয়াগির শরীরের কোমলতাটা আরও বেশি প্রকটভাবে টের পাচ্ছিলাম আমি। তাতে মন এতটাই বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে, আরেকটু হলেই ট্রাফিকের লাল বাতি পার করে যেতাম। আচমকা ব্রেক কষার ফলে সে আমাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল! মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, সে যাতে আমার পাগলের মতো ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডের শব্দ টের না পায়।
একটা টিলার ওপর উঠে পুরা এলাকা দেখা যায়, এমন দেখে একটা স্পট বেছে নিলাম। কাছাকাছি একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে দুটা কফি হাতে নিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম রাতের সৌন্দর্য। মৃদু কমলা রঙের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল আমাদের নিচে থাকা রেসিডেনশিয়াল এলাকা। পেছনে ফেলে আসা শহরটাকে এখান থেকে বেশ দূরে মনে হচ্ছিল।
ফেরার পর দাঁত মেজে, বিছানায় শুয়ে মিয়াগির কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ছোটদের যেভাবে গল্পের বই পড়ে শোনানো হয়, ঠিক সেভাবেই সে আমাকে তার পূর্বে পর্যবেক্ষণ করা মানুষগুলোর গল্প শোনাচ্ছিল। সবচেয়ে সাদামাটা, ভবিষ্যতহীন গল্পটাও আমাকে যে স্বস্তি দিচ্ছিল, তা সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য নিদর্শনগুলোও দিতে পারেনি।
পরের দিন আমি বেঁচে যাওয়া ওরিগামি পেপার দিয়ে কাগজের সারস বানাতে বসলাম। বানাতে বানাতে ভাবলাম, এরপর আমার কী করা উচিত টেবিলের অপর পাশে মিয়াগিও কাগজ ভাঁজ করতে ব্যস্ত ছিল। তুমি চাইলে পুরোটা সময় এভাবেও কাটাতে পার, সে আমাকে পরামর্শ দিল। হ্যাঁ, কাগজের সারসের স্তূপে মরাটা খুব একটা খারাপ লাগছে না বৈকি, সায় দিলাম আমি। একমুঠো কাগজের সারস নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে মারলাম। আমার দেখাদেখি মিয়াগিও তাই করল।
সেদিন কাগজের সারসের বৃষ্টি হয়েছিল আমার এপার্টমেন্টে।
ওরিগামি ভাঁজ করতে করতে বিরক্ত লাগতে শুরু করায় একটু খোলা হাওয়ার জন্য বাইরে গেলাম আমি। দোকান থেকে হোপ কোম্পানির সিগারেট কিনে বাইরে এসেই সেটা ধরলাম। কাছাকাছি একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা কফির ক্যান কিনে তাতে চুমুক দিতে গিয়ে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার।
এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও আজই প্রথমবারের মতো পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেটাকে।
বোধহয় আমি বিড়বিড় করতে শুরু করেছিলাম, কারণ মিয়াগি আমার চোখমুখ দেখে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে?”
“একটা বোকার মতো জিনিস মাথায় এসেছে। এইমাত্র উপলব্ধি হলো, আমার অনেক অনেক প্রিয়-এমন একটা জিনিস আসলেই রয়েছে।”
“কী?”
“ভেন্ডিং মেশিন,” লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে মাথা চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিলাম।
“ও,” মিয়াগি বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। “ভেন্ডিং মেশিনের মধ্যে এমন কী আছে, যা তুমি পছন্দ কর?”
“নিশ্চিত না আমি। মনে হয় না সেটার উত্তর আদৌ জানা রয়েছে আমার। তবে ছোটবেলায় আমি প্রায়ই ভেন্ডিং মেশিন হতে চাইতাম।
আমার কথাবার্তা শুনে সে পুরোপুরি বোকা বনে গিয়েছে।
“ইয়ে মানে, আরেকটু পরিষ্কার হওয়া যাক। ভেন্ডিং মেশিন মানে তুমি এইমাত্র যেখান থেকে কফি কিনে আনলে-সেই ধরনের ভেন্ডিং মেশিন?”
“হ্যাঁ। কিন্তু শুধু কফিই না, সিগারেট, ছাতা, সৌভাগ্যের মাদুলি, ভাজা ওনিগিরি, উডন নুডুলস, বরফ, আইসক্রিম, হ্যামবার্গার, ওডেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ভভুট্টোদানা দিয়ে রান্না করা বিফ স্যান্ডুইচ্ ইনস্ট্যান্ট রামেন, বিয়ার, শোচু মদ ভেন্ডিং মেশিন সবধরনের সবকিছু বিক্রি করে। জাপান হচ্ছে ভেন্ডিং মেশিনের নগরী।”
“আর তুমি এই ভেন্ডিং মেশিনই তোমার সবচেয়ে প্রিয়, ভালোবাসার জিনিস?”
“একদম তাই। ওগুলো যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করা কিংবা সেটার দিকে শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকার স্বাধীনতা রয়েছে তোমার। ভেতরে কিচ্ছুটি নেই, এমন ভেন্ডিং মেশিনও আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করি।”
“হুমম-বেশ স্বকীয় একটা শখের কথা শোনালে আমাকে,” মিয়াগি দুর্বলভাবে একটু উৎসাহ দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু আসলেই ফালতু একটা শখ ছিল সেটা। পুরোপুরি তুচ্ছ, নিষ্ফল একটা শখ। স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলাম, আসলেই শখটা দিয়েই বোঝা যায় কতটা বোকার মতো জীবন পার করে এসেছি আমি।
“কিন্তু এর পেছনের কারণটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারছি আমি,” মিয়াগি একটু উৎসাহ দিতে চাইল।
“কোনটা, ভেন্ডিং মেশিন হওয়ার স্বপ্নের পেছনের কারণ?” বলে হেসে ফেললাম।
“না, ঐ স্বপ্নটার পেছনের কারণটা আমার জানা নেই। কিন্তু একটু ভেবে দেখ-ভেন্ডিং মেশিনগুলো সবসময় তাদের জায়গাতেই উপস্থিত থাকে। তোমার পকেটে টাকা থাকলে তার বিনিময়ে সে তোমাকে কিছু খেতে বা পান করতে দেবে। তাদের কাজকর্মে একটা অপরিবর্তনশীল, শ্বাশ্বত কিছু একটা ব্যাপার রয়েছে।”
ব্যাখ্যাটা শুনে বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম। “অসাধারণ। আমি যেসব কথা বলতে চেয়েছিলাম, তা সংক্ষেপে সুন্দর করে বলে দিয়েছ।”
“ধন্যবাদ,” অবশ্য তাকে খুশি দেখাল না। “ভেন্ডিং মেশিন কিন্তু আমাদের মতো পর্যবেক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তারা আমাদেরকে দোকানের কর্মচারীদের মতো অদৃশ্য ভাবে না, অগ্রাহ্য করে না সে যাই হোক, ভেন্ডিং মেশিনের প্রতি ভালোবাসাটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু শখপূরণের জন্য এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কী করতে চাও তুমি?”
“প্রশ্নটার উত্তর দিতে হলে তোমাকে আমার প্রিয় একটা গল্প শোনাতে হবে। প্রত্যেকবার এভাবে দোকান থেকে সিগারেট কিনতে এলে আমার পল এস্টারের ‘স্মোক’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। সিগারের দোকানের মালিক প্রতিদিন চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন সকালে একটা নির্দিষ্ট জায়গার ছবি তোলে। বিষয়টা আমাকে বেশ চমৎকৃত করেছিল; আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল সেই সিনেমা, তা বললেও ভুল হবে না। তাই আমি ভাবছি অগি রেনের মতো যেসব জিনিস তুচ্ছ আর অর্থহীন, সেসবের ছবি তুলব। ভেন্ডিং মেশিনের একদম বেসিক কিছু ছবি তুলব আমি, যেসব ভেন্ডিং মেশিন সবজায়গাতেই দেখা যায়। যে কাজটা যে কেউ চাইলেই করতে পারবে, সেটাই করতে ইচ্ছুক আমি।”
“এর ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না জানি,” মিয়াগি মুখ খুলল, “কিন্তু কাজটা আমার পছন্দ হয়েছে।”
আর এভাবেই আমার ভেন্ডিং মেশিন দর্শন করা শুরু হলো।
পুরোনো, সেকেন্ডহ্যান্ড একটা দোকান থেকে আমি জং ধরা পুরোনো, জেলাটিন সিলভার রঙের একটা প্রিন্ট ক্যামেরা আর গলায় ঝোলাবার জন্য স্ট্র্যাপ কিনলাম। এ দুটো জিনিসই যথেষ্ট। আমি জানি, ডিজিটাল ক্যামেরা দামে আরও সস্তা, সুলভ। কিন্তু আমি ছবি তোলার পেছনের অনুভূতিটা তুলে আনাতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ক্যামেরার ভেতর ফিল্মটা বসিয়ে তা ফিট করা, বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ানর সময় কোনো ভেন্ডিং মেশিন পছন্দ হলে বাইক থামিয়ে সেটার ছবি তোলা-ঠিক এটাই করতে চাই আমি।
প্রত্যেকটা ছবি তোলার সময় আমি মেশিনের আশেপাশে যা কিছু আছে, সবকিছুকে একসাথে তুলে আনতে চেষ্টা করলাম। মেশিনের ভেতর কী কী কোম্পানির জ্যুস রয়েছে কিংবা কীভাবে সাজানো সেটা, সেটায় আমার আগ্রহ নেই। ভেন্ডিং মেশিনটা কোথায় অবস্থিত আর এলাকায় এর কীরকম প্রভাব, সেটা তুলে আনতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম আমি।
যখন ভেন্ডিং মেশিন খোঁজা শুরু হলো, এর বিপুল পরিমাণে থেকে অবাক হতে বাধ্য হলাম। এপার্টমেন্টের আশেপাশের এলাকাতেই অন্তত কয়েক ডজন ছবি তুলে ফেললাম আমি। অনেকগুলো ছিল যা আমি আগে মিস করে গিয়েছি, এমনকি যে রাস্তা দিয়ে আমি সচরাচর চলাফেরা করি, সে রাস্তাতেও অনেকগুলো নতুন মেশিন আবিষ্কার করলাম। প্রত্যেকটা মেশিন আবিষ্কারের পর আমার হৃৎপিণ্ড একদম লাফিয়ে উঠত। আর একই ভেন্ডিং মেশিন সকালে একরকম আর রাতে অন্যরকম দেখাত। কিছু মেশিন উজ্জ্বল আলো দিয়ে মানুষের মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করত। সেই আলো পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করত অনেক। আর কিছু ছিল যেগুলোর বাটনগুলোই কেবল অন্ধকারে জ্বলজ্বল করত। এর পেছনের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ বাঁচানো।
আমার জানা ছিল, এরকম ফালতু শখের কাজের বেলাতেও এমন কিছু মানুষ ছিল যারা কাজটা আমার থেকে হাজার গুণে ভালো করতে সক্ষম। আমি তাদের একাগ্রতা কিংবা ক্ষমতার ধারেকাছেও যেতে পারব না। তাতে আমার সমস্যা নেই। যে যা খুশি বলুক, এই মেথডে কাজ করতেই বেশি ভালো লাগছে আমার।
প্রতিদিনের রুটিন দাঁড়াল এই—
সকাল সকাল ফটো ডেভেলপমেন্ট ল্যাবে আগের দিনে ছবিভর্তি ফিল্ম নিয়ে যাওয়া, ছবি প্রিন্ট হওয়ার ত্রিশ মিনিট সময়টুকু সকালের নাস্তা খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা, বাকি দিন ছবি তুলে বেড়ানো। দিনশেষে সকালবেলা যেসব ছবি প্রিন্ট করার পর হাতে এসেছে সেগুলো টেবিলে রেখে অ্যালবামে ঢোকানো। সেসময় মিয়াগিও হাত লাগাত। প্রত্যেকটা ছবির বিষয়বস্তু ছিল ভেন্ডিং মেশিন। কিন্তু বিষয়বস্তুর মিল থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকটা ছবি ছিল স্বতন্ত্র। কোনো মানুষ যদি একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলে, ঠিক সেরকমই লাগে ভেন্ডিং মেশিনের ছবিগুলো। ভেন্ডিং মেশিন দিয়েই এর আশেপাশের সবকিছু বিচার করা যাচ্ছিল।
ফটো ল্যাবের মালিক আমার প্রতি বেশ কৌতূহলী হয়েছিল। স্বাভাবিক। আমি প্রতিদিন সকালবেলা তার কাছে আসছি, হাতে এক ফিল্মভর্তি শুধু ভেন্ডিং মেশিনের ছবি। সাদা চুলের আধিক্য তার মাথায়, অস্বাভাবিক চিকন শরীর আর চল্লিশ বছর বয়স সত্ত্বেও তিনি হাঁটতেন কুঁজো হয়ে। আমাকে বাতাসের সাথে কথা বলতে দেখে (আসলে মিয়াগির সাথে কথা বলছিলাম) একদিন প্রশ্ন করলেন,
“তোমার পাশে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে?”
আমি মিয়াগির দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ। একটা মেয়ে। নাম মিয়াগি। তার কাজ হচ্ছে আমাকে পর্যবেক্ষণ করা,” জবাব দিলাম। কাজটা অর্থহীন, তাও মিয়াগি সম্মানসূচক ভাবে মাথা নুইয়ে বলল, “হ্যালো।’
সে আমাকে বিশ্বাস করুক, এই উদ্দেশ্য আমার ছিল না। কিন্তু মানুষটা শুধু বলল, “ও আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং তো” বলে আমার কথাটা মেনে নিল। মাঝেমধ্যে এরকম মানুষের দেখা মেলে।
“তার মানে এই ছবিগুলো কী ঐ মেয়ের ছবি?”
“না। এগুলো কেবল কতগুলো ভেন্ডিং মেশিনের ছবি। ভেন্ডিং মেশিনের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলার সময় অবশ্য সে আমাকে সাহায্য করে।”
“তার মানে এই ছবিগুলো তোলার ফলে ওর নিশ্চয়ই কোনো না কোনো লাভ হচ্ছে?”
“তাও না। এই ছবি তোলার ব্যাপারটা সম্পূর্ণই আমার শখ। মিয়াগি শুধু আমার সঙ্গ দিচ্ছে। ওর কাজই এইটা।”
আমার কথাবার্তায় তাকে বিস্মিত দেখাল। কিন্তু “শুভকামনা রইল,” বলতে সে ভুলল না।
দোকান থেকে বের হলাম দুজনে। মিয়াগি বাইকের পাশে দাঁড়াল, আমি উঠে বাইক চালু করলেই সে পেছনের সিটে বসে পড়বে।
আমি ঝট করে একটা ছবি তুলে ফেললাম তার।
“কী করছ?” সে জিজ্ঞেস করল।
“ইয়ে মানে, লোকটা বলার পর কেন জানি তোমার একটা ছবি তোলার ইচ্ছে হলো।”
“অন্য মানুষ কিন্তু ছবিটা দেখে ভাববে তুমি একটা বাইকের ছবি তুলেছ কেবল। এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই।”
“আমার ছবি দেখে কেউ উদ্দেশ্য খোঁজার কথা ভাববেই না,” ব্যঙ্গ করে জবাব দিলাম।
অবশ্য ফটো ডেভেলপার এর মতো মানুষ আজকাল কমই দেখা যায়। এরাই আজকাল সমাজে সংখ্যালঘু। হয়তো এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে ভালো কোনো কারণ রয়েছে। সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হচ্ছি, এমন সময় আমার পাশের এপার্টমেন্টের বাসিন্দার সাথে দেখা হয়ে গেল। আকারে বেশ লম্বা, চেহারা-সুরতও বেশ খতরনাক ধরনের। মিয়াগির জন্য দরজাটা খুলে রেখেছিলাম আমি (মিয়াগি জুতোর ফিতা বাঁধছিল তখন)। মিয়াগি বের হয়ে আমাকে “অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ” বলতেই জবাব দিলাম, “ঠিক আছে, চলো এখন।” আমাকে এভাবে অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলতে দেখে বুঝতে পারলাম, লোকটা আমার আচরণে বিরক্ত হয়েছে।
পরিষ্কার, ঝকঝকে, নির্মল একটা দিন ছিল সেদিন। মৃদুভাবে বাতাস বইছিল। ঘুরতে ঘুরতে এমন এক জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম, যে জায়গার কথা আগে কখনো শুনিনি—যাওয়া তো দূরের কথা। দুঘণ্টা বাইকযাত্রার পর অবশেষে চেনাজানা এক জায়গার দেখা মিলল। তাও আবার যে সে জায়গা না-হিমেনো আর আমার শৈশবের স্মৃতিবিজরিত একটা স্থান ছিল সেটা। হয়তো পথ হারিয়ে ফেললে অবচেতন মনেই আমি ওদিকে যাওয়ার কথা ভাবি। কোনো জন্তুর ‘বাড়ি ফেরবার প্রবৃত্তিবোধ’ এর সাথে তুলনা করা যায় একে।
স্বাভাবিক ভাবেই এ এলাকাতেও ভেন্ডিং মেশিন রয়েছে। বাইকে চড়ে এলাকাটা ঘুরে ভেন্ডিং মেশিনের ছবি তুলে বেড়াতে লাগলাম।
ছোটবেলায় আমি নিয়মিত একটা ক্যান্ডিশপে যেতাম। সেখানে একটা রেট্রো আইসক্রিম মেশিন ছিল। দোকানটার কথা মনে পড়ে যেতেই মনে হতে শুরু করল ছোটবেলায় খাওয়া সেইসব সুস্বাদু চকলেটগুলোর কথা-চকলেট হুইট পাফ, ক্যান্ডি স্টিক, রোস্টেড সয়াবিনের আটা দিয়ে মাখানো ক্যান্ডি স্টিক, চারকোণা আকারের ক্যারেমেল, কমলা স্বাদের চুইং গাম, বনতান ক্যান্ডি আরও কতকিছু! সোজা ভাষায়, ছোটবেলায় মিষ্টি জাতীয় সবকিছুই আমার পছন্দের ছিল।
দোকানটা বেশকিছুকাল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেখা গেল। কিন্তু সেই ভাঙাচোরা, জং ধরা আইস্ক্রিম মেশিনটা এখনও রয়েছে দোকানের ঠিক পাশেই। রাস্তার ঠিক অপর পাশের পাবলিক টেলিফোন বুথটাকে দেখে তখন পাবলিক টয়লেটের কথা মনে হতো। বিস্ময়ের ব্যাপার, এখনও ওটা কাজ করছে।
আগাছাভর্তি পার্কে গাছের ছায়ায় বসে আমি আর মিয়াগি সকালে বানানো ওনিগিরি খেয়ে ক্ষুধা মেটালাম। পার্কে মানুষজন ছিল না, তবে দুটা বিড়াল চোখে পড়ল। একটা ছিল কুচকুচে কালো রঙের, আরেকটা বাদামি। দূর থেকে ওরা আমাদের দেখল কিছুক্ষণ। যখন সিদ্ধান্ত নিল যে আমরা ওদের ক্ষতি করব না, তখন আমাদের আরেকটু কাছাকাছি আসল। আফসোস লাগল, আমাদের কাছে এমন কোনো খাবার নেই যা বিড়ালকে খাওয়ানো যাবে।
“আচ্ছা, বিড়ালেরা কি তোমাকে দেখতে পায়?” জিজ্ঞেস করলাম মিয়াগিকে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়ালগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। কালোটা চট করে পালাল, আর বাদামিটা সতর্কের দৃষ্টিতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
“দেখতেই তো পাচ্ছ, কুকুর বিড়ালেরা আমাকে দেখতে পায়,” আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে জবাব দিল। “অবশ্য তার মানে এই না যে, তারা আমাকে পছন্দ করতে শুরু করবে।
খাবার শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম। তখন মিয়াগি নোটবুকে কী জানি পেন্সিল দিয়ে আঁকার চেষ্টা করছে। বিড়ালগুলো তখন কীভাবে জানি পার্কের স্লাইডের একদম উপরে উঠে বসে ছিল। দৃশ্যটা যে তার ভালোই পছন্দ হয়েছে, তা টের পেলাম।
তার এই শখ দেখে বেশ অবাকই হলাম। হয়তো এই গোটা সময়টা আমাকে পর্যবেক্ষণের সময় সে নোটবুকে রেকর্ড না, বরং আঁকাআঁকিতেই ব্যস্ত ছিল সে।
“আমার তো জানা ছিল না তোমার এরকম শখ-টখ আছে,” অবশেষে মুখ খুললাম আমি।
“অবাক লাগছে, তাই না?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তোমার আঁকার হাত তো তেমন একটা ভালো না।”
সেজন্যই তো প্র্যাকটিস করছি। হাস্যকর, তাই না?” মুখ টিপে সে হাসল।
“এর আগে কী কী এঁকেছ, দেখানো যাবে?”
“চলো, পরের ভেন্ডিং মেশিনের খোঁজে বেরোনো যাক,” বলে সে আমার প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল। ততক্ষণে ব্যাগে নোটবুকটাও ঢুকিয়ে ফেলেছে।
.
অর্ধেক দিন সময় ব্যয় করে আমি আমার হোমটাউনের এলাকা ঘুরে বেড়ালাম। কাজ শেষ করে আবার ঐ পথ দিয়েই বের হয়ে যাচ্ছি। বাইকটা পুরোনো ক্যান্ডি শপটার সামনে থামালাম।
দোকানটার সামনের বেঞ্চে (বেঞ্চটায় একটা দুধের কোম্পানির বিজ্ঞাপন লাগানো ছিল) একজনকে বসে থাকতে দেখলাম।
মানুষটাকে আমার খুব ভালোমতোই চেনা ছিল। বাইকটা রাস্তার একপাশে পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করলাম, তারপর বুড়ো মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। “হ্যালো।”
তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই ধীরগতির। তবে আমার কথা যে তিনি শুনতে পেরেছেন, তা বোঝা গেল তাকে আমার দিকে সরাসরি তাকাতে দেখে। বয়স বোধহয় তাঁর নব্বই পেরিয়েছে। গোটা মুখে ছিল অজস্র ভাঁজ, আর হাতদুটো কোলের ওপর রাখা ছিল তাঁর। একদম সাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলো তাঁর মুখের সামনে প্রায় নিষ্প্রাণ অবস্থায় জায়গা করে নিয়েছিল। এর কারণে তাকে আরও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
আমি তাঁর বেঞ্চের সামনে হাঁটুগেড়ে বসলাম। আবার ‘হ্যালো’ বলার পর প্রশ্ন করলাম, “আমাকে বোধহয় আপনার মনে নেই, তাই না?”
তাকে চুপ থাকতে দেখে ধরে নিলাম, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। মহিলার দৃষ্টি তাঁর সামনের কয়েক মিটার দূরের মাটিতে স্থির হয়ে রয়েছে। তাও আমি থামলাম না।
“কিন্তু সত্যি বলতে কী, আপনাকে আমার বেশ ভালোভাবেই মনে রয়েছে। না, আমার স্মৃতিশক্তির বড়াই করছি না আমি। হ্যাঁ আমার বয়স বিশের ঘরে, কিন্তু তার সাথে এই স্মৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। অতীতের বহু ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি। যদি স্মৃতিগুলো পুনরায় মনে করার বিশেষ কোনো কারণ না থাকে, তবে স্মৃতিটা সুখের হোক কিংবা দুঃখের সময়ের স্রোতে একদিন তা হারিয়ে যেতে বাধ্য। মানুষ এরকম জিনিস ভুলে যাওয়ার কারণ হলো, সে যে ভুলে গিয়েছে-এই তথ্যটাই তার মন থেকে হারিয়ে যায়। যদি আমরা অতীতের প্রিয় মুহূর্তগুলো স্পষ্ট মনে রাখতে সক্ষম হতাম, তাহলে বর্তমানে আমাদের চেহারায় আরও বেশি কষ্ট ফুটে থাকত। তাও কিন্তু মানুষ বলে, ‘জিনিসটা আমার স্পষ্ট মনে আছে’, কারণ মনে রাখার ভান করাটাই বেশি সহজ।”
আমার কথায় একমত বা দ্বিমত-কোনোকিছুই পোষণ করলেন না তিনি। একদম কাকতাড়ুয়ার মতো নিশ্চল বসে রইলেন বেঞ্চে।
“আপনি কিন্তু আমার এই অনিশ্চিত স্মৃতিগুলোয় একটা জায়গা দখল করে রেখেছেন। কারণ, একবার আপনি আমার সাথে ভালো আচরণ করেছিলেন। আমার জন্য খুবই দুর্লভ ঘটনা ছিল সেটা। সত্যি বলতে কী, দশ বছর আগে আমি কখনো কাউকে কোনোকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানাইনি। যদি বড়মানুষেরা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করত, তাহলে ধরেই নিতাম তিনি জোর করে এই ভালো আচরণ করছেন, মন থেকে নয়-হ্যাঁ আমি জানি আমার চিন্তাভাবনা একদম বাজে ধরনের ছিল তখন। হয়তো সে কারণেই আমি বাড়ি পালানোর কথা ভেবেছিলাম। যখন আমার বয়স আট কিংবা নয়, আমার সঠিক মনে নেই, আমি মায়ের সাথে রাতের বেলা ঝগড়া করে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। কী কারণে ঝগড়া করেছিলাম তা ভুলে গিয়েছি। তবে কোনো ফালতু, তুচ্ছ কোনো কারণে-সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”
বুড়ির পাশে বসে বেঞ্চে হেলান দিয়ে দূরের স্টিল আর প্লাস্টিকের তৈরি টাওয়ারগুলোর দিকে, আর আকাশে গুচ্ছ আকারে ভাসতে থাকা মেঘরাজির দিকে তাকালাম।
“চিন্তাভাবনা না করে হুট করে বেরিয়ে আসার কারণে সময় নষ্ট করার জন্য আমি এই দোকানটাকে বেছে নিয়েছিলাম। রাতের বেলা সাধারণত বাচ্চা ছেলেমেয়েরা একলা ঘোরাফেরা করে না, তাই আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে, ‘বাড়ি যাবে না?’ ওরকম ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হবার কারণে আমি জবাব দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার গলা শুনে আপনি দোকানের রেজিস্টারের পেছনের দরজা খুলে সেখানে বসিয়ে কিছু চকলেট খেতে দিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর আপনাকে আমার বাবা- মা ফোন দিয়েছিল, ‘আমাদের ছেলে কি আপনার দোকানে বসে আছে?’ আপনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘সে এখানেই আছে। কিন্তু আগামী একঘণ্টার জন্য ধরে নিন ও এখানে নেই’ বলে আপনি ফোন কেটে দিয়েছিলেন- হয়তো আপনার জন্য ব্যাপারটা তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু আমি যে এখনও ভেতরে ভেতরে মানুষের কাছ থেকে ভালো কিছুর আশা করি, তার একমাত্র কারণ শুধু আপনিই। অন্তত আমার তাই ধারণা।”
জিজ্ঞেস করলাম তাকে, আমার বকবকানি তিনি আরও কিছুক্ষণ সহ্য করতে পারবে কিনা। তিনি চোখ মুদে একদম স্থির হয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে তাকে একদম মৃত মানুষের মতো মনে হচ্ছে।
“আমাকে যদি ভুলে থাকেন, তবে হিমেনো’কেও নিশ্চিতভাবেই ভুলে গিয়েছেন। সে আমার সাথে প্রায়ই এই দোকানে আসত-হিমেনো, নামের মতোই সে ছিল একদম রুপকথা থেকে উঠে আসা রাজকন্যা। কথাটা বলার জন্য আগে থেকেই মাফ চাইছি-কিন্তু এরকম এলাকা ওর মতো মিষ্টি মেয়ের জন্য যোগ্য ছিল না। আমাদের দুজনকে এলিমেন্টারি স্কুলে একদম একঘরে করে রাখা হতো। আমি বেয়াড়া গোছের ছিলাম বলে আমাকে ঘৃণা করত। কিন্তু হিমেনো ছিল এখানকার সবার থেকে আলাদা-আর সে কারণেই ওকে ওরা ঘৃণা করত। অবশ্য কথাটা বলতে খারাপ লাগছে, তাদের এরকম আচরণের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমাদেরকে সবধরনের বন্ধুবান্ধবদের দল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তাই আমরা একে অপরের অবলম্বনে পরিণত হয়েছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত হিমেনো আমার পাশে থাকত, ততক্ষণ কে কী আমাকে বলল তা বিন্দুমাত্র গায়ে লাগত না। মনে হতো, আমি হিমেনোর মতোই বাজে আচরণের শিকার হচ্ছি। তার মানে আমি আর হিমেনো আসলে একই ধরনের মানুষ।”
প্রত্যেকবার হিমেনো’র নাম উচ্চারণ করায় টের পাচ্ছিলাম, বুড়ি চোখেমুখে সামান্য হলেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল।
সন্তুষ্ট হয়ে বলতে লাগলাম, “ফোর্থ গ্রেডে পড়াকালীন সময়ে হিমেনোর বাবার আরেক জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় এ এলাকা ছাড়তে হয়েছিল তাদের। এরপর থেকেই সে দেবীরুপে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। তার বলা একটা বাক্য মাথায় একদম গেথে গিয়েছিল আমার ‘যদি বিশ বছরে পা দেবার পরেও আমাদের জীবনে কেউ না আসে, তবে আমরা একে অপরের সঙ্গী হবো’-এই বাক্যটাই আমাকে বিগত দশবছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেদিন কঠিন একটা সত্য জানতে পারলাম, হিমেনো আমাকে তেমন একটা পছন্দ করত না, এমনকি একটা সময় পর সে আমাকে এতটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিল যে, আমার মৃত্যুকামনা করতেও তার বাঁধেনি। সে চেয়েছিল আমার চোখের সামনে আত্মহত্যা করতে। অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছিলাম, আমার ভুলটা আসলে কোথায় ছিল-অকস্মাৎ মাথায় একটা চিন্তা এলো। তার সাথে দেখা করার আগে আমি আমাদের ক্লাসের মাটিতে পুঁতে রাখা টাইম ক্যাপসুল খুঁড়ে বের করে এনেছিলাম। হ্যাঁ, কাজটা আমার করা উচিত হয়নি, কিন্তু আমি আসলে-সহজভাবে বললে, খুব শীঘ্রই আমি মারা যাচ্ছি, তাই কাজটা করলে ধরে নিচ্ছি কেউ খারাপ কিছু মনে করবে না-এই চিন্তা করেই কাজটা করেছি।”
এখন।
উত্তরটা সঠিক কিনা দেখা যাক।
“অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? ক্যাপসুলের ভেতর হিমেনোর চিঠিটা ছিল না। তখন ভেবেছিলাম হিমেনো হয়তো সেদিন স্কুলেই আসেনি। কিন্তু যতই ভাবতে লাগলাম, ততই মনে হলো, মোটেও তা হতে পারে না। আমাদের শিক্ষিকা এ বিষয়ে মোটেও ছাড় দেবার মানুষ নন, কেউ শুধুমাত্র চিঠি দেবার দিন অনুপস্থিত থেকে তার হাত থেকে পার পাবে না। আর সবার চিঠি ক্যাপসুলে না রেখে তিনি মোটেও সেটা মাটিতে পোঁতার কথা ভাববেন না। এর একটাই মাত্র সমাধান—কেউ আমার আগে ক্যাপসুল খুঁড়ে বের করে হিমেনোর চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছে। এ কাজ হিমেনো বাদে আর কারো পক্ষে করা সম্ভব না।”
কথাটা বলার আগ পর্যন্ত পুরো চিত্রটা মাথায় ঠিকভাবে সাজানো ছিল না। বলার আগ মুহূর্তে মাথায় সবকিছু তৈরি হচ্ছিল।
এতক্ষণে সবগুলো বিন্দু জোড়া লেগে গিয়েছে।
“সতেরো বছর বয়সে হিমেনো আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিটার তথ্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। চিঠিটায় প্রেরক হিসেবে তার নাম আর প্রাপক হিসেবে আমার নামটাই যথেষ্ট ছিল। সে মোটেও কাউকে চিঠি লেখা বা ফোন দেবার মানুষ না। কোনো পরিস্থিতিতেই না। চিঠিটায় রিটার্ন এড্রেসটাও পরিষ্কার ভাবে দেয়া ছিল-এ থেকে আসলেই আমার সবকিছু বোঝা উচিত ছিল।”
হ্যাঁ।
আমার আসলেই বোঝা উচিত ছিল না।
“চিঠিটা ছিল হিমেনোর SOS। সে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছিল। আমার মতো সেও বন্দী হয়ে পড়েছিল, অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছিল প্রাণপণ। আর তাই টাইম ক্যাপসুলটা খুঁড়ে বের করে অতীতের একমাত্র বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তাকে চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিটার মানে আমি বুঝতে পারিনি, তাই তাকে সাহায্যও করার অধিকারও আমার ছিল না। আমি হিমেনো’কে হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং কারণ আমি হিমেনোর যোগ্য নই। সে অতঃপর ভেতরে ভেতরে একদম শূন্য হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু জানার পর আমারও তাই বোধ হয়েছিল। হিমেনো খুব শীঘ্রই আত্মহত্যা করবে, আর আমিও খুব শিগগিরই মারা যাব—আমি জানি এ পর্যায়ে এসে কথা থামিয়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এটাই সমাপ্তি। এত দীর্ঘ আর মন খারাপ করে দেয়া একটা গল্প শোনানোর জন্য আমি দুঃখিত।”
উঠে দাঁড়ালাম। বুড়ি ক্ষীণ কন্ঠস্বরে বলল, “বিদায়।”
এতক্ষণ পর এই কথাটাই তার মুখ থেকে বের হলো।
“আপনাকে ধন্যবাদ। বিদায়,” বলে সেখান থেকে চলে আসলাম।
আমার একসময়ের রক্ষাকর্তা যে আমাকে ভুলে গিয়েছে তাতে কষ্ট পাইনি। স্মৃতির কাছে প্রতারিত হতে হতে আসলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
একই সাথে অবশ্য আমি একটা সম্ভাবনার কথা পুরোপুরি মিস করে গিয়েছিলাম।
এত দুর্ভাগ্যের পরেও একটা মেয়ে আমার পাশে সঙ্গী হিসেবে ছিল, আমাকে মানসিকভাবে সাহায্য করে যাচ্ছিল অনবরত।
ভবিষ্যতহীন একটা মেয়ে, যে কিনা আমার মতোই হতাশাকে আলিঙ্গন করেছে, নিজের জীবনের আয়ু বিক্রি না করে সময় বিক্রি করে দিয়েছে।
খুবই কোমল হৃদয়ের একটা মেয়ে, যার হয়তো স্বাভাবিক মানুষদের মতো ব্যক্তিত্ব ছিল না, কিন্তু সে তার নিজস্ব উপায়ে সে সবসময় অন্যদের জন্য চিন্তা করত, অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
মিয়াগিও যে আমার সাথে প্রতারণা করবে তা কখনোই ভাবিনি আমি।
.
“কুসুনোকি? কুসুনোকি?”
বাইক চড়ার সময় আমাকে আঁকড়ে ধরতে আজকাল আর দ্বিধাবোধ হয় না মিয়াগির। সে আমার কাঁধে টোকা দিতেই আমি বাইকের গতি কমিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?” হয়তো আমার মনটা ভালো করে দিতেই সে বলল, “তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই।”
“মাত্র মনে পড়ল,” সে বলতে লাগল। “এই রাস্তায় আমি আগেও এসেছি, অনেক অনেক আগে। পর্যবেক্ষক হবারও আগে-তুমি যদি এই রাস্তা ধরে আরও কিছুক্ষণ আগাও, তারপর ডানে একজায়গায় মোড় নিয়ে সোজা চলতে থাক, তবে তারকা-শোভিত লেক এর দেখা মিলবে।”
“তারকা-শোভিত লেক?”
“ঐ যে, বলেছিলাম না, যে লেকটা আমি মৃত্যুর আগে দেখতে যেতে চাই? আসল নামটা আমার জানা নেই।”
“ও হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে।”
“কী, গোপন কথাটা কেমন লাগল?”
“ভালো,” উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, “চলো তাহলে এখন ওখানে যাওয়া যাক।”
“বাইকে তেল আছে?”
“যেতে যেতে কোথাও ভরে নেয়া যাবে।”
কাছাকাছি একটা সেলফ-সার্ভিং স্টেশন থেকে ট্যাংক ভর্তি করে নিয়ে মিয়াগির দেখানো পথ ধরে এগোতে থাকলাম। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ছটা বেজে গিয়েছে। একঘণ্টা ধরে লম্বা একটা পাহাড়ি পথ পেরোনোর পর (মাঝে মাঝে বাইক থামিয়ে ইঞ্জিনটাকে বিশ্রাম নেবার সুযোগ করে দিচ্ছিলাম)। অবশেষে মিয়াগির বর্ণিত তারকা-শোভিত লেকে পৌঁছালাম।
কাছাকাছি একটা দোকান থেকে ইনস্ট্যান্ট কাপ নুডুলস কিনে সেটা দোকানের বাইরের বেঞ্চে বসে খেয়ে নিলাম। বাইকটা লেক থেকে বেশ দূরের একজায়গায় পার্ক করে বাতি বিহীন একটা রাস্তা ধরে লেকের দিকে এগোতে থাকলাম আমরা। মিয়াগি আশেপাশের দালানকোঠা দেখে বারবার নস্টালজিক হয়ে পড়তে লাগল। মাঝেমধ্যে অবশ্য আমাকে সে সতর্ক করে দিচ্ছিল, আমি যাতে উপরে না তাকাই। অবশ্য চোখের এক কোণা থেকেই টের পাচ্ছিলাম, মাথার ওপরে তারার বিশাল একটা চাদর অপেক্ষা করছিল। তবে মিয়াগির কথা মেনে নিয়ে উপরে তাকাবার কথা মাথায় আনলাম না।
“এবার আমি যা বলব তা মন দিয়ে শোনো,” সে বলল। “আমি সামনে হাঁটব, তাই চিন্তা নেই। আমি চাই, আমার না বলা পর্যন্ত তুমি চোখ বন্ধ রাখ।”
“তার মানে একদম নিখুঁত মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত তুমি আমাকে কিছুই দেখতে দিতে চাও না, তাই না?”
“হ্যাঁ। আমরা এখানে তারা দেখতে এসেছি, তাই সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তে সেটা উপভোগ করাই শ্রেয়, ঠিক না? এখন চোখ বন্ধ করে ফেল।”
সে যা বলল, তাই করলাম। মিয়াগি আমার হাতটা ধরে বলল, ‘এদিকে চলো।” সতর্কতার সাথে সে আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো হাঁটার কারণে অনেক শব্দই শুনতে পাচ্ছিলাম, যা আগে কখনো টের পাইনি। গ্রীষ্মে যেসব পোকামাকড়ের গুঞ্জনের মিক্সচার শোনা যায়, এখন সে শব্দগুলোকে চারটা আলাদা ভাগে ভাগ করতে পারছি। কিছু পোকা তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচায়, কিছু মৃদু আওয়াজে। কিছু পোকামাকড় এর ডাক পশুপাখির মতো আলাদা করা যায়, আবার কিছু আছে ব্যাঙের মতো বিরক্তিকর শব্দ করে ডেকেই চলে। বাতাসের হালকা প্রবাহের শব্দও আমি টের পাচ্ছিলাম, সেই সাথে কানে আসছিল আমাদের পায়ের শব্দ।
“আচ্ছা কুসুনোকি, তোমাকে যদি আমি বোকা বানিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা কোথাও নিয়ে যাই, তবে তুমি কী করবে?”
“কী ধরনের জায়গা?”
“ভালো প্রশ্ন করেছ আচ্ছা ধরে নাও অনেক উঁচু কোথাও, যেমন পাহাড়ের চূড়া বা ব্রিজের ওপর।”
“এমন চিন্তা মাথায় আসেনি আমার। এমনকি ভবিষ্যতে মাথায় আনতেও চাই না।”
“কেন?”
“কারণ তুমি যে ওরকম কিছু করতে পার, তা কল্পনা করাও আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“ওহ,” কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো সে খানিকটা আশাহত হয়েছে।
আস্তে আস্তে পায়ের তলায় রাস্তার পিচ বিদায় নিল, এরপর এলো বালি। আচমকা টের পেলাম, লতানে উদ্ভিদ মাড়িয়ে সামনে এগোচ্ছি এখন। “এখন থেমে যাও। চোখ কিন্তু খুলবে না,” মিয়াগি বলল। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “সাবধানে পিঠটা মাটিতে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়। যখন একদম সরাসরি উপরের দিকে মুখ থাকবে, ঠিক তখনই চোখ খুলবে, এর আগে নয়।”
আস্তে করে হাঁটু ভাজ করে পিঠটা আলতো করে মাটিতে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লাম। জোরে একটা শ্বাস টেনে নিলাম। তারপর চোখটা খুললাম।
যে দৃশ্যটা আমার সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম, তা মোটেও আমার চেনাজানা কোনো তারাভরা আকাশ নয়।
না, কথাটা বলতে ভুল হচ্ছে। সে রাতেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম, তারকা-শোভিত রাত আসলে দেখতে কীরকম।
আগে বইয়ে কিংবা টিভিতে এরকম দৃশ্য দেখেছিলাম আমি। ঐ যে, সামার ট্রায়াঙ্গেল, এর মধ্যে দিয়ে স্বর্গীয় আলোর স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। সেদিনই বুঝতে পারলাম, আকাশের কালো কুচকুচে ক্যানভাসের মধ্যে ব্রাশ দিয়ে গাঢ় রঙের তারা আঁকার মতো দৃশ্য আসলেই বাস্তবে দেখা সম্ভব।
বইয়ে হয়তো এ দৃশ্যের রঙ আর আকার বর্ণনা দেয়া সম্ভব, কিন্তু যতই নিখুঁত হোক না কেন সেসব তথ্য-এর বিশালত্বটাকে কোনোভাবেই কল্পনা করা সম্ভব না। একদম অসম্ভব কাজ হবে সেটা।
আমার কল্পনার চেয়েও কয়েক গুণ বিশাল ছিল সে দৃশ্যটা। মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে ঐ ‘আলোকিত’ বরফের কণাগুলো আমার ওপর পড়ার জন্য প্রস্তুত।
“এখন বুঝতে পারছি তুমি কেন মারা যাবার আগে একবারের জন্য হলেও এই দৃশ্যটা দেখতে চেয়েছ,” অস্ফুট স্বরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিয়াগির দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
“ঠিক না?” আমার দিকে সে গভীর সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে তাকাল।
এরপর অনেকক্ষণ সময় আমরা দুজন পাশাপাশি শুয়ে তারার এই শোভা উপভোগ করলাম। তিনটা ‘শুটিং স্টার’ চোখে পড়ল আমার। ভাবলাম, আরও একটা চোখে পড়লে আমি কিছু একটা মনে মনে উইশ করব (প্রচলিত রয়েছে, আকাশ থেকে খসে পড়া তারা অর্থাৎ শুটিং স্টার দেখে মনে মনে উইশ করলে সেটা নাকি সত্যি হয়)। না, আমার আয়ু ফিরে পেতে চাই না আমি। হিমেনো’কে আর দেখতে চাই না। আর সময়কে পিছিয়ে নিয়ে আবার প্রথম থেকে সবকিছু শুরু করার প্রশ্নই আসে না। ওরকম ইচ্ছেশক্তি আমার মধ্যে বেঁচে নেই।
বোধহয় আমি নিশ্চিন্তে, শান্তিতে মরতে চাওয়ার উইশই করব। একদম ঘুমিয়ে পড়ার মতো মৃত্যু চাই আমি। এর বেশি কিছু চাওয়া মোটেও ঠিক হবে না।
মিয়াগি কী চাইতে পারে, তা আমার একবারের জন্যও ভাবতে হলো না। সে দ্রুত এই পর্যবেক্ষকের কাজ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে চায়। অপরের চোখে সে আর অদৃশ্য থাকতে চায় না। এই জগতের প্রত্যেকটা মানুষ তাকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে দিনের পর দিন, তাকে কেবল দেখতে পাচ্ছে আয়ু বিক্রি করে দেয়া মানুষেরা-যারা নিশ্চিতভাবেই একবছরের মাথায় মারা যাবে। মিয়াগি একজন ধৈর্যশীল মানুষ হতে পারে, কিন্তু এভাবে ত্রিশ বছর জীবন কাটালে সে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।
“মিয়াগি,” মুখ খুললাম আমি। “তুমি আমাকে রক্ষা করার জন্যই মিথ্যেটা বলেছিলে, তাই না? হিমেনো আমাকে ভুলে গিয়েছে, এই মিথ্যা কথাটা বলে তুমি আমাকে থামাতে চেয়েছিলে।”
মিয়াগি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সে আচমকা বলল, “আমারো একটা ছোটবেলার বন্ধু ছিল।”
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। “তুমি তোমার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কথা বলেছিলে। ওর কথাই বলতে চাচ্ছ?”
“হুম। তোমার মনে আছে দেখে অবাক লাগছে।”
মাথা নেড়ে তার কথা শোনার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অবশেষে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মিয়াগি বলতে শুরু করল, “হিমেনো তোমার কাছে যেমন ছিল, আমার জীবনেও এরকম একটা মানুষের অস্তিত্ব ছিল। আমরা দুজনেই ছিলাম এ জগতে সম্পূর্ণ একা দুজন মানুষ। তাই নিজেরা নিজেরাই একটা আলাদা জগত গড়ে তুলেছিলাম, যার বাসিন্দা ছিলাম কেবল আমরা দুজন। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিলাম আমরা। পর্যবেক্ষক হবার পর প্রথমবার ছুটি পেয়েই আমি ওর খোঁজে ছুটে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ‘আমি না থাকায় সে বোধহয় একদম হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে।’ ধরেই নিয়েছিলাম, নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়ে সে আমার অপেক্ষা করছে কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর যখন ওকে দেখতে পেলাম, আবিষ্কার করলাম, সে আমাকে ছাড়াই জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। সত্যি বলতে কি, আমার ‘অদৃশ্য’ হবার একমাসের মধ্যে সে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জগতে ঢুকে পড়েছিল। যারা আমাদের সবসময় খাটো চোখে দেখত, সেই জগতেরই একটা অংশতে পরিণত হয়েছিল সে।
মাথা ঘুরিয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। মুখে একটা হাসি ফুটে উঠেছে ওর।
“আর ঠিক তখনই টের পেলাম, আমি ওর জীবনে তার পায়ের শিকল বাদে আর কিছুই ছিলাম না-সত্যি বলতে কী, আমি মনে মনে চাইতাম সে অসুখী থাকুক। চাইতাম সে দুঃখ পাক, কষ্ট পাক, হতাশায় ডুবে যাক, নিজেকে গুটিয়ে ফেলুক, ফেরার সম্ভাবনা যতই কম হোক না কেন-আমার অপেক্ষায় সে কোনোমতে বেঁচে থাকুক। ও যে আমাকে ছাড়াই বাঁচতে পারবে এই জগতে, তা ওকে জানতে দিতে চাইনি আমি-এরপর আর তাকে দেখতে যাইনি আমি। সে এখন সুখী না অসুখী-তথ্যটা জানতে চাই না আমি। কারণ, তথ্যটা যেটাই হোক না কেন, আমি অনেক কষ্ট পাব।”
“তা সত্ত্বেও মৃত্যুর আগে ওকে তুমি দেখতে চাও, তাই না?”
“হ্যাঁ। আমার আর কিছুতেই যায় আসে না। একদম শেষ পর্যন্ত আমি এ ইচ্ছেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই।” মিয়াগি উঠে বসে তার স্বভাবসুলভ হাঁটু দুটোকে জড়িয়ে ধরল। “তাই তুমি কীরকম বোধ করছ, তা আমার ভালোমতই জানা আছে। অবশ্য তুমি সেটা বোধহয় কাউকে জানাতে চাও না।”
“কথাটা মোটেও সত্য না,” আমি ঝট করে বললাম। “তুমি যে আমাকে বুঝতে পেরেছ, তাতে আমি অনেক খুশি। তোমাকে ধন্যবাদ।”
“ওয়েলকাম,” লজ্জার হাসি হেসে মিয়াগি জবাব দিল।
লেকের আশেপাশে থাকা ভেন্ডিং মেশিনগুলোর ছবি তুলে এপার্টমেন্টে ফিরে এলাম।
মিয়াগি নাকি আজকে সারাদিনের কাজকর্মে অনেক ক্লান্ত, তাই তাড়াতাড়ি করে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। এক মুহূর্তে কেন জানি না, উঁকি মেরে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আবিষ্কার করলাম, সেও একই কাজ করতে যাচ্ছিল। সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে অপর পাশে মুখ করে শুয়ে পড়লাম আমি।
এই দিনগুলো যাতে কোনোদিনও শেষ না হয়, শুটিং স্টারটার কাছে বোধহয় আমার এই জিনিসটাই চাওয়া উচিত ছিল।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মিয়াগি নেই।
সে আমার বালিশের কাছে তার নোটবুকটা রেখে চলে গিয়েছে।