ভুশুণ্ডি কাক
ভুশুণ্ডি (ভূশুণ্ডি, ভূষণ্ডি, ভুশণ্ডি, ভূষণ্ডি) হলেন পুরাণবর্ণিত ত্রিকালদর্শী (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যার নখদর্পণে) বা সর্বজ্ঞ কাকবিশেষ। বহুদর্শী দীর্ঘজীবী প্রবীণ ব্যক্তিকে বুঝাতে প্রবাদে ভুশুণ্ডি শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে আমাদের সমাজে।
যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের নির্বাণ অধ্যায়ের পূর্বভাগে ১৫-২৭ অধ্যায়ে ভুশুণ্ডির উপাখ্যান বিস্তারিত লেখা আছে। বশিষ্ঠ মুনি রামচন্দ্রকে বেদান্ততত্ত্ব (উপনিষদ্ বা জ্ঞানকাণ্ড সম্পর্কিত দর্শনশাস্ত্র) ও আত্মার চিরশান্তি (নির্বাণ) বিষয়ে যে উপদেশ দান করেন তা এই গ্রন্থে রয়েছে। যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণকে রামায়ণের উত্তরখণ্ড নামেও অভিহিত করা হয়। এর আরেক নাম বাশিষ্ঠ-রামায়ণ। গ্রন্থটি বৈরাগ্য, মুমুক্ষ ব্যবহার, উৎপত্তি, স্থিতি, উপশম ও নির্বাণ নামক ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। তুলসী দাসের (১৫৪০-১৬২৩ খ্রি.) রামচরিতমানসের (১৫৭৪) শেষ অধ্যায় (উত্তরকাণ্ড) অনুযায়ী ভুশুণ্ডি একজন সর্বদর্শী ঋষি। ভক্তিযোগ সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণ করতেন তিনি।
ভুশুণ্ডি আবহমানকাল অস্তিমান থেকে পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখে আসছে। কুরুক্ষেত্র মহাসমর শেষ হলে শ্রীকৃষ্ণ ভুশুণ্ডিকে যুদ্ধের বিবরণ জিজ্ঞাসা করেন। কাক ভুশুণ্ডি উত্তর দেয়—
‘সত্যযুগ থেকে আমি পৃথিবীর অবস্থা দেখে আসছি। সত্যযুগে শুম্ভ- নিশুম্ভ (দেবী ভগবতীর হাতে নিহত পাতালবাসী দুর্দান্ত অসুর ভ্রাতৃদ্বয়) যুদ্ধের সময় বিনা পরিশ্রমে মুষলধারে বৃষ্টির মতো রক্তপাত হা করে পেট পুরে পান করেছি। ত্রেতাযুগে রাম-রাবণের যুদ্ধে ততটা না হলেও রক্তের প্রাচুর্য ছিল। অল্প পরিশ্রমে ইচ্ছেমতো রক্ত খেয়েছি। কিন্তু দ্বাপরযুগের কুরুপাণ্ডব যুদ্ধে আমার কষ্টের সীমা ছিল না, কারণ নরদেহ ঠুকরে ঠুকরে রক্ত পান করতে করতে আমার ঠোঁট ভোঁতা হয়ে গেছে।’
অর্জুনের অহঙ্কার হয়েছিল যে, তার মতো মহাবীর অতীতে কখনো জন্মগ্রহণ করেনি অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যত রক্তপাত ঘটেছে এরকম রক্তপাত ঘটার নজির আর কোনো বীরের বিজয়ের সাথে নেই। কিন্তু ভুশুণ্ডির উত্তর শুনে অর্জুনের দর্প অনেকখানি স্তিমিত হলো।
নেপালে ভুশুণ্ডির নামে সরোবর আছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নানা মন্দির। পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরের কাছে ভুশুণ্ডি কাকের চার পা-বিশিষ্ট পাথরের মূর্তি আছে। কাহিনী অনুসরণে আমাদের সমাজে বিচক্ষণ ও বহুদর্শী মানুষকে কলির ভুশুণ্ডি নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।