তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৫/২ – ভুতুড়ে বর্ম – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০
[টিপু কিবরিয়া রচিত বিপজ্জনক বর্ম কাহিনিটিকে তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব।]
১
ঠিক জমল না, বলল কিশোর। পিছিয়ে গেল।
মানুষটার দেহ গিলোটিনের সামনে হাঁটু মুড়ে আছে। ওদিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কিশোর। মানুষটার দুহাত পিছমোড়া করে বাধা। কয়েক ফুট দূরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছে কাটা মাথাটা।
কাটা গলা থেকে আরও রক্ত পড়া উচিত না?
অন্তঃসার শূন্য দুচোখ সরাসরি কিশোরের দিকে চেয়ে আছে। স্থির। হাঁ হয়ে আছে মুখ। তীব্র আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠার মুহূর্তে মারা গেছে লোকটা।
পুরো জমল না, বলল কিশোর। রোমাঞ্চিত হইনি আমি।
ঠিক বলেছ, কিশোর, মোমের ডামির উপর আরও রক্ত ঢালতে ঢালতে বলল হ্যাগার্ড।
গিলোটিনের তীক্ষ্ণধার স্টিলের ব্লেড বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চটচটে লাল তরল ঝরতে লাগল।
এবার হয়েছে! বলল কিশোর। সত্যিই কিন্তু একটু ভয় ভয় লাগছে! দারুণ!
ও-য়া-ক! গলা টানল জিনা।
স্কুল ছুটি, রকি বিচ পাবলিক লাইব্রেরিতে পার্ট টাইম চাকরি করে বলে গোবেল বিচে আসতে পারেনি রবিন। খামারবাড়ির কাজে ব্যস্ত মুসা। জিনার বাড়িতে আসবার কথা ছিল, শেষে একাই চলে এসেছে। কিশোর। কদিন বেড়িয়ে যাবে।
চুপচাপ ছিল বলে জিনার কথা ভুলেই গিয়েছিল কিশোর। পুরানো মমির বাক্সটার উপর বসে আছে ও। ভুতুড়ে বর্ম
একবছর বয়সী বাদামি রঙের মাংগ্রল, লম্বা-লেজ রাফিয়ান জিনার পায়ের কাছে বসেছে। ভউ, হউ-হউ, হুফ বলে হঠাৎ জিনার হাত চেটে দিল। যেন বলতে চাইল: আমিও তোমার সঙ্গে একমত।
উঠে দাঁড়াল জিনা। কিশোরের উদ্দেশে বলল, তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না! এ কোন খেলা বলো তো! এমন বিচ্ছিরি কাণ্ডের মধ্যে দারুণের কী দেখলে? ঝাঁঝের সাথে বলল, ইস, নকল রক্ত ঢেলে ডামিটার কী বাজে অবস্থা করেছে! ওটাকে… ওটাকে…
এইমাত্র ঘরে ঢুকেছেন হ্যারিসন জোনাথন পারকার, জিনার বাবা। বললেন, একেবারে বাস্তব লাগছে কিন্তু!
মমিগুলো ঝাড়পোছ করছিলেন তিনি। দ্যমাকড়সার জাল, ঝুল লেগে আছে জামা-কাপড়ে। মাথা চুল ধুলো-ময়লায় একাকার
গিলোটিনের কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন মুণ্ডুহীন ধড়টাকে। একটু একটু করে প্রশংসার হাসি ফুটছে তার ঠোঁটে। দারুণ হয়েছে! প্রশংসা করতেই হয়।
হ্যাগার্ড জাদুঘরের দারোয়ান কাম কেয়ারটেকারের চাকরিটা মনপ্রাণ দিয়ে করছে, মুখে গর্বের হাসি ফুটল তার।
মিস্টার পারকার বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বিলেতি কায়দায় আরেকবার নীরব প্রশংসা করলেন কিশোর ও হ্যাগার্ডের। বললেন, তবে আরেকটু রক্ত ঢাললে দেখতে আরও দারুণ হবে।
প্লাস্টিকের বোতলটা তুলে নিলেন। ছিপি খুলে ডামির ছিন্ন মুণ্ডুতে আরও খানিকটা রক্ত ঢাললেন। কাজ শেষ করে সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এইবার হয়েছে। হঠাৎ দেখলে যে-কারও পিলে চমকে যাবে।
ঠিক বলেছেন, আঙ্কেল, কিশোর হাসল।
ওদিকে জিনা নিচু স্বরে বিড়বিড় করে কী যেন বলল।
মিস্টার পারকার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মেয়ের দিকে। ভুলে যাচ্ছ। কেন, এ-ধরনের জাদুঘরের এসবই মূল আকর্ষণ। এগুলো দেখে মানুষ যদি ভয়ই না পেল, আমাদের এত খাটুনি মাঠে মারা যাবে না? নকল রক্ত লেগে আছে মিস্টার পারকারের হাতে। গাল চুলকালেন।
রক্তমাখা ডামি দেখে যতটা ভয় লাগছে, তার চেয়ে জ্যান্ত মানুষের রক্তমাখা মুখ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
ভৌতিক জাদুঘরে নানান ভৌতিক দৃশ্যের ব্যবস্থা করতে হয়, বললেন। তবেই খুশি হবে সবাই। আমাদের এই গোবেল বিচে দূর দূরান্ত থেকে আসবে মানুষ।
মিস্টার পারকার বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ফাঁকে জাদুঘর চালাবেন ঠিক করেছেন। মাস দেড়েক আগে আমেরিকার চেম্বারস অভ হররস-এর আদলে গোবেল বিচে একটা জাদুঘর খোলার শখ। চাপল তার মাথায়। একজন কেয়ারটেকারের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোক ইন্টারভিউ দিতে এল। শেষমেশ পাইন বিচ-এর লোক হেনরি রব। হ্যাগার্ডকে পছন্দ হলো, চাকরি হয়ে গেল তার।
বাড়ির নীচতলায় জাদুঘর বানিয়ে ফেলেছেন মিস্টার পারকার।
চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন উনি, এখন এই জাদুঘরে এমন একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে দর্শক রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। শিউরে উঠতে হবে। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসবে। তবেই দলে দলে লোক আসবে। ভয় পেতে মানুষ ভালবাসে, সেটা জানো?
বাড়ির পেছনদিকে এলিয়েন ট্র্যাকিং স্টেশন বসিয়েছ, বাবার দিকে তাকিয়ে বলল জিনা। লোকজন কৃত্রিম ভিনগ্রহবাসীর চলাফেরা, কাজকারবার দেখতে পাবে ওখান থেকে। পেছনদিকে আছে দুই মাথাওয়ালা লামা, আরও আছে শিংওয়ালা বিদঘুঁটে সেই জন্তুটা, ঘোড়ার মত।…কী যেন নাম ওটার?
ইউনিকর্ন, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, ইউনিকর্ন। তারপর আছে গিলোটিন, মমি, মোমের মূর্তি আর কত ভয়ঙ্কর জিনিস চাই তোমাদের!
মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন মিস্টার পারকার। ভাল কথা মনে করেছ, ওই ইউনিকর্নটার কথা তো খেয়ালই ছিল না। আমার। কিশোরের দিকে ফিরলেন তিনি। ওটা দেখে একেবারে জ্যান্ত মনে হয়, তাই না?
শুধু জ্যান্তই না, আঙ্কেল, বলল গোয়েন্দা-প্রধান। ওটার ঘোড়ার মত দেহ আর বিদঘুঁটে শিং দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে মেয়েদের।
সন্তুষ্ট হলেন মিস্টার পারকার। এই জাদুঘর তৈরি করবার পর থেকে মাঝে মাঝে হাসছেন।
কপাল কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল জিনা। জাদুঘরের প্রতি কোনও আগ্রহই নেই ওর। এই বিদঘুঁটে, ভয়ঙ্কর সব কারবার ওর পছন্দ নয়। তাই এ নিয়ে বাবার তারিফ শুনতেও ভাল লাগছে না। কিশোর জাদুঘরের প্রশংসা করলেই খেপছে।
জাদুঘরটা সত্যিই দারুণ হয়েছে, আড়চোখে জিনার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। অনেক মেয়ে তো হার্টফেলই করবে। আসলেই ভয়ঙ্কর সমস্ত কাণ্ড আছে এখানে, আঙ্কেল।
হবে না? বিড়বিড় করে বলল জিনা। কলজের পানি শুকানো। রাজ্যের জিনিস এনে ঠেসে রাখলে ভয়ঙ্কর হবে না কেন? আমার তো মনে হয় টিকিট কেটে একবার যে আসবে, সে তার চোদ্দগুষ্টির কাউকে আর এখানে আসতে দেবে না। কাজ নেই, টাকা খরচ করে মানুষ আসবে ভয় পেতে, হুহ!
শুনে ফেলল কিশোর। কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই জিনা বলে উঠল, বাবা, এখনও সময় আছে, বন্ধ করো এসব। ড্রইংরুমে মমি, ডাইনিংরুমে কফিন, কিচেনে গুলতি-তলোয়ার; এসব ভাল ঠেকছে না আমার।
আমার কিন্তু ভাল লাগছে, মন থেকে বলল কিশোর।
জবাব দিল না জিনা। চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।
আগে ওগুলো ড্রইং, ডাইনিংরুম, আর কিচেনে থাকলেও এখন। পুরো নীচতলায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
গোটা বাড়ি জাদুঘর নয়, জাদুঘর শুধু নীচতলাটা।
আঙ্কেল-আন্টি-জিনা উপর তলায় থাকে। আর আছে কয়েকটা গেস্টরুম। নীচের তলার চেয়ে দোতালাটাকে সাধারণ মনে হয়। কিশোরের। উপর তলায় কোনও ঝামেলা নেই। জাদুঘর চালু হলে। যখন-তখন মানুষ উপরে উঠে আসবে না।
মেয়ে ও কিশোরের উদ্দেশে বললেন মিস্টার পারকার, আর দুই সপ্তা পর ক্রিসমাস। গোবেল বিচে আজকাল এমনিতেই লোকজনের আনাগোনা বেশি, ক্রিসমাসের সময় আরও বাড়বে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। রাতারাতি আমার ভৌতিক জাদুঘরের নাম ছড়িয়ে পড়বে। কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে মিস্টার পারকারের চোখ জোড়া গম্ভীর হয়ে উঠতে দেখল কিশোর।
গোবেল বিচে ভৌতিক জাদুঘর এই একটাই। এর দর্শনার্থীরা দেখতে পাবে ভৌতিক কাজ কারবার। এখানকার প্রায় প্রতিটি দর্শনীয় জিনিসই ঐতিহাসিক এবং বিখ্যাত।
মোম-হলে ওত পেতে আছে মোমের তৈরি ডামি।
পিছনের পোর্চে ঝুলছে নির্যাতন করার ভয়ঙ্কর সব প্রাচীন যন্ত্রপাতি।
সামনের হলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মধ্যযুগীয় ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র।
দর্শনীয় জায়গা বটে, ভাবল কিশোর।
দেখবেন লাইন দিয়ে দর্শক আসবে, বলল হ্যাগার্ড। মিস্টার পারকার সিনিয়র যা পাঠাবেন বলেছেন, সেটা এলে তো কথাই নেই, জাদুঘরের আকর্ষণ আরও বেড়ে যাবে।
মিস্টার পারকার মাথা দোলালেন। কাল ফোন করেছিল আমার ভাই। বলেছে ওটা ট্রান্সপোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। শীঘি এসে পড়বে। একটা প্রাচীন বর্ম আসছে ভাবতেই… কথা শেষ না করে থেমে গেলেন।
আঙ্কেলের চাচাত ভাই ওটা পাঠিয়েছেন।
আসলে কিশোরেরও তর সইছে না। আগেকার আমলের বর্মপরা সৈন্যদের আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। মাত্র কদিনই কেয়ারটেকার হ্যাগার্ডের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব সৃষ্টির এটাও একটা কারণ। সে বর্মধারী সৈন্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। একবার বলা শুরু করলে আর থামতে পারে না।
ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান রাখে লোকটা।
হ্যাগার্ডের বয়স আন্দাজ করা যায় না। তবে দেখে মনে হয়। মিস্টার পারকারের চেয়ে বেশি। ছিপছিপে লম্বা দেহ। সাদা, বাবরি চুল কাঁধ ছুঁয়েছে। ঠোঁটের উপর চওড়া কাঁচাপাকা গোঁফ। লোকটা যখন নিজের প্রিয় বিষয় নিয়ে বলে, তখন তার চোখজোড়া চকচক করতে থাকে। মমি বানানোর কায়দা, গিলোটিনে গলা কাটার নিয়ম-ইত্যাদি বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। কখনও কখনও এসব বিষয়ে তাকে বিশেষজ্ঞ মনে হয় কিশোরের।
অতীতের রাজ-রাজড়াদের আমলের বর্মধারী সৈন্য, তলোয়ার, প্রাসাদ, ড্রাগন এসব বিষয়েও যথেষ্ট জ্ঞান লোকটার।
বর্মধারী সৈন্যদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, বিশেষ করে মধ্যযুগের ইউরোপীয় নাইটদের সম্বন্ধে। তাদের ব্যবহৃত সব ধরনের অস্ত্রের নাম জেনেছে কিশোর লোকটার কাছ থেকেই। নাইটদের যাবতীয় রীতিনীতির ব্যাপারেও বলেছে ওকে। এই রীতিনীতিটাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। কড়া ট্রেইনিং শেষে লড়াইয়ের কায়দা শিখত। হয়ে উঠত সাহসী বীর।
হ্যাগার্ড ধীর পায়ে কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল। সিনিয়র পারকার চিঠিতে বিশেষ একটা কথা লিখেছেন, ঠোঁটের কোণে হাসি তার। মনে আছে তোমাদের?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। লিখেছেন, তোমাদের জন্যেও বিশেষ একটা উপহার পাঠিয়ে দিলাম।
জিনার চেহারা কালো হয়ে উঠল। সিনিয়র চাচা ওকে আলাদাভাবে কোনও উপহার পাঠাচ্ছেন না বলে মেজাজ খারাপ ওর। চেহারা কুঁচকে রেখেছে।
গত পরশু কিশোর ওর সঙ্গে অদ্ভুত এক বাজি ধরেছিল। দুজনকে সামনা-সামনি বসে পুরো একটা করে বাতাবি লেবু খেতে হবে, লবণ ছাড়া। খাওয়ার সময় বিরতি দেয়া যাবে না। জিনা অর্ধেকটা খেয়ে চেহারার যে অবস্থা করেছিল, এখনও ঠিক সেরকম দেখাচ্ছে।
শেষে বাজিতে অবশ্য ও-ই জিতেছিল। ওকে দুদুটো আইসক্রীম খাওয়াতে হয়েছে কিশোরকে।
সিনিয়র চাচা চিঠিতে আরেকটা কথাও লিখেছেন, কিশোর বলল। যে বর্মটা উনি পাঠাচ্ছেন, সেটা নাকি ভুতুড়ে।
ন্যাকড়া দিয়ে গালের রক্ত মুছতে মুছতে বললেন মিস্টার পারকার, ওটা যদি সত্যি সত্যি ভুতুড়ে হতো…
নিজের অজান্তে শিউরে উঠল জিনা। অজানা শিহরণের স্রোত বয়ে গেল ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। অস্বস্তি লেগে উঠল।
মিস্টার পারকার, বাসায় আছেন? সামনের পোর্চ থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। নার্ভাস কণ্ঠ। কিছু ডেলিভারি দিতে বা মেরামতির কাজ করতে যারাই আসে ভৌতিক জাদুঘরে, সবার কণ্ঠ এমনই নার্ভাস শোনায়। আমরা জি.এম.আর. ট্রাভেলস থেকে এসেছি। একটা পার্সেল আছে।
এক ছুটে সামনের পোর্চে বেরিয়ে এল সবাই।
দেখা গেল বাসার সামনে একটা ভ্যান দাঁড়িয়েছে। ওটার গায়ে কালো, চ্যাপ্টা হরফে লেখা : জি.এম. আর. ট্রাভেলস।
দুজন লোক ভ্যানের পিছন থেকে কফিনের মত বড় একটা বাক্স টেনে বের করছে। হ্যাঁ, কফিনই বলা চলে।
পোর্চের মাঝখানে থমকে দাঁড়াল কিশোর। জিনার পক্ষে সময়মত ব্রেক কষা সম্ভব হলো না। ধাক্কা খেল কিশোরের পিঠে। পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল কিশোর। জিনা ওর কাঁধের উপর দিয়ে। সামনে তাকাল।
কাঠের কফিনটা বেশ লম্বা। দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরানো। কফিনের উপর দিকের কয়েকটা তক্তা বাঁকা এবং চিড় ধরা।
ডেলিভারি-ম্যানরা কফিনটাকে লম্বালম্বি দাঁড় করাল। উচ্চতায় তাদের সব কজনকে ছাড়িয়ে গেল ওটা।
মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ড ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কফিনটাকে।
কিশোর দ্রুত পায়ে এগিয়ে মিস্টার পারকারের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। জিনা ভয়ে ভয়ে এগোল, কিশোরের পাশে দাঁড়াল।
জিনিসটাকে কাঁধে তোলার সময় সঙ্গে আসা লোকদের মুখ দিয়ে যে অদ্ভুত গোঙানি বেরোল, তাতে বোঝা গেল কফিনের ওজন নেহায়েত কম নয়।
ফাটল দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু ভিতরে অন্ধকার বলে দেখা গেল না কিছু। সেই বর্ম মনে হয়, নিচু স্বরে বলল।
মিস্টার পারকার কিছু না বলে মাথা ঝাঁকালেন। সাবধান! খুব সাবধান! তাড়াহুড়ো কোরো না। হ্যাঁ, আস্তে এগোও, মানুষগুলোর উদ্দেশে বলে চলেছেন তিনি। বারান্দায় তুলে রাখো। পরে আমরা। ভেতরে ঢুকিয়ে নেব। সরে দাঁড়াও, জিনা। কিশোর, অত কাছে যেয়ো না, সাবধান! তুমি…
আচমকা থেমে গেলেন উনি। বাক্সের দরজা হাঁ হয়ে গেছে অনেকটা, ভিতর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে। রোদের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠল ওটা।
ভাল করে খেয়াল করতে কিশোর বুঝল ওটা বড়সড় একটা কুঠার। বর্মধারীর কুঠার।
ওটার চকচকে লম্বা ব্লেড বাতাসে শিস কেটে কোপ মারার ভঙ্গিতে দ্রুত নীচে নেমে এল। যেন অদৃশ্য কোনও হাত ভিতর থেকে ঘটিয়েছে কাজটা।
একটা চাপা গোঙানি ছেড়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। পারল না। ক্ষুরধার ব্লেডটা ওর ডান পায়ের উপর পড়ছে!
২
ডান পা নড়ানোর চেষ্টা করল কিশোর। ধীরে ধীরে আঙুল নাড়াচাড়া করল। ভয়ে ভয়ে নীচে তাকাল। না, একটুর জন্য পায়ের উপর পড়েনি।
কাঠের মেঝেতে ডেবে আছে কুঠারের ব্লেড। ডান পায়ের সামান্য আগে পড়েছে। ব্লেডের ওপাশে ওর জুতোর কালো ডগা দেখা যাচ্ছে। এপাশে পা সহ বাকি অংশ। নিখুঁতভাবে কাটা পড়েছে জুতোর ডগা।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ও। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। জুতোর কাটা ডগা দিয়ে বেরিয়ে থাকা পায়ের আঙুলগুলো নাড়াল, শ্বাস ফেলল। ওগুলো এখনও পায়ের সাথে এঁটে আছে। পুরো পাঁচটা আঙুলই আছে। একটাও কাটা পড়েনি।
ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিস্টার পারকার। কিশোর তার দিকে চেয়ে বোকা বোকা হাসল।
জুতোর ডগা কাটা পড়েছে, আঙ্কেল, লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে বলল ও। আঙুল কাটেনি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।
তোমার আরও সাবধান থাকা উচিত ছিল, কিশোর, গম্ভীর গলায় বললেন মিস্টার পারকার। যাও, জুতো পাল্টে এসো।
কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। জিনিসটা পুরো না দেখা পর্যন্ত সরতে মন চাইছে না।
হ্যাগার্ড এগিয়ে এসে এক হাত রাখল ওর কাঁধে। বলল, এসো, কিশোর। দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে যাক তোমার আমার মধ্যে।
কথায় কথায় প্রতিযোগিতা করা হ্যাগার্ডের স্বভাব। সব ব্যাপারে ছোট-বড় সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারলে যেন তার পেটের খাবার হজম হয় না।
অবশ্য কিশোরও লোকটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মজা পায়। কারণ এ পর্যন্ত যতবার প্রতিযোগিতা হয়েছে, কিশোরই জিতেছে প্রত্যেকবার।
দৌড় শুরু হয়ে গেল।
সিঁড়ি ভেঙে ঘরের দিকে ছুটল কিশোর। চোখের পলকে দরজার সামনে পৌঁছে গেল। দরজায় কালো রঙের পটভূমিতে ক্যাটকেটে লাল রঙে লেখা ভৌতিক জাদুঘর।
ঠেলে দরজা খুলে ফেলল কিশোর, ডানে বাঁক নিয়ে এগোল জুতোর র্যাকের দিকে। ঝটপট কাটা জুতো খুলে আরেক জোড়া পরে নিল।
এসময় হাঁসফাঁস করতে করতে পৌঁছুল হ্যাগার্ড।
শামুকের মত এলে পারবেন না আপনি কখনও, বলল কিশোর।
তা-ই তো দেখছি, হাসল হ্যাগার্ড।
লোকটাকে খোঁচা দিয়ে কোনও লাভ হয় না। যে খোঁচা গায়ে মাখে না, তাকে খোঁচা দেয়ার সার্থকতা কোথায়? হ্যাগার্ড খেপে না, উল্টে হাসে দাঁত বের করে।
কিন্তু এ যাত্রায় হাসিটা নিষ্প্রাণ। কিশোরের কথা তার কানে গেছে বলেও মনে হলো না। যে-কারণেই হোক, লোকটাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। বাদামী চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে।
কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি যা দেখলাম, তুমি তা দেখেছ, কিশোর?
ঘুরে দরজার দিকে তাকাল সে। ডেলিভারি-ম্যানরা ভারী কফিনটা বারান্দায় ওঠাচ্ছে।
কী? প্রশ্ন করল কিশোর।
কফিনটার গায়ের লেখাগুলো পড়েছ? জিজ্ঞেস করল সে।
লেবেল? নাহ!
বলো কী! বিস্ময় ফুটল লোকটার চেহারায়।
পড়ার সুযোগ পেলাম কোথায়।
লেবেলে লেখা আছে, মণ্ট্যানার জ্যাণ্ডে ভিলা থেকে ওটা লস অ্যাঞ্জেলেসে পাঠানো হয় প্রথমে। ওখান থেকে এখানে এসেছে।
আসতেই পারে, বলল কিশোর। সিনিয়র পারকার হয়তো মণ্ট্যানা থেকে আনিয়েছেন ওটা।
হ্যাঁ, তাই হবে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার যদি ভুল হয়… থেমে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল হ্যাগার্ড। একটু পর বলল, হ্যাঁ, ভুল না হওয়ারই কথা। জ্যাণ্ডে ভিলা নামে একটা বাড়ি আছে। মণ্ট্যানার হেলেনায়। বাড়িটা তিন শতাব্দী আগের দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সৈন্য নেজার ম্যাণ্ডারের। মার নামে চ্যাপেলের ধাচের বাড়িটা সে বানিয়েছিল।
নেজার ম্যাণ্ডারের কথা এমনভাবে বলছে লোকটা, যেন সে বিখ্যাত কেউ। আসলে উল্টো।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাগার্ড। নেজারের কাহিনি জানো তুমি? সে ছিল হাড় বজ্জাত এক সৈন্য। জাত বদমাশ। নিষ্ঠুর। ১৭০৫ সালের দিকে হেন বদ কাজ নেই যা সে করত না। ইংরেজ রাজার আস্কারায় দিনকে দিন বদমায়েশী মাত্রা ছাড়িয়ে যায় নেজারের, চলে আসে আমেরিকায়। সে-সময়ে প্রতাপশালী কয়েকজন বণিকের অনুরোধে এক নামকরা জাদুকর জাদু করে নেজারকে। নিজের বর্মের মধ্যে তাকে চিরতরে বন্দি করে। বর্মের মধ্যে বন্দি অবস্থায় সে মারা যায়। কফিনবন্দি বর্মটা সবার অজান্তে তারই বাড়ির তলকুঠুরিতে লুকিয়ে রাখে জাদুকর। এটা হয়তো সেই বর্মটাই।
তা হলে তো আরও ভাল, কিশোর বলল। যেসব জিনিসে ভূত ভূত গন্ধ আছে, সেসবই তো এখানে দরকার। আমার মনে হয় বর্মটা। পারকার আঙ্কেলের পছন্দ হবে।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাগার্ড। আমারও তা-ই মনে হয়, চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটল লোকটার। গলা আপনাআপনি নিচু হয়ে এল।
নেজারের কাহিনির বাকি অংশটুকু তোমার চাচা জানেন কিনা আমি বলতে পারি না।
লোকটার বলার ভঙ্গি কিশোরকে সচকিত করল। রহস্যের গন্ধ পেল ও। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, বাকি অংশটা কী?
শব্দ করে হাসল লোকটা। না না, তেমন কিছু না, নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল। সে-কথা শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আষাঢ়ে গল্পের মত মনে হবে। লোক কাহিনি মতে নেজারের বর্মটা যার কাছে গেছে, তারই কপাল নাকি পুড়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে সে।
সত্যিই যদি ওটা ভুতুড়ে হয়, তা হলে তো জাদুঘরের জন্যে ভালই, তা-ই না?
তীক্ষ্ণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল হ্যাগার্ড। ভুরু কুঁচকে উঠেছে। সামনে ঝুঁকে কিশোরের মুখের কাছে নাক এনে বলল, জাদুঘরের জন্যে ভাল হবে কি না জানি না, তবে আমাদের জন্যে যে ভাল হবে না, সে-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল লোকটা কয়েক মুহূর্ত। কী যেন ভাবল। তারপর কিশোরের চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি তো গোয়েন্দাগিরি করতে পছন্দ করো, তা-ই না?
করি। মৃদু হাসল কিশোর। আপনি কী বলতে চান বুঝতে পেরেছি। বর্মটার ওপর নজর রাখতে হবে আড়াল থেকে, এই তো?
মাথা উপর-নীচ করল সে। হ্যাঁ।, ঠিক আছে, মিস্টার হ্যাগার্ড, কিশোর বলল। আপনি যখন। কাজে ব্যস্ত থাকবেন, তখন আমি চোখ রাখব।
আর তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে, কিশোরের কাঁধে হাত রাখল সে, তখন আমি নজর রাখব। ঠিক আছে?
আচ্ছা।
বারান্দায় বেরিয়ে এল দুজন।
কফিন রেখে গাড়িতে ফিরে গেছে লোকগুলো। বারান্দার এক কোণে রাখা আছে কফিনটা।
মিস্টার পারকার আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করতে নারাজ। একটা ক্রোবার হাতে ওটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন তিনি। কফিনের ডালার নীচে ক্রোবারের বাঁকানো মাথাটা ঢুকিয়ে চাড় দিলেন। পেরেক দিয়ে কোনওরকমে আটকে ছিল ডালা, চাপ পড়তেই কড়মড় শব্দে উঠে এল।
মিস্টার পারকার ডালাটা সামান্য তুলে ধরতে হ্যাগার্ড ফাঁক দিয়ে হাত ভরে ওটাকে টান মারতে লাগল উপর দিকে।
জিনা একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিশোরের চোখে ওর ভিতরের নার্ভাস ভাবটা ঠিকই ধরা পড়ে গেল। নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে জিনা। ঘাবড়ে যাওয়ার লক্ষণ–কিশোর জানে।
একটু একটু করে উত্তেজনা বাড়ছে কিশোরের। তীক্ষ্ণ চোখে মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ডের কাজ দেখছে।
তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় অবশেষে খুলে উঠে এল ডাটা।
কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। জিনা ওর গা ঘেঁষে থামল। ঝুঁকে কফিনের ভিতরে উঁকি দিল ওরা একযোগে।
ফেঁশো জিনিস দেখা গেল ভিতরে। ওগুলো আর কিছু নয়, লম্বা ফালি করে কাটা প্যাকিঙের কাগজ। একই সাইজের।
কাগজ! জিনার কণ্ঠে হতাশা। কিশোরও রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছে।
খালি কাগজ নয়, রহস্য করে বললেন মিস্টার পারকার। হাত ঢুকিয়ে দেখো ওর ভেতরে আসল জিনিসও আছে।
ইয়ে… না, থাক, এক পা পিছিয়ে গেল জিনা। তুমিই দেখো, বাবা।
ভয় করছে? নরম সুরে বলল কিশোর। মনে মনে হাসছে।
মোটেই না, কড়া স্বরে মিথ্যে বলল জিনা। সম্মানে লেগেছে। ভয় পাব কেন? ভয়ের কী আছে! কিশোরের কাছে ছোট হতে রাজি নয়।
আরও কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল কিশোর। কিন্তু জিনা সে সুযোগ দিল না। কারণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুলহাতা জামার আস্তিন গুটিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। প্যাকিং কাগজের মধ্যে কনুই পর্যন্ত ঢুকে গেল ওর।
নিরেট একটা কিছুর ছোঁয়া পাওয়ার আশায় দ্রুত হাত নাড়াচাড়া করছে জিনা।
খসখস আওয়াজ উঠছে।
সামনে ঝুঁকে আরও ভিতরে হাত ঢোকাল ও।
এই তো পেয়েছি! কিন্তু… কথা শেষ না করে থেমে গেল। পরক্ষণে তীক্ষ্ণ বাঁশির মত চিৎকার করল, ওটা… ওটা আমাকে খামচে ধরেছে! কী… কী ওটা!!
পাগলের মত হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও। কিন্তু কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছে ওর হাত।
ছাড়ছে না!
৩
একদিকে চেঁচাচ্ছে জিনা, আরেক দিকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। চেহারা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে।
মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ড একযোগে উবু হলো কফিনের উপর।
দুই জোড়া হাত মুঠো মুঠো করে টুকরো কাগজ তুলল ভিতর থেকে।
একটু সবুর করো, জিনা, গম্ভীর হয়ে বললেন মিস্টার পারকার।
জলদি করো, বাবা! কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল জিনা।
কিশোর বুঝতে পারছে জিনার হাত আটকে গেছে কিছুর সঙ্গে।
মিস্টার পারকার জিনার হাত তুলে আনলেন কফিন থেকে। সঙ্গে বাহুসহ একটা ধাতব হাতও উঠে এল। ওটা ধাতব কাঁধের সঙ্গে আটকে ছিল। এখন খসে পড়েছে।
না হেসে গম্ভীর হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার।
জিনা বোকার মত নিজের হাতের দিকে চাইল।
আসলে মুঠো পাকানো ধাতব হাতটার আঙুলে ওর ব্রেসলেট আটকে আছে-খামচায়নি কেউ।
কাণ্ড! মিস্টার পারকার বললেন। দাঁড়াও, খুলে দিচ্ছি।
ধাতব আঙুলগুলো একটা একটা করে সিধে করলেন তিনি।
ছাড়া পেয়েই জিনা একটানে হাত সরিয়ে নিল।
কপাল কুঁচকে কফিনটার ভিতরে তাকাল।
সবার সামনে এভাবে বেইজ্জতি হওয়ায় মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের আক্রান্ত হাতের দিকে নজর দিল ও। অন্য হাতে ডলতে লাগল ব্যথা পাওয়া জায়গাটা।
আড়চোখে হ্যাগার্ডের দিকে তাকিয়ে বাপ-বেটির অলক্ষে ভুরু নাচাল কিশোর। সে-ও জবাব দিল একইভাবে।
মিস্টার পারকার কফিনের উপর ঝুঁকে হাত ঢোকালেন ভিতরে। কী একটা জিনিস তুলে আনলেন।
দেখো, কী সুন্দর জিনিস, কিশোরদের উদ্দেশে বললেন।
একটা হেলমেট ধরে আছেন তিনি। অস্তমান সূর্যের কোমল কিরণ পড়াতে ঝিকিয়ে উঠল ওটার চকচকে মসৃণ দেহ।
ওটার দিকে চেয়ে রইল কিশোর মন্ত্রমুগ্ধের মত। অবশেষে বলল, দেখে মনে হচ্ছে জিনিসটা কনে ঠাণ্ডা, তা-ই না, আঙ্কেল?
হেলমেট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন মিস্টার পারকার। বললেন, ধরেই দেখো না ঠাণ্ডা না গরম। চোখে দেখে কোনও কিছুর তাপ বোঝা যায়?
হাতে নিতে কিশোর বুঝল যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভারী জিনিসটা। হাত বোলাল ওটার গায়ে। নিরেট ধাতু যেমন ঠাণ্ডা হয়, এটা মোটেই তেমন নয়, বরং কিছুটা গরমই ঠেকছে। যেন অনেকক্ষণ পরে থাকার পর এইমাত্র খুলে রেখেছে কেউ।
অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেল কিশোরের সারা দেহে। দুহাতে ধরল ও হেলমেটটা।
মিস্টার পারকার কফিন থেকে একটা শিনগার্ড (হাঁটুর নীচের অংশের আবরণ বের করে মেঝেতে রাখলেন। তারপর বের করলেন একটা ধাতব পা।
উত্তেজনায় দুচোখ চকচক করছে তার। ছড়ানো-ছিটানো। কাগজের মধ্যে দ্রুত হাত চলছে।
বর্মের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে পাশে জড়ো করছেন ব্যস্ত হয়ে।
এই সেই জিনিসই, নীরবতা ভাঙলেন উনি। এটাই হবে ভৌতিক জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস। শুধু গোবেল বিচে কেন, গোটা ক্যালিফোর্নিতে এমন চমকানো বর্ম দুটো নেই। এটার কথা একবার প্রচার হলেই দলে দলে লোক আসবে এই জাদুঘরে।
হঠাৎ থেমে গেলেন উনি। কপাল কুঁচকে উঠেছে। আবার কফিনের ভিতরে হাত চালাতে শুরু করেছেন। আচমকা থেমে গেলেন।
বোঝা গেল কিছু একটা ঠেকেছে তাঁর হাতে।
এ আবার কী! বলতে বলতে হাত তুলে আনলেন।
উজ্জ্বল এবং চকচকে একটা জিনিস দেখা গেল তার হাতে।
অদ্ভুত, গোল জিনিসটা। একটা সোনালি চেইনের প্রান্তে ঝুলছে।
বড়সড় একটা মার্বেলের মত মনে হচ্ছে ওটাকে।
তবে মার্বেল যে নয়, এক নজর দেখলেই বোঝা যায়।
জিনিসটার ভিতরে নীল ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, উঠছে-নামছে। ধোঁয়ার ভিতরে আবার উজ্জ্বল রুপোলি কণা ভেসে বেড়াচ্ছে ছুটন্ত তারার মত।
মিস্টার পারকার কিশোরের হাতে দিলেন ওটা।
চোখের সামনে নিয়ে দেখল কিশোর। আঙ্কেলের দিকে তাকাল। এটাই বোধহয় আমাদের জন্যে সিনিয়র আঙ্কেলের সেই সারপ্রাইজ?
তা-ই মনে হচ্ছে, বললেন মিস্টার পারকার। চট করে জিনাকে দেখে নিয়ে কিশোরকে বললেন, উনি বোধহয় এটা তোমার জন্যেই পাঠিয়েছেন। জিনার তো লকেট আছে।
আমার জন্যে তা হলে কী? গরম স্বরে বলল জিনা।
পরে পাঠাবেন হয়তো।
গম্ভীর হয়ে গেল জিনা। বলল, কিশোরের জিনিস… ও। দেখতেও তো ভাল না। ভেতরে আবার ধোঁয়া।
একমুহূর্ত দ্বিধা করল কিশোর। তারপর চেইনটা গলায় ঝোলাল। মুখ নিচু করে সাদা টি-শার্টের উপর ঝুলে থাকা লকেটটার দিকে তাকাল। দারুণ জিনিস, তা-ই না, আঙ্কেল?
নীরবে একমত হলেন উনি মাথা ঝাঁকিয়ে।
জিনা কিছু বলল না, তবে ওর দৃষ্টিতে ঈর্ষা। তাই জিনিসটা দ্বিগুণ ভাল লাগল কিশোরের।
এগিয়ে এল হ্যাগার্ড।
লকেটটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, আমার কী মনে হয়, জানো?
কী?
মনে হয় এটা জাদুর লকেট।
তা-ই বুঝি? বলল কিশোর।
জাদুর লকেট!
বহুদিন পর চমৎকার একটা লকেট উপহার পেয়েছে কিশোর। তাই মনে মনে সিনিয়র পারকারকে লম্বা-চওড়া থ্যাঙ্কস না দিয়ে পারল না।
সত্যি দারুণ একটা জিনিস গিফট করেছেন উনি।
এরমধ্যে কফিনটার ভিতর থেকে বর্মের বাকি অংশগুলো বের করে ফেলেছেন মিস্টার পারকার। ওগুলো জড়ো করে নিয়ে চলল কিশোর সামনের হলের দিকে।
কিশোর ও হ্যাগার্ড ওখানে পৌঁছে বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো একে একে মিস্টার পারকারকে দিল। একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে নেজারের বর্মটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন মিস্টার পারকার।
প্রিয় রাফিয়ানের পিঠে হাত রেখে কিশোরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জিনা, বাবার কাজ দেখছে।
চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটার প্রতি কোনও আগ্রহই নেই ওর।
একটু পিছু হটে বর্মটার দিকে ভাল করে তাকাল কিশোর।
যোদ্ধা নেজারের গড়ন কেমন ছিল, ওটা দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না ওর। বর্মের দুকাঁধ চওড়ায় এক গজ মত হবে।
পা জোড়া গোলাকার ও নিরেট, ছোটখাটো গাছের গুঁড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনটে কিশোর অনায়াসে লুকাতে পারবে বর্মটার ব্রেস্টপ্লেটের মধ্যে।
রবিনের কাছ থেকে নিয়ে মধ্যযুগীয় যোদ্ধাদের উপরে লেখা একটা বই পড়েছিল কিশোর। ওই বইতে ছিল মধ্যযুগের, অর্থাৎ ১১০১ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে যত দুর্ধর্ষ লড়াকু লোক ছিল, তাদের জীবন-কাহিনি।
সামনের বর্মটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সেই বইটার কথা মনে পড়ে গেল ওর।
কী বিদঘুঁটে! বলল ও বিড়বিড় করে।
শুনে ফেলল হ্যাগার্ড। কিশোরের কাঁধে হাত রেখে বলল, ঠিক বলেছ, কিশোর। আমারও বর্মটাকে বিদঘুঁটেই লাগছে।
চোখ তুলে তাকালেন মিস্টার পারকার। শুনেছি বর্মটা নাকি ভুতুড়ে। তাই যেন হয়। ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না। এই বর্ম দিয়েই জিনাকে বুঝিয়ে দেব ওসব মিথ্যে।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল।
মিস্টার পারকার ধরতে গেলেন।
হ্যাগার্ডও বেরিয়ে গেল। বলে গেল, মোমের জাদুঘরে জরুরী। কাজ পড়ে আছে তার।
কিশোরের দিকে তাকাল জিনা। গলা নামিয়ে বলল, তোমার কি মনে হয়, বর্মটা সত্যি ভুতুড়ে?
হতে পারে, বিজ্ঞের ভঙ্গি করে বলল ও। আবার না-ও হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে তোমার চেহারাটা যে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কথার খোঁচা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে তৈরি হয়েছিল জিনা।
কিন্তু কিশোর সেই সুযোগ দিল না ওকে। সিঁড়ি বরাবর দৌড় দিল। আণ্টি ডাকছেন নাস্তা করতে!
উপর তলা থেকে আণ্টি আবারও ডাকলেন।
দৌড়ে কিশোরকে হারাতে ছুটল জিনা। দুজন সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল একইসঙ্গে। ধাপগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে টপকাল। একইসঙ্গে ডাইনিঙে ঢুকল। হারল না কেউ।
৪
কাল একবার ফোন করতে হবে রকি বিচে, ভাবল কিশোর মনে। মনে।
মুসার এক বিখ্যাত মামা মিশর থেকে বেড়াতে আসার কথা। মুসাদের বাসায় উঠবেন। উনি এরমধ্যে আসার তারিখ জানিয়েছেন। কি না জানতে হবে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায় ও।
তা ছাড়া পরশুদিন সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছে রবিন, ওর হাল কী তা-ও জানা দরকার।
ভুলে যাবার ভয়ে কালকের করণীয় কাজগুলো একটা কাগজে লিখে ওটা টেবিলক্লথের নীচে রাখল কিশোর।
হরর ছবি আছে রাত সাড়ে নটায়। দেখা দরকার। অবশ্য প্রায়। একঘণ্টা বাকি আছে এখনও।
ইলেকট্রনিক্স গেম ওয়াচ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল কিশোর। খেলতে খেলতে একসময় বিরক্তি ধরে গেল, টিভি দেখার এনার্জিও গায়েব হয়ে গেছে ততক্ষণে।
দাঁত ব্রাশ করে এসে পাজামা পরে নিল। তারপর লম্বা হলো। বিছানায়।
চেইনটা গলায় ঝুলছে।
চিত হয়ে শুয়ে চোখের সামনে তুলে ধরল ওটা।
জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় লকেটের ভিতর নীলচে ধোঁয়ার ঘুরপাক দেখল।
ওর কেন যেন মনে হতে লাগল এই অপার্থিব ধোঁয়া সুকৌশলে কিছু একটা আড়াল করে রেখেছে। বড় কিছু।
আরও ভাল করে দেখার জন্য লকেটটা চোখের কাছাকাছি নিয়ে এল ও। সমানে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে ভিতরকার ধোঁয়া, মুহূর্তের জন্যও বিরাম নেই।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর।
থপ থপ!
স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও।
দেখল হ্যাগার্ড হাফপ্যান্ট পরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে একটা কচুরিপানা ভরা পুকুরে।
দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেখল, ইয়া মোটা একটা ছাতিম গাছের ডালে একটা হলুদ মার্বেল ঝুলছে। আর… আর দেখল, একটা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে নেজার ম্যাণ্ডারের বর্ম।
একের পর এক আরও কত কী যে দেখল ও, তার ইয়ত্তা নেই। এক দৃশ্যের সাথে আরেক দৃশ্যের মিল নেই। সব ছাড়া ছাড়া, আজগুবি।
উদ্ভট।
থপ থপ!
আবারও কানে এল আওয়াজটা।
চোখ খুলে কান পাতল কিশোর।
থপ থপ!
নাহ, শব্দটা স্বপ্নে শুনছে না ও। নিজেকে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো কিশোর। শুনছে বাস্তবে।
উঠে বসে দম বন্ধ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত।
থপ থপ!
পা ঝুলিয়ে দিল খাট থেকে। মাথা কাত করে ভাল করে শোনার চেষ্টা করল।
থপ্ থপ!
কিশোর মনে করতে পারছে না নীচতলায় এমন কী আছে যা এরকম আওয়াজ করতে পারে।
আশ্চর্য তো!
পাঁচ দিন হলো এই বাড়িতে আছে কিশোর, এমন আওয়াজ এর মধ্যে আর কখনও শোনেনি।
থপ্ থপ!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। হঠাৎ জিনিসটার কথা মনে পড়ে গেল। ওই একটা জিনিসই আছে এ বাড়িতে, যা ওরকম আওয়াজ তুলতে পারে।
বর্ম!
হ্যাঁ, নেজারের বর্ম।
থপ থপ!
সিঁড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল কিশোর। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ভয় করছে?
যেতে ইচ্ছে করছে, তা বলা যায় না।
কিন্তু কৌতূহলের কাছে হেরে গেল ভয়।
জাদুঘরের কিচেনটা ঠিক কিশোরের রুমের নীচে। আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে।
থপ থপ!
মুখ নিচু করে লকেটটার দিকে তাকাল কিশোর। ওটার ভিতরের নীলচে ধোঁয়া থপ্ থপ আওয়াজের তালে তালে ঘুরপাক খাচ্ছে, উঠছে-নামছে।
আশ্চর্য!
থপ থপ!
শব্দ অনুসরণ করে নীচে নেমে এল, জাদুঘরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল। কিচেনের কাছে পৌঁছে থেমে দাঁড়াল। লম্বা শ্বাস টানল। বার কয়েক, যেন কয়েক মাইল পথ দৌড়ে এসেছে।
সুযোগ এসেছে!
নতুন কোনও এক ভূতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ও!
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে বর্মটা সত্যিই ভুতুড়ে কি।
থপ থপ!
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবধানে কিচেনের দরজা খুলে ফেলল ও।
থপ থপ!
কাঁপা পায়ে কিচেনে ঢুকল কিশোর। এক-পা দুই-পা করে এগোল কয়েক পা।
থপ্ থপ!
চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের।
দেখতে পেয়েছে ওটাকে!
অন্ধকারে ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকার মত লাগছে দেখতে!
৫
আর পারল না কিশোর, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল ওর। কড়া স্বরে বলল, জিনা, তুমি! এত রাতে এখানে কী করছ?
ঝাড়ু হাতে কিচেনের মাঝখানে উঁচ একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে র্জিনা। ওটার গোড়া দিয়ে থেকে থেকে সিলিঙে শব্দ করছিল এতক্ষণ।
আগুন-ঝরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। হচ্ছেটা কী এসব? ধমকের সুরে বলল ও।
হেসে উঠল জিনা। কিশোরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, তুমি না ভূত শিকারী! এই বাড়িতে ভূত খুঁজবে!
হাসতেই থাকল জিনা। মনে ভূতের সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে কিশোরকে টেনে এনে আনন্দে আটখানা। ভাবছে বোকা বানাতে পেরেছে।
রাত-বিরেতে ঘর ঝাঁট দিতে শখ হয়েছে দাও, কিন্তু সিলিঙে ঠোকাঠুকির দরকারটা কী? বলল কিশোর। নীচতলায় এই কাজ করলে ওপরতলায় কার না সন্দেহ হবে? তা ছাড়া আমার কাজই অলৌকিক, অবিশ্বাস্য, রোমহর্ষক আর ভীতিকর সব ঘটনার সমাধান খুঁজে বের করা। তোমার ঝাড়ুর থপথপ শুনে ভাবলাম, দেখি কোন ভূত এই বাড়িতে এল ভিতুর ডিম জিনাকে ভয় দেখাতে। তাই এসেছি, কিন্তু এর মধ্যে এত হাসির কী হলো?
নিজের বুকের উপর ঝুলন্ত নীল লকেটটার দিকে তাকাল কিশোর। থপ্ থপ শব্দ বন্ধ হওয়াতেই বুঝি ভিতরের ধোঁয়ার মেঘ অনেকটা শান্ত হয়েছে।
লকেটটার এমন কাণ্ডের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝল না ও।
তোমার কপাল ভাল, মাথা দোলাল কিশোর। আঙ্কেল পারকার জেগে ওঠেননি। উনি শুনলে মনে করতেন সত্যি সত্যি বুঝি ভূত এসেছে এ বাড়িতে। ব্যাপার সত্যি কি না যাচাই করার জন্যে এখানে এসে তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে ঝটার বাড়ি একটাও মাটিতে পড়ত না। কী বলে?
এবার যেন রসভঙ্গ হলো জিনার। ঝাড় রেখে দিল। আসলে বাবার কথা ভাবিইনি আমি, বলল দ্বিধা করে। আমার মাথায় ছিল শুধু তোমাকে ভয় দেখানোর চিন্তা।
না, শুধু আমাকে ভয় দেখানোর চিন্তা ছিল না তোমার মাথায়, দুহাত বুকের উপর বেঁধে গম্ভীর হলো কিশোর। ও লক্ষ করেছে, এমন ভঙ্গি করলে মুখের কথার ওজন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সহজেই প্রভাবিত হয় প্রতিপক্ষ। তোমার মাথায় ছিল আসলে অনর্থক ঝামেলা। পাকানোর চিন্তা।
অস্বস্তি ঝেড়ে টুল থেকে নেমে দাঁড়াল জিনা। এক পা সামনে বাড়ল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তুমি সত্যি বর্মটাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ, তা-ই না?
কাকে কী বলছ? অবাক হলো ও। ভয় পাচ্ছি আমি? না তুমি? বিকেলে কী চেঁচানোটাই না চেঁচালে। আরেকটু হলে গোটা পাড়া জড়ো হয়ে যেত।
বিকেলের কথা বাদ দাও, বলল জিনা। কাঁধের উপর থেকে চুলের গোছা কানের পিছনে গুজল। ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না, করো তোমরা তিন গোয়েন্দা। তুমি আসলে বিশ্বাস করো বর্মটা ভুতুড়ে, আমি নই।
করতেই পারি। কারণ ভূতের সঙ্গে বহুবার মোলাকাত হয়েছে। আমার। তুমি ভাল করেই জানো সেসবের সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবও নেই আমার হাতে। ভূতে বিশ্বাস করা আর ভূতের ভয় পাওয়া এক নয়। আজকাল আমি ভূতে বিশ্বাস করি, কিন্তু ভয় করি না। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু ভয় পাও। ধরো ওই বর্মটার ব্যাপারে যে কাহিনি চালু আছে, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে? থেমে দম নিল কিশোর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জিনার দিকে। তারপর বলল, তুমি চাইবে ভয়ঙ্কর এক সৈনিক ভূতের মুখোমুখি হতে?
দেখো কিশোর, কপাল কুঁচকে বলল জিনা, আমি জানি রহস্যময় বা অলৌকিক সব কাণ্ড-কারখানা শুধু তোমাকে আর রবিন মুসাকে ঘিরেই ঘটে। না হয় মানলাম ভূত বলে কিছু একটা আছে, তাই বলে নিরীহ বর্মটাকেও ভুতুড়ে বলবে তুমি? রাতের বেলায় ওটা হেঁটে বেড়ায়, এমন আজগুবি কথা তুমি বিশ্বাস করো?
আমি হা-না কিছুই বলব না, জবাব দিল গোয়েন্দা-প্রধান।
সেটা জানার একটাই উপায় আছে, এখনই একবার গিয়ে চেক করে দেখা।
জিনা এমন ভান করল, যেন কিশোরের প্রস্তাবটা ওর কানেই যায়নি। বাইরে যতই মুড দেখাক, ভিতরে ভিতরে ও যে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, কিশোরের বুঝতে অসুবিধে হলো না।
চলো, একবার দেখে আসি, আবার প্রস্তাব করল কিশোর।
অসম্ভব! দুপাশে মাথা দোলাল জিনা। আমার আর খেয়ে কাজ নেই যে…
বুঝতে পেরেছি, ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হেসে উঠল কিশোর, ভয় পেয়েছ তুমি।
কিশোরের সামনে নিজেকে ভিত প্রমাণের কোনও ইচ্ছে নেই জিনার। তা-ই ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হতেই হলো। আচ্ছা, চলো, হাল ছাড়া ভঙ্গিতে বলল।
কিচেন থেকে বেরিয়ে অন্ধকার করিডর ধরে এগোল ওরা। বুকের মধ্যে কেমন যেন ধুপধাপ শুরু হলো কিশোরের। দোতলায় বসে থপ। থপ শব্দটা প্রথম শোনার সময়ও এমনটা লেগেছিল।
অকারণে ভয় পেতে রাজি নয় কিশোর। কিন্তু এখন এমন লাগছে। কেন?
আসলে ভুতুড়ে জাদুঘরটাই এর কারণ। এটাকে গভীর রাতে কেমন যেন শ্মশান শ্মশান মনে হলো ওর।
হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এল কিশোরের।
খর-খর-খরখর-খরখর!
ব্ল্যাকবোর্ডে নখ দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন শব্দ।
নিজের অজান্তে গায়ে কাঁটা দিল ওর।
থেমে দাঁড়াল।
অমনি শব্দটাও থেমে গেল।
মেঝের আওয়াজ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।
আগেই বোঝা উচিত ছিল, এবাড়ির প্রায় সবকিছু থেকে নানান রকম আওয়াজ হয়। পুরানো, প্রকাণ্ড এই বাড়িটাতে যে-কারণে মজা। লাগে কিশোরের, তার একটা হলো গা শিউরানো এইসব আওয়াজ।
অবশ্য রাতের বেলা ওসব তেমন একটা ভাল ঠেকে না, বিশেষ করে যখন অদ্ভুতুড়ে সংগ্রহগুলোর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হয়, তখন।
ভী-ষ-ণ অস্বস্তি লাগে।
গা শিরশির করে। সেই অস্বস্তি এই মুহূর্তে আবার ভর করেছে। ওর উপর।
ভুতুড়ে বর্মটা দেখতে চলেছে ওরা।
ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে জিনার।
কখন কী করে বসে মেয়েটা, বলা মুশকিল। ওর সামনে। কিশোরের ভয় প্রকাশ পেলে আরও ঘাবড়ে যাবে ও। তাই যতটা সম্ভব মনের ভাব চেপে রেখেছে কিশোর। নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছে, ও কিছু নয়, বাতাস।
ডাইনিং রুমে ঢুকল ওরা।
মিস্টার পারকারের সমস্ত কফিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই রুমে প্রদর্শনের জন্য। তাই এ রুমের নাম রাখা হয়েছে কফিনঘর।
লুকোচুরি খেলার জন্য কফিন-ঘরের তুলনা নেই। লুকানোর জায়গার অভাব নেই এখানে।
দিনের বেলায় অবশ্য।
রাতে?
বুকটা কেঁপে উঠল কিশোরের।
এই গভীর রাতে..
চাপা একটা হেঁচকির আওয়াজ কানে এল কিশোরের। পরক্ষণে টের পেল হেঁচকিটা ও নিজেই তুলেছে। ঝট করে জিনার মুখের দিকে তাকাল।
জিনা যে এখন ওকে টিপ্পনী কাটবে, তাতে কোনও ভুল নেই।
কিন্তু কিশোরকে অবাক করে দিয়ে নিশ্চপ রইল ও।
আসলে এ রুমের থমথমে ভাব বোবা বানিয়ে দিয়েছে ওকে। কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরল। পা চলতে চাইছে না ওর, যেন সীসার মত ভারী হয়ে উঠেছে।
ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল কিশোর।
সব কটা কফিনের ডালা বন্ধ। হ্যাগার্ড ঘুমাতে যাবার আগে বন্ধ করে রেখে যায়।
কিন্তু তাতে কী?
কিশোর, জিনা দুজনেরই জানা, ওগুলোর ভিতরে কী আছে!
ওদের সবচেয়ে কাছের কফিনটার ভিতরে আছে মোমের তৈরি ড্রাকুলার ডামি। ওটার বুকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ঢোকানো আছে একটা কাঠের গোঁজ, বা কীলক।
ডান দিকের কফিনটার মধ্যেও আছে একটা মোমের ডামি। ডামিটা ওয়্যারউলফের।
তার পাশের কফিনটায় আছে একটা আধা গলা লাশের ডামি। ওটার মাথার জায়গায় বসানো আছে একটা আয়না।
বীভৎস দেহের ডামিটাকে দেখার জন্য সামনে ঝুঁকলেই ওই আয়নায় দর্শকদের প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা একটা প্রবাহের ওঠা-নামা টের পেল কিশোর।
সরসর করে খাড়া হয়ে গেল গায়ের সমস্ত রোম। চলার গতি বাড়িয়ে দিল ও।
আমার ভয় করছে, কিশোর, লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই বসল জিনা। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
দূর, কীসের ভয়! জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু কণ্ঠস্বর বিশ্বাসঘাতকতা করল নাকি? তেমন একটা দৃঢ় শোনাল না।
হঠাৎ চেহারা বিকৃত করে ককিয়ে উঠল কিশোর।
জিনা খপ করে ওর বাহু আঁকড়ে ধরল। কী হলো?
৬
কফিনের কোনায় গুঁতো খেয়েছি, কুঁজো হয়ে হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ও।
তাই বলে ওভাবে চেঁচাবে? ফিসফিস করে বলল জিনা। বাবা জেগে গেলে মজা টের পাবে।
পাশাপাশি হেঁটে চলল কিশোর-কিশোরী।
জিনা হঠাৎ থেমে দাঁড়াল।
কিশোর পাশ ফিরে তাকাল। কী হলো?
চোখ পিটপিট করে কফিনগুলো দেখছে জিনা। বেশ কিছুক্ষণ পর কপালের সামনে থেকে এক গোছা চুল সরাল ও। বলল, সত্যিই যদি এ ঘরে ভূত থেকে থাকে, তা হলে? আমার মনে হয় ওটাকে সপ্তাখানেক সময় দেয়া উচিত আমাদের। নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হয়ে উঠুক, তারপর না হয়…
জবাব দিল না কিশোর।
ওর মন বলছে, এ বাড়িতে ভূত আছে।
এবং ওটা অভিশপ্ত ভূত।
মিস্টার পারকারের মত ও-ও চায় ভৌতিক জাদুঘরে দেশ-বিদেশ থেকে দলে দলে দর্শনার্থী আসুক। কিন্তু ভুতুড়ে বর্মটা যদি বিপজ্জনক হয়ে থাকে?
হ্যাগার্ডের কথাই যদি সত্যি হয়?
তা হলে বদনাম হয়ে যাবে জাদুঘরের। লোকজন আসতে দ্বিধা করবে। মিস্টার পারকারের এই বিচিত্র হবি ভেস্তে যাবে।
অবশেষে কফিনঘর পেরিয়ে পাশের রুমে ঢুকল ওরা। মিস্টার পারকার আজ সারাটা বিকেল মমি ঝাড়পোছ করে। কাটিয়েছেন এখানে। এত পরিশ্রম করেছেন যে আজ আর তার প্রিয় ল্যাবরেটরিতে যাননি একবারের জন্য। এত ঝাড়া-মোছার পরও প্রতিটি জিনিসে চিকচিক করছে বালু।
ওদের প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে ধুলো উড়ছে। রীতিমত বিরক্তিকর লাগছে ধুলোর অত্যাচার। অবশ্য মেঝেতে ধুলোর ছড়াছড়ির ব্যবস্থা। মিস্টার পারকার ইচ্ছে করেই করেছেন।
তাঁর কথা হলো, ভুতুড়ে জাদুঘর হবে ধুলোমোড়া, যা-তা চেহারার। দেয়াল থেকে ঝুলবে মাকড়সার জাল। পরিবেশ হবে। ভৌতিক, ইত্যাদি।
ওদের হাঁটার তালে তালে মৃদু খসখস শব্দ উঠছে।
মমি হাঁটলেও এমন শব্দ হয়, মুসার কাছে শুনেছে কিশোর। মিশরে মসা নাকি ওই আওয়াজ পেয়েছে।
দূর, এসব কী ভাবছি আমি! নিজের উপর বিরক্ত হলো কিশোর।
হ্যাগার্ড ঘুমাতে যাবার আগে মমি কেসের ঢাকনা লাগিয়ে যেতে ভুল করে না কখনও। কয়েকটা কেস অবশ্য খোলাই থাকে
এখনও। ওগুলোর টুকটাক কাজ চলছে। মিস্টার পারকার নিজে করেন সেসব।
চোখের কোণ দিয়ে পারকার আঙ্কেলের প্রিয় মমিটার দিকে তাকাল ও। মিস্টার পারকার ওটার নাম দিয়েছেন উদাস।
উদাস তার খাড়া কফিনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গজমোড়া বাহু দুটো সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।
কোটরের গর্তে বসা চোখজোড়া যেন অন্ধকার ভেদ করে চেয়ে। আছে সোজা কিশোরের দিকে।
আস্তে ঢোক গিলল ও। নিজের অজান্তেই কেশে উঠল। হয়তো সহজ হওয়ার জন্য।
দ্রুত পা চালাল।
কিছুক্ষণ পর নির্দিষ্ট রুমের সামনে পৌঁছল ওরা। রুমের ভিতর দরজার কাছেই কাঠের একটা স্ট্যাণ্ডের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল বর্মটাকে।
চোখ গোল গোল করে কিশোরের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকাল জিনা।
চোয়াল ঝুলে পড়েছে। হাত ইশারা করল ও। সামনে তাকাল কিশোর। সাথে সাথে বেদম এক ঝাঁকি খেল।
জায়গাটা শূন্য!
বর্মটা নেই!
৭
কিশোর! জিনার গলা কেঁপে উঠল। কোথায় গেল ওটা? কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল!
বর্মটা গায়েব হয়ে গেছে। ওটার কাঠের স্ট্যাণ্ডটা আছে কেবল।
এর অর্থ বুঝতে পারছ, জিনা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারছি, ঢোক গিলল জিনা। বর্মটা হাঁটাচলা করতে পারে। ওটা… ওটা… আসলেই…
মনে হয় ভুতুড়ে! ওর কথা কেড়ে নিল কিশোর। বদমাশ নেজারের ভূত আছে ওটার মধ্যে। ভূতটা বর্মসহ নড়াচড়া করে। হাঁটাচলাও করতে পারে।
ওটা এখন কোথায় আছে কে জানে! সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল জিনা। চেহারায় তীব্র আতঙ্কের ছাপ পড়ল। তলকুঠুরিতে লুকিয়ে আছে। হয়তো। নয়তো… নয়তো ওপরতলায় গেছে। এক পা পিছিয়ে মমিঘরে পা রাখল ও। এই রুমেও থাকতে পারে। হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে অন্ধকারে কোথাও।
চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিশোর। আমার তা মনে হয়, বলল ও। ওটার যে সাইজ, এখানে ঘাপটি মেরে থাকা সম্ভব নয়। অন্য কোথাও আছে। এসো, খুঁজে দেখি।
দরকার নেই, পিছিয়ে গেল জিনা। সময় হলে আপনিই ফিরে আসবে। চলো, ফিরে যাই।
বলো কী! কিশোর অবাক হলো। এতদূর এসে ফিরে যাব? তুমি ভাল করেই জানেনা সেটা উচিত হবে না। এই রহস্য ভেদ না করতে পারলে চলবে না।
জিনার ঢোলা জামার আস্তিন ধরল ও। নিয়ে চলল যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে।
এর মধ্যে জানা হয়ে গেছে, নেজার মমিঘরে নেই।
কফিনঘরেও নেই।
কিচেনের অন্ধকার কোণ আর ছায়াগুলো ভাল করে পরখ করল। ওরা, ওখানেও নেই বর্মটা।
তা হলে?
আর কোথায় থাকতে পারে ওটা?
চলো, মোমঘরটা চেক করে আসি, কিশোর বলল।
অসম্ভব! তীব্র প্রতিবাদ জানাল জিনা। ওই ঘরে কেন যেন কখনোই যেতে চায় না ও, ভয় পায়। ওই ঘর ছাড়া যেখানে খুশি চলো।
ঠিক আছে, ওখানে যাব না, বলল কিশোর। কী যেন ভাবছে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কনজারভেটরিতে থাকতে পারে।
বাড়ির পিছন দিকে বিশেষভাবে তৈরি একটা কাঁচের ঘর ওটা। বাগান ঘর।
জিনা ওখানে না যাবার উছিলা খুঁজল, কিন্তু যুৎসই কোনও কারণ দাঁড় করানোর সময় পেল না। কিশোর তার আগেই ওকে নিয়ে চলল বাড়ির পিছন দিকে।
এই বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছে কিশোর, সেদিন মিস্টার পারকার, জিনা আর হ্যাগার্ডের মুখে বারবার শুনেও বুঝতে পারেনি কনজারভেটরি কী জিনিস।
শেষে মিস্টার পারকার ওকে বোঝালেন ওটা আর কিছু নয়, এক ধরনের গ্রিন হাউজ।
ওটা প্রকাণ্ড এবং ফাঁকা। ওটার ছাদ আর তিনদিকের দেয়াল কাঁচের।
মিস্টার পারকার ওখানে নানান জাতের শাক-সবজি, গাছপালা লাগিয়ে গবেষণা করেন। কিশোর যতদূর জানে, ওই ঘরটাকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করার কোনও ইচ্ছে নেই মিস্টার পারকারের। রুমটা বিশাল, বেঢপ।
তা ছাড়া এখানে জাদুঘর করতে গেলে এখানে-ওখানে বিস্তর মেরামত করাতে হবে। সাময়িক শখের জন্য অত ঝামেলায় যেতে রাজি নন মিস্টার পারকার।
কনজারভেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল কিশোর ও জিনা।
চাঁদের রহস্যময় নীল আলো দেয়াল আর ছাদ ভেদ করে ভিতরে ঢুকছে। একেবারেই অন্যরকম লাগছে জায়গাটাকে।
দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা পা টিপে টিপে। কতগুলো গাছের আড়ালে চলে এল ওরা। জাদুঘরে ব্যবহার করার জন্য মিস্টার পারকার গাছগুলো লাগিয়েছেন।
ঝুলে থাকা বড় বড় কিছু লতা-পাতার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকাল কিশোর।
সামনে ওর নাক বরাবর কিছু একটা ঝিকিয়ে উঠল। যেন কোনও চক্চকে জিনিসের উপর চাঁদের আলো পড়েছে।
কিশোর ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করল জিনাকে।
ছায়ার ভিতর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চলল ওরা বেড়ালের মত, নিঃশব্দে।
একটা মাকড়সার জাল আটকে গেল কিশোরের মুখে। বাঁ হাতে চটচটে জালটা সরাল ও। খুব সাবধানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিল, কোনও অবাঞ্ছিত শব্দ যাতে না হয়।
নেজার ম্যাণ্ডার!
হ্যাঁ, এখানেই আছে ব্রিটিশ রাজার সৈন্য।
রুমটার ঠিক মাঝখানে প্রমাণ সাইজের একটা ঘোড়ার ডামির পিঠে বসে আছে সে। মাথার উপর খিলানের মত কাঁচের ছাদ।
হঠাৎ কিশোরের মনে হলো নেজারকে নড়তে দেখেছে ও।
চোখের পলক পড়ল না ওর।
এক কদম সামনে বাড়ল।
আম্মু! প্রকাণ্ড, শূন্য কাঁচের ঘরে জিনার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি তুলল। কিশোরের কানে বড় বেশি লাগল আওয়াজটা।
ঘোড়াটার গায়ে হেলান দেয়া রয়েছে একটা মই। মিস্টার পারকার ওটাকে উঁচু জিনিসপত্র সেট করার কাজে ব্যবহার করেন।
ভয় করছে? ফিসফিস করে বলল কিশোর। সব কিছু সহজ চোখে দেখার অভ্যেস করো। আমার মনে হয় পারকার আঙ্কেলই ওটাকে এখানে এনে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে রেখেছেন।
মুখে বলল বটে, তবে তেমন জোরাল শোনাল না কণ্ঠ।
অবাক হয়ে লক্ষ করল কিশোর, মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র জাদুঘরে যা ছিল, তার প্রায় সবই কখন যেন সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে।
ঘোড়সওয়ারের বাঁ পাশের দেয়ালে ঝুলছে মিস্টার পারকারের সংগ্রহের বর্শাগুলো। সংখ্যায় প্রায় এক ডজন হবে।
কিশোর দেখতে পেল নেজার ম্যাণ্ডারের ডানদিকের দেয়ালে বড়সড় ধাতব তলোয়ার আর ঢাল ঝোলানো আছে।
এক কোণে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা একটা নকল বর্মও দেখা গেল।
জাদুঘরের জন্য এটা সংগ্রহ করেছিলেন মিস্টার পারকার। একটু দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ওটা আসল না নকল। এমনভাবে রং করা হয়েছে যে ওটা যে আসলে সস্তা, পাতলা টিনের তৈরি, তা বোঝা যায় না।
কিশোরের বেশ ভাল লেগেছে জিনিসটা। তবে সত্যিকারের বর্ম জোগাড় হওয়ার পর ওটার গুরুত্ব ও আকর্ষণ দুটোই কমে গেছে।
দেখেছ, পারকার আঙ্কেল কত কিছু এখানে নিয়ে এসেছেন? কিশোর বলল।
জিনাকে চিন্তিত দেখাল। কিন্তু কেন? বলল ও। কখন আনলেন বাবা? আমাদের চোখে পড়ল না কেন?
আমার মনে হয় পারকার আঙ্কেল হঠাৎ করেছেন কাজটা, বলল কিশোর। রুমটা বড় বলে এটাকেও হয়তো জাদুঘরের অংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের অজান্তে এখানে নিয়ে এসেছেন এসব।
নেজারের বর্মের দিকে তাকাল গোয়েন্দা-প্রধান। ওটাকে ভয়ঙ্কর। লাগছে, তাই না?
হ্যাঁ, ফিসফিস করে বলল জিনা। ভয়ার্ত চোখে তাকাল ওটার দিকে।
ঘোড়ায় চেপে থাকা বর্মটা দেখে মনে হলো লড়াই করবার জন্য তৈরি ওটা।
একহাতে লম্বা, চুঁচাল ডগার একটা বর্শা ধরে আছে। অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম ও একটা ঢাল।
ধাতব হেলমেট চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। ঝিলিক মারছে বর্শাটাও।
বর্ম থেকে অদ্ভুত সবুজাভ একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বর্মের ভিতর থেকেই বেরোচ্ছে।
অবাক না হয়ে পারল না কিশোর।
এ কী করে সম্ভব?
ওটার ভিতরে সবুজ আলো এল কোত্থেকে?
যতটা সম্ভব বর্মের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিশোর। কাছ থেকে ভাল করে দেখার ইচ্ছে। এক পা সামনে এগোতেই পিছন। থেকে ওর হাত টেনে ধরল জিনা। ফিসফিস করে বলল, অ্যাই, কিশোর, কী করছ?
থেমে দাঁড়াল ও। ভাল করে দেখা দরকার।
বাবা যদি জানতে পারেন আমরা এখানে…
কিছুই বলবেন না।
বলবেন, একশো বার বলবেন, কিশোরের মাথার ভিতর থেকে বলে উঠল দ্বিতীয় কিশোর। বর্মটা নিয়ে তোমাকে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখলে পারকার আঙ্কেল রেগে যাবেন। শাস্তি হিসেবে টয়লেটে আটকেও রাখতে পারেন, বলা যায় না। যা রাগী মানুষ! তুমি তো ভাল করেই জানো ওটা পারকার আঙ্কেলের পছন্দের শাস্তি। প্রায়ই জিনাকে টয়লেট-শাস্তি পোহাতে হয়। তোমাকেও ছাড়বেন না, যদি… কি আমি তো পারকার আঙ্কেলের কোনও ক্ষতি করছি না, দ্বিতীয় কিশোরের উদ্দেশে বলল ও। আমি শুধু একটু কাছ থেকে বর্মটাকে দেখতে চেয়েছি, ব্যস। দেখব ওটার ভেতর থেকে কেন ওই সবুজ আলো আসছে। আঙ্কেল আমার কথা শুনবেন, বুঝিয়ে বললে রাগ করবেন না।
আর যা-ই হোক, ঘোড়ার পিঠে ওটাকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে,
তা-ই না, জিনা?
জিনা জবাব দিল কি না খেয়াল করল না কিশোর।
ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেল–বর্মের ভিতর আলো। এল কোত্থেকে?
বর্মটার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখন কিশোর।
যতদূর সম্ভব হাত বাড়াল সামনে। ঘোড়ার পিঠের নাগাল পাওয়া গেল না। নেজার ঘোড়ার পিঠে চেপে আছে, আর ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে চৌকো একটা প্ল্যাটফর্মের উপর।
নিজেকে এই মুহূর্তে বড় বেশি ছোট মনে হলো কিশোরের।
এখন?
এই দেখো! হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি খেলে যেতে আপনমনে বলে উঠল ও। হাঁদা হয়ে গেছি আমি! এই জিনিস হাতের কাছে থাকতে আমি কিনা চিন্তা করছি!
মই ধরে বেয়ে উপরে উঠতে লাগল কিশোর।
কিশোর, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! নীচ থেকে ফিসফিস। করল জিনা। চলো, ফিরে যাই।
পাত্তা দিল না গোয়েন্দা-প্রধান।
কোনও কিছুকেই পাত্তা দিল না।
শুধু ওর ভিতরের শিরশিরে অনুভূতিটাকে ছাড়া।
মইয়ের ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কিশোর খেয়াল করল হাত দুটো ওর মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে চাইছে না বিচ্ছিরি ভাবে কাঁপছে।
কোনওমতে মইয়ের মাথায় উঠে এল ও। বর্মটাকে এখন পরিষ্কার দেখতে পেল।
শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয়ে এল ওর।
বর্মটার ব্রেস্ট-প্লেট আর হেলমেটের সূক্ষ্ম কারুকাজ খুঁটিয়ে দেখল ও। ওটার কয়েক জায়গা তুবড়ে গেছে। বুঝতে বাকি রইল না নেজার ম্যাণ্ডার আর যা-ই হোক, দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল।
মুখের আবরণটার দিকে তাকাল ও। এই অংশটা খুলে বর্মধারী। যোদ্ধারা খাওয়া-দাওয়া করত, কথা বলত।
সামনে ঝুঁকল কিশোর। ওটার উপরের সরু ফাঁক দুটোর একটা দিয়ে বর্মের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। এই ফাঁক দুটো চোখের জায়গায়, ওখান দিয়ে যোদ্ধারা দেখত।
ভিতরটা অন্ধকার।
কিছুই চোখে পড়ল না।
বাঁ হাতে মই আঁকড়ে ধরে ডানহাতে হেলমেটটা ছুঁয়ে দেখল ও।
ভিতরের শিরশিরানি বেড়ে গেল। তবে তা বাইরে প্রকাশ করল কিশোর।
দেখলে তো, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, নীচে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল ও।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে জিনা। ভয়ে কুঁকড়ে আছে। মুখে কিছু না বললেও কিশোরের উপর ও যে প্রচণ্ড বিরক্ত, তা ওর চেহারাই বলে দিল।
মুখ তুলল কিশোর। বর্মের মুখের ঢাকনা নিয়ে পড়ল। খোলার। চেষ্টা করল ওটা। কাঁকো শব্দ তুলে খুলে গেল।
অপ্রত্যাশিত শব্দটা কাঁপন তুলল ওর সারা দেহে।
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল ও।
হেলমেটটার মুখোমুখি এখন কিশোর।
কিছুই দেখার নেই ভিতরে।
রাতের চেয়েও নিকষ কালো।
আরও সামনে ঝুঁকে ভিতরে নজর ফেলল কিশোর।
অন্ধকার।
ঘন।
কালিগোলা।
অসহ্য একটা বোটকা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারল ওর। যেন পচা জঞ্জালের স্তূপ আছে ভিতরে।
পেটের ভিতর নাড়ি-ভুড়ি পাক খেয়ে উঠল। প্রলম্বিত একটা গোঙানির আওয়াজ কানে এল। কেউ যেন দীর্ঘ একটা টানেলের আরেক মাথায় বসে গোঙাচ্ছে।
আওয়াজটা চড়তে লাগল একটু একটু করে।
দ্রুত ভাবতে চাইল কিশোর। কীসের আওয়াজ?
তীব্র হচ্ছে। প্রলম্বিত হচ্ছে।
কীসের?
কোনও জবাব খুঁজে পেল না।
খানিক পিছনে হেলে দাঁড়াল ও। নড়ে উঠল মইটা। কিশোরের গা কাঁটা দিয়ে উঠল।
কিছু একটা নড়ছে।
হেলমেটের ভিতর!
উঠে আসছে কিছু একটা!
কুচকুচে কালো একটা ছায়া!
তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত গোঙানির আওয়াজটা আরও চড়ছে।
চড়তেই থাকল।
বর্ম নড়ে উঠল। তারপর প্রবলভাবে কাঁপতে শুরু করল।
তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ আর্তনাদ করে কালো ছায়াটা ঝড়ের বেগে। বেরিয়ে এল বর্মের ভিতর থেকে।
৮
কিশোরের দিকে ছুটে এল ওটা। মহা আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলল ও।
এক জোড়া ডানার ভয়ঙ্কর ফড়ফড় আওয়াজ শুনতে পেল ও মাথার চারপাশে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল কালো ছায়াটা উড়ে বেড়াচ্ছে ওকে কেন্দ্র করে।
একটু পর সামান্য দূরে সরল ওটা। তারপর তীর বেগে ডাইভ দিল সোজা ওকে লক্ষ্য করে।
আঘাত এড়াতে ঝট করে মাথা নিচু করল কিশোর। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
এ পর্যন্ত ওর দেখা সবচেয়ে বড়, কালো আর কুৎসিত বাদুড়টা প্রায় ওর মুখের উপর আছড়ে পড়ল।
ভয়ঙ্কর দুটো লাল জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পেল কিশোর, জমে গেল আতঙ্কে।
মুখ হাঁ হলো ওটার। তীক্ষ্ণ সারিবদ্ধ দাঁত বেরিয়ে আছে। ওটার ভয়ঙ্কর নখর দেখে শিউরে উঠল কিশোর। ওকে আক্রমণ করতে তৈরি।
হিংস্র দানবের মত বাদুড়টা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে নিজের অজান্তে দুহাতে মাথা পেঁচিয়ে ধরল ও। তবু শেষরক্ষা হলো না। ওর বাঁ কানে ডানা দিয়ে বাড়ি মারল ওটা।
আউ! ককিয়ে উঠল কিশোর। নড়াচড়ার কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। মই থেকে পা ছুটে গেল সড়াৎ করে। তারপর যা হওয়ার তাই।
সোজা পপাত ধরণীতল।
পড়লে কী করে, কিশোর? জিনা ওর পাশে এসে দাঁড়াল দ্রুত। এক হাত সামনে বাড়িয়ে বলল, বেশি লাগেনি তো? এ হাতটা ধরল না কিশোর। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল। ব্যথায় টনটন করছে সারা গা। মনে হলো একটা হাড়ও আস্ত নেই।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করল কিশোর।
ডান পায়ের গোড়ালিতে টনটনে ব্যথা, থেঁতলে গেছে যেন মাংস।
ডাইভটা ভালই হয়েছে! তির্যক মন্তব্য করল জিনা। কিন্তু মাছটা ফসকে গেল, এই যা।
লজ্জায় গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর।
মাথা নিচু করে পাজামার পিছনটা ঝাড়ল। ওর স্লিপার জোড়া, নেজারের ঘোড়ার পায়ের কাছে পড়ে আছে। পায়ে গলাল ওগুলো।
কমসে কম পঞ্চাশ পাউন্ড হবে বাদুড়টার ওজন, বিড়বিড় করে বলল কিশোর।
ভুরু নাচাল জিনা। গেল কোথায় ওটা? দুহাতে মাথা আড়াল করে ছাদের দিকে তাকাল।
জানি না, জবাব দিল কিশোর। রুমের চারদিকে নজর বোলাল। ওটাকে কোথাও দেখা গেল না।
রাত দুপুরে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা করার কোনও মানে হয় না, জিনা বলল। তুমি থাকো, আমি শুতে চললাম।
যাও, তাৎক্ষণিক জবাব দিল কিশোর।
দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগোল জিনা। রুমের শেষ মাথায়। ছায়াগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।
কিশোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে নিজেকে বলল, আগেও বলেছি জিনাটা আসলে ভীষণ ভিতু। দেখলে এখন, সামান্য একটা বাদুড়ের ভয়ে তোমাকে একা ফেলে কেমন সটকে পড়ল?
নাকি অন্য কোনও কারণ আছে?
কী এমন কারণ থাকতে পারে? ভাবল কিশোর মনে মনে।
নেজারের ভূতের ভয়?
কে জানে?
এখানে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা অনর্থক বলে মনে হলো ওর।
এখানে কি কোনও ভূতের দেখা পেল ও?
না।
দেখল শুধু একটা বাদুড়ের বাঁদরামি।
আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কিশোর। ক্ষোভ-হতাশা জমল মনে। দরজার দিকে এগোল ধীর পায়ে।
চটা চটাশ আওয়াজ তুলছে ওর স্লিপার।
রুমের মাঝামাঝি পৌঁছে মনে হলো একটা কিছুর নড়াচড়া টের পেয়েছে যেন ও।
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
কিছু একটা নড়েছে।
থেমে দাঁড়াল কিশোর। ঘুরে তাকাল বর্মটার দিকে।
চাঁদের আলোয় ঝিক্ করে উঠল কী যেন।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওটার মুখের দিকে।
বর্মের মুখাবরণটা খোলা ছিল না? হ্যাঁ, ভোলাই তো ছিল। বন্ধ হলো কীভাবে? কে করল?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চোখ ডলল।
না, তা হয় কী করে?
বাদুড়টার আক্রমণের আগ মুহূর্তে কিশোরই হয়তো নিজের অজান্তে ওটা বন্ধ করেছিল। এখন মনে নেই।
হতেও তো পারে।
পারে না?
আর একমুহূর্তও এখানে নয়, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। ঘুরে যত দ্রুত সম্ভব পা চালাল।
ফ্লোরে পায়ের আওয়াজ উঠল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢিপঢিপ করছে হৃৎপিণ্ড
দরজার কাছে পৌঁছে বর্মটার দিকে ঘুরে তাকাল ও। নাহ্, জায়গামতই আছে ওটা।
নেজার নিজের ঘোড়ার পিঠে বসে আছে একইভাবে।
কনজারভেটরি থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। নীচতলার কিচেনে ঢুকল। সামনে এগোল কয়েক পা।
কিচেনের জানালা দিয়ে চাঁদের ভুতুড়ে আলো আসছে। সেই সাথে আসছে শীতল বাতাস। কেন যেন কেমন লেগে উঠল কিশোরের।
দেয়ালে ঝোলানো বড়সড় একটা তলোয়ার চাঁদের আলোয় ঝম করে উঠল। ওটার পাশে ঝুলছে এক সেট ভারী শেকল। শেকলের কড়াগুলোকে প্রাগৈতিহাসিক কোনও জন্তুর দাঁতের মত লাগছে।
ক্ষুধার্ত হিংস্র হায়েনার দাঁতের মত। যেন ওর দিকে তাকিয়ে কটাক্ষের হাসি হাসছে।
শান্ত হও, কিশোর, নিজেকে বলল মনে মনে। অযথা ভয় পাচ্ছ। তুমি। অকারণে ভয় পাওয়ার ছেলে তো তুমি নও। এই বাড়িতে পারকার আঙ্কেল নিজ হাতে একটা জাদুঘর গড়েছেন, ওটা ছাড়া আর কিছুই নেই। এ বাড়িকে তুমি নিজের বাড়ির মতই মনে করো। ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই এখানে।
কফিনটাকে যেমন দেখে গিয়েছিল, এখনও তেমনি আছে।
কোনও রদবদল হয়নি। হওয়ার কারণও নেই।
নাকি হয়েছে?
ড্রাকুলার কফিনের ডালাটা
খোলা ছিল বলে তো মনে হচ্ছে না! যতদূর মনে পড়ে সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল ওটা।
ব্যাপার বুঝতে গিয়ে সময় নষ্ট করল না কিশোর। দ্রুত মমিঘরে ঢুকল।
উদাসকে দেখতে পেল প্রথমেই। সবসময় যেখানে থাকে, সেখানেই আছে সে। চোখে সেই উদাস চাউনি। দুই বাহু আগের মতই সামনে বাড়ানো। দশ মমি-আঙুল প্রসারিত।
দ্রুত ওটাকে পেরিয়ে গেল কিশোর, মনে হলো এখনই বুঝি প্রাণ ফিরে পাবে মমিটা, দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরবে।
কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। ঘটার কারণও নেই।
লম্বা করে দম নিল কিশোর।
মমির ধুলো এসে ঢুকল নাকে। কেশে উঠল খকখক করে। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মমিঘর থেকে পড়িমরি ছুটে বেরিয়ে এল।
সামনে দরজা। জাদুঘর থেকে বেরোনোর পথ। কাশতে কাশতে ছুটল কিশোর দরজার দিকে।
বাতাস!
বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।
দরজাটা প্রকাণ্ড, সাধারণ দরজার প্রায় দ্বিগুণ। অনেকটা কিশোরদের স্কুলের সামনের গেটের মত।
দরজার একপাশে ধাতব হাতল। খুলতে হলে ওটা ধরে ঠেলা দিতে হয়। দরজার হাতল ধরে জোরে ঠেলা দিল কিশোর।
নড়ল না দরজা।
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে আবার ঠেলা দিল ও।
নাহ্, কাজ হলো না। দরজার ভারী পাল্লা এক ইঞ্চিও নড়ল না।
একহাতে দেয়াল হাতড়াতে লাগল কিশোর। সুইচ খুঁজে পেতে সময় লাগল না। বাতি অন করল। মাথার উপরের বৃত্তাকার টিউব জ্বলে উঠল।
পরমুহূর্তে চোখের সামনে অকল্পনীয় দৃশ্যটা দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ল ওর।
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধই হয়ে এল প্রায়। দরজার দুই হাতলের ভিতর বর্মধারীর একটা তলোয়ার শক্ত করে ভরে দিয়েছে কেউ।
হঠাৎ মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল কিশোরের।
তলোয়ারের হাতল ধরে টানল।
সর্বশক্তি দিয়ে।
দাঁতে দাঁত চেপে।
মরিয়া হয়ে।
কিন্তু চুল পরিমাণ নড়ানো গেল না ওটাকে।
ফাঁদে পড়ে গেছে কিশোর।
৯
ফাঁদে আটকে গেছি! কিশোরের স্বগতোক্তি শূন্য রুমের চার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল। নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই ভৌতিক লাগল ওর।
তলোয়ারটার ঠাণ্ডা, কঠিন হাতল শক্ত করে ধরল আবার। বুক। ভরে দম নিয়ে হ্যাঁচকা টান মারল। জোরে।
যত জোরে সম্ভব।
হাত ব্যথা হয়ে গেল। পেশি টন্ করছে, মনে হলো ছিঁড়েই যাবে বুঝি।
মাথার শিরা-উপশিরা দপদপ করছে।
রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেছে।
কিছু লাভ হলো না। ব্যর্থ হলো ওর চেষ্টা।
হাঁপাতে হাঁপাতে তলোয়ারের হাতলে খানিক দমাদম কিল মারল কিশোর।
তবু কাজ হলো না।
কয়েক পা পিছিয়ে এল ও হাঁপাতে হাঁপাতে। তারপর ছুটে গিয়ে দরজায় কষে লাথি ঝাড়ল।
লাভের লাভ তো কিছু হলোই না, উল্টে ব্যথায় টাটিয়ে উঠল পা। দরজা বা তলোয়ারের গোজ, কোনওটাই নড়ল না।
ফাঁদে পড়ে গেছি!
কথাটা বারবার ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।
যে পথ ধরে এসেছে, সে পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই কিশোরের। জাদুঘরের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। তার মানে আবার মমিঘর, কফিনঘর, ভৌতিক কিচেন পেরোতে হবে। ভয়ঙ্কর জিনিসগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হবে আবার।
কনজারভেটরির শেষপ্রান্তে একটা ব্যাক ডোর আছে। ওটা দিয়ে বেরোনো ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।
কিন্তু ওই অশুভ রুমটাতে আর যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কোনওমতে ওই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে তবেই রক্ষে।
না পারলে?
একটু দমে গেল কিশোর। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড়।
কীভাবে বন্দি হলো ও? জিনা তো ওই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেছে মাত্র কয়েক মিনিট আগে। এর মধ্যে তৃতীয় কেউ এসে দরজার হাতলে তলোয়ারটা ভরে দিয়েছে। কিন্তু কেন?
কাজটা কীভাবে সম্ভব হলো?
কাজটা যে-ই করে থাকুক, তাকে তো কিশোরের চোখে পড়ার কথা।
অবশ্যই।
কীভাবে ওর চোখ ফাঁকি দিল সে? তাকে কেন দেখতে পেল না ও?
যত ভাবছে কিশোর, তত জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে।
পা দ্রুত, চলছে ওর। সেসঙ্গে সমান তালে চলছে চিন্তা।
গলার নীল লকেটটা ডানহাতে চেপে ধরে আছে কিশোর। কেন, নিজেই জানে না। তবে শান্তি, স্বস্তি–দুটোই পাচ্ছে ওটার ছোঁয়ায়। মনে হচ্ছে জিনিসটা ওকে সাহস জোগাচ্ছে। যেন বলছে ভয় নেই, আমি আছি।
কখন জাদুঘর পেরিয়ে এসেছে, বলতে পারে না কিশোর। কনজারভেটরির দরজার সামনে এসে থেমে দাঁড়াল।
টেনে খুলল দরজাটা। কাঁচকোচ শব্দ তুলল জং ধরা কবজা।
উঁকি দিল ভিতরে।
নেজার এখনও আছে ওখানে–ডামি ঘোড়াটার পিঠে। তখন যে অবস্থায় দেখে গিয়েছিল ও, সেই অবস্থাতেই আছে।
তবু আশ্বস্ত হতে পারল না কিশোর। মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা কিছুতেই গেল না।
মিস্টার পারকারের লাগানো গাছগুলোর পাশে চলে এল। কিশোর। তারপর ওগুলোর ভিতর দিয়ে সাবধানে সামনে এগোল।
বেড়ালের মত নিঃশব্দে। কেন যেন মনে হচ্ছে শব্দ করা ঠিক হবে না।
বর্মটাকে পেরিয়ে যাবার পরও যখন অস্বাভাবিক কিছু ঘটল না, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।
আর কয়েক কদম দূরেই রয়েছে কাক্ষিত দরজা। ওটার কাছে পৌঁছতে পারলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না।
এগিয়ে চলল কিশোর। প্রায় নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। দরজা। আর তিন কি চার কদম…
এমন সময় পিছনে অদ্ভুত একটা শব্দ উঠল।
ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-চ!
কিশোরের হাত-পায়ের শিরায় শিরায় শিহরণ জাগল। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড লাফ দিল।
এগিয়ে যাও, কিশোর, নিজেকে বলল ও। ভুলেও পেছন ফিরে তাকিয়ো না। যেভাবেই হোক ওই দরজার কাছে তোমাকে পৌঁছতেই হবে।
কিন্তু না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ও, কৌতূহলের কাছে হেরে গেল আরেকবার। থেমে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল।
এবং যা দেখল, তাতে এক লহমায় গায়ের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে গেল। পরপর দুটো বিট মিস করল হৃৎপিণ্ড।
নেজারের বর্ম!
কিশোরের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে!
ওর পাশে উঁচু একটা টাওয়ারের মত লাগছে ওটাকে।
বর্মটা ঘোড়া থেকে নামল কীভাবে?
শব্দ করে ঢোক গিলল কিশোর। গলা-বুক শুকিয়ে কাঠ।
কণ্ঠতালু খটখট করছে। বোঁ-বোঁ করছে দুকান।
বর্মের মুখাবরণের উপর দিকের চোখের সরু দুই ফাঁক দিয়ে ভয়ঙ্কর লাল আভা বেরোচ্ছে! দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল!
হঠাৎ করে চরম সত্যি কথাটা উপলব্ধি করল কিশোর। এই বর্মের ভিতরে নেজারের ভূত রয়েছে!
ওটা আরও এক কদম সামনে বাড়তে আবার কাঁচ-কাঁচ শব্দ উঠল। নীরব রাতে ভয়ঙ্কর শোনাল সে-আওয়াজ।
নিজের অজান্তে পিছিয়ে গেল কিশোর।
মনে হচ্ছে সময় যেন থমকে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি না, ফিসফিস করে বলল কিশোর। আরও কিছু বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ও। পা দুটোকে স্বাভাবিক রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাল।
কিন্তু পারছে? না। বুক ধকধক করছে।
বর্মের একটা ধাতব বাহু ধীরে ধীরে শূন্যে উঠতে লাগল। অভিযোগের ভঙ্গিতে তর্জনী খাড়া ওটার। আঙুলটা কিশোরের দিকে তাক করে রেখেছে নেজার!
হাতটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। বিস্ময়ে দুচোখ বিস্ফারিত।
এবার! ভারী একটা কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠল বর্মের ভিতর থেকে। এবার আমার হাত থেকে তোমার রেহাই নেই, শয়তান জাদুকর!
১০
অ্যাঁ? হাঁ হয়ে গেল কিশোর। কী… কী বলছেন আপনি? আমি জাদুকর?
হ্যাঁ। তুমি-ই সেই শয়তান জাদুকর। ভেবেছ আমার চোখে ধুলো দিয়ে এবারও আমাকে ফাঁকি দেবে? তোমার সে আশা মিথ্যে!
এসব কী বলছেন আপনি? মরিয়া হয়ে বলার চেষ্টা করল কিশোর। জাদুকর হতে যাব কেন আমি? আমার নাম কিশোর। বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
চুপ করো! খ্যাকানি মারল নেজার। ওই পাপী মুখে আর কত মিথ্যে কথা বলবে তুমি? জাদুর বলে আমাকে তুমি বন্দি করে রেখেছ এই বর্মের মধ্যে।
আমি?বলল কিশোর। প্রবলভাবে মাথা দোলাল। বুকের উপর নীল লকেটটা দুলে উঠল পেণ্ডুলামের মত।
ওটার ভেতরকার নীল ধোঁয়ার মেঘ আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে।
পাক খাচ্ছে অবিরাম।
আপনি ভুল করছেন, বলল কিশোর। আর কারও সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। আমি সত্যি জাদুকর নই। এর আগে কোনওদিন আপনাকে দেখিনি। বিশ্বাস করতে পারেন, আমি…
চুপ করো! আবারও গর্জে উঠল বর্মবন্দি। ভিতরের আগুন লকলক করে উঠল। মাথাটা সামান্য নোয়াল সে।
ভিতরে কয়েকশো পাউণ্ড জঞ্জাল থাকা সত্ত্বেও ক্ষিপ্র গতিতে আগে বাড়ল ওটা। যত শক্তিশালীই হোক, কোনও মানুষ এত দ্রুত নড়তে পারবে কি না সন্দেহ।
হাতের বর্শাটার উঁচাল প্রান্ত কিশোরের গলায় ঠেকাল নেজার। মরার জন্যে তৈরি হও, শয়তান! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
বর্শার আলপিনের মত চোখা প্রান্ত কিশোরের গলার চামড়া ফুটো করে দিল।
ভীষণ গরম ঠেকল জিনিসটা।
ভূতটা কিশোরকে খুন করতে চায়!
গলা চিরে ফেলতে চায়!
তারপরও নেজার ম্যাণ্ডারের মনের জ্বালা জুড়াবে বলে মনে হয় না।
তার মত পূর্ণবয়স্ক যোদ্ধার কাছে কিশোর কী-ই বা! কিছুই করার নেই ওর।
তা-ও লোকটা জীবিত হলে একটা কথা ছিল।
মৃত সে।
অশরীরী।
অনেক কষ্টে ঢোক গিলে দুকদম পিছিয়ে গেল কিশোর।
সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল বর্মবন্দি। দুর্বোধ্য এক গোঙানি ছাড়ল। মুখাবরণের অগ্নিশিখা সাপের চেরা জিভের মত লকিয়ে উঠল।
ভেবেছ বাচ্চা ছেলের রূপ ধরে আমাকে ধোঁকা দেবে, তা-ই না? গমগমে কণ্ঠে বলল বর্মবন্দি। তুমি যখন ডাইনোসরের রূপ ধরেছিলে, তখন আমি তোমার বিরুদ্ধে লড়েছি। যখন আগুনের দেয়াল হয়েছিলে, তখনও পিছপা হইনি। আর এখন…,
বর্শাটা আবার কিশোরের গলায় ঠেকাল প্রেতাত্মা। আজ আমি প্রতিশোধ নেব। ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ…।
সাহায্যের আশায় চিৎকার করার চেষ্টা করল কিশোর। পারকার আঙ্কেল ও হ্যাগার্ডকে ডাকার চেষ্টা করল।
কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হলো না। চাপা গোঙানির মত আওয়াজ বেরোল কেবল। গলায় শক্তিও নেই।
নেজার ম্যাণ্ডার গলাটা নিচু করে আবার তুলল। ধাতব, খ্যানখেনে গলায় পৈশাচিক হাসি দিল।
বহু কষ্টে আরেক পা পিছাল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ওটাও এগিয়ে এল এক পা। যেন মাঝখানের ব্যবধান কিছুতেই বাড়তে দিতে রাজি নয়।
আচমকা হাতের বর্শাটা একদিকে ছুঁড়ে মারল নেজার। জোরাল ঠঠ শব্দ তুলে মেঝেতে আছড়ে পড়ল ওটা।
যাক! মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেছে, ভাবল কিশোর। হাঁপ ছাড়ল।
আরেক পা সামনে এগোল ওটা।
আজকের এই দিনটির জন্যে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি। তোমাকে তিলে তিলে মারব আমি, জাদুকর! দুচোখ ভরে দেখব তোমার মরণ-যন্ত্রণা, তার ভারী কণ্ঠস্বরে পৈশাচিক রুক্ষতা।
ভয়ে জমে গেল কিশোর।
ওকে বিশ্বাস করেনি নেজার!
মুক্তি দেয়নি!
অনেক কষ্টে মুখ তুলে চাইল কিশোর উপর দিকে।
নড়ার শক্তিও নেই দেহে।
চারদিকে নজর বোলানোর ফাঁকে কিশোর বুঝল লুকানোর জায়গা নেই কোথাও। নেজারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়।
মধ্যযুগের যত অস্ত্র আছে মিস্টার পারকারের সংগ্রহে, ঘোড়ার ডামিটার চারদিকে সাজিয়ে রাখা আছে সেসব। ওগুলোর দিকে নজর যেতে ঢোক গিলল ও।
নেজারের হাত থেকে আজ ওর রেহাই নেই।
পারকার আঙ্কেলের এই কনজারভেটরির মধ্যেই তা হলে ওর মরণ লেখা ছিল।
এটা দরকার আমার, লম্বা একটা তলোয়ার তুলে নিয়ে বলল নেজার। এটাও, আরেক হাতে তুলে নিল দশাসই এক গদা।
জিনিস বটে একখানা!
যেমন বিদঘুঁটে, তেমন ভারী। ওটার মাথার অসংখ্য চোখা পেরেক মারমুখো করে পোতা রয়েছে অনেকটা টুথব্রাশের ব্রিসলের মত। তবে অত ঘন নয়। তাতে অবশ্য কিছু আসবে যাবে না। এক ঘা খেলেই কম্ম কাবার।
চক্চক্ করছে গদার পেরেকগুলো। থেকে থেকে ঝিকিয়ে উঠছে। তলোয়ার।
কিশোর ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ওই গদার পেরেকঠাসা মাথার একটা খোঁচা খেলে কেমন লাগবে ভাবতে গিয়ে গায়ের তাপমাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে গেল।
শুনুন! আচমকা চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। হঠাৎ এত শক্তি কোত্থেকে এসে ভর করল গলায়, ভেবে নিজেই অবাক হলো। মারার আগে বাঁচার শেষ চেষ্টার সময় সবারই বোধহয় এমনই বেড়ে যায় জোর। আপনি তো একজন যোদ্ধা, তা-ই না? নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে একজন সত্যিকারের যোদ্ধা কখনও নিরস্ত্র কাউকে আক্রমণ করে না?
বর্মটার মুখাবরণের ভিতরের লাল আগুন লল করে উঠল।
ঠিক বলেছ, একমত হলো যোদ্ধার ভূত। আমি কখনও নিরস্ত্র কাউকে আক্রমণ করিনি। কয়েক পা পিছাল। তারপর এক হাতে ইশারায় দেয়ালে ঝোলানো অস্ত্রসম্ভার দেখাল কিশোরকে। ওখান থেকে বেছে নাও যা খুশি।
দুহাত কাঁপছে কিশোরের।
বুকের মধ্যে অনবরত হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
কোনওমতে এগিয়ে একটা ঢাল তুলে নিল ও। ঢালটা বেশ বড় আর ভারী। দুহাতে জিনিসটা ধরে ওটা দিয়ে মাথা আড়াল করল।
বাহ্! ভাবল ও। আত্মরক্ষার ভাল একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল।
কিন্তু নেজার ম্যাণ্ডার আরও খেপে উঠল। জলদি অস্ত্র বেছে নাও!
তার ভারী ও চড়া নির্দেশে চমকে উঠল কিশোর। ঢালের আড়াল থেকে মাথা তুলল। তারপর কাঁপা হাতে মাঝারি আকারের একটা গদা তুলে নিল।
ঢালটা বাঁ হাতে ধরেছে, গদা ডান হাতে।
মনে হচ্ছে ও দুটোর ওজন কয়েক টন করে হবে। ধরে রাখতেই জান বেরিয়ে যাবার দশা হলো কিশোরের। দুই হাত টন্ট করে উঠল।
লড়বে কীভাবে?
লড়ার চেষ্টা করার সুযোগ পাবে তো?
নেজার ম্যাণ্ডার মাথা পিছনে হেলিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। অপার্থিব হাসি।
লড়াই শুরু হলো।
ঢালের উপর দিয়ে উঁকি দিল কিশোর।
প্রেতাত্মাকে তার গদাটা মাথার উপরে ওঠাতে দেখল ও।
কিশোরের মাথা সই করে দ্রুত নেমে আসতে লাগল ওটা।
চোখা পেরেকগুলো বাতাসে শিস কেটে নীচে নেমে আসার সময়। চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল।
বিজাতীয় একটা আওয়াজ করে কিশোর শক্ত হাতে ধরল ঢালটা। আগেই মাথা নিচু করে রেখেছে। শরীরের প্রতিটি পেশি টাটা হয়ে উঠেছে।
ওর ঢালে গদার বাড়ি পড়তেই গোটা দেহ কেঁপে উঠল। লোহার সঙ্গে লোহার ঘর্ষণে ফুলঝুরির মত স্ফুলিঙ্গ ছুটল।
একইসঙ্গে ঝন্ঝন্ জাতীয় একটা শব্দ কানে এল ওর। দ্বিতীয় আঘাত কিশোরের ঢাল যে সইতে পারবে না সে-ব্যাপারে কোনও ভুল নেই।
প্রাণের আশা ছেড়ে দিল কিশোর। বুঝতে পারছে, আসলেই ও হেরে গেছে।
১১
দম বন্ধ করে রেখেছে কিশোর। নিজের হৃৎস্পন্দন শুনছে। শেষ হৃৎস্পন্দন।
বড়জোর আর কয়েক সেকেণ্ড আয়ু আছে ওর। গদার আঘাতে হাড়-মাংস থেঁতলে যেতে আর দেরি নেই।
তারপর সব শেষ।
এক।
দুই।
আড়াই সেকেণ্ড
পৌনে তিন…
কই, কিছুই তো ঘটল না।
ধীরে ধীরে কচ্ছপের মত মাথা তুলল ও ঢালের কিনারা দিয়ে। নিজের ঢালটা ভাল করে দেখল। এখনও অক্ষত আছে, ওটা।
ওর কয়েক পা দূরে বর্মটাকে দেখা গেল। নেজারের চোখবিহীন, চোখের দুই ফুটো নিজের গদার উপর স্থির।
কিশোরও তাকাল ওটার দিকে।
মানে গদাটার অবশিষ্টাংশের দিকে।
কিশোর ওর ঢালটা ধরে রেখেছিল শরীর আড়াল করে, নেজারের গদা আঘাত হেনেছিল ওটায়, আর তাতে ভেঙেচুরে অগুনতি টুকরোয় পরিণত হয়েছে তার গদা। ওটার তীক্ষ্ণ পেরেকগুলো খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
নেজার যখন অবাক বিস্ময়ে নিজের ভাঙা অস্ত্রের দিকে চেয়ে আছে, কিশোর তখন মাথা তুলে সামনে ঝুঁকে ওর ঢালের সামনের দিকটা দেখে নিল। বড়সড় একটা ট্যাপ চোখে পড়ল।
ব্যস এটুকুই। আর কিছু হয়নি ওটার।
অথচ বারোটা বেজে যাওয়ার কথা ওটার। নিজের সৌভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হলো ও।
হচ্ছেটা কী এসব?
প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছেড়ে হাতের অকেজো গদাটা ছুঁড়ে মারল যোদ্ধা। গর্জে উঠল, কোনও জাদুমন্ত্রে এবার কাজ হবে না। এবার আমার হাতেই তোমার মরণ লেখা আছে।
নেজারের অন্য ধাতব হাতে এখনও শোভা পাচ্ছে তলোয়ারটা।
ওটা উঁচিয়ে কিশোরের দিকে এগোল। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে শূন্যে তলোয়ার চালাল সে। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল ভয়ঙ্কর অস্ত্রটা।
মাথা নোয়াল কিশোর।
এখন কী হবে?
পালাও! ভিতর থেকে দ্বিতীয় কিশোর বলল ওকে। শিগগির পালাও, কিশোর!
কিন্তু কোথায় পালাবে ও? পিছনের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। বর্মটা।
ঘুরে যে-পথ দিয়ে ও এসেছিল সে-পথেই হাঁটতে শুরু করল। আবার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কিচেনের দিকে যাবে।
পিছনে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠল।
ভারী ঢালটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কিশোর। তারপর দৌড়াতে শুরু করল। টের পেল দম নিতে সমস্যা হচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ঢোকও গেলা যাচ্ছে না।
পিছনের শব্দ ওকে জানান দিল খুব কাছে এসে পড়েছে বর্মবন্দি। পিছনে না তাকিয়েও মনের চোখ দিয়ে দেখতে পেল ওর দিকে লম্বা
একটা ধাতব হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওটা। যে-কোনও মুহূর্তে ওর ঘাড় ধরবে ওই হাত।
জোর ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলেই কিচেনে ঢুকে পড়ল কিশোর। ফ্লোরে ওর স্লিপার পিছলে গেল। পা দুটো নিয়ন্ত্রণ হারাল।
দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ল ও। পরমুহূর্তে পিছনে হিশহিশ শব্দ উঠতেই বুঝল হাতে তলোয়ারটা বাতাসে নাচাচ্ছে নেজার ম্যাণ্ডার।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে উঠে বসল ও। কিচেনের ভিতর একটা আইল্যাণ্ড আছে। দেখতে অনেকটা রেস্টুরেন্টের কাউন্টারের মত। এই বাড়িতে আগে ওটাকে রান্নাবান্না ও খাবার পরিবেশনের কাজে ব্যবহার করা হতো। পারকার আঙ্কেল ওটাকে অস্ত্রপাতি পরিষ্কার করার কাজে লাগাচ্ছেন।
চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ওটার আড়ালে চলে এল কিশোর।
মাথা নিচু করে সামনে এগোতে লাগল। কাউন্টারের শেষপ্রান্তে পৌঁছে ওর মনে হলো, নেজারের নাগালের বাইরে আসা গেছে।
ধীরে ধীরে মুখ তুলে উঁকি দিল ও সামনে।
বর্মবন্দির অতৃপ্ত আত্মা খেপে উঠেছে। তাকে দমানোর ক্ষমতা। নেই কারও।
তার বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বে কিশোর?
রুমটার চারদিকে নজর বোলাল ও চকিতে।
দেয়ালে ঝুলন্ত শেকল?
সে তো অনেক দূরে।
শেকলের পাশে ঝোলানো তলোয়ার?
ওগুলো বড় বেশি ভারী, অন্তত কিশোরের পক্ষে।
এরপরই জিনিসটা চোখে পড়ল কিশোরের।
একটা গুলতি।
ওটা রয়েছে কিশোর আর দরজার মাঝামাঝি জায়গায়। কেন যেন কিশোরের মনে হচ্ছে প্রাচীন ওই গুলতিটা হাতে পেলে জীবন্ত দুঃস্বপ্নটার মোকাবিলা করতে পারবে ও।
হয়তো এ যাত্রা বেঁচে যাবে।
ওদিকে কিশোরের অবস্থান টের পেয়ে গেছে নেজার। তার চোখের আগুন ধধ করে জ্বলছে।
রোবটের মত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগোতে লাগল বর্মবন্দি। কাউন্টারের ওপাশে পৌঁছে থেমে দাঁড়াল।
প্রথমে তলোয়ারটা শূন্যে তুলল। তারপর কিশোরকে লক্ষ্য করে নামিয়ে আনল।
কাউন্টারের উপর আছড়ে পড়ল ভারী অস্ত্রটা। ওটার কী দশা হলো দেখার জন্য অপেক্ষা করল না ও।
আগেই সরে গেছে জায়গা থেকে। গুলতিটার দিকে দৌড়াল ও দম বন্ধ করে। তলোয়ার তুলে ভয়ঙ্কর হুঙ্কার ছাড়ল যোদ্ধা। দ্রুত শূন্যে চালাতে লাগল ওটা–ডান থেকে বায়ে, বা থেকে ডানে।
ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে এগোতে লাগল।
গুলতির কাছে পৌঁছে গেল কিশোর। সারাশরীর অবশ হয়ে আসছে। ওটা নামানোর জন্য হাত বাড়াল। গুলতিটা যে লিভারে চলে, সেটায় হাত লেগে গেল ওর নিজের অজান্তে। তারপর কোনদিক দিয়ে কী ঘটে গেল, টের পেল না কিশোর।
পরপর দুটো শব্দ কানে এল। প্রথমে টুং তারপর হুশ্শ।
পারকার আঙ্কেল মনে হয় মান্ধাতা আমলের এই গুলতিটায় একটা পাথর আটকে রেখেছিলেন। বর্মটার দিকে ওটাকে ঝড়ের বেগে ছুটে যেতে দেখা গেল।
কিশোর বুঝতে পারল পাথরটা বর্মের গায়ে গিয়ে আঘাত করবে। অবশ্য তাতে যে ওটার তেমন কোনও ক্ষতি হবে না, তা-ও বুঝল। তবু কিশোর খুশি হয়ে উঠল, কারণ দরজার দিকে দৌড়াতে যেটুকু সময় দরকার, তা হয়তো পাওয়া যাবে এর ফলে।
পালানোর একটা সুযোগ তাতে মিলেও যেতে পারে।
পাথরটা নেজারের বুকে আঘাত করল।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। ছুট লাগানোর এখনই সময়।
চোখের কোণ দিয়ে দেখল টলে উঠেছে বিশাল বর্মটা। দুবাহু। শূন্যে উঠে গেল নেজারের। হাতের তলোয়ারটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে।
মাথা তুলল প্রেতাত্মা।
কিশোরের দিকে তাকাল সরাসরি।
চোখের আগুন অগ্নিগিরির জ্বালামুখের মত বিস্ফোরিত হলো।
পরমুহূর্তে কান ফাটানো আওয়াজ তুলে মেঝেতে আছড়ে পড়ল প্রকাণ্ড বর্মটা।
নিশ্চপ, নিথর হয়ে পড়েই থাকল।
১২
ব্যাপার কী? ভাবল কিশোর।
সামান্য একটা পাথরের আঘাতে কাবু হয়ে গেল অমন একটা বর্ম?
না, হতেই পারে না। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় আছে।
গুলতিটার কাছ থেকে সরে সামনে এগোল কিশোর। ভাল করে বর্মটার দিকে তাকাল।
চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। হেলমেট কাত হয়ে আছে। একদিকে। মুখাবরণের উপরের ফাঁক দুটোর দিকে তাকাল কিশোর।
কী দেখল?
কিছুই না।
কিছুই দেখা গেল না ভিতরে।
অন্ধকার।
বর্মটার ব্রেস্টপ্লেটের ঠিক মাঝে একটা বড়সড়, গভীর ট্যাপ চোখে পড়ল ওর। ওখানেই আঘাত করেছে পাথরটা।
কিশোরের উত্তেজনা একটু একটু করে কমে আসছে। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে ওর। প্রাণ ভরে শ্বাস টানল ও। মনে হলো অনেক দিন পর সজীব বাতাস ঢুকল ওর ফুসফুসে। কী শান্তি!
কিচেন-টেবিলের নীচে পাথরটা পড়ে আছে। এগিয়ে উবু হয়ে ওটা তুলে নিল ও। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও অনেক হালকা ওটা। এরকম একটা জিনিস কোনওমতেই ভারী বর্মধারী এক যযাদ্ধার ভূতকে ধরাশায়ী করবে না।
ও হেরে গেছে! বিড়বিড় করে বলল ও। কিন্তু কী করে? আমি তো কিছুই জানি না! প্রাণে বেঁচে গেছে ভাবতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠল কিশোর।
কিশোর! একটা পরিচিত কণ্ঠ করিডর থেকে ভেসে এল। পরমুহূর্তে কিচেনে ঢুকলেন মিস্টার পারকার, সঙ্গে জিনা। ভাবনার জাল ছিন্ন হলো ওর। এত রাতে এখানে কী করছ তুমি? শুতে যাওনি কেন?
কেন শুতে যাইনি বলব পারকার আঙ্কেলকে? ভাবল ও।
কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ পেল না। সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিলেন মিস্টার পারকার। শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। কিশোর।
সামনে নজর পড়তে খাবি খেলেন মিস্টার পারকার। চেহারা সাদা হয়ে উঠল।
মেঝেতে পড়ে থাকা বর্মটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ে ঝুলে পড়েছে চোয়াল।
মিস্টার পারকার কী ভাবছেন, কিশোর জানে। মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালেন তিনি। তাঁর চাউনি দেখে কিশোরের আত্মা উড়ে গেল।
নেজার ম্যাণ্ডার কিশোরকে খুন করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। মিস্টার পারকারের চাউনি দেখে ওর মনে হচ্ছে করলেই ভাল ছিল।
পারকার আঙ্কেলকে ও কী করে বোঝাবে…
কিশোর! গমগমে কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লেন মিস্টার পারকার। আমি তোমাকে ওটা থেকে দূরে সরে থাকতে বলিনি? বর্মটা ইঙ্গিত করলেন।
এক মুহূর্ত কেশে নিয়ে কিশোর বলল, আঙ্কেল, আসলে আমার কোনও দোষ নেই। যা ভাবছেন…
এ সব দোষ ওই বাদুড়টার, ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল জিনা। বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েছে বাবার পাশে। চেহারা দেখেই বোঝা গেল কিশোরের দুরবস্থা দেখে একটু মজাই পাচ্ছে যেন ও। আসলে তোমাকে যে বাদুড়টার কথা বললাম না, বাবা, ওটাই সব নষ্টের গোড়া। ওটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। কিশোর। নিশ্চয়ই সারাবাড়ি ছোটাছুটি করেছে এতক্ষণ। তাতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব। এমন কী বর্মটাও রেহাই পায়নি, দেখো।
খুলে বলো সব, কিশোর, গম্ভীর স্বরে বললেন মিস্টার পারকার।
জিনা, একটু আগে আমাকে একা ফেলে চলে গেল, বলল কিশোর। তখন থেকে যা ঘটেছে… আঙ্কেল, নেজার ম্যাণ্ডারই গণ্ডগোল শুরু করে। আমাকে দাবড়ে বেড়িয়েছে এতক্ষণ। বার বার বলেছে আমি নাকি এক শয়তান জাদুকর। গদা, তলোয়ার দিয়ে আমাকে মারার চেষ্টা করেছে…
থেমে গিয়ে মিস্টার পারকারের দিকে তাকাল কিশোর। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে। পারকার আঙ্কেল কি ওর কথা আদৌ বুঝতে পারছেন? বুঝলেও বিশ্বাস করছেন?
নাকি…
হঠাৎ কিশোরের মনে হলো পারকার আঙ্কেলের চেহারা থেকে। ঘুম-ঘুম ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। চশমার পিছনে তার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে উঠেছে।
উৎসাহে?
নাকি বিস্ময়ে?
কে জানে!
ভূত! এগিয়ে এসে ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন উনি।
যোদ্ধার ভূত! খুশিতে চক করে উঠল তাঁর দুচোখ। এই নিয়েই তো গবেষণা করছেন তিনি। ওটা ছুটোছুটি করেছে? তোমাকে দাবড়ে বেড়িয়েছে, কিশোর?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
পারকার আঙ্কেল ওর কথা বিশ্বাস করেছেন বুঝতে পেরে খুশি।
ওয়াণ্ডারফুল! মিস্টার পারকার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ওয়াণ্ডারফুল!
আপনি জানেন না ওটা কতটা ভয়ঙ্কর, বলল কিশোর।
ঠিকই বুঝতে পেরেছি আমি। ওটা ভুতুড়ে বর্ম। ওটার মধ্যে আছে এক যোদ্ধার আত্মা। ঠিক না?
বর্মটার দিকে তাকালেন তিনি।
দরজার কাছে পড়ে থাকা ওটার বিচ্ছিন্ন একটা হাত তুলে নিলেন। শূন্যে ঘোরালেন ওটাকে। কী কাণ্ড! কিশোর, জিনা, তোমরা বুঝতে পারছ এর অর্থ কী?
কীসের কী অর্থ, বাবা? জিনা শুধাল।
এই যে বর্মটা, এটা ভুতুড়ে। চকচক করছে আঙ্কেলের চোখ। কত ভূত খুঁজেছেন তিনি। এবার হয়তো একটাকে পাওয়া গেছে। এবার বিজ্ঞান দিয়েই ভূত ব্যাখ্যা করতে পারবেন বিজ্ঞানীদের কাছে।
এক পা এগিয়ে এল কিশোর। আঙ্কেল, শুনুন। ওটা কেবল ভুতুড়ে বর্মই নয়, বিপজ্জনকও। আরেকটু হলে ওই যোদ্ধার ভূত আমাকে মেরেই ফেলেছিল। তখনই…
থেমে গেল কিশোর। আঙ্কেল ওর কথা শুনছেন না। তাকে কখনও এতটা উত্তেজিত হতে দেখেনি কিশোর।
আশ্চর্য মানুষ!
কিশোর, ও কি সত্যি ওই ঘোড়ায় উঠে বসে ছিল? ওখান থেকে নিজেই নেমে এসেছে? মিস্টার পারকারের চোখে-মুখে চরম উত্তেজনা। চেহারায় আগ্রহ। হেঁটেছে? সত্যিই কথা বলেছে?
হতাশায় কাঁধ ঝুলে পড়ল কিশোরের। হ্যাঁ, হেঁটেছে, জবাব, দিল। কথাও বলেছে। তারপর ওই তলোয়ারটা দিয়ে আমাকে ফালা। ফালা করতে চেয়েছে।
মিস্টার পারকার আনমনা হয়ে উঠলেন। ঘুরে বর্মটার দিকে তাকালেন।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল কিশোর, ভূতটা বর্মের মধ্যে আছে। ওটার হাত থেকে আমাদের কারও রেহাই নেই। আমাদের খুন করবে ওটা।
মৃদু হাসলেন মিস্টার পারকার।
ব্যাপারটার গভীরে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না।
হয়তো ভাবছেন, একটা ভূত বড়জোর ভয় দেখাতে পারে। তাই বলে খুন খারাবি?
অসম্ভব।
মিস্টার পারকারের চোখজোড়া চকচক করছে।
বাবা, সত্যিই যদি ভূতটা থেকে থাকে? ফ্যাকাসে চেহারায় জিজ্ঞেস করল জিনা।
যদি মানে? অবশ্যই আছে।
এগিয়ে এসে জিনার কাঁধে হাত রাখলেন। আরেক হাত রাখলেন কিশোরের কাঁধে। আমি সফল হতে চলেছি! চাপা স্বরে বললেন।
ভূত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেব আমি। ভূত আছে বিজ্ঞানীরা সেটা স্বীকার করবে এরপর!
দোতলায় উঠে এল সবাই। পারকার আঙ্কেল নিজের রুমে ঢুকলেন। বিড়বিড় করে আন্টি তাঁকে কী যেন বললেন। জিনা চলে গেল নিজের রুমে। করিডর ধরে কিশোর এগিয়ে গেল ওর রুমের দিকে।
একা হতে কেমন অস্বস্তি লেগে উঠল ওর। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ভয় করছে তোমার?
অন্তর থেকে কোনও জবাব নেই।
এখন কী করা উচিত ভাবতে চাইল ও? কয়েক মুহূর্ত পর বুঝল, যা করার ওকেই করতে হবে।
কিন্তু সেটা কী?
পারকার আঙ্কেলকে কিছুতেই বোঝানো গেল না বর্মটা কতখানি বিপজ্জনক।
কিশোর বুঝতে পারছে, কিন্তু কাউকে বোঝানো গেল না।
মাথার ভিতরে একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর।
ক্লান্তি লাগছে।
মন বিষণ্ণ।
সামনেই ওর রুম। এমনসময় একটা আওয়াজ কানে এল। কান। খাড়া করল কিশোর।
আবারও শোনা গেল আওয়াজটা।
অস্পষ্ট।
শব্দটা কিসের বুঝতে পেরেছে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল।
ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ওটা।
১৩
পরদিন।
জিনার সাথে ওদের স্কুলে এল কিশোর। গোবেল বিচ গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল। রকি বিচের স্কুলগুলোর মত অত কড়াকড়ি নেই এখানে।
জিনার সঙ্গে ওর ক্লাসরুমে, ছেলেদের দিকটায় বসল কিশোর। বেশ কজন টিচারের সঙ্গে পরিচয় হলো। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা স্কুলে পড়ে বলেই কিনা কে জানে, সবারই খাতির পেল ও।
ভাল লাগল স্কুলটা।
স্কুল থেকে ফিরে সোজা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল দুজন।
খাওয়া শেষ হতে জাদুঘরে ঢুকল কিশোর, হ্যাগার্ডের সঙ্গে দেখা করবে।
পারকার আঙ্কেল ওর কথায় কান দেননি, কিন্তু কিশোর জানে হ্যাগার্ড দেবে। লোকটা অন্যরকম। বক্তা হিসেবে তার তুলনা নেই, দেখা যাক শ্রোতা হিসেবে কেমন।
কনজারভেটরিতে পাওয়া গেল তাকে। নেজার ম্যাণ্ডারের বর্মের কাছে বসে কাজ করছে।
কিশোর দেখল আবারও স্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে ঘোড়ার ডামির পিঠে চেপে আছে বর্মটা।
বর্মের তলোয়ারটা পালিশ করছে হ্যাগার্ড।
কিশোর ভেতরে ঢুকতে মুখ তুলে তাকাল সে। হাসল।
আপনার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কিশোর।
খুব জরুরি। আপনি তো ওটার ব্যাপারে সবই জানেন।
কীসের ব্যাপারে? ভুরু কুঁচকে উঠল কেয়ারটেকারের।
বর্মটার ব্যাপারে, বলল ও। নেজার ম্যাণ্ডারের ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন, সব সত্যি।
সারও তা-ই বলছিলেন, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আগামী শনিবার জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। বড় ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে।
হেনরি রব হ্যাগার্ডের পাশে বসে পড়ল কিশোর।
সত্যিই! অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল ও। এখনও সময় আছে। উদ্বোধনের আগে বর্মটার ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার, না হলে বড় ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে।
অবাক হলো কেয়ারটেকার। কী হয়েছে খুলে বলো তো।
লম্বা শ্বাস টানল কিশোর। অন্তত একজন ওর কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে চেয়েছে। যেভাবে হোক, বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে হবে পারকার আঙ্কেলকে।
আগামী শনিবার জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু তার আগে। নেজারের ব্যাপারে কিছু ফয়সালা করতে হবে।
নইলে…
হ্যাগার্ডকে গতকাল রাতের পুরো ঘটনা খুলে বলল কিশোর। কিছুই বাদ দিল না।
বলে চলেছে কিশোর, বড় হতে থাকল হ্যাগার্ডের চোখ জোড়া। কিশোরের কথা যখন শেষ হলো, তার দুচোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্রায়।
অবাক হয়েছে হ্যাগার্ড, তবে চেহারায় উত্তেজনার চিহ্ন নেই। মিস্টার পারকারের মত উত্তেজিত হয়নি সে।
খানিকক্ষণ ঝিম্ মেরে থাকল লোকটা। আপনমনে মাথা দোলাল, গোঁফে তা দিল। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল।
চোয়াল শক্ত।
কিশোরের বুঝতে অসুবিধে হলো না গভীর চিন্তায় ডুবে আছে কেয়ারটেকার।
একটু পর ঝট করে উঠে দাঁড়াল হ্যাগার্ড। কিশোরও উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। ওর কাধ চাপড়ে লোকটা বলল, তোমার নিজেকে নিয়ে গর্ব করা উচিত, কিশোর। ভয়ঙ্কর বদ এক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়েছ তুমি। তাকে হারিয়ে দিয়েছ। বাঁচিয়ে দিয়েছ আমাদের সবাইকে।
কিন্তু আবার যদি জেগে ওঠে ওই আত্মা? দ্বিধা করে বলল ও। এমন কি হতে পারে না ওই অতৃপ্ত আত্মা নতুন সুযোগের অপেক্ষায় আছে?
হুঁম! চিন্তিত ভঙ্গিতে গোঁফের, কোণা মোচড়াল হ্যাগার্ড। কী হতে পারে আমি জানি না, কিশোর। তবে এ কথা বলতে পারি কিছু সময়ের জন্যে হলেও যোদ্ধার আত্মাকে অক্ষম করে দিয়েছ তুমি। বর্মটার দিকে তাকাল সে সরু চোখে। এখন ওটাকে দেখে চুপচাপ মনে হচ্ছে, যেন কিছু বোঝে না।
বর্মটার দিকে তাকাল কিশোরও। এটাই যে গতকাল রাতে ওর আত্মা উড়িয়ে দিয়েছিল, দেখে বোঝার উপায় নেই এখন।
চোখের দুই ফোকর দিয়ে যে ভুতুড়ে আলো বের হয়েছে, তা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়।
সত্যিই এখন বর্মটাকে ভদ্র মনে হচ্ছে।
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।
হ্যাগার্ড হয়তো ঠিকই বলেছে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য ও নেজারের প্রেতাত্মাকে দমিয়ে দিয়েছে।
অথবা কে জানে, হয়তো চিরদিনের জন্য।
জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেল ওর। নামি দামি অনেক লোককে দাওয়াত করেছেন পারকার আঙ্কেল। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে কয়েকজন রিপোর্টারও আসবে।
সবাই এখানে ভুতুড়ে কিছু দেখতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। নিজের চোখে ভূত বা ওই জাতীয় কিছু দেখতে চাইবে।
নইলে ভুতুড়ে জাদুঘরের সার্থকতা কোথায়?
নতুন আরেক চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল কিশোরের মাথায়। ও যদি সত্যিই প্রেতাত্মাটাকে চিরতরে দূর করে দিয়ে থাকে, তা হলে আমন্ত্রিত অতিথিরা ভুতুড়ে কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হবে। জাদুঘরের বদনাম হয়ে যাবে।
হোক।
তবু জেনেশুনে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে দিতে পারে না ও।
আপাতত বর্মটার ওপর নজর রাখা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, বলল কেয়ারটেকার।
কিশোর বুঝল, ভুল বলেনি মানুষটা।
আরও কিছুক্ষণ টুন্টা কাজ করে কিশোরসহ কনজারভেটরি থেকে বেরিয়ে এল হ্যাগার্ড।
.
সে-রাতের কথা।
ঘম আসছে না কিশোরের।
বালিশে হেলান দিয়ে নীল লকেটের দিকে চেয়ে আছে। মন খারাপ।
মন খারাপের কারণ–নেজার ম্যাণ্ডার ফিরে আসতে পারে। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে বাড়ির যে-কেউ। পারকার আঙ্কেলের সাধের জাদুঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে।
আরেকটা কথা ভেবেও খারাপ লাগছে ওর। নেজার ফিরে না। এলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জমবে না।
এই ভাবনাটা দুর্বল করে তুলল ওকে।
খোদা, ফিরিয়ে আনা এই যোদ্ধার আত্মাকে, মনে মনে বলতে বাধ্য হলো কিশোর।
ভাবনার সাগরে এতই তলিয়ে গিয়েছিল কিশোর যে প্রথমে আওয়াজটা ঠিকমত শুনতে পেল না।
থপ থপ!
উঠে বসে কান পাতল ও।
থপ থপ!
জিনা! বিড়বিড় করল ও। আবার ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। বিছানা ছাড়ল ও। আমাকে বোকা পেয়েছে নাকি যে বারবার একই
কায়দায় ভয় দেখাবে?
ধীরে ধীরে নীচতলায় নেমে এল ও।
আওয়াজটা আরও জোরাল হলো। এগিয়ে চলল কিশোর শব্দ। লক্ষ্য করে। মনে হয় কিচেনের পিছন থেকে আসছে শব্দটা।
কিচেন? আবার কিচেনে গেছে ও? স্রেফ অবজ্ঞার সাথে মাথা ঝকাল কিশোর। মেয়েটার বুদ্ধি কমে গেল নাকি!
আলো জ্বালার ঝামেলায় না গিয়ে জাদুঘরের ভিতর দিকে এগোল ও। ওখান থেকে বেরিয়ে পা রাখল কিচেনে।
থপ থপ!
আওয়াজটা এবার স্পষ্ট শোনা গেল। কিন্তু জিনাকে দেখা গেল না। কিচেনে ওর টিকির চিহ্ন নেই।
কয়েক মুহূর্ত পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। ভয় একটু একটু করে চেপে ধরছে ওকে।
হঠাৎ কেউ বা কিছু একটা খপ করে ওর বাহু চেপে ধরল। ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল কলজে।
সরি, কিশোর।
হ্যাগার্ড।
লোকটাকে দেখতে পেয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল ও।
কিন্তু শব্দটা থামেনি।
এখনও চলছে।
অর্থাৎ হ্যাগার্ডেরও নয় কাজটা, জিনার তো নয়ই।
তা হলে?
ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে কিশোরকে চুপ থাকার ইশারা করল কেয়ারটেকার। আমি আসলে তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি, ফিসফিস করে বলল। মমিঘরে কাজ করছিলাম, হঠাৎ আওয়াজটা কানে এল। তোমার কী মনে হয়, কিশোর, ওটা কীসের আওয়াজ?
মনে হয় জিনার কাজ, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। কাল রাতে সিলিঙে ঝাটার গোড়া দিয়ে শব্দ তুলে আমাকে ভয় দেখিয়েছে ও। আজও বোধহয় তা-ই করছে।
হ্যাগার্ড পা টিপে টিপে কনজারভেটরির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আওয়াজটা এই ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। চলো, দেখে আসি।
ঢোক গিলল কিশোর। মনে হলো জিভ ভারী হয়ে গেছে। মুখের ভিতরটা সিরিশ কাগজের মত খটখটে হয়ে আছে।
ওর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসল হ্যাগার্ড। চেহারায় ভয় নেই, এসো আমার সঙ্গে ধরনের ভাব ফুটিয়ে ঢুকে পড়ল।
বাধ্য হয়ে তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
যে-মুহূর্তে ওরা কনজারভেটরির ভিতরে পা রাখল, ঠিক সেই মুহূর্তে থেমে গেল আওয়াজটা।
মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ওরা দুজন। তারপর একযোগে ঘুরে তাকাল বর্মটার দিকে।
হ্যাঁ, যেখানে থাকার কথা, সেখানেই বসে আছে ওটা। আবার ঘোড়ার পিঠে ওঠানো হয়েছিল ওটাকে আজ সকালে, ওখানেই নাকি মানায়।
চুপচাপ বসে আছে ওটা একই ভঙ্গিতে। মাথা এদিকে ফেরানো। বর্শাটা এক হাতে উঁচু করে ধরে আছে।
সব স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না কিশোর বা হ্যাগার্ডের।
আমার ধারণা বোধহয় ঠিক না, নিচু স্বরে বলল হ্যাগার্ড। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আর যাই হোক, শব্দটা ভূত করছে না।
দরজার দিকে ঘুরল হ্যাগার্ড। কিশোরও।
এক পা এগোল কিশোর।
এমন সময় ওর মনে হলো কিছু একটা শা করে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে। মাথার এত কাছ দিয়ে গেল যে ওর চুল পর্যন্ত দুলে উঠল।
হ্যাগার্ডও টের পেয়েছে ব্যাপারটা।
মুহূর্তে চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। পরমুহূর্তে কিছু একটা বিস্ফোরিত হওয়ার আওয়াজ হলো।
লম্বা একটা তীর ফুলের টবগুলোর একটায় আঘাত হেনেছে। তীরটা ভিতরের মাটিতে গেঁথে গেছে ত্রিশ ডিগ্রি কোনাকনি হয়ে। লেজটা তিরতির করে কাঁপছে।
একটা ক্রস-বো থেকে ছোঁড়া হয়েছে ওটা। কিশোর জানে আড়াইশো বছর আগে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা এসব আড়ধনু ব্যবহার করত।
হ্যাগার্ড আর কিশোর একযোগে পিছন দিকে তাকাল।
ওটা যে নেজার ম্যাণ্ডারই ছুঁড়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইল ওরা।
১৪
জলদি পালান! হ্যাগার্ডের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠেই সামনে ছুটল কিশোর। পিছনে খুরের আওয়াজ উঠল আবার।
এগিয়ে আসছে আওয়াজটা।
দ্রুত কমে আসছে ঘোড়া ও কিশোরদের মাঝের দূরত্ব।
ডানে সরে ছুটতে লাগল কিশোর। ঘোড়সওয়ারও ডানে সরে গেছে বলে মনে হলো।
পরক্ষণে বাঁয়ে সরল ও। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল।
ওর পিছনেই রয়েছে হ্যাগার্ড। তার পিছনে নেজার।
তার মুখাবরণের দিকে তাকাতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল কিশোরের। বর্শাটা উঁচু করে ধরে আছে সে। ওটার চোখা মাথা দেখে আত্মা উড়ে গেল, কারণ বর্শাটা ওর দিকেই তাক করা।
সামনের দরজাটা মনে হলো বহু মাইল দূরে।
অমোঘ নিয়তির মত পিছন পিছন তেড়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত।
জানপ্রাণ বাজি রেখে ছুটছে কিশোর। লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। পা। অবশ হয়ে আসছে। তবু ছুটছে ও।
এখনও মনে হচ্ছে দরজাটা কয়েক মাইল দূরে। সারাজীবন ছুটেও ওটার নাগাল পাবে বলে ভরসা হলো না। কিশোরের।
আর হয়তো এক মুহূর্ত। তারপরই বর্শাটা ওর পিঠে গেঁথে দেবে শয়তানটা। ভাবতেই গায়ের সব রোম দাঁড়িয়ে গেল ওর।
ঠিক সে-সময় আরেকটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। জিভ আর টাকরা এক করে জোরে বাতাস ছাড়ার মত আওয়াজ।
ভয়ে চোখ বুজে ফেলল কিশোর। বুঝতে পারছে নেজারের বর্শা উড়ে আসার আওয়াজ ওটা। এখনই এফেঁড়-ওফোঁড় করে দেবে ওকে।
কিন্তু কিছুই ঘটল না।
থেমে পড়ল কিশোর। হ্যাগার্ডও। নিজের অজান্তে কেয়ারটেকারের বাহু খামচে ধরেছে কিশোর।
দেয়ালে ঝোলানো পারকার আঙ্কেলের সবগুলো বর্শা একযোগে উড়ে যাচ্ছে ওদের মাথার উপর দিয়ে। ওগুলোর লক্ষ্য। নেজার।
কয়েকটা ঠিক তার সামনের ফ্লোরে পড়ল। মাটিতে ডেবে গিয়ে এদিক-ওদিক কাঁপতে লাগল। কতগুলো বিধল পিছনের ফ্লোরে। সাত-আটটা ডানে আর বাকিগুলো বায়ে।
ঘেরাও হয়ে গেল নেজার।
অকল্পনীয় দৃশ্য!
অদৃশ্য কোনও হাত যেন বর্শার বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তাকে। ঘোড়াটা আচমকা কান ফাটানো ডাক ছাড়ল, খুর দিয়ে সশব্দে মাটি ঠুকছে।
ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল নেজার। চোখের দুই গর্তের ভিতরদিকে লাল আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।
হ্যাগার্ডের হাত ছেড়ে দিল কিশোর। উত্তেজনায় বুক ধুপধাপ করছে। সাহস করে সামনে এগোল। বর্শাগুলো পরখ করে দেখবে। কাণ্ডটা কীভাবে ঘটল ভেবে পেল না ও।
কী মনে করে মুখ নিচু করল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঝোলানো লকেটের উপর চোখ পড়ল। ভিতরের ধোঁয়া আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে।
ঘুরপাক খাচ্ছে।
উঠছে-নামছে।
নীল আলো ঝিকমিক্ করছে ভিতরে।
নেজারের ভুতুড়ে চোখের চেয়েও উজ্জ্বল আলো।
এইবার আসল ঘটনা বুঝতে পারল ও। ঘটনা আসলে এই লকেটই ঘটাচ্ছে।
আরও একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে ওকে।
সামান্য একটা গুলতির পাথর কখনও স্টিলের অতবড় বর্মকে ঘায়েল করতে পারত না। গতকাল রাতে নেজারকে আসলে পাথর দিয়ে ধরাশায়ী করেনি কিশোর, এই লকেটই ওকে বাঁচিয়েছে প্রেতাত্মার হাত থেকে। আজও এটা আরেকবার বাঁচাল ওকে।
এটাই নিজের অলৌকিক শক্তির জোরে বর্শাগুলোর সাহায্যে নেজারকে ঠেকিয়েছে। লকেটটার যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সে ব্যাপারে কিশোরের আর কোনও সন্দেহ রইল না।
মিস্টার হ্যাগার্ড, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন? লোকটার দিকে তাকাল ও। চাঁদের আলোয় লকেট উঁচিয়ে ধরল। এই লকেট! এটাই এতসব করল জাদুর বলে!
লকেটটা শক্ত মুঠোয় ধরে বর্মটার কাছে এসে দাঁড়াল ও। হ্যাগার্ড ওর পিছনে দাঁড়িয়ে।
কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে দুজনই।
ওদিকে দেয়ালে ঝোলানো তলোয়ারগুলো ঠুং-ঠাং শব্দে পরস্পর ঠোকর খাচ্ছে। কুঠারগুলো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে শূন্যে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ওগুলো।
অবিশ্বাস্য!
অকল্পনীয়!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো কিশোরের।
কী মনে করে লকেটটা উঁচিয়ে ধরে নাড়তে লাগল গোয়েন্দা প্রধান।
অমনি ভয়ে নিচু হলো বর্মধারী। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা ধাতব হাত দিয়ে মুখ আড়াল করল।
তার মুখাবরণের উজ্জ্বল আলো হঠাৎ দপ্ করে নিভে গেল।
শুনতে পাচ্ছ? বর্মটার দিকে তাকিয়ে জোরে বলল কিশোর, এরপর আবার বাড়াবাড়ি করলে ফল ভাল হবে না।
সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। বর্মের দিকে লকেটটা বাড়িয়ে ধরে রেখেছে এখনও। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা তলোয়ার একযোগে ছুটে এসে আঘাত করল বর্মটাকে।
বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে দুহাত চালাল নেজার। কিন্তু তলোয়ারগুলো ঠিকই আঘাত হেনে চলল। ব্যর্থ হলো না একটাও।
লকেট আরও উঁচু করে ধরল কিশোর। কাঁচের গোলকটার উপর চাঁদের আলো পড়ল। ঝলমল করে উঠল ওটা।
হঠাৎ করে ওটার ভিতর থেকে গাঢ় নীল আলোর রশ্মি বেরিয়ে নেজারের দিকে ছুটে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে গেল বর্মটা।
ঝকমক করে উঠল ওটা।
খটমট শব্দ উঠল কয়েক মুহূর্ত ধরে।
এবং তারপরই বিস্ফোরণ হলো!
বুম্ম্!
১৫
প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে হেলমেট তীরবেগে সিলিঙের দিকে ছুটে গেল।
গনগনে আগুন বেরিয়ে এল বর্মের ভিতর থেকে। পরক্ষণে গোটা বর্মটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
নেজারের ব্রেস্ট প্লেটটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ঢাল। তার পরপরই জোড়া থেকে খসে পড়ল দুই হাত।
দুপা টলমল করে উঠল। এবং পরমুহূর্তে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল।
ওদের বিস্ফারিত চোখের সামনে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল বর্মটা। অনেকটা টায়ার পোড়ার মত বিচ্ছিরি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
নাক, বুকের ভিতরটা জ্বালা করে উঠল কিশোরের।
ছিন্নভিন্ন ধাতুর একটা স্কুপে পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে বর্মটা।
পটার ভিতর থেকে লাল ধোঁয়ার ভুতুড়ে মেঘ উঠছে পেঁচিয়ে পেচিয়ে।
নাক বন্ধ করে এক পা সামনে বাড়ল কিশোর। মৃদু একটা আওয়াজ কানে এল। সাইকেলের টায়ার পাংচার হলে এমন আওয়াজ হয়।
তীক্ষ্ণ চোখে স্তূপটার দিকে তাকাল কিশোর।
চলে গেছে নেজার ম্যাণ্ডার। চিরতরে চলে গেছে।
ও শেষ! ক্লান্ত স্বরে বলল, কিশোর। হেরে ভূত হয়ে গেছে! জীবনে কখনও এত খুশি হয়েছে কি না সন্দেহ। আসলেই যদি আমি জাদুকর হতাম! ভাবল ও।
এমন সময় একটা কণ্ঠ কানে এল ওর। অদ্ভুত, রক্ত পানি করা। স্বর।
দমকা বাতাসে মোমবাতি যেমন দপ্ করে নিভে যায়, তেমনি নিভে গেল কিশোরের আনন্দ।
চুপ করো বোকার হদ্দ! তুমি কিছুই করোনি। যা করার আমিই করেছি সব। সব আমি করেছি।
জমে গেল কিশোর।
সেই জাদুকরের কণ্ঠ?
কনজারভেটরির মধ্যে গমগমে প্রতিধ্বনি উঠল।
ওর চারপাশের কাঁচের দেয়াল কেঁপে উঠল। পায়ের নীচের ফ্লোর পর্যন্ত কেঁপে উঠল থরথর করে।
হঠাৎ হিমশীতল হাওয়ায় ভরে গেল গোটা কনজারভেটরি। কাপ ধরে গেল কিশোরের সারা দেহে।
ভয়ঙ্কর গলাটার উৎসের খোঁজে ঘুরে দাঁড়াল ও।
বোকারাম! তুমি কী মনে করেছ তোমার জাদুশক্তি আছে? হাহ্ হাহ হাহ!
আওয়াজটা কি হ্যাগার্ডের গলা দিয়ে বেরোচ্ছে?
হ্যাগার্ডের?
তা হয় কী করে?
আবারও হেসে উঠল হ্যাগার্ড। শিরদাঁড়ায় শীতল প্রবাহ টের পেল কিশোর। এমন পৈশাচিক হাসি মানুষ হাসতে পারে?
কী ভয়ঙ্কর সেই হাসি! কলজের পানি জমিয়ে দেয় একেবারে।
লোকটার দাঁতগুলো তীক্ষ্ণ আর ছুঁচাল দেখাল। মুখের চামড়া টাটান হয়ে আছে, ঠিক যেন একটা রক্ত-মাংসহীন চামড়ামোড়া খুলি।
কী করবে ভেবে পেল না কিশোর।
মিস্টার হ্যাগার্ড? লোকটার দিকে চেয়ে থাকল ও।
হ্যাগার্ড সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিশোরের মনে হলো ওর চারপাশের বাতাসে ঝড় উঠেছে। লোকটা ওর একটা হাত ধরল। মানুষটার হাত এত ঠাণ্ডা, চটচটে কেন? ঘামে গোসল হয়ে গেছে?
মিস্টার হ্যাগার্ড আপনিই কী… থেমে গেল কিশোর।
আমি হ্যাগার্ড নই, গমগম স্বরে বলল সে। আমি সালমি, সালমি বেন কাজেম–সর্বকালের সেরা জাদুকর। এবার তুমি মরার জন্য তৈরি হও!
ধীরে ধীরে দুহাত তুলল হ্যাগার্ড–না, সালমি বেন কাজেম। আঙুলে অনেকগুলো সোনালি আংটি, না আংটি কোথায়?
সাপ ওগুলো! সাপগুলোর জ্বলজ্বলে, লাল চোখগুলো বড় বেশি জ্বলজ্বল করছে।
কিশোরের দিকে হাত বাড়াল জাদুকর। আঙুল থেকে ঝুলছে সাপ। এদিক-ওদিক পিছলে যাচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর সামলে উঠতে পারছে না কিশোর।
একটু পর বড় হতে শুরু করল সাপগুলো।
হচ্ছে তো হচ্ছেই!
হিশহিশ করতে করতে এগুলো তার কবজি পেঁচিয়ে সামনে এগোতে লাগল। ওগুলোর কুৎসিত জিভ লক্ করছে কিশোরকে লক্ষ্য করে।
একটা সাপ ছোবল মারার ভঙ্গিতে ঝট করে মাথা বাড়িয়ে দিল। ওর দিকে।
সময়মত সরে গেল কিশোর। ওটার হাঁ দেখে পিলে চমকে উঠল। তীক্ষ্ণধার দাঁত দেখা গেল ওটার।
হাত ঝাড়া মারল জাদুকর। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরের চোখের সামনে যেন ভোজবাজির খেলা ঘটে গেল।
হিশহিশ করতে থাকা সোনালি সাপগুলো মুহূর্তে বজ্রে পরিণত হলো। আকাশের বজ্ৰ চমকে ওঠে মুহূর্তের জন্য, কিন্তু কাজেমের হাতের বজ্র লকলক করছে টিউব লাইটের মত।
দূরত্ব সামান্য বলে তুকে বজ্রের তাপের আঁচ পেল কিশোর। হঠাৎ একটা বজ্র ওর দিকে তেড়ে এল। ঝট করে মাথা নোয়াল ও।
দেরি হয়ে গেছে।
চুল পোড়ার বিচ্ছিরি গন্ধ এল নাকে।
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারল না।
মিস্টার হ্যাগার্ড!
লোকটার সঙ্গে ওর রীতিমত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আর সে কি না ওকে ধোকা দিয়ে এসেছে?
অকল্পনীয়।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। বোকার মত তাকিয়ে আছে। লোকটার দিকে। কী করবে ভাবতে চাইল।
লোকটার দেহের গড়ন পাল্টে যাচ্ছে দেখে ঝাঁকি খেল কিশোর। এত বিস্ময়ের ধাক্কা সামলানো কঠিন।
লোকটার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। তবে নেজার ম্যাণ্ডারের চোখের মত নয়।
কেমন শীতল এবং কঠিন।
ফয়েল পেপারের মোড়কের মত চকচক করছে লোকটার চামড়া। দেখতে দেখতে গায়ের রং পাল্টে যেতে থাকল। শুধু রং নয়, চেহারাও পাল্টাতে লাগল লোকটার। দুগালে কোত্থেকে যেন ঘন। চাপদাড়ি এসে জুটল। ধবধবে সাদা চাপদাড়ি।
মাথার উপর এক হাত তুলে ঘোরাল সে। অমনি কোত্থেকে একটা লম্বা রুপোলি ছড়ি চলে এল তার হাতে।
ছড়িটা মাথার উপর দ্রুত চক্রাকারে ঘোরাতে লাগল সে। বাতাসে শশ শব্দ তুলল ওটা। সবেগে ঘুরছে।
একবার… দুবার… তিনবার…
গতি আরও বাড়ছে। আবছা দেখাচ্ছে এখন ছড়িটাকে। মনে হচ্ছে মাথার উপর অস্পষ্ট একটা চাকতি ঘুরছে।
চোখের পলক পড়ল কিশোরের।
হাত থেমে গেল জাদুকরের।
কিশোরের মুখোমুখি হলো সে। লম্বা, পিঙ্গল একটা জোব্বা তার পরনে। পায়ে পিঙ্গল বুট। মাথায় ঝলমলে পিঙ্গল একটা পাগড়ি।
সালমি বেন কাজেমের জোব্বা আর পাগড়িতে সেঁটে থাকা অজস্র মেডেল ঝকমক করছে-রুপোলি চাঁদ, সোনালি তারা, আরও কত কী!
কোনওটা ছোট, কোনওটা বড়।
কোনওটা ঝকমক করছে, কোনওটা ম্লান।
এমন মেডেল ঠাসা পোশাক জীবনে দেখেনি কিশোর। ডেভিড কপারফিল্ড, আমাদের জুয়েল আইচ–ওঁরাও তো জাদুকর। কিন্তু এমন বিদঘুঁটে পোশাক তাদের পরতে দেখা যায় না! অবশ্য পরবেনই বা কেন, ওঁরা তো আর শয়তান জাদুকর নন।
ওগুলোর মধ্যে বড়সড় একটা নীল বৃত্ত দেখতে পেল কিশোর। ওটার মধ্যে নীল ধোঁয়ার মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিক ওর লকেটের মত। মুখ নিচু করে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিশোর। জুলজুল করছে জিনিসটা।
শোনো, কিশোর, হ্যাগার্ড, মানে সালমি বেন কাজেম বলে উঠল। সারা গায়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি জাগল কিশোরের। যেন অজস্র ঘাসফড়িং হেঁটে বেড়াচ্ছে দেহে। তুমি ভেবেছ এসব তুমিই করেছ, তা-ই না? থেমে আবারও একচোট হেসে নিল সে।
জাদুর জ-ও জানা নেই তোমার, আছে? জাদুশক্তি আছে আমার। আসল কথা হলো আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি, আমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। দুশমনকে খতম করার জন্যে।
সালমি তার লম্বা, রুপোলি লাঠিটা তাক করল ধ্বংস হয়ে যাওয়া। বর্মটার দিকে। পিঙ্গল বুট দিয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকা হেলমেটে লাথি ঝেড়ে দিল। ঠুংঠাং শব্দে গড়িয়ে গেল ওটা এক কোনায়।
চাপা হাসল জাদুকর।
প্রতি আশি বছর পরপর নেজার আর আমাকে লড়াইয়ের জন্যে মুখোমুখি হতে হয়, বলতে শুরু করল সে। আমি তাকে হারাতে পারলে যথারীতি ঘুম দেয় সে পরবর্তী আশি বছরের জন্যে। এই আশি বছর সে অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী লড়াইয়ের। আমাকে হারানোর অপেক্ষায় থাকে। কারণ আমাকে হারাতে পারলেই… থেমে শ্রাগ করল জাদুকর।
কিন্তু সেটা হবার নয়, আবার বলল সে। তীক্ষ্ণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল।
ঢোক গিলে অজান্তে এক পা পিছিয়ে গেল কিশোর।
নেজার ম্যাণ্ডারের একটা মন্তব্য মনে পড়ে গেল। সে বলেছিল, এর আগে যে জাদুকরের বিরুদ্ধে সে লড়েছে, ডাইনোসরের রূপ ধরেছিল সে, আগুনের দেয়াল হয়েছিল।
ঠিকই বলেছিল নেজার, কিশোরের মনের কথা বুঝতে পেরে বলে উঠল কাজেম। সে তোমাকে সালমি বেন কাজেম মনে করেছিল। ভেবেছিল তোমার মত ছোটখাট, দুর্বল এক ছেলের রূপ ধরেছি বুঝি। আমার পরিকল্পনা আসলে এরকম ছিল না। তবু এতেই কাজ হয়ে গেল। আমার মত এক জাদুকর কেন এইরকম আস্তাকুড়ে এসে উঠেছে, জানো?
জবাব দিল না কিশোর।
কনজারভেটরির চারদিকে তাকাল জাদুকর। চোখমুখ কুঁচকে উঠল।
কারণ আমার ক্ষমতার বলে জানতে পেরেছিলাম আজ হোক কাল হোক নেজার আসবেই এখানে। তোমার বান্ধবীর চাচা বর্মটা মণ্ট্যানা থেকে এখানে পাঠাবে। এক বুড়োর কাছ থেকে কিনে এখানে পাঠানোর অনেক আগে থেকেই জানতাম। অপেক্ষা করতে হলো আমাকে। কারণ তার সঙ্গে লড়াইয়ের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে এসেছিল।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিশোরের লকেটটার দিকে তাকাল কাজেম। ঠোঁট, চাটল জিভ দিয়ে। মুচকি হাসল।
গা শিরশির করে উঠল কিশোরের।
আমার আগেই তুমি ওই লকেট কফিন থেকে তুলে নিয়েছিলে, বলল সে। পরেও ফেলেছিলে সঙ্গে সঙ্গে। ওটাকে ধরা-ছোঁয়ার নির্দিষ্ট একটা নিয়ম আছে। তুমি আগে ছুঁয়ে ফেলায় আমি আর হাত বাড়াতে পারিনি ওটার দিকে। ছিনিয়ে নিতে পারিনি ওটা তোমার কাছ থেকে। পারার কথাও নয়। কারও নেই সে-ক্ষমতা। অন্তত যতক্ষণ না নেজার নতুন করে আশি বছরের জন্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখন…
সম্মোহিতের মত হয়ে গেছে কিশোর অনেকটা।
চুপচাপ জাদুকরের কথা শুনছে।
ক্রুর হাসি ফুটল জাদুকর কাজেমের ঠোঁটে।
মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা নেজারের ছিন্নভিন্ন বর্মটার দিকে তাকাল সে। জ্বলজ্বল করছে তার দুচোখ।
হাতের ছড়িটা কিশোরের দিকে তাক করল সে।
ওটার মাথা থেকে সরু একটা আলোর রেখা ছুটে এল কিশোরের দিকে।
ওর বুকে এসে লাগল।
লকেটটা ঝকমক করে উঠল, যেন কাজেমের জাদুর জবাব দিল।
বুক থেকে শূন্যে উঠে পড়ল ওটা, এগিয়ে গেল জাদুকরের দিকে। কিশোরকেও টেনে নিয়ে চলল ওটা।
জাদুর শক্তির কাছে হার মানল কিশোরের শক্তি।
আমার জিনিস তোমার কাছে থাকবে কেন? ছড়ির মাথা দিয়ে লকেটটা স্পর্শ করল জাদুকর। ছিঁড়ে গেল চেইন।
ছড়িটা দোলাতে লাগল জাদুকর। কিশোরকে অবাক করে দিয়ে। ওটার মাথায় সেঁটে থাকল লকেটটা।
আমার জিনিস এখন আমার কাছে, বলল সে।
নেজার আর কোনওদিন আমার সঙ্গে সুবিধে করতে পারবে না। জাদুর এই লকেট আমাকে আরও ক্ষমতাধর করে তুলবে।
মার্বেলটার দিকে তাকাল সে।
শয়তানী হাসিতে চেহারা ভরে উঠল।
কিশোরের দিকে মন দিল জাদুকর। সুন্দর চেহারার খুঁত কী। জানো? ব্রণ। আমার চলার পথে তুমিও এখন তা-ই। বিচ্ছিরি একটা খুঁত, একটা-ঝামেলা। তোমাকে শেষ করে দিতে হবে। গোপন অনেক কথা বলে ফেলেছি তোমাকে। আমি চাই না আর কেউ তা। জানুক। হুম! এখন আমার কী করা উচিত? শেষ কথাটা যেন নিজেকেই বলল সে।
ঠোঁট চাটল সালমি বেন কাজেম।
ভাবছে।
ভাবছে কীভাবে কিশোরকে খতম করা যায়।
ঢোক গিলল কিশোর।
অত্যন্ত সন্তর্পণে পিছিয়ে গেল এক পা। উদ্দেশ্য–খিঁচে দৌড় দেবে, যা থাকে কপালে।
ওসব চিন্তা বাদ দাও, গর্জে উঠল লোকটা। তার ভয়ঙ্কর চাউনি কিশোরকে জমিয়ে দিল। হ্যাঁ, পেয়েছি! তোমাকে নিকেশ করার কায়দা পেয়ে গেছি আমি। তোমাকে আমি একটা বিড়াল বানিয়ে ফেলব। তবে আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি–ভুলেও কুকুরের ধারে-কাছে যেয়ো না যেন। হাঃ হাঃ হাঃ।
শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল কিশোরের।
টের পেল হাতদুটো কাঁপছে। ওর কাঁপুনি টের পেয়ে ঠোঁট মুড়ে হাসল জাদুকর।
কিশোরের মাথার উপর হাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, একদম নড়াচড়া করবে না। ভরা পূর্ণিমায় আমি, জাদুকর সালমি বেন কাজেম চাই, এই ছেলেটা বিড়াল হয়ে যাক… মন্ত্র পড়ার ভঙ্গিতে কথাটা বলে চলল সে।
দুবার বলা শেষ হয়েছে কী হয়নি, এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, থামো!
থতমত খেয়ে সামনে তাকাল সালমি বেন কাজেম।
একটু একটু করে বড় হয়ে উঠল দুচোখ।
কনজারভেটরির আরেক প্রান্তের ছায়ার ওদিক থেকে এসেছে। নির্দেশটা।
অপার্থিব শোনাল কণ্ঠটা।
কাঁটা দিল কিশোরের গা। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
ছায়ার ভিতর থেকে একটা ছায়া-কাঠামো বেরিয়ে এল ধীরে ধীরে। যতই এগোতে থাকল, ততই স্পষ্ট হতে থাকল অস্পষ্ট কাঠামোটা।
ধাতব জুতো পরে আছে ওটা।
পরে আছে চওড়া ব্রেস্টপ্লেট।
মাথায় হেলমেট।
ওটার মুখাবরণের উপর দিকে দুটো ফাঁকা জায়গা। চোখের ফুটো।
বর্মধারী তার এক হাত তুলল।
কাজেমের উদ্দেশ্যে গগমে কণ্ঠে বলল, শয়তান জাদুকর, এবার মরার জন্য তৈরি হও।
১৬
নেজার ম্যাণ্ডার!
আবার ফিরে এসেছে!
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে বর্মধারী।
এক কদম।
দুই কদম।
তিন কদম।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বর্মটার দিকে তাকাল কিশোর। এবং বিষম খেল।
নেজার ম্যাণ্ডার নয় ও। মিস্টার পারকারের নকল বর্ম ওটা, জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা-ই বা কী করে সম্ভব?
এসব হচ্ছেটা কী? চিন্তায় পড়ে ভাবল কিশোর। নেজারের ভূত কি এখন এই বর্মের ভিতরে ভর করেছে?
বর্মধারী যত এগিয়ে আসছে, তত পিছাতে লাগল কিশোর। যদিও বুঝতে পারছে তার চাউনি ওর উপর নয়, জাদুকরের উপর স্থির।
কাজেমের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর বর্মধারীর দিকে।
কার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত ওর? কোনজন বেশি খারাপ?
কিন্তু ভাবনা নিয়ে এগোবার সুযোগ পেল না কিশোর। জাদুকরের চোখ ঝিকিয়ে উঠল। কাঁধ ঝাঁকাল সে।
দুহাত বাড়াল দুদিকে।
বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল।
আরও এগিয়ে এল বর্মধারী। চট করে জাদুকরের দিকে এক হাত বাড়াল সে। তার হাত জাদুকরের লাঠির ডগা ছুঁয়ে দিল।
সময় মত সরে যেতে পারল না কাজেম। তার ছড়ির নীল মার্বেলটা নড়ে উঠল। এদিক-ওদিক করতে লাগল।
তারপরই ওটা পড়ে গেল ছড়ির মাথা থেকে।
মরিয়া হয়ে দুহাত আগে বাড়াল জাদুকর। মার্বেলটা পড়ে যাচ্ছে। ওটা ধরতে চায় সে। কিন্তু পারল না। তার আঙুল ছুঁয়ে ফ্লোরে আছড়ে পড়ল খুদে জিনিসটা।
ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
কান ফাটানো আওয়াজ উঠল একটা। বজ্রপাতের শব্দকে হার মানায় সে আওয়াজ।
ঝিকিয়ে উঠল উজ্জ্বল, নীল আলো।
এতই উজ্জ্বল যে চোখ বুজতে বাধ্য হলো কিশোর।
এরপরই অদ্ভুত একটা য্যযু জাতীয় আওয়াজ কানে এল।
লকেটটা ভেঙেচুরে অগুনতি টুকরোয় পরিণত হয়েছে। অজস্র টুকরো হয়ে ছুটল এদিক-ওদিক।
কাঁচের টুকরোগুলোকে খুদে নক্ষত্রের মত লাগছে।
এক মুহূর্ত পরই ফ্লোর থেকে নীল ধোঁয়ার মেঘ উঠতে দেখা গেল।
উঠতেই থাকল।
লকেটটা যেখানে পড়ে ভেঙেছে, সেখান থেকে অনবরত ধোঁয়া উঠছে। মাটির নীচের কোনও ধোঁয়ার উৎসমুখ যেন খুলে গেছে।
গলগল করে বের হচ্ছে তো হচ্ছেই।
জীবনে অনেক আজব কাণ্ড দেখেছে কিশোর, কিন্তু এমন কাণ্ড দেখেনি।
নীল ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
শীতের সময় ঘন কুয়াশা যেমন ভেসে বেড়ায়, কনজারভেটরির মধ্যেও তেমনি নীল ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে এই ধোঁয়া অস্থির ও রহস্যময়।
কিশোরের পা ঢেকে ফেলল নীল ধোঁয়া। শরীরের যেখানেই ধোঁয়া লাগছে, সেখানেই ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হলো হাড়ে গিয়ে ঠেকছে। ঠাণ্ডা।
এরপর জাদুকরকে ঘিরে ধরতে শুরু করল ধোঁয়া।
নীল ধোঁয়া তাকে ঘিরে উঠছে তো উঠছেই। থামাথামি নেই। পিঙ্গল জোব্বা পরা লোকটা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
না! না! আর্তনাদ করে উঠল সে। উন্মত্তের মত দুহাত নাড়তে লাগল উপর-নীচ, এদিক-ওদিক।
ধোঁয়া সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কিন্তু বেয়াড়া ধোঁয়ার মেঘ গিলে ফেলেছে তাকে।
মুখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরানোর মরিয়া চেষ্টা করল জাদুকর। পারল না।
খেপার মত বুট দিয়ে ধোঁয়ায় লাথি হাঁকাল অনর্থক।
নীল ধোঁয়া তাতে বরং গাঢ় হলো আরও।
এবার হাল ছেড়ে দিল জাদুকর। অসহায়ের মত কপাল টিপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
পরক্ষণে ফ্লোর হাতড়াতে শুরু করল পাগলের মত।
কী খুঁজছে লোকটা?
কী?
কী আছে ওখানে, যার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে? ভাবতে লাগল কিশোর। গাঢ় ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে ফ্লোর দেখার চেষ্টা করল।
হ্যাঁ, দেখতে পেল জিনিসটা।
ছোট্ট সোনালি একটা তলোয়ার। ধোঁয়ার মধ্যেও ঝমক করছে।
বিস্ময়ে গুঙিয়ে উঠল কিশোর।
এতদিন ওটা নিশ্চয়ই লকেটটার মধ্যে লুকানো ছিল। জাদুকর ওটার দিকে হাত বাড়াল।
ডাইভ দিল কিশোর।
কেন যেন মনে হলো ওই ছোট্ট জিনিসটা এখন ওকে এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
হ্যাঁ, বরাবরের মত এবারও জিত হলো কিশোরের। এতদিন হারিয়ে এসেছে হ্যাগার্ডকে। এবার হারাল জাদুকর সালমি বেন কাজেমকে।
তলোয়ারটা ধরতেই ওর মনে হলো যেন হাতে বৈদ্যুতিক শক লেগেছে। বেদম এক ঝাঁকি খেল।
টান মেরে হাত পিছিয়ে নিল। তবে তলোয়ারটা ছাড়ল না। হাতের সবকটা আঙুল চিনচিন করে উঠল ব্যথায়।
পাত্তা দিল না কিশোর।
শক্ত হাতে ধরে রাখল জিনিসটা। ওর মুঠো থেকে স্ফুলিঙ্গ ছুটতে লাগল। মুঠো সামান্য আলগা করল।
ছোট্ট তলোয়ারটা বড় হতে শুরু করেছে। কিশোরের হাতে বড় হচ্ছে ওটা।
বড় হতেই থাকল।
লম্বা হচ্ছে। ফলা চওড়া, ভারী হচ্ছে।
সৈন্যদের তলোয়ারের মত বড়সড়–লম্বা হয়ে গেল ওটা দেখতে দেখতে।
এবার তলোয়ারটার হাতল ধরল কিশোর শক্ত করে। ওর হাতের মুঠোয় এঁটে বসল ওটা।
. তলোয়ার ধরা হাতটা আগে বাড়িয়ে দ্রুত দোলাল কিশোর। তলোয়ারের ব্লেডে চাঁদের আলো পড়তে কয়েকশো তারার উজ্জ্বলতা নিয়ে ঝিকিয়ে উঠল ওটা।
হঠাৎ হুশ! জাতীয় একটা শব্দ কানে এল কিশোরের। তারপর নেজার ম্যাণ্ডারের বর্মের টুকরোগুলো দেখা গেল শূন্যে ভাসছে।
ওগুলো কিশোরের দিকেই ছুটে আসছে।
শিন গার্ডটা ওর হাঁটুতে জুড়ে বসল আঘাত থেকে পা দুটোকে বাঁচানোর জন্য।
ব্রেস্টপ্লেট এসে সেঁটে গেল ওর বুকে।
বর্মের অন্যান্য অংশ এসে টপাটপ জুড়ে বসতে লাগল দেহের বিভিন্ন অংশে।
এবার সোনালি তলোয়ারটা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াল ও। সালমি বেন কাশেমের মুখোমুখি হলো।
জাদুকরের বিরুদ্ধে কী পারবে ও?
একটা অপশক্তির বিরুদ্ধে?
লোকটার মাথা হঠাৎ পিছনে হেলে পড়ল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসতে লাগল সে। মুখের ভিতরে লম্বা ছুঁচাল দাঁত আর আলজিভ পরিষ্কার দেখা গেল তার।
ভীতিকর গর্জন ছাড়ল জাদুকর। তার হাতের দশ আঙুলের ডগায়। বিদ্যুৎ চমকে উঠল–সরু, লকলকে এবং ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎ।
ভেবেছ তুমি আমাকে হারাতে পারবে? গর্জে উঠল কাজেম। দমকা বাতাস বয়ে গেল গোটা রুমে। তার ধাক্কায় মনে হলো পড়েই যাবে কিশোর।
নিজেকে সামলে নিল ও। পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি নেই যা আমার জাদুর গুণ নষ্ট করতে পারে, আবারও গর্জে উঠল জাদুকর।
সালমি বেন কাজেম তার দুবাহু প্রসারিত করল দুদিকে।
বিকট রূপ ধারণ করতে লাগল সে, অতিকায় দানবে পরিণত হতে লাগল একটু একটু করে।
হঠাৎ চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল জাদুকরের ছড়ি থেকে।
কনজারভেটরি ঝলসে উঠল নীলচে সাদা সেই তেজী আলোয়। চোখ ধাঁধিয়ে গেল কিশোরের। চোখ বুজে গেল আপনাআপনি।
আলোটা কিছুক্ষণ ভেসে রইল রুমের বাতাসে। হিশহিশ, মটমট শব্দ তুলল।
কিশোরের বর্ম ভেদ করে দেহে এসে লাগল তার উত্তাপ। মনে। হলো শরীরটা ঝলসে যাবে।
বোলিং করার ভঙ্গিতে মারাত্মক সেই বিজলিটাকে কিশোরের দিকে পাঠিয়ে দিল সালমি বেন কাজেম। ছুটে এল ওটা সোজা কিশোরের উদ্দেশে।
১৭
সময়মত লাফ দিল কিশোর। এক পাশে সরে নিজেকে বাঁচাল এ যাত্রা।
দ্বিতীয় বর্মটা কিশোরের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে এখন। হাল ছেড়ো না, কিশোর! ফিসফিস করে বলে উঠল বর্মধারী প্রেতাত্মা।
জিনা! চমকে বলল কিশোর। বিস্মিত। বর্মের ভেতরে তুমি!
হ্যাঁ, জবাব এল ভিতর থেকে।
ব্রেস্ট প্লেটের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে চেয়ে আছে ও কিশোরের দিকে।
তুমি সত্যিই চমকে দিয়েছিলে, বলল কিশোর।
এখন কী করব! বলল জিনা। লড়বে? নাকি পালাবে?
পালানোর উপায় নেই, ফিসফিস করে জবাব দিল কিশোর। আমাকে লড়তে হবে ওর বিরুদ্ধে–একা।
আপাদমস্তক কেঁপে উঠল জিনা।
ঠনঠন্ আওয়াজ তুলল কিশোরের বর্ম। ভারী এক পা সামনে বাড়িয়ে তলোয়ার উঁচাল ও আধা আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
সালমি বেন কাজেম গাছের মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
হিংস্র পশুর মত গর্জে উঠল সে বিজাতীয় শব্দে।
কিশোর সরাসরি তার চোখে চোখ রাখল, আক্রমণ করার জন্য জাদুকর তার দুবাহু দুদিকে বাড়াল।
রুপোর ছড়িটা ঘোরাতে লাগল শূন্যে। জোব্বাটা কেমন যেন খসখস শব্দ তুলল।
কিশোর লাফিয়ে পিছু হটল।
মাথা ঝাড়া দিল সে সজোরে। প্রলম্বিত চিৎকার ছাড়ল।
আচমকা জাদুকরের চামড়া চকচক করে উঠল। লম্বা হতে শুরু করল সে।
দুই হাত লম্বা হচ্ছে। আঙুলের নখগুলো হলদে, পৈশাচিক নখরে পরিণত হলো। পা জোড়াও হয়ে উঠল দানবীয় আকৃতির।
শুধু তা-ই নয়, ধড়টাও প্রকাণ্ড হয়ে উঠল। গোটা দেহটা কোনও মহীরূহের আকৃতি পেয়েছে।
অট্টহাসি হাসতে হাসতে শূন্যে উঠে পড়ল জাদুকর। দেখতে দেখতে কিশোরের মাথার উপরে উঠে গেল।
টলমল পায়ে পিছু হঠল গোয়েন্দা-প্রধান। চোয়াল ঝুলে পড়েছে মহাবিস্ময়ে।
জাদুকরের ঘাড় বকের মত লম্বা হতে লাগল। বাজপাখির ঠোঁটের মত লম্বা হয়ে গেল তার নাক।
সিলিং পর্যন্ত পৌঁছে গেল তার মাথা।
তলোয়ার শক্ত করে ধরল কিশোর।
সম্পূর্ণ তৈরি–কীসের জন্য, নিজেও তা জানে না।
চোখ সরু করে সালমি বেন কাজেমের গাঢ় রঙের আঁকাবাঁকা দেহটার দিকে তাকাল। অতিকায় দেহটা ওর মাথার উপর শূন্যে ভাসছে। যেন ওটা মানুষের নয় দানবাকৃতির একটা গ্যাস বেলুন!
হঠাৎ ওটা নীচে নেমে আসতে লাগল।
দুহাতে মাথা ঢেকে ফেলল কিশোর। হিহি শব্দ কানে এল। বাতাসে ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ উঠল।
ঢোক গিলে উপর দিকে তাকাল কিশোর।
একটা প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের মুখোমুখি হলো ও।
অতিকায় করালদর্শন ডাইনোসরবিশাল দুটো পিঙ্গল ডানাও আছে ওটার।
প্রকাণ্ড দেহটা আগাগোড়া পিঙ্গল আঁশে ঠাসা। আঁশ থেকে সমানে চটচটে নরম নোংরা আঠাল রস গড়িয়ে পড়ছে।
কী বিচ্ছিরি গন্ধ! দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
ডাইনোসরের তিনটে চোখ! সমানে পাক খেল ওগুলো।
দুটো লম্বা, কালো, চেরা জিভ ওটার মুখ থেকে বেরিয়ে এসে লকলক করছে। দুর্গন্ধময় সবুজ লালা ওটার মুখ থেকে ছিটকে পড়ছে। সেগুলোর একেক দলা ফ্লোরে পড়ামাত্র ছাৎ-ছাৎ শব্দ উঠল। নীলচে ধোঁয়া উঠছে সেখান থেকে।
এক পা সামনে এগোল কিশোর। দুহাতে হাতল আঁকড়ে ধরে তলোয়ার চালাল সর্বশক্তি দিয়ে।
ডাইনোসরটা ঝট করে দেহ সরিয়ে নিল। চেরা জিভ দুটো ভয়ঙ্কর ভাবে ওর দিকে এগিয়ে এল। সশব্দে লম্বা শ্বাস টানল ওটা।
পরক্ষণে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
পচা, অসহ্য দুর্গন্ধ বাতাস ধাক্কা মারল কিশোরের নাকে। গলা দিয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। বর্মের ভিতরে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য ওর ফুসফুস হাঁসফাস করতে লাগল।
কিন্তু কোথায় পাবে বিশুদ্ধ বাতাস?
কিশোর দেখল দানবটার প্রকাণ্ড দুই চোয়াল আবার আলগা হয়ে গেছে। লাফিয়ে পিছু হটল ও। ওটার মুখের দুর্গন্ধ অসহ্য লেগে উঠল। প্রাণীটার মুখ দিয়ে আগুনের লম্বা একটা শিখা বেরিয়ে আসতে দেখে আত্মা উড়ে গেল ওর। সেই শিখা ওর পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ল। মনে হলো পা পুড়ে গেল বুঝি।
মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল কিশোরের। পায়ে পায়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো ও।
ডাইনোসরটা আবার লম্বা দম নিল।
আরেক হলকা আগুনের মোকাবিলা করতে তৈরি হলো কিশোর।
জিনাকে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার হাতে ছুটে আসতে দেখল। ও। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য পারকার আঙ্কেল ওগুলোর বেশ কয়েকটা এনে রেখেছেন জাদুঘরে।
জিনা ওর গা থেকে বর্ম খসিয়ে ফেলেছে। এখন দ্রুত চলাফেরা করতে পারছে।
ডাইনোসরের দিকে এক্সটিংগুইশার তাক করল জিনা। লিভার টেনে ধরল।
প্রথমে ফট! করে একটা আওয়াজ হলো। তারপর হুশশ শব্দে ফেনিল সাদা তরল ছড়িয়ে ছুটল উপর মুখো হয়ে। তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ডাইনোসরের গলায় পড়ল ধারাটা। কিশোরের গায়েও ছিটে এসে লাগল।
জিনার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর।
মুখ তুলে ডাইনোসরটার দিকে তাকাতেই আঁকি খেল ও। ওটা আর ডাইনোসর নেই। সালমি বেন কাজেম হয়ে গেছে।
ফেনিল তরল তার দাড়ি বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পাগড়ি আর জোব্বাতেও সাদা ফেনা লেগে আছে।
লোকটার হলদে চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।
শয়তানের দল! আমার সাথে মশকরা! হুঙ্কার ছেড়ে হাতের লাঠিটা শূন্যে দোলাতে লাগল সে। সেই সঙ্গে বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্র আওড়াতে লাগল।
ছড়িটা মাথার উপর ছুঁড়ে মারল সে।
পাক খেতে খেতে উপরে উঠে গেল ওটা। আবার ফিরে এল। ওটা যখন খপ করে ধরে ফেলল কাজেম, তখন আর ওটা ছড়ি নেই, তীক্ষ্ণধার একটা তলোয়ার হয়ে গেছে।
ওটার গা থেকে আলো ঠিকরে বের হলো।
হামলা করবে বলে তলোয়ারটা বাগিয়ে ধরল জাদুকর।
কিশোর, সাবধান! চিৎকার করে ওকে সতর্ক করল জিনা।
দরকার ছিল না অবশ্য। বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তির বশে কিশোর আগেই তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেছে।
জাদুকর ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তলোয়ার চালাল সালমি বেন কাজেম। নিজের সোনালি তলোয়ার দিয়ে আঘাতটা ঠেকাল কিশোর। দুই তলোয়ারে সংঘর্ষ হলো বিকট শব্দে।
আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটল।
কিশোরের হাত কেঁপে উঠল। মনে হলো কাঁধ থেকে হাত ছিঁড়ে যাবে।
বেন কাজেম কিশোরকে লক্ষ্য করে আবার তলোয়ার চালাল।
লাফিয়ে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়াল কিশোর।
সালমিও সামান্য পিছিয়ে গেল।
ঘন ঘন দম নিচ্ছে সে। হাঁপিয়ে উঠেছে।
কিশোরের অবস্থা আরও খারাপ।
ক্রুদ্ধ চোখে পরস্পরকে দেখল দুজন। ঘেমে একাকার হয়েছে কিশোর। গাল বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম চোখে পড়তেই চোখ জ্বলে উঠল ওর। বর্মের মধ্যে ওর বুকটা ধুকপুক করছে। যতটা না ভয়ে, তার চেয়ে বেশি উত্তেজনায়।
শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টার ফাঁকে সালমি বেন কাজেমের উপর দৃষ্টি স্থির করল কিশোর। লোকটা এখন কী করে বসে বলা যায় না।
জাদুকর তার তলোয়ার ওঠাল।
কিশোর তার ঠোঁট কাঁপতে দেখল। তাকে গোঁ-গোঁ করতে শুনল। গো-গোঁ করে মন্ত্র পড়ছে এখন!
জাদুকর তার তলোয়ার কিশোরের দিকে তাক করল।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর আচমকা জাদুকরের তলোয়ারের চোখা প্রান্ত থেকে ছরছর করে পিঙ্গল স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে এল। কাঁচের সিলিঙে আঘাত করল। ভেঙে ওদের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের টুকরো।
স্ফুলিঙ্গটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকতেই হাত-পা অসাড় হয়ে এল কিশোরের। মাথা ঝিম ধরে গেল। ভারী হয়ে এল চোখের পাতা।
লক্ষণ খারাপ।
ওদিকে তাকিয়ো না, কিশোর, মনে মনে নিজেকে নির্দেশ দিল ও। খবরদার, ওদিকে তাকিয়ো না। চোখ সরিয়ে নাও।
কিন্তু কাজ হলো না। নিজের নির্দেশ নিজেই অমান্য করল।
জাদুকরের তলোয়ারের ফুলিঙ্গ রত্নের মত ঝকম করছে।
সম্মোহিতের মত একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিশোর। চোখ ফেরাতে পারছে না।
এখনও সময় আছে! মরিয়া হয়ে নিজেকে বলল ও মনে মনে। চোখ ফিরিয়ে নাও। নইলে শেষ হয়ে যাবে তুমি। জাদুকর তোমাকে…
ঘন ঘন চোখের পলক পড়তে লাগল কিশোরের। চোখের পাতা অসম্ভব ভারী ঠেকছে। বুজে আসতে লাগল দুচোখ। প্রায় বুজে এল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মাথা আরও ভারী ঠেকল। এত ভারী যে খাড়া রাখতে সমস্যা হলো।
দুচোখ বুজে এল ওর। চিবুক বুকে ঠেকে গেল। দুই হাঁটু বেজায় দুর্বল ঠেকছে। পা জোড়া টলে উঠল। পড়ে পড়ে অবস্থা।
না, কিশোর, না! জিনা চিৎকার করে উঠল। কিশোরের মনে হলো ওর গলা কয়েক মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে। চোখ খোলো, কিশোর! প্লিজ, চোখ খোলো!
জানে না কীভাবে, অবশেষে চোখ মেলে তাকাল কিশোর।
পিঙ্গল স্ফুলিঙ্গ ওর চারপাশে ঝরে পড়ছে। ওগুলো গায়ে পড়লে কী ঘটতে পারে, জানে না কিশোর। জানতে চায়ও না। এখন ওসব ভাবার সময় নেই।
শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তা-ই দিয়ে দুহাতে তলোয়ারটা আঁকড়ে ধরে তুলল কিশোর। কাধ সমান উঁচুতে তুলে তৈরি হলো। স্ফুলিঙ্গ ওর কাছে এলেই তলোয়ারের খোঁচায় দূরে সরিয়ে দিল।
কিছু কিছু স্ফুলিঙ্গ তলোয়ারে লেগে চড়চড় শব্দে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। আর কিছু কিছু তলোয়ারে বাড়ি খেয়ে উপরে উঠে গেল। তারপর আবার পড়তে লাগল।
এবং পড়তে লাগল সালমি বেন কাজেমের মাথায়।
না-আ!! আর্তনাদ করে উঠল জাদুকর।
চমকে উঠল কিশোর।
কিছু স্ফুলিঙ্গ তার পাগড়িতে পড়ল। অমনি হিশহিশ শব্দ উঠল। কিশোর দেখল স্ফুলিঙ্গ তার গায়ের যেখানে পড়ে, সেখান থেকেই নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়া পেঁচিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
অজস্র ফুলিঙ্গ জাদুকরের জোব্বা ঢেকে ফেলল দেখতে দেখতে। এবং সেই সঙ্গে নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়ার মেঘ জমল তাকে ঘিরে।
ধীরে ধীরে ঘন, গাঢ় হয়ে এল ধোঁয়া।
সালমি বেন ক্যাজম সরে যেতে চাইল। কিন্তু না-ছোড় ধোঁয়া তাকে কামড়ে ধরার মত ঘিরে থাকল চারপাশ থেকে। হাত-পা সমানে ছুঁড়েও সে ধোঁয়া সরাতে পারল না।
ঘন, ঢেউ খেলানো ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে হাত-পা ছুঁড়ছে জাদুকর। ধোঁয়ার হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাচ্ছে না।
না-আ-আ!বোঝা যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার করে হাত-পা ছুঁড়ছে পাগলের মত।
লাভ হচ্ছে না।
জিনা নিঃশব্দে কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওরা দেখল, নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলল জাদুকরকে। ক্রমশ ঘন হচ্ছে ধোঁয়ার প্রাচীর।
-না-না-আ! সমানে চেঁচিয়ে চলেছে সালমি বেন কাজেম। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। চেহারা বিকৃত। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। মুখে ঢুকছে ধোঁয়া।
একটু পর আবছা হয়ে এল জাদুকরের কাঠামো।
তার জোব্বার জাদুকরী মেডেলগুলো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তার সাদা দাড়িও ঢেকে গেল নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়ায়।
দুচোখ ঢেকে গেল।
এখন তার হাত-পা ছোঁড়া আর দেখতে পাচ্ছে না কিশোর জিনা।
পাগড়ির উপরের অংশটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে।
না! না! না! ধোঁয়ার মেঘের ভিতর থেকে তার দুর্বল কণ্ঠের। আর্তনাদ ভেসে আসছে।
এ হতে পারে না। কিছুতেই না। আমার এই পরিণতি কিছুতেই হতে পারে না। শয়তান বিচ্ছুর দল! আমি সালমি বেন কাজেম, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর। আহ্-না-আ-আ! আমি তোমাদের ছাড়ব না। আমি…
জাদুকরের কণ্ঠস্বর আরও দুর্বল হয়ে এল।
এক সময় আর কথা শোনাই গেল না। ধোঁয়ার মেঘ সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিচ্ছিরি একটা গন্ধ এসে ঝাঁপটা মারল দুই কিশোর-কিশোরীর নাকে। দম বন্ধ হয়ে এল। জিনা কেশে উঠল।
চারদিকে অসহ্য নীরবতা নেমে এসেছে হঠাৎ করেই।
কিশোর আর জিনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
কান খাড়া। পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় আছে।
কোত্থেকে কে জানে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শীতল করে তুলল পরিবেশ। ধোঁয়ার ঘন মেঘ দ্রুত কেটে গেল।
ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেছে সালমি বেন কাজেম।
নাকি নিজেই উধাও হয়ে গেছে জাদুর বলে?
না, আসলে তা হয়নি।
জাদুকর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে কিছু একটা দেখল কিশোর। সামনে এগিয়ে গেল ওরা।
একটা কুৎসিত, পিঙ্গল শামুক দেখে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল। জিনা।
ওটা আমাদের আর ক্ষতি করতে পারবে না, বলতে বলতে শামুকটার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। ফোলা ফোলা লাল দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে শামুকটার শুড়ের শেষ মাথায়। পুরু হয়ে শ্যাওলা জমে আছে ওটার খোলে।
জিনা দুপা এগোল।
ওর উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কিশোর। হাতের তলোয়ার দিয়ে শামুকটার গায়ে খোঁচা মারল ও। শামুকটার। শুড় কিছুক্ষণ শূন্যে এদিক-ওদিক করল। চোখ দুটো মনে হলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বীভৎস মাথাটা ঝকাল ওটা। তারপর টলতে টলতে পিছলে সরে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে স্থির হলো।
চিরতরে।
মেঝেতে অবশিষ্ট রইল কেবল সালমি বেন কাশেমের পোশাকের রঙের মত পিঙ্গল তরলের পিচ্ছিল একটা দলা।
১৮
কিশোর, তুমি… ঠিক আছ… বিড়বিড় করে বলল জিনা। ওর ফ্যাকাসে মুখে হাসি ফুটল। সত্যি তুমি সাঙ্ঘাতিক!
কিশোর হাসল। হেলমেট খুলে ফেলল। ওটার ওজন আর সহ্য করতে পারছে না।
সাঙ্ঘাতিক? মাথার উপর, তলোয়ার ঘোরাল কিশোর। তবে তোমার মত অতটা সাঙ্ঘাতিক নই, জিনা। ওই বর্মটা পরার আইডিয়া কী করে এল তোমার মাথায়?
আসলে তোমার সঙ্গে মজা করার জন্যে ওটার মধ্যে ঢুকেছিলাম, লাজুক মুখে স্বীকার করল জিনা। কিন্তু যখন হ্যাগার্ডের… মানে সালমি বেন কাজেমের কথা কানে এল, তখন নিজেই চমকে উঠলাম। জানতাম বাবা জরুরি একটা কাজে বাইরে গেছেন। মাকে ডাকব ভাবলাম, তারপর মনে হলো তাঁর সাহায্যের আশায় বসে না থেকে ভেতরে ঢুকে পড়া দরকার। ওইলোক তোমাকে বেড়াল বানিয়ে ফেলার মন্ত্র পড়া শুরু করতেই ঘাবড়ে গেলাম আমি। বাধ্য হয়ে ঠিক করলাম জাদুকরের মন্ত্র পড়া থামানোর ঝুঁকিটা নেব।
তোমার এত বুদ্ধি সত্যিই আমার জানা ছিল না, এর বেশি কিছু বলা সম্ভব হলো না কিশোরের পক্ষে। বলার মত অবস্থাও নেই।
হাই তুলে তলোয়ারটা একদিকে ছুঁড়ে মারল ও। এরপর একে একে খুলে ফেলল বর্মের বাকি অংশ। মেঝেতে ওগুলোর স্তূপ জমে গেল।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। এমন ওজনদার বর্ম পরে আগের দিনের সৈন্যরা যে কীভাবে লড়াই করত, ভেবে পাই না।
নেজার ম্যাণ্ডারের বর্মের স্তূপের পাশে বসে পড়ল ও।
বর্মটাকে আবার দাঁড় করাতে খুব একটা কষ্ট হবে না পারকার আঙ্কেলের। এবার আর কোনও ভূত-টুতের ভয় নেই। ফেলে দেয়া তলোয়ারটা তুলে নিয়ে ওটা দিয়ে নেজারের একটা জুতোয় খোঁচা মারল ও। দূরে সরে গেল জিনিসটা। এবার একটা গ্লাভ ঠেলে সরাল একপাশে। তারপর তলোয়ার ফেলে দিল।
ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে আমার, হাই তুলে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে এখানেই… এত কিছু ঘটে গেল বিশ্বাসই…
ওর পাশেই কিছু একটা নড়ে উঠতে থেমে গেল। জিনার অস্পষ্ট গোঙানি কানে এল। কিন্তু ওর দিকে তাকানোর সময় পেল না কিশোর।
নেজার ম্যাণ্ডারের একটা গ্লাভের উপর নজর স্থির।
আপনাআপনি গ্লাভটা বর্মের স্তূপ থেকে উঠে এসে তলোয়ারের হাতলের উপর বসল। একে একে সব কটা আঙুল বেঁকে গেল, এঁটে বসল হাতলে।
সোনালি তলোয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরল গ্লাভের ধাতব আঙুল।
ও, ক্রাইস্ট! আঁৎকে উঠল জিনা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। এটা কী?
তলোয়ারটা শূন্যে উঠে পড়ল। ভাসতে লাগল বাতাসে।
গভীর একটা গোঙানি শুনতে পেল কিশোর। ভয়ে ওর ঘাড়ের খাটো খাটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল।
গোঙানির আওয়াজটা নিচু হতে লাগল। মনে হচ্ছে কয়েক মাইল। দূর থেকে আসছে। অবশ্য পরমুহূর্তে আবার চড়া হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ খুব কাছ থেকে গোঙাচ্ছে।
একটু পর মনে হলো চারদিক থেকেই আসছে আওয়াজটা।
আতঙ্কভরা চোখে বর্মের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্তূপটার দিকে তাকাল কিশোর। তলোয়ারটার ডগা ঘুরে গেল বর্মের বিচ্ছিন্ন পা দুটোর দিকে। পরমুহূর্তে হুশহুশ শব্দ কানে এল। পা দুটো উঠে পড়ল। শূন্যে। তলোয়ারটার দিকে ছুটে এল। তারপর গতি পরিবর্তন করে যেখানে থাকার কথা, সেখানে এসে স্থির হয়ে গেল।
এরপর তলোয়ারটা ঘুরে গেল বুট জোড়ার দিকে।
কিশোর! ওর বাহু আঁকড়ে ধরল, জিনা। কিশোর, কিছু একটা করো, প্লিজ! জলদি কিছু একটা করো! ও ফিরে আসছে আবার!
সত্যিই তা-ই! বর্মের ভূত তা হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। জ্যান্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার। নইলে…
আর ভাবার সময় নেই। নেজার ম্যাণ্ডারের বুটজোড়ার দিকে ছুটল কিশোর। কিন্তু জিনিস দুটো ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক শক খেল ও, ঝট করে দুহাত সরিয়ে নিল।
ঠাণ্ডায় দুহাত জমে যাওয়ার জোগাড়। ওগুলো কীভাবে এত ঠাণ্ডা হলো কে জানে!
দুহাত গরম করার জন্য জোরে জোরে ঘষল ও।
বিস্ফারিত চোখে কিশোর দেখল খটমট শব্দ তুলে বুটজোড়া দূরে সরে যাচ্ছে। টাইলের ফ্লোরে আওয়াজটা স্বাভাবিকের চেয়েও চড়া শোনাচ্ছে।
নেজারের লেগ-গার্ড দুটো যেখানে ছিল, সেখানে চলে গেল। বুটজোড়া।
এদিকে গোঙানির আওয়াজ আরও চড়া হয়েছে। কানে তালা। লাগার জোগাড় হলো কিশোর-জিনার।
নেজারের ব্রেস্ট-প্লেটটা শূন্যে উঠে পড়ল। এবং বর্মটার ঠিক মাঝখানে বসে গেল সুন্দরভাবে।
এরপর হাত জোড়া উঠে এল স্তূপ থেকে। নিজের নিজের অবস্থানের দিকে ছুটে চলল। ব্রেস্ট-প্লেট যেখানে কাঁধের সাথে। মিলেছে, সেখান থেকে ঝুলে পড়ল ওদুটো।
যে বাহুতে কোনও হাত নেই, অন্য গ্লাভটা ছুটে গিয়ে সেটার সঙ্গে এঁটে বসল।
কিশোর মনে হলো পাথর হয়ে গেছে। অথবা পাথরের চেয়েও অনড়। টের পেল কপালের শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে ওর। বুকের ভিতর ভয়ঙ্কর ভাবে ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। যে-কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে ওটা।
জিনা ও কিশোর একযোগে নেজার ম্যাণ্ডারের দিকে তাকাল।
পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে সে, দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে।
শুধু… তার মাথাটা নেই।
ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শব্দ উঠল হঠাৎ। আতঙ্কে কিশোর-জিনার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল।
শো-শোঁ আওয়াজটা তুলছে গ্লাভ পরা হাতে ধরা সোনালি তলোয়ারটা। ওটা এবার একটু একটু করে ঘুরছে বর্মের হেলমেটের দিকে।
বাধ্য ছেলের মত হেলমেটটা শূন্যে উঠে বাতাসে ভাসতে লাগল। তারপর বর্মের দিকে এগোতে শুরু করল।
কিশোরদের পেরিয়ে গেল। পরক্ষণে চারপাশে শীতল বাতাস বইতে শুরু করল।
বর্মের উপর গিয়ে স্থির হলো হেলমেটটা। খটমট শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বসে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়।
দুসেকেন্ড পেরিয়ে গেল।
তারপর…
তারপর ফেসপ্লেটের ভিতরের আগুনটা আচমকা দপ করে জ্বলে উঠল কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়।
জ্বলে উঠল নেজার ম্যাণ্ডারের চোখজোড়া।
লাল।
রক্ত লাল।
নিঃশব্দে তলোয়ার তুলল বর্ম-প্রেতাত্মা।
ওটার চোখা প্রান্ত ঠেকাল কিশোরের বুকে।
১৯
এবার কিশোরকে কুচিকুচি করবে প্রেতাত্মা। কোনও সন্দেহ নেই।
শুধু কিশোরকে নয়, জিনাকেও।
সৈনিকের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকল কিশোর।
সামান্য আগে বাড়ল সে। কিশোর টের পেল তলোয়ারের তীক্ষ্ণ ডগা ওর শার্ট ফুটো করে ত্বকে ঠেকেছে।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে ও। মূর্তির মত ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জিনা।
জীবনের শেষ মুহূর্ত কটা গুনছে কিশোর। তলোয়ারে ওর বুক এফেঁড়-ওফোড় হবার অপেক্ষায় আছে।
নেজার তার ভারী মাথাটা ঘোরাল। শামুকের পিঙ্গল তরলের দলাটার দিকে তাকাল। আবার চোখ ফেরাল কিশোরের দিকে।
কে মেরেছে সালমিকে? প্রশ্নটা নেজারের বর্মের ভিতরে কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো।
কিশোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
জিনা ওকে ঠেলে সামনে এগিয়ে দিল।
কিশোর! বলল ও কিশোরের দিকে আঙুল তাক করে। এ মেরেছে সালমি বিন কাজেমকে। জাদুকরের জাদু তারই বিরুদ্ধে লাগিয়ে তাকে খুন করেছে ও।
সৈনিকের প্রেতাত্মা নড়ল না।
আতঙ্কভরা চোখে কিশোর-জিনা দেখল তার গনগনে চোখজোড়া ভাটার মত জ্বলজ্বল করছে।
সত্যি? প্রশ্ন করল সে।
হ্যাঁ, নিজেকে ফিরে পেয়ে বলল কিশোর। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার। প্রথমে ওই জাদুকর আমাকে একটা বেড়াল বানিয়ে ফেলতে চেয়েছিল, পরে সে স্ফুলিঙ্গ দিয়ে আমাকে খুন করার চেষ্টা করে। ওই স্ফুলিঙ্গ তার দিকে ফেরত পাঠাই আমি ওই সোনালি তলোয়ার দিয়ে।
কথা শেষ করে ইশারায় তলোয়ারটা দেখাল কিশোর। হাত দুটো মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে চাইছে না, থরথর করে কাঁপছে। আবার বলতে শুরু করল ও কাঁপা গলায়, স্ফুলিঙ্গ যখন জাদুকরকে আঘাত করে; তখন পিঙ্গল ধোঁয়ার মেঘে ঢাকা পড়ে যায় সে। তারপর… তারপর শামুক হয়ে যায়। বড়সড় পিঙ্গল একটা শামুক।
শামুক! শামুক হয়ে গেছে ব্যাটা! নেজার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দারুণ সাজা হয়েছে বদমাশটার! একদম উচিত সাজা হয়েছে।
জিনা আর কিশোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শুনছে নেজারের প্রেতাত্মার স্বগতোক্তি।
হাসছে নেজার। হেসেই চলেছে।
তার মুখাবরণের ভিতরের আগুন এখন আর আগের মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না। হঠাৎ কিশোরের মনে হলো নেজার আসলে ভয়ঙ্কর নয়। মোটেই তেমন লাগছে না এখন তাকে।
এক হাঁটুতে ভর করে বসে পড়ল নেজার। মাথা নোয়াল কুর্নিশের ভঙ্গিতে।
তোমাকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কিশোর পাশা!। নিজের অজান্তে বিস্মিত চোখে ঝলমলে হেলমেটটার দিকে তাকাল কিশোর।
জিনা প্রায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, শুনেছি আপনি ইতিহাসের জঘন্য এক চরিত্র। আপনাকে আমি ঘৃণা করি।
এখনও লোকটা তার তলোয়ার, ধরে আছে। তবে ওটার ডগা। মেঝেতে ঠেকে আছে। করো… যত খুশি ঘৃণা করো। তারপরেও কিশোরের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
কোনও চালাকি করছেন না তো? বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে বলল জিনা।
এ না-সূচক মাথা নাড়াল সে। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, আমাকে মাফ করে দিয়ো, কিশোর। প্রথমে তোমার গলায় লকেট দেখে আমি তোমাকেই সালমি বেন কাজেম মনে করেছিলাম। ভেবেছি ওই শয়তান জাদুকর আমাকে ধোকা দেয়ার জন্যে বাচ্চা ছেলের রূপ ধরেছে। এখন বুঝতে পারছি আমার ধারণা ভুল ছিল, ওই জাদুকরের সঙ্গে তোমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। তুমি নির্দোষ। ইতিহাসের কথা বলছ? ইতিহাস বদলে দেয়ার ক্ষমতা। আমার নেই। থাকলে তা-ই দিতাম।
কনজারভেটরির চারদিকে চোখ বোলাল সে।
তোমরা কেউই আমার দুশমন নও। ওই জাদুকর ছাড়া। এখানকার সবাই আমার বন্ধু। এখনও তা-ই আছ।
আমি? নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকাল জিনা। কিন্তু আমি আপনার বন্ধু হতে চাই না। চ হ্যাঁ, তুমি আমার বন্ধু।
নেজার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। মিস্টার পারকার বর্মটায় রোজ তেল দেয়া সত্ত্বেও জয়েন্টগুলোর জং এখনও পুরোপুরি যায়নি।
ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠল। টলে উঠল নেজার। কিশোর তার দিকে এক হাত বাড়াল। কেন যেন মানুষটার জন্য সহানুভূতি হচ্ছে ওর।
আশ্চর্য!
এবার তার হাতটা আর শীতল লাগল না। কেন কে জানে!
সালমি নিশ্চয়ই উদ্ভট কোনও গল্প শুনিয়ে তোমাদের বিভ্রান্ত করেছে? আমি জানি কী হতে পারে সেই গল্প। বলে উঠে দাঁড়াল সে। সে তোমাদের বলেছে আমি পাজি, তা-ই না?
উপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল জিনা।
সালমি একটা ঘূণ্য পশু, নেজার সোজা কিশোরের দিকে চেয়ে আছে। আমি কখনও পাজি ছিলাম না। পাজি ছিল সালমি। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। ব্রিটেনের রাজার আমল। আমি কাজেমের মেয়েকে ভালবাসতাম। কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি সে। কিছুতেই রাজি হলো না আমাদের বিয়েতে। তার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে আমার চেয়ে অনেক ধনী, ক্ষমতাধর কারও সঙ্গে বিয়ে দেবে। একদিন তার সঙ্গে তর্কাতর্কি বেধে যায় আমার। এক পর্যায়ে আমি যখন তাকে বলি যে-কোন মূল্যে, আমি তার মেয়েকেই বিয়ে করব, তখন সে ভয়ানক খেপে যায় আমার ওপর। তার সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয় আমার। সুবিধে করতে না পেরে কী সব মন্ত্র পড়ে সে, এই বর্মের মধ্যে আমাকে বন্দি করে। তোমরা জানো না, কেউ জানে না, সেই আমলে ওর মত পাজি জাদুকর দুটো ছিল না। দুনিয়ায়। এখনও বেঁচে আছে ও, বুঝতেই পারছ তার জাদুর গুণ কত ভয়ঙ্কর। সাধারণ মানুষ জানত না তার কথা, গোপনে জাদুচর্চা করত সে। জাদুর বলে বেঁচে ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। তার এই অস্বাভাবিক আয়ুর কথা লোকে যাতে জানতে না পারে, সেজন্য সত্তর-আশি বছর পরপর জায়গা বদলাত সে। যা হোক, সালমি আমাকে বর্মে বন্দি করার সময় জানায় আমি কেবল সেদিনই মুক্তি পেতে পারি, যেদিন আমি তাকে হারাতে পারব। কিন্তু হারাব কী করে? সে আমাকে বন্দি করে রাখে আমারই বাড়ির তলকুঠুরিতে। আমার বাড়ি তখন এই আমেরিকায়, মন্টানায়। এই বর্মের ভেতরে থেকে খিদে-তেষ্টায় মারা গেলাম আমি একদিন। তারপর ভূত হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বন্দিদশা ঘুচল না। আমার বন্দিত্ব ঘোচাবার একমাত্র উপায় আমার এই সোনালি তলোয়ার।
থেমে কয়েক মুহূর্ত ফ্লোরের দিকে চেয়ে রইল নেজার। চোখে ঘৃণা।
সালমি আমার তলোয়ার তার মার্বেলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে, ফের বলতে শুরু করল নেজার। লকেটটা আমার সঙ্গেই রেখে দেয়। কিন্তু ওটা ব্যবহার করার কোনও ক্ষমতা ছিল না আমার। আমি কিছুতেই লকেটের ভেতর থেকে আমার তলোয়ার বের করতে পারিনি। ওই তলোয়ার ছাড়া দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেলাম আমি। টের পেয়ে গেলাম, পারব না আর কোনওদিন জাদুকরকে হারাতে। আজ সেই অসাধ্য কাজ করলে তোমরা, কিশোর-জিনা, বলে থামল নেজার, জিনার দিকে তাকাল। কিছু মনে কোরো না তোমরা।
নেজার ম্যাণ্ডার হাসছে।
মুক্তির আনন্দে হাসছে।
তার হাসি জিনার সব ভয় দূর করে দিল। সহজ হয়ে উঠল ও।
কিশোরও সহজ হয়ে এল।
তোমাদের দুঃসাহসিকতার কারণেই অবশেষে আমি বর্মের কারাগার থেকে মুক্তি পেলাম। বর্মের এই কবর থেকে বেরোতে পারলাম। কিন্তু তার আগে…।
নেজার তার তলোয়ার কিশোরের দিকে ঘোরাল। হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল। কাছে এসো, কিশোর।
কিশোর! ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল জিনা। যেয়ো না। কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। বলা যায় না, নতুন কোনও দুর্ঘটনা… সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে ও বর্মটার দিকে।
কিন্তু কিশোরের মনে কোনও সন্দেহ নেই। আসল-নকল চিনতে ওর ভুল হয়নি আজ পর্যন্ত।
কিছু করবে না, ফিসফিস করে জিনার কানের কাছে বলল। কিশোর। ও প্রেতাত্মার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। কাজেই নির্দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে বর্মটার সামনে দাঁড়াল।
নেজার তার তলোয়ার ওঠাল। তারপর ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল। প্রথমে কিশোরের ডান কাঁধে ছোঁয়াল, তারপর বাঁ কাঁধে।
আমি নেজার ম্যাণ্ডার কিশোরকে তার সৎসাহস ও দুর্দান্ত মনোবলের। জন্য একটি বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করছি। আজ থেকে কিশোর… থেমে গেল সে। তারপর আবার বলল, আজ থেকে কিশোরের অন্য নাম–ভিক্টর।
ভিক্টর! ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
অর্থ জানো তো? প্রশ্ন করল নেজার।
হ্যাঁ। শত্রু দমনকারী।
ঠিক। তুমি পৃথিবীর জঘন্যতম এক শত্রুকে দমন করেছ। ভিক্টর নামটা তাই তোমার প্রাপ্য। ধন্যবাদ, কিশোর–ভিক্টর।
নেজার সামান্য পিছাল। দুহাতে তলোয়ারটা সামনে ধরে রেখেছে। জিনার দিকে চাইল সে। বলল, বন্ধুরা, চিরকাল তোমাদের কথা মনে থাকবে। আসি, কেমন?
হঠাৎ কোত্থেকে হালকা নীল ধোঁয়া এসে ঘিরে ধরল নেজারকে। এ ধোঁয়া সালমি বেন কাজেমকে ঘিরে ধরা ধোঁয়ার মত উৎকট নয়। এ ধোঁয়া কোমল। ধোঁয়ার মেঘটা নেজারকে ঢেকে ফেলল গরম কম্বলের মত। কিশোর নেজারকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুনল।
পাঁচ সেকেণ্ড পর ধোঁয়ার মেঘ কেটে গেল। সেই সঙ্গে নেই হয়ে। গেল নেজার ম্যাণ্ডার।
২০
এই হলো ঘটনা, পরদিন সকালে মিস্টার পারকারকে বলল কিশোর। বুঝতেই পারছেন ওই বর্ম আর কনজারভেটরি আমি ইচ্ছে। করে লণ্ডভণ্ড করিনি…
আর কৈফিয়ত দিতে হবে না তোমাকে, বললেন মিস্টার পারকার। আমি বুঝতে পারছি সব। সত্যিই দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছ তুমি।
মিস্টার পারকার এক হাত রাখলেন কিশোরের কাঁধে।
কিশোরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জিনা। মিস্টার পারকার ওর কাঁধে অন্য হাত রাখলেন। আমার মেয়েটাও কম সাহসী নয়, কী বলো, কিশোর?
মাথা দুলিয়ে সায় দিল কিশোর। আমার চেয়ে বেশি।
শয়তান এক জাদুকর কীভাবে আমাদের সবার চোখে ধুলো দিয়েছে! বললেন মিস্টার পারকার। দাঁড়াও, সিনিয়রকে হাতের কাছে পেয়ে নিই একবার। এমন বকা দেব। ও যদি বর্মটা না পাঠাত…
মিস্টার পারকার আছেন? দরজায় নক করে ডাক দিল কেউ।
মিস্টার পারকার, আমরা জি.আর.এম. ট্রাভেলস থেকে এসেছি।
কণ্ঠটা বেশ উত্তেজিত শোনাল।
ব্যাপার কী?
চকিতে মিস্টার পারকারের দিকে তাকাল জিনা। নার্ভাস দৃষ্টি।
মিস্টার পারকার মেয়ের দিকে তাকাল।
জিনা তাকাল কিশোরের দিকে।
পরক্ষণে দৌড় দিল দুজন পোর্কের উদ্দেশে।
কী ওটা? কফিনের মত প্রকাণ্ড একটা বাক্সের দিকে চেয়ে বলল কিশোর। আগন্তুক আর তার সহকারীরা ওটাকে ভ্যান থেকে নামিয়ে আনছে।
বাক্সটার সারা গায়ে অজস্র লাল স্ট্যাম্প। সব কটাতেই ছোট বড় করে লেখা-ভঙ্গুর।
ভ্যানের লোকেরা ধরাধরি করে বাক্সটা পোর্চে নিয়ে এল।
কোত্থেকে এল ওটা? দ্বিধার সাথে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জানি না, মিস্টার পারকার জবাব দিলেন। ভ্যানের লোকদের ধন্যবাদ জানালেন।
ভ্যানটা চলে যাওয়ার পর মিস্টার পারকার তাঁর ক্রোবার নিয়ে এলেন ভিতর থেকে।
বাক্সের পেরেকগুলো খুলে ডালা তুলে ফেললেন।
গোটা বাক্স টুকরো টুকরো প্যাকিং কাগজে ভরা।
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। জিনা নার্ভাস কণ্ঠে বলল, এটার চেহারা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভেতরে হাত ঢোকালে না আবার আঁকড়ে ধরে!
আমারও খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না, মিস্টার পারকার বললেন। যাই হোক, দেখি কী আছে ভেতরে। বলতে বলতে দুহাত ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন।
পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
ভাবছে।
কী দেখতে হবে মিস্টার পারকার হাত বের করার পর?
কোনও হেলমেট, যার ভিতরে ধকধক করে জ্বলছে দুটো ভৌতিক চোখ? নাকি জাদুর কোন লকেট, যার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে নীল ধোঁয়া?
নাকি বড়সড় পিঙ্গল কোনও শামুক?
ভেবে পাচ্ছে না কিশোর।
সেকেণ্ড চারেক পর মিস্টার পারকার তার দুহাত বের করলেন। এক হাতে লম্বা, সাদা একটা খাম।
এটা আবার কী? কপাল কুঁচকে ওটা দেখলেন মিস্টার পারকার। খুলব? তোমরা কী বলো?
বললেন ঠিকই, তবে কিশোর বা জিনার জবাবের অপেক্ষা না করে ছিঁড়ে ফেললেন ওটার মুখ। ভিতর থেকে বের করে আনলেন একটা চিঠি। ভাজ খুললেন। মনে হচ্ছে আমাদের সিনিয়রের পাঠানো চিরকুট।
তা-ই নাকি? জিনা আগে বাড়ল। ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, কী লেখা আছে ওতে?
মিস্টার পারকার গলা খাকারি দিয়ে পড়তে শুরু করল:
প্রিয় হ্যারিসন,
জিনিসটা পাঠালাম। ফোন দিতে পারতাম, কিন্তু চিঠির দামই অন্যরকম, তাই চিঠিই দিলাম। জিনিসটা পাঠাতে দেরি হয়ে গেল। এই বর্ম নিয়ে আজগুবি সব গল্প চালু রয়েছে। আমি জানি না সেসব সত্যি কি না। তবে যার কাছ থেকে বর্মটা কিনেছি, সে বলেছে ওটা নাকি আসলেই ভুতুড়ে। তবে এমন ভুতুড়ে কিন্তু নয়, যাতে তোমাদের বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা কোনও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। মোট কথা, বর্মটা হয়তো ভুতুড়ে, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। তোমাদের তো এমন একটা বৰ্মই দরকার, তা-ই না? কাজের চাপ কমলেই দেখতে আসব ভুতুড়ে জাদুঘর।
কিশোর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
মিস্টার পারকার এবং জিনাও।
কিশোর বলল, ব্যাপার কিছু বুঝলেন, পারকার আঙ্কেল?
হ্যাঁ। সালমি ভালই খেল দেখিয়ে গেল। এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে নেজার ম্যাণ্ডারের বর্ম আমার ভাই পাঠায়নি। ওর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে সে নিজেই… কতবড় দুঃসাহস!
কিন্তু কেন? জিনা প্রশ্ন করল। কেন সে এ কাজ করতে গেল?
কেন আবার। নিরিবিলিতে জানের দুশমনকে খতম করার। জন্যে। আমার জাদুঘরটাকেই বেছে নিয়েছিল সে কাজটা সারবে বলে।
চিঠিটা শেষ করো, জিনা বলল।
চিঠির শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্যে লেখা রয়েছে:
জিনা-কিশোর, কফিনের ভেতর তোমাদের জন্যে বিশেষ জিনিস আছে।
জিনার চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল। নির্ঘাত কোনও লকেট হবে! বলল কাঁপা গলায়।
তিনজোড়া হাত একযোগে ঢুকে গেল কফিনের ভিতর। সবাই ভাল করেই জানে, আর যা-ই হোক, কোনও লকেট অন্তত নেই ভিতরে।
দুহাতে কাগজ সরাতে লাগল সবাই।
একটা প্যাকেট ঠেকল কিশোরের হাতে। নরম।
বের করে আনল। ফিরোজা রঙের কাগজে মোড়ানো ওটা।
কিশোর-জিনার হৃৎপিণ্ড উত্তেজনায় লাফাতে শুরু করেছে।
কাগজটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলল কিশোর। সাদা কিছু একটা আছে প্যাকেটের ভিতর।
দুটো টি-শার্ট।
ওগুলো একে একে খুলে ফেলল কিশোর। ওগুলোর বুকে-পিঠে লেখা:
ভূত বিশেষজ্ঞ!