পাহাড়ে আতঙ্ক

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৫/২ – পাহাড়ে আতঙ্ক – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

মনে হচ্ছে জীবনেও পৌঁছতে পারব না, কিশোর, রবিন আর ডানার কাছে অভিযোগ করল মুসা।

বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর।

এরচেয়ে মরা পোকা-মাকড় খাওয়াও ভাল, বলল ও।

শশশ! সাবধান করল মুসা। মিসেস হকিন্স শুনে ফেলবেন। ওদের টিচার মিসেস হকিন্স বাসের সামনের দিকে বসা। আজ তার, পরনে নীল জিন্স আর হাইকিং বুট। তবে গলায় সবুজ লকেটটা ঠিকই ঝুলছে। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ের ধারণা তাদের টিচার ভ্যাম্পায়ার এবং তার লকেটটার বিশেষ ক্ষমতা আছে।

ডানা চোখের উপর থেকে সোনালী চুল সরিয়ে বাসের চারধারে নজর বুলাল। রুবি মাউন্টেনে নেচার হাইকে যাচ্ছে ফোর্থ গ্রেডাররা। বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই।

রুবি মাউন্টেনে দারুণ মজা হবে, কিশোরকে বলল ডানা।

মিসেস হকিন্স বলেছেন আজকে আমরা প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগ পাব।

কিন্তু ওখানে আছেটা কী? বলল কিশোর। পচা-পচা কিছু গাছ আর ঝাঁকে ঝাকে মশা।

পাহাড়ের পাদদেশে এক মাটির রাস্তায় ঝাঁকনি খেতে খেতে চলেছে বাসটা। শেষমেশ ব্রেক কষে দাঁড়াল। মিসেস হকিন্স ধীরে। সুস্থে ওদের দিকে ঘুরে চাইলে ছেলে-মেয়েদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। মিসেস হকিন্স কখনও গলা চড়ান না, কাজেই সবাইকে মনোযোগী। হতে হলো। বিজাতীয় সুরে কথা শুরু করলেন তিনি।

রুবি মাউন্টেনে গাছ-পালা, জীব-জন্তু অবাধে বাড়ছে, বললেন টিচার। এটা সবার জন্যে শান্তির জায়গা, আর আমাদের সায়েন্স ফিল্ড ট্রিপের জন্যে আদর্শ।

কিশোর গুঙিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। রবিন ওর পাজরে আলতো। কনুই মারল। মিসেস হকিন্সের চোখজোড়া ওদের উদ্দেশে ঝলসে গেল, তবে তিনি কথা থামালেন না।

আমাদের সবার ট্র্যাকে থাকাটা জরুরী। এই পাহাড়ে অনেক বুনো জন্তুর বাস। আমরা ওদেরকে বিরক্ত না করলে ওরাও আমাদেরকে কিছু বলবে না।

এবার তিনি ধীরে ধীরে বাসের সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন। ছেলে-মেয়েরা স্কুলের ব্যাকপ্যাক তুলে নিয়ে তার পিছনে সারি বাধল। তিন বন্ধু আর ডানা অপেক্ষা করছে বাসের পিছন দিকে।

কপাল ভাল হলে ভালুক কিংবা হরিণ দেখা যেতে পারে, বলল নথি।

ডানা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। ঘন বনভূমিতে লোমশ দেহ খুঁজছে ওর চোখ।

ট্রেইলে খাবার ফেলো না যেন, সাবধান করল কিশোর।

ভালুকদেরকে ভয় নেই, আশ্বস্ত করল মুসা। উঁচু-উঁচু পাইন গাছের দিকে দৃষ্টি ওর। রুবি মাউন্টেন আমার বাসার ব্যাকইয়ার্ডের মতই নিরাপদ।

এহ, বিশ্রী গন্ধটা কীসের? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

ডানা নাক টিপে ধরল।

বাসটা মনে হয় কোন স্কাঙ্ককে চাপা দিয়েছে।

হয় তাই, বলে নাক ঢাকল মুসা, আর নয়তো ওরা রুবি মাউন্টেনকে জঞ্জালের স্তূপ বানিয়ে ফেলেছে।

জায়গাটা আমার প্রথম থেকেই পছন্দ নয়, বলল কিশোর।

এসো, বাতলে দিল রবিন। বাস থেকে নেমে পড়ি। তাজা বাতাসে ভাল লাগবে। অন্যান্যদের পিছু পিছু বাস থেকে নেমে পড়ল। তিন গোয়েন্দা আর ডানা। কিন্তু বাইরে বেরনোর পর গন্ধটা কমল তো না-ই বরং বাড়ল।

মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়ব, বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল ডানা। কী জঘন্য গন্ধ!

তুমি মনে হয় সকালে গোসল করনি, ঠাট্টা করে বলল কিশোর।

ডানা জবাব দিতে যাবে, কিন্তু মিসেস হকিন্সকে ওদের দিকে চাইতে দেখে থেমে গেল।

প্রকৃতি বড়ই আজব, বললেন তিনি। গন্ধও অনেক সময় অদ্ভুত লাগে। কিন্তু যেসব জন্তু-জানোয়ার এখানে বাস করে তাদের কাছে এ গন্ধটা স্বাভাবিক।

ঠিক, অচেনা এক কণ্ঠ বলল। ছেলে-মেয়েরা ঘুরে দাঁড়াল। সবুজ প্যান্টে গোজা সবুজ শার্ট, হাইকিং বুট আর চওড়া ব্রিমের হ্যাট পরা এক মহিলাকে দেখতে পেল ওরা। কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপে ঝুলছে ক্যামেরা। আমার নাম পপি, আমি রুবি মাউণ্টেনের পার্ক রেঞ্জার।

আমি আজকে তোমাদের হাইক গাইড করব।

আপনার সাথে ক্যামেরা কেন? প্রশ্ন করল ডানা।

আঙুলের নখ দিয়ে ক্যামেরায় টোকা দিলেন মহিলা।

হঠাৎ যদি নতুন ধরনের কোন জন্তুর দেখা পেয়ে যাই তাই।

মিসেস হকিন্স তার স্বভাবসিদ্ধ আধো হাসিটা হাসলেন।

বড় বড় রাস্তা আর শহর গড়ে ওঠার আগে নেচার কীরকম ছিল এরা তা জানতে এসেছে, রেঞ্জার পপিকে বললেন তিনি। আমরা কি এখন শুরু করব?

রেঞ্জার পপি মাথা ঝাঁকালেন।

ফলো মি, বললেন। সবাই কিন্তু ট্রেইলে থাকবে আর…অদ্ভুত কিছু চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

হোঁতকা ম্যাকনামারা হাত তুলল।

অদ্ভুত কিছু বলতে?

গাছ-গাছালির জটলার দিকে চকিতে চাইলেন রেঞ্জার পপি। তারপর মৃদু হাসলেন।

আমি কিছু বলিনি। আমি শিয়োর আমাদেরকে কোন কিছু জ্বালাতন করবে না।

এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সরু ট্রেইল ধরে পা চালালেন। লম্বা-লম্বা গাছের আবছায়ায় হারিয়ে গেলেন ছেলে-মেয়েদেরকে পিছনে নিয়ে, তিন বন্ধু আর ডানা লাইনের শেষে থাকল।

উঁচু এক গাছ থেকে একটা পাখি ডেকে উঠলে চমকে উঠল কয়েকটা মেয়ে।

এরা আগে মনে হয় পাখির ডাক শোনেনি, বলল কিশোর।

অচেনা শব্দ শুনলে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক, ডানা বলল ওকে।

কালো পাখি আর মশা ছাড়া এখানে কিছুই নেই, বলল কিশোর। এগুলো বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডেই দেখা যায়। এত দূর আসার দরকার পড়ে না।

তা হলে ওটা কী? প্রশ্ন করল মুসা।

আমি তো কিছুই শুনিনি, জানাল রবিন।

মুসা ওর বাহু চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।

থামলে কেন? কিশোর জবাব চাইল।

শ শ শ, সতর্ক করল মুসা। কী একটা যেন আমাদেরকে ফলো। করছে।

কে জানে কী, বলল কিশোর। তবে ওটার গায়ে ভয়ানক দুর্গন্ধ। আর ক্রমেই কাছিয়ে আসছে।

ওরা চারজন ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শীঘ্রি ট্রেইলে মিলিয়ে এল। অন্যান্য হাইকারদের চলার শব্দ। ঠিক এমনিসময় ওরা শুনতে পেল। ওদের পিছনে ভারী পদশব্দ। গাছের ফাঁক দিয়ে ওরা যখন উঁকি দিল, কিছুই দেখতে পেল না।

খাইছে, শব্দ শুনে মনে হচ্ছে বড়সড় কিছু, ফিসফিস করে বলল। মুসা। বিশাল সাইযের।

আমাদেরকে মনে হয় ফলো করছে, শিউরে উঠে বলল ডানা।

ঢোক গিলল রবিন।

চলো রেঞ্জারকে খুঁজে বের করি। তিনি নিশ্চয়ই জানবেন ওটা কী।

ওরা চারজন ট্রেইল ধরে হনহন করে পা চালাল।

ক্লাসের অন্যদের নাগাল ধরল ওরা চারজন। কাঁধের উপর দিয়ে বার বার পিছু চাইল ওরা, কিন্তু ভারী পায়ের শব্দটা আর শুনতে পেল না। রেঞ্জার পপি ওদেরকে ছোট ছোট জীব-জন্তু দেখালেন। কিন্তু তাঁর কোন কথাতেই কান দিল না কিশোর, ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল। মাটিতে।

ওরা লাঞ্চের জন্য শেল্টারে ফিরে আসা মাত্রই, রেঞ্জার পপি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ট্রেইল ধরে হাঁটা দিলেন।

আপনি আমাদের সাথে পিকনিক করলে খুশি হতাম, মিসেস হকিন্স বললেন।

উঁচু গাছ-পালার জটলার দিকে নার্ভাস দৃষ্টিতে চাইলেন রেঞ্জার পপি।

ধন্যবাদ, কিন্তু…আমি একটা জিনিস খুঁজছি। মনে হয় জানি কোথায় পাবে ওটাকে। রেঞ্জার পপি গ্রীনহিলস স্কুলের ছেলে মেয়েদেরকে একাকী রেখে উধাও হয়ে গেলেন।

বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে শশব্যস্তে এগোল শেল্টারের নীচে বসতে আর লাঞ্চ খেতে। কিন্তু তিন বন্ধু আর ডানা বিশাল এক হেমলক গাছের তলায় বসে পিনাট বাটার স্যাণ্ডউইচ আর প্রেটযেল খেতে লাগল।

আঙুল থেকে পিনাট বাটার চেটে কিশোরের কাঁধে খোঁচা দিল রবিন।

কী ব্যাপার, এত চুপচাপ কেন? প্রশ্ন করল।

বিশ্রী গন্ধটা বোধহয় ওর মাথা গুলিয়ে দিয়েছে, হেসে বলল মুসা।

বন্ধুরা কিশোরের জবাবের অপেক্ষায় থাকল। কিন্তু ওর মুখে কুলুপ আঁটা।

কিশোর আরেক কামড় স্যাণ্ডউইচ খেয়ে রবিনের কথার জবাব দিল।

আমি জঙ্গলের মধ্যে কিছু একটা দেখেছি, বলল ও। এবং আমাদের সাবধান থাকা উচিত।

কী বলছ তুমি? প্রশ্ন করল মুসা। এই পাহাড়ে কীসের কাছ থেকে সাবধান থাকতে হবে?

কিশোর বন্ধুদের সবার চোখের দিকে চাইল। এবার ফিসফিস করে জবাব দিল।

বিগ ফুট!

বিগ ফুট? ওর বন্ধুরা সভয়ে একসঙ্গে বলে উঠল।

শ শ শ, সতর্ক করল কিশোর। একটা আঙুল রাখল ঠোঁটে। ও শুনে ফেলবে।

কে শুনে ফেলবে? রবিনের জিজ্ঞাসা। তোমার কথার মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝছি না।

বিগ ফুট, আবারও বলল কিশোর।

বিগ ফুট এক ধরনের দানো। জঙ্গলে থাকে, বলল মুসা।

প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে, যোগ করল রবিন।

এখন বুঝলে তো আমি কী বলতে চাইছি, বলল কিশোর।

আমরা কিছুই দেখিনি, ডানা বলল ওদেরকে। আর আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের ধারেকাছেও নেই। তা ছাড়া এসব জঙ্গলে কোন দানো-টানো লুকিয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।

অত শিয়ের হয়ো না, ফিসফিসিয়ে বলে কাঁধের উপর দিয়ে চাইল কিশোর।

এই জঙ্গলের একমাত্র দানো হচ্ছ তুমি, রবিন বলল কিশোরকে।

রবিন ঠিকই বলেছে, বলল মুসা। এখানে দানো আছে তা তুমি হলফ করে বলতে পারো না।

পারি, কিশোর বলল। ট্রেইলে ট্র্যাক দেখেছি আমি। বিগ ফুটের ট্র্যাক!

স্মিত হাসল রবিন।

ওগুলো ছিল আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েদের ট্র্যাক।

কিশোর গভীর শ্বাস টেনে মাথা ঝাঁকাল।

প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এই ট্রাকগুলো বিশাল।

তা হলে রেঞ্জার পপির বুটের ছাপ, বলল ডানা। ওঁর বুট জোড়া বিরাট।

এই ট্র্যাকগুলোর কাছে তাঁর বুটের ছাপ নস্যি, তর্কের সুরে বলল কিশোর। আর এই ট্রাকগুলো যার সে খালি পায়ে ছিল। পায়ের পাতায় ছাপ দেখেছি আমি।

রবিন কিশোরের পিঠ চাপড়ে দিল।

এবার বোঝা গেল। তুমি সম্ভবত কোন জন্তুর থাবার ছাপ দেখেছ, বলল ও।

জন্তু কোন সন্দেহ নেই, গম্ভীর স্বরে বলল কিশোর। এবং সেই জন্তুটা হচ্ছে বিগ ফুট!

মুসা তর্ক করার সুযোগ পেল না, কারণ ঠিক সে মুহূর্তে দীর্ঘদেহী, লোমশ এক লোক টলতে টলতে বেরিয়ে এল বনভূমির ভিতর থেকে। লোকটা অন্তত সাত ফুট লম্বা। পিঠে ঝুলছে লম্বা এক পনিটেইল। দাড়ি তার বেল্টের কলস ছুঁয়েছে প্রায়। সত্যি কথা বলতে কী, সর্বাঙ্গে লোম তার। এমনকী আঙুলের গাঁটগুলোও লোমে ভরা।

কে ওটা? রবিন ফিসফিস করে জানতে চাইল।

ত্যাগ করল মুসা।

হয়তো আরেকজন রেঞ্জার।

হ্যাটটা সুন্দর, ঠাট্টা করে বলল কিশোর। লম্বা, লোমশ লোকটির মাথায় পেল্লায় এক হ্যাট। কাউবয়রা যে ধরনের হ্যাট পরে।

ওটাকে দশ-গ্যালন হ্যাট বলে, ব্যাখ্যা করল রবিন।

আমার মনে হচ্ছে সাড়ে সাতশো গ্যালন, বলল কিশোর।

জঙ্গল এতটাই ঘন লোকটাকে আসতে দেখিনি, ডানা ফিসফিস করে বলল।

আমরা এরকম একটা লোককে মিস করলাম কীভাবে? প্রশ্ন। করল রবিন। ও তো ক্রিসমাস ট্রীর সমান! কথাটা সত্যি, গাছের নীচ দিয়ে হাঁটার সময় মাথা নোয়াতে হয় লোকটিকে।

ও মনে হয় টেক্সাস থেকে এসেছে, মৃদু গলায় বলল ডানা। শুনেছি ওখানে নাকি সব কিছুই বড় বড়। মাথা নোয়াতে নোয়াতে লোকটা কুঁজো হয়ে গেছে।

আগন্তুক সোজা ওদের দিকে হেঁটে এল।

চার বন্ধুর কাছ থেকে কফুট দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

শুনলাম তোমাদের ক্লাস নাকি গাড়ি-প্লেনের আগে প্রকৃতি কেমন ছিল জানতে চায়, গর্জে উঠল লোকটা। তোমাদের রেঞ্জারকে দেখলাম সটকে পড়ল, কাজেই আমি তোমাদেরকে আগেকার মানুষের জীবন সম্পর্কে জানাতে চাই। আমরা নাচ দিয়ে শুরু করব।

ডানা একটা হাত তুললে লোকটা ভ্রু কুঁচকে চাইল।

কী চাও তুমি? ঘাউ করে উঠল।

আপনার নামটা তো জানা হলো না, বলল ডানা।

নাম? থতমত খেল বিশালদেহী।

হ্যাঁ আমরা আপনাকে কী বলে ডাকব? ডানা জিজ্ঞেস করল।

লোমশ চিবুক ঘষে মুহূর্তের বিরতি নিল সে। ছেলে-মেয়েরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এবার জবাব দিল লোকটা।

স্কোয়াশ, শেষমেশ গর্জে উঠল। মিস্টার স্কোয়াশ। এখন শেল্টারে যাও

আমরা দলে দলে ভাগ হব।

ছেলে-মেয়েরা হনহন করে খোলা বিল্ডিংটার দিকে পা চালাল। দাঁড়িয়ে রইল শুধু কিশোর। ওর দৃষ্টি স্থির মি. স্কোয়াশের পিঠে।

চলে এসো, রবিন গলা ছেড়ে বলল কিশোরকে।

কিশোর জবাব দিল না। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে।

এসো, রবিন বলল আবারও, ফিরে এসে কিশোরের বাহু ধরে টানল।

কিশোর ঢোক গিলে রবিনের দিকে চাইল।

মিস্টার স্কোয়াশের মধ্যে অদ্ভুত কিছু একটা আছে, বলল ও।

জানি, বলল রবিন। কত দিন গোসল করে না কে জানে।

উঁহু, অন্য কিছু, বন্ধুকে বলল কিশোর।

কী?

ঠিক জানি না, বলল কিশোর। কিন্তু জানতে হবে!

মি. স্কোয়াশ একটা মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে কথা বলল। তার। কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো পাহাড়ে।

তোমরা এখান থেকে যাওয়ার আগে অতীতের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবে, ছেলে-মেয়েদেরকে বলল সে।

একটা টেপ প্লেয়ার চালু করল মি. স্কোয়াশ। লাউডস্পিকার। ফাটিয়ে ফেলল ফিডল মিউজিক।

আগে একটু স্কয়্যার নাচ হয়ে যাক, মাইক্রোফোনে চেঁচাল মি. স্কোয়াশ। সবাই একজন পার্টনার খুঁজে নিয়ে ঘুরতে থাকো।

ছেলে-মেয়েরা পার্টনার খুঁজে নিতে ব্যস্ত হলো। মি. স্কোয়াশ এবার নাচটা ওদেরকে শিখিয়ে দিল।

মি. স্কোয়াশ বড় এক বৃত্ত ঘিরে ছেলে-মেয়েদেরকে জড় করল, আরও কিছু স্টেপ যাতে শিখিয়ে দিতে পারে।

.

নাচ শেষে তিন বন্ধু আর ডানা হেমলক গাছটার নীচে বসে লেমোনেড পান করছিল। মি. স্কোয়াশ, মিসেস হকিন্স আর ক্লাসের অন্যান্যরা। রয়েছে শেল্টারে।

মিস্টার স্কোয়াশের পা দুটো কী বিশাল বাপরে বাপ, বলল কিশোর। আমার ধারণা লোকটা বিগফুট।

হেসে উঠল মুসা।

নাচতে গিয়ে তোমার মাথা ঘুরে গেছে, বলল ও। ।

লোকটা যখন হাসল তখন ওর দাঁতগুলো দেখনি? বলল কিশোর। হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে।

মানলাম দাঁতগুলো হলদেটে, বলল ডানা। কিন্তু তাতে কী? হয়তো ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার পয়সা নেই বেচারার।

হয়তো ডেন্টিস্টকে ও খেয়ে ফেলেছে, বাতলে দিল কিশোর।

সবাই জানে বিগফুটের বড় বড় হলুদ দাঁত থাকে। ঠিক মিস্টার

স্কোয়াশের মত।

হতে পারে। কিন্তু আমি শিয়োর বিগফুট পাহাড়ে স্কয়্যার ড্যান্স করে না, বলল রবিন।

রবিন ঠিকই বলেছে, বলল মুসা। মিস্টার স্কোয়াশের দুটো পা হয়তো বিশাল, কিন্তু তাতেই সে দানব হয়ে যায় না।

কিশোর শেল্টারের দিকে চকিতে চাইল। মি. স্কোয়াশ এক কোণে বসে ছেলে-মেয়েদের লেমোনেড পান করা দেখছে।

বিশ্বাস করতে না চাইলে কোরো না, বন্ধুদেরকে বলল কিশোর।

কিন্তু বিগফুট যখন গ্রীন হিলসে দাপিয়ে বেড়াবে তখন মজা টের পাবে!

দিন শেষে ছেলে-মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। রুবি মাউন্টেনে ওদের ফিল্ড ট্রিপ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। মিসেস হকিন্স ছাত্র-ছাত্রীদের মাথা গুনছেন! কিশোর চেয়ে চেয়ে দেখছে মি. স্কোয়াশকে। লোকটা এক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বনভূমির দিকে চেয়ে রয়েছে। ভাবখানা এমন যেন কিছু শুনতে পেয়েছে। এবার এক ছুটে পিকনিক শেল্টারের পিছনে গিয়ে হারিয়ে গেল গাছের জটলার ওপাশে।

দেখো, বলে রবিনকে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল কিশোর। বিগফুট উধাও হয়ে গেল!

বিদায় পর্যন্ত নিল না, রবিন বলল।

তাকে গিয়ে আমাদের জানানো দরকার আমরা কতটা এনজয় করেছি, বলল ডানা। কিন্তু সে সময় ওরা পেল না, কেননা রেঞ্জার পপি শিস দিতে দিতে ট্রেইল ধরে এগিয়ে এলেন। ওদেরকে পিকনিক শেল্টারের কাছে দেখে মৃদু হাসি ফুটল তাঁর মুখে।

আমি ভেবেছিলাম আপনারা চলে গেছেন বুঝি, মিসেস হকিন্সকে বললেন তিনি।

মিসেস হকিন্স তার আধো হাসিটা হাসলেন।

আমরা স্কয়্যার ড্যান্স শিখতে ব্যস্ত ছিলাম, তবে এখন যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছি।

স্কয়্যার ড্যান্স দারুণ জিনিস, সায় জানালেন রেঞ্জার পপি।

রুবি মাউণ্টেনে আরও স্কয়্যার ড্যান্স হওয়া উচিত। ব্যাকপ্যাক আর ক্যামেরা নামিয়ে রেখে বাসে একটা কুলার তুলতে সাহয্য করলেন। কজন ছেলে-মেয়েকে।

কিশোর রেঞ্জার পপির ক্যামেরাটা ইশারায় দেখাল।

যা খুঁজছিলেন পেয়েছেন? জবাব চাইল ও।

না, বললেন মহিলা। একটুর জন্যে মিস করেছি।

কিশোর তাঁকে আরও প্রশ্ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু মিসেস হকিন্স ওর কাঁধে হাত রাখলেন। টিচারের লম্বা, সবুজ নখগুলো দেখে পিছিয়ে গেল ও। হনহন করে পা চালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল। বাসে ওঠার জন্য।

আমি ক্লান্ত, ওরা বসার পর অভিযোগ করল ডানা।

আমিও, বলল রবিন। তবে আমার ভাল লেগেছে। অনেক কিছু জানতে পারলাম।

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

মিস্টার স্কোয়াশ অতীতের অনেক কিছু জানে। জুলিকে বলছিল শুনলাম সে নাকি ওয়েস্ট কোস্টের গহীন পাহাড়ে থাকত।

কিশোর বিনাবাক্যব্যয়ে রবিনের পাশে বসে পড়ল। চারপাশে ছেলে-মেয়েরা ব্যাকপ্যাক রেখে যার যার আসনে বসছে।

আমাকে জানালার পাশে বসতে দেবে? মুসাকে জিজ্ঞেস করল ডানা।

তুমি তো সব সময় জানালার পাশে বসো, অভিযোগ করল মুসা। আমাকে একবার অন্তত বসতে দাও।

ওকে জানালার পাশে বসতে দাও, নইলে বমি করে ভাসাবে, বলল কিশোর।

মুসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানাকে খোলা জানালার পাশে বসার সুযোগ করে দিল। বাসটা মেটে রাস্তার উপর দিয়ে চড়-চড় শব্দ তুলে রওনা দিলে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল ডানা। রুবি মাউন্টেনের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ওরা।

ওরা বেশি দূর যায়নি এসময় ডানা সিধে হয়ে বসে আর্তচিৎকার ছাড়ল।

ওই যে একটা বুনো জন্তু!

মুসা উঠে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে চোখ রাখল আঁধার ঘনিয়ে আসা জঙ্গলের দিকে।

কয়োটি নাকি? প্রশ্ন করল। না, ডানা শ্বাসের ফাঁকে বলল। কয়োটির চাইতে বড়। অনেক

হরিণ হতে পারে, বলল রবিন।

মাথা নাড়ল ডানা।

না, সারা গায়ে লোম। দুপায়ে দৌড়াচ্ছিল।

তা হলে ভালুক হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছল মুসা।

কই, আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, বলল জুলি। ছেলে মেয়েরা সবাই গাছ-পালার দিকে উঁকি দিল। শুধু কিশোর ঠায় বসে রইল। তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছে না সে।

তুমি দেখবে না? মুসার প্রশ্ন।

দেখার দরকার নেই, মৃদু কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি জানি ওটা কী!

খাইছে, কিশোরের কী যেন হয়েছে, মুসা রবিন আর ডানাকে শনিবারদিন কথাটা বলল। রুবি মাউন্টেন থেকে গতকাল ঘুরে এসেছে ওরা। এখন স্কুলের খেলার মাঠে জড় হয়েছে। বড় ওক গাছটার নীচে।

কী হয়েছে? প্রশ্ন করল রবিন।

ওকে একটু আগে দেখলাম গ্রীন হিলস লাইব্রেরিতে ঢুকতে, বন্ধুদেরকে জানাল মুসা।

বলো কী! এক সঙ্গে বলে উঠল রবিন আর ডানা। শনিবার সকালে লাইব্রেরিতে যাওয়ার বান্দা তো কিশোর নয়।

সাথে এক গাদা বইও ছিল, বলল মুসা।

দেখতে হচ্ছে, বলল রবিন। ওর ওপর চোখ রাখব আমরা।

ওরা তিনজন খেলার মাঠ আড়াআড়ি পেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে ছুটল। সহকারী লাইব্রেরিয়ান মি. লিসেকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে নন ফিকশন সেকশনে চলে এল ওরা।

ওই যে কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। বড় বড় বই নিয়ে লম্বা এক কাঠের টেবিলে বসা কিশোর। রবিন, মুসা আর ডানা এক শেলফের আড়াল নিতেই ফটাস করে একটা বই বন্ধু করল। গোয়েন্দাপ্রধান। ওরা আবার যখন উঁকি দিল, কিশোর আরেকটা বই খুলেছে।

দেখি ও কী করছে, ফিসফিস করে বলল ডানা, বন্ধুরা ওকে থামাতে পারার আগেই হামাগুড়ির ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে পড়ল ও। এবার নিঃশব্দে, একটু একটু করে কিশোরের পিছনে গিয়ে হাজির হলো। কিশোর কী পড়ছে দেখার জন্য ওর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল।

ইতোমধ্যে মুসা আর রবিনও গোপন স্থান থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসেছে। কিশোরের হাত থেকে বইটা এক টানে ছিনিয়ে নিল মুসা। বইটার নাম: দ্য বিগ ফুট মনস্টার।

তুমি এখনও এসব আজগুবী ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছ? মুসা বলল।

আজগুবি নয়, বলল কিশোর। প্রমাণ। বিগফুট সত্যিই আছে!

বিগ ফুট দেখা গেছে এরকম এক তালিকায় আঙুল নামিয়ে আনল রবিন।

প্রায় সব স্টেটে বিগ ফুট দেখা গেছে, মৃদু কণ্ঠে বলল সে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

এই বইতে বলছে বিগফুট দানবরা বসবাসের জন্যে নতুন জায়গা খুঁজছে, কেননা নগরায়নের ফলে আশ্রয় হারাচ্ছে তারা। ওরা। খুব লাজুক ধরনের হয়, তাই নির্জন কোন পাহাড়ের সন্ধানে দুনিয়া। চষে বেড়াচ্ছে।

এটা দেখো, মুসা এক ডজন নামের একটি তালিকা ইঙ্গিত করল। এগুলো গ্রীন হিলস থেকে বেশি দূরে নয়।

হ্যাঁ, বিগ ফুট আমাদের আশপাশেই আছে, বলল কিশোর। কোমরে দুহাত রাখল ডানা।

মিস্টার স্কোয়াশ বিশালদেহী আর তার দাঁতগুলো হলদেটে বলেই তুমি তাকে যা খুশি বলতে পারো না।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

আমি তো তাকে গালি দিচ্ছি না। শুধু বলতে চাইছি মিস্টার স্কোয়াশই বিগ ফুট।

বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, মুসা বলল কিশোরকে। বিগ ফুট কাল্পনিক জীব। এই তালিকাটাও বানোয়াট।

টেবিলে দুম করে কিল বসাল কিশোর।

এত এত লোক মিথ্যে বলতে যাবে কোন দুঃখে? কেউ কেউ বিগফুটের অস্তিত্ব সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত যে তারা বিগ ফুটের খোঁজে জীবন পার করে দিচ্ছে। প্রথম যে কাছ থেকে বিগ ফুটের ছবি নিতে পারবে সে বিখ্যাত এবং বড়লোক হয়ে যাবে। বিগ ফুটের দেখা পেলে কোথায় ফোন করতে হবে সে নম্বরও দেয়া আছে। এখানে।

এই নম্বর পাগলদের জন্যে, নরম গলায় বলল নথি।

আমি পাগল নই। এবং সেটা তোমাদের কাছে প্রমাণ করে। ছাড়ব, বলে উঠল কিশোর।

বইটা থেকে পড়তে শুরু করল ও।

বিগ ফুট বাদামী কিংবা কালো লোমে ঢাকা লম্বা এক প্রাণী।

মিস্টার স্কোয়াশের সাথে খানিকটা মিলছে, স্বীকার করল ডানা। কিশোর পড়ে চলল।

বিগ ফুটের গায়ে ভয়ানক দুর্গন্ধ, অনেকটা স্কাঙ্কের মত। আমরা বিশ্রী একটা গন্ধ পেয়েছিলাম, মনে করিয়ে দিল মুসা।

এতেই শেষ নয়, বলল কিশোর। বিগফুটের আরেকটা পরিচিত নাম হচ্ছে সাসকোয়াচ।

শুনতে স্কোয়াশের মত লাগছে, বলে শ্বাস চাপল ডানা।

ঠিক, বলল কিশোর। আরও আছে। এই বইতে তাদের ছবি আছে যারা বিগ ফুটকে দেখেছে।

ওসব ছবিতে কিছু প্রমাণ হয় না, তর্কের সুরে বলল রবিন।

হয় যদি তাদের কাউকে তুমি চেনো, বলল কিশোর। কয়েক পাতা উল্টে অস্পষ্ট এক ছবি বের করল ও। এবার বন্ধুদেরকে দেখাল। সাদায়-কালোয় রেঞ্জার পপি। উনি বিগ ফুট ধরতে গ্রীন হিলসে আছেন।

আমি তারপরও বিশ্বাস করি না, বলল মুসা। আর বিগ ফুট যদি সত্যি সত্যি রুবি মাউন্টেনে ঘাঁটি গেড়ে থাকে তো আমরা কী করব?

আমাদের করার কাজ একটাই আছে, বলল কিশোর। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, আমরা বিগফুটকে পাকড়াও করব!

কী বলছ এসব উল্টো পাল্টা? লাইব্রেরি ত্যাগ করার সময় বলল মুসা। বিগ ফুট বলে যদি কিছু থাকে, তো সে এক কামড়ে আমাদের সাবাড় করে দেবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ডানা।

মুসা ঠিক বলেছে।

আমরা আবার রুবি মাউন্টেনে যাব, ব্যাখ্যা করল কিশোর। একমাত্র তা হলেই প্রমাণ হবে মিস্টার স্কোয়াশ আসলেই বিগফুট।

রবিন শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে বদলে নিল।

শোনো, আমি বিগ ফুটে বিশ্বাস করি না, বলল ও। কিন্তু এভাবে রুবি মাউন্টেনে যাওয়াটা আমাদের ঠিক হবে না। ভালুক-টালুক কিংবা অন্য কোন বুনো জন্তু আক্রমণ করতে পারে।

ডানা মাথা ঝাঁকাল। চোখ ছানাবড়া।

চলে আসার সময় কিছু একটা দেখেছি আমি। বিশালদেহী। আমার ধারণা জন্তুটা বিপজ্জনক।

খাইছে, আমাদের আস্ত গিলে খাবে, বলল মুসা।

কিশোর ওর ব্যাকপ্যাক তুলে ধরল বন্ধুদের দেখানোর জন্য।

বিগ ফুট ধরতে যা যা লাগে সব আছে এখানে।

কী? অ্যাটম বোমা? রবিনের প্রশ্ন।

চাচার ক্যামেরা। লোড করা আছে। বিগ ফুটের ছবি তুলব আমরা, জানাল কিশোর।

আমাদের ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না, বলল মুসা।

ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে সরাসরি মুসার চোখে চোখ রাখল কিশোর।

তুমি না বলেছিলে রুবি মাউন্টেন তোমার বাসার ব্যাকইয়ার্ডের মত নিরাপদ?

শ্রাগ করল মুসা।

তখন তো বিগ ফুটের প্রসঙ্গ আসেনি।

আর আমিও তখন বুনো জন্তুটাকে দেখিনি, ডানা বলল কিশোরকে।

কিশোর বাস স্টপের দিকে হাঁটা দিল।

সেই বুনো জন্তুটাই বিগফুট, আমি যার ছবি তুলতে যাচ্ছি।

তুমি কিন্তু মারা পড়বে, সাবধান করল রবিন।

একা একা ওখানে যাওয়াটা খুব বিপজ্জনক হবে, সতর্ক করল মুসা।

ওর দিকে চাইল কিশোর।

কে বলল একা যাচ্ছি? বলল ও। তোমরাও যাচ্ছ আমার সাথে!

১০

তিন বন্ধু আর ডানা রুবি মাউন্টেনের গোড়ায় সিটি বাস থেকে নেমে পড়ল।

তোমরা ঠিক জান তো এখানেই নামবে? বাস ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল। আমি কিন্তু ছটার আগে ফিরছি না। তখন কিন্তু আঁধার হয়ে যাবে।

কোন অসুবিধা নেই, ড্রাইভারকে বলল কিশোর। আমরা ছটার সময়ই ফিরব।

ড্রাইভার শ্রাগ করে বাস চালু করল। এ মুহূর্তে রুবি মাউন্টেনে যাওয়ার মেটে সংযোগ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ছেলে মেয়েরা। জঙ্গলে একটা পাখি ক্য-ক্য করে ডেকে উঠলে আঁতকে উঠল ডানা।

ইস, কেন যে এলাম! কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বলল ও।

বিগফুটের ছবি নেয়ার পর তোমার আর আফসোস থাকবে না, বলল কিশোর। ব্যাকপ্যাক থেকে ক্যামেরা বের করে গলায় ঝুলাল। চলো, শেল্টারের দিকে যাই।

বাহ, ক্যামেরাটা সুন্দর তো। কীভাবে ব্যবহার করে জানো? প্রশ্ন করল রবিন।

মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল কিশোরের।

অবশ্যই জানি। চাচা গত সামারে শিখিয়ে দিয়েছে।

ছেলে-মেয়েরা রাস্তা ধরে এগোল। শেল্টারের উল্টোদিকে গাছের এক জটলার আড়ালে সেঁধিয়ে পড়ল। অপেক্ষা করছে বিগফুটের জন্য।

অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরোয় না। মৌমাছি ভনভন করছে, মশা কামড়াচ্ছে।

উফ, খেয়ে ফেলল! বলে শরীর মোচড়াল ডানা।

খুশি থাকো যে বিগফুট তোমার পায়ের পাতা চিবিয়ে খাচ্ছে না, বলল মুসা।

আউচ, ডানা মশার কামড় খেয়ে ককিয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ল। কিশোরের সামনে। আর পারছি না।

কিশোর ডানার মুখে হাত চাপা দিল।

চুপ না করলে আমার কামড় খাবে, বলল ও। বিগফুট আওয়াজ পেলে আর সামনে আসবে না। চুপচাপ বসে থাকো। আমার সামনে থেকে সরো।

ডানা কিশোরের সামনে ঝুঁকে বসে স্থির থাকার চেষ্টা করল। কাজটা সহজ হলো না। চারদিকে পোকা-মাকড়। তা ছাড়া আঁধার ঘনাচ্ছে। বিশাল এক মাকড়সা ওর জুতোর ডগা লক্ষ্য করে এগোলে ঢোক গিলল ও।

বাপরে, অস্ফুটে বলে উঠল ডানা। দেখো।

কিশোর মাথা ঝাঁকিয়ে ক্যামেরা তাক করল। শেল্টারের ওপাশে কটা গাছের দিকে নজর ওর। লোমশ, বিশালকায় এক অবয়ব ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে।

ওই যে বিগফুট, ফিসফিস করে বলল কিশোর। এবার একের পর এক ছবি নিতে লাগল।

১১

এটাকে সরাও! ডানা গুঙিয়ে উঠে লাফ দিল।

সামনে থেকে সরো, হিসিয়ে উঠল কিশোর। ও ছবি নিচ্ছে আর ডানা ক্রমাগত চেঁচিয়েই যাচ্ছে।

সরাও না! চেঁচিয়ে উঠে শূন্যে পা ছুঁড়তে লাগল ডানা। ওর সাদা জুতো আঁকড়ে ধরে রয়েছে লোমশ মাকড়সাটা।

কী হয়েছে তোমার? ফিসফিস করে প্রশ্ন করল মুসা। তুমি কি চাও বিগ ফুট আমাদের দেখে ফেলুক?

জুতোটা আঙুল ইশারায় দেখাল ডানা। আরেকটু হলেই কেঁদে ফেলবে।

এটাকে ফেলো নইলে আমাকে কামড়াবে!

মাকড়সাটাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে চোখ ঘুরাল মুসা। তারপর টু শব্দটি না করে এক ঝটকায় জুতোর উপর থেকে ফেলে দিল।

গেছে, বলল মুসা।

হ্যাঁ, গেছে, সায় জানাল রবিন। বনভূমির যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল লোমশ জানোয়ারটা সেদিকে ভ্রূ দেখাল। গাছ-পালা ছাড়া এখানে এখন আর কিছু নেই।

ছোট এক মাকড়সাকে এত ভয়! তোমার চেঁচানিতে বিগ ফুট ভয় পেয়ে পালিয়েছে, ডানাকে বলল মুসা।

ওটা ছোট হলো? ডানা তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। আস্ত গ্রীন হিলসের সমান।

কাজ হয়ে গেছে, বলল কিশোর। প্রমাণ এখন আমাদের কাছে।

রেডিয়াম ঘড়ি দেখে নিল রবিন।

এখনই না গেলে বাস মিস করব, বন্ধুদেরকে বলল ও।

এসো, বলল মুসা। মেটে রাস্তাটা ধরে দৌড় দিল বাস স্টপের উদ্দেশে। বন্ধুরা ওর পিছু নিল।

পোকার কামড় খেয়ে জান শেষ, অভিযোগ করল ডানা। ভীষণ জ্বলুনি হচ্ছে।

পিছনে দেখো, হঠাৎই বলে উঠল রবিন। কাঁধের উপর দিয়ে চাইল ওরা চারজন। মি. স্কোয়াশ দানবীয় পা পেলে তেড়ে আসছে। ওদের দিকে। মাথায় কাউবয় হ্যাট চোখে খেপাটে দৃষ্টি।

মুসা সবার আগে বাসটাকে দেখতে পেল।

দাঁড়ান! চিৎকার করল ও। বাস থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ওরা যখন মেটে রাস্তাটার শেষ প্রান্তে, এসময় বাসটা গোঁ গোঁ করে রওনা হয়ে গেল।

আমরা রুবি মাউন্টেনে আটকা পড়ে গেছি! আর্তনাদ ছাড়ল রবিন।

আমরা খতম, বলল কিশোর।

এখনই না, চেঁচাল মুসা। দৌড়াও!

১২

মুসা, ডানা, রবিন আর কিশোর বাসের পিছন পিছন দৌড় দিল।

দাঁড়ান! চেঁচাল ওরা। রাস্তার এক বাঁক ঘুরল। আরেকটু হলেই সিটি বাসটার পিছনে ধাক্কা খেত ওরা।

আমি ভেবেছিলাম তোমরা হিচ হাইকিং করে শহরে ফিরে গেছ, ওরা বাসে উঠলে বলল ড্রাইভার। ভাগ্যিস একজন প্যাসেঞ্জার তোমাদের হাত নাড়া দেখতে পেয়েছিল।

ডানা হাঁফাচ্ছে দস্তুর মত, একটা সিটে নেতিয়ে পড়ল।

থেমেছেন বলে ধন্যবাদ, বলল ও।

আপনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন! ড্রাইভারকে বলল রবিন। পিছনের জানালা দিয়ে চাইল ও। দেখতে পেল মি. স্কোয়াশ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে।

বাস সগর্জনে বড় রাস্তা ধরে গ্রীন হিলসের দিকে ছুটে চলল। কিশোর ওর ক্যামেরা শক্ত করে চেপে ধরে আছে, কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না, যতক্ষণ পর্যন্ত রুবি মাউন্টেন আর মি. স্কোয়াশ দৃষ্টিসীমার আড়াল না হলো।

.

পরদিন সকাল। স্কুল বসার আগে ওরা ডেনভারস ডিপার্টমেন্ট স্টোরে মিলিত হলো। ছবি ভর্তি এক খাম কিশোরের হাতে।

এখানে আছে আমাদের প্রমাণ, বলল ও।

দেখি, বলল মুসা।

কিশোর খামটা খুলল, কিন্তু কেউ একজন পিছন থেকে ওর চেপে ধরল।

কিশোর চোখ তুলে চাইতেই রেঞ্জার পপির ক্রুদ্ধ মুখের চেহারা দেখতে পেল।

বাস ড্রাইভারের কাছে শুনলাম তোমরা রুবি মাউন্টেনে গিয়েছিলে। ওখানে কী করতে গিয়েছিলে? প্রশ্ন করলেন।

বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছ তোমরা। ওখানে বুনো জীব-জন্তু ঘুরে বেড়ায়।

কিশোর রেঞ্জার পপির হাত থেকে ছুটে খামটা তুলে ধরল।

ওখানকার বুনো জীব-জন্তুদের সম্পর্কে আমরা সবই জানি। এ ও জানি আপনি পালের গোদাটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা আগে ওটাকে খুঁজে পেয়েছি। এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। মিস্টার স্কোয়াশ ইতিহাস হয়ে যাবে!

কপাল কুঁচকে গেল রেঞ্জার পপির।

তুমি কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না, বললেন তিনি। বোঝার মত সময়ও নেই, কারণ আমাকে একজন স্কয়্যার নাচ জানা। টিচারের খোঁজ বের করতে হবে।

মিস্টার স্কোয়াশকে নিন না, বলল ডানা।

রেঞ্জার পপিকে বিভ্রান্ত দেখাল।

আমি কোন স্কোয়াশকে চিনি না, যে ছিল সে দুমাস আগে চলে গেছে।

কিশোর বন্ধুদের দিকে চেয়ে

উঁচু করল। কোমরে হাত রাখলেন রেঞ্জার পপি।

বড় কেউ সাথে না থাকলে আর কখনও রুবি মাউন্টেন যাবে। না। বড় ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে।

রেঞ্জার পপি চলে না যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল কিশোর। ওর মুখে অলিম্পিক সোনা জয়ের হাসি।

উনি বিগফুটের খোঁজ করছেন, কিন্তু দেখা পাননি। আমরা পেয়েছি। এই যে প্রমাণ।

আমার কাছে দাও, বলল রবিন। খামটা ছিনিয়ে নিল কিশোরের হাত থেকে। এবার বিনাবাক্যব্যয়ে ছবিগুলো দেখে চলল একটার পর একটা।

বিগ ফুটের ছবি পেলে? মুসার প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল রবিন।

একটা ফুটের ছবি তো বটেই। ডানার পায়ের ছবি!

কী? চেঁচিয়ে উঠে ছবিগুলো ছোঁ মেরে কেড়ে নিল কিশোর। ওগুলো এক ঝলকে দেখে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে ডানার দিকে চাইল। তোমাকে বলেছিলাম না সামনে থেকে সরতে? খেঁকিয়ে উঠল।

উপস, বলল ডানা। আমিই মনে হচ্ছে গ্রীন হিলসের একমাত্র বিগফুট!

খাইছে, প্রমাণ হলো রুবি মাউন্টেনে বিগ ফুট-টুট বলে কিছু নেই, বলল মুসা।

হাজার হলেও বিগফুট স্কয়্যার নাচ নাচে না, খিল খিল করে হেসে বলল ডানা।

হেসে উঠল রবিন।

কিশোরও না!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *