ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
চন্দ্রবংশীয় ঋক্ষরাজের পুত্র প্রতীপ। উল্লেখ্য যে, চন্দ্রবংশ থেকে পুরুর পৌরববংশ এবং পৌরব বংশ থেকে কৌরব বংশের উৎপত্তি। অর্থাৎ কুরু- পাণ্ডবরা মূলত চন্দ্রবংশ থেকেই উদ্ভূত। প্রতীপের পুত্র মহারাজ শান্তনু। শান্তনু যুবক হলে প্রতীপ তাকে রাজ্যভার দিয়ে বনে গমন করেন।
পূর্বপুরুষদের মতো শান্তনু ছিলেন মৃগয়াপ্রিয় অর্থাৎ বন্য পশুপাখি শিকারে তার নেশা ছিল। একদিন মৃগয়ায় গিয়ে ভাগীরথী নদীতীরের উপবন অতিক্রম করার সময় এক অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যাকে দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়লেন শান্তনু। তাকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। সেই কন্যা বিয়েতে রাজি হলেন শর্ত আরোপ করে। শর্তে ঐ কন্যা উল্লেখ করলেন যে, তার কোনো কাজ রাজার কাছে অপছন্দের হলেও রাজা তা নিষেধ করতে পারবেন না। নিষেধ করলে বা বাধা দিলে তিনি সেই মুহূর্তেই রাজাকে ত্যাগ করে চলে যাবেন। শর্ত মেনে নিয়ে রাজা তাকে বিয়ে করলেন। ঐ কন্যা হলেন গঙ্গা। শান্তনু তার আসল পরিচয় তখন জানতে পারেননি
কালক্রমে গঙ্গার গর্ভে মহারাজ শান্তনুর আটটি পুত্র জন্মলাভ করে। প্রথম সাতটি পুত্রকে গঙ্গা জন্মের পরপরই গঙ্গায় বিসর্জন দেন। শান্তনু মর্মাহত হলেও প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে স্ত্রীর কাজে বাধা দেননি। কিন্তু অষ্টম পুত্ৰ ভূমিষ্ঠ হলে রাজা আর স্থির থাকতে পারলেন না। বংশলোপের ভয় এবং অনাবশ্যকভাবে পুত্রহত্যার বিষয় ভেবে তিনি গঙ্গাকে বাধা দিলেন। সেইসাথে তিনি অমানবিক কাজে নিরত স্ত্রীকে তার আসল পরিচয় দিতে বলেন। গঙ্গা তার শর্ত মোতাবেক শান্তনুকে ত্যাগ করে চলে যাবার আগে তার এবং বিসর্জিত পুত্রগণের পরিচয় দিয়ে যান।
শান্তনু জানতে পারেন যে, তার স্ত্রী ছিলেন স্বয়ং গঙ্গাদেবী। তার পুত্ররূপে যারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারা সকলেই বশিষ্ঠমুনির অভিশাপগ্রস্ত ইন্দ্রের অনুচর অষ্টবসু (ধর, ধ্রুব, সোম, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস ও দ্যু)। বশিষ্ঠের কামধেনু হরণ করায় তারা অভিশপ্ত হন। বশিষ্ঠ পরে অভিশাপ সংশোধন করে বলেছিলেন যে, সাতটি বসু নরজন্ম লাভ করার একবছরের মধ্যে মুক্তি পাবে কিন্তু সর্বকনিষ্ঠ দ্যু দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বাস করার পর স্বর্গে যাবে। অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, গঙ্গা সাতটি বসুকে পূর্বোক্তভাবে মুক্তি দেন। অষ্টম বসু দ্যু হলেন দেব্রত ভীষ্ম। এ বিষয়ে মহাভারতে বিস্তারিত বিবরণ আছে। গঙ্গাদেবী আরও জানান যে, এই পুত্র হবেন ধর্মাত্মা, তিনি বিয়ে করবেন না, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে রাজার প্রিয় কাজ করবেন নিষ্ঠার সাথে।
গঙ্গা চলে গেলেন শর্তানুযায়ী। মহারাজ শান্তনু পুত্রকে গাঙ্গেয় ও দেবব্ৰত নামে অভিহিত করলেন। বিদ্যা, ধনুর্বেদ, রাজনীতি ইত্যাদি সব বিষয়েই চৌকস হয়ে উঠলেন দেব্রত। রাজা শান্তনু একদিন যমুনাতীরে গিয়ে সত্যবতী নামক দাসকন্যাকে দেখে তার পিতা দাসরাজের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। দাসরাজ সম্মত হলেন এই শর্তে যে, সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রকে রাজা করতে হবে, বড় ছেলে ভীষ্ম রাজ্যভার নিতে পারবেন না। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে না পেরে মহারাজ শান্তনু বিমর্ষ হয়ে থাকেন।
দেব্রত বিষয়টি জানতে পেরে দাসরাজের কাছে যান এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি পিতৃসিংহাসন কখনোই দাবি করবেন না। তাছাড়া তিনি চিরকুমার থাকবেন যাতে তার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যতে রাজা হবেন এমন সম্ভাবনাও থাকবে না। সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই রাজা হবেন। দেব্রতের এই কঠিন প্রতিজ্ঞা সবাইকে বিস্মিত করে। তিনি আজীবন এই প্রতিজ্ঞা কঠোরভাবে প্রতিপালন করেছিলেন।
শান্তনুর ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের। শান্তনুর মৃত্যুর পর সত্যবতীপুত্র চিত্রাঙ্গদ রাজা হন। তিনি গন্ধর্বদের হাতে নিহত হবার পর সত্যবতীর দ্বিতীয় পুত্র বিচিত্রবীর্যকে রাজসিংহাসনে বসান ভীষ্ম। বালক বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে রেখে বিমাতা সত্যবতীর নির্দেশে ভীষ্ম রাজ্যপালন করেন এবং সকলের কাছে প্রিয় হিসেবে খ্যাত হন।
পরবর্তীকালে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর সত্যবতী ভীষ্মকে অনুরোধ করেন ভ্রাতৃজায়ার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে ধর্মরক্ষা করতে। ঐ সময় ভীষ্ম বলেছিলেন, ‘মা তুমি যা বলেছ, তা ধর্ম বটে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার যে প্রতিজ্ঞা আছে, তাও তুমি জানো। ঐ প্রতিজ্ঞা আমি তোমার কারণেই করেছিলাম। এখন আবার সেই সত্য অক্ষুন্ন রাখার জন্য প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি ত্রৈলোক্য পরিত্যাগ করতে পারি, দেবলোকের রাজত্ব ত্যাগ করতে পারি অথবা তা অপেক্ষা আরো বেশি যা হতে পারে তাও ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু আমি কখনো সত্যকে ত্যাগ করতে পারবো না। যদি দেবগণ কিংবা ধর্মরাজ ধর্মত্যাগ করেন, তবুও আমি সত্য হতে বিচলিত হবো না। তুমি ধর্মের দিকে তাকাও, আমাদের সকলকে বিনষ্ট করো না। ক্ষত্রিয়ের অসত্যাচরণ নিতান্তই নিন্দার। অতএব আমার দ্বারা এ কাজ কখনোই সম্পন্ন হবে না।’
ভীষ্মের এরূপ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে সত্যবতী আর তাকে অনুরোধ করেননি ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞা থেকে একচুল বিচ্যুত হননি কখনো। এজন্য অবিচল বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাকে মানুষ ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা বলে অভিহিত করে থাকে প্রবাদে।