ভাঙন

অনেক কিছু থাকে। কালকের মন থাকে, মানুষটি থাকে। কালটি থাকে না। দিন থাকে না। তারপর কালে কালে সবই যায়। মানুষটিও থাকে না। যম নয়, শমন নয়, মহাকাল এসে তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় কালের বুক থেকে। কাল বদলায়, তার বুকে যেন মানুষ বুদবুদের মতো ফোটে, তারপর দম শেষ হলে ফেটে যায়। কালের সৃষ্টি-ভাণ্ডার এত পরিপূর্ণ, দিবানিশি তাই তাকে কেবল ভাঙতেই হচ্ছে। 

শ্রাবণ গেছে। ভাদ্রেরও শেষাশেষি। জন্মাষ্টমীর দিন থেকে তিন দিন সমানে বৃষ্টি হয়েছে। এখন বৃষ্টি ধরেছে কয়েকদিন। নীল আকাশ ভরে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। যেন পিটুলি গোলার বিচিত্র চিত্রাঙ্কন ছড়ানো রয়েছে লেপা-পোঁছা কালো মাটির উঠোনে। আকাশ ভরে রোদ ছায়ার লুকোচুরি। সে খেলার ডাক শোনা যায় কখনও চাপা গুড়গুড় ধ্বনিতে। হঠাৎ রিমিঝিমি বৃষ্টিতে। রূপ দেখা যায় সোনা ঝরা রোদে, বাতাসে দোলা সবুজ মাঠে। আর দিকে দিকে ভরা ভরতি। টাবুটুবু গঙ্গা, ঢলঢল দিঘি পুকুর, উপচানো খানা খন্দ নালা। 

কৃষ্ণপক্ষ গিয়ে পড়েছে শুক্লপক্ষ। সামনে ঝুলনযাত্রা। গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে চলেছে। ঝুলনের আয়োজন। সংক্রান্তির দেরি নেই আর। কামার, স্বর্ণকার, তাঁতিরা বিশ্বকর্মা পুজোর উদ্যোগ আয়োজনে ব্যস্ত। যেখানে যা কণা কুটো পাওনা সবটুকু টুকে টুকে খুঁটে খুঁটে নিচ্ছে। তাদের তো এই বছরের শেষ, এখন আর বাকি রাখলে চলবে না।

ভাদ্রের ভরা, সবটুকু ভরা। ধরিত্রীর কোথাও কোনও ফাঁক নেই যেন। যখন তার এখানে ভরে, তখন তার সেখানেও ভরে। সেখানে, ইনি আর উনি, আকাশ আর মাটির এই বিশাল ফাঁকটুকুও বাঁধা পড়ে। মহাভাদ্র কী জানি কী এক গুরুগম্ভীর সুরে মুখোমুখি মিলিয়ে দেয় সব অমিলকে। মিল নেই মানুষের। প্রকৃতির মন্দির ভরা, শুধু মানুষের মন্দির শূন্য। এত অমিল! সেখানে চাওয়ার মিল নেই, পাওয়ার মিল নেই। মনে অমিল, হৃদয়ে অমিল। অসামঞ্জস্য কটাক্ষে, বেসুর হাসিতে। সব অমিলকে নিয়ে বিশ্ব সংসার ঘুরছে চক্রাকারে। 

আর এই অখিলের মাঝে দিবানিশি ঝিম ঝিম করে বাজে শুধু ভানুমতীর পায়ের মল। রান্নাঘরে, শোবার ঘরে, গোয়ালে, উঠোনে, গোলায়। আচমকা চমকায় নৈঃশব্দ্যে বাড়ির পিছনের খিড়কি দ্বারে, পুকুরঘাটে। পাতামল হাসুলির ঝিমি-ঝিমি, হাওয়ায় হুশ করে এসে ঝাঁপ খেয়ে পড়ে চতুম্পাঠীর সীমানায়। যদিও চতুষ্পঠীর সীমানায় আসা বারণ আছে ভানুমতীর। কিন্তু কোনও বারণের বেড়া দিয়ে বাঁধা যায় তাকে? ধর্মশাস্ত্র-সমাজ সবকিছুকে বেঁধেও একজনকে বাঁধা যাচ্ছে না কিছুতেই। সে শিবনাথের দুর্বার রক্ত দিয়ে গড়া পুতুল। সে তার নিজের রঙ্গ তরঙ্গে লুকোচ্ছে সবখানে। চতুম্পাঠী পর্যন্ত চমকায় সে শব্দে। অধ্যয়নে ভুল হয় পণ্ডিতের। ছাত্রদের কানে কানে ঝাঁপটা খায় পাতামল। 

একজনের বিশেষ করে। যাকে শোনাতে চায় ভানুমতী নিজে। সে অবনী। পণ্ডিতদের অবন, সর্দার পোডো। তাকে বড় ভাল লাগে ভানুর। অবনকে একলা পেলে হয়। কারণে অকারণে এসে ঘুরঘুর করে কাছে। কথা বলে অনর্গল। কী করছ, কেন করছ? এক কথা বলতে আর এক কথা। কখনও কথায় পায়। হাসিতে পায় কখনও। 

কথা জোগায় না অবনের মুখে। ভয় আছে, সংকোচ আছে। একটু অন্যায়বোধও যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে মনে মনে। তবু, শুধু চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে দেখে আর আঠারোর রক্ত কাঁসরে বাজে এক প্রলয়ের বাজনা। এমনি করে চেয়ে থাকত নব। এক হাতে তালি বাজে না। নইলে অবনের সঙ্গেও বড় ঝগড়া করতে প্রাণ চায় ভানুর। কিন্তু অবনের সঙ্গে ঝগড়া হয় না কিছুতেই। সর্দার পোডোর চেহারা, পণ্ডিতের মতো তার পোশাক, নিরীহ নম্র কথা, সব মিলিয়ে নব থেকে আলাদা মনে হয়। তাই ঝগড়া পাকাবার ফন্দি থাকলেও মুখঝামটা দেওয়ার সুবিধা হয় না। আর মুখ ঝামটা না দিলে যেন ভানুর কিছুতেই ভাব জমতে চায় না। কেবল যখন সবাইকে লুকিয়ে, মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে অবন, তখন টের পেয়ে দূর থেকে ঠোঁট টিপে চোখ ঘুরিয়ে ঘুষি পাকিয়ে দেখায় ভানু। কখনও বুড়ো আঙুল দেখায় নেড়ে নেড়ে, জিভ ভেংচে দেয়। হাসে খিলখিল করে। অবন লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। মনে ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা। ভাল লাগার লজ্জা। 

দুদিন অবনকে ডেকে নিয়ে গেছে পুকুরঘাটে৷ হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে গেছে। নিশির হাতছানি। ডাকাডাকি এমনি। এতে যে কোনও অপরাধ আছে, সে বোধ যেন নেই। ভাল লাগে তাই। বসো, কথা বলল। কী কথা তার ভানু কী জানে। নাম কী? অবনীমোহন…কী? 

মুখোপাধ্যায় বেরোয়নি ভানুর মুখ দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছে, চৌবাড়ির কথায় কেন? এমনি মুখের কথায় বলো না। 

চৌবাড়ির অর্থাৎ ওটি চতুষ্পঠীর আটপৌরে উচ্চারণ। তারপর মুখুজ্জে শুনে বলেছে, ও! মুকুজ্জা? তুমি মুকুজ্জা বামুন? বাড়ি কোথায়? চুঁচুড়া? বড় ভয়ের দেশ ওটি ভানুর কাছে। তবু, চুঁচুড়ার কথা শুনেছে অবনের কাছ থেকে। চুঁচুড়ার গঞ্জ, বাজার, সাহেব, দপ্তর, কোর্ট, কাছারি। কিন্তু বলতে পারেনি নিজের প্রাণের কথাটুকু। প্রাণ কেঁদেছে। তবু নয়। 

বলেছে হালিশোর চেন? গেছ? ওমা! তুমি কে গো?

তারপর বলেছে, আমাকে তোমার খুউব ভাল লাগে, না? সেই জন্য চেয়ে চেয়ে দেখ বুঝিন? 

অবনের বুক কেঁপেছে থরথর করে। টোলের ছাত্র, কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসে যেন ফাটল ধরেছে কোথায়। তাই নিজের সর্বনাশা আবেগ দমনের জন্য ভগবানকে ডাকতে পারেনি। সত্যান্বেষী কূট কঠিন বুদ্ধি ভানুমতীর কিশোরী ঠোঁটের হাসিতে ভেঙে গেছে খানখান হয়ে। চোখে চোখ রাখতে পারেনি। বলেছে, মিথ্যে কথা বলেছে, দেখি আপনি যে আমার গুরুপত্নী। 

আমি গুরুপত্নী! সে আবার কী? আমাকে আপুনি বলছেন কী গো? তুমি বাউনের ছেলে, আমার পাপ হবে যে!

চমকে উঠেছে অবন। পাপ! কেন, গুরুপত্নী কি তবে ব্রাহ্মণ কন্যা নয়? কিন্তু ফিরে তাকিয়ে দেখতে পারেনি। ভেবেছে, ব্রাহ্মণ কন্যা, কিন্তু ছেলেমানুষ। কথায় পেলে যে সে এমনি আবোল-তাবোলই বকে। ডেকে নিয়ে বায়না ধরেছে, সাঁতার কাটবে। আবার ফিক ফিক করে হেসে ফিসফিস করে বলেছে, আমার ননদটা পাগলি, জানো৷ 

অর্থাৎ শিবনাথের দিদি। আরও অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করেছে অবনকে। অনেক কথা। তার সব কথা। কিন্তু ভরসা হয় না। একদিন বলবে। একদিন, যেদিন ভরসা করতে পারবে। 

কখনও টানা টানা চোখে তাকায় কটমট করে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, তুমি খালি হাঁ করে তাককে তাককে দেখো, হ্যাঁ। কেন? কেন? 

এক ফোঁটা মেয়ে ভানু! সে পাপ বোঝে না। কিন্তু অবনের কাঁচা সোনা বুকে প্রথম রং লাগিয়েছে। প্রথম পুড়িয়েছে, গলিয়েছে। কেন? অবন-ই কি বোঝে! গুরুপত্নী! ছি! তবু কেন, কেন যে! 

ভানু বলে চোখের তারা নাচিয়ে, ঠোঁট টিপে হেসে, জানি কেন।

বলে খিলখিল করে হাসে স্থান কাল পাত্র ভুলে। অবনের গলানো সোনায় ফোটে মিনে করা ফুল। ভানুর এ অবনপ্রীতিটুকু শিবনাথের নজরে পড়ে কি না কে জানে। সব চেয়ে চেয়ে দেখেন শুধু দিদি। নিজে এখন কিছুই করেন না সংসারের। বসে আছেন, বসেই আছেন। কখনও সখনও হঠাৎ ভানুর কাছে এসে দাঁড়ান। কী যেন বলেন। বলেন না, চেয়ে থাকেন বড় বড় চোখে। ভানু বলে, কিছু বলছ? 

দিদি ঘাড় নাড়েন নিঃশব্দে। ভানু মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, তবে অমন করে তাকোনি বাপু। আমার ভয় লাগে। 

যেন কতকালের বউ। কত দিনের গিন্নি। বলেই হয়তো এক মুঠো আমচুর মুখে পুরে দুর দুর করে ছুটে যায় পুকুরঘাটে চাল ধুতে। এ সেই ভানু, যার নাম বিনি জেলেনির মেয়ে গঙ্গা। ভানু, ভানি। কখনও বাটনা বাটতে বাটতে ছোলা ভাজা চিবুচ্ছে। রাঁধতে বসে বিষ টোকো করমচা কাটছে দাঁতে কুটুস কুটুস করে। ভাতের ফেন গালতে ভুলে ঘরে গিয়ে সাজতে বসে। সিন্দুক খুলে গহনা বার করে পরে। পোশাকি চেকনাই শাড়ি জড়ায় গায়ে। সিন্দুকের পাল্লায় গাঁথা আরশি। আরশিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নিজেকে। নিজেকে দেখা চাই একবার প্রতি দিন। প্রতি দিন আঁতিপাঁতি করে। দেখে, অবাক হয় আর কাপড় জড়ায়। জড়িয়ে জড়িয়ে আর জড়ানো হয় না। কী এক কৃপণের ধন যেন দিনে দিনে সঞ্চিত ফীত হচ্ছে বুকে। জীবনে কী এক বিচিত্র লজ্জার আবির্ভাব যেন ঘটছে। কখনও ভাত পোড়ে। উনুন নিভে যায়। গাই বাছুরগুলি হাম্বা হাম্বা রবে চেঁচায়। ভানু তখন আরশি ছেড়ে হয়তো পুকুরের ভাঙা ঘাটে বসে নিজের ছায়া দেখে জলে। ভেংচায় ছায়াকে। চুল এলো করে দেখে। আবার ছুটে ছুটে সংসার করে।

হায় বাচস্পতি গৃহিণীর এমন মূর্তি আর কোথাও দেখা যায় না। 

স্বভাবতই, ভরা সংসার ছড়ানো। আগোছালো, অবিন্যস্ত। দিদি কয়েক দিন আগে পর্যন্তও শিবনাথের পূজা আহ্নিকের ব্যবস্থা করে দিতেন নিজে। পরিষ্কার করে, ধুয়ে মুছে রাখতেন। এখন তাও থাকে না। কোষাকুষিগুলি মাজা থাকে না সবসময়। গঙ্গাজলের কলসি থাকে শূন্য। আবার ডাক পড়ে ভানুমতীর। বড় বেসামাল শিবনাথ ভানুকে নিয়ে। কিন্তু দুঃখ নেই। নালিশ নেই একটুও। হয়তো এতখানি ভাবেনি শিবনাথ এত ছেলেমানুষ। আর দামাল! তবু এত বেসামাল হয়েও সামাল দিতে ইচ্ছে করে না। নিজেও বেসামাল যে। কখনও দুরদুর করে ভানু ছুটে যায় চতুম্পাঠীর উঠোনে। ঘোমটা ঢেকে, হাতছানি দিয়ে ডাকে অধ্যয়নরত শিবনাথকে। ব্যস্ত শিবনাথ ছুটে ছুটে আসে। কী ব্যাপার। ভানু কখনও বলে, আমাকে একটা ছাঁকনি জাল এনে দিতে হবে। কুঁচো চিংড়ি ভরে আছে পুকুরের ধারে ধারে। শিবনাথের কপালের রেখা এঁকে-বেঁকে ওঠে। শিবনাথ বাচস্পতির পত্নী ছাঁকনি জালে মাছ ধরতে চায়! হবে। তাই হবে। 

কখনও ডেকে নিয়ে এসে উনুনে ফুঁ দিতে বলে, কাঠ পেড়ে দিতে বলে। তা ছাড়া বড় যে ভয় শিবনাথের ভানুর মুখকে। কখন যে কী বলে, কী যে বলবে, তার ঠিক কী! বড় একটা ঘাঁটাতে সাহস পায় না তাকে শিবনাথ। 

এদিকে চতুম্পাঠীর অবস্থা খারাপ। নারায়ণ চলে গিয়ে শিক্ষকের অভাব। ভেবেছিল, অবন সে অভাব মেটাতে পারবে। কিন্তু অবন নিরাশ করেছে। শুধু নিরাশ নয়, ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। নারায়ণের অভাব সে মিটিয়েছে ঠিকই। তবে শিবনাথকে নয়, ঈশান মিত্রকে। ঈশানের অনুপস্থিতিতে সে নীলকর রায়তদের কাজ করছে অষ্টপ্রহর। ঘুরে বেড়াচ্ছে মোকামে মোকামে, মৌজায় ও পরগনায়। এ অঞ্চলের রায়তদের তারাই ভরসা। রায়তেরা এ দুজনের মুখ চেয়ে আছে সর্বক্ষণ। কলকাতায় দীনবন্ধু হরিশ। বেহুলা গুপ্তিপাড়ায় ঈশান ও অবন। গুপ্তিপাড়ার কুঠিতে ছোট সাহেব শিবনাথকে ডেকে নিয়ে বলেছে, তুমি বেইমান পণ্ডিত। নিজে আড়ালে থেকে ছাত্রকে লেলিয়ে দিয়েছ! শীঘ্রই যমালয়ের মুখ দেখবে তোমার ছাত্র। তুমিও রেহাই পাবে না। তোমার ছাত্রের বাপ অভয় মুখুজ্জে আমার বন্ধু মানুষ। চুচুড়াতে সে বহুৎ পয়সাওয়ালা বেনিয়া। তাকে আমি আজই চিঠি লিখছি। তুমি হুঁশিয়ার। 

শিবনাথ বলেছে, আমি কিছুই জানিনে সাহেব। 

তবে তোমার স্টুডেন্ট কেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিলোচনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে? বহুৎ কড়া চিঠি। বাপের পয়সায় ইংরেজি শিখে নালায়েক ছেলে কুঠিয়ালকে বে-ইজ্জত করতে চায়? হরিশ মুখার্জী ফাঁসি যাবে। তোমার ছাত্রকে তুমি সাবধান করে দিয়ো৷ 

সাবধান নয়, স্নেহের শাসন দিয়ে বাধা দিতে গেল শিবনাথ। অবন নিরাপদে কাজ করে চলল। এমনকী, আশ্বিন মাসে অবনের নবদ্বীপে পণ্ডিতদের সভায় যাওয়ার কথা। সে যাবে না বলে স্থির করেছে। একমাত্র অবনই ভরসা ছিল শিবনাথের। তার টোল থেকে, গুপ্তিপাড়ার পথ থেকে, হয়তো হুগলি বর্ধমানের তরফ থেকে নবদ্বীপ জয় করে আসতে পারত শুধু অবন। এখন বলছে সে তৈরি হতে পারেনি। দুর্বাসার মতো জ্বলে উঠতে ইচ্ছে করে শিবনাথের কিন্তু পারে না। অবনের মেধা ও বুদ্ধির কাছে তার একটি গুপ্ত দুর্বলতা আছে। আরও কথা ছিল, আশ্বিন মাসে অবন নবদ্বীপ যাবে। আর ফিরে এসে শিবনাথের সঙ্গে চুঁচুড়ার বাড়িতে ফিরবে। শিবনাথের যজমান তারা। কয়েক দিন শিষ্যবাড়ির ভক্তি আদর যত্ন ভোগ করবে। কিন্তু সমস্ত আশা ধূলিসাৎ। 

তারপর চিঠি এল অবনের বাবার। শত কোটি প্রণাম জানিয়ে লিখেছেন, অবনের কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় আছি। আপনি তো জানেন, সে আমার একমাত্র পুত্র। তার উপরে মাতৃহীন। ডাচ্ ও ইংরাজি ভাষা ছাড়াও সংস্কৃত জ্ঞানলাভ করুক, এই চেয়েছিলাম। সে আমার কাছে লোক পাঠিয়ে অনেক টাকা চেয়ে নিয়েছে। কেন। জানি না। আপনি মহাপুরুষ, আপনি ভরসা। 

শিবনাথ নিজেকে ধিক্কার দিয়ে আপন মনেই বলে উঠেছে, না না, কোনও ভরসা নেই। মহাপুরুষ নয় শিবনাথ। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে পাঠাতে চায় সে। 

খবর নিয়ে জানল দরিদ্র রায়তদের মামলা লড়বার জন্য টাকা আনিয়েছে অবন। শিবনাথের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ঈশানের উপর, যদিও ঈশানও সর্বস্বান্ত হতে বসেছে। কিন্তু অবন আজ বাড়ি ফিরে যাওয়ার উর্ধ্বে। ফেরা না ফেরা আজ আর শিবনাথের হাতে নেই। শুনল, বিলোচন ফিরে এসেছে। তার সর্বাঙ্গে পীড়নের দাগ। জামা খুলে সবাইকে দেখিয়েছে বিলোচন। কিন্তু শিবনাথের কাছে আসবার সময় সে পায়নি। সবাই খালি বলল, উঃ, কী মারইনা মেরেছে! বিলোচনকে নাকি কলকাতায় পাঠানো হবে, তার গায়ের শ্যামচাঁদের দাগ দেখাতে। চারদিকে এই ব্যাপার নিয়ে হই-চই হুলুস্থুল! লোকের মুখে মুখে অবন আর ঈশান। 

শিবনাথের মুখে অবনের কথা শুনে ভানু বলল, খুব হয়েছে, ঠিক করেছে। বড় ঢ্যামনা ওই নীলকর সাহেবগুলান। 

ভয় হয়, লজ্জা হয় ভানুর মুখের সামনে দাঁড়াতে। অবনী টাকা দিয়েছে শুনে ভানুর খুশির সীমা নেই! চোখ বড় বড় করে সে বলল, ট্যাকা দিয়েছে! ওমা! তোমার সদ্দার পোড় তত ভগবান গো। বড় ভাল মিনসে, আমার খুউব ভাল লাগে। 

সর্দার পোড়ো, অর্থাৎ অবন। আশ্চর্য! অন্য সব ভুলে যায় শিবনাথ। বুকের মধ্যে কোথায় যেন টনটন করে। জিজ্ঞেস করে ভানুকে, আমাকে ভাল লাগে না? 

ভানু বলে বাঃ, তুমি তো সোয়ামি।

 সোয়ামি! অর্বাচীন, কিন্তু শুনতে বড় মিষ্টি লাগে।

শিবনাথ বলে, সোয়ামিকে ভাল লাগে না তোমার, না?

 ভানু গাল ফুলিয়ে বলে, তোমার কাছে তো আমি রোজ রাতে শুই।

বিচিত্র জবাব। কী কথায় কী কথা এসে পড়ল আবার! সে কি ভাল লাগার চেয়েও ভাল, না খারাপ? এ বালিকাকে কী করে বোঝাবে শিবনাথ, শুধু স্বামী-স্ত্রীর নিয়মের দিন রাত্রি উদযাপন নয়। ভানুর আসল মন প্রাণ কোনদিকে ধাবিত? সেইটি যে চায় সে ভানুর কাছে। 

সকালের দিকে সেদিন ভানু চেঁচিয়ে উঠল, ও মা! সেই মেয়ে-খুনে বাপটা এসেছে গো।

শুনে শিবনাথ হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, দেখল, নীলরতন চক্রবর্তীস্বর্ণলতার বাবা। সে ডুকরে উঠল–ছিঃ বউ, চুপ চুপ! ভানু অমনি ফোঁস করে উঠল, চুপ করব কেন গো? জানিনে বুঝিন? 

মিনসেটা মেয়ে মারলে, তোমার মিতে ঠাউরটাকে গাঁ ছাড়া করলে… 

ব্যস্তসমস্ত হয়ে শিবনাথ ভানুর মুখে হাত চাপা দিল। মুখ নীল হয়ে উঠল তার। আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় ভেঙে পড়ে বলল, চুপ, চুপ, তোমার হাতে ধরি! 

শিবনাথের মুখ দেখে ভয়ে বিস্ময়ে নির্বাক হল ভানু। শিবনাথ হাতজোড় করে ছুটে গেল নীলরতনের কাছে, ক্ষমা করুন খুড়োমশাই, ক্ষমা করুন। ছেলেমানুষ। 

নীলরতন বলল, ঠিকই বলেছে শিবু। তোমার পরিবার মিছে কয়নি। 

তবুও শিবনাথ হাতজোড় করল। দেখল নীলরতনের কালো মুখ পোড়া হয়েছে। চোখ ঢুকেছে গর্তে। বিভ্রান্ত দৃষ্টি। আড়ালে গিয়ে সে বলল, শিবু বাবা, আমাকে একটু প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে হবে। 

কীসের প্রায়শ্চিত্ত খুড়োমশাই?

 প্রাণী হত্যার।

শিবনাথ এমনটি একেবারেই ভাবেনি। তার গলা চেপে এল। তবু বলল, প্রয়োজনানুযায়ী প্রাণী হত্যায় তো পাপ নেই। 

নীলরতন বলল, প্রাণী নয় শিবু, নরহত্যার প্রায়শ্চিত্ত। 

শিবনাথ তবুও বলল, ধর্মার্থে তাতেও বারণ নেই খুড়োমশাই। আপনার বাবা তো নরবলি দিয়েছিলেন চণ্ডিকার মন্দিরে। 

দুহাতে নিজের গলা টিপে ধরে বলল নীলরতন, শুধু নরহত্যা নয়, আরও কিছু শিবু। সে যে অন্য বস্তু, আমার ঔরসজাত, আমার, আমারি। সে আমার প্রথম সন্তান শিবু। সন্তান হত্যার প্রায়শ্চিত্ত চাই বাবা। 

শিবনাথনীলরতনকে এতখানি পাপী বোধ করেনি। এখন তার মুখে এ কথা শুনে শিবনাথের নিজের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। 

নীলরতন আবার বলল, শিবু, বাড়িতে হাঁড়ি চাপে না। বাকি তিনটে মেয়ে সারাদিন নারায়ণ পুজো করছে। কিন্তু নারায়ণের নাম মুখে নেয় না। বলে ওই নাম তাদের মুখে নিতে নেই। সর্বক্ষণ আরায়ণ আরায়ণ শব্দ বাড়িতে। আমার গায়ে কাঁটা দেয় সেই ডাক শুনে। আমি তো রাজা দক্ষ নই শিবু, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। নারায়ণ শিরোমণি স্বয়ং শিব হয়ে রইল। শিবু, আমিও দিন রাত ডাকি, হে বিপদভঞ্জন মধুসূদন, হে ত্রাণকর্তা নারায়ণ! 

শিবনাথের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্যবস্থা দেবে কী, ভীরু দুর্বলের মতো তার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করল। 

.

নীলরতন চলে গেছে। হয়তো শিবনাথকে অপদার্থ ভেবেই গেছে। আরও নিষ্ঠুর, শয়তান ভেবে গেছে হয়তো। যাক, যাক তাতে শিবনাথের পাপ কোথায়! ভানুমতী তার জীবনে আশ্চর্য ক্ষমতা বয়ে এনেছে। সমস্ত ভাবনা, দুশ্চিন্তা, ভয় ছাড়িয়ে সে বালিকা ভানুর আঁচলে আঁচলে ফিরছে। তার বাইরের দরজা ভেঙেছে। ভিতরের দরজা তো বন্ধ। সেখানে ধর্ম, শাস্ত্র, ধ্যান, জ্ঞান, পূজা আর ভানুমতী। সেখানে সে নিষ্কলঙ্ক, ভরপুর। সমস্ত জমি যদি নীলকর নেয়, যজমানেরা থাকবে। চতুম্পাঠীও যদি উঠে যায়, নিজের শাস্ত্রচর্চায় বাধা কোথায়। অবন? সে তো ত্যাগ করেছে কবেই। 

.

শোনা গেল গগন পালের বিধবা মেয়ে এসেছে সধবা হয়ে। সেই মেয়ে আর তার দোকর বিয়ের স্বামী, দুজনে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে ঢুকতে গিয়েছিল। মোহান্ত ঢুকতে দেয়নি। দুজনে হত্যে দিয়েছে দরজায়। অগণিত লোক ভিড় করেছে সেখানে। গুপ্তিপাড়া বেহুলার লোক শুধু নয়। ওদিকে কালনা নবদ্বীপ, ওপারের শান্তিপুর, উলো, এদিকে সপ্তগ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসেছে নতুন সধবা দেখতে। যেন রথের মেলা দেখতে এসেছে সবাই। মোহান্ত লাঠিয়াল বসিয়েছে। শিবনাথের যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু যেতে পারে না। নারায়ণ আছে সেখানে। জানে, অবন যখন বাড়িতে নেই, সেও সেখানেই আছে। ভানু যাওয়ার জন্য লাফালাফি করছে। যেতে পারছে না একলা। খেতে, বসতে, রাঁধতে গালাগাল দিচ্ছে মোহান্তকে। দিদি ছটফট করছেন। ঘুরছেন, বসছেন, আঁচল নাড়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন। গায়ে যেন কী রয়েছে, ঝেড়ে ফেলতে চান। দু দিন বাদে শোনা গেল, মন্দিরের দরজা খুলেছে। ঢুকতে দিয়েছে গগন পালের মেয়েকে। 

দিদি আর থাকতে পারলেন না। ঘোমটা ঢেকে গিয়ে দেখে এলেন গগন পালের মেয়েকে। দেখে এসে আরও উন্মনা আনমনা হয়ে গেলেন। গোয়ালে গিয়ে বসেন, বাগানে গিয়ে বসেন। দেখলেন, ভানু পুকুরঘাটে, একটি বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে। আবার ইতি-উতি দেখে এক ফাঁকে নিঃশব্দ পদ সঞ্চারে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। খিল এঁটে দাঁড়ালেন আরশির সামনে। সামনেই ছিল ভানুর নীলাম্বরী। টেনে নিয়ে জড়ালেন থানের উপরেই। জড়িয়ে ঘোমটা দিলেন। দর দর ধারে ঘেমে হাঁপাতে লাগলেন। যেন এখুনি মরে যাবেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। কম্পিত হাতে, সিঁদুর কৌটা নিয়ে সিঁথিতে দিলেন টিপ, দিলেন কপালে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন, কে, কে তুমি? 

গগন পালের মেয়ের মুখ মনে পড়ল। আর সমস্ত অতীতকে ছিঁড়ে দেখতে চাইলেন, আর একটি মেয়ের মুখ। বালিকার সধবার মুখ। কিন্তু এ কে? কে? কে? ঠোঁটের কষে ফেনা দেখা দিল। বুকটা ফেটে পড়তে চাইছে। যেন চোখের পলকে ঘটছে সমস্ত কিছু। আতঙ্কে ভয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, না, না, না, ক্ষমা করো! যেন শরীর থেকে আগুন ঝেড়ে ফেলার মতো নীলাম্বরী খুলে ফেললেন। সজোরে ঘষতে লাগলেন সিঁথি কপাল। কিন্তু রং তো মোছে না। হে ভগবান! হে মুখপোড়া বিদ্যেসাগর! মাথা জ্বলে গেল! একী করলুম। খুট করে দরজা খুললেন। থান দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে ছুটে গেলেন নরসুন্দরের বাড়ি। ওরে, শিগগির শিগগির মাথা মুড়িয়ে দে। নরসুন্দর গড় করে বলল, কী হয়েছে মা ঠাকরুন। 

ওরে রং লেগে গেছে কপালে মাথায়। আমি বামুনের রাঁড়ি। কী পাপ! জ্বলে গেল বাবা, দে, দে, তাড়াতাড়ি মুড়িয়ে যে বাবা। 

ঠাকরুনের অবস্থা দেখে নরসুন্দর ক্ষুর নিয়ে বসল। প্রৌড়া বিধবার বাসনার বিচিত্র রন্ধ্রের দিকে তার নজরও গেল না। তাড়াতাড়ি মাথায় জল ঢেলে কচ কচ করে কামিয়ে দিল। 

বললেন কপালটা? কপালটা একটু চেঁচে দে বাবা।

কপাল? কপাল চাঁচব কী করে ঠাকরুন। অক্ত বেরুবে যে। 

তবে মাটি লেপে দে। বলে নিজের হাতে মাটি লেপে দিলেন। চুলের গোছা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেলেন গঙ্গার ধারে। সপরিবারে নরসুন্দর স্তম্ভিত হয়ে রইল। তারপর স্ত্রীকে বলল, দেখলি, এটটুখানি রং লেগে গেছে তো কেমন করছে? একে বলে বামুনের রাঁড়ি। 

দিদি এসে গঙ্গার স্রোতে চুল ফেলে দিয়ে বললেন, রং লেগেছিল, শুদ্ধ রং। পাপ রং। 

জলে ডুব দিয়ে বললেন, ধুয়ে মুচে যাক সব রং, যাক যাক।

 তারপর পাড়ে বসে জপ করতে লাগলেন। 

.

ভানু উঠে আসছিল পুকুর ঘাট থেকে। বনের ভেতর থেকে সামনে এসে দাঁড়াল শৈল। বলল, কী লো মুখপুড়ি, একেবারে যে ভুলে গিচিস। 

ভানু চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই হেসে জড়িয়ে ধরল শৈলকে। বলল, দি-মণি, তুমি?

 শৈল কিন্তু হাসল না। বলল, থাক, আর দি-মণি করিসনে লো। বাউন ভাতার পেয়ে যে সবই ভুলে গেলি। 

বাউন ভাতার। খিলখিল করে হেয়ে উঠল ভানু। বলল, কী যে বলো তুমি। 

শৈল তীব্র চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ভানুকে। বলল, ঠিকই বলেছি। বের জল নেগেচে ভেঁসে উটিচিস। বেউলের মস্ত পণ্ডিতের বউ হয়েছিস। পণ্ডিতকে নিকি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিস। শুনি, সবই শুনতে পাই।

শৈলর কথাগুলি কেমন বাঁকা বাঁকা। চেপে ছুঁচ বিধানোর মতো। পান খাওয়া ঠোঁটের কোলে বাঁকা শ্লেষ। চোখেও যেন ছুরি শানিয়ে এসেছে। 

ভানুর ঠোঁটের হাসিটুকু আড়ষ্ট হয়ে উঠল। এক খণ্ড হালকা মেঘ নেমে আসে যেন মুখে। তবু হেসে, দু হাতে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শৈলকে। কোনও কথা বলল না। শৈল দু হাতে তাকে সামনে এনে আবার এক বার দেখল অপাঙ্গে। চোখ বুজে একটি বিচিত্র ইশারা করে বলল, হবে না। আগুন যে। এ রূপ দেখে কি আর পণ্ডিতের মাথার ঠিক আছে? জাতে মরেও ভেড়া বনে গেছে। বলে আমারই পাণ চায়। তা পুরুষ তো লই। 

বলে গাল টিপে দিল ভানুর। গালটা লাল হয়ে উঠল। কিন্তু ঔষধি লতা গন্ধে সন্ত্রস্ত সর্পিণীর মতো শিরদাঁড়াটা শক্ত হয়ে উঠল ভানুর। বাতাসে বিপদের গন্ধ। মাটিতে যেন চোরাবালির রেখা! বয়স অল্প। ছেলেমানুষ। কিন্তু মাটিতে পা দিলে বুঝতে পারে, কোথায় ধস নামছে। ভানুর মনটা হঠাৎ কেন যেন খারাপ গেয়ে উঠল। ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল। 

ভ্রূ বেঁকল শৈলর। ছোট হল চোখ। খপিসের মতো হেসে বলল, ভাল লাগছে না বুঝিন দিদিমণির কথা। ও, হ্যাঁ লা, বলি বাউন পণ্ডিতকে ন্যাজে-গোবরে করিচিস, বেশ করিচিস। নিজে ভুললি কীসে লো অ্যাঁ? কী মন্তোর পড়ালে তোকে ওই বুড়ো ঘাট-মুখো পণ্ডিত। 

ভানু বড় আশায় জড়িয়ে ধরেছিল শৈলকে। হাতটা যেন আলগা হল। বলল, কী মন্তোর আবার। 

তবে? বুড়ো পণ্ডিতেই মন ভরল। নাকি দানা পেয়ে শখের পায়রা বনে গেলি?

 টিপে টিপে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলে শৈল, এদিক ওদিক দেখে। কিন্তু আসল কথা বলে না। আবার বলল, নাকি, আর কাউকে জল্পে-ছিস, রূপের বিষ ঢেলেছিস? 

বলে ধাক্কা দিয়ে মুখ ঝামটা দিল, মাগি শক্ত হচ্ছিস কেন? দেখি? 

কাপড় সরিয়ে বুকে হাত দিয়ে বলল, হুঁ, বয়সের জল লেগেছে, কিন্তু বড় ধক ধক করছে যে! বাঃ চেন হার গলায়, কানে ভেঁড়ি চাঁপা, হাতে কাঁকন, পায়ে পাতমল! শুনিচি আরও অনেক আছে। চন্দ্রহার, অনন্ত, গোট, টিকুলি বাকসো ভরতি লবাবি আমলের গয়না। তাই আর দিদিমণিকে মনে নেই। 

দুজনে এক মুহূর্ত নীরব। তারপর ভানুকে নিয়ে শৈল ঘাটের একেবারে শেষ ধাপে নেমে এল যেন উপর থেকে কেউ দেখতে না পায়। বলল, কিন্তুন, মুখপুড়ি, সব কি ভুলে গিছিস। এত যে বুইঝেছিলাম, নিজে বলেছিলি কাঁড়ি কাঁড়ি কথা, তার কী হল? শোধ নিবিনি?

অস্থির হয়ে উঠল ভানু। কথা বলতে ভয় হল, লজ্জা হল। তার সে মন যে কবেই মরে গেছে। জীবনের একটি বিড়ম্বনাকে ছাড়িয়ে এসে আর নতুন বিড়ম্বনা নিজের হাতে তৈরি করতে চায় না সে। শান্তি চায় ভানু, বাঁচতে চায় নিঃশঙ্ক মনে। তবু না বলে পারল না, আমি আর কোথাও যাব না দি-মণি। 

শৈল যেন চড় খেয়ে হকচকিয়ে উঠল, যাবিনি কী লো? 

ভানু বলল, কোথা যাব? ভয় করে, বড্ড ভয় করে গো আর কোথা যেতে, সোনা চুরি করতে। এখানেই থাকব আমি।

শৈল ডুকরে উঠল, আ পোড়ামুখি, মর মর মর। মরণ তোর, হারামজাদি, যিদিন জানতে পারবে তুই কৈবত্তের মেয়ে, সিদিন যে মুখে নাথি দিয়ে, ন্যাংটো করে বিদেয় দেবে। জাতকাট চিনিসনি। তখন সে সব পিরিত ফসকা গেরো হবে। 

ভানু বলল, কেউ তো কিছু জানে না। 

জানে না, জানতে কতক্ষণ। 

জানতে কতক্ষণ! কিন্তু কে বলবে? দুজনেই চুপচাপ। ভানু ভাবে, তবে? মনে হল, যম বসে আছে। তার সামনে। শমন নিয়ে এসেছে। অনেক দিন আগের সেই যন্ত্রণাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মগজে। দূরাগত জলস্রোতের মতো কল কল করে শোরগোল উঠল মস্তিষ্কে। জানলে বিদায় করে দেবে? তবে কোথায় যাবে সে? আবার কোথায়, কোনখানে? শৈলর সেই ঘরে? তার চেয়ে যে এখানেই ভাল লাগে। শৈলও ভাবে। মনটা টনটন করে। অনেক পেয়েছে মেয়েটা। একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছে। মনটা বসে গেছে। আর কোথাও তাই যাওয়ার নামে ভয়। সত্যি, কত বা সয় ওইটুকু প্রাণে। কিন্তু সে যে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মেয়েটার সর্বনাশ হবে। ওরা জানবে, আর বিদায় করবে মেয়েটাকে। ছিঁড়ে খাবে দশটা শেয়াল শকুনে। নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কত মেয়েকে করেছে ওরা এমনি। আর ওই কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না আবার একজন এসে পরবে। আর একটি মেয়ে কিনবে বাচস্পতি ঠাকুর, যা তাদের পেশা। প্রায়শ্চিত্ত করবে ঘটা করে। তারপর সোহাগ করে সমস্ত সোনা-দানা ঢেলে দেবে নতুন বউকে, কত দেখল শৈল। কিন্তু না, তা হবে না। ওই সোনা ছাড়া হবে না। ভানুকে সে যে সত্যিবিয়ে দেবে, রাতারাতি চালান করে দেবে বর্ধমানে। সবই ঠিক রয়েছে। এই তত সময়। সবাই নীলের গণ্ডগোলে ব্যস্ত, অস্থির। নিশ্চিন্তে কাজ হবে। 

বললে, যারা মেয়ে লুটে বেচে কেনে, তাদের শোধ দিবিনে মুখপুড়ি। তোর কীসের ভয়। আমি নেই? 

শৈল আছে, শৈল, তার দিদিমণি। কিন্তু তবুও কোনও কথা নেই ভানুর মুখে। শৈল আবার বুকে টেনে আদর করল ভানুকে। বলল, আমার মুখের দিক দ্যাখ, শোন, ও সব মায়া রাখ। এ পিরিত থাকবে না। সামনে ঝুলন পুন্নিমে। সেই দিন রাতে আসব, সজাগ থাকবি, গয়না গায়ে পরবি, যত পারিস। বাকি আঁচলে বাঁধবি। আর ট্যাকা পয়সা আছে কিছু জানিস? 

ভানু সে খোঁজ তো কোনওদিন করেনি। ঘাড় নেড়ে জানাল, জানে না। 

তবে কি খালি ওই বুড়ো পণ্ডিতের সঙ্গে র‍্যাশা করছিলি? মেয়েমানুষের নাম ডোবালি। এটটুখানি সোহাগের সুড়সুড়ি পেইচিস অমনি ঢলে পড়েচিস। সিন্দুক খুঁজে ভেঁড়েমুসে নিবি। আর দেরি করব না, উঠলুম। 

উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল শৈল। রাংচিতের বন কাঁপছে, মড়মড় করে ছুটে আসছে কী যেন। উঁকি মেরে দেখল, একটা শেয়াল। মনে মনে বলল শৈল, মুখপোড়া শেয়াল আর সময় পেল না। বেরুবার। কেমন যেন অশুভ লক্ষণ গেয়ে উঠল মনটার মধ্যে। ভানুর দিকে ফিরে তাকাল সে তীক্ষ্ণ চোখে। বলল, কথামতো কাজ হয় যেন। ঝুলনের দিন সাজরি, গয়না পরবি, রাতে কান রাখবি বাইরে। টোকা দেব তিনটে টক টক টক। আর অন্য কোনও মতলব ভাঁজিসনে, গঙ্গার ঘাটে নৌকা থাকবে। আমি থাকব সঙ্গে। দুজনে মিলে চলে যাব, কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না। 

শৈল যেতে উদ্যত হল। তার আঁচল চেপে ধরল ভানু। শৈল বলল, কী হল আবার?

ভানু বলল, দি-মণি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে গয়না দিয়ে দেব। আমায় নিয়ে যেয়ো না। 

থমকে গেল শৈল। ভাবল এক মুহূর্ত। সত্যি সত্যি ভাবল, ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। বুঝতে পারছে, মেয়েটার আর ভাসতে ইচ্ছে নেই। কিন্তু, কোনওদিন যদি জানাজানি হয়, তখন শৈলর গয়না নেবার কথা যদি স্বীকার করে ফেলে? তখন যে হুগলিতে ঘানি টানতে যেতে হবে। তা ছাড়া, মেয়েটা বোকা। কাদের কাছে টিকে থাকতে চাইছে, জানে না। শৈল বলল, ওলো না মুখপুড়ি, তোকে রেখে যেতে পারব না, তুই বুঝবি নে। যা বলে গেলুম, কথা রাখিস,নইলে জানিস, বিপদ হবে। ঝুলন পুন্নিমের দিন, মনে থাকে যেন। 

পুকুরের ধার ধরে, বনের মধ্যে অদৃশ্য হল শৈল। কাছের পাড়া থেকে, একটি ছোট ছেলের গলা শোনা গেল, 

অ গ নীল সাপে ধরলে পরে ছাড়ে না। 
ভব ছেড়ে, অক্কা পেলে, যাবে নীলের যন্তোন্না ॥

ভানুর সাড়া নেই। ভাদ্রের চড়া রোদ লাগছে গায়ে। ঘামে কাপড় ভিজেছে। মুখ লাল চোখ লাল। শুধু লাল নয়, একটা বিচিত্র ভাবলেশহীন বিভ্রান্ত নজর। তার কাঁচা মন ভাবে, এই কি মানুষের সংসার। এ সংসারে মানুষ হাসে গায় আমোদ করে। এ সর্বনেশে সংসারে কি মানুষ শুধু এ সবই করে? তবে এ সংসার জ্বলে না কেন? পোড়ে না কেন? ধসে না কেন? সবাই ফিসফিস করছে, ষড়যন্ত্র করছে। তার মাও করত? বাবাও করত? নবও কি করত? বড় অসহায় দিশেহারা হয়ে ভানু জলের দিকে তাকাল। তার একলা খেলার সঙ্গিনী এই জল। যার বুকে মুখ দেখে সে হাসে, ভ্যাংচায়, মুগ্ধ হয়, কথাও বলে। পুকুরের জল। সে কি কিছু বলতে পারে না ভানুকে। 

জল আসছে চোখ ফেটে ভানুর। ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে ছোট্ট বুকখানি। 

একজন দেখছিল এ সব। অবন এসেছিল টোলের পিছনে, ঘাটে। আসতে গিয়ে থেমে গেছে, রাংচিতের ঝাড়ে আড়াল করেছে নিজেকে। কার সঙ্গে কথা বলছে গুরুপত্নী? মুখোনি যেন দেখা দেখা অন্য মেয়েমানুষটির, চেনা চেনা লাগছে যেন। কবে যেন কোথায় দেখেছে অবন। কিন্তু নীচ জাতিয়া স্ত্রীলোক মনে হচ্ছে, তবে গুরুপত্নীর গায়ে হাত দিয়ে কথা হচ্ছে অমন ফিসফিস গুজগুজ করে? এত কীসের ব্যাকুল আকুতি ছোট্ট ভানুমতীর। 

কেন যেন ভয় হতে লাগল অবনের। একটা অশুভ ভাবনা গুনগুন করতে লাগল তার মনের মধ্যে। অনেক দুশ্চিন্তা তার মস্তিষ্কে। হয়তো বাবা আসবেন দু-চারদিনের মধ্যেই। তাঁর কলকাতার ব্যবসায়ে লাগিয়ে দেবেন হয়তো। সেই জাঁতাকলে এক বার পড়লে আর বেরুতে পারবে না অবন। কলকাতায় বসে আরও পড়াশোনা করতে চাইলেও সুযোগ পাবে না। আজ যে আর গুপ্তিপাড়া ছাড়তে চায় না সে। নিজের মনের আরশিতে নিজেকে দেখে বড় লজ্জা হয়, ঘৃণা হয়, নৈয়ায়িক মন যুক্তিহীন অসহায় বোধ করে। তবু, তবু গুরুপত্নীর খেলাঘরের খেলুড়ি সে, খেলা শেষ না হলে ছুটি কোথায় তার। আরও ভয়, যে কোনওদিন পুলিশে ধরে নিয়ে যেতে পারে তাকে। কুঠির সাহেব আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাকে গারদে দেবার। সরকারের গারদ না হোক, কুঠির গারদেও কয়েদ করতে পারে। কিন্তু গুরুপত্নীর দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তা যেন আরও তীব্র মনে হল।

মেয়েমানুষটি চলে গেল, তবু ভানু কাঁদছে বসে বসে। কেন, কান্না কেন? আঠারো বছরের পৌরুষ, আঠারো বছরের মমতা দুর্বার হয়ে উঠল। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। 

দেখা মাত্র ভানুর চোখের জলে হাসি চমকে উঠল। চোখ মুছে ডাকল হাতছানি দিয়ে। 

ভয় করে অবনের। লোভয়, সমাজের ভয়, পাপের ভয়। তবু না গিয়ে পারে না। কত দিন যে গেছে। কাছে আসতেই ভানু তার হাত ধরল। ধরলে যে ছাড়ানো যায় না। বলল, কিছু বলছেন? 

ভানু বলল, হ্যাঁ। তোমার গুরুদেব যদি আমাকে তাইড়ে দেয়, তুমি আমাকে নেবে তো? চমকে উঠল অবন। তাড়িয়ে দেবে? কেন? বলল, তাড়িয়ে দেবেন কেন? 

ভানু বলল, যদি দেয়? 

এক বার যেন স্পষ্ট চোখে দেখতে চাইল অবন ভানুকে। টানা টানা দুটি চোখ ভানুর। অপলক চোখদুটিতে ভয় চিকচিক করছে কেন। অবন গুরুদেবের কথা জানে না। বোধ হয় নিজেরই মনের কথা বলল, তা কি কেউ কখনও পারে? ভানু বলল, তা হলে তোমার কাছে চলে যাব, কেমন? 

অবন ঘাড় নাড়ল। সত্য মিথ্যা জানে না সে। ভানুমতী যেমন আদেশ করবে, তেমনি হবে। চলে গেল অবন। ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় মন কুঁকড়ে উঠল। কেন, তাড়িয়ে দেবার কথা কেন? ভানু তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাংচিতের পাতা খুঁটতে লাগল। 

বউ? শিবনাথ ডাকছে, সন্ত্রস্ত গলায় ডাকছে, বউ! ও বউ। বউ কোথায় গেলে? দিদি ও দিদি। তোমাদের বউ কোথায়? বউ! বউ! 

ভানু জবাব দিতে পারে না। শিবনাথ ঘাটে এসে পড়ল ডাকতে ডাকতে। ভানুকে দেখে মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, একী এখানে যে? কোটা কুটনো সব গোরুতে খেয়েছে, ভাত পুড়ে আঙ্গার। দিদি নেই ঘরে…

একমুহূর্ত ভানুকে দেখে শিবনাথ বলল, কী হয়েছে? কাঁদছিলে? না, কাঁদেনি, ভানু ভাবছে, শিবনাথের দিকে তাকিয়ে, তাড়িয়ে দেবে? ইস! দিক তো। তবে কাকে এত বউ বউ বলে ডাকবে। 

মায়ের কথা মনে পড়ে ভানুর। বোঝে না বুঝি সে। মাও তো বামুনের সঙ্গে চলে গেছে। ঘর ছেড়ে গেছে। সে বামুনও সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ। তবে? ভানু বলল, হ্যাঁ। কেন? 

ভানু বলল চোখ বাঁকিয়ে, তুমি তো আমায় তাইড়ে দেবে।শিবনাথ অবাক হয়ে বলল, কেন, কেন গো? 

ভানু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, তার আমি কী জানি।

হেসে বলে শিবনাথ, পাগলি, একেবারে পাগলি। তুমি যে আমার মাথার মণি! 

ভানু অবাক হয়ে নিজের কথা নিজে শোনে। এমন করে কথা বলতে পারে সে, পারে! সে যে ভাবতে শিখেছে। জীবন তাকে ভাবতে শেখাচ্ছে। বাঁচবার আর বিপদ এড়াবার অন্ধি সন্ধি খুঁজতে শেখাচ্ছে। ভাবে, বলব, বলে ফেলব সব কথা? 

তবু তাড়িয়ে দেবে? ইস! কপটতা আজও আয়ত্ত করতে পারেনি, তবু বলতে গিয়েও আটকাল। এক দিন গেল। দু দিন গেল। 

সন্ধ্যা হলে চাঁদ ওঠে দেবদারুর কোল দিয়ে। ভানু চাঁদ দেখে বড় বড় চোখে। কখনও ছায়া, কখনও জ্যোৎস্না। ভাদ্রের শুক্লা আকাশে আলোছায়ার অপূর্ব খেলা। ঘণ্টা বাজে শিবনাথের পূজার ঘরে। চন্দন আর ধূপের গন্ধ লেপটে থাকে সর্বত্র। ভাদ্রের জ্যোৎস্না। যেখানে আলো, সেখানে ধবধবে সাদা; যেখানে অন্ধকার, সেখানে গাঢ় কালিমা। সন্ধ্যা রাত্রে চিতেবাঘ আর হায়না বেরোয় সেই অন্ধকারে, দেখে ভানুকে। 

ভানু চাঁদ দেখে–কেমন তর তর করে বেড়ে উঠেছে চাঁদ! কেমন করে চাঁদ বাড়ে দিনে দিনে, তাও যে দেখতে হবে ভানুকে এমনি করে, তা কে জানত। দেখতে দেখতে ভরে উঠছে, গোল হয়ে উঠছে। চাঁদ। ঝুলন পুন্নিমে। এমন পূর্ণিমাও ছিল ভানুর কপালে। শৈলর মুখ, শৈলর কথাই মনে পড়ে খালি। রাগ হয় অবনের উপর। হৃ বাঁকিয়ে দেখে সে অবনকে। বলবে, বলবে চুচড়োর ছেলেকে? না কি ঠাকুরকে বলবে। যদি তাড়িয়ে দেয়, তবে? তার চেয়ে শৈল ভাল। 

শিবনাথ ভাবে, কী হল? মেয়েটি, তার বউটি হঠাৎ এত গম্ভীর হয়েছে কেন? 

অবন দিনান্তে একবার চতুষ্পঠীতে ফিরে আসেই। দূর থেকে সেও দেখে, ভাবে। ভাবে, কী হয়েছে তার গুরুপত্নীর। গুরুদেব তাড়িয়ে দেবে, সেই ভাবনা? কীসের ভয় ধরেছে তাকে? মলের ঝমঝমানি তো ঝড় তোলে না সর্বত্র। কাজে কাজে মন থাকে। তারপরে এ ভাবনায় মনটা বড় দমে যায়। 

আর দিদি সারাদিন শুধু জপ করেন। কুটোটি পর্যন্ত নাড়েন না। চেয়েও দেখেন না কিছু।

ঠাকুরের দিকেই মন ঝোঁকে ভানুর। শৈল বলে, পিরিত। এই পিরিতি কি না কে জানে! ঠাকুরকে তার ভাল মানুষ বলেই মনে হয়। তার আদরে সোহাগে আবেগ নেই ভানুর। কেমন যেন আলগা আলগা লাগে। তবু মানুষটাকে লাগে ভাল। উঠতে বসতে বউ বউ করে। তাড়িয়ে দেবে? তবে অত বউ বউ কেন? অবনের কথা মনে হয়। সেও কি মুখ ফেরাবে? তবে অত চেয়ে চেয়ে দেখা কেন? ভানু ভাবে। চোখের কোণ দিয়ে দেখে শাণিত আঁশবটি। নিজের গলায় বসিয়ে দিতে পারে না ওটা সে? দরকার নেই উঁচড়োর ছেলের মনটানা চাউনি দিয়ে, ঠাকুর পণ্ডিতের সোহাগ, শৈলর চাপা চাপা ঢাকা ঢাকা ভয় ভয় জীবনের ডাক। কোনও কিছু চায় না। মরণ চায় সে। মরণ, ছিঁড়েখুঁড়ে চেঁচিয়ে রক্তারক্তি মরণ। এমনি করে ভাবে ভানু। আর ভাবতে ভাবতে চতুর্দশী এসে পড়ল। কাল পূর্ণিমা, ঝুলন পূর্ণিমা। মা গো! চাঁদটা কী রাক্ষসের মতো বড় হয়ে উঠেছে দেখতে দেখতে।

সন্ধ্যারাত্রি। গোয়ালের সামনে খুঁটিতে হেলান দিয়ে চাঁদ দেখছে ভানু। গোয়ালের অন্ধকারে গোরু নিশ্বাস ফেলছে। কোথায় কাঁসর বাজছে দূরে। রাত্রিচর পক্ষিণী ডাকছে কোন গাছের অন্ধকারে। শেয়াল ডেকে উঠছে পুকুরের ধারে রাংচিতের বনে। চুল বাঁধেনি ভানু, গয়নাও পরেনি। বুক অবধি জ্যোৎস্না পড়েছে। বাকিটুকু দেবদারুর ছায়ায় অস্পষ্ট। মনে হয়, বড় মেয়ে একটি। গভীর ভাবনায় ডুবে রয়েছে। কিন্তু চোখের তারায় অস্থিরতা। সে হাসতে চায়, হেসে হেসে গলে লুটিয়ে পড়তে চায় শিবনাথের কাছে। সে কি ছলনা, না ভুলানো। ওইখানে চতুম্পাঠীতে প্রদীপ জ্বলছে। ছাত্রেরা সন্ধ্যাহ্নিক শেষ করে রান্না চাপিয়েছে। ওই উঠোনে এসে একজন দাঁড়িয়ে থাকে এ সময়ে রোজ। সর্দার পোড় দাঁড়িয়ে থাকে গুরুপত্নীর একটু অঙ্গুলি সংকেতের জন্য। 

তার এ ভাবনার ঘোরে শিবনাথ এসে দাঁড়াল। পুজো শেষে পরিতৃপ্ত মনে, কাছে এসে বলল, কী হয়েছে বউ? ওখানে কেন? 

জন্মকাল থেকে বাঁকা চোখে তাকিয়েছে ভানু। টেরে টেরে চেয়েছে, গেয়েছে, নেচেছে মায়ের সঙ্গে; কথা বলেছে ঠোঁট ফুলিয়ে। তেমনি করেই বলল, কেন আবার। তুমি তো আমায় তাইড়ে দেবে। 

ছিঃ, ও কথা বোলো না।

ভানু যেন অভিমান ভরে বলল, না কেন, দেবে তো। আমি যে জেলের মেয়ে।

 হাসতে গিয়ে খচ করে লাগল শিবনাথের। বলল, ছিঃ বউ, ও কথা বলতে নেই।

বালিকার চোখে তীব্র অনুসন্ধিৎসা, শিশুর অনুসন্ধিৎসা। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। বলল, কেন নয়? সত্যি যে। হালিশোরের বাউনেরা মিছে কথা বলে তোমার কাছে আমায় বিকিরি করে দিয়েছে।

চুপ, চুপ বউ!–চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল শিবনাথ। কাঁপতে লাগল থরথর করে। বলল, মিছে, মিছে কথা। বউ, বলল, মিছে কথা বলেছ তুমি, বলল।

আশ্চর্য! ভানু বড় বড় চোখ মেলে অবলীলাক্রমে আবার বলল, মিছে কেন বলব? আমি যে হালিশোরের ভোলা কৈবত্তের মেয়ে গঙ্গা। তুমি আমায় তাইড়ে দেবে? তুমি… 

চুপ! চিৎকার করে উঠল শিবনাথ। কুঁজো হয়ে পড়ল। মনে হল যেন গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। অন্ধ হয়ে গেছে যেন সে। কাঁপতে কাঁপতে খুঁটি ধরল। 

চিৎকার শুনে চকিতে সরে দাঁড়াল ভানু। ভয় পেয়েছে। মারবে, কাটবে নাকি তাকে? ছুটবে? তবু সে বলল, আমি কৈবত্তের মেয়ে আর তোমার বউ নয়, না? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরল শিবনাথ। ভানুর হাত টেনে ধরে চকিতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ভানুর সামনে জানু পেতে বসে বলল, কী বলছ, এ সব কী বলছ তুমি বউ? কেন বললে–কেন-কেন? 

ছড়ানো কেশ, খসানো লুটোনো আঁচল ভানুর। ঘরে ঢুকে শক্ত হয়ে উঠেছে আক্রমণের ভয়ে। বলল, নইলে শৈলী যে তোমাকে বলে দিত। 

শৈলী? কে শৈলী?

গড় গড় করে বলে গেল ভানু সব কথা। বাপের অপঘাত মৃত্যু, সর্বেশ্বর, নন্দন, শৈলী বাগদিনি। আর শিবনাথ মনে মনে বলতে লাগল, প্রচার হয়ে যাবে সব। মুহূর্তে, বিদ্যুৎ গতিতে। তার ধর্ম, শাস্ত্র, অনুশাসন, সংস্কার, অহংকার, তার ক্রীতা পত্নী ভানুমতীর্থেতলে দুমড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। ঘাম ঝরছে শিবনাথের। গায়ের চন্দন গলে গলে পড়ছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে; দৃষ্টি উদভ্রান্ত। হঠাৎ বলল, কেন গেলে না শৈলী বাগদিনির সঙ্গে? 

ভানু বলল, তুমি যে ভাল মানুষ। তুমি যে বউ বললো আমাকে?

ছিটকে সরে গেল শিবনাথ। বলল না, বলো না, মনে মনে আর্তনাদ করে উঠল, নারায়ণ শুনতে পাবে। নারায়ণ শিরোমণি আমার প্রাণের মিতা। 

মনটা থমকাল শিবনাথের। মনে পড়ল অনেকের কথা, যারা শূদ্রা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে প্রায়শ্চিত্ত করছে। তাদের ঢাক সংবাদপত্রে, মুখে মুখে, চণ্ডীমণ্ডপে বাজছে। তবু তারা আবার ঘর করছে। তবে? কলকাতা, ভাটপাড়া, বর্ধমানের বৈদিক, রাঢ়ীয়, শূদ্রা ও যবনীর সঙ্গে ঘর করেছে, সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আবার প্রায়শ্চিত্তও করেছে। তা হলে? নারায়ণের কঠিন হাসিমুখ, অনেক বিতর্ক, নীলরতন চক্রবর্তী, স্বর্ণলতা, স্বর্ণ। স্বর্ণহারা নারায়ণের সামনে সে দাঁড়াবে? কেমন করে? নারায়ণ। সে নেই। সে ছেড়ে গেছে, দুরে, কলকাতায়। কার কাছে ছুটে যাবে সে তার শাস্ত্র ধর্মের সমস্ত অহংকারের ডালি নিয়ে। সব ছেড়ে যে খোলসের মধ্যে আত্মগোপন করেছিল, সেই খোলস আজ দুহাতে গলা টিপে মারতে আসছে তাকে। তার ধর্ম, বিশ্বাস, শাস্ত্র, কুল, মেল, প্রাচীন বন্ধন, যাকে সে অখণ্ডবাদ আখ্যা দিয়েছে, কালজয়ী বলেছে। তার একী মূর্তি? দুরে গিয়ে দাঁড়াল সে৷ সে, শিবনাথ বাচস্পতি। ঘরের মেঝেয় গাঁথা সিন্দুকের ডালা খুলল কাঁপতে কাঁপতে। দু হাতে তুলে ধরল তালপাতার পুথি। 

যুগ-যুগান্তরের অসংখ্য পুথি ভরা সিন্দুকে। সঞ্চিত পবিত্র শাস্ত্র। ঝরে ঝরে পড়ল। অসাবধানে বহুদিনের শুকনো পাতা ভেঙে ভেঙে পড়ল। বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা, ন্যায়, অঙ্ক, কাম, তন্ত্র, জ্যোতিষী….মনে পড়ল, তন্ত্রশান্ত্রের চৌষট্টি জাতীয় নারী সহবাস, যবনী সঙ্গিনী…। কিন্তু সে ধর্ম ও ইষ্টলাভের উদ্দেশ্যে বিশেষ ক্রিয়া মাত্র।

নারায়ণ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। কারা কোলাহল করছে চারদিকে। সমাজপতি শিবনাথ বাচস্পতি! চারিদিকে জনাপবাদ। হাসি ও বিদ্রুপের লেলিহান শিখা। সব যাক, কিন্তু নিজের অন্তরে সে আগুন কে ঠেকাবে। ফিরে তাকাল ভানুর দিকে। ঘরের এককোণে লেপটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রদীপ শিখা কাঁপছে তার সর্বাঙ্গে। ছায়া কাঁপছে থরথর। বিশাল উদ্দীপ্ত চোখের চারপাশে চুলের গোছা পড়েছে, আঁচল খসা বুক দিয়েছে ঢেকে।

শিবনাথ তার কিস্তৃতাকৃতি মস্ত ছায়াটা নিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। তার বউ, ভানুমতী জেলেনি। ভানু চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, আমার খুন করবে? 

শিবনাথ বলল, না। 

তাড়িয়ে দেবে?

না।

তবে?

 তোমায় সাজাব।

সাজাবে?

 হ্যাঁ গো হ্যাঁ। 

শিবনাথের গলায় বার্ধক্য নেমে এসেছে যেন। সারা গায়ের চামড়া যেন কুঁচকে ঝুলে পড়েছে। কপালে ছায়া পড়ে অন্ধ গর্ত দেখাচ্ছে চোখজোড়া। মাথার সামনের মুণ্ডিত অংশ চকচক করছে কঙ্কালের খুলির মতো। কম্পিত হাতে ভানুকে কাছে টেনে বলল, তুমি সাজনি কেন? এসো তোমাকে নিজের হাতে আমি সাজাই। তোমারই জন্য যে আমি সব রেখে দিয়েছিলুম। তোমারই জন্য। 

দেয়ালে গাঁথা সিন্দুক খুলে, গহনার বাকস তুলে বসল মেঝেয়। ভানুর পায়ের সামনে ছিন্ন পবিত্র পুথির পাতা। বিচিত্র শান্তভাবে নিজের হাতে সাজাল শিবনাথ ভানুকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে অলংকারে ঝলমল করে উঠল ভানুর। রক্ত-রেশমি শাড়ি পরাল। আর কাঁটা দিয়ে শিউরে উঠল ভানুর গায়ের মধ্যে। 

শিবনাথ পায়ে মল বাঁধতে গেল। পিছিয়ে গেল ভানু। ছি। বামুন হয়ে পায়ে হাত দেবে! কিন্তু এ চেতনা তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলল। ক্রোধে ও ভয়ে বিকৃত গলায় ফুঁপিয়ে উঠল সে, কেন সাজাচ্ছ! কেন! আমি কী করিচি? 

বলে সে গায়ের অলংকার খুলতে উদ্যত হল। শিবনাথ ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, খুলো না, খুলো না বউ। তুমি যে আমার সত্যি বউ। একটু থাকো ওই বেশে। তুমি যে দেবী মহাদেবী, সর্ব-পাপবিনাশিনী। এ মূর্তি না ধরলে যে পাপ নাশ হবে না। তুমি যে পাপকে শেষ করতেই এসেছ! 

ভানু বলল, ওমা গো। পাপ শেষ। সে আবার কী? তোমার চোখদুটো অমন খুনে হয়েছে কেন? 

খুনে? শিবনাথ হাসল। ভয়ংকর শান্ত নিঃশব্দ হাসি। বলল, খুনে নই। তুমি যে আমার পাপ সংহারিণী চণ্ডিকা। 

ভানু বলল ঘাড় বাঁকিয়ে, তুমি অমনি করলে আমি চেঁচিয়ে মরব, কিন্তু। 

আবার ভানুর সামনে জানু পেতে বসল শিবনাথ। ভানুর হাত ধরে সামনে টেনে বলল, তুমি নাচতে জান? নাচতে পার আমার বুকে? মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ভানু, এখন পারব না। 

ভানুকে জানুর উপর বসিয়ে বলল, তুমি রাধা, কেমন!

ভানু বলল, তুমি কেষ্ট ঠাকুর?

 শিবনাথ মনে মনে বলল, সেই ভাল। ধর্মান্তর গ্রহণ আর পলায়ন। জাত, কুল, মান, ধর্ম, অনুশাসন, সব গিয়েও প্রাণ ভরে থাকবে। অমনি কে যে তার সর্বাঙ্গে ছপটি দিয়ে চাকাতে লাগল। সর্বাঙ্গে, তার প্রশস্ত মুখে ও হৃৎপিণ্ডে। সে বলে উঠল, না না না! 

না, আমি রাধা হতে চাইনে। আমি ভানুমতী।

ভানুমতী। ফিসফিস করে বলল শিবনাথ, সেই ভাল। তুমি, ভানুমতী৷ 

ভানুমতী আচমকা সশব্দে একটি চুমু খেল শিবনাথের গালে। সেশব্দ যেন বজের মতো। কানে তালা লেগে গেল শিবনাথের। ভানুর প্রথম চুম্বন। কেন, ভানুও তা বোঝে না যে। মন চাইল, তাই। যেন পাগল শিশুকে শান্ত করার জন্য আবার একটি চুমু এঁকে দিল। মুহুর্মুহু বজ্রাঘাতে পুড়িয়ে যেন নিঃশেষ করে দিতে লাগল। আর বিচিত্র বিস্ময় ও কৌতূহলী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শিবনাথের মুখ, তার ভাব, তার চাউনি। শিবনাথ মাতালের মতো উঠে দাঁড়াল। শরবিদ্ধ জন্তুর মতো ছুটে গেল দরজার কাছে। 

ভানু বলল, কোথায় যাচ্ছ? আমার ভয় করবে যে? শিবনাথ দরজা খুলল। ভানুও দরজার কাছে এল। তার চলায় ফেরায় সারা ঘরে সোনা ও মুক্তার আলো চমকায়। বলল, তাড়াতাড়ি আসবে? তবে তোমার ওই সর্দার পোড়োকে ডেকে দিয়ে যাও। ও এখেনে থাকুক। 

সর্দার পোড়ো! অবন। বাইরে এসে দাঁড়াল শিবনাথ। নিঃশব্দে চতুষ্পঠী পার হয়ে গেল সে। পিতৃপিতামহের শিক্ষালয়। ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে সব। চারিদিকে শুধু ভাঙন। বাসুকী মাথা তুলেছে আর ধরিত্রী ধসে পড়ছে, ভাঙছে। নিশূপে বাগানের দিকে চলে গেল সে। রাংচিতের বনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

ভানু দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। এক বার ফিরে তাকাল খোলা ঘরের দিকে। তারপর ছুটে গেল শিবনাথের পথে। ভয় নেই, একটু খেয়াল নেই, হাজার হাজার টাকার অলংকার সর্বাঙ্গে। নির্বাক জ্যোৎস্না ও অন্ধকার গায়ে লেপটে রয়েছে। মুখে মুখ দিয়ে যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে এই আলো-আঁধারে। অন্ধকার দুলছে একটু একটু আলোর গায়ে। কে জানে, কোথায় সেই রসরাজ কৃষ্ণ, কোথায় কোন কুঞ্জবনে সঙ্গিনীকে নিয়ে দোলনায় ঝুলছে। টুকরো টুকরো মেঘ ভাসছে। হালকা ছায়ায় ভরে যাচ্ছে, আবার আলো ফুটছে। আকাশ পৃথিবী নিরালা পেয়ে লুকোচুরি খেলা জুড়েছে। ঝিঁঝি ও ব্যাঙ-এর কলতান তাল দিচ্ছে। রাত্রিচর পশুরা শিকার খুঁজছে নিঃশব্দে। 

রাংচিতের বন পেরিয়ে অনেক দূরে এসে পড়ল ভানু। কোথায় গেল? ওই যে, ওই যে। গাছের তলা দিয়ে, বনের পাশ দিয়ে দুর দুর করে এগিয়ে গেল ভানু। সামনেই মস্ত বড় নীলের মাঠ। তারপরে ধানক্ষেত। আরও দূরে পেত্নির মতো মাথা দোলাচ্ছে পেঁড়িতে। কিন্তু কই? দেখা যায় না তো৷ পিছন দিকে তাকাল ভানু। বন, অন্ধকার ও জ্যোৎস্না একাকার। হালকা বাতাসে চাপা শিউলির গন্ধ। 

কৌতূহল থিতিয়ে গেল ভানুর। গায়ে কাঁটা দিল হঠাৎ। কেউ নেই তো। ফিরে যাবার পথ কোথায়? চমকে উঠল, ওই যে, কে যায়! ঠাকুর। ঠাকুর যাচ্ছে ক্ষেতের ধার দিয়ে। অনেক দূরে। ডাকবে? ডাকতে গেল, পারল না। ডাকতে ভয় হল। পাছে অন্য লোক ছুটে আসে, দেখে যদি এত রাত্রে। এগিয়ে গেল তর তর করে ক্ষেতের পাশ দিয়ে। সেঁড়ি ক্ষেতের পাশ দিয়ে পথ বাঁক নিয়ে গেছে গঙ্গার ধারে। কোথায় যাচ্ছে ঠাকুর। আবার হারিয়ে গেল। রিনিঝিনি বাজতে লাগল সোনায় সোনায়। 

রক্ত রেশমি ও সোনা জ্বলতে লাগল জোনাকির চাকের মতো। সামনেই গঙ্গা। উঁচু পাড়ে। নীচে ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। যেন অনেক নীচে, মাটির তলায় কে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করছে ছপ ছপ ছপ। চাঁদের আলোয় সোনার তরঙ্গ ছুটছে। চকচকে ঢেউ ভেঙে গড়িয়ে তীব্র স্রোতে কল কল করে ছুটে চলেছে। দুরে বালুচর। এপারে শুধু ভাঙন। 

ছপ ছপ ছলাৎ–ভাঙছে। গভীর জলের ঘূর্ণাবর্তে পাক খেয়ে গলে যাচ্ছে। 

ওই তো শিনাথ। হারায়নি। দুরে দাঁড়াল ভানু। রাগে ও কান্নায় আঁচল চেপে ধরল মুখে। কী নচ্ছার, পাজি আর হাড় জ্বালানে বামুন। শুধু শুধু তাকে ফেলে চলে এসেছে গঙ্গার ঘাটে। ভানুর বুঝি ভয় করে না।

শুধু শুধু নয়। উবু হয়ে বসে কী যেন হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে। দূরের গাছের ছায়ায় নজরে পড়ল না। ভানুকে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে অজান্তে, আর হাতড়াচ্ছে। হাতড়ে হাতড়ে কিনারে এসে পড়ল শিবনাথ। নীচে, অনেক নীচে, শুধু জল, তীব্র স্রোত ও চক্ৰাবর্তের মাঝে শুধু পাতালগামী ভয়ংকর ঘূর্ণিগর্ত। কই, জলতরঙ্গে কোথায় সেই খুঁটি–যে খুঁটিতে নৌকা বেঁধেছিল নিমাই, মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ। শাস্ত্র ও পাণ্ডিত্যের অহংকার দেখে যে নামতেও ভরসা পায়নি গুপ্তিপাড়া বেহুলার মাটিতে। কোথায়, মুক্তি দাও শিবনাথকে। অহংকারকে চূর্ণ করো। জাত নাও, কুল নাও, মান নাও, শাস্ত্র ধর্ম পাণ্ডিত্য অনুশাসন সব নাও। তোমার সর্বমুক্ত প্রেম দাও, বাধাবন্ধনহীন প্রেম। 

সহসা হাত পা বেঁকে উঠল, শিরা ছিন্ন একটা তীব্র যন্ত্রণা তার চৈতন্য লুপ্ত করে দিল। বন্ধ হয়ে এল নিশ্বাস। জীবন্ত থাকতেই মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছে সে।

মাটি নড়ে উঠল। ভেঙে পড়ল বিশাল ভারে। মাটির চাংড়া বুকে নিয়ে মুহূর্তে ঘূর্ণাবর্তে অদৃশ্য হল শিবনাথ। এক বার উঠল, আবার ডুবল। বুদবুদ উঠল। তারপর ঘূর্ণি-আবর্তের একটি ধারা পাক খেতে খেতে তীব্র স্রোতে কল কল করে ধেয়ে গেল দক্ষিণে মহাসমুদ্রের দিকে। ভানু চিৎকার করে উঠল। আলো আঁধারে নির্বাক নিশীথ কাঁপিয়ে আঁ আঁ শব্দে ছুটে এল জলের কিনারে। চিৎকার করে ডাকল– ঠাকুর, ঠাকুর।

তরঙ্গে তরঙ্গে হারিয়ে গেল সেই শব্দ। এ প্রেম কি না ভানু জানে না। কিন্তু ঠাকুর তার সব আশা নিয়ে ভেসে গেল। তবু সে ঝাঁপ দিতে পারল না জলে। ভেসে যেতে পারল না। ঘূর্ণি-আবর্তে খল খল হাসি শুনে ছিটকে পেছনে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ল মাটিতে। 

ঢেউ ভেঙে ভেঙে স্রোত ছুটে গেল দক্ষিণে। দূর দক্ষিণে।

 কেবল সর্দার পোড়ো অবনী ভয়ে বিস্ময়ে গুরু ও গুরুপত্নীকে খুঁজছে শূন্য ঘরে উঁকি দিয়ে, নির্জন উঠানে ও পুকুরঘাটে। কোথায়, কোথায় তারা? এ সময়ে যে ভানুমতী মল বাজিয়ে, ঘর থেকে রান্নাঘর ছুটোছুটি করত, কোথায় গেল।