সকাল দশটা নাগাদ থানায় এল মিতিন। অফিসার ইন চার্জ সুবীর হালদারকে ফোন করাই ছিল, মিতিনকে দেখেই তার পুলিশি গলা গমগম, আসুন, আসুন ম্যাডাম। আপনার জন্যই ধূপধুনো জ্বালিয়ে বসে আছি।
— আমার সৌভাগ্য। মিতিন চেয়ার টেনে বসল, লাবণ্যদেবীর বডি কি পোস্টমর্টেম চলে গেছে?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। এত ক্ষণে বোধহয় পুলিশ মর্গ থেকে বেরিয়ে কাঁটাপুকুরের টেবিলে।
— পি এম রিপোর্ট কবে পাচ্ছেন?
— মঙ্গলবার, কিংবা বুধ। বড়সড় টেবিলের ওপারে ঘুরনচেয়ারে উপবিষ্ট দশাসই চেহারার সুবীর ঝুঁকল সামান্য। মোটা মোটা ভুরু নাচিয়ে বলল, ব্যাপার কী বলুন তো? কাল রাত্তিরে ফোন… আজ সকালে ফোন… মহিলা কি আপনার চেনা জানা?
— একেবারে অপরিচিত আর বলি কী করে? মিতিন অল্প হাসল, ভদ্রমহিলা এই বুধবারেই তো আমার কাছে এসেছিলেন।
— তাই নাকি?
— হুঁ। বলছিলেন ওঁকে নাকি স্লো পয়জনিং করা হচ্ছে।
— ইন্টারেস্টিং! সুবীর চোখ পিটপিট করল, জানেন তো, আমিও কাল স্পটে গিয়েই গন্ধ পেয়েছি। জরুর ডালমে কুছ কালা হ্যায়।
— কী রকম?
— অ্যাপারেন্টলি সুইসাইড কেস। নিজের বিছানায় হাত পা বেঁকিয়ে পড়ে আছে, মুখে গ্যাঁজলা…। কিন্তু ও দিকে আবার ড্রয়িংরুমের টেবিলে আধ গ্লাসের ওপর হুইস্কি। আত্মহত্যার আগে কেউ অতটা মাল ফেলে রেখে যায়, বলুন? টেনশানেই তো ঢকাস করে গলায় ঢেলে দেবে। প্লাস, কিচেনের সিংকে আর একটি গ্লাস নামানো। ফাঁকা, তবে আমি ডেফিনিট ওতেও ড্রিংকস ছিল। হাইলি ফিশি।
— অর্থাৎ আপনি বলছেন, ভদ্রমহিলার সঙ্গে আর এক জন কেউ ড্রিংক করছিলেন?
— অথবা করেছিলেন।
— কিন্তু গ্লাসটা সিংকে ফেলে যাবে কেন? ধুয়ে মুছে জায়গা মতন রেখে দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল। অফকোর্স যদি সেই মার্ডারার হয়। মিতিন আপন মনেই যেন বিড়বিড় করল কথাগুলো। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে বলল, বাই দা বাই, আপনারা নিউজটা পেলেন কখন?
— অ্যারাউণ্ড সাড়ে সাতটা। মহিলার হাজব্যাণ্ড থানায় ফোন করেছিল।
পলকের জন্য মিতিনের ভুরুতে ভাঁজ। পরক্ষণে স্বাভাবিক স্বরে বলল, উনিই কি প্রথম ডেডবডিটা দেখেন?
— না। ওদের কাজের মেয়ে। কোথায় যেন চরতে বেরিয়েছিল, ফিরে দেখে ওই কাণ্ড। তার পর মেয়েটাই হল্লা জুড়ে ফ্যামিলির লোকজনকে ডাকে।
— মৃত্যুর টাইমটা জানা গেছে?
— পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে।
— হুম। মিতিন একটু ক্ষণ চুপ থেকে বলল, খুব খারাপ লাগছে, জানেন। ভদ্রমহিলা আমার হেল্প চাইলেন, অথচ ভাল করে কিছু বোঝার আগেই উনি…
— তাই বুঝি মর্মপীড়ায় ভুগছেন?
— একদম ঠিক। এখন আপনাদের পাশে পাশে আমিও একটা ইনভেস্টিগেশান চালাতে পারলে মানসিক শান্তি পাই। অফকোর্স আপনাদের কো অপারেশানও দরকার।
— দেখুন ঘাঁটাঘাঁটি করে। সুবীর মুচকি হাসল, তবে আপনাদের লাবণ্য মজুমদার সম্পর্কে রিপোর্ট কিন্তু খুব খারাপ। স্বভাবচরিত্র নাকি মোটেই সুবিধের ছিল না মহিলার। যদ্দূর খবর পেয়েছি, অত্যন্ত ফাস্ট লাইফ লিড করত। রেগুলার ক্লাব, পার্টি, হাঁসের মতো মাল টানা, রাতদুপুরে বেহেড হয়ে ফেরা, আটচল্লিশ বছর বয়সেও কচি ছেলে ধরার জন্য ছোঁকছোঁক, গুণের সৌরভে একেবারে ম ম। এই টাইপের মহিলারাই তো বেঘোরে মরে।
— তা বলে কেউ তাকে মেরে ফেলবে, এটাও নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যায় না?
— অফকোর্স নট। হোমিসাইড প্রমাণ হলে আমরাও কোমর বেঁধে লাগব বই কী! হুইস্কি আর গ্লাস দুটো ফরেনসিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। পি এম রিপোর্টটাও হাতে আসুক…
সুবীরের সঙ্গে আরও দু’চারটে কথা বলে উঠে পড়ল মিতিন। সকাল থেকে বেশ মেঘ করেছে আজ। ভাদ্রের শুরুতে আকাশ ক’দিন দারুণ ঝকঝকে ছিল, এখন আবার বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে সাঝে। রাস্তায় নেমে মিতিন দেখে নিল ব্যাগে ছাতাটা আছে কি না। হাঁটছে চিন্তিত মুখে।
থানা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব বেশি নয়। মিনিট দশেকের মধ্যে মিতিন পৌঁছে গেছে এমারেল্ড টাওয়ারে। খাড়া দশতলা আবাসনটির গেটে নিরাপত্তারক্ষীর বেজায় কড়াকড়ি। বহিরাগতদের নাম ঠিকানা গন্তব্য লিখে ঢুকতে হয়। রীতিপ্রকরণের বেড়াটুকু টপকে মিতিন যখন লাবণ্যদের ফ্ল্যাটে বেল বাজাল, ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা ছুঁয়েছে।
দরজা খুলেছে এক মাঝবয়সী পুরুষ। সাদামাটা, বিশেষত্বহীন চেহারা। চোখে চশমা, মাথায় উস্কোখুস্কো কাঁচাপাকা চুল, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। মুখে একটা দিশেহারা ভাব। ভদ্রলোক প্রশ্ন করার আগে মিতিনই সপ্রতিভ স্বরে বলে উঠল, নমস্কার। আমার নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। থার্ড আই থেকে আসছি। আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার মজুমদার? আই মিন, লাবণ্যদেবীর হাজব্যাণ্ড?
— আবার মিডিয়া? অনিমেষ হাত জোড় করল, কাল রাত থেকে তো অনেক হল, এ বার একটু ছাড়ান দিন না, প্লিজ।
— ভুল করছেন স্যর। আমি মিডিয়ার লোক নই। মিতিন বিনয়ী সুরে বলল, আমি এক জন পেশাদার গোয়েন্দা।
— ও। তা এখানে কী চাই?
— জাস্ট দু’চারটে প্রশ্ন ছিল। যদি কাইণ্ডলি একটু সময় দেন…। মিতিনের গলা আরও নরম, আসলে দিন তিনেক আগে লাবণ্যদেবী আমার কাছে এসেছিলেন তো…
— লাবণ্য আপনার কাছে গেছিল? কেন?
— সেটা নিয়েই তো আলোচনা করতে চাইছিলাম। জানি খুব অসময়ে এসেছি, লাবণ্যদেবীর এখনও ক্রিমেশান হয়নি, তবু…
দু’চার সেকেণ্ড থমকে রইল অনিমেষ। একটু বুঝি জরিপও করল মিতিনকে। ভারী গলায় বলল, আসুন।
লিভিংরুমখানা বিশাল। বিদেশি সোফাসেট, পুরু কার্পেট, কোণে রাখা স্ট্যাণ্ডল্যাম্প, বড়সড় ঝাড়বাতি, নামী আর্টিস্টদের পেন্টিং, মহার্ঘ পর্দা আর তামা ব্রোঞ্জ পিতলের ছোটবড় শো পিস থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে বৈভবের দ্যুতি। তবে ঘরের অঙ্গসজ্জা যেন সম্পদের সঙ্গে মানানসই নয়। একটু বা ছন্নছাড়া। অন্তত তেমনটাই মনে হল মিতিনের। অদূরে প্রকাণ্ড ডাইনিং টেবিল। রান্নাঘরের একটা অংশও যেন দেখা যায়। বন্ধ কাচের দরজার ওপারে ব্যালকনিও দৃশ্যমান। স্প্লিট এসি মৃদু মৃদু ঠাণ্ডা ছড়াচ্ছে হলে। কাচের সেন্টার টেবিলে আলগা চোখ বুলিয়ে মিতিন বলল, লাবণ্যদেবী আমাকে মিট করেছিলেন বুধবার। সম্ভবত আপনি তখন কলকাতায় ছিলেন না।
— হ্যাঁ। হায়দরাবাদে গিয়েছিলাম। বিজনেস ট্যুর।
— উনি আজ বিকেলে আবার আমার কাছে যাবেন বলেছিলেন। আর আপনার বোধহয় আজ রাতে ফেরার কথা।
— কাজ মিটে গেল, তাই চলে এলাম। অনিমেষ একটু যেন থতমত। কেন বলুন তো?
— লাবণ্যদেবীর আপনার বিরুদ্ধে কিন্তু একটা অভিযোগ ছিল। মিতিন স্থির চোখে তাকাল, আপনি নাকি ওঁকে…
— বুঝেছি। স্লো পয়জনিং করছিলাম। তাই তো? অনিমেষ তেতো স্বরে বলল, ওর মাথাটা ইদানীং একেবারেই গিয়েছিল।
— আমারও অবশ্য লাবণ্যদেবীকে খুব নরমাল লাগেনি। তবে শনিবার… মানে আজ… আমার কাছে সেকেণ্ড ভিজিটের আগেই দুম করে উনি মারা গেলেন… এটা কি একটু মিস্টিরিয়াস লাগে না?
— দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার ইঙ্গিতটা আমি বুঝেছি। অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। বাঁ হাতের তর্জনী তুলে বলল, শুনুন, আমার স্ত্রী ছিল এক সাইকিক পেশেন্ট। মুঠো মুঠো ডিপ্রেশানের ওষুধ খেত সে। বিশ্বাস না হয়, আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডক্টর সেনগুপ্তকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আপনারা কেন যে রহস্য খুঁজছেন জানি না। তবে যারা লাবণ্যকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা একবাক্যে বলবে, ডিপ্রেশানের ঝোঁকে কিছু একটা খেয়ে আত্মহত্যা করা তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
— অর্থাৎ আপনি সিওর, লাবণ্যদেবী সুইসাইড করেছেন?
— আর কী হতে পারে?
— পুলিশ কিন্তু ফ্ল্যাটে দুটো গ্লাস পেয়েছে। একটায় হুইস্কি ছিল, একটা ফাঁকা।
কথাটায় হঠাৎই থম মেরে গেল অনিমেষ। খানিক পরে নিচু গলায় বলল, দেখুন, আপনার কাছে সে গিয়েছিল বলেই বলছি। আমার স্ত্রী ছিল অ্যালকোহলিক। ইনফ্যাক্ট, মদের নেশাই তার মানসিক রোগের কারণ। ফ্ল্যাটে যখন তখন সে বোতল খুলে বসে যেত। হয়তো কালও…
— কিন্তু সিংকে ফাঁকা গ্লাস গেল কী করে?
— বলতে পারব না। তবে নেশার সময়ে তো তার হুঁশ থাকত না… একটা গ্লাস রেখে এসে আর একটা গ্লাসে হয়তো ড্রিংকস ঢেলেছে। …কী যে পাগলামি করত, আর কী করত না, তার সব কিছু আপনাকে বলতে পারব না। এই মুহূর্তে বলাটা শোভনও নয়। শুধু একটা কথাই বলতে পারি, শি ওয়াজ নট অ্যাট অল নরমাল।
— স্লো পয়জনিংয়ের আতঙ্কটা তবে সেই অস্বাভাবিকতারই লক্ষণ?
— অবশ্যই। কে তাকে মারতে যাবে বলুন? কেন মারবে? কী হবে মেরে?
— হুম। মিতিন মাথা নাড়ল, ওই আতঙ্কটা কাটানোর জন্য আমি ওঁকে একটা রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছিলাম। আর্সেনিক টেস্ট। বৃহস্পতি শুক্রর মধ্যে রিপোর্ট এসে যাওয়ার কথা। রিপোর্টটা আনা হয়েছিল কি না বলতে পারেন?
— না। আমি তো ব্যাপারটা জানিই না। তবে পুলিশ কাল তন্ন তন্ন করে সব খুঁজছিল। পেলে তো নিয়েই যেত।
— তা অবশ্য ঠিক। …আর একটা কোয়েশ্চন। লাবণ্যদেবীর মৃত্যুর খবরটা যখন পান, তখন নিশ্চয়ই আপনি অফিসে?
— হ্যাঁ। এগারোটা, সওয়া এগারোটা নাগাদ ফিরলাম হায়দরাবাদ থেকে। তার পর বাড়িতে ঘণ্টা দুয়েক রেস্ট নিয়ে তো বেরিয়ে গেছি।
— তখন লাবণ্যদেবী কী করছিলেন?
— ঘরেই ছিল। আয়নার সামনে বসে কী সব মাখছিল মুখে।
— তার মানে তখনও উনি নরমাল মুডে?
— জানি না। এত জেরা করছেন কেন, অ্যাঁ? অনিমেষ হঠাৎই অস্থির। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে বলল, আপনি এখন আসুন তো। বাড়িতে ভিড় হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে খানিক ক্ষণ একা থাকতে দিন।
— সরি, সরি। মিতিনও উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে যেতে গিয়েও ঘুরে তাকিয়েছে, আপনার মেয়ে জামাই কি বডি আনতে গেছেন?
— আরও অনেকেই আছে সঙ্গে। আমার শ্যালক, প্লাস কয়েক জন বন্ধু, রিলেটিভ…
— আপনাদের কাজের মেয়েটিকে দেখলাম না তো! সে কোথায়?
— মালতী? সম্ভবত নিজের ঘরে।
— তার সঙ্গে একটু কথা বলা যায়?
— ওকেও জ্বালাবেন? অনিমেষের গলায় ঝাঁঝ, আমার সারভেন্টস রুমে বাইরে থেকেও ঢোকা যায়। বেরিয়ে বাঁ সাইডে দরজা আছে, সেখানে নক করুন। অনুগ্রহ করে মাথায় রাখবেন, পুলিশ ওকে যথেষ্ট হ্যারাস করেছে, শি ইজ ইন স্টেট অব শক।
সত্যিই যেন ঘাবড়ে আছে মালতী, মুখে প্রায় কথা ফুটছে না। মিতিন পুলিশের লোক নয় জেনে খানিকটা যেন আশ্বস্ত হল বছর কুড়ির স্বাস্থ্যবতী মেয়েটি। ছোট্ট ঘরের সরু তক্তপোষে বসতে বলল মিতিনকে। প্রায় আসবাবহীন ঘর। বেঁটে একখানা আলমারির মাথায় আয়না, আর সাজগোজের নানান সরঞ্জাম। আলনায় ঝুলছে জামাকাপড়। সস্তার নয়, সালোয়ার কামিজগুলো বেশ দামি।
মিতিন কোমল গলায় বলল, তুমি নার্ভাস হোয়ো না। ভেবেচিন্তে আমায় খালি দুটো চারটে উত্তর দাও। …কাল তুমি কখন দেখলে উনি মারা গেছেন?
— আমি প্রথমটা বুঝিনি উনি বেঁচে নেই। ঘরে ঢুকে পেছন দরজাটা দিয়ে ও দিকে গেছি… দেখি মামি কেমন ভাবে যেন পড়ে আছে বিছানায়, কষ বেয়ে ফেনা গড়াচ্ছে। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি দিদি-জামাইবাবুকে ফোন করলাম। ওরা এসে বলল…
— ওরা দেখেই বুঝে গেল লাবণ্যদেবী মারা গেছেন?
— না, না। দিদি তো প্রথমে মামির হাতটা তুলে নাড়ি দেখল। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা কেমন হয়ে গেল দিদির। বলল, সর্বনাশ, বডি তো ঠাণ্ডা!
— তার পর?
— জামাইবাবু সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে ডাক্তারবাবুকে। দিদি মামাবাবুকে। দু’জনেই এসে পড়ল দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা টরিক্ষা করে বলল, অনেক ক্ষণ আগেই নাকি মরে গেছে। উনিই তো মামাবাবুকে বলল, পুলিশে খবর দিন, মিত্যুটায় গণ্ডগোল আছে। মামাবাবুর তখন কী করুণ দশা। কত বার ডাক্তারবাবুকে বলল, পুলিশের ঝামেলায় গিয়ে কী লাভ… জানেনই তো মাথার গোলমাল ছিল… এখন পুলিশ এলে চার দিকে তো শুধু কাদা ছিটবে…। তাও ডাক্তারবাবুটা কিছুতেই সাট্টিফিকেট দিল না।
মেয়েটা দিব্যি গুছিয়ে কথা বলছে এখন। আড়ষ্টতা বুঝি কেটেছে। মিতিন চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মালতী, তোমার কী মনে হয়? তোমার মামির মাথায় কি সত্যিই গোলমাল ছিল?
— কী জানি বাপু পাগল কাকে বলে! মালতী ঠোঁট উল্টোল, তবে হঠাৎ হঠাৎ খেপে যেত খুব। শ্রীরাধিকে তখন মা চণ্ডী। হাত পা ছুঁড়ছে, আছড়ে আছড়ে জিনিসপত্তর ভাঙছে…
শ্রীরাধিকে শব্দটা কানে লাগল মিতিনের। মালতীর বাচনভঙ্গিও। কয়েক পল মালতীকে দেখে নিয়ে বলল, কালও কি উনি কোনও কারণে মাথা গরম করেছিলেন?
— না, না। কাল তো মনমেজাজ ভালই…। অবশ্য দুপুরের পর কী হয়েছে বলতে পারব না।
— কেন?
— দুপুর দুটোর পর তো আমি বেরিয়ে গেছি।
— কোথায়?
— বাড়ি। পঞ্চাননতলায়। শুককুরবার করে দুপুরে যাই। ফিরি সেই সন্ধেয়।
— প্রত্যেক শুক্রবার? সেই যবে থেকে কাজ করছ?
— এ বাড়িতে তো বেশি দিন আসিনি। জোর পাঁচ মাস।
— ও। মিতিনের ভুরু ফের জড়ো হয়েছে, কাল কখন ফিরেছিলে?
— সাড়ে ছটা হবে।
— দুপুরে যখন বেরোলে, মামাবাবু বাড়িতে ছিলেন?
— না। তার আগেই তো খেয়েদেয়ে অফিস চলে গেল। বলতে বলতে মালতী আচমকা মিতিনের হাত চেপে ধরেছে, বিশ্বাস করুন দিদি, মামাবাবুর কিন্তু কোনও দোষ নেই। মানুষটা বড় ভাল। প্রাণে খুব দয়ামায়া।
— তাই বুঝি? মিতিন ঝলক চোখ বোলালো আলনায়। খানিক তির্যক সুরেই বলল, তোমার ড্রেসগুলো ভারী সুন্দর। কে দিয়েছে? তোমার মামাবাবু?
— এগুলো বেশির ভাগই দিদির। রুমকিদিদির। আমাকে দিয়েছে।
— ও, আচ্ছা।
— পুলিশ মামাবাবুকে খুব জেরা করেছে দিদি। আমাকেও। আপনারা একটু দেখবেন।
মিতিনকে খবরের কাগজের লোক বলে ধরে নিয়েছে মালতী। ভুলটা না ভাঙিয়ে মিতিন বেরিয়ে এল। লিফ্টে নীচে নেমে গেটের সামনে থেকে ট্যাক্সি ধরেছে। সিটে হেলান দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিল আজই এমারেল্ড টাওয়ারে ছুটে এসে লাভ হল কিনা। কিংবা কতটা হল। নাহ, ঠাহর করা কঠিন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত সবটাই ধোঁয়া। তত ক্ষণ ধৈর্য ধরতেই হবে।
নিস্তরঙ্গ কাটল তিনটে দিন। বুধবার সন্ধেয় সুবীর হালদারের ফোন, পি এম রিপোর্ট পেয়ে গেছি ম্যাডাম।
— কী বেরোল?
— যা ভেবেছি তাই। বিষেই মৃত্যু। পয়জনিংয়ের এফেক্ট ব্রেনের ভাইটাল সেন্টারে হেমারেজ, কার্ডিয়াক সেন্টারে রক্তসঞ্চালন বন্ধ, এবং অক্কা।
— ও। মিতিন নিরুত্তেজ, কী বিষ?
— আর্সেনিকই হবে। হুইস্কিতে মেশানো ছিল। হেভি ডোজে।
— কিন্তু… আর্সেনিকে কি ও ভাবে গ্যাঁজলা বেরোয়?
— ও সব নিয়ে আপনি ভাবুন। গ্লাসের গায়ে দু’রকম ফিংগারপ্রিন্ট মিলে গেছে। একটা লাবণ্যদেবীর। দু’নম্বরটি কার ধরতে পারলেই কাম ফতে। কাল সকালেই বাড়ির মেম্বারদের হাতের ছাপ নিয়ে নেব। সুবীর গমগম হাসল, কে জানে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কী কেউটে বেরোয়।
মিতিনের ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছিল, কেসটাকে বোধহয় বেশি সরলীকৃত করে ফেলছে সুবীর। তবে তর্কাতর্কিতে গেল না মিতিন। অনুরোধের সুরে বলল, একটা কথা বলি? ভিসেরা রিপোর্টটার জন্য ওয়েট করলে হত না? বিষের নেচারটা তা হলে অ্যাকিউরেটলি জানা যেত।
— অসম্ভব। আমি একটা দিনও নষ্ট করতে রাজি নই। এমনিই তো মিডিয়া সারাক্ষণ পুলিশকে ডলছে… আমরা নাকি গদাইলস্করি চালে হাঁটি… কোনও কম্মের নই…
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। যান ও বাড়ি। তবে কাল সন্ধেয়।
— কেন বলুন তো?
— ভাবছিলাম ফ্যামিলির লোকগুলোকে আর এক বার বাজিয়ে দেখি। মিতিনের স্বরে মধু ঝরল, আপনারই কাজের সুবিধে হবে। আগেও তো দেখেছেন, পুলিশি কেসে ইনভলভড হলেও আমি কোনও ক্রেডিট দাবি করি না। সুতরাং সুনাম হলে তাও তো আপনাদেরই।
— বেশ। দিলাম একটা বেলা। করুন পণ্ডশ্রম।
টেলিফোন রেখে মিতিন গুম হয়ে বসে রইল কিছু ক্ষণ। ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের জোরে খানিকটা সময় সে পেল বটে, কিন্তু এগোবে কোন পথে?